শিবির অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • আল কুরআন
  • আল-হাদীস
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • স্কুল পাঠ্য
  • কর্মী সিলেবাস
  • সাথী সিলেবাস
  • সদস্য সিলেবাস
  • উচ্চতর সিলেবাস
  • অডিও বই
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • আল কুরআন
  • আল-হাদীস
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • স্কুল পাঠ্য
  • কর্মী সিলেবাস
  • সাথী সিলেবাস
  • সদস্য সিলেবাস
  • উচ্চতর সিলেবাস
  • অডিও বই
শিবির অনলাইন লাইব্রেরি

সীরাতে সরওয়ারে আলম – ১ম খণ্ড

অন্তর্গতঃ ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন, সদস্য সিলেবাস
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. সূচনা
    1. উপক্রমনিকা
    2. সংকলকদ্বয়ের কথা
    3. গ্রন্থকারের ভূমিকা
  2. অধ্যায় ১ : নবুয়াতের মর্মকথা
    1. মানবতার জন্যে আল্লাহর পথনির্দেশ
    2. নবুয়াতের ব্যাপারে বিবেক বুদ্ধির রায়
    3. নবুয়াতের প্রয়োজন ও তাৎপর্য
    4. নবুয়াত কি?
    5. নবীদের দাওয়াত ও মর্যাদা
  3. অধ্যায়ঃ ২ – অহী
    1. অহীর অর্থ, রূপ ও প্রকারভেদ
  4. অধ্যায়ঃ ৩ – নবুয়াতে মুহাম্মদী (সা)-এর প্রয়োজন ও তার প্রমাণ
    1. পূর্ববর্তী নবীগণের পরে রসূলুল্লাহ (সা)-কে প্রেরন করার কারণ
    2. রসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুয়াতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ
    3. হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নবুয়াতের স্বপক্ষে কুরআনের যুক্তি
    4. বিশ্বনবী সম্পর্কে তাওরাত ও ইঞ্জিলের ভবিষ্যদ্বাণী
  5. অধ্যায়ঃ ৪- বিশ্বনেতা
    1. সরওয়ারে আলমের প্রকৃত অবদান
  6. অধ্যায়ঃ ৫ – খতবে নবুয়াত
    1. খতবে নবুয়াতের তাৎপর্য ও তার যুক্তি
    2. খতমে নবুয়াতের আকীদা সম্পর্কে গবেষণামূলক আলোচনা
    3. হাদীসের আলোকে ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’-এর তাৎপর্য
    4. কাদিয়ানদের আরও কিছু বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা
  7. অধ্যায়ঃ ৬ – মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যক্তিগত জীবন ও নবী-জীবন
    1. মহানবীর অনুসরণ ও আনুগত্য
    2. নবীর আনুগত্য এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামী ধারনা
    3. রিসালাত ও তদসংক্রান্ত ইসলামী বিধান
    4. রসূল (সা)-এর ব্যক্তি জীবন ও নবী-জীবনের পর্যালোচনা
    5. কুরআনের দৃষ্টিতে নবুয়াতের পদ ও দায়িত্ব
    6. নবী (সা)-এর প্রতি কুরআন ছাড়া অতিরিক্ত অহী নাযিল
  8. অধ্যায়ঃ ৭ – রসূলের মানবত্ব
    1. নবীদের মানবত্ব
    2. নবী মুহাম্মদ (সা)-ও মানুষ ছিলেন
  9. অধ্যায়ঃ ৮ – দ্বীনে হক
    1. ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব
    2. কুরআনের দৃষ্টিতে দ্বীন
  10. অধ্যায়ঃ ৯ – মোজেযাসমূহ
    1. মোজেযা সম্পর্কে আলোচনা
    2. পূর্বতন নবীগণের মোজেযা পর্যালোচনা
    3. হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মোযেজা
    4. হযরত মূসা (আ)-এর মোজেযাসমূহ
    5. হযরত সুলায়মান (আ) এর মোজেযা
    6. অন্যান্য নবীর মোজেযা
    7. হযরত ঈষা (আ)-এর মোজেযা
    8. নবী মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর মোজেযাসমূহ
    9. এটা বড় রকমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মোজেযা
  11. অধ্যায়ঃ ১০ – মাসালায়ে শাফায়াত
  12. অধ্যায়ঃ ১১ – ভবিষ্যদ্বাণী
    1. নবী পাকের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী
    2. কুরআনের ভবিষ্যদ্বানী
    3. হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণী
    4. হযরত মসীহ (আ)-এর আগমন সম্পর্কে নবীর ভবিষ্যদ্বাণী
    5. দাজ্জাল ও তার আবির্ভাব
  13. অধ্যায়ঃ ১২ – কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে প্রাচ্যবিদগনের তাত্ত্বিক অসাধুতা
    1. প্রাচ্যবিদগণের অযৌক্তিক কর্মপদ্ধতি
    2. সন্যাসী বাহিরার কাহিনী
    3. কুরআনের তিনটি কাহিনী আলোচনা
    4. একঃ হযরত মূসা (আ)-এর নদীসঙ্গম ভ্রমণ
    5. দুইঃ ফেরাঊনের মূসা (আ)-কে হত্যা করার সংকল্প
    6. তিনঃ আসহাবে কাহাফের কাহিনী গুহায় অবস্থানকাল সম্পর্কে প্রতিবাদ
  14. নির্দেশিকা

অধ্যায়ঃ ৬ – মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যক্তিগত জীবন ও নবী-জীবন

মহানবীর অনুসরণ ও আনুগত্য

যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন ও মুসলিম উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান তাঁদের জন্যে রসূল তখন আর কেবল বার্তাবাহক থাকেন না বরং রসূল তখন তাঁদের জন্যে একাধারে শিক্ষক প্রশিক্ষণ-গুরু এবং ইসলামী জীবন পদ্ধতির বাস্তব নমুনারূপে পরিগণিত হন। সর্বোপরি তিনি তাদের জন্যে তখন এক মতান নেতার মর্যাদা লাভ করেন যাঁর নিরঙ্কুশ আনুগত্য সকল যুগেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

শিক্ষক, প্রশিক্ষণদাতা ও আদর্শ মানুষ

শিক্ষক হিসেবে মহানবী (সা)-এর দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ যা কিছু শিক্ষা ও উপদেশ দিয়েছেন এবং যেসব আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ নাযিল করেছেন সে সবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ভারো করে সবাইকে বুঝিয়ে দেবেন। কুরআনের এই বাক্যটিতে এ কথাই বলা হয়েছেঃ (আরবী*********) “তাদেরকে তিনি কিতাব ও (কিতাবের শিক্ষা বাস্তবায়ন করার) তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা ও আইন-কানুন অনুযায়ী মুসলমানদেরকে তৈরী করে সেই ছাঁচে তাদের জীবন গড়ে তুলবেন (আরবী******)। আর আদর্শ মানুষ হিসেবে রসূল (সা)-এর ভূমিকা হলো এই যে, তিনি নিজেকে কুরআনের শিক্ষার মূর্তপ্রতীক হিসেবে পেশ করবেন –আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী একজন মুসলমানের জীবন যে ধরনের হওয়া উচিত তাঁর জীবন হবে হুবহু সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রত্যেকটি কথা ও কাজ দেখে জানা যাবে যে, কথা এভাবে বলতে হবে, আপন শক্তির সদ্ব্যবহার এভাবে করতে হবে এবং পার্থিব জীবনে এ ধরনের আচার-আচরণই আল্লাহর কিতাবের অভিপ্রেত। তার বিপরীত যতকিচু তা সবই উক্ত কিতাবের ইচ্ছার পরিপন্থী। কুরআনের এ আয়াত দু’টির বক্তব্যও ঠিক তাইঃ (আরবী************) “তোমাদের জন্যে রসূলুল্লাহর জীবনে উত্তম নমুনা বা আদর্শ রয়েছে”। (আরবী**************************) “তিনি কোনো মনগড়া কথা বলেন না। যা কিছু বলেন তা তাঁর কাছে অহীর মাধ্যমেই আসে”। সাথে সাথে রসূল মুসলমানেরদ আমীর বা নেতাও। কিন্তু তিনি এমন নেতা নন যাঁর কথা ও কাজে কোনোরূপ মতানৈক্য ও বিতর্ক করা যেতে পারে। বরং তিনি এমন নেতা যে, কুরআনের ভাষায় (আরবী******************) “তোমরা কোনো ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হলে তা আল্লাহ ও রসূলের কাছে পেশ করো”। (আরবী*****************) “যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহর আনুগত্য করে”। তিনি এমন নেতা নন যে, শুধু জীবদ্দশায় নেতা, বরং তিনি কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম জাতির নেতা। তাঁর নির্দেশাবলী মুসলমানদের জন্যে সকল যুগে ও সকল অবস্থায় অবশ্য পালনীয়।

কেবলমাত্র প্রচারক ও বার্তাবাহক নন

কুরআনের বাক্য (আরবী******) “আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দেয়াই আপনার জাক”। এবং অনুরুপ আরো কিছু আয়াত থেকে কেউ কেউ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, রসূলের কাজ শুধুমাত্র প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এসব লোক এ কথাটা ভুলে যান যে, রসূল কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত প্রচারক মাত্র, যতক্ষণ লোকেরা ইসলাম গ্রহণ না করে এবং তা কেবল তাদের জন্যেই যারা এখনও রসূলের শিক্ষাকে মেনে নেয়নি। কিন্তু যারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাদের জন্যে রসূল শুধু প্রচারক নন বরং রসূল তাদের একাধারে নেতা, শাসক, আইনদাতা, বিচারক, শিক্ষক এবং প্রশিক্ষক গুরু এবং সর্বোপরি এমন এক আদর্শ মানব যাঁর অনুকরণ ও অনুসরণ করতেই হবে।

আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ এবং ইসলাম প্রচারক আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (সা)-এর মধ্যে এভাবে যে পার্থক্য কেউ কেউ করতে চেয়েছেন, পবিত্র কুরআন থেকে তা মোটেই প্রমাণিত হয় না। কুরআনে মহানবীর মাত্র একটা পরিচয়ই দেয়া হয়েছে এবং তাহলো এই যে, তিনি নবী ও রসূল। তিনি প্রত্যেকটি কথা আল্লাহর রসূল হিসেবেই বলতেন এবং প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর রসূল হিসেবেই করতেন। এবাবে রসূলের পদমর্যাদায় আসীন হওয়া থেকেই তিনি একাধারেপ্রচারক ও শিক্ষাগুরুও ছিলেন, প্রশিক্ষণদাতা ও চরিত্র শোধনকারীও ছিলেন, বিচারক ও শাসক, নেতা এবং পরিচালকও ছিলেন। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের সকল কাজকর্মও রসূল হিসেবেই পরিচালিত ও সম্পাদিত হতো। জীবনের এ সমস্ত বিভাগেই তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানব, একজন অনুগত মুসলিম এবং একজন সত্যনিষ্ঠ মুমিনের ন্যায় নিখুঁত, নিষ্কলুষ ও পবিত্র জীবনধারার অধিকারী। তাঁর সেই নিষ্কলুষ পবিত্র ও জীবনধারার অনুসরণ ও অনুকরণ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের সাফল্য অর্জনের জন্যে অপরিহার্য। এ কথঅ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ২১ আয়াতে ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী*******************************************পিডিএফ ২২২ পৃষ্ঠায়)

নবী হিসেবে, মানুষ হিসেবে এবং শাসক হিসেবে হযরত (সা)-এর জীবনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়েছে এমন ধারণা কুরআনের কোনো বাক্য থেকে সামান্য ইশারা-ইঙ্গিতেও পাওয়া যায় না। এমন পার্থক্য কি করেই বা সম্ভব হতে পারে? তিনি যখন আল্লাহর রসূল তখন তাঁর পুরো জীবনটাই যে আল্লাহর শরীয়াতের অধীন ও অনুসার হবে এবং ইসলামী বিধানের প্রতিনিধিত্ব করবে সেটা তো অপরিহার্য। আল্লাহর অপছন্দনীয় কোনো কাজ বা আচরণ তাঁর দ্বারা হতেই পারে না।

তিনি প্রবৃত্তি ও মনের খেয়ালখুশী দ্বারা চালিত হতেন না

হযরত রসূলুল্লাহ (সা) যে কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত ছিলেন এবং নিজের খেয়ালখুশী দ্বারা চালিত হতেন না, সে কথা পবিত্র কুরআনের সূরা নাজমের প্রথম কয়টি আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ (আরবী**********) “তোমাদের সাথী [অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা)] খারাপ পথেও চালিত হননি পথভ্রষ্টও হননি”। (আরবী********) “তিনি কোনো কথাই নিজের খেয়ালখুশী মতো বলেন না”। (আরবী**********) “তাঁর প্রতিটি উক্তি তাঁর ওপর অবতীর্ণ অহী ছাড়া আর কিছু নয়”। (আরবী********) “তাঁকে শিখিয়েছেন একজন জবরদস্ত ক্ষমতাশালী উস্তাদ”। কতক লোকের ধারণা, এ আয়াতগুলোতে কেবল কুরআনের অহী হওয়ার দাবী করা হয়েছে। কোনো কাফেররা সেটাই অস্বীকার করত। কিন্তু আমি এ আয়াতগুলোতে কোথাও কুরআনের দিকে সামান্য ইঙ্গিতও দেখতে পাই না। (আরবী*****) এ আয়াতটিতে (আরবী)(তা) সর্বনামটি রসূলের (সা) কথার দিকেই নির্দেশ করছে। অর্থাৎ (আরবী*********) “নিজের খেয়ালখুশীতে তিনি কোনো কথাই বরেন না”। এ বাক্যের মধ্যে যে ‘কথা’ শব্দটি আছে তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। রসূলের (সা) কথা দ্বারা যে এখানে কেবল কুরআনকেই নির্দিষ্ট করে বুঝানো হয়েছে তা বলার মতো কোনো ভিত্তি এ আয়াগুলোতে নেই। রসূলের (সা) মুখ থেকে যে কথাই বরে হোক না কেন তা যে অহীই হবে এবং প্রবৃত্তির তাড়না ও মনের খেয়ালখুশী থেকে মুক্ত হবে, এ আয়াতগুলোতে সে কথাই বলা হয়েছে। কুরআন যে এই সার্টিফিকেট দিচ্ছে তার উদ্দেশ্য হলো রসূলকে (সা) যাদের কাছে পাঠান হয়েছে তারা যেন সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে ও নিসন্দেহে জেনে নিতে পারে যে, রসূল (সা) বিন্দুমাত্রও ভুল পথে চালিত হননি এবং তিনি নিজের খেয়ালখুশী অনুযায়ী বলেছেন –আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেননি, তাহলে রসূল হিসেবে তাঁর ওপর কারও আস্থা থাকত না। কাফেররাও তো এ কথাই অর্থাৎ তাঁর রসূল হওয়ার কথাই অস্বীকার করত। তারা ভাবত যে, (নাউজুবিল্লাহ) নবী মুহাম্মদ (সা)-এর মাথা খারাপ হয়েছে, কিংবা কোনো মানুষ তাকে গোপনে শিখিয়ে দিয়ে যায়, কিংবা তিনি নিজে মনগড়া কথা বলেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা নাজমের এ আয়াতগুলো নাযিল করে এ ভুল ধারনার অপনোদন করেছেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের সঙ্গী কুপথগামীও নয়, পথভ্রষ্টও নয়। সে মনগড়া কথাও বলে না। তার মুখ দিয়ে যে কথাই বেরোয়, সত্য বেরোয় এবং আমার তরফ থেকেই না নাযিল হয়। কোনো মানুষ, জ্বীন বা শয়তান তাকে পড়িয়ে দেয় না বা শিখিয়ে দেয় না তাকে শিখায় এক মহা শক্তিশালী শিক্ষক। স্বয়ং হযরত রসূলুল্লাহ (সা) নিজের জিহবার দিকে ইশারা করে এ কথাই বলেছিলেন, (আরবী*****) “আমার জীবন-মৃত্যু যাঁর হাতে সেই আল্লাহর শপত করে বলছি, এ জিহবা দিয়ে সথ্য কথা ছাড়া কিছুই বেরোয় না”।

সকল অবস্থায় তাঁর অনুসরণ বাধ্যতামূলক

বড়ই দুঃখের বিষয় যে, কিছু লোক এ কথা মানতে চান না যে, সকল অবস্থাতেই রসূল (সা)-এর আনুগত্য করা জরুরী। তাঁরা বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ (সা) নিজ গৃহে আপন স্ত্রীদের সাথে কিংবা ঘরের বাইরে অন্যান্য লোকের সাথে যেসব কথাবার্তা বলতেন, সেগুলো সম্পর্কে দাবী করা হতো না যে, তাও অহী আর কাফেররাও তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। আমি বলতে চাই, হযরত রসূলুল্লাহ (সা) যখন যে অবস্থায় যা কিছু করতেন তা রসূল হিসেবেই করতেন। তাঁর সবকিচুই গোমরাহী ও প্রবৃত্তির লালসা থেকে মুক্ত ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে নিখুঁত, নির্ভুল ও সত্যাশ্রয়ী বিবেক ও স্বভাব-প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এবং খোদাভীতি ও পবিত্রতার যে সীমারেখা তাঁর জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন, তাঁর সকল কথা ও কাজ সেই স্বভাব প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত হতো এবং সেই সীমারেখার মধ্যেই সীমিত থাকত। সমগ্র মানব জাতির অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য একটা উৎকৃষ্ট নমুনা ও আদর্শ ছিল তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বে। বস্তুত ইসলামে কি বৈধ, কি অবৈধ, কি হালাল ও  কি হারাম; কোন কোন জিনিস আল্লাহর পছন্দনীয় এবং কোনটা অপছন্দনীয়, কোন কোন ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার ও চিন্তা-গবেষণার স্বাধীনতা আছে আর কোন কোন ব্যাপারে তা নেই সেসব আমরা ঐ আদর্শের নিরীখেই জানতে পারি। সেই আদর্শই আমাদের বলে দেয় –কিভাবে নেতা ও শাসকের আনুগত্য করতে হবে, কিভাবে পরামর্শের ভিত্তিতে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে, আর আমাদের দ্বীন ইসলামে গণতন্ত্রের অর্থই বা কি।

নবী মুহাম্মদ (সা) ছিলেন আল্লাহ তায়ালার নিযুক্ত আমীর

হযরত রসূলুল্লাহ (সা) মানুষের নির্বাচিত বা মনোনিত আমীর ছিলেন না, নিজে নিজেও তা হননি। তিনি ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত আমীর ও নেতা। নেতা হিসেবে তাঁর যে ভূমিক ছিল, তা রসূল হিসেবে তাঁর ভূমিকা থেকে ভিন্নতর ছিল না বরং আসলে তিনি আল্লাহর রসূল হিসেবেই মানুষের নেতা ছিলেন। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তিনি নেতা বা আমীর ছিলেন না বরং আল্লার আজ্ঞাবহ ছিলেন। নিজের অনুসারীদের সাথে পরামর্শ করার হুকুম তাঁকে দেয়া হয়েছিল, সে কথা ঠিক। এ জন্যে যে, তিনি নিজেকে তাঁর উম্মতের কাছে পরামর্শের প্রতীক হিসেবে পেশ করবেন। স্বয়ং আপন কাজকর্মের দ্বারা তিনি গণতন্ত্রের (Democracy) সঠিক মূলনীতি শিক্ষা দিতেন। এর থেকে এ সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না যে, তাঁর মর্যাদা ছিল অন্যান্য নেতাদের মতোই। অন্যান্য নেতাদেরম জন্যে তো আইন করে দেয়া হয়েছে যে, তারা অবশ্যি পরামর্শ করে কাজ করবে। (আরবী******) “তাদের যাবতীয় কাজ পারস্পরিক পরামর্শক্রমেই চালাতে হবে”। আর পরামর্শ করতে গিয়ে মতানৈক্য ঘটলে সরাসরি আল্লাহ ও রসূল (সা) তথা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নির্দেশ নিতে হবেঃ (আরবী*************************) (কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে, সে বিষয়টির ফায়সারা আল্লাহ ও রসূলের নিকট থেকে গ্রহণ কর)। অথচ রসূলুল্লাহ (সা)-কে পরামর্শ করার হুকুম দিয়ে সাথে সাথেই এ কথাও বলে দেয়া হয়েছেঃ (আরবী*******) “অতপর যখন কোনো বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো”। এ থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। তবুও তাঁকে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে শুধু এ জন্যে যে, রসূলের (সা) পবিত্র হাত দিয়ে একটা সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিপত্তন হোক।

নেতা বা আমীর হিসেবে রসূলের আনুগত্য

এ ব্যাপারেও কেউ কেউ ভুল ধারণায় লিপ্ত আছেন। তারা বলেন, নেতা হিসেবে হযরত (সা)-এর আনুগত্য তাঁর জীবদ্দশাতেই সীমাবদ্ধ। অথচ এ কথা ঠিক নয়। তারা প্রমাণ দর্শান সূরা আনফালের ২০ নম্বর আয়াতের (আরবী********) শব্দগুলো থেকে এবং তারা এরূপ অর্থ গ্রহণ করেন যে, রসূল (সা)-এর কথা মেনে চলার হুকুম কেবল তাদেরকে দেয়া হয়েছে যারা তখন তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। অথচ এ আয়াতের প্রকৃত অর্থ তা নয়। সূরা আনফালেরই প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, (আরবী*************) “তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তবে আল্লাহ ও রসূলের কথা মতো চল”। শুধু তাই নয় বরং যারা রসূল (সা)-এর জিহাদের ডাকে সাড়া দিতে মনে মনে ইতস্তত বোধ করতো ৫নং আয়াতে তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। তারপর ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে, (আরবী***************) “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে বাদানুবাদ করে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা”।

এসব কথা বলার পরই ২০নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************পিডিএফ ২২৫ পৃষ্ঠায়)

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর হুকুম মান এবং রসূলের হুকুম মান। হুকুম অমান্য কর না –যখন তা শুন পাচ্ছ”। এ আয়াতে ও আগের আয়াতগুলোতে রসূলের সাথে সাথে আল্লাহর হুকুম মানার কথা বারবার বলা হয়েছে। রসূলের হুকুম মানা যে স্বং আল্লাহর হুকুম মানারই শামিল তা বুঝানই এর উদ্দেশ্য। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করতে হবে। সব জায়গাতেই ‘রসূল’ শব্দ বলা হয়েছে, ‘আমীর’ শব্দ কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি এমন কোনো প্রচ্ছন্নতম ইঙ্গিতও এতে নেই যাতে বুঝা যায় যে, রসূল অর্থ নেতা বা আমীর জাতীয় এমন কোন পদমর্যাদা –যা রসূল (সা)-এর পদমর্যাদা থেকে আলাদা। সঙ্গে সঙ্গে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, রসূলের (সা) হুকুম উপেক্ষা করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং তা শুনতে পাচ্ছ” এ কথার সুস্পষ্ট মর্ম এই দাঁড়ায় যে, তোমরা আমার এত বারবার উচ্চারিত হুকুমগুলো শুনেও আমার রসূলের (সা) আনুগত্য করতে অস্বীকার কর না। এখানে ‘তোমরা’ শব্দটির অর্থ রসূলের (সা) আনুগত্য করতে অস্বীকার কর না। একানে ‘তোমরা’ শব্দটির অর্থ রসূলের (সা) জীবদ্দশায় জীবিত মুসলমানই শুধু নয় বরং কেয়ামত পর্যন্ত যত মুমিন কুরআনের বাণী শুনবে তাদের সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের সকলের জন্যেই রসূলের (সা) প্রতিটি আদেশ মানা ও কার্যকর করা ফরজ, তা যেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছুক না কেন।

একটা অদ্ভুত যুক্তি

কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, নবী করীম (সা)-এর নেতৃত্বের দায়িত্ব ঠিক তেমনি সাময়িক যেমন অন্যান্য নেতাদের বেলায় হয়ে থাকে। কেননা আজকের এ যুগে বদর ও ওহোদ যুদ্ধের মতো সড়কী-বল্লম ও তরবারী দিয়ে লড়াই করা অসম্ভব। এ একটা অদ্ভুত যুক্তি বটে! রসূলুল্লাহ (সা) সে যুগে যেসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতেন সেগুলোর ব্যবহার সে যুগের বিশেষ পরিবেশে সীমাবদ্ধ হতে পারে। তাই বলে তিনি যুদ্ধে যেসব নৈতিক বিধি-নিষেধ মেনে চলতেন এবং অন্যকেও মেনে চলতে বলে গেছেন সেটা কোনো বিশেষ যুগের ব্যাপার নয়। বরং ওগুলো দিয়ে তিনি মুসলমানদের জন্যে একটা স্থায়ী সমরবিধি তৈরী করে দিয়ে গেছেন।

আসলে শরীয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত (সা) যুদ্ধে কি কি অস্ত্র ব্যবহার করতেন –তরবারী, বন্দুক, না কামান; সেটা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। বরং তিনি ঐসব অস্ত্র কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন এবং তা দিয়ে কি রকম রক্তপাত ঘটাতেন সেটিই আসল বিবেচ্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে তিনি যে আদর্শ বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন তা ইসলামী জিহাদের জন্যে এক চিরন্তন ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। তাই আদর্শগতভাবে ও নীতিগতভাবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কেয়ামত পর্যন্ত সর্বযুগের সকল মুসলিম সেনাদলের সর্বাধিনায়ক।

নবীর নেতৃত্বের বিশিষ্ট মর্যাদা

জনৈক ভদ্রলোক এমারত ও রিসালাতের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে বলেন যে, মুসলমানরা তাদের নেতার সাথে বিতর্ক ও দ্বিমত করার অধিকার রাখে –অথচ রসূলের (সা) সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায় না। আমি  সে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করি, রসূলের (সা) নেতৃত্ব আর অন্যান্য নেতার নেতৃত্ব কি করে সমান হতে পারে? যে নেতার সামনে উচ্চৈস্বরে কথা পর্যন্ত বলা যেত না, শুধু উচ্চৈস্বরে কথা বললেই সারা জীবনের সমস্ত নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে বলে সূরা হুজুরাতে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার সাথে বাদানুবাদ করলে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে বলে সূরা নিসায় সতর্ক করা হয়েছে। তাঁর সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করার কোন অধিকার কি মুসলমানের থাকতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে সেই নেতার নেতৃত্ব ও অন্যান্য নেতার নেতৃত্ব কি করে সমান হতে পারে? অন্যান্য নেতার সাথে দ্বিমত পোষণের অধিকার তো মুসলমানদেরকে দেয়াই হয়েছে।

আনুগত্যের তিনটি পর্যায়

রসূল (সা)-এর আনুগত্য করার যেসব নির্দেশ কুরআনে এসেছে তাকে আমীর বা নেতার আনুগত্যের সমার্থক বলে কেউ কেউ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন। এ ধরনের একটি অভিমতের উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হলঃ

“আল্লাহ ও রসূলের (সা) আনুগত্যের হুকুম কুরআনের যেখানে যেখানে একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তার অর্থ হলো সাধারণভাবে মুসলমানের সেই নেতৃত্বের আনুগত্য যা কুরআনকে আইন ও শাসনতন্ত্রের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে এবং তা স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা) অথবা তাঁর খলিফা কর্তৃক পরিচালিত হয়। যেমন কুরআনে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ (আরবী************) “জনগণ তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলে দাও, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ ও রসূলের”। এটা জানা কথাইযে, গনিমতের মাল সংক্রান্ত এ নির্দেশ হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর যুদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না বরং পরবতীকালের জন্যেও তা সমভাবে পালনীয়। সে হুকুম (সা) অর্থাৎ সমসাময়িক মুসলিম নেতৃত্বের হাতে নিবদ্ধ। কাজেই নেতা হিসেবে রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিজের যে মর্যাদা তাঁর খলিফাদেরও অবিকল তা-ই।

এ অভিমত স্পষ্টতই সত্যের অপলাপ মাত্র। পবিত্র কুরআনে নেতৃত্বের তিনটি স্তর সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য, রসূলের (সা) আনুগত্য এবং ‘উলুল আমরের আনুগত্য’। আল্লাহর আনুগত্য বলতে কুরআনের হুকুসমুহের আনুগত্য বুঝায়। রসূলের (সা) আনুগত্য বলতে হযরতের কথা ও কাজের অনুসরণ ও অনুকরণ বুঝায়। আর ‘উলুল আমর’-এর আনুগত্যের অর্থ হলো, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য ও ইসলামের বিধান অনুযায়ী মুসলমানদের পরিচালনাকারী এবং নীতি-নির্দেশক নেতৃত্বের আনুগত্য। প্রথম দু’টো পর্যায় সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। কুরআন বারংবার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ ও রসূলের (সা) নির্দেশের ওপর বিন্দুমাত্র বিতর্কের অবকাশ নেই। মুসলমানদের কাজ হলো শুধু তা শোনা ও সে অনুসারে কাজ করা। আল্লাহ ও রসূল যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন সে ব্যাপারে অতপর অন্য কোনো মুসলমানের নতৃন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আদৌ কোনো এখতিয়ার নেই। অন্য কথায় বলা যায়, এ দু’টো পর্যায়ে কোনো আপত্তি বা বিরোধিতা বা বিতর্ক তোলার চেষ্টা করলেই ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যেতে হয়। আর তৃতীয়টি সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য হলো, আমীর বা নেতার আনুগত্য আল্লাহ ও রসূলের অধীন। বিতর্ক, বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে আল্লাহ ও রসূলের (সা) বিধান অনুসারে তার ফায়ষালা করতে হবে। এমন পরিস্কার ও সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকতে আল্লাহ ও রসূলের (সা) অর্থ মুসলমানদের নেতৃত্ব –এ কথা বলার অবকাশই নেই। হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর নেতৃত্ব আর সাধারণ মুসলিম নেতৃবন্দের নেতৃত্বকে এক পর্যায়ে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে (আরবী**************) “আয়াত থেকে যে যুক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করা হয়েছে তা ঠিক নয়। গনিমতের সম্পদ আল্লাহ ও রসূলের হওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহ ও রসূল (সা) প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ, সংগঠন ও রাষ্ট্রের কল্যাণে তা ব্যয় করতে হবে। এ আয়াত থেকে কি করে বুঝা গেল যে, আল্লাহ ও রসূল মানেই মুসলিম নেতৃত্ব?

ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টির ভ্রান্ত প্রচেষ্টা

কুরআনে এমন কোনো প্রচ্ছন্নতম ইঙ্গিতও পাওয়া যায় না যাতে করে রসূলুল্লাহ (সা)-এর শুধুমাত্র ধর্মীয় কার্যকলাপকেই শাশ্বত ও কালজয়ী আদর্শ বলে মনে করা যায় এবং তাঁর সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিষয় সংক্রান্ত নীতি-নির্দেশ ও সিদ্ধান্তসমূহকে কেবল বিশেষ যুগের জন্যে প্রয়োজ্য মনে করা যায়। এমন কোনো আয়াদ যদি কুরআনে থেকে থাকে –যার আলোকে এ দু’ধরনের কার্যকলাপের মধ্যে পার্থক্য করা চলে তাহলে তা কেউ দেখিয়ে দিলে ভাল হয়। আমার জানা মতে, কুরআনের এটাই সুস্পষ্ট বিধান যেঃ

(আরবী*******************************************পিডিএফ ২২৭ পৃষ্ঠায়)

“আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর কোনো মু’মিন নারী-পুরুষের নিজেদের ব্যাপারে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আর থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করবে সে প্রকাশ্য গোমরাহিতে লিপ্ত হয়ে যাবে”।–(সূরা আল আহযাবঃ ৩৬)

এ আয়াতে যুগ বা সময়ের গণ্ডী চিহ্নিত করে দেয়অ হয়নি। এখানে যে মু’মিন নারী ও পুরুষের কথা রয়েছে তার মানে রসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় মু’মিন নারী-পুরুষ –এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশ বা সিদ্দান্তের বিষয়ও কেবল ধর্মীয় বলে নির্দিষ্ট করা হয়নি বরং তার মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক, তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক –সব ধরনের বিষয়ই অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ ও রসূল অর্থ আল্লাহ ও রসূলই ‘এমারত’ বা নেতৃত্ব কখনই নয়। কোনো আমীর অথবা ‘উলুল আমর’ তো মু’মিনই হবেন। আর এখানে আল্লাহ ও রসূল কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত করে দেয়ার পর কোনো মু’মিন নারী-পুরুষের আর কোনো অধিকারই থাকছে না যে, তারা নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত করতে পারে। এ সিদ্ধান্ত কেউ একা করুক অথবা সকলে মিলে করুক। তারপর বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এর বিরুদ্ধাচরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। এর মানে হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল তাঁদের নির্দেশ ও বিধানের ভিত্তিতে ইসলামী জামায়াত বা সমাজের যে বিধান কায়েম করেছেন তা ঐ আইন ও বিধানকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা ছাড়া টিকিয়ে রাখাই সম্ভব নয়।

আল্লাহ যা বলেছেন এবং তাঁর রসূল যা করেছেন তা উপেক্ষা করে যদি মানুষ আপন ইচ্চা ও এখতিয়ারের কোনো পন্থা অবলম্বন করে তাহলে সে বিধান টিকে থাকবে না।

নবীর আনুগত্য এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামী ধারনা

 

এক ভদ্রলোক লিখেছেনঃ

“সূরা আহযাবের হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা) এবং হযরত যয়নব (রা)-এর যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তাতে একটা প্রশ্ন জগে। হযরত রসূলুল্লাহ (সা) যায়েদকে বললেন, (আরবী**********) (তোমার স্ত্রীকে নিজের দাম্পত্য বন্ধকে বহাল রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর) কিন্তু হযরত যায়েদ মহানবীর এ নির্দেশের বিপরীত কাজ করলেন এবং হযরত যয়নবকে তালাক দিলেন। এ কাজটা যে রসূলুল্লাহ (সা)-এর হুকুমের খেলাফ হলো তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিতে স্পষ্টাক্ষরে বা ইঙ্গিতে এমন কোনো কথা পাওয়া যায় না যাতে হযরত যায়েদের এ বিরুদ্ধাচরণকে আল্লাহ বিন্দুমাত্র অপছন্দ করেছেন বলে বুঝা যায়। বরঞ্চ ঘটনার শুরুতে হযরত যায়েদকে আল্লাহর অনুগৃহীত বান্দাহরূপে অভিহিত করা হয়েছে, (আরবী*********) (যার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন) এ থেকে ধারণা জন্মে যে, তাহলে বোধ হয় নবীর হুকুমের খেলাফ কাজ করাতে দোষ নেই এবং নবীর কথা যদি প্রমাণিতও হয় তথাপি তা মেনে চলা আল্রাহর হুকুমের মতো অপরিহার্য নয়”।

প্রশ্নের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই এবং অল্প কথায় প্রশ্নকারীর সন্দেহ দূর করা যেত। কিন্তু আসলে যেখান থেকে সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে সেখান থেকে বিভিন্ন ভুল ধারণাও উৎসারিত হচ্ছে। আর সে ভুল ধারণাগুলোর শিক[ অনেক গভীরে সঞ্চারিত। তাই এ সন্দেহ নিরসনের সাথে সাথে তার মূল ও শাখা-প্রশাখাগুলোর ওপরও কিছু আলোকপাত করা যাক।

নির্দেশ দানের অধিকার একমাত্র আল্লাহর

অন্যান্য আসমানী কিতাবের চেয়ে কুরআন অধিকতর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, সর্বোচ্চ ও সার্বভৌম আইনদাতা, হুকুমদাতা ও শাসক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। (আরবী*********) (আল্লাহ ছাড়া আর কারও অধিকার নেই আইন জারি করার ও শাসন করার) আল্লাহ তায়ালাই যেমন খুশী নির্দেশ দিতে পারেনঃ (আরবী********) নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা যা ইচ্ছা তাই হুকুম করেন) একমাত্র তিনিই এমন শাসক যাঁর নির্দেশাবলীর মধ্যে কোনোরূপ প্রশ্নের অবকাশ নেইঃ (আরবী********) (তাঁর কোনো কাজে প্রশ্ন তোলা যায় না)। কেবল আল্লাহরই আনুগত্য করা ফরজ এবং তা এ জন্যেই ফরজ যে, সৃষ্টিগতভাবে সে তারই বান্দা বা গোলাম। তাকে সৃষ্টি করাই হয়েছে আল্লাহর দাসত্বের জন্যে। (আরবী*************) (আজি জ্বিন ও মানুষকে কেবল আমার গোলামী বা দাসত্ব করার জন্যেই সৃষ্টি করেছি)। মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কারও সৃষ্টিও নয়, দাসও নয়, পোষ্যও নয়। তাই কোনো মানুষের জন্যে অন্য মানুষের আনুগত্য বাধ্যতামূলক নয়। (আরবী*******************) (তারা জিজ্ঞেস করে, শাসন কর্তৃত্বে আমাদের কোনো অংশ আছে কি? তুমি জানিয়ে দাও, শাসন-কর্তত্ব নিরংকুশভাবে একমাত্র আল্লাহর)। সুতরাং কোনো মানুষের যেমন অন্য মানুষের ওপর সার্বভৌম ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব (Absolute Authority) নেই, তেমনি কোনো মানুষের ওপর এ বাধ্যবাধকতাও নেই যে, খোদা ছাড়া সে অন্য কারও আদেশ মেনে চলবে, শুধু এ কারণে যে, আদেশটি ঐ বিশেষ ব্যক্তির।

মানুষের ওপর মানুষের শাসন কর্তৃত্ব

কুরআন মানুষের কাঁধের ওপর থেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন সত্তার আনুগত্যের জোয়াল নামিয়ে ফেলতে ইচ্ছুক। তাকে প্রকৃত সার্বভৌম মনিব ও শাসক আল্লাহর আনুগত দাসে পরিণত করতে চায়। অতপর তাদে দিতে চায় চিন্তা ও বিবেক-বুদ্ধির পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। বস্তুত এটাই ছিল কুরআন নাযিল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য। এ জন্যেই আমরা দেখতে পাই, মানুষের গোলামী ও দাসত্বের বিরুদ্ধে কুরআনই করেছে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম। একজন মানুষ নিজের ইচ্ছা মতো কোনো জিনিসকে হারাম বা হালাল বলে ঘোষনা করবে, আর তার আদেশ ও নিষেধকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের মতো শিরোধার্য করে নিতে হবে এমন অধিকার তার দৃষ্টিতে কোনো মানুষেরই নেই। কুরআন কোনো মানুষেরই এমন নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। বরং এ ধরনের আদেশ-নিষেধ মেনে চলাকে সে শিরক বলে ঘোষণা করেছে। যারা আলেম, পীর-মুর্শেদ, পাদ্রী-পুরোহিত এবং শাসকদেরকে (আরবী*********) বা আল্লাহর বিকল্প দেবতা ও খোদার আসনে সবায়, তাদের কথাকে অম্লান বদনে মেনে নেয়, কুরআন তাদেরকে মুশরিক বলে ঘোষণা করেছে। কোনো কোনো মানুষ যখন অন্য মানুষের প্রতি এমন নির্ভেজাল আনুগত্য পোষণ করে তখন সে অনিবার্যভাবেই তাকে নিজের মনিব এবং নিজেকে তার গোলাম বলে ভাবতে থাকে। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের সামনে নিজের বিবেক-মন ও দেহের স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় পুরোপুরিবাবে বিসর্জন দিতে রাজি হতে পারে কেবল তখনই যখন সে তাকে সকল ভুল-ত্রুটির ঊর্ধে এবং সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ও নিষ্কলংক মনে করে অথবা যখন মনে করে যে সে নিজস্ব অধিকারের বলে যে কোন ধরনের আদেশ নিষেধ করার ক্ষমতা রাখে এবং শাসন ও কর্তৃত্ব চালানোর সহজাত অধিকার তার রয়েছে। অথবা এরূপ মনে করে যে, ক্ষতি বা উপকার করার যাবতীয় ক্ষমতা কেবল তারই আছে, জীবিকা দেয়া বা বন্ধ করার ক্ষশতাও কেবল তারই রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রাণী বা পদার্থের এ ধরনের গুণাবলী থাকার কথা বিশ্বাস করাই শিরক ও দাসত্বের মূল উৎস। পক্ষান্তরে তাওহিদী আদর্মের মূল কথাই হলো আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রাণী বা বস্তুই এসব গুণের অধিকারী নয় বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং সকলেরই কর্তৃত্ব বা শাসনাধিকার প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সৃষ্টির গোলামী থেকে মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি ও স্বাধীনতা লাভই এ আদর্শের অনিবার্য ফলশ্রুতি।

নবীর আনুগত্য কি হিসেবে করতে হবে

ওপরের আলোচনা হৃদয়ঙ্গম করার পর ভেবে দেখতে হবে যে নবী (সা)-এর যে আনুগত্য ইসলাম অপরিহার্য করা হয়েছে এবং যার ওপর ‘দ্বীন’ নির্ভরশীল তা কি হিসেবে করতে হবে। এ আনুগত্য কিছুতেই এ জন্যে নয় যে, নবী এক বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন ইমরান পুত্র অথবা মরিয়াম পুত্র অথবা আবদুল্লাহ পুত্র এবং এ বিশিষ্ট ব্যক্তি হওয়ার কারণে আদেশ ও নিষেধ করার এবং হালাল ও হারাম নির্ধারণ করার অধিকার তাঁর আছে। এমন হলে তো মায়াযাল্লাহ, নবী স্বয়ং আরবাবুস্মিন দুনিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বিকল্প বহু আল্লাহর মদ্যে তিনি একজন হয়ে পড়বেন। আর এভাবে স্বয়ং তাঁর হাতেই সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে –যার জন্যে তাঁকে নবী করে পাঠান হয়েছে। কুরআন এ বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট বাষায় ব্যক্ত করেছে। সে বলে, ব্যক্তি হিসেবে নবী অন্যান্য মানুষের মতই একজন মানুষ। (আরবী********************) “হে নবী! তুমি বলঃ আমার প্রভু সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধে। বস্তুত আমি একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু নই –যাকে রসূলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে”। (আরবী******************) “তাদেরকে তাদের নবীরা বললেন যে, আমরা তো তোমাদের মতই মানুষ”। অবশ্য নবী হওয়ার কারণে তাঁর মধ্যে ও অন্যান্য মানুষের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে যায়। তাঁকে যখন নবুয়াত দান করা হয় তখন সেই সাথে তাঁকে অর্পন করা হয় শাসন ক্ষমতাও। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী******************) “নবীরা হলেন তাঁরাই যাঁদেরকে আমি কিতাব,শাসন ক্ষমতা ও নবুয়াত দান করেছি”। এখানে ‘হুকুম’ বা শাস ক্ষমতা বলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয়ই বুঝায়। অতএব স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, নবীর হাতে যে ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয়ই বুঝায়। অতএব স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, নবীর হাতে যে ক্ষমতা ও এখতিয়ার তা তাঁর ব্যক্তিগত নয় –বরং আল্লাহর অর্পিত ক্ষমতা ও এখতিয়ার। এ জন্যে তাঁর আনুগত্য স্বয়ং আনুগত্য। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী******************) “যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো সে যেন আল্লাহরই আনুগত্য করলো”। নবীকে পাঠানোর উদ্দেশ্যই এই যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে আল্লাহর নির্দেশসহূম জারি করবেন এবং মুসলমানরা তা মেনে চলবে। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী******************) “আমি যে নবীই পাঠাই তা এ জন্যেই পাঠাই যে, আল্লাহর নির্দেশেই তাঁর আনুগত্য করতে হবে”। এ হিসেবে রসূলের (সা) হুকুম পাঠাই যে, আল্লাহর নির্দেশেই তাঁর আনুগত্য করতে হবে”। এ হিসেবে রসূলের (সা) হুকুম স্বয়ং আল্লাহরই হুকুম। এ সম্পর্কে কারও কোনো প্রশ্নই তোলার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩১ পৃষ্ঠায়)

“হেদায়াত সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে ব্যক্তি নবীর সাথে কোন্দল-কলহ করে এবং এমন পথ অবলম্বন করে –যা ঈমানদারদের পথ থেকে পৃথক হয়, তাকে আমি সেদিকেই ফিয়ে দেই যেদিকে সে মুখ ফিরায়। তারপর তাকে আমি জাহান্নামে ঠেলে ফেলে দেই। আর জাহান্নাম অতীব নিকৃষ্ট স্থান”।

নিরংকুশ আনুগত্য

রসূল (সা)-এর কার্যত নাফরমানী করা তো দূরের কথা, মনে মনেও যদি নাফরমানির ইচ্ছা পোষণ করা হয় তাহলও নিশ্চিতভাবে ঈমান চলে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

(আরবী******************************পিডিএফ ২৩১ পৃষ্ঠায়)

“আল্লাহর শপথ, তারা কখনও মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমাকে নিজেদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে মীমাংসাকারীরূপে মেনে নেবে এবং তুমি যে ফায়সালা করবে তা মেনে নিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করবে না। বরং তার সামনে পুরোপুরিভাবে মাথানত করে দেবে”।

রসূলের অবাধ্যতা মানুষকে এনে দেয় চিরন্তনের জন্যে ক্ষতি ও ব্যর্থতা। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

(আরবী******************পিডিএফ ২৩২ পৃষ্ঠায়)

“যারা কুফরী ও রসূলের নাফমানী করেছে, কেয়ামতরে দিন তাদের ওপর এমন আপদ আসবে যে তারা কামনা করবে তাদের ওপর গোটা পৃথিবীটা চাপিয়ে দেয়া হোক”।

নবী মানুষকে তাঁর গোলামে পরিণত করেন না

নবীর আনুগত্য এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের ওপর ‘দ্বীন’ ও ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, হেদায়াত নির্ভর করে নবীর পুঙ্খানুপুঙ্খ আনুগত্যের ওপর। (আরবী******************) মানুষ অথবা ব্যক্তি হিসেবে এ আনুগত্য যে নবীর প্রাপ্য নয় তা পূর্বেই বলা হয়েছে। মানুষকে নিজের দাস ও গোলাম বানাবার জন্যে নবীরা প্রেরিত হন না বরং মানুষকে আল্লাহর অনুগত করে দেয়ার জন্যেই তার প্রেরিত হন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী******************পিডিএফ ২৩২ পৃষ্ঠায়)

“কোনো মানুষের পক্ষে এটা সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, শাসনক্ষমতা ও নবুয়াত দান করবেন আর সে পরক্ষণেই মানুষকে বলবে, তোমরা আল্লাহর বান্দা না হয়ে আমার বান্দা হয়ে যাও। না, বরং সে বলবে, তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও”।

নবী এ জন্যে আগমন করেননি যে, তিনি মানুষকে তাঁর ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার আনুগত্য করতে বাধ্য করবেন, নিজের মহত্ব ও বুজুর্গির প্রভাব তাদের ওপর বিস্তার করবেন তারা তাঁর মতামতের মোকাবিলায় নিজেদের মতামত পোষণ করার অধিকার থেকেই বঞ্চিত হবে এবং নিজেদের মন-মস্তিষ্ক তাঁর কাঝে নিষ্ক্রীয় করে রেখে দেবে। এ তো সেই গায়রুল্লাহর বন্দেগীই হলো যার মূলোৎপাটনের জন্যেই নবীর আগমন।

মানুষের কাঁধে মানুষের দাসত্বের যত রকম শৃঙ্খল চাপানো হয়েছে তা সব ছিন্ন করার জন্যেই তো নবীর আগমন। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী******************) “আর তিনি (নবী) তাদের ওপর চাপানো যাবতীয় বোঝা নামিয়ে দেন এবং যেসব বন্ধনে তারা আবদ্ধ থাকে তা তাদেরকে মুক্ত করেন”। মানুষ মানুষের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং বৈধ ও অবৈধের মনগড়া সীমারেখা নির্ধারণ করার যে ক্ষমতা ও এখতিয়ার করায়ত্ব করে রেখেছিল, তা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যেই নবী এসে থাকেন। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী******************) “নিজের মুখ দিয়ে যাকে ইচ্ছা হারাম বা হালাল বলে ঘোষণা করার কোনো অধিকার তোমাদের নেই”। মানুষের হুকুম ও সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নেয়ার মত যে হীনা মানুষকে পেয়ে বসেছিল তা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যেই নবুয়াতের আবির্ভাব ঘটেছিল। কুরআন এ কথাই মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেঃ (আরবী******************) “আমাদের মধ্য হতে কোনো মানুষ যেন অন্য মানুষকে আল্লাহর পরিবর্তে নিজের রব বানিয়ে না নেয়”। সুতরাং একজন নবী মানুষের কাঁধের ওপর থেকে অপরের গোলামীর শিকল ছিন্ন করে তাদেরকে নিজের গোলামীর শিকল দিয়ে নতুন করে বাঁধবেন এটা কি করে বৈধ হতে পারে? তিনি হালাল হারাম নির্ধারণের অধিকার অন্য সবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবেন এবং পরক্ষণে নিজেই তা দখল করে বসবেন এবং ক্ষমতা ও আধিপত্যের আসন থেকে অন্য সবাইকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই গিয়ে তার ওপর সমাসীন হবেন, এটা কেমন করে সমীচীন হতে পারে? যে নবী ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদেরকে এই বলে তিরস্কার করেন যে, তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় নেতা ও পীর-পুরোহিতদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বানিয়ে নিয়েছে, (আরবী******************) তিনি কি করে বলবেন যে, এখন তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাকে রব বা খোদা বলে স্বীকা কর এবং আমার ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির দাসত্ব কর?

নবী হিসেবে নবীর আনুগত্য

বস্তুত এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীকে দিয়ে বারংবার এ সত্যটি প্রকাশ করেছেন যে, মু’মিনকে যে আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যে আনুগত্যের ওপর ঈমান থাকা না থাকা নির্ভরশীল এবং যে আনুগত্য বর্জন তো দূরের কথা, চুল পরিমাণ তা থেকে দূরে সরারও অধিকার মু’মিনের নেই, সেটা আসলে মানুষ হিসেবে নবীর আনুগত্য নয় বরং –নবী হিসেবেই তাঁর আনুগত্য। অর্থাৎ যে  হুকুম, যে জ্ঞান, যে পথনির্দেশ ও যে আইন ও বিধান নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন, তারই আনুগত্য করতে হবে। এ আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, ইসলাম মানুষকে যে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে সেটা আসলে মানুষের আনুগত্য নয় বরং আল্লাহরই আনুগত্য। আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী****************** পিডিএফ ২৩৩ পৃষ্ঠায়)

“(হে নবী!) আমি তোমার কাছে এই সত্য গ্রন্থ এ জন্যেই নাযিল করেছি যে, আল্লাহ তোমাকে যে ন্যায়নিষ্ঠা দেখিয়েছেন সেই অনুসারে যেন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করতে পার”।–(সূরা আন নিসাঃ ১০৫)।

(আরবী****************** পিডিএফ ২৩৩ পৃষ্ঠায়)

“আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুসারে বিচার-ফায়সালা করে না তারাই প্রকৃতপক্ষে যালিম”।–(সূরা আল মায়িদাঃ ৪৫)।

আল্লাহর এই আইন মেনে চলতে যেমন অন্য সব মানুষ বাধ্য তেমনি একজন মানুষ হিসেবে স্বয়ং নবীও তা মেনে চলতে বাধ্য। (আরবী******************) “অহীর মাধ্যমে আমার কাছে যা কিছু নাযিল করা হয় কেবলমাত্র তা-ই আমি মেনে চলি”।–(সূরা আনয়ামঃ ৫০)

নবীর আনুগত্য আল্লাহর নির্দেশের অধীন

উপরোক্ত আয়াতগুলো ছাড়াও আরও বহু আয়াত সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, আনুগত্য কেবল আল্লাহরই, আর কারও নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর দাসত্ব এবং মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব ও আধিপত্যের যদি অবকাশ থেকে থাকে তবে তা মানুষ হিসেবে নয়। নবীর আনুগত্য করতে হবে সত্য কিন্তু সেটা এ জন্যে যে, আল্লাহর তরফ থেকে তাকে নির্দেশ জারী করার অধিকার দেয়া হয়েছে। শাসক-প্রশাসকদের আনুগত্য করতে হবে এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও রসূলের (সা) হুকুম প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত। আলেমদের আনুগত্য এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও রসূলের (সা) আদেশ-নিষেধ এবং তাঁর নির্দেশিত বৈধ-অবৈধের সীমারেখা জানিয়ে দেন। এঁদের মধ্যে কেউ যদি আল্লাহর হুকুম পেশ করেন তবে তার সামনে মাথানত করে দেয়া প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। এর যৌক্তিকতা বা বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার তার নেই। আল্লাহর সামনে কোনো মু’মিনের চিন্তার স্বাধীনতা ও মতামতের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু যদি কোনো মানুষ আল্লাহর হুকুম নয় –বরং নিজের কোনো মত বা ধারণা পেশ করে তবে তা মেনে নেয়া মুসলমানের ওপর ফরয নয়। সে ক্ষেত্রে সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও নিজস্ব মত পোষণের অধিকারী। স্বেচ্ছায় তার সাথে দ্বিতমত পোষণ করার অধিকার তার রয়েছে। এরূপ শুধু আলেম ও শাসক কেন স্বয়ং ব্যক্তিগত মতের সাথে দ্বিমত পোষণেও কোনো বাধা নেই।

মহানবীর (সা) জীবনের উদ্দেশ্য ছিল দু’টি

মহানবী (সা)-এর জীবনের একটি উদ্দেশ্য হলো মানুসের গলায় আল্লাহর গোলামী ও আনুগত্যের শিকল পরিয়ে দেয়া। অন্যটি হলো মানুষের আনুগত্য ও গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত ও স্বাধীন করা। এ দু’টো কাজই নবী হিসেবে তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং দু’টোর গুরুত্বই ছিল সমান। প্রথম কাজটি সম্পন্ন করার জন্যে নবী হিসেবে তাঁর আনুগত্য করতে সকল মুসলমানকে বাধ্য করা ছিল অপরিহার্য। কেননা তাঁর আনুগত্যের ওপরই আল্লাহর আনুগত্য নির্ভরশীল ছিল। অপরদিকে দ্বিতীয় কাজটি সম্পন্ন করার জন্যেও ঠিক ততখানিই জরুরী ছিল যে, সর্বপ্রথম তিনি তাঁর কার্যকলাপ ও আচার-ব্যবহার দ্বারা মুসলমানদের মনে এ সত্যটি বদ্ধমূল করে দেবেন যে, কোনো মানুষেরই এমনকি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদেরও মানুষ হিসেবে আনুগত্য করাও তাদের জন্যে ফরজ নয় এবং তাদের মন মানুষের দাসত্ব করা থেকে ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটা ছিল একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একই ব্যক্তির মধ্যে নবুয়াত ও মনুষত্ব –এ উভয় গুণের সমাবেশ ছিল। কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেত না। কিন্তু আল্লাহর রসূল (সা) আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা দিয়ে অত্যন্ত নিপুণভাবে এ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। একদিকে নবী হিসেবে তিনি এমন আনুগত্য লাভ করলেন যা বিশ্ব ইতিহাসের কোনো নায়ক কোনো কালেই লাভ করেনি। অপরদিকে মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর নিবেদিত প্রাণ অনুসারীদেরকে এমন ব্যক্তি-স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, দুনিয়ার অতি বড় গণতন্ত্রমনা নেতাও কোনো দিন তাঁর অনুসারীদেরকে এমন স্বাধীনতা দিতে পারেনি।

নবী হিসেবে তাঁর অনুসারীদের ওপর তাঁর কতখাতি প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল এবং মুসলমানদের কাছে তিনি কতখানি শ্রদ্ধাভাজন ও জনপ্রিয় ছিলেন তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী হয়েও তিনি দৈনন্দিন আচার-আচরণে নিজের মানবিক মর্যাদা ও নবীসুলভ মর্যাদাকে এমন নিখুঁতভাবে আলাদা করে রাখতেন যে, তার নযির খুঁজে পাওয়া যায় না। নবী হিসেবে শর্তহীন এ দ্বিধাহীন আনুগত্য লাভের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে তিনি মানুষকে মতামতের অবাধ স্বাধীনতা দান করতেন, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত মতের সাথে দ্বিমত পোষণেও তিনি সকলকে উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে, তবে সে অবশ্যই উপলব্ধি করবে যে, এমন পরিপূর্ণ আত্মসংযম, এমন বিস্ময়কর বাচবিচার ক্ষমতা এবং এহেন উচ্চস্তরের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন একজন নবীর পক্ষেই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন অনুভূত হয় যে, নবীর ব্যক্তিগত পদমর্যাদা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও নবুয়াদের পদমর্যাদার মধ্যে তা হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এটাও স্পষ্ট হয়ে ধলা পড়ে যে, ব্যক্তিগত আচার-আচরণের মধ্য দিয়েও তিনি নবুয়াতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তাঁদেরকে শিখান, মানুষের সাথে আচরণে নিজের চিন্তার স্বাধীনতাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, মানুষ তার মত ও চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রত্যেক মানুষের মোকাবিলায় প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে যাঁকে সে সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি বলে মানতে বাধ্য, সেই শ্রেষ্ঠতম মানুষটির মোকাবিলায়ও সে এ স্বাধীনতার মালিক এবং তা প্রয়োগ করতে পারে। একজন নবী ছাড়া আর কেউ যদি মানুষের ওপর এমন পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হতো তাহলে সে নির্ঘাত তাদেরকে নিজের গোলামে পরিণত করত এবং তাদের ওপর নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করত, যেমনটি করেছে যুগে যুগে দেশে দেশে পাদ্রী, পুরোহিত, পীর ও রাজারা। হযরত রসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩৫ পৃষ্ঠায়)

“আমিও একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদেরকে তোমাদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনো হুকুম দেব তখন তা মেনে নিও। আর যখন নিজের মতানুসারে কিছু বলব তখন জানবে, আমি একজন মানুষ মাত্র”।

মতামতের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করার কয়েকটি দৃষ্টান্ত

একবার হুযুর (সা) মদীনার ফলের বাগানের মালিকদেরকে খেজুর চাষ সম্পর্কে কয়েকটি পরামর্শ দেন। বাগানের মালিকরা সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তাতে তেমন উপকার হলো না। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা)-কে যখন বলা হলো, তখন তিনি বললেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩৫ পৃষ্ঠায়)

“আমি কেবল অনুমান করে একটা কথঅ বলেছিলাম। নিছক আন্দাজ-অনুমান ও নিজস্ব মতের ভিত্তিতে আমি যা বলি তা মেন না। হ্যাঁ যখন আল্লাহহর তরফ থেকে কিছু বলি তখন তা মেনে নিও। কেননা আমি আল্লাহর ওপর কখনও মিথ্যা আরোপ করিনি”।

বদরের যুদ্দে নবী (সা) যেখানে প্রথম তাঁবু ফেলেছিলেন সে জায়গাটা তেমন ভাল ছিল না। সাহাবী হযরত হুবাব ইবনে মুনযির (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ জায়গাটা কি অহীর নির্দেশে নির্বাচন করা হয়েছে, না  কেবল সামরিক কৌশল হিসেবে? হযরত (সা) বললেন, অহীর নির্দেশে নয়। তখন হুবাব বললেন, তাহলে আমার মতে আরও সামনে গিয়ে অমুক জায়গায় তাঁবু ফেলা উচিত। হযরত (সা) তাঁর কথা মেনে নিলেন এবং সেই অনুসারে কাজ করলেন।

বদরের যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে হযরত (সা) সাহাবীবৃন্দের সাথে পরামর্শ করেন এবং নিজেও দলের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে নিজের মত ব্যক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে হযরত ওমর (রা) রসূলুল্লাহ (সা) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। এটা ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। সেই বৈঠকেই হযরত (সা) নিজের জামাতা আবুল আ’স সম্পর্কেও কথা তোলেন এবং সাহাবীগণকে বলেন, তোমরা যদি অনুমতি দাও তাহলে আবুল আ’সের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে যে হারখানা পাওয়া গেছে তা তাকে ফেরত দেয়া যেতে পারে। সকল সাহাবী খুশী মনে অনুমোদন করলেই তিনি সেই হার তাকে ফেরত দেন।

খন্দকের যুদ্ধে হযরত বনী গাতফান গোত্রের সাথে সন্ধি করতে চাইলেন। আনসারদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বললেন, ‘এটা যদি অহীর নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে কোনো কথা নেই। আর যদি হযরতের (সা) নিজস্ব মত হয়ে থাকে হতে এতে আমাদের দ্বিমত আছে’। হরযত (সা) তাঁদের মত মেনে নিলেন এবং নিজ হাতে সন্ধির খসড়াটি ছিঁড়ে ফেললেন।

হোদায়বিয়ার সন্ধিটি আপাতঃ দৃষ্টিতে নতি স্বীকারমূলক সন্ধি মনে হওয়ায় সাহাবীদের মনঃপুত হয়নি। হযরত্ ওমর (রা) প্রকাশ্যে ভিন্নমত ব্যক্ত করলেন। কিন্তু যখন হযরত (সা) বলেন, এটা আমি নবী হিসেবে করছি তখন ইসরামী সম্ভ্রমবোধের দরুন সবাই একটু মনঃক্ষুণ্ণ থাকলেও কেউ টু-শব্দটিও করার সাহস দেখালেন না। হযরত ওমর (রা) মৃত্যুর পূর্বমুহুতর্ পর্যন্ত নানা উপায়ে এ ভুলের জন্যে অনুতাপ করতে থাকেন যে, তিনি হযরতের সাথে এমন একটা বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বসেছিলেন যা তিনি রসূল হিসেবে করতে যাচ্ছিলেন।

হোনাইনের যুদ্ধের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তিনি অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাবসম্পন্ন অমুসলিমদের প্রতি যে সৌজন্য প্রদর্শন করেন তাতে আনসাররা মনঃক্ষুণ্ণ হন। হযরত তাঁদেরকে ডেকে আনালেন। তিনি নিজের সমর্থনে এ কথা বললেন না যে, আমি নবী –যা খুশী তাই করব বরং একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান যেমন বিরোধী দলের লোকদের সামনে যক্তিতর্ক দিয়ে বক্তৃতা করে নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করেন তেমনি করলেন। রসূলের (সা) ওপর ঈমান থাকে তো এটা মেনে নাও –এ ধরনের আবেনদ তিনি করলেন না, বরং তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগের কাছে আবেদন জানালেন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করে তবে বিদায় করলেন।

এ তো গেল সমাজের উচ্চমর্যাদাশীল লোকদের সাথে আচরণের কথা। মহানবী (সা) দাস-দাসীদের মধ্যে পর্যন্ত স্বাধীন মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিলেন। যারীরা নাম্নী এক দাসী তার স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তার সঙ্গ ত্যাগ করে। কিন্তু তার স্বামী তার প্রতি ছিল পরম অনুরক্ত। তার স্বামীর কান্নাকাটি দেখে বারীরাকে হযরত (সা) বললেন, “তুমি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে গেলে মন্দ হতো না”। সে বললো, “হে আল্লাহর রসূল (সা)! আপনি কি হুকুম দিচ্ছেন?” হযরত (সা) বললেন, “হুকুম নয়,তবে সুপারিশ করছি”। সে বললো, “এটা যদি সুপারিশ হয় তাহলে আমি তার কাছে ফিরে যেতে চাইনে”।

এ ধরনের আরও বহু দৃষ্টা্ত আছে। এসব থেকে বুঝা যায় যে, হাবভাব দ্বারা কিংবা হযরতের সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা যখন বুঝা যেত যে হযরত (সা) নিজস্ব মতানুসারে কথা বলছেন, তখন লোকেরা স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করত আর তিনিও তাদেরকে স্বাধীন মতামত প্রকাশে উৎসাহ দিতেন। এরূপ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোসণ করা শুধু বৈধই ছিল না বরং তাঁর কাছে পছন্দনীয়ও ছিল এবং তিনি অনেক সময় নিজের মত প্রত্যাহার করে নিতেন।

হযরত যায়েদের ঘটনার তাৎপর্য

এবার আসুন হযরত যায়েদের ঘটনা পর্যালোচনা করি। নবী পাক (সা)-এর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল কয়েক রকমের। একটা সম্পর্ক ছিল এই যে, হুযুর (সা) তাঁর নেতা ছিলেন এবং যায়েদ ছিলেন হুযুর (সা)-এর অনুসারী। অন্য একটি সম্পর্ক ছিল এইযে, হযরত ছিলেন শ্যালক আর যায়েদ ভগ্নিপতি।–[হযরত যয়নব ছিলেন নবী পাক (সা)-এর ফুফাতো বোন এবং হযরত যায়েদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল।] তৃতীয় সম্পর্ক হলো, হযরত (সা) ছিলেন তাঁর পালক পিতা (মুরুব্বী) এবং যায়েদ তাঁর পালিত পুত্র। যায়েদের সাতে তাঁর স্ত্রীর বনিবনাও হলো না। তাই তিনি তাঁকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এমতাবস্থায় একজন শ্যালকের তাঁর ভগ্নিপতিকে এবং পালকের তার পালিত পুত্রকে যে ধরনের পরার্মশ দেয়া স্বাভাবিক, হযরত সেই ধরনের উপদেশই দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি বলেছিলেন, আল্লাহকে ভয় কর, স্ত্রীকে তালাক দিও না। কিন্তু উভয়ের মেজাজ প্রকৃতির পার্থক্যের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ঘৃনার সঞ্চার হয়েছিল তা হযরত যায়েদ স্বয়ং অনুভব করতেন অনেক বেশী। এটা তাঁর দ্বীন ও ঈমানের ব্যাপার ছিল না, বরং ছিল মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির। সে জন্যে তিনি হযরতের দেয়া পরামর্শ গ্রহণ না করে তালাক দিয়ে দিলেন। এখানে তিনি যে বিরুদ্ধাচরণ করলেন সেটা একজন রসূলের বিরুদ্ধাচরণ ছিল না। আর হযরত যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাও তিনি আল্লাহর রসূল হিসেবে দেননি। তাই তিনি ও নারাজ হননি, আল্লাহ তায়ালাও নারাজ হননি। কিন্তু হুযুর (সা)-এর স্থলে যদি এমন কেউ হতো যে, কাউকে শৈশবে প্রতিপালন করেছে তার ওপরে অনুগ্রহ-অনুকম্পা দেখিয়ে এসেছে। দাসত্বের কলঙ্ক থাকা সত্ত্বেও তার সাথে আপন ভগ্নির বিয়ে দিয়েছে এবং তারপর নিষেধ করা সত্ত্বেও সে ভগ্নিকে তালাক দিয়েছে, তাহলে সে ব্যক্তি অবশ্যই অসন্তুষ্ট হতো। কিন্তু হযরত (সা) শুধু মুরুব্বী এবং শ্যালকই ছিলেন না বরং আল্লাহর রসূলও ছিলেন। মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করা এবং মানুষের হারানো মানবিক অধিকার তাকে ফিরিয়ে দেয়া রসূল হিসেবে তাঁর কর্তব্য ছিল। সে জন্যেই তিনি হুকুম দেননি, দিয়েছেন পরামর্শ। আর সেই পরামর্শ অমান্য করার তিনি বিন্দুমাত্রও অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। এ থেকেই বুঝা যায় যে, তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে নবীসুলভ পদমর্যাদা পৃথক পৃথকও ছিল আবার ওতপ্রোতভাবে জড়িতও ছিল। এ উভয়ের প্রয়োগ ক্ষেত্রে তিনি এমন বিস্ময়কর ভারসাম্য রক্ষা করেছেন যে, একজন নবীই এমন ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম। মানুষ হিসেবেও তিনি এমনভাবে কাজ করতেন যে, নবুয়াতের দায়িত্ব এবং কর্তব্যও সেই সাথে আপনা-আপনিই সম্পন্ন হয়ে যেত।

চিন্তার স্বাধীনতা সম্পর্ক নবীর শিক্ষা

চিন্তার স্বাধীনতার যে বীজ নবী করীম (সা) বপন করেছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশাবলী মেনে চলার সাথে সাথে মানুষের সামনে স্বাধীন মতামত প্রকাশে যে শিক্ষা তিনি তাঁর কাজ ও আচরণের মাধ্যমে দিয়েছিলেন তার প্রভাবেই সাহাবায়ে কেরাম (র) অন্য সকল মানুষের চেয়ে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অধিকতর আনুগত্যশীল এবং সকলের চেয়ে অধিকতর স্বাধীনচেতা ও গণতন্ত্রমনা ছিলেন। বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনেও তাঁরা আপন মতামত প্রকাশের স্বাধীনচেতা ও গণতন্ত্রমনা ছিলেন। বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনেও তাঁরা আপন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেন না। কোনো অভিমত নিছক কোনো মহান ব্যক্তির হওয়ার কারণে সমালোচনার ঊর্ধ্বে হতে হবে –এমন চিন্তা তাঁদের মন-মস্তিষ্কে স্থান পেত না। তাদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন এবং যাদের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁরা নিজেরাও স্বীকার করতেন এবং আজকের দুনিয়াও স্বীকার করে, তাঁদের মতকেও তাঁরা কখনও কেবল তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে গ্রহণ করেননি, বরং স্বাধীনভাবে কখনও গ্রহণ করেছেন, কখনও প্রত্যাখ্যান করেছেন। রসূলুল্লাহ (সা)-এর পরেই সবচেয়ে বেশী মতামতের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন। তাঁরা তাদের মহান নেতার দেখাদেখি মানুষের স্বাধীনতাকে শুধু সহ্য করেছেন তা নয়, বরং তাকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা কখনও একজন অতি নগণ্য মানুষকেও বলেননি যে, আমরা শ্রেষ্ঠ মানব। কাজেই আমাদের কথা দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নাও।

খেলাফতে রাশেদার পর চিন্তার স্বাধীনতা

খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা চিন্তা ও মতামতের স্বাধীনতা কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও কঠোর যুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে, আবার কখনও লোভ দেখিয়ে নানাভাবে হরণ করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও সাহাবীদের উত্তরসূরী তাবেঈস এবং তাঁদের উত্তরসূরী তাবে-তাবেঈদের মধ্যে এমনকি তাঁদের পরবর্তী মুসলমানদের মধ্যেও দীর্ঘদিন যাবত স্বাধীন চিন্তার প্রেরণা অক্ষুণ্ণ ছিল। প্রথম দুই-তিন শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে এর অত্যন্ত উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ দেখতে পাওয়া যাবে। অবশ্য শাসক ও আমীর-ওমরাহদের সামনে স্বাধীনতাবোধ অপেক্ষাকৃত নগণ্য ব্যাপার। আত্মা ও বিবেকের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন এই যে, মানুষ যে ব্যক্তিত্বকে পরম শ্রদ্ধেয় ও পবিত্র মনে করে তার মনের মণিকোঠায় যার প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও মর্যাদা বিরাজমান তারও অন্ধ অনুকরণ থেকে বিরত থাকবে, তার মোকাবিলায়ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করবে ও স্বাধীন মতামত স্থির করবে। এরূপ স্বাধীনতাবোধ আমরা সে যুগের বিদ্বান ও পণ্ডিতদের মধ্যে দেখতে পাই।

ফকীহ ও ইমামদের চিন্তার স্বাধীনতা

সাহাবীদের চেয়ে পবিত্র ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আর কেইবা হতে পারে? আর তাঁদের প্রতি তাবেঈদের চেয়ে বেশী শ্রদ্ধাশীল বা কে? তথাপি তাঁরা সাহাবীদের মতামতের অবাধে সমালোচনা করতেন, সাহাবীদের পারস্পরিক মতবিরোধের বিচার-বিবেচনা করতেন এবং একজনের মতামত অগ্রাহ্য করে অন্যজনের মতামত গ্রহণ করতেন। সাহাবীদের পারস্পরিক মতবিরোধের ব্যাপারে ইমাম মালেক (র) দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, (আরবী**************) “সাহাবীদের মতামতের মধ্যে ভুল ও নির্ভুল উভয়ই আছে। তোমরা স্বয়ং চিন্তা-ভাবনা করে মতামত স্থির কর”। অনুরূপভাবে ইমাম আবু হানিফা (র) বলেন, (আরবী*********************) “দু’টো ভিন্ন ধরনের মতের একটিকে অবশ্যই ভুল মনে করতে হবে”।

স্বয়ং এই ইমামদের কেউ কখনও বলেননি যে, আমাদের কোনো ভুল নেই। তোমরা নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা বন্ধ রেখে শুধু আমাদের অনুকরণ করে চল। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) যখনই কোনো বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতেন সাথে সাথে বলতেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩৯ পৃষ্ঠায়)

“এ হলো আমার মত। এটা ঠিক হলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে আর ভুল হলে আমার পক্ষ থেকে এবং আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী”।

হযরত ওমর (রা) বলতেন, (আরবী***************************) “ভ্রান্ত মতকে বিশ্ব মুসলিমের আদর্শে পরিণত হতে দিও না”।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩৯ পৃষ্ঠায়)

“সাবধান! তোমাদের কেউ যেন ইসলামের ব্যাপারে কারও অন্ধ অনুকরণ না করে এবং এমন না হয় যে, অনুসৃত ব্যক্তি যদি মু’মিন হয় তবে সেও মু’মিন হলো আর অনুসৃত ব্যক্তি কাফের হলে সেও কাফের হলো। বস্তুত খারাপ ও ভুল কাজে কারও অনুকরণ করা চলে না”।

ইমাম মালেক (রা) বলেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৩৯ পৃষ্ঠায়)

“আমি একজন মানুষ মাত্র। আমর মত ভুলও হতে পারে, ঠিকও হতে পারে। তোমরা আমার মত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা কর। যা কিছু কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক পাও তা মেনে নাও, আর যা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী পাও তা বর্জন কর”।

ইমাম মালেকের এ ঘটনা ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে, আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তাঁর কিতাব মুয়াত্তাকে সারা মুসলিম বিশ্বের কার্যকর সংবিধানরূপে চালু করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, ফেকাহর প্রচলিত সকল মাযহাব বাতিল করে দিয়ে তিনি কেবল মালেকী মাযহাব চালু করে দেবেন। কিন্তু ইমাম মালেক নিজেই তাঁকে সেটা করতে দেননি। কেননা তিনি অন্যদের চিন্তা, গবেষণা, মতামত ও ইজতিহাদের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চাননি।

ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেনঃ (আরবী********************পিডিএফ ২৪০ পৃষ্ঠায়)

“আমরা যে মত প্রকাশ করেছি তার উৎস না জেনে অন্যদের তা মেনে নেয়া বৈধ নয়”।

ইমাম শাফেয়ী (র) বলেনঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৪০ পৃষ্ঠায়)

“যে ব্যক্তি প্রমাণ ব্যতিরেকে জ্ঞান অর্জন করে সে রাতের অন্ধকারে কাষ্ঠ আহরণকারীর ন্যায়। সে কাষ্টের বোঝা মাথায় তুলবে। অথচ সে জানে না যে বোঝার মধ্যে সাপ লুকিয়ে আছে যা তাকে দংশন করবে”।

চিন্তার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত স্বাধীনতার পতন যুগ

হযরত রসূলে করীম (সা) স্বীয় অনুসারীদের মধ্যে চিন্তা-গবেষণার মতামত ও সত্যানুসন্ধানের অবাধ স্বাধীনতার যে প্রাণশক্তি উজ্জ্বীবিত করে গিয়েছিলেন, মুসলমানদের মধ্যে তা প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর আমীর-ওমরাহ, শাসক-আলেম ও পীরদের স্বৈরাচার ঐ প্রাণশক্তি নস্যাৎ করে দিতে আরম্ভ করে। চিন্তাশীল লোকদের স্বাধীন চিন্তার অধিকার এবং দেখার ও কথা বলারর অধিকারও ছিনিয়ে নেয়া হয়। দরবার থেকে শুরু কের মাদ্রাসা ও খানকা পর্যন্ত মুসলমানদেরকে গোলামীর শিক্ষা দেয়া হতে থাকে। মন-মগজ, আত্মা ও দেহের সর্বাত্মক গোলামীতে তাদেরকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলা হয়। শাসকরা তাদের উদ্দেশ্যে রুকূ’-সিজদা করিয়ে সৃষ্টি করেন গোলামীর মানসিকতা। মাদ্রসার পরিচালকগণ খোদাপুরস্তি শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে মুরব্বী পূজার বিষপাষ্পও মাথায় ঢুকিয়ে দেন। আর ‘বায়য়াত’ এর যে পদ্ধতি হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগ থেকে চলে আসছে, পীর-মুর্শেদগণ তা বিকৃত করে এক ধরনের ‘পবিত্র গোলামী’র শৃঙ্খলে মুসলমানদেরকে আবদ্ধ করেন। সে শৃঙ্খল এমনই ভয়াবহ যে মানুষ মানুষের জন্যে –তার চেয়ে কঠিন ও ভারী শৃঙ্খল বোধ হয় আর কখনও উদ্ভাবন করতে পারেনি।

ফলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সামনে মাথা নত হতে লাগল, তার সামনে নামাযের মত হাত বাঁধা শুরু হলো, মানুষের দিকে চোখ তুলে দেখা বেয়াদবীর শামিল হলো, মানুষের হাত-পা চুম্বন করা শুরু হলো, মানুষ মানুষের খোদা ও রেজেকদাতা হয়ে গেল, মানুষ আপনা-আপনিই আদেশ-নিষেধ করার এখতিয়ার লাভ করল এবং কুরআন ও সুন্নাহর দলিল-প্রমাণ থেকে বেপরোয়া হয়ে গেল, মানুষকে দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করা হতে লাগল, মানুষের হুকুম ও মতামতকে আকীদাহ বিশ্বাসের দক দিয়ে না হলেও কার্যত খোদার হুকুমের ন্যায় অবশ্য পালনীয় মনে করা হলো। এমন অবস্থা যখন হলো তখন মনে করতে হবে যে, তখন সেই শাশ্বত দাওয়াত থেকে মুখ ফেরান হলো যা আল্লাহর নবী দিয়েছেন। তা হলোঃ

(আরবী************************************পিডিএফ ২৪১ পৃষ্ঠায়)

“(আসুন) আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও দাসত্ব আনুগত্য করব না এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না। আর আমাদের কেউ যেন কাউকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে খোদা বানিয়ে না নেয়”। তারপর আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব নয়। পতনই হবে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।

 

Page 18 of 37
Prev1...171819...37Next

© 2019 Shibir Online Library

কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • আল কুরআন
  • আল-হাদীস
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • স্কুল পাঠ্য
  • কর্মী সিলেবাস
  • সাথী সিলেবাস
  • সদস্য সিলেবাস
  • উচ্চতর সিলেবাস
  • অডিও বই

© 2019 Shibir Online Library