অর্থনীতিতে রাসূল (স.) এর দশ দফা

ভূমিকা

 

অর্থনীতি সমাজকাঠামো ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার অন্যতম মৌল ভিত্তি। যুগে যুগে বিশ্বের নানা অঞ্চলে যে সব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাদের প্রত্যেকেরই অর্থনৈতিক উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি সমসাময়িক যুগে ছিল অবিশ্বাস্য। ঐসব সভ্যতার ক্ষমাতাগর্বী শাসকগোষ্ঠী ও অমাত্যজন আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসূলদের শিক্ষা ভুলে সমাজে যে ভয়াবহ শোষণ ও নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে তাও ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে। মিসরীয় সভ্যতা, রোমান সভ্যতা শ্রমশোষণ ও বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণেরও ইতিহাস। কালস্রোতে সেসব সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু সে সবের প্রভাব ও আচরিত প্রথা বিলুপ্ত হয়নি। ফলে সমাজে অনাচার আর অত্যাচারে সয়লাব বয়ে গেছে। তাই নির্যাতিত মানবতা মুক্তির প্রহর গুনেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে কবে তাদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও হতাশা দূর হবে। শোষণের যাঁতাকল হতে কবে তারা নিষ্কৃতি পাবে?

 

রাজা বাদশাহ ও জমিদারের বিলাসিতার কড়ি যোগাতে না পারায় অগণিত বনি আদম বন্দীশালার হিমশীতল মেঝেতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছে। সুদের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ হয়েছে। যুগের পর যুগ নারীরা রয়ে গেছে সম্পত্তির অধিকার বঞ্চিত। ইয়াতীমরা হয়েছে সম্পত্তি হতে বিতাড়িত। সর্বনাশা জুয়ার খপ্পরে পড়ে অগণিত মানুষ হয়েছে সহায় সম্বলহীন। ব্যবসায়িক অসাধুতার কারণে জনসাধারণের জীবনে উঠেছে নাভিশ্বাস আর হারাম উপার্জনের জৌলুসের কাছে পরাস্ত হয়েছে মেহনতী কর্মচারীর পূত পবিত্র অনাড়ম্বর জীবন। অমানিশার এই গাড় অন্ধকার দূর করতে আল-কুরআনের আলোকে বর্তিকা হাতে নিয়ে আজ হতে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন সৃষ্টি জগতের শেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। নবুয়তপূর্ব যুগের চল্লিশ বছরে রাসূলে আকরাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব ঘনিষ্ঠভাবে আরব ভূখন্ডের জনগণের জীবনধারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজে বিরাজমান শোষণ নির্যাতন তাঁকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল। মুক্তির পথ খুঁজতে তিনি তাই হেরা গুহায় নিবিষ্ট মনে চিন্তা করেছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছল। তারপর এক শুভক্ষণে মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ নিয়ে আর্বিভূত হলেন জিবরীল ফেরেশতা। শুরু হলো মানব ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। মানবতার মুক্তির সনদ এখন রাসূলেরই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতে। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবার পরিবর্তে প্রচন্ড বিরোধিতা করল মক্কার নেতারা, ক্ষমতার মসনদে আসীনরা। তাদের বিত্তবৈভবে এতটুকু ভাঁটা পড়ুক, দাসদের মুক্তি প্রদানের ফলে আয়েশী জীবনের ইতি ঘটুক, ইয়াতীমদের সম্পদ কুক্ষিগত করে ধনের পাহাড় গড়া বন্ধ হোক, সুদ প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে নিনাশ্রমে অর্থাগমের পথ রুদ্ধ হোক এ তারা এতটুকুও বরদাশত করতে রাজী ছিল না। তাই রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্মপ্রয়াস ক্রমশ; সংকীর্ণ হয়ে এল। তাঁর জীবনের পরে হুমকি এল। দীর্ঘ তের বছর পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করলেন নতুন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ইয়াসরিবে, আজকের মদীনা মুনাওয়ারায়।

 

মদীনায় তিনি একটি সুদৃঢ় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার প্রয়াস চালান একেবারে শুরু হতেই। একই সময়ে সমাজদেহ হতে সকল অনাচার ও পংকিলতা দূর করারও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেহেতু একটি রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব ও সমৃদ্ধির বুনিয়াদ তাই এক্ষেত্রেও তিনি আল-কুরআনের আলোকে ঘোষণা করলেন দশ দফা কর্মসূচী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাত্র দশ বছরের মধ্যে শিশু ইসলামী রাষ্ট্রের যে বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটতে শুরু করেছিল তা ছিল সমকালীন বিশ্বের বিস্ময়। এরপর দীর্ঘ নয়শত বছর ধরে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা দাপটের সাথে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। একই সংগে তাঁর ব্যতিক্রমী অর্থনৈতিক কর্মসূচীর কল্যাণস্পর্শে সমগ্র মানব জাতি নতুন এক সভ্যতার ইতিহাসের শতজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের শীর্ষতম ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ্যমান অর্থনীতির কর্মপদ্ধতি, নীতি ও ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন এবং বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর অনুসৃত দশ দফা কর্মসূচীর বদৌলতেই সুদূর স্পেন হতে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল মুসলিম বিশ্বে শোষণমুক্ত ও কল্যাণধর্মী নতুন এক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

 

প্রসঙ্গত: মনে রাখা দরকার, দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে আল কুরআন সমগ্র মানব জাতির জন্যে এক ঐশী গাইডবুক এবং মানবতার বন্ধু রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাস্তব রূপকার। এক হাদীসে বলা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কোন কাজ করেননি, এমন কোন কথা বলেননি যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সম্মতি বা ইঙ্গিত ছিল না। এজন্যেই প্রখ্যাত সুফী সাধক ও দার্শনিক রূমী বলেন-

 

মুহাম্মাদ হারগিজ না গুফতা তা না গুফতা জিবরাঈলজিবরাঈল হারগিজ না গুফতা তা না গুফতা কারদিগার।

 

অর্থ্যাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও কিছু বলেননি যতক্ষণ জিবরীল তাঁকে কিছু না বলেছেন। আর জিবরীল কিছু বলেন নি যতক্ষণ না আল্লাহ পরওয়ারদিগার কিছু বলেছেন। তাই অর্থনীতির ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাঁকে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি সেসবই বাস্তবায়নের জন্যে কর্মকৌশল উদ্ভাবন করেছে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রশক্তি পর্যন্ত প্রয়োগ করেছেন। প্রচলিত অর্থনীতিতে রাসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছিলেন আজকের যুগের দফার হিসেবে সেগুলিকে দশটি দফার উল্লেখ করা যায়। এই দফাগুলো ছিল আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকারের সমন্বয়। এই কর্মসূচীর মাধ্যেমেই তিনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একাধারে সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন করেছিলেন। নীচে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহীত সেই কর্মসূচী তথা দফাগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।প্রচলিত অর্থনীতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নতুন বিষয়গুলি প্রবর্তন করেছিলেন সেগুলি হলো-হালাল উপায়ে উপার্জন ও হারাম পথ বর্জনসুদ উচ্ছেদব্যবসায়িক অসাধুতা উচ্ছেদযাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তনবায়তুলমালের প্রতিষ্ঠামানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তনওশরের প্রবর্তন ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইসলামীকরণউত্তরাধিকার ব্যবস্থার যৌক্তিক রূপদানন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিধান, এবং১০সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন

 

উল্লেখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করলে বোঝা যাবে, এসব কর্মসূচী তৎকালীন অর্থনীতিকে কি প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল, বৈশিষ্টের দিক হতে কি সুদূর প্রসারী ও প্রগতিশীল চরিত্রের ছিল এবং দেশের আপামর জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নে কি বিপুল সহায়ক হয়েছিল। এই আলোচনা হতে বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য অর্থনৈতিক মতবাদের সঙ্গে ইসলামের অর্থনীতির মৌলিক পার্থক্য ও সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। উপরন্ত ইসলামই যে বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তিসনদ একথা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত এই বিশেষ পদক্ষেপগুলি।

 

অর্থনীতিতে রাসূল (স.) এর দশ দফা

শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড