ইসলামী সাহিত্য : মূল্যবোধ ও উপাদান

প্রসঙ্গ কথা

 

মুসলমানরা যা কিছু লেখে তাই ইসলামী সাহিত্য বলে অনেকের ধারণা। আবার ধর্মীয় বিষয়ে যা কিছু লেখা হয় সেগুলোকেও অনেকে ইসলামী সাহিত্য মনে করেন। ইসলঅমকে একটি ধর্ম মাত্র মনে করার কারণে দ্বিতীয় ধারণাটি এসেছে। আর মুসলমানের লেখা যদি ইসলামের উদ্দেশ্যের বিপরীত এবং ইসলামের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে জানি না কে তাকে ইসলামী সাহিত্য আখ্যা দেবার সাহস করবে।তাই ইসলামী সাহিত্য যথার্থই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম যেমন একটি বিশ্বজনীন মতবাদ ও আদর্শ- তেমনি ইসলামী সাহিত্যও একটি বিশ্বজনীন সাহিত্য। ত্রয়োদশ শতকে আমাদের এদেশে মুসলমানরা যখন প্রথম ইসলামী সমাজের গোড়া পত্তন করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই কুরআনের আদর্শকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন। এই আদর্শের ভিত্তিতে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস তারা চালিয়েছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। এর প্রথম প্রমাণ হচ্ছে ইসলামের মানবতাবাদকে তারা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ফলে দেবদেবীর পরিবর্তে মানুষ হয়ে উঠেছিল সে সাহিত্যের বিষয়বস্তু। এভাবেই আমরা দেখি ইসলাম যে দেশেই বিস্তার লাভ করেছে সে দেশের সমাজ, সভ্যতা, জীবন ব্যবস্থার সাথে সাথে সাহিত্যের উপরও পড়েছে তার সুগভীর প্রভাব। কোন বিষয়ে ইসলামের একটি আদর্শকে গ্রহণ করা আর ইসলামের সার্বিক মতবাদ ও আদর্শের ভিত্তিতে কোন বিষয় গড়ে তোলার মধ্যে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এখানে এই দ্বিতীয়টাই আমাদের আলোচ্য।বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিকেই আমরা লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। সাহিত্যে ইসলামী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া এদেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলা সম্ভবপর নয়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা যেমন সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণের বার্তাবহ তেমনি ইসলামী সাহিত্যও মানবতার আশা আকাংখা পূরণের যথার্থ ধারক। ইসলামী সাহিত্য মানুষের সমাজকে কল্যাণ ও সফলতায় ভরে দেয়। বোধ হয় মানুষের প্রত্যেকটা কাজের উদ্দেশ্য কল্যাণ ও সফলতা অর্জন। নিজের অকল্যাণ ও ব্যর্থতা ডেকে আনার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই মানুষ কোন কাজ করে না। আশা করি এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। কাজেই সাহিত্য ক্ষেত্রে অকল্যাণ ও ব্যর্থতার প্রতিষ্ঠাকে আমরা উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। সাহিত্য মানবতার জন্য, সাহিত্য জীবনের জন্য। সাহিত্য কল্যাণের জন্য, সাহিত্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের উৎখাতের জন্য। ইসলামী সাহিত্যের এটিই হচ্ছে মৌল পরিচয়। মানুষের সমাজ গড়ায় সাহিত্যের যতটুকু অংশ রয়েছে তা তার এই উদ্দেশ্যের সাফল্যের সাথে বিজড়িত।দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মুসলমানরা বিপুল সাহত্য সম্ভার গড়ে তুলেছেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বড় বড় মুসলিম সাহত্যিকের জন্ম হয়েছে। তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য ইসলামী সাহিত্যের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎস। তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা ইসলামী মতাদর্শ ও ইসলামী মূল্যবোধকে নিজেদের সাহিত্য কর্মের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁরাই আমাদের আদর্শ।বিগত আট ন’শো বছর থেকে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে মুসলমানদের পদচারণা। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে মুসলমানদের সৃষ্টি সম্ভারও কম নয়। কিন্তু তাদের রচনার একটি বিরাট অংশ ভিন্ন মতবাদ আশ্রিত। বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে মুসলিম সাহিত্যিকদের বৃহত্তর অংশ সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছেন। এক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে তাদের এগিয়ে না আসারই কথা। তাই অপেক্ষাকৃত তরুণ তাজাদের মধ্যে এ আগ্রহটা দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক কালে। ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির জন্য একদল বিশ্বাসী তরুণ এগিয়ে এসেছেন। প্রবীণদের কিছু সংখ্যক মাথাও তাদের মধ্যে গণনা করার মত।তাদেরই অনুরোধে ইসলামী সাহিত্য সম্পর্কিত এ আলোচনাটির অবতারণা। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিতে তৎপর সাহিত্য সংগঠন বাংলা সাহিত্য পরিষদের প্রথম সাধারণ সাহিত্য সভায় ১৯৮৩ সালের জুন মাসে প্রবন্ধটি পড়ে শুনানো হয়। বিষয়-বস্তুর অভিনবত্বের জন্য অনেকেই আলোচনাটির ব্যাপক প্রচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলা সাহিত্য পরিষদ যথাসময়ে এর প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়ে লেখককে দায়মুক্ত করেছেন এ জন্য পরিষদ কর্তৃপক্ষকে অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে হয়।আবদুল মান্নান তালিব১৮০ শান্তিবাগ, ঢাকা

জীবন ও জগতের সম্পর্ক

আমরা প্রথম চোখ মেলি পৃথিবীর কোলে। পৃথিবীর আলো বাতাসে আমাদের প্রাণ স্পন্দিত হয়। এর খাদ্য শস্য ফলমূলে দেহ পরিপুষ্ট হয়। জীবনে জোয়ার আসে। জীবনের নৌকা ভেসে চলে গভীর পানিতে। আমাদের চারপাশের এই পৃথিবী, আকাশ-বাতাস, আলো-আঁধার, প্রকৃতি-পরিবেশ সবটা নিয়ে আমাদের জগত। আমাদের চিন্তা ভাবনা, আশা-আকাংখা, আগ্রহ-অনাগ্রহ তার ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যতক্ষণ আমরা এই জগতের বুকে আছি ততক্ষণ। যখনই চোখ দু’টি মুদে জগতের বুক থেকে বিদায় নিই মুহূর্তেই সেই দূরন্ত ছুটন্ত ঘোড়া উধাও হয়।আমাদের জীবন আমাদের জগতের সাথে এক সূতোয় বাঁধা। একটা টানলে আরটা আসে, আরটা টানলে অন্যটা আসে। জীবন শেষ হয়ে গেলে মনে হয় জগতও বুঝি নেই। আবার জগতের যেদিন শেষ মুহূর্ত ঘোষিত হবে সেদিন জীবনেরও বিলোপ ঘটবে। কল্পনার পাখায় ভর করে আমরা জগতের সীমানাও পেরিয়ে যাই। কিন্তু চৈতন্য ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই কল্পনার পাখিটি দুম করে আছড়ে পড়ে জগতের বুকে। জগতের সূতোয় আমাদের জীবন আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। একটু নড়াচড়া করে পটপট করে যে এই সূতোগুলো ছিড়ব সে আশায়ও গুড়ে বালি।যতদিন জগতের বুকে থাকি আমরা কাজ করে যাই। ভালো মন্দ সব রকম কাজ আমরা করি। জগতটা যেন যন্ত্র আমরা তার চালক। এই যন্ত্রে হাত রাখলেই তার চাকা ঘুরতে থাকে। পেছনের দিকে ঘুরুক বা সামনের দিকে ঘুরুক, এদিকে ঘুরুক বা ওদিকে ঘুরুক, তা ঘুরতেই থাকে, অনবরত ঘুরতে থাকে। অথবা আমরা যেন যন্ত্র আর জগতটা তার চালক। যে রকম ইচ্ছে সে আমাদের চাকা ঘুরাতে থাকে। তার দরবারে করুনার আর্জি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তখন আমাদের আর কোন উপায় থাকে না। এ অবস্থায় আমরা হয়ে পড়ি মানবেতর। মহত কিছু সৃষ্টি, বৃহত কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের সৃষ্টি আমাদের কাজ তাই কালে আমাদের বা আমাদের উত্তর পুরুষদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আর জগতকে যখন আমরা বশ করি, কাজে লাগাই তখন আমাদের সৃষ্টি হয়ে ওঠে মহত্তর, কালোত্তীর্ণ। আমরা জগত থেকে বিদায় নিই। কিন্তু আমাদের সৃষ্টি থেকে যায় আমাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর হয়ে।জগতের সাথে আমাদের জীবনের সম্পর্ক কী তা মনে হয় এই আলোচনা থেকে অনেকটা খোলাসা হয়ে গেছে। এখন এই জীবন ও জগতের উদ্দেশ্য জানতে হবে। তবে তার আগে জীবন ও জগতের স্রষ্টা কে তা অবশ্য জানা প্রয়োজন।

 

ইসলামী সাহিত্য : মূল্যবোধ ও উপাদান

আব্দুল মান্নান তালিব

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড