ইসলামের যাকাত বিধান ( ১ম খন্ড )

প্রসঙ্গ-কথা

মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশেষত গরীব, নিঃস্ব ও অসহায় লোকদের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সমস্যা। এই সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থায় কিচু ‘কল্যাণধর্মী’ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব পদক্ষেপ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে কোন নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি। ফলে কল্যাণধর্মী বলে খ্যাত রাষ্ট্রগুলোতেও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচী এখনো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃশ্যত কিছু কল্যাণধর্মী ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ সে সব দেশে চরম দুরাবস্থার মধ্যে বসবাস করছে। ইসলাম আল্লাহ্র দেয়া এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় এক সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি ছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করার জন্যে যাকাত-এর একটি চ মৎকার কর্মসূচীর বিধান ছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করার জন্যে যাকাত-এর একটি চমৎকার কর্মসূচীর বিধান রাখা হয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও সচ্ছল লোকদের বাড়তি সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিত আদায় করে দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকদের মধ্যে যথাযথ বন্টন করাই এ কর্মসূচীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বলাবুহল্য, এটি যেমন একটি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, তেমনি ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদতও। তাই পবিত্র কুরআনে বহুতর স্থানে নামায প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যাকাত প্রদানেরও আদেশ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যাকাত সম্পর্কে স্পষ্টতর ধারণার অভাবে এই কল্যাণময় ব্যবস্থাটি থেকে আমাদের সমাজ যথোচিতভাবে উপকৃত হতে পারছে না। আরব জাহানের স্বনামধন্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সপণ্ডিত আল্লাম ইউসুফ আল-কারযাভী প্রণীত ‘ফিক্হুয যাকাত’ নামক বিশাল গ্রন্থটি এদিক থেকে আমাদের জন্যে এক পরম সম্পদ। যাকাত আদায়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতগুলো অত্যন্ত পুংখানুপুংখভাবে বিবৃত করা হয়েছে দুই খণ্ডে বিভক্ত এই মূল্যবান গ্রন্থে। এ কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ) ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ শিরোনামে এই অনন্য গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করে সময়ের এক বিরাট দাবি পূরণ করেছেন। কিন্তু গ্রন্থটির প্রকাশনায় ধারাবাহিকতা না থাকায় এর অপরিমেয় কল্যাণ থেকে যথোচিতভাবে উপকৃত হতে পারেননি আমদের বিদগ্ধ পাঠক সমাজ, বরং গত কয়েক বছর ধরে গ্রন্থটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না বলে আগ্রহী পাঠকরা সরাসরি অভিযোগ করেছেন আমাদের কাছে। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)-এর গ্রন্থাবলী প্রকাশের দায়িত্বে নিয়োজিত ‘খায়রুন প্রকাশনী’ এখন থেকে ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ শীর্ষক গ্রন্থটির যথাযথ প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তদনুসারে বর্তমানে এর প্রথম খণ্ডটি সহৃদয় পাঠকদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এর দ্বিতীয় খণ্ডটিও যথাসম্ভব শীঘ্র প্রকাশের ব্যবস্থা করা হবে, ইনশাআল্লাহ। গ্রন্থটির এ সংস্করণে আমরা পূর্বেকার মুদ্রণ-প্রমাদগুলোর সংশোধনের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এর অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পরিপাট্যকেও উন্নত করার ব্যাপারে যত্ন নেয়া হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্থটির এ সংস্করণ পাঠকদের কাছে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সমাদৃত হবে। মহান আল্লাহ গ্রন্থকার ও অনুবাদককে এই অনন্য খেদমতের উত্তম প্রতিফল দান করুন, এটাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা। মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান চেয়ারম্যান, মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন ঢাকা: ১৩, এপ্রিল, ১৯৯৭ অনুবাদকের কথা ‘যাকাত’ দ্বীন-ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। কিন্তু এ বিষয়ে আধুনিক সমাজ ও অর্থনীতির দৃষ্টিতে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থ উপমহাদেশের কোন ভাষায় ছিল না। তাই এ বিষয়ে একখানি গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করেছিলাম বহুদিন থেকে। তবে এ যুগের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও সুপণ্ডিত এবং কাতারের অধিবাসী আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী লিখিত ‘ফিকহুয্ যাকাত’ (আরবী*****) নামক আরবী গ্রন্থটির নাম শুনে আসছিলাম ১৯৬৯ সন থেকেই। কিন্তু দুই খণ্ডে বিভক্ত এই বিরাট গ্রন্থখানি পড়ার কোন সুযোগ তখন আমি পাই নি। এর দশ বছর পর ১৯৭৯ সনের রমযান মাসে এই গ্রন্থখানি আমি সর্বপ্রথম দেখতে পাই এবং তখনই আমি এর অনুবাদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভীর এ এক অমর ও অতুলনীয় সৃষ্টি। আমার জানামাতে আরবী ভাষাযও এর সমতুল্য আর কোন গ্রন্থ নেই। বস্তুত ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শের ক্ষে্রেত যাকাত যেমন মহান আল্লাহর একটি বিশেষ অবদান, দুনিয়ার বঞ্চিত মানবতার দারিদ্র্য মুক্তির জন্য যাকাতও এক অনন্য ও অনবদ্য ব্যবস্থা। এ বিষয়ে ব্যাপক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এই গ্রন্থখানি এক মহামূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থখানি রচনা করে আল্লামা কারযাভী দ্বীন-ইসলামের এক অতুলনীয় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবঙ সেই সঙ্গে গোটা মুসলিম জাহানের মহাকল্যাণ সাধন করেছেন। আমি আশা করি, এই গ্রন্থখানি আদ্যন্ত পাঠ করে পাঠকবৃন্দ যাকাতের গুরুত্ব ও মানবতার কল্যাণে এর বিরাট ভূমিকার কথা সবিস্তারে জানতে পারবেন। এই বিরাট গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ সম্পূর্ণ করে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সম্মুখে পেশ করতে পারা আমার জন্যে একটি পরম সৌভাগ্যের ব্যাপারে এবং এজন্য আমি মহান আল্লাহর দরবারে নিবেদন করছি অশেষ শুকরিয়া। (মওলানা) মুহাম্মদ আবদুর রহীম মুস্তফা মনযিল ২০৮, নাখালপাড়া, ঢাকা ২৮-৮-১৪০২ হিজরী সূচীপত্র গ্রন্থকারের কথা কুরআনের তাফসীর লেখকগণের ভূমিকা মুহাদ্দিস ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারদের ভূীমকা ফিকাহবিদদের কাজ ইসলামের অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ফিকাহ আলিমগণের কাজ আলোচনার পদ্ধতি ও ধরন মৌল উৎস নির্ধারণ ও তত্ত্ব সংগ্রহ আলোচনার বন্টন ও তার বিভিন্ন বিন্যাস তুলনামুলক আলোচনা ব্যাখ্যা ও কারণ প্রদর্শন যাচাই ও অগ্রাধিকার দান গ্রহণ, অগ্রাধিকার ও সত্য নির্ধারণে অবলম্বিত নিয়ম-নীতি সুদৃঢ় ইজমার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন সহীহ কিয়াস কার্যকরকরণ লক্ষ্য ও কল্যাণের গুরুত্ব স্বীকার আলোচনার পদ্ধতি যাতা ও সাদকার অর্থ ‘যাকাত’ শব্দের বিশ্লেষণ সাদকার অর্থ কুরআন মজীদে যাকাত প্রথম অধ্যায়ঃ যাকাত ওয়াজিব: ইসলামে তার স্থান শুরুর কথা প্রাচীণ সভ্যতার দারিদ্র সমাজ দারিদ্রের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মের ভূমিকা আসমানী ধর্মসমূহের অবদান পর্যালোচনা দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের অবদান মক্কী যুগ থেকে কুরআনের ভূমিকা মিসকীনদের খাবার দেয়া ঈমানের অংগ মিসকীনের অধিকার আদায়ের জন্যে উৎসাহ দান ভিখারী, বঞ্চিত, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের অধিকার শস্য কর্তনকালীন অধিকার মক্কায় ‘যাকাত’ দান মক্কী যুগের যাকাত নিঃশর্তঃ মদীনা পর্যায়ে যাকাত কুরআনের মাদানী আয়াতে যাকাতের বিধান ‘যাকাত’ প্রসঙ্গে সূরা তাওবা’র দৃষ্টান্ত কুরআনে মোটামুটি বলা কথার ব্যাখ্যা দেয় সুন্নাত যাকাতের হিসাব ও পরিমাণ সুন্নাত কর্তৃক নির্ধারিত রোযাপর পরই যাকাত যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ যাকাত না দেয়ার কঠোর আযাবের ভয় প্রদর্শন পরকালীন আযাব যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের শরীয়তসম্মত শাস্তি যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হযরত আবূ বকর (রা)-এর যুক্তির দুটি দিক দ্বীন-ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব যাকাত অমান্যকারী কাফির ইসলামের যাকাত ও অন্যান্য ধর্মের যাকাতের মধ্যে পার্থক্য যাকাতের প্রকৃতি সম্পর্কে শাখ্ত-এর ধারণা ভুল দ্বিতীয অধ্যায়: যাকাত কার উপর ফরয ইসলাম অমুসলিমদের উপর যাকাত প্রথম পর্ব ফরয করেনি কেন অমসলিমদের কাছ থেকে যাকাত-পরিমান কর গ্রহণ করা হবে কিনা দ্বিতীয় পর্ব বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত যাকাত ফরয হয় না বলে যাঁরা মত দিয়েছেন এঁদের দলীল বালক ও পাগলের মালে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষের লোকদের কথা বালকের ধন মালে যাকাত হওয়ার দলীল তুলনা ও অগ্রাধিকার দান ফরয না-হওয়া মতের বাতুলতা সার কথা তৃতীয় অধ্যায়: যেসব ধন-মালে যাকাত ফরয হয় তার নিসাব পরিমাণ যে সম্পদে যাকাত ফরয হয় ‘মাল’ শব্দের অর্থ-আভিধানিক শরীয়াতের পরিভাষা যে মালে যাকাত ফরয হয় তার শর্তাবলী পূর্ণাংগ মালিকানা এ শর্তটির যৌক্তিকতা এ শর্তের দলীল এ শর্তের আনুষঙ্গিক কথা ওয়াক্ফকৃত জমি হারাম সম্পদে যাকাত হয় না ঋণের যাকাত চাকুরীজীবীদের বেতন ও সঞ্চয় প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি শর্ত করার যৌক্তিকতা এ শর্তের দলীল বর্ধনশীল রহিত সম্পদ নিসাবের শর্ত মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এ শর্তের দলীল ঋণমুক্তি এ পর্যায়ের দলীলসমূহ নিম্নরূপ যাকাতের প্রতিবন্ধক ঋণের শর্ত এ ঋণ বর্তমানকালের হওয়া কি শর্ত এক বছর অতিক্রমণ কতিপয় মালের এক বছরের শর্তের কারণ এক বছরের শর্তের প্রমাণ কতিপয়, সাহাবী ও তাবেয়ীনের ভিন্ন মত সমন্বয়ের কেন্দ্রবিন্দু প্রাপ্ত ধন-মালের ব্যাপারে মতপার্থক্য পশু সম্পদের যাকাত পশুর যাকাতরে সাধারণ শর্ত তার সংখ্যা নিসাব-মাত্রা পর্যন্ত পৌঁছতে হবে মালিকানার এক বছর ‘সায়েমা’ হতে হবেউটের যাকাত একশ’টির উপর সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাতের মতভেদ ও তার কারণ হানাফী মাযহাবের মত ও তার পর্যালোচনা যাকাত সংক্রান্ত পত্রসমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্যের তাৎপর্য গরুর যাকাত গরুর যাকাতের নিসাব প্রসিদ্ধ কথা-নিসাব সংখ্যা ত্রিশ ইমাম তাবারীর মতে নিসাব পরিমাণ পঞ্চাশটি ইবনুল মুসাইয়্যিব ও জুহরীর মত এই মতের দলীল ভিন্নমত প্রাসঙ্গিক কথা ছাগলের যাকাত বহুসংখ্যক ছাগলের যাকাত ফরয হয় কেন ছোট গবাদিপশুর যাকাত কি যাকাত দিতে হবে গবাদিপশুর যাকাত বাবদ কি গ্রহণ করা হবে যাকাতের জন্তুতে মিশ্রণের প্রভাব ঘোড়ার যাকাত যানবাহন বোঝা বহন ও জিহাদে ব্যবহৃত ঘোড়ার যাকাত নেই ব্যবসায়ের ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে ঘরে ঘাস খাওয়ানো ঘোড়ার যাকাত নেই ঘোড়ার যাকাত না হওয়ার দলীল ইমাম আবূ হানীফার মত আবূ হানীফার মতে যাকাতের নিসাব পর্যালোচনা ঘোড়া ছাড়া অন্যান্য গবাদিপশু প্রাথমিক কথা তৃতীয় অধ্যায়: স্বর্ণ ও রৌপ্রের যাকাত নগদ সম্পদের যাকাত নগদ সম্পদের ভূমিকা ও পর্যাসমুহ রাসূলে করীমের যুগে প্রচলিত নগদ অর্থ নগদ সম্পদে যাকাত ফরয হওয়ার দলীল নগদ সম্পদে যাকাত ধার্য হওয়ার দলীল নগদ সম্পদে যাকাত ধার্যা হওয়ার যৌক্তিকতা নগদ সম্পদে যাকাতের পরিমাণ একালে এ পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় কি? নগদ সম্পদের নিসাব সংশয় ও তার অপনোদন শরীয়াতসম্মত ‘দিরহাম’ ও দীনারের পরিমাণ সমকালীন চিন্তাবিদদের একটা বড় ভুল এ যুগে নিসাব নির্ধরণ কিসে হবে? নগদ সম্পদের কোন স্থির মান নির্ধারণ কি সম্ভব অন্রান্য নিসাব পরিমাণ নির্ধারণ শস্য ও ফল-ফসলের নিসাব অনুযায়ী নির্ধারণ কি সম্ভব? অন্যান্য নিসাব পরিমাণ নির্ধারণ শস্য ও ফল-ফসলের নিসাব অনুযায়ী নির্ধারণ কি সম্ভব? গবাদিপশুর নিসাবের দৃষ্টিতে নিসাব নির্ধারণ কি সম্ভব? নগদ সম্পদের নিসাবের গ্রহণযোগ্য মান নগদ কাগজী মুদ্রা ও তার বিচিত্রতা কাগজী নগদের যাকাত নগদ সম্পদে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত নিসাব পরিমাণ হওয়া নিসাব পরিমাণের একক মালিক হওয়া কি শর্ত? একটি বছরকাল অতিবাহিত হওয়া ঋণমুক্তি মৌল প্রয়োজনের বাড়তি হওয়া অলংকারাদি, তৈজসপত্র ও স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত উপঢৌকনাদির যাকাত স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত পাত্রাদি ও উপঢৌকনাদির যাকাত পুরুষের ব্যবহৃত হারাম অলংকারাদিতেও যাকাত ফরয স্ত্রীলোকদের মুক্তা ও মণি নির্মিত অলংকারের যাকাত স্ত্রীলোকদের স্বর্ণ-রৌপ্যের অলংকারের যাকাত সম্পর্ক বিভিন্ন মত অলংকারের যাকাত ফরয হওয়ার দলীল এ কথার দলীল অলংকারের যাকাত ফরয না হওয়ার পক্ষেমত এ মতের দলীল পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান অলংকারের যাকাত ফরয হওয়ার দলীল ভুল যে অলংকার পুঁজি বানানো হবে, তারই যাকাত দিতে হবে সারনির্যাস চতুর্থ অধ্যায়: ব্যবসায়ী সম্পদের যাকাত ব্যবসায়ে যাকাত ফরয হওয়ার দলীল কুরআনের আয়াত সুন্নাত সাহাবী, তাবেয়ীন ও প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের ইজমা কিয়াস-বিবেচনা বিরুদ্ধবাদীদের শোবাহ-সন্দেহ ব্যবসায় পণ্য সম্পর্কে জাহিরী ফিকাহ্র মত ব্যবসা-পণ্যে যাকাতের শর্ত ব্যবসায়ী তার ব্যবসা সম্পদের যাকাত কিভাবে দেবে মজুদদার ব্যবসায়ী ও চলতি বাজারদরে বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য স্থিতিশীল পণ্যের যাকাত নেই যাকাত দেয়ার সময় পণ্যদ্রব্যের মূল্য কোন্ দরে হিসাব করা হবে? ব্যবসায়ী মূল ব্যবসা দ্রব্য থেকে যাকাত দিবে না তার মূল্য থেকে পঞ্চম অধ্যায়: কৃষি সম্পদের যাকাত ফল ও ফসলে যাকাত ফরয হওয়ার দলীল কুরআন মজীদ সুন্নত ইজমা কৃষি ফসলে ফরয যাকাত হযরত ইবনে উমরের মত ইমাম মালিক ও শাফেয়ীর মত ইমাম আহমদের মত ইমাম আবূ হানীফার মত জমির সর্বপ্রকার উৎপাদনেই যাকাত এই মতের পক্ষে দলীল পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার কৃষি ফসল ও ফল-ফঁকড়ার যাকাত নিসাবের হিসাব পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান শস্য ও ফলের নিসাব ছা’র পরিমাণ ছা’র ব্যাপারে হিজাজ ও ইরাকের মধ্যকার পার্থক্য ইরাকী ফিকাহ্বিদদের দলীল হিজাজীদের দলীল দুটো কথার সমন্বয়ের কোন পথ আছে কি? ফলশ্রুতি আধুনিক মানে শস্য ও ফলের নিসাব পাত্র দিয়ে মাপা হয় এমন জিনিসের নিসাব আমাদের গৃহীত মত নিসাব কখন হিসাব করা হবে যাকাতের পরিমাণ ও তার পার্থক্য ওশর ও অর্ধ-ওশর সেচ প্রয়োজন না হলেও কষ্টের সম্ভাব্যতা অনুমানের ভিত্তিতে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ অনুমান করার উপযুক্ত সময় অনুমানকারীর ভুল খেজুর-আঙ্গুর ছাড়া অন্যান্য ফলেও কি অনুমান করা যাবে? কৃষি ফসল ও ফলের মালিকের জন্যে কি ছেড়ে দেয়া যাবে ঋণ ও ব্যয়ভার বাদ দিয়ে অবশিষ্টের যাকাত ঋণ ও ব্যয়ভার বাদ দিয়ে কি যাকাত দেয়া হবে? ভাড়া করা জমির যাকাত মারিক নিচেই চাষ করলে ধার করা জমির যাকাত জমি-মালিক ও শরীক মালিক যাকাত দেবে, না কেরায়দার? ইমাম আবু হানীফার মত জমহুর ফিকাহবিদদের মত মতপার্থক্যের কারণ অগ্রাধিকার দান ওশর ও খারাজ জমি কখন ওশরী হয়, কখন খারাজী ওশরী জমি খারাজী জমির বিভিন্ন প্রকার খারাজী জমি ক্রয় ও বিক্রয় সমর্থনের মাধ্যমে খারাজ ধার্যকরণ ওশর ও খারাজ কি একসাথে ধার্য হতে পারে হানাফী মত ও তার দলীল মজহুর ফিকাহ্বিদদের অভিমত পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান উৎপাদন থেকে খারাজ বাদ দিয়ে অবশিষ্টের যাকাত দান এক্ষণে খারাজী জমি কোথায় ওশর ও খারাজ একত্র হওয়া সম্পর্কে একালের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গী ষষ্ঠ অধ্যায়: মধু ও প্রাণী উৎপাদনের যকাত মধুর যাকাত শুরুর কথা মধুর যাকাতের পক্ষেযাঁরা এ মতের দলীল এ পর্যায়ে অন্যান্য মত আবূ উবায়দার মত মধুর যাকাত পর্যায়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত মধুর যাকাত পর্যায়ে অগ্রাধিকারপ্রা্ত মত মধুর যাকাতের পরিমাণ মধুর নিসাব রেশম ও দুগ্ধ ইত্যাদির প্রাণীজাত সম্পদের যাকাত সপ্তম অধ্যায়: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত খনি, পুঁজি বা সঞ্চিত ধন ও মাটির তলে পুঞ্জিত সম্পদ সংক্রান্ত বর্ণনা মাটির তলায় প্রোথিত সম্পদ এবং তার উপর ধার্য যাকাত খনি এবং খনিজ পদার্থের যাকাত যে খনিজ সম্পদের উপর যাকাত ধার্য হয় খনিজ সম্পরেদ উপর ধার্য যাকাতের পরিমাণঃ এক-পঞ্চমাংশ অথবা এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ দেয়ার পক্ষের দলীল এক-পঞ্চমাংশ দেয়ার পক্ষের দলীল শ্রম পরিমাণ ফরয হওয়ার মত খনিজ সম্পদের নিসাব- তা কখন গণনা করা হবে খনিজ সম্পদের কি কোন নিসাব আছে নিসাব নির্ধারণের সময়-মিয়াদ খনিজ সম্পদে যাকাত ধার্যকরণে এক বছর কি শর্ত খনিজ সম্পদের যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র খনিজ সম্পদের যাকাত কোথা ব্যয় করা হবে? সমুদ্র থেকে লব্ধ সম্পদ সমুদ্র থেকে পাওয়া মণি-মুক্ত আম্বর ইত্যাদি প্রসঙ্গে মাছে কি ধার্য হবে অষ্টম অধ্যায়: দালান-কোঠা ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি প্রবৃদ্ধিমূলক প্রতিষ্ঠানের যাকাত প্রবৃদ্ধি দান-ক্ষেত্রসমূহের যাকাত যাকাত ধার্যকরণে সংকীর্ণতাবাদীদের বক্তব্য যাকাত ধার্যকরণে উদার দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের বক্তব্য যাকাত ধার্য করার ক্ষেত্রে সংকীর্ণকারীদের মতের প্রতিবাদ দালান-কোঠা ও শিল্প-কারখানার যাকাত কিভাবে দিতে হবে ভাড়া দেয়া ঘর-বাড়ি ইত্যাদি মুনাফা লাভের উপায় থেকে যাকাত গ্রহণের ব্যাপারে দুটি প্রাচীন মত প্রথম দৃষ্টিকোণ: মূল্যায়ন করে ব্যবসায়ী যাকাত গ্রহণ হাম্বলী ফকীহ ইবনে আকীলের মত আমদানী বৃদ্ধির জন্যে নির্মিত ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ‘হাদুইয়ার’ মত ভিন্ন মতের উত্থাপিত আপত্তি পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ: আমদানী হাতে আসার পর নগদ সম্পদের মতই তার যাকাত দিতে হবে ইমাম আহমদের মত মালিকী মতের কথা সাহাবী, তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তী লোকদের মত এ কালের আলিমদের মত, আয়েল যাকাত শস্য ও ফলের যাকাতের মত পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান ইমারত ইত্যাদির যাকাতের নিসাব যে মেয়াদের মধ্যে নিসাব গণ্য হবে আমদানী থেকে ঋণ ও ব্যয়াদি বাদ দেয়া জীবিকার জন্যে নিম্নতম পরিমাণ বাদ দেয়া নবম অধ্যায়: স্বাধীন শ্রমের উপার্জনের যাকাত শুরু কথা স্বাধীন ও পেশাভিত্তিক উপার্জনের স্বরূপ নির্ধারণ সমসাময়িক অভিমত মাসিক বেতন ও মজুরীলব্ধ মাল অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে সুচিন্তিত মত এক বছর পূর্তি সংক্রান্ত হাদীস হযরত আলী (রা) বর্ণিত হাদীস ইবনে উমর বর্ণিত হাদীস আনাস বর্ণিত হাদীস আয়েশা বর্ণিত হাদীস অর্জিত মাল সম্পর্কিত হাদীস অর্জিত মাল সম্পর্কে সাহাবী, তাবেয়ীন ও পরবর্তী লোকদের মতপার্থক্য অর্জিত মাল পর্যায়ে সাহাবী ও তাবেয়ীর মত ইবনে মাসউদ মু’য়াবিয়া উমর ইবনে আবদুল আযীয অন্যান্য তাবেয়ী ফিকাহ্বিদ ইমাম বাকের, সাদেক, নাসের ও দাঊদের মত অর্জিত মাল হস্তগত করার সাথে সাথে যাকাত দিতে হবে এ কালের বিশেষজ্ঞদের অভিমত কাজ ও স্বাধীন পেশার বিনিময়ে পাওয়া সম্পদের নিসাব এ প্রসঙ্গে অবশিষ্ট কথা অর্জিত সম্পদের যাকাত দেয়ার নিয়ম নির্ভেজাল আমদানী ও মাসিক বেতনের যাকাত কর্মে উপার্জিত সম্পদের যাকাত পরিমাণ দশম অধ্যায়: শেয়ার ও বণ্ডের যাকাত শেয়ার ও বন্ডের মধ্যে পার্থক্য বিভিন্ন কোম্পানী শেয়ারের যাকাত দেয়ার পদ্ধতি কোম্পানী স্বরূপ অনুযায়ী শেয়ারের মূল্যায়ন বন্ডের যাকাত শেয়ারগুলোকে ব্যবসা পণ্য হিসেবে গণ্য করা কোম্পানীর আয় ও শেয়ারের যাকাত কি এক সাথে নেয়া হবে নিষিদ্ধ দ্বৈততা সাদৃশ্যসম্পন্ন অবস্থাসমুহ, -যা ফিকাহবিদগণ নিষেধ করেছেন গবাদি পশুর ব্যবসায় ও তার যাকাত দেয়ার নিয়ম

 

ইসলামের যাকাত বিধান প্রথম খণ্ড আল্লাহর বিধান (আারবী**********) লোকদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর এবং তাদের জন্যে কল্যাণের দেয়া কর। নিসন্দেহে তোমার এই দোয়া তাদের জন্য পরম সান্ত্বনার কারণ। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। গ্রন্থকারের কথা সমস্ত তারীফ ও প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম রাসূলে করীম (স)-এর জন্য; তাঁর বংশ-পরিবার, সঙ্গী-সাথী ও তাঁর নিকট থেকে প্রাপ্ত হিদায়াতের অনুসরণকারীদের প্রতি- দ্বীন-ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। তাওহীদী ঈমান ও নামায কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে এই যাকাত রীতিমত আদায় করেই এক ব্যক্তি মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। অধিকারী হতে পারে মুসলিম জনগণের ভাই হওয়ার, পারে পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর ও ঘনিষ্ঠ করে নিতে। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: (আরবী*************) যদি এই লোকেরা তওবা করে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই হবে। যাকাত সাধারণত ইবাদতের পর্যায়ে গণ্য। কুরআন মজীদে নামাযের সঙ্গেই আছে যাকাতের উল্লেখ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাকাত ইসলামের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিধানের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কারণে তা খুব গুরুত্ব সহাকারেই উপস্থাপিত হয়, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে এবং এই পর্যায়ে লিখিত গ্রন্থাবলীতে। ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এই কারণে যাকাতের আইন ও বিধি-ব্যবস্থা এবং তত্ত্ব ও তথ্যের উপর পরিপূর্ণ বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্যে সহকারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন- এই প্রসঙ্গে গবেষণা চালিয়েছেন। কুরআনের তাফসীর লেখকগণের ভূমিকা কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে যাকাতের উল্লেখ রয়েছে, তাফসীর লেখকগণ সেই সব আয়াতকে ভিত্তি করে যথেষ্ট চিন্তা-গবেষনা ও বিস্তারিত আলোচনা পর্যালোচনা চালিয়েছেন। এই পর্যায়ে সূরা আল-বাকারার ২৬৭ ও তৎপরবর্তী আয়াত, সূরা আল-আনআমের ১৪১ আয়াত, সূরা আত-তওবা’র ৩৪, ৬০ ও ১০৩ আয়াত এবং আরও কয়েকটি সূরার কতিপয় আয়াত উল্লেখ্য। তাফসীরকারগণ উপরিউক্ত আয়াতসমূহের পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে যে মহামূল্য ও বৃহদাকার গ্রন্থাবলী রচিত হয়েছে তন্মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ: -আবূ বকর আর-রাযী আল-জাস্সাস : আল আহকামুল কুরআন -আবূ বকর ইবনুল আরাব: আল-আহাকামুল কুরআন -আবূ আবদুল্লাহ আল-কুরতুবী: আল-জামে’লি-আহকামিল কুরআন মুহাদ্দিস ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারদের ভূমিকা এ পর্যায়ে হাদীসসমূহের আলোচনা ও ব্যাখ্যাদানে মুহাদ্দিস ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ফিকাহ্ গ্রন্থের পদ্ধতিতে হাদীসের যে সব গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে যাকাত সম্বন্ধে একটা বিশেষ অধ্যায় সংযোজিত করেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম মালিক প্রণীত মুয়াত্তা, বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী, আবূ দাউদ ও ইবনে মাজা প্রভৃতি গ্রন্থের নাম উল্লেখ্য। সেই বিশেষ অধ্যায়ে রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত তাঁর কথা ও কাজের বিবরণ সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। একমাত্র বুখারী শরীফেই যে ‘কিতাবুস যাকাত’ উদ্ধৃত আছে তাতেই ১৭২টি সহীহ্ মারফূ [মারফূ বলা হয় সেই হাদীসকে, যা রাসূলের কথা সম্বলিত এবং কোন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত] হাদীস সংকলিত রয়েছে। মুসলিম শরীফেও তাঁর থেকে সতেরিটি হাদীস ছাড়া অবশিষ্ট সকল হাদীসই উদ্ধৃত হয়েছে। মুসলিম শরীফেও তাঁর থেকে সতেরটি হাদীস ছাড়া অবশিষ্ট সকল হাদীসই উদ্ধৃত হয়েছে। উপরন্তু সাহাবা ও তাবেয়ীনের বিশটি উক্তিও তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।[ফহ্হুল বারী-বুখারী শরীফের শরাহ্। তাতে কিতাবুয যাকাত উপসংহারে দ্রষ্টব্য।] ফিকাহবিদদের কাজ ফিকাহ্র কিতাবসমূহে যাকাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয ইবাদত হিসেবে। এই কারণে কুরআন ও সুন্নাহ্র অনুসরণে নামাযের পরপরই তার উল্লেখ রয়েছে ইবাদাতসমূহের আলোচনা ব্যপদেশে। ইসলামের অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ফিকাহ্র আলিমগণের কাজ তাঁরা ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবেই যাকাতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে সে বিষয়ে আলোচনায় আমরা দেখতে পাই ইমাম আবূ ইউসুফের ‘কিতাবুল খারাজ’-এ, ইয়াহ্ ইয়া ইবনে আদাম লিখিত ‘কিতাবুল খারাজ’-এ, আবূ উবাইদ লিখিত ‘কিতাবুল আমওয়াল’-এ, মাওদী শাফেয়ী ও আবূ-ইয়ালী আল-হাম্বলী রচিত ‘আল-আহ্কামুস সুলতানীয়া’ নামক গ্রন্থদ্বয়ে এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা লিখিত ‘আস-সিয়াতুশ-শরীয়াহ’ গ্রন্থে। এক্ষণেযাকাত পর্যায়ে আলোচনাকারী যে মৌল বস্তুর মুখাপেক্ষী হয়, তা অত্যন্ত ভারী ও দুরূহ। তার উৎস বিপুল এবং প্রচুর। তাহলে নতুন করে যাকাত সম্পর্কে এই আলোচনার অবতারণার প্রয়োজন কি? অন্য কথায়, ইসলামী গ্রন্থকার কি এই ধরনের এক নবতর বিরাট আলোচনার মুখাপেক্ষী, যাতে যাকাতের নিয়ম-বিধান, তার লক্ষ্য এবং ব্যক্তি-সমষ্টির জীবনে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা হবে? বর্ণনা করা হবে সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় তার স্থান সম্পর্কে? এ প্রশ্নের জবাব আমরা নিশ্চিন্তেই ইতিবাচকভাবে দিতে সক্ষম। বরং বলতে পারি, এ ধরনের আলোচনার প্রয়োজন অত্যন্ত তীব্র। তার কয়েকটি কারণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: ১. এ কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্তম্ভ সম্পর্কে আলোচনাকারী ও লেখকগণের একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে এই বিষয়টির পৌনপুনিক আলোচনা, প্রয়োজন হচ্ছে বিভিন্ন উৎস বিস্তিীর্ণ হয়ে থাকা তার হুকুম-আহকাম, তার তত্ত্ব ও তথ্য একত্র করার এবং তাকে সমসাময়িক যুগের পদ্ধতি ও যুক্তিসঙ্গত কলেবরে নতুন করে উপস্থানের। অতীত-কালে বিশেষজ্ঞগণ এ পর্যায়ে যে চিন্তা ও গ্রন্থাবলী উপস্থাপন করেছেন, এ যুগের জন্য তাকে যথেষ্ট মনে করা যায় না কোনক্রমেই। কেননা তাঁরা যে গ্রন্থাবলী প্রণয়ন করেছেন, তা তাঁদের যুগোপযোগী সেকালের ভঙ্গী ও স্টাইল অনুযায়ী করেছেন। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেকযুগেরই একটা নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গী রয়েছে, প্রত্যেক যুগের স্টাইল স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী************) আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে তার সময়কার লোকদের ভাষা ও ভঙ্গী (এবং কথা বলার যোগ্যতা) সহকারে প্রেরণ করেছি, যেন সে লোকদের সামনে স্পষ্ট বক্তব্য রাখতে সক্ষম হয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় দুটি প্রধান বিষয় অধ্যয়ন, পর্যালোচনা ও সর্বদিক দিয়ে স্পষ্ট করে তোলা একান্তই আবশ্যক। বিষয় দুটি পরস্পর বিরোধী। একটি ইতিবাচক আর অপরটি নেতিবাচক। একটি ইসলামের ফরযসমূহের মধ্যে গণ এবং সত্য কথা হচ্ছে, তা ইসলামেরপাঁচটি মৌল স্তম্ভের অন্যতম। আর দ্বিতীয়টি ইসলামে শুধু নিষিদ্ধই নয়, ধ্বংসকারী সাতটি কাজের অন্যতম। প্রথমটি যাকাত আর দ্বিতীয়টি সূদ। প্রথমটির ফরয হওয়ার কথা কিংবা দ্বিতীয়টির হারাম হওয়ার কথা অস্বীকার ও অমান্যকারী ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবে কাফির- ইসলাম ত্যাগকারীরূপে অভিহিত। আর বাস্তবিকপক্ষে দ্বিতীয় বিষয়টি- অর্থাৎ সুদ-মুসলিম মানীষীদের কাছে প্রথমটির তুলনায় বেশী গুরুত্ব লাভ করেছে। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ্ দারাজ, ঈসা আবদুহু, মুহাম্মাদ আবূ জুহরা, মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল-আরাবী, মাহমুদ আবুস-সউদ, মুহাম্মাদ বাকর আস্-সদর ও মুহাম্মাদ আজীজ প্রমুশ মনীষী এ পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। [এই মনীষীদের লিখিত বইয়ের নাম এখানে যথাক্রমে এই: ‘সুদ’, ‘আল্লাহ সূদ হারাম করেছেন কেন’ সুদ হারামকরণ একটা অর্থনৈকি সংগঠন’, বিশেষ মালিকানা ও ইসলামে তাঁর সীমা, ইসলামী অর্থনীতির প্রধান রূপরেখা, আমাদরে অর্থ ‘ব্যবস্থা’, ‘সুদমুক্ত ব্যাংক সাফল্যেল চাবিকাঠি’ প্রভৃতি।] তাঁরা খালেস ইসলামী দৃষ্টিকোণ কিংবা সম্পদ ও জীবন সম্পর্কে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ প্রভাবিত দৃষ্টিকোণে অনেক কিছুই লিখেছেন। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিবর্তনের দৃষ্টিতে বিষয়টি অধিক ও গভীর ও ব্যাপক পর্যালোচনার প্রয়োজনও এখনও অব্যাহত। যারাই বেশী গবেষণা ও চেষ্টা-সাধনা করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্যে এ ক্ষেত্রটি চিরকাল বিস্তীর্ণ হয়ে থাকবে। তবে সেই অধ্যয়ন অবশ্যই তুলনামূলক হতে হবে। সেই সঙ্গে উল্লেখ করতে হবে ইসলামেরমৌল উৎসমূহের। সর্বাবস্থায়ইবিষয়টি অধিক যত্ন ও গুরুত্বের দাবি রাখে। কিন্তু ‘যাকাতৎ আলোচ্য বিষয় হিসেবে আলোচনাকারী ও বিশেষজ্ঞদের নিকট যথাযথ গুরুত্ব লাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। এর ধরনের একটি বিষয় যে পরিচর্যা পাওয়ার অধিকারী, তা আদৌ করা হয়নি। অথচ ইসলামের ফরযসমূহের মধ্যে তার একটা বিশেষ স্থান রয়েছে, বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজস্ব ও সামষ্টিক ব্যবস্থায়। ২. এখানে এমন কতগুলো সমস্যা আছে, যে বিষয়ে প্রাচীনকালীন ফিকাহ্দিদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ রয়েছে। প্রক্যেক মতের সমর্থকবৃন্দ তাঁদের মত উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলিল-প্রমাণেরও উল্লেখ করেছেন। ফতোয়া দানকারিগণ পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। প্রত্যেকেই নিজের মত ও তার ইমামের (অগ্রবরতী মত প্রদানকারী) সমর্থন জানিয়েছেন। আর সাধারণ ফতোয়া প্রার্থীগণ ফতোয়া প্রদানকারী বিশেষজ্ঞদের এই পারস্পরিক বৈপরীত্যের সম্মুখে দিশেহারা হয়ে অবস্থান করছে। এ কারণে এসব পারস্পর বিরোধী উক্তি, তাদের প্রত্যেকের উপস্থাপিত প্রমাণ ও যুক্তির পুনর্বিবেচনা হওয়া এবং আল্লাহ্র অবতীর্ণ কিতাব ও মানদণ্ডের উপর ইনসাফের দৃষিএত তার যাঁচাই-পরখ হওয়া একান্তই আবশ্যকীয় ছিল। একান্তই জরুরী ছিল পরস্পর বিপরীত এসব মতের মধ্যে একটি মতকে এমনভাবে অগ্রাধিকার দান করা, যেন পরবর্তীকালে আলোচনাকারীরা একটা নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনতি হতে সমর্থ হন। এই কারণে শিক্ষাগুরু মরহুম শায়খ মাহমুদ শালতুত তাঁর রচিত ‘আল-ইসলাম আকীদাতুন ওয়া-শরীয়াতুন’-ইসলাম: একটি বিশ্বাস ও বিধান’ শীর্ষক মূল্যবান গ্রন্থে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন: যাকাত একটি সাধারণ দ্বীনী স্তম্ভ। তিনি লিখেছেন: যদিও আমি বিশ্বাস করি, নীতিগত মতপার্থক্য জীবন্ত চিন্তাশক্তির নিদর্শন এবং এ মত-পার্থক্যের যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে তার উদারতা থাকা সত্ত্বেও যখনি এই কর্তব্যের বাস্তবায়নে ইমামগণের মতবিরোধের ক্ষেত্র লক্ষ্য করি, আমাদের দিল কুণ্ঠিত হয়ে উঠে, যদিও ফিকাহ্র কিতাব ও নিয়ম-বিধানে যথেষ্ট প্রশস্ততা দেখতে পাওয়া যায়। এই ফরয কাজটির উল্লেখ প্রায়শই নামায সংক্রান্ত নির্দেশের পাশাপাশি হয়েছে। কাজেই তাতে মুসলমানদের ভূমিকা কিংবা তাদের সকলের ক্ষেত্রে এই ফরয কাজটির ভূমিকা ঠিক নামাদের মতই হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কথায়, নামায মুসলিম জনগণের কাজে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এ কাজটিও ঠিক ততটা গুরত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। তার মর্যাদা এমন সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে কোন অষ্পষ্টতা থাকবে না, থাকবে না কোন বিরোধ-পার্থক্যের একবিন্দু অবকাশ। ঠিক মেযন দিন-রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। এ ফরয কাজটির মৌল ও পরিমাণ বিশেষজ্ঞদের মতবিরোধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পরিমাণের ক্ষেত্রে তাঁদের মতবিরোধ এমন একটা প্রকাশ ঘটিয়েছে, যা মুসলমানদের দ্বীনী কর্তব্য পালনে বিশেষ পার্থক্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর অন্ধ অনুসরণে মতবিরোধ এবং তার পথের বিভিন্নতা ও বিপুলতাই তার মূলে নিহিত কারণ। কারো কারো মতে শিশু-বালক ও পাগলের মাল-সম্পদে যাকাত ধার্য হয়, কারো কারো মতে তা হয় না। এমনিভাবে কেউ কেউ মনে করেন, জমি থেকে মানুষ যা-ই উৎপাদন করে তাতেই যাকাত ধার্য হয়। অপরদের মতে এক বিশেষ ধরনের ফসল বা ফল ছাড়া অন্য কিছুতে যাকাত ধার্য হয় না। কারো মতে ঋণ থাকলেও যাকাত দিতে হবে, অপর লোকেরা এর সঙ্গে একমত হতে পারেন নি। ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ধার্য হওয়ার কথা অনেকে বলেছেন, অনেকে আবার ভিন্নমত পোষণ করেন। মহিলাদের ব্যবহার্য অলংকারেও যাকাত ধার্য হয় কিন্তু অনেকে তা মেনে নিতে পারেননি। অনেক বিশেষজ্ঞ যাকাত ফরও হওয়ার জন্য একটা নিম্নতম পরিমাণ মাল নিসাব নির্দিষ্ট করেন এবং তা কারো মালিকানায় এলেই যাকাত দিতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নিম্নতম পরিমাণের শত অনেকই মানছেন না। এক কথায় যাকাত ফরয হওয়া না-হওয়ার দ্রব্যসামগ্রী পর্যায়ে বিভিন্ন মত উপস্থাপিত হয়েছে। অনুরূপভাবেযাকাত ব্যয়ক্ষেত্র সম্পর্কেও যথেষ্ট মতপার্থক্য থাকার কথা অস্বীকার করা যায় না। শায়খ শালতুত এ কথার উল্লেখ করার পর খুবই দ্রুততা সহকারে এ ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার জন্য আকুল আহবান জানিয়েছেন। কেননা তিনি মনে করেন, ইমামগণের নিকট বিরোধীয় বিষয়সমূহ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই মতবিরোধ মূল ফরযটির উপরই কঠিন আঘাত হানতে পারে এবং তার বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনা হতে হবে সেই মূল লক্ষ্যের ভিত্তিতে, যে কারণে কুরআন মজদি এই কাজটিকে ফরয করেছে, একে একটি দ্বীনী কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে, যেন তার ও তার সমগ্র দিকের সাথে সমস্ত মুসলমানের সম্পর্ক সমমানের হতে পারে। (আরবী***************) ৩. এ ক্ষেত্রে আরও কতগুলো ব্যাপারে সম্পূর্ণ নতুনভাবে এই যুগে দেখা দিয়েছে। প্রাচীনকালীন ফিকাহ্বিদগণ এ সম্পর্কে কিছুমাত্র অবহিত ছিলেন না। শেষেরদিকের ফিকাহ্বিদগণও সেসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিতই রয়ে গেছেন। এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্ত আবশ্যক, যেন মানুষ মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে এবং সাধারণ মুসলমানদের মুখে উচ্চারিত উদ্বেগ সৃষ্টিকারী প্রশ্নাবলীর স্পষ্ট জবাব দানে সক্ষম হয়। একালে জন্তু-জানোয়ার, নগদ অর্থ, কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি ছাড়াও বহু সম্পদ নতুনভাবে দেখা দিয়েছে, বহু আকাশচুম্বী দালান-কোঠা নির্মিত হয়েছে ভাড়ায় লাগানো ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে। বড় বড় শিল্প-কারখানা নির্মিত হয়েছে ভাড়ায় লাগানো ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে। বড় বড় শিল্প-কারখানা নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জামও পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের মূলধন-স্থাবর ও অস্থাবর রয়েছে যা মালিকদের হাতে আবর্তিত হয় ও উৎপাদন হতেথাকে, ভাড়া দেয়া হয়, যেমন নৌকা, গাড়ি, উড়োজাহাজ, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও প্রেস ইত্যাদি। বিপুল সংখ্যক শিল্প-ব্যবসায়ী কোম্পানী কায়েম ও চালু হয়ে আছে। স্বাধীন পেশাধারী লোকও বিপুল পরিমাণ অর্থোপার্জন করে থাকে, যেমন চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, উকীল প্রভৃতি। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক উচ্চ মর্যাদা, মজুরী ও বিনিময় সম্পন্ন মাসিক বেতনধারী লোকও রয়েছে। এ পর্যায়ে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান-সংখ্যা ও ক্রমবর্ধমান মূলধন কি যাকাত ফরযের আওতায় পড়ে অথবা প্রাথমিক যুগে যেসব জিনিসের উপর যাকাত চালু ছিল, এখনও তা তারই মধ্যে সীমিত হয়ে থাকবে? এ সবের উপরও যাকাত যদি ফরয ধরা হয়, তাহলে তার পরিমাণ কি হবে কখন তা ফরয হবে এবং সেজন্য ফিকাহসম্মত ভিত্তি কি হতে পারে? কতগুলোর ক্ষেত্রে নিসাব (যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতর পরিমাণ) এবং শরীয়তসম্মত পরিমাণ নির্ধারিত রয়েছে। যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে নিসাব নির্ধারণকারী অকট্য দলিল রয়েছে। কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদির যাকাত ফরয হওয়ার জন্য পাঁচ ‘অসাক্ক’, রোযা-ভঙ্গের যাকাত একশ’ এবং নগদ টাকায় যাকাত ফরয হওয়ার জন্য দুইশ’ দিরহাম অথবা বিশ ‘দীনার’ নির্ধারিত আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বর্তমান সময়ে আমরা এই প্রাচীনকালীন নিসাপের পরিমাণ ও কালের মুদ্রায় কিভাবে নির্ধারিত করতে পারি? এ কালের প্রচলিত পরিমাণে তার রূপান্তর কিভাবে সম্ভব? তা‘ছাড়া এ প্রশ্নও প্রবল যে, এগুলো কি অপরিবর্তনশীল, না তাতে কোনরূপ পরিবর্তন-হ্রাস-বৃদ্ধি করার অবকাশ আছে? কেননা অর্থনৈতিক ও সামাজিক আধার (Receptacles) পরিবর্তিত এবং নগদ অর্থের ক্রয়মূল্য উঠানামা করছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ইসলামী যুগের- যখন এগুলো নির্ধারিত হয়েছিল—তুলনায় অনেকটা ভিন্ন ধরনের রূপ পরিগ্রহ করেছে আমাদের একালে এবং এখানকার সমাজে। উপরন্তু আধুনিক কালের কর ধার্যকরণের (Taxation) ব্যাপারটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য। তা কখনও প্রকারভিত্তিতে হয়, কখনও অ-প্রকারভিত্তিতে; আবার কখনও আপেক্ষিকভাবে ও ঊর্ধ্বমুখী ভাবধারায়। এগুলো সাম্প্রতিককালেল রাষ্ট্র-সরকার কর্তৃক ধার্য হয়ে থাকে। আর রাষ্ট্রের সাধারণ প্রয়োজন পূরণে তৎলব্ধ অর্থ ব্যয় করা হয়। অনেক সামষ্টিক লক্ষ্য বাস্তবায়নেও তা বিনিয়োগ করা হয়। প্রশ্ন হল, যাকাতেরসাথে এই সব ধার্যকৃত করের (Taxation) সম্পর্ক কি? উৎস, ব্যয়ের ক্ষেত্র ও লক্ষ্য ইত্যাদিতে এ দুয়ের মাঝে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের প্রকৃত কারণ কি? ধার্যকৃত কর কি কখনও যাকাতের পাশাপাশি কর ধার্যকরণ কি শরীয়াত অনুযায়ী জায়েয? এগুলো বড় বড় ও জটিলতার প্রশ্ন। এ যুগ এইসব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব। আমাদের পক্ষে এ পর্যায়ে কোন-না-কোন অভিমত ব্যক্ত করা একান্তই অপরিহার্য, যদিও প্রাচীন কালের ফিকাহ্বিদগণযেসব বিষয়ে কোন মত দিয়ে যান নি, সেসব বিষয়ে এ কালের আলিমগণের পক্ষে কোন মত স্থির করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। আর তার কারণ হল, ইসলামের প্রাথমিক যুগের পর যে ‘ইজতিহাদ’ কার্যকর ছিল এ কালে তার দ্বার চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে লোকদের বদ্ধমূল ধারণা রয়ে গেছে। অথচ এই কথাটি যে সুস্পষ্ট-রূপে ভুল ও বিভ্রান্তিকর, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। বস্তুত স্বয়ং রাসূলে করীম (স) যে দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তা রুদ্ধ করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না। তবে বিশেষজ্ঞগণ যেমনবলেছেন, ইজতিহাদ কয়েক প্রকার ও কয়েকটি ক্ষেত্রে সমন্বিত। কোন কোন আলিম বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে ও ক্ষেত্রে ইজতিহাদে পারদর্শী হতেপারেন, অন্যান্য বিষয়ে হয়ত তা করতে তাঁরা সক্ষম নন। বস্তুত এ ব্যাপারটি যেমন অসম্ভব নয়, তেমনি নয় কঠিন ও দুরূহ। তবে তা সম্ভব সেইসব আলিমদের জন্যে, যাঁরা তা করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করবে এবং ইসলামী শরীয়াত আরবী ভাষা অধ্যয়নে দ্বীনের মূল উৎস্য আহরণ ও আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে অনুসন্ধানে (Explore) এবং পারস্পরিক মূল্যায়ন ও উদ্ভাবনে অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণে (Inference) ব্রতী ও যোগ্যতা-প্রতিভাসম্পন্ন হবেন। আমি বিশ্বাস করি, উপরিউক্ত বিষয়াবলীতে কোন সুস্পষ্ট ও অকাট্য অভিমত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে সামষ্টিক ইজতিহাদ একান্তই অপরিহার্য। তা করতে হবে মুসলিম আলিম সমষ্টিকে সমবেতভাবে। তসে সেই সঙ্গে এই বিশ্বাসও আমার রয়েছে যে, বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও ইজতিহাদী চিন্তা-ভাবনা নির্ভুল সামষ্টিক ইজতিহাদের পথ শুধু উন্মুক্তই করে না, আলোকজ্জ্বলও করে তোলে। তাতে পূর্বপ্রস্তুতি শূন্যতা বা অপরিপক্কতার কোন প্রশ্রয় থাকবে না। সামষ্টিক ইজতিহাদে সারা দেশের মুসলিম আলিমদের মধ্যকার শক্তিশালী বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের অভিমত অভিব্যক্তিও প্রতিফলিত হতে পারে। তার সম্মুখে সব সময়েই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধক প্রচণ্ড হয়ে দাঁড়াবে। তার বড় বড়গুলো রাজনৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও প্রশাসকদের স্বেচ্ছাচারিতায় মারাত্মক পরিণতি লাভ করবে। ৪. এ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক মুসলিমের বড় বেশী ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে—এটা দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে যাঁরা সংস্কৃতিসম্পন্ন বলে গণ্য, তাঁরাও সেই ভুল ধারণা থেকে মুক্ত নন। তাঁরা মনে করেন যাকাত কতিপয় পয়সার সামগ্রী মাত্র কিংবা শস্য দানার একটি ওজন বিশেষ। তা দিয়ে দানশীল ধনী ব্যক্তিরা দরিদ্র-নিঃস্বদের উপর মর্যাদাবান হয়ে উঠেন। তার দ্বারা কয়েক দিনের ক্সুধা নিবৃত্ত হয় মাত্র—পরিমাণেতা কম হোক, কি বেশী।তারপরই সেই দরিদ্র, নিঃস্ব ব্যক্তি আবার সেই দানশীল ধনী ব্যক্তির দ্বারস্থ হয়—ভিক্ষার হাত প্রসারিত করেতার দান গ্রহণের উদ্দেশ্যে। সে তার পবিত্র হাত দিয়ে সেই দান গ্রহণ করে এবং তার ধন-জনে শ্রীবৃদ্ধির জন্যে কল্যাণের দোয়া করে মহান আল্লাহর দরবারে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ বিধানের সাথে এই অবস্থার কোন সম্পর্ক নেই। তবু স্বীকার করতে হবে যে, পরবর্তীকালসমুহে মুসলিম সমাজে এটা একটা রেওয়াযে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রচারমান দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ আমাদের হয়েছে। তার একটিতে জনৈক লেখক [লেখক কমিউনিস্ট বলে পরিচিত। নাম: আহমদ বাহাউদ্দিন, আর পত্রিকার নাম আখবারুল ইয়াউম ২৯৬১ সন।] এই ধারণা উপস্থাপিত করেছেন যে, যাকাত আমাদের এ কালেরসমাজের পক্ষে শোভন নয়। কেননা এ কালে সমাজের অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক সংগঠন-সংস্থা দানের উপর নির্ভরশীল নয়। এ কালের সমাজ কাজ ও উৎপাদনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁরামনে করেন, ইসলামী ব্যবস্থায় যাকাত হচ্ছে ভিক্ষুকদের জন্যে বিশেষ দান অথবা অলস-নিষ্কর্মা লোকদের জন্যে জীবিকা। অপর একজনলেখক এখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাতে ইসলামী সুচিবার ব্যবস্থাকে ‘দানের সাম্যবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে [কিতাবখানির নাম: আরবী******) (আমরা এখান থেকে শুরু করছি(। খালেদ মুহাম্মাদ খালেদ এই বইখানির রচয়িতা।] এ সব কিছু থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ লোকগুলো হয় গভীর মূর্খতায় নিমজ্জিত নতুবা তারা অসদুদ্দেশ্যপরায়ণ। এই প্রেক্ষিতেই আমাদের বক্তব্য হল, প্রস্তাবিত আলোচনা যে একান্ত অপরিহার্য, তা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে। যার পক্ষেই এ বিসয়ে আলোচনা করা সম্ভব, তার এ দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা কিছুতেই উচিত নয়। আমি বিশ্বাসকরি, জ্ঞানবান লোকদের উপর তা ‘ফরযে কিফঅয়া’ [যা সাধারণভাবে সকলেরই উপর ফরয কিন্তু তাদের কতিপয় আদায় করলেই সকলেল আদায় হয়ে যায়] কেননা কেউই এ কর্তব্য পালন না করলে সকলেই গুনাহ্গার হবে। ইসলামে সম্পদ ও অর্থব্যবস্থা পর্যায়ে জনৈক আলোচনাকারী বিস্ময় [তিনি মাহমুদ আবুস-সউদ ‘আল-মুসলিমুন’ নামক পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধ।] প্রকাশ করেছেন এই অবস্থা দেখে যে, আধুনিক কালের ইসলামী গ্রন্থ প্রণয়ন সংস্থাসমূহ যাকাত পর্যায়ে একখানি উত্তম গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ না করে পারলো কি করে? অথচ তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বীন-ইসলামে তার স্থান অনস্বীকার্য। মিসরের ওয়াক্ফ্ মন্ত্রণালয়ের ইসলামী বিষয়ক উচ্চতর সংস্থা এই প্রয়োজনের কথা বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছে। বিগত নয় বছর কাল ধরে কতকগুলো ইসলামী বিষয়ে প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হয়ে এসেছে। সারা মুসলিম জাহানের লেখক-চিন্তাবিদদের তাতে রচনা পেশ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে সেই রচনার আকার যেন বড় আকারের ৩৫০ পৃষ্ঠার কম না হয়। ‘ইসলামেরযাকাত’ ছিল এই পর্যায়েরএকটি বড় উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৯৬৩ সনেরমার্চ মাসে কায়রো শহরে যে ইসলামী আলোচনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার ঘোষণায় উপরিউক্ত কাজের প্রয়োজনের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রায় চল্লিশটি দেশের ইসলাম বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি তাতে অংশ করেছিলেন। এই সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল: যাকাত, ইসলামের অর্থোৎপাদনের উপায়, ফল গ্রহণের পন্থা এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির সাথে এগুলোর সম্পর্ক—এই হল আজকের আলোচ্য বিষয়। কেননা এগুলো ইসলামী শরীয়াতের দুটি বিভাগের মিলনক্ষেত্র। আর সেই বিভাগ দুটি হচ্ছে: ইবাদত, সামাজিক-সামষ্টিক আচরণবিধি। এই কারণে সম্মেলনতার পরবর্তী অধিবেশনসমূহে আলোচনা ও চিন্তা-গবেষণার জন্য এই বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করেছে। এ আলোচনার [টীকা: (আরবী*********)] গুরুত্বপূর্ণদিক ছিল নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যাবলী পরিপূরণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ: ক. সংশ্লিষ্ট বিষয়েল উপাদানসমূহ—যা মৌল উৎেসে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে রয়েছে—একত্র করা। হাদীস, তাফসীর, বিভিন্ন মাযহাবের ফিকাহ্র গ্রন্থাদি, শরীয়াত ও অর্থ সংক্রান্ত কিতাবাদি প্রভৃতিই হল এ পর্যায়ের মৌল উৎস। ইসলামী সংস্কৃতির এগুলোই হল প্রধান উৎস। এগুলো সংগ্রহ করার পর সেগুলোকে নতুন করে উপস্থাপন করা এমনভাবে যেন তা থেকে ইসলামের বিধান স্পষ্টভাবে পাওয়া যেতে পারে। খ. সংশ্লিষ্ট বিসয়ে যে বহু বিভিন্ন মত রয়েছে তা মন্থন করা, যেন তন্মধ্যে অগ্রাধিকার পাওয়ারযোগ্য মত সহজেই জানতে পারা যায়। তা হবে শরীয়াতের অকাট্য দলিলভিত্তিক এবং বর্তমান সময়ের ও প্রয়োজনের দৃষ্টিতে মুসলিম জনগণের পক্ষে কল্যাণকর, তা ব্যক্তির সীমিত শক্তিসামর্থ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। গ. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেসব নতুন প্রশ্ন, সমস্যা ও ঘটনা দেখা দিয়েছে, যার সাথে প্রাচীনকালীন আলিমগণ আদৌ পরিচিত ছিলেন না—সেই সব বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করা। কেননা এ সব এমন গুরুত্বপূর্ণ যে, সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণ সে সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও নিঃসম্পর্ক হয়ে থাকতে পারেন না। ঘ. ‘ইসলামী কর’ হিসেবে যাকাতের মর্মকথা স্পষ্ট করে তোলা। সেই সঙ্গে তার ও আধুনিককালে আরোপিত করের মধ্যে তুলনা করা। এ দুয়ের মাঝে যে সাদৃশ্য বা বৈপরীত্য রয়েছে, তা ব্যক্ত করা। ঙ. মুসলিম সমাজ জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও ফলশ্রুতি বর্ণনা করা। মুসলিম সমাজের দারিদ্র্য, নিঃস্বতা, ভিক্ষাবৃত্তি, আকস্মিক বিপদ-আপদ ও ঘটনা-দুর্ঘটনা প্রভৃতি সমস্যার সমাধান করা, সেই সঙ্গে একালে প্রকাশিত বিভিন্ন সামষ্টিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাসমূহ কার্যকর করা। চ. ‘যাকাত’কে কেন্দ্র করে যে সব ভুল চিনাতা-ধারণা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে তার পরিশুদ্ধিকরণ। বুল বুঝ্-সমঝ ও তাকে ভুল ভাবে প্রয়োগই হল এর কারণ অথবা ইসলামের দুশমনদের উত্থাপিত সন্দেহগুলোর দরুনই তা হয়েছে। বস্তুত এ সব কাজ সম্মুখে রেখেই উপরিউক্ত আলোচনা-সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলও কাজ করেছে। আমি মনে করি, তাতে যথেষ্ট সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। [(আরবী*********)] আলোচনার পদ্ধতি ও ধরণ সম্মুখবর্তী আলোচনায় যে পদ্ধতিটি অনুসৃত হয়েছে ও যে দৃষ্টিকোণ অবলম্বিত হয়েছে তা এখানে স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে: ১. মৌল-উৎস নির্ধারণ তত্ত্ব সগ্রহ এ পর্যায়ে আমার প্রথম কাজ ছিল কাঙ্ক্ষিত তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করা। অন্য কথায় প্রস্তাবিত আলোচনার জন্যে যে সব দলিল-প্রমাণ এবং উক্তি জরুরী তা প্রাচীন ও আধুনিক উৎসমূহ থেকে সংগ্রহ করে সম্মুখে রাখা। এই দলিল-প্রমাণ ও উক্তি যেমন শরীয়াহ থেকে সংগৃহীত, তেমনি মনীষীদের লিখিত গ্রন্থাদি থেকেও। এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ্র অকাট্য দলিলসমূহ (Wordings)। কেননা যাকাতের মর্মকথা, তার নিয়ম ও আইন-বিধান এবং তার লক্ষ্য, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তা-ই হচ্ছে প্রথম ভিত্তি। বস্তুত এই আলোচনায় তত্ত্ব ও তথ্যের উৎস বিপুল ও অফুরন্ত। বিভিন্ন সময়ে লিখিত তাফসীর গ্রন্থসমূহ এ পর্যায়ে বড় অবলম্বন। এই তাফসীল দুই ধরনের।একধরনেরতাফসীল আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। অপর এক প্রকারের তাফসীর লেখকের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা-গবেষণার ফসল উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে কুরআন মজীদের আইন-বিধান পর্যায়ের আয়াতসমূহের তাফসীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। হাদীসের গ্রন্থসমূহ: হাদীসের মূল বর্ণনা, তার ব্যাখ্যাসমূহ, বিভিন্ন বর্ণনা, তাতে প্রযুক্ত বুদ্ধিমত্তা, হাদীসের সমালোচনা-পর্যালোচনা—সহীহ বা অ-সহীহ নির্ধারণ। যেসব হাদীস গ্রন্থে ফিকাহ্র দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা (আরবী*********) ও এই দুখানি হাদীস সংগ্রহ এবং ব্যাখ্যা পুস্তক। বিভিন্ন মাযহাবের ফিকাহ্র কিতাব এবং তুলনামূলক মাযহাবী ফিকাহ্র কিতাব। বিশেষ করে ফিকাহ্র যেসব গ্রন্থে বিশেষ মাযহাবের দলিলাদী উদ্ধৃত হয়েছে, বিরোধী মতের দলিলাদি রদ করা হয়েছে, আইন-প্রণয়নের মৌলনীতি ও ফিকাহ্ শাস্ত্রের কায়দা-কানুন সংক্রান্ত কিতাবাদিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামী অর্থশাস্ত্র ও প্রতিষ্ঠানাদি সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী: এ পর্যায়ে ইমাম আবূ উবাইদ আর-কাসেম ইবনে সালাম ইসলামী সামাজিক বিধান আলোচিত হয়েছে, তেমনি ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈাতিক ব্যবস্থা পর্যালোচিত হয়েছে। এ ছাড়া সাহায্যকারীগ্রন্থাদিতো রয়েছে বিপুল সংখ্যক অভিধান, ইতিহাস, জীবনচরিত, বিশ্বকোষ ও গ্রন্থাদির তালিকাপ্রভৃতি বিশেষ কাজ দিয়েছে। এসব প্রাচীন ও এ কালের লিখিত গ্রন্থাদি থেকে আমিযা-ই উদ্ধৃত করেছি, মূল আলোচনা ব্যপদেশে তার উল্লেখ করেছি। অথবা সেই পৃষ্ঠার টীকায় তার নাম, পৃষ্ঠা ও গ্রন্থকারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এমন সব গ্রন্থাদিরও সাহায্য গ্রহণ করেছি যা লেখক সমাজের কাছে সাধারণভাবে পরিচিত নয়। এক স্থানে যে গ্রন্থের নামের উল্লেখ করা হয়েছে, পরবর্তী স্থানে সেই কিতাবের আসল নাম অথবা তা বোঝা যায় এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অনৈক সময় ছোট অথচ প্রখাত উক্তিও উদ্ধৃত করা হয়েছে কিন্তু তার উৎসের উল্লেখের প্রয়োজন মনে হয় নি। আর তা অত্যন্ত বিরল এবং মূলসিদ্ধান্ত তার উপর নির্ভরশীলও নয়। আমাদের পূর্বকালীন লেখকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে, যার উক্তিরই উল্লেখ করা হোক তার সঙ্গে আসল উক্তিকারীর নামের উল্লেখ করাই বাঞ্ছনীয়। তাঁরা বলেছেন: (আরবী*********) যার কথাই উদ্ধৃত করা হোক তা তার নামে উল্লেখ করাতেই বরকত রয়েছে। এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, এই আলোচনার একটা মহামূল্য অবদান হল ধন-সম্পদ ও অর্থনীতি সংক্রান্ত অধ্যয়নের বদ্ধ দুয়ার আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে। আমি এই বিষয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার ইচ্ছায় নিভৃত একাকীত্বে মগ্ন হয়েছিলাম। ফলে এ পথে আমি ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা-অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়েছি। তার নিদর্শনাদি আমার কাছে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। তার প্রাথমিক তথ্যাবলী এবং সমর্থখ তথ্যাদিও আমার চোখের সম্মুখে উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এগুলো আমি স্বতন্ত্র একখানি গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি। সেই গ্রন্থের নাম (আরবী*********) (দারিদ্র সমস্যা ও তার ইসলামী সমাধান)। ২. আলোচনার বন্টন ও তার বিভিন্ন বিন্যাস বিষয়বস্তুর প্রকৃতি, তার বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমস্যাদির পূর্ণাঙ্গতা বিধানের দৃষ্টিতে এগুলোকে বিস্তীর্ণ প্রেক্ষিতে গ্রহণ করা হয়েছে। কেননা এর এক অংশ অপর অংশের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমি আমারসীমিত সাধ্যানুযায়ী এইমহান ইসলামী বিষয়টিকে একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি সংগ্রহ করে দিতে চেষ্টানুবর্তী হয়েছি। এইকারণে প্রতিটি আলোচনাই অপেক্ষাকৃতভাবে দীর্ঘায়িত হয়েছে। এই গোটা আলোচনা নয়টি অধ্যায় ও একটি উপসংহারে বিভক্ত। অধ্যায়সমূহের বিন্যাস যুক্তসঙ্গতভাবেই করা হয়েছে। প্রথমে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কিত আলোচনা, পরে যাকাত কার উপর ফরয হয়, সেইআলোচনা—অতঃপর কিসে কিসে ও কতটা পরিমাণ ফরয তার বর্ণনা; এই যাকাত কার জন্যে ব্যয় করা হবে, কার জন্যে তা গ্রহণ করা হারাম, তার বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে যাকাত আদায় করার পন্থা এবং তার লক্ষ্য ও ফলাফল। ফিতরের যাকাত পর্যায়ের আলোচনা এরপর এসেছে। যাকাত দেয়ার পর ব্যক্তির ধনমালের উপর অপরাপর যেসব অধিকার ধার্য হয় এবং যাকাত ও আধুনিক কালে ধার্য করা। কর বা খাজনা ইত্যাদির মধ্যকার সম্পর্ক, সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য পর্যায়ের আলোচনাও পেশ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়: এ পর্যায়ে যাকাত ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা দেখিয়েছি, সব ধর্ম ব্যবস্থায়ই গরীব ও দুর্বল-অক্ষমদের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম মক্কী স্তর থেকেই এ ব্যাপারে খুব বেশী গুরুত্ব সহকারে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। আর মদীনা শরীফে সুনির্দিষ্টভাবে যাকাতের বিধান কার্যকর হয় এবং তার সাহায্যে সমাজের দরিদ্রদের অভাব পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ইসলামের এই ব্যবস্থা যেমন অভিনব, তেমনি বিরল। এর পূর্বে কোন ধর্ম বা রাষ্ট্র বিধান এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নি। দ্বিতীয অধ্যায়: যাকাত কার ওপর ওয়াজিব, তা এই পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বালক ও পাগলের ধন-সম্পদে যাকাত ধার্য হওয়ার ব্যাপারটি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। অমুসলিমের কাছ থেকে যাকাত আদায় করা যায় কিনা, এ প্রশ্ন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়: যাকাতের পাত্র ও পরিমাণ অর্থাৎ পশু সম্পদ, নগদ অর্থ, ব্যবসায় পণ্য, কৃষি ফসল, খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, মধু ইত্যাদি প্রাণিজ সম্পদ প্রভৃতি থেকে যাকাত ফরযহওয়ার পরিমাণ আলোচিত হয়েছে এই অধ্যায়ে। শস্যোৎপাদনের প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী মূলধন গড়ে তোলা, অনুরূপভাবে শ্রেণীভিত্তিক মজুরী ও স্বাধীন জীবিকা গ্রহণের উপযোগী লোক সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা সেই সঙ্গে রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়: কুরআন মজীদে যাকাত ব্যয়ের যে আটটি ক্ষেত্রের উল্লেখ রয়েছে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও পর্যায়ে দেয়া হয়েছে। কোন্ ক্ষেত্রে কত ব্যয় করা হবে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে সমান পরিমাণ ব্যয় করা হবে কিনা? কাদের জন্য কত যাকাত ব্যয় করা যাবে না, এ সব বিষয়ের আলোচনা। পঞ্চম অধ্যায়: যাকাত আদায় করার পন্থা, যাকাতের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, যাকাত আদায়ে ত্বরিত পন্থা বিলম্বিতকরণ, তা এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিতকরন, যাকাতের দূল্য দান ও এতদ্সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়: যাকাতের লক্ষ্য ও ফলাফল, দাতা, গ্রহণকারী ও গোটা সমাজের প্রেক্ষিতে যাকাতের লক্ষ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সমাজের বড় বড় সমস্যার—যেমন বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, আকস্মিক ঘটনা-দুর্ঘটনা, ঝগড়া—বিবাদ, নিঃস্বর্তা—সর্বপরি দরিদ্র্য সমস্যার সমাধানে যাকাতের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়: ফিতরের যাকাত (ফিত্রার সাদকা) ও তার আইন-বিধান আলোচিত হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়: যাকাত আদায় করার পরও ব্যক্তির ধন-মালে অন্যান্য যেসব অধিকার ধার্য হয়—এর পক্ষের মত ও বিপক্ষের মত এবং উভয় পক্ভের দলীল—প্রমাণ পর্যায়ে আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। উক্ত দুই পক্ষের মতবিরোধের মূল স্থান বা কারণ নির্ধারণ এবং একটি মতের অগ্রাধিকার দান সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। নবম অধ্যায়: যাকাত ও কর সম্পর্কে আলোচনা। যাকাত তার প্রকৃতি ও ভিত্তির দিক দিয়ে এক বিশেষত্ব সম্পন্ন ও বিশিষ্ট কর হওয়ার আলোচনা। তার মৌলনতি (Principle) নিরাপত্তামূলক অবদান ও লক্ষ্য, তার মৌলনীতি ও বিধি-বিধান, আধুনিক ‘কর’ সংক্রান্ত চিন্তার পরিণতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। নিয়ম-বিধান, লক্ষ্য ও নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক কর ব্যবস্থা যা করতে অক্ষম রয়ে গেছে, যাকাত তা করতে সক্ষম হয়েছে। এ পর্যায়ে যাকাত গ্রহণের ব্যবস্থা কার্যকর করার পর বিভিন্ন খাতে ‘কর’ গ্রহণকে শরীয়াত জায়েয মনে করে কিনা, আর যাকাত দিয়ে দিলে বিভিন্ন প্রকারকর দেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কিনা—এ আলোচনার নবম অধ্যায়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে। উপসংহার: এ পর্যায়ে যাকাত ব্যবস্থার মর্মকথা সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে। এতে যাকাত সম্পর্কে বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম লেখকদরে সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সাথে সুবিচার, সাম্য ও সমাজবধ্য লোকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় যাকাতের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই সব আলোচনা মিলিয়ে ‘যাকাত’ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত বিষয়কে একত্র ও সম্পূর্ণ করা হয়েছে। যাকাতের মৌল নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান এবং লক্ষ্য ও ফলাফল বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। আলোচনার এ হচ্ছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: ৩. তুলনামূলক আলোচনা তার দুটি রূপ রয়েছে: প্রথম. ইসলামের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন মতের পারস্পরিক তুলনা করা। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও দলিল-প্রমাণের দিক দিয়ে সর্বাধিক শক্তিশালী মত সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করে তোলা। দ্বিতীয়. ইসলামী শরীয়াত ও অন্যান্য শরীয়াতের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা। এই অন্যান্য শরীয়াতের মধ্যে যেমন কতিপয় আসমানী ধর্ম রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের গড়া কতিপয় বিধান ও ব্যবস্থা। তার কতিপয় প্রাচীণ এবং কয়েকটি নতুন—এ কালের রচিত। এর ফলে আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ শরীয়াতের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব অপরাপর বাতিলকৃত আসমানী শরীয়াতের অপেক্ষা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানব-রচিত মতবাদের অক্ষমতা ও সম্পূর্ণতাও প্রকট হয়ে উঠেছে। ইসলামের ভিতরকার মাযহাবসমূহের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে আমি কেবল চারটি প্রখ্যাত মাযহাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিনি। কেননা তা ইসলামী ফিকাহ্র অন্য সমস্ত বড় বড় মাযহাব ও মতের প্রতি অবিচার করা হত। এই আলোচনায় সাহাবী, তাবেয়ীন ও তৎপর্বী ফিকাহ্বিদদের মাযহাবের উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা সেই মাযহাব ও মতকে উপেক্ষা করা ও তা থেকে ফায়দা গ্রহণ না করা, না শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েজ হতে পারে, না বিবেক-বুদ্ধির দৃষ্টিতে। সাহাবিগণের মর্যাদা ও ইলমী বিশেষত্ব সম্পর্কে কোন মতদ্বৈধতার অবকাশ নেই। তাঁদের বাদ দিলে সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, উমর ইবনে আবদুল আজীজ, জুহরী, নখয়ী, হাসান, আতা, শাবী, মাইমুন ইবনেমিহরান প্রমুখ প্রধান তাবেয়ীনের মাযহাব আমাদরে সামনেআসে। আ তাদের পরবর্তীদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা দেখতে পাই—ইমাম সওরী, আওযায়ী, আবূ উবাইদ, তাবারী ও দাউদ জাহেরী প্রমুখ ফিকাহ্বিদকে। এ মনীষীদের মত ও উক্তি ইসলামী জ্ঞানসমুদ্রে মহামূল্য সম্পদ। তা বাদ দিলে যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে মহা ভুল করা হবে, তেমনি দ্বীন-ইসলামেরও বড় ক্ষতি সাধিতহবে। আমি ‘শিয়া’ মাযহাবকেও বাদ দিইনি। সেখানে ‘যায়দীন’ ও ‘ইমামীয়া’ ফিকাহ্ বর্তমান রয়েছে। আমার জানামতে আমাদের ও এঁদের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য শুধু খুঁটিনাটি ব্যাপারে এবং তা সামান্য। শেষের দিকের দুজন মনীষীর নীতি আমি অধ্যয়ন করেছি। তাঁরা হলেন, ‘সুবুলুসসালাম’-এর (আরবী*****) লেখক ইমাম সান্য়ানী এবং ‘নায়লুল আওতার’-এর )আরবী****) গ্রন্থকার শওকারী। দুজনই অতি বড় মুহাদ্দিস। তাঁরা নিজ নিজ গ্রন্থে ‘যায়দীয়া’ ও ‘ইমামীয়া’ মাযহাবের উল্লেখ করেছেন। আল-হাদী, আল-কাসেম, আল-বাক্কের, আন-নাসের প্রমুখ এই শোষোক্ত মাযহাবদ্বয়ের ইমাম। আহলে সুন্নাতের আলিমএঁদের মতকে খুববেশী উল্লেখ ও ব্যবহার করছেন এবং তাতে তাঁরা কোন দেখতে পান নি। ইসলামী ফিকাহ্-বহির্ভূত মতসমূহের তুলনামূলক আলোচনায় আমরাযাকাত ও প্রাচীন ধর্মসমূহ প্রবর্তিত দানসমূহের মধ্যে তুলনা করেছি। আধুনিককালে যে সম্পদে কর ধার্য হয়, তার ও যাকাতের মধ্যকার পার্থক্যও স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এ কালের বড় অবদান যেসামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তার সাথে যাকাতের তুলনামূলক আলোচনাও আমরা উপস্থাপিত করেছি। ৪. ব্যাখ্যা ও কারণ প্রদর্শন প্রতিটি ব্যাপারে শুধু শরীয়াতের বিধান বা হুকুম উল্লেখ করেই আমি ক্ষান্ত হইনি—তাকেই যথেষ্ট মনেকরিনি। তার পশ্চাতে যে যৌক্তিকতা ও বুদ্ধিমত্তা নিহিত, তারও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে চেষ্টা করেছি। শরীয়াতে যা ওয়াজিব বা মুস্তাহাব ঘোষিত হয়েছে কিংবা যা নিষিদ্ধ হয়েছে বা অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছে, তার মূলে নিশ্চয়ই একটা তত্ত্বগত দিক রয়েছে। সেইদিকের উন্মোচন না হলে তার সৌন্দর্য অনুধাবন সম্ভব হয় না। শরীয়াতের বিধানদাতার নিজের অনুসৃত এই পন্থাকে আমরা অনুসরণ করেছি। বিধি-বিধানের মূলগত কারন, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, ব্যক্তি বা সমষ্টিগতভাবে মানুষের জন্যে তার কল্যাণ প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। কেবল শরীয়াত পালনের দায়িত্ব ও নির্মম কর্তব্যের কথা বলে দিয়েই ক্ষান্ত হতে চেষ্টা করিনি। ঈমানের তাকীদে শরীয়াতের সর্বপ্রকার আদেশ-নিষেদ অবশ্যই পালন করতে হবে—তার যৌক্তিকতা কেউ বুঝুক আর না-ই বুঝুক, এই নীতিকে সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হয়েছে। শরীয়াতের অন্তর্নিহিত যুক্তি ও সৌন্দর্য বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা সর্বাবস্থায়ই যখন অতীব বাঞ্ছনীয় ও মঙ্গলময় কাজ, তখন এ কালে তার অপরিহার্যতা তো শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশ্চাত্য বিপর্যয়কারী চিন্তাধারা, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী চিন্তা-প্রবাহ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে আগত সাংস্কৃতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে তার আরও বেশী প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। কাজেই একদিক থেকে শুধু বিধান ঘোষণা ও অপর দিক থেকে ‘শুনলাম ও মানলাম’ বলে মাথা নত করে দেয়া বর্তমান যুগে কোনক্রমেই যথেষ্ট হতে পারে না। ৫. যাচাই ও অগ্রাধিকার দান আলোচনাকারীকে অবশ্যই সমগ্র উৎসকে মন্থন করতে হবে। বিষয় সম্পর্কিত সমস্ত উক্তি, দলীল-প্রমাণ উল্লেখ এবং সে সবের মধ্যে তুলনা ও যাচাই করা আবশ্যক।কেননা সেযদি বিশেষ একটি কথায় বন্দী হয়ে পড়ে বা বিশেষ একটি মাযহাবের অন্ধ অনুসারী হয়ে থাকে, তাহলে তার সমস্ত চেষ্টা-সাধনা-গবেষণা এই মাযহাবের সমর্থন ও শক্তি বর্ধন এবং তার বিপরীত মাযহাবের প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে যাবে। প্রকৃত কল্যাণে উপনীত হওয়া তার পক্ষে সম্ভবপর হবে না। এই কারণে আমি আমার গর্দান বিশেষ একটি মাযহাব ও তার অন্ধ অণুসরণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নিয়েছি। তবে এই ব্যাপারটি অতীব নতুন বলা চলে। প্রাচীনকালের লোকেরা এর সাথে পরিচিত ছিলেন না। আর বস্তুতই যদি কেউকোন বিশেষ ফিকাহ্বিদকে প্রতিটি বিষয়ে ও ক্ষেত্রে তার দলীল দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অনুসরণকরে, তাহলে সে তাঁকে ‘শরীয়াত-দাতা’ রূপে মেনে নিল। অথচ শরীয়াতদাতা আল্লাহ এবং রাসূল ছাড়া আর কেউই নন। পরন্তু অন্ধ অনুসরণে বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল ও নিষ্ক্রিয় করে দিতে হয়। কিন্তু তা কোনক্রমেই উচিত হতে পারে না। ইমামইবনুল জাওজী বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে চিন্তা-বিবেচনা ও ভাল-মন্দ বিচারের যোগ্যতাদিয়ে সৃষ্টি করেছেন (উদ্দেশ্যহচ্ছে, এগুলোকে সে পুরোপুরি কাজে লাগাবে)। কাজেই যে লোককে আলোকবর্তিকা দেয়া হয়েছে আর কেউ হতে পারে না। অন্য মনীষীদের উক্তি হচ্ছে, অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলে সে, যে বরম বিদ্বেষী অথবা নিতান্তই বুদ্ধিহীন। এই প্রেক্ষিতে বলতে চাই, আমি বিভিন্ন মনীষীর উক্তি ও দলীল-প্রমাণসমূহ একজন অন্ধ অনুসরণকারীর মনোভাব নিয়ে পাঠ করিনি পাঠ করেছি অনুসন্ধনকারী, সত্যানুসন্ধিৎসু ও যাচাই-পরখকারীর দৃষ্টিতে। বস্তুত, সত্যের আবিষ্কারকামী পরোয়া করে না কোথায় সে সত্য পাওয়া গেল, কার সঙ্গে চলে তা পাওয়া গেল। সে তা পেতে পারে আগের কালের লোকদের কাছে, পেতে পারে পরে আসালোকদের কাছে। অনেক সময় প্রকৃত সত্য পাওয়া যায় স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের কাছে, আধুনিক কালের অথবা হাদীসবিদদের কাছে। কখনও জাহেরী ফিকাহ্বিদদের কাছে, চারটি প্রখ্যাত মাযহাবেও তা পাওয়া যেতে পারে। অপরাপর ইমামগণের কাছেও সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না, এমন কথাও নয়। বিদ্বেষপরায়ণ, সংশয়বাদী ও প্রতিটি প্রাচীন মতে অবিচল হয়ে থাকা লোকদের পথে আমি চলিনি। যারা মনে করে, চারজন প্রখ্যাত ইমামের পরে আর কোন ‘ইমাম’ আসেনি, আমি তাদের সাথেও একমত নই। প্রথম যুগের ইজতিহাদের দ্বার চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথাও আমি সমর্থন করি না; পরবর্তীকালে তাক্লীদকারী ফিকাহ্বিদ ছাড়া আর কারোর কাছে ইল্মনেই, যারা তাদের বিপরীত মত গ্রহণ করেতারা তাদের সাথে শত্রুতা করে—এরূপ গোঁড়ামী মনোভাবকে আমি কল্যাণকর মনে করতে পারিনি। এতদ্সত্ত্বেও আমি সেসব আত্মাভিমানী লোকদের দলভুক্ত নাই, যারা ইজতিহাদের যোগ্যতা ছাড়াই এক-একজন বড় মুজতাহিদ হওয়ার দাবিতে মুখর। সেসব নতুনত্ব বাদীদেরও আমি সমর্থন করি না, যারা নুতন দ্বীন, নতুন ভাষা-পরিভাষা এবং নতুন চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টির অহমিকায় দিশেহারা। জ্ঞান-চর্চা ও সত্যানুসন্ধানে আমি সম্পূর্ণ মধ্যমও ভারসম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বনকরে চলেছি। যে কোন কল্যাণময় নতুনকে আমি স্বাগত জানাই। যে কোন নির্ভুল পুরাতনকে গহণ করতে আমি সতত উদগ্রীব। প্রাচীন গ্রন্থাদির হরিং বর্ণ মুদ্রণ বিভ্রাট আমাকেতা পাঠ করতে বাধাগ্রস্ত করেনি। বরং আমি তার গভীরে তলিয়ে সত্য উদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছি। এক কথায়, পুরাতন ও নতুন উভয় ধরনের জ্ঞান-ভান্ডার থেকেই আমি তত্ত্ব ও তথ্য-সুধা আহরণ করেছি। তাতে কোন কুণ্ঠা বা সংশয় আমার গতিকে শ্লথ করতে পারেনি। উভয় ক্ষেত্রেই আমার ভূমিকা হচ্ছে মূল আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান তথ্য বাছাই-ছাঁটাইকারীর মত। ভাল ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে, অকাতরে ও অকপটে তা তুলে নিয়েছি। যা অপ্রয়োজনীয় আবর্জনাবৎ, তা পরিহার করে সম্মুখে চলে গেছি। সংগৃহীত সম্পদ যাচাই ও তুলনা করে দেখেছি। ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করছি। যার কথার যৌক্তিকতা আমার কাছে প্রকট ও অকাট্য প্রমাণিত হয়েছে, তা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হইনি। কোনরূপ বিদ্বেষার্ত মনোভাব আমার মনে ছিল না—কোন মুনির কথার প্রতি, কোন ইমামের মাযহাবের প্রতি। একটি বিষয়ে আমি যদি ইমাম আবূ হানীফার মত গ্রহণ করে থাকি, তাহলে অপর ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছি ইমাম মালিকের মত। তৃতীয় ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ী, সুফিয়ান, আহমদ, আওযায়ী, আবূ উবাইদ বাতাঁদের পূর্ব কিংবা পরবর্তী কোন ইমামের মত। কেননা তাঁরা প্রত্যেকেই কোন সাহাবী কিংবাকোন তাবেয়ী’র সহীহ্ মতকে গ্রহণ করেছেন বলে আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস। আমার এ নীতিকে মিথ্যা দ্বারা সজ্জিতকরণ (Embishment) বা জাল দলীল উদ্ভাবন (Fabrcate) অথবা ‘সহজিয়া’ নীতি বলে অভিহিত করা (ও তাই এর নিন্দা করা) চলে না। কেননা আসলে এ নীতির সারবত্তা হচ্ছে, ‘দলীল-প্রমাণের অনুসরণ, যেখানেই তা পাওয়া যাক। কোন লেখক-চিন্তাবিদেরই কেবলমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ্ ব্যতিরেকে অপর কোন মতের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা উচিত নয়। হযরত ইবনে আব্বাস, আতা ও মালিক প্রমুখ থেকে বর্ণিত: (আরবী***********) যে কারোরই কথা যেমন গ্রহণ করা চলে তেমনি তা প্রত্যাখ্যান করাও চলে। তবে রাসূলে করীম (স)-এর কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাকে কোন কোন বিষয়ে কোন পরিত্যক্ত ও অপ্রখ্যাত উক্তি বা মত গ্রহণ করতে হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বহুসংখ্যকের মতকেও অগ্রাহ্য করতে হয়েছে। কেননা বেশী লোক বললেই যে একটা কথা অকাট্য সত্য হয়ে যাচে—এ কোন কথা নয়। তেমনি কম লোকে বললে কথাটি মিথ্যা বলে মনে করতে হবে, তার পেছনেও কোন যুক্তি নেই। দুনিয়ায় এমন ফিকাহ্বদি রয়েছেন, যাঁদের কথার সমর্থনে অকাট্য যুক্তি থাকলেও তাতে তিনি এককই রয়ে গেছেন। অল্পসংখ্যক লোকের মতের ক্ষেত্রে সর্বত্র এরূপই অবস্থা দেখা গিয়েছে। কিন্তু আমি তার পরোয়া করিনি। পরোয়া করব কেন? আমি অনেক বড় বড় ইমামকে দেখেছি, তাঁরা নিজ নিজ মতের উপর একক ও অনন্য হয়েই অবিচল হয়ে রয়েছেন; যদিও অধিকাংশ লোক তাঁর বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর কথাই ধরুন, তিনি বলেন: একটি ব্যাপার যা আল্লাহর কিতাবে নেই, রাসূলে করীম (স)-এর ফয়সালাতেও পাওয়া যায় না। অথচ তোমরা দেখবে, সব লোকই তা গ্রহণ করেছে। তাহলে মৃতের শুধু কন্য থাকলে তার বোনও মীরাস পায়। [(আরবী*********)] সমস্ত মানুষ এ মতকে নিজের বিরুদ্ধে দলীলরূপে মনে করেনি। ইমাম মালিক (র) ফতোয়া দিয়েছেন যে, ফল-পাকুড় বিক্রির ক্ষেত্রেও শুফ্ফা (Pre-emption) কার্যকর হবে। পরে তিনি বলেছেন: ‘এ এমন একটা ব্যাপার যা আমি কখনও শুনিনি কিংবা অপর কেউ এ মত দিয়েছেন—এমন খবরও আমার কাছে পেটৗঁছায়নি।’ [ঐ, পৃষ্ঠা ৫৪২] প্রত্যেক ইমামেরই এমন বহু ব্যাপার ছিল, যে সম্পর্কে তাঁরা একান্ত নিজস্ব মত পোষণ করে গেছেন। অপর কেউই তাঁদের সমর্থন করেনি। তাতে তাঁরা কোন দোষই মনে করেন নি। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের এরূপ একক ও অন্যদের অসমর্থিত বহু মতকে একত্রিত করে একখানি বিশেষ গ্রন্থও রচিত হয়েছে। গ্রহণ, অগ্রাধিকার ও সত্য নির্ধারণে অবলম্বিত নিয়ম নীতি বক্ষমাণ আলোচনা বহু মৌলনীতি সমষ্টির উপর প্রতিষ্ঠিত। দৃষ্টিতে যা স্পষ্ট প্রতিভাতক হয়ে উঠেছে তা অবলম্বন বা গ্রহন, বিভিন্ন মতদ্বেধতা সম্পন্ন নিয়ম-বিধানের একটিকে অগ্রাধিকার দান এবং ইজতিহাদী কার্যক্রমের সাহায্যে সম্পূর্ণ নতুন বা প্রায় নতুন কোন মত উদ্ভাবনের একটা শরীয়াতী নিয়ম রয়েছে। এসব নিযম-নীতিকে আমরা মোটামুটিভাবে উল্লেখ করছি: ১. দলীলকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ—যতক্ষণ বিশেষ অর্থে গ্রহণের কোন দলীল পাওয়া না যায় বস্তুত দ্বীন-ইসলামের বহু দলীলই সাধারণ অর্থবোধক শব্দ সহকারে এসেছে, যেন তার তাৎপর্যের ব্যাপকতায় বহু একক ও খুঁটিনাটি ব্যাপারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। দ্বীন-ইসলাম যে শাশ্বত ও চিরন্তন এবং তা সর্বকালে সকল স্থানেই সমানভাবেই প্রযোজ্য, এটা তার একটা অকাট্য প্রমাণ। এ কারণে আমি মনে করি, কুরআন মজীদের আয়াতে এবং রাসূলে করীম (স) –এর হাদীসে সাধারণ অর্থবোধক যে শব্দ, এত সাধারণভাবে প্রযোজ্য যেসব বিধান এসেছে, সেসব সেভাবেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সাধারণ তাৎপর্যের প্রেক্ষিতেই তার প্রয়োগ হওয়া উচিত। তবে কোন বিশেষ নির্ভুল অকাট্য দলীল যদি তা থেকে বিশেষ অল্থ ও তাৎপর্য গ্রহণে বাধ্য করে, তা হলে তখন আমরা সে সাধারণ অর্থ ও তাৎপর্য পরিহার করে বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্যই গ্রহণ করব। সহীহ সুন্নাতের সুন্দর জাহেরী তাৎপর্য এবং সাধারণ তাৎপর্যকে উপস্থাপক আয়াতসমূহ যারা প্রত্যাখ্যান করেন, আমিতাদের সাথে একমত নাই। যাঁরা হাদীসের সাহায্যে কুরআনের সাধারণ তাৎপর্যকে বিশেষ তাৎপর্য়য পরিণত করেন, তাঁদের নীতিকেও আমি সমর্থন করতে পার না। যদিও তাঁর সনদে নমনবীয়তা আছে অথবা কোন সহীহ্ হাদীস দ্বারাও বিশেষ অর্থ গ্রহণের দিকে নিয়ে যেতে চাই না—যদিও তাঁর ইঙ্গিতে দুর্বলতা বা স্পষ্টতা বিদ্যমান। ইমাম আবূ হানীফঅ (র) একটি হাদীস গ্রহণ করতে রাযী হন নি। হাদীসটি হল এই: (আরবী**********) পাঁচ ওয়াসেক্ (একটা বিশেষ পরিমাণ) খেজুরের কম পরিমাণে যাকাত নেই। তিনি মনে করেন কুরআনের আয়াত: (আরবী**********) যমীন থেকে যা-িই আমরা উৎপাদন করে দিয়েছি (তারই ‘ওশর’ দিতে হবে) এবং (আরবী************) আকাশের বর্ষণে যে ভূমিই সিক্ত হয়, তার ফসলের ‘ওশর’ (দশ ভাগের এক ভাগ) ধার্য হবে। সাধারণ বিধান উপস্থাপক ও হাদীসের ভিত্তিতে প্রথমোক্ত হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেনছেন এবং সকল পরিমাণের ফসলের উপরই যাকাত ফয বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখানে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মত গ্রহণ করতে পারিনি। কেননা উক্ত হাদীসটি সহীহ্ এবং বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত। আর এ কথা বলে তার ব্যাখ্যা দেন যে, ব্যবসায়ের জন্যে খেজুর নির্দিষ্ট হলে তখন হাদীসটি প্রযোজ্য হবে, তা যেমন দুর্বল ব্যাখ্যা, তেমনি অ-অগ্রাধিকারদানযোগ্য, বরং ভুল। এ কারণে ইমাম আবূ হানীফা (র)-র মত গ্রহণ না করে এ পর্যায়ে ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ এবং অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত গ্রহণ করেছি। ফলে জ মি যে ফসলই দেয় তাতে যাকাত ধার্যকরণে আমি নিসাব (নিম্ন পরিমাণ) নির্ধারণ করার প্রয়োজন মনে করেছি—যেমন অন্যান্য স ধরনের ধন-মালের ক্ষেত্রে নিসাব ধার্য হয়ে থাকে। আর ধনশালী ব্যক্তিদের উপর যাকাত ফরয করার মূলে যে যৌক্তিকতা আমার এ মত তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। তবে ইমাম আবূ হানীফা (র) উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসের যে সাধারণ তাৎপর্য গ্রহণ করেছেন, তাতে আমি তাঁর মত সমপূর্ণ সমর্থন করছি এবং তাৎপর্যের এ সাধারণতাকে (আরবী*********) ‘শাক-সব্জিতে যাকাত হয় না’ এ হাদীসের তাৎপর্য দ্বারা বিশেষ অর্থে গ্রহণ করি না কেননা হাদীসটি খুবই দুর্বল। তবে তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে এই অর্থে যে, তাতে যাকাত হয় না যা সংগ্রহকারীরা গ্রহণ করতে পারে। কেননা তা তো খুব শীঘ্রই বিনষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিস (Perishable goods)। বায়তুলমালে তা টিকে থাকতে পারে না। অতএব জন্তু ও ফসল ইত্যাদির ন্যায় তা গ্রহণ করার বিধান শরীয়াতে দেয়া হয়নি। এগুলোর ওয়াজিব হওয়াটা পূর্বোক্ত সাধারণ অর্থবোধক শব্দ দ্বারা প্রত্যাহৃত হয়ে যায়নি। কুরআন ও সুন্নাহতে যে সাধারণ তাৎপর্যসম্পন্ন বিধান ও ব্যবস্থা রয়েছে, তা ঠিক অনুরূপ মর্যাদা সহকারেই মেনে নেয়া উচিত, যতক্ষণ না বিশেষ অর্থ গ্রহণে বাধ্যকারী কোন সহীহ্ দলীল পাওয়া যাবে। এ প্রেক্ষিতে যে সব আয়াত ও হাদীস সাধারণভাবে সর্বপ্রকারের ধন-মালে যাকাত ফরয ঘোষণা করেছে, আমরা সেগুলোকে সেই সাধারণ অর্থেই গ্রহণ করেছি। যেমন আল্লাহর নির্দেশ: (আরবী*********) ধনী লোকদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর। (আরবী*********) তাদের ধন-মালে সুনির্দিষ্ট হক রয়েছে। নবী করীম (স)-এর কথা: (আরবী*********) তোমরা তোমাদরে ধন-মালের যাকাত আদায় করে দাও। এসব সাধারণ তাৎপর্যমূলক আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধন-মালের মধ্যে পার্থক্য বা তারতম্য করা যায় না। এ সাধারণ তাৎপর্য থেকে বাইরে রাখব শুধু তা-ই, যে সম্পর্কে অকাট্য ও সহীহ্ দলীল পাওয়া যাবে। ২. সুদৃঢ় ইজমার প্রতি সমর্থন প্রদর্শন যেহেতু শরীয়াতের কোন বিশেষ হুকুমের ব্যাপারে গোটা মুসলিম উম্মতের আলিমগণের, বিশেষ করে, প্রাথমিক যুগে—ঐকমত্য হওয়া স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি যে বিষয়ে ঐকমত্য পৌঁছেছেন সে বিষয়ে শরীয়াতের সহীহ্ দলীল বা সার্বিক কল্যাণবোধ অথবা অনুভবযোগ্য কোন ব্যাপারের ভিত্তিতে করেছেন। তাই তাঁদের এ ঐকমত্যের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন একান্তই বাঞ্ছনীয়। তার ফলে ঐকমত্যের ক্ষেত্রসমূহ শরীয়াতে সুরক্ষিত থাকতে পারে, তা ভারসাম্য মৌলনীতি হতে পারে এবং চৈন্তিক অস্থিরতা ও উচ্ছৃংখলতা বন্ধ হতে পারে। যেমন রৌপ্যের যাকাতের অনুপাতে স্বর্ণের যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের সম্পূর্ণ ঐকমত্য সাধিত হয়েছে দশ ভাগের এক-চতুর্থাংশ। আর যেমন তাদের ইজমা হয়েছে যে, এক ‘মিসকাল’ হ চ্ছে এক দিরহাম ও এক দিরহামের সাত ভাগের তিন ভাগ পরিমাণ। এভাবে আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। শিরোনামে আমি ‘সুদৃঢ় ইজমা’ ব্যবহার করছি। তার কারণ এই যে, কোন কোন ফিকাহ্বিদ এমন সব বিষয়ে ইজমা হয়েছে বলে দাবি করেছেন, যে বিষয়ে অন্যদের কাছে মতদ্বৈধতা রয়েছে। এ মতদ্বৈধতারও কারণ রয়েছে। প্রাথমিক যুগসমহের মুজতাহিদ আলিমগণ বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন ও পরস্পর সম্পর্কহীন অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের সংখ্যাও ছিল অনেক। প্রতিটি ইজতিহাদী বিষয়ে তাঁদের অভিমত জানতে পারা ও একত্র করা খুবই দুরীহ ব্যাপার ছিল। ইমাম আহমদ এ পর্যায়ে বলেছেন: (আরবী*********) যে দাবি করে যে, কোন বিষয়ে ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছে, সে মিথ্যাবাদী, কেননা হয়ত সে জানে না যে, লোকেরা ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে অথবা সে খবর তার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। অতএব বলা দরকার যে, লোকেরা হয়ত ভিন্নমত প্রকাশ করেছে, তার সংবাদ আমার পর্যন্ত আসেনি। এ পর্যায়ে এমন এক দৃষ্টান্তই দেয়া যেতে পারে, যাতে ইজমা সংঘটিত হওয়ার দাবি করা হয়েছে বটে অথবা সেই বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করার সংবাদ সে জানে না বলে জানিয়েছে। তা সত্ত্বেও তাতে ভিন্নমত প্রমাণিত হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী গরুর যাকাত পর্যায়ে বলেছেন: প্রতি ত্রিশটি গরুর যাকাত বাবদ একটা এক বছরের বাচুর (***) দিতে হবে। আর চল্লিশটিতে দিতে হবে একটি (*******) আর এতে ভিন্নমত আছে বলে আমি জানি না। ... অথচ এ কথা প্রমাণিত যে, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব, কাতাদাহ এবং ইবনে যুবাইরের মদীনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ এ বিসয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। [আরবী********] ইবনুল মুনযির ধন-মালের যাকাত অমুসলিমকে দেয়া যাবে না—এই মতে ইজমা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। অথচ জুহরী, ইবনে সিরীন ও কিরামা এ থেকে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, হ্যাঁ, অমুসলিমদের জন্যে তা থেকে ব্যয় করা জায়েয। আর যেমন বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমরের বাহ্যিক মত এটাই। [যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র-এই অধ্যায়ে অমুসলিমদের যাকাত দানের আলোচনা দ্রষ্টব্য।] ইবনে কুদামাহ্ তাঁর ‘আল-মুগনী (আরবী****) গ্রন্থে লিখেছেন: বনু হাশিম বংশের লেকাদের ফরয যাকাত গ্রহণ করা যায়েয নেই—এ বিষয়ে কোন মতদ্বৈতা আছে বলে আমরা জানি না। আর টীকায়, হাফেয ইবনে হাজারলিখিত ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থ থেকেও তার এরূপ মতের কথা উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তাবারী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (র) তা জায়েয বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন যে, তারা যদি রাসূল (স)-এর নিকটাত্মীয় হওয়ার দরুন প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জন্য ফরয যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। ইমাম তাহাভীও এরূপ উদ্ধৃত করেছেন। মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ আবহরী থেকেও এ মতের উল্লেখ করেছেন। আর তা-ই কোন কোন শাফেয়ীর মত্ ইমাম আবূ ইউসুফ থেকে বর্ণিত হয়েছে: বনূ হাশিমের লোকেরা পরস্পরের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করতে পারে। মালিকী মাযহাবের এ ব্যাপারে চারটি মতের উল্লেখ করা হয়েছে। এক—জায়েয, দুই—জায়েয নয়, তিন—নফল দান গ্রহণ কায়েয, ফরয দান নয়; এবং চার—এর বিপরীত (অর্থা নফল দান গ্রহণ জায়েয নয়, ফরয যাকাত গ্রহণ জায়েয)। [(****) ৩য় খণ্ড, ২২৭ পৃষ্ঠা; যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র-এ পর্যায়ে নবম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] বস্তুত এই যে ইজমা—কোন বিষয়ে ঐকমত্যের দাবি, দলীলের ভিত্তিতে আমরা তার বিরোধিতা করতে পারি, করলে কোন দোষ হবে না। কেননা প্রকৃতপক্ষে এটা ইজমা নয়। তবে যে ইজমা সুদৃঢ়—যাতে কোন বিপরীত মত আদৌ জানা যায় নি—তার সম্ভাবনা, বাস্তবতা ও অকাট্যতা নিয়ে যত বিতর্কেররই সৃষ্টি হোক না-কেন, সেই পর্যায়ের কোন শরীয়াতী হুকুমের বিরোধিতা আমি করছি না, যেমন এর পূর্বে আমি বলছি। কিন্তু আমি বিরোধিতা করছি এ মতে ইজমা হওয়ার, যাতে উসুলে ফিকাহ্র আলিমগণের এই মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, কোন সময়ের আলিমগণ কোন বিষয়ে দুটি মতে মতদ্বৈধতা করলে তাঁদের পরবর্তী লোকদের তৃতীয় কোন মত নতুন করে বলা জায়েয নয়। কেননা মুসলিম উম্মত যদি দুটি মতের মধ্যে মতদ্বৈধতা সীমাবদ্ধা করে রাখে, তাহলে বুঝতে হবে, তাৎপর্যের দিক দিয়ে উম্মত তৃতীয় মত নতুন করে সৃষ্টি করতে নিষেধ করে দিয়েছে। আ-মদী (প্রখ্যাত উসূলে ফিকাহ্বিদ) মনে করেন, তৃতীয় মতটি যদি পূর্ববর্তী দুই মতের সাথে সাযুজ্যপূর্ণহয়, তাহলে সেরূপ মত দেয়া জায়েয নয়। অন্যথায় যদি এক হিসেবে দুটি মতের একটির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হয়, আর অপর দিক দিয়ে তার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে তা জায়েয হবে, কেননা তাতে ইজমা ভঙ্গ করা হয় না। [আল-অ-মদী লিখিত (****) ১ম খণ্ড, ১৩৭-১৩৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।] এর দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেছেন: (আরবী********) ‘ফসলে ওশর দেয়ার দায়িত্ব জমির মালিকের আর অধিক সংখ্যক ফিকাহ্বিদ (*****) বলেছেন: যে লোক জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করবে, তাকে দিতে হবে ওশর। এখানে এ দুটি মতের মধ্যে ঐকম্যত ভিত্তিক মত হল: ওশর ওয়াজিব-অবশ্যই দেয়। অতঃপর আমরা যখন বলব, ওশরজমির ফসলথেকে ভাড়ায় চাষকারীর দেয়া ওয়াজিব—জমির মালিককে মূল্য বা ভাড়া বাবদ দেয়া মূল্য বাদ দেয়ার পর; এবং বলব, মালিক ভাড়াকারীর কাছ থেকে যে মূল্য আদায় করেছে তা থেকে যাকাত দিতে হবে, তখন আমরা—অ-মদী যেমন বলেছেন—ইজমা ভঙগ্কারী হব না। তবে আলিমগণের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, কোন বিষয়ে দুটি মতের দ্বৈধতা এ কথার অকাট্য প্রমাণ যে, তাতে ইজতিহাদ করার বিপুল অবকাশ বিদ্যমান। তৃতীয় মতটি তো ইজতিহাদেরই ফলশ্রুতি এবং তা জায়েয। অনেক বিষয়েই কোন কোন তাবেয়ী তৃতীয় মত নতুন করে প্রকাশ করেছেন, যা সাহাবীদের কেউ বলেন নি। যেমন ইবনে সিরীন ও মসরূক্ব প্রমখথেকে বর্ণিত হয়েছে। [আল-আ-মদী লিখিত (****) ১ম খণ্ড, ১৩৭-১৩৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।] বস্তুত বিষয়টি যতক্ষণ ইজতিহাদ পর্যায়ভুক্ত থাকবে, ততক্ষণ তা-ই ঘটতে থাকবে। কেননা তাতে দৃষ্টির প্রসারতা ও ইজতিহাদ করার সুযোগ থেকেই যায়। ৩. সহীহ কিয়াস (Analogy) কার্যকরণ ‘কিয়াস’ বলা হয় একটি ক্ষেত্রে তারই মত অপর একটি ক্ষেত্রে দেয়া শরীয়াতী মত (****) প্রয়াগ করাকে। তা এমন একটি কারণের (***) দরুন হয়, যা উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে বর্তমান। এ ব্যাপারটিকে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখেছেন। ইবনুল কাইয়্যেম যেমন বলেছেন, এটা হচ্ছে সেই ‘মীযান’ (মানদণ্ড) যা আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদের সঙ্গে করে নাযিল করেছেন, তার সহকারী ও সহযাত্রী বানিয়েছেন। এখানে এ পর্যায়ে দুটো আয়াতের উল্লেখ করা যায়: (আরবী*********) আল্লাহ্ তিনিই, যিনি পরম সত্যতা সহকারে কিতাব ও আল-মীযান—নির্ভুল মানদণ্ড নাযিল করেছেন। (আরবী*********) এব আমরা নিঃসন্দেহে আমাদেররাসূলগণকে পাঠিয়েছি অকাট্য-স্পষ্ট দলীল সহকারে এবং আমরাতাদের সঙ্গে নাযিল করেছি আল-কিতাব ও আল-মীযান, যেন মানুষের সুবিচার সহকারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই আল-মীযান (*****) অর্থ সুবিচার, ন্যায়পরতা এবং সুবিচার-ন্যায়পরতা কি এবং কি নয়, তার প্রমাণকারী যন্ত্র। নির্ভুল কিয়াসই হচ্ছে কুরআন প্রবর্তিত এই ‘আল-মীযান’। প্রথমত আল্লাহ্ এর যে নামকরণ করেছেন তা প্রশংসাসূচক নাম।তা সর্বাবস্থায় সকলের জন্যে কর্তব্য—প্রত্যেকের সাধ্যানুযায়ী। ‘কিয়াস’-এর নামকরণ এভাবে হয়নি। তা দুভাবে বিভক্ত; ‘হক’ হতে পারে, হতে পারে ‘বাতিল’ও। তা যেমন প্রশংসেোগ্য হয়, তেমনি রিতষ্কারযোগ্য। হয় সহীহ্—নির্ভুল ও খারাপ—বিপর্যয়কারীও। তবে সহীহ্ ‘কিয়াস’ হচ্ছে সেই আল-মীযান, যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবের সঙ্গী করে নাযিল করেছেন। [(আরবী*********)] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন: ‘কিয়াস’ একটা মোটামুটি অর্থজ্ঞাপক শব্দ। সহীহ্ কিয়াস ও অ-সহীহ্ কিয়াস উভয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। তবেসহীহ্ কিয়াসই শরীয়াত সমর্থিত। আর তা হচ্ছে দুই সমান বিষয়ের একত্রীকরণ, দুটো পরস্পর পার্থক্যপূর্ণ জিনিসের মধ্যে পার্থক্যকরণ। প্রথমটি প্রত্যাহারের কিয়াস। আর দ্বিতীয়টি বিপরীতের কিয়াস। আর তা-ই সে সুবিচার, যা করার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলে করীম(স)-কে পাঠিয়েছেন। সহীহ কিয়াস হচ্ছে, যেমন মুল বিষ যে, কারণ (****) বর্তমান থাকার দরুনশরীয়াতের একটা হুকুম হয়েছে, সে কারণটি অপর যে বিষয়ে পাওয়া যাবে তাতেও শরীয়াতের সে হুকুমই গ্রহণীয় হবে। কেননা অনুরূপ হুকুম দ্বিতীয় ক্ষেত্রে গ্রহণ করার প্রতিবন্ধক কিছুই নেই। শরীয়াত এরূপ কিয়াসের বিরুদ্ধে কখনিই কিছু নিয়ে আসেনি। পার্থক্যকারী বাতিলকরণের কিয়াসও এমনিইহয়ে থাকে তা হচ্ছে এই যে, দুটো অবস্থার মধ্যে পার্থক্য হবে না, যা দ্তিীয অবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শরীয়াত এরূপ কিয়াসের বিরুদ্ধে নয়। [আরবী***********] আসল বক্তব্য হল, ‘কিয়াস’ যখন মূল ও তার সদৃশ দ্বিতীয় জিনিসের মধ্যে সমন্বয়কারী ‘কারণ’-কে স্পষ্ট করে তোলে এবং দুটোর মাঝে প্রকাশমান বা প্রচ্ছন্ন কোন পার্থক্যকারী না থাকে, গণনার যোগ্য কোন প্রতিবাদীও পাওয়া না যায় তখন তাকে একটি শরীয়াতসম্মত দলীল হিসেবে গ্রহণ করা ও মেনে নেয়া ওয়াজিব। তাতে কোন দোষ হওয়ার কারণ নেই। কেউ আপত্তি তুলতে পারেন এই বলে যে, যাকাত একটি বিশেষ ইবাদতের কাজ। আর ইবাদাতের কাজে কোন ‘কিয়াস’ চলে না। তা হলে আমরা বলব: হ্যাঁ, একথা সত্য যে, খালেস ইবাদতের কাজে কিয়াসের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। কেননা ইবাদত ফরয হওয়ার ‘ইল্লাত’ (কারণ) বিস্তারিতভাবে জানা সম্ভব নয়। ইবাদতের কাজে তো কোন কারণের প্রতি দৃষ্পিাত না করে শুধু আল্লাহর কুম পালন করাই লক্ষ্য হতে হবে। অতএব নামায, রোযা, হজ্জ প্রভৃতি নিছক ইবাদত পর্যায়ের কাজসমূহে কোনরূপ কিয়াস করা ঠিক হবে না। তাহলেই লোকদের জন্যে দ্বীনের নামে এমন কাজের বিধান করা বন্ধ হবে, যার অনুমতি আল্লাহ তা’আলা দেননি। না তেমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে, না কোন কাজ করার দায়িত্ব থেকে কাউকে মুক্ত করা যাবে। কিন্তু যাকাতের অবস্থা ভিন্নতর। তার আরও একটা দিক রয়েছে। তা নিছক ইবাদত নয়। তা সুপরিজ্ঞাত হক্ও। একটা সুনির্দিষ্ট ও দার্যকৃত করও। তা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামষ্টিক ও ধন-সম্পদ সংক্রান্ত ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও। তা একদিকে ইবাদতের তাৎপর্য ও ভাবধারা সমন্বিত। শরীয়াতে তাঁর বিধিবদ্ধ হওয়া ও তৎসংক্রান্ত হুকুম-আহকাম নাযিল হওয়ার মূল কারণ (***) প্রখ্যাত ও সর্বজনবিতি। তাহলে সেই ‘ইল্লাত’ বা ‘কারণ’ অনুযায়ী আর যা যা তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ রয়েছে, শরীয়াতের অকাট্য দলীলেল ভিত্তিতে সেই বিষয়েও অনুরূপ বিধান হওয়ার কথা আমরা ‘কিয়াস’ করব না কেন? নবী করীম(স) স্বয়ং কোন কোন দানা জীবন ও ফল-ফসর মেন যব, খেজুর, কিসমিস, মনাক্কা ইত্যাদি থেকে ফিতরায় যাকাত গ্রহণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী, আহ্মদ ও তাঁদের ইত্যাদি থেকে ফিতরার যাকাত গ্রহণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী, আহ্মদ ও তাঁদের সঙ্গীগণ সাধারণত বা বেশীর ভাগ খাদ্য হিসেবে গৃহীত জিনিসের উপর ‘কিয়াস’ করেছেন। তাঁরা এসব গৃহীত জিনিসকে মূলত ইবাদতের লক্ষ্যস্বরূপ ধরে নেন নি। কেননা তাহলে এর উপর কিয়াস করা চলতো না। কৃষি-ফসল ও ফল-পাকড়েরর ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে বেশীর ভাগ ফিকাহ্বিদ অন্যান্য এমনসব দানা বা বীজ সম্পর্কে কিয়াস করেছেন, যে সম্পর্কে দলীল পাওয়া গেছে এবং তাঁরা কেবল হাদীসে উল্লিখিত গম, যব, খেজুর ও কিসমিসের মধ্যে যাকাতকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। হযরত উমর (রা)-ও যাকাত পর্যায়ে কিয়াস প্রয়োগ করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, এক-একটি ঘোড়ার মূল্য একশতটি উষ্ট্রের সমান হয়, তখন ঘোড়ার যাকাত গ্রহণের জন্যে তিনি নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, আমরা চল্লিশটি ছাগল থেকে যাকাত আদায় করি; কিন্তু ঘোড়া থেকে কিছুই নিচ্ছি না, (এটা হওয়া উচিত নয়)। ইমাম আবূ হানীফঅ (র) সুপরিজ্ঞাত শর্তের ভিত্তিতে এই মতকেই মেনে নিয়েছেন। [এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা এই গ্রন্থে যথস্থানে করা হবে।] এই আলেঅকে আমরা কৃষিজমির উপর ‘কিয়াস’ করেছি বসবাসের জন্যে ভাড়া দেয়া দালান-কোঠা, ঘর-বাড়ি, ইত্যাদি। যেসব দানের জিনিসথেকেহযরত ইবনে মাসউদ, মুয়াবিয়া ও উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ যাকাত গ্রহণ করতেন তা ব্যয় করা কালে—যদিও তা সাধারণভাবে যাকাত ফরয হওয়া জিনিসের অন্তর্ভুক্ত তার উপর আমরা কিয়াস করছি মাসিক বেতন (****) ও মজুরীকে। মধুর উপর ওশর ধার্য হওয়ার কথা হাদীসে (***)-ই উদ্ধৃত হয়েছে। আমরা তার উপর কিয়াস করছি মিল্কও দুগ্ধ ইত্যাদি পশুজ-উৎপন্ন দ্রব্যাদি। কিয়াসের গুরুত্ব প্রমাণ করার প্রসংগে ইমাম শাফেয়ী তাঁর (****) গ্রন্থে স্বর্ণের যাকাত পর্যায়ে যা লিখেছেন, এখানে তার উল্লেখ যথেষ্ট হবে বলে মনে করছি। তিনি বলেছেন: নবী করীম (স) ‘আল-অরাক্ক, (নগদ রৌপ্য)-এ যাকাত ফরয করেছেন। তাঁর পরে মুসলিম সমাজ স্বর্ণে যাকাত গ্রহণ করেছে। হয় এমন হাদীসের (****) ভিত্তিতে, যা আমাদের কাছে পৌঁছেনি অথবা এই কিয়াস করে যে, স্বর্ণ ও মুদ্রা লোকদের এমন নগদ সম্দ, যা তারা পুঁজি করে এবং ইসলামের পূর্বে ও পরে তারা যে ক্রয়-বিক্রয় করত তাতে মূল্য হিসেবে তা তারাও চালু করেছে। [(আরবী*********)] অতএব নগদ স্বর্ণ মুদ্রার যাকতা গ্রহণ—এই মুদ্রাই হল বিশ্বের বড় বড় জাতির নগদ মুদ্রার বিশ্বমান—খুব সহজ ব্যাপর নয়। তা সত্ত্বেও রাসূলে করীম (স)-এর পর মুসলমানগণ এই যাকাত গ্রহণ করেছেন এবং তা করেছেন কিয়াস-এর সাহায্যে। এটাই অধিকতর সম্ভব। এ পর্যায়ে কোন হাদীস থেকে থাকলেও তা ইমাম শাফেয়ীর কাছে পৌঁছায়নি—যদিও তিনি খুব তালাশ করেছেন অনুরূপ কিছু ভিত্তি পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করেছেন। অনুরূফভাবে ইমাম মালিক, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের কাছেও এই পর্যায়ে কিছুই পৌঁছায়নি। কাজেই বলতে হয়যে, এ পর্যায়ে কোন হাদীসের অস্তিত্ব একটা বহু দূরবর্তী সম্ভাবনা। এই কারণে ইমাম মালিক কোন হাদীসের অপেক্ষা না করে ‘আমল’ বা কাজের উপর ভিত্তি করেছেন এবং বলেছেন: (আরবী*********) আমাদের মতে যে সুন্নাতে কোন মতদ্বৈধতা নেই, তা হচ্ছে সরাসরিভাবে বিশটি দীনারে (স্বর্ণমুদ্রা) যাকাত ফরয যেমন দুইশ’ দিরহামে (রৌপ্য মুদ্রায়) যাকাত ফরয হয়ে থাকে। ৪. লক্ষ্য ও কল্যাণের গুরত্ব স্বীকার ইসলামের সুবিজ্ঞ ও গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মনীষিগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছৈন যে, শরীয়াতের হুকুম-আহকাম ও আইন-বিধান কার্যকর করা হয়েছে আল্লাহর বান্দাদের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের দৃষ্টিতে। সে সব কল্যাণ জরুরীমূলক হোক, প্রতিবন্ধকতামূলক অথবা সৌন্দর্যসূচক, তাতে কোন পার্থক্য নেই। এ কথার দলীল—যেমন ইমাম শাতেবী লিখেছেন—তা হচ্ছে শরীয়াতের বিধান অনুসন্ধান ও তার সামষ্টিটক ও অংশসম্পর্কিত দলীলাদির উপর দৃষ্টিপাত। তা কোন বিশেষ একটি দলীলের মধ্যে সীমিত নয়, কোন একটা বিশেষ ঘটনা কেন্দ্রিকও নয়। বরং গোটা শরীয়াত সম্পূর্ণরূপে তার উপর আবর্তিত। [আরবী**********] ইমাম শাতেবী একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়মের উল্লেখ করেছেন: ‘শরীয়াত পালনে বাধ্যবাধতার প্রেক্ষিতে ইবাদতের আসল কথা হল দাসত্ব স্বীকার—তার তাৎপর্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে। আর আদত-অভ্যাস-মুয়ামিলাত-এর মূল কথা হল তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ্য আরোপ। [(আরবী*********)] এ কথা প্রমাণের জন্যে তিনি এতসব স্পষ্ট অকাট্য দলীলের উল্লেখ করেছেন, যা এখানে উদ্ধৃত করার অবকাশ নেই। এখানে আমি আবার বলছি, পূর্বোক্ত কথার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করছি: যাকাত যদিও ইবাদতের পর্যায়ে নামাযের সঙ্গে সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও তা প্রকৃতপক্ষে একটা ইবাদাত মাত্র নয়। আসলে তা ‘আদত’ বা মুয়ামিলাতের অতীব নিকটবর্তী কাজ। কেননা তা মুসলিম জনগণের ধন-মাল সংক্রান্ত ব্যাপার; বড়জোর তা রাষ্ট্র ও ধন-মালিকের মধ্যকার ব্যাপার অথবা রাষ্ট্রের অবর্তমানে বা নিষ্ক্রিয়তার সময়ে ধন-মালের মালিক ও দরিদ্র ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের দিক। আর তার প্রমাণ এই যে, ইসলামের অর্থ-বিজ্ঞান ও প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত গ্রন্থাদিতে যাকাত এ পর্যায়ে উল্লিখিত ও আলোচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গের গ্রন্থাদির মধ্যে কিতাবুল খারাজ, কিতাবুল আমওয়াল, আহকামুস্ সুলতানয়া ও আস্সিয়া সাতুশ-শরঈয়া উল্লেখ্য।আসলে যাকাত ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটা বিশেষ অংশ। আমরা যদি ইসলামী ফিকাহ্কে আধুনিক পদ্ধতিতে পুনর্বিন্যাস করতে ইচ্ছা করি, তাহলে যাকাতকে আমরা অবশ্যই অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক বিধানের অন্তর্ভুক্ত করব। নিছক ইবাদতের মধ্যে গণ্য করেই ক্ষান্ত হয়ে যাব না। আইন প্রণয়ণকালেও তাই করতে হবে। কেননা তা যে অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক বিধি প্রণয়নের অন্তর্ভুক্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরূপ করা হলে যাকাত ইবাদতের পরিমণ্ডল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাবে না। ইমাম শাতেবী ঘোষণা করেছেন: আদতের মধ্যে যদি বন্দেগীর ভাবধারা পাওয়া যায়, তাহলে তা অবশ্যই মানতে হবে এবং দলীলের সাথে স্থিতি গ্রহণ করতে হবে। যেমন বিবাহে মোহরানা দাবি করা, খাদ্য হিসেবে গৃহীত জন্তুর দেহের বিশেষ স্থানে যবেহ করা, মীরাস বন্টনে নির্দিষ্ট অংশসমূহ এবং তালাকের সংখ্যায় মাসের সংখ্যা গণনা প্রভৃতি। যাকাতের পরিমাণ ও নিসাবকে আমি এ পর্যায়েই গণ্য করছি। কেননা তা শরীয়াতদাতা কর্তৃক সুনির্দিষ্ট। তাই তার সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং চূড়া্ত করে দিয়েছেন। বিগত কাল ও যুগসমহে বিশ্বের মুসলিমগণ সেই ব্যাপারে সম্পূর্ণ ঐকমত্য রক্ষা করে এসেছেন। কাজেই এ ক্ষেত্রে ঠিক দলীলের উপর স্থিতি ও ঐকমত্য হওয়া কর্তব্য। এ কাারণে যেসব লোক যাকাতের পরিমাণ ও নিসাবকে কাল ও অবস্থার অনুপাতে পরিবর্তন ও হ্রাস-বৃদ্ধির যাঁতাকলে ফেলতে চাইছেন, আমি তাঁদের বিরোধিতা করছি। কেননা তা করা হলে শরীয়াতভিত্তিক যাকাতের মর্যাদই বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তাকেও একটা রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স পর্যায়ে নামিয়ে দেবে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাষ্ট সরকার যেমন বিভিন্ন ধরনে ও পরিমাণের ট্যাক্স ধার্য করে থাকে, যাকাতও ঠিক সেই রকমের একটা অতীব নগণ্য জিনিসে পরিণত হবে। সারকথা: ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন এবং ক্ষতি ও বিপর্যয়ের পথ বা কারণসমূহ প্রতিরোধ। ইমামমালিক ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের অনুসৃত নীতি এই মৌল নীতির সমর্থন পাওয়া যায়। কেননা তাঁরা ‘জনকল্যাণ’ (Public good or welfare) (আরবী*********)-কে শরীয়াতের একটি দলীলরূপে গণ্য করেছেন। তাই ‘যরায়ে’ (ক্ষতির কারণ) বন্ধ করার নীতি অনুযায়ী যেমন আমল করা দরকার, [বরং আল-কারাফী বলেছেন: অন্যের ‘মাসালিহে মুরসালার’ ব্যাখ্যা তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ দিয়ে করেছেন। কিন্তু তার শাখা-প্রশাখা বর্ণনাকালে শুধু ‘মুসলিহা’ বলেন। [ তেমনি এই ‘জনকল্যাণ’ অনুযায়ীও আমল হওয়া আবশ্যক। তবেহাম্বলী মাযহাবের বহু সংখ্যক ফিকাহ্বিদ এ বিতর্ক দূরীভূত করে দিয়েছেন। ইাম ইবনে তাইমিয়্যা ও তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যেম নিজ নিজ গ্রন্থে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন যুগিয়েছেন। এ পর্যায়ে তাঁরা দু’জনই বহু দলীল ও সহীহ শরীয়াতী হিসাব-নিকাশ উপস্থাপিত করেছেন। এই ভিত্তিতে ইবনুল কাইয়্যেম একটা অধ্যায় দাঁড় করিয়েছেন। কাল-স্থান, অবস্তা, মনোভাব ও ব্যবহারের পার্থক্যের দৃষ্টিতে ফতোয়া পরিবর্তন ও পার্থক্য দেয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে বলে তিনি দাবি করেছেন। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন: ‘এ-এক বিরাট কল্যাণদায়ী পরিচ্ছেদ।’ এ সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুন শরীয়াতের ব্যাপারে বড় ভুল সংঘটিত হয়েছে। এর কারণে বহু দুঃখ-কষ্ট ও অসুবিধার উদ্ভব হয়েছে। অথচ শরীয়াত উচ্চমানের কল্যাণ দৃষ্টিসমপ্পন্ন হওয়ার দরুন িএই ধরনের অবস্থার সুযোগ দেয় না। কেননা শরীয়াতের ভিত্তি সংস্থাপিত হয়েছে জনগণের ইহকালীন ও পরকালীণ কল্যাণ চিন্তার উপর। এটা সম্যক সুবিচার, আল্লাহ্র অপরিসীম রহমত, সামষ্টিক কল্যাণ, অতীব যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তাসঞ্জাত। অতএব যে বিষয়ই সুবিচারে সীমা পেরিয়ে জুলুমের পর্যায়ে পড়বে, রহমতের পরিবর্তে অশান্তির কারণ হবে, অকল্যাণের পরিবর্তে বিপর্যয় ডেকে আনবে, যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার পরিবর্তে অর্থহীনতা ও আবর্জনার প্রশ্রয় দেবে, তা শরীয়াত হতে পারে না—তার যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক-না-কেন। শরীয়াত হচ্ছে বান্দাগণের মধ্যে আল্লাহর সুবিচার। তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুকম্পা, পৃথিবীর উপর মহাশান্তির ছায়া বিস্তার। তাঁর সৃষ্টিকুলেল প্রতি অনুকম্পা, পৃথিবীর উপর মহাশান্তির ছায়া বিস্তার। তাঁর যৌক্তিকতা ও কর্মকৌশলের নিদর্শন, মহানবী (স)-এর সভ্যতার অকাট্য প্রমাণ। তা নূর বিশেষ, দৃষ্টিমানরা তার আলোকেই দেখতে পারে, হেদায়াতপ্রাপ্ত লোকেরা তাঁরই হেদায়াত পেয়ে ধন্য হয়। [(আরবী*********)] বস্তুত এ অতীব লোভনীয় ও আগ্রহসম্পন্ন কালাম। জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক প্রচার সাধন আমাদের কর্তব্য। আমাদের এই যুগেও এর বিপরীত কিছু বলার থাকতে পারে না। বস্তুত ইবনুল কাইয়্যেম যখন বলেণ যে, কাল ও অবস্থার পরিবর্তনে ফতোয়াও বদলে যায়, তখন তিনি খুব ঠিক কথাই বলেন, অতব সত্য কথা বলেন। কেননা তখন মূলত শরীয়াতের বিধান কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয় না, পরিবর্তিত হয় শুধু তার প্রয়োগ। আইন বদলে যায় না, আইনেসর বুঝ-সমঝ বদলে যায়। শরীয়াত তো আল্লাহ্র ওহী, তা শাশ্বত। কিন্তু ফতোয়া, বুঝ-সমঝ ও বিচার মানুষের কর্ম। রাসূলে করীমের যুগে কুরআনের আয়াত অনুযায়ী ‘আল-মুয়াল্লাফাতুল কুলূব’ [Whose hearts have learn (recently) reconciled to (truthe)]-কে যাকাত দেয়া হত। উত্তরকালে খলীফা হযরতত উমর ফরূক (রা) তাদের যাকাত দিতে অস্বীকার করলেন। বললেন: (আরবী*********) নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করে দিয়েছেন এবং ওদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা শেষ করেছেন। একথা বলে ও এ কাজ করে তিনি মূলত শরীয়াতের কোন হুকুমকে পরিবর্তিত করে দেন নি, কুরআনী অকাট্য দলীলকে বাতিল ঘোষণা করেন নি—যদিও এরূপ ভিত্তিহীন কথা অনেকেই মনে করে নিয়েছে। তিনি রাসূলে করীমের সময়কাল ও অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার দরুন ফতোয়া—(শরীয়াতী হুকুমের প্রয়োগ) পরিবর্তন করে দিয়েছেন মাত্র। ফলে উয়াইনা ইবনে হাসান ও আক্রা ইবনে হাবেসের ন্যায় লোকদের উপর তাদের মন ফিরিয়ে রাখার জন্যে ইসলামের যে নির্ভরশীলতা ছিল ও তারাও কিছু পাওয়ার জন্যে আকাঙ্ক্ষিত ছিল, তার আর কোন অবকাশই থাকল না। কেননা রাসূলে করীম (স) তাদের দিল আকৃষ্ট করার জন্যে কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে যান নি, -সাদা চেকে স্বাক্ষর করে যান নি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপ্রধানের পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে, তিনি যখন তার মন আকৃষ্ট করে রাখার প্রয়োজন মনে করবেন, তাই করতে পারবেন, আর যখন দেখবেন যে, কোন ব্যক্তি বা লোক সমষিট্টর মত খুশী করার আদৌ প্রয়োজন নেই অথবা অবস্থার পরিবর্তনের কারণে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে অথবা ধন ব্যয়েল অন্য ক্ষেত্রসমূহ তুলনামূলকভাবে অধিকতর প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে, তখন তদনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের তার অধিকার রয়েছে। তাতে চিরদিনের জন্যে এ খাতিট বাতিল করেও দেয়া হবে না। সেকালের ও একালের কোন হানাফী আলিম তাই মনে করেছেন। কেননা আল্লাহ কিতাবের কোন হুকুম বাতিল ও নিষ্ক্রিয়করণের কোন অধিকার হ যরত উমরতো দূরের কথা, গোটা মুসলিম উম্মতেরও থাকতে পারে না। তবে তিনি সেকালে মুসলিম জনগণের ক্যাণ এতেই নিহিত বলে মনে করেচিলেন যে, মন রক্ষার জন্যে যাকাতের অর্থ প্রতি লোভীদের নিরাশ করে দেবেন। পরবর্তীকালে কারোর মন রক্ষারজন্যে যাকাতের অর্থের প্রতি লোভীদের নিরাশ করে দেবেন। পরবর্তীকালে কারোর মন রক্ষার জন্যে অথবা সাধারণ কল্যাণের দৃষ্টিটতে কিছু দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে তা করার পর এর দরুন বন্ধ হয়ে যায় নি। [(আরবী*********) দ্রষ্টব্য।] সাধারণ জনকল্যাণের দৃষ্টিতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বিপর্যয়কারী পথ বন্ধ করা যে শরীয়াত বিরোধী নয়, হযরত উমরের এই কাজ তার অকাট্য দৃষ্টান্ত। অনুরূপভাবে কাল ও স্থানের পরিবর্তনের দরুন ফতোয়া পরিবর্তিত হওয়ারও তা অতীব উত্তম ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অবস্থার পরিবর্তনে ফতোয়া পরিবর্তিত হওয়া পর্যায়ে হযরত উমরের দ্বিতীয় অবদান হচ্ছে ঘোড়ার উপর যাকাত ধার্যকরণ। সিরিয়ার কতিপয় লোক এসে তাঁর কাছে ঘোড়ার যাকাত জমা দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু তা গ্রহণে তাঁর মনে দ্বিধার সঞ্চার হল। কেননা নবী করীম (স)-ও এ কাজ করেন নি, তাঁর পূর্ববর্তী খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-ও এ কাজের কোন দৃষ্টান্ত রেখে যান নি। পরবর্তীকালে ইয়ালা ইবনে উমাইয়া ও তাঁর ভাই যখন দেখলেন একটি ঘোড়ার মূল্য একশটি উষ্ট্রের সমান হয়েছে, তখন কিয়াসকে দলীলরূপে গ্রহণ করে তিনি ঘোড়ার উপর যাকাত ধার্য করে দিলেন। এ কাজটি আসলে পরম লক্ষ্য ও কল্যাণ ও শরীয়াতের ভিত্তি যে সুবিচার, তার দাবি পূরণ পর্যায়ের। স্থান ও কালের পরিবর্তনের দরুন ফতোয়ার পরিবর্তন হয়ে যাওয়া এখানে উল্লেখ্য আর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে রাসূলে করীম (স) যখন হযরত মুয়ায (রা)-কে ইয়েমেনে পাঠিয়ে দিলেন, তখন নির্দেশ দিয়ে দিলেন যে, তিনি যেন সেখানকার ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে সেখানকার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করেন। এ পর্যায়ের নির্দেশে বলা হয়েছিল: শস্য থেকেশস্য গ্রহণ কর, ছাগল থেকে ছাগী, উষ্ট্র থেকে উষ্ট্র। এই নির্দেশ জনগণের প্রতি একটা সুবিধা দানের ব্যাপারই মনে করা হয়েছিল। লোকদের কাছে এভাবে দাবি করা হবে; কিন্তু তাঁদের জন্যে যদি সেই জিনিসের মূল্য দিয়ে দেয়া সহজ হয় তবে তাকে অবশ্যই স্বাগতম জানানো হবে। কেননা জনগনের পক্ষে সহজতর পন্থা তা-ই। তাদের পিছনে অবস্থানকারী রাজধানী মদীনাবাসীদের জন্যেও তাতেই ফায়দা নিহিত। কেননা কোন জিনিস উদ্বৃত্ত হয়ে গেলে তা তো সেখানেই পাঠিয়ে দেয়া হবে। হযরত মুয়ায ইয়েমেনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেণ: (আরবী*********) তোমরা আমাকে খামীস কিংবা তোমাদের তৈরী পোশাক দাও। আমি তা তোমাদের কাছ থেকে শস্য বা যবের পরিবর্তে গ্রহণ করব। কেননা তা-ই তোমাদরে জন্য সহজ আর মদীনায় অবস্থাকারী মুজাহিদদের পক্ষেও সুবিধাজনক। [এ গ্রন্থে ‘যাকাত আদায়ের পন্থা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] হযরত মুয়ায (রা) হালাল-হারাম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। হাদীসে এরূপই বলা হয়েছে এবং তিনিই দেখলেন যে, যাকাতের বিধানদাতা তার দ্বারা জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই করতে চেয়েছেন। এ উদ্দেশ্যেই যাকাতের ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। তিনি ফসলের যাকাত বাবদ ফসলের পরিবর্তে ইয়েমেনী বস্ত্র গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। যদিও তা বাহ্যত হাদীসের বিরুদ্ধ মত। কিন্তু হযরত মুয়ায তো আর হাদীসের বিরোধিতা করতে পারেন না। তিনিই কুরআন ও সুন্নাতের পর ইজতিহাদকে আইনের তৃতীয় উৎস রূপে ঘোষণা করিয়েছিলেন। তিনি এখানে হাদীসের মূল লক্ষ্য অনুধাবন করে তাকে কার্যকর করেছেন, তার মৌল বক্তব্যকে লংঘন করেন নি। এ কারণে ফিকাহ্র মৌল নীতিবিদগণ মুজাহিত হওয়ার অন্যতম শর্ত করেছেন, তাকে আইন-বিধানের মর্মকতা ও শরীয়াতের আসল লক্ষ্য সম্পর্কে সঠিকভাবেআলিম হতে হবে। সেই সাথে তাকে যুগের জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কেও অবহিত হতে হবে। আর একথা খুবই সত্য। কেননা যে লোক বহু ও বিপুল বিদ্যা অর্জন করল, ইজতিহাদের উপায়-উপকরণসমূহও আয়ত্বাধীন করেনিল কিন্তু সে কোন নিভৃত কোণে কিংবা গির্জা-খানকার মধ্যে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে বলে সমাজ-সমষ্টির কল্যাণ বা অকল্যাণ সম্পর্কে কোন ধারণাই অর্জন করতে পারেনি, জনমনে ঝগড়া-বিবাদের কি সব কারণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাও বুঝতে পারেনি—বাস্তব ও বৈষয়িক জীবন যাপন করেনি, সে মুজতাহিদ হতে পারে না, ইসলামী শরীয়াতের কোন ব্যাপারে সে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম থেকে যাবে। আমরা এখানে শরীয়াতের যে সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সার্বিক কল্যাণের কথা বলছি, এর পক্ষে বেশ কয়েকজন সাহাবী মত প্রকাশ করেছেন। যেমন অনেকে বলেছেন, স্ত্রীলোকদের ব্যবহার্য অলংকারে যাকাত নেই। কেননা যাকাত প্রবর্তনে শরীয়াতের লক্ষ্য তাঁরা বুঝেছেন, ক্রমবৃদ্ধিশীল ধন-মার থেকে যাকাত গ্রহণ অথবা বর্ধন প্রবণতাসম্পন্ন ধন-মালের যাকাত গ্রহণ-রাসূলে করীম(স) তাই করেছেন। যেন অতিরিক্ত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সম্পদ থেকেই সাদারণভাবে যাকাত গ্রহণ করা হয় এবং মূল সম্পদ যেন মালিকের কর্তৃত্বে অবশিষ্ট থেকে যায়। এ দৃষ্টিতে আল্লাহ নারীদের জন্যে যে অলংকার ব্যবহার জায়েয করে দিয়েছেন, তা তো বৃদ্ধিশীল নয়—বৃদ্ধির প্রবণতা সম্পন্নও নয় বরং তা ক্ষয়িষ্ণু, তা সৌন্দর্য ও শোভা বৃদ্ধিকারী পোশাক বা ঘরের সরঞ্জাম পর্যায়ের জিনিস। শরীয়াতের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে নিরপেক্ষ সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার উপর। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে বিরাহ্র মতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তাঁর মত হল ফসল উৎপাদনে যে ব্যয় হয়েছে তা বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট ফসল থেকে যাকাত গ্রহণ। জমি ভাড়ায় নিয়ে যারা ফসল উৎপাদন করে, তাদেরও উৎপাদন ব্যয় বাদ দেয়ার পরই যাকাতের হিসাব লাগাতে হবে। জমির ভাড়াটাও বাদ পড়বে। ভাড়ার জমির মালিকশুধু দখলের কারণে যে ভাড়া পায় তার উপরও যাকাত ধার্য হবে। তা থেকে ‘ওশর’ কিংবা ‘অর্ধেক ওশর’ আদায় করা হবে। কেননা সে নিজে চাষাবাদ করলে যা উৎপাদন হত, এ ভাড়াটা তারই বিকল্প। আলোচনার পদ্ধতি বক্ষমাণ আলোচনায় আমি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, তাকে সহজ ও কঠিন—উভয় পরিব্যাপ্ত বলা যায়। বৈজ্ঞানিক বিষয়াদির আলোচনায় সাধারণত যে কঠিন ও দুর্বোধ্যতা আরোপ করা হয়, আমি তা পরিহার করে চলেছি। প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে খুব স্পষ্ট অর্থজ্ঞাপক বক্তব্যের উদ্ধৃতিও দিয়েছি। মূল তাৎপর্য সংরক্ষণ সহকারে অল্প অল্প কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। সফল ও সঠিক পদ্ধতি তা-ই হতে পারে যাতে কঠিন কঠিন সূক্ষ্ম বিষয়াদি স্পষ্ট করে বলা হয়। আমি তাই করতে চেষ্টা পেয়েছি। সম্ভবত আমি তাতে সাফল্য লাভ করেছি কিংবা সাফল্যের নিকটবর্তী হয়েছি। পরবর্তী কথা হচ্ছে, আমি দীর্ঘ ছয় বছরাধিক কাল ধরে এই আলোচনাকে একটা বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দানের জন্যে চেষ্টা করেছি। এরপর এর পথে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। আল্লাহ্ যা করেন, তাতেই মংগল নিহিত। আমি এই পাণ্ডুলিপি সম্মুখে রেখে নাড়াচাড়া করতে থাকি। কোথাও কথা বাড়াতে থাকি, পুনর্বিন্যাসকরতে থাকি, পরিচ্ছন্ন ও পরিমার্জিত করতে থাকি। সর্বশেষ মহান আল্লাহ্র ইচ্ছায় বর্তমান আকার ও অবস্থায় তা প্রকাশিত হচ্ছে। সুস্থ দৃষ্টিবান চিন্তাবিদ ও লেখকগণ আশা করি এর প্রতি গুরুত্ব দেবেন এবং নিরপেক্ষ নিষ্ঠাবান সমালোচকগণের পর্যবেক্ষণ থেকে আশা করি বঞ্চিত হব না। সে-যাই হোক, আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত করেছি। এই সুদৃঢ় ফরয কাজের (যাকাতরে) মর্মকথা ব্যাখ্যা করার যে সাধ্যযোগ্যতা আমার ছিল, তা এ কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হইনি। ইসলামী বিধানের অবদান এই যাকাত ব্যবস্থা। তার সাথে সংশ্লিষ্ট আইন-বিধানের নিরপেক্ষতা, তাতে নিহিত তত্ত্বের গভীরতা এবঙ তার বিরাট লক্ষ্য ও প্রভাব সমুদ্ঘাটিত ও সমুদ্ভাসিত করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই দীর্ঘ আলোচনা। মুসিলমগণ এর আলোকে ইসলাম সম্পর্কিত ধারণা সঠিকভাবে গড়ে নেবেন, দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতি ও অপরিচিতির পর এই ব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন করবেন এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সামষ্টিক ব্যবস্থার এক অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে যাকাত আবার গ্রহণ ও কার্যকর করবেন, আমি এটারই আশা পোষণ করছি। কেননা তার ফলেই আল্লাগর সন্তোষ লাভ সম্ভব। শুধু তাই নয়, মুসলিম জনগণের বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর বহুলাংশের সমাধান এর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব বলে মনে করি। এ কালের যুবক সমাজে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তা থেকে তাদের রক্ষা করার এটাই অন্যতম পন্থা বলে আমার বিশ্বাস। এখন এই অর্ধয়ন যদি তার লক্ষ্যে সাফল্যমন্ডিত হয়, তাহলে আমি সেজন্যে আল্লাহর হামদ করব। আল্লাহ্র শোকার আদায় করাই আমার এই চেষ্টা-প্রচেষ্টর চরম লক্ষ্য। তিনিই এই চেষ্টর শুভ ভল দানে সক্ষম, তিনিই পারেন আমার এই কাজে বরকত দিতে—যদিও তা আমার লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছতে অসমর্থ রয়েছে। আমার জন্যে সান্ত্বনার বিষয় হল, আমি আমার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি, তাতে কোন ত্রুটি বা অবসাদের প্রশ্রয় দেইনি। আর যে লোক প্রাণপণ চেষ্টা করে তার ‘মজুরি’ এবং যে নিয়ত করে, তার সওয়াব বন্ধ হয়ে যায় না। প্রত্যেক চেষ্টাকারীরই একটা প্রাপ্য রয়েছে। আর প্রত্যেকেই তা-ই পায়, যা পাওয়অর জন্য সে ইচ্ছা করেছে—এটাই ইসলামের নিয়ম। (আরবী*********) ইউসুফল আল-কারযাভী, দোহা, কাতার জুমাদিুল আউয়াল ১৩৮৯ হিজরী জানুয়ারী ১৯৬৯ প্রাথমিক কথা যাকাত ও সাদকার অর্থ ‘যাকাত’ শব্দের বিশ্লেষণ আভিধানিক অর্থ: বলা হয়: (***) যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়’। (*****) অমুক ব্যক্তি যাকাত দিয়েছে অর্থ—সুস্থ ও সুসংবদ্ধ হয়েছে। অতএব ‘যাকাত’ হচ্ছে ‘বরকত’—পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ করা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা-শুদ্ধতা-সুসংবদ্ধতা। [***১] ‘লিসানুল আরব’ গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘যাকাত’ শব্দের মূল আভিধানিক অর্থ: (******) পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশসা।’ এ সব কয়টি অর্থই কুরআন ও হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। ওয়াহেদী প্রমুখ বলেছেন: বাহ্যত (****) এ মূলের আসল অর্থ হচ্ছে আধিক্য ও প্রবৃদ্ধি। আরবীতে বলা হয়: (আরবী*********) কৃষিফসল বৃদ্ধি পেয়েছে-পেয়েছে যেমন করেবৃদ্ধি পেয়ে থাকে। আর যে জিনিসই বৃদ্ধি পায়, তাই ‘যাকাত’ হয়। আর কৃষিফসল ক্রমবৃদ্ধি পাওয়া কেবল তখনই সম্ভব, যখন তা আবর্জনামুক্ত হয়। তাই ‘যাকাত’ শব্দটিতে পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার ভাবধারা বিদ্যমান। ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় ‘যাকাত’ শব্দ ব্যবহৃত হলে তা হবে সুস্থতা-সুসংবদ্ধতা অর্থে। তখন ব্যক্তির মধ্যে কল্যাণের আধিক্য হওয়া বোঝাবে। যেমন বলা হয়: (****) অর্থাৎ পবিত্র জাতির মধ্যে চরম মাত্রার কল্যাণসম্পন্ন ব্যক্তি। আর (আরবী*********) বলা হবে যখন বিচারক সাক্ষ্য প্রমাণের অধিকতর কল্যাণ বর্ণনা করবে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ‘যাকাত ব্যবহৃত হয় ধন-মালে আল্লাহ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ও ফরযকৃত অংশ বোঝাবার জন্যেয়। যেমন পাওয়অর যোগ্য-অধিকারী লোকরেদ নির্দিষ্ট অংশের ধন-মাল দেওয়াকেও ‘যাকাত’ বলা হয়। ধন-মাল থেকে এই নির্দিষ্ট অংশ বের করাকে ‘যাকাত’ বলা হয় এজন্যে যে, যে মাল থেকে তার বের করা হলো তদ্দরুন তা বৃদ্ধিপ্রা্ত হয়। প্রকৃতপক্ষেই তার মাত্রা ও পরিমাণ বেড়ে যায়। তা বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পায়। ইমাম নববী ওয়াহেদী থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। [আল্লামা যামাখশারী তাঁর ‘আল-ফায়েক’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৫৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: ‘যাকাত’ সাদকা’র মতই একটা কাজ বিশেষ। এ একটা সমন্বিত অর্থজ্ঞাপক শব্দ। তার একটা অর্থ: যাকাত বাবদ দেয়া ধনমালের একটা অংশ। আর দ্বিতীয় হল পরিচ্ছন্নতাকরণের কাজ। কুরআনের আয়াত (আরবী*********)-এর অর্থ মূর্খতাবশত প্রথমটি মনে করার দুরুন ভুল তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে। আসলে এর অর্থ- যারা তাযকীয়া—পরিচ্ছন্ন িপবিত্রতার কাজ করেছে।] ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেছেন: সাদকায় দানকারীর মন ও আত্মা পবিতও হয়, তার ধন-মাল বৃদ্ধি পায়, পরিচ্ছন্ন হয় এবং প্রকৃতপক্ষে পরিমাণে বেশী হয়। [(আরবী*********)] ক্রমবৃদ্ধি ও পবিত্রতা কেবল ধন-মালের মধ্যেই সাধিত হয় না। যাকাত দানকারীর মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা পর্যন্ত তা সংক্রমিত হয়। সম্ভবত এ দিকে লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) তুমি তাদের ধন-মাল থেকে সাদকা (যাকাত) গ্রহণ কর, তুমি তার দ্বারা তাদের পবিত্র করবে ও পরিচ্ছন্ন (প্রবৃদ্ধিমান) করবে। আজহারী লিখেছেন—তা দরিদ্র্যকেও প্রবৃদ্ধি দান কর। দরিদ্রের জন্য বস্তুগত ও মনস্তাত্তিবক প্রবৃদ্ধি ব্যক্ত করে—এ শব্দটি এই অর্থের দিকে সুন্দর এক দৃষ্টিপাত বা ইংগিত করে। সেই সাথে ধনমালী ব্যক্তির মন ও সম্পদ প্রবৃদ্ধি সাধন করে—এ কথাও বোঝায়। ইমাম নব্বী ‘আল-হাভী’ গ্রন্থ প্রণেতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন: তোমরা জানবে, ‘যাকাত’ আরবী শব্দ ইসলামী শরীয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বেও এই শব্দটি সর্বজন পরিচিত ছিল। জাহিলিয়াতের যুগের কাব্য ও কতিপয় তা ব্যবহৃত হয়েছে, এই ব্যবহারকে অনেক সময় দৃষ্টান্ত হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়। দাঊদ যাহিরী লিখেছেন: অভিধানে এই নামের কোন ভিত্তি নেই। শরীয়াতের বিধান দ্বারাই তা প্রচলিত। ‘আল-হাভী’ প্রণেতা বলেছেন, এ কথাটি যদিও বিপর্যয়কারী, তবে যাকাতের বিধানে তার মধ্যকার মতদ্বৈধতা কিছুমাত্র প্রভাবশালী নয়। [(আরবী*********)] এসব কথা জেনে নেয়ার পর প্রখ্যাত ইয়াহুদী প্রাচ্যবিদ—শাখ্ত-এর কথায় যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুবাদকৃত ইসলামী বিশ্বকোষে ‘যাকাত’ শব্দ সম্পর্কে লিখিত হয়েছে: নবী করীম (স) ‘যাকাত’ শব্দটি তার আভিধানিক অর্থের তুলনায় অনেক বেশী প্রশস্ত তাৎপর্যে ব্যবহার করছেন। তিনি আসলে শব্দটির ইয়াহুদী ব্যবহার গ্রহণ করেছেন। (ইয়াহুদী ব্যবহারে এরমীয় শব্দ—যাকাত (***) মক্তা শরীফে (****) বা (****) রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। (***) মূল থেকে বিভিন্ন রূপ গটিত হয়, (***) অর্থ (***) পবিত্র হয়েছে। যাকাতরে সাথে সম্পৃক্ত-আরবদের আভিধানিক অনুভূতির দিক দিয়ে, এসব বিভিন্নভাবে গড়া শব্দ কুরআনে ব্যবহৃত হয়ে সেই অর্থ দেয় না যা মূলত আরবী নয়। যা ইয়াহুদী ভাষা থেকে গৃহীত। তার অর্থ: ‘তাকয়া’। [(আরবী*********)] শাখ্ত ও অন্য প্রাচ্যবিদগণ (Orientalists) ইসলামের চিন্তাধারা, তার পরিভাষিক শব্দ, বিধি-বিধান, তাৎপর্য ইত্যাদিকে ইয়াহুদী বা খৃস্টানদের উৎসের সাথে সম্পর্কিত দেখাবার জন্য একটা চরম পাগলামিমূলক অহমিকায় নিমজ্জিত। তারা যেগুলোকে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কোন-না কোন উৎস থেকে আসা বলে প্রমাণ করতে সব সময় সচেষ্ট থাকেন। আসলে এ ক্ষেত্রে তারা একটা অমূলক ধারণা দ্বারা চালিত। নিজেদের ইচ্ছেমতই তারা যা তা বলতেও কুণ্ঠিত নন। এ কথার জবাবে আমরা দুটি বিষয়ের অবতারণা যথেষ্ট বলে মনে করছি: প্রথমত, কুরআন মজীদ ‘যাকাত’ শব্দটি মুসলিম সমাজে পরিচিত অর্থেই ব্যবহার করেছে সেই মক্কী জীবনের প্রাথমিক সময় থেকেই। এ পর্যায়ে আল-আরাফ-এর ১৫৬ আয়াত, সূরা মরিয়মের ৩১ ও ৫৫ আয়াত, সূরা আল-আম্বিয়ার ৭২ আয়াত, সূরা আল-মুমিনুনের ৪ আয়াত, সূরা আন-নামলের ৩ আয়াত, সূরা আর-রুম-এর ৩৯ আয়াত, সূরা লুকমানের ৩ আয়াত, সূরা ফুস্সিলাত-এর ৭ আয়াত দ্রষ্টব্য। আর নিশ্চিতরূপে বলা যায়, নবী করীম (স) ইব্রীয় ভাষা জানতেন না। আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানতে পারা তাঁর পক্ষে আদৌ সম্ভভপরও ছিল না। ইয়াহুদীদের সাথে তার দেখা-সাক্ষাৎ ও মেলামেশা সম্ভব হয়েছিল মদীনা শরীফে হিজরতের পরে, তার পূর্বে নয়। তাহলে তিনি কুরআনের এসব মক্কী সূরার আয়াতে ব্যবহৃত ‘যাকাত’ শব্দ ইয়াহুদ বা ইয়াহুদী ভাষা থেকে কি করে গ্রহণ করতে পারেন? সুতরাং শাখ্ত-এর ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দ্বিতীযত, দুই ভাষায় সমন্বিত অর্থের কোন শব্দ পাওয়া গেলে তা যথাযথ উদ্ধৃত করার চিন্তা করা গবেষণা পদ্ধতি ও আলিমদের পরিণাম-চিন্তা-উদাসীন বিরোধী চরিত্রের ব্যাপারে। একই অর্থের শব্দ হলে দুই ভাষার এক ভাষায় অপর ভাষা থেকে গ্রহণ করা কোন জরুরী ব্যাপার নয়। তৃতীয়ত, দুই ভাষার মধ্যে একটিকে নকলকারী এবং অপরটিকে তা থেকে নকল করা হয়েছে মনে করা একটা যুক্তি বা প্রমাণহীন জবরদস্তি ব্যাপার। যা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়, তাকেই অগ্রাধিকার দান করা। এ পদ্ধতিকে যারা অভ্যাস হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের জ্ঞানের আমানতের খিয়ানত হয়ে যায় এবং আলিম চরিত্রের পরিপন্থী কাজ হয়, তাতে সন্দেহ নেই। সাদকার অর্থ কুরআন ও সুন্নাতের ভাষায় শরীয়াতসম্মত ও ‘যাকাত’ ‘সাদকা’ নামে অভিহিত। মা-ওয়ার্দী লিখেছেন: সাদকা যাকাত, যাকাত সাদকা। নাম পার্থক্যপূর্ণ হলৌ সে জিনিসের নামকরণ করা হয়েছে, তা এক ও অভিন্ন। [(আরবী*********) একাদশ অধ্যায়] আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) তাদের ধন-মাল থেকে সাদকা গ্রহণ কর, তুমি তার দ্বারা তাদের পবিত্র করবে ও পরিচ্ছন্ন নির্মল করবে। বলেছেন: (আরবী*********) এদের মধ্যে এমনলোক রয়েছে যারা সাদকাতের ব্যাপারে তোমাকে দোষী করে, তা থেকে তাদের দেয়া হলে তারা সন্তুষ্ট হয়। আরর দেয়া না হলে তখন তারা অসন্তুষ্ট। (আরবী*********) সাদকাত (যাকাত) ফকীর ও মিসকীনের জন্য.....। [মরহুম মূসা‘শাখ্ত ইউসুফ সম্পর্কে বিশ্বকোষ (****)-এর টীকায় লিখেছেন: ‘কুরআন’ সর্ব প্রথম যাকাতকে ‘সাদকা’ নামে ভূষিত করেছে। পরে ‘যাকাত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের মক্কী সূরা-সমূহ সম্মুখে রেখে চিন্তা করলে বোঝা যায় কুর আন সর্বপ্রথম ‘যাকাত’ শব্দটিকে ব্যবহর করেছে। ‘সাদকা’ বা ‘সাদাকাত’ শব্দের ব্যবহার কেবলমাত্র মাদানীয় সমাজেই হয়েছে।’ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে: (আরবী*********) পাঁচ অসক্ ফসলের ‘সাদকা’ নেই। তিন বছর থেকে দশ বছর বয়সের উষ্ট্রের পাঁচটির কমে সাদকা নেই। আর পাঁচ আওয়অকের (***) কমে সাদকা নেই। হযরত মুয়ায (রা)-কে ইয়েমেনে প্রেরণ সংক্রান্ত হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী*********) তাদের জানিয়ে দাও যে, তাদের ধন-মালে আল্লাহ্ তা’আলা সাদকা ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে। এ সব ঘোষণা ও অকাট্য বিধান ‘যাকাত’ সম্পর্কেই উদ্ধৃত হয়েছে, যদিও শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘সাদকা’। যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারীকে ‘মুসাদ্দিক’ –‘সাদকা আদায়কারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা সে সাদকা একত্র করে এবং বন্টন প্রার্থ ও ভিখারীদের দেয়া হয়। কিন্তু প্রচলিত ব্যবহার যেন আমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং কুরআন নাযিল হওয়া কালে আরবদের ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের মূল তত্ত্ব থেকে যেন আমরা বঞ্চিত হয়ে না থাকি, সেদিকে আমাদেরকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। আর ‘সাদকা’ শব্দটি সিদ্ক-সত্যতা থেকে গৃহীত। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী ‘যাকাত’-কে ‘সাদকা’ নামে অভিহিত করা সম্পর্কে একটা দৃঢ় কথা বলেছেন। তাঁর কথা হল, এ শব্দটি মুখের কথা ও দিলের বিশ্বাসের অনুরূপ কাজ বোঝানোর জন্যে ‘সিদ্কা’ থেকে গৃহীত হয়েছে। (****) এ তিনটি অক্ষর দ্বারা গঠিত শব্দ (****) একটি জিনিস দ্বারা অপর একটি জিনিস প্রমাণ করা ও তাকে শক্তিশালী করার দিকে ইংগিত করা বোঝায় (****) ‘নারীর মোহরানা’ বলতে বোঝায়, শরীয়াত অনুযায়ী বিয়ের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়তার হালাল হওয়াএবং তার সত্যতা প্রমাণ করা। শব্দটির রূপান্তর ঘটলে অর্থেও পার্থক্য ঘটবে। যেমন বলা হয়: (আরবী*********) ‘সেসত্য কথা বলেছে, কথার সত্যতা প্রমানিত করেছে, যেমন করে তা প্রমাণ করতে হয়।’ আর- (আরবী*********) আমি অর্থ দান করেছি। যেমন করে তা দান করতে হয়। (আরবী*********) স্ত্রীটিকে আমি মোহরানা দিয়েছি, যেমন করে তা দিতে হয়। শব্দের রূপান্তর বলতে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থর প্রতি ইংগিত করা বোঝায়। এ সিদ্ক বা সত্যতার সদৃশ শব্দ হচ্ছে ‘সাদকা’। দ্বীনের সবচাইতে বেশী প্রত্যয়পূর্ণ। আর এ নিকটবর্তী ঘর পরকালে যাওয়ার সিঁড়ি। মন্দ কিংবা ভালোর দিকে যাওয়ার দ্বার-যার জন্রে সে কাজ করেছে। সে অগ্রে যা পাঠিয়েছে, তা-ই তথায় পাবে। এ ব্যাপারে সে সন্দেহ করলে বা সেজন্যে কাজ করায় আলস্র করলে, তার উপর পৃথিবীর জীবনকে অধিক গুরুত্ব দিলে সে তার ধন-মালে কার্পণ্য করবে, তার কামনা-বাসনা পূরণে প্রস্তুতি নিলে পরিণামের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে না।[(আরবী*********)] আমি বলব, এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা (***) দেয়ার ও (***) সত্য বলে মানা—এ দুইয়ের সমন্বয় করেছেন, যেমন সমন্বয় করেছেন কার্পণ্য ও মিথ্যা মনে করার মধ্যে নিম্নের আয়াতে: (আরবী*********) অতেএব যে দিল ও ভয় করল এবং জান্নাতকে সত্য বলে মেনে নিল, আমরা অবশ্যইতার জন্যে জান্নাত সহজলভ্য করে দেব। আর যে লোক কার্পণ্য করল—বেপরোয়া নীতি অনুসরণ করল এবং জান্নাতকে মিথ্যা মনে করল, তার জন্যে কষ্টের জাহান্নাম অবশ্যই সহজপ্রাপ্য করে দেব। কাজেই ‘সাদকা’ ঈমানে সত্যতার প্রমাণ এবং বিচার দিনের সত্যতা যথার্থতার স্বীকৃতি। এ জন্যেই নবী করীম(স) বলেছেন: (আরবী*********) সাদকা অকাট্য দলীল। কুরআন মজীদে যাকাত কুরআন মজীদে ‘যাকাত’ শব্দটি বারবার উল্লিখিত হয়েছে একটি সর্বজন-পরিচিত শব্দ (****) হিসেবে[মাত্র দুটি আয়াতে ‘অপরিচিত’ (***) হিসেবেব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন অর্থে। একটি সূরা কাহাফে, অপরটি সূরা মারিয়ামে।] ত্রিশটি আয়াতে। তন্মধ্যে সাতাশটি আয়াতে নামযের সঙ্গে একত্র করে। একটি আয়াতে নামাযের প্রেক্ষিতে উল্লিখিত হয়েছে। আয়াতটি হচ্ছে: (আরবী*********) আর যারা ‘যাকাত’ দানেসক্রিয়। এরই পূর্বে রয়েছে: (আরবী*********) যারা তাদের নামাযে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় নিমগ্ন। অবশিষ্ট যে ত্রিশটি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি উদ্ধৃত হয়েছে, তন্মধে্যে আটটি হচ্ছে মক্কী সূরার আয়াত। আর সবকয়টিই মাদানী সূরায় রয়েছে। [(আরবী*********) এ ‘যাকাত’ শব্দ দ্রষ্টব্য—মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুলবাকী লিখিত] কোন কোন গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন যে, কুরআনের ৮২টি আয়অতে ‘যাকাত’ শব্দটির নামাযের সাথে উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু এটা খুব বাড়াবাড়ি মনে হয়। উপরে উল্লিখিত গণনা তার প্রতিবাদ করে। তারা যদি বলে যে, ‘যাকাত’ বলতে সে সবই বোঝায়, যাতে ‘ব্যয়’ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে—যেমন (***) ও (***) মিসকীনের খাবার প্রভৃতি, তাহলে বলব এ সংখ্যাটি সুসংবদ্ধ নয়। বাহ্যত মনে হয়, ৩২ সংখ্যাকেভুল বশত ৮২ লিখাহয়েছে। আর ‘সাদকা’ (***) এবং ‘সাদকাত’ (***) শব্দটি কুরআনে ১২টি বার এসেছে। এ সবই মাদানী সূরায়। প্রথম অধ্যায় যাকাত ওয়াজিব: ইসলামে তার স্থান প্রাচীন সভ্যতায় দরিদ্র শ্রেণীর অবস্থা দরিদ্রদের প্রতি কল্যাণকরণে আসমানী ধর্মসমূহের উদারতা মক্কী পর্যায়ে পর্যন্ত দরিদ্রদের প্রতি ইসলামের সহানুভূতিমূলক অবদান মক্কী জীবন পর্যন্ত শুধু যাকাতের উৎসাহ দান সুনির্দিষ্ট পমিাণে যাকাত ফরয ঘোষণা- মাদানী যুগে ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব যে তার দিকে অস্বীকা র কারে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ইসলামের যাকাত ও অন্যান ধর্মের কল্যাণকর কাজের মধ্যে পার্থক্য যাকাত সম্পর্কে শাখ্ত-এর বিভিন্ন ধারণার সমালোচনা শুরু কথা দ্বীন-ইসলামে ‘যাকাত’ ফরয হওয়া এবং তার গুরুত্ব ও স্থান সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বেইসলাম-পূর্ব সমাজে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণী লোকদের কি অবস্থা ছিল তার বিশ্লেষণ দেয়া সমীচীন মনে হচ্ছে। প্রাচীন কালের ধর্মবিধান তাদের প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যার সমাধানে কতটা অবদান রেখেছে, সেই বর্ণনাও এ প্রসঙ্গে উপস্থাপন আবশ্যক। এই অধয়নে জানা যাবেযে, এহেন গুরুত্বপূর্ণ দিকটির সংশোধনে ইসলাম অন্যান সর্ব প্রকার ধর্ম ও মতকে অতিক্রম করে গেছে। শুধু তাই নয়, ইসলাম এর মৌলিক সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছে। ইসলাম সুবিচারের ভিত্তি স্থাপনের সাথে সাথে সামাজিক-সামষ্টিক নিরাপত্তা দানেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ইসলামের এই অবদান দৃঢ় ভিত্তিক, তার স্তম্ভসমূহ অত্যন্ত মজবুত। কুরআন মজীদ এর অবতারণা করেছে এবং রাসূলের হাদীসবা সুন্নাত তার রূপায়ণ করেছে। প্রাচীন সভ্যতার দরিদ্র সমাজ মানুষ অতীব প্রাচীনকাল থেকেই দারিদ্র্য ও অধিকার বঞ্চনার সাথে মুকাবিলা করে এসেছে। দূর অতীতকালের ইতিহাসে দরিদ্র ও বঞ্চিত মানবতার উল্লেখ বিদ্যমান। সত্য কথা হচ্ছে, মানব সভ্যতা কোন এক যুগেও এমন সব লোক থেকে শূন্য ছিল না, যারা মানবতাকে আহ্বান জানাতে সতত কর্তব্যরত ছিল। মানবতাকে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার এবং তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা-প্রচেষ্টা আজকের দিনে কোন নতুন কথা নয়। তবে দরিদ্র জনগণ খুবই মর্মান্তিক অবস্থার সম্মুখীন হয়ে রয়েছে চিরকাল। মানবতার ললাটদেশে তা ছিল একটা কলংক টিকা। এ যুগের মনীষী-বিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিকগণ সমাজকে যে উপদেশদিয়েছেন, সমাজ তা কখনই গ্রাহ্য করেনি। এখানে একজন খ্যাতনামা গ্রন্থকারের উল্লেখ করা যায়। [তিনি উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মাদ ফরীদ ওজদী (আরবী**********) দ্রষ্টব্য। তিনি সেই প্রাচীনকাল থেকেই এ কালো ইতিহাসকে আমাদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। সব-পাওয়া ধনী ও সর্বহারা দরিদ্রের মধ্যকার এই ইতিহাস খুবই মর্মস্পর্শী। তিনি লিখেছেন: ‘প্রাচীনকালের জাতিসমূহের ইতিহাস গ্রন্থকার যেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, দেখতে পেয়েছেন, মানুষ মাত্র দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। এ দুয়ের মাঝে তৃতীয় শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়নি।শ্রেণী দুটি হচ্ছে: ধনী ও দরিদ্র। এর পশ্চাতে লক্ষ্য যোগ্র ব্যাপার ছিল, ধনী শ্রেণীর স্ফীতি সীমা ছাড়িয়ে গেছে আর দরিদ্র শ্রেণী ক্ষীন হতে হতে মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তেলহীন প্রদীপেরন্যায় নিভু নিভু জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে মাত্র। এরূপ দুর্বলতার ভিত্তির উপর সমাজ-প্রাসাদের ভিত্তি সংস্থাপিত। ধনী সুখী শ্রেণী কোন্ দিকথেকে যে তাদের মাথার উপর ছাদ ধ্বসে পড়বে, তা ভাবতেও সক্ষম নয়। প্রাচীন মিসরছিল পৃথিবীর বুকে আল্লাহ্র জান্নাত। তথায় যে ফসল ও খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হত তা সেখান কার অধিবাসীদের কয়েকগুণ বেশী লোকের জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু সেখানকার দরিদ্র শ্রেণী খাবার থেকে বঞ্চিত ছিল। কেননা ধনী শ্রেণীর লোকেরা তাদের জন্যে নিতান্ত উচ্ছিষ্ট বা তলানী ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রাখতো না। আর তা খেয়ে তাদের জীবন ধারণ ছিল অসম্ভব। দ্বাদশ পরিবারের রাজত্বের আমলে যখন মারাত্মক ধরনের দুর্ভিক্ষ দেখা দিল তখন দরিদ্ররা ধনীদের কাছে নিজেদের বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হল। আর তারা তখনসুযোগ পেয়ে দরিদ্রদের চরমভাবে গ্রাসকরে ফেলল এবং অমানুষিক আযাব ও নির্যাতন-নিষ্পেষণে তাদের জর্জরিত করে দিল। ব্যাবিলনেও দরিদ্রদের অবস্থা মিসরের মতই ছিল। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির কোন ফল দরিদ্রদের ভাগ্যে জুটত না, যদিও প্রবৃদ্ধি ও উৎসর্গতায় তারা ফিরাউনের দেশের তুলনায় কিছুমাত্র পশ্চাদপদ ছিল না। সেখানকার ঝরণাসমূহ পারস্য পর্যন্ত প্রবাহিত হত। প্রাচীন গ্রীক সমাজের অবস্থা এ থেকে ভিন্নতর ছিল না বরং কোন কোন রাজত্বকালের এমন ঘটনা ইতিহাসে উদ্ধৃত হয়েছে, যা অন্তরে কম্পন এবং দেহে লোমহর্ষণ সৃষ্টি করে। দরিদ্র শ্রেণীর লোকদেরতারা অত্যন্ত হীন কাজে নিয়োজিত করত এবং সামান্য কারণে ছাগল যবেহ করার ন্যায় তাদের যবেহ করত। স্পার্টর শাসন আমলে দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের সম্পূর্ণ অনুর্বর ও অ-আবাদযোগ্য জমিতে চাষাবাদের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে তারা প্রাণপণ পরিশ্রম করেও খাদ্যোৎপাদনে অক্ষম থেকে যায় এবং তারা না খেয়ে থাকতে ও মরতে বাধ্য হয়। আবিসিনিয়ায় ধনী শ্রেণীর লোকেরা দরিদ্রের উপর এমন শাসন ও প্রশাসন চালাত যে, তারা তাদের ঠিক ক্রীতদাসের মত হাটে-বাজারে বিক্রয় করে দিত যদি তাদের উপর ধার্যকৃত কর ও র্যালেট দিতে অক্ষম হয়ে পড়ত। রোম ছিল আইন-বিধানেরন কেন্দ্রভূমি। বড় বড় আইনবিদ ও আইনের মূলনীতি-বিদদের অধিবাস ও অবস্থান ছিল এখানে। ধনী শ্রেণীর লোকেরাই জনগণের উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সাধারণ মানুষ থেকে তারা অত্যন্ত ভিন্নতর ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল, আর তাদের অন্তরালে সাধারণ মানুষ ছিল সবদিক দিয়ে পরিত্যক্ত, অবহেলিত ও পদদলিত। তাদের তারা কিছুই দিত না। তারা যখন খুব বেশী দুর্বলহয়ে পড়ত, তখন তারা শহর-নগর ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হত। এ দিক দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘মিলিশিয়া’ লিখেছেন: দরিদ্ররা প্রতিদিন দরিদ্রতর হয়ে যেত, ধনীরা ক্রমশ অধিকতর ধনশালী হয়ে যেত। তারা বলত, দেশেরসব লোক ধ্বংস হোক, না খেয়ে মরুক। তাহলে তারা আর যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারবে না। [(আরবী**********)] রোমান সম্রাজ্যের পতনেরপর তার সমাধির উপর যখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ গড়ে উঠল, তখন দরিদ্র শ্রেণীর অবস্থা আরও মারাত্মক ও মর্মান্তিক হয়ে পড়ল। তখন তারা তাদের অঞ্চলে তাদের জমি-ক্ষেতসহ ঠিক গরু-ছাগলের মত ক্রয়-বিক্রয় হত। প্রাচীন সুদীর্ঘকালের দরিদ্র সমাজের এটা হল ইতিহাস। ধনী লোকদের ভূমিকা এ সমস্ত কালে এক ও অভিন্ন ছিল। এক্ষণে প্রশ্ন জাগে যে, এরূপ অবস্থায় দরিদ্রদের মুক্তি এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা বিলোপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের কি ভূমিকা ছিল? দরিদ্রের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মের ভূমিকা সত্য কথা এই যে, দুনিয়ার সব ধর্মই—মনগড়া ধর্ম ব্যবস্থাসমূহ ও কোন আসমানী কিতাবেরসাথে যে-সবধর্মেরকোন সম্পর্ক নেই—মানব সমাজের এ দিকটির প্রতি যথাসাধ্য দৃষ্টি পাত করেছে। কেননা এ ছাড়া সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও পবিত্র জীবনের ভাবধারা প্রবাহমান হতে পারে না। চার হাজার বছর পূর্বেদুটি খালের মাঝে অবস্থিত দেশগুলোতেও আমরা তাই দেখতে পাই। সর্বপ্রথম শরীয়াতের বিধান ও আইন হাম্বুরাবীর মাধ্যমে পাওয়া যায়। তিনি প্রথম সম্বর্ধনা পর্যায়ে বলেছিলেন: আল্লাহ্গণ তাকে পাঠিয়েছেন দুর্বল লোকদের উপর নিগ্রহ-নির্যাতন চালানো থেকে শক্তিশালীদের বিরত রাখার উদ্দেশ্যে, জনগণকে হিদায়াতের পথ দেখাতে এবং সুযোগ-সুবিধাকে সাধারণের জন্যে নিরাপত্তাপূর্ণকরে দেয়ার লক্ষ্যে। কয়েক হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মিসরের জনগণ এ দিক দিয়ে সচেতন ছিল যে, তারা যখন বলত: আমি ক্ষুধার্তকে খাবার দিয়েছি, বস্ত্রহীনকে পোশাক দিয়েছি, যারা নদী পার হতে পারছিল না, তাদের আমার নৌকায় পার করে দিয়েছি, আমি ইয়াতীমের পিতা হয়েছ, বিধবার স্বামী হয়েছি এবং প্রচষ্ট বাতাসের ঝাপটায় ছিন্ন-ভিন্ন লোকদের সংরক্ষণকারী হয়েছি—তখন তারা ঠিক ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছিল। [(আরবী**********)] আসমানী ধর্মসমূহের অবদান তবে আসমানী ধর্মসমূহের দরিদ্র ও দুর্বল লোকদের কল্যাণের জন্যে যে দাওয়াত ছিল, তা ছিল অধিকতর বলিষ্ঠ ও গভীর প্রভাবশালী। অন্যান্য মানবীয় দর্শনের তুলনায় সে সবেরঅবদান ছিল অসামান্য। মানব রচিত ধর্মমত ও বা বৈষয়িক ধর্মবিশ্বাস অনুরূপ অবদান রাখতে সম্পূর্ণ অক্ষম ছিল। কুরআন ‘যাকাত’ নামে যে জিনিসকে অভিহিত করেছে, কোন নবী-রাসূলের দাওয়াত এ মানবিক দিকের প্রতি গুরুত্ব আরোপ না করে পারে নি। এ পর্যায়ে যখন আমরা কুরআন মজীদের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করি, -এ কুরআনই হচ্ছে বিশ্বমানবতার জন্যে সর্বশেষ ও অবশিষ্ট নির্ভরযোগ্য ও সহীহতম দলীল—তখন আমরা দেখতে পাই, হযরত ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে: (আরবী**********) আমরাতাদের ইমাম (নেতা) বানিয়েছি, তারা আমার বিধান অনুযায়ী চলে এবং আমরা তাদের প্রতি ভালো-ভালো কাজ, নামায কায়েমকরা ও যাকাত দেয়ার জন্যে ওহী পাঠিয়েছি। আর তারা বস্তুতই আমাদের ইবাদাতকারী ছিল। হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে: (আরবী**********) কিতাবে ইসমাইলের কথা স্মরণ কর। সে ওয়াদা সত্যপ্রমাণকারী ছিল। ছিল রাসূল, নবী। সে তার জনগণকে নামায পড়ার ও যাকাত দেয়ার জন্যে নির্দেশদিত। আর সে তার আল্লাহ্র কাছে পছন্দ, সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ছিল। বনূ ইসরাঈলীদের সাথে চুক্তির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: (আরবী**********) আর স্মরণ কর, আমরা যখন বনূ ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ চাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না, পিতামার সাথে আন্তরিকভাবে....ভালো ব্যবহার করবে.... নামায কায়েমকর ও যাকাত দাও.... অপর এক সূরায় উদ্ধৃত হয়েছে: (আরবী**********) আল্লাহ তা’আলা বনূ ইসমাইলের কাছ থেকে চুক্তি গ্রহণ করেছেন। আমরা তাদের মধ্য থেকে বারজন দল-প্রধান প্রেরণ করলাম। আর আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি যদি তোমরা নামাযকায়েম কর, যাকাত দাও এবং আমার নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা কর, আর আল্লাহকে ‘করযে হাসানা’ দাও, তাহলে আমিতোমাদের থেকে তোমাদের সব খারাপ ও দোষ দূর করে দেব এবং তোমাদের সেই জান্নাতে দাখিল করে দেব, যার নিম্নদেশথেকে ঝর্ণাধারা সতত প্রবাহমান। আর যে কুফল করবে এরপর, সে তো সঠিক সরল পথ হারিয়ে ফেলল। হযরত ঈসা (আ) দোলনায় থাকাকালে বলেছিলেন: স(আরবী**********) এবং আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন নামায ও যাকাত সম্পর্কে যদ্দিন আমি জীবিত থাকব। সাধারণ আহ্লি কিতাব সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন: (আরবী**********) তাদের শুধু এই নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা একমাত্র আল্লাহ্রই ইবাদত করবে, তারই জন্যে আনুগত্যকে খালেস করে একমুখী হবে। আর তারা নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। আর িএ-ই হচ্ছে স্থির-সঠিক সুদৃঢ় দ্বীন। আমরা যখন তাওরাত ও ইনজীল—পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম—দেখি—যা আমাদের সামনেই রয়েছে—তখন তাতে দুর্বল ও দরিদ্র লোকদের প্রতি সহৃদয়তা ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ গ্রহণের বহু আদেশ ও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদিপুস্তকে বলা হয়েছে: যে দরিদ্রের ক্রন্দনে কর্ণরোধ করে সে আপনিই ডাকিবে কিন্তু উত্তর পাইবে না। গুপ্তধন শান্ত করে ক্রোধ আর বক্ষ স্থলে দত্ত উপঢৌকন শান্ত করে প্রচণ্ড ক্রোধ। (হিতোপদেশ: ২১:১৩, ১৪) সুনয়ন ব্যক্তি আশীর্বাদযুক্ত হইবে; কারণ সে দীনহীন লোককে আপন খাদ্যের অংশ দেয়। (পুর্বোক্ত: ২২:৯) যে দরিদ্রকে দান করে সে পরমুখাপেক্ষী হয় না। আর যে তার চক্ষুদ্বয় আড়াল করে, তার উপর অশেষ অভিসম্পাত। (পূর্বোক্ত: ২৭) অন্যত্র বলা হয়েছে:” তোমার ভাইদের মধ্যে কেউ দরিদ্র হলে, তোমার দরজায় কোন দরিদ্র এলে—তোমার দেশে যা, তোমার আল্লাহ্ সদাপ্রভু তোমাকে দিয়েছেন তার প্রতি তোমার মন কঠিন করিও না। তোমার দরিদ্র ভাই থেকে তোমার হাত গুটিয়ে নিও না। বরং তার জন্য উন্মুক্ত কর তোমার হস্ত। তাকে ঋণ দাও, যতটা তার প্রয়োজন সেই পরিমাণ দাও তাকে। দেওয়ার সময় তোমার মন যেন খারাপ হয়ে না যায়। কেননা এ কাজের দরুন তোমার আল্লাহ সদাপ্রভু তোমাকে বরকত দেবেন। তোমার সব কাজে এবং সেইসব ক্ষেত্রে, যেদিকে তোমাকে হাত প্রসারিত করবে। কেননা পৃথিবীতে দরিদ্রদের কখনও হারাবে না। এ জন্যে আমি তোমাদের উপদেশদিয়ে বলছি: তোমার দরিদ্র ভাইয়ের জন্যে তোমার হস্ত উন্মুক্ত কর তোমার নিজ দেশে। (দ্বিতীয় বিবরণ: ১৫:৭, ৮) বলা হয়েছে: তুমি তোমার বীজ হইতে উৎপন্ন যাবতীয় শস্যের বীজ বৎসের যাহা ক্ষেতে উৎপন্ন হয়, তাহার দশমাংশ পৃথক করিবে। (পূর্বোক্ত: ২২) তৃতীয় বৎসরের শেষে তুমি সেই বৎসরে উৎপন্ন আপন শস্যাদিব যাবতীয় দশমাংশ বাহির করিয়া আনিয়া আপন নগর-দ্বারের ভিতরে সঞ্চয় করিয়া রাখিবে। তাহাতে তোমার সাথে যাহার কোন অংশ কি অধিকার নাই, সেই লেবীয় এবং বিদেশী, পিতৃহীন ও বিধবা, তোমার নগর-দ্বারের মধ্যবর্তী এই সকল লোক আসিয়া ভোজন করিয়া তৃপ্ত হইবে; এরূপে যেন তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমার হস্তকৃত সমস্ত কর্মে তোমাকে আশীর্বাদ করেন। বলা হয়েছে: তোমরা যা কিছু সব বিক্রয় কর এবং সাদকা দাও। (১৩:৩৩) যাহার দু’খানা কাপড় সেযেন যার নাই তাহাকে দেয়। যাহার খাদ্য আছে সেও যেন তাহাই করে। (১৪:১০) বরং ভিতরে যাহা আছে, তাহা দান কর, আর দেখ, তোমাদের পক্ষে সকলই শুচি। (লূক: ১১:৪১) তুমিযখন মধ্যাহ্নভোজ কিংবা রাত্রিভোজ প্রস্তুত কর, তখন তোমার বন্ধুগণকে বা তোমার ভ্রাতাদিগকে বা তোমার জ্ঞাতিদিগকে কিংবা ধনী প্রতিবেশীগণকে ডাকিও না; কি জানি তাহারাও তোমাকে পাল্টা নিমন্ত্রণ করিবে, আর তুমি প্রতিদিন পাইবে। কিন্তু তুমি যখন ভোজ প্রস্তুত করিবে তখন দরিদ্র, লুলা, খঞ্জ ও অন্ধদিগকে নিমন্ত্রণ করিও, তাহাতে ধন্য হইবে, কেননা তোমার প্রতিদান করিতে তাহাদের কিছুই নাই, তাই ধার্মিকগণের পুনরুত্থান সময়ে তুমি প্রতিদান পাইবে। (লুক-১৪:১২:১৪) পরে তিনি চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন, ধনবানেনা ভান্ডারে আপন-আপন দান রাখিতেছে। আর তিনি দেখিলেন, একটি দীন হীনা বিধবাসেই স্থানে দুটি সিকি পয়সারাখিতেছে; তখন তিনি কহিলেন, আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি এই দরিদ্র বিধবা সকলের অপেক্ষা অধিক রাখিল, কেননা ইহারা সকলে আপন আপন অতিরিক্ত ধন হইতে কিছু কিছু দানের মধ্যে রাখিল কিন্তু এ নিজ অনটন সত্ত্বেও ইহার যাহা কিছু ছিল, সমুদয় জীবনোপায় রাখিল। যে তোমার কাছে যাচ্ঞা করে তাহাকে দাও, এবং যে তোমার কাছে ধার চায় তাহা হইতে বিমুখ হইও না। সাবধান, লোককে দেখাইবার জন্য তাহাদের সাক্ষাতে তোমাদের ধর্ম করিও না, করিলে তোমাদের স্বর্গস্থ পিতার কাছে তোমাদের পুরষ্কার নাই। অতএব তুমি যখন দান কর, তখন তোমার সম্মুখে তুরি বাজাইও না, যেমন কপটরা লোকের কাছে গৌরব পাইবার জন্য সমাজ-গৃহে ও পথে করিয়া থাকে। আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, তাহারা আপনাদের পুরস্কার পাইয়াছে। কিন্তু তুমিযখন দান কর তখন তোমাদের দক্ষিন হস্ত কি করিতেছে তাহা তোমার বাম হস্তকে জানিতে দিও না। এইরূপে তোমার দান যেন গোপনে হয়, তাহাতে তোমার পিতা, যিনি গোপনে দেখেন, তিনি তোমাকে ফল দিবেন। (মথি, ৬:৪-১) আর যে কেহ এই ক্ষুদ্রগণের মধ্যে কোন একজনকে শিষ্য বলিয়া কেবল এক বাটি শীতল জল পান করিতে দেয়, আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, যে কোন মতে আপন পুরস্কার বঞ্চিত হইবে না। (মথি, ১০:৪২) পর্যালোচনা: দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের ব্যাপারে প্রাচীন ধর্মসমূহ যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার কিছুটা উজ্জ্বল নমুনা উপরে উদ্ধৃত হল। কুরআনে পূর্বেকার আসমানী কিতাবসমূহের এটাই ছিল দাওয়াত। কিন্তু এখানে কতিপয় বিষয় স্পষ্ট প্রয়োজন বলে মনে করছি: ১. এ সব উদ্ধৃতি থেকে এ কথা স্পষ্ট জানা গেল যে, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ দরিদ্রদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্যে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছে। স্বার্থপরতা ও কার্পণ্যের প্রণিতি সম্পর্কে ভয় দেখানো হয়েছে এবং ব্যক্তিগত ও ইচ্ছামূলকভাবে দান সাদকা করার জন্যে স্পষ্ট বলিষ্ঠ আহবান পেশ করেছে। ২. তবে এগুলো এই কাজকে কর্তব্য ও বাধ্যতামূলক করার দিক দিয়ে উচ্চতর মানে উন্নীত হতে পারে নি। এসব কাজ না করলেও দ্বীনের কোন মৌলিক কাজ ত্যাগ করা হয়েছে বলে এসব কথা দ্বারা অনুভূতি জেগে উঠে না এবং তদ্দরুন ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ্ তা’আলা কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করবেন, সে কথাও তা থেকে জানা যায় না। ৩. এই কাজকে ব্যক্তির খুশী—ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাদের মনকে এদিকে উৎসাহিত করতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের উপর এই কাজ করানোর জন্যে রাষ্ট্রকে কোন কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি। না সংগ্রহ ও আদায় করার জন্যে, না তা বন্টন করার জন্যে। ৪. সাদকা ও দান করার কাজ কর্তব্র হওয়ার জন্যে ধন-মালের কোন পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। তার জন্যে কোন শর্তও আরোপ করা হয়নি। কত পরিমাণ দিতে হবে, তাও অনির্ধারিতই রয়ে গেছে। এর ফলে রাষ্ট্র তা আদায় করে নেয়ার কোন দায়িত্ব বুঝতে পারে না। কেননা যার পরিমাণ নির্ধারিত নয়, সীমা অনির্দিষ্ট, তা আদায় করা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। ৫. দরিদ্রদের প্রতি যে অনুগ্রহ প্রদর্শন করার উপদেশ দেয়া হয়েছে, দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান তার লক্ষ্য নয়। দারিদ্র্য মূলোৎপাটিত করাকে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। দরিদ্র্যকে মালিকদের মুখী করে দেয়ারও কোন ইচ্ছা নেই বরং তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুধু তাদের দুরবস্থার মাত্রা হ্রাস করা এবং তাদের ফরিয়াদের ধ্বনিকে ক্ষীণ করা মাত্র। এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই দরিদ্র ও দুর্বল লোকেরা সক্ষম ধনী শ্রেণী লোকদের দয়া ও অনুগ্রহের অধীন বেঁচে থাকত। যখন তাদের মধ্যে আল্লাহ প্রেম, পরকালের ভয় জাগত কিংবা জনগণের কাছ থেকে প্রশংসা ও খ্যাতি লাভের ইচ্ছা জাগত, ঠিক তখনই তারা কিছু দান করত—পরিমাণ তার যত সামান্যই হোক-না-কেন, দুর্বল ও দরিদ্র্য জর্জরিত লোকেরা ঠিক তখনই ধনীদের কাছ থেকে কিছু একটা পেতে পারত। তখন এই ধনীরা বড় দাতা ও বদান্যতাসম্পন্ন লোক বলে প্রশংসিত হয়। কিন্তু তারা যখন ধন-প্রেম ও স্বার্থপরতায় অন্ধ হয়ে যেত, তখন দরিদ্রদের ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া চাড়া কোন পরিণতি হত না। দরিদ্র্যর থাবা তাদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। তা থেকে আত্মরক্ষা করার মত কোন অবলম্বনই তাদের ছিল না। অধিকারের দাবি তোলার সামর্থ্যও ছিল না তাদের। কেনা তাদের কোন অধিকার স্বীকৃতি ও সপরিজ্ঞাত ছিল না। এই অনুগ্রহদানের ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। দারিদ্র বিমোচনে ইসলামের অবদান দারিদ্র বিমোচনে ইসলামের অবদান দারিদ্র বিমোচনে ইসলামের ভূমিকা এবং দরিদ্র-অভাবগ্রস্ত ও দুর্বল-অক্ষম লোকদের প্রতি কর্তব্য পালনে ইসলামের যে নীতি ও অবদান; কোন আসমানী ধর্ম বা মানব রচিত বিধানই তার সমতুল্য হতে পারে না। শুধু লালন ও শিক্ষণ প্রশিক্ষণের দিকদিয়েই হোক কিংবা আইন প্রণয়ন ও সংগঠন গড়ে তোলার দিক দিয়েই হোক আর বাস্তবায়ন ও কার্যকরণের দিক দিয়েই হোক—কোন একটি দিক দিয়েও ইসলামের সাথে অন্য কিছুরই তুলনা হতে পারে না। মক্কী যুগ থেকে কুরআনের ভূমিকা দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানে ইসলামযে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে, গরীব জনগণ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছে, ইসলামের শুভ সূ্র্যোদয়কালীন মক্কা শরীফস্থ অবস্থাই তার বড় প্রমাণ। তখন মুসলমান ছিল আংগুল গণনা করা কয়েকজন ব্যক্তি মাত্র। দ্বীণ-ইসলাম কবুল করার কারণে তারা ছিল কঠিনভাবে বিপদগ্রস্ত। দ্বীনের দাওয়াত দানে তারা ছিল প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন। তাদের হাতে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তি বলতে কিছুই ছিল না। তখনও এই মানবিক সামষ্টিক—গরী মিসকীনদের ব্যাপারটি খুব বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। কুরআন মজীদ তার জন্যে বিশেষ ও স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কুরআন মজীদ এ পর্যায়ে কখনও মিসকীনকে খাদ্য দান ও সেজন্যে অন্যদের উৎসাহিতকরণের গুরুত্ব দিয়েছে, কখনও আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় ও বন্টনের কথা বলে উৎসাহিত করেছে; কখনও বলেছৈ, এ হচ্ছে প্রার্থ, বঞ্চিত মিসকীন ও নিঃসম্বল পথিকের অধিকার আদায়, কোথাও স্পষ্ট ভাষায় ‘যাকাত’ দেয়ার তাকীদ করেছে। বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন শিরোনামেতার উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মজীদ থেকে এ পর্যায়ে কতিপয়ের আয়াত এখানে উদ্ধৃত করা হলে আমাদের পূর্বোক্ত কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। মিসকীনকে খাবার দেয়া ঈমানের অংগ সূরা ‘আল-মুদ্দাসসির’ প্রাথমিক পর্যায়ে অবতীর্ণ সূরাসমহের অন্যতম। তাতে কিয়ামতের দিনের চিত্র অংকিত হয়েছে। দক্ষিণ বহুপন্থী মু’মিনগণ অপরাধী কাফির ও অমান্যকারীদের সম্পর্কে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে; এদের জন্যে তো জাহান্নাম নির্ধারিত করা হয়েছে। তাদের উপর কি ধরনের আযাব এসেছে, কি কি কারণে সে আযাবেতারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তা-ই হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাস্য। দেখানো হয়েছে যে, তাদের আযাবের মূল কারণ হচ্ছে মিসকীনদের অধিকারের প্রতি উপেক্ষা প্রদরশন, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও বস্ত্রহীনতার আগুনে তাদের দগ্ধ হওয়ার জন্যে ছেড়ে দেয়াও তাদের এই মর্মান্তিক অবস্থা বিদূরণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বলা হয়েছে: (আরবী***********) প্রতিটি প্রাণী স্বীয় উপার্জনের বিনিময়ে রেহেনবন্দী—দক্ষিণ বাহুওয়ালা লোকদের ব্যতীত। তারা তো জান্নাতে অবস্থান করবে। সেখানে তারা অপরাধী লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করবে: কোন্ জিনিসটি তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে গিয়েছে, তারা বলবে: আমরা নামায পড়া লোকদের মধ্যে শামিল ছিলাম না, মিসকীণদের খাবার খাওয়াতাম না। আর প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে কথা রচনাকারীদের সাথে মিলিত হয়ে আমরাও অনুরূপ কথাবার্তা রচনার কাজে মশগুল হয়েছিলাম। সেই সাথে প্রতিফল দেয়ার দিনটিকেও আমরা অসত্য মনে করতাম। মিসকীনদের পোশাক দান, আশ্রয় দান এবং তাদের প্রয়োজন ও অভাব-অনটন বিদূরণ প্রভৃতিও এই ‘খাদ্যদান’ (***) কথাটির অন্তর্ভুক্ত। সূরা ‘আল-কলম’-এর ভাষণে আল্লাহ্ তা’আলা সেই বাগান মালিকদের কিস্সা বর্ণনা করেছেন, যারা রাত্রিকালেই ফল আহরণের ওয়াদা পরস্পরে করেছে, যেন ফল পাড়ার সময় দরিদ্ররা যে স্বভাবতই ভিড় জমায় ও তা থেকে অংশ পেতে চায়, তার সুযোগটা না আসে বরং তারা যেন বঞ্চিতই থেকে যায়। কিন্তু আল্লাহ্র আযাব খুব শিগগিরই তাদের গ্রাস করে ফেলল। (আরবী*************) রাতের বেলা তারা নিদ্রামগ্ন ছিল। এই সময় তোমার আল্লাহ্র কাছ থেকে একটি বিপদ সেই বাগানের উপর অপতিত হল এবং তার অবস্থা যেন কর্তিত ফসলের মত হয়ে গেল। সকালবেলা তারা পরস্পরকে ডাকল যে, ফল পাড়তে হলে খুব সকাল-সকালই ক্ষেতের দিকে রওয়ানা হয়ে চল। অতঃপর তারা রওয়ানা হয়ে গেল। তারা পরস্পর চুপে চুপে (কথা) বলতে বলতে চলছিল যে, আজ যেন কোন ভিখারী তোমাদের কাছেও ঘেঁষতে না পারে; তারা কাউকে কিছু না দেয়ার সিদ্ধান্ত করে ফলে ভোরে ভোরে তাড়াহুড়া করে সেখানে এমনভাবে উপস্থিত হল যেন তারা ফল পাড়তে খুব সক্ষম। কিন্তু বাগানটি যখন তারা দেখল, তারা বলতে লাগল, আমরা নিশ্চয় পথ ভুলে গেছি। না, বরং আমরা বঞ্চিত রয়ে গেছি। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি উত্তম ছিল, সে বলল, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, তোমরা তসবীহ্ করো না কেন?... তারা উচ্চঃস্বরে বলে উঠল: মহান পবিত্র আমাদের রব্! আমরা সত্যই বড় গুনাহ্গার ছিলাম। পরে তারা পরস্পরকে তিরস্কার করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তারা বলল: আমাদের অবস্থার জন্যে বড়ই দুঃখ! আমরা নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী হয়ে গিয়েছিলাম। কুব অসম্ভব নয় যে, আমাদের রব্ আমাদের এ থেকেও উত্তম বাগান দান করবেন। আমরা আমাদের ইলাহ্র দিকেই ফিরে যাচ্ছি।.... এমনি হয়ে থাকে আযাব। আর পরকালের আযাব তো আরও অনেক বড়। যদি তারা তা জানতো। মিসকীনের অধিকার আদায়ের জন্যে উৎসাহ দান কুরআন মজীদের মক্কায় অবতীর্ণ সূরা ও আয়াত মিসকীনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন, তাদের খাবার দানের ও তাদের দুঃখ দূরীকরণের জন্যে উৎসাহ দান, তাদের প্রতি অবহেলা ও নির্মমতা প্রদর্শনে ভয় দেখানো প্রভৃতি কাজটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি, তা অতিক্রম করে সম্মুখের দিকে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। ইসলাম প্রত্যেক মুমিনের উপর মিসকীনের অধিকার ধার্য করে দিয়েছে তাদের খাবার দেয়ার ও তাদের দুঃখ মোচনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসার জন্যে। অন্যদের উৎসাহিত করাও তাদেরই দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর এ কাজ না করাকে আল্লাহ্র প্রতি কুফরী সমতুল্য এবং আল্লাহ্র ক্রোধ-অসন্তোষ ও পরকালীন আযাব উদ্রেককারী বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে?। সূরা ‘আল-হাক্কাহ্’ –এ বামপন্থীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: (আরবী**********) আর যার আমলনামা তার বাম হস্তে দেয়া হবে, সে বলবে, হায় আমার আমলনামা আমাকে যদি না-ই দেয়া হত আর আমার হিসেব কি তা যদি আমি না-ই জানতাম। হায়, আমার দুনিয়ায় ঘটিত মৃত্যুই যদি চূড়ান্ত হত। আজ আমার ধন-মাল আমার কোন কাজে এলো না। আমার সব ক্ষমতা-আধিপত্য-প্রভুত্ব নিঃশেষ হয়ে গেছে। পরে রাব্বুল আলামীন তার উপর সুবিচারপূর্ণ ফয়সালা জারি করেছেন, সে যে আযাব পাওয়ার যোগ্য, সেই আযাবই তাকে দেয়া হল। বলা হয়েছে: (আরবী**********) ধর লোকটিকে, তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দাও, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। আর তারপর তাকে সত্তর হতে দীর্ঘ শিকলে বেঁধে ফেল। এভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে আযাব, অপমান ও লাঞ্ছনা দেয়ার কারণ কি? তার কারণ দুটো। একটি, সে মহান আল্লাহ্র প্রতি ঈমান রাখতো না। আর দ্বিতীয়, মিসকীনদের খাবার দেয়ার জন্যে লোকদের উৎসাহিত করতো না। এসব আয়াতে কঠিন আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে। এ ভয় দিলকে কাঁপিয়ে দেয়। এগুলো ঠিক তেমনি, যেমন হযরত আবুদ-দারদা (রা) তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন: হে উম্দে দারদা! আল্লাহ্র একটা শিকল রয়েছে, যা সব সময়—যে সময় জাহান্নাম সৃষ্টি হয়েছে, সেইসময় থেকেই জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। তা সেই দিন পর্যন্ত উত্তপ্ত করতে থাকা হবে, যেদিন তা লোকদের গলায় পরানো হবে। আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনার কারণে তার অর্ধেক থেকে তো তিনি আমাদের নাজাত দিয়েছেন। (এক্ষুণে বাকী অর্ধেক থেকে মুক্তির জন্যে) হে উম্মে দারদা! মিসকীনকে খাবার দেয়ার জন্যে উৎসাহিত করতে থাক। [আরবী******} কুরআনের পূর্বেক দুনিয়ায় এমন কোন ধর্মগ্রন্থ দেখা যায়নি, যা মিসকীনদের খাবার দেয়ার উৎসাহিত করার কাজ না করাকে জাহান্নামে যাওয়ার ও কঠিন আযাব ভোগ করার কারণস্বরূপ উল্লেখ করেছে। সূরা ‘আল-ফজর’ –এ আল্লাহ তা’আলা জাহিলিয়াতের লোকদের সম্বোধন করেছেন যারা ধারণা করত যে, তাদের ধর্ম তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে এবং তারা তাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্মের উপর কায়েম রয়েছে। আল্লাহ্ তাদের ধিক্কার দিয়ে ভর্ৎসনা করে বলেছেন: (আরবী*********) তোমাদের ধারণা সত্য নয়। তোমরা বরং (অপরাধ করছ এই যে, ) তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না এবং মিসকীনদের খাবার দেয়ার জন্যে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। বস্তুত এই ছোট্ট আয়াতে সমাজের গরীব-মিসকীনদের মৌলিক অধিকার আদায়ের নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা হয়েছে। শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুহু এ প্রসংগে লিখেছেন, আয়াত মিসকীনকে খাবার দিতে বলার পরিবর্তে খাবার দেয়ার জন্যে উৎসাহ দানের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি বলার হলে বলা হত (*****) ‘তোমরা মিসকীনকে খাবার দাও না।’-এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে কথা স্পষ্ট হত। কিন্তু তা বলা হয়নি। কেননা সমাজের ব্যক্তিরা পরস্পরের জন্যে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকেরই উচিত অপর প্রত্যেক লোককে ন্যায় কাজের আদেশ দান এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা। সেই সাথে যে কাজের আদেশ সে অন্যকে করবে, সে নিজে তা অবশ্যই পালন করবে। অনুরূপভাবেযে কাজ করতে অন্যদের নিষেধ করবে, সে নিজেও তা থেকে বিরত থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। সূরা আল-মাউন এ ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয়া ও মিসকীনকে খাবার দেবার জন্যে উৎসাহ দান না করাকে বিচার দিনের প্রতি অবিশ্বাস ও কুফরী করার অনিবার্য ফলশ্রুতি বলা হয়েছে। [আরবী********] আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: (আরবী**********) তুমিকি সেই লোকটিকে দেখেছ, যে লোক বিচারের দিনকে অসত্য মনে করে? এই জিজ্ঞাসা প্রতিটি সমঝদার ব্যক্তির প্রতি। অর্থাৎ পরকাল ও বিচারের দিনকে অসত্য মনে করে কে, তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ? যদি না-ই বুঝে থাক, না-ই চিনেথাক, তাহলে জেনে নাও, সে হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাবার দেয়ার জন্যে লোকদের উৎসাহিত করে না। মিসকীনকে খাবার দেয়ার জন্যে উৎসাহ দান বলতে বোঝায় এই কাজের ব্যবস্থাপনার জন্যে লোকদের আহ্বান জানানো। কেননা যে লোক মিসকীনকে খাবার দেয়ার জন্যে লোকদের উৎসাহিত কর না, সে স্বভাবতই নিজে মিসকীনকে খাবার দেয় না। কাজেই আল্লাহর কথা: (আরবী*********) মিসকীনকে খাবার দেবার জন্যে উৎসাহিত করে না- সেই ব্যক্তিকে বোঝায়, যে খাদ্যাভাবী ও উপার্জনে অক্ষম দরিদ্র ব্যক্তিকে নিজের ধন-মাল থেকে একবিন্দু পরিমাণও দান করে না। এখানে ইংগিতপূর্ণ কথা বলার প্রকারন্তরে একথাই বোঝানো হয়েছে যে, তোমার কাছে মিসকীনের প্রয়োজন প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হলে আর তোমার কাছে দেবার মত কিছু না থাকলে তখন অন্যদেরকে তা দিতে বলা ও উৎসাহিত করা তোমার কর্তব্য। এখানে পরকালে বিশ্বাসী লোকদের দরিদ্রের ফরিয়াতে তাদের দান করার জন্যে উৎসাহিত করা হয়েছে, তা অন্যদের কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে হলেও অবশ্যই করতে হবে। আর এ হচ্ছে খয়রাতী কাজে সংগঠন ও সংস্থা গড়ে তোলার একটা পন্থা। কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতটিই হল তার মৌল ভিত্তি। যেমন সূরা আল-ফঅজ্র-এ বলা হয়েছে। (আরবী*********) না, কখনই নয়, আসলে তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান দেখাও না এবং মিসকীনকে খাবার দেয়ার জন্যে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। বস্তুত এ একটা অতীব উত্তম পন্থা। এর মাধ্যমে দরিদ্রদের সাহায্য করা যায়, মিসকীণদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এ ভাবেই সম্ভব। [আরবী********] পরকালে অবিশ্বাসী লোকদের পরিচয় দান প্রসঙ্গে পরে বলা হয়েছে: (আরবী**********) দুঃখ সেই নামাযীদের জন্যে, যারা নামাযের ব্যাপারে অবসাদ ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে। তারা ওরাই, যারা লোকদের দেখানোমূলক কাজ করে এবং নিত্য সাধারণ প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করতেও কুন্ঠিত হয়। আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন: অর্থাৎ তারা তাদের আল্লাহর ইবাদত উত্তমভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি যেমন, তেমনি আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতিও কোন কল্যাণমূলক অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। এমনকি সামান্য-নগণ্য যেসব জিনিস দিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করা যায়, যা দ্বারা লোকদের বেশ উপকারও হয় এবং মূল জিনিসটিও যথাযথ অক্ষুণ্ণ থাকে; বিনস্ট বিলুপ্ত হয় না ও তা আসল মালিকের কাছে ফিরে আসে। এ সব লোক যে যাকাত ও অন্যান্য রকমারি উপকারী জিনিস দিতেও রাযী নয়, তা তো আরও সত্য কথা। [আরবী******] এই ধরনের লোকদের নামাযও তাদের কোন কাজে আসবে না এবং পরকাল-বিশ্বাসী লোকদের মধ্যে তাদের মধ্যে গণ্যও করা হবে না। ভিখারী, বঞ্চিত. মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের অধিকার সূরা আয্-যারিয়াত-এ আল্লাহ তা’আলা সে সব মুত্তাকী লোকের উল্লেখ করেছেন, যারা তাঁর কাছে জান্নাত ও অফুরন্ত নিয়ামত পাওয়ার অধিকারী হবে। এই লোকদের সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিচিত হচ্ছে: (আরবী***********) তাদের ধন-মালে ভিখারী প্রার্থী ও বঞ্চিতদের সুস্পষ্ট ও সুপরিজ্ঞাত অধিকার রয়েছে। ‘ভিখারী’ বা প্রার্থী বলতে বোঝানো হয়েছে সে লোক, যে এসে দয়াস্বরূপ কিছু পেতে চায়; যদিও তার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ‘বঞ্চিত’ বলে সেই লোককে বোঝানো হয়েছে, যার ধন-মাল কিছুই নেই, উপার্জন নেই, জীবিকা নির্বাহের কোন রোজগারও নেই। এ কথার দরুন উপরিউক্ত মুত্তাকী লোকের অনুধাবন করতে পারলে যে, তাদের কাছে যে ধন-মাল রয়েছে, তারা তার নিরংকুশ মালিক নয়। তার কারণে তারা অন্যদের থেকে কোন স্বতন্ত্র মর্যাদা বা অধিকারেরও দাবিদার হতে পারে না। তাতে নিশ্চিতরূপে অভাবগ্রস্ত অন্য লোকদের অধিকার রয়েছে। তা তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের ‘হেবা’ করেও দিয়ে দেয়া হয়নি। আর এর কারণে তোমরা তাদের থেকে কোন বিশিষ্টতাও পেয়ে যাওনি। এ মূলতই তাদের হক-পাওনা। আর ‘পাওনা’ গ্রহণের কারণে তাদের অমর্যাদাও কিছু হতে পারে না। তোমরা তা দিয়ে দিলেও তাদের উপর তোমাদের অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে বলে দাবি করতে বা কোনরূপ অহমিকতাও বোধ করতে পার না। সূরা ‘আল-মা’আরিজ’-এ এই পরিচিতিটিরই পুনরুল্লেখ হয়েছে। তবে তাতে একটা অতিরিক্ত শব্দ বসানো হয়েছে। সেই মু’মিনদের পরিচিত প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে, যারা তাদের ঈমান ও নৈতিকতার শক্তিতে মানবীয় দুর্বলতাকে জয় করেছে। [আরবী****] মানবীয় দুর্বলতার উল্লেখ করে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: (আরবী*********) মানুষ খুবইসংকীর্ণমনা (ছোট আত্মার) সৃষ্ট হয়েছে। তার উপর যখন বিপদ আসে তখন ঘাবড়িয়ে যায়এবং যখন স্বাচ্ছন্দ্য আসে তখন সে কার্পণ্য করতে শুরু করে। কিন্তু সেই সব লোক (এই জন্মগত দুর্বলতা থেকে মুক্ত), যারা নিজেদের নামায রীতিমত ও স্থায়ীভাবে আদায় করে, যাদের ধন-মালে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের একটা নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। এ আয়াতে ধনীদের ধন-মালে একটা সুপরিজ্ঞাত (Known) অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, এ ‘সুপরিজ্ঞাত অধিকার’ হচ্ছে ‘যাকাত’। কেননা ধনীদের ধন-মালে পরিমিত ও সুপরিজ্ঞাত হক তো এটাই।তাঁরা এ-ও জানে; উল্লেখও করেছেন যে, এ সূরাটি মক্কা শরীফে অবতীর্ণ। এতে কোনই সন্দেহ নেই। আর এ কথাও সকলেরই জানা যে, যাকাত কার্যত মদীনাতেই ফরয ঘোষিত হয়, তাহলে বলতে হবে: উক্ত আয়াতে যে ‘সুপরিজ্ঞাত হক’-এর কথা বলা হয়েছে, তা ভাগ করে দেয়া অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ভাগ করে দিয়ে দেয়ার কাজটিকে তারা নিজেরাই নিজেদের উপর ফরয করে নিয়েছিল এবং তারা প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্যে নির্দিষ্টিও করে দিয়েছিল। [আরবী**********] তাহলে এ ‘হক’ ও সুপরিচিত ‘যাকাত’—এ দুইয়ের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, উক্ত ‘হক’ তারা নিজেরাই পরিমিত ও নির্ধারিত করে নিয়েছিল নিজেদের জন্যে বাধ্যতামূলক হিসেবে। আর ‘যাকাত’ সুনির্দিষ্ট হয়েছে—পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে স্বয়ং শরীয়াতের বিধানদাতা কর্তৃক। সূরা ‘আল-ইসরা’ ও ‘সূরা আর্-রূম’ –এ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) এবং নিকটাত্মীয়দের তাদের হক, আর মিসকীন, নিঃস্ব পথিককে এবং বেহুদা ব্যয় করো না। (আরবী*********) অতএব দাও নিকটাত্মীয়কে হক এবং মিসকীন ও নিঃস্ব পথিককে। তা অতীব উত্তম সেই লোকদের জন্যে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চায়। এ সব কথা দ্বারা কুরআন মজীদ মক্কীযুগের প্রথম দিনগুলো থেকেই মুসলমানের প্রাণে এ ভাবধারা দৃঢ়মূল করে বসাতে চেয়েছে যে, নিকটাত্মীয় ও অভাবগ্রস্ত সাধারণ লোকদের এক নিশ্চিত অধিকার রয়েছে তার ধন-মালে এবং সেই হক আদায় করা তার একান্তই কর্তব্য। এটা নিছক ইচ্ছামূলক নফল দানমাত্র নয়। তাই ইচ্ছা হলে দেবে নতুবা দেবে না—এটা নয় আদপেই বরং এটা অবশ্য দেয়। শস্য কর্তনকালীন অধিকার সূরা আল-আন’আমের আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) সেই মহান আল্লাহ্ই নানা ধরনের বাগ-বাগিচা, আঙুর বাগান, খেজুর বাগান সৃষ্টি করেছেন, খেত-খামার বানিয়েছেন, যা থেকে নানা প্রকারের খাদ্য-উৎপন্ন হয়, জয়, জয়তুন ও আনারের বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন, যার ফলসমূহ দেখতে সদৃশ কিন্তু স্বাদে ভিন্ন।....খাও তার ফসল, যখন তা হবে এবং আল্লাহ্র হক দিয়ে দাও যখন তার ফসল তুলবে। আর সীমালংঘন করো না, আল্লাহ্ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। এ আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন, জমি যে ফল বা ফসল ফলায়, তাতে অনিবার্যভাবে দেয় হক রয়েছে এবং তা সেদিনই আদায় করে দিতে হবে যেদিন তা পাড়া বা কাটা হবে। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়েল (রা) থেকে বর্ণিত—তিনি বলেছেন: এই নির্দেশ ছিল যাকাতের বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তখন তার ক্ষেতের ফসল ধেকে দান করত, পশুরা বিচরণ করত। ইয়াতীম মিসকীন ও কামাই-রোযগারে অক্ষম লোকেরা তা থেকে হিসসা লাভ করত। এ অধিকার ছিল শর্তহীন এবং ওশর বা অর্ধেক ওশর অনির্ধারিত। ক্ষেত্রও বাগান-মালিকের ঈমানের উপর এই কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কেননা তাদের চতুর্দিকে অভাবগ্রস্ত লোক কিলবিল করত। পরবর্তীকালে রাসূলে করীম (স) িএই হক-এর পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেন এবং তা মদীনা শরীফে সংঘটিত হয়। যেমন আল্লাহ্র তরফ থেকে ওশর বা অর্ধেক ওশর দেয়া ফরয করে দেয়া হয়েছে পাঁচ অসাক্ পরিমাণ শস্য ও ফল-পাকড় থেকে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন, মক্কায় যে ব্যবস্থা ছিল, এই পরিমাণ নির্ধারণ তা নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু শেষের দিকের ফিকাহ্বিদদের মতে এই পারিভাসিক নাকচকরণ (****) এখানে প্রযোজ্য নয়। এ পর্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করব ‘ফসল ও ফলের যাকাত’ পর্যায়ে। মক্কায় ‘যাকাত’ দান মক্কা শরীফে অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতসমূহের প্রায় সর্বত্রই এই ধরণ ও পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। সকল অবস্থায়ই দরিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। ধন-মাল থেকেতাদের অংশদিয়ে দেয়ার জন্যে তাকীদ করা হয়েছে। তার উদ্দেশ্য হল মু’মিনদের সমাজে দরিদ্ররা যেন কষ্ট না পায়। শেষ পর্যায়ে এই পদ্ধতি ও স্টাইল পরিবর্তিত হয়েছে এবং ‘যাকাত দান’ কথাটি বলা হয়েছে। যারা তাদেয় তাদের প্রশংসা করা হয়েছে আর যারা দেয় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। কুরআনের মক্কী সূরাসমূহের আয়াত সমষ্টি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সূরা ‘আর-রুম’-এ আল্লাহ তা’আলা নিকটাত্মীয়, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকেরহক্ আদায় করে দেয়ার আদেশ করেছেন। তাতে সুদ, যা বাহ্যত ধনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হ্রাসকরে এবং যাকাত বাহ্যত ধনের পরিমাণহ্রাস করে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি করে—এ দুইয়ের মাঝে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন: (আরবী********) অতএব তোমরা দাও নিকটাত্মীয়কে তার হক এবং মিসকীন ও নিঃস্ব পথিককে। তা অতীব উত্তম তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে ইচ্ছুক। আর তারাই সফলকাম। আর তোমরা যে সুদ দাও—লোকদের ধন-মালের পরিমাণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। আর তোমরা যে যাকাত দাও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, তারাই আসলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ধনের মালিক হয় (যারা যাকাত দেয়)। আর সূরা ‘আন-নামল-এ আল্লাহ্ মু’মিনদের পরিচিতি স্বরূপ বলেছেঠন, যাদের জন্যে তাঁর কিতাবকে হিদায়েত ও সুসংবাদবাহক বানিয়ে নাযিল করেছন। তাতে বলা হয়েছে: (আরবী********) এসব কুরআনেরই আয়াত, সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাব, হিদায়াতের ও সুসংবাদের গ্রন্থ মু’মিনদের জ ন্যে, যারা নামায কায়েমকরে ও যাকাত দেয় আর তারা প্রকৃত পক্ষে পরকালের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়শীল। যাকাত দানের কথাটি নামায কায়েম করার কথার পর যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ধন-মালের যাকাততের কথাই বলা হয়েছে। কেননা এটা কুরআনের রীতি। সূরা ‘লূকমান’-এর শুরুতে বলা হয়েছে: (আরবী*******) হিদায়াতের বিধান ও রহমত ঐকান্তিক নিবেদিত (বান্দা)-দের জন্যে যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়... পূর্ববর্তী আয়াত প্রসংগে যা বলা হয়েছে, এ পর্যায়েও তা-ই বলা যায়। সূরা ‘আল-মু’মিনুন’ এ ফিরদাউস জান্নাতের অধিকারী মু’মিনের পরিচিত বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে: (আরবী********) আর যারা যাকাত দান করে... সূরা ‘আল-আ’রাফ-এ মূসা নবী ও তাঁর জনগণের কিসসা বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে: (আরবী**********) আর আমার রহমত সব কিছুতে পরিব্যাপ্ত। আমি তা লিখব তাদের জন্যে, যারা মুত্তাকী, যারা যাকাত দেয়, আর যারা আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, যারা উম্মী নবী-রাসূল (স)-কে অনুসরণ করে চলে। সূরা ‘ফুস্সিলাত’-এ মুশরিকদের জন্যে অভিশাপ বর্ষণ করেছেন এবং তাদের প্রধান ও বিশেষ পরিচিতির উল্লেখ করেছেন। সে পরিচিতি হচ্ছে, তারা যাকাত দেয় না িএবং পরকালে অবিশ্বাস করে। আয়াতটি হচ্ছে: (আরবী**********) দুঃখ মুশরিকদের জন্যে, যারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালে অবিশ্বাস করে। স্পষ্ট কথা, নিষ্ঠাবান মু’মিনরা যাকাত দেয়, তারাই পরকালের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়শীল। আর ওরা যাকাত দেয় না। পরকালে অবিশ্বাসী। মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে এটাই বড় পার্থক্য। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, এখানে ‘যাকাত’ বলে মনের যাকাত—পরিচ্ছন্নতা, নির্মলতা ও পবিত্রতা বুঝিয়েছেন। কেননা শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় ময়লা-আবর্জনা। যেমন এ আয়াতে বলা হয়েছে: (আরবী**********) সত্যিই কল্যাণ লাভ করছে, যে (আত্মাকে) পবিত্র করেছে। (আরবী**********) নিশ্চয় সাফল্য লাভ করেছে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে। এ ধরনের তাফসীর করে আসলে ধন-সম্পদের যাকাত ব্যাপারে ‘পলায়নী নীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে, যা মদীনায় বিধিবদ্ধ হয়েছে বলেই সকলেই জানেন। তাই ইবনে জারীর তাবারী এরূপ তাফসীল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের তাফসীর ও তাৎপর্যে বলেছেন: “তারা তাদের ধন-মাল থেকে তার যাকাত বের করে ব্যয় করে না। তার বড় দলীল হল, ‘যাকাত’ শব্দটি বিশেষভাবে ‘ধন-মালের যাকাত’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য অর্থে নয়। কুরআনে প্রায় সর্বত্রই যাকাত প্রসঙ্গে (****) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ, (****) দেয়া বা দান করা। ধন-মালের যাকাত দেয়া প্রসঙ্গে এই শব্দের ব্যবহার সটিক ও উত্তমভাবেই হয়েছে। মক্কী সূরাসমূহে ‘যাকাত’ প্রসঙ্গে ‘আদেশ’ নাযিল হয়নি। তাহলে তা পালন করা ফরয হয়ে যেত। বরং সংবাদ দানের ভঙ্গীতে বলা হয়েছে, মু’মিন, মুত্তাকী ও মুহসিনলোকদের একটা মৌলিক গুণ হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে। [সূরা আল-মুয্যাম্মিলের শেষআয়াতে যা বলা হয়েছে তা মক্কী বলে বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ কেউ মাদানী বলে উল্লেখ করেছেন।এতে যে মতভেদ রয়েছে—তা স্পষ্ট।] এবং কাফিরদের পরিচিতিস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে তার তরককারী বলে। বস্তুত কল্যাণ প্রাপ্ত মু’মিনদের মৌলিক গুণাবলীর মধ্যে গণ্য হচ্ছে যাকাত দান। তানা-দেয়া মুশরিকদের অবিচ্ছিন্ন গুণপনা। কথার এ ধরণই প্রমাণ করে যে, তাদেয়া ফরয। কেননা মু’মিনদের গুণপনায় ভূষিত ও সুশোভিত হওয়া এবং মুশরিকদের বিশেষসমূহ থেকে মুক্ত ও রিক্ত হওয়া ঈমানদার ব্যক্তিমাত্রেরই কর্তব্য। তাতে কোনরূপ মতদ্বৈধতা নেই। আর সেই সবের উপর স্পষ্ট আদেশ হচ্ছে: (আরবী**********) এবং দাও তার হক্ তা কাটার দিনেই। মক্কী যুগের যাকাত নিঃশর্ত প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী আইন রচনারইতিহাসে সর্বজনজ্ঞাত কথা হচ্ছে, যাকাত মদীনায় ফরয হয়েছে। তাহলে উপরিউক্ত কথা ও কুরআনের মক্কী সূরার আয়াত বা সূরাসমূহে যাকাতের উল্লেখ কি করে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, মক্কী সূরাসমূহে যে যাকাতের উল্লেখ হয়েছে, তা হুবহু সেই ‘যকাত’-এ নয় যা পরে মদীনায় বিধিবদ্ধ হয়েছে এবং তার পমিাণ ও নিসাব নির্ধারিত হয়েছে। তা সংগ্রহ ও আদায় করার জন্যে কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছে। তার সংগঠন করার জন্যে রাষ্ট্র সরকার দায়িত্বশীল হয়েছে। মক্কায় যাকাত নিঃশর্ত, নিসাব ও পরিমাণ অনির্ধারিত। আর তা আদায় করা ব্যক্তিদের ঈমানও তাদের মু’মিন ভাইদের ভ্রাতৃত্বের কর্তব্যবোধের উপর ছিল ন্যস্ত। তখন ধন-মালথেকে কিছু একটা পরিমাণ দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ছিল।যদিও অভাবআরও অধিক ব্যয় করার দাবি করছিল। মক্সী সূরাসমূহে উদ্ধৃত ‘তার হক’ ও ‘প্রার্থী ও বঞ্চিতেরদ হক’ ‘সুপরিজ্ঞাত হক্’ প্রভৃতি কথার একটা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোন আলোচনাকারী।তাঁরা বলেছেন এটা সম্ভব যে, মক্কী পর্যায়েই নবী করীম (স) হয়ত যাকাতের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে যারা তাদিতে সক্ষম তাদের জন্যে তা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। [‘সীরাতুর-রাসূল’ কুরআন থেকে গৃহীত আকৃতি’ মুহাম্মাদ ইজ্জাত দরোজা লিখিত-২য় খন্ড, ৩৪১ পৃষ্ঠা।] কিন্তু এ কথাটি প্রমাণিত হয়নি বরং তার বিপরীত কথাই উদ্ধৃতহয়েছে। বস্তুত তখনকার সময় এ নির্ধারণ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। কেননা তখন তো লোকেরা নিজেরাই দিয়ে দিচ্ছিলেন এবং যা ছিল তাঁদের হাতে আসত, তা প্রায় সবই দ্বীনের পথে ব্যয় করে দিচ্ছিলেন অকাতরে।আর রাসূল (স) কর্তৃক পরিমাণ নির্ধারণ ছাড়া গরীবদের হক্ সুপরিজ্ঞাত হতে পারেনা, এটাও কোন জরুরী কথা নয়। হয়ত প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি নিজেই স্বীয় ধন-মালে গরীবদের হকের পরিমাণ নির্ধারণ করতেন। কোন তাফসীরকার এ কথার উল্লেখও করেছেন। অথবা তখনকার অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে একটা পরিমাণ প্রচলিত ও সর্ব জনবিদিত ছিল এবং সেই অনুযায়ীই তাঁরা ব্যয় করতেন। হাফেয ইবন কাসীর সূরা ‘আল-মু’মিন’ –এর আয়াত: (আরবী**********)-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন: অধিকাংশ তাফসীরবিদ মনে করেন, এখানে ‘যাকাত’ বলতে ধন-মালের যাকাতই বুঝিয়েছেন, যদিও এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ এবং যদিও যাকাত ফরয হয়েছে, তা নিসাব ও পরিমাণভিত্তিক। নতুবা আসল কথা হচ্ছে মৌলিকভাবেযাকাত মক্কা শরীফেই ফরয হয়। [(আরবী**********)] আল্লাহ্ তা’আলা সূরা ‘আল-আন’আম’-এ বলেছেন: (আরবী**********) ‘এবং দাও তাঁর হক তা কাটার দিনই।’ এ সূরাটি মক্কাশরীফেই নাযিল হয়েছে। আমাদের পূর্বোদ্ধৃতবহু আয়াত থেকেই এর সমর্থন পাওয়া যায়। মদীনা-পর্যায়ে যাকাত মুসুলিমগণ মক্কা শরীফে একক ব্যক্তি হিসেবে দ্বীনী দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মদীনায়পৌঁছার পরই তাঁরা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন যাপন করতে শুরু করেন। সেখানে তাঁদের ছিল ভৌগলিক ভূখণ্ড (Territory) প্রশাসন-সংস্থা ও সার্বভৌমত্ব। তাই এখানে ইসলামী প্রশাসনিক আইন-বিধান এমন এমন একটা নতুন রূপ পেয়েছে, যা এ উত্তরণের সাথে পুরোপুরিভাবে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে সব কিছু সুনির্দিষ্ট, বিশেষভাবে চিহ্নিত। যদিও পূর্বে মক্কী পর্যায়ে তা-ই ছিল সাধারণ ও শর্তহীন। মক্কায় যা ছিল শুধু উপদেশ, দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিতান্তই উৎসাহদান পর্যায়ে, মদীনায় তা-ই হয়েছে শক্তি ও সার্বভৌমত্ব বলে জারী ও কার্যকর। এখানেও মানুষেরঈমান ও মনের প্রতি আবেদন পরিত্যক্ত হয়নি। যাকাতের ব্যাপারে এ মাদানী রীতি অত্যন্ত প্রকট। এখানে শরীয়াত প্রদাতা কত পরিমাণ ধন-মালে যাকাত ফরয, ফরয হওয়ার শর্ত ও পরিমাণ এবং তার ব্যয়ের ক্ষেত্র ইত্যাদি সব কিছুই সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যাকাত আদায় ও বন্টনের একটা পূর্ণাংগ সংস্থা গড়ে উঠেছিল এখানে। কুরআনের মাদানী আয়াতে যাকাতের তাকীদ ও বিধি-বিধান মদীনা শরীফে অবতীর্ণ কুরআনযাকাত ফরয হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে স্পষ্ট আদেশের ভঙ্গীতে এবং তা দেয়ার জন্যে স্পষ্ট ভাষায় আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে। মদীনায় অবতীর্ণ সূরা ‘আল-বাকারা’য় আমরা পড়ি: (আরবী**********) আর তোমরা কায়েম কর নামায এবং দাও যাকাত। ক্ষেত্র এখানে প্রশস্ত। কিন্তু উদ্ধৃত যাকাত সংক্রান্ত আদেশের গুরুত্বের কারণেই আমি আর একটি আয়াতের উল্লেখ করছি। তা হচ্ছে সূরা ‘আত্-তাওবা’র আয়াত। এই সূরা সর্বশেষ নাযিল হয়েছে। ‘যাকাত’ প্রসঙ্গে সূরা তাওবা’র দৃষ্টান্ত ক. এই সূরা’র শুরুতে চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। তিনি তাদের জন্যে চার মাসের অবকাশও নির্দিষ্টকরেন, যেন এই সময়ের মধ্যে তারা দুনিয়া পরিভ্রমণ করতেও নিজেদের জন্যে একটা পন্থা চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) হারাম মাসসমূহ অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তোমরা মুশরিকদের হত্যা কর যেখানেই তাদের পাও। তাদের পাকড়াও কর, পরিবেষ্টিত কর, এবংতাদের জন্যে প্রতিটি ঘাটিতে অপেক্ষায় বস। অতঃপর তারা যদি তওবা করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তাহলে তখন তাদের পথ উন্মুক্ত করে দাও। জানবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও দয়াবান। এআয়াত অনুযায়ী মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা থেকে বিরত থাকা ও তাদের পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্যে শর্ত তিনটি: প্রথম. শিরক থেকে তওবা। আর তার প্রমাণহবে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’র সাক্ষ্য দান। দ্বিতীয়, মুসলিমদের জন্যে ফরয করা নামায কায়েম করা—তা ঈমানের প্রকাশ ক্ষেত্র, ইসলামের সর্বাপেক্ষা বড় স্তম্ভ, প্রতি দিন-রাতে পাঁচবার কাম্য। মুসলিম ও কাফিরের মধ্যে তা-ই হচ্ছে প্রধান পার্থক্যকারী এবং মুসলিমদের পারস্পরিক, আত্মিক, সামষ্টিক ও দ্বীনী যোগাযোগের প্রধান সূত্র। এবং তৃতীয়: ধনীদের ধন-মালে অভাবগ্রস্ত ও সাধারণ জনগণের কল্যাণের জন্যে ফরয-করা যাকাত রীতিমত আদায় করা। তা মুসলিম সমষ্টির পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামষ্টিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক সূত্র। খ. এই সূরাটিতে ছয়টি আয়াতের পরই আল্লাহ্ তা’আলা অন্যান্য মুশরিক জাতির প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) অতঃপর তারা যদি তওবা করেও নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। জানে, এমন লোকদের জন্যে আমরা আয়াতসমূহকে আলাদা-আলাদা করে বর্ণনা করছি। তাহলে কাফিরদের জন্য মুসলিমসমাজে প্রবেশ করার ও তাদের সাথে এমন দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোন পথই উন্মুক্ত নেই—যে ভ্রাতৃত্ব প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমষ্টির একজন বানিয়ে দেয়, যেখানে ব্যক্তির জন্যে তা-ই হয় যা সমষ্টির জন্যে; ব্যক্তির দায়িত্ব তা-ই হয় যা সমষ্টির দায়িত্ব এবং পরস্পরকে অবিচ্ছিন্ন বন্ধরে বেঁধে দেয়, এই রকমের ভ্রাতৃত্বের কোন পথ দেখা যায় না।তবে তার একটি মাত্র পথই রয়েছে। আর তা হচ্ছে শিরক থেকে তওবা করা এবং তার আনুষঙ্গিক প্রথমকাজ হচ্ছে, মুসলিমদেরকে আল্লাহর আনুগত বানায় যে নামায, সেই নামায কায়েমকরা। এই নামাযের মাধ্যমেই তারা পরস্পরের সাথে পরিচিত, নিকটবর্তী ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। আর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে যাকাত দেয়া। যার মাধ্যমে তারা পরস্পরের দুঃখ মোচন করতে পারে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারে। সাহাবীদের সময় থেকেই বিশেষজ্ঞগণ একটি ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন, এখানে তা উল্লেখ্য। তা হচ্ছে এই যে, নামাযের পাশাপাশিই যাকাতের উল্লেখ কুরআন মজীদের একটা রীতি। এ দুটিকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন: (আরবী**********) তোমাদেরকে একসঙ্গে আদেশ করা হয়েছে নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার জন্যে। তাই কেউ যাকাত না দিলেতার নামাযও হবে না। ইবনে যায়েদ বলেছেন: (আরবী**********) নামাযওযাকাত এক সাথে ফরয করাহয়েছে, এ দুটির মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি। অতঃপর তিনি পড়লেন: (আরবী**********) বললেন: যাকাত চাড়া শুধু নামাযগ্রহণ করতে অস্বীকার করা হয়েছে।তিনি আরও বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা আবূবকর (রা)-কে রহমত করুন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান ফিকাহ্বিদ। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন: আল্লাহ যে দুটি জিনিসকে একত্র করেছেন, আমি সে দুটিকে কখনই বিচ্ছিন্ন করব না। গ. এসূরাতেই আল্লাহ তা’আলা যেসব মসজিদ প্রতিষ্ঠাকারীদের উল্লেখ করেছেন, যাঁদের কাছ থেকেতিনি তা কবূল করবেন। বলেছেন: (আরবী**********) সন্দেহ নেই, আল্লাহ্র মসজিদসমূহ প্রতিষ্ঠা ও আবাদ করে সেইলোক, যে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি এবং নামায কায়েম করেছে ও যাকাত দিয়েছে, আর আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করেনি। খুবই সম্ভব এ লোকেরাই হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ কাফির—মুশরিকরা যদি মসজিদও প্রতিষ্ঠা করে, তবুতা গ্রহণ করা হবে না—যতক্ষণতারা ঈমান না আনবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত না দেবে। ঘ. এসূরাতেই কঠিন আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে যেসব স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয়কারীদের প্রতি, যারা তা থেকে আল্লাহ্র হক আদায় করে না। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী**********) আর যারাই স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে আটকে রাখে, তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন তাদের উপর তা উত্তপ্ত করেতাদের মুখাবয়বে ও পার্শ্বে-পিঠে দাগ দেয়া হবে, বলা হবে যে, এই সেইঅপরাধের শাস্তিযা তোমরা (স্বর্ণরৌপ্য) সঞ্চয় করে নিজেদের জন্যে সংগ্রহ করেছ। অতএব তোমরা তার স্বাদ আস্বাদন কর যা তোমরা নিজেরাই সঞ্চয় করেছিলে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: এ পর্যায়ে এত বড় শাসনবাণী উচ্চারিত হওয়ার কারণ হল, অর্থ-সম্পদের লোভ ও কার্পণ্য মানব-প্রকৃতি নিহিত স্বভাব। তাই তারা যদি এ ব্যাপারে ভয় করে এবং তা থেকেবিরত থাকতে পারে, তা হলে তারা আল্লাহর আনুগত্যমূলক সব কাজে বিনীয় ও নিবেদিত হবে বলে আশা করা যায়। [(আরবী**********)] ঙ. যাকাত বাবদ লব্ধ সম্পদ কোথায় ও কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় করা হবে, ত-ও এই সূরাতেই বলে দেয়া হয়েছে। সাদ্কা সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এ কথা মূলত বলা হয়েছিল লোভী ও লালসান্ধ সেসব লোকের প্রতিবাদস্বরূপ, যারা কোনরূপ অধিকার ব্যতীতই যাকাতের সম্পদ পেতে চেয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) এদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা তোমাকে সাদ্কার ব্যাপারে দোষী করে। তা থেকে তাদর দেয়া হলে তারা খুশী হয়, আর দেয়া না হলে তারা তখন অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। তারা যদি সন্তুষ্ট হতো তা পেয়ে, যা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল তাদের দিয়েছেন এবং বলত যে, আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট, আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ থেকে আমাদের দেবেন অবশ্যই এবং তাঁর রাসূলও (তা হলে নিশ্চয়ই ভাল হত)। .... আমরা তো আল্লাহ্র দিকেই আগ্রহী। এর সাথে সাথেই বলা হয়েছে: (আরবী**********) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে, সাদ্কা-যাকাত কেবলমাত্র দরিদ্র, মিসকীন, যে (যাকাত সংগ্রহ ও বন্টন) কাজে নিযুক্ত কর্মচারী, যাদের দিল আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, যারা বন্দী, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে এবং নিঃস্ব পথিকের জন্যে। এ আল্লাহ্র নিকট থেকে ফরযরূপে নির্ধারিত। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞানী। এই চূড়ান্ত কথা ঘোষণাকারী আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা লোভীদের লোভ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাদের লেলিহান জিহ্বা কর্তন করলেন। যাকাত বন্টনের কাজটিকে লোভীদের লোভ-লালসার অধীন রাখলেন না। কোন প্রশাসকের ইচ্ছাধীনও করে দিলেন না। তার বন্টন আটটি খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট করে দিলেন। আর এই বন্টন খাত যে অতীব ইনসাফপূর্ণ, তাতে কোন সন্দেহই থাকতে পারেনা। বস্তুত ঈমানদার লোকদের কাছে আল্লাহ্র চাইতে উত্তম ফয়সালাকারী আর কে হতে পারে? (আল-মায়েদা: ৫০) আয়াতটি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, যাকাত আদায়, সংগ্রহ ও বন্টনের কাজ ‘সে কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের’ মধ্যে সমাধা করতে হবে। সেইসাথে বলা হয়েছে যে, যাকাত সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব ব্যক্তিদের উপর নয়, সরকারের উপর ন্যস্ত (পরে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে)। চ. মুসলিম সমাজের মৌল কাঠামো গড়ে তোলার পদ্ধতি ও বিধি-বিধানের কথাও এ সূরাতেই বলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী**********) আর মু’মিন স্ত্রী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, অভিবাবক। তারা ভাল ও ন্যায় কাজের আদেশ করে, খারাপ ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়, আর আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করে। এসব লোককে আল্লাহ্ অবশ্যই রহমত দান করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী, সুবিজ্ঞানী। মু’মিন সমাজ ও মুনাফিক সমাজের মধ্যে পার্থক্যকারী অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে: (আরবী**********) মুনাফিক পুরুষ ও স্ত্রীগণপরস্পরের (পৃষ্ঠপোষক)। তারা পাক ও অন্যায় কাজের আদেশ করে, ভাল ও পুণ্যের কাজ করতে নিষেধ করে। আর তাদের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, আল্লাহও তাদের ভুলে গেছেন। আসলে মুনাফিকরাই সীমালংঘনকারী। মুনাফিকদের ‘হাত মুষ্টিবদ্ধ’ করার অর্থ ও লোভ ও লালসান্ধ হওয়া। ফলে তারা আল্লাহর কাছেও বিস্মৃত হয়েছে। আল্লাহ তাদের ত্যাগ করেছেন কিন্তু মু’মিনগণহাত উন্মুক্ত ও প্রশস্ত প্রসারিত করে রাখে। তারা আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের কারণে ব্যাপকভাবে দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করে। ফলে তারা আল্লাহ্র রহমত পাওয়ার যোগ্য অধিকারী হয়। ছ. আলোচ্য সূরা তওবায়ই আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল এবংতাঁর পরে যারাই মুসলিম উম্মতের পরিচালক হবে তাদের সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন: (আরবী**********) তাদের ধন-মাল থেকে ‘সাদকা’ (যাকাত) গ্রহণ কর, পবিত্র কর, তাদের পরিচ্ছন্ন পরিশুদ্ধ কর তাদেরতাদিয়ে। আর তাদের জন্যে পূর্ণরহমতের দোয়া কর। কেননা তোমার দোয়া তাদের জন্যে শান্তির বাহক। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। তাফসীরকারগণ আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন: (***) শব্দের পূর্বে (***) বসানো হয়েছে বলেধন-মালের একটা অংশ গ্রহণের নির্দেশ বোঝায়। কেননা ফরয যাকাত বাবদ সম্পূর্ণ ধন-মাল দিতে হয় না, তার থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশই শুধু দিয়ে দিতে হয়। আর (****) (তাদের মালসমূহ থেক) বলা হয়েছে; (****) (তাদের মাল থেকে) বলা হয়নি। বহুবচনের এই শব্দ বিভিন্ন প্রকার ও ধরনের মাল সম্পদ শামিল করছে বলে সেই সব কিছু থেকেই নির্দিষ্ট অংশ আদায় করতে হবে। আর (তাদের) বলে সমস্ত মুসলিম উম্মত বোঝানো হয়েছে। সর্বসাধারণ তাফসীরকারদের এটাই মত। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত মুসলিমের সর্বপ্রকারের ধন-মাল থেকেই যাকাত গ্রহণ করতে হবে। কেননা দ্বীনের হুকুম-আহ্কাম পালনে তারা সকলেই সমানভাবে বাধ্য। [(আরবী*********)] আয়াতটি এ কথাও বলেছে যে, যাকাত আদায় করতে রাষ্ট্র প্রধান অথবা তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি। হাদীস থেকেও এ কথাই প্রমাণিত। খুলাফায়ে রাশেদুন বাস্তবভাবেযে আমল করেছেন, তা-ও এ কথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘যাকাত আদায়’ শীর্ষক আলোচনায় আমরা এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলব। হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা)-এর খিলাফত আমলে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীরা এ আয়াতকে ভিত্তি করেই বলেছিল: আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে রাসূলেকরীম (স)-কে। কাজেই কেবল তিনি যাকাত আদায়ের অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কেউহই আদায় করতে পারেন না। (আর তিনি তো ইহকাল ত্যাগ করে চলে গেছেন, অতএব আর যাকাত নেয়া যাবে না, দিতেও হবে না)। বিশেষজ্ঞগণ এ ধারণাটির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন, তাদের এই সন্দেহ নিতান্তই ভিত্তিহীন। একটু পরেই আমরা এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, উপরিউক্ত আয়াতে যে ‘সাদাকাত’-এর কথা বলা হয়েছে, তাতে ‘যাকাত’ বোঝায় না। তবুকযুদ্ধে যারা যোগদান করেনি, যারা নেক আমলের সঙ্গে বদ আমল সংমিশ্রিত করেছে, আয়াতটি তাদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। তাদের কাছ থেকে যে ‘সাদ্কা’ গ্রহণ করা হয়েছে, তা-ই তাদের উক্ত গুনাহের কাফ্ফারা হয়েছে। তাহলে তা ‘নফল দান’ বিশেষ এবং তা বিশেষভাবে তাদের জন্যে প্রযোজ্য। পূর্বকথা থেকেও তা-ই মনে হয় অথচ সাধারণ অর্থবোধক শব্দে কারণের কোন বিশেষত্ব গণ্য হতে পারে না। যাকাত যে ফরয সেখানেও তাদের বিশেষত্ব কিছু নেই। আর তাদের যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত থাকাটাও তার কারণ হতে পারে না। কেননা যাকাত হচ্ছে ইসলামের অধিকার। অপরাধের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ বা কাফ্ফারাস্বরূপও তা ফরয করা হয়নি। [(আরবী*********)] ইমাম তাবারীও একথাই সমর্থন করেছেন। বহু সংখ্যক ব্যাখ্যাকারের এ অভিমত বলেও তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক তাফসীরকার বলেছেন, উপরিউক্ত আয়াতের শব্দ (****) এর অর্থ ‘যাকাত’। প্রাচীন ও পরবর্তী সর্বকালের দ্বীন-অভিজ্ঞগণ এ আয়াতের ভিত্তিতেই যাকাতের যাবতীয় আইন-বিধান সংকলন করেছেন।তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বকথা ‘সাদ্কা’ শব্দের অর্থ হিসেবেযাকাত মনে করণে কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নয়। আর পরবর্তী আয়াতকে পূর্ববর্তী আয়াতের সঙ্গে যুক্ত করে তাফসীর করতে হলে তার জন্যে অকাট্য দলীলের প্রয়োজন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকেও এ কথা বর্ণিত। কুশাইরীর উদ্ধৃতি অনুযায়ী ইকরামাও এ মতই প্রকাশ করেছেন। তবে পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতের মধ্যে সংযুক্তি সূত্র হিসেবে ইমাম ফকরুদ্দীন রাযী অপর একটি যুক্তিসঙ্গত দিকের উল্লেখ করেছেন।তা হচ্ছে এই যে, যাকাত তাদের উপর ফরয ছিল। তারা যখন যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকার গুনাহ থেকেতওবা করল, উত্তমভাবে ইসলাম মেনে চলতে শুরু করল এবং যাকাতও দিতে লাগল, তখন আল্লাহ তাঁর রাসূল (স)-কে তা গ্রহণ করার নির্দেশদিলেন অথচ কোন মুনাফিকের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা যায় না। [ইমাম রাযী ও কাসেমী লিখিত তাফসীর।] ‘বিশেষ কারণ’ শব্দের সাধারণ অর্থ জ্ঞাপনের বিরোধী নয়। বিশেষজ্ঞদের কাছে এটাই গ্রহেোগ্য মত। উপরিউক্ত আয়াতের ‘সাদকাত’ শব্দের অর্থ এই যে, তার বড় ও স্পষ্ট দলীল হচ্ছে, হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে যাকাত দিতে অস্বীকারকারীরা তো এই আয়াতটিকেই দলীল হিসেবে পেশ করেছিল। দাবি করেছিল যে, এই নির্দেশ বিশেষভাবে রাসূলের প্রতি, অতএব তার পরে এর কোন অবকাশনেই (একটু পূর্বেই আমরা এ কথার উল্লেখ করেছি, পরেও করা হবে)। অথচ তখন কোন সাহাবীই এ কথার প্রতিবাদ করেন নি। যদিও আয়াতটি সম্পর্কে এবং কোন্ কথা বোঝবার জন্যে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল সেসম্পর্কে তাঁরাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল। এ আয়াতটি ‘ফরয সাদকা-যাকাত ছাড়া অপর কোন বিষয়ে নাযিল হয়েছে এমন কথা কেউই বলেন নি। পরবর্তী কোন আলিম-বিশেষজ্ঞও এই মত প্রকাশ করেন নি। সকলেই একবাক্যে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, উক্ত আয়াতে রাসূল (স)-কে সম্বোধন করা হয়েছে যেমন তেমনি তাঁর পরে যারাই মুসলিম উম্মতের কর্ণধার হবে তাদের সকলকেই এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। [(আরবী*********)] ‘সাদাকাত’ অর্থ যে যাকাত তার কতগুলো লক্ষণও রয়েছে। বনূ হাশিম গোত্রের কতিপয় যুবক রাসূলে করীম (স)-এর কাছে যাকাত সংস্থার কর্মচারী হওয়ার দাবি জানায়। তাদের এই দাবির জবাবেনবী করীম (স) বলেছিলেন: (আরবী*********) এই যাকাত (তা সংগ্রহের কর্মচারী হওয়া) মুহাম্মাদের বংশের লোকদের জন্যে হালাল নয়। কেননা তা জনগণের ময়লা। এই প্রতীকী ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটি আল্লাহ্র কথার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ: ‘তুমি তাদের পবিত্র করবে, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন করবে।’ ইমাম মুসলিম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে: (আরবী*********) যখন কোন লোক-সমষ্টির ‘সাদকা (যাকাত) নিয়ে আসা হত তখননবী করীম(স) তাঁদের জন্যে রহমতের দোয়া করতেন। আমার পিতা তাঁর ‘সাদকা’ নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেন: ‘হে আল্লাহ! পূর্ণ রহমত নাযিল কর আবূ আওফার বংশেরলোকদের প্রতি।’ রাসূলে করীম (স) লোকদের ‘সাদকা’ গ্রহণের আদেশপালন করতে গিয়ে আল্লাহ পরবর্তী আদেশ ‘সাদকা’ দাতাদের জন্যে রহমতের দোয়া করার আদেশও পালন করেছেন, তা উক্ত হাদীসের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট জানা যায়। এ থেকে সব আলিমই এই মত দিয়েছেন যে, মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর স্থলাভিষিক্তের কর্তব্য হল ‘যাকাত’ দানের জন্যে দোয়া করা। সূরা তওবায় যাকাত পর্যায়ে যত কথাই এসেছে, তন্মধ্যে এটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ কথা। আর তা মাদানী সূরাসমূহে যাকাত ফরয হওয়ার এবং তার বিধি-বিধানের গুরুত্ব বোঝাবার ব্যাপারে প্রযুক্ত সাধারণ ভঙ্গীর প্রতীক। কুরআনের দৃষ্টিাতে যাকাত না দিয়ে কোন লোকই কল্যাণ পেতে পারে না, সত্যবাদী নেক্কার ও মুত্তাকী লোকদের মধ্যে গণ্যও হতে পারে না। তা হতে হলে অবশ্যই রতিমত যাকাত দিতে হবে। পরকালের প্রতি বিশ্বাসী মুনাফিকদের থেকেও কেউ ভিন্নতর পরিচিতি লাভ করতে পারে না নিয়মিত যাকাত না দিলে। মুঠিবন্ধকারী িএবং লোকদের জন্যে ব্যয় করতে অস্বীকারকারী মুনাফিকদের থেকেও ভিন্নতর পরিচয়ে ভূষিত হওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। যাকাত না দিলে লোকেরারহমত পাওয়ার যোগ্য অধিকারীও হতে পারে না। কেননা আল্লাহ্ নিজেই যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্যে রহমত লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বলেছেন: (আরবী*********) আমার রহমত সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে নিয়েছে। তা আমি লিখে দেব সেই লোকরেদ জন্যে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং তারাই আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, ‘যাকাত’ না দিলে আল্লাহ্র বন্ধুত্ব, রাসূলের এবং মু’মিনদের পৃষ্ঠপোষত্বও লাভ করা যেতে পারে না। কেননা আল্লাহ নিজেই বলেছেন: (আরবী*********) তোমাদের একমাত্র বন্ধু-পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল আর ঈমানদার লোকেরা, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়, তারাই অনুগত। আর আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ও ঈমানদার লোকদের যারাই অভিভাবক বানাবে, (তারাই আল্লাহর দলভুক্ত) আর শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র দলই বিজয়ী হবে। কুরআনের ঘোষণা, যারাই আল্লাহর যাহায্য করবে, আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করবেন। কিন্তু এই সাহায্য সেই লোক কখনই পাবে না, যে যাকাত দেবে না। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী*********) যে লোক আল্লাহকে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। সন্দেহ নেই, আল্লাহ সর্বশক্তিসম্পন্ন, সর্বজয়ী। তারা সেইলোক, যাদের আমরা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করি, তাহলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভাল কাজের আদেশকরবে ও মন্দ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে। আর সর্বকাজের পরিণতি আল্লাহর জন্যই। কুরআনের মোটামুটি বলা কথার ব্যাখ্যা দেয়া সুন্নাত কুরআন ইসলামের সংবিধান, তার মৌল উৎস। কাজেই তাতে শুধু মৌলিক নিয়ম-কানুন (Fundamental Principles)-ই দেয়া হয়েছে, সাধারণ (Common) নিয়ম-বিধিরই উল্লেখ রয়েছে তাতে। বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয়ের উল্লেখ বড় একটা নেই। তাও আছে শুধু সেই বিষয়ে, যেখানে খুঁটিনাটি বলেনাদিলে মতদ্বৈধ্যতার কারণে আল্লাহ্র বিধান অ-পালিত থেকে যাওয়ার ও বিভ্রান্তি হওয়ার আশংকা বিদ্যমান। সুন্নাতই হচ্ছে কুরআনের বাক-ব্যাখ্যা, বাস্তব রূপ। কুরআনে যা মোটামুটি, সুন্নাতে তার বিস্তারিত রূপ প্রস্ফূটিত। কুরআনে যা অস্পষ্ট, সুন্নাতে তা স্পষ্ট। কুরআনে যা অনির্দিষ্ট, নিঃশর্ত, সুন্নাতে তা সুনির্দিষ্ট। রাসূলে করীম (স)-এর কথা, কাজ ও সমর্থনের সাহায্যে এই কাজ সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, তিনি মহান আল্লাহ্র কাছ থেকেই এ ক্ষমতা, যোগ্যতা ও জ্ঞান লাভ করেছেন। আল্লাহ্ নিজেই বলে দিয়েছেন: (আরবী*********) আমরা তোমার কাছে কুরআন নাযিল করেছি এই উদ্দেশ্যে যে, যা কিছু জনগণের জন্যে নাযিল হয়েছে, তুমি তা তাদের কাছে স্পষ্ট করেবর্ণনা করবে। কুরআনে ‘যাকাত’ ফরয ঘোষিত হয়েছে। সুন্নাত তারই তাকীদ করেছে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এবং তা মক্কী জীবন থেকেই। হযরত জাফর ইবনে তালিব (রা) হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের নামে হাবশা-সম্রাট নাজ্জাশীকে সম্বোধন করে কথা বলেছেন, তাঁকে নবী করীম (স) সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি তাদের কি কি শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁকে নবী করীম (স) সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন, তিনিতাদের কি কি শিক্ষা দিয়েছেন, সেই পর্যায়ে বলতে গিয়ে বলেছেন: (আরবী*********) তিনি আমাদের আদেশকরেন নামায পড়তে, যাকাত দিতে ও রোযা রাখতে। এখানে শুধুই নামা-রোযা-যাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার কোন নির্দিষ্ট রূপ তখনও গড়ে উঠেনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও তখন পর্যন্ত ফরয হয়নি, রমযানের রোযাও নির্দিষ্ট হয়নি। আর নিসাব ও পরিমাণসহ যাকাত তখনও চালু হয়নি। [(আরবী*********)] এ সবের বিস্তারিত, স্পষ্ট ও সুনির্ধারিত বিধান তো পরে মদীনা শরীফে নাযিল ও কার্যকর হয়েছে। ‘ফরয যাকাত’ পর্যায়ে কথা বলার প্রশস্ত স্থান ও পরিবেশ গড়ে উঠেছিল মদীনা শরীফে। তাই এখানে তার নিসাব, পরিমাণ ও শর্তসমূহ সবিস্তারে বর্ণিত ও বিবৃত হয়। তা আদায় করার উৎসাহদান ও দিতে অস্বীকারকারীদের ভয় প্রদর্শন ও এখানেই সম্ভব ছিল। যাকাতের নিসাবও পরিমাণ সুন্নাত কর্তৃক নির্ধারিত যে সব ধন-মালে যাকাত ফরয হয়, তার পূর্ণ বিবরণ সুন্নাতে উদ্ধৃত হয়েছে। প্রতিটির নিসাব অর্থাৎ কত পরিমাণের হলে যাকাত ফরয হবে এবং কোন্ জিনিসে যাকাতের পরিমাণ কত, তা বিস্তারিতভাবেবলে দেয়া হয়েছে। উপরন্তু যাকাত বাবদ লব্ধ সম্পদ কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় করা হবে, কোন্ কোন্ ধরনের লোক তা পাবে, তার মৌল কথা কুরআনের আয়াতে বলা হলেও তার বিস্তারিত আলোচনা সুন্নাতে পাওয়া যায়। আমরাও এ গ্রন্থে সে পর্যায়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত করব। এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হল, সুনির্দিষ্ট নিসাব ও পরিমাণসহ যাকাতে ফরয হওয়ার ইতিহাস। আমরা জানতে পেরেছি যে, নিঃশর্ত ও পরিমাণ-অনির্ধারিত যাকাত মক্কী পর্যায়েই ফরয হয়েছে। বহু সংখ্যক ফকীহ ইমামও মত দিয়েছেন। কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে তা-ই প্রমাণিত হয়। মাদানী সূরার আয়অতে ফরয যাকাতের উপর তাকীদ এসেছে, তার কোন কোন আইন ও বিধান বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছে। নিসাব, যাকাতের পরিমাণ ও তার সীমা-শর্ত উপস্থাপিত করেছে। এখানে অবশ্য প্রশ্ন উঠে এ সব নির্ধারণ হিজরতের পর কখন এবং কোন্ সনে সুসম্পন্ন হয়েছে। সকলের জানা ও প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, হিজরতের দ্বিতীয় বছরেই তা ফরয হয়েছে—রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে। সা’দ ইবনে উবাদা বর্ণিত হাদীস থেকেও তা-ই প্রমাণিতহয়। তিনি বলেন: (আরবী*********) রাসূলে করীম (স) যাকাত সংক্রান্ত হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে ‘সাদকায়ে ফিতর’ দেয়ার জন্যে আমাদের আদেশ করেছিলেন। যাকাত ফরয হওয়ার কথা নাযিল হয়েছে তার পরে। হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন, এ হাদীসটির সনদ সহীহ্। তা প্রমাণ করে যে, ‘সাদকায়ে ফিতর’ ফরয হয়েছে যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে। কাজেই তা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পরেই হয়ে থাকবে। [(আরবী*********)] আর বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত যে, রমযানের রোযা ফরয হয়েছিল হিজরতের পর। কেননা যে আয়াত এ ফরয ঘোষণা করেছে, তা সর্বসম্মতভাবেই মদীনায় অবতীর্ণ। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর দৃঢ়তা সহকারে লিখেছেন: যাকাত ফরয হয়েছে হিজরতের নয় বছর পর। সা’লাবা ইবনে হাতিব সংক্রান্ত ঘটনা থেকেওএ কথার সমর্থন মেলে। তাতে বলা হয়েছে: ‘সাদকা’র যাকাতের আয়াত নাযিল হলে নবী করীম(স) তা আদায় করার উদ্দেশ্যে কর্মচারী পাঠালেন। সে গিয়ে বলল: ‘এটা জিযিয়া ছাড়া কিছু নয়, তা জিযিয়ার বোন।’ জিযিয়া ওয়াজিব হয়েছে নবমহিজরী সনে। অতএব যাকাত ফরয হয়েছে এ নবম হিজরীতে, একথা বলতে হয়। ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, এ হাদীসটি যয়ীফ। এটাকে দলীল হিসেবে পেশ করা (গ্রহণ করা) যায় না। [(আরবী*********)-৭৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হাদীসটি খুব বেশী যয়ীফ।] হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন: যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি ঘটে নবম হিজরী সনের পূর্বে। জিমাম ইবনে মা’লাবাত সংক্রান্ত একটি হাদীস হযরত আনাস থেকে বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি এসে নবী করীম (স)-কে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং রাসূয়ে করীম (স) যেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন, তন্মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল: “আল্লাহ কি আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের কাছ থেকে এ সাদকা (যাকাত) গ্রহণ করবেন তা আমাদের মধ্যকার দরিদ্রের মধ্যে মন্টন করবেন?” নবী করীম (স) এর জবাবে বললেন: “হ্যাঁ। এ জিমাম রাসূলে করীম (স)-এর কাছে হিজরী পঞ্চম সনে এসেছিলেন ও তখন এই প্রশ্নোত্তর হয়েছিল্ তবে যাকাত আদায়ের জন্যে কর্মচারী প্রেরণের ব্যাপারটি নবম হিজরী সনেই সংঘটিত হয়েছিল। তাহলে তার পূর্বেই যাকাত ফরয হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। সূরা তাওবার পূর্বোদ্ধৃত আয়াত (আরবী*********)-টি লোভী লোকদের লোভ নিবারণের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছিল। তারা ছিল মুনাফিক, তারা রাসূলে করীম (স)-এর সাদকা বন্টনের ব্যাপার নিয়ে তাঁকে নানাভাবে অভিযুক্ত করেছিল—এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, যাকাত কার্যকর ও কায়েম ছিল তার পূর্ব থেকেই। আর রাসূল (স) তার সংগ্রহ বন্টনের জন্যে দায়িত্বশীল ছিলেন। তা যে আয়াতটির নাযিল হওয়ার পূর্ব থেকেই চলে আসা ব্যাপার এটা নিঃসন্দেহে। রোযার পরই যাকাত হাদীস সমষ্টি থেকে এবং ইসলামী আইন প্রণয়নের ইতিহাস দৃষ্টে আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই মুসলিমদের প্রতি সর্বপ্রথম ফরয হয়েছিল। আর তা হয়েছিল মক্কা শরীফে মি’রাযের পরই। অতঃপর মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয বছর রমযানের রোযা ফরয হয়। সেই সাথে করা হয় ফিতরার যাকাত; ফরয রোযাদারের বেহুদা কাজ—ইত্যাদি থেকে তাকে পবিত্র রাখার ব্যবস্থাস্বরূপ এবং ঈদের দিনে গরীব-মিসকীনের দরিদ্র্য-মুক্তি বিধানের উদ্দেশ্যে।তার পরে ধন-মালের যাকাত ফরয ঘোষিত হয় নিসাব ও পরিমাণ নির্ধারণ সহ। অবশ্য এই নির্ধারণ ঠিক কোন্ সনে হয় তা আমরা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না। আর জিমাম ইবনে মা’লাবাতা রাসূলের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন পঞ্চম হিজরী সনে। সেখানকার কথাবার্তা ও প্রশ্নত্তোর থেকে একথা অকাট্যভাবে জানা যায় যে, তাঁর আগমনের পূর্ব থেকেই যাকাত সুপরিচিত ফরয হিসেবে সমাজে চালূ ও কার্যকর ছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবীকে পাঠিয়েছেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কালেমার সাক্ষ্যসহ। লোকেরা যখন তা গ্রহণ করে নিল, তাদের জন্যে নামায ফরয করা হল। তা-ও যখন তারা পালন করতেলাগল, তখন রোযা ফরয করা হল। তাকে যখন তারা সত্যরূপে গ্রহণ করে নিল, তখনতাদের উপর যাকাত ফরয করা হল। তা মেনে নেয়ার পর হজ্জ ফরয করাহল। তারপর ফরয করা হল জিহাদ। অতঃপর তাদের জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলেন। বললেন: (আরবী*********) আজকের দিনে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করেদিলাম। সম্পূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত। আর তোমাদের দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম। ইবনে আকীল (***) গ্রন্থে লিখেছেন: (আরবী*********) যাকাত ফরয হয়েছে রোযা ফরয হওয়ার পর—। যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ নবী করীম (স) মদীনা শরীফে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে তাকীদ করেছেন, দ্বীন-ইসলামেতার স্থান ও গুরুত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ীই তা দ্বীন-ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ। তিনি তা আদায় করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন, দিতে যারা অস্বীকার করে তাদের জন্যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, বহু সংখ্যক হাদীসের মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ভঙ্গীতে। প্রখ্যাত ‘হাদীসে জিবরীলে’ উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘ইসলাম কি?” রাসূলে করীম (স) জবাবে বললেন, “ইসলাম হচ্ছে তুমি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে এবং আল্লাহর ঘরের হজ্জ করবে যদি তার সামর্থ্য তোমার থাকে।” (বুখারী, মুসলিম) হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত প্রখ্যাত হাদীসের বক্তব্য হল: ‘ইসলাম পাঁচটি জিনিসের উপর ভিত্তিশীল। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্যদান, নামায কায়েম করা, যাকাত দেয়া, রমযানের রোযা রাখা, সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা।’ (বুখারী, মুসলিম) উপরোক্ত হাদীস দুটির মাধ্যমে নবী করীম(স) ঘোষণা করেছেন—(এ পর্যায়ে আরও বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে): ইসলামের ‘রুকন’ –স্তম্ভ পাঁচটি। তার প্রথমহল, দুটি কথার সাক্ষ্য দান। দ্বিতীয় হল নামায এবং তৃতীয যাকাত। অতএব বলা যায়, কুরআন যেমন, হাদীসেও তেমনি যাকাত হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এটা না হলে ইসলামের ভিত্তিই রচিত হতে পারে না। ইসলাম এ কয়টির উপরই প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য রাসূলে করীম(স) কখনও কখনও পাঁচটির পরিবর্ত দুটি বা তিনটিরও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নামায ও যাকাতের উল্লেখ সর্বত্রিই হয়েছে কথার সূচনা-স্বরূপ। এই দুটির প্রতিই লোকদের আহ্বান জানিয়েছেন, মুসলমানের কাছ থেকে বায়’আত গ্রহণ করেছেন প্রধানত এ দুটির উপরই। বুখারী-মুসলিমে উদ্ধৃত হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (স) হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়েমেনে প্রেরণকালে বলেছিলেন: [ইমাম শাওকানী লিখেছেন: এটা দশ হিজরীর ঘটনা, রাসূলের বিদায় হজ্জের পূর্বের। কারো মতে তা ছিল নবমসনের ঘটনা, তবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে। কেউ বলেছেন, তা ছিল মক্সা বিজয়ের বছরের ঘটনা। তবে এ ব্যাপারে পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে যে, হযরত মুআয হযরত আবূ বকরের খিলাফতকাল পর্যন্ত ইয়েমেনে অবস্থান করেছেন। ইবনে আব্দুল বার-এর মতে তিনি ছিলেন বিচারপতি। আর নাসায়ীল মতে তিনি ছিলেন গভর্ণর।] তুমি আহলে-কিতাবের একটা জাতির কাছে যাবে [ওসীয়ত বা উপদেশের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে একথা বলেছিলেন, যেন তার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। কেননা তদানীন্তন ‘আহলে কিতাব’ মোটা-মুটি শিক্ষিত লোক ছিল। তাই তিনি যেন তাদের সাথে তেমনভাবে কথা না বলেন, যেমন মূর্খ লোকদের সাথে বলা হয়।] তাদের তুমি দাওয়াত দেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ সাক্ষ্যদানের জন্যে। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ্ তাদের উপর ফরয করেছেনদিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। তা-ও তারা মেনে নিলে তাদের জানাবে, আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর ‘সাদকা’ (যাকাত) ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। [কেবল (****) গরীব লোকদেরই উল্লেখ করা হয়েছে অথচ যাকাত ব্যয়েল খাত (****) রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তখন ওরাই ছিল বেশী সংখ্যক।] তারা এ কথাও মেনে নিলে পর তোমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন তাদের ধন-মালের উত্তম অংশই তুমি নিয়ে নাও, আর মজলুমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহ্র মাঝে কোন আবরণ বা অন্তরাল নেই। এই ভাষণে নবী করীম (স) নামায ও যাকাত উল্লেখ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। কেননা শরীয়াতে প্রকৃতপক্ষে এ দুটির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামের দিকে লোকদের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এটাই করা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ্তে ঈমানের সাক্ষ্যের পর এ দুটির উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যাবে। যেমন আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন: (আরবী*******) তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। উপরের হাদীসটি থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নবী করীম(স) দায়িত্বশীল কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। যাকাতের বিশেষত্ব হচ্ছে, তা আদায় করে নিতে হবে, সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তিদের উপর তা ছেড়ে দেয়া যাবেনা। রাসূলের প্রতি যাকাত গ্রহণের যে নির্দেশ কুরআনের আয়াতে এসেছে, এখানে তার সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। বুখারীতে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেছেন: (আরবী*********) আমি রাসূলের হাতে বায়’আত করেছি নামায কায়েম করা, যাকাত দেয়া ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে কল্যাণ কামনার উপর। বুখারী-মুসলিমে হযরত উমর (রা) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, রাসূলে করীম (স) বলেছেন: (আরবী*********) আমি আদিষ্ট হয়েছি এ জন্যে যে, আমি যুদ্ধ করব লোকদের সাথে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই, মুহাম্মাদদ আল্লাহ্র রাসূল, নামায কায়েমকরবে এবং যাকাত দেবে। এখানে ‘লোকদের’ বলতে সেসব মূর্তি পূজারী আরবদের বুঝিয়েছেন, যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে ও সীমালংঘন করেছে এবং যাতের সাথে সন্ধি করার আর কোন পথ থাকেনি। কেননা আসলেতাদের কোন ধর্ম ছিল না যা বিলীন করা যেত, কোন আইন-বিধান ছিল না, যা তাদের সুশৃংখলিত করতে পারত। তাদের শাসকও কেউ ছিলনা, যার কথা তারা মানতে প্রস্তুত হতে পারে। এদিকে আল্লাহ তা’আলা আরব জমীনকে ইসলামে হেরেম ও কেন্দ্রভূমি বানাবার ইচ্ছা করেছিলেন। এ কারণে দেশটিকে শিরকের ময়লা থেকে পবিত্র করার এবং এই ভূমির জনগণকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে মুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। হযরত আনাস (রা) বলেছৈন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) আল্লাহর প্রতি পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা, তাঁর মুক্ত ইবাদত নামায কায়েম ও যাকাত দিতে থাকা অবস্থায় যে লোক দুনিয়া ত্যাগ করল সে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবেই দুনিয়া ছেড়ে গেল। হযরত আনাস (রা) বলেছেন: আল্লাহ এ দ্বীন নিয়েই নবী-রসূলগণ এসেছেন এবং আল্লাহর পক্ষথেকে তা প্রচার করেছেন, ঘটনা-দুর্ঘটনার উত্তেজনা ও ইচ্ছা-বাসনার বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বে। আল্লাহ্র কিতাবের সর্বশেষ অবীর্ণ আয়াতে তার সমর্থন রয়েছে। বলেছেন, ‘তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ উন্মুক্ত করে দাও।’ বলেছেন, ‘মূর্তিপূজা পরিহার করা, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, নামায কায়েম করা ও যাকাত দেয়াই হচ্ছে তাদের তওবা।’ অবর এক আয়াতে বলেছেন: ‘তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েমকরে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।’ যাকাত না দেয়ায় কঠোর আযাবের ভয় প্রদর্শন অপরাপর বহু কয়টি হাদীসে নবী করীম(স) যাকাত দিতে অস্বীকারী লোকদের পরকালীন কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়েছেন। এরূপ ভয় প্রদর্শনের মূলে চেতনাহীন মন-মানসে চেতনা সৃষ্টি এবং লোভী ওস্বার্থপর মানুষকে দানশীল বানানোর উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। তিনি উৎসাহদানের ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদেরকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে আইনের চাবুক ও তরবারির ঝংকার তাদের প্রকম্পিত করবে। পরকালীন আযাব বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম(স) বলেছেন: (আরবী*********) আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের—যার দুই চোখের উপর দুটি কালো চিহ্ন রয়েছে—রূপ ধারণ করবে। বলবে, আমিই তোমারধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। অতঃপর নবী করীম (স) এ আয়াতটি পাঠ করলেন: ‘যারা আল্লাহর দেয়া ধন-মালে কার্পণ্য করেত তারা যেন মনে করে না যে, তাদের জন্যে তা মঙ্গলময় বরং তা তাদের জন্যে খুবই খারাপ। তারা যে মাল দিয়ে কার্পণ্য করছে তা-ই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে। ইমাম মুসলিম তারই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে মালিকই তার উপর ধার্য হক আদায় করে দেবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলোকে তার পাশ্বে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। পরে তার উপর জাহান্নামের আগুনে তাপ দেয়া হবে, সেই উত্তপ্ত বস্তু দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্টে দাগ দেয়া হবে; সেইদিন-যার সময়কাল পঞ্চাশ বছর হাজার বছরের সমান দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত লোকদের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করা হবে। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে। হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। গরু বা ছাগলের মালিকও যদি তার উপর ধার্য হক আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতেরদিন তা নিয়ে আসা হবে, সেগুলো নিজেদের দুভাগে বিভক্ত পায়ের খুর দিয়ে মালিককে লাথি মারবে এবং তার শিং দ্বারা তাকে গুঁতোবে যখনই তার উপর অপরটি এসে যাবে, প্রথমটি প্রত্যাহার করা হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার বন্দীদের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন, যে দিনের সময়-কাল তোমাদের গণনামতে পঞ্চাশ হাজার বছরকালের সমান। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে, হয় জান্নাতের দিকে, নয় জাহান্নামের দিকে। যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি রাসূলের সুন্নাত যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্যে কেবল পরকালীণ আযাবের ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বৈষয়িক শাস্তির কথাও বলিষ্ঠভাবে বলা হয়েছে। সে শাস্তি যেমসন শরীয়াতসম্মত, তেমনি পরিণামগত।তা প্রযোজ্য হবে এমন সব ব্যক্তির, যে তার মালে ধার্য আল্লাহ্র ও ফকীরের হক আদায় করে দিতে কার্পণ্য করবে। পরিণামগত শাস্তি- যা উচ্চতর মূল্য লাভে সক্ষম হবে। এ পর্যায়ে নবী করীম (স) বলেছেন: ‘যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কুঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দেবেন। [(আরবী*********) এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সিকাহ্, হাকেম ও বায়হাকীতে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা অতিরিক্ত কথা নকল করেছেন (আরবী*********)-যে জাতি যাকাত দেয় না, তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়। হাকেম বলেছেন, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ্।] দ্বিতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে: ‘ওরা ওদের ধন-মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতকে বন্ধ করিয়েছে মাত্র। তারপরও অবশ্য কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই বৃষ্টিপাত হয়। (ইবনে মাজা, বাজ্জার, বায়হাকী) অপর একটি হাদীসের কথা হল: যাকাত যে মালের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকবে, তা অবশ্যই বিপর্যয় হবে। (বাজ্জার, বায়হাকী) এ হাদীসটির দুটি অর্থ হতে পারে: প্রথম, সাদকা অর্থাৎ যাকাত কোন ধন-মালের মধ্যে রেখে দেয়া হলে তা হিসেব করে মূল ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা করে না হলে তা-ই সেই ধন-মালের ধ্বংস ও বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়অর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অপর একটি হাদীসের বক্তব্যেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে: (আরবী*********) স্থল ও জলভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয় শুধু যাকাত আটকে রাখার দরুন। [তাবরানী বলেছেন, উমর ইবনে হারুন নামক বর্ণনাকারী ‘যয়ীফ’।] দ্বিতীয়, এক ব্যক্তির যাকাত গ্রহণ করে- যদিও সে যাকাতের মুখাপেক্ষী বা এর উপর নির্ভরশীল নয়। সে এ কাজ করে তার নিজের ধন-মালের সঙ্গে যাকাতকেও ধ্বংস ও বিনষ্ট করে। ইমাম আহমদ হাদীসটির এই ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর শরীয়াতসম্মত শাস্তি যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর জন্য একটা শরীয়াতসম্মত শাস্তিও রয়েছে। প্রশাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানই এ শাস্তি দানের জন্যে দায়িত্বশীল। নবী করমি(স) যাকাত পর্যায়ে বলেছেন: (আরবী*********) যে লোক সওয়াব পাওয়ার আশায় যাকাত দিয়ে দেবে, সে তার সওয়াব অবশ্যই পাবে। আর যে তা দিতে নারায হবে, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব তার ধন-মালের অংশ থেকে। তা হচ্ছে আমাদের রব্ বহু সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের অন্যতম। মুহাম্মাদ (স)-এর বংশের লোকদের পক্ষেতা থেকে কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়। [বায়হাকী এ হাদীসটি বর্ণনা করে লিখেছেন। আবূ দাউদও তা উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী ও মুসলিম উদ্ধৃত করেন নি। কেননা বর্ণনাকারী মুআবিয়া ইবনে হায়দাতা দুর্বল।] এ হাদীসটিতে যাকাত পর্যায়ের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মৌলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো: এক, যাকাত সম্পর্কে আসল কথা হল, মুসলিম ব্যক্তি তা দেবে সওয়াব পাওয়ার নিয়তে ও আশায়। সে সওয়াব মহান আল্লাহ্র কাছ থেকেই পাওয়া যাবে, এই দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করবে সে। কেননা সে তো তা দিয়ে আল্লাহর নির্ধারিত ইবাদত পালন করছে মাত্র। কাজেই যে তা করবে, সে তার সওয়াব—শুভ কর্মফল অবশ্যই পাবে। আল্লাহ্র কাছে তা-ই তার ইবাদতের চূড়ান্ত প্রতিফল। দুই, যে লোক কার্পণ্য, লেঅভ-লালসা ও পার্থিব প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়বে ও যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, তাকে সে অবস্থায় থাকবার সুযোগ দেয়া যাবে না। তার কাছ থেকে তা জোরপূর্বক আদায় করতে হবে। সে জোর আসবে শরীয়াতের সার্বভৌমত্বের বলে। রাষ্ট্রই এই শক্তি প্রয়োগ করবে। তখন তার যাকাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবেএবং শাস্তি ও দণ্ডস্বরূপ তার অর্ধেক ধন-মাল নিয়ে নেয়া হবে। কেননা সে তার ধন-মালে আল্লাহর নির্ধারিত হককে গোপন ও অস্বীকার করছে। তা অন্যদের জন্যেও শিক্ষামূলক হবে। ফলে আর কেউ যাকাত অস্বীকৃতির পথে অগ্রসর হবে না। বলা হয়েছে, ইসলামের সূচনাকালে এরূপ শাস্তিদানের ব্যবস্থা চালূ ছিল। কিন্তু উত্তরকালে তা বাতিল হয়ে যায়। [শীরাজী তাঁর গ্রন্থ (*****) –এ এই কথার উল্লেখ করেছেন।] কিন্তু এ কথার কোন দলীল বা প্রমাণ নেই। কেবল সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে এই ধরনের কোন কথা বলাও যুক্তিসঙ্গত নয়। আমি মনেকরি, এরূপ কোন শাস্তির ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র পরিচালকের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত। যেখানেই দেখা যাকে লোকেরা যাকাত অস্বীকৃতিতে চরম সীমায় পৌঁছে গেছে, সেখানেই তা কার্যকর করা যাবে। কেননা এই কাজ থেকে তাদের বিরত রাখার বিকল্প কোন পন্থা নেই। আমরা ‘যাকাত আদায়’ আলোচনায় এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলব। তিন. যাকাত আদায়ে এরূপ কঠোরতা ও দৃঢ়তা অবলম্বনের কারণ হচ্ছে সমাজের গরীব ও মিসকীনদের অধিকার আদায়ের দায়িত্বের বাধ্যবাধকতা। কেননা আল্লাহ্ই তাদের জন্যে যাকাত ফরয করেছেন। তা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু নবী করীম (স) এবং তাঁর বংশের লোকদের জন্যে এই যাকাতে কোন অংশ নেই। তাদের পক্ষে এ থেকে একবিন্দু গ্রহণ করাও হালাল নয়। এটি ‘সাদকা’ সম্পর্কে ইয়াহুদীদের অবলম্বিত নতিরও বিরোধী। কেননা তথায় যাকাতরে দশমাংশ হযরত হারুন নবীর বংশধরদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। আর অপর একটি অংশ ধর্মীয় পদাধিকারী লোকদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। [আবুল হাসান নধবী লিখিত (আরবী******) দ্রষ্টব্য।] যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের শাস্তিদান পর্যায়ে ইসলাম কোন জরিমানা ধরনের ব্যবস্থা চালু করেনি বা তাছাড়াও ভিন্ন ধরনের শাস্তির প্রয়োগ থেকে বিরত রয়েছে। বরং যাকাত দিতে অস্বীকারকারী শক্তি ও দাপট সম্পন্ন বিদ্রোহী প্রতিটি দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তরবারি ব্যবহার ও যুদ্ধ ঘোষণাকেই ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এ পথে নরহত্যা ও রক্তের বন্যা প্রবাহিত করাকেও বিন্দু মাত্র পরোয়া করা হয়নি। কেননা অধিকার রক্ষা ও আদায়ের উদ্দেশ্যে যে রক্তপাত করা হয়, তা কখনই নিষ্ফল যায় না। আল্লাহ্র পথে—পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যে প্রাণ দান করা হয়, তা কখনই মরে না, কখনই মরতে পারে না। এ কথঅটি আমাদের সম্মুখে প্রকট হয়ে দেখা দেয়, যখন আমরা সত্যের জন্যে আর্লাহর বিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বনকারী ঈমানদার লেঅকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করি। তাদের ছাড়া অন্যান্য যেসব লোক আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করেছে, তাদের ধন-মালের ধার্য আল্লাহ্র হক আদায় করতে অস্বীকার করেছে, তাদের উপর অর্পিত আমানত রক্ষায় যত্নবান হয়নি, তারা নিষ্ফল ও অন্যায়ভাবেই রক্ত দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জন করেছে। যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ছিল তাদের কর্তব্যই তারই উপর তারা বিপরীতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের জান ও মালের নিরাপত্তার যা ছিল ভিত্তি, তারা নিজেরাই তাকে চূর্ণ করেছে। বস্তুত যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ্ হাদীস দ্বারা মেযন প্রমাণিত, তেমনি এর উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্য (ইজমা)-ও কায়েম হয়েছে। বস্তুত যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি এর উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্য (ইজমা)-ও কায়েমহয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বুখারী মুসলিমে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছে। নবী করীম(স) ঘোষণা করেছেন: (আরবী*********) লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, নামাযকায়েমকরবে ও যাকাত দেবে। তারা যদি তা করে, তাহলে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল—তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্যে কিছু করার প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। আর তার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ আল্লাহ্র কর্তৃত্বাধীন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করমি(স) বলেছেন: আমাকে আদেশ করা হয়েছে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, আমার ও আমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান আনবে। তারা তা করলে তাদের রক্ত ও ধন-মাল আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। তবে তার হক আদায়ের জন্যে কিচু করার প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। তাদের হিসাব আল্লাহ্র কাছে। ইমাম বুখারী, মুসলিম এবং নাসায়ী এ হাদীসটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। মুসলিম ও নাসায়ী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ থেকেও এ রকমের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী*********)] এসব হাদীস অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে যে, যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং তা চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না তারা তাদিয়ে দেয়। বাহ্যত মনে হয়, হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর কাছে এরূপ স্পষ্ট বলিষ্টভাষার হাদীস পৌঁছায়নি; [তা অসম্ভব বা অস্বাভাবিকও কিছু নয়, কেননা কোন কোন সাহাবী হয়ত একটা হাদীস শুনেছেন, অন্যরা তা শুনেন নি।] পৌছালেতাঁরা ইসলামের নামায-রোযা ইত্যাদি শরীয়াতী বিধান পালনে প্রস্তুতলোকেরাযাকাত দিতে অস্বীকৃত হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সেরূপ কথোপকথনে প্রবৃত্ত হতেন না, যা তাঁরা করেছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য সর্বজনবিদিত যে, রাসূলের প্রথম খলীফার আমলে আরবেরবিভিন্ন গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। যদিও তারা নামায-রোযা পালনে প্রস্তুত ছিল। মুসায়লাম কায্যাব, সাজাহ্ ও তুলায়হা প্রভৃতি মিথ্যা নবুওয়ত দাবিকারী এবং তাদের লোকজন তাদের নীতিকে প্রবল সমর্থন জানায়। এ পর্যায়ে হযরত আবূ বকর (রা)-এর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। তিনি দৈহিক ইবাদাত—নামায এবং আর্থিক ইবাদত—যাকাত এর মধ্যে কোনরূপ বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্যকে বরদাশত করতে ও মেনে নিতে প্রস্তুত হনন নি। এর কোন একটির প্রতি একবিন্দু উপেক্ষাও তাঁর সহ্য হতে পারে নি। কেননা তাঁর পূর্বে রাসূলের যামানায় তার করা সম্ভব ছিল না। একটা ছোট ছাগল বা উষ্ট্র বাঁধার একটা রজ্জুর ক্ষেত্রেও নয়। এ পর্যায়ে মহান সাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-র বর্ণনা এখানে অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে। তা থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি িস্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি বলেন: নবী করীম (স) যখন ইন্তিকাল করলেন, তখন হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা হলেন। এ সময় আরবের কিছু লোক কুফরী অবলম্বন করে। তখন হযরত উমর (রা) বললেন: আপনি কি করে এ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? অথচ রাসূলে করীম(স) বলেছৈন: আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষন না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে। তারা যদি তা বলে, তাহলে তাদের রক্ত ও ধন-মাল আমার কাছে রক্ষা পাবে। তবে তার হক্ রক্ষার জন্যে কিছু করতে হলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত! তখন হযরত আবূ বকর (রা) জবাবে বললেন: (আরবী***********) আল্লাহ্র শপথ; আমি অবশ্যিই যুদ্ধ করব সেই লোকের বিরুদ্ধে, যে নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা যাকাত হল ধন-মালেল হক। আল্লাহ্র কসম, ওরা যদি একটা উষ্ট্রও দিতে অস্বীকার করে, যা রাসূল (স)-এর যামানায় তারা দিত, তা হলে আমি তাদের এই অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এ কথা শুনে হযরত উমর (রা) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন: (আরবী**********) আল্লাহ্র শপথ! এ আর কিছু নয়, আর্লাহ্ই আবূ বকরের অন্তরকে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এটাই সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত। হযরত উমর (রা) প্রথমে বাহ্যিক কথার মধ্যেই জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কথার শেষ দিকটার দিকে লক্ষ্য দেন নি এবং তার শর্তসমূহও অনুধাবন করেন নি। তিনি মনে করেছিলেন কালেমা সিলামে দাখিল হলেই বুঝি ব্যক্তির রক্ত ও ধন-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যেতে পারে। সাধারণ কতিপয় হাদীস থেকে যদিও এ কথাই বোঝা যায় কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা সত্য নয়। হযরত আবূ বকর (রা)-এর যুক্তির দুটি দিক: একটি, হাদীসটির মূল বক্তব্য, যার সাথে এ নিরাপত্তার শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, তা হল (****) তবে তার হক রক্ষার জন্যে কিছু করতে হলে ভিন্ন কথা।’ আর যাকাত হচ্ছে ধন-মালের হক্। এ হক রক্ষার জন্যে যুদ্ধও করা যাবে। এ কথা হযরত উমর (রা) ও অন্যরা অস্বীকার করতে পারে না। দ্বিতীয়টি, যাকাতকে নামাযের মতই মনে করতে হবে। কেননা তা নামাযেরই ‘বোন’। কুরআন ও সুন্নাতে এ দুটি এক সঙ্গে ও পাশাপাশি উদ্ধৃত হয়েছে সর্বত্র। হযরত আবূ বকর (রা) দলীল পেশ করেছেন, তা থেকে মনে হয়, হযরত উমর (রা) ও অন্যান্য সাহাবা প্রকাশ্যে নামায অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। এটা ঐকমত্যের ক্ষেত্রে। পরে মতদ্বৈধতার বিষয়টিকে ঐকমত্যে নিয়ে আসা হয়। হযরত উমরের নিকট হযরত আবূ বকরের অভিমত সত্য বলে স্থিতি লাভ করে। তিনি তা নির্ভুল মনে করেন এবং যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধকে তিনি মনে প্রাণে মেনেও নেন। তার উপরোদ্ধৃত স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। রাসূলে করীম (স)-এর পর যে সব আরব গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে বসে, তাদের ব্যাপার প্রথম খলীফার অনুসৃত নীতি ছিল এই। সকল সাহাবায়ে কিরাম (রা) তাঁর এ নীতি অকুন্ঠিতভাবে সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে শরীক হন। এমনকি প্রথমে এ ব্যাপারে যাঁর মনে সংশয় জেগেছিল তিনিও। এ থেকে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠি হল। ইসলামী শরীয়াতে এ ইজমা একটা অন্যতম দলীল। এ প্রেক্ষিতে ইমাম নববী লিখেছেন: এক ব্যক্তি বা একটা জনগোষ্ঠী যদি যাকাত দিতে অস্বীকৃত হয়, যুদ্ধ করতেও তারা রাযী না হয়, তবুও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-র কথা থেকে এরই সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন: প্রথমদিকে সাহাবায়ে কিরাম যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন মত পোষণ করতেন। কিন্তু যখন হযরত আবূ বকর (রা) যখন যুদ্ধের পক্ষে মত ব্যক্ত করন, তাঁর দলিলও তিনি সকলের সমক্ষে পেশ করেন, তখন এ মতের যৌক্তিকতা সকলের কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তখন সকলেই তা মেনে নেন এবং সর্বসম্মতভাবে এ যুদ্ধ কার্যকর হয়। [(আরবী************)] সম্ভবত ইতিহাসে হযরত আবূ বকর (রা) পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রই সর্বপ্রথম দরিদ্র, মিসকীন ও সমাজের দুর্বল ব্যক্তিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। সমাজের শক্তিমান লোকেরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত এদেরই শোষণ করে আসছিল। কিন্তু তারা কোন শাসকের কাছে এর প্রতিকার পায় নি। ধনী ও শক্তিমানদের কাতার ছেড়ে দুর্বলদের পক্ষেদাঁড়াতে এ পর্যন্ত কেউই রাযী হয়নি। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) ও তাঁর সঙ্গী-সাথী সাহাবিগণ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের সৃষ্ট সংশয়ে বিভ্রান্ত হতে রাযী হননি। তাঁরা অকুণ্ঠ চিত্তে সেইযুদ্ধ করে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যাকাত অস্বীকারকারীরা কুরআনেরই (সূরা তাওবা) আয়াত: (আরবী***********) দিয়েই এই বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, এ নির্দেশ তো বিশেষভাবে নবী করীম(স)-এর প্রতি। তিনি ছাড়া অন্য কারো প্রতি এই নির্দেশ ছিল না এবং অন্য কেউ সেই যাকাত আদায় করার অধিকারও পেতে পারে না। ফলে রাসূল (স)-এর ইন্তিকালের সাথে সাথেই যাকাত দেয়ার বাধ্যবাধকতাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা আরও বলেছিল যে, “রাসূলে করীম (ষ) আমাদের কাছ থেকে যাকাত নিয়ে তার বিনিময়ে আমাদরে দিতেন পবিত্রকরণ ও বিশুদ্ধকরণ কাজ। আমাদরে জন্যে তিনি রহমতের দোয়া করতেন। আর তাঁর দোয়া বঞ্চিত হয়ে গেছি। কিন্তু তাদের এ ধারণা ছিল মারাত্মক বিভ্রান্তিপ্রসূত, একটা ভিত্তিহীন সংশয়মূলক ব্যাপার। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী তাই লিখেছেন যে, কুরআনের ব্যাপারে এরূপ ধারণা মূর্খ লোকদের মনেই জাগতে পারে, যে লোক শরীয়াতের উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। অথবা যে লোক দ্বীন নিয়ে খেল-তামাশায় অভ্যস্ত, দৃষ্টি সংকীর্ণ। [(আরবী***********)] তার কারণ এই যে, উপরিউক্ত আয়াতে স্পষ্টত নির্দেশ যদিও রাসূলেকরীম (স)-এর প্রতি ছিল কিন্তু আসলে এই নির্দেশ সব রাষ্ট্র পরিচালকদের প্রতিই- যারা মুসলিম উম্মতের উপর কর্তৃত্বসম্পন্ন হয়। এ আয়াতটির সম্বোধন সেই বিশেষ সম্বোধন নয়, যেরূপ নিম্নে এ আয়াতটির রয়েছে: (আরবী***********) হে নব, িআমরা তোমার জন্যে তোমার স্ত্রীদের হালাল করে দিয়েছি। অথবা (আরবী***********) রাতের বেলা তুমি তাহাজ্জুদ পড়, তোমার জন্যে তা নফল। এ দুটি আয়াতেই সম্বোধন বিশেষভাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি। অন্য কারোর প্রতি নয়। ইমাম খাত্তাবী লিখেছেন: কুরআন মজীদের সম্বোধন তিন প্রকারের- একটি সম্বোধন সাধারণ, যার সম্মুকে সাধারণ লোকজন রয়েছে। যেমন: (আরবী***********) হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা যখন নামাদের জন্যে প্রস্তুতি নেবে, তখন তোমরা দৌত করবে তোমাদের মুখমন্ডল... দ্বিতীয় প্রকারের সম্বোধন বিশেষভাবে রাসূলে করীম(স)-এর প্রতি। তাতে অন্য কেউই শরীক নেই। এ ধরনের সম্বোধন বিশেষ একটা স্পষ্ট লক্ষণ থাকে, অন্য কারো না হওয়ার কথা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়। যেমন: (আরবী***********) রাতের বেলা তাহাজ্জুদের নামায পড় এটা তোমার জন্যে নফল। অথবা (আরবী***********) একান্তভাবে তোমার জন্যে, মু’মিনদের ছাড়াই। তৃতীয় এক প্রকারের সম্বোধন যদিও রাসূলে করীম (স)-কে লক্ষ্য করেই হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনিসহ গোটা মুসলিম উম্মত শামিল রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী***********) নামায কায়েম কর সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়া সময় থেকে শুরু করে রাত্রি আচ্ছন্ন হওয়ার সময় পর্যন্ত....। অথবা (আরবী***********) যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে, আল্লাহর নামে পানা চাইবে- এ নির্দেশসমূহ বাহ্যত রাসূলের প্রতি হলেও তা সকলেরই পালনীয়। যাকাত সম্পর্কিত আয়াত: (আরবী***********) টিও এ পর্যায়ের এবং এ সম্বোধনও বাহ্যত রাসূলের প্রতিহলেও তা সাধারণভাবে সব মুসলিমকেই পালন করতে হবে। কেবল রাসূলই তা পালনে বাধ্য নন। এই ধরনের সম্বোধনে একটা বিশেষ ফায়দা নিহিত আছে। প্রথমত তিনিই দ্বীনের আহ্বানকারী- আল্লাহর দিকে। আল্লাহর কথার মুল বক্তব্যের ব্যাখ্যাদাতা তিনিই। কাজেই এ ধরনের নির্দেশ তাঁকে সম্বোধন করা হলে দ্বীনের শরীয়অত প্রথমে তাঁরই দ্বারা পালিত হবে এবং তাঁর দেখানো পদ্ধতিতে গোটা উম্মতই তা পালন করতে সমর্থ হবে। যাকাত অমান্যকারীরা বলেছৈ যে, রাসূলে করীম (স) যাকাত নিতেন, আর তার বদলে তিনি আমাদরে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করতেন, আমাদের জন্য দোয়া করতেন- অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া যাবে না, এটা একটা ভিত্তিহীন কথা। কেননা এই পবিত্রকরণ ও পরিশুদ্ধকরণ যাকাতের মাধ্যমেই সম্পনন হয়। কাজেই তা রাসূলের বেলয় যেমন, তাঁর পরে অন্যদের বেলায়ও ঠিক তেমনিভাবেই সম্পন্ন হতে থাকবে। রাসূল ছাড়া অন্যদের মাধ্যমে তা হবে না, এমন কথা নয়। তাদের জন্যে দোয়ার ব্যাপারটিও অনুরূপ। যিনিই লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করবেন—তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হোন, কি তাঁর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি—তিনি যাকাতদাতাদের ধন-মালে বরকত ও শুভ-প্রতিফলের জন্য দোয়া করতে আদিষ্ট। আর এই দোয়াতেই ধন-মালের মালিকের জন্যে সান্ত্বনা নিহিত রয়েছে। এভাবেই কার্য ও কারণে আল্লাহর বিধান সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব। এ এক সাধারণ ব্যাপার, রাসূল (স)-এর জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট নয়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাসূল (স)-এর দোয়ার মর্যাদা সর্বোচ্চ এবং তার তাসীরও মনে প্রাণে অনেক ব্যাপক ও গভর যার তুলনা হয় না। এ দিকে দৃষ্টি রেখে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: যাকাতদাতার জন্যে রাসূল (স)-এর পবিত্রকরণ পরিশুদ্ধকরণ ও দোয়া সবই পাওয়া যাবে আল্লাহ্ ও রাসূল (স)-এর আনুগত্য করার মাধ্যমে। নবীর জীবদ্দশায় নেক আমলের যে সওয়াব নির্ধারিত ছিল, তাই চিরদিনই কার্যকর থাকবে, কোনদিনই তা ফুরিয়ে যাবে না। [দেখুন (আরবী***********) অথবা (আরবী***********)] হযরত আবূ বকর (রা)-এর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল, এরা তাদের একটা গোষ্ঠী। তাদের পন্থায় বিদ্রোহকারী আরো ছিল। তারা নিঃসন্দেহে প্রকাশ্যে কুফরী অবলম্বন করেছিল। নবুয়্যাত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুসায়লামা, কায্যাব প্রভৃতি নবুয়্যাতের মিথ্যা দাবিকারীদের সহায়তা করেছিল। নামায ও যাকাত সমান ও অভিন্নভাবে ফরয হওয়ার কথা তারা অস্বীকার করেছিল। দ্বীন-ইসলামেযাকাতের গুরুত্ব অতঃপর দ্বীন-ইসলামে যাকাতরে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা পর্যায়ে আলোচনা আবশ্যক। ইসলামের অন্যতম ‘রুকন’ বা স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। এ কথা বিশেষ ও সাধারণ সকলেই জানেন। যাকাত যে ফরয, তা বার বার আবৃত্ত কুরআনের আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণার দ্বারা প্রমাণিত। নবীর ‘মুতাওয়াতির’ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। পুর্বের ও পরের গোটা উমএতর লোকদের সামষ্টিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা অস্বীকৃত। যুগের পর যু- বংশের পর বংশের মাধ্যমে তা প্রচলিত ও প্রতিপালিত। [করআন, সুন্নাহ ও ইজমা ছাড়া নিতান্ত বিবেক-বুদ্ধির বিচারেও যাকাত ফরয প্রমাণিত। অবশ্য এ বিবেক-বুদ্ধি ঈমানদার লোকের-বেঈমানের নয়। ঈমানদার ব্যক্তিমাত্রই আল্লাহর ন্যা বিচার ও সৃষ্টির প্রতি তাঁর অফুরন্ত রহমতের কথা বিশ্বাস করে। অন্তত তিনটি দিক দিয়ে বিবেচনা করা চলে: (১) যাকাত দিলে গরীব, মিসকীন, অক্ষমের সাহয্য হয়। তা পেয়ে তারা আল্লাহ্র নেক বান্দার দায়িত্ব পালন করে বেঁচে থাকার সুযোগ পেতে পারে। আল্লাহর ধার্যকৃত ফরয আদায় করার যোগ্যতা হয় তাদের; (২) যাকাত আদায়কারীর মন-অন্তর পবিত্র করে, পাপের গ্লানি ও মলিনতা থেকে পরিচ্ছন্ন করে। তার চরিত্রকে দানশীলতা গুণে বিভুষিত করে। সে কার্পণ্য ও লোভ-লালসা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। যদিও মানুষ স্বভাবগতভাবেই লোভী ও স্বার্থপর। যাকাত দেয়ার ফলে তার মধ্যে বদান্যতা ও মহানুভবতা জেগে ওঠে। আমানত সমূহ আদায় করতে অভ্যস্ত হয়। পাওনাদারদের পাওনা ও হকদারদের হক দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়। আর (৩) আল্লাহ্ তা’আলা ধনী লোকদের নিয়ামত দিয়েছেন, নানা ধন-সম্পত্তি ও মর্যাদায় ভূসিত করেছেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ধন-মাল দিয়েছেন। সে তা দিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্য সহকার জীবন-যাপন করে। এ জন্যে তার শোকর আদায় করা কর্তব্য। যাকাত দিয়ে সে এ শোকর আদায়ের সুযোগ পায়।] যাকাত অমান্যকারী কাফির ইসলামী শরীয়াতে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে আলিমগণ বলেছেন যে, লোক তা অস্বীকার করবে, তার ফয হওয়াকে অমান্য করবে, সে অবশ্যই কাফির হয়ে যাবে এবং ধনুক থেকে তীর যেমন করে বের হয়ে যায়, সেও ঠিক তেমনিভাবে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। ইমাম নববী বলেছেন: যাকাত দেয়া ফরয একথা স্বীকার করে কেউ যদি তা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে দেখতে হবে সে কি নও-মুসলি হিসেবে এ সম্পর্কে এখনও জানতে পারে নি বলে তা করছে কিংবা সমাজসভ্যতা থেকে বহু দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণে এরূপ মনোভাব পোষণ করছে? যদি তা হয়, তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না। তখন তাকে ভালোভাবে জানাতে ও বোঝাতে হবে এবং এরপর তার কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নিতে হবে। তখন দিতে অস্বীকার করলে অবশ্যই তাকে কাফির বলতে হবে। যদি লোকটি এমন হয় যে প্রকৃত ব্যাপার তার কাছে প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে না। যেমন মুসলিম সমাজে মিলেমিশে বসবাসকারী মুসলমান; সে যদি তা অস্বীকার করে, তা হলে যে নির্ঘাত কাফির বলে গণ্য হবে। তার উপর মুরতাদ হওয়ার শাস্তি কার্যকর হবে। প্রথমে তাকে তওবা করতে বলা হবে এবং তওবা না করলেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কেননা যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত, তা দ্বীন-ইসলামের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কাজেই তা অস্বীকার করা হলে আল্লাহকে অস্বীকার করা হয়। রাসূলকেও অমান্য করা হয়। অতএব তাদের কাফির হওয়ার কোনেই সন্দেহ থাকে না। ইবনে কুদামা প্রমুখ বড় বড় ফিকাহ্বিদেরও এই মত। [আরবী*************] শরীয়াতের এই সুস্পষ্ট, বলিষ্ঠ ও ঐকমত্য ভিত্তিক সিদ্ধান্তের আলোকেই আমরা সেসব লোক সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, যারা যাকাতকে অবহেলা ও উপেক্ষার চোখে দেখে এবং বলে, “তা এ যুগের উপযুক্তনয়” তারা নাকি আবার মুসলমান। মুসলিম বংশের সন্তান এবং মুসলিম জাহানের প্রাণকেন্দ্রে লালিত-পালিত। প্রকৃতপক্ষে এটা সুস্পষ্ট মুরতাদ হওয়ার কাজ, যদিও তাদের শাসনের জন্যে আবূ বকরের মত খলীফা নেই। [আবুল হাসান নদভী লিখিত এক পুস্তিকা।] ইসলামের যাকাত ও অন্যান্য ধর্মের যাকাতের মধ্যে পার্থক্য দ্বীন-ইসলামে যাকাত ফরয হওয়া ও তার স্থান বা মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন, সুনআহ ও ইজমা’র ভিত্তিতে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল। এক্ষণে আমরা এ ফরযকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিচার-বিচেনা সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করতে পারি। এ পর্যায়ে প্রথম কথা হল, প্রাচীণ ধর্মসমূহ দরিদ্র ও অক্ষমলোকদের প্রতি যে করুণা ও অনুগ্রহ তুলনা করা চলে না। এখানে কয়েকটি দিক দিয়ে আমাদের বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে: এক. ইসলামে যাকাত কখনই একটা নিছক নেক কাজ বা খুব ভালো অভ্যাসের ব্যাপা ছিল না। তা সব সময়ই ইসলামের একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘রুকন’ রূপে গণ্য। তা ইসলামের এক তুলনাহীন অবদান। চারটি প্রধান ইবাদতের অন্যতম হচ্ছে এই যাকাত।তা দিতে অস্বীকার করা চিরকালই ফিস্ক—ইসলামের সীমালংঘন বলে চিহ্নিত। তার ফরযিয়াত অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়েছে। এটা কোন ইচ্ছামূলক নেক কাজ বা অনুগ্রহ বিশেষ কোন দিনই ছিল না। আর এটি নফল সাদ্কাও নয়। বরং এটা বড় ফরয কাজ, অতীব উচ্চমানের, নৈতিক ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পর্যায়ে গণ্য। দুই. ইসলামের দৃষ্টিতে তা ধনীদের ধন-মালে গরীবদের সুনির্দিষ্ট হক। ধন-মালের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্ই এ হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারাই খলীফা হবে, তাদের কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে তা আদায় ও বন্টন করা। তারা হচ্ছে যাকাতরে ভাণ্ডারী। এ কারণে তাতে গরীবদের উপর ধনীদের অনুগ্রহ হওয়ার কোন ভাবধারাই নেই। কেননা ধন-ভাণ্ডারের আসল মালিকের নির্দেশে তার কোন অংশ কাউকে দিলে তাতে ভাণ্ডারী বা বন্টন কারীর অনুগ্রহের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তিন. এ ‘হক’ সুপরিজ্ঞাত। ইসলামী শরীয়াতই তার ‘নিসাব’ ও পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর সীমা ও শর্তও তার নির্ধারিত। কখনতা দিতে বা আদায় করতে হবে, তার পন্থা ও নিয়ম কি, এই সব কিছুইআগে থেকে বলে দেয়া। প্রতিটি মুসলিমই জানে তার দলিল ও প্রমাণ। চার. এই অধিকরটি ব্যক্তিদের মনের ভাল-না-লাগার উপর ছেড়ে দেয়া হয় নি। তা সংগ্রহ বা আদায় করা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এবং বন্টন করা ইনসাফের নীতি অনুযায়ী সরকারের উপর অর্পিত দায়িত্ব। আর তা করা হবে এই কাজে নিযুক্ত বিশেষ কর্মচারীর মাধ্যমেএবং কর্তৃপক্ষ ধার্যকৃত করের মতই তা আদায় করা হবে। এই কারণে কুরআনর ‘তাদের-ধন-মাল থেকে সাদ্কা গ্রহণ কর।’—এ নির্দেশেরব্যাখ্যায় সুন্নাত বলেছে: ‘তা গ্রহণ করা হবে ধনীদের কাছ থেকে।’ পাঁচ. এই ফরয কাজ করতে অর্থাৎ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী প্রত্যেকব্যক্তিকেই সরকার শাস্তি দেবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সে শাস্তি মালিকের অর্ধেক সম্পদ নিয়ে নেয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে রাসূলের কথা—“আমি তা গ্রহণ করবই এবং তার সম্পদের অর্ধেক।” ছয়. এই ফরয আদায়ে যে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীই বিদ্রোহ করবে, মুসরমানদের রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হল তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করা। যতক্ষণ না তাদের ধন-মাল থেকে আল্লাহ নির্ধারিত গরীবদের হক দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়। সহীহ্তম হাদীসসমূহ িএকথা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) তাঁর সঙ্গী-সাথী, সাহাবায়ে কিরাম বাস্তবে তা-ই করছেন। সাত. মুসলিম ব্যক্তি এই ফরয আদায় করার জন্যে আদিষ্ট- রাষ্ট্র ও সরকার বা সমাজ-সংস্থা যদি তাআদায় করার কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ নাও করে। কেননা এই ফরযটি প্রথমেতো একটা বড় ইবাদত, যা পালন করে মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং স্বীয় মন-মানসিকতা ও ধন-মাল পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে পারে। কাজেই রাষ্ট্র সরকার তার দাবি না করলেও তার ঈমান ও কুরআন তার প্রতি এজন্যে তাকীদ করছে। অতএব শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী তাকে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। আট. যাকাত বাবদ সংগ্রহীত সম্পদ শাসক-প্রশাসকদের খামখেয়ালীর ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। ইয়াহুদী সমাজে যেরূপ করা হয়েছিল। বরং পাওয়ার অধিকারী নয় এমন লোভী লোকদের লোভ-লালসা বা খেয়াল-খুশি অনুযায়ীও তা যথেচ্ছ ব্যয়-ব্যবহার করা যেতে পারে না। এজন্যে ইসলামতার সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং পাওনাদারদের তালিকাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। যেমন কুরআনের আয়াত—নিঃসন্দেহে যাকতা-সাদকাত হচ্ছে গরীব ও মিসকীনদের জন্যে। হাদীসেও তার স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা রয়েছে। লোকেরা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পেরেছে যে, এখানে ধন-সম্পদ সংগ্রহ করাটাই সমস্যা নয়, তার ব্যয়-বন্টনটাও অতি বড় সমস্যা। এই কারণে নবী করীম (স) ঘোষণা করেছিলেন যে, আমার ও আমার বংশের লোকদের জন্যে তাতে কিছু নেই। তা প্রতিটি এলাকার সমাজের ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং সেই সমাজেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে।” নয়. গরীবদের উপস্থিত প্রয়োজন পূরণ কিংবাতাদের সাময়িক দৈন্য-দুর্দশা বিদূরণের জন্যে এইযাকাত কোন বাদান্যতার ব্যাপার নয়। তা দারিদ্র্য ও দৈন্যের ব্যবদান করা গ্রাসের মুখে ছেড়ে দিলেই চলবে না। আসলে তার লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানা, দরিদ্রদেরকে দারিদ্র্য থেকে চিরমুক্তির ব্যবস্থা করা।তাদের জীবনথেকে অভাব তাড়নার মূলোৎপাটন করা, জীবিকার ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনভাবে বিচরণ করার যোগ্য করে তোলা। কেননা এ একটি নিয়মিত আবর্তনশীল কর্তব্য। গরীবদের জৈবিক মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করে দেয়া তার কাজ। ‘যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র’ পর্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। দশ. কুরআন নির্ধারিত ও সুন্নাহ কর্তৃক বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্ট মনে হয়, তা দিয়ে বহু সংখ্যক আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, সামষ্টিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করাই উদ্দেশ্য। এই কারণে যাদের মন জয় করতে হেব, যারা বন্দী, ঋণগ্রস্ত এবং আল্লাহ্র পথে—এই সবকে ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এগুলো যে প্রশস্ত ক্ষেত্র অন্যান্য ধর্মের প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার তুলনায় অনেক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যসম্পন্ন, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। এ সব পার্থক্যকারী দিক আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলা যে, ইসলামের যাকাত একটা নবতর বিধান, অন্যান্য ধর্ম প্রবর্তিত ব্যবস্থাসমূহ থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। অন্যান্য ধর্মের উপদেশ-নসীহত. পুণ্য কাজের উৎসাহদান এবং কার্পণ্য সম্পর্কিত সতর্কবাণী ইত্যাদির সাথে ইসলামের প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার কোন তুলনাই হতে পারে না। অনুরূপভাবেরাজা-বাদশাহ ও শাসক-প্রশাসকদের আদায় করা ট্যাক্স বা খাজনা ইত্যাদির সাতেও তার কোন সাদৃশ্য নেই। বরং সে ব্যবস্থায় গরীবদের কাছ থেকে নিয়ে ধনীদের মধ্যেই বন্টন করা হয়, কর্তাদের ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থাপনায় ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের মনের অভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে, তাদের রাষ্ট্রীয় গদী রক্ষার্থে উদারহস্তে উড়ানো হয়। যাকাতের প্রকৃতি সম্পর্কে শাখ্ত (Joseph Schacht)-এর ধারণা ভুল ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব, স্থান ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনা উপরে পেশ করা হল এই প্রেক্ষিতে যাকাত সম্পর্কে কতিপয় ভিত্তিহীন ধারণা ও মন্তব্য সম্পর্কে একটা পর্যালোচনা উপস্থাপিত করা হচ্ছে। এ সব ধারণা ও উক্তি যাদের, তারা আসলে জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধির দিকপাল কিছু নন। কেনা জ্ঞানের ব্যাপারে সাধারণ দায়িত্বই এখানে উপেক্ষিত। ইসলামী বিশ্বকোষ-এর প্রবন্ধকার ‘যাকাত’ সম্পর্কে লিখেছেন: হাদীসে এমন কিছু অবস্থার উল্লেখ আছে, যখন যাকাত দেয়া হয় তা পরে প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সে যাই হোক, যাকাতের প্রকৃতি নবী করীমেরজীবদ্দশায়সব সময়ই প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট রয়ে গেছে; তা দ্বীনের ধার্য করা কোন করও ছিল না। এই কারণে নবীর ইন্তেকালের পর বহু সংখ্যক আরব গোত্র তা দিতে অস্বীকার করে। কেননা তারা মনে করে নিয়েছিল যে, মূল চুক্তিকারীর ইন্তেকাল যাকাত দেয়ার চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেছে। কোন কোন মু’মিনও তা দিতে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে হযরত উমর (রা) অন্যতম। পরে তাঁরা তা মেনে নেন। (আরবী অনুবাদ-৩৫৮ পৃঃ) কিন্তু শাখ্ত (Joseph Schacht) যে হাদীসেরকথা বলেছেন, তা চিহ্নিত করেন নি। করলে সে সব হাদীস সম্পর্কে আমাদের মতামত দিতে পারতাম। িএখন আমরা বলতে পারি যে, শাখত-এর এই অন্তঃসারশূণ্য দাবির এক কানাকড়িও মূল্য নেই। তার বক্তব্যের ‘পরে প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থা’ বলে তিনি এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, ইসলামেরযাকাত ব্যবস্থা বুঝি নবী করীম(স)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিমজনগণই উদ্ভাবন করেছেন, এটা আল্লাহ্র কাছ থেকে অবতীর্ণ ওহী-প্রবর্তিত নয়। বরং তা অবস্থা ও মানবীয় অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি, যা মুসলমানরা পারস্য ও রোমান সমাজ থেকে লাভ করেছে। শাখ্ত এবং তাঁর মত অন্যান্য অরিয়েন্টালিস্টদের মুখে এ ধরনের কথাই শোনা যায়, যার সত্যিই কোন ভিত্তি নেই। বস্তুত কুরআন মজীদের আয়াত, সহীহ্ হাদীস, সাহাবা ও খুলাফায়ে রাশেদুনের অনুসৃত আদর্শ প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত করেছে। অকাট্যভাবে প্রমাণিত করেছে যে, যাকাত-ব্যবস্থা একান্তভাবে ইসলাম উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত, অন্য কোন ব্যবস্থা থেকে তা গ্রহণ করা হয় নি। তার পূর্ববর্তী, কোন ধর্মব্যবস্থা বা মানব রচিত বিধানে যাকাত-সদৃশ কোন অর্থ ব্যবস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে কোন ইনসাফগার ব্যক্তি এ পর্যায়ে বলতে বাধ্য হবেন যে, এটা সম্পূর্ণ ও মৌলিকভাবেই আল্লাহ্ তা’আলার অবদান: (আরবী***********) আল্লাহ্র রং, আল্লাহর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? দ্বিতীয়, রাসূলের যুগে যাকাত দুর্বোধ্য ছিল বলে শাখ্ত যে অভিযোগ তুলেছেন সেটা সত্যিই আজব কথা। আমি বুঝতে পারি না, এই আলোচনাকারী এমন কথা কি করে বলতে পারলেন, অথচ তিনি ইসলামী শরীয়াত ও ফিকাহ্-এর বড় বিশেষজ্ঞ হওয়ার দাবি করেছেন, আর রাসূলের যুগে ‘যাকাত’ ব্যবস্থা দুর্বোধ্য ছিল, তা দ্বীন-ইসলামের দাবি অনুযায়ী প্রবর্তিত কোন ‘কর’ ছিলনা, বলে যুক্তি প্রদর্শন করার সাহস করেছেন। তিনি দুর্বোধ্রতা কোথায় দেখতে পেলেন? অথচ রাসূলে করীম (স) নিজেই যাকাত সংক্রান্ত সব বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোন্ কোন্ ধন-মালে যাকাত ফরয হয়, তা-ও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। তাতে নবী যুগের আরব সমাজে সর্বপ্রকারের ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালই শামিল ছিল। গৃহপালিত পশু, ফসল, ফল-পাকড়, স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি সব বিষয়ের কথাই বলেছেন। সেইসাথে তিনি পরিমাণও বলে দিয়েছেন। ফসলের দশভাগের এক ভাগ কি বিশ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে, তা বলতেও বাকি রাখেন নি। তা ফরয হওয়ার জন্য সময়সীমাও নির্ধারণ করেছেন। বলেছৈন, প্রতিবারের ফসলেই তা ফরয হবে। যাকাতলব্ধ সম্পদ কোথায়, কিভাবে ব্যয় বন্টন করা হবে, তাও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। হাদীসেও তার ব্যাখ্যা রয়েছে। যাকাত আদায় করার পন্থা কি হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। বললেন, এ জন্যে সতন্ত্রভাবে সংগ্রহ ও বন্টন করার ব্যবস্থা করতে হবে। কুরআনের শব্দ (*****) (Collectors)-এ-ই তার ভিত্তি রয়েছে। তিনিনিজে মুসলিম জাহানের সর্বত্র কর্মচারী ও দায়িত্বশীল লোক প্রেরণ করেছেন। তারা যাকাত আদায় করেছ, বন্টনও করেছে ইসলামের সুস্টন বিধান অনুযায়ী। এ ব্যাপারটি এতই সর্বজনবিদিত যে, সে সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নাই। এতদ্সত্ত্বেও একথা বলা কিসঙ্গত যে, রাসূলের জীবদ্দশায় যাকাতের ব্যাপারটি দুর্বোধ্য ছিল? এবং তা কোন দ্বীনি বিধানভিত্তিক নয়। তা কি করে সম্ভব হতে পারে? রাসূল (স) তো ইসলামের মৌল স্তম্ভের উল্লেখের সাথে সাথে সব সময়ই যাকাতের কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। বেশকিছু হাদীস আমরা এমনও দেখতে পাই, যাতে হজ বা রোযার হয়ত উল্লেখ নেই; কিন্তু নামায ও যাকাতরে কথা শাহাদাদের কালেমাদ্বয়ের সাথে মিলিত সব সময়ই উল্লেখ করেছেন। শুধুতা-ই নয়, এই যাকাত আদায়েল জন্যে প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করার কথাও বলেছেন। হযরত ইবনে উমর, আবূ হুরায়রা ও জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহে তা-ই রয়েছে। রাসূলে করীম(স) নব দীক্ষিত আরব গোত্রসমূহের সাথে যত চুক্তি করেছেন তার সবটাতেই নামাযও যাকাতের উল্লেখসমান গুরুত্ব সহকারে রয়েছে। তিনি তাঁর নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্নরদের প্রতি যেসব চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর কাছে বিভিন্ন দেশও গোত্রের পক্ষথেকে যে প্রতিনিধি দল এসেছে, তাদের কাছেও তিনি নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলেছেন। ইসলামে নামাযের গুরুত্ব ও স্থান শাখ্ত ও তাঁর মত অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারেন না। তাহলে সকল প্রকার চুক্তি ও সরকারী চিঠিপত্রে যাকাত, তার পরিমাণ, নিসাব ও প্রকারসমূহের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।তাতে কোন প্রকারের দুর্বোধ্যতা, অস্পষ্টতা বা শোবাহ্-সন্দেহের প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে কোথাও মোটামুটিভাবে বলা হয়ে থাকতে পারে। সেখানে হয়তো বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি সহ বলা হয়নি, তা অস্বীকার করা যায় না। এ পর্যায়ে আর অধিক স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ তথ্য জানতে হলে ডঃ হামিদুল্লাহ রচিত- (আরবী***********) নবী করীমও খিলাফতে রাশেদা আমলের চুক্তিসমষ্টি পাঠ করুন। শাখ্ত নবী যুগের যাকাতের ব্যাপারটি অস্পষ্ট থাকার কথা প্রমাণ করতে গিয়ে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলের ইন্তেকালের বহু সংখ্যক আরব গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। কেননা তারা মনে করেছিল যে, রাসূলের ইন্তেকালেল সাথে-সাথেই যাকাত দেয়ার চুক্তিও নাচক হয়ে গেছে। আরও অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে হযরত উমরও তা সমর্থন করেছেন। শাখ্তের এ কথাটি সম্পূর্ণ বাতিল। প্রকৃত অবস্থার সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। সত্যকথা হল, গোত্রগুলো ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির বিভিন্ন চরিত্রের। তন্মধ্যে কিছু কিছু গোত্রে মুসায়লাম সাজাহ, আস্ওয়াদ, তুলায়হা প্রভৃতি নামের লোকের মিথ্যা নবুয়্যাতের দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের বহুসংখ্যক সাহায্য-সমর্থনকারীও দাঁড়িয়েছিল। এসব গোত্রের লোকদের থেকে। তাই বলে নবুয়্যাতের ব্যাপারটিও অস্পষ্ট ছিল নাকি? এমন গোত্রও ছিল, যারা নামায ও শরীয়াতের অপরাপর হুকুম-আহকাম পালন করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু যাকাতের ব্যাপারে তাদের মনে সংশয়ের উদ্রেক হয়ে পড়ে। পূর্বেই বলা হয়েছে, তার কাণ নতুন মুসলিমহওয়া ও দূর মরুভূমিতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা। যাকাত-প্রকৃতির দুর্বোধ্যতার দরুন নয়। ইমাম আবূ সুলায়মান আল-খাত্তাবী প্রমুখ মনীষী তাই এদের মুরতাদ বলেন নি, বলেছেন ‘বিদ্রোহী’। যদিও এদের মধ্যে রাসূলের ইন্তেকালের পর যাকাত ফরয থাকার কথা অস্বীকারকারী লোকও ছিল। আর তারা মরুবাসী ছিল, নও-মুসলিম ছিল বিধায় তাদের অন্যান্যের মত কাফির আখ্যায়িত করা হয়নি, তাদের মধ্যে অনেকে আবার যাকাতকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেনি। বরং তারা যাকাত অমান্যকারী গোত্র সরদারদের অধীনে বাস করত বলে তারা যাকাত দিতে পারেনি- কাবীলা সরদাররা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বনূ ইয়ারবু কাবলীরা এই অবস্থাই হয়েছিল। তারা তাদের যাকাত সংগ্রহ করে একত্রিত করেছিল এবং খলীফার কাছে তা পাঠাবার ইচ্ছাও করেছিল। কিন্তু মালিক ইবনে নুয়াইরা তা পাঠাতে বাধা দান করে। তবে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর মনেও সংশয় জাগার কথাটি সত্য। কিন্তু তা শুধু যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সন্দেহ। তিনি হযরত আবূ বকর (রা)-এর সাথে কথা বলেছেন। তিনি তাঁর যুক্তি পেশ করেছেন; হযরত উমর তা মেনে নিয়েছেন। অতঃপর সর্বসম্মতভাবেই সে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ফলে এ নিয়ে আর কোন কথা উঠতে পারে না। শাখ্ত মনে করেছেন, যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকর কর্তৃক গ্রহীত নীতিই এ ফরযটির স্থিত ও চিরন্তনতার ব্যবস্থা করেছে। শাখ্ত এ কথাটি হযরত আবূ বকর (রা)-কে ভালবেসে বলেন নি। বলেছেন এ কথা লোকদের সামনে স্পষ্ট করে তোলার কুমতলবে যে, যাকাতের ব্যাপারটি মুসলমানদের কাছে—এমন কি হযরত উমর ফারূক (রা)-এর কাছেও স্পষ্ট ছিল না। তিনি ভুলে গেছেন যে, এটা হযরত আবূ বকরের নিজস্বভবে উদ্ভাবিত কোন নীতি ছিল না। তিনি রাসূলে করীমের প্রবর্তিত নীতিরই অনুসরণ করেছেন মাত্র। এ করণেই তিনি বলেছিলেন: “রাসূলেল সময়ে লোকেরা যে যাকাত দিত, তার একটা রশিও যদি তখন দিতে অস্বীকার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমি লড়াই করব।” এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে, হযরত আবূ বকর (রা) রাসূলের নীতিকে বাস্তবায়িত করেছেন মাত্র্ নতুন কোন নীতির প্রচলন করেন নি। রাসূলের নীতিতে তিনি অক্ষরেরও পরিবর্তন করেন নি। হযরত উমর (রা) এবং তাঁর সঙ্গীরা মনে করেছিলেন: ওদের নামাযকে মুসলমানিত্বের প্রমাণস্বরূপ গ্রহণকরা হোক, আর যাকাত ওদরে জন্যে ছেড়ে দেয়া হোক। শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। বিরোধ নির্মূল হবে এবং আল্লাহর দল জয়ী হবে। কিন্তু হযরত আবূ বকরের নীতি ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। কেননা তাঁর দলীল ছিল অকাট্য এবং কুরআন ও সুন্নাত থেকে গ্রহীত। আল্লাহ্ সত্যিই বলেছেন: (আরবী***********) যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দিতে থাকে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই গণ্য হবে। দ্বিতীয় অধ্যায় যাকাত কার উপর ফরয -অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয় -বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত প্রথম পর্ব ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাত কেবলমাত্র স্বাধীন, বয়স্ক মুসলমানের উপর ধার্য কর, সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকানা রয়েছে। [ফিকাহ্বিদগণ এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না। কেউ প্রয়োজন বোধ করলে দেখুন- (আরবী***********)] পূর্বে দলীলাদির ভিত্তিতে একথা বলা হয়েছে। কুরআনের স্পষ্ট আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলের প্রমাণিত হাদীসসমূহেরও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। সে সবের দ্বারা যাকাতের ফরয হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। মুসলমানরা যুগের পর যগ ধরে এ গুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে এসেছে। মুতাওয়াতির বর্ণনাসমূহ রয়েছে রাসূলের কথা এবং কাজের। দ্বীন-ইসলামের মৌলিক বিধানের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, নও-মুসলিম নয় এমন যে কোন মুসলিম ব্যক্তি যাকাতকে অস্বীকার করলে কাফির হবে। মুসলমানদের এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে যে, কোন অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়। কেননা এটা ইসলামের স্তম্ভ। যারা ইসলামকেই মানে না তাদের উপর তা ফরয হতে পারে না। হ্যাঁ, তবেকোন অমুসলিমইসলাম কবুল করলে ও যাকাত দেয়ার পরিমাণ ধনসম্পদ তার থাকলে তখন অবশ্যই তাকে তা দিতে হবে। এ কথার দলীল হচ্ছে বুখারী-মুসলিমে উদ্ধৃত হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীস। তা এই- রাসূলেকরীম (স) যখন হযরত মুআযকে ইয়েমেনে পাঠালেন তখন তিনি তাঁকে বললেন: তুমি আহলে-কিতাবের একটা জাতির কাছে যাচ্ছ। তাদের প্রতি তোমার সর্বপ্রথম দাওয়াত হবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দানের। তারা তা মেনে নিলে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নাময ফরয করে দিয়েছেন। তা মেনে নিলে তাদের বলবে, আল্লাহ্ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। [দেখুন ফতহুল বারী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২২ন] ইবাম নব্বী যেমন লিখেছেন, এ হাদীসটি প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম কবুল করলেই একজনকে ইসলামের ফরযসমূহ পালন করার কথা বলা যেতে পারে, তার পূর্বে নয়। এ পর্যন্তকার কথা সর্বসম্মত। [মৌলনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। কাফিররা শরীয়াতের খুঁটিনাটি পালনে বাধ্য কি? তাহলে তা পালন না করার অপরাধে পরকালে তাদের আযাব অনেক বেশী হতে হবে কি? অধিকাংশ ফিকাহইবদ এ মত দিয়েছেন। তবে হানাফীরা ভিন্নমত দিয়েছেন। আসলে এ একটা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক।] বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, যাকাত যেহেতু ইসলামেরই একটি অন্যতম রুকন কাজেই তা কাফিরদের প্রতি ধার্য হতে পারে না যেমন নামায পড়া ও রোযা রাখা। এ পর্যায়ে ভিন্ন একটা কারণ প্রদর্শন করা হয়েছে। শাফিয়ী মাযহাবের শীরাজ ও নববী বলেছেন, আসল কাফিরের প্রতি তা ফরয নয়। এ একটা হক, যা সে নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নেয়নি বলে সে জন্যে সে বাধ্য নয়। সে যুধ্যমান ব্যক্তি হোক, কি যিম্মী, তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হবে না। কাজেই তার কুফরী অবস্থায় তার প্রতি শরীয়াতের হুকুম পালনের দাবি করা যায় না। আর ইসলাম কবুল করলে কুফরী জীবনের যাকাত দাবি করা যাবে না। অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয় বলে তার যাকাত দেয়াটাও একটি ইবাদত হিসেবে সহীহ্ কাজ হতে পারে না। কেননা ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত ঈমান ও ইসলামই এখানে অনুপস্থিত। আল্লাহ বলেছেন: (আরবী***********) আর যা কিছু তাদের কৃতকর্ম রয়েছে, তা নিয়ে আমরা ধূলিকণার মত উড়িয়ে দেব। তবে এ কথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, নেক-আমল পরকালীন আযাব অনেক পরিমাণে হালকা করে দেবে। সব আসল কাফিরদের ব্যাপারেই একথা প্রযোজ্য। তবে যে লোক ফিত্নার সৃষ্টি করে ও মুরতাদ হয়ে যায়, মুসলিম থাকা অবস্থায় তার উপর যাকাত ফরয করা হয়ে থাকলে তাতার কাছ থেকে অবশ্যই নিতে হবে। কেননা এটা তো একটা হক, যা তার মুরতাদ হয়ে যাওয়অর দরুন নাকচ হয়ে যেতে পারে না। এটা ইমাম শাফিয়ীর মত। ইমমা আবূ হানীফঅ ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে মুরতাদ হয়ে যাওয়া কাল সম্পর্কে শাফিয়ী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের কেউ কেউ যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটিকে চূড়ান্ত মনে করেন। কেননা তা গরীব ও অভাবগ্রস্তদের হক। তাই মুরতাদ হয়ে যাওয়ার দরুন তা বাতিল হতে পারে না। ইসলাম অমুসরিমদের উপর যাকাত ফরয করেনি কেন এ পর্যায়ে কোন কোন লোকের মনে প্রশ্ন জেগেছে: ইসলাম অন্যান্য অমুসলিমদের জন্যে বিপুল সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। তাদের প্রতি আল্লাহ্ ও রাসূলের দায়িত্ব ঘোষিত হয়েছে। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপদমূলক আশ্রয় নিশ্চিত জীবন-যাপনের সুযোগ পায়। তাদের মর্যাদা তথায় সুরক্ষিত, তাদরে স্বাধীনতা উন্মুক্ত ও অ-প্রভাবিত। সেখানে তারা মুসিলম নাগরিকদের সমান অধিকার লাভ করে, সমান দায়িত্বতাদের উপরও বর্তে। তাহলে যাকাত ফরয করার ব্যাপারে মুসলিম-অমুসিমের মধ্যে পার্থক্য করা হল কেন? অথচ যাকাত একটা সামাজিক দায়িত্বের ব্যাপার। একটা অর্থনৈতিক কর বিশেষ। তদলব্ধ অর্থ-সম্পদ তো দেশেরদুর্বল, অভাবগ্রস্ত ও সাধারণ দরিদ্র নাগরিকদের মধ্যেই বন্টন করা হয়? প্রশ্নটির জবাব দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। মূলত এখান দুটি দিক দিয়ে যাকাত ফরয হওয়ার মর্মকথা অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে। প্রথম, যাকাত একটি সামাজিক ও সামষ্টিক দায়িত্বের ব্যাপার, একটি সুনির্দিষ্ট অধিকার (Determined Claim)। প্রার্থী ও বঞ্চিত লোকদের জন্য। তা একটা অর্থনৈতিক কর। আল্লাহ্ তা’আলাই তা ফরয করেছেন। জাতির ধনীদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে, যেন তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা যায়। এতে করে ভাই ভাইয়ের অধিকার রক্ষা করার সুযোগ পায়। এটা সামষ্টিক অধিকারের ব্যাপারে যেমন তেমনি আল্লাহ্রও হক। দ্বিতীয, তা ইসলামের ইবাদতসমূহের অন্যতম। যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের গোটা কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে যাকাত তার মধ্যে একটি। কালেমার সাক্ষ্যদান ও নামায কায়েম করা, রমযানের রোযা ও আল্লাহর ঘরের গহ প্রভতির মতই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বে বহুবার আমরা দেখিয়েছি, কুরআন মজীদে যাকাতকে নামাযের পাশেই উল্লেখ করা হয়েছে। শিরক থেকেতওবা করার একটা ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নামায কায়েম করা ইসলামে প্রবেশের প্রকাশ্য লক্ষণ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অধিকার লাভের একটা মাধ্যম। যাকাতের কোন কোন অংশ যেমন ইসলামের সাহায্যে ও দ্বীনের কালেমা প্রচারে ব্যয় হতে পারে—দ্বীনের দাওয়াতের সুবিধার্থে সাধারণ জনকল্যাণমূরক কাজে ব্যয় করা যেতে পারে-এ কারণে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ –আল্রাহর পথে’ বলে একটা খাত আছে। নির্দিষ্ট লোকদের মন রক্ষার কাজেও তা ব্যয় হতে পারে। ‘আল-মুয়াল্লাকাতুল কুলুব’ একটি খাত রয়েছে বলে। বিভিন্ন হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, “তা ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হবে, যেন গরীবদের মধ্যে বন্টন করা যায়” –এ অনুযায়ী যাকাতরে প্রথম উদ্দেশ্য আদায় হতে পারে, আর তা হল গরীবদের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তিদান। কিন্তু কুরআন তো আটটি খাতের উল্লেখ করেছে। পূর্বোল্লিখিত দুটি এরই মধ্যে শামিল। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই ইসলামের উদারতা ও অনুভূতিশীলতা অমুসলিমদের কাছে যাকাত গ্রহণে তাদের ধর্মীয় আকীদার প্রতি সম্ব্রমবোধকে গুরুত্ব দিয়েছে। আসলে ইসলামের এ একটি দ্বীনি ব্যবস্থা বলে তা অমুসলিমদের উপর ধার্য করতে চায়নি। যাকাত তো ইসলামের একটা বড় অনুষ্ঠান (Religious Cermony)-রূপে গণ্য চারটি বড় ইবাদতের একটি, পাঁচ ‘রুকন’-এর অন্যতম। তা অমুসলিমদের উপর কি করে ধার্য হতে পারে? অমুসলিমদের কাছ থেকে যাকাত-পরিমাণ কর গ্রহণ করা হবে কি না এ পর্যায়ে আর একটি প্রশ্ন উঠেছে। যাকাত একটা দ্বীনি ইবাদত ও ফরয হিসেবে অমুসলিমদের কাছ থেকে নেয়া যাবে না, বুঝলাম। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ বাসম্পদ কর হিসেবে তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা যাবে কিনা, যা ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ করা হবে? তখন মুসলমানরা যাকাত দেবে ফরয ইবাদত হিসেবে, আর অন্যরা দেবে কর হিসেবে? এ ব্যবস্থা দ্বারা একই দেশের অধিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য ও তারতম্য সৃষ্টি থেকে বাঁচা যাবে এবং মুসলিমদের উপর অমুসলিম নাগরিকদের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ চাপ প্রয়োগ করা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে? এ একটি বিতর্কিত বিষয়। এর মীমাংসার জন্যে ইজতিহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের সামষ্টিক ইজতিহাদ প্রয়োজন। তবে এই ধরনের ইজতিহাদ সম্পন্ন হওয়া যখন কঠিন, তখন যদ্দিন তা না হচ্ছে, তার পূর্বে আমরা এ প্রসঙ্গে একটা অভিমত অবশ্যই প্রকাশ করতে পারি। সংশ্লিস্ট বিষয়ে যতটা অধ্যয়ন ও চিন্তাভাবনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তার ভিত্তিতেই এ মত প্রকাশ করা হবে। আর আসলেও ব্যক্তিপর্যায়ের ইজতিহাদ সামষ্টিক ইজতিহাদের পথ সুগম করে দেয় বলে আমার এ মত প্রকাশ কিচুমাত্র অবান্তর হবে না বলে মনে করি। আমার এ মত নির্ভুল হলে তা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বলে মনে করতে হবে। আর ভুল হলে সেজন্যে আমাকে ও শয়তানকেই অভিযুক্ত করা যাবে। আমার সুস্পষ্ট মত হল: ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসিলম যিম্মী নাগরিকদের কাছ থেকে যাকাতের মতই একটা কর গ্রহণ করার পথে প্রকৃতপক্ষে কোন বাধা নেই, যদি রাষ্ট্র পরিচালক তা গ্রহণ করা সমীচীন বা প্রয়োজন মনেকরেন। ওই মতের সমর্থনে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো পেশ করা যাচ্ছে: ১. অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরয নয় ব লে ইসলামের আলিমগণ যে মত দিয়েছেন, তা হহ্ছে দ্বীনি ফরয হিসেবের কথা, তা দুনিয়ার দাবি করা ও পরকালীন সওয়াব ও আযাবের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক ‘পরামর্শ পরিষদের’ (Parliament) বিবেচনা অনুযায়ী সামষ্টিক কল্যাণের জন্যে একটি রাজনৈতিক কর্তব্যরূপে অমুসলিমদের উপর ধার্য করা হলে তা কোনোক্রমেই অন্যায় হবে না। ২. অমুসলিমদের উপর যাকাত ধার্য না করার কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, এটা এমন একটা হক যার বাধ্যবাধকতা তারা গ্রহণ করেনি, তাই সে জন্যে তাদের বাধ্য করা যায় না। তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, তারা যদি তা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়, তাহলে তা গ্রহণ করতে কোন অসবিধা নেই। ৩. ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মিগণ সব সময়ই একটা আর্থিক কর দিত, কুরআন তার নাম দিয়েছে ‘জিযিয়া’। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাধারণ ব্যয় নির্বাহে, জনকল্যাণমূরক কাজে ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায—তারা শরীক হচ্ছিল। তাদের অক্ষমতা, বার্ধক্য ও জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণও এর মধ্যে তাদের দারিদ্র্যের সময়ে রয়েছে। এদিক দিয়ে তারা সাধারণ মুসলিম সমান সুযোগের অধিকার। হযরত উমর (রা) এক ইয়াহুদীকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাকরতে দেখেতার জন্যে মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন বায়তুল মাল থেকে। কিন্তু বর্তমান সময়ের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোতে বসবাসকারী আহলে-কিতাব লোকেরা ‘জিযিয়া’ দেয় না, তারা তার নাম শুনতেও রাযী নয়। তাই তার পরিবর্তে যাকাতরে সমপরিমাণ একটা ‘কর’ অনায়াসে দিতে পারে এবং তার ‘জিযিয়া’ নামকরণ কিছুমাত্র জরুরী নয়। ঐতিহাসেক, হাদীসবিদ ও ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ বনূ তাগলিব নামক খৃস্টান গোত্রের সাথে হযরত উমরের অবলম্বিত যে নীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তার আলোকে আমরা বাস্তবতা ও সাধারণ কল্যাণের প্রয়োজনে এ পর্যায়ে নতুন করে বিবেচনা করতে পারি। হযরত উমর (রা) তাগলিবের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। তখন নু’মান ইবনে জুর্য়া বললেন: ‘হে আমীরুল মু’মিনীন। বনু তাগলিব একটা আরব গোত্র। ওরা ‘জিযিয়া’ দেয়া পছন্দ করে না, স্বর্ণ-রৌপ্য বলতেও ওদের মালিকানায় কিছু নেই। ওরা কৃষিজীবি, পশুপালক। শত্রুদের মধ্যে ওদের একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, এ জন্যে তাদের বিরুদ্ধে আপনার শত্রুদের আপনি সাহায্য করবেন না।’ তখন হযরত উমর (রা) যাকাতরে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ দেয়ার শর্তে তাদের সাথে সন্ধি করলেন। কোন কোন হাদীসের বর্ণনানুযায়ী হযরত উমর বলরেন, ‘তোমরা তার নাম যা ইচ্ছা রাখতে পার।’ বায়হাকী উবাদা ইবনে নু’মান থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে এই কথাটুকু বর্ণনা করেছেন: হযরত উমর (রা) যখন বনূ তাগলিবের সাথে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদানের শর্তে সন্ধি করলেন, তখন তারা বলল, ‘আমরা তো আরব, অনারবরা যা দেয় আমরা তো দেব না। বরং আমাদের কাছ থেকে সেভাবে গ্রহণ করুন যেমন করে পরস্পর থেকে লোকেরা নিয়ে থাকে। হযরত উমর বললেন, ‘না, এটা তো মুসলমানদের অংশ।’ তারা বলল, ‘তা হলে আপনি যতটা ইচ্ছা বাড়িয়ে দিন, কিন্তু জিযিয়া’র নামে নয়।’ হযরত উমর (রা) তাই করলেন। তখন উভয় পক্ষই মুসলমানদের দেয় পরিমাণের দ্বিগুণ দেয়ার শর্তে রাযী হয়ে গেল। কোন কোন বর্ণনামতে হযরত উমর বলেছিলেন: ‘নাম তোমরা যা-ই দাও না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না।’ [কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ৫৪১। ইবনে হাজম বনূ তাগলিব সংক্রান্ত গোটা ইতিহাসকেই দুর্বল বর্ণনা বলেছেন (আল-মুহাল্লা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১১১)। কিন্তু আসলে এ ইতিহাসটি বহুল প্রচারিত। ইবনে আবূ শায়বা, ইমাম আবূ ইউসুফ (আল-খারাজ, পৃঃ১৪৩) ও ইয়াহ্ ইয়া ইবনে আদাম উদ্ধৃত করেছেন(কিতাবুল খারা, পৃঃ ৬৬-৬৭)। বালাযুরী ফুতুহুল-বূলদানেও এর উল্লেখ করেছেন। (পৃঃ ১৮৯) বনূ তাগলিব সম্পর্কে হযরত উমর (রা) কর্তৃক গৃহীত এ নীতি সম্পর্কে ইমাম আবূ উবাইদ লিখেছেন: যখন তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন, তখন তার নাম—অপরাপর যিম্মীদের ন্যায় ‘জিযিয়া’ রাখলেন না; বরং তার নাম রাখলেন “সিস্তনিক সদ্কা’। তাদের এরূপ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল এবং ‘জিযিয়া প্রত্যাহার করা হয়েছিল শুধু এজন্যে যে তার প্রতি তাদের মনে একটা ঘৃণা—একটা হীনতাবোধ জেগেছিল। এর ফলে মুসলমানদের ক্ষতি কিছুই হয় নি। কেননা ‘জিযিয়া’ বাবদ যা কিছু পাওয়অর ছিল, তা তো পাওয়াই গেলই; বরং সাদ্কা নামে তার দ্বিগুণ আদায় করা হল। যে ভাঙনটা তাদের দিক থেকে এসেছিল এভাবে সেটা মেরামত করা হল। তবে মুসলমানদের হক আদায় করে নিতে ত্রুটি করা হল না। হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী***********) আল্লাহ্ তা’আলা উমরের কণ্ঠ ও দিলের উপর সত্যকে মুদ্রিত করে দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন: ‘আমি উমর (রা)-কে যখনই দেখেছি, তাঁর দুটি চোখের উপর ফেরেশতাকে তা বন্ধ করতে দেখেছি।’ হযরত আলী (রা) বলেছেন: উমরের মুখের প্রশান্তি কথা বলে, তা বুঝতে আমাদের বিলম্ব হয়নি।’ হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন: ‘তিনি কুণ্ডলি পাকানো একক বুনট ছিলেন। সর্ব ব্যাপারে তিনি প্রস্তুত থাকতেন। ইমাম আবূ উবাইদ বলেছেন: ‘হযরত উমরের এ কাজটি তাঁর অসংখ্য সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম।’ [(আরবী***********)] এই উমর ফারুক (রা) তা*র থিলাফতের অধীনে বসবাসকারী খৃস্টানদের কাছ থেকে ‘সাদকা’ নামে একটা কর বা জিযিয়া গ্রহণ করায় কোন দোষ দেখতে পান নি। কেননা তারা ‘জিযিয়া’ নামটাকে অপছন্দ করত। মুসলিমদের উপর ফরয করা সাদ্কা অপেক্ষা তার পরিমাণও দ্বিগুণ ছিল। এই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ কারণেই জুহ্রী বলেছেন: আহে্-লে কিতাবের পালিত গরু-ছাগল ইত্যাদির কোন যাকাত নেই। তবে তাগলিব খৃস্টানদের কথা ভিন্ন অথবা বলেছেন আরবের খৃস্টানদের সাধারণ ধন-মাল ছিল গৃহপালিত পশু। [(আরবী***********)] এটা হযরত উমরের অবদান। তাঁর সঙ্গী সাহাবায়ে কিরামও এ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠে—এ কালের ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে বসবাসকারী যিম্মিী কেন? তা তো ইসলামী ব্যবস্থার একটা বিধান; মুসলমানদের উপর অর্পিত দুটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিকল্প ব্যবস্থামাত্র। মুসলমানদের একটি কর্তব্য জিহাদ, যাতে রক্ত ও জীবন দিতে হয়। আর দ্বিতীয় করব্য হল যাকাত, যা ধন-মাল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে দিতে হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের পরামর্শ পরিষদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এই কর অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে নেয়া হবে না কেন? তারা তা জিযিয়া বা যাকাত নামেদিতে না চাইলে হযরত উম (রা) বনু তাগলিবের ক্ষেত্রে যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা অনুসরণ করতে বাধা কোথায়? আমার বিশ্বাস, হযরত উমরের এই নীতি একটা বড় আলোকবর্তিকা, যা এ ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের চাহিদা ও সমস্যা পূরণের উদ্দেশ্যে কোন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তির চলার পথ সমুদ্ভাসিত করে দিয়েছে। শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ মত প্রকাশ করেছেন: ‘অমুসলিম জনগোষ্ঠী যদি খুব শক্তিশালী ও দাপসম্পন্ন এবং জিযিয়া দিতে প্রস্তত না হয়ে বনূ তাগলিবের ন্যায় অন্য কিছু দিতে রাযী হয়ে সন্ধিচুক্তি করতে প্রস্তুত হয় এবং তাদের এই চুক্তি মেনে না নিলে যদি ক্ষতির আশংকা দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রপ্রধান তা মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা অনুধাবন করেন, তাহলে মেনে নেয়া জযায়েয হবে। হযরত উমর (রা) বনূ তাগলিবেরপ্রতি যে নীতি অনুসরণ করেচিলেন সেই নীতি অনুযায়ী এ কাজ সঙ্গত হবে। [(আরবী***********)] এ কথাটি খুবই যুক্তি সঙ্গত এবং এর দলীল অকাট্য বলে মনে করি। এ কথায় সন্দেহ নেই যে, প্রতিটি বর্ধনশীল সম্পদ থেকে যে যাকাত গ্রহণ করা হয় তা নিশ্চিতরূপে ‘জিযিয়া’র পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশী, জিযিয়ার পরিমাণ তো” খুবই সামান্য হয়ে থাকে।– আর তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে কেবলমাত্র অস্ত্র ধারণে সক্ষম ব্যক্তিদের কাছ থেকে। অথচ যাকাত গ্রহণ করা হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল ধনশালী ব্যক্তির কাছ থেকেই। এমন কি, বালক ও পাগলের কাছ থেকেও। এটাই অধিকাংশ ফিকাহ্বিদরে মত। যিম্বীদের কাছে থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ যাকাত গ্রহণ করা কোন অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার নয়। হযরত উমর (রা) তা কেবলমাত্র বনূ তাগলিব গোত্রের প্রতিই প্রয়োগ করেছিলেন। কেননা তারা তো এর জন্যেই দাবি করেছিল, এই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আর তা মেনেও নিয়েছিল। িএটা শরীয়অতের প্রয়োগ নীতির ব্যাপার, দ্বীন ও রাষ্ট্রের সাধারণ কল্যাণ বিবেচনার ফলশ্রুতি মাত্র। ইবনে রুশ্দ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন এবং তার শিরেনাম দিয়েছেন (আরবী***********) –‘যিম্মীদের উপর যাকাত’। অতঃপর লিখেছেন অধিকাংশ ফকীহ্র মত হল, সমস্ত ‘যিম্মী’র উপরই যাকাত ধার্য হবে না। বনূ তাগলিব খৃস্টান গোত্রের যাকাত পরিমাণ দ্বিগুণ করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অন্য কথায়, প্রতিটি জিনিস বাবদ মুসলমানদের কাছ থেকে যতটা পরিমাণ যাকাত গ্রহণ করা হবে, যিম্মীদের কাছ থেকেও তা-ই গ্রহণ করা হবে। ইবনে রুশ্দের এ কথাটি খুবই যথার্থ। ইমাম শাফেয়ী, আবূ হানীফা, আহমদ ও সওরী প্রমুখ ফিকাহ্র ইমামগণ এই মতই দিয়েছেন। এ পর্যায়ে ইমাম মালিকের কোন মত জানা যায় নি। হযরত উমর (রা) তা-ই করেছিলেন বলেই ইমামগণ এই মত প্রকাশ করেছেন। মনে হচ্ছে, তাঁরা সকলে এটাকে শরীয়াতসিদ্ধ কথা বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু ফিকাহ্র মৌলনীতি তা সমর্থন করে না। [(আরবী***********)] আমার বক্তব্য এই যে, আবূ উবাইদ হযরত উমরের কাজের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা আমরা দেখেছি। তাতে কিন্তু ফিকাহ্র মৌলনীতির সাথে এর সংঘর্ষ দেখতে পাইনি। মূলত মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ ও তাদের ক্ষতি বিদূরণই আসল লক্ষ্য। আর তা সব সময়ই শরীয়তভিত্তিক হতে হবে, এমনটা জরুরীও নয়। খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নাত অনুসরণ করে চলার নির্দেশও আমাদের প্রতি রয়েছে। ৪. আমাদের কথার সমর্থনে উল্লেখ্য, ইমাম আবূ হানীফার সঙ্গী ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান (র) বলেছেন: মুসলিমব্যক্তি যদি তার ওশরী জমি ‘যিম্মীর’ কাছে বিক্রয় করেদেয় যার খারাজ নেই, তাহলে যিম্মীকে ওশরই দিতে হবে। কেননা তার ক্রয় করা জমির উপর তো ওশর ধার্য হয়ে আছে। অতএব মালিকের পরিবর্তনে জমির ব্যবস্থা বদলে যাবেনা। ইসরামী রাষ্ট্রে যিম্মী জমি ভোগ করবে আর তার বিনিময় দেবে না, তা হতে পারে না। [(আরবী***********) এই মত দিতে গিয়ে মুহাম্মাদ (রা) প্রধান দুজন ইমামের বিরোধিতা করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা বলেছৈন, “যিম্মীকে খারাজ দিতেহলে জমি খারাজী হয়ে যাবে।” ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেন, তাকে দুই ওশর দিতে হবে- বনূ তাগলিবের মত।”] ৫. আহলে-কিতাবের লোকদেরও তাদরে ধর্মগ্রন্থ যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; দরিদ্রদের কল্যাণ-কাজে ব্রতী হতে বলা হয়েছে। পূর্বে আমরা কুরআনের আয়াত এ পর্যায়ে দলীল হিসেবে উদ্ধৃত করেছি, যেখানে বলা হয়েছে: (আরবী***********) তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু এ কাজের জন্যে যে, তারা আল্লাহ্র বন্দেগী করবে, দ্বীনকে তাঁরই জন্যে খালঅস করে—একমুখীহয়ে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাদি থেকেও আমরা পূর্বৈবিস্তারিত উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছি। কাজেই তাদের কাছে ‘যাকাত’ চাওয়া হলে তা তাদের ধর্মের বিধানের ভিত্তিতেই চাওয়া হবে।তাতে নতুন হবে শুধু পরিমাণ নির্ধারণ, সীমানা ঠিক করণ এবং বাধ্যবাধকতা আরোপ। ৬. হযরত উমর (রা) ও কতিপয় তাবেয়ী যিম্মীদের জন্যে যাকাত সম্পদ ব্যয় করা জায়েয হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এ গ্রন্থে ‘কার জন্যে যাকাত হারাম’ শীর্ষক আলোচনায় এ পর্যায়ে কথা বলেছি। মুসলমানদের কাছ থেকে গৃহীত যাকাত বা তার একটা অংশ যখন যিম্মীদের জন্যে ব্যয় করা যায়েজ, তখন তাদরে ধনীদের কাছ থেকে এ বাবদ ‘যাকাত’ গ্রহণ করাও অবশ্যই জায়েয হবে, যেন তাদের সমাজেরই দরিদ্রের জন্যে তা ব্যয় করা যায়। কেননা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল মুসিলম-অমুসিলম সব নাগরিকেরই অর্থনৈতিক নিরপত্তা বিধান করা। তাই তা ‘সামষ্টিক নিরাপত্তা কর’ নামে অভিহিত হবে। তাতে করে তা ইসলামের যাকাত থেকে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত হতে পারবে। এর ফলে তাদের মনের দ্বিধা-সংকোচও দূর হবে এবং মুসলমানদের মনেও কোন উদ্বেগের কারণ থাকবে না। বস্তুত মুসলমানদের যাকাত ও অমুসলিমদের কাছ থেকে গৃহীত কত ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যয়িত হওয়া বাঞ্ছনীয়, পাত্র, শর্ত ও পরিমাণে এ দুটো অভিন্ন তাকলেও নাম, পরিস্থিতি ও ব্যয়ের ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে। কেননা প্রতিটি প্রকৃতি আলাদা আলাদা, লক্ষ্য ও ফরয হওয়ার মূলও এক নয়। দ্বিতীয় পর্ব বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত প্রত্যেক মুসলিম সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ও বয়স্ক ব্যক্তির ধন-মালেই যাকাত ফরয। এ ব্যাপারে সব আলিম একমত হলেও বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয কিনা, সে ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয কিনা? কিংবা বালক যতক্ষণ পূর্ণবয়স্ক না হবেএবং পাগল যতদিনে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন না হবে, ততদিন তাদের ধন-মালে যাকাত ফরয হবে কিনা? এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণ যে বিষূটি মতভেদের মধ্যে রয়েছেন, তাতে করে তাঁদের দুটো বড় বড় ভাগে বিভক্ত চরা চলে: (১) এক ভাগের ফিকাহ্বিদগণ তাদের ধন-মালে অথবা তাদের কোন কোন ধন-মালে আদৌ যাকাত হয় বলে মনে করেন না। (২) দ্বিতীয় ভাগের ফিকাহ্বিদগণ এ দুই পর্যায়ের ব্যক্তিদের সকল প্রকার ধন-মালে যাকাত ফরয হয়বলে মত দিয়েছেন। যাকাত ফরয হয় না বলে যাঁরা মত দিয়েছেন (ক) আবূ উবাইদ, আবূ জা’ফর ও শা’বী থেকে বর্ণনা করেছেন, এ দুজন ফিকাহ্বিদের মত হচ্ছে, ইয়াতীমের মালে যাকাত হয় না। [(আরবী***********)] ইবনে হাজম নখয়ী শুরাইয়অহ্-ও এই মতই উল্লেখ করেছেন। (খ) ইমাম হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ইয়াতীমের মাল-সম্পদে যাকাত হয় না, তবে কৃষি ফসল বা অনুরূপ জিনিসে (যাকাত হবে)। ইবনে হাজম তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে অনুরূপ কথারই উল্লেখ করেছেন শিবরামা থেকে। [(আরবী***********)] (গ) কিতাবুল আমওয়াল’ গ্রন্থে মুজাহিদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে ইয়াতীমের যে ধন-মাল বর্ধনশীল অথবা বলেছেন, গরু, ছাগল বা কৃষি ফসল কিংবা যে মাল দ্বারা কর দেয়া হয়, তার সবগুলোতেই যাকাত ফরয হবে। যা বন্ধ্যা, ফল দেয় না, তা থেকে যাকাত দিতে হবে না। তবে ‘ফল’ ধরতে শুরু করলে তাতে যাকাত হবে। [(আরবী***********)] মালিকী মাযহাবের আলিমগণের মধ্যে লাখ্মী বলেছেন, বালকের ধন-মালে যাকাত ধার্য হবে না। কেননাতার ধন-মাল তো বৃদ্ধি হয় না, সেনিজে তা বাড়াতেও অক্ষম।যেমন মাটির তলায় রক্ষিত মালের মালিক যদি তার সন্ধান হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা না পাওয়া পর্যন্ত তাতে যাকাত হবে না। কোন ধন-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা যদি কেউ এক বা একাধিক বছর পর জানতে পারে, তাহলে তা না পাওয়া পর্যন্ত তার যাকাত দিতে হবেনা। ইবনে বশীল এ যুক্তির জবাব দিয়ে বলেছেন, বালকের মাল বৃদ্ধি সাধনে অক্ষমতা হচ্ছে মালিকানার দিকথেকে। আর যে লোকতার ধান-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে অক্ষম, তার ধন-মালেরও যাকাত হবে। তাতে কারোরই দ্বিমত নেই। তবে প্রবৃদ্ধি না হওয়াটা যদি মালের প্রকৃতির কারণে হয়, তা হলে ভিন্ন কথা। ইবনুল হাজেব বলেছেন: উপরে লাখ্মীর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে, তা একটা দুর্বল মত। [(আরবী***********)] (ঘ) আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীগণ মত দিয়েছেন যে, বালকের শুধু কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ায় যাকাত ধার্য হবে। তার অন্যান্য ধন-মালে হবে না। [(আরবী***********)] ইবনে হাজম বলেছেন, এ ধরনের বন্টন-বিভাগ আরকেউ করেছেন বলে আমরা জানি না। তবে যায়দীয়া মতের ফিকাহ গ্রন্থ (****)-এর প্রণেতা যায়েদ ইবনে আলী ও জা’ফর সাদিকের এ মত উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী***********)] আর এঁরা দুজনই ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক। [যায়েদ ১২২ হিজরী সনে নিহত হন, জা’ফর ইন্তিকাল কনে ১৪৮ হিজরীতে।তাঁরসম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, “তাঁর মত ফিকাহ্বিদ আমি আর দেখিনি।” কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, যায়েদ সাদেক ও আহলে বায়ত থেকে নাসির হযরত আলী (রা) থেকে সহীহ্ বর্ণনার মাধ্যমেজানা মতের সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। হযরত আলী (রা) তো আবূ রাফে’র ইয়াতীম বংশধরদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করতেন। যায়েদকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “আমরা রসূলের বংশধরেরা এ মত অস্বীকার করি।” [(আরবী***********)] এঁদের দলীল (ক) উপরিউক্ত আলিমগণ দ্বিতীয় দিকটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, যেমন পূর্বে বলেছি। তা হচ্ছে, যাকাত নামাযের মতেই একটা নিছক ইবাদতের কাজ। আর ইবাদতে নিয়ত জরুরী। কিন্তু বালক ও পাগল নিয়ত নির্ধারণে অক্ষম। অতএব তাদের উপর ইবাদত তো ফরয নয়। সেজন্যে তাদের উপর থেকে নামাযও নাকচ হয়ে গেছে। কাজেই অনুরূপ কারণে তাদের উপর থেকে যাকাত নাকচ হওয়াও বাঞ্ছনীয়। [(আরবী***********)] (খ) এ মতের সমর্থনে নবী করীম (স)-এর বাণী উল্লেখ করা যায়। তিনি ইরশাদ করেছেন: (আরবী***********) তিন জনের আমল লেখা হয় না। তারা হল: বালক—যতদিন পূর্ণ বয়স্ক না হবে, নিদ্রাচ্ছন্ন—যতক্ষণে জেগে না উঠবে এবং পাগল—যতক্ষণে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন না হবে। [নববী বলেছেন: এ হাদীসটি সহীহ্, আবূ দাউদ ও নাসায়ী ‘কিতাবুল হুদুদে’ এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। আলী (রা) তার বর্ণনাকারী।] ‘লেখা হয় না’-র অর্থ এদের উপর শরীয়াত পালনের দায়িত্ব নেই। কেননা শরীয়াতের নির্দেশপালনে বাধ্য সেইলোক, যে শরীয়াতদাতার কথা বুঝতে সক্ষম। কিন্তু বাল্যকাল, নিদ্রা ও পাগলত্ব তার বড় প্রতিবন্ধক। (গ) কুরআনের আয়াত এ মতকে সমর্থন করে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী***********) তুমি তাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধি কর এর দ্বারা। পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণের কাজ হয় গুনাহের মলিনতা থেকে। কিন্তু বালকও পাগলের কোন গুনাহ নেই। কাজেইযাকাত নিয়ে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণের কোন প্রশ্ন উঠে না। অতএব যাকাত গ্রহণ করতে হবে যাদের কাছ থেকে, এ দুইজন তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। সত্য কথা এই যে, উপরিউক্ত দলীল তিনটি এমন নয়, যাকে ভিত্তি করে হানাফী মাযহাবেরলোকেরা –যাঁরা বালক ও পাগলের কোন মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করা ফরয মনে করেন—কোন কথা বলতে পারেন না। মুজাহিদ, হাসান ও ইবনে শবরামা প্রমুখ এরূপ বক্তব্য রেখেছেন। উপরিউক্ত দলীল তিনটি ইমাম বাকের, শা’বী, নখয়ী ও শুরাইহ্-এর মতের সমর্থন দিচ্ছে। কেননা তাঁরা বালক ও পাগলের কোন শ্রেণীর ধন-মালের যাকাত ফরয হয় বলে মনে করেন না। (ক) ইসলাম সকল প্রকারের আইন-বিধানে সার্বিক কল্যাণের দিকে নযর রেখেছে। এখানেও সে দিকটি কিছুমাত্র উপেক্ষিত নয়্ আর অল্প বয়স্ক ও পাগলের ধন-মাল যথাযথ অক্ষুণ্ণ রাখায়ই নিহিত রয়েছে। তাদের কল্যাণ। তাই তাদের ধন-মালে যাকাত ধার্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। অন্যথায় যাকাতই তা নিঃশেষ করে দেবে। যাকাত ফরয হওয়ার যে মৌল কারণ (***) তা এখানে অনুপস্থিত। নাবালেগ, বালক ও পাগল নিজেদের জন্যে কিছুই করতে পারে না, তাদের ধন-মালের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে কিছু চিন্তা করার সাধ্যও তাদের নেই। এমতাবস্থায় প্রতি বছর যাকাত গ্রহণ করা হলে তাদের ধন-মাল শেষ হয়ে গিয়ে তাদরে কঠিন দারিদ্র্য ও অর্থাভাব নিপতিত করবে। এ ধরনের ব্যক্তির বর্ধনশীল ধন-মালে যাকাত ধার্য হওয়ার মূলে সম্ভবত এই তত্ত্বই নিহিত, যেমন কৃষিফসল ও গৃহপালিত পশু অথবা কাজ করার দরুন যা বৃদ্ধি পায়—যেমন মূলধন, যদি তার দ্বারা ব্যবসা করা যায়। হাসান বসরী ও ইবনে শাব্রামা নাবালেগের ধন-মালের যাকাত ফরয হওয়া থেকে কেবল তাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যকেই বাদ দিয়েছেন। কৃষি ফসল ও গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে যাকাত ধার্য করেছেন। কেননা শেষোক্ত দুটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রবৃদ্ধি কাজ করছে, স্বর্ণষ ও রৌপ্য নিজস্বভবে প্রবৃদ্ধিপ্রবণ মাল নয়। তা নিয়ে ব্যবসা করলে বা মুনাফয় বিনিয়োগ করা হলে তবেই তাতে প্রবৃদ্ধি ঘটে। বালক ও পাগল উভয়ই এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অক্ষম। অতএব এই প্রকারের ধন-মালে যাকাত দেয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে তাদের অব্যাহিত দেয়া হয়েছে। বালক ও পাগলের মালে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষের লোকদের কথা আতা, জাবির ইবনে যায়দ, তায়ুম, মুজাহিদ ও জুহরী প্রমুখ তাবেয়ী ফিকাহ্বিদ এবং তাঁদের পরবর্তীকালের রবীয়া মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইসহাক, হাসান ইবনে সালেহ, ইবনে আবূ ইয়ালা, ইবনে উয়াইনাহ্, আবূ দউবায়িদ ও সওর প্রমুখ ফকীহ বালক ও পাগলের সকল প্রকারের ধন-মালে যাকাত ফরয হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। হাদী ও মুয়াইদ বিল্লাহ প্রমুখ শিয়া ফিকাহ্বিদও এ মত দিয়েছেন। হযরত উমর (রা) তাঁর পুত্র, আলী, আয়েশা, জাবির প্রমুখ সাহাবীরও এই মত। মুজাহিদ বা হাসান ও ইবনে আবূ শায়বা কিংবা আবূ হানীফা যেমন কিছু কিছু ধন-মালকে যাকাত থেকে বাদ দিয়েছেন, পূর্বোক্ত তা-ও করেন নি। বালকের ধন-মালে যাকাত হওয়ার দলীল তাঁরা কয়েকটি যুক্তির উল্লেখ করেছেন: ১. প্রথম যুক্তি হল কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ সাধারণভাবেই সব ধনী লোকের ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ার কথাই বলেছে, তাতে কোন তারতম্য হয়নি। যেমন: (আরবী ***********) তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তা দিয়ে তাদের পবিত্র পরিশুদ্ধ কর। আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম বলেছেন, এ আয়াতটিতে ছোট-বড়, সুস্থ বিবেকবান ও পাগলের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। কেননা তাদের সকলেরই প্রয়োজন আর্লাহর পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি লাভ। কেননা এরা সকলেই ঈমানদার। [(আরবী ***********)] নবী করীম(স) হযরত মুআয (রা)-কে যখন ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন, তখন বলেছিলেন, তাদের জানিয়ে দেবে যে, তাদের ধন-মালে আল্লাহ্ যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এই কথাটিও এ পর্যায়ের একটি দলীল। কেননা বালক ও পাগল দরিদ্র হলে এ হাদীস অনুযায়ী তাদের জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাহলে তারা যদি ধনী হয়, তবে তাদের কাছ থেকে তা আকায় করা হবে না কেন? ২. তাদের দ্বিতীয় দলীল ইউসুফ ইবনে মালিক থেকে শাফেয়ী বর্ণিত হাদিসটি। নবী করীম(স) বলেছেন: (আরবী ***********) তোমরা ইয়াতীমের মালের দিকে লক্ষ্য দিও। যাকাত যেন তহা নিঃশেষ করে না ফেলে। এই হাদীসটির সনদ সহীহ্। বায়হাকী ও নববীও তাই বলেছেন, কিন্তু ইউসুফ ইবনে মালিকতাবেয়ী, তিনি রাসূলে করীম (স)-কে দেখেন নি। কাজেই তাঁর হাদীসটি ‘মুরসাল’। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী অন্যান্য সাধারণ দলীলের ভিত্তিতে এই মুরসাল হাদীসটিকে অধিক শক্তিশালী করে তুলেছেন। ইয়াতীমের মালে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে সাহাবীদের পক্ষ থেকে বর্ণিত সহীহ্ হাদীসও উদ্ধৃত হয়েছে। [(আরবী ***********)] তাবরানী আনাস ইবনে মালিক িথেকে বর্ণন উদ্ধৃত করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী ***********) তোমরা ইয়াতীমের ধন-মাল নিয়ে ব্যবসা করবে, যেন যাকাত তা খেয়ে না ফেলে। হায়সামীবলেছেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। [(আরবী ***********)] হাফেয যয়নুদ্দিন আল আল-ইরাকীও তাই বলেছেন। [সুয়ূতীও তাঁর (*****) গ্রন্থে এই হাদীসটির সহীহ্ হওয়ার পক্ষে ইংগিত করেছেন। কিন্তু সে ইংগিত যথার্থ নয়; বরং বিকৃত মনে হয়। তাঁর ব্যাখ্যাকার আল-মুনাতী বলেছেন, সুয়ূতী (*****) গ্রন্থে বলেছেন এটি সহীহ্।] ‘তিরমিযী’ গ্রন্থে আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর পিতার কাছ থেকে- তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে- তিনি নবী করীম (স)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন: (আরবী ***********) যে লোক ইয়াতীমের অভিভাবক হবে, সে যেন তার পক্ষে ব্যবসা করে। তার ধন-মালযেন বেকার ফেলে না রাখে।তাহলে যাকাত তা খেয়ে ফেলবে। হযরত উমরের কথানুযায়ী এই হাদীসটি সহীহ্। বায়হাকী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর (রা) বলেছেন: “তোমরা ইয়াতীমের মালের দিকে নযর দাও। তা যেন যাকাত দিয়ে শেষ করা না হয়।” বায়হাকী বলেছৈন, এর সনদ সহীহ্। এখানেও সাদ্কা অর্থ যাকাত। বেশকয়েকটি বর্ণনায় এর সমর্থন রয়েছে। এ হাদীসটির তাৎপর্য এই যে, নবী করীম (স) বিশেষ করে ইয়াতীমের অভিভাবকদের প্রতি এবং সাধারণভাবে গোটা সমাজের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন ইয়াতীমের মাল বৃদ্ধি সাধনের চেষ্টা করার জন্যে। পাগলদের ব্যাপারেও সেই কথা। মুনাফার আশায় ব্যবসা করার তাকীদ করা হয়েছে। তার ফল বৃদ্ধির চেষ্টা না করার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন- ‘অন্যথায় যাকাতই তা খেয়ে ফেলবে।’ বস্তুত ধন-মালের প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে তা থেকে নিয়মিত যাকাত দিয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে মুলধনটিকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করা। আর যাকাত যদি প্রকৃতপক্ষে ফরযই হয়, তবেই তা রীতিমত দেয়ার প্রশ্ন উঠে। আর ইয়াতীমের অভিভাবকের পক্ষেতার ধন-মাল থেকে ফরয নয় এমন কাজে ব্যয় করা জায়েয হতে পারে না। তাহলে যা উত্তম নয়, এমনকাজে তার সব ধন-মাল উজাড় হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহ্ আমাদের প্রতি নির্দেশ জারী করেছেন যে, আমরা যেন যা উত্তম নয় এমনকাজে ব্যয় করার জন্যে ইয়াতীমদের ধন-মালের কাছেও না যাই-যদ্দিনস না সেপূর্ণ বয়স্ক হচ্ছে। [যেমন সূরা আন’আম-১৫২ আয়াত এবং সূরা আল-ইসরা-৩১ আয়াতে বলা হয়েছে] ৩. এ ব্যাপারে সাহাবীদের কাছ থেকে যে বর্ণনা সহীহ্ প্রমাণিত হয়েছে, তা-ই হয়েছে এ পর্যায়ে তৃতীয় দলীল। আবূ উবাইদ, বায়হাকী ও ইবনে হাজম বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর, আলী, আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর, আয়েশা ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বালকের ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ারর কথা বলেছেন। [***১] কোন সাহাবী তার বিরোধিতা করেছেন বলে জানা যায়নি। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যে বর্ণনাটি রয়েছে, তা যয়ীফ বলে দলীল হিসেবে গ্রহণীয় নয়। [(*****) ৫ম খণ্ড, ২-৮পৃঃ (****) ৫ম খণ্ড, ৩২৯ পৃঃহাদীসটির যয়ীফ হওয়অর কারণ ইবনে লাহ্ইয়া।] ৪. এ মতের চতুর্থ দলীল হচ্ছে সেই বিবেকসম্মত তাৎপর্য যার জন্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ধনীদের- ধন-মালের অংশ দিয়ে গরীবদের দারিদ্র্য বিদূরণই যাকাতের আসল লক্ষ্য। তাতে করে যেমন আল্লাহ্র শোকার আদায় হবে, তেমনি ধন-মালের পবিত্রতা বিধাও হবে। আর বালক ও পাগলের ধন-মালথেকে যখন সাধারণ ব্যয়ভার বহন করা যায়, ঋণ শোধ করা যায়, তখন যাকাত আদায় করা যাবে না কোন্ কারণে, কোন যুক্তিতে? [(আরবী *****) ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২০৮] তাঁরা বলেছেন: একথা যখন সুনিশ্চিত হয়ে দাঁড়াল যে, অভিভাবককেই বালক ও পাগলের ধন-মাল থেকে যাকাত দিতে থাকতে হবে, তখন তা বয়স্ক ও সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকে যাকাতের মতই আদায় করা ফরয হবে।তার সর্ব দেয় আদায় করার ব্যাপারে অভিভাবকই তার স্থলাভিষিক্ত হবে। তা যেহেতু বালক ও পাগলের ধন-মাল থেকে আদায় করা ফরয, কাজেই যাকাত তাদের পক্ষথেকে আদায় করা অভিভাবকের পক্ষেই কর্তব্য। হবে। যেমন নিকটাত্মীয়দের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা ইত্যাদি।যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে মালের মালিকের নিয়তের মতই অভিভাকের নিয়ত গ্রহণযোগ্য হবে। [(আরবী ***********)] মালিকীমাহযাবের কোন কোন ফকীহ্ বলেছেন, বালকেরধন-মালথেকে অভিভাবক যাকাত দেবে তখন, যদি সেজন্যে তার জবাবদিহি করার কোন আশংকা না থাকে। নতুবা দেবে না, আর যখন তা দেবে তার জন্যে সাক্ষ্য রাখবে। সাক্ষী না রাখা হলে ইবনে হুবাইব বলেছেন, সে যদি জবাবদিহি থেকে নিরাপদ থাকে, তাহলে তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেয়া হবে। [(আরবী ****) প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২০৮] অভিাবক যদি ভয় করে যে, যাকাত দিলে বালক বড় হয়ে কিংবা পাগল ভাল হয়ে তার কাছে তা ফের চাইবে তাহলে ব্যাপারটি বিচারকের কাছে সোপর্দ করতে হবে। [(আরবী ***********)] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান বালক ও পাগলের ধন-মাল যাকাত আদায় করা ফরয—এ মতের সমর্থনে যে সব দলীলের যুক্তি দেয়া হয়, তা উপরের এক এক করে উদ্ধৃত হল। প্রায় সমস্ত সাহাবী, তাবেয়ীন ও পরবর্তীকালেল আলিমরাই এ মত পোষণ করতেন। স্বীকার করতে হবে যে, এদের দলীল ও যুক্তি বিপরীত মতের যুক্তি ও দলীলৈর তুলনায় অনেক শক্তিশালী, অকাট্য এবং বলিষ্ঠ। ক. যাকাতের পক্ষের সব দলীলই ছোট-বড়, অল্প বয়স্ক, পূর্ণ বয়স্ক এবং সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ও পাগল সবাইকেই পরিব্যাপ্ত করে। এ দলীল অকাট্য, সে সম্পর্কে কোন আপত্তি নেই। কেননা ধনীদের অর্থে সব গরীব-মিসকীনের জন্যেইআল্লাহ্ তা’আলা হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ধরী হলেই এ হক স্বীকার করতে হবে। তাকে পূর্ণ বয়স্ক হতে হবে, এমন কোন শর্ত আরোপ করা হয় নি। যদিও ইয়াতীমেরধন-মালের সংরক্সণের ওপর শরীয়াতে খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক্ষণে যদি কেউ কোন শর্ত আরোপ করতে চায়, তাহলে তার মতের পক্ষে দলীল পেশ করা তারই কর্তব্য। কিন্তু সে দলীল কোথায়? খ. ইয়াতীমেরধন-মাল বৃদ্ধি করার তাকীদ সম্পন্ন পূর্বোদ্ধৃত ইউসুফ ইবনে মাহাক বর্ণিত হাদীসটির সনদ সহীহ কথা স্পষ্ট, যদিও তা মুরসাল (অর্থাৎ হাদীসটির সাহাবী বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ ন করেই রাসূল (স)-এর কথারূপে বর্ণনা করেছেন একজন তাবেয়ী), কিন্তু তা অন্যান্য বর্ণনার সাহায্যে যথেষ্ট মজবুত হয়ে আছে। সমার্থক সহীহ হাদীস আরও রয়েছে। সাহাবীদের বহু উক্তিও রয়েছে তার সমর্থনে।হযরত আনাসের যে হাদীসটি তাবরানী উদ্ধৃত করেছেন তাও এ পর্যায়েরই। গ. হযরত উমর, আলী, আয়েশা, ইবনে উমরও জাবির(রা) প্রমুখের উক্তি এ ধরনের বিষয়ে যখন অভিনন হয়, তখন বুঝতেই হবে যে, এটা সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে সেই সমাজে, যেখানে লোকেরা যুদ্ধ-বিহাদে পর পর শাহাদত বরণ করেছেন এবং ইয়াতীমের সংখ্যা ছিল গণনার বাইর। তাদের উপরিউক্ত ধরনের উক্তি থেকেই তাই বোঝা যায়। এ সম্মিলিত উক্তিসমূহকে মূল্যহীন মনে করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না। তাঁরা যেমন পরিস্থিতি বুঝতেন, তেমনি রাসূল (স)-এর সমসাময়িকও ছিলেন। ইয়াতীমের ধন-মাল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা যা কিছু নাযিল করেছেন, তার করাঘাত তাঁরা বুঝতে পারতেন। আর সত্য কথা এই যে, ইয়াতীমের মালে যাকাত ফরয না হওয়া পর্যায়ে সাহাবীদের কোন উক্তি কারো কাছ থেকেই সহীহ প্রমাণিত হয়নি। হযরত ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যা বর্ণিত, তা যয়ীফ। এ ধলনের কোন বর্ণনা দলীল হিসেবে পেশ করা বা গ্রহণ করা যায় না। [ আল্লামা মুবারকপুরীলিখিত (****) ২৫ পৃঃ দ্রষ্টব্য।] ঘ. যাকাতের বিধান কার্যকরকরার তাৎপর্য বিবেচনা করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তা গরীব, মিস্কীন ও ধনীদের ধন-মালের অধিকারীদের হক। আর বালক ও পাগলের ধন-মালেও তাদের হক ধার্য হতে পারে। কেনো তারা দুজনও এমন যে, তাদের ধন-মালে যাকাত ধার্য হওূা কিছুমাত্র অযৌক্তিক নয়। যাকাতকে জগণের, অধিকারসমূহের মধ্যকার একটি হক বলা হয় এজন্য যে, তা নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে অন্তর্ভুক্ত: (আরবী***********) আর যাদের ধন-মালে সুপরিজ্ঞাত হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্যে। অপর আয়াতটি হল: (আরবী***********) যাকাত ফকির, গরবী ও মসিকীনদের জন্যে............ আয়াতে যে, (****) বলা হয়েছে, তার তাৎপর্য হচ্ছে যাকাত মালিকানার দিক দিয়ে গরীবদের জন্যে খাস......। ‘যাকাত’ একটা অর্থনৈতিক অধিকার। প্রথম খলীফা হযরত উমর (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন: (আরবী***********) আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব তার বিরুদ্ধে, যে মানায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা যাকাত হচ্ছে ধন-মালের হক। বালক ও পাগলের মালিকানাধীন ধন-মালে জনগণের ফরয হতে পারে এ কথাটি সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত। কেননা নাবালকত্ব ও পাগলামী জনগণের অধিকার আদায়ের পথে প্রতিবন্ধক হয় না। এ কারণে তাদের ধন-মাল থেকে ক্ষতিপূরণ, অপরাধের বিনিময় বা জরিমানা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের জন্যে ব্যয় ইত্যাদি গ্রহণ করায়কোনই বাধা নেই। [(আরবী***********)] এ প্রেক্ষিতে আমরা বলব, বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফর হবে সেই সব শর্তের ভিত্তিতে, যা আমরা এই পর্যায়ে বলে এসেছি। একটি হ মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। তাদের নিজেদের প্রয়োজনে অপরিহার্য ব্যয়ের জন্যে নগদ অর্থ বের করা হবে এই শর্তের ভিত্তিতেই। কেনো তা তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। এ সব কথা থেকেই ইমাম আবূ হানীফার মাযহাবের উপর অপর তিনজন ইমামের মতের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বিশেষ করে তাঁরা বালক ও পাগলের জমির ফসলের ওপর ফরয বলে মত প্রকাশ করেছেন। ফিত্রার যাকাত দেয়াও কথাও তাঁরা বলেছেন। কিন্তু এসব ছাড়া তাদরে অন্যান্য ধন-মালে যাকাত ফরয বলেন নি। অথচ বিবেকের দৃষ্টিকে বিবেচনা করলে যার কৃষি ফসলের ওশর ফরয হয় তার সমস্ত ধন-মালের যাকাত ফরয হওয়ার যৌক্তিকতা সহজেই বুঝতে পারা যায়। কেননা নিম্নোদ্ধৃত দুটি আয়াতের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই: (আরবী***********) ফসল কাটার দিনই তার হক দিয়ে দাও। (আরবী***********) তাদের ধন-মালে প্রার্থী ও বঞ্তিদের হক রয়েছে। প্রথমটি থেকে ওশর প্রমাণিত হয় এবং দ্বিতীয়টি থেকে প্রমাণিত হয় যাকাত। অনুরূপভাবেরাসূল (স)-এর বাণী: (আরবী***********) বৃষ্টির পানিতে সিক্ত জমি মাত্রেই ওশরধার্য হয়। (আরবী***********) মুদ্রায় দশ ভাগের চার ভাগের এক ভাগ দিতে হবে। এ দুটির মধ্যেও কোন পার্থক্য হয় না। হানাফী ফকীহগণ যেকৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং অন্যান্য ধন-মালের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং বলেছেন যে, প্রথমটিতে সাহায্যের তাৎপর্য প্রবল; দ্বিতীয়টিতে নয়—এই পার্থক্য করণের কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। তেমনি কিছু বর্ণিত হয়নি। ইমাম ইবনে হাজম এই পার্থক্যকরণ দেখে চিৎকার করে উঠেছেন। বলেছেন কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং গৃহপালিত পশু ও স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাতের মধ্যে কি করে পার্থক্যকরা যায়, তা আমার বোধগম্য নয়। তাদের এইকথাকেযদি উল্টিয়ে ধরা হয় এবং তাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদিতে যাকাত ধরা হয় আর ফসল ও ফল০ফাঁকড়ার যাকতা নাকটকরা হয়, তাহলে এ দুটি জবরদস্তির হুকুমের বিপর্যয়ের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য হবে কি? ইবনে রুশ্দ বলেছৈন, যা জমির উৎপাদন এবং জমির উৎপাদন নয়, যা প্রচ্ছন্ন ও যা প্রকাশমান এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোন দলীল আছে বলে আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি। [(আরবী***********)] ফরয না হওয়া মতের বাতুলতা ক. বালক ও পাগলের ধন-মালেযাকাত ফরয হয় না, এ মতের পক্ষের দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: (আরবী**********) লোকদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করে তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর। এখানে যে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করণের কথা বলা হয়েছে, ম তা বালক ও পাগলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা এ উদ্দেশ্য কার্যকর হয় গুনাহের প্রতিকূলে।আর দুজনের কোনগুনাহ্ই হয় না। তাই তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণেরও কোন প্রশ্ন উঠে না। এ কথার জবাবে বলা যায় যে, ‘পবিত্র ও পরিশুদ্ধকরণ’ কাজটি বিশেষভাবে কেবল গুনাহের প্রতিকূলে হবে তা হতে হবে এমন কোন কথা নেই। চরিত্র-গঠন মনের পবিত্র ভাবধারার বৃদ্ধি সাধন এবং তাকে লোকদের প্রদি দয়া-সহানুভূতিতে পরিপূরর্ণ করে তোলার জন্যেও তা হতে পারে। তাছাড়া ধন-সম্পদ পবিত্রকরণও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তখন ‘তাদের পবিত্র করবে’ –এ কথার অর্থ করা হবে ‘তাদের ধন-মাল পবিত্র করবে।’ আমরা যদি স্বীকারও করি- যেসব ইমাম নববী বলেছেন। [ইমাম নববী বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার বড় ও প্রধান কারণ হচ্ছে পরিশুদ্ধিকরণ; কিনতউ তা শর্ত নয়। কেননা তাদের ধন-মালে ফিতরা ও ওশর ফরয হওয়াকে আমরা একমত হয়ে মেনে নিয়েছি। দিও তার আসল লক্ষ্য পরিশুদ্ধকরণ।] আয়তাটি দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণই যাকাত ফরয হওয়ার মৌল উদ্দেশ্য, তবুও কেবল বিশেষ ধরনের ‘পবিত্র পরিশুদ্ধিকরণ’ই তার লক্ষ্য নয়। আর তা ফরয হওয়ার সেটাই একমাত্র কারণও নয়। আলিমগণ একমত হয়ে বলেছেন যে, যাকাত ফরয হওয়ার আর একটা কারণ রয়েছে এবং তা হচ্ছে, ইসলাম ও মুসলিমের দারিদ্র্য দূর করা। আর বালক ও পাগল উভয়িই মুসলিম সমাজের লোক। খ. (আরবী*****) তিনজন লোকের আমল লেখা হয় না...... কথাটির তাৎপর্য সম্বন্ধে ইমাম নববী বলেছেন: গুনাহ্ এবং কোন কিচু ফরয হওয়া থেকে এ তিনজন মুক্ত; আমরা বলব, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে তিনজনের কোন গুনাহ্ লেখা হয় না। আর যাকাতও তাদের উপর ফরয হয় না। তা ফরয হয় এবং তাদের ধন-মালের উপর। তা তাদের অভিভাকের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। মেযন তারা যদি কোন জিনিসসষ্ট করে ফেলে, তাহলে, তাদের সম্পত্তি থেকে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া অবশ্যই ফরয হবে এবং তাদের অভিভাবক তা দিতে বাধ্য হবে। [(আরবী**********)] গ. তাঁরা যে বলেছেন যাকাত নামাযের মতই ইবাদত বিশেষ, এ কারণে কুরআন মজীদে নামাযের পাশাপাশিই যাকাতের উল্লেখ রয়েছে। আর ইবাদতে নিয়্যাতের প্রয়োন; কিন্তু বালক ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিহীন লোকের নিয়্যাত হয় না। এ কারণে নামাযও তাদের জন্যে ফরয নয়। অতএব যাকাত দেয়ার দায়িত্বও তাদের উপর অর্পিত হতে পারে না। এ কথার জবাব এই যে, যাকাত একটা ইবাদত, কুরআনে তা নামাযের পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে এবং তা ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম, এ কথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা বলছি যাকাত অর্থনৈতিক সামষ্টিক ব্যাপার বলে তা প্রকৃতিগতভাবেই এক স্বতন্ত্র ধরনের ইবাদত। তা একটি অর্থনৈতিক ইবাদত বলে তাতে প্রনিধিত্ব চলে। তার অভিভাবক আদায় করে দিলে তা অবশ্যই আদায় হয়ে যাবে। এ কারণে তাতে জোর প্রয়োগ এবং সে কাজেনিযুক্ত কর্মচারীর কাছে হল্ চাওয়ার অবকাশরয়েছে, এ দুইটি কাজ জনগণের অধিকার আদায়ে অবশ্যই চলবে। যেমন হানাফী ফকীহ্গণের মতে যিম্মীকেযাকাত আদায় করার জন্যে দায়িত্বশীল বানানো জায়েয। অথচ যিম্মী ইবাদতের যোগ্য লোকদের মধ্যে গণ্য নয়। যাকাত নিয়্যাত ছাড়া আদায় হয় না বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের জবাবে ইবনে হাজম বলেছেন: আল্লাহ্র আদেশক্রমে যকাত আদায় করবে মুসলিমসমাজ ও তার রাষ্ট্রকর্তা। আর যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্রেই যখন নেয়া হবে, তখন এ নেওয়াটা অনুপস্থিত, মূর্ছা যাওয়া বক্তি ও পাগল ও বালক-নিয়্যাত করতে পারে না- এমন সব লোকের তরফ থেকেই তা যথাযথভাবে আদায় হয়ে যাবে। সারকথা: যাকাত অর্থনৈতিক ইবাদত, তাতে প্রতিনিধিত্ব বা স্থলাভিষিক্ততা চলে। অভিভাবক িএ ব্যাপারে বালকের প্রতিনিধি। কাজেই এ ফরয কাজ সম্পন্নকরণে সে স্থলাভিষিক্ত হবে। তবে নামায ও রোযা ইত্যাদি দৈহিক ইবাদতের কথা স্বতন্ত্র। কেননা তা ব্যক্তিগত ইবাদত, তাতে অন্যকে দায়িত্বশীল বা প্রতিনিধি বানানো চলে না, তা ব্যক্তির নিজেরই সম্পন্ন করা উচিত। কেননা তাতে দৈহিক কষ্টের প্রয়োজন বলে ইবাদতের দিকটি স্পষ্ট। আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশ্যেই তা করা হবে। কিন্তু নামায ও যাকাতরে মধ্যে এমন অবিচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্নতা নেই, যার দরুন দুটো এক সঙ্গে প্রমাণিত হলে এক সাথে নাকচও হতে হবে। কাজেই তাদের দুজনের নামায আদায়ের বাধ্যতা বাতিল হলে এবং যাকাত আদায়ের বাধ্যতা হলে বহাল থাকলে শরীয়াতের দলীলের দিক দিয়ে কোনই অসুবিধা হয় না। [(আরবী**********)] কেননা আল্লাহ্ তা’আলা সবগুলোর ফরয কাজ এমনভাবে ধার্য করেন নি যে, তা তার একটি প্রমাণিত হলে অপরটিও প্রমাণিত হয়ে যাবে, আর একটি নাকচ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অপরটিকেও নাকচ হয়ে যেতে হবে।কাজেই নামায পত্যাহৃত হলে যাকাতকেও প্রত্যাহৃত হতে হবে এমন কথার কোন যুক্তি নেই। তারও কারণ এই যে, আল্লাহ্ বা তাঁর রাসূল যা ফরয করেছেন তা নাকচ হতে পারে যদি আল্লাহ ও রাসুল তা নাকচ করেন। আর একটি ফরয নাকচ হলে সেই কারণে ভ্রান্ত মতের ভিত্তিতে অন্যটিকেও নাকচ করে দেয়া যায় না—কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীল ছাড়া। [(আরবী**********)] এ পর্যায়ে আবূ উবাইদ যা লিখেছেন, তা অবশ্যই প্রনিধানযোগ্য। তা হল: ইসলামী শরীয়াতের কিছু অংশের উপর ভিত্তি করে চিন্তা করা যায় না। কেননা সেগুলো মৌলিক। আর তার প্রতিটিই নিজস্ব ফরয হওয়ার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। [(আরবী**********)] নামায বান্দাদের কাছে আল্লাহর হক, তা বন্দা ও মাবুদের মধ্রকার সম্পর্কের ব্যাপারে বিশেষ অবদান রাখে। পক্ষান্তরে যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত ধনীদের ধন-সম্পদে গরীব-মিসকীনের হক। [(আরবী**********)] একদিকে বালক ও পাগলের কল্যাণ, আর অপরদিকে গরীব-মিসকীনের কল্যাণ। দ্বীন ও রাষ্ট্রের কল্যাণের ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও শরীয়াত বালক-পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের কল্যাণের প্রতি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করেন নি। কেননা যে কোন বর্ধনপ্রবণ ধন-মালেই যাকাত ফরয হওয়া অবধারিত; কার্যত তা বৃদ্ধি না পেলেও। যেমন মৌল প্রয়োজন পূরণের পর উদ্বৃত্ত ধন-মালছাড়া যাকাত ফরয হয় না। কোন কোন হানাফী ফিকাহ্বিদ মত দিয়েছেন, যে সব নগদ টাকা মালিকের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্যে নির্দিষ্ট, তাতে যাকাত ফরয হয় না, তা নিসাব পরিমাণ হলেও; এবং একটি বছরকাল অতিক্রান্ত হলেও। কেননা তা যেন অস্তিত্বহীন (তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে)। বালক ও পাগলের ক্ষেত্রেও আমরা চিন্তাই যথার্থ মনে করছি, যদি বালকের পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার সময় এবং পাগলের সুস্থ হওয়ার সময় তাদের মৌল প্রয়োজন পূরণের পরিমাণের অধিক নগদ টাকার মালিক না হয়। এখানে কয়েকটা জরুরী কথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে: প্রথম. বালক যে ইয়াতীমহবেই (এবং এই সুবাদে যাকাতরে ক্ষেত্রে সে সুবিধা পাওয়ার অধিকার) বলে মনে করতে হবে—এমন কোন কথা নেই। বালক তার মা’র সম্পদ-সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হতে পারে, কেউ-তাকে ‘হেবা’ করতে পারে, দাতা বা অন্য কোন নিকটাত্মীয়—কোন অপরিচিত ব্যক্তি তার জন্যে ওসীয়ত করতে পারে। এ কারণে এ আলোচনার শিরোনাম হওয়া উচিতঃ বালকের মালের যাকাত’; ইয়াতীমের মালের যাকাত নয়। দ্বিতীয়. ইয়াতীমদের ধন-মালের প্রবৃদ্ধি সাধনে মনোযোগী হওয়ার জন্যে কুরআন-হাদীসে অভিভাবকদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যেন যাকাত তা নিঃশেষ করে না দেয়। আমর ইবনে শুয়াইব কর্তৃক- তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছৈন, রাসূলে করীম (স) লোকদের সামনে ভাষণ দিয়ে বলেছেন: (আরবী**********) তোমরা যারা ইয়াতীমের অভিভাবক হবে, সে ইয়াতীমের ধন-মাল থাকলে তা নিয়ে যেন ব্যবসাকরা হয়, তা বেকার ফেলে রাখা না হয়। নতুবা যাকাত তা খেয়ে ফেলবে। (তিরমিযী, দারে কুতনী) ইউসুফ ইবনে মাহাক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল করীম(স) বলেছেন: (আরবী**********) ইয়াতীমের ধন-মালের প্রতি তোমরা লক্ষ্য রাখ, যাকাত যেন তা শেষ করে না ফেলে। (তিরমিযী, দারে কুত্নী) অতএব ইয়াতীমের ধন-মালের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হল তার প্রবৃদ্ধি সাধনে মনোযোগী হওয়া, অনুরূপভাবে তা থেকে যাকাত হিসেব করে দিয়ে দেওয়াও তাদেরই কর্তব্য। স্বীকার করছি, সম্পদের দিক দিয়ে এ দুটো হাদীসের দুর্বলতা রয়েছে, অথবা তার বর্ণনা পরম্পরা অবিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু তা নানাভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে: প্রথমত. অনেক কয়েটি সূত্রে এ অর্থের হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যার একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে তোলে। হাফেয ইরাকী তো কয়েকটি সূত্রকেই সহীহ বলেছেন। দ্বিতীয়ত, কোন কোন সাহাবী থেকে অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয়ত, ইয়াতীমেরধন-মাল নিয়ে ব্যবসায় করার কথাটি কুরআনের এ আয়াতটির প্রতিধ্বনিত: (আরবী**********) তোমরা তাতে তাদের খোরাক-পোশাকের ব্যবস্থা কর। তা থেকে এ ব্যবস্থা করতে বলা হয় নি। উক্ত কথাটি ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্পাদকে উৎপাদনের কাজে লাগানো এবং পুঁজিকরণ নিষিদ্ধ হওয়া। উপরোদ্ধৃত হাদীসমূহে ইয়াতীমদের ধন-মালের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে বিশেষভাবে তাদের অভিভাবকদের প্রতি এবং সাধারণভাবে মুসলিম সমাজে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি। কাজেই সরকারীভাবে ইয়াতীমেরধন-মালের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দায়িত্বশীল লোক নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে, যেন তার প্রবৃদ্ধি সাধনে উত্তম ব্যবস্থার দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায়, শরীয়াতের বিধান তাতে কার্যকর করা হয়, ক্ষতিপূরণসমূহ দেয়া হয়, ইয়াতীমের প্রয়োজন পূরণ ও তার প্রবৃদ্ধি সাধন সম্ভব হয়। তা হলে যাকাত সে ধন-মাল খেয়ে ফেলতে পারবে না। ইয়াতীমের জন্যে কোন আশংকা বোধ করার কারণ নেই। প্রথমত, তারা সচ্ছল অবস্থার নিকটাত্মীয়দের রক্ষণাবেক্ষণ পাবে, অন্তত রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উপর তারা নির্ভরশীল হতে পারবে। আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী*******) লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কি খরচ করবে? তুমি বলে দাও, তোমরা যে ভাল জিনস ব্যয় করবে, তা করবে পিতামাতার জন্যে, নিকাটত্মীয়, িইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে। আর তোমরা যে ভালো জিনিসই ব্যয় করবে, সে বিষয়ে আল্লাহ্ পুরাপুরি অবহিত। (আরবী*******) পূর্বে ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোই প্রকৃত ধর্মপ্রাণতা (Righteousness) নয়।; বরং প্রকৃত ধর্মপ্রাণতা আছে তার, যে ঈমান এনেছে, আল্লাহ্ পরকাল, ফেরেশ্তা, কিতাব ও নবী-রাসূলগণের প্রতি এবং আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার দরুন অর্থ সাহায্য দিয়েছে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী ও দাস বা বন্দীদের মুক্তির জন্যে। (আরবী*******) তোমরা জেনে রাখ, যে জিনিসিই তোমরা গনীমত হিসেবে পাবে, তারই এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে। (আরবী*******) নগরবাসীদের থেকে যা কিছু আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে দান করেছেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে, যেন তা তোমাদের ধনীদের মধ্যেইি আবর্তনশীল হয়ে না থাকে। এ সব আয়াতের আলোকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ব্যক্তিদের ধন-মালে ইয়াতীমের অংশ রয়েছে যখন তারা যাকাত বা যাকাত ছাড়া অন্যভাবে কোন কিছু ব্যয় করবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ- যাকাত, গণীমত ও ‘ফাই’ যাই হোক- তাতেই ইয়াতীমের অংশ রয়েছে। এটা তাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যবস্থা। তাদের অক্ষমতা-দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেকই তা করা হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী*******) প্রতিটি মুসলমানেরকাছে তার নিজের তুলনায় আমি অধিক উত্তম। যে লোক ধন-মাল রেখে যাবেতার উত্তরাধিকারীদের জন্যে হবে। আর যে লোককোন ঋণ বা ধ্বংসহয়ে যাওয়ার মত সন্তানাদি রেখে যাবে, তাদের ব্যাপারে আমারদিকেএবং তাদের দায়িত্ব আমার উপর। বস্তুত ইয়াতীম ইসলামী সমাজের সামষ্টিক দায়িত্বে থাকবে। এ কারণে তার বিপদে পড়ার বা অর্থাভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনই আশংকা থাকতে পারে না। সারকথা বালক ও পাগলের ধন-মালে অবশ্যই যাকাত ফরয হবে। কেননা তা একটা হক, ধন-মালের সাথে তার সম্পর্ক। কাজেই তার মালিক ছোট বা পাগল হলে সে হ ক নাকচ হয়ে যেতে পারে না। আর সে ধন-মাল গৃহপালিত পশুহোক কিংবা কৃষি ফসলবা ফল-ফাঁকড়া, ব্যবসা পণ্য বা নগদ টাকা-তাতে কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য যে নগদ টাকা স্বীয় মৌল প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাখা হয়েছে তার কথা নয়, কেননা তা তো তখন আসল প্রয়োজনের পরিমাণের অতিরিক্ত হবে না। বালক ও পাগলের অভিভাবকের কাছে যাকাত দাবি করা হবে। মালিকী মাযহাবের কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত অনুযায়ী ‘শরীয়াত বিভাগ’-এ তা আদায় করে নেবে। তৃতীয় অধ্যায় যেসব ধন-মালে যাকাত ফরয হয় তার নিসাব পরিমাণ ১. যে ধন-মালে যাকাত ফরয হয় ২. জন্তু ও পশুসম্পদের যাকাত ৩. স্বর্ণ ও রৌপ্যের নগদ অর্থ ও অলংকারের যাকাত ৪. ব্যবসা পণ্যের যাকাত ৫. কৃষি সম্পদের যাকাত ৬. মধু ও পশু উৎপাদনের যাকাত

৭. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত ৮. ঘর-বাড়ী ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি উৎপাদনের যাকাত ৯. স্বাধীন শ্রম ও উপার্জনলব্ধ সম্পদের যাকাত ১০. বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন বিষয়ের আলোচনা শেয়ার, বণ্ডস্ ইত্যাদি। যেসব ধন-মালে যাকাত ফরয এবং যাকাতের নিসাব পরিমাণ এ অধ্যায়ে যাকাতের নিয়ম বিধান আলোচিত হয়েছে, যাকাত কোন্ কোন্ ধন-মালে ফরয হয়, কত পরিমাণের মাল থাকলে যাকাত ফরয হবে তৎসংশ্লিষ্ শর্তাবলী- ইত্যাদির আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। এ অধ্যায়ে মোট দশটি পরিচ্ছেদ রয়েছে: প্রথম পরিচ্ছেদ : যে সব ধন-মালে যাকাতফরয হয় তার প্রাথমিক লাচনা ও শর্তাবলী দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পশু সম্পদের যাকাত তৃতীয পরিচ্ছেদ : স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাত চতুর্থ পরিচ্ছেদ : ব্যবসা সম্পদের যাকাত পঞ্চম পরিচ্ছেদ : কৃষি সম্পদ ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাত ষষ্ট পরিচ্ছেদ : মধু ও পশু উৎপাদনের যাকাত সপ্তম পরিচ্ছদ : খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত অষ্টম পরিচ্ছেদ : ভাড়ায় লাগানো ঘর-বাড়ি ও কল-কারখানা ইত্যাদির যাকাত নবম পরিচ্ছেদ : স্বাধীন শ্রম-মেহনত ও কর্মোপার্জন-উদ্ধৃত্তে যাকাত দশম পরিচ্ছেদ ; বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা প্রথম পরিচ্ছদ যে সম্পদে যাকাত ফরয হয় যে সব ধন-সম্পদে যাকাত ফরয হয় কিংবা ফরয হওয়ার শর্ত কি, এ পর্যায়ে কুরআনের নির্দিস্ট করে কিছু বলেনি। এমনকি কোন্ সম্পদে কি পরিমাণ যাকাত ফরয, সে ব্যাপারেও কুরআন নীরব। এ কাজটির দায়িত্ব সুন্নাতের উপর অর্পিত হয়েছে, তা কথার মাধ্যমে জানা যাক, কি কাজের বর্ণনার মাধ্যমে।বস্তুত কুরআনে যা মোটামুটিভাবে বলা হয়েছে, সুন্নাতই তা বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছে ও তার বাস্তব কর্মরূপ উপস্থাপিত করেছে। কুরআনে যা অস্পষ্ট রয়েছে, সুন্নাত তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। কুরআনে যা সাধারণভাবে বলা হয়েছে, সুন্নাত তা বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে; আর বাস্তবায়নের পন্থা নির্দেশ করেছে। কুরআনে যে মতাদর্শের রূপরেখা পেশ করা হয়েছে, সুন্নাতে তার বাস্তব রূপ তুলে ধরেছে, মানব জীবন অনুসরণের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। কেননা রাসূলে করীম(স)-ই আল্লাহর নাযিল করা বিধানের বাস্তব ব্যাখ্যাদানের জন্যে দায়িত্বশীল। আর তা তিনি করেছেন তাঁর মুখের কথা দ্বারা, কাজের দ্বারা এবং সমর্থনের দ্বারা। আল্লাহর কালামের আসল বক্তব্য কি, তা দুনিয়ার সব মানুষের তুলনায় তিনিই অধিক ভাল জানেন। এ পর্যায়েই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী********) আর তোমার প্রতি কুরআন এ জন্যে নাযিল করেছি যে, লোকদের জন্যে তাতে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা তুমি লোকদের সবিস্তারে ও সঠিকভাবে বলে দেবে এবং সম্ভবত তারাও চিন্তা-ভাবনা করবে। দুনিয়ার মানুষের কাছে ধন-মাল সম্পদ বিচিত্র ধরনের। কুরআন এই কথার উল্লেখ করেছে এবং তার যাকাত দেয়া সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছে। তাতে আল্লাহর হক থাকার কথাও মোটামুটি বলেছে। প্রথম—স্বর্ণ ও রৌপ্য। এর উল্লেখ হয়েছে কুরআনের এ আয়াতে: (আরবী********) আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করেতা আল্লাহর পথে ব্রয় করে না, তাদের পীড়ানকারী আযাবের সুসংবাদ দাও। দ্বিতীয়-কৃষিফসল ও ফল-ফাঁকড়া। কুরআনে বলা হয়েছে: (আরবী********) তোমরাসকলে তার ফল খাও যখন তা ফল দেবে। আর তা কাটার দিনই তার হক আদায় করে দাও। তৃতীয়-ব্যবসা ইত্যাদির উপার্জন। কুরআনে বলা হয়েছে: (আরবী********) হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা যে সব পবিত্র ধন-মাল উপার্জন কর, তা থেকে ব্যয় কর। চতুর্থ—জমি, খনি িইত্যাদির উৎপাদন। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী********) আর সেই জিনিস থেকেও, যা আমরা জমি থেকে তোমাদের জন্যে উৎপাদন করেছি। এসব ছাড়াও কুরআন সাধারণ ও নিঃশর্ত কথা দ্বারা যাকাত ফরয হওয়ার ধন-সম্পদের প্রতি ইংগিত করেছে। কুরআনে উদ্ধৃত একটি শব্দ হচ্ছে (***) অর্থাৎ ধন-মাল-সম্পদ-সম্পত্তি। বলা হয়েছে: (আরবী********) তাদের ধন-মালসম্পদ থেকে যাকাত আদায় কর। অপর আয়াতে রয়েছে: (আরবী********) তাদের ধন-মালে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। ‘মাল’ শব্দের অর্থ- আভিধানিক শরীয়াতের পরিষাভায় কুরআন মজীদে এবং হাদীসেও যে ‘মাল’-এর কথা বলা হয়েছে যার বহু বচর ‘আমওয়াল’-তার অর্থ কি? যে-আরবদের ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে, তাদের কাছে ‘মাল’ বলতে বোঝায় এমন জিনিসই যা অর্জন-দখল করা এবং মালিক হওয়ার কামনা-বাসনা ও চেষ্টা মানুষের মধ্যে থাকে। এই দিক দিয়ে উষ্ট্র মাল, গরুও মাল, ছাগলও মাল, খেজুর গাছ, স্বর্ণ ও রৌপ্য এ সবই ‘মাল’। আরবী অভিধান ‘কামুসুল মুহীত’ ‘লিসানুল আরব’-এ বলা হয়েছে: (আরবী********) –‘জিনিস-পত্রের মধ্যে তুমি যারই মালিক হবে, তা-ই ‘মাল’। তবে মরুবাসীরা সাধারণত ‘মাল’ বলতে কেবল গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুই বুঝে। আর নগরবাসীরা সাধারণ ‘স্বর্ণ-রৌপ্যকেই ‘মাল’ মনে করে। যদিও সব জিনিসই ‘মাল’। ইবনুল আসীর লিখেছেন : মুলত ‘মাল’ বলতে মালিকানায় লব্ধ বোঝায়। কিন্তু চলতি অর্থে যেসব জিসের মালিকানা লাভ হয় ও দখলে আনতে চাওয়া হয়, তা সবই ‘মাল’ রূপে গণ্য। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ‘মাল’ শব্দের অর্থ নির্ধারণে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন। হানাফী ফিকাহ্বিদদের মতে যা করায়ত্ত করা যায় এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা-ই ‘মাল’। এ দৃষ্টিতে দুটি গুণ ব্যতিরেকে কোন জিনিসকে ‘মাল’ বলা যাবে না। একটি হল অধিকৃত (possession) হওয়ার গুণ আর দ্বিতীয়টি স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হওয়া সম্ভাব্যতা। অতএব যে জিনিসই অধিকৃত হবে এবং কার্যত ব্যবহার করা যাবে, তা-ই ‘মাল’ বলে গণ্যহবে। জমি, পশু ইত্যাদি যে সবের আমরা মালিকহয়ে থাকি তা সব-ই মাল- তা বস্তু বা দ্রব্য হোক, কি নগদ টাকা। যেসব জিনিস উপস্থিত অবস্থায় অধিকৃত ও ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্য নয়; কিন্তু যে সবের মধ্যে তা রূপায়িত হতে পারে তার সম্ভাব্য রয়েছে তা-ই ‘মাল’-এর মধ্যে গণ্য। নদী-সমুদ্র গর্ভস্থ মাছ বা শুন্যে উড়ন্ত পাখী, বনজংগলের পশু। এগুলোর করায়ত্ত করা সম্ভব এবং স্বাভাবিকভাবেই তা ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু যা করায়ত্ত হওয়ার যোগ্য নয়, তা ব্যবহৃত হতে পালেও ‘মাল’রূপে গণ্য হবে না। যেমন সূর্যের আলো ও তাপ, বাতাস ইত্যাদি। তেমনি যা স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না- কারর্যত তা অর্জিত হতে পারলেও ‘মাল’ বলা যাবেনা। যেমন একমুঠি মাটি, পানির ফোঁটা, মৌমাছি, চাউলের একটা দানা ইত্যাদি। এ অর্থ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হচ্ছে এ কথা স্পষ্ট করা যে, ‘মাল’ ‘বস্তু’ ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুই করায়ত্ব করা যায়, দখল করা যায়। বস্তু ব্যবহারের ফায়দা ‘মাল’ বলে গণ্য হবে না- যেমন ঘরবাড়িতে বসবাস, গাড়ি ঘোড়ায় আরোহণ, বস্ত্র পরিধান কেননা এগুলো দখল ও করায়ত্ব করা যায় না। অধিকারসমূহও সেইরূপ। যেমন ইত্যাদি লালন-পালনের অধিকার, অভিভাবকত্বের অধিকার। এটা হানাফী মাযহাবের মত। শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাবের মত হল, বস্তুর ব্যবহারকারিতাই মাল। কেননা তাঁদের মতে মূল জিনিসের অধিকৃত ও করায়ত্ত হওয়ার সম্ভাব্যতাই আবশ্যকীয় নয়, তার মৌল ও উৎস করায়ত্ত করার সম্ভাব্যতাই যথেষ্ট। আর ব্যবহারিকতার ক্ষেত্র ও উৎস করায়ত্ত করার দ্বারাই ব্যবহারিক মল্য করায়ত্ত করা সম্ভব। যেমন কেউ কোন গাড়ি করায়ত্ত করেনিলে অপরকে তার অনুমতি ভিন্ন তা ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যায়। আইন প্রণয়নকারীরা এ মতই গ্রহণ করেছে বলে মালের ব্যবহারিক মূল্যকেও ‘মাল’ গণ্য করেছেন। যেমন গ্রন্থস্বত্ব, আবিষ্কারের সাক্ষ্যাদিও ‘মাল’। ফিকাহ্বিদ্দের কাছে যা ‘মাল’ বলে গণ্য, তার চাইতে অধিক সাধারণ অর্থে তারা ‘মাল’ শব্দ ব্যবহার করেন [(আরবী*********)] এ পর্যায়ে আমাদের মত হল, ‘মাল’ শব্দের যে তাৎপর্য হানাফী মতের ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন তা তার অভিধানের অর্থের নিকটবর্তী; আরবী অভিধানসমূহে যেমন বলা হয়েছে।যাকাত পর্যায়ে যত দলীল এসেছে তা সবই এ অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা মূল বস্তু ব্যবহারিকতা নয়; ইহা তো গৃহীত, হস্তগত ও সংগ্রহীত হতে ও বায়তুলমালে রক্ষিত হতে পারে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টন করা যেতে পারে। ইবনে নজীম বলেছেন, মাল হচ্ছে: (আরবী*********) যা সংগৃহীত ও সঞ্চিত হতে পারে প্রয়োজনের জন্যে। অর্থাৎ মুল বস্তু। ব্যবহারিকতার মালিক বানানো এর মধ্যে গণ্য নয়। ‘কাশফুল কবীর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে: (আরবী*********) মূল দৃঢ় কঠিন বস্তুটির মালিক বানানো ছাড়া যাকাত আদায়ের উপায় নেই। এমন কি, কেউযদি তার ঘরে কোন গরীব ব্যক্তিকে বসবাসকরতে দেয় যাকাত আদায়ের নিয়তে, তাতে তা আদায় হবে না। ব্যবহারিকতা তো আর মূল বস্তু নয়। এ হল দুটি পন্থার একটি। অপরটি হল ব্যবহারিকতা ও মাল। প্রয়োগের সময়তা মূল বস্তুর দিকে প্রবর্তিত হবে। [(আরবী*****)] যে মালে যাকাত ফরয হয়তার শর্তাবলী মানুষ যে জিনিসের মালিক হয়, যার কোন মূল্য আছে- তা-ই মাল। তাহলে সর্ব প্রকার মালেই কি যাকাত ফরয হবে? তার পরিমাণ যা-ই হোক না কেন? তার প্রয়োজন যতটাই থাক না কেন? মানুষের বাসগৃহও মাল, পরিধেয় বস্ত্রও মা, পড়ার জন্যে সংগৃহীত বই-পত্রও মাল। চাষ-বাস ইত্যাদি কাজেহাতে ব্যবহার্য যন্ত্র ও পাত্র ইত্যাদিও মাল। ..... তাহলে এগুলোর উপরও কি যাকাত হবে? একজন আরববেদুই দুটি উষ্ট্রের মালিক কিংবা কিছু ব্যবহার্য দ্রব্যাদির। তার উপর যাকাত ফরয? কৃষক তার জমি চাষকরে এক বা দুই ‘আরবদের’ ফসল ফলায় তার নিজের ও পরিবারবর্গের খোরাকের জন্যে। তার উপরও কিযাকাত ধার্য হবে? প্রায় প্রত্যেক মানুষইকিছুটচাকার মালিকহয়ে থাকে। তার উপও কি যাকাত ধার্য হবে? ব্যবসায়ী কিছু না কিছু পরিমাণ পণ্যের মালিক হয়ে থাকে। কিন্তু নগদ টাকাও তার কাছে থাকা স্বাভাবিক, সেই সাথে তার থাকে সমপরিমাণ বা ততোধিক পরিমাণের ঋণ। এখন তাকেও কি যাকাত দিতে হবে? ইসলাম যে ন্যায়বিচারের আহবান নিয়ে এসেছে, ইসলামী শরীয়াত মানবজীবনেযে সহজতা ও সুখ-শান্তি বিধানের প্রতিশ্রুদিবদ্ধ, তামানুষকে কষ্ট অসুবিধা কঠিনতায় নিক্ষেপ করতে অস্বীকার করে। কেননা আল্লাহই তা তাদের থেকে দূর করেদিতে চান। এরূপ অবস্থায় যে মালের উপর যাকাত ফরয হতে পারে তার গুণ, পরিমাণ ও পরিচিত সুনির্দিষ্ট হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। তার শর্তাবলীও সম্মুখে থাকা আবশ্যক। আমরা এখানে এই শর্তাবলীর উল্লেখকরছি। ১. পূর্ণাঙ্গ মালিকানা সমস্বত ধন-মাল আসলে আল্লাহ্র মালিকানায়। তিনি তার উদ্ভাবক, তার স্রষ্টা। তিনি তা মানুষকে দান করেছেন। তা-ই মানুষের রিযিক। এ জন্যেকুরআন বারবার এই মহাসত্যকে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছে। বহু সংখ্যক আয়াতে সমস্ত ধন-মাল আল্লাহ্র বলে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। (আরবী*******) এবং তোমরা তাদের দাও আল্লাহর সেই ‘মাল’ থেকে যা তিনি তোমাদের দান করেছেন। (আরবী*******) এবং ব্যয় কর তোমরা সেই রিযিক থেকে, যা আমরা তোমাদের দিয়েছি। (আরবী*******) তার কার্পণ্য করে তা নিয়ে আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ থেকে তাঁদের দিয়েছেন। এ সব ধন-মালে মানুষের স্থান ও মর্যাদা হচ্ছে উকিলবা প্রতিনিধিত্বের মাত্র। তারা শুধু ধন-ভাণ্ডারে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বশীল। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন: (আরবী*******) এবং খরচ কর তোমরা সেই জিনিস থেকে, যাতে আল্লাহ্ তোমাদের খলীফা বানিয়েছেন। আল্লাহ যদিও সব ধন-মালের প্রকৃত মালিক, প্রকৃত অধিকারী, তা সত্ত্বেও এ সব তিনি তাঁর বান্দাদের দিয়েছেন তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ। সেইসাথে তা আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহে বান্দাদের পরীক্ষার মাধ্যমেও। আল্লাহ্ চান, আল্লাহ্ চান, তারা যেন আল্লাহ্র দানের কথা সচেতনভাবেস্বীকার করে। তারা আল্লাহ্র পৃথিভীতে তাঁর খলীফা, এ কথা যেন তারা বুলে না যায়। আল্লাহ্ এ সব তাদের মালিকানায় দিয়ে তাঁরিই প্রতি দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, এ জন্যে তাঁর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে, এ কথা যেন সব সময় তাদের স্মরণে থাকে। তারা যেন হয় এ সবের ব্যাপারে আল্লাহ্র আমানতদার। ঠিক যেমন পিতা তার বিত্ত-সম্পত্তির একাংশ তার সন্তানদের দান করে। যেন তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের চেতনা জাগ্রত হয়, তার নিজস্বভাবেতা ব্যয়-ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। পিতা পরীক্ষা করে সন্তানদের, তারা তার শুভ ধারণানুযায়ী উত্তমভাবে সেগুলোর ব্যয়-ব্যবহার করতে পারছে কিনা, না তা খারাপভাবে ব্যবহার করে তাদের ব্যর্থতা প্রকট করে তোলে—বাস্তবতা তা দেখতে চায়। ধন-মালের মালিকআল্লাহ্ মানুষকে এ সব দিয়ে ঠিক সেই কাজ করেছেন। এ একটা ভালো দৃষ্টান্ত মাত্র। এর কারণে কুরআন শরীফেই আমরা দেখতে পাই, ধন-মাল প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা মানুষের বলে উল্লেখ করছেন। যেমন বলেছেন: (আরবী*********) হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের ধন-মাল (যা তোমাদের আয়ত্তে রয়েছে) যেন তোমাদের গাফিল না বানিয়ে দেয়। (আরবী*********) তোমাদের ধন-মাল ও তোমাদের সন্তান পরীক্ষার মাধ্যম। (আরবী*********) ভাবে- মনে করে যে, তার ধন-মাল তাকে চিরন্তন বানিয়ে দেবে। (আরবী*********) তাকে মুখাপেক্ষীহীন বানায় নি তার ধন-মাল আর যা সে উপার্জন করছে, তা। (আরবী*********) তাদের ধন-মালে হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের। (আরবী*********) তাদের ধন-মাল থেকে সদ্কা গ্রহণ কর। (আরবী*********) তাদের ধন-মাল ও সন্তান যেন তোমাকে বিস্মিত ও হতচকিত না করে। (আরবী*********) অএব তাদের ফিরিয়ে দাও তাদের ধন-মাল। (আরবী*********) তোমরা তোমাদের ধন-মাল পারস্পরিকভাবে বাতিল পন্থায় ভক্ষণ করো না। এ সব আয়াতে ধন-মাল মানুষের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা দ্বিগুণিত ও চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর দেয়া ধন-মাল থেকে মানুষেরকাছে করয চান। তিনি নিজে সবকিচুর মালিক হয়েও তা তিনি তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে ক্রয় করেন। এটা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) কে আছে আল্লাহকে করযে হাসানা দিতে প্রস্তুত, তাহলে তিনি তা বহুগুণ বেশী করে ফিরিয়ে দেবেন। (আরবী*********) কে আছে আল্লাহ্কে উত্তম করয দিতে প্রস্তুত, তাহলে তিনি তাকে তার জন্য বহুগুণ বেশী করে ফিরিয়ে দেবেন এবং তার জন্যে উত্তম কর্মফল হবে। (আরবী*********) অতএব তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ্কে করযে হাসানা দাও। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী*********) নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের কাছ থেকে তাদের জানমাল ক্রয় করে দিয়েছেন এই শর্তে যে, তাদের জন্যে জান্নাত হবে। হাসান বলেছেন: আল্লাহ্ তাদের থেকে জানমাল ক্রয় করে নিয়েছেন, যদিও তিনি তার স্রষ্টা। জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন, যদিও তিনি তার প্রদাতা।’ তা সত্ত্বেও মানুষের এ মালিকানা পূর্ণাঙ্গ নয়। প্রকৃত মালিকানা একমাত্র আল্লাহ্র। কথিত মানুষের মালিকানার অর্থ করায়ত্তকরণ, ব্যয়-ব্যবহার করা মানুষের সাথে তা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া। মানুষের কোন কিছুর মালিক হওয়ার অর্থ সেই জিনিসটি দ্বারা উপকৃত হওয়া বা তার কল্যাণ লাভ করার অধিকার অন্য কারোর তুলনায় তার বেশী হওয়া। শরীয়াত-সম্মত উপায়ে কেউ কোন জিনিস করায়ত্ত করে নিলে এরূপ হয়। আর সে উপায় হচ্ছে, শ্রম বা কাজ, চুক্তি অথবা উত্তরাধিকার; কিংবা অন্য কিছু। মানুষের এ মালিকানা আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে এবং তাঁর শরীয়াত অনুযায়ী হয়। মানুষকে মালিক বানানোর মর্মকথা- যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেছেন: আল্লাহ্ তা’আলা যখন মানুষের জন্যে পৃথিবী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা ভোগ ব্যবহার করা মুবাহ করে দিয়েছেন, তখন একটা জগড়ার সৃষ্টি হল। তখন হুকুম হল, কেউ যেন অপরের দখল করা জিনিসে হস্তক্ষেপ না করে। আসলে সমস্ত পৃথিবী মসজিদ বা মুসাফিরখানার মত। পথিকদের জন্যে তা ওয়াক্ফ করা হয়েছে। তারা তাতে সকলেই শরীক। এখানে যে আগে আসবে সে আগে পাবে, এ নীতি কার্যকর হবে। আর কারোর কোন জিনিসের মালিক হওয়ার অর্থ, সে তা ভোগ ব্যবহার করার অন্যদের অপেক্ষা বেশী অধিকারী। [(আরবী*********)] এ ভূমিকার পর ‘পূর্ণাঙ্গ মালিকানা’ বলতে আমরা কি বোঝাতে চাই, তা বলব। তা একটা ফিকাহ্শাস্ত্রের পরিভাষা। তাতে দুটো অংশ রয়েছে। এক মালিকানা, দ্বিতীয়টি পূর্ণাঙ্গ। মালিকানা আভিধানিক অর্থ তা করায়ত্ত করা, তার ওপর শক্তি প্রয়োগ করা। কেউ মালিক হয়েছে অর্থ, তা দখল করে নিয়েছে, একার ব্যবহারের অধীন বানিয়েছে। এ আভিধানিক অর্থই শরীয়াতে গৃহীত হয়েছে। ফিকাহ্বিদ কামাল ইবনুল হুম্মাম (****) নামের গ্রন্থে লিখেছেন: (আরবী*********) হস্তক্ষেপ করার- ব্যয়-ব্যবহার করার প্রাথমিক শক্তি, কোন বাধাদানকারী ব্যতীতই। অর্থাৎ এটা সূচনাকারী শক্তি, অন্য ব্যক্তি পর্যন্ত বিলম্বিত নয়্ কিরাফী (****) গ্রন্থে তার সংজ্ঞা দিয়েছেন: (আরবী*********) কোন জিনিসে তার অস্তিত্ব পরিমাণ শরীয়াতী হুকুম, যা যে ব্যক্তিকে তার ব্যবহার বা তার বিনিময় করণের অধিকারী বানানো হবে, তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে— যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে বাধাদানকারী কেউ থাকবে না। ‘সদরুশ্ শরীয়াহ’ সংজ্ঞা দিয়েছেন: কোন জিনিস ও ব্যক্তির মধ্যকার শরীয়াতসম্ম যোগসূত্র যা তাতে নিঃশর্ত হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয় এবং অপর লোকের হস্তক্ষেপ স্থাপনের কথাই বলেছে। অভিধান গ্রন্থসমূহ থেকে যেমন এ কথা জানা যায়, আইনের অভিজ্ঞ লোকেরাও তাই বলেছেন। একটি সংজ্ঞা এই: (আরবী*********) একটা কর্তৃত্ব যা তার মালিককে একটা জিনিস ব্যবহার ও তার থেকে ফায়দা লাভের অধিকারী বানায়- সে সসর্বপ্রকারের ফায়দা সহ যা এ জিনিস থেকে লাভ করা সম্ভব- যা মালিকের জন্যে স্থায়ীভাবে হবে অথবা সঙ্কীর্ণ সময়ের জন্যে হবে। সম্পূর্ণ মালিকানার অর্থ হল, মাল মালিকের হস্তগত, নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে থাকবে। [(আরবী*********)] কোন কোন ফিকাহ্বিদ বলেছেন: মালিকের হাতে মাল থাকাই তার মালিকানা, যাতে অন্য কারোর অধিকার নেই এবং সে নিজ ইচ্ছামত তা ব্যয়-ব্যবহার করতে সক্ষম। তার উপকারিতা বা কল্যাণ তার লব্ধ হবে। [(আরবী*********)] এ কারণে তাঁরা বলেছেন: ব্যবসায়ী যে পণ্য ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করে তা হস্তগত করার পূর্বে তার উপর যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তা করায়ত্ত হয়নি এখনও। যা অপহৃত হয়েছে আর যা দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, তা যখন তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে, তখন তাতেও যাকাত হবে না। নিঃস্ব পথিকের উপরও যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তার প্রতিনিধির হস্ত তার নিজের হস্তের মতই। যাকাত ফরয হওয়ার আর একটি প্রতিবন্ধক হচ্ছে বন্ধক রাখা, যখন সেই দ্রব্যটি ‘বন্ধ রক্ষকের’ হাতে থাকবে, কেননা তা মালিকের হাতে মজুদ নেই। [(আরবী*********)] কোন কোন ফিকাহ্বিদ পূর্ণাঙ্গ মালিকানার শর্ত বলতে বুঝেছেন সুনিশ্চিত নির্ধারণ। যায়দীরা ফিকাহ্ণ এ মত পোষণ করেন। তাঁরা শর্ত করেছেন যে, সমস্ত বছর ধরে নিসাব পরিমাণ মাল নির্দিষ্ট থাকতে হবে। তা মালিকের হাতে থাকতে হবে, তার স্থান জানা থাকতে হবে, তা ধরতে বা আনতে যেন কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে অথবা তার নিজের অনুমতিক্রমে অপর কারোর হাতে থাকবে। সেই ‘অপর কেউ’ নির্ভরযোগ্য হবে, অস্বীকারকারী হবে না অথবা তা এমন হতে হবে যে, তা চাইলেই পাওয়া যাবে- তা পাওয়ার আশা আছে, তাতে নৈরাশ্য নেই। যেমন কোন জিনিস হারিয়ে গেলেও তা ফিরে পাওয়ার আশা থাকে। কিংবা অপহৃত হয়ে থাকলেও তা ফিরিয়ে দেয়ার অথবা বিনিময় দেয়ার নৈরাশ্য থাকবে না। কারো কাছে গচ্ছিত থাকলে তা যদি দিতে অস্বীকার করা হয়, মালিকের কাছে দলীল-প্রমাণ আছে, যার বলে তা পাওয়ার আশা করা যায়। এগুলোকে ‘আশা আছে’ পর্যায়ে গণ্য করতে হবে। কিন্তু কোন মাল যদি আয়ত্তযোগ্য না হয়, ফিরে পাওয়ারওআশা না থাকে, তা কখনও ফিরিয়ে দিলে যে কয়টি বছর তার হাতের বাইরে রয়েছে, ততটি বছরের যাকাত ফরয হবে না। যদি কখনও ফিরে পাওয়া যায়, তাহলে তখন থেকে বছর গণনা শুরু করতে হবে ও তদনুরূপ যাকাত দিতে হবে। এই শর্তটির যৌক্তিকতা এ শর্তটির যৌক্তিকতা হচ্ছে, মালিকানা একটা মহান নিয়ামত। কেননা তা স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাধীনতার ফলশ্রুতি। আর সত্যিকথা হচ্ছে তা মানবতার ফসল। কেননা জন্তু-জানোয়ার কোন কিছুর মালিক হয় না। মানুষই কোন কিছুর মালিক হয়, মালিকত্ব মানুষের মধ্যে শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের চেতনা জাগিয়ে তোলে। তার মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রবণতা তীব্রভাবে বর্তমান, তার চাহিদা পূরণ করে ও মালিকত্ব। পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বই মানুষকে মালিকানাধীন জিনিস ভোগ-ব্যবহার করার এবং তার নিজের তার প্রতিনিধির পক্ষে তার প্রবৃদ্ধি সাধন ও তার উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার অধিকার দেয়। এ নিয়ামতটি যে পেয়েছে, এ পাওয়ার জন্যে তার উচিত শোকর আদায় করা। তাই ইসলামযদি তার মালিকের কাছে যাকাতের দাবি করে, তবেতা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না। অতএব মালিকানাধীন ধন-মালের হক আদায় করা মালিকের কর্তব্য। এ হক আদায় করার জন্যেই যাকাত দিতে হবে। এই শর্তের দলীল এই শর্তটি আরোপের দুটি দলীল রয়েছে। প্রথম- কুরআন ও সুন্নাহ্তে ধন-মালকে তার মালিকের জিনিস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে: ‘তাদের ধন-মাল’ থেকে যাকাত গ্রহণ কর। ‘তাদের ধন-মালে’ হক রয়েছে: হাদীসের কথা: (আরবী*********) ‘আল্লাহ্ তা’আলা ‘লোকদের ধন-মালে’ তাদের উপর ফরয করেছেন’ ..... ‘তোমরা তোমাদরে ধন-মালের’ দশভাগের চারভাগের এক ভাগ দিয়ে দাও। এ সব কথা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আল্লাহ নিজেই সব ধন-মালের মালিক হয়েও ‘মানুষের ধন-মাল’ বলে দিয়েছেন। অন্য কথায় তিনিই মানুষকে সে সবের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। তাদের মাল’ ‘তোমাদের মাল’ কথাগুলোই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ ধরনের কথা তখনই বলা চলে, যখনমানুষ তার বিশেষভবে মালিকহয়। তার ফলে সেই বিশেষ জিনিসের ক্ষেত্রে সে অন্যদের থেকে বিশিষ্ট হয়ে পড়ে। সেই জিনিস ভোগ-ব্যবহার করার কেবল তারই অধিকার হয়ে যায়। দ্বিতীয়- যাকাত বলতে বোঝায়, যারা পাওয়ার উপযুক্ত ও অধিকারী তাদেরকেতার মালিক বানিয়ে দেয়া। পাওয়ার উপযুক্ত ও অধিকারী যারা, তাদের কথা কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। আর ‘মালিক বানানো’ মালিকানারই প্রশাখা মাত্র। যে নিজে কোন কিছুর মালিক সে-ই অন্যকে সেই জিনিসের মালিক বানিয়ে দিতে পারে। যে তা নয়, সে তা পারেও না। এ শর্তের আনুসঙ্গিক কথা যে ধন-মালের নির্দিষ্ট মালিক নেই: যে ধন-মালের নির্দিষ্ট কোন মালিক নেই, তার যাকাত নেই। যেমন সরকারায়ত্তাধীন ধন-মাল।সরকার নিজেই যাকাত ও কর ইত্যাদি আদায় বা সংগ্রহ করে। কাজেই তার আয়ত্তাধীন ধন-মালের যাকাত ফরয নয়। তার কারণ, তার কোন নির্দিষ্ট মালিক নেই। তা সমগ্র জাতির মিলিত সাধারণ বিত্ত-সম্পত্তি। তা ছাড়া সরকারই যাকাত সংগ্রহের অধিকরী। তাই তার উপর যাকাত ফরয হওয়ার কোন অর্থ হয় না। এ কারণেই বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: ‘ফাই’ মালে যাকাত নেই। গনীমতের এক-পঞ্চমাংশেও যার মালিক সরকার-তারও যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা তো মুসলিম জনগণের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। সর্বসাধারণের সমান অধিকারের বিত্ত-সম্পত্তির ক্ষেত্রেও এই কথা। [(আরবী*********)] ওয়াক্ফকৃত জমি সাধারণভাবে ওয়াক্ফকৃত জমিবা জিনিসের উপর কোন যাকাত নেই। গরীব, মিসকীন, মসজিদ, মুজাজিদ, অথবা ইয়াতীম, কিংবা মুসাফিরখানা, মাদরাসা প্রভৃতির জন্যে ওয়াক্ফত করা জমি বা জিনিস সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য। কেননা এ কাজ জনকল্যাণমূলক। অতএব সহীহ্ কথা হচ্ছে তাতে যাকাত ধার্য হবে না। কিন্তু যা কোন নির্দিষ্ট এক বা সমষ্টির জন্যে ওয়াক্ফক করা হয়েছে, যেমন কারোর পুত্র বা সন্তানাদি অথবা একটা নির্দিষ্ট গোত্রে লোকদের জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়, তাতে যাকাত ধার্য হওয়া সহীহ কথা। কেননা ওয়াক্ফ করা সম্পদ সম্পত্তির ক্ষেত্রে মালিকানা হস্তান্তরিত হয় যার জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়েছে তার প্রতি। সে-ই তার স্থায়ী মালিকহয়ে বসে, ঠিক যেন তা ওয়াক্ফ হয়নি এমনি। [(আরবী*********)] কিন্তু সে মূল ওয়াক্ফ করা সম্পত্তির উপর কোন যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মালিকত্বের স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে মালিক অন্যদের তুলনায় তা ব্যয়-ব্যবহার করার অধিকারী। তাকে তার থেকে উৎখাতও কেউ করতে পারে না। কোন কোন ফিকাহ্বিদ মত দিয়েছেন যে, প্রতিটি ওয়াক্ফ সম্পত্তির উপরই যাকাত ফরয। তা সাধারণভাবে ওয়াক্ফ করা হোক কিংবা বিশেষভাবে ইবনে রুশ্দ বলেছেন, মিসকীনের উপর যাকাত ফরয- এ কথা বলার কোন অর্থ নেই, যদি জমিবা অন্য কিছু তাদের জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়। কেননা তাতে দুটি জিনিসের সমাবেশ ঘটে। িএকটি, তা অসম্পূর্ণ মালিকানা, দ্বিতীয়- তা যাকাত ব্যয়ের জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহের কোন প্রকারের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে ওয়াক্ফ করা হয়নি। যাদের উপর যাকাত ফরয, তারা তাদের মধ্যেও নয়। [(আরবী*********)] হারাম সম্পদের যাকাত হয় না যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে মালিকানা শর্ত বিধায় ঘুষ বা হারাম কোন উপায়ে অর্জিত সম্পদ বা সম্পত্তিতে যাকাত ফরয হতে পারে না। পরস্পরাপহরণ, চুরি, মিথ্যা বা প্রতারণা, সুদ, মজুদকরণ, ধোঁকাবাজি বা ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদও এ পর্যায়ে গণ্য। কেননা এগুলো বাতিল পন্থায় লোকদের মাল গ্রহণের ব্যাপারে যা কুরআনে নিষিদ্ধ। অত্যচারী রাজা-বাদশাহ্ ও চরিত্রহীন রাজন্যবর্গের ধন-সম্পদের ক্ষেত্রেও এ কথা। কেননা তারা এ সব সম্পদের প্রকৃত মালিক নয়। তারা যদি তাদের হালাল মালকে তার সাথে মিশ্রিত করে এবং তা আলাদা করা সম্ভব না হয়, তাহলেও যাকাত হবে না। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, খারাপ (হারাম) মাল নিসাব পরিমাণের হলেও তার উপর যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তা প্রকৃত মালিকের সন্ধান পাওয়া গেলে তার বা তার উত্তরাধিকারীর কাছে তা ফেরত দেয়াই তার কর্তব্য। আর তার সন্ধান পাওয়া না গেলে তা দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হবে। এক্ষণে সবকিছুই ‘সদকা করে দিতে হবে। তার কতকাংশ দান করলে কোন লাভ হবে না। [ ইবনে নজীম লিীখত (******) এবংইবনে আবেদীন লিখিত তার টীকা ২য় খণ্ড, ২২১ পৃঃ এ পর্যায়ে ইমাম আবূ হানীফা (র) মনে করন- কেউ যদি কিচু পরিমাণ টাকা অপহরণ করে ও তার নিজের টাকার সাথে তা মিশ্রিত করে তাহলে মনে করতে হবে, সেতা খরচ করে ফেলেছে। সেতা মালিককেফিরিয়ে দেয়ার জন্যে দায়ী থাকবে। অবশ্য ইমাম ইউসুফ ও মুহাম্মাদের মতে দায়ী হবে না। কেননা সেখানে মালিকানাই প্রমাণিত নয়; তা সম্মিলিত সম্পদ। তার উপর যাকাত ফরয হবে না।] হারাম মালের যাকাত না নেয়ার যুক্তি স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা তো দাতার নিজের মালিকানাভুক্ত সম্পদ নয়। তাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করাই নিষিদ্ধ। যাকাত দেয়াও এক প্রকারের হস্তক্ষেপ। তা গ্রহণ করা হলে তার অবস্থা এই দাঁড়াবে যে, তা একদিক দিয়ে আদিষ্ট ও অপর দিক দিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তুতা সম্ভব। [(আরবী*********)] সারকথা, হারাম মালের মালিক শরীয়াতের দৃষ্টিতে ধনী প্রমাণিত নয়। তা স্তূপাকারে হলেও এবং তা দীর্ঘদিন ধরে একজনের মালিকানাভুক্ত থাকলেও। ইমাম সারাখ্শীর মতে সে মাল জালিম রাজা-বাদশাহ্কেও দিয়ে দেয়া যেতে পারে। তিনি এদেরকে ‘দরিদ্র’ গণ্য করেছেন। কেননা তাদের হাতে যে ধন-মাল রয়েছে তা তো মুসলিম জনগণের, তাদের নিজেদের নয়। তা যদি ফিরিয়ে দেয়, তা হলে তাদের কাছে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে তারা দরিদ্রতম ব্যক্তি হয়ে যাবে। [(আরবী*********)] মুহাম্মাদ ইবনেমুসলিমা বলেছেন, খোরাসানের শাসক আলী ইবনে ঈসা ইবনে হামানকে যাকাত দেয়া জায়েয, বলখের আমীরের উপর কাফ্ফারা দেয়া ওয়াজিব হয়েছিল। তাঁকে ফতওয়া দেয়া হয়েছিল তিন দিনের রোযা রাখার। তা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। বলেছিল: যার কিছুই নেই, তার যা কাফ্ফারা, আমাকেও সেই কাফ্ফারা দিতেবলা হচ্ছে। [পূর্বোল্লিখিত উৎস। ইবনুল হুম্মাম বলেছৈন, এ কাফফারা জরুরী নয়।] ইবনুল হুম্মাম বলেছেন, ওদের নিজের মাল এবং যা অন্যদের কাছ থেকে নিয়েছে তা মিলিয়ে-মিশিয়ে ফেলেছে, এক্ষণে উভয়ের মধ্যে পার্থক্র করা সম্ভব না হলে ইমাম আবূ হানীফার মতে তা নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। তখন সে তার মালিক হয়ে বসেছে। অতএব তাকে তার ক্ষতপিূরণ দিতে হবে। এমনকি তার উপর যাকাত ফরযও বলা হয়েছে। কোনরূপ ক্ষতি ব্যতিরেকেই তার উত্তরাধিকার কার্যকর হবে। কেননা অনুরূপ পরিমাণ মাল ফেরত দেয়া তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। আর যার হাতে যত পরিমাণ মাল আছে সে সেই পরিমাণ মালের ঋণগ্রস্ত হলে সে তো দরিদ্র ব্যক্তি। এই ফতওয়ার আলোকে যে কথাটি প্রতিভাত হচ্ছে তা হল, হারাম মালের মালিক হওয়া যায় না। তা গ্রহণকারীর জন্যেও শুভনয়। তার উত্তরাধিকারীদের জন্যেও নয়। তবে উপরিউক্ত ধরনের জালিম শাসক-প্রশাসকের দান করেদেয়া- এজন্যে যেতারা প্রকৃতপক্ষেদরিদ্র কিংবা ঋণগ্রস্ত আদৌ জায়েয নয়। কেননা যে দরিদ্র ব্যক্তি অর্থ সাহায্য পেয়ে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজ বেশী করবেবলে আশংকা হবে, তাকে যাকাতের মাল দেয়াই জায়েয নয়। অনুরূপভাবে যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি টাকা পেয়ে নাফরমানীর কাজে লিপ্ত হয় তা থেকে তওবা না করে, যাকাতরে অংশতাকে দেয়াও অবৈধ। যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র পর্যায়ে আমরা এ বিসয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ঋণের যাকাত ঋণের যাকাত পর্যায়ের আলোচনা এ শর্তের প্রসঙ্গেই আসে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যক্তি মালের প্রকৃত ঋণদাতা, সে যাকাত দেবে, না গ্রহণকারী দেবে? যে সেমাল ব্যয় করছে এবং তা দিয়ে ফায়দা পেয়েছে অথবা উভয়ই সে দায়িত্ব থেকে মুক্ত? কিংবা উভয়েই সে যাকাত দিতে বাধ্য? উভয়েই ঋণের টাকার যাকাত দেবে, একথা কেউ বলেন নি। ইকরামা ও আতা প্রমুখ ফিকাহ্বিদ বলেছেন, কাউকেইসে টাকার যাকাত দিতে হবে না। ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেছেন, ঋণগ্রহণকারীকে ঋণেরযাকাত দিতে হবে না। আর ঋণ-দাতা- টাকার আসল মালিক তার যাকাত দেবে যখন তা সে ফেরত পাবে। [(****) ইমাম মালিকের ছাত্র ইবনুল কাসেম বলেছেন, অহহরণকারী যখন মাল অপহরণ করেছে তখন তার দায়িত্ব সে ফেরত দিতে বাধ্য। অতএব তার উপর যাকাত ধার্য হবে।] ইবনে হাজম হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ঋণ দেয়া টাকার যাকাত নেই অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাকেতার যাকাত দিতেহবে না। যাহেরী মাযহাবের এটাই মত। তার কারণ, এ টাকার মালিকত্ব উভয়ের ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ। ঋণগ্রহীতার হাতে ঋণ করা টাকা এলেও সে তার প্রকৃত মালিক নয়। তার দখলে তা থাকলেও এ দখলটা মালিকত্বের নয়, যদিও সেতা ব্যয়-ব্যবহার করছে। এ টাকা তো মূলত ঋণদাতার। সে যখনই চাইবে, তা ফেরত দিতে হবে। আর ঋণদাতা যাকাত দেবেনা এজন্যে যে, টাকা তো তার হাতে নেই। অন্য লোকে তা ব্যয়-ব্যবহার করছে। অতএব, তার মালিকত্বও সম্পূর্ণ নয়। ‘কিতাবুল আমওয়াল’-এ ইমাম নখরী’র মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঋণের টাকার রস ভক্ষণকারীকেই তার যাকাত দিতে হবে। কেউ যদি ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়, যে ব্যবসায়ী তা বৃদ্ধি করে তা দিয়ে ফায়দা পায় ও ফিরিয়ে দিতে বিলম্ব করে, তার যাকাত তাকেই দিতে হবে। এ কথাটি বলা হল যার হাতে মাল রয়েছে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে; যে তার আসল মালিকতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নয়। অথচ তা পূর্ণাঙ্গ মালিকত্ব ধারণার পরিপন্থী। আর এ পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বের ব্যাপারটিতে সব ফিকাহ্বিদই সম্পূর্ণ একমত। সম্ভবত ঋণগ্রহীতার উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে এজন্যে যে, সে তা ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করে। সাহাবী ও তৎপরবর্তীকাল থেকে অধিকাংশ ফিকাহ্বিদ মনে করেন যে, ঋণ দুই প্রকারের: ১. এমন ঋণ যা আদায় হওয়ার ও ফিরিয়ে পাওয়ার আশা আছে। মেযন একজন সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে, সেতা স্বীকারও করে, তার কাছ থেকে তা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়ই আশা আছে। এরূপ অবস্থায় সে অর্থাৎ ঋণদাতা তার ও তার অন্যান্য হস্তস্থিত মালামালের যাকাত দেবে। এ কথাটি হযরত উমর, উসমান, ইবনেউমর ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত। জারির ইবনে যায়দ, মুজাহিদ, ইবরাহিম ও মায়মুন ইবনে মাহরান প্রমুখ তাবেয়ীও এ মত পোষণ করেন। ২. দ্বিতীয় প্রকার ঋণ হল যা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই। হয়ত ঋণগ্রহীতা খুব অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে, তা সচ্ছলতার কোন সম্ভাবনা নেই। অথবা সে ঋণের কথা অস্বীকার করেছে কিংবা সে ঋণের প্রমাণপত্র কিছু নেই। এরূপ অবস্থায় কি করা হবে, সে পর্যায়ে কয়েকটি মত ব্যক্ত হয়েছে: প্রথম ঋণেল টাকা যে কয় বছর পর ফেরত পাওয়া যাবে, তখনই সেই কয় বছরের যাকাত এক সাথে দিয়ে দেবে।হযরত আলী ও ইবনে আব্বাসএ মত দিয়েছেন। দ্বিতীয়, ফেরত পাওয়ার মাত্র এক বছরের যাকাত দেবে। হাসান ওউমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ এ মত দিয়েছেন। আর সর্ব প্রকারের ঋণের ক্ষেত্রে তা ফেরত পাওয়ার আশা থাক আর নাই থাক; ইমাম মালিকের এটাই মত। তৃতীয়, অতীত বছরগুলোর কোন যাকাত দিতে হবে না, সেই বছরেরও যাকাত দিতে হবে না- যে বছর ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় এ মত প্রকাশ করেছেন। ঠিক যেমন নতুন পাওয়া মালের বছরটি গণনা করা হয়, এখানেও তাই করতে হবে। ইমাম আবূ উবাইদ এ মত পোষণ করেন। তিনি হযরত উমর, উসমান, জাবির ও ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত উচ্চমানের হাদীসমূহের ভিত্তিতে বলেছেন, যে মালিক তার নিজহাতে বর্তমান ধন-মালের সাথে তারও যাকাত প্রতি বছরই দেবে যদ্দিন সে ঋণ ধনশালী লোকদের উপর ধার্য থাকবে। কেননা তার প্রাপ্য টাকা তো তার নিজের হাতে ও ঘরে রক্ষিত ধন-মালের মতই। এ ভয়ে সতর্কতা স্বরূপ ঋণের টাকার যাকাত তা ফেত পাওয়া পর্যন্ত বিলম্বিবত করার পক্ষে ইমাম আবূ উবাইদ মত দিয়েছেন। তাই ঋণের টাকার যে অংশই প্রত্যর্পিত হবে তারই যাকাত দিতে হবে। আর যে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই কিংবা নৈরাশজনক, সেক্ষেত্রে হযরত আলীও ইবনে আব্বাস (রা)-এর মত অনুযায়ী আমল করতে বলেছেন। আর তা হল, খুব তাড়াহুড়া করে যাকাত দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যখন তা নিজের হাতে ফেরত পাওয়া যাবে তখনই যাকাত দিতে হবে অতীত বছরগুলোর বাবদ, যেহেতু তা তার মালিকানায়ই রয়ে গেছে। তা হলে তার উপর আল্লাহ্র যে হক ধার্য তা নকচ হবে কেমন করে? মালিকত্ব তো সেই আল্লাহ্র কাছ থেতেই প্রাপ্য। [আল-আমাওযাল, পৃঃ ৪৩৪-৩৫] ফেরত পাওয়ার আশা আছে যে ঋণ, তাতে আবূ উবাইদের মতকে আমরা সমর্থন করি। কেননা তা তো তার হাতের সম্পদের মতই। কিন্তু যে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার আশা নেই, তা তার মুল মালিকানায় থাকলেও তার যাকাত দিতে হবে না। কেননা তার হাতে নেই। এমতাবস্থায় তার উপর তার মালিকত্ব অসম্পূর্ণ। আর অসম্পূর্ণ মালিকত্ব সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ নিয়ামত নয়। যাকাত তো সেই পূর্ণাঙ্গ মালিকানার উপরই ধার্য হয়, যার সাথে অপর কারোর হক সম্পৃক্ত নয় এবং সে নিজ ইচ্ছামত তা ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে। [(আরবী*********)] পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বের দাবি হচ্ছে, মালিকতার মালিকানা ধন-সম্পদ সম্পত্তি নিজ ইচ্ছানুযায়ী ব্যয়-ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। উপরিউক্ত অবস্থায় তা বাস্তবায়িত নয়। ফেরত পাওয়ার আশা নেই, এমন ঋণের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা এবং তাঁর সে সম্পর্কেও এই কথা। কেননা যে সব ধন-সম্পদের মালিকতো ভোগ-ব্যবহার করতে পারে না, তার দরুন সে ধনী বলে গণ্য হবে না। আর যাকাততো কেবল ধনী ব্যক্তিদের উপর ধার্য হয়ে থাকে। [(আরবী*********)] যেসব ঋণ ফেত দিতে অস্বীকার করা হয়েছে বা ফেরত পাওয়ার আশা নেই তার ক্ষেত্রে আমরা ইমাম আবূ হানীফার মত সমর্থন করি। আর সাধারণব্যবহারের অযোগ্য ধন-মাল যখন হস্তগত হবে তখন তা নতন প্রাপ্ত ধন-মালের মতই গণ্য হবে।কাজেইঅতীত বছরগুলোর যাকাতদিতে হবেনা। যদিও আমরা হাসান, উমর ইবনে আবদুল আযীয ও ইমাম মালিকের এই মতকে অগ্রাধিকার দিতামযে তা ফেরত পাওয়া গেলে এক বছরের মালিক হয়েব্যয়-ব্যবহার করার সময়ই তার যাকাত দিতে হয় তাতে এক বছর অতীত শর্ত থাকবে না। এ বিষয়ে আমরা যথাস্থানে বিস্তারিত বলব। চাকরীজীবিদের বেতন ও সঞ্চয় এ পর্যায়ে সাধারণত একটি প্রশ্নই উঠে। চাকুরীজীবিরা সরকার বা প্রতিষ্ঠান-সমূহে যেখানে তারা কাজ করে- তাদের নগদ পাওনা জমা হয়ে থাকে। তা তাদেরই প্রাপ্য বটে অথবা তাদের হিসেবেই তা সঞ্চয় ও জমা করে রাখা হয়।তারকি যাকাত দিতে হবে? এর জবাব এ সম্পদের প্রকৃতি ও অবস্থার নির্ধারণের উপর নির্ভরশীল। প্রথমেই টিককরতে হবে, তা চাকুরীজীবিদের পূর্ণ মাত্রায় মালিকত্বের অধীন কি-না? অর্থাৎ তারা কি তা যখন ইচ্ছা তখন ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে? কিংবা পারে না? তাতাদেরই হক, না তা সংশ্লিষ্ট সরকার বা প্রতিষ্ঠানের অনুগ্রহের দান? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তা হস্তগত না পাওয়া পর্যন্ত তার উপর মালিকত্ব কার্যকর হয় না। আর যদি তা চাকুরীজীবির অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে তা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান অকেজো করে রাখতে পারে না। সে যখনই ইচ্ছা করবে, তা সে ব্যয়-ব্যবহার করতে পারবে। কাজেই আমার মতে তার উপর তার পূর্ণাঙ্গ মালিকানা স্থাপিত। আর তা এমন ঋণ, যা ফেত পাওয়ার আশা রয়েছে। ইমাম আবূ উবাইদ এ পর্যায়ে বলেছেন: এই সম্পদ যেন তার হাতেই মজুদ রয়েছে এমন। কাজেই তার উপর প্রতি বছরই যাকাত ফরয হবে, যদিতার পরিমাণ নিসাব সমান হয় এবং অন্যান্য শর্তও মজুদ থাকে। [কিন্তু ইমাম মালিকের মত হলো- এই সম্পদের উপর যাকাত ধার্য হবে তখন, যখন তা তার হাতে আসবে। তখন মাত্র এক বছর যাকাত দিলেই অতীতের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।] তাঁরা বলেছেন, বৃদ্ধিশীল সম্পদ দু’রকমের। একটা প্রকৃত, অপরটা পরিমাণগত। প্রকৃত প্রবৃদ্ধি জন্ম-প্রজনন, বংশবৃদ্ধি, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি হচ্ছো তা এমনভাবে বেড়ে যাওয়া যে, তার গ্রহণকারীর বা তার প্রতিনিধির হাতে তা বৃদ্ধি পাবে। [(আরবী*********)] প্রবৃদ্ধি শর্ত করার যৌক্তিকতা ইবনুল হুম্মাম বলেছেন, যাকাত ফরয করার আসল উদ্দেশ্য যদিও সম্পদ-মালিককে পরীক্ষা করা; কিন্তু সেই সঙ্গে দরিদ্রদের দারিদ্র্য মোচনও তার অন্যতম লক্ষ্য এবং তা এমনভাবে, যেন সে নিজে দরিদ্র হয়ে না যায়। সে তার অতিরিক্ত সম্পদ থেকেই একটা অংশ দেবে মাত্র। তাই যে সম্পদ মূলত প্রবৃদ্ধিশীল নয়, তার উপর যাকাত ফরয করা হলে পর পর বছরগুলোতে যাকাত দেয়াটা তাই বিপরীত পড়ে যাবে। বিশেষত খরচের প্রয়োজন দেখা দিলে তা অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে।[(আরবী*********)] এই প্রেক্ষিতে রাসূলে করীম(স)-এর বাণীটির যথার্থতাপ্রকাশিত হয়: (***) যাকাত দিলে মূল সম্পদের ঘাটতি পড়ে না। [(আরবী *********)] কেননা যাকাত বাবদ যে অল্প পরিমাণ মালদিয়ে দেয়া হয় বিপুল পরিমাণ সম্পদ থেকে, তা তো ক্রমবৃদ্ধিশীল। তা কখনই ঘাটতি সৃষ্টি করে না। এটাই আল্লাহ্র নিয়ম। এ পর্যায়ে লক্ষ্যকরার বিষয় হচ্ছে, মাল মূলত বৃদ্ধিশীল কিনা, তাতে প্রবৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য আছে কিনা। কার্যত তা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা, তা বিবেচ্য। যেহেতু শরীয়াতে কার্যত প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব নেই। কেননা এভাবে করতে গেলে তা কোন সীমায় সীমিত করা সম্ভবপর হবে না এবং তাতে অপরিমেয় মতভেদ দেখা দেবে। ইমাম কাসানী লিখেছেন, যাকাত মানেই প্রবৃদ্ধি। তাই তা ক্রমবৃদ্ধিশীল সম্পদ থেকেই নেয়া হবে। আমরাও এই কথার যথার্থতা স্বীকার করছি। মূল সম্পদের বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা থাকাই যথেষ্ট। তা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেহতে পারে, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে পশু পালনের মাধ্যমেওহতে পারে। কেননা গাভীকে ঘাস খাওয়ালে তার দুগ্ধ পাওয়া যাবে, তার বাচ্চা হবে, দুগ্ধ দিয়ে মাখন তৈরী হবে। তার ব্যবসা করে মুনাফা লাভকরাযায়। তখন মুনাফা লব্ধ সম্পদ মূল সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। আর তার উপরও যাকাত ফরয হয়। [তিরমিযী, আবূ কাবশা-আল-আসমায়ী বর্ণিত হাদীসের অংশ। হাদীসটি হাসান ও সহীহ্] আমলও এই সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নবী করীম (স) ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে সংগ্রহীতি মাল-সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করেন নি। নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী*********) মুসলিম ব্যক্তির নিজ ব্যবহার্য ঘোড়া ও ক্রীতদাসের উপর কোন যাকাত নেই। ইমাম নববী বলেছেন: এই হাদীসটির মূল কথা হল, নিজ ব্যবহার্য দ্রব্য-সম্পদের উপর যাকাত হয় না। [সহীহ মুসলিম: ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৫] নবী করীম (স) কেবলমাত্র ক্রমবর্ধনশীল বা বর্ধনপ্রবণ সম্পদের উপরই যাকাত ধার্য করেছেন। তদানীন্তন সময়ে আরব দেশেএই পর্যায়ের বহু প্রকারের সম্পদ মজুদ ছিল। তন্মধ্যে উট, গরু ও ছাগল, স্বর্ণ ও রৌপ্য-ব্যবসায়ে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হত, অনেকেতা পুঁজি করেও রাখত। ফল ও ফসর- যব, গম, খেজুর, কিশমিশ, মনাক্কা প্রভৃতি উল্লেখ্য। মধুও এ পর্যায়ে গণ্য। পূর্বের লোকদের মাটির নীচে জমা করে যাওয়া সম্পদ, যখন তা হস্তগত হবে। খনিজ সম্পদ এ পর্যায়ে গণ্য। পূর্বের লোকদের মাটির নীচে জমা করে যাওয়া সম্পদ, যখন তা হস্দগত হবে। খনিজ সম্পদওও এ পর্যায়ে গণ্য, -যদিও তা ‘ফাই’ গণ্য হবে না যাকাত ধার্য হওয়ার ক্ষেত্রে গণ্য হবে, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। শরীয়াতের আইন-বিধানের মূল কারণ নিহিত আছে, এ কথায় বিশ্বাসী ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, উপরোল্লিখিত দ্রব্য-সামগ্রীর উপর যাকাত ফরয হওয়ার কারণ হল সেগুলোর কার্যত প্রবৃদ্ধি। অথবা প্রবৃদ্ধি প্রবণ। গৃহপালিত পশু কার্যত বৃদ্ধিশীল। তা পরিপুষ্ট ও মোটা হয়, বাচ্চা দেয়, দুগ্ধ দেয়। এদের প্রবৃদ্ধি স্বভাবসম্মত ও স্বাভাবিক। আর তার ফলে পশু সম্পদও বৃদ্ধি পায়। গোশ্ত ও দুগ্ধের কথা তো না বললেও চলে। ব্যবসা পণ্যও কার্যত ক্রবর্ধনশীল। কেননা ব্যবসায়ে মুনাফা লাভ একটা সাধারণ ব্যাপার। যদিও তা পশু সম্পদ বা কৃষি সম্পদের মত ক্রমবৃদ্ধিশীল নয়। তা শৈল্পিক প্রবৃদ্ধি, স্বাভাবিকতার সাথে সাদৃশ্য সম্পন্ন। িইসলাম এই প্রবৃদ্ধিকে শরীয়াতসম্মত ও হালাল ঘোষণা করেছে। আজ পর্যন্তকার সব ধর্ম রাষ্ট্রীয় আইন ও মানবীয় বুদ্ধি-বিবেকও তা-ই গণ্য করেছে। নগদ অর্থ ও বৃদ্ধিমান সম্পদ। তা পণ্যের বিকল্প বিনিময় মাধ্যম দ্রব্য সমূহের মূল্য নির্ধারণের মান। তা যখন শিল্প ও ব্যবসা ইত্যাদিতে বিনিয়োগকৃত হবে, তখনমুনাফা দেবে। আর এই প্রবৃদ্ধি কাম্য। এই নগদ অর্থ যদি পুঁজি করা হয় তখন উৎপাদন বিনিময় ও আবর্তনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পালন থেকে তাকে আটকে রাখা হয়, তাহলে একটা সামগ্রিক অচলাবস্থা দেখা দেবে। পুঁজিকারী ব্যক্তি সেজন্যে দায়ী হবে; এ ঠিক একটা সুস্থ সবল ও কল্যাণকদায়ক যন্ত্রকেঅচল করে রাখার মত অবস্থা। ইসলামী শরীয়াত এ অবস্থা থেকেমুক্ত রাখারজ্যে নগদ অর্থ-সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছে- যেন তা কার্যত বৃদ্ধি লাভ করতে পারে। তাহলে মালিক নিজে এবং গোটা সমাজ তা থেকে উপকৃত হতে পারবে। কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি মূলত বৃদ্ধিমান। তা নব উৎপাদনে সক্ষম। মধু, সঞ্চিত ধন ও খনিজ দ্রব্যও তাই। ফিকাহ্বিদগণ নবী করীম (স)-এর কাছ থেকে পাওয়া হিদায়াতের ভিত্তিতেই এ শর্তটি আরোপ করেছেন। খুলাফায়ে রাশেদুনের কার্যাবলীও তা৭দের সম্মুখে প্রতিভাত। ‘যাকাত’ শব্দটি এই ভাবধারাসম্পন্ন। কেননা তার প্রকাশ্য অর্থই হল প্রবৃদ্ধি বা বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, সম্পদ থেকে গ্রহীত পরিমাণটিকে যাকাত বলা হয় এজন্যে যে, তার চূড়ান্ত পরিণতিই হচ্ছে বরকত ও বৃদ্ধি। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা এ ওয়াদাই করেছেন: (আরবী*********) তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্যে ব্যয় করবে পরে তিনি তা এনে দেবেন। (আরবী*********) তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে যাকাত দাও, সেই দাতারাই আসলে তাদের মাল-সম্পদ বৃদ্ধি করে। তার আরও একটা দিক প্রকট। যাকাত আদায় করা হবে কেবলমাত্র সেসব ধন-মাল থেকে যা ক্রমবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত। এ কারণে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা প্রবৃদ্ধির কাজে লিপ্ত নয়। অনুরূপভাবে যেসব মাল-সম্পদ অপহৃত বা বিনষ্ট হওয়ার দরুন প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত হতে পারছে না, তাতেও যাকাতফরয হয় না। বলা যায়, ধন-মাল প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়েঅজিত হতে পারছে না, তাতেও যাকাত ফরয হয় না। বলা যায়, ধন-মাল প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত কর এবং এই প্রবৃদ্ধি প্রাপ্ত সম্পদ থেকে যাকাত দাও। প্রথম যুগ থেকেই মুসলিম সমাজ এই শর্তারোপ সম্পূর্ণ ঐকমত্যে কাজ করে এসেছে। নিজের ব্যবহার্য যানবাহন, বসাবসের ঘর, দালান-কোঠা, শিল্পী-কারিগরের যন্ত্রপাতি, ঘরের ব্যবহার্য দ্রব্যসম্ভার প্রভৃতির উপর যাকাত ধার্য নয়, তেমনি তার যোগ্যতাও নেই। এর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেলোকজন এও বলেছেন যে, যে লোক নিজের বা তার প্রতিনিধি তার ধন-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়, তাতেও যাকাত দিতে হয় না। যেসব মাল ফিরে পাওয়ার আশা নেই, তাতেও যাকাত নেই। পাওয়ার আশা থাকলে অবশ্য যাকাত হবে। যে মাল ব্যবহারের সুযোগ নেই-সামর্থ্য বহির্ভূত, তার উপর মূল মালিকত্ব বহাল থাকলেও তাতে যাকাত দিতে হয় না। যাকাতের মালে প্রবৃদ্ধির শর্ত আরোপের দরুন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদির যাকাত বছর আবর্তিত হওয়ার দরুন বার-বার দিতে হবে না। যেমন কৃষি ফল-ফলাদিতে ওশর ফরয হয় কিন্তু তাতে অতঃপর আর কিছুই ফরয হবে না, তা মালিকের হাতে কয়েক বছর পর্যন্ত মজুদ হয়ে থাকলেও। কেননা যাকাত তো বর্ধনশীল ধন-মালে ধার্য থাকে। আর যেসব ফসল ও ফল সঞ্চয় করে রাখা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিবঞ্চিত। ক্রমশ ধ্বংস ও বিনাসমান। প্রবৃদ্ধির শর্ত আরোপে ইমাম মালিকের মত অধিক প্রশস্ত। কেননা ঋণ বাবদ দেয়া সম্পদে- যা অন্য লোকের কাছে পাওনা- তিনি যাকাত ফরয মনে করেন না। তবে তা যখন ফেরত পাবে, তখন তাতে যাকাত ধার্য হবে এক বছরের মাত্র। অপহৃত ও মাটির তলায় গচ্ছিত মাল- যার সন্ধান নেই এর যাকাত দিতে হয় না। যেসব মাল বিনষ্ট হয়ে গেছে কিংবা মালিকানাচ্যুত হয়ে গেছে, তারও যাকাত নেই। তা ফেরত পাওয়া গেলে মাত্র এক বছরের যাকাত দিতে হবে। সর্বপ্রকারের ঋণ বাবদ দেয় সম্পদের বেলায়ই এ নিয়ম। তবে যেসব ব্যবসায়ী পণ্য ক্রয় করে ও নগদ মূল্যে বিক্রয় করে, তাদের দেয়া ঋণ যেহেতু আতায় হবে বলে আশা আছে, এজন্যে সেঋণের ব্যাপার স্বতন্ত্র। এসব ঋণ নগদ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত বলে তাতে অবশ্যই প্রতি বছর যাকাত ধার্য হবে। ঋণ বাবদ দেয়া টাকার যাকাত ফরয না হওয়া পর্যন্ত মালিকী মতে যুক্তি হল তাঁর উপর যাকাত ফরয হতে পারে না। যেসব ব্যবসায়ী পণ্য কিনে পুঁজি করে রাখে ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে, তারা সেই সব জমি ক্রয়কারীর মত, যারা জমি খরিদ করে তার মূল্য বৃদ্ধি পাবে এই আশায়। তাদের পণ্যের উপর প্রতিবছর যাকাত ধার্য হবে না। তারা যেসব নিসাপ পরিমাণ যদি বিক্রি করে তবে তার উপর যাকাত হবে এক বছরের জন্যে, যদিও তা তার হাতে বিক্রয়ের পূর্বে বেশ কয়টি বছর ধরে পুঁজিকৃত হয়েছিল। কেননা এসব আটকে রাখা পণ্য একবারই মাত্র মুনাফা দিয়েছে। তাই একবারই যাকাত ফরয হবে।[(আরবী*********)] বর্ধনশীলতা রহিত সম্পদ যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে সম্পদের বর্ধনশীলতা যখন শর্ত, তখন যে মাল-সম্পদ বর্ধনশীলতা রহিত, সে সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত হবে? তাতে কি যাকাত ফরয হবে? যদি হয় তাহলে বছরের আবর্তনের সাথে সাথে যাকাত দেয়ার দরুন মুল সম্পদই নিঃশেষহয়ে যাবে, নাকি তা যাকাত মার্যনা পাবে? বস্তুত তাহলে তা অবশিষ্ট থাকতে পারে। এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, বর্ধনশীলতা রহিত মাল-সম্পদ দুই প্রকারের হতে পারে: প্রথম, যেসব মাল স্বতঃই বর্ধন-রহিত। আর দ্বিতীয, মালিকের অক্ষমতার দরুন বর্ধনশীলতা থেকে বঞ্চিত। যেসব ধন-মাল স্ততঃই বর্ধনশীলতা রহিত, যেমন তা লুণ্ঠিত বা অপহৃত হয়েছে; কিন্তু তার কোন প্রমাণ নেই কিংবা ঋণ দেয়া হয়েছে, যা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই। অথবা মাটির তলায় প্রোথিত হয়েছে কিন্তু কোথায় রাখা হয়েছে তা ভুলে গেছে। এমতাবস্থায় তার যাকাত দেয়া সম্ভব হয় না- যতক্ষণ না তা হস্তগত হচ্ছে। তবে যে সব মালের মালিক নিজেই বর্ধনশীলতায় বিনিয়োগ করতে অক্ষম, তার এই অক্ষমতা শরীয়াতের বিধানদাতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই তার উপর যাকাত ফরয। অক্ষমতার কারণ সম্পর্কে কোন প্রশ্নই নেই। কেননা মুসলমান মাত্রের প্রতিই এটা ধরে নেয়া কথা যে, সে তার ধন-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চায়ে যাবে। হয় সে নিজে তাকরবে, না হয় অন্যকে এই কাজে শরীককরবে। আর সেজন্যে কার্যকরণের ব্যবস্থা করা ও প্রতিবন্ধক দূর করা মুসলমানের পক্ষে অসম্ভব বা কঠিন কিছু নয়। অতএব অক্ষমতা ইসলামের দৃষ্টিতে কোন ‘ওযর’ নয়, এ কারণে সম্পদের মালিক যাকাত দেয়ার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। বরং এজ্যে তাকে তিরস্কৃত হতে হবে। কেননা ব্যক্তির অক্ষমতা কিংবা সমষ্টির বিপর্যয়ের কারণে তা ঘটেছে। এ কারণে নবী করীম(স) এই অক্ষমতা থেকে আল্লাহ্র কাছে পানাহ চেয়েছেন, অক্ষম হতে নিষেধ করেছেন, অক্ষম ব্যক্তিকে তিরস্কার করেছেন। নবী করীম (স) সব সময় দোয়া করতেন এই বলে: (আরবী*********) হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অক্ষমতা ও অবসাদগ্রস্ততা থেকে পানা চাই। তিনি বলেছেন: (আরবী*********) তোমার জন্যে যা কল্যাণকর তা তুমি লাভ করতে আগ্রহী হও এবং আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাও, আর তুমি অক্ষম হয়ে পড়ো না। এক ব্যক্তিকে তিনি বলেছিলেন: (আরবী*********) আল্লাহ্ অক্ষমতার জন্যে তিরস্কার করেন। বর্ধনপ্রবণ সব সম্পদেই যাকাত এই শর্তের আলোকে আমরা বলব, সর্বপ্রকারের বর্ধনশীল ধন-মালই যাকাত ধার্য হওয়ার ক্ষেত্র, যদিওঠিক সেই প্রকারের মালের নাম করে নবী করীম(স) যাকাত ধার্য করেন নি। সে ক্ষেত্রে কুরআনও হাদীসের সাধারণ অর্থবোধক ঘোষণাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট দলীল। এ মতটি এক শ্রেণীর ফিকাহ্বিদের মতের বিপরীত। যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে তাঁরা খুবই সংকীর্ণ মত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, নবী করীম(স) নিজে যে সব জিনিস থেকে যাকাত আদায় করেছেন, কেবলমাত্র সেসব জিনিস থেকেই যাকাত নেয়া যাবে। তা চাড়া অন্য কোন জিনিসথেকে নয়। ইমাম ইবনে হাজম এই মতের বড় প্রকক্তা। তিনি তাঁর ‘আল-মুহাল্লাহ’ গ্রন্থে মাত্র আটটি জিনসের উপর যাকাত ফরয বলে ঘোষণা করেছেন। তা হচ্ছে: উষ্ট্র, গরু, ছাগল, গম, যব, খেবুর স্বর্ণ ও রৌপ্য। এমনকি কিশমিশের উপর যাকাত ফরয হওয়ার কথা বলেন নি।’ পশু সম্পদের মধ্যে কেবলমাত্র উষ্, গরু ও ছাগলের কথাই বলেছেন। কৃষি সম্পদের মধ্যে কেবল ধান, গম, যব ও খেজুর ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। আর স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়া আর কোন খনিজ ও নগদ সম্পদের যাকাত দেয়ার কথা বলেন নি। তাঁর মতে ব্যবসা পণ্যের উপর যাকাত ধার্য হয় না। অন্যান্য ফিকাহ্বিদের মতে অনেকেই অনুরূপ বা তার কাছাকাছি মত দিয়েছেন। অনেকে আবার এই ক্ষেত্রকে বহু বিস্তীর্ণ করে দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা এ ক্ষেত্রে অধিক প্রশস্তা ও ব্যাপকতার কথা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, জমিতে যা-ই উপন্ন হবে- তার উদ্দেশ্য যদি প্রবৃদ্ধি সাধন হয- তবে তার উপর যাকাত ফরয হবে। এজন্যে তিনি কোন নিসাবেরও শর্ত আরোপ করেন নি। ঘোড়ার উপর যাকাত ফরয হওয়ার কথা তিনিই বলেছেন। অলংকারাদিকেও তিনি বাদ দেন নি। তবে তা কেবল শরীয়াত পালনে বাধ্য এমন বয়স্কদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অল্প বয়স্ক ও পাগলের অলংকারে যাকাত হবে না বলে রায় দিয়েছেন। তিনি খারাজী জমিতে ওশর ধার্য হওয়ার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ফলে বিপুল সংখ্যক জমিই ওশর ফরয হওয়ার বাধ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ইবনে হাজম এবং তাঁর সাথে ঐকমত্য প্রকাশকারী শেষদিকের দুজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ইমাম শাওকানী ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান প্রমুখের যাকাতক্ষেত্র সংকীর্ণতাকরণের মত দুটি ভিত্তির উপর স্থাপিত: প্রথম, মুসলমানের মাল ‘হারাম’ সম্মানার্হ, কোন অকাট্য দলীল ছাড়া তা গ্রহণ করা যেতে পারে না। আর দ্বিতীয়, যাকাত হচ্ছে একটা শরীয়াত ভিত্তিক বাধ্যবাধকতা। মানুষ মূলত সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্বমুক্ত। তার উপর কেবল তা-ই পালন করার দায়িত্ব চাপানো যেতে পারে, যা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এমন কি আল্লাহ্ যে বিসয়ে কোন অণুমতি দেন নি সে কাজ করা রবাধ্যবাধকতাও তার উপর চাপানো যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ‘কিয়াসা’কে ব্যবহার করা যেতে পারে না- বিশেষ করে যাকাতের ব্যাপারে। আমাদের মত কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তা এ দুটি ভিত্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ভিত্তির উপর স্থাপিত। নিম্নে আমরা তার ব্যাখ্যা পেশ করছি: ১. কুরআন ও সুন্নাহের সাধারণ ঘোষণাবলী সর্বপ্রকারের ধন-মালে গরীবের হক ধার্য করেছে, তা যাকাত বা সাদ্কা নামেই অভিহিত হোক-না কেন। যেমন বলা হয়েছে: (আরবী*********) আর তারা যাদের ধন-মালে সুনির্দিষ্ট হক রয়েছে। (আরবী*********) তাদের ধন-মাল থেকে ‘সাদকা’ গ্রহণ কর। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) তাদের জানিয়ে দাও, আল্লাহ্ তাদের ধন-মালে যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। বলেছেন: ‘তোমরা তোমাদের ধন-মালের যাকাত আদায় কর।’ এসব বাণীতে ধন-মালের যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। আর হাদীসের আলোকে আমরা এ কথাও জানতে পেরেছি যে, এসব অকাট্য দলীল ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে রক্ষিত দ্রব্যাদির ব্যাপারে নয়। কাজেই যাকাত বা সাদ্কা আদায়ের বাধ্যবাধকতা থেকে কোন প্রকারের মালই বাদ যেতে পারে না। তবে সেজন্যে কোন দলীল থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এখানে তেমন কোন দলীলই নেই। ২. প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিরই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ করা কর্তব্য। আর সা সে লাভ করতে পারে ব্যয় ও দানের মাধ্যমে। পবিত্রতা লাভ করবে স্বার্থপরতা ও লোভ-লালসার পংকিলতা থেকে, আত্মম্বরিতা ও আত্মপ্রেম থেকে। এ জন্যেই আল্লাহ বলেছেন: ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর- তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন কর এবং দ্বারা।’ এ কাজটি কেবলমাত্র গম ও যব উৎপাদনকারীদেরই করত্ব্য হবে এবং বড় প্রশস্ত ফলের বাগানের মালিকের কর্তব্য হবে না, কল-কারখানা মালিক ও বিশাল দালান-কোঠার অধিকারী এ থেকেমুক্ত থাকবে, তা কোনক্রমেই বোধম্য নয়। কেননা কৃষি উৎপাদকের তুলনায় এসব মালিকদের মুনাফা ও আয় শত শথ গুণ বেশী। ৩. প্রত্যেক ধন-মালেরই পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা লাভ জরুরী, কেননা তা উপার্জন নানা প্রকারের শোবাহ্-সন্দেহের সংমিশ্রণ ঘটে। আর ধন-মালের পবিত্রতা কেবল যাকাত দেয়ার মাধ্যমেই। হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে: (আরবী*********) আল্লাহ তা’আলা ধন-মালের পবিত্রতা বিধানের উদ্দেশ্যেই যাকাত ফরয করেছেন। অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী*********) তুমি যখন তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে, তখন তুমি তা থেকে খারাবীটা দূর করে দিলে। কাজেই এ কাজটি ইবনে হাজম উল্লেখিত মাত্র আটটি জিনিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে। অন্যান্য ধন-মালের উপর প্রযোজ্য হবে না; বিশেষ করে বর্তমানে যেগুলো জাতি ও সরকারের সম্পদের প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। তাই বলতে হবে, সর্ব প্রকারের ধন-মালেরই পবিত্রতা অর্জন ও তার খারাপ দিক থেকে নিষ্কৃতি একান্তই জরুরী। আর তা সম্ভব যাকাত আদায় করে। ৪. যাকাত ফরয করা হয়েছে গরবি, মিসকীন, ঋণগ্রস্ত ও নিঃস্ব পথিকের প্রয়োজন পূরণার্থে, সাধারণ মুসলিম জনতার কল্যাণ বিধানের জন্যে। যেমন আল্লাহ্র পথে জিহাদ, ইসলামের দিকে অমুসলিমের দিল আকৃষ্টকরণ, তাদের পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ, পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠূ রাখার জন্যে সকল ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সাহায্যে। কেননা এসব কাজের দ্বারাই তো ইসলামকে শক্তিশালী ও দুর্জয়ী করে তোলা যায়। তাই এসব প্রয়োজন পরিপূরণ ও এসব কল্যাণ বাস্তবায়নের জন্যে সর্বপ্রকারের ধন-মালের মালিকের উপরই যাকাত আদায় করা কর্তব্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, আল্লাহ্ তা’আলা পাঁচটি উটের মালিক বা চল্লিশটি ছাগলের মালিক কিংবা পাঁচ ‘অসাক’ যবের মালিকের উপর যাকাত ধার্য করবেন, আর বড় বড় কল-কারখানা শিল্পোৎপাদনের মালিক পুঁজিপতি বিশাল দালন-কোঠার মালিক, বড় বড় নামকরা ডাক্তার, আইন ব্যবসায়ী, বড় বড় বেতনভুক্ত চাকুরীজী ও বড় বড় স্বাধীন উপার্জনকারীদের এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেবেন, আল্লাহ্ সম্পর্কে এ কথা চিন্তাও করা যায় না। কেননা প্রথমোক্তরা বছরের পর বছর ধরে ম্রম করে যা আয় করে, তা শেষোক্ত একদিনে বা এক ঘন্টায় আয় করে বসে। ধন-মাল সম্পর্কে ইসলামের চিন্তা ও বিশ্বাসই হল এই যে, তার প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্ তা’আলা। মানুষতাতে শুধু খলীফা বা প্রতিনিধি মাত্র। প্রকৃত মালিকের প্রতিনিধিত্ব করাই তার দায়িত্ব। সমাজের গরীব-মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত লোকেরা যেহেতু আল্লাহ্পর প্রতিপালিত, তাই এ সব মালেই তাদের হক রয়েছে। তা ছাড়া জাতির জনগণের সার্বিক কল্যাণ- ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে উৎসর্গীত। কাজেই সর্ব প্রকারের ধন-মালই তার অন্তর্ভুক্ত এবং সব ধন-মালিকই যাকাত আদায় করতে বাধ্য। তা কৃষিলব্ধ হোক, শিল্পলব্ধ হোক, আর ব্যবসালব্ধই হোক-না কেন। ৫. ‘কিয়াস’ ইসলামী আইন প্রণয়নে গোটা মুসলিম উম্মাতের কাছে স্বীকৃত ও সমর্থিত একটি মৌল ধারা। ইবনে হাজম ও অন্যান্য যাহেরী মতালম্বীরা যতই বিরোধিতা করুন না কেন, রাসূলে করীম (স) যেসব মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর উপর কিয়াস করে অন্যান্য সর্ব প্রকারের ধন-মালকেই যাকাতের ক্ষেত্ররূপে গণ্য করতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, শরীয়াত দুটি সদৃশ মালের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি- যেমন দুটি পরস্পর বিপরীত জিনিসের উপর একই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করেনি। কোন প্রকারের মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করা ফরয বলে আমরা যখন কিয়াসের সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব, তখন তা শরীয়াতেই সিদ্ধান্ত হবে। আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ তখন হবে না। আর পূর্বে যেমন বলেছি যাকাত নিছক একটা ইবাদতের কাজই নয়, তা ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও। ৬. মুসলিমের ধন-মাল ‘হারাম’ –সম্মানার্হ, এতে আমাদরে দ্বিমত নেই। বরং তার এ বিশেষ মালিকানাভুক্ত ধন-মালেই তো ‘হক’ ধার্য হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, ধনীর ধন-মালে আল্লাহ্র হক, অন্য কথায় সমাজ-সমষ্টির হক, অভাবগ্রস্ত লোকদের হক অকাট্য দলীল দ্বারাই তা প্রমাণিত। তবে ইবনে হাজম নিজেই অন্যভাবে আমাদরে মতের সমর্থন যুগিয়েছেন। তিনি ধন-মালে যাকাত ছাড়াও হক্ ধার্য করেছেন; আর তা গরীব-মিসকীনের জন্যে আদায় করা- সেজন্যে ধনীদের উপর বল প্রয়োগ করা রাষ্ট্রকর্তাতের কর্তব্য ও অধিকার বলে ঘোষণা করেছেন। এজন্যে গরীবদের যুদ্ধ করা পর্যন্ত জায়েয বলেছেন। কিন্তু যাকাত ছাড়া অন্যান্য মালথেকে হক্ আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, সর্বপ্রকারের মাল থেকেই যাকাত আদায় করা। তাতে সব ধনীই সমানভাবে যাকাত দিতে বাধ্য হবে। কোন ধনীই বাদ পড়বে না। যখনই প্রয়োজন অপূরিত থাকবে, সব ধনী লোকদের কাছে গিয়েই আমরা বলব, তোমাদরে ধন-মালের যাকাত ছাড়াও লোকদের হক রয়েছে, তা দিতে হবে। তবে নবী করীম(স) তাঁর যুগে কোন কোন বর্ধনশীল মালথেকে যে যাকাত গ্রহণ করেন নি, তার দুটি কারণ বলা যেতে পারে। একটি হচ্ছে, তার বর্ধনশীলতা তখনদুর্বল ছিল। মালিকদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এবং তার বর্ধনশীলতা বাড়াবার সুযোগ দান ও সেই সঙ্গে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে তিনি যাকাত গ্রহণ করেন নি। দ্বিতীয়, তিনি সেই লোকদের ঈমানও মন প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ না গ্রহণ করার দরুন সেই লোকদের চিরদিন পবিত্রকরণ ও পরিচ্ছন্নকরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেহবে এমনকোন কথাই হতে পারে না। অথচ তারা তাদের দ্বীন থেকে জানতে পেরেছে যে, তাদের ধন-মালে হক রয়েছে এবং তা যাকাত বাবদ আদায় না করা পর্যন্ত তাদের কল্যাণ হতে পারে না। ৩. নিসাবের শর্ত ইসলাম ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালের যে-কোন পরিমাণের উপরই যাকাত ফরয করেনি, তা যতই দুর্বল ও ক্ষীণ হোক-না কেন, বরং যাকাতফরয হওয়ার জন্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের মাল হওয়া অপরিহার্য শর্ত বিশেষ। ফিকাহ্র পরিভাষায় তাকেই নিসাব’ বলে। যেমন হাদীসে নবী করীমের স্পষ্ট উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, পাঁচটির কম সংখ্যক উষ্ট্র ও চল্লিশটির কম ছাগলে যাকাত নেই। অনুরূপভাবে দুইশত নগদ রৌপ্যমুদ্রার কমের উপর এবং ফল ও দানার পাঁচ অসাকের কম পরিমাণের উপর যাকাত নেই। যাকাতরে জন্যে এ পরিমাণ নির্ধারণের কারণ হল এ জন্যে যে, এর কম পরিমাণ একটা পরিবারের বছরের প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্টনয়। পরিবারেরস্বামী-স্ত্রী ও তৃতীয় একজন লোক অবশ্যই থাকবে। সেই সাথে একজন সেবক ও সন্তানরাও থাকতে পারে। খুবকম পরিবারই এর বিপরীত হতে পারে আর মানুষের বেশীর ভাগের খাদ্য এক ‘তরল’ কিংবা একমদ্ পরিমাণ শস্য। উপরিউক্ত লোকেরা সকলেই যদি খাদ্য গ্রহণ করে, তাহলে উক্ত পরিমাণ এক বছরের জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। আর অবশিষ্ট যা থাকবেতা তাদের বিপদ-আপদ ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্ট হবে। আর পাঁচ অসাক্ ও দুইশ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছে এজন্যে যে, তা এমন একটি পরিমাণ যা একটা পরিবারেরসম্বৎসরের ব্যয়ের জন্যে যথেষ্ট; যদি অধিকাংশ এলাকায় দ্রব্যমূল্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় আর ভারসাম্যপূর্ণ দেশগুলোর দ্রব্যমূল্যের বেশী কমের খোঁজ খবর নিলে এটাই পাওয়া যাবে। পাঁচটি উটের যাকাত বাবদ একটি ছাগী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও মূলত যাকাত বাবদসেই মালই গ্রহণ করা হয় যার যাকাত দেয়া হবে। তারই একটা পরিমাণকে নিসাব নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরূপ করার কারণ এই যে, উষ্ট্র বড় আকারের জন্তু।তার ফায়দা অনেক। তা যেমন যবাই করা যায়, তেমনিতার পিঠে সওয়ারও হওয়া যায়। তার দুগ্ধ দোহন ও সেবন করা যায়, তার বংশ বৃদ্ধি করা চলে, তার পশম ও চামড়া ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করা যায়, তার বাছাই করা চামড়া দিয়ে জুতা বানানো যায়। আর সেকালে একটি উষ্ট্রকে দশটি ছাগলের সমান ধরাহত। ...যেমন বহু কয়টি হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। এভাবে পাঁচটি উষ্ট্রকে ছাগলের নিকটবর্তী বনিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্যেতাতে একট ছাগল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। [(আরবী****)] যাকাতের মালের নিসাব পরিমাণ হওয়ার শর্ত আরোপ ইসলামী বিশেষজ্ঞগণের কছে সর্ববাদীসম্মত ও সমর্থিত। অবশ্য তা কৃষি ফসল, ফলফঅঁকড়া ও খনিজ দ্রব্য পর্যায়ে। ইমাম আবূ হানীফার মত হচ্ছে, জমি যা-ই উৎপাদন করবে, তার পরিমাণ বেশী হোক বাকম, তাতেই ওশর দিতে হবে। ইবনে আব্বাস ও উমরইবনে আব্দুল আযীয প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে শাক-সব্জির প্রতি দশটি বোঝার উৎপাদন থেকে একটি বোঝা যাকাত বাবদ দিতে হবে। কিন্তু জমহুর ফিকাহ্বিদগণ প্রত্যেক মালের যাকাত ধার্য করার জন্যে তার একটা নিসাব নির্দিষ্ট হওয়া একান্তই জরুরী মনে করেন, যা জমির উৎপাদনের সাথে সামস্যপূর্ণ হবে। এ পর্যায়ে তাদের দলীল হচ্ছে এ হাদীস: (আরবী********) পাঁচ অসাকের কমে যাকাত নেই। [পাঁচ অসাক হিজাজী ওজনে ১৮ মণ ৩০ সেরএবং ইরাকী ওজনে ২৮ মণ ৫ সের হয়।] তা অন্যান্য মালের উপর কিয়াস করার দাবি রাখে, যেমন পশু, নগদ টাকা ও ব্যবসা পণ্য ইত্যাদি। বস্তুত যাকাতের নিসাব নির্ধারণের শর্ত খুবই স্পষ্ট ও প্রকট। কেননা যাকাত হচ্ছে ধনীদের কাছ থেকে গরীবদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে গ্রহণ করা কর। ইসলাম ওমুসলিমের কল্যাণে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। কাজেই সহানুভূতি কার্যত এমন পরিমাণই গ্রহণ করতে হবে। গরীবদের কাছ থেকে কর গ্রহণের তো কোন অর্থ হয় না। তারা তোসাহায্য পাওয়ারই অধিকারী, সাহায্য করতে তারা সক্ষম নয়। নবী করীম (স) এর নিম্নোক্ত কথাটি এ পর্যায়েরই: (আরবী************) প্রকাশ্য ধনীর কাছ থেকেই যাকাত গ্রহণ করতে হবে। আধুনিককালে কর ধার্যকরণ বিধানে একটা সীমাবদ্ধ পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তির মালিককে কর দেয়ার দায়িত্বথেকে এজন্যেএ নিষ্কৃতি দেয়া হয়ে থাকে। এটাও তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন। তাদের অবস্থার দাবি অনুযায়ী তা কম করা হয়। কেননা তারা তা দেয়ার সামর্থ রাখে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চৌদ্দশত বছর পূর্বেই ইসলাম সঠিক পথ-নির্দেশ করেছে। ৪. মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া কোন কোন ফিকাহ্বিদ মালের বর্ধনশীলতা ছাড়াও নিসাবের পরিমাণটা মালিকের মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার শর্ত করেছেন। হানাফী ফিকাহ্বিদদের সাধারণ কিতাবাদিতে এ কথা স্থিরভাবে লিখিত হয়েছে। কেননা এর ফলেই ধনাঢ্যতাও নিয়ামতের তাৎপর্য বলে প্রতিভাত হতে পারে। আর তা মনের খুশীর সাথেই দিয়ে দেয়া যেতে পারে। যে অভাবগ্রস্ত তার পক্ষে প্রয়োজনমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না, সেটা তার জন্যে নিয়ামত হয় না। নিম্নতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ সামগ্রী পাওয়া গেলে সুখ-সম্ভোগ হয় না। কেননা তা তো বেঁচে থাকার সামগ্রী। জীবন রক্ষার জন্যই তা প্রয়োজন। তার শোকর আদায় তো দৈহিক নিয়ামতের শোকর আদায়। এরূপ অবস্থায় কিছু দিতে হলে তা মনের সুখে ও আনন্দ সহকারে দেয়া হয় না। ফলে তখনকার দেয়াটা রাসূলে করীম(স)-এর এ হাদীস অনুযায়ী হবে না, যাতেতিনি বলেছেন: (আরবী*******) তোমরা তোমাদের ধন-মালের যাকাত দাও তোমাদরে মনের সুখ ও সন্তুষ্টি সহকারে। তাউ উপরিউক্ত লোকদের যাকাত দিতে হলে যাকাত আদায় হবে না। কতিপয় ফিকাহ্বিদ এ শর্তটি এড়িয়ে গিয়ে বর্ধনশীলতার শর্তের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর তা এজন্যে যে, মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দ্রব্যাদি সাধারণত বর্ধনশীল হয় না। তার প্রবণতা বা যোগ্যতাও সে সবের মধ্যে থাকে না। বসবাসের ঘর, চলাচলের জন্তু বা যানবাহন, পরিধানের কাপড়, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পড়ার বই এবং কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এ পর্যায়ের দৃষ্টান্ত; এগুলো অ-বর্ধনশীল। তাঁরা আরও বলেছেন, প্রকৃত প্রয়োজনের ব্যাপারটি নিগুঢ় রহস্য-আচ্ছন্ন। তা সাধারণভাবে জানা যায় না। ফলে সেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কি এবং কতটুকু তা-ও জানা সম্ভব হয় না। অতএব প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে যে দলীল পেশ করা হয়েছে, তা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে। আর তা হচ্ছে ব্যবসায়েল জন্যে প্রস্তুতকরণ। িএ প্রস্তুতকরণের দ্বারাই বর্ধনশীলতা বাস্তবায়িত হতে পারে। সত্যি কথা হচ্ছে, বর্ধনশীলতার শর্ত পূর্ণ হওয়াটাই যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়; তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্তও হতে হবে। কেনা উক্ত ফিকাহ্বিদগণ নগদ অর্থ সম্পদকে স্বভাবতই বর্ধনশীল বলে দাবি করেছেন। কেননা উক্ত ফিকাহ্বিদগণ নগদ অর্থ সম্পদকে স্বভাবতই বর্ধনশীল বলে দাবি করেছেন। কেননা তা আবর্তিত ও উৎপাদনশীল হওয়ার জন্যে সৃষ্ট। তার মালিক তার প্রবর্ধন কার্যত না করলেও তার এপ্রকৃত অপরিবর্তিত থাকবে। কাজেই এ শর্তটি আরোপিত না হলে নিসাব পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক তার নিজের ও তার পরিবারবর্গের খোরাক-পোশাক, বসবাস, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্যে তার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। কেননা এগুলো পরিপূরণ করা তার কর্তব্য। ফলে সে এতটা ধনী নয়, যাতে সে যাকাত দিতে পারে। যদিও বহু বিশেষজ্ঞ আলিমের মতে মৌল প্রয়োজন পূরণ নিয়োজিত সম্পদ অস্তিত্বহীনরূপেই গণ্য। আমরা মৌল প্রয়োজনের কথা বলেছি। কেননা মানুষের প্রয়োজন তো সীমাহীন, অশেষ। আমাদের এ যুগে বহু বিলাস দ্রব্য ‘প্রয়োজনীয়রূপে’ গণ্য। কাজেই মানুষের মন যা চায় তাকেই ‘মৌল প্রয়োজন’ মনে করা যায় না। কেননা মানুষের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, সে স্বর্ণের দুটি খনি লাভ করলে তৃতীয়টির জন্যে তার কামনা তীব্রহয়ে উঠবে। আসলে ‘মৌল প্রয়োজন’ বলতে আমরা বুঝি, যা না হলে মানুষের বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। যেমন খাবার, পোশাক, পানীয়, বাসস্থান, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের বই পত্র, তার পেশা উপযোগী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। হানাফী আলিমদের কেউ কেউ মৌলিক প্রয়োজনের খুব সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েচেন। বলেছেন: যা মানুষকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে সুস্পষ্টভাবে, যেমন দৈনন্দিন খরচাদি, ঘরের প্রয়োজনীয়, যুদ্ধাস্ত্রসমূহ, শীত-গ্রীষ্ম উপযোগী পোশাক, অথবা ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা, যা দিয়ে সেনিজেকে পাওনাদারের দাবি থেকে রক্ষা করতে পারে। কেননা সে কারণে জেলে যেতে হলে তো নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলা হবে। আর পেশায় কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যানবাহন, শিক্ষার বই পত্র- কেননা মূর্খতা তো ধ্বংসেরই নামান্তর। কারো কাছে যদি এ সব প্রয়োজন পরিপূর্ণ পরিমাণের নগদ অর্থ থাকে, যা নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তা থাকারই শামিল। যেমন কারো কাছে পিপাসা নিবৃত্তির জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ পানি থাকলেও সে তায়াম্মুম করতে পারে। কেননা সেই পানি দিয়ে ওযু করা হলে পিপাসা নিবৃত্তির কোন ব্যবস্থা তার কাছে থাকবে না। [আরবী*****] আমরা খুবই গুরুত্ব সহকারে এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, উক্ত আলিমগণ জ্ঞানকে জীবন ও মূর্খতাকে মৃত্যু ও ধ্বংসগণ্য করেছেন। আর মূর্খতা থেকে রক্ষাকারী জিনিসসমূহকে ক্ষুধা নিবৃত্তিকারী খাদ্যের, উলংগতাও কষ্ট বিদূরণে পোশাকের মত মৌল প্রয়োজনের মধ্যে শামিল করেছেন। যেমন তাঁরা স্বাধীনতাকে জীবন এবং কারাগার ও কয়েদকে ধ্বংস গণ্য করেছেন। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনকাল, অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত হয়ে যায় ও বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। কাজেই এ ব্যাপারটি বিশেষজ্ঞদের নির্ধারণ ও ইজতিহাদের উপরই ছেড়ে দেয়া আবশ্যক। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, যাকাত দিতে বাধ্য লোকদের মৌলিক প্রয়োজনের কথা। তাদের স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ও পিতামাত্র, নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণ ইত্যাদির ব্যাপার। কেননা তা-ও তাদের মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী ফিকাহ্ বহু পূর্বেই এক্ষেত্রে বিশেষ পথনির্দেশ উস্থাপিত করেছে। আধুনিক কর ধার্যকরণের ক্ষেত্রে চিন্তা সম্পূর্ণ একালের জিনিস। তাতে জীবন ধারণের নিম্নতম পদ্ধতি ছিল মূল সম্পদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। ব্যক্তি, তার অবস্থা, প্রয়োজন, ঋণ, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ইত্যাদির প্রতি কোনরূপ সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি না রাখা। কিন্তু বহু দেশে অর্থশালী বহু লোকই ও দৃষ্টিকোণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারে নি। তারা বড়জোর কেবলমাত্র ব্যক্তির জৈবিক প্রয়োজন কিংবা তার দুই তিনটি ছেলে মেয়ের ব্যাপারকে মেনে নেয়, যদিও তাদের ছেলে-সন্তানদের সংখ্যা ৮-১০টি রয়েছে। পিতাম তা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর যতই থাক না কেন, তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয় না। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এই শর্তের দলীল ১. ফিকাহ্বিদগণ এ শর্তের পক্ষে যতই যুক্তি দিন-না কেন, কুরআন হাদীসেওএর দলীল রয়েছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী*********) ধনাঢ্যতার প্রকাশ থেকেই যাকাত হবে। হাফেয ইবনে হাজার এ শিরোনামের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- যাতে তিনি হাদীসটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, সদকা যাকাত দানকারীর জন্যে শর্ত হচ্ছে সে নিজে ও যার যার ব্যয় বহন তার দায়িত্ব, তারা দরিদ্র হবেনা। (ক) কুরআনের আয়াত: (আরবী********) লোকেরা জিজ্ঞাসা করে তারা কি (কত) খরচ করবে? তুমি বল যা অতিরিক্ত। হযরত ইবনে আব্বাস(রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‘অতিরিক্ত’ বলতে বোঝায় পরিবার বহনের সব দায়িত্ব পালনের পর যা অতিরিক্ত বা অবশিষ্ট হবে তা। হযরত ইবনে উমর, মুজাহিদ, আতা, ইকরামা, সাঈদ ইবনে যুবায়র, মুহাম্মদ ইবনে কা’ব, হাসান, কাতাদাহ, কাসেম, সালেম, আতা খোরাসানী, রবী ইবনে আব্বাস প্রমুখ ফিকাহ্বিদও এই মতই দিয়েছেন। [আরবী ******] তার অর্থ মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা’আলা যাকাত বাবদ ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছেন মৌল প্রয়োজন পূরণের পর যা অতিরিক্ত থাকে তা। কেননা ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন অপর লোকদের প্রয়োজনের তুলনায় অগ্রাধিকারের দাবিদার। আর নিজের পরিবারবর্গের প্রয়োজন নিজেরই প্রয়োজন গণ্য। কাজেই এজন্যে যা দরকার তা দান করার জন্যে শরীয়াত কোন দাবি করতে পারে না। কেননা তার সাথে ব্যক্তির মনের সম্পর্ক রয়েছে, সে ব্যয়ে ব্যক্তির মনের সন্তুষ্টি ও প্রশান্তি নিহিত। হাসানউক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘এটা এজন্য যে, তুমি যেন তোমার ধন-মাল ব্যয় করে পরের কাছে ভিক্ষা চাইতে বাধ্য নাহও।’ ইবনে জরীর আবূ হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: “একব্যক্তি এসে বলল, হে রাসূল! আমার কাছে একটি মুদ্রা রয়েছে। বললেন, তা তুমি নিজের জন্যে ব্যয়কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তা তোমারদ স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তা তোমার সন্তানের জন্যে ব্যয় কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তুমি নিজেই বোঝ।” এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যক্তির নিজের, তার স্ত্রীর ও সন্তানাদির প্রয়োজন সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে। হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলেকরীম(স) এক ব্যক্তিকে বললেন: (আরবী********) তোমার নিজেকেই প্রথমে রাখবে। এর জন্যে ব্যয় করবে। অতিরিক্ত কিছু হলে তোমার পরিবারবর্গের জন্যে ব্যয় করবে। পরিবারববের্গর জন্যে ব্যয় করার পর কিছু অতিরিক্ত থাকলে তা তোমার নিকটাত্মীয়দের জন্য ব্যয় করবে। তার পরও অতিরিক্ত থাকলে এমনি.... এমনি ভাবে.....। এ সব হাদীসের কোন কোনটিতে যদিও নফল ব্যয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, তবুও তা-ই সাধারণ নিয়ম। ব্যয় পর্যায়ে ইসলামের হিদায়েত এমনিই। অতিরিক্ত হচ্ছে সাদ্কা-যাকাতের ক্ষেত্র। জমহুর আলিম ও ফিকাহ্বিদগণ তা-ই বুঝেছেন। ৫. ঋণমুক্তি পূর্বে পূর্ণাঙ্গ মালিকানার যে শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে তারপর মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকার সে কথা বলা হয়েছে, সেই সঙ্গে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকারও একটি জরুরী শর্ত। যদিও সম্পদের মালিক ঋণগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নিমজ্জিত হয়ে যায় বা তার চাইতে কম হয়ে পড়ে, তাহলে তার উপর যাকাত প্রদান করা ফরয হবে না। এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বাহ্যিক ধন-মালের ঋণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মতপার্থক্য মূলত যাকাত সংক্রান্ত ধারণার বিভিন্নতার দরুনই দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যাকাত কি শুধু একটা ইবাদত? না, ধন-মালে মিসকীন লোকদের আরোপিত অধিকার?’ তাঁরা এই শেষোক্ত মত গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মতে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে না। কেননা মিসকীনের অধিকারের আগেই তার উপর পাওনাদারের অধিকার আরোপিত। তখন আসলে তা পাওনাদারের টাকা যার হাতে ইবাদত মনে করেছেন, তাদের মতে মাল যার হাতেই রয়েছে তাকেই যাকাত দিতে হবে। কেননা এই ইবাদতের শর্তই হল মাল বর্তমান থাকা। তার উপর ঋণ চাপানো আছে কি নেই, তা এখানে অবান্তর প্রশ্ন। এখানে আসলে দুটি অধিকারের দ্বন্দ্ব। একটি আল্লাহ্র হক, অপরটি মানুষের হক। আর আল্লাহর হক অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিক অধিকারী। [(আরবী*********)] ইবনে রুশ্দ লিখেছেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর থেকে যাকাত দেয়ার দায়িত্ব তুলে নেয়াই শরীয়াতের লক্ষ্য। শরীয়াতের দলীলাদি, তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা ও তার সাধারণ মৌলনীতি সবকিছু থেকেই এ কথা বোঝা যায়। এ পর্যায়ের দলীলসমূহ নিম্নরূপ প্রথম, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মালিকানা দুর্বল ও অসম্পূর্ণ। কেননা ঋণদাতার পাওনা তার উপর চেপে বসে আছে। সে অনবরত তার পাওনা ফেরত চাচ্ছে। পাওনাদার তার পাওনা অবশ্যই নিয়ে নেবে। ইমাম আবূ হানীফার এই মত। আর পূর্ণ মালিকানা হওয়ার যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যে শর্ত, তা আমরা আগেই বলেছি। দ্বিতীয়, ঋণদাতা তার মালের যাকাত দিতে বাধ্য। কেননা ঋণ বাবদ দেয়া অর্থ তার মালিকানাভুক্ত, সে-ই মালিক। এক্ষণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিও যদি যাকাত দেয় তাহলে একই মালেল দুইবার যাকাত দেয়া হবে। কিন্তু তা শরীয়াতে নিষিদ্ধ। তৃতীয, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ যদি নিসাব পরিমাণ হয় কিংবা তার কম হয়, তাহলে তার নিজের পক্ষেই যাকাত গ্রহণ সম্পূর্ণ হালাল। কেননা সে তো দরিদ্র ব্যক্তি। সে ‘ঋণগ্রস্ত’ –তাহলে তার যাকাত দেয়া কি করে কর্তব্য হতে পারে? চতুর্থ, যাকাত-সাদকা ফরয হয়েছে ধনী লোকদের প্রতি। হাদীসে তা-ই বলা হয়েছে। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তো ধনী নয়। তার ঋণ শোধন করাই প্রধান দায়িত্ব। কেননা সেজন্যে তার উপর দিনরাতের ভাবনা চিন্তা ও অপমান ভয় ছাড়াও কারাবরণের আতংক সওয়ার হয়ে আছে। পঞ্চম, একথা সুস্পষ্ট যে, যাকাত ফরয হয়েছে অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি সহানুভূতি স্বরূপ। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি দরিদ্র ব্যক্তির মতই কিংবা তার চাইতেও বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সে অহর্নিশ ঋণ শোধের জন্যে চিন্তান্বিত। এমতাবস্থায় অপরের প্রয়োজন পূরণের জন্যে দেয়ার পরিবর্তে ঋণদাতার পাওনা ফেরত দেয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। এ জন্যেই নবী করীম (স) বলেছেন: ‘প্রথমে নিজের প্রয়োজন, তারপরে তোমার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন পূরণ কর।’ ষষ্ঠ, হযরত উসমান (রা) বলেছেন: এটা তোমাদের যাকাত দেয়ার মাস। যার ঋণ আছে তা প্রথমে দিয়ে দাও। তারপরে তোমাদের ধন-মালের যাকাত দাও। [(আরবী*******)] অর বর্ণনানুযায়ী কথাটি হল ‘যার ঋণ রয়েছে, সে তার ঋণ প্রথমে আদায় করবে। পরে তার অবশিষ্ট মালের যাকাত দেবে।’ [(আরবী*******)] একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসূলের মিম্বরে দাঁড়িয়ে হযরত উসমান (রা) উক্ত কথাটি বলেছিলেন বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে। কিন্তু কেউ তার প্রতিবাদ করেন নি। তার অর্থ সব সাহাবীই এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। এসব কারণে জমহুর ফিকাহ্বিদ এই মত গ্রহণ করেছেন যে, ঋণ যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক অথবা তা গোপন মালেল- নগদ টাকা ও ব্যবসা পণ্যের পরিমাণ হ্রাস করে দেয়। আতা সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, হাসান নখয়ী, লাইস, মালিক, সওরী, আওযায়ী, আহমদ, ইসহাক, আবূ সওর, আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণ এই মতই গ্রহণ করেছেন। রবীয়া, হাম্মাদ ও শাফেয়রি নতুন মত ছাড়া এর বিপরীত মত আর কারো নেই। প্রকাশমান ধন-মাল, পালিত পশু ও কৃষি ফসল পর্যায়ে কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত হচ্ছে, এক্ষেত্রেও ঋণ যাকাত দেয়ার পথে বাধা। এই দুই ধরনের সম্পদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, দ্বিতীয় প্রকারের সম্পদের যাকাত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে যে, তা প্রকাশমান ও গরীবদের দৃষ্টি তার উপরই নিবন্ধ। এ কারণে মালিকদের কাছ থেকেই যাকাত আদায় করে নেয়ার জন্যে সরকারী কর্মচারী পেরণের বিধান করা হয়েছে। নবী করীম(স) ও তাঁর খলীফাগণ তাই করতেন। তখন যে তা দিতে চায়নি, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন হযরত আবূ বকর (রা)। তাঁরা অপ্রকাশমান ধন-মালের যে যাকাত পেত, তা-ই তারা গ্রহণ করত। তার উপর কোন ঋণ চাপানো আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করত না। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঋণ প্রকাশমান ধন-মালের যাকাতের পথে প্রতিবন্ধক নয়। আর দরিদ্রদের মনের চাহিদাও তার প্রতিই অধিক। তার সংরক্ষণের প্রয়োজন বেশী। কাজেই তার যাকাত দেয়া অধিকতর তাকিদপূর্ণ। [(আরবী*******)] ইমাম মালিক, আওযায়ী ও শাফেয়ী এ মত দিয়েছেন। ইমাম আহমদেরও একটি মত এর পক্ষে। ইমাম আবূ হানীফা মনে করন, ঋণ ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার যাকাত ছাড়া সব যাকাতেরই প্রতিবন্ধক। কৃষির উপর ঋণের ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস বলেছেন, ফসলের ঋণ শোধ করার পর অবশিষ্টের যাকাত দিতে হবে। আর ইবনে উমর বলেছেন, ফসল থেকে ঋণ ও পরিবারবর্গের খরচাদি বাদ দিয়ে অবশিষ্টের যাকাত দেবে; আমাদের বিবেচনায় প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান ধন-মালের মধ্যকার কথিত পার্থক্য অস্পষ্ট। এটা আপেক্ষক ব্যাপার। অনেক সময় একালের পণ্যদ্রব্য পশু ও কৃষি ফসলের অপেক্ষা অধিক প্রকাশমান হয়ে পড়ে। কাজেই বলতে হয়, উপরিউক্ত কারণ পূর্বোক্ত সাধারণ দলীলকে নাকচ করতে পারে না। ঋণ সর্বপ্রকার মালের যাকাতের পথেই প্রতিবন্ধক হবে। শরীয়াত ঋণগ্রস্তদের প্রতি সব সময় উদার দৃষ্টি রাখে। আতা, হাসান, সুলায়মান, মায়মুন ইবনে মাহ্রান, নখ্য়ী, সওরী, লাইস, ইসহাক ও আহমদের একটি বর্ণনা এ মতের স্বপক্ষে। আবূ উবাইদ ও তায়ুসও এ ধরনেরই মত দিয়েছেন। আবূ উবাইদ বলেছেন, ঋণ সত্য প্রমাণিত হলে কৃষি ফসল ও পশু মালিকের উপর যাকাত ফরয হবে না। সুন্নাতের অনুসরণ এভাবেই সম্ভব। কেননা নবী করীম (স) বলেছেন: ‘যাকাত ধনীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে ও দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করতে হবে।’ আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তো যাকাত প্রাপক, তার কাছ থেকে যাকাত কিভাবে নেয়া যাবে। আর ঋণ থাকার কথা যদি কেবল মৌখিক হয় এবং তার সত্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত না হয়, তাহলে তার কাছ থেকে কৃষি ফসল ও পালিত পশু উভয়েরই যাকাত আদায় করা হবে। কেননা কৃষি ফসল ও পশুর যাকাত একটা প্রকাশমান কর্তব্য। তা অবশ্যই দিতে হবে। আর সে যে ঋণ থাকার কথা বলছে, তা প্রকাশমান, জানা যায় না, সে হয়ত মিথ্যা বলছে। তাই সে দাবি গ্রহণ করা হবে না। যেমন এক ব্যক্তির উপর বহু লোকের পাওনা রয়েছে। সে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এবং তা আদায় করে দেয়ার দাবি করল। তখন তাকে সত্য বলে মেনে নেয়া যাবে না। মোটকথা ঋণ যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক এ শর্তে যে, ঋণ হওয়ার কথা সত্য প্রমাণিত হতে হবে। যেন ঋণের দাবি দ্বারা আল্লাহ্ ও গরীবের হক বিনষ্ট হতে না পারে। যাকাতের প্রতিবন্ধক ঋণের শর্ত এ পর্যায়ে যে শর্তে কোন মতপার্থক্য নেই, তা হচ্ছে ঋণের পরিমাণ নিসাব সমান বা তার কম হতে হবে এবং এ নিসাব পরিমাণ ছাড়া ঋণ শোধের আর কিছুই পাবে না। তা ছাড়া তার উপায়ও কিছু থাকবে না। যেমন একজনের হাতে বিশটি মুদ্রা রয়েছে আর ঋণ রয়েছে একটি মুদ্রা অথবা তার বেশী কিংবা কম। এক্ষণে ঋণ শোধ করা হলে নিসাব পরিমাণে ঘাটতি পড়বে। নিসাব ছাড়া অন্য কিছু থেকে দিয়ে তা পূরণ করাও কিছু পাচ্ছে না। আর যদি তার ত্রিশটি মুদ্রা থাক, আর ঋণ থাকে দশটি মুদ্রা। তা হলে তাকে বিশটি মুদ্রার যাকাত দিতে হবে। আর যদি দশটি মুদ্রার অধিক ঋণ থাকে, তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে না। আর পাঁচটি মুদ্রার ঋণ থাকলে পঁচিশ মুদ্রার যাকাত দিতে হবে। যদি কারোর কাছে একশত ছাগল থাকে, আর তার ঋণ থাকে ষাটটি ছাগলের মূল্য পরিমাণ, তা হলে সে অবশিষ্ট চল্লিশটি ছাগলেল যাকাত দেবে। আর তার ঋণ পরিমাণ যদি একষট্টিটি ছাগল সমান হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা তা নিসাবের কম হয়ে যাচ্ছে। [(আরবী*******)] এই ঋণ বর্তমানকালের হওয়া কি শর্ত? আসলে বর্তমান ও বিলম্বিতকালের ঋণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা এ পর্যায়ের দলীলসমূহ নির্বিশেষ। যদিও কোন কোন আলিম বলেছেন, বিলম্বিত ঋণ যাকাত ফরয হওয়া প্রতিবন্ধক নয়। কেননা বর্তমানে তা ফেরত চাওয়া হচ্ছে না। [(আরবী*******)] এ বিলম্বিত ঋণেরর মধ্যে স্ত্রীর বিলম্বে দেয় মোহরানাও গণ্য হবে; যা তালাকবা মৃত্যু পর্যন্ত বিলম্ব হয়ে থাকে। কিন্তু তা যাকাত ফরয হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হবে কি হবে না, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিলম্বিত মোহরানা প্রতিবন্ধক হবে না। কেননা তা সাধারণভাবে তাৎক্ষণিকভাবে দাবি করা হচ্ছে না। নগদ দেয় মোহরানার কথা ভিন্ন। অপর লোকেরা বলেছেন, প্রতিবন্ধক হবে। কেননা তা-ও অন্যান্য ঋণের মতই একটা ঋণ বিশেষ। অন্যান্যরা বলেছেন, স্বামী তা নগদ আদায়ের সংকল্প রাখে, তবে প্রতিবন্ধক হবে, নতুবা নয়, কেননা তা ঋণরূপে গণ্য নয়। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ যদি স্বামীর উপর ঋণ হয়ে দাঁড়ায়, কোন সমঝোতার ভিত্তিতে অথচা চুকিয়ে দেয়ার দরুন নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণও অনুরূপ তাহলে তা যাকাতের প্রতিবন্ধক হবে। [(আরবী*******)] এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র ঋণ ও মানুষের ঋণ কি সমান? শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম নববী বলেছেন, আমরা যখন বলি যে, ঋণ যাকাতের প্রতিবন্ধক, তখন অর্থই হয় যে, আল্লাহর ঋণ ও মানুষের ঋণ সমান। হানাফী মাযহাবের লোকেরা বলেছেন, ঋণ যাকাতের প্রতিবন্ধক, যতক্ষণ তা জনগণের দাবি হিসেবে উত্থিত। যাকাত এ পর্যায়ের। কেননা তাতেই সমগ্র দাবি নিবন্ধ। তাতে পাওনাদাররা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রশাসকের অধিকার হবে পাওনাদারদের অধিকার আদায় করার জন্যে তার কাছ থেকে মাল গ্রহণ করা। তাই বলতে হয়, তার মালিকানা দুর্বল, অস্থায়ী। কিন্তু মানত ও কাফ্ফারা প্রভৃতি আল্লাহ্র হক্ সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যদি কারো উপর অতীত কয়েক বছরের যাকাত অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা সেই ঋণের মধ্যে গণ্য হবে, যদি দাবি জনগণের পক্ষথেকে হবে। তখন এ প্রশাসক পাওনাদারদের পক্ষের প্রতিনিধি বলে গণ্য হবেন। আমরা এ মত গ্রহণকরতে পারি যদি সরকার মুসলিম ও ইসলামীহয়। তা-ই যাকাতের ব্যাপার নিয়ে দাঁড়াবে। যেন মালদার লোকদের মধ্য থেকে কেউ এ দাবি না করতে পারে যে, তার উপর অনেক মানত ও অনেক কাফ্ফারা চেপে বসেছে। কেননা এ দাবি এমন, যার সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণ করা কঠিন। হবে। মুসলিম ব্যক্তি নিজেইযদি নিজের যাকাত আদায় করে, তাহলে সে তার এ সব ঋণ হিসাব করে তার মাল থেকে আদায় করে দেবে যাকাত দেয়ার পূর্বেই। কেননা হাদীসের কথা হল, ‘আল্লাহ্র ঋণ সর্বাগ্রে আদায় করতে হবে।’ ৬. একবছর অতিক্রমণ অর্থাৎ মালিকানা সম্পদ মালিকের হাতে একটি বছর-পূর্ণ বারটি মাস- অবস্থিত থাকলেই যাকাত ফরয হবে। পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায়ের পণ্য সম্পর্কে এই শর্ত আরোপিত হয়েছে। বলা যায়, এ হচ্ছে মূলদনের যাকাতয়। কিন্তু কৃষি ফসল, ফল-ফাঁকড়া, মধু, খুনি ও গচ্ছিত ধন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এ এক বছরকালের মালিকানার কোন শর্ত নেই। তা হল উৎপাদনের যাকাত। কতিপয় মালে এক বছরের শর্তের কারণ যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যে সব মালের মালিকানা এক বছরকাল থাকার শর্ত করা হয়েছে ও যে সব মালেতা করা হয়নি, এদুইয়ের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে ইমাম ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন, প্রথম পর্যায়ের ধন-মাল হচ্ছে বর্ধনশীল পর্যায়ের। পালিত পশুর বংশবৃদ্ধি হয়, ব্যবসায়ের পণ্য মুনাফা লাভকরে। এ জন্যে এ ক্ষেত্রে এক বছরকালের সময় অতিবাহিত হওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে, কেননা প্রবৃদ্ধি লাভেরজন্যে অন্তত এ সময়টা প্রয়োজন, যেন তার বাবদ যা দেয়া হবে তা মুনাফার ভাগ থেকে দেয়া যায়। এটাই সহজ ও কল্যাণময়। আর যাকাত তো সহানুভূতিমূলক ব্যবস্থা। বর্ধনশীলতার প্রকৃত রূপ কি? তা আয়ত্ত করা হয়নি। কেননা এতে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তা সুসংবদ্ধও করা হয়নি। আর যার সম্ভাব্যতা স্বীকার করা হয়েছে, তার নিগূঢ় তত্ত্ব উদ্ঘাটনের দিকে লক্ষ্য দেয়া হয়নি। এসব মালে যাকাত বারবার ধার্য হয়। সেজন্যে একটা স্থির নিয়মের প্রয়োজন, যেন একটি বছরে একই মাল থেকে কয়েকবার যাকাত দিতে না হয়, তাহলে তো মালিকের সমস্ত ধনই ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু কৃষি ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার স্বতঃই বর্ধিষ্ণু। তা থেকে যাকাত বের করার সম্পূর্ণ মাত্রায়ই বর্তমান থাকে। কাজেই তার যাকাত তাৎক্ষণিকভঅবে আদায় করা হবে। পরে তো কমতির দিকে যাবে, প্রবৃদ্ধির দিকে নয়। তাই তার উপর দ্বিতীয়বার যাকাত ফরয হবে না এজন্যে যে, তার প্রবৃদ্ধি আকাঙ্ক্ষিত নয়। আর ধনীর উৎপাদন কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার মতই ভূমি-উৎপন্ন। এ সব ক্ষেত্রে একটি বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। এক বছরের শর্তের প্রমাণ ইবনে রুশ্দ লিখেছেন, সর্ব সাধারণ ফিকাহ্বিদগণ স্বর্ণ-রৌপ্য ও পালিত পশুর যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে মালিকানার একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত করেছেন। কেননা চার খলীফা থেকেই তা প্রমাণিত। সাহাবিগণও তদনুযায়ী আমল করেছেন। তাদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। তা নিশ্চয়ই আল্লাহ্র তরফ থেকে নির্ধারিত। হযরত উমর (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী*******) একটা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে কোন মালে যাকাত ফরয হয় না। সব ফিকাহ্বিদই এ ব্যাপারে একমত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ পর্যায়ে কোন মতভেদ ছিল না। তবে ইবনে আব্বাস ও মুআবিয়া থেকে ভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সে পর্যায়ে কোন হাদীস উদ্ধৃত হয়নি। কতিপয় সাহাবী ও তাবেয়ীনের ভিন্ন মত ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস ও মুআবিয়া (রা) বলেছেন: যখনই মাল ব্যবহারযোগ্য হবে, তখনই তাতে যাকাত ফরয হবে। এক বছর অতিবাহিত হওয়ার কোন শর্ত নেই। ভিন্ন মতাবলম্বী এ সাহাবিগণের সাথে কতিপয় তাবেয়ীন একমত্য প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মত হচ্ছে, কারো মাল যখনই নিসাব পরিমাণ হবে, তখনই তার যাকাত দিতে হবে। মালিকানার এক বছর অতিবাহিত হোক আর না-ই হোক। ইবনে রুশ্দ এ পার্থক্যের কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, এ পর্যায়ে কোন হাদীস উদ্ধৃত হয়নি। সমন্বয়ের কেন্দ্রবিন্দু প্রাচীন ও পরবর্তীকালের মনীষদের পার্থক্যমুক্ত মত হচ্ছে, পশু ও নগদ সম্পদ, ব্যবসায়ী সম্পদ প্রভৃতি মূলধনে িএক বছরে মাত্র একবারই যাকাত দেয়া ফরয। এক বছরে একই মাল-সম্পদ থেকে একাধিকবারযাকাত গ্রহণ করা হবে না। ইমাম জুহ্রী বলেছৈন, এ জাতির কোন প্রশাসক মদীনা কেন্দ্রিক আবূ, বকর, উমর ও উসমান- কেউই দুইবারযাকাত আদায় করেছেন এমন খবর আমাদের কাছে পৌঁছেনি। তাঁরা প্রতি বছর ফলনশীরতা বা বন্ধ্যাত্ব অবস্থায়ই যাকাত সংগ্রহকারী পাঠাতেন। কেননা তা আদায় করা রাসূলের সুন্নাত। আসলে এটা ইসলামী শরীংয়াতের সর্বাগ্রে দেয়া বিধান। এটিই তার সুবিচার এবং তার মুজিযায়। কাজেই যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি প্রশাসক ও লালসাকারীদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। তারা যখন-ইচ্ছা তা আদায়ও করতে পারে না। তা একটি আবর্তনশীল নির্দিষ্ট ফরয। তা বৎসরান্তর সময়ে দিতে হবে। এই এক বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটে, মালদার লোকদের উপার্জন নতুনত্ব পায় এবং অবাবগ্রস্তদের প্রয়োজনও প্রবল হয়ে ওঠে। এই মেয়াদটি খুবই যুক্তিসংগত। মূলধনের প্রবৃদ্ধি এই সময়কালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। ব্যবসায়ে মুনাফা প্রকাশ পায়। পালিত পশুরা বাচ্চা জন্ম দেয়, আর ছোটরা বড় হয়। যাকাত পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর আদর্শ হচ্ছে, তিনি সাধারণ মালের ক্ষেত্রে তা বছরে একবার মাত্র ফরয করেছেন। আর কৃষি ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার ক্ষেত্রে তার পরিপক্কতাই তার এক বছর। এটা সুবিচারপূর্ণ নীতি। কেননা প্রতি মাসে বা প্রতি শুক্রবার দিন যাকাত আদায় করা হলে মালদার লোকদের পক্ষে কঠিন অবস্থা দেখা দিত্ আর সারাজীবনে একবার দেয়ার ব্যবস্থা হলে গরীব লোকদের হক মারা যেত। পক্ষান্তরে ফল-ফাঁকড়ার ক্ষেত্রে প্রতি বছর একবার যাকাত ফরয হলেও তা সুবিচারপূর্ণ হত না। প্রাপ্ত ধনমালের ব্যাপারে মত পার্থক্য এক ব্যক্তির কোন ধন-মাল ছিল না, পরে সে পেয়ে গেল। সে তার মালিক হল। তা সে বেতন থেকে পেয়েছে, কি পারিশ্রমিকরূপে ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ী মুনাফা বা হেবা ইত্যাদি বাবদ পেয়েছে সে প্রশ্ন অবান্তর। তার মধ্যে ফসল, ফল-ফাঁকড়া, মধু, গচ্ছিত ধন বা খনি, তা ব্যবহারকারোপযোগী হলেই তার যাকাত দেয়া ফরয। অবশ্য যতি তা নিসাব পরিমাণের হয়। এ ব্যাপারে বিপরীত কোন মত নেই। তবে একজন মুসলমান যখন এমন ধন-মালের মালিক হয় ও ব্যবস্থা করতে পারে যে, তা যদি এক বছরকাল ব্যবহারোপযোগী না থাকে যেমননগদ অর্থ, ব্যবসায় পণ্য ও পালিত পশু তাহলে কি করা হবেচ? সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলা রয়েছে। ইবনে কুদামাহ এ পর্যায়ে তিন প্রকার কথা বলেছেন। ১. ব্যাবহারোপযোগী মাল যদি কারো কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে, তা হলে তাতে যাকাত ফরয হবে। যেমন ব্যবসা পণ্যের মুনাফা ও পশুর বাচ্চা দান। এসব ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে রক্ষিত কোন মূল্যের সাথে তাকেশামিল মনেকরতে হবে। তখন তার এক বছরেই প্রবৃদ্ধির ও বছর গণনা করতে হবে। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কোন মতবিরোধের কথা আমরা জানি না। কেননা তা তো তারই স্বজাতীয় প্রবৃদ্ধি। যেমন ব্যবসাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিজনিত অতিরিক্ত লাভ।

২. মালিকের কাছে যদি প্রাপ্ত মাল তার কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের স্বজাতীয় না হয়- যেমন কারো কাছে নিসাব সংখ্যক উষ্ট্র রয়েছে, পরে যে একটি গাভী লাভ করল। সে ক্ষেত্রে সেই নতুন প্রাপ্ত মাল নিয়েই মাসলা সাব্যস্ত করতে হবে। পূর্ব থেকে রক্ষিত ও বছর অতিক্রান্ত মালের সাথে তা মেলান হবে না তাও তা শামিল ধরে নিসাবের হিসাব করা হবে না। বরং সেই নতুন প্রাপ্ত মাল যদি নিসাব পরিমাণ হয় ও এক বছর অতিবাহিত হয়, তবেই তার যাকাত দিতে হবে, নতুবা নয়। সর্বসাধারণ আলিমদের এটাই সিদ্ধান্ত। ইবনে মাসউদ, উবনে আব্বাস ও মুআবিয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‘তাতে যাকাত ফরয হবে যখন তা ব্যবহারোপরোযী হবে।’ ইমাম আহমদ বলেছেন, ‘তা যখন ব্যবহার করা হবে, তখন যাকাত দিতে হবে।’ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন: ‘আবদুল্লাহ আমাদেরকে দান করতেন এবং তা থেকেই তার যাকাত দিতেন। যে ব্যক্তি তার ঘর কিংবা দাস বিক্রয় করল সে প্রাপ্ত মূল্যে যাকাত দেবে তখন, যখন সেই মূল্য তার হাতে আসবে। তাঁর জন্য যদি যাকাত দেয়ার একটা নির্দিষ্ট মাস থাকে, তবেসেই মাস পর্যন্ত বিলম্বিত করেঅন্যান্য মালেরসাথে এক সাথে যাকাত দিয়ে দেবে। ৩. পরে প্রাপ্ত মাল যদি তার কাছে পূর্বে থেকে রক্ষিত নিসাব পরিমাণ মালের স্বজাতীয় হয়ে যার উপর যাকাত হওয়ার একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে স্বতন্ত্র কারণে- যেমন কারো কাছে যদি চল্লিশটি ছাগল থাকে, যার উপর একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে, অতঃপর সে আর একশটি ছাগল ক্রয় করল কিংবা দান হিসেবে পেয়ে গেল। তাহলে তার এই ছাগলের উপর একটি বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত যাকাত ফরয হবে না- ইমাম আহমদ শাফেয়ীরমতে। ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, বিগত বছরে তার কাছে যা ছিল তার সাথে পরে পাওয়া ছাগল একসঙ্গে হিসেবে করে সবকিছুরই যাকাত দিতে হবে, তার কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের একটি বছর পূর্ণ হওয়ার পর। তবে যাকাত দেয়া মালের বিনিময় হলে অন্য কথা। কেননা তা এক জাতীয় মালের সাথে শামিল হচ্ছে নিসাব গঠনে। ফলে বছর গুণতিতেও তারই সাথে গুণিত হবে। কেননা এই শেষেপাওয়া মালের বছর স্বতন্ত্রভাবে গণণা করা হলে ফরয আদায় খণ্ডিত হয়ে যাবে; যাকাত ফরয হওয়ার সময়ও বিভিন্ন হয়ে দাঁড়াবে। মালিকানা লাভে সময় স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত করতে হবে। আর সম্পদের প্রতি অংশের যাকাতের পরিমাণ আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এভাবে সামান্য পরিমাণ আলাদা করে দিয়ে দেয়া কঠিন হবে, পরের বছরগুলোতেও অনুরূপ অবস্থাই দেখা দেবে। আর এটা খুব িকঠিন কাজের দায়িত্ব চাপানো ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ (আরবী*******) দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেন নি। শরীয়াতে এরূপ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুধু ভিন্ন জাতীয় জিনিসের ক্ষেত্রে, পঁচিশটি উষ্ট্রের কম হলে আর মুনাফা ও উৎপাদন তার মূল ও আসলের বছরের সাথে গণনা করতে হবে। এই অসুবিধা দূর করাই এরূপ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। [আল-মুগনী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬১৭] ইবনে কুদামাহ যদিও হানাফী মাযহাবের এই মতের প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু সত্য কথা এই যে, বাস্তবায়নে হানাফী মতই অধিকতর সহজ। অতএব তা-ই গ্রহণীয়। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পশুসম্পদের যাকাত পশু জগত বিশালও বহু প্রকার। তার বিভক্তি কয়েক হাজারে পৌছতে পারে। কিন্তু মানুষ তার মধ্য থেকে খুব কম সংখ্যক পশুই ব্যবহার করে থাকে। পশুর মধ্যে সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত হয় সেই শ্রেণী, যাকে আরবগণ আল-আন’আম (***) বলে চিনে। আর তা হচ্ছে উষ্ট্র, গরু, মহিষ- এগুলো। ছাগল ভেড়া, দুম্বা এরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা এগুলো দিয়ে তাঁর বান্দাদের প্রতি বিরাট কল্যাণ এনে দিয়েছেন। কুরআনমজীদে এই পশুগুলোর কল্যাণের কথা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। সূরা আন-নাহলে বলা হয়েছে: (আরবী**********) (আল্লাহ) জন্তু পয়দা করেছেন, তাতে তোমাদের জন্যে পোশাকও রয়েছে আর খাদ্যও। আরও নানাবিধ অন্যান্য ফায়দাও নিহিত রয়েছে। সেসবের মধ্যে তোমাদের সৌন্দর্য রয়েছে, যখন সকালবেলাতোমরা সেগুলোকে বিচরণের জন্যে পাঠাও এবং যখন সন্ধ্যায় সেগুলোকে ফিরিয়ে আন। ওরা তোমাদের ভার বোঝা বহন করে এমন-এমন স্থান পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা খুব কঠোর শ্রম ছাড়া পৌঁছতে পার না। আসল কথা এই যে, তোমাদের আল্লাহ্ বড়ই অনুগ্রহসম্পন্ন ও মেহরবান। এ সূরারই অপর আয়াতে বলা হয়েছে: (আরবী**********) আর তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ গৃহপালিত জন্তুতেও এক শিক্ষা নিহিত রয়েছে। ওদের পেট থেকে গোপর ও রক্তের মাঝখান থেকে তোমাদের খাঁটি দুগ্ধ পান করাই যা পানকারীদের জন্যে খুবই উপাদেয়। অপর আয়াতে বলা হয়েছে: (আরবী**********) কিন্তু জন্তু জানোয়ারের চামড়া থেকে তোমাদের জন্যে এমন ঘর সৃষ্টি করেছেন, যা তোমাদের জন্য বিদেশ সফরে ও একস্থানে অবস্থান-উভয় অবস্থাতেই খুব হাল্কা থাকে। জিনি জন্তুর পশমউষ্ট্র ও খরগোসের পশম ও চুল দ্বারা তোমাদের জন্যে পরিধানের ব্যবহারের অসংখ্য জিনিস বানিয়েদিয়েছেন, যা জীবনের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তোমাদের কাজে আসে। সূরা ইয়াসীন-এর আয়াত: (আরবী**********) এ লোকেরা কি দেখে না যে, আমরা আমাদের হাতে তৈরী করা জিনিসগুলো দিয়ে তাদের জন্যে গৃহপালিত পশু সৃষ্টি করেছি আর এখন এসবের মালিক? আমরা এগুযলোকে এমনভাবে তাদের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছি যে, এগুলোর কোন একটির উপর তারা সওয়ার হয়, কোনটির গোশত খায় তারা। এগুলোর মধ্যে তাদের জন্যে রকম-বেরকমের কল্যাণ ও পানীয় রয়েছে। তাহলে তারা শোকার গুযার হয় না কেন? কুরআন যে শোকর-এর জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে, তার সর্বাধিক প্রকাশ ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্নাত প্রবর্তিত যাকাত। তারা নিসাব নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং প্রতি বছর আদায়কারী পাঠিয়ে মালিকদের কাছ থেকে তা আদায় করার ব্যবস্থা করেছে। যারা তা দিয়ে অস্বীকৃত হবে তাদের দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে। বস্তুত আরবদের জন্যে বিশেষ করে উহা খুবই কল্যাণকর ছিল। অনেক দেশেই এ সম্পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তিরূপে গণ্য।তা প্রায় সর্বত্রই এ উদ্দেশ্যে লালিত-পালিত হয়। তাই শরীয়াত তার উপর যাকাত ফরয হওয়ার নিসাব নির্ধারিত করে দিয়েছে। এ পর্যায়ের যাকাতের বিস্তারিত বিধান আমরা এখানে পেশ করছি। প্রথম আলোচনা পশুর যাকাতের সাধারণ শর্ত যে কোন সংখ্যক মালিকানার পশুর উপর শরীয়াত যাকাত ধার্য করেনি। সর্বপ্রকারের জন্তুর উপরও করা হয়নি। যে সব জন্তুর মধ্যে বিশেষ কতগুলো শর্ত পাওয়া যাবে, কেবল সেগুলোতে যাকাত ফরয করা হয়েছে। শর্তগুলো এই: ১. তার সংখ্যা নিসাবমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে প্রথম শর্ত হচ্ছে, শরীয়াত নির্ধারিত নিসাব সংখ্যক পর্যন্ত তার সংখ্যা পৌঁছাতে হবে। কেননা ইসলামে কেবলমাত্র ধনী ব্যক্তিদের উপরই যাকাত ধার্য হয়েছে। কিন্তু একটি বা দুটি উষ্ট্রের মালিকই তো আর ধনী গণ্যহতে পারে না। এ জন্যে উষ্ট্রের ক্ষেত্রে সে সংখ্যা হচ্ছে পাঁচ। এ ব্যাপারে সর্বকালের মুসলমান সম্পূর্ণ একমত। অতএব তার কম সংখ্যক উষ্ট্রের মালিকানায় যাকাত ফরয হবে না। আর চল্লিশ ছাগলের দাম কম সংখ্যক হলেও যাকাত দেয়া লাগবে না। হাদীসসমূহে তা-ই বলা হয়েছে এবং রাসূলে করীম(স)ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলও এ নীতিতেই চ লেছে। গুরুর নিম্নতম নিসাব কত তা নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। পাঁচটা থেকে ত্রিশটা- পঞ্চাশটার কথা বলা হয়েছে। ২. মালিকানার এক বছর মালিকের মালিকানায় একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলও তাই ছিল। তাঁরা যাকাত আদায়কারী লোক বছরে মাত্র একবারই পাঠাতেন পশুর যাকাত আদায়ের জন্রে। পূর্বেই বলেছি, ব্যবহার্য সম্পদে এক বছরে মালিকানার শর্ত সর্বসম্মত। এমন কি, যে সব ফিকাহ্বিদ ব্যবহার্য মালে এক বছরকাল অতিক্রান্ত হওয়ার শর্ত করেছে, তাঁরা গৃহপালিত পশুর উৎপাদনের ক্ষেত্রে তা করেন নি। পশুর মায়েদের এক বছরকে বাচ্চাদেরও এক বছর ধরা হয়েছে। ৩. ‘সায়েমা’ হতে হবে ‘সায়েমা’র শাব্দিক অর্থ বিচরণশীল। শরীয়াতের পরিভাষায় সেই পশুকে ‘সায়েমা’ বলা হয়, যা বছরের অধিকাংশ সময় বিচরণ করে আহার গ্রহণকরতে সক্ষম। দুগ্ধ, মাখান ও পনিরের মাত্রা বেশী হওয়াই লক্ষ্য। তাই ‘সায়েমা’ বলা হয় সেই পশুকে, যা নিজেই ঘাসে বিচরণ করে। মালিক নিজে ঘাস সংগ্রহ করে খাওয়ালে তা এর মধ্যে গণ্য নয়। শর্ত হচ্ছে, জন্তু বছরের অধিকাংশ সময় নিজেই বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করবে, বছরের সমস্ত দিনগুলোতে বিচরণ করা শর্ত নয়। কেননা অধিকাংশ সময়ের ব্যাপারকেই সমগ্র সময়ের ব্যাপার ধরা যায়। ‘সায়েমা’ তো বছরের কোন না-কোন দিন নিজেই ঘাস খেয়ে নিতে পারে। দুগ্ধ, চর্বি ও মাখন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পালন করা হলেই তাকে ‘সায়েমা’ মনে করা হবে ও তাতে যাকাত ফরয হবে। কিন্তু যদি ভার বহন বা তার যানবাহন হিসেবে ব্যবহার অথবা গোশ্ত খাওয়ার উদ্দেশ্যে পালা হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা এ প্রবৃদ্ধিটা ব্যক্তিগত ফায়দার জন্যে। ‘সায়েমা’ মনে করা হবে ও তাতে যাকাত ফরয হবে। কিন্তু যদি ভার বহন বা যানবাহন হিসেবে ব্যবহার অথবা গোশ্ত খাওয়ার উদ্দেশে পালা হয় তাহলেতার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা এ প্রবৃদ্ধিটা ব্যক্তিগত ফায়দার জন্যে। ‘সায়েমা’ হওয়ার শর্ত আরোপের কারণ হচ্ছে, যাকাত ফরয হয়েছে- এমনভাবে যেন মালিকের পক্ষেতা দিয়ে দেয়া সহজ হয়। কুরআনের ‘অতিরিক্তটা গ্রহণ কর’ কথার দ্বারা তা-ই বোঝানো হয়েছে। ‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যয় করবে তারা?’ বল, ‘অতিরিক্ত।’ আর এ ‘অতিরিক্ত’ শব্দটি বাস্তবায়িত হবে যদি তার জন্যে কষ্ট কম হয়, প্রবৃদ্ধি বেশী হয়। ‘সায়েমা’ হলেই তা হয়। কিন্তু যে জন্তুকে ঘাস এনে খাওয়াতে হয়, তাতে মালিকের কষ্ট বেশী হয়। এবং তা যাকাত বাবদ দিতে মানসিক কষ্ট হয়। এ শর্তের দলীল হচ্ছে রাসূলের হাদীস: (আরবী*******) সায়েমা উষ্ট্রের প্রতি চল্লিশটি যাকাত বাবদ একটা বিনতেল লাবুন। দুই বছর পার হয়ে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। হাদীসের ইমামগণ এ হাদীসটিকে সহীহ্ মনে করেছেন। উষ্ট্রের ‘সায়েমা’ হওয়ার শর্ত করায় বোঝা যায় যে, যে সব উষ্ট্রকে ঘাস খাওয়ার জন্যে মাঠে পাঠানো হয় না, এনে খাওয়ানো হয়, তাতে যাকাত ধার্য হবে না। নিজের বিচরণ করার শর্ত করার অবশ্যই একটা ফায়দা থাকতে হবে। কেননা শরীয়াতের বিধানদাতার কালচক্র তো আর অর্থহীন হতে পারে না; স্পষ্ট মনে হয় যার যার উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি বিশেষ হুকুম রয়েছে, যার উল্লেখক করা হয়নি, সে সম্পর্কিত হুকুমের বিপরীত। ইমাম খাত্তাবী বলেছেন: আরবরা যখন কোন জিনিসের দুটি অপরিহার্য গুণের উল্লেখ করে বিকল্প হিসেবে, তখন তার একটা গুণের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম হবার পূর্ণ সম্পন্ন জিনিস থেকে ভিন্নতর হবে। [আরবী *******] গুণের তাৎপর্য অনুযায়ীই ভাষাভাষীদের আমল হয়ে থাকে। কাজেই কোন একটি বিশেষ গুণ নির্ধারণ করা হলে তার লক্ষ্যটা সম্মুখে রাখতে হবে। আল্লাহ্ ও রাসূলের কালামে এ বিষয়ের গুরুত্ব সর্বাধিক।[(আরবী ********)] বুখারী উদ্ধৃত ও হযরত আনাস (রা) বর্ণিত একটি হাদীস এ কথার সমর্থক। তা হচ্ছে: (আরবী ********) স্ববিচরণকারী ছাগলের যাকাত হচ্ছে চল্লিশটিতে একটি ছাগী। আর ছাগলের ক্ষেত্রে যখন স্ববিচরণকারী হওয়ার শর্ত আরোপিত, তখন উষ্ট্র ও গরুর ক্ষেত্রে তো তা অবশ্যই আরোপিত হবে ফিকাহ্র নীতি কিয়াস অনুযায়ী। কেননা এ দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। রবীয়া, মালিক ও লাসি প্রমুখ ফকীহ্ সর্বসাধারণ ফিকাহ্বিদদের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি। তাঁরা উষ্ট্র, গরুও ছাগলের মধ্যে যে সবকে ঘাস খাওয়ানো হয়, তার উপর যাকাত ধার্য করেছেন। [(আরবী ********)] চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, এ জন্তু মালিকের কোন কাজে- জমি চাষ, ক্ষেত-খামারের সেচ বা বোঝা বহন ইত্যাদি ধরনের কাজে নিয়োজিত হবে না। এ শর্তটি উষ্ট্র ও গরুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আরোপিত। হযরত আলী (রা) বলেছেন: (আরবী ********) কর্মে নিয়োজিত গরুর কোন যাকাত হয় না। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী ********) কৃষি কাজে নিয়োজিত জন্তুর যাকাত নেই। [আল-আমওয়াল, পৃঃ ৩৮০] এছাড়া রাসূলে করীম(স) থেকে বর্ণিত এক হাদীসের ভাষা এই: (আরবী ********) প্রতি চল্লিশ দিরহামের দশের চার ভাগের এক ভাগ এক দিরহাম যাকাত বাবদ দাও। বলা হয়েছে: কাজে নিয়োজিত পশুর যাকাত হয় না। ইবরাহীম, মুজাহিদ, জুহরী, উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ ফিকাহ্বিদের এ মত বর্ণিত হয়েছে এবং আবূ হানীফা, সওরী, শাফেয়ী, যায়দিয়া ও লাইসও এ মতই সমর্থন করেছেন। দুটো দিক দিয়ে পূর্বোক্ত বর্ণনাসমূহের সমর্থন পাওয়া যায়: প্রথম যে সব মাল মালিকের সুখ বিধানের কাজে নিয়েঅজিত- যেমন কাপড়, চাকর-গোলাম, বসবাসের ঘর ও আরোহণের যানবাহন, পড়ার বই-কিতাব- এ সবের কোন যাকাত হয় না। এ দৃষ্টিতে চাষবাষে গরুর ও পানি তোলার চাকা বহনকারী বলদেরও যাকাত হওয়ার কথা নয়। বিবেচনাও তাইবলে আর শরীয়াতের দলীলও এর সমর্থক। ‘সায়েমা’ ও এই গরু-বলদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। এগুলো ক্রমবৃদ্ধির দিকদিয়ে কাজে নিয়োজিত এবং তা কাপড় ও ঘরের মতই। দ্বিতীয, পানি বহনের বলদ ও গাভী এবং চাষের গরুর কোন যাকাত নেই, কেননা তা কৃষির পানি বহন ও কৃষিকাজে নিয়োজিত। এ কথা জুহরী থেকে বর্ণিত। [***১] সাঈদ ইবনে আব্দুল আযিয বলেছেন: চাষের কাজে নিয়েঅজিত গরুর যাকাত নেই। কেনা কৃষি উৎপন্ন গমের যাকাত রয়েছে। আর এ সব তো গরুরই সাহায্যেই পাওয়া গেছে। কেননা এগুলো যন্ত্রপাতি পর্যায়ের; কৃষি কাজে এগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর ফলে জমি যা উৎপন্ন গমের যাকাত রয়েছে। আর এ সব তো গরুর সাহায্যেই পাওয়া গেছে। কেননা এগুলো যন্ত্রপাতি পর্যায়ের; কৃষিকাজে এগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর ফলে জমি যা উৎপাদন করে তাতে যাকাত ফরয। এক্ষণে এগুলোর উপরও যদি যাকাত ফরয হয়, তাহলে একই জিনিসের উপর দ্বিগুণ যাকাত ফরয হবে। ইমাম মালিক ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে কর্মে নিয়োজিত হোক আর নাই হোক, গরু ও বলদের উপর অবশ্যই যাকাত ফরয হবে। মালিকীমতের কোন কোন ফিকাহ্বিদ অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের পূর্বোক্ত মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেননা এঁদের মত হচ্ছে, ভূমি হিসেবে ফরয হওয়া ও অনুরূপ অপরটি যাকাত ফরয না হওয়া পরস্পর বিরোধী কথা। আমাদের দৃষ্টিতে এটাই সুবিচারপূর্ণ মত। দ্বিতীয় আলোচনা উটের যাকাত সমস্ত মুসলমান, নবী করীম(স) থেকে বর্ণিত হাদীস ও সাহাবিগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, পাঁচটি থেকে একশথ বিশটি উষ্ট্রের যাকাতের নিসাব ও যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত তালিকা অনুযায়ী হবে: বলদের নিসাব যাকাতের পরিমাণ ১টি থেকে ৯টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি ছাগী ১০টি থেকে ১৪টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি ছাগী ১৫টি থেকে ১৯টি উষ্ট্রের যাকাত ৩টি ছাগী ২০টি থেকে ২৪টি উষ্ট্রের যাকাত ৪টি চাগী ২৫টি থেকে ৩৫টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি গরুর মাদী বাচ্চা যার বয়স ১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে ২ বছরে পদার্পণ করেছে। ৩৬টি থেকে ৪৫টি উষ্ট্রের যাকাত দুই বছর পর তৃতীয বছরে শুরু বয়স্ক একটি গাভী। ৪৬টি থেকে ৬০টি উষ্ট্রের যাকাত তিন বছর অতিক্রমকারী একটি গাভী। ৬১টি থেকে ৭৫টি উষ্ট্রের যাকাত চার বছর বয়স অতিক্রম করে পাঁচ বছরে প্রবেশকারী একটি গাভী। ৭৭টি থেকে ৯০টি উষ্ট্রের যাকাত দুই বছর অতিক্রম করে তৃতীয বর্ষে অতিক্রমকারী উষ্ট্রীর বাচ্চা। ৯১টি থেকে ১২০টি উষ্ট্রের যাকাত তিন বছর বয়স অতিক্রম করে চতুর্থ বছরে প্রবেশকারী উষ্ট্রীর দুটি বাচ্চা। যাকাতরে এ নিসাব ও পরিমাণ সম্পর্কে ইজমা- সম্পূর্ণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে হযরত আলী (রা) থেকে একটা ভিন্ন কথা বর্ণিত হয়েছে।তিনি বলেছেন: ২৫টি উটের যাকাত বাবদ পাঁচটি ছাগী দিতে হবে। আর উটের সংখ্যা ২৬টি হলে দুই বছরের একটি উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। ইবনে মনযির বলেছেন: পঁচিশটি উষ্ট্রের যাকাত যে একটি দুই বছর বয়স চলা উষ্ট্রী শাবক, এ বিষয়ে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে হযরত আলী থেকে বর্ণিত কোন মত নির্ভুল সূত্রে প্রমাণিত হয়নি। উটের সংখ্যা একশ’ বিশটির ঊর্ধে হলে অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত ও আমল নিম্নোদ্ধৃত তালিকায় অনুরূপ: প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি তিন বছর বয়স অতিক্রমকারী উষ্ট্রী শাবক; আর প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক। ১২১ থেকে ১২৯টি সংখ্যার যাকাত তিনটি তৃতীয় বর্ষের উষ্ট্রী শাবক। ১৪০থেকে ১৪৯ টি সংখ্যার যাকাত একটি ৪ বছর বয়সে পড়া উষ্ট্রী, ২টি তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রীর শাবক। ১৫০ থেকে ১৬৯টি সংখ্যার যাকাত ৩টি চতুর্থ বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক। ১৬০ থেকে ১৬৯টি সংখ্যার যাকাত ৪টি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী ১০ থেকে ১৯৯টি সংখ্যার যাকাত ৩টি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্র শাবক+১টি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উস্ট্র শাবক। ২০০ থেকে ২০৯ সংখ্যার যাকাত ৪টি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক অথবা ৫টি ৩য় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। এ ভাবে দশটির কম সংখ্যক উষ্ট্রে কোন যাকাত হবে না। দশটি পূর্ণ হলে পূর্বে যেমন বলেছি, প্রতি ৫০টিতে একটি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। আর প্রতি ৪০টিতে একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্টী শাবক। পূর্বোক্ত তালিকাদুটি থেকে স্পষ্ট হয় যে, উষ্ট্রের যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতম সংখ্যা হচ্ছে পাঁচটি। তাই যার চারটি উস্ট্র আছে, সে যাকাত দেবে না। দান-সাদ্কা করলে ভিন্ন কথা। পাঁচটি সংখ্যায় গেলেই তাকে একটি ছাগী যাকাত বাবদ দিতে হবে। বলাহয়েছে, এ পরিমাণ-নির্ধারণ মূল্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে।কেননা উষ্ট্রের যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতম বয়স সীমা হচ্ছে একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। সেকালে তার মূল্য হতো ৪ দিরহাম। আর একটি ছাগীর মূল্যও তাঁই পাঁচ দিরহাম ছিল। তাই পাঁচটি উষ্ট্রের যাকাত ফরযহওয়ার অর্থ দুইশত দিরহাম মূল্যের রৌপ্য যাকাত ফরয হওয়া। পঁচিশটির কম সংখ্যার উষ্ট্রের যাকাতে ছাগী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে- উষ্ট্রী নয়। যদিও প্রত্যেক জিনিসেরযাকাত সেই জিনিসের অংশ থেকে দেয়া সাধারণ নিয়ম।এর কারণ হচ্ছে, উষ্ট্র মালিকের উষ্ট্রের সংখ্যা কমহওয়া। এর ফলে ধন-মালিক ও দরিদ্র উভয় পক্ষের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কেননা পাঁচটি উষ্ট্র তো বিরাট সম্পদ বটে। তার উপর যাকাত ফরয করা না হলে দরিদ্রের অধিকার নষ্ট হয়। কিন্তু তারই একটা যাকাত বাবদ দিতে হলে মালের মালিকদের স্বার্থ বিনষ্ট হয়। আর একটি উষ্ট্রের কতকাংশ দেয়া সাব্যস্ত হলে মালিকের ধনের ক্ষতি সাধন হয়। উপরে যে পরিসংখ্যানের উল্লেখ করাহয়েছে, তা খোদ নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত ও তৎকর্তৃক অনুসৃত। ইমাম নববী লিখেছেন: গৃহপালিত পশুর যাকাত নির্ধারণের ব্যাপারটি হযরত আনাস ও ইবনে উমর বর্ণিত দুটি হাদীসের উপর ভিত্তিশীল। হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসটি হচ্ছে- হযরত আবূ বকর (রা) তাঁকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তাঁকে লিখেছিলেন: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ রাসূলে করীম(স) মুসলমানদের জন্যে যে যাকাত ফরয করেছেন, যে বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, তার হার তোমাকে লিখে পাঠাচ্ছি। মুসলমানদের কাছে যে তা চাইবে, সে যেন তাকে তা দিয়ে দেয়। এর বেশী চাইলে দেবেনা। চব্বিশবা তার চাইতে কম সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাত ছাগী দ্বারা দিতে হবে অর্থাৎ পাঁচটি একটিতে ছাগী। ২৫টি থেকে ৩৫টি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত একটি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। ৪৬থেকে ৬০টি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত ৪র্থ বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক। ৬১ থেকে ৭৫টি পর্যন্ত বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক (***)। ৭৬টি থেকে ৯০টি পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। ৯১টি থেকে ১২০ টি পর্যন্ত দুটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। তার ঊর্ধ্ব সংখ্যক হলে প্রতি চারটিরজনেস্য একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। যার মাত্র চারটি উষ্ট্র রয়েছে তাকে যাকাত দিতে হবে না। ৫টি হলেই একটি ছাগী দিতে হবে। নিজস্বভাবে বিচরণকারী ৪০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত ছাগলের যাকাত বাবদ ১টি ছাগীদিতে হবে। তার ঊর্ধ্বে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী। ২০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ৩টি ছাগীর সংখ্যা ৪০টির কম হয়, তাহলে যাকাত দিতে হবে না। আর নগদ সমএদর দশ ভাগের এক ভাগের চতুর্থাংশ পরিমাণ দিতে হবে। যদি ১৯৯ সংখ্যক নগদ মুদ্রা হয় তাহলে তাতে যাকাত দিতে হবে না। এ চিঠিতে আরও লিখিত ছিল: যার যাকাত হবে একটি দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত শাবক, কিন্তু তার কাছে তা যদি না থাকে, আর থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলে তাঁর কাছ থেকেতা গ্রহণ করা হবে। আদায়কারী তা৭কে বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে অথবা তার দুটি ছাদী। আর যদি না থাকে, আর থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলেতাঁর কাছ থেকেতা গ্রহণ করা হবে। আদায়কারী তাঁকে বিশটি দিরহামফেরত দেবে অথবা দেবে দুটি ছাগী। আর যদি তার কাছে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক না থাকে, থাকেতৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলেতার কাছ থেকে গ্রহণ তা গ্রহণ করা হবে, কিন্তু সে সঙ্গে কিছুই নেয়া হবে না। যার যাকাত হবে পঞ্চম বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক কিন্তু তার কাছে তা না থাকে, তার কাছে থাকে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলে তার কাছ থেকেতাই গ্রহণ করা হবে, তার সঙ্গে আরও দুটি ছাগী বা বিশ দিরহামনিয়ে নেয়া হবে। যার যাকাত হবে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক: কিন্তু তা যদি তার কাছে না থাকে, থাকে পঞ্চম বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক; তবে তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করাহবে, আর আদায়কারী তাকে বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে অথবা দুটি ছাগী। আর যাকাত যাকাত দিতে হবে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, কিন্তু তার কাছে তা না থাকে- থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তা না হলে তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করে তাকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে। যার যাকাত একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তার কাছে রয়েছে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তার কাছ থেকে সেটি নিয়ে বিশটি দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী তাকে দিতে হবে। যার যাকাত হবে তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক; কিন্তু তার কাছে তা নাথাকে, থাকে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক তারকাছ থেকে তা নিয়ে বিশ দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী তাকে ফেরত দেবে। দাঁত পড়া, দোষযুক্ত বা পাঠা যাকাত বাবদ দেয়া যাবে না। তবে আদায়কারী তা নিতে চাইলে স্বতন্ত্র কথা। খুচরা অংশ কখনো মিশানো হবে না। আর যাকাত দেয়ারভয়ে একত্রে রাখা জন্তুগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেও দেখানো যাবেনা। দুই মিলনো অংশে সমান হারে যাকাত ধার্য হবে। এ দীর্ঘ চিঠির বর্ণনা বুখারী শরীফের ‘কিতাবুয যাকাত’ অধ্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। এখানে তা একত্রিত করে লেখা হয়েছে। আহমদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী, দারে কুতনীওএ বর্ণনা নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ সহীহ। শাফিয়ী, বায়হাকী ও হাকেমও এ চিটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ইবনে হাজমবলেছেন, ‘এ অত্যন্ত সহীহ্ বর্ণনা।’ ইবনে উমরের বর্ণিত হাদীস হচ্ছে: ‘রাসূলে করীম(স) যাকাত সম্পর্কিত ফরমান লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের প্রতি তা পাঠানোর পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। পরে হযরত আবূবকর (রা) ও হযরত উমর ফারুক (রা) তদনুযায়ী আমল করেছেন। তাতে লেখা ছিল: পাঁচটি উষ্ট্রের যাকাত িএকটি ছাগী। আর দশটিতে দুটি ছাগী...। হাদীসটি আবূ দাউদ ও তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। এর সনদ উত্তম। দারে কুত্নী, হাকেম ও বায়হাকীও তা উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে হাজম হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, তাচূড়ান্ত মাত্রায় সহীহ।হযরত আবূবকর সিদ্দীক অন্যান্য সব সাহাবীর উপস্থিতিতে তদনুযায়ী আমল করেছেন। এ থেকে ভিন্নমত পোষণকারী কেউ কোথাও নেই। আমাদের বিপরীত মতের লেকেরা তো এর চাইতেও কম অবস্থায় ইজমা হওয়ারদাবি করেন তাদের বিরোধী মতের প্রতিবাদে। মুসলিম উম্মতের বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ উপরিউক্ত দুটি বর্ণনানুযায়ী আমল করেছেন। যদিও ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুইন প্রমুখ কয়েকজন হাদীসবিদ্ এ দুটি বর্ণনার সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছেন। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ এ নীরবতাকে যাকাত পর্যায়ের সব হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ বলে ধরে নিয়েছেন। তাঁর মতে গোটা যাকাত ব্যবস্থাটাই সন্দেহযুক্ত। মনে করেছেন, যাকাত পর্যায়ে যে সব ফিক্হী মত গ্রহীত হয়েছে, তা হাদীসের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা এ পর্যায়ে গোটা যাকাত ব্যবস্থা সবিস্তারে উল্লেখ করতে চাই, যা প্রধানত হযরত আবূ বকরের উপস্থাপিত। তা অনেক সময় স্বয়ং নবী করীম(স)-এর অথবা হযরত উমর ফারূকের কিংবা হযরত আলীর নামেও উল্লেখ করা হয়। উপরিউক্ত প্রাচ্যবিদ হযরত মুহাম্মাদ (স)-এরসুন্নাতের প্রতি যে চরম শত্রুতা পোষণ করেন, তা সর্বজনবিদিত। তিনি সন্দেহের উদ্রেক করার ও তার উপর ঘৃণা প্রকাশ খরার কোন সুযোগই ছেড়ে দেন না। তিনি এ বিষয়ে একখানি গ্রন্থ রচনা করে সর্বপ্রকারের সংশয়-সন্দেহ ও গালাগাল একত্রিত করে দিয়েছেন। কিন্তু ডঃ মুস্তফা আযমী তাঁর লিখিত গ্রন্থে ব্যক্তির বিষদাঁত ভেঙে দেন এবং তার হিংস্র মস্তক চূর্ণ করে করে দিয়েছেন। [***১] বস্তুত মিঃ শাখ্ত যদি একটু ন্যায়পরায়ণতার আশ্রয় দিতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারতেন যে, উষ্ট্র ছাগলের যাকাতের ন্যায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নবী করীম (স) কিছুই বলে যান নি, তা কিছুতেই কল্পনা করা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই তার হার নির্ধারণ করে গেছেন। কেননা তা-ই ছিল তদানীন্তন আররেবর সবাচাইতে বড় ধনও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তখন যাকাত আদায়কারী লোকেরা প্রতিবছর কবীলাসমূহের লোকদের কাছে উপসিথত হয়ে তা-ই গ্রহণ করত ও যা পাওয়া যেত, তা নিয়ে এসে বন্টন করেদিত। তা তারা গ্রহণ করত ধনী লোকদের কাছ থেকে তাদের ধন-মাল থেকে প্রাপ্য অংশ হিসেবে। কিন্তু কি তারা গ্রহণ করত? কি তারা রেখে আসত? তাদের সাথে কিভাবে কার্য সম্পাদন করত? এ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেইসব হাদীসই মিথ্যা-কল্পরচিত, এমন কথা কোন সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পনন ব্যক্তিই চিন্তা করতে পারে না। কাজেই নবী করীম(স)-এ পর্যায়ে কোন ‘চিঠি’ লিখাবিন ও তাতে তার পরিমাণ ও নিসাব স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করবেন, তা কিছুমাত্র অসম্ভব বা বিচিত্র নয়। তাতে বিশেষ করে নিজেস্বভাবে ঘাস খেয়ে বেড়ানো জন্তু ও সেকালের বর্ধনশীল ধন-মালের যাকাত নির্ধারণ করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। এ পর্যায়ে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর ফারুকের চিঠিও উদ্ধৃত হয়েছে। দুটোর মূল উৎসনবী করীম(স) স্বয়ং। যেমন হযরত আবূ বকরের চিঠির শুরুতে বলা হচ্ছে: যাকাতরে দেয় ফরযের এ বিবরণ যা রাসূলে করীম(স) মুসলমানদের উপর ধার্য করেছেন। আর হযরত উমর ফারূকের চিঠিখানার বর্ণনা, তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে: ‘নবী করীম(স) যাকাত সংক্রান্ত এই চিঠি লিখেচিলেন।’ হযরত আলীর নামের চিঠি নবী করীমের চিঠি না তাঁর নিজের; তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বটে এবং তা হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের চিঠির মত খ্যাত ও প্রসিদ্ধও নয়। সনদের দিক দিয়েতা অপর দুটির ন্যায় শক্তিশালীও নয়। আর জন্তু জানোয়ারের যাকাত পর্যায়ে এই চিঠি কয়টিই চূড়ান্ত দলীল নয়। আরও কয়েকটি চিঠিও রয়েছে।তাতেও ফরয যকাতা ও দিয়ত সংক্রান্ত মসলার উল্লেখ রয়েছে। গরুর যাকাত পর্যায়ে রয়েছে হযরত মুআযের চিঠি। এই সব চিঠিতে সম্মিলিতভাবে নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলোর উল্লেখ রয়েছে: ১. পাঁচটি কম উষ্ট্রের কোন যাকাত নেই, ২. চল্লিশটির কম ছাগলের কোন যাকাত নেই, ৩. দুইশত দিরহাম মূল্যের রৌপ্যের (টাকার) কমে যাকাত নেই ৪. পঁটিশটির কম সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাত হচ্ছে ছাগল, ৫. আর তার যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে প্রতি পাঁচটির উষ্ট্র বাবদ একটি ছাগী, ৬. পঁচিশটি থেকে একশ’ বিশটি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত সমান হারে ধরা হয়েছে। ৭. এ কথায় ঐকমত্য হয়েছে যে, মধ্যম মানের মাল যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হবে। বাছাই করা সর্বোত্তম মালও নয় এবং সর্ব নিম্ন মালও নয়। অতঃপর কতিপয় খুঁটিনাটি বিষয়ে বিভিন্ন মতের উল্লেখ রয়েছে। যেমন একশ’ বিশটি উষ্ট্রের পর আরও যে উষ্ট্র রয়েছে, তার যাকাত বাবদ কি দিতে হবে? হযরত আবূ বকরের চিঠি বলছে, প্রতি চল্লিশটি বাবদ একটি তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটি বাবদ একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। হযরত আলী ও আমর ইবনে হাজমের চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘অতঃপর প্রথম থেকে হিসাব ধরে আসতে হবে।’ এই দুই ধরনের মতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পন্থা হচ্ছে, তাৎপর্যের দিক দিয়ে উভয় দলীলকেই অভিন্ন মনে করতে হবে এবং দলীলের ব্যাখ্যায়ই মতপার্থক্য ধরে নিতে হবে। মূল দলীলের কোনরূপ মতপার্থক্য নেই। এই চিঠিসমূহ নগদ স্বর্ণমুদ্রা বা গরু ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোন অকাট্য দলীল পেশ করছে না। আমার মতে এসব বিষয়ে কোন অকাট্য দলীল না দেওয়াই এ চিঠিসমূহের সত্যতার অকাট্য দলীল এবং এসব চিঠির মৌল উৎস নবী করীম(স), তা-ও নিঃসন্দহভাবে প্রমাণিত।তা কখনো কৃত্রিম বা মিথ্যা হতে পারে না। তা যদি শাখ্ত্-এর ধারণানুযায়ী পরবর্তীকালে ফিকহী মতের প্রভাবে রচিত হত, তাহলে তাতে বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চয়ই বক্তব্য পাওয়া যেত এবং পরবর্তীকালে যেসব ধন-মাল আবিষ্কৃত ও উদ্ভূত-উদ্ভাবিত হয়েছে, তা তার যাকাত পরিমাণের উল্লেখসহ সুন্দরভাবে সুমার্জিত ও সুবিন্যস্ত পাওয়া যেত। কিন্তু নবী করীম (স) প্রত্যেক জাতি ও গোত্রকে তাদের সম্মুখবর্তী বাস্তবভাবে উপস্থিত বিষয়ে পথ নির্দেশদিয়ে চিঠি পাঠাতেন। এ কারণে নগদ স্বর্ণমুদ্রা সম্পর্কে তিনি কোন স্পষ্ট কথা উল্লেখ করেছেন বলে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। কেননা তদানীন্তন সমাজে তা খুব বেশী ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না। ছিল রৌপ্য মুদ্রা, তাই সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেছে। গরু তখনকার দিনে সে দেশে বেশী ছিল না। এই কারণে সে বিষয়ে কেবলমাত্র ইয়েমেনে প্রেরিত মুআযকে লেখা চিঠিতেই তার উল্লেখ পাওয়া যায়, অন্যত্র নয়। একশ’টির উপর সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাতে মতভেদ ও তার কারণ আমরা পূর্বেই বলেছি, উষ্ট্রের সংখ্যা একশটির ঊর্ধ্বে উঠলে কি হিসেবে যাকাত দিতেহবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ও জমহুর ফিকাহ্বিদগণ মনে করেন প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্র শাবক দিতে হবে। আর প্রতি চল্লিশটিতে দিতে হবে একটি করে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক। হযরত আনাসও ইবনেউমর বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী আবু বকর ও উমর ফারূকের চিঠিতে তা-ই বলা হয়েছে। আর আমর ইবনে হাজম ও হাজারমাউতের প্রতি যিয়াদ ইবনে ওয়ালীদ লিখিত পত্রে রাসূলে করীম(স)-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে। একশ’ বিশটির ঊর্ধ্ব সংখ্যক উষ্ট হলে প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক যাকাত বাবদ দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে দিতেহবে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। কোন কোন বর্ণনায় সংক্ষিপ্তভাবে শুধু বিশেষ কথাটুকু উদ্ধৃত হয়েছে। কেননা নবী করীম(স) ইচ্ছা করেই ‘চল্লিশ’টির উল্লেখ ত্যাগ করেছেন। তবে এ বর্ণনাসমূহ পরস্পর পরিপূরক। হানাফী মাযহাবের মত ও তার পর্যালোচনা নখ্য়ী, সাওরী ও আবূ হানীফা প্রমুখ ইমাম বলেছেন: উষ্ট্র যদি একশ’ বিশটিরও অধিক থাকে, তাহলে নতুন করে ফরয সাব্যস্ত হবে অর্থাৎ চাগল দিয়ে যাকাত দিতে হবে- প্রতি পাঁচটিতে একটি ছাগী, ২৫টিতে একটি দুই বছর বয়সে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক এমনিভাবে। তার অর্থ, নিম্নোক্ত তালিকা অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে: উষ্ট্রের সংখ্যা চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক ছাগী ১২৫ ২+ ১ ১৩০ ২+ ২ ১৩৫ ২+ ৩ ১৪০ ২+ ৪ ১৪৫ ২+ দুই বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক ১ ১৫০ ৩ - ১৫৫ ৩ ১টি চাগী ১৬০ ৩+ ২টি ছাগী উষ্ট্রের সংখ্যা চতুর্থ বর্ষে উপনীতা শাবক ছাগী ১৬৫ ৩+ ৩টি ছাগী ১৭০ ৩+ ৪টি ছাগী ১৭৫ ৩+ দুই বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক ১৮৬ ৩+ তৃতীয় বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক ১৯৬ ৪ - ২০০ ৮ অথবা ৫টি তৃতীয় বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক দুই মতের পর প্রতি পাঁচটি উষ্ট্রের জন্য একটি ছাগী। এমনিভাবে হিসাব চলবে। পঞ্চাশটি পর্যন্ত পৌঁছলে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। তার পরে যাকাত দিতে হবে ছাগল দ্বারা। পরেদিতে হবে দুই বছরের উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দ্বারা। তার পরে দেবে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। পরে আবার সেউ চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। লক্ষণীয় যে, প্রথমবার নতুন করে যে হিসাব ধরা হয়েছে, একশ বিশটির পর একশ পঞ্চাশটি পর্যন্ত, তাতে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবদ ধরা হয়নি। হানাফী মতের দলীল হচ্ছে, আবূ দাউদে উদ্ধৃত একটি ‘মুরসাল’ হাদীস।তা ইসহাক ইবনে রাহওয়াই তাঁর মুসনাদ গ্রন্থেও উদ্ধৃত করেছেন। আর তাহাভী বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ ইবনে সালমাতা থেকে। তিনি বলেছেন: আমি কাইস ইবনে সায়াদকে বললাম: ‘আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে গাজমের চিঠিটি দিন। তিনি আমাকে একটি চিঠি দিলেন। বললেন, এটি তিনি আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাজম থেকে গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, নবী করীম (স) আমার দাদার নামে এ চিঠি লিখিয়েছিলেন। অতঃপর আমি তা পড়লাম। তাতে উস্ট্রের যাকাত বাবদ কি দিতে হবে তা লিপিবদ্ধ ছিল।’ পরে তিনি গেটা হাদীসটির উল্লেখ করলেন। একশ’ বিশটি হলে কি দিতে হবে, তার উল্লেখ ছিল।তার অধিক হলে প্রতি পঁচিশটির জন্য একটি চার বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাসক দেয়ার কথাও তাতে রয়েছে। এর অধিক হলে প্রথম ফরয অনুযায়ী হিসাব চালাতে হবে। আর পঁচিশটির কম হলে ছাগল দিতে হবে। প্রতি তিন থেকে দশটি উষ্ট্রের জন্য একটি করে ছাগী দিতে হবে। এই সব সংখ্যা নির্ধারণ শরীয়াতের বিধান, তা কোন লোক কল্পনা করে বলতে পারে না। ইবনে রুশ্দ এ কথাটি বলেছেন। [আরবী *********] জমহুর ফিকাহ্বিদগণ হানাফী মতের উপরিউক্ত দলীল প্রত্যাখ্যান করেচেন। তাঁদের মতেও সব কথা সম্পূর্ণ যয়ীফ, গ্রহণের অযোগ্য। বায়হাকী বলেছেন, ‘ইবনে মাসউদ থেকে উপরিউক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়নি।’ আর হযরত আলীর নিজের উক্তি কিনা, এ বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর লিখিত চিঠির সমর্থনে যেমন বর্ণনা এসেছে, তেমনি তার বিরোধী বর্ণনাও উদ্ধৃত হয়েছে। আর কোন হাদীসের বর্ণনায় এরূপ মতভেদ সংঘটিত হলে অন্যান্য বিরোধমূলক বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করাই শ্রেয়। আসমের নিজের বর্ণনায় এমনসব বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, যা প্রত্যাহার করা সম্পর্কে সকলেই একমত। যেমন পঁচিশটি উষ্ট্র বাবদ পাঁচটি ছাগী দিতে হবে, দুই বছর উপনীতা উষ্ট্রী শাবক নয়। তবে হাদীসের সাথে সংগতি সম্পন্ন শুরু থেকেই ফরয ধরা সংক্রান্ত বর্ণনা সম্ভব মনে করা যায়। আর আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তাদের মনোভাব হল: ক. শুরু থেকেই ফরয ধরা অর্থ তা-ই, যা হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের চিঠিদ্বয়ে উল্লিখিত হয়েছে অর্থাৎ প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক ও প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দেয়া ফরয। এ মতে সমস্ত হাদীস একমত। [আরবী******* খ. বহু লোকই উক্ত হাদীসকে যয়ীফ মনে করেন। ১) কেননা তা হযরত আনাসবর্ণিত সহীহ হাদীসের বিরোধী। ২) কেননা হযরত আবূ বকর ও উমরের চিটিদ্বয়ের সাথে সংগতিসম্পন্ন অন্যান্য হাদীসসমূহেরও তা বিপরীত। বায়হাকী প্রমুখ এ সব বর্ণনার উপর আস্থা স্থাপন করেছেন। [আরবী*******] ৩) যাকাত পর্যায়ে যে মূলনীতি, হাদীসটি তার বিরোধী। আর তা হচ্ছে, যাকাত যে মালের, সেই মালই যাকাত বাবদ গ্রহণ করতে হবে- নিতান্তই প্রয়োজন দেখা দিলে ভিন্ন কথা। পঁচিশের কম সংখ্যক উষ্ট্রে যেমন হয়। তখন অন্য জিনিস দিয়ে যাকাত আদায় করা যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উষ্ট্রের বিপুলতার দরুন ছাগল গ্রহণের কোন প্রয়োজন নেই। আরও এ জন্যে যে, পাঁচটির অধিক সংখ্যক উষ্ট্র থাকলে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবকের পরিবর্তে চতুর্থ বর্ষের উষ্ট্রী শাবকদিতে হয়। এটা সামান্য বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে এরূপ পরিবর্তনের কোন আবশ্যক নেই। একুশটির অধিক হলে প্রথম ফরযের দিকে প্রত্যাবর্তন সর্বসম্মত। ফিকাহ্বিদদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, আমর বিন হাজমের চিঠিতে লিখিত কথা হযরত আবূ বকরও উমর ফারুকের চিঠিদ্বয়ে উল্লিখিত কথা দ্বারা নাকচ হয়ে গেছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা জম্হুর ফিকাহ্বিদদের মত গ্রহণ করে তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছেন। ইমাম শাফেয়ী, আওযায়ী, আহমদ, ইবনে হাম্বল এবং আহ্লি হাদীস ফকীহ্গণ এই মতই গ্রহণ করেছেন। এঁরা এ ক্ষেত্রে রাসূলের ও তাঁর খলীফাগণের সুন্নাতেরই অনুসারী। তিনটি মতের মধ্যে যেটি মধ্যম বা উত্তম, তাই তারা গ্রহণ করেছেন। আর তা হচ্ছে, বহু সংখ্যক উষ্ট্র থাকলে প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী এবং প্রতি পঞ্চাশটিতে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী দিতে হবে। কেননা নবী করীম(স)-এর যে দুটি কাজের বিবরণ জানা গেছে, এটি তন্মধ্যে সর্বশেষ আমল। কিন্তু একশ’ বিশটির পর নতুন করে ফরযেরহিসাব করার মতটি প্রথমে প্রকাশিত। কেননা আমর ইবনেহাজম নাজরানে নিযুক্ত হয়েছিলেন রাসূলে করীমের জীবনের শেষভাগে; মৃত্যুর প্রাক্কালে। আর হযরত আবূ বকর লিখিত চিঠি তো নবী করীম (স) কর্তৃকই শিখানো হয়েছিলো। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত আবূ বকরই তা সর্ব প্রথম প্রকাশ করেছেন। [(আরবী **********)] ইবনে তাইমিয়্যা আমর ইবনে হাজমের চিঠিকে দুর্বল বলেন নি। তিনিমনে করেছেন, তা নাকচ হয়ে গেছে। কেননা তা প্রথম দিকের কাজ ছিল। আবূ বকর ও উমরের চিঠি ছিল শেষ পর্যায় সংক্রান্ত বিষয়ে আর নিয়ম হচ্ছে, দুটি মতের মধ্যে সামস্য বিধান সম্ভব না হলে শেষের মতটি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় মতটিকে প্রথম মতটির নাকচকারী মনে করতে হবে- অবশ্য যদি প্রথম কোনটি ও শেষে কোনটি তা নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায়। এ সব কথা থেকেই এ কথা স্পষ্টহয়ে উঠে যে, দলীলেরদিক দিয়ে জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতই অকাট্য। হানাফী মতের তুলনায় এ মতটির পক্ষে দলীল অনেক বেশী। জমহুর আলিমগণ এ মতই প্রকাশ করেছেন। শেখ আব্দুল আলী বহরুর উলুম উপাধিধারী (আরবী***) গ্রন্থে (১৭০-১৭১পৃঃ) ইবনুল হুম্মামের মতের প্রতিবাদ করেছেন। পরেলিখেছেন ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহ্মদেরমতই অধিক গ্রহণযোগ্য। [(আরবী **********)] তাবারীর মত ইমাম আবূ জাফর তাবারী এক মধ্যম মত গ্রহণ করেছেন। তাতে তিনি উভয় মতকেই সহীহ্ বলেছেন এবং বলেছেন: এ দুটি মতের চরম লক্ষ্যকে অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়। [(আরবী **********)] আমার দৃষ্টিতে এটি একটি উত্তম মত। কেননা একটি মতের দ্বারা অপর মতটি নাকচ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার তো তখনই গ্রহণীয় হতে পারে, যখন উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় বিধান অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তাবারীর সমন্বয় সাধনের মত অবশ্যই গ্রহণীয়। কেননা লক্ষণীয় যে, এ বয়স, পরিমাণ, সংখ্যা ও রকম বা প্রকার নির্ধারণ কাজের সুবিধা ও সহজের জন্যেই তা করা হয়েছে। এতে করে হিসাব করাও সহজসাধ্য, ব্যাপকভাবে কার্যকর করাও সম্ভবপর। এমতাবস্থায় যাকাত দাতা যখনই বাছাই করে কোন একটা করার অধিকারী হবে, তখন তার পক্ষে তা করাও সহজ হবে। যাকাত সংক্রান্ত পত্রসমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্যের তাৎপর্য এখানে খনিকটা অপেক্ষা করে একটি বিষয় বিবেচনা করা আবশ্যক। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন থেকে যাকাত পর্যায়ে যেসব চিঠি বর্ণিত হয়েছে, আমরা সে সবের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য লক্ষ্য করছি। আমরা যে সব বর্ণনার কথাই বলছি, যার সনদ গ্রহণযোগ্য। যয়ীফ ও প্রত্যাখ্যাত সনদে বর্ণিত কথার প্রতি আমরা ভ্রুক্ষেপও করছি না। এই ধরনের একটি বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আলীর চিঠি, যাতে লিখিত রয়েছে: যাকাতদাতা যদি কোন এক বয়স অপেক্ষা অধিক জন্তু যাকাত বাবদ দিয়ে দেয় তাহলে দশ দিরহাম কিংবা দুইটি ছাগী তাকে ফেরত দিতে হবে। [(আরবী **********)] হযরত আবূবকরের চিঠিতে নবী করীম(স)-এর ধার্য করা যাকাত পরিমাণ পর্যায়ে বলা হয়েছে: তিনি নির্দেশ দিয়েছেন য, দুটি ছাগী কিংবা বিশটি দিরহাম তাতে ফেরত দিতে হবে। পূর্বে উদ্ধৃত হযরত আনাসের হাদীসওতা-ই বলা হয়েছে। হযরত আবূ বকর ও উমরের চিঠিদ্বয়ের বিপরীত কিছু কিছু কথা হযরত আলীর চিঠিতে এসেছে। এ কথা সত্য, হযরত আলীর কথা নবী করীম(স) থেকে পাওয়া বলে প্রমাণিত হয়নি। এ কথাও সত্য যে, তা হযরত আলীরই কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত আলী নবী করীম(স)-এর লিখত কথার বিপরীত কথাকে কি করে চালু করলেন? তাহলে আমরাকি হযরত আবূ বকর ও উমর ফারূক লিখিত চিঠিতে দোষ তালাশ করতে সচেষ্ট হব? অথচ তা অতীব বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়েছে? অথবা আমরাকি বলব যে, হযরত আলী জানতে পেরেছেন, অন্যান্য চিঠি নাকচ হয়ে গেছে? আর তাঁর মতটাই সুরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হয়, প্রথম দুজন খলীফার সময়ে তা অপ্রকাশিত থাকতে পারল কি ভাবে? আসলে এসব সম্ভাবনাই অগ্রহণযোগ্য। আমার দৃষ্টিতে স্পষ্ট কথা হচ্ছে, নবী করীম(স) এসব পরিসংখ্যান ও পরিমাণ নির্ধারণেরকাজ করেছেন। এই মর্যাদা সহকারে যে তিনিই মুসলিম উম্মতের উপর নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন। নবী হিবেনয়। আর নেতৃত্বের বিশেষত্ব ও অধিকার হচ্ছে সময়, স্থান ও অবস্থার প্রেক্ষিতে জনগণের জন্যে যা-ই সর্বাধিক কল্যাণকর হবে, তা-ই তিনি চালু করবেন; তা কার্যকরকরার জন্যে সকলকে নির্দেশদেবেন। আর সেই সময় স্থান ও অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেল- অথবা এর কোন একটিও পরিবর্তিত হলে সেই অনুপাতে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত ব্যবস্থা চালু করবেন। পক্ষান্তরে যা নবী হিসেবে বলা হবে, তা সংশ্লিষ্ট্য সকলের জন্যে সর্বকালে ও সর্বস্থানে অবশ্য পালনীয়। শরীয়াতী বিধানে এই যে বিভিন্ন বয়স এবং দুই ছাগী ও বিশ দিরহামের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও এ ধরনের অবস্থায় একই স্থিতিশীল মূল্যের উপর পার্থক্য প্রমাণিত হয়; কেননা উষ্ট্র ও ছাগীর মধ্যে সম্পর্ক বা আনুপাতিকতা যদিও প্রমাণিত হয়, কিন্তু দুটি ছাগীর বিশ দিরহাম মূল্য নির্ধারণ কোন ক্রমেই প্রমাণিত হয় না। কেননা এতে করে ছাগীর মূল্য অত্যধিক করা হয়েছে। অথবা দিরহামের ক্রয়শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এর বিপরীতটা হয়েছে- যেমন একালে সর্বত্র লক্ষণীয়; নবী করীম(স) যখন ছাগীর মূল্য বিশ দিরহাম নির্ধারণ করেছেন, তখন তা করেছেন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে চলমান বাজার মূল্যেল অনুপাতে। তাই এ ছাড়াও পার্থক্য পরিমাপ করায় কোন বাধা আছে আমরা মনে করি না। কেননা বাজার মূল্য তো পার্থক্যপূর্ণ হয়ে থাকে।সব সময় বাজার মূল্য একই রকম থাকতে পারে না। এই ভিত্তির উপর নির্ভর করেই রাষ্ট্রনেতা হযরত আলীর পরিমাণ নির্ধারণ কার্যকর হয়েছে। দুই ছাগীর বয়স কিংবা দশ দিরহামের পার্থক্য নির্ধারিত হয়েছে। এতে মনে হয় তাঁর খিলাফত আমলে ছাগলের মূল্য হ্রাস পেয়েছিল। তাই তাতে নবীর আদেশের বিরোধতার কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। চিঠিসমূহের পারস্পরিক পার্থক্যের- কিছু কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপারে পার্থক্যের- এ ব্যাখ্যা বা কারণ বিশ্লেষণ করা এসবের সনদ ও প্রমাণে সংশয় আরোপ কর তা প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে অনেক উত্তম বলে মনে হয়। ইমাম ইয়াহ্ ইয়া ইবনে মুয়ীন যেমন করেছেন। বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণের ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ্ প্রমাণিত হয়নি। -এই যেমন উষ্ট্রের বয়স বা পরিসংখ্যান, গরু ইত্যাদির নিসাব। ইবনে হাজম তীব্রভাবে এর প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, তাঁর এ কথাটি প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কেননা এটা একটা দলীলহীন দাবি মাত্র। আর প্রাচ্যবিদ শাখ্ত যেমন করে যাকাত সংক্রান্ত সমস্ত সহীহ্ হাদীসের প্রতিই সংশয় আরোপ করেছেন। অথচ এ হাদীসসমূহ নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত এবং তা থেকে যাকাত ব্যবস্থার বিস্তারিত রূপ প্রাণিত হয়। তৃতীয় আলোচনা গরুর যাকাত গরু বিশেষ প্রকারের গবাদিপশু। আল্লাহ তা’আরা এগুলো সৃষ্টি করে মানুষেরপ্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তার সাথে মানুষের বহু প্রকারের কল্যাণ যুক্ত করে দিয়েছেন। এগুলো যেমন বংশবৃদ্ধির জন্যে পালা হয়, তেমনি চাষাবাদ ও পানি টানার জন্যেও প্রয়োজনীয়। এর গোশ্ত, চামড়া, অস্থি সবই মানুষের কাজে লাগে। আর দেশ, অবস্থা ও প্রয়োজনের পার্থক্যের ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়।] মহিষ ও গরুরই পর্যায়ে গণ্য গবাদিপশু। কাজেই এ দুটির মধ্যে কোন পার্থক্য করা চলে না। ইবনুল মুনযির তাই বলেছেন। [(আরবী *********)] আর গরুর যাকাত দেয়া তো সর্বসম্মতভাবেই ফরয। ইজমা ও হাদীস উভয়ই তা প্রমাণ করে। উল্লেখ্য হাদীস হযরত আবূ যর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: আমি নবী করীম(স)-এর কাছে উস্থিত হলে তিনি বললেন; যার মুস্টির মধ্যে আমার প্রাণ (বা যিনি ছাড়া ইলাহ্ কেউ নেই), যে লোকেরই উষ্ট্রী বা গরু বা ছাগল থাকবে; কিন্তু যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তার চাইতে বড় আকারের আকৃতি হয়ে তা আসবে এবং ক্ষুর দিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করবে এবং শিং দিয়ে তাকে আহত করবে। যখন দ্বিতীয়টি আসবে, প্রথমটিকে প্রত্যাহার করা হবে- যতক্ষণ না লোকদের মধ্যে চূড়ান্ত বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ ইমাম বুখারী বলেছেন, হযরত আবূ হুরায়রা নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ‘যে লোক যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিন ও কঠোর আযাব দেয়া হবে।’ কেননা যাকাত হচ্ছে ধন-মালের দেয় হক্। হযরত আবূ বকর এজন্যেই যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। হযরত উমর ও অন্যান্য সবসাহাবীই এ পদক্ষেপকে যথার্থ বলে সম্মতি দিয়েছিলেন। সমগ্র মুসলিম সমাজ এ যাকাতের ফরয হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। কোন প্রকার শোবাহ্-সন্দেহ এতে নেই। কোন এক যুগেও কোন সামান্য মত-পার্থক্য দেখা দেয়নি। অবশ্য নিসাব নির্ধারণে সামান্য মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। [আরবী *********] গরুর যাকাতের নিসাব একথা সকলেরই জানা যে, ইসলাম সর্বপ্রকারের ধন-মালে তা কম হোক কি বেশী, যাকাত ফরয করেনি। উপরন্তু যাকাত বাবদ খুব কম পরিমাণ মালই ফরয করা হয়েছে। কত পরিমাণ বেশী ধন-মাল থাকলে যাকাত দিতে হবে, তার সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাকেই পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলা হয়। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন থেকে বর্ণিত বহু হাদীসেই এ সীমা নির্দিষ্ট হয়েছে। বলা হয়েছে, পাঁচটি উষ্ট্র থাকলে যাকাত হবে এবং চল্লিশটি ছাগল থাকলে যাকাত দিতে হবে। তাহলে কত সংখ্যক গরু থাকলে যাকাত দিতে হবে- যার কমহলে যাকাত ফরয হবে না? নবী করীম (স) থেকেএ পর্যায়ে কোন নিসাব নির্ধারণকারী সহীহ্ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়নি। তবে উষ্ট্রের নিসাব ও সংখ্যা ও ফরযের পরিমাণ স্পষ্ট ভাষায় ও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। হিজাজে অনেক সময় গরুর সংখ্যাল্পতা দেখা দিত। এ কারণে তিনি তাঁর লিীখত ও প্রখ্যাত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিপত্রে গরুর যাকাত সম্পর্কে কিছুই লিখেন নি, যেমন অন্যান্য বিষয়ে লিখেছেন। এটাও সম্ভব যে, উষ্ট্রের যাকাতের কথা বলে দেয়াকেই এ পর্যায়ে যথেষ্ট মনে করেছেন। কেননা শরীয়াতের দৃষ্টিতে দুটি একই ধরনের গবাদিপশু। আর এ কারণেই গুরর যাকাতরে পরিসংখ্যানে ফিকাহ্বিদগণের মধ্য মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রসিদ্ধ কথা- নিসাবের সংখ্যা ত্রিশ চারটি মাযহাবেই সমর্থিত প্রখ্যাত করা হচ্ছে, গরুর নিসাব-সর্বনিম্ন সংখ্যা- ত্রিশ। অর্থাৎ ত্রিশটি গরু থাকলেই যাকাত দিতে হবে। তার কম সংখ্যার জন্যে নয়। আর ত্রিশটি গরু থাকলে ও তার যাকাত বাবদ িএক বছর বয়সের একটা বাছুর দিতে হবে। আর চল্লিশটি থাকলে দিতে হবে দুই বছর বয়সের একটা বাছুর। অতঃপর ঊনষাটটি পর্যন্ত আর কিছুই দিতে হবে না। যদি ষাটটি হয়, তাহলে দুটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। ষাটের পর সত্তরটি হলে একটি দুই বছর বয়সের ও একটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। আশিটি হলে দুটি দুই বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। নব্বইটি হলে তিনটি এক বছর বয়সের, একশটি হলে একটি দুই বছর বয়সের ও দুটি এক বছর বয়সের এবং একশ’ বিশটি হলে তিনটি দুই বছর বয়সের অথবা চারটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। এ কথার দলীল হচ্ছে হযরত মুআয থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন: রাসূলে করীম(স) আমাকে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং আমাকে প্রতি ত্রিশটি গরুর যাকাত বাবদ একটি এক বছর বয়সের ও প্রতি চল্লিশটির জন্যে একটি দুই বছর বয়সের বাছুর গ্রহণ করতে আদশে করলেন। [(আরবী *********)] ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটিকে উত্তম এবং ইবনে হাব্বান ও হাকেম এ হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। ইবনে আব্দুল বার্ বলেছেন, এই হাদীসটির সনদ বিঘ্নমুক্ত সহীহ্ এবং সপ্রমাণিত। মুয়াত্তা গ্রন্থেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। তবে ইবনে হাজম এই হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন। কেননা তার মতে বর্ণনাকারী মস্রুক হযরত মুআযের সাক্ষাত পান নি। কিন্তু পরে অন্যত্র এই ভুলের সংশোধন করে লিখেছেন যে, মসরুক মুআযের সাক্ষাত পেয়েছেন নিঃসন্দেহে। কাজেই গরুর যাকাত পর্যায়ে এ হাদীস অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। হাফেয ইবনে হাজর আল-আসকালানী লিখেছেন গরুর যাকাত পর্যায়ে হযরত মুআয বর্ণিত হাদীসেবলা কথাই সর্বসম্মত, এই বিষয়ে কোন মতভেদই নেই। রাসূলে করীমের যে চিঠি আমর ইবনে হাজমের প্রতি লিখি, তাতেও এ কথাই উদ্ধৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, ত্রিশটি গরুতে একটা এক বছরের বাছুর দিতে হবে। কিন্তু মুআয ও আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসে একথা বলা হয়নি যে, এই ত্রিশটিই সর্বনিম্ন নিসাব। কাজেই ত্রিশটির কম সংখ্যক গরুর যাকাত গ্রহণ করায় উক্ত হাদীসদ্বয়ে নিষেধ নেই। ইবনে আবদুল বার গরুর উক্তরূপ যাকাত- নিসাব সর্বসম্মত ও তার উপর ইজমা রয়েছে বলে যে দাবি করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। কেননা সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব জুহরী, আবূ কালাবা ও তাবারী প্রমুখ ইমাম ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। হাফেয আবদুল হক্ থেকে বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, গরুর যাকাতের নিসাব পর্যায়ে সর্ব সমর্থিত কোন সহীহ্ হাদীস নেই। মুআয বর্ণিত হাদীসেএকটি কথা অকাট্য যে, গরু চল্লিশটির ঊর্ধ্ব সংখ্যক হলে ষাটটি না হওয়া পর্যন্ত আর কোন যাকাত নেই। মুআয বর্ণনা করেছেন, লোকেরা ভগ্ন সংখ্যার যাকাতনিয়ে এলে তা গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনজন বড় ইমাম, আবূ ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ও জমহুর আলিমগণ এই মতই সমর্থন করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা থেকে প্রখ্যাত মত পাওয়া গেছে যে, চল্লিশটির অধিক গরুর হিসাবে হবে প্রতিটি গরুর জন্যে দুই বছর বয়সের বাছুরের দশ ভাগের এক-চতুর্থাংশ। হাসান বর্ণনা করেছেন, চল্শিটির বেশী হলে পঞ্চাশটি না হওয়া পর্যন্ত কোন যাকাত হবে না। পঞ্চাশটি হলে একটি দুই বছর বয়সের বাছর ও এক-চতুর্থাংশ যাকাত বাবদ দিতে হবে। ইমাম তাবারীর মতে নিসাব পরিমাণ পঞ্চাশটি ইমাম আবূ জাফর তাবারী মত দিয়েছেন যে, গরুর নিম্ন সংখ্যক নিসাব হল পঞ্চাশটি। এ পর্যায়ে সুনিশ্চিত ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এতে কোনরূপ মত বৈষম্যের অবকাশ নেই। আর তা হচ্ছে, প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি গরু দিতে হবে। তাই তা গ্রহণ করাই জরুরী। আর তার কমে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে তা ফরয হওয়ার পক্ষে কোন অকাট্য দলীল নেই। ইবনেহাজম ইমাম তাবারীর এই মত গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, এ ব্যাপারে মতবিরোধ হয়েছে এবং ফরয হওয়ার পক্ষেকোন দলীল নেই, তার ভগ্নাংশ করার পক্সেও কোন কথা বলা হয়নি। কেননা তাতে মুসলিম ব্যক্তির মাল ফরয যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হয় নিশ্চয়তাবিহীনভাবে। কেননা তার পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর কোন অকাট্য দলীল নেই। ইবনে হাজম এ মতেরসমর্থনে আমর ইবনে দীনার বর্ণিত একটি কথার উল্লেখ করেছ। তাতে বলা হয়েছে, ইবনে যুবায়র ও ইবনে আউফের কর্মচারীরা প্রতি পঞ্চাশটি গুরুর যাকাত বাবদ একটি গরু গ্রহণ করতেন। আর প্রতি একশটির জন্যে গ্রহণ করতেন দুটি গরু। তার অধিক গুরু গ্রহণ করতেন। আর প্রতি একশটির জন্যে গ্রহণকরতেন দুটি গরু। তার অধিক হলে প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি গরু নিতেন। এ কাজটি সাহাবাগণের উপস্তিতিতেই করা হয়েছে; কিন্তু তাঁরা এর প্রতিবাদ করেন নি। এই মতের উপর দুটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমটি হাদীসের বর্ণনার দৃষ্টিতে, আর দ্বিতীযটি বিবেচনার দৃষ্টিতে: ক. আমর ইবনে হাজমের সাদকা ও দীয়ত পর্যায়ে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, প্রতি ত্রিশটি গরুতে একটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। আর প্রতি চল্লিশটিতে একটি গুরু। বহু সংখ্যক ইমামএ হাদীসটিকে সহীহ্ বলেছেন। হযরত মুআয বর্ণিত হাদীসেও প্রতি ত্রিশটি ও প্রতি চল্লিশটির উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। এ হাদীসটিকে সহীহ্ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। খ. বিবেচনার দৃষ্টিতে প্রশ্ন উঠে, শরীয়াতের হুকু-আহকাম কারণের উপর ভিত্তিশীল। তার লক্ষ্য মানবতার কল্যাণ। এ দৃষ্টিতে একটা স্বাভাবিক যে, সুবিচারক শরীয়াত প্রতি পাঁচটি উষ্ট্রে ও প্রতি চল্লিশটি ছাগলের উপর যাকাত ধার্য করব এবং পাঁচটির কম গরুর উপর যাকাত ধার্য করবে না। কেননা তা ঠিক উটের মত না হলেও ছাগলের তুলনায় অধিক উপকারী ও কল্যাণদায়ক। ইনুল মুসায়্যিব ও জুহ্রীর মত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, মুহাম্মদ িইবনে শিহাব জুহারী ও আবূ কালাবা প্রমুখ ইমাম মত প্রকাশ করেছেন যে, উষ্ট্রের নিসাবই গরুর নিসাব। গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হবে, যা উষ্ট্রের যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হয়। তবে উষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন বয়সের শর্ত রয়েছে, তেমন কোন শর্ত এক্ষেত্রে নেই। এ কথাটি যাকাত পর্যায়ে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব লিখিত চিঠির বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হচে, যা গ্রহণ করা হবে উষ্ট্রের যাকাত বাবদ। অন্যান্য মনীষীদেরও এ মতই বর্নিত হয়েছে। হযরত জবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা) বলেছেন: প্রতি পাঁচটি গরুর যাকাত বাবদ একটি ছাগী দিতে হবে, প্রতি দশটিতে দুটি ছাগী, পনেরটিতে তিনটি ছাগী এবং বিশটিতে চারটি ছাগী। জুহরীর মতে গরুর ফরয যাকাত উষ্ট্রের মতই। তবেতাতে বয়সের কোন শর্ত নেই। পঁচিশটি গরু হলে িএকটি গরু দিতে হবে। এ হিসাব পঁচাত্তরটি পর্যন্ত চলবে। তার অধিক হলে একশ বিশটি পর্যন্ত দুটি গাভী দিতে হবে। তার অধিকহলে প্রতি চল্লিশটিতেও একটি গাভী দিতে হবে। একটি বর্ণনায় ইয়েমেনবাসীদের জন্যে পরিমাণ হালকা করে প্রতি ত্রিশটিতে একটি এক বছর বয়সের শাবক এবং প্রতি চল্লিশটিতে একটি গাভী দিতে হবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইকরামা ইবনে কালিদ বলেছেন, আমাকে যাকাত আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে আমি যাকাত দাতাদের সাথে সাক্ষাত করি। এটা নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশার কথা। তারা আমাদের কাছে বিভিন্ন মত প্রকাশ করে। কেউ বলে, উষ্ট্রের যাক, গরুর যাকাত তা-ই গ্রহণ করুন। কেউ বলে, প্রতি চল্লিশটি গরু বাবদ দুই বছরের একটি বাছুর গ্রহরণ করুন। উমর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে খালদাতাল্ আনসারী থেকেও বর্নিত হয়েছে যে, গরুর যাকাত উষ্ট্রের যাকাতের মতই। এই মতের দলীল ক. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান বলেছেন: নবী করীম (স) ও উমর ইবনুল খাত্তাব লিখিত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে: গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হবে, যা গ্রহণ করা হয় উষ্ট্রের বাবদ। মা’মার থেকে বর্ণিত: সামাক ইবনুল ফযল আমাকে নবী করীম(স)-এর একটি চিঠি দিলেন যা মালিক ইবনে কুফলান্সের কাছে লেখা হয়েছিল তাতে আমিপড়লাম.... গরুতে তা-ই, যা উষ্ট্রে....। খ. ইমাম জুহরী বলেছেন, এটাই রাসূলে করীম (স)-এর সর্বশেষ কথা। প্রথম কথা ছিল, প্রতি ত্রিশটি গরুরতে একটা এক বছরের বাচুর। এটা ইয়েমেনবাসীদের জন্যে সহজকৃত হার ছিল। এটি ‘মুরসাল’ হাদীস হলেও পূর্বোদ্ধৃত হাদীস ও সাহাবীগণের কথা এর সমর্থক। ইবন হাজম বলেছেন, কারোর ‘মুরসাল’ হাদীস গ্রহণ করা হলে ইমাম জুহরীর ‘মুরসাল’ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কেননা তিনি হাদীস সম্পর্কে বড়ই পারদর্শী। আরও এজন্যে যে, তিনি বহু সংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন। খ. পূর্বে যে সাধারণ অর্থবোধক হাদীসটি আমরা উদ্ধৃত করেছি (যাতে বলা হয়েছে ‘যে, গরু-মালিক যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিন শাস্তিদেয়া হবে’) তা প্রত্যেক গরু সম্পর্কেই বক্তব্য। তবে বিশেষ কোন দলীল কিংবা ইজমা যদি তার বিপরীত হয়, তবে সে কথা স্বতন্ত্র। তাঁরা বলেছেন, অন্যেরা যদি অপর হাদীসটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেন তা হলে আমরা এ হাদীসটিকে দলীল মনে করব। আর হাদীসে ত্রিশটির কমসংখ্যক গরুতে যাকাত না হওয়ার কথার উল্লেখ নেই। এ কথার কোন দলীলও নেই। ঘ. গরুকে উষ্ট্রের মত গবাদিপশু মনেকরা হলে উক্ত মত অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফিকাহ্বিদগণ বলেন, একটি উস্ট্রে যেমন সাত জন লোকের কুরবানী চলে, তেমনি একটি গরুতেও চলে। যদিও অনেকে আমাদের সাথে একমত নয়। তাই উষ্ট্রের যাকাত যা, গরুর যাকাত তা-ই। ইবনে হাজম এ মতের বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁর মতে এ পর্যায়ে রাসূল থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহের সনদ তিনি পর্যন্ত পৌঁছেনি। এ কারণে তার দলীল হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারে না। সাধারণ অর্থবোধকযে হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে, তা হানাফী ও মালিকী মায্হাব অনুসারীদের জন্যে বাধ্যতামূলক। তা সব গরুর ক্ষেত্রেই সমান। আরও দলীল এই যে, কুরআনের আয়াত- তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর’ সাধারণ অর্থবোধক বিধায় মধুতেও যাকাত ফরয হয়। এ কারণে হানাফী মত-অনুসারীদের জন্যে তা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাআমাদরে উপর বাধ্যতামূলক নয়। কেননা দলীলের সাধারণ বোধগম্য অর্থ স্বীকার করেও আমাদের মত হল, তা শরীয়াতের কোন বিধানরূপে স্বীকৃত হতে পারে না। কিন্তু পাঁচটি গরুতে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে রাসূলে করীম(স) থেকে কোন সহী্ দলীল প্রমাণিত হয় না। উষ্ট্রের যাকাত-নিসাব অনুরূপ গরুর যাকাত-নিসাব নির্ধারণ এই মতে বিশ্বাবাসীদের জন্যেই বাধ্যতামূলক হতে পারে। কোন কিয়াস যদি ‘সহীহ হয়ই, তা হলে এটা অবশ্যই সহীহ্ মানতে হবে। আর উষ্ট্র ও গরু সংক্রান্ত শরীয়াতী হুকুমেকোন সর্বসম্মত পার্থক্য আছে বলে আমরা জানতে পারিনি; ইবনে হাজম এতদূর বলেছেন যে, তাদের এ দলীল আমাদের উপর প্রযোজ্য থাকেনি। কেবলমাত্র হানাফী, মালিকী ও শাফেয়ী মাযহাবের লোকদের জন্যেই তা বাধ্যতামূলক। মাযহাবপন্থী আলিমগণ এ মতের প্রতিবাদ করে বলেছেন, উপরিউক্ত মতের উষ্ট্রের উপর গরুকে ‘কিয়াস’ করা হয়েছে। কিন্তু নিসাব কখনও কিয়াসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় না। তা হবে অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে। কিন্তু তাঁরা কোন দলীলের উল্লেখ করতে পারেন নি বলে তা অপ্রমাণিত। ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন এ কিয়াস গ্রহণের অযোগ্য। কেননা পঁয়ত্রিশটি ছাগল কুরবানীরর ক্ষেত্রে পাঁচটি উষ্ট্রের সমান হয়। আর তাতে যাকাত নেই, যেমন মুআয সংক্রান্ত হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। ভিন্নমত ইবনে রুশ্দ ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। আর তা হল প্রতি দশটি গরুতে একটি ছাগী দিতে হবে। ত্রিশটি পর্যন্ত তাই চলবে। ত্রিশটিতে দিতে হবে একটি দুই বছরের বাছুর। ইবনে আবূ শায়বা’র ‘আল-মুসান্নাফ’ গ্রন্থে লিখিত আছে: প্রতি দশটি গরুতে একটি করে ছাগী, প্রতি বিশটি গরুতে দুদিট ছাগী এবং প্রতি ত্রিশটিতে একটি দুই বছরের বাছুর দিতে হবে। এ কথার অর্থ, দশটিই হল গরুর নিসাব পাঁচটি নয়। ইবনে আবূ শায়বা এ কথার পক্ষেকোন দলীলের উল্লেখ করেন নি। আমি মনে করি, উক্ত কথার দলীলরূপে সেসব হাদীসই গণ্য করা যেতে পারে, যা দীয়তের পরিমাণ পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে। আর তা হচ্ছে, একশ’টি উষ্ট্র অথবা দুইশ’টি গরু। হযরত উমরের কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীমের উক্তিরূপেই উদ্ধৃত হয়েছে যে, একটি উষ্ট্র দুটি গরুর সমান। তাই উস্ট্রেরযখন একটি ছাগী, তখন প্রতি দশটি গরুতে একটি ছাগী যাকাত বাবদ দিতে হবে। প্রাসঙ্গিক কথা উপরে উদ্ধৃত বিভিন্ন মতের প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যে ত্রিশ-চল্লিশ ও তদূর্ধ্ব সংখ্যার মত দিয়েছেন, উপরিউক্ত মতসমূহের মধ্যে তা-ই অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযোগী। এই পর্যায়ে দলীল হচ্ছে, হযরত মুআয ও আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীস। তবে ত্রিশের কম সংখ্যকের ব্যাপারে হাদীস দুটির পক্ষেরবা বিপক্ষের কিছুই নেই। কেননা এ হাদীস দুটি আগেই বলে দিয়েছে ফরযের পরিমাণ ও তার পরিচয়। অতএব তা নিসাব- বর্ণনার অধিক। আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, প্রতি চল্লিশ দীনারে কে দীনার যাকাত। কিন্তু তাই বলে জমহুর ফিকাহ্বিদগণ বিশ দীনারে যাকাত গ্রহণ করতে নিষেধ করেন নি। কেননা হাদীসটি পরিমাণের উল্লেখ করেছে, নিসাব নয়। কাজেই ইবনুল মুসাইয়্যির, জুহরী ও তাঁদের সমর্থক অপরাপর তাবেয়ী ফিকাহ্বিদগণ পাঁচটি গরুর যে নিসাব নির্দিষ্ট করেছেন, তা গ্রহণ করার বড় সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে হযরত উমর লিখিত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিতে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীদের মধ্যে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ও রয়েছেন। বরং তাঁর সম্পর্ক রাসূলে করীম(স)-এর চিঠির সাথে। যদিও আবূ উবাইদ বলেছৈন যে, অসংরক্ষিত। লোকেরা তা জানে না। কিন্তু সাহাবী ও তাবেয়িগণ তা জানেন। সর্বোপরি, উষ্ট্রের উপর ধারণা করে গরু সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ একটিপন্থা। এটাই ইবনে হাজমের কথা- ‘কিয়াস অগ্রহণযোগ্য-, তার কোন গুরুত্ব নেই’। সুতরাং মুসলিম উম্মতের অধিকাংশ লোকের মতই ঠিক। তা হচ্ছে, ‘সহীহ কিয়াস্ ইসলামী শরীয়াত একটা মৌল ভিত্তিরূপে গ্রহণযোগ্য, তা ইসলামী আইন প্রণয়ণের উৎসেরও কাজ করে, যতক্ষণ তা কোনসহীহ দলীল বা প্রতিষ্ঠিত নিয়মের পরিপন্থী না হয়। তবে কোন কোন হাদীসে যেমন রয়েছে, একটি উষ্ট্রকে দুটি গরুর সমান মনে করা- যেমন দীয়তে করা হয়েছে- এর দরুন এই কিয়াসটি দুর্বল হয়ে যায়। এ গ্রন্থকারের ধারণা, যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাসূলে করীম(স) ইচ্ছা করেই অনেক কথা অ-বলা রেখে গেছেন। তা অকাট্য ও সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করে যান নি। যেন মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষে নীতি নির্ধারণে সহজতর হয়। তাঁরা যেন স্থান, সময় ও অবস্থার প্রেক্সিতে জনগণের জন্যে সুবিধাজনক কোন নীতি নির্ধারণ করবার সুযোগ পান। কেননা রাষ্ট্রনায়কগণ অনেক সময় অনেক দেশে উষ্ট্রের তুলনায় গরুর মূল্য বেশী দেখতে পান। কল্যাণ ও বংশবৃদ্ধির দিক দিয়েও তা অধিক উত্তম বলে মনে হয়। এ যুগে বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম গরু দেখা যায়। অতএব এখানে পাঁচটির দ্বারা নিসাবঠিক করা সম্ভব এবংতাতে একটি ছাগী, দশটিতে দুটি ছাগী এবং বিশটিতে চারটি ছাগী বাবদ ফরয ধরা যেতে পারে। তারপর হযরত মুআয বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী কাজ করা যা। আর যেখানেই এ ধরনের গরুর মালিকানা থাকবে সেখানেই এ মত অগ্রাধিকার পাবে- যেতে পারে। কিন্তু যেখানে গরুর মূল্য নিম্নতম হবে, কল্যাণের দিকদিয়ে সামান্য হবে, যেখানে পাঁচ বা দশটির মালিকানায় কেউ ধনী গণ্য হবে না, সেখানে ত্রিশটিতে নিসাব নির্ধারণ করাই যুক্তিসঙ্গত। ইমাম জুহ্রীর ত্রিশটির নিসাব নির্ধারণ সংক্রান্ত মতের তাৎপর্য এভাবেই বোঝা যায়। তা ছিল ইয়েমেনবাসীদের জন্যে হালকা পরিমাণ। জুহরীর কথা যদি সহীহ হয় তবু তা প্রচলিত অর্থে নাকেছকারী হয়নি। নবী করীম(স) তা করেছেন মুসলিম জনগণের নেতা ও রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে। তিনি তো পরিবর্তনশীল যুগ, অবস্থার সাথে সংগতি বিধানস্বরূপ এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। আর কালের ও অবস্থার পরিবর্তনে আইনের পরিবর্তন হয়ে যায়, এটা সর্বাবাদীসম্মত। নবী করীম(স) মুসলিম নেতা হিসেবে যা বলেছেন বা করেছেন, তা নবী হিসেবে কথা বা কাজ থেকে ভিন্নতর। এ দু’য়ের মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। চতুর্থ আলোচনা ছাগলের যাকাত ছাগলের যাকাত ফরয। সুন্নাত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত। হাদীসের দলীলটি পূর্বোদ্ধৃত হযরত আবূ বকরের চিঠির উল্লিতি হয়েছে, ছাগলের যাকাত হচ্ছে, যখন তার সংখ্যা চল্লিশটি হবে, তখন তার যাকাত দিতে হবে একটি ছাগী; একশ’ বিশটি পর্যন্ত তা চলবে। তার অধিক হলে দুইশ’ টি পর্যন্ত দুটি ছাগী দিতে হবে। তার উপর থেকে তিনশ’টি পর্যন্ত তিনটি ছাগীদিতে হবে। তিনশ’টির ঊর্ধ্বে হলে প্রতি একশ’তে একটি ছাগী। আর চল্লিশটির একটি কম হলেও যাকাত দিতে হবেনা। তবে মালিক ইচ্ছা করে দিলে অন্য কথা। ইবনে উমর বর্ণিত ও অন্যান্য বহু হাদীসেই এরূপ কথা রয়েছে। ছাগলের যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূর্বোদ্ধৃত হাদীস অনুযায়ী যাকাত পরিাণের তালিকা নিম্নরূপ: হইতে পর্যন্ত ফরযের পরিমাণ ১ ৩৯ কিছুই নয় ৪০ ১২০ একটি ছাগী ১২১ ২০০ দুটি ছাগী ২০১ ৩৯৯ তিনটি ছাগী ৪০০ ৪৯৯ চারটি ছাগী ৫০০ ৫৯৯ পাঁচটি ছাগী অতঃপর প্রতি একশ’টিতে একটি ছাগী। যাকাত বাবদ যে ছাগলের গ্রহণ করা হবে তা স্ত্রী হবে, না পুরু? কি তার বয়স হওয়া উচিত? ভালমন্দের দিকতিয়ে তার গুণাগুণ কি রকম হবে? এই পর্যায়ে গবাদিপশুর যাকাত সংক্রান্ত আলোচনা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। বহু সংখ্যক ছাগলেরযাকাত ফরয হয় কেন লক্ষ্য করা যায়, যাকাতের ফরয হওয়া ছাগল সংখ্যা অনেক বেশী। তাতে মালিকের অনেক সহজতর বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অন্য কোন ক্ষেত্রে এরূপ সহজতা লক্ষ্য করা যায় না। দেখা যায় একশ’তে একটি ফরয করা হয়েছে। যদিও মূলদনের প্রচলিত যাকাত হার হচ্ছে একশ’তে ২.৫ অর্থাৎদশ-এর চারভাগের একভাগ। এর কারণ বা যৌক্তিকতা কি? এ পর্যায়ের আলোচনাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ নীতি নির্ধারণ করে ইসলামী শরীয়াত জৈব-সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে উৎসাহ প্রদান করতে চেয়েছে। এ কারণে যাকাতের পরিমাণ খুবই হালকা রাখা হয়েছে। আর তাতে চক্রবৃদ্ধি হারে করও ধার্যা করা হয়েছে, যেন এই গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক লক্ষ্য বাস্তাবয়িত হয়। কিন্তু এ ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করা হয়েছে এই বলে যে, এরূপ দৃষ্টিভঙ্গী কোন প্রকারের পশু সম্পদে গৃহীত হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, উষ্ট্র বেশী সংক্যক হলে প্রতি চল্লিশটিতে একটি কর তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হয়। অপরদিকে প্রতি ত্রিশটি গরুতে একটি এক বছর বয়সের বাছুর, আর প্রতি চল্লিশটি গরুতে একটি করে দুই বছরের বাছুর দিতে হয়- স্ত্রীকি পুরুষ অর্থাৎ দশের এক-চতুর্থাংশ, একশটিতে ২.৫ প্রায়। আর মূলদনের যাকাতের সাধারণ হারও হচ্ছে তাই্ এই কারণ ও যুক্তি প্রদর্শন সহীহ্ হয়ে থাকে, তাহলে উষ্ট্র ও গরুতেও তা অবশ্য প্রকাশিতহবে। কিন্তু তা যখন হয়নি, তখন ছাগলের যাকাত সংক্রান্ত অপর একটি ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা আবশ্যক। আমার দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা হচ্ছে, ছাগল বিপুল সংখ্যক হলে তাতে বহু সংখ্যক ছোট বয়সেরও থাকে। কেননা তা বছরে বহুবার জন্ম নেয়, একবার একাধিক সংখ্যায় জন্মায়। এগুলোও মালিকের সম্পদরূপে গণ্য হয়, কিন্তু তা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয় না। পঞ্চম ও ষষ্ঠ আলোচনায়এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলা হবে। ছাগলের ব্যাপারে এই কারণেই এই হালকা ব্যবস্থা অর্থাৎ যাকাতের চাপ খুবইকম রাখা হয়েছে। সুবিচার ও ন্যায় পরায়ণতার প্রতিষ্ঠাই এ ক্ষেত্রে শরীয়াতের লক্ষ্য- অন্যথায় প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে যাকাত ফরয হলে- যেমন গু ও উষ্ট্রে রয়েছে- বহু সংখ্যক ছোট বয়সের ছাগল থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ নাহলে- ছাগলের মালিকদের প্রতি খুবই অবিচার করা হয়। গরু ও উষ্ট্র মালিকদের তুলনায় তা হত অধিক। প্রথম চল্লিশটিতে একটি ছাগী ফরয করা হয়েছে এ শর্তে যে, সেইসবগুলো বেশী বয়সের হবে। এ প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যাকাত একটি প্রমাণিক আপেক্ষিক কর। তার হার না বৃদ্ধি পায়, না হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। মালিকী মনীষী শায়খ জওরাক্ বলেছেন: ধন-সম্পদ অধিক হলে তাৎসংক্রান্ত দায়-দায়িত্বও বেশী হয়ে থাকে; মনের উপরও একটা ভীতি ভয়ংকর হয়ে চাপে। এই কারণে যাকাত কমহয়। এটা মালিকের প্রতি একটা অনুকম্পা। এ কারণে নগদ অর্থ সম্পদের দশ ভগের- এক চতুর্থাংশ দেয়া হয়। কিন্তু শায়খ মালেকীর এই কারণ দর্শানোর তাৎপর্য আমি বুঝে উঠতে পারিনি। সাধারণ ধারণা এই যে, ধন-সম্পদ বেশী হলে ভাবনা-চিন্তা কমহয়, ব্যয়ভার হালকা হয়। এ কারণে বিভিন্ন প্রকারের গবাদিপশুর মালিকরা সব মিলিয়েই রাখেও হিসাব করে থাকে। তাদের খরচাদি কম পড়ে। সেজন্য একই রাখাল ও তার এক থাকার স্থান যথেষ্ট হয়ে থাকে। বর্তমানে অর্থনীতির ক্ষেত্রেএ একটা সনির্দিষ্ট ব্যাপার। এ একটা বিশেষ উৎপাদন পন্থাও বটে। উৎপাদন ব্যবস্থায় যতটা প্রশস্তাতা আসবে প্রতিষ্ঠানগত কষ্ট ও ব্যয় ততই কম হবে। এ কারণে ছোটখাটো উৎপাদকরা বড় বড় উদপাদকদের সাধারণ ভয় করে থাকে। ক্ষুদ্রায়তন প্রতিষ্ঠান বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটা ভীতি সব সময়ই বোধ করে; কেননা তাদে উৎপাদন ব্যয় খুবই কম হয়ে থাকে। বস্তুত উপরে যে কারণ দর্শানো হয়েছে, তা যদি সঠিক হয় তাহলে তা সর্বপ্রকারের ও সর্ব সংখ্যক গবাদিপশুর ক্ষেত্র সটিক বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তা হয়নি। বিপুল ধন-মালের ভয় মনে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপাটি অনুরূপ। যা সে ধন-মালের মালিকের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে বলে বলা হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তা যদি সহীহ্ হত, তা হলে তা সকল প্রকার গবাদি পশু ও সাধারণ ধন-মাল সম্পর্কেই দেখা যেত। কেননা মিলিয়ন পরিমাণ ধন-মালের মালিক নিশ্চয় হাজার পরিমাণ ধন-মালের মালিকের সমান নয়। তাই তার ক্ষেত্রে ফরয ধার্যকরণে অধিক হালকা নীতি গৃহীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আসলে আমরা উপরে যে কারণের কথা বলেছি, হা- হচ্ছে সবদিক দিক দিয়ে উত্তম। পঞ্চম আলোচনা ছোট গবাদিপশুর কি যাকাত দিতে হবে ছোট উষ্ট্র, ছোট গরু ও ছোট ছাগলের কি যাকাত দিতে হবে? মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ ও নাসায়ী গ্রন্থে উদ্ধৃতহয়েছে, সুয়াইদ ইবনে গাফলাতা বলেন, রাসূল (স)-এর পক্ষথেকে যাকাত আদায়কারী এলে আমরা তার পার্শ্বে বসলাম। তখন তাকে বলতে শুনেছি, ‘দুগ্ধপোষ্য শাবকের যাকাত গ্রহণ না করাই আমার দায়িত্ব।’ এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, ছোট বয়সের পশুর শাবকের যাকাত গ্রহণ করা হবে না। বেশ কয়জন ইমাম এই মতই পোষণ করেন। কিন্তু আসলে উপরিউক্তি হাদীসটির সনদ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা রয়েছে। হযরত উমরতাঁর নিয়োজিত যাকাত আদায়কারী সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ্ সাকাফীকে বলেছেন: ‘রাখালেরা যেসব পশু শাবক হাতে ধরে লালন করে, তাও গণনা কর।’ শাফেয়ী এবং আবূ উবাইদও এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এই উক্তিটি পূর্বোদ্ধৃত হাদীসের বিপরীত কথা প্রমাণ করে অর্থাৎ ছোট বয়সের পশুরও নিসাব গণনা করতে হবে এবংতা থেকে যাকাত নিতে হবে।’ বেশ কয়েকজন ফকীহও এই মত পোষণ করেন। অন্যান্যরা হযরত উমর ও সুয়াইদ বর্ণিত হাদীসকে ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেচেন এবং কেবলমাত্র ছোট বয়সের পশুর শাবক হলে তার যাকাত গ্রহণ করার মত দিয়েছেন। তবে সেগুলোর সাথে মায়েরা থাকলে সেসবকেও গণনা করার কথা বলেছেন। কেউ কেউ শর্তারোপ করছেন যে, মায়েদের সংখ্যা নিসাব পরিমাণ হতে হবে। নিসাবের অতিরিক্ত বাচ্চাদের গণনা করাহবে। তাদের সম্পূর্ণরূপে হিসাব থেকে বাদ দেয়া চলবে না। ইবনে হাজম প্রমুখ এই মত দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও শাফেয়ীও এই মতই সমর্থন করেচেন।সকল মতের মধ্যে এই মতটি আমারকাছে অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকারী। যথার্থতা ও সুবিচারের দৃষ্টিতেও তা গ্রহণীয়। কেননা অল্প মালের মালিকদের নিষ্কৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে শরীয়াতের যে যুক্তিপূর্ণ নীতি, তা প্রযোজ্য হবে যাকাত পরিমাণে কম হলে। তাই পাঁচটি উটের বাচ্চা বা চল্লিশটি ছাগল ছানা হলে তা থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে না। কেননা এই মালের মালিক কখনই ধনী গণ্য হতে পারে না। এমতাবস্থায় তার উপর যাকাত ধার্য হলে তার প্রতি জুলুম করা হবে। অতএব যাকাত পরিমাণের অতিরিক্ত হলে তাতে ছোটগুলোকেও গণ্য করা হবে ও তা থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে। কেননা শরীয়াত পশুর মালিকেরযাকাত দানের বোঝা অনেকটা হালকা করে দিয়েছে এবং তাদের খুব বেশী সুবিধা দান করেছে। এই কারণে নিসাব অধিক হলে সেই অধিকারের হিসাব যাকাত ধার্য করেনি; বরং দুই নিসাব পরিমাণের মধ্যবতী সংখ্যার উপর যাকাত ধার্যকরণ রহিত করেছে।যেমন পাঁচটি উট হলে একটি ছাগল দেয়া ফরয, নয়টা হলেও একটি। প৭চিশটি হলে দুই বছরের উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক- পঁয়ত্রিশটি পর্যন্ত তাই চলবে। ছত্রিশটি হতে পঁতাল্লিশটি পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতেহবে। এ ভাবে দুই ফরয পরিমাণের মাঝখানের সংখ্যার উপর কোন যাকাত দিতে হবে না। এই ক্ষমার তত্ত্ব হচ্ছে- যা আমার মনে আসে- বিপুল সংখ্যক ছোট ছোট বয়সের পশু থাকে বলেই এরূপ করা হয়েছে। ছাগলের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি অধিকতর স্পষ্ট। কেননা ছাগল বছরে বহু সংখ্যক বাচ্চা দান করে থাকে। এই কারণে তাতে যাকাত মাফের ব্যাপারটিও বহু ব্যাপক। প্রথম চল্লিশটিতে একটি- একশ’ বিশটি পর্যন্ত, তার অধিকহলে দুইটি ছাগল। আর তিন শতাধিক হলে প্রতি একশ’টিতে একটি দিতে হয়। ষষ্ঠ আলোচনা গবাদিপশুর যাকাত বাবদ কি গ্রহণ করা হবে গবাদিপশুর মালিক যাকাত বাবদ যা দেবে এবং যাকাত আদায়কারী যা গ্রহণ করবে, তাতে নিম্নোকত দিকগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। ১. তা দোষত্রুটি মুক্ত হবে। কোনটি যেন রোগাক্রান্ত বা অঙ্গহীন না হয়। দাঁতপড়া বৃদ্ধও যেন না হয়। এমন না হয় যে, তার দ্বারা কোন ফায়দাই হয় না, কোন কাজেই লাগে না, কোন দামেই বিক্রয় করা যায় না। তার দলীল হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশ: (আরবী**********) তোমরা খারাপ জিনিসের উপর লক্ষ্য আরোপ করো না এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তা আল্লাহ্র জন্যে ব্যয় করবে। নবী করীম (স) ইরশাদকরেছেন: যাকাত বাবদ দাঁতপড়া বৃদ্ধ, কানা-খোড়া বা ফুরিয়ে যাওয়া জন্তু দেবে না- যাকাত গ্রহণকারীতা নিতে রাযী হলে ভিন্ন কথা। কেননা এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত জন্তু গ্রহণ করা হলে তাতে দরিদ্র লোকদেরই ক্ষতি। এ জন্যে যে, তা তো তাদেরই প্রাপ্য, অতএব তা যাকাত বাবদ জায়েয নয়। আর ত্রুটিযুক্ত বলতে বোঝায়, যা ক্রয়-বিক্রয়ে অচল। যার কুরবানীও চলে না। কেবলমাত্র তখনই ত্রুটিযুক্ত গ্রহণ করা চলবে, যদি যাকাত দেয়ার সমস্ত মালই তেমন হয়, তখন আদায়কারী তা থেকেইগ্রহণ করবে। ২. স্ত্রী পশু হওয়া দরকার। এজন্যেই দুই বছরে উপনীতা, তিন বছরে উপনীতা বা চার বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাবকের কথা বলা হয়েছে। তবে কোথাও হাদীসে যদি পুরুষ পশুর কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলে তা গ্রহণ করা চলবে। হানাফী মতে মূল্য ধারনের দিক দিয়ে পুরুষ পশুও গ্রহণ করা চলে। কেননাএ মতে যাকাত বাবদ দেয় জন্তুর মূল্যও আদায় করা যায়। গরুর যাকাত বাবদ প্রতি ত্রিশটিতে একটি ‘তবী’ বা তবীয়া (প্রথম বছরের বাছুর) গ্রহণের দলীল রয়েছে। এ পর্যায়ে কোন বিরোধ দেখা দেয়নি। পুরুষ পশুর গ্রহণের ক্ষেত্রে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে বটে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, তা জায়েয নয়। হানাফী মতের ফিকাহ্বিদগণ জায়েয বলেছেন। কেননা তাঁদের মতে পুরুষও স্ত্রী পশুর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। তাঁদের দলীল হচ্ছে ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস: প্রতি ত্রিশটিতে একটি ‘তবী’ (এক বছরে বাছুর), প্রতি চল্লিশটিতে একটি দুই বছরের বাছুর- স্ত্রী বা পুরুষ। হানাফী মতে উভয়ই গ্রহণ করা চলে। কেননা এ দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। শরীয়াতের বিধানদাতাএকটি ছাগল দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তার অর্থ কেবল স্ত্রী ছাগল নয়, পুরুষ ছাগল মালিকী মাযহাবে ছাগলের দুই বছর বয়সের ছাগল ছানা (***) কিংবা স্ত্রী-ছানা (****) দিতে হবে। আর হাম্বলী মতে নিসাবের স্ত্রী পশু থাকলে পুরুষ গ্রহণ করা জায়েয নয়।– যেমন উটের ক্ষেত্রে শরীয়াত নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইমাম মলিক ও শাফেয়ী বলেছৈন: ‘যাকাত আদায়কারী যদি মনে করে যে, পুরুষ পশু গ্রহণ করা অধিক লাভজনক, তাহলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা জায়েয। কেননা হাদীসে তাকে এ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ইমাম নববী বলেছেন, পুরুষ পশু যাকাত বাবদ দেয়ার দুটি দিক। সর্বাধিক সহীহ দিক হল তা জায়েয। ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সঙ্গিগণ এ মত প্রকাশ করেচেন। কুরবানীতে যেমন পুরুষ পশু যবেহ করা যায়েয, ঠিক তেমনি। তার দ্বিতীয দিক হল, তা জায়েয নয়। গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে হানাফী মতে পুরুষও স্ত্রী পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদিও উষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা রয়েছে। হাদীসে উষ্ট্র গ্রহণের কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গরীব ও যাকাত গ্রহণকারীদের পক্ষে কোন ক্ষতির কারণ হয় না, কোন দলীলের বিরোধীতা করতে হয় না। আমরা যা বললাম, তা ছাগলের ও পঁচিশটির কম সংখ্যক উস্ট্রের ক্ষেত্রে যে ছাগল যাকাত বাবদ দেয়া ফরয, সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ৩. বয়সের ব্যাপারে কথা হল হাদীসে সুনির্দিষ্ট বয়সের কথা বলে দেয়া হয়েছে, তাই এ তাকীদ অবশ্যই মানতে হবে। কেননা তার কম বয়সের জন্তু গ্রহণকরা হলে তাতে গরীবদেরই হক নষ্ট ও ক্ষতির কারণ ঘটে। আর তার অধিক বয়সের গ্রহণ করা হলে পশুর মালিকদেরই হক নষ্ট ও ক্ষতির কারণ ঘটে। আর তার অধিক বয়সের গ্রহণ করা হলে পশুর মালিকদের ক্ষতি সাধন করা হয়। সব মাযহাবেই এ কথা সমর্থিত। ছাগলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম মালিক বলেছেন: ছাগী ছানা দুই বছরের ও তিন বছরে উপনীতা হলে চলবে। কেননা হাদীসে বলা হয়েছে: দুই বছর বয়সে বাচ্চাতেই আমাদের অধিকার। আর তা এ জন্যে যে, তা একই জাতির দুই প্রজাতির মাত্র। কাজেই যা এক ক্ষেত্রে যথেষ্ট তা অন্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট হবে। ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ বলেছেন পুরুষ ও স্ত্রী পশু শাবক থেকেই দুই বছর বয়সের শাবক গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শাফেয়ী মাযহাবের লোকেরা এ দুটির বয়স নির্ধারণের বিভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ হাম্বলী মত অনুযায়ী এক বছরের বাচ্চাকেসনী (***) বলেছৈন আর ছয় মাসের বাচ্চাকে ময়য (****) বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন (****) ‘জযয়া’ বলতে বোঝায় সেই শাবক, যার বয়সএক বছর পূর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয বর্ষে পদার্পণ করেছে। আর যে শাবক দুই বছরে পূর্ণ করে তৃতীয বর্ষে উপনীত হয়েছে, তা হল (*****) ইমাম নববীর উক্তি মতে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে এ কথাটি অধিক সহীহ। ইবনে কুদামাহ্ হাম্বলী মতের সমর্থনে দুটি কথা বলেছেন: (ক) সুয়াইদ ইবনে গাফলাতা বর্ণিত হাদীস হল প্রথশ কথা: আমাদের কাছে রাসূলের পক্ষতেকে যাকাত আদায়কারী এসে বললো- আমাদেরকে গরুর যাকাত বাবদ দুই বছরের বাছুর এবং ছাগলের তৃতীয বর্ষের ছানা গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। এ এক স্পষ্ট কথা। (খ) দুই বছরের বাছুর কুরবানী দেয়া চলে; কিন্তু দুই বছরের ছাগল নয়। কেননা নবী করীম(স) আবূ বুরদা ইবনে দীনারকে বলেছিলেন: ‘দুই বছরের ছাগল তোমার জন্যে কুরবানী করা জায়েয হবে। তোমার পর অন্য কারোর জন্যে তা জায়েয হবে না।’ ইবরাহীম হর্বী বলেছেন, দুই বছরের গরু কুরবানী জায়েয এ জন্যে যে, তা এ বয়সে যৌনক্রিয়া করতে সক্ষম; কিন্তু ছাগল তৃতীয় বর্ষের না হওয়া পর্যন্ত তা হয় না। ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ এ মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফার একটি কথা এই যে, তৃতীয় বর্ষের না হওয়া পর্যন্ত তা যাকাত বাবদ দেয়া জায়েয নয়। দুই বছরের হলে তার মূল্য যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া যেতে পারে। এখানে একটি কথা থেকে যায়। তাহল, উষ্ট্রের প্রয়োজনীয় বয়স না হলে কি করা হবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। ইবনে রুশ্দের মতে মালিককে সেই বয়সের জন্তু কিনে দিতে বাধ্য হবে। অনেকের মত তার কাছে যে বয়সের জনতু আছে, তাই দেবে এবং সেইসঙ্গে বিশ দিরহাম অতিরিক্ত দেবে- যদি কম বয়সেরজন্তু হয়ে থাকে অথবা অতিরিক্ত দুটি ছাগী দেবে। আর বেশী বয়সের জন্তু হলে যাকাত আদায়কারী সেটি নিয়ে বিশ দিরহাম বা দুটি ছাগী তাকে ফেরত দেবে। ইবনে রুশ্দ বলেছৈন, যাকাতের অধ্যায়ে এ কথাটি স্বপ্রমাণিত। অতএব এ নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন হয় না। সম্ভবত ইমাম মালিক এ হাদীসটি পান নি বলে তাঁর মত এর বিপরীত হয়েছে। অথচ ইমাম শাফেয়ী ও আবূ সওর উক্ত হাদীসের ভিত্তিতেই মত গঠন করেছেন। -ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, তার মূল্য দেয়া কর্তব্য। অন্যান্য লোকেরা বলেছেন, বরং তার কাছে যে বয়সের জন্তু আছে, সে তা-ই দেবে অথবা দুয়ের মধ্যবর্তী মূল্য। আমার মতে ইমাম আবূ হানীফা মূল্য দেয়ার মত দিয়ে হাদীস লংঘন করেন নি। কেননা নবী করীম(স) উষ্ট্রের ক্ষেত্রে বয়সে তারতম্যকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম দ্বারা পরিমাপ করেছেন এ হিসেবে যে, তিনি চিলেন মুসলিম জাতির নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান। আর এ ধরনের ব্যবস্থাপনা কখনই চিরস্থায়ী বা সর্বকালের জন্যে হয় না। বরং তা পরিবর্তিত হয়। এ কারণে হযরত আলী থেকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম দ্বারা এ তারতম্য পরিমাপ করার কথা যথার্থভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর আমলে ছাগল খুব সস্তা ছিল। আর নবী করীম(স) কর্তৃক নবী হিসেবে চালু করা কোন নিয়মের বিরোধিতা তিনি করেছেন বলে ধারণাও করা যায় না, তার কারণও কিছুনেই। এ তত্ত্বটি অনুধাবন করা হলে অনেক জটিল বিষয়েরই সহজ মীমাংসা হয়ে যেতে পারে। ৪. আর একটি শর্ত হল, যাকাতের জন্তু মধ্যম মানের হওয়া উচিত। অতএব অতীব উত্তম জন্তু বাছাই করে নেয়া যাকাত আদায়কারীর পক্ষে যেমন জায়েয নয়, তেমনি জায়েয নয় নিতান্ত রদ্দী মাল গ্রহণ করা। তবে মালিক রাযী হলে মূল্য নির্ধারণ করে নেয়া যেতে পারে। নবী করীম(স) হযরত মুআযকে বলেছিলেন, ‘তুমি অবশ্য উত্তম মাল থেকে বিরত থাকবে। আর অত্যাচারিদের ফরিয়াদ সব সময় ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহ্র মধ্যে কোন অন্তরায় নেই।’ ইবনে আবূ শায়বা বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) যাকাত বাবদ আদায়কৃত উষ্ট্রের মধ্যে একটি খুবই উত্তম ও সুন্দর উষ্ট্র দেখতে পেলেন। তখন তিনি যাকাত আদায়কারীর প্রতি খুবই ক্রোধ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘এটা কি?’ সে বলল, ‘আমি উষ্ট্র পালের মধ্য থেকে দুটি উষ্ট্রের বদলে এটা গ্রহণ করেছি।’ বললেন, ‘তা হলে দোষ নেই।’ আর যেহেতু যাকাতের ভিত্তি হচ্ছে দাতা গ্রহীতা উভয় পক্ষের সম্মতির উপর। আর সে কারণেই মধ্যম মানের মাল গ্রহণের তাকীদ। কেননা অতীব উত্তম জন্তু গ্রহণের মালের মালিকের ক্ষতি, আর নিকৃষ্টতম মালে গরীব লোকদের অধিকার হরণ। মধ্যম মানের মালে উভয় পক্ষের সম্মতি ও স্বার্থের সংরক্ষণ নিহিত। নবী করীম (স) থেকে আবূ দাউদ উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেছেন “তিনটি কাজ যে করল, সে ঈমানের স্বাদ অস্বাদন করল। প্রথম যে কেবলমাত্র এক আল্লাহর বন্দেগী করল- কেননা সেই এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মাবুদ নেই। দ্বিতীয়, যে মালের যাকাত দিল মনের সন্তুষ্টি সহকারে প্রতি বছর নিয়মিত ও সুনির্দিষ্টভাবে- বেছে বেছে বুড়ো খুনখুনে জন্তুও দিল না, ময়লা আবর্জনা রোগীও দিল না, ছোট ছোট ও খারাপ খারাপ মালও দিল না, দিলমধ্যম মানের মাল। কেননা আল্লাহ্ তোমাদের সর্বোত্তম মালও চান না, আর নিকৃষ্ট মাল দিতেও বলেন না।” যাকাত বাবদ গাভীন বা বাছুরকে দুধ খাওয়ায় এমন জন্তুও গ্রহণ করা চলবে না। যেসব জন্তু খেয়ে দেয়ে মোটা হওয়ার জন্যে আলাদা করে রাখা হয়েছে বা যা না-খেয়ে মরণাপন্ন হয়েছে এবং খাসি- পুরুষ ছাগল তাও গ্রহণ করা হবে না। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: হযরত উমর (রা) যাকাত বাবদ আদায় করা ছাগলের মধ্যে বড় পালান ও দুগ্ধ ভারাক্রান্ত ছাগী দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ছাগীটি কি রকম?’ লোকেরা বলল, ‘এটি যাকাত বাবদ আদায় করা ছাগী।’ তখন তিনি বললেন, ‘এর মালিক নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে এ ছাগীটি দেয়নি, জবরদস্তি করে আনা হয়েছে। তোমরা মানুষকে বিপদে ফেলো না, আর মুসলমানদের বাছাই করা উত্তম মালসমূহওগ্রহণ করবে না।’ মধ্যম মানের মাল লওয়ার যৌক্তিকতা এ থেকেও প্রমাণিত হয়। ছোট বয়সের বাচ্চা মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হবে যদি সেগুলোর মায়েদের সংখ্যা নিসাব পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেগুলো গ্রহণ করা হবে না, যেমন করে সর্বোত্তম ও বাছাই করা –পছন্দ করা মালসমূহ গ্রহণ করা হবে না। কেননা বিশেষ মর্যাদার কারণে সেগুলোর উপর লোকদের লোভহয় থাকে বলে এ নিষেধাজ্ঞা। এ কারণে হযরত উমর যখন সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ্ সাকাফীকে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ করে পাঠালেন, তখন তিনি আদায়কৃত ছোট বয়সের জন্তুগুলো লোকদের কাছে ফেরত দিচ্ছিলেন। লোকেরা বললো, ‘ছোটগুলো ফেরত দিচ্ছেন, তা থেকে কিছুই গ্রহণ করছেন না কেন?’ সুফিয়ান হযরত উমরকেএ কথা জানালেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোট বয়সের জন্তু ফেরতই দেয়া হবে। রাখাল যা পুষবে, তা গ্রহণ করবে না। অনুরূপভাবে খেয়ে মোটা হওয়ার জন্যে আলাদা করা, ছানাকে দুগ্ধ দানকারী গাভীন ও খাসিছাগল গ্রহণ করবে না। গ্রহণ করবে দুই বছর বয়সের ছাগী।’ আহমদ আবূ দাউদ ও নাসায়ীর বর্ণনায় উদ্ধৃতহয়েছে, রাসূলের দুইজন যাকাত আদায়কারী বলেছেন: ‘রাসূলে করীম (স) আমাদের গাভীন জন্তু নিতে নিষেধ করেছেন।’ সুয়াইদ বর্ননা করেছেন, রাসূল প্রেরিত জনৈক যাকাত আদায়কারীকে বলতে শুনেছি, ‘দুগ্ধদায়ী ছাগী গ্রহণ করতে রাসূলে করীম (স) আমাদের নিষেধ করেছেন।’ সপ্তম আলোচনা যাকাতের জন্তুতে মিশ্রণের প্রভাব গবাদিপশুর যাকাত পর্যায়ে নিসাব ও পরিসংখ্যান যা কিছু উপরে উল্লিখিত হয়েছে, তা স্পষ্ট এবং কার্যকর হবে যদি পশুর মালিক একজন হয় এবং সে নিসাব বাতার অধিক পরিমাণের মালিক হয়। কিন্তু সাধারণ লক্ষ্য করা যায়, পশুমালিকরা কেত্রিত হয়ে তাদের গরু, ছাগল ও উষ্ট্র ইত্যাদি গৃহপালিত পশুগুলোকে একত্রিত ও সংমিশ্রিত করে রাখে, তাতে ব্যয় ও শ্রম অনেকটা কম হয় বলে। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচিত্র ধরনের পশুর মালিকদেরকে কি একক মালিক মনে করা হবে? অথবা প্রত্যেক জাতীয় পশুর মালিকানা ভিন্ন ভিন্ন ধরা হবে িএবং সেই অনুযায়ী তার কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হবে? অন্যকথায়, এ সংমিশ্রণে যাকাতের নিসাব ও তার ফরয পরিমাণে কোন প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কি? এ প্রশ্নের জবাব আলোচনার পূর্বে একটি কথার ব্যাখ্যা হওয়া প্রয়োজন। যে সংমিশ্রণের কথা বলা হল, তা দু’প্রকারের। একটি হল শরীকানার সংমিশ্রণ আরঅপরটি প্রতিবেশীমূলক সংমিশ্রণ। প্রথমটির তাৎপর্য হচ্ছে, বেশ কয়জন মালিক মিলিত হয়ে পশু পালন করবে এমনভাবে যে, তাদের প্রত্যেকের মালিকানা সম্পদ আলাদা করে গণনা করা যায় না। যেমন বহু সংখ্যক লোক উত্তরাধিকার সূত্রে পশুপালন পেয়েছে বা ক্রয় করেছে। এরা সকলেই তাতে সমানভাবে শরীক রয়েছে। তাদের কারোরই মালিকানার পশুকে আলাদা করে গণনা করা সম্ভব হয় না। আর দ্বিতীয় প্রকারের তাৎপর্য হল, মালিকদের সকলেরই এবং প্রত্যেকেরই মালিকানা সম্পদ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন, অপর থেকে সুনির্দিষ্ট, কারোর ত্রিশটি বা ষাটটি ছাগল চিহ্নিত ও স্বতন্ত্রভাবে রক্ষিত। কারোর অনুরূপ সংখ্যক কিংবা তার বেশী বা কম রয়েছে। কিন্তু তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত। অথচ এ সব মালিক পরস্পরের প্রতিবেশী, আর পশুগুলো সংমিশ্রিত- যেন তা একজনের মালিকানাভুক্ত। এখন প্রশ্ন হল প্রত্যেক সংমিশ্রণকারীর যাকাত পরিমাণ নির্ধারণে কি স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হবে? কিংবা শরীকানা মিশ্রিত বলে ধরা হবে, যা প্রতিবেশী-সূলভ সংমিশ্রণ নয়? ইবনে রুশ্দ এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদদের মতামত খুবই উত্তমরূপে ওসংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের প্রত্যেকের দলীলও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন: অধিকাংশ ফিকাহ্বিদই যাকাতের ফরয পরিমাণ নির্ধারণে এ সংমিশ্রণের প্রভাব কার্যকর হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে তা নিসাবের পরিমাণে হবে কিনা, সে বিষয়ে তাঁদের বিভিন্ন মত রয়েছে। িইমাম আবূ হানীফঅ কিন্তু এ প্রভাবের কথা অস্বীকার করেছেন। না ফরয পরিমাণে, না নিসাব পরিমাণে তিনি তা স্বীকার করেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও সমকালীন বহুসংখ্যক ফিকাহ্বিদ বলেছৈন, এ সংমিশ্রণকারীরা একজন মালিকের ন্যায় যাকাত দেবে। তবে দুটি ব্যাপারে এদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে। একটি হচ্ছে শরীকদের নিসাবের ক্ষেত্রে। শরীকদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকুক আর না-ই থাকুক, তারা কি সকলে একজন মালিক গণ্য হবে? কিংবা তারা সকলে মিলে একজন মালিক হিসেবে যাকাত দিয়ে দেবে- তাদের প্রত্যেকের আলাদা নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও? দ্বিতীয়টি, যে সংমিশ্রণের প্রভাব যাকাতের নিসাব নির্ধারণে কি এ সংমিশ্রণে কোন প্রভাব আছে? ফরয পরিমাণে? কিংবা কোন প্রভাব নেই? আসলে এ মত-পার্থক্যের কারণ হচ্ছে যাকাত গ্রহণ পর্যায়ে প্রমাণিত হাদীসের তাৎপর্য অনুধাবনে নিহিত পার্থক্য। হাদীসটি হচ্ছে: (আরবী***********) বিচ্ছিন্ন জিনিসগুলো একত্রিত করা যাবেনা, একত্রিত জিনিসগুলো বিচ্ছিন্ন করা যাবে না যাকাত দেয়ার ভয়ে। আর যে দুটো সংমিম্রিত, তা সমানভাবে প্রত্যাবর্তিত হবে। উভয় পক্ষই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী হাদীসটির ব্যাখ্যা করেছেন। যাঁরা মনে করেছেন, নিসাব ও ফরয পরিমাণে অথবা শুধু ফরয পরিমাণে সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে, তাঁরা বলেছেন, রাসূলের এ কথাটির স্পষ্টভাবে প্রমাণি করছে যে, দুটো সংমিশ্রিত সম্পদে মালিকানা এক ব্যক্তির মালিকানার মতই। ফলে রাসূলের কথা: ‘পাঁচটির কম সংখ্যক উষ্ট্রের যকাত নেই’-এর পরিসর সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ইমাম মালিকের মতে যাকাত ফরয পরিমাণে এবং যাকাত ও নিসাব উভয় ক্ষেত্রেই- শাফেয়ী ও তাঁর সঙ্গীদের মতে। কিন্তু যাঁরা সংমিশ্রণে বিশ্বাসী নন, তাঁরা বলেছেন, দুই শরীকদের দুই সংমিশ্রণকারী বলা হয়। উপরিউক্ত হাদীসের যাকাত সংগ্রহকারীদের নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, এক ব্যক্তির মালিকানা যেন এমনভাবে বিভখ্ত করা না হয়, যার দরুন তার উপর যাকাতের অধিক বোঝা চেপে বসতে পারে। যেমন এক ব্যক্তির একশ’ বিশটি ছাগী রয়েছে। তাকেতিনি চল্লিশে বিভখ্ত করা অথবা একজনের মালিকানা অন্যজনের মালিকানারসাথে একত্রিত করে দেয়া, ফলে অধিক যাকাত ধার্য হতে পারে। কাজেই এই (কাজ জায়েয নয়)। তাঁরা বলেছৈন, হাদীসটিতে যখন এর অবকাশ রয়েছে, তখন তার ভিত্তিতে প্রমাণিত মৌলনীতি যেন সংকুচিত করা না হয়। কেননা তা সর্বসম্মত। অর্থাৎ নিসাব ও ফরয পরিমাণ যাকাত একই ব্যক্তির মালিকানায় গণ্য হবে। আর যারা সংমিশ্রণে বিশ্বাসী, তাঁরা বলেছেন, সংমিশ্রণ কথাটাই শরীকানায় অধিক সুস্পষ্ট। ব্যাপারটি যখন এই, তখন রাসূলের কথা ‘দুটি সমানভাবে প্রত্যাবর্তিত হবে- এ কথাই প্রমাণ করে যে, এ দুটোর উপর যে ফরয পরিমাণ ধার্য হবে, তা একই ব্যক্তির মত হবে। আর রাসূলের উক্ত কথাটি প্রমাণ করছে যে, দুই সংমিশ্রিত মালিকানা দুই শরীক নয়। কেননা দুই শরীকের মধ্যে পারস্পরিক প্রত্যাবর্তন ধারণা করা যায় না। কেননা যাকাত তো শরীকানার মাল থেকেই গ্রহীত হবে। যে লোক এ তাৎপর্যাকে চূড়ান্ত নে করেছেন, তার উপর নিসাব ধারণা করেন নি। তিনি বলেছৈন, দুই সংমিশ্রিত মালিকানা এক ব্যক্তির যাকাতের মতই যাকাত দেবে- যদি তাদের দুজনেরই আলাদাভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে থাকে। আর যিনি নিসাবকে ফরয পরিমাণ সংক্রান্ত হুকুমের অধীন মনে করেছেন, তিনি বলেছেন, তাদের দুজনের নিসাবই একব্যক্তির নিসাব। যেমন তাদের দুজনের যাকাত এক ব্যক্তির যাকাতের মত। এদের প্রত্যেকেই রাসূলে করীম(স)-এর উপরিউক্ত হাদীসটির তাৎপর্য নিজ নিজ নীতি অনুযায়ী গ্রহণ করেছেন। ইমাম মালিক বলেছেন, ‘সম্মিলিতকে ভিন্ন ভিন্ন গণ্য করবে না’। অর্থাৎ দুই সংমিশ্রিত মালিকানার অর্থ- দুজনের প্রত্যেকের জন্যে দু’শ দু’শ করে ছাগী হলে তাতে তিনটি ছাগী ধার্য হবে, আর তা ভিন্নকরে দিলে দু’জনের প্রত্যেকের জন্যে একটি ছাগী যাকাত বাবদ ধার্য হবে। তার মতের দৃষ্টিতে সংমিশ্রণকারীদের প্রতিই নিষেদ নিবদ্ধ হয়েছে- যাদের প্রত্যেকেরই নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, ‘একত্রিতকে ভিন্ন ভিন্ন করা যাবে না’ অর্থ, দুজনের চল্লিশটি ছাগী রয়েছে। তাদের মালিকানা বিচ্ছিন্ন করা হলে তাদের কারোর উপরই যাকাত হবে না, যদি তার মতে সংমিশ্রণকারীদের নিসাব একক মালিকানার নিসাব অনুযায়ী হয়। যাঁরা সংমিম্রণকে গুরুত্ব দেন, তাঁরা যাকাতে কোন্ ধরনের সংমিশ্রণ প্রভাব রাখে এ বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী বলেছৈন, সংমিশ্রণের জরুরী শর্ত হচ্ছে জন্তুগুলোকে একত্রিত ও সংমিশ্রিত করতে হবে। একজনের জন্যেই চলবে, একজনের জন্যেউ দুধ দেবে, একজনের জন্যেই বিহারে ছেড়ে দেয়া হবে, একসঙ্গে পানি পান করা হবে। দুজনের বলদগুলো সংমিশ্রিত হবে। তাঁর মতে সংমিশ্রিত ও শরীকানার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। এ কারণে দুই শরীকের কারোরই মালিকানা পূর্ণ নিসাব সমান গণ্য করা হয় না। ইমাম মালিকের পানি তোলার পাত্র, কূপ, চাকি, রাখাল ও বলদ- এই সবে শরীক দুই ব্যক্তির পরস্পর সংমিশ্রণকারী। এ সবেরকোন কোনটি বা সব কয়টির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গিগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আর ‘সংমিম্রণ’ নামটির মধ্যে এই সব কয়টি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। এ কারণে কেউ কেউ যাকাতের সংমিশ্রণের কোন প্রভাব আছে বলে মনে করেন না। ইবনে হাজমের মতও তা-ই। যাঁরা মনে করেন সংমিশ্রণ যাকাতরে প্রতিবন্ধক, ইবনে হাজম তাঁদের মত ভিত্তিহীন প্রমাণিত করেছেন। কেননা তাতে হাদীস অনুযায়ী নিসাব পরিমাণের কম যাকাত না হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণে যাকাত ধার্য হওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। আর ‘সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে এই মতেরও তা পরিপন্থী আর প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজের ও তার ধন-মালের ব্যাপারে আল্লাহ্র কাছে দায়িত্বশীল, এই কথারও বিপরীত হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********) প্রত্যেক ব্যক্তিই তার উপার্জনের জন্যে দায়ী, কোন বোঝা বহনকারীই অপরের বোঝা বহন করবে না। সংমিশ্রণ যাকাতের প্রতিবন্ধক করে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা একজনের অপরের অধিকারের উপর উপার্জনকারী করে দেন। একজনের মালের উপর অপর জনের মালের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। কিন্তু তা সত্য বিরোধী, কুরআন ও সুন্নাহ্র পরিপন্থী। যাকাত নির্ধারণে সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম শাফেয়ীর মত অধিক প্রশস্ত। তিনি মনে করেন যে, কেবল জন্তুর মালিকানার ক্ষেত্রেইসংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে। বরং কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং দিরহাম-দীনারের ক্ষেত্রেও তা সম্প্রসারিত। অংশভিত্তিক শরীকানা কারবারের মসলা নির্ধারণে এ কথাটি ভিত্তিরূপে গণ্য হতে পারে। অভিন্ন ব্যক্তিত্বের যাকাত কার্যকরণ পর্যায়ে তার প্রয়েঅজন দেখা দিলে তা যাবে। কেননা তাতে কার্যকরণ সুপ্রশস্ত হবে, কার্য সম্পাদন সহজতর হবে এবং শ্রম ও ব্যয়ও অনেক কম হবে। অষ্টম আলোচনা ঘোড়ার যাকাত যানবাহন, বোঝা বহন ও জিহাদের ব্যবহৃত ঘোড়ার যাকাত নেই এ বিষয়ে সারা দুনিয়ার মুসলমান একমত যে, যেসব ঘোড়া সওয়ারী, ভার বহন বা আল্লাহর পথে জিহাদের কাজে ব্যবহৃত হয়, সে সব ঘোড়ার কোন যাকাত দিতে হবে না। তা ছেড়ে দিয়ে পালিত হোক, কি তাকে কাটা ঘাস খাইয়ে পোষা হোক, উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা তা মালিকের প্রয়োজন পূরণে নিয়েঅজিত। আর যাকাত দিতে হয় বর্ধনশীল ও প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-মালে। ব্যবসায়ের ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে অনুরূপভাবে যা ব্যবসায়েল জন্যে পোষা হয়, তার যাকাত দিতে হবে। এ ব্যাপারে জাহিরী মাযহাবের ফিকাহ্বিদ ছাড়া আর সকলেই সম্পূর্ণ একমত। কেননা ব্যবসায়েল জন্যে পালিত হওয়াটাই প্রমাণ করে যে, তা ক্রমবর্ধনশীল- ছেড়ে দিয়ে পোষা হোক, কি কাটা ঘাস খাইয়ে পোষা হোক। এরূপ অবস্থায় তা পণ্যদ্রব্য সমতুল্য, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের মতই তার হুকুম। যেসব জন্তু গাছপালা, প্রস্তুর আদি মুনাফা লাভের আশায় কেনা-বেচা হবে, তার সম্পর্কেও এই একই কথা। ঘরে ঘাস খাওয়ানো ঘোড়ার যাকাত নেই ফিকাহ্বিদগণ এ বিষয়েও একমত যে, যেসব ঘোড়াকে ঘরে রেখে সারাটি বছর কিংবা বছরের অধিকাংশ সময় ঘাস খাইয়ে পোষা হয়, তার যাকাত নেই। কেননা জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে যাকাত দিতে হবে শুধু সেসব ঘোড়ার, যা ছেড়ে দিয়ে ঘাস খাইয়ে পোষা হয়। প্রবৃদ্ধি লাভ ও বংশ বৃদ্ধির জন্যে পোষা ঘোড়ার যাকাত দেয়া সম্পর্কে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর জন্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে, তা সবই পুরুষ ঘোড়া হবে না। যদি তা হয়, তাহলে তাতে যাকাত হবে না। কেননা পুরুষ ঘোড়ার বাচ্চা হওয়ার প্রশ্ন থাকে না। তবে যদি স্ত্রী মিশ্রিত হয় অথবা শুধু স্ত্রী ঘোড়া হয় এবং চেড়ে দিয়ে পোষা হয়, তা হলে ইমাম আবূ হানীফার মতে তার যাকাত দিতে হবে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ অব্য ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে কিছুই ফরয হবে না। ঘোড়ার যাকাত না হওয়ার দলীল ১. প্রথমত হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: (আরবী******) মুসলমানের ক্রীতদাস ও ঘোড়ার কোন যাকাত নেই। এ পর্যায়ে সব ঘোড়াই শামিল, তা ছেড়ে দিয়ে পোষা হোক বা অন্যথা হোক, পুরুষহোক কি স্ত্র; কিংবা মিশ্রিত হোক, কি অমিশ্রিত। ২. দ্বিতীয় হযরত আলী নবী করীম(স) থেকে বর্ণনা করেছেন: (আরবী **********) ঘোড়া ও ক্রীতদাসের যাকাত মাফ করে দিয়েছি। তবে নগদ টাকার যাকাত দিতে হবে প্রতি চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম- তাই নিয়ে এসে। ৩. তৃতীয়ত, ঘোড়ার যাকাত গ্রহণের ব্যাপারে কোন বাস্তব সুন্নাত বর্ণিত হয়নি। অথচ গবাদিপশুর যাকাত গ্রহণের সুন্নাত অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কুআন মালের যাকাত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে: (আরবী **********) তাদের ধন-মালের যাকাত গ্রহণ করে তাদের পবিত্র কর। রাসূলে করীম (স)-ই এ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যাদাতা। তিনি তাঁর কাজ দ্বারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ঘোড়া এই ধন-মালের মধ্যে গণ্য নয়। ৪. চতুর্থ দলীল হচ্ছে যুক্তি। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা যেসব গবাদিপশুর মুনাফার উপর যাকাত ফরয করেছেন, তা ঘোড়ায় নেই। তাই ঘোড়াকে অন্যান্য গবাদিপশুর মত মনে করা ঠিক হয়। শরীয়াতের বিধানদাতা ঘোড়া পোষার বিশেষ উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যা অন্যান্য গবাদিপশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা ঘোড়া যেজন্য পোষা হয়, উষ্ট্র সেজন্যে পোষা হয় না। উষ্ট্র পোষাহয় বংশ বৃদ্ধি, গোশ্ত খাওয়া, বোঝা বহন, ব্যবসা ও তার উপর সওয়ার হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত প্রভৃতি উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘোড়া সৃষ্টিই করা হয়েছে দাপটে-প্রতাপ, দৌঢ়-ঝাঁপ, দ্বীন কায়েম ও দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদ ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। শরীয়াতের বিধানদাতার তার সংরক্ষণ ও প্রতিপালনে ভিন্নতর লক্ষ্য।এ কারণেতার যাকাত মাফ করে দেয়া হয়েছে, যেন সে দিকে মানুষের অধিক আগ্রহ জাগে এবং আল্লাহ্ ও রাসূল যে উদ্দেশ্যে তার লালন-সংরক্ষণ বিধিবদ্ধ করেছেন, সেই কাজে তা ব্যবহার করে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী **********) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তোমরা যথাসাধ্য শক্তি সংগ্রহ ও অশ্বপালন করে প্রস্তুতি গ্রহণ কর। এআয়াতের দৃষ্টিতে অশ্বপালন যুদ্ধের সরঞ্জামের মধ্যে গণ্য। আর যুদ্ধের সরঞ্জামের উপর কোন যাকাত হতে পারে না, তা যতই বিপুল হোক না কেন; যতক্ষণ তা ব্যবসায়ের জন্যে না হবে। ইমাম আবূ হানীফার মত ইমাম আবূ হানীফার মতে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে পোষা হলে তার যাকাত দিতে হবে। তার কয়েকটি দলীল রয়েছে: প্রথম- বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হযরত আবূ হুরায়রার বর্ণনা। নবী করীম (স) বলেছৈন: (আরবী **********) ঘোড়া কারোর জন্যে বড় সওয়াবের কারণ, কারোর জন্যে তা আবরণ, আর কারোর জন্যে তা দুর্বহ বোঝা। সওয়াবের কারণ হয় সেই ব্যক্তির ঘোড়া যে তা আল্লাহর জন্যে পোষে (জিহাদে তা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে), তা তার জন্যে বড় সওয়াবের কারণ। আর যে ব্যক্তি তা পোষে সম্পদ বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার উদ্দে্যে, পরে সে তার গলায় ও পিঠে আল্লাহ্র হক ভুলে যায় না, তা তার জন্যে আবরণ। আর যে লোক তা গৌরব প্রকাশ ও লোক দেখানোর জন্যে এবং মুসলমানদের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে পোষে তার ঘোড়া তার জন্যে গুনাহের কারণ হবে। ঘোড়ার গলদেশ আল্লাহর হক্ হচ্ছে যাকাত দেয়া, আর ঠেকায় পড়া লোকদের তাধার দেয়া- তাতে আরোহণের জন্যে তার পৃষ্ঠে আল্লাহ্র হক্। গলদেশে আল্লাহর হক ধার্য হওয়া পর্যায়ে ভিন্ন মত হচ্ছে- তা যাকাত নয়, তাকে নিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করাই আল্লাহ্ হক। কেউ কেউ মনে করেন, তার অর্থ, তার প্রতি দয়া প্রদর্শন, তার খাওয়া-দাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাকরণ। পৃষ্ঠদেশ যাকাত ধার্য হওয়ার স্থান নয়। দ্বিতীয়, হযরত জাবির নবী করীম(স) থেকে বর্ণনা করেছেন: (আরবী **********) প্রতিটি উন্মুক্ত ঘোড়ার যাকাত এক দ্বীনার অথবা দশ দিরহাম। ইমাম দারেকুত্নী ও বায়হাকী এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন। এই কারণে জম্হুর ফিকাহ্বিদগণ মনে করেন, পূর্বে উদ্ধৃত ঘোড়ার যাকাত ফরয না হওয়ার হাদীসটির প্রতিকূলে এই হাদীসটি দলীল হতে পারে না। তৃতীয়- উষ্ট্রের ন্যায় ঘোড়াও যাকাত ফরয হওয়া। এ দুটোই তো গবাদিপশুর মধ্যে গণ্য, বর্ধনশীল এবং কল্যাণকর। তাতে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত মজুদ রয়েছে। আর তা হচ্ছে চিহ্নিত করে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ দিক দিয়ে ঘোড়া ও অন্যান্য গবাদিপশুর মধ্যে পার্থক্য পর্যায়ে যা কিছু বলা হয়েছে, তা হিসাবের মধ্যে ধরার মত নয়। কেননা প্রত্যেক শ্রেণীর পশুরই একটা বিশেষ বিশেষত্ব রয়েছে, যার দরুন তা অন্য শ্রেণীর পশু থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে। উট এবং ছাগলের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও উভয়ের উপরই যাকাত ধার্য হয়ে থাকে। এ কারণে মনে করা হয়, ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি বুদ্ধিভিত্তিক ইবাদতমূলক নয়। আর প্রবৃদ্ধিশীলতাই হল তার যৌক্তিকতার কারণ। এটা যখন যাকাত ফরয হওয়ার কারণরূপে স্বীকৃত, তখন এই ‘কারণ‘ যেখানে এবং যাতেই পাওয়া যাবে, তার উপরই যাকাত ফরয হওয়া বাঞ্ছনীয়। চতুর্থ, সাহাবিগণের উক্তিসমূহ, যা বর্ণনায় পাওয়া গেছে, তা সবই উপরিউক্ত প্রত্যয়কে সমর্থন ও অধিক শক্তিশালী করে দেয়। তাহাভী ও দারে কুত্নী সহীহ্ সনদে উদ্ধৃত করেছেন, খায়ের িইবনে ইয়াযীদ বলেছৈন, ‘আমি আমার পিতাকে দেখেছি, তিনি ঘোড়া পালতেন ও তার যাকাত উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।’ আবদুর রায্যাক ও বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন, ইয়ালী ইবনে উমাইয়্যা বলেছৈন, আবদুর রহমান একজনের ইয়েমেনবাসীর কাছ থেকে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন একশ’টি উষ্ট্রীর বিনিময়ে। পরে বিক্রেতা লজ্জিত হল ও উমরের কাছে উপস্থিত হয়েবলল, িইয়ালী ও তার ভাইরা আমার একটি ঘোড়া অপহরণ করে নিয়ে গেছে। উমর (রা) ‘ঘোড়ার মূল্য কি তোমাদের কাছে এতদূর পৌঁছে যায়? আমি তো তা জানি না। আমরা তো প্রতি চল্লিশটি ছাগল থেকে একটি ছাগী যাকাত বাবদ নিয়ে থাকি অথচ ঘোড়া থেকে কিছুই লই না। এক্ষণে প্রতিটি ঘোড়া থেকে এক দিনার গ্রহণ কর।’ অতঃপর প্রতিটি ঘোড়ার উপর এক দীনার করে যাকাত ধার্য হয়ে গেল। ইবনে হাজম উদ্ধৃত করেছেন, খায়ের ইবনে ইয়াযীদ জানিয়েছেন যে, তিনি উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে ঘোড়ার যাকাত নিয়ে উপস্থিত হতেন। ইবনে শিহাব বলেছেন, উসমান ইবনে আফ্ফানও ঘোড়ার যাকাত দিতেন। আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর (রা) ঘোড়া থেকে দশ দিরহাম ও পাঁচ দিরহামকরে যাকাত গ্রহণ করতেন।যায়দ ইবনে সাবিত আনসারীও এই মত সমর্থন করতেন। মারওয়ান ইবনে হাকামের শাসনামলে আলিমগণ চেড়ে দেয়া চিহ্নিত ঘোড়ার যাকাত সম্পর্কে বিতর্কে পড়ে যান। তাঁরা িএ বিষয়ে মারওয়ানের সাথে পরামর্শ করেন। তখন হযরত আবূ হুরায়রা এই হাদীসটি বর্ণনা করেন: ‘ক্রীতদাসও ঘোড়ার কোন যাকাত দিতে হবে না। মারওয়ান এজন্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তখন হযরত আবূ হুরায়রা বলেন, ‘আমিতো রাসূলের হাদীস বর্ণনা করছি আর আপনি তাতে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? রাসূল (স) সত্যই বলেছেন। তিনি মুজাহিদদের ঘোড়ার যাকাত না নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু যদি কেউ ব্যবসা বা বংশবৃদ্ধির জন্যে ঘোড়া পোষে, তবে তাতে অবশ্যই যাকাত ধার্য হবে। কত?.. প্রতিটি ঘোড়ায় এক দিনার অথবা দশ দিরহাম।’ কিতাবুল আমওয়ালে উদ্ধৃত হয়েছে, তায়ূস হযরত ইবনে আব্বাসের কাছে ঘোড়ার যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘জিহাদের ঘোড়ার কোন যাকাত নেই।’ তার অর্থ, এছাড়াও অন্য সব ঘোড়ারই যাকাত দিতে হবে। ইবরাহীম নখয়ীও এই মত প্রকাশ করেছে। বলেছেন, বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পালিত ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে। ইচ্ছে করলে প্রতিটি ঘোড়া বাবদ এক দীনার অথবা দশ দিরহারম দেবে। অথবা ঘোড়ার মূল্য ধরে প্রতি দুইশ’ দিরহাম বাবদ দশ দিরহাম আদায় করবে। আবূ হানীফার মতে যাকাতের নিসাব ইমাম আবূ হানীফা ঘোড়ার যাকাতের কোন নিসাব নির্ধারণ করেন নি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর কাছে কোন নির্দিষ্ট নিসাব আছে কি নেই? অধিক সহীহ কথা হচ্ছে, নেই। কেননা তিনি তা নির্ধারণই করেন নি। কিন্তু বলা হয়েছে তার নিসাব হচ্ছে, তিনটি, কেউ বলেছেন পাঁচটি। পাঁচটি হওয়াই অধিক সম্ভব। কেননা পাঁচটি উটের বা পাঁচ অসাকের কমে যাকাত ধরা হয়নি। কিন্তু কতটা যাকাত ফরয? ইমাম আবূ হানীফার মত বলে কথিত হয়েছে, আরবদের ঘোড়ায় ইচ্ছা করলে প্রতিটি বাবদ িএক দীনার অথবা তার মূল্য ধরে প্রতি দুইশ’ দিরহামে পাঁচ দিরহাম দেয়া যেতে পারে। অন্যদের ঘোড়া হলে তার মূল্য ধরেই যাকাত দিতে হবে। পর্যালোচনা উপরে দুটি মাযহাবের অভিমত ও দলীল উল্লেখ করার পর আমার বক্তব্য হচ্ছে, ঘোড়ার যাকাত না লওয়া সম্পর্কে রাসূলে করীমের কোন সুস্পষ্ট উক্তি পাওয়া যায় না, যেমন স্পষ্ট ভাষায় তা ফরয বলে ঘোষণাও করেন নি। ‘মুসলমানের ক্রীতদাস ও ঘোড়ার যাকাত নেই’ হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত এ হাদীসটি শুধু এতটুকু বলে যে, মুসলমানদের যেসব ঘোড়া জিহাদ ও সাধারণ চলাচলে ব্যবহৃত হয় তার যাকাত দিতে হবে না। যায়দ ইবনে সাবিত ও ইবনে আব্বাস (রা) থেকেও তা-ই বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের ‘ক্রীতদাস’ বলতে বোঝায় ব্যক্তির খেদমতে নিয়োজিত দাস, তার চলাচল ও জিহাদের ব্যবহৃত ঘোড়া। আর জাহেরী ফিকাহ্বিদ ব্যতীত আর সকলেই এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ব্যবসায়ের জন্যে যেসব ঘোড়া ও দাস সংগ্রহ করা হবে, তার যাকাত অবশ্যই দিতে হবে। হযরত আবূ হুরায়রাও কুরআন-হাদীসের বাহ্যিক ও প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণেই আগ্রহী ছিলেন। তিনি যায়দ ও ইবনে আব্বাস (রা)-এর ন্যায় ফিকাহ্ বিদ্যায় পারদর্শী রূপে খ্যাতি লাভ করেন নি। হযরত আলী বর্ণিত হাদীস ‘আমি তোমাদের ঘোড়া ও দাসের যাকাত মাফ করে দিয়েছি’- কথাটি তাঁর নিজের, রাসূলের নয়। ইামম দারেকুত্নীর মতে এ হাদীসটিও মৌলিকভাবে তার উপর যাকাত ফরয হওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে- যদিও তা মাফঠ করার কথা বলা হচ্ছে। সে মাফ করার অনেক কারণ থাকতে পারে। সে যুগে তো ঘোড়া বেশীর ভাগ জিহাদ ও পাহারাদারীর কাজেই প্রয়োজন হত। তা-ই ছিল সেকালের প্রধান প্রস্তুতি সামগ্রী। আর তখনকার আরবে সম্পদ এতটা বিস্তীর্ণও ছিল না। সে যা-ই হোক, ঘোড়ার যাকাত দেয়া পর্যায়ে কোন সুস্পষ্ট কথার প্রমাণ করে না যে, তাতে যাকাত কখনই ধার্য করেছেন। স্বর্ণ সম্পর্কে তাঁর এ রকম কোন সুস্পষ্ট উক্তি নেই। কেননা সেকালের প্রধান নগদ মুদ্রা রৌপ্য নির্মিত ছিল। তা্ িসে বিষয়ে যাকাত ফরয হওয়ার কথা প্রমাণিত হওয়ায় রৌপ্যর উপরও তা ধার্য করা হসহ হয়েছে। কেননা এ দুয়ের কল্যাণ ও লক্ষ্য অভিন্ন। উপরে উদ্ধৃত ইয়ালী ও হযরত উমর সংক্রান্ক কিস্সা যাকাত পর্যায়ে খুব বেশী গুরুত্বের দাবি রাখে। তাতে দেখা যায়, হযরত উমর এ ব্যাপারে কিয়াসের আশ্রয় নিয়েছেন। আর তা প্রমাণ করে যে, ইজতিহাদ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। নবী করীম (স) যে যে মালের যাকাত নিয়েছেন, তা এই কথা প্রমাণ করে যে, অনুরূপ মাল-সম্পদের যাকাত গ্রহণে মূলত নিষেধ কিছুই নেই। আর যে মূল-সম্পদই বর্ধনশীল তা থেকেযাকাত গ্রহণ করাই আবশ্যক। তার পরিমাণ নির্ধারিত না থাকলে সেজন্যে ইজতিহাদ করতে হবে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন যে, তা হযরত উমরের ইজতিহাদ বৈ কিছু নয়। অতএব তা অকাট্য দলীল হতে পারে না- এ কথার উপর যে, তিনি তাদেরকে তার জন্যে আদেশ করেছিলেন তখন, যখন তারা ইচ্ছা করেই ঘোড়ার যাকাত দিতে চেয়েছিল। অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, সিরিয়াবাসী কিছু লোক এসে বলেছিল, ‘আমরা কিছু ঘোড়া ও দাস পেয়ে গেছি। তাতে যাকাত ধার্য হওয়া আমরা প৪ছন্দ করি।’ তখন হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার পূর্ববর্তী দুইজন (রাসূলে করীম ও হযরত আবূ বকর) যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, আমি সেই অনুযায়ী কাজ করব।’ তিনি অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শও করলেন। হযরত আলী বললেন, ‘তাই ভাল। কোন কোন জিযিয়া যদি প্রচলিত না থেকে থাকে, তবে আপনার পরে তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হতে থাকবে।’ আমি মনে করি, সিরিয়ার লোকদের সাথে উক্ত ঘটনা ইয়েমেনের লোকদের সাথে সংঘটিত ঘটনার পূর্বের ব্যাপার। হযরত উমর বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঘোড়ার খুব বেশী মূল্য হয়ে থাকে, তাই তা যাকাতমুক্ত হতে পারে না। সেই কারণে উক্তরূপ উক্তি করেছিলেন যা বর্ণিত ঘটনার শেষে বলা হয়েছে। অতএব যুক্তিসঙ্গত কথা হচ্ছে, উক্ত ঘটনার পর এই ঘটনা। প্রথমত, তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন এ জন্যে যে, যে কাজ রাসূলে করীম ও হযরত আবু বকর করেন নি, তা তিনি কিভাবে করবেন? তাই তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। হযরত আলী সেই দিকে ইঙ্গিত করেই তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন। এতে কড়া সতর্কতা অবলম্বনের নীতি নিহিত রয়েছে। কিন্তু এ শেষোক্ত ঘটনায় তিনি কারোর কাছেই পরামর্শ চান নি। তিনি যা দেখেছেন, তারই ভিত্তিতে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ইয়েমেনে নিযুক্ত গভর্ণরকে প্রতিটি ঘোড়া বাবদ এক দীনার গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, প্রতিটি ঘোড়া বাবদ এক দীনার গ্রহণ করা কোন বাধ্যতামূলক কাজ নয়। কেননা দীনারের ক্রয়ক্ষমতা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হয়ে থাকে। তাই কোন দেশে একটি ঘোড়া বাবদ পাওয়া এক দীনার অনেক মুল্যবান, আবার অন্য দেশে খুব সামান্য। আমাদের এ যুগে ইমাম নখরী ও আবূ হানীফার মত অনুযায়ী ঘোড়ার মূল্য ধরে তার দশ ভাগের এক ভাগের চারভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ গ্রহণ করাই সমীচীন। শরীয়াত নগদ সম্পদ ও পণ্যদ্র্রব্যের যাকাতে এ হারই চালু করেছে। গবাদিপশুর যাকাত এ রকমই প্রায়। কেননা সেক্ষেত্রে প্রতিটি চল্লিশটি উষ্ট্রে একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চতুর্থ বছরে উপনীতা উষ্ট্রী, প্রতি ত্রিশটি গরুতে একটি করে এক বছর বয়সের বাছুর, আর প্রতি চল্লিশটিাতে একটি দুই বছর বয়স্ক বাছুর ধার্য হয়েছে। কোন গবাদিপশুর পালে বিভিন্ন বয়সের ছোট ও বড় জন্তু থাকে। তাই দশ ভাগের এক ভাগের এক চতুর্থাংশই শ্রেয়। তবে ছাগলের যাকাতের প্রতি একশটিতে একটি ছাগী ধার্য হয়েছে এজন্যে যে, তাতে ছোট ও বড় জন্তু থাকে। তাই দশ বাগের এক ভাগের এক-চতুর্থাংশই শ্রেয়। তবে ছাগলের যাকাত প্রতি একশটিতে একটি ছাগী ধার্য করা হয়েছে এজন্যে যে, তাতে ছোট বয়সের ছাগল বেশী থাকাই স্বাভাবিক। সেগুলোও তো গণনা করা হবে; কিন্তু তার যাকাত নেয়া হবে না। পূর্বে যেমন বলেছি, এ পর্যায়ে আমার মত হচ্ছে, নবী করীশ (স) গরুর হিসাব সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেন নি মুসলিম উম্মতকে কিছুটা সুবিধা দান ও রাষ্ট্রপ্রধানের বিবেচনা খাটানোর সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। আর তিনি এ পর্যায়ের কথা বলেছিলেন মুসলমানদের নেতা হিসেবে। তা ক রার অধিকাও ছিল। তিনি আদেশও করবেন, নিষেধও করবেন। বাধ্য করবেন, আবার নিষ্কৃতিও দেবেন। গোটা জাতির সামষ্টিক কল্যাণের দৃষ্টিতে তাঁর সমগ্র কাজ আঞ্জাম পাবে। অনেক সময় ঘোড়ার যাকাত না লওয়াটাই সামষ্টিক কল্যাণের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাসূলে করীম(স) নবী হিসেবে যা বলেছেন এবং যা বলেছেন মুসলিম জাতির রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যকরা যাবে কি ভাবে? সেপার্থক্য করা যাবে অবস্থার লক্ষণের দৃষ্টিতে। হাদীসের বিষয়বস্তু রাষ্ট্রনীতি বা অর্থনীতি, সামরিক কিংবা প্রতিষ্ঠানগত কল্যাণ সম্পর্কিত হবে, যা থেকে বোঝা যাবে যে, রাসূলে করীম (স) সেই কথা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বলেছেন অথবা এমন দলীল হবে যা তার বিরোধী হবে কেবল স্থান, কাল ও অবস্থার বিরোধিতার কারণে; যা প্রমাণকরবে যে, তাতে সাময়িক ও আংশিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, তাতে চিরস্থায়ীভাবে আইন প্রণয়ন লক্ষ্য নয়। আর দৃষ্টান্ত হিসেবে ইমাম কিরাফীর গ্রন্থ ‘আল-আহকাম’-এর উদ্ধৃত একটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা যায়। হাদীসটি হচ্ছে: (আরবী********) যে লোক কোন লোককে জিহাদে হত্যা করল, নিহত ব্যক্তির সঙ্গের জিনিসপত্রের সে-ই পাবে। ইমাম মালিক বলেছেন, রাসূলের এ কথা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বলা কথা। কাজেই যুদ্ধের পূর্বের রাষ্ট্রনেতার অনুমতি ছাড়া কোন মুজাহিদ যেন তার হাতে নিহত ব্যক্তির সঙ্গের জিনিসপত্র নিজের জন্যে খাস মনে করে নিয়ে নেবে না। রাসূলে করীম (স) থেকে তাই ঘটেছে। যে সব বিষয় ইমাম মালিকের এই মত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে, আল্লামা কাওয়াফীর মতে তা হচ্ছে: ১. গনীমত বন্টন সংক্রান্ত আয়াত ও এ হাদগীসের সাথে তার বৈসাদৃশ্য, ২. মুজাহিদদের নিয়ত নষ্ট করা- যখন তা শুরুতেই ঘটবে। ৩. উক্ত হাদীসে যেমন বলা হয়েছে, তা অবস্থার লক্ষণের ইঙ্গিত। যুদ্ধে উৎসাহ দানের জন্যেই তা বলা হয়েছিল। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেন: জানা উচিত, রাসূলে করীম(স) থেকে যা বর্ণিত এবং যা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে সঙ্কলিত, তা দুভাগে বিভক্ত। একটি ভাগের সেসব কথা, যা রিসালাতের দায়িত্ব পালন স্বরূপ তিনি বলেছেন। আল্লাহর আদেশ- যা রাসূল তোমাদের দেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তোমরা তা থেকে বিরত থাক’ –এই পর্যায়ের কথা। এ ছাড়া পরকাল ও বিশ্বলোকের বিস্ময়কর জগত সম্পর্কিত তথ্যাবলীও এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।’ দ্বিতীয় যা রিসালাতের দায়িত্ব পালন পর্যায়ে নয়। রাসূলের উক্তি- ‘আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কিত কোন বিষয়ে কিছু বলি, তখন তোমরা তা অবশ্যই গ্রহণকরবে। আর আমার নিজের অভিমত হিসেবে, যদি কিছু বলি, তা হলে মনে রাখবে আমি একজন মানুষ।’ চিকিৎসা সংক্রান্ত কথাবার্তা এ পর্যায়ে গণ্য।তা রাসূলের অর্জিত অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। রাসূলে করীম(স) অভ্যাস-বশত যা করেছেন- ইবাদত হিসেবে নয়- তা-ও এ পর্যায়ে গণ্য হবে। ঘটনাবশত যা করেছেন, ঠিক ইচ্ছা করে করেন নি, তাও তাঁর মানুষ হিসেবে করা কাজ। তিনি তৎকালীন সাধারণ জনকল্যাণের অংশহিসেবে যা কিছু বলেছৈন, গোটা জাতির সকলের জন্যে তা বাধ্যতামূলক নয়, তাও এ পর্যায়ে গণ্য করতে হবে। সৈন্যবাহিনী সজ্জায়ন ও আচার-আচরণ নির্ধারণ.... এ ব্যাপারের দৃষ্টান্ত। এ পর্যায়ে বহু আদেশ-নির্দেশও উদ্ধৃত হয়েছে। (আরবী********) যে মুজাহিদ কোন কাফিরকে যুদ্ধে হত্যা করর, তার সঙ্গের যাবতীয় জিনিস তারই হবে। (আরবী********) যে লোক প্রতিত জমি চাষেপযোগী বানালো তা তারই মালিকানাভুক্ত হবে। মালিকী মায্হাবের লোকেরা এ পর্যায়ে বলেছেন যে, হত্যাকারী কোন নিহত ব্যক্তির সঙ্গের জিনিসপত্র পাবে না, যদি যুদ্ধের পূর্বে নবী করীম(স)-এর ন্যায় রাষ্ট্রপ্রধান উক্তরূপ ঘোষণা প্রদান না করেন। হানাফীরাও বলেছৈন, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন পতিত জমি চাষোপযোগী করতে চেষ্টা করা কারোর পক্ষেই জায়েয হবে না। আমার মতে, ঘোড়ার যাকাত মাফ করে দেযা সংক্রান্ত রাসূলের ঘোষণা যদি সহীহ্ প্রমাণিত হয়ও, তবু তা এ পর্যায়েরই ঘোষণা হবে। তিনি তখন এরূপ করাকেই জনগণের জন্যে কল্যাণকর মনে করেছিলেন। তাতে লোকেরা ঘোড়া পালন করার উৎসাহ পাবে, এ-ই ছিল তাঁর ধারণা। রাসূলের উক্তি ‘আমি মাফ করে দিলাম’ এই কথাই প্রমাণ করে। কেননা যা অবশ্য পালনীয়, তাতেই ক্ষমা করা বা মাফ করে দেয়ার সুযোগ থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যাপারটি তাঁর বিবেচনার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই পরবর্তী সমস্ত কালের রাষ্ট্রপ্রধানদের বিবেচনার উপর তা নির্ভর করবে। তারা যাকাত ধার্য করলে তা দিতে হবে, নতুবা নয়। বস্তুত ঘোড়া যখন বিভিন্ন দেশে বংশবৃদ্ধি ও অর্থোপার্জনের সূত্র হিসেবে পালিত হয় এবং উষ্ট্রের তুলনায় অধিক বেশী মূল্যবান সম্পদরূপে গণ্য হয়, তখন তার যাকাত গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। তাতে সব ধনীদের প্রতিই সমতা রক্ষা করা হবে। অন্যথায় কোন কোন ধনী লোকদের কাছ থেকে তাদের ধন-মালের যাকাত গ্রহণ ও কোন কোন