কাদিয়ানী সমস্যা

আমাদের কথা

 

পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর ১৯৫৩ সাল নাগাদ পাকিস্তানের বিভিনন শহরে কাদিয়ানীদেরকে অমুসিলম ঘোষণার দাবীতে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। এ সময় মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী (র) জনগণ যেন আইনের সীমা লংঘন না করে এবং শিক্ষিত শ্রেণী যাতে কাদিয়ানীদের ব্যাপারে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে এবং কাদিয়ানী সমস্যার যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে সে উদ্দেশ্যে “কাদিয়ানী মাসআলা” নামে একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। পুস্তিকাটি সকল মহলের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

 

এদিকে পাঞ্জাবে কাদিয়ানী সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যকার দাংগা ভয়াবহরূপ ধারণ করে। এরূপ পরিস্থিতিতে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ৫৩ সালের আটাশে মার্চ তারিখে মাওলানা মওদূদীসহ জামায়াতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে কোন অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করে। এটা ছিল মূলত সামরিক কর্তৃপক্ষের ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার নগ্ন বহিপ্রকাশ।

 

মাওলানাকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে “কাদিয়ানী মাআলা” পুস্তিকার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এ অভিযোগেই ৮ই মে তারিখে সামরিক আদালত মাওলানাকে ফাসীর আদেশ প্রদান করে। মূলত এটা ছিল একটা ছূতা। ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালারকে যেনো তেনো উপায়ে হত্যা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর তীব্র বিরোধিতা ও ক্ষোভের মুখে তাঁরা তাঁর মৃত্যু দণ্ডাদেশ মওকুফ করে তারা মাওলানাকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করে। কিন্তু বিশ মাস কারাবাসের পর মাওলানা বিনা শর্তে মুক্তি লাভ করেন।

 

মজার ব্যাপার হলো, সামরিক কর্তৃপক্ষ যে “কাদিয়ানী মাসআলা” পুস্তিকা প্রণয়নের অজুহাতে মাওলানাকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করে সে পুস্তিকাটির কিন্তু তারা বাজেয়াপ্ত করেনি। লাহোরের সামরিক আদালতে তার বিচার চলাকালেই লাহোর শহরেই পুস্তিকাটি বাম্পার সেল চলছিল। মূলত পুস্তিকাটির কোথাও কোন উস্কানীমূলক কথা ছিল না। বরং তাতে তিনি প্রত্যক্ষ্য সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। উল্লেখ্য, সে সময় জামায়াত বাদে অন্য সব দল একত্রিত হয়ে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট এ্যাকশন কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল। জামায়াতের কেন্দ্রিয় মজলিসে শুরার প্রস্তাবেও এরূপ কর্মসূচী ঘোষণার নিন্দা করা হয়।

 

কাতিয়ানীরা যে মুসলমান নয়, অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এ পুস্তিকায়ি তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাদিয়ানীদেরকে আইনগত ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করাই ছিল মাওলানার দাবী। এ দাবীর স্বপক্ষে  প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য এ পুস্তিকায়ি সরবরাহ করা হয়েছে।এ দাবী আদায়ের লক্ষ্যে মাওলানা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলবার আহ্বান জানান। অবশেষে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। কাদিয়ানীরা যে, অমুসলিম এ ব্যাপারে উম্মতের গোটা আলেম সমাজ একমত।

 

১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় আলেমগণ একত্রিত হয়ে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশমালা বিবেচনা করে কতিপয় প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে িএকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এতে মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে যারা নিজেদের ধর্মীয় নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদেরকে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে ঘোষণার দাবীও বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

প্রস্তাবে স্বাক্ষরকারী আলেমগণ হলেন:

 

১। মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ হাসান সাহেব

 

২। আল্লামা সোলায়মান নদবী সাহেব

 

৩। মাওলানা আবূল হাসানাত সাহেব

 

৪। মাওলানা দাউদ গজনবী সাহেব।

 

৫। মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী সাহেব

 

৬। মাওলানা আহমদ আলী সাহেব?

 

৭। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেব

 

৮। মাওলানা ইহতেশামূল হক সাহেব

 

৯। মাওলানা সামসুল হক ফরিদপুরী সাহেব

 

১০। মাওলানা আবদুল হামেদ কাদেরী বদায়ূনী

 

১১। মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শফী সাহেব

 

১২। মাওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী সাহেব

 

১৩। মাওলানা খায়ের মোহাম্মদ সাহেব

 

১৪। হাজী মোহাম্মদ আমীন সাহেব

 

১৫। হাজী আবদুস সামাদ সরবাজী সাহেব

 

১৬। মাওলানা আতহার আলী সাহেব

 

১৭। মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ সাহেব

 

১৮। মওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব

 

১৯। মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেব

 

২০। মওলানা মোহাম্মদ সাদেক সাহেব

 

২১। মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেব

 

২২। খলিফা হাজী তুরুঙ্গজয়ী সাহেব- প্রমুখ

 

বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের তৎপরতা ইদানি বেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদেরকে অমুসরিম ঘোষণার দাবীও বেশ জোরদার হচ্ছে। কিন্তু সরকার এখনো তাদের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। হয়তো বা কাদিয়ানীরা যে অমুসলিম নয়, সে ব্যাপারে কারো কারো মধ্যে সংশয় থাকতে পারে। এ সংশয় নিরসনকল্পে আমরা ‘কাদিয়ানী মাসআলা’র বংগানুবাদ ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ বইটি পুনঃ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। মূল বইটি অনুবাদ হয়েছে ১৯৬৩ সালে সাধু ভাষায়। দীর্ঘদিন বইটি বাজারে ছিল না। সেই অনুবাদটির সাথেই আমরা এখন কাদিয়ানীদের প্রসংগে মাওলানার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাসায়েল ও মাসায়েল’ থেকে কতিপয় প্রশ্নোত্তর সংযোজন করে দিয়েছি। এতে পাঠকরা অধিকতর অবগতি লাভ করবেন বলে আশা করি।

 

এ বইটির সাথে আগ্রহী পাঠকগণ অবশ্যি মাওলানার খতমে নবুয়্যাত পুস্তিকাটি অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি। আর যে গ্রন্থটি এখনো উর্দূ ভাষা থেকে বংগানুবাদ হয়নি উর্দূ জানা ব্যক্তিগণকে মাওলানার সে গ্রন্থটিও এ প্রসঙ্গে পাঠ করার অনুরোধ করছি। গ্রন্থটির উর্দূ না্ম হলো ‘কাদিয়ানী মাসআলা আওর উসকে মাযহাবী, সিয়াসী আওর মাওয়াশিরাতি পাহলু’।

 

এ পুস্তিকাটির মাধ্যমে ইসলামের ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকারীদের সম্পর্কে মুসলমানগণ সতর্কহলেই আমাদের শ্রম সার্থক হবে। আমীন।

 

আবদুশ শহীদ নাসিম

 

পরিচালক

 

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী

 

 

 

 

 

বিসমিল্লাহির রহমানি রহীম

 

১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে একটি সর্বদলীয় ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশসমূহ বিচার বিবেচনার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় ৩৩ জন আলেম একত্রিত হইয়া কতিপয় প্রস্তাবসহ একটি সংশোধনী রিপোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করন। তন্মধ্যে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নিজেদের ধর্মীয় নেতা হিসাবে অনুসরণকারীদিগকে আলাদা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে ঘোষণার দাবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদে পাঞ্জাবী মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট আসন হইতে একটি আসন কাদিয়ানীদিগকে দেওয়ার জন্য উক্ত প্রস্তাবে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হইয়াছিল তাহাও প্রণিধানযোগ্য।

 

ওলামা সম্মেলনে গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবসমূহের যৌক্তিকতা সম্পর্কে কোন প্রকার দ্বিধা সন্দেহের অবকাশ নাই। এই কারণেই আজ পর্যন্তে কেহ সে বিষয়ে প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা টু শব্দটিও করেন নাই। আলেম বিদ্বেষীরাও এ বিষয়ে কোন প্রকার ত্রুটি আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। যদি কেহ কোথাও কিছু বলিয়া থাকেন, তবে তা ‘ব্যর্থ প্রেমিকের দীর্ঘ নিঃশ্বাস’ ব্যতীত আর কিছুই নহে। শিক্ষিত সমাজে তাহার মূল্য নাই। কিন্তু সর্বদলীয় ওলামা সম্মেলনে গৃহীত এই বিশেষ প্রস্তাবটি কাদিয়ানী সমস্যার সঠিক সমাধান হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ শিক্ষিত লোক এখনও ইহার প্রয়োজন এবং যৌক্তিকতা পূর্ণরূপে অনুধাবন করিতে পারেন নাই বলিয়া মনে হয়। পাঞ্জাব এবং বাহওয়ালপূর ব্যতীত দেশের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করিয়া পূর্ব অঞ্চলে জনসাধরণ এই সমস্যাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে পারেন নাই। এই করণেই দেশবাসীর সম্মুখে সর্বদলীয় সম্মেলনে কাদিয়ানী সম্প্রদায় সম্পর্কে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা আবশ্যক। এই পুস্তিকাটির মাধ্যমে আমি সেই চেষ্টাই করিব।

 

কাদিয়ানী সমস্যা

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড