প্রধম সংস্করণ
ভুমিকা
অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন রচিত “সুদ সমাজ অর্থনীতি” বইটির পাণ্ডুলিপি পড়লাম। আমার মতে, আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুদের ওপর এত বিস্তারিত আলোচনা বিশেষ করে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম। সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইটিতে সুদের বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে এর নৈতিক ও সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ যুক্তিসহ চমৎকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুঁজি গঠন, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের গতিকে শ্লথ করে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের হাতিয়ার হয়ে এই সুদ সমাজের ভিতরে ও বাইরে কিভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে তার একটি অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে এই বইতে।
আসলে এর বিপরীত কোন ফলাফল আশা করাটাই ছিল অবাস্তব। কেননা ১৪ শত বছর পূর্বেই আল-কুরআনে (রিবা) সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। বইটির আলোচনা থেকে দুটো জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ (ক) উক্ত (নির্দেশ) শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য এটা মনে করা সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক হবে এবং (খ) সুদের কু-প্রভাব থেকে সমাজ তথা দেশকে মুক্ত করার জন্য কেবলমাত্র অর্থনীতিবিদরাই দায়িত্ব বহন করবেন তাও হবে অযৌক্তিক। রিবামুক্ত অর্থনীতি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের পূর্বশর্ত, এই সত্যটি আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যত তাড়াতাড়ি খোলা মন নিয়ে উপলব্ধি করতে পারব ততই মঙ্গল।
তবে, সুদের আর্থ-সামাজিক কুফলসমূহ সকল সচেতন মহলের সামনে তুলে ধরা উল্লেখিত লক্ষ্য অর্জনের প্রাথমিক ধাপ মাত্র। এগিয়ে যেতে হবে আরও অনেক দূর। সুদের কার্যকরী বিকল্প (লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে কারবার) পদ্ধতি দক্ষতা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি আন্তরিকতার সাথে চালু করতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেখানে যেখানে এই পদ্ধতি কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে সেখানকার গবেষণালব্ধ ফলাফল সকল সচেতন ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে প্রায়োগিক গবেষণা চালাতে হবে।
বইটির বহুল প্রচারের মাধ্যমে এরূপ একটি পরিবেশ সৃষ্টি হোক এই কামনা করছি।
প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
ভাইস চ্যান্সেলর
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়া
মাঘ ২৬,১৩৯৮
শাবান, ০৪, ১৪১২
ফেব্রুয়ারী ০৯, ১৯৯২
প্রকাশকের কথা
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইনের ‘সুদ সমাজ আর্থনীতি’ নামক বইটি আমাদের প্রকাশনা তালিকায় এক অনন্য সংযোজন। বইটি সুদের ওপর বাংলা ভাষায় রচিত ব্যাপক চিন্তা, গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল। ঈমান-আকিদা ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুদের অভিশাপ যে কত ভয়াবহ তা অত্যন্ত নিখুঁত ভাষায় বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্ট করা হয়েছে বইটিতে। আমরা আশা করি সম্মানিত পাঠকগণ এ বই থেকে সুদ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানতে পারবেন। আমাদের এ প্রকাশনাটি ছাত্র, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের উপকারে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
অধ্যাপক শরীফ হুসাইনের এ মূল্যবান পুস্তকটি প্রকাশের জন্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন অর্থ যোগান দেয়ায় এর প্রকাশনা সম্ভবপর হলো। আমরা ব্যুরোর পক্ষ থেকে তাই ব্যাংক ফাউন্ডেশনকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ এ বই পাঠে উপকৃত হলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেব। আল্লাহ পাক সকলের অবদান কবুল করুন। আমীন।
মীর কাসেম আলী
চেয়ারম্যান
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ বুরো
ঢাকা।
ঢাকা
মাঘ ২৬, ১৩৯৮
শাবান ০৪, ১৪১২
ফেব্রুয়ারী ০৯, ১৯৯২
লেখকের কথা
সর্বপ্রথম পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি যে, তিনি সুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ফলাফল সম্পর্কে সামান্য কিছু জানা এবং তা প্রকাশ করার তৌফিক দিয়েছেন।
বস্ত্ততঃ ইসলামের প্রভাবেই আরবের অসভ্য জাতি একদিন মানবতাকে অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিল; গুরুর আসনে বসে তারা ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দানে সক্ষম হয়েছিল। ইসলাম-পরবর্তী আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং স্পেন-করডোভার স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসই এর জ্বলন্ত সাক্ষী। কিন্তু শত শত বছরের রাজনৈতিক পরাধীনতা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম জাতিকে তার আদের্শ থেকে কেবল দূরে সরিয়েছে তাই নয়, বরং এই মহান আদর্শের সৌন্দর্যকেও বিস্মৃত করে দিয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃত ধারণা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছে। পশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এর স্বার্থেই ইসলামী বিধি-বিধানের সত্যতা, কার্যকারিতা ও এর কল্যাণধর্মিতা সম্পর্কে নানা সংশয় ও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
এমনি একটি বিষয় হচ্ছে সুদ। ইসলামী শরীয়তে হারাম ঘোষিত কাজের মধ্যে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশী কঠোর। কিন্তু পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে সুদ আজ সারা দুনিয়ায় অর্থনীতিকে ছেয়ে ফেলেছে। পুঁজিবাদের প্রবক্তাগণ তাদেরেই স্বার্থে হারাম হওয়ার ব্যাপারে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে এবং এখনও করে চলেছে। এসব প্রশ্ন ও মন্তব্যের ধরন হচ্ছে নিম্নরূপঃ
-ইসলাম যে সুদ হারাম করেছে তা তৎকালে আরবে প্রচলিত সুদ; পরবর্তীকালের সুদ সেই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্থ নয়;
-ইসলাম কেবল ভোগ্য ঋণের ওপর সুদের লেনদেনকে নিষিদ্ধ করেছে; উৎপাদনশীল ঋণের সুদকে ইসলাম হারাম করেনি;
-কুরআন মাজীদ শুধুমাত্র চক্রবৃদ্ধি হারের সুদকে হারাম করেছে, সরল সুদকে নয়;
-ইসলাম উচ্চ হারের (usury) সুদকে হারাম করেছে, নিম্ন হারের সুদকে (interst) হারাম করেনি;
-ইসলাম মহাজনী সুদকে হারাম করেছে, আধুনিককালের ব্যাংকে প্রচলিত সুদকে নিষিদ্ধ করেনি এবং
-আধুনিককালে সুদ ছাড়া অর্থনীতি চলতে পারে না ইত্যাদি।
আলহামদু লিল্লাহ, বিগত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিদেশী গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত হবার পর মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মুসলিম গবেষকগণ ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক গবেযণা পরিচালনা করেছেন। সুদ, যাকাত তথা ইসলামী অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক গবেষণা চলছে। এসব মনীষীদের গবেষণায় দেখা যায়, ইসলাম কোন বিশেষে ধরনের সুদকে হারাম করেনি বরং সকল প্রকার সুদকেই নিষিদ্ধ করেছে; সুদের হার উচ্চ হোক না নিম্ন হোক, চক্রবৃদ্ধি সুদ হোক বা সরল সুদ হোক, ইসলামের সব সুদই হারাম। গবেষকগণ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, তদানীন্তন আরবে কেবল ভোগ্য ঋণের সুদই চালু ছিল তা নয়, বরং বাণিজ্যিক ঋণ তথা উৎপাদনশীল ঋণের ওপরও সুদের প্রচলন ছিল। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী (সাঃ) সুদকে হারাম ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পাওনা যাবতীয় সুদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। আব্বাসের (রাঃ) নিকট থেকে বনু সাকিফ গোত্র যে ঋন নিয়েছিল তা ভোগের জন্য নয়, বরং ব্যবসার উদ্দেশ্যেই নিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) সে সুদকেও নিষিদ্ধ করেছেন।
গবেষকগণ এটাও প্রমাণ করেছেন যে, মাহজনী সুদী কারবার আর আধুনিক ব্যাংকের সুদী কারবারের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে কোন পার্থক্য নেই; বরং বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন মহাজনী সুদের তুলনায় আধুনিক ব্যাংকের সংগঠিত সুদ অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক।
সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি চলার জন্য ইসলাম যে পথ দেখিয়েছে, গবেষকগণ তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।
ইসলামী চিন্তাবিদ. উলামায়ে কিরাম, ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও গবেষকগণ সুদ হারাম হবার করণ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা ও গভীর অধ্যয়ন করেছেন। এরা সুদকে মানবতার জন্য একটি জঘন্য অভিশাপরূপে চিহ্নিত করেছেন। সম্প্রতি পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদগণও সুদের মারাত্মক ধ্বংসকারী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠেছেন। এ সব অর্থনীতিবিদ গবেষকদের আলোচনায় সুদের যে মারাত্মক কুফলের উল্লেখ করা হয়েছে তারই একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা চেষ্টা করা হয়েছে এ ক্ষদ্র পুস্তকে। আলোচনার ভাষা যথাসম্ভব সহজ করার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে সাধারণ পাঠকগণও এ থেকে উপকৃত হতে পারেন।
বইটি লেখার কাজ প্রথম হাতে নিই ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক পৃথিবী’ ধারাবাহিক কটি সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশ করে। মাসিক পৃথিবীর অনেক পাঠক এবং সেন্টারের সম্মানিত ডাইরেক্টর অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদের পরামর্শে লেখাটি পুস্তকাকারে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর পরিচালকমণ্ডলীর সভাপতি এবং ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সভাপতি কমডোর (অবঃ) আতাউর রহমান বইটির পণ্ডলিপি দেখেন এবং ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য দিয়ে ইসলামিক ইকোনকিস রিসার্চ ব্যুরোকে বইটি প্রকাশের অনুরোধ করেন। ব্যুরো এ দায়িত্ব গ্রহণ করে। মাসিক পৃথিবীতে প্রকাশিত অংশে প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং আরও কিছু নতুন অংশ সংযোজন করে পুস্তকাকারে প্রকাশে বেশ বিলম্ব হয়ে গেল।
পুস্তকটি প্রণয়নকালে যাঁরা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে জনাব শাহ আব্দুল হান্নান, ড. সালাহউদ্দিন আহমদ, জনাব তাজুল ইসলাম ও জনাব এস, এম. আলী আক্কাসের নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম. এ. হামিদ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন এবং বইটির ভূমিকা লিখে এর মান বৃদ্ধি করেছেন।
জনাব হাসান রহমতী বইটির প্রুফ দেখার মত কঠিন কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। ব্যুরোর ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব ফেরদৌস কোরায়েশী বইটি ছাপার কাজে সহযোগিতা করেছেন এবং আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ এজন্য বেশ পরিশ্রম করেছেন।
মোটকথা, উল্লেখিত সকলের সহযোগিতা, পরামর্শ ও শ্রমের ফলেই পুস্তকটি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হলে। এদের এ ঋণ শোধ করার সাধ্য আমার নেই। মেহেরবান আল্লাহ তাঁদের জাযা দান করুন এটাই কামনা করি।
বইটি প্রধানত অর্থনীতির অত্যন্ত জটিল বিষয় নিয়ে লেখা বিধায় এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া যথার্থ পরামর্শ ও সহযোগিতা বইটিকে আরও সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ ব্যাপারে সুধী পাঠক, সম্মানিত উলামায়ে কিরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ তাদের মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সাহয্য করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের এ শ্রমকে কবুল করুন এবং সুদের অভিশাপ থেকে মানবতাকে মুক্ত করুন-আমীন।
মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন
ঢাকা
তারিখ
বৈশাখ ১৫, ১৩৯৯
এপ্রিল ২৮, ১৯৯২
শাওয়াল ২৩, ১৪১২