রাহে আমল – ১ম খণ্ড

গ্রন্থকারের ভূমিকা

(*****আরবী**********)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালার একটি শাশ্বত নিয়ম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। সেই নিয়মটি হলো, যে ব্যক্তি হেদায়াতের জন্য উদগ্রীব হয়, পোষণ করে তীব্র পিপাসা, আগ্রহ ও অস্থিরতা, আল্লাহ তাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করেন। আর যার ভেতরে হেদায়াতের পিপাসা নেই, তাকে তিনি কখনো হেদায়াত দান করেন না।

কোন বাবা তার সন্তানের সাথে এবং স্নেহময় শিক্ষক স্বীয় অধ্যবসায়ী শিষ্যের সাথে যে ধরনের আচরণ করে থাকে, আল্লাহ তায়ালা তার হেদায়াত প্রত্যাশী বান্দার সাথে ঠিক তদ্রূপ আচরণ করে থাকেন। আল্লাহ তাকে হেদায়াতের পথে তুলে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকেন না, বরং তাকে অব্যাহতভাবে নিজের দিকে টানতে থাকেন এবং সামনে এগিয়ে নিতে থাকেন। পক্ষান্তরে যার ভেতরে হেদায়াত লাভের কোন আকাংখা বা কামনা-বাসনা নেই, আল্লাহ তার কোন ধার ধারেন না। তার ব্যাপারে আল্লাহ বেপরোয়া হয়ে যান। তাকে ছেড়ে দেন, যে পথে ইচ্ছা চলুক এবং যে গর্তে ইচ্ছা পড়ুক।

পবিত্র কোরআন মানব জাতিকে সঠিক ও নির্ভুল পথ দেখানো জন্যে নাযিল হয়েছে। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার তীব্র বাসনা, অদম্য ইচ্ছা ও প্রবল পিপাসা যে পোষণ করে, একমাত্র সেই তা থেকে আলো পেয়ে থাকেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের সুপথ প্রাপ্তি ও আত্মশুদ্ধির জন্য নয়, বরং নিছক বাড়তি জ্ঞান অর্জনের খাতিরে এটি অধ্যয়ন করে, সে কোরআন থেকে কোন পথ-নির্দেশনা পায় না। রাসূলের (সা) হাদীসের বেলায়ও এ কথাটা প্রযোজ্য। কোরআনের ন্যায় হাদিসও একই উৎস থেকে উৎসারিত বলে এ বৈশিষ্ট্যটি হাদীসেও সমভাবে বিদ্যমান। কেউ যদি হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে হাদীস পড়ে, তবে সে তা থেকে হেদায়াত পাবে। আর যদি নিছক বাড়তি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে পড়ে, তবে সে তা থেকে কোন পথ নির্দেশ পাবে না। হেদায়াত ও বিপথগামিতার ব্যাপারে আল্লাহর এই নিয়ম ও নীতি চিরন্তন। আল্লাহর নিয়ম-নীতি কখনো পরিবর্তিত হয় না।

রাহে আমল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রজ্ঞাময় বাণীসমূহের একটি সংকলন। চিন্তা ও চরিত্রের সংশোধন ও উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে এটি সংকলিত। নিছক জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এটি অধ্যয়ন করা উচিত হবে না। রাসূল (সা)-এর বানী এরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে পড়ায় লাভ তো দূরের কথা, ক্ষতির আশংকাই বেশী। দ্বিতীয়তঃ হাদীসের শুধু অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পড়া এবং হাদীসের মূল ভাষ্য না পড়া নিজেকে অনেক অমূল্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর। তৃতীয়তঃ প্রতিটি হাদীসের উপর একটু সময় নিয়ে চিন্তা গবেষণা চালানো উচিত। এতে সংশোধন ও সংস্কারের এমন অনেক দিক উদ্ভাসিত হবে, যা হয়তো অনুবাদ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বাদ পড়ে গেছে। সাধারণভাবে তো আমরা সকল মুসলমানই সার্বক্ষণিক সংস্কার ও সংশোধনের মুখাপেক্ষী। কিন্তু এর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তাদের, যারা আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সাধনা ও সংগ্রামে নিয়োজিত। যারা বিকৃতি ও বিভ্রান্তির এই যুগেও এই প্রতিকূল পরিবেশে সত্যের সাক্ষ্য দানের এ কাজটির জন্য বিপুল প্রস্তুতির প্রয়োজন।

পাঠকগণের কাছে অনুরোধ রইল, এ কোথাও কোন ভুলত্রুটি চোখে পড়লে অনুগ্রহপূর্বক অবহিত করবেন। এ জন্য আমি যেমন কৃতজ্ঞ থাকবো, তেমনি আল্লাহ তায়ালাও প্রতিদান দেবেন।

(********আরবী********)

জলীল আহসান নাদভী

সূচীপত্র

১.       হাদীস সংকলনের ইতিহাস

২.       নিয়তের বিশুদ্ধতা

উদ্দেশ্যে সততা ও একনিষ্ঠতা

৩.      ঈমানিয়াত

যে সব বিষয়ে ঈমান আনা জরুরী

আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

ঈমানের পূর্ণতা লাভের উপার

ঈমানের প্রকৃত স্বাদ কখন পাওয়া যায়?

রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

সর্বোত্তম কথা ও সর্বোত্তম আদর্শ

কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা রাসূলের সুন্নাত

দুনিয়া ত্যাগ তথা বৈরাগ্যবাদ রাসূলের নীতি নয়

আল্লাহ ভীতির প্রকৃত পরিচয়

ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুসরণের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী

প্রকৃত ঈমানের দাবী

ঈমানের মাপকাঠি

আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসার প্রকৃতস্বরুপ

রাসূল প্রীতির ঝুঁকি

কোরআন শরীফের ওপর ঈমান আনার তাৎপর্য

কোরআনের বিষয়সমূহ

তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণা লাভ

তাকদীরের অর্থ

তাকদীর আগে থেকেই নির্ধারিত

যদি এমন হতো বলা অনুচিত

আখিরাতের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

কেয়ামতের আযাব থেকে মুক্তি

পৃথিবীর সাক্ষ্য

আল্লাহর সামনে উপস্থিতি

মোনাফেকির ভয়াবহ পরিণাম

হিসাব সহজ করার দোয়া

কেয়ামত মুমিনের জন্য হালকা হবে

মুমিনের কল্পনাতীত পুরস্কার

বেহেশতের একটুখানি জায়গাও মূল্যবান

দুনিয়া ও আখিরাতের সুখ দুখের তুলনা

জান্নাত ও জাহান্নামের আসল পার্থক্য

জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে সচেতনতা

বিদয়াতকারী হাউযে কাউসারের পানি পাবে না

বিদয়াতকারী হাউযে কাউসারের পানি পাবে না

কেয়ামতের দিন আত্নীয়তার বন্ধন নিষ্ফল

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্নসাতের ভয়াবহ পরিণাম

৪.      এবাদত

নামাযের গুরুত্ব

নামায দ্বারা গোনাহ মোচন হয়

নামায দ্বারা গুনাহ মোচনের শর্ত

মুনাফিকের নামায

ফজর ও আসরের নামাযের জামায়াতে ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ

নামাযের হেফাজত ছাড়া দ্বীনের হেফাজত অসম্ভব

কেয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে যারা

লোক দেখানো এবাদত শিরকের শামিল

জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা

বিনা ওযরে জামায়াত ত্যাগ করলে নামায কবুল হয় না

মসজিদে জামায়াতে নামায পড়া বিধিবদ্ধ সুন্নাত

৫.      ইমামতি

ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব

জামায়াতবদ্ধ নামায সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত

ইমামের কিরাত সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়

৬.       যাকাত, ছদকায়ে ফেতের, ওশর

যাকাত দারিদ্র দুর করার কার্যকর উপায়

যাকাত আদায় না করার শাস্তি

যাকাত না দিল ধনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়

ফেতরার দুটো উদ্দেশ্য

ওশর বা ফসলের যাকাত

৭.      রোযা

রমযান মাসের ফযিলত

রোযা ও তারাবীর প্রতিদান গুনাহ মুক্তি

রোযার নৈতিক শিক্ষা

রোযাদারের পক্ষে রোযার সুপারিশ

নামায, রোযা ও যাকাত গুনাহের কাফফারা

রোযার ব্যাপারে রিয়া থেকে হুশিয়ারী

সাহরীর বরকত

তাড়াতাড়ি ইফতার করার আদেশ

মুসাফিরের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি

নফল এবাদতে বাড়াবাড়ি ভালো নয়

ইতিকাফ

ইতিকাফ কয় দিন?

রমযানের শেষ দশ দিনে রাসূলের ব্যস্ততার চিত্র

৮.      হজ্জ

হজ্জ একটি ফরয এবাদত

হজ্জ মানুষকে নিষ্পাপ করে

জেহাদের পর হজ্জ সর্বোত্তম এবাদত

হজ্জ ফরয হলে তা দ্রুত আদায় করা উচিত

সামর্থবান লোকদের হজ্জ না করার কঠোর পরিণতি

হজ্জের সফর শুরুর সাথে সাথেই হজ্জ শুরু

৯.       মোয়ামালাত (লেনদেন)

নিজের হাতে জীবিকা উপার্জনের ফযিলত

হারাম জীবিকা উপার্জন করলে দোয়া কবুল হয় না

হালাল হারামের বাছবিচার

হারাম সম্পদ জাহান্নামের পাথেয়

চিত্র শিল্পীর আযাব অবধারিত

১০.     ব্যবসায়বাণিজ্য

হাতের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ সর্বাধিক পবিত্র

ক্রয় বিক্রয়ে উদার আচরণের তাগিদ

সৎ ব্যবসায়ীর উচ্চ মর্যাদা

সততা ব্যতীত ব্যবসায়ী পাপী গণ্য হবে

বেশী কসম খাওয়ায় ব্যবসায়ে বরকত নষ্ট হয়

মিথ্যে শপথকারী ব্যবসায়ীর সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না

ব্যবসায়ীদের দান ছদকার মাধ্যমে ভুলত্রুটির কাফফারা দেয়া উচিত

মাপ ও ওজনে সতর্কতা

মজুদদারী মহাপাপ

মজুদদার অভিশপ্ত

মজুদদার আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দা

পণ্যের ত্রুটি ক্রেতাকে জানাতে হবে

১১.     ধার-কর্জ

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে সদয় ব্যবহার

ঋণ মাফ করে দেয়ার বিরাট সওয়াব

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুযোগ দানের সুফল

অন্যের ঋণ পরিশোধ করে দেয়ার সওয়াব

ঋণ থেকে শহীদেরও রেহাই নেই

ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব ও গড়িমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা

সর্বোত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করা

ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে তালবাহানা করা যুলুম

ঋণ পরিশোধের নিয়ত থাকলে আল্লাহ তা পরিশোধ করে দেবেন

ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না করার ভয়ংকর পরিণাম

জবর দখল ও খেয়ানত

যুলুম ও জবরদস্তির মাধ্যমে অন্যের সম্পত্তি দখল করা

যে সম্পদ তার মালিক খুশী মনে দেয় না তা হালাল নয়

ধার কর্জ ফেরত দেয়া অপরিহার্য

খেয়ানতকারীর সাথে খেয়ানত করা যাবে না

যেখানে খেয়ানত, সেখানে শয়তান

ক্ষেত খামার ও বাগান করা সদকায় পরিণত হয়

প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকে রাখার ভয়াবহ পরিণাম

শ্রমিকের মজুরী ঘাম শুকানোর আগে দিতে হয়

শ্রমিকের মজুরী আত্নসাতের পরিণাম

১২.     অবৈধ ওসিয়ত

অবৈধ ওসিয়ত ষাট বছরের এবাদত বিনষ্ট করে দেয়

উত্তরাধিকারীকে প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করলে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে

সকল উত্তরাধিকারীর অনুমতি ছাড়া কোন বিশেষ উত্তরাধিকারীর পক্ষে ওসিয়ত করা যাবে না

এক তৃতীয়াংশের বেশী ওসিয়ত করা যাবে না

১৩.     সুদ ও ঘুষ

সুদের সাথে জড়িতরা অভিশপ্ত

ঘুষখোর ও ঘুষদাতা উভয়ই অভিশপ্ত

শাসককে ঘুষদাতা ও ঘুষখোর শাসক উভয়ই অভিশপ্ত

সন্দেহজনক জিনিস ও কাজ বর্জন করা উচিত

তাকওয়ার পরিচয়

১৪.     সামাজিক বিধান

বিয়ে

বিয়ে চরিত্রের হেফাজত করে

পাত্র বা পাত্রীর দ্বীনদারী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে

দ্বীনদার মেয়ে কালো হলেও ভাল

দ্বীনদারী ও সচ্চরিত্র পাত্র নির্বাচন না করলে অরাজকতা দেখা দেবে

বিয়ে শাদীতে তাশাহহুদ (খুতবা) পড়া

দেনমোহর

মোহর প্রদান করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

মোহর ধার্যকরণে বাড়াবাড়ি বর্জনীয়

সর্বনিম্ন মোহর সর্বোত্তম

বৌভাতে গরীবদের দাওয়াত দেয়া উচিত

ফাসেকের দাওয়াত কবুল করা নিষিদ্ধ

১৫.     পিতামাতা ও আত্নীয় স্বজনের অধিকার

বাবার চেয়ে মায়ের অধিকার তিনগুণ বেশী

বার্ধক্যে মা বাবার খেদমতের গুরুত্ব

মায়ের অবাধ্যতা হারাম

মা বাবার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি করণীয়

দুধ মায়ের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে

দুধ মা মোশরেক হলেও তাকে সমাদর করতে হবে

আত্নীয়তার প্রকৃত সমাদর

অসদাচরণের জবাবে সদাচরণের মর্যাদা

১৬.     স্বামী স্ত্রীর অধিকার

স্ত্রীর অধিকার

স্বামী ও স্ত্রীর পানাহার এবং পোশাকের মান সমান হওয়া চাই

স্ত্রীর সাথে দাসীবাঁদীর মত আচরণ করা চলবে না

প্রহারকারী স্বামীরা সর্বোত্তম মানুষ নয়

স্ত্রীদের মধ্যে শুধু দোষ থাকেনা গুণও থাকে

স্বামী স্ত্রী উভয়ের অধিকার আছে

পরিবারের পেছনে ব্যয় সদকাস্বরুপ

পোষ্যদেরকে নষ্ট হতে দেয়া উচিত নয়

স্বামীর অধিকার

স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর বেহেশতে যাওয়ার অন্যতম উপায়

সর্বোত্তম স্ত্রী

স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোযা রাখা জায়েয নেই

নারীর অকৃতজ্ঞতার ব্যাধি

নেককার স্ত্রী সর্বোত্তম সম্পদ

স্ত্রী স্বামীর বাড়ী ও সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক

১৭.     সন্তানদের অধিকার

উত্তম শিক্ষাই উত্তম উপহার

সাত বছর বয়সেই নামাযের আদেশে দেয়া চাই

সৎ সন্তান এক মহা মূল্যবান সম্পদ

ইয়াতীম ও মেয়ে সন্তান লালন পালনের ফযিলত

পুরুষ সন্তান ও মেয়ে সন্তান বৈষম্য করা উচিত নয়

ভালো ব্যবহার করলে মেয়ে সন্তান দোযখ থেকে রক্ষা করবে

সন্তানদেরকে উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে সাম্য জরুরী

প্রাক্তন স্বামীর সন্তানদেরকে দান করলেও সওয়াব হবে

যে মহিলা শিশু সন্তানের লালন পালনের খাতিরে পুনরায় বিয়ে করে না

তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের ভরণ পোষণ সর্বোত্তম সদকা

১৮.     এতীমের হক বা অধিকার

এতীমের লালন পালনের ফযিলত

এতীমের প্রতি সদ্ব্যবহার ও অসদ্ব্যবহার

এতীম মিসকিনের প্রতি সদয় আচরণে হৃদয়ের নিষ্ঠুরতা দূর হয়

এতীম ও নারীর অধিকার সম্মানার্হ

দরিদ্র হলে পালিত এতীমের সম্পদ সীমিত পরিমাণে ভোগ করা যায়

এতীমকে প্রহার করা সম্পর্কে

১৯.     অতিথির অধিকার

অতিথির সমাদর ঈমানের দাবী

গৃহকর্তাকে বিব্রত করা অতিথির অনুচিত

২০.    প্রতিবেশীর অধিকার

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া ঈমানদারীর লক্ষণ নয়

প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে জিবরীলের পুনঃপুনঃ তাগিদ

প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া ঈমানের লক্ষণ নয়

প্রতিবেশীকে রান্না করা খাবার দেয়ার উপদেশ

প্রতিবেশীকে দেয়া উপহার সামান্য হলেও তুচ্ছ নয়

নিকটতর প্রতিবেশীকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতে হবে

প্রতিবেশীর সাথে সৎ ব্যবহার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়

প্রতিবেশীকে কটু কথা বললে নামায রোযাও বৃথা

কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম দুই প্রতিবেশীর বিরোধের বিচার হবে

২০.    দরিদ্র লোকদের অধিকার

অভাবী লোকদের খাওয়ালে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায়

ক্ষুধার্তকে পেট ভরে খাওয়ানো সর্বোত্তম সদকা

প্রকৃত দরিদ্রের পরিচয়

দরিদ্র ও বিধবাদের সেবাকারীর উচ্চ মর্যাদা

ভৃত্যদের অধিকার

দাসদাসীরা ভাই বোন তুল্য

ভৃত্যকে সাথে বসিয়ে খাওয়ানো উচিত

ভৃত্যদেরকে সন্তানের মত সমাদর করা উচিত

নামাযী ভৃত্যকে প্রহার করা চলবে না

২১.     সফরের সহযাত্রীর অধিকার

কোন জাতির সরদার তাদের সেবক হয়ে থাকে

প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাহনে সহযাত্রীর অধিকার

প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী শয়তানের

মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ

২২.     রোগীর দেখাশুনা ও পরিচর্যা

রোগীর সেবা ও পরিচর্যার গুরুত্ব

রোগীর খোঁজ খবর নেয়ার আদেশ

রোগীকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়াও পরিচর্যার অংশ

রোগীর পরিচর্যার পদ্ধতি

 

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

হাদীস শাস্ত্রের সমস্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত পরিসের উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এজন্য স্বতন্ত্র পুস্তক রচনার প্রয়োজন। এনে হাদীসের সংগ্রহ ও সংকলনের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে। এ থেকে অনুমান করা যাবে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাদীসের এই অমূল্য সম্পদ এই তের শত বছর কোন কোন পর্যায়ে অতিক্রম করে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এ থেকে আরও জানা যাবে, কোন মহা ব্যক্তিগণ হিকমাত ও হেদায়াতের এই উৎসকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট সংরক্ষিত আকারে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনবোধে এ কাজে জীবন বাজি রাখতেও পশ্চাৎপদ হননি।

তিনটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা ) এর হাদীসসমূহ আমাদের নিকট পৌঁছেছে।

(১) লিখিত আকারে, (২) স্মৃতিতে ধরে রাখার মাধ্যমে, (৩) পঠন পাঠনের মাধ্যমে।

হাদীস সংগ্রহ, বিন্যাস ও পুস্তককারে সংকলনের সময়টাকে চার যুগে বিভক্ত করা যায়।

প্রথম যুগ

নবী পাক (সা) এর যুগ থেকে ১ম হিজরী শতকের শেষ পর্যন্তঃ এই যুগের হাদীস সংগ্রাহক, সংকলক ও মুখস্তকারীগণের পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

হাদীসের প্রসিদ্ধ হাফেজগণ

(১) হযরত আবু হুরায়রা (রা) (আবদুর রহমান): ৭৮ বছর বয়সে ৫৯ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত (বর্ণিত) হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪ এবং তাঁর ছাত্র সংখ্যা ৮০০ পর্যন্ত।

(২) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা): ৭১ বছর বয়সে ৬৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ২৬৬০।

(৩) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা): ৬৭ বছর বয়সে ৫৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন তাঁর রেওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ২২১০।

(৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা): ৭৪ বছর বয়সে ৭৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৬৩০।

(৫) হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা): ৯৪ বছর বয়সে ৭৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ১৫৬০।

(৬) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা): ১০৩ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াকৃত হাদীসের সংখ্যা ১২৮৬।

(৭) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা): ৮৪ বছর বয়সে ৭৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১৭০।

এই কজন মহান সাহাবীর প্রত্যেকেরই এক হাজারের অধিক হাদীস মুখস্থ ছিল। তাছাড়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (মৃঃ৬৩ হিজরী) , হযরত আলী (মৃঃ৪০ হিজরী) এবং উমার ফারুক (মৃঃ২৩ হিজরী) রাদিয়াল্লাহু আনহুম সেইসব সাহাবীর অন্তর্ভুক্ত যাঁদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫০০ থেকে এক হাজারের মধ্যে।

অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর (মৃঃ ১৩ হিজরী) , হযরত উসমান (মৃঃ ৩৬ হিজরী) হযরত উম্মে সালামা (মৃঃ ৫৯হিজরী) হযরত আবু মূসা আশআরী (মৃঃ ৫২ হিজরী) , হযরত আবু যার গিফারী (মৃঃ৩২ হিজরী) হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (মৃঃ ৫১ হিজরী) রাদিআল্লাহ আনহুম থেকে এক শতের অধিক এবং পাঁচ শতের কম হাদীস বর্ণিত আছে।

সাহাবীদের ছাড়া এ যুগের একদল মহান তাবিঈর কথাও স্মরণ করতে হয় যাঁদের নিরলস পরিশ্রম ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় হাদীস ভাণ্ডার থেকে মিল্লাতে ইসলামিয়া কিয়ামত পর্যন্ত উপকৃত হতে থাকবে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হল।

(১) সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহঃ): উমার ফারুক (রা) এর খিলাফতের দ্বিতীয় বর্ষে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৫ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তিনি হযরত উসমান (রাঃ) , হযরত আয়েশা (রাঃ) , হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) , হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) প্রমুখ সাহাবার নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন।

(২) উরওয়া ইবনুয যুবাইরঃ মদীনার বিশিষ্ট আলেমগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) এর বোন-পুত্র। তিনি তাঁর কাছ থেকেই বেশির ভাগ হাদীস বর্ণনা করেছেন। অনন্তর তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ও যায়েদ ইবনে সাবেতের (রাঃ) নিকটও হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। সালেহ ইবনে কাইসান ও ইমাম যুহরীর মত আলেমগণ তাঁর ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ৯৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

(৩) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা): মদীনার প্রসিদ্ধ সাতজন ফিকহবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহ অপরাপর সাহাবীর নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। নাফে, ইমাম যুহরী ও অপরাপর প্রসিদ্ধ তাবিঈগণ তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি ১০৬ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

(৪) নাফে (রাঃ): তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) এর মুক্তদাস। তিনি তাঁর মনিবের বিশিষ্ট ছাত্র এবং ইমাম মালেক (রঃ) এর শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইবনে উমার (রাঃ) এর সূত্রেই বেশীর ভাগ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ১১৭ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

এই যুগের সংকলনসমূহ

(১) সহীফায়ে সাদেকা

এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর(রা) ইবনুল আস কর্তৃক সংকলিত হাদীস গ্রন্থ। পুস্তক রচনার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা) এর নিকট যা কিছু শুনতেন তা লিখে রাখতেন। এজন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। ৭৭ বছর বয়সে ৬৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

(২) সহীফায়ে সহীহা

হাম্মাম ইবনে মুনাব্বেহ (মৃঃ১০১ হিজরী) এটা সংকলন করেন। তিনি হযরত আবু হুরায়রার (রা) ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর উস্তাদ মুহতারামের বর্ণিত হাদীসগুলো এই গ্রন্থে একত্রে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। গ্রন্থটির হস্তলিখিত কপি বার্লিন ও দামিশকের গ্রন্থাগারসমূহে সংরক্ষিত আছে। ইমাম আহমাদ (র) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রার (রা) শিরোনামে পূর্ণ গ্রন্থটি সন্নিবেশ করেছেন। এই সংকলনটি কিছুকাল পূর্বে ডঃ হামীদুল্লাহ সাহেবের প্রচেষ্টায় হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য) থেকে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ১৩৮ টি হাদীস রয়েছে।

এই সংকলনটি হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীসের একটি অংশমাত্র। এর অধিকাংশ হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও পাওয়া যায়। মূল পাঠ প্রায় একই, বিশেষ কোন তারতম্য নাই। হযরত আবু হুরায়রার (রা) অপর ছাত্র বশীর ইবনে নাহীকও একটি সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন। আবু হুরায়রার (রা) ইন্তিকালের পূর্বে তিনি তাঁকে এই সংকলন পড়ে শুনান এবং তিনি তা সত্যায়িত করেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ডঃ হামীদুল্লাহ কর্তৃক সম্পাদিত সহীফায়ে ইবনে হাম্মাম এর ভূমিকা।

(৩) মুসনাদে আবু হুরায়রা(রা)

সাহাবাদের যুগেই এই সংকলন প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর একটি হস্তলিখিত কপি উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) এর পিতা এবং মিসরের গভর্নর আবদুল আযীয ইবনে মারওয়ান (মৃঃ ৮৬ হিজরী) এর নিকট ছিল। তিনি কাসীর ইবনে মুররাকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, তোমাদের কাছে সাহাবায়ে কিরামের যেসব হাদীস বর্তমান আছে তা লিপিবদ্ধ করে পাঠাও। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস লিখে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। কেননা তা আমাদের কাছে লিখিত আকারে বর্তমান আছে। আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এর স্বহস্তে লিখিত মুসনাদে আবি হুরায়রা (রাঃ) এর একটি কপি জার্মানির গ্রন্থাগারসমূহে বর্তমান আছে। (তিরমিযি শরাহ তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থের ভূমিকা, পৃ১৬৫)

(৪) সহীফায়ে হযরত আলী (রাঃ)

ইমাম বুখারী (র) এর ভাষ্য থেকে জানা যায়, এই সংকলনটি বেশ বড় ছিল। এর মধ্যে যাকাত, মদীনার হেরেম, বিদায় হজ্জের ভাষণ ও ইসলামী সংবিধানের ধারাসমূহ বিবৃত ছিল। (সহীহ বুখারী কিতাবুল ইতসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, ১ম খন্ড পৃ ৪৫১)

(৫) নবী পাক (সাঃ) এর লিখিত ভাষণ

মক্কা বিজয়কালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু শাহ ইয়ামানী (রাঃ) র আবেদনক্রমে তাঁর দীর্ঘ ভাষণ লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ভাষণ মানবাধিকারের বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত। (সহীহ বুখারী ১ম খন্ড, পৃ.২০)

(৬) সহীফা হযরত জাবির (রাঃ)

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁর ছাত্র ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ (মৃঃ১১০ হিজরী) ও সুলাইমান ইবনে কায়েস লশকোরী লিখিত আকারে সংকলন করেছিলেন। এই সংকলনে হজ্জের নিয়মাবলী ও বিদায় হজ্জের ভাষণ স্থান লাভ করে।

(৭) রেওয়ায়াতে আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)

হযরত আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁর ছাত্র বোন-পুত্র উরওয়া ইবনুয যুবায়ের (র) লিখে নিয়েছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৮৩)

(৮) আহাদীসে ইবনে আব্বাস (রাঃ)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর রিওয়ায়াতসমূহের সংকলন। তাবিঈ হযরত সাঈদ ইবন জুবায়েরও তাঁর হাদীসসমূহ লিখিত আকারে সংকলন করতেন। (দারমী, পৃ.৬৮)

(৯) সহীফা আনাস মালেক (রাঃ)

সাঈদ ইবনে হেলাল বলেন, আনাস (রা) তাঁর স্বহস্ত লিখিত সংকলন বের করে আমাদের দেখাতেন এবং বলতেন, এই হাদীসগুলো আমি সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট শুনেছি এবং লিপিবদ্ধ করার পর তা পাঠ করে তাঁকে শুনিয়ে সত্যায়িত করে নিয়েছি। (সহীফায়ে হাম্মামের ভূমিকা পৃ.৩৪)

(১০) আমর ইবনে হাযম (রহ)

যাঁকে ইয়ামানের গভর্নর নিয়োগ করে পাঠানোর সময় নবী (সাঃ) একটি লিখিত নির্দেশনামা দিয়েছিলেন। তিনি কেবল এই নির্দেশনামাই সংরক্ষণ করেননি, বরং এর সাথে নবী (সা) এর আরও ফরমান যুক্ত করে একটি সুন্দর সংকলন তৈরি করেন। (ডঃ হামীদুল্লাহ, আল ওয়াসাইকুস সিয়াসিয়া, পৃ.১০৫)

(১১) রিসালা সামুরা ইবন জুনদুব (রা)

তাঁর সন্তান এটা তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হন। এটা হাদীসের একটা উল্লেখযোগ্য সংকলন ছিল। (তাহযীবুত তাহযীব, ৪র্থ খন্ড, পৃ.২৩৬)

(১২) সহীফা সাদ ইবনে উবাদা (রা)

এই সাহাবী জাহিলী যুগ থেকেই লেখাপড়া জানতেন।

(১৩) মাআন থেকে বর্ণিত

তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর পুত্র আব্দুর রহমান আমার সামনে একটি কিতাব এনে শপথ করে বললেন, এটা আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) স্বহস্তে লিখিত। (জামিউল ইলম, পৃ.৩৭)

(১৪) মাকতুবাত নাফে(র)

সুলাইমান ইবনে মূসা বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হাদীস বলতেন আর তাঁর ছাত্র নাফে তা লিপিবদ্ধ করতেন। (দারিমী, পৃ.৬৯, সহীফা ইবনে হাম্মামের ভূমিকা, পৃ.৪৫)

যদি গবেষণা ও অনুসন্ধানের ধারা অব্যাহত রাখা হয় তবে উল্লিখিত সংকলনগুলো ছাড়া আরও অনেক সংকলনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে । এই যুগে সাহাবায়ে কেরাম ও প্রবীণ তাবেঈগণ বেশীরভাগ নিজেদের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে সংরক্ষিত হাদীসসমূহ লিখে রাখার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ আরও ব্যাপকতা লাভ করে। হাদীস সংকলকগণ নিজেদের ব্যক্তিগত ভাণ্ডারের সাথে নিজ নিজ শহর ও অঞ্চলের মুহাদ্দিসগণের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সংগ্রহ একত্র করেন।

দ্বিতীয় যুগ

এই যুগটি প্রায় দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে গিয়ে শেষ হয়। এই যুগে তাবিঈদের একটি বিরাট দল তৈরি হয়ে যায়। তাঁরা প্রথম যুগের লিখিত ভাণ্ডারকে ব্যাপক সংকলনসমূহে একত্র করেন।

এই যুগের হাদীস সংকলকগণ হলেনঃ

(১) মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব

ইমাম যুহরী নামে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ (মৃ.১২৪ হিজরী)। তিনি নিজ যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) আনাস ইবন মালেক (রা) সাহল ইবনে সাদ (রা) এবং তাবিঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব(র) ও মাহমুদ ইবনে রাবী(র) প্রমুখের নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম আওযাঈ (র) ও ইমাম মালেক (র) এবং সুফিয়ান ইবন উয়াইনা(র) এর মত হাদীসের প্রখ্যাত ইমামগণ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে গণ্য। ১০১ হিজরীতে উমার ইবনে আব্দুল আযীয(র) তাঁকে হাদীস সংগ্রহ করে তা একত্র করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি মদীনার গভর্নর আবু বাকর মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযমকে নির্দেশ দেন যেন তিনি আবদুর রহমান কন্যা আমরাহ ও কাসিম ইবনে মুহাম্মাদের নিকট হাদীসের যে ভাণ্ডার রয়েছে তা লিখে নেন। এই আমরাহ (র) হযরত আয়েশা সিদ্দীকার (রা) বিশিষ্ট ছাত্রী ছিলেন এবং কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র। হযরত আয়েশা (রা) নিজের তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব, খ.৭, পৃ.১৭২)

কেবল এখানেই শেষ নয়, বরং হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয (র) ইসলামী রাষ্ট্রের সকল দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে হাদীসের এই বিরাট ভাণ্ডার সংগ্রহ ও সংকলনের জোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে হাদীসের বিরাট সম্পদ রাজধানীতে পৌঁছে গেল। খলীফা হাদীসের সংকলন প্রস্তুত করিয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। (হাযকিরাতুল হুফফাজ, খ.১ পৃ.১০৬, জামিউল ইলম, পৃ.৩৮)

ইমাম যুহরীর সংগৃহীত হাদীস সংকলন করার পর এই যুগের অপরাপর আলেমগণও হাদীসের গ্রন্থ সেকলনের কাজ শুরু করেন। আবদুল মালেক ইবনে জুরাইজ(মৃ.১৫০হিজরী) মক্কায়, ইমাম আওযাঈ(মৃ.১৫৭ হিজরী) সিরিয়ায় মামার ইবনে রাশেদ (মৃ.১৫৩ হিজরী) ইয়ামানে, ইমাম সুফিয়ান সাওরী (মৃ.১৬১ হিজরী) কুফায়, ইমাম হাম্মাদ ইবনে সালামা (মৃ.১৬৭ হিজরী) বসরায় এবং ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (মৃ.১৮১ হিজরী) খোরাসানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন।

(২) ইমাম মালেক ইবন আনাস (রহ)

(জন্ম ৯৩ হিজরী, মৃত্যু ১৭৯ হিজরী) ইমাম যুহরীর পরে মদীনায় হাদীস সংকলন ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন। তিনি নাফে, যুহরী ও অপরাপর আলেমের ইলম দ্বারা উপকৃত হন। তাঁর শিক্ষক সংখ্যা নয়ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাঁর জ্ঞানের প্রসবণ থেকে সরাসরি হেজায, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, মিসর, আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার (স্পেন) হাজারো হাদীসের শিক্ষাকেন্দ্র তৃপ্ত হয়েছে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে লাইস ইবনে সাদ (মৃ.১৭৫ হিজরী) , ইবনুল মুবারক (মৃ.১৮১ হিজরী) , ইমাম শাফিঈ (মৃ.২০৪ হিজরী) ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আশ শায়বানী (মৃ.১৮৯ হিজরী) এর মত মহান ইমামগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

এই যুগে হাদীসের অনেকগুলো সংকলন রচিত হয়, যার মধ্যে ইমাম মালেক (র) এর মুয়াত্তা বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এই গ্রন্থ ১৩০ হিজরী থেকে ১৪১ হিজরীর মধ্যে সংকলিত হয়। এতে মোট ১৭০০ রিওয়ায়াত আছে। তার মধ্যে ৬০০টি মারুফ, ২২৮ টি মুরসাল, ৬১৩টি মাওকুফ রিওয়ায়াত এবং তাবেঈদের ২৮৫টি বাণী রয়েছে। এ যুগের আরও কয়েকটি সংকলনের নাম নিম্নে দেয়া হলঃ

১। জামে সুফিয়ান সাওরী (মৃ.১৬১হিজরী) ২। জামে ইবনুল মুবারাক, ৩। জামে ইবনে আওযাঈ(মৃ.১৫৭হিজরী) ৪। জামে ইবনে জুরাইজ(মৃ.১৫০হিজরী) , ৫। ইমাম আবু ইউসুফ(মৃ.১৮৩হিজরী) এর কিতাবুল খিরাজ, ৬। ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুল আসার। এই যুগে রাসুলুল্লাহ (সা) এর হাদীস, সাহাবাদের আসার (বাণী) এবং তাবিঈদের ফতোয়াসমূহ একই সংকলনে সন্নিবিষ্ট করা হত। কিন্তু সাথে একথাও বলে দেওয়া হত যে, কোনটি রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাদীস এবং কোনটি সাহাবা অথবা তাবিঈদের বাণী।

তৃতীয় যুগ

এই যুগে প্রায় দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরুপঃ

(১) এই যুগে নবী পাকের (স) হাদীসসমূহকে সাহাবাগণের আসার ও তাবিঈদের বাণী থেকে পৃথক করে সংকলন করা হয়।

(২) নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহের পৃথক সংকলন প্রস্তুত করা। এভাবে যাচাই বাচাই এবং গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর দ্বিতীয় যুগের সংকলনসমূহ তৃতীয় যুগের বিরাট গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

(৩) এই যুগে হাদীসসমূহ কেবল জমা করাই হয়নি, বরং ইলমে হাদীসের হেফাযতের জন্য মহান মুহাদ্দিসগণ এই ইলমের এক শতাধিক শাখার ভিত্তি স্থাপন করলেন, যার উপর বর্তমান কাল পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন এবং তাঁদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করুন।

সংক্ষিপ্তভাবে এখানে হাদীসের জ্ঞানের কয়েকটি শাখার পরিচয় দেয়া হলঃ

(১) ইলম আসমাইর রিজাল (রিজাল শাস্ত্র)

এই শাস্ত্রে হাদীস বর্ণনাকারী রাবীদের পরিচয়, জন্ম মৃত্যু, শিক্ষক ও ছাতদের বিবরণ, জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যাপক ভ্রমণ এবং নির্ভরযোগ্য (সিকাহ) বা অনির্ভরযোগ্য হওয়া সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত সন্নিবেশিত হয়েছে। জ্ঞানের এই শাখা বহু ব্যাপক, উপকারী ও আকর্ষণীয়। কোন কোন গোঁড়া প্রাচ্যবিদও স্বীকার না করে পারেননি যে, রিজাল শাস্ত্রের বদৌলতে পাঁচ লাখ রাবীর জীবন ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে। মুসলিম জাতির এই নজীর অন্য জাতির মদ্যে পাওয়া অসম্ভব। রিজাল শাস্ত্রের উপর শত শত গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। কয়েকটি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ

(ক) তাহযীবুল কামালঃ গ্রন্থকার ইমাম ইউসুফ আল মিযযী( মৃ.৭৪২ হিজরী) রিজাল শাস্ত্রের এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।

(খ) তাহযীবুত তাহযীবঃ গ্রন্থকার সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবন হাজার আল আসকালীন (মৃ. ৮৫২ হিজরী) গ্রন্থটি১২ খন্ডে বিভক্ত এবং হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য) থেকে প্রকাশিত।

(গ) তাযকিরাতুল হুফফাজঃ গ্রন্থকার শামসুদ্দীন আয যাহাবী (মৃ.৭৪৮ হিজরী, ) গ্রন্থটি পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত।

(২) ইলম মুসতালাহুল হাদীস (উসূলে হাদীস)

এ শাস্ত্রের সাহায্যে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতা যাচাইয়ের নিয়ম কানুন জানা যায়। এই শাখায় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে উলুমুল হাদীস। এটা মুকাদ্দামা ইবনিস সালাহ নামে পরিচিত। এর রচয়িতা হচ্ছেন আবু উমার ওয়া উসমান ইবনুস সালাহ (মৃ.৫৭৭হিজরী)। নিকট অতীতে উসূলুল হাদীসের উপর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। (ক) তাওজীহুন নাজার, গ্রন্থকার আল্লামা তাহের ইবনে সালেহ জাযাইরী(মৃ.১৩৩৮হিজরী) এবং (২) কাওয়াইদুল হাদীস, গ্রন্থাকার আল্লামা সাইয়িদ জামালুদ্দীন কাসিমী (মৃ.১৩৩১২ হিজরী)। প্রথমোক্ত গ্রন্থে হাদীসের মূলনীতি (উসূল) শাস্ত্র সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে এবং শেষোক্ত গ্রন্থে এই জ্ঞানকে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

(৩) ইলম আরীবুল হাদীস

এই শাস্ত্রে হাদীসের কঠিন ও দ্ব্যর্থবোধক শব্দসমূহের আভিধানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই শাস্ত্র আল্লামা যামাখশারী (মৃ.৫৩৮ হিজরী) এর আল ফাইক এবং ইবনুল আছীর (মৃ.৬০৬ হিজরী) এর নিহায়া গ্রন্থদ্বয় উল্লেখযোগ্য।

(৪) ইলম তাখরীজিল আহাদীস

প্রসিদ্ধ তাফসীর, ফিকহ, তাসাওউফ ও আকাইদ এর গ্রন্থসমূহে যেসব হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে ইলমের এই শাখার মাধ্যমে তার উৎস সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। যেমন বুরহানুদ্দীন আলী ইবনে আবি বাকর আল মারগীনানী (মৃ.৫৯২ হিজরী) এর আল হিদায়া নামক ফিকহ গ্রন্থে এবং ইমাম গাযালী (মৃ.৫০৫ হিজরী) এর ইহয়াউ উলুম গ্রন্থে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তার সনদ ও গ্রন্থ বরাত উল্লেখ করা হয়নি। এখন কোন পাঠক যদি জানতে চায় এই হাদীসগুলো কোন পর্যায়ের এবং হাদীসের কোন সব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তা উল্লেখ আছে, তবে প্রথমোক্ত গ্রন্থের জন্য হাফয যাইলাঈ(মৃ.৭৯২ হিজরী) এর নাসাবুর রাইয়াহ ও হাফেয ইবনে হাজার আল আসকালানীর আদ দিরাইয়াহ গ্রন্থদ্বয়ের সাহায্য নিতে হবে। আর শেষোক্ত গ্রন্থের জন্য হাফেজ যায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃ.৮০৬ হিজরী) এর আল মুগনী আন হামালিল আসফার গ্রন্থের সাহায্য নিতে হবে।

(৫) ইলমুল আহাদিসুল মাওদুআহ

এই বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ আলেমগণ স্বতন্ত্র গ্রন্থ সংকলন করেছেন এবং মাওদু(মনগড়া) রিওয়ায়াতগুলো পৃথক করে দিয়েছেন। এ বিষয়ের উপর কাযী শাওকানী (মৃ.১২৫৫ হিজরী) এর আল আওয়াইদুল মাজমুআহ এবং হাফেজ জালালুদ্দীন সূয়াতী (৯১১ হিজরী) এর আল লালিল মাসনুআহ গ্রন্থদ্বয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

(৬) ইলমুল নাখিস ওয়াল মানসুখ

এই শাস্ত্রের উপর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মূসা হাযিমী(মৃ.৭৮৪ হিজরী) এর কিতাবুল ইতিবার অধিক প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য।

(৭) ইলমুত তাওফীক যাইনাল আহাদীস

যেসব হাদীসের বক্তব্যের মধ্যে বাহ্যত পারস্পরিক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়, জ্ঞানের এই শাখায় তার সঠিক ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ইমাম শাফিঈ(মৃ.২০৪ হিজরী) এই বিষয়ের উপর আলোচনা করেন। তাঁর পুস্তিকাখানি মুখতালিফুল হাদীস নামে প্রসিদ্ধ। ইমাম তাহাবী (মৃ.৩২১হিজরী) এর মুশকিলুল আছার ও এ বিষয়ে একখানি সহায়ক গ্রন্থ।

(৮) ইলমুল মুখতালিফ ওয়াল মুতালিফ

এই শাখায় হাদীসের যেসব রাবীর নাম, ডাকনাম, উপাধি, পিতা দাদার অথবা শিক্ষকদের নাম পরস্পর সংমিশ্রিত হয়ে গেছে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মিশ্রণ জানিত এই সংশয়ের কারণে যে কোন অনভিজ্ঞ লোক ভূলে শিকার হতে পারে। এই বিষয়ের উপর ইবনে হাজার আল আসকালানী (র) এর তাবীরুল মুস্তাবিহ গ্রন্থখানি অধিক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ।

(৯) ইলম আতরাফিল হাদীস

জ্ঞানের এই শাখার সাহায্যে কোন হাদীস কোন গ্রন্থে আছে এবং কে কে তার রাবী তা জানা যায়। যেমনঃ কোন ব্যক্তির ইন্নামাল আমালু বিন নিয়াত হাদীসের একটি বাক্য মনে আছে। সে পূর্ণ হাদীসটি এবং সকল রাবী ও হাদীসের কোন গ্রন্থে তা আছে সেটা জানতে চায়। তখন তাকে এই শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হবে। এই বিষয়ে হাফেজ মিযযী (মৃ.৭৪২ হিজরী) এর তুহফাহুল আশরাফ গ্রন্থখানি অধিক ব্যাপক ও বিস্তৃত। এই গ্রন্থে সিহাহ সিত্তার সব হাদীসের সূচি এসে গেছে। এই গ্রন্থের বিন্যাসে তাঁর ২৬ বছর সময় লেগেছে। কঠোর পরিশ্রমের পর গ্রন্থখানি পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়।

বর্তমান কালে প্রাচ্যবিদগণ এইসব গ্রন্থের সাহায্যে কিছুটা নতুন ঢং এ হাদীসের সূচি প্রস্তুত করেছেন। যেমনঃ মিফতাহ মুনুষিস সুন্নাহ গ্রন্থখানি ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৩৪ খৃ. মিসর থেকে এর আরবী সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছ। বর্তমানে আল মুজামুল মাফাহরাস লি আলফাজিল হাদীসিন নাবাবী নামে একটি সূচি এ.জে. ব্রিল কর্তৃক লাইডেন(নেদারল্যান্ড) থেকে আরবীতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা বৃহৎ সাত খণ্ডে বিভক্ত এবং এতে সিহাহ সিত্তা ছাড়াও মুয়াত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ ও দারিমীর হাদীস সূচীও যোগ করা হয়েছে।

(১০) ফিকহুল হাদীস

এই শাখায় হুকুম আহকাম সম্বলিত হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ের উপর হাফেজ ইবনুল কাইয়্যেম(মৃ.৭৫১ হিজরী) এর ইলামুল মুকিঈন এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী(মৃ.১১৭৬ হিজরী) এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ প্রন্থদ্বয়ের সাহায্য নিয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও বিশেষজ্ঞ আলেমগণ জীবন ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন। যেমন অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে আবু উবায়েদ কাসিম ইবনে সাল্লাম (মৃ.২২৪ হিজরী) এর কিতাবুল আমওয়াল গ্রন্থ সুপ্রসিদ্ধ এবং জমীন, উশর, খাজনা প্রভৃতি বিষয়ের উপর ইমাম আবু ইউসূফ(মৃ.১৮২হিজরী) এর কিতাবুল খারাজ একটি সর্বোত্তম সংকলন। অনন্তর শরীআ আইনের অন্যতম দ্বিতীয় উৎস হওয়া সম্পর্কে এবং হাদীস প্রত্যাখানকারীদের (মুনাকিরীনে হাদীস) ছড়ানো ভ্রান্ত মতবাদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলো অত্যন্ত উপকারী।

(১) কিতাবুল উম্ম ৭খন্ড, (২) আর রিসালা ইমাম শাফিঈ, (৩) আল মুওয়াফিকাত ৪খন্ড, এর রচয়িতা হচ্ছেন আবু ইসহাক শাতিবী, (মৃ.৭৯০ হিজরী) , (৪) সাওয়াইক মুরসিলা (২খন্ড) , রচয়িতা ইবনুল কাইয়্যেম, (৫) ইবনে হাযম আন্দালুসী (মৃ.৪৫৬ হিজরী) এর আল আহকাম, (৬) মাওলানা বদরে আলম মীরাঠির মুকাদ্দমা তারজুমানুস সুন্নাহ (উর্দু) , (৭) অত্র গ্রন্থের সংকলকের পিতা মাওলানা হাফেজ আবুদস সাত্তার হাসান উমরপুরীর ইসবাতুল খাবার (৮) মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর হাদীস আওর কুরআন। অনন্তর (৯) ইনকারে হাদীস কা মানজার আওর পাস মানজার নামে জনাব ইফতেখার আহমাদ বালখীর গ্রন্থখানিও সুখপাঠ্য। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির দুই খন্ড প্রকাশিত হয়েছে।

ইলমে হাদীসের ইতিহাস ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

হাফেজ ইবনে হাজার আল আসকালানী (র) এর ফাতহুল বারী গ্রন্থের ভূমিকা, হাফেজ ইবনে আবদিল বার আল আন্দাসুলী (মৃ.৪৬৩ হিজরী) এর জামি বায়ানিল ইলম ওয়া আহলিহি, ইমাম হাকেম নিশাপুরী(মৃ.৪০৫ হিজরী) এর মারিফাতু উলুমিল হাদীস, মাওলানা আবদুর রহমান (মুহাদ্দিস) মুবারকপুরী(মৃ. ১৩৫৩ হিজরী) এর তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থের ভূমিকা। নিকট অতীতে রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এই শেষোক্ত গ্রন্থটি আলোচনার ব্যাপকতা ও প্রয়োজনের দিক থেকে একটি শ্রেষ্ঠ অবদান। অনুরূপভাবে মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানীর ফাতহুল মুলহিম গ্রন্থের ভূমিকা এবং মাওলানা মানাজির আহসান গীলানীর তাদবীনে হাদীস (উর্দু) গ্রন্থদ্বয়েও ইলমে হাদীসের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয় যুগের হাদীস সংকলকবৃন্দ

এ যুগের প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলকবৃন্দ ও নির্ভরযোগ্য সংকলনসমূহের পরিচয় নিম্নে দেয়া হলঃ

(১) ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল

(জন্ম ১৬৪ হিজরী, মৃ.২৪১ হিজরী) এর গুরুত্বপূর্ণ সংকলন মুসনাদে আহমাদ নামে পরিচিত। এতে তিরিশ হাজার হাদীস (পুনরাবৃত্তিসহ) বর্তমান রয়েছে। গ্রন্থটি ৫খন্ডে বিভক্ত। উল্লেখযোগ্য সব হাদীস এতে সংগৃহীত হয়েছে। এতে বিষয়সূচি অনুযায়ী বিন্যাসের পরিবর্তে প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত সব হাদীস একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের হাদীসগুলো বিষয়সূচি অনুযায়ী বিন্যাস করার কাজ শায়খ হাসানুল বান্না শহীদের পিতা আহমাদ আবদুর রহমান সা আতী শুরু করেছিলেন। ত৭ার এ গ্রন্থটি ২৪খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

(২) ইমাম আবু আবদুল্লাহ মাহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী

(জন্ম ১৯৪হিজরী, মৃ.২৫৬হিজরী)। তাঁর জন্ম তারিখ সত্যবাদিতা এবং মৃত্যু তারিখ নূর বিচ্ছুরণ করে। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে সহীহ বুখারী। এর পূর্ণ নাম আল জামিউস সহীহুল মুসানাদুল মুখতাসার মিন উমুরি রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়া আলাইহি।

এই গ্রন্থ সংকলনে ১৬ বছর সময় লেগেছে। তাঁর কাছে সরাসরি সহিহ বুখারী অধ্যয়নকারী ছাত্রের সংখ্যা ৯০ হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। কখনও কখনও একই মজলিসে উপস্থিতিদের সংখ্যা ২ হাজারে পৌঁছে যেত। এই ধরনের মজলিসে পরপর পৌঁছে দেয়া লোকদের সংখ্যা তিন শতের অধিক হত (কারণ তখন মাইক বা লাউডস্পিকারের সুবিধা ছিল না) এই গ্রন্থে মোট ৯, ৬৮৪টি হাদীস রয়েছে। পুনরুক্তি ও তালীকাত (সনদবিহীন রিওয়ায়াত) , শাওয়াহিদ (সাহাবাদের বাণী) ও মুরসাল হাদীস বাদ দিলে শুধু মারফু হাদীসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬, ২৩০ এর। ইমাম বুখারী (র) অপরাপর মুহাদ্দিসের তুলনায় অধিক শক্ত মানদন্ডে রাবীদের যাচাই বাছাই করেছেন।

(৩) ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আবুল হুইসাইন আল কুশাইরী

(জন্ম ২০২ হিজরী, মৃ. ২৬১ হিজরী)। ইমাম বুখারী এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) তাঁর শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমাম তিরমিযী, আবু হাতিম রাবী ও আবু বাকর ইবনে খুযাইমা তাঁর ছাত্র ছিলেন। তাঁর সংকলিত গ্রন্থ সহীহ মুসলিম বিন্যাসগত দিক থেকে সুপ্রসিদ্ধ। এই গ্রন্থে মোট ৯, ১৯০ টি হাদীস (পুনরুক্তিসহ)

(৪) ইমাম আবু দাউদ আশআছ ইবনে সুলাইমান আস সিজিস্তানী

(জন্ম ২০২ হিজরী, মৃ.২৭৫) সুনান আবি দাউদ নামে প্রসিদ্ধ। এই গ্রন্থে আহকাম সম্পর্কিত হাদীস পরিপূর্ণরূপে একত্র করা হয়েছে। ফিকহী ও আইনগত বিষয়ের জন্য এই গ্রন্থ এ কটি উত্তম উৎস। এতে ৪, ৮০০ হাদীস রয়েছে। (কিন্তু এর ইংরেজী সংস্করণে ক্রমিক নং ৫২৫৪ পর্যন্ত পৌঁছেছে- অনুবাদক)

(৫) ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী)

(জন্ম ২০৯ হিজরী, মৃ. ২৭৯ হিজরী) তাঁর সংকলিত গ্রন্থ জামে আত তিরমিযী নামে পরিচিত। এতে ফিকহী বিষয়ের বিস্তারিত ত আলোচনা রয়েছে এবং একই বিসয়ে যে যে সাহাবীর হাদীস রয়েছে তাঁর নামও উল্লেখ করা হয়েছে।

(৬) ইমাম আহমদ ইবনে শুআইব নাসাঈ

(মৃ. ৩০৩ হিজরী)। তাঁর সংকলনের নাম আস সুনানুল মুজতবা, যা সুনানে নাসাঈ নামে প্রসিদ্ধ।

(৭) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজা কাযবীনী

(মৃ.২৭৩ হিজরী)। তাঁর সংকলিত গ্রন্থ সুনানে ইবনে মাজা নামে প্রসিদ্ধ। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থ ছাড়া উল্লিখিত ছটি গ্রন্থকে হাদীস বিশারদদের পরিভাষায় সিহাহ সিত্তা বলা হয়। কোন কোন বিশেষজ্ঞ আলেম ইবনে মাজাহ গ্রন্থের পরিবর্তে ইমাম মালেকের মুয়াত্তা গ্রন্থকে সিহা সিত্তার মধ্যে গণ্য করেন।

উল্লিখিত গ্রন্থগুলি ছাড়া এ যুগে আরও অনেক প্রয়োজনীয় এবং পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এই তিনটি গ্রন্থকে একত্রে জামি বলা হয় অর্থাৎ আকীদা বিশ্বাস, ইবাদাত, নৈতিকতা, পারস্পরিক লেনদেন ও আচার ব্যবহার ইত্যাদি শিরোনামের অধীন হাদীসসমূহ এতে বর্তমান আছে। আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাকে একত্রে সুনান বলা হয়। অর্থাৎ এই গ্রন্থগুলোতে বাস্তব কর্মজীবনের সাথে সম্পর্কিত হাদীসই বেশী স্থান পেয়েছে।

হাদীসের গ্রন্থাবলীর স্তরবিন্যাস

হাদীস বিশারদগণ রিওয়ায়াতের যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতার তারতম্য অনুযায়ী হাদীসের গ্রন্থাবলীকে চার স্তরে বিভক্ত করেছেনঃ

(১) মুয়াত্তা ইমাম মালেক, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এই তিনটি গ্রন্থ সনদে বিশুদ্ধতা ও রাবীদের নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।

(২) আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ এই তিনটি গ্রন্থের কোন কোন রাবী নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে প্রথম স্তরের গ্রন্থাবলীর রাবীদের তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। কিন্তু তবুও তাদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকার করা হয়। মুসনাদে আহমাদও এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত।

(৩) আবু মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আদ দারিমী (মৃ. ২৫৫ হিজরী) এর সুনান (মুসনাদ) , ইবনে মাজা, বায়হাকী, দারেকুতনী (মৃ. ৩৮৫/৯৯৫) , তাবারানী (মৃ.৩৬০ হিজরী) এর সংকলনসমূহ, তাহাবী (মৃ.৩১১ হিজরী) এর সংকলনসমূহ, মুসনাদে শাফিঈ(মৃ.৪৬৩ হিজরী) র গ্রন্থাবলী, আবু নাঈম(মৃ.৪০৩ হিজরী) ইবনে আসাকির(মৃ.৫৭১ হিজরী) , দায়লামী (মৃ.৫০৯ হিজরী) র ফিরদাওস, ইবনে আদী (মৃ.২৬৫/৯৭) র আল কামিল, ইবনে মারদাবিয়া(ম. ৪১০ হিজরী) র গ্রন্থাবলী, ওয়াকিদী (মৃ.২০৭ হিজরী) র সংকলন এবং এই পর্যায়ের অপরাপর গ্রন্থকারের গ্রন্থাবলী চতুর্থ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। এসব গ্রন্থে সব ধরনের হাদীস স্থান পেয়েছে। এমনকি অনেক মাওদু (মনগড়া) রিওয়ায়াতও এর মধ্যে রয়েছে। সাধারণ বক্তাগণ, ঐতিহাসিকগণ এবং তাসাওউফপন্থীগণ বেশীর ভাগ এসব গ্রন্থের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অবশ্য যাচাই বাছাই ও পরী নিরীক্ষার সাহায্যে এরসব গ্রন্থের মধ্যেও অতি মূল্যবান মনিমুক্তা পাওয়া যায়।

চতুর্থ যুগ

এই যুগ হিজরী পঞ্চম শতক থেকে শুরু হয় এবং তা বর্তমান কাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে তৃতীয় যুগের গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্তি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই যুগে যে কাজ হয়েছে তার বর্ণনা নিম্নে দেয়া হলঃ

(১) হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলীর ভাষ্যগ্রন্থ, টীকা অন্যান্য ভাষায় তরজমা গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

(২) হাদীসের যেসব শাখা প্রশাখার কথা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, সেসব বিষয়ের উপর এই যুগেই অসংখ্য গ্রন্থ এবং এসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও সারসংক্ষেপ রচিত হয়েছে।

(৩) বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নিজেদের আগ্রহ অথবা প্রয়োজনের তাগিদে তৃতীয় যুগের রচিত গ্রন্থাবলী থেকে হাদীস চয়ন করে প্রয়োজনীয় গ্রন্থ প্রস্তুত করেছেন। এ ধরনের কয়েকটি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ

(ক) মিশকাতুল মাসাবীহ সংকলক ওয়ালীউদ্দীন খতীব তাবরীযী। নির্বাচিত সংকলনগুলোর মধ্যে এটাই সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। এতে সিহাহ সিত্তার প্রায় সব হাদীস এবং আরও দশটি মৌলিক গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে আকীদা –বিশ্বাস ইবাদাত, পারস্পরিক লেনদেন ও আচার ব্যবহার, চরিত্র, নৈতিকতা, শিষ্টাচার এবং আখিরাত সম্পর্কিত রিওয়ায়াতসমূহ একত্র করা হয়েছে।

(খ) রিয়াদুস সালেহীনঃ সংকলক ইমাম আবু যাকারিয়া ইবনে শারাফুদ্দনি নববী (মৃ.৬৭৬ হিজরী)। তিনি সহীহ মুসলিমেরও ভাষ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটা বেশীর ভাগ চরিত্র, নৈতিকতা ও শিষ্টাচার সম্পর্কিত হাদীস সম্বলিত একটি চয়নিকা। প্রতিটি অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে প্রাসঙ্গিক আয়াতও উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই এই গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সহীহ বুখারীর সংকলন এবং বিন্যাস পদ্ধতিও এইরূপ।

(গ) মুনতাকাল আখবারঃ সংকলক মাজদুদ্দীন আবুল বারাকাত আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়া(মৃ.৬৫২ হিজরী)। তিনি শায়খুল ইসলাম তাকিউদ্দীন আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (মৃ.৭২৮ হিজরী) র দাদা। আল্লামা শাওকানী নাইনুল আওতার নামে (আট খণ্ডে) এই গ্রন্থের একটি শরাহ (ভাষ্য গ্রন্থ) লিখেছেন।

(ঘ) বুলুগুল মারাম সংকলক সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আল আসকালীন (মৃ.৮৫২ হিজরী)। এই চয়নিকায় ইবাদত ও মুআমালাত সম্পর্কিত হাদীসই অধিক সন্নিবেশিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আস সানআনী(মৃ.১১৮২ হিজরী) সুবুলুস সালাম শিরোনামে আরবী ভাসায় এবং নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান (মৃ.১৩০৭ হিজরী) , মিসকুল খিতাম নামে ফারসী ভাষায় এর ভাষ্য লিখেছেন।

হিমালয়ান উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দিললবী(মৃ.১০৫২ হিজরী) সুসংগঠিতভাবে ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু করেন। তাঁর পরে শাহ ওয়ালীউল্লাহ(মৃ.১১৭৬ হিজরী) , তাঁর পুত্রগণ, পৌত্রগণ এবং সুযোগ্য শাগরিদবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই অংশ সুন্নাতে নববীর আলোকে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে।

পৃথিবী তার প্রভুর নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। ”(যুমার-৬৯)

শাহ ওয়ালীউল্লাহ(র) এর পর থেকে হাদীসের অনুবাদ গ্রন্থ, ব্যাখ্যা এবং চয়নিকা গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশের পূণ্যময় কাজ আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ইন্তেখাবে হাদীস গ্রন্থখানিও এই প্রচেষ্টারই অংশ বিশেষ। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের সংকলকও হাদীসের সেবকগণের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে, যেসব মহান ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস সংকলন ও তার প্রচারে নিজেদের তুলনা হতে পারে না। এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে অনুমান করা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কোন একটি যুগেও হাদীসের চর্চা বন্ধ হয়নি।

হাদীস শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা

১. হাদীসঃ রাসুলুল্লাহ (সা) এর নবুয়াতী জীবনের সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদনকে হাদীস বলে।

২. মুহাদ্দিসঃ যিনি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলে।

৩. মারফুঃ যে হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা রাসুলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান থেকে কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েনি, তাকে মারফু হাদীস বলে।

৪. মাওকুফঃ যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র শুধু কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাকতু বলে।

৫. মুত্তসিলঃ সেসব হাদীসের বর্ণনা সূত্র শুধু কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাকতু বলে।

৬. মুত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মুত্তাসিলঃ হাদীস বলে।

৭. মুনকাতেঃ যে হাদীসের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানের কোন এক স্তরে কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস বলে।

৮. মুরসালঃ সনদের মধ্যে তাবিঈর পর বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়লে তাকে মুরসাল হাদীস বলে।

৯. মুদালঃ যে হাদীসের সনদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে দুজন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়ে গেছে তাকে হাদীসে মুদাল বলে।

১০. মুদাল্লাহঃ যেসব হাদীসে রাবী ঊর্ধ্বতন রাবীর সন্দেহযুক্ত শব্দ প্রয়োগে উল্লেখ করেছেন, তাকে মুদাল্লাহু হাদীস বলে।

১১. মুআল্লাকঃ যে হাদীসে সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুআল্লাক হাদীস বলে।

১২. মুআল্লালঃ যে হাদীসের সনদে বিশ্বস্তার বিপরীত কার্যাবলী গোপনভাবে নিহিত থাকে, তাকে মুআল্লাল হাদীস বলে।

১৩. মুযতারিবঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী মতন বা সনদকে বিভিন্ন প্রকার এলোমেলো করে বর্ণনা করেছেন তাকে মুযতারিব হাদীস বলে।

১৪. মুদরাজঃ যে হাদীসের মধ্যে বর্ণনাকারী তাঁর নিজের অথবা কোন সাহাবী বা তাবিঈর উক্তি সংযোজন করেছেন তাকে মুদরাজ হাদীস বলে।

১৫. মুসনাদঃ যে মারফু হাদীসের সনদ সম্পূর্ণরূপে মুত্তাসিলঃ তাকে মুসনাদ হাদীস বলে।

১৬. মুনকারঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী দুর্বল এবং তার বর্ণিত হাদীস যদি অপর দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী হয়, তবে তাকে মুনকার হাদীস বলে।

১৭. মাতরুকঃ হাদীসের বর্ণনাকারী যদি হাদীসের ব্যাপারে মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে দৈনন্দিন কথায় মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাকে মাতরুক হাদীস বলে।

১৮. মাওদুঃ বর্ণনাকারী যদি সমালোচিত ব্যক্তি হন আর যদি তিনি হাদীস বর্ণনায় মিথ্যাবাদী হন তবে তার বর্ণিত হাদীসকে মাওদু হাদীস বলে।

১৯. মুবহামঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে তার দোষ গুণ বিচার করা যেতে পারে, এমন হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে।

২০. মতনঃ হাদীসের মুল শব্দাবলীকে মতন বলে।

২১. মুতাওয়াতিরঃ যে সব হাদসের সনদে বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত অধিক যে, তাদের সকলের একযোগে কোন মিথ্যার উপর ঐকমত্য হওয়া অসম্ভব। আর এই সংখ্যাধিক্য যদি সর্বস্তরে থাকে তবে তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে।

২২. মাশহুরঃ যেসব হাদীসের বর্ণনাকারী তিন বা তিনের অধিক হবে কিন্তু মুতাওয়াতিরের পর্যায় পর্যন্ত পৌছবে না, এমন হাদীসকে মাশহুর হাদীস বলে।

২৩. মারুফঃ কোন দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল বর্ণনাকারীর হাদীসকে মারুফ হাদীস বলে।

২৪. মুতাবিঃ এক রাবির হাদীসের অনুরুপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসকে প্রথম হাদীসের মুতাবি বলে।

২৫. সহীহঃ যে মুত্তাসিলঃ হাদীসের সনদে উদ্ধৃত প্রত্যেক বর্ণনাকারীই নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, প্রখর স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং হাদীসখানি সকল প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত, তাকে সহীহ হাদীস বলে।

২৬. হাসানঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি কিছুটা দুর্বল বলে প্রমাণিত, তাকে হাসান হাদীস বলে।

২৭. যায়ীফঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী কোন হাসান বর্ণনাকারীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যায়ীফ হাদীস বলে।

২৮. আযীযঃ যে সহীহ হাদীস প্রতি স্তরে কমপক্ষে দুজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন, তাকে আযীয হাদীস বলে।

২৯. গারীবঃ যে সহীহ হাদীস কোন স্তরে মাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন, তাকে গারীব হাদীস বলে।

৩০. শাযঃ যে হাদীস কোন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী একাকী বর্ণনা করেছেন এবং তার সমর্থনে অন্য কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, তাকে শায হাদীস বলে।

৩১. আহাদঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা মুতাওয়াতিরের সংখ্যা পর্যন্ত পৌঁছেনি তাকে আহাদ হাদীস বলে।

৩২. মুত্তাফাকুন আলাইহিঃ যে হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) একই রাবী থেকে স্ব স্ব গ্রন্থে সংকলন করেছেন তাকে মুত্তাফাকুন আলাইহি বলে।

৩৩. আদালতঃ বর্ণনাকারী মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী হওয়া এবং ফিসকের উপায় উপকরণ থেকে মুক্ত এবং মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকাকে আদালত বলে।

৩৪. যাবুতঃ শ্রুত বিষয়কে জড়তা ও বিনষ্টি থেকে স্মৃতিশক্তি এমনভাবে সংরক্ষন করা যেন তা যথাযথভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হয়, তাকে যাবুত বলে।

৩৫. ছিকাহঃ যে বর্ণনাকারীর মধ্যে আদালত ও যাবত পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাকে ছিকাহ বা সাবিত বলে।

৩৬. শায়খঃ হাদীসের শিক্ষাদানকারী বর্ণনাকারীকে শায়খ বলে।

৩৭. শায়খাইনঃ মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) কে শায়খাইন বলে।

৩৮. হাফিযঃ যিনি হাদীসের সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লাখ হাদীস মুখস্থ করেছেন, তাকে হাফিয বলে।

৩৯. হুজ্জাতঃ যিনি তিন লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত বলে।

৪০. হাকিমঃ যিনি সমস্ত হাদীস সনদ ও মতনসহ মুখস্থ করেছেন তাকে হাকিম বলে

৪১. রিজালঃ হাদীসের বর্ণনাকারীর সমষ্টিকে রিজাল বলে।

৪২. তালিবঃ যিনি হাদীস শাস্ত্র শিক্ষায় নিয়োজিত তাকে তালিব বলে।

৪৩. রিওয়াতঃ হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে।

৪৪.সিহাহ সিত্তাহঃ হাদীস শাস্ত্রের প্রধান ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের সমষ্টিকে সিহাহ সিত্তাহ বলে।

৪৫. সুনানে আরবাআঃ আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাকে একত্রে সুনানে আরবাআ বলে।

৪৬. হাদীসে কুদসীঃ যে হাদীসের মূল ভাব মহান আল্লাহর এবং ভাষা মহানবী (সা) এর নিজস্ব, তাকে হাদীসে হাদীসে কুদসী বলে।

নিয়তের বিশুদ্ধতা

উদ্দেশ্যে সততা ও একনিষ্ঠতা

(আরবী******)

১. হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেন, নিয়ত বা উদ্দেশ্যের উপরই সব কাজ নির্ভরশীল। মানুষ যা নিয়ত করে, তাই পায়। যেমন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, তার হিজরতই হবে প্রকৃত হিজরত। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন স্বার্থ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, তার হিজরত পরিগণিত হবে দুনিয়ার জন্য কিংবা সংশ্লিষ্ট নারীর জন্য কৃত হিজরত হিসাবে। (বোখারী, মুসলিম)

মানুষের চিন্তা ও কর্মের পরিশুদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। রাসূল (সা) এর এ হাদীসের মর্ম এই যে, যে কোন সৎ কাজই করা হোক না কেন, তা কী উদ্দেশ্যে ও কোন নিয়তে করা হয়েছে, তার ভিত্তিতেই তার পরিণাম ও প্রতিদান নির্ণীত হবে। যদি উদ্দেশ্য সৎ থেকে থাকে, তবে তার সওয়াব পাওয়া যাবে, নচেৎ সওয়াব পাওয়া যাবে না। কোন কাজ দেখতে যতই পুণ্যের কাজ মনে হোক, আখিরাত তার প্রতিদান কেবল তখনই পাওয়া যাবে, যখন তা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হবে। এই কাজের পেছনে যদি কোন দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছা কার্যকর থেকে থাকে, যদি তা কোন পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষে করা হয়ে থাকে, তবে পরকালের বাজারে তার কোন দাম থাকবে না। সেখানে ঐ কাজ অচল মুদ্রা হিসাবে গণ্য হবে। এ কথাটাকে তিনি হিজরতের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। হিজরত কত বড় ত্যাগ ও পুণ্যের কাজ, মানুষে নিজের ঘরবাড়ী, সহায় সম্পদ ও জন্মভূমি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু এত বড় ত্যাগও পুণ্যের এই কাজটিও আদৌ পুণ্যের কাজ হিসাবেই গৃহীত হবে না এবং এ কাজের কোন সওয়াবই পাওয়া যাবে না যদি মানুষ তা আল্লাহ ও রাসূলের জন্য না করে। বরং নিছক নিজের দুনিয়াবি স্বার্থ ও সুবিধা লাভের জন্য করে। এতে বরঞ্চ সে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির দায়ে অভিযুক্ত হবে। কারণ সে নিজেকে আল্লাহর জন্য হিজরতকারী হিসাবে চিহ্নিত করে মুসলমানদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধোঁকা দিয়ে পার্থিব সুযোগ সুবিধা যথা খাদ্য ও আশ্রয় ইত্যাদি লাভ করেছে। অথচ আসলে সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হিজরত করেনি।

(আরবী*******)

২. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তোমাদের আকৃতি, চেহারা ও ধনসম্পদ দেখবেন না। তিনি দেখবেন তোমাদের মন ও আমলকে। (মুসলিম)

(আরবী******)

৩. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে আরো বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন সর্ব প্রথম এমন এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হবে, যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আল্লাহর আদালতে হাজির করা হবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেয়া নেয়ামতগুলো স্মরণ করিয়ে দেবেন। যাবতীয় নেয়ামতের কথা তার মনে পড়বে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তুমি আমার নেয়ামতগুলো পেয়ে কি কাজ করছ? সে বলবেঃ আমি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য(তোমার দ্বীনের বিরুদ্ধে লড়াইতে লিপ্তদের সাথে) যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি যে বললে আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করেছি এ কথা ভুল বলেছ। তুমি যুদ্ধ করেছ শুধু এ জন্য যে, লোকেরা তোমাকে বীর ও সাহসী বলবে। সেটা বলাও হয়েছে এবং দুনিয়াতেই তুমি তার প্রতিদান পেয়ে গেছে। অতঃপর হুকুম দেয়া হবে যে, এই স্বকথিত শহীদ কে মুখ নীচের দিকে দিয়ে টেনে নিয়ে যাও এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। তৎক্ষণাৎ তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এরপর দ্বিতীয় আরেক ব্যক্তি আসবে আল্লাহর আদালতে। সে ছিল ইসলামের বিশিষ্ট পণ্ডিত তথা আলেম, শিক্ষক ও কোরআন অধ্যয়নকারী। তাকে আল্লাহ তাঁর দেয়া নেয়ামতগুলো স্মরণ করিয়ে দেবেন। লোকটির যাবতীয় নেয়ামতের কথা মনে পড়বে। তখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন এতসব নেয়ামত পেয়ে তুমি কি কাজ করেছ?সে বলবে, হে আল্লাহ, আমি তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তোমার দ্বীন শিখেছি। তোমারই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তা অন্যকেও শিখিয়েছি এবং তোমারই জন্য কোরআন পড়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন তুমি মিথ্যে বলছ। তুমি তো কেবল এ জন্য ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেছ যেন লোকেরা তোমাকে একজন আলেম বলে। আর কোরআন তুমি এজন্য শিখেছ, যেন জনগণ তোমাকে কোরআনের জ্ঞানী বলে। তোমার এ আশা দুনিয়াতেই মিটে গেছে এবং লোকে তোমাকে আলেম ও ক্বারি বলেছে। এরপর হুকুম দেয়া হবে যে, ওকে মুখ নীচের দিকে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাও এবং জাহান্নামে ফেলে দাও। তৎক্ষণাৎ তাকে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তৃতীয় ব্যক্তি হবে দুনিয়ার সেই ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিপুল প্রাচুর্য ও রকমারি অঢেল সম্পদ দান করেছেন। তাকে হাজির করার পর আল্লাহ তাকে দেয়া নেয়ামতের কথা স্মরণ করাবেন। সকল নেয়ামতের কথা তার মনে পড়বে এবং সে স্বীকার করবে যে, এ সকল নেয়ামত তাকে দেয়া হয়েছিল। এরপর তার প্রতিপালক তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার নেয়ামতগুলো পেয়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে, যে সব খাতে খরচ তুমি পছন্দ কর, সেই সব খাতে তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে খরচ করেছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যে বলছ। তুমি সমস্ত সম্পদ এজন্য দান করেছিলে যেন লোকে তোমাকে দানশীল বলে। এ উপাধি তুমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেছ। এরপর আদেশ দেয়া হবে যে, ওকে মুখ নীচের দিকে দিয়ে টেনে নিয়ে আগুনে ছুড়ে মারো। তাকে তৎক্ষণাৎ আগুনে ফেলে দেয়া হবে। (মুসলিম)

ব্যাখ্যা: এই তিনটি হাদীস যে বিষয়টি তুলে ধরেছে, তা হলোঃ আখিরাতে কোন সৎকাজে বাহ্যিক রূপ ও আকৃতি দেখে পুরস্কার বা প্রতিদান দেয়া হবে না। সেখানে শুধু সেই কাজই সওয়াবের যোগ্য বিবেচিত হবে, যা কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে। যত বড় নেক কাজই হোক, তা যদি এ উদ্দেশ্যে করা হয় যে, সমাজের লোকেরা তাতে খুশী হবে কিংবা জনগণের চোখে তার মর্যাদা বাড়বে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার চোখে তার কোন মর্যাদা থাকবেনা। আখিরাতের বাজারে এ ধরনের পণ্যের কোন মূল্য হবে না। আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় এ ধরনের নেক আমল অচল ও নকল পণ্য বিবেচিত হবে। এ ধরনের লোক দেখানো ঈমানও সেখানে কাজে আসবে না।

সুতরাং আমাদেরকে এই লোক দেখানো ও খ্যাতি অর্জনের সর্বনাশা মানসিকতা থেকে সতর্ক ও হুশিয়ার থাকতে হবে। নচেৎ আমাদের অজান্তেই আমাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনা ও শ্রম বরবাদ হয়ে যাবে। শুধু যে বরবাদ হবে তাই নয়। কেয়ামতের ময়দানে হাজির হবার আগে এই বরবাদ হওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও জানা যাবে না। সেই ময়দানে মানুষ প্রতিটি আমলের প্রয়োজন অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভব করবে, চাই তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন।

ঈমানিয়াত

যে সব বিষয়ে ঈমান আনা জরুরী

(আরবী****)

৪. হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। আগন্তুক (যিনি প্রকৃতপক্ষে জিবরাইল (আ ) ছিলেন এবং মানুষের রূপ ধারণ করে রাসূল (সা) এর কাছে এসেছিলেন। ) রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলো, ঈমান কি বলুন। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহ তায়ালাকে ও আখিরাতকে সত্য জানবে ও সত্য বলে বিশ্বাস করবে, আর এটাও বিশ্বাস করবে যে, পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটবে, আল্লাহর পক্ষ থেকেই ঘটে, চাই তা ভালো হোক বা মন্দ হোক। এটাই ঈমান। (মুসলিম)

এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। এটি হাদীসে জিবরাইল নামে খ্যাত। একদিন হযরত জিবরাইল (আ ) মানুষের আকার ধারণ করে রাসূল (সা) এর কাছে এলেন এবং ইসলাম কি, ঈমান কি, ইহসান কাকে বলে ও কেয়ামত কবে হবে জিজ্ঞেস করেন। রাসূল (সা) প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন। এগুলোর মধ্য থেকে ঈমান সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

ব্যাখাঃ ঈমানের আসল অর্থ হলো কারো উপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা এবং সে কারণে তার কথাকে সত্য বলে মান্য করা। মানুষ তখনই কারো কথাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। যখন তার সত্যবাদিতা সম্পর্কে অটল-বিশ্বাস রাখে। বিশ্বাস ও আস্থাই হলো ঈমানের মুল কথা। আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলগণের মাধ্যমে যা যা এসেছে, তার সব কটিকে সত্য বলে গ্রহণ করা মুমিন হওয়ার জন্য অপরিহার্য।

এগুলোর মধ্য থেকে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। পৃথক পৃথক ভাবে এগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নিম্নে দেয়া গেলঃ-

আল্লাহর প্রতি ঈমানঃ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো, তিনি অনাদি ও অনন্ত কাল ধরে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। তিনি একাই সমগ্র বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব জগতের একক ও সর্বময় পরিচালক ও শাসক বলে বিশ্বাস করতে হবে। আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিতে এবং এর শাসন ও পরিচালনায় তার কোন অংশীদার নেই। তিনি সব রকমের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি যাবতীয় সদগুণাবলীর অধিকারী এবং সমস্ত কল্যাণ ও মহত্বের উৎস।

ফিরিশতাদের উপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ ফিরিশতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা এবং স্বীকার করা যে তারা অত্যন্ত পবিত্র ও নিষ্পাপ, তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন না। সদা সর্বদা আল্লাহর এবাদত করেন। অনুগত গোলামের মত মনিবের প্রতিটি হুকুম বাস্তবায়নের জন্য তার দরবারে অনবরত হাত বেধে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং পৃথিবীর সকল সৎকর্মশীল ও পুণ্যবানের জন্য দোয়া করতে থাকেন।

কিতাবের উপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবী ও রসূলগণের মাধ্যমে সময়ে সময়ে আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ সম্বলিত যে সব গ্রন্থ পাঠিয়েছেন, সে সব গ্রন্থকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর মধ্যে সর্বশেষ গ্রন্থ কোরআন শরীফ। পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীরা নিজেদের কিতাবগুলোকে বিকৃত করে ফেলেছে, সেহেতু আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ মুহাম্মাদ (সা) এর মাধ্যমে সর্বশেষ গ্রন্থও প্রেরণ করেছেন। এই গ্রন্থ সুস্পষ্ট, অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন। এত কোন ত্রুটি বিচ্যুতি বা অসম্পূর্ণতা নেই। এ গ্রন্থ সর্ব প্রকারের বিকৃতি থেকে মুক্ত। এখন এরই কিতাব ছাড়া পৃথিবীতে এমন আর কোন কিতাব নেই, যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে পৌছা যায়।

রসূলগণের উপর ঈমান আনার তাৎপর্যঃ এর অর্থ যতজন নবী ও রাসূল আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত হয়েছেন, তাদের সকলের সম্পর্কে বিশ্বাস করা যে, তারা সবাই সত্যবাদী। তারা আল্লাহর বার্তাকে অবিকলভাবে ও কোন রকম হেরফের এবং কমবেশি না করেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বশেষ নবী ও রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মাদ (সা)। এখন একমাত্র তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণেই মানুষের মুক্তি ও পরিত্রাণ নিহিত।

আখিরাতের ওপর ঈমানঃ এর অর্থ হলো এ কথা বিশ্বাস করা যে, এমন একটি দিনের আগমন অবধারিত। যেদিন সকল মানুষের জীবনের কৃতকর্মের বিচার হবে। যার কাজ ভালো ও সন্তোষজনক হবে, সে পুরস্কৃত হবে। আর যার কাজ অসন্তোষজনক হবে, সে পাবে কঠিন শাস্তি। শাস্তিও হবে সীমাহীন, পুরস্কারও হবে অনন্তকাল ব্যাপী।

তকদীরের ওপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ এই মর্মে বিশ্বাস রাখা যে, পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে বা ঘটবে, কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুমেই ঘটবে। এখানে কেবল তারই হুকুম চলে। এমন কখনো হয় না যে, আল্লাহ চান এক রকম, আর বিশ্বজগত চলছে অন্যভাবে। ভালো মন্দ এবং সুপথগামিতা ও বিপথগামিতার ব্যাপারে আল্লাহর একটা অকাট্য বিধান রয়েছে, যা তিনি আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর কৃতজ্ঞ ও শোকর-গুজার বান্দাদের ওপর যখনই কোন বিপদ মুসিবত, সমস্যা সংকট ও পরীক্ষা আসে, তাদের প্রতিপালকের আদেশেই আসে এবং আগে থেকেই নির্ধারিত নিয়ম ও বিধান অনুসারেই আসে।

আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্যঃ

(আরবী***************)

৫। হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রা) বলেনঃ কোন এক সফরে আমি রাসূল (সা) এর পেছনে উটের ওপর বসা ছিলাম। আমার ও তাঁর মাঝে ঘোড়ার জিনের (কাঠের তৈরী আসন) পেছনের অংশটি ছাড়া আর কোন ব্যবধান ছিলনা। তিনি বললেন“মুয়ায বিন জাবাল!আমি (আগের মতই) বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ, ভৃত্য উপস্থিত। এবারও তিনি কিছুই বললেন না। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি ডাকলেন মুয়ায বিন জাবাল। আমি এবারও বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ , ভৃত্য উপস্থিত। তিনি বললেনঃ তুমি কি জান, বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক (প্রাপ্য) কি? আমি বললাম আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক এই যে, তারা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করবে এবং হুকুম পালনে অন্য কাউকে শরীক করবে না। আরো কিছুদূর চলার পর তিনি বললেন হে মুয়ায! আমি আমি বললাম হে রাসূলুল্লাহ, ভৃত্য উপস্থিত, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো ও আনুগত্য করবো। তিনি বললেন, তুমি কি জান আল্লাহর ওপর বান্দার হক (প্রাপ্য) কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর ওপর তাঁর অনুগত বান্দাদের হক এই যে, তিনি যেন তাদেরকে আযাব না দেন। (বোখারী ও মুসলিম)

হযরত মুয়াযের বর্ণনার সারমর্ম হলো, তিনি রাসূল (সা) এর এত কাছে বসেছিলেন যে, কথা শুনতে ও শুনাতে কোনই অসুবিধা হচ্ছিল না। রাসূল (সা) এর কথা তিনি খুব সহজেই শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু যে কথাটা রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে চাইছিলেন তা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তিনি তাকে তিনবার ডাকলেন এবং কিছুই বললেন না। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মুয়ায যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাটা শোনেন এবং কথাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। এরপর রাসূল (সা) যা বললেন, তা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহর একত্ব তথা তাওহীদ অত্যন্ত জরুরী এবং তা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাতে সক্ষম। যে জিনিস আল্লাহর গযব থেকে নিষ্কৃতি দেয় ও জান্নাতের হকদার বানায়, বান্দার কাছে তার চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর কি হতে পারে?*

(আরবী**************)

৬. রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ (আবুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে) তোমরা জান, একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়নের অর্থ কি? তারা বললো আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসূল (সা) বললেনঃ এর অর্থ হলো, এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল, আর নামায যথাযথভাবে আদায় করা, যাকাত দেয়া ও রমযানের রোযা রাখা। (মেশকাত) (আরবী**********)

৭. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) যখনই কোন ভাষণ দিতেন, একথাটা অবশ্যই বলতেন যে, যার ভেতরে আমানতদারী নেই, তার ভেতরে ঈমান নেই, আর যে ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষা করাকে গুরুত্ব দেয় না, তার কাছে দ্বীনদারী নেই। (মেশকাত)

রাসূলুল্লাহ (সা) এর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় করে না, সে পরিপক্ব ঈমানের অধিকারী নয়। আর যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে ওয়াদা করে অথচ সেই ওয়াদা পূরণ করে না, সে দীনদারীর ন্যায় মহামূল্যবান সম্পদ ও নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। যার অন্তরে ঈমানের শেকড় দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল থাকে, সে সকল হক বা অধিকার আদায়ে বিশ্বস্ত হয়ে থাকে। এই বিশ্বস্ততাই আমানতদারী। কোন হক বা অধিকার আদায়ে সে অবহেলা করে না। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তির ভেতরে দ্বীনদারী থাকবে, সে মৃত্যু পর্যন্ত ওয়াদা পালন করবে। মনে রাখা দরকার যে, সবচেয়ে বড় হক বা অধিকার হচ্ছে আল্লাহর, তাঁর রাসূলের এবং তাঁর কিতাবের। আল আল্লাহর হক ও বান্দার হক কি কি, তার পুরো তালিকা আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদেই দিয়ে রেখেছেন। আরো মনে রাখতে হবে যে, মানুষ আল্লাহ তায়ালার সাথে তাঁর প্রেরিত নবীর সাতে ও নবীর আনীত দ্বীনের সাথে যে ওয়াদা করে, সেটাই সবচেয়ে বড় ওয়াদা। সুতরাং ওয়াদা পালনের ক্ষেত্রে এই ওয়াদা সবচেয়ে অগ্রগণ্য।

(আরবী**********)

৮. হযরত আমর ইবনে আবাসা (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, ঈমান কি? তিনি বললেন ঈমান হচ্ছে সবর ও সামাহাতের আর এক নাম। (মুসলিম)

অর্থাৎ ঈমান হলো, আল্লাহর পথ অবলম্বন করা, এই পথে যত বিপদ মুসিবত আসুক, তা সহ্য করা এবং আল্লাহর সাহায্যের আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। একেই বলা হয় সবর। আর নিজের উপার্জিত সম্পদ থেকে যত বেশী পরিমাণে সম্ভব আল্লাহর অসহায় ও পরমুখাপেক্ষী বান্দাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা এবং ব্যয় করে তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করা। আরবীতে একেই বলে সামাহাত। অবশ্যই সামাহাত বিনম্র আচরণ, মহানুভবতা ও উদারতা অর্থেরও ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

ঈমানের পূর্ণতা লাভের উপায়

(আরবী********)

৯. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব করে, আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে, আল্লাহর জন্যই দান করে এবং আল্লাহর জন্যই দান থেকে বিরত থাকে, সে নিজের ঈমানকে পূর্ণতা দান করে। (বোখারী, আবু উমামা থেকে বর্ণিত)

এ হাদীসের মর্মার্থ এই যে, ঈমানদার বান্দা নিজের আত্মশুদ্ধি ও আত্নগঠনের জন্য অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালাতে চালাতে অবশেষে এ পর্যায়ে উপনীত হয়ে যে, সে যখন কারো সাথে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই করে এবং আল্লাহর অর্জিত হয় এমনভাবেই করে। আবার কারো সাথে যদি সম্পর্কচ্ছেদ করে ও শত্রুতার মনোভাব পোষণ করে, তবে তাও আল্লাহকে খুশী করার জন্যই করে এবং আল্লাহ খুশী হন এমনভাবেই করে। অনুরূপভাবে, কাউকে দান করলেও তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে এবং আল্লাহ যাকে ও যেভাবে দান করলে খুশী হন সেইভাবে দান করে। আর কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকলে তাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে যেখানে ও যাকে দান করা সংগত নয় সেখানে দান করে না। মোটকথা, সে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে ও দ্বীনের মাপকাঠি দিয়ে মেপেই কাউকে ভালোবাসে বা ঘৃণা করে। তার ভালোবাসা ও শত্রুতা, অনুরাগ ও বিরাগ, নিজের কোন ব্যক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হয় না, বরং কেবলমাত্র আল্লাহ ও তার দ্বীনের জন্য হয়ে থাকে। এরকম অবস্থায় কেউ যখন পৌঁছে যায়, তখন বুঝবে তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করেছে।

ঈমানের প্রকৃত স্বাদ কখন পাওয়া যায়?

(আরবী**********)

১০. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করে, যে আল্লাহকে নিজের একমাত্র প্রভু হিসাবে, ইসলামকে নিজের একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে ও মুহাম্মাদ (সা) কে নিজের রাসূল হিসাবে মেনে নিয়ে খুশী ও পরিতৃপ্ত হয়। (বোখারীও মুসলিম, আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত)

অর্থাৎ নিজেকে আল্লাহর দাসত্বে সমর্পণ করে, ইসলামী শরীয়তের অনুকরণ ও অনুসরণ করে এবং আল্লাহর রাসূলের পরিপূর্ণ আনুগত্য করে পূর্ণ আত্মতৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে। আর এই মর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট হয় যে, জীবনে আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও গোলামী কবুল করবো না। সর্বাবস্থায় ইসলামের ওপর চলবো এবং রাসূলুল্লাহ(সা) ছাড়া আর কারো নেতৃত্ব মানবো না। যে ব্যক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছে যায়, বুঝতে হবে সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পেয়েছে।

রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

সর্বোত্তম কথা ও সর্বোত্তম আদর্শ

(আরবী*****************)

১১. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহর কিতাবই শ্রেষ্ঠ বাণী এবং মুহাম্মদ (সা) এর আদর্শই শ্রেষ্ঠ আদর্শ(যার অনুসরণ করতে হবে। ) (মুসলিম)

কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা রাসূলের সুন্নাত

(আরবী**********************)

১২. হযরত আনাস (রা) বলেন রাসূল (সা) আমাকে বলেছেনঃ প্রিয় বৎস, তুমি যদি এভাবে জীবন যাপন করতে পার যে, তোমার মনে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অশুভ কামনা নেই, তাহলে তাই কর। এটাই আমার সুন্নাত বা নীতি। (অর্থাৎ আমি কারো প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা বা অশুভ কামনা পোষণ করিনা। ) যে ব্যক্তি আমার নীতিকে ভালোবাসে, নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (মুসলিম)

দুনিয়া ত্যাগ তথা বৈরাগ্যবাদ রাসূলের নীতি নয়

(আরবী*****************************)

১৩. একবার তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এবাদত বন্দেগী সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের লক্ষে তাঁর স্ত্রীদের কাছে এল। যখন তাদেরকে জানানো হলো, রাসূলুল্লাহ (সা) কেমন এবাদত বন্দেগী করেন, তখন তাঁরা তাঁর সামনে নিজেদের এবাদত বন্দেগীকে অত্যন্ত কম ও নগণ্য মনে করলো।

তারা মনে মনে বললোঃ রাসূল(সা) এর সামনে আমরা কোথায় ? তাঁরতো আগেও কোন গুনাহ ছিল না, পরেও কোন গুনাহ হবে না। (আর আমরা তো নিষ্পাপ নই। কাজেই আমাদের বেশী করে এবাদত বন্দেগী করা উচিত। ) এরপর তাদের একজন বললোঃ আমি সব সময় নফল এবাদত করে পুরো রাত কাটিয়ে দেব। আর একজন বললো আমি সব সময় নফল রোযা রাখবো, দিনের বেলা কখনো পানাহার করবো না। আর একজন বললোঃ আমি সব সময় নারীদেরকে এড়িয়ে চলবো, কখনো বিয়ে করবো না। রাসূল (সা) (যখন এ সব জানতে পারলেন তখন ) তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন, তোমরাই কি এসব কথা বলছিলে? তারপর তিনি বললেন শোন, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তাঁর অবাধ্যতা বেশী এড়িয়ে চলি। অথচ আমি কখনো (নফল) রোযা রাখি, আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে আমি কখনো নফল পড়ি, আবার কখনো ঘুমাই। আর আমি বিয়েও করেছি। (কাজেই আমার রীতিনীতি অনুসরণ করাতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত। ) যে ব্যক্তি আমার রীতিনীতির গুরুত্ব দেয় না ও উপেক্ষা করে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম) , আনাস (রা) থেকে বর্ণিত)

আল্লাহ ভীতির প্রকৃত পরিচয়

(আরবী*******************)

১৪. একবার রাসূল(সা) একটি কাজ নিষিদ্ধ করে দিলেন। পরে আবার তার অনুমতি দিলেন, কিন্তু এরপরও কিছু লোক সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে থাকতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের এই মানসিকতার কথা জানতে পেরে একটা ভাষণ দিলেন। (সেই ভাষণে) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন কিছু লোক আমি যে কাজ করি, তা থেকে বিরত থাকছে কেন?আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখি এবং আল্লাহ তায়ালাকে তাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। (বোখারী ও মুসলিম, আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত)

ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুসরণের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি

(আরবী***************************)

১৫. হযরত জাবের (রা) বলেনঃ একবার হযরত ওমর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে এলেন এবং বললেনঃ আমরা ইহুদীদের কাছে থেকে এমন এমন বাণী শুনি, যা আমারে কাছে ভালো লাগে। আপনি কেমন মনে করেন, যদি আমরা তাদের সেই সব বাণী থেকে কিছু কিছু লিখে রাখি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ইহুদী ও খৃষ্টানরা যে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, তোমারাও সেই গোমারাহীতে লিপ্ত হতে চাও নাকি? আমি তোমাদের কাছে থেকে এমন উজ্জ্বল নিখুঁত ও সহজ বিধান নিয়ে এসেছি যে, এমনকি আজ যদি স্বয়ং মূসাও (আ ) বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিও আমার এই বিধান অনুসরণ না করে পারতেন না। (মুসলিম)

ইহুদী খৃষ্টানরা তাদের কাছে অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করে ফেলেছিল। তবে পুরোপুরি বিকৃত করতে পারেনি। তাতে কিছু কিছু ভালো কথাও অবশিষ্ট ছিল। মুসলমানরা সে সব কথা শুনতো এবং তা তাদের কাছে ভালো লাগতো। রাসূল (সা) যদি সেই সব বাণী লিখে রাখার অনুমতি দিতেন, তা হলে ইসলামের নিদারুণ ক্ষতি হয়ে যেত। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, তার কিছু না কিছু ভালো কথা আছে। তাই বলে যার নিজ বাড়িতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানির ঝর্ণা বিদ্যমান, অন্যের ঘোলা পানির চৌবাচ্চার কাছে ঝর্ণা দেয়া তার শোভা পায় না। হযরত ওমরকে রাসূল (সা) যে জবাব দিলেন, তা থেকে এই কথাটিই সুস্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে।

প্রকৃত ঈমানের দাবী

(আরবী********************)

১৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি যতক্ষণ (কাঙ্ক্ষিত মানে উত্তীর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ তার ইচ্ছা ও মনে ঝোঁক আমার আনীত বিধানের (তথা কোরআনের) অনুসারী না হয়। (মেশকাত)

অর্থাৎ রাসূল (সা) এর ওপর ঈমান আনার দাবী হলো, নিজের কামনা বাসনা, ইচ্ছা ও মনের ঝোঁক প্রবণতাকে রাসূলের আনীত বিধানের অনুগত করে দিতে হবে এবং নিজের খেয়াল খুশী ও খায়েশের বাগডোর ও নিয়ন্ত্রণভার কোরআনের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এটা না করতে পারলে রাসূল(সা) এর ওপর ঈমান আনার দাবী নিরর্থক হয়ে পড়বে।

ঈমানের মাপকাঠি

(আরবী****************************)

১৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের বাবা, সন্তান ও অন্য সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব, ততক্ষণ তোমরা মুমিন হতে পারবে না। (বোখারীও মুসলিম, হযরত আনাস থেকে বর্ণিত) রাসূল (সা) এর এ উক্তির মর্মার্থ এই যে, মানুষ প্রকৃত মুমিন তখনই হয়, যখন তার মনে রাসূল ও তার আনীত দ্বীন ঈমানের ভালোবাসা অন্য সমস্ত ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার চেয়ে প্রবল হয়। সন্তানের স্নেহ মমতা মানুষকে একদিকে যেতে বলে, বাবার প্রতি ভালোবাসা অন্য একদিকে চলতে প্ররোচনা দেয়, আর রাসূল (সা) দাবী জানান অন্য এক পথে চলার। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি অন্য সমস্ত স্নেহ, মমতা ভালোবাসার দাবী প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র রাসূল (সা) এর আদিষ্ট পথে চলতে প্রস্তুত ও বদ্ধপরিকর হয়, বুঝতে হবে সেই ব্যক্তিই পাক্কা মুমিন, সেই রাসূল (সা) কে যথাযথভাবে ভালোবাসে। এই মানের ঈমানদারই ইসলামের প্রয়োজন। এ ধরনের দুরন্ত মুমিনেরাই পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস গড়ে। কাঁচা ও দুর্বল ঈমান নিয়ে কেউ পিতা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ইসলামের পথে চলতে পারে না।

আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ

(আরবী*****************)

১৮. হযরত আবদুর রহমান বিন আবি কিরাদ বলেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সা) ওযু করলেন। তখন তাঁর কিছু সাহাবী তার ওযুর পানি হাতে নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে মাখাতে লাগলেন। তা দেখে রাসূল (সা) বললেন কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তোমরা এ কাজ করলে? তারা বললেন আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলকে ভালোবাসে অথবা আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসা পেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করতে চায়, তার উচিত যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হবে, তখন আমানত হিসাবে রক্ষিত জিনিস অক্ষতভাবে মালিককে ফিরিয়ে দেবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। (মেশকাত)

রাসূলুল্লাহ (সা) এর ওযু করা পানি হাতে নিয়ে বরকতের উদ্দেশ্যে মুখে মাখানোর কারণ ছিল রাসূলের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। এটা কোন মন্দ কাজ ছিল না যে, তার জন্য রাসূল (সা) তাদেরকে তিরস্কার করবেন। তবে তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, সর্বোচ্চ ভালোবাসা এই যে, আল্লাহ ও রাসূল যা কিছু হুকুম দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত করা, তিনি যে দ্বীন এনেছেন, তাকে নিজের জীবন ব্যবস্থায় পরিণত করা। রাসূলের অনুকরণ অনুসরণই হলো রাসূল প্রীতির সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট রূপ যদি তা যথার্থ আন্তরিক ও রাসূলের প্রতি হৃদয়ের টান সহকারে করা হয়।

রাসূল প্রীতির ঝুঁকি

(আরবী******************)

১৯. হযরত আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে এল এবং সে রাসূল (সা) কে বললোঃ আমি আপনাকে ভালোবাসি। তিনি বললেনঃ তুমি যে কথাটা বললে, তা নিয়ে আরো একটু চিন্তাভাবনা কর। এরপরও সে তিনবার বললো যে, আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে ভালোবাসি। রাসূল (সা) বললেন তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দারিদ্রের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হও। কেননা যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, তার কাছে অভাব ও ক্ষুধা স্রোতের পানির চেয়েও দ্রুতবেগে আসে। (তিরমিযি)

কাউকে ভালোবাসার অর্থ এটাই হয়ে থাকে যে, সে যা পছন্দ করে তাই পছন্দ করতে হবে এবং সে যা অপছন্দ করে তা অপছন্দ করতে হবে, প্রিয় ব্যক্তি যে পথে চলে সেই পথে চলতে হবে। তার নৈকট্য, ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির খাতিরে সমস্ত প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে হবে ও কুরবানী করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

রাসূল (সা) কে ভালোবাসা ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ হলো, তিনি যে পথে চলেছেন, সে পথের যাবতীয় চিহ্ন ও রূপরেখা সঠিকভাবে জেনে ও মেনে সেই পথে চলতে হবে। যে পথে চলতে গিয়ে তিনি আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, দুঃখকষ্ট ও মুসিবত ভোগ করেছেন, শত আঘাত ও মুসিবত সহ্য করেও সেই পথে ছলার হিম্মত ও সাহস অর্জন করতে হবে। এই পথে কখনো হেরা গুহারও সাক্ষাত মিলবে, বদর হুনায়েনের মুখোমুখি হতে হবে।

আল্লাহর দ্বীন অনুসারে চলতে গেলে অভাব ও ক্ষুধার মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আর অর্থনৈতিক আঘাতটাই যে সবচেয়ে দুঃসহ আঘাত, তা সবাই জানে। এ আঘাতের মোকাবিলা কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা ও আল্লাহর ভালোবাসার অস্ত্র দিয়েই করা সম্ভব। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি এরকম পরিস্থিতিতে ভাবে যে, আমার অভিভাবক তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, সুতরাং আমি অসহায় নই। আমিতো তার দাস। দাসের একমাত্র কাজ হলো মনিবকে খুশি করা ও তার ইচ্ছা পূরণ করা। আমি যার কাজে নিয়োজিত, তিনি দয়ালু ও ন্যায়বিচারক। সুতরাং আমার শ্রম বৃথা যেতে পারে না। তার এ ধরনের চিন্তা সমস্ত বিপদ মুসিবতকে সহজ করে দেয় এবং শয়তানের যাবতীয় অস্ত্রকে ভোতা করে দেয়।

কোরআন শরীফের ওপর ঈমান আনার তাৎপর্য

(আরবী***********************************)

২০. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করবে, সে দুনিয়াতেও গোমরাহ হবেনা, আখিরাতেও বঞ্চনার শিকার হবে না। এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেনঃ (আরবী****************************)

যে ব্যক্তি আমার নির্দেশ মেনে চলবে। সে দুনিয়াতেও গোমরাহ হবে না, আখিরাতেও দুর্ভাগ্যের শিকার হবে না। (মেশকাত)

কোরআনের বিষয়সমূহ

(আরবী**************)

২১.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ পবিত্র কোরআনে পাঁচটি জিনিস আছেঃ হালাল, হারাম, মুহকা, মুতাশাবিহ ও উদাহরণ। তোমরা হালালকে হালাল মানো। হারামকে হারাম মানো। মহকামের (যে অংশে আকীদা, এবাদাত, আমল আখলাক, আইন কানুন ইত্যাদির শিক্ষা দেয়া হয়েছে) ওপর আমল কর। মুতাশাবিহের (যে অংশে অদৃশ্য বিষয় তথা বেহেশত, দোযখ, আরশ ইত্যাদির বিবরণ রয়েছে) ওপর বিশ্বাস রাখো। (অর্থাৎ অদৃশ্য বিষয়গুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন বা বিতর্ক না তুলে হুবহু যা বলা হয়েছে তাই মেনে নাও। ) এবং উদাহরণ (অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর শিক্ষামূলক কাহিনী) থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। (মেশকাত)

(আরবী***************************)

২২. হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কিছু কাজ ফরজ করেছেন। সেগুলোকে তোমরা নষ্ট করো না। কিছু কাজ হারাম করেছেন, সেগুলোকে লঙ্ঘন করো না। কিছু সীমা নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো অতিক্রম করো না। কিছু জিনিস সম্পর্কে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করো না। (মেশকাত)

(আরবী***********************************)

২৩. হযরত যিয়াদ বিন লাবিদ (রা) বলেন একবার রাসূলুল্লাহ (সা) একটা ভয়ংকর জিনিসের উল্লেখ করে বললেন। এমন অবস্থা ঘটবে তখন, যখন ইসলামের জ্ঞান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামের জ্ঞান কিভাবে নিশ্চিহ্ন হবে? আমরা তো কোরআন নিজেরাও পড়ছি। আমাদের সন্তানদেরকেও শেখাচ্ছি এবং আমাদের সন্তানরাও তাদের সন্তানদেরকে শেখাতে থাকবে। রাসূল (সা) বললেনঃ ওহে যিয়াদ, আমি তো তোমাকে মদিনার সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোক মনে করতাম। তুমি কি দেখতে পাওনা, ইহুদী ও খৃষ্টানরা তাওরাত ও ইনজিল কত তেলাওয়াত (আবৃত্তি) করে। কিন্তু তার শিক্ষা অনুযায়ী একটুও কাজ করে না? (ইবনে মাজা)

তকদীরের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণা লাভ

(আরবী*************************************)

২৪. হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকের দোযখ ও বেহেশত নির্ধারিত হয়ে আছে। লোকেরা বললো, হে রাসূলুল্লাহ, তাহলে আমরা আমাদের নিজ নিজ নির্ধারিত ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে কাজ কর্ম ছেড়ে দেই না কেন? রাসূল (সা) বললেনঃ না। কাজ করে যাও। কেননা যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তার জন্য সেই কাজই সহজ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যশালী, তাকে সৌভাগ্যজনক ও বেহেশতে যাওয়ার উপযোগী কাজ করার সামর্থ্য দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি হতভাগা ও জাহান্নামী, তাকে জাহান্নামে যাওয়ার উপযোগী কাজ করার সামর্থ্য দেয়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) সূরা ওয়াল্লাইল এর এই আয়াত কটি পড়লেনঃ যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয় করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বোত্তম বাণীর স্বীকৃতি দেয় (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করে) তাকে আমি উত্তম জীবন যাপনের (অর্থাৎ জান্নাতবাসের উপযোগী জীবন যাপনের) ক্ষমতা দেব। আর যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয়ে কার্পণ্য করে, (আল্লাহ সম্পর্কে) বেপরোয়া হয় এবং উত্তম জীবন যাপনকে প্রত্যাখ্যান করে, তাকে আমি কষ্টদায়ক জীবন যাপনের (অর্থাৎ জাহান্নামের উপযোগী জীবন যাপনের) ক্ষমতা যোগাবো। (বোখারী, মুসলিম)

ব্যাখ্যা: মানুষ কোন কোন কাজের দরুন দোযখের উপযুক্তে এবং কোন কোন কাজের দ্বারা জান্নাতের উপযুক্ত হবে, সেটা আল্লাহ তায়ালা আগে থেকেই নির্ধারিত করে রেখেছেন। এই পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থার নামই তাকদীর বা অদৃষ্ট। এই তাকদীর বা অদৃষ্ট কোরআনেও বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সা) সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপর মানুষ জাহান্নামের পথে চলা পছন্দ করবে, না জান্নাতের পথে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। দুটোর মধ্য থেকে যে কোন একটা অবলম্বন করা তারই দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং জীবন চলার পথ নির্ধারণে তাকে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাই তাকে দোযখের শাস্তি ভোগ করাবে। অথবা এর বদৌলতেই সে জান্নাতের অধিকারী হবে। কিন্তু অনেকের বুদ্ধি এতই বক্র ও ভোঁতা যে, নিজের দায়দায়িত্ব আল্লাহর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেকে অক্ষম মনে করে এবং ভাবে যে, সে যা কিছুই করছে, আল্লাহ তাকে দিয়ে তা জোরপূর্বক করাচ্ছেন। সুতরাং তার আর কোন দায়দায়িত্ব নেই।

তকদীরের অর্থ

(আরবী***************************)

২৫. হযরত আবু খুযামা (রা) তার বাবার কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (আবু খুযামার বাবা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম যে, হে রাসূলুল্লাহ। আমরা আমাদের রোগব্যাধির চিকিৎসার জন্য যে দোয়া তাবিজ ও ঔষধ ব্যবহার করি এবং বিপদ মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করি, এগুলো কি আল্লাহর তাকদীরকে (নির্ধারিত ব্যবস্থা) ঠেকাতে পারে? তিনি জবাব দিলেন যে, এ সব ব্যবস্থাও তো আল্লাহর তাকদীরেরই অন্তর্ভুক্ত(তিরমিযি)

রাসূলুল্লাহর (সা) জবাবের সারমর্ম এই যে, মহান আল্লাহ আমাদের জন্য এই সব রোগব্যাধি নির্ধারিত করেছেন। সেই আল্লাহই এও স্থির করেছেন যে, এসব রোগব্যাধি অমুক ঔষধ বা চেষ্টা তদবির দ্বারা দূর করা যায়। আল্লাহ তায়ালা রোগের ও স্রষ্টা এবং তা দূর করার ঔষধেরও স্রষ্টা। সবকিছুই আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম নীতি ও বিধিবিধানের আওতাধীন।

তাকদীর আগে থেকেই নির্ধারিত

(আরবী*************************************)

২৬. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। একদিন যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর পেছনে বাহ জন্তুর পিঠে বসে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, হে বালক, আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি। (মনোযোগ দিয়ে শোন) তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখ, তাহলে আল্লাহ তোমাকে স্মরণ রাখবেন। তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখ, তাহলে আল্লাহকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন কোন বিপদে সাহায্য চাইতে হয়, তখন আল্লাহর সাহায্য চাও। আর জেনে রাখ, সমগ্র মানব জাতিও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার ভাগ্য লিপিতে লিখে রেখেছেন। (অর্থাৎ কারো কাছে দেয়ার মত যখন কিছু নেই, তখন কোথা থেকে দেবে? সব কিছু তো আল্লাহর। তিনি যতটুকু কাউকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ততটুকুই সে পায় তা সে যার মাধ্যমেই পাক) আর যদি সমগ্র মানবজাতি একত্র হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তবে তারাও ততটুকুই ক্ষতি করতে পারে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। (সুতরাং তোমার একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভরশীল হওয়া উচিত এবং একমাত্র আল্লাহকেই নিজের সাহায্যকারী মেনে নেয়া উচিত। ) (মেশকাত)

যদি এমন হতো বলা অনুচিত

(আরবী******************************)

২৭. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী ও সবল মুমিন আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয় ও উত্তম। তবে উভয়ের ভেতরেই কল্যাণ আছে। তুমি (আখিরাতের জন্য) উপকারী বস্তুর প্রত্যাশী হও। নিজের সমস্যা সংকটে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং সাহস হারিও না। আর তোমার ওপর কোন বিপদ মুসিবত এলে এভাবে করো না যে, যদি অমুক কাজটি করতাম তাহলে এমন হতো। বরং এভাবে চিন্তা কর যে, আল্লাহ এ রকমই নির্ধারণ করেছেন এবং যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কেননা যদি শব্দটা শয়তানের অপতৎপরতার দরজা খুলে দেয়। (মেশকাত)

ব্যাখ্যা: এই হাদীসের প্রথমাংশের মর্ম এই যে, যে ব্যক্তির দৈহিক ও মেধাগত ক্ষমতা বেশী, সে যদি আল্লাহর পথে সকল শক্তি নিয়োগ ও ব্যয় করে, তাহলে তার হাতে ইসলামের কাজ অনেক বেশী হবে। পক্ষান্তরে যার স্বাস্থ্য খারাপ। কিংবা যার চিন্তাগত ও মেধাগত ক্ষমতা কম। সে আল্লাহর পথে সকল শক্তি ব্যয় করলেও প্রথমোক্ত ব্যক্তির মত অত বেশী কাজ সে করতে পারবে না, তা সহজেই বোধগম্য। তাই দ্বিতীয় ব্যক্তির চাইতে তার পুরস্কার বেশীই প্রাপ্য হওয়ার কথা। অবশ্য দুজনই যেহেতু একই পথ আল্লাহর পথের পথিক। তাই এই দুর্বল মুমিনকে অল্প কাজ করার জন্য পুরস্কার বা প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করা হবে না। আসলে শক্তিশালী মুমিনকে এই বলে উদ্দীপিত করা হচ্ছে যে, তোমাকে যে শক্তি দেয়া হয়েছে, তার কদর কর, এই শক্তি কাজে লাগিয়ে যত অগ্রগতি অর্জন করতে পার, অর্জন কর। কেননা দুর্বলতা এসে যাওয়ার পর মানুষ কিছু করতে চাইলেও করতে পারেনা। হাদীসের শেষাংশের মর্মার্থ এই যে, মুমিন নিজের মেধা ক্ষমতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। বরং সর্বাবস্থায় শুধু আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। তার ওপর যখন মুসিবত আসে, তখন তার মন এভাবে চিন্তা করে যে, এই মুসিবত আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। এটা তো আমার প্রশিক্ষণেরই একটি অংশ। এতে করে তার বিপদ মুসিবত, তার তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আখিরাতের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

কেয়ামতের আযাব থেকে মুক্তি

(আরবী*********************************)

২৮.হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি কিভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে ও আরাম আয়েশের জীবন যাপন করতে পারি যখন শিঙ্গা মুখে নিয়ে কান লাগিয়ে কপাল ঝুঁকিয়ে ইসরাফিল (আ) অপেক্ষায় আছেন, কখন ফুঁক দেয়ার আদেশ দেয়া হবে? (শিঙ্গা হলো বিউগল। যা দ্বারা সেনাবাহিনীকে শত্রুর সংবাদ জানিয়ে সতর্ক করা হয়। কিংবা তাদেরকে সমবেত হবার জন্য তা বাজানো হয়। কেয়ামতের বিউগলের প্রকৃত স্বরূপ একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। ) লোকেরা বললোঃ হে রাসূল!এমতাবস্থায় আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন তোমরা পড় আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি সর্বোত্তম অভিভাবক ও কার্যনির্বাহী। (হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকীল) , (তিরমিযী, আবু সাঈদ খুদরী রা)

রাসূলুল্লাহ (সা) এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর যে অস্থিরতা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছে, তা বুঝতে পেরে সাহাবায়ে কেরাম স্বভাবতই আরো বেশী বিচলিত ও পেরেশান হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনার অবস্থা যখন এই, তখন আমাদের কি উপায় হবে? আমাদেরকে বলে দিন, আমরা কি করলে সেদিন মুক্তি পাব ও সফল হবো। তিনি বললেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। তাঁর অভিভাবকত্বে জীবন যাপন কর ও তাঁর আনুগত্য কর। যারা তাঁকে যথেষ্ট মনে করে ও তার ওপর নির্ভর করে তারাই সফল হবে।

(আরবী********************************)

২৯.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি কেয়ামতকে চাক্ষুষ ঘটনার আকারে দেখতে অভিলাষী, সে যেন তাকভীর, ইনফিতার ও ইনশিকাক এই তিনটে সূরা পড়ে। এই তিনটে সূরায় কেয়ামতের এমন নিখুঁত ছবি আঁকা হয়েছে যে, তা মনমগজে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। (তিরমিযী, ইবনে উমার রা)

(আরবী*****************************************)

৩০. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) আয়াত (আরবী****) সেদিন পৃথিবী তার সমস্ত অবস্থা জানাবে পড়লেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ জান, সমস্ত অবস্থা জানানোর অর্থ কি? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, পৃথিবী কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক নারী বা পুরুষ অমুক দিন অমুক সময়ে তার পিঠের ওপর অমুক ভালো বা মন্দ কাজ করেছে। এই হলো এ আয়াতের মর্ম। মানুষের কৃত কর্মকে আয়াতে অবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (তিরমিযি)

আল্লাহর সামনে উপস্থিতি

(আরবী**************************************)

৩১. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সংগে আল্লাহ সরাসরি কথা বলবেন। (হিসাব নেবেন) সেখানে তার জন্য কোন সুপারিশকারীও থাকবে না। কোন পর্দাও থাকবে না। যার আড়ালে সে লুকাতে পারবে। সে ডান দিকে তাকাবে (কোন সুপারিশকারী ও সাহায্যকারী আছে কিনা খুঁজে দেখার জন্য)। কিন্তু সেখানে নিজের কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছু দেখবে না। তারপর বাম দিকে তাকাবে, সেখানেও নিজের কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছু দেখবে না। তারপর সামনের দিকে তাকাবে, সেদিকে কেবল (সর্ব প্রকারের ভয়ংকর আযাবের দৃশ্য সমেত) দোযখ দেখবে। সুতরাং ওহে লোক সকল, দোযখ থেকে বাচার চেষ্টা কর, একটা খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও। (বোখারী ও মুসলিম, আলী(রা) বর্ণিত)

এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবায়ে কেরামকে আল্লাহর পথে দান করার বিষয়টি শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তাই শুধু এই বিষয়েরই উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, কারো কাছে যদি একটা খেজুর থাকে এবং সে তারই অর্ধেক দেয়, তবে আল্লাহর চোখে তাও মূল্যবান। আল্লাহ সম্পদ কম না বেশী তা দেখেন না। তিনি দেখেন যে ব্যক্তি সম্পদ দান করছে তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কতখানি।

মোনাফেকির ভয়াবহ পরিণাম

(আরবী*****************************************)

৩২. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ কেয়ামতের দিন এক বান্দা আল্লাহর সামনে হাজির হবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে বলবেন হে অমুক, আমি কি তোমাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করিনি! আমি কি তোমাকে স্ত্রী দেইনি?তোমার কর্তৃতে কি উট ও ঘোড়া দেইনি? আমি কি তোমাকে অবকাশ দেইনি যে, শাসন চালাবে ও জনগণের কাছ থেকে কর খাজনা আদায় করবে? সে এই সব নিয়ামত স্বীকার করবে। পুনরায় আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন। তুমি কি বিশ্বাস করতে যে, একদিন তোমাকে আমার সামনে উপস্থিতি হতে হবে? সে বলবে না। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন দুনিয়াতে তুমি যেমন আমাকে ভুলে ছিলে, তেমনি আজ আমি তোমাকে ভুলে থাকবো।

এরপর অনুরুপ আরো একজন (কেয়ামত অস্বীকারকারী) আল্লাহর দরবারে আসবে। তাকেও অনুরুপ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারপর তৃতীয় আর একজন আসবে। আল্লাহ পূর্বোক্ত দুজনকে (কাফের) যেরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, তদ্রূপ তাকেও করবেন। তৃতীয় ব্যক্তি বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমার ওপর, তোমার কিতাবের ওপর এবং তোমার রসূলগণের ওপর ঈমান এনেছিলাম। আমি নামায পড়তাম, রোযা রাখতাম এবং তোমার পথে সম্পদ ব্যয় করতাম। রাসূল (সা) বলেন, এভাবে সে যথাসাধ্য উৎসাহ উদ্যমের সাথে নিজের আরো বহু ভালো কাজের উল্লেখ করবে। তখন আল্লাহ বলবেন যথেষ্ট হয়েছে। এবার আসো। আমি এক্ষুনি তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী ডাকছি। সে মনে মনে ভাববে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, এমন কে আছে? অতঃপর তার মুখকে সিল মেরে বন্ধ করে দেয়া হবে। (কেননা ঐ মুখ দিয়ে সে দুনিয়াতে যেমন রাসূল (সা) ও মুমিনদের সামনে চরম নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার সাথে নিজের মিথ্যা পরহেজগারী ও সততার ঢোল পিটাতো। তেমনি কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনেও মিথ্যা বলতে কুণ্ঠিত হবে না) অতঃপর তার উরু, গোশত ও হাড্ডিগুলোকে তার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এসব জিনিস তার প্রতিটি কাজের প্রকৃত স্বরূপ বর্ণনা করবে ও তার ধোঁকাবাজির মুখোশ খুলে দেবে। এভাবে আল্লাহ তার মিথ্যা বুলি আওড়ানোর দরজা বন্ধ করে দেবেন। রাসূল (সা) বলেনঃ এ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে দুনিয়াতে মোনাফেকি করে বেড়াতো এবং আল্লাহর ক্রোধভাজন ছিল। (মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) বর্ণিত):

(আরবী************************************)

৩৩.হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (সা) কে কোন কোন নামাযে এভাবে দোয়া করতে শুনেছিঃ হে আল্লাহ, আমার কাছ থেকে সহজ হিসাব নিও। আমি জিজ্ঞেস করলাম! হে আল্লাহর নবী সহজ হিসাব নেয়ার অর্থ কি? রাসূল (সা) বললেন, সহজ হিসাব এই যে, আল্লাহ তার বান্দার আমলনামার ওপর নযর বুলাবেন এবং তার মন্দ কাজগুলোকে ক্ষমা করবেন। হে আয়েশা, যার প্রতিটা কাজের খুঁটিনাটি ও সুক্ষ্নাতিসুক্ষ হিসাব নেয়া হবে, তার ভালাই হবে না। (মুসনাদে আহমাদ)

পবিত্র কোরআনে ও বিভিন্ন হাদীসে সুস্পষ্টভাবে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর পথে চলে, বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং সংগ্রাম করতে করতে তাদের আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন এবং সৎকাজের মূল্যায়ন করে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

কেয়ামত মুমিনের জন্য হালকা হবে

(আরবী*********************************)

৩৪. আবু সাঈদ খুদরী(রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর দরবারে উপস্থিত হলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, কেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ঐ দিনের কথা চিন্তা কর যেদিন মানুষ হিসাব কিতাবের জন্য বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হবে। সেই কেয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি দণ্ডায়মান থাকতে পারবে? (যখন একদিন হাজার বছরের সমান হবে) রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন (সেদিনের দুঃসহ কষ্ট অপরাধী ও খোদাদ্রোহীদের জন্য। তাদের কাছে একদিন তাজার বছরের মত মনে হবে। কেননা বিপদাপন্ন মানুষের দিন দীর্ঘ অনুভূত হয়। কোনভাবেই তা শেষ হতে চায়না। ) মুমিনদের জন্য সেদিন হবে হালকা। শুধু হালকাই নয়, ফরজ নামাজের মত আনন্দ ও খুশীর ব্যাপার। (মেশকাত)

মুমিনের কল্পনাতীত পুরস্কার

(আরবী*********************************)

৩৫. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি আমার সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও পুণ্যবান বান্দাদের জন্য এমন সব নেয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষের হৃদয় কল্পনাও করতে পারেনি। মনে চাইলে তোমরা এ আয়াতটি পড়তে পার কেউ জানে না, পুণ্যবান বান্দাদের জন্য কত আনন্দ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যা পরকালে পাওয়া যাবে। (বোখারী, মুসলিম)

বেহেশতের একটুখানি জায়গাও মূল্যবান

(আরবী*********************************)

৩৬. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ জান্নাতে একটা ছড়ি রাখবার মত জায়গাও সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় সহায় সম্পদের চেয়ে উত্তম। (বোখারী, মুসলিম)

ছড়ি রাখার মত জায়গা দ্বারা সেই অতিক্ষুদ্র জায়গা বুঝানো হয়েছে, যেখানে মানুষ কোন রকমে নিজের বিছানা বিছয়ে পড়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন অনুসারে চলতে গিয়ে কারো দুনিয়া যদি নষ্ট হয়ে যায়। সমস্ত সহায় সম্পদ খোয়া যায় এবং তার পরিবর্তে জান্নাতের অতি সামান্য একটু জায়গাও পেয়ে যায়। তবে তাও তার জন্য একটা বিরাট প্রাপ্তি। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জিনিস কুরবানী দেয়ার প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ তাকে এমন জিনিস দিলেন, যা চিরস্থায়ী অক্ষয়।

দুনিয়া ও আখিরাতের সুখ দুখের তুলনা

(আরবী************************************************)

৩৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কেয়ামতের দিন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এমন এক ব্যক্তিকে ডাকা হবে, যার দোযখে যাওয়া অবধারিত হয়ে গেছে। তাকে দোযখে ফেলে দেয়া হবে। যখন আগুন তার সমস্ত শরীরকে দগ্ধ করবে, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য দেখেছ? তুমি কি সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম আয়েশ উপভোগ করেছ? সে বলবে, হে আমার প্রভু, তোমার কসম, কখনো নয়। এরপর এমন একজনকে ডাকা হবে যে, জান্নাতের অধিবাসী হবে। কিন্তু পৃথিবীতে সে ছিল চরম অসচ্ছলতা ও শোচনীয়তম অভাব অনটনের শিকার। সে যখন জান্নাতের সুখ ও আরাম আয়েশে বিভোর হবে, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো দারিদ্র ও অভাব অনটন দেখেছ? তোমার ওপর কি কখনো দুঃখ কষ্টের দিন অতিবাহিত হয়েছে? সে বলবে না, হে আমার প্রতিপালক, আমি কখনো অভাব অনটনের মুখ দেখিনি। কখনো পরমুখাপেক্ষী হইনি এবং আমি কষ্টের কোন যুগ কখনো দেখিনি। (মুসলিম)

জান্নাত ও জাহান্নামের আসল পার্থক্য

(আরবী***********************************)

৩৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন প্রবৃত্তির লালসা জাহান্নামকে এবং অনাকাংখিত দুঃখ কষ্ট জান্নাতকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। (বোখারী, মুসলিম)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির পূজা করবে এবং দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ ও আনন্দ লাভের চেষ্টায় মত্ত হবে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর যে ব্যক্তি জান্নাতের অভিলাষী হবে, সে দ্বীনের খাতিরে কাঁটা ছাড়ানো পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা করবে না এবং আল্লাহর জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে তাকে যে কোন কঠিন পরিশ্রম ও অবাঞ্ছিত কষ্টকর পন্থা অবলম্বনে বাধ্য করবে। এই কষ্টকর ঘাটি অতিক্রম না করে চির সুখের আবাস জান্নাতে পৌছার কোনই সুযোগ নেই।

জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে সচেতনতা

(আরবী***************************)

৩৯. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি জাহান্নামের মত এমন ভয়ংকর আর কোন জিনিস দেখিনি, যা থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য পলায়নপর মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। আর জান্নাতের মত এত ভালো জিনিস আর দেখিনি। যার অভিলাষ পোষণকারী ঘুমিয়ে থাকে। (তিরমিযি)

এর তাৎপর্য এই যে, কোন ভয়ংকর জিনিস দেখার পর মানুষের চোখে ঘুম থাকে না। সে ঐ জিনিসের কাছ থেকে দূরে পালায়। যতক্ষণ তা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ সে ঘুমায়না।

অনুরুপ কেউ যদি কোন ভালো জিনিসের অভিলাষী হয়, তবে তা অর্জন না করা পর্যন্ত সে ঘুমায়ওনা, বিশ্রামও নেয়না। দুনিয়ার একটা সাধারণ ভালো ও মন্দ জিনিসের ব্যাপারে যখন মানুষের অবস্থা এরূপ, তখন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জিনিস জান্নাতের অভিলাষী কিভাবে ঘুমায়?আর সবচেয়ে খারাপ জিনিস জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার চিন্তা করে না কেন? যে ব্যক্তি কোন জিনিসের আশংকা করে, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না। আর কোন ভালো জিনিস অর্জনের তীব্র আকাংখা যার থাকে, সে তা অর্জন না করে বিশ্রাম নিতে পারে না।

বিদয়াতকারী হাউজে কাউসারের পানি পাবে না

(আরবী*******************************************)

৪০.রাসূলুল্লাহ (সা) (স্বীয় উম্মতকে সম্বোধন করে) বলেছেন আমি তোমাদের সবার আগে হাউজে কাউসারে পৌঁছে তোমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবো এবং তোমাদেরকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করবো। যে ব্যক্তি আমার কাছে আসবে, সে পানি পান করবে। আর যে ব্যক্তি সেই পানি পান করবে, তার আর কখনো পিপাসা লাগবে না। তবে এমন কিছু লোকও আমার কাছে আসবে, যাদেরকে আমি চিনবো এবং তারাও আমাদেরকে চিনবে। কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেয়া হবে না। তখন আমি বলবো, ওরা আমার লোক। (ওদেরকে আমার কাছে আসতে দাও। ) জবাবে আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না। আপনার ইন্তিকালের পর তারা ইসলামের কত নতুন জিনিস (বিদআত ) ঢুকিয়েছে। একথা শুনে আমি বলবো দূর হয়ে যাক, দূর হয়ে যাক, যারা আমার পর ইসলামের কাঠামোতে পরিবর্তন সাধন করেছে। (বোখারী, মুসলিম, সাহল ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত)

এ হাদীসের ভিতরে চমকপ্রদ সুসংবাদও আছে। আবার ভয়াবহ দুঃসংবাদও। সুসংবাদ এই যে, যারা রাসুলুল্লাহ (সা) এর আনিত দ্বীনকে কোন কমবেশী না করে হুবহু গ্রহণ করেছে ও তদনুসারে কাজ করেছে, তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) হাউজে কাউসারে অভ্যর্থনা জানাবেন। আর যারা জেনে বুঝে ইসলামের ভেতরে ইসলামের অংশ আখ্যায়িত করে এমন সব নতুন জিনিস ঢুকাবে, যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পৌছতে পারবে না এবং হাউজে কাউসারের পানি পান করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

রাসূলের শাফায়াত পাওয়ার শর্ত

(আরবী***************************)

৪১. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত বা সুপারিশ লাভের সৌভাগ্য সেই ব্যক্তি সর্বাধিক অর্জন করবে যে অন্তরের পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা সহকারে বলবেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। (বোখারী)

রাসূল (সা) এর এ উক্তি শাব্দিক দিক দিয়ে খুবই চোট হলেও মর্মগত দিক দিয়ে খুবই ব্যাপক। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওহীদকে গ্রহণ করেনি, ইসলামকে কবুল করেনি এবং শেরকের নোংরামিতে পড়েই রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহর (সা) শাফায়াত লাভ করবে না। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি মুখ দিয়ে তো কলেমা পড়লো এবং দৃশ্যত ইসলামে প্রবেশ করলো, কিন্তু মন থেকে তাকে সঠিক বলে বিশ্বাস করলো না। সেও রাসূলুল্লাহর (সা) শাফায়াত থেকে বঞ্চিত থাকবে। রাসূল (সা) শুধু তাদের জন্য শাফায়াত করবেন, যারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঈমান আনবে এবং তাওহীদের সত্যতা ও অকাট্যতায় অবিচল প্রত্যয় পোষণ করবে। যেমন অন্য এক হাদীসে (আরবী****) তার অন্তর দৃঢ় প্রত্যয়শীল থাকবে, কথাটা এসেছে। এই সাথে এ কথাও স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, বিশ্বাস মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। নিজের শিশু সন্তান কুয়ায় পড়ে গেছে এই খবর কোন ব্যক্তিই যখনই পায় এবং এই খবরে যখনই তার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে, তখনই সে প্রবল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যায়। একনিষ্ঠ ঈমানের অবস্থাও তদ্রূপ। এ ঈমান মানুষের ভেতর পরকালীন মুক্তির ভাবনা জাগায় এবং কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

কেয়ামতের দিন আত্নীয়তার বন্ধন নিষ্ফল

(আরবী***********************************)

৪২. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত (যখন সূরা শুয়ারার আয়াত (আরবী*****) তোমার নিকটতম আত্মীয়গণকে সতর্ক কর নাযিল হলো, তখন) কোরাইশ জনগণকে সমবেত করে রাসূল (সা) বললেন হে কোরাইশ, নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার চিন্তা কর। আমি তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর আযাব এতটুকুও হঠাতে পারবোনা। হে আবদ মানাফের বংশধর, আমি তোমাদের ওপর থেকে আল্লাহর আযাব একটুও হঠাতে পারবোনা। হে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে আব্বাস, (রাসূলের আপন চাচা) আমি আল্লাহর আযাবকে তোমাদের ওপর থেকে একটুও হঠাতে পারবোনা। হে সুফিয়া (রা) (রাসুলের আপন ফুফু) আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব থেকে একটুও রক্ষা করতে পারবোনা। হে আমার মেয়ে ফাতেমা, তুমি আমার অর্থ সম্পদ থেকে যত চাও দিতে পারি। কিন্তু আল্লাহর আযাব থেকে তোমাকে রেহাই দিতে পারবো না। (কাজেই নিজেকে রক্ষা করার ভাবনা নিজেই কর। কেননা পরকালে প্রত্যেকের নিজের ঈমান, আমল চাড়া আর কিছুই কাজে আসবে না। ) (বোখারী, মুসলিম)

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্নসাতের ভয়াবহ পরিণাম

(আরবী************************************)

৪৩.হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি গনিমতের মালের (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) চুরি সংক্রান্ত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পেশ করলেন। তারপর বললেনঃ আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা উট উচ্চস্বরে চিৎকার করছে। আর সে বলছে হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে সাহায্য করুন। (অর্থাৎ আমার গুনাহর এই শোচনীয় পরিণতি থেকে আমাকে রক্ষা করুন) তখন আমি বলবো, আমি তোমাকে একটুও সাহায্য করতে পারবো না। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই এ কথা জানিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা ঘোড়া চিহি চিহি করছে। আর সে বলছেঃ হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলবো আমি তোমাকে কোনই সাহায্য করতে পারবো না আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা ছাগল ব্যা ভ্যা করছে। আর সে বলছে, হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাকে জবাব দেবো যে, আমি তোমার জন্য এখানে কিছুই করতে পারবো না। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই সমস্ত বিধি জানিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেকতে চাই না যে তার ঘাড়ের ওপর একজন মানুষ চড়াও হয়ে বসে চিৎকার করছে। আর সে বলছে, হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলবো, আমি তোমাকে এখন কোন সাহায্য করতে পারবোনা। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর কাপড়ের টুকরো উড়ছে। আর সে বলছেঃ হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তখন বলবো যে, আমি তোমার জন্য এখন কিছুই করতে পারবো না। আমি তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই সাবধান করে এসেছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এ অবস্থায় দেখতে চাই না যে, তার ঘাড়ের ওপর সোনরুপা চাপানো রয়েছে এবং সে বলছেঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তার জবাবে বলবো, আমি তোমার গুনাহর পরিণতিকে একটুকুও হঠাতে পারবোনা। আমি তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পৌছিয়ে দিয়ে এসেছি। (বোখারী, মুসলিম)

পশুরি কথা বলা ও কাপড়ের টুকরো উড়তে থাকা ইত্যাদির অর্থ হলো, গনিমতের মাল চুরির সংক্রান্ত এ সব অপকর্ম ও অপরাধ কেয়ামতের দিন লুকানো সম্ভব হবে না। প্রত্যেকটি পাপ চিৎকার করে করে বলতে থাকবে যে, সে অপরাধী। আর এটা শুধু গনিমতের মাল চুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রত্যেক বড় বড় গুনাহর অবস্থা এ রকমই। আল্লাহর অমন ভয়ংকর পরিণতি থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে রক্ষা করুন এবং খারাপ সময় আসার আগে তওবা করার তৌফিক দিন।

এবাদত

নামায দ্বারা গোনাহ মোচন হয়

(আরবী****************************)

৪৪. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তোমাদের কারো বাড়ীর সামনে যদি একটা নদী থাকে এবং তাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তাহলে বলতো তার শরীরে কি কিছুমাত্র ময়লা থাকতে পারে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, না, তার দেহে এক বিন্দুও ময়লা থাকতে পারেনা। রাসূল (সা) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যাপাটাও তদ্রূপ। আল্লাহ তায়ালা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায দ্বারা গুনাহগুলো মোচন করেন। (বোখারী, মুসলিম)

এ হাদীস দ্বারা নবী (সা) এ সত্য স্পষ্ট করে দিলেন যে, নামায মানুষের গুনাহ মাফ হবার মাধ্যম ও উপলক্ষ হয়ে তাকে। এ বিষয়টাকে তিনি একটা সহজ বোধ্য উদাহরণ দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছেন। নামায দ্বারা মানুষের মনে কৃতজ্ঞতার এমন অবস্থা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয় যে, তার ফলে সে আল্লাহর আনুগত্যের পথে ক্রমাগতভাবে ও অব্যাহতভাবে অগ্রসর হতে থাকে এবং নাফরমানী থেকে তার মনমগজ দূরে সরে যায়। এমনকি তার দ্বারা যদি কখনো কোন ভুলত্রুটি হয়েও থাকে, তবে তা সে জেনে বুঝে করেনা। ভুলত্রুটি সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথেই সে আপন প্রতিপালকের সামনে লুটিয়ে পড়ে ও কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চায়।

(আরবী**********************)

৪৫.(ক) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি জনৈকা অচেনা মহিলাকে চুমু খেল। অতঃপর সে রাসূল (সা) এর কাছে উপস্থিত হলো এবং তাকে তার কৃত এই গুনাহর সংবাদ জানালো। তৎক্ষণাৎ এ আয়াত নাযিল হলো এবং রাসূল (সা) তা পড়ে শোনালেন।

(আরবী*************)

অর্থাৎ দিনের দুই প্রান্ত ভাগে নামায পড় এবং রাতেরও কোন কোন অংশে।

নিশ্চয়ই সৎকাজ মন্দ কাজকে মোচন করে। এ কথা শুনে লোকটা বললোঃ এটা কি শুধু আমার জন্য নির্দিষ্ট? তিনি বললেনঃ না, আমার উম্মাতের সকলের জন্য। (বোখারী, মুসলিম)

এ হাদীস দ্বারা উপরোক্ত হাদীসের অধিকতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যাতে বলা হয়েছে যে, নদীর পানির দ্বারা গোসল করলে শরীরের ময়লা ধুয়ে যায়। তেমনি নামায দ্বারা পাপ মোচন হয়। এ হাদিসটিতে যে ব্যক্তির উল্লেখ করা হয়েছে, সে একজন ঈমানদার লোক ছিল। সে স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে ও জেনে বুঝে পাপ কার্য্য করতো না। কিন্তু মানবীয় দুর্বলতাবশত পথিমধ্যে আবেগের তাড়নায় সংযম হারিয়ে জনৈকা অচেনা মহিলাকে চুমু খেয়ে বসলো। এতে সে এত পেরেশান ও অনুতপ্ত হয়ে যে, সে রাসূল (সা) এর কাছে এসে বরে যে, আমি একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছি। আমাকে শাস্তি দেয়া হোক। রাসূল (সা) সূরা হুদের শেষ রুকুর উপরোক্ত আয়াতটি তাকে শোনালেন, যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে দিনের ও রাতের বিভিন্ন সময়ে নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন। তারপর আয়াতে বলা হয়েছে (আরবী****) সৎকাজগুলো মন্দ কাজগুলোকে বিনষ্ট করে দেয় এবং মন্দ কাজগুলোর কাফফারায় পরিণত হয়। এতে লোকটি আশ্বস্ত হলো ও তার অস্থিরতা দূরীভূত হলো । এ দ্বারা অনুমিত হয় যে, রাসূল (সা) স্বীয় সাহাবীগণকে কত উঁচুমানের প্রশিক্ষণ দিতেন।

নামায দ্বারা গুনাহ মোচনের শর্ত

(আরবী**********************************)

৪৫.(খ) রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ও যথাযথভাবে ওযু করে নির্ধারিত সময়ের ভেতরে নামায আদায় করে। রুকু ও সিজদা সঠিকভাবে করে এবং নামাযের মধ্যে আল্লাহর দিকে মন ঝুঁকিয়ে রাখে। আল্লাহ তায়ালা তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে ব্যক্তি এরূপ করে না তার জন্য আল্লাহ তায়ালা এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন না। ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন, ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দেবেন। (আবু দাউদ)

(আরবী***********************************)

৪৬.আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূল (সা) নামাযের আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, যে ব্যক্তি সঠিকভাবে নিজের নামাযের তত্ত্বাবধান করবে, তার জন্য কেয়ামতের দিন নামায আলো ও দলীল প্রমাণে পরিণত হবে এবং মুক্তির কারণ হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের নামাযগুলোর তত্ত্বাবধান করবে না, তার নামায তার জন্য আলোও হবে না। দলীল প্রমাণও হবে না এবং মুক্তির কারণ হবে না।

এ হাদীসে মোহাফাযাত শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ তদারকী, তত্ত্বাবধান, লক্ষ্য রাখা ও দেখাশুনা করা। এর মর্মার্থ এই যে, একজন নামাযীর সর্বক্ষণ লক্ষ্য রাখা কর্তব্য যে, সে সঠিকভাবে ওযু করেছে কিনা, নামাযের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নামায পড়ছে কিনা, রুকু সজদা যথাযথ করছে কিনা এবং সর্বোপরি নামাযের মধ্যে তার মনের অবস্থা কেমন ছিল। মন কি আল্লাহর দিকে ছিল, না দুনিয়াবি কাজ কারবার ও চিন্তাভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত ও ঘূর্ণায়মান ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে ব্যক্তি এভাবে নিবিড় তদারকীর মধ্য দিয়ে নামায পড়েছে এবং তার মন নামাযে সর্বক্ষণ আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট থেকেছে, সে জীবনের অন্যান্য কাজ কর্মেও আল্লাহর অনুগত বান্দা হবার চেষ্টা করবে এবং এরই ফলে আখিরাতে সফল হবে।

মুনাফিকের নামায

(আরবী************************************)

৪৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মোনাফেকের নামায এরকম হয়ে থাকে যে, সে বসে বসে সূর্যর গতিবিধি দেখতে থাকে। অবশেষে যখন সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং মোশরেকদের সূর্য পূজার সময় সমাগত হয়। তখন সে ধড়মড় করে ওঠে এবং পড়িমরি করে চার রাকায়াতের বারটা ঠোকর মারে। (ঠিক যেমন মুরগী মাটিতে চঞ্চু দিয়ে ঠোকর মারে এবং তৎক্ষণাৎ চঞ্চু তুলে আনে) নামাযে আল্লাহকে মোটেই স্মরণ করে না। (মুসলিম)

এ হাদীস দ্বারা মোমেন ও মোনাফেকের নামাযের পার্থক্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোমেন সময়মত নামায পড়ে, রুকু সিজদা ঠিকমত করে এবং তার মন আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে মোনাফেক যথাসময়ে নামায পড়েনা। রুকু সিজদা যথাযথভাবে করে না এবং তার মন আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট থাকে না। সাধারণভাবে সব নামাযই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফজর ও আসরের গুরুত্ব একটু বেশী। আসরের সময়টা অবহেলা ও উদাসীনতার সময়। মানুষ কায়কারবারে ব্যস্ত থাকে। রাত হওয়ার আগে কেনা বেচা শেষ করে নিতে এবং ছড়িয়ে থাকা কাজগুলোকে গুটিয়ে আনতে চায়। এ জন্য মুমিনের মন সতর্ক ও সচেতন না হলে আসরের নামায বিপন্ন তথা কাযা হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। ফজরের নামাযের গুরুত্বের কারণ এই যে, ওটা ঘুমের সময়। রাতের শেষ ভাগের ঘুম কত গভীর হয় ও কত মিষ্টি লাগে তা সবাই জানে। মানুষের অন্তরে যদি জীবন্ত ঈমান না থাকে, তাহলে অমন মজার ও প্রিয় ঘুম ছেড়ে সে আল্লাহর সে আল্লাহর স্মরণের জন্য উঠতে পারে না।

ফজর ও আসরের নামাযের জামায়াতে ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ

(আরবী************************)

৪৮. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ রাত ও দিনের যে সব ফেরেশতা পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকে, তারা নিজেদের দায়িত্বের পালা বদলের জন্য ফজর ও আসরের নামাযে একত্রিত হয়। যে সকল ফেরেশতা তোমাদের মধ্যে কর্মরত ছিল, তারা যখন আপন প্রতিপালকের নিকট চলে যায়, তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার বান্দাকে কি অবস্থায় রেখে এসেছে? তারা বলেঃ যখন আমরা তাদের কাছে পৌঁছেছিলাম, তখনও তাদেরকে নামাযরত অবস্থায় পেয়েছিলাম। আর যখন তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি তখনও তাদেরকে নামাযরত অবস্থায় দেখে এসেছি। (বোখারী, মুসলিম)

এ হাদীস ফজর ও আসরের গুরুত্ব খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে। ফজরের নামাযে দায়িত্ব পালন করবে, তারাও যোগদান করে। আর যে ফেরেশতারা দিনের বেলায় দায়িত্ব পালন করবে, তারাও যোগদান করে। অনুরূপভাবে আসরের নামাযেও বিদায়ী ও নবাগত উভয় শ্রেণীর ফেরেশতারা যোগদান করে। মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে যে, তার ফেরেশতাদের সাথে নামায আদায় করার সুযোগ পায়।

নামাযের হেফাজত ছাড়া দ্বীনের হেফাজত অসম্ভব

(আরবী***************************)

৪৯. হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তার সকল প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে লিখেছিলেন যে, তোমাদের যাবতীয় কাজের মধ্যে আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে নামায। যে ব্যক্তি নিজের নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং তার ওপর দৃষ্টি রাখবে, সে তার গোটা দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হবে। সে নামায ছাড়া অন্যান্য দ্বীনি কাজের রক্ষণাবেক্ষণে আরো বেশী ব্যর্থ হবে। (মেশকাত)

কেয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে যারা

(আরবী***********************************)

৫০.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবেনা, সেদিন আল্লাহ তায়ালা সাত ধরনের মানুষকে নিজের ছায়ায় নীচে স্থান দেবেন। (১) ন্যায় বিচারক নেতা ও শাসক (২) যে যুবকের যৌবনকাল আল্লাহর এবাদত ও হুকুম পালনে অতিবাহিত হয় (৩) যে ব্যক্তির মন মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে। একবার মসজিদ থেকে বের হলে আবার মসজিদে প্রবেশ করার সময়ের অপেক্ষায় থাকে। (৪) যে দুই ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব করে, এই প্রেরণা নিয়েই একত্রিত হয় এবং এই প্রেরণা নিয়েই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। (৫) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং অশ্রু বিসর্জন করে। (৬) যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরমা সুন্দরী মহিলা ব্যভিচারের আহবান জানায় এবং সে শুধু আল্লাহর ভয়ে সেই আহবানকে প্রত্যাখ্যান করে। (৭) যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার বাম হাতও জানেনা ডান হাত কি দান করছে। (বোখারী ও মুসলিম)

লোক দেখানো এবাদত শিরকের শামিল

(আরবী************************************)

৫১. হযরত শাদ্দাদ বিন আওস (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে সে শিরকে লিপ্ত হয়। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোযা রাখে সে শিরক করে এবং যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করে সে শিরক করে। (মুসনাদে আহমাদ)

এ উক্তি দ্বারা রাসূল(সা) বলতে চান, যে কোন সৎকাজই করা হোক, তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই করা উচিত। নিয়ত শুধু এই হবে যে, এটা আমার প্রতিপালকের নির্দেশ। আমি শুধু তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই এ নির্দেশ পালন করছি। অন্যদের চোখে পুণ্যবান বলে খ্যাত হওয়া এবং অন্যদেরকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে যে সৎকাজ করা হবে তার কোন মূল্য নেই। মূল্য আছে শুধু সেই কাজের, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হবে।

জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা

(আরবী*********************************)

৫২.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি শরীয়ত সম্মত ওজর ছাড়া মুসলমানদের জামায়াত থেকে পৃথক একাকী নামায পড়ে, তার নামায অপেক্ষা জামায়াতের নামায সাতাইশ গুণ বেশী মর্যাদার অধিকারী। (বোখারী, মুসলিম)

এ হাদীসে ফায শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ একাকী ও বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থানকারী। জামায়াতের নামায়ে সকল ধরনের মুসলমান অংশ গ্রহণ করে। ধনী, গরীব, দামী ও সুন্দর পোশাকধারী এবং পুরানো ছেড়া ফাটা কাপড় পরিধানকারী সবাই। যারা আভিজাত্য ও ধন ঐশ্বর্যর অহংকারে মত্ত থাকে, তারা পছন্দ করে না যে, তাদের সাথে কোন গরীব মানুষ নামাযে দাঁড়াক। তাই তারা নামায একাকী বাড়ীতে পড়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) এই মানসিক রোগের চিকিৎসার্থে আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা জামায়াতের সাথে নামায পড়, নিজের ঘরে বা মসজিদে একা একা নামায পড়েনা।

এ কথাও জানা দরকার যে, সাধারণত জামায়াতের সাথে নামায পড়ায় শয়তানের কু প্ররোচনা সৃষ্টির অবকাশ খুবই কম থাকে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক মজবুত হয়। এ কারনেই রাসূল (সা) এর ঘোষণা অনুসারে জামায়াতে নামাযের মর্যাদা সাতাইশ গুন বেশী। পরবর্তী ৫৩ নং হাদীসেও এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

(আরবী*****************************************)

৫৩.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে যে নামায আদায় করে, তা তার একাকী পড়া নামাযের চেয়ে অধিকতর ঈমানী প্রেরণা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক। আর যে নামায সে দুজনের সাথে পড়ে, তা একজনের সাথে পড়া নামাযের চেয়ে বেশী ঈমানোদ্দীপক। এভাবে যত বেশী লোকের সাথে নামায পড়া হবে ততই তা আল্লাহর কাছে প্রিয় হবে। (আবু দাউদ)

অর্থাৎ ততই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত হবে। বিনা জামায়াতে নামায পড়লে শয়তানের প্রভাব জোরদার হয়।

(আরবী*********************************)

৫৪. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে জনপদে বা গ্রামে তিনজন মুসলমান বাস করে অথচ তারা জামায়াতের সাথে নামায পড়ে না, সেই গ্রাম বা জনপদের অধিবাসীদের ওপর শয়তান বিজয়ী হয়। সুতরাং তুমি জামায়াতের সাথে নামায পড়াকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক বানিয়ে নাও। মনে রেখ, বাঘ সেই ছাগলেরই ঘাড় মটকায়, যে তার রাখাল থেকে দূরে ও পাল থেকে আলাদা থাকে। এ হাদীসের মর্মার্থ এই যে, জামায়াতবদ্ধভাবে নামায আদায়কারীদের ওপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয় এবং তিনি তাদের হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু কোন জনপদে যদি জামায়াতবদ্ধভাবে নামায পড়ার ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে আল্লাহ সেই জনপদবাসীর হেফাজত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেন। ফলে তারা শয়তানের কর্তৃত্বে চলে যায়। তারপর সে তাদেরকে যেভাবে ইচ্ছা শিকার করে এবং যেদিকে ইচ্ছা চালায়। উদাহরণস্বরূপ, ছাগলের পাল যতক্ষণ রাখালের নিকটে থাকে, ততক্ষণ তার ওপর দুদিক থেকে প্রহরা থাকে। প্রথমত রাখালের প্রহরা, দ্বিতীয়ত নিজেদের একতা। এই দুটি কারণে বাঘ তাদেরকে শিকার করতে পারে না। কিন্তু কোন নির্বোধ ছাগল যদি তার রাখালে মর্জির বিরুদ্ধে পাল থেকে বেরিয়ে যায় ও পেছনে একাকী পড়ে থাকে, তবে বাঘ অতি সহজেই তাকে শিকার করে। কেননা একে তো একাকী হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপরন্তু রাখালের হেফাজত থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করেছে।

বিনা ওজরে জামায়াত ত্যাগ করলে নামায কবুল হয় না।

(আরবী********)

৫৫. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আযান শুনলো এবং তার এমন কোন ওজর নেই, যা তাকে তৎক্ষণাৎ আযানের ডাকে সাড়া দিতে বাধা দেয়, সে ব্যক্তি যদি একাকী নামায পড়ে তবে সে নামায কুবল হবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ ওজর দ্বারা কি বুঝানো হচ্ছে? তিনি বললেনঃ ভয় অথবা রোগ।

এখানে ভয় দ্বারা প্রাণনাশের ভয় বুঝানো হয়েছে। চাই কোন শত্রুর কারণে হোক অথবা হিংস্র প্রাণী বা সাপের কারণে হোক। আর রোগ দ্বারা এমন শারীরিক অবস্থা বুঝানো হয়েছে, যার কারণে মসজিদ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়না। প্রবল ঝড়ো বাতাস, বৃষ্টি বা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডাও ওজর হিসাবে গণ্য। তবে শীত প্রধান দেশে ঠাণ্ডা ওজর হিসেবে গণ্য নয়। বরঞ্চ গরম দেশে কখনো কখনো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে এবং তাতে প্রাণনাশের আশংকা থাকে। এ ধরণের ঠাণ্ডা ওজর হিসাবে গণ্য। অনুরুপ ঠিক নামাযের সময়ে যদি পেশাব বা পায়খানা প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সেটিও ওজরের অন্তর্ভুক্ত।

মসজিদে জামায়াতে নামায পড়া বিধিবদ্ধ সুন্নাত

(আরবী*************************************)

৫৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ (রাসুল (সা) এর যুগে আমাদের অবস্থা ছিল এ রকম যে, মোনাফেক হিসাবে সুপরিচিত অথবা রোগী চাড়া আমাদের আর কেউ জামায়াতবদ্ধ নামায থেকে পিছিয়ে থাকতো না। এমনকি রোগীও দুজন লোকের সাহায্যে মসজিদে পৌছাতো এবং জামায়াতে অংশ গ্রহণ করতো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আরো বলেন, রাসূল(সা) আমাদেরকে সুন্নাতুল হুদা (বিধিবদ্ধ সুন্নাত) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যে মসজিদে আযান দেয়া হয়, সে মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়াও সুন্নাতুল হুদার অন্তর্ভুক্ত। (সুন্নাতুল হুদা বা বিধিবদ্ধ সুন্নাত বলা হয় আইনগত মর্যাদার অধিকারী সুন্নাতকে। যা করার জন্য উম্মাতকে আদেশ দেয়া হয়েছে। ) অপর এক বর্ণনা মতে তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন অনুগত ও ফরমাবরদার বান্দা হিসাবে আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চায়, সে যেন এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায সেই মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে আদায় করে, যেখান থেকে আযান দেয়া হয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নবীকে বিধিবদ্ধ সুন্নাত শিখিয়েছেন এবং এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায বিধিবদ্ধ সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা যদি মোনাফেকদের মত (মসজিদের পরিবর্তে নিজ নিজ বাড়ীতে নামায পড়, তাহলে তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করবে। আর নবীর সুন্নাত ত্যাগ করলে তোমরা বিপথগামী হয়ে যাবে। (মুসলিম)

ইমামতি

ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব

(আরবী****************************)

৫৭. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ইমাম জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন আমানতদার। হে আল্লাহ, ইমামদেরকে সৎ বানাও এবং মুয়াজ্জিনদেরকে ক্ষমা কর। (আবু দাউদ)

ইমামকে যামিন বা যিম্মাদার বলার তাৎপর্য এই যে, ইমাম জনগণের নামাযের জন্য দায়ী। সে যদি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ না হয়, তাহলে সবার নামায নষ্ট করে দেবে। এ জন্য রাসূল (সা) দোয়া করেন যে, হে আল্লাহ, ইমামদেরকে নেকার ও সৎ বানাও। মুয়াজ্জিনের আমানতদার হবার অর্থ হলো, লোকেরা তাদের নামাযের বিষয়টা তার হাতে সমর্পণ করেছে। তার দায়িত্ব সময় মত আযান দেয়া, যাতে লোকেরা আযান শুনে নামাযের প্রস্তুতি নিতে পারে এবং ধীরে সুস্থে জামায়াতে শরীক হতে পারে। সময় মত আযান দেয়া না হলে আশংকা থাকে যে, বহু লোক জামায়াত থেকে হয় বঞ্চিতই হয়ে যাবে, নতুবা দুই এক রাকায়াত ছুটে যাবে। এ হাদীসে একদিকে তো ইমাম ও মুয়াজ্জিনদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। অপরদিকে মুসলমানদেরকে আদেশ দেয়া হচ্ছে যেন সৎ ও পরহেজগার লোক দেখে ইমাম নিয়োগ করে এবং দায়িত্ব সচেতন লোক দেখে মুয়াজ্জিন নিয়োগ করে।

জামায়াতবদ্ধ নামায সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত

(আরবী*****************************************)

৫৮.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ ইমামতি করে তখন (পরিস্থিতি ও নামাযীদের অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে) সে যেন হালকা নামায পড়ায়। কেননা তোমাদের পেছনে দুর্বল, রোগী ও বৃদ্ধ নামাযী থাকতে পারে। অবশ্য তোমাদের কেউ যখন একাকী নামায পড়ে তখন যত লম্বা নামায পড়তে চায় পড়তে পারে। (বোখারী, মুসলিম, আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত)

(আরবী******************************************)

৫৯.হযরত আবু মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা) এর নিকট এল। সে বললোঃ অমুক ইমাম ফজরের নামায অত্যন্ত লম্বা করে পড়ায়। তার কারণে আমি ফজরের জামায়াতে দেরীতে পৌঁছাই। (আবু মাসউদ বলেন) আমি বক্তৃতা ও উপদেশ দানরত অবস্থায় রাসূল (সা) কে এত রাগান্বিত হতে আর কখনো দেখিনি যতটা সেদিন দেখলাম। তিনি বললেনঃ হে জনতা, তোমাদের মধ্যে কিছু ইমাম এমন আছে যারা আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর এবাদতের প্রতি বিরক্ত ও তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সাবধান!তোমাদের যে করে ইমামতি করবে, সে যেন নামাযকে সংক্ষিপ্ত করে। কেননা তার পেছনে বৃদ্ধও থাকতে পারে, বালকও থাকতে পারে এবং কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া আছে এমন লোকও থাকতে পারে। (বোখারী, মুসলিম)

নামায সংক্ষিপ্ত করার অর্থ এটা নয় যে, তাড়াহুড়ো করে ত্রুটিপূর্ণ নামায পড়িয়ে দিতে হবে এবং চার রাকায়াত নামায দু এক মিনিটে সেরে দেবে। এ ধরনের নামায ইসলাম সম্মত নামায নয়। তবে নামাযীদের সময় ও অবস্থার দাবী বিবেচনায় আনা দরকার।

ইমামের কিরাত সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়

(আরবী*******************************************)

৬০.হযরত জাবের(রা) বর্ণনা করেন যে, হযরত মুয়ায বিন জাবাল রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে (মসজিদে নববীতে নফলের নিয়তে) নামায পড়তেন। এরপরে বাড়ীতে যেয়ে পুনরায় নিজ গোত্রের লোকদের জামায়াতে ইমামতি করতেন। একদিন এশার নামায রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাথে পড়লেন। তারপর নিজ গোত্রের জামায়াতে গিয়ে পুনরায় ইমামতি করলেন এবং সূরা বাকারা পড়া শুরু করলেন। এক ব্যক্তি সালাম ফিরিয়ে নামায ছেড়ে দিল এবং পৃথকভাবে নিজের নামায পড়ে বাড়ী চলে গেল। অন্যান্য নামাযীরা (নামায শেষে ) তাকে বললোঃ তুমি তো মোনাফেক সুলভ কাজ করেছ। সে বললোঃ না, আমি মোনাফেক সুলভ কাজ করিনি। আল্লাহর কসম, আমি রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে যাবো(এবং মুয়াযের লম্বা কিরাতের কথা জানাবো) সে গিয়ে বললোঃ হে রাসুলুল্লাহ, আমরা উপ দিয়ে পানি আনাই(পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের ক্ষেতখামার ও বাগানের পানি সিঞ্চনের কাজ করি। ) দিনভর এ কাজ করে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে যাই। আর মুয়ায এশার নামায একবার আপনার সাথে পড়ে গিয়েছিল। তারপর আবার আমাদের ওখানে গিয়ে সূরা বাকারা দিয়ে পড়া শুরু করেছিল। (সারা দিনের কর্মক্লান্ত ও অবসন্ন শরীর নিয়ে এত দীর্ঘ সময় আমরা কিভাবে তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?) একথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) মুয়াযকে লক্ষ্য করে বললেন হে মুয়ায, তুমি কি মানুষকে বিপথগামী করতে চাও? তুমি নামাযে ওয়াশ শামছি ওয়া দুহাহা, ওয়াল লাইলি ইযা ইয়াগশা এবং ছাব্বি হিসমা রব্বিকাল আলা পড়বে। (বোখারী, মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ (সা) এর নিয়ম ছিল এশার নামায রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে পড়তেন। হযরত মুয়ায রাসূল (সা) এর সাথে নফলের নিয়তে শরীক হতেন। তারপর বাড়ীতে যেতে খানিকটা সময় লাগতো। তারপর আবার সূরা বাকারার মত লম্বা সূরা দিয়ে ইমামতি করতেন। এতে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। ওদিকে লোকেরা সারাদিন ক্ষেত খামারে ও বাগানে কাজ করতে করতে শ্রান্ত, ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়তো। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এবং এই শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে এ রকমের লম্বা কিরাত দিয়ে নামায পড়ালে লোকদের নামায ছেড়ে চলে যাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ কারণেই রাসূল (সা) হযরত মুয়াযকে সতর্ক করলেন। হযরত মুয়াযের এই কাজটার ওসিলায় মুসলিম জাতির ইমামরা যে এত মূল্যবান একটি শিক্ষা লাভ করলেন। সে জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত মুয়াযের ওপর সন্তুষ্ট হোন ও রহমত বর্ষণ করুন।

যাকাত, ছদকায়ে ফেতের, ওশর

যাকাত দারিদ্র দুর করার কার্যকর উপায়

(আরবী*****************)

৬১. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা ছদকা ফরজ করেছেন। যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রদেরকে ফেরত দেয়া হবে। (বোখারী, মুসলিম)

ছদকা শব্দটা যাকাত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যা প্রদান করা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। এখানে এটি যাকাত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, এ ছাড়া মানুষ স্বেচ্ছায় যে সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাকেও ছদকা বলে। এ হাদীসে ফেরত দেয়া হবে শব্দটার প্রয়োগ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ধনীদের কাছ থেকে আদায়কৃত যাকাত মূলত সমাজের দরিদ্র-ক্লিষ্ট ও অভাবী লোকদেরই প্রাপ্য, যা ধনীদের কাছে গচ্ছিত ছিল এবং তা তার আসল পাওনাদারদের কাছে ফেরত দেয়া হবে।

যাকাত আদায় না করার শাস্তি

(আরবী***************************************)

৬২. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধনসম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে সেই ধনসম্পদের যাকাত দেয়নি, তার এই ধনসম্পদ কেয়ামতের দিন বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করবে। যার মাথার ওপর দুটো কালো তিল থাকবে। (যা ঐ সাপের চরম বিষধর হওয়ার লক্ষণ) অতঃপর ঐ সাপ তার গলায় শেকল হয়ে ঝুলতে থাকবে এবং তার উভয় চোয়ালকে জাপটে ধরে সে বলতে থাকবে, আমি তোর ধনসম্পদ, আমি তোর পুঁজি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা) কোরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয়ে কার্পণ্য করে, তারা যেন মনে না করে যে, তাদের এ কার্পণ্য তাদের জন্য কল্যাণকর হবে। বরং তা হবে তাদের জন্য ক্ষতিকর। তাদের এ সম্পদ কেয়ামতের দিন তাদের গলার শিকলে পরিণত হবে। অর্থাৎ তাদের জন্য ভয়াবহ সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। (বোখারী)

যাকাত না দিল ধনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়

(আরবী**********************************)

৬৩. হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছিঃ যখন কোন ধনসম্পদের যাকাত আদায় করা হবে না এবং তা ধনসম্পদের সাথে মিলে থাকবে। তখন তা ধনসম্পদের বিনাশ না ঘটিয়ে ছাড়বে না। (মেশকাত)

বিনাশ ঘটানোর অর্থ এ নয় যে, কেউ যাকাত না দিয়ে যাকাতের অর্থ নিজে খেয়ে নিলে তার সমস্ত ধনসম্পদ সর্বাবস্থায় অবশ্য অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিনাশ ঘটার অর্থ এই যে, যে সম্পদ ভোগ করার কোন অধিকার তার ছিল না এবং যা গরীবদেরই প্রাপ্য ছিল, তা আত্নসাত করে সে নিজের দ্বীন ও ঈমানকে ধ্বংস করে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল থেকে এই ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে। তবে এমনও দেখা গেছে যে, যে ব্যক্তি যাকাতের অর্থ খেয়ে ফেলেছে, তার সমস্ত ধনসম্পদ আক্ষরিক অর্থেই মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হেয়ে গেছে।

ফেতরার দুটো উদ্দেশ্য

(আরবী**************************)

৬৪. রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মাতের ওপর ফেতরা ধার্য করেছেন এই উদ্দেশ্যে, যাতে রোযা রাখা অবস্থায় যেসব বেহুদা ও অশালীন কার্যকলাপ রোজাদারের দ্বারা সংঘটিত হয়, তার কাফফারা হয়ে যায় এবং দরিদ্রের খানাপিনার ব্যবস্থাও হয়ে যায়। (আবু দাউদ)

অর্থাৎ শরীয়তে যে ছদকায়ে ফেতের বা ফেতরা ওয়াজিব করা হয়েছে, তার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমতঃ রোজাদার যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করা সত্বেও তার দ্বারা যে সকল ত্রুটি বিচ্যুতি রোযা রাখা অবস্থায় সংঘটিত হয়ে যায়। ফেতরা দ্বারা তার ক্ষতি পূরণ হয়ে যায়। দ্বিতীয়তঃ যে দিন সকল মুসলমান খুশীর ঈদ উদযাপন করে, সেদিন সমাজের দরিদ্র লোকেরা যেন অনাহারে না থাকে। বরং তাদের খাবার দাবারের কিছু ব্যবস্থা হয়ে যায়। সম্ভবত এ উদ্দেশ্যেই পরিবারের সকল সদস্যের ওপর ফেতরা ওয়াজিব করা হয়েছে এবং তা ঈদের নামাযের আগেই দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।

ওশর বা ফসলের যাকাত

(আরবী************************)

৬৫.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে সব ভূমি বৃষ্টির পানি ও বহমান নদী বা খালের পানি দ্বারা সিঞ্চিত হয়, অথবা নদীর নিকটবর্তী হওয়ার কারণে সেচের প্রয়োজনই হয়না, তার উৎপন্ন ফসলের দশভাগের এক ভাগ এবং যে ভুমিতে শ্রমিক নিয়োগ করে সেচ দেয়া হয়, তার ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত(ওশর) দিতে হবে। (বোখারী)

রোযা

রমযান মাসের ফযিলত

(আরবী*******************************************)

৬৬.হযরত সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন শাবান মাসের শেষ দিন রাসুল (সা) আমাদের সামনে এরূপ ভাষণ দেন হে জনগণ, অত্যন্ত মর্যাদাবান ও কল্যাণময় একটা মাস তোমাদের কাছে সমাগত। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে রোযা রাখাকে ফরয করেছেন এবং এ মাসের রাতে তারাবীহ পড়াকে নফল করেছেন। (অর্থাৎ ফরয নয়, বরং সুন্নাত যা আল্লাহর কাছে প্রিয়) যে ব্যক্তি এ মাসে কোন একটা নফল কাজ স্বেচ্ছায় করলো সে যেন রমযান মাস ছাড়া অন্যান্য মাসে একটা ফরয কাজ করলো। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোন একটা ফরয কাজ করলো, যেন অন্য মাসে সত্তরটা ফরয আদায় করলো। এ মাস ধৈর্য ও সহিঞ্চুতার মাস। আর ধৈর্য সহিঞ্চুতার প্রতিদান হচ্ছে বেহেশত। এ মাস সমাজের দরিদ্র ও অভাব অনটনে জর্জরিত লোকদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। (মেশকাত)

ধৈর্য মাস অর্থ হলো, রোযার মাধ্যমে মুমিনকে আল্লাহর পথে অটল ও অবিচল থাকা এবং প্রবৃত্তির লালসা কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রণের ট্রেনিং দেয়া ও অভ্যাস গড়ে তোলা হয়। মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে অন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহ হুকুম মোতাবেক পানাহার থেকেও বিরত থাকে। স্ত্রীর কাছে যাওয়া থেকেও বিরত থাকে। এ দ্বারা তার ভেতরে আল্লাহর আনুগত্য করার মনোভাব সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনের সময় সে নিজের আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনাকে কতখানি সংযত রাখতে পারে, এ দ্বারা এই ব্যাপারে ট্রেনিং দেয়া হয়। পৃথিবীতে মুমিনের অবস্থান যুদ্ধের ময়দানের সৈনিকের মত। তাকে প্রতিনিয়ত শয়তানী কামনা বাসনার বিরুদ্ধে এবং অন্যায় ও পাপাচারী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। তার ভেতরে যদি ধৈর্য গুন সৃষ্টি না হয়। তা হলে শত্রুর আক্রমণের প্রথম আঘাতেই সে ধরাশায়ী হয়ে যাবে এবং নিজেকে শত্রুর কাছে সপে দেবে।

সহানুভূতির মাস এর মর্মার্থ হলো, যে সব রোযাদারকে আল্লাহ তায়ালা সচ্ছল বানিয়েছেন, তাদের উচিত স্থানীয় দরিদ্র ও অভাবী লোকদেরকে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের অংশীদার করা এবং তাদের জন্য সাহরী ও ইফতারের ব্যবস্থা করা। মূল হাদীসে মুয়াসাত শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ আর্থিক সহানুভূতি প্রকাশ করা। মৌখিক সহানুভূতি প্রকাশও মুয়াসাতের আওতাভুক্ত।

রোযা ও তারাবীর প্রতিদান গুনাহ মুক্তি

(আরবী***********************************)

৬৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি ঈমানদার সুলভ মানসিকতা সহকারে এবং পরকালের পুরস্কার লাভের আশা আকাংখা নিয়ে রমযানের রোযা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি রমযানের রাতে ঈমানদার সুলভ মানসিকতা ও আখিরাতের পুরস্কার প্রাপ্তির আকাংখা নিয়ে (তারাবির) নামায পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। (বোখারী ও মুসলিম)

রোযার নৈতিক শিক্ষা

(আরবী*****************************************)

৬৮.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ রোযা ঢালস্বরুপ। তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে, তখন সে যেন মুখ দিয়ে কোন অশ্লীল কথা উচ্চারণ না করে এবং হৈচৈ ও চিৎকার না করে। কেউ যদি তাকে গালি গালাজ করে কিংবা তার সাথে মারামারি করতে উদ্যত হয়, তাহলে সেই রোজাদারের চিন্তা ও স্মরণ করা উচিত যে, আমি তো রোজাদার। (কাজেই আমি কিভাবে গালির জবাবে গালি দিতে পারি বা মারামারিতে শরীক হতে পারি?) (বোখারী, মুসলিম)

রোজাদারের পক্ষে রোযার সুপারিশ

(আরবী*************************************)

৬৯. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ রোযা ও কোরআন বান্দার পক্ষে সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার মনিব, এই ব্যক্তিকে আমি দিনের বেলায় খাওয়া দাওয়া ও অন্যান্য লালসা চরিতার্থ করা থেকে বিরত রেখেছি এবং সে বিরত থেকেছে। হে আমার মনিব, এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কোরআন বলবে, আমি এই ব্যক্তিকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি(এবং সে মজার ঘুম ছেড়ে নামাযে কোরআন পড়েছে। ) এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। তৎক্ষণাৎ তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (বায়হাকী, মেশকাত, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত)

পাপাচার ত্যাগ না করলে রোযা নিষ্ফল উপবাসে পরিণত হয়

(আরবী************************************)

৭০. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি (রোযা রাখা সত্ত্বেও) মিথ্যা বলা ও মিথ্যা অনুযায়ী আমল করা ত্যাগ করেনি, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বোখারী)

অর্থাৎ রোযা ফরয করা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য মানুষকে সৎ বানানো। যদি রোযা রেখেও সৎ না হয়, হক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে জীবন গড়ে না তোলে, রমযান মাসেও বাতিল ও অন্যায় কথা বলা ও কাজ করা অব্যাহত রাখে এবং রমযানের বাইরেও তার জীবনে সত্যবাদিতা ও সততা পরিলক্ষিত না হয়, তাহলে এ ধরনের লোকের আত্নসমালোচনা করা উচিত যে, সে কি কারণ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থেকেছে এবং এতে তার লাভই বা কি?এ হাদীসের লক্ষ্য এই যে, রোযা রাখার উদ্দেশ্য এবং আসল প্রাণশক্তি ও প্রেরণা সম্পর্কে রোজাদারের অবহিত থাকা উচিত এবং কি কারণে সে দানাপানি ত্যাগ করছে, তা তার সব সময় হৃদয়ে জাগরূক রাখা উচিত।

(আরবী**********************************)

৭১. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ এমন বহু (হতভাগা) রোজাদার রয়েছে যার রোযা থেকে ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। আর (রমযানের রাতের) নামায (তারাবীহ) পড়ুয়াদের মধ্যেও অনেকে এমন রয়েছে যাদের তারাবীহ থেকে বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। এ হাদিসও পূর্ববর্তী হাদীসের ন্যায় এ শিক্ষা দেয় যে, রোজা রাখা অবস্থায় রোজাদারের রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা মনে রাখা উচিত।

নামায, রোযা ও যাকাত গুনাহের কাফফারা

(আরবী************************************)

৭২.হযরত হুযাইফা (রা) বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি যে, মানুষ নিজের পরিবার পরিজন, ধন সম্পদ ও পাড়া প্রতিবেশীর ব্যাপারে যে ভুলত্রুটি করে, নামায রোযা ও যাকাত সে সব ভুলত্রুটির কাফফারা হয়ে যায়। (বোখারী)

অর্থাৎ মানুষ সাধারণত নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারণে গুনাহর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে ব্যবসায় বাণিজ্য ও পাড়া পড়শিদের ব্যাপারেও সচরাচর ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যায়। এসব ত্রুটিবিচ্যুতি আল্লাহ তায়ালা নামায রোযা ও যাকাতের কারণে ক্ষমা করে দেন। (তবে এইসব গুনাহ বা ভুলত্রুটি যখন অনিচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত হয়ে যায় কেবল তখনই এ কথা প্রযোজ্য, ইচ্ছাকৃতভাবে করলে প্রযোজ্য নয়। )

রোযার ব্যাপারে রিয়া থেকে হুশিয়ারী

(আরবী********************************)

৭৩.হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। যখন কেউ রোযা রাখে তখন তার তেল লাগানো উচিত, যাতে তার মধ্যে রোযার লক্ষণ পরিদৃষ্ট না হয়। (আল আদাবুল মুফরাদ)।

অর্থাৎ রোজাদারের উচিত যেন লোক দেখানো রোযা না রাখে, গোসল করে যথারীতি শরীরে তেল লাগায়, যাতে রোযার কারণে শরীরে যে অবসাদ ও আড়ষ্টতার সৃষ্টি হয় তা দূর হয়ে যায় এবং রিয়াকারীর পথ বন্ধ হয়ে যায়।

সাহরীর বরকত

(আরবী**************************************)

৭৪. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমরা সাহরী খেও। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে। (বোখারী)

অর্থাৎ সাহরী খেয়ে রোযা রাখলে দিনটা সহজে কেটে যাবে, আল্লাহর এবাদাতে ও দৈনন্দিন অন্যান্য কাজে দুর্বলতা ও অলসতা আসবে না। আর সাহরী না খেলে ক্ষুধার দরুন অবসাদ, অলসতা ও দুর্বলতা অনুভূত হবে ও এবাদতে মন বসবে না। এটা হবে খুবই বে বরকতীর ব্যাপার। অন্য হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন তোমরা দিনে রোযা রাকার জন্য সাহরীর সাহায্য নাও এবং রাতে তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য দিনের বেলা ঘুমের সাহায্য নাও।

তাড়াতাড়ি ইফতার করার আদেশ

(আরবী************************************)

৭৫.হযরত সাহল বিন সাদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মুসলমানরা যত দিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততদিন ভালো থাকবে। (বোখারী)

এর মর্ম এই যে, তোমরা ইফতারে ইহুদীদের নিয়মের বিরোধিতা করবে। তারা অন্ধকারে চারিদিক

আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর ইফতার করে। তোমরা যদি সূর্য ডোবার সাথে সাথে ইফতার কর এবং ইহুদীদের নিয়ম অনুসরণ না করো, তাহলে প্রমাণিত হবে যে তোমরা ধর্মীয় দিক দিয়ে ভালো অবস্থায় আছ।

মুসাফিরের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি

(আরবী************************************)

৭৬. হযরত আনাস বিন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা (রমযান মাসে) রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাথে সফরে যেতাম। তখন কেউবা রোযা রাখতো, কেউবা রাখতো না। কিন্তু রোজাদার কখনো অরোযাদারের বিরুদ্ধে এবং অরোযাদার কখনও রোজাদারের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলতো না। (বোখারী)

মুসাফিরকে কোরআনে রোযা না রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি সফর অবস্থায় সহজে রোযা রাখতে পারবে তার পক্ষে রোযা রাখা উত্তম। আর যার পক্ষে কষ্টকর হবে তার রোযা না রাখা উত্তম। কারো ওপর কারো আপত্তি তোলা উচিত নয়।

নফল এবাদতে বাড়াবাড়ি ভালো নয়

(আরবী************************************)

৭৭. রাসুলুল্লাহ (সা) আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমার সম্পর্কে আমি শুনেছি যে, তুমি প্রতিদিন রোযা রাখ এবং রাতভর নফল নামায পড়ে থাক। এটা কি সত্য? তিনি বললেন, হে রাসুলুল্লাহ, এ কথা সত্য। রাসূল (সা) বললেনঃ এরূপ করোনা। কখনো ঘুমাও। কখনো তাহাজ্জুদ পড়। কেননা তোমার কাছে তোমার দেহেরে প্রাপ্য আছে, তোমার চোখের প্রাপ্য আছে, তোমার কাছে তোমার দেহের প্রাপ্য আছে, তোমার চোখের প্রাপ্য আছে, তোমার স্ত্রীর প্রাপ্য আচে এবং তোমার সাক্ষাৎ প্রার্থী ও অতিথিদেরও প্রাপ্য আছে। তুমি প্রতি মাসে মাত্র তিনদিন রোযা রাখ। এতটুকুই তোমার জন্য যথেষ্ট। (বোখারী)

অবিরাম রোযা রাখা ও রাতভর নামায পড়ায় স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। বিশেষত বেশী রোযা রাখলে ও রাত জাগলে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) তা থেকে নিষেধ করেছেন। মুমিনকে সব কিছুতে মধ্যম পন্থা অবলম্বন ও ভারসাম্য রক্ষা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

(আরবী***************************************)

৭৮.হযরত আবু জুহায়ফা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) সালমান ও আবু দারদা (রা) এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একদিন সালমান আবু দারদার বাড়ীতে বেড়াতে গেলেন। তিনি উম্মে দারদাকে (আবু দারদার স্ত্রী) অত্যন্ত নিম্নমানের বেশভূষায় দেখে (অর্থাৎ বিধবা মহিলার উপযোগী সাজসজ্জা বিহীন দেখে) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার একি অবস্থা? (অর্থাৎ এমন বিধবা সুলভ সাজসজ্জা অবলম্বন করছ কেন?) উম্মে দারদা বললেন, তোমার ভাই আবু দারদার তো দুনিয়ার প্রতি আর কোন আসক্তি নেই। (সুতরাং সাজসজ্জা আর কার জন্য করবো?) এরপর আবু দারদা এলেন এবং মেহমান ভাই এর জন্য খাবার তৈরী করালেন। তারপর বললেন, তুমি খাও। আমি রোযা রেখেছি। সালমান বললেন, তুমি না খেলে আমি কাব না। অগত্যা আবু দারদা রোযা ভেঙ্গে তার সাথে খানা খেলেন। আবার যখন রাত হলো, তখন আবু দারদা নফল নামায পড়ার উদ্দেশ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। সালমান বললেন, শুয়ে পড়। আবু দারদা (ঘরে গিয়ে) শুলেন। কিছুক্ষণ পর আবার উঠলে সালমান বললেন ঘুমাও। তারপর রাতের শেষভাগে সালমান বললেন, এখন ওঠ। অতঃপর দুজনে একত্রে নামায পড়লেন। তারপর সালমান বললেন, জান তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকেরও প্রাপ্য আছে, (যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি) আবার তোমার নিজেরও প্রাপ্য আছে(যথা পার্থিব জীবনের স্বাদ আনন্দ উপভোগ করা) এবং তোমার স্ত্রীরও প্রাপ্য আছে। অতএব সকলের প্রাপ্য পরিশোধ কর। অতঃপর রাসূল (সা) এর কাছে এলেন এবং পুরো ঘটনা জানালেন। ঘটনা শুনে রাসুল (সা) বললেন, সালমান সঠিক কথাই বলেছেন।

(এই হাদীসে সালমান (রা) কর্ক আবু দারদার স্ত্রীর সাথে যে ধরনের সাক্ষাত ও কথাবার্তার উল্লেখ রয়েছে, তা থেকে মনে হয় তখনো পর্দার কড়া হুকুম নাযিল হয়নি। নচেৎ সালমান ও আবু দারদার মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা পর্দার কড়াকড়ি শিথিল করার জন্য যথেষ্ট নয়। অবশ্য সালমান কুবই বয়োবৃদ্ধ সাহাবী ছিলেন বিধায় কিছুটা শৈথিল্যের অবকাশ থাকতে পারে। (অনুবাদক)

(আরবী**************************************************)

৭৯.হযরত মুজীবা বাহেলীয়া (রা) বাহেলা গোত্রের জনৈকা মহিলা সাহাবী। তাঁর বাবা বা চাচা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তাঁর বাবা (ইসলামের শিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যে) রাসূল (সা) এর নিকট গেলেন। অতঃপর ফিরে এলেন। এক বছর পর পুনরায় রাসূল(সা) এর নিকট উপস্থিত হলেন। তখন তার (শারীরিক) অবস্থা ও আকৃতি বদলে গিয়েছিল। তিনি বললেন, হে রাসূলুল্লাহ, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? রাসুল (সা) বললেন, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি বাহেলী গোত্রের লোক। গত বছর আপনার কাছে এসেছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমার এ অবস্থা কেন? গত বছর যখন এসেছিলে তখন তোমার চেহারা ও স্বাস্থ্য খুবই সুদর্শন ছিল। তিনি বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে যাওয়ার পর থেকে অবিরাম রোযা রেখে যাচ্ছি। রাতে ছাড়া কিছুই খাই না। রাসুল(সা) বললেন, তুমি নিজের ওপর নির্যাতন চালিয়েছ। (অর্থাৎ ক্রমাগত রোযা রেখে শরীরকে দুর্বল করে ফেলেছ) তারপর তিনি তাকে উপদেশ দিলেন যে, ধৈর্য মাস রমযানের রোযা রেখ, আর তা ছাড়া প্রত্যেক মাসে একটা করে রোযা রেখ। বাহেলী বললেন, আমার ওপর আরো কিছু রোযা বাড়িয়ে দিন। কেননা আমার (প্রতি মাসে একাধিক রোযা রাখার) সামর্থ্য আছে। রাসূল (সা) বললেন, বেশ তাহলে প্রতি মাসে দুদিন রোযা রাখ। বাহেলী গোত্রের লোকটি বললেন, আরো কিছু বাড়িয়ে দিন। রাসূল (সা) বললেন, ঠিক আছে। তুমি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখ। তিনি বললেন, আরো কিছু বাড়িয়ে দিন। রাসূল (সা) বললেন, ঠিক আছে তুমি প্রত্যেক বছর সম্মানিত মাসগুলোতে রোযা রাখ, আবার বাদ দাও। এভাবে প্রতি বছর কর। এ কথা বলার সময় তিনি তিন আঙ্গুল একত্র করলেন, আবার ছেড়ে দিলেন। (এ দ্বারা ইংগিত দিলেন যে, সম্মানিত মাস রজব, যিলকদ, যিলহজ্জ ও মুহাররমে রোযা রাখ। আবার কোন কোন বছর রেখ না। ) (আবু দাউদ)

ইতিকাফ

ইতিকাফ কয় দিন?

(আরবী********************************)

৮০. হযরত ইবনে উমার (রা) বলেন, রাসূল (সা) রমযানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। (বোখারী, মুসলিম)

রাসুল (সা) সাধারনভাবে সর্বদাই আল্লাহর এবাদত ও বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকতেন। কিন্তু রমযান মাসে তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যেত। বিশেষত শেষ দশ দিন পুরোপুরি আল্লাহর এবাদতে কাটাতেন। মসজিদে গিয়ে অবস্থান করতেন। নফল নামায, কোরআন তেলাওয়াত, যিকর ও দোয়ায় মশগুল হয়ে যেতেন। কেননা রমযান মাস মোমেনের প্রস্তুতির মাস যাতে সে অবশিষ্ট এগারো মাসে শয়তান ও শয়তানী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করতে পারে।

রমযানের শেষ দশ দিনে রাসূলের ব্যস্ততার চিত্র

(আরবী********************************************)

৮১.হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রমযানের শেষ দশদিন উপস্থিত হলেই রাসূল (সা) এর অবস্থা এ রকম হতো যে, রাতের বেশীর ভাগ জেগে এবাদত করতেন। নিজের স্ত্রীদেরকে জাগাতেন (যাতে তারাও বেশী করে রাত্র জাগে এবং নফল ও তাহাজ্জুদ পড়ে। ) এবং আল্লাহর এবাদতের জন্য পোশাককে শক্তভাবে এঁটে বেঁধে নিতেন। (পোশাককে এঁটে বেঁধে নেয়ার অর্থ হলো, সর্বাত্মক আবেগ ও উদ্দীপনা সহকারে এবাদতে নিয়োজিত হতেন। )

হজ্জ

হজ্জ একটি ফরয এবাদত

(আরবী*****************************************)

৮২.হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) এক ভাষণে বলেছেন, হে মানবমন্ডলী আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্জ আদায় কর। (মুনতাকা)

হজ্জ মানুষকে নিষ্পাপ করে

(আরবী******************************************)

৮৩.রাসূল(সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি এই ঘরের কাছে উপস্থিত হয়ে যাবতীয় অশ্লীলতা ও লজ্জাহীনতার কথা ও কাজ থেকে বিরত রইল এবং আল্লাহর নাফরমানী থেকে দুরে থাকলো, সে তার মায়ের পেট থেকে জন্ম গ্রহণের সময়ের মত (নিষ্পাপ) হয়ে বাড়ী ফিরে যাবে।

জেহাদের পর হজ্জ সর্বোত্তম এবাদত

(আরবী********************************************)

৮৪. আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসুল (সা) এর নিকট জিজ্ঞেস করা হলো, কোন কাজটি সর্বোত্তম? তিনি জবাব দিলেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। আবার প্রশ্ন করা হলো এরপর কোন কাজ সর্বোত্তম? তিনি বললেনঃ আল্লাহর দ্বীনের জন্য সর্বাত্ন্যক সংগ্রাম তথা জেহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোন কাজ উৎকৃষ্টতম? তিনি বললেনঃ এমন হজ্জ যার অভ্যন্তরে আল্লাহর কোন রকম নাফরমানী করা হয়নি। (মুনতাকা)

হজ্জ ফরয হলে তা দ্রুত আদায় করা উচিত

(আরবী************************************)

৮৫. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি হজ্জ করার সিদ্ধান্তে নেয়, তার দ্রুত হজ্জ সম্পন্ন করা কর্তব্য। কেননা সে রোগাক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। তার উট হারিয়ে যেতে পারে। (অর্থাৎ যানবাহন তথা সফরের উপায় উপকরণ হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। পথ বিপদ সংকুল হয়ে যেতে পারে এবং সফরের প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। ) এবং এমন কোন কাজের প্রয়োজন পড়তে পারে যা হজ্জ করতে যাওয়াকে অসম্ভব করে তুলবে। সুতরাং তোমরা দ্রুত হজ্জ সম্পন্ন কর। (কে জানে কখন কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়ে এবং হজ্জ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাও। ) (ইবনে মাজা, ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত)

সামর্থবান লোকদের হজ্জ না করার কঠোর পরিণতি

(আরবী**************************************)

৮৬. হাসান (রা) বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর (রা) বলতেনঃ আমি এই সব শহরে (মুসলমানদের দখলীকৃত এলাকায়) কিছু লোক পাঠাতে চাই, যারা তদন্ত করে দেখবে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করেনি, অতঃপর তাদের ওপর জিযিয়া আরোপ করতে চাই। (অমুসলিম নাগরিকদের জান মালের নিরাপত্তা বাবদ আদায়যোগ্য করকে জিযিয়া বলা হয়। ) কেননা তারা মুসলমান নয়। (মুসলমান হলে তারা অনেক আগেই হজ্জ করতো। মুসলমান অর্থ হলো আল্লাহর কাছে আত্ন্যসমর্পনকারী। তারা যদি আল্লাহর কাছে আত্নসমর্পণকারী হতো তাহলে বিনা ওজরে হজ্জের মত মহান এবাদতে শৈথিল্য দেখাতো না। )

হজ্জের সফর শুরুর সাথে সাথেই হজ্জ শুরু

(আরবী************************************)

৮৭.রাসূল(সা) বলেছেন যে ব্যক্তি হজ্জ ওমরা বা জেহাদ করার লক্ষ্য নিয়ে নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে, অতঃপর পথে তার মৃত্যু হয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবিকল সেই সওয়াব ও পুরস্কার দেবেন। যা হ্জী, গাযী ও ওমরা আদায়কারীদের প্রাপ্য। (মেশকাত, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)

মোয়ামালাত (লেনদেন)

নিজের হাতে জীবিকা উপার্জনের ফযিলত

(আরবী******************************************)

৮৮. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন নিজের হাতে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম জীবিকা কেউ কখনো ভোগ করেনি আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ) স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদই ভোগ করতেন। (বোখারী)

মুমিনদের ভিক্ষাবৃত্তি ও অপরের কাচে হাত পাতা থেকে বিরত রাখাই এ হাদীসের মুল উদ্দেশ্য। এতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেকের নিজের জীবিকা নিজেই উপার্জন করা এবং কারো ওপর বোঝা হয়ে জীবন না করাই উত্তম।

হারাম জীবিকা উপার্জন করলে দোয়া কবুল হয় না

(আরবী************************************************)

৮৯.রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র। তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া অন্য কিছু কবুল করেন না। আর আল্লাহ তাঁর রাসুলদেরকে যে আদেশ দিয়েছেন মুমিনেদেরকেও অবিকল সেই আদেশ দিয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন হে রসূলগণ, তোমরা পবিত্র জীবিকা ভোগ কর ও সৎকাজ কর। আল্লাহ আরো বলেছেন, হে মুমিনগণ তোমাদেরকে যে হালাল জীবিকা দিয়েছি তাই ভোগ কর। এরপর রাসূল (সা) এমন এক ব্যক্তির উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পবিত্র স্থানে পৌঁছেছে। তার সমস্ত শরীর ধুলায় আচ্ছন্ন। সে দুহাত আকাশে তুলে দোয়া করে অথচ তার খাদ্য হারাম পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারাম জীবিকা দ্বারাই সে লালিত পালিত হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে। (মুসলিম)

এ হাদীসে প্রথম যে কথাটা বলা হয়েছে তা হলোঃ আল্লাহ তায়ালা কেবল সেই ছদকাই কবুল করেন, যা পবিত্র ও বৈধ। আল্লাহ তায়ালার পথে হারাম সম্পদ ব্যয় করলে আল্লাহ তা গ্রহণ করেন না।

হালাল হারামের বাছবিচার

(আরবী*******************************)

৯০.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন মানব জাতি একদিন এমন এক সময়ের সম্মুখীন হবে, যখন কেউ হালাল হারামের বাছবিচার করবে না।

হারাম সম্পদ জাহান্নামের পাথেয়

(আরবী**********************************)

৯১.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ কোন বান্দা যদি হারাম সম্পদ উপার্জন করে এবং তা থেকে আল্লাহর পথে ছদকা করে তবে সে ছদকা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না। আর তা যদি নিজের ওপর ও নিজের পরিবার পরিজনের ওপর ব্যয় করে তবে তাতে বরকত থাকবে না। আর যদি সে হারাম সম্পদ রেখে মারা যায় তবে তা তার জাহান্নামের সফরে পাথেয় হবে। আল্লাহ তায়ালা অন্যায়কে অন্যায় দ্বারা প্রতিহত করেন না। অন্যায়কে ন্যায় দ্বারা প্রতিহত করেন। খারাপ কাজ খারাপ কাজকে প্রতিহত করে না। (মেশকাত)

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, ভালো কাজ বৈধ উপায়ে করা হলেই তাকে ভালো কাজ বিবেচনা করা হবে। ভালো কাজের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি উভয়ই পবিত্র হওয়া চাই। নচেৎ তা দ্বারা আখিরাতের কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করা যায় না।

চিত্র শিল্পীর আযাব অবধারিত

(আরবী*************************************)

৯২.হযরত সাঈদ বিন আবিল হাসান বলেন আমি (একদিন) ইবনে আব্বাসের নিকটে ছিলাম। সহসা এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল। সে বললোঃ হে ইবনে আব্বাস! আমি এমন এক ব্যক্তি, যে নিজ হাতেই নিজের জীবিকা উপার্জন করি। আমি এই সব চিত্র তৈরী করে থাকি। ইবনে আব্বাস বললেনঃ আমি তোমাকে শুধু সেই কথাই বলছি, যা রাসূল (সা) এর কাছ থেকে শুনেছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি কোন ছবি নির্মাণ করবে, সে যতক্ষণ তাতে প্রাণ সঞ্চার না করবে ততক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তাকে শাস্তি দেবেন। অথচ সে কখনো প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না। এ কথা শুনে লোকটির মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল এবং সে জোরে জোরে ওপরের দিকে শ্বাস নিতে লাগলো। ইবনে আব্বাস বললেন, তুমি যদি চিত্র শিল্পের কাজ করতেই চাও তবে গাছ ও যাবতীয় নিষ্প্রাণ বস্তুর ছবি নির্মাণ কর। (বোখারী)

এই চিত্রগুলো নিজের উপার্জন সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তাই সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের নিকট এসে প্রশ্ন করেছিল। এই প্রশ্ন করাটা তার ঈমানদারীর আলামত। তার মনে যদি আল্লাহ ভীতি না থাকতো এবং হালাল হারাম বাছবিচারের চেতনা না থাকতো তা হলে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের কাছে যেতইনা। আখিরাতে ধরপাকড়ের ভয় যার থাকেনা, সে হালাল হারামের বাছবিচার করে না।

ব্যবসায় বাণিজ্য

হাতের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ সর্বাধিক পবিত্র

(আরবী**********************************************)

৯৩. হযরত রাফে বিন খাদীজ (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন উপার্জন সর্বাধিক পবিত্র? রাসূল(সা) বললেন, মানুষের নিজ হাতের কাজ এবং যে ব্যবসায় মিথ্যাচার বেঈমানী থেকে মুক্ত। (মেশকাত)

ক্রয় বিক্রয়ে উদার আচরণের তাগিদ

(আরবী************************************************)

৯৪. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তির ওপর অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করুন, যে ক্রয়ে বিক্রয়ে ও নিজের দেয়া ঋণ আদায়ে নমনীয় ও উদার আচরণ করে। (বোখারী, জাবের (রা) থেকে বর্ণিত)

সৎ ব্যবসায়ীর উচ্চ মর্যাদা

(আরবী***************************************************)

৯৫. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন সত্যবাদিতা ও সততার সাথে লেনদেনকারী আমানতদার ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবীগণ, সিদ্দীকগণ ও শহীদগণের সাথে থাকবে। (তিরমিযি, আবু সাঈদ খুদরী(রা) থেকে বর্ণিত) ব্যবসায় দৃশ্যত একটা দুনিয়াদার সুলভ কাজ। কিন্তু এ কাজ যদি সততা ও সত্যবাদিতার সাথে করা হয়, তবে তা এবাদতে পরিণত হয়। এই সদগুণাবলীর অধিকারী ব্যবসায়ী আল্লাহ তায়ালার পুণ্যবান বান্দা নবী, সিদ্দিক ও আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণকারীদের সাহচর্য লাভ করবে।

সিদ্দিক সেই মুমিনকে বলা হয় যার জীবন সততা ও সত্যবাদিতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় এবং যে আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকার সমগ্র জীবন ব্যাপী পালন করে এবং যার জীবনে কথা ও কাজে অমিল ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় না।

সততা ব্যতীত ব্যবসায়ী পাপী গণ্য হবে

(আরবী*****************************************)

৯৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, একমাত্র তাকওয়া ও সততা অবলম্বনকারী (অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্যতা পরিহারকারী ও মানুষের হক অর্থাৎ পাওনা পুরোপুরিভাবে প্রদানকারী) এবং সত্যবাদী ব্যতীত সফল ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন পাপী ও বদকার হিসাবে উত্থিত হবে। (তিরমিযী)

বেশী কসম খাওয়ায় ব্যবসায়ে বরকত নষ্ট হয়

(আরবী*************************************)

৯৭.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন সাবধান পণ্য বিক্রয়ে বেশী কসম খাওয়া থেকে বিরত থাকে এতে (সাময়িকভাবে) ব্যবসায়ে উন্নতি হয় বটে। তবে শেষ পর্যন্ত বরকত নষ্ট হয়ে যায়। (মুসলিম, আবু কাতাদা(রা) থেকে বর্ণিত) ব্যবসায়ী যদি ক্রেতাকে তার পণ্যের ব্যাপারে কসম খেয়ে খেয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, পণ্যের এই মূল্যই সঠিক এবং পণ্যটি খুবই ভালো, তা হলে সাময়িকভাবে ক্রেতা হয়তো ধোঁকা খেয়ে যাবে। কিন্তু পরে যখন প্রকৃত ব্যাপার জানতে পারবে, তখন আর ঐ দোকানের ধারে কাচেও যাবে না। ফলে তার ব্যবসায়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।

মিথ্যে শপথকারী ব্যবসায়ীর সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না

(আরবী************************************)

৯৮.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পাক পবিত্র করে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন না। উপরন্তু তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন। আবু যর বললেনঃ যে ব্যক্তি অহংকার ও দাম্ভিকতা বশত টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করে, যে ব্যক্তি কারো উপকার করে খোটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যে কসম খেয়ে নিজের বাণিজ্যিক পণ্যের বিক্রি বৃদ্ধি করে। (মুসলিম, আবু যর গিফারী(রা) থেকে বর্ণিত)

আল্লাহ তায়ালার কথা না বলা ও না তাকানোর অর্থ হলো আল্লাহ তার ওপর রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হবেন এবং তার সাথে স্নেহ ও মমতার সাথে আচরণ করবেন না। একজন সাধারণ মানুষও যার ওপর অসন্তুষ্ট হয় তার দিকে তাকায় না এবং তার সাথে কথাও বলে না।

পরিধেয় পোশাককে টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে রাখার বিরুদ্ধে উচ্চারিত এই হুমকি সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে, অহংকার দাম্ভিকতার বশে এটা করে। যে ব্যক্তি টাখনুর নীচে পোশাক পরে বটে, তবে সে অহংকারী ও দাম্ভিক নয়, তার এ কাজও গুনাহ। কেননা রাসুল (সা) মুসলমানদেরকে টাখনুর নীচে পোশাক পরতে সর্বতোভাবে নিষেধ করেছেন। সুতরাং এ ব্যক্তিও গুনাহগার যদিও তার গুনাহ অহংকারীর তুলনায় কিছুটা হালকা। অবশ্য মুমিন কোন গুনাহকেই হালকা মনে করে না। একজন অনুগত গোলামের কাছে মনিবের সামান্যতম অসন্তোষও অত্যন্ত ভয়ংকর মনে হয়।

ব্যবসায়ীদের দান ছদকার মাধ্যমে ভুলত্রুটির কাফফারা দেয়া উচিত

(আরবী***********************************************)

৯৯.হযরত কায়েস বিন আবু গারযা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) এর আমলে আমাদেরকে সামাসিরা (দালাল বা ফড়িয়া) বলে আখ্যায়িত করা হতো। রাসুলুল্লাহ (সা) একদিন আমাদের কাছে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি আমাদেরকে আরো ভালো নামে আখ্যায়িত করলেন। তিনি বললেনঃ ওহে ব্যবসায়ীর দল, পণ্য বিক্রয়ের সময় অতিশয়োক্তি করা ও মিথ্যা কসম খাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং তোমরা তোমাদের ব্যবসায়ে সদকার মিশ্রণ ঘটাও। (আবু দাউদ)

রাসুলুল্লাহ (সা) এর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ব্যবসায়ে অনেক সময় মানুষ নিজের অজান্তেই অনেক অর্থহীন কথাবার্তা বলে ফেলে, কখনো বা মিথ্যে কসমও খেয়ে বসে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের বিশেষভাবে আল্লাহর পথে দান সদকা করার নিয়ম চালু করা উচিত, যাতে তাদের ঐ সব ভুলত্রুটির কাফফারা হয়ে যায়।

মাপ ও ওজনে সতর্কতা

(আরবী************************************)

১০০. রাসূলুল্লাহ (সা) মাপ ও ওজনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীদেরকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা এমন দুটো কাজের দায়িত্ব পেয়েছ, যার কারণে তোমাদের পূর্বে অতিবাহিত জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। (তিরমিযি)

মজুদদারী মহাপাপ

(আরবী********************)

১০১.রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মুজদদারী করে, সে পাপী। মূর আরবী শব্দ ইহতিকারের অর্থ হচ্ছে মুজদদারী।

অর্থাৎ জনগণের প্রয়োজনীয় জিনিস আটকে রাখা, বাজারে না আনা, কবে অনেক দাম বাড়বে তার অপেক্ষা করা, দাম বেড়ে যাওয়া মাত্রই পণ্য বাজারজাত করা এবং প্রচুর পরিমাণে মুনাফা অর্জন করা। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচরাচর এই মানসিকতা দেখা যায়। তাই রাসূল (সা) এই মানসিকতা প্রতিহত করেছেন। কেননা এ মানসিকতা মানুষকে নির্দয় ও পাষাণ হৃদয়ে পরিণত করে। অথচ ইসলাম মানুষের সাথে সদয় আচরণ করার শিক্ষা দেয়। কিছু সংখ্যক আলেমের মত এই যে, যে মজুদদারীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা শুধু খাদ্য শস্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য ছাড়া অন্যান্য জিনিস আটকে রাখলে ও বাজারে না আনলে তারা এই হুমকির আওতাভুক্ত হবে না। পক্ষান্তরে অন্যান্য আলেমদের মত হলো, এটা শুধু খাদ্যশস্যের জন্য নির্দিষ্ট নয় বরং যে কোন প্রয়োজনীয় দ্রব্য আওতাভুক্ত হবে। আমার মতে শেষোক্ত দলের মতটি অধিকতর যুক্তি গ্রাহ্য।

মজুদদার অভিশপ্ত

(আরবী*************************)

১০২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথা সময়ে বাজারে সরবরাহ করে সে আল্লাহর রহমত ও অধিকতর জীবিকা লাভের যোগ্য। আর যে ব্যক্তি মজুদদারীতে লিপ্ত, সে অভিশপ্ত। (ইবনে মাজা)

মজুদদার আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দা

(আরবী***************************)

১০৩.হযরত মুয়ায থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ মজুদদার হচ্ছে নিকৃষ্ট বান্দা। আল্লাহ যদি জিনিসপত্র সস্তা করে দেন তবে সে মনোকষ্টে ভোগে। আর যদি দাম বাড়ে তবে সে খুশী হয়। (মেশকাত)

পণ্যের ত্রুটি ক্রেতাকে জানাতে হবে

(আরবী*********************************)

১০৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন জিনিসের ভেতরে যে ত্রুটি রয়েছে তা জানিয়ে দেয়া ব্যতীত বিক্রি করা বৈধ নয়। আর যে ব্যক্তি উক্ত দোষত্রুটির কথা জানে তার পক্ষে তা খোলাখুলিভাবে বর্ণনা না করে নীরবতা অবলম্বন করা বৈধ নয় (মুনতাকা, ওয়াসেলা (রা) থেকে বর্ণিত)

এ হাদীসে প্রথমে বিক্রেতাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, সে যেন তার পণ্য বিক্রির সময় পণ্যের দোষ ক্রেতাকে জানিয়ে দেয়। অতঃপর বিক্রেতার নিকটে যদি এমন কেউ থাকে যে, ঐ পণ্যের দোষত্রুটির কথা জানে, তবে সেই ব্যক্তিকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, সে যেন ক্রেতাকে দোষত্রুটির কথা জানিয়ে দেয়। (বিক্রেতা যদি দোষ গোপন করে তবে ক্রেতাকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য এটি সর্বশেষ ব্যবস্থা। –অনুবাদক)

একবার রাসূল(সা) জনৈক বিক্রেতার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন সে খাদ্য শস্য বিক্রি করছিল। তিনি ঐ খাদ্য শস্যের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। ভেতরের অংশটা ভিজে ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ কি? সে বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তিনি বললেনঃ তাহলে এটিকে ওপরে রাখনি কেন? তারপর তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমাদেরকে (সমাজকে) ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

ধার-কর্জ

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে সদয় ব্যবহার

ঋণ মাফ করে দেয়ার বিরাট সওয়াব

(আরবী*********************************)

১০৫. রাসুল (সা) বলেছেনঃ এক ব্যক্তি মানুষকে ঋণ দিত। তারপর সে প্রদত্ত ঋণ আদায় করতে একজন আদায়কারী পাঠাতো। আদায়কারীকে সে বলে দিত যে, অত্যধিক অভাবী কোন ব্যক্তি পেলে তাকে মাফ করে দিও। হয়তো এর কল্যাণে আল্লাহ আমাদেরকেও মাফ করে দেবেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ এই লোকটি যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হলো, তখন আল্লাহ তাকে গুনাহ মাফ করে দিলেন। (বোখারী, মুসলিম)

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুযোগ দানের সুফল

(আরবী**************************************)

১০৬.রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করলে যার আনন্দ লাগে, সে যেন দরিদ্র ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় অথবা তার ওপর থেকে ঋণের বোঝা একেবারেই নামিয়ে দেয়। (অর্থাৎ মাফ করে দেয়। –অনুবাদক, মুসলিম, আবু কাতাদাহ(রা) থেকে বর্ণিত)

অন্যের ঋণ পরিশোধ করে দেয়ার সওয়াব

(আরবী******************************************)

১০৭. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সা) এর নিকট একটি লাশ এলো, যেন তিনি তার ওপর জানাযার নামায পড়ান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই সাথীর (মৃত ব্যক্তির) ওপর কি কোন ঋণ আছে? লোকেরা বললো, জি, ঋণ আছে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ সে কি কোন সম্পত্তি রেখে গেছে, যা দ্বারা এই ঋণ পরিশোধ করা যায়? লোকেরা বললোঃ না। তখন রাসূল (সা) বললেন, তোমরা ওর জানাযার নামায পড়। (আমি পড়বো না) এই পরিস্থিতি দেখে হযরত আলী (রা) বললেন হে রাসুলুল্লাহ (সা) সামনে এগিয়ে গেলেন ও জানাযার নামায পড়ালেন। অন্য বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন হে আলী, তুমি যেভাবে নিজের এই মুসলিম ভাই এর ঋণের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাকে রক্ষা করলে, সেভাবে আল্লাহ তায়ালা তোমাকেও দোযখ থেকে রক্ষা করুন। যে কোন মুসলমান নিজের মুসলমান ভাই এর ঋণ পরিশোধ করে দেবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহর তায়ালা তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দেবেন।

ঋণ থেকে শহীদেরও রেহাই নেই

(আরবী*************************)

১০৮.রাসূল(সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তার সকল গুনাহ মাফ হবে। কিন্তু ঋণ মাফ হবে না। (মুসলিম, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত)

ঋণ পরিশোধ করা যে কত জরুরী, তা উল্লিখিত দুটো হাদীস থেকে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায়। যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ পর্যন্ত আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছে, সেও যদি কারো কাছে ঋণগ্রস্ত থেকে থাকে এবং তা পরিশোধ না করে থাকে, তবে তা মাফ হবে না। কেননা এটা বান্দাহর হকের সাথে সম্পৃক্ত। পাওনাদার মাফ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাও মাফ করবেননা। অবশ্য ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত বা ইচ্ছা পোষণ করে থাকে কিন্তু পরিশোধ করতে না পারে ও মারা যায় তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা পাওনাদারকে ডাকবেন, তাকে মাফ করতে বলবেন এবং তার বদলায় তাকে বেহেশতের অঢেল নিয়ামত দেয়ার আশ্বাস দেবেন। ফলে পাওনাদার তার পাওনা মাফ করে দেবে। কিন্তু যদি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করে বা দুনিয়ায় থাকতে মাফ করিয়ে না নেয়, কেয়ামতের দিন তার ক্ষমার কোন উপায় নেই।

ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব ও গড়িমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা

সর্বোত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করা

(আরবী*************************************************)

১০৯.হযরত আবু রাফে (রা) বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) একটি অল্পবয়স্ক উট এক ব্যক্তির কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এরপর তাঁর কাছে যাকাতের কিছু উট এল। তাই তিনি আমাকে আদেশ দিলেন ঐ ব্যক্তির অল্পবয়স্ক উটের ঋণ যেন পরিশোধ করে দেই। আমি বললাম এই উটগুলোর ভেতরে তো কেবল একটা উটই এমন আছে যা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট এবং সাত বছর বয়স্ক। রাসূল (সা) বললেন ওটাই তাকে দিয়ে দাও। কেননা সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম মানুষ, যে সর্বোত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করে। (মুসলিম)

ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে তালবাহানা করা যুলুম

(আরবী****************************************************)

১১০.রাসূল(সা) বলেছেন ধনী ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের তালবাহানা করা যুলুম। আর যদি কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বলে যে, তুমি তোমার ঋণ অমুক সচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নাও। তাহলে অযথা সেই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়ে থাকা উচিত নয়। তার এই অনুরোধ গ্রহণ করা ও সে যে ব্যক্তির বরাত দিয়েছে তার কাছে গিয়ে নিয়ে নেয়া উচিত। (বোখারী, মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)

এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, যার কাছে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই এবং সে ঋণদাতাকে বলে যে, অমুক ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নিন। আমার সাথে তার আলোচনা হয়েছে এবং সে ঋণ পরিশোধ করে দিতে সম্মত আছে। সেই তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণদাতার ঋণের অর্থ না নিয়ে আমি তোমার কাছ থেকেই নেব। আমি আর কাউকে চিনিনা ইত্যাদি বলা উচিত নয়। বরঞ্চ তার সাথে নমনীয় ও উদার আচরণ করা উচিত এবং যার বরাত দিয়েছে তার কাছ থেকেই নেয়া উচিত।

ঋণ পরিশোধের নিয়ত থাকলে আল্লাহ তা পরিশোধ করে দেবেন

(আরবী******************************************)

১১১.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জনগণের কোন সম্পদ ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে এবং তা পরিশোধ করার নিয়ত তাঁর থাকে, তার ঐ ঋণ আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি তা আত্নসাত করার নিয়ত রাকে আল্লাহ তাকে সেই কারণে ধ্বংস করে দেবেন। (বোখারী, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)

ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না করার ভয়ংকর পরিণাম

(আরবী******************************************)

১১২.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম সত্ত্বেও তালবাহানা ও গড়িমসি করে, তার অপমানিত হওয়া ও শাস্তি পাওয়া বৈধ হয়ে যায়। (আবু দাউদ)

অপমানিত হওয়া ও শাস্তি পাওয়া বৈধ হওয়ার অর্থ হলো, যে ব্যক্তি ঋণ নেয় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করতে তালবাহানা করে তার এ অপরাধটা এতই খারাপ যে, সমাজের চোখে তার সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা বৈধ হয়ে যায় এবং তাকে শাস্তি দেয়া যায়। যে দেশে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা চালু থাকবে, সে দেশে এ ধরনের লোক থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারীরা তাকে শাস্তি দিতে পারবে এবং তাকে সম্ভাব্য বিভিন্ন উপায়ে অপমানিত করতে পারবে।

জবর দখল ও খেয়ানত

যুলুম ও জবরদস্তির মাধ্যমে অন্যের সম্পত্তি দখল করা

(আরবী********************************************)

১১৩.রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত পরিমাণ ভূমিও অত্যাচার ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে দখল ও আত্নসাত করবে। আল্লাহ কেয়ামতের দিন সাতটা পৃথিবী তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেবেন। (বোখারী)

যে সম্পদ তার মালিক খুশী মনে দেয় না তা হালাল নয়

(আরবী***********************************************)

১১৪.রাসূল(সা) বলেছেনঃ সাবধান, কেউ যুলুম করো না। কোন ব্যক্তির সম্পদ ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল নয়, যতক্ষণ তার মালিক সন্তুষ্ট চিত্তে তা না দেয়। (বায়হাকী)।

ধার কর্জ ফেরত দেয়া অপরিহার্য

(আরবী****************************************************)

১১৫. রাসূল (সা) বলেছেনঃ ধারে নেয়া জিনিস, দুধ খাওয়ার জন্য প্রদত্ত জন্তু ও ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি কারো জামিন হবে তাকে তার জামানত অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। (তিরমিযি)

অর্থাৎ যে জিনিস কারো কাছ থেকে সাময়িক ব্যবহারের জন্য চেয়ে আনা হয় তা ব্যবহারের পর ফেরত দিতে হবে। আরবের রীতি ছিল যে, ধনী লোকেরা নিজেদের আত্নীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে দুধ খাওয়ানোর জন্য উটনী দিত। একে মিনহা বলা হতো। হাদীসের মর্ম এই যে দুধ খাওয়ার জন্য যে জন্তু দেয়া হবে তার দুধ শেষ হওয়া মাত্রই জন্তুকে মালিকের নিকট ফেরত দিতে হবে। আর ঋণ অবশ্যই যথা সময়ে পরিশোধ করতে হবে। আত্নসাত করা যাবে না। আর যে ব্যক্তি কারো জামিন হবে, তার কাছ থেকে জামানত অবশ্যই আদায় করতে হবে।

খেয়ানতকারীর সাথে খেয়ানত করা যাবে না

(আরবী**********************************************)

১১৬.রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমাকে বিশ্বস্ত মনে করে যে ব্যক্তি তোমার কাছে কোন আমানত রাখবে, তার আমানত ফিরিয়ে দিও। আর যে ব্যক্তি তোমার সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাস ঘাতকতা করবে, তুমি তার সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না। (নিজের ন্যায় পাওনা আদায়ে অন্য কোন বৈধ পন্থা অবলম্বন কর। ) (তিরমিযি)

যেখানে খেয়ানত, সেখানে শয়তান

(আরবী***********************************************)

১১৭.রাসূল(সা) বলেছেন আল্লাহ তায়ালা বলেন যতক্ষণ কোন কারবারের দুই সহযোগী পরস্পরের সাথে খেয়ানত বিশ্বাসঘাতকতা না করবে ততক্ষণ আমি তাদের সাথে থাকি। কিন্তু যখন এক শরীক অপর শরীকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন আমি সেই দুজনের মধ্য থেকে বের হয়ে আসি। আর আমার বের হওয়ার সাথে সাথে সেখানে চলে আসে শয়তান। (আবু দাউদ)

এ হাদীসের মর্ম হলো, কারবারে শরীক লোকেরা যতক্ষণ পরস্পরের সাথে খেয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা ও ধোকাবাজি ঠগবাজী না করে, ততক্ষণ আমি তাদেরকে সাহায্য করি, তাদের উপর রহমত ও করুণা বর্ষণ করি এবং তাদের ব্যবসায়ে ও পারস্পরিক সম্পর্কে বরকত দেই। কিন্তু যখন তাদের কারো নিয়ত তথা মানসিকতা খারাপ হয়ে যায় এবং বিশ্বাস ঘাতকতায় লিপ্ত হয়, তখন আমি সাহায্য ও রহমত বর্ষণ বন্ধ করে দেই। এরপর সেখানে শয়তান চলে আসে এবং তাদের উভয়কে ও তাদের কারবারকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।

ক্ষেত খামার ও বাগান করা সদকায় পরিণত হয়

(আরবী******************************************)

১১৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে মুসলমান কৃষি কাজ করে, গাছের চারা লাগায় এবং তা তেকে (ফলমুল ও চারা) পাখী, মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী খেয়ে ফেলে, তা তার জন্য সদকায় পরিণত হবে। (মুসলিম)

প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকে রাখার ভয়াবহ পরিণাম

(আরবী****************************************)

১১৯.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তিন শ্রেণীর ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কেয়ামতের দিন কথাও বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না, প্রথমত, যারা নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যে কসম খেয়ে বলে যে, এর যত দাম আমি চাইছি, তার চেয়ে বেশী দাম খরিদ্দাররা বলে গেছে। দ্বিতীয়তঃ যারা আছরের নামাযের পর মিথ্যে কসম খায় এবং তার মাধ্যমে কোন মুসলমানকে ঠকিয়ে তার পণ্য নিয়ে নেয়। তৃতীয়তঃ যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানির অধিকারী হয়ে তা আটকে রাখে এবং কাউকে দেয়না। শেষোক্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেনঃ তুমি যেমন তোমার অতিরিক্ত পানি আটকে রেখেছ অথচ তুমি পানির স্রষ্টা নও, আমি তেমনি আজ (তোমার প্রতি) আমার অনুগ্রহ আটকে রাখবো। (বোখারী, মুসলিম)

শ্রমিকের মজুরী ঘাম শুকানোর আগে দিতে হয়

(আরবী********************************************)

১২০.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও। (ইবনে মাজা)

বস্তুত শ্রমিক বলাই হয় সেই ব্যক্তিকে, যে নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ভরণ পোষণ চালানোর জন্য প্রতিদিন শ্রম খাটাতে বাধ্য হয়। তখন তার মজুরী যদি পরবর্তী কোন দিনে দেয়া হবে বলে বিলম্বিত করা হয়, অথবা আত্নসাত করা হয়, তাহলে ঐ দিন সন্ধ্যায় সে নিজেই বা কী খাবে। আর তার ছেলেমেয়েকেই বা কি খাওয়াবে?

শ্রমিকের মজুরী আত্নসাতের পরিণাম

(আরবী**********************************************)

১২১.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ যে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ আমি কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবোঃ এক, যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং তারপর তা ভঙ্গ করে। দুই, যে ব্যক্তি কোন সম্ভ্রান্ত ও স্বাধীন ব্যক্তিকে (অপহরণ করে) বিক্রি করে দেয় এবং তার পণ্যের অর্থ আত্নসাত করে। তিন, যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে নিয়োগ করলো, তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করলো, অতঃপর কাজ আদায় করার পর তাকে মজুরী দিল না। (বোখারী)

অবৈধ ওসিয়ত

অবৈধ ওসিয়ত

অবৈধ ওসিয়ত ষাট বছরের এবাদত বিনষ্ট করে দেয়

(আরবী********************************************)

১২২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন পুরুষ ও নারী একাধারে ষাট বছর আল্লাহর এবাদতে কাটিয়ে দেয়ার পরও যদি মৃত্যুর সময়ে এমন ওসিয়ত করে যাতে উত্তরাধিকারীদের ক্ষতি হয়, তবে সেই পুরুষ ও নারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়। এরপর হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা হাদীসের সমর্থনে সূরা নিসার (আরবী******) থেকে (আরবী*****) পর্যন্ত আয়াতাংশ পাঠ করে শোনান। (মুসনাদে আহমদ)

কখনো কখনো একজন সৎ লোকও নিজের আত্নীয় ও ঘনিষ্টজনদের ওপর ক্ষিপ্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং কামনা করে যেন তারা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোন অংশ না পায়। এ ধরনের লোকেরা মৃত্যুর সময় তার সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পর্কে এমন ওসিয়ত করে যায়, যার কারণে এক বা একাধিক উত্তরাধিকারী সেই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। অথচ কোরআন ও হাদীসের আলোকে তাদের অংশ পাওয়া অপরিহার্য ও অখণ্ডনীয়। এ ধরনের পুরুষ ও নারী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে, তারা একাধারে ষাট বছর আল্লাহর এবাদত করেও শেষ পর্যন্ত জাহান্নামের যোগ্য হয়।

হযরত আবু হুরায়রা হাদিসটির সমর্থনে যে আয়াত পড়লেন, তা সূরা নিসার ২য় রুকুতে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা উত্তরাধিকারীদের অংশ নির্ধারণ করার পর আয়াতে বলেছেন যে, এই অংশগুলো উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত ও ঋণ পরিশোধ করার পর। তারপর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সাবধান। ওসিয়তের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের ক্ষতি করবে না। এটা আল্লাহর কঠোর নির্দেশ, তিনি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর রচিত এ আইন অজ্ঞতাপ্রসূত নয় বরং জ্ঞান ও বিজ্ঞান ভিত্তিক। এতে যুলুম ও বে ইনসাফীর লেশমাত্র নেই। সুতরাং এ আইনকে সানন্দে মেনে নাও। এর পরের দুটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ এগুলো হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সীমানা। যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, তাদেরকে আল্লাহ এমন মনোরম উদ্যানে তথা জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত থাকবে। সেখানে তারা চিরদিন অবস্থান করবে এবং এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্য হবে এবং তার নির্দিষ্ট সীমাগুলো লঙ্ঘন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, সেখানে তারা চিরদিন অবস্থান করবে এবং তাদেরকে ভোগ করতে হবে অবমাননা কর শাস্তি।

উত্তরাধিকারীকে প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করলে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে

(আরবী********************************************)

১২৩.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারীকে প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন। (ইবনে মাজা)

সকল উত্তরাধিকারীর অনুমতি ছাড়া কোন বিশেষ উত্তরাধিকারীর পক্ষে ওসিয়ত করা যাবে না

(আরবী******************************************************)

১২৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন কোন উত্তরাধিকারীর পক্ষে ওসিয়ত করা জায়েয হবে কেবল তখনই, যখন অন্যান্য উত্তরাধিকারী তাতে সম্মতি দেবে। (মেশকাত)

এক তৃতীয়াংশের বেশী ওসিয়ত করা যাবে না

(আরবী**********************************************************)

১২৫.হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) বলেনঃ আমি রুগ্ন থাকা অবস্থায় রাসূল(সা) আমাকে দেখতে এলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি ওসিয়ত করেছ? আমি বললাম, হাঁ করেছি। তিনি বললেন কতটুকু? আমি বললামঃ তারা ধনী সচ্ছল। না, এক দশমাংশ ওসিয়ত কর। এরপর আমি ক্রমাগত বলতে লাগলাম যে, এতো খুবই কম। আরো বেশী ওসিয়ত করার অনুমতি দিন। অবশেষে রাসূল (সা) বললেনঃ বেশ তুমি নিজের সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ ওসিয়ত কর। এক তৃতীয়াংশ একটি বিরাট অংশ। (তিরমিযি)

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, মৃত ব্যক্তি নিজের সম্পত্তির মাত্র এক তৃতীয়াংশের ভেতরে ওসিয়ত করতে পারে, এর বেশী নয়। এর মধ্যে সে কোন মাদ্রাসা কিংবা মসজিদের জন্য যতটুকু ইচ্ছা ওয়াকফ করে দিতে পারে অথবা যে কোন অভাবী মুসলমানের পক্ষে ওসিয়ত অর্থাৎ দান করতে পারে। এ ব্যাপারে সে স্বাধীন। তবে সর্বপ্রথম তার এটা খতিয়ে দেখা বাঞ্ছনীয় যে, নিজের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনদের কেউ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে কিনা এবং তার আর্থিক অবস্থা কেমন। যদি কেউ এমন থেকে থাকে, যে আইনগতভাবে উত্তরাধিকারের কোন অংশ পায়নি (যেমন তার জীবদ্দশায় তার ছেলে বা মেয়ে মারা গেছে এবং নাতি নাতনী ও পৌত্র পৌত্রীরা বাবার উত্তরাধিকার পায়নি। – অনুবাদক) তার সন্তান সন্ততি আচে এবং আর্থিক অবস্থাও সচ্ছল নয়, তাহলে তার জন্য ওসিয়ত করা অধিকতর সওয়াবের কাজ হবে।

সুদ ও ঘুষ

সুদের সাথে জড়িতরা অভিশপ্ত

(আরবী**********************************************)

১২৬.হযরত ইবনে মাসউদ(রা) থেকে বর্ণিত, যে সুদ খায়, যে খাওয়ায়, দু ব্যক্তি সুদের সাক্ষী হয় এবং যে ব্যক্তি এতদসংক্রান্ত বিবরণ কাগজপত্রে লিপিবদ্ধ করে, তাদের সকলকে রাসূলুল্লাহ (সা) অভিসম্পাত করেছেন। (বোখারী ও মুসলিম)

ভাবনার বিষয় বটে যে, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা) যে গুনাহর জন্য অভিসম্পাত করেন, তা কত বড় সাংঘাতিক গুনাহ! শুধু তাই নয়, নাসায়ী শরীফে বর্ণিত আছে যে, যারা জেনে শুনে সুদ খায়, খাওয়ায়, সাক্ষী হয় এবং সংশ্লিষ্ট দলীল দস্তাবেজ তৈরি করে, তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) কেয়ামতের দিন অভিশাপ দেবেন। এর অর্থ হলো, এ ধরনের লোকদের জন্য (যদি তওবা না করে মারা যায়) তিনি শাফায়াত বা সুপারিশ করা তো দূরের কথা। অভিশাপ দেবেন। আল্লাহর কাছে এমন মহাপাপ থেকে পানাহ চাওয়া উচিত। লানত বা অভিশাপের অর্থ হলো ধিক্কার দেয়া ও তাড়িয়ে দেয়া।

ঘুষখোর ও ঘুষদাতা উভয়ই অভিশপ্ত

(আরবী*************************************)

১২৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ঘুষখোর ও ঘুষদাতা উভয়ের ওপর আল্লাহর অভিশাপ হোক। (বোখারী, মুসলিম)

শাসককে ঘুষদাতা ও ঘুষখোর শাসক উভয়ই অভিশপ্ত

(আরবী*****************************************)

১২৮.হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ শাসককে যে ঘুষ দেয় সে অভিশপ্ত। আর সেই শাসকও অভিশপ্ত যে ঘুষ নেয়। (মুনতাকা)

অন্যের হক বা অধিকার হরণ করার জন্য যে টাকা সরকারের কেরানী ও কর্মচারী কর্মকর্তাদেরকে দেয়া হয়, তাকেই ঘুষ বলা হয়। তবে নিজের ন্যায্য পাওনা আদায় করার জন্য যে অর্থ সরকারের দুর্নীতি পরায়ণ কর্মচারী কর্মকর্তাদেরকে অন্তরের সর্বাত্ন্যক ঘৃণা সহকারে বাধ্য হয়ে দিতে হয় এবং যা না দিলে নিজের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় হয় না, সে অর্থ দেয়ার জন্য মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হবে না, ইনশায়াল্লাহ। অবশ্য এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যে আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হবে না, ইনশাল্লাহ। অবশ্য এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ী হওয়া ও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অপরিহার্য্যতাই জোরদার দাবী জানায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সন্দেহজনক জিনিস ও কাজ বর্জন করা উচিত

(আরবী*********************************************)

১২৯.হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এ দুয়ের মাঝখানে কিছু সন্দেহজনক জিনিস রয়েছে। যে ব্যক্তি সন্দেহজনক গুনাহ বর্জন করবে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ থেকে সহজেই রক্ষা পাবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক গুনাহর কাজ করার দুঃসাহস দেখাবে, তার সুস্পষ্ট গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। গুনাহর কাজগুলো হচ্ছে আল্লাহর নিষিদ্ধ এলাকা। (এর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই এবং বিনা অনুমতিতে প্রবেশ অপরাধ) যে জন্তু নিষিদ্ধ এলাকার আশপাশ দিয়ে বিচরণ করে, সে যে কোন সময় নিষিদ্ধ এলাকার ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। (বোখারী, মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ (সা) এর বক্তব্যের মর্মার্থ এই যে, যে জিনিসের হারাম হওয়া অকাট্য জানা যায় না এবং হালাল হওয়াও সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না বরং তার কতক দিক হালাল মনে হয় এবং কতক দিক হারাম মনে হয়, সে জিনিসের ধারে কাছেও ঘেঁষা মুমিনের উচিত নয়। এ ধরনের সন্দেহ জনক জিনিস বা কাজ থেকে যে ব্যক্তি সংযত হয়ে চলে, সে প্রকাশ্য সুস্পষ্ট হারাম কাজ যে করতে পারে না, তা বলাই নিষ্প্রয়োজন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক জিনিসের অবৈধ দিকগুলো দেখেও তা গ্রহণ করে, তার এই কাজের ফল দাঁড়াবে এই যে, তার মন সুস্পষ্ট হারাম কাজ করতে বা হারাম জিনিস গ্রহণ করতে সাহসী হয়ে উঠবে। এই ধৃষ্টতা মনের খুবই বিপদজনক অবস্থা।

তাকওয়ার পরিচয়

(আরবী******************************************)

১৩০.হযরত আতিয়া সাদী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি কেবল তখনই মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু গণ্য হতে পারে, যখন গুনাহে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে, যাতে গুনাহ নেই তাও বর্জন করে। (তিরমিযি)

অর্থাৎ যে জিনিস মোবাহ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে, যা করলে কোন গুনাহ হ৯য় না, কিন্তু তার শেষ সীমা গুনাহর সাথে মিলিত, সচেতন মানুষ বুঝতে পারে যে, সে যদি ঐ মোবাহ কাজের সীমানার শেষ প্রান্তে বেপরোয়া ঘুরতে থাকে, তাহলে যে কোন মুহূর্তে পা পিছলে গুনাহর মধ্যে নিপতিত হতে পারে, আর এই ভয়ে সে ঐ মোবাহ কাজ দ্বারা উপকৃত হওয়াই বর্জন করে। মনের এই অবস্থাটার নামই তাকওয়া বা খোদাভীরুতা। এ ধরনের সচেতন ও সতর্ক মনের অধিকারী ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে মুত্তাকী বা খোদাভীরু। পবিত্র কোরআনের যে সব আয়াতের লক্ষ্য মানুষকে আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখা, সেখানে আল্লাহ একথা বলেননি যে, আমার নির্ধারিত এই সীমাগুলো লঙ্ঘন করো না বরং বলেছেন, এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। তোমরা এগুলোর কাছেও যেওনা।

সামাজিক বিধান

বিয়ে

বিয়ে চরিত্রের হেফাজত করে

(আরবী*****************************************)

১৩১.হযরত ইবনে মাসউদ(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যার বিয়ের দায়দায়িত্ব বহন করার সামর্থ্য আছে তার বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। আর যার সে সামর্থ্য নেই, যৌন আবেগের তীব্রতা দমনের জন্য তার মাঝে মাঝে রোযা রাখা উচিত। (বোখারী, মুসলিম) অর্থাৎ বিয়ে করলে চোখ এদিক ওদিক লাগামহীনভাবে তাকানো থেকে এবং যৌন ক্ষমতা অপচয় ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা পায়।

পাত্র বা পাত্রীর দ্বীনদারী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে

(আরবী*************************************)

১৩২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ চারটে জিনিসের ভিত্তিতে কোন মেয়েকে বিয়ে করা হয়। মেয়ের ধনসম্পদের প্রাচুর্য, তার বংশীয় সম্ভ্রান্ততা ও মর্যাদা, তার সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী। তবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাও দ্বীনদার নারী লাভ করাকে। তোমার কল্যাণ হোক। (বোখারী, মুসলিম)

হাদিসটির তাৎপর্য এই যে, পাত্রী নির্বাচনে সাধারণত এই চারটে জিনিস দেখা হয়। কেউ পাত্রীর বিত্ত বৈভব ও ধনসম্পদ দেখে, কেউ দেখে তার সামাজিক ও বংশীয় মর্যাদা, কেউ তার বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্যের কারণে বিয়ে করে, আবার কেউ তার দ্বীনদারীকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু রাসূল (সা) মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পাত্রীর খোদাভীতি ও ধার্মিকতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও অগ্রগণ্যতা দিতে হবে। দ্বীনদারী ও খোদাভীতির সাথে যদি অন্য সব গুণাবলীও সমাবেশ ঘটে, তাহলে তো খুবই ভাল কথা। দ্বীনদারীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা শুধু ধনসম্পদ ও রূপ সৌন্দর্যের ভিত্তিতে বিয়ে করা মুসলমানের কাজ নয়।

দ্বীনদার মেয়ে কালো হলেও ভাল

(আরবী********************************)

১৩৩.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তোমরা কেবল সৌন্দর্যের জন্য নারীদেরকে বিয়ে করো না। কেননা এই সৌন্দর্য তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কেবল ধন সম্পদের জন্যও তাদেরকে বিয়ে করো না। কেননা তাদের ধনসম্পদ তাদেরকে অহংকারী বানিয়ে দিতে পারে। বরঞ্চ দ্বীনদারীর ভিত্তিতে তাদেরকে বিয়ে কর। মনে রেখ একটা কালো বাদীও যদি দ্বীনদার হয়, হবে সে আল্লাহর চোখে সুন্দরী সম্ভ্রান্ত অধার্মিক নারীর চেয়ে উত্তম। (মুনতাকা)

দ্বীনদারী ও সচ্চরিত্র পাত্র নির্বাচন না করলে অরাজকতা দেখা দেবে

(আরবী***********************************************)

১৩৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যখন তোমাদের কাছে এমন কোন পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়, যার চরিত্র ও দ্বীনদারীর ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট, তখন তাকে তোমরা বিয়ে দাও। অন্যথায় দেশে ফেতনা ও মারাত্ন্যক অরাজকতা দেখা দেবে। (তিরমিযি)

এ হাদীস প্রথমোক্ত হাদীসের বক্তব্যের সমার্থক। রাসূলুল্লাহ(সা) এর বক্তব্য এই যে, বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারী ও সচ্চরিত্রই আসল বিবেচ্য বিষয়। এটা বিবেচনায় না এনে কেবল ধনসম্পদ ও পারিবারিক মর্যাদাই যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এ দ্বারা মুসলিম সমাজে মারাত্নক বিপর্যয় দেখা দেবে। যারা এতটা দুনিয়া পূজারী হয়ে যায় যে, তাদের চোখে দ্বীনদারীর গুরুত্ব থাকে না এবং ধনসম্পদ ও বিত্তবৈভবই তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তারা সমাজে ইসলামের বিস্তার ও প্রসারের চিন্তা কিভাবে করবে?রাসূল(সা) এ হাদীসে ফেতনা ও ফ্যাসাদ শব্দ দ্বারা এ অবস্থাই বুঝিয়েছেন।

বিয়ে শাদীতে তাশাহহুদ (খুতবা) পড়া

(আরবী***********************************)

১৩৫.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল(সা) আমাদেরকে নামাযের তাশাহহুদও শিখিয়েছেন, বিয়ের তাশাহহুদও শিখিয়েছেন। ইবনে মাসউদ নামাযের তাশাহুদ উল্লেখ করার পর বলেন, বিয়ের তাশাহুদ হচ্ছে এই (মুল হাদীসে দ্রষ্টব্য অনুবাদ এরুপঃ)

সকল কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। আমরা শুধু তারই কাছে সাহায্য চাই, তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিজের অন্যায় অনাচার থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। যাকে আল্লাহ হেদায়াত করেন তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারে না। আর যাকে আল্লাহ বিপথগামী করেন তাকে কেউ হেদায়াত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল। এরপর তিনি তিনটে আয়াত পাঠ করতেন। যথা-(১) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথোচিতভাবে ভয় কর এবং পরিপূর্ণ মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।

(২) হে মানব জাতি, তোমাদের সেই প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তা থেকে তার জোড়াকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই দুজন থেকে বহু নর ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন। আর তোমরা সেই আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের কাছ থেকে পাওনা দাবী করে থাক, আত্নীয় স্বজনের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখ। মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক।

(৩) হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং সঠিক কথা বলো। তা হলে আল্লাহ তোমাদের কাজকেও সঠিক বানিয়ে দেবেন। আর তোমাদের অনিচ্ছাকৃত গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সফলতা লাভ করবে। (তিরমিযি)

এ হাদীসে বিয়ের সময় পঠিত খুতবা শিখানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এ কথা বুঝানো যে বিয়ে শুধু আমোদ ফুর্তির নাম নয় বরং বিয়ে হচ্ছে একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পাদিত একটা চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা স্বীকার করে যে, আমরা দুজনে দুজনের সারা জীবনের সাথী ও সাহায্যকারী হয়ে গেলাম। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় আল্লাহকে ও তার বান্দাদেরকে সাক্ষী করা হয়। এই খুতবার আয়াতগুলো তেকে সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে যে, এই চুক্তির বাস্তবায়নে যদি স্বামী বা স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় এবং চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না করা হয়। তা হলে তার ওপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং সে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। এই তিনটি আয়াতে ঈমান দারদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহর ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষা করার হুকুম দেয়া হয়েছে।

দেনমোহর

মোহর প্রদান করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

(আরবী**************************************)

১৩৫.রাসূল(সা) বলেছেনঃ সেই শর্তটি পূরণ করা সর্বাধিক অগ্রগণ্য যার বলে তোমরা নারীর সতীত্বের মালিক হয়েছ। (অর্থাৎ মোহরানা) (বোখারী, মুসলিম, উকবা ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত)

মোহর ধার্যকরণে বাড়াবাড়ি বর্জনীয়

(আরবী******************************)

১৩৬. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেনঃ সাবধান তোমরা অত্যধিক পরিমাণে মোহর ধার্য্য করো না। কেননা এটা যদি দুনিয়ায় সম্মান ও আভিজাত্যের উপকরণ হতো এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন মুত্তাকী সুলভ কাজ হতো, তাহলে আল্লাহর নবীই সবচেয়ে বেশী পরিমাণে মোহর ধার্য করতেন। কিন্তু রাসূল (সা) ১২ উকিয়ার বেশী মোহর দিয়ে কোন স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন কিংবা কোন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই (তিরমিযি)

হযরত ওমর যে জিনিসটির প্রতিরোধ করতে চাইছেন তা হলো, পারিবারিক ও বংশীয় আভিজাত্যের দম্ভের কারণে লোকেরা এমন মোটা মোটা দাগে মোহর ধার্য করতো, যা দেয়ার সামর্থ্য তাদের থাকতো না। ফলে এই মোহর তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাড়াতো। তাই হযরত ওমর মুসলিম গোত্র ও ব্যক্তিগুলোকে এই আভিজাত্যের বড়াই জাহির করতে নিষেধ করেছেন। সাদাসিধে জীবন যাপনের শিক্ষা দিচ্ছেন এবং রাসূল (সা) এর বাস্তব জীবন যাপন প্রণালী তাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

এক উকিয়া হচ্ছে সাড়ে দশ তোলা রুপার সমান রাসূল (সা) স্বয়ং যে মহিলাকেই বিয়ে করেছেন বা নিজের কন্যাদের বিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশী মোহর তিনি ধার্য করেননি। উম্মাতের জন্য এটা একটা বাস্তব দৃষ্টান্ত। তবে উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার মোহর ব্যতিক্রম। তাঁর মোহর ছিল অনেক বেশী। কেননা ঐ মোহর বাদশাহ নাজ্জাশী ধার্য করেছিলেন এবং তিনিই দিয়ে দিয়েছিলেন। আর বিয়েটি ছিল গায়েবী।

সর্বনিম্ন মোহর সর্বোত্তম

(আরবী*************************************)

১৩৭. উকবা বিন আমের (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন, সর্বোত্তম মোহর হচ্ছে সেটি, যা সবচেয়ে মামুলী তথা সবচেয়ে কম। (নাইলুল আওতার)

অর্থাৎ বেশী মোহর পরিবারে খুবই জটিলতার সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এমনও হয় যে, স্ত্রী থাকতে চায়না । স্বামীও রাখতে চায়না। অথচ তালাক দেয় না শুধু এই ভয়ে যে, তখন মোহর পরিশোধ করতে হবে যা তার সাধ্যতিত। এর ফলে উভয়ের জন্য বাড়ীটা জাহান্নামে পরিণত হয়।

বৌভাতে গরীবদের দাওয়াত দেয়া উচিত

(আরবী************************************************)

১৩৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ওলীমা বা বৌভাতে কেবল ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরীবদেরকে উপেক্ষা করা হয়, আর যে ব্যক্তি ওলীমার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো, সে আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করলো। (বোখারী, মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত) এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, ওলীমা বা বৌভাতের আয়োজন করা সুন্নত। আর যে বৌভাতে কেবল ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরীবদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় না, সেটা খারাপ বৌভাত। অনুরূপভাবে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা সুন্নাতের পরিপন্থী।

ফাসেকের দাওয়াত কবুল করা নিষিদ্ধ

(আরবী****************************************************)

১৩৯.ইমরান বিন হাসীন (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) ফাসেক তথা আল্লাহর অবাধ্য লোকদের দাওয়াত কবুল করতে নিষেধ করেছেন। (মেশকাত) ফাসেক হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের সাথে অগ্রাহ্য করে এবং হালাল ও হারাম মানে না। এ ধরনের লোকের দাওয়াত খেতে যাওয়া উচিত নয়। যে ব্যক্তি ইসলামের অবমাননা করে তার দাওয়াত কবুল করে সম্মান বাড়ানো একজন একজন দ্বীনদার ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে সম্ভব?বন্ধুর শত্রু বন্ধু হতে পারেনা। তবে তার দাওয়াত ভদ্র ও বিনয় ভাষায় ফিরিয়ে দেয়া উচিত।

পিতামাতা ও আত্নীয় স্বজনের অধিকার

বাবার চেয়ে মায়ের অধিকার তিনগুণ বেশী

(আরবী******************************************)

১৪০.এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো হে রাসূলুল্লাহ কোন ব্যক্তি আমার কাছে সবচেয়ে বেশী সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী? তিনি বললেনঃ তোমার মা, সে বললো তারপর কে? তিনি বললেন তোমার মা। সে আবার বললোঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে বললোঃ তারপর কে? তিনি বললেন তোমার বাবা। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বললেনঃ তোমার মা। তারপর তোমার মা। তারপর তোমার মা। তারপর তোমার বাবা। তারপর পর্যায়ক্রমে তোমার আত্মীয়স্বজন। (বোখারী, মুসলিম)

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, মার মর্যাদা বাবার চেয়ে বেশী। কোরআন থেকেও এ কথাই জানা যায়। সূরা লোকমানে আল্লাহ বলেন আমি মানুষকে মা বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছি। এর অব্যবহিত পরেই আল্লাহ আবার বলেছেনঃ তার মা কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে নয় মাস পর্যন্ত তাকে নিজের পেটে বয়ে বেড়িয়েছেন। এ জন্যই আলেমগণ লিখেছেন যে, ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক দিয়ে বাবার এবং খেদমতের দিক দিয়ে মায়ের অধিকার সবচেয়ে বেশী।

বার্ধক্যে মা বাবার খেদমতের গুরুত্ব

(আরবী**********************************************)

১৪১.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন সেই ব্যক্তি ধিকৃত, সেই ব্যক্তি ধিকৃত, সেই ব্যক্তি ধিকৃত। জিজ্ঞেস করা হলো, হে রাসুলুল্লাহ কে? তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি তার মা বাবাকে বা তাদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, তারপরও (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে যেতে পারলো না। (মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত)

মায়ের অবাধ্যতা হারাম

(আরবী*************************************************)

১৪২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর হারাম করেছেন মায়ের অবাধ্য হওয়া, মেয়েদেরকে জ্যান্ত কবর দেয়া এবং লোভ-লালসা ও কৃপণতা। আর তিনি নিষ্প্রয়োজন কথা বলা, বেশী প্রশ্ন করা ও সাহায্য চাওয়া এবং সম্পদ অপচয় করাকে গর্হিত কাজ গণ্য করেছেন।

বেশী প্রশ্ন করার অর্থ হলো নিষ্প্রয়োজন প্রশ্ন করা। অজানা জিনিসকে জানতো চাওয়ার জন্য প্রশ্ন করা দোষের নয়। বনী ইসরাইল যেমন গাভী সম্পর্কে অনর্থক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছিল। সে রকম করা ঠিক নয়। সে ধরনের প্রশ্ন সাধারণত তারই করে থাকে যারা দ্বীন অনুযায়ী কাজ করতে চায়না।

মা বাবার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি করণীয়

(আরবী********************************************)

১৪৩. আবু উসাইদ (রা) বলেন আমরা রাসূল (সা) এর কাছে বসেছিলাম। এমতাবস্থায় বনু সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি রাসূল (সা) এর কাছে এল। সে বললো হে আল্লাহর রাসূল (সা) , মা বাপের ইন্তিকালের পরও কি তাদের কোন হক বাকী থাকে, যা আমার প্রদান করা উচিত? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন হা, তাদের জন্য দোয়া করবে, ক্ষমা চাইবে, তারা যদি (শরীয়াত সম্মতভাবে) কোন ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে, তবে তা পূরণ করবে। যাদের সাথে মা বাপের আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিল, তাদের আত্নীয়তার বন্ধন বজায় রাখবে এবং মা বাপের বন্ধুবান্ধবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। (আবু দাউদ)

দুধ মায়ের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে

(আরবী************************************)

১৪৪.আবু তোফাইল (রা) বলেন আমি রাসূল (সা) কে জিয়াররানা নামক স্থানে গোশত বন্টনরত অবস্থায় দেখলাম। সহসা জনৈকা মহিলা তাঁর কাছে এল এবং রাসূল (সা) এর কাছে চলে গেল। তিনি নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন এবং তাতে সে বসলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ মহিলা কে? লোকেরা বললো, এ মহিলা রাসূল(সা) এর দুধ মা। (আবু দাউদ)

দুধ মা মোশরেক হলেও তাকে সমাদর করতে হবে

(আরবী**********************)

১৪৫. হযরত আবু বকরের মেয়ে আসমা বলেন যে সময়ে কোরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে সন্ধি হয়েছিল (হোদায়বিয়ার সন্ধি) তখন আমার মা (দুধ মা) আমার কাছে এলেন। তিনি তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি বরং মোশরেক ছিলেন। আমি রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম আমার মা আমার কাছে এসেছেন এবং তিনি চান আমি যেন তাকে কিছু দেই। আমি কি তাকে কিছু দিতে পারি? তিনি বললেন হাঁ তুমি তার সাথে মমতা-পূর্ণ আচরণ কর। (বোখারী, মুসলিম)

আত্নীয়তার প্রকৃত সমাদর

(আরবী***************)

১৪৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন আত্নীয় সম্প্রীতি-পূর্ণ আচরণ করলে তার বদলায় সম্প্রীতি-পূর্ণ আচরণকারী প্রকৃত আত্নীয় সমাদর-কারী নয়। বরং আত্নীয়তার প্রকৃত সমাদর হলো, অন্য আত্মীয়স্বজন যখন আত্নীয়সুলভ আচরণ করবে না, তখন তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা ও তাদের হক দেয়া। (বোখারী, ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত)

অর্থাৎ আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে সদাচরণের জবাবে সদাচরণ করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সদাচরণ ও সমাদর নয়। সবচেয়ে বড় আত্নীয় তোষণকারী হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যাকে অন্যান্য আত্নীয়রা দূরে ঠেলে দেয় ও সম্পর্ক ছিন্ন করে, অথচ সে তাদের সাথে সম্পর্ক জোড়ার চেষ্টা করে। অন্য আত্নীয়রা তাকে তার প্রাপ্য হক দেয় না, অথচ সে তাদের সমস্ত হক দিতে সদা প্রস্তুত থাকে। এটা মহত্ব ও মহানুভবতার এত উঁচু একটা স্তর যেখানে আরোহণ করা সর্বোত্তম মানের তাকওয়া ও খোদাভীতি ছাড়া সম্ভব নয়।

অসদাচরণের জবাবে সদাচরণের মর্যাদা

(আরবী*************************)

১৪৭.এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বললো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার এমন কিছু আত্নীয় স্বজন রয়েছে যাদের যাবতীয় অধিকার আমি দিয়ে থাকি। কিন্তু তারা আমার অধিকার দেয় না। আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি, কিন্তু তারা আমার সাথে অসদাচরণ করে। আমি তাদের সাথে সহনশীলতা প্রদর্শন করি, কিন্তু তারা আমার সাথে গোয়ার্তমি করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমার অবস্থা যদি সত্যই তুমি যেমন বলছ তেমন হয়ে থাকে, তাহলে তুমি যেন তাদের মুখে কালিমা লেপন করে চলেছ এবং যতক্ষণ তুমি এই আচরণ বজায় রাখবে, ততক্ষণ আল্লাহ তাদের মোকাবিলায় তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন। (মুসলিম, আবু হুরাইরা(রা) থেকে বর্ণিত)

স্বামী স্ত্রীর অধিকার

স্ত্রীর অধিকার

স্বামী ও স্ত্রীর পানাহার এবং পোশাকের মান সমান হওয়া চাই

(আরবী************************)

মুয়াবিয়ার পুত্র হাকীম তাঁর পিতা মুয়াবিয়া থেকে বর্ণনা করেন, মুয়াবিয়া বলেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, স্বামীর নিকট স্ত্রীর হক (অধিকার) কি কি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ তার হক এই যে, তুমি যখন আহার করবে, তখন তাকেও আহার করাবে, তুমি যখন পোশাক পরিধান করবে, তখন তাকেও পোশাক দেবে, তার মুখে কখনো প্রহার করবে না, তাকে কখনো বদদোয়া করবে না বা অভিশাপ দেবে না। আর তার সাথে কখনো সাময়িক সম্পর্কচ্ছেদ করলে তাকে বাড়ীতে রেখেই করবে। (আবু দাউদ)

অর্থাৎ যে মানের খাদ্য তুমি আহার করবে, সেই মানের খাদ্য তাকেও আহার করাবে, যে মানের পোশাক তুমি পরবে, সেই মানের পোশাক তাকেও পরাবে।

শেষ বাক্যটির ব্যাখ্যা এই যে, স্ত্রী যদি অবাধ্যতা প্রদর্শন ও অসদাচরণ করে, তবে কোরআনের নির্দেশ অনুসারে প্রথমে তাকে নম্র ও কোমল ভাষায় বুঝাতে হবে, তাতেও যদি ভালো না হয় তবে বিছানা আলাদা করে নেবে। কিন্তু উভয়ের বিছানা বাড়ীর ভেতরেই থাকা চাই। উভয়ের ভেতরের অসন্তোষের বিষয়টি বাইরে ফাঁস হতে দেবে না। কেননা এটা পারিবারিক সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী। এতেও ভালো না হলে স্ত্রীকে মৃদু প্রহার করা যেতে পারে। তবে মুখমণ্ডল বাদ দিয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে। তাও এতটা সাবধানে মারতে হবে যেন কোন ক্ষত না হয় বা হাড় না ভাঙ্গে।

স্ত্রীর সাথে দাসীবাঁদীর মত আচরণ করা চলবে না

(আরবী*********************************)

১৪৯.লোকিত বিন সাবেরা (রা) বলেন, আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহ, আমার স্ত্রী খুবই কটুভাষী। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ তালাক দিয়ে দাও। আমি বললাম আমাদের একটা সন্তান রয়েছে। তা ছাড়া আমরা এক সাথে বহু দিন কাটিয়ে এসেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ তাহলে তাকে উপদেশ দিতে থাক। তার ভেতরে সৎ পথ অবলম্বনের যোগ্যতা থাকলে সে তোমার উপদেশ মেনে নেবে। সাবধান, তোমার স্ত্রীকে দাসীবাঁদীর মত মারপিট করবে না। (আবু দাউদ)

এ হাদীসের শেষ বাক্যটার অর্থ এটা নয় যে, দাসীবাঁদীদেরকে যেমন ইচ্ছা মারপিট করা যাবে। এর অর্থ এই যে, সচরাচর দাসীবাঁদীর সাথে যে রকম আচরণ করা হয়ে থাকে, স্ত্রীর সাথে সে রকম আচরণ করা উচিত নয়।

প্রহারকারী স্বামীরা সর্বোত্তম মানুষ নয়

(আরবী*******************)

১৫০.রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন তোমরা আল্লাহর বাঁদিদেরকে (অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে) মারপিট করো না। এরপর ওমর (রা) এলেন। তিনি বললেন, আপনার এই আদেশের কারণে স্বামীরা মারপিট করা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে স্ত্রীরা স্বামীদের মাথায় চড়ে বসেছে এবং তাদের ধৃষ্টতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ কথা শুনে রাসূল (সা) পুনরায় প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহর (সা) সহধর্মিণীদের কাছে বহু মহিলা আসতে লাগলো এবং তাদের স্বামীরা তাদেরকে মারপিট করে বলে অভিযোগ করতে লাগলো। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ আমার স্ত্রীদের কাছে বহু মহিলা তাদের স্বামীদের মারপিটের অভিযোগ নিয়ে আসছে। মারপিটের স্বামীরা সর্বোত্তম মানুষ নয়। (আবু দাউদ, আয়াস ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত)

স্ত্রীদের মধ্যে শুধু দোষ থাকেনা গুণও থাকে

(আরবী*********************)

১৫১.রাসূলূল্লাহ (সা) বলেনঃ কোন মুমিন স্বামীর নিজের মুমিন স্ত্রীকে ঘৃণা করা উচিত নয়। তার একটা অভ্যাস যদি স্বামীর খারাপ লাগে, তবে অন্য একটা অভ্যাস ভালো লাগবে। (মুসলিম)

অর্থাৎ স্ত্রী যদি সুদর্শনা না হয়ে থাকে কিংবা অন্য কোন দোষ ত্রুটি তার ভেতরে থেকে থাকে, তাহলে সেজন্য তৎক্ষণাৎ সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেল না। একজন নারীর ভেতরে যদি কোন দিক দিয়ে কোন কমতি বা অসন্তোষজনক ব্যাপার থেকে থাকে, তবে অন্য বহু দিক এমনও থাকতে পারে, যা দিয়ে সে স্বামীর হৃদয় জয় করে নিতে সক্ষম, যদি তাকে সময় ও সুযোগ দেয়া হয় এবং তার একটি ত্রুটির কারণে মনে তার প্রতি চিরস্থায়ী ঘৃণা ও বিদ্বেষ বদ্ধমূল করে না নেয়া হয়।

স্বামী স্ত্রী উভয়ের অধিকার আছে

(আরবী******)

১৫২.আমর বিন আহওয়াস জুশামী(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলের (সা) ভাষণ শুনেছেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর বিভিন্ন রকমের উপদেশ দিলেন, অবশেষে বললেনঃ হে জনতা শোন, স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ কর। কেননা তারা তোমাদের কাছে কয়েদীর মত। তারা খোলাখুলি অবাধ্যতা প্রদর্শন না করা পর্যন্ত তাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করবে না। যখন তা করবে, তখন তাদের সাথে বিছানায় সম্পর্ক ছিন্ন কর। (অর্থাৎ দুজনের বিছানা আলাদা কর অথবা একই বিছানায় পৃথক পৃথকভাবে শয়ন কর। –অনুবাদক) আর তাদেরকে এমনভাবে প্রহার করতে পার যা খুব কঠোর অর্থাৎ ক্ষত সৃষ্টিকারী না হয়। এরপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তাহলে আর তাদেরকে কষ্ট দেয়ার বাহানা খুঁজো না। শুনে নাও, তোমাদের কাছেও তোমাদের স্ত্রীদের কিছু অধিকার প্রাপ্য আছে, আর তোমাদের স্ত্রীদের কাছেও তোমাদের কিছু অধিকার প্রাপ্য রয়েছে। তাদের কাছে তোমাদের প্রাপ্য অধিকার এই যে, তোমরা পছন্দ করো না এমন কাউকে যেন তোমাদের বিছানা মাড়াতে না দেয় এবং তোমরা পছন্দ করোনা না এমন কাউকে তোমাদের বাড়ীতে যেন আসতে না দেয়। আর শুনে নাও, তোমাদের কাছে তাদের প্রাপ্য অধিকার এই যে, তোমরা তাদেরকে যথাযথভাবে খোরপোষ দেবে। (তিরমিযি)

পরিবারের পেছনে ব্যয় সদকাস্বরুপ

(আরবী******)

১৫৩. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন পরকালে সওয়াব পাওয়া যাবে এই নিয়তে কোন ব্যক্তি যখন নিজ পরিবারে পেছনে অর্থ ব্যয় করে, তখন তা সদকায় পরিণত হয়। (বোখারী ও মুসলিম)

পোষ্যদেরকে নষ্ট হতে দেয়া উচিত নয়

(আরবী****************)

১৫৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন মানুষের গুনাহগার তওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাদের ভরণ পোষণ করে তাদেরকে নষ্ট হতে (অর্থাৎ বিপথগামী হতে ) দেবে। (আবু দাউদ। )

একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার না করার পরিণাম

(আরবী***************)

১৫৫. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তির দুজন স্ত্রী রয়েছে, সে যদি তাদের সাথে সুবিচার না করে তবে সে কেয়ামতের দিন তার অর্ধেক দেহ ফেলে রেখে আসবে। (তিরমিযি)

যে স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার সে দেয়নি, সে তো তার দেহেরই অংশ ছিল। তার প্রতি অবিচার করার মাধ্যমে সে তো তার দেহেরে অর্ধাংশ দুনিয়াতেই কেটে রেখে এসেছে। কাজেই কেয়ামতের দিন সে পূর্ণাঙ্গ দেহ পাবে কোথায়?

স্বামীর অধিকার

স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর বেহেশতে যাওয়ার অন্যতম উপায়

(আরবী**********)

১৫৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন স্ত্রী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন সে বেহেশতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে। (মেশকাত)

সর্বোত্তম স্ত্রী

(আরবী*************)

১৫৭.রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বোত্তম স্ত্রী কে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন যে স্ত্রীর দিকে তাকালেই স্বামী খুশী হয়, স্বামী নির্দেশ দিলেই তা পালন করে এবং নিজের ও নিজের সহায় সম্পদের ক্ষেত্রে এমন কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করে না, যা স্বামী অপছন্দ করে। (নাসায়ী)

এখানে নিজের সহায় সম্পদ দ্বারা সেই সম্পদ সম্পত্তিকে বুঝানো হয়েছে, যা স্বামী গৃহকত্রী হিসাবে স্ত্রীর কাছে সোপর্দ করেছে।

স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোযা রাখা জায়েয নেই

(আরবী*********************)

১৫৮.আবু সাঈদ(রা) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে আমরা বসেছিলাম। এমতাবস্থায় এক মহিলা তাঁর কাছে এল। সে বললো সাফওয়ান ইবনুল মুয়াত্তাল আমার স্বামী। আমি নামায পড়লে আমাকে মারপিট করে, রোযা রাখলে রোযা ভাংতে বলে। আর সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ফজরের নামায পড়ে না। এ সময়ে সাফওয়ান ওখানেই বসা ছিলেন। রাসূল (সা) সাফওয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, তার স্ত্রীর অভিযোগ সম্পর্কে তার বলার কি আছে। সাফওয়ান বললেনঃ হে রাসূলুল্লাহ, নামায পড়লে মারপিটের যে অভিযোগ সে করেছে, তার প্রকৃত রহস্য এই যে, সে নামাযে দুটো সূরা পড়ে। অথচ আমি তা করতে থাকে নিষেধ করেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন একটা সূরা পড়াই যথেষ্ট। সাফওয়ান বললেন রোযা ভাঙ্গনের অভিযোগের রহস্য এই যে, সে ক্রমাগত ভাবে রোযা রাখতে থাকে, অথচ আমি যুবক মানুষ। ধৈর্য ধারণ করতে পারি না। রাসূল (সা) অতঃপর বললেনঃ কোন স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া (নফল) রোযা রাখতে পারেনা। অতঃপর সাফওয়ান বললেনঃ সূর্য ওঠার পর নামায পড়া সম্পর্কে আমার বক্তব্য এই যে, আমার এমন এক গোত্রের লোক যার সম্পর্কে সবাই জানে যে, আমরা সূর্য ওঠার আগে জাগতে পারি না। রাসূল (সা) বললেন হে সাফওয়ান ঘুম থেকে যখনই জাগবে তখনই নামায পড়ে নিও। (আবু দাউদ)

এ হাদীস থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে-

১.স্ত্রীকে ফরয নামায পড়তে নিষেধ করার অধিকার তো কোন স্বামীর নেই, তবে স্বামীর প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখা স্ত্রীর কর্তব্য। দ্বীনদারীর আবেগে লম্বা লম্বা সূরা কিরাত পড়া তার উচিত নয়। নফল নামাযের বেলায়ও স্বামীর প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার অনুমতি চাড়া নফল নামাযে নিয়োজিত থাকা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে নফল রোযাও তার অনুমতি ছাড়া রাখা যাবে না।

২.সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল রাত জেগে মানুষের ক্ষেত খামারে পানি দিতেন। রাতের একটা বিরাট অংশ জুড়ে এ ধরনের পরিশ্রম করলে ঠিক সময়ে জেগে ফজরের নামায পড়া যে সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা) উচুস্তরের সাহাবী। তাঁর সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না যে, তিনি ফজরের নামাযের ব্যাপারে শিথিল, অসতর্ক বা বেপরোয়া ছিলেন। সম্ভবত ঘটনাক্রমেই এমন হতো যে, রাতে দেরীতে ঘুমিয়েছেন, সকালে কেউ জাগায়নি, ফলে ফজরের নামায কাযা হয়ে গেছে। এ রকম পরিস্থিতির কারণেই রাসূল (সা) বলেছেন, হে সাফওয়ান যখনই ঘুম থেকে ওঠো, নামায পড়ে নিও। নতুবা রাসূলের দৃষ্টিতে তিনি যদি নামাযের ব্যাপারে শিথিল ও অসাবধান হতেন, তাহলে তাঁর ওপর তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করতেন।

নারীর অকৃতজ্ঞতার ব্যাধি

(আরবী************)

১৫৯.আসমা বিনতে ইয়াজিদ(রা) বলেন আমি আমার সমবয়স্কা কয়েকটি মেয়ের সাথে বসেছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদেরকে সালাম করলেন এবং বললেন তোমরা সদাচারী স্বামীর অকৃতজ্ঞতা থেকে দূরে থাক। তোমাদের অনেকের এমন হয়ে থাকে যে, দীর্ঘদিন মা বাবার বাড়ীতে কুমারী অবস্থায় কাটিয়ে দেয়, তারপর আল্লাহ তাকে স্বামী দান করেন, তাঁর পক্ষ থেকে তার সন্তানাদিও হয়, তারপর কোন এক ব্যাপারে সে রেগে যায় এবং স্বামীকে বলেঃ তোমার কাছ থেকে কখনো শান্তি পেলামনা, তুমি আমার সাথে কখনো ভালো আচরণ করলে না। (আদাবুল মুফরাদ)

এ হাদীসে মহিলাদেরকে অকৃতজ্ঞতা থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এটা মহিলাদের একটা সাধারণ ব্যাধি। তাই মহিলাদের এটি থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত।

নেককার স্ত্রী সর্বোত্তম সম্পদ

(আরবী*************)

১৬০.ছাওবান (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ যখন এ আয়াত নাযিল হলো, যারা সোনা, রুপা সঞ্চয় করে রাখে----- তখন আমাদের কেউ কেউ বললো এ আয়াত তো সোনা রুপা সঞ্চয় করা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যা দ্বারা বুঝা গেল, সোনা, রুপা সঞ্চয় করা ভালো কাজ নয়। আমরা যদি জানতাম কোন সম্পদ উত্তম, তাহলে সেটাই সঞ্চয় করার কথা ভাবতাম। রাসূল (সা) বললেন সর্বোত্তম সম্পদ হলো আল্লাহকে স্মরণকারী জিহ্বা, আল্লাহর শোকরকারী মন এবং নেককার স্ত্রী যে স্বামীকে ইসলামের পথে টিকে থাকতে সাহায্য করে। (তিরমিযি)

এ হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, আল্লাহর যিকির বা স্মরণ জিহ্বা দ্বারা করা উচিত, আর যে যিকির শোকরে মনোভাব নিয়ে করা হয় সেই যিকিরই কাঙ্ক্ষিত। এও জানা গেল যে, যে স্ত্রী নিজের দ্বীনদার স্বামীর সাথে দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসিবতেও সংগ দেয় দ্বীনের পথে চলতে উৎসাহ উদ্দীপনা জোদায় এবং পথের বাধা হয়ে দাড়ায় না, সেই স্ত্রী আল্লাহর মস্ত বড় নেয়ামত।

স্ত্রী স্বামীর বাড়ী ও সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক

(আরবী**********)

১৬১.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন তোমাদের প্রত্যেকেই রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। যারা তোমাদের অধীন, তাদের সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে। শাসকও তত্ত্বাবধায়ক এবং তাকে তার শাসিতদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্বামী তার পরিবারপরিজনের তত্ত্বাবধায়ক এবং স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ী ও সন্তানদের তত্ত্বাবধায়ক। মোটকথা তোমাদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক এবং নিজ নিজ অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কোন কোন বর্ণনায় আরো আছেঃ চাকরও তার মনিবের সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক।

হাদীসের এ অংশটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, স্ত্রী তার স্বামীর সন্তান ও ঘরবাড়ীর তত্ত্বাবধায়ক। এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, স্বামী তার স্ত্রীর শুধু খাদ্য পানীয়ের দায়্ত্বিশীল নয়। বরং তার দ্বীনদারী ও চরিত্রেরও রক্ষণাবেক্ষণ তার দায়িত্বের আওতাভুক্ত। আর স্ত্রীর দায়িত্ব তার দ্বিগুণ। সে স্বামীর বাড়ী ও সম্পদের রক্ষক তো আছেই, তার সন্তানদের লালন পালনের বিশেষ দায়িত্বও তার ওপর অর্পিত। কেননা স্বামী তো জীবিকা উপার্জনের তাগিদে বেশীর ভাগ সময় বাইরে কাটাতে বাধ্য হয়। বাড়ীতে ছেলেমেয়েরা মায়ের প্রতিই অধিকতর অনুরক্ত থাকে। তাই ছেলেমেয়েদের লালন পালনের অতিরিক্ত দায়িত্ব তাদের মায়ের ওপরই অর্পিত।

সন্তানদের অধিকার

উত্তম শিক্ষাই উত্তম উপহার

(আরবী***********)

১৬২.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ পিতা সন্তানকে যা কিছুই উপহার দিক, সবচেয়ে ভালো উপহার হলো তাকে উত্তম শিক্ষা দান। (মেশকাত)

সাত বছর বয়সেই নামাযের আদেশ দেয়া চাই

(আরবী********)

১৬৩.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়স থেকেই নামায পড়ার আদেশ দাও। আর দশ বছর বয়সে নামাযের জন্য প্রহার কর এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।

ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসের সারকথা এই যে, ছেলেমেয়েদের বয়স সাত বছর হলেই তাদেরকে নামাযের নিয়ম শোকানো ও নামায পড়তে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। আর দশ বছর বয়সে যদি নামায না পড়ে তবে সেজন্য তাদেরকে মারপিটও করা যেতে পারে। তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তোমরা নামায না পড়লে আমরা অসন্তুষ্ট হই। এই বয়সে ডেপৗচার পর শিশুদের বিছানাও পৃথক করে দেয়া উচিত। এক সাথে একই খাটে বা চৌকিতে একাধিক ছেলেমেয়েকে শুতে দেয়া উচিত নয়।

সৎ সন্তান এক মহা মূল্যবান সম্পদ

(আরবী***************************)

১৬৪. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কেবল তিন রকমের আমল রয়েছে, যার সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। (১) সে যদি সদকায়ে জারিয়া করে যায়। (২) সে যদি এমন কোন জ্ঞান বা বিদ্যা রেখে যায়, যা দ্বারা জনগণ উপকৃত হতে থাকবে, (৩) সে যদি কোন সৎ সন্তান রেখে যায়, যে তার জন্য দোয়া করতে থাকবে।

ব্যাখ্যাঃ সদকায়ে জারিয়া দ্বারা সেই সদকাকে বুঝানো হয়, যা দীর্ঘকাল চালু থাকে। যেমন, খাল বা কুয়া খনন করে দেয়া, প্রবাসীদের বাসস্থান বানিয়ে দেয়া। পথের পারে গাছ লাগিয়ে দেয়া, কোন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী পুস্তকাদি দান করা ইত্যাদি। যতদিন মৃত জনসাধারণ এসব কাজ দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে, ততদিন ব্যক্তি এর সওয়াব পেতে থাকবে। অনুরূপভাবে, সে যদি কাউকে বিদ্যাশিক্ষা দিয়ে যায়, অথবা ধর্মীয় পুস্তকাদি লিখে রেখে যায়, তবে তার সওয়াবও সে পেতে থাকবে।

তৃতীয় যে জিনিসটির সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে, তাহলো তার নিজ সন্তান, যাকে সে প্রথম থেকেই উত্তম শিক্ষা দিয়েছে এবং সেই শিক্ষার ফলে সে খোদাভীরু ও পরহেজগার হিসাবে গড়ে উঠেছে। এই সন্তান যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে, ততদিন তার যাবতীয় সৎকাজের সওয়াব তার বাবা মা কবরে বসে পেতে থাকবে। উপরন্তু সে যেহেতু নেকার সন্তান, তাই তার বাবা মায়ের জন্য তো সে দোয়া করতেই থাকবে এবং তাদ্বারাও বাবা মা উপকৃত হতে থাকবে।

ইয়াতীম ও মেয়ে সন্তান লালন পালনের ফযিলত

(আরবী******************)

১৬৫.ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন এতিমকে আশ্রয় দেবে এবং নিজের খানাপিনায় শরীক করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবধারিত করে দেবেন। অবশ্য সে যদি ক্ষমার অযোগ্য কোন গুনাহ করে থাকে তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি তিনটে মেয়ে অথবা তিনটে বোনের লাল পালন ও অভিভাবকত্ব করবে, তাদের লেখাপড়া করাবে, প্রশিক্ষণ দে;বে এবং তাদের সাথে সদয় আচরণ করবে, যাতে তারা অন্যের মুখাপেক্ষী না থাকে, তার জন্য আল্লাহ বেহেশত অবধারিত করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, যদি বোন বা মেয় মাত্র দুটোই হয়, তাহলেও? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন দুটো মেয়ের অভিভাবকত্বের জন্যও একই রকম পুরস্কার। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, লোকেরা যদি একজনের কথা জিজ্ঞেস করতো, তবে তিনি একজনের ব্যাপারেও এরূপ সুসংবাদই দিতেন। আর যে ব্যক্তির দুটো অতি প্রিয় জিনিস আল্লাহ নিয়ে নেন, তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে রাসূলুল্লাহ, দুটো অতি প্রিয় জিনিস কী? তিনি জবাব দিলেনঃ তার দুটো চোখ।

এ হাদীসের যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলোঃ কারো যদি শুধুই মেয়ে হয়, তবে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়, বরং তাদের যথাযথ অভিভাবকত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া উচিত এবং তাদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে দয়া, স্নেহ ও মমতা-পূর্ণ আচরণ করা উচিত। যে ব্যক্তি এরূপ করবে, তাকে রাসূল (সা) বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছেন। অনুরুপ কোন ভাই এর কাচে যদি কয়েকটি ছোট বোন থাকে। তবে তারও উচিত ঐ বোনগুলোকে যেন গলার কাঁটা না মনে করে। বরং সাধ্যমত তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা উচিত। তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা ও দ্বীনদারীর প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত এবং বিয়ে হওয়া পর্যন্ত সদয় ব্যবহার করা উচিত।

পুরুষ সন্তান ও মেয়ে সন্তান বৈষম্য করা উচিত নয়

(আরবী***************)

১৬৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তির মেয়ে সন্তান জন্মে এবং সে জাহেলী প্রথা অনুসারে তাকে জীবিত মাটিতে পুতে ফেলে না, তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করে না কিংবা তার ওপর ছেলে সন্তানকে অগ্রাধিকার দেয় না, তাকে আল্লাহ বেহেশতে প্রবেশ করবেন।

ভালো ব্যবহার করলে মেয়ে সন্তান দোযখ থেকে রক্ষা করবে

(আরবী*************)

১৬৭. হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ আমার কাছে দুটো মেয়েসহ এক মহিলা সাহায্য চাইতে এল। আমার কাছে তখন একটা খেজুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি সেটাই তাকে দিলাম। মহিলা সেই খেজুরটি তার দুই মেয়েকে ভাগ করে দিল এবং নিজে কিছুই খেল না। তারপর সে উঠলো ও চলে গেল। এরপর যখন রাসূল (সা) আমার কাছে এলেন তখন আমি তাকে সেই মহিলার ঘটনা জানালাম (যে সে নিজে ক্ষুধার্ত হয়েও নিজে না খেয়ে নিজের মেয়ে দুটিকে খাওয়ালো। ) রাসূল (সা) বললেন এইসব মেয়ে সন্তান দ্বারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও যে ব্যক্তি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে, মেয়েগুলো তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে। অর্থাৎ আল্লাহ যাকে শুধুই মেয়ে সন্তান দেন, তার জন্য মেয়ে সন্তানও একটি মূল্যবান উপহারস্বরুপ হয়ে থাকে। আল্লাহ দেখতে চান, মা বাবা এসব মেয়ে সন্তানের সাথে কেমন আচরণ করে। মেয়ে সন্তানরা আয় উপার্জন করেও মা বাবাকে দেয় না, তাদেরকে সেবা করার জন্য তাদের কাছে আজীবন থাকে না। তথাপি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে তারা মা বাবার গুনাহ মাফ করানোর ওসীলা হয়ে যাবে।

সন্তানদেরকে উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে সাম্য জরুরী

(আরবী***************)

১৬৮. নুমান বিন বশীর (রা) বলেনঃ আমার বাবা (বশীর) আমাকে সাথে নিয়ে রাসূল (সা) এর কাছে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমার কাছে একটা ক্রীতদাস ছিল, তা এই ছেলেকে দিয়েছি। রাসূল (সা) বললেন, তোমার সব ছেলেকেই কি দিয়েছ?বাবা বললেনঃ না। রাসূল (সা) বললেন তাহলে ক্রীতদাসটি ফেরত নাও। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ রাসূল(সা) বললেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানের সাথে এরূপ আচরণ করেছ? বাবা বললেন না । রাসূল(সা) বললেন আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজের সন্তানদের সাথে সমান আচরণ কর। এরপর বাবা বাড়ী ফিরে আমাকে দেয়া ক্রীতদাসটি ফিরিয়ে নিলেন। অপর বর্ণনায় আছে, রাসূল (সা) বললেনঃ তাহলে আমাকে সাক্ষী বানিও না। আমি যালেমের সাক্ষী হব না।

আরো একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়ঃ রাসূল (সা) বললেন, তুমি কি চাও যে সকল ছেলে তোমার সাথে সমান আচরণ করুক?বাবা বললেনঃ হা। রাসূল (সা) বললেনঃ তাহলে এরূপ করো না।

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, সন্তানদের সাথে সমান আচরণ করা উচিত। নচেৎ তা হবে যুলুম। সমান আচর না করলে তাদের মন খারাপ হবে এবং যে সন্তানরা বঞ্চিত হবে বা কম পাবে, তাদের মনে বাবার প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হবে।

প্রাক্তন স্বামীর সন্তানদেরকে দান করলেও সওয়াব হবে

(আরবী********************)

১৬৯.হযরত উম্মে সালমা(রা) বলেনঃ আমি রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি আবু সালমার সন্তানদেরকে দান করি, তাহলেও কি আমি সওয়াব পাব?আমি তো তাদেরকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দিতে পারি না। কারণ তারা তো আমারই সন্তান। রাসূল (সা) বললেন হা, তুমি তাদের পেছনে যা কিছু ব্যয় করবে, তারও সওয়াব পাবে।

হযরত উম্মে সালমা (রা) এর প্রথম স্বামীর নাম আবু সালমা (রা) তার ইন্তিকালের পরে তিনি রাসূল (সা) এর সহধর্মিণী হন। তাই আবু সালমার ঔরসে তার যেসব সন্তান ছিল, তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন।

যে মহিলা শিশু সন্তানের লালন পালনের খাতিরে পুনরায় বিয়ে করে না

(আরবী***********)

১৭০. রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন আমি ও ঝলসে যাওয়া মুখমন্ডলধারিনী কেয়ামতের দিন এই দু আঙ্গুলের মত থাকবো। (বর্ণনাকারী সাহাবী এযীদ বিন যারী নিজের লাগোয়া দুই আঙ্গুর দেখান) অর্থাৎ যে মহিলার স্বামী মারা গেছে এবং সে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও সুন্দরীও বটে, কিন্তু সে তার মৃত স্বামীর সন্তানদের খাতিরে পুনরায় বিয়ে করে না এবং তারা তার কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া বা মৃত্যু বরণ করা পর্যন্ত সে তাদের কাছেই থাকে। (আবু দাউদ, আওফ বিন মালেক থেকে বর্ণিত)

এ হাদীসের মর্ম এই যে, কোন মহিলা যদি বিধবা হয়, তার ছোট ছেলে মেয়ে থাকে এবং লোকেরা তাকে বিয়ে করতে আগ্রহীও হয়। কিন্তু সে তার সেই এতীম শিশুদের লালনপালনের খাতিরে পুনরায় বিয়ে করে না এবং সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষণ করে জীবন যাপন করে, তবে এ ধরনের মহিলা কেয়ামতের দিন রাসূল (সা) এর নৈকট্য লাভ করবে।

তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের ভরণ পোষণ সর্বোত্তম সদকা

(আরবী*****************)

১৭১.রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বোত্তম সদকা কি, তা কি আমি বলে দেব? তা হচ্ছে তোমার সেই মেয়ে, যাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তুমি ছাড়া তার আর কোন উপার্জনকারী নেই।

অর্থাৎ কদাকার বা শারীরিক খুঁত থাকার কারণে যে মেয়ের বিয়ে হয় না, কিংবা বিয়ের পর তালাকপ্রাপ্ত হয় এবং মা অথবা বাবা চাড়া তার ভরণ পোষণকারী আর কেউ নেই। তার পেছনে যা কিছু করা হবে, তা হবে আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোত্তম সদকা।

এতীমের হক বা অধিকার

এতীমের লালন পালনের ফযিলত

(আরবী*****************)

১৭২.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন আমি ও এতীমের পৃষ্ঠপোষক এবং অন্যান্য অসহায় মানুষের পৃষ্ঠপোষক বেহেশতে এভাবে এক সাথে থাকবো। এ কথা বলে তিনি লাগোয়া দুটো আঙ্গুলকে দেখালেন এবং উভয়ের মাঝখানে সামান্য ফাঁকা রাখলেন।

অর্থাৎ এতীমদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীরা বেহেশতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য অবস্থান করবে। আর এ সুসংবাদ শুধু এতীমের পৃষ্ঠপোষকের জন্য নয়, বরং অসহায় ও পরমুখাপেক্ষী লোকদের পৃষ্ঠপোষকদের জন্যও বটে।

এতীমের প্রতি সদ্ব্যবহার ও অসদ্ব্যবহার

(আরবী*******)

১৭৩. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে বাড়ীতে এতীমের প্রতি সদ্ব্যবহার করা হয়, তা সর্বোত্তম বাড়ী। আর যে বাড়ীতে এতীমের প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হয়, তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাড়ী।

এতীম মিসকিনের প্রতি সদয় আচরণে হৃদয়ের নিষ্ঠুরতা দূর হয়

(আরবী*************)

১৭৪.এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ(সা) কে জানালো যে, তার মন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও কঠোর। তিনি বলেন এতীমের মাথায় স্নেহের হাত বুলাও এবং মিসকিন (দরিদ্র) দেরকে খানা খাওয়াও।

এ হাদীসের শিক্ষা এই যে, কেউ যদি নিজের হৃদয়ের নিষ্ঠুরতার চিকিৎসা করাতে চায়, তবে তার অবিলম্বে স্নেহ ও দয়ার কাজ শুরু করে দেয়া উচিত। অভাবী ও অসহায় লোকদের প্রয়োজন পূরণ করলে এবং তাদেরকে সাহায্য ও উপকার করলে পাষাণ মন দয়ালু মনে পরিণত হয়ে যাবে।

এতীম ও নারীর অধিকার সম্মানার্হ

(আরবী********)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন হে আল্লাহ, আমি এতীম ও নারীর অধিকারকে সম্মানার্হ বলে ঘোষণা করছি।

রাসূল(সা) এর এই বাচনভঙ্গি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও প্রেরণাদায়ক। এ দ্বারা প্রকারান্তরে তিনি সকলকে আদেশ দিচ্ছেন যে, এতীম ও নারীদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে এই দুটি শ্রেণী আরবে সবচেয়ে বেশী নিপীড়িত ও মজলুম ছিল। এতীমদের সাথে ব্যাপকভাবে খারাপ ও নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হতো এবং তাদের অধিকার হরণ করা হতো। নারীদেরও সমাজে কোনই মর্যাদা ছিল না।

দরিদ্র হলে পালিত এতীমের সম্পদ সীমিত পরিমাণে ভোগ করা যায়

(আরবী********)

১৭৬. রাসূল (সা) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললোঃ আমি দরিদ্র ও নিঃস্ব। আমার পালিত একজন এতীমের বিপুল সম্পত্তি আছে। (আমি কি তার সম্পত্তি থেকে কিছু ভোগ করত পারি?) তিনি বললেন হাঁ তুমি তোমার পালিত এতীমের সম্পত্তি থেকে কিছু ভোগ করতে পার, যদি অপচয় ও অব্যয় না কর, তাড়াহুড়ো না কর এবং তার সম্পত্তিকে স্থায়ীভাবে নিজের সম্পত্তিতে পরিণত না কর।

অর্থাৎ যদি কোন এতীমের অভিভাবক ধনী হয়, তবে কোরআনের বিধান অনুসারে তার কিছুই গ্রহণ করা উচিত নয়। কিন্তু সে যদি দরিদ্র হয় এবং এতীম সম্পদশালী হয়, তবে সে তার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করবে, তা যাতে বৃদ্ধি পায় সে জন্য চেষ্টা করবে এবং তা থেকে নিজের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করবে। তবে এমনভাবে গ্রাস করবে না, যাতে তার যৌবন প্রাপ্তির আগেই তার সম্পত্তি নিঃশেষ হয়ে যায় এবং তা থেকে নিজের স্থায়ী সম্পত্তিও বানাতে পারবে না। যারা আল্লাহকে ভয় করে না, তারা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে এতীমদের সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তি বায়ে ফেলে অথবা তার বড় হওয়ার আগে তার সম্পত্তি খেয়ে উড়িয়ে দেয়।

সূরা নিসায় আল্লাহ তায়ালা এতীমদের সম্পত্তি সম্পর্কে এই আদেশই দিয়েছেন, যা এ হাদীসে রয়েছে। আল্লাহ বলেছেনঃ(আরবী****)

অপচয় ও অব্যয়ের মাধ্যমে এতীমের সম্পত্তি ভোগ করো না এবং তাদের বড় হওয়ার আশংকায় তাড়াহুড়ো করে খেও না। আর যে সম্পদশালী, তার এতীমের সম্পত্তি খাওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকা উচিত। আর যে দারিদ্র, সে যেন প্রচলিত ন্যায্য রীতি অনুসারে তা থেকে খায়।

এতীমকে প্রহার করা সম্পর্কে

(আরবী**********)

১৭৭.হযরত জাবের (রা) বলেন, আমি বললামঃ হে রাসূলুল্লাহ, আমার পালিত এতীমকে কী কী কারণে প্রহার করতে পারি? রাসূল (সা) বললেনঃ যে যে কারণে তোমার নিজ সন্তানকে প্রহার করতে পার। সাবধান, নিজের সম্পত্তি রক্ষার্থে তার সম্পত্তি নষ্ট করো না এবং তার সম্পত্তি দিয়ে নিজের সম্পত্তি বানিও না।

নিজের সন্তানকে যেমন লেখাপড়া শেখানো ও চরিত্র সংশোধনের উদ্দেশ্যে মারধর করা যায়। তেমনি এতীমকেও দ্বীনদারী ও সততা শেখানোর জন্য মারধর করা যায়। বিনা কারণে কথায় কথায় শিশুদেরকে মারপিট করা রাসূল(সা) এর নীতির বিরোধী। আর এতীমকে অকারণে প্রহার করা তো মহাপাপ।

অতিথির অধিকার

অতিথির সমাদর ঈমানের দাবী

(আরবী******)

১৭৮.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমান রাখে, সে যেন অতিথির সমাদর করে।

গৃহকর্তাকে বিব্রত করা অতিথির অনুচিত

(আরবী******)

১৭৯.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান রাখে, সে যেন অতিথির সমাদর করে। প্রথম এক রাত ও একদিন অতিথিকে সর্বোত্তম আপ্যায়নের দিন। আতিথেয়তা তিন দিন পর্যন্ত । (অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন বেশী কষ্ট করে আপ্যায়ন করা নৈতিকভাবে জরুরী নয়। ) এরপর সে যে কিছু করবে তা তার জন্য সদকায় পরিণত হবে। আর অতিথির জন্য গৃহকর্তার কাছে এত দীর্ঘ সময় অবস্থান করা বৈধ নয়, যাতে সে বিব্রত বোধ করে।

এ হাদিসটিতে অতিথি ও গৃহকর্তা উভয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গৃহকর্তাকে বলা হয়েছে, সে যেন অতিথির সমাদর করে। সমাদর করার অর্থ শুধু খাওয়ানো দাওয়ানো নয়। বরং হাসিমুখে কথা বলা ও হাসিখুশি ব্যবহার করা সবই। আর অতিথিকে বলা হয়েছে যে, কারও বাড়ীতে অতিথি হয়ে গেলে সেখানে এত দীর্ঘ দিন পড়ে থেক না যে গৃহকর্তা বিরক্ত ও অস্থির হয়ে পড়ে। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এ বিষয়টির উত্তম বিশ্লেষণ রয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ কোন মুসলমানের জন্য তার ভাই এর নিকট এত দীর্ঘ সময় অবস্থান করা বৈধ নয়, যাতে সে বিব্রত বোধ করে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে বিব্রত বোধ করবে? রাসূল (সা) বললেনঃ এত দীর্ঘ সময় অবস্থান করে যে এক সময় তার কাছে আতিথেয়তা করার জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

প্রতিবেশীর অধিকার

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া ঈমানদারীর লক্ষণ নয়

(আরবী*******)

১৮০. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেঃ আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে রাসূলুল্লাহ, কে? তিনি বললেনঃ যার প্রতিবেশী তার কষ্টদায়ক আচরণ থেকে নিরাপদ থাকে না।

প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে জিবরীলের পুনঃপুনঃ তাগিদ

(আরবী********)

১৮১.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য এত ঘনঘন উপদেশ দিতে থাকেন যে, আমি ভেবেছিলাম হয়তো শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা হবে।

প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া ঈমানের লক্ষণ নয়

(আরবী*******)

১৮২.ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি সেই ব্যক্তি মুমিন ন যে নিজে তৃপ্তি সহকারে আহার করে, অথচ তার প্রতিবেশী তার পাশেই অনাহারে থাকে। (মেশকাত)

প্রতিবেশীকে রান্না করা খাবার দেয়ার উপদেশ

(আরবী*******)

১৮৩. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন হে আবু যর, তুমি যখন ঝোল রান্না করবে, তখন তাতে পানি বেশী করে দাও এবং তা দিয়ে প্রতিবেশীর খবর নাও। (মুসলিম)

প্রতিবেশীকে দেয়া উপহার সামান্য হলেও তুচ্ছ নয়

(আরবী********)

১৮৪.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হে মুসলিম নারীগণ, কোন প্রতিবেশিনী অপর প্রতিবেশিনীকে যত সামান্য উপহারই দিক, তাকে তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়, এমনকি তা যদি ছাগলের একটা ক্ষুরও হয়। (বোখারী, মুসলিম)

মহিলাদের মানসিকতা সচরাচর এ রকম হয়ে থাকে যে, কোন মামুলী জিনিস প্রতিবেশিনীর বাড়তে পাঠানো পছন্দ করে না। সব সময় খুব ভালো জিনিস পাঠাতে চায়। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) মহিলাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যত সামান্য জিনিসই হোক, প্রতিবেশীর কাছে পাঠাতে দ্বিধা বোধ করো না। আর যে মহিলার কাছে প্রতিবেশীর কাছ থেকে কোন উপহার আসে, সে যেন তা নগণ্য হলেও সাদরে গ্রহণ করে। অবজ্ঞা করা বা সমালোচনা করা ঠিক নয়।

নিকটতর প্রতিবেশীকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতে হবে

(আরবী*******)

১৮৫. হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহ, আমার দুজন প্রতিবেশী রয়েছে, তন্মধ্যে কার কাছে উপহার পাঠাবো? রাসূল (সা) বললেন, তাদের মধ্যে যে জনের দরজা তোমার নিকটতর তার কাছে। (বোখারী)

প্রতিবেশীত্বের এলাকা চল্লিশ বাড়ী পর্যন্ত বিস্তৃত। এদের মধ্যে যে বাড়ী নিকটতর, তার অধিকার অগ্রগণ্য।

প্রতিবেশীর সাথে সৎ ব্যবহার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়

(আরবী******)

১৮৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাকে ভালবাসুক, সে যেন সব সময় সত্য কথা বলে, তার কাছে কোন জিনিস আমানত রাখা হলে তা তার মালিকের নিকট অক্ষতভাবে ফেরত দেয় এবং নিজের প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করে।

প্রতিবেশীকে কটু কথা বললে নামায রোযাও বৃথা

(আরবী************************)

১৮৭. এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(সা) কে বললোঃ হে রাসূলুল্লাহ, অমুক মহিলা প্রচুর নফল নামায, রোযা ও সদকার জন্য প্রসিদ্ধ, কিন্তু প্রতিবেশীকে কটু কথা বলার মাধ্যমে কষ্ট দেয়। রাসূল(সা) বললেনঃ সে জাহান্নামে যাবে। লোকটি আবার বললেন হে রাসূলুল্লাহ, অমুক মহিলা সম্পর্কে খ্যাতি রয়েছে যে, সে খুবই কম নফল নামায, রোযা ও সদকা করে এবং পনিরের দু একটা টুকরো সদকা করে থাকে। কিন্তু নিজের জিহ্বা দিয়ে কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসূল (সা) বললেনঃ সে জান্নাতে যাবে।

প্রথমোক্ত মহিলার দোযখে যাওয়ার কারণ এই যে, সে বান্দাহর হক বা অধিকার হরণ করেছে। প্রতিবেশীর অধিকার এই যে, তাকে কষ্ট দেয়া যাবে না। সে এ অধিকার সংরক্ষণ করে নি এবং দুনিয়ার জীবনে সে নিজের প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমাও চায়নি। তাই জাহান্নামই তার উপযুক্ত আবাসস্থল।

কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম দুই প্রতিবেশীর বিরোধের বিচার হবে

(আরবী*******)

১৮৮.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন কেয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে দুই ব্যক্তির মামলা আল্লাহর আদালতে বিচারার্থে পেশ করা হবে তারা হবে দুজন প্রতিবেশী। (মেশকাত)

অর্থাৎ বান্দার হক সংক্রান্ত বিরোধের বিচারের জন্য কেয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতের সামনে সর্ব প্রথম এমন দুই ব্যক্তি দাঁড়াবে। যারা পৃথিবীতে পরস্পরের প্রতিবেশী ছিল এবং একে অপরকে কষ্ট দিয়েছে ও যুলুম করেছে। তাদের মামলাই সর্ব প্রথম বিচারে জন্য পেশ করা হবে।

দরিদ্র লোকদের অধিকার

অভাবী লোকদের খাওয়ালে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায়

(আরবী******)

১৮৯.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেনঃ হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে খাওয়াওনি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমাকে কিভাবে খাওয়াবো? তুমি তো সর্ব জগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি কি জনা না, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি? তুমি কি জান না, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি? তুমি কি জান না, তমি তাকে খাওয়ালে তা আজ এখানে আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমাকে কিভাবে পানি পান করাবো?তুমি তো সারা বিশ্বের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি যদি তাকে পানি দিতে তবে সেই পানি আজ আমার এখানে পেতে। (মুসলিম)

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো ও তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো খুবই সওয়াবের কাজ এবং তা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।

ক্ষুধার্তকে পেট ভরে খাওয়ানো সর্বোত্তম সদকা

(আরবী******)

১৯০.রাসূল(সা) বলেনঃ যে ব্যক্তি সাহায্য চাইতে আসে, তাকে কিছু না কিছু দিয়ে ফেরত দিও। এমনকি পোড়া ক্ষুর হলেও দিও। (মেশকাত)

অর্থাৎ কোন দরিদ্র ব্যক্তি যদি তোমার দরজায় আসে তবে তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিও না। তাকে কিছু না কিছু দিও। তা সে যত ক্ষুদ্র ও মামুলী জিনিসই হোক না কেন।

প্রকৃত দরিদ্রের পরিচয়

(আরবী****************)

১৯২.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: প্রকৃত দরিদ্র সে নয়, যে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং এক গ্রাস, দু গ্রাস বা একটা খেজুর বা দুটো খেজুর নিয়েই বিদায় হয়ে যায়। প্রকৃত দরিদ্র হলো সেই ব্যক্তি, যার কাছে নিজের প্রয়োজন পূরণের উপযুক্ত দ্রব্য সামগ্রী বা অর্থ থাকে না এমনকি সাধারণ মানুষ তার দরিদ্র বুঝতেও পারে না, যে তাকে সদকা দেবে এবং সে মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে ভিক্ষাও করেনা (বোখারী, মুসলিম) এ হাদীস দ্বারা উম্মাতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তোমরা সেই প্রকৃত দরিদ্র লোকদের সন্ধান কর, যারা অভাব অনটনে বিপর্যস্ত হলেও আত্মসম্মান ও আত্মাভিমানের কারণে নিজের দুরবস্থাকে মানুষের সামনে প্রকাশ পেতে দেয় না। নিঃস্ব মানুষের মত মুখমণ্ডলকে বিমর্ষ বানিয়ে ঘুরে বেড়ায় না এবং অন্যদের কাছে হাতও পাতে না। এ ধরনের লোকদেরকে খুঁজে খুঁজে সাহায্য দেয়া খুব বড় নেক কাজ।

দরিদ্র ও বিধবাদের সেবাকারীর উচ্চ মর্যাদা

(আরবী********)

১৯৩.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যারা দরিদ্র ও বিধবাদের সেবার জন্য সচেষ্ট, তারা সেই ব্যক্তির মত, যে আল্লাহর পথে জেহাদ করে এবং সেই ব্যক্তির মত যে, সারা রাত আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে(নামায পড়ে) এবং কখনো ক্লান্ত হয় না এবং সবসময় রোযা থাকে, কখনো রোযা ভাঙ্গে না। (বোখারী, মুসলিম)

ভৃত্যদের অধিকার

(আরবী*********)

১৯৪.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: ভৃত্যের অধিকার এই যে, তাকে খাবার ও পোশাক দিতে হবে এবং তাকে তার সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ দিতে হবে। (মুসলিম)

মুল হাদীসে ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে মামলুক, যা দ্বারা দাসদাসী বুঝানো হয়। ইসলামের পূর্বে আরব সমাজে যে দাসদাসী ছিল তাদের সংগে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করা হতো। উপরন্তু তাদেরকে তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হতো। যখন ইসলামের অভ্যুদয় ঘটলো, তখন এই শ্রেণীটি বিদ্যমান ছিল। রাসূল (সা) মুসলমানদের কঠোর নির্দেশ দিলেন যে, তাদের সাথে মানুষের মত আচরণ কর। তোমরা যা কাও তাই তাদেরকে খাওয়াও, তোমরা যে কাপড় চোপড় পর, তাই তাদেরকে পরাও এবং তাদের ওপর তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ চাপিওনা। যতটা কাজ করা তাদের সাধ্যে কুলায়, ততটাই তাদের ওপর চাপিও।

যে সমস্ত চাকর নকর স্থায়ীভাবে আমাদের অধীনে থাকে এবং দিনরাত আমাদের সাথে কাটায়, তাদের সাতেও অনুরুপ আচরণই করা উচিত। ভৃত্যদের সাথে আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আবু কুলাবার বর্ণনাটি প্রণিধান যোগ্য। আবু কুলাবা (রা) বলেন:হযরত সালমান ফারসী যখন একটি প্রদেশের গভর্নর, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে গিয়ে দেখলো, তিনি নিজ হাতে আঁটা তৈরী করছেন। লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, এ কী ব্যাপার? হযরত সালমান বললেন আমি আমার চাকরকে একটা কাজের জন্য বাইরে পাঠিয়েছি। দুটো কাজেরই দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপানো আমি পছন্দ করিনা।

দাসদাসীরা ভাই বোন তুল্য

(আরবী**********)

১৯৫.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: দাসদাসীরা তোমাদের ভাইবোন তুল্য। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের কর্তৃত্বের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যার কর্তৃত্বে তার ভাইকে অর্পণ করেছেন, সে যেন নিজে যা খায়, তাকেও তাই খাওয়ায়, নিজে যা পরিধান করে তাকেও তাই পরিধান করায় এবং যে কাজ তার ক্ষমতার বাইরে সে কাজ তাকে করতে বাধ্য না করে। আর যদি তার ক্ষমতা বহির্ভূত কাজ করতে তাকে বাধ্য করে তবে সে যেন তাকে সেই কাজে সাহায্য করে। (বোখারী, মুসলিম)

ভৃত্যকে সাথে বসিয়ে খাওয়ানো উচিত

(আরবী******************)

১৯৬.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তোমাদের ভৃত্য যখন তোমাদের জন্য খাবার তৈরী করে, অতঃপর তা তোমাদেরকে পরিবেশন করে এবং সে খাবার তৈরী করতে গিয়ে আগুনের তাপ ও ধুয়ায় কষ্ট পায়, তবে তাকে নিজের কাছে বসিয়ে খাওয়ানো উচিত। কিন্তু খাবার যদি পরিমাণে কম হয়, তবে তাকে অন্তত এক লোকমা বা দু-লোকমা দেয়া উচিত। (মুসলিম, আবু হুরায়রা)

ভৃত্যদেরকে সন্তানের মত সমাদর করা উচিত

(আরবী*****)

১৯৭.হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন: দাসদাসী ও ভৃত্যদের ওপর ক্ষমতার অপপ্রয়োগকারী বেহেশতে যেতে পারবেনা। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো হে রাসূলূল্লাহ, আপনি কি আমাদেরকে জানাননি যে, এই উম্মাতে অন্য সকর উম্মাতের চেয়ে দাসদাসী ও এতীমের সংখ্যা বেশী? তিনি বললেন: হা, সুতরাং তাদেরকে আপন সন্তানের মত সমাদর কর এবং তোমরা যা খাও, তাদেরকেও তাই খাওয়াও। (ইবনে মাজাহ)

নামাযী ভৃত্যকে প্রহার করা চলবে না

(আরবী******)

১৯৮.রাসূলুল্লাহ (সা) আলী (রা) কে একটি ক্রীত দাস দিলেন, অতঃপর বললেন ওকে মার ধর করো না। কেননা নামাযীকে প্রহার করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। ওকে আমি নামায পড়তে দেখেছি। (মেশকাত)

সফরের সহযাত্রীর অধিকার

কোন জাতির সরদার তাদের সেবক হয়ে থাকে

(আরবী******)

১৯৯.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: কোন জাতি বা দলের সরদার তাদের সেব হয়ে থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি মানুষের সেবা ও উপকারে অগ্রণী হয়, একমাত্র আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করা ছাড়া আর কোন কাজ দ্বারা কেউ তার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না।

ব্যাখ্যা:যে ব্যক্তি কোন দলের সাথে সফর করে, তার কর্তব্য এই যে, সে যেন ঐ দলের সেবা করে, তাদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে। এই সেবার জন্য সে অনেক সওয়াব পাবে। এর চেয়ে বেশী সওয়াব যদি কোন কিছুতে থেকে থাকে তবে তা একমাত্র আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হওয়াতেই রয়েছে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাহনে সহযাত্রীর অধিকার

(আরবী**********)

২০০. আবু সাঈদ খুদরী(রা) বলেন: একবার আমরা যখন সফরে ছিলাম, তখন উষ্ট্রীর ওপর আরোহণকারী এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল এবং এসেই ডানে বামে তাকাতে লাগলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: যার কাছে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাহন আছে, তার কর্তব্য অতিরিক্ত বাহন সেই ব্যক্তিকে ধেয়া, যার বাহন নেই। আর যার কাছে অতিরিক্ত খাবার আছে, তার কর্তব্য যার খাবার নেই, তাকে সেই খাবার দেয়া। আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূল (সা) এভাবে এক এক করে বহু রকমের সামগ্রীর উল্লেখ করলেন, যা দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে জিনিসই আমাদের কাছে থাকুক, তাতে আমাদের কোন অধিকার নেই। (মুসলিম)

আগন্তুক ডানে বামে তাকাচ্ছিল এ জন্য যে, আসলে তার কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব ছিল এবং কেউ তাকে সাহায্য করুক এটা কামনা করছিল।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী শয়তানের

(আরবী*********)

২০১.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: কিছু উট ও কিছু ঘরবাড়ী শয়তানের হয়ে থাকে। শয়তানের উঠ তো আমি দেখেছি। তোমাদের কেউ বহু সংখ্যক মোটাতাজা ও নাদুস নুদুস উট নিয়ে পথে বেরন হয়। সেই সব উটের একটিতেও সে নিজেও আরোহণ করে না, আবার তার যে ভাই এর কোন বাহন যার কোন বাহন নেই, তার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকেও তাতে আরোহণ করায় না। (এই সব উট হলো শয়তানের উট) তবে শয়তানের বাড়ী আমি দেখিনি। (আবু দাউদ)

শয়তানের বাড়ী দ্বারা রাসূল (সা) সেই সব বাড়ীকে বুঝিয়েছেন, যা লোকেরা নিছক ধন সম্পদের বড়াই প্রদর্শনের জন্য নির্মাণ করে থাকে। সেগুলোতে নিজেও বাস করে না অন্য কোন বাড়িঘর বিহীন লোককেও বাস করতে দেয় না। এ ধরনের ঐশ্বর্য প্রদর্শনী ইসলাম পছন্দ করে না। রাসূল (সা) এ ধরনের লোক দেখানো বাড়িঘর দেখেননি। কেননা সে যুগে এ ধরনের প্রদর্শনী মনোভাবের অধিকারী লোক ছিল না। তবে পরবর্তীকালে এ ধরনের বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে এবং আমাদের পূর্ব পুরুষরা তা দেখেছেন। আমরাও আমাদের যুগের ধনাঢ্য পুঁজিপতি মুসলমানদের এ ধরনের প্রদর্শনীমূলক অট্টালিকা দেকতে পাচ্ছি।

মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ

(আরবী*********)

২০২. হযরত মুয়ায (রা) বলেন: আমরা রাসূল (সা) এর সাথে কোন এক যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমাদের সাথীরা এমন গাদাগাদি করে অবস্থান করতে লাগলো যে, চলাচলের রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেল। রাসূল (সা) একজন ঘোষণাকারী পাঠিয়ে ঘোষণা করিয়ে দিলেন যে, যে ব্যক্তি অবস্থান স্থলকে সংকীর্ণ করে দেবে বা চলাচলের পথ বন্ধ করে দেবে, সে জেহাদের সওয়াব পাবে না।

এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, মুসলিম মুজাহিদগণ এমনভাবে অবস্থান করছিলো যে, পথিকদের চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ জন্যই এরূপ ঘোষণা জারী করান। যারা কোন সৎ কাজের উদ্দেশ্যে সফরে বের হবে, তাদের উচিত পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করতে হলে যেন বেশী ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান না করে, বরং কেবল প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গা ব্যবহার করে। অন্য সফর সঙ্গীদের স্থান সংকুলান হয় না বা যাতায়াত ও চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয় এমনভাবে অবস্থান করা ঠিক নয়।

রোগীর দেখাশুনা ও পরিচর্যা

রোগীর সেবা ও পরিচর্যার গুরুত্ব

(আরবী********)

২০৩. রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ওহে আদম সন্তান, আমি রোগাক্রান্ত ছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রভু, আপনি তো সারা বিশ্বের প্রতিপালক, আপনি কিভাবে রোগাক্রান্ত হলেন এবং আপনাকে কিভাবে দেখতে যাব? আল্লাহ বলবেন: তুমি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত ছিল, কিন্তু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। যদি তাকে দেকতে যেতে, তবে আমাকে তার কাছেই পেতে।

রোগীকে দেকতে যাওয়ার অর্থ শুধু তার কাছে চলে যাওয়া ও কেমন আছে জিজ্ঞেস করা নয়। বর রোগীর যথার্থ তদারকী এই যে, সে দরিদ্র হলে তার ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করা দরকার। আর দরিদ্র না হলেও হতে পারে যে, তার সময়মত ওষুধ এনে দেয়া ও খাওয়ানোর লোক নেই। সে ক্ষেত্রে তার ওষুধ পথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করাই হলো তার যথার্থ সেবা, পরিচর্যা তদারকী।

রোগীর খোঁজ খবর নেয়ার আদেশ

(আরবী****)

২০৪.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন তোমরা রোগীর খোঁজ খবর নাও, ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়াও এবং বন্দীর মুক্তির ব্যবস্থা কর। (বোখারী)

রোগীকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়াও পরিচর্যার অংশ

(আরবী******)

২০৫.রাসূল (সা) এর একজন ইহুদী ভৃত্য ছিল, যে রাসূল এর সেবা করতো। সে রোগাক্রান্ত হলে রাসূল (সা) তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসলেন ও তাকে বললেন: তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। ভৃত্যটির বাবা তার কাছেই ছিল। সে তার বাবার দিকে তাকালো। বাবা তাকে বললো তুমি আবুল কাসেমের (রসুলুল্লাহর) আদেশ মান্য কর। সে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তার কাছ থেকে একথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন যে, আল্লাহর শোকর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করলেন। (বোখারী)

রাসূল(সা) এর পবিত্র ও নিখুঁত স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে শত্রু ও বন্ধু সবাই ওয়াকিবহাল ছিল। সকল ইহুদী রাসূল (সা) এর শত্রু ছিল না। এই ইহুদীর রাসূল(সা) এর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তাই সে নিজের ছেলেকে তাঁর ভৃত্য হিসাবে কাজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

রোগীর পরিচর্যার পদ্ধতি

(আরবী*****)

২০৬. ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ রোগীর পরিচর্যার ক্ষেত্রে বেশী শব্দ না করা ও অল্প সময় অবস্থান সুন্নাত। (মেশকাত)

এ আদেশ সর্ব সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু রোগী যদি অন্তরঙ্গ বন্ধু বা প্রিয়জন হয় এবং তার কাছে বেশীক্ষণ অবস্থান করা রোগী পছন্দ করবে বলে বুঝা যায়, তাহলে বেশীক্ষণ অবস্থান করতে পারে।

রাহে আমল – ১ম খণ্ড

আল্লামা জলীল আহসান নদভী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড