আমাদের কথা
যে কোন মানুষকেই প্রশ্ন করা হয় –যুদ্ধ চান নাকি শান্তি তিনি অবশ্যই বলবেন শান্তি। অথচ পৃথিবীতে আজ শান্তির বড় অভাব, সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অশান্তি, হানাহানি ও অস্থিরতা।
মানুষের মনগড়া মতবাদই এই সব অশান্তির একমাত্র কারণ। শুধুমাত্র পৃথিবীতে শান্তি, শৃংখলা, ভালবাসা ও সুখ ফিরিয়ে আনতে পারে ইসলাম। আল্লাহর দেয়া ও রাসূলের (সঃ) দেখানো পথ ইসলাম। ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কেই ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট ও সুন্দর। ইসলাম সহজ, সরল, সকলের অনুসরণ করার মত, বিজ্ঞানসম্মত ও সব সময়ই আধুনিক। যা ইসলাম তা’ই বিজ্ঞান, তা’ই আধুনিক। কিন্তু এই সহজ ও সুন্দর ইসলামকে না জানা না বুঝার কারণেই অনেকে ইসরামের নাম শুনলে ভয় পায়। দেশের ভবিষ্যত নাগরিক শিশু-কিশোরদের কাছে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপটি সহজ ও সুন্দরভাবে তুলে ধরার তীব্র প্রয়োজনীয়তা বহুদিন ধরে অনুভব করা হচ্ছিলো। “মোদের চলার পথ ইসলাম” বইটি প্রকাশের মাধ্যমে অনেকদিক পর সে চাহিদা সামান্য হলেও পূরণ করা গেল বলে আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।
বিশিষ্ট শিশু-কিশোর সাহিত্যিক জনাব মাসুদ আলী তাঁর সুপরিচিত সহজ ভাষা ও সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে বইটি লিখে নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের অভাব পূরণ করেছেন। আশা করি বইটি শিশু-কিশোরদের কাছে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে সহায়ক হবে।
বইটিকে আরো সুন্দর করার ব্যাপারে যে কোন পরামর্শ আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।
লেখকের কথা
চঞ্চল তরুণ মনের সবটুকুই রোমাণ্টিক নয়। শরতের হিমেল বাতাস আর বসন্তের ফুলের সুবাস তার মনকে যতটুকু চঞ্চল করে তার চেয়ে বেশী চঞ্চল হয় তার মন সমাজের কুটিলতা, হানাহানি, জুলুম ও নির্যাতন দেখে। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির প্রতি পলে পলে অন্যায় ক্লেদ, হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা, কথা ও কাজের গরমিল আজকে তরুণ সমাজকে তাই করেছে বিদ্রোহী, তার চরাকে করেছে উদ্দাম।
তারুণ্যে উজ্জীবিত দিশেহারা মন কোন আদর্শের পরিচয় না পেয়ে হয়ে উঠেছে আগ্নেয়গিরির মত ধ্বংসকামী, এইতো স্বাভাবিক।
অথচ তারুণ্যের এই উদ্দামকে, তার কোমল হৃদয়ে সুপ্ত ভালবাসাকে, তার প্রতিভাকে, যোগ্যতাকে, দেশ ও দশের কাজে মোটকথা মানবতার উপকারে লাগাতে হলে তরুণদের সামনে তুলে ধরতে হবে এক সুন্দর আদর্শ –যে আদর্শ তরুণ মনে হাজারো প্রশ্নের উত্তর যোগাবে, যে আদর্শ তাকে নিজকে চিনতে শেখাবে, যে আদর্শ তাকে দিবে পথের দিশা।
আজ তাই তরুণ সমাজের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শ তুলে ধরার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। “মোদের চলার পথ ইসলাম” তরুণদের কাছে ইসলামের বিপ্লবী আওয়াজ তুলে ধরার এমনি একটি প্রয়াস। এই পুস্তক যদি আমাদের তরুণদের মনে ইসলামকে বুঝা, তাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা এবং জীবনের সকল দিকে বাস্তবায়নের প্রেরণা যোগায় তবেই আমাদের এই প্রচেষ্টা সফল হবে। আল্লাহ আমাদের এই উদ্যোগ কবুল করুন। আমীন।
প্রথম অধ্যায়
ইসলামী আদর্শ
ও তার বৈশিষ্ট্য
ইসলাম শান্তির ধর্ম
ইসলাম স্বভাব ধর্ম
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
ইসলাম সকলের জন্য
ইসলাম আল্লাহর দেখানো পথ
সহজ সরল পথঃ ইসলাম
ইসলামী আদর্শ ও তার বৈশিষ্ট্য
দুনিয়ার মানুষকে তার প্রভু আল্লাহ যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন তার নাম ‘ইসলাম’। ইসলাম আমাদেরকে জানায় এ জীবনের উদ্দেশ্য কি, মানুষের জীবনের পরিণতি কি, এ দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা কতটুকু, দুনিয়ায় কি কাজ করতে হবে, কি কি কাজ আমাদের জন্য ক্ষতিকর, মানুষের জীবনের সফলতা কোন পথে। মোটকথা, আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দেয় ইসলাম। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন পরিচালনার জন্য সবচেয়ে সুন্দর উপায় বাতলে দেয় ইসলাম।
ইসলাম মানুষকে আল্লাহর দেখানো পথে পরিচালিত করে। ইসলামের শাব্দিক অর্থ হলো আত্মসমর্পণ অর্থাৎ নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। এর অর্থ আল্লাহর হুকুমকে মেনে নেওয়া, আল্লাহর হুকুম মেনে চললে মানুষের জীবনে নেমে আসে অনাবিল শান্তি। এ অর্থে ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম।
ইসলাম শান্তির ধর্ম
আমাদের চারিদিকে –চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, নদী, গাছপালা, পশু-পাখি সবকিছু এক সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে –মেনে চলছে আল্লাহর বিধান। তাই তাদের মধ্যে কোন অশান্তি দেখিনা-দেখিনা কোন গড়মিল। প্রতিদিনের শুরুতে ঠিক পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠে এবং দিন শেষে ঠিক পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। আসে রাত। চাঁদ উঠে আকাশে, তারারা হাসে রাতের আকাশে। আবার রাত কেটে যায়। ফুলেরা হাসে। বসন্তে গাছে গাছে সবুজ পাতার বাহার –এমনিভাবে প্রকৃতির সব কিছু এক সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে। কেউ এ নিয়ম ভাঙ্গতে পারেনা। সকলেই আল্লাহর নিয়ম মানছে। সকলেই আল্লাহর নিয়ম মানতে বাধ্য।
কিন্তু মানুষের ব্যাপারটি একটু আলাদা। আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন জ্ঞান, দিয়েছেন ভাল ও মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন রাসূল ও কিতাব। এতো কিছুর পরেও আল্লাহ মানুষকে তাঁর আইন মানতে বাধ্য করে না। তাঁর আইন মানা না মানা পুরোটাই মানুষের ইচ্ছা। আর এভাবেই তিনি আমাদের পরীক্ষা করতে চান।
প্রকৃতির সকলেই মেনে চলছে আল্লাহর আইন। তাই প্রকৃতিতে বিরাজ করছে শান্তি ও শৃঙ্খলা। তেমনি আমরা যদি নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে আমাদের কাছে যে পথের দিশা এসেছে তা মেনে চলি তাহলে আমাদের জীবনেও আসবে শান্তি ও সমৃদ্ধি। জীবনে এই শান্তি পেতে হলে আল্লাহর হুকুম ও আদেশ-নিষেধকে স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে। সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে আল্লাহর কাছে। আর তখনই আমাদের জীবনে নেমে আসবে শান্তি। আল্লাহর কাছে সসবকিছু সঁপে দেওয়ার নামই ‘ইসলাম’।
ইসলাম শুধু ব্যক্তির জীবনেও এই শান্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ইসলাম’ শিক্ষা দেয় –এসো সকলে মিলে সত্যের জন্য কাজ করি এবং অন্যায়কে নির্মূল করি।
দুনিয়য় মানুষের জীবনটা কয়দিনেরইবা। প্রত্যেক মানুষকে মরতে হবে। মৃত্যুর পর যে জীবন সে জীবনে মুক্তি ও শান্তির জন্য জীবনে আল্লাহর আইন মেনে চলতে হয়। এভাবে ইসলাম মানুষকে শুধু দুনিয়ায় নয় –দুনিয়ার পর যে অনন্ত জীবন আছে সেখানেও পথ দেখায়। কোরআন আমাদের তাই চাইতে শিখালো-
হে আমাদের রব, আমাদেরকে মঙ্গল দাও এই দুনিয়ায়, মঙ্গল দাও আখেরাতে এবং দোজখের আগুনের আজাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও।
সূরা বাকারা-২০১
ইসলাম স্বভাব ধর্ম
মানুষের স্বভাবটাই এমন যে সে সব সময় ভালকে পছন্দ করে, মন্দকে ঘৃণা করে। সত্য কথা বলা এ গুণটা সকলেরই পছন্দ, আবা মিথ্যা কথা বলা সকলের অপছন্দ। এমনি একজন মিথ্যাবাদী সে নিজেও চায় না সবাই তাকে মিথ্যুক বলুক। এইভাবে অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের কষ্টের সময় তার পাশে দাঁড়ানো, পিতা-মাতার প্রতি ভাল ব্যবহার, বিনয়, সততা এসব সৎগুণ সব সময়ই মানব সমাজে প্রশংসিত। অন্যদিকে অন্যেল মনে কষ্ট দেওয়া, রুক্ষতা, পিতা-মাতার সাথে খারাপ ব্যবহার, হঠকারিতাকে সব সময় সকলে ঘৃণা করে। তাই আমরা বলতে পারি সত্যকে পছন্দ করা এবং মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের স্বভাব। কোরআনের ভাষায় সত্য হলো ‘মারুফ’ এবং মিথ্যা হলো ‘মুনকার’। ইসলাম ‘মারুফ’ প্রতিষ্ঠা করা ও ‘মুনকারকে উৎখান করার শিক্ষা দেয়। তাই আমরা বলতে পারি ইসলাম হলো মানুষের স্বভাব ধর্ম।
মানুষের শরীরটার দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? দেখি তার মাতা, শিরা-উপশিরা, পেশিগুলো, হাত-পা, নাক, নাক, মোটকথা তার পুরো দেহটাই তাদের নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহ যাকে যা করার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং যেভাবে তা করতে বলেছেন, সে সেইভাবে তা করে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে মানুষের দেহটা আল্লাহর হুকুম মেনে যাচ্ছে। তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অণু-পরমাণু আল্লাহর দেওয়া আইনের অনুসারী। হাত, পা, মুখ, মোটকথা তার পুরো দেহটা স্বভাবের দিক থেকে আল্লাহর আইনের অধীন। অর্থাৎ বলা যেতে পারে স্বভাব প্রকৃতির দিক থেকে তার দেহটা ‘মুসলমান’।
এখন যদি কেউ স্রষ্টাকে চিনে, তাঁকেই একমাত্র মনিব হিসাবে মেনে নেয় মোট কথা ইসলামকে মেনে চলে তাহলে বলা যায় সে স্বভাবের মূল দাবীই পুরণ করলো। তাই স্বেচ্ছায় ইসলাম মেনে নেওয়া মানুষের স্বভাব ধর্ম। আর ইসলামকে অস্বীকার করা নিজের স্বভাব ধর্মকে অস্বীকার করা।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
এই দুনিয়ায় মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। ইসলাম সব কাজই কিভাবে আল্লহর নির্দেশ অনুযায়ী করতে হবে তা বলে দেয়। জীবনের এমন কোন দিক নেই যেদিকে আল্লাহর নির্দেশ কি তা জানা যায়নি। এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে ইসলাম পথ নির্দেশ দেয়নি।
ব্যক্তি জীবনের, সমাজ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে ইসলাম মানুষকে পথ দেখায়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কি করতে হবে তা কোরআন যেমন বলে দিয়েছে তেমনি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে বাস্তবে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
তাই ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। অন্যান্য মতবাদে আমরা দেখি জীবনের বিশেষ কোন একটি দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক ধর্ম শুধু ব্যক্তির আত্মাকে সুন্দর করার কথা বলে। অনেক মতবাদ ‘অর্থ’কে বড় করে দেখে। কেউ আবার ভুল হোক সঠিক হোক নিজের ‘কওম’ টাকে বড় করে দেখাতে শেখায়। এসব মতবাদ হলো জীবনটাকে খণ্ড খণ্ড করে দেখার ফল। মানুষের পুরো ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য এসব মতবাদ কোন সঠিক পথের দিশা দিতে পারেনা।
ইসলাম মানুষের জীবনটাকে এভাবে খণ্ড খণ্ড করে দেখেনা। ইসলাম মানুষের স্বভাবকে অস্বীকার করেনা।
দেখ কুরআন কি বলছে-
আর খাও এবং পান করো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেও না।
সূরা আরাফ-৩১
হে নবী! বল আল্লাহর সে সকল সোন্দর্য ও অলংকার কে হারাম করেছে, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য হালাল করেছেন এবং খোদার দেয়া পাক জিনিসগুলোকে (খাওয়া ও ব্যবহারের জন্য) কে তা নিষিদ্ধ করেছে?
সূরা আল আ’রাফ-৩২
ওদিকে ইসলাম মানুষকে একেবারে স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দেয়নি। তার লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিয়ম-কানুনও বলে দিয়েছে। তোমার লোভ-লালসা ও জুলুমে অন্যের ক্ষতি হবে এটা ইসলাম কখনও বরদাশত করেনা। মোটকথা, ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেনা তেমনি সমষ্টিকেও বঞ্চিত করেনা। দুয়ের মাঝে এক সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করার পথ বাতলে দেয়। তাই ইসলামকে মানতে হলে পুরোপুরিভাবেই মানতে হয়। পবিত্র কোরআন বলেঃ
তোমরা পুরোপুরিভাবে ইসলামে দাখিল হয়ে যাও।
সূরা বাকারা-২০৮
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে মেনে চল।
ইসলাম সকলের জন্য
ইসলামের শিক্ষা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য। ইসলাম বিশেষ কোন দেশ, জাতি বা বর্ণের জন্য নয়। ইসলাম হচ্ছে বিশেষ কতকগুলো গুণের নাম। যার মাঝেই সেই গুণের পরিচয় পাওয়া যায় সেই মুসলমান। সে যে কোনভাষা, যে কোন জাতি বা যে কোন বর্ণের হতে পারে।
ইসলাম যাকে সারা বিশ্বের প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করে সেই ‘আল্লাহ’ দুনিয়ার সকল মানুষের আল্লাহ। ইসলামের ‘নবী’ দুনিয়ার সকল মানুষের নবী।
এই দুনিয়ায় অনাচারের মূলে আছে মানুষে মানুষে বিভেদ। এক দেশের লোক অন্য দেশের লোকের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের লোকের কোন অধিকারই স্বীকার করতে চায় না। তাই যে আইন তারা মানে তা স্বাভাবিকভাবেই এক তরফা। নিজের জন্য যা ঠিক তা অন্যের জন্য ঠিক নাও হতে পারে। নিজেদের জন্য যা সত্য, অন্যের জন্য মিথ্য। একই অপরাধের ফলে নিজ জাতির লোকের জন্য এক ধরনের বিচার-আচার, অন্য জাতির লোকদের জন্য অন্য ধরনের বিচার। ইসলাম মানুষে মানুষে এই বিভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। ইসলামের চোখে সবাই সমান। ইসলাম মানবতাকে এক পতাকা তলে আনতে চায়। তাই হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত এই পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র আশার আলো।
ইসলাম আল্লাহর দেখানো পথ –মানুষের তৈরী মতবাদ নয়
ইসলমা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো একটি আদর্শ। মানুষের মত মগজের তৈরী কিংবা সাধনার ফলে পাওয়া কোন মতবাদ নয়। এ কারণেই ইসলাম একটি স্বতন্ত্র মতবাদ।
পৃথিবীর কোন মানুষই মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয়। মানুষ বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যতে কি ঘটবে সে তা জানেনা। নিজের পরিবেশের বাইরের খবরও তার জানা নেই। এ অবস্থায় মানুষ আন্তরিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করলেও তার চিন্তা-ভাবনার ফসল সীমাবদ্ধই হবে।
মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সাময়িক একটা সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু মানুষের সকল সমস্যার প্রকৃত ও সঠিক সমাধান দিতে পারেনা। এদিক থেকে ইসলামের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহ নিজেই এই মতবাদ নাজিল করেছেন। সেই আল্লাহ যিনি সমস্ত বিশ্বের মালিক, পালনকর্তা এবং রক্ষাকারী।
ইসলাম আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো বলেই এর মৌলিক বিশ্বাস ও ভিত্তিগুরো ধ্রুব সত্য। সকল মানুষ মিলে এমনকি দুনিয়ার সকল মুসলমানরা একত্র হয়েও এর সামান্য পরিবর্তন আনতে পারবেনা।
অবশ্য সব ধর্মই দাবী করে যে তা আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো ধর্ম। কিন্তু এটি ইতিসাহ থেকে প্রমাণিত যে, ইসলাম ছাড়া আর অন্য সব ধর্মই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।
অন্যান্য সব ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মের শিক্ষার মধ্যে পরিবর্তন এনেছে এবং সেই সাথে নিজেদের মতামত ও নতুন নতুন কথা যোগ করেছে। একথা তারা নিজেরাই স্বীকার করে। অন্যদিকে ইসলামের শিক্ষার মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন পরিবর্তন আসেনি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে যে কোরআন এসেছিল আজ চৌদ্দশত বছর পার হওয়ার পরও তা তেমনিই আছে এবং ভবিষ্যতে একই রকম থাকবে। এর মধ্যে একটি অক্ষর যোগ করাও হয়নি। এবং একটি অক্ষর বাদ দেয়াও হয়নি।
সহজ সরল পথঃ ইসলাম
ইসলামে কোন রূপকথার স্থান নেই। নেই কোন কুসংস্কার কিংবা যুক্তিহীন কথা। ইসলাম বিশ্বাস করতে বলে আল্লাহকে, রাসূল (সাঃ) কে ও আখেরাতকে, এসব কিছু কোন যুক্তিহীন কথা নয়। এর পিছনে আছে সুন্দর ও বলিষ্ঠ যুক্তি।
ইসলামের প্রতিটি শিক্ষা সহজ ও সরল। ইসলাম মেনে চলতে কোন জটিলতা নেই। ইসলাম মেনে চলতে গুরু, পাদ্রী কিংবা কোন সাধুকে ধরতে হয়না। প্রতিটি মানুষ সরাসরি কোরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং কোরআনের আলোকে জীবন চালাতে পারে। ইসলাম মানুষকে যুক্তিবাদী করে। তার মধ্যে সৃষ্টি করে জানার আগ্রহ।
তার নজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করে। বাস্তবতার দৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে শিখায়। তাইতো মুসলমানদের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান পেলো উৎকর্ষতা। তাই কোরআনের দোয়া হলো-
হে প্রভু, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও
সূরা ত্বোয়া-হা-১১৪
কোরআন বলে,
“যার জ্ঞান নেই এবং যার জ্ঞান আছে তারা দুজন এক সমান হতে পারেনা”।
সূরা যুমার-৯
আল্লাহর নবী ও বিশ্বের পথ প্রদর্শক বলেন-
জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর এবং নারীর উপর ফরজ। -ইবনু মাজাহ
দ্বিতীয় অধ্যায়
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হবে
তাওহীদ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলযন্ত্র
শিরকের তাৎপর্য
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদের বিশ্বাসের সুফল
রেসালাত
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী ও তাৎপর্য
অন্যান্য নবী ও মুহাম্মদ (স) এর মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
কিতাবের উপর ঈমান
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
মৃত্যুর পর জীবন
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকাল বিশ্বাসে উপকার
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
দুনিয়ায়চলতে হলে জানতে হয় অনেক কিছু। জানতে হবে আমরা কারা? আমরা মানুষ, আমাদের জীবনের কি কোন উদ্দেশ্য আছে? না কি, অন্যান্য জীব-জন্তুর মত আমাদের জীবন? কে আমাদের সৃষ্টি করলো? কে সৃষ্টি করলো এত বড় বিশ্বটাকে? কে পাঠালো আমাদের এই পৃথিবীতে? কেন পাঠালো? পাঠালোইযখন তখন আমরা কিভাবে চলবো? কোন পথে চললে পাবো শান্তি এবং মুক্তি? সে পথ কি আমরা নিজেরা আবিস্কার করে নেব? নাকি কেউ আমাদের বাতলিয়ে দেবে? সব মানুষই মরে যায়, কিন্তু মরণের পরে কি সব শেষ হয়ে যায়? এমন হাজারও প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হবে আমাদেরকে।
‘সঠিক’ উত্তর কেন? কেননা এসব কিছুর সঠিক উত্তরের উপরই নির্ভর করে মানুষ কিভাবে চলবে এই দুনিয়ায়। মনে করো একজন বিশ্বাস করে মানুষ অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মত নয়, বরং সে সব সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর অন্য একজন বিশ্বাস করে মানুষ আদতে অন্যান্য জীব-জানোয়ারের মতই। খাও, দাও –এই তার কাজ। এখন স্বাভাবিকভাবেই এই দু’জনের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র আলাদা হবে, তাইনা?
এই দু’জনের চলার পথ এক হতে পারেনা। তাই আমরা বলতে পারি জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে মানুষের চলার পথ এবং পন্থা। জীবন সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাস যার সঠিক হবে সেই পাবে সঠিক পথ। আর যার বিশ্বাস হবে ভুল, তার জীবনের পথও হবে ভুল।
ইসলাম হলো আল্লাহর শেখানো পথ। ইসলাম জীবন সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয়। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আল্লাহর গুণরাজি, আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের দেয় সঠিক সম্পর্ক। কিভাবে মানুষ পাবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম, কিভাবে জানতে হবে সেসব আইন-কানুন। আল্লাহর আইন-কানুন মানলে আমাদের কি কি উপকার হবে, আর না মানলে আমাদের কি অপকার হবে।
আরও একটা জিনিস আমাদের ভাল করে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের দেওয়া এসজ জ্ঞান শুধু জানলেই হবে না; এর উপর থাকতে হবে পুরোপুরি বিশ্বাস। জেনে বুঝে সেই মতো আমল করতে হবে। জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানা এবং তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘ঈমান’। সহজ ভাষায় ঈমানের অর্থ হলো, ‘জানা এবং মেনে নেয়া’। মানুষ, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি, জীবনের সফলতা কিসে, মানুষের করণীয় কাজ কি কি –এসব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার জন্য মুসলমানদেরকে দেয় জীবন সম্পর্কে সঠিক, স্বচ্ছ ও সুন্দর ধারণা। তাই ঈমানকে বলতে পারি জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান থাকতে হবে
যে যে বিষয়ের উপর মুসলমানগণ দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যয় ঘোষণা করে তা সুন্দরভাবে নীচে বলা হয়েছে যাকে আমরা বলি “আল-ঈমানুল সুফাসসাল”। যার অর্থ হলোঃ
আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলকগণকে, কিয়ামতের দিনকে, অদৃষ্টের ভালমন্দের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর।
এখানে সাতটি জিনিসের উপর বিশ্বাস আনার কথা বলা হয়েছেঃ
১। আল্লাহ
২। ফেরেশতাসমূহ (মালাকাহ)
৩। কিতাবসমূহ (কুতুবুল্লাহ)
৪। রাসূলগণ (রাসূলুল্লাহ)
৫। বিচার দিবস (ইয়াওমুদ্দিন)
৬। অদৃষ্ট (আল কদর)
৭। মৃত্যুর পর জীবন (আখেরাত)
তাওহীদ
তাওহীদ অর্থ আল্লাহর একত্ব। তাওহীদ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিশ্বাস। এর তাৎপর্য হলো এ বিশ্বের প্রতিটি জিনিস এক এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তিনি আল্লাহ। এই বিশ্বের তিনিই রক্ষণাবেক্ষণকারী –প্রতিপালক। তিনিই একমাত্র এই বিশ্বের পরিচালক।
তাওহীদ হলো আল্লাহকে তাঁর ক্ষমতা ও সকল গুণসহ বিশ্বাস করা। তিনি মেহেরবান। তিনি সকল অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদেরকে দেখেন কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাইনা। তিনি অতীতে ছিলেন, এখনও আছেন এবং অনন্তকাল ধরে থাকবেন –তিনি শাশ্বত। তিনি আদি, তিনি অন্ত। তাঁর কোন অংশীদার নেই, কোন শরীক নেই, কোন সন্তান-সন্ততি নেই। তিনিই আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন এবং মৃত্যুর পর আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহর প্রকৃত পরিবয় বা সত্তা (যাত), তাঁর গুণাবলী (সিফাত), তাঁর অধিকার (হুকুম) এবং তাঁর ক্ষমতা (ইখতিয়ার) সহ তাঁকে বিশ্বাস করা এবং এ ব্যাপারে কাউকে অংশীদার না বানানোই হচ্ছে তাওহীদ।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলমন্ত্র
তাওহীদ হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সুন্দরভাবে উচ্চারিত হয়েছে কালেমা শাহাদাতে। কালেমা শাহাদাতে ঘোষণা দিতে হয়ঃ
আশহাদু আল্ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়া দাহু লাশারিকা লাহু,
ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।
এই কালেমার অর্থ বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই ইলাহ ও আল্লাহ শব্দ দুটোর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে হবে।
ইলাহ শব্দের অর্থ মাবুদ বা হুকুমকর্তা-মনিব। মোটকথা যিনি এবাদতের যোগ্য। আমাদের ইবাদত ও বন্দেগীর কে যোগ্য হতে পারেন? তিনিইতো আমাদের এবাদতের যোগ্য যিনি শ্রেষ্টত্ব, গৌরব ও মহত্বে সকলের চেয়ে বড়। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী, যাঁর শক্তি সম্পর্কে মানুষ ধারণা করতে পারেনা।
ইলাহ শব্দের অর্থ এও যে তিনি নিজে কারও মুখাপেক্ষী হবেন না। বরং সকলেই তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইবে।
আমরা কার ইবাদত করব? আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব যিনি আমাদেরকে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আল্লাহ হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্তার মৌলিক নাম। মূল সত্তার পরিচায়ক নাম। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর মাধ্যমে তাই দু’টো ঘোষণা দেওয়া হলো। একটি ‘অস্বীকার’ করার, অন্যটি ‘স্বীকার’ করার ঘোষণা। ‘লা ইলাহা’ হলো অস্বীকার করা, আর ‘ইল্লাল্লাহু’ হলো স্বীকার করা।
একজন মুমিম ব্যক্তিকে প্রথমে অন্তরে সব ধরনের ‘দেবতা’ বা অন্য কিছুর পূজা করা থেকে পরিস্কার করতে হবে। তারপরই সেখানে এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাসের বীজ বপন করা সম্ভব। জমীনে যেমন বপন করার আগে আগাছা দূর করতে হয়। এও ঠিক তেমনি ধরনের। তাহলে বুঝতে হবে, যে হৃদয়ে ‘তাওহীদের’ চাষ হয়নি সে হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারুর পূজা এবং এবাদতের আগাছা আপনা থেকেই বেড়ে উঠেছে।
শিরকের তাৎপর্য
তাই আমাদের জানতে হবে মানুষের মধ্যে কেন আল্লাহ ছাড়া আর কোন ‘খোদা’, ‘দেবতা’ কে পূজা বা ইবাদত করার ঝোঁক দেখা দেয়।
খুব গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানুষ জন্ম থেকেই করানো না কারো গোলাম হয়েই জন্মগ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই সে দুর্বল, দুঃস্থ এবং পরমুখাপেক্ষী। বেঁচে থাকার জন্য তার এমন সব জিনিসের কখনও তার হাতে সে নিজের শক্তি দিয়ে পেতে পারেনা। এসব জিনিস কখনও তার হাতে আসে আবার কখনও আসেনা। আর এমনও জিনিস আছে যা তার জন্য ক্ষতিকর। তার সারা জীবনের পরিশ্রম নষ্ট করে দেয়। হাজার ইচ্ছা থাকলেও সে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেনা।
এমনিভাবে মানুষ নিজেকে বড় অসহায় মনে করে। এই অসহায় মানুষ তখন নিজকে অন্য কারোও গোলাম বা অধিনস্ত ভাবতে শুরু করে। সে ভাবতে শুরু করে আমি যা চাই তা আমি পেতে পারিনা। আমাকে অন্য কেউ তা দিবে। অন্য কোন সত্তা আমাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে। বাঁচাবে রোগ-শোক, দুঃখ ও ক্ষতি থেকে। অন্যের কাছে চাওয়া, অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া, অন্য সত্তার পূজা এবং ইবাদত করাটা মানুষের একটা স্বভাব ধর্ম। এমনিভাবে মানুষের মনে একজন মালিক কিংবা প্রভুর ধারণা জন্ম নেয়।
মানুষ এই চিন্তার ফলেই পাথর, মেঘ, বৃষ্টি, সূর্য, চন্দ্র ও আগুনকে পূজা করেছে। এদের শক্তি ও ক্ষমতা দেখে মানুষ মনে করলো এরাই খোদা। কিন্তু পরর্বীতে মানুষ দেখলো এই সব কিছু আসলে মানুষের কোনই উপকার করতে পারেনা বরং নিজেরাই কোন না কোন বিশেষ বিধানের আনুগত্য করে চলছে। মনে হয় খালি চোখে দেখা যায়না এমন কোন এক অদৃশ্য রহস্যময় শক্তির নিয়মে সব কিছু চলছে। তখন মানুষ পাথর, আলো, বাতাস, পানি ব্যাধি, স্বাস্থ্য এমন সব কিছুর পেছনে এক একটি অদৃশ্য শক্তির কল্পনা করে নিল এবং তাদের পূজা করা শুরু করলো। জন্ম হলো বহু খোদা-বহু দেবতার ধারণা।
আবার কেউ ভাবরো এইসব খোদা বুঝি কোন এক বড় খোদার হুকুম মত চলে। তা না হলে সারা বিশ্বজুড়ে সবকিছু একটি নিয়মে চলছে কেন? তাই বড় খোদাকে খুশী করতে হলে এইসব ছোট ছোট খোদাকে খুশী করতে হবে।
কিন্তু মানুষ যখন জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি লাভ করলো –চিন্তা করলো, ভাবলো তখন এক একটা ছোট ছোট খোদার সংখ্যা কমতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত এক খোদার ধারণাই অবশিষ্ট থাকলো।
কিন্তু সেই এক খোদার ধারণার মধ্যেও গলদ দেখা দিলো। কেউ মনে করলো, এই খোদা আমাদের মত রক্ত মাংস দেহের অধিকারী। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবই আছে। আবার কেউ মনে করলো, খোদা মানুষের রূপ নিয়ে অবতার হয়ে পৃথিবীতে আসে।
কেউ বলে, এই দুনিয়ার সবকিছু চালু করে দিয়ে খোদা বসে আছেন। আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। সুতরাং এই দুনিয়ায় আমরা আমাদের মত চলবো। আমাদের ইচ্ছায় আমরা চলবো। এইবাবে নিজের ইচ্ছা, নিজের মনের বাসনাকেউ কেউ আবার খোদা বানিয়ে নিলো।
কেউ ভাবলো, খোদা, সেতো বিরাট ব্যাপার, আমরা তাঁর কাছে কিভাবে পৌঁছাবো? কিভাবে আমাদের মনের কথা পৌঁছাবো? তাই আমাদের মধ্যে কোন এক বুজুর্গ লোক খুঁজে বের করে তাঁরই সুপারিশ নিয়ে খোদার কাছে যেতে হবে। খোদাকে পেতে হলে আরও একজনকে সুপারিশকারী ধরে প্রকৃতপক্ষে আরও একজন খোদার জন্ম দিলো মানুষ। এমনিভাবে মানুষ অজ্ঞতার বশে নিজের মনের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া হাজারো খোদার জন্ম দেয়। একেই বলে ‘শিরক’ করা।
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদ বিশ্বাসের তাৎপর্য হলো এমনি সব ভ্রান্ত খোদার গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে এক ও একক আল্লাহর বিশ্বাসকে মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সেই আল্লাহকে যে আল্লাহর কোন শরীক নেই। যে আল্লাহর কোন অংশীদার নেই। যে আল্লাহর কোন সন্তান নেই। যে খোদা কারও মুখাপেক্ষী নন এবং স্বাধীন, সর্বশক্তিমান। যিনি সব কিছু জানেন, শুনেন এবং দেখেন। যাঁর হুকুম কেউ অমান্য করতে পারেনা। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী। যিনি সকল অভাব, ভুল এবং দুর্বলতা থেকে মুক্ত। যে আল্লাহ তাঁর বান্দার ডাক শুনেন –সরাসরি তার মনের কথা জানেন।
আল্লাহ সম্পর্কে এই সঠিক ধারণাই যুগে যুগে নবীর পয়গাম্বররা মানুষকে দিয়েছেন। সকল জ্ঞানের সেরা এই জ্ঞান।
তাওহীদের এই শিক্ষা সুন্দরভাবে ‘সূরা ইখলাসে’ বলা হয়েছেঃ
বল, তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ সবকিছু থেকে নিরপেক্ষ, মুখাপেক্ষীহীন, সবাই তাঁরই মুখাপেক্ষী, না তাঁর কোন সন্তান আছে, আর না তিনি কারো সন্তান এবং কেউ তাঁর সমতুল্য নয়।
তাওহীদ বিশ্বাসের সুফল
এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাস মানুষের পুরো জীবনটাকে বদলিয়ে দেয়।
ক. তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এইভাবে পুরোপুরিভাবে সে আল্লাহর গোলামে পরিণত হয়। এই জমীন-আসমানের সবকিছু মানুষের জন্যই। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আল্লাহর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলে তাই আর অন্য সব সৃষ্টির উপর মানুষেল নিয়ন্ত্রণ আসবে।
খ. এক আল্লাহতে বিশ্বাস মানুষকে করে আত্মবিশ্বাসী, আত্মসচেতন। মানুষ নিজকে চিনতে পারে। পৃথিবীর শ্রেষ্ট সৃষ্টি হিসেবে নিজকে জানতে পারে। নিজের অভাব পূরণের জন্য সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো মুখাপেক্ষী নয়। এই চেতনা তাকে করে আত্মবিশ্বাসী। একজন গরীব ক্রীতদাস তখন নিজেকে ছোট মনে কেরনা। সে তার নিজের আসল পরিচয় খুঁজে পায়। সে পায় মানুষের মর্যাদা।
গ. সে বিশ্বাস করে তার যা কিছু আছে সব আল্লাহর দেওয়া। তাই তাওহীদে বিশ্বাসী লোক কখনও অহংকারী, দেমাগী হয়না। সে হয় বিনয়ী ও ভদ্র।
ঘ. তাওহীদে বিশ্বাস মানুষকে করে কর্তব্যপরায়ণ। সে জানে তার একমাত্র কাজ হলো আল্লাহর হুকুম মেনে চলা। এই হুকুম মেনে চললে আল্লাহ খুব খুশী হবেন। তাই সে কোন দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনা। করেনা কোন অন্যায় ও পাপ কাজ।
ঙ. তার মন হয় প্রশান্ত ও তৃপ্ত। সে কোন দুশ্চিন্তা করেনা। সে জানে তার যা কিছু প্রয়োজন সবই আল্লাহ দিচ্ছেন। সে জানে তার জন্য আল্লাহ যা কিছু করেন সবই তার ভালর জন্য করেন। সাময়িক বিপদ-আপদ সবই আল্লাহর তরফ থেকে আসে। আল্লাহ যাকে সাহায্য করতে চান তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবেনা। আর আল্লাহ যাকে কিছু দিতে চাননা তাকে কেউ কিছু দিতে পারবেন না। তাই মুমিন মন কখনও হতাশ হয়না। মুমিনের মন কখনও ভাঙ্গেনা। সে আল্লাহতে থাকে তুষ্ট।
চ. তাওহীদ মানুষের মনে সৃষ্টি করে দৃঢ় সংকল্প, উচ্চাকাংখা, অধ্যবসায় ও সবর। সে মৃত্যুকে ভয় পায়না। দুঃখ ও কষ্টে টলেনা। তাই কোনো ভাল কাজ, মহৎ কাজ করতে সে কখনও পিছপা হয়না। মৃত্যুভয়, জুলুম, অত্যাচার তাকে সত্যের পথ থেকে টলাতে পারেনা। ধন-সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততির ভালবাসা কোনটাই তার কাছে স্থান পায়না। একমাত্র আল্লহার রাস্তায় সে হয় বিপ্লবী সাহসী পুরুষ।
ছ. সবচেয়ে বড় কথা একজন মুমিন বিশ্বাস করে, আল্লাহ তার অন্তরের সব কিছু জানেন, সব কিছু দেখেন। এই চিন্তা তাকে আল্লাহর আদেশ মান উৎসাহিত করে। তার দ্বারা কোন পাপ কাজ হয়না। কেউ না দেখলেও তার দ্বারা কোন খেয়ানত হয় না। এমনিভাবে সে হয় আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা। তার বিশ্বাসের সাথে কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রেসালাত
এই দুনিয়ায় চলতে হলে মানুষের অনেক কিছু প্রয়োজন। আল্লাহ মানুষকে চলার জন্য এই দুনিয়ায় সব রকমের উপকরণই দিয়ে দিয়েছেন। তার কোন হিসাব নেই। মানুষের চলার জন্য দিয়েছেন পা, কাজ করার জন্য হাত, শুনবার জন্য কান, দেখবার জন্য চোখ এমন অনেক কিছু। এছাড়া বেঁচে থাকার জন্য দিয়েছেন খাদ্য, পানীয়, বাতাস, তাপ ও আলো। সুন্দর জীবন গড়ার জন্য দিয়েছেন মায়ের আদর, পিতার স্নেহ, অন্যের মনে তার জন্য ভালবাসা।
দুনিয়ায় সব কাজ কারবার যেন ঠিকমত চলে সেজন্য আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থা কি চমৎকার! দেখো, তিনি একেক মানুষের মধ্যে দিলেন একেক যোগ্যতা, একেক গুণ। একেক পারদর্শিতা। কারও মধ্যে থাকে নেতৃত্বের গুণাবলী, কেউবা অসাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার গুণ লাভ করে। কেউবা আল্লাহর দেওয়া প্রতিভায় মানুষের জন্য আবিস্কার করে নতুন নতুন জিনিস। ফলে দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন গুণে পারদর্শী হয়।
কোন সমস্যা হলে তাই আমরা সকলের কাছে না গিয়ে সেইসব বিশেষজ্ঞদের কাছে ছুটে যাই। রোগ হলে যাই ডাক্তারের কাছে। বড় বড় দালান-কোঠা, পুল, রাস্তা তৈরী করতে হলে যাই ইঞ্চিনিয়ারের কাছে। বিজ্ঞানের জটিল সমস্যা দেখা দিলে ছুটে যাই বৈজ্ঞানিকের কাছে মোট কথা, আমাদেরকে কোন এক সমস্যার সমাধান পেতে হলে সেই বিশসে পারদর্শীর কাছে যেতে হবে।
এমনিভাবে দুনিয়ার সব সমস্যারই সমাধানের এক চমৎকার ব্যবস্থাও আল্লাহই করে দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও একটা বিরাট সমস্যা থেকে যায়। জীবনে চলার জন্য প্রয়োজন জীবনের উদ্দেশ্য জানা, আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে জানা, সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ জানা। এসব জানার উপায় কি? মহান দয়ামতয় আল্লাহ সে উপায়ও আমাদের বাতলিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে সঠিক পথ চিনবার জন্য, মানুষকে সঠিক পথে চালানোর জন্য এক চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন।
দুনিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন লোককে যেমন বিভিন্ন যোগ্যতা দিয়ে তিনি পারদর্শী বানিয়েছেন তেমনি আল্লাহকে চিনার উচ্চতম যোগ্যতা দিয়ে মানুষের মাঝে কিছু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সেইসব মনোনীত মানুষকে আল্লাহ সঠিক পথের জ্ঞান দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন খোদার বিধান। আর সে বিধান অনুযায়ী তাঁদের চরিত্রকে গঠন করেছেন এবং অন্যকে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেওয়ার, বুঝিয়ে দেওয়ার এবং বাস্তবে পালন করে দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তাদেরকে দিয়েছেন। এইসব মহান মানুষদেরকে আমরা বলি নবী, রাসূল বা পয়গম্বর।
আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে হেদায়াত দানের এটাই একমাত্র ব্যবস্থা। নবী, রাসূলদের এই ধারাকে ইসলামী পরিভাষায় বলে ‘রেসালাত’। আল্লাহ এবং মানুষের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো এই রেসালাত।
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী এবং তাৎপর্য
সাধারণ মানুষের কাজ হলো সে সত্যিকারের পয়গাম্বরকে চিনে নেবে। বেছে নেবে জীবনে চলার পথের নেতাকে। আল্লাহর নবীকে চিনে নেবার পর তার কাজ হলো সেই নবীর আদর্শের উপর ঈমান আনা, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা, তাঁর দেখানো পথে চলা। কাউকে পয়গাম্বর হিসেবে মেনে নেবে অথচ তাঁর হুকুম মান হবে না, এটা একেবারেই বুদ্ধিহীনেরকাজ। কেননা নবী পয়গাম্বররা যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তাঁদেরকে না মানার অর্থ আল্লাহকে না মানা। তাদের বিরোধিতা করার অর্থ আল্লাহর বিরোধিতা করা।
পয়গাম্বর আমাদের যা বিশ্বাস করতে বলেছেন আমরা তা বিশ্বাস করবো। যা পালন করতে বলেছেন আমরা তা পালন করব। যা নিষেধ করেছেন আমরা তা করবোনা।
নবীর কোন কাজ, কোন কথা বুঝতে না পারলে কিংবা আমাদের বুদ্ধিতে না কুলালেও তা মেনে নিতে হবে। এটই হলো রেসালাতের উপর ঈমানের দাবী। তাই নবী-রাসূলদের শুধু স্বীকার করলেই হবেনা, তাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ মানুষকে নবী –পয়গাম্বরদের মাধ্যমেই হেদায়াত দিয়েছেন। সরল এবং সঠিক সবসময় একটিই হয়। সেই সরল, সঠিক পথের সন্ধান আল্লাহ পয়গাম্বরদের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই নবী, পয়গাম্বরদের পথ ছাড়া আর কোন পথইতো আল্লাহর পথ হতে পারেনা। কোন পথই আল্লাহকে জানার ও পাওয়ার জন্য সরল এবং সঠিক পথ হতে পারেনা। নবীর হুকুম মানার মাধ্যমেই আল্লাহর হুকুম মানা সম্ভব।
নবীদের পরিচয়
নবী-রাসূলরা আমাদের মত মানুষ ছিলেন। তাই তাঁদেরকে অতি মানব ভাবা ঠিক নয়। তাঁদের সম্পর্কে এটাও ধারণা করা ঠিক নয় যে, তাঁরা আল্লাহর পুত্র, কিংবা আল্লাহর অংশীদার (নাউযুবিল্লাহ)। নবী-রাসূলদের আনুগত্য করা অর্থ তাঁদের পূজা করা নয়। আনুগত্য তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর। নবীদের দেখানো পদ্ধতির আনুগত্য করলেই সেটা হবে প্রকৃত আল্লাহর আনুগত্য। নবী ও রাসূল হলো আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম।
আল্লাহ সব যুগে, সব জাতির, সব গোত্রের জন্য নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়ঃ
প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রাসূল রয়েছে।
সূরা ইউনুছ-৪৭
প্রত্যেক জাতির জন্য একজন পথ প্রদর্শক রয়েছে।
সূরা আর-রা’দ-৭
কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের কাছে কোন না কোন সতর্কবাণী আসে নাই।
সূরা ফাতের-২৪
এমনি ভাবে প্রত্যেক যুগেই মানুষকে সরল সঠিক পথ দেখানোর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কি সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে দেখো। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর হাদীস অনুযায়ী নবী-রাসূলদের সংখ্যা একলাখ চব্বিশ হাজার। কিন্তু এদের সকলের নাম জানা যায়নি। পবিত্র কোরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে।
মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে সকল নবী-পয়গাম্বরের উপর ঈমান আনতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ মানুষকে হযরত আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে হেদায়াতের যে ধারা শুরু করেছিলেন হযতর মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর মাধ্যমে তার পূর্ণতা দিয়েছেন।
অন্যান্য নবী ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য
আমরা অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরকে বিশ্বাস করবো ঠিক। কিন্তু আমাদের কয়েকটি বিষয় জেনে নিতে হবে। তা হলো আমাদের প্রিয় নবী শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য পয়গাম্বরদের মধ্যে পার্থক্য কি?
১। পূর্ববর্তী নবীরা বিশেষ যুগে বিশেষ কওমের মধ্যে এসেছিলেন কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে পাঠানো হয়েছে সারা দুনিয়ার জন্য এবং সর্বকালের জন্য।
২। পূর্ববর্তী নবীদের জীবন কাহিনী সঠিকভাবে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাঁদেরকে অনুসরণ করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনী, শিক্ষা, মুখের কথা, কাজ সব কিছু মোটকথা পুরো জীবনী সঠিকভাবে আমাদের কাছে আছে। তাই পয়গাম্বর হিসেবে একমাত্র তাঁরই অনুসরণ সম্ভব।
৩। পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা ছিলো তাঁদের যুগের জন্য। প্রত্যেক নবী এসে তাঁর পূর্ববর্তী নবীর আদেশ, আইন, হেদায়াত সংশোধন ও সংযোজন করেছেন। তাই পূর্বের সকল নবীর শরীয়ত আপনা থেকেই বাতিল হয়ে গেছে। সর্বশেষে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা সবদিক থেকে পূর্ণাঙ্গ। তাই শেষ নবীর অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে সকল নবীর শিক্ষার আনুগত্য করা হয়।
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
নবী করীম (সঃ) আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে বলেছেন। ফেরেশতারা কারা? কি তাদের কাজ? মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কেনই বা আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে হবে?
ফেরেশতারা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিশেষ কাজ করার জন্য ‘নূর’ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন মানুষকে ‘মাটি’ দিয়ে, জ্বীনকে ‘আগুন’ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। ইবলীস শয়তান জ্বীনদের মধ্যের একজন। অনেকের ভুল ধারণা ইবলীস ফেরেশতাদের সর্দার ছিলো।
ফেরেশতারা সব সময় আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কাজ করছে। আল্লাহর কাজের জন্য হুকুম দিয়েছেন সে সেই কাজই করছে। তাদের কোন ঘুম নেই, নেই আমাদের মত ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। আল্লাহ তাঁর অনুগত সুন্দর সৃষ্টি ফেরেশতাদের দ্বারা বিশ্বজাহান পরিচালনা করছেন। আল্লাহর সৃষ্টি জগতে বহু ফেরেশতা আছে। আমরা মাত্র মাত্র কয়েক জন বিখ্যাত ফেরেশতার নাম জানি। আল্লাহর কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসতেন জীবরাঈল (আঃ)। আমাদের মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে আসেন আজরাঈল (আঃ)। মানুষের খাদ্য বণ্টন করেন মীকাইল (আঃ) এবং কিয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন ইস্রাফিল (আঃ)।
এই ফেরেশতাদের মধ্যে একশ্রেণীর ফেরেশতা সব সময় আমাদের মাঝে থাকেন। আমাদের ভাল মন্দ সব কাজ তারা দেখছেন এবং লিখে রাখছেন। মোট কথা তাদের কাছে সব মানুষের জীবনের সকল রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মৃত্যুর পর আমরা যখন আল্লাহর কাছে হাজির হবো তখন তারা আমাদের সেই রেকর্ড বা আমলনামা আল্লাহর সামনে পেশ করবেন। তখন আমরা দেখতে পাবো জীবনভর আমরা কি কি ভাল কাজ করেছি এবং কি কি খারাপ কাজ করেছি। সবকিছু ঠিক ঠিক মত পেশ করা হবে আল্লাহর কাছে। তারা সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করছেন। মানুষ ফেরেশতাদেরকে দেখতে পারেনা যতক্ষণ না তারা আল্লাহর হুকুমে মানুষের রূপ নিয়ে আসেন। আল্লাহর হুকুমে তারা যে কোন রূপ নিতে পারেন। একবার হযরত জীবরাইল (আঃ) মানুষের রূপ নিয়ে নবী এবং তাঁর সাথীদের মাঝে এসেছিলেন।
এখন আমরা দেখব এই অদৃশ্য ফেরেশতাদেরকে আমাদের কেন বিশ্বাস করতে বলা হলো।
আগেই বলা হয়েছে যে মানুষের দুর্বল মন কখনও কখনও এই দুনিয়ার বিভিন্ন কাজের পিছনে বিভিন্ন অদৃশ্য রহস্যময় শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করে। সে ধারণা করে কোন শক্তি বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্য কোন এক শক্তির হুকুমে আগুন জ্বলছে। আবার কেউ দান করছে মানুষকে আলো। মানুষ ভাবে এরা আল্লাহর সন্তান-সন্ততি। সে মনে করে এদেরকে খুশী করতে পারলে আল্লাহ খুশী হবেন। তাই তাদের কল্পিত মূর্তি তৈরী করে পূঝা করে অবুঝ মানুষ।
ইসলামের শিক্ষা হলো-না, এসব রহস্যময় শক্তি খোদা নয়। এমনকি খোদার সন্তান-সন্ততিও নয়। তারা ফেরেশতা। আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি, এমনিভাবে ফেরেশতার অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস মানুষকে অন্ধ শিরক থেকে মুক্তি দেয়।
কিতাবের উপর ঈমান।
মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমতের শেষ নেই। আল্লাহ মানুষকে মুক্তির পথের দিশা দিয়ে পাঠালেন নবী ও পয়গাম্বরদের। আল্লাহ তাঁদের কাছে যে বাণী পাঠালেন তাকে অহি বলা হয়। অহির মাধ্যমে অনেক নবীর কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন আল্লাহ। এভাবে সৎ, সঠিক, নির্ভুল প্রয়োজনীয় জ্ঞান লিখিত আকারে মানুষের কাছে এলো। এরচেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে?
কোরআন যে সব কিতাবের কথা উল্লেখ আছে আমরা সে সব কিতাবে বিশ্বাস করি। সেগুলি হলো হযরত মুসা (আঃ)-এর ‘তাওরাত’, হযরত দাউদ (আঃ)-এর ‘জাবুর’, হযরত ঈসা (আঃ)-এর ‘ঈঞ্জিল’, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ‘কোরআন’। এছাড়াও বিভিন্ন নবীর কাছে বিভিন্ন কিতাব এসেছে। সে সবের নাম ও পরিচয় আমাদেরকে বলা হয়নি। তাই বর্তমান বিশ্বে আর যেসব ধর্মীয় গ্রন্থ আছে তা যে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এ কথা যেমন জোর দিয়ে বলতে পারিনা, তেমনি এ কথাও বলতে পারিনা যে এসব আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। আসল কথা হলো কোরআন ছাড়া আর কোন ধর্মীয় গ্রন্থকে আমরা সঠিকভাবে পাইনা।
একমাত্র কোরআন ঠিক যেভাবে নাযিল হয়েছে সেইভাবে অক্ষত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় আছে। তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল যেভাবে, সে ভাষায় নাযিল হয়েছিল সেভাবে, সে ভাষায় নেই। তাওরাত ছিল ‘হিব্রু’ ভাষায় এবং ইঞ্জিল ছিল ‘আরামিক’ ভাষায়। বর্তমানে তাদের মূল শব্দাবলীতেও পরিবর্তন এসেছে। সংশ্লিষ্ট নবীদের মৃত্যুর অনেক পরে তাদের অনুসারীরা আবার নতুন করে এসব কিতাব সংকলিত করার দাবী করে। ফলে এ সবের মধ্যে রয়েছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং মনগড়া কথা। আল্লাহর মূল কথার সাথে মিশে গেছে মানুষের কথা। শুধু তাই নয়, বাইবেলে আছে অনেক ভুল তথ্য। আছে নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন গল্প।
তাই এসব কিতাব সম্পর্কে শুধু এটাই বলা যায় যে, এসবের মধ্যে আল্লাহর কালামের সাথে মানুষের কথা মিশে গেছে। কোনটা আল্লাহর কথা আর কোনটা স্বার্থবাদী মানুষের কথা তা বুঝবার কোন উপায় নেই।
তাহলে এসব কিতাবের কথা বলা হলো কোরআনে? সব কিতাবের উল্লেখ করে কোরআন এ কথাই জানিয়ে দিলো –আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রত্যেক যুগেই নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন তাঁদের মাধ্যমে কিতাব ও হুকুম-আহকাম। অতীদের নবীর অনুসারীরা সেই কিতাবের শিক্ষাকে ভুলে গেছে। সে শিক্ষাকে নষ্ট করেছে। কোরআন কোন অভিনব জিনিস নয়। মানুষের জন্য আল্লাহর একটা রহমত যা তিনি পাঠিয়েছেন শেষ নবীর কাছে। অতীতের সেই শিক্ষাকে আবার জীবন্ত করার জন্য কোরআন নাযিল করা হয়েছে।
আল্লাহর এও এক অপার রহমত যে সেই কোরআন আজও অপরিবর্তিত, অক্ষত অবস্থায় আমাদের মাঝে আছে। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি।
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
দুনিয়াতে আমরা দেখি প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যু আছে। দুনিয়ায় এই জীবন চিরস্থায়ী নয়। হাসি ও আনন্দ, সুখ ও দুঃখের এই জীবন একদিন শেষ হয়ে যায়। এই মৃত্যু সকলের জীবনে একদিন না একদিন আসবেই। মৃত্যু কখন আসবে তাও কেউ জানেনা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ
অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরতে হবে।
-আল-ইমরান-১৮৫
মৃত্যুর পর জীবন
মৃত্যুর পর জীবনের এক চরম সত্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই সকলের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু জিনিসটি কি? মানুষ মৃত্যুর পর যায় কোথায়? এই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন এসে দেখা দেয়, তা হলো, মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের এই দুনিয়ার জীবনের সব ভাল ও মন্দ কাজের ফলাফল কি শেষ হয়ে যায়? দুনিয়ার জীবনে মানুষ যা কিছু করলো, ভাল কিংবা মন্দ এর ফল কি এই দুনিয়াতেই শেষ? বিষয়টা আরও একটু গভীরভাবে ভাবি।
আমরা দেখি এই দুনিয়ার জীবনে হাজারও কষ্টের মধ্যে, হাজারও প্রতিকূলতার মধ্যে অনেক লোক এমন আছেন যিনি সৎ পথে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন সব সময়। তিনি অন্যের উপকার করছেন, অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি এই দুনিয়াতে এই সৎ কাজের জন্য পুরোপুরি কোন পুরস্কার পাচ্ছেন না; বরং পাচ্ছেন উল্টোটা-দুর্নাম ও নির্যাতন। কখনওবা তাঁর ভাগ্যে জোটে মৃত্যুদণ্ড। তাহলে কি তিনি যে সৎ কাজ করলেন তা সব বিফলে যাবে? তাঁর মৃত্যুর পর তার সৎ কাজের সুফল এই দুনিয়াবাসী অনন্ত কাল ধরে পাবে আর তিনি নিজে তাঁর ফলাফল পাবেন অসম্পূর্ণ, এটা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়?
অন্যদিকে একজন লোক জীবনভর অন্যায় কাজ করলো। আমরা দেখলাম সে হয়তো তার দুষ্কর্মের জন্য দুনিয়ায় কিছুটা শাস্তিও পেলো। কিন্তু তার দুষ্কর্মের শাস্তি সে পুরোপুরি পেলনা। কখনও কখনও এই ধুরন্ধর ব্যক্তি দুনিয়ার সকলকে ফাঁকি দিয়ে দুনিয়ার শাস্তিও এড়িয়ে যায়। লোকের চোখের আড়ালে দুষ্কর্ম চালিয়ে যায়। অথচ তার দুষ্কর্মের ফল অন্যেরা পেতেই থাকে। এই জুলুমের পুরোপুরি শাস্তি কি সে কোন দিনও পাবেনা? দুনিয়ায় যে জুলুম সে করেছেন, যে খারাপ কাজ সে করেছে, তার মৃত্যুর পর তার পরিণাম দুনিয়াবাসী ভোগ করতেই থাকবে। আর মৃত্যু এসে এই জালিমকে একেবারেই বাঁচাবে শাস্তি থেকে, একি কখনও হতে পারে?
মোট কথা, আমরা দেখি দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ কখনও তার ভাল এবং মন্দ কাজের সঠিক পুরস্কার কিংবা শাস্তি পেতে পারেনা। বিবেকের কথা হলো, মৃত্যুর পরও তার ভাল ও মন্দ কজের জন্য পুরস্কার কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
ইসলাম বল মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন আছে। যাকে আমরা বলি ‘পরকাল’। ‘মৃত্যু’ দেখা যায় কিন্তু মৃত্যুর পর কি আছে তা দেখা যায়না। আর দেখা যায়না বলেই অনেকে মৃত্যুর পর কিছু আছে বলে বিশ্বাস কতে চায়না। আমরা নিজেরা দেখতে পারিনা, নিজেরা অনুভব করতে পারিনা বলেই মৃত্যুর পর কিছু আছে কিনা তা বিশ্বাস করবো না এটা কি যুক্তিসঙ্গত হলো? আমরা দেখবো, বিবেক কি বলে। আমরা দেখবো এই পরকাল বিশ্বাস করা কিংবা তা না করার ফলে মানুষের জীবনে কি প্রভাব পড়ে। আমরা দেখবো, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে সৎ-মহৎ ও পবিত্র বলে প্রমাণিত আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কি শিখালেন।
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
১। যে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাস করেনা তার জন্য তো দুনিয়ার এই জীবনটাই সব। তাই খাও, ফুর্তি করো এটাই তার জীবনের লক্ষ্য। সব কাজ সে এই দৃষ্টিতে দেখবে। যে কাজে তার স্বার্থ নেই সেই কাজে সে উৎসাহ পাবেনা। যে ভাল কাজের ফল সে এ দুনিয়ায় পাবেনা, সেটা তার কাছে ভাল কাজ বলে মনে হবেনা। আর যে অন্যায় কাজের জন্য দুনিয়ায় সে শাস্তি এড়াতে পারবে, তার কাছে সেটা অন্যায় বলে মনে হবেনা।
২। কোন ব্যক্তি যদি পরকালে বিশ্বাস না করে তবে সে কোন সৎকাজে উৎসাহ পেতে পারেনা। কেননা দুনিয়ায় সব সৎকাজের ফল পাওয়া যায়না। ফলে তার চোখের সামনে অন্যায় হবে, জুলুম হবে আর সে তা তাকিয়ে দেখবে। অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকারের কোন উপায় না দেখে তার মনোবল ভেঙ্গে যাবে।
৩। এইভাবে সমাজ থেকৈ দিন দিন ভাল কাজ লোপ পায়। আর স্বার্থপরতা, লোভ লালসা বাড়তে থাকে। একে অন্যের জন্য কষ্ট করবে, একে অন্যকে সাহায্য করবে, অন্যের দুঃখে শরিক হবে, এসব ভাল গুণের কদর কমতে থাকে। কে কিবাবে কাকে ঠকাবে, অন্যের সম্পদ কিভাবে লুটবে এটাই হয় মানুষের সব সময়ের চিন্তা। সমাজ তখন মানুষের বসবাসের যোগ্য থাকেনা।
তুমি কি দেখেছ সে লোককে যে পরকালের শুভ প্রতিফল ও শাস্তিকে অস্বীকার করে।
সূরা মাউন-১
তাই পরকালে বিশ্বাস একটা মামুলী বিষয় নয়। পরকালের প্রতি অবিশ্বাস মানুষকে প্রকৃত পক্ষে পশুতে পরিণত করে। মানবতাকে ধ্বংস করে। মানুষ পরিণত হয় খোদাদ্রোহী জালেমে।
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকালের প্রতি বিশ্বাসকে ইসলাম তাই এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় পরকালকে ভলা হয় ‘আখেরাত’। নবী রাসূলগণ আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেনঃ
১। আল্লাহ একদিন এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ করে ধ্বংস করে দেবেন। সে দিনের নাম ‘কিয়ামত’।
২। এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হবার পর আবার সবাইকে দেওয়া হবে নতুন জীবন। মানুষ আবার নতুন দেহ পাবে। সবাইকে আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে, আল্লাহ সকলের বিচার করবেন। একে বলা হয় ‘হাশর’।
৩। বিচারের জন্য মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু করেছে সেই আমলনামা মানুষের সামনে পেশ করা হবে। মানুষের ভাল কাজ মন্দ কাজ, সব কিছু তার সামনে তুলে ধরা হবে। সত্য ও ইনসাফের সাথে তার বিচার করা হবে। আল্লাহর মানদণ্ডে যার ভাল কাজ মন্দ কাজের চেয়ে বেশী হবে তাকে আল্লাহ পুরস্কার দেবেন। ভাল কাজের পুরস্কার হিসাবে তাকে দেবেন জান্নাত আর খারাপ কাজের জন্য শাস্তি হিসাবে সে পাবে জাহান্নাম।
এভাবেই ইসলাম জানিয়ে দেয় দুনিয়ার এই জীবনই মানুষের শেষ নয়। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। এখানে মানুষের সকল কাজের পুরোপুরি ফলাফল প্রকাশ পায়না। দুনিয়ায় ভাল ও মন্দ কাজের পুরোপুরি ফলাফল পাওয়া যায় আখেরাতে। তাই আখেরাতের জীবনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতাই হচ্ছে আসল। দুনিয়া এবং আখেরাতে শান্তিই মানুষের জীবনের চরম ও পরম আকাংখা হওয়া উচিত।
পরকালে বিশ্বাসের উপকার
ইসলাম আখেরাত বিশ্বাসকে সকল বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের বুনিয়াদ হিসেবে নিয়েছে।
১। আখেরাতে বিশ্বাস মানুসের মধ্যে এক শক্তিশালী বিবেকের জন্ম দেয়। যা সত্য তাকে সে সত্য বলেই মনে করে। মিথ্যাকে সে মিথ্যা বলতে ভয় পায়না। দুনিয়ার কোন লাভ বা ভয়-ভীতির কারণে সে ভাল কাজ করেনা। নিজের বিবেকের তাড়নাতেই সে সত্যের পথে চলে নির্ভীকভাবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে তাকে হাজির হতে হবে সে চিন্তা তাকে পর্বত প্রমাণ জুলুম সাহসিকতার সাথে মোকাবিলার সাহস জোগায়।
২। আখেরাতের উপর বিশ্বাস মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে দুর্লভ গুণ। পরকালে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় সে দুনিয়ায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে পরের উপকারে, অন্যের সাহায্যে। তার দ্বারা কারও হক নষ্ট হয়না। এতিম, মিসকিন, পথচারী, প্রতিবেশী সকলের প্রতি সে হয় সদয়।
৩। আখেরাতে বিশ্বাস মানুষকে দায়িত্বশীল করে। সে বিশ্বাস করে দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। দুনিয়ার প্রতিটি কাজ সে তাই দায়িত্ববোধের সাথেই পালন করে। কোনপ্রকার তদারকি ছাড়াই সে নিজের দায়িত্ব পালন করে যায়।
৪। এমনিভাবে আখেরাত বিশ্বাসের উপর যে সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে বিরাজ করে ভ্রাতৃত্ব, মমতা, সহানুভূতি, দয়া ও ভালবাসা। সে সমাজে হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে সকল কাজ পরিচালিত হয়। আর তখনই মানুষ পায় মানুষের প্রকৃত মর্যাদা।
তৃতীয় অধ্যায়
ইবাদত
ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য
পাঁচটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত
নামায
নামায মানুষের স্বভাব ধর্মের পরিচয়
নামায আল্লাহর স্মরণ
নামায প্রকৃত বান্দা তৈরী করে
নামাযের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় খোদাভীতি
জামায়াতে নামায
নামায কিভাবে উপকারে আসে
রোযা
রোযা খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি করে
রোযা ইচ্ছা শক্তি বাড়ায়
রেযা ভ্রাতৃত্ব বাড়ায়
অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে চলা
মৌলিক গুণাবলীর লালন
রোযা সহানুভূতিশীল করে
অন্যান্য উপকার
হজ্ব
হজ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান
হজ্বের তাৎপর্য
যাকাত
যাকাত একটি ইবাদত
যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে
যাকাতের উপকারিতা
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয়
যারা যাকাত নিতে পারে
ইবাদত
আল্লাহ চান এই দুনিয়ায় তাঁর দাসত্ব করুক, তাঁর আনুগত্য করুক। আল্লাহকে প্রভু হিসাবে মেনে নিয়ে তাঁর হুকুম মত মানুষ জীবন পরিচালনা করুক। জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর নির্দেশ মত করুক। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফে বলেছেন-
আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।
সূরা আয-যারিয়াত-৫৬
ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য
‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ বন্দেগী বা দাসত্ব। মানুষ আল্লাহর দাস বা গোলাম (আরবীতে আবদ)। আল্লাহ মানুষেল ‘মাবুদ’। কোন গোলাম বা চাকর যদি সত্যিকারভাবে তার (১) মনিবের দাসত্ব স্বীকার করে নেয় (২) তার মনিবের একান্ত অনুগত হয় এবং (৩) গোলামের মত আচরণ করে, তাঁকে সম্মান করে এবং তাঁর দানের শোকর করে তবে তার এই গোলামীকে বলে ইবাদত।
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহর গোলামী করা। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। এইসব কাজ খোদার আইন অনুযায়ী করার নামই ‘ইবাদত’। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি গতিবিধি খোদার নির্ধারিত সীমার মধ্যে হতে হবে। এই হিসেবে সে যে কাজই করে তাই ‘ইবাদত’। এই সীমার মধ্যে তার ঘুম, জেগে থাকা, খাওয়া-দাওয়া, চলাফিরা, কথা বলা, লেনদেন সবই ‘ইবাদত’।
আল্লাহর এই দাসত্ব মেনে নেয়া জীবনের কোন এক বিশেষ মুহুর্তের জন্য নয়। দিন-রাত্রির কোন বিশেষ সময়ের জন্য নয়। দিনের চব্বিশটি ঘণ্টা, বছরের প্রতিটি দিন মোটকথা মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর গোলাম হয়ে তাঁর হুকুম মত প্রতিটি কাজ করতে হবে। তাই আল্লহর প্রকৃত দাস হিসেবে জীবন পরিচালনা করা সহজ বিষয় নয়। এজন্যে চাই দৃঢ় ঈমান, চাই সাধনা ও অনুশীলন।
আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার পথে প্রথম বাধা আসে নিজের ভিতর থেকে। মানুষের নিজের ভিতরে আছে আরামপ্রিয়তা, লোভ-লালসা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস। সব ধরনের জড়তা, দুর্বলতা, অলসতা কাটিয়ে আল্লাহর গোলাম হিসেবে নিজকে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ কতকগুলো ‘কাজ’ ফরয করে মানুষকে আল্লাহর গোলাম হবার ট্রেনিং দেয়। যে যত ভালভাবে এই ট্রেনিং নেবে সে তত ভালভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবে যেজন্য আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। এই সব ইবাদত পালন করে মানুষ গোটা জীবনকে আল্লাহর ‘এবাদতে’ পরিণত করার উপযুক্ত হয়।
দিনে পাঁচমার নামায স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা আল্লাহর দাস-একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা আমাদের কর্তব্য। এক মাস পুরো রোযা পালনের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ভিতরের পশু প্রবৃত্তিকে শাসন করতে শিখে। যাকাত স্মরণ করিয়ে দেয় তুমি যে অর্থ উপার্জন করেছো তা খোদার দান-নিজের খেয়াল-খুশীমত তা খরচ করলে চলবেনা। আল্লাহর হুকুম মত তোমার অর্থ ব্যয় করতে হবে। হজ্ব মানুষের মন ভরিয়ে দেয় খোদার প্রেম ও ভালবাসায়। আল্লাহ মহান ও শ্রেষ্ঠ এই অনুভূতি তার হৃদয়ে এমন দাগ কাটে যা কোনদিন ভুলে যাবার নয়। তাই আল্লাহর গোলাম হবার জন্য আমাদেরকে সঠিকভাবে নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত আদায় করতে হবে।
পাঁচটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত
কালেমা শাহাদাতের ঘোষণা দান, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত এই পাঁচটি ইবাদতকে আল্লাহ আমাদের জন্য অবশ্যকরণীয় ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এই পাঁচটি ইবাদতকে ইসলামের ভিত্তি (আরকানে দ্বীন) বলা হয়। একটি ঘর যেমন খুঁটি বা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে, এও ঠিক তেমনি। কালেমা শাহাদাতের ঘোষণা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর একত্ব ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর রেসালাতের স্বীকৃতি। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের (সঃ) অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজে আমাদেরকে সাহায্য করে অন্য চারটি আরকান-নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত।
নামায
নামায ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআনের ভাষায় এর নাম ‘সালাত’। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশী যে ইবাদতটি করতে হয় তা হলো নামায। নামায ফরজ হবার পর থেকে প্রতিদিন পাঁচবার অবশ্যই এই নামায আদায় করতে হয়।
নামায মানুষের স্বভাব ধর্মের পরিচয়
মানুষেল স্বভাব হলো এক বিরাট শক্তির কাছে নিজকে পেশ করা ও শ্রদ্ধা জানানো। নদী যেমন আপনা আপনি বিরাট সমুদ্রের দিকে ছুটে চলে, তেমনি মানুষও এক মহৎ লক্ষ্য বা পথে নিজকে নিবেদন করতে চায়। তাই যুগে যুগে মানুষ কোন না কোন কিছুকে বিরাট শক্তিময় মনে করে তার পূজা করেছে।
আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টি জগতের বৃহত্তম সত্তা। আল্লাহকে পাওয়াই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। তাই আল্লাহর সামনে নিজকে পেশ করে, মনে-প্রাণে এবং উচ্চারণে তাঁর প্রশংসা করে, তাঁর কাছে নিজকে নিবেদনের ওয়াদা করে, বুকে হাত রেখে দৃষ্টি অবনমিত রেখে, কোমর অবনত করে, মাটিতে মাথা রেখে যে ‘কাজ’ বা ইবাদতটিকে আমরা নামায বলি তা মানুষের স্বভাব ধর্মেরই পরিচয়।
নামায মানুষের দেহ ও মনের এক স্বাভাবিক দাবী। প্রত্যেক নবী রাসূল তাই তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লহার সামনে নিজকে পেশ করা, আল্লাহকে স্মরণ করা এবং আল্লাহর প্রশংসা করার জন্য নামাযের মত কোন না কোন ইবাদতকে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের প্রিয় নবী আমাদেরকে দিয়েছেন দিনে পাঁচবার নামাযের শিক্ষা।
নামায আল্লাহর স্মরণ বা জেকের
আমরা নামায আদায়ের মাধ্যমে আল্লহাকে স্মরণ করি। নামায আমাদেরকে আল্লাহে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায আদায় কর।
সূরা ত্বাহা-১৪
ইসলামের সবচেয়ে বড় কথা হলো আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর আনুগত্য। মুসলমান হিসেবে দুনিয়ার প্রতিটি কাজে সব সময় স্মরণ রাখতে হবেঃ আল্লাহ আছেন, তিনি আমাকে দেখছেন এবং আমার অন্তরের সব কিছু জানেন। ‘শয়তান’ আমাদেরকে তার দাস বানাতে চায়। আমাদের ভুলিয়ে রাখতে চায় সব সময়। তাই ‘আল্লাহর স্মরণ’ সব সময় জাগরুক রাখার জন্যেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে দিনের শুরুতে একবার, দিনের নানান কাজের ফাঁকে তিন তিনবার এবং রাতের বেলায় ঘুমের সময় হলে আর একবার আনুষ্ঠানিকভাবে নামায আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আমরা আল্লাহর গোলাম’।
নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ)-এর শেখানো নিয়ম অনুযায়ী তাই আমরা নামায আদায় করছি। একজন মুসলমানদের নামাযের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করো, কি সুন্দর এক ব্যবস্থা। আল্লাহকে স্মরণ করার, আল্লাহর দাসত্ব ঘোষণা করার, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার, আল্লাহর কিতাবের শিক্ষাকে বারবার উচ্চারণ করার, রাসূলের সত্যতা স্বীকার করার, আল্লাহর আদলতে জবাবদিহির কথা স্মরণ করার জন্য এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা কি আর আছে? চেয়ে দেখ, নামাযের জন্য পাঁচবার ওজু, নামাযে দাঁড়ানোর আদব, রুকু সেজদার মাধ্যমে ফুটে উঠা বিনয়ীভাবে-সব কিছু মিলিয়ে নবীজির শেখানো নামায মানুষকে কত পবিত্র করে, মহান করে তোলে মাটির মানুষকে।
এজন মুসলমান ঘুম থেকে উঠে পাখী ডাকা সকালে নামাযের মত একটি সুন্দর ব্যবস্থার মাধ্যমে শুরু করে তার দিন-সতেজ অনুভূতিতে। এরপর কাজের ফাঁকে গড়িয়ে যায় দিন। ভরা দুপুরে মুয়াজ্জিনের ডাকে আবার সে সজাগ হয় যোহরের সময়। ঈমানকে তাজা করে নিয়ে সে আবার ফিরে যায় দুনিয়ার কাজ কারবারে। কয়েক ঘণ্টা পর পড়ন্ত বেলায় আছরের নামায। তাজা করে নেয় সে আবার তার ঈমানকে। এরপর দিন শেষ হয়-হয় মাগরিবের সময়। ভোরে সে যে এবাদতের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিল দিন-রাতও শুরু করে সে সেই এবাদতের মধ্য দিয়ে-যেনো সেই শিক্ষা সতেজ থাকে তার চেতনায় রাতভর। তারপর ঘনিয়ে আসে এশার সময়। দিনের কোলাহলে সে যে সুযোগ পায়নি রাত্রির প্রশান্তিতে নিশ্চিন্তে মনে সেই এবাদতে মশগুল হয় তার দেহ-মন।
এই হলো সেই নামায-নবীর শেখানো নামায, যা ইসলামের ভিত্তিতে মজবুত করে। যে বড় ‘এবাদতের’ জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে সেই ‘এবাদতের’ জন্য তৈরী করার ‘ইবাদত’ নামায।
নামায প্রকৃত বান্দা তৈরী করে
মুসলমান হিসেবে প্রতি পদে পদে আল্লাহর হুকুম মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। তাই মনের মধ্যে সব সময় থাকতে হবে এই কর্তব্যবোধ। মন থাকবে আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সদা প্রস্তুত। আল্লাহর হুকুম মানাকে জীবনের এক স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করে নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ট্রেনিং-এর ঠিক সৈনিকের মত। একজন সৈনিককে যেমন প্রতিদিন যুদ্ধ করতে না হলেও যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। একজন মুসলমানকেও তেমনি সকল অবস্থায় আল্লাহর আইন পালনের জন্য প্রস্তুত থাকার উদ্দেশ্যে নামাযের মাধ্যমে প্রতিদিন ট্রেনিং নিতে হয়। সৈনিকের মত নিয়ম-শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, ধৈর্য, সাহস শৃঙ্খলার ট্রেনিং সে পায় নামাযের মাধ্যমে।
মুসলমান সে যে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে ইসলাম অনুযায়ী কাজ করবে, কুফরী ও ফাসেকীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আর এইভাবে মনে-প্রাণে প্রস্তুত হবার ‘ট্রেনিং’-এর জন্য দিন রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে। আল্লাহকে খুশী করার জন্য, জেহাদে প্রস্তুত সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠার এক বাস্তব কর্মসূচী নামায। বাস্তব জীবনে আমরা আল্লাহর আইন মানতে প্রস্তুত কিনা তার পরীক্ষা ও প্রমাণ নেবার জন্যই এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায। আর এজন্যই নামায পড়াকেই নবীজি কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন বলে উল্লেখ করেছেন।
নামাযের মাধ্যমে সৃষ্টিহয় খোদাভীতি
আল্লাহ আমাদেরকে সব সময় সব জায়গায় দেখছেন, আমাদের সব কিছু জানেন ও শুনে। খোদার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকা যায় না। মনের মধ্যে এই বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে, আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধান মেনে চলা তত সহজ হবে। আর এই বিশ্বাস দুর্বল হলে মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকা কঠিন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে মনের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃড় হয়। তাই নামায মুসলমান হিসেবে জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এক ইবাদত।
প্রত্যেক দিন পাঁচবার নামায আদায় করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয় কিন্তু যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, তাদের জন্য এ এক সহজ কাজ। আল্লাহ এ কথা সুন্দরভাবে কোরআনে বলেছেনঃ
তোমরা ধৈর্য এবং নামাযের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাহায্য চাও-
এটি সত্য একটি কঠিন কাজ, কিন্তু তাদের জন্য কঠিন নয় যারা মনে রেখেছে যে, একদিন আল্লাহর সাথে দেখা হবে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।
সূরা বাকারা-৪৫-৪৬
জামায়াতে নামায
নামাযে আমরা কোরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করি। কোরআন আল্লাহর বিধান। বুঝে শুনে কোরআনের এসব আয়াত পাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর বিধানকে জানার সুযোগ পাই। এছাড়া নামাযের জামায়াতে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ধরনের মুসলমানই একত্রিত হয়। এর মাধ্যমে মনের আদান প্রদানের এক চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আল্লাহর আইন, বিধি-বিধান জেনে নেওয়ারও এক সুন্দর সুযোগ হয়। জামায়াতে নামাযের ব্যবস্থা সৃষ্টি করে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা।
খোদার দুশমনদেরকে নির্মূল করা এবং দুনিয়ায় খোদার আইন জারি করার জন্য মুসলমানদের যে মিলিত শক্তির প্রয়োজন –যে ঐক্য শক্তির প্রয়োজন-দিনরাত পাঁচবার জামায়াতে নামায, জুময়ার দিনে বড় জামায়াত, বছরের দুই ঈদের জামায়াত মুসলমানদের মধ্যে সেই ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে –সেই ঐক্য-চেতনার জন্ম দেয়। আর সারা বিশ্বের মুসলমাদনরা একই ভাষায় একই পদ্ধতিতে নামায আদায়ের মাধ্যমে সেই চেতনারই সাক্ষ্য দেয় যে মুসলমানরা এক জাতি।
নামায কিভাবে উপকারে আসে
নামায আমাদের মধ্যে যেসব ভাল গুণ ও অভ্যাস সৃষ্টি করে তা আলোচনা করা হলো। কিন্তু এখানে একটি কথা ভালভাবে জেনে তিনে হবে –তা হলো নামায থেকে আমরা এতসব উপকার তখনই পাবো যখন আমরা জেনে বুঝে নামায আদায় করবো। নামাযের মধ্যে আমরা আল্লাহর দাস হিসেবে নিজকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর সামনে বিনয়ের সাথে যেভাবে রুকু করছি, সিজদা করছি, নামাযের বাইরে দুনিয়ায় অন্যান্য কাজও আমাদেরকে তেমনি আল্লাহর গোলামের মতই করতে হবে। আল্লাহ যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, নামায আদায় করার পর সেস কাজ কি আমরা করতে পারি?
নামাযের মধ্যে আমরা যেখানে বলছিঃ হে প্রভু! আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সব কিছু চাই –(সূরা ফাতেহা) সেখানে নামাযের বাইরে কি আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন কাজ করতে পারি?
নামাযের মধ্যে আমরা যেখানে বলছিঃ হে প্রভু! আমরা তোমরাই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সব কিছু চাই- (সূরা ফাতেহা) সেখানে নামাযের বাইরে কি আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন কাজ করতে পারি?
তাই নামায থেকে ফায়দা বা উপকার পাওয়ার উপায় হলোঃ
১। নামাযে আমরা যা যা পড়ছি বা বলছি সেসব কিছুর অর্থ ভালভাবে বুঝতে হবে।
২। আল্লাহর সামনে নামায আদায় করছি এই অনুভূতি নিয়ে নামায আদায় করতে হবে।
৩। নামাযের মাধ্যমে যেসব শপথ নিচ্ছি –যেসব ওয়াদা করছি নামাযের বাইরে আমাদের সব কাজে তার ছাপ থাকতে হবে।
রোযা
প্রতি বছর রমজান মাসে মুসলমানরা রোযা রাখে। রোযাকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘সওম’। ‘সওম’ অর্থ বিরতি থাকা বা বিরত রাখা। রোযার দিনে রোযাদাররা কোন জিনিস খাওয়া বা পান করা থেকে বিরত থাকে। শুধু তাই নয়, রোযা রাখলে খারাপ কথা বলা যায় না, খারাপ কাজ করা যায় না, খারাপ চিন্তা করা যায় না।
এমনিভাবে নামায আমাদেরকে যে শিক্ষা প্রতিদিন পাঁচবার স্মরণ করিয়ে দেয়, রোযা বছরে একবার তা একমাস ধরে প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়, রোযা বছরে একবার তা একমাস ধরে প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিতে দিতে থাকে। এ হলো মহান প্রভু আল্লাহর হুকুম-আহকাম মানার জন্য প্রস্তুত হবার বার্ষিক ট্রেনিং প্রোগ্রাম। পুরো একমাস এমনিভাবে কঠিন সাধনা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। মজার ব্যাপার হলো, এমনিভাবে রোযা রাখা শুধু আমাদের জন্যই যে ফরয করা হয়েছে তা নয়, আমাদের প্রিয় নবীর পূর্বেও যে সকল নবী ছিলেন তাঁদের অনুসারীদের জন্যও রোযার বিধান ছিল।
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন-
হে ঈমানদাররা, তোমাদের জন্য রোযা রাখা ফরয করা হয়েছে
যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর তা ফরয করা হয়েছিল।
আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পরহেযগারীর গুণ সৃষ্টি হবে।
সূরা বাকারা-১৮৩
কোরআনের এই আয়াত থেকে রোযার উদ্দেশ্য কি তা জানা যায়। কেউ ভালভাবে, ভাল নিয়তে রোযা রাখলে রোযার মাধ্যমে তার মধ্যে পরহেযগারীর গুণ সৃষ্টি হয়। পরহেযগারী কি? দুনিয়ার সব লোভ-লালসা ও খারাপ কাজ থেকে নিজকে দূরে রাখার নাম পরহেযগারী।
রোযা খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি করে
রোযার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি হয়। একটু খেয়াল করে দেখ, রোযার দিনে মানুষ যা কিছু ভাল কাজ করে তা কাউকে দেখানোর জন্য নয়। একমাত্র আল্লাহর জন্যই সব কিছু করে। সামান্য কিছু লুকিয়ে খেলে, কেউ কি তা দেখতে পারবে? খারাপ কিছু চিন্তা করলে কেউ কি তা জানতে পারবে? কিন্তু যে রোযা রাখে সে এটা বিশ্বাস করে যে, কোন মানুষ তা না দেখলেও আল্লাহ সব কিছু দেখেন, সবকিছু জানেন এবং সবকিছু শুনেন। এমনিভাবে আল্লাহকে স্মরণ করেই সে সারাদিন কষ্ট করে, ক্ষুধা লাগলেও কিছু খায়না। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাল কাজ করে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখলে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়।
রোযা ইচ্ছা শক্তি বাড়ায়
রোযা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। মানুষ সাধারণতঃ একটু আরাম চায়, একটু আয়েশ চায়, ভাল খেতে চায় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এ আগ্রহকে সব সময় সীমার মধ্যে রাখতে হয়। আর এ জন্য প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি। রোযা এ ইচ্ছা শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। মনের ভিতরে দৃঢ় হয় খোদাভীতি। আল্লাহ সব জায়গায় আছেন, সব কিছু দেখছেন –এই বিশ্বাস হয় মজবুত। আখেরাতের জীবনের উপর ঈমান হয় দৃঢ়। আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শের প্রতি ভালবাসা হয় আরও গভীর। আল্লাহর বিধান পালনের কর্তব্য অনুভূতি হয় বলিষ্ঠ।
রোযা ভ্রাতৃত্ব বাড়ায়
রমযান মাস আসলে সব দেশের মুসলমানরা রোযা রাখে। এ পৃথিবীর মুসলমানরা এক আল্লাহর নির্দেশে, একই নবীর দেখানো নিয়মে রোযা রাখে। এর ফলে সব মুসলমানের মনে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জেগে উঠে। দুনিয়ায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐক্যশক্তির প্রয়োজন তারই অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে মুসলিম জাতি পুরো এক মাস।
অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে চলা
আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন জীবনের সকল ব্যাপারে খাপ খাইয়ে চলার মত মানসিক অবস্থা, প্রজ্ঞা ও কৌশল। রমযান মাসে মানুষেল দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন ঘটে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজকে মহৎ উদ্দেশ্যে গড়ে তোলার খাতিরে পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হয় রমযান মাসে।
মৌলিক গুণাবলীসমূহের লালন
এমনিভাবে আবার লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য যেসব ব্যবহারিক ও মৌলিক গুণাবলী একান্ত প্রয়োজন –রোযা মানুষের মধ্যে সেসব গুণাবলী বিকাশে সাহায্য করে। কর্তব্যের প্রতি অবিচলতা, ধৈর্য্য, একাগ্রতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা, প্রদর্শনেচ্ছা পরিহার, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, এইসব মৌলিক গুণাবলী রোযার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। মোটকথা এই দুনিয়ায় নেতৃত্ব দানের জন্য মুসলমানদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক মৌলিক গুণাবলী প্রয়োজন তারই সাধনার জন্য রোযার মত এক সুন্দর ইবাদত যেন ফরয করা হয়েছে মুসলিম জাতির জন্য। মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নিঃসন্দেহে এ এক অপূর্ব নিয়ামত।
রোযা সহানুভূতিশীল করে।
ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় যে কষ্ট তা রোযাদাররা উপলব্ধি করতে পারে। ফলে সমাজের ধনীরা দারিদ্র্যের কষ্ট হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। ফলে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার গুণাবলী বিকশিত হয় সমাজে।
রোযার অন্যান্য উপকার
এ ছাড়াও রোযা রাখলে স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও বেশ কিছু উপকার হয়। শরীরের চর্বি জাতীয় উপাদান কমে যায়। দেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক জীবাণূ এবং রাসায়নিক পদার্থ যেমন ইউরিক এসিড প্রভৃতির পরিমাণ কমে যায়। এমনিভাবে রেযার অনেক উপকার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য এ নয়। রোযা রাখার সবচেয়ে বড় কথা হলো –আরা রোযা এজন্যই রাখি যে আল্লাহ রোযা রাখতে বলেছেন এবং আল্লাহর অনুগত গোলাম হওয়ার উদ্দেশ্যেই আমরা রোযা রাখি।
হজ্ব
‘হজ্ব’ একটি আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বের হওয়া। ইসলামে হজ্ব বলতে আমরা বুঝি –যিলহজ্ব মাসে আরব দেশের মক্কা নগরে অবস্থিত কাবা ঘরে পৌঁছা। সেখানে যাওয়ার পর কতকগুলো আচার-অনুষ্ঠান করতে হয়। এসব কাজ কোরআন ও সুন্নাহ (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের দেখানো নিয়ম) অনুযায়ী করা হয়। আসলে নবী হযরত ইব্রাহীন আলাইহিস সালাম, তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আঃ) এবং পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণেই এ সব আচার অনুষ্ঠান করা হয়। আল্লাহর প্রতি প্রেম, ত্যাগ ও কোরবানীর কারণে হযরত ইব্রাহীন (আ)-এর নাম আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হজ্ব পালনের আসল উদ্দেশ্যই হলো সেই ত্যাগ ও কোরবানীর কথা স্মরণ করে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে নিজকে বিলিয়ে দেয়া।
দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, সুখ, টাকা-পয়সার প্রতি মোহ, সম্পদের প্রতি লোভ, ছেলেমেয়ের প্রতি ভালবাসা প্রভৃতি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে রাখে। হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে এসব বিষয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালবাসার উপরে তিনি কোন কিছুকে বড় করে দেখেননি। এমনকি আল্লাহকে খুশী করার জন্য নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নির্জন স্থানে রেখে এসেছিলেন। নিজের পুত্রকে কোরবানী দিতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর পথে এর চেয়ে বড় ত্যাগ আর কি হতে পারে? তাই আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের এই ঘটনা আজও আমাদেরকে সমানভাবে প্রেরণা দেয়। হজ্বের সময় হযরত ইব্রাহীন (আঃ), তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র ইসমাঈল (আ) এর কথা স্মরণ করে হাজীরা প্রেরণা পান নিজকে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দেয়ার। হজ্বের সময় বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা একত্রিত হয়। বংশ, শিক্ষা, অর্থ সব কিছুর ভেদাভেদ ভুলে আল্লাহর ডাকে জমা হন সকলে। সকলের গায়ে একই ধরনের কাপড়। সকলে একই আচার-অনুষ্ঠান করছেন। সকলেই এক আল্লাহতে খুশী করার জন্য এসেছেন। আল্লাহর সামনে সবাই সমান হয়ে যান। মুসলমানদের মধ্যে এমনিভাবে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্ব। সকলেরই মনে পড়ে যায় কেয়ামতের দিন এমনিভাবে সব মানুষকে আল্লাহর সামনে একত্রিত হতে হবে।
হজ্বের সময় একজন মুসলমান সেইসব জায়গা দেখার সৌভাগ্য পান যেখানে মহানবী (স)-এর জীবন কেটেছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই স্মরণে পড়ে অনেক ঘটনা। মনে পড়ে যায় রাসূল (স)-এর সংগ্রামী জীবন, রাসূল (স)-এর সাথীদের কথা।
হজ্ব হলো ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির একটি। সামর্থ আছে এমন মুসলমানের জন্যে জীবনে একবার হজ্ব করা ফরয। সামর্থ্যবান বলতে বুঝায় –তার স্বাস্থ্য ভাল থাকতে হবে, তার পক্ষে হজ্বের জন্য পথ খরচ ও অন্যান্য খরচ করা সম্ভব হতে হবে এবং হজ্বে চলে গেলে তার পরিবারের সকলের যেন ভালভাবে দিন কাটে।
এমন এক সামর্থ্যবান মুসলমান যদি একবার হজ্ব না করেই মারা যান তবে তার বদলে অন্য কেউ হজ্ব পারন করতে পারেন। অসুস্থ লোকদের বদলে অন্য কেউ হজ্ব করতে পারে।
এখানে বলে রাকা দরকার, কাবা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্মস্থান নয় এবং কেউ রাসূল (সা) কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিকে পূজা করার জন্য সেখানে যান না। কাবা এবং অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের সাথে জড়িত ইতিহাস ও ঘটনার কারণেই এই জায়গাগুলো হাজীদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ। কাবায় পৌঁছা মানে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া। তাঁর সামনে হাজির হওয়া। তাই হাজীরা আল্লাহর ঘর দেখার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে বলে উঠেন ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক –হে প্রভু হাজির হয়ে গেছি’।
হজ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান
হজ্ব করতে যাওয়ার সময় প্রত্যেক হাজীকে এহরাম বাঁধতে হয়। এহরাম বাঁধা অর্থ হলো হজ্ব পালনের ইচ্ছা ঘোষণা করা-নিয়ত করা। এহরামের পরই শুরু হয় হজ্ব। এহরাম বাঁধার পরপরই হাজীরা যেন নিজকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিলেন। এরপর থেকে কোন খারাপ কাজ কিংবা খারাপ চিন্তাও হাজীরা করেন না। সুন্দর ও পবিত্র ভাব সবার মনে, শান্তির ভাব সকলের হৃদয়ে।
এহরাম অবস্থায় কেউ খারাপ কথা বলেন না। এ অবস্থায় কোন ঝগড়া করা যায় না। কোন প্রাণীকে আঘাত বা হত্যা করা যায় না। এমনকি শরীরের স্বাভাবিক দাবীগুলো পূরণ থেকে বিরত থাকতে হয়।
শুধু বাইরের দিক থেকে নয় –মনের দিক থেকেও একমাত্র আল্লাহর কথাই চিন্তা এবং নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো স্মরণ করে আল্লাহর কাছে মাফ চান হাজীরা। হজ্বের অনুষ্ঠানগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে থাকেন। শুরু থেকে নিয়ে মিনায় পৌঁছে, প্রথম পাথর মারা পর্যন্ত হাজীরা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করেন তালবিয়াঃ
লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান্নি’মাতা লাক ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাকা।
অর্থঃ আমি হাজির। হে প্রভু, আমি হাজির হয়ে গেছি তোমার দরবারে। তোমর কোন শরীক নেই। আমি তোমার সামনে হাজির হয়ে গেছি। সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং সব কিছুর মালিকানা বা কর্তৃত্ব তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই।
কাবা পৌঁছেই হাজীরা দোয়া করেন এবং কাবার চারদিকে সাতবার ঘুরে আসেন। কালো পাথর (আল আসওয়াদ) থেকে এই ঘোরা শুরু হয়। ঐতিহাসিক এই কালো পাথরে চুমু দিয়ে অথবা তা স্পর্শ করে কিংবা শুধু তার দিকে হাত তুলে এই ঘোরা শুরু হয়। এইভাবে হাজীরা শুধু আল্লাহর হুকুম পালন করেন রাসূল (সঃ)-এর দেখানো পথে।
এরপর হাজীদেরকে কাবার পাশেই দুই পাহাড়-সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড় দিতে হয় সাতবার। হযরত ইব্রাহীম (আ) তাঁর স্ত্রী বিবি হাজরা (আ) ও পুত্র ইসমাইলকে (আ) আল্লাহর হুকুমে মক্কার ধূসর মরুভূমির বুকে রেখে গিয়েছিলেন। খাবার ফুরিয়ে গেলো। মরুভূমির খাঁ খাঁ রোদে পানির জন্য কাতরাচ্ছে শিশু। মাতা হাজরা (আ) পাগলের মত পানির সন্ধানে একবার সাফা পাহাড়ে উঠছেন আবার দৌড়ে নেমে মারওয়ায় উঠছেন –কোথাও পানি পাওয়া যায় কিনা। কোথাও পানি নেই। ফিরে এসে দেখেন পুত্র ইসমাইলের (আ) পায়ের কাছে তৈরী হয়েছে এক ফোয়ারা। এই হলো যমযম। পরে এই যমযম বালুর নীচে চাপা পড়ে যায়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দাদা মুত্তালিব একদিন স্বপ্নে এই যমযমের সন্ধান পান। ফলে এই যমযমের উৎস আবার খুঁজে পাওয়া যায়।
পানির জন্য হাজরার এই দৌড়াদৌড়িকে স্মরণ করে হাজীদেরকে ‘সাঈ’ করতে হয়। প্রত্যেক হাজী সাফার উপরে উঠেন। ‘তালবিয়া’ উচ্চারণ করে নামেন এবং মারওয়ায় পৌঁছেন –আবার উপরে উঠেন এবং সেই তালবিয়া উচ্চারণ করেন। এইভাবে সাতবার দৌড় দিতে হয়।
হজ্বের তাৎপর্য
এইভাবে লক্ষ্য করে দেখা যায় হজ্বের আচার-অনুষ্ঠানগুলো শুধু কতকগুলো সাধারণ অনুষ্ঠান নয়। ঈমানকে মজবুত করার জন্য, দুনিয়ার সকল কোলাহল ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে একাগ্র মনে আল্লাহর সামনে হাজির হবার জন্য মনকে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সব ধরনের কষ্টকে স্বীকার করার মত মানসিকতা তৈরীর উদ্দেশ্যে হজ্ব এক অনুপম ‘ইবাদত’।
হজ্বের মধ্যে যেন এক হয়ে গেছে নামায, রোযা, যাকাতের শিক্ষা। আমরা দিনে পাঁচবার আল্লাহকে নামাযের মাধ্যমে স্মরণ করি। আর হজ্বের সময় সব সময় সকল মুহুর্তে আল্লাহর স্মরণেই কাটে। আমরা যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সম্পদের মোহ ত্যাগ স্বীকার করি। হজ্ব পালন করতে হলে তার চেয়েও বেশী আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। রোযা আমাদেরকে শিখায় দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থেকে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে। হজ্বের সময় এহরাম অবস্তায় তার চেয়েও বেশী কঠোর সাধনা করতে হয়। হজ্বের সকল আচার-অনুষ্ঠান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা সকলেই আল্লাহর। আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে –আমাদেরকে তাঁরই আদেশ অনুযায়ী চলতে হবে।
যাকাত
দুনিয়ার মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। একেক কাজ একেক ধরনের। একেক কাজ একেক উদ্দেশ্যের। একজন মুসলমানকে দুনিয়ার সব কাজ এমনভাবে করতে হয় যেন আল্লাহ খুশী হন। টাকা-পয়সা মানুষের জীবনে খুব দরকারী জিনিস। তাই টাকা-পয়সা আয় করতে হয় সকলকেই। কিন্তু টাকা-পয়সার প্রতি লোভ থাকাটা সর্বনাশের। ধন-দৌলতের কারণে লোক গরীব, ধনী হয়। এজন্য একজন অন্য একজনের চেয়ে বড় হয়। টাকার অহংকারে এক মানুষ অন্য মানুষকে হেয় ভাবে দেখে। টাকার ফলে আরাম-আয়েশে সহজেই মেতে উঠে। তাই টাকা উপার্জন, খরচ করা এবং টাকা জমানোর ব্যাপারে প্রত্যেক লোককে সতর্ক হতে হবে। আমাদের প্রভু আল্লাহ। তিনি মানুষের এ দুর্বলতাটা ভালভাবে জানেন। তাই টাকা-পয়সা ও ধন-দৌলতের ব্যাপারেও তিনি পথনির্দেশ দিয়েছেন। কিভাবে টাকা উপার্জন করতে হবে, কিভাবে খরচ করতে হবে, এসব তিনি জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে।
যাকাত একটি ইবাদত
আল্লাহর নির্দেশ মত কাজ করাকে ইবাদত বলে। আল্লাহর নির্দেশ মত টাকা উপার্জন করা এবং খরচ করাও তাই ইবাদত। যাদের টাকা-পয়সা আছে তাদের জন্য এমনি একটি ইবাদত যাকাত।
প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানকে তার সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট হারে কিছু অর্থ গরীবদের মধ্যে বিলি করতে হয়, একে ‘যাকাত’ বলে। মোটকথা ধনী মুসলমানদের সম্পদের কিছু অংশ তাদের গরীব ভাইদেরকে দিতে হয়। তাই অনেকে ভুল করে যাকাতকে মনে করে ‘দান’ অথবা ট্যাক্স। আসলে যাকাত দান কিংবা ট্যাক্সের মত কোন জিনিস নয়। এটা এমন একটি দায়িত্ব যা আল্লাহ পালন করতে বলেছেন। যাকাত একটি ইবাদত।
যাকাত কথাটি আরবী। এ শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা। যাকাত টাকা-পয়সার প্রতি লোভ-লালসা থেকে মনকে পবিত্র রাখে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সুন্দর বলেছেনঃ
তোমাদের বাকী ধন-দৌলতকে পবিত্র করার জন্যই আল্লাহ যাকাতন ফরয করেছেন। (আবু দাউদ, যাকাত অধ্যায়)
যাকাতের এই অর্থ আমাদেরকে একথাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, টাকা-পয়সা উপার্জন করতে হলে তা পবিত্র উপায়েই করতে হবে।
যাকাত সমাজকেও পবিত্র করে। সমানে অর্থনৈতিক সমস্যার সুন্দর সমাধান দিয়েছে যাকাত। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ঈমানের পবিত্রতার পর আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে ভাল কাজ হলো দয়া, ক্ষমা, অন্যের জন্য ভাল কাজ করা।
যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, যারা রাগকে দমন করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল হয়, যারা ভাল কাজ করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।
সূরা আল ইমরান-১৩৪
যাকাতের গুরুত্ব
আল্লাহ এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ তো তাঁরই। মানুষ শুধু তাঁর খলিফা। তাই মুসলমানরা টাকা উপার্জন করে, খরচ করে, দান করে সব আল্লাহকে খুশী করার জন্য। টাকা উপার্জন করা বা জমানোই আসল কাজ নয়। টাকা-পয়সা অপ্রয়োজনীয় ও খারাপ কাজে ব্যয় করা বা অন্য লোকের উপর নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্য খাটানো কিংবা জুলুম নির্যাতন এবং শোষনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নয়। একটা পবিত্র জীবন যাপনের জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। তাই অর্থকে পবিত্র পথে খরচ করা দরকার। টাকা পয়সা কখনও সমাজে অভিশাপ হয়ে থাকে। যখন কিছু লোক অন্যায়ভাবে টাকা জমাবার সুযোগ পায়, যখন কিছু সংখ্যক লোকের হাতে সমাজের সব টাকা জমায় হয় এবং সেই হাতেগোনা কয়েকজন লোক নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য অন্যের উপর নিজের মাতব্বরী খাটায় এবং অন্যান্য নোংরা কাজে সে টাকা খরচ করে, তখনই সমাজে দেখা দেয় বিপর্যয়।
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রক্ত আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু দরকার হলো সে রক্ত আমাদের শরীরের সব শিরা-উপশিরায় দৌড়াদৌড়ি করবে। কোথাও জমা হয়ে গেলে আমাদের শরীর হবে অসুস্থ। তেমনি একটি সমাজে টাকা-পয়সাকে হতে হবে সচল। তাই এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে, যার ফলে টাকা কোথাও কারও হাতে অন্যায়ভাবে জমা থাকনে না পারে। যাকাতের মাধ্যমে ধনী লোকদের কিছু সম্পদ গরীবদের হাতে পৌঁছে যায়। এভাবে ‘অর্থ’ সমাজে সচল অবস্থায় থাকে।
ইসলাম একটি সুন্দর সমাজ গড়তে চায়। টাকা-পয়সা, মাল-সম্পদের ব্যাপারটি মানুষের জীবনের একটি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই ইসলাম এ বিষয়ের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য যাকাতকে ইসলামের একটি স্তম্ভ বলা হয়েছে। নামায, রোযা, হজ্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, যাকাতও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।
যাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
নামায, রোযার মত যাকাতের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর কাছে নিজেকে নত করে দেয়া, আল্লাহ যা দিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করা এবং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। মোটকথা, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে আল্লাহকে খুশী করা। তাই যাকাত দেয়া আল্লাহর একটি হুকুম পালন করা।
আল্লাহকে খুশী করার জন্য যাকাত দেয়া হয়। কারো এটা মনে করা উচিত নয় যে, অনুগ্রহ দেখিয়ে একজনকে যাকাত দেয়া হচ্ছে। আসলে যে যাকাত নেয়, তার এটা পাওয়ার অধিকার আছে এবং যে দেয় তার এটা কর্তব্য। তাই অন্যান্য এবাদতের মত যাকাত দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে যিনি দিচ্ছেন তার এবং যিনি নিচ্ছেন তার-দুজনেরই মনের উদ্দেশ্য বা নিয়ত পবিত্র হওয়া উচিত। যাকাত দিতে পারা তাই কোন অহংকারের বিষয় নয়, এটা নামাযের মত পবিত্র একটা ইবাদত। যাকাত দেয়ার পর তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা দরকার। আল্লাহর দরবারে নিজের অন্যান্য গোনাহর জন্য মাফ চাওয়া দরকার।
যাকাতের উপকারিতা
নৈতিক দিক থেকে যাকাতের উপকার হলো-যাকাত যে দেয় তার মন থেকে অর্থের প্রতি লোভ এবং স্বার্থপরতা দূর হয়ে যায়। আবার যাকাত নেওয়ার ফলে ধনীদের প্রতি হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থাকে না।
একটি সমাজে যাকাতের উপকারতা অনেক। যে সমাজে যাকাতের ব্যবস্থা থাকে, সে সমাজে ধনীরা গরীবদের প্রতি হয় দয়াশীল ও সহানুভূতিশীল। আর গরীবদের মন থেকে সব কালিমা মুছে যায়। যে ভাই তার চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে তার প্রতি তার ভাল ধারণা হয়।
যে সমাজে যাকাত ব্যবস্থা চালু আছে সে সমাজে ধনীদের মধ্যে টাকা জমানোর ইচ্ছা লোপ পায় এবং টাকা জমানোর সুযোগও কম থাকে। ফলে টাকা-পসাকে হাতিয়ার করে যে জুলুম, শোষণ, হিংসা-বিদ্বেষ তা অচিরেই দূর হয়ে যায়।
যাকাত এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করে যে সমাজে ভালবাসা থাকে, থাকে সম্মান, ভ্রাতৃত্ব, মমতা, সহানুভূতি। সে সমাজের একজন অন্য জনের কল্যাণের চিন্তা করে। আর তাই একটি ইসলামী সমাজে ধনী মুসলমানদের কাজ থেকে যাকাত আদয় করে নিয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য তা ব্যয় করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) তাই যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আসলে যাকাত এমনভাবে দেয়া দরকার যাতে সব মিলিয়ে সমাজের উপকার হয়। সমাজ থেকে দূর হয়ে যায় দারিদ্রতার অভিশাপ।
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয়
নগদ টাকা ও অলংকার, গবাদী পশু এবং ক্ষেতের ফসলের জন্য যাকাত দিতে হয়। গবাদী পশু ও ক্ষেততের ফসলের জন্য যাকাতের হিসাবটা বেশ জটিল।
নগদ টাকার ব্যাপারে হিসাব হলো কমপক্ষে শতকরা আড়াই ভাগ। বছরের শেষে সব খরচের পর যার কাছে কমপক্ষে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান টাকা থাকে, তাকে যাকাত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এটি হলো সর্বনিম্নহার।
যারা যাকাত নিতে পারে
কোরআনে বলা হয়েছে-
এই সাদাকাসমূহ (যাকাত) তো কেবল তাদের জন্য যারা নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, যারা তা সংগ্রহ করে (কর্মচারী), যাদের মনকে আকর্ষণ করা হলো (নও-মুসলিম) ঋণ গ্রস্তদের ঋণ মুক্ত করার জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সবকিচু জানেন এবং তিনি মহাজ্ঞানী
সূরা তওবা-৬০
তাহলে দেখা যায় ধনী লোকদের জমানো টাকা থেকে যাকাত পায়ঃ
- গরীব
- মিসকিন
- নও-মুসলিমঃ যারা অন্য ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে
- দাস-দাসীঃ দাস-দাসীদের মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হয়
- যারা যাকাত সংগ্রক করেঃ সরকারীভাবে যাকাত সংগ্রহের জন্য যেসব কর্মচারী কাজ করে
- মুসাফির
- যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে
চতুর্থ অধ্যায়
ইসলমী জীবন ব্যবস্থা
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন
আধ্যাত্মিক জীবন
বুদ্ধিভিত্তিক জীবন
বাহ্যিক জীবন
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা
খাদ্য
পোশাক-পরিচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা
খেলাধুলা, চিত্ত বিনোদন ও উৎস
ইসলামের সামাজিক জীবন
সকল মানুষ সমান
পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি
নারীর মর্যাদা
সামাজিক দায়িত্ববোধ
ইসলামী সমাজের লক্ষ্য
ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত
শরিয়তের উৎস
ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য
ইসলামের অর্থনীতি
উপার্জন
ব্যয়
যাকাতের ব্যবস্থা
ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
সুদকে হারাম ঘোষনা উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)
ইসলামের রাজনীতি
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
কুরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান
খেলাফত
পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসন
সরকার ও জনগণের দায়িত্ব
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব
অমুসলিমদের অধিকার
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা
ইসলাম নিছক কোন ধর্ম নয়। কতকগুলো বিশ্বাস কিংবা আচার-আচরণের নামও ইসলমান নয়। মানুষের পুরো জীবনের জন্য আল্লাহর দেয়া একটি ব্যবস্থা হলো ইসলাম। পুরো জীবন অর্থঃ তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, আর্থিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন-সবকিছু। তাই ইসলামের আলোকে একটি জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আমরা সংক্ষেপে এই জীবন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছি। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই তবে এই আলোচনার মাধ্যমে তোমাদের মদ্যে ইসলামের পুরো জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হোক এটাই আমাদের কাম্য।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন
ইসলাম একান্ত ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও বিশদভাবে আলোচনরা করে। এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো –কোন মানুষই তুচ্ছ কোন সৃষ্টি নয়। এমনকি কোন উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি নয়। তাই ব্যক্তি তার নিজ ইচ্ছায় নিজকে ধ্বংস করবে, নিজকে বিপথগামী করবে কিংবা নিজ সম্পর্কে উদাসীন হবে এমন কোন সুযোগ ইসলাম দেয় না। কোরআন বলেঃ
হে প্রভু তুমি আমাকে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করোনি।
সূরা আলে-ইমরান-১৯১
এই চেতনা ব্যক্তিকে নিজের সম্পর্কে সচেতন করে। এমনিভাবে ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা যে কোন জীবন পদ্ধতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘ব্যক্তি’ এবং এই কারণে ইসলাম সব সময় ব্যক্তি থেকে তার যাত্রা শুরু করে।
মানুষের রয়েছে দু’টি প্রকৃতি –একটি অভ্যন্তরীণ যা দেখা যায় না এবং অন্যটি হলো বাহ্যিক যা দেখা যায়। ইসলাম এ দু’টি সত্তাকেই গুরুত্ব দেয়। এ দুটি সত্তা পরস্পর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, সম্পৃক্ত এবং পরিপূরক। ইসলাম এ দুটি সত্তার ভারসাম্যপূর্ণতার মাধ্যমে ব্যক্তি গঠন করতে চায়।
মানুষের ভিতরের যে পরিচয় তাকে আবার দুটি জিনিসে ভাগ করা যায় –একটি ‘রুহ’ (আত্মা, খুদি বা কলব) অন্যটি ‘আকল’ (মন, যুক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি) ইসলাম এই দুইটি প্রকৃতির খোরাক যোগায়।
আধ্যাত্মিক জীবন
ইসলাম আত্মার প্রশান্তির জন্য যে ব্যবস্থা তা নিম্নরূপঃ
১। নামায
২। যাকাত
৩। রোযা
৪। হজ্ব
৫। খোদা ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা
৬। খোদার প্রতি আস্থাশীলতা
৭। নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর পথে আত্মদান
এসব দিয়ে বিশদ আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। এসব কিছুর অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলাম মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে চায়।
বুদ্ধিভিত্তিক জীবন
আর বুদ্ধির খোরাকের জন্য ইসলাম মানুষকে জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিক করেছে। অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের জন্য ঐশী আদেশ কোরআনই প্রথম দিয়েছে মানুষকে।
কোরআন মানুষকে তার প্রতিটি কর্মকে জেনে বুঝে করার জন্য অনুপ্রাণিত করেনা বরং বুদ্ধি ও জ্ঞানের উপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা জ্ঞাপন করেছে। কেননা মানুষের ভিতরের আত্মা ও মন সুস্থ ও নিরাপদ হলেই প্রকৃতপক্ষে বাইরের দিকটা অনুরূপ সুস্থ ও নিরাপদ হতে পারে।
তাই মুসলমানদের জন্য একান্ত প্রয়োজনঃ
- নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন
- হাদীস অধ্যয়ন
- নবী-সাহাবীদের জীবন অধ্যয়ন
- কোরআন হাদীসের আরোকে লেখা ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন
এছাড়া একজ মুসলমানের জন্য বর্তমান দুনিয়ায় কোথায় কি ঘটছে তা জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
এমনিভাবে গড়ে উঠে মুসলমানদের এক বুদ্ধিভিত্তিক জীবন –যা তাকে করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমৃদ্ধ, নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল। সেই সঙ্গে এই জ্ঞান তাকে তার আদর্শের একজন নিষ্টাবান প্রচারক হিসেবে গড়ে তুলে।
বাহ্যিক জীবন
ব্যক্তির বাহ্যিক সুন্দর করার জন্য পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য-সামগ্রী, পোশাক, আচার-ব্যবহার, সাজ-সজ্জা এসব সম্পর্কে ইসলাম সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ভুল করেনি।
১। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো শুধু তার দৈহিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য নয় তার মানসিক পবিত্রতার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। দিনে অন্ততঃ পাঁচবার ওজু (প্রয়োজনে গোসল), নিয়মিত দাঁত মাজা, চুল ছাঁটা এসব স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ তা আজ সকলের কাছে পরিস্কার। আর ইবাদত হিসেবে পালন করে এসব স্বাস্থ্য রক্ষার বিধান পরিণত হয়েছে আরও মহিমান্বিত ও চমৎকার এক একটি পবিত্র কাজে।
২। খাদ্য
মানুষ যা খায় তার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক সরাসরি। খাদ্যের সাথে শুধু তার দেহের সম্পর্ক নয়, মনেরও সম্পর্ক আছে। তাই ইসলাম ব্যক্তির খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যেল জন্য নিয়ম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য হতে হবে স্বাভাবিকভাবে পবিত্র, মানুষের জন্য কল্যাণকর। খাদ্যের পরিমাণের ব্যাপারেও তা হতে হবে মধ্যম।
কোরআন বলেছে,
হে মানুষ! জমীনে যে সব হালাল ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে তা খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলোনা, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
সূরা বাকারা-১৬৮
যেসব খাদ্য ও পানীয় খাওয়া বা পান করা যায় সেসবকে বলা হয় ‘হালাল’ এবং নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয়কে বলা হয় ‘হারাম’।
৩। পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজ-সজ্জা
মানুষ আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি তাই পোশাকও হতে হবে সুন্দর ও শালীন। পোশাক শুধুমাত্র লজ্জাও উলঙ্গতা ঢাকার জন্য নয়। পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বকে সুন্দর করার একটি মাধ্যম।
কোরআন খুব সুন্দরভাবে বলেছে,
হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাক দিয়েছি যাতে করে তোমরা দেহের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকতে পারো। এটি তোমদের শোভা বর্ধনের উপায়ও। আর সর্বোত্তম পোশাক হলো ‘খোদাভীতি’র পোশাক।
সূরা আল আরাফ-২৬
পোশাকের ধরণ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম কোন বিশেষ ধরনের পোশাকের কথা বলেনি। তবে কতগুলো নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলোঃ
- পুরুষরা নাভি থেকে হাঁটু অবশ্যই ঢেকে রাখবে।
- মেয়েরা ঘরে মুখ, হাত, পায়ের পাতা ছাড়া সারা শরীর ঢেকে রাখবে কিন্তু বাইরে বের হবার সময় কিংবা পর পুরুষের সাথে দেখা করার সময় এই সাথে চোখের অংশ ছাড়া মুখমণ্ডল প্রায় সবটাই ঢাকবে। অবশ্য কোন কোন মাজহাব পুরো মুখ খোলা রাখার সুযোগ দিয়েছে।
- মেয়েদের এমন কোন পোশাক পরা উচিত নয় যাতে তাদের দেহের অংশ দেখা যায় কিং বা প্রদর্শিত হয়।
- খাঁটি রেশমী কাপড় কিংবা সোনর কাজ করা কাপড় পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।
- পুরুষের মেয়েদের পোশাক পরা নিষেধ।
- মুসলমানদের এমন সব পোশাক পরা উচিত নয় যেসব অন্য জাতি বা ধর্মের পোশাক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
ইসলাম খুব সাধাসিধা পোশাক পরার জন্য উৎসাহিত করেছে। গর্ববোধ, অহমিকা কিংবা প্রদর্শনেচ্ছা জাগিয়ে তোলে এমন পোশাক পরিধান করা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে।
মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশে কোন কঠোরতা নেই বরং মেয়েদের স্বভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষার জন্যই মেয়েদের সাজ-সজ্জা, সৌন্দর্য রক্ষা, হাঁটা-চলা এমনকি দৃষ্টি নিক্ষেপের ব্যাপারে ইসলাম নীতিমালা দিয়েছে। এই পুরো নীতিমালাকে একত্রে আমরা বলতে পারি ‘পর্দা প্রথা’।
৪। খেলাধুলা, চিত্ত-বিনোদন ও উৎসব
প্রিয় নবী দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য ও বলিষ্ঠ মনোবল গড়ে তোলার উপযোগী খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনকে অনুমোদন করেছেন। মোটকথা যা কিছু মানুষের মধ্যে সুস্থ চিন্তার সৃষ্টি করে, তার মনকে সতেজ করে, শরীরকে সুস্থ রাখে ইসলাম তাকে উৎসাহিত করে। রাসূল (সঃ) একটি হাদীস থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি বলেছেন,
সকল মুমিনের মধ্যেই ভাল গুণাবলী আছে তবে,
শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির চেয়ে শ্রেয়। (সহীহ মুসলিম, ইবনু মাজাহ)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন অত্যন্ত অর্থবহ। এর একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। জীবনকে যেমন তেমন করে কাটিয়ে দেয়া যায় না। আর তাই মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকেও ইসলাম আল্লাহর নির্দেশে লাগাম টেনে ধরেছে। এই দৃষ্টিতেই ইসলামে জুয়া খেলা, মদ্যপান, লাগামহীন সময় অপচয় করে তাস খেলা প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলির কোনটাই আনন্দদায়খ বা বিনোদনমূলক কাজ নয়।
ইসলামের উৎসব পালনও এই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ে থাকে। ইসলামে উৎসব নিছক শুধু আনন্দের জন্য নয়। এসব উৎসবের মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনি উদ্দেশ্য নিয়েই ইসলামের দুটি বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালিত হয়।
কবিতা, গান এসব ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশ একই ধরনের। মোকটথা, যে খেলাধুলা কিংবা চিত্তবিনোদন একটি মুহুর্তের জন্য হলেও বান্দাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে মুমিন মুসলমানের জন্য তা কখনই আনন্দদায়ক, সুখকর কোনকাজ হতে পারে না। মুমিনের আনন্দতো আল্লাহকে পাওয়ার মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো আল্লাহর আইনকে দুনিয়ার বুকে কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রতিটি কাজে এগিয়ে আসা।
ইসলামের সামাজিক জীবন
কোন লোকই একা বেঁচে থাকতে পারেনা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তার যে পরিবার সেই পরিবার নিয়েও সে একা বাঁচতে পারেনা। তাকে আরও অনেকের সাথে মিশতে হয়, চলতে হয়, লেনদেন করতে হয়, মতের আদান প্রদান করতে হয়। মোটকথা, একটা সমাজের মধ্যে তাকে মিশে থাকতে হয়। পরিবার এবং সমাজরে মাঝে থেকে তার নিজের এবং সমাজের অন্যের উন্নতি, সুখ-শান্তির জন্য একজন মুসলমান আল্লাহ ও রাসূলের (স) শেখানো নীতিমালা অনুযায়ী চলে।
সকল মানুষ সমান
ইসলামী সামাজিক জীবনের মূলনীতি হলো দুনিয়ার সকল মানুষ সমান এবং সকলে একই পিতা-মাতা আদম (আ) ও হাওয়ার (আ) সন্তান। দুনিয়ার মানুষের কারো গায়ের রং কালো, কারো সাদা, কারো বাদামী। একেক জনের ভাষা একেক রকম। সামাজিক রীতি-নীতি, চাল-চলন একেক জনের একেক রকম। তবুও সব মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি মানুষকে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক যে পার্থক্য তাকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। আমরা দুনিয়ার সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি-একই পিতা-মাতার সন্তান –এই সত্যকে যখন স্বীকার করে নেওয়া হয় তখন একজন অন্যজনের ভাষা, অন্যের গায়ের রং, অন্যের সামাজিক রীতি-নীতিকে মর্যাদা দিতে শিখে। তাই কোরআন এবং হাদিসে বারবার একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরআন বলেছেঃ
হে মানুষেরা! তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি ‘প্রাণ’ থেকে সৃষ্টি করেছেন।
সূরা নিসা-১
মুমিনরাতো পরস্পরের ভাই
সূরা হুজরাত-১০
এভাবেই ইসলাম বর্ণগত, ভাষাগত, বংশগত, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবীকে নির্মূল করে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের পথকে সুগম করে তোলে।
অধিকারের দিক থেকে মর্যাদার দিক থেকৈ সকল মানুষ সমান এই নীতিমালার উপর ইসলাম গড়ে তুলতে চায় এক সুন্দর পরিবার, এক সুন্দর সমাজ, এক সুন্দর দেশ –গড়ে তুলতে চায় সুন্দর পৃথিবী।
পারিবারিক জীবন-ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি
প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূল ভিত্তি। একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সমাজের প্রতিটি পরিবারকে সুন্দর করার পরিকল্পনা আছে ইসলামে। আর এজন্য পরিবারের স্বামীর ভূমিকা ও দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য –এ সব বিষয়ে ইসলাম সুন্দর ও কার্যকর শাশ্বত বিধানসমূহ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি সমঝোতার জন্য কোরআন যেসব বিধান দিয়েছে এবং আমাদের প্রিয়নবি (স) যেসব উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরেছেন যার নজির ইতিহাসে বিরল।
একটি সুন্দর পরিবার গঠনের জন্য দেয়া হয়েছে বিবাহের ব্যবস্থা, দেয়া হয়েছে পর্দার বিধান। এক একটি সুন্দর পবিত্র বাগান হিসাবে সমাজের সকল পরিবারকে গড়ে তুলতে চায় ইসলাম।
নারীর মর্যাদা
সমাজে নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে মাতা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে নারীর ভূমিকা অনন্য। ইসলাম নারীর এই মর্যাদাকে স্বীকার করে নিয়েছে। মাতা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইসলাম ছাড়া আর কোন মতবাদ এতো গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি। প্রিয় নবী (স) বলেছেন,
মাতার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।
স্ত্রী হিসাবে নারীকে নির্দিষ্ট মর্যাদা দিয়ে নবী (স) বলেছেন,
তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।
কন্যা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইষলাম সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। (ইবনু মাজাহ, বিবাহ অধ্যায়)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মত আয় করতে পারে এবং সম্পদের মালিক হতে পারে। ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়েছে। পিতা, স্বামী অথবা তার পুত্রহীন ভাইয়ের স্মপত্তিতে তার অংশকে নির্দিষ্ট করেছে।
ইসলামই নারীকে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়েছে। এবং নির্ধারিত সীমার মধ্য কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।
কোরআন বলেছে,
নারী পুরুষ দুজনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেকের রয়েছ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সূরা আল-লাইল-৩-৪
প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজক কাজক স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ধর্ম অনুযায়ী ভাগ করে দিয়েছে। শরীরের দিক থেকে সবল ও মানসিক দিক থেকে সাহসী হবার কারণে জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করার যোগ্যতা দিয়ে পুরুষকে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভালবাসা, মায়া, মমতা প্রভৃতি দুর্লভ গুণাবলীর জন্য নারীকে দেয়া হয়েছে সমাজের আগামী দিনের নাগরিকদের গড়ে তোলার কঠিন ও মহৎ দায়িত্বটি।
এই প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করার এই অর্থ নয় যে নারীদেরকে অন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাস এর সাক্ষ্য। সন্তান পালন ও সংসারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সাথে সাথে মুসলিম নারীদের দেখা গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহন করতে, আহত ও অসুস্থ রুগীদের সেবা করতে, আহত রুগীদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে, এমন কি কখনো কখনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দিয়েছে এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করেনি।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মতবাদই নারীকে তার সঠিক মূল্য দিতে পারেনি। পাশ্চাত্যে নারী হচ্ছে আনন্দের সামগ্রী। ‘নারী স্বাধীনতার’ শ্লোগান দিয়ে পুরুষরা তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজে নারী স্বাধীনতা পায়নি, পায়নি সমান অধিকার। মাঝখান থেকে সে হারিয়েছে পরিবারে এবং সমাজে তার স্বাভাবিক সহজাত মর্যাদা ও অধিকারকে।
সামাজিক দায়িত্ববোধ
ইসলাম মানুষকে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে শিখায়। সমাজের প্রতি রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব। অন্যের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা, অন্যেল জন্য অর্থব্যয়, একমনি সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা দেয় ইসলাম। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তির কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য সমাজকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ এক সুন্দর সম্পর্ক। যখন ব্যক্তি সক্ষম থাকে তখন সে হয় দানকারী এবং সমাজ হয় দান গ্রহণকারী। আর ব্যক্তি যখন অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তাকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দানের দায়িত্ব সমাজের। এমনিভাবে ইসলামী সমাজে কোন ব্যক্তি অন্যের ব্যাপারে উদাসীন হতে পারেনা –হতে পারেনা স্বার্থপর। সে এমন কোন কাজও করতে পারেনা যাতে সমাজের কোন প্রকার ক্ষতি হয়। বরং নিজের জন্য যা পছন্দ করা হবে অন্যের জন্য তাই করতে বলা হয়েছে। (আল হাদিস)
ইসলামী সমাজের লক্ষ্য
সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে যে ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে কোন বিশেষ ব্যক্তির, কোন বিশেষ বংশের, কোন বিশেষ গোত্রের, কোন বিশেষ ভাষার মানুষের, কোন বিশেষ বর্ণের বা জাতির বড় হবার কোন উপায় নেই। সে সমাজের প্রধান লক্ষ্য হলো খোদার বন্দেগী এবং খোদার উদ্দেশ্য সফল করে তোলা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে –মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামী সমাজ জীবনের উল্লেখযোগ্য মূল উপাদানগুলো হলোঃ সহযোগী লোকদের প্রতি ভালবাসা, ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীর অধিকার সচেতনতা, আর্তের সান্ত্বনা ও সমবেদনা, রোগীর সেবা, জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের প্রশ্নে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কোরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলের (স) অনেক বাণীতে প্রতিটি মুসলমানকে এসব গুণাবল অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত
যুগে যুগে নবী-রাসূলেরা এসেছেন। মানুষকে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বলেছেন –ঈমান আনতে বলেছেন আখিরাতের উপর, কিতাবের উপর। বলেছেন সব পথ ছেড়ে আল্লাহর এবং নবী-রাসূলদের দেখানো পথে চলতে, তাঁদের আনুগত্য করতে –তাঁদেরকে অনুসরণ করতে। এই ঈমান ও এবাদতের নাম হচ্ছে দ্বীন। সব নবীর দ্বীন ছিল এক। সব নবীর শিক্ষা এক। কিন্তু এবাদতের পদ্ধতি কি, সামাজিক রীতিনীতি কি হবে, পারস্পরিক লেনদেন ও সম্বন্ধ রক্ষার বিধান কি, কোনটা হালাল, কোটনা হারাম, কোনটা করণীয়, কোনটা নয় –এর সবকিছু যুগের ভিন্নতার কারণে একেক নবীর জন্য একেক রকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই মৌলিক দিক থেকে দ্বীন হলেও আল্লাহ নবী রাসূলদের মাধ্যমে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কওমের জন্য এইসব দ্বীন পালনের বিভিন্ন রীতিনীতিও পাঠিয়ে দিয়েছেন। এইসব রীতি-নীতি, পদ্ধতি, বিধি-বিধানকে শরিয়ত বলে। শরিয়ত অর্থ সোজা পথ বা উদাহরণ। আমাদের জন্য শরিয়ত হলো মেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে পাওয়া এবাদতের পদ্ধতি, সামাজিক রীতি-নীতি, পারস্পরিক আদান-প্রদান সংক্রান্ত আইন-কানুন, হালাল-হারামের সীমারেখা ইত্যাদি।
শরীয়তের উৎস
পবিত্র কোরআন হলো শরীয়তের মূল উৎস যেখান থেকে ইসলামের সকল পবিত্র রীতি-নীতি, আইন-কানুন নেওয়া হয়েছে। এটি হলো আল্লাহর কালাম যার প্রতিটি বিন্দু আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। যা নবী করীম (স)-এর জীবনে ২৩ বছর ধরে অল্প অল্প করে নাজিল হয়েছে। আর নবী (স) হচ্ছেন এই কোরআনের বাস্তব উদাহরণ।
নবীর (স) সারাজীবন হলো কোরআনের ব্যাখ্যা। তাই শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো নবীর ‘সুন্নাহ’। ‘সুন্নাহ’-এর শাব্দিক অর্থ পথ, ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন, কাজ করার পদ্ধতি, জীবন পদ্ধতি, উদাহরণ। ইসলামী পরিভাষায় ‘সুন্নাহ’ অর্থ নবী করীম (স)-এর জীবন ও কাজ।
‘হাদীস’ বলতে আমরা বুঝি নবীর কথা, কাজ এবং তার অনুমোদন নিয়ে করা কাজ। আমাদেরকে কিভাবে আল্লাহর মর্জি মত চলতে হবে সেসব কিছু নবী (স) শিখিয়ে গেছেন তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে। শুধু মুসলমানদের জন্যই নয় –সারা বিশ্বের জন্য এটি সৌভাগ্যের যে, আজও নবী করীম (স) এর জীবনের কথা ও কাজ মোটকথা পুরো জীবনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মানব জাতির জন্য সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে।
নবীর (স) কথা তাঁর সংগী সাথীরা নিষ্ঠার সাথে স্মরণ রাখতেন। প্রতিটি নির্দেশ যত্নের সাথে শিখে নিতেন। এসব কথা সাহাবীদের কাছ থেকে মানুষ শুনেছে, মুখস্ত করেছ, কেহ তা লিখে রেখেছে। যার কাছে শুনেছে তার নামও লিখে রেখেছে। ক্রমে ক্রমে এসব বর্ণণা পুস্তকাকারে সংগৃহীত হয়েছে। এসব গ্রন্থকে ‘হাদীস’ বলে। যার ফলে নবীর (স) কথা ও কাজের বর্ণনা সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কোন নেতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর অনুসারীদের নিষ্ঠার, আন্তরিকতার এমন উদাহরণ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
হাদীসের কিতাবের মধ্যে ছয়টি বিশেষভাবে নির্ভরযোগ্যঃ
১। সহীহ আল-বোখারী (মোহাম্মদ বিন ইসমাইল, ইমাম বোখারী (র) নামে পরিচিত, জন্ম ১৯৪ হিঃ মৃত্যু ২৫৬ হিঃ)
২। সহীহ মুসলিম (মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ, ইমাম মুসলিম (রঃ) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৬১ হিঃ)
৩। সুনানে আবু দাউদ (সুলাইমান বিন আসন্দ, আবু দাউদ (র) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৭৫ হিঃ)
৪। সুনানে ইবনে মাজা (মোহাম্মদ বিন ইয়াজিদ (রঃ) জন্ম ২০৯ হিঃ মৃত্যু ২৭৩ হিঃ)
৫। জামি আত-তিরমীজি (মোহাম্মদ বিন ঈসা (র) জন্ম জানা নেই, মৃত্যু ২৭৯ হিঃ)
৬। সুনানে আন-নিসাঈ (আহমদ বিন সোয়ায়েব (র) জন্ম ২১৫ হিঃ মৃত্যু ৩০৩ হিঃ)
এছাড়া ইমাম মালিক এর (জন্ম ৯৩ হিঃ মৃত্যু ১৭৯ হিঃ) মুয়াত্তা, ইমাম আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন বিন মাসউদ (মৃত্যু ৫১৬ হিঃ) এর মিশকাত আল মাসাবি এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (জন্ম ১৬৪ হিঃ মৃত্যু ২৪১ হিঃ) এর মশনদ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ হিসাবে প্রসিদ্ধ।
প্রকৃতপক্ষে কোরআনই শরিয়তের উৎস। ইসলামী আইনের মূলনীতি আমরা পাই কোরআনে আর সুন্নাহর মাধ্যমে পাই সেই আইনের বাস্তব প্রয়োগ বা প্রয়োগের উদাহরণ। উদাহরণস্বরূপ কোরআন বলেছে নামায কায়েম কর, রোযা পালন কর, যাকাত আদায় কর, পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে (শূরা) সিদ্ধান্ত নাও। কিন্তু কোরআন এসব কিভাবে পালন করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি। ‘সুন্নাহ’ই আমাদেরকে এ সব বিষয়ে সবিস্তারে জানায়।
ইসলামী শরিয়ত মানুষের জন্য। মানুষের উন্নয়নের জন্য। তাই শরিয়ত যুগের প্রয়োজনেই আইন-কানুন নীতি নির্ধারনের পথ বাতলে দিয়েছে। যুগের প্রয়োজনে এমন একটি বিষয় এলো যেখানে কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ নেই তখন ‘কোরআন’ ও ‘সুন্নাহ’ পারদর্শী আলেমগণ একত্রে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কোনক্রমেই কোরআন ও সুন্নাহর মূল আদর্শ ও নীতির পরিপন্থী হতে পারবে না। একে বলে ‘ইজমা’। ‘ইজমার’ শাব্দিক অর্থ ‘সর্বসম্মত’। খোলাফায়ে রাশেদার যুগ থেকে ‘ইজমা’ চালু হয়েছে।
একটি বিশেষ অবস্থা বা নীতির সাথে মিল রেখে, সম্পর্ক রেখে অন্য একটি বিশেষ সমস্যার সমাধানের নিয়মকে বলে ‘কেয়াছ’। কেয়াছ অর্থ উপমা, একই ধরনের অবস্থার ভিত্তিতে যুক্তি বা দর্শন। তাই ‘ইজমা’ ও ‘কেয়াছ’ এ দু’টিও শরিয়তী আইনের দুটি উল্লেখযোগ্য ভিত্তি।
ফিকাহ
‘কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে ইসলামী আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত গ্রন্থরাজিকে বলা হয় ‘ফিকাহ’। আলেম সমাজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফরে এই ফিকাহ শাস্ত্র তৈরী হয়েছে। মুসলমানদের জন্য এটি একটি বিরাট সম্পদ। ইসলামী আলেম, বিশেষজ্ঞদের এই মহান ত্যাগের ফলেই আজ কোটি কোটি মুসলমানদের পক্ষে কোরআন ও সুন্নাহর সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানা না থাকলেও কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করার কাজটি সহজ করে দিয়েছে ‘ফিকাহ’।
ইসলামী আইন-কানুনের চারজন বিখ্যাত সংকলক হচ্ছেন
১। ইমাম আবু হানিফা (র) (৮০-১৫০ হিঃ)
২। ইমাম মালেক (র) (৯৩-১৭৬ হিঃ)
৩। ইমাম শাফেয়ী (র) (১৫০-২৪০ হিঃ)
৪। ইমাম হাম্বল (র) (১৬৪-২৪১ হিঃ)
তাঁদের চিন্তা, গবেষনা ও উপলব্ধি ছিল সত্যকে জানার জন্য, উদ্দেশ্য ছিল মহান ও মুসলমানদের কল্যাণে নিবেদিত এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাই তাঁদের মতামত, গবেষণা, চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কম-বেশী পার্থক্য থাকবেই। পার্থক্য থাকলেও মুসলিশ উম্মাহ এই চার মহান আলেমের চার ফিকাহকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। আমরা শরিয়তী আইনের ক্ষেত্রে এই চার তরিকার যে কোন একটি তরিকাকে মেনে নিতে পারি। কিন্তু চার রকমের তরিকা একত্রে আনুগত্য করা চলতে পারে না। অনেক আলেম আবার এ মতও পোষণ করেন যে, এ চার তরিকার কোন বিশেষ ফিকাহর আনুগত্যের প্রয়োজন নেই। বরং আন্তরিকতার সাথে কোরআন ও সুন্নাহর বিধান বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আর যাদের জ্ঞান তত গভীর নয় তাদের উচিত আস্থাভাজন কোন আলেমের আনুগত্য করা। এদেরকে বলা হয় ‘আহলে হাদীস’। এই তরিকা উপরের চার তরিকার মতই সঠিক।
শরিয়তের উদ্দেশ্য
এতোক্ষণের আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হলো যে, শরিয়ত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জীবন যাপনকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং শরিয়ত হলো ইসলামের অনুমোদিত আদর্শ জীবনে বাস্তবায়নের পথ। শরিয়ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ দেখিয়ে দেয়। শরিয়তের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয় যায় না। শরিয়তের বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোন অভিনব পন্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করায় কোন লাভ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের আনুগত্য মুক্ত হয়ে নিজেদের মনগড়া পন্থায় আল্লাহকে পাওয়ার পথ খুঁজছেন। এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল। আল্লাহ ও রাসূলের (স) দেখানো পথের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা।
ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্যঃ
শরিয়তের ভিত্তি, উদ্দেশ্য এবং উৎসের দিকে লক্ষ্য করলে মানুষের তৈরী আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মানুষের তৈরী আইনের কোন স্থির ভিত্তি নেই। একেক সমাজের জন্য, একেক জাতির জন্য, একেক সম্প্রদায়ের জন্য তা একেক রকম হতে পারে। ফলে একটি সমাজের জন্য যা উপকারী, অন্য একটি সম্প্রদায়ের জন্য তা জুলুম হতে পারে। যে সমাজে যে সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব সে সমাজে সে সম্প্রদায়ের আইন চলে। সেখানে অন্যদের কার কি কষ্ট হচ্ছে তা দেখার কোন দরকার নেই। তাই আমরা দেখতে পাই দেশের মুষ্টিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্বকারী পার্লামেন্ট ধনীদের স্বার্থে ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। যদিও এর ফলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কষ্ট বাড়ছে। এইসব আইন তৈরী করে মানুষ। অপরদিকে ইসলামী আইনের উৎস হলো আল্লাহর বিধান। সেই আল্লাহ যিনি মানুষের সৃষ্টিকর্তা, যার কাছে দুনিয়ার প্রতিটি জাতি সমান, ধনী গরীব সকলে এক। তাই ইসলামী আইন সকল মানুষের জন্য, সকল জাতির জন্য এক ও অভিন্ন। পুরনের নিশ্চয়তা আছে, তেমনি আছে অন্য মানুষের –তার আত্মীয়, তার প্রতিবেশী, তার জাতির লোক, দুনিয়াবাসী সকলের অধিকার হেফাজতের ব্যবস্থা।
ইসলামের অর্থনীতি
মানুষকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষার এক সুষ্ঠু ব্যবস্থা। তাই উপার্জন করা এবং ব্যয় করা দুটোই মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় দিক। মোটকথা, ‘অর্থ’ মানুষের জীবনের একটি দরকারী জিনিস। তাই বলে অর্থ বা টাকা পয়সাই জীবনর সব নয়। আমাদের জীবনের আছে এক মহৎ উদ্দেশ্য। আমরা দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। আমাদের যেমন রয়েছে দেহ তেমনি রয়েছে মন, বিবেক।
ইসলাম মানুষের জীবন পথের সন্ধান দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিয়েছে নির্দেশনা, দেখিয়েছেন চলার পথ। ইসলাম তাই মানুষের জীবনের আর্থিক দিককে অবহেলা করেনি। উপার্জন, ব্যয় এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষের মঙ্গরের জন্য। ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি সমাজ গঠন যেখানে সকলেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে আন্তরিকতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে এবং প্রত্যেকেই পাবে তার ন্যায্যা অধিকার, সম্মান এবং মর্যাদা। সততা, ন্যায়, মায়া-মমতাকে বিসর্জন দিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধার সিংহ ভাড় কেড়ে নেওয়ার মত ‘ধূর্ত শিয়ালের’ সমাজ ইসলামী সমাজ নয়।
ইসলাম সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের জন্য কয়েকটি নিয়ম ও সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা এখন সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করবো।
উপার্জন
ইসলাম মানুষকে কাজ করে উপার্জন করার জন্য উৎসাহিত করেছে, এটি শুধু কর্তব্যই নয় বরং পুণ্যের কাজ।
নবী (স) বলেছেন,
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সকল সম্ভাব্য উপায়ে চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টা পূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর।
ইসলাম কাজ করাকে মর্যাদার চোখে দেখেছে, আর অন্যের উপর নির্ভর করা, অলসতা এবং ভিক্ষা করাকে ঘৃণা করেছে। মুসলমানদেরকে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, কারো গলগ্রহ হওয়া থেকে দূরে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সেই সংগে চায় একটি ন্যায় ও সততার সমাজ। সকল অন্যায়ের মূলে আঘাত হানে চায় ইসলাম। তাই উপার্জনের সকল অবৈধ উপায় ইসলাম বন্ধ করে দিয়েছে। উপার্জন হতে হবে হালাল পথে। উপার্জন হতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী।
মাদক দ্রব্যের মত চরিত্র বিধ্বংসী দ্রব্যের উৎপাদন, বিক্রি এবং বিতরণের সকল উপার্জন তাই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। তেমনিভাবে হারাম জুয়া, লটারী ও সুদের ব্যবসা। মোটকথা অন্যের ক্ষতি হবে, সমাজের ক্ষতি হবে এমন উপায়ে তুমি টাকা কামাবে, তা হবে না। চুরি, ডাকাতি, ঠকবাজি, মিথ্যা, চোরচালানীর উপর ভিত্তি করে ব্যবসা করবে, তাও চলবে না। সেই সাথে অন্যায়ভাবে খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিনের পর দিন মজুদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।দ
ব্যয়
সৎভাবে উপার্জনের সাথে সাথে ইসলাম সৎ ব্যয়েরও নির্দেশ দিয়েছে। একজন মুসলমান কোন কাজই দায়িত্বহীনের মত করতে পারেনা। তাই তার অর্থ ব্যয়ও হতে হবে সমাজ এবং পরিবারের দায়িত্বশীলের মত। প্রয়োজনে অতিরিক্ত খরচ করা ইসলাম সমর্থন করে না। অন্যদিকে জোঁকের মত টাকা আটকে রাখাকেও ইসলাম পছন্দ করেনা। প্রকৃতপক্ষে সমাজের উপকারের জন্যই সম্পদ সমাজে স্বাভাবিকভাবে সচল থাকতে হবে। ব্যবসা চলবে, লাভ হবে, লাভের টাকা আবার খাটবে –এর ফলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, উৎপাদন বাড়ে, শ্রমিকের কাজের সংস্থান হয়, বেকার সমস্যা কমে। কিন্তু সম্পদ যদি কোথাও কারও হাতে কিংবা সমাজের বিশেষ কোন শ্রেণরি হাতে কুক্ষিগত হয়, তখন দেশে অর্থনীতিতে চরম অব্যবস্থা দেখা দেয়। কিংবা যদি মুষ্টিমেয় বড় লোক আরাম-আয়েশে বিলাসিতার পথে চলে তাহলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনাচার, নৈতিকতাহীনতা, সমাজ জীবন হয় দূষিত। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ আটকে রাখা কিংবা বিলাসিতায় সম্পদ নষ্ট করা দুটো হারাম বা অবৈধ। এ কারণেই ইসলাম চায় না সমাজের সকল সম্পদ ধনীদের হাতে জমা হোক।
যাকাতের ব্যবস্থা
সমাজের সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে জনা না হয় সেজন্য ইসলামে রয়েছে এক সুন্দর ব্যবস্থা-তাহলো যাকাত। যাকাত দান ইসলামী অর্থনীতির একটি মূলভিত্তি। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সম্পদ যার কাছে থাকবে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে যাকাত দিতে হবে। যাকাত একদিকে একটি ইবাদত অন্যদিকে একটি সামাজিক দায়িত্ব। যাকাত ধনী ও গরীবের মাঝখানে দূরত্ব কমায়। সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু চলাচলের ব্যবস্থা করে যাকাত। যাকাত হলো সামাজিক নিরাপত্তা। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চায়। এটি পূরণ করতে হলে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। ধনীর জমানো টাকা গরীবের উপকারে লাগে –এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। (যাকাতের উপর বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে)।
ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
মানুষ নিজে যা কিছু উপার্জন করে কিংবা বৈধ উপায়ে তার যে সম্পদ আছে সে সম্পদের উপর তার অধিকারকে ইসলাম স্বীকার করে। এটিকে ইসলাম তার মৌলিক অধিকার হিসাবে গন্য করে। অর্জিত সম্পদের মালিকানার উপর ইসলামী রাষ্ট্র ততক্ষণ হস্তক্ষেপ করেনা যতক্ষণ না সমাজের বৃহৎ অংশের জন্য তা ক্ষতিকর হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন লোক নিম্ন উপায়ে সম্পদের মালিক হতে পারেঃ
ক) শিকার
খ) মালিকানাবিহীন পতিত জমি আবাদ করা
গ) ভূগর্ভস্থ খনি উদ্ধার (মালিকী মত অনুসারে পেট্রোল, লোহা, কয়লা এ জাতীয় খনিজ পদার্থ যা সকলের ব্যবহারের জন্য তা জনগণের সম্পদ)
ঘ) বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈর
ঙ) ব্যবসা
চ) গনিমতের মাল
ছ) অন্যের জন্য পরিশ্রম করা, চাকুরী করা
জ) মালিকানাবিহীন জমি বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া
ঝ) শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে উপার্জন করা সম্পদ
কিন্তু ইসলাম সম্পদের মালিকানা লাভের জন্য যা ইচ্ছে তাই করার অনুমতি দেয় না। আমাদের বর্তমান সমাজের মূল সমস্যা কিন্তু এখানেই। মানুষ সম্পদের মালিক হবার জন্য কিংবা সম্পদ বাড়ানোর জন্য যা ইচ্ছে তাই উপায় অবলম্বন করছে। এজন্য ধোঁকাবাজি করছে, প্রতারণা করছে, শ্রমিকের অধিকার হরণ করছে, মজুতদারী করছে, চুরি-ডাকাতি করছে। ইসলামে এসব অবৈধ-অনৈতিক সমাজ বিরোধী পথ বন্ধ করতে চায়।
মানুষের কাছে সম্পদ থাকা এবং তাকে সম্পদ বাড়াতে দেয়ার অধিকার দিয়ে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়াকে বলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। উপার্জনের পথ এবং ব্যয়ের পথের উপর নৈতিকতার কোন চাপ না থাকায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। এ ব্যবস্থায় ধনীরা দিন দিন তাদের সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ পায় এবং গরীবরা দিন দিন হয় আরও গরীব। ইসলাম এই ব্যবস্থার বিরোধী। সেই সাথে ইসলাম ব্যক্তির মালিকানাকে কেড়ে নেয়াও সমর্থন করে না। কারো কোন কিছু থাকবে না, সব কিছু রাষ্ট্রের সম্পদ, ‘সমাজতন্ত্রের’ এই গালভরা বুলি ইসলামে বৈধ নয়।
নিজে পরিশ্রম করবে, পরিশ্রমের ফসল নিজ পরিবারের জন্য ব্যয় করবে, তাদের জন্য রেখে যাবে জমানো সম্পদ এটা হলো প্রতিটি মানুষের একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা ও আকাংখা। এই ইচ্ছা ও আকাংখা মানুষকে কাজের প্রেরণা যোগায়। শুধু তাই নয়, এই স্বাধীনতা তাকে সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস যোগায়। কিন্তু রাষ্ট্র এই ব্যক্তি মালিকানা কেড়ে নিলে মানুষের আর কিইবা থাকে! সে পরিণত হয় রাষ্ট্রের একটি ‘যন্ত্রে’। রাষ্ট্রের হাতে সব ক্ষমতা। এমনকি তার খাওয়া-পরাও রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর। এ অবস্থায় জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে হক কথা বলার সাহসও সে হারিয়ে ফেলে। ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের স্বাভাবিক মন, প্রাণ, ইচ্ছা, স্বাধীনতার মৃত্যু ঘটে। আর তাই দুনিয়ার প্রায় সব সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দ্রুতই হলো।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার ব্যাপারে যে মত পোষণ করে সেটাই হলো সঠিক মত সঠিক দৃষ্টিভংগী।
সুদকে হারাম ঘোষণা
ইসলামী অর্থনীতি সুদ থেকে মুক্ত। সুদ হচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের মূলভিত্তি। আজকালকার সমাজে সুদ হচ্ছে সকল ব্যবসার মাধ্যম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুদ কোন ‘ব্যবসা’ নয়। এটা কোন ‘লাভ’ নয়। সুদ জুলুমের হাতিয়ার। সম্পদ গুটিকতক লোকের জমা করার মাধ্যম। সুদের ফলে একজন আরেকজনের গোলামে পরিণত হয়। একটি দেশ আরেকটা দেশের হুকুমের তাবেদার হয়। ইসলাম সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। যদিও আজ কালকার সামজে সুদ ছাড়া কো কিছু চিন্তা করা সম্ভব নয় –তবু আলহামদুলিল্লাহ পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশে সুদবিহীন অর্থনীতিকে বাস্তবে পরিণত করারজণ্য সামান্য হলেও প্রচেষ্টা চলছে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইনসিওরেন্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)
সম্পদ যাতে এক জায়গায় কুক্ষিগত না হতে পারে সেজন্য আরও একটি সুন্দর ব্যবস্থা হলো ‘উত্তরাধিকার আইন’। একজনের মৃত্যুর পর তার সম্পদ এক সুন্দর নিয়মে সুষ্ঠুভাবে ন্যায়ের ভিত্তিতে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ইসলাম।
ইসলামের অর্থনীতির মূল বিষয়গুলোর আলোচনার মাধ্যমে আমরা এটাই পেলাম যে, ইসলামের অর্থনীতির ভিত্তি হলো সরলতা, বিনয়, উদারতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও খোদাভীতি। সেখানে লোভ, লালসা, কুটিলতা, অপচয়, বিলাসিতা, হিংকা-বিদ্বেষের কোন স্থান নেই। মোটকথা ইসলাম মানুষের মানবিক গুণাবলীর উপর তার অর্থনীতির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মানুষের পশুবৃত্তিকে দমন করে মানুষের সমাজকে পশুর সমাজ হওয়া থেকে রক্ষা করতে চায়।
ইসলামে রাজনীতি
মানুষ কখনও একা থাকতে পারেনা। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। সকলেই যেমন সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে, কেউ কোন অন্যায় না করে না, অন্যায় করলে তার যেন বিচার হয় সেজন্য সমাজের সকলেই একজনকে নেতা হিসাবে মেনে নেয়। মানব সমাজের প্রথম থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। শুধু তাই নয় সমাজে জন্য আইন-কানুন ঠিক করা, নিত্য নতুন আইন তৈরী করার প্রয়োজনও দেখা দেয়। মানুষের সমাজ যখন ছোট ছিল তখনও প্রত্যেক সমাজে একটা নিয়ম ছিল নেতা নির্বাচনের, আইন তৈরীর। এখন সমাজের পরিধি বড় হয়েছে, দেশের পরিধি বড় হয়েছে তাই সমাজ কিভাবে চলবে, দেশ কিভাবে চলবে, কিবাবে দেশের নেতা নির্বাচিত হবে সে ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশ শাসন, শাসন পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন, আইন-কানুন তৈরীর ব্যবস্থাকে ‘রাজনীতি’ বলে। ইসলামে রাজনীতি আলাদ কোন ব্যবস্থা নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন চলবে এক নিয়মে, আর দেশের শাসন ব্যবস্থা চলবে অন্য নিয়মে ইসলামে এমন কোন বিভাজন নেই। কেননা ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজ পরিচালনার জন্য একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আর রাজনীতি হলো সামজ জীবনের একটি অংশ মাত্র। তাই ইসলাম যেমন আমাদের নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কে নিয়ম-নীতি দিয়েছে তেমনি কিভাবে একটি দেশ চলবে, কিভাবে শাদসন পরিচালনার জন্য সরকার গঠন করা হবে, কিভাবে আইন তৈরীর জন্য পার্লামেন্ট গঠন হবে, কিভাবে অন্য দেশের সাথে চুক্তি হবে, কিবাবে দেশের বাণিজ্য চলবে –সব কিছু সম্পর্কে নিয়ম-নীতি বলে দিয়েছে। বিস্তারিতভাবে ইসলামী রাজনীতির সব দিক আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবুও আমরা ইসলামী রাজনীতির নীতিমালাগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
সার্বভৌমত্ব হলো ক্ষমতার উৎস। ইসলামে আল্লাহই হচ্ছেন সকল ক্ষমতা এবং আইনের উৎস। মোটকথা ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ। কোন শাসক কিংবা জনগণ কেউ ইসলামে সার্বভৌমত্বের মালিক নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক তিনি যাকে জনগণ আল্লাহর আইন অনুযায়ী তাদের সেবা করার জন্য মনোনীত করে। আল্লাহ ভালভাবে জানেন মানুষের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ। তাই আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর আইন হচ্ছে চূড়ান্ত আইন। তাই মানুষ আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারোন। এমনকি জনগণ একত্রিত হয়ে কিংবা কোন সরকার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারেনা।
কোরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান
ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো খোদার বিধান আল-কোরআনের আলোকে সকল কাজ পরিচালিত করা। তাই আমরা বলতে পারি কোরআনই ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান আর কোরআনতো মানুষকে সে পথেই নিয়ে যায় যেখানে আছে শান্তি, শৃংখলা, উন্নতি এবং সফলতা।
খেলাফত
মুসলমানদের কাজ হলো দুনিয়ার বুকে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়ে সে আল্লাহর প্রতিনিধি। ইষলামী রাজনীতির পরিববাষায় এক বলে ‘খেলাফত’। সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ এবং মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রেও মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর পছন্দনীয় উপায়ে দেশ ও সমাজ পরিচালনা করা, আল্লাহর আইন তথা শরিয়তী আইনকে সমাজে চালু করা, আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা এসব কাজ মানুষই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে করে থাকে। মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ এই কাজ করাতে চান। তাই মুসলমানরা আল্লাহর আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য নিজেদের মধ্য থেকে যাকে নেতা নির্বাচিত করে তাঁকেও ‘খলিফা’ নামে ডাকা হয়।
খেলাফত একটি ‘আমানত’। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছাকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে একটি বিরাট ‘আমানত’ হিসেবে।
পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ
ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের আইন তৈরী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরামর্শের ভিত্তিতে করতে হয়। ইসলামী পরিভাসায় একে বলা হয় ‘শূরা’। সিদ্ধান্ত সকলের পরামর্শ ও সম্মতি নিয়ে করার জন্য কোরআনে গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। তাই কোন এক ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে, ইসলামে এমন সুযোগ নেই। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ শাসন করা ইসলামী রাজণীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
সরকার ও জনগণের দায়িত্ব
খোদার বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কাজতো দেশের সব লোক একত্রে করতে পারেনা। তাই স্বাভাবিকবাবেই জনগণ তাদের মধ্য থেকে ধার্মিকতা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততার ভিত্তিতে উত্তম গুনসম্পন্ন কয়েকজন নাগরিককে শাসন এবং সরকারের নিজেরেদ ইচ্ছামত কিছু করতে পারেনা। কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরামর্শের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করাটা তাদের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তারা প্রথমে আল্লাহর কাছে দায়ী এবং তারপর দায়ী জনগণের কাছে। প্রকৃতপক্ষে শাসক ও সরকারকে নির্বাচন করে তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করার জন্য। জনগণ, শাসক ও প্রশাসকবর্গ সকলেইতো আল্লাহর খলিফা। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কয়েকজনের উপর ছেড়ে দিয়েই কিন্তু জনগণের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। শাসক ও প্রশাসকবর্গ ঠিকমত পরিচালনা করছে কিনা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে পরার্মশ দেয়া, ভাল কাজে সহযোগিতা করা, মন্দ কাজের সমালোচনা করা জনগনের দায়িত্ব। প্রতিটি নাগরিক সরকারকে সমর্থন করা কিংবা কোন একটি সরকারী নীতির বিরোধিতা করার স্বাধীনতা রাখে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও জনগণ সকলের মর্যাদা মানুষ হিসেবে সমান। দেশের আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামী রাজনীতির একটি মূল বিশয় হলো বিচার ব্যবস্থা সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা হতে হবে। যাতে করে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারের হোমরা-চোমরা মন্ত্রীদেরকেও প্রয়োজন হলে আদালতে ডেকে আনা যায়। শাসক কিংবা প্রশাসকবর্গের ক্ষমতার জোরে ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব
ইসলামী রাজনীতির মূল বিয়ষগুলো আলোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে ইসলামী রাষ্ট্রকে কোন অনৈসলামী প্রকৃতির রাজনৈতিক সংগঠন দিয়ে পরিচারনা করা কিংবা কোন বিদেশী শক্তির পদানত করা যেতে পারেনা। মুসলমানতো তারাই যারা একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য নিজে এগিয়ে আসে এবং আল্লাহর আইন প্রয়োগকারী ও শর্তাবলী পালনকারী সরকারের প্রতি সহযোগিতা ও সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাই মুসলিম জাতির পক্ষে অনৈসলামী সরকারের বশ্যতা স্বীকার করা শোভা পায়না। ইসলামী রাষ্ট্র ও তার জনগণ এদিক থেকে প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীনতা ভোগ করে। এই অর্থে ইসলামই প্রকৃত স্বাধীনতা। ইসলামই মানুষকে তার প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে কিংবা দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রেরণা জোগায়। মুসলিম দেশগুলোর স্বাধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনা করলে একথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, জনগণের ইসলামী প্রেরণাই তাদের সাহস জুগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে, প্রেরণা দিয়েঝে জীবন বিলিয়ে দিতে।
অমুসলিমদের অধিকার
ইসলাম অমুসলিমদের নাগরিক অধিকারকে শুধু স্বীকারই করেনা, অমুসলিমদের নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম অমুসলিম উভয় নাগরিকের কল্যানের জন্য সমানভাবে দায়ী। এসব কথা কোন কল্প কথা নয়। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তারপর চার খলিফার খেলাফতের আমলের অনেক ঘটনা আছে যা আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁদের মৌলিক অধিকার পেয়েছে, স্বাধীনতা ভোগ করেছে তা ইতিহাসে এখনও বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঞ্চম অধ্যায়
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
জিহাদঃ ইসলামী আন্দোলন
জিহাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
জিহাদ নবীর শেখানো পথ
জিহাদ মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ভাল কাজের উৎসাহ দান/তা’মরুরুনা বিল মারুফ
অন্যায় কাজের রোধ/নাহি আনিল মুনকার
জিহাদ ঈমানের পরীক্ষা
জিহাদ জীবনের সাফল্য
ইসলামী সংগঠন
ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী জামায়াতঃ মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসা
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
জিহাদঃ ইসলামী
আল্লাহ, রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তকদীরের ভালমন্দ এবং শেষ বিচারের দিন এইসব কিছুকে ইসলাম বিশ্বাস করতে বলেছে। এই জিনিসগুলোর উপর ঈমান এনে যে কোন ব্যক্তি মুসলমানদের দলভুক্ত হয় কিন্তু এতেই সে পুরোপুরি মুসলিম হতে পারে না। পুরোপুরিবাবে মুসলমান সে তখনই হতে পারে যখন আল্লাহর কাছে নিজকে সে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেয়। প্রতিটি কাজ আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলে খোদার (সা) দেকানো নিয়ম অনুযায়ী করে। প্রতিটি কাজ করে আল্লাহকে খুশী করার জন্য। প্রতিটি কাজে সে চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি। মনের এই অবস্থার জন্য কঠিন, কঠোর সাধনায় সে এগিয়ে আসে। প্রতিদিন আদায় করে নিষ্ঠার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, বছরে একটি মাস পালন করে রোযা। এমনিভাবে আদায় করে হজ্ব ও যাকাতের হুকুম আহকাম। এভাবে আল্লাহকে খুশী করার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের (স) নির্দেশমত কাজ করতে করতে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় মজবুত। আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা সে পছন্দ করতে শুরু করে। আল্লাহ যা পছন্দ করেন না, তা সে নিজের জীবনের সবখান থেকে ধুয়ে মুছে ফেলে। এ সম্পর্ক যখন আরও মজবুত হয় তখন সে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজকে শুধু নিজের জন্যই পছন্দ করে না –অন্যের জন্যও তা ভাল মনে করে। দুনিয়ার প্রতিটি লোক আল্লাহর পথে চলুক এটাই সে চায়। সে চায় দুনিয়াতে একমাত্র আল্লাহর হুকুম চলুক। এইজন্য সে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের প্রচার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় সব কিছুর উপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। নিজের জীবন, ধন, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা, যোগ্যতা সব কিছুকে সে এ কাজের জন্য খাটায়। শুধু তাই নয়, আল্লাহ যা ভালবাসেন না –আল্লাহ যা অপছন্দ করেন –তা সে নিজেই অপছন্দ করে ক্ষান্ত হয়না –দুনিয়ার বুক থেকে সব অন্যায় ও অসত্যকে দূর করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালায়। এইভাবে নিজেদের সবকিছু দিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার কাজে এগিয়ে আসে। এ লক্ষ্যেই ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মানকে সে মনে করে নিজের সম্মান। তার প্রতিটি কাজ হয় ইসলাম ও মুসলিম জাতির কল্যাণ, সম্মান, উন্নতির জন্য। ইসলামী পরিভাষায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠার এই কাজটিকে বলা হয় ‘জিহাদ’। এই পবিত্র কাজকে আমরা আধুনিক ভাষায় বলি ‘ইসলামী আন্দোলন’।
জিহাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ হলো সকল শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালানো। তাই আল্লাহর দ্বীনকে ধন দিয়ে, কথা দিয়ে, কলম দিয়ে সবকিছুর উপরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও এই অর্থে জিহাদ। আবার সকল অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে, ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও জিহাদ। আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার এই কাজ আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাই জিহাদ আল্লাহর জন্যই। ইসলামী পরিভাষায় তাই একে বলা হয় “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ আল্লাহর জন্য জিহাদ।
মুসলমানরা জিহাদ করে নিজেদের স্বার্থে নয়। নিজের ধন, মাল ও সম্মানকে বৃদ্ধি করার জন্য নয়। মুসলমানদের সকল ত্যাগ, কোরবানী, চেষ্টা-সাধনার উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ায় সকল মানুষের জন্য এক সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আর এক কাজ করলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। নামাজ, রোযা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে আল্লাহর হুকুম মানায় অভ্যস্ত করে।
নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে ইসলামের জন্য বেঁচে থাকতে নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে ইসরামের জন্য বেঁচে থাকতে এবং এরই জন্য মৃত্যুবরণ করতে উৎসাহিত করে। মোটকথা নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মূল লক্ষ্যই হলো ‘জিহাদ’। জিহাদ ছাড়া ইসলামকে কল্পনা করা যায় না। কে না চায় দুনিয়ায় সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক অসত্য পরাজিত হোক, বন্ধ হোক সকল অনাচার-অত্যাচার, জুলুম! কিন্তু তা তো আপনা আপনি হবে না। এজন্য চেষ্টা-সাধনা করতে হবে। ইসলামের প্রতিটি কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি না তার উদ্দেশ্য হয় ‘জিহাদ’ আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করা।
জিহাদ নবীর শেখানো পথ
নবী রাসূলগণ একাজই করেছেন। তাঁরা নিজেরা আল্লহার হুকুম মেনে চলেছেন। অন্যদের সামনে এ আদর্শ তুলে ধরেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) সমাজে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক সুন্দর পথ তুলে ধরেছেন আমাদের জন্য। আমাদেরকে রাসূলের দেখানো সেই জিহাদের পথে আমাদের নিজেদের জীবনে এবং সমাজ জীবনে ইসলামকে কায়েম করতে হবে।
রাসূলের (সঃ) শেখানো নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত যেমন আমাদের জন্য ফরয, আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার কাজে অংশ গ্রহণ করাও তেমন ফরয। বরং বলা যায় সব ফরজের বড় ফরয। কেননা কে সমাজে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই, যে সমাজে আল্লাহর আইন নেই, সেই সমাজে প্রকৃতপক্ষে নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত পালন কঠিন হয়ে পড়ে। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত যা আমাদের শেখায় তা বাস্তবে প্রয়োগ করাও কঠিত হয়ে পড়ে। তাই জিহাদ বা আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার কাজে নিজের জান মাল সব কিছু নিয়ে প্রচেষ্টা চালানো একটা গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবাদাত।
জিহাদ মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজকে আমরা বলি ইসলামী আন্দোলন। কোরআনে এই কাজটিকে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে।
এখন দুণিয়ার সর্বোত্তম জাতি তোমরা যাদেরকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর, অন্যায় এবং পাপ কাজ থেকে লোকদেরদে বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো।
সূরা আল-ইমরান-১১০
তোমাদের মধ্যে এমন কিচু লোক থাকতেই হবে যারা নেকী ও মঙ্গরের দিকে ডাকবে। ভাল ও সত্য কাজের নির্দেশ দেবে এবং পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ করবে তারাই সার্থকতা পাবে।
সূরা আল-ইমরান-১০৪
নিজে আল্লাহর হুকুম মত চলা, অন্যকে আল্লাহর হুকুম মানতে বলা এবং দুনিয়া থেকে অন্যায়, অসত্য দূর করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে নিজকে ব্যস্ত রাখা মুসলমানদের দায়িথ্ব ও কর্তব্য। ভাল কাজে উৎসাহ দান (তা’মুরুনা বিল মারুফ) এবং অন্যায়কে রোধ করা (নাহি আনিল মুনকার) মুসলমানদের দুটি বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ভাল কাজে উৎসাহ দান/তা’মুরুনা বিল মারুফ
ভাল কাজ অর্থাৎ সব ধরনের ভাল কাজ নিজে করা এবং অন্যকে করতে আহবান করা উৎসাহিত করা মুসলমানদের কাজ। তুমি নিজে ইসলামকে জানার চেষ্টা করো। নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। তোমার বন্ধুদেরকে, আত্মীয়দেরকে ইসরাম মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করো। তাদের সাথে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করো। কেউ ইসলাম সম্পর্কে ভুল বললে বা বুঝলে তাকে বুঝাও –এসব কিছু কাজ –এসব কিচুই ইবাদত। অন্যকে ন্যায়ের পথে সত্যের পথে ইসলামের দিকে আনতে হলে শুধু মুখে মুখে ইসলামের কথা বলা নয় তোমার নিজের জীবনটাকেও ইসলামের আলোকে সুন্দর করতে হবে। তোমার কথা হবে মধুর, তোমার ব্যবাহর হবে আকর্ষণীয়, তুমি যা কিছু বলো সে রকম নিজে হবার চেষ্টা করবে –তবেই না তোমাকে দেখে অন্যেরা উৎসাহিত হবে।
হে ঈমানদাররা, তোমরা কেন তা বলো যা তোমরা করনা। আল্লাহর কাছে এটি খুব ঘৃণার কাজ যে তোমরা যা বলো তা করো না।
সূরা আস সফ-২-৩
কোরআনের এই বাণী স্পষ্ট করে আমাদের কাজকে আমাদের কথার সাথে মিল রখার জন্য বলেছে। এজন্য আমাদেরকে নিজেদের ভাল করার চেষ্টা করতে হবে এবং সেই সাথে অন্যকে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবেই আমাদের চরিত্রের দুর্বলতা এবং আমাদের কমতিগুলো দূর হবে। আমাদের মধ্যে কেউই একবোরে খাঁটি নয়। কিন্তু আমাদের ত্রুটিগুলো আস্তে আস্তে দূর হবে যদি আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থে জিহাদের দায়িত্ব পালন করি।
অন্যায় কাজের রোধ/নাহি আনিল মুনকার
শুধু ভাল কথা বলা এবং ভাল কাজ করলেই চলবে না। সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এজন্য আল্লাহ মুসলমানদের প্রয়োজনে যুদ্ধ করার হুকুম দিয়েছেন। অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য জীবন বাজি রাখার আহবান জানিয়েছে কোরআন।
সব ধরনের অন্যায়, জুলুম ও অসত্যকে ঘৃণা করা, তার বিরুদ্ধে কথা বলা, তাকে দুনিয়ার বুক থেকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ করা পবিত্র ইবাদত। এ কাজ করতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। পবিত্র এই এবাদতের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া সাধারণ কোন মৃত্যু নয় –এটাকে বলা হয় ‘শাহাদাত’।
শাহাদাত সকলের ভাগ্যে হয় না কিন্তু শাহাদাত প্রতিটি মুসলমানের জীবনের কামনা। আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন বিলিয়ে শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করার চেয়ে বড় কাজ কি হতে পারে? অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করার বিষয়ে নবী (স) খুব জোরালোভাবে বলেছেনঃ
তোমাদেরকে সৎ ও ন্যায় কজা করতে হবে। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখতে হবে এবং পাপী ও অন্যায়কারীর হাত ধরে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে, খোদার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পাপী ও খারাপ লোকদের প্রভাব তোমাদের মনের উপরে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা অভিশপ্ত হবে।
প্রিয় নবী এতদূর পর্যন্ত বলেছেন,
তোমরা যদি দুর্বল হও তা হলে অন্তত অন্যায়কে মনে মনে ঘৃনা কর, আর এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল জিহাদ।
জিহাদ ঈমানের পরীক্ষা
প্রকৃতপক্ষে জিহাদ হলো ঈমানের বাস্তব পরীক্ষা। শুধু মুখে মুখে ঈমান আনলেই চলে না। বাস্তব জীবনে তার প্রমাণ দিতে হবে। বাস্তব জীবনে ইসলামের পথে চলতে প্রতি পদে পদে আসে বাধা। এই বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রামইতো জিহাদ। সত্য প্রচারের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে লাগে ধৈর্য এবং সাহস। ত্যাগ করতে হয় জীবনের অনেক আরাম-আয়েশ। বরণ করতে হয় অনেক দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা, অপবাদ। পড়তে হয় ষড়যন্ত্রের শিকারে। মাথা পেতে নিতে হয় জুলুম, অত্যাচার। দাঁড়াতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাই জিহাদের মাধ্যমেই বুঝা যায় কে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ভালবাসে আর কে ভালবাসে জীবনের আরাম-আয়েশ।
জিহাদই জীবনের সাফল্য
জিহাদের এই কাজ একদিন দু’দিনের কাজ নয়। এটি আমাদের প্রতিটি মুহুর্তের, প্রতিটি দিনের কাজ। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত এ কাজ করে যেতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ত্যাগের। প্রয়োজন ধৈর্য এবং ছবরের। এজন্য নিজের জীবনের সব কিছুকে আর্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের জান মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মরে এবং মারে।
সূরা-আত তওবা-১১১
ইসলামী সংগঠন
মানুষের সমাজের সকল স্তরে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কাজটি কখনও একা করা সম্ভব নয়। এ কাজ করার জন্য অন্যকে সাথে নিতে হবে। নবী-রাসূলগণও আল্লাহর দ্বীনের এই কাজের প্রচার ও প্রসারের জন্য সমাজ থেকেই লোক বেছে নিয়েছেন। আস্তে আস্তে নবী-রাসূলদেরকে দিয়েগড়ে উঠেছে মুমীনদের এক দল-একটি জামায়াত। তাই জামায়াত বা সংগঠন ছাড়া আল্লাহর দ্বীনের এই কাজ ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বা ইসলামী আন্দেলন সম্ভব নয়। ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্যে যেমন আন্দোলন বা জিহাদের প্রয়োজন তেমন আন্দোলন বা জিহাদ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি মজবুত সংগঠন বা দল। আর এই সংগঠনকে অবশ্যই হতে হবে ইসলামের বিশ্বাস, শিক্ষা, আদর্শ, মূলনীতি অনুযায়ী। এই সংগঠন হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে।
ইসলামী জামায়াতের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী জামায়াতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
১। ইসলামী জামায়াতের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি হবে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক।
২। ইসলামী জামায়াতের নেতা ও কর্মী সকলেই হবেন কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী। আদেশ দেয়া, আদেশ পালন, সমালোচনা করা, সমালোচনা গ্রহণ, পরামর্শ গ্রহণ সকল ক্ষেত্রে নেতা ও কর্মী সকলেই মেনে নিবেন কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথ।
৩। ইসলামী জামায়াতের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মপন্থা একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলের (স) নির্দেশ অনুযায়ী হবে।
৪। ইসলামী জামায়াত ইসলামকে বিঝয় করার আন্দোলন কিন্তু তা কোন অন্যায় পথে নয়। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে, সততা ও বিশ্বস্ততার পথে ইসলামী বিপ্লবের কাজ পরিচালনা করে ইসলামী জামায়াত। রাতারাতি বিপ্লবের জন্য কোন চোরাগুপ্ত পথ খুঁজে না ইসলামী জামায়াত।
৫। ইসলামী জামায়াত তার প্রচার কাজ করে সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে। কোন বিশেষ শ্রেণী, সম্পদ্রায়, এলাকা, বর্ণ, গোত্র বা ভাষার লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ইসলামী সংগঠনের কাজ।
৬। ইসলামী জামায়াত মানুষকে জানায় আল্লাহর পথে। আর দাওয়াত মানুষের কাছে পেশ করা হয় সুন্দরভাবে। কোন তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কিংবা ফেতনা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়া ইসলামী জামায়াতের কাজ নয়।
৭। ইসলামী জামায়াত ইসলামের কোন এক বিশেষ দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। ইসলামী জামায়াত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ইসলামের প্রচার করে। কালেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত থেকে শুরু করে ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক মোটকথা ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপ তুলে ধরা সকলের সামনে।
৮। ইসলামী জামায়াত ইসরামকে প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের সৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। আল্লাহর দ্বীনকে এই যুগে প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের বিপ্লবী, যোগ্য, সৎ ও ঈমানদার লোকের প্রয়োজন তা একদিনে তৈরী হয় না। বিপ্লবী এই কর্মী বাহিনী তিলে তিলে গড়ে উঠে ইসলামী জামায়াতের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে। তাই ইসলামী জামায়াতে অবশ্যই থাকতে হবে ব্যক্তি গঠনের এক বাস্তব ও কার্যকর কর্মসূচী।
৯। ইসলামী জামায়াত কাজ করে এমন একটি সমাজে যেখানে ইসলাম পুরোপুরি ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য তাই ইসলামী জামায়াত গ্রহণ করে সমাজসেবা এবং সমাজ সংস্কারের কাজ। সমাজের জামায়াত তুলে সোচ্চার আওয়াজ। আর সেই সাথে নিজের সীমাবদ্ধ পরিসরে গড়ে তোলে ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, ভালবাসার ভিত্তিতে ন্যায়, ইনসাফপূর্ণ এক রুচিশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
১০। ইসলামী জামায়াত ব্যাপক অর্থে সারা বিশ্বের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে কিন্তু এর প্রাথমিক কাজের ক্ষেত্রে হচ্ছে জামায়াতে অংশগ্রহণকারীদের জন্মস্থান-নিজ দেশ।
১১। ইসলামী জামায়াত নিজ জন্মস্থানে-নিজ দেশে কায়েম করতে চায় ইসামী শাসন ব্যবস্থা। তাই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামী জামায়াত থাকে সজাগ এবং সতর্ক। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসে ইসলামী জামায়াত। তেমনি সমাজের সকল ক্ষেত্রে অসৎ, দুর্নীতিবাজ লোকদের সরিয়ে সৎ ও খোদাভীরু লোকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক আপোষহীন আন্দোলন পরিচালনা করে ইসলামী জামায়াত।
ইসলামী জামায়াতঃ মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসা
আজ সারা বিশ্বের মানুষ শান্তির সন্ধানে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। দুর্ভাগ্য মুসলিম দেশগুলোতেও নেই ইসলাম আদর্শের সঠিক বাস্তবায়ন। দেশে দেশে মুসলমানদের মধ্যে যতটুকু ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শ বেঁচে আছে তাও ধ্বংস করার জন্য কাজ করছে মুসলমান সামজের ভিতরে কিছু দল ও গোষ্ঠী। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আজ বিভ্রান্ত। যারা মুসলমান দেশ ও জাতির ক্ষমতার আসনে বসে আছেন তারা নিজেরা যেমন পাশ্চাত্যের চমকে ভুলে গেছেন ইসলামের আসল রূপ তেমনি বিভ্রান্ত করছেন জনগণকে ইসলামের সুমহান আদর্শ থেকে।
কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী এমনি অবস্থাতেও প্রতিটি মুসলিম দেশে দানা বেঁধে উঠছে ইসলামী আন্দোলন। শুধু মুসলিম দেশ নয় যে সব দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানেও মুসলমানরা গড়ে তুলছে ইসলামী সংগঠন। মুসলমান যুবকদের মধ্যে এসেছে চেতনা।
ইসলামে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেশে দেশে মুসলিম যুবকরা গড়ে তুলছে ইসলামী জামায়াত। পরিচালনা করছে ইসলামী আন্দোলন সাহসের সাথে। মোকাবিলা করছে ইসলাম বিরোধী শক্তির। বরণ করছে জুলুম, নির্যাতন। শিকার হচ্ছে নানান মিথ্যা অপপ্রচার এবং নিন্দাবাদের। নৈতিক ভাবে হেরে যাওয়া আদর্শচ্যুত হায়নাদরে শিকার হচ্ছে সেসব মর্দেমুমীন মুসলিম যুবকরা। আর তারই পরিণতিতে কাতারে কাতারে যুবক বিলিয়ে দিচ্ছে নিজের অমূল্য জীবন আল্লাহর পথে –শাহাদাতের পথে। তাদের শাহাদাতের রক্ত রাঙ্গা পথে আবার দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর দ্বীন। উড়বে আবার ন্যায়, নীতি, সাম্য, হক ও ইনসাফের পতাকা। শাহাদাতের রক্ত রাঙ্গা এই সব ইসলামী সংগঠন আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের আশা-মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসাস্থল।
#########০০০০০০০০০############
', 'মোদের চলার পথ ইসলাম', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a5-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae', '', '', '2019-10-24 12:20:14', '2019-10-24 06:20:14', '
মোদের চলার পথ ইসলাম
মাসুদ আলী
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
তাদের হাতে যারা ইসলামকে ভালবেসেছো আর গ্রহণ করেছো জীবনের চলার পথ হিসেবে ইসলামকে
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে
আমাদের কথা
যে কোন মানুষকেই প্রশ্ন করা হয় –যুদ্ধ চান নাকি শান্তি তিনি অবশ্যই বলবেন শান্তি। অথচ পৃথিবীতে আজ শান্তির বড় অভাব, সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অশান্তি, হানাহানি ও অস্থিরতা।
মানুষের মনগড়া মতবাদই এই সব অশান্তির একমাত্র কারণ। শুধুমাত্র পৃথিবীতে শান্তি, শৃংখলা, ভালবাসা ও সুখ ফিরিয়ে আনতে পারে ইসলাম। আল্লাহর দেয়া ও রাসূলের (সঃ) দেখানো পথ ইসলাম। ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কেই ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট ও সুন্দর। ইসলাম সহজ, সরল, সকলের অনুসরণ করার মত, বিজ্ঞানসম্মত ও সব সময়ই আধুনিক। যা ইসলাম তা’ই বিজ্ঞান, তা’ই আধুনিক। কিন্তু এই সহজ ও সুন্দর ইসলামকে না জানা না বুঝার কারণেই অনেকে ইসরামের নাম শুনলে ভয় পায়। দেশের ভবিষ্যত নাগরিক শিশু-কিশোরদের কাছে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপটি সহজ ও সুন্দরভাবে তুলে ধরার তীব্র প্রয়োজনীয়তা বহুদিন ধরে অনুভব করা হচ্ছিলো। “মোদের চলার পথ ইসলাম” বইটি প্রকাশের মাধ্যমে অনেকদিক পর সে চাহিদা সামান্য হলেও পূরণ করা গেল বলে আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।
বিশিষ্ট শিশু-কিশোর সাহিত্যিক জনাব মাসুদ আলী তাঁর সুপরিচিত সহজ ভাষা ও সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে বইটি লিখে নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের অভাব পূরণ করেছেন। আশা করি বইটি শিশু-কিশোরদের কাছে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে সহায়ক হবে।
বইটিকে আরো সুন্দর করার ব্যাপারে যে কোন পরামর্শ আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।
লেখকের কথা
চঞ্চল তরুণ মনের সবটুকুই রোমাণ্টিক নয়। শরতের হিমেল বাতাস আর বসন্তের ফুলের সুবাস তার মনকে যতটুকু চঞ্চল করে তার চেয়ে বেশী চঞ্চল হয় তার মন সমাজের কুটিলতা, হানাহানি, জুলুম ও নির্যাতন দেখে। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির প্রতি পলে পলে অন্যায় ক্লেদ, হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা, কথা ও কাজের গরমিল আজকে তরুণ সমাজকে তাই করেছে বিদ্রোহী, তার চরাকে করেছে উদ্দাম।
তারুণ্যে উজ্জীবিত দিশেহারা মন কোন আদর্শের পরিচয় না পেয়ে হয়ে উঠেছে আগ্নেয়গিরির মত ধ্বংসকামী, এইতো স্বাভাবিক।
অথচ তারুণ্যের এই উদ্দামকে, তার কোমল হৃদয়ে সুপ্ত ভালবাসাকে, তার প্রতিভাকে, যোগ্যতাকে, দেশ ও দশের কাজে মোটকথা মানবতার উপকারে লাগাতে হলে তরুণদের সামনে তুলে ধরতে হবে এক সুন্দর আদর্শ –যে আদর্শ তরুণ মনে হাজারো প্রশ্নের উত্তর যোগাবে, যে আদর্শ তাকে নিজকে চিনতে শেখাবে, যে আদর্শ তাকে দিবে পথের দিশা।
আজ তাই তরুণ সমাজের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শ তুলে ধরার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। “মোদের চলার পথ ইসলাম” তরুণদের কাছে ইসলামের বিপ্লবী আওয়াজ তুলে ধরার এমনি একটি প্রয়াস। এই পুস্তক যদি আমাদের তরুণদের মনে ইসলামকে বুঝা, তাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা এবং জীবনের সকল দিকে বাস্তবায়নের প্রেরণা যোগায় তবেই আমাদের এই প্রচেষ্টা সফল হবে। আল্লাহ আমাদের এই উদ্যোগ কবুল করুন। আমীন।
প্রথম অধ্যায়
ইসলামী আদর্শ
ও তার বৈশিষ্ট্য
ইসলাম শান্তির ধর্ম
ইসলাম স্বভাব ধর্ম
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
ইসলাম সকলের জন্য
ইসলাম আল্লাহর দেখানো পথ
সহজ সরল পথঃ ইসলাম
ইসলামী আদর্শ ও তার বৈশিষ্ট্য
দুনিয়ার মানুষকে তার প্রভু আল্লাহ যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন তার নাম ‘ইসলাম’। ইসলাম আমাদেরকে জানায় এ জীবনের উদ্দেশ্য কি, মানুষের জীবনের পরিণতি কি, এ দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা কতটুকু, দুনিয়ায় কি কাজ করতে হবে, কি কি কাজ আমাদের জন্য ক্ষতিকর, মানুষের জীবনের সফলতা কোন পথে। মোটকথা, আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দেয় ইসলাম। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন পরিচালনার জন্য সবচেয়ে সুন্দর উপায় বাতলে দেয় ইসলাম।
ইসলাম মানুষকে আল্লাহর দেখানো পথে পরিচালিত করে। ইসলামের শাব্দিক অর্থ হলো আত্মসমর্পণ অর্থাৎ নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। এর অর্থ আল্লাহর হুকুমকে মেনে নেওয়া, আল্লাহর হুকুম মেনে চললে মানুষের জীবনে নেমে আসে অনাবিল শান্তি। এ অর্থে ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম।
ইসলাম শান্তির ধর্ম
আমাদের চারিদিকে –চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, নদী, গাছপালা, পশু-পাখি সবকিছু এক সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে –মেনে চলছে আল্লাহর বিধান। তাই তাদের মধ্যে কোন অশান্তি দেখিনা-দেখিনা কোন গড়মিল। প্রতিদিনের শুরুতে ঠিক পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠে এবং দিন শেষে ঠিক পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। আসে রাত। চাঁদ উঠে আকাশে, তারারা হাসে রাতের আকাশে। আবার রাত কেটে যায়। ফুলেরা হাসে। বসন্তে গাছে গাছে সবুজ পাতার বাহার –এমনিভাবে প্রকৃতির সব কিছু এক সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে। কেউ এ নিয়ম ভাঙ্গতে পারেনা। সকলেই আল্লাহর নিয়ম মানছে। সকলেই আল্লাহর নিয়ম মানতে বাধ্য।
কিন্তু মানুষের ব্যাপারটি একটু আলাদা। আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন জ্ঞান, দিয়েছেন ভাল ও মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন রাসূল ও কিতাব। এতো কিছুর পরেও আল্লাহ মানুষকে তাঁর আইন মানতে বাধ্য করে না। তাঁর আইন মানা না মানা পুরোটাই মানুষের ইচ্ছা। আর এভাবেই তিনি আমাদের পরীক্ষা করতে চান।
প্রকৃতির সকলেই মেনে চলছে আল্লাহর আইন। তাই প্রকৃতিতে বিরাজ করছে শান্তি ও শৃঙ্খলা। তেমনি আমরা যদি নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে আমাদের কাছে যে পথের দিশা এসেছে তা মেনে চলি তাহলে আমাদের জীবনেও আসবে শান্তি ও সমৃদ্ধি। জীবনে এই শান্তি পেতে হলে আল্লাহর হুকুম ও আদেশ-নিষেধকে স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে। সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে আল্লাহর কাছে। আর তখনই আমাদের জীবনে নেমে আসবে শান্তি। আল্লাহর কাছে সসবকিছু সঁপে দেওয়ার নামই ‘ইসলাম’।
ইসলাম শুধু ব্যক্তির জীবনেও এই শান্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ইসলাম’ শিক্ষা দেয় –এসো সকলে মিলে সত্যের জন্য কাজ করি এবং অন্যায়কে নির্মূল করি।
দুনিয়য় মানুষের জীবনটা কয়দিনেরইবা। প্রত্যেক মানুষকে মরতে হবে। মৃত্যুর পর যে জীবন সে জীবনে মুক্তি ও শান্তির জন্য জীবনে আল্লাহর আইন মেনে চলতে হয়। এভাবে ইসলাম মানুষকে শুধু দুনিয়ায় নয় –দুনিয়ার পর যে অনন্ত জীবন আছে সেখানেও পথ দেখায়। কোরআন আমাদের তাই চাইতে শিখালো-
হে আমাদের রব, আমাদেরকে মঙ্গল দাও এই দুনিয়ায়, মঙ্গল দাও আখেরাতে এবং দোজখের আগুনের আজাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও।
সূরা বাকারা-২০১
ইসলাম স্বভাব ধর্ম
মানুষের স্বভাবটাই এমন যে সে সব সময় ভালকে পছন্দ করে, মন্দকে ঘৃণা করে। সত্য কথা বলা এ গুণটা সকলেরই পছন্দ, আবা মিথ্যা কথা বলা সকলের অপছন্দ। এমনি একজন মিথ্যাবাদী সে নিজেও চায় না সবাই তাকে মিথ্যুক বলুক। এইভাবে অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের কষ্টের সময় তার পাশে দাঁড়ানো, পিতা-মাতার প্রতি ভাল ব্যবহার, বিনয়, সততা এসব সৎগুণ সব সময়ই মানব সমাজে প্রশংসিত। অন্যদিকে অন্যেল মনে কষ্ট দেওয়া, রুক্ষতা, পিতা-মাতার সাথে খারাপ ব্যবহার, হঠকারিতাকে সব সময় সকলে ঘৃণা করে। তাই আমরা বলতে পারি সত্যকে পছন্দ করা এবং মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের স্বভাব। কোরআনের ভাষায় সত্য হলো ‘মারুফ’ এবং মিথ্যা হলো ‘মুনকার’। ইসলাম ‘মারুফ’ প্রতিষ্ঠা করা ও ‘মুনকারকে উৎখান করার শিক্ষা দেয়। তাই আমরা বলতে পারি ইসলাম হলো মানুষের স্বভাব ধর্ম।
মানুষের শরীরটার দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? দেখি তার মাতা, শিরা-উপশিরা, পেশিগুলো, হাত-পা, নাক, নাক, মোটকথা তার পুরো দেহটাই তাদের নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহ যাকে যা করার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং যেভাবে তা করতে বলেছেন, সে সেইভাবে তা করে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে মানুষের দেহটা আল্লাহর হুকুম মেনে যাচ্ছে। তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অণু-পরমাণু আল্লাহর দেওয়া আইনের অনুসারী। হাত, পা, মুখ, মোটকথা তার পুরো দেহটা স্বভাবের দিক থেকে আল্লাহর আইনের অধীন। অর্থাৎ বলা যেতে পারে স্বভাব প্রকৃতির দিক থেকে তার দেহটা ‘মুসলমান’।
এখন যদি কেউ স্রষ্টাকে চিনে, তাঁকেই একমাত্র মনিব হিসাবে মেনে নেয় মোট কথা ইসলামকে মেনে চলে তাহলে বলা যায় সে স্বভাবের মূল দাবীই পুরণ করলো। তাই স্বেচ্ছায় ইসলাম মেনে নেওয়া মানুষের স্বভাব ধর্ম। আর ইসলামকে অস্বীকার করা নিজের স্বভাব ধর্মকে অস্বীকার করা।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
এই দুনিয়ায় মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। ইসলাম সব কাজই কিভাবে আল্লহর নির্দেশ অনুযায়ী করতে হবে তা বলে দেয়। জীবনের এমন কোন দিক নেই যেদিকে আল্লাহর নির্দেশ কি তা জানা যায়নি। এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে ইসলাম পথ নির্দেশ দেয়নি।
ব্যক্তি জীবনের, সমাজ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে ইসলাম মানুষকে পথ দেখায়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কি করতে হবে তা কোরআন যেমন বলে দিয়েছে তেমনি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে বাস্তবে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
তাই ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। অন্যান্য মতবাদে আমরা দেখি জীবনের বিশেষ কোন একটি দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক ধর্ম শুধু ব্যক্তির আত্মাকে সুন্দর করার কথা বলে। অনেক মতবাদ ‘অর্থ’কে বড় করে দেখে। কেউ আবার ভুল হোক সঠিক হোক নিজের ‘কওম’ টাকে বড় করে দেখাতে শেখায়। এসব মতবাদ হলো জীবনটাকে খণ্ড খণ্ড করে দেখার ফল। মানুষের পুরো ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য এসব মতবাদ কোন সঠিক পথের দিশা দিতে পারেনা।
ইসলাম মানুষের জীবনটাকে এভাবে খণ্ড খণ্ড করে দেখেনা। ইসলাম মানুষের স্বভাবকে অস্বীকার করেনা।
দেখ কুরআন কি বলছে-
আর খাও এবং পান করো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেও না।
সূরা আরাফ-৩১
হে নবী! বল আল্লাহর সে সকল সোন্দর্য ও অলংকার কে হারাম করেছে, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য হালাল করেছেন এবং খোদার দেয়া পাক জিনিসগুলোকে (খাওয়া ও ব্যবহারের জন্য) কে তা নিষিদ্ধ করেছে?
সূরা আল আ’রাফ-৩২
ওদিকে ইসলাম মানুষকে একেবারে স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দেয়নি। তার লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিয়ম-কানুনও বলে দিয়েছে। তোমার লোভ-লালসা ও জুলুমে অন্যের ক্ষতি হবে এটা ইসলাম কখনও বরদাশত করেনা। মোটকথা, ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেনা তেমনি সমষ্টিকেও বঞ্চিত করেনা। দুয়ের মাঝে এক সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করার পথ বাতলে দেয়। তাই ইসলামকে মানতে হলে পুরোপুরিভাবেই মানতে হয়। পবিত্র কোরআন বলেঃ
তোমরা পুরোপুরিভাবে ইসলামে দাখিল হয়ে যাও।
সূরা বাকারা-২০৮
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে মেনে চল।
ইসলাম সকলের জন্য
ইসলামের শিক্ষা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য। ইসলাম বিশেষ কোন দেশ, জাতি বা বর্ণের জন্য নয়। ইসলাম হচ্ছে বিশেষ কতকগুলো গুণের নাম। যার মাঝেই সেই গুণের পরিচয় পাওয়া যায় সেই মুসলমান। সে যে কোনভাষা, যে কোন জাতি বা যে কোন বর্ণের হতে পারে।
ইসলাম যাকে সারা বিশ্বের প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করে সেই ‘আল্লাহ’ দুনিয়ার সকল মানুষের আল্লাহ। ইসলামের ‘নবী’ দুনিয়ার সকল মানুষের নবী।
এই দুনিয়ায় অনাচারের মূলে আছে মানুষে মানুষে বিভেদ। এক দেশের লোক অন্য দেশের লোকের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের লোকের কোন অধিকারই স্বীকার করতে চায় না। তাই যে আইন তারা মানে তা স্বাভাবিকভাবেই এক তরফা। নিজের জন্য যা ঠিক তা অন্যের জন্য ঠিক নাও হতে পারে। নিজেদের জন্য যা সত্য, অন্যের জন্য মিথ্য। একই অপরাধের ফলে নিজ জাতির লোকের জন্য এক ধরনের বিচার-আচার, অন্য জাতির লোকদের জন্য অন্য ধরনের বিচার। ইসলাম মানুষে মানুষে এই বিভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। ইসলামের চোখে সবাই সমান। ইসলাম মানবতাকে এক পতাকা তলে আনতে চায়। তাই হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত এই পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র আশার আলো।
ইসলাম আল্লাহর দেখানো পথ –মানুষের তৈরী মতবাদ নয়
ইসলমা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো একটি আদর্শ। মানুষের মত মগজের তৈরী কিংবা সাধনার ফলে পাওয়া কোন মতবাদ নয়। এ কারণেই ইসলাম একটি স্বতন্ত্র মতবাদ।
পৃথিবীর কোন মানুষই মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয়। মানুষ বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যতে কি ঘটবে সে তা জানেনা। নিজের পরিবেশের বাইরের খবরও তার জানা নেই। এ অবস্থায় মানুষ আন্তরিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করলেও তার চিন্তা-ভাবনার ফসল সীমাবদ্ধই হবে।
মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সাময়িক একটা সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু মানুষের সকল সমস্যার প্রকৃত ও সঠিক সমাধান দিতে পারেনা। এদিক থেকে ইসলামের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহ নিজেই এই মতবাদ নাজিল করেছেন। সেই আল্লাহ যিনি সমস্ত বিশ্বের মালিক, পালনকর্তা এবং রক্ষাকারী।
ইসলাম আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো বলেই এর মৌলিক বিশ্বাস ও ভিত্তিগুরো ধ্রুব সত্য। সকল মানুষ মিলে এমনকি দুনিয়ার সকল মুসলমানরা একত্র হয়েও এর সামান্য পরিবর্তন আনতে পারবেনা।
অবশ্য সব ধর্মই দাবী করে যে তা আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো ধর্ম। কিন্তু এটি ইতিসাহ থেকে প্রমাণিত যে, ইসলাম ছাড়া আর অন্য সব ধর্মই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।
অন্যান্য সব ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মের শিক্ষার মধ্যে পরিবর্তন এনেছে এবং সেই সাথে নিজেদের মতামত ও নতুন নতুন কথা যোগ করেছে। একথা তারা নিজেরাই স্বীকার করে। অন্যদিকে ইসলামের শিক্ষার মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন পরিবর্তন আসেনি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে যে কোরআন এসেছিল আজ চৌদ্দশত বছর পার হওয়ার পরও তা তেমনিই আছে এবং ভবিষ্যতে একই রকম থাকবে। এর মধ্যে একটি অক্ষর যোগ করাও হয়নি। এবং একটি অক্ষর বাদ দেয়াও হয়নি।
সহজ সরল পথঃ ইসলাম
ইসলামে কোন রূপকথার স্থান নেই। নেই কোন কুসংস্কার কিংবা যুক্তিহীন কথা। ইসলাম বিশ্বাস করতে বলে আল্লাহকে, রাসূল (সাঃ) কে ও আখেরাতকে, এসব কিছু কোন যুক্তিহীন কথা নয়। এর পিছনে আছে সুন্দর ও বলিষ্ঠ যুক্তি।
ইসলামের প্রতিটি শিক্ষা সহজ ও সরল। ইসলাম মেনে চলতে কোন জটিলতা নেই। ইসলাম মেনে চলতে গুরু, পাদ্রী কিংবা কোন সাধুকে ধরতে হয়না। প্রতিটি মানুষ সরাসরি কোরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং কোরআনের আলোকে জীবন চালাতে পারে। ইসলাম মানুষকে যুক্তিবাদী করে। তার মধ্যে সৃষ্টি করে জানার আগ্রহ।
তার নজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করে। বাস্তবতার দৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে শিখায়। তাইতো মুসলমানদের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান পেলো উৎকর্ষতা। তাই কোরআনের দোয়া হলো-
হে প্রভু, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও
সূরা ত্বোয়া-হা-১১৪
কোরআন বলে,
“যার জ্ঞান নেই এবং যার জ্ঞান আছে তারা দুজন এক সমান হতে পারেনা”।
সূরা যুমার-৯
আল্লাহর নবী ও বিশ্বের পথ প্রদর্শক বলেন-
জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর এবং নারীর উপর ফরজ। -ইবনু মাজাহ
দ্বিতীয় অধ্যায়
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হবে
তাওহীদ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলযন্ত্র
শিরকের তাৎপর্য
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদের বিশ্বাসের সুফল
রেসালাত
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী ও তাৎপর্য
অন্যান্য নবী ও মুহাম্মদ (স) এর মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
কিতাবের উপর ঈমান
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
মৃত্যুর পর জীবন
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকাল বিশ্বাসে উপকার
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
দুনিয়ায়চলতে হলে জানতে হয় অনেক কিছু। জানতে হবে আমরা কারা? আমরা মানুষ, আমাদের জীবনের কি কোন উদ্দেশ্য আছে? না কি, অন্যান্য জীব-জন্তুর মত আমাদের জীবন? কে আমাদের সৃষ্টি করলো? কে সৃষ্টি করলো এত বড় বিশ্বটাকে? কে পাঠালো আমাদের এই পৃথিবীতে? কেন পাঠালো? পাঠালোইযখন তখন আমরা কিভাবে চলবো? কোন পথে চললে পাবো শান্তি এবং মুক্তি? সে পথ কি আমরা নিজেরা আবিস্কার করে নেব? নাকি কেউ আমাদের বাতলিয়ে দেবে? সব মানুষই মরে যায়, কিন্তু মরণের পরে কি সব শেষ হয়ে যায়? এমন হাজারও প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হবে আমাদেরকে।
‘সঠিক’ উত্তর কেন? কেননা এসব কিছুর সঠিক উত্তরের উপরই নির্ভর করে মানুষ কিভাবে চলবে এই দুনিয়ায়। মনে করো একজন বিশ্বাস করে মানুষ অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মত নয়, বরং সে সব সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর অন্য একজন বিশ্বাস করে মানুষ আদতে অন্যান্য জীব-জানোয়ারের মতই। খাও, দাও –এই তার কাজ। এখন স্বাভাবিকভাবেই এই দু’জনের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র আলাদা হবে, তাইনা?
এই দু’জনের চলার পথ এক হতে পারেনা। তাই আমরা বলতে পারি জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে মানুষের চলার পথ এবং পন্থা। জীবন সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাস যার সঠিক হবে সেই পাবে সঠিক পথ। আর যার বিশ্বাস হবে ভুল, তার জীবনের পথও হবে ভুল।
ইসলাম হলো আল্লাহর শেখানো পথ। ইসলাম জীবন সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয়। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আল্লাহর গুণরাজি, আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের দেয় সঠিক সম্পর্ক। কিভাবে মানুষ পাবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম, কিভাবে জানতে হবে সেসব আইন-কানুন। আল্লাহর আইন-কানুন মানলে আমাদের কি কি উপকার হবে, আর না মানলে আমাদের কি অপকার হবে।
আরও একটা জিনিস আমাদের ভাল করে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের দেওয়া এসজ জ্ঞান শুধু জানলেই হবে না; এর উপর থাকতে হবে পুরোপুরি বিশ্বাস। জেনে বুঝে সেই মতো আমল করতে হবে। জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানা এবং তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘ঈমান’। সহজ ভাষায় ঈমানের অর্থ হলো, ‘জানা এবং মেনে নেয়া’। মানুষ, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি, জীবনের সফলতা কিসে, মানুষের করণীয় কাজ কি কি –এসব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার জন্য মুসলমানদেরকে দেয় জীবন সম্পর্কে সঠিক, স্বচ্ছ ও সুন্দর ধারণা। তাই ঈমানকে বলতে পারি জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান থাকতে হবে
যে যে বিষয়ের উপর মুসলমানগণ দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যয় ঘোষণা করে তা সুন্দরভাবে নীচে বলা হয়েছে যাকে আমরা বলি “আল-ঈমানুল সুফাসসাল”। যার অর্থ হলোঃ
আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলকগণকে, কিয়ামতের দিনকে, অদৃষ্টের ভালমন্দের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর।
এখানে সাতটি জিনিসের উপর বিশ্বাস আনার কথা বলা হয়েছেঃ
১। আল্লাহ
২। ফেরেশতাসমূহ (মালাকাহ)
৩। কিতাবসমূহ (কুতুবুল্লাহ)
৪। রাসূলগণ (রাসূলুল্লাহ)
৫। বিচার দিবস (ইয়াওমুদ্দিন)
৬। অদৃষ্ট (আল কদর)
৭। মৃত্যুর পর জীবন (আখেরাত)
তাওহীদ
তাওহীদ অর্থ আল্লাহর একত্ব। তাওহীদ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিশ্বাস। এর তাৎপর্য হলো এ বিশ্বের প্রতিটি জিনিস এক এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তিনি আল্লাহ। এই বিশ্বের তিনিই রক্ষণাবেক্ষণকারী –প্রতিপালক। তিনিই একমাত্র এই বিশ্বের পরিচালক।
তাওহীদ হলো আল্লাহকে তাঁর ক্ষমতা ও সকল গুণসহ বিশ্বাস করা। তিনি মেহেরবান। তিনি সকল অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদেরকে দেখেন কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাইনা। তিনি অতীতে ছিলেন, এখনও আছেন এবং অনন্তকাল ধরে থাকবেন –তিনি শাশ্বত। তিনি আদি, তিনি অন্ত। তাঁর কোন অংশীদার নেই, কোন শরীক নেই, কোন সন্তান-সন্ততি নেই। তিনিই আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন এবং মৃত্যুর পর আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহর প্রকৃত পরিবয় বা সত্তা (যাত), তাঁর গুণাবলী (সিফাত), তাঁর অধিকার (হুকুম) এবং তাঁর ক্ষমতা (ইখতিয়ার) সহ তাঁকে বিশ্বাস করা এবং এ ব্যাপারে কাউকে অংশীদার না বানানোই হচ্ছে তাওহীদ।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলমন্ত্র
তাওহীদ হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সুন্দরভাবে উচ্চারিত হয়েছে কালেমা শাহাদাতে। কালেমা শাহাদাতে ঘোষণা দিতে হয়ঃ
আশহাদু আল্ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়া দাহু লাশারিকা লাহু,
ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।
এই কালেমার অর্থ বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই ইলাহ ও আল্লাহ শব্দ দুটোর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে হবে।
ইলাহ শব্দের অর্থ মাবুদ বা হুকুমকর্তা-মনিব। মোটকথা যিনি এবাদতের যোগ্য। আমাদের ইবাদত ও বন্দেগীর কে যোগ্য হতে পারেন? তিনিইতো আমাদের এবাদতের যোগ্য যিনি শ্রেষ্টত্ব, গৌরব ও মহত্বে সকলের চেয়ে বড়। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী, যাঁর শক্তি সম্পর্কে মানুষ ধারণা করতে পারেনা।
ইলাহ শব্দের অর্থ এও যে তিনি নিজে কারও মুখাপেক্ষী হবেন না। বরং সকলেই তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইবে।
আমরা কার ইবাদত করব? আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব যিনি আমাদেরকে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আল্লাহ হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্তার মৌলিক নাম। মূল সত্তার পরিচায়ক নাম। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর মাধ্যমে তাই দু’টো ঘোষণা দেওয়া হলো। একটি ‘অস্বীকার’ করার, অন্যটি ‘স্বীকার’ করার ঘোষণা। ‘লা ইলাহা’ হলো অস্বীকার করা, আর ‘ইল্লাল্লাহু’ হলো স্বীকার করা।
একজন মুমিম ব্যক্তিকে প্রথমে অন্তরে সব ধরনের ‘দেবতা’ বা অন্য কিছুর পূজা করা থেকে পরিস্কার করতে হবে। তারপরই সেখানে এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাসের বীজ বপন করা সম্ভব। জমীনে যেমন বপন করার আগে আগাছা দূর করতে হয়। এও ঠিক তেমনি ধরনের। তাহলে বুঝতে হবে, যে হৃদয়ে ‘তাওহীদের’ চাষ হয়নি সে হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারুর পূজা এবং এবাদতের আগাছা আপনা থেকেই বেড়ে উঠেছে।
শিরকের তাৎপর্য
তাই আমাদের জানতে হবে মানুষের মধ্যে কেন আল্লাহ ছাড়া আর কোন ‘খোদা’, ‘দেবতা’ কে পূজা বা ইবাদত করার ঝোঁক দেখা দেয়।
খুব গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানুষ জন্ম থেকেই করানো না কারো গোলাম হয়েই জন্মগ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই সে দুর্বল, দুঃস্থ এবং পরমুখাপেক্ষী। বেঁচে থাকার জন্য তার এমন সব জিনিসের কখনও তার হাতে সে নিজের শক্তি দিয়ে পেতে পারেনা। এসব জিনিস কখনও তার হাতে আসে আবার কখনও আসেনা। আর এমনও জিনিস আছে যা তার জন্য ক্ষতিকর। তার সারা জীবনের পরিশ্রম নষ্ট করে দেয়। হাজার ইচ্ছা থাকলেও সে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেনা।
এমনিভাবে মানুষ নিজেকে বড় অসহায় মনে করে। এই অসহায় মানুষ তখন নিজকে অন্য কারোও গোলাম বা অধিনস্ত ভাবতে শুরু করে। সে ভাবতে শুরু করে আমি যা চাই তা আমি পেতে পারিনা। আমাকে অন্য কেউ তা দিবে। অন্য কোন সত্তা আমাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে। বাঁচাবে রোগ-শোক, দুঃখ ও ক্ষতি থেকে। অন্যের কাছে চাওয়া, অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া, অন্য সত্তার পূজা এবং ইবাদত করাটা মানুষের একটা স্বভাব ধর্ম। এমনিভাবে মানুষের মনে একজন মালিক কিংবা প্রভুর ধারণা জন্ম নেয়।
মানুষ এই চিন্তার ফলেই পাথর, মেঘ, বৃষ্টি, সূর্য, চন্দ্র ও আগুনকে পূজা করেছে। এদের শক্তি ও ক্ষমতা দেখে মানুষ মনে করলো এরাই খোদা। কিন্তু পরর্বীতে মানুষ দেখলো এই সব কিছু আসলে মানুষের কোনই উপকার করতে পারেনা বরং নিজেরাই কোন না কোন বিশেষ বিধানের আনুগত্য করে চলছে। মনে হয় খালি চোখে দেখা যায়না এমন কোন এক অদৃশ্য রহস্যময় শক্তির নিয়মে সব কিছু চলছে। তখন মানুষ পাথর, আলো, বাতাস, পানি ব্যাধি, স্বাস্থ্য এমন সব কিছুর পেছনে এক একটি অদৃশ্য শক্তির কল্পনা করে নিল এবং তাদের পূজা করা শুরু করলো। জন্ম হলো বহু খোদা-বহু দেবতার ধারণা।
আবার কেউ ভাবরো এইসব খোদা বুঝি কোন এক বড় খোদার হুকুম মত চলে। তা না হলে সারা বিশ্বজুড়ে সবকিছু একটি নিয়মে চলছে কেন? তাই বড় খোদাকে খুশী করতে হলে এইসব ছোট ছোট খোদাকে খুশী করতে হবে।
কিন্তু মানুষ যখন জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি লাভ করলো –চিন্তা করলো, ভাবলো তখন এক একটা ছোট ছোট খোদার সংখ্যা কমতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত এক খোদার ধারণাই অবশিষ্ট থাকলো।
কিন্তু সেই এক খোদার ধারণার মধ্যেও গলদ দেখা দিলো। কেউ মনে করলো, এই খোদা আমাদের মত রক্ত মাংস দেহের অধিকারী। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবই আছে। আবার কেউ মনে করলো, খোদা মানুষের রূপ নিয়ে অবতার হয়ে পৃথিবীতে আসে।
কেউ বলে, এই দুনিয়ার সবকিছু চালু করে দিয়ে খোদা বসে আছেন। আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। সুতরাং এই দুনিয়ায় আমরা আমাদের মত চলবো। আমাদের ইচ্ছায় আমরা চলবো। এইবাবে নিজের ইচ্ছা, নিজের মনের বাসনাকেউ কেউ আবার খোদা বানিয়ে নিলো।
কেউ ভাবলো, খোদা, সেতো বিরাট ব্যাপার, আমরা তাঁর কাছে কিভাবে পৌঁছাবো? কিভাবে আমাদের মনের কথা পৌঁছাবো? তাই আমাদের মধ্যে কোন এক বুজুর্গ লোক খুঁজে বের করে তাঁরই সুপারিশ নিয়ে খোদার কাছে যেতে হবে। খোদাকে পেতে হলে আরও একজনকে সুপারিশকারী ধরে প্রকৃতপক্ষে আরও একজন খোদার জন্ম দিলো মানুষ। এমনিভাবে মানুষ অজ্ঞতার বশে নিজের মনের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া হাজারো খোদার জন্ম দেয়। একেই বলে ‘শিরক’ করা।
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদ বিশ্বাসের তাৎপর্য হলো এমনি সব ভ্রান্ত খোদার গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে এক ও একক আল্লাহর বিশ্বাসকে মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সেই আল্লাহকে যে আল্লাহর কোন শরীক নেই। যে আল্লাহর কোন অংশীদার নেই। যে আল্লাহর কোন সন্তান নেই। যে খোদা কারও মুখাপেক্ষী নন এবং স্বাধীন, সর্বশক্তিমান। যিনি সব কিছু জানেন, শুনেন এবং দেখেন। যাঁর হুকুম কেউ অমান্য করতে পারেনা। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী। যিনি সকল অভাব, ভুল এবং দুর্বলতা থেকে মুক্ত। যে আল্লাহ তাঁর বান্দার ডাক শুনেন –সরাসরি তার মনের কথা জানেন।
আল্লাহ সম্পর্কে এই সঠিক ধারণাই যুগে যুগে নবীর পয়গাম্বররা মানুষকে দিয়েছেন। সকল জ্ঞানের সেরা এই জ্ঞান।
তাওহীদের এই শিক্ষা সুন্দরভাবে ‘সূরা ইখলাসে’ বলা হয়েছেঃ
বল, তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ সবকিছু থেকে নিরপেক্ষ, মুখাপেক্ষীহীন, সবাই তাঁরই মুখাপেক্ষী, না তাঁর কোন সন্তান আছে, আর না তিনি কারো সন্তান এবং কেউ তাঁর সমতুল্য নয়।
তাওহীদ বিশ্বাসের সুফল
এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাস মানুষের পুরো জীবনটাকে বদলিয়ে দেয়।
ক. তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এইভাবে পুরোপুরিভাবে সে আল্লাহর গোলামে পরিণত হয়। এই জমীন-আসমানের সবকিছু মানুষের জন্যই। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আল্লাহর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলে তাই আর অন্য সব সৃষ্টির উপর মানুষেল নিয়ন্ত্রণ আসবে।
খ. এক আল্লাহতে বিশ্বাস মানুষকে করে আত্মবিশ্বাসী, আত্মসচেতন। মানুষ নিজকে চিনতে পারে। পৃথিবীর শ্রেষ্ট সৃষ্টি হিসেবে নিজকে জানতে পারে। নিজের অভাব পূরণের জন্য সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো মুখাপেক্ষী নয়। এই চেতনা তাকে করে আত্মবিশ্বাসী। একজন গরীব ক্রীতদাস তখন নিজেকে ছোট মনে কেরনা। সে তার নিজের আসল পরিচয় খুঁজে পায়। সে পায় মানুষের মর্যাদা।
গ. সে বিশ্বাস করে তার যা কিছু আছে সব আল্লাহর দেওয়া। তাই তাওহীদে বিশ্বাসী লোক কখনও অহংকারী, দেমাগী হয়না। সে হয় বিনয়ী ও ভদ্র।
ঘ. তাওহীদে বিশ্বাস মানুষকে করে কর্তব্যপরায়ণ। সে জানে তার একমাত্র কাজ হলো আল্লাহর হুকুম মেনে চলা। এই হুকুম মেনে চললে আল্লাহ খুব খুশী হবেন। তাই সে কোন দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনা। করেনা কোন অন্যায় ও পাপ কাজ।
ঙ. তার মন হয় প্রশান্ত ও তৃপ্ত। সে কোন দুশ্চিন্তা করেনা। সে জানে তার যা কিছু প্রয়োজন সবই আল্লাহ দিচ্ছেন। সে জানে তার জন্য আল্লাহ যা কিছু করেন সবই তার ভালর জন্য করেন। সাময়িক বিপদ-আপদ সবই আল্লাহর তরফ থেকে আসে। আল্লাহ যাকে সাহায্য করতে চান তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবেনা। আর আল্লাহ যাকে কিছু দিতে চাননা তাকে কেউ কিছু দিতে পারবেন না। তাই মুমিন মন কখনও হতাশ হয়না। মুমিনের মন কখনও ভাঙ্গেনা। সে আল্লাহতে থাকে তুষ্ট।
চ. তাওহীদ মানুষের মনে সৃষ্টি করে দৃঢ় সংকল্প, উচ্চাকাংখা, অধ্যবসায় ও সবর। সে মৃত্যুকে ভয় পায়না। দুঃখ ও কষ্টে টলেনা। তাই কোনো ভাল কাজ, মহৎ কাজ করতে সে কখনও পিছপা হয়না। মৃত্যুভয়, জুলুম, অত্যাচার তাকে সত্যের পথ থেকে টলাতে পারেনা। ধন-সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততির ভালবাসা কোনটাই তার কাছে স্থান পায়না। একমাত্র আল্লহার রাস্তায় সে হয় বিপ্লবী সাহসী পুরুষ।
ছ. সবচেয়ে বড় কথা একজন মুমিন বিশ্বাস করে, আল্লাহ তার অন্তরের সব কিছু জানেন, সব কিছু দেখেন। এই চিন্তা তাকে আল্লাহর আদেশ মান উৎসাহিত করে। তার দ্বারা কোন পাপ কাজ হয়না। কেউ না দেখলেও তার দ্বারা কোন খেয়ানত হয় না। এমনিভাবে সে হয় আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা। তার বিশ্বাসের সাথে কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রেসালাত
এই দুনিয়ায় চলতে হলে মানুষের অনেক কিছু প্রয়োজন। আল্লাহ মানুষকে চলার জন্য এই দুনিয়ায় সব রকমের উপকরণই দিয়ে দিয়েছেন। তার কোন হিসাব নেই। মানুষের চলার জন্য দিয়েছেন পা, কাজ করার জন্য হাত, শুনবার জন্য কান, দেখবার জন্য চোখ এমন অনেক কিছু। এছাড়া বেঁচে থাকার জন্য দিয়েছেন খাদ্য, পানীয়, বাতাস, তাপ ও আলো। সুন্দর জীবন গড়ার জন্য দিয়েছেন মায়ের আদর, পিতার স্নেহ, অন্যের মনে তার জন্য ভালবাসা।
দুনিয়ায় সব কাজ কারবার যেন ঠিকমত চলে সেজন্য আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থা কি চমৎকার! দেখো, তিনি একেক মানুষের মধ্যে দিলেন একেক যোগ্যতা, একেক গুণ। একেক পারদর্শিতা। কারও মধ্যে থাকে নেতৃত্বের গুণাবলী, কেউবা অসাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার গুণ লাভ করে। কেউবা আল্লাহর দেওয়া প্রতিভায় মানুষের জন্য আবিস্কার করে নতুন নতুন জিনিস। ফলে দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন গুণে পারদর্শী হয়।
কোন সমস্যা হলে তাই আমরা সকলের কাছে না গিয়ে সেইসব বিশেষজ্ঞদের কাছে ছুটে যাই। রোগ হলে যাই ডাক্তারের কাছে। বড় বড় দালান-কোঠা, পুল, রাস্তা তৈরী করতে হলে যাই ইঞ্চিনিয়ারের কাছে। বিজ্ঞানের জটিল সমস্যা দেখা দিলে ছুটে যাই বৈজ্ঞানিকের কাছে মোট কথা, আমাদেরকে কোন এক সমস্যার সমাধান পেতে হলে সেই বিশসে পারদর্শীর কাছে যেতে হবে।
এমনিভাবে দুনিয়ার সব সমস্যারই সমাধানের এক চমৎকার ব্যবস্থাও আল্লাহই করে দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও একটা বিরাট সমস্যা থেকে যায়। জীবনে চলার জন্য প্রয়োজন জীবনের উদ্দেশ্য জানা, আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে জানা, সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ জানা। এসব জানার উপায় কি? মহান দয়ামতয় আল্লাহ সে উপায়ও আমাদের বাতলিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে সঠিক পথ চিনবার জন্য, মানুষকে সঠিক পথে চালানোর জন্য এক চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন।
দুনিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন লোককে যেমন বিভিন্ন যোগ্যতা দিয়ে তিনি পারদর্শী বানিয়েছেন তেমনি আল্লাহকে চিনার উচ্চতম যোগ্যতা দিয়ে মানুষের মাঝে কিছু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সেইসব মনোনীত মানুষকে আল্লাহ সঠিক পথের জ্ঞান দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন খোদার বিধান। আর সে বিধান অনুযায়ী তাঁদের চরিত্রকে গঠন করেছেন এবং অন্যকে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেওয়ার, বুঝিয়ে দেওয়ার এবং বাস্তবে পালন করে দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তাদেরকে দিয়েছেন। এইসব মহান মানুষদেরকে আমরা বলি নবী, রাসূল বা পয়গম্বর।
আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে হেদায়াত দানের এটাই একমাত্র ব্যবস্থা। নবী, রাসূলদের এই ধারাকে ইসলামী পরিভাষায় বলে ‘রেসালাত’। আল্লাহ এবং মানুষের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো এই রেসালাত।
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী এবং তাৎপর্য
সাধারণ মানুষের কাজ হলো সে সত্যিকারের পয়গাম্বরকে চিনে নেবে। বেছে নেবে জীবনে চলার পথের নেতাকে। আল্লাহর নবীকে চিনে নেবার পর তার কাজ হলো সেই নবীর আদর্শের উপর ঈমান আনা, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা, তাঁর দেখানো পথে চলা। কাউকে পয়গাম্বর হিসেবে মেনে নেবে অথচ তাঁর হুকুম মান হবে না, এটা একেবারেই বুদ্ধিহীনেরকাজ। কেননা নবী পয়গাম্বররা যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তাঁদেরকে না মানার অর্থ আল্লাহকে না মানা। তাদের বিরোধিতা করার অর্থ আল্লাহর বিরোধিতা করা।
পয়গাম্বর আমাদের যা বিশ্বাস করতে বলেছেন আমরা তা বিশ্বাস করবো। যা পালন করতে বলেছেন আমরা তা পালন করব। যা নিষেধ করেছেন আমরা তা করবোনা।
নবীর কোন কাজ, কোন কথা বুঝতে না পারলে কিংবা আমাদের বুদ্ধিতে না কুলালেও তা মেনে নিতে হবে। এটই হলো রেসালাতের উপর ঈমানের দাবী। তাই নবী-রাসূলদের শুধু স্বীকার করলেই হবেনা, তাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ মানুষকে নবী –পয়গাম্বরদের মাধ্যমেই হেদায়াত দিয়েছেন। সরল এবং সঠিক সবসময় একটিই হয়। সেই সরল, সঠিক পথের সন্ধান আল্লাহ পয়গাম্বরদের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই নবী, পয়গাম্বরদের পথ ছাড়া আর কোন পথইতো আল্লাহর পথ হতে পারেনা। কোন পথই আল্লাহকে জানার ও পাওয়ার জন্য সরল এবং সঠিক পথ হতে পারেনা। নবীর হুকুম মানার মাধ্যমেই আল্লাহর হুকুম মানা সম্ভব।
নবীদের পরিচয়
নবী-রাসূলরা আমাদের মত মানুষ ছিলেন। তাই তাঁদেরকে অতি মানব ভাবা ঠিক নয়। তাঁদের সম্পর্কে এটাও ধারণা করা ঠিক নয় যে, তাঁরা আল্লাহর পুত্র, কিংবা আল্লাহর অংশীদার (নাউযুবিল্লাহ)। নবী-রাসূলদের আনুগত্য করা অর্থ তাঁদের পূজা করা নয়। আনুগত্য তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর। নবীদের দেখানো পদ্ধতির আনুগত্য করলেই সেটা হবে প্রকৃত আল্লাহর আনুগত্য। নবী ও রাসূল হলো আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম।
আল্লাহ সব যুগে, সব জাতির, সব গোত্রের জন্য নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়ঃ
প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রাসূল রয়েছে।
সূরা ইউনুছ-৪৭
প্রত্যেক জাতির জন্য একজন পথ প্রদর্শক রয়েছে।
সূরা আর-রা’দ-৭
কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের কাছে কোন না কোন সতর্কবাণী আসে নাই।
সূরা ফাতের-২৪
এমনি ভাবে প্রত্যেক যুগেই মানুষকে সরল সঠিক পথ দেখানোর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কি সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে দেখো। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর হাদীস অনুযায়ী নবী-রাসূলদের সংখ্যা একলাখ চব্বিশ হাজার। কিন্তু এদের সকলের নাম জানা যায়নি। পবিত্র কোরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে।
মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে সকল নবী-পয়গাম্বরের উপর ঈমান আনতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ মানুষকে হযরত আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে হেদায়াতের যে ধারা শুরু করেছিলেন হযতর মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর মাধ্যমে তার পূর্ণতা দিয়েছেন।
অন্যান্য নবী ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য
আমরা অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরকে বিশ্বাস করবো ঠিক। কিন্তু আমাদের কয়েকটি বিষয় জেনে নিতে হবে। তা হলো আমাদের প্রিয় নবী শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য পয়গাম্বরদের মধ্যে পার্থক্য কি?
১। পূর্ববর্তী নবীরা বিশেষ যুগে বিশেষ কওমের মধ্যে এসেছিলেন কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে পাঠানো হয়েছে সারা দুনিয়ার জন্য এবং সর্বকালের জন্য।
২। পূর্ববর্তী নবীদের জীবন কাহিনী সঠিকভাবে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাঁদেরকে অনুসরণ করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনী, শিক্ষা, মুখের কথা, কাজ সব কিছু মোটকথা পুরো জীবনী সঠিকভাবে আমাদের কাছে আছে। তাই পয়গাম্বর হিসেবে একমাত্র তাঁরই অনুসরণ সম্ভব।
৩। পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা ছিলো তাঁদের যুগের জন্য। প্রত্যেক নবী এসে তাঁর পূর্ববর্তী নবীর আদেশ, আইন, হেদায়াত সংশোধন ও সংযোজন করেছেন। তাই পূর্বের সকল নবীর শরীয়ত আপনা থেকেই বাতিল হয়ে গেছে। সর্বশেষে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা সবদিক থেকে পূর্ণাঙ্গ। তাই শেষ নবীর অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে সকল নবীর শিক্ষার আনুগত্য করা হয়।
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
নবী করীম (সঃ) আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে বলেছেন। ফেরেশতারা কারা? কি তাদের কাজ? মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কেনই বা আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে হবে?
ফেরেশতারা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিশেষ কাজ করার জন্য ‘নূর’ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন মানুষকে ‘মাটি’ দিয়ে, জ্বীনকে ‘আগুন’ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। ইবলীস শয়তান জ্বীনদের মধ্যের একজন। অনেকের ভুল ধারণা ইবলীস ফেরেশতাদের সর্দার ছিলো।
ফেরেশতারা সব সময় আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কাজ করছে। আল্লাহর কাজের জন্য হুকুম দিয়েছেন সে সেই কাজই করছে। তাদের কোন ঘুম নেই, নেই আমাদের মত ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। আল্লাহ তাঁর অনুগত সুন্দর সৃষ্টি ফেরেশতাদের দ্বারা বিশ্বজাহান পরিচালনা করছেন। আল্লাহর সৃষ্টি জগতে বহু ফেরেশতা আছে। আমরা মাত্র মাত্র কয়েক জন বিখ্যাত ফেরেশতার নাম জানি। আল্লাহর কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসতেন জীবরাঈল (আঃ)। আমাদের মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে আসেন আজরাঈল (আঃ)। মানুষের খাদ্য বণ্টন করেন মীকাইল (আঃ) এবং কিয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন ইস্রাফিল (আঃ)।
এই ফেরেশতাদের মধ্যে একশ্রেণীর ফেরেশতা সব সময় আমাদের মাঝে থাকেন। আমাদের ভাল মন্দ সব কাজ তারা দেখছেন এবং লিখে রাখছেন। মোট কথা তাদের কাছে সব মানুষের জীবনের সকল রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মৃত্যুর পর আমরা যখন আল্লাহর কাছে হাজির হবো তখন তারা আমাদের সেই রেকর্ড বা আমলনামা আল্লাহর সামনে পেশ করবেন। তখন আমরা দেখতে পাবো জীবনভর আমরা কি কি ভাল কাজ করেছি এবং কি কি খারাপ কাজ করেছি। সবকিছু ঠিক ঠিক মত পেশ করা হবে আল্লাহর কাছে। তারা সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করছেন। মানুষ ফেরেশতাদেরকে দেখতে পারেনা যতক্ষণ না তারা আল্লাহর হুকুমে মানুষের রূপ নিয়ে আসেন। আল্লাহর হুকুমে তারা যে কোন রূপ নিতে পারেন। একবার হযরত জীবরাইল (আঃ) মানুষের রূপ নিয়ে নবী এবং তাঁর সাথীদের মাঝে এসেছিলেন।
এখন আমরা দেখব এই অদৃশ্য ফেরেশতাদেরকে আমাদের কেন বিশ্বাস করতে বলা হলো।
আগেই বলা হয়েছে যে মানুষের দুর্বল মন কখনও কখনও এই দুনিয়ার বিভিন্ন কাজের পিছনে বিভিন্ন অদৃশ্য রহস্যময় শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করে। সে ধারণা করে কোন শক্তি বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্য কোন এক শক্তির হুকুমে আগুন জ্বলছে। আবার কেউ দান করছে মানুষকে আলো। মানুষ ভাবে এরা আল্লাহর সন্তান-সন্ততি। সে মনে করে এদেরকে খুশী করতে পারলে আল্লাহ খুশী হবেন। তাই তাদের কল্পিত মূর্তি তৈরী করে পূঝা করে অবুঝ মানুষ।
ইসলামের শিক্ষা হলো-না, এসব রহস্যময় শক্তি খোদা নয়। এমনকি খোদার সন্তান-সন্ততিও নয়। তারা ফেরেশতা। আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি, এমনিভাবে ফেরেশতার অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস মানুষকে অন্ধ শিরক থেকে মুক্তি দেয়।
কিতাবের উপর ঈমান।
মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমতের শেষ নেই। আল্লাহ মানুষকে মুক্তির পথের দিশা দিয়ে পাঠালেন নবী ও পয়গাম্বরদের। আল্লাহ তাঁদের কাছে যে বাণী পাঠালেন তাকে অহি বলা হয়। অহির মাধ্যমে অনেক নবীর কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন আল্লাহ। এভাবে সৎ, সঠিক, নির্ভুল প্রয়োজনীয় জ্ঞান লিখিত আকারে মানুষের কাছে এলো। এরচেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে?
কোরআন যে সব কিতাবের কথা উল্লেখ আছে আমরা সে সব কিতাবে বিশ্বাস করি। সেগুলি হলো হযরত মুসা (আঃ)-এর ‘তাওরাত’, হযরত দাউদ (আঃ)-এর ‘জাবুর’, হযরত ঈসা (আঃ)-এর ‘ঈঞ্জিল’, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ‘কোরআন’। এছাড়াও বিভিন্ন নবীর কাছে বিভিন্ন কিতাব এসেছে। সে সবের নাম ও পরিচয় আমাদেরকে বলা হয়নি। তাই বর্তমান বিশ্বে আর যেসব ধর্মীয় গ্রন্থ আছে তা যে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এ কথা যেমন জোর দিয়ে বলতে পারিনা, তেমনি এ কথাও বলতে পারিনা যে এসব আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। আসল কথা হলো কোরআন ছাড়া আর কোন ধর্মীয় গ্রন্থকে আমরা সঠিকভাবে পাইনা।
একমাত্র কোরআন ঠিক যেভাবে নাযিল হয়েছে সেইভাবে অক্ষত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় আছে। তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল যেভাবে, সে ভাষায় নাযিল হয়েছিল সেভাবে, সে ভাষায় নেই। তাওরাত ছিল ‘হিব্রু’ ভাষায় এবং ইঞ্জিল ছিল ‘আরামিক’ ভাষায়। বর্তমানে তাদের মূল শব্দাবলীতেও পরিবর্তন এসেছে। সংশ্লিষ্ট নবীদের মৃত্যুর অনেক পরে তাদের অনুসারীরা আবার নতুন করে এসব কিতাব সংকলিত করার দাবী করে। ফলে এ সবের মধ্যে রয়েছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং মনগড়া কথা। আল্লাহর মূল কথার সাথে মিশে গেছে মানুষের কথা। শুধু তাই নয়, বাইবেলে আছে অনেক ভুল তথ্য। আছে নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন গল্প।
তাই এসব কিতাব সম্পর্কে শুধু এটাই বলা যায় যে, এসবের মধ্যে আল্লাহর কালামের সাথে মানুষের কথা মিশে গেছে। কোনটা আল্লাহর কথা আর কোনটা স্বার্থবাদী মানুষের কথা তা বুঝবার কোন উপায় নেই।
তাহলে এসব কিতাবের কথা বলা হলো কোরআনে? সব কিতাবের উল্লেখ করে কোরআন এ কথাই জানিয়ে দিলো –আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রত্যেক যুগেই নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন তাঁদের মাধ্যমে কিতাব ও হুকুম-আহকাম। অতীদের নবীর অনুসারীরা সেই কিতাবের শিক্ষাকে ভুলে গেছে। সে শিক্ষাকে নষ্ট করেছে। কোরআন কোন অভিনব জিনিস নয়। মানুষের জন্য আল্লাহর একটা রহমত যা তিনি পাঠিয়েছেন শেষ নবীর কাছে। অতীতের সেই শিক্ষাকে আবার জীবন্ত করার জন্য কোরআন নাযিল করা হয়েছে।
আল্লাহর এও এক অপার রহমত যে সেই কোরআন আজও অপরিবর্তিত, অক্ষত অবস্থায় আমাদের মাঝে আছে। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি।
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
দুনিয়াতে আমরা দেখি প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যু আছে। দুনিয়ায় এই জীবন চিরস্থায়ী নয়। হাসি ও আনন্দ, সুখ ও দুঃখের এই জীবন একদিন শেষ হয়ে যায়। এই মৃত্যু সকলের জীবনে একদিন না একদিন আসবেই। মৃত্যু কখন আসবে তাও কেউ জানেনা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ
অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরতে হবে।
-আল-ইমরান-১৮৫
মৃত্যুর পর জীবন
মৃত্যুর পর জীবনের এক চরম সত্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই সকলের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু জিনিসটি কি? মানুষ মৃত্যুর পর যায় কোথায়? এই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন এসে দেখা দেয়, তা হলো, মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের এই দুনিয়ার জীবনের সব ভাল ও মন্দ কাজের ফলাফল কি শেষ হয়ে যায়? দুনিয়ার জীবনে মানুষ যা কিছু করলো, ভাল কিংবা মন্দ এর ফল কি এই দুনিয়াতেই শেষ? বিষয়টা আরও একটু গভীরভাবে ভাবি।
আমরা দেখি এই দুনিয়ার জীবনে হাজারও কষ্টের মধ্যে, হাজারও প্রতিকূলতার মধ্যে অনেক লোক এমন আছেন যিনি সৎ পথে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন সব সময়। তিনি অন্যের উপকার করছেন, অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি এই দুনিয়াতে এই সৎ কাজের জন্য পুরোপুরি কোন পুরস্কার পাচ্ছেন না; বরং পাচ্ছেন উল্টোটা-দুর্নাম ও নির্যাতন। কখনওবা তাঁর ভাগ্যে জোটে মৃত্যুদণ্ড। তাহলে কি তিনি যে সৎ কাজ করলেন তা সব বিফলে যাবে? তাঁর মৃত্যুর পর তার সৎ কাজের সুফল এই দুনিয়াবাসী অনন্ত কাল ধরে পাবে আর তিনি নিজে তাঁর ফলাফল পাবেন অসম্পূর্ণ, এটা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়?
অন্যদিকে একজন লোক জীবনভর অন্যায় কাজ করলো। আমরা দেখলাম সে হয়তো তার দুষ্কর্মের জন্য দুনিয়ায় কিছুটা শাস্তিও পেলো। কিন্তু তার দুষ্কর্মের শাস্তি সে পুরোপুরি পেলনা। কখনও কখনও এই ধুরন্ধর ব্যক্তি দুনিয়ার সকলকে ফাঁকি দিয়ে দুনিয়ার শাস্তিও এড়িয়ে যায়। লোকের চোখের আড়ালে দুষ্কর্ম চালিয়ে যায়। অথচ তার দুষ্কর্মের ফল অন্যেরা পেতেই থাকে। এই জুলুমের পুরোপুরি শাস্তি কি সে কোন দিনও পাবেনা? দুনিয়ায় যে জুলুম সে করেছেন, যে খারাপ কাজ সে করেছে, তার মৃত্যুর পর তার পরিণাম দুনিয়াবাসী ভোগ করতেই থাকবে। আর মৃত্যু এসে এই জালিমকে একেবারেই বাঁচাবে শাস্তি থেকে, একি কখনও হতে পারে?
মোট কথা, আমরা দেখি দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ কখনও তার ভাল এবং মন্দ কাজের সঠিক পুরস্কার কিংবা শাস্তি পেতে পারেনা। বিবেকের কথা হলো, মৃত্যুর পরও তার ভাল ও মন্দ কজের জন্য পুরস্কার কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
ইসলাম বল মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন আছে। যাকে আমরা বলি ‘পরকাল’। ‘মৃত্যু’ দেখা যায় কিন্তু মৃত্যুর পর কি আছে তা দেখা যায়না। আর দেখা যায়না বলেই অনেকে মৃত্যুর পর কিছু আছে বলে বিশ্বাস কতে চায়না। আমরা নিজেরা দেখতে পারিনা, নিজেরা অনুভব করতে পারিনা বলেই মৃত্যুর পর কিছু আছে কিনা তা বিশ্বাস করবো না এটা কি যুক্তিসঙ্গত হলো? আমরা দেখবো, বিবেক কি বলে। আমরা দেখবো এই পরকাল বিশ্বাস করা কিংবা তা না করার ফলে মানুষের জীবনে কি প্রভাব পড়ে। আমরা দেখবো, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে সৎ-মহৎ ও পবিত্র বলে প্রমাণিত আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কি শিখালেন।
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
১। যে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাস করেনা তার জন্য তো দুনিয়ার এই জীবনটাই সব। তাই খাও, ফুর্তি করো এটাই তার জীবনের লক্ষ্য। সব কাজ সে এই দৃষ্টিতে দেখবে। যে কাজে তার স্বার্থ নেই সেই কাজে সে উৎসাহ পাবেনা। যে ভাল কাজের ফল সে এ দুনিয়ায় পাবেনা, সেটা তার কাছে ভাল কাজ বলে মনে হবেনা। আর যে অন্যায় কাজের জন্য দুনিয়ায় সে শাস্তি এড়াতে পারবে, তার কাছে সেটা অন্যায় বলে মনে হবেনা।
২। কোন ব্যক্তি যদি পরকালে বিশ্বাস না করে তবে সে কোন সৎকাজে উৎসাহ পেতে পারেনা। কেননা দুনিয়ায় সব সৎকাজের ফল পাওয়া যায়না। ফলে তার চোখের সামনে অন্যায় হবে, জুলুম হবে আর সে তা তাকিয়ে দেখবে। অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকারের কোন উপায় না দেখে তার মনোবল ভেঙ্গে যাবে।
৩। এইভাবে সমাজ থেকৈ দিন দিন ভাল কাজ লোপ পায়। আর স্বার্থপরতা, লোভ লালসা বাড়তে থাকে। একে অন্যের জন্য কষ্ট করবে, একে অন্যকে সাহায্য করবে, অন্যের দুঃখে শরিক হবে, এসব ভাল গুণের কদর কমতে থাকে। কে কিবাবে কাকে ঠকাবে, অন্যের সম্পদ কিভাবে লুটবে এটাই হয় মানুষের সব সময়ের চিন্তা। সমাজ তখন মানুষের বসবাসের যোগ্য থাকেনা।
তুমি কি দেখেছ সে লোককে যে পরকালের শুভ প্রতিফল ও শাস্তিকে অস্বীকার করে।
সূরা মাউন-১
তাই পরকালে বিশ্বাস একটা মামুলী বিষয় নয়। পরকালের প্রতি অবিশ্বাস মানুষকে প্রকৃত পক্ষে পশুতে পরিণত করে। মানবতাকে ধ্বংস করে। মানুষ পরিণত হয় খোদাদ্রোহী জালেমে।
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকালের প্রতি বিশ্বাসকে ইসলাম তাই এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় পরকালকে ভলা হয় ‘আখেরাত’। নবী রাসূলগণ আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেনঃ
১। আল্লাহ একদিন এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ করে ধ্বংস করে দেবেন। সে দিনের নাম ‘কিয়ামত’।
২। এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হবার পর আবার সবাইকে দেওয়া হবে নতুন জীবন। মানুষ আবার নতুন দেহ পাবে। সবাইকে আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে, আল্লাহ সকলের বিচার করবেন। একে বলা হয় ‘হাশর’।
৩। বিচারের জন্য মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু করেছে সেই আমলনামা মানুষের সামনে পেশ করা হবে। মানুষের ভাল কাজ মন্দ কাজ, সব কিছু তার সামনে তুলে ধরা হবে। সত্য ও ইনসাফের সাথে তার বিচার করা হবে। আল্লাহর মানদণ্ডে যার ভাল কাজ মন্দ কাজের চেয়ে বেশী হবে তাকে আল্লাহ পুরস্কার দেবেন। ভাল কাজের পুরস্কার হিসাবে তাকে দেবেন জান্নাত আর খারাপ কাজের জন্য শাস্তি হিসাবে সে পাবে জাহান্নাম।
এভাবেই ইসলাম জানিয়ে দেয় দুনিয়ার এই জীবনই মানুষের শেষ নয়। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। এখানে মানুষের সকল কাজের পুরোপুরি ফলাফল প্রকাশ পায়না। দুনিয়ায় ভাল ও মন্দ কাজের পুরোপুরি ফলাফল পাওয়া যায় আখেরাতে। তাই আখেরাতের জীবনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতাই হচ্ছে আসল। দুনিয়া এবং আখেরাতে শান্তিই মানুষের জীবনের চরম ও পরম আকাংখা হওয়া উচিত।
পরকালে বিশ্বাসের উপকার
ইসলাম আখেরাত বিশ্বাসকে সকল বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের বুনিয়াদ হিসেবে নিয়েছে।
১। আখেরাতে বিশ্বাস মানুসের মধ্যে এক শক্তিশালী বিবেকের জন্ম দেয়। যা সত্য তাকে সে সত্য বলেই মনে করে। মিথ্যাকে সে মিথ্যা বলতে ভয় পায়না। দুনিয়ার কোন লাভ বা ভয়-ভীতির কারণে সে ভাল কাজ করেনা। নিজের বিবেকের তাড়নাতেই সে সত্যের পথে চলে নির্ভীকভাবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে তাকে হাজির হতে হবে সে চিন্তা তাকে পর্বত প্রমাণ জুলুম সাহসিকতার সাথে মোকাবিলার সাহস জোগায়।
২। আখেরাতের উপর বিশ্বাস মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে দুর্লভ গুণ। পরকালে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় সে দুনিয়ায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে পরের উপকারে, অন্যের সাহায্যে। তার দ্বারা কারও হক নষ্ট হয়না। এতিম, মিসকিন, পথচারী, প্রতিবেশী সকলের প্রতি সে হয় সদয়।
৩। আখেরাতে বিশ্বাস মানুষকে দায়িত্বশীল করে। সে বিশ্বাস করে দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। দুনিয়ার প্রতিটি কাজ সে তাই দায়িত্ববোধের সাথেই পালন করে। কোনপ্রকার তদারকি ছাড়াই সে নিজের দায়িত্ব পালন করে যায়।
৪। এমনিভাবে আখেরাত বিশ্বাসের উপর যে সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে বিরাজ করে ভ্রাতৃত্ব, মমতা, সহানুভূতি, দয়া ও ভালবাসা। সে সমাজে হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে সকল কাজ পরিচালিত হয়। আর তখনই মানুষ পায় মানুষের প্রকৃত মর্যাদা।
তৃতীয় অধ্যায়
ইবাদত
ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য
পাঁচটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত
নামায
নামায মানুষের স্বভাব ধর্মের পরিচয়
নামায আল্লাহর স্মরণ
নামায প্রকৃত বান্দা তৈরী করে
নামাযের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় খোদাভীতি
জামায়াতে নামায
নামায কিভাবে উপকারে আসে
রোযা
রোযা খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি করে
রোযা ইচ্ছা শক্তি বাড়ায়
রেযা ভ্রাতৃত্ব বাড়ায়
অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে চলা
মৌলিক গুণাবলীর লালন
রোযা সহানুভূতিশীল করে
অন্যান্য উপকার
হজ্ব
হজ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান
হজ্বের তাৎপর্য
যাকাত
যাকাত একটি ইবাদত
যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে
যাকাতের উপকারিতা
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয়
যারা যাকাত নিতে পারে
ইবাদত
আল্লাহ চান এই দুনিয়ায় তাঁর দাসত্ব করুক, তাঁর আনুগত্য করুক। আল্লাহকে প্রভু হিসাবে মেনে নিয়ে তাঁর হুকুম মত মানুষ জীবন পরিচালনা করুক। জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর নির্দেশ মত করুক। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফে বলেছেন-
আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।
সূরা আয-যারিয়াত-৫৬
ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য
‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ বন্দেগী বা দাসত্ব। মানুষ আল্লাহর দাস বা গোলাম (আরবীতে আবদ)। আল্লাহ মানুষেল ‘মাবুদ’। কোন গোলাম বা চাকর যদি সত্যিকারভাবে তার (১) মনিবের দাসত্ব স্বীকার করে নেয় (২) তার মনিবের একান্ত অনুগত হয় এবং (৩) গোলামের মত আচরণ করে, তাঁকে সম্মান করে এবং তাঁর দানের শোকর করে তবে তার এই গোলামীকে বলে ইবাদত।
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহর গোলামী করা। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। এইসব কাজ খোদার আইন অনুযায়ী করার নামই ‘ইবাদত’। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি গতিবিধি খোদার নির্ধারিত সীমার মধ্যে হতে হবে। এই হিসেবে সে যে কাজই করে তাই ‘ইবাদত’। এই সীমার মধ্যে তার ঘুম, জেগে থাকা, খাওয়া-দাওয়া, চলাফিরা, কথা বলা, লেনদেন সবই ‘ইবাদত’।
আল্লাহর এই দাসত্ব মেনে নেয়া জীবনের কোন এক বিশেষ মুহুর্তের জন্য নয়। দিন-রাত্রির কোন বিশেষ সময়ের জন্য নয়। দিনের চব্বিশটি ঘণ্টা, বছরের প্রতিটি দিন মোটকথা মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর গোলাম হয়ে তাঁর হুকুম মত প্রতিটি কাজ করতে হবে। তাই আল্লহর প্রকৃত দাস হিসেবে জীবন পরিচালনা করা সহজ বিষয় নয়। এজন্যে চাই দৃঢ় ঈমান, চাই সাধনা ও অনুশীলন।
আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার পথে প্রথম বাধা আসে নিজের ভিতর থেকে। মানুষের নিজের ভিতরে আছে আরামপ্রিয়তা, লোভ-লালসা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস। সব ধরনের জড়তা, দুর্বলতা, অলসতা কাটিয়ে আল্লাহর গোলাম হিসেবে নিজকে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ কতকগুলো ‘কাজ’ ফরয করে মানুষকে আল্লাহর গোলাম হবার ট্রেনিং দেয়। যে যত ভালভাবে এই ট্রেনিং নেবে সে তত ভালভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবে যেজন্য আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। এই সব ইবাদত পালন করে মানুষ গোটা জীবনকে আল্লাহর ‘এবাদতে’ পরিণত করার উপযুক্ত হয়।
দিনে পাঁচমার নামায স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা আল্লাহর দাস-একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা আমাদের কর্তব্য। এক মাস পুরো রোযা পালনের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ভিতরের পশু প্রবৃত্তিকে শাসন করতে শিখে। যাকাত স্মরণ করিয়ে দেয় তুমি যে অর্থ উপার্জন করেছো তা খোদার দান-নিজের খেয়াল-খুশীমত তা খরচ করলে চলবেনা। আল্লাহর হুকুম মত তোমার অর্থ ব্যয় করতে হবে। হজ্ব মানুষের মন ভরিয়ে দেয় খোদার প্রেম ও ভালবাসায়। আল্লাহ মহান ও শ্রেষ্ঠ এই অনুভূতি তার হৃদয়ে এমন দাগ কাটে যা কোনদিন ভুলে যাবার নয়। তাই আল্লাহর গোলাম হবার জন্য আমাদেরকে সঠিকভাবে নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত আদায় করতে হবে।
পাঁচটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত
কালেমা শাহাদাতের ঘোষণা দান, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত এই পাঁচটি ইবাদতকে আল্লাহ আমাদের জন্য অবশ্যকরণীয় ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এই পাঁচটি ইবাদতকে ইসলামের ভিত্তি (আরকানে দ্বীন) বলা হয়। একটি ঘর যেমন খুঁটি বা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে, এও ঠিক তেমনি। কালেমা শাহাদাতের ঘোষণা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর একত্ব ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর রেসালাতের স্বীকৃতি। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের (সঃ) অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজে আমাদেরকে সাহায্য করে অন্য চারটি আরকান-নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত।
নামায
নামায ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআনের ভাষায় এর নাম ‘সালাত’। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশী যে ইবাদতটি করতে হয় তা হলো নামায। নামায ফরজ হবার পর থেকে প্রতিদিন পাঁচবার অবশ্যই এই নামায আদায় করতে হয়।
নামায মানুষের স্বভাব ধর্মের পরিচয়
মানুষেল স্বভাব হলো এক বিরাট শক্তির কাছে নিজকে পেশ করা ও শ্রদ্ধা জানানো। নদী যেমন আপনা আপনি বিরাট সমুদ্রের দিকে ছুটে চলে, তেমনি মানুষও এক মহৎ লক্ষ্য বা পথে নিজকে নিবেদন করতে চায়। তাই যুগে যুগে মানুষ কোন না কোন কিছুকে বিরাট শক্তিময় মনে করে তার পূজা করেছে।
আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টি জগতের বৃহত্তম সত্তা। আল্লাহকে পাওয়াই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। তাই আল্লাহর সামনে নিজকে পেশ করে, মনে-প্রাণে এবং উচ্চারণে তাঁর প্রশংসা করে, তাঁর কাছে নিজকে নিবেদনের ওয়াদা করে, বুকে হাত রেখে দৃষ্টি অবনমিত রেখে, কোমর অবনত করে, মাটিতে মাথা রেখে যে ‘কাজ’ বা ইবাদতটিকে আমরা নামায বলি তা মানুষের স্বভাব ধর্মেরই পরিচয়।
নামায মানুষের দেহ ও মনের এক স্বাভাবিক দাবী। প্রত্যেক নবী রাসূল তাই তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লহার সামনে নিজকে পেশ করা, আল্লাহকে স্মরণ করা এবং আল্লাহর প্রশংসা করার জন্য নামাযের মত কোন না কোন ইবাদতকে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের প্রিয় নবী আমাদেরকে দিয়েছেন দিনে পাঁচবার নামাযের শিক্ষা।
নামায আল্লাহর স্মরণ বা জেকের
আমরা নামায আদায়ের মাধ্যমে আল্লহাকে স্মরণ করি। নামায আমাদেরকে আল্লাহে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায আদায় কর।
সূরা ত্বাহা-১৪
ইসলামের সবচেয়ে বড় কথা হলো আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর আনুগত্য। মুসলমান হিসেবে দুনিয়ার প্রতিটি কাজে সব সময় স্মরণ রাখতে হবেঃ আল্লাহ আছেন, তিনি আমাকে দেখছেন এবং আমার অন্তরের সব কিছু জানেন। ‘শয়তান’ আমাদেরকে তার দাস বানাতে চায়। আমাদের ভুলিয়ে রাখতে চায় সব সময়। তাই ‘আল্লাহর স্মরণ’ সব সময় জাগরুক রাখার জন্যেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে দিনের শুরুতে একবার, দিনের নানান কাজের ফাঁকে তিন তিনবার এবং রাতের বেলায় ঘুমের সময় হলে আর একবার আনুষ্ঠানিকভাবে নামায আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আমরা আল্লাহর গোলাম’।
নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ)-এর শেখানো নিয়ম অনুযায়ী তাই আমরা নামায আদায় করছি। একজন মুসলমানদের নামাযের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করো, কি সুন্দর এক ব্যবস্থা। আল্লাহকে স্মরণ করার, আল্লাহর দাসত্ব ঘোষণা করার, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার, আল্লাহর কিতাবের শিক্ষাকে বারবার উচ্চারণ করার, রাসূলের সত্যতা স্বীকার করার, আল্লাহর আদলতে জবাবদিহির কথা স্মরণ করার জন্য এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা কি আর আছে? চেয়ে দেখ, নামাযের জন্য পাঁচবার ওজু, নামাযে দাঁড়ানোর আদব, রুকু সেজদার মাধ্যমে ফুটে উঠা বিনয়ীভাবে-সব কিছু মিলিয়ে নবীজির শেখানো নামায মানুষকে কত পবিত্র করে, মহান করে তোলে মাটির মানুষকে।
এজন মুসলমান ঘুম থেকে উঠে পাখী ডাকা সকালে নামাযের মত একটি সুন্দর ব্যবস্থার মাধ্যমে শুরু করে তার দিন-সতেজ অনুভূতিতে। এরপর কাজের ফাঁকে গড়িয়ে যায় দিন। ভরা দুপুরে মুয়াজ্জিনের ডাকে আবার সে সজাগ হয় যোহরের সময়। ঈমানকে তাজা করে নিয়ে সে আবার ফিরে যায় দুনিয়ার কাজ কারবারে। কয়েক ঘণ্টা পর পড়ন্ত বেলায় আছরের নামায। তাজা করে নেয় সে আবার তার ঈমানকে। এরপর দিন শেষ হয়-হয় মাগরিবের সময়। ভোরে সে যে এবাদতের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিল দিন-রাতও শুরু করে সে সেই এবাদতের মধ্য দিয়ে-যেনো সেই শিক্ষা সতেজ থাকে তার চেতনায় রাতভর। তারপর ঘনিয়ে আসে এশার সময়। দিনের কোলাহলে সে যে সুযোগ পায়নি রাত্রির প্রশান্তিতে নিশ্চিন্তে মনে সেই এবাদতে মশগুল হয় তার দেহ-মন।
এই হলো সেই নামায-নবীর শেখানো নামায, যা ইসলামের ভিত্তিতে মজবুত করে। যে বড় ‘এবাদতের’ জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে সেই ‘এবাদতের’ জন্য তৈরী করার ‘ইবাদত’ নামায।
নামায প্রকৃত বান্দা তৈরী করে
মুসলমান হিসেবে প্রতি পদে পদে আল্লাহর হুকুম মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। তাই মনের মধ্যে সব সময় থাকতে হবে এই কর্তব্যবোধ। মন থাকবে আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সদা প্রস্তুত। আল্লাহর হুকুম মানাকে জীবনের এক স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করে নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ট্রেনিং-এর ঠিক সৈনিকের মত। একজন সৈনিককে যেমন প্রতিদিন যুদ্ধ করতে না হলেও যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। একজন মুসলমানকেও তেমনি সকল অবস্থায় আল্লাহর আইন পালনের জন্য প্রস্তুত থাকার উদ্দেশ্যে নামাযের মাধ্যমে প্রতিদিন ট্রেনিং নিতে হয়। সৈনিকের মত নিয়ম-শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, ধৈর্য, সাহস শৃঙ্খলার ট্রেনিং সে পায় নামাযের মাধ্যমে।
মুসলমান সে যে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে ইসলাম অনুযায়ী কাজ করবে, কুফরী ও ফাসেকীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আর এইভাবে মনে-প্রাণে প্রস্তুত হবার ‘ট্রেনিং’-এর জন্য দিন রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে। আল্লাহকে খুশী করার জন্য, জেহাদে প্রস্তুত সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠার এক বাস্তব কর্মসূচী নামায। বাস্তব জীবনে আমরা আল্লাহর আইন মানতে প্রস্তুত কিনা তার পরীক্ষা ও প্রমাণ নেবার জন্যই এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায। আর এজন্যই নামায পড়াকেই নবীজি কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন বলে উল্লেখ করেছেন।
নামাযের মাধ্যমে সৃষ্টিহয় খোদাভীতি
আল্লাহ আমাদেরকে সব সময় সব জায়গায় দেখছেন, আমাদের সব কিছু জানেন ও শুনে। খোদার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকা যায় না। মনের মধ্যে এই বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে, আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধান মেনে চলা তত সহজ হবে। আর এই বিশ্বাস দুর্বল হলে মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকা কঠিন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে মনের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃড় হয়। তাই নামায মুসলমান হিসেবে জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এক ইবাদত।
প্রত্যেক দিন পাঁচবার নামায আদায় করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয় কিন্তু যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, তাদের জন্য এ এক সহজ কাজ। আল্লাহ এ কথা সুন্দরভাবে কোরআনে বলেছেনঃ
তোমরা ধৈর্য এবং নামাযের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাহায্য চাও-
এটি সত্য একটি কঠিন কাজ, কিন্তু তাদের জন্য কঠিন নয় যারা মনে রেখেছে যে, একদিন আল্লাহর সাথে দেখা হবে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।
সূরা বাকারা-৪৫-৪৬
জামায়াতে নামায
নামাযে আমরা কোরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করি। কোরআন আল্লাহর বিধান। বুঝে শুনে কোরআনের এসব আয়াত পাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর বিধানকে জানার সুযোগ পাই। এছাড়া নামাযের জামায়াতে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ধরনের মুসলমানই একত্রিত হয়। এর মাধ্যমে মনের আদান প্রদানের এক চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আল্লাহর আইন, বিধি-বিধান জেনে নেওয়ারও এক সুন্দর সুযোগ হয়। জামায়াতে নামাযের ব্যবস্থা সৃষ্টি করে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা।
খোদার দুশমনদেরকে নির্মূল করা এবং দুনিয়ায় খোদার আইন জারি করার জন্য মুসলমানদের যে মিলিত শক্তির প্রয়োজন –যে ঐক্য শক্তির প্রয়োজন-দিনরাত পাঁচবার জামায়াতে নামায, জুময়ার দিনে বড় জামায়াত, বছরের দুই ঈদের জামায়াত মুসলমানদের মধ্যে সেই ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে –সেই ঐক্য-চেতনার জন্ম দেয়। আর সারা বিশ্বের মুসলমাদনরা একই ভাষায় একই পদ্ধতিতে নামায আদায়ের মাধ্যমে সেই চেতনারই সাক্ষ্য দেয় যে মুসলমানরা এক জাতি।
নামায কিভাবে উপকারে আসে
নামায আমাদের মধ্যে যেসব ভাল গুণ ও অভ্যাস সৃষ্টি করে তা আলোচনা করা হলো। কিন্তু এখানে একটি কথা ভালভাবে জেনে তিনে হবে –তা হলো নামায থেকে আমরা এতসব উপকার তখনই পাবো যখন আমরা জেনে বুঝে নামায আদায় করবো। নামাযের মধ্যে আমরা আল্লাহর দাস হিসেবে নিজকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর সামনে বিনয়ের সাথে যেভাবে রুকু করছি, সিজদা করছি, নামাযের বাইরে দুনিয়ায় অন্যান্য কাজও আমাদেরকে তেমনি আল্লাহর গোলামের মতই করতে হবে। আল্লাহ যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, নামায আদায় করার পর সেস কাজ কি আমরা করতে পারি?
নামাযের মধ্যে আমরা যেখানে বলছিঃ হে প্রভু! আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সব কিছু চাই –(সূরা ফাতেহা) সেখানে নামাযের বাইরে কি আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন কাজ করতে পারি?
নামাযের মধ্যে আমরা যেখানে বলছিঃ হে প্রভু! আমরা তোমরাই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সব কিছু চাই- (সূরা ফাতেহা) সেখানে নামাযের বাইরে কি আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন কাজ করতে পারি?
তাই নামায থেকে ফায়দা বা উপকার পাওয়ার উপায় হলোঃ
১। নামাযে আমরা যা যা পড়ছি বা বলছি সেসব কিছুর অর্থ ভালভাবে বুঝতে হবে।
২। আল্লাহর সামনে নামায আদায় করছি এই অনুভূতি নিয়ে নামায আদায় করতে হবে।
৩। নামাযের মাধ্যমে যেসব শপথ নিচ্ছি –যেসব ওয়াদা করছি নামাযের বাইরে আমাদের সব কাজে তার ছাপ থাকতে হবে।
রোযা
প্রতি বছর রমজান মাসে মুসলমানরা রোযা রাখে। রোযাকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘সওম’। ‘সওম’ অর্থ বিরতি থাকা বা বিরত রাখা। রোযার দিনে রোযাদাররা কোন জিনিস খাওয়া বা পান করা থেকে বিরত থাকে। শুধু তাই নয়, রোযা রাখলে খারাপ কথা বলা যায় না, খারাপ কাজ করা যায় না, খারাপ চিন্তা করা যায় না।
এমনিভাবে নামায আমাদেরকে যে শিক্ষা প্রতিদিন পাঁচবার স্মরণ করিয়ে দেয়, রোযা বছরে একবার তা একমাস ধরে প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়, রোযা বছরে একবার তা একমাস ধরে প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিতে দিতে থাকে। এ হলো মহান প্রভু আল্লাহর হুকুম-আহকাম মানার জন্য প্রস্তুত হবার বার্ষিক ট্রেনিং প্রোগ্রাম। পুরো একমাস এমনিভাবে কঠিন সাধনা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। মজার ব্যাপার হলো, এমনিভাবে রোযা রাখা শুধু আমাদের জন্যই যে ফরয করা হয়েছে তা নয়, আমাদের প্রিয় নবীর পূর্বেও যে সকল নবী ছিলেন তাঁদের অনুসারীদের জন্যও রোযার বিধান ছিল।
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন-
হে ঈমানদাররা, তোমাদের জন্য রোযা রাখা ফরয করা হয়েছে
যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর তা ফরয করা হয়েছিল।
আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পরহেযগারীর গুণ সৃষ্টি হবে।
সূরা বাকারা-১৮৩
কোরআনের এই আয়াত থেকে রোযার উদ্দেশ্য কি তা জানা যায়। কেউ ভালভাবে, ভাল নিয়তে রোযা রাখলে রোযার মাধ্যমে তার মধ্যে পরহেযগারীর গুণ সৃষ্টি হয়। পরহেযগারী কি? দুনিয়ার সব লোভ-লালসা ও খারাপ কাজ থেকে নিজকে দূরে রাখার নাম পরহেযগারী।
রোযা খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি করে
রোযার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টি হয়। একটু খেয়াল করে দেখ, রোযার দিনে মানুষ যা কিছু ভাল কাজ করে তা কাউকে দেখানোর জন্য নয়। একমাত্র আল্লাহর জন্যই সব কিছু করে। সামান্য কিছু লুকিয়ে খেলে, কেউ কি তা দেখতে পারবে? খারাপ কিছু চিন্তা করলে কেউ কি তা জানতে পারবে? কিন্তু যে রোযা রাখে সে এটা বিশ্বাস করে যে, কোন মানুষ তা না দেখলেও আল্লাহ সব কিছু দেখেন, সবকিছু জানেন এবং সবকিছু শুনেন। এমনিভাবে আল্লাহকে স্মরণ করেই সে সারাদিন কষ্ট করে, ক্ষুধা লাগলেও কিছু খায়না। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাল কাজ করে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখলে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়।
রোযা ইচ্ছা শক্তি বাড়ায়
রোযা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। মানুষ সাধারণতঃ একটু আরাম চায়, একটু আয়েশ চায়, ভাল খেতে চায় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এ আগ্রহকে সব সময় সীমার মধ্যে রাখতে হয়। আর এ জন্য প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি। রোযা এ ইচ্ছা শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। মনের ভিতরে দৃঢ় হয় খোদাভীতি। আল্লাহ সব জায়গায় আছেন, সব কিছু দেখছেন –এই বিশ্বাস হয় মজবুত। আখেরাতের জীবনের উপর ঈমান হয় দৃঢ়। আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শের প্রতি ভালবাসা হয় আরও গভীর। আল্লাহর বিধান পালনের কর্তব্য অনুভূতি হয় বলিষ্ঠ।
রোযা ভ্রাতৃত্ব বাড়ায়
রমযান মাস আসলে সব দেশের মুসলমানরা রোযা রাখে। এ পৃথিবীর মুসলমানরা এক আল্লাহর নির্দেশে, একই নবীর দেখানো নিয়মে রোযা রাখে। এর ফলে সব মুসলমানের মনে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জেগে উঠে। দুনিয়ায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐক্যশক্তির প্রয়োজন তারই অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে মুসলিম জাতি পুরো এক মাস।
অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে চলা
আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন জীবনের সকল ব্যাপারে খাপ খাইয়ে চলার মত মানসিক অবস্থা, প্রজ্ঞা ও কৌশল। রমযান মাসে মানুষেল দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন ঘটে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজকে মহৎ উদ্দেশ্যে গড়ে তোলার খাতিরে পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হয় রমযান মাসে।
মৌলিক গুণাবলীসমূহের লালন
এমনিভাবে আবার লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য যেসব ব্যবহারিক ও মৌলিক গুণাবলী একান্ত প্রয়োজন –রোযা মানুষের মধ্যে সেসব গুণাবলী বিকাশে সাহায্য করে। কর্তব্যের প্রতি অবিচলতা, ধৈর্য্য, একাগ্রতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা, প্রদর্শনেচ্ছা পরিহার, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, এইসব মৌলিক গুণাবলী রোযার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। মোটকথা এই দুনিয়ায় নেতৃত্ব দানের জন্য মুসলমানদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক মৌলিক গুণাবলী প্রয়োজন তারই সাধনার জন্য রোযার মত এক সুন্দর ইবাদত যেন ফরয করা হয়েছে মুসলিম জাতির জন্য। মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নিঃসন্দেহে এ এক অপূর্ব নিয়ামত।
রোযা সহানুভূতিশীল করে।
ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় যে কষ্ট তা রোযাদাররা উপলব্ধি করতে পারে। ফলে সমাজের ধনীরা দারিদ্র্যের কষ্ট হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। ফলে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার গুণাবলী বিকশিত হয় সমাজে।
রোযার অন্যান্য উপকার
এ ছাড়াও রোযা রাখলে স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও বেশ কিছু উপকার হয়। শরীরের চর্বি জাতীয় উপাদান কমে যায়। দেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক জীবাণূ এবং রাসায়নিক পদার্থ যেমন ইউরিক এসিড প্রভৃতির পরিমাণ কমে যায়। এমনিভাবে রেযার অনেক উপকার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য এ নয়। রোযা রাখার সবচেয়ে বড় কথা হলো –আরা রোযা এজন্যই রাখি যে আল্লাহ রোযা রাখতে বলেছেন এবং আল্লাহর অনুগত গোলাম হওয়ার উদ্দেশ্যেই আমরা রোযা রাখি।
হজ্ব
‘হজ্ব’ একটি আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বের হওয়া। ইসলামে হজ্ব বলতে আমরা বুঝি –যিলহজ্ব মাসে আরব দেশের মক্কা নগরে অবস্থিত কাবা ঘরে পৌঁছা। সেখানে যাওয়ার পর কতকগুলো আচার-অনুষ্ঠান করতে হয়। এসব কাজ কোরআন ও সুন্নাহ (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের দেখানো নিয়ম) অনুযায়ী করা হয়। আসলে নবী হযরত ইব্রাহীন আলাইহিস সালাম, তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আঃ) এবং পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণেই এ সব আচার অনুষ্ঠান করা হয়। আল্লাহর প্রতি প্রেম, ত্যাগ ও কোরবানীর কারণে হযরত ইব্রাহীন (আ)-এর নাম আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হজ্ব পালনের আসল উদ্দেশ্যই হলো সেই ত্যাগ ও কোরবানীর কথা স্মরণ করে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে নিজকে বিলিয়ে দেয়া।
দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, সুখ, টাকা-পয়সার প্রতি মোহ, সম্পদের প্রতি লোভ, ছেলেমেয়ের প্রতি ভালবাসা প্রভৃতি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে রাখে। হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে এসব বিষয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালবাসার উপরে তিনি কোন কিছুকে বড় করে দেখেননি। এমনকি আল্লাহকে খুশী করার জন্য নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নির্জন স্থানে রেখে এসেছিলেন। নিজের পুত্রকে কোরবানী দিতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর পথে এর চেয়ে বড় ত্যাগ আর কি হতে পারে? তাই আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের এই ঘটনা আজও আমাদেরকে সমানভাবে প্রেরণা দেয়। হজ্বের সময় হযরত ইব্রাহীন (আঃ), তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র ইসমাঈল (আ) এর কথা স্মরণ করে হাজীরা প্রেরণা পান নিজকে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দেয়ার। হজ্বের সময় বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা একত্রিত হয়। বংশ, শিক্ষা, অর্থ সব কিছুর ভেদাভেদ ভুলে আল্লাহর ডাকে জমা হন সকলে। সকলের গায়ে একই ধরনের কাপড়। সকলে একই আচার-অনুষ্ঠান করছেন। সকলেই এক আল্লাহতে খুশী করার জন্য এসেছেন। আল্লাহর সামনে সবাই সমান হয়ে যান। মুসলমানদের মধ্যে এমনিভাবে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্ব। সকলেরই মনে পড়ে যায় কেয়ামতের দিন এমনিভাবে সব মানুষকে আল্লাহর সামনে একত্রিত হতে হবে।
হজ্বের সময় একজন মুসলমান সেইসব জায়গা দেখার সৌভাগ্য পান যেখানে মহানবী (স)-এর জীবন কেটেছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই স্মরণে পড়ে অনেক ঘটনা। মনে পড়ে যায় রাসূল (স)-এর সংগ্রামী জীবন, রাসূল (স)-এর সাথীদের কথা।
হজ্ব হলো ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির একটি। সামর্থ আছে এমন মুসলমানের জন্যে জীবনে একবার হজ্ব করা ফরয। সামর্থ্যবান বলতে বুঝায় –তার স্বাস্থ্য ভাল থাকতে হবে, তার পক্ষে হজ্বের জন্য পথ খরচ ও অন্যান্য খরচ করা সম্ভব হতে হবে এবং হজ্বে চলে গেলে তার পরিবারের সকলের যেন ভালভাবে দিন কাটে।
এমন এক সামর্থ্যবান মুসলমান যদি একবার হজ্ব না করেই মারা যান তবে তার বদলে অন্য কেউ হজ্ব পারন করতে পারেন। অসুস্থ লোকদের বদলে অন্য কেউ হজ্ব করতে পারে।
এখানে বলে রাকা দরকার, কাবা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্মস্থান নয় এবং কেউ রাসূল (সা) কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিকে পূজা করার জন্য সেখানে যান না। কাবা এবং অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের সাথে জড়িত ইতিহাস ও ঘটনার কারণেই এই জায়গাগুলো হাজীদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ। কাবায় পৌঁছা মানে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া। তাঁর সামনে হাজির হওয়া। তাই হাজীরা আল্লাহর ঘর দেখার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে বলে উঠেন ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক –হে প্রভু হাজির হয়ে গেছি’।
হজ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান
হজ্ব করতে যাওয়ার সময় প্রত্যেক হাজীকে এহরাম বাঁধতে হয়। এহরাম বাঁধা অর্থ হলো হজ্ব পালনের ইচ্ছা ঘোষণা করা-নিয়ত করা। এহরামের পরই শুরু হয় হজ্ব। এহরাম বাঁধার পরপরই হাজীরা যেন নিজকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিলেন। এরপর থেকে কোন খারাপ কাজ কিংবা খারাপ চিন্তাও হাজীরা করেন না। সুন্দর ও পবিত্র ভাব সবার মনে, শান্তির ভাব সকলের হৃদয়ে।
এহরাম অবস্থায় কেউ খারাপ কথা বলেন না। এ অবস্থায় কোন ঝগড়া করা যায় না। কোন প্রাণীকে আঘাত বা হত্যা করা যায় না। এমনকি শরীরের স্বাভাবিক দাবীগুলো পূরণ থেকে বিরত থাকতে হয়।
শুধু বাইরের দিক থেকে নয় –মনের দিক থেকেও একমাত্র আল্লাহর কথাই চিন্তা এবং নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো স্মরণ করে আল্লাহর কাছে মাফ চান হাজীরা। হজ্বের অনুষ্ঠানগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে থাকেন। শুরু থেকে নিয়ে মিনায় পৌঁছে, প্রথম পাথর মারা পর্যন্ত হাজীরা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করেন তালবিয়াঃ
লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান্নি’মাতা লাক ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাকা।
অর্থঃ আমি হাজির। হে প্রভু, আমি হাজির হয়ে গেছি তোমার দরবারে। তোমর কোন শরীক নেই। আমি তোমার সামনে হাজির হয়ে গেছি। সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং সব কিছুর মালিকানা বা কর্তৃত্ব তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই।
কাবা পৌঁছেই হাজীরা দোয়া করেন এবং কাবার চারদিকে সাতবার ঘুরে আসেন। কালো পাথর (আল আসওয়াদ) থেকে এই ঘোরা শুরু হয়। ঐতিহাসিক এই কালো পাথরে চুমু দিয়ে অথবা তা স্পর্শ করে কিংবা শুধু তার দিকে হাত তুলে এই ঘোরা শুরু হয়। এইভাবে হাজীরা শুধু আল্লাহর হুকুম পালন করেন রাসূল (সঃ)-এর দেখানো পথে।
এরপর হাজীদেরকে কাবার পাশেই দুই পাহাড়-সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড় দিতে হয় সাতবার। হযরত ইব্রাহীম (আ) তাঁর স্ত্রী বিবি হাজরা (আ) ও পুত্র ইসমাইলকে (আ) আল্লাহর হুকুমে মক্কার ধূসর মরুভূমির বুকে রেখে গিয়েছিলেন। খাবার ফুরিয়ে গেলো। মরুভূমির খাঁ খাঁ রোদে পানির জন্য কাতরাচ্ছে শিশু। মাতা হাজরা (আ) পাগলের মত পানির সন্ধানে একবার সাফা পাহাড়ে উঠছেন আবার দৌড়ে নেমে মারওয়ায় উঠছেন –কোথাও পানি পাওয়া যায় কিনা। কোথাও পানি নেই। ফিরে এসে দেখেন পুত্র ইসমাইলের (আ) পায়ের কাছে তৈরী হয়েছে এক ফোয়ারা। এই হলো যমযম। পরে এই যমযম বালুর নীচে চাপা পড়ে যায়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দাদা মুত্তালিব একদিন স্বপ্নে এই যমযমের সন্ধান পান। ফলে এই যমযমের উৎস আবার খুঁজে পাওয়া যায়।
পানির জন্য হাজরার এই দৌড়াদৌড়িকে স্মরণ করে হাজীদেরকে ‘সাঈ’ করতে হয়। প্রত্যেক হাজী সাফার উপরে উঠেন। ‘তালবিয়া’ উচ্চারণ করে নামেন এবং মারওয়ায় পৌঁছেন –আবার উপরে উঠেন এবং সেই তালবিয়া উচ্চারণ করেন। এইভাবে সাতবার দৌড় দিতে হয়।
হজ্বের তাৎপর্য
এইভাবে লক্ষ্য করে দেখা যায় হজ্বের আচার-অনুষ্ঠানগুলো শুধু কতকগুলো সাধারণ অনুষ্ঠান নয়। ঈমানকে মজবুত করার জন্য, দুনিয়ার সকল কোলাহল ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে একাগ্র মনে আল্লাহর সামনে হাজির হবার জন্য মনকে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সব ধরনের কষ্টকে স্বীকার করার মত মানসিকতা তৈরীর উদ্দেশ্যে হজ্ব এক অনুপম ‘ইবাদত’।
হজ্বের মধ্যে যেন এক হয়ে গেছে নামায, রোযা, যাকাতের শিক্ষা। আমরা দিনে পাঁচবার আল্লাহকে নামাযের মাধ্যমে স্মরণ করি। আর হজ্বের সময় সব সময় সকল মুহুর্তে আল্লাহর স্মরণেই কাটে। আমরা যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সম্পদের মোহ ত্যাগ স্বীকার করি। হজ্ব পালন করতে হলে তার চেয়েও বেশী আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। রোযা আমাদেরকে শিখায় দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থেকে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে। হজ্বের সময় এহরাম অবস্তায় তার চেয়েও বেশী কঠোর সাধনা করতে হয়। হজ্বের সকল আচার-অনুষ্ঠান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা সকলেই আল্লাহর। আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে –আমাদেরকে তাঁরই আদেশ অনুযায়ী চলতে হবে।
যাকাত
দুনিয়ার মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। একেক কাজ একেক ধরনের। একেক কাজ একেক উদ্দেশ্যের। একজন মুসলমানকে দুনিয়ার সব কাজ এমনভাবে করতে হয় যেন আল্লাহ খুশী হন। টাকা-পয়সা মানুষের জীবনে খুব দরকারী জিনিস। তাই টাকা-পয়সা আয় করতে হয় সকলকেই। কিন্তু টাকা-পয়সার প্রতি লোভ থাকাটা সর্বনাশের। ধন-দৌলতের কারণে লোক গরীব, ধনী হয়। এজন্য একজন অন্য একজনের চেয়ে বড় হয়। টাকার অহংকারে এক মানুষ অন্য মানুষকে হেয় ভাবে দেখে। টাকার ফলে আরাম-আয়েশে সহজেই মেতে উঠে। তাই টাকা উপার্জন, খরচ করা এবং টাকা জমানোর ব্যাপারে প্রত্যেক লোককে সতর্ক হতে হবে। আমাদের প্রভু আল্লাহ। তিনি মানুষের এ দুর্বলতাটা ভালভাবে জানেন। তাই টাকা-পয়সা ও ধন-দৌলতের ব্যাপারেও তিনি পথনির্দেশ দিয়েছেন। কিভাবে টাকা উপার্জন করতে হবে, কিভাবে খরচ করতে হবে, এসব তিনি জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে।
যাকাত একটি ইবাদত
আল্লাহর নির্দেশ মত কাজ করাকে ইবাদত বলে। আল্লাহর নির্দেশ মত টাকা উপার্জন করা এবং খরচ করাও তাই ইবাদত। যাদের টাকা-পয়সা আছে তাদের জন্য এমনি একটি ইবাদত যাকাত।
প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানকে তার সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট হারে কিছু অর্থ গরীবদের মধ্যে বিলি করতে হয়, একে ‘যাকাত’ বলে। মোটকথা ধনী মুসলমানদের সম্পদের কিছু অংশ তাদের গরীব ভাইদেরকে দিতে হয়। তাই অনেকে ভুল করে যাকাতকে মনে করে ‘দান’ অথবা ট্যাক্স। আসলে যাকাত দান কিংবা ট্যাক্সের মত কোন জিনিস নয়। এটা এমন একটি দায়িত্ব যা আল্লাহ পালন করতে বলেছেন। যাকাত একটি ইবাদত।
যাকাত কথাটি আরবী। এ শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা। যাকাত টাকা-পয়সার প্রতি লোভ-লালসা থেকে মনকে পবিত্র রাখে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সুন্দর বলেছেনঃ
তোমাদের বাকী ধন-দৌলতকে পবিত্র করার জন্যই আল্লাহ যাকাতন ফরয করেছেন। (আবু দাউদ, যাকাত অধ্যায়)
যাকাতের এই অর্থ আমাদেরকে একথাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, টাকা-পয়সা উপার্জন করতে হলে তা পবিত্র উপায়েই করতে হবে।
যাকাত সমাজকেও পবিত্র করে। সমানে অর্থনৈতিক সমস্যার সুন্দর সমাধান দিয়েছে যাকাত। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ঈমানের পবিত্রতার পর আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে ভাল কাজ হলো দয়া, ক্ষমা, অন্যের জন্য ভাল কাজ করা।
যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, যারা রাগকে দমন করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল হয়, যারা ভাল কাজ করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।
সূরা আল ইমরান-১৩৪
যাকাতের গুরুত্ব
আল্লাহ এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ তো তাঁরই। মানুষ শুধু তাঁর খলিফা। তাই মুসলমানরা টাকা উপার্জন করে, খরচ করে, দান করে সব আল্লাহকে খুশী করার জন্য। টাকা উপার্জন করা বা জমানোই আসল কাজ নয়। টাকা-পয়সা অপ্রয়োজনীয় ও খারাপ কাজে ব্যয় করা বা অন্য লোকের উপর নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্য খাটানো কিংবা জুলুম নির্যাতন এবং শোষনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নয়। একটা পবিত্র জীবন যাপনের জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। তাই অর্থকে পবিত্র পথে খরচ করা দরকার। টাকা পয়সা কখনও সমাজে অভিশাপ হয়ে থাকে। যখন কিছু লোক অন্যায়ভাবে টাকা জমাবার সুযোগ পায়, যখন কিছু সংখ্যক লোকের হাতে সমাজের সব টাকা জমায় হয় এবং সেই হাতেগোনা কয়েকজন লোক নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য অন্যের উপর নিজের মাতব্বরী খাটায় এবং অন্যান্য নোংরা কাজে সে টাকা খরচ করে, তখনই সমাজে দেখা দেয় বিপর্যয়।
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রক্ত আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু দরকার হলো সে রক্ত আমাদের শরীরের সব শিরা-উপশিরায় দৌড়াদৌড়ি করবে। কোথাও জমা হয়ে গেলে আমাদের শরীর হবে অসুস্থ। তেমনি একটি সমাজে টাকা-পয়সাকে হতে হবে সচল। তাই এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে, যার ফলে টাকা কোথাও কারও হাতে অন্যায়ভাবে জমা থাকনে না পারে। যাকাতের মাধ্যমে ধনী লোকদের কিছু সম্পদ গরীবদের হাতে পৌঁছে যায়। এভাবে ‘অর্থ’ সমাজে সচল অবস্থায় থাকে।
ইসলাম একটি সুন্দর সমাজ গড়তে চায়। টাকা-পয়সা, মাল-সম্পদের ব্যাপারটি মানুষের জীবনের একটি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই ইসলাম এ বিষয়ের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য যাকাতকে ইসলামের একটি স্তম্ভ বলা হয়েছে। নামায, রোযা, হজ্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, যাকাতও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।
যাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
নামায, রোযার মত যাকাতের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর কাছে নিজেকে নত করে দেয়া, আল্লাহ যা দিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করা এবং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। মোটকথা, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে আল্লাহকে খুশী করা। তাই যাকাত দেয়া আল্লাহর একটি হুকুম পালন করা।
আল্লাহকে খুশী করার জন্য যাকাত দেয়া হয়। কারো এটা মনে করা উচিত নয় যে, অনুগ্রহ দেখিয়ে একজনকে যাকাত দেয়া হচ্ছে। আসলে যে যাকাত নেয়, তার এটা পাওয়ার অধিকার আছে এবং যে দেয় তার এটা কর্তব্য। তাই অন্যান্য এবাদতের মত যাকাত দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে যিনি দিচ্ছেন তার এবং যিনি নিচ্ছেন তার-দুজনেরই মনের উদ্দেশ্য বা নিয়ত পবিত্র হওয়া উচিত। যাকাত দিতে পারা তাই কোন অহংকারের বিষয় নয়, এটা নামাযের মত পবিত্র একটা ইবাদত। যাকাত দেয়ার পর তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা দরকার। আল্লাহর দরবারে নিজের অন্যান্য গোনাহর জন্য মাফ চাওয়া দরকার।
যাকাতের উপকারিতা
নৈতিক দিক থেকে যাকাতের উপকার হলো-যাকাত যে দেয় তার মন থেকে অর্থের প্রতি লোভ এবং স্বার্থপরতা দূর হয়ে যায়। আবার যাকাত নেওয়ার ফলে ধনীদের প্রতি হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থাকে না।
একটি সমাজে যাকাতের উপকারতা অনেক। যে সমাজে যাকাতের ব্যবস্থা থাকে, সে সমাজে ধনীরা গরীবদের প্রতি হয় দয়াশীল ও সহানুভূতিশীল। আর গরীবদের মন থেকে সব কালিমা মুছে যায়। যে ভাই তার চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে তার প্রতি তার ভাল ধারণা হয়।
যে সমাজে যাকাত ব্যবস্থা চালু আছে সে সমাজে ধনীদের মধ্যে টাকা জমানোর ইচ্ছা লোপ পায় এবং টাকা জমানোর সুযোগও কম থাকে। ফলে টাকা-পসাকে হাতিয়ার করে যে জুলুম, শোষণ, হিংসা-বিদ্বেষ তা অচিরেই দূর হয়ে যায়।
যাকাত এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করে যে সমাজে ভালবাসা থাকে, থাকে সম্মান, ভ্রাতৃত্ব, মমতা, সহানুভূতি। সে সমাজের একজন অন্য জনের কল্যাণের চিন্তা করে। আর তাই একটি ইসলামী সমাজে ধনী মুসলমানদের কাজ থেকে যাকাত আদয় করে নিয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য তা ব্যয় করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) তাই যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আসলে যাকাত এমনভাবে দেয়া দরকার যাতে সব মিলিয়ে সমাজের উপকার হয়। সমাজ থেকে দূর হয়ে যায় দারিদ্রতার অভিশাপ।
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয়
নগদ টাকা ও অলংকার, গবাদী পশু এবং ক্ষেতের ফসলের জন্য যাকাত দিতে হয়। গবাদী পশু ও ক্ষেততের ফসলের জন্য যাকাতের হিসাবটা বেশ জটিল।
নগদ টাকার ব্যাপারে হিসাব হলো কমপক্ষে শতকরা আড়াই ভাগ। বছরের শেষে সব খরচের পর যার কাছে কমপক্ষে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান টাকা থাকে, তাকে যাকাত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এটি হলো সর্বনিম্নহার।
যারা যাকাত নিতে পারে
কোরআনে বলা হয়েছে-
এই সাদাকাসমূহ (যাকাত) তো কেবল তাদের জন্য যারা নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, যারা তা সংগ্রহ করে (কর্মচারী), যাদের মনকে আকর্ষণ করা হলো (নও-মুসলিম) ঋণ গ্রস্তদের ঋণ মুক্ত করার জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সবকিচু জানেন এবং তিনি মহাজ্ঞানী
সূরা তওবা-৬০
তাহলে দেখা যায় ধনী লোকদের জমানো টাকা থেকে যাকাত পায়ঃ
- গরীব
- মিসকিন
- নও-মুসলিমঃ যারা অন্য ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে
- দাস-দাসীঃ দাস-দাসীদের মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হয়
- যারা যাকাত সংগ্রক করেঃ সরকারীভাবে যাকাত সংগ্রহের জন্য যেসব কর্মচারী কাজ করে
- মুসাফির
- যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে
চতুর্থ অধ্যায়
ইসলমী জীবন ব্যবস্থা
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন
আধ্যাত্মিক জীবন
বুদ্ধিভিত্তিক জীবন
বাহ্যিক জীবন
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা
খাদ্য
পোশাক-পরিচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা
খেলাধুলা, চিত্ত বিনোদন ও উৎস
ইসলামের সামাজিক জীবন
সকল মানুষ সমান
পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি
নারীর মর্যাদা
সামাজিক দায়িত্ববোধ
ইসলামী সমাজের লক্ষ্য
ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত
শরিয়তের উৎস
ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য
ইসলামের অর্থনীতি
উপার্জন
ব্যয়
যাকাতের ব্যবস্থা
ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
সুদকে হারাম ঘোষনা উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)
ইসলামের রাজনীতি
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
কুরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান
খেলাফত
পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসন
সরকার ও জনগণের দায়িত্ব
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব
অমুসলিমদের অধিকার
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা
ইসলাম নিছক কোন ধর্ম নয়। কতকগুলো বিশ্বাস কিংবা আচার-আচরণের নামও ইসলমান নয়। মানুষের পুরো জীবনের জন্য আল্লাহর দেয়া একটি ব্যবস্থা হলো ইসলাম। পুরো জীবন অর্থঃ তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, আর্থিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন-সবকিছু। তাই ইসলামের আলোকে একটি জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আমরা সংক্ষেপে এই জীবন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছি। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই তবে এই আলোচনার মাধ্যমে তোমাদের মদ্যে ইসলামের পুরো জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হোক এটাই আমাদের কাম্য।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন
ইসলাম একান্ত ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও বিশদভাবে আলোচনরা করে। এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো –কোন মানুষই তুচ্ছ কোন সৃষ্টি নয়। এমনকি কোন উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি নয়। তাই ব্যক্তি তার নিজ ইচ্ছায় নিজকে ধ্বংস করবে, নিজকে বিপথগামী করবে কিংবা নিজ সম্পর্কে উদাসীন হবে এমন কোন সুযোগ ইসলাম দেয় না। কোরআন বলেঃ
হে প্রভু তুমি আমাকে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করোনি।
সূরা আলে-ইমরান-১৯১
এই চেতনা ব্যক্তিকে নিজের সম্পর্কে সচেতন করে। এমনিভাবে ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা যে কোন জীবন পদ্ধতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘ব্যক্তি’ এবং এই কারণে ইসলাম সব সময় ব্যক্তি থেকে তার যাত্রা শুরু করে।
মানুষের রয়েছে দু’টি প্রকৃতি –একটি অভ্যন্তরীণ যা দেখা যায় না এবং অন্যটি হলো বাহ্যিক যা দেখা যায়। ইসলাম এ দু’টি সত্তাকেই গুরুত্ব দেয়। এ দুটি সত্তা পরস্পর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, সম্পৃক্ত এবং পরিপূরক। ইসলাম এ দুটি সত্তার ভারসাম্যপূর্ণতার মাধ্যমে ব্যক্তি গঠন করতে চায়।
মানুষের ভিতরের যে পরিচয় তাকে আবার দুটি জিনিসে ভাগ করা যায় –একটি ‘রুহ’ (আত্মা, খুদি বা কলব) অন্যটি ‘আকল’ (মন, যুক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি) ইসলাম এই দুইটি প্রকৃতির খোরাক যোগায়।
আধ্যাত্মিক জীবন
ইসলাম আত্মার প্রশান্তির জন্য যে ব্যবস্থা তা নিম্নরূপঃ
১। নামায
২। যাকাত
৩। রোযা
৪। হজ্ব
৫। খোদা ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা
৬। খোদার প্রতি আস্থাশীলতা
৭। নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর পথে আত্মদান
এসব দিয়ে বিশদ আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। এসব কিছুর অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলাম মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে চায়।
বুদ্ধিভিত্তিক জীবন
আর বুদ্ধির খোরাকের জন্য ইসলাম মানুষকে জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিক করেছে। অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের জন্য ঐশী আদেশ কোরআনই প্রথম দিয়েছে মানুষকে।
কোরআন মানুষকে তার প্রতিটি কর্মকে জেনে বুঝে করার জন্য অনুপ্রাণিত করেনা বরং বুদ্ধি ও জ্ঞানের উপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা জ্ঞাপন করেছে। কেননা মানুষের ভিতরের আত্মা ও মন সুস্থ ও নিরাপদ হলেই প্রকৃতপক্ষে বাইরের দিকটা অনুরূপ সুস্থ ও নিরাপদ হতে পারে।
তাই মুসলমানদের জন্য একান্ত প্রয়োজনঃ
- নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন
- হাদীস অধ্যয়ন
- নবী-সাহাবীদের জীবন অধ্যয়ন
- কোরআন হাদীসের আরোকে লেখা ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন
এছাড়া একজ মুসলমানের জন্য বর্তমান দুনিয়ায় কোথায় কি ঘটছে তা জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
এমনিভাবে গড়ে উঠে মুসলমানদের এক বুদ্ধিভিত্তিক জীবন –যা তাকে করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমৃদ্ধ, নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল। সেই সঙ্গে এই জ্ঞান তাকে তার আদর্শের একজন নিষ্টাবান প্রচারক হিসেবে গড়ে তুলে।
বাহ্যিক জীবন
ব্যক্তির বাহ্যিক সুন্দর করার জন্য পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য-সামগ্রী, পোশাক, আচার-ব্যবহার, সাজ-সজ্জা এসব সম্পর্কে ইসলাম সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ভুল করেনি।
১। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো শুধু তার দৈহিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য নয় তার মানসিক পবিত্রতার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। দিনে অন্ততঃ পাঁচবার ওজু (প্রয়োজনে গোসল), নিয়মিত দাঁত মাজা, চুল ছাঁটা এসব স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ তা আজ সকলের কাছে পরিস্কার। আর ইবাদত হিসেবে পালন করে এসব স্বাস্থ্য রক্ষার বিধান পরিণত হয়েছে আরও মহিমান্বিত ও চমৎকার এক একটি পবিত্র কাজে।
২। খাদ্য
মানুষ যা খায় তার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক সরাসরি। খাদ্যের সাথে শুধু তার দেহের সম্পর্ক নয়, মনেরও সম্পর্ক আছে। তাই ইসলাম ব্যক্তির খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যেল জন্য নিয়ম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য হতে হবে স্বাভাবিকভাবে পবিত্র, মানুষের জন্য কল্যাণকর। খাদ্যের পরিমাণের ব্যাপারেও তা হতে হবে মধ্যম।
কোরআন বলেছে,
হে মানুষ! জমীনে যে সব হালাল ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে তা খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলোনা, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
সূরা বাকারা-১৬৮
যেসব খাদ্য ও পানীয় খাওয়া বা পান করা যায় সেসবকে বলা হয় ‘হালাল’ এবং নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয়কে বলা হয় ‘হারাম’।
৩। পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজ-সজ্জা
মানুষ আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি তাই পোশাকও হতে হবে সুন্দর ও শালীন। পোশাক শুধুমাত্র লজ্জাও উলঙ্গতা ঢাকার জন্য নয়। পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বকে সুন্দর করার একটি মাধ্যম।
কোরআন খুব সুন্দরভাবে বলেছে,
হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাক দিয়েছি যাতে করে তোমরা দেহের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকতে পারো। এটি তোমদের শোভা বর্ধনের উপায়ও। আর সর্বোত্তম পোশাক হলো ‘খোদাভীতি’র পোশাক।
সূরা আল আরাফ-২৬
পোশাকের ধরণ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম কোন বিশেষ ধরনের পোশাকের কথা বলেনি। তবে কতগুলো নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলোঃ
- পুরুষরা নাভি থেকে হাঁটু অবশ্যই ঢেকে রাখবে।
- মেয়েরা ঘরে মুখ, হাত, পায়ের পাতা ছাড়া সারা শরীর ঢেকে রাখবে কিন্তু বাইরে বের হবার সময় কিংবা পর পুরুষের সাথে দেখা করার সময় এই সাথে চোখের অংশ ছাড়া মুখমণ্ডল প্রায় সবটাই ঢাকবে। অবশ্য কোন কোন মাজহাব পুরো মুখ খোলা রাখার সুযোগ দিয়েছে।
- মেয়েদের এমন কোন পোশাক পরা উচিত নয় যাতে তাদের দেহের অংশ দেখা যায় কিং বা প্রদর্শিত হয়।
- খাঁটি রেশমী কাপড় কিংবা সোনর কাজ করা কাপড় পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।
- পুরুষের মেয়েদের পোশাক পরা নিষেধ।
- মুসলমানদের এমন সব পোশাক পরা উচিত নয় যেসব অন্য জাতি বা ধর্মের পোশাক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
ইসলাম খুব সাধাসিধা পোশাক পরার জন্য উৎসাহিত করেছে। গর্ববোধ, অহমিকা কিংবা প্রদর্শনেচ্ছা জাগিয়ে তোলে এমন পোশাক পরিধান করা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে।
মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশে কোন কঠোরতা নেই বরং মেয়েদের স্বভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষার জন্যই মেয়েদের সাজ-সজ্জা, সৌন্দর্য রক্ষা, হাঁটা-চলা এমনকি দৃষ্টি নিক্ষেপের ব্যাপারে ইসলাম নীতিমালা দিয়েছে। এই পুরো নীতিমালাকে একত্রে আমরা বলতে পারি ‘পর্দা প্রথা’।
৪। খেলাধুলা, চিত্ত-বিনোদন ও উৎসব
প্রিয় নবী দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য ও বলিষ্ঠ মনোবল গড়ে তোলার উপযোগী খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনকে অনুমোদন করেছেন। মোটকথা যা কিছু মানুষের মধ্যে সুস্থ চিন্তার সৃষ্টি করে, তার মনকে সতেজ করে, শরীরকে সুস্থ রাখে ইসলাম তাকে উৎসাহিত করে। রাসূল (সঃ) একটি হাদীস থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি বলেছেন,
সকল মুমিনের মধ্যেই ভাল গুণাবলী আছে তবে,
শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির চেয়ে শ্রেয়। (সহীহ মুসলিম, ইবনু মাজাহ)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন অত্যন্ত অর্থবহ। এর একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। জীবনকে যেমন তেমন করে কাটিয়ে দেয়া যায় না। আর তাই মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকেও ইসলাম আল্লাহর নির্দেশে লাগাম টেনে ধরেছে। এই দৃষ্টিতেই ইসলামে জুয়া খেলা, মদ্যপান, লাগামহীন সময় অপচয় করে তাস খেলা প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলির কোনটাই আনন্দদায়খ বা বিনোদনমূলক কাজ নয়।
ইসলামের উৎসব পালনও এই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ে থাকে। ইসলামে উৎসব নিছক শুধু আনন্দের জন্য নয়। এসব উৎসবের মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনি উদ্দেশ্য নিয়েই ইসলামের দুটি বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালিত হয়।
কবিতা, গান এসব ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশ একই ধরনের। মোকটথা, যে খেলাধুলা কিংবা চিত্তবিনোদন একটি মুহুর্তের জন্য হলেও বান্দাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে মুমিন মুসলমানের জন্য তা কখনই আনন্দদায়ক, সুখকর কোনকাজ হতে পারে না। মুমিনের আনন্দতো আল্লাহকে পাওয়ার মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো আল্লাহর আইনকে দুনিয়ার বুকে কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রতিটি কাজে এগিয়ে আসা।
ইসলামের সামাজিক জীবন
কোন লোকই একা বেঁচে থাকতে পারেনা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তার যে পরিবার সেই পরিবার নিয়েও সে একা বাঁচতে পারেনা। তাকে আরও অনেকের সাথে মিশতে হয়, চলতে হয়, লেনদেন করতে হয়, মতের আদান প্রদান করতে হয়। মোটকথা, একটা সমাজের মধ্যে তাকে মিশে থাকতে হয়। পরিবার এবং সমাজরে মাঝে থেকে তার নিজের এবং সমাজের অন্যের উন্নতি, সুখ-শান্তির জন্য একজন মুসলমান আল্লাহ ও রাসূলের (স) শেখানো নীতিমালা অনুযায়ী চলে।
সকল মানুষ সমান
ইসলামী সামাজিক জীবনের মূলনীতি হলো দুনিয়ার সকল মানুষ সমান এবং সকলে একই পিতা-মাতা আদম (আ) ও হাওয়ার (আ) সন্তান। দুনিয়ার মানুষের কারো গায়ের রং কালো, কারো সাদা, কারো বাদামী। একেক জনের ভাষা একেক রকম। সামাজিক রীতি-নীতি, চাল-চলন একেক জনের একেক রকম। তবুও সব মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি মানুষকে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক যে পার্থক্য তাকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। আমরা দুনিয়ার সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি-একই পিতা-মাতার সন্তান –এই সত্যকে যখন স্বীকার করে নেওয়া হয় তখন একজন অন্যজনের ভাষা, অন্যের গায়ের রং, অন্যের সামাজিক রীতি-নীতিকে মর্যাদা দিতে শিখে। তাই কোরআন এবং হাদিসে বারবার একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরআন বলেছেঃ
হে মানুষেরা! তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি ‘প্রাণ’ থেকে সৃষ্টি করেছেন।
সূরা নিসা-১
মুমিনরাতো পরস্পরের ভাই
সূরা হুজরাত-১০
এভাবেই ইসলাম বর্ণগত, ভাষাগত, বংশগত, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবীকে নির্মূল করে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের পথকে সুগম করে তোলে।
অধিকারের দিক থেকে মর্যাদার দিক থেকৈ সকল মানুষ সমান এই নীতিমালার উপর ইসলাম গড়ে তুলতে চায় এক সুন্দর পরিবার, এক সুন্দর সমাজ, এক সুন্দর দেশ –গড়ে তুলতে চায় সুন্দর পৃথিবী।
পারিবারিক জীবন-ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি
প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূল ভিত্তি। একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সমাজের প্রতিটি পরিবারকে সুন্দর করার পরিকল্পনা আছে ইসলামে। আর এজন্য পরিবারের স্বামীর ভূমিকা ও দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য –এ সব বিষয়ে ইসলাম সুন্দর ও কার্যকর শাশ্বত বিধানসমূহ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি সমঝোতার জন্য কোরআন যেসব বিধান দিয়েছে এবং আমাদের প্রিয়নবি (স) যেসব উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরেছেন যার নজির ইতিহাসে বিরল।
একটি সুন্দর পরিবার গঠনের জন্য দেয়া হয়েছে বিবাহের ব্যবস্থা, দেয়া হয়েছে পর্দার বিধান। এক একটি সুন্দর পবিত্র বাগান হিসাবে সমাজের সকল পরিবারকে গড়ে তুলতে চায় ইসলাম।
নারীর মর্যাদা
সমাজে নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে মাতা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে নারীর ভূমিকা অনন্য। ইসলাম নারীর এই মর্যাদাকে স্বীকার করে নিয়েছে। মাতা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইসলাম ছাড়া আর কোন মতবাদ এতো গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি। প্রিয় নবী (স) বলেছেন,
মাতার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।
স্ত্রী হিসাবে নারীকে নির্দিষ্ট মর্যাদা দিয়ে নবী (স) বলেছেন,
তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।
কন্যা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইষলাম সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। (ইবনু মাজাহ, বিবাহ অধ্যায়)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মত আয় করতে পারে এবং সম্পদের মালিক হতে পারে। ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়েছে। পিতা, স্বামী অথবা তার পুত্রহীন ভাইয়ের স্মপত্তিতে তার অংশকে নির্দিষ্ট করেছে।
ইসলামই নারীকে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়েছে। এবং নির্ধারিত সীমার মধ্য কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।
কোরআন বলেছে,
নারী পুরুষ দুজনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেকের রয়েছ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সূরা আল-লাইল-৩-৪
প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজক কাজক স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ধর্ম অনুযায়ী ভাগ করে দিয়েছে। শরীরের দিক থেকে সবল ও মানসিক দিক থেকে সাহসী হবার কারণে জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করার যোগ্যতা দিয়ে পুরুষকে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভালবাসা, মায়া, মমতা প্রভৃতি দুর্লভ গুণাবলীর জন্য নারীকে দেয়া হয়েছে সমাজের আগামী দিনের নাগরিকদের গড়ে তোলার কঠিন ও মহৎ দায়িত্বটি।
এই প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করার এই অর্থ নয় যে নারীদেরকে অন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাস এর সাক্ষ্য। সন্তান পালন ও সংসারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সাথে সাথে মুসলিম নারীদের দেখা গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহন করতে, আহত ও অসুস্থ রুগীদের সেবা করতে, আহত রুগীদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে, এমন কি কখনো কখনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দিয়েছে এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করেনি।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মতবাদই নারীকে তার সঠিক মূল্য দিতে পারেনি। পাশ্চাত্যে নারী হচ্ছে আনন্দের সামগ্রী। ‘নারী স্বাধীনতার’ শ্লোগান দিয়ে পুরুষরা তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজে নারী স্বাধীনতা পায়নি, পায়নি সমান অধিকার। মাঝখান থেকে সে হারিয়েছে পরিবারে এবং সমাজে তার স্বাভাবিক সহজাত মর্যাদা ও অধিকারকে।
সামাজিক দায়িত্ববোধ
ইসলাম মানুষকে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে শিখায়। সমাজের প্রতি রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব। অন্যের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা, অন্যেল জন্য অর্থব্যয়, একমনি সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা দেয় ইসলাম। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তির কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য সমাজকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ এক সুন্দর সম্পর্ক। যখন ব্যক্তি সক্ষম থাকে তখন সে হয় দানকারী এবং সমাজ হয় দান গ্রহণকারী। আর ব্যক্তি যখন অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তাকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দানের দায়িত্ব সমাজের। এমনিভাবে ইসলামী সমাজে কোন ব্যক্তি অন্যের ব্যাপারে উদাসীন হতে পারেনা –হতে পারেনা স্বার্থপর। সে এমন কোন কাজও করতে পারেনা যাতে সমাজের কোন প্রকার ক্ষতি হয়। বরং নিজের জন্য যা পছন্দ করা হবে অন্যের জন্য তাই করতে বলা হয়েছে। (আল হাদিস)
ইসলামী সমাজের লক্ষ্য
সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে যে ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে কোন বিশেষ ব্যক্তির, কোন বিশেষ বংশের, কোন বিশেষ গোত্রের, কোন বিশেষ ভাষার মানুষের, কোন বিশেষ বর্ণের বা জাতির বড় হবার কোন উপায় নেই। সে সমাজের প্রধান লক্ষ্য হলো খোদার বন্দেগী এবং খোদার উদ্দেশ্য সফল করে তোলা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে –মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামী সমাজ জীবনের উল্লেখযোগ্য মূল উপাদানগুলো হলোঃ সহযোগী লোকদের প্রতি ভালবাসা, ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীর অধিকার সচেতনতা, আর্তের সান্ত্বনা ও সমবেদনা, রোগীর সেবা, জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের প্রশ্নে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কোরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলের (স) অনেক বাণীতে প্রতিটি মুসলমানকে এসব গুণাবল অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত
যুগে যুগে নবী-রাসূলেরা এসেছেন। মানুষকে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বলেছেন –ঈমান আনতে বলেছেন আখিরাতের উপর, কিতাবের উপর। বলেছেন সব পথ ছেড়ে আল্লাহর এবং নবী-রাসূলদের দেখানো পথে চলতে, তাঁদের আনুগত্য করতে –তাঁদেরকে অনুসরণ করতে। এই ঈমান ও এবাদতের নাম হচ্ছে দ্বীন। সব নবীর দ্বীন ছিল এক। সব নবীর শিক্ষা এক। কিন্তু এবাদতের পদ্ধতি কি, সামাজিক রীতিনীতি কি হবে, পারস্পরিক লেনদেন ও সম্বন্ধ রক্ষার বিধান কি, কোনটা হালাল, কোটনা হারাম, কোনটা করণীয়, কোনটা নয় –এর সবকিছু যুগের ভিন্নতার কারণে একেক নবীর জন্য একেক রকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই মৌলিক দিক থেকে দ্বীন হলেও আল্লাহ নবী রাসূলদের মাধ্যমে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কওমের জন্য এইসব দ্বীন পালনের বিভিন্ন রীতিনীতিও পাঠিয়ে দিয়েছেন। এইসব রীতি-নীতি, পদ্ধতি, বিধি-বিধানকে শরিয়ত বলে। শরিয়ত অর্থ সোজা পথ বা উদাহরণ। আমাদের জন্য শরিয়ত হলো মেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে পাওয়া এবাদতের পদ্ধতি, সামাজিক রীতি-নীতি, পারস্পরিক আদান-প্রদান সংক্রান্ত আইন-কানুন, হালাল-হারামের সীমারেখা ইত্যাদি।
শরীয়তের উৎস
পবিত্র কোরআন হলো শরীয়তের মূল উৎস যেখান থেকে ইসলামের সকল পবিত্র রীতি-নীতি, আইন-কানুন নেওয়া হয়েছে। এটি হলো আল্লাহর কালাম যার প্রতিটি বিন্দু আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। যা নবী করীম (স)-এর জীবনে ২৩ বছর ধরে অল্প অল্প করে নাজিল হয়েছে। আর নবী (স) হচ্ছেন এই কোরআনের বাস্তব উদাহরণ।
নবীর (স) সারাজীবন হলো কোরআনের ব্যাখ্যা। তাই শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো নবীর ‘সুন্নাহ’। ‘সুন্নাহ’-এর শাব্দিক অর্থ পথ, ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন, কাজ করার পদ্ধতি, জীবন পদ্ধতি, উদাহরণ। ইসলামী পরিভাষায় ‘সুন্নাহ’ অর্থ নবী করীম (স)-এর জীবন ও কাজ।
‘হাদীস’ বলতে আমরা বুঝি নবীর কথা, কাজ এবং তার অনুমোদন নিয়ে করা কাজ। আমাদেরকে কিভাবে আল্লাহর মর্জি মত চলতে হবে সেসব কিছু নবী (স) শিখিয়ে গেছেন তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে। শুধু মুসলমানদের জন্যই নয় –সারা বিশ্বের জন্য এটি সৌভাগ্যের যে, আজও নবী করীম (স) এর জীবনের কথা ও কাজ মোটকথা পুরো জীবনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মানব জাতির জন্য সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে।
নবীর (স) কথা তাঁর সংগী সাথীরা নিষ্ঠার সাথে স্মরণ রাখতেন। প্রতিটি নির্দেশ যত্নের সাথে শিখে নিতেন। এসব কথা সাহাবীদের কাছ থেকে মানুষ শুনেছে, মুখস্ত করেছ, কেহ তা লিখে রেখেছে। যার কাছে শুনেছে তার নামও লিখে রেখেছে। ক্রমে ক্রমে এসব বর্ণণা পুস্তকাকারে সংগৃহীত হয়েছে। এসব গ্রন্থকে ‘হাদীস’ বলে। যার ফলে নবীর (স) কথা ও কাজের বর্ণনা সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কোন নেতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর অনুসারীদের নিষ্ঠার, আন্তরিকতার এমন উদাহরণ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
হাদীসের কিতাবের মধ্যে ছয়টি বিশেষভাবে নির্ভরযোগ্যঃ
১। সহীহ আল-বোখারী (মোহাম্মদ বিন ইসমাইল, ইমাম বোখারী (র) নামে পরিচিত, জন্ম ১৯৪ হিঃ মৃত্যু ২৫৬ হিঃ)
২। সহীহ মুসলিম (মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ, ইমাম মুসলিম (রঃ) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৬১ হিঃ)
৩। সুনানে আবু দাউদ (সুলাইমান বিন আসন্দ, আবু দাউদ (র) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৭৫ হিঃ)
৪। সুনানে ইবনে মাজা (মোহাম্মদ বিন ইয়াজিদ (রঃ) জন্ম ২০৯ হিঃ মৃত্যু ২৭৩ হিঃ)
৫। জামি আত-তিরমীজি (মোহাম্মদ বিন ঈসা (র) জন্ম জানা নেই, মৃত্যু ২৭৯ হিঃ)
৬। সুনানে আন-নিসাঈ (আহমদ বিন সোয়ায়েব (র) জন্ম ২১৫ হিঃ মৃত্যু ৩০৩ হিঃ)
এছাড়া ইমাম মালিক এর (জন্ম ৯৩ হিঃ মৃত্যু ১৭৯ হিঃ) মুয়াত্তা, ইমাম আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন বিন মাসউদ (মৃত্যু ৫১৬ হিঃ) এর মিশকাত আল মাসাবি এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (জন্ম ১৬৪ হিঃ মৃত্যু ২৪১ হিঃ) এর মশনদ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ হিসাবে প্রসিদ্ধ।
প্রকৃতপক্ষে কোরআনই শরিয়তের উৎস। ইসলামী আইনের মূলনীতি আমরা পাই কোরআনে আর সুন্নাহর মাধ্যমে পাই সেই আইনের বাস্তব প্রয়োগ বা প্রয়োগের উদাহরণ। উদাহরণস্বরূপ কোরআন বলেছে নামায কায়েম কর, রোযা পালন কর, যাকাত আদায় কর, পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে (শূরা) সিদ্ধান্ত নাও। কিন্তু কোরআন এসব কিভাবে পালন করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি। ‘সুন্নাহ’ই আমাদেরকে এ সব বিষয়ে সবিস্তারে জানায়।
ইসলামী শরিয়ত মানুষের জন্য। মানুষের উন্নয়নের জন্য। তাই শরিয়ত যুগের প্রয়োজনেই আইন-কানুন নীতি নির্ধারনের পথ বাতলে দিয়েছে। যুগের প্রয়োজনে এমন একটি বিষয় এলো যেখানে কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ নেই তখন ‘কোরআন’ ও ‘সুন্নাহ’ পারদর্শী আলেমগণ একত্রে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কোনক্রমেই কোরআন ও সুন্নাহর মূল আদর্শ ও নীতির পরিপন্থী হতে পারবে না। একে বলে ‘ইজমা’। ‘ইজমার’ শাব্দিক অর্থ ‘সর্বসম্মত’। খোলাফায়ে রাশেদার যুগ থেকে ‘ইজমা’ চালু হয়েছে।
একটি বিশেষ অবস্থা বা নীতির সাথে মিল রেখে, সম্পর্ক রেখে অন্য একটি বিশেষ সমস্যার সমাধানের নিয়মকে বলে ‘কেয়াছ’। কেয়াছ অর্থ উপমা, একই ধরনের অবস্থার ভিত্তিতে যুক্তি বা দর্শন। তাই ‘ইজমা’ ও ‘কেয়াছ’ এ দু’টিও শরিয়তী আইনের দুটি উল্লেখযোগ্য ভিত্তি।
ফিকাহ
‘কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে ইসলামী আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত গ্রন্থরাজিকে বলা হয় ‘ফিকাহ’। আলেম সমাজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফরে এই ফিকাহ শাস্ত্র তৈরী হয়েছে। মুসলমানদের জন্য এটি একটি বিরাট সম্পদ। ইসলামী আলেম, বিশেষজ্ঞদের এই মহান ত্যাগের ফলেই আজ কোটি কোটি মুসলমানদের পক্ষে কোরআন ও সুন্নাহর সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানা না থাকলেও কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করার কাজটি সহজ করে দিয়েছে ‘ফিকাহ’।
ইসলামী আইন-কানুনের চারজন বিখ্যাত সংকলক হচ্ছেন
১। ইমাম আবু হানিফা (র) (৮০-১৫০ হিঃ)
২। ইমাম মালেক (র) (৯৩-১৭৬ হিঃ)
৩। ইমাম শাফেয়ী (র) (১৫০-২৪০ হিঃ)
৪। ইমাম হাম্বল (র) (১৬৪-২৪১ হিঃ)
তাঁদের চিন্তা, গবেষনা ও উপলব্ধি ছিল সত্যকে জানার জন্য, উদ্দেশ্য ছিল মহান ও মুসলমানদের কল্যাণে নিবেদিত এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাই তাঁদের মতামত, গবেষণা, চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কম-বেশী পার্থক্য থাকবেই। পার্থক্য থাকলেও মুসলিশ উম্মাহ এই চার মহান আলেমের চার ফিকাহকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। আমরা শরিয়তী আইনের ক্ষেত্রে এই চার তরিকার যে কোন একটি তরিকাকে মেনে নিতে পারি। কিন্তু চার রকমের তরিকা একত্রে আনুগত্য করা চলতে পারে না। অনেক আলেম আবার এ মতও পোষণ করেন যে, এ চার তরিকার কোন বিশেষ ফিকাহর আনুগত্যের প্রয়োজন নেই। বরং আন্তরিকতার সাথে কোরআন ও সুন্নাহর বিধান বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আর যাদের জ্ঞান তত গভীর নয় তাদের উচিত আস্থাভাজন কোন আলেমের আনুগত্য করা। এদেরকে বলা হয় ‘আহলে হাদীস’। এই তরিকা উপরের চার তরিকার মতই সঠিক।
শরিয়তের উদ্দেশ্য
এতোক্ষণের আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হলো যে, শরিয়ত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জীবন যাপনকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং শরিয়ত হলো ইসলামের অনুমোদিত আদর্শ জীবনে বাস্তবায়নের পথ। শরিয়ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ দেখিয়ে দেয়। শরিয়তের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয় যায় না। শরিয়তের বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোন অভিনব পন্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করায় কোন লাভ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের আনুগত্য মুক্ত হয়ে নিজেদের মনগড়া পন্থায় আল্লাহকে পাওয়ার পথ খুঁজছেন। এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল। আল্লাহ ও রাসূলের (স) দেখানো পথের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা।
ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্যঃ
শরিয়তের ভিত্তি, উদ্দেশ্য এবং উৎসের দিকে লক্ষ্য করলে মানুষের তৈরী আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মানুষের তৈরী আইনের কোন স্থির ভিত্তি নেই। একেক সমাজের জন্য, একেক জাতির জন্য, একেক সম্প্রদায়ের জন্য তা একেক রকম হতে পারে। ফলে একটি সমাজের জন্য যা উপকারী, অন্য একটি সম্প্রদায়ের জন্য তা জুলুম হতে পারে। যে সমাজে যে সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব সে সমাজে সে সম্প্রদায়ের আইন চলে। সেখানে অন্যদের কার কি কষ্ট হচ্ছে তা দেখার কোন দরকার নেই। তাই আমরা দেখতে পাই দেশের মুষ্টিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্বকারী পার্লামেন্ট ধনীদের স্বার্থে ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। যদিও এর ফলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কষ্ট বাড়ছে। এইসব আইন তৈরী করে মানুষ। অপরদিকে ইসলামী আইনের উৎস হলো আল্লাহর বিধান। সেই আল্লাহ যিনি মানুষের সৃষ্টিকর্তা, যার কাছে দুনিয়ার প্রতিটি জাতি সমান, ধনী গরীব সকলে এক। তাই ইসলামী আইন সকল মানুষের জন্য, সকল জাতির জন্য এক ও অভিন্ন। পুরনের নিশ্চয়তা আছে, তেমনি আছে অন্য মানুষের –তার আত্মীয়, তার প্রতিবেশী, তার জাতির লোক, দুনিয়াবাসী সকলের অধিকার হেফাজতের ব্যবস্থা।
ইসলামের অর্থনীতি
মানুষকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষার এক সুষ্ঠু ব্যবস্থা। তাই উপার্জন করা এবং ব্যয় করা দুটোই মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় দিক। মোটকথা, ‘অর্থ’ মানুষের জীবনের একটি দরকারী জিনিস। তাই বলে অর্থ বা টাকা পয়সাই জীবনর সব নয়। আমাদের জীবনের আছে এক মহৎ উদ্দেশ্য। আমরা দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। আমাদের যেমন রয়েছে দেহ তেমনি রয়েছে মন, বিবেক।
ইসলাম মানুষের জীবন পথের সন্ধান দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিয়েছে নির্দেশনা, দেখিয়েছেন চলার পথ। ইসলাম তাই মানুষের জীবনের আর্থিক দিককে অবহেলা করেনি। উপার্জন, ব্যয় এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষের মঙ্গরের জন্য। ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি সমাজ গঠন যেখানে সকলেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে আন্তরিকতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে এবং প্রত্যেকেই পাবে তার ন্যায্যা অধিকার, সম্মান এবং মর্যাদা। সততা, ন্যায়, মায়া-মমতাকে বিসর্জন দিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধার সিংহ ভাড় কেড়ে নেওয়ার মত ‘ধূর্ত শিয়ালের’ সমাজ ইসলামী সমাজ নয়।
ইসলাম সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের জন্য কয়েকটি নিয়ম ও সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা এখন সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করবো।
উপার্জন
ইসলাম মানুষকে কাজ করে উপার্জন করার জন্য উৎসাহিত করেছে, এটি শুধু কর্তব্যই নয় বরং পুণ্যের কাজ।
নবী (স) বলেছেন,
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সকল সম্ভাব্য উপায়ে চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টা পূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর।
ইসলাম কাজ করাকে মর্যাদার চোখে দেখেছে, আর অন্যের উপর নির্ভর করা, অলসতা এবং ভিক্ষা করাকে ঘৃণা করেছে। মুসলমানদেরকে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, কারো গলগ্রহ হওয়া থেকে দূরে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সেই সংগে চায় একটি ন্যায় ও সততার সমাজ। সকল অন্যায়ের মূলে আঘাত হানে চায় ইসলাম। তাই উপার্জনের সকল অবৈধ উপায় ইসলাম বন্ধ করে দিয়েছে। উপার্জন হতে হবে হালাল পথে। উপার্জন হতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী।
মাদক দ্রব্যের মত চরিত্র বিধ্বংসী দ্রব্যের উৎপাদন, বিক্রি এবং বিতরণের সকল উপার্জন তাই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। তেমনিভাবে হারাম জুয়া, লটারী ও সুদের ব্যবসা। মোটকথা অন্যের ক্ষতি হবে, সমাজের ক্ষতি হবে এমন উপায়ে তুমি টাকা কামাবে, তা হবে না। চুরি, ডাকাতি, ঠকবাজি, মিথ্যা, চোরচালানীর উপর ভিত্তি করে ব্যবসা করবে, তাও চলবে না। সেই সাথে অন্যায়ভাবে খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিনের পর দিন মজুদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।দ
ব্যয়
সৎভাবে উপার্জনের সাথে সাথে ইসলাম সৎ ব্যয়েরও নির্দেশ দিয়েছে। একজন মুসলমান কোন কাজই দায়িত্বহীনের মত করতে পারেনা। তাই তার অর্থ ব্যয়ও হতে হবে সমাজ এবং পরিবারের দায়িত্বশীলের মত। প্রয়োজনে অতিরিক্ত খরচ করা ইসলাম সমর্থন করে না। অন্যদিকে জোঁকের মত টাকা আটকে রাখাকেও ইসলাম পছন্দ করেনা। প্রকৃতপক্ষে সমাজের উপকারের জন্যই সম্পদ সমাজে স্বাভাবিকভাবে সচল থাকতে হবে। ব্যবসা চলবে, লাভ হবে, লাভের টাকা আবার খাটবে –এর ফলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, উৎপাদন বাড়ে, শ্রমিকের কাজের সংস্থান হয়, বেকার সমস্যা কমে। কিন্তু সম্পদ যদি কোথাও কারও হাতে কিংবা সমাজের বিশেষ কোন শ্রেণরি হাতে কুক্ষিগত হয়, তখন দেশে অর্থনীতিতে চরম অব্যবস্থা দেখা দেয়। কিংবা যদি মুষ্টিমেয় বড় লোক আরাম-আয়েশে বিলাসিতার পথে চলে তাহলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনাচার, নৈতিকতাহীনতা, সমাজ জীবন হয় দূষিত। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ আটকে রাখা কিংবা বিলাসিতায় সম্পদ নষ্ট করা দুটো হারাম বা অবৈধ। এ কারণেই ইসলাম চায় না সমাজের সকল সম্পদ ধনীদের হাতে জমা হোক।
যাকাতের ব্যবস্থা
সমাজের সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে জনা না হয় সেজন্য ইসলামে রয়েছে এক সুন্দর ব্যবস্থা-তাহলো যাকাত। যাকাত দান ইসলামী অর্থনীতির একটি মূলভিত্তি। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সম্পদ যার কাছে থাকবে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে যাকাত দিতে হবে। যাকাত একদিকে একটি ইবাদত অন্যদিকে একটি সামাজিক দায়িত্ব। যাকাত ধনী ও গরীবের মাঝখানে দূরত্ব কমায়। সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু চলাচলের ব্যবস্থা করে যাকাত। যাকাত হলো সামাজিক নিরাপত্তা। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চায়। এটি পূরণ করতে হলে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। ধনীর জমানো টাকা গরীবের উপকারে লাগে –এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। (যাকাতের উপর বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে)।
ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
মানুষ নিজে যা কিছু উপার্জন করে কিংবা বৈধ উপায়ে তার যে সম্পদ আছে সে সম্পদের উপর তার অধিকারকে ইসলাম স্বীকার করে। এটিকে ইসলাম তার মৌলিক অধিকার হিসাবে গন্য করে। অর্জিত সম্পদের মালিকানার উপর ইসলামী রাষ্ট্র ততক্ষণ হস্তক্ষেপ করেনা যতক্ষণ না সমাজের বৃহৎ অংশের জন্য তা ক্ষতিকর হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন লোক নিম্ন উপায়ে সম্পদের মালিক হতে পারেঃ
ক) শিকার
খ) মালিকানাবিহীন পতিত জমি আবাদ করা
গ) ভূগর্ভস্থ খনি উদ্ধার (মালিকী মত অনুসারে পেট্রোল, লোহা, কয়লা এ জাতীয় খনিজ পদার্থ যা সকলের ব্যবহারের জন্য তা জনগণের সম্পদ)
ঘ) বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈর
ঙ) ব্যবসা
চ) গনিমতের মাল
ছ) অন্যের জন্য পরিশ্রম করা, চাকুরী করা
জ) মালিকানাবিহীন জমি বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া
ঝ) শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে উপার্জন করা সম্পদ
কিন্তু ইসলাম সম্পদের মালিকানা লাভের জন্য যা ইচ্ছে তাই করার অনুমতি দেয় না। আমাদের বর্তমান সমাজের মূল সমস্যা কিন্তু এখানেই। মানুষ সম্পদের মালিক হবার জন্য কিংবা সম্পদ বাড়ানোর জন্য যা ইচ্ছে তাই উপায় অবলম্বন করছে। এজন্য ধোঁকাবাজি করছে, প্রতারণা করছে, শ্রমিকের অধিকার হরণ করছে, মজুতদারী করছে, চুরি-ডাকাতি করছে। ইসলামে এসব অবৈধ-অনৈতিক সমাজ বিরোধী পথ বন্ধ করতে চায়।
মানুষের কাছে সম্পদ থাকা এবং তাকে সম্পদ বাড়াতে দেয়ার অধিকার দিয়ে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়াকে বলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। উপার্জনের পথ এবং ব্যয়ের পথের উপর নৈতিকতার কোন চাপ না থাকায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। এ ব্যবস্থায় ধনীরা দিন দিন তাদের সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ পায় এবং গরীবরা দিন দিন হয় আরও গরীব। ইসলাম এই ব্যবস্থার বিরোধী। সেই সাথে ইসলাম ব্যক্তির মালিকানাকে কেড়ে নেয়াও সমর্থন করে না। কারো কোন কিছু থাকবে না, সব কিছু রাষ্ট্রের সম্পদ, ‘সমাজতন্ত্রের’ এই গালভরা বুলি ইসলামে বৈধ নয়।
নিজে পরিশ্রম করবে, পরিশ্রমের ফসল নিজ পরিবারের জন্য ব্যয় করবে, তাদের জন্য রেখে যাবে জমানো সম্পদ এটা হলো প্রতিটি মানুষের একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা ও আকাংখা। এই ইচ্ছা ও আকাংখা মানুষকে কাজের প্রেরণা যোগায়। শুধু তাই নয়, এই স্বাধীনতা তাকে সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস যোগায়। কিন্তু রাষ্ট্র এই ব্যক্তি মালিকানা কেড়ে নিলে মানুষের আর কিইবা থাকে! সে পরিণত হয় রাষ্ট্রের একটি ‘যন্ত্রে’। রাষ্ট্রের হাতে সব ক্ষমতা। এমনকি তার খাওয়া-পরাও রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর। এ অবস্থায় জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে হক কথা বলার সাহসও সে হারিয়ে ফেলে। ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের স্বাভাবিক মন, প্রাণ, ইচ্ছা, স্বাধীনতার মৃত্যু ঘটে। আর তাই দুনিয়ার প্রায় সব সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দ্রুতই হলো।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার ব্যাপারে যে মত পোষণ করে সেটাই হলো সঠিক মত সঠিক দৃষ্টিভংগী।
সুদকে হারাম ঘোষণা
ইসলামী অর্থনীতি সুদ থেকে মুক্ত। সুদ হচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের মূলভিত্তি। আজকালকার সমাজে সুদ হচ্ছে সকল ব্যবসার মাধ্যম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুদ কোন ‘ব্যবসা’ নয়। এটা কোন ‘লাভ’ নয়। সুদ জুলুমের হাতিয়ার। সম্পদ গুটিকতক লোকের জমা করার মাধ্যম। সুদের ফলে একজন আরেকজনের গোলামে পরিণত হয়। একটি দেশ আরেকটা দেশের হুকুমের তাবেদার হয়। ইসলাম সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। যদিও আজ কালকার সামজে সুদ ছাড়া কো কিছু চিন্তা করা সম্ভব নয় –তবু আলহামদুলিল্লাহ পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশে সুদবিহীন অর্থনীতিকে বাস্তবে পরিণত করারজণ্য সামান্য হলেও প্রচেষ্টা চলছে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইনসিওরেন্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)
সম্পদ যাতে এক জায়গায় কুক্ষিগত না হতে পারে সেজন্য আরও একটি সুন্দর ব্যবস্থা হলো ‘উত্তরাধিকার আইন’। একজনের মৃত্যুর পর তার সম্পদ এক সুন্দর নিয়মে সুষ্ঠুভাবে ন্যায়ের ভিত্তিতে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ইসলাম।
ইসলামের অর্থনীতির মূল বিষয়গুলোর আলোচনার মাধ্যমে আমরা এটাই পেলাম যে, ইসলামের অর্থনীতির ভিত্তি হলো সরলতা, বিনয়, উদারতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও খোদাভীতি। সেখানে লোভ, লালসা, কুটিলতা, অপচয়, বিলাসিতা, হিংকা-বিদ্বেষের কোন স্থান নেই। মোটকথা ইসলাম মানুষের মানবিক গুণাবলীর উপর তার অর্থনীতির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মানুষের পশুবৃত্তিকে দমন করে মানুষের সমাজকে পশুর সমাজ হওয়া থেকে রক্ষা করতে চায়।
ইসলামে রাজনীতি
মানুষ কখনও একা থাকতে পারেনা। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। সকলেই যেমন সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে, কেউ কোন অন্যায় না করে না, অন্যায় করলে তার যেন বিচার হয় সেজন্য সমাজের সকলেই একজনকে নেতা হিসাবে মেনে নেয়। মানব সমাজের প্রথম থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। শুধু তাই নয় সমাজে জন্য আইন-কানুন ঠিক করা, নিত্য নতুন আইন তৈরী করার প্রয়োজনও দেখা দেয়। মানুষের সমাজ যখন ছোট ছিল তখনও প্রত্যেক সমাজে একটা নিয়ম ছিল নেতা নির্বাচনের, আইন তৈরীর। এখন সমাজের পরিধি বড় হয়েছে, দেশের পরিধি বড় হয়েছে তাই সমাজ কিভাবে চলবে, দেশ কিভাবে চলবে, কিবাবে দেশের নেতা নির্বাচিত হবে সে ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশ শাসন, শাসন পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন, আইন-কানুন তৈরীর ব্যবস্থাকে ‘রাজনীতি’ বলে। ইসলামে রাজনীতি আলাদ কোন ব্যবস্থা নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন চলবে এক নিয়মে, আর দেশের শাসন ব্যবস্থা চলবে অন্য নিয়মে ইসলামে এমন কোন বিভাজন নেই। কেননা ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজ পরিচালনার জন্য একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আর রাজনীতি হলো সামজ জীবনের একটি অংশ মাত্র। তাই ইসলাম যেমন আমাদের নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কে নিয়ম-নীতি দিয়েছে তেমনি কিভাবে একটি দেশ চলবে, কিভাবে শাদসন পরিচালনার জন্য সরকার গঠন করা হবে, কিভাবে আইন তৈরীর জন্য পার্লামেন্ট গঠন হবে, কিভাবে অন্য দেশের সাথে চুক্তি হবে, কিবাবে দেশের বাণিজ্য চলবে –সব কিছু সম্পর্কে নিয়ম-নীতি বলে দিয়েছে। বিস্তারিতভাবে ইসলামী রাজনীতির সব দিক আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবুও আমরা ইসলামী রাজনীতির নীতিমালাগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
সার্বভৌমত্ব হলো ক্ষমতার উৎস। ইসলামে আল্লাহই হচ্ছেন সকল ক্ষমতা এবং আইনের উৎস। মোটকথা ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ। কোন শাসক কিংবা জনগণ কেউ ইসলামে সার্বভৌমত্বের মালিক নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক তিনি যাকে জনগণ আল্লাহর আইন অনুযায়ী তাদের সেবা করার জন্য মনোনীত করে। আল্লাহ ভালভাবে জানেন মানুষের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ। তাই আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর আইন হচ্ছে চূড়ান্ত আইন। তাই মানুষ আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারোন। এমনকি জনগণ একত্রিত হয়ে কিংবা কোন সরকার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারেনা।
কোরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান
ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো খোদার বিধান আল-কোরআনের আলোকে সকল কাজ পরিচালিত করা। তাই আমরা বলতে পারি কোরআনই ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান আর কোরআনতো মানুষকে সে পথেই নিয়ে যায় যেখানে আছে শান্তি, শৃংখলা, উন্নতি এবং সফলতা।
খেলাফত
মুসলমানদের কাজ হলো দুনিয়ার বুকে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়ে সে আল্লাহর প্রতিনিধি। ইষলামী রাজনীতির পরিববাষায় এক বলে ‘খেলাফত’। সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ এবং মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রেও মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর পছন্দনীয় উপায়ে দেশ ও সমাজ পরিচালনা করা, আল্লাহর আইন তথা শরিয়তী আইনকে সমাজে চালু করা, আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা এসব কাজ মানুষই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে করে থাকে। মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ এই কাজ করাতে চান। তাই মুসলমানরা আল্লাহর আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য নিজেদের মধ্য থেকে যাকে নেতা নির্বাচিত করে তাঁকেও ‘খলিফা’ নামে ডাকা হয়।
খেলাফত একটি ‘আমানত’। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছাকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে একটি বিরাট ‘আমানত’ হিসেবে।
পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ
ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের আইন তৈরী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরামর্শের ভিত্তিতে করতে হয়। ইসলামী পরিভাসায় একে বলা হয় ‘শূরা’। সিদ্ধান্ত সকলের পরামর্শ ও সম্মতি নিয়ে করার জন্য কোরআনে গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। তাই কোন এক ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে, ইসলামে এমন সুযোগ নেই। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ শাসন করা ইসলামী রাজণীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
সরকার ও জনগণের দায়িত্ব
খোদার বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কাজতো দেশের সব লোক একত্রে করতে পারেনা। তাই স্বাভাবিকবাবেই জনগণ তাদের মধ্য থেকে ধার্মিকতা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততার ভিত্তিতে উত্তম গুনসম্পন্ন কয়েকজন নাগরিককে শাসন এবং সরকারের নিজেরেদ ইচ্ছামত কিছু করতে পারেনা। কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরামর্শের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করাটা তাদের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তারা প্রথমে আল্লাহর কাছে দায়ী এবং তারপর দায়ী জনগণের কাছে। প্রকৃতপক্ষে শাসক ও সরকারকে নির্বাচন করে তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করার জন্য। জনগণ, শাসক ও প্রশাসকবর্গ সকলেইতো আল্লাহর খলিফা। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কয়েকজনের উপর ছেড়ে দিয়েই কিন্তু জনগণের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। শাসক ও প্রশাসকবর্গ ঠিকমত পরিচালনা করছে কিনা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে পরার্মশ দেয়া, ভাল কাজে সহযোগিতা করা, মন্দ কাজের সমালোচনা করা জনগনের দায়িত্ব। প্রতিটি নাগরিক সরকারকে সমর্থন করা কিংবা কোন একটি সরকারী নীতির বিরোধিতা করার স্বাধীনতা রাখে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও জনগণ সকলের মর্যাদা মানুষ হিসেবে সমান। দেশের আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামী রাজনীতির একটি মূল বিশয় হলো বিচার ব্যবস্থা সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা হতে হবে। যাতে করে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারের হোমরা-চোমরা মন্ত্রীদেরকেও প্রয়োজন হলে আদালতে ডেকে আনা যায়। শাসক কিংবা প্রশাসকবর্গের ক্ষমতার জোরে ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব
ইসলামী রাজনীতির মূল বিয়ষগুলো আলোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে ইসলামী রাষ্ট্রকে কোন অনৈসলামী প্রকৃতির রাজনৈতিক সংগঠন দিয়ে পরিচারনা করা কিংবা কোন বিদেশী শক্তির পদানত করা যেতে পারেনা। মুসলমানতো তারাই যারা একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য নিজে এগিয়ে আসে এবং আল্লাহর আইন প্রয়োগকারী ও শর্তাবলী পালনকারী সরকারের প্রতি সহযোগিতা ও সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাই মুসলিম জাতির পক্ষে অনৈসলামী সরকারের বশ্যতা স্বীকার করা শোভা পায়না। ইসলামী রাষ্ট্র ও তার জনগণ এদিক থেকে প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীনতা ভোগ করে। এই অর্থে ইসলামই প্রকৃত স্বাধীনতা। ইসলামই মানুষকে তার প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে কিংবা দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রেরণা জোগায়। মুসলিম দেশগুলোর স্বাধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনা করলে একথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, জনগণের ইসলামী প্রেরণাই তাদের সাহস জুগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে, প্রেরণা দিয়েঝে জীবন বিলিয়ে দিতে।
অমুসলিমদের অধিকার
ইসলাম অমুসলিমদের নাগরিক অধিকারকে শুধু স্বীকারই করেনা, অমুসলিমদের নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম অমুসলিম উভয় নাগরিকের কল্যানের জন্য সমানভাবে দায়ী। এসব কথা কোন কল্প কথা নয়। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তারপর চার খলিফার খেলাফতের আমলের অনেক ঘটনা আছে যা আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁদের মৌলিক অধিকার পেয়েছে, স্বাধীনতা ভোগ করেছে তা ইতিহাসে এখনও বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঞ্চম অধ্যায়
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
জিহাদঃ ইসলামী আন্দোলন
জিহাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
জিহাদ নবীর শেখানো পথ
জিহাদ মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ভাল কাজের উৎসাহ দান/তা’মরুরুনা বিল মারুফ
অন্যায় কাজের রোধ/নাহি আনিল মুনকার
জিহাদ ঈমানের পরীক্ষা
জিহাদ জীবনের সাফল্য
ইসলামী সংগঠন
ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী জামায়াতঃ মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসা
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
জিহাদঃ ইসলামী
আল্লাহ, রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তকদীরের ভালমন্দ এবং শেষ বিচারের দিন এইসব কিছুকে ইসলাম বিশ্বাস করতে বলেছে। এই জিনিসগুলোর উপর ঈমান এনে যে কোন ব্যক্তি মুসলমানদের দলভুক্ত হয় কিন্তু এতেই সে পুরোপুরি মুসলিম হতে পারে না। পুরোপুরিবাবে মুসলমান সে তখনই হতে পারে যখন আল্লাহর কাছে নিজকে সে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেয়। প্রতিটি কাজ আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলে খোদার (সা) দেকানো নিয়ম অনুযায়ী করে। প্রতিটি কাজ করে আল্লাহকে খুশী করার জন্য। প্রতিটি কাজে সে চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি। মনের এই অবস্থার জন্য কঠিন, কঠোর সাধনায় সে এগিয়ে আসে। প্রতিদিন আদায় করে নিষ্ঠার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, বছরে একটি মাস পালন করে রোযা। এমনিভাবে আদায় করে হজ্ব ও যাকাতের হুকুম আহকাম। এভাবে আল্লাহকে খুশী করার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের (স) নির্দেশমত কাজ করতে করতে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় মজবুত। আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা সে পছন্দ করতে শুরু করে। আল্লাহ যা পছন্দ করেন না, তা সে নিজের জীবনের সবখান থেকে ধুয়ে মুছে ফেলে। এ সম্পর্ক যখন আরও মজবুত হয় তখন সে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজকে শুধু নিজের জন্যই পছন্দ করে না –অন্যের জন্যও তা ভাল মনে করে। দুনিয়ার প্রতিটি লোক আল্লাহর পথে চলুক এটাই সে চায়। সে চায় দুনিয়াতে একমাত্র আল্লাহর হুকুম চলুক। এইজন্য সে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের প্রচার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় সব কিছুর উপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। নিজের জীবন, ধন, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা, যোগ্যতা সব কিছুকে সে এ কাজের জন্য খাটায়। শুধু তাই নয়, আল্লাহ যা ভালবাসেন না –আল্লাহ যা অপছন্দ করেন –তা সে নিজেই অপছন্দ করে ক্ষান্ত হয়না –দুনিয়ার বুক থেকে সব অন্যায় ও অসত্যকে দূর করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালায়। এইভাবে নিজেদের সবকিছু দিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার কাজে এগিয়ে আসে। এ লক্ষ্যেই ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মানকে সে মনে করে নিজের সম্মান। তার প্রতিটি কাজ হয় ইসলাম ও মুসলিম জাতির কল্যাণ, সম্মান, উন্নতির জন্য। ইসলামী পরিভাষায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠার এই কাজটিকে বলা হয় ‘জিহাদ’। এই পবিত্র কাজকে আমরা আধুনিক ভাষায় বলি ‘ইসলামী আন্দোলন’।
জিহাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ হলো সকল শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালানো। তাই আল্লাহর দ্বীনকে ধন দিয়ে, কথা দিয়ে, কলম দিয়ে সবকিছুর উপরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও এই অর্থে জিহাদ। আবার সকল অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে, ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও জিহাদ। আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার এই কাজ আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাই জিহাদ আল্লাহর জন্যই। ইসলামী পরিভাষায় তাই একে বলা হয় “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ আল্লাহর জন্য জিহাদ।
মুসলমানরা জিহাদ করে নিজেদের স্বার্থে নয়। নিজের ধন, মাল ও সম্মানকে বৃদ্ধি করার জন্য নয়। মুসলমানদের সকল ত্যাগ, কোরবানী, চেষ্টা-সাধনার উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ায় সকল মানুষের জন্য এক সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আর এক কাজ করলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। নামাজ, রোযা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে আল্লাহর হুকুম মানায় অভ্যস্ত করে।
নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে ইসলামের জন্য বেঁচে থাকতে নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত আমাদেরকে ইসরামের জন্য বেঁচে থাকতে এবং এরই জন্য মৃত্যুবরণ করতে উৎসাহিত করে। মোটকথা নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মূল লক্ষ্যই হলো ‘জিহাদ’। জিহাদ ছাড়া ইসলামকে কল্পনা করা যায় না। কে না চায় দুনিয়ায় সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক অসত্য পরাজিত হোক, বন্ধ হোক সকল অনাচার-অত্যাচার, জুলুম! কিন্তু তা তো আপনা আপনি হবে না। এজন্য চেষ্টা-সাধনা করতে হবে। ইসলামের প্রতিটি কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি না তার উদ্দেশ্য হয় ‘জিহাদ’ আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করা।
জিহাদ নবীর শেখানো পথ
নবী রাসূলগণ একাজই করেছেন। তাঁরা নিজেরা আল্লহার হুকুম মেনে চলেছেন। অন্যদের সামনে এ আদর্শ তুলে ধরেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) সমাজে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক সুন্দর পথ তুলে ধরেছেন আমাদের জন্য। আমাদেরকে রাসূলের দেখানো সেই জিহাদের পথে আমাদের নিজেদের জীবনে এবং সমাজ জীবনে ইসলামকে কায়েম করতে হবে।
রাসূলের (সঃ) শেখানো নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত যেমন আমাদের জন্য ফরয, আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার কাজে অংশ গ্রহণ করাও তেমন ফরয। বরং বলা যায় সব ফরজের বড় ফরয। কেননা কে সমাজে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই, যে সমাজে আল্লাহর আইন নেই, সেই সমাজে প্রকৃতপক্ষে নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত পালন কঠিন হয়ে পড়ে। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত যা আমাদের শেখায় তা বাস্তবে প্রয়োগ করাও কঠিত হয়ে পড়ে। তাই জিহাদ বা আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার কাজে নিজের জান মাল সব কিছু নিয়ে প্রচেষ্টা চালানো একটা গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবাদাত।
জিহাদ মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজকে আমরা বলি ইসলামী আন্দোলন। কোরআনে এই কাজটিকে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে।
এখন দুণিয়ার সর্বোত্তম জাতি তোমরা যাদেরকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর, অন্যায় এবং পাপ কাজ থেকে লোকদেরদে বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো।
সূরা আল-ইমরান-১১০
তোমাদের মধ্যে এমন কিচু লোক থাকতেই হবে যারা নেকী ও মঙ্গরের দিকে ডাকবে। ভাল ও সত্য কাজের নির্দেশ দেবে এবং পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ করবে তারাই সার্থকতা পাবে।
সূরা আল-ইমরান-১০৪
নিজে আল্লাহর হুকুম মত চলা, অন্যকে আল্লাহর হুকুম মানতে বলা এবং দুনিয়া থেকে অন্যায়, অসত্য দূর করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে নিজকে ব্যস্ত রাখা মুসলমানদের দায়িথ্ব ও কর্তব্য। ভাল কাজে উৎসাহ দান (তা’মুরুনা বিল মারুফ) এবং অন্যায়কে রোধ করা (নাহি আনিল মুনকার) মুসলমানদের দুটি বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ভাল কাজে উৎসাহ দান/তা’মুরুনা বিল মারুফ
ভাল কাজ অর্থাৎ সব ধরনের ভাল কাজ নিজে করা এবং অন্যকে করতে আহবান করা উৎসাহিত করা মুসলমানদের কাজ। তুমি নিজে ইসলামকে জানার চেষ্টা করো। নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। তোমার বন্ধুদেরকে, আত্মীয়দেরকে ইসরাম মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করো। তাদের সাথে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করো। কেউ ইসলাম সম্পর্কে ভুল বললে বা বুঝলে তাকে বুঝাও –এসব কিছু কাজ –এসব কিচুই ইবাদত। অন্যকে ন্যায়ের পথে সত্যের পথে ইসলামের দিকে আনতে হলে শুধু মুখে মুখে ইসলামের কথা বলা নয় তোমার নিজের জীবনটাকেও ইসলামের আলোকে সুন্দর করতে হবে। তোমার কথা হবে মধুর, তোমার ব্যবাহর হবে আকর্ষণীয়, তুমি যা কিছু বলো সে রকম নিজে হবার চেষ্টা করবে –তবেই না তোমাকে দেখে অন্যেরা উৎসাহিত হবে।
হে ঈমানদাররা, তোমরা কেন তা বলো যা তোমরা করনা। আল্লাহর কাছে এটি খুব ঘৃণার কাজ যে তোমরা যা বলো তা করো না।
সূরা আস সফ-২-৩
কোরআনের এই বাণী স্পষ্ট করে আমাদের কাজকে আমাদের কথার সাথে মিল রখার জন্য বলেছে। এজন্য আমাদেরকে নিজেদের ভাল করার চেষ্টা করতে হবে এবং সেই সাথে অন্যকে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবেই আমাদের চরিত্রের দুর্বলতা এবং আমাদের কমতিগুলো দূর হবে। আমাদের মধ্যে কেউই একবোরে খাঁটি নয়। কিন্তু আমাদের ত্রুটিগুলো আস্তে আস্তে দূর হবে যদি আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থে জিহাদের দায়িত্ব পালন করি।
অন্যায় কাজের রোধ/নাহি আনিল মুনকার
শুধু ভাল কথা বলা এবং ভাল কাজ করলেই চলবে না। সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এজন্য আল্লাহ মুসলমানদের প্রয়োজনে যুদ্ধ করার হুকুম দিয়েছেন। অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য জীবন বাজি রাখার আহবান জানিয়েছে কোরআন।
সব ধরনের অন্যায়, জুলুম ও অসত্যকে ঘৃণা করা, তার বিরুদ্ধে কথা বলা, তাকে দুনিয়ার বুক থেকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ করা পবিত্র ইবাদত। এ কাজ করতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। পবিত্র এই এবাদতের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া সাধারণ কোন মৃত্যু নয় –এটাকে বলা হয় ‘শাহাদাত’।
শাহাদাত সকলের ভাগ্যে হয় না কিন্তু শাহাদাত প্রতিটি মুসলমানের জীবনের কামনা। আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন বিলিয়ে শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করার চেয়ে বড় কাজ কি হতে পারে? অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করার বিষয়ে নবী (স) খুব জোরালোভাবে বলেছেনঃ
তোমাদেরকে সৎ ও ন্যায় কজা করতে হবে। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখতে হবে এবং পাপী ও অন্যায়কারীর হাত ধরে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে, খোদার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পাপী ও খারাপ লোকদের প্রভাব তোমাদের মনের উপরে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা অভিশপ্ত হবে।
প্রিয় নবী এতদূর পর্যন্ত বলেছেন,
তোমরা যদি দুর্বল হও তা হলে অন্তত অন্যায়কে মনে মনে ঘৃনা কর, আর এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল জিহাদ।
জিহাদ ঈমানের পরীক্ষা
প্রকৃতপক্ষে জিহাদ হলো ঈমানের বাস্তব পরীক্ষা। শুধু মুখে মুখে ঈমান আনলেই চলে না। বাস্তব জীবনে তার প্রমাণ দিতে হবে। বাস্তব জীবনে ইসলামের পথে চলতে প্রতি পদে পদে আসে বাধা। এই বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রামইতো জিহাদ। সত্য প্রচারের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে লাগে ধৈর্য এবং সাহস। ত্যাগ করতে হয় জীবনের অনেক আরাম-আয়েশ। বরণ করতে হয় অনেক দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা, অপবাদ। পড়তে হয় ষড়যন্ত্রের শিকারে। মাথা পেতে নিতে হয় জুলুম, অত্যাচার। দাঁড়াতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাই জিহাদের মাধ্যমেই বুঝা যায় কে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ভালবাসে আর কে ভালবাসে জীবনের আরাম-আয়েশ।
জিহাদই জীবনের সাফল্য
জিহাদের এই কাজ একদিন দু’দিনের কাজ নয়। এটি আমাদের প্রতিটি মুহুর্তের, প্রতিটি দিনের কাজ। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত এ কাজ করে যেতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ত্যাগের। প্রয়োজন ধৈর্য এবং ছবরের। এজন্য নিজের জীবনের সব কিছুকে আর্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের জান মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মরে এবং মারে।
সূরা-আত তওবা-১১১
ইসলামী সংগঠন
মানুষের সমাজের সকল স্তরে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কাজটি কখনও একা করা সম্ভব নয়। এ কাজ করার জন্য অন্যকে সাথে নিতে হবে। নবী-রাসূলগণও আল্লাহর দ্বীনের এই কাজের প্রচার ও প্রসারের জন্য সমাজ থেকেই লোক বেছে নিয়েছেন। আস্তে আস্তে নবী-রাসূলদেরকে দিয়েগড়ে উঠেছে মুমীনদের এক দল-একটি জামায়াত। তাই জামায়াত বা সংগঠন ছাড়া আল্লাহর দ্বীনের এই কাজ ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বা ইসলামী আন্দেলন সম্ভব নয়। ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্যে যেমন আন্দোলন বা জিহাদের প্রয়োজন তেমন আন্দোলন বা জিহাদ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি মজবুত সংগঠন বা দল। আর এই সংগঠনকে অবশ্যই হতে হবে ইসলামের বিশ্বাস, শিক্ষা, আদর্শ, মূলনীতি অনুযায়ী। এই সংগঠন হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে।
ইসলামী জামায়াতের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী জামায়াতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
১। ইসলামী জামায়াতের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি হবে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক।
২। ইসলামী জামায়াতের নেতা ও কর্মী সকলেই হবেন কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী। আদেশ দেয়া, আদেশ পালন, সমালোচনা করা, সমালোচনা গ্রহণ, পরামর্শ গ্রহণ সকল ক্ষেত্রে নেতা ও কর্মী সকলেই মেনে নিবেন কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথ।
৩। ইসলামী জামায়াতের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মপন্থা একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলের (স) নির্দেশ অনুযায়ী হবে।
৪। ইসলামী জামায়াত ইসলামকে বিঝয় করার আন্দোলন কিন্তু তা কোন অন্যায় পথে নয়। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে, সততা ও বিশ্বস্ততার পথে ইসলামী বিপ্লবের কাজ পরিচালনা করে ইসলামী জামায়াত। রাতারাতি বিপ্লবের জন্য কোন চোরাগুপ্ত পথ খুঁজে না ইসলামী জামায়াত।
৫। ইসলামী জামায়াত তার প্রচার কাজ করে সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে। কোন বিশেষ শ্রেণী, সম্পদ্রায়, এলাকা, বর্ণ, গোত্র বা ভাষার লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ইসলামী সংগঠনের কাজ।
৬। ইসলামী জামায়াত মানুষকে জানায় আল্লাহর পথে। আর দাওয়াত মানুষের কাছে পেশ করা হয় সুন্দরভাবে। কোন তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কিংবা ফেতনা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়া ইসলামী জামায়াতের কাজ নয়।
৭। ইসলামী জামায়াত ইসলামের কোন এক বিশেষ দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। ইসলামী জামায়াত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ইসলামের প্রচার করে। কালেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত থেকে শুরু করে ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক মোটকথা ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপ তুলে ধরা সকলের সামনে।
৮। ইসলামী জামায়াত ইসরামকে প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের সৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। আল্লাহর দ্বীনকে এই যুগে প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের বিপ্লবী, যোগ্য, সৎ ও ঈমানদার লোকের প্রয়োজন তা একদিনে তৈরী হয় না। বিপ্লবী এই কর্মী বাহিনী তিলে তিলে গড়ে উঠে ইসলামী জামায়াতের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে। তাই ইসলামী জামায়াতে অবশ্যই থাকতে হবে ব্যক্তি গঠনের এক বাস্তব ও কার্যকর কর্মসূচী।
৯। ইসলামী জামায়াত কাজ করে এমন একটি সমাজে যেখানে ইসলাম পুরোপুরি ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য তাই ইসলামী জামায়াত গ্রহণ করে সমাজসেবা এবং সমাজ সংস্কারের কাজ। সমাজের জামায়াত তুলে সোচ্চার আওয়াজ। আর সেই সাথে নিজের সীমাবদ্ধ পরিসরে গড়ে তোলে ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, ভালবাসার ভিত্তিতে ন্যায়, ইনসাফপূর্ণ এক রুচিশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
১০। ইসলামী জামায়াত ব্যাপক অর্থে সারা বিশ্বের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে কিন্তু এর প্রাথমিক কাজের ক্ষেত্রে হচ্ছে জামায়াতে অংশগ্রহণকারীদের জন্মস্থান-নিজ দেশ।
১১। ইসলামী জামায়াত নিজ জন্মস্থানে-নিজ দেশে কায়েম করতে চায় ইসামী শাসন ব্যবস্থা। তাই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামী জামায়াত থাকে সজাগ এবং সতর্ক। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসে ইসলামী জামায়াত। তেমনি সমাজের সকল ক্ষেত্রে অসৎ, দুর্নীতিবাজ লোকদের সরিয়ে সৎ ও খোদাভীরু লোকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক আপোষহীন আন্দোলন পরিচালনা করে ইসলামী জামায়াত।
ইসলামী জামায়াতঃ মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসা
আজ সারা বিশ্বের মানুষ শান্তির সন্ধানে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। দুর্ভাগ্য মুসলিম দেশগুলোতেও নেই ইসলাম আদর্শের সঠিক বাস্তবায়ন। দেশে দেশে মুসলমানদের মধ্যে যতটুকু ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শ বেঁচে আছে তাও ধ্বংস করার জন্য কাজ করছে মুসলমান সামজের ভিতরে কিছু দল ও গোষ্ঠী। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আজ বিভ্রান্ত। যারা মুসলমান দেশ ও জাতির ক্ষমতার আসনে বসে আছেন তারা নিজেরা যেমন পাশ্চাত্যের চমকে ভুলে গেছেন ইসলামের আসল রূপ তেমনি বিভ্রান্ত করছেন জনগণকে ইসলামের সুমহান আদর্শ থেকে।
কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী এমনি অবস্থাতেও প্রতিটি মুসলিম দেশে দানা বেঁধে উঠছে ইসলামী আন্দোলন। শুধু মুসলিম দেশ নয় যে সব দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানেও মুসলমানরা গড়ে তুলছে ইসলামী সংগঠন। মুসলমান যুবকদের মধ্যে এসেছে চেতনা।
ইসলামে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেশে দেশে মুসলিম যুবকরা গড়ে তুলছে ইসলামী জামায়াত। পরিচালনা করছে ইসলামী আন্দোলন সাহসের সাথে। মোকাবিলা করছে ইসলাম বিরোধী শক্তির। বরণ করছে জুলুম, নির্যাতন। শিকার হচ্ছে নানান মিথ্যা অপপ্রচার এবং নিন্দাবাদের। নৈতিক ভাবে হেরে যাওয়া আদর্শচ্যুত হায়নাদরে শিকার হচ্ছে সেসব মর্দেমুমীন মুসলিম যুবকরা। আর তারই পরিণতিতে কাতারে কাতারে যুবক বিলিয়ে দিচ্ছে নিজের অমূল্য জীবন আল্লাহর পথে –শাহাদাতের পথে। তাদের শাহাদাতের রক্ত রাঙ্গা পথে আবার দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর দ্বীন। উড়বে আবার ন্যায়, নীতি, সাম্য, হক ও ইনসাফের পতাকা। শাহাদাতের রক্ত রাঙ্গা এই সব ইসলামী সংগঠন আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের আশা-মুক্তিকামী মানবতার একমাত্র ভরসাস্থল।
#########০০০০০০০০০############