আসান ফেকাহ ( ২য় খন্ড )

ভূমিকা

দীর্ঘদিন থেকে ইলমে ফেকাহের উপর এমন একটি গ্রন্থের প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছিল যা হবে সংক্ষিপ্ত অথচ প্রত্যেক মুসলিমের জীবনের সর্ব দিকের প্রয়োজন মেটাবে। আল্লাহর শোকর মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ ইসলাহী কর্তৃক উর্দু ভাষায় রচিত আসান ফেকাহ আমাদের সে প্রয়োজন পূর্ণ করেছে।

 

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক জনাব আব্বাস আলী খান কর্তৃক ভাষান্তর হওয়ায় বইটির অনুবাদ যথার্থ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। এ খণ্ডে সাওম, যাকাত ও হজ্জ নামে তিনটি অধ্যায় রয়েছে।

 

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ইলমে ফিকাহের চারটি মত প্রচলিত রয়েছে, তাহলো হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী। এছাড়াও ভিন্ন একটি মতেরও অনুসারী রয়েছে যাঁরা উপরোক্ত চার মতের কারো অনুসরণ করেন না। তাঁরা সরাসরি কুরআন হাদীসের অনুসরণের পক্ষপাতী। তাঁরা সালাফী বা আহলে হাদীস নামে পরিচিত। উপরোক্ত সব মতই সঠিক। সব মতের ভিত্তিই কুরআন ও হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত। সকলেরই প্রচেষ্টা ছিল কুরআন ও হাদীসের সার্বিক অনুসরণ। উপরোল্লিখিত মতপার্থক্যের কারণে একে অন্যের উপর দোষারোপ করা একে অন্যক দীন থেকে খারিজ মনে করে মুসলিম উম্মার ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির প্রচেষ্টা কোনো মুখলেস হকপন্থীর কাজ হতে পারে না।

 

উপমহাদেশে সব মতের অনুসারীই রয়েছে। কিন্তু হানাফী মতের অনুসারীদের সংখ্যাই অধিক বিধায় মতপার্থক্য এড়িয়ে শুধুমাত্র হানাফী মতের উপর ভিত্তি করেই এ গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। যাতে করে সাধারণ মুসলমান দ্বিধাহীন চিত্তে ও পূর্ণ নিশ্চিন্ততার সাথে নিজস্ব মাযহাবের অনুসরণ করতে পারে। তবে প্রায় ক্ষেত্রে আহলে হাদীসের অভিমতও সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

 

বিভিন্ন যুগে ওলামায়ে কেরাম কোনো কোনো মাসয়ালার ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণার পর বিভিন্ন মতের সুপারিশ করেছেন এসব মতের যেটিকে সঠিক মনে করা হয়েছে তাও টিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে করে যে চায় প্রশস্ত অন্তকরণে তার উপরও আমল করতে পারে। এছাড়া মাসয়ালা মাসায়েলের সাথে সাথে ইবাদাত ও আমলের ফযীলত ও গুরুত্ব হাদীসের আলোকে বর্ণিত হয়েছে যাতে ইবাদাতের প্রতি অন্তরে জযবা পয়দা হয়।

 

আমাদের সাফল্য পাঠকদেরই বিচার্য। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার দীনের পূর্ণ অনুসরণের তাওফীক দিন। আমীন।

 

গ্রন্থপঞ্জি

 

আহকামের ফযীলত ও হেকমত সংক্রান্ত আলোচনায় নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলীর সাহায্য নেয়া হয়েছেঃ

 

১. তাফসীরে নাসাফী ২. তাফসীরে খাযেন ৩. তাফসীরে বায়যাবী ৪. তরজমানু কুরআন-মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ৫. তাফহীমুল কুরআন-মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) ৬. তরজমা ও তাফসীর-মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী ৭. সিহাহ সিত্তা ৮. মুয়াত্তা-ইমাম মালেক (র) ৯. রিয়াদুস সালেহীন ১০. আল-আদাবুল মুফরেদ ১১. হিসনে হাসীন ১২. মিশকাত ১৩. এহইয়াও উলুমদ্দীন ১৪. কাশফুল মাহজুব।

 

মাসায়েল ও আহকামগুলো ইজতেহাদী আলোচনা ছাড়া নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলী থেকে উদ্বৃত করা হয়েছে এবং শুধু মাত্র সর্বসম্মত মতে সাধারণ্যে প্রযোজ্য মাসয়ালাগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে।

 

১. হেদায়া ২. আইনুল হেদায়া-শরহে হেদায়া ৩. ফাতহুল কাদীর ৪. কুদুরী ৫. শরহে বেকায়া ৬. নূরুল ইয়াহ ৭. ফিকহুস সুন্নাহ ৮. ইলমুল ফিকাহ ৯. তালীমুল ইসলাম ১০. ইসলামী তালীম ১১. আলাতে জাদীদাহ কে শরয়ী আহকাম-মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) ১২. রাসায়েল ও মাসায়েল-মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র) ১৩. বেহেশতি জেওর ১৪. ফতোয়া-দারুল উলুম দেওবন্দ ইত্যাদি।

 

যাকাত অধ্যায়

 

 

 

যাকাতের বিবরণ

 

নামায ও যাকাত প্রকৃতপক্ষে গোটা দ্বীনের প্রতিনিধিত্বকারী দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। দৈহিক ইবাদাতে নামায সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে।আর আর্থিক ইবাদাতে যাকাত সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বীনের পক্ষ থেকে বান্দার ওপরে যেসব হক আরোপ করা হয় তা দু প্রকারের। আল্লাহর হক এবং বান্দার হক। নামায আল্লাহর হক আদায় করার জন্যে বান্দাকে তৈরী করে এবং যাকাত বান্দাদের হক আদায় করার গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর এ দু প্রকারের হক ঠিক ঠিক আদায় করার নামই ইসলাম।

 

যাকাতের মর্যাদা

 

যাকাত ইসলামের তৃতীয় বৃহৎ রুকন বা স্তম্ভ। দ্বীনের মধ্যে নামাযের পরই যাকাতের স্থান। বস্তুত কুরআন পাকে স্থানে স্থানে ঈমানের পরে নামাযের এবং নামাযের পর যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। যার থেকে একদিকে এ সত্য সুস্পষ্ট হয় যে, দ্বীনের মধ্যে নামায এবং যাকাতের মর্যাদা কতখানি। অপরদিকে এ ইংগিতও পাওয়া যায় যে, নামাযের পরে মর্যাদা বলতে যাকাতেরই। এ তথ্য নবী পাক (সাঃ) এর হাদীস থেকেও সুস্পষ্ট হয়ঃ

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) মায়ায বিন জাবাল (রা)কে ইয়ামেন পাঠাবার সময় নিম্নোক্ত অসিয়ত করেন: তুমি সেখানে এমন সব লোকের মধ্যে পৌছতেছ যাদেরকে কেতাব দেয়া হয়েছিল। তুমি সর্ব প্রথম তাদেরকে ঈমানের সাক্ষ্যদানের দাওয়াত দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রাসূল। তারা যখন এ সত্য স্বীকার করে নেবে তখন তাদেরকে বলে দেবে যে, আল্লাহ রাত ও দিনের মধ্যে তাদের উপর পাঁচবার নামায ফরয করে দিয়েছেন। তারা এটাও মেনে নিলে তাদেরকে বল যে, আল্লাহ তাদের ওপর সাদকা (যাকাত) ফরয করেছেন। তা নেয়া হবে তাদের সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে এবং বণ্টন করা হয়ে তাদের মধ্যকার অক্ষম ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে। তারা একথাও যখন মেনে নেবে তখন যাকাত আদায় করার সময় বেছে বেছে তাদের ভালো ভালো মাল নেবে না এবং মাজলুমের বদদোয়া থেকে বেচে থাকবে। কারণ মাজলুম ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দার প্রতিবন্ধকতা থাকে না। (বুখারী, মুসলিম)

 

যাকাতের অর্থ

 

যাকাতের অর্থ পাক হওয়া, বেড়ে যাওয়া, বিকশিত হওয়া। ফেকার পরিভাষায় যাকাতের অর্থ হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। প্রত্যেক সাহেবে নেসাব মুসলমান তার মাল থেকে শরীয়াতের নির্ধারিত পরিমাণ মাল ঐসব লোকদের জন্যে বের করবে শরীয়াত অনুযায়ী যাকাত নেয়ার যারা হকদার।

 

যাকাত দিলে মাল পাক পবিত্র হয়। তারপর আল্লাহর মালে বরকত দান করেন। তার জন্যে আখিরাতে যাকাত দানকারীকে এতো পরিমাণ প্রতিদান ও পুরস্কার দেন যে, মানুষ তার ধারণাও করতে পারে না। এজন্যে এ ইবাদাতকে যাকাত অর্থাৎ পাককারী এবং বর্ধিত কারী আমল বলা হয়েছে।

 

যাকাতের মর্মকথা

 

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যখন মুমিন তার প্রিয় এবং পছন্দই মাল আল্লাহর পথে সন্তুষ্টচিত্তে ব্যয় করে তখন সে মুমিনের দিলে এক নূর এবং উজ্জ্বলতা পয়দা হয়। বস্তুগত আবর্জনা ও দুনিয়ার মহব্বত দূর হয়ে যায়। তারপর মনের মধ্যে একটা সজীবতা পবিত্রতা এবং আল্লাহর মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয়। অতঃপর তা বাড়তেই থাকে। যাকাত দেয়া স্বয়ং আল্লাহর মহব্বতের স্বরূপ এবং এ মহব্বত বাড়াবার কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্য উপায়ও।

 

যাকাতের মর্ম শুধু এই নয় যে, তা দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তের ভরণ পোষণ ও ধনের সঠিক বণ্টনের একটা প্রক্রিয়া পদ্ধতি। বরং তা আল্লাহ তায়ালার ফরজ করা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এছাড়া না মানুষের মন ও রূহের পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করণ সম্ভব আর না সে আল্লাহর মুখলেস ও মুহসেন সৎ বান্দা হতে পারে। যাকাত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের জন্য তার শোকর গুজারীর বহিঃপ্রকাশ। অবশ্যি আইনগত যাকাত এই যে, যখন সচ্ছল লোকের মালের এক বছর পার হয়ে যাবে তখন সে তার মাল থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ হকদারের জন্য বের করবে। কিন্তু যাকাতের মর্ম শুধু তাই নয়। বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালা এ আমলের দ্বারা মুমিনের দিল থেকে দুনিয়ার সকল প্রকার বস্তুগত মহব্বত বের করে নিয়ে সেখানে তার আপন মহব্বত বসিয়ে দিতে চান। এভাবে তিনি তরবিয়াত দিতে চান যে, মুমিন আল্লাহর পথে তার মাল জাল সকল শক্তি ও যোগ্যতা কুরবান করে রূহানী শান্তি ও আনন্দ লাভ করুক। সব কিছু আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতার আবেগ প্রকাশ করুক যে, আল্লাহ তার ফযল করমে তার পথে জানমাল কুরবান করার তৌফিক তাকে দিয়েছেন। এজন্য শরীয়ত যাকাতের একটি আইনগত সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছে যে, এতোটুকু ব্যয় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। এতটুকু খরচ না করলেও ঈমানই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার সাথে সর্ব শক্তি দিয়ে এ  প্রেরণাও দিয়েছে যে, একজন মুমিন যেন এতোটুকু ব্যয় করাকে যথেষ্ট মনে না করে। বরঞ্চ বেশী বেশী আল্লাহর পথে খরচ করার অভ্যাস যেন করে। নবী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর জীবন থেকেও এ সত্যই আমাদের সামনে প্রকটিত হয়।

 

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী পাক (সাঃ) এর দরবারে হাজির হলো। সে নবীর কাছে সওয়াল করলো।তখন নবী (স) এর কাছে এতো সংখ্যক ছাগল ছিল যে, দু পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা ছাগলে পরিপূর্ণ ছিল। নবী (স) ছওয়ালকারীকে সেই সব ছাগল দান করলেন। সে যখন তার কওমের কাছে ফিরে গেল তখন তাদেরকে বললো- লোকেরা তোমরা সব মুসলমান হয়ে যাও। মুহাম্মদ (সাঃ) লোকদেরকে এত বেশী দান করেন যে, অভাবগ্রস্ত হওয়ার আর কোন ভয় থাকে না। -(কাশফুল মাহযুব)

 

একবার হযরত হুসাইন (রাঃ) এর দরবারে এক ভিখারি এসে বললো- হে নবীর পৌত্র আমার চারশ দিরহামের প্রয়োজন। হযরত হুসাইন তখনি ঘর থেকে চারশ দিরহাম এনে তাকে দিয়ে দিলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। লোকেরা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন কাঁদছি এজন্য তার চাইবার আগে কেন তাকে দিলাম না। যার জন্য তাকে ছওয়াল করতে হলো। কেন এ অবস্থা হলো যে, সে ব্যক্তি আমার কাছে এসে ভিক্ষার জন্য হাত বাড়ালো? -(কাশফুল মাহযুব)

 

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, একবার বাড়িতে একটি ছাগল যবেহ হলো। নবী (স) ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ছাগলের গোশত কিছু আছে কিনা। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুধু একটা রান বাকী আছে (আর সব বণ্টন হয়ে গেছে)। নবী বললেন, না বরঞ্চ ঐ রান ছাড়া আর যা কিছু আর যা কিছু বণ্টন হয়েছে তা আসলে বাকি রয়েছে। (যার প্রতিদান বা মূল্য আখিরাতে আশা করা যায়।(জামে তিরমিযি)

 

হযরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা) বলেন, নবী (স) তাকে বলেন, আল্লাহর ভরসা করে মুক্ত হস্তে তার পথে দান করতে থাক। গুণে গুণে হিসেব করে দেবার চক্করে পড়ো না যেন। গুণে গুণে আল্লাহর রাস্তায় দান করলে তিনিও গুণে গুণেই নিবেন। সম্পদ গচ্ছিত করে রেখো না। নতুবা আল্লাহও তোমার সাথে এ ব্যবহারই করবেন এবং অগণিত সম্পদ তোমার হাতে আসবে না। অতএব যতোটা হিম্মত কর খোলা হাতে আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর। (বুখারী, মুসলিম)

 

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর তার প্রত্যেক বান্দাকে বলেন, হে বনী আদম। আমার পথে খচর করতে থাক। আমি আমার অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তোমাদেরকে দিতে থাকবো। (বুখারী, মুসলিম)

 

হযরত আবু যার (রা) বলেন, একবার আমি নবী (স) এর দরবারে হাজির হলাম। তিনি তখন কাবা ঘরের ছায়ায় আরাম করছিলেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, কাবার রবের কসম। ওসব লোক ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন। বললাম, আমার না-বাপ আপনার জন্যে কুরবান হোক, বলুন তারা কে যারা ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন। ইরশাদ হলো, ঐসব লোক যারা পুঁজিপতি ও সচ্ছল। হা, তাদের মধ্যে ঐসব লোক ক্ষতি থেকে নিরাপদ যারা খোলা মনে সামনে পেছনে, ডানে বামে তাদের মাল আল্লাহর পথে খচর করছে। কিন্তু মালদারের মধ্যে এমনে লোকের সংখ্যা খুবই কম।-(বুখারী, মুসলিম)

 

যাকাত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য

 

যাকাত ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে মুমিনের দিল থেকে দুনিয়ার মহব্বত ও তার মূল থেকে উৎপন্ন যাবতীয় ঝোপ ঝাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে আল্লাহর মহব্বত প৫য়দা করতে চায়। এটা তখনই সম্ভব যখন মুমিন বান্দা শুধু যাকাত দিয়ে সন্তুষ্টি থাকে না। বরঞ্চ যাকাতের সে প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা করে এবং মনে করে আমার কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর। সেসব তারই পথে খরচ করেই তার সন্তুষ্টি লাভ করা যেতে পারে। যাকাতের ঐ প্রাণশক্তি ও উদ্দেশ্য আত্মস্থ না করে না কেউ আল্লাহর জন্যে মহব্বত করতে পারে, আর না আল্লাহর হক জেনে নিয়ে তা পূরণ করার জন্য সজাগ ও মুক্ত হস্ত হতে পারে।

 

যাকাত ব্যবস্থা আসলে গোটা ইসলামী সমাজকে কৃপণতা সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, মনে কঠিনতা এবং শোষণ করার সূক্ষ্ম প্রবণতা থেকে পাক পবিত্র করে। তার মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, ত্যাগ, দয়া দাক্ষিণ্য, নিষ্ঠা, শুভাকাঙ্ক্ষা, সহযোগিতা, সাহচর্য প্রভৃতি উন্নত ও পবিত্র প্রেরণার সঞ্চার করে এবং সেগুলোকে বিকশিত করে। এ কারণেই যাকাত প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপর ফরয ছিল। অবশ্য তার নেসাব এবং ফেকার হুকুম আহকামের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কিন্তু যাকাতের হুকুম প্রত্যেক শরীয়াতের মধ্যেই ছিল।

 

যাকাত পূর্ববর্তী শরীয়াত

 

যাকাতের এ মর্মকথা ও প্রাণশক্তি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে দেখলে জানা যায় যে, যাকাত মুমিনের জন্যে একটি অপরিহার্য আমল এবং একটি অপরিহার্য গুণ। এ কারণে প্রত্যেক নবীর শরীয়াতে এর হুকুম বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যায়।

 

কুরআন সাক্ষ্য দেয় যে, যাকাত সকল আম্বিয়ার উম্মতের ওপর তেমনি ফরয ছিল যেমন নামায ফরয। সূরা আম্বিয়াতে হযরত মূসা (আ) ও হযরত হারূন (আ) এর প্রসঙ্গে বর্ণনায় পর বিস্তারিতভাবে সে চিন্তামূলক কথোপকথন বর্ণনা করা হয়েছে যা হযরত ইবরাহীম (আ) ও তার জাতির মধ্যে হয়েছিল। অতঃপর এ প্রসঙ্গেই হযরত লুত (আ) হযরত ইসহাক (আ) এবং হযরত ইয়াকুব (আ) এর উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছেঃ

 

***** আরবী *********

 

এবং আমরা তাদের সকলকে নেতা বানিয়েছি। তারা আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী হেদায়াতের কাজ করতো। এবং আমরা তাদেরকে ওহীর মাধ্যমে নেক কাজ করার নামাযের ব্যবস্থাপনা করার যাকাত দেয়ার হেদায়াত করেছিলাম এবং তারা সকলে ইবাদাতকারী বান্দা ছিল।

 

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ঐ ওয়াদা ও শপথের উল্লেখ করা হয়েছে যা ইহুদীদের নিকট থেকে নেয়া হয়েছিল। তার গুরুত্বপূর্ণ দফাগুলোর মধ্যে একটি দফা এটাও ছিল যে, তারা নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে।

 

******* আরবী ******

 

এবং স্মরণ কর সেই কথা যখন আমরা বনী ইসরাঈলের নিকট পাকা ওয়াদা নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া তোমরা কারো বন্দেগী যেন না কর, মা বাপের সাথে যেন ভালো ব্যবহার কর। আত্মীয় স্বজন এতীম ও মিসকিনের সাথেও যেন ভালো ব্যবহার কর এবং লোকের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে। নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। (সুরা আল বাকারা ৮৩)

 

অন্য একস্থানে বনী ইসরাইলকেই আল্লাহ তায়ালা বলেন

 

******* আরবী *******

 

এবং আল্লাহ (বনী ইসরাইলকে) বলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি যদি তোমরা নামায কায়েম করতে থাক এবং যাকাত দিতে থাক।

 

(সূরা মায়েদা ১২)

 

হযরত ইবরাহীম (আ) এর পুত্র এবং নবী (স) এর পূর্ব পুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ) এর প্রশংসা করতে গিয়ে কুরআন বলে যে, তিনি তার আপন লোকজনদেরকে নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার তাকীদ করতেন

 

******* আরবী ********

 

এবং (ইসমাঈল) তার আপন লোকজনকে নামায ও যাকাতের জন্যে তাকীদ করতো এবং সে তার রবের পছন্দই বান্দা ছিল। (সূরা মরিয়ম ৫৫)

 

হযরত ঈসা (আ) তার পরিচয় পেশ করতে গিয়ে তার নবুয়াতের পদে ভূষিত হওয়ার উদ্দেশ্যেই এটা বলেন, আমার আল্লাহ আমাকে আজীবন নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার অসিয়ত করেন।

 

********** আরবী *************

 

এবং তিনি আমাকে হুকুম করেছেন যে, নামায কায়েম করি এবং যাকাত দিতে থাকি যতদিন বেচে থাকবো। (সুরা মরিয়ম ৩১)

 

যাকাতের মহত্ব ও গুরুত্ব

 

ইসলামে যাকাতের যে অসাধারণ মহত্ব ও গুরুত্ব রয়েছে তার অনুমান এর থেকে করা যায় যে, কুরআন পাকে অন্তত বত্রিশ স্থানে নামায ও যাকাতের এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের পর প্রথম দাবীই হচ্ছে নামায ও যাকাতের। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি ইবাদাত পালন করার অর্থ গোটা দ্বীন পালন করা। যে বান্দা মসজিদের মধ্যে আল্লাহর সামনে গভীর আবেগ সহকারে তার দেহ ও মন বিলিয়ে দেয়, সে মসজিদের বাইরে আল্লাহর হক কিভাবে অবহেলা করতে পারে? ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি তার প্রিয় ধন সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আল্লাহর পথে সন্তুষ্ট চিত্তে বিলিয়ে দিয়ে মনে গভীর শান্তি অনুভব করে, সে অন্যান্য বান্দাদের হক কিভাবে নষ্ট করতে পারে? আর ইসলাম তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও বান্দার হকেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্যে কুরআন নামায এবং যাকাতের ইসলামের পরিচায়ক এবং ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশের সাক্ষ্য বলে গণ্য করে। সূরা তওবায় আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা ও অসন্তোষ প্রকাশের পর মুসলমানদেরকে এ হেদায়াত দেন যে, তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে নামায কায়েম করতে ও যাকাত দিতে থাকে, তাহলে তারা দ্বীনি ভাই বরে গণ্য হবে। তারপর ইসলামী সমাজে তাদের সেস্থান হবে যা মুসলমানদের আছে।

 

********** আরবী ************

 

যদি তারা (কুফর ও শিরক থেকে) তওবা করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।(সূরা আত তওবা ১১)

 

এ আয়াত একথাই বলে যে, নামায ও যাকাত ইসলামের সুস্পষ্ট আলামত এবং অকাট্য সাক্ষ্য। এ জন্যে কুরআন যাকাত না দেয়াকে মুশরিকদের নিদর্শন ও কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছে। এ ধরনের লোককে আখিরাতে অস্বীকারকারী ও ঈমান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

 

********** আরবী ************

 

ধ্বংস ওসব মুশরিকদের জন্যে যারা যাকাত দেয় না এবং আখিরাত অস্বীকারকারী। (সূরা হা মীম আস সাজদা ৬-৭)

 

প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) এ খেলাফত কালে যখন কিছু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করলো তখন তিনি তাদেরকে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ও মুরতাদ হওয়ার সমতুল্য মনে করলেন এবং ঘোষণা করলেন, এসব লোক নবীর যামানায় যে যাকাত দিতো তার মধ্যে থেকে একটি ছাগলের বাচ্চা দিতেও যদি অস্বীকার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবো। হযরত উমর (রা) সিদ্দিকে আকবরকে বাধা দিয়ে বললেন, আপনি তাদের বিরুদ্ধে কি করে জেহাদ করবেন যেহেতু তারা কালেমায় বিশ্বাসী। তিনি আরও বলেন, নবী (স) এর ইরশাদ হচ্ছে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে তার জান মাল আমার পক্ষ থেকে নিরাপদ। হযরত আবু বকর (রা) তার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করে বলেন।

 

********** আরবী ************

 

আল্লাহর কসম যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই করবো।(বুখারী, মুসলিম)(হযরত আবু বকর (রা) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জেহাদের যুক্তি হিসেবে সূরা তাওবার ৫নং আয়াত পেশ করেন:

 

********** আরবী ************

 

তারা যদি তওবা করে নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দাও। (অনুবাদক)

 

নামায ও যাকাত দ্বীনের এমন দুটি রুকন বা স্তম্ভ যা অস্বীকার করলে অথবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করলে তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে পড়া এবং মুরতাদ হওয়ার সমতুল্য। আর মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে মুরতাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ বলেন, আমাদেরকে নামায পড়ার এবং যাকাত দেয়ার হুকুম করা হয়েছে। যে যাকাত দেবে না তার নামাযও নেই- (তাবরানী)

 

যারা যাকাত দেয়া থেকে বিরত, কুরআন তাদেরকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত বলেছেঃ

 

********** আরবী ************

 

হেদায়াত ঐ সব মুত্তাকীদের জন্যে যারা গায়েবের ওপর ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং যা আমি তাদেরকে দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে। (সূরা আল বাকারা ২-৩)

 

কুরআনের দৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে তারাই সাচ্চা মুমিন যারা যাকাত দেয়-

 

********** আরবী ************

 

যারা নামা কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যা দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে তারাই সাচ্চা মুমিন। (সুরা আনফাল ২-৩)

 

নবী করীম (স) যাকাতের মহত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ

 

দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী, এবং জাহান্নাম থেকে দূরে। অপরদিকে কৃপণ আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের নিকটে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, একজন জাহেল দানশীল একজন কৃপণ আবেদের তুলনায় আল্লাহর নিকটে অনেক বেশী পছন্দনীয়। (তিরিমিযি)

 

যাকাত অবহেলার ভয়ংকর পরিণাম

 

যাকাতের অসাধারণ গুরুত্বের কারণে, কুরআন ঐসব লোকদের জন্যে চরম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা বলেছে যারা যাকাত দেয় না। ক্ষয়শীল ধন সম্পদের মহব্বতে উন্মত্ত হয়ে তারা যেন ভয়াবহ পরিণাম ডেকে না আনে, তার জন্যে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তারা যেন সে ভয়াবহ শাস্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, যার ধারণা করতেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়।

 

********** আরবী ************

 

যারা সোনা চাঁদি জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। ( সে শাস্তি হলো এই যে,) এমন একদিন আসবে যেদিন জাহান্নামের আগুনে সেসব সোনা চাঁদি উত্তপ্ত করা হবে এবং তারপর তা দিয়ে তাদের চেহারা ও মুখমণ্ডল, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। (এবং বলা হবে) এ হলো সেই ধন সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা করে রেখেছিলে। অতএব এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের আস্বাদ গ্রহণ করো। (সূরা আত তওবা ৩৪-৩৫)

 

হযরত আবদুল্লাহ  বিন উমর (রা) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, এ আয়াতে ..... বলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বলতে কি বুঝায়। তিনি বলেন ........ বলতে সে ধন সম্পদ বুঝায় যার যাকাত দেয়া হয়নি। যারা যাকাত দেয় না তাদেরকে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে নবী (স) আখিরাতের ভয়ংকর আযাবের চিত্র এভাবে এঁকেছেন।

 

যাকে আল্লাহ তায়ালা ধন দৌলত দিয়েছেন তারপর সে তার ধনের যাকাত দিলো না। তখন তার ধনকে কিয়ামতের দিন বিষধর সাপের রূপ দেয়া হবে। বিষের তীব্রতায় সে সাপের মাথা লোমহীন হবে। তার চোখ দুটি কালো দাগ হবে। কেয়ামতের দিন সে যাকাত না দেয়া কৃপণ ব্যক্তির গলা জড়িয়ে ধরবে এবং তার দু চোয়ালে তার বিষধর দাঁত বসিয়ে দিয়ে বলবে আমি তোর ধন সম্পদ আমি তোর সঞ্চিত ধন দৌলত।

 

তারপর নবী (স) নিম্নের আয়াত তেলাওয়াত করেন:

 

********** আরবী ************

 

যাদেরকে আল্লাহ তার অনুগ্রহে দান দৌলত দিয়েছেন এবং কৃপণতা করে তারা যেন এ ধারণা না করে যে, এ কৃপণতা তাদের জন্যে মঙ্গলজনক, বরঞ্চ এ তাদের জন্য অত্যন্ত অমঙ্গলজনক। কৃপণতা করে যা কিছু তারা জমা করে রেখেছে কেয়ামতের দিন তা হাসুলি বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে। (সুরা আলে ইমরান ১৮০)

 

উপরন্তু নবী পাক (স) যাকাত অবহেলা করার ভয়ানক পরিণাম থেকে বাচার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে নসীহত করেন, তিনি বলেন-

 

কেয়ামদের দিন তোমাদের মধ্য কেই যেন আমার কাছে এ অবস্থায় না আসে যে, তার ছাগল তার ঘাড়ের ওপর চাপানো থাকবে এবং সে সাহায্যর জন্যে আমাকে ডাকবে। আমি তখন বলবো আজ তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে পারবো না আমি তোমাকে আল্লাহর হুকুম আহকাম পৌছিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর দেখ, সেদিন তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার উট তার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে আমার নিকটে না আসে। সে সাহায্যের জন্যে আমাকে ডাকবে এবং আমি তাকে বলবো তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে পারবো না। আমি তো আল্লাহর হুকুম তোমাকে পৌছিয়ে দিয়েছিলাম। (বুখারী)

 

একদিন নবী (স) দেখলেন যে, দুজন মহিলা হাতে সোনার কঙ্কণ পরিধান করে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এর যাকাত দাও কিনা। তারা না বললে নবী বললেন, তোমরা কি তাহলে এটা চাও যে, এ সবের পরিবর্তে তোমাদের আগুনের কঙ্কণ পরানো হবে? তারা বললো না না, কখনোই না।

 

তখন নবী (স) বললেন, এ সবের যাকাত দিতে থাকো। (তিরমিযি)

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা) বলেন, নবী (স) খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকেরা! লোভ লালসা থেকে দূরে থাকো। তোমাদের পূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছে তারা এ লোভ লালসার জন্যেই হয়েছে। লোভ তাদের মধ্যে কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা কৃপণ ও ধনের পূজারী হয়ে পড়ে। এ তাদেরকে আপনজনের প্রতি দয়া মায়ার সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রেরণা দেয় এবং তারা দয়া মায়া ছিন্ন করার অপরাধ করে বসে। এ তাদেরকে পাপাচার প্রেরণা দেয় এবং তারা পাপাচার করে। (আবু দাউদ)

 

কুরআন ও সুন্নাতের এসব সাবধান বাণীর ফলে সাহাবায়ে কেরাম (রা) ....... সদকার ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। অনুভূতি এতোটা তীব্র ছিল যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কপর্দকও কাছে রাখা হারাম মনে করতেন। আবু যর (রা) এর তো চির অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি একত্রে কিছু লোক দেখতেন তখন যাকাতের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

 

যাকাতের তাকীদ ও প্রেরণা

 

যাকাতের অসাধারণ গুরুত্ব ও মহত্বের কারণে কুরআন পাকের বিরাশি স্থানে এর তাকীদ করা হয়েছে। সাধারণত নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলা হয়েছে। যেমন:

 

********** আরবী ************

 

এবং নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও।

 

কুরআন ও সুন্নাতের তার বিরাট দ্বীনি ও দুনিয়াবি ফায়দার কথা বলে বিভিন্নভাবে এজন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন:

 

যারা তাদের মাল আল্লাহর পথে খরচ করে তাদের এ খরচের দৃষ্টান্ত একটি শস্যদানার মতো যে দানা থেকে সাতটি শীষ বের হয় এবং প্রত্যেক শীষে একশটি দানা হয়। এভাবে আল্লাহ যে আমলকে চান তাকে বাড়িয়ে দেন এবং আল্লাহ প্রশস্ত ও মুক্ত হস্ত এবং জ্ঞানী (সূরা বাকারা ২৬১)

 

কৃষক তার শস্যবীজ আল্লাহর যমীনের কাছে হস্তান্তর করে আশায় দিন গুনতে থাকে এবং বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে। তাপর আল্লাহ তাকে একটি বীজের পরিবর্তে অগণিত শস্য দানা দান করেন। এ ঈমান উদ্দীপক অভিজ্ঞতাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করে আল্লাহ এ কথা বুঝাতে চান যে, বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যা কিছু খরচ করবে আল্লাহ তা এতোটা বাড়িয়ে দেবেন যে, এক একটি দানার বিনিময়ে সাতশ দানা দান করবেন। বরঞ্চ এর চেয়ে অধিকও তিনি দিতে পারেন। বান্দার গভীর নিষ্ঠা এবং আবেগ উচ্ছ্বাসের স্বীকৃতি আল্লাহ দিয়ে থাকেন। তিনি এতো পরিমাণে দান করেন যে, বান্দা তার ধারণাই করতে পারে না। আর এ দান ও ......... আখিরাতের জন্যেই নির্দিষ্ট নয়, বরঞ্চ দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা .......... সমাজকে মঙ্গল ও বরকত, সচ্ছলতা ও উন্নতি দান করে থাকেন।

 

********** আরবী ************

 

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তোমরা যে যাকাত দাও, যাকাত দানকারী প্রকৃতপক্ষে তার মাল বর্ধিত করে। (সূরা আর রূম ৩৯)

 

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যাকাত, সদকা প্রভৃতি তারাই দেয় যারা উদার, দানশীল, পরস্পর সহানুভূতিশীল, শুভাকাঙ্ক্ষী। আর এসব গুণাবলী সৃষ্টি করে যাকাত ও সদকা।দুনিয়াতে মঙ্গল ও বরক, শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নতি ও সচ্ছলতা ঐ সমাজের ভাগ্যে জোটে যার লোকের মধ্যে এসব গুণাবলী সাধারণভাবে পাওয়া যায়, ধন মুষ্টিমেয় স্বার্থপর, সংকীর্ণচেতা ও কৃপণের হাতে পুঞ্জিভূত হয় না। বরঞ্চ গোটা সমাজে তার সুষম বণ্টন হয় এবং সকলের আপন আপন সাহস ও যোগ্যতা অনুযায়ী জীবিকা অর্জন ও খরচ করার স্বাধীনতা থাকে এবং সকলে একই প্রকার সুযোগ সুবিধা লাভ করে।

 

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার পবিত্র উপার্জন থেকে একটি খেজুরও সদকা করে, আল্লাহ সেটা নিজ হাতে নিয়ে বর্ধিত করতে থাকেন যেমন তোমরা তোমাদের সন্তান প্রতিপালন কর, তারপর সেটা একটা পাহাড়ের সমান হয়ে যায়। (বুখারী)

 

হযরত আবু হুরাইরা (রা) আরও বলেন, নবী (স) বলেছেন, সদকা দেয়াতে মাল কম হয় না (বেড়েই যায়) কাউকে ক্ষমা করাতে মহত্বই বাড়ে (তাতে অপমান হয় না) এবং যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর জন্যে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে উচ্চমর্যাদা দান করেন। (মুসলিম)

 

কুরআন সুস্পষ্ট করে বলে যে, অন্তরকে পাক-পবিত্রকারী, সৎ পথের পথিক, হিকমতের গুণে গুণান্বিত আল্লাহর সন্তুষ্টি, মাগফেরাত ও রহমত লাভকারী, আখিরাতের চিরন্তন শান্তি ও আল্লাহর

 

নৈকট্য লাভকারী ঐসব লোক যারা সন্তুষ্টচিত্তে হরহামেশা যাকাত দিতে থাকে।

 

********** আরবী ************

 

(হে নবী) তাদের মাল থেকে সদকা গ্রহণ করে তাদেরকে পাক কর এবং নেকির পথে তাদেরকে অগ্রসর কর। (সূরা আত তওবা ১০৩)

 

শয়তান তোমাদেরকে অভাব ও দৈন্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল ও লজ্জাজনক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করারে প্ররোচনা দেয়। অন্যদিকে আল্লাহ তোমাদেরকে তার মাগফেরাত ও করুণার আশ্বাস দেন এবং তিনি মুক্ত হস্ত এবং বিজ্ঞ। তিনি যাকে চান হিকমত দান করেন। আর যে হিকমত লাভ করে প্রকৃতপক্ষে সে বিরাট সম্পদ লাভ করে। (সূরা আল বাকারা ২৬৮-২৬৯)

 

********** আরবী ************

 

এবং তারা যা কিছু আল্লাহর পথে খরচ করে তা আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং রাসূল (স) এর পক্ষ থেকে রহমতের দোয়া নেবার উপায় বানায়। মনে রেখো, ও অবশ্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় এবং আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে তার রহমতের মধ্যে নিয়ে নেবেন। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমা দয়াশীল। (সূরা আত তওবা ৯৯)

 

********** আরবী ************

 

এবং জাহান্নামের আগুন থেকে ঐ ব্যক্তিকে দূরে রাখা হবে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করে এবং যে এজন্য অপরকে মাল দান করে যাতে করে তার মন কৃপণতা লোভ ও দুনিয়ার মোহ থেকে পাক হয়। (সূরা আল লাইল ১৭-১৮)

 

হযরত আদী বিন হাতিম (র) বলেন, নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি হে লোকেরা! জাহান্নামের আগুন থেকে বাচ, খুরমা খেজুরের এক টুকরা দিয়ে হলেও। (বুখারী)

 

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন নবী (স) বলেছেন, কেয়ামতের দনে আল্লাহর আরশ ছাড়া যখন কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না, তখন সাত রকমের লোক আরশের ছায়ায় থাকতে পারবে। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি এমন হবে, যে এমন গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে যে, তার বাম হাত জানতে পারবে না ডান কি খরচ করলো। (বুখারী)

 

নবী (স) এর দরবারে কেউ সদকার মাল নিয়ে হাজির হতো যখন তিনি অত্যন্ত খুশী হতেন এবং তার জন্যে রহমতের দোয়া করতেন। একবার হযরত আবু আওফা (রা) সদকা নিয়ে নবীর দরবারে হাজির হন। তখন নবী (স) তার জন্যে নিম্নের দোয়া করেন:

 

********** আরবী ************

 

হে আল্লাহ আবু আওফার পরিবারের ওপর তোমার রহমত নাযিল কর। (বুখারী)

 

একবার নবী পাক (স) আসরের নামাযের পরেই ঘরে চলে যান এবং কিছুক্ষণ পর বাইরে আসেন। সাহাবায়ে কেরাম কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, সোনার এক টুকরা ঘরে রয়েছিল। রাত পর্যন্ত তা ঘরের পড়ে থাকবে এটা আমি ঠিক মনে করলাম না। তাই তা অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে এলাম। (বুখারী)

 

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সদকা ও দান করার ফলে আল্লাহর রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং খারাপ ধরনের মৃত্যু থেকে মানুষ রক্ষা পায়।

 

একথা ঠিক যে, আল্লাহর গযব থেকে নিরাপদ এবং খাতেমা বিল খায়ের (ঈমানের সাথে মৃত্যু) ছাড়া একজন মুমিনের চরম ও পরম বাসনা আর হতে পারে?

 

যাকাতের হুকুম

 

প্রত্যেক সাহেব নেসাবের (সচ্ছল ব্যক্তি) ওপর ফরজ যে, যদি তার কাছে নেসাব পরিমাণ মাল এক বৎসর যাবত মজুদ থাকে, তাহলে তার যাকাত সে অবশ্যই দেবে। যাকাত অপরিহার্য ফরজ। এ ফরজ কেউ অস্বীকার করলে সে কাফের হবে। আর যে ফরজ হওয়া অস্বীকার করে না বটে কিন্তু যাকাত দেয় না সে ফাসেক এবং কঠিন গুনাহগার।

 

যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য

 

সরকারের পক্ষ থেকে জনসাধারণের উপর যে ট্যাক্স ধার্য করা হয়, যাকাত এ ধরনের কোন জিনিষ নয়। এ হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। এবং দ্বীন ইসলামের অন্যতম রোকন বা স্তম্ভ, নামাজ রোজা ইসলামের রোকন। কুরআনে নামাজের সাথে সাথেই সাধারণত যাকাতের উল্লেখ আছে। এ হচ্ছে আল্লাহর সেই দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যা প্রত্যেক যুগে নবীগণের দ্বীন ছিল।

 

যাকাত ব্যবস্থার ফলে মানুষের মনে ও ইসলামী সমাজে যে বিরাট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সুফল হয় তা একমাত্র তখনই হতে পারে যখন ইবাদত ও ট্যাক্সের মৌলিক পার্থক্য মনে বদ্ধমূল থাকবে এবং যাকাত আল্লাহর ইবাদত মনে করেই দেওয়া হবে।

 

অবশ্য যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা ইসলামী রাষ্ট্রের উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। এবং এ আইন শৃঙ্খলার একটা দায়িত্ব। কিন্তু এ জন্য নয় যে, এ একটি ট্যাক্স বা সরকার আরোপিত কোন কর। বরঞ্চ ইসলামের সকল সামষ্টিক ইবাদতে একটা শৃঙ্খলা বিধান করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

 

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত

 

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সাতটি।(আহলে হাদীসের দৃষ্টিতে প্রথম পাঁচটি শর্ত জরুরী। তাদের নিকটে জ্ঞান সম্পন্ন (সজ্ঞান) ও বালেগ হওয়া যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য জরুরী নয়। তাদের দলিল হচ্ছে কুরআনের বাণী .....আরবী...... যাকাত দাও। এবং প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষের জন্যে এবং .......আরবী ....... (হে নবী) তাদের মাল তেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক এবং তাদের তাযকিয়া কর। পবিত্রতা ও তাযকিয়া প্রত্যেক মুসলমানদের আবশ্যক। সে জন্যে প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষের ওপর যাকাত ফরয। সে জ্ঞানবান ও বালেগ হোক বা না হোক। আহলে হাদীস ছাড়া অন্যান্য আলেমগণও পরের দুটি শর্ত স্বীকার করেন না। অর্থাৎ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্যে জ্ঞান সম্পন্ন ও বালেগ হওয়াকে শর্ত বলে গণ্য করেন না।)

 

(১) মুসলমান হওয়া.

 

(২) নেসাবের মালিক হওয়া.

 

(৩) নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া.

 

(৪) ঋণগ্রস্ত না হওয়া.

 

(৫) মাল এক বছর স্থায়ী হওয়া.

 

(৬) জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া.

 

(৭) বালেগ হওয়া.

 

নিম্নে এসব শর্তের বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ

 

১. মুসলমান হওয়া।অমুসলিমের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। অতএব যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলো, তাকে তার অতীত জীবনের যাকাত দিতে হবে না।

 

২. নেসাবের মালিক হওয়া।অর্থাৎ এতো পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে যার উপর শরীয়ত যাকাত ওয়াজিব করেছে।

 

৩. নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। প্রকৃত প্রয়োজন বলতে বুঝায় এমন সব জিনিষ যার উপর মানুষের জীবন যাপন ও ইজ্জত আব্রু নির্ভরশীল যেমন খানা-পিনা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বাসের বাড়ি-ঘর, পেশাজীবী লোকের যন্ত্রপাতি, মেশিন প্রভৃতি। যানবাহনের পশু, সাইকেল মোটর প্রভৃতি, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, পড়াশুনার বই-পুস্তক, (বিক্রির জন্য নয়) এসব কিছু প্রকৃত প্রয়োজনের জিনিষ। এসবের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে অতিরিক্ত মাল নেসাবের পরিমাণ হলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি অন্যান্য শর্তগুলোও থাকে।

 

৪. ঋণগ্রস্ত না হওয়া।যেমন কোন ব্যক্তির নিকটে নেসাবের পরিমাণ মাল আছে বটে কিন্তু অপরের কাছে তার ঋণ রয়েছে। তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে এতো পরিমাণ মাল আছে যে, ঋণ পরিশোধ করার পরও নেসাবের পরিমাণ মাল অবশিষ্ট থাকে তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

৫. মাল এক বছরকাল স্থায়ী হওয়া। নেসাব পরিমাণ মাল হলেই তার যাকাত ওয়াজিব হবে না। বরঞ্চ সে পরিমাণ মাল এক বছর স্থায়ী হলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

হযরত ইবনে উমর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যে কোনো উপায়েই সম্পদ লাভ করুক তার ওপর যাকাত তখনই ওয়াজিব হবে যখন তা পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী থাকবে। (তিরমিযি)

 

৬. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। যে ব্যক্তি জ্ঞান বুদ্ধি থেকে বঞ্চিত যেমন পাগল। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।

 

৭. বালেগ হওয়া। নাবালেগ শিশুর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়, তার কাছে যতোই মাল থাক না কেন। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। তার অলীর ওপরও ওয়াজিব নয়। (এ প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটা মত এই যে, এতিমের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। দ্বিতীয় মত হচ্ছে এই যে, এতিম সাবালক হওয়ার পর তার অলী তার সম্পদ তাকে হস্তান্তর করার সময় তাকে যাকাতের বিবরণ বলে দেবে। তখন তার কাজ হচ্ছে এই যে, সে তার এতিম থাকাকালীন সময়ের পুরো যাকাত আদায় করবে।তৃতীয় মত এই যে, এতিমের মাল যদি কোনো কারবারে লাগানো হয়ে থাকে এবং তার মুনাফা হচ্ছে তাহলে তার অলী যাকাত দেবে। অন্যথায় যাকাত ওয়াজিব হবে না। চতুর্থ মত এই যে, এতিমের মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব এবং তা দেয়ার দায়িত্ব অলীর। এ চতুর্থ অভিমত অধিকতর সঠিক। হাদীসে আছে:

 

অর্থাৎ সাবধান, যে ব্যক্তি এমন এতিমের অলী যার মাল আছে তার উচিত, তার মালে কোনো ব্যবসা করবে এবং তা এমনি পড়ে থাকতে দেবে না, যাতে তার সব মাল যাকাতে খেয়ে না ফেলে। (তিরমিযি, দারে কুতনী, বায়হাকী)

 

এর সম অর্থবোধক একটি মুরসাল হাদীস ইমাম শাফেয়ী (র) এবং মরফু হাদীস তাবারানী ও আবু উবায়দ থেকে বর্ণিত আছে। তার সমর্থক সাহাবা ও তাবেঈন দ্বারা পাওয়া যায় যা হযরত উমর (রা) হযরত আয়েশা (রা), হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা) এবং হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে।

 

মস্তিষ্ক বিকৃত লোকের সম্পর্কেও এ ধরনের মতভেদ আছে যেমন উপরে বলা হয়েছে। এতেও আমাদের মতে সঠিক অভিমত এই যে, পাগলের মালেরও যাকাত ওয়াজিব এবং তা আদায় করার দায়িত্ব অলীর। ইমাম মালেক (র) এবং ইবনে সোহাব যুহরী ও অভিমতেরই ব্যাখ্যা করেছেন। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ.১৩০, ১৩৮)

 

যাকাত আদায় সহীহ হওয়ার শর্ত

 

যাকাত আদায় সহীহ হওয়ার শর্ত ছয়টি। এ ছয়টি শর্ত পাওয়া গেলে যাকাত আদায় হবে। অন্যথায় হবে না। যেমন-

 

১. মুসলমান হওয়া,

 

২. যাকাত দেয়ার নিয়ত করা,

 

৩. নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা,

 

৪. মালিকানা বানিয়ে দেয়া,

 

৫. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া,

 

৬. বালেগ হওয়া। নিম্নে এ সবের বিশ্লেষণ ও ফায়দা বর্ণিত হলোঃ

 

১. মুসলমান হওয়া। যাকাত সহীহ হওয়ার শর্ত এই যে, যাকাতদাতাকে মুসলমান হতে হবে। যেহেতু অমুসলিমের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। সে জন্যে কোনো অমুসলিম যাকাত দিলে তা হবে না। অতএব ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যদি কেউ ভবিষ্যতের যাকাত দিয়ে দেয় এবং তারপর ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে পূর্বের দেয়া যাকাত দিয়ে দেয় এবং তাপর ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে পূর্বের দেয়া যাকাত সহীহ হবে না। মুসলমান হওয়ার পর পুনরায় যাকাত দিতে হবে।

 

২. যাকাত দেয়ার নিয়ত করা। যাকাত বের করার সময় অথবা হকদারকে দেয়ার সময় যাকাত দেয়ার নিয়ত জরুরী। যাকাত বের করার সময় যাকাতের নিয়ত না করলে হবে না। যাকাতের জন্য এটা প্রয়োজন যে, সে মাল হকদারের কাছে পৌঁছে যেতে হবে।

 

৩. যাকাত দেওয়ার সময় যাকাত গ্রহণকারীকে তার মালিক বানাতে হবে। সে মালিক হকদারকে বানানো হোক অথবা যাকাত আদায়কারী ও বণ্টনকারী সংস্থাকে করা হোক।

 

৪. নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা। যাকাত দেয়ার খাত কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। এসব ছাড়া অন্য কোন খাতে ব্য করলে তা হবে না।

 

৫. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। মস্তিষ্ক বিকৃত অথবা পাগল যাকাত দিলে তা হবে না।

 

৬. বালেগ হওয়া।নাবালেগ শিশু যাকাত দিলে তা হবে না।

 

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার কিছু মাসায়েল

 

১. প্রকৃত প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ রাখা হয়েছে তা যদি ঐ বছরেই খরচ করার প্রয়োজন হয় তাহলে তার যাকাত দিতে হবে না। আর যদি সে বছরের পর ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। -(ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)

 

২. যে মালের মধ্যে অন্য কোন হক, যেমন ওশর, খেরাজ প্রভৃতি ওয়াজিব হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। (ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)

 

৩. কেউ যদি কোন কিছু কারো কাছে রেহেন বা বন্ধক রাখে তাহলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। যে রেহেন দেবে এবং যে নেবে তাদের কারো ওয়াজিব হবে না।-(ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)

 

৪. কারো কোন মাল হারিয়ে গেলে কিংবা অর্থ হারিয়ে গেল। তারপর কিছু কাল পরে আল্লাহর ফযলে তা পাওয়া গেলে এবং হারানো অর্থ হস্তগত হলে, তাহলে হারানোর সময় ওয়াজিব হবে না। এজন্য যে, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য মাল নিজেরে আয়ত্বে এবং মালিকানায় থাকা দরকার।

 

৫. কারো কাছে বছরের প্রথমে নেসাবের পরিমাণ মাল মওজুদ ছিলো। মাঝখানে কিছু সময় তা হারিয়ে গেল অথবা নিঃশেষ হয়ে গেল। তারপর বছরের শেষভাগে আল্লাহর ফযলে নেসাবের পরিমাণ মাল হয়ে গেল। তাহলে সে মালের যাকাত ওয়াজিব হবে। মাঝামাঝি সময় মাল না থাকা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না।-(ইলমুল ফেকাহ)

 

৬. কেউ গ্রেফতার হলে তার মালের যাকাত দিতে হবে। তার অবর্তমানে যে ব্যক্তি তার কারবার চালাবে অথবা তার মালের মোতায়াল্লি হবে সে যাকাত দেবে। (রাসায়েল ও মাসায়েল-২য় খন্ড)

 

৭. মুসাফিরের মালের উপর যাকাত ওয়াজিব যদি সে নেসাবের মালিক হয়। অবশ্যি মুসাফির হওয়ার কারণে গ্রহণেরও হকদার হবে। কিন্তু যদি সে ধনী ও সাহেবে নেসাব। সে জন্য তার উপর যাকাত ওয়াজিব। তার সফর তাকে যাকাতের হকদার বানায় এবং তার মালদার হওয়া তার উপর যাকাত ফরজ হয়। (বেহেশতী জিউর-৩য় খন্ড)

 

৮. কেউ কাউকে কিছু দান করলো। তা যদি নেসাবের পরিমাণ হয় এবং এক বছর অতীত হয় তাহলে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। (ঐ)

 

৯. ঘরের সাজ সরঞ্জাম, যেমন তামা, পিতল, এলুমিনিয়াম, স্টিল, প্রভৃতির বাসনপত্র, পড়নের ও গায়ে দেওয়ার কাপড়-চোপড়, শতরঞ্জি, ফরাস, ফার্নিচার, প্রভৃতি, সোনা চাঁদি ছাড়া অন্য ধাতুর অলংকার, মতির অলংকার, মতির হার, প্রভৃতি, যতোই মূল্যবান হোক, তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। (ঐ)

 

১০. কোন উৎসবের জন্য কেউ বহু পরিমাণ শস্যাদি খরিদ করলো। তারপর মুনাফার জন্য তা বিক্রি করে দিল। তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। যাকাত ঐ মালের উপর ওয়াজিব হবে না যা ব্যবসার নিয়তে কেনা হবে। (ঐ)

 

১১. কারো কাছে হাজার টাকা ছিলো। বছর পূর্ণ হওয়ার পর পাঁচশ টাকা নষ্ট হয়ে গেল এবং বাকী পাঁচশ সে ব্যক্তি খয়রাত করে দিল। তাহলে নষ্ট হওয়া টাকার যাকাতই ওয়াজিব রইলো খয়রাতের টাকার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (ইমাম শাফেয়ী (র) এর মতে সমুদয় টাকার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি ব্যবসায় মোট টাকা নেসাবের পরিমাণ বা তার বেশী হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে পৃথকভাবে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ না হলেও।)

 

১২. যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর কারো সব সহায় সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না।

 

১৩. কোন ব্যবসায় কয়েক ব্যক্তি অংশীদার। সকলের টাকাই লাগানো হয়েছে। যদি প্রত্যেক অংশীদারের পৃথক পৃথক অংশ নেসাবের কম হয় তাহলে কারো ওপরে যাকাত ওয়াজিব হবে না, তাদের সকলের মোট অংশ নেসাব পরিমাণ হোক বা তার অধিক হোক।

 

১৪. কোনো ব্যক্তি রমযান মাসে দু হাজার টাকার যাকাত দিয়ে দিল। এ দু হাজার টাকা তার কাছে সংরক্ষিত রয়ে গেল। এখন রজব মাসে আল্লাহর ফজলে আরও দু হাজার অতিরিক্ত সে পেয়ে গের। এখন বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাকে চার হাজারের যাকাত দিতে হবে। তার একথা মনে করলে চলবে না যে, সে রজব মাসে যা পেলো তা এক বছর পূর্ণ হয়নি। বছরের ভেতরে যে টাকা বা মাল বাড়বে, তা ব্যবসার মুনাফার কারণে হোক অথবা পশুর বাচ্চা হওয়ার কারণে হোক। অথবা দান বা মীরাস পাওয়ার কারণে হোক, মোট কথা যেভাবেই মাল বা অর্থ পাওয়া যাক না কেন, সব মালের যাকাত দিতে হবে পরবর্তী সময়ে পাওয়া মাল বা অর্থ এক বছর পূর্ণ না হলেও তার যাকাত দিতে হবে।

 

যাকাতের মাসায়েল

 

১. যাকাত দেয়ার সময় হকদারকে বা যাকাত গ্রহীতাকে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এ যাকাত। বরঞ্চ উপহার, বাচ্চাদের জন্যে তোহফা এবং ঈদের উপহার বলে দেয়াও জায়েয। এতটুকু যথেষ্ট যে যাকাত দাতা যাকাত দেয়ার নিয়ত করবে।

 

২. শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক হিসেবে এবং কর্মচারী বা খাদেমকে বেতন হিসেবে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। তবে বায়তুলমালের পক্ষ থেকে যেসব লোক যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নিযুক্ত থাকে তাদের বেতন যাকাতের টাকা থেকে দেয়া যেতে পারে।

 

৩. বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েজ এবং মাসিক কিস্তিতে দেয়াও জায়েয এ শর্তে যে দাতা সাহেবে নেসাব হবে। যদি কেউ এ আশায় অগ্রিম যাকাত দেয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে তাহলে এমন ব্যক্তির যাকাত হবে না। সে সময়ে সে সাহেবে নেসাব হবে এবং বছর পূর্ণ হবে তখন তাকে আবার যাকাত দিতে হবে। (বেহেশতি জিওর)

 

হযরত আলী (রা) বলেন, হযরত আব্বাস (রা) অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে নবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)

 

৪. যাকাতে মধ্যম ধরনের মাল দিয়ে দেয়া উচিত। এটা ঠিক নয় যে, যাকাত দাতা সাধারণ মাল যাকাত হিসেবে দিবে এবং এটাও ঠিক নয় যে, যাকাত সংগ্রহকারী সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাল যাকাত হিসেবে নিয়ে নেবে। দাতা আল্লাহর পথে ভালো জিনিস দেবার চেষ্টা করবে এবং আদায়কারী কারো ওপরে বাড়াবাড়ি করবে না।

 

৫. যাকাত যে আদায় করবে (সংগ্রহ করবে) সে ইচ্ছা করলে যে বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে বস্তুত নিতে পারে, যেমন সোনা অথবা পশু এবং ইচ্ছা করলে তার মূল্যও নিতে পারে। উভয় অবস্থায় যাকাত হয়ে যাবে। একথা মনে রাখতে হবে মূল্য আদায় করতে হলে তা যাকাত দেবার সময়ে যে মূল্য হবে তাই আদায় করতে হবে যে সময়ে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে সময়ের মূল্য নয়। যেমন মনে করুন এক ব্যক্তি ছাগল প্রতিপালন করে। বছর পূর্ণ হবার পর একটি ছাগল তার যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। এখন তার মূল্য ৫০ টাকা। এখন কোনো কারণে যাকাত কয়েক মাস বিলম্বে দেয়া হচ্ছে। আর এ সময়ে সে ছাগলটির মূল্য যদি বেড়ে গিয়ে ৬০ টাকা হয় অথবা কমে গিয়ে ৪০ টাকা হয় তাহলে এ ষাট অথবা চল্লিশ টাকা যাকাত দিতে হবে।

 

৬. যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালেই জমা হওয়ার কথা। ইসলামী রাষ্ট্রেরই এ দায়িত্ব যে, সে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা করবে। যেখানে মুসলমানগণ তাদের অবহেলার কারণে গোলামির জীবন যাপন করছে অর্থাৎ যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই, সেখানে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কায়েম করবে এবং সেখানে সকল যাকাত নির্দিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয় করবে। আর এ ধরনের সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা থেকে যদি মুসলমান বঞ্চিত হয় তাহলে নিজের পক্ষ থেকেই হকদারদের কাছে যাকাত পৌছিয়ে দেবে এবং অবিরাম শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে যাতে করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ তায়ালার বহু নির্দেশ ও আইন কানুন মেনে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।

 

৭. যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে যাকাতের হকদার যেমন পঙ্গু, রোগী, স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল, গরীব দুস্থ, মিসকিন, বিধবা, এতিম প্রভৃতি। তাদেরকে সাময়িকভাবেও বায়তুলমাল থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে এবং স্থায়ীভাবেও তাদের ভরণ পোষণের অথবা ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

৮.বায়তুলমাল থেকে যাকাত হকদার কোনো এক ব্যক্তিকেও দেয়া যায় এবং কোনো সংগঠন বা সংস্থাকেও দেয়া যায়। স্বয়ং এ ধরনের কোনো সংস্থাও কায়েম করা যেতে পারে যা যাকাত ব্যয় করার উপযোগী, যেমন এতিমখানা, দুঃস্থদের জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 

৯. অভাবগ্রস্তদেরকে যাকাত খাত থেকে কর্জে হাসানা দেয়াও জায়েয। বরঞ্চ অভাবগ্রস্তদের অবস্থার উন্নয়নের জন্যে এবং তাদের আপন গায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে কর্জে হাসানা দেয়া অতি উত্তম কাজ।

 

১০.যেসব আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েজ, তাদেরকে দিলে দ্বিগুণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। এক যাকাত দেয়ার এবং দ্বিতীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিদান বা সওয়াব। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন যাকাত গ্রহণ করতে যদি লজ্জাবোধ করে অথবা অভাবগ্রস্ত হওয়া স্বত্বেও যাকাত নেয়া খারাপ মনে  করে, তাহলে তাদেরকে একথা বলা ঠিক নয় এ যাকাতের টাকা বা বস্তু। কারণ হকদারকে যাকাতের কথা বলে শর্ত নয়। উৎকৃষ্ট উপায় এই যে, কোনো ঈদের পূর্বে অথবা বিয়ে শাদীতে সাহায্য বা উপঢৌকন স্বরূপ অথবা অন্য কোনো প্রকারে যাকাত তাদেরকে পৌছিয়ে দিতে হবে।

 

১১. চাঁদ মাস হিসেবে যাকাত হিসেবে করে দিয়ে দেয়া ভালো। তবে এটা জরুরী নয়। সৌর মাস হিসেবেও যাকাত দেয়া যায়। কোনো বিশেষ মাসে যাকাত দিতে হবে তাও জরুরী নয়। কিন্তু যেহেতু রমযান মাস মুবারক ও বেশী নেকী করার মাস এবং সওয়াব বেশী গুণে পাওয়া যায়, সে জন্যে এ মাসে যাকাত দেয়া সবচেয়ে ভালো। তাই বলে এমন করা ওয়াজিব নয়। যাকাত আদায়ের এ কোনো শর্তও নয়।

 

১২. সাধারণভাবে এটাই ন্যায়সঙ্গত যে, এক অঞ্চলের যাকাত সেই অঞ্চলেই ব্যয় বা বণ্টন করা। কিন্তু অন্য অঞ্চলেও বিশেষ প্রয়োজনে দেয়া যায়। যেমন বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অন্য এলাকায় বাস করে এবং তারা অভাবগ্রস্ত অথবা অন্য এলাকায় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে এমন অবস্থায় সেসব এলাকায়ও যাকাত পাঠানো যায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে প্রথম এলাকা বা বস্তির কোনো দুঃস্থ লোক যেন বঞ্চিত না হয়।

 

১৩. যাকাত আদায় হওয়ার জন্যে এটাও শর্ত যে, যাকে যাকাত দেয়া যাবে তাকে যাকাতের মালিক বানাতে হবে এবং যাকাত তার হস্তগত হতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি খানা তৈরী করে হকদারকে খাইয়ে দিলো, তাহলে সে যাকাত সহীহ হবে না। হা খানা তৈরী করে তার হাতে দিয়ে তাকে যদি এ এখতিয়ার দেয়া হবে যে, সে তা নিজেও খেতে পারে কিংবা অন্যকে খাওয়াতে অথবা যা খুশি তোই করতে পারে, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কোনো সংস্থা বা বায়তুলমালকে যাকাত দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে যাকাত সংগ্রহ বা আদায়কারীকে দিয়ে দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূর্ণ হয়। তারপর বায়তুলমাল অথবা যাকাত আদায়কারীর দায়িত্ব এসে গেল। যাকাত দাতার এ দায়িত্ব নয় যে, হকদারকে পুনরায় মালিক বানিয়ে দেবে।

 

১৪. যদি কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো আত্মীয়, বন্ধু অথবা যে কোনো লোকের পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে তা হয়ে যাবে। যেমন স্বামী তার স্ত্রীর গহনা প্রভৃতির যাকাত নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিলে স্ত্রীর যাকাত দেয়া হয়ে যাবে।

 

একবার নবী পাক (স) এর চাচা হযরত আব্বাস (রা) নবীর নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী হযরত ওমর (রা) কে যাকাত দিলেন না। তাতে নবী (স) বললেন, তার যাকাত আমার দায়িত্ব। বরঞ্চ তার চেয়েও বেশী। ওমর তুমি বুঝ না যে, চাচা পিতার সমতুল্য। (মুসলিম)

 

মালিকানা দানের প্রসঙ্গ

 

হানাফী আলেমগণের মতে যাকাত সহীহ হওয়ার অনিবার্য শর্ত হচ্ছে, অন্যকে মালিক না বানালে যাকাত আদায় হবে না।এ প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী বিশদ টীকা লিখেছেন যা মালিক বানাবার প্রসঙ্গ উপলব্ধি করার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। নিম্নে তার দূর দৃষ্টিমূলক টীকা বা মন্তব্য দেয়া হলোঃ

 

আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে:

 

********** আরবী ************

 

সদকা তো গরীব দুঃখীদের জন্যে এবং মিসকিনদের জন্যে। তাদের জন্যেও যারা এর জন্যে কাজ করে এবং তাদেরও জন্যে যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্যে। (সূরা আত তাওবাঃ ৬০)

 

লক্ষ্য করুন এখানে লামের কার্যকারিতা শুধুমাত্র গরীব দুঃখীর ওপর নয়। বরঞ্চ মিসকিন, যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতে কুলুবুহুম (যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য) এর ওপরও বটে। এ লাম মালিক বানিয়ে দেবার জন্য অধিকার দেয়ার জন্য। অথবা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য হোকে এবং অন্য যে কোনো অর্থেই হোক, মোটকথা যে অর্থেই গরীব দুঃখীর জন্যে সম্পৃক্ত হবে, ঐ অর্থে বাকী তিন প্রকার লোকের জন্যেও হবে। এখন হানাফীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদি লাম তামলিক বা মালিকানা দানের দাবী করে তাহলে যাকাত এবং ওয়াজিব সদকার মাল এ চার প্রকারের লোকের যে কাউকেই দেয়া হোক তাতে মালিকানা দানের দাবী পূরণ হয়ে যায়। তারপর আবার বার বার মালিকানা প্রদানের হুকুম কোথা থেকে বের হয়? ফকির মিসকিনদের মালিকানায় যাকাতের মাল পৌঁছে যাওয়ার পর তা ব্যয় করার ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ আছে নাকি? যদি না থাকে তাহলে যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারীদের ............. হাতে যাকাত পৌঁছে যাওয়ার পর মালিক বানিয়ে দেয়ার ইলামের দাবী যেহেতু পূরণ হয়ে যায়, সে জন্য পুনরায় মালিক বানিয়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতার যুক্তি কি হতে পারে? লামকে যদি মালিকানা প্রদানের অর্থেই গ্রহণ করা হয়,তাহলে এক ব্যক্তি যখন যাকাত ও ওয়াজিব সদকার মাল যাকাত বিভাগরে কর্মচারীদের হাতে তুলে দেয়, তখন সে তো বলতে গেলে তাদেরকে তার মালিক বানিয়ে দিল এবং এ মাল এভাবে তাদের মালিকানা ভুক্ত হয়ে গেল যেমন ফাই ও গণিমতের মাল সরকারের (ইসলামী রাষ্ট্রের) মালিকানাভুক্ত হয়ে যায়। তারপর তাদের ওপর এ বাধ্যবাধকতা আর থাকে না যে, পরে সেসব মাল তারা যেসব হকদারের ওপর ব্যয় করবে তা মালিকের আকারেই করবে। বরঞ্চ তাদের এ অধিকার রয়েছে যে, অবশিষ্ট সাতটি যাকাতের খাতে যেভাবে মুনাসিব এবং প্রয়োজন বোধ করবে খরচ করবে তামলিকে লামের দৃষ্টিতে (মালিক বানানোর যে শর্ত সে দিক দিয়ে) তাদের ওপর কোন বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। অবশ্যি যে বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে তা শুধু এই যে, যে ব্যক্তিই যাকাত সংগ্রহ এবং বণ্টনের কাজ করবে সে তার কাজের পারিশ্রমিক নেবে। অবশিষ্ট মাল সে অন্যান্য হকদারের জন্যে ব্যয় করবে। এজন্যে যে, এসব লোককে যাকাত বিভাগের কর্মচারী হওয়ার কারণে ওসব মালের মালিক বানিয়ে দেয়া হয় স্বর হকদার হওয়ার দিক দিয়ে নয়। ...... যাকাত আদায় ও বণ্টনের কর্মচারী শব্দগুলো স্বয়ং সে উদ্দেশ্য প্রকাশ করে যার জন্য যাকাত তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অতপর এ শব্দগুলো এটাও নির্ধারিত করে দেয় যে, কর্মচারী হিসেবে এ মারের কত অংশ বৈধভাবে নিজের জন্যে ব্যয় করার অধিকার রাখে।

 

এ বিশ্লেষণের  পর সেই হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক যা ইমাম আহমদ (র) হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলো-

 

********** আরবী ************

 

আপনার প্রেরিত কর্মচারীকে যখন আমি যাকাত দিয়ে দিলাম তখন আমি আল্লাহ এবং তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হলাম তো?

 

নবী (স) জবাবে বললেনঃ

 

********** আরবী ************

 

হ্যাঁ তুমি যখন তা আমার প্রেরিত কর্মচারীর হাতে তুলে দিলে তখন তুমি আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হয়ে গেলে। এ প্রতিদান তোমার জন্য রয়েছে। যে নাজায়েয ভাবে তা ব্যয় করবে তার গোনাহ তার হবে।

 

এর থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যাকাতদাতা তার যাকাত ........ যাকাত কর্মচারীর হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যায়। অন্য কথায় যেভাবে ফকীর মিসকিনের যাকাত দলে মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়, ঠিক তেমনি ............. কে দিলেও তা পূরণ হয়ে যায়।

 

এখন একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, ............ এর শব্দগুলো যা কুরআনে বলা হয়েছে, তা কোন কোন লোকের ওপর প্রযোজ্য হয়। লোক তা শুধু ঐসব কর্মচারী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ মনে করে যাদেরকে ইসলামী সরকার নিযুক্ত করেন। কিন্তু কুরআন পাকের শব্দগুলো সাধারণভাবে বলা হয়েছে যা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হতে পারে যে যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ করে। সাধারণ অর্থে ব্যবহার্য এই শব্দগুলোকে বিশেষ অর্থে ব্যবহারে কোন যুক্তি আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে নেই। যদি কোন ইসলামী সরকার না থাকে অথবা আছে কিন্তু তার দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন এবং মুসলমানদের কোন একটি দল এ কাজ করার জন্য মাছে নামলো। তাহলে কোন যুক্তি বলে একথা বলা যেতে পারে যে, না তোমরা********** আরবী ************

 

আমার দৃষ্টিতে এতো আল্লাহর এক রহমত যে ********** আরবী ************

 

(যাকাত কর্মচারী) সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করার পরিবর্তে তাঁর হুকুম এমন সাধারণ শব্দ দিয়েছন যে, তার ফলে এ অবকাশ পায় যে, ইসলামী সরকারের অবর্তমানে অথবা কর্তব্যে অবহেলাকারী সরকার বিদ্যমান থাকলেও মুসলমান নিজেদের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা করতে পারে। যদি আল্লাহ তায়ালার এ সাধারণ হুকুমকেই সাধারণই থাকতে দেওয়া হয়। তাহলে গরীব ছাত্রদের শিক্ষা, এতিমদের প্রতিপালন, বৃদ্ধ অপারগ ও পঙ্গু ব্যক্তিদের দেখাশুনা, দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা এবং এধরনের অন্যান্য কাজের জন্য যেসব সংস্থা কাজের জন্য সে সবের ব্যবস্থাপকগন একেবারেই ন্যয়সঙ্গতভাবেই ********** আরবী ************এর পর্যায়ে পড়বে। ফলে তাদের যাকাত গ্রহণ করার এবং প্রয়োজন অনুসারে খরচ করার এখতিয়ার থাকবে। এমনিভাবে এমন ধরনের সংস্থা কায়েম করারও অবকাশ থাকবে যা বিশেষভাবে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য কায়েম করা হবে। তাদের ব্যবস্থাপকও********** আরবী ************বলে গণ্য হবে। এবং যাকাত বণ্টন করার ব্যাপারে তামলিকের ফতোয়া দ্বারা তাদের হাত বাধার প্রয়োজন থাকবে না।

 

আমার দৃষ্টিতে যদি কুরআনের শব্দগুলোকে সাধারণ অর্থে রাখা যায় তাহলে উপরোক্ত ********** আরবী ************(যাকাত কর্মচারী ও ব্যবস্থাপকদের) এর উপরই তা প্রযোজ্য হবে না। বরঞ্চ অন্যান্য বহু কর্মচারীও এর সংজ্ঞায় পড়বে। যেমন একজন এতিমের অলী, একজন রোগী ও পঙ্গু ব্যক্তর দেখাশুনা করার লোক এবং একজন অসহায় ব্যক্তির সেবা শুশ্রূষাকারী ব্যক্তিও আমেল যাকাত কর্মী। যাকাত সংগ্রহ করে ঐসব লোকের প্রয়োজন পূরণ করার তার অধিকার রয়েছে। প্রচলিত পন্থায় তার কাজের পারিশ্রমিক সে নিতে চাইলেও নিতে পারবে।

 

যাকাতের টাকা পয়সা যদি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে তার জন্য ডাক খরজ এবং ব্যাংকের পারিশ্রমিক ও তার থেকে দেওয়া যেতে পারে। কারণ তারাও খেদমত করার সময় পর্যন্ত **********আরবী ************(যাকাতের কর্মচারী) বলে বিবেচিত হবে।

 

যাকাত আদায় করতে, যাকাতের মাল একস্থান তেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে অথবা যাকাতের হকদারদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্যে রেলগাড়ি, বাস, টাঙ্গা, ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি যা কিছু ব্যবহার করা হবে, সে সবের ভাড়া যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ এসব খেদমত করার সময় এ সবই **********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।

 

যাকাতের হকদারদের জন্যে যত প্রকার কর্মচারী ও মজুর কাজে লাগেনা হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ তারা সব **********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।

 

যাকাতের হকদারের জন্যে যত প্রকার কর্মচারী ও মজুর কাজে লাগানো হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ তারা সব **********আরবী ************ এর মধ্যে গণ্য হবে। কেউ রেলওয়ে ষ্টেশনে খাদ্য শস্যের বস্তা নিয়ে গেলে, কেউ দরিদ্র রোগীদের খেদমতের জন্যে গাড়ী চালালে অথবা কেউ এতিম শিশুদের দেখাশুনো করলে তারাও ঐ পর্যায়ে পড়বে।

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, **********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারীগণ যে খরচ পত্রাদি করবে তার মধ্যে এমন কোন বাধা নিষেধ আছে নাকি যে, তারা যাকাতের হকদারের খেদমতের জন্য কোন ঘর-দোর বানাতে পারবে না এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন, গাড়ী, ঔষধ-পত্র, যন্ত্রপাতি, কাপড় প্রভৃতি খরিদ করতে পারবে না? আমি একথা বলি যে, হানাফীগণ এ আয়াতের যে ব্যাখ্যাদান করেছেন তার দৃষ্টিতে এ বাধা নিষেধ শুধুমাত্র তাদের জন্যে যারা যাকাত দেয়। তারা স্বয়ং নিঃসন্দেহে এ ধরনের কোনো খরচ-পত্রাদি করতে পারে না। তাদের কাজ হলো এই যে, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত যাদের জন্যে তাদের অথবা তাদের মধ্যে কারো মালিকানায় তা দিয়ে দেবে। এখন রইলো **********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারী)এর ব্যাপারে তো তাদের বেলায় এ ধরনের কোনো বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। তারা যাকাতের সকল হকদারদের জন্যে আপন স্থানে অলী বা উকিল। প্রকৃত হকদার এ মাল থেকে যেভাবে খরচপত্র করতে পারে, সে সমুদয় খরচপত্রও তারা তাদের অলী অথবা উকিল হিসেবে করতে পারে। তারা যখন ফকীর মিসকিনদের প্রয়োজনে কোনো ঘর দোর তৈরী করে অথবা কোনো যানবাহন খরিদ করে তখন তা যেন ঠিক এমন যে, বহু ফকীর মিসকিন প্রত্যেকে আলাদা আলাদা যাকাত পাওয়ার পর সম্মিলিতভাবে কোনো ঘর দোর তৈরী করলো অথবা কোনো যানবাহন খরিদ করলো, যেসব খরচপত্রাদী করার জন্যে তাদের ওপর কোনো বাধা নিষেধ নেই। যাকাত কর্মচারীদেরকে **********আরবী ************ যাকাত দেয়ার পন্থা আল্লাহ তায়ালা এজন্যে নির্ধারণ করেছেন এবং তাদের হাতে যারা যাকাত দেয় তাদেরকে আল্লাহর রাসূল এজন্যে ফরয থেকে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন যে, তাদেরকে এ মাল দেয়ার অর্থ সকল হকদারকে নিয়ে দেয়া। তারা হকদারদের পক্ষ থেকেই যাকাত সংগ্রহ করে এবং তাদের প্রতিনিধি ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তা খরচ করে। তাদের খরচপত্রের ব্যাপারে এ দিক দিয়ে অবশ্যই আপত্তি ও অভিযোগ করা যেতে পারে যে, তারা অমুক খরচ অপ্রয়োজনে করেছে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করেছে অথবা আপন পারিশ্রমিক প্রচলিত হার থেকে অধিক নিয়েছে অথবা কর্মচারীকে প্রচলিত হার থেকে অধিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার জানা মতে শরীয়াতের এমন কোনো কায়দা কানুন নেই যার ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে যে, অমুক অমুক খরচ করা যাবে আর অমুক অমুক খরচ করা যাবে না। যাকাতের হকদারদের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন কাজ করার অনুমতি শরীয়াত তাদেরকে দিয়েছে। (তরজুমানুল কুরআন ডিসেম্বর, ১৯৫৪)

 

যাকাতের নেসাব

 

যাকাতের নেসাব বলতে বুঝায় মূলধনের সেই সর্বনিম্ন পরিমাণ যার ওপর শরীয়াত যাকাত ওয়াজিব করে। যে ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ মূলধন থাকবে তাকে সাহেবে নেসাব বলা হয়।

 

অর্থনৈতিক ভারসাম্য

 

যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা। ধন আবর্তনশীল রাখার জন্য এবং সমাজের সকল শ্রেণীর সুবিধা ভোগের জন্যে ধনশালী ও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হয় এবং দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নবী করীম (স) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা লোকের ওপর সদকা (যাকাত) ফরয করেছেন। তার নেয়া হবে ধনীদের কাছ থেকে এবং বিলিয়ে দেয়া হবে দুঃস্থদের মধ্যে। (বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি)

 

শরীয়াতের দৃষ্টিতে ধনী ও সচ্ছল তারা যাদের কাছে নেসাব পরিমাণ মাল মওজুদ থাকে এবং বছর অতীত হওয়ার পরও মওজুদ থাকে। নবীর যমানায় ঐসব লোক ধনী ও সচ্ছল ছিল যাদের কাছে খেজুরের বাগান, সোনা, চাঁদি, গৃহপালিত পশু ছিল এবং শরীয়াত ঐসব জিনিসের একটা বিশিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে বলে যে, অন্তত এতটুকু পরিমাণ যার কাছে মওজুদ থাকবে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে সচ্ছল। তার মাল থেকে সদকা আদায় করে সমাজের দুঃস্থদেরকে দেয়া হবে। নবী (স) বলেনঃ পাঁচ ওয়াসাক ওজনের কম খেজুরের যাকাত নেই। পাঁচ উকিয়ার কম চাঁদির যাকাত নেই এবং পাঁচ উটের কম হলে তার যাকাত নেই। (বুখারী, মুসলিম)। ওয়াসাক ও উকিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রঃ

 

নেসাবের মধ্যে পরিবর্তনের প্রশ্ন

 

বর্তমান যুগে যেহেতু টাকার মূল্য অসাধারণ ভাবে কমে গেছে এবং সোনা, চাঁদি, ও গৃহপালিত পশুর যে নেসাব নবীর যমানায় নির্ধারিত করা হয়েছিল মূল্যের দিক দিয়ে তার মধ্যেও অসাধারণ পার্থক্য এসে গেছে। এ জন্যে কেউ কেউ এ দাবী করেছেন যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে যাকাতের নেসাব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যাক। এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বলেনঃ

 

খোলাফায়ে রাশেদীনের যমানার নবী (স) কর্তৃক নির্ধারিত নেসাব ও যাকাতের হারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এবং এখন তার কোনো প্রয়োজনও অনুভূত হয় না।আমাদের ধারণা এই যে, নবী (স) এর পরে তার নির্ধারিত নেসাব পরিবর্তন করার এখতিয়ার কারো নেই। অবশ্যই সোনার নেসাবে পরিবর্তন সম্ভব। কারণ যে রেওয়ায়েতে তার নেসাব বিশ মিসকাল বলা হয়েছে তার সনদ অত্যন্ত দুর্বল (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ১৪৪-১৪৫)

 

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নেসাব এবং যাকাতের হারে পরিবর্তন না করার হিকমত ও তাৎপর্যের ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী (র) বলেনঃ শরীয়াত প্রণেতা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখারও নির্দিষ্ট পরিমাণে রদবদল করার অধিকার আমাদের নেই। এ দ্বারা যদি একবার খুলে দেয়া হয় তাহলে এক যাকাতেরই নেসাব ও পরিমাণের ওপর আঘাত পড়বে না। বরঞ্চ নামায, রোযা, হজ্জ, বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বহু বিষয় এমন আছে যার মধ্যে সংশোধন ও রহিত করণের কাজ শুরু হয়ে যাবে এবং এর জের কোথাও গিয়ে শেষ হবে না। উপরন্তু এ দুয়ার একবার খুলে দিলে যে ভারসাম্য শরীয়াত প্রণেতা ব্যক্তি এ সমাজের মধ্যে সুবিচারের জন্যে কায়েম করেছেন তা খতম হয়ে যাবে। তারপর ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে। ব্যক্তিবর্গ চাইবে নেসাব ও হারের মধ্যে পরিবর্তন তাদের স্বার্থ অনুযায়ী হোক এবং জামায়াত বা সমাজ চাইবে তাদের স্বার্থ মুতাবেক হোক। বাছাইয়ের সময় এ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।নেসাব কমিয়ে হার বাড়িয়ে যদি কোনো আইন প্রণয়ন করা হয় তাহলে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তারা তা সন্তুষ্টচিত্তে দেবে না যা দেয়া ইবাদাতের আসল স্পিরিট। বরঞ্চ ট্যাক্সের মতো জরিমানা মনে করে দেবে এবং তারপর দিতে নানা বাহানা ও অবহেলা করবে। এখন যেমন আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মনে করে প্রত্যেক ব্যক্তি মাথা নত করে এবং ইবাদাতের প্রেরণাসহ সন্তুষ্টচিত্তে যাকাতের টাকা বের করে দেয়, তা আর অবশিষ্ট থাকবে না। যদি আইন সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাদের ইচ্ছামতো কোনো নেসাব এবং কোনো হার অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ১৫৭)

 

সোনা চাঁদির নেসাব

 

চাঁদির নেসাব দুশ দিরহাম যার ওজন ছত্রিশ তোলা সাড়ে পাঁচ মাশা চাঁদি হয়। যার কাছে এ পরিমাণ চাঁদি থাকবে এবং তার ওপর এক বছর অতীত হবে তার যাকাত ওয়াজিব। তার কম ওজনের চাঁদির যাকাত ওয়াজিব নয়। (এ নেসাব মাওলানা আবদুশ শুকুর সাহেবের গবেষণালব্ধ (ইলমুল ফেকাহ দ্রঃ) মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গী মহল্লীর গবেষণাও তাই। অবশ্যি কিছু আলেমের মতে চাঁদির নেসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এটাই অধিক প্রচলিত।)

 

সোনার নেসাব বিশ তালাই মিসকাল যার ওজন পাঁচ তোলা আড়াই মাশা সোনা। (এ নেসাবও মাওলানা আবদুস শুকুর সাহেবের গবেষণার ফল (ইলমুল ফেকাহ) যা মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গী মহল্লা সমর্থন করেন। অবশ্য সাধারণত এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, সোনার নেসাব সাড়ে সাত তোলা। (বেহেশতী জেওর) যার কাছে এতো ওজনে সোনা হবে এবং তারপর এক বছর অতীত হবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। তার কম ওজনের সোনার জন্যে যাকাত দিতে হবে না।

 

মুদ্রা ও নোটের যাকাত

 

সরকারী মুদ্রা, যে কোনো ধাতুর হোক না কেন এবং কাগজের নোট প্রভৃতির যাকাত ওয়াজিব। তাদের মূল্য তাদের ধাতব দ্রব্য অথবা কাগজ হওয়ার কারণে নয় বরং তাদের ক্রয় ক্ষমতার জন্যে আইন গত তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে তা সোনা চাঁদির স্থলাভিষিক্ত। অতএব যার কাছে ৩৬ তোলা সাড়ে পাঁচ মাশা চাঁদির মূল্য মুদ্রা অথবা নোটের আকারে থাকবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

যে মুদ্রার বাজারে প্রচলন নেই, অথবা খারাপ হয়ে গিয়েছ অথবা সরকার উঠিয়ে নিয়েছে- তার মধ্যে যদি কিছু পরিমাণে সোনা চাঁদি থাকে, তাহলে চাঁদি বা সোনার পরিমাণ অনুযায়ী তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

বিদেশী মুদ্রা যদি নিজ দেশে সহজেই আপন মুদ্রার সাথে বদল করা যায় তাহলে তার হুকুম নগদ মূল্যের মতো। যদি বদল করা না যায় তাহলে তার ওপর যাকাত এ অবস্থায় ওয়াজিব হবে যদি তার মধ্যে নেসাব পরিমাণ সোনা চাঁদি থাকে। সোনা চাঁদি না থাকলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।

 

দিরহামের ওজনের যাচাই

 

যাকাত প্রসঙ্গে যে দিরহাম উল্লেখ করা হয়েছে তা বলতে এমন দিরহাম যার ওজন ২ মাশা দেড় রতি। নবী (স) এবং হযরত আবু বকর (রা) এর যমানায় দিরহাম বিভিন্ন ওজনের হতো। হযরত ওমর (রা) মনে করলেন দিরহাম বিভিন্ন ওজনের হওয়ার কারণে লোকের ভেতর পারস্পারিক কলহ সৃষ্টি হয় এবং যাকাতের ব্যাপারেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি প্রত্যেক ওজনের এক এক দিরহাম নিয়ে একত্র করে গলিয়ে নেন। এবং তিন ভাগ করে এক ভাগের ওজনেই করেন। তাতে চৌদ্দ কীরাত হয় এবং এ ওজনের ওপরে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা হয়। তারপর সমস্ত আরবের এ ওজনের প্রচলন হয়। সে মোতাবেক শরীয়াতের দায়িত্ব পালন হতে থাকে। (বাহরুর রায়েক প্রভৃতি)

 

তাহারাত ও নাজাসাত (পবিত্রতা অপবিত্রতা) অধ্যায়ে যে দিরহামের কথা বলা হয়েছে তা এক মিসকাল অর্থাৎ দীনারের সমান। আল্লামা ইবনে আবেদ শামীম গবেষণা অনুযায়ী একশ যবে এক দীনার, চার যবে এক রতি এবং আট রতিতে এক মাশা হয়। এ হিসেব অনুযায়ী এক দীনারের ওজন তিন মাশা এক রতি হয়। এ গবেষণা অনুযায়ী আসান ফেকাহর প্রথম খণ্ডে আমরা এক দিরহামের ওজন ৩ মাশা ১ রতি লিখেছি।

 

 

 

ব্যবসার মালের যাকাত

 

ব্যবসার মালের নেসাবও তাই যা সোনা চাঁদির নেসাব। অর্থাৎ সোনা অথবা চাঁদির নেসাবের ভিত্তিতে যাকাত দিতে হবে। যেমন ধরুন আপনার কাছে মোট চারশ টাকা মওজুদ আছে। এত সোনার নেসাব তো হয় না কিন্তু চাঁদির নেসাব হয়, তাহলে সেই নেসাব অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে।

 

ব্যবসার মালের যাকাতের পদ্ধতি এই যে, ব্যবসা শুরু করার দিন থেকে এক বছর হয়ে গেলে মওজুদ মালে Stock in trade মূল্য হিসেব করতে হবে। তারপর দেখতে হবে নগদ তহবিল Cash in hand কি আছে। এখন উভয়ের সমষ্টির ওপর যাকাত বের করতে হবে। যদি মওজুদ স্টক এবং নগদ তহবিল নেসাবের কম হয় এবং তারপর হঠাৎ ব্যবসার পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় নেসাব পরিমাণ কিংবা তার অধিক হয়ে যায়, তাহলে যে তারিখ থেকে দাম বেড়েছে সে তারিখ থেকে যাকাতের বছর শুরু হবে।

 

যদি কোন ব্যবসায় কয়েকজন অংশীদার থাকে,তাহলে ব্যবসার সামগ্রিক স্টক এবং নগদ তহবিলের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। বরঞ্চ প্রত্যেক অংশীদারের অংশ এবং মুনাফার টাকার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি এ অংশ এবং তার মুনাফা নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে নতুবা হবে না।

 

এমনিভাবে কিছু মাল যদি কয়েক ব্যক্তির অংশীদারিত্বে হয় তাহলে তার ওপর যাকাত তখনই হবে, যখন প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ হবে। যেমন ধরুন, দু ব্যক্তির মিলে চল্লিশ ছাগল আছে অথবা ষাট তোলা চাঁদি দু ব্যক্তির মালিকানায় আছে। তাহলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না।

 

ব্যবসার কাজে প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, ফার্নিচার, ষ্টেশনারী দ্রব্যাদি, দালানকোঠা, অর্থাৎ উৎপাদনের উপাদানের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয় না। শুধু ব্যবসার মালপত্র এবং নগদ তহবিল মিলে যে মূল্য হবে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। (ইমাম শাফেয়ীর অভিমত এই যে, কারবারে সামগ্রিক স্টক এবং নগদ তহবিল যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ হোক বা না হোক। ইমাম মালেকের মতেও যাকাত সামষ্টিক মাল থেকেই আদায় করতে হবে। কিন্তু ঐসব অংশীদারকে গণনার বাইরে রাখাতে হবে যারা সাহেবে নেসাব নয় অথবা যে এক বছরের কম সময়ে তার অংশের মালিক হয়েছে। এ অভিমতই বেশী মুনাসিব এবং বাস্তব)যাকাত দেয়ার সময় এসব কাজের টাকা পয়সাও হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে যা ব্যবসা করা কালীন আদান প্রদান হয়েছে। হযরত সামরা বিন জুন্দুব বলেন, নবী (স) আমাদেরকে ব্যবসার মালের যাকাত দিতে বলেছেন। (আবু দাউদ)

 

অলংকারের যাকাত

 

সোনা চাঁদি যে আকারেই হোক তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তা সে মুদ্রা হোক, খন্ড, তারব্রকেড হোক, অথবা কাপড়ের ওপর সোনার জরির কাজ হোক, অথবা কাপড় বুনোনে সোনা বা সোনা চাঁদির চিকন তার হোক, অথবা মেয়েদের ব্যবহারের অলংকার হোক, প্রত্যেক বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

ইয়ামেনের জনৈকা মহিলা নবী (স) এর খেদমতে হাজির হলো, তার সাথে তার মেয়ে ছিল যার হাতে সোনার দুটি মোটা কঙ্কণ ছিল। নবী (স) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এর যাকাত দাও?  সে বলল, জি না, যাকাত তো দিই না। নবী (স) বললেন, তুমি কি এটা পছন্দ করো যে, কেয়ামতের দিন ঐ অপরাধে তোমাকে আগুনের কঙ্কণ পরিয়ে দেয়া হবে। একথা শুনে মহিলাটি দুটি কঙ্কণ খুলে নবীর হাতে দিয়ে বললো, এগুলো আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যে পেশ করছি। (নাসায়ী)

 

হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেন, আমি কঙ্কণ পরতাম এবং একদিন নবী (স)কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ। এটা কানয (যে সঞ্চিত সম্পদে যাকাত দেয়া হয় না) বলে গণ্য হবে? তিনি বললেন, যে মাল যাকাত দেয়ার পরিমাণে পৌছে এবং তার যাকাত দেয়া হয় তা কানয নয়। (আবু দাউদ)

 

অলংকারের যাকাত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা মওদূদী বলেনঃ অলংকারের যাকাত সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত আছে। একটি অভিমত এই যে, এর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। কর্জ হিসেবে তা দেয়াটাই তার যাকাত। এ হচ্ছে আনাস বিন মালেক, সাঈদ বিন মুসাইয়্যের এবং শাবীব উক্তি। দ্বিতীয় অভিমত এই যে, অলংকারের যাকাত জীবনে একবার দিলেই যথেষ্ট হবে। তৃতীয় অভিমত এই যে,যে অলংকার সর্বদা ব্যবহার করা হয় তার ওপর যাকাত নেই। যা অধিক সময়ে তুলে রাখা হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। চতুর্থ অভিমত এই যে, সব রকমের অলংকারের যাকাত ওয়াজিব। আমাদের মতে এ সর্বশেষ অভিমতটি সঠিক। প্রথমত, যেসব হাদীসে সোনা চাঁদির ওপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার হুকুম রয়েছে তার শব্দগুলো সাধারণ। যেমন চাঁদির ওপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত এবং পাঁচ উকিয়ার কম হলে তার ওপর যাকাত নেই। বিভিন্ন হাদীস ও আসার থেকে জানা যায় যে, অলংকারের ওপর যাকাত ওয়াজিব। আবু দাউদ, তিরমিযি ও নাসায়ীতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে যে, একজন নারী নবী (স) এর দরবারে আসে এবং তার সাথে তার মেয়ে ছিল। তার দুটি হাতে সোনার কঙ্কণ ছিল। নবী (স) বললেন, তুমি এর যাকাত দাও? সে বললো না। তখন নবী (স) বলেন, তুমি কি পছন্দ কর যে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে তার বদলে আগুনের কঙ্কণ পরিয়ে দেবেন?

 

উপরন্তু মুয়াত্তা, আবু দাউদ ও দারে কুতনীতে নবী (স) এর এ উক্তি নকল করা হয়েছে ********** আরবী ************ যে অলংকারের যাকাত তুমি দিয়েছ তা কানয নয়। ইবনে হাযম বলেন, হযরত ওমর (রা) ও তার গভর্নর আবু মূসা আশয়ারীকে যে ফরমান পাঠান, তাতে এ হেদায়েত ছিল মুসলমান মেয়েলোকদেরকে আদেশ কর তারা যেন তাদের অলংকারের যাকাত দেয়।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল অলংকার সম্পর্কে হুকুম কি? তিনি বলেন, যখন তা দুশ দিরহাম পরিমাণ হবে তখন তার যাকাত দিতে হবে। এ ধরনের উক্তি সাহাবাদের মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) এবং আয়েশা (রা) এবং তাবেঈনদের মধ্যে সাইদ বিন মুসাইয়্যেব, সাঈদ বিন বুহাইব, আতা, মুজাদি, ইবনে সিরীন ও যুহরী এবং ফেকার ইমামদের মধ্যে সুফিয়ান সাওরী, আবু হানিফা ও তার সঙ্গীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

 

যাকাতের হার

 

১. সোনা, চাঁদি, ব্যবসার মাল, ধাতু মুদ্রা, নোট, অলংকার প্রভৃতির শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

২. সোনা চাঁদি অথবা অলংকারে চল্লিশ ভাগের একভাগ সোনা অথবা যাকাত হিসেবে দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু জরুরী নয় যে সোনা চাঁদি যাকাত হিসেবে দিতে হবে। তার মূল্য হিসেব করে নগদ অর্থ দেওয়া যেতে পারে। কাপড় অন্যান্য বস্তু দেওয়া যেতে পারে। নগদ অর্থ ও তেজারতি মালের মূল্য সোনা অথবা চাঁদির কোনটির নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।

 

৩. সোনা চাঁদি নেসাব পূর্ণ হয়ে কিছু বেশী সোনা চাঁদি অথবা তেজারতি মাল কারো কাছে যদি থাকে তাহলে তার উপর এ অবস্থায় যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি তা নেসাবের এক পঞ্চমাংশ হয়। তার কম হলে যাকাত মাফ। (ইলমুল ফেকাহ)

 

৪. যদি কোন অলংকার দলা অথবা কাপড়ে সোনা বা চাঁদি উভয়ে থাকে তাহলে দেখতে হবে কার পরিমাণ বেশী। যার পরিমাণ বেশী হবে তার হিসেব ধরতে হবে। যদি সোনা ধরতে তাহলে সব সোনা মনে করে সোনার নেসাবনুযায়ী যাকাত দিতে হবে। যদি চাঁদির পারিমাণ বেশী হয় তবে সমুদয় চাঁদি মনে করে চাঁদির নেসাব অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে।

 

৫. সোনা, চাঁদির অলংকারাদীতে যদি অন্য কোন ধাতু মিশ্রিত থাকে এবং তার পরিমাণ যদি সোনা চাঁদির কম হয় তাহলে তা ধর্তব্যের মধ্যে হবে না। তা সোনা চাঁদি মনে করে যাকাত দিতে হবে। আর যদি তার মধ্যে সোনা চাঁদি কম থাকে তাহলে শুধু সোনা চাঁদির হিসেব করতে হবে। তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে, নতুবা দিতে হবে না।

 

৬. একজনের নিকট কিছু সোনা ও কিছু চাঁদি আছে। তার মধ্যে যেটারই নেসাব পুরো হবে তার সাথে অন্যটার মূল্য হিসেব করে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।

 

৭. যদি কারো নিকটে সোনাও নেসাবের কম এবং চাঁদিও নেসাবের কম আছে। তাহলে চাঁদিকে সোনার সাথে মিলিয়ে অথবা সোনাকে চাঁদির সাথে মিলিয়ে যে নেসাব পুরো হবে তার শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে। এমনি কিছু নগদ টাকা আছে, কিছু চাঁদি আছে, কিছু তেজারতি মাল আছে। তাহলে সব মিলিয়ে যদি চাঁদি অথবা সোনার নেসাব পুরো তাহলে যাকাত দিতে হবে।

 

৮. অলংকারের যেসব মণিমুক্তা প্রভৃতি থাকবে তার যাকাত নেই। ওজনে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকী সোনা চাঁদির শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে।

 

যে সবের উপর যাকাত নেই

 

১. বাঁশের বাড়ি ঘরের উপর যাকাত নেই তা যতই মূল্যবান হোক না কেন।

 

২. যে কোন প্রকারের মণিমুক্তা ইত্যাদির উপর যাকাত নেই।

 

৩. কৃষি সেচ কাজের জন্য যে পশু, যেমন- গরু, মহিষ, উট প্রতি পালন করা হয় তার উপর যাকাত নেই। এ ব্যাপারে মূলনীতি এই যে এক ব্যক্তি তার কারবারে উৎপাদনের যেসব উপাদান ব্যবহার করে তা যাকাত বহির্ভূত। হাদীসে আছে ********** আরবী******* যেসব উঠ দিয়ে কৃষি কাজ করা হয় তার উপর যাকাত নেই। কারণ তার যাকাত যমীন থেকে উৎপন্ন ফসল থেকে আদায় করা হয়। এরূপ উৎপাদনের যন্ত্রপাতির উপর যাকাত নেই।

 

৪. কল-কারখানা মেশিন যন্ত্রপাতির উপর যাকাত নেই। উপরুন্ত কারখানার দালান কোটা, ব্যবসার ব্যবহৃত ফার্নিচার, দোকান ঘর এসবের উপর যাকাত নেই।

 

৫. ডেইরী ফার্মের পশুর উপর যাকাত নেই। কারণ সেগুলো তো উৎপাদনের উপাদানের মধ্যে পড়ে। অবশ্য ডেইরী থেকে উৎপাদিত বস্তুর উপর যাকাত ওয়াজিব আছে।

 

৬. মূল্যবান কোন জিনিস কেউ যদি শখ করে ঘরে রাখে তার উপর যাকাত নেই। তবে যদি ব্যবসা করা হয় তার উপর যাকাত আছে। যেমন তেজারতি মালের উপর।

 

৭. কেউ যদি চৌবাচ্চায় বা পুকুরে সৌখিন মাছ পুষে তাহলে তার উপর যাকাত নেই। কিন্তু তার ব্যবসা করলে যাকাত দিতে হবে।

 

৮. গৃহপালিত পশু যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাখা হয়, যেমন দুধ পানের জন্য গাভী, বোঝা বহনের জন্য গরু –মহিষ, যানবাহনের জন্য ঘোড়া হাতি উঠ থাকলে তার সংখ্যা যতই হোক না কেন তার যাকাত দিতে হবে না।

 

৯. চড়ে বেড়াবার জন্য মোটর সাইকেল কার বাস থাকলে তার উপর যাকাত নেই।

 

১০. ডিম বিক্রির জন্য হাঁস-মুরগির ফার্ম করলে হাঁস-মুরগির উপর যাকাত নেই। তবে বিক্রি করা ডিমের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে যেমন অন্যান্য ব্যবসার উপর হয়।

 

১১. সখ করে মুরগি অথবা কোন পাখি পুষলে তার উপর যাকাত নেই।

 

১২. যেসব জিনিষের ভাড়া খাটানো হয়, যেমন সাইকেল, রিক্সা, ট্যাক্সি, বাস, ফার্নিচার, ক্রয়কারী প্রভৃতির উপর যাকাত নেই। তবে এসব থেকে যা মুনাফা হবে তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে বছরে অতীত হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে। ঐসব জিনিষের মূল্যের উপর কোন যাকাত নেই।

 

১৩. দোকান ও বাড়ি ঘর থেকে যে যাকাত আদায় করা হয় তার উপর কোন যাকাত নেই, তার মূল্য যতই হোক না কেন।

 

১৪. পরনের কাপড়, কোট, প্যান্ট, চাদর, কম্বল, টুপি, জুতা, ঘড়ি, ঘরের আসবাবপত্র, কলম প্রভৃতির উপর যাকাত উপর যাকাত নেই,তার মূল্য যতই হোক না কেন।

 

১৫. গাধা, খচ্চর, ঘোড়ার উপর যাকাত নেই, যদি তা ব্যবসার জন্য না হয়।

 

১৬. ওয়াকফের পশুর ওপরও যাকাত নেই। যেসব ঘোড়া জেহাদের জন্য পালা হয় এবং যেসব অস্ত্রশস্ত্রও জেহাদও দীনের খেদমতের জন্য, তার ওপরও যাকাত নেই।

 

পশুর যাকাত

 

সাধারণ মাঠে ময়দানে চরে বেড়ানো গৃহপালিত পশু বংশ বৃদ্ধি ও দুধের জন্য প্রতিপালিত হলে তাকে পরিভাষায় সায়েমা বলে। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। যেসব পশু গোশত খাওয়ার জন্য পালা হয় এবং বন্য পশু যেমন হরিণ, নীল গাই, চিতা প্রভৃতির উপর যাকাত নেই। তবে এ বন্য পশু যদি ব্যবসার জন্য হয়,তাহলে তার উপর তেমনি যাকাত ওয়াজিব হবে যেমন তেজারতের মালের উপর। অর্থাৎ ব্যবসার মূলধন যদি বছরের সূচনায় ও শেষে দিরহাম অথবা তার বেশী হয় তাহলে যাকাত নতুবা হবে না।

 

যে পশু গৃহপালিত ও বন্য পশুর সংগমে পয়দা হয় তার উপর যাকাত ওয়াজিব এবং শর্তে যে, সংগমকারী পশুগুলোর মধ্যে মাদা গৃহ পালিত হয় এবং নর বন্য হয়। যেমন ছাগল ও নর হরিণের সংগমে যে পশু পয়দা হয় তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

 

যেসব সায়েমা পশু ওয়াকফ করা তার উপর যাকাত নেই। এভাবে যে ঘোড়া ওয়াকফ করা অথবা জেহাদের জন্য পালা হয় তার উপর যাকাত নেই।

 

সায়েমা পশু যদি যাকাতের জন্য পালা হয় তাদের উপর ঐরূপ যাকাত ওয়াজিব হবে যা তেজারতি মালের উপর হয়।

 

যদি কেউ বংশ বৃদ্ধির জন্য সায়েমা পশু পালন করে তারপর বছরের মাঝখানে ব্যবসার ইচ্ছা করলো। তাহলে সে বছরে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু যে দিন থেকে ব্যবসার ইচ্ছা করছে সেদিন থেকে তার তেজারতি বছর শুরু হবে। এবং বছর পুরো হওয়ার পর তেজারতি যকাত দিতে হবে।

 

ভেড়া ছাগলের নেসাব ও যাকাতের হার

 

যাকাতের ব্যাপারে ভেড়া ছাগল দুম্বা সকলের একই হুকুম। সকলের একই নেসাব এবং যাকাতের হার একই। যদি কারো কাছে দুম্বাও আছে এবং ছাগলও আছে এবং তা নেসাব পরিমাণ হয়েছে তাহলে উভয়ের পৃথক পৃথক যাকাত দিতে হবে।আর যদি উভয়ের একত্র করলে নেসাব পূর্ণ তাহলে যর সংখ্যা বেশী যাকাতে সেই পশুটি দিতে হবে। উভয়ের সংখ্যা সমান হলে যেটা ইচ্ছা দেয়া যায়।

 

নেসাব ও যাকাতের হার আদায়

 

৪০টি ভেড়া ছাগলে একটি ভেড়া বা ছাগল।

 

৪১ থেকে১২০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত ওয়াজিব নয়।

 

১২১ হলে দুটি ছাগল যাকাত দিতে হবে।

 

১২২ থেকে ২০০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।

 

২০১ হলে তিনটি ছাগল।

 

২০২ থেকে ৩৯৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।

 

৪০০ হলে ৪টি ছাগল বা ভেড়া যাকাত দিতে হবে।

 

৪০০ এর পরে ১০০ পুরো হলে একটা ছাগল বা ভেড়ার হিসেবে যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ শতকরা একটি করে। ভেড়া ছাগলের যাকাত এক বছর বা তার বেশী বয়সের বাচ্চা যাকাত দিতে হবে।

 

গরু মহিষের নেসাব ও যাকাতের হার

 

যাকাতের ব্যাপারে গরু ও মহিষের একই হুকুম। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয (র) মহিষকে গরু হিসেবে ধরে তার ওপর ঐ ধরনের যাকাত আরোপ করেন যা নবী (স) নির্ধারণ করেছিলেন। উভয়ের নেসাব ও যাকাতের হার এক কারো কাছে উভয় ধরনের পশু থাকলে উভয়কে মিলিয়ে নেসাব পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যার সংখ্যা বেশী হবে তার মধ্যে থেকে যাকাত দিতে হবে। উভয়ের সংখ্যা সমান হলে যে কোনো একটা দেয়া যাবে।

 

নেসাব ও যাকাতের হার

 

যে ব্যক্তি ৩০টি গরু মহিষের মালিক হবে তার ওপর যাকাত ফরয হবে। তার কম হলে যাকাত নেই।

 

৩০টি গরু মহিষের মধ্যে গরু বা মহিষের একটি বাচ্চা দিতে হবে যার বয়স পূর্ণ এক বছর হয়েছে।

 

৩১ থেকে ৩৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই। ৪০টি গরু মহিষ হলে এমন একটি বাচ্চা যাকাত দিতে হবে যার বয়স পূর্ণ দু বছর।

 

৪১ থেকে ৫৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই। ৬০টি গরু মহিষ হলে এক বছরের দুটি বাচ্চা যাকাত দিতে হবে। ষাটের পরে প্রত্যেক ৩০ গরু মহিষ এক বছরের বাচ্চা এবং প্রত্যেক ৪০ গরু মহিষে দু বছরের বাচ্চা দিতে হবে।

 

যেমন ধরুন কারো কাছে ৭০টি গরু মহিষ আছে। এখন ৭০টিতে দু নেসাব আছে একটা তিরিশের এবং অন্যটা চল্লিশের। যদি ৮০টি গরু মহিষ হয় তাহলে চল্লিশ চল্লিশের দু নেসাব হবে। অতএব দু বছরের দু বাচ্চা ওয়াজিব হবে। ৯০টি হলে ত্রিশ ত্রিশের তিন নেসাব হবে। যার জন্যে প্রত্যেক ৩০টির ওপর এক বছরের বাচ্চার হারে যাকাত দিতে হবে।

 

উটের নেসাব ও যাকাতের হার

 

যে ব্যক্তি পাঁচটি উটের মালিক হবে সে সাহেবে নেসাব হবে। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তার কম উটের যাকাত নেই।

 

নেসাব ও যাকাতের বিবরণ

 

পাঁচটি উটের ওপর একটি ছাগল ওয়াজিব এবং ৯টি উট পর্যন্ত ঐ একটি ছাগল।

 

দশটি উট হলে দুটি ছাগল এবং ১৪টি পর্যন্ত ঐ দুটিই।

 

পনেরোটি উট হলে তিনটি ছাগল এবং ১৯টি পর্যন্ত ঐ একই।

 

বিশটি উটে ৪টি ছাগল এবং ২৪টি পর্যন্ত ঐ একই।

 

পঁচিশটি উটের ওপর এমন এক উটনী যার বয়স দ্বিতীয় বছর শুরু হয়েছে।

 

২৬ থেকে ৩৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না। ৩৬টি উট হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স তৃতীয় বছর শুরু হয়েছে।

 

৩৭ থেকে ৪৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোন যাকাত নেই।

 

৪৬টি হলে উট হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে।

 

৪৭ থেকে ৬০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।

 

৬১টি হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স পঞ্চম বছর শুরু হয়েছে।

 

৬২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।

 

৭৬ হলে দুটি উটনী যাদের বয়স তৃতীয় বছর শুরু হয়েছে।

 

৭৭ থেকে ৯০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।

 

৯১ হলে দুটি এমন উটনী যাদের বয়স চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে।

 

১২০ পর্যন্ত উপরোক্ত দুটি উটনী।

 

তারপর পুনরায় সেই হিসেব শুরু হবে অর্থাৎ ৫টির ওপর এক ছাগল, ১০টির উপর দু ছাগল।

 

যাকাত দানের ব্যাপারে একটি জরুরী ব্যাখ্যা

 

সোনা,চাঁদি ও পশুর যে যাকাত ওয়াজিব হবে তা সোনা, চাঁদি এবং পশুর আকারেও দেয়া যাবে এবং নগদ টাকাও দেয়া যাবে। অলংকারের যাকাতে সোনা চাঁদি দেয়া জরুরী নয়। বাজারের প্রচলিত নিরিখে তার মূল্য ধরে নগদও দেয়া যায়।

 

কোন কোন খাতে যাকাত ব্যয় করা যায়

 

কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা শুধু যাকাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম বয়ান করে তার জন্যে শুধু তাকীদই করেননি, বরঞ্চ বিশদভাবে তার ব্যয় করার খাতগুলোও বলে দিয়েছেন।

 

********** আরবী ************

 

এ সদকা তো ফকীর মিসকিনদের জন্যে এবং তাদের জন্য যারা সদকার কাজের জন্য নিয়োজিত এবং তাদের জন্য যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য। এবং শৃঙ্খলা মুক্ত করার জন্যে। ঋণগ্রস্তদের সাহায্যে জন্যে। আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে অবশ্য পালনীয় ফরয আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং মহাজ্ঞানী। (সূরা আত তাওবাঃ৬০)

 

এ আয়াতে যাকাতের আটটি খাতের কথা বলা হয়েছেঃ

 

১) ফকীর বা দরিদ্র, ২) মিসকিন অভাবগ্রস্ত অথচ হাত পাতে না, ৩) যাকাত আদায় ও বণ্টনের কর্মচারী, ৪) মন জয় করার উদ্দেশ্যে, ৫) শৃংখলমুক্ত করার জন্যে, ৬) ঋণগ্রস্তদের জন্যে, ৭) ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে, ৮) পথিক মুসাফির।

 

যাকাত এ আটা খাতেই ব্যয় করা যেতে পারে তার বাইরে নয়।

 

হযরত যিয়াদ বিন আল হারেস (রা) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নবী (স) এর খেদমতে এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বললো, যাকাত থেকে আমাকে কিছু দিন। নবী (স) বললেন, আল্লাহ যাকাত ব্যয় করার খাতগুলো কোনো নবীর ওপর ছেড়ে দেননি আর না কোনো নবীর ওপর। বরঞ্চ তিনি স্বয়ং তার ফায়সালা করে দিয়েছেন। তার আটটি খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তুমি যদি এ খাতগুলোর মধ্যে পড় তাহলে অবশ্যই তোমাকে যাকাত দিয়ে দেব।

 

খাতগুলোর বিশদ বিবরণ

 

১. ফকীর: ফকীর বলতে সে সব নারী পুরুষকে বুঝায় যারা তাদের জীবন ধারণের জন্যে অপরের সাহায্য সহযোগিতায় ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে ঐসব দুঃস্থ, অভাবগ্রস্ত, অক্ষম অপারগ ব্যক্তি শামিল যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে আর্থিক সাহায্যের হকদার। জীবিকা অর্জনে অক্ষম ব্যক্তি, পঙ্গু, এতিম শিশু, বিধবা, স্বাস্থ্যহীন, দুর্বল, বেকার এবং যারা দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার এমন লোকদেরকে সাময়িকভাবে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে এবং তাদের জন্যে স্থায়ী ভাতাও নির্ধারিত করা যেতে পারে।

 

২. মিসকীনঃ মিসকিন বলতে ঐসব দরিদ্র সম্ভ্রান্ত লোক বুঝায় যারা খুবই দুস্থ ও অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সম্মানের ভয়ে ও লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না। জীবিকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা ও পরিশ্রম করার পরও দু মুঠো ভাত জোগাড় করতে পারে না, তবুও নিজের দুঃখের কথা কাউকে বলে না। হাদীসে মিসকিনের সংজ্ঞা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

 

********** আরবী ************

 

যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না, আর না তাকে (তার আত্মসম্মানের জন্যে) বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্যে লোক তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে, আর না সে বেরিয়ে পড়ে লোকের কাছে কিছু চায়। (বুখারী, মুসলিম)

 

৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী ***** আরবী *****: এরা হচ্ছে ঐসব লোক, যারা যাকাত, ওশর আদায় করে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করে,বণ্টন করে এবং তার হিসেব পত্র সংরক্ষণ করে। তারা সাহেবে নেসাব হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের বেতন যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে।

 

৪. যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য ***** আরবী ****: এ হচ্ছে ঐসব লোক যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য। ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের স্বার্থে তাদেরকে হাত করা, তাদের বিরোধিতা বন্ধ করা প্রয়োজন হয়। এসব লোক কাফেরও হতে পারে এবং ঐসব মুসলমানও হতে পারে যাদের ইসলাম তাদেরকে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের খেদমতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে যথেষ্ট নয়। এসব লোক সাহেবে নেসাব হলেও তাদেরকে যাকাত দেয়া যেতে পারে।

 

হানাফীদের অভিমত এই যে, ইসলামের সূচনায় এ ধরনের লোকের মন জয় করার জন্য যাকাত থেকে খরচ করা হতো। কিন্তু হযরত ওমর (রা) হযরত আবু বকর (রা) এর যমানায় এ ধরনের লোককে যাকাত দিতে অস্বীকার করেন (প্রকৃত ঘটনা এই ছিল যে, নবী (স) এর ইন্তেকালের পর উয়ায়না বিন হাসান এবং আকরা বিন হারেস হযরত আবু বকর (রা) এর কাছে এক খন্ড যমী দাবী করেন। তিনি তাদেরকে দানের ফরমান লিখে দেন। তারা চাইছিল যে, বিষয়টিকে মজবুত করার জন্যে অন্যান্য সাহাবীগণও সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করুক। কিছু স্বাক্ষরও হলো। তারপর যখন হযরত ওমর (রা) এর সাক্ষ্য নিতে গেল তখন তিনি ফরমান পড়ার পর তাদের চোখের সামনেই ছিঁড়ে ফেলে দেন। তাদেরকে বলেন, নবী (স) তোমদের মন জয় করার জন্যে তোমাদেরকে এরূপ দিতেন। কিন্তু সেটা ছিল ইসলামের দুর্বলতা যুগ। এখন আল্লাহ ইসলামকে তোদের মুখাপেক্ষী করে রাখেননি। তারপর তারা হযরত আবু বকর (রা) এর নিকটে অভিযোগ করে বলে, খলীফা কি আপনি, না ওমর? কিন্তু না হযরত আবু (রা) এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন, আর না অন্যান্য সাহাবীগণ হযরত ওমর (রা) থেকে ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। এর থেকে হানাফীগণ এ যুক্তি পেশ করেন যে, যখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেল এবং এমন শক্তির অধিকারী হলো যে, তারা নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হলো, তখন স অবস্থা আর রইলো না যার কারণে মন জয় করার জন্যে একটা অংশ রাখা হয়েছিল। অতএব সাহাবীদের ইজমার ভিত্তিতে ঐ অংশ চিরদিনের জন্যে রহিত হয়ে গেল) এবং এ ব্যবস্থা চিরদিনের জন্যে রহিত হয়ে যায়।

 

এ অভিমত ইমাম মালেকও পোষণ করেন। অবশ্যি কোনো কোনো ফকীহর মতে এ খাত এখনো বাকী রয়েছে এবং প্রয়োজন অনুসারে মন জয় করার জন্যে যাকাতের মাল ব্যয় করা যেতে পারে। (আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেনঃ আমাদের নিকটে সঠিক এটাই যে, মুয়াল্লেফাতু কুলুব এর অংশ কেয়ামত পর্যন্ত রহিত হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। নিঃসন্দেহে হযরত ওমর (রা) যা কিছু বলেছিলেন তা ঠিক ছিল। যদি ইসলামী রাষ্ট্র মন জয় করার জন্যে অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজনবোধ না করে, তাহলে কেউ তার ওপরে এটা ফরয করে দেননি যে, এ খাতে অবশ্যই কিছু না কিছু খরচ করতে হবে। কিন্তু কোনো সময়ে যদি তার প্রয়োজন হয়, তাহলে আল্লাহ তার জন্যে অবকাশ রেখেছেন, তা বাকী থাকা উচিত। হযরত ওমর (রা) এবং সাহাবায়ে কেরামের যে বিষয়ের ওপর ইজমা হয়েছিল তা এই যে, সে সময়ে যে অবস্থা ছিল তখন মন জয় করার জন্যে কাউকে কিছু দেয়া তারা জরুরী মনে করেননি। তার থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সংগত কারণ নেই যে, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা ঐ খাতকে কেয়ামত পর্যন্ত রহিত করে দিয়েছে যা কুরআনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বাঞ্ছনীয়তার জন্যে রাখা হয়েছিল। (তাহফীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৭, ইমাম শাফেয়ীরও তাই মত)

 

৫. শৃংখলমুক্ত করা (গোলাম আযাদ করা): অর্থাৎ যে গোলাম তার মনিবের সাথে এরূপ চুক্তি করেছে যে, এতো টাকা দিলে তাকে মুক্ত করে দেবে, এমন গোলামকে বলে মাকাতিব। আযাদীর মূল্য পরিশোধ করার জন্যে মাকাতিবকে যাকাত দেয় যেতে পারে। সাধারণ গোলামকে যাকাতের টাকা দিয়ে আযাদ করা জায়েয নয়। কোনো সময়ে যদি গোলাম বিদ্যমান না থাকে, তাহলে এ খাত রহিত হয়ে যাবে।

 

৬.ঋণগ্রস্তঃ যারা ঋণের বোঝায় পিষ্ট এবং আপন প্রয়োজন পূরণের পর ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। বেকার হোক অথবা উপার্জনশীল এবং এতো সম্পদ নেই যে কর্জ পরিশোধের পর নেসাব পরিমাণ মাল তার কাছে থাকবে। ঋণগ্রস্তের মধ্যে তারাও মাশিল যারা কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণ অথবা জরিমানা দিতে হয়েছে অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট নষ্ট হয়ে গেছে অথবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার সব সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে।

 

৭. ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে): এর অর্থ আল্লাহর পথে জেহাদ। কেতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের তুলনায় জেহাদ শব্দটি সাধারণত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জেহাদ ফী সাবিলিল্লাহর মধ্যে যে সমুদয় চেষ্টা চরিত্র শামিল যা মুজাহিদগন কুফরী ব্যবস্থাকে নির্মূল করে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে করে থাকেন। সে চেষ্টা চরিত্র কলমের দ্বারা হোক, হাত মুখ ও তরবারির দ্বারা হোক অথবা কঠোর শ্রম সাধনার দ্বারা হোক তার সীমারেখা এতো সীমিত নয় যে, তার অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ এবং তার এতোটা ব্যাপকও নয় যে, তার মধ্যে দৈনন্দিন সকল সমাজকল্যাণমূলক কাজও শামিল করা যায়। অতীতে ইসলামের মনীষীগণ জেহাদে ফী সাবিলিল্লাহর সর্বসম্মতভাবে এ অর্থই গ্রহণ করেছেন যে, তা এমন সব চেষ্টা চরিত্র যা দ্বীনে হক কায়েম করার জন্যে, তার প্রচার ও প্রসারের জন্যে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে করা হয়। এ চেষ্টা চরিত্র যারা করে তাদের যাতায়াত খরচ, যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করার জন্যে যাকাত থেকে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।

 

৮. পথিক বা মুসাফিরঃ পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়িতে যত ধন সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।

 

যাকাতের অর্থ ব্যয় সম্পর্কে কিছু কথাঃ

 

১. এটা জরুরী নয় যে, যাকাতের অর্থ সব খাতেই ব্যয় করতে হবে যা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। বরঞ্চ প্রয়োজন অনুসারে ও সুযোগ সুবিধা মত যে যে খাতে যতোটা মুনাসিব মনে করা হবে ব্যয় করা যেতে পারে। এমনকি যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো একটি খাতে সমুদয় অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।

 

২. যাকাত ব্যয় করার যেসব খাত, ওশর এবং সদকায়ে ফিতরেরও সেই খাত। নফল সদকা অবশ্যি দাতার এখতিয়ারাধীন।

 

৩. বনী হাশিমের লোক যদি যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজে নিযুক্ত হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত থেকে পারিশ্রমিক দেয়া জায়েয হবে না। নবী (স) তার নিজের ওপর এবং বনী হাশিমের লোক বিনা পারিশ্রমিকে এ খেদমত করতে চাইলে করতে পারেন যেমন নবী (স) স্বয়ং যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ করেছেন।

 

৪. সাধারণ অবস্থায় কোনো ব্যক্তির যাকাত সে বস্তিরই অভাবগ্রস্ত ও দুঃস্থদের মধ্যে ব্যয় করা উচিত, এটা মুনাসিব নয় যে, সে বস্তির লোক বঞ্চিত থাকবে এবং যাকাত অন্য স্থানে পাঠানো হবে। তবে অন্য স্থানের প্রয়োজন যদি তীব্র হয় অথবা দীনি বাঞ্ছনীয়তার দাবী হয়, যেমন কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে অথবা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে অথবা কোনো আকস্মিক বিপদ এসেছে, কিংবা প্রলয়ঙ্কর ঝড়-তুফান হয়েছে, অথবা অন্য স্থানে কোনো দ্বীনি মাদরাসা আছে যার আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন, অথবা কোনো আত্মীয় স্বজন আছে, তাহলে অন্য স্থানে যাকাত পাঠানো জায়েয। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, নিজ বস্তির লোক একেবারে যেন বঞ্চিত না হয়।

 

যাদের যাকাত দেয়া জায়েয নয়

 

সাত প্রকারের লোককে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। দিলে যাকাত আদায় হবে না।

 

১. বাপ-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, তাদের বাপ-মা।

 

২. সন্তান-সন্ততি, নীচের দিক পর্যন্ত যথা ছেলে-মেয়ে, পৌত্র, প্রপৌত্র, নাতী-নাতনী প্রভৃতি।

 

৩. স্বামী।

 

৪. স্ত্রী।

 

এসব লোককে যাকাত দেয়ার অর্থ আপনজনদেরকে উপকৃত করা। তবে তার অর্থ এটাও কখনো নয় যে, লোক তার মাল দ্বারা এসব লোকের কোনো সাহায্য করবে না। বরঞ্চ শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাদের ভরণ পোষণ ও দেখা শুনা করা প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। উপরোক্ত চার ধরনের আত্মীয় ছাড়া অন্যান্য সকল আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া শুধু জায়েযই ....... অতি উত্তম ও বেশী সওয়াবের বিষয়।

 

৫. সাহেবে নেসাব সচ্ছল ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ দেয়াও নাজায়েয। কোনো গরীব দুঃস্থকে এতোটা দেয়াও জায়েয নয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যায়। তবে যদি সে ঋণগ্রস্ত হয় অথবা অধিক সন্তানের মালিক হয় তাহলে প্রয়োজন অনুসারে বেশী পরিমাণ দেয়া যেতে পারে। নবী (স) বলেন, সদকা মালদারের জন্যে জায়েয নয় এ পাঁচ ধরনের লোক ছাড়া, যথা (১) আল্লাহর পথে জেহাদকারী, (২) ঋণগ্রস্ত,( ৩) সদকা আদায় ও বন্টনকার, (৪) এমন ব্যক্তি যে তার অর্থ দিয়ে সদকার মাল খরিদ করে, (৫) এমন ব্যক্তি যার প্রতিবেশী মিসকিন এবং মিসকিন এবং মিসকিন তার ধনী প্রতিবেশীকে তার প্রাপ্ত সদকা হাদীয়া পেশ করে। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)

 

৬. অমুসলিমকে যাকাত দেয়াও জায়েয নয়।

 

৭. বনী হাশিমের বংশধরদের নিম্নের তিন গোত্রকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়।

 

(ক) হযরত আব্বাস (রা) এর বংশধর।

 

(খ) হারেসের বংশধর।

 

(গ) আবু তালেবের বংশধর।

 

হযরত আলী (রা) ও হযরত ফাতেমা (রা) এর সন্তানগণ উক্ত তৃতীয় গোত্রের।

 

অবশ্যি আজকাল এ যাচাই করা মুস্কিল যে, প্রকৃতপক্ষে বনী হাশিমের বংশধর কে। অতএব বায়তুলমাল থেকে তো প্রত্যেক অভাবগ্রস্তের সাহায্য পাওয়া উচিত। তবে যদি কারো হাশেমী হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে তাহলে তার যাকাত নেয়া উচিত নয়।

 

ইমাম মালেক (র) বলেন, নবী (স) বলেন, সদকার মাল মুহাম্মাদ (স) এর আওলাদের জন্যে জায়েয নয়। এজন্যে যে, সদকা লোকের ময়লা তো বটে। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)

 

 

 

যাকাতের বিভিন্ন মাসয়ালা

 

১. কাউকে আপনি টাকা কর্জ দিয়েছেন। কিন্তু তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন যদি আপনি আপনার যাকাতের মধ্যে ঋণ কেটে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। কিন্তু যদি ঋণের পরিমাণ টাকা তাকে যাকাত দিয়ে দেন এবং তাপর তার কাছে তা আবার ঋণ হিসেবে আদায় করে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

 

২.ঘরে কাজ কর্মের যেসব চাকর চাকরানি, দাই প্রভৃতি থাকে তাদের কাজের পারিশ্রমিক ও বেতন হিসেবে তোদেরকে যাকাত থেকে দেয়া জায়েয হবে না।

 

৩. দুঃস্থ অভাবগ্রস্তদের কাপড় বানিয়ে দিতে, শীতের মওসুমে লেপ কম্বল বানিয়ে দিতে, বিয়ে শাদীতে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যাকাত থেকে ব্যয় করা যেতে পারে।

 

৪. যে মেয়েলোক কোনো শিশুকে দুধ খাইয়েছে সে যদি গরবী দুঃস্থ হয় তাহলে তাকে যাকাতের টাকা পয়সা দেয়া যেতে পারে। সে শিশু বয়স্ক হওয়ার পর তার দুধ মাকে যাকাত দিতে পারে।

 

৫. একজনকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়া হলো। তারপর জানা গেল যে সে সাহেবে নেসাব অথবা হাশেমী সাইয়েদ, অথবা অন্ধকারে যাকাত দেয়া হলো তারপর জানা গেল যে, সে আপন মা অথবা মেয়ে অথবা এমন কোনো আত্মীয় যাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়, তাহলে এ অবস্থায় যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্যি যে নেবে সে যদি হকদার না হয় তাহলে তার নেয়া উচিত নয় এবং নেয়ার পর তার ফেরত দেয়া উচিত।

 

৬. কাউকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়ার পর জানা গেল যে, সে অমুসলিম, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় দিতে হবে।

 

৭. নোট, মুদ্রা, তেজারতি মাল যা কিছুই সোনা চাঁদির নেসাবের পরিমাণ হবে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। যেমন, কারো কাছে কিছু নোট আছে এবং বিভিন্ন মুদ্রা আছে সব মিলে ৪০০/- টাকা হচ্ছে অথবা এতো টাকার তেজারতি মাল আছে, তাহলে যদিও সোনার নেসাব পুরো হচ্ছে না, চাঁদির নেসাব পুরো হচ্ছে, তাহলেও সে ব্যক্তি সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে এবং তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এজন্যে যে ৪০০/- টাকা সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্যের অধিক। (মনে রাখা দরকার যে, সোনা এবং চাঁদির মূল্য বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে (১৯৮৩) সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্য প্রায় তিন হাজার টাকা। তাছাড়া নেসাব সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে সাড়ে ৫২ তোলা চাঁদি এবং সাড়ে ৭ ভরি সোনা যাকাতের নেসাব। যাই হোক, সোনা ও চাঁদির বাজার দরের ওপরই যাকাতের নেসাব ঠিক হবে। অনুবাদক

 

৯. ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর যাকাত ওয়াজিব।

 

১০. এক ব্যক্তি সারা বছর বিভিন্নভাবে সদকা খয়রাত করতে থাকলো কিন্তু যাকাতের নিয়ত করলো না। তাহলে বছর শেষ হওয়ার পর ঐসব খয়রাত করা মাল যাকাতের হিসেবে ধরা যাবে না। এজন্যে যাকাত বের করার সময় যাকাতের নিয়ত করা শর্ত।

 

১১. যাকাতের টাকা মানি অর্ডার করে পাঠানো যায় এবং মানি অর্ডার ফিস যাকাত থেকে বাদ দেয়া জায়েয।

 

 

 

ওশরের বিবরণ

 

ওশরের অর্থ

 

ওশরের আভিধানিক অর্থ এক দশমাংশ। কিন্তু পরিভাষায় ওশর হচ্ছে উৎপন্ন ফসলের যাকাত যা কোনো জমির উৎপন্নের দশ ভাগের এক ভাগ এবং কোনো জমির বিশ ভাগের এক ভাগ।

 

ওশরের শরয়ী হুকুম

 

********** আরবী ************

 

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের রোজগারের উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে খরচ কর। এবং তার মধ্য থেকেও যা তোমাদের জন্যে আমি জমিন থেকে বের করেছি। (উৎপন্ন করেছি)। (সূরা আল বাকারাঃ ২৬৭)

 

অন্য স্থানে বলা হয়েছেঃ

 

********** আরবী ************

 

এবং আল্লাহর হক আদায় কর যেদিন তোমরা ফসল কাটবে। (সূরা আল আনআমঃ১৪১)

 

তাফসীরকারগণের এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে, এর অর্থ হলো উৎপন্ন ফসলের যাকাত অর্থাৎ ওশর।

 

কোরআন পাকের উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ ফরয এবং হাদীস সম্পর্কে তাকীদ রয়েছে। নবী বলেনঃ

 

যে জমি বৃষ্টির পানি অথবা ঝর্নার বা নদী নালার পানিতে প্লাবিত হয় অথবা নদীর কিনারে হওয়ার কারণে স্বভাবত উর্বর ও পানিসিক্ত থাকে, তার থেকে উৎপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ ওশর বের করা ওয়াজিব। আর যে জমিতে কুপের পানি তুলে চাষ করা হয় তার বিশ ভাগের একভাগ ওয়াজিব।

 

ওশরের হার

 

বর্ষা নদী নালার পানিতে যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় অথবা নদীর কিনারায় হওয়ার কারণে যে জমিতে স্বভাবতই উর্বরতা ও পানি থাকে সে জমির উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ যাকাত হিসাবে বের কর ওয়াজিব। আর বিভিন্ন উপায়ে সেচ কাজের দ্বারা যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় তার বিশভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে বের করা ওয়াজিব।

 

ওশর (ফসলের যাকাত) আল্লাহর হক এবং তা মোট উৎপন্ন ফসলের প্রকৃত এক-দশমাংশ অথবা এক-বিশমাংশ। অতএব শস্য অথবা ফল ব্যবহারযোগ্য হলে প্রথমে তার ওশর বের করতে হবে তারপর সে শস্য বা ফল ব্যবহার করা হবে।

 

ওশর বের করার আগে তা ব্যবহার করা জায়েজ নয় নতুবা এক-দশমাংশ হোক অথবা তার অর্ধেক তা আল্লাহর পথে যাবে।

 

কোন কোন জিনিষের ওশর ওয়াজিব

 

জমি থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক বস্তুর ওপর ওশর ওয়াজিব। যা গুদামজাত করা হয় এমন ফসলের উপরও, যেমন খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, আখ, খেজুর, শুকনো ফল প্রভৃতি এবং ঐসব ফসলের উপরও যা গুদামজাত করা যায় না, যেমন শাকসবজি, শসা, খিরা, গাজর, মূলা, শালগম, তরমুজ, আম, মালটা প্রভৃতি।(কোনো ফকীহর মতে শাক সবজি, তরি-তরকারী, ফলমূল যা গুদামজাত করা যায় না তার ওপর ওশর ওয়াজিব নয়। তবে যদি কৃষক বাজারে বিক্রি করে তাহলে তার উপর তেজারতি যাকাত ওয়াজিব হবে তার মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে। অর্থাৎ যদি বছরের প্রথমে এবং শেষে তেজারতি মাল দুশ দিরহাম অথবা অধিক হয়।)

 

মধুর উপরেও ওশর ওয়াজিব।নবী (স) বলেনঃ ********** আরবী ***********মধুর ওশর দাও।–(বায়হাকী)

 

হযরত আবু সাইয়াদাহ (রা) বলেন, আমি নবী (স)-কে বলেছিলাম আমার কাছে মৌমাছি পালিত আছে। তখন নবী (স) বলেন, তাহলে তার ওশর দাও।(ইমাম মালেক (রা) এবং হযরত সুফিয়ান সওরী (র) এর নিকট মধুর ওশর নেই। ইমাম শাফেয়ী (র) এর মশহুর বক্তব্যও তাই। ইমাম বুখারী (র) বলেন, মধুর যাকাতের ব্যাপারে কোনো হাদীস সহীহ নয়। বায়হাকীতে আছে এক ব্যক্তি নবীর দরবারে মধুর ওশর এনে আরজ করে, সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করুন। নবী (স) সে বনের হেফাযতের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর হযরত ওমর (রা) এর খেলাফত আমলে সুফিয়ান বিন ওয়াহাব এ ব্যাপারে তার কাছে প্রকৃত সত্য জানতে চাইলেন, তিনি তাকে লিখে জানালেন যে, সে নবীকে যা দিতো তা তোমাকে দিতে এলে নিয়ে নিবে এবং সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করে দেবে। নতুবা তা তো মৌমাছি দ্বারা তৈরী জিনিস আসমানের পানির মতো। যে ইচ্ছা করে সে তা ব্যবহার করতে পারে।

 

আল্লামা মওদূদীর অভিমত এই যে, মধুর ওপরে যাকাত নেই। তবে তার ব্যবসার ওপরে সেই ধরনের যাকাত হবে যা অন্যান্য তেজারতি মালের ওপর হয়ে থাকে।)

 

ওশরের মাসয়ালা

 

১. ওশরের মোট উৎপন্ন ফসলের আদায় করতে হবে। ওশর আদায়ের পর অবশিষ্ট ফসল থেকে কৃষির যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। যেমন কারো জমিতে ত্রিশ মণ ফসল হল। এক দশমাংশ তিন মণ ওশর দেওয়ার পর বাকি সাত মণ থেকে কৃষির খরচপত্র বহন করতে হবে।

 

২. ফসল যখনই ব্যবহার যোগ্য হবে তখনই তার উপর ওশর ওয়াজিব হবে। যেমন-ছোলা, মটর, আম প্রভৃতির পাকার পূর্বেই ব্যবহার করতে হবে। অতএব তখন যে পরিমাণ হবে তার ওশর বের করতে হবে। ওশর বের করার পূর্বেই তা ব্যবহার করা দুরস্ত নয়।

 

৩. কারো বাগানে ফল হয়েছে। তা পাকার পূর্বে বিক্রি করলে ওশর খরিদদারের উপর ওয়াজিব হবে। পাকার পর বিক্রি করলে ওশর বিক্রেতার ঘাড়ে পড়বে।

 

৪. জমিতে যে চাষ করবে ওশর তারই উপর ওয়াজিব হবে তা সে জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করুক অথবা বর্গা নিয়ে চাষ করুক।

 

৫. দুজন মিলে চাষাবাদ করলে ওশর উভয়ের উপর ওয়াজিব হবে তা যদি বীজ একজনের হয় তবুও।

 

৬. ওশর ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব কোন শর্ত নয়।(ইমাম আযম ও ইমাম শাফেয়ীর মতে পাঁচ ওয়াসাক (ত্রিশ মণ) এর কম হলে তার ওশর নেই। আহলে হাদীসের অভিমতও তাই। ওশর ফরয হওয়ার এ একটি শর্ত যে, উৎপন্ন ফসল অন্তত পাঁচ ওয়াসাক বা ত্রিশ মণ হবে। তার প্রমাণ নিম্ন হাদীসঃ ................. আরবী ............

 

পাঁচ ওয়াসাকের কম ফসলের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।-বুখারী) ফসল কম হোক বেশী হোক ওশর দিতে হবে। অবশ্যি দু আড়াই কিলো ফসল ধর্তব্য নয়।

 

৭. ওশরে বছর পূর্ণ হওয়ার প্রশ্নও নেই। বরঞ্চ যে জমিতে বছরে দু ফসল হয় তার প্রত্যেক ফসলের ওশর দিতে হবে।

 

৮. নাবালেগ শিশু ও মাথা খারাপ লোকের ফসলেরও ওশর ওয়াজিব।

 

৯. ওয়াকফ করা জমি চাষ করলে চাষির উপর ওশর ওয়াজিব।

 

১০. বৃষ্টির পানিতে উর্বর জমিতে কৃত্রিম উপায়ে সেচ কার্য করলে তার ওশর নির্ধারণে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, স্বাভাবিক বর্ষণের কারণে সে জমি অধিক উর্বরতা লাভ করেছে, না সেচের কারণে।

 

১১. ওশর ফসলের আকারেও দেয়া যায় অথবা তার মূল্য।

 

১২. বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে যেসব জমি মুসলমানদের মালিকানায় আছে, তা ওশরী এবং তার ওশর দিতে হবে।

 

১৩. জমির খাজনা দিলে ওশর মাফ হয় না।

 

১৪. যাকাত যেসব খাতে ব্যয় করা হয়, ওশরও সেসব খাতে ব্যয় করতে হবে।

 

গুপ্তধন ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা

 

মাটির নীচে রক্ষিত সম্পদ ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা নিম্নরূপ:

 

১. মাটির নীচে রক্ষিত প্রাপ্ত সম্পদের পাঁচ ভাগের এক বায়তুল মালের জন্য নির্দিষ্ট। হাদীসে আছে ................. আরবী ............ অর্থাৎ গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশও বায়তুল মালে দেয়া ওয়াজিব।

 

২. খনিজ দ্রব্য তা ধাতব পদার্থ হোক যেমন লোহা, রূপা, সোনা, রাং ইত্যাদি অথবা অধাতব পদার্থ যেমন গন্ধক, এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালের অংশ। আর বাকী চার ভাগ খনির মালিক পাবে।

 

৩. যেসব খনিজ দ্রব্য আগুনে পোড়ালে নরম হয় না যেমন জাওহার ইত্যাদি অথবা তরল পদার্থ যেমন কেরোসিন ও পেট্রোল ইত্যাদি। এসব দ্রব্যে বায়তুলমালের কোনো অংশ নেই। (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর মতে খনিজ পদার্থ ধাতব, অধাতব বা তরল যা-ই হোক না কেন শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত ওয়াজিব যদি তা নেসাব পরিমাণ হয় এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়ে এ মতে আমল করা হতো।)

 

 

 

সদকায়ে ফিতরের বয়ান

 

সদকায়ে ফিতরের অর্থ

 

ফিতরের আভিধানিক অর্থ রোযা খোলা। সদকায়ে ফিতরের অর্থ রোযা খোলার সদকা। পারিভাষিক অর্থে সদকায়ে ফিতর বলতে বুঝায় সেই ওয়াজিব সদকা যা রমযান খতম হওয়ার এবং রোযা খোলার পর দেয়া হয় যে বছর মুসলমানদের ওপর রমযানের রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার হুকুম দেন।

 

সদকায়ে ফিতরের তাৎপর্য ও উপকারিতা

 

রমযান মাসে রোজাদারগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী এ চেষ্টা করেন যাতে করে তারা রমযানের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন এবং ঐসব সীমারেখা, নিয়ম পদ্ধতি ও শর্তাবলীর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখেন যা মেনে চলার জন্যে শরীয়াতে তাকীদ করা হয়েছে। তথাপি জ্ঞাতে অজ্ঞাতে মানুষের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে যায়। সদকায়ে ফিতরের একটি তাৎপর্য এইযে, মানুষ আল্লাহর পথে আগ্রহ সহকারে তার অর্জিত মাল খরচ করবে যাতে করে তার ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হয় এবং আল্লাহর দরবারে রোযা কবুল হয়। উপরন্তু ঈদ উপলক্ষে সদকায়ে ফিতর দেয়ার একটা তাৎপর্য এটাও যে, সমাজের গরীব দুস্থ লোক যেন নিশ্চিন্তে এবং ভালোভাবে অন্ত বস্ত্রের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে ঈদগাহে উপস্থিত হতে পারে যাতে করে ঈদগাহের সম্মেলন বিরাট হয় এবং পথে মুসলমানদের বিপুল জনসমাগমের কারণে ইসলামের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে।

 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর এজন্য নির্ধারিত করেছেন যে, এ ফিতরা রোজাদারদেরকে বেহুদা কাজ কর্ম এবং অশ্লীলতার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পাক করবে এবং সে সাথে অভাবগ্রস্তদের খানা পিনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করবে তার সে সদকা কবুল হবে এবং যে নামাযের পরে পরিশোধ করবে তা সাধারণ দান খয়রাতের মতো একটি সদকা হবে। (আবু দাউদ)

 

শাহ অলী উল্লাহ (র) বলেন, ঈদের দিন খুশীর দিন। এদিনে মুসলমানদের বিরাট জনসমাবেশের মাধ্যমে ইসলামের শান শওকত প্রকাশ পায় এবং সদকায় ফিতরের দ্বারা এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। তাছাড়া সদকায়ে ফিতর রোযার পূর্ণতারও কারণ হয়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ)

 

সদকায়ে ফিতরের হুকুম

 

সদকায়ে ফিতর এমন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমান নারী পুরুষ, নাবালক সাবালকের ওপর ওয়াজিব (আহলে হাদীসের মতে সদকায়ে ফিতর যাকাতের মতো ফরয। অতএব প্রত্যেক ধনী গরীব, নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট-বড়, সকলের ওপর ফরয। তাদের যুক্তি এই যে, নবী (স) মক্কার অলিতে গলিতে লোক পাঠিয়ে এ ঘোষণা করিয়ে দেন সাধান থাক। সদকায় ফিতর প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আযাদ গোলাম, ছোট-বড় সকলের ওপর ওয়াজিব। (তিরমিযি) উপরন্তু ইবনে ওমর (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর ফরয বলেছেন এবং তাহলো প্রত্যেক নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট ও বড়োর জন্যে এক সা খেজুর, এক সা যব এবং হুকুম দিয়েছেন যে, ঈদগাহে যাবার পূর্বে তা দিতে হবে।)যার কাছে তার প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতো মূল্যের মাল হবে যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়। সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক। যেমন ধরুন, কারো কাছে তার বসবাসের গৃহ ছাড়া আরও বাড়ী-ঘর আছে যা খালি পড়ে আছে অথবা ভাড়ার জন্যে তৈরী করা হয়েছে। যদি সে ঘর-বাড়ীর মূল্য নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার মালিকের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে যদিও সে বাড়ীর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। তবে যদি বাড়ীর ভাড়ার দ্বারা সে জীবিকা অর্জন করে তাহলে তা তার প্রকৃত প্রয়োজনের মধ্যে শামিল হবে এবং তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে না। অথবা কারো ঘরে ব্যবহারের সামগ্রী ছাড়াও কিছু আসবাবপত্র আছে যেমনঃ তামার বাসনপত্র, মূল্যবান ফার্নিচার প্রভৃতি যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ অথবা তার অধিক, তাহলে তার ওপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। যদিও সে সব মালের যাকাত দিতে হবে না।

 

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে ওপরে বর্ণিত নেসাব ছাড়া অন্য কোনো শর্ত নেই। না আযাদী কোনো শর্ত, আর না বালেগ হওয়া অথবা হুশ জ্ঞান থাকা। গোলামের ওপরও ওয়াজিব। কিন্তু তার মনিব তা দিয়ে দিবে। নাবালেগ ও পাগল ছেলেমেয়েদের ফিতরা তার বাপ-মা অথবা ওলী দিয়ে দেবে।

 

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য এটাও শর্ত নয় যে, মাল এক বছর স্থায়ী হতে হবে। বরঞ্চ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পূর্বেও যদি কেউ ধন দৌলতের মালিক হয়, তাহলে তার ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।

 

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়

 

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় ঈদের দিনের প্রভাতকাল (আহলে হাদীসের নিকটে সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় রমযানের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদের নামাযের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। এক বলা হয় রোযা খোলার সদকা। অতএব রমযানের শেষ রোযা খোলার পর থেকেই এ ওয়াজিব হয় যদিও তা আগেও দিয়ে দেয়া দুরস্ত আছে) অতএব যে ব্যক্তি ফজর হওয়ার পূর্বে মারা যায় অথবা ধন দৌলত থেকে বঞ্চিত হয় তার ওপর ওয়াজিব হবে না। যে শিশু ফজরের পর জন্মগ্রহণ করবে তার ওপরও ওয়াজিব হবে না। তবে যে ঈদের রাতে জন্মগ্রহণ করবে তার ওপর ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে যে ফজরের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে অথবা ধনের মালিক হয় তাহলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।

 

সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করার সময়

 

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় যদিও ফজরের সময় কিন্তু ওয়াজিব হওয়ার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য এটাই দাব করে যে, ঈদের কিছু দিন পূর্বে তা অভাবগ্রস্তদের কাছে পৌছিয়ে দেয়া হোক। যাতে করে গরীব দুস্থ অন্ন-বস্ত্রের সামগ্রী নিশ্চিন্তে লাভ করে সকলের সাথে ঈদগাহে যেতে পারে। বুখারী শরীফে আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা) দু একদিন পূর্বেই সদকায়ে ফিতর বিতরণ করতেন। দু চার দিন পূর্বে দেয়া না গেলে ঈদের নামাযের পূর্বে অবশ্যই দিয়ে দেয়া উচিত। নবী (স) বলেনঃ

 

********** আরবী ************

 

যে ব্যক্তি সদকায়ে ফিতর নামাযের পূর্বে দিয়ে দেবে তাহলে সেটা হবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত সদকা। আর যে নামাযের পরে দেবে, তার সদকা হবে দান খয়রাতের মতো একটি সদকা।

 

কাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব

 

১. সচ্ছল ব্যক্তি তার নিজের ছাড়াও নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দিবে, নাবালেগ সন্তান যদি ধনবান হয় তাহলে তাদের ধন থেকে নতুবা নিজের পক্ষ থেকে দেবে।

 

২. যেসব সন্তান হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তাদের মাল থাক আর না থাক, তাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দেয়া ওয়াজিব, তারা সাবালক হোক বা না হোক।

 

৩. যারা তাদের খাদেম বা চাকর বাকরের পৃষ্ঠপোষকতা ও ভরণ পোষণ করে তারা তাদের পক্ষ থেকে সদকা দিয়ে দেবে।

 

৪. সাবালক সন্তানদের পক্ষ থেকে পিতার দেয়া ওয়াজিব যদি তারা দুস্থ ও দরিদ্র হয়। মালদার হলে ওয়াজিব হবে না।

 

৫. বিবির পক্ষ থেকে ওয়াজিব তো নয়। তবে স্বামী দিয়ে দিলে বিবির পক্ষ থেকে হয়ে যাবে।

 

৬. বাপ মারা গেলে দাদার উপরে সকল দায়িত্ব এসে পড়ে যা পিতার ছিল।

 

৭. স্ত্রীলোক যদি সচ্ছল হয় তাহলে শুধু তার সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তার নিজের ছাড়া স্বামী, সন্তান বা মা-বাপের পক্ষ থেকে দেয়া তার ওয়াজিব নয়।

 

সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ

 

সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ আশি তোলা সেরের হিসেবে এক সের তিন ছটাক গমের আটা (মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মতে- একজনের সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ এক সের সাড়ে বার ছটাক। সাবধানতার জন্যে দু সের দেয়া ভালো) যব বা যবের আটা, অথবা খুরমা, মুনাক্কা দিতে হলে গমের দ্বিগুণ দিতে হবে। (নবী (স) এর যুগে সম্ভবত যব এবং খুরমা মুনাক্কার মূল্য সমান ছিল)

 

সদকায়ে ফিতরের বিভিন্ন মাসায়েল

 

১. যে ব্যক্তি কোনো কারণে রমযানের রোযা রাখতে পারেনি, তারও সদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব। সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে রোযা শর্ত নয়।

 

২. সদকায়ে ফিতর খাদ্য শস্যের আকারেও দেয়া যায়, তার মূল্যও দেয়া যায়। দেয়ার সময় ফকীর মিসকিনদের সুবিধা বিবেচনা করে খাদ্য শস্য বা মূল্য দেয়া উচিত।

 

৩. গমের পরিবর্তে অন্য কিছু যেমন জোয়ার, বাজরা, ছোলা, মটর প্রভৃতি দেয়ার ইচ্ছা থাকলে গম অথবা যবের মূল্যে পরিমাণ হওয়া উচিত।

 

৪. একজনের সদকায়ে ফিতর একজন ফকীরকেও দেয়া যায় এবং কয়েকজনকেও দেয়া যায়। তেমনি কয়েকজনের ফিতরা একজনকেও দেয়া যায় এবং কয়েকজনকেও দেয়া যায়।

 

৫. কারো কাছে কিছু গম এবং কিছু যব আছে। তাহলে হিসেব করে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ পূর্ণ করে দেবে।

 

৬. প্রয়োজন হলে ফিতরা অন্যস্থানেও পাঠানো যায়। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া অন্যত্র না পাঠানো উচিত।

 

৭. সদকায়ে ফিতরের ব্যয়ের খাতও তাই, যাক যাকাতের।

 

 

 

রোযার অধ্যায়

 

 

 

রোযার বিবরণ

 

রমজানের রোজা ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কুরআনে শুধু রোজা রাখার হুকুম দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ রোজার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেওয়া হয়েছে। রমজানের মহত্ব ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মাসের রোজা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযিলত ও বরকত প্রথমে আমরা বর্ণনা করবো।

 

রমজানুল মুবারকের ফযিলত

 

কুরআনে রমজানের মহত্ব ও ফযিলত

 

কুরআন পাকে রমজানের মহত্ব ফযিলতের তিনটি কারণ বলা হয়েছেঃ

 

১. কুরআন নাযিল হওয়া অর্থাৎ এ মাসে কুরআন নাযিল হয়।

 

২. লায়লাতুল কদর। অর্থাৎ এ মাসে এমন এক রাত আছে যা মঙ্গল ও বরকতের দিক দিয়ে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

 

৩. রোজা ফরজ হওয়া। অর্থাৎ এ মাসে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ হয়েছে।

 

এসব ফযিলতের জন্য নবী (স) এ মাসকে ********** আরবী ************বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস থেকে উৎকৃষ্টতম বলেছেন। নিম্নে তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ

 

রমজানের ফযিলতের কারণ

 

১. কুরআন নাযিল হওয়াঃ কুরআন বলেন-********** আরবী ************

 

রমজান এমন এক মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে- যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ। যা সত্য পথ প্রদর্শনকারী, সুস্পষ্ট শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং হকও বাতিলকে সুস্পষ্ট করে উপস্থাপনকারী। (সূরা আল বাকারাঃ১৮৫)

 

রমজানের মহত্ব ফযিলত বুঝবার জন্য একথাই যথেষ্ট নয় যে, তার মধ্যে আল্লাহর হেদায়েতের সর্বশেষ কেতাব নাযিল করা হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে,মানবতা যদি হেদায়েতের উৎস থেকে বঞ্চিত হতো। তাহলে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির অস্তিত্বের এ বিরাট কারখানাটির সূর্যের আলো ও চাঁদ তারার শুভ্র রশ্মি সত্ত্বেও লন্ড ভণ্ড হয়ে যেত।বিশ্ব প্রকৃতি তার সুনিপুণ কারুকার্য ও সৌন্দর্য সত্বেও অর্থহীন অপূর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়তো। ফলে কুফর নাস্তিকতা শিরক ও সত্ত্বেও মানুষ বনের হিংস্র পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে পড়তো। কুরআনও পৃথিবীতে হেদায়েতের আলোকের একমাত্র উৎস। এর থেকে যে বঞ্চিত সে সে হেদায়েত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।

 

২. লাইলাতুল কদরঃ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, তা রমজান মাসে শামিল করা হয়েছে এবং তা লাইলাতুল কদরে নাযিল করা হয়েছে। তার অনিবার্য অর্থ এই যে, লাইলাতুল কদর রমজানের কোনো একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেনঃ রমজানের শেষ দশ বেজোড় রাতের রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)

 

৩. রোজা ফরজ হওয়াঃ রোজার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন এবং গোটা মাসের রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন:

 

********** আরবী ************ অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য অপরিহার্য যে সে পুরো মাস রোজা রাখবে।

 

রমজানের মহত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে হাদীস

 

নবী (স) রমজানের মহত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জ্বিনগুলিকে শৃঙ্খল দিয়ে বেধে রাখা হয় এবং দোযখের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার কোন একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার কোনো একটি দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয় না। তারপর আল্লাহর একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে। যারা কল্যাণ ও মঙ্গল চাও তারা সামনের দিকে অগ্রসর হও। যারা বদকাম পাপাচার করতে চাও তারা থাম। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক নাফরমান বান্দা কে দোযখ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। আর এ কাজ রমজানের প্রত্যেক রাতেই করা হয়। (তিরমিযি,ইবনে মাযাহ)

 

  •  
  • এ এমন একটি মাস যে মসে মুমিনদের রুজি বৃদ্ধি করা হয়।(মিশকাত)
  •  
  • রমজান মাস সকল মাসের সরদার ।(ইলমুল ফেকাহ)
  •  
  • এ মাসের প্রথম অংশ রহমত, দ্বিতীয় অংশ মাগফেরাত, তৃতীয় এবং শেষ অংশ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই ও মুক্তি।(মিশকাত)
  •  
  • এ মাসে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপন ইচ্ছায় কোন নফল নেকী করবে সে অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াবের হকদার হবে। (মিশকাত)
  •  

 

ইতিহাসে রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব

 

ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, হক ও বাতিলের প্রথম সিদ্ধান্তকর যুদ্ধ এ মাসে হয়েছিল। এবং হক কে বাতিল থেকে আলাদা করে দেওয়ার যে দিন কে কুরআনে ইয়ামুল ফোরকান বলা হয়েছে তা ছিলো এ মাসের একটি দিন। এ দিনেই হকের প্রথম বিজয় সূচিত হয় এবং বাতিল পরাজিত হয়। ইতিহাস এ কথাও বলে যে, এ মাসেই মক্কা বিজয় হয়।এসব তথ্য সামনে রেখে চিন্তাভাবনা করুন তাহলে উপলব্ধি করবেন।

 

  •  
  • হকের হেদায়েত এ মাসেই নাযিল হয়।
  •  
  • ইসলামের প্রাথমিক বিজয় এ মাসেই হয়।
  •  
  • ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় এ মাসেই হয়।
  •  

 

এসব সত্য কে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রমজান মাস প্রতি বছর আসে। শরীয়ত এ মাসে রোজা ফরজ করেছে, রাতের নামাজ ও তেলাওয়াতে কুরআনের ব্যবস্থা করেছে যাতে করে মুমিনের মধ্যে জেহাদের প্রাণ শক্তি নিষ্প্রাণ না হয়ে পড়ে। এবং বছরের অন্তত একবার রমজান মাসে কুরআন শুনে বা পড়ে আপন পদমর্যাদায় দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতি সহকারে মনের মধ্যে তরজমা করতে পারে।কুরআনের নাযিল হওয়া, তার অধ্যয়ন এবং রোজার মুজাহিদ সুলভ তরবিয়ত এ জন্য যে, ইসলামের সন্তানগণ দীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জীবিত রয়েছে এবং কখনো যেন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফিল না হয়।

 

রোজার অর্থ

 

রোজাকে আরবী ভাষায় সাওম বা সিয়াম বলে। তার অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা এবং তা পরিত্যাগ করা। শরীয়তের পরিভাষায় সাওমের অর্থ

 

সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা।

 

রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম

 

হিজরতের দেড় বছর পর রমজানের রোজা মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়।

 

********** আরবী ************

 

হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো। রোজা ফরজে আইন যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের এবং বিনা ওজরে যে রাখবে না সে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে।

 

রোজার গুরুত্ব

 

কুরআন এ সাক্ষ্য দেয় যে, সকল আসমানী শরীয়তের অধীন রোজা ফরজ ছিলো। এবং প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের মধ্যে তা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

 

********** আরবী ************

 

যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর।

 

এ আয়াত শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয়, বরঞ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোজার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার তার একটা স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। বরঞ্চ এমন মনে হয় যে, তরবিয়ত ও তাযকিয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া তা পূর্ণ হতে পারে না। অন্য কোন ইবাদত তার বিকল্প হতেই পারে না।এজন্যই রোজা সকল নবী গনের শরীয়াতে ফরজ ছিল।

 

রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর অথবা রোগ ছাড়া রমজানের একটি রোজা ছেড়ে দেবে যদি সে সারা জীবন ধরে রোজা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরন হবে না। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)

 

অর্থাৎ রমজানের রোজার মহত্ব, কল্যাণ, বরকত ও গুরুত্ব এইযে, যদি কোন উদাসীন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন রোজা নষ্ট করে বা না রাখে, তার ফলে তার যে ক্ষতি হলো তা জীবনব্যাপী রোজা রাখলেও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তবে তার আইনগত কাযা হতে পারে।

 

রোযার উদ্দেশ্য

 

রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া পয়দা করার ....... আরবী ...... যাতে করে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া পয়দা হতে পারে। তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর সত্তার ওপর ঈমান,ও তার গুণাবলী দয়া অনুগ্রহের গভীর অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তা অন্য গুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তিদানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাচার সত্যিকার উপায়।

 

রোযা আল্লাহর সত্তার ওপরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার অনুগ্রহ ও অসন্তোষের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। সারাদিন ক্রমাগত কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রবৃত্তির একেবারে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় দাবী পূরণ থেকে বিরত থাকার কারণে মানুষের ওপর এ প্রভাব পড়ে যে, সে চরম অক্ষম, অসহায় ও মুখাপেক্ষী হয়। সে জীবনের প্রতি মূহুর্তের জন্য আল্লাহর রহম ও করমের ভিখারি হয়। তারপর সে যখন তার জীবনকে আল্লাহর নিয়ামতে সমৃদ্ধ দেখতে পায়, তখন সে আল্লাহর মহব্বতের আবেগ উচ্ছ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয় এবং আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীতে তৎপর হয় তখন সে নিভৃতে তার প্রবল যৌন বাসনাকে সংযত করে রাখে যেখানে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ থাকে না তখন তার মনে আল্লাহর ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ফলে তার মনের ওপর আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন ছাপ পড়ে যে গোনাহের চিন্তা করতেও তার শরীর কেপে ওঠে।

 

প্রকৃত রোযা

 

রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসির করা যেতে পারে, যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হয় এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হয় যার প্রভাবে রোযা প্রাণ হীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা তো তাই যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করবে।

 

নবী (স) বলেন, তুমি যখন রোযা রাখবে তখন তোমার কর্তব্য হবে তোমার কান, চোখ, মুখ, হাত, পা এবং সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা। (কাশফুল মাহজুব)

 

নবী (স) আরো বলেন, যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন ছিল না। (বুখারী)

 

এমন বহু রোজাদার আছে যে, রোযায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)

 

রোযার ফযিলত

 

নবী (স) বলেন, প্রত্যেক নেক আমলে প্রতিদান দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু আল্লাহ এরশাদ হচ্ছে, রোযার ব্যাপারটাই অন্য রকম। তাতো আমার জন্য নির্দিষ্ট। আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব। বান্দা আমার জন্যে তার যৌনবাসনা ও খানাপিনা বন্ধ রাখে। রোযাদারের জন্যে দুটি আনন্দ, একটা হচ্ছে ইফতারের সময় যখন সে এ আবেগ উল্লাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল্লাহর নিয়ামত উপভোগ করতে থাকে যে, আল্লাহ তাকে একটা ফরয আদায় করার তাওফিক দান করেছেন।

 

দ্বিতীয় আনন্দ আপন পরওয়ারদেগারের সাথে মিলিত হওয়ায় যখন সে আল্লাহর দরবারে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করবে এবং দীদার লাভ করে চক্ষু শীতল করবে।

 

রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উৎকৃষ্টতর। রোযা গোনাহ থেকে আত্মরক্ষার ঢাল স্বরূপ। তোমাদের মধ্যে কেউ রোযা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা ও হৈ হাংগামা থেকে দূরে থাকে। যদি কেউ গালিগালাজ করতে থাকে অথবা ঝগড়া করতে আসে, তাহলে তার মনে করা উচিত যে, সে রোযা আছে। (বুখারী, মুসলিম)

 

নবী (স) আরও বলেন, যে ঈমানের অনুভূতি এবং আখিরাতের সওয়াবের আশায় রোযা রাখে তা পূর্বের সব গোনাহ (সগীরা) মাপ করে দেয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম)

 

রুইয়েতে হেলাল বা চাঁদ দেখার নির্দেশাবলী

 

১. শাবানের উনত্রিশ তারিখে রমযানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করা মুসলমানদের ওয়াজিবে কেফায়া। (সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব যে, রমযানের চাঁদ দেখার ব্যবস্থা তারা করবে। গোটা সমাজ যদি এর গুরুত্ব অনুভব না করে এবং বিষয়টিকে অবহেলা করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে) পঞ্জিকা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে রোযা রাখা এবং চাঁদ দেখা থেকে বেপরোয়া হওয়া কিছুতেই জায়েয নয়। এমনকি যারা গণনা শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ এবং নেক ও পরহেজগার, তাদেরও নিজের হিসেবের ওপর আমল করা জায়েয নয়। নবী (স) বলেন, চাঁদ দেখা রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা খতম কর। যদি ২৯ শাবান চাঁদ দেখা না যায় তাহলে শাবানের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

 

২. কোনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চাঁদ দেখা মেনে নেয়া এবং তদনুযায়ী রোযা রাখা জায়েয নয়। যেমন একটা প্রবাদ আছে যেদিনটি রজব মাসের ৪ঠা সে দিনটি রমযানের পয়লা এবং বারবার এটা পরীক্ষা করা হয়েছে।

 

৩. রজবের উনত্রিশ তারিখে চাঁদ দেখার চেষ্টা ও ব্যবস্থা করা মোস্তাহাব। কারণ রমযানের পয়লা তারিখ জানার জন্যে শাবানের তারিখগুলো জানা জরুরী। যেমন মনে করুন উনত্রিশ রজব চাঁদ উদয় হলো। কিন্তু লোকে তা দেখার কোনো ব্যবস্থা করেনি। তারপর ১লা শাবানকে ৩০শে রজব মনে করে হিসেব করতে থাকলো। এভাবে ৩০শে শাবান এসে গেল। কিন্তু আকাশে মেঘ অথবা ধুলাবালির কারণে চাঁদ দেখা গেল না। যেহেতু তা শাবানের ২৯ তারিখ মনে করা হচ্ছিল। এ জন্যে ১লা রমযানকে লোক ৩০শে শাবান মনে করে বসলো এর ফলে অবহেলার কারণে রমযানের একটা রোযা নষ্ট হয়ে গেল।

 

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) শাবান মাসের দিনগুলো ও তারিখগুলো যেমন চিন্তা ভাবনা ও হিসেবে করে মনে রাখতেন, অন্য কোনো মাসের তারিখ এতো যত্ন সহকারে মনে রাখতেন না, তারপর তিনি রমযানের চাঁদ দেখে রোযা রাখতেন। (আবু দাউদ)

 

৪. যে ব্যক্তি স্বচক্ষে রমযানের চাঁদ দেখবে, তার কর্তব্য হচ্ছে বস্তির সকল লোক অথবা মুসলমানদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়া তা সে পুরুষ হোক বা নারী হোক।

 

৫. পশ্চিম আকাশ চাঁদ ওঠার স্থান যদি পরিষ্কার হয়, তাহলে এমন অবস্থায় শুধুমাত্র দুজন দীনদার লোকের সাক্ষ্যে রমযানের চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না আর না ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে। এ অবস্থায় অন্তত এতজন লোকের সাক্ষ্য দরকার যাতে করে তাদের কথায় চাঁদ ওঠা সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।

 

৬. চাঁদ ওঠার স্থান পরিষ্কার না হলে রমযানের নতুন চাদের প্রমাণের জন্যে শুধু একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট তা সে পুরুষ হোক বা নারী। তবে নিম্নে শর্তে:

 

ক) সাক্ষ্যদাতা বালেগ, জ্ঞান সম্পন্ন এবং দীনদার মুসলমান হতে হবে।

 

খ) তাকে বলতে হবে যে, সে নিজ চক্ষে চাঁদ দেখেছে।

 

৭. আকাশ পরিষ্কার হলে ঈদের নতুন চাঁদের জন্যে একজনের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয় সে যেমন ধরনের বিশ্বস্ত লোক হোক না কেন। ঈদের চাঁদের জন্যে প্রয়োজন দুজন দ্বীনদার মুত্তাকী পুরুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করা অথবা একজন দ্বীনদার পুরুষ এবং দুজন দ্বীনদার নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা। যদি চারজন স্ত্রীলোক সাক্ষ্য দেয় যে তারা চাঁদ দেখেছে তথাপি তার দ্বারা ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না।

 

৮. যেখানে কোনো মুসলমান কাযী অথবা শাসক নেই, সেখানকার মুসলমানদের উচিত নিজেরাই চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করবে, তার প্রচার করবে এবং তদনুযায়ী কাজ করবে।

 

৯. সারা শহরে একথা ছড়িয়ে পড়লো যে, চাঁদ দেখা গেছে, কিন্তু বহু অনুসন্ধানের পরেও এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া গেল না যে একথা স্বীকার করবে, সে নিজে চাঁদ দেখেছে। এ অবস্থায় চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না।

 

১০. যদি এমন ব্যক্তি রমযানের চাঁদ দেখেছে বলে বলা হচ্ছে যার সাক্ষ্য শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। এবং সে ছাড়া আর কেউ চাঁদ দেখেনি, তাহলে তার কথায় শহর বা বস্তির লোক রোযা রাখবে না। কিন্তু সে অবশ্যই রোযা রাখবে তার রোযা রাখা ওয়াজিব। তারপর তার ত্রিশ রোযা হয়ে গেলে এবং ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তখন সে ৩১ রোযা করবে এবং বস্তির লোকের সাথে ঈদ করবে।

 

১১. কোনো কারণে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেল না এবং অন্য স্থান থেকে চাঁদ দেখার খবর এল। যদি সে খবর শরীয়াতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তার দ্বারা রমযানের চাঁদও প্রমাণিত হবে। এবং ঈদের চাঁদও। মুসলমান দায়িত্বশীলদের প্রয়োজন হবে যে, তারা এসব খবর যাচাই করে দেখবে এবং শরীয়াত মুতাবেক যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে শহরে তার পাবলিসিটি করার এন্তেযাম করবে।

 

১২. দুজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত লোকের সাক্ষ্য দানে চাঁদ দেখা যদি প্রমাণিত হয় এবং সে অনুযায়ী লোক রোযা রাখে, কিন্তু ৩০ রোযা পুরো হওয়ার পর ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তাহলে ৩১শে দিনে ঈদ করবে। সেদিন রোযা জায়েয হবে না।

 

নতুন চাঁদ দেখার পর রোযা

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) নতুন চাঁদ দেখলে, বলতেন:

 

********** আরবী ************

 

আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, হে আল্লাহ এ চাঁদকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান ও ইসলামের চাঁদ হিসেবে উদিত কর। যে কাজ তোমার পছন্দনীয় এবং প্রিয় সে কাজের তাওফিক আমাদেরকে দাও। হে চাঁদ! তোমার এবং আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ। (তিরমিযি ও দারেমী)

 

রোজার প্রকারভেদ ও তার হুকুম

 

রোজা ছয় প্রকার-যার বিস্তারিত বিবরণ ও হুকুম জানা জরুরী।

 

(১) ফরজ, (২) ওয়াজিব, (৩) সুন্নাত, (৪) নফল, (৫) মাকরূহ, (৬) হারাম।

 

১. ফরজ রোযা- বছরে শুধু রমজানের রোজা (৩০ বা ২৯চাদ অনুযায়ী) মুসলমানদের উপর ফরজ। কুরআন ও হাদীস থেকে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুসলিম উম্মত আর গোটা ইতিহাসে বরাবর এর উপর আমল করে এসেছে। যে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার অস্বীকার করবে সে কাফের হবে এবং ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হবে। আর বিনা ওজরে রোজা ত্যাগ করলে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে। রমজানের রোজা কোন কারণে বা অবহেলা করে করা না হলে তার কাযা করাও ফরজ। এ ফরজ কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, যখনই সুযোগ হবে করতে হবে। বরঞ্চ যথা শীঘ্র করা উচিত।

 

২. ওয়াজিব রোজা- মানতের রোজা, কাফফারার রোজা ওয়াজিব।কোন নির্দিষ্ট দিনে রোজ রাখার মানত করলে সেই দিনে রোজা রাখা জরুরী। দিন নির্দিষ্ট না করলে যে দিন ইচ্ছা করা যয়। বিনা কারণে বিলম্ব করা ঠিক নয়।

 

৩. সুন্নাত রোজা- যে রোজা নবী (স) স্বয়ং করেছেন এবং করতে বলেছেন তা সুন্নাত। তা রাখার বিরাট সওয়াব রয়েছে। কিন্তু তা সুন্নাতে মুয়ক্কিদাহ নয় এবং না করলে গোনাহ হবে না। সুন্নাত রোজা নিম্নরূপ:

 

  •  
  • আশুরার রোজা।অর্থাৎ মুহররমের নয় তারিখ এবং দশ তারিখে দুটি রোজা।
  •  
  • আরাফার দিনের রোজা। অর্থাৎ যুলহজ্জের নয় তারিখে রোজা।
  •  
  • আইয়াম বীযের রোজা। অর্থাৎ চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা।
  •  

 

৪. নফল রোজা- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত বাদে সব রোজা নফল বা মোস্তাহাব। নফল রোজা এমন যে, তা নিয়মিত করলে বিরাট সওয়াব পাওয়া যায়। যেমনঃ

 

  •  
  • শাওয়াল মাসের ছটি রোজা।
  •  
  • সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা।
  •  
  • শাবানের ১৫ই তারিখের রোযা।
  •  
  • যুলহজ্জ মাসের প্রথম আট রোজা।
  •  

 

৫. মাকরূহ রোজা-

 

  •  
  • শুধু শনি অথবা রবিবার রোজা রাখা।
  •  
  • শুধু আশুরার দিন রোজা রাখা।
  •  
  • স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে রোজ রাখা।
  •  
  • মাঝে কোন দিন বাদ না দিয়ে ক্রমাগত রোজা রাখা যাকে সাওমে ভেসাল বলে।
  •  

 

৬. হারাম রোজা-বছরে পাঁচদিন রোজা রাখা হারাম

 

  •  
  • ঈদুল ফিতরের দিন রোজা ।
  •  
  • ঈদুল আযহার নে রোজা।
  •  
  • আইয়ামে তাশরীকে রোজা রাখা অর্থাৎ ১১ই, ১২ই, ১৩ই যুলহাজ্জ তারিখে রোজা রাখা হারাম।
  •  

 

রোজার শর্তাবলী

 

রোজার শর্ত দুইপ্রকার:

 

  •  
  • রোজা সহীহ হওয়ার শর্ত।
  •  
  • রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত।
  •  

 

রোজা ওয়াজিব হওয়ার জন্য যেসব জিনিষের প্রয়োজন তাকে শারায়াতে সিহহাত বলে এবং হওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তাকে শারায়াতে অযুব বলে।

 

রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত

 

১. ইসলাম।কাফেরের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।

 

২. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।

 

অবশ্যি অভ্যাস সৃষ্টি করার জন্য নাবালেগ ছেলেমেয়েদের উপর রোজা রাখতে বলা উচিৎ। যেমন নামাজ পড়বার অভ্যাস করবার তাগিদ হাদীসে করা হয়েছে। তেমনি রোজা রাখবার জন্যও প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। যারা ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করতে পারে তাদেরকেই শুধু রোজা রাখতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

 

৩. রমজানের রোজা ফরজ হওয়া সম্বন্ধে জানা থাকা।

 

৪. মাযুর বা অক্ষম না হওয়া। অর্থাৎ এমন কোন ওজর না থাকা যাতে রোজা না থাকার অনুমতি রয়েছে, সফর, বার্ধক্য, রোগ, জিহাদ, ইত্যাদি।

 

রোজা সহীহ হওয়ার শর্তাবলী

 

১. ইসলাম। কাফেরের রোজা সহীহ নয়।

 

২. মহিলাদের হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া।

 

৩. নিয়ত করা। অর্থাৎ মনে মনে রোজা রাখার ইরাদা করা। রোজা রাখার ইরাদা ছাড়া কেউ সারাদিন যদি ঐসব জিনিস থেকে বিরত থাকে যার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তাহলে তার রোজা হবে না।

 

 

 

রোজার ফরয

 

রোজার মধ্যে সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকা ফরজ।

 

১. কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা।

 

২. কিছু পান করা থেকে বিরত থাকা।

 

৩. যৌন বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকা।

 

যৌনবাসনা পূরণের মধ্যে ঐসব যৌন সম্ভোগ শামিল যার দ্বারা বীর্যপাত হয়, তা স্ত্রী সংগমের দ্বারা হোক বা যে কোন মানুষ, পশু প্রভৃতির সাথে যৌন ক্রিয়ার দ্বারা হোক। অথবা হস্তমৈথুনের দ্বারা হোক। মোটকথা এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্যি আপন স্ত্রীকে দেখা আদর করা, জড়িয়ে ধরা অথবা চুমু থেকে বিরত থাকা ফরজ নয়। কারণ তাতে বীর্যপাত হয় না।

 

রোযার সুন্নাত ও মোস্তাহাব

 

১. সিহরীর ব্যবস্থা করা সুন্নাত, কয়েকটি খেজুর হোক বা এক চুমুক পানি হোক।

 

২. সিহরীর সময় খাওয়া মোস্তাহাব।সুবহে সাদিক হতে যখন সামান্য বাকি।

 

৩. রোজার নিয়ত রাতেই করে নেওয়া মোস্তাহাব।

 

৪. ইফতার তাড়াতাড়ি করা মোস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অথবা বিলম্ব না করা।

 

৫. খুরমা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা মোস্তাহাব।

 

৬. গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা বল, রাগ এবং বাড়াবাড়ি না করা সুন্নাত। এ কাজ অবশ্যি অন্য সময় করাও ঠিক নয়। কিন্তু রোজার সময় তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা বেশী করে করা উচিৎ।

 

কি কি কারণে রোজা নষ্ট হয়

 

রোযা অবস্থায় তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকা ফরয, যথাঃ

 

(১) কিছু না খাওয়া (২) কিছু পান না করা এবং (৩) যৌনবাসনা পূর্ণ না করা। এসব থেকে বিরত থাকা ফরয।

 

অতএব উপরোক্ত তিনটি ফরযের খেলাপ কাজ করলেই রোযা নষ্ট হয়। যেসব জিনিস রোযা নষ্ট করে তা আবার দু প্রকার। এক - যার দ্বারা শুধু কাযা ওয়াজিব হয়। দুই-যার দ্বারা কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়।

 

কাফফারা ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে কিছু নীতিগত কথা

 

১. কোনো কিছু ইচ্ছা করে পেটে প্রবেশ করালে এবং তা উপকারী হওয়ার ধারণাও যদি থাকে, তা খাদ্য হোক, ঔষধ হোক অথবা এমন কাজ হোক যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো, তাহলে এসব অবস্থায় কাযা এবং কাফফারা দুই ওয়াজিব হয়।

 

২. কোনো কিছু যদি আপনা আপনি পেটের মধ্যে চলে যায়, তার উপকারী হওয়ার ধারনাও না থাকে, অথবা এমন কোনো কাজ করা হলো যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো নয়, তাহলে শুধু মাত্রা কাযা ওয়াজিব হবে।

 

৩. শুধু রমযানের রোযা নষ্ট হলেই তার কাফফারা ওয়াজিব হয়, রমযান ছাড়া অন্য রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, তা ভুলক্রমে নষ্ট হোক অথবা ইচ্ছা করে নষ্ট করা হোক।

 

৪. রমযানের কাযা রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু রমাযান মাসে রোযা নষ্ট হলে কাফফারা ওয়াজিব হবে।

 

৫. যাদের মধ্যে রোযা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় না, তাদের রোযা নষ্ট হলেও কাফফারা ওয়াজিব হবে না। যেমন, মুসাফিরের রোযা, হায়েয নেসাফ ওয়ালী মেয়েদের রোযা। যদিও মুসাফির এবং হায়েয নেফাস ওয়ালী মেয়েলোক রোযার নিয়ত সফর শুরু করার আগে এবং হায়েয নিফাস হওয়ার আগে করে থাকে।

 

৬. যে কোনো কাজ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়, যেমন ভুল করে কেউ কিছু খেয়ে নিলো, অথবা যৌন ক্রিয়া করলো, অথবা কুল্লি করতে হঠাৎ পানি গলার ভেতর চরে গেল, অথবা কেউ জবরদস্তি করে যৌন ক্রিয়া করালো তাহলে এসব অবস্থায় কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

 

৭. যৌনক্রিয়ায় ক্রিয়াকারী এবং যার ওপর কারা হলো এ উভয়ের জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। উভয়ের মধ্যে যে জ্ঞানসম্পন্ন এবং স্বেচ্ছায় এ কাজ করবে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে। নারী জ্ঞানসম্পন্ন হলে কাফফারা তাকে দিতে হবে পুরুষকে নয়। আবার পুরুষ জ্ঞানসম্পন্ন হলে তাকে কাফফারা দিতে হবে, মাথা খারাপ পাগল মেয়ে মানুষের ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

 

৮. কোনো মেয়েলোক নাবালক ছেলে দ্বারা যৌন ক্রিয়া করে নিলে অথবা কোনো পাগলের দ্বারা, তার ওপর কাযা ও কাফফারা দুটিই ওয়াজিব হবে।

 

৯. রমযানে রোযার নিয়ত ব্যতিরেকে কেউ খানা-পিনা করলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। কাফফারা তখনই ওয়াজিব যদি রোযার নিয়ত করার পর তা নষ্ট করে।

 

১০. কোনো সন্দেহের কারণে কেউ রোযা নষ্ট করলে কাফফারা দিতে হবে না।

 

যেসব ব্যাপারে শুধু রোযা কাযা করতে হবে

 

১. কারো বিলম্বে ঘুম ভাঙল এবং সিহরীর সময় আছে মনে করে খানা পিনা করলো। তাপর দেখলো যে ভোর হয়ে গেছে। তাহলে সে রোযার কাযা করা ওয়াজিব হবে।

 

২. কেউ বেলা ডোবার আগেই সূর্য ডুবেছে মনে করে ইফতার করলো। তাহলে কাযা করতে হবে।

 

৩. অনিচ্ছায় কোনো কিছু পেটের মধ্যে গেল, যেমন কুল্লি করতে গিয়ে গলার ভেতর পানি চলে গেল, নাকে বা কানে ওষুধ দিল তা পেটের মধ্যে গেল, পেট বা মাথার ঘায়ে ওষুধ দেয়া হলো, তা পেটে বা মাথার মধ্যে ঢুকলো এসব অবস্থায় কাযা ওয়াজিব হবে।

 

৪. কেউ রোযাদারকে জোর করে খাইয়ে দিল তাহলে শুধু কাযা করতে হবে।

 

৫. কেউ কোনো নারীর সাথে জোর করে সহবাস করলো অথবা মেয়ে মানুষ অঘোরে ঘুমচ্ছিল অথবা বেহুশ হয়ে ছিল কেউ তার সাথে সহবাস করলো, তাহলে সে মেয়েলোকটির শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

 

৬. কোনো নির্বোধ লোক কোনো মৃত নারী অথবা অল্প বয়স্ক বালিকা অথবা কোনো পশুর সাথে যৌন ক্রিয়া করলো, অথবা কাউকে ঝাপটে ধরলো, অথবা চুমো দিল অথবা হস্তমৈথুন করলো এবং এসব অবস্থায় বীর্যপাত হলো তাহলে শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

 

৭. কেউ রোযার নিয়তই করলো না কিন্তু খানাপিনা থেকে বিরত থাকলো অথবা নিয়ত করলো কিন্তু দুপুরের পর, তাহলে এমন অবস্থায় রোযা হবে না, কাযা ওয়াজিব হবে।

 

৮. রোযা অবস্থায় কারো মুখে চোখের পানি অথবা ঘাম ঢুকলো এবং লবণাক্ত অনুভব করলো এবং তা গিলে ফেললো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা করতে হবে।

 

৯. মুখে পান রেখে কেউ ঘুমিয়ে পড়লো তারপর সুবেহ সাদেকের পর ঘুম ভাঙল, তাহলে শুধু কাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

 

১০. রোযার মধ্যে মুখ ভরে বমি করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে, কাযা করতে হবে।

 

১১. কেউ রোযা অবস্থায় কোনো পাথর বা লোহার টুকরো এবং এমন কোনো জিনিস খেয়ে ফেললো যা না আহার হিসেবে খায়, না ওষুধ হিসেবে, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা করতে হবে।

 

১২. কোনো স্ত্রীলোক রোযার মধ্যে তার গুপ্তাংগে কোনো ওষুধ বা তেল দিল, তাহলে শুধু কাযা করতে হবে।

 

১৩. কেউ রোযা রেখে ভুলে কিছু খেয়ে ফেললো, তারপর রোযা নষ্ট হয়েছে মনে করে ইচ্ছা করেই খানাপিনা করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে, কাযা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।

 

১৪. কেউ রোযা রেখে কানে তৈল দিল অথবা জুলাপ নিল, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা করতে হবে।

 

১৫. কোনো মেয়ে মানুষ চিকিৎসা প্রভৃতির জন্যে তার আঙ্গুল লজ্জাস্থানে প্রবেশ করালো অথবা কোনো দাইয়ের দ্বারা প্রবেশ করালো তাপর সমস্ত আঙ্গুল বা তার কিছুটা বের করে পুনরায় ঢুকালো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে। আর যদি পুনরায় প্রবেশ না করায় কিন্তু আঙ্গুল কোনো কিছুতে ভিজে গেল তাহলে প্রথমবার ঢুকালেই রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে যদি কোনো মেয়ে মানুষ তার লজ্জাস্থানে তুলা প্রভৃতি রাখে এবং সবটুকু ভেতরে ঢুকে পড়ে, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে।

 

১৬. সহবাস ব্যতিরেকে যৌন সম্ভোগের এমন কোনো কাজ করলো যাতে সাধারণত বীর্যপাত হয়, যদি বীর্যপাত হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। যেমন কেউ হস্তমৈথুন করলো, অথবা কেউ স্ত্রীর নাভিতে, উরুতে অথবা বগলে তার পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করিয়ে বীর্যপাত করলো, অথবা কোনো পশুর সাথে এ কাজ করলো, অথবা কোনো স্ত্রীলোক অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সাথে যৌন আনন্দের চেষ্টা করলো এবং বীর্যপাত হলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

 

১৭. মিসওয়াক করার সময় অথবা এমনিতেই দাঁতের রক্ত বেরুলো এবং রোযা থাকা অবস্থায় তা থুথুসহ গিলে ফেললো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে।কিন্তু রক্ত যদি থুথুর পরিমাণ থেকে কম হয় এবং গলায় তা অনুভব করা গেল না, তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

 

 

 

যে যে অবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়

 

১. কেউ রোযার মধ্যে উত্তেজনা বসে যৌন ক্রিয়া করে বসলো, সে নারী হোক বা পুরুষ অথবা কোনো পুরুষ সমমৈথুন করলো, তাহলে কাযা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

 

২. কোনো নারী পুরুষের শয্যা সঙ্গিনী হলো এবং পুরুষাঙ্গের মাথা তার লজ্জা স্থানে প্রবেশ করলো, এমন অবস্থায় বীর্যপাত হোক বা না হোক কাযাও ওয়াজিব হবে এবং কাফফারাও।

 

৩. কোনো নির্বোধ তার স্ত্রীর পাশে শয়ন করে তার পশ্চাদ্বারে তার পুরুষাঙ্গ ঢুকালো, তাহলে উভয়ের রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

 

৪. কেউ রোযা রেখে এমন কিছু খেলো বা পান করলো যা খাওয়া এবং পান করা হয়, অথবা এমন জিনিস খেলো যা আহার হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু ওষুধ হিসেবে খেলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

 

৫. স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে অথবা বেহুশ হয়ে আছে, স্বামী তার সাথে সহবাস করলো, তাহলে স্বামী বা পুরুষের কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে।

 

৬. কেউ এমন কিছু কাজ করলো যাতে রোযা নষ্ট হয় না। কিন্তু মনে করলো যে রোযা নষ্ট হয়েছে এবং তারপর খানাপিনা করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযাও করতে হবে, কাফফারাও করতে হবে।

 

যেমন ধরুন, কেউ সুরমা লাগালো, অথবা মাথায় তেল দিল, অথবা মেয়ে মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরলো অথবা চুমো দিল, তারপর মনে করলো যে রোযা নষ্ট হয়েছে এবং সে তারপর ইচ্ছা করেই খানাপিনা করলো, তাহলে এ অবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

 

যেসব জিনিসে রোযা মাকরূহ হয়

 

অর্থাৎ ঐসব জিনিসের বর্ণনা যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না বটে কিন্তু মাকরূহ হয়। এসব মাকরূহ তানযিহী, তাহরীমি নয়।

 

১. কোনো জিনিসের আস্বাদ গ্রহণ করা। তবে যদি কোনো মেয়েলোক বাধ্য হয়ে খাবার জিনিস চেখে দেখে অথবা বাজার থেকে খরিদ করার সময় এ জন্যে চেখে দেখে যে, তার স্বামী বড়ো বদমেজাজি এবং কঠোর অথবা কোনো চাকরানী তার মনিবের ভয়ে চেখে দেখে, তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

২. মুখে কোনো কিছু চিবানো অথবা এমনি দিয়ে রাখা, যেমন কোনো মেয়ে মানুষ ছোটো বাচ্চাকে খাওয়াবার জন্যে মুখে নিয়ে কোনো কিছু চাবায় অথবা নরম করার জন্যে বা ঠাণ্ডা করার জন্যে মুখে রাখে তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না। অবশ্যি বাধ্য হয়ে এসব করা জায়েয। যেমন কারো বাচ্চার খিদে পেয়েছে এবং সে শুধু সে জিনিসই খায় যা মুখে দিয়ে চিবিয়ে দিতে হয় এবং বেরোজাদার লোকও নেই, তাহলে এ অবস্থায় চিবিয়ে দিলে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

৩. কোনো মেয়েলোকের ওষ্ঠ (ঠোট) মুখের মধ্যে নেয়া অথবা উলঙ্গ অবস্থায় জড়িয়ে ধরা মাকরূহ--বীর্যপাত হওয়ার ও সহবাস করার আশংকা থাক বা না থাক।

 

৪. রোযা রেখে এমন কোনো কাজ করা মাকরূহ যার দ্বারা শরীর এতোটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে, রোযা ভেঙ্গে ফেলার আশংকা হয়।

 

৫. কুল্লি করার সময় বা নাকে পানি দেয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা।

 

৬. বিনা কারণে মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা।

 

৭. অস্থিরতা প্রকাশ করা, ঘাবড়িয়ে যাওয়া এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রকাশ করা।

 

৮. গোসলের প্রয়োজন হলো এবং সুযোগও ছিল কিন্তু বিনা কারণে সুবেহ সাদেকের পর পর্যন্ত গোসল করলো না। তাহলে রোযা মাকরূহ হবে।

 

৯. মাজন, পেস্ট অথবা কয়লা প্রভৃতি চিবিয়ে দাঁত মাজলে রোযা মাকরূহ হবে।

 

১০. রোযা রেখে গীবত করলে, মিথ্যা বললে, গালিগালাজ ও মারপিট অথবা কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করলে রোযা মাকরূহ হবে।

 

১১. ইচ্ছা করে মুখের মধ্যে ধুয়া অথবা ধুলাবালি গ্রহণ করা মাকরূহ। আর যদি লোবান জ্বালিয়ে তার ঘ্রাণ নেয়া হয় অথবা হুক্কা, বিড়ি, সিগারেট খাওয়া হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

 

যেসব জিনিস রোযা মাকরূহ হয় না

 

১.রোযার খেয়াল নেই এমন অবস্থায় কেউ ভুলে খানাপিনা করলে এমনকি ভুলে স্ত্রীসহবাস করলে-এমনকি ভুলে একাধিকবারও করলে এবং ভুলে পেট ভরে আহার করলে রোযা নষ্ট হবে না এবং মাকরূহ হবে না।

 

২. রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় যদি স্বপ্নদোষ হয় এবং গোসল ফরয হয় তথাপি রোযা মাকরূহ হবে না।

 

৩. দিনের বেলায় সুরমা লাগানো, তেল মাথায় দেয়া, শরীরে তেল মালিশ করা, খুশবু গ্রহণ করা জায়েয, সুরমা লাগাবার পর কাশির মধ্যে যদি সুরমার চিহ্ন দেখা যায়, তথাপি রোযা নষ্ট হবে না।

 

৪. স্ত্রীর সাথে শুয়ে থাকা, দেহ জড়িয়ে ধরা, চুমো দেয়া সবই জায়েয। তবে যদি বীর্যপাতের আশংকা হয় অথবা কামোত্তেজনা বশে সহবাসের আশংকা হয় তাহলে এসব মাকরূহ হবে।

 

৫. থুথু ফেলা ও গিলা মাকরূহ নয়।

 

৬. গলার মধ্যে মাছি ঢুকে পড়লো অথবা আপনা আপনি ধুলাবালি বা ধূয়া ঢুকলো তাতে রোযা মাকরূহ হবে না। তবে ইচ্ছা করে এসব পেটের মধ্যে গ্রহণ করলে রোযা নষ্ট হবে।

 

৭. কোনো মেয়েলোকের গুপ্তাংগ দেখার পর অথবা যৌনবাসনা মনে জাগ্রত হওয়ার পর বীর্যপাত হলে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

৮. কোনো পশুর স্ত্রীলিঙ্গ স্পর্শ করার পর যদি বীর্যপাত হয় তবুও রোযা নষ্ট হবে না।

 

৯. পুরুষের গুপ্তাংগের ছিদ্রে তেল, পানি অথবা ঔষধ দেয়া অথবা পিচকারী দিয়ে এসব পৌঁছানো অথবা দিয়াশলাই যা সুরমাদানির কাঠি প্রবেশ করানো জায়েয এবং এতে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

১০. যদি কেউ তার পশ্চাৎদ্বারে আঙ্গুলি অথবা শুকনো কাঠ ঢুকায় এবং শুকনো কাঠ ভেতরে চরে না যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

 

১১. কেউ মনে করলো যে এখনো রাত আছে এবং স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হলো, অথবা রোযার খেয়াল নেই সহবাস শুরু করলো, তারপর হঠাৎ মনে হলো যে, সুবহে সাদেক হয়েছে অথবা রোযার কথা মনে হলো এবং সংগে সংগে স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত হলো। স্ত্রী থেকে পৃথক হওয়ার পরও যদি বীর্যপাত হয় তবুও রোযা নষ্ট হবে না।এ বীর্যপাত স্বপ্নদোষের বীর্যপাতের মতো মনে করা হবে।

 

১২. কানের ভেতর পানি চলে গেলে অথবা ইচ্ছা করে দিলে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

১৩. দাঁতের মধ্যে খাদ্য, গোশতের টুকরো কোনো আশ অথবা সুপারির টুকরো রয়ে গেল এবং মুখ থেকে বের করা হলো না বরঞ্চ সেখান থেকে গিলে ফেললো, এখন পরিমাণ যদি ছোলা থেকে কম হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

 

১৪. অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখভরে বমি হলো- কম হোক বেশী হোক তাতে রোযা মাকরূহ হবে না।। কিছু পেটের মধ্যে আপনা আপনি ঢুকে পড়লেও রোযা মাকরূহ হবে না।

 

১৫. রোযা রেখে যে কোনো সময়ে মিসওয়াক করলে, তা শুকনো হোক, ভিজা হোক অথবা টাটকা হোক এমনকি নিমের তাজা মিসওয়াকের তিক্ত স্বাদ অনুভব করলেও রোযা মাকরূহ হবে না।

 

১৬. অধিকমাত্রা গরমে কুল্লি করা, নাকে পানি দেয়া, হাত মুখ ধোয়া, গোসল করা, ভিজে কাপড় গায়ে দেয়া মাকরূহ হবে না।

 

১৭. পান খাওয়ার পর ভালো করে কুল্লি ও গড়গড়া করা হয়েছে কিন্তু থুথুর মধ্যে লাল আভা দেখা যাচ্ছে তাতে রোযা মাকরূহ হবে না।

 

১৮. ইচ্ছা করে বমি করলে তা যদি সামান্য হয় এবং মুখ ভরে না হয় তাহলে রোযা নষ্টও হবে না, মাকরূহ হবে না।

 

১৯. মিসওয়াক করার সময় অথবা আপনা আপনি মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় এবং তা যদি গিলে ফেলা হয় এবং রক্তের পরিমাণ থুথু থেকে কম হয় গলায় রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না

 

রোযার নিয়তের মাসয়ালা

 

১. নিয়ত করার অর্থ মনে মনে এরাদা করা, মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরী নয়, শুধু মনের মধ্যে ইচ্ছা করাই যথেষ্ট। বরঞ্চ সেহরি খাওয়াটাই নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। এজন্যে যে রোজার জন্যই সেহরি খাওয়া হয়। অবশ্যি যারা ঐ সময় খেতে সাধারণত অভ্যস্ত অথবা যেসব নাদান নিয়মিত সেহরি খায় কিন্তু রোজা রাখে না, তাদের জন্য নিয়ত করা জরুরী।

 

২. রমজানের প্রত্যেক রোজার জন্য আলাদা নিয়ত করা জরুরী। গোটা রমজানের জন্য একবার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।

 

৩. রমজানের চলতি রোজার জন্য ফরজ বলে নিয়ত কার জরুরী নয়। শুধু রোজার নিয়ত করাই যথেষ্ট। কিন্তু কোন রোগী রমজানের রোজা রাখলে সে ফজরের নিয়ত করে। কারণ তার উপর রমজানের রোজা ফরজ নয়। যদি শুধু রোজার নিয়ত করে অথবা নফল রোজার নিয়ত করে তাহলে তার রোজা রমজানের রোজা হবে না।

 

৪. মুসাফিরের জন্য জরুরী যে রমজানে সে যেন অন্য কোন ওয়াজিব রোজার নিয়ত না করে। যেন রমজানের ফরজ রোজার নিয়ত করে অথবা নফল রোজার নিয়ত করে তা দুরস্ত হবে না।

 

৫. রমজানের কাযা রোজার জন্য নির্দিষ্ট করে ফজরের নিয়ত করা জরুরী।

 

৬. কেউ রাতে রোজার নিয়ত করতে ভুলে গেল দিনের বেলায় মনে হলো, তাহলে তিন ধরনের রোজায় দুপুরের পূর্বে নিয়ত করলে দুরস্ত হবে।

 

ক. রমজানের চলন্ত রোজার জন্য।

 

খ.মানতের ওসব রোজার জন্য যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

 

গ. নফল রোজার জন্য।

 

৭. নিম্নে চার প্রকারের রোজার জন্য সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত নিয়ত করা জরুরী। সুবহে সাদেকের পর নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।

 

ক.রমজানের কাযা রোজায়।

 

খ. মানতের ঐসব রোজায় যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট নয়।

 

গ. কাফফারার রোজায়।

 

ঘ. ঐসব নফল রোজার কাযায় যা শুরু করার পর কোন কারণে নষ্ট হয়েছে।

 

৮. রাতে রোজা রাখার নিয়ত ছিল না। সকালেও রোজা রাখার খেয়াল ছিল না, তারপর দুপুরের আগে হঠাৎ মনে পড়লো যে, রমজানের রোজা ছাড়া ঠিক নয় এবং তড়িঘড়ি করে নিয়ত করে ফেলল, তাহলে রোজা দুরস্ত হবে। কিন্তু সকালে যদি কিছু খেয়ে থাকে তাহলে তো নিয়ত করার কোনো অবকাশই রইলো না।

 

৯. রমযান মাসে কেউ ফরয রোযার পরিবর্তে নফল রোযার নিয়ত করলো এবং মনে করলো যে পরে ফরয রোযার কাযা করে নেবে। তথাপি সে রোযা রমযানের রোযাই হবে। নফল রোযা হবে না। এমনি নফল রোযার পরিবর্তে ওয়াজিব রোযার যদি নিয়ত করে,তথাপি রমযানের রোযা হবে। নীতিগত এক এই যে, রমযানে শুধু রমযানের ফরয রোযাই হবে,অন্য রোযা হবে না।

 

১০. রোযা সুবেহ সাদেক থেকে শুরু হয়। অতএব সুবেহ সাদেকের পূর্বে এ সকল কাজ জায়েয যার থেকে বিরত থাকা রোযার মধ্যে ফরয। কেউ মনে করে যে, রোযার নিয়ত করার পর কিছু খাওয়া দাওয়া করা জায়েয নয়। একথা ঠিক নয়। সুবেহ সাদেকের পূর্বে খাওয়া দাওয়া প্রভৃতি জায়েয-যদিও সূর্যাস্তের পরই পরের দিনের রোযার নিয়ত করা হয়ে থাকে।

 

১১. নফল রোযার নিয়ত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। সকালে নিয়ত করার পর যদিও তা ভেঙ্গে ফেলা হয় তাহলে সে রোযার কাযা ওয়াজিব হবে।

 

১২. কেউ রাতে এরাদা করলো যে, পরদিন রোযা রাখবে। কিন্তু সকাল হওয়ার পূর্বেই ইচ্ছা পরিবর্তন করলো এবং রোযা রাখলো না। এ অবস্থায় কাযা ওয়াজিব হবে না।

 

১৩. রাতে নিয়ত করলে বলবে ..... আরবী ........ আমি আগামীকাল মাহে রমযানের রোযা রাখার নিয়ত করলাম। দিনে নিয়ত করলে বলবে .......... আরবী ........ মাহে রমযানের আজকের দিনের রোযার নিয়ত করছি। কিন্তু আরবীতে নিয়ত করা জরুরী নয়, যে কোনো ভাষায় বলা যায়।

 

 

 

সিহরী ও ইফতার

 

রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদেকের পূর্বে যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকে সিহরী বলে। নবী (স) স্বয়ং সিহরীর ব্যবস্থাপনা করতেন এবং অন্যকেও সিহরী খাওয়ার তাকীদ করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) সিহরীর সময় আমাকে বলতেন, আমার রোযা রাখার ইচ্ছা আমাকে কিছু খেতে দাও। তখন আমি তাকে কিছু খেজুর এবং এক বাটি পানি খেতে দিতাম।

 

নবী (স) সিহরীর তাকীদ করতে গিয়ে বলেন, সিহরী খেয়ো এজন্য যে, এতে বিরাট বরকত রয়েছে।

 

বরকত বলতে এই যে, দিনের কাজকর্মে এবং ইবাদাত বন্দেগীতে দুর্বলতা মনে হবে না এবং রোযা সহজ হবে।

 

একবার নবী (সা) বলেনঃ দিনে রোযা রাখার জন্যে সিহরী খাওয়া দ্বারা সাহায্য নাও এবং রাতের ইবাদাতের জন্যে কায়লূলা দ্বারা সাহায্য নিও।

 

সিহরী খাওয়া সুন্নাত। মুসলমান এবং ইহুদী নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তারা সিহরী খায় না, মুসলমান খায়, ক্ষিধে না হলে কিছু মিষ্টি, অথবা দুধ অথবা পানি খেয়ে নেয়া উচিত এজন্যে সিহরী খাওয়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব আছে।

 

নবী (স) বলেন, সিহরী খাওয়া প্রত্যক্ষ বরকত। সিহরী খেতে ভুলো না, তা এক চুমুক পানি হোক না কেন। কারণ সিহরী যারা খায় তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্যে এস্তেগফার করেন।

 

সিহরী বিলম্বে করা

 

সুবহে সাদেক হতে সামান্য বাকী আছে এতোটা বিলম্ব করে সিহরী খাওয়া মুস্তাহাব।অনেকে সাবধানতার জন্যে অনেক আগে সিহরী খায়। এটা ভালো নয়। বিলম্বে খাওয়াতে সওয়াব আছে।

 

ইফতার তাড়াতাড়ি করা

 

ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সাবধানতার জন্যে বিলম্ব করা মনাসিব নয়, বরঞ্চ তৎক্ষণাৎ ইফতার করা উচিত। এভাবে অপ্রয়োজনীয় সাবধানতার ফলে দ্বীনি মানসিকতা লোপ পায়। এটা দীনদারি নয় যে, লোক অযথা নিজেদেরকে কষ্টে ফেলবে। বরঞ্চ দীনদারি হচ্ছে এই যে, বিনা বাক্যে ব্যয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে।

 

নবী (স) বলেন, তিনটি বিষয় পয়গম্বরসুলভ আচরণের শামিলঃ

 

১. সিহরী বিলম্বে খাওয়া।

 

২. ইফতার তাড়াতাড়ি করা।

 

৩. নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।

 

হযরত ইবনে আবি আওফা(রা) বলেন, আমরা একবার সফরে নবী (স) এর সাথী ছিলাম। তিনি রোযা ছিলেন। যখন সূর্য দৃষ্টির আড়াল হলো তখন তিনি একজনকে বললেন, ওঠ আমার জন্যে ছাতু গুলে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আর  একটু দেরী করুন সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভালো হয়। এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নাম এবং আমাদের জন্যে ছাতু গুলে দাও। সে আবার বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ,এখনো দিন আছে বলে মনে হচ্ছে। আবার এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নেমে পড় এবং আমাদের জন্যে ছাতু তৈরী করে দাও। তখন সে নামলো এবং সকলের জন্যে ছাতু তৈরী করলো। নবী (সা) ছাতু খেয়ে বললেন, তোমরা যখন দেখবে যে রাতের কালো ছায়া ওদিক থেকে ছেয়ে আসছে তখন রোযাদারের রোযা খোলা উচিত।(বুখারী)

 

নবী (স) বলেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, আমার বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐ বান্দাহকে আমার পছন্দ হয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। (তিরমিযি) (অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কিছুতেই বিলম্ব করো না।)

 

নবী (স) আরো বলেন, লোক ভালো অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করতে থাকবে। (বুখারী, মুসলিম)

 

কোন জিনিস দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব

 

খেজুর এবং খুরমা দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব তা না হলে পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।নবী (স)স্বয়ং এসব দিয়ে ইফতার করতেন।

 

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) মাগরিবের নামাযের পূর্বে কয়েকটি ভিজানো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না হলে খুরমা দিয়ে। তাও না হলে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

 

এসব জিনিস দিয়ে ইফতার করার জন্যে নবী (স) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ রোযা রাখলে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। তা না হলে পানি দিয়ে। আসলে পানি অত্যন্ত পবিত্র। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)

 

খেজুর ছিল আরবের উপাদেয় খাদ্য এবং ধনী গরীব সকলেই তা সহজেই লাভ করতো। আর পানি তো সর্বত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এসব দিয়ে ইফতার করার জন্যে প্রেরণা দেয়ার তাৎপর্য এই যে, উম্মত যেন কোনো কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সময় মতো সহজেই রোযা খুলতে পারে। পানির একটা বৈশিষ্ট্য নবী (স) বলেন যে, তা এতোটা পাক যে তার দ্বারা সবকিছু পাক করা যায়। বাহ্যিক পাক তো অনুভবই করা যায়। তার সাথে রূহানী পবিত্রতাও হয়। রোযাদার যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সচেতন ঈমানের সাথে সারাদিন তৃষ্ণার্ত থেকে এবং সূর্যাস্তে ঠান্ডা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে শোকর গুজারির প্রেরণা সৃষ্টি হয় যার দ্বারা তার বাতেন বা আধ্যাত্মিক দিক আলোকিত করার সৌভাগ্য হয়।

 

কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা এবং অন্য কোনো জিনিস দিয়ে ইফতার করা তাকওয়ার খেলাফ মনে করা একেবারে ভুল। এমনি এ ধারণা করাও ভুল যে লবণ দিয়ে ইফতার করা বড়ো সওয়াবের কাজ।

 

ইফতারের দোয়া

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ তোমার জন্য রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।

 

ইফতারের পরের দোয়া

 

*******আরবী*********

 

পিপাসা চলে গেলে, রগ শো ঠিক হয়ে গেল এবং আল্লাহ চাইলে প্রতিদানও অবশ্যই মিলবে। (আবু দাউদ)

 

ইফতার করাবার সওয়াব

 

অন্যকে ইফতার করানোও পছন্দনীয় আমল এবং ইফতার যে করায় তাকেও ততোটা সওয়াব দেয়া হয় যতোটা দেয়া হয় রোযাদারকে। তা রোযাদারকে দু লোকমা খানা খাইয়ে দেয়া হোক অথবা একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হোক।

 

নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের মতোই সওয়াব পাবে। (বায়হাকী)

 

সিহরী ছাড়া রোযা

 

রাতে সিহরীর জন্যে যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তবুও রোযা রাখা উচিত। সিহরী খাওয়া না হলে রোযা না রাখা কাপুরুষের কাজ। সিহরী না খাওয়ার জন্যে রোযা ছেড়ে দেয়া বড় গোনাহের কাজ।

 

যদি কখনো দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে এবং মনে হয় যে, রাত বাকী আছে এবং কিছু খানাপিনা করা হলো। তারপর দেখা গেল যে, সুবহে সাদেকের পর খানাপিনা করা হয়েছে। তাহলে এ অবস্থায় যদিও রোযা হবে না, তথাপি রোযাদারের মতোই থাকতে হবে কিছু পানাহার করা যাবে না।

 

এতো বিলম্বে যদি ঘুম ভাঙ্গে যে, সুবহে সাদেক হওয়ার সন্দেহ হয় তাহলে এমন সময় খানাপিনা মাকরূহ এবং সন্দেহ হওয়ার পর খানাপিনা গোনাহর কাজ। পরে সত্যি সত্যিই জানা গেল যে, সুবেহ সাদেক হয়েই গেছে তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে। কিন্তু সন্দেহেই যদি থেকে যায় তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে না। তবে সতর্কতার জন্যে কাযা করবে।

 

 

 

যেসব ওজরের কারণে রোযা না রাখার অনুমতি আছে

 

যেসব ওজরের কারণে রোযা না রাখার অনুমতি আছে তা হলো দশটি। তার বিবরণ নিম্নরূপ:

 

(১) সফর, (২) রোগ (৩) গর্ভধারণ (৪) স্তন্যদান (৫) ক্ষুধা তৃষ্ণার প্রাবল্য (৬) বার্ধক্য ও দুর্বলতা (৭) জীবন নাশের ভয় (৮) জেহাদ (৯) বেহুঁশ হওয়া (১০) মম্তিষ্ক বিকৃতি।

 

১। সফর

 

শরীয়াত তার যাবতীয় হুকুমের মধ্যে বান্দাহর সহজসাধ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। কোনো ব্যাপারেও তাকে অযথা কষ্ট ও সংকীর্ণতার সম্মুখীন করা হয়নি। বস্তুত কুরআন পাকে রোযা ফরয হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করতে গিয়ে মুসাফির ও রোগীর অক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং রোযা না রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

 

*******আরবী*********

 

অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে যেন রোযা রাখে। আর যে ব্যক্তি রোগী অথবা সফরে আছে, সে অন্যান্য দিনে রোযা রেখে তার হিসেব পুরো করবে। (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৫)

 

১. সফর যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, এবং তার মধ্যে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থাক অথবা দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হোক, সকল অবস্থায় মুসাফিরের রোযা না রাখার অনুমতি আছে। অবশ্যই যে সফরে কোনো অসুবিধা নেই, তাতে রোযা রাখাই মুস্তাহাব যাতে করে রমযানের ফযিলত ও বরকত লাভ করা যায়। কিন্তু পেরেশানি ও অসুবিধা হলে রোযা না রাখা ভালো।

 

২. যদি রোযার নিয়ত করার পর অথবা রোযা শুরু হয়ে যাওয়ার পর কেউ সফরে রওয়ানা হয়। তাহলে সেদিনের রোযা কাযা জরুরী। কিন্তু রোযা ভেঙে দিলে কাফফারা দিতে হবে না।

 

৩. যদি কোনো মুসাফির দুপুরের আগে কোথাও মুকীম হয়ে যায় এবং ঐ সময় পর্যন্ত রোযা নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ সে করেনি, তাহলে তার জন্যেও সেদিন রোযা রাখা জরুরী, কিন্তু রোযা নষ্ট করলে কাফফারা দিতে হবে না।

 

৪. যদি কোনো মুসাফির কোনো স্থানে মুকীম হওয়ার ইরাদা করে, ১৫দিনের কমই ইরাদা করুক না কেন, তথাপি তার উচিত যে, সে রোযা রাখে, এ দিনগুলোতে রোযা না রাখা মাকরূহ। আর যদি ১৫ দিন থাকার ইরাদা করে তাহরে তো রোযা না রাখা জায়েয নয়।

 

২। রোগ

 

১.যদি রোযা রাখার কারণে কোনো রোগ সৃষ্টির আশংকা হয় অথবা এ ধারণা হয় যে, ওষুধ না পাওয়ার কারণে অথবা আহার না পাওয়ার কারণে রোগ বেড়ে যাবে, অথবা যদি এ ধারণা হয় যে, স্বাস্থ্য বিলম্বে লাভ হবে তাহলে এসব অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। কিন্তু জেনে রাখা দরকার যে, এমন ধারণা করার সংগত কারণ থাকতে হবে। যেমন ধরুন, কোনো নেক ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শ দেয় অথবা নিজের বার বার অভিজ্ঞতা হয়েছে অথবা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। নিছক অমূলক ধারণার ভিত্তিতে রোযা না রাখা জায়েয নয়।

 

২. যদি কারো নিজের নিছক এ ধারণা হয় যে সম্ভবত রোযা রাখলে রোগ সৃষ্টি হবে অথবা বেড়ে যাবে যার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, অথবা কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বা হেকীমের পরামর্শ নেয়া হয়নি এবং রোযা রাখা হলো না, তাহলে গোনাহগার হবে এবং তার কাফফারাও দিতে হবে।

 

৩. কোনো বেদীন চিকিৎসক, যে শরীয়াতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুভব করে না, তার পরামর্শ অনুযায়ী চলাও ঠিক নয়।

 

৩। গর্ভ

 

১. যদি কোনো স্ত্রীলোকের প্রবল ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে তার পেটের সন্তানের ক্ষতি হবে অথবা স্বয়ং তার ক্ষতি হবে, তাহলে তার জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

 

২. যদি রোযার নিয়ত করার পর কোনো মেয়ে মানুষ জানতে পারে যে, তার গর্ভসঞ্চার হয়েছে এবং তার সুস্পষ্ট ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে তার ক্ষতি হবে তাহলে তার জন্যে এ অনুমতি আছে যে, সে রোযা ভেঙে ফেলবে। তারপর কাযা করবে। তার কাফফারা দিতে হবে না।

 

৪। স্তন্যদান

 

১. রোযা রেখে স্তন্যদান যদি প্রবল ধারণা হয় যে, প্রসূতির ভয়ানক ক্ষতি হবে, যেমন দুধ শুকিয়ে যাবে এবং বাচ্চা ক্ষুধায় ছটফট করবে অথবা তার জীবনেই আশংকা হয়, তাহলে তার রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

 

২. যদি পারিশ্রমিক দিয়ে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে এবং বাচ্চাও যদি অন্য কারো দুধ খায়, তাহলে রোযা না রাখার দুরস্ত নয়, আর যদি বাচ্চা অন্য কারো দুধ খেতেই চায় না, তাহলে রোযা না রাখার জায়েয আছে।

 

৩. পারিশ্রমিক নিয়ে যে দুধ খাওয়ায়, তারও যদি এ প্রবল ধারণা হয় যে, রোযা রাখার কারণে তার বাচ্চা অথবা স্বয়ং তার ক্ষতি হবে, তাহলে সে রোযা ছেড়ে দিতে পারে।

 

৪. কোনো মেয়ে মানুষ ঠিক রমযানের দিনেই দুধ খাওয়ানোর কাজ শুরু করলো। ঐ দিন যদি সে রোযার নিয়তও করে থাকে তবুও তার রোযা না রাখা জায়েজ। রোযা ভাঙ্গার জন্য কাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

 

৫। ক্ষুধা-তৃষ্ণার তীব্রতা

 

কোনো ব্যক্তি রোগী তো নয়, কিন্তু রোগের কারণে এতোটা দুর্বল হয়েছে যে, রোযা রাখলে পুনরায় অসুস্থ হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে, তাহলে তার জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

 

৬। দুর্বলতা ও বার্ধক্য

 

কোনো ব্যক্তি বার্ধক্যের কারণে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার জন্যে অনুমতি আছে যে,সে রোযা রাখবে না। আর এমন ব্যক্তির সম্পর্কে এ আশা তো করা যায় না যে, সুস্থ হয়ে কাযা করবে। এজন্যে তার ওয়াজিব যে, সে রোযার ফিদিয়া দেবে তখনই দিক বা পরে। ফিদিয়ার পরিমাণ সাদকায়ে ফিতরের সমান।

 

৭। জীবনের আশংকা

 

যদি কঠোর পরিশ্রমের কারণে জীবনের আশংকা হয় অথবা কেউ যদি এ বলে বাধ্য করে যে, রোযা রাখলে তাকে মেরে ফেলবে, অথবা নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করবে অথবা কোনো অঙ্গ কেটে দেবে, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্যেও রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

 

৮। জিহাদ

 

দীনের দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদের নিয়ত আছে এবং এ ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে দুর্বল হয়ে পড়বে তাহলে রোযা না রাখার  অনুমতি আছে।

 

*কার্যত জেহাদ চলছে তখনও রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

 

*কার্যত জেহাদ চলছে না, কিন্তু শীঘ্রই সংঘর্ষের আশংকা রয়েছে, এমন অবস্থায়ও অনুমতি আছে।

 

*রোযা রাখার পর যদি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয় তাহলেও রোযা ভেঙ্গে ফেলার অনুমতি আছে। তার জন্যে কাফফারা দিতে হবে না।

 

৯। হুশ না থাকা

 

কেউ যদি বেহুশ হয়ে যায় এবং কয়েকদিন ধরে বেহুশ থাকে, এ অবস্থায় যেসব রোযা রাখা হবে তার কাযা ওয়াজিব হবে। তবে যে রাতে সে বেহুশ হয়েছে তার পরদিন যদি তার দ্বারা এমন কোনো কাজ না হয় যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয় এবং এটাও যদি জানা যায় যে, সে রোযার নিয়ত করেছে বা করেনি, তাহলে সেদিন তার রোযা ধরা হবে এবং তার কাযা করতে হবে না। অবশ্যই পরের দিনগুলোর কাযা করতে হবে।

 

১০। মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়া

 

যদি কেউ পাগল হয়ে পড়ে এবং রোযা রাখতে না পারে তাহলে তার দুটি উপায় রয়েছেঃ

 

এক – কোনো সময়েই পাগলামি ভালো হচ্ছে না। এমন অবস্থায় রোযা বিলকুল মাফ-কাযা ফিদিয়া কিছুই দরকার নেই।

 

দুই – কোনো সময়ে পাগলামি ভালো হয়ে যাচ্ছে তাহলে এ অবস্থায় কাযা করতে হবে।

 

যেসব অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয

 

১. হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে, এমন কোনো রোগ যার ফলে জীবন বিপদাপন্ন অথবা মোটর দুর্ঘটনায় আহত, উঁচু জায়গা থেকে পড়ে অবস্থা আশংকাজনক এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয।

 

২. কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং জীবনের আশংকা নেই কিন্তু আশংকা যে রোযা যদি ভাঙা না হয় তাহলে রোগ খুব বেড়ে যাবে, এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার অনুমতি আছে।

 

৩. কারও এমন প্রচন্ড ক্ষুধা তৃষ্ণা লেগেছে যে, কিছু পানাহার না করলে জীবন যাওয়ার আশংকা রয়েছে, তাহলে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা দুরস্ত আছে।

 

৪. কোনো গর্ভবতী মেয়েলোকের এমন দুর্ঘটনা হলো যে, তার নিজের অথবা পেটের বাচ্চার জীবনের আশংকা হলো, এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার এখতিয়ার আছে।

 

৫. কাউকে সাপে দংশন করেছে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ওষুধ পত্রের প্রয়োজন। এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা উচিত।

 

৬. দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সাহস করে রোযা রাখা হলো। তারপর মনে হলো যে, যদি রোযা ভাঙা না হয় তাহলে জীবনের আশংকা রয়েছে, অথবা সাংঘাতিকভাবে রোগ বেড়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার অনুমতি আছে।

 

কাযা রোযার মাসায়েল

 

১. রমযানের যেসব রোযা কোনো কারণে করা হয়নি, তার কাযা আদায় করতে অযথা বিলম্ব করা উচিত নয়। যতো শীঘ্র করা যায় ততোই ভালো।

 

২. রমযানের রোযা হোক বা অন্য কোনো রোযা, তা ক্রমাগত করা জরুরী নয়। এটাও জরুরী নয় যে, ওজর শেষ হওয়ার সাথে সাথেই করতে হবে। সুযোগ মতো কাযা আদায় করলেই চলবে।

 

৩. রোযার কাযা ক্রমানুসারে করা ফরয নয়। যেমন কাযা রোযা না করেও রমযানের চলতি রোযা করা যায়।

 

৪. কাযা রোযা রাখার জন্যে দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা জরুরী নয়। যতো রোযা কাযা হয়েছে তার বদলার ততোগুলো রোযা রাখতে হবে।

 

৫. যদি রমযানের দু বছরের রোযা কাযা পড়ে থাকে, তাহলে কোন বছরের কাযা আদায় করা হচ্ছে তা নির্দিষ্ট হওয়া জরুরী। এজন্যে এ নিয়ত করতে হবে যে, অমুক বছরের কাযা রোযা রাখা হচ্ছে।

 

৬. কাযা রোযা রাখার জন্যে রাতেই নিয়ত করা জরুরী। সুবেহ সাদেকের পর কাযা রোযার নিয়ত করলে তা দুরস্ত হবে না। সে রোযা নফল হয়ে যাবে। কাযা রোযা পুনরায় রাখতে হবে।

 

৭. রমযানের কিছু রোযা কাযা হয়ে গেল। এ কাযা রোযা রাখার সুযোগ পাওয়া গেল না এবং আর এক রমযান এসে গেল। তাহলে প্রথমে রমযানের রোযা রাখতে হবে, কাযা রোযা পরে রাখবে।

 

৮. কেউ সন্দেহে দিনে রমযানের রোযা রাখলো। পরে জানা গেল যে, সেদিন শাবানের ৩০ তারিখ। তাহলে এ রোযা নফল হয়ে যাবে যদিও তা মাকরূহ হবে। আর যদি সে রোযা ভেঙে ফেলা হয় তো তার কাযা ওয়াজিব হবে না।

 

কাফফারার মাসায়েল

 

রমযানের রোযা নষ্ট হয়ে গেলে তার কাফফারা এই যে, ক্রমাগত ষাট দিন রোযা রাখতে হবে। মাঝে কোনো রোযা ছুটে গেলে আবার নতুন করে ক্রমাগত ষাট রোযা রাখতে হবে। মাঝে যে রোযা ছুটে গেছে তা হিসেবের মধ্যে গণ্য হবে না।

 

কোনো কারণে কেউ রোযা রাখতে না পারলে ষাটজন অভাবগ্রস্তকে দু বেলা পেট ভরে খাওয়াতে হবে।

 

১. মেয়েদের জন্যে কাফফারা এ সুবিধা আছে যে, হায়েযের জন্যে মাঝে রোযা বাদ পড়লে ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে না। তবে হায়েয বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে রোযা শুরু করতে হবে।

 

২. কাফফারা রোযা রাখার সময় যদি নেফাসের অবস্থায় হয় তাহলে ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। আবার নতুন করে ষাট রোযা রাখতে হবে।

 

৩. কাফফরা রোযা রাখার সময় যদি রমযান মাস এসে যায় তাহলে রমযানের রোযা রাখতে হবে। তারপর পুনরায় এক সাথে ষাট রাখতে হবে।

 

৪. যদি একই রমযানে একাধিক রোযা নষ্ট হয় তাহলে সব নষ্ট রোযার জন্যে একই কাফফারা ওয়াজিব হবে।

 

৫. কারো ওপর একটি কাফফারা ওয়াজিব হয়েছে। এ আদায় করার পূর্বে আর এক কাফফারা ওয়াজিব হলো। তাহলে দুয়ের জন্যে একই কাফফারা ওয়াজিব হবে তা এ দুটি কাফফারা দুটি রমযানের হোক না কেন। শর্ত এই যে, যৌনক্রিয়ার কারণে যদি রোযা নষ্ট না হয়ে থাকে। যৌনক্রিয়ার কারণে যতো রোযা নষ্ট হবে তার প্রত্যেকটির জন্যে আলাদা আলাদা কাফফারা ওয়াজিব হবে।

 

৬. ষাটজন দুঃস্থ লোকের ব্যাপারে এটা লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তারা পূর্ণ বয়স্ক হতে হবে, ছোট বালককে খানা খাওয়ালে তার বদলায় পুনরায় বয়স্ক দুঃস্থকে খাওয়াতে হবে।

 

৭. খানা খাওয়ানোর পরিবর্তে খাদ্য শস্য দেয়াও জায়েয। অথবা তার মূল্যও দিয়ে দেয়া যায়।

 

৮. দুঃস্থদের খাওয়ানোর ব্যাপারে সাধারণ মানের খাদ্য হতে হবে- না খুব ভালো, না খারাপ।

 

৯. দুঃস্থদের খাওয়াবার ব্যাপারে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করলে কোনো ক্ষতি নেই কাফফারা হয়ে যাবে।

 

১০. একই ব্যক্তিকে ষাটদিন খাওয়ালে সহীহ হবে না- খাদ্য শস্য বা তার মূল্য দেয়ার ব্যাপারেও তাই।

 

ফিদিয়া

 

কেউ যদি বার্ধক্যের কারণে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা এমন কঠিন পীড়ায় ভুগছে যে, বাহ্যত সুস্থ হওয়ার আশা নেই এবং তার রোযা রাখার শক্তি নেই। এমন অবস্থায় শায়িত এ ধরনের লোকের জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছে। প্রত্যেক রোযার বদলে এক একজন দুঃস্থকে ফিদিয়া দেবে। ফিদিয়ার মধ্যে খানাও খাওয়ানো যেতে পারে, পরিমাণ মতো খাদ্য শস্যও দেয়া যেতে পারে অথবা তার মূল্যও দেয়া যেতে পারে।

 

ফিদিয়ার পরিমাণ

 

একজন ফকীরকে সাদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্য শস্য দেয়া অথবা তার মূল্য দেয়া। প্রত্যেক রোযার বদলায় দু বেলা কোনো অভাবগ্রস্তকে খানা খাওয়ানোও দুরস্ত আছে। মধ্যম ধরনের খানা খাওয়াতে হবে।

 

ফিদিয়ার মাসায়েল

 

১. ফিদিয়া আদায় করা সত্ত্বেও যদি রোগী স্বাস্থ্যবান হয়ে যায় তাহলে রোযাগুলোর কাযা ওয়াজিব হবে। যে ফিদিয়া দেয়া হয়েছে তার আলাদা সওয়াব আল্লাহ দেবেন।

 

২. কারো জিম্মায় কিছু কাযা রোযা আছে। মৃত্যুর সময় সে অসিয়ত করে গেল যে, তার মাল থেকে যেন ফিদিয়া দিয়ে দেয়া হয়। কাযা রোযার মোট ফিদিয়া যদি তার এ পরিত্যক্ত মালের এক তৃতীয়াংশের পরিমাণ হয় (পরিত্যক্ত মাল বলতে বুঝায় যা দাফন কাফনের ব্যয় ভার বহন এবং ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করার পর যা বাচে। তার এক তৃতীয়াংশ।) তাহলে ফিদিয়া ওয়াজিব হবে। ফিদিয়ার মূল্য যদি অধিক হয় আর এক তৃতীয়াংশের মালের পরিমাণ কম হয়, তাহলে এক তৃতীয়াংশ মালের বেশী ফিদিয়া তখন জায়েয হবে যখন ওয়ারিশগণ খুশী হয়ে রাযী হবে। নাবালেগ বাচ্চাদের অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই।

 

৩. মৃত ব্যক্তি যদি অসিয়ত করে না থাকে এবং ওয়ারিশগণ আপন ইচ্ছায় যদি ফিদিয়া আদায় করে তাহলেও দুরস্ত হবে। আশা করা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা ফিদিয়া কবুল করবেন।

 

৪. প্রতি ওয়াক্তের নামাযের ফিদিয়াও তাই যা রোযার ফিদিয়া। মনে রাখতে হবে দিনে পাঁচ ওয়াক্তের নামায এবং তার সাথে বেতের নামায অর্থাৎ দৈনিক ছয় নামায।

 

৫. মৃত্যুর সময় কেউ নামাযের জন্যে ফিদিয়া দেয়ার অসিয়ত করলে তার হুকুম রোযার ফিদিয়ার মতোই হবো।

 

৬. মৃত ব্যক্তি পক্ষ থেকে তার ওয়ারিশ যদি নামায পড়ে বা রোযা রাখে, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।

 

৭. সামান্য অসুখের জন্যে রমযানের রোযা কাযা করা অথবা এ ধারণা করা যে পরে কাযা আদায় করবে অথবা ফিদিয়া দিয়ে মনে করবে যে, রোযার হক আদায় হয়েছে এমন মনে করা ঠিক নয়।

 

নবী (স) বলেন, যদি কেউ বিনা ওজরে অথবা রোগের কারণ ছাড়া একটা রোযাও ছেড়ে দেবে- সারা জীবন রোযা রাখলেও তার ক্ষতি পূরণ হবে না। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

 

রোযার বিভিন্ন হুকুম ও নিয়মনীতি

 

১. যে ব্যক্তি কোনো কারণে রোযা রাখতে পারলো না তার জন্যে এটা জরুরী যে, সে যেন প্রকাশ্যে খানাপিনা না করে এবং বাহ্যত রোযাদারের মতো হয়ে থাকে।

 

২. যার মধ্যে রোযা ফরয হওয়া ও সহীহ হওয়ার সকল শর্ত পাওয়া যায়, তার রোযা যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার জন্যে ওয়াজিব যে, সে দিনে বাকী অংশ রোযাদারের মতো হয়ে থাকবে এবং খানাপিনা ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থাকবে।

 

৩. কোনো মুসাফির যদি দুপুরের পর বাড়ী পৌঁছে অথবা কোথাও মুকীম হওয়ার এরাদা করে তাহলে দিনের বাকী অংশ রোযাদারের মতো হয়ে থাকা এবং খানাপিনা থেকে বিরত থাকা তার জন্যে মুস্তাহাব হবে। এমনিভাবে কোনো স্ত্রীলোক যদি দুপুরের পর হায়েয বা নেফাস থেকে পাক হয় তাহলে তার জন্যেও মুস্তাহাব যে, সে দিনের বাকী অংশ খানাপিনা থেকে বিরত থাকবে।

 

৪. যদি কেউ ইচ্ছা করে রোযা নষ্ট করে অথবা কেউ রাত আছে মনে করে সুবেহ সাদেকের পর খানা খায়, তাহলে তার জন্যে ওয়াজিব হবে সারাদিন রোযাদারের মতো কাটানো এবং খানাপিনা থেকে বিরত থাকা।

 

৫. দুপুরের পর যদি কোনো শিশু বালেগ হয় অথবা কেউ যদি মুসলমান হয়, তাহলে তাদের জন্যে মুস্তাহাব এই যে, তারা বাকী দিনটুকু রোযাদারের মতো কাটাবে।

 

৬. রোযা রাখার পর যদি কোনো মেয়ে মানুষের হায়েয শুরু হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে। কিন্তু তারপর তার উচিত রোযাদারের মতো খানাপিনা থেকে বিরত থাকা।

 

নফল রোযার ফযিলত ও মাসায়েল

 

শাওয়ালের ছয় রোযা

 

এ রোযার অনেক ফযিলত হাদীসে বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং পরপর শাওয়ালের ছয় রোযা করলো, সে যেন হামেশা রোযা রাখলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)

 

নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং তারপর শাওয়ালের ছটি রোযা রাখলো সে গোনাহ তেকে এমন পাক হলো যেন তার মা তাকে আজই  প্রসব করলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)

 

এটা জরুরী নয় যে, সে রোযাগুলো ঈদের পর একত্রে করতে হবে। একত্রেও করা যায় এবং মাঝে বাদ দিয়েও করা যায়।

 

তবে শাওয়ালের ছয় তারিখে এ রোযা শুরু করা ভালো। তবে তা জরুরী নয়। পুরো মাসের মধ্যে যখনই সুবিধা হয় করা যেতে পারে।

 

আশুরার দিনের রোযা

 

মহররমের দশ তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বা আশুরার দিন বলে। ঐ দিনে মক্কার কুরাইশরাও রোযা রাখতো এবং কাবা ঘরে নতুন গেলাব চড়াতো। এ রোযাকে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর প্রতি আরোপ করা হতো। নবী (স) নিজেও এ রোযা রাখতেন। তারপর যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন দেখলেন যে, ইহুদীরাও সে রোযা রাখছে। তখন তিনিও ঐ দিন রোযা রাখলেন এবং সকল সাহাবীকে রোযা রাখার তাকীদ করলেন।

 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন ইহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাছে এ দিনের কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ? তারা বলল, এ বড় মহত্বপূর্ণ দিন। এ দিনে আল্লাহ হযরত মূসা (আ ) কে এবং তার জাতিকে নাজাত দান করেন ও ফেরাউন এবং তার লোক লস্করকে নিমজ্জিত করেন। এজন্যে মূসা (আ ) আল্লাহর অনুগ্রহের শোকারগুজারির জন্য ঐ দিন রোযা রাখেন। আমরাও এ জন্যে এ দিনে রোযা রাখি।

 

নবী (স) বলেন, মুসা (আ ) এর সাথে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশী। আর আমরা এ জিনিসের বেশী হকদার যে এ দিন আমরা রোযা রাখি।

 

তারপর নবী (স) স্বয়ং সে দিন রোযা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোযা রাখার হুকুম দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)

 

দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ অথবা এগার তারিখ রোযা রাখা ভালো যাতে করে সেদিনের ফযীলতও লাভ করা যায় এবং ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্যও না হয়।

 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) স্বয়ং এ রোযা রাখা শুরু করেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার তাকীদ করেন। তখন সাহাবীগণ আরজ  করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ দিনকে তো ইহুদী-নাসারাগণ বড় দিন হিসেবে পালন করে। আমরা ঐদিনে রোযা রাখলে তো তাদের সাথে সাদৃশ্য হয়। তখন তিনি বলেন, সামনে বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখে রোযা রাখবো। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কিন্তু সামনে বছর আসার পূর্বেই নবী (স) ইন্তেকাল করেন। (মুসলিম)

 

আরাফাতের দিনের রোযা

 

হজ্জের মাসের নয় তারিখকে ইয়াওমে আরফা বা আরাফাতের দিন বলা হয়। হাদীসে এ দিনের রোযার অনেক ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। নবী (স)বলেন, আমি আল্লাহর সত্তা থেকে এ আশা রাখি যে, আরাফাতের দিনের রোযা আগামী বছর ও গত বছর এ উভয় বছরের কাফফারা বলে গণ্য হবে। (তিরমিযি)

 

আরাফার দিনের রোযার সওয়াব এক হাজার দিনের রোযার সমান। (তিরমিযি)

 

নবী (স)এ দিনে রোযার যত্ন নিতেন। আরাফার দিনের আগের আট দিনের রোযারও বড়ো সওয়াব আছে।

 

নবী (স)বলেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের মত আল্লাহর নিকট কোনো দিনই এত প্রিয় নয়। এ দশ দিনের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমান এবং এসব রাতের নফল নামায শবে দকর এর নফরে সমান।

 

আইয়ামে বীযের রোযা

 

প্রত্যেক চাঁদ মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীয বলে। এ হচ্ছে শুক্লপক্ষের বিশেষ কয়েকটি দিন। এগুলোকে বলা হয় আইয়ামে বীয- (উজ্জ্বল জোস্না প্লাবিত তারিখগুলো)। নবী (স) এ দিনগুলোর রোযার বড়ো তাকীদ করতেন।

 

হযরত কাতাদাহ বিন মালহান (রা) বলেন, নবী (সা) আমাদেরকে তাকীদ করতেন যে, আমরা যেন চাঁদের তের, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে রোযা রাখি। তিনি বলতেন, এ তিন রোযা সওয়াবের দিক দিয়ে হামেশা রোযা রাখার বরাবর। (আবু দাউদ, নাসায়ী)

 

সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা

 

নবী (স) স্বয়ং সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন এবং সাহাবীগণকে রাখার তাকীদ করতেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সা) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। (তিরমিযি, নাসায়ী)

 

উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে নবী (সা) বলেন,সোম ও বৃহস্পতিবার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। আমি চাই যে, যেদিন আমার আমল পেশ করা হয় সেদিন রোযা রাখি। (তিরমিযি)

 

একবার সাহাবীগণ নবী (স)কে সোমবার রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বললেনঃ ঐদিন আমার জন্ম হয়েছিল এবং ঐদিনই আমার ওপর কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। (মুসলিম)

 

নফল রোযার বিভিন্ন মাসায়েল

 

১. নফল রোযা রাখার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোনো কারণে নষ্ট হলে বা নষ্ট করলে কাযা ওয়াজিব হয়ে যায়।

 

২. বিনা ওজরে নফল রোযাও ভাঙা জায়েয নয়। অবশ্যই নফল রোযা ফরয রোযার তুলনায় সামান্য ওজরে ভাঙা যায়।

 

৩. কেউ রোযাদারকে খানার দাওয়াত করলো এবং মনে করা হলো যে, মেহমান না খেয়ে মেজবান অসন্তুষ্ট হবে অথবা সে মেহমানকে ছেড়ে খেতে রাজী হবে না অথবা না খেলে মেজবান মনে আঘাত পাবে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয। কিন্তু রোযাদারের উচিত তার কাযা আদায় করা।

 

৪. মেয়েদের জন্যে রমযানের রোযা ছাড়া অন্য যে কোনো রোযা স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা মাকরূহ তাহরীমি। যদি কেউ রাখে এবং তার স্বামী রোযা ভাঙতে বলে তাহলে ভেঙে দেয়া জরুরী। তারপর সে রোযার কাযাও স্বামীর অনুমতি নিয়ে করবে।

 

৫. যদি কেউ ঐসব দিনে রোযা রাখার মানত করে যেসব দিনে রোযা রাখা হারাম। যেমন, দু ঈদের দিন। তাহলে অন্য কোনো দিনে রাখবে।

 

৬. কেউ নফল রোযা রাখলো এবং তার বাড়ীতে মেহমান এলো। এখন সে যদি মেহমানের সাথে খানা না খায় তাহলে মেহমান অসন্তুষ্ট হবে। এমন অবস্থায় নফল রোযা ভাঙা জায়েয।

 

৭. কেউ ঈদের দিনে রোযার নিয়ত করলো এবং রোযা রাখলো। তারও উচিত রোযা ভেঙে ফেলা এবং তার কাযা করা।

 

৮. রমযানের এক দুদিন আগে রোযা রাখা ঠিক নয়। নবী (স)বলেন, কেউ যেন রমযানের এক দুদিন আগে রোযা না রাখে। কিন্তু যদি কেউ ঐ দিন রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রাখতে পারে। (বুখারী)

 

তারাবীর নামাযের বয়ান

 

তারাবীহ তারাবীহ শব্দের বহুবচন। তার অর্থ বিশ্রামের জন্যে একটুখানি বসা। পরিভাষায় তার অর্থ হলো রমযানুল মুবারকে রাতে যে সুন্নাত নামায পড়া হয় তার চার রাকায়াত পর পর বিশ্রামের জন্য বসা। যেহেতু ঐ বিশ রাকায়াত নামাযে পাঁচটি তারাবীহ করা হয়, সে জন্যে এ সুন্নাত নামাযকে তারাবীহ বলা হয়ে থাকে।

 

তারাবীর নামাযের হুকুম

 

তারাবীর নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। নবী (স) তার বিশেষ ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা)ও। যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তারাবীহ পরিত্যাগ করবে সে গোনাহগার হবে। এ নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তারপর এটাও মনে রাখতে হবে, তারাবীহ নামায রোযার অধীন নয়। অর্থাৎ এরূপ মনে করা ভুল যে, তারাবীহ পড়া জরুরী যদি সেদিন রোযা রাখা হয়। এ দুটি পৃথক পৃথক ইবাদত। যারা কোনো ওজর বা অক্ষমতার কারণে রোযা রাখতে পারে না। যেমন কেউ রোগী অথবা সফরে রয়েছে, অথবা রোযা রাখেনি, অথবা মেয়ে মানুষ হায়েয নেফাসের কারণে রোযা রাখেনি কিন্তু তারাবীর সময় পাক হয়ে গেছে- তাদের তারাবীহ পড়া উচিত। না পড়লে সুন্নাত পরিত্যাগ করার গোনাহ অপরিহার্য হবে।

 

তারাবীহ নামাযের ফযিলত

 

নবী (স) শাবান মাসের শেষ দিন রমযান মাসের আগমনীকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেনে। তিনি বলেন, এ মাসে একটি রাত এমন আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। এ মাসে রাতের বেলায় আল্লাহ তায়ালা তারাবীহ নামায পড়া নফল করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ ফরয নয়, সুন্নাত। এজন্যে যে ফরযের মুকাবেলায় সুন্নাত মুস্তাহাব সবকেই নফল বলা হয়।) যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো কাজ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টি সহকারে করবে, তার প্রতিদান ও সওয়াব এতো হবে- যতোটা অন্যান্য মাসের ফরয ইবাদাতের হয়। (মিশকাত-বর্ণনাকারী সালমান ফারসী (র)। এ এক দীর্ঘ বর্ণনা। এখানে কিছুটা অংশ নকল করা হয়েছে।)

 

নবী (স) আর একটি হাদীসে একে মাগফেরাতের উপায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রাতগুলোতে ঈমানী প্রেরণা এবং আখিরাতের প্রতিদানের নিয়তে তারাবীহ নামায পড়লো, তার কৃত সকল গোনাহ মাফ করে  দেয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)

 

তারাবীহ নামাযের সময়

 

যে রাতে রমযানের চাঁদ দেখা যাবে সে রাত থেকে তারাবীহ শুরু হয়। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে তারাবীহ বন্ধ হয়ে যায়। তারাবীহ নামাযের সময় এশার নামাযের পর থেকে শুরু হয় এবং ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। যদি কেউ এশার নামাযের পূর্বে তারাবীহ পড়ে তাহলে তারাবীহ হবে না। যদি কেউ এশার নামাযের পর তারাবীহ পড়ে এবং কোনো কারণে এশার নামায পুনরায় পড়তে হয়, তাহলে তারাবীহ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার)

 

অবশ্যই এক তৃতীয়াংশ রাতের পর মধ্যে রাতের আগেই তারাবীর নামায পড়া মুস্তাহাব। মধ্য রাতের পর পড়া জায়েয হলেও আগেভাগে পড়ার যে নীতি তার খেলাপ হবে। (তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটি এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বড়ো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেনঃ এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটা। এশার সময়, না তাহাজ্জুদের সময়? উভয়ের সপক্ষে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু বেশী আগ্রহ দেখা যায় শেষ সময়ের দিকে। কিন্তু প্রথমে সময়কে প্রাধান্য দেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি এই যে, মুসলমানগণ সমষ্টিগতভাবে প্রথম সময়েই তারাবীহ পড়তে পারে। শেষ ময় অবলম্বন করা হলে উম্মতের বিরাট সংখ্যা গরিষ্ঠ এ সওয়াব থেকে বঞ্চিত রয়ে যাবে এবং তা বিরাট ক্ষতির বিষয় হবে। যদি কিছু নেক লোক শেষ সময়ের ফযিলত লাভের উদ্দেশ্যে প্রথম ওয়াক্তের জামাতে শরীক না হয়, তাহলে এ আশংকা হতে পারে যে, জনসাধারণ হয়তো এসব নেক লোকের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে অথবা তাদের জামায়াতে শরীক না হওয়ার কারণে জনসাধারণ নিজেরাই তারাবীহ পড়া ছেড়ে দেবে। অথবা ঐসব নেক রোকদেরকে তাদের তাহাজ্জুদ পড়ার ঢাক ঢোল পেটাতে হবে। (রাসায়েল ও মাসায়েল, তৃতীয় খন্ড, ২৩১ পৃঃ)

 

তারাবীহ নামাযের জামায়াত

 

নবী (স) রমযানে তিন রাত ২৩, ২৫ এবং ২৭শে রাত তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়িয়েছেন। তারপর যখন তিনি সাহাবীদের মধ্যে বিরাট উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুরাগ লক্ষ্য করলেন তখন মসজিদে এলেন না। সাহাবায়ে কেরাম (রা) মনে করলেন তিনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তারা তার দরজায় আওয়াজ দিতে লাগলেন। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় আরও বরকত দিন। আমি এ আশংকায় বাইরে যাইনি যে, কি জানি এ নামায তোমাদের ওপর ফরয হয়ে না যায় এবং হামেশা তোমরা তা পালন করতে না পার। এ জন্যে তোমরা এ নামায ঘরেই পড়তে থাক, কারণ নফল নামায ঘরে পড়াতে বেশী সওয়াব ও বরকতের কারণ হয়। (বুখারী)

 

এ হাদীস থেকে এতোটুকু প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং নবী পাক (স) তিন রাত জামায়াতে তারাবি পড়িয়েছেন। অবশেষে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা) রীতিমতো তার জামায়াত কায়েম করেন এবং সাহাবায়ে কেরাম নতশিরে তা মেনে নেন। পরবর্তীকালে কোনো খলীফাই এ সুন্নাতের বিরোধিতা করেননি। এ জন্যে আলেম সমাজ এ জামায়াতকে সুন্নাতে মুয়াককাদাহ কেফায়া বলেছেন। (তারাবীর নামাযের জামায়াত সম্পর্কে এক ব্যক্তি আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) কে প্রশ্ন করেন। তিনি বিশদভাবে তার জবাব দেন এবং বিষয়টির ওপর ভালোভাবে আলোচনা করেন। নিম্নে প্রশ্ন ও তার জবাব দেয়া হলোঃ

 

প্রশ্নঃ ওলামায়ে কেরাম সাধারণত বলে থাকেন যে, তারাবীহ আউয়াল ওয়াক্তে (এশার সাথে) পড়া ভালো এবং তারাবীহ জামায়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ যদি কোনো মহল্লায় জামায়াতসহ তারাবীহ পড়া না হয়, তাহলে মহল্লাবাসী গোনাহগার হবে। আর যদি দুজন মিলেও মসজিদে তারাবীহ পড়ে তাহলে সকলের পক্ষ থেকে জামায়াত ত্যাগের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। একথা কি ঠিক? যদি তাই হয়। তাহলে হযরত আবু বকর (রা) এর যামানায় কেন তা হয়নি? তাহলে সে সময়ের মুসলমানদের ওপর কি হুকুম হবে? জামায়াত সহ তারাবীহ না পড়ার কারণে তারা কি গোনাহগার ছিলেন?

 

জবাবঃ নবী (স) এর যামানা থেকে শুরু করে হযরত ওমর (রা) এর প্রাথমিক কার পর্যন্ত রীতিমতো এক জামায়াতে সকল লোকের তারাবীহ পড়ার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। বরঞ্চ লোক হয়তোবা আপন আপন ঘরে পড়তো কিংবা মসজিদে আলাদা আলাদাভাবে ছোট ছোট জামাত করে পড়তো। হযরত ওমর (রা) যা কিচু করেন তাহলো এই যে, এ বিচ্ছিন্নতা দূর করে সকলকে একটি জামায়াতের আকারে নামায পড়ার হুকুম দেন। তার জন্যে হযরত ওমর (রা) এর নিকটে এ অকাট্য যুক্তি ছিল যে, নবী (স) এর ধারাবাহিকতা একথা বলে বন্ধ করে দেন যে, তা কোনো দিন ফরয না হয়ে যায়। তারপর নবী (সা) এর অতীত হওয়ার পর এ আশংকা আর রইলো না যে, কোনো কাজের দ্বারা এ জিনিস ফরয বলে গণ্য হবে। এ জন্যে হযরত ওমর (রা) সুন্নাত হিসেবে তা জারী করেন। এ ছিল হযরত ওমর (রা) এর দীন সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার এক অন্যমত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে, তিনি শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যার ফলে তিনি উম্মতের মধ্যে একটা সঠিক তরীকা প্রচলিত করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা) এর মধ্যে কারো এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন না করা, বরঞ্চ তা নতশিরে মেনে নেয়া একথাই প্রমাণ করে যে, তিনি শরীয়াত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবেই পূরণ করেছেন যে, তাকে যেন ফরযের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া না হয়।

 

অন্ততপক্ষে একবার তো তার তারাবীতে শরীক না হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। একবার তিনি আবদুর রহমান বিন আবদের সাথে বাইরে বের হয়ে মসজিদে লোকদেরকে তারাবীহ পড়তে দেখে তার প্রশংসা করেন। যার ভিত্তিতে আলেম সমাজ একথা বলেন যে, যে বস্তিতে মোটেই তারাবীর নামায জামায়াতসহ পড়া হয় না সে মহল্লায় সকল লোক গুনাহগার হবে, তাহলে এই যে, তারাবীহ ইসলামের এমন একটি সুন্নাত যা খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে গোটা উম্মতের মধ্য প্রচলিত আছে, ইসলামের এমন এক পদ্ধতি পরিত্যাগ করা এবং বস্তির সব লোক মিলে পরিত্যাগ করা দীন থেকে বেপরোয়া হওয়ার আলম। তা যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে ক্রমশ তার থেকে ইসলামের সকল রীতি পদ্ধতি মিটে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।)

 

তারাবীহ নামাযের রাকায়াতসমূহ

 

সাহাবীগণের ইজমা থেকে প্রমাণিত যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত। বিশ রাকায়াত এভাবে পড়তে হবে যে, দু দু রাকায়াতের পর সালাম ফিরাতে হবে এবং প্রত্যেক চার  রাকায়াত পর বিশ্রামের জন্যে এতোটা সময় বসতে হবে যতোটা সময়ে চার রাকায়াত পড়া যায়। বিশ্রামের জন্যে এতোটুকু সময় বসা মুস্তাহাব। তবে যদি অনুভব করা হয় যে, মুক্তাদীগণ এতক্ষণ বসতে পেরেশানি বোধ করেন তাহলে ততোক্ষণ না বসা ভালো। এ ব্যাপারে মুক্তাদীদের ভাবাবেগের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।

 

আহলে হাদীসের মতে আট রাকায়াত তারাবীহ পড়া সুন্নাত। তাদের মতে বিশ রাকায়াত পড়া সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।তাদের মতে অধিকাংশ রেওয়াতের আট রাকায়াতের এবং হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) এর যে রেওয়ায়েতে বিশ রাকায়াতের কথা বলা হয়েছে তা অন্যান্য হাদিসগুলোর তুলনায় দুর্বল। আল্লামা মওদূদী (র) এ বিষয়ে যে অভিমত প্রকাশ করেনে তা নিম্নে দেয়া হলোঃ

 

হযরত ওমর (রা) এর জামানায় যখন জামাতের সাথে তারাবী পড়ার সিলসিলা শুরু হল তখন সাহাবীগণের সর্বসম্মতিক্রমেই বিশ রাকায়াত পড়া হত। হযরত ওসমান গনী (রা) হযরত আলী (রা) এর জামানায় এ নিয়ম মেনে চলা হত। তিনজন খলীফা এ বিষয় একমত হওয়া এবং এ ব্যাপারে মতবিরোধ না করা এ কথারই প্রমাণ যে, নবী (স) এর যুগ থেকেই লোক বিশ রাকায়াত পড়তেই অভ্যস্ত। এ কারনেই ইমাম আবু হানীফা (র) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বিশ রাকাতের পক্ষেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর সপক্ষে ইমাম মালেকেরও এর একটি উক্তি পাওয়া যায়। দাইদ যাহেরী (র) একে প্রমাণিত সুন্নাত বলে মেনে নিয়েছে।

 

হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজ (র) এবং আবান ইবনে ওসমান বিশের পরিবর্তে ছত্রিশ রাকায়াত পড়ার নিয়ম শুরু করেন। তার কারণ এ ছিল না যে, তাদের তাহকীক ও তথ্যানুসন্ধান খোলাফায়ে রাশেদীনের তাহকীকের বিপরীত ছিল। বরঞ্চ তাদের লক্ষ ছিলো যাতে করে ছওয়াবের দিক দিয়ে মক্কার বাইরের লোক মক্কাবাসীদের সমান হতে পারে। মক্কাবাসীদের নিয়ম ছিলো এই যে, তারা তারাবীর প্রত্যেক চার রাকাআত পর কাবা ঘরের তাওয়াফ করতেন। এ দুই বুযুর্গ প্রত্যেক তাওয়াফের বদলে চার রাকায়াত পড়া শুরু করেন। এ নিয়ম যেহেতু মদীনাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং যেহেতু ইমাম মালেক মদীনাবাসীদের আমলকে সনদ মনে করতেন। সে জন্য তিনি পরবর্তীকালে বিশ রাকায়াতের স্থলে ছত্রিশ রাকায়াতের ফতোয়া দেন।

 

চার রাকায়াত পরপর বিশ্রামের সময় কি আমল করা যায়

 

তারাবীহ বা বিশ্রামের সময় ইচ্ছা করলে কেউ চুপচাপ বসেও থাকতে পারে অথবা মসবীহ পড়তে পারে এবং ইচ্ছা করলে নফল পড়তে পারে। মক্কা মুয়াযযমার লোক বসে থাকার পরিবর্তে তা্ওয়াফ করতেন। মদীনাবাসী চার রাকায়াত নফল পড়ে নিতেন। কতিপয় ফকিহ বলেন যে, তারাবীর সময় নিম্নের দোয়া পড়বেঃ

 

*******আরবী*********

 

বাদশাহ শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতি অক্ষমতা থেকে পাক পবিত্র। পাক ও মহান সত্তা যিনি, সকল সম্মান, শ্রদ্ধা, মহত্ব, ভয়ভীতি, শক্তিমত্তা, বড়ত্ব,পরাক্রমশীলতার অধিকারী। পবিত্র সেই সত্তা, যিনি চির জীবিত, যার নিদ্রা ও মৃত্যু নেই। তিনি পাক পবিত্র ও ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে । তিনি আমাদের রব এবং ফেরেশতাকুল এবং জিবরাঈলের রব প্রভু পরওয়ারদেগার। হে রব! আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দাও।

 

বেতের নামাজের জামাত

 

শুধু রমজান মাসে বেতের নামাজ জামায়াতে পড়া প্রমাণিত আছে। রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতের জামায়াতে পড়া যায়েজ নেই।

 

*******আরবী*********

 

রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতেরের জামায়াত যায়েজ নেই। এতে মুসলিম উম্মতের ইজমা রয়েছে। (হেদায়া)

 

যারা একাকী নামাজ পড়লো তারাও জামায়াতে বেতেরের নামাজ পড়তে পারে। কিন্তু যারা তারাবীহ জামায়াতে পড়লো তাদের জন্য বেতের জামায়াতে পড় জরুরী। কারণ তারাবীর সুন্নাত নামাজ জামাতে পড়ার পর বেতেরের ওয়াজিব নামাজ একা পড়া দুরস্ত নয়। এটাও ঠিক নয় যে, তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ে শুয়ে পড়বে এবং পরে তাহাজ্জুদের সাথে বেতের পড়বে।

 

তারাবীতে কুরআন খতম

 

রমজান মুবারকের পুরো মাসে একবার কুরআন পাক ক্রমানুসারে খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (ইলমুল ফেকাহ)

 

নবী করীম (স) প্রতি মাসে হযরত জিবরাঈল আমীন (আ ) কে পুরো কুরআন শুনিয়ে দিতেন। যে বছর তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন, সে বছর জিবরাঈলকে তিনি দুবার কুরআন শুনিয়ে দেন। উম্মতকে তিনি এভাবে উব্ধুদ্ধ করেনঃ

 

রোজা ও কুরআন মুমিনের জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে আমার রব! আমি এ ব্যক্তিকে দিনের বেলায় খানা পিনা ও অন্যান্য সম্ভোগ থেকে বিরত রাখলাম এবং সে বিরত থাকলো। অতএব হে আমার রব! এ লোকের পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করো। কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বিরত রেখেছি। এবং সে তার মিষ্টি ঘুম ছেড়ে দিয়ে তোমার দরবারে দড়িয়ে দাড়িয়ে কুরআন পড়তে থাকে। অতএব হে আমার রব! এ ব্যক্তির পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল কর। আল্লাহ উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন।(মিশকাত)

 

সাহাবায়ে কেরাম (রা) এ সুন্নাত যত্ন সহকারে পালন করেন। হযরত ওমর (রা) তারাবীহ নামায জামায়াত সহ পড়ার এবং এতে পুরো কুরআন শুনাবার বিশেষ ব্যবস্থা করতেন। দীন থেকে সাধারণ সম্পর্কহীনতা, লোকের অলসতা ও অমনোযোগিতার কারণে এ সুন্নাত ছেড়ে দেয়া কিছুতেই ঠিক নয়। অন্তত একবার তো তারাবীর মধ্যে পুরো কুরআন শুনার এবং শুনাবার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই করা উচিত। আর যেখানে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাবে, ইবাদাত ও কুরআন তেলাওয়াত অনুরাগ দেখা যাবে এবং নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, কুরআন পাক পূর্ণ মনোযোগ ও আদবের সাথে থেমে থেমে এমনভাবে পড়া যাবে যে, তেলাওয়াতের হক আদায় হবে, সেখানে একাধিকবার খতম করাও পছন্দনীয় কাজ বলা হয়েছে। অবশ্যই তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা ঠিক নয়। কারণ এ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতের হক আদায় করা যাবে না।

 

নবী (সা) এর তেলাওয়াতের ধরণ হাদীসে এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে যে তিনি এক একটি অক্ষর সুস্পষ্ট করে এবং এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন। তিনি উম্মতকে তারতীলের সাথে এবং থেমে থেমে তেলাওয়াত করার ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে বলেন-কুরআন পাঠকারীদের কেয়ামতের দিন বলা হবে- তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে থেমে থেমে খোশ এলাহানের সাথে সেজেগুজে কুরআন পড়তে ঠিক তেমনিভাবে পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময় এক স্তর ওপরে ওঠাতে থাক। তোমরা তেলাওয়াতের সর্বশেষ আয়াতের নিকটেই তোমার বাসস্থান পাবে। (তিরমিযি)

 

জরুরী হেদায়াত

 

যদি কোথাও নামায ও কুরআনের প্রতি অনুরাগ অসাধারণ কম হয় এবং মুক্তাদীদের অলসতা ও অবহেলার কারণে এ আশংকা হয় যে, যদি তারাবীতে পুরো কুরআন খতম করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তা শুধু লোকের ওপর বোঝাই হবে না, বরঞ্চ মসজিদে আসা এবং জামায়াতে নামায পড়া তারা এড়িয়ে চলতে থাকবে, এমন অবস্থায় খতমে কুরআনের ব্যবস্থা না করাই ভালো। তখন সংক্ষিপ্ত সূরা দিয়ে তারাবীহ পড়তে হবে যাতে করে তারাবীর সুন্নাত থেকে মানুষ বঞ্চিত না হয়। কিছু লোক জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারাবীতে কুরআন শুনা এবং শুনানোকে আসল উদ্দেশ্যে মনে করে। তারা তারাবীর নামাযে শান্ত পরিবেশ, ভারসাম্য এবং একাগ্রতার দিকে মোটেই লক্ষ্য রাখে না। এসব লোক যখন তারাবীতে গোটা কুরআন অত্যন্ত দ্রুতবেগে শুনে, তখন তারা পুনরায় না তারাবীহ পড়ার প্রতি যত্ন নেয় আর না জামায়াতে তারাবীহ পড়ার জন্যে মসজিদে আসা প্রয়োজন মনে করে। এ ধরনের চিন্তা অত্যন্ত মারাত্মক। যদি পুরো কুরআন শুনার সুযোগ না হয়, অথবা কুরআন খতম হয়ে যায়, তারপরও তারাবীর নামায এক স্থায়ী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এর ব্যবস্থাপনায় কখনো অবহেলা প্রদর্শন করা উচিত নয়।

 

তারাবীহ নামাযের বিভিন্ন মাসায়েল

 

১. তারাবীর নিয়ত এভাবে করবে- দু রাকায়াত সুন্নাত তারাবীর নিয়ত করছি। তারপর দু রাকায়াতের নিয়ত। এমনিভাবে দশ সালাম সহ বিশ রাকায়াত পুরো করতে হবে।

 

২. তারাবীর পর বেতের পড়া উৎকৃষ্ট। কিন্তু কোনো কারণে যদি তারাবীহ পড়ার পূর্বে অথবা সমস্ত তারাবীহ পড়ার পূর্বে বেতের নামায পড়া হয়, তো জায়েয হবে।

 

৩. যদি কোনো মুক্তাদী বিলম্বে এলো এবং তার কিছু তারাবীহ বাকী থাকতে ইমাম বেতেরের জন্য দাঁড়ালো, তাহলে তার উচিত ইমামের সাথে বেতের পড়া। তারপর বাকী তারাবীহ পরে পুরো করবে।

 

৪. চার রাকাআত পড়ার পর এতো সময় পর্যন্ত আরাম নেয়া মুস্তাহাব যতো সময়ে চার রাকায়াত পড়া হয়েছে। কিন্তু বেশীক্ষণ বসা যদি মুক্তাদীদের জন্যে কষ্টকর হয় তাহলে অল্প সময় বসা ভালো।

 

৫. যদি কেউ এশার ফরয না পড়ে তারাবীহ শরীক হয় তাহলে তার তারাবীহ দুরস্ত হবে না।

 

৬. কেউ যদি এশার ফরয জামায়াতে পড়লো এবং তারাবীহ জামায়াতে পড়লো না, তার জন্যেও বেতের নামায জামায়াতে পড়া দুরস্ত হবে।

 

৭. যদি কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়লো না, সেও বেতের নামায জামায়াতে পড়তে পারে।

 

৮. বিনা ওজরে বসে তারাবীহ পড়া মাকরূহ। অবশ্য ওজর থাকলে বসে পড়া দুরস্ত।

 

৯. কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়তে পারলো না, তার জন্যে তারাবীর নামায জামায়াতে পড়া জায়েয।

 

১০. ফরয ও বেতের এক ইমাম এবং তারাবীহ দ্বিতীয় কোনো ইমাম পড়াতে পারে। হযরত ওমর (রা) ফরয এবং বেতের স্বয়ং পড়াতেন এবং তারাবীহ পড়াতেন হযরত ওবাই বিন কায়াব (রা)।

 

১১. যদি তারাবীর কয়েক রাকায়াত কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা পুনরায় পড়া জরুরী। তখন কুরআন পাকের ঐ অংশও পুনরায় পড়া উচিত যা নষ্ট হওয়া রাকায়াতগুলোতে পড়া হয়েছে যাতে কুরআন খতম সহীহ নামাযে হয়।

 

১২. তারাবীতে দ্বিতীয় রাকায়াতে বসার পরিবর্তে ইমাম দাড়িয়ে গেল, যদি তৃতীয় রাকায়াতের সেজদার পূর্বে তার মনে পড়ে যায় অথবা কোনো মুক্তাদী মনে করিয়ে দেয় তাহলে ইমামের উচিত বসে যাওয়া এবং তাশাহুদ পড়ে এক সালাম ফিরিয়ে সেজদা সাহু দেবে, তারপর নামায পুরো করে সালাম ফিরাবে। তাতে করে এ দুরাকায়াত সহীহ হবে। আর যদি তৃতীয় রাকায়াতে সেজদা করার পর মনে পড়ে তাহলে এক রাকায়াত তার সাথে মিলিয়ে চার রাকায়াত পুরো করবে। এ চার রাকায়াত দু রাকায়াতের স্থলাভিষিক্ত হবে।

 

১৩. যদি ইমাম দ্বিতীয় রাকায়াতে কাদার জন্যে বসে পড়ে এবং তারপর তৃতীয় রাকায়াতের জন্যে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ অবস্থায় চার রাকায়াত পুরো করে তাহলে চার রাকায়াতই সহীহ হবে।

 

১৪. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি তাদের জন্যে তারাবীহ জামায়াতে পড়া দুরস্ত নয়। এজন্যে যে ফরয নামায একা পড়ে নফল নামায জামায়াতে পড়লে নফলকে ফরযের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। তার দুরস্ত নয়।

 

১৫. কেউ যদি মসজিদে এমন সময় পৌঁছে যখন এশার ফরয হয়ে গেছে তাহরে সে প্রথমে ফরয পড়বে তারপর তারাবীতে শরীক হবে। তারাবীর যেসব রাকায়াত বাদ যাবে সেগুলো হয় বিরতির সময় পড়ে নেবে অথবা জামায়াতে বেতের পড়ার পর পড়বে।

 

১৬. কিছু লোক এশার ফরয নামায জামায়াতে পড়ার পর তারাবীহ জামায়াত করে পড়েছে। তাদের সাথে ঐসব লোকও শরীক হতে পারে যারা ফরয জামায়াতে পড়েনি। এজন্যে যে, এরা ঐসব লোকের অনুসরণ করেছে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে তারাবীহ জামায়াতের সাথে পড়ছে।

 

১৭. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি একা পড়েছে তারাও ঐসব লোকের সাথে বেতেরের জামায়াতে শরীক হতে পারে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে বেতের জামায়াতে পড়ছে।

 

১৮. আজকাল শবীনার যেরূপ রেওয়াজ হয়ে পড়েছে তা কিছুতেই জায়েয নয়। শবীনা পাঠকারী একান্ত বেপরোয়া হয়ে দ্রুতবেগে পড়ে যায়। তার না শুদ্ধ অশুদ্ধ পড়ার কোনো চিন্তা থাকে আর না তেলাওয়াতের আদবের দিকে সে খেয়াল করে। এ ধরনের কেরায়াত থেকে প্রভাব ও হেদায়াত গ্রহণ করার কোনো অনুভূতিই হয় না। কোনো প্রকারে খতম করাই হয় পাঠকারীর উদ্দেশ্যে। তারপর মুক্তদীদের অবস্থা এই হয় যে, কয়েকজন ইমামের পেছনে দাড়িয়ে থাকে বটে, কিন্তু অধিকাংশই কয়েক রাকায়াত মাত্র ইমামের সাথে পড়ে। অনেকে পেছনে বসে বসে গল্প করে। ইমামের দ্রুত পড়ার প্রশংসা করে এবং নানান ধরনের গল্প গুজব করে। এটা সে রাতের নামায ও তেলাওয়াত নয় যা নবী (স) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা সুন্নাত মনে করে সাহাবায়ে কেরাম রীতিমতো পালন করতেন। এ প্রকৃতপক্ষে কুরআনের সাথে যুলুম ও বাড়াবাড়ি করা এবং তারাবীর বিদ্রূপ করা।

 

কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

এ কিতাব কল্যাণ ও বরকতের উৎস যা আমরা তোমার ওপর নাযিল করেছি যাতে লোক তার আয়াতগুলোর ওপর চিন্তা-গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ তার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ২৯)

 

নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করলো। সে কিছুতেই কুরআন বুঝলো না। (তিরমিযি)

 

কুরআন বলে- যখন কুরআন পড়া হয় তখন পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তা শুনো।

 

১৯. তারাবীতে কুরআন পড়ার নিয়ম এই যে, কোনো এক সূরায় বিসমিল্লাহ উচ্চস্বরে পড়তে হবে। কারণ এ কুরআনের একটি আয়াত। পুরে কুরআন পাঠকারীকে বিসমিল্লাহ পড়তে হবে এবং শ্রবণকারীকে শুনতে হবে। এজন্যে হাফেযকে উচ্চস্বরে পড়তে হবে। সাধারণত কুল হু আল্লাহ এর প্রথমে বিসমিল্লাহ পড়া হয়। এটা জরুরী নয়। যে কোনো সুরার শুরুতে পড়া যায়। যে কোনো সুরার সূতে পড়া উচিত যাতে করে লোকের এ ভুল ধারণা দূর হয় যে, কুল হু আল্লাহ এ শুরুতে পড়তে হয়। যাদের মতে এ প্রত্যেক সূরায় একটি আয়াত তাদের উচিত তারাবীর নামাযে প্রত্যেক সুরার শুরুতে তা পড়বে। হানাফী মতে বিসমিল্লাহ কুরআন মজীদের একটি আয়াত। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী এবং মক্কা ও কুফার ক্বারীগণের মতে এ প্রত্যেক সূরার একটি আয়াত।

 

২০. কেউ কেউ তারাবীতে তিনবার কুল হু আল্লাহু পড়ে (কেউ বলেন- কুল হু আল্লাহ তিনবার পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু নামাযে নয়, নামাযের বাইরে) তা পড়া মাকরূহ।

 

২১. কুরআন খতম করার পর সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার কুরআন শুরু করা সুন্নাত। নবী (সা) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ কাজ পছন্দ করেন যে, কেউ কুরআন খতম করলে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার শুরু করে ..................... পর্যন্ত পড়বে।

 

কুরআন তেলাওয়াতের নিয়মনীতি

 

১। তাহারাত পাক পবিত্রতা

 

কুরআন পাক আল্লাহ পাকের পবিত্র ও মহান কালাম। তাতে হাত লাগাতে এবং তেলাওয়াত করার জন্যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পুরোপুরি ব্যবস্থা দরকার। অযু না থাকলে অযু করা এবং গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল করা অপরিহার্য।

 

*******আরবী*********

 

তাতে সে ব্যক্তিই হাত লাগাতে পারে যে একান্ত পাক পবিত্র। (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৭৯)

 

হায়েয নেফাস ও জানাবাতের (গোসল ফরয হওয়া) অবস্থায় কুরআন শুনা তো জায়েয, কিন্তু পড়া এবং স্পর্শ করা হারাম। বিনা অযুতে পড়া জায়েয কিন্তু স্পর্শ করা ঠিক নয়। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) সকল অবস্থায় তেলাওয়াত করতেন এবং বিনা অযুতেও। কিন্তু জানাবাতের অবস্থায় কখনো তেলাওয়াত করতেন না। হযরত ওমর (রা) বলেন, হায়েয হয়েছে এমন নারী এবং গোসল ফরয হয়েছে এমন লোক কুরআন থেকে কিছুই পড়বে না। (অর্থাৎ এমন অবস্থায় কুরআন পড়া হারাম) (তিরমিযি)

 

২। কুরআন তেলাওয়াতের সময় নিয়ত খাটি হওয়া উচিত। তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং হেদায়াত চাওয়া। কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করা। নিজের খোশ এলহানের ওপর গর্ব করা, নিজের দীনদারির ঢাকঢোল পেটানো, লোকে প্রশংসা করুক এমন বাসনা পোষণ করা নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা। এমনিভাবে যারা মানুষ দেখানো কুরআন পড়ে অথবা দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্যে কুরআন পড়ে তারা কখনো কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করবে না। এস লোক কুরআন পড়া সত্ত্বেও কুরআন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। প্রকৃতপক্ষে যে নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা, অসৎ প্রবণতা এবং অসাধু উদ্দেশ্যে পোষণ করে,তার মধ্যে কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে না কোনো অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে, আর না কুরআনের পরিচয় ও নিগূঢ় তত্ত্ব লাভ করতে পারে।

 

৩। নিয়মিত পাঠ এবং একে অপরিহার্য মনে করা

 

কুরআন পাঠ দৈনিক নিয়মিতভাবে হওয়া উচিত। কোনো দিন বাদ না দিয়ে দৈনিক পড়া মুস্তাহাব। তেলাওয়াত যে কোনো সময়ে করা যায় কিন্তু উপযুক্ত সময় হচ্ছে সকাল বাদ ফজর। যাদেরকে আল্লাহ কুরআন হিফয করার সৌভাগ্য দিয়েছেন তাদের তো দৈনিক পড়া এজন্যে নেহায়েত জরুরী যে, না পড়লে মনে থাকবে না। আর কুরআন পাক মুখস্থ করার পর ভুলে যাওয়া কঠিন গোনাহের কাজ। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাক মুখস্থ করেছে, তারপর ভুলে গিয়েছে সে কেয়ামতের দিন কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হবে। (বুখারী)

 

নবী (সা) আরও বলেন-

 

কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করো, নতুবা এ তোমাদের বক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম, রশি ঢিল করলে যেমন উট পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি সামান্য অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাবের জন্যে কুরআন বক্ষ থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। (মুসলিম)

 

নিয়মিত তেলাওয়াতের প্রেরণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়লো এবং দৈনিক নিয়মিত তেলাওয়াত করতে থাকলো, তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ থলিয়ার মতো যার সুগন্ধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়া শিখেছে কিন্তু তা তেলাওয়াত করে না তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ বোতলের মতো যা কর্ক বা ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে। (তিরমিযি)

 

খোশ এলহানের সাথে তেলাওয়াত করার বিরাট সওয়াব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, কেয়ামতের দিনে কুরআন পাঠকারীদের বলা হবে, তোমরা যেমন থেমে ও খোশ এলহানে দুনিয়ায় কুরআন পড়তে তেমনি পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে এক একটি স্তর ওপরে উঠতে থাক। তোমার ঠিকানা হবে তোমার শেষ আয়াতের নিকটে। (তিরমিযি)

 

রাগ-রাগিনীসহ কুরআন পাঠ মাকরূহ তাহরীমি। এর থেকে বিরত থাকতে হবে।

 

৪। কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনা

 

উৎসাহ উদ্দীপনাসহ কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনাও হওয়া উচিত। হযরত খালেদ বিন মাদান বলেন, কুরআন শুনার সওয়াব কুরআন পড়ার দ্বিগুণ। (দারেমী)

 

নবী (সা) অন্যের কুরআন পড়ার শুনতে বড়ো ভালবাসতেন। একবার তিনি হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কে বললেন, আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বললেন, হুজুর আপনাকে কুরআন শুনাবো? কুরআন তো আপনার ওপরে নাযিল হয়েছে। নবী (সা)বললেন, হ্যাঁ শুনাও। কেউ পড়লে তা শুনতে আমার বড়ো ভালো লাগে। তখন হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) সূরা নিসা পড়া শুরু করলেন। যখন তিনি পড়লেন-

 

*******আরবী*********

 

চিন্তা করে দেখ, তখন কি অবস্থা হবে যখন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষ্যদাতা নিয়ে আসব এবং তাদের ওপর তোমাকে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দাঁড় করাব। (সূরা আন নিসাঃ৪১)

 

তখন নবী (সা) বললেন, থাম, থাম।

 

হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি দেখলাম নবী (স)এর দু চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। (বুখারী)

 

হযরত আবু মূসা (রা) খুব সুন্দর কুরআন পড়তেন। যখনই তার সাথে হযরত ওমর (রা) এর দেখা হতো, তিনি বলতেন, আবু মূসা, আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ করিয়ে দাও। তখন আবু মূসা কুরআন তেলাওয়াত শুরু করতেন। (সুনানে দারেমী)

 

৫। চিন্তা গবেষণা

 

কুরআন বুঝে শুনে পড়া, তার আয়াতগুলোর ওপরে চিন্তা গবেষণা করা এবং  তার দাওয়াত ও হেকমত আয়ত্ত করার অভ্যাস করা উচিত। এ সংকল্প নিয়ে তেলাওয়াত করা উচিত যে, তার আদেশগুলো মানতে হবে এবং নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহর কেতাব তো এজন্যেই নাযিল হয়েছে যে, তা বুঝে শুনে পড়তে এবং তার হুকুমগুলোর ওপর আমল করতে হবে।

 

আল্লাহ বলেনঃ

 

*******আরবী*********

 

যে কেতাব তোমার ওপরে নাযিল করেছিলাম তা বরকতপূর্ণ যাতে করে তারা এর আয়াতগুলো ওপর চিন্তা গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ ২৯)

 

ফর ফর করে দ্রুত কয়েক সূরা পড়ার চেয়ে অল্প কিছু চিন্তা ভাবনা করে ও বুঝে পড়া অনেক ভালো। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেনঃ ক্বাদর এবং আল কারি’আ এর মতো ছোট ছোট সূরা বুঝে পড়া অনেক ভালো ফর ফর করে আল  ইমরান এবং বাকারা পড়ার চেয়ে।

 

নফল নামাযে এটাও জায়েয যে, কেউ একই সূরা অথবা একই আয়াত বার বার পড়বে। তার মর্মকথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করবে এবং মহব্বতের সাথে বার বার পড়বে। একবার নবী (সা) একই আয়াত বারবার সারারাত পড়তে থাকনে এবং এভাবে ভোর হয়ে যায়। আয়াতটি হলো-

 

*******আরবী*********

 

হে রব! তুমি যদি তাদেরকে আযাব দাও তাহলে এরা তো তোমার বান্দাহ। আর যদি ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ। (সূরা আল মায়েদাঃ ১১৮)

 

অবশ্য কুরআনের অর্থ ও মর্ম না জেনে তেলাওয়াত করারও বিরাট সওয়াব রয়েছে কিন্তু যে তেলাওয়াতের দ্বারা অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাযকিয়া হয় এবং আমলে প্রেরণা সঞ্চার হয় তাহলো বুঝে শুনে পড়া।

 

নবী (সা) বলেনঃ লোহা যেমন পানিতে জং ধরে, তেমনি অন্তরে জং ধরে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে এ জং দূর করার উপায় কি? নবী (স) বললেন, বেশী বেশী মৃত্যুতে স্মরণ করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা।

 

তাওরাতে আছে, আল্লাহ বলেন, বান্দাহ! তোমার লজ্জা করেন যে, যখন সফরে তোমার কাছে তোমার ভাইয়ের চিঠি আসে তখন তুমি থেমে যাও অথবা রাস্তা থেকে সরে গিয়ে বসে পড় এবং তার এক একটি অক্ষর পড়তে থাক ও তার ওপর চিন্তা গবেষণা কর। আর এক কেতাব (তাওরাত) হচ্ছে আমার ফরমান যা তোমার জন্যে পাঠিয়েছি যাতে করে তুমি সবসময় চিন্তা-গবেষণা করতে পার এবং তার হুকুমগুলো মেনে চলতে পার। কিন্তু তুমি এটা মানতে অস্বীকার করছো এবং তার হুকুম মেনে চলতে গড়িমসি করছ আর যদি তা পড় তো তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা কর না। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

 

হযরত হাসান বসরী (রা) বলেন, ইসলামের প্রথম যুগের লোকেরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন যে, কুরআন হচ্ছে আল্লাহর ফরমান এবং তার পক্ষ থেকে  এ নাযিল হয়েছে। বস্তুত তারা রাতের বেলায় গভীর মনোনিবেশ সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং দিনের বেলায় তার হুকুমগুলো মেনে চলতেন। কিন্তু তোমাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা শুধুমাত্র তার শব্দগুলো পড় এবং অক্ষরগুলোর যের যবরও দুরস্ত কর। কিন্তু আমলের দিক দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, তোমরা এ ব্যাপারে একেবারে পেছনে রয়েছ। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

 

৬। একনিষ্ঠা ও বিনয়

 

পূর্ণ একাগ্রতা, আগ্রহ ও বিনয় নিষ্ঠার সাথে কেবলা মুখী হয়ে তেলাওয়াত করা উচিত। তেলাওয়াতের সময় অবহেলা করে ও বেপরোয়া হয়ে, এদিক সেদিক তাকানো, কারো সাথে কথাবার্তা বলা, এমন কোনো কাজ করা যাতে একাগ্রতা নষ্ট হয় এসব কিছুই মাকরূহ বা অবাঞ্ছিত কাজ।

 

৭। তাউয-তাসমিয়া

 

তেলাওয়াত শুরু করার সময় *******আরবী****** পড়া উচিত।মাঝে অন্য কোনো কাজের দিক মন দিলে কিংবা কারো সাথে কথাবার্তা বললে পুনরায় *****আরবী********* পড়া উচিত। নামাযের বাইরে প্রত্যেক সূরার শুরুতে পড়া *******আরবী*********মুস্তাহাব। শুধু সূরা তাওবার শুরুতে *******আরবী********* না পড়া উচিত।

 

৮। তেলাওয়াতের সময় কুরআন পাকের বিষয়বস্তু থেকে প্রভাব গ্রহণ এবং তা প্রকাশ করা মুস্তাহাব। (কিন্তু এ ব্যাপারে অত্যন্ত হুশিয়ার ও সজাগ থাকতে হবে। কারণ রিয়া মানুষের সকল নেক আমল  বরবাদ করে দেয়।) যখন পুরস্কার এবং জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতের উল্লেখ করা হয় এবং মুমিনদেরকে রহমত ও মাগফিরাতের কল্যাণ ও নাজাতের, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দীদারের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন আনন্দিত হওয়া উচিত। আর যখন আল্লাহর রাগ ও গজব, জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি, জাহান্নামবাসীর আর্তনাদ প্রভৃতির উল্লেখ সম্বলিত আয়াতগুলো পড়া হবে, তখন তার ভয়ে কাদা উচিত। যদি কান্না না আসে তো কান্নার চেষ্টা করতে হবে। নবী (স) তেলাওয়াতের সময় আযাবের আয়াত পড়ে দোয়া করতেন এবং ক্ষমা করে দেয়ার আয়াত পড়লে তাসবিহ পড়তেন।

 

৯। আওয়াজে ভারসাম্য

 

তেলাওয়াত অতি উচ্চস্বরে ও অতি নিম্নস্বরে নয় বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বরে পড়তে হবে যেন নিজের মনও সেদিকে আকৃষ্ট হয় এবং শ্রোতাদের শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাহলে চিন্তা-ভাবনার দিকে মন আকৃষ্ট হবে।

 

কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

এবং নামায বেশী উচ্চস্বরে পড়ো না, আর না একেবারে নিম্নস্বরে। বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বর অবলম্বন করবে। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১১০)

 

১০। তাহাজ্জুদে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন

 

তেলাওয়াত যখনই করা হোক না কেন তা প্রতিদান ও সওয়াবের বিষয় এবং হেদায়াতের কারণ হয়, কিন্তু বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযে কুরআন তেলাওয়াতের ফযিলত সবচেয়ে বেশী। আর একজন মুমিনের এটাই আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত যে, সে উচ্চ থেকে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করে। তাহাজ্জুদের মনোরম সময় রিয়া, প্রদর্শনী ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত; লিল্লাহিয়াত ও আল্লাহর দিকে একমুখী হওয়ার উৎকৃষ্টতম এক পরিবেশ, বিশেষ করে মানুষ যখন আল্লাহর সামনে দাড়িয়ে একনিষ্ঠা ও আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করতে থাকে। নবী (স) তাহাজ্জুদে লম্বা তেলাওয়াত করতেন।

 

১১। কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন

 

নামায ছাড়া অন্য সময় কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াত করলে অধিক সওয়াব ও উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়। একেতো তেলাওয়াত করার সওয়াব দ্বিতীয়তঃ কালামুল্লাহকে হাতে স্পর্শ করার এবং স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সওয়াব ও বদলা। (এতকাল)

 

১২। ক্রমিক পদ্ধতির লক্ষ্য

 

কুরআনে যে ক্রমিক পদ্ধতি রয়েছে সূরাগুলো সে ক্রমানুসারে পড়া উচিত। অবশ্যই শিশুদের পাট সহজ করার জন্যে এ ক্রমিক ধারা অবলম্বন না করা পড়া জায়েয। যেমন আমপারা সূরা নাস থেকে উল্টো দিকে সূরা নাবা পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে কুরআন পাকের ক্রমিক পদ্ধতির খেলাপ তেলাওয়াত করা সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ।

 

১৩। মনের গভীর একাগ্রতা

 

অনেকে অযীফা ও যিকির আযকার গভীর একাগ্রতার সাথে করে থাকেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন। কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত ততোটা একাগ্রতার সাথে করেন না। অথচ কুরআন তেলাওয়াতের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো যিকির অযীফা হতে পারে না। এর চেয়ে ভালো তাযকিয়ার নফসের (আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির) উপায় আর কিছু হতে পারে না, কুরআনের ওপরে অন্য কোনো অযীফাকে প্রাধান্য দেয়া দীনকে ভালোভাবে উপলব্ধি না করারই ফল এবং তা গোনাহও বটে। নবী (স) বলেন, বান্দাহ তেলাওয়াতে কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহর বেশী নিকটবর্তী হতে পারে। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

 

নবী (সা) বলেন, আমার উম্মতের জন্যে সবচেয়ে ভালো ইবাদাত হচ্ছে তেলাওয়াতে কুরআন।

 

১৪। তেলাওয়াতের পর দোয়া

 

তেলাওয়াতের পর নিম্নের দোয়া পড়া সুন্নাতঃ

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ!তুমি কুরআনের অসিলায় আমার ওপর রহম কর, তাকে আমার পথপ্রদর্শক, নূর, হেদায়াত ও রহমত বানিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তার মধ্যে যা কিছু ভুলে যাই তা স্মরণ করিয়ে দাও, আর যা জানি না তা শিখিয়ে দাও এবং আমাকে তাওফিক দাও যেন রাতের কিছু অংশে এবং সকাল সন্ধ্যায় তা তেলাওয়াত করতে পারি। আর হে রাব্বুল আলামীন তুমি তাকে আমার সপক্ষে দলীল প্রমাণ বানিয়ে দাও।

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের বয়ান

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের হুকুম

 

কুরআন চৌদ্দটি (আহলে হাদীসের নিকটে পনেরো আয়াত। তারা সূরা হজ্জের ৭৭ আয়াতেও সিজদা করেন। শাফেয়ীদের মতেও তাই)আয়াত এমন আছে যা পড়লে বা শুনলে সিজদা করা ওয়াজিব হয়। (ইমাম আবু হানীফা ছাড়া অন্যান্যদের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াত সুন্নাত।)তা পুরো আয়াত পড়া হোক অথবা পূর্বাপর সহ সিজদার শব্দ (ঐসব আয়াতের উপর রেখা টানা থাকে)পড়া হোক সিজদা ওয়াজিব হয়ে যাবে। একে সিজদায়ে তেলাওয়াত বলে।

 

নবী (স) যখন কেউ সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করে তখন শয়তান এক ধারে বসে বিলাপ করতে থাকে এবং বলে হয় আফসোস, আদম সন্তানদের সিজদার হুকুম দেয়া হলে তারা সিজদা করলো এবং জান্নাতের হকদার হলো। আমাকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হলে আমি অস্বীকার করে জাহান্নামের হকদার হলাম। (মুসলিম, ইবনে মাজা)

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের স্থানগুলো

 

সূরা আরাফের ২০৬ আয়াত, সুরা রাদের ১৫ আয়াত, সূরা নহলের ৪৯, ৫০আয়াত, সুরা বনী ইসরাঈলের ১০৯আয়াত, সুরা মরিয়মের ৫৮ আয়াত, সূরা হজ্জের ১৮ আয়াত, সূরা ফুরকানের ৬০ আয়াত,সূরা আন নামলের ২৫-২৫ আয়াত, সূরা হা-মীম সাজদার ৩৮ আয়াত, সূরা আন নাজমের ৬২ আয়াত, সূরা ইনশিকাকের ২০-২১ আয়াত এবং সূরায়ে আলাকের ১৯ আয়াত।

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্ত

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্তঃ

 

(অর্থাৎ নামাযের যেসব শর্ত,সিজদায়ে তেলাওয়াতেরও তাই। যেসব কারণে নামায নষ্ট হয়, সেসব কারণে সিজদায়ে তেলাওয়াত নষ্ট হয়।)

 

১. তাহারাত

 

শরীক পাক হওয়া। অর্থাৎ নাজাসাতে গালীযা থেকে পাক হতে হবে। নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক হতে হবে। অযু না থাকলে অযু করতে হবে এবং গোসলের দরকার হল গোসল করতে হবে।

 

  •  
  • পোশাক পাক হওয়া।
  •  
  • নামাযের স্থান পাক হওয়া।
  •  
  • সতর ঢাকা।
  •  
  • কেবলার দিকে মুখ করা।
  •  
  • সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করা।
  •  

 

অধিকাংশ আলেমের এ মত। কিন্তু কোনো কোনো আলেমের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াতের জন্যে অযু থাকা জরুরী নয়। আহলে হাদীসের মতে অযুসহ সিজদায়ে তেলাওয়াত তো উত্তম কিন্তু বিনা অযুতেও জায়েয।

 

আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেনঃ

 

এ সিজদার জন্যে অধিকাংশ আলেম ঐসব শর্তের পক্ষে যা নামাযের শর্ত। কিন্তু যতো হাদীস সিজদায়ে তেলাওয়াত সম্পর্কে পাওয়া যায় তার মধ্যে এসব শর্তের জন্যে কোনো দলিল নেই। তার থেকে এটাই মনে হয় যে, সিজদার আয়াত শুনার পর যে যেখানে যে অবস্থায় আছে সিজদাহ করবে তা অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী হওয়া সম্ভব হোক বা না হোক। প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক পাওয়া যায় যারা এ পদ্ধতিতে আমল করেছেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি পথ চলতে চলতে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোথাও সিজদার আয়াত এলে ব্যাস মাথা নত করতেন। অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী থাকুন বা না থাকুন। এসব কারণে আমরা মনে করি যে, যদি কেউ অধিকাংশ আলেমগণের খেলাফ আমল করে তাহলে তাকে মন্দ বলা যাবে না। কারণ আলেম সাধারণের মতের সমর্থনে কোনো প্রমাণিত সুন্নাত নেই এবং প্রথম যুগে মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায় যাদের আমল আলেম সাধারণের মতের খেলাপ ছিল। (তাফহীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, সূরা আল আরাফ, টীকা ১৫৭)

 

সিজদার জন্যে এ নিয়ত করা শর্ত নয় যে, এ সিজদা অমুক আয়াতের। আর যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করা হয় তো নিয়ত শর্ত নয়।

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ম

 

কেবলামুখী দাড়িয়ে সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করতে হবে এবং আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। সিজদা করার পর আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাড়াতে হবে। তাশাহুদ পড়ার ও সালাম ফেরানোর দরকার নেই।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, যখন তোমরা সিজদার আয়াতে পৌছবে তখন আল্লাহ আকবার বলে সিজদায় যাবে এবং মাথা উঠাবার সময় আল্লাহু আকবার বলবে। (আবু দাউদ)

 

বসে বসেও সিজদায়ে তেলাওয়াত করা যায় তবে দাড়িয়ে সিজদায় যাওয়া মুস্তাহাব।

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা ছাড়াও অন্য মাসনুন তসবিহ পড়া যায়। কিন্তু ফরয নামাযে সিজদায়ে তেলাওয়াত করতে হলে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা পড়া ভালো। অবশ্যই নফল নামায অথবা নামাযের বাইরে সিজদায়ে তেলাওয়াতে যে কোনো তসবিহ পড়া যায়। যেমন নিম্নের তসবিহ পড়া যেতে পারেঃ

 

*******আরবী*********

 

আমার চেহারা সেই সত্তাকে সিজদা করছে যিনি তাকে পয়দা করেছেন এবং তার মধ্যে কান ও চোখ দিয়েছেন। এসব তারই শক্তির দ্বারা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মহত্ব ও বরকতের উৎস, যিনি সর্বোৎকৃষ্ট স্রষ্টা।

 

সিজদায়ে তেলাওয়াতের মাসায়েল

 

১. সিজদায়ে তেলাওয়াত তাদের ওপর ওয়াজিব যাদের ওপর নামায ওয়াজিব। হায়েয নেফাস হয়েছে এমন নারী এবং নাবালেগদের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব নয়। এমন বেহুশ লেকের ওপরও ওয়াজিব নয় যে একদিন এক রাতের বেশী বেহুশ রয়েছে।

 

২. সিজদার আয়াত নামাযে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সিজদাহ ওয়াজিব হবে বিলম্বের অনুমতি নেই। নামাযের বাইরে সিজদার আয়াত পড়লে তৎক্ষণাৎ সিজদা করা ভালো। বিলম্বেও কোনো দোষ নেই। অবশ্যই বিনা কারণে বেশী বিলম্ব করা মাকরূহ।

 

৩.যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়া হয়। তাহলে এ সিজদা ঐ নামাযেই আদায় করা ওয়াজিব হবে। যদি সিজদার আয়াত পড়ে কেউ অন্য কোনো নামাযে সিজদা আদায় করে তাহলে জায়েয হবে না। যদি কেউ সিজদার আয়াত পড়ে নামাযের মধ্যে সিজদাহ করতে ভুলে যায় তাহলে তওবা এস্তেগফার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। হ্যাঁ যদি এ নামায নষ্ট হয় তাহলে নামাযের বাইরে সিজদাহ করা যাবে।

 

৪. কেউ নামায পড়ছে বা পড়াচ্ছে। সে যদি অন্য কারো কাছে সিজদার আয়াত শুনে, তা সে অন্য লোক নামাযেই পড়ুক অথবা নামাযের বাইরে পড়ুক, তাহলে শ্রবণকারী নামাযী বা ইমামের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব হবে না।

 

৫. কোনো মুক্তাদী সিজদার আয়াত পড়লে, না ইমামের ওপর না মুক্তাদীর ওপর সিজদাহ ওয়াজিব হবে।

 

৬. কেউ ইমামের নিকটে সিজদার আয়াত শুনলো কিন্তু সে এমন সময় জামায়াতে শামিল হলো যখন সিজদাহ করে ফেলেছে। তাহলে যদি সে ঐ রাকায়াত পেয়ে যায় যে রাকায়াতে ইমাম সিজদাহ করেছে তাহলে তারও সিজদাহ হয়ে যাবে। কিন্তু পরের রাকায়াতে শামিল হলে তাকে নামাযের পর সিজদাহ করতে হবে।

 

৭. কেউ যদি মনে মনে সিজদার আয়াত পড়ে, মুখে না পড়ে। অথবা শুধু লেখে অথবা এক এক অক্ষর পড়ে, তাহলে সিজদা ওয়াজিব হবে না।

 

৮. যদি একই স্থানে সিজদার আয়াত বার বার পড়ে তাহলে একই সিজদাহ দিতে হবে। আর যদি কয়েক সিজদার আয়াত পড়ে তাহলে যতো আয়াত পড়বে ততো সিজদাহ করতে হবে। আবার এক আয়াত কয়েক স্থানে পড়লে যতো স্থানে পড়বে ততবার সিজদাহ করতে হবে।

 

৯। তেলাওয়াতের সময় সকল শ্রোতার যদি অযু থাক, তাহলে সিজদার আয়াত উচ্চস্বরে পড়া ভালো। কিন্তু বিনা অযুতে থাকলে অথবা সিজদাহ করার অবকাশ না থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে পড়া ভালো এজন্যে যে, তারা অন্য সময়ে সিজদাহ করতে ভুলে যেতে পারে এবং গুনাহগার হবে।

 

১০. সিজদার আয়াতের আগে এবং পরের আয়াত পড়া এবং সিজদার আয়াত বাদ দেয়া অথবা পুরো সূরা পড়া এবং সিজদার শেষ আয়াত বাদ দেয়া মাকরূহ।

 

১১. কিছু নাদান লোক কুরআন পড়তে পড়তে সিজদার আয়াতে পৌছলে কুরআনের ওপরেই সিজদাহ করে। এভাবে সিজদা আদায় হবে না। সিজদায়ে তেলাওয়াত ঐভাবে আদায় করা উচিত যা ওপরে বলা হয়েছে।

 

১২. সিররী (যা আস্ত পড়া হয়) নামাযগুলোতে এমন সূরা পড়া উচিত নয় যাতে সিজদাহ আছে। এমনি জুমা ও দু ঈদের নামাযে পড়া উচিত নয় যেখানে বিরাট জামায়াত হয়। তাহলে মুক্তাদীদের সন্দেহের সৃষ্টি এবং নামায নষ্ট হবে।

 

শুকরানা সিজদাহ

 

শুনে অথবা আল্লাহর রহমতে কোনো বিরাট নিয়ামত লাভ করে অথবা কোনো ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করে অথবা কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় অথবা কোনো বিপদ মুসিবত দূর হয়ে যায় তখন আল্লাহর ফজল ও করমের জন্যে শুকরানা সিজদাহ আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু এ সিজদাহ নামাযের সাথে সাথেই না করা উচিত। নতুবা অজ্ঞ লোক একে নামাযের অংশ মনে করতে থাকবে অথবা এটা সুন্নাত মনে করে পালন করতে থাকবে। এ নামায থেকে পৃথক সিজদাহ। এজন্যে তা এমনভাবেই করা উচিত যাতে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে। হযরত আবু বকর (রা) বলেন, নবী (স) যখন কোনো ব্যাপারে খুশী হতেন অথবা কোনো সুসংবাদ শুনতেন তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য সিজদাহ করতেন। (তিরমিযি)

 

কোনো কোনো লোক বেতরের পর দু সিজদাহ করে এবং তা সুন্নাত মনে করে এটা ভুল। সুন্নাত মনে করে তা করা ভুল এবং ত্যাগ করা উচিত।

 

এতেকাফের অর্থ

 

অভিধানে কোনো স্থানে আটকে পড়া অথবা কোনো স্থানে থেমে যাওয়াকে এতেকাফ বলে। শরীয়াতের পরিভাষায় এতেকাফের অর্থ কোনো লোকের দুনিয়ার সংস্রব, সম্বন্ধ ও বিবি বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে মসজিদে অবস্থান করা।

 

এতেকাফের মর্মকথা

 

এতেকাফ হচ্ছে এই যে, মানুষ দুনিয়াবি কারবার ও সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সাংসারিক কর্ম ব্যস্ততা ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা ও কাজের শক্তি এবং যোগ্যতাকে আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদাতে লাগিয়ে দেবে। তারপর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর প্রতিবেশী হয়ে পড়বে। এ কাজের দ্বারা একদিকে সে ব্যক্তি সকল প্রকার বেহুদা কথাবার্তা ও মন্দ কাজ থেকে বেচে থাকতে পারবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। তার নৈকট্য লাভ করবে এবং তার ইয়াদ ও ইবাদাতে মনে শান্তি লাভ করবে। কয়েকদিনের তারবিয়াতের এ আমল তার মনের ওপর এমন গভীর ছাপ ফেলবে যে, চারিদিকে দুনিয়ার রং তামাশা ও মন ভুলানো বস্তুসমূহ দেখার পরও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত রাখতে পারবে। আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাচতে পারবে এবং তার হুকুম পালন করে আনন্দ অনুভব করবে। এমনিভাবে সমগ্র জীবন আল্লাহর বন্দেগীতে কাটিয়ে দেবে।

 

এতেকাফের প্রকারভেদ

 

এতেকাফ তিন প্রকার ওয়াজিব, মুস্তাহাব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

 

ওয়াজেব এতেকাফ

 

মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। কেউ এমনি এতেকাফের মানত করলো অথবা কোনো শর্তসহ মানত করলো যেমন কেউ বললো, যদি আমি পরীক্ষায় পাশ করি, অথবা যদি আমার অমুক কাজ হয়ে যায় তাহলে এতেকাফ করবো। তাহলে এ এতেকাফ ওয়াজিব হবে এবং তা পূরণ করতে হবে।

 

মুস্তাহাব এতেকাফ

 

রমযানে শেষ দশদিন ব্যতিরেকে যতো এতেকাফ করা হবে তা মুস্তাহাব হবে তা রমযানের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দশদিনে অথবা যে কোনো মাসে করা হোক।

 

সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এতেকাফ

 

রমযানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করা সুন্নাত মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ মুসলমানদের সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাতের ব্যবস্থাপনা করা উচিত কারণ হাদীসগুলোতে এ বিষয়ে তাকীদ করা হয়েছে।

 

কুরআন পাকে আছেঃ

 

*******আরবী*********

 

আপন স্ত্রীদের সাথে মিলিত হইও না যখন তোমরা মসজিদে এতেকাফ থাকবে। (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৭)

 

নবী (স) নিয়মিতভাবে প্রতি বছর এতেকাফ করতেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তা পালন করেন। একবার কোনো কারণে এতেকাফ করতে পারেননি বলে পরের বছর বিশদিন পর্যন্ত এতেকাফ করেন। এজন্যে মুসলমানগণ যদি সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাত পরিত্যাগ করে তাহরে গোনাহগার হবে। যদি বস্তির কিছু লোকও এ সুন্নাত পালনের ব্যবস্থাপনা করে তাহলে, যেহেতু তা সুন্নাতে কেফায়া, এ অল্প লোকের এতেকাফ সকলের জন্যে যথেষ্ট হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে যদি গোটা মুসলিম সমাজ এর থেকে বেপরোয়া হয়ে পড়ে এবং নবীর এ প্রিয় সুন্নাতটি একেবারে টিমে যাবে।

 

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এ আমল তার মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে। তার এন্তেকালের পর তার বিবিগণ এতেকাফের নিয়ম পালন করেন। (বুখারী, মুসলিম)

 

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এক বছর তিনি এতেকাফ করতে পারেন নি। সে জন্যে পরের বছর বিশদিন এতেকাফ করেন। (তিরমিযি)

 

সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ

 

মসজিদুল হারামে এতেকাফ করলে তা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ। তারপর মসজিদে নববীতে এবং তারপর বায়তুল মাকদেসে। তারপর উৎকৃষ্ট এতেকাফ হয় কোনো জামে মসজিদে করলে যেখানে রীতিমতো জামায়াতে নামায হয়। তারপর মহল্লার মসজিদে যেখানে জামায়াতে নামায হয়।

 

এতেকাফের শর্ত

 

এতেকাফের চারটি শর্ত রয়েছে যা ব্যতিরেকে এতেকাফ সহীহ হবে না।

 

১। মসজিদে অবস্থান

 

পুরুষের জন্যে জরুরী যে, সে মসজিদে এতেকাফ করবে তাতে পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতসহ নামায হোক বা না হোক। (ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকটে এটা জরুরী যে, যে মসজিদে জামায়াত হয় তাতে এতেকাফ করতে হবে। ইমাম মুহাম্মাদ (রা) ও ইমাম আবু ইউসুফ (র) এর মতে প্রত্যেক মসজিদেই এতেকাফ দুরস্ত হবে। সে যুগে এর ওপরেই ফতোয়া হয়।-দুরুরল মুখতার)মসজিদ ছাড়া পুরুষের এতেকাফ সহীহ হবে না।

 

২। নিয়ত

 

অন্যান্য ইবাদাতের জন্যে যেমন নিয়ত শর্ত তেমনি এতেকাফের জন্যে নিয়ত শর্ত। নিয়ত ছাড়া এতেকাফ হবে না নিয়ত ছাড়া এমনি যদি কেউ মসজিদে অবস্থান করে তাহলে এ অবস্থান এতেকাফ হবে না। তারপর এটাও ঠিক যে ইবাদাতের নিয়ত তখন মাত্রই সহীহ হতে পারে যখন নিয়তকারী মুসলমান হয়। তার জ্ঞান থাকতে হবে। বেহুশ বা পাগলের নিয়ত ধরা যাবে না।

 

৩। হাদীসে আকবর থেকে পাক হওয়া।

 

অর্থাৎ নারী পুরুষের গোসল ফরয হলে তা করে শরীর পাক করে নেবে এবং নারী হায়েয নেফাস থেকে পাক হবে।

 

৪। রোযা

 

এতেকাফ রোযা রাখাও শর্ত। অবশ্য তা শুধু ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে। মুস্তাহাব এতেকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। আর সুন্নাত এতেকাফের জন্যে রোযা শর্ত এজন্য নয় যে, তাও রমযান মাসেই করতে হবে।

 

এতেকাফের নিয়মনীতি

 

১. ওয়াজিব এতেকাফ অন্ততপক্ষে একদিনের জন্যে হতে পারে। তার কম সময়ের জন্যে হবে না এজন্য ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত।

 

২. ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত বটে। কিন্তু এটা জরুরী নয় যে, সে রোযা খাস করে এতেকাফের জন্যে করতে হবে। যেমন কেউ রমযান মাসে এতেকাফের মানত করলো। তাহলে এতেকাফ সহীহ হবে। রমযানের রোযাই এতেকাফের জন্যে যথেষ্ট। অবশ্য এটা জরুরী যে এতেকাফে যে রোযা রাখা হবে তা ওয়াজিব হতে হবে, নফল নয়।

 

৩. ওয়াজিব এতেকাফের মুদ্দত কমপক্ষে একদিন এবং বেশী যতো ইচ্ছা হতে পারে।

 

৪. মুস্তাহাব এতেকাফের কম মুদ্দত নির্ধারিত নেই, কয়েক মিনিটের এতেকাফও হতে পারে।

 

৫. ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে যেহেতু রোযা শর্ত সেজন্যে কেউ যদি রোযা না রাখার নিয়ত করে তবুও রোযা রাখা অপরিহার্য হবে এবং এজন্যে যদি কেউ শুধু রাতের জন্যে এতেকাফের নিয়ত করে তা অর্থহীন হবে।

 

৬. যদি কেউ রাত ও দিনের এতেকাফের নিয়ত করে অথবা কয়েক দিনের এতেকাফের নিয়ত করে তাহলে রাত তার মধ্যে শামিল মনে করতে হবে এবং রাতেও এতেকাফ করতে হবে। তবে যদি এক দিনের এতেকাফের মানত করা হয় তাহলে সারাদিনের এতেকাফ ওয়াজিব হবে রাতের এতেকাফ ওয়াজিব হবে না।

 

৭. মেয়েদের নিজ ঘরেই এতেকাফ করা উচিত। তাদের মসজিদে এতেকাফ করা মকরূহ তানযিহী। সাধারণত ঘরে যে স্থানে তারা নামায পড়ে তা পর্দা দিয়ে ঘিরে নেবে এবং এতেকাফের জন্যে তা নির্দিষ্ট করে নেবে।

 

৮. রমযানের শেষ দশদিনে যেহেতু এতেকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া, এজন্যে সেটা করা উচিত যাতে বাড়ির কিছু লোক অবশ্যই এর ব্যবস্থা করতে পারে। যদি এর প্রতি অবহেলা করা হয় এবং মহল্লার কেউ যদি এতেকাফ না করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে।

 

৯. ওয়াজিব এতেকাফ যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে তার কাযা ওয়াজিব হবে। অবশ্য সুন্নাত মুস্তাহাব এতেকাফের কাযা নেই।

 

এতেকাফের মসনুন সময়

 

এতেকাফের মসনুন সময় রমযানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু পূর্ব থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। তা চাঁদ ২৯শে রমযান উদয় হোক না কেন অথবা ৩০শে রমযানে যে কোনো অবস্থায় মসনুন এতেকাফ পূর্ণ হয়ে যাবে।

 

এতেকাফকারী ২০শে রমযান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে পৌছবে এবং মেয়ে মানুষ হলে বাড়ীর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাবে যা সে নামাযের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত এতেকাফের স্থান থেকে বের হবে না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, যেমন পেশাব-পায়খানা অথবা ফরয গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরীয়াতের প্রয়োজন যেমন জুমার নামায প্রভৃতির জন্যে বের হওয়া জায়েয। কিন্তু প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই এতেকাফের স্থানে ফিরে যেতে হবে।

 

ওয়াজিব এতেকাফের সময়

 

ওয়াজিব এতেকাফের জন্য যেহেতু রোযা শর্ত সে জন্য তার কমসে কম সময় একদিন। একদিনের কম কয়েক ঘন্টার জন্য এতেকাফের মানত অর্থহীন, কারণ রোযার সময়ই হচ্ছে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

 

মুস্তাহাব এতেকাফের সময়

 

নফল এতেকাফ যে কোনো সময় হতে পারে। না এর জন্যে রোযা শর্ত আর না কোনো বিশেষ মাস বা সময়। যখনই কেউ মসজিদে থাকে নফল এতেকাফের নিয়ত করতে পারে। মসজিদে যে সময়টুকুই থাকবে তার সওয়াব পাবে।

 

এতেকাফের সময়ে মুস্তাহাব কাজ

 

১. যিকির আযকার করা দীনের মাসয়ালা মাসায়েল ও এলেম কালামের উপর চিন্তা ভাবনা করা। তসবিহ তাহলিল লিপ্ত থাকা।

 

২. কুরআন তেলাওয়াত ও তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা।

 

৩. দরূদ শরীফ ও অন্যান্য যিকির করা।

 

৪. দীন সম্পর্কে পড়াশুনা করা ও পড়ানো।

 

৫. ওয়াজ ও তাবলীগ করা।

 

৬. দীন সম্পর্কিত বই পুস্তক রচনায় লিপ্ত থাকা।

 

এতেকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েয

 

১. পেশাব পায়খানার জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়। মসজিদের নিকটে এমন স্থান আছে কিন্তু তা বেপর্দা অথবা অত্যন্ত নোংরা। তাহলে আপন বাড়ীতে পেশাব পায়খানার জন্যে যাওয়ার অনুমতি আছে।

 

২. ফরয গোসলের জন্যেও এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদেই গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে।

 

৩. খানা খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় যদি খানা নিয়ে আসর কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।

 

৪. জুমা ও ঈদের নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয। আর যদি এমন মসজিদে এতেকাফ করা হয় যেখানে জামায়াত করা হয় না। তাহলে পাঞ্জেগানা নামাযের জন্যে অন্যত্র যাওয়া জায়েয।

 

৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরঞ্চ জরুরী। কিন্তু এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

 

৬. কেউ যদি কোনো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাযের জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে কোনো দোষ হবে না।

 

৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরীয়াতের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।

 

৮. জুমার নামাযের জন্যে এতটা পূর্বে যাওয়া, যাতে করে তাহিয়্যাতুল মসজিদ এবং জুমার সুন্নাতগুলো নিশ্চিন্তে পড়া যায়, জায়েয আছে। সময়ের আন্দায এতেকাফকারীর ওপর নির্ভর করে।

 

৯. কাউকে যদি জোর করে এতেকাফের স্থান থেকে বের করে দেয়া হয় অথবা কেউ তাকে যদি বাইরে আটক রাখে তাহলেও এতেকাফ শেষ হয়ে যাবে।

 

১০. যদি কাউকে কোনো ঋণদাতা বাইরে আটক করে অথবা সে ব্যক্তি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এতেকাফের স্থানে পৌছাতে বিলম্ব হয়ে যায় তবুও এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

 

১১. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়ীতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা এতেকাফকারীর জায়েয।

 

১২. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।

 

১৩. যদি কেউ এতেকাফ করার নিয়ত করতে গিয়ে এ নিয়ত করে যে, সে জানাযার জন্যে যাবে তাহলে যাওয়া জায়েয। অন্য নিয়ত করলে তার জন্যে যাওয়া জায়েয হবে না।

 

১৪. এতেকাফ অবস্থায় কাউকে দীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।

 

এতেকাফে যেসব কাজ না জায়েয

 

১. এতেকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা ও চুমো দেয়াতে বীর্যপাত না হলে এতেকাফ নষ্ট হবে না।

 

২. এতেকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।

 

৩. এতেকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।

 

৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বরা মাকরূহ।

 

৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া জায়েয নয়। তাতে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

 

লায়লাতুল কদর

 

রমযানের শেষ দশদিনের মধ্যে এমন এক রাত আছে যাকে লায়লাতুল কদর এবং লায়লাতুম মুবারাকাতুন বলা হয়েছে এবং তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম বলা হয়েছে।

 

কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

আমরা এ কিতাবকে এর মুবারক রাতে নাযিল করেছি।

 

দ্বিতীয় আর এক স্থানে কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

অবশ্যই আমরা এ কুরআনকে লায়লাতুল কদরে নাযিল করেছি। তুমি জান, লায়লাতুল কদর কি? তা হচ্ছে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। (সূরা আল কদর)

 

 

 

লায়লাতুল কদরের অর্থ

 

কদরের দুটি অর্থ

 

এক- নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন।

 

*******আরবী*********

 

ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় আমাদের নির্দেশক্রমে। (সূরা দুখান)

 

কুরআনের অন্যত্র আছেঃ

 

*******আরবী*********

 

এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং বিশেষ করে জিবরাঈল নাযিল হন যারা তাদের রবের নির্দেশে সকল কার্য সম্পাদনের জন্যে নীচে নেমে আসেন। (সূরা আল কদরঃ ৪)

 

দুই কদরের দ্বিতীয় অর্থ মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত আল্লাহর নিকট যার বিরাট মহত্ব ও ফযীলত রয়েছে। তার মর্যাদা ও মহত্বের এ প্রমাণই যথেষ্ট যে, আল্লাহ সে রাতে কুরআনের মতো বিরাট নিয়ামত নাযিল করেছেন। এর চেয়ে বৃহত্তর কোনো নিয়ামত না মানুষ ধারণা করতে পারে আর না কামনা করতে পারে। এ মঙ্গল ও বরকত এবং মহত্ব ও ফযীলতের ভিত্তিতেই কুরআন তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে ঘোষণা করেছে।

 

লায়লাতুল কদর নির্ধারণ

 

হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, এ রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোনো একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে অথবা ২৯শে রাত। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন- রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)

 

এ রাতকে সুস্পষ্ট করে চিহ্নিত না করার তাৎপর্য এই যে, রমযানের এ শেষ দশদিনে যাতে করে যিকির ও ইবাদাতের বেশী করে ব্যবস্থাপনা করা যায়।

 

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) রমযানের শেষ দশ দিন যিকির ও ইবাদাতের এমন ব্যবস্থা করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না। (মুসলিম)

 

এ রাতে বেশী বেশী নামায বন্দেগী, যিকির, তাসবিহ ইত্যাদির প্রেরণা দান করে নবী (স) বলেন, যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহম ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাড়িয়ে বসে আল্লাহর ইয়াদ ও ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী)

 

নবী (সা) আরও বলেন, লোক সকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে যে ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ)

 

লায়লাতুল কদরের খাস দোয়া

 

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি তাকে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি কোন রাতটি লায়লাতুল কদর, তাহলে কি দোয়া করবো? তার জবাবে নবী (স) বলেন, এ দোয়া পড়বে।

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করেনেওয়ালা এবং বড়োই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমার গুনাহগুলো মাফ করে দাও।

 

সদকায়ে ফিতরের হুকুম আহকাম

 

যে বছর মুসলমানদের ওপর রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার জন্যে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেন। আল্লাহর ফরয করা ইবাদাতগুলো বান্দাহ সকল শর্ত ও নিয়মনীতি সহ পালন করার ব্যবস্থা করে, কিন্তু জ্ঞাত অজ্ঞাতসারে তার মধ্যে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে যায়। রোযার মধ্যে যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তার ক্ষতিপূরণের জন্যে রমযানের শেষে সদকায়ে ফিতর শরীয়তে ওয়াজিব করে দিয়েছে। এর দ্বারা তাদের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণও হবে এবং গরীব দুঃখী মুসলমান নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া পরার জিনিস পত্র সংগ্রহ করে সকল মুসলমানদের সাথে ঈদের নামাযে শরীক হতে পারবে।

 

যেসব সচ্ছল ব্যক্তির কাছে তার প্রয়োজন পূরণের পর এতোটা সম্পদ থাকবে যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ হয়, সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক তাকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

 

সদকায়ে ফিতর ঈদের দু একদিন আগে দিয়ে দিলে বেশী ভালো হয় নতুবা ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উচিত। ঈদের নামাযের পূর্বে দেয়া মুস্তাহাব।

 

গম দিতে হলে এক সের তিন ছটাক- যব তার দ্বিগুণ। কারো কারো মতে গম এক সের সারে বারো ছটাক। খুরমা মুনাক্কা গমের দ্বিগুণ দিতে হবে।

 

সদকায়ে ফিতর ঐ লোককে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া হয়।

 

 

 

হজ্জের অধ্যায়

 

হজ্জের বিবরণ

 

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজ্জের একটা ঈমান উদ্দীপনা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর প্রতি লক্ষ্য না রাখলে হজ্জের মহত্ব, তাৎপর্য ও মূল উদ্দেশ্যে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কুফর ও শিরক পরিবেশিত এক শক্তিশালী পরিবেশে এক মুমিন বান্দাহ খালেস তাওহীদের ঘোষণা করেন। তারপর বাতিল যালেম শক্তির চরম বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈমান, তাকওয়া, ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, এশক ও মহব্বত, ত্যাগ ও কুরবানী নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ আল্লাহর আনুগত্য ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নজিরবিহীন প্রেরণা ও আমলের দ্বারা ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস তৈরী করেন এবং তাওহীদ ও এখলাসের এমন এক কেন্দ্র তৈরী করেন যা দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার থেকে বিশ্ব মানবতা তাওহীদের পয়গাম পেতে থাকবে।

 

এ ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করার জন্যে এবং মানুষের মনে আবেগ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করার জন্যে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে তাওহীদের প্রেম পাগল পতঙ্গসমূহ ঐ কেন্দ্রে জমায়েত হয়ে ঐসব কিছুই করে যা তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ) করেছিলেন। তারা কখনো দু খন্ড কাপড় পরিধান করে আবেগ উচ্ছ্বাসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং কখনো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাদেরকে দৌড়াতে দেখা যায়। কখনো আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং কখনো কুরবানীগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর সাথে মহব্বতের শপথ গ্রহণ করে। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সকাল সন্ধ্যায় তাদের এ একই ধ্বনিতে হেরেমের গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে আয় আল্লাহ! তোমার দরবারে তোমার গোলাম হাজির আছে। প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র তোমারই, দয়া করা তোমারই কাজ, তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কেউ শরীক নেই।

 

প্রকৃতপক্ষে এসব অবস্থা সৃষ্টি করার এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ওপর সোপর্দ করারই নাম হজ্জ।

 

হজ্জের অর্থ

 

হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো যিয়ারতের এরাদা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় হজ্জের অর্থ হলো সেই সার্বিক ইবাদাত যা একজন বায়তুল্লাহ পৌঁছে করে থাকে। যেহেতু হজ্জে মুসলমান আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের এরাদা করে সে জন্যে একে হজ্জ বলা হয়।

 

হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত

 

ইসলামী ইবাদাত দুই প্রকারের। এক – দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা। দুই – মালের ইবাদত, যেমন সদকা যাকাত দান খয়রাত ইত্যাদি। হজ্জের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। অন্যান্য স্থায়ী ইবাদতগুলোর দ্বারা এখলাস, তাকওয়া, বিনয়, নম্রতা, বন্দেগীর পিপাসা। আনুগত্য, কুরবানী, ত্যাগ, আত্মসর্মপন, আল্লাহর নৈকট্য প্রভৃতির যে, প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথক পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে, হজ্জের সার্বিকতা এই যে, এ সকল অনুভূতি ভাবাবেগ ও মানসিক অবস্থা একই সময়ে এবং একই সাথে তৈরী হয় ও বিকাশ লাভ করে।

 

যে নামাজ দ্বীনের উৎস, তা কায়েম করার জন্য যমীনের উপর যে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরী করা হয়, হজ্জে মুমিনগণ সে মসজিদের চারপাশে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে তওয়াফ করে। সারা জীবন দূরদূরান্ত থেকে যে মসজিদের দিকে মুখ করে মুসলমান নামাজ পড়ে, হজ্জে তার এ সৌভাগ্য হয় যে, সে ঐ মসজিদে দাড়িয়ে নামাজ সমাধা করে।

 

যে রোজা মন ও চরিত্রের সংশোধনের উপযোগী ও অনিবার্য উপায় এবং যে রোজায় একজন মুমিন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় শক্তি লাভ করে ও আল্লাহর সিপাহী ও মুজাহিদ হওয়ার অভ্যাস করে।

 

হজ্জে ইহরাম বাধার সময় থেকে ইহরাম খোলা পর্যন্ত ঐরূপ সংগ্রাম সাধনায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, মন থেকে এক একটা চিত্র মুছে ফেলে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতের চিত্র অংকিত করে। দীন রাত তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত করে শুধু মাত্র তওহীদের পতাকাবাহী হয়ে যায়।

 

সদকা ও যাকাতে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ দান করে মুমিন বান্দাহ ধনলিপ্সার প্রবণতা মুছে ফেলে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করে । হজ্জেও লোক তার সারাজীবনের সঞ্চিত ধন শুধু আল্লাহর মহব্বতে মুক্ত হস্তে দান করে এবং তার পথে কুরবানী করে তার সাথে কৃত ওয়াদা চুক্তি পূরণ করে। মোটকথা, হজ্জের দ্বারা আল্লাহর সাথে প্রেমপূর্ন সম্পর্ক, মন, চরিত্রের সংশোধন এবং আধাত্নিক উন্নতির সকল উদ্দেশ্য একই সাথে পূর্ণ হয়। তবে শর্ত এই যে, হজ্জ শুধু মাত্র যেন হজ্জের অনুষ্ঠান পালনের কাজ না হয়।

 

হজ্জের হাকীকত

 

হজ্জের হাকীকত বা মর্মকথা এই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতে সোপর্দ করে দেবে এবং একনিষ্ঠ মুসলমান হয়ে যাবে। আসলে আল্লাহ তায়ালার পাত সত্তা থেকে এ শক্তি আশা করা যায় যে, সংস্কার সংশোধনের সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য প্রচেষ্টা সত্বেও বান্দাহর জীবনে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তা হজ্জের করনীয় কাজগুলো এবং হজ্জের স্থানগুলোর বরকতে দূর হয়ে এবং সে হজ্জের মাধ্যমে এমন পাক সাফ হয়ে ফিরে আসবে যেন সে আজই জন্ম গ্রহণ করেছে। সেই সাথে প্রকৃত অবস্থার একটা কষ্টিপাথর ও বটে। অর্থাৎ কার হজ্জ প্রকৃত হজ্জ এবং কে হজ্জের সকল আরকান পালন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা সত্ত্বেও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আর এটাও সত্য যে, হজ্জের তাওফীক লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সম্পর্কে খুব কম আশাই করা যেতে পারে যে, অন্য কোনো উপায়ে তার সংশোধন হতে পারবে। এজন্য হজ্জ পালনকারীর জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, সে যেন তার আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনার পর্যালোচনা করে এবং এবং হজ্জের এক একটি রুকন আমল পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও অনুভূতির সাথে আদায় করে হজ্জের সেসব ফায়দা হাসিল করে যার জন্য ফরয করা হয়েছে।

 

হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ) এর কাছে এক ব্যক্তি হাজির হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করে (হজ্জ করে) ফিরে এসেছে কিন্তু তার জীবনের উপর হজ্জের কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? সে বললো আমি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে  আসছি।

 

হযরত জুনাইদ (র) খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন। তুমি হজ্জ করেছ নাকি ?

 

মুসাফির –জি হ্যাঁ, আমি হজ্জ করেছি।

 

হযরত – যখন তুমি হজ্জের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হয়েছিলে, তখন তুমি গোনাহ থেকে দূরে ছিলে কি না ?

 

মুসাফির – হযরত আমি এভাবে চিন্তা করেনি।

 

হযরত – তাহলে তুমিতো হজ্জের জন্য মোটেও বের হওনি। আচ্ছা বলোতো তুমি এ পবিত্র ছফরে তুমি যেসব মনযিল অতিক্রম করেছ এবং যেখানে যেখানে রাত কাটিয়েছে তখন তুমি কি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনযিলগুলোও অতিক্রম করেছ কি না ?

 

মুসাফির – হযরত, আমারতো এসব খেয়ালই হয়নি।

 

হযরত – তাহলে তুমি তো না বায়তুল্লাহর দিকে কোনো সফর করেছ। আর না সেদিকে কোন মনযিল অতিক্রম করেছ। আচ্ছা বল তো তুমি যখন ইহরাম বাধলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক খুলে ফেললে তখন তার সাথে সাথে তোমার মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলো তোমার জীবন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলে কিনা?

 

মুসাফির- হযরত, এভাবে তো আমি চিন্তা করে দেখিনি।

 

হযরত জুনাইদ তখন খুব দুঃখ করে বললেন। তাহলে তুমি ইহরামই বা বাধলে কোথায়? আচ্ছা বলত যখন তুমি আরাফাতের ময়দানে দাড়ালে তখন কিছু মুশাহাদার অনুভূতি হয়েছিল কি?

 

মুসাফির- হযরত, এর অর্থই বুঝলাম না

 

হযরত -তার অর্থ এই যে, আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার সময় তুমি তোমার মধ্য এ অবস্থা কি অনুভব করেছ যে, তোমার রব তোমার সামনে এবং তুমি তাকে দেখছ?

 

মুসাফির- হযরত, এ অবস্থা তো আমার হয়নি।

 

হযরত - তাহলে তুমি তো আরাফাতে পৌঁছাওনি। আচ্ছা তারপর বল দেখি, মুযদালাফায় পৌছার পর তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পরিহার করেছ কিনা?

 

মুসাফির- হযরত, আমি এ বিষয় তো কোনো মনোযোগ দেইনি।

 

হযরত তাহলে তুমি তো মুযদালাফাও যাওনি। আচ্ছা, বল দেখি, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের জ্যোতি ও অলৌকিক শক্তি লক্ষ্য করেছ কি?

 

মুসাফির- হযরত আমি এর থেকে বঞ্চিত ছিলাম।

 

হযরত -তাহলে তুমি মোটেই তাওয়াফ করনি। আচ্ছা, তারপর তুমি যখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে তখন সাফা মারওয়া ও তার মধ্যে সায়ী করার হিকমত, মর্মকথা ও তার উদ্দেশ্যে হাসিল করেছ কি?

 

মুসাফির এসবের তো কোনো অনুভূতিই আমার ছিল না।

 

হযরত-তাহলে তুমি বলতে গেলে সায়ীও করনি। তারপর তুমি কুরবানগাহে গিয়ে যে কুরবানী কররে, তখন তুমি তোমার প্রবৃত্তি ও তার কামনা বাসনাকেও কুরবানী করেছ কি?

 

মুসাফির- হযরত এদিক আমি লক্ষ্যই করিনি।

 

হযরত – তাহলে তুমি কুরবানীই বা করলে কোথায়? আচ্ছা বল দেখি, তুমি জমরাতে পাথর মারলে, তখন তুমি তোমার অসৎ সহকর্মী, সাথী ও কুপ্রবৃত্তিকেও তোমার কাছ থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছ কি?

 

মুসাফির- তাতো করিনি।

 

হযরত – তাহলে তুমি রামীও করোনি।

 

তারপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র) বড় দুঃখের সাথে বলেন, যাও ফিরে যাও এবং এরূপ মনে অবস্থাসহ আবার হজ্জ কর। যাতে করে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় যার ঈমান ও ওয়াদা পালনের স্বীকৃতি করতে গিয়ে কুরআন এ সাক্ষ্য দেয়-

 

*******আরবী*********

 

এবং তিনি ইবরাহীম (আ ) যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন।

 

হজ্জের মহত্ব ও গুরুত্ব

 

কুরআন ও সুন্নাতে হজ্জের হিকমত, দীনের মধ্যে হজ্জের মর্যাদা, তার মহত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছ। কুরআন বলে

 

*******আরবী*********

 

মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবার শক্তি সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ্জ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)

 

১. হজ্জ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারই বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাবার শক্তি সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্যে আল্লাহর হক আদায় করা ফরয। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, সেসব যালেম আল্লাহর হক নষ্ট করে। আয়াতের এ কথার দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত হযরত আলী (রা) এর বয়ান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবী (স) এর পক্ষ থেকে হজ্জ ফরয হওয়ার ঘোষণা তখনই করা হয় যখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযি-কিতাবুল হজ্জ)

 

এ অর্থে সহীহ মুসলিমেও একটি রেওয়ায়েত আছে, যাতে নবী (স) বলেন-

 

হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব হজ্জ আদায় কর।

 

২. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যের প্রতি এ আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে, সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করা কুফরী আচরণ, যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কুরআনে নামায ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছেঃ

 

*******আরবী*********

 

এবং  নামায কায়েম কর এবং (নামায ত্যাগ করে) মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।

 

ঠিক তেমনি আলোচ্য আয়াতের এ স্থানে হজ্জ না করাকে কুফরী আচরণ বলা হয়েছে। নবী (স) ইরশাদ করেন-

 

যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের জরুরী খরচের অর্থ সামগ্রী মওজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌছাতে পারে, তারপর সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ জন্যে যে আল্লাহ বলেন-

 

*******আরবী*********

 

হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য এই যে যারা হজ্জ করে না নবী (স) তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য বলেছেন। হজ্জ যারা করে না তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য এবং নামায যারা পড়ে না তাদেরকে মুশরিকদের সমতুল্য ঘোষণা করার মর্ম এই যে, আহলে কিতাব হজ্জ একবারে পরিত্যাগ করেছিল এবং মুশরিকগণ হজ্জ করলেও নামায পরিত্যাগ করেছিল। এজন্যে নামায পরিত্যাগ করাকে মুশরিকী ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জ পরিত্যাগ করাকে ইহুদী খৃষ্টানের ক্রিয়াকর্ম বলা হয়েছ। অতএব এটাও এক মোক্ষম সত্য যে, স্বয়ং কুরআনেও এ ধরনের লোককে এ সতর্কবাণীও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী আয়াতের শুধু প্রথম অংশ পাঠ করেছেন। নতুবা যে সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আয়াতের এ অংশে রয়েছে। যথাঃ

 

*******আরবী*********

 

যারা অর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ করতে অস্বীকার করার আচরণ দেখাবে তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। অর্থাৎ হজ্জ পরিত্যাগকারীর কুফরী আচরণের কোনো পরোয়া তিনি করেন না। তিনি ঐসব লোকের কোনো পরোয়া করেন না যে, তারা কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এ হচ্ছে সতর্কবাণীর বড়ো কঠিনতম প্রকাশভঙ্গী। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর তার অসন্তোষ ও মুখাপেক্ষহীনতার কথা ঘোষণা করেন, যে ঈমান ও হেদায়াত দ্বারা কি করে ভূষিত হতে পারে?

 

হযরত হাসান (রা) বলেন, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) বলেছেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা এই যে যেসব শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেসব শহরে কিছু লোক পাঠিয়ে দেব তারা খোজ খবর নিয়ে দেখবে যে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ করছে না। তাদের ওপর আমি জিযিয়া (জিযিয়া এমন এক প্রতিরক্ষা কর যা অমুসলিমদের নিকট থেকে তার জানমালের নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়) নির্ধারিত করে দেব। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়। (আল মুনতাকা)

 

মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর হজ্জের মর্মও এ ই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে। এরা যদি মুসলিম হতো তাহলে কি করে হজ্জের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতো এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও কি করে হজ্জ থেকে উদাসীন থাকতো?

 

হজ্জের ফযীলত ও প্রেরণা

 

হজ্জের এ গুরুত্বকে সামনে রেখে নবী (স) বিভিন্নভাবে এর প্রেরণা দান করেছেন। বিভিন্নভাবে এর অসাধারণ ফযীলত বর্ণনা করে এর জন্যে প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টি করেছেন।

 

১. যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে এলো, তারপর কোনো অশ্লীল যৌন ক্রিয়া করলো না, আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ করলো না, তাহলে সে গোনাহ থেকে এমনভাবে পাকসাফ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন পাকসাফ সে ঐদিন ছিল যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল। (বুখারী মুসলিম)

 

২. হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। সে তার মেযবান আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন, সে তার কাছে মাগফেরাত চাইলে তিনি তাকে মাগফেরাত দান করেন। (ইবনে মাজাহ)

 

৩. হ্জ্জ ও ওমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র ও অভাব এবং গোনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা দূর করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো একমাত্র জান্নাত। (তিরমিযি, নাসায়ী)

 

হজ্জে মাবরুর বলে এমন হজ্জকে যা পরিপূর্ণ এখলাস (নিষ্ঠা) অনুভূতি ও শর্তাবলীর পালনসহ আদায় করা হয় এবং যার মধ্যে হজ্জকারী আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেচে থাকার পুরোপুরি ব্যবস্থা করে।

 

৪. যদি কোনো হেরেম শরীফ যিয়ারতকারীর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়, তাহলে তার বাড়ী  পৌঁছাবার আগেই তাকে সালাম কর, তার সাথে মুসাফা কর এবং তাকে অনুরোধ কর তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাতের দোয়া করার। এজন্যে যে, তার গোনাহের মাগফেরাতের ফায়সালা করা হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ)

 

৫. হযরত হুসাইন (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর কাছে আরজ করলো, হুজুর, আমার শরীর মন উভয়ই দুর্বল। ইরশাদ হলো, তুমি এমন জেহাদ কর যাতে একটা কাটাও গায়ে না লাগে। প্রশ্নকারী বলে হুজুর, এমন জেহাদ আবার কেমন, যাতে কোনো আঘাত ও দুঃখ কষ্টের আশংকা নেই? নবী (স) ইরশাদ করেন, তুমি হজ্জ কর। (তাবারানী)

 

৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে নবী (স) এর একেবারে নিকটে সওয়ারীর উপরে ছিল এমন সময়ে হঠাৎ সে নীচে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে। নবী (স) বললেন, তাকে গোসল দিয়ে ইহরামের পোষাকসহই দাফন কর। এ কিয়ামতের দিনে তালবিয়া পড়া অবস্থায় ওঠবে। (তালবিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য)। তার মাথা ও মুখমন্ডল খোলা থাকতে দাও। (বুখারী, মুসলিম)

 

৭. হযরত আবু যর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ ) আল্লাহর কাছে আরয করে বলেন, পরওয়ারদেগার! যে বান্দাহ তোমার ঘর যিয়ারত করতে আসবে তাকে কি প্রতিদান দেয়া হবে? আল্লাহ বলেন, হে দাউদ! সে আমার মেহমান। তার অধিকার হচ্ছে এই যে, দুনিয়াতে আমি তার ভুলত্রুটি মাফ করে দেই এবং আখিরাতে যখন সে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে আমি আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি।

 

হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী

 

হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দশটি। তার মধ্যে কোনো একটি শর্ত পাওয়া না গেলে হজ্জ ওয়াজিব হবে না।

 

১. ইসলামঃ অমুসলিমের প্রতি হজ্জ ওয়াজিব হতে পারে না।

 

২. জ্ঞান থাকাঃ পাগল, মস্তিষ্ক বিকৃত ও অনুভূতিহীন লোকের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।

 

৩. বালেগ  হওয়াঃ নাবালেগ শিশুদের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়, কোনো সচ্ছল ব্যক্তি বালেগ হওয়ার পূর্বেই শৈশব অবস্থায় হজ্জ করলে তাতে ফরয আদায় হবে না। বালেগ হওয়ার পর পুনরায় তাকে হজ্জ করতে হবে। শৈশবের হজ্জ নফল হবে।

 

৪. সামর্থঃ হজ্জকারীকে সচ্ছল হতে হবে। তার কাছে প্রকৃত প্রয়োজন ও ঋণ থেকে নিরাপদ এতোটা অর্থ থাকতে হবে যা সফরের ব্যয়ভার বহনের জন্যে যথেষ্ট হয় এবং হজ্জ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার অধীন পরিবারস্থ লোকের জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট অর্থ মওজুদ থাকে, কারণ এসব লোকের ভরণপোষণের দায়িত্ব শরীয়াত অনুযায়ী তার।

 

৫. স্বাধীনতাঃ গোলাম ও বাদীর ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।

 

৬. শারীরিক সুস্থতাঃ এমন অসুস্থ না হওয়া যাতে করে সফর করা সম্ভব নয়। অতএব ল্যাংড়া, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, এবং অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বয়ং হজ্জ করা ওয়াজিব নয়। অন্যান্য সব শর্তগুলো পাওয়া গেলে অন্যের সাহায্যে হজ্জ করাতে পারে।

 

৭. কোনো যালেম ও স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষ থেকে জীবনের কোনো আশঙ্কা না থাকা এবং কারাগারে আবদ্ধ না থাকা।

 

৮. পথ নিরাপদ হওয়াঃ যদি যুদ্ধ চলছে এমন অবস্থা হয়, পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যানবাহন ধ্বংস করা হচ্ছে, পথে চোর ডাকাতের আশংকা থাকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জলপথে ভ্রমণ সম্ভব না হয় অথবা যে কোনো প্রকারের আশংকা যদি থাকে, তাহলে এসব অবস্থায় হজ্জ ওয়াজিব হবে না। অবশ্য এ অবস্থায় এমন লোকের অসিয়ত করে যাওয়া উচিত যে, তার পরে অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুকূল হলে তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ হজ্জ করবে।

 

৯. হজ্জের সফরে স্বামী অথবা কোনো মুহররম ব্যক্তি থাকতে হবেঃ এর ব্যাখ্যা এই যে, সফর যদি তিন রাত দিনের কম হয় তাহরে মেয়েলোকের স্বামী ছাড়া সফরের অনুমতি আছে।তার বেশী সময়ের সফল হলে স্বামী অথবা মুহররম পুরুষ ছাড়া হজ্জের সফর জায়েয নয়। (যে মহিলার স্বামী নেই এবং কোনো মুহররম পুরুষও নেই, তার ঐসব বন্ধু সফরকারীর সাথে যাওয়া জায়েয যাদের নৈতিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে। এ হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম মালেকের অভিমত। নির্ভরযোগ্য বন্ধু বান্ধব এর ব্যাখ্যা ইমাম শাফেয়ী (র) এভাবে করেছেনঃ কিচু সংখ্যক মেয়েলোক নির্ভরযোগ্য হতে হবে এবং তারা মুহররম লোকের সাথে হজ্জে যাচ্ছে। তাহলে এ দলের সাথে স্বামিহীন একজন মেয়েলোক যেতে পারে। অবশ্য দলে মাত্র একজন মেয়েলোক থাকলে যাওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ীর এ অভিমত অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে একজন স্বামীহিন ও মুহাররমহীন মেয়েলোকের হজ্জ আদায় করার সুযোগ রয়েছে এবং ওসব ফেতনার আশংকাও নেই যার কারণে কোনো মেয়েলোকের মুহররম ছাড়া সফর করা নিষিদ্ধ।)এটাও জরুরী যে, এ মুহররম জ্ঞানবান, বালেগ, দীনদার এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে। অবোধ শিশু, ফাসেক, এবং অনির্ভরযোগ্য লোকের সাথে সফর জায়েয নয়।

 

১০. ইদ্দত অবস্থায় না হওয়াঃ ইদ্দত স্বামীর মৃত্যুর পর হোক অথবা তালাকের পর হোক, ইদ্দতের সময় হজ্জ ওয়াজিব হবে না।

 

হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত

 

হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত চারটি। এ শর্তগুলোসহ হজ্জ করলে তা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হবে। নতুবা হবে না।

 

১. ইসলামঃ ইসলাম হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার যেমন শর্ত, তেমনি সহীহ হওয়ার শর্ত। যদি কোনো অমুসলিম হজ্জের আরকান আদায় করে এবং তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করেন, তাহলে এ হজ্জ সহীহ হওয়ার জন্যে জরুরী যে, হজ্জকারী মুসলমান হবে।

 

২. হুশ জ্ঞান থাকাঃ হুশ-জ্ঞানহীন ও পাগল ব্যক্তির হজ্জ সহীহ হবে না।

 

৩. সকল আরকান নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে আদায় করা। হজ্জের মাসগুলো হচ্ছে, শাওয়াল, যুলকাদ, ও যুলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। এমনি হজ্জের সকল আরকান আদায় করার সময়ও নির্দিষ্ট আছে,স্থানও নির্দিষ্ট আছে। আর ব্যতিক্রম করে হজ্জের আরকান আদায় করলে হজ্জ সহীহ হবে না।

 

৪. যেসব কারণে হজ্জ নষ্ট হয় তার থেকে বেচে থাকা এবং হজ্জের সকল আরকান ও ফরয আদায় করা। যদি হজ্জের কোনো রুকন আদায় করা না হয় কিংবা ছুটে যায় তাহলে হজ্জ সহীহ হবে না।

 

হজ্জের আহকাম

 

১. হজ্জ ফরয হওয়ার সকল শর্ত বিদ্যমান থাকলে জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। হজ্জ ফরযে আইন এবং তার ফরয হওয়া কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে। যে ব্যক্তি হজ্জ ফরয হওয়া অস্বীকার করবে সে কাফের এবং যে ব্যক্তি হজ্জের শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করবে না সে গুনাহগার এবং ফাসেক।

 

২. হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে সে বছরই তা আদায় করা উচিত। ফরয হওয়ার পর বিনা কারণে বিলম্ব করা এবং এক বছর থেকে আর এক বছর পর্যন্ত টালবাহানা করা গুনাহ।

 

নবী (স) বলেন, যে হজ্জের ইচ্ছা পোষণ করে তার তাড়াতাড়ি করা উচিত। হতে পরে যে, সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। অথবা সওয়ারীর উটনী হারিয়ে যেতে পারে। আর এটাও হতে পারে যে, অন্য কোনো প্রয়োজন তার হতে পারে। (ইবনে মাজাহ)

 

উটনী হারিয়ে যাওয়ার অর্থ সফরের উপায় উপাদান না থাকা। পথ নিরাপদ না থাকা এবং এমন কোনো প্রয়োজন এসে যাওয়া যার জন্যে হজ্জের আর সম্ভাবনা থাকে না। মানুষ ফরযের বোঝা মাথায় নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। পরিস্থিতি কখন অনুকূল হবে এবং জীবনেরই বা কি ভরসা? অতএব কোন ভরসায় মানুষ বিলম্ব করবে এবং হজ্জ করার পরিবর্তে শুধা টালবাহানা করতে থাকবে?

 

৩. হজ্জের ফরয আদায় করার জন্য যাদের অনুমতি নেয়া শরীয়াতের দিক দিয়ে জরুরী যেমন কারো মা বাপ দুর্বল অথবা রোগাক্রান্ত এবং তার সাহায্য প্রার্থী অথবা কোনো ব্যক্তি কারো কাছে ঋণী অথবা কারো জামিন এমন অবস্থায় অনুমতি ছাড়া হজ্জ করা মাকরূহ তাহরীমি।

 

৪. হারাম কামাইয়ের দ্বারা হজ্জ হারাম।

 

৫. ইহরাম না বেধে মীকাতে প্রবেশ করলে হজ্জ ফরয় হয়ে যায়।

 

৬. হজ্জ ফরয হওয়ার পর কেউ বিলম্ব করলো, তারপর সে অসমর্থ হয়ে পড়লো এবং অন্ধ, পঙ্গু অথবা কঠিন অসুখে পড়লো এবং সফরের যোগ্য রইলো না, তাহলে সে তার নিজের খরচে অন্যকে পাঠিয়ে বদলা হজ্জ করে নেবে।

 

মীকাত ও তার হুকুম

 

১. মীকাত অর্থ সেই নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত স্থান যেখানে ইহরাম বাধা ছাড়া মক্কা মুকাররামা যাওয়া জায়েয নয়। যে কোনো কারণেই কেউ মক্কা মুকাররামা যেতে চাক তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধবে। ইহরাম বাধা ছাড়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)

 

২. বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকদের জন্য পাঁচটি মীকাত নির্দিষ্ট আছে।

 

ক. যুল হুলায়ফাহঃ

 

এটি মদীনাবাসীদের জন্যে মীকাত। ঐসব লোকের জন্যেও যারা মদীনার পথে মক্কা মুকাররমা আসতে চায়। এ মীকাত মদীনা থেকে মক্কা আসবার পথে প্রায় আট নয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ মীকাত মক্কা থেকে অন্যান্য সব মীকাতের তুলনায় অধিকতর দূরত্বে অবস্থিত, আর মদীনাবাসীদের এ অধিকারও রয়েছে এজন্যে যে, সর্বদা মদীনাবাসী আল্লাহর পথে অধিকতর কুরবানী করেছে।

 

খ. যাতে ইরাকঃ

 

এটি ইরাক এবং ইরাকের পথে আগত লোকদের মীকাত। এ মীকাত মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

 

গ. হুজফাহঃ

 

এটি সিরিয়া এবং সিরিয়ার দিক থেকে আগমনকারী লোকদের জন্যে মীকাত। মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

 

ঘ. কারনুল মানাযেলঃ

 

মক্কা মুকাররামা থেকে পূর্ব দিকে পথের ওপর এক পর্বতময় স্থান যা মক্কা থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নজদবাসীদের মীকাত এবং ঐসব লোকের জন্যে যারা এ পথে আসে।

 

ঙ. ইয়ালামলামঃ

 

মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে এসেছে এমন পথের ওপর একটি পাহাড়ী স্থান যা মক্কা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে। এটি ইয়ামেন এবং এ পথে আগমনকারী লোকদের মীকাত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের লোকের জন্যেও এ মীকাত।

 

এসব মীকাত স্বয়ং নবী (স) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম থেকে একথা জানা যায়। এসব মীকাত ঐসব লোকের জন্যে যারা মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী, যাদেরকে পরিভাষায় আফাকী বর এখন যারা মীকাতের মধ্যে বসবাস করে তারা যদি হেরেমের সীমার ভেতরে হয় তাহলে হেরেমই তাদের মীকাত। আর হেরেমের সীমার বাইরে হিলে অবস্থানকারী হলে তার জন্যে হিল মীকাত। অবশ্য হেরেমের মধ্যে অবস্থানকারী ওমরার জন্যে ইহরাম বাধতে চাইলে তার মীকাত হিল, হেরেম নয়।

 

হজ্জের ফরয

 

হজ্জের চারটি ফরয। তার মধ্যে কোন একটি ছুটে গেলে হজ্জ হবে না। ফরয নিম্নরূপঃ

 

১. ইহরাম – এটি হজ্জের শর্ত এবং হজ্জের রুকন।

 

২. আরাফাতে অবস্থান কিছু সময়ের জন্য হলেও।

 

৩. যিয়ারতে তাওয়াফ – এর প্রথম চার চক্কর ফরয এবং বাকী তিন চক্কর ওয়াজিব।

 

৪. এ ফরযগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রম অনুসারে আদায় করা।

 

ইহরাম ও তার মাসয়ালা

 

১. হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোষাক পরিধান করা ও তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। হজ্জের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার পর লোক মুহরেম হয়ে যায়। যেমন নামাজে তাকবীর বলার পর লোক নামাজে প্রবেশ করে এবং তারপর খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায়, তেমনি ইহরাম বাধার পর হজ্জ শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু জিনিষ যা ইহরাম বাধার পরে জায়েয ও মুবাহ ছিল, ইহরাম অবস্থায় সেসব কাজ হারাম হয়ে যায়। এজন্য একে ইহরাম বলে।

 

২. যে কোন কারণে মক্কা যেতে হোক ভ্রমণ ব্যবসা বাণিজ্য অথবা যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধা অত্যাবশ্যক। ইহরাম ছাড়া মীকাত থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরুহে তাহরীমা।

 

৩. ইহরাম বাধার পূর্বে গোসল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। শিশুদের গোসল করাও মসনুন। মেয়েলোক হায়েয নেফাস অবস্থায় তাদের গোসল করাও মসনুন। হ্যাঁ তবে গোসল করতে অসুবিধা হলে বা কষ্ট হলে অযু অবশ্য করে নেওয়া উচিৎ। এ অযু বা গোসল শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য, পাক পবিত্রতার জন্য নয়। এ জন্য পানি না পেলে তায়াম্মুম করার দরকার নেই।

 

৪. ইহরামের জন্য গোসল করার জন্য চুল কাটা, নখ কাটা ও সাদা চাদর ও তহবন্দ পরা এবং খসবু লাগানো মুস্তাহাব।

 

৫. মীকাতে পৌছার পূর্বেও ইহরাম বাধা জায়েয। ইহরামের সম্মান রক্ষা করতে পারলে তা ভালো। নতুবা মীকাতে পৌছার পর ইহরাম বাধা ওয়াজিব।

 

৬. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজঃ এসবের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সব সময় নিষিদ্ধ। কিন্তু ইহরাম অবস্থায় যে সব কাজ করা অধিকতর গোনাহের কাজঃ

 

১. যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়া অথবা যৌন সম্পর্কিত আলাপ আলোচনা করা, আপন স্ত্রীর সাথেও এ ধরনের কথাবার্তায় আনন্দ উপভোগ করা নিষিদ্ধ।

 

২. আল্লাহর নাফরমানী ও গোনাহ করা।

 

৩. লড়াই-ঝগড়া ও গালাগালি করা। কর্কশ কথা বলা।

 

৪. বন্য পশু শিকার করা। শিকার শুধু হারাম নয়। বরঞ্চ শিকারির সাথে কোন প্রকার সহযোগীতা করা অথবা শিকারিকে পথ দেখানো অথবা শিকারের দিকে ইংগিত করাও হারাম।

 

৫. সিলাই করা জামা কাপড়। যেমন শার্ট, পাঞ্জাবী, পায়জামা, শিরওয়ানী, কোট-প্যান্ট, টুপি, বেনিয়ান, দস্তানা প্রভৃতি পরিধান করা। মেয়েরা মিলওয়ার কামিজ পড়তে পারে। মোজাও পরতে পারে এবং ইচ্ছা করলে অলংকার ব্যবহার করতে পারে।

 

৬. রঙিন ও খোশবুদার রঙে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা। মেয়েরা রেশমী কাপড় পড়তে পারে এবং রঙিন কাপড়ও। অবশ্য খুশবুদার হওয়া চলবে না।

 

৭. মাথা ও মুখমন্ডল ঢাকা।মেয়েরা মাথার চুল ডেকে রাখবে।

 

৮. মাথা দাড়ি সাবান প্রভৃতি দিয়ে ধোয়া।

 

৯. শরীরে কোনে স্থানের চুল কামানো। কোন কিছুর সাহায্যে চুল উঠিয়ে ফেলা।

 

১০. নখ কাটা অথবা পাথর প্রভৃতিতে ঘসে সাফ করা।

 

১১. খুশবু লাগানো।

 

১২. তৈল ব্যবহার করা।

 

৭. ইহরাম অবস্থায় জায়েয কাজঃ

 

ওপরে যেসব বিষয় বলা হল তা ছাড়া সব কিছু কর জায়েয। যেমনঃ

 

১. কোনো ছায়ায় আরাম করা।

 

২. গোসল করা, মাথা ধোয়া, তবে সাবান ব্যবহার না করা।

 

৩. শরীর বা মাথা চুলকানো। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে চুল উঠে না যায় অথবা চুলের উকুন পড়ে না যায়।

 

৪. টাকা পয়সা অস্ত্র প্রভৃতি সাথে রাখা

 

৫. অবসর সময়ে ব্যবসা করতে দোষ নেই। কুরআনে আছেঃ

 

 ******আরবী********

 

হজ্জের সময় তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (ব্যবসার দ্বারা মুনাফা) তালাশ কর, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।

 

৬. ইহরামের কাপড় বদলানো বা ধোয়া।

 

৭. আংটি ঘড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করা।

 

৮. সুরমা লাগানো তবে খুশবু সুরমা নয়।

 

৯. খাতনা করা।

 

১০. নিকাহ করা।

 

১১. অনিষ্টকর জীব হত্যা করা। যেমন চিল, কাক, ইঁদুর, সাপ, বিচ্ছু, বাঘ, কুকুর, প্রভৃতি। নবী (স) বলেন, হেরেমে বা ইহরামের অবস্থায় পাঁচ প্রকারের জীব হত্যায় কোন দোষ নেই। যেমন, ইঁদুর, কাক, চিল, বিচ্ছু, আক্রমণকারী কুকুর।

 

১২. সামুদ্রিক শিকার জায়েয। কোনো গায়ের মুহররম (যে ইহরাম অবস্থায় নেই)যদি স্থলের কোন শিকার তোহফা দেয় তাহলে খাওয়া জায়েয।

 

৮. ইহরামের পদ্ধতি:

 

ভালোভাবে চুল নখ কেটে গোসল করে খুশবু লাগিয়ে ইহরামের পোশাক পরবে। অর্থাৎ এক চাদর, এক তহবন্দ পরে দু রাকায়াত নফল নামায পড়বে। তারপর হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়বে। (মুফরেদ হলে শুধু হজ্জের নিয়ত করবে। কারেন হলে হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করবে। মুতায়াত্তা হলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করবে এবং ওমরাহ শেষ করে হজ্জের নিয়ত করবে। এসব পরিভাষার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য।) হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার সাথে সাথে ইহরাম বাধা হয়ে যায়। তারপর সে মুহররম হয়ে যায়। তারবিয়ার পরিবর্তে যদি কুরবানীর উট মক্কার দিকে রওয়ানা করে দেয়া হয় তাহলে তা তালবিয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়।

 

তালবিয়া ও তার মাসয়ালা

 

হজ্জের নিয়ত করার পরই হেরেম যিয়ারতাকারী যেসব কথা বলে তাকে তালবিয়া বলে, যথাঃ

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি তোমার ডাকে হাজির। আমি তোমার দরবারে হাজির আছি, তোমার কোনো শরীক নেই। এটা সত্য যে, প্রশংসা ও শোকর পাবার অধিকারী তুমি। দান ও অনুগ্রহ করা তোমারই কাজ। তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বে কেউ শরীক নেই।

 

১. ইহরাম বাধার পর একবার তালবিয়া পড়া ফরয। বেশী বলা সুন্নাত।

 

২. ইহরাম বাধার পর থেকে ১০ই যুলহাজ্জ তারিখে প্রথম জুমরায় পাথর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকতে হবে। প্রত্যেক নীচুতে নামার সময় এবং ওপরে ওঠার সময় প্রত্যেক কাফেলার সাথি মিলিত হবার সময় প্রত্যেক নামাযের পর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তালবিয়া পড়তে হবে।

 

৩. জোরে জোরে তালবিয়া পড়া সুন্নাত। নবী (স) বলেন, আমার কাছে জিবরাঈল (আ ) এসে এ ফরমান পৌছিয়ে দেয় যে, আমি যেন আমার সঙ্গীদেরকে হুকুম দেই তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়ে। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক (র) তিরমিযি, আবু দাউদ প্রভৃতি। কিন্তু মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়বে না। হেদায়ায় আছে মেয়েরা তালবিয়া পড়ার সময় আওয়াজ বুলন্দ করবে না। এজন্যে যে এতে করে ফেতনার আশংকা সহতে পারে। তারা রমলও করবে না এবং সায়ী করার সময় দৌড়াবে না। এজন্যে যে, এতে পর্দা নষ্ট হবে।)

 

৪. তালবিয়া পড়লে তিনবার পড়তে হবে। তিনবার পড়া মুস্তাহাব।

 

৫. তালবিয়া পড়ার সময় কথা বলা মাকরূহ। সালামের জবাব দেয়া যেতে পারে।

 

৬. যে তালবিয়া পড়ছে তাকে সালাম না দেয়া উচিত। তাকে সালাম করা মাকরূহ।

 

৭. তালবিয়ার পর দরুদ পড়া মুস্তাহাব।

 

তালবিয়ার হিকমত ও ফযীলত

 

কাবা নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হুকুম করেন-

 

এবং মানুষকে হজ্জের জন্যে সাধারণ আহবান জানিয়ে দাও যেন তারা তোমার কাছে দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেটে অথবা উটের পিঠে চড়ে আসে।

 

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই য আহবান, বান্দার পক্ষ থেকে তার জবাব হচ্ছে এই তালবিয়া।  বান্দাহ বলে, পরওয়ারদেগার তোমার ডাক শুনেছি এবং তুমি যে তলব করেছ তার জন্যে তামার দরবারে হাজির হয়েছি। আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী কিছুক্ষণ পরপর এ ধ্বনি বুলন্দ করেছে। প্রকৃতপক্ষে সে বলেছে, পরওয়ারদেগার! তুমি তোমার ঘরে হাজিরা দেয়ার জন্যে ডেকেছ এবং আমরা শুধু তোমার মহব্বতে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাগলের মতো এসে হাজির হয়েছি। আমরা তোমার সে দয়া অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করছি। তোমার তাওহীদের স্বীকৃতি দিচ্ছি। এ তালবিয়া ধ্বনি মুমিনের শিরায় শিরায় তাওহিদের বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত করে এবং তাকে এভাবে তৈরী করে যে, দুনিয়াতে তার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র এই যে, সে তাওহীদের বাণী সর্বত্র পৌছিয়ে দেবে।

 

নবী (স) তালবিয়ার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন কোনো মুমিন বান্দাহ লাব্বায়েক ধ্বনি করে, তখন তার ডানে বামে যাকিছু আছে সবই লাব্বায়েক ধ্বনি করে তা পাথর হোক, বৃক্ষলতা হোক কিংবা মাটি হোক। এমনি কি যমীনের এক প্রান্ত থেকে তা অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। (তিরমিযি)

 

নবী (স) আরও বলেন, যে মুহররম ব্যক্তি সারাদিন লাব্বায়েক লাব্বায়েক ধ্বনি করে এবং এভাবে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন তার সকল গুনাহ মিটে যায় এবং সে এমন পাক হয়ে যায় যেন সে সদ্য তার মায়ের পেট থেকে জন্ম লাভ করেছে।

 

তালবিয়ার পর দোয়া

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রার্থী এবং জাহান্নাম থেকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় চাই।

 

হযরত আম্মার বিন খুযায়মা তার পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী (স) যখন ইহরাম বাধার জন্যে তালবিয়া পড়তেন, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত ভিক্ষা চাইতেন এবং তার রহমতের বদৌলতে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। (মুসনাদে শায়েফী)

 

ইহরামের পর বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারী যে দোয়া ইচ্ছা করতে পারে এবং যতো খুশী করতে পারে। কিন্তু প্রথমে ওপরের মসনুন অবশ্যই করবে। কারণ এ এক সার্বিক দোয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাত লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ তিনটি বস্তু একজন মুমিনের চরম আকাঙ্ক্ষা এবং তার সকল চেষ্টার চরিত্রের ফল।

 

ওয়াকুফ ও তার মাসয়ালা

 

১.  ওয়াকুফ অর্থ দাঁড়ানো ও অবস্থান করা। হজ্জর সময় তিন স্থানে অবস্থান করতে হয় এবং তিন স্থানের হুকুম বিভিন্ন রকমের। উপরন্তু এসব স্থানে অবস্থানকালে যেসব আমল করতে হয় তার জন্যে সেখানে পৌছাতে হয়। এর নিয়ত করা এবং দাঁড়ানো জরুরী নয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে নিয়ত করা শর্ত।

 

২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরাফাত, যেখানে অবস্থান করতে হয়। আরাফাত এক অতি প্রকাণ্ড ময়দান। হেরেমের সীমা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাত এলাকা শুরু হয় এ ময়দান মক্কা মুকাররামা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূর। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্জের রুকনগুলোর বড়ো একটা রুকন। বরঞ্চ নবী (স) একবার আরাফাতের অবস্থানকেই হজ্জ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ *******আরবী********* আরাফাতের দিনে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ একই পোশাক পরিধান করে আল্লাহর দরবারে বিনয় নম্রতার মূর্ত ছবি হয়ে দাড়ায় তখন তারা যেন এ সময়ের জন্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে হাশরের ময়দানে পৌঁছে যায়। এ এক বিরাট ঈমান উদ্দীপক দৃশ্য। এখানে অবস্থানের ফলে হাশরের ময়দানের কথা মনে জাগ্রত হয়।

 

এর গুরুত্ব এই যে, যদি কোনো কারণে হাজী ৯ই যুলহজ্জের দিনে অথবা দিনগত রাতে আরাফায় পৌছাতে না পারে তাহলে তার হজ্জ হবে না। হজ্জের অন্যান্য অনুষ্ঠান যথা তাওয়াফ, সায়ী, রামি প্রভৃতি যদি বাদ পড়ে তাহলে তার ক্ষতি পূরণ সম্ভব। কিন্তু আরাফাতে অবস্থান করা না হলে তার ক্ষতিপূরণ কোনো উপায় নেই।

 

৩. আরাফাতে অবস্থানের সময় ৯ই যুলহজ্জ বেলা পড়ে গড়ে যাওয়ার পর (যোহর ও আসরের নামায পড়ার পর)। কিন্তু যেহেতু এ হজ্জের সবচেয়ে বড়ো রুকন এবং এর ওপরেই হজ্জ নির্ভরশীল, সে জন্যে এ সময়কে প্রশস্ত করে দিয়ে এ সুযোগ দেয়া দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ নয় ও দশ যুলহজ্জের মধ্যবর্তী রাত সুবেহ সাদেকের পূর্বে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্যে হরেও আরাফাতে পৌছা যায় তাহলে তার অবস্থান নির্ভরযোগ্য হবে এবং তার হজ্জ হয়ে যাবে। (আবদুর রহমান বিন ইয়ামার ওয়াবলী বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হজ্জের ওয়াকুফ হচ্ছে আরাফাত। যে ব্যক্তি মুযদালফার রাতে ফজর হওয়ার পূর্বে পৌছবে, তার হজ্জ হয়ে যাবে। তিরমিযি, আবু দাউদ)

 

৪. আরাফাতের অবস্থান যতো দীর্ঘ হয় ততো ভালো। এ ধারণা ও অনুভূতি সহ আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো যেন হাশরের ময়দান। বান্দার নিজের মনে বলবে আমি সকল কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী নিজের মামলা মিটাবার জন্যে ও তার অনুগ্রহ ভিক্ষা করার জন্য তার দরবারে দাঁড়িয়েছি। এ হচ্ছে মুমিনের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কে জানে জীবনে এ সৌভাগ্য আর হবে কিনা। এজন্যে ঈমান ও আত্মবিশ্লষণের শক্তি জাগ্রত রেখে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এ দিন রাতের এক একটি মুহূর্তের গুরুত্ব অনুভব করতে হবে। নবী (স) এর ব্যাপারে হযরত জাবের (রা) বলেন, যোহর ও আসর নামাযের পর নবী (স) তার উটনী কাসওয়ার পিঠে সওয়ার হলেন এবং আরাফাতের ময়দানের বিশেষ অবস্থানের জায়গায় এলেন। তারপর যেদিকে পাথরের বড়বড় খন্ড পড়েছিল তার উটনীকে সে মুখী করলেন। তারপর জনতাকে সামনে রেখে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। এভাবে যখন সূর্য অস্ত গেল তখন তিনি মুযদালফার দিকে রওয়ানা হলেন। - (মুসলিম)

 

৫. আরাফাতে অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, বছরের ৩৬০ দিনের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই যে দিনে আল্লাহ তায়ালা আরাফাতের দিনের চেয়ে অধিক পরিমাণে বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন।  এ দিন আল্লাহ বান্দার অতি নিকটবর্তী হন। ফেরেশতাদের কাছে তিনি বান্দাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! দেখছ এ বান্দারা কি চায় (মুসলিম)? হযরত আনাস বিন মালেক (রা) বলেন, নবী (স) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করলেন। সূর্য অস্ত যাবে এমন সময় তিনি হযরত বেলাল (রা) এর প্রতি ইশারায় বললেন, চুপ কর। তখন নবী (স) বললেন, হে লোক সব। এই মাত্র জিবরাঈল আমার কাছে এসে আল্লাহ তায়ালার সালাম ও এ পয়গাম পৌঁছে গেলেন আল্লাহ আরাফাতের ময়দানের সকলকে মাফ করে দিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ!এ পয়গাম কি আমরা সাহাবীদের জন্যে খাস না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বললেন, এ তোমাদের জন্যে এবং ঐসব লোকের জন্যেও যারা তোমাদের পরে এখানে আসবে।(আত তারগীব)

 

আরাফাতের ময়দানের দোয়া

 

আরাফাতের ময়দানের দোয়ার বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার এবং  ওখানে অবস্থানকালে সর্বদা আল্লাহর দিকে একাগ্রচিত্ত হয়ে থাকতে হবে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে ভালো দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। নিম্নে কিছু মসনুন দোয়া দেয়া হলোঃ

 

(ক) নিম্নের দোয়া নবী (স) আরাফাতের ময়দানে খুব বেশী করে করতেনঃ

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ! তুমি এমন প্রশংসার অধিকারী যেমন তুমি নিজে তোমার প্রশংসা করেছ এবং আমরা যতোটা করতে পারি তার চেয়ে অনেক ভালো প্রশংসার হকদার তুমি। হে আল্লাহ! তোমার জন্যেই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু। তোমার দিকেই আমাকে ফিরে যেতে হবে এবং তোমার জন্যেই আমার সবকিছু। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই কবর আযাব থেকে, মনে মধ্যে সৃষ্ট কুমন্ত্রণা (অসঅসা) থেকে কাজকর্মের কুফল ও বিভেদ থেকে। হে আল্লাহ! আমি তামার আশ্রয় গ্রহণ করছি ওসব বিপদ থেকে যা বাতাসে বয়ে নিয়ে আসে। (তিরমিযি)

 

(খ) আল হিযবুল মকবুলে এক সার্বিক দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা করলে বরকত পাওয়া যাবে।

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সেই কল্যাণ চাই যা তোমার নবী (স) তোমার কাছে চেয়েছেন ঐসব অমঙ্গল তেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই যেসব থেকে তোমার নবী (স) তোমার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। পরওয়ারদেগার! আমরা আমাদের জীবনের ওপরে বড়ো যুলুম করেছি। তুমি যদি মাফ না কর এবং আমাদের ওপর রহম না কর তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবো। হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানাও এবং আমার সন্তানদেরকেও তার তাওফীক দাও। পরওয়ারদেগার! আমার দোয়া কবুল কর। আমার মা-বাপকে মাফ করে দাও। সেদিন সকল মুসলমানকে মাফ করে দিও যেদিন হবে হিসাব কেতাবের দিন। হে আমার রব! আমার মা-বাপ উভয়ের ওপর রহম কর যেমন তারা আমার শৈশবকালে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আমার প্রতিপালন করেছে। হে রব! আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের ঐসব ভাইদেরকে মাফ করে দাও যারা ঈমান আনার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগামী ছিল, এবং আমাদের মনের মধ্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা বিদ্বেষ হতে দিও না। যারা ঈমান এনেছে। হে আল্লাহ! তুমি বড়ো মেহেরবান ও দয়াশীল! পরওয়ারদেগার! তুমি সবকিছু শুন এবং জান, তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, তুমি তাওবা কবুলকারী ও দয়াশীল। গুনাহ থেকে বাচার কোনো শক্তি এবং হুকুম পালন করার সামর্থ অতীব উচ্চ ও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে না।

 

(গ) নবী (স) এ দোয়া বেশী করে করতে বলেছেনঃ

 

*******আরবী*********

 

হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।

 

এসব মসনুন দোয়া ছাড়াও আরও কিছু মসনুন দোয়া আছে যা পড়া যেতে পারে। তাছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে কল্যাণ মানুষ আল্লাহর কাছে চাইতে পারে তা চাইবে এবং বারবার চাইবে। কারণ ঐ সময়ে আল্লাহ বান্দার ওপর বড়ো দয়াশীল হয়ে যান এবং তিনি তার মেহমানকে বঞ্চিত করেন না।

 

৭. মুযদালফার অবস্থান করা ওয়াজিব। মুযদালফার সীমানায় পায়ে হেটে প্রবেশ করা মসনুন। এখানে অবস্থানের সময় মাঝে মাঝে তালবিয়া, তাহলীল ও তাহমীদ পড়া মুস্তাহাব। এখানে একরাত্রি কাটানো মসনুন। হাদীসে আছে নবী (স) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাত থেকে মুযদালাফা রওয়ানা হন এবং এখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়েন। তারপর শুয়ে পড়েন এবং ফজর পর্যন্ত বিশ্রাম করেন।

 

৮. যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে কোনো সময়ে মিনাতে পৌছা মসনুন। সূর্য উঠার পর ওখানে পৌছা যোহর ওখানে পড়া এবং ওখানেই রাত্রি যাপন করা মুস্তাহাব।

 

তাওয়াফ ও তার মাসায়েল

 

তাওয়াফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর চারদিকে চক্কর দেয়া ও প্রদক্ষিণ করা। ইসলামী পরিভাষায় তার অর্থ বায়তুল্লাহর চার ধারে ভক্তি সহকারে প্রদক্ষিণ করা ও চক্কর দেয়া।

 

বায়তুল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা

 

বায়তুল্লাহ ইট পাথরের নিছক একটা ঘর নয়। বরঞ্চ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর মহত্বের বিশেষ নিদর্শন ও তার দীনের বিশেষ অনুভূত কেন্দ্র যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার আপন তত্ত্বাবধানে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য পয়গাম্বর দ্বারা নির্মাণ করান যার নেতৃত্ব ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান সমভাবে মেনে নিয়েছে। *******আরবী********* এবং স্মরণ করো সে সময়টি যখন আমরা ইবরাহীমকে এ ঘরের (কাবা) স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। (সূরা হজ্জঃ ২৬)

 

কুরআন পাক একথার সাক্ষ্য দান করে যে, আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয় তাহলো এ বায়তুল্লাহ (কাবা ঘর)।

 

*******আরবী*********

 

নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ইবাদাতের ঘর যা মানুষের জন্যে তৈরী করা হয় তা ঐ ঘর যা মক্কায় রয়েছে।

 

প্রকৃতপক্ষে বায়তুল্লাহ দীনের উৎস কেন্দ্র।কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ তাওহীদের উৎস এবং নামাযের প্রকৃত স্থান, আর এ তাওহীদ এবং নামায গোটা দীনের মস্তিষ্ক ও সারাংশ। আকীদার দিক দিয়ে তাওহীদ দীনের আসল  বুনিয়াদ এবং আমলের দিক দিয়ে নামায দীনের স্তম্ভ। বায়তুল্লাহর নির্মাণ এদু বুনিয়াদী উদ্দেশ্যের জন্যেই। এক জন্যে আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকতের এবং হেদায়াতের উৎস বলে ঘোষণা করেছেন। *******আরবী*********এতে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছে এবং বিশ্ববাসীর জন্যে তাকে হেদায়াতের উৎস বানিয়ে দেয়া হয়েছে। (সূরা আল বাকারার ১২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন-

 

*******আরবী*********

 

এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অসিয়ত করেছিলাম এই বলে আমার এ ঘরকে রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে পাক রেখো। সূরা হজ্জের ২৬ আয়াতে বলা হয়-

 

*******আরবী*********

 

এবং স্মরণ কর যে সময়কে যখন আমি ইবরাহীম এর জন্যে এ ঘর নির্ধারিত করেছিলাম হেদায়াত সহ যে, আমার সাথে যেন কাউকে শরীক করা না হয় এবং আমার ঘরকে তাওয়াফ, কিয়াম, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে যেন পাক রাখা হয়।)

 

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দু স্থানে তাকে *******আরবী********* (আমার ঘর) বলে উল্লেখ করেছেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ ) তার বংশধরকে মক্কার প্রস্তরময় মরু প্রান্তরে পুনর্বাসিত করার সময় বলেন হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে তোমার ঘরের প্রতিবেশী করে পুনর্বাসিত করেছি। (সূরা ইবরাহীমের ৩৭  আয়াতে বলা হয়েছে-

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ! পানি ও তরুলতাহীন মরুপ্রান্তরে তোমার পবিত্র ঘরের পাশে আমার সন্তানদেরকে পুনর্বাসিত করলাম।)বায়তুল্লাহর মহত্ব এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ঘর যিয়ারত করে হজ্জ করাকে মুসলমানদের ওপরে তার এক অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। আর হজ্জ এই যে, মুমিন ইহরাম বেধে অর্থাৎ নিজেকে বায়তুল্লাহতে হাজির হওয়ার যোগ্য জানিয়ে ভক্তি ভরে তার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করবে। তাতে লাগানো হিজরে আসওয়াদের চুমো দেবে। মুলতাযেমের সাথে দেহমন নিবিড় করে দেবে। মসজিদুল হারামে নামায পড়বে এবং আরাফাতে অবস্থান করবে।

 

তাওয়াফের ফযীলত

 

আল্লাহর ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই যে, তার তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ ) কে এর জন্যে তাকীদ করেছেন এবং এ তাকীদ কুরআনে দু স্থানে করা হয়েছে।

 

*******আরবী*********

 

*******আরবী*********

 

১. আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্যে পাক রাখ। (সূরা আল বাকারাঃ ১২৫)

 

২. এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করতে হবে। (সুরা আল হাজ্জঃ ২৬)

 

তাওয়াফের ফযীলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ নামাযের মতোই এক ইবাদত। পার্থক্য শুধু এই যে, তাওয়াফে তোমরা কথা বলতে পার এবং নামাযে তার অনুমতি নেই। অতএব তাওয়াফের সময় কেউ কথা বলতে চাইলে মুখ থেকে যেন ভালো কথা বের হয়। (তিরমিযি, নাসায়ী)

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হিজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামেনী হাত দিয়ে স্পর্শ করা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আমি তাকে একথাও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এ ঘর সাতবার তাওয়াফ করেছে এবং পূর্ণ অনুভূতি ও নিবিষ্ট মনে করেছে তার প্রতিদান এক টি গোলাম আযাদ করার সমান। নবী (স) কে আরও বলতে শুনেছি যে, তাওয়াফের সময় যে কদম ওঠাবে তার প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে একটি করে গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি করে নেকী লিখে দেবেন। (তিরমিযি)

 

ইস্তেলাম

 

ইস্তেলামের আভিধানিকদ অর্থ স্পর্শ করা এবং চুমো দেয়া। পারিভাষিক অর্থ হিজরে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এবং রুকনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা। তাওয়াফের প্রত্যেক পাক বা ঘূর্ণন শুরু করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা এবং তাওয়াফ শেষ করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা সুন্নাত। রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলাম মুস্তাহাব।

 

হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে চুমো দেয়ার সময় মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ না হয়। হিজরে আসওয়াদে শুধু মুখ রাখা মসনুন। এটাও লক্ষ্য  রাখতে হবে যে, অত্যন্ত ভিড়ের কারণে চুমো দেয়া সম্ভব না হরে কোনো ছড়ি প্রভৃতির দ্বারা হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমো দেবে। তাও সম্ভব না হলে দু হাতের তালু হিজরে আসওয়াদের দিকে করে হাত কান পর্যন্ত তুলে হাতে চুমো দেবে।

 

হিজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলামের ফযীলত সম্পর্কে নবী (স) বলেন-

 

আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জীবন দান করে ওঠাবেন। তার দুটি চোখ হবে যা দিয়ে সে দেখবে। তার মুখ হবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। যেসব বান্দাহ তার ইস্তেলাম করতে তাদের সপক্ষে সে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

 

রুকনে ইয়ামেনীর দোয়া

 

রুকনে ইয়ামেনীর ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- রুকনে ইয়ামেনীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছে। তারা ঐসব প্রত্যেক বান্দার দোয়ার পর আমীন বলে যারা এ দোয়া করেঃ

 

হে আল্লাহ! আমি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছ থেকে ক্ষমা ও স্বাচ্ছন্দ্য চাই। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর এবং নেক লোকদের সাথে বেহেশতে স্থান দাও।

 

তাওয়াফের প্রকার ও তার হুকুমাবলী

 

বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছয় প্রকার এবং প্রত্যেকের হুকুম পৃথক পৃথক।

 

১. তাওয়াফে যিয়ারতঃ একে তাওয়াফে ইফাদা এবং তাওয়াফে হজ্জও বলে। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের অন্যতম রুকন। কুরআন বলে *******আরবী********* এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করা উচিত। ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে তাওয়াফে যিরারতের কথাই বলা হয়েছে, যা আরাফাতে অবস্থানের পর দশ তারিখে করা হয়। কোনো কারণে যিলহজ্জের দশ তারিখে করতে না পারলে ১১/১২ তারিখেও করা যেতে পারে।

 

২. তাওয়াফে কুদুমঃ একে তাওয়াফে তাহিয়্যাও বলে। মক্কা প্রবেশের পর প্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। এ তাওয়াফ শুধু তাদের জন্য ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। (ইলমুল ফিকাহ ৫ম এবং কুদুরীতে একে মসনুন বলা হয়েছে। ইমাম মালেক (র) এর নিকট অবশ্য তাওয়াফে কুদুম ওয়াজিব বলা হয়েছ। তার যুক্তি এই যে, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে আসবে তার উচিত তাওয়াফে তাহিয়্যা করা। আয়নুল হেদায়া, প্রথম খন্ড,পৃঃ ৯৯৭) পরিভাষায় একে আফাকী বলে।

 

৩. তাওয়াফে বেদাঃ বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় নেবার সময় যে শেষ তাওয়াফ করা হয় তাকে বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর বলে। এ তাওয়াফও আফাকীর (মীকাতের বহিরাগত) জন্যে ওয়াজিব। এ তাওয়াফের পর মুলতাযেমের সাথে নিজেকে জড়িত করে বুক ও ডান গাল তাতে লগিয়ে এবং ডান হাতে বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে একান্ত বিনয় সহকারে ও অশ্রু কাতর কন্ঠে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে বিদায়ের সময় এবং বলা যায় না যে আবার কখন এ সৌভাগ্য হবে। এ এ তাওয়াফ সম্পর্কে নবী (স) এর হেদায়াত হচ্ছে-

 

কেউ যেন বিদায়ী তাওয়াফ না করে বায়তুল্লাহ থকে ফিরে না যায়। শুধু মাত্র ঐ মেয়েলোকের জন্যে অনুমতি আছে যার হায়েয হয়েছে। (বুখারী)

 

৪. তাওয়াফে উমরাহঃ এ হচ্ছে উমরার তাওয়াফ যা উমরার রুকন।এ তাওয়াফ ছাড়া উমরাহ হবে না।

 

৫. তাওয়াফে নযরঃ কেউ তাওয়াফে নযর মানলে তা করা ওয়াজিব।

 

৬. নফল তাওয়াফঃ এটা যে কোনো সময়ে করা যায়। মক্কায় যতদিন থাকার সুযোগ হয়। বেশী বেশী তাওয়াফ করার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর মানুষের কি হতে পারে?

 

তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ

 

তাওয়াফের মধ্যে নয়টি জিনিস যত্ন সহকারে পালন করা ওয়াজিব।

 

১. নাজাসাতে হুকমীঃ অর্থাৎ হাদীসে আসগার ও হাদীসে আকবার থেকে পাক হওয়া। মেয়েদের জন্যে হায়েয, নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। হযরত আয়েশা (রা) এর হজ্জের সময় মাসিক ঋতু শুরু হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। নবী (স) বলেন, এতে কাদার কি আছে? এ এমন জিনিস যা আদম কন্যাদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। তুমি ওসব কাজ করতে থাক যা হাজীদের করতে হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি তার থেকে পাক হবে। (বুখারী, মুসলিম)

 

২. সতরে আওরতঃ অর্থাৎ শরীরের ঐসব অংশ ঢেকে রাখা যা ঢাকা জরুরী। নবী (স) বলেনঃ *******আরবী********* অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে (সতর খুলে) কেউ যেন তাওয়াফ না করে। (বুখারী)

 

৩. হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম থেকে তাওয়াফ শুরু করা।

 

৪. তাওয়াফ ডান দিক থেকে শুরু করা। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) মক্কায় তশরিফ আনার পর সর্বপ্রথম তিনি হিজরে আসওয়াদের নিকট গেলেন, তার ইস্তেলাম করলেন এবং তারপর ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন।

 

৫. পায়ে হেটে তাওয়াফ করা। ওজর থাকলে সওয়ারীতে তাওয়াফ জায়েয। নফল তাওয়াফ বিনা ওজরে সওয়ারিতে জায়েয। কিন্তু পায়ে হেটে করাই ভালো।

 

৬. তাওয়াফের প্রথম চার ফরয চক্করের পর বাকী তিন চক্কর (শওত) পুরো করা।

 

৭. সাত তাওয়াফে শেষ করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা নবী (স) এর সাথে বায়তুল্লাহ পৌছার পর তিনি হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করলেন। প্রথম তিন চক্করে তিনি রমল (পরিভাষা দ্রঃ) করলেন, বাকী চারটি সাধারণভাবে করলেন। তারপর তিনি মাকে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ  (এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী জায়নামায বানিয়ে নাও) তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে মাকামে ইবরাহীম তার ও বায়তুল্লাহর মধ্যখানে রইলো তারপর তিনি নামায পড়লেন। (মুসলিম)

 

৮. হাতীমের বাইরে থেকে তাওয়াফ করা যাতে করে হাতীম তাওয়াফের মধ্যে শামিল হয়।

 

৯. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা।

 

তাওয়াফে দোয়া

 

খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার জন্য হিজরে আসওয়াদের নিকট পৌছলে *******আরবী********* বলে নিম্ন দোয়া পড়তে হয়ঃ

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ! তোমার ওপর ঈমান এনে, তোমার কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে, তোমার নবী (স) এর সুন্নাতের অনুসরণে (এ ইস্তেলাম এবং তাওয়াফের কাজ শুরু করছি)।

 

তাওয়াফের সময় আস্তে আস্তে এ দোয়া পড়তে হবেঃ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, সকল প্রশংসা তার জন্যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই যে সৎপথে চালাতে পারে এবং কোনো শক্তি নিই যে পাপাচার থেকে বাচাতে পারে।

 

যখন রুকনে ইয়ামেনী পৌছবে তখন রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পড়বে।

 

*******আরবী*********

 

নিম্নের দোয়াও পড়বে-

 

*******আরবী*********

 

হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তৃপ্তি দান কর যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তার ওপর এবং তার মধ্যেই আমাকে বরকত দান কর। আর প্রত্যেকটি অদৃশ্য বস্তুতে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণসহ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাও।

 

তার সাথে নিম্নের দোয়াও পড়া ভালোঃ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই, প্রশংসা সব তারই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।

 

তাওয়াফের মাসায়েল

 

১. প্রত্যেক তাওয়াফ অর্থাৎ চক্কর পুরো করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া ওয়াজিব। দু তাওয়াফ একত্র করা এবং মাঝখানে নামায না পড়া মাকরূহ তাহরিমী।

 

২. সাত চক্কর দেয়ার পর যদি কেউ অষ্টম চক্কর দেয় তাহরে অতিরিক্ত ছয় চক্কর দিয়ে আর এক তাওয়াফ করা দরকার। এজন্য যে নফল ইবাদাত শুরু করার পর তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

 

৩. যেসব সময়ে নামায মাকরূহ। যেসব সময়ে তাওয়াফ মাকরূহ নয়।

 

৪. তাওয়াফ করার সময় পাঞ্জেগানা নামাযের মধ্যে কোনো নামাযের সময় এলে, অথবা জানাযা এলে অথবা অযূর প্রয়োজন হলে, এসব থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে তাওয়াফ শুরু করার প্রয়োজন নেই। যেখানে ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই আবার শুরু করে তাওয়াফ পুরো করবে।

 

৫. তাওয়াফ করতে করতে যদি ভুলে যায় যে, কত চক্কর হলো তাহলো নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে যদি কোনো নির্ভরযোগ্য লোক স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তার কথামতো কাজ করবে।

 

৬. তাওয়াফের সময় খানাপিনা করা, বেচাকেনা করা, গুনগুন করে কবিতা পাঠ বা গান করা এবং বিনা প্রয়োজনে কথা বলা মাকরূহ।

 

৭.তাওয়াফকালে নাজাসাতে হাকীকী থেকে পাক হওয়া মসনুন।

 

৮. হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের প্রথমে যে তাওয়াফ করা হয় তাতে রমল করা মসনুন এবং ইযতেবাগও মসনুন। (এগুলোর জন্যে পরিভাষা দ্রঃ)

 

রমল

 

কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলা, যাতে করে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে। একে বলা হয় রমল।

 

নবী (স) যখন সপ্তম হিজরিতে বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম (রা) সহ ওমরাহ করার জন্যে মক্কায় আসেন, তখন কিছু লোক পরস্পর এভাবে বলাবলি করতে থাকে এদের কি অবস্থা। এরা বড়ো দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে। আসলে মদীনার আবহাওয়া বড্ড খারাপ।

 

নবী (স) যখন মক্কাবাসীদের এসব কথা শুনতে পান  তখন তিনি হুকুম দেন তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল কর অর্থাৎ দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহদের  সে সময়ের আচরণ এতো পসন্দ করেন যে, তা স্থায়ী সুন্নাত হিসবে গণ্য হয়।

 

যে তাওয়াফে সায়ী করা হয় শুধু তাতে রমল সুন্নাত। অতএব যদি কেউ তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করতে না চায়, সে এ তাওয়াফে রমল করবে না। কিন্তু তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে যার পরে তাকে সায়ী করতে হয়। তেমনি কেরান হজ্জকারী যদি তাওয়াফে ওমরায় রমর করে থাকে তাহলে তাওয়াফে হজ্জ রমল করবে না। যদি কেউ প্রথম তিন চক্করে রমল করতে ভুলে যায় তাহলে পরে আর মোটেই করবে না। সাত চক্করেই রমল করা মাকরূহ তানযীহি।

 

ইযতেবাগ

 

চাদর প্রভৃতি এমন ভাবে গায়ে দেয়া যাতে  করে তার এক কিনারা ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে গায়ে দেয়া এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা। এভাবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।

 

হজ্জের ওয়াজিবসমুহ

 

হজ্জের ওয়াজিব নয়টি

 

১. সায়ী করা। অর্থাৎ সাফা মারওয়ার মাঝে দ্রুত চলা। (কুরআন পাকের বয়ান থেকে তাই মনে করা হয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে সায়ী ফরয। তার দলীল নিম্নোক্ত হাদীসঃ

 

*******আরবী*********

 

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির হজ্জ ও ওমরাহ পরিপূর্ণ বলে গণ্য করেন না যে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলো না। (মুসলিম)

 

২. মুযদালফার অবস্থান করা। অর্থাৎ ফজর শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো সময়ে সেখানে পৌছা।

 

৩. রামী করা। অর্থাৎ জুমরাতে পাথর মারা।

 

৪. তাওয়াফে কুদুম করা। অর্থাৎ মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তাওয়াফ করা। তাওয়াফে কুদুম তাদের জন্যে ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরে থাকে যাদেরকে আফাকী বলা হয়।

 

৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। অর্থাৎ খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় তাওয়াফ করা। এটাও শুধু আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।

 

৬. মাথা মুড়ানো বা চুল ছাটা। হাজ্জের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাটা। যুলহজ্জের দশ তারিখে জুমরাতে ওকবায় পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছাটা ওয়াজিব।

 

৭. কুরবানী একত্রে পড়া। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে যোহর আসর একত্রে এবং মুযদালাফায় মাগরিব এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।

 

৯. রামী, মস্তক মুণ্ডন ও কুরবানী ক্রমানুসারে করা।

 

সায়ী

 

অভিধানে সায়ী শব্দের অর্থ যত্ন সহকারে চলা, দৌড়ানো এবং চেষ্টা করা। পারিভাষিক অর্থে সায়ী বলতে হজ্জের সেই ওয়াজিব আমল বুঝায় যাতে হেরেম যিয়ারতকারী সাফা ও মারওয়া নামাক দুটি পাহাড়ের মাঝে দৌড়ায়।সাফা বায়তুল্লাহর দক্ষিণে এবং মারওয়া উত্তর দিকে অবস্থিত। আজকাল এ দুটি পাহাড়ের নামমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট আছে এবং তাদের মধ্যবর্তী স্থানে দুটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে এবং অপরটি মারওয়া থেকে সাফা আসার জন্যে। অর্থাৎ দুটি পাশাপাশি আপ ডাউন সড়ক। এ সড়ক দুটির ওপর বিরাট ছাদ তৈরী করে সড়ক দুটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে যাতে করে সায়ীকারীগণ রৌদ্রে কষ্ট না পায়।

 

সায়ীর হাকীকত ও হিকমত

 

কুরআন পাক বলে-

 

*******আরবী*********

 

সাফা ও মারওয়া নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশাবলীর মধ্য গণ্য।........ শব্দের বহুবচন। কোনো আধ্যাত্মিক মর্ম এবং কোনো ধর্মীয় স্মৃতি অনুভব ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে জিনিস নিদর্শন স্বরূপ নির্ধারিত করা হয় তাকে ......... বলে। প্রকৃতপক্ষে এসব স্থান (সাফা মারওয়া) আল্লাহ পুরস্তি এবং ইসলামের বাস্তব বহিঃপ্রকাশের স্মরণীয় স্থান। মারওয়া হচ্ছে সেই স্থান যেখানে আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ ) তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ ) কে উপুড় করে শুইয়ে তার গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাতে করে তার দেখা স্বপ্ন কার্যে পরিণত করতে পারেন। সেই সাথে তার জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করে তার স্বীয় উক্তির *******আরবী********* (আমি পুরোপুরি নিজেকে রাব্বুল আলামীনের অধীন করে দিয়েছি) বাস্তব সাক্ষ্যদান করেন।

 

ইসলাম বা আত্মসমর্পণ করার এ অভিনব দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছ। এত কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ছিল এক বিরাট পরীক্ষা।

 

*******আরবী*********

 

এবং আমরা তাকে এ বলে ডাকলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমরা নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটা সত্য যে এ হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

 

সাফা ও মারওয়ার ওপর দৃষ্টি পড়তেই স্বাভাবিকভাবেই মুমিনের মনে কুরবানীর এ গোটা ইতিহাস ভেসে ওঠে। আর সেই সাথে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের চিত্রও ভেসে ওঠে।

 

এ সত্যটিকে মনে বদ্ধমূল করার জন্যে এবং এ প্রেরণাদায়ক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য সায়ীকে আল্লাহ তায়ালা মানাসেকের মধ্য শামিল করে দিয়েছেন।

 

আল্লাহ বলেনঃ

 

*******আরবী*********

 

অতএব যে ব্যক্তি হজ্জেও ওমরা করে, তার এ দুয়ের মধ্যে সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। আর যে আগ্রহ সহকারে কোনো ভালো কাজ করে, আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন এবং তার মূল্য দান করেন।

 

জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার মুশরিকগণ এ দুটি পাহাড়ের ওপর তাদের প্রতিমার বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। সাফার ওপরে আসাফের এবং মারওয়ার ওপরে নায়েলার প্রতিমা ছিল। তাদের চারধারে তাওয়াফ করা হতো। এজন্যে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল যে, এ দু পাহাড়ের মাঝে তারা সায়ী করবে কিনা। তখন আল্লাহ বলেন এ সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। এজন্যে যে, সায়ী বলতে হজ্জের মানাসেকের (করণীয় অনুষ্ঠানাদি) মধ্য গণ। হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হজ্জের যেসব মানাসেক শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সায়ী করার নির্দেশও ছিল। এজন্যে কোনো প্রকার ঘৃণা অনীহা ব্যতিরেকেই মুসলমানগণ যেন মনের আগ্রহ সহকারে সাফা মারওয়ার সায়ী করে। আল্লাহ মনের অবস্থা ভালোভাবে জানেন এবং মানুষের সৎ আবেগ অনুভূতি ও সৎকাজ সম্মানের চোখে দেখেন।

 

সায়ীর মাসায়েল

 

১. কাবার তাওয়াফের পর সায়ী করা ওয়াজিব। তাওয়াফের পূর্বে সায়ী জায়েয নয়।

 

২. সায়ী করার সময় হাদাসে আসগার ও হাদাসে আকবার থেকে পাক হওয়া ওয়াজিব নয় বটে, কিন্তু মসনুন।

 

৩. সায়ী তে সাতবার দৌড় দিতে হয়। এ সাতবারই ওয়াজিব।

 

৪. তাওয়াফ শেষ করার সাথে সাথেই সায়ী শুরু করা মসনুন, তবে ওয়াজিব নয়।

 

৫. সায়ী সাফা থকে শুরু করা ওয়াজিব।

 

৬. সায়ী পায় হেটে করা ওয়াজিব। বিশেষ কারণে সওয়ারীতে করা যায়।

 

৭. গোটা হজ্জে একবারই সায়ী করা উচিত। তা তাওয়াফে কুদুমের পরে অথবা তাওয়াফে যিয়ারতের পরে হোক। তাওয়াফে যিয়ারতের পর করা ভালো।

 

৮. সাফা মারওয়ার ওপরে ওঠা বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু হাত দোয়ার জন্যে ওঠানো এবং দোয়া করা মাসনুন।

 

৯. সায়ী করার সময় কেনাবেচা মাকরূহ। প্রয়োজন হলে কথা বলা যায়।

 

সায়ী করার পদ্ধতি ও দোয়া

 

তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে যিয়ারত যার পরেই সায়ী করা হোক, তাওয়াফ শেষ করে সাফা পাহাড়ে ওঠতে হবে। তারপর এ আয়াত পড়তে হয় *******আরবী********* (সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত)। সাফার এতোটা উচ্চতায় চড়তে হবে যেন বায়তুল্লাহ চোখে পড়ে। তারপর বায়তুল্লাহর দিক মুখ করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক এবং তার কোনো শরীক নেই।  শাসন কর্তৃত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসাও তার। তিনি প্রত্যেক বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ শক্তিশালী। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি একক। তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করে দেখিয়েছেন, তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি  একাই সমস্ত কাফের দলকে পরাজিত করছেন। (মুসলিম)

 

তারপর দরূদ শরীফ পড়ে যে দোয়া করার ইচ্ছা তা করা উচিত। নিজের জন্যে, আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনের জন্যে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান। সে জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্যে প্রাণভরে দোয়া করা উচিত। তারপর আবার নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ! তুমি বলেছ আমার কাছে চাও আমি দিব। আর তুমি কখনো ওয়াদা খেলাফ করো না। তোমার কাছ আমার চাওয়া এই যে, তুমি যেমন আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দান করেছ, তেমনি এ সম্পদ থেকে তুমি কখনও আমাকে বঞ্চিত করো না এভাবে আমার যেন মৃত্যু হয় এবং আমি যেন মুসলমান হয়ে মরতে পারি। (মুয়াত্তা)

 

তারপর সাফা থেকে নেমে মারওয়ার দিকে চলতে হবে এবং এ দোয়া পড়তে হবে-

 

*******আরবী*********

 

হে রব! আমাকে মাফ কর এবং রহম কর। তুমি পরম পরাক্রান্ত-শালী ও মহান।

 

সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন পাওয়া যায়। এ দুটি চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো সুন্নাত। এটা শুধু পুরুষদের জন্যে। মেয়েরা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তারা দৌড়ালে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে।

 

তারপর মারওয়া পাহাড়ে ওঠার পর ঐসব দোয়া পড়তে হয় যা সাফার ওপরে পড়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যিকির ও তসবিহতে মশগুল থাকা উচিত। কারণ এটা হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান।

 

তারপর মারওয়া থেকে নেমে পুনরায় সাফার দিকে যেতে হবে এবং ঐসব দোয়া পড়তে হবে যা আসবার সময় পড়া হয়েছে। আর এভাবে দু সবুজ চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াতে হবে। এভাবে সাতবার সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।

 

রামী

 

রামীর আভিধানিক অর্থ নিক্ষেপ করা ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো। পরিভাষা হিসেবে রামী বলে সেই আমলকে যাতে হাজীগণ তিনটি স্তম্ভের ওপর পাথর মারে। জুমরাতে রামী করা ওয়াজিব। জুমরাতে জিমার অথবা জুমরাহ শব্দের বহুবচন। প্রস্তর খণ্ডকে জুমরাহ বলে। মিনার পথে কিছু দূরে দূরে অবস্থিত মানুষ সমান তিনটি স্তম্ভ আছে। সে সবের ওপরে যেহেতু পাথর মারা হয় সে জন্যে এগুলোকেও জুমরাত বলা হয়। এ তিনটিকে জুমরায় উলা, জুমরায়ে উস্তা এবং জুমরায়ে ওকবাহ বলে। মক্কার নিকটবর্তী যেটি, তাকে জুমরায়ে ওকবাহ বলে। তার পরেরটিকে বলে জুমরায়ে উস্তা এবং তার পরেরটি যা মসজিদে খায়েফের নিকটবর্তী তাকে জুমরায়ে উলা বলে।

 

রামীর মর্মকথা ও হিকমত

 

নবী পাক (স) এর জন্মের কিছুদিন পূর্বে (অধিকাংশের মতে পঞ্চাশ দিন হবে) হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহ ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে আগ্রাসন পরিচালনা করে। সে হস্তীবাহিনী সহ বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হতে থাকে। মক্কার অতি নিকটবর্তী মহার উপত্যকা পর্যন্ত সে উপনীত হয়। আল্লাহ তায়ালা তার এ অসৎ উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তাদের প্রত্যেকে ঠোটে একটি করে এবং দু পায়ে দুটি করে ছোট ছোট পাথর নিয়ে এসেছিল এবং গোটা সেনাবাহিনীর ওপরে এমন মুষলধারে বর্ষণ করলো যে, অধিকাংশ ঘটনাস্থলেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং অবশিষ্ট পথে পড়ে পড়ে মরতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আবরাহার দুরভিসন্ধি নির্মূল করে দেন।

 

জুমরাতে পাথর মারা সেই ধ্বংসকারী প্রস্তর বর্ষণের স্মৃতি বহন করে। জুমরাতের ওপরে আল্লাহ আকবার বলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে পাথর নিক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এ সত্য সম্পর্কে দুনিয়াকে হুশিয়ার করে দেয়া এবং আপন সংকল্পের ঘোষণা করা যে, মুমিনের অস্তিত্ব দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার জন্য।

 

কোনো শক্তি যদি দুরভিসন্ধি সহকারে দীনের প্রতি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং তাকে মুলোৎপাটনের চেষ্টা করে তাহলে তাকে নির্মূল করে দেয়া হবে জুমরাতে পাথর নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এ সংকল্পের ঘোষণা করা হয়।

 

রামীর মাসায়েল

 

১. রামী করা ওয়াজিব। ইমাম মালেকের নিকট জুমরাতে ওকবায় রামী ফরয়। এ রামী না করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।

 

২. নিচু স্থানে দাড়িয়ে রামী করা মসনুন। উঁচু স্থান থেকে করা মাকরূহ।

 

৩. প্রত্যেক পাথর মারার সময় আল্লাহু আকবার বলা মসনুন।

 

৪. পাথর যদি জুমরাতে না লাগে অর্থাৎ লক্ষ্যচ্যুত হয় তাহলে তাতে দোষ হবে না।

 

৫. যুলহজ্জের দশ তারিখে অর্থাৎ প্রথম দিন শুধু জুমরায়ে ওকবাতে পাথর মারবে। তারপর এগারো বারো তারিখে তিনটি জুমরাতেই পাথর মারতে হবে। তের তারিখে পাথর মারা মুস্তাহাব। সর্বমোট সাতবার পাথর মারা হচ্ছে। সাতটি করে উনপঞ্চাশটি পাথর মারতে হয়।

 

৬. একটি বড়ো পাথর ভেঙ্গে সাতটি করা মাকরূহ।

 

৭. সাতবারের বেশী পাথর মারা মাকরূহ।

 

৮. সাতটি পাথর সাতবার মারা ওয়াজিব। কেউ এক সাথে সাতটি পাথর মারলে তা একবারই মারা হবে।

 

৯. রামীর জন্যে মুযদালাফা থেকে আসার সময়ে মুহাসসার প্রান্তর থেকে ছোট ছোট পাথর সাথে নিয়ে আসা মুস্তাহাব। জুমরাতের আশপাশ থেকে পাথর কুড়িয়ে নেয়া মাকরূহ।

 

উল্লেখ্য যে, জুমরাতের পাশে যেসব প্রস্তর কণা রয়ে যায় সেগুলো আল্লাহ কবুল করেন। যেগুলো তার দরবারে কবুল হয় তা ফেরেশতাগণ ওঠিয়ে নিয়ে যান। এজন্য ওখানে পড়ে থাকা পাথর কণা দিয়ে রামী করা মাকরূহ।

 

হযরত আবু সাঈদ খুদরী নবী (স) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রতি বছর আমরা যেসব পাথর কনা দিয়ে রামী করি তার সংখ্যা তো কমে যায় বলে মনে হয়। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ, এসবের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ কবুল করেন, তা ওঠিয়ে নেয়া হয়। নতুবা তোমরা দেখতে পেতে যে, পাথর কণাগুলো পাহাড়ের মত স্তূপ হয়ে যেতো। (দারে কুতনী)

 

১০. যে পাথর কণা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা হয় যে, তা নাপাক, তার দ্বারা রামী করা মাকরূহ।

 

১১. দশ তারিখে রামী শুরু করতেই তালবিয়া বন্ধ করা উচিত। বুখারী শরীফে আছে যে, হুজুর (স) জুমরায়ে ওকবাতে রামী করা পর্যন্ত তালবিয়া করতে থাকেন।

 

১২. দশই যুলহজ্জ রামী করার মসনূন সময় হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত। তারপরেও সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়েয, কিন্তু সূর্যাস্তের পর মাকরূহ। অন্য তারিখগুলোতে বেলা গড়া তেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রামী করার মসনূন সময়।

 

১৩. রামী করার জন্যে এক রাত্র মিনাতে কাটানো মসনূন।

 

১৪. দশ তারিখে জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর অন্য তারিখগুলোতে নিম্ন ক্রম অনুসারে রামী করা মসনূনঃ

 

প্রথমে জুমরায়ে উলাতে রামী করতে হবে যা মসজিদে খায়েফের নিকটে অবস্থিত। তারপর জুমরায়ে উস্তা এবং তারপর জুমরায়ে ওকবা।

 

১৫. জুমরায়ে উলা ও জুমরায়ে উস্তায় রামী পায়ে হেটে করা ভালো এবং জুমরায়ে ওকবার সওয়ারীতে থেকে করা ভালো।

 

১৬. জুমরায়ে উলা ও উস্তায় রামী করার পর এতটুকু সময় দাড়িয়ে থাকা, যে সময়ে সূরা ফাতেহা তেলাওয়াত করা যায় এবং তাহমীদ, তাহলীল, তাকবীর, দরূদ প্রভৃতি পড়াতে মশগুল থাকা এবং হাত তুলে দোয়া করা মসনূন।

 

১৭. মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তীস্থানে এক প্রান্তর ছিল যাকে মুহাসসাব বলা হতো। এখন সেখানে বসতি হয়ে গেছে। আজকাল তাকে মুয়াহেদা বলে। বিদায় হজ্জে নবী পাক (স) এখানে অবস্থান করেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) এখানে যোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামায আদায় করেন। তারপর কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম করেন। তারপর এখান থেকে রওয়ানা হয়ে বায়তুল্লাহ পৌঁছে তওয়াফ করেন। (বুখারী)

 

অবশ্য এখানে অবস্থান করা সুন্নাত, ওয়াজিব এবং অপরিহার্য নয়। না করলে কোনো দোষ নেই।

 

১৮. রামী ওসব বস্তুর দ্বারা করা যায় যার দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয। যেমন ইট, পাথর, পোড়া মাটি, পাথর কণা, মাটি, ঢিল প্রভৃতি। কাঠ বা কোনো ধাতব দ্রব্য দ্বারা রামী জায়েয নয়।

 

রামী করার পদ্ধতি ও দোয়া

 

জুমরায়ে ওকবাতে প্রথম রামি করার পূর্বে তালবিয়া ছেড়ে দিয়ে রামী করা উচিত। রামী করার মসনূন পদ্ধতি এই যে, কোনো নিচু স্থানে দাড়িয়ে প্রথমে এ দোয়া পড়বে-

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। শয়তানের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে (এ কাজ করছি) হে আল্লাহ এ হজ্জকে হজ্জে মাবরুর বানিয়ে দাও। গোনাহ মাফ করে দাও এবং এ চেষ্টা কবুল কর।

 

তারপর প্রস্তর কণা আঙ্গুল দিয়ে ধরে প্রত্যেকটি আল্লাহু আকবার বরে মারবে, জুমরাতে লক্ষ্য করে মারবে। জুমরায়ে ওকবাতে পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর মারা অথবা বড়ো বড়ো ইট বা পাথর দিয়ে মারা জুমরাতের নিকটে পড়ে থাকা কণা দিয়ে মারা মাকরূহ।

 

মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাসায়েল

 

মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছাটা হজ্জের আমলসমূহের একটি অপরিহার্য আমল। আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে-

 

*******আরবী*********

 

তোমরা ইনশাআল্লাহ মসজিদুল হারামে মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছেঁটে নিরাপদে প্রবেশ করবে। আর তোমাদের কোনো প্রকারের ভয় ভীতি থাকবে না। (সূরা ফাতাহ: ২৭)

 

আসলে মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এবং হালাল হওয়ার একটা নির্ধারিত শরীয়াতের পন্থা। এর তাৎপর্য সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে শাহ অলীউল্লাহ (র) বলেন, মাথা মোড়ানোর তাৎপর্য এই যে, এ ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এক বিশেষ নির্ধারিত পদ্ধতি। এমন পদ্ধতি যদি নির্ধারিত করা হতো যা মর্যাদার পরিপন্থী, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন ইচ্ছামতো তার ইহরাম খতম করতো এবং পৃথক পৃথক পদ্ধতি প্রবর্তন করতো। (হুজ্জাতুল্লাহেল বালেগা)

 

১. দশই যুলহজ্জ কুরবানীর দিন জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ওয়াজিব।

 

২. পুরুষদের জন্যে মাথা মোড়ানো অথবা চুল ছাটা উভয়ই জায়েয। তবে মস্তক মুন্ডানোর ফযীলত বেশী। এজন্যে যে, নবী (স) মস্তক মুন্ডনকারীদের জন্যে দুবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন এবং যারা চুল ছাটে তাদের জন্য একবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন। (আবু দাউদ, জামাউল ফাওয়ায়েদ)

 

৩. মেয়েলোকদের কিছুটা চুল কেটে ফেলা উচিত। তাদের জন্যে মস্তক মুণ্ডন জায়েয নয়। হযরত আলী (রা) বলেন, নবী (স) মেয়েদের মস্তক মুণ্ডন করতে নিষেধ করেছেন।

 

৪. পুরুষরা সমস্ত মাথার চুলের এক আঙ্গুল পরিমাণ কেটে ফেললে তা জায়েয হবে এবং এক চতুর্থাংশ চুলের কিছু ছেঁটে ফেলাও জায়েয। মেয়েদের জন্যে তাদের চুলের অগ্রভাগ কিছুটা ছেঁটে ফেললেই যথেষ্ট হবে।

 

৫.কারো মাথায় যদি চুল মোটেই গজায়নি অথবা টাক থাকে, তাহলে মাথার উপর শুধু খুর বুলালেই যথেষ্ট হবে।

 

৬. চুল সাফ করার কোনো ওষুধ দ্বারা যদি কেউ চুল সাফ করে তাহলে তাও জায়েয হবে।

 

৭. মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরামের অবস্থার অবসান হয় এবং তারপর তার জন্যে ওসব কাজ হালাল হয়ে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তবে স্ত্রী সহবাস তখনও জায়েয হবে না যতক্ষণ না তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করা হয়েছে।

 

 

 

কুরবানীর বর্ণনা

 

কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানীর, পূজা অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।

 

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী

 

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর হযরত আদম (আ ) এর দু পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।

 

*******আরবী*********

 

এবং তাদেরকে আদমের দু পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুজন কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না। (সূরা আল মায়েদাঃ ২৭)

 

প্রকৃতপক্ষে একজন যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে।

 

অপর ব্যক্তির নাম ছির কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো। হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।

 

সকল খোদায়ী শরীয়াতে কুরবানী

 

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবেরও মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

 

*******আরবী*********

 

আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। (সূরা হজ্জঃ৩৪)

 

অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমুহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তার নাম নিয়েই।

 

*******আরবী*********

 

অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।

 

পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তার নাম নিয়েই তার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মঙ্গল নিহিত রেখেছেন।

 

কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু

 

আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইসলাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প,দৃঢ় বিশ্বাস,আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তার পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই

 

ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।

 

*******আরবী*********

 

যখন সে (ইসমাঈল) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌছলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো প্রিয় পুত্র। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি রা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে) তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আরআমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সুরা আস সাফফাতঃ ১০২-১১১)

 

অর্থাৎ যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ ) এ ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তার উৎসর্গীকৃত বন্দাগণ টিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ ) আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতের জীবন দানকারী মুমিনগণ।

 

নবী (স) এর প্রতি নির্দেশ।

 

কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

 

*******আরবী*********

 

বল, হে মুহাম্মাদ (স) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমা বরদার। (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)

 

আল্লাহর ওপর পাকা পোক্ত ঈমান এবং তার তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা চরিত্র তারই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তোর ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।

 

কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন,  নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)

 

নবী (স) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (জামাউল ফাওয়ায়েদ)

 

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাযের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।

 

একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহেতেই কুরবানী করতেন।

 

কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক

 

কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।

 

১. কুরবানীর পশু আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন

 

*******আরবী*********

 

আর কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমার জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৬)

 

....... শব্দ ............ এর বহুবচন। ........ (শারীয়াহ) ঐ বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা কোনো আধ্যাত্মিক ও অর্থপূর্ণ তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা স্মরণ করার কারণ ও আলামত হয়ে পড়ে, কুরবানীর পশু ঐ আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূত আলামত। কুরবানীকারী আসলে এ আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে যে, কুরবানীর পশুর রক্ত তার আপন রক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। সে আবেগও প্রকাশ করে যে, তার জীবনও আল্লাহর পথে ঐভাবে কুরবানী করা হবে, যেভাবে এ পশু সে কুরবানী করেছে।

 

২. কুরবানী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

 

*******আরবী*********

 

এভাবে এসব পশুকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূর আল হজ্জঃ৩৬)

 

আল্লাহ তায়ালা পশুকে মানুষের বশীভূত করে দিয়ে তাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। মানুষ এসব থেকে বহু উপকার লাভ করে। তার দুধ পান করে, গোশত খায়। তার হাড়, চামড়া, পশম প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরী করে। চাষাবাদে তার সাহায্য নেয়। তাদের পিঠে বোঝা বহন করে, তাদেরকে বাহন হিসেবেও ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও প্রকাশ করে। কুরআন এসবের উপকারের দিকে ইংগিত করে ও তাদেরকে মানুষের বশীভূত করার উল্লেখ করে আল্লাহ পুরস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চার করতে চায়। সেই সাথে এ চিন্তাধারাও সৃষ্টি করতে চায় যে, যে মহান আল্লাহ এ বিরাট নিয়ামত দান করেছেন- তার নামেই কুরবানী হওয়া উচিত। কুরবানী আল্লাহর বিরাট নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

 

৩. কুরবানী আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তার দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৭)

 

অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা প্রকৃতপক্ষে একথারই ঘোষণা যে, যে আল্লাহ এসব নিয়ামত দান করেছেন এবং যিনি এসব আমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছেন- তিনিই এসবের প্রকৃত মালিক। কুরবানী সেই আসল মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং একথারও বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মুমিনের অন্তর থেকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে।

 

পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে সে উপরোক্ত সত্যের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ও ঘোষণা করে এবং মুখে বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবার বলে এ সত্যের স্বীকৃতি দান করে।

 

কুরবানীর প্রাণ শক্তি

 

প্রাক ইসলামী যুগে লোক কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহর সম্মুখে এনে রেখে দিত। তার রক্ত বায়তুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। কুরআন বললো, তোমাদের এ গোশত ও রক্তের কোনোই প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তার কাছে তো কুরবানীর সে আবেগ অনুভূতি পৌঁছে যা যবেহ করার সময় তোমাদের মনে সঞ্চারিত হয় অথবা হওয়া উচিত। গোশত ও রক্তের নাম কুরবানী নয়। বরঞ্চ কুরবানী এ তত্ত্বেরই নাম যে, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্যে এবং তার পথেই উৎসর্গ করার জন্য।

 

কুরবানীকারী শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না। বরঞ্চ তার সকল কু প্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয়, তা হযরত ইবরাহীম (আ ) ও হযরত ইসমাঈল (আ ) এর সুন্নাত নয়, একটা জাতীয় রসম মাত্র। তাতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু সেই তাকওয়ার অভাব দেখা যায় যা কুরবানীর প্রাণ শক্তি।

 

*******আরবী*********

 

ওসব পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে।

 

যে কুরবানীর পেছনে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই আল্লাহর দৃষ্টিতে সে কুরবানীর কোনোই মূল্যে নেই। আল্লাহর কাছে সে আমলই গৃহীত হয় যার প্রেরণা দান করে তাকওয়া।

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন।

 

উট কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক

 

এবং কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের জন্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল। অতএব, তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও এবং যখন (পড়ে গিয়ে) তাদের পার্শ্বদেশ যমীনে লেগে যাবে তখন তোমাদের স্বয়ং তা (গোস্ত) খাও এবং খাইয়ে দাও তাদেরকে যারা চায় না এবং তাদেরকেও যারা চায়। (সূরা হজ্বঃ ৩৬)

 

উট কুরবানী করার নিয়ম এই যে, তাদেরকে এক সারিতে দাড় করিয়ে তাদের হলকুমে (কণ্ঠদেশে) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার থেকে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। রক্ত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে যায়। কুরবানীর এ দৃশ্য একবার মনের মধ্যে অংকিত করুন এবং চিন্তা করুন যে, পশুর এ কুরবানী কোন বস্তু। এটা তো এই যে, এভাবে আমাদেরও জীবন আল্লাহর পথে কুরবান হওয়ার জন্যে তৈরী আছে। প্রকৃতপক্ষে এ কুরবানী আপনজনের কুরবানীরই স্থলাভিষিক্ত। এ অর্থেই উট কুরবানীর চিন্তা করুন। তার আহত হওয়া, রক্ত প্রবাহিত হওয়া, মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার দৃশ্যটা একবার ভেবে দেখুন, যেন মনে হবে যে, জেহাদের ময়দানে আল্লাহর সৈনিকগণ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। তাদের কণ্ঠদেশে শত্রুর তীর অথবা গুলি বিদ্ধ হচ্ছে, তারপর খুনের ঝর্ণা ছুটছ। তারপর খুনরাঙা যমীন তাদের জীবনদানের সাক্ষ্য  দিচ্ছে এবং তারা একজন মাটিতে পড়ে আল্লাহর হাতে তাদের জান পেশ করছে।

 

কুরবানীর পদ্ধতি ও দোয়া

 

যবেহ করার জন্য পশুকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তা কেবলামুখী হয়, ছুরি খুব ধারালো করতে হবে। যথাসম্ভব কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করতে হবে। কোনো কারণে নিজ যবেহ করতে না পারলে তার নিকটে দাড়িয়ে থাকতে হবে।

 

যবেহ করার সময় প্রথম এ দোয়া পড়তে হবে-

 

*******আরবী*********

 

আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবরাহীমের তরীকার ওপরে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি যিনি আসমান যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি কখনো শিরককারীদের মধ্যে নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যে তার কোনো শরীক নেই। এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমি অনুগতদের মধ্যে একজন। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া। (মেশকাত)

 

তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবাইয়ের পর এ দোয়া পড়তে হবে-

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মাদ (স) এবং তোমার খলীল ইবরাহীম (আ ) এর কুরবানী কবুল করেছিলে।

 

দোয়ার প্রথমে ............ শব্দ আছে। নিজের কুরবানী হলে ...... বলতে হবে। আর অন্য বা একাধিক লোকের পক্ষ থেকে হলে তাদের নাম বলতে হবে।

 

কুরবানীর ফযিলত ও তাকীদ

 

নবী (স) কুরবানীর ফযিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন,

 

১. নাহারের দিন অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুর সহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, মনের আগ্রহ সহ এবং সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর। (তিরমিযি ইবনে মাজাহ)

 

২. সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানী কি বস্তু? নবী বলেন, এ তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ ) এর সুন্নাত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী (স) বলেন, তার প্রত্যেক পশমের জন্যে এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

 

৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) হযরত ফাতেমা যোহরা (রা) কে বলেন, ফাতেমা! এসো, তোমার কুরবানীর পশুর কাছে দাড়িয়ে থাক। এজন্যে যে, তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যেও। (জামউল ফাওয়োদে)

 

৪. হযরত ইবনে বারীদাহ (রা) তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন, নবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে নামাযে যেতেনে না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদুল আযহার নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, আহমাদ)

 

তারপর নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর কলিজী খেতেন।

 

 

 

কুরবানীর আহকাম ও মাসায়েল

 

কুরবানী দাতার জন্যে মসনূন আমল

 

যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। এ আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। এ কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।

 

হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল ও নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এ দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন ঐ বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী (স) বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে এ তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)

 

কুরবানীর পশু ও তার হুকুম

 

১. কুরবানীর পশু নিম্নরূপ:

 

উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।

 

২. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু এক ব্যক্তির জন্যে হতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি তাতে অংশীদার হতে পারবে না।

 

৩. গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সাতজন অংশীদার হতে পারে, তার বেশী নয়। তবে তার জন্য দুটি শর্তঃ

 

প্রথম শর্ত এই যে, প্রত্যেক অংশীদারের নিয়ত কুরবানী অথবা আকিকার হতে হবে। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত যেন না হয়।

 

দ্বিতীয় শর্ত এই যে, প্রত্যেকের অংশ ঠিক এক সপ্তমাংশ হবে। তার কম কেউ অংশীদার হতে পারে না।

 

এদুটো শর্তের মধ্যে কোনো একটি পূরণ না হলে কুরবানী ঠিক হবে না।

 

৪. উট ও গরু-মহিষে সাতজনেরও কম অংশীদার হতে পারে, যেমন দুই, চার অথবা তার কম বেশী অংশ কেউ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও এ শর্ত জরুরী যে, কোনো অংশীদার সাত ভাগের এক ভাগ এর কম অংশীদার হতে পারবে না। নতুবা কারো কুরবানী ঠিক হবে না।

 

৫. এক ব্যক্তি গরু খরিদ করলো এবং তার ইচ্ছা যে অন্য লোককে অংশীদার করে কুরবানী করবে। এটা দুরস্ত হবে। যদি খরিদ করার সময় গোটা গরু নিজের জন্যে খরিদ করার নিয়ত করে পরে অন্য লোককে অংশীদার করার ইচ্ছা করে, তাও জায়েয হবে। অবশ্য এটা করা ভালো যে, সে এমন অবস্থায় তা প্রথম ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা পশু নিজের জন্যই কুরবানী করবে। তবে কাউকে শরীক করতে চাইলে সচ্ছল ব্যক্তিকে শরীক করবে, যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এমন ব্যক্তিকে যদি শরীক করা হয় যার কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।

 

৬. গরু মহিষের কুরবানীতে কেউ এক বা একাধিক অতিরিক্ত লোকের অংশ নিজে নিজেই ঠিক করলো, অংশীদারদের অনুমতি নেয়া হলো না, তাহলে এ কুরবানী জায়েয হবে না। যাদের অংশ রাখা হবে তাদের তাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। এটা করা যাবে না যে, কুরবানীর অংশীদার মনে মনে ঠিক করে প্রথমে কুরবানী করা হলো এবং তারপর অংশীদারের অনুমতি পরে নেয়া হলো।

 

৭. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পূর্ণ এক বছর বয়সের হলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে। এক বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। গরু মহিষ পূর্ণ দু বছরের হতে হবে। দু বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। উট পাঁচ বছরের হলে কুরবানী হবে। তার কম হলে জায়েয হবে না।

 

৮. যে পশুর শিং জন্ম থেকে ওঠেনি, অথবা ওঠার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তাহলে তার কুরবানী করা জায়েয হবে। কিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙ্গে যায় তাহলে তা কুরবানী জায়েয হবে না।

 

৯. অন্ধ, কানা পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যে পশু তিন পায়ের ওপর চলে এমন ল্যাংড়া পশু কুরবানী করাও জায়েয হবে না। চতুর্থ পা যদি মাটিতে রাখে কিন্তু খুড়িয়ে চলে, তাহলে দুরস্ত হবে।

 

১০. যে পশুর কান এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা অথবা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।

 

১১. দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হলেও মোটাতাজা ও সুন্দর পশু কোরবানী করা ভালো। পশু যদি এমন দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয় যে, তার হাড় একেবারে মজ্জাহীন হয়ে পড়েছে তাহলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।

 

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) শিং বিশিষ্ট মোটা তাজা একটা দুম্বা কুরবানী করছিলেন যার চোখের চারপাশে কালো রং ছিল, যার মুখও কালো রঙের ছিল এবং যার পাগুলো ছিল কালো রঙের। (আবু দাউদ)

 

১২. যে পশুর জন্ম থেকেই কান হয়নি অথবা হয়ে থাকলে খুব ছোট ছোট তা কুরবানী করা দুরস্ত হবে।

 

১৩. যে পশুর দাঁত মোটেই নেই তার কুরবানী করা দুরস্ত হবে না। কিন্তু দাঁত পড়ে গেছে এবং অধিকাংশ দাঁত আছে তাহলে জায়েয হবে।

 

১৪. খাসি, পাঠা কুরবানী জায়েয। নবী (স) স্বয়ং খাসি দুম্বা কুরবানী করেছেন।

 

১৫. যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব এমন এক সচ্ছল ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে একটি পশু খরিদ করলো। খরিদ করার পর তার মধ্যে এমন ত্রুটি পাওয়া গেল, যার জন্যে তা কুরবানী করা দুরস্ত হলো না। তখন সে আর একটি পশু খরিদ করে কুরবানী করবে। তবে কোনো দরিদ্র লোকের এমন অবস্থা হলে- যার ওপর কুরবান ওয়াজিব ছিল না, তার পক্ষে ঐ ত্রুটি পূর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হবে।

 

১৬. গাই-বকরী গর্ভবতী হলেও তা কুরবানী জায়েয হবে। বাচ্চা জীবিত হলে তাও যবেহ করা উচিত।

 

কুরবানীর হুকুম

 

১. কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কে একজন জিজ্ঞেস করলো কুরবানী কি ওয়াজিব? তিন বলেন, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় সে প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছ না যে, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন।

 

২. কুরবানী কারেন এবং মুতামাত্তার ওপরে ওয়াজিব। তবে মুফরেদের ওপর ওয়াজিব নয়। সে যদি আপন ইচ্ছায় করে তাহলে তার সওয়াব পাবে।

 

৩. হাজীদের ছাড়া অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত এই যে,যে সচ্ছল হবে। সচ্ছল হওয়ার অর্থ তার ততোটা ধন-সম্পদ থাকতে হবে যে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত এতো সম্পদ থাকবে যে, তার হিসেব করলে নেসাব পরিমাণ হবে।

 

অর্থাৎ যার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

 

দ্বিতীয় শর্ত এই যে, মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।

 

৪. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।

 

৫. কোন ব্যক্তির ওপরে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কুরবানী ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়তে পশু খরিদ করেছে। তাহলে সে পশু কুরবানী করা তার ওয়াজিব হবে।

 

৬. এক ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল, কুরবানীর তিন দিন অতীত হয়ে গেলে কোনো কারণে সে কুরবানী করতে পারলো না। যদি এ উদ্দেশ্যে সে কোনো ছাগল খরিদ করে থাকে তাহলে জীবিত সে ছাগল খয়রাত করে দেবে। খরিদ করে না থাকলে একটি ছাগলের মূল্য খয়রাত করবে।

 

৭. কেউ এ বলে মানত মানলো যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে কুরবানী করবো। আল্লাহর ফযলে তার সে কাজ হয়ে গেল। এখন সে ব্যক্তি সচ্ছল হোক অথবা অসচ্ছল তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। মানত কুরবানীর হুকুম এই যে, তার সমস্ত গোস্ত গরীব ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে- না কুরবানীকারী খাবে এবং না কোনো সচ্ছল ব্যক্তিকে খাওয়াবে।

 

কুরবানীর দিনগুলো ও সময়

 

১. ঈদুল আযহা অর্থাৎ যুলহজ্জের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে কোনো দিনে সুযোগ সুবিধা মতো কুরবানী করা জায়েয। তবে কুরবানী করর সবচেয়ে উত্তম দিন হলো ঈদুল আযহার দিন। তারপর এগারো তারিখে এবং তার বারো তারিখে।

 

২. শহর ও বন্দরের অধিবাসীদের জন্যে ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী জায়েয নয়। নামাযের পর কুরবানী করবে। তবে গ্রামাঞ্চলের লোক ফজর নামাযের পরও কুরবানী করতে পারে। (সম্ভবত এজন্যে যে, বহু দুর দূরান্তের ঈদগাহ থেকে নামা পড়ে আসতে বহু বিলম্ব হবে এমন কি বিকেল হয়ে যেতে পারে।)

 

৩. শহরের অধিবাসী যদি তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে করায় তাহলে তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে ফজরের পরও হতে পারে। ঈদের নামাযের পূর্বই যদি গোস্ত এসে যায় তাহলেও কুরবানী জায়েয হবে।

 

৪. কুরবানীর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময়ে দিনে বা রাতে, কুরবানী করা জায়েয।

 

তবে রাতে কুরবানী না করা ভালো। কারণ কোনো রগ হয়তো ভালোভাবে কাটা নাও যেতে পারে যার জন্যে কুরবানী দুরস্ত হবে না।

 

৫. কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত মুকীম হওয়া এবং সচ্ছল হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি সফরে থাকে এবং বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী পৌঁছে এবং সে যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে; সে যদি মুকীম এবং দরিদ্র হয়, কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যদি আল্লাহ তাকে মালদার বানিয়ে দেয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

কুরবানীর বিভিন্ন মাসায়েল

 

১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়। শুধু মনের নিয়ত ও ইরাদা কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে মুখে দোয়া পড়া ভালো।

 

২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার। যেমন নবী (স) হযরত ফাতেমা (রা) কে বলেছিলেন ফাতেমা চল, তোমার কুরবানীর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। এ জন্যে যে, তার প্রতিটি রক্ত কণার বদলায় তোমার পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ফাতেমা বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। একি আমাদের আহলে বায়তের জন্যে নির্দিষ্ট, না সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের জন্যেও এবং সকল মুসলমানদের জন্যেও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)

 

৩. গরু মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোস্ত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, গুর্দা, কলিজী প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যেতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।

 

৪. কুরবানীর গোস্ত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বণ্টন করা যায়। এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করলেও কোন দোষ নেই।

 

৫. গরু মহিষ বা উটে কয়েক ব্যক্তি অংশীদার রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোস্ত ভাগ করে নেয়ার পরিবর্তে যদি সব একত্রে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে।

 

৬. কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।

 

৭. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।

 

৮. কুরবানীর চামড়া নিজের কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন জায়নামাজ বানানো হলো।

 

৯. কসাইকে গোস্ত বানাবার মজুরী স্বরূপ গোস্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে। রশি, চামড়া প্রভৃতি খয়রাত করতে হবে।

 

১০. যার ওপর কুরবানী ওয়াজেব তাকে তো করতেই হবে। যার ওপর ওয়াজিব নয়, তার যদি খুব বেশী কষ্ট না হয় তাহলে তারও করা উচিত। অবশ্য ধার কর্জ করে কুরবানী করা ঠিক নয়।

 

মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানী

 

আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন সে শুধু তার ওয়াজিব কুরবানী করেই ক্ষান্ত হবে না। বরঞ্চ কুরবানীর অফুরন্ত সওয়াব পাওয়ার জন্যে আপন মুরব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো। এমন কি যার বদৌলতে হেদায়াত ও ঈমানের সম্পদ লাভ সম্ভব হয়েছে এমন হাদী ও মুরশিদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তো মুমিনের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এভাবে আযওয়াজে মুতাহহেরা অর্থাৎ রূহানী মা-দের পক্ষ থেকে কুরবানী করাও অশেষ সৌভাগ্যের কথা।

 

হাদীর বয়ান

 

হাদী শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদীয়া তোহফা, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যাকে হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পাঠিয়ে দেয়।

 

১. হাদী তিন প্রকারঃ উট, গরু, ছাগল। উট সর্বোৎকৃষ্ট হাদী এবং ছাগল সর্বনিম্ন। ভেড়া, দুম্বা প্রভৃতি ছাগলের পর্যায়ে এবং মহিষ প্রভৃতি গরু গাভীর পর্যায়ে।

 

২. হাদীর পশুর বয়স, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে হুকুম ও শর্ত তাই যা কুরবানীর পশু সম্পর্কে রয়েছে।

 

৩. হাদী যদি ইচ্ছাকৃত হয়,যেমন ইফরাদ হজ্জকারী আপন  ইচ্ছায় নফল কুরবানী করে। তাহলে সে কুরবানীর গোস্ত হাদীকারী নিজেও খেতে পারে। তেমনি কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারী আপন আপন কুরবানীর গোস্ত খেতে পারে। যেমন সাধারণ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া জায়েয। কারণ কেরান এবং তামাত্তুর হাদী কোনো অপরাধ অথবা ত্রুটি বিচ্যুতির কাফফারা নয়। বরঞ্চ শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারীর ওপর ওয়াজিব করেছেন। এজন্যে সাধারণ কুরবানীর গোস্তের মতো তা খাওয়া জায়েয। নবী (স) তার হাদীর প্রত্যেকটি পশুর এক এক টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন এবং তার শুরবাও পান করেছেন। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের (রা) এর বর্ণনা এবং অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত আছে যে, নবী (স) হজ্জে কয়েকটি কুরবানী করেন।

 

প্রকাশ থাকে যে, কেরান এবং তামাত্তু তো একটি কুরবানীই হয়ে থাকে এবং বাকীগুলো নফলই হয়ে থাকবে। তিনি যখন প্রত্যেকটি থেকে এক একটা টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন তাহলে জানা গেল যে, তামাত্তু, কেরান এবং নফল তিন প্রকারের গোস্ত কুরবানীকারী স্বয়ং খেতে পারে।

 

৪. তামাত্তু, কেরান ও ইচ্ছাকৃত নফল কুরবানীর গোস্ত ছাড়া কোনো হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয়। তা সে কোনো অপরাধের কাফফারার হাদী হোক কিংবা মানতের অথবা ইহসাবের দমের (পরিভাষা দ্রষ্টব্য) কুরবানী হোক। নবী (স) যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, তখন তিনি নাজিরা আসালামীর মাধ্যমে ইহসারের হাদী পাঠিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, তার গোস্ত সে যেন না খায় এবং সঙ্গীকেও খেতে না দেয়।

 

৫. যে হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয় তার সমস্ত গোশত ফকীর মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে এবং তা করা ওয়াজিব। হেরেমের গরীবদের মধ্যে হোক অথবা তার বাইরের হোক উভয়ই জায়েয। হেরেমের গরীবদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। (আয়নুল হেদায়া)

 

৬. যে হাদীর গোস্ত খাওয়া জায়েয তার সমস্ত গোস্ত ফকীর মিসকিনকে সদকা করা ওয়াজিব নয়। বরঞ্চ মুস্তাহাব। তার তিন ভাগ করা উচিত। এক ভাগ নিজের জন্যে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্যে এবং এক ভাগ ফকীর মিসকিনের জন্যে। তবে এমন করা জরুরী নয়। সমস্তই ফকীর মিসকিনকে দিলেও তা জায়েয হবে।

 

আবে যমযম, আদব কায়দা ও দোয়া

 

বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে একটি ঐতিহাসিক কূপ আছে যাকে যমযম বলে। হাদীসে এ কুয়ার অনেক ফযিলত ও তার পানির অনেক বরকত ও ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ ) আল্লাহর হুকুমে যখন হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মা হযরত হাজেরা (আ ) কে মক্কার বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মাতা ও সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্যে যমযম প্রস্রবণ প্রবাহিত করে ছিলেন। হাদীসে আছে-

 

*******আরবী*********

 

এ হচ্ছে জিবরাঈলের তৈরী করা কূপ এবং ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের ছোট হাউজ। (দারু কুতনী)

 

সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন প্রভৃতি শেষে পেট ভরে যমযমের পানি পান করা উচিত। এমন বেশী করে পানি পান করা, যাতে পাঁজরাগুলো ডুবে যায়, এটা ঈমানের আলামত। ঈমান থেকে বঞ্চিত মুনাফিক এতোটা পান করতে পারে না। নবী (স) বলেন আমাদের এবং মুনাফিকদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন এই যে, মুনাফিক যমযমের পানি পেটভরে পান করতে পারে না যাতে পাঁজরা ডুবে যায়। (ইবনে মাজাহ)

 

আবে যমযমের বরকত ও ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, আবে যমযম যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয় তার জন্যেই ফলদায়ক হয়। রোগ আরোগ্যের জন্য পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। তৃপ্তি লাভের জন্যে পান করা হলে আল্লাহ তৃপ্তিদান করবেন। পিপাসা নিবারণের জন্যে পান করলে আল্লাহ পিপাসা নিবারণ করবেন। এ হচ্ছে সেই কুয়া যা জিবরাঈল (আ ) পায়ের গোড়ালির আঘাতে খনন করেন এবং এ হচ্ছে ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের উন্মুক্ত জলাধার। (দারু কুতনী)

 

অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ )বিশেষভাবে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরা (আ )এর জন্যে বারিহীন অনুর্বর প্রান্তরে যমযম বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে যায়।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সকল পানি থেকে উৎকৃষ্ট যমযমের পানি। ক্ষুধার্তদের জন্যে এ আহার, রোগীর জন্য আরোগ্য। (ইবনে আব্বাস)

 

তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ও উদ্দেশ্যে যমযমের পানি পান করে যে, সে দুশমন থেকে আশ্রয় লাভ করবে- তাহলে সে আশ্রয় পাবে।(হাকেম)

 

যমযমের পানি দাড়িয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে পান করা উচিত এবং পেটভরে পান করা উচিত। পান করার সময় এ দোয়া পড়বে।

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ আমি তোমার কাছে মঙ্গলকর ইলম চাই, প্রশস্ত রুজি চাই এবং প্রত্যেক রোগ থেকে আরোগ্য চাই। (নায়লুল আওতার)

 

মুলতাযেম ও তার দোয়া

 

মুলতাযেম বায়তুল্লাহর ও দেয়ালের সে অংশকে বলে যা কাবার দরজা এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ প্রায় ছফুটের অংশ এবং দোয়া কবুলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এর সাথে দেহ বুক ও মুখ লাগিয়ে বিনয় ও নম্রতার সাথে ও কাতর কণ্ঠে দোয়া করা হজ্জের একটি মসনুন আমল । তাওয়াফ শেষ করার পর মুলতাযেমের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া ও দোয়া করা বিশেষ করে এমন এক অনুভূতি ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করে যে, এটা বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হওয়ার এক বেদনা দায়ক মুহূর্ত।

 

হযরত আমর ইবনে শোয়াইব বলেন, আমার পিতা শুয়াইব বর্ণনা করেছেন, আমি আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আস (রা) এর সাথে তাওয়াফ করার সময় কিছু লোক কে বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে বললাম, আমাকে একটু ঔ জায়গায় নিয়ে চলুন। লোকদের সাথে আমরাও বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গন করি। তিনি বললেন আউযুবিল্লাহে মিনশ শায়তানির রাজিম। তারপর যখন তিনি তাওয়াফ শেষ করলেন তখন হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী বায়তুল্লাহের ঐ অংশের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম এটা ঐ স্থান যার সাথে নবী (স) কে আলিংগনাবস্থায় দেখেছি। (বায়হাকী)

 

আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ বিন আমের (রা) হিজরে আসওয়াদ এবং বাবে কাবার মাঝে দাড়িয়ে গেলেন এবং আপন বক্ষ মুখ মণ্ডল ও দুহাত প্রসারিত করে কাবার দেওয়ালে রাখলেন এবং বললেন নবী (স) এমন করতে দেখেছি। (আবু দাউদ)

 

মুলতাযেমের দোয়া সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিপদাপন্ন হয়ে এখানে দোয়া চাইবে সে অবশ্যই নিরাপদ হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)

 

মুলতাযেমের সাথে দেহ আবিষ্ট করে প্রথমে নিম্নের দোয়া পড়বে। তারপর দ্বীন দুনিয়ার জায়েজ মনস্কামনা পূরণের দোয়া করবে:

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ! প্রশংসার হকদার তুমিই, এমন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা যার দ্বারা তোমার নিয়ামতের কিছু হক আদায় হতে পারে। আর এ সব নিয়ামতের উপর  কিছু এহসান কিছু এনামের কিছু বিনিময় হতে পারে। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব গুণাবলীর সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব নিয়ামতের সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। সকল অবস্থায় আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আয় আল্লাহ! দরুদ ও সালাম মুহাম্মদ (স) এর উপরে এবং মুহাম্মদের বংশধরের উপর। আয় আল্লাহ! মরদূদ শয়তান থেকে তোমার পানাহ চাই এবং প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে আমাকে আশ্রয় দাও।তুমি যা কিছু আমাকে দিয়েছ তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে দাও। আমার জন্য তাতে বরকত দাও। আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার সম্মানিত মেহমানদের মধ্যে শামিল কর। আর তুমি আমাকে সোজা পথে চলবার তাওফীক দাও, রাব্বুল আলামীন, যতক্ষণ না আমি তোমার সাথে মিলিত হই।

 

দোয়া কবুলের স্থানসমূহ

 

হজ্জের সময় প্রত্যেক আমল করতে গিয়ে যিকর তসবীতে মশগুল থাকা এবং প্রত্যেক স্থানে বেশী করে দোয়া করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অধিক পরিমাণ দোয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত হাসান বসরী যখন মক্কা থেকে বসরায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মক্কাবাসীদের নিকট একখানা পত্র লেখেন। তাতে তিনি মক্কায় অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযিলত বয়ান করেন এবং বিশেষ করে বলেন যে, নিম্নের এগারটি স্থানে বিশেষভাবে মুমিনের দোয়া কবুল হয়ঃ

 

১. মুলতাযেমের সাথে দেহ মন আবিষ্ট করে দোয়া করা। নবী (স) বলেন, মুলতাযেম এমন এক স্থান যেখানে দোয়া কবুল হয়। এখানে বান্দাহ যে দোয়াই করে তা কবুল হয়।

 

২. মিযআবের নিচে।

 

৩. পাক কাবার ভিতরে।

 

৪. যমযমের নিকটে।

 

৫. সাফা-মারওয়ায়।

 

৬. সাফা-মারওয়ায় যেখানে দৌড়ে চলতে হয়।

 

৭. মাকামে ইবরাহীমের নিকটে।

 

৮. আরাফাতের ময়দানে।

 

৯. মুযদালফায়ে।

 

১০. মিনায়।

 

১১. জুমরাতের পাশে।

 

ওমরা

 

ওমরা অর্থ প্রতিষ্ঠিত গৃহের যিয়ারত করা এবং শরীয়াতের পরিভাষায় ওমরার অর্থ ছোট হজ্জ যা সবসময়ে হতে পারে। তার জন্যে কোনো মাস ও দিন নির্ধারিত নেই। যখনই মন চাইবে ইহরাম বেধে  বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে, সায়ী করবে এবং মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে ইহরাম খুলবে। ওমরা হজ্জের সাথেও করা যায় এবং আলাদাও করা যায়। কুরআন বলে-

 

*******আরবী*********

 

এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ্জ ও ওমরা করি। (সূরা আল বাকারা)

 

হাদিসে ওমরার বিরাট ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আমল ঈমানের সাক্ষ্যদান। তারপর হিজরত ও জিহাদের মর্যাদা। তারপর দুটো আমলের চেয়ে উৎকৃষ্ট আমল আর কিছু নেই। একটি হজ্জে মাবরুর এবং দ্বিতীয়টি ওমরাহ মাবরুর। (মুসনাদে আহমদ)

 

ওমরাহ মাবরুর অর্থ এমন ওমরাহ যা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তার সকল নিয়ম নীতি ও শর্তগুলোসহ পালন করা হয়।

 

নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার নিয়তে বাড়ী থেকে রওয়ানা হলো এবং তারপর সে পথেই মৃত্যুবরণ করলো, সে বিনা হিসেবে বেহেশতে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারীদের জন্যে গর্ববোধ করেন। (বায়হাকী, দারুকুতনী)

 

নবী (স) বলেন, হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। তারা আল্লাহর দাওয়াতে আসে। অতএব, তারা যা কিছু তার কাছে চায়, তা পায়। (আল বাযযার)

 

এক ওমরাহ দ্বিতীয় ওমরাহ পর্যন্ত গুনাহগুলোর কাফফারা হয়ে যায়। (বুখারী, মুসলিম)

 

ওমরার মাসায়েল

 

১. জীবনে একবার ওমরা করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তাছাড়া তা যখনই করা হোক, তার জন্যে প্রতিদান ও বরকত রয়েছে। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ওমরাহ কি ওয়াজিব? নবী (স) বলেন- না, তবে ওমরা করো, এর বড়ো ফযিলত রয়েছে।

 

২. ওমরার জন্যে কোনো মাস, দিন ও সময় নির্ধারিত নেই যেমন হজ্জের জন্যে রয়েছে। যখনই সুযোগ হবে ওমরাহ করা যেতে পারে।

 

৩. রমযানে ওমরাহ করা মুস্তাহাব। নবী (স) বলেন, রমযানে ওমরা করা এমন যেন আমার সাথে হজ্জ করা। (আবু দাউদ) বুখারীতে আছে, রমযানে ওমরা হজ্জের সমান।

 

৪. ওমরার জন্যে মীকাত হচ্ছে হিল এবং সকলের জন্যেই তাই, চাই তারা আফাকী হোক অথবা মীকাতের ভেতরের হোক অথবা মক্কার অধিবাসী হোক। হজ্জের মীকাত মক্কাবাসীদের জন্যে হিল।

 

৫. ওমরার আমল শুধু ইহরাম বাধা, তাওয়াফ করা, সায়ী করা এবং মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করা।

 

হজ্জের প্রকার

 

হজ্জ তিন প্রকার এবং প্রত্যেকের পৃথক পৃথক মাসায়েল রয়েছে। (১) হজ্জে এফরাদ, (২) হজ্জে কেরান, (৩) হজ্জে তামাত্তু।

 

হজ্জে এফরাদ

 

এফরাদের আভিধানিক অর্থ একাকী করা, এক কাজ করা প্রভৃতি। শরীয়াতের পরিভাষায় এফরাদ ঐ হজ্জকে বলে যার সাথে ওমরাহ করা হয় না, শুধু হজ্জের ইহরাম বাধা হয় এবং হজ্জের রীতি পদ্ধতি পালন করা হয়। এফরাদ হজ্জকারীকে মুফরেদ বলা হয়। মুফরেদ এহরাম বাধার সময় শুধু হজ্জে নিয়ত করবে এবং পূর্ব বর্ণিত হজ্জের রুকনগুলো পালন করবে। মুফরেদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।

 

হজ্জে কেরান

 

কেরান শব্দের অর্থ দুটো জিনিসকে একত্রে মিলানো।পরিভাষা হিসেবে হজ্জ ও ওমরার এহরাম এক সাথে বেধে উভয়ের রুকন পালন করাকে হজ্জে কেরান বলে। এ হজ্জকারীকে কারেন বলে।

 

হজ্জে কেরান এফরাদ ও তামাত্তু থেকে উৎকৃষ্ট। (ইমাম শাফেয়ীর মতে এফরাদ উৎকৃষ্ট এবং ইমাম মালেকের মতে তামাত্তু উৎকৃষ্ট। এজন্যে যে হজ্জে তামাত্তুর উল্লেখ কুরআনে আছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, কুরবানীর পশু সাথে থাকলে কেরান উৎকৃষ্ট, না থাকলে তামাত্তু উৎকৃষ্ট। আহলে হাদীসের মতে হজ্জে কেরান ওমরা ও হজ্জের জন্যে একই তাওয়াফ ও সায়ী যথেষ্ট।)

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (র) বলেন, নবী (স) বলেছেন, হজ্জ ওমরাহ একত্রে মিলিয়ে আদায় কর। এজন্যে যে, এ দুটো দারিদ্র্য ও গুনাহ এমনভাবে নির্মূল করে দেয় যেমন আগুনের চুল্লি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা নির্মূল করে দেয়। (তিরমিযি)

 

কেরানের মাসায়েল

 

১. হজ্জের মাসগুলোতে ওমরাহ করা কারেনের জন্যে জরুরী।

 

২. হজ্জে কেরানে ওমরার তাওয়াফ হজ্জের তাওয়াফের আগে করা ওয়াজিব।এবং ওমরার জন্যে পৃথক তাওয়াফ ও সায়ী এবং হজ্জের জন্যেও পৃথক।

 

৩. কেরানের ওমরায় সকল কাজ সমাধার পর হজ্জের কাজ শুরু করা মসনুন।

 

৪. কারেনের ওমরার পর মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটা নিষেধ।

 

৫. কারেনের জন্যে ওমরার তাওয়াফ এবং হজ্জের তাওয়াফে কুদুম এক সাথে করা জায়েয বটে এবং উভয়ের সায়ীও এক সাথে করা জায়েয, কিন্তু এসব করা সুন্নাতের খেলাপ।

 

৬. কারেনের জন্যে কুরবানী ওয়াজিব। এ কুরবানী এমন শুকরিয়া আদায়ের জন্যে যে, আল্লাহ হজ্জ ওমরা এক সাথে আদায় করার সুযোগ দিয়েছেন। কুরবানীর সামর্থ্য না থাকলে দশ রোযা রাখা ওয়াজিব। তিন রোযা কুরবানীর দিনের আগে এবং সাত রোযা আইয়ামে তাশরীকের পর। কুরআন বলে-

 

*******আরবী*********

 

যার কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই, সে তিন দিন রোযা রাখবে হজ্জের সময়ে এবং সাত রোযা রাখবে যখন তোমরা হজ্জ শেষ করে ফিরবে, এ মোট দশ দিন।

 

৭. হজ্জে কেরান ও তামাত্তু শুধু তাদের জন্যে যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী তাদেরকে আফাকী বলা হয়। কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

এ (তামাত্তু ও কেরান) তাদের জন্যে যাদের পরিবার মসজিদে হারামের থাকে না। যারা মীকাতের ভেতরের অধিবাসী তাদের জন্যে শুধু হজ্জে এফরাদ।

 

হজ্জে তামাত্তু

 

তামাত্তু শব্দের অর্থ কিছুক্ষণের জন্যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করা।পারিভাষিক অর্থে হজ্জে তামাত্তু যাকে বলা হয়, তাহলো এই যে, ওমরাহ ও হজ্জ সাথে সাথে করা। এমনভাবে করা যে, এহরাম পৃথক পৃথক বাধবে এবং ওমরাহ করার এহরাম খুলবে এবং ঐসব সুযোগ ভোগ করবে যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তারপর হজ্জের এহরাম বেধে হজ্জ করবে। এ ধরনের হজ্জে যেহেতু ওমরাহ ও হজ্জের মধ্যবর্তী সময়ে এহরাম খুলে হালাল বস্তু উপভোগ করার সময় পাওয়া যায়, সেজন্যে একে হজ্জে তামাত্তু বলে।

 

কুরআন বলে

 

*******আরবী*********

 

অতএব যে ব্যক্তি হজ্জের দিনগুলোর মধ্যে ওমরার ফায়দা লাভ করতে চায় তার জন্যে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানী।

 

হজ্জে তামাত্তু এফরাদ থেকে ভালো। এজন্যে যে এর মধ্যে দুটো ইবাদাত এক সাথে জমা করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর কিছু অধিক ইবাদাত পদ্ধতি সমাধা করার সৌভাগ্য লাভ করা যায়।

 

হজ্জে তামাত্তুর দুটো উপায় আছে। একটি এই যে, কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় এই যে, হাদীর পশু সাথে করে নিবে না। প্রথমটি দ্বিতীয়টি থেকে উৎকৃষ্ট।

 

তামাত্তুর মাসায়েল

 

১. তামাত্তুকারীর জন্যে জরুরী যে, সে ওমরার তাওয়াফ হজ্জের মাসগুলোতে করবে। (হজ্জে মাসগুলো হলো, শাওয়াল, যুলকাদ ও যুলহজ্জের প্রথম দশ দিন) অথবা অন্ততপক্ষে ওমরার তাওয়াফের অধিকাংশ চক্কর হজ্জের সময়কালের মধ্যে হতে হবে।

 

২. তামাত্তু হজ্জের জন্যে জরুরী এই যে, ওমরাহ ও হজ্জের তাওয়াফ একই বছর হতে হবে। কেউ যদি এক বছর ওমরার তাওয়াফ করে এবং দ্বিতীয় বছর হজ্জের তাওয়াফ, তাহলে তাকে তামাত্তুকারী বলা যাবে না।

 

৩. তামাত্তুর জন্যে জরুরী এই যে, প্রথমে ওমরার এহরাম বাধতে হবে এবং এটাও জরুরী যে, হজ্জের এহরাম বাধার পূর্বে ওমরার তাওয়াফ করে ফেলতে হবে।

 

৪. তামাত্তুকারীর জন্যে জরুরী এই যে, ওমরাহ ও হজ্জের এহরামের মাঝখানে আলমাম করবে না। আলমামের অর্থ ওমরার এহরাম খোলার পর আপন পরিবারের মধ্যে গিয়ে পড়বে না। তবে কুরবানীর পশু সাথে করে আনলে তামাত্তু সহীহ হবে।

 

৫. হজ্জে তামাত্তু শুধু তাদের জন্যে যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। যারা মক্কায় অথবা মীকাতের ভিতরে বসবাস করে তাদের জন্যে তামাত্তু ও কেরান মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)

 

৬. তামাত্তুকারীর জন্যে তাওয়াফে কুদুম করা মসনুন এবং তার উচিত তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করা।

 

৭. কারেনের মতো তামাত্তুকারীর জন্যেও কুরবানী ওয়াজিব। সামর্থ্য না থাকলে দশ রোযা করবে হজ্জের সময় কুরবানীর দিনের আগে তিন রোযা এবং আইয়ামে তাশরীকের পর সাত রোযা।

 

৮. তামাত্তুকারী যদি কুরবানীর পশু সাথে না এনে থাকে তাহলে ওমরার সায়ী এবং মাথা মুন্ডানোর পর এহরাম খুলবে। সাথে কুরবানীর পশু আনলে এহরাম খুলবে না, ১০ই যুল হজ্জ কুরবানী করার পর এহরাম খুলবে।

 

নবীর বিদায় হজ্জ

 

নবী (স) এর সাহাবী হযরত জাবের (রা) এর ভাষায়ঃ

 

মদীনায় শেষ সাহাবী হযরত জাবের (রা) তার মৃত্যুর পর মদীনায় আর কোনো সাহাবী ছিলেন না। তিনি খুব বৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং বয়স হয়েছিল নব্বইয়েরও বেশী। দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ সে সময়ের ঘটনা যখন হযরত হুসাইন (রা) এর পৌত্র মুহাম্মাদ বিন আলী অর্থাৎ ইমাম বাকের হযরত জাবের (রা) এর খেদমতে হাজির হন। ইমাম বাকের (র) বলেন, আমরা কয়েকজন তার খেদমতে হাজির হলে তিনি প্রত্যেকের নাম ও অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। যখন আমি বললাম যে, আমি হযরত হুসাইনের পৌত্র, তখন তিনি খুবই স্নেহ সহকারে আমার মাথায় হাত বুলালেন। তারপর আমার কোরতার বুকের বোতাম খুলে আমার ঠিক বুকের মাঝখানে হাত রাখলেন। তখন আমার পূর্ণ যৌবন। তিনি বড়ো খুশী হয়ে বললেন, খোশ আমদেদ আমার ভাইপো। তুমি তো হুসাইনের স্মৃতি চিহ্ন। বল, কি জন্যে এসেছ। আমি বলতে লাগলাম -------------। তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন ছিলেন। এমন সময় নামাযের সময় হলো। তিনি একটা ছোট চাদর গায়ে দিয়ে ছিলেন। তাই নিয়ে নামাযের  জন্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাদর এতো ছোট ছিল যে, যখন তা কাঁধের ওপর রাখতেন তখন তা পড়ে যেত। এটাই তিনি গায়ে দিয়ে রাখলেন অথচ বড়ো চাদর নিকটেই রাখা ছিল। তিনি আমাদেরকে নামায পড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হলেন তখন আমি আরজ করলাম, হযরত আমাদেরকে নবী (স) এর বিদায় হজ্জের বিবরণ শুনিয়ে দিন।

 

তিনি হাতের আঙুলের নয় পর্যন্ত গুণে বললেন, রাসূলুল্লাহ (স) মদীনা আসার পর ন বছর হজ্জ করেননি। হিজরতের দশম বছরে তিনি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে দিলেন যে, তিনি হজ্জে যাবেন। এ খবর পাওয়া মাত্র বহু লোক মদীনায় জমায়েত হতে লাগলো। প্রত্যেকেই এ আশা করছিল যে, সে হজ্জের সফরে নবীর সাথী হবে, তার হুকুম মেনে চলবে এবং তিনি যা করবেন তারাও তাই করবে।

 

অবশেষে মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় এসে গেল। সমস্ত কাফেলা নবীর সাথে রওয়ানা হয়ে যুলহুলায়ফা পৌঁছে অবস্থান করলো।

 

এখানে এক বিশেষ ঘটনা ঘটলো। কাফেলার একজন মহিলা, হযরত আবু বকর (রা) এর স্ত্রী আসমা বিনতে ওমাইস (রা) সন্তান প্রসব করলেন। তিনি নবীকে জিজ্ঞেস করলেন এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত। নবী (স) বললেন, এ অবস্থায় এহরামের জন্যে গোসল কর এবং এ অবস্থায় অন্যান্য মেয়েদের মতো ল্যাংগোট বাধ।

 

তারপর নবী (স) যুলহুলায়ফায় নামায পড়লেন। নামাযের পর উটনী কাসওয়ার ওপর সওয়ার হলেন। উটনী তাকে নিয়ে নিকটস্থ উচ্চ প্রান্তর বায়দায় পৌছলো। বায়দার ওপর থেকে যখন আমি চারদিকে তাকালাম তখন দেখলাম যতদূর দেখা যায় চারদিকে ডানে বামে শুধু মানুষ থৈ থৈ করছে। কিছু সওয়ারীর ওপরে, কিছু পায়ে হেটে। নবী ছিলেন আমাদের মাঝে। তার ওপর কুরআন নাযিল হচ্ছিল। তিনি কুরআন ভালোভাবে উপলব্ধি করছিলেন বলে আল্লাহর হুকুমে যা কিছু করতেন আমরাও তাই করতাম। এখানে পৌঁছে তিনি উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়লেন-

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ বান্দাহ তোমার দরবারে হাজির। তোমার ডাকে তোমার দরবারে হাজির হয়েছি। তোমার কোনো শরীক নেই। আমি হাজির আছি। প্রশংসার হকদার তুমি এবং দয়া অনুগ্রহ ও পুরস্কার দেয়ার অধিকার তোমারই। শাসন কর্তৃত্বে তোমার (এ ব্যাপারে) কোনো শরীক নেই।

 

সকলেই উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়লো। তারা কিছু কথা যোগ করলো কিন্তু নবী (স) প্রতিবাদ করলেন না। তিনি তার তালবিয়া সর্বদা পড়তে থাকেন।

 

হযরত জাবের (রা) বলেন, এ সফরে আমাদের নিয়ত ছিল হজ্জ করার, ওমরাহ আমাদের করার কথা ছিল না। অবশেষে যখন আমার নবী পাকের সাথে বায়তুল্লাহ পৌঁছলাম, তখন তিনি প্রথমে হিজরে আসওয়াদে চুমো দিলেন। তারপর তাওয়াফ শুরু করলেন। প্রথমে তিন চক্করে তিনি রমল করলেন এবং পরের চার চক্করে সাধারণ গতিতে চাললেন। তারপর মাকামে ইবরাহীম এসে এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ

 

*******আরবী*********

 

এবং মাকামে ইবরাহীমকে নিজের জন্যে ইবাদাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর।

 

তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, মাকামে ইবরাহীম তার এবং বায়তুল্লাহর মাঝখানে ছিল। এখানে তিনি দু রাকাত নামায পড়লেন, প্রথমে রাকাতে *******আরবী********* এবং দ্বিতীয় রাকাতে *******আরবী********* পড়লেন। তারপর হিজরে আসওয়াদের নিকটে এসে তাকে চুমো দিলেন। তারপর সাফা পাহাড়ের দিকে চললেন। সাফার নিকটে পৌঁছে পড়লেন *******আরবী********* এবং বললেন *******আরবী********* আমি সাফা থেকে সায়ী শুরু করছি যেভাবে আল্লাহ এ আয়াতে তার উল্লেখ করে শুরু করেছেন।

 

অতএব তিনি সাফার ওপরে এতোটা উঁচুতে উঠলেন যে বায়তুল্লাহ স্পষ্ট তার চোখের সামনে এলো। তিনি কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তিনি তাওহীদ ও তাকবীরে মশগুল হলেন।

 

তিনি পড়লেনঃ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক, তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তার এবং তিনি প্রশংসার হকদার। তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক । তিনি তার ওয়াদা পূরণ করেছেন অর্থাৎ দ্বীনকে সমগ্র আরবে বিজয়ী করে দিয়েছেন।তিনি তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং কাফের মুশরিকের দলকে তিনি একাকীই পরাস্ত করেছেন।

 

তিনি তিনবার একথাগুলো আবৃত্তি করলেন এবং দোয়া করলেন। তারপর নীচে মেনে মারওয়ার দিকে চললেন। মারওয়াতে তাই বললেন যা সাফায় বলেছিলেন। এভাবে শেষ চক্কর পুরো করে মারওয়ায় পৌঁছলেন। এখানে তিনি সাথীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি ওপরে ছিলেন এবং সাথীগণ নীচে।

 

তিনি বলেন-

 

একথা শুনে সুরাকা বিন মালেক দাড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এ হুকুম কি শুধ এ বছরের জন্যে, না চিরদিনের জন্য। (মক্কাবাসীদের নিকটে হজ্জের মাসগুলোতে স্থায়ীভাবে ওমরাহ করা কঠিন গুনাহ মনে করা হতো। সুরাকা বিন মালেক দেখলেন যে, হজ্জের মাসগুলোতে তাওয়াফ ও সায়ীকে স্থায়ীভাবে ওমরা গণ্য করা হচ্ছে। তাই তিনি এ প্রশ্ন করেন।)

 

প্রথমে যদি একথা অনুভব করতাম যা পরে অনুভব করলাম, তাহলে হাদীর পশু সংগে আনতাম না। তাহলে এ তাওয়াফ ও সায়ীকে ওমরার তাওয়াফ ও সায়ী গণ্য করে ওমরায় পরিণত করতাম ও ইহরাম খুলে ফেলতাম। তোমাদের মধ্যে যারা হাদীর পশু সাথে আনেনি, তারা এসে ওমরার তাওয়ায় ও সায়ী মনে করে ইহরাম খুলতে পারে।

 

নবী (স) জবাবে বলেন, শুধু এ বছরের জন্যে নয়, চিরদিনের জন্য।

 

হযরত জাবের (রা) অতঃপর বলেন, হযরত আলী (রা) ইয়ামেন থেকে নবী জন্যে অনেক কুরবানীর পশু নিয়ে মক্কায় পৌঁছান। তিনি দেখলেন তার বিবি হযরত ফাতেমা ইহরাম খুলে ফেলেছেন। রঙ্গিন কাপড়ও পরেছেন এবং সুরমা লাগিয়েছেন। এসব হযরত আলী (রা) ভালো মনে না করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, আব্বাজান আমাকে এর হুকুম দিয়েছেন। অর্থাৎ নবী (স) ইহরাম খোলার হুকুম দিয়েছেন।

 

নবী (স) হযরত আলীর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করনে, তুমি ইহরাম বেধে তালবিয়া পড়ছিলে তখন কি নিয়ত করেছিলে- শুধু হজ্জের নিয়ত করেছিলে, না হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করেছিলে?আলী (রা) বলেন, আমি বলেছিলাম, আয় আল্লাহ আমি ঐ জিনিসের ইহরাম বাধছি, যার ইহরাম তোমার রাসূল বেধেছেন।

 

নবী (স) বলেন, আমি যেহেতু আমার সাথে হাদীর পশু এনেছি, সে জন্যে আমার ইহরাম খোলার কোনো সুযোগ নেই। তুমিও আমার মতো নিয়ত করেছ। অতএব তোমারও ইহরাম খোলার উপায় নেই।

 

হযরত জাবের (রা) বলেন, ইয়ামেন থেকে হযরত আলী নিয়ে আসা উট ও নবীর উটের মোট সংখ্যা ছিল একশ। (কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যায় যে, নবী (স) সাথে করে ৬৩টি উট এনেছিলেন এবং হযরত আলী (রা) ইয়ামেন থেকে এনেছিলেন ৩৭টি উট।)

 

সকল সাহাবী নবীর নির্দেশ অনুযায়ী ইহরাম খুলে ফেলেন এবং চুল মুণ্ডন করে বা কাটিয়ে হালাল হয়ে গেলেন। তবে নবী (স) এবং যেসব সাহাবী হাদী সাথে এনেছিলেন ইহরাম অবস্থায় রইলেন।

 

তারপর ৮ই যুলহজ্জ লোক হজ্জের ইহরাম বাধে যারা ওমরার পর ইহরাম খুলেছিল। নবী (স) কাসওয়ার পর সওয়ার হয়ে মিনা রওয়ানা হন। এখানে তিনি যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। ফজরের নামাযের পর কিছুক্ষণ তিনি মিনায় অবস্থান করেন। সূর্য ভালোভাবে ওপরে উঠে এলে তিনি আরাফাতের দিকে রওয়ানা হন। তিনি আদেশ করেন যে, নিমরা (নিমরা প্রকৃতপক্ষে এমন এক স্থান যেখানে হেরেমের সীমানা শেষ হয়ে আরাফাতের সীমানা শুরু হয়। জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশগণ হেরেমের সীমানারে ভেতরে মাশয়ারুল হারামের নিকটে অবস্থান করতো এবং সাধারণ লোক অবস্থান করতো আরাফাতের ময়দানে। এজন্যে কুরাইশগণের ধারনা ছিল যে, নবী (স) ঐ স্থানেই অবস্থান করবেন। কিন্তু তিনি অবস্থান করার প্রকৃত স্থানেই তাঁবু খাটাবার আদেশ পূর্বাহ্ণেই করে দিয়েছিলেন।)নামাক স্থানে তার জন্যে যে পশমের তাঁবু খাটানো হয়। কুরাইশগণ নিঃসন্দেহ ছিল যে, নবী (স) মাশয়ারুল হারামের নিকটেই অবস্থান করবেন। কারণ, জাহেলিয়াতের যুগে সর্বদা তাই করা হতো। কিন্তু নবী (স) মাশয়ারুল হারামের সীমা অতিক্রম করে আরাফাতের সীমার মধ্যে প্রবেশ করেন। নিমরা নামক স্থানে তার নির্দেশে যে তাঁবু খাটানো হয়েছিল তার মধ্যে তিনি অবস্থান করেন।

 

তারপর বেলা যখন পড়ে গেল তখন তিনি কাউসারের পিঠে হাউদা বাধতে বলেন। হাউদা বাধা হলে তিনি উটনীর পিঠে চড়ে ওড়না প্রান্তরে পৌঁছান। ওখানে একটা উঁচু স্থানে উটের পিঠ থেকে জনতার সামনে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন-

 

সমবেত জনতা! অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং অবৈধভাবে কারো সম্পদ হস্তগত করা তোমাদের জন্য হারাম। এটা ঠিক ঐরূপ হারাম যেমন আজকের দিন তোমাদের জন্য হারাম (এবং তোমরা হারাম মনে কর)।

 

ভালো করে বুঝে নাও যে, জাহেলিয়াতের যুগের সব কিছুই আমার পায়ের তলায় নিবিষ্ট করা হল। এবং জাহেলিয়াতের যুগের খুন মাফ করা হলো। সকলের আগে আমার বংশের খুন অর্থাৎ রবিয়া বিন হারিস বিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রের খুন মাফ করার ঘোষণা করছি। রবিয়ার পুত্র বনি সাদ কাবিলায় দুধ পানের জন্য থাকত। তাকে হাযিল কাবিলার লোক খুন করে।

 

জাহেলিয়াত যুগের সকল সূদের দাবী পরিত্যক্ত হলো। এ ব্যাপারে আমি সকলের প্রথমে আমার চাচা আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবের সূদের দাবী প্রত্যাহার করার ঘোষণা করছি। আজ তার সকল সূদের দাবী শেষ হয়ে গেল।

 

সমবেত জনগণ! মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহর আমানত স্বরূপ তোমরা তাদেরকে তোমাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছ। তাদেরকে উপভোগ করা আল্লাহর কালেমা এবং আইন অনুযায়ীই তোমাদের জন্য হালাল হয়েছে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর বিশেষ হক এই যে, যাদেরকে তোমরা তোমাদের বাড়ীতে আসা পছন্দ কর না, তাদেরকে যেন তোমাদের শয্যার ওপর বসতে তারা সুযোগ না দেয়। তারা যদি এ ভুল করে বসে তাহলে তাদেরকে মামুলী শাস্তি দিতে পার। তাদের বিশেষ হক তোমাদের ওপর এই যে, তোমরা সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খোরাক পোশাকের ব্যবস্থা করবে।

 

আমি তোমাদের মধ্যে হেদায়াতের এমন উৎস রেখে যাচ্ছি যদি তাকে তোমরা মজবুত করে ধর এবং তার নির্দেশে চল, তাহলে তোমরা কখনো সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। হেদায়াতের এ উৎস হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব।

 

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা আমার সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌছিয়ে দিয়েছি কিনা। বল সেদিন তোমরা আমার সম্পর্কে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে?

 

সমবেত জনতা এক বাক্য বললো আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তাবলীগের হক আদায় করেছেন। আপনি সব কিছু পৌছিয়ে দিয়েছেন। নসীহত দানকারী ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কোনো কাজই বাকী রাখেননি।

 

একথার পর নবী (স) তার শাহাদত আঙ্গুলি আসমানের দিকে উঠিয়ে মানুষের দিকে ইংগিত করে বললেন- আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক; আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক, আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক; আমি তোমার পয়গাম, তোমার আহকাম তোমার বান্দাহদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি এবং তোমার বান্দাহগনও সাক্ষী যে, আমি তাবলীগের হক আদায় করেছি।

 

তারপর হযরত বিলাল (রা) আযান দিলেন ও একামত বললেন। নবী (স) যোহরের নামায পড়ালেন। তারপর হযরত বেলাল (রা) দ্বিতীয়বার একামত বললেন এবং নবী (স) আসর নামায পড়ালেন। যোহর আসর এক সাথে পড়ার পর তিনি ঐ স্থানে এলেন যেখানে অবস্থান করা যায়। তারপর তিনি তার কাসওয়ার দিকে মুখ বড়ো বড়ো প্রস্তর খন্ডের দিকে করে দিলেন এবং সমবেত জনগণ তার সামনে হয়ে গেল। জনতা ছিল সওয়ারী বিহীন ও পদব্রজে। নবী (স) কেবলামুখী হলেন এবং ওখানেই অবস্থান করলেন। অবশেষে সূর্য অস্তমিত হলে তিনি আরাফাত থেকে মুযদালাফার দিকে রওয়ানা হলেন এবং উসামা বিন যায়েদকে তার পেছনে উটের পিঠে বসিয়ে নিলেন। মুযদালফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়লেন। আযান হলো এবং দু নামাযের জন্যে দুবার একামত হলো। এ দু নামাযের মধ্যে তিনি কোন সুন্নাত নফল পড়লেন না। তারপর তিনি বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লেন। অবশেষে সুবহে সাদেক হয়ে গেল। আযান ও একামতের পর তিনি ফজরের নামা আদায় করলেন। নামাযের পর তিনি মাশয়ারুল হারামের নিকটে এসে কেবলামুখী দাড়িয়ে তসবিহ তাহলীলে মশগুল হলেন। পূর্বদিক যখন বেশ ফর্সা হয়ে গেল তখন সূর্য ওঠার আগেই সেখান থেকে মিনার দিকে রওয়ানা হলেন। এবার তিনি তার উটর পেছন দিকে ফযল বিন আব্বাসকে বসিয়ে নেন। যখন তিনি মুহার উপত্যকার মাঝে পৌঁছালেন তখন উটনীর গতি দ্রুত করে দেন। মুহার প্রান্তর থেকে বের হয়ে মাঝপথ ধরলেন যা বড়ো জুমরার নিকটে গিয়ে বের হয়েছে। তারপর ঐ জুমরায় পৌঁছে যা গাছের নিকট ছিল, তিনি পাথর মারলেন। জুমরাতে সাতটি ছোট ছোট পাথর মারলেন এবং মারার সময় আল্লাহু আকবার বললেন। এসব পাথর নিচু স্থান থেকে মারলেন। পাথর মারা শেষ করে কুরবানী করার স্থানে গেলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি কুরবানী যবেহ করলেন। বাকীগুলো হযরত আলী (রা) এর দায়িত্বে ছেড়ে দিলেন। তিনি হযরত আলীকে তার হাদীর মধ্যে শরীক করেছিলেন তারপর প্রত্যেক কুরবানী থেকে এক এক টুকরা নেবার হুকুম করলেন। তা নিয়ে রান্না করা হলো। তারপর নবী (স) এবং হযরত আলী (রা) এ গোশতের কিছু খেলেন এবং শুরবা পান করলেন। তারপর নবী উটনীর পিঠে চড়ে যিয়ারতের জন্যে বায়তুল্লাহর দিকে রওয়ানা হলেন। মক্কায় পৌঁছে যোহর নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি আবদুল মুত্তালিব পরিবারের লোকদের কাছে এলেন যারা যমযমের পানি তুলে লোকদের পান করাচ্ছিল। তিনি বললেন, বালতি ভরে পানি তুলে লোকদের পান করাও। যদি আমার এ আশংকা হতো যে আমাকে দেখে লোক তোমাদের সাথে বালতি টেনে তুলতাম। তারা নবীকে বালতি ভরে পানি দিল এবং নবী তার থেকে পান করলেন। (মুসলিম-জাফর বিন মুহাম্মাদ বিন আতিয়া থেকে বর্ণিত)

 

জেনায়েতের বয়ান

 

জেনায়েত অর্থ কোনো হারাম কাজ করা, গুনাহ করা প্রভৃতি। কিন্তু হজ্জ প্রসঙ্গে জেনায়েতের অর্থ হলো এমন কোনো কাজ করা যা হেরেমে হওয়ার কারণে অথবা এহরাম বাধার কারণে হারাম হয়ে যায়। জেনায়েত দু প্রকারের

 

একঃ জেনায়েতে হেরেম

 

দুইঃ জেনায়েতে এহরাম

 

লোকের পক্ষ থেকে এমন কোনো কাজ হয়ে যায় যা হেরেমের গণ্ডির মধ্যে হারাম অথবা এমন কোনো কাজ হয় যা এহরাম অবস্থায় হারাম, তাহরে এ দুটোর ক্ষতিপূরণের জন্যে কাফফারা ও কুরবানীর পৃথক পৃথক হুকুম রয়েছে, যা পরে বলা হচ্ছে।

 

হেরেমে মক্কা ও তার মহত্ত্ব

 

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে বরকতপূর্ণ এবং সবচেয়ে সম্মানের গৃহ ঐটি যাকে আল্লাহ তার আপনঘর বলে উল্লেখ করেছেন। যে ঘর তাওহীদ ও নামাযের কেন্দ্রবিন্দু এবং পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর। যা আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে তৈরী করা হয়েছিল এ ঘর হচ্ছে হেদায়াত ও বরকতের উৎস এবং সমগ্র মানবতার আশ্রয়স্থল।

 

এ আল্লাহর ঘর যে মুবারক মসজিদের মাঝখানে অবস্থিত, তাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানার্হ মসজিদ) বলা হয়েছে। এ দুনিয়ার সকল মসজিদ থেকে উৎকৃষ্টতমই নয়, বরঞ্চ প্রকৃত মসজিদ বলা হয়েছে। দুনিয়ার অন্যান্য মসজিদগুলোতে নামায এইজন্যে সহীহ যে, ওগুলো এ মসজিদে হারামের স্থলাভিষিক্ত এবং ওদিকে মুখ করেই সকলকে নামায পড়তে হয়। মসজিদুল হারামের মহত্ত্ব এতোখানি যে, তাতে এক নামায পড়লে এক লক্ষ নামাযের সওয়াব পাওয়া যায়। (ইবনে মাজাহ)

 

তারপর আল্লাহ তায়ালা শুধু এ মক্কা শহরকেই হেরেম গণ্য করেননি, বরঞ্চ তার চারদিকে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী অঞ্চলকে হেরেমের সীমাভূক্ত করে হেরেম (অর্থাৎ সম্মানযোগ্য অঞ্চল) বলে ঘোষণা করেছন। তার মহত্ত্বের জন্যে সম্মান প্রদর্শনের কিছু রীতি পদ্ধতি ও হুকুম আহাকাম নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ সীমারেখার ভেতরে বহু কাজ এ অঞ্চলের সম্মানের জন্যে হারাম ও নাজায়েয করা হয়েছে যা সারা দুনিয়ায় জায়েয ও মুবাহ।

 

হেরেমের এ সীমারেখা প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ ) নির্ধারণ করেন। পরে নবী (স) তার রেসালাতের যুগে এ সীমারেখার তাজদীদ বা নবায়ন করেন। এ সীমারেখা সুপরিচিত ও সুপরিজ্ঞাত। মদীনার দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা, ইয়ামেনের দিকে প্রায় এগারো কিলোমিটার তায়েফের দিকেও তাই এবং ইরাকের দিকেও প্রায় এতো কিলোমিটার, জেদ্দার দিকে প্রায় ষোল কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা। নবী (স) এর পরে হযরত ওমর (রা) হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত মুয়াবীয়া (রা) ঐ একই সীমারেখা নবায়ন করেন। অতএব, এ সীমারেখা এখন অতি সুপরিচিত। হেরেমের সীমারেখার মহত্ত্ব ও সম্মান আল্লাহ ও তার দীনের সাথে সম্পর্ক ও আনুগত্যের পরিচায়ক। যতদিন পর্যন্ত উম্মত সামগ্রিকভাবে এ ভক্তি শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ণ রাখবে ততদিন তাদের ওপর আল্লাহর হেফাজত ও রহমত অব্যাহত থাকবে এবং তারা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করতে পারবে।

 

নবী (স) বলেন- আমার উম্মত যতদিন মুকাদ্দাস হেরেমের মহত্ত্ব ও ভক্তি শ্রদ্ধার হক আদায় করতে থাকবে, ততদিন তারা কল্যাণ লাভ করতে থাকবে। আর যখন তারা এর সম্মান নষ্ট করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ)

 

জেনায়েতে হেরেম

 

১. হেরেমে উৎপন্ন বন্য তৃণলতা, ঘাস, সবুজ শ্যামল গুল্ম গুচ্ছ কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত। এ যদি কারো মালিকানাধীন না হয় তাহলে তার কাফফারা এই যে, তার মূল্য আল্লাহর পথে সদকা করতে হবে, যদি কারো মালিকানাধীন হয় তাহলে দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে। সদকাও করতে হবে মালিককেও মূল্য দিতে হবে।

 

২. ইযখির (ইযখির এক প্রকার সুগন্ধি ঘাস) কাটা বা উৎপাটন করা জায়েয। হযরত আব্বাস (রা) এর অনুরোধে নবী (স) ইযখির কাটার অথবা উৎপাটনের অনুমতি দিয়েছিলেন।

 

৩. বন্য তৃণ লতা, ঝোপ ঝাড় হোক না কেন, কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত।

 

৪. কোন ডাল-পালা যদি বন্য না হয়, লাগানো হয়, তাহলে তা কাটা জেনায়েত হবে না। তেমন কোনো গাছের কিছু পাতা ছেড়া জেনায়েত নয়। যদি তা কারো মালিকানাধীন না হয়।কারো মালিকানাধীন হলে তার বিনা অনুমতিতে ছেড়া যাবে না। মালিক স্বয়ং ছিঁড়লে জেনায়েত হবে না।

 

৫. হেরেমের শিকার মারা জেনায়েত। হত্যাকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

 

৬. হেরেমের পাখীর ডিম ভাঙ্গা বা রান্না করা জেনায়েত। টিড্ডি মারাও জেনায়েত।

 

৭. কারো কাছে কিছু শিকার রয়েছে এবং সে হেরেমে প্রবেশ করছে। তার সে শিকার ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। তবে শিকার যদি রশি দিয়ে বাধা থাকে এবং রশি তার হাতে থাকে অথবা শিকার খাঁচায় আবদ্ধ আছে তাহলে তা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব নয়।

 

৮. মীকাতে ইহরাম না বেধে হেরেমে প্রবেশ করাও জেনায়েত। এর জন্য একটি কুরবানী ওয়াজিব।

 

৯. হেরেমের সীমার ভেতরে এসব মারা জেনায়েত নয়, যথা- বোলতা, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, মাছি, ছারপোকা, মশা, পিঁপড়ে প্রভৃতি এবং ঐসব জীব যা আক্রমণ করতে আসে এবং যার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা অপরিহার্য।

 

১০. হেরেমের বাইরে গিয়ে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটা (ইহরাম খোলার জন্য) জেনায়েত। তার জন্যে একটি কুরবানী ওয়াজিব।

 

ইহরাম জেনায়েত

 

ইহরামের জেনায়েত তিন প্রকার।

 

১. যার জন্যে দু কুরবানী।

 

২. যার জন্যে এক কুরবানী।

 

৩. যার জন্যে সদকা কুরবানী।

 

যাতে দু কোরবানী ওয়াজিব

 

১. পুরুষ যদি কোনো গাঢ় খুশবু অথবা গাঢ় মেহদী মাথায় লাগায় এবং একদিন একরাত স্থায়ী হয়, তা সমস্ত মাথায় লাগানো হোক বা এক চতুর্থাংশ মাথায় দুটো কুরবানী তার জন্যে ওয়াজিব। কিন্তু হোক স্ত্রীলোক এমন করলে একটি কুরবানী দিতে হবে।

 

২. ঐসব জেনায়েত যার জন্যে হজ্জে ইফরাদকারীর একটি কুরবানী ওয়াজিব হয়, কারেনের জন্যে দু কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

৩. তামাত্তু হজ্জকারী যদি হাদীর পশু সাথে করে আনে তাহলে তার জন্যে সকল জেনায়েতের জন্যে দু কুরবানী, আর মুফরেদের জন্যে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

যেসব জেনায়েতের জন্যে এক কুরবানী

 

শুধু দু’অবস্থায় উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হয়। নতুবা যেখানে যেখানে কুরবানীর কথা বলা হয়েছে সেখানে ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী বুঝতে হবে।

 

১. জানাবাতের অবস্থায় (যার জন্যে গোসল ফরয হয়) যদি কেউ তাওয়াফে যিয়ারত করে, তাহলে এক উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

২. আরাফাতে অবস্থানের পর তাওয়াফে যিয়ারত অথবা মস্তক মুণ্ডনের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে। এ দু অবস্থায় ছাড়া অন্য সকল অবস্থায় ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

৩. তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো একটি বাদ গেলে একটি কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেচে থাকাও তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্য শামিল। এসবের মধ্যে কিছু নিষিদ্ধ কাজের কুরবানী সম্পর্কে নিম্নে মাসায়েল বয়ান করা হচ্ছে।

 

৪. যদি বেশী খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে। যদি অল্প খুশবু লাগানো হয় কিন্তু শরীরের বৃহৎ অংশে যেমন মাথা, হাত পা প্রভৃতির ওপর মালিশ করা হয়, তাহলেও এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

৫. যদি একই স্থানে সমস্ত শরীরে খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী এবং বিভিন্ন স্থানে সমস্ত শরীরে লাগানো হয় তাহলে প্রত্যেক স্থানের এক একটি কুরবানী করতে হবে।

 

৬. খুশবু লাগানোর পর কুরবানী করা হলো কিন্তু খুশবু গেল না, তাহলে পুনরায় কুরবানী করতে হবে।

 

৭. খুশবুদার পোশাক পরে একদিন কাটালে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

৮. তরল মেহদী মাথা, দাড়ি, হাত ও পায়ে মাখলে এক কুরবানী।

 

৯. সিলাই করা কাপড় পরিধান করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত এই যে, যদি তা একদিন ও একরাত পরিধান করে থাকা হয়। তার কম সময় পরিধান করে থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে না। শুধু সদকা করতে হবে। এটাও শর্ত যে, সিলাই করা কাপড় নিয়ম মাফিক পরিধান করবে। যদি কোর্তা বা শিরওয়ানী এমনি কাঁধের ওপর ফেলে রাখে এবং আস্তিনে হাত দেয়া না হয়, তাহলে জেনায়েত হবে না।

 

নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক না হয়ে তাওয়াফ করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে মাসায়ালা নিম্নরূপ:

 

১০. তাওয়াফে যিয়ারত ছাড়া যে কোনো তাওয়াফ জানাবাত অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

১১. তাওয়াফে যিয়ারত হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব এবং ওমরার তাওয়াফ হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

১২. তাওয়াফে যিয়ারতে ঊর্ধ্ব সংখ্যায় তিন চক্কর বাদ পড়লে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে এবং তিনের বেশী বাদ গেলে শুধু কুরবানীতে হবে না; দ্বিতীয়বার তাওয়াফ করতে হবে।

 

১৩. হজ্জের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো ওয়াজিব পরিত্যাগ করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

১৪. মুফরেদ মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটা অথবা তাওয়াফে যিয়ারত ১০ই যুলহজ্জের পরে করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

১৫. কারেন যদি যবেহ করার পূর্বে অথবা রামী করার পূর্বে মস্তক মুণ্ডন করে তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

 

যেসব জেনায়েত শুধু সদকা ওয়াজিব

 

১. খুশবু ব্যবহার এমন পরিমাণে করা যার জন্যে কুরবানী ওয়াজিব হয় না সে অবস্থায় সদকা ওয়াজিব হবে। (সদকা অর্থ সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সদকা) যেমন, এক অঙ্গের কম স্থানে খুশবু লাগানো হলো, অথবা পোশাক এক বর্গ বিঘত স্থানের কম অথবা বেশী স্থানে লাগানো হলো কিন্তু পুরো একদিন বা পুরো এক রাত ব্যবহার করা হলো না।

 

২. সেলাই করা পোশাক একদিন অথবা এক রাত্রের কম সময়ে পরিধান করা হয়েছে অথবা এতো সময় মাথা ঢাকা হয়েছে, তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে। আর যদি অল্প সময়ের জন্য মাথা ঢাকা হয়েছে অথবা সেলাই করা কাপড় পরা হয়েছে। যেমন এক ঘন্টারও কম, তাহলে একমুষ্টি আটা দিলেই যথেষ্ট হবে।

 

৩. তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে বেদা (বিদায়ী তাওয়াফ) অথবা কোনো নফল তাওয়াফ হাদাসে আসগারের অবস্থায় করলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।

 

৪. তাওয়াফে কুদুম অথবা বিদায়ী তাওয়াফ অথবা সায়ী তিন অথবা তিনবারের কম চক্কর পরিত্যাগ করলে প্রত্যেক চক্করের জন্য এক একটি সদকা ওয়াজিব হবে।

 

৫. এক দিনে যতবার রামী ওয়াজিব তার অর্ধেকের কম ছেড়ে দিলে যেমন ১০ই তারিখ জুমরাতুল ওকবায় সাত রামী ওয়াজিব, তার মধ্যে কেউ তিন রামী অর্থাৎ পাথর মারা বাদ দিল। তাহলে প্রত্যেক পাথরের বদলায় এক এক সদকা ওয়াজিব হবে।

 

৬. কেউ অন্য কোনো ব্যক্তির মাথা অথবা ঘাড়ের চুল বানিয়ে  দিল, তা সে দ্বিতীয় ব্যক্তি মুহরেম অথবা গায়ের মুহরেম হোক, তাহলে এক সদকা যে চুল বানিয়ে দেবে তার ওপর ওয়াজিব হব।

 

৭. পাঁচটি নখ অথবা তার বেশী কাটিয়ে নেয়া হলো, কিন্তু এক হাত বা পায়ের নখ নয়, বিভিন্ন হাত পায়ের তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।

 

নীতিগত হেদায়েত

 

১. যদি একটি সদকার মূল্য অথবা কয়েকটি ওয়াজিব সদকার মূল্য একটি কুরবানীর মূল্যের সমান হয়, তা কুরবানী সস্তা হওয়ার কারণে হোক কিংবা কয়েকটি সদকার মূল্য এতো বেশী হলো যে, তা দিয়ে একটি কুরবানী খরিদ করা যায়, তাহলে স মূল্য থেকে কিছু অর্থ কমিয়ে ফেলা উচিত যাতে করে অবশিষ্ট মূল্য কুরবানীর সমান না হয়।

 

২. হজ্জের কোনো ওয়াজিব যদি বিনা কারণে বাদ যায় তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। আর যদি কোনো ওজরের কারণে বাদ পড়ে তাহলে কুরবানী ও সদকা কোনোটাই ওয়াজিব হবে না।

 

৩. ইহরাম অবস্থায় যে কাজ নিষিদ্ধ তা করলে কোনো সময়ে কুরবানী এবং কোনো সময়ে সদকা ওয়াজিব হয়। কুরবানী ওয়াজিব হলে এ এখতিয়ারও থাকে যে, কুরবানীর পরিবর্তে ছয়জন মিসকীনকে একটি করে সদকা দিয়ে দেয়া যায়। এ এখতিয়ারও আছে যে, যখন এবং যেখানে ইচ্ছা তিনটি রোযাও রাখা যায়।

 

সদকা ওয়াজিব হওয়ার পর সদকার স্থলে একটি রোযা রাখার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।

 

শিকারের বিনিময়

 

ইহরামে নিষিদ্ধ কাজের মধ্যে বন্য পশু শিকারও শামিল। এ শিকার করা নিষিদ্ধ এবং শিকারের কাউকে সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। বদলা অর্থ শিকারের মূল্য যা দুজন ন্যায়পরায়ণ লোক ঠিক করে দেবে। কুরআনে আছেঃ

 

*******আরবী*********

 

হে ঈমানদারগণ ইহরাম অবস্থায় শিকার করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত শিকার করে, তাকে তার সমতুল্য এক পশু বদলা দিতে হবে। আর এর ফায়সালা তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি করবে। আর এ হাদী কাবায় পাঠাতে হবে অথবা এ জেনায়েতের কাফফরা স্বরূপ কয়েকজন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা সেই পরিমাণে রোযা রাখতে হবে যাতে করে কৃতকর্মের পরিমাণ ভোগ করতে পারে। (সূর আল মায়েদাঃ ৯৫)

 

এ আয়াতে যে শিকার হারাম করা হয়েছে তা স্থল ভাগের শিকার। নদী বা সমুদ্রের শিকার জায়েয। তা খাওয়া জায়েয হোক বা না হোক। কুরআন সুস্পষ্ট করে বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের জন্যে অবস্থান কালেও এবং কাফেলার পাথেয় হিসেবেও। কিন্তু স্থল ভাগের শিকার যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় আছে তোমাদের জন্যে হারাম। (সূরা আল মায়েদাঃ৯৬)

 

শিকার ও তার বদলার মাসায়েল

 

১. স্বয়ং শিকার করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি শিকারির সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। শিকারির জন্যে যেমন বদলা দিতে হবে, সাহায্যকারীকেও বদলা নিতে হবে।

 

২. কয়জন মুহরেম মিলিত হবে কোনো শিকার করলো অথবা একজন শিকার করলো এবং অন্যান্যজন সাহায্য করলো তাহলে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বদলা দিতে হবে।

 

৩. যদি একজন মুহরেম কয়েকটা শিকার করে তাহলে প্রত্যেক শিকারের জন্য আলাদা বদলা দিতে হবে।

 

৪. শুধু বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। পালিত পশু শিকার করলে বা হত্যা করলে তার বদলা দিতে হবে না। যেমন কেউ যদি ছাগল, গরু, উট, মুরগী ইত্যাদি মারে তাহলে তার বদলা দিতে হবে না

 

৫. যেসব পশুর গোশত হালাল নয়, তা যতো বড়ো হোক না কেন তার বদলা একটি ছাগল। যেমন কেউ হাতি মারল, তাহলে তার বদলায় একটা ছাগল দিতে হবে।

 

৬. জুই অথবা ফড়িং যদি তিনটার চেয়ে বেশী নিজে মারে অথবা অন্যকে মারতে আদেশ দেয় তাহলে এক সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। তিনটা অথবা তিনটার কম মারলে যা ইচ্ছা সদকা হিসেবে দিয়ে দেবে।

 

৭. শিকার যদি কারো মালিকানায় হয় তাহলে দ্বিগুণ বদলা দিতে হবে আল্লাহর পথে দিতে তো হবেই, মালিককে প্রস্তাবিত মূল্যও দিতে হবে।

 

৮. শিকার যে স্থানে করা হবে সে স্থানের এবং সে সময়ের মূল্য ওয়াজিব হবে। অন্য কোনা স্থান বা সময়ের মূল্য ধরা যাবে না। এজন্যে স্থান ও কালের জন্য মূল্যর মধ্যে কম বেশী হয়।

 

৯. এটাও করা যেতে পারে যে, শিকারের সমতুল্য পশু খরিদ করে হেরেমে যবেহ করার জন্য পাঠিয়ে দিতে হবে। এটাও করা যেতে পারে যে, তার মূল্য দ্বারা খাদ্যশস্য খরিদ করে প্রত্যেক মিসকীনকে এক এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে দিতে হবে। অথবা প্রত্যেক মিসকীনকে সদকার পরিবর্তে এক একটি রোযা রাখতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত মূল্য যদি কোনো কুরবানী খরিদ না করা যায় তাহলে দুটো পন্থা আছে। প্রত্যেক মিসকীনকে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে অথবা প্রত্যেক সদকার পরিবর্তে একটি করে রোযা রাখবে।

 

১০. যদি শিকারের প্রস্তাবিত মূল্যে এতোটা না হয় যার দ্বারা এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্য শস্য কেনা যায়, তাহলে যতোটুকু পাওয়া যায় সদকা করবে অথবা রোযা রাখবে।

 

১১. বদলাতে যে সদকা দেয়া হবে তার হুকুম ও ব্যয়ের খাত তাই, যা সদকায়ে ফিতরের।

 

এহসানের বয়ান

 

এহসানের ............ আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া, নিষেধ করা, বিরত রাখা। পরিভাষায় এহসানের অর্থ এইযে, কোনো ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার জন্যে ইহরাম বাধলো। তারপর হজ্জ বা ওমরায় যাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখা হলো, এমন ব্যক্তিকে পরিভাষায় বলা হয় মুহসসার (যাকে বিরত রাখা হয়েছে)।

 

ইহরাম বাধার পর হজ্জ থেকে বিরত থাকা, হজ্জ ওমরাহ করতে না পারা জেনায়েত। এজন্যে মুহাসসারের ওয়াজিব যে, সে এহসানের বদলার সাধ্যমত কুরবানী করবে। তাকে বলে দমে এহসার। কুরআন বলেঃ

 

*******আরবী*********

 

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ্জ ও ওমরার নিয়ত করলে তা পূরণ কর। যদি কোথাও পরিবেষ্টিত হয়ে পড় কিংবা থেমে যেতে হয়, তাহলে যে কুরবানীই পাওয়া যায় তা আল্লাহর সামনে পেশ কর এবং মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না হাদীর পশু গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়। (সূরা বাকারাঃ ১৯৬)

 

এহসানের কয়েকটা উপায়

 

ইহরাম বাধার পর বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ও হজ্জ করতে না পারার বহু কারণ হতে পারে যার কিছুটা উল্লেখ করা হলোঃ

 

১. পথ নিরাপদ না হওয়া, দুশমনের ভয় থাকা, হত্যা ও লুণ্ঠনের ভয়, পথে কোনো হিংস্র জন্তু থাকা অথবা অন্য কোনো প্রকারের জানমালের আশংকা হওয়া।

 

২. ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া, এমন আশংকা যে, সামনে অগ্রসর হলে রোগ বেড়ে যাবে, দুর্বলতার কারণে আর অগ্রসর হওয়ার শক্তি না থাকা।

 

৩. ইহরাম বাধার পর নারীর সাথে কোনো মুহাররাম পুরুষ না থাকা, আছে তবে অসুস্থ হলো, অথবা মারা গেল, অথবা ঝগড়া হলো এবং সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলো কিংবা কেউ তাকে যেতে দিল না।

 

৪. সফর খরচ রইলো না, কম হয়ে গেল অথবা চুরি হয়ে গেল।

 

৫. রাস্তা ভুলে গেল এবং রাস্তা বলে দেয়ার কেউ রইলো না।

 

৬. কোনো নারীর ইদ্দত শুরু হলো। যেমন স্বামী তালাক দিল অথবা ইহরাম বাধার পর স্বামীর মৃত্যু হলো।

 

৭. কোনো নারী স্বামীর বিনা অনুমতিতে ইহরাম বাধলো এবং ইহরাম বাধার পর স্বামী নিষেধ করলো। এ সকল অবস্থায় ইহরাম বাধার পর সে ব্যক্তি মুহাসসার হয়ে যাবে।

 

এহসানের মাসায়েল

 

১. এহসানের ফলে মুহাসসার সাধ্য মতো উট,গরু, ছাগল যা পারে তা-ই খরিদ করে হেরেমে পাঠিয়ে দেবে যেন তার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়।

 

২. এহসানের কুরবানী ওয়াজিব। যতক্ষণ মুহাসসারের পক্ষ থেকে হেরেমে কুরবানী করা না হয়, ততোক্ষণ মুহাসসার তার ইহরাম খুলবে না। কুরবানীর পশু বা তার অর্থ পাঠাবার সময় সে যবেহ করার দিন ধার্য করে দেবে যাতে করে ঐদিন সে তার ইহরাম খুলতে পারে।

 

৩. ওমরাহ অথবা হজ্জে এফরাদ করতে বাধাপ্রাপ্ত হলে এক কুরবানী এবং হজ্জে কেরান বা তামাত্তু করতে না পারলে দু কুরবানী পাঠাতে হবে যা তার অর্থ পাঠাতে হবে।

 

৪. এহসানের কুরবানীর গোশত মুহাসসারের জন্য খাওয়া জায়েয নয়। কারণ এটাও এক প্রকার জেনায়েতের কুরবানী।

 

৫. কুরবানীর পশু পাঠাবার পর যদি বাধা উত্তীর্ণ হয়ে যায় এবং এটা সম্ভব হয় যে, মুহাসসার কুরবানীর পশু যবেহ হবার পূর্বে মক্কায় পৌছতে পারবে এবং হজ্জের সৌভাগ্য লাভ করবে। তাহলে শীঘ্রই হজ্জের রওয়ানা হওয়া তার ওপর ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি কুরবানীর পূর্বে পৌছতে না পারে এবং হজ্জের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে রওয়ানা না হওয়াই তার জন্য ওয়াজিব।

 

বদলা হজ্জ

 

বদলা হজ্জের অর্থ হলো নিজের স্থলে নিজের খরচায় অন্যকে দিয়ে হজ্জ করানো। এক ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয কিন্তু কোনো অনিবার্য কারণে সে নিজে হজ্জে যেতে পারছে না। যেমন অসুস্থতা, অতি বার্ধক্য এবং এ ধরনের অন্য কোনো কারণে। সে জন্য তার এ সুযোগ রয়েছে যে, সে অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে হজ্জে পাঠিয়ে দেবে এবং সে ব্যক্তি তার হয়ে হজ্জ করবে।

 

হযরত আবু রেযীন (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা অতি বৃদ্ধ হয়েছেন, না তিনি হজ্জ করতে পারেন না ওমরাহ। তিনি সওয়ারীর ওপর বসতেও পারেন না। নবী (স) বলেন তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ ও ওমরাহ কর। (তিরমিযি)

 

এর থেকে জানা গেল যে, অন্যের পরিবর্তেও হজ্জ করা সহীহ হবে। যে ব্যক্তি স্বয়ং তার ফরয হজ্জ আদায় করতে পারে না সে অন্যকে পাঠিয়ে নিজের ফরয আদায় করতে পারে। বরঞ্চ এমন অবস্থায় নিজের ফরয আদায় করানো উচিত। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত ফরয এবং যে ব্যক্তি অন্যকে পাঠাবার সুযোগ পায় না সে অসিয়ত করে যাবে যে, তারপর তার মাল থেকে বদলা হজ্জ করাতে হবে।

 

এ ব্যক্তি নবী (স) এর দরবারে হাজির হলো এবং বললো ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং তার জীবদ্দশায় তিনি ফরয হজ্জ আদায় করতে পারেন নি। তাহলে আমি কি তার হয়ে হজ্জ করবো? নবী (স) বললেন, যদি তার কোনো ঋণ থাকতো তাহলে তুমি তা পরিশোধ করতে? লোকটি বললোঃ জি হ্যাঁ, অবশ্যই পরিশোধ করতাম। নবী (স) বললেন, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা তো আরও জরুরী। (জামউল ফাওয়ায়েদ)

 

বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত

 

বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ায় ষোলটি শর্ত যার মধ্যে প্রথম পাঁচটি শর্ত তার সাথে সম্পর্কিত যে বদলা হজ্জ করাবে এবং এগারোটি শর্ত বদলা হজ্জকারীর সাথে সম্পর্কিত।

 

১. যে বদলা হজ্জ করাতে চায়, শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার ওপর হজ্জ ফরয হতে হবে। এমন ব্যক্তি যদি বদলা হজ্জ করায় যার ওপর হজ্জ ফরয নয় অর্থাৎ তার সামর্থ্য নেই, তাহলে এ বদলা হজ্জ ফরয আদায় হবে না। যেমন সে বদলা হজ্জের পর সে ব্যক্তি আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থবান হলো এবং তার ওপর হজ্জ ফরয হলো।তখন তার করানো বদলা হজ্জের দ্বারা তার ফরয আদায় হবে না। বরঞ্চ পুনরায় বদলা হজ্জ করাতে হবে, যদি সে নিজে না পারে।

 

২. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তার স্বয়ং অক্ষম হতে হবে। তার অক্ষমতা যদি সাময়িক হয় যা দূর হওয়ার আশা আছে। তাহলে বদলা হজ্জ করাবার পর যখন সে অক্ষমতা স্থায়ী হয় ও তা দূর হবার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, যেমন বার্ধক্যের কারণে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা অন্ধ হয়েছে তাহলে এ অক্ষমতার শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা শর্ত নয়। যদি আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ মেহেরবানীতে বদলা হজ্জ করাবার পর তার ক্ষমতা দূর করে দেন তাহলে পুনর্বার হজ্জ করা ফরয হবে না ফরয আদায় হয়ে গিয়েছে বুঝতে হবে।

 

৩. বদলা হজ্জ করাবার পূর্বে এ অক্ষমতা প্রকাশ হওয়া দরকার। বদলা হজ্জ করাবার পর যদি অক্ষমতা প্রকাশ পায় তাহলে বদল হজ্জ ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না। অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়ার পর বদলা হজ্জ করানো জরুরী হবে।

 

৪. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তাকে স্বয়ং অন্য কাউকে হজ্জের জন্যে বলতে হবে। যদি কেউ নিজে নিজে অন্যের পক্ষ থেকে তার বলা ছাড়া হজ্জ করে তাহলে ফরয দায়মুক্ত হবে না মরবার সময় অসিয়ত করাও বলার মধ্যেই শামিল। অবশ্য কারো ওয়ারিশ যদি মৃত ব্যক্তির অসিয়ত ছাড়া তার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করে বা অন্য কারো দ্বারা করায় তাহলে ফরয আদায় হয়ে যাবে।

 

৫. যে বদলা হজ্জ করাবে তাকে স্বয়ং হজ্জের সমুদয় খরচ বহন করতে হবে।

 

৬. বদলা হজ্জকারীকে মুসলমান হতে হবে।

 

৭. বদল হজ্জকারীকে হুশ জ্ঞানসম্পন্ন লোক হতে হবে- পাগল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়া চলবে না।

 

৮. বদল হজ্জকারীকে বুদ্ধিমান হতে হবে- নাবালেগ হলেও চলবে। বুদ্ধি শুদ্ধি নেই এমন লোকের বদলা হজ্জ চলবে না। ফরয আদায় হবে না।

 

৯. বদলা হজ্জকারী ইহরাম বাধার সময় তার পক্ষ থেকে হজ্জের নিয়ত করবে- যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে।

 

১০. সেই ব্যক্তি বদলা হজ্জ করবে যাকে হজ্জ করতে বলবে ঐ ব্যক্তি  যার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করা হচ্ছে। অর্থাৎ যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যাকে বদলা হজ্জ করতে বলবে একমাত্র সেই করবে। তবে যদি এ অনুমতি সে দেয় যে, অন্য কাউকে দিয়েও সে বদলা হজ্জ করাতে পারবে। তাহলে অন্য ব্যক্তির দ্বারাও বদলা হজ্জ সহীহ হবে।

 

১১. বদলা হজ্জকারী ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হজ্জ করবে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে। যেমন যে ব্যক্তি বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যদি কেরানের কথা বলে কিংবা তামাত্তুর কথা বলে তাহলে বদলা হজ্জকারীকে তদনুযায়ী কেরান অথবা তামাত্তু হজ্জ করতে হবে।

 

১২. বদলা হজ্জকারী একই প্রকার হজ্জের এবং এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে ইহরাম বাধবে। দু ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলা হজ্জের ইহরাম বাধলে ফরয আদায় হবে না।

 

১৩. বদলা হজ্জকারী যানবাহনে করে হজ্জে যাবে পায়ে হেটে নয়।

 

১৪. বদলা হজ্জ যে করাতে চায় তার স্থান থেকেই বদলা হজ্জকারীকে হজ্জের সফর শুরু করতে হবে। যদি মৃত ব্যক্তির এক তৃতীয়াংশ মাল থেকে বদলা হজ্জ করানো হয় তাহলেও এ অর্থে যেখান থেকে হজ্জের সফর শুরু করা যেতে পারে, সেখান থেকে সফর করতে হবে।

 

১৫. বদলা হজ্জকারী যেন হজ্জ নষ্ট না করে। হজ্জ নষ্ট করার পর তার কাযা করলে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে তার ফরয আদায় হবে না।

 

১৬. হানাফীদের মতে বদলা হজ্জকারীর জন্যে এ শর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই যে, তাকে প্রথমে আপন ফরয হজ্জ আদায় করতে হবে এবং তারপর সে বদলা হজ্জ করতে পারবে। অবশ্য আহলে হাদীসের কাছে শর্ত এই যে, প্রথমে ফরয হজ্জ করে না থাকলে সে বদলা হজ্জ করতে পারবে না।

 

মদীনায় উপস্থিতি

 

মদীনায় তাইয়েবাতে হাজিরা দেয়া অবশ্য হজ্জের কোনো রুকন নয়। কিন্তু মদীনার অসাধারণ মহত্ব ও ফযিলত মসজিদে নববীতে নামাযের প্রভূত সওয়াব এবং নবীর দরবারে হাজিরার প্রবল আকাংখা মুমিনকে মদীনায় টেনে নিয়ে যায়। চিরদিন তা-ই হয়ে এসেছে। মানুষ দূর দূরান্তে সফর করে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌছবে এবং তারপর দরবারে নববীতে দরূদ ও সালাম পেশ না করেই বাড়ী ফিরবে এ এক চরম বেদনাদায়ক নৈরাশ্য। তার জন্যে মুমিনের দিল আর্তনাদ করে ওঠে।

 

মদীনা তাইয়েবার মহত্ত্ব ও ফযিলত

 

এর থেকে অধিক মহত্ত্ব ও ফযিলত মদীনার আর কি হতে পারে যে, এখানে মানবতার মহান শুভাকাঙ্ক্ষী তার জীবনের দশটি বছর অতিবাহিত করেছেন। এখানে তার পবিত্র হস্তে নির্মিত মসজিদ রয়েছে। যার মধ্যে তিনি তার সাহাবায়ে কেরামসহ নামায আদায় করেছেন। এখানেই সেই ঐতিহাসিক প্রান্তর রয়েছে যেখানে হক ও বাতিলের সিন্ধান্তকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এ পাক যমীনেই বদরের শহীদগণ শান্তিতে শায়িত রয়েছেন যাদের জন্যে গোটা উম্মাতে মুসলেমা গর্বিত। এখানেই ঐসব পাকরূহ বিশ্রাম করছে যাদেরকে তাদের জীবদ্দশায় নবী (স) বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, আর এ পাক যমীনেই রহমতের নবী স্বয়ং অবস্থান করছেন।

 

হিজরতের পূর্বে এ শহরের নাম ছিল ইয়াসরাব। হিজরতের পর মদীনায়ে তাইয়েবা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর নাম রেখেছেন তাবা .......... বলে। (হযরত জাবের বিন সামরা (রা) বলেন, আমি নবী (স)কে একথা বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা মদীনার নাম তাবা রেখেছেন। (মুসলিম)

 

তাবা, তীবা ও তাইয়েবা ............... শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে পবিত্র ও মনোরম সত্য কথা বলতে কি মদীনার পাক যমীন প্রকৃতপক্ষে পবিত্র ও মনোরম।

 

হিজরতের পর হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত বেলাল (রা) কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। কারণ এখানকার আবহাওয়া ছিল খুবই খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর। প্রায়ই মহামারি রোগ দেখা দিত। নবী (স) দোয়া করেন, হে পরওয়ারদেগার! মদীনার জন্যে আমাদের হৃদয়ে মহব্বত পয়দা করে দাও যেমন মক্কার জন্যে আমাদের মহব্বত রয়েছে। এখানকার জ্বর ব্যাধিকে হুজফার দিকে বিতাড়িত করে দাও এবং এখানকার আবহাওয়া মনোরম করে দাও। (বুখারী)

 

মদীনার প্রতি নবী (স) এর যে অসাধারণ মহব্বত ছিল এর থেকে অনুমান করা যায় যে, যখনই করা যায় যে, যখনই তিনি কোনো সফর থেকে মদীনায় ফিরতেন, তখন দূর থেকে শহরের দালান কোঠা দেখেই তিনি আনন্দে অধীর হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, এইতো তারা এসে গেল। (বুখারী) তারপর তিনি ঘাড়ের ওপর থেকে চাদর নামিয়ে ফেলে বলতেন, এ হচ্ছে তাইয়েবার বাতাস ওহ! কত মধুর।

 

তার সঙ্গী সাথীদের মধ্যে যারা ধুলাবালি থেকে বাঁচবার জন্যে মুখ ঢেকে রাখতেন তাদেরকে বলতেন, মদীনার মাটিতে আরোগ্য রয়েছে। (জাযবুল কুলুব)

 

নবী (স) বলেন,ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, মদীনার মাটিতে সকল রোগের ওষুধ রয়েছে।

 

হযরত সাদ (রা) বলেন,আমার মনে হয়, নবী বলেছিলেন, এর মাটিতে কুষ্ঠরোগেরও আরোগ্য রয়েছে। (আত -তারগীব)

 

মদীনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে তাকীদ করে নবী (স) বলেছেন-ইবরাহীম (আ ) মক্কাকে হেরেম বলে ঘোষণা করেন এবং আমি মদীনাকে হেরেম ঘোষণা করছি। মদীনার দু ধারের মধ্যবর্তী স্থানও হেরেম। এখানে না খুনখারাবি করা যাবে, না অস্ত্রধারণ করা যাবে। গাছের পাতা পর্যন্ত ছেড়া যাবে না। অবশ্য পশুর খাদ্যের জন্য তা করা যেতে পারে। (মুসলিম)

 

মদীনায় বসবাস করতে গিয়ে সেখানে দুঃখ কষ্ট স্বীকার করার ফযিলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি মদীনায় দুঃখ কষ্ট স্বীকার করে বসবাস করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে শাফায়াত করব। (মুসলিম)

 

নবী (স) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সকলের প্রথমে আমি মদীনাবাসীদের শাফায়াত করব। তারপর মক্কাবাসীর এবং তারপর তায়েফবাসীর। (তাবারানী)

 

হযরত ইবরাহীম (আ ) মক্কা ভূমিতে তার বংশধরকে পুনর্বাসিত করতে গিয়ে এ ঘোষণা করেন-

 

*******আরবী*********

 

অতএব (হে আল্লাহ) তুমি মানুষের অন্তঃকরণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদের খাদ্যের জন্যে ফলমূল দান কর। যাতে করে তারা কৃতজ্ঞ বান্দাহ হতে পারে। (সূরা ইবরাহীম)

 

নবী (স) এ দোয়ার বরাত দিয়ে মদীনার সপক্ষে কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করেন-

 

আয় আল্লাহ! ইবরাহীম (আ )তোমার খাস বান্দাহ। তোমার দোস্ত এবং তোমার নবী ছিলেন। আমিও তোমার বান্দাহ ও নবী। তিনি মক্কার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তোমার কাছে দোয়া করেন। আমিও মদীনার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তেমনি দোয়া করছি বরঞ্চ তার চেয়ে অধিক। (মুসলিম)

 

মদীনার পবিত্রতা ও দীনি গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- কিয়ামত সে সময় পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না মদীনা তার ভেতর থেকে দুষ্কৃতিকারীদেরকে এমনভাবে বের করে দেবে যেমন কর্মকারের চুল্লি লোহার ময়লা বের করে দেয়। (মুসলিম)

 

মদীনায় মৃত্যুবরণের আকাংখা এবং চেষ্টা করার ফযিলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন-

 

কেউ মদীনায় মৃত্যুবরণ করতে পারলে যেন তা অবশ্যই করে। এজন্যে যে, যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করবে আমি তার শাফায়াত করব। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি)

 

হযরত ইবনে সাদ ৯রা) বলেন, হযরত আওফ বিন মালেক আশজানী (রা) স্বপ্ন দেখেন যে, হযরত ওমর (রা) কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। এ স্বপ্নের কথা তার কাছে বলা হলে তিনি দুঃখ করে বলেন-

 

আমার শাহাদাতের ভাগ্য কেমন করে হবে। আমি তো আরব ভূখণ্ডেই অবস্থান করছি, স্বয়ং কোনো জেহাদেই শরীক হই না এবং লোক আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। তবে হ্যাঁ যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় তাহলেও এ অবস্থাতে তিনি আমাকে শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করবেন। তারপর তিনি এ দোয়া পড়লেন-

 

*******আরবী*********

 

আয় আল্লাহ! আমাকে তোমার পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য দান কর এবং তোমার রাসূলের শহরে আমার মৃত্যু দাও।

 

মসজিদে নববীর মহত্ত্ব

 

মসজিদে নববীর বড়ো মহত্ত্বও এই যে, নবী পাক তার পবিত্র হাতে এ মসজিদ তৈরী করেন এবং কয়েক বছর ধরে তার মধ্যে নামায পড়েন। এ মসজিদকে তিনি তার নিজের মসজিদ বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমার মসজিদে এক নামায পড়া অন্য মসজিদে হাজার নামাজের চেয়ে বেশী উত্তম, শুধু মসজিদুল হারাম ছাড়া।

 

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ক্রমাগত চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এভাবে পড়বে যে মাঝের একটি নামাযও বাদ যাবে না, তার জন্য জাহান্নামের আগুন ও অন্যান্য আযাব মাফ করা হবে এবং এভাবে মুনাফেকি থেকেও তাকে রক্ষা করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, আত--তারগীব)

 

নবী (স) বলেন, আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানের মধ্যে একটি এবং আমার মিম্বর হাউজে কাওসার। (বুখারী, মুসলিম)

 

রওযা পাকের যিয়ারত

 

সেসব মুসলমান কত ভাগ্যবান ছিলেন যাদের চক্ষু শীতল হতো রাসূলে পাক (স) এর দীদার লাভে তারা সর্বদা রাসূলের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন এবং তার কথায় প্রেরণা লাভ করেছেন। এ সৌভাগ্য শুধু সাহাবায়ে কেরামের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু এ সুযোগ তো কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে যে, রাসূল প্রেমিকগণ তার রওযা পাকে হাজিরা দেবে এবং তার দহলিজে দাড়িয়ে তার ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করবে।

 

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো এবং আমার মৃত্যুর পর আমার রওযা যিয়ারত করলো, সে আমার যিয়ারতের সৌভাগ্য ঠিক তার মতো লাভ করলো যে আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত লাভ করেছে। (বায়হাকী)

 

যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যিয়ারত করলো, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করলো। যে আমার করব যিয়ারত করলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার কোনো ওজর ওজরই নয়। (ইলমুল ফিকাহ)

 

যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারতের জন্যে এলো এবং এছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য আমার ওপর এ হক হয়ে গেল যে, আমি তার শাফায়াত করি। (ইলমুল ফিকাহ)

 

রওযা পাকের যিয়ারতের হুকুম

 

রওযা পাক যিয়ারত করা ওয়াজিব। হাদীস থেকে তাই মনে হয়। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো কিন্তু আমার কবর যিয়ারত করতে এলো না সে আমার ওপর যুলুম করলো। আর এক হাদীসে আছে, যে শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হাদীসের আলোকে ওলামায়ে কেরাম রওযা পাক যিয়ারত ওয়াজিব বলেছেন।

 

বস্তুত সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাবেঈন এবং অন্যান্য ইসলামী মনীষীগণ রওযা যিয়ারতের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) এর অভ্যাস ছিল যখনই কোনো সফর থেকে আসতেন সর্বপ্রথম রওযা পাকে গিয়ে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।

 

হযরত ওমর (রা) একবার কাব আহবারকে নিয়ে মদীনা এলেন এবং সর্বপ্রথম রওযা পাকে হাজির হয়ে দরূদ ও সালাম পেশ করলেন।

 

হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয সিরিয়া থেকে এ উদ্দেশ্যে তার বাণী বাহককে মদীনায় পাঠালেন যে, সে সেখানে পৌঁছে দরবারে রেসালাতে তার (ওমর বিন আবদুল আযীয) সালাম পৌঁছাবে।

 

এক নজরে হজ্জের দোয়া

 

হজ্জের সময় বিভিন্ন স্থানে হজ্জের আরকান আদায় করতে গিয়ে দোয়া করতে হয়। সেগুলো যথাযথ এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং সে সবের তরজমাও করে দেয়া হয়েছে। দোয়াগুলোর সূচী ও পৃষ্ঠা নিম্নে দেয়া হলোঃ

 

আবে যমযম পানের দোয়া-২৭০ পৃঃ

 

তালবিয়ার পর দোয়া-১৬৬ পৃঃ

 

রামী করার দোয়া- ১৮৭ পৃঃ

 

সায়ীর দোয়া-১৮২ পৃঃ

 

তাওয়াফের দোয়া-১৭৬ পৃঃ

 

দোয়া কবুলের স্থানসমূহ- ২০৮ পৃঃ

 

কুরবানীর দোয়া-১৯৬ পৃঃ

 

মুলতাযিমের দোয়া ২০৭ পৃঃ

 

আরাফাতের ময়দানের দোয়া-১৬৮ পৃঃ

 

হজ্জের স্থানসমূহ

 

হেরমে পাক ও তার পার্শ্ববর্তী যেসব পবিত্র স্থানগুলোতে হজ্জের আমল ও রুকন আদায় করা হয় তা খুবই সম্মানের স্থান। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন। ইসলামের ইতিহাসের সাথে এগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তা অবগত হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে হজ্জ যাত্রীদের জন্যে। এর ফলে তারা হজ্জের পুরো ফায়দা হাসিল করতে পারবেন। হজ্জে তাদের সে আধ্যাত্মিক আবেগ অনুভূতি সৃষ্ট হবে যা হজ্জের প্রাণ। সেসব স্থানের নাম ও পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো।

 

১. বায়তুল্লাহ

 

এ এক চতুষ্কোণ পবিত্র গৃহ যা আল্লাহর আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ) তৈরী করেছিলেন। এ আশায় করেছিলেন যে, যতদিন দুনিয়া থাকবে ততদিন তা সমগ্র মানবতার জন্যে হেদায়েত কেন্দ্রস্থল হয়ে থাকবে। এখান থেকেই সেই রাসূলের আবির্ভাব হয় যিনি সমগ্র বিশ্বের জন্যে হেদায়াতের বিরাট দায়িত্ব পালন করতে থাকবে। কুরআন সাক্ষ্য দেয় যে, দুনিয়ায় আদম সন্তানের জন্যে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয়েছিল তা এ বায়তুল্লাহ। এটা সমগ্র বিশ্বের জন্যে কল্যাণ ও বরকতের উৎস ও হেদায়াতের কেন্দ্র। হজ্জের সময় হেরেম যিয়ারতকারীগণ এর চারদিকে পরম ভক্তি শ্রদ্ধা ও বিনয় নম্রতা সহকারে তাওয়াফ করে।

 

২. বাতনে উরনা

 

আরাফাতের ময়দানে এক বিশেষ স্থান যা বাতনে উরনা অথবা উরনা প্রান্তর নামে প্রসিদ্ধ। বিদায় হজ্জের সময় এ প্রান্তরেই নবী (স) জনসমাবেশে ভাষণ দান করেন।

 

৩. জাবালে রহমাত

 

আরাফাতের ময়দানের এক বরকতময় পাহাড়।

 

৪. জাবালে কাযাহ

 

মুযদালফায় মাশায়ারুল হারামের নিকটে একটি পাহাড়।

 

৫. জাবালে আরাফাত

 

ময়দানে আরাফাতের এক পাহাড়। এ পাহাড়ের জন্যেই এ উপত্যকা বা প্রান্তরকে আরাফাত বা ময়দানে আরাফাত বলা হয়।

 

৬. হুজফা

 

মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম হুজফা। সিরিয়াবাসী এবং সিরিয়ার পথে আগমনকারী সকলের জন্যে হুজাফ মীকাত। হেরেমে আসার জন্যে সেখানে ইহরাম বাধাতে হয়।

 

৭. জুমরাত

 

মিনায় কিছু দুরে অবস্থিত তিনটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলোকে জুমরাত বলে। প্রথম স্তম্ভ যা মসজিদে খায়েফের দিকে বাজারে অবস্থিত তাকে বলে জুমরায়ে উলা। বায়তুল্লাহর দিকে অবস্থিত দ্বিতীয় স্তম্ভের নাম জুমরায়ে ওকবা। এ দুয়ের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। তার নাম জুমরায়ে ওস্তা।

 

৮. হেরেম

 

যে মক্কা শহরে বায়তুল্লাহ এবং মসজিদুল হারাম অবস্থিত তার আশে পাশের কিছু এলাকাকে হেরেম বলে। হেরেমের সীমানা নির্ধারিত আছে এবং তা সকলের জানা। প্রথমে এ সীমানা নির্ধারণ করেন হযরত ইবরাহীম (আ )। তারপর নবী (স) তার যামানায় এ সীমানা নবায়িত ও সত্যায়িত করেন। মদীনার দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেরেমের সীমানা। ইয়ামেনের দিকে প্রায় এগারো কিলোমিটার, তায়েফের দিকেও প্রায় এগারো কিলোমিটার এবং এতো কিলোমিটার ইরাকের দিকে। নবী (স) এর পর হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাদের আপন আপন যুগে এ সীমানা ঠিক রাখেন। আল্লাহর দীনের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের দাবি এই যে, মুসলমান এ সীমারেখাগুলোর মহত্ত্ব, শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখবে এবং এ সীমারেখার ভেতর যেসব কাজ নিষিদ্ধ তা করা থেকে বিরত থাকবে।

 

৯. হাতীম

 

বায়তুল্লাহর উত্তর পশ্চিমের অংশ হযরত ইবরাহীম (আ )এর যুগে কাবা গৃহের শামিল ছিল এবং পরবর্তীকালে সংস্কারের সময় তা মূল গৃহের শামিল করা হয়নি। নবী পাকের নবুয়াতের পূর্বে আগুন লেগে কাবা ঘরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। কুরাইশগণ পুনরায় তা নির্মাণ করতে গেলে পুঁজি কম পড়ে যায় এবং কিছু দেয়াল ছোট করে রেখে দেয়া হয়। এ অসমাপ্ত অংশকে হাতীম বলে।হাতীম যেহেতু বায়তুল্লাহরই অংশ, সে জন্যে তাওয়াফকারীগণ হাতীমের বাহির দিক দিয়ে তাওয়াফ করেন, যাতে করে হাতীমের তাওয়াফ হয়ে যায়।

 

১০. যাতে ইরাক

 

মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আমি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থান যা ইরাকবাসীদের জন্যে মীকাত নির্ধারিত আছে এবং ঐসব লোকদেরও জন্যে ইরাকের পথে যারা হেরেমে প্রবেশ করে।

 

১১. যুল হুলায়ফাহ

 

মদীনা থেকে মক্কা আসার পথে মদীনা থেকে আট নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যুল হুলায়ফা নামক স্থানটি। এটা মক্কা থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে মদীনাবাসীদের ও মদীনা থেকে আগমনকারীদের জন্যে মীকাত।

 

১২. রুকনে ইয়ামেনী

 

বায়তুল্লাহর যে কোণ ইয়ামেনের দিকে তাকে রুকনে ইয়ামেনী বলে। এটা অতি বরকতপূর্ণ স্থান। নবী (স) বলেন, রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (আত তারগীব)

 

১৩. যমযম

 

যমযম একটি ঐতিহাসিক কূপ যা বায়তুল্লাহর পূর্ব দিকে অবস্থিত। হযরত ইবরাহীম (আ ) যখন আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরাকে মক্কায় বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেন তখন আল্লাহ তাদের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং এ প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্য যমযমের এ ঝর্ণা প্রবাহিত করেন। হাদীসে এ ঝর্ণা ও তার পানির বড়ো ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যমযমের পানি পেট ভরে পান করা উচিত। এ যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তা ফলদায়ক হবে। এ ক্ষুধার্তের জন্যে খাদ্য, রোগীর জন্যে আরোগ্য।

 

১৪. সাফা

 

বায়তুল্লাহর পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ের নাম সাফা। এখন সে পাহাড়ের সামান্য চিহ্নই বাকী আছে। তার বিপরীত বায়তুল্লাহর উত্তরে মারওয়াহ পাহাড়। এ দুয়ের মাঝখানে হেরেম দর্শনার্থীর সায়ী করা ওয়াজিব। এ সায়ীর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।

 

১৫. আরাফাত

 

আরাফাত মক্কা থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে এক অতি প্রশস্ত ময়দান। হেরেমের সীমানা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাতের সীমানা শুরু। আরাফাতের ময়দানে পৌছা ও অবস্থান করা হজ্জের অতি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এ রুকন ছেড়ে দিলে হজ্জ হবে না। হাদীসে আরাফাতে অবস্থানের বড়ো ফযিলত বলা হয়েছে।

 

১৬. কারনুল মানাযিল

 

মক্কা থেকে পূর্বমুখী সড়কের ওপর এক পাহাড়ি স্থানের নাম কারনুল মানাযিল। এটা মক্কা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটা নাজদবাসীদের জন্যে এবং নাজদের পথে যারা হেরেমে প্রবেশ করে তাদের জন্য মীকাত।

 

১৭. মুহাসসাব

 

মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি প্রান্তর যা দুটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। আজকাল একটি বসতিপূর্ণ হয়ে গেছে। এখন তাকে মুয়াহেদা বলে। নবী (স) মিনা থেকে যাবার সময় এখানে কিছুক্ষণ থেমে ছিলেন। কিন্তু এখানে থামা হজ্জের ক্রিয়াকলাপের কিছু নয়।

 

১৮. মুযদালফা

 

মিনা ও আরাফাতের একেবারে মাঝখানে এক স্থানে নাম মুযদালফা। একে জমাও বলে এজন্যে যে, ১০ই যুলহাজ্জের রাতে হাজীদের এখানে জমা হতে হয়। মুযদালফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। অবস্থানের সময় ফজরের সূচনা থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত।

 

১৯. মসজিদুল হারাম

 

মসজিদুল হারাম দুনিয়ার সকল মসজিদ থেকে উৎকৃষ্ট। বরঞ্চ নামাযের প্রকৃত স্থানই এ মসজিদ এবং দুনিয়ার সকল মসজিদ প্রকৃতপক্ষে এ মসজিদেরই স্থলাভিষিক্ত। এ হচ্ছে সেই মুবারক মসজিদ যার মাঝখানে আল্লাহর সেই ঘর অবস্থিত যা দুনিয়ার ইবাদাতের প্রথম ঘর এবং সমস্ত মানবতার হেদায়াত ও বরকতের উৎস। নবী (স) বলেন, এ মসজিদে এক নামায পড়ার সওয়াব অন্য স্থানের এক লক্ষ নামাযের সমান।

 

২০. মসজিদে নববী

 

নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন তিনি এখানে একটি মসজিদ তৈরী করেন। নির্মাণ কাজে সাহাবীদের সাথ তিনি নিজেও বরাবর শরীক ছিলেন। তিনি বলেন, এ আমার মসজিদ। তিনি দশ বছর এ মসজিদে নামায পড়েন এবং সাহাবায়ে কেরামও বহু বছর এতে নামায পড়েন। এ মসজিদের ফযিলত ও মহত্ত্ব বর্ণনা করে নবী (স) বলেন-

 

শুধুমাত্র তিনটি মসজিদের জন্যে মানুষ সফর করতে পারে। মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার এ মসজিদ। (বুখারী ও মুসলিম)

 

তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এভাবে আদায় করে যে, মাঝের এক ওয়াক্ত ছুটে যাবে না, তাকে জাহান্নামের আগুন ও অন্যান্য আযাব থেকে নাজাত দেয়া হবে। এভাবে মুনাফেকি থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হবে। (আত-তারগীব)

 

২১. মসজিদে খায়েফ

 

এ হচ্ছে মিনার একটি মসজিদ। মিনায় অবস্থানকালে হাজীগণ এ মসজিদে যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর নামায আদায় করেন।

 

২২. মসজিদে নিমরাহ

 

এ হেরেম ও আরাফাতের ঠিক সীমান্তের ওপর অবস্থিত। এ মসজিদের যে দেয়াল মক্কার দিকে রয়েছে তাই হেরেম ও আরাফাতের সংযোগস্থল। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশগণ আরাফাতে না গিয়ে হেরেমের সীমার মধ্যেই অর্থাৎ মাশয়ারুল হারামের পাশেই অবস্থান করতো এবং একে নিজেদের বৈশিষ্ট্য মনে করতো। কিন্তু নবী (স) বিদায় হজ্জে এ নির্দেশ দেন যে, তার তাঁবু যেন নিমরাতে খাটানো হয়। তাই করা হয়। এ স্থানেই মসজিদে নিমরা রয়েছে।

 

২৩. মাশয়ারুল হারাম

 

মুযদালফা প্রান্তরে এক উঁচু নিশানা রয়েছে। তার ধার দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। এ স্থানকে বলে মাশয়ারুল হারাম। এখানে অধিক পরিমাণে যিকর ও তসবিহ পাঠের তাকীদ করা হয়েছে। নবী (স) ঐ উঁচু স্থানে ওঠে তসবিহ পাঠ ও দোয়া করেন। এটাও দোয়া কবুলের একটি স্থান। কুরআন পাকেও বলা হয়েছে যে, এখানে বেশী করে আল্লাহর যিকির করতে হবে-

 

*******আরবী*********

 

অতএব , তোমরা যখন আরাফাত থেকে ফিরে আসবে তখন মাশয়ারুল হারামের নিকটে আল্লাহর যিকর কর যেভাবে করতে বলা হয়েছে।

 

২৪. মুতাফ

 

বায়তুল্লাহর চারদিকে যে ডিম্বাকৃতির স্থান রয়েছে যার মধ্যে হাতীমও শামিল একে মুতাফ বলে অর্থাৎ তাওয়াফ করার স্থান। এখানে দিন রাত প্রতি মুহূর্তে মানুষ পতঙ্গের ন্যায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে। শুধু নামাযের জামায়াতের সময় তাওয়াফে বিরতি থাকে।

 

২৫. মাকামে ইবরাহীম

 

বায়তুল্লাহর উত্তর পূর্ব দিকে কাবার দরজার একটু দূরে একটা কোব্বা বানানো আছে। তার ভেতরে এক পবিত্র পাথর আছে যার ওপরে ইবরাহীম (আ ) এর দু পায়ের দাগ রয়েছে। একেই বলা হয় মাকামে ইবরাহীম। এটি অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতপূর্ণ স্থান এবং আল্লাহর বিরাট নিদর্শনাবলীর একটি। আল্লাহ বলেন-

 

*******আরবী*********

 

এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী ইবাদাতগার বানিয়ে নাও।

 

তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ করার পর তাওয়াফকারী মাকামে ইবরাহীমের পাশে দু রাকায়াত নামায পড়ে। নামাযের স্থান মাকামে ইবরাহীম ও কাবার দরজার মাঝখানে। ইমাম মালেক (র) বলেন, মাকামে ইবরাহীম ঠিক ঐ স্থানেই আছে যেখানে হযরত ইবরাহীম (আ ) রেখে গেছেন।

 

২৬. মুলতাযেম

 

বায়তুল্লাহর দেয়ালের ঐ অংশকে মুলতাযেম বলে যা হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মাঝখানে অবস্থিত। এটা প্রায় ছয় ফুট অংশ। এটি দোয়া কবুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুলতাযেম শব্দের অর্থ হলো আবিষ্ট হওয়ার স্থান অর্থাৎ বক্ষ, মুখমণ্ডল, হাত দিয়ে আবেষ্টন করার স্থান। এভাবে আবেষ্টন করে অত্যন্ত বিনয় ও আন্তরিক আবেগ সহকারে এখানে দোয়া করা মসনুন।

 

২৭. মিনা

 

হেরেমের সীমার মধ্যে মক্কা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থান। যুলহজ্জের আট ও নয় তারিখের মধ্যবর্তী রাতে হাজীগণ এখানে অবস্থান করেন। নয় তারিখে ভালোভাবে সূর্য উদয় হওয়ার পর হাজীগণ এখান থেকে আরাফাতের দিকে রওয়ানা হন।

 

২৮. মাইলাইনে আখদারাইনে (দুটি সবুজ নিশানা)

 

সাফা মারওয়ার মাঝখানে মারওয়া যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন আছে। এ দুটিকে বলে মাইলাইনে আখদারাইনে। এ দুটির মাঝখানে দৌড়ানো মসনুন। তবে শুধু পুরুষের জন্যে মেয়েদের জন্য নয়।

 

২৯. ওয়াদিয়ে মুহাসসার

 

মুযদালফা ও মিনার মাঝ পথে একটি স্থানকে বলে  মুহাসসার। নবী পাক (স) এর জন্মের কিছু দিন পূর্বে হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহকে ধূলিসাৎ করার দুরভিসন্ধিসহ মক্কা আক্রমণ করে। যখন সে এ মুহাসসার প্রান্তরে পৌঁছে তখন আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে বহু সংখ্যক ছোট ছোট পাখীর ঝাঁক পাঠিয়ে দেন। এসব পাখীর ঠোটে ও পায়ে ছোট ছোট পাথর ছিল। এসব পাথর আবরাহার সৈন্যদের উপর এমন প্রবল বেগে ও অবিরাম বর্ষণ করতে থাকে যে, গোটা সেনাবাহিনী তসনস হয়ে যায়। হজ্জ-যাত্রীগণ এ স্থান থেকে ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে আনে এবং তাই দিয়ে রামী করে। এ সংকল্পসহ রামী করা হয় যে, দীনে হক বরবাদ করার দুরভিসন্ধি নিয়ে যদি কেউ অগ্রসর হয় তাহলে তাকেও এভাবে তসনস করে দেয়া হবে যেমন পাখীর ঝাঁক আবরাহার সৈন্যবাহিনীকে করেছিল। হাজীদের উচিত এখান থেকে ছোলার পরিমাণ ছোট ছোট পাথর প্রয়োজন মতো সংগ্রহ করে নেয়া এবং অবিলম্বে এ স্থান পরিত্যাগ করা। কারণ এ হলো আযাবের স্থান।

 

৩০. ইয়ালামলাম

 

মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে আসার পথে একটি স্থানের নাম। এ মক্কা থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। ইয়ামেন এবং ইয়ামেনের দিক থেকে আগমনকারীদের মীকাত এ স্থানটি। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতবাসী হাজীদের এখানে ইহরাম বাধতে হয়।

 

পরিভাষা

 

১. ইহরাম

 

হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোশাক পরিধান করা এবং তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। ইহরাম যে বাধে তাকে মুহরেম বলে। নামাযের জন্যে তাকবীরে তাহরিমা বলার পর যেমন খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায় তেমনি ইহরাম বাধার পর বহু এমন সব জিনিস হারাম হয়ে যায় যা পূর্বে মুবাহ ছিল। এ জন্যে একে ইহরাম বলা হয়।

 

২. এহসার

 

এহসারের আভিধানিক অর্থ হলো বাধা দেয়া, বিরত রাখা। পরিভাষায় এর অর্থ হলো এই যে, কোনো ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করলো, তারপর তাকে হজ্জ বা ওমরা থেকে বিতর রাখা হলো। এমন ব্যক্তিকে বলে মুহাসসার।

 

৩. ইস্তেলাম

 

এর অর্থ স্পর্শ করা, চুমো দেয়া। তাওয়াফে প্রত্যেক চক্কর শুরু করার সময় এবং তাওয়াফ শেষে হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা বা চুমো দেয়া সুন্নাত। রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা মুস্তাহাব।

 

৪. ইস্তেবাগ

 

চাদর এমনভাবে গায়ে দেয়া যাতে তার একধার ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে বের করে বাম কাঁধের ওপর ফেলতে হবে। ডান কাঁধ খোলা থাকবে। এতে চটপটে ভাব, শক্তিমত্তা ও উৎসাহ প্রকাশ পায় এবং এভাবে প্রকাশ করা হয় যে, আল্লাহর সৈনিক দুশমনের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত।

 

৫. এতেকাফ

 

এতেকাফ অর্থ হলো লোক কিছু সময়ের জন্যে দুনিয়ার কর্মব্যস্ততা পরিত্যাগ করে কোনো মসজিদে অবস্থান করবে এবং সেখানে যিকর, তসবিহ, আল্লাহর ইয়াদ প্রভৃতিতে মগ্ন থাকবে। রমযানের শেষ দশ দিনে এ আমল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।

 

৬. আফাকী

 

মীকাতের বাইর বসবাসকারী লোকদের আফাকী বলে।

 

৭. ইফরাদ

 

হজ্জ তিন প্রকার। তার এক প্রকার ইফরাদ। এ হজ্জকারীদের মুফরেদ বলে।

 

৮. আলমাম

 

আলমাম অর্থ নেমে পড়া। পরিভাষায় আলমাম অর্থ ইহরাম খোলার পর আপন পরিবারের লোকজনের মধ্যে গিয়ে পড়া।

 

৯. উকিয়া

 

এক ওজন যা ৪০ দিরহাম।

 

১০. আইয়ামে বীয

 

প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীয অর্থাৎ উজ্জ্বল দিনগুলো।

 

১১. আইয়ামে তাশরীফ

 

যুলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত আইয়ামে তাশরীক

 

১২. তালবিয়া

 

হেরেম যিয়ারতকারীদের জন্যে বিশেষ দোয়া যা তারা বরাবর পড়তে থাকে।

 

১৩. তামাত্তু

 

তামাত্তু এক প্রকারের হজ্জ। হজ্জ ও ওমরা এক সাথে করা এবং উভয়ের জন্যে পৃথক পৃথক ইহরাম বাধা। ওমরার পর ইহরাম খুলে ফেলবে। তখন তার জন্যে ঐসব জিনিস হালাল হবে যা ইহরামের সময় হারাম। তারপর পুনরায় হজ্জের জন্যে ইহরাম বাধবে। এমন ব্যক্তিকে মুতামাত্তা বলে।

 

১৪. তামলিক

 

তামলিক অর্থ মালিক বানিয়ে দেয়া। যাকাতের একটি শর্ত এই যে, যাকাতের মাল যার হাওয়ালা করা হবে তাকে মালিক বানিয়ে দেয়া যাতে করে সে যেমন খুশী তেমনিভাবে তা ব্যয় করবে।

 

১৫. জেনায়েত

 

জেনায়েত অর্থ কোনো নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ করা। পরিভাষায় এর অর্থ হলো এমন কোনো কাজ করা যা হেরেমে থাকা অবস্থায় অথবা ইহরাম অবস্থায় করা হারাম।

 

১৬. দমে এহসার

 

নিয়ত করার পর কাউকে যদি হজ্জ বা ওমরা থেকে বিরত রাখা হয় তাহলে তাকে সাধ্যানুযায়ী কুরবানী করতে হয়। এ কুরবানীকে বলে দমে এহসার।

 

১৭. রমল

 

তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে হেলে দুলে দ্রুত চলাকে রমল বলে।

 

১৮. রামী

 

মিনাতে কিছু দূরে দূরে তিনটি স্তম্ভ আছে। সেগুলো লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে হয়। তাকে রামী বলে। স্তম্ভগুলোকে জুমরাত বলে।

 

১৯. সায়েমা

 

সায়েমা এমন সব পশু যারা বনে জঙ্গলে ঘাস খেয়ে বাচে। তাদেরকে বাড়ীতে চারা প্রভৃতি খাওয়াতে হয় না। কিন্তু দুধের জন্যে সেগুলো প্রতিপালন করা হয়।

 

২০. তাওয়াফে কুদুম

 

মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। যারা মীকাতের বাইরে বসবাস করে তাদের জন্য এটা ওয়াজিব।

 

২১. তাওয়াফে যিয়ারত

 

আরাফাতের অবস্থানের পর ১০ই যুলহজ্জ যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে যিয়ারত বলে। এ তাওয়াফ ফরয।

 

২২. তাওয়াফে বেদা বা বিদায়ী তাওয়াফ

 

বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হবার পূর্বে যে তাওয়াফ করা হয় তা বিদায়ী তাওয়াফ। এ তাওয়াফ আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।

 

২৩. ওমরাহ

 

ওমরাহ হলো ছোট হজ্জ। এ যে কোনো সময় হতে পারে। যখনই সুযোগ হবে ইহরাম বেধে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে। সায়ী করবে এবং মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরাম খুলবে। হজ্জের সাথেও ওমরাহ করা যায়, পৃথকভাবেও করা যায়।

 

২৪. ফিদিয়া

 

রোযা রাখতে না পারার কারণে শরীয়াতে অক্ষম ব্যক্তিকে এ সুযোগ দিয়েছে যে, সে তার বদলে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্যশস্য কোনো অভাবগ্রস্তকে দেবে অথবা দু বেলা খানা খাওয়াবে। একে পরিভাষায় ফিদিয়া বলে। শস্যের মূল্য দেয়াও জায়েয।

 

২৫. কেরান

 

হজ্জ ও ওমরার ইহরাম এক সাথে বাধা এবং উভয়ের রুকন আদায় করা। এমন হজ্জকারীকে কারেন বলে। কেরান হজ্জে তামাত্তু ও হজ্জে ইফরাদ উভয় থেকে উৎকৃষ্ট।

 

২৬. কীরাত

 

এক কীরাত পাঁচ যবের সমান। বিশ কীরাতে এক মিসকাল হয়।

 

২৭. কাফফারা কোনো শরীয়াতের দৃষ্টিতে ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ করার শরীয়াত যে আমল বলে দিয়েছে তাকে কাফফারা বলে।

 

২৮. মিসকাল

 

এক প্রকার ওজনকে বলে মিসকাল। তাহলো তিন মাশা এক রতির সমান।

 

২৯. মুহরিম

 

মীকাত থেকে যে ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার ইহরাম বাধে তাকে মুহরিম বলে।

 

৩০. মুহাসসার

 

যে ব্যক্তি হজ্জ বা ওমরার নিয়ত করার পর কোনো কারণে হজ্জ ও ওমরা থেকে বিতর থাকতে বাধ্য হয়, তাকে মুহাসসার বলে।

 

৩১. মীকাত

 

মীকাত এমন এক নির্দিষ্ট স্থান যেখান থেকে ইহরাম না বাধলে মক্কা মুকাররামা যাওয়া নিষিদ্ধ। যে কোনো উদ্দেশ্যেই কাউকে মক্কা যেতে হোক তাকে মীকাত পৌঁছে ইহরাম বাধতে হবে। ইহরাম ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী।

 

৩২. ওয়াসাক

 

ওয়াসাক অর্থ এক উটের ওজন যা ৬০ সা এর সমতুল্য।

 

৩৩. হাদী

 

শাব্দিক অর্থ তোহফা, হাদিয়া, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী বলতে সেই পশু বুঝায় যা হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে করে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পৌছিয়ে দেয়।

 

৩৪. ইয়াওমে তারবিয়া

 

যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখকে ইয়াওমে তারবিয়া বলে। বলার অর্থ এই যে, ঐদিন হজ্জের আমল  শুরু হয়।

 

৩৫. ইয়াওমে আরাফাত

 

যুল হজ্জ মাসের ৯ তারিখ অর্থাৎ হজ্জের দিনকে ইয়াওমে আরাফাত বা আরাফাতের দিন বলে। এ দিন হজ্জকারীগণ আরাফাতের ময়দানে জমায়েত হন।

 

৩৬. ইয়াওমে নহর

 

যুলহজ্জ মাসের ১০ তারিখকে ইয়াওমে নহর বলে। কারণ ঐদিন থেকে কুরবানী শুরু হয়।

 

--- সমাপ্ত ---

'

আসান ফেকাহ ( ২য় খন্ড )

মাওলানা ইউসুফ ইসলাহী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড