সীরাতে ইবনে হিশাম

ভূমিকা

ইতিহাস ও সীরাত

জাহিলিয়াত যুগে আরবরা ইতিহাস কি জিনিস, তা জানতো না। ইতিহাস বলতে তাদের কাছে ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জনশ্রুতি। আরব জীবনের স্বভাব +প্রকৃতির বর্ণনাই ছিল সেকালের প্রচলিত ইতিহাসের একমাত্র উপাদান। বাপদাদার বীরত্বগাথা এবং তাদের বদান্যতা, স্বগোত্রের প্রতি আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি পরায়ণতার গৌরবময় কাহিনীতে তা ছিল ভরপুর। বংশ পরম্পরা ও শত্রু মিত্রের পরিচয়মূলক বিবরণে সমৃদ্ধ ছিল সে ইতিহাস। পবিত্র কা’বাঘর ও তার রক্ষকদের, ইতিবৃত্ত, যমযম কূপের উদ্ভব-বৃত্তান্ত, জুরহুম ও কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জীবন কথা, মাআরিবের বাঁধভাঙা প্লাবন ও তার পরিণতিতে সেখানকার অধিবাসীদের শতধাবিচ্ছিন্ন হযে দিকবিদিক  ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী, গণক ও যাজকদের ভবিষ্যদ্বানী ও তাদের ছন্দবদ্ধ গদ্য-কবিতা ইত্যাদি-যার দ্বারা তৎকালীন আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের স্বরূপ জানা যায়- এসবই ছিল আরব জাতির ইতিকথার প্রধান উপজীব্য। যখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলামের পুনরাবির্ভাব ঘটলো, তখনো ঐসব জনশ্রুতিমুলক ইতিকাহিনী মানুষের মুখে মুখে বিবৃত হওয়া অব্যাহত থাকলো। অধিকন্তু ইসলামের প্রতি আহ্বান ও তার পূর্বে পরিলক্ষিত নবুওয়াতে পূর্বাভাস, তাঁর ক্রমবিকাশ ও বয়োপ্রাপ্তি, নবুওয়াতোত্তর জীবন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জীবনের ঘটনাবলী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার  আদর্শ জীবনের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন নামধারী মুসলিম, খৃস্টান, ইহুদী ও মুশরিকদের কাহিনী- এসবের মধ্যে আরব কথক ও কহিনীকাররা এক ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী উপকরণ পেয়ে গেল। ফলে এসব নতুন কহিনীও একইভাবে মৌখিক বর্ননার মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।পবিত্র কুরআন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সাহাবাদের কথাবার্তা ঐ নতুন জীবনের এক সুপরিসর দলীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।

পবিত্র কুরআন তো প্রথম থেকেই লিখিত ছিল। কিন্তু মহানবীর (সা) হাদীস দীর্ঘকাল ব্যাপী অলিখিত থাকে তবে লোকেরা এগুলোকে বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য বর্ণনা বলে জানতো। হাদীসকে ব্যাপকভাবে লিখে রাখতে কেউ সাহসই করেনি। হযরত আবু সাঈদ (রা) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “কুরআন ছাড়া আমার কোন কথা লিখো না, যদি লিখে থাক হবে তা নিশ্চিহ্ন করে দাও ”- এই উক্তির কারণেই কেউ লিপিবদ্ধ করতে সাহস পায়নি।

এই নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। কুরআন নাযিল হবার কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি লিখে রাখলে কুরআনের সাথে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে-এরূপ আশংকা ছিল। শুধুমাত্র এই মিশ্রণ এড়ানোর মহান লক্ষ্য সামনে রেখেই যে এই নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিল এবং তা যে কুরআন নাযিলকালের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল, সে কথা না বললেও চলে।

তথাপি উমার ইবনে আবদুল আযীযের শাসনকালের প্রারম্ভ পর্যন্ত ব্যপকভাবে হাদীস প্রনয়নের কাজে হাত দেয়া হয়নি। ৯৯ হিজরী সন থেকে ১০১ হিজরী সন পর্যন্ত তিনি খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। কথিত আছে যে, তিনি হাদীস প্রণয়নের কাজে হাত দেবেন কিনা তা নিয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ইস্তিখারা করেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর তরফ থেকে হাত দেয়া কর্তব্য বলে আভাস পান। ফলে তিনি আবু বাকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে উমার ইবনে হাযামকে হাদীস  সংকলনের কাজে নিয়োজিত করেন। আবু বাকর ছিলেন মদীনার গভর্নর ও বিচারক। তিনি ১২০ হি: সন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যেসব হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল, তা তিনি একটি পুস্তকের আকারে লিপিবদ্ধ করে পর্যালোচনার জন্য বিভিন্ন শহরে পাঠান। উমার ইবনে আবদুল আযীয মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব আযযুহরীকেও হাদীস সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি একখানা হাদীস গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।

এরপর থেকে মুসলমানগণ হাদীস সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখেন। তবে সে কাজ কোন বিশেষ বিন্যাস পদ্ধতির অনুস্ারী ছিল না যিনি যেভাবে পরতেন সংগ্রহ করতেন। কেউ বা শরীয়াতের বিধানের কোন বিশেষ পরিচ্ছেদের অধীন একখানা পুস্তকের আকারে লিপিদ্ধ করতেন। এরপর এই পুস্তক প্রণয়নের ধারা এগিয়ে চলে। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, অনেকে হাদীস গ্রস্থের পরিচ্ছেদ বিন্যাস করেছেন এবং সেইসব গ্রন্থ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বৃত্তান্তকে আলাদা করেছেন। এই পর্যায়ে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, ধাত্রীগৃহে তাঁর লালন পালন এবং নবুওয়াতপূর্ব অন্যান্য ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর কৃরাইশদেরকে আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বান জানানো এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁর ও তাঁর সহচরবৃন্দের ওপর পরিচালিত যুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণের ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেইসাথে যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনাবলী সংক্রান্ত হাদীসগুলোরও সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

ঐতিহাসিকগণ অনুসরণ করেছেন ভিন্নতর পন্থা। তাঁরা ইতিহাস বিষয় নিয়ে ব্যাপক গ্রন্থরাজি রচনা করেছন। এর মাধ্যমে তাঁদের ইসলামী ভাবাবেগই প্রতিফলিত হয়েছে- যার কারণে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বে মুসলমানদের জন্য সন্দেহাতীতভাবে অনুকরণীয় আদর্শ ও হিদায়াত প্রাপ্তির উৎসের সন্ধান পেয়েছেন।

 

সীরাত গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী মুসলিম ঐতিহাসকগণ

সীরাত গ্রন্থের প্রথম রচয়িতা ছিলেন উরওয়াহ ইবনুয্ যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম (৯২হি:), আব্বান ইবনে উস্মান (১০৫হি:), ওয়াহ্াব ইবনে মুনাববিহ (১১০ হি:), শুরাহবীল ইবনে সা’দ (১২৩হি:),ইবনে শিহাব আয্যুহরী (১২৪ হি:) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র ইবনে হাযাম (১৩৫ হি:)। এদের রচিত গ্রন্থাবলীর প্রায় সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু অংশ বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। তাবাবীর ইতিহাসের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আর ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহর গ্রন্থের একটি অংশ বর্তমানে জার্মানীর হাইডেলবার্গ নগরীতে সংরক্ষিত আছে।

এঁদের পরে ইতিহাস ও সীরাত গ্রস্থের রচয়িতাদের আর একটি দল আবির্ভূত হন।তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ হলেন মূসা ইবনে উকবাহ (১৪১ হি:), মুয়াম্মার ইবনে রাশেদ (১৫০ হি:) ও মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (১৫২ হি:)। এদের পরবর্তী দলের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গ হলেন, যিয়াদ আল বুকায়ী (১৮৩ হি:), ওয়াকেদী যিনি মাগাযী (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের ইতিহাস) গ্রন্থের রচয়িতা (২০৭ হি:), ইবনে হিশাম (২১৮ হি:) এবং বিখ্যাত তাবাকাত প্রণেতা ইবনে সা’দ (২৩০ হি:)।

সীরাতে ইবনে ইসহাক

উল্লিখিত সীরাত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, সর্বাধিক প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে উন্নতমানের গ্রন্থ হলো সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক। [১. “মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের আযাদকৃত দাস। তাঁর দাদা ইয়াসার কুফার পশ্চিমে বারিয়ার দিকে অবস্থিত শহর আইনুত তামারের অন্যতম যুদ্ধবন্দী ছিলেন। হযরত আবু বাক্রের খিলাফতকালে ১২ হিজরী সনে এই শহর মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হলে ইয়াসারকে মদীনায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে ৮৫ হজিরী সনে তাঁর পৌত্র মুহাম্মাদ জন্মগ্রহণ করেন। মদীনাতেই তিনি যৌবন কাটান। অত:পর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ভ্রমণে বের হন। ১১৫ হিজরী সনে তিনি ইস্কান্দারিয়া গমন করেন এবং মিসরীয় একদল হাদীসবেত্তার নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ ও বর্ণনা করেন। এরপর তিনি আলজাজিরা, কুফা, রাই, বুহায়রা ও সর্বশেষে বাগদাদ সফর করেন। এখানেই ১৫২ হিজরী সনে তাঁর ইনতিকাল হয়। প্রখ্যাত মনীষী ইবনে আদী তাঁর সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে,“সমসাময়িক বাদশাহদেরকে আজেবাজে পুস্তকাদি প্রণয়নের কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সশস্ত্র সংগ্রাম, তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তি ও বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস রচনার কাজে আত্ননিয়োগ করতে উদ্বুদ্দ করা যদি ইবনে ইসহাকের একমাত্র কৃতিত্বও হতো, তথাপি এ কৃতিত্বে তিনিই অগ্রণী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হতেন।”] এ গ্রন্থ তিনি রচনা করেন আব্বাসী শাসনামলের গোড়ার দিকে। বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার বাগদাদে আব্বাসী শাসক মানসূরের দরবারে প্রবেশ করেন। মানসূরের সামনেই তাঁর পুত্র মাহদী উপবিষ্ট ছিলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি জানো ইনি কে?” ইবনে ইসহাক বললেন, “হাঁ, আমীরুল মুমিনীনের (মানসূর) ছেলে”। তখন মানসূর বললেন, “যাও, ওর জন্য এমন একখানা গ্রন্থ রচনা কর, যাতে আদমের (আ) সৃষ্টি থেকে শুরু কের আজকের দিন পর্যন্ত যবাতীয় ঘটনাবলীর বর্ণনা থাকবে”। তখন ইবনে ইসহাক চলে গেলেন এবং কিছুকালের মধ্যে উক্ত গ্রন্থ রচনা করে মানসূরের নিকট উপস্থপন করলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি গ্রন্থকে অতি মাত্রায় দীর্ঘ করে ফেলেছো। এখন গ্রন্থখানি সংক্ষিপ্ত করে লিখ”। এরপর ঐ বিশাল গ্রন্থখানি খলীফার কোষাগারে রেখে দেয়া হলো।

সীরাতে ইবনে হিশাম

ইবনে ইসহাকের পর আসেন ইবনে হিশাম। [২.আবু মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব আল হিমইয়ারী। জন্মস্থান বসরা। পরে তিনি মিশরে গমন করেন এবং ইমাম শাফেয়ীর সাথে মিলিত হন। এরপর উভয়ে প্রচুর আরব কাব্যচর্চা করেন। সীরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষিপ্ত সংকলন ছাড়াও ইবনে হিশাম হিমইয়ার গোত্রের রাজন্যবর্গ ও বংশাবলী সম্পর্কেও একখানি গ্রন্থরচনা করেন। তাছাড়া সীরাত সম্পর্কিত দুর্লভ কবিতাসমূহের ব্যাখ্যা করে আরো একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। ২১৮ হিজরীসনে ফুসতাত নগরীতে তিনি ইনতিকাল করেন।]তিনি আমাদের জন্য এই সীরাত গ্রন্থকে সংক্ষিপ্ত করে পেশ করেন। এ কাজ তিনি সম্পন্ন করেন ইবনে ইসহাক কর্তৃক মূল গ্রন্থ রচনার প্রায় অর্থ শতাব্দী পরে। ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের এই সংক্ষিপ্ত সার রচনায় তিনি যিয়াদ আল বুকায়ী নামক মাত্র এক ব্যক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেন।[৩.হাফেজ আবু মুহাম্মাদ যিয়াদ ইবনে আবদুল মালেক ইবনে আত্তুফাইল আল বুকায়ী আল আমেরী আল কুফী। বনী আমের ইবনে ছা’ছায়ার শাখা বনীল  বুকা থেকে উদ্ভূত বলে তিনি বুকায়ী নামে পরিচিত। তিনি বাগদাদ আগমন করেন এবং সেখানে ইবনে ইসহাক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক অভিযানসমূহের ইতিবৃত্ত এবং মুহাম্মাদ ইবনে সালেম থেকে শরীয়াতের বিধান শিক্ষা ও প্রচার করেন। অত:পর কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেখাসে খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে ১৮৩ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন। ইবনে হিশাম যে তাঁর এই উস্তাদের যথাযথ কদর করতেন, গ্রন্থের শুরুতে উল্লিখিত এই কথা কয়টি তারই প্রমাণ বহন করছে, “আমি সেইসব বিষয় বাদ দিযেছি যার বর্ণনা অনেকের কাছে অপ্রীতিকর লাগবে অথবা যা বুকায়ী নিজের বর্ণনা দ্বারা আমাদের কাছে প্রামাণ্য বলে সাব্যস্ত করেননি।”] ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত ইবনে ইসহাকের মূল গ্রন্থখানি আজকের এই গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুকে অত্যধিক সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত আকারে পেশ করেন। কোন কোন জায়গায় কিছু সংযোজন ও সমালোচনা ও এর অঙ্গীভূত করেন। আবার কখনো অন্যান্য মনীষীর বর্ণনার সাথে ইবনে ইসহাকের বর্ণনার তুলনা বা যাচাই বাছাইও করেছেন। ঐ গ্রন্থের সংকলনে তাঁর অনুসৃত পদ্ধতির কিছু বর্ণনা তিনি গ্রন্থের শুরুতেই দিয়েছেন। এতদসত্তেও আমরা এব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করি না যে, ইবনে হিশাম জূর্ণ সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সাথে ইবনে ইসহাকের গ্রন্থ সংকলন করেছেন। তাথেকে তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি। আর যেখানেই ইবনে ইসহাকের বর্ণনার ত্রুটি তুলে ধরা, কিংবা কোন দুর্বোধ্য বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া অথবা কোন বর্ণনার বিরেধী অন্য কোন বর্ণনা পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন, সেখানে ‘ইবনে হিশাম বলেন’ উক্তি দ্বারা তা  শুরু করেছেন।

সংক্ষেপকরণই মূলত: তাঁর সীরাত গ্রন্থ সংকলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য তিনি সৃষ্টির আদিকাল থেকে শুরু করে হযরত ইসমাঈলের বংশধরদের ইতিহাস এবং অন্যান্য যেসব কাহিনীর সাথে সীরাতের কোন সম্পর্কই তিনি দেখতে পাননি, তাও বাদ দিয়েছেনে। আর সেইসব কবিতাও তিনি এর অন্তর্ভুক্ত করেননি, যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন।

যিনি ইবনে হিশামের সংকলন থেকে মূল সীরাত গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুর সন্ধান লাভ করতে চেষ্টা করবেন, তিনি তাতে চরম নিষ্ঠ ও পরম বিশ্বস্ততার পরিচয়ই লাভ করবেন- যা সেই প্রচীন যুগের মুসলিম মনীষীদের বৈশিষ্ট্য ছিল।

সীরাতে ইবনে হিশামের মর্যাদা

মূলত: ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থই সীরাত পাঠকদের জন্য প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রধান প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাসে বুৎপত্তিসম্পন্ন খুব কম লোকই এমন ছিলেন যাঁরা ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থ’কে ঐ বিয়য়ের প্রধান পথ-প্রদর্শকরূপে গ্রহণ করেননি। এ সীরাতে ইবনে ইসহাকই প্রাচীনকাল থেকে “সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে জ্ঞানীজনের কাছে পরিচিত। কেননা ইবনে হিশাম এই গ্রন্থের সংকলক ও সংক্ষেপক ছিলেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন,“ইবনে হিশামই ইবনে ইসহাকের সংগৃহীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক ও সাধারণ জীবনেতিহাসসহ গোটা জীবনেতিহাসকে একত্রিত, সংকলিত ও সংক্ষিপ্ত করেছেন।এটাই বর্তমানে সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পাঠক সমাজের হাতে শোভা পাচ্ছ।”

বেশ কিছুসংখ্যক টীকাকার ও ব্যাখ্যাকার সীরাতে ইবনে হিশামের টীকা লিখতে এগিয়ে এসেছিলেন। তন্মধ্যে আবুল কাসেম আবদুর রহমান  আস্ সুহাইলীর (৫৮১ হি:) “আর রাউদুল আনফ” নামক টীকাটি খুবই বিস্তারিত ও দীর্ঘ পরিসর।[৪.আবুল কাশেম আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে আলখুসায়মী আস-সুহাইলী আল আন্দালুসী আল মালকী। সুহাইল স্পেনের কোরা এলাকার অস্তর্গত একটি উপত্যকার সাম। তিনি ৫০৮ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ কর্নে এবং সেখানেই বসবাস করেত থাকেন। পরে মরক্কোতেও তিন বছর অতিবাহিত করেন এবং সেখানে ৫৮১ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন।] এরপরে যিনি এই গ্রন্থের পর্যলোচনায় মনোযোগী হন, তিনি হলেন আবু যার আল খুশানী।[৫. আবু যার মুসআব ্ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মাসউদ আল জিয়ানী আল খুশানী। স্পেনের খুশাইন নামক গ্রামে এবং কাদায়ার খুশাইন গোত্রের নামানুসারে তিনি খুশানী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি হিজরী ৫৩৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬০৪ সনে ইনতিকাল করেন।] তিনি এই দুর্বোধ্য অংশগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং তার গ্রন্থ ‘র্শাহ সীরাতুন্ নববীয়া’য় কিছু কিছু সমালোচনাও করেন। আর ডক্টর ব্রুনলাহ গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। বদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আইনী“কাশফুল লিসান ফী শারহে সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে এর ব্যাখ্যা প্রণয়ন সম্পন্ন করেন ৮০৫ হিজরী সনে।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু গ্রন্থাকার এই গ্রস্থের সংক্ষেপকরণের দিকেও মনোযোগী হয়েছেন। তাদের একজন হলেন বুরহানুদ্দীন ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ আল মুরহাল আশ্শাফেয়ী। ‘আযযাখীরা ফী মুখ্তাছারিস্ সীরাহ্” নামে আঠারটি অধ্যায়ে গ্রথিত এই গ্রস্থে তিনি সীরাতে ইবনে হিশামকে শুধু সংক্ষিপ্তই করেননি, বরং কিছু বিষয়ের সংযোজনও করেছেন।৬৬১ হিজরী সনে তিনি এই গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। অত:পর ৭১১ হিজরী সনে আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে ইবরাহীম  ইবনে আবদুর রহমান আলওয়াসেতী “মুখতাছার সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে আর একটি সংক্ষেপিত গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন।এমনকি কতিপয় গ্রন্থাকার সীরাতে ইবনে হিশামকে কাব্যাকারেও সংকলন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন (১) আবু মুহাম্মাদ আবদুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সাইদ আদ দুমাইরী আদ দাইরিনী, ওফাত ৬০৭ হিজরী, (২)আবু নছর আল ফাতাহ বিন মূসা বিন মুহাম্মাদ আল মাগরিবী, ওফাত ৭৯৩ হিজরী। শেষোক্ত গ্রন্থাকারের রচিত গ্রস্থের নাম “আল ফাতহুল কারীব ফী সীরাতিল হাবীব।” গ্রন্থখানি দশ হাজার পংক্তিতে সংকলিত হয়।

সীরাতে ইবনে হিশামের বক্ষ্যমাণ সংক্ষিপ্ত রূপ

যৌবনের প্রারম্ভে আমি এই গ্রন্থখানা আগাগোড়া পড়বার জন্য বার বার চেষ্টা করতাম কিন্তু এর রচনা পদ্ধতির বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা ঘোর মানসিক পীড়া ও একঘেঁয়েমী সৃষ্টি করতে। ফলে খানিকটা এখান থেকে খানিকটা ওখান থেকে পড়তাম। ভাষার মাধুর্য ও লালিত্য এবং বিষয়বস্তুর মাহাত্ন্যই আমাকে এইসব বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পড়তে আকৃষ্ট করতো। ঐ অংশগুলো আমার কাছে ঊষর মরুভূমিতে পুষ্পকাননের মত উপভোগ্য মনে হতো।

আসলে কুরআন-হাদীস পড়লে মনে যে নিখাদ বন্দেগীর ভাব জাগে ও ঐকান্তিক আনুগত্যবোধ অনুভূত হয় সীরাত বিষয়ক বই-পুস্তক পড়লে আমি ঠিক তেমনি ধরনের অসুভূতি লাভ করতাম। মনে হয়, কি এক অজানা রহস্যের দুর্বার আকর্ষণে আমি বার বার ওটা পড়তে চাইতাম। আমার মরহুম পিতাও সীরাত বিষয়ের একজন গ্রন্থাকার ছিলেন। “তালখিছুদ দুরুসিল আওয়ালিয়াহ ফিস সীরাতিল মুহাম্মাদিয়া” নামে তিনি ত্রিশটি অধ্যায়ে সমাপ্ত একখানা সংক্ষিপ্ত রচনা করেন। দীর্ঘদিন ব্যাপী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওটাই ছিাল একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। বলা বাহুল্য,তৎকালে সীরাত ছিল বিদ্যালয়গুলোর অন্যতম পাঠ্য বিষয়।

এতদসত্বেও সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থখানি আমি আগাগোড়া পড়তে সক্ষম হইনি। আগেই বলেছি যে, রচনা পদ্ধতির বিন্যস্ততার অভাব এবং অসংলগ্ন ও খাপছাড়া বর্ণনা রীতিই এর কারণ। সেখানে একজন সীরাত পাঠকের সমনে হঠাৎ করে  এসে গতিরোধ করে দাঁড়ায় বদরের সকল যুদ্ধবন্দীর নাম, বদরের মুসলিম বাহিনীর ব্যবহৃত সমস্ত ঘোড়ার নাম, আনসার ও কুরাইশদের মধ্য থেকে যেসব মুসলিম সৈনিক বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যারা শহীদ হন এবং  মুশরিকদের মধ্যে যাঁরা নিহত হয় তাদের সকলের নামের সুদীর্ঘ ফিরিস্তি। অনুরূপভাবে বদর যুদ্ধে যেসব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছে, পূর্ব-পুরুষের মহিমা কীর্তনমূলক যেসব সংলাপ উচ্চারিত হয়েছে, বংশ পরম্পরা উল্লেখ করে যেসব ভাষণ দেয়া হয়েছে, নিছক শব্দের মায়াজাল বুনে যে লম্বা বুলি আওড়ানো হয়েছে এবং সীরাতের মূল বিষয়ের সাথে সংগতিহীনÑ যদিও তার কাছাকাছি কুরআনের যেসব ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়েছে এর অধিকাংশ সীরাত গ্রন্থে’র প্রচলিত রীতি মুতাবিক বর্ণনা পরম্পরা তথা সনদের উল্লেখ যার গুরুত্ব একমাত্র সমালোচক পন্ডিতদের কাছেই স্বীকৃত, এসব জিনিস পাঠকের সীরাত অধ্যায়নে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়।

এজন্য আমি বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, অধ্যয়নের দারাবাহিকতা বিনষ্ট না করার ব্যবস্থা সম্বলিত ও নবতর আঙ্গিকে শোভিত করে সীরাতের এই নির্যাসটুকু ইপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। অবশ্য মূল গ্রন্থের আসল বক্তব্য যাতে অবিকৃত থাকে, সে ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেষ্ট থেকেছি, যাতে করে পাঠক তা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারেন ও আসল গ্রন্থ থেকে প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। মূল গ্রন্থের একটি বর্ণও আমি পরিবর্তন করিনি। কেননা গ্রন্থকারের বক্তব্য অবিকলভাবে উপস্থাপন করা যে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা আমি সব সময় মনে রেখেছি। ইবনে হিশামের কথা যথাযথভাবে উদ্ধৃত করা ও সেজন্য কথার শুরুতেই ‘ইবনে হিশাম বলেছেন’ বলে উল্লেখ করার রীতি আমি গ্রহণ করেছি ও তা অব্যাহতভাবে অনুসরণ করেছি। সংকলনের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারেই যেখানে যেমন করা দরকার করেছি। বাদ বাকী সমস্ত ইবনে ইসহাকের বক্তব্য, যা ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যোখানে প্রয়োজন হয়েছে, কেবলমাত্র সেখানে ব্যতীত আর কোথাও আমি বর্ণনাদাতাদের নাম উল্লেখ করিনি, যদিও মূল গ্রন্থে ইবনে ইসহাক অথবা ইবনে হিশাম প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ইবনে হিশামের সমস্ত উদ্ধৃতিতে আমি শৃঙ্খলার সাথে বিন্যস্ত করার প্রতি যত্নবান থেকেছি, প্রয়োজনবোধে তার কোন কোনটার ব্যাখ্য-বিশ্লেষন করেছি। এ ক্ষেত্রে সীরাত বিশ্লেষকদের বর্ণনা এর্ব বিশ্বস্ত হাদীস গ্রন্থ ও অভিধানের উপর আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে।

যার মূল গ্রন্থ অধ্যয়নের সুযোগ থেকে বঞ্জিত, বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত সংকলন তাদের পক্ষে ঐ গ্রন্থ পাঠের একটা সহজ পন্থাবিশেষ। এতে করে বর্তমান তরুণ সমাজের সাথে তাদের প্রাচীন ও সুমহান উতরাধিকারের সুষ্ঠু সংযোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে।

পাঠকগণ এই গ্রন্থ মাত্র কয়েকদিনেই পড়ে শেষ করতে পারেন এবং তা থেকে দ্রুততার সাথে মূল্যবান ও কল্যাণকর জ্ঞানার্জনে সক্ষম হতে পারেন। কিন্তু এর স্থলে তাকে যদি মূল গ্রন্থ পাঠ করতে হতো যা বর্তমানে পাঠক মাত্রেরই নাগালের বাইরে তাহলে তাতে তার বহু মাস লেগে যেতো।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই গ্রন্থ দ্বারা সমাজকে উপকৃত করেন। জ্ঞানের রাজ্যে আমার এই ক্ষুদ্র ও নগণ্য প্রচেষ্টা সার্থক হলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টিই আমার এ প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য।

আব্দুস সালাম হারূন

মিসরুল জাদীদাহ্

মধ্য রমজান

১৩৭৪ হিজরী

 

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আদম আলাইহিস্ সালাম পর্যন্ত ঊর্ধতন বংশপরম্পরা

আবু মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম বলেন:

এই গ্রন্থখানিতে আল্লাহর রাসূল হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী আলোচিত হয়েছে। তাঁর উর্ধতন বংশপরম্পরা নিম্নরূপ:

পিতা আবদুল্লাহ, তদীয় পিতা আবদুল মুত্তালিব (আবদুল মুত্তালিবের প্রকৃত নাম শায়বা), তদীয় পিতা হাশিম (হাশিমের প্রকৃত নাম আমর), তদীয় পিতা আবদে মানাফ (আবদে মানাফের প্রকৃত নাম আল মুগীরা) তদীয় পিতা কুসাই (কুসাই-এর প্রকৃত নাম যায়েদ), তদীয় পিতা কিলাব, তদীয় পিতা মুররাহ, তদীয় পিতা কা’ব, তদীয় পিতা লুয়াই, তদীয় পিতা গালেব,  তদীয় পিতা ফিহির, তদীয় পিতা মালেক, তদীয় পিতা নাদার, তদীয় পিতা কিনান, তদীয় পিতা খুযাইমা, তদীয় পিতা মুদরিকা (মুদরিকার প্রকৃত নাম আমের), তদীয় পিতা ইলিয়াস, তদীয় পিতা মুদার, তদীয় পিতা নিযার, তদীয় পিতা মা’আদ, তদীয় পিতা আদনান, তদীয় পিতা  উদ্, তদীয় পিতা  মুকাওয়াম, তদীয় পিতা নাহুর, তদীয় হিতা তাইরাহ্, তদীয় পিতা ইয়’রুব, তদীয় পিতা ইয়াশজুব, তদীয় পিতা নাবেত, তদীয় পিতা ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা তারেহ (তারেহের অপর নাম আযর), তদীয় পিতা নাহুর, তদীয় পিতা সারীগ, তদীয় পিতা রাউ, তদীয় পিতা ফালেখ, তদীয় পিতা উবায়ের, তদীয় পিতা শালেখ, তদীয় পিতা আরফাখশাদ, তদীয় পিতা সাম, তদীয় পিতা নূহ (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা লামক, তদীয় পিতা মুত্তাওশালাখ, তদীয় পিতা আখ্নুখ (ঐতিহাসিকদের ধারণা, তিনি হযরত ইদ্রিস আলাইহিস্ সালাম), তদীয় পিতা ইয়ারদ, তদীয় পিতা মাহলীল, তদীয় পিতা কাইনান, তদীয় পিতা  ইয়নিশ, তদীয় পিতা শীস, তদীয় পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম।

ইবনে হিশাম বলেন,

“ইনশাআল্লাহ এই গ্রন্থ আমি হযরত ইবরাহীমের পুত্র ইসমাঈলের বিবরণ দিয়েই শুরু করবো। অত:পর ইসমাঈলের (আ) ঔরসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব পিতৃপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন এবং যাঁরা সেই সব পিতৃপুরুষের ঔরষজাত সন্তান ছিলেন, পর্যয়ক্রমে তাঁদের বর্ণনা দেব। এভাবে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পর্যন্ত সমস্ত পিতৃপুরুষ ও তাঁদের সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীসমূহ আলোচনা করবো। কিন্তু ইসমাঈলের (আ) যেসব সন্তান হযরত মুহাম্মাদের (সা) পিতৃপুরুষ নন, গ্রন্থের কলেবর সংক্ষিপ্ত ও শুধুমাত্র সীরাত বিয়য়ক বক্তব্যের মধ্যে সীমিত রাখার তাকিদে আমি তাঁদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করবো না। একই ভাবে, গ্রন্থের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে ইবনে ইসহাকের কিছু কিছু বর্ণনা বাদ দেবো যা তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ইবনে ইসহাকের ঐসব বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন উল্লেখ নেই, সে সম্পর্কে কুরআনেও কোন কথা নাযিল হয়নি, কিংবা তা এই গ্রন্থের কোন বক্তব্যের উপলক্ষ, ব্যাখ্যা বা দলীল প্রমাণেরও পর্যায়ে পড়ে না। ইবনে ইসহাকের উল্লেখ করা এমন কিছু কবিতাও আমি বর্জন করেছি, যা কবিতায় পারদর্শীদের কাছে অজ্ঞাত বলে লক্ষ করেছি। এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের কিছু কিছু অরুচিকর ও গণমনে অসন্তোষ উৎপাদনকারী উক্তি এবং বুকায়ী কর্তৃক সমর্থিত নয়, এমন কিছু বিষয়ও আমাকে বাদ দিতে হয়েছে। এ কয়টি জিনিস ছাড়া ইবনে ইসহাকের বাদবাকী সমস্ত তথ্য যতটা বর্ণিত ও স্বীকৃত, ততটা ইনশাআল্লাহ পুরোপুরিভাবে উল্লেখ করবো।”

ইসমাঈল আলাইহিস্ সালামের অধস্তন পুরুষদের বংশক্রম

ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ঔরসে ১২ জন পুরুষ সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন: নাবেত, কাইযার, আযরাল, মীশ, মাসমা’, মাশী, দাম, আযর, তীম, ইয়াতুর, নাবাশ ও কাইয়ুম।

নাবেতের ঔরসে ইয়াসজুব, ইয়াসজুবের ঐরসে ইয়া’রুব, ইয়া’রুবের ঔরসে উদ এবং উদের ঔরসে আদনান জন্মগ্রহণ করেন।

আনদানের পর থেকে ইসমাঈলের বংশধরগণ গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আদনানের দু’টি পুত্রসন্তান ছিল : মাআদ ও আক।

আক ইবনে আদনান চলে যান ইয়ামানে এবং সেখানেই তাঁর বংশধররা স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। আক সেখানকার বনু আশয়ার গোত্রে বিয়ে করেন এবং তাদের সাথেই বসবাস করতে থাকেন, ফলে তাদের দেশ ও ভাষা উভয়ই এক হয়ে যায়। বনু আশয়ার গোত্রের ঊর্ধতন পুরুষরা হলো : আশয়ার, তদীয় পিতা নাবাত, তদীয় পিতা উদ, তদীয় পিতা হামাইসা, তদীয় পিতা আমর, তদীয় পিতা উরাইব, তদীয় পিতা ইয়াশজুব, তদীয় পিতা যায়েদ, তদীয় পিতা কাহলান, তদীয় পিতা ইয়াশযুব, তদীয় পিতা ইয়ারুব ও তদীয় পিতা কাহতান।

আদনানের অপর পুত্র মাআদ ইবনে আদনানের চারটি সন্তান জন্মে : নিযার, কুদাআ, কানাস ও ইয়াদ। কুদাইর বংশধর হিমইয়ার ইবনে সাবা পর্যন্ত বেঁচে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে। কিন্তু মাআদ সংক্রান্ত বংশধর বিশেষজ্ঞের মতে, কানাস বিন মাআদের বাদবাকী বংশধর নিশ্চিহ্ন হযে যায়। তবে হিরার বাদশাহ নুমান ইবনে মুনযির তাদেরই বংশধর।

রাবিয়া ইবনে নসরের স্বপ্ন

রাজাদের মধ্যে ইয়ামানের রাবিয়া ইবনে নসর একজন দুর্বল পরাধীন রাজা ছিলেন।একবার তিনি একটা ভয়ংকর সপ্ন দেভে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যান। তাঁর রাজ্যে যত গণক, যাদুকর, আয়েফ [৬. তৎকালে এক ধরনের গণক ছিল যারা পখির ডাক, গতিবিধি ইত্যাদি দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করতো। তাদেরকে বলা হতো আয়েফ।]

বা জ্যোতিষী ছিল তাদের সবাইকে তিনি সমবেত করে বলেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তোমরা আমাকে বলবে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি এবং তার ত’বীরই বা কি?” সমবেত জ্যোতিষীরা বললো, “সপ্নটা আমাদের কাছে বর্ণনা করুন। আমরা তার তাবীর বলবো।” রাজা বললেন, “স্বপ্নটা যদি আমি বলে দিই তাহলে তোমাদের তাবীরে আমি স্বস্তি বা প্রশান্তি লাভ করতে পারবো না। কেননা এই স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা একমাত্র সে-ই করতে সক্ষম যে আমার বলার আগেই স্বপ্ন সম্পর্কেও বলতে সক্ষম।” জ্যোতিষীদের একজন বললো, ‘জাঁহাপনা, যদি এইভাবে স্বপ্নের তা’বীর জানতে চান তাহলে সাতীহ ও শেক্কে ডেকে পাঠান। কারণ তাদের চেয়ে পারদর্শী আর কেউ রনই। আপনি যা জানতে চান তা তারাই বলতে পারবে।”

রাজা ঐ দ’জন ভবিষ্যদ্বক্তাকে ডেকে পাঠালেন। প্রথমে রাজার দরবারে হাজির হলো সাতীহ। রাজা তাকে বললেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তুমি বল আমি কি স্বপ্ন দেখেছি? তুমি যদি স্বপ্নটা সঠিকভাবে বলতে পার তাহলে তার ব্যাখ্যাও সঠিকভাবে করতে পারবে।”

সাতীহ বললো, “বেশ, আমি তাই করবো। আপনি স্বপ্নে দেখেছেন, অন্ধকারের ভেতর থেকে এক টুকরো আগুন বেরিয়ে এসে নিম্নভূমিতে নামলো এবং সেখানে যত প্রাণী ছিল, সবাইকে গ্রাস করলো।”

রাজা বললেন, ‘বাহ্! স্বপ্নটা তো তুমি সঠিকভাবেই বলে দিয়েছ। এখন বলতো এর তাৎপর্য কি?”

সে বললো, “দুই প্রস্তরময় দেশে বিরাজমান সমস্ত সাপের শপথ করে বলছি, আবিসিনিয়াবাসী আপনার ভূখন্ডে প্রবেশ করবে এবং সমগ্র ইয়ামান দখল করে নেবে।”রাজা বললেন, “হে সাতীহ, এটাতো ভীষণ বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার।

এটা কবে ঘটবে? আমার আমলেই, না আমার পরে।?”

সে বললো, “আপনার আমলের কিছু পরে, ষাট বা সত্তর বছরের বেশী অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।” রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “এই ভূখন্ঠ কি চিরকালই তাদের অধিকারে থাকবে, না তাদের জবরদখলের অবসান ঘটবে?” সে বললো, “৭০ বছরের কিছু বেশীকাল উত্তীর্ণ হবার পর তাদের দখলের অবসান ঘটবে? তারপর তারা হয় নিহত হবে নয়তে পালিয়ে যাবে। রাজা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “তাদেরকে কে হত্যা বা বহিষ্কার করবে?” সাতীহ বললো, “তারা নিহত বা বহিষ্কৃত হবে ইরাম ইবনে যীইয়াযানের হাতে। তিনি এডেন থেকে আবির্ভূত হবেন এবং ইয়ামানে তাদের একজনকেও অবশিষ্ট রাখবেন না।”

রাজা বললেন,“ইরামের আধিপত্য কি চিরস্থায়ী হবে না অস্থায়ী?”

সাতীহ বললো, “তাদের আধিপত্য অস্থায়ী হবে।”

রাজা বললেন, ’‘কার হাতে ক্ষমতার অবসান ঘটবে।?”

সাতীহ বললো,“এক পূত:পবিত্র নবীর হাতে। তিনি ঊর্ধজগত থেকে ওহী লাভ করবেন।”

রাজা বললেন, “এ নী কোন বংশোদ্ভূত?”

সাতীহ বললো,“তিনি নাদারের পুত্র মালেকের পুত্র ফিহির, ফিহিরের পুত্র গালেবের বংশ থেকে উদ্ভূত হবেন। তাঁর জাতির তাতে ক্ষমতা থাকবে বিশ্বজগতের বিলুপ্তি ঘটার মুহূর্ত পর্যন্ত।”

রাজা  বললেন, “বিশ্বজগতের আবার শেষ আছে নাকি?”

সে বললো,“হ্যাঁ, যেদিন পৃথিবীর প্রথম মানবগন ও শেষ মানবগণ একত্রিত হবে। যারা সৎকর্মশীল তারা সুখী হবে, আর যারা অসৎকর্মশীল তারা দুঃখ ভোগ করবে।”

রাজা বললেন,“তোমার ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্য?”

সে বললো, “হ্যাঁ, রাতের অন্ধকার ও ঊষার আলোর শপথ, সুবিন্যস্ত প্রভাতের শপথ, আমি যা বলেছি তা পুরোপুরি সত্য।”

এরপর শেক এসে পৌঁছলো রাজার দরবারে। সাহীহকে রাজা যা যা বলেছিলেন শেককেও তাই বললেন। কিন্তু সাতীহ যা বলেছে তা তাকে জানতে দিলেন না- তারা উভয়ে একই ধরনের ভবিস্যদ্বাণী করে, না ভিন্ন রকমের, তা দেখবার জন্য তিনি ব্যাপারটা গোপন করলেন।

শেক বললো, “আপনি স্বপ্নে দেখেছেনে, অন্ধকার থেকে এবটি অগ্নিশিখা বেরিয়ে এলো। সেটা একটা পর্বত ও একটা বাগানের মাঝখানে পতিত হলো। অতঃপর সেখানকার সকল প্রণীকে গ্রাস করলো।”

রাজা বুঝতে পারলেন যে, উভয়ের বক্তব্য অভিন্ন। শুধু এতটুকু পার্থক্য যে সাতীহ বলেছিল, টুকরোটা নিম্নভূমিতে নামলো। আর শেক বলেছে, একটি পর্বত ও একটি বাগানের মাঝখানে নামলো। অতঃপর তিনি শেককে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। এবার বল এর তাবীর কি?”

সে বললো,“ দুই পর্বতাকীর্ণ দেশের সমস্ত মানুষের শপথ করে বলছি, আপনার দেশে সুদানীরা আক্রমণ চালাবে এবং সব দুর্বল লোক তাদের অঙ্গুলী হেলনে চলতে বাধ্য হবে। তারা আবইয়ান থেকে নাজরান পর্বত সমগ্র ভূখ-ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।”

রাজা বললেন, “এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার। এ ঘটনা কবে ঘটবে? আমার জীবদ্দশাতেই, না আরো পরে?”

সে বললো, “আপনার পরে বেশ কিছুকাল অতিক্রান্ত হবার পর। এরপর একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তি আপনাদেরকে উদ্ধার করবে এবং হানাদারদেরকে ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে বিতাড়িত করবে।”

রাজা বললেন, “এই পরাক্রমশালী ব্যক্তি কে?”

সে বললো, “একজন যুবক, যিনি নগণ্য বা নীচাশয় নয়। যী-ইয়াযানের বাড়ী থেকে তার অভ্যুদয় ঘটবে। তিনে হানাদারদের একজনকেও ইয়ামানে টিকতে দেবেন না।”

রাজা বললেন, “এই ব্যক্তির শাসন কি চিরস্থায়ী হবে না ক্ষণস্থায়ী?”

শেক বললো একজন প্রেরিত রাসূলের আগমনে তার শাসনের অবসান ঘটবে-যিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, ধার্মিক ও সজ্জনদের সমভিব্যাহারে আসবেন, তাঁর জাতির শাসন চলবে কিয়ামত পর্যন্ত।”

রাজা বললেন, “কিয়ামত কি?”

সে বললো,“যেদিন শাসকদের বিচার হবে, আকাশ থেকে আহ্বান আসবে, সে আহ্বান জীবিত ও মৃত সকলেই শুনতে পাবে। আর নির্দিষ্ট সময়ে সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। সেদিন মিতাচারী লোকদের জন্য হবে সাফল্য ও কল্যাণ।”

রাজা বললেন, “তুমি যা বলেছো তা বি সত্য?”

সে বললো,“হ্যাঁ, আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মধ্যকার সকল সমতল ও অসমতল সব কিছুর রবের শপথ করে বলছি, আমি আপনার কাছে যে ভবিষ্যদ্বাণী করলাম তা সঠিক ও সন্দেহাতীত।”

রাবিয়া এই দুই ভবিষ্যদ্বক্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকে প্রয়োজনীয় পাথেয় দিয়ে ইরাক পাঠিয়ে দিলেন। তারপর পারস্যের তৎকালীন সম্রাট শাপুর ইবনে খুরযাদকে চিঠি লিখে পাঠালেন। শাপুর তাদেরকে হিরাতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আবু কারব হাস্্সান ইবনে তুব্বান আস’আদ কর্তৃক ইয়ামান রাজ্য অধিকার এবং ইয়াসরিব আক্রমণ

রাবিয়ার মৃত্যুর পর সমস্ত ইয়ামানের রাজত্ব বলে যায় আবু কারব হাস্সান ইবনে তুব্বান আস’আদের হাতে। তাঁর পিতা তুব্বান আস’আদ আগে থেকেই পূর্ব দিক দিয়ে মদীনায় (ইয়াসরিব) আসতেন এবং এভাবে মদীনাবাসীদেরকে বিব্রত না করেই সুকৌশলে আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন। সেখানে তিনি নিজের এক পুত্রকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। কিন্তু উক্ত পুত্র সহসা গুপ্তঘাতক কর্তৃক নিহত হয়। এরপর তুব্বান মদীনা ধ্বংস ও তার অধিবাসীদেরকে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়ে আবার সেখানে আসেন। অতঃপর আমর বিন তাল্লার নেতৃত্বে লোকদের একটি দল সংঘবদ্ধ হয়। তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর  সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই দলটি এমন ভাব দেখায় যে, তারা যেন দিনের বেলায় তাঁর সাথে যুদ্ধ করে ও রাত্রে আতিথেয়তা করে। তুব্বান তাদের এ আচরণে বিষ্মিত হয়ে বলেন, আশ্চর্য! এ জাতি বাস্তবিক পক্ষেই ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। এভাবে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলো। এমতাবস্থায় একদিন দু’জন ইহুদী পন্ডিত মদীনা ও তার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছ্রা কথা জানতে পেরে তাঁর কাছে আসেন। তারা তাঁকে বললেন,“হে রাজা, এ কাজটি করবেন না আপনি যদি জিদ ধরেন, তাহলেও আপনার সমনে অপ্রতিরোধ্য বাধা আসবে। ফলে আপনি যা চান তা করতে পারবেন না। অথচ আপনি অচিরেই শাস্তি ভোগ করবেন।” রাজা বললেন, “কি আরণে আমি শাস্তি ভোগ করবো?” তারা বললেন, “মদীনা শেষ যামানার নবীর আশ্রয় স্থল। কুরাইশদের দ্বারা তিনি পবিত্র স্থান থেকে বহিস্কৃত হবেন এবং এখানে এসে বসবাস করবেন।”

এ কথা শুনে রাজা নিবৃত্ত হলেন। তাঁর মনে হলো নোক দুটো যথার্থই জ্ঞানী লোক। তাদের কথঅয় রাজা মুগ্ধ হলেন। তিনি মদীনা ত্যাগ করে ঐ পন্ডিতদ্বয়ের ধর্ম গ্রহন করলেন।

তুব্বা তথা তুব্বান আস’আদ ও তাঁর গোত্রর লোকেরা পৌত্তলিক ছিলেন।তিনি ইয়ামানের পথে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উসমান ও আমাজ নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যস্থলে পৌঁছলে হাযাইল ইবনে মুদারাকা গোত্রের কতিপয় লোক তাঁর কাছে বললো,“হে রাজা, আপনি কি এমন এবটি অজানা ঘরের সন্ধান পেতে ইচ্ছুক, যা হীরক, মণিমুক্তা, চুন্নিপান্না প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদে পরিপূর্ণ, অথচ আপনার পূর্ববর্তী রাজারা সে ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল।” রাজা বললেন, “হ্যাঁ, এরকম ঘরের সন্ধান অবশ্যই পেতে চাই।” তারা বললো, ‘মক্কাতে একটি ঘর আছে। মক্কাবাসীরা সেখানে ইবাদাত করে ও তার পাশে নামায পড়ে।”

আসলে বনী হুযাইলের লোকেরা তুব্বানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে েেদয়ার উদ্দেশ্যেই এ পরামর্শ দিয়েছিল। কেননা তারা জানতো, কাবাঘরকে করতলগত করার ইচ্ছে যে রাজাই করেছ এবং তার ওপর আক্রমণ যে-ই চালিয়েছে, সে-ই ধ্বংস হয়েছে।

তুব্বানের ইচ্ছাহলো, বনী হুযাইলের পরামর্শ অনুসারে কাজ করবে। কিন্তু তা করার আগে সেই ইহুদী পন্ডিতদ্বয়ের কাছে দূত পাঠিয়ে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। পন্ডিতদ্বয় বললেন, “আপনাকে ও আপনার সৈন্য সামন্তকে ধ্বংস করাই বনী হুযাইলের ইচ্ছা। পৃথিবীতে আল্লাহর কোন ঘরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নিজের মালিকানায় নিতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। তারা যে পরামর্শ দিয়েছে সে অনুসারে আপনি যদি কাজ করেন তাহলে আপনার ও আপনার সহচরদের সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হতে হবে। এটা অনিবার্য ও অবধারিত।” রাজা বললেন, “তাহলে আমি যখন ঐ ঘরের কাছে যাব তখন আমার কি করা উচিত বলে আপনারা মনে করেন?” তারা বললেন “মক্কাবাসীরা যা করে আপনিও তাই করবেন। ঘরের চারপাশে তাওয়াফ করবেন এবং তার সম্মান ও তাজীম করবেন। তার কাছে থাকাকালে মাথায় চুল কামিয়ে ফেলবেন। যতক্ষণ ঐ ঘরের কাছ থেকে বিদায় না হন ততক্ষণ অত্যন্ত বিনয়াবনত থাকবেন।” রাজা বললেন, “আপনারা এসব করেন না কেন?”তারা বললেন, “খোদার কসম, ওটা আমাদের পিতা ইব্রাহীমের বানানো ঘর। এ ঘর সম্পর্কে আপনাকে আমরা যা যা বলেছি সবই সত্য। তবে ঘরের চারপাশে বহুসংখ্যক মূর্তি স্থাপন করে মক্কাবাসী আমাদের ঐ ঘরের কাছে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ঐ ঘরের কাছে রক্তপাত(নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও) চালু রেখেও তারা আমাদের যাওয়া বন্ধ করেছে। তারা অংশীবাদী ও অপবিত্র।”

তুব্বান ইহুদী আলেমদ্বয়ের উপদেশ মেনে নিলেন এবং তা বাস্তবায়িত করলেন। এরপর হুযাইল গোত্রের সেই লোকদের কাছে গেলেন এবং তাদের হাত পা কেটে দিলেন। অতঃপর মক্কায় গেয়ে পবিত্র কা’বাঘর তাওয়াফ করলেন, তার পাশে পশু জবাই করে কুরবানী আদায় করলেন এবং মাথার চুল কামালেন। এভাবে তিনি ছয়দিন মক্কায় কাটালেন। এ ছয়দিন পশু কুরবানী করে মক্কাবাসীকে খাওয়ানো এবং মধু পান করানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি স্বপ্নে দেখলেন কা’বা শরীফকে তিনি যেন গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করছেন। অতঃপর তিনি খাসফ নামক মোটা কাপড় দিয়ে কা’বায় গিলাফ চড়ালেন।

তিনি আবার স্বপ্ন দেখলেন যে, আরো ভালো কাপড় দিয়ে কা’বাকে গিলাফ পরাচ্ছেন। সুতরাং পরে তিনি মূল্যবান ইয়ামানী কাপড়ে কা’বাকে আবৃত করলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই তুব্বা তথা তুব্বানই প্রথম ব্যক্তি যিনি কা’বা শরীফকে গিলাফ পরিয়েছিলেন এবং কা’বার মুতাওয়াল্লী জুরহুম গোত্রের লোকদেরকে গিলাফ পরানোর অসীয়াত করে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম কা’বা ঘরকে পবিত্র করার (মূর্তি থেকে মুক্ত করা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) নির্দেশ দেন, কা’বার ধারেকাছে যেন তারা রক্তপাত না ঘটায়, মৃতদেহ এবং ঋতুবর্তী মহিলাদের ব্যবহৃত ময়লা বস্ত্রখ- ফেলে না রাখে-এসব ব্যাপারে তিনি সবাইকে সাবধান করে দেন। তিনি কা’বা ঘরের জন্য দরজা তৈরী ও তালাচাবির ব্যবস্থা করেন।

এরপর তুব্বা মক্কা থেকে বেরিয়ে তাঁর সৈন্য সামন্ত ও ইহুদী প-িতদ্বয়কে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করেন। ইয়ামানে পৌঁছে তিনে সেখানকার জনগণকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে তাঁর গৃহীত ধর্মমত গ্রহণের দাওয়াত দেন। ইয়ামান বাসী সুস্পষ্টভাবে জানায় তারা তাদের প্রথামত আগুনের কাছে ফায়সালা চাওয়া ছাড়া ধর্ম ত্যাগ করবে না।

ইয়ামনবাসীরা আগুনের মাধ্যমে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করতো। ঐ আগুন অত্যাচারীকে গ্রাস করতো কিন্তু মযলুমের ক্ষতি করতো না। একদিন ইয়ামনবাসী তাদের প্রতিমাসমূহ ও তাদের ধর্ম পালনের অন্যান্য সরঞ্জামাদি সহকারে এবং ইহুদী প-িতদ্বয় তাদের আসমানী কিতাব কাঁধে ঝুলিয়ে যে স্থান দিয়ে আগুন বেরোয় সেখানে গিয়ে বসলো। আগুন বেরিয়ে প্রথমেই ইয়ামানবাসীদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইয়ামান বাসী তা দেখে ভীত হয়ে পড়লো এবং আগুন থেকে দূরে সরে গেল। উপস্থিত লোকেরা তাদেরকে তিরষ্কার করে ধৈর্যের সাথে যথাস্থানে বসে থাকতে বললো। তারা ধৈর্য ধারণ করে বসতেই আাগুন তাদেরকে ঘেরাও করে ফেললো এবং প্রতিমা ও অন্যান্য ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম পুড়িয়ে ভষ্ম করে দিল। হিমইয়ার গোত্রের যে ক’জন পুরোহিত ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম বহন করছিল তারাও ভষ্মীভ’ত হলো। ফলে হিমইয়ার গোত্র তুব্বানের ধর্মে দীক্ষা নিল। তখন থেকে ইয়ামানে ইহুদী ধর্মের পত্তন হলো।

তুব্বানের পর ইয়ামানের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর ছেলে হাস্সান। তিনি সমগ্র ইয়ামনবাসীকে সাথে নিয়ে সমগ্র আরব ও অনারাব জগত দখল করার অভিপ্রায়ে এক বিজয় অভিযান শুরু করেন। এভাবে বাহরাইন ভূখ-ে পৌঁছলে হিমইয়ার ও অন্যান্য ইয়ামানী গোত্রগুলো তাঁর সাথে আর সামনে এগুতে চাইল না। তারা তাদের স্বদেশ ও পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধাস্ত নিল। তারা ঐ বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী হাস্সানের এক ভাই আমরের কাছে এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বললো,“তুমি তোমার ভাই হাস্সানকে হত্যা কর এবং আমাদের সাথে স্বদেশে ফিরে চল। আমরা তোমাকেই রাজা হিসেবে বরণ করে নেব।” আমর তার বহিনীর লোকজনের সাথে আলোচনা করলে সবাই একমত হলো। কেবল যূ-রুআইন আল হিমইয়ারী এর বিরোধিতা করলো ও হত্যাকা- ঘটাতে নিষেধ করলো। কিন্তু আমর তার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করলো। তখন যূ-রুআইন নিম্নলিখিত কবিতা আবৃতি করলো,

“হুঁশিয়ার! কে আছে নিজের নিদ্রার বিনিময়ে নিদ্রাহীনতাকে বরণ করে নেবে।

যে ব্যক্তি তার সুখময় জীবনকে অব্যাহত রাখে

সে-ই প্রকৃত ভাগ্যবান। কিন্তু

হিমাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আর যূ-রুআইনের জন্য খোদার স্বীকৃত ওজর রইল।”

এই কবিতাটুকু সে ইক টুকরো কাগজে লিখে তাতে সীল মারলো। অতঃপর আমরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, “আমার লেখা এই চিরকুট আপনার কাছে রেখে দিন।” আমর সেটা রেখে দিল। অতঃপর সে তার ভাই হাস্সানকে হত্যা করলো এবং দলবল সাথে নিয়ে ইয়ামানে প্রত্যাবর্তন করলো।

আমর ইবনে তুব্বান ফিরে আসার পর ঘোর অনিদ্রায় আক্রান্ত হলো। রোগ যখন মারাত্নক আকার ধারণ করলো তখন সে চিকিৎসক পাখীর সাহায্যে ভাগ্য গণনাকারী জ্যোতিষী ও ভবিষ্যদ্বক্তাদের ডাকলো এবং তার রোগের রহস্য উদ্ঘাটনে তাদের মতামত চাইলো। একজন বললো, “দেখুন, আপনি যেভাবে নিজের ভাইকে হত্যা করেছেন, এভাবে আপন ভাই বা রক্ত সম্পর্কীয় আপনজনকে যখনই কেউ হত্যা করেছে তাকে এ ধরনের নিদ্রাহীনতহায় ভুগতে হয়েছে।”

একথা শোনা মাত্রই আমর তার ভাই হাস্সানকে হত্যার পরামর্শ দানকারী ইয়ামানের সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হত্যা করতে লাগলো। একে একে তাদের সবাইকে হত্যা করার পর যখন যূ-রুআইনের কাছে এলো তখন সে বললো, “আমার নির্দোষিতার প্রমাণ আপনার কাছেই রয়েছে।” আমর বললো, “সেটা কি?” যূ-রুআইন বললো, “আমার লিখিত এক টুকরো কাগজ যা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম।” তখন আমর সেটা বের করে দেখলো তাতে দু’টি পংক্তি লেখা আছে। সে বুঝতে পারলো যে, যূ-রুআইন তাকে সদুপদেশই দিয়েছিল। তাই সে তাকে হত্যা করলো না।

এরপর আমর মারা গেল। তার মৃত্যুর পর হিমইয়ারী শাসনের ক্ষেত্রে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল এবং তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ঘাড়ের উপর শাসক হয়ে চেপে বমলো লাখনিয়া ইয়াসূফ যূ-শানাতির নামক রাজ পরিবার বহির্ভূত এক ভয়ঙ্কর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি। সে তাদের সম্ভ্রান্ত লোকজনদেরকে হত্যা করলো এবং রাজ পরিবারের লোকজনদের সাথে আমোদ প্রমোদে লিপ্ত হলো।

লাখনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপাবার ছিল সমকাম। হাস্সানের ভাই এবং তুব্বানের ছেলে যূর’আ যু-নাওয়অসকে একদিন সে এই অভিপ্রায়ে ডেকে পাঠালো। হাস্সান নিহত হওয়ার সময় যূর’আ ছিল ছোট বালক। কিছু দিনের মধ্যে সে এক সুঠামদেহী ও বুদ্ধিমান তরুণ যুবকে পরিণত হলো। যূর’আর কাছে লাখনিয়ার বার্তাবাহক এলে সে তার কমতলব বুঝতে পারলো। সে একখানা তীক্ষèধার হালকা ছুরি নিজের পায়ের তলায় জুতার ভেতর লুকিয়ে নিয়ে লাখনিয়ার কাছে গেল। লাখনিয়া নিভৃতে ডেকে নিয়ে যূর’আর ওপর  চড়াও হলো। সে সুযোগ বুঝে তৎক্ষণাৎ ছুরি দিয়ে তাকে প্রচ-ভাবে আঘাত করলো। যূর’আ লাখনিয়অকে হত্যা করে জনসাধারণের সামনে এসে সগর্বে নিজের কীর্তি প্রচার করতে লাগলো। এবার জনগণ বললো,“তুমি আমদেরকে এই নরাধমের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছ। সুতরাং আমাদের শাসক হিসেবে তুমিই যোগ্যতম ব্যক্তি।”

হিমইয়ার গোত্র ও সমগ্র ইয়ামানবাসীর সহযোগিতায় যূর’আ যূনাওয়াস তাদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী পরাক্রমশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত  করলো। যূর’আ ছিলেন হিমইয়ার বংশের সর্বশেষ সম্রাট এবং সে (কুরআনের সূরা বুরূজের) পরিখায় পুরে আগুনে পুড়িয়ে মারার গটনার নায়ক।

ইয়ামানের নাজরান প্রদেশে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রকৃত অনুসারীদের অবশিষ্ট একটি গোষ্ঠী তখনও বেঁচে ছিল। তাঁরা ছিলেন জ্ঞানী-গুণী ও সুদৃঢ় মনেবলের অধিকারী। তাঁদের নেতা ছিলেন আবুদল্লাহ ইবনে সামের। যূ-নাওয়াস তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে ইহুদীবাদ গ্রহণের দাওয়াত দিলো এবং পরিষ্কার বলে দিলো, “হয় ইহুদী হও, নচেৎ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।” সুতরাং তাদের জন্য পরিখা খনন করা হলো। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো এবং অনেককে তরবারি দিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ বিকৃত করা হলো। এভাবে যূ-নাওয়াস প্রায়২০ হাজার লোককে হত্যা করলো।

এই যূ-নাওয়াস ও তার সৈন্য-সামন্তের প্রসঙ্গেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল করেন, “পরিখার জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডলীর নায়কদের ওপর অভিসমাপ্ত। স্মরণ কর যখন তারা পরিখার পাশে বসেছিল, মুমিনদের ওপর তারা যে হত্যালীলা অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত ছিল, সে দৃশ্য উপভোগ করছিল। মুমিনদের বিরুদ্ধে তাদের শুধু এই কারণে আক্রোশ ছিল যে, মহাপরাক্রান্ত, চিরনন্দিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি তারা ঈমান এনেছিল।”

কথিত আছে যে, যূ-নাওয়াসের হাতে নিহত এই মুমিনদলের ইমাম ও অধিনায়ক ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সামের।

 

হাবশীদের দখলে ইয়ামান

যূ-নাওয়াসের অগ্নিকুন্ডে নিহত মুমিনদের একজন কোন রকমে আত্নরক্ষা করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সাবা গোত্রোদ্ভূত দাওস যূ-সুলুবান নামক এই ব্যক্তি আগুনের পরিখা থেকে সুকৌশলে উদ্ধার পেয়ে নিজের ঘোড়ায় চড়ে ঊর্ধশ্বাসে মরুভূমির ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকেন। যূ-নাওয়াসের পশ্চাদ্ধাবনকারী লোকজনের চোখে ধূলো দিয়ে। ছুটতে ছুটতে তিনি রোম সম্রাটের দরবারে উপনীত হন। তিনি উহুদীবাদী যূ-নাওয়াস ও তার সৈন্য সমন্তের হাতে নাজরানবাসী মুমিনদের যে লেমহর্ষক গণহত্যা ও নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিররণ দিয়ে যূ-নাওয়াসের শক্তির বিরুদ্ধে রোম সম্রাটের সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। সম্রাট বলেন, “তোমার দেশ আমার এখান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাই আমি আবসিনিয়ার রাজাকে চিঠি লিখবো। তিনিও আমার ধর্মাবলম্বী। আর তাঁর দেশ তোমার দেশের কাছাকাছি।” সম্রাট আবিসিনিয়ার রাজাকে শুধু সাহায্য করার নির্দেশই নয়, সেই সাথে প্রতিশোধ গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিলেন। হাবশার রাজা নাজাশীর কাছে রোমান সম্রাটের ঐ চিঠি নিয়ে হাজির হলেন দাওস। নাজাশী হাবশা থেকে ৭০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী দাওসের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। বাহিনীর সেনাপতি করা হলো আরিয়াত নামক এক ব্যক্তিকে। তার সহযোগী হিসেবে ঐ বাহিনীতে রইলো আবরাহা আল আশরাম নামক অপর এক ব্যক্তি।

আরিয়াত তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে সমুদ্রপথে ইয়ামানের উপকূলে গিয়ে নামলেন। তার সাথে দাওস যূ-সুলুবানও ছিলেন। খবর পেয়ে যূ-নাওয়াস, হিমইয়ার ও তার অনুগামী অন্যান্য ইয়ামানী গোত্র সমভিব্যাহারে আরিয়াতের সৈন্যদের বাধা দিতে এগিয়ে গেলেন। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই হলো। অবশেষে যূ-নাওয়াস ও তার দলবল পাজয় বরণ করলো। এ অবস্থা দেথে যূ-নাওয়াস তার ঘোড়াকে সমুদ্রের দিকে হাঁকালো। ঘোড়া সমুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো এবং যূ-নাওয়াসের সলিল সমাধি ঘটলো। এখানেই যূ-নাওয়াস ও তার ইহুদীবাদী শাসনের অবসান ঘটলো। আরিয়াত ইয়ামানে প্রবেশ করে সিংহাসনে আরোহণ করলেন।

আরিয়াত ও আবরাহা দন্দ্ব

আরিয়াত দীর্ঘকাল ইয়ামানের শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। এক সময় আবরাহা তাঁর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তাঁর দাবী ছিল, নাজাশীর প্রতনিধি হিসেবে ইয়ামান শাসনের অধিকার তাঁরই বেশী। হাবশী সৈন্যরা এ প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়লো। দুই দলে যুদ্ধ হবার উপক্রম হলে আবরাহা আরিয়াতকে এই মর্মে বার্তা পাঠালেন, “হাবশীরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলে নিজেরাই ধবংস হযে যাবে,পরিণামে কোন লাভ হবে না। সুতরাং এসো আমরা দু’জনে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হই। আমাদের দু’জনের মধ্যে যে জয়যুক্ত হবে, সমস্ত সৈন্যবাহিনী তার আনুগত্য করবে।”আরিয়াত এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে বললো,“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।” আরিয়াত ও আবরাহার মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো আবারাহা অপেক্ষাকৃত ধার্মিক, মোটা ও বেঁটে এবং আরিয়াত লম্বা, সুদর্শন ও বিশালদেহী ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি অস্ত্র। আবরাহা তাঁর পৃষ্ঠদেশকে রক্ষা করার জন্য তাঁর আতুদাহ নামক ক্রীতদাসকে পিছনের দিকে রাখলেন। আরিয়াত তাঁর তরবারি দ্বারা আবরাহার মাথায় আঘাত করলেন,কিন্তু তা তাঁর মুখম-লের ওপর লাগলো। এতে আবরাহার নাক ও কপালের ভ্রু কেটে গেল এবং ঠোঁট ও চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলো। একারণেই তাকে আবরাহা আল-আশরাম বা নাক কাটা বলা হয়। এইবার আতুদাহ আবরাহার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে আরিয়াতকে আক্রমণ করে হতৃা করলো। এরপর আরিয়াতের অনুগত হাবশীসৈন্যরা আবরাহার দলে ভিড়ে যায় এবং আবরাহা আবিসিনিয়ার সর্বসম্মত প্রতিনিধিরূপে ইয়ামান শাসন করতে থাকেন।

আসহাবুল ফীলের ঘটনা

অতঃপর আবরাহা সানাতে কুল্লাইস নামে এমন একটি গীর্জা তৈরী করে, তৎকালীন বিশ্বে যার সমতুল ও সদৃশ কোন ঘর ছিল না।[৭.এটাই হলো সেই ঐতিহাসিক গীর্জা, যাকে আবরাহা পবিত্র কা’বার বিকল্প হিসেবে তৈরী করেছিলো। আরবরা কা’বার পরিবর্তে ঐ গীর্জাকে হজ্জের কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করুক, ঐ গীর্জার  এলাকার হজ্জকে স্থনান্তরিত করুক এটাই ছিল তার অভিলাষ।]

অতঃপর সে নাজাশীকে পত্র লিখলো, “হে রাজা, আমি আপনার জন্য এমন একটি গীর্জা গড়েছি, যার তুলনা ইতহাসে পাওয়া যায় না। আরবদের হজ্জকে আমি এই গীর্জার এলাকায় স্থনাস্তরিত না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবো না।”নাজাশীর কাছে লেখা আবরাহার এই চিঠির কথা অচিরেই আরবদের জানাজানি হয়ে লেল। তারা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো।বনী কিনানা গোত্রে রক্তপাত নিষিদ্ধ হওয়ার মাসকে হালাল করণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী একটা গোষ্ঠী। [৮.এই গোষ্ঠীকে বলা হতো নাসায়াহ। জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররম এই তিন মাসকে এক নাগাড়ে রক্তপাতহীন মাস হিসেবে  পালন করা আরবদের পক্ষে কষ্টকর ছিল। নরহত্যার মাধ্যমে ডাকাতি লুটতরাজ ইদ্যাদি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ চলতো। এজন্য এক নাগাড়ে তিন মাস নিষিদ্ধ মাস যাপন তদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিল। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হজ্জ সমাপন করে মিনা থেকে ৮এর বাকী অংশ .... বেরিয়ে লোকজনের সামনে নিম্নরূপ ঘোষণা উচ্চারণ করতো, “আমি সেই ব্যক্তি যার কোন কলংক নেই, যার হুমকির কোন জবাব আসে না এবং যার সিদ্ধান্ত কেউ পাল্টাতে পারে না।” সবাই সমস্বরে বলতো, “আলবৎ! আলবৎ!!” অতঃপর পুনরায় সবাই বলতো, “আমাদের একটা নিষিদ্ধ মাস পিছিয়ে দাও। মুহাররম মাসটা হালাল করে দাও এবং তার বদলে সফর মাস নিষিদ্ধ বলে গণ্য কর।” এটাই নাসা বা হারাম মাসকে মনগড়[ভাবে পিছিয়ে নেয়াপর প্রক্রিয়া। এটা একটা জাহেলী রেওয়াজ এবং সম্পূর্ণ অনৈসলামিক রীতি।-অনুবাদক]

তাদের একজন রগচটা লোক গোপনে গিয়ে আবরাহার ঐ গীর্জায় পয়াখানা করে রেখে আবার নিজের বসতিতে ফিরে এলো।

যথাসময়ে ব্যাপারট আবরাহার কানে গেল। সে লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,

“এই কা-টা কে করলো?” লোকেরা জানালো, “জনৈক আরব এ কাজ করেছে। সে মক্কার কা’বাঘরে হজ্জ আদায়কারীদের দলভুক্ত। আপনি মক্কা থেকে এখানে হজ্জ স্থানান্তর করতে ইচ্ছুকÑ একথা শুনে সে রেগে গিয়ে এ কাজ করেছে। এ দ্বারা সে প্রমাণ করতে চায় যে, এই গীর্জা কা’বার বিকল্প হতে পারে না এবং এটা হজের কেন্দ্র হবার যোগ্য নয়।”

আবরাহা তো রেগেই আগুন। সে শপথ করলো যে, যেমন করেই হোক সে কা’বাকে ধ্বংস করবেই। হাবশীদেরকে সে তার অভিপ্রায় জানালো। হাবশীরা সব রকমের উপকরণ ও সরঞ্জাম দিয়ে তাকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করলো। যথাসময়ে সে একদল হস্তীনিয়ে কা’বা অভিযানে বেরিয়ে পড়লো। আরবরা ব্যাপারটা জানতে পেরে ভীষণ প্রমাদ গুনলে এবং ভীত সন্ত্রন্ত হয়ে পড়লো। আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বাকে আবরাহা ধ্বংস করতে চায় শুনে আরবরা উপলব্ধি করলো যে, হানাদরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা তাদের একান্ত কর্তব্য

ইয়ামানের জনৈক সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী নাগরিক ‘যূ-নফর’ সমগ্র ইয়মানবাসী ও অন্যান্য আরবদেরকে আহ্বান জানালেন কা’বা শরীফকে রক্ষা করার জন্য আরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। যারা তার আহ্বানে সাড়া দিল। তদের নিয়ে যূ-নফর আবারাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর বাহিনী পরাজিত হলেন এবং যূ-নফর বন্দী হলেন। এরপর আবরাহা তার ইস্পিত লক্ষ্যে এগিয়ে গেলো। খাস’য়াম উপজাতীয়দের এলাকায় পৌঁছলে নুফাইল ইবনে হাবীব আল্ খাসয়ামী দু’টি খাসয়ামী গোত্র শাহরান ও নাহিস  এবং আরো কয়েকটি সমমনা আরব গোত্রকে সাথে নিয়ে আবরাহার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। যুদ্ধে নুফাইলও সদলবলে পরাজিত ও বন্দী হলেন। আবরাহা নুফাইলকে মুক্তি দিলে সুফাইল তার পথ প্রদর্শক হিসেবে সহযাত্রী হলেন। আবরাহা যখন তায়েফের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছিল, তখন সাকীফ গোত্রের কিছু লোকজন সাথে নিয়ে মাসউদ ইবনে মু’আততিব তার সাথে সাক্ষাৎ করলো এবং তাকে বললো, “হে রাজা, আমরা একান্ত অনুগত গোলাম তুল্য। আপনার বিরোধী নই আমরা। আপনি যে ঘর লক্ষ্য করে চলেছেন, ওটা আমাদের উপাসনার ঘর নয়। আপনি তো চাইছেন মক্কার ঘরে হামলা চালাতে। বেশ আমরা আপনার পথপ্রদর্শক হিসেবে একজন লোক সঙ্গে দিচ্ছি। সে আপনাকে দেখিয়ে দেবে কা’বা ঘর।” আবরাহা তাদের প্রতি প্রীত ও সদয় হলো। তায়েফবাসী তার সাথে আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তি কে মক্কার পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্য পাঠালো। আবরাহা ও তার দলবলকে সাথে নেয়ে মুগাম্মাস[৯.তায়েফগামী পথে মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম।]নামক স্থানে উপনীত হলে আবু রিগাল মারা গেল। পরবর্তীকালে আরববাসী আবু রিগালের কবরে পাথর নিক্ষেপ করতো এবং আজও মুগাম্মাসে তার কবরে লোকেরা পাথর নিক্ষেপ করে থাকে।

আবরাহা মুগাম্মাসে যাত্রাবিরতি করার সময় আসওয়াদ বিন মাকসূদ নামক জনৈক হাবশী নাগরিককে ঘোড়ায় চড়িয়ে মক্কা পরিদর্শনে পাঠায়। আসওয়াদ মক্কা পর্যন্ত যায় এবং ফিরে আসার সময় উপত্যকায় চারনভূমিতে বিচরণশীল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্রের লোকদের গবাদি; পশু ধরে নিয়ে আসে। এইসব গবাদি পশুর মধ্যে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের দুশো উটও ছিল। তিনি ঐ সময় কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও বড় নেতা ছিলেন। গবাদি পশু ধরে নিয়ে আসার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ঐ এলাকার কুরাইশ, কিনানা ও হুযাইল গোত্র আবরাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজেদের অক্ষমতা বুঝতে পেরে তারা সে ইচ্ছা পরিহার করে।

আবরাহা হুনাতাহ আল্ হিমইয়ারীকে মক্কায় পাঠাবার সময় বলে দিল, “প্রথমে মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ও নেতা যিনি, তাঁকে চিনে নিও। অতঃপর তাঁকে বলো, রাজা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসেননি। এসেছেন শুধু কা’বা ঘরকে ধ্বংস করতে। তোমরা যদি আমাদেরকে একাজে বাধা দিতে  কোন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত না হও তাহেল তোমাদের রক্তপাতের কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। তিনি যদি আমার সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক না হয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”

হুনাতাহ মক্কায় প্রবেশ করে খোজ নিয়ে জানতে পারলো, মক্কায় সমচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ও নেতা হলেন আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। সে আবদুল মুত্তালিবের কাছে উপস্থিত হলে এবং রাজা তকে যা বলতে বলেছিলো তা বললো। আবদল মুত্তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, আমরা তার সাথে যুদ্ধ করতে চাইনে এবং সে ক্ষমতাও আমাদের নেই। এটা আল্লাহর পবিত্র ঘর। এটা তাঁর নিজস্ব ঘর ও নিজস্ব সম্ভ্রমের ব্যাপার। আর যদি তিনি বাধা না দেন তবে আমাদের কিছু করার থাকবে না।”

তখন হুনাতাহ বললো, “আপনি আমার সাথে রাজার কাছে চলুন। কারণ তিনি আমাকে আদেশ করেছেন আপনাকে সঙ্গে করে তার কছে নিয়ে যেতে।” আবদুল মুত্তালিব তাঁর এক পুত্রকে সাথে নিয়ে আবরাহার নিকট চললেন। আবরাহার সৈন্যদের কাছে পৌঁছেই তিনি যূ-নফর নম্পর্কে খোঁজ নিলেন, যিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন। বন্দী যূ-নফরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি কললেন, “হে যূ-নফর, আমাদের উপর যে বিপদ নেমে এসেছে, তার প্রতিকারে তোমার দ্বারা কি কোন সাহায্য হতে পারে?” যূ-নফর বললো, “এমন একজন রাজবন্দীর কি-ইবা সাহায্য করার ক্ষমতা থাকতে পারে, যে প্রতি মুহূর্তে প্রহর গুনছে, এই বুঝি তাকে হত্যা করা হয়? আমার বাস্তবিকই তোমাদের এই মুসিবতে তেমন কিছু করার নেই। তবে আনীস নামক একজন মাহুত আছে। সে আমার বন্ধু। তাকে আমি বার্তা পাঠাচ্ছি। তোমার উচ্চ মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে তাকে অবহিত করবো ও রাজার কাছে তুমি যাতে নিজের বক্তব্য পেশ করতে পার সেজন্য তাকে অনুমতি চেয়ে দিতে বলবো। এমনকি সম্ভব হলে সে যাতে তোমার ব্যাপারে সুপারিশও করে, সেজন্য তাকে অনুরোধ করবো।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “এটুকুই যথেষ্ট হবে।” এরপর যূনফর আনীসের নিকট এই বলে বার্তা পাঠালো, “শোনো! আবদুল মুত্তালিব হলেন কুরাইশদের একচ্ছত্র অধিপতি। মক্কার বণিক সমাজের নেতা। উপত্যকাভূমিতে মানুষের এবং পাহাড় পর্বতের বন্য পশুর খাদ্য সরবরাহকারী হিসেবে তিনি পরিচিত। যেসব পশু রাজার হস্তগত হয়েছে, তন্মধ্যে দু’শত উট এই আবদুল মুত্তালিবের। সুতরাং তুমি রাজার সাথে সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করে দাও এবং যতটা পার তাঁর উপকার কর।” আনীস বললো, “ঠিক আছে। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।” আনীস আবরাহাকে বললো, “হে রাজা, কুরাইশদের নেতা আপনার দরবারে উপস্থিত। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান। তিনি মক্কায় বণিকদের দলপতি। তিনি উপত্যকা ভূমিতে যেমন মানুষের আহার করান, তেমনি পর্বত শীর্ষের বন্য পশুর খাদ্য সরবরাহকারী বলেও সুখ্যাত। অনুগ্রহপূর্বক তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে তাঁর দাবী-দাওয়া পেশ করতে দিন।” আবরাহা তাঁকে অনুমতি দিলো।

আবদুল মুত্তালিব ছিলেন সেই সময়কার শ্রেষ্ঠতম সুদর্শন  এবং অতি গণ্যমান্য ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। আবরাহা তাঁকে দেখেই মুগ্ধ ও অভিভূত হলো। সে আবদুল মুত্তালিবকে এতখানি সম্মানিত মনে করলো যে, নিজে উচ্চ আসনে বসে তাঁক নীচে বসতে দিতে পারলো না। পক্ষান্তরে হাবশীরা তাঁকে রাজার সাথে একই রাজকীয় আসনে উপবিষ্ট দেখুক, তাও পছন্দ করলো না। অগত্যা আবরাহা স্বীয় রাজকীয় আসন থেকে নেমে নীচের বিছানায় বসলো এবং আবদুল মুত্তালিবকে সেখানে নিজের পাশে বসালো অতপর দোভাষীকে বললো, “তাঁকে বক্তব্য পেশ করতে বলো।” দোভাষী আদেশ পালন করলো। আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমার অনুরোধ, আমার যে দুশো উট রাজার হাতে এসেছে, তা ফেরত দেয়া হোক।” দোভাষী যখন একথা আবরাহাকে জানালো তখন আবরাহা দোভাষীর মাধ্যমে বললো,“তোমাকে প্রথম দৃষ্টিতে যখন দেখেছিলাম তখন অবিভূত হয়েছিলাম কিস্তু এখন তোমার কথা শুনে তোমার প্রতি আমার ভীষণ বীতশ্রদ্ধা জন্মে গেছে। এচা খুবই আশ্চর্যজনক যে, তুমি আমার সাথে আমার হস্তগত দুশো উটের দাবী নিয়ে কথা বলছো। অথচ তোমার ও তোমার বাপদাদার ধর্মের কেন্দ্র যে কা’বাগৃহ, আমরা সেটাকে ধ্বংস করতে এসছি এ কথা জেনেও তুমি সে সম্বন্ধে কিছুই বলছো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি শুধু উটেরই মলিক। কা’বা গৃহের মালিক আর একজন আছন, তিনিই তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।” আবরাহা বললো,“আমার আক্রমণ থেকে তিনি এ ঘরকে ঠেকাতে পারবেন না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন,“ সেটা আপনার আর কা’বা ঘরের মলিকের ব্যাপার।”

আবরাহা  আবদুল মুত্তালিবের উট ফিরিয়ে দিলো। আবদুল মুত্তালিব কারাইশদের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে সমস্ত ব্যাপারটা জানালেন। তিনি তাদেরকে মক্কা থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড় পর্বতের গোপন গুহাগুলোতে আশ্রয় নিয়ে আবরাহার সৈন্যদের সম্ভাব্য নির্যাতন থেকে আত্নরক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব নিজে কুরাইশদের একদল লোককে সাথে নিয়ে কা’বার দরজার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর কাছে আবরাহা ও তার সৈন্য সামন্তের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাঁর সাহায্য কামনা করে দোয়া করতে লাগলেন। আবদুল মুত্তালিব কা’বার চৌকাঠ ধরে বলতে লাগলেন,

“হে আল্লাহ, একজন বান্দাও তার দলবলকে রক্ষা করে থাকে। অতএব তুমি তোমার অনুগত লোকদেরকে রক্ষা কর। ওদের ক্রুশ বলবিক্রম যেন তোমার শক্তির উপর জয়যুক্ত না হয়। আমাদের কিবলাকে তুমি যদি ওদের  করুণার ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তাহলে যা খুশি কর!”

এপর আবদুল মুত্তালিব কা’বার দরজার চৌকাঠ ছেড়ে দিলেন এবং তিনি ও তাঁর কুরাইশ সঙ্গীরা পর্বত গুহায় আশ্রয় নিলেন। সেখানে বসে তারা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন আবরাহা মক্কায় ঢুকে কি করে।

পরদিন প্রত্যুষে আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার প্রস্তুতি নেতে লাগলো। তার হস্তী বাহিনী ও সৈন্য বাহিনীকে সুসংহত করলো। তার হাতীর নাম ছিল মাহমুদ। আবরাহার সংকল্প ছিল, প্রথমে কা’বাকে ধ্বংস করবে, অতঃপর ইয়ামান ফিরে যাবে। হস্তী বাহিনীকে মমক্কা অভিমুখে পরিচালিত করলে নুফাইল ইবনে হাবীব এগিয়ে এলো এবং আবরাহার হাতীর পাশে দাঁড়ালো। অতঃপর সে হাতীর কান ধরে বললো, “হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো। নচেত যেখান থেকে এসেছো ভালোয় ভালোয় সেখানে ফিরে যাও। জেনে রেখো তুমি আল্লাহর পবিত্র নগরীতে রয়েছো।” অতঃপর কান ছেড়ে দিতেই হাতী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। নুফাইল হাতীকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে কোন রকমে পাহাঢ়ের ওপর চড়ালো। এরপর অনেক মারধোর করেও হাতীকে ওঠানে সম্ভব হলোনা। অতঃপর তার শুঁড়ের ভেতর  আঁকাবাঁকা লাঠি ঢুকিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া হলো যাতে হাতী উঠে দাঁড়ায়। তবুও উঠলোনা। অতঃপর তাকে পেছনের দিকে ইয়ামান অভিমুখে  ফিরতি যাত্রা করার জন্য চালিত করা মাত্রই ছুটতে আরম্ভ করলো। সিরিয়ার দিকে চালিত করলেও জোর কদমে চলতে লাগলো। অতঃপর যেই মক্কার দিকে চালিত করা হলো অমনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ঠিক এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে এক ধরনের কালো পাখী পাঠালেন। প্রতিটি পাখিীর সাথে তিনটি করে পাথরের নুড়ি ছিল। একটা তার ঠোঁটে আর দুটো দুইপায়ে। পাথরগুলো কলাই ও বুটের মত। যার গায়েই সেগুলো পড়তে লাগলো, সে-ই তৎক্ষণাৎ মরতে লগলো। কিন্তু সবার গায়ে পড়তে পারলোনা। অনেকেই পালিয়ে যেখান থেকে এসেছে সেদিকে ফিরে যেতে লাগলো। লোকেরা রাস্তার যেখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলো। আবরাহার গায়ে একটা গুড়ি পড়তেই সে তৎক্ষনাৎ মারা গেল। ইবনে ইসহাক বলেন,

আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পাঠানোর পর এই ঘটনাকে কুরাইশদের প্রতি তাঁর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেন। কেননা এর মাধ্যমেই তিনি হাবশীদের পরাধীনতার বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেছিলেন। যাতে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহাল থাকে। আল্লাহ সূরা ফীলে বলেন,

[আরবী ***********]

“তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক হাতীওয়ালাদের সাথে কি রকম আচরণ করেছিলেন? তিনি কি তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেননি? তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী পাঠিয়েছিলেন, যারা তাদের প্রতি কঠিন কংকর নিক্ষেপ করছিলো আর এভাবে তাদেরকে চর্বিত ভূষি বা ঘাসের মত বানিয়ে দিয়েছিলেন।”

নিযার ইবনে মা’আদের বংশধর

নিযার ইবনে মা’আদের ঔরসে তিনটি পুত্র জন্মগ্রহণকরে : মুদার, রাবিয়া ও আনমার।[১০. ইবনে হিশাম চতুর্থ সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘ইয়াদ’কে।]

মুদারের দুই পুত্র : ইলিয়াস ও আইলান

ইলিয়াসের তিন পুত্র : মুদরাকা, তাবেখা, কামা’আ

মুদরাকার দুই পুত্র : খুযাইমা, হুযাইল

খুইযামার চার পুত্র : কিনানা, আসাদ, ইসদাহ ও আল হাউন

কিনানার চার পুত্র : নাদার১১, মালেক, আবদমানাহ, মিলকান

নাদারের দুই পুত্র : মালেক ও ইয়খলুদ

মেিলকের এক পুত্র : ফিহির

ফিহিরের চার পুত্র : গালেব, মুহারিব, হারেস, আসাদ

গালেবের দুই পুত্র : লুয়াই, তাইম

লুয়অইয়ের চার পুত্র : কা’ব, আমের উসামা, ই্ফ

কা’বের তিন পুত্র : র্মুরা, আদী, হুছাইছ

র্মুরার তিন পুত্র : কিলাব, তাইম, ইযাকযাহ

কিলাবের দুই পুত্র : কুসই, যুহরাহ

কুসাই-এর চার পুত্র : আবদ মানাফ, আবদুদ-দার, আবদুল উযযা, আবদ কুসাই

আবদ মানাফের চার পুত্র : হাশিম, আবদ শামস, মুত্তালিব, নাওফেল

 

আবদুল মুত্তালিব বিন হশিমের সন্তান সন্তুতি

ইবনে হিশাম বলেন,

“আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ঔরসে দশ পুত্র ও ছয় কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্ররা হলেনঃ আল-’আব্বাস, হামযা, ’আবদুল্লাহ, আবুতালিব, যুবায়ের, হারেস,

১১.ইবনে হিশামের মতে নাদারের অপর নাম কুরাইশ। তার বংশধরই কুরাইশী বলে খ্যাত। তার বংশোদ্ভূত না হলে কাউকে কুরাইশী বলা চলে না। অন্যেরা বলেন ফিহির ইবনে মালিকের নাম কুরাইশ।

হাজলা, মুকাওয়েম, দিরা, আবু লাহাব (প্রকৃত নাম আবদুল উয্যা)। কন্যাগণ হলেনঃ সাফিয়া, উম্মে হাকিম আল বায়দা, আতিকা, উমায়মা, আরওয়া, বাররাহ।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতামাতা

আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহর ঔরসে এবং ওয়াহাবের কন্যা আমিনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন আদমের (আ) শ্রেষ্ঠতম সন্তান মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব। আল্লাহ তাঁর পরিবার পরিজনদের প্রতি অশেষ শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল করুন।

মাতার দিক থেকে তাঁর বংশ পরম্পরা নিম্নরূপ:

আমিনা বিনতে ওয়াহাব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে যুহরাহ ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে নাদার। আমিনার মাতা বারা বিনতে আবদুল উয্যা ইবনে উসমান ইবনে ‘আবদুদ-দার ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে মালেক ইবনে নাদার।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আদমের (আ) সন্তানদের মধ্যে পিতৃ মাতৃ উভয় কূলের দিক থেকে সম্ভ্রান্ততম, শ্রেষ্ঠতম, উচ্চতম ও মহত্তম।

যমযম কূপ খনন ও তদবিষয়ে সৃষ্ঠ মতবিরোধ

একদিন আবদুল মুত্তালিব পবিত্র কা’বার হাতীমের [১২. অর্থাৎ কা’বার ভিত্তির যে অংশ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু কুরাইশরা তার ওপর আর কোন কিছু নির্মাণ করেনি।]মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন এমন সময়ে স্বপ্নে যমযম কূপ খননের আদেশ পেলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবদুল মুত্তালিবের বর্নলা নিম্নরূপঃ আমি হাতীমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। এমতাবস্থায় এক অচেনা আগন্তুক এলেন এবং আমাকে বললেন, পবিত্র কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ পবিত্র কূপ? আগন্তুক এর কোন জবাব না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পরদিন আমি নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে ঘুমালাম, এ রাতেও সেই আগন্তুক এসে বললেনঃ সংরক্ষিত কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ সংরক্ষিত কূপ? আগন্তুক কোন জবাব না দিয়ে অর্দশ্য হয়ে গেলেন। পরদিন আম উক্ত স্থানে ঘুমাতে গেলাম, সেই আগন্তুক আবার এলেন এবং বললেন : যমযম খনন কর। আমি বললাম : যমযম কি? তিনি বললেন : “যে কূপের পানি কখনো কমে না বা শুকায় না, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক হাজীকে খাবার পানি সরবরাহ করতে পারবে, যা অবস্থিত গোবর ও রক্তের মাঝখানে সাদা ডানাবিশিষ্ট কাকের বাসার নিকটে।” [১৩.কথিত আছে যে,  আবদুল মুত্তালিব যখন কূপ খনন করতে উদ্যোগী হলেন তখন তাঁকে খননের যে স্থান নির্দেশ করা হয়েছিল, সেখানে পিঁপড়ের ঢিবি ও কাকের গুহা দেখতে পেলেন। কিস্তু গোবর ও রক্ত দেখতে পেলেন না। ফলে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সহসা সেখানে একটি গাভীকে ছুটে আসতে দেখলেন। এক ব্যক্তি গাভীটি জবাই করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু গাভীটি ছুটে পালিয়ে আসে। লোকটি পিছু পিছু ছুটে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। গাভী শেষ পর্যন্ত মসজিদেহারামের চৌহদ্দির ভেতরে এসে ঢুকে পড়লো। চিহ্নিত স্থানটিতে এসে গাভী দাঁড়ালে লোকটি সেখানেই সেটিকে জবাই করলো। ফলে গাভীর রক্ত ও গোবর বেরিয়ে এল। আবদুল মুত্তালিবের কাছে সমগ্র ব্যাপারটা পরিস্কার হযে গেল এবং তিনি সেখানেই খনন কাজ শুরু করে দিলেন।]

আগন্তুক তাঁর কাছে যখন যমযম কূপের বৈশিষ্ঠ স্পষ্ট করে দিল ও স্থান নির্দিষ্ঠ হলো এবং স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইলো না, তখন পরদিন সকালে পুত্র হারেসকে সাথে করে কোদাল নিয়ে সেখানে গেলেন। হারেস ছাড়া তখন তাঁর আর কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করেনি। যমযম কূপ [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব প্রকৃতপক্ষে যমযম কূপ পুনঃখনন করেন। এই কূপের আবির্ভাব ঘটে সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্বে ১৯১০ সালে, হযরত ইসমাঈলের জন্মের বছরে। হিজরী সাল অনুযায়ী রাসূল (সা) এর জন্মের ২৫৭২ বছর আগে এটির আবির্ভাব ঘটে। পরে এক পর্যায়ে যমযম কূপ শুকিয়ে যায় ও মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এর কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট থাকেনি। আবদুল মুত্তালিবের হাওত পুনঃখনন না হওয়া পর্যন্ত এর সন্ধান কেউ পায়নি। (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃঃ২২,২৩ ও ২৪) ] খননের কাজ এগিয়ে চললো।যখন আবদুল মুত্তালিব সেই প্রস্তরটি দেখতে পেলেন যা থেকে কূপ উৎসারিত হয়েছে তখন আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কুরাইশরা ঐ ধ্বনি শুনে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব যা খুঁজছেন তা পেয়ে গেছেন। সবাই তাঁর কাছে এসে বললো, “হে আদুল মুত্তালিব, ওটা তো আমাদের পিতা ইসমাঈলের কূপ। এতে আমাদেরও হক আছে। আপনি আমাদের কে এই কূপের অংশীদার করুন!” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি তা পারবো না। এ জিনিসটা শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে, তোমাদেরকে নয়।” তারা বললো, “আমাদের সাথে ন্যায় সঙ্গতভাবে ফায়সালা করুন। তা না হলে আমরা চূড়ান্ত বুঝাপড়া না করে আপনাকে ছাড়বো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “বেশ, তাহলে তোমাদের ও আমার মধ্যে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য যাকে খুশী সালিশ মানো। আমি তার ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত।” তারা বললো, “বনু সা’দ গোত্রে হুযাইম নামে এক জ্যোতিষিণী আছে। সে-ই আমাদের সালিশ।” আবদুল মুত্তালিব বনু আবদ মানাফ গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে সেখানে রওনা দিলেন। প্রতিটি কুরাইশ গোত্রের একজন করে লোক গেল তাঁর সাথে। সমগ্র যাত্রাপথটা ছিল মরু অঞ্চণের ভেতর দিয়ে। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এক মরুভুমিতে পৌঁছেতেই আবদুল মুত্তালব ও তাঁর দলের লোকদের পানি ফুরিয়ে গেল। পিপাসায় তাদের এমন শোচনীয় দশা হলো যে, বাঁচার আর কোন আশাই রইলো না। সহগামী কুরাইশ গোত্রগুলোর কাছে তাঁরা খাবার পানি চাইলে তারা দিতে রাজী হলোনা। তারা বললো, “আমরাও মরুভূমিতে আছি। আশংকা হয় আমাদের অবস্থাও তোমাদের মত হতে পারে।”

আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নিষ্ঠুর আচরনে মর্মাহত হয়ে এবং নিজেদের সম্ভাব্য শোচনীয় পরিনতির কথা চিন্তা করে সহযাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে তোমরা মনে কর?” সহযাত্রীরা এক বাক্যে বললো, “আমরা শুধু আপনার মতানুসারে কাজ করবো। আপনি যা ভালো মনে করেন নির্দেশ দিন।” তিনি বললেন, “আমি মনে করি, আমাদের গায়ে এখনো যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে প্রত্যেকে নিজের কবর খুঁড়ে রাখি। অতঃপর যখন একজন মারা যাবে, তখন আমরা যারা জীবিত থাকবো তারা তাকে ঐ কবরে নিক্ষেপ করবো এবং মাটি ঢেকে দেবো। সবার শেষে মাত্র একব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে। গোটা কাফিলার লাশ নষ্ট হওয়ার চেয়ে একটিমাত্র লোকের লাশ নষ্ট হোক, তাও ভালো সবাই একবাক্যে আবদুল মুত্তালিবের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলো এবং সবাই নিজ নিজ কবর খুঁড়লো। অতঃপর পিপাসার দরুন অবধারিত মৃত্যুর অপেক্ষঅয় সবাই বসে প্রহর গুনতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আবদুল মুত্তালিব তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “আল্লাহর কসম, একবারেই নিশ্চেষ্ট বসে বসে কোথাও না গিয়ে এবং জীবন বাঁচানোর কোন অবলম্বন না খুঁজে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কবলে নিজেদেরকে এভাবে সঁপে দেয় ভীষণ কাপুরুষতা। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ কোন স্থানে আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। অতএব, চল, যাত্র শুরু করা যাক।” যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সফরের সহযাত্রী অন্যান্য কুরাইশরা (যারা পানি দিতে অস্বীকার করেছিল) এতক্ষণ তাদের সমস্ত তৎপরতা নিরীক্ষণ করছিল। আবদুল মুত্তালিব সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। যেই সওয়ারী চলতে আরম্ভ করেছ, অমনি তার পায়ের খুরের নীচ থেকে সুপেয় পানির একটি ঝর্ণা নির্গত হলো। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন অতঃপর আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা সওয়ারী থেকে নেমে পানি পান করলেন এবং মশকগুলো পূর্ণ করে পানি ভরে নিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে ডেকে বললেন, “এসো, আল্লাহ আমাদের পানি পান করিয়েছেন।তোমরাও পানি পান করে যাও ও মশক ভরে নিয়ে যাও।” তারা এলো এবং পানি পান করে ও মশক ভরে নিয়ে গেল। অতঃপর তারা বললো, “হে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহর কসম, আমাদের ওপর তোমার প্রাধান্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমরা যমযমের ব্যাপারে আর কখনো তোমার সাথে কলহ করবো না। আমরা বুঝতে পেরেছি, যিনি আজ তোমাকে এই মরুভূমিতে পানি পান করিয়েছেন, তিনিই তোমাকে যমযমের পানি পান করিয়েছেন। অতএব তুমি পুনরায় তোমার পানি পান করানোর মহান কাজে দ্বিধাহীনভাবে নিয়োজিত হও।”

আবদুল মুত্তালিব ফিরে চললেন এবং সেই কাফিলার অন্য সবাই ফিরে চললো। জ্যোতিষিণীর নিকট কেউ গেল না এবং আবদুল মুত্তালিবকেও তার কাছে যাওয়া থেকে সবাই অব্যহতি দিল।

আবদুল মুত্তালিব কর্তৃক তাঁর পুত্রকে কুরবানীর মানত

আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খননের সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মানত করেছিলেন যে, যদি তাঁর দশটি সন্তান জন্মে এবং তারা তাঁর জীবদ্দশায় বয়োপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় তাহলে তিনি একটি সন্তানকে আল্লাহর নামে কা’বার পাশে কুরবানী করবেন। সুতরাং তাঁর পুত্রের সংখ্যা যখন দশটি পূর্ণ হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, তারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবে তখন তিনি তাদের সবাইকে ডেকে একত্র করলেন এবং তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানালেন। অত:পর তাদেরকে ঐ মানত পূরণের আহ্বান জানালেন। পুত্ররা সবাই সম্মতি প্রকাশ করলো। জিজ্ঞেস করলো।, “আমাদের কিভাবে কি করতে হবে?” তিনি বললেন, “তোমরা প্রত্যেকে একটা করে তীর নেবে। অতঃপর তাতে নিজের নাম লিখে আমার কাছে আসবে।” সকলে তাই করলো এবং তার কাছে এলো। আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সাথে নিয়ে ‘হুবাল’ নাম মূর্তির নিকট গেলেন। তখন হুবাল থাকতো কা’বার মধ্যবর্তী একটি গহ্বরের কাছে। এই গহ্বরেই জমা হতো কা’বার নামে উৎসর্গীকৃত যাবতীয় জিনিস।

হুবালের কাছে ৭টি তীর থাকতো। প্রত্যেক তীরেই এক একটা কথা উৎকীর্ণ ছিল। একটা তীরে উৎকীর্ণ ছিল “রক্তপণ।” যখন তাদের ভেতরে “রক্তপণ” কার ওপর বর্তায় (অর্থাৎ আমার হত্যাকারী কে) তা নিয়ে মতবিরোধ ঘটতো, তখন ৭টা তীর টানা হতো। যদি “রক্তপন” উৎকীর্ণ তীর বেরিয়ে আসতো তাহলে যার নাম বেরুতো,তাকেই “রক্তপণ” দিতে হতো। একটা তীরে লেখা ছিল “হাঁ”। যখন কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করা হতো, তখন একই নিয়মে তীরগুলো টানা হতো। যদি ঐ “হা” লেখা তীর বেরুতো তাহলে ইস্পিত কাজ করা হতো। আর একটা তীরে লেখা ছিল “না”। যে কোন কাজের ইচ্ছা নিয়ে তীরগুলো টানা হতো। যদি“না” লেখা  তীর বেরিযে আসতো, তাহলে আর সে কাজ তারা করতো না। আর একটা তীরে লেখা ছিল “তোমাদের অন্তর্ভুক্ত বা তোমাদের মধ্য থেকে ” আর একটা তীরে লেখা ছিল “সংযুক্ত” আর একটাতে “তোমাদের বহির্ভূত” আর একটাতে “পানি”। কূপ খনন করতে হলে তারা এই তীর গুলোর মধ্য থেকে একটি টানতো যার মধ্যে এই তীরটিও থাকতো যা ফলাফল বেরুতো সেই অনুসারে কাজ করতো।

তৎকালে আরববাসী যখনই কোন বালকের খাত্না করাতে কিংবা কোন কন্যার বিয়ে দিতে ব্ াকোন মৃতকে দাফন করতে চাইতো অথবা কোন শিশুর জন্ম বৈধ কিনা তা নিয়ে সন্দেহে পড়তো, তখন তাকে ‘হুবাল’ নামক দেবমূর্তির নিকট হাজির করতো এবং সেইসাথে একশো দিরহাম ও একটা বলির উটও নিয়ে যেতো। টাকা ও উট তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে দিত। অতঃপর যার ব্যাপারে নিষ্পত্তি কাম্য, তাকে মূর্তির সামনে হাজির করে বলতো, “হে আমাদের দেবতা, সে অমুকের পুত্র অমুক, তার ব্যাপারে আমরা তোমার নিকট থেকে অমুক বিযযে ফায়সালা কামনা করছি। অতএব তার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত কী, তা আমাদের জানিয়ে দাও।” অতঃপর তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে তারা তীর টানতে বলতো। যদি ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে তারা বুঝতো যে, সংশ্লিষ্ট শিশু বৈধ সন্তান, আর যদি ‘তোমাদের বহির্ভূত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ সন্তান তাদের মিত্র বলে গণ্য হতো। আর যদি ‘সংযুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে সে তাদের মধ্যে ঐ অবস্থাতেই থাকতো; তার বংশমর্যাদা বা মৈত্রী  অনির্ধারিতই থেকে যেতো। আর যদি তাদের ইস্পিত অন্য কোন কাজের প্রশ্নে ‘হাঁ’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ কাজ অবিলম্বেই সম্পন্ন করতো। কিন্তু ‘না’ লেখা তীর বেরুলে ঐ বছরের জন্য কাজটি স্থগিত রাখতো। পরবর্তী বছর ঐ কাজ সম্পর্কে একই পন্থায় সমাধান চাইতো। এভাবে তীরের ফায়সালাই ছিল তাদের সকল ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা।

আবদুল মুত্তালিব তীর টানায় নিয়োচিত ব্যক্তিকে বললেন, “আমার এই পুত্রদের ব্যাপারে তীর টেনে দেখুন তো।” তিনি তাকে নিজের মানত সম্পর্কেও অবহিত করলো। আবদুল্লাহ ছিলেন ঐ সময় আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠতম পুত্র। [পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারী হামযা ও আব্বাস (রা) আবদুল্লাহ্রও ছোট ছিলেন।] তিনি ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সর্বাধিক প্রিয় সন্তান। তাই তিনি ব্যগ্রভাবে লক্ষ্য করছিলের যে, তীর আবদুল্লাহকে পাশ কাটিয়ে যায় কি না। পাশ কাটিয়ে গেলেই তো আবদুল্লাহ বেঁচে যান। তীর টানা লোকটি যখন তীর টানতে উদ্যত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব হুবাল দেবতার কাছে দাঁড়িয়ে  আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলে দেখা গেল, তীর আবদুল্লাহর নামেই বেরিয়েছে। অলে আবদুল মুত্তালিব এক হাতে আবদল্লাহকে ও অন্য হাতে বড় একটা ছোরা নিযে তাকে জবাই করার উদ্দেশ্যে ইসাফ ও নায়েলার  (দেব-দেবী) পাশে গেলেন। আসর জমিয়ে বসা কুরাইশ নেতারা তখন উঠে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে আবদুল মুত্তালিব, ব্যাপার কি?” তিনি তখন উঠে গিয়ে বললেন, “আমার এই ছেলেকে জবাই করবো।” তখন কুরাইশগণ ও তার পুত্ররা একযোগে বলে উঠলো, “উপযুক্ত কারণ ছাড়া কিছেুতেই ওকে জবাই করো না। আর যদি তুমি এভাবে ছেলেকে জবাই করো, তবে অনাগত কাল পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। লোকরো নিজ নিজ সন্তানকে এনে বলি দিতে থাকবে এবং মানব বংশ একে একে নিঃশেষ হয়ে যাবে।” আবদুল্লাহর মামাদের গোত্রীয় জনৈক মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে মাখযুম বললেন, “একেবারে অনন্যোপায় হওয়া ছাড়া এমন কাজে প্রবৃত্ত হয়ো না। যদি আমরা মুক্তিপণ দিয়ে অব্যাহতি দিতে পারি তাহলে আমরা মুক্তিপণ দিতে প্রস্তুত।” পক্ষান্তরে, কুরাইশগণ ও আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা কললো, “তাকে জবাই করো না। বরং ওকে নিয়ে হিজাযে চলে যাও। সেখানে এক মহিলা জ্যোতিষী রয়েছে, তার অধীনে জ্বিন আছে। তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও, কাজটা ঠিক হবে কিনা। এরপর আমরা বাধা দেব না। তুমি স্বাধীনভাবে যা খুশী ক’রো। মহিলা যদি জবাই করতে বলে জবাই করো, আর যদি অন্য কোন উপায় বাৎলে দেয় তাহলে সেটাই গ্রহণ করে নিও।” কুরাইশদের উপদেশটাই মেনে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সহযোগীরা হিজায অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। তাঁরা মদীনায় পৌঁছলেন ও খাইবারে সেই মহিলার সাক্ষাৎ পেলেন। আবদুল মুত্তালিব মহিলাকে তাঁর ও তাঁর পুত্রের সকল বৃত্তান্ত খুলে বললেন। মহিলা বললেন, “তোমরা আজ চলে যাও। আমার অনুগত জিন আসুক, তার কাছ থেকে আমি জেনে নিই”। সবাই মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলেন। বিদায় নিয়ে বেরিয়েই আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করনৈ। পরদিন সকালে আবার সবাই মহিলার কাছে সমবেত হলেন। মহিলা বললেন, “আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জেনেছি। তোমাদের সমাজে মুক্তিপণ কি হারে ধার্য আছে?” তারা জানেিলন, “দশটা উট।” মহিলা বললেন, যাও তোমাদের দেশে ফিরে যাও, অতঃপর তোমাদের সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে মূর্তির নিকট হাজির কর ও ১০টা উট উৎসর্গ কর। অতঃপর উট ও তোমাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাগ্য বিধানের জন্য তীর টানো। যদি তোমাদের লোকের নামের বিপক্ষে তীর বেরোয় তাহলে উট আরো দাও, যতক্ষন তোমাদের মনিব খুশী না হন। আর যদি উটের নাতে বেরোয় তাহলে বুঝবে তোমাদের মনিব সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তোমাদের ব্যক্তিটি অব্যহতি পেয়েছে।”

এরপর সবাই মক্কায় চলে গেল। অতঃপর যখন তারা মহিলার কথা অনুযাী মূর্তির নিকট গিয়ে কর্তব্য সমাধায় প্রস্তুত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন। অতঃপর তারা আবদুল্লাহকে ও সেই সাথে দশটা উটকে যথারীতি হাজির করলো। আবদুল মুত্তালিব হুবালের নিকট দাঁড়িযে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলো। তীর আবদুল্লাহর নমেই বেরুলে তারা আরো দশটা বৃদ্ধি করলো। ফলো উটের সংখ্যা দাঁড়ালো বিশ। আবদুল মুত্তালিব আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে ’লাগলেন। পুনরায় তীর টানা হলো এবং এবারও আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। ফলে আরো দশটি উট বৃদ্ধি করে ত্রিশ করা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে চল্লিশ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন আবদুল মুত্তালিব। এবার ও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে পঞ্চাশ করা হলা এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলো এবং তা আবদুল্লাহর নামে বেরুলো অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা ষাট করার পর একই পন্থায় তীর টানা হলে তখনো আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।আবার দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা সত্তর করার পর একই নিয়মে তীর টানা হলে আবারো  হলো। এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো। এরপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা আশি করা হলো এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।অতঃপর আবার দশটা উট বাড়িয়ে নব্বই করা হলে আবার আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে একশো করার পর আবদুল মুত্তালিব একই নিয়মে আল্লাহর নিকট দোয়া করে তীর টানতে বললে এবার উটের নামে তীর বেরুলো। সমবেত কুরাইশগণ ও অন্য সবাই বলে উঠলো, “হে আবদলু মুত্তালিব, তোমার প্রভু এবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন।”

অনেকের মতে আবদুল মুত্তালিব এরপর বললেন, “আমি আরো তিনবার তীর না টেনে ক্ষান্ত হব না।” ফলে আবদূল্লাহ ও উটের নামে তীর টানা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে দোয়া করতে লাগলেন। তীর উটের নামে বেরুলো। এভাবে দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বারেও তীর উটের নামে বেরুলো। অবশেণে ঐ একশো উট কুরবানী করা হলো এবং কুরবানীর পর পশুগুলোকে এমনভাবে ফেলে রাখা হলো যেন কোন মানুষকে তার কাছে যেতে বাধা দেয়া বা ফিরিয়ে দেয়া না হয়।

মহানবীর (স্) আমিনার গর্ভে থাকাকালের ঘটনাবলী

প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গর্ভে আসার পর তাঁর কাছে কোন এক অপরিচিত আগন্তুক আসেন এব্ং তাঁকে বলেন, “তুমি যাকে গর্ভে ধারণ করেছ, তিনি এ যুগের মানব জাতির মহানায়ক। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হবেন তখন  তুমি বলবেঃ সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এই শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অতঃপর তার নাম রাখবে মুহাম্মাদ। [১৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে মাত্র তিনজনের এনাম রাখা হযেছে। যথা: (১) কবি ফরাজদাকের দাদার দাদা মুহাম্মাদ ইবনে সুফিয়ান বিন মুজাশি। (২) মুহাম্মাদ ইবনে উহাইহা ইবনে আল জাল্লাহ (৩) মুহাম্মাদ ইবনে হিমরান ইবনে রাবিয়াহ। এ তিনজনের প্রত্যেকের পিতা জানতে পারেন যে, আল্লাহর এক রাসূলের আবির্ভাবের সময় ঘরিয়ে এসেছে এবং তিনি হিজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। লোকমুখে একথা শুনে তাদের প্রত্যকে আকাক্সক্ষা জাগে যে, তিনি যেন তারই সন্তান হন। একবার তারা আসমানী কিতাবের  জ্ঞান রাখে এমন এক বাদশাহর কাছে গমন করেন। তিনি তাদেরকে যানান যে, মাহাম্মাদ নামে একজন নবঢর আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। এই সময় তাঁরা বাড়ীতে নিজ নিজ স্ত্রীকে গর্ভবতী দেখে এসেছিলেন। ফলে প্রত্যেকেই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। এই সিধান্ত অনুসারেই তাঁরা তাঁদের তিন ছেলের নাম রেখেছিলেন।

তিনি গর্ভে থাকাকালে আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর ভেতর থেকে এমন একটা আলোকরশ্মি বেরুলো যা দিয়ে তিনি সিরীয় ভূখ-ের বুসরার প্রাসাদসমূহ দেখতে পেলেন।

এরপর তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই অল্পদিনের মধ্যে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেন।

রাসূলুল্লাহর (স) জন্ম

‘আমুল ফীল অর্থাৎ হস্তীবাহিনী নিয়ে আবরাহার কা’বা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে, সেই বছরের রবিউল আউয়াল মানের দ্বাদশ রজনী অতিক্রান্ত হবার শুভ মুহূর্তে সোমবারে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন।

কায়েস ইবনে মাখরামা থেকে বণিৃত, তিনি কলেছেন, “আমি ও রাসূলুল্লাহ (সা) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী”

হাসসান ইবনে সাবিত বলেন,

“আমি তখন সাত আট বছরের বালক হলেও বেশ শক্তিশালী ও লম্বা হয়ে উঠেছি। যা শুনতাম তা বুঝতে পারার ক্ষমতা তখন হয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম জনৈক ইহুদী ইয়াসরিবের (মদীনার) একটা দুর্গের ওপর উঠে উচ্চস্বরে ওহে ইহুদী সমাজ!’ বলে চিৎকার করে উঠলো। লোকেরা তার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললো, “তেমার কি  হয়েছে?”আজ রাতে আমাদের জন্মে সেই নক্ষত্র উদিত হয়েছে।”

অতঃপর হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর মা আমিনা তাঁর দাদা আবুদল মুত্তালিবের নিকট এই বলে খবর পাঠালেন যে, “আপনার এক পৌত্র জন্মেছে। আসুন, তাঁকে দেখুন।” আবদুল মুত্তালিব এলেন, এসে তাঁকে দেখলেন। এই সময় আমিনা তাঁর গর্ভকালীন সময়ে দেখা স্বপ্নের কথা, নবজাতক সম্পর্কে যা তাঁকে বলা হয়েছে এবং তাঁর যে নাম রাখতে বলা হয়েছে তা সব জানালেন। অতঃপর আবদুল মুত্তলিব তাঁকে নিয়ে কা’বাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শিশুকে মায়ের কাছে দিয়ে ধাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন। অবশেষে বনু সা’দ ইবনে বাক্রের আবু যুয়াইবের কন্যা হালিমাকে ধাত্রী হিসেবে পাওয়া গেল।

 

হালীমার কথা

হালীমা বর্ননা করেছেন যে, তিনি তাঁর স্বামী ও একটি দুগ্ধপোষ্য পুত্রকে সাথে নিয়ে বনু সা’দের একদল মহিলার সাথে দুধ-শিশুর সন্ধানে বের হন। ঐ মহিলারা সকলেই দুধ-শিশুর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। বছরটি ছিল ঘোর অজন্মার। আমরা একেবারেই সকলেই দুধ-শিশুর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। বছরটি ছিল ঘোর অজন্মার। আমরা একোরেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। আমি একটি সাদা গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সাথে ছিল আমাদের বয়স্ক উটটি। সেটি এক ফোটা দুধও দিচ্ছিল না। আমাদের যে শিশু-সন্তানটি সাথে ছিল ক্ষুধার জ্বালায় সে এত কাঁদছিল যে, তার দরুন আমরা সবাই বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছিলাম। তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করার মত দুধ আমার বুকেও ছিল না, উষ্ট্রীর পালানেও ছিল না। বৃষ্টি ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের আশায় আমর উন্মুখ হযে ছিলাম। এ অবস্থায় আমি নিজের গাধাটার পিঠে চড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। পথ ছিল দীর্ঘ এবং এক নাগাড়ে চলতে চলতে আমাদের গোটা কফিলা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লো। অবশেষে আমরা দুধ-শিশুর খোঁজে মক্কায় উপনীত হলাম। আমাদের প্রত্যেককেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু যখনই বলা হয় যে, তিনি পিতৃহীন, তখন প্রত্যেক্ েঅস্বীকার করে বসে। কারণ আমরা প্রত্যেকেই শিশুর পিতার কাছ থেকে উত্তম পারিতোষিক প্রত্রাশা করতাম। কারণ আমরা প্রত্যেকেই শিশুর পিতার কাছ থেকে উত্তম পারিতোষিক প্রত্যাশা করতাম। আমরা প্রত্যেকেই বলাবলি করতাম, “পিতৃতীন শিশু! শিশুর মা আর দাদা কিইবা পারিতোষিক দিতে পারবে?” এ কারণে আমরা সবাই তাঁকে গ্রহণ করতে অপছন্দ করছিলাম। ইতিমধ্যে আমার সাথে আগত সকল মহিলাই একটা না একটা দুধ-শিশু পেয়ে গেল। পেলাম না শুধু আমি। খালি হাতেই ফিরে যাবো বলে যখন মনন্থির করেছি, তখন আমি আমার স্বামীকে বললাম, “খোদার কসম, এতগুলো সহযাত্রীর সাথে শূন্য হাতে ফিরে যেতে আমার মোটেই ভাল লাগছে না। খোদার কসম, ঐ ইয়াতীম শিশুটার আছে আমি যাবোই এবং ওকেই নেব।” আমার স্বামী বকললেন, “নিতে পার। হয়তো আল্লাহ ওর ভেতরই আমাদের জন্য কল্যাণ রেখেছেন। ”

হালীমা বলেন, অতঃপর আমি গেলাম ও ইয়াতীম শিশুকে নিয়ে এলাম। আমি শুধু অন্য শিশু না পাওয়ার কারণেই তাকে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম তাকে নিয়ে কাফিলার কাছে চলে গেলাম। তাকে যখন কোলে নিলাম তখন আমার স্তন দু’টি দুধে অর্তি হয়ে গেল এবং তা থেকে শিশু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেট ভরে দুধ খেলেন। তার দুধভাইও পেট ভরে দুধ খেলো। অতঃপর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ ইতিপূর্বে তার জ্বালায় আমরা ঘুমাতে পারতাম না। আমার স্বামী আমাদের সেই উষ্ট্রীটার কাছে যেতেই দেখতে পেলেন, সেটির পালানও দাধে ভত্যি। অতঃপর তিনি প্রচুর পরিমানে দুধ দোহন করলেন এবং আমরা দু’জনে তৃপ্ত হয়ে দুধ পান করলাম। এরপর বেশ ভালোভাবেই আমাদের রাতটা কাটলো।

সকাল বেলা আমার স্বামী বললেন, “হালীমা, জেনে রেখো, তুমি এক মহাবল্যাণময় শিশু এনেছ।” আমি বললাম, “বাস্তবিকই আমারও তাই মনে হয়।”

এরপর আমরা রওয়ানা দিলাম। আমি গাধার পিঠে সওয়ার হলাম। আমার গাধা গোটা কাফিলাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো। কাফিলার কারো গাধাই তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হলোনা। আমার সহযাত্রী মহিলারা বরতে লাগলো, “হে আবু যুয়াইবের কল্যা, একটু দাঁড়াও আবং আমাদের জন্য অপেক্ষা কর। এটা কি তোমার সেই গাধা নয় যেটার পিঠে চড়ে তুমি এনছিলে?” আমি তাদেরকে বললাম, “হা্রাঁ, সেইটাই তো।” তারা বললো, “আল্লাহর কসম, এখন এর অবস্থাই পাল্টে গেছে।”

শেষ পর্যন্ত আমরা বনি সা’দ গোত্রে আমাদের নিজ নিজ গৃহে এসে হাজির হলাম। আমাদের ঐ এলাকাটার মত খরাপীড়িত এলাকা দুনিয়ার আর কোথাও ছিল বলে আমার জানা ছিল না। শিশু মাহাম্মাদকে নিয়ে বাড়ী পৌঁছার পরে প্রতিদিন আমাদের ছাগল ভেড়াগুলো খেয়ে পরিতৃপ্ত এবং পালান ভর্তি দুধ নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। আমরা তা যথামত দোহন করে পান করতে লাগলাম, অথচ অন্যান্য লোকেরা এক কাতরা দুধ দোহাতে পাতো না। তাদের ছাগল-ভেড়ার পালানে এক ফোঁটা দুধও পেতো না। এমনকি আমাদের গোত্রের লোকেরা রাখাদের বলতে লাগলো, “আবু যুরাইবের কন্যার (হালীমা) রাখল যেখানে মেষ চরায় সেখানে নিয়ে চড়াবে।” রাখালরা আমার (হালীমার) মেষ চড়ানো সত্বেও মেষপাল ক্ষুধার্ত আবস্থায় ফিরে আসতো। এভাবে ক্রমেই আমার সংসার প্রাচুর্য ও সুখ-সমৃদ্ধিমে ভরে উঠতে লাগলো। এ অবস্থার ভেতর দিয়েই দু’বছর অতি বাহিত হলো এবং আমি শিশু মুহাম্মাদের (সা) দুধ ছাড়িয়ে দলাম। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে দ্রুত গতিতে তিনি বড় হতে লাগলেন। দু’বছর  বয়স হতেই তিনি বেশ চটপটে ও নাদুসনুদুস বালকে পরিনত হলেন। আমরা তাঁকে তাঁর মার কাছে নিয়ে গেলাম। তবে আমরা তাঁকে আমাদের কাছে রাখতেই বেশী আগ্রহী ছিলাম। আরণ তাঁর আসার পর থেকে আমর াবিপুল কল্যাণের অধিকারী হয়েছিলাম। তাঁর মাকে আমি বললাম, “আপনি যদি এই ছেলেকে আমার কাছে আরো হৃষ্টপুষ্ট হওয়া পর্যন্ত থাকতে দিতেন তাহলেই ভালো হতো। আমার আশংকা হয়, মক্কার রেগ-ব্যাধিতে বা মহামারিতে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন।” শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁকে আমাদের সাথে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।

আমরা তাঁকে নিয়ে ফিরে এলাম। এর মাত্র কয়েক মাস পরে একদিন তিনি তাঁর দুধভাই-এর সাথে আমাদের বাড়ীর পেছনের মাঠে মেষ শাবক চরাচ্ছিলেন। এমন সময়  তাঁর ভাই দৌড়ে এলো এবং আমাকে ও তাঁর পিতাকে বললো,“আমার ঐ কুরাইশী ভাইকে সাদা কাপড় পরিহিত দুটো লোক এসে ধরে শুইেেয় দিয়ে পেট চিরে ফেলেছে এবং পেটের সবকিছু বের করে নাড়াচড়া করছে।”

আমি ও তার পিতা-দুজনেই তাঁকে পড়িয়ে ধরলাম  এবং বললাম, “বাবা তোমার কী হয়েছে?” তিনি বললেন, “আমার কাছে সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক এসেছিলো। তারা আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার পেট চিরেছে। তারপর কি যেন একটা জিনিস খুঁজেছে, আমি জানি না তা কী?”

এরপর আমরা মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিয়ে নেজেদের বাড়ীতে ফিরলাম। আমার স্বামী বললেন, “হালীমা, আমার আশংকা, এই ছেলের ওপর কোন কিছুর আছর হয়েছে। কাজেই কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দাও।”

যথার্থই আমরা তাঁকে কাঁর মার কাছে নিয়ে গেলাম। তাঁর মা বললেন, “ধাত্রী বোন, তুমি তো ওকে কাছে রাখতে খুব উদগ্রীব ছিলে। কি হয়েছে যে, একে নিয়ে এলে?” আমি বললাম, “আল্লাহ আমাকে দু’টি ছেলের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। কোন অঘটন ঘটবে বলে আমার আশংকা হয়। এ নিয়ে আমার চিন্তার অবধি নেই। তাই আপনার ছেলেকে ভালোয় ভালোয় আপনার হাতে তুলে দিলাম।” আমিনা বললেন, “তুমি যা বলছো তা প্রকৃত ঘটনা নয়। আসল ব্যাপারটা কি আমাকে সত্য করে বলো।” এভাকে পুরো ঘটনা খুলে না বলা পর্যন্ত  তিনি আমাকে ছাড়লেন না। ঘটনা শুনে আমিনা বললেন, “তুমি কি তাহলে মনে করছো ওকে ভূতে ধরেছ্ ে”আমি বললাম, “হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “ওকে যখন গর্ভে ধারণ করেছি তখন স্বপ্নে দেখি, আমার দেহ থেকে একটা জ্যোতি বেরিয়ে এলো এবং তার প্রভায় সিরীয় ভুখ-ের বুসরার প্রসাদগুলে আলোকিত হয়ে গেল। অতঃপর সে গর্ভে বড় হতে লাগলো। আল্লাহর কসম, এত হালকা ও বহজ গর্ভধারণ আমি আর কখনো দেখিনি। যখন ওকে প্রসব করলাম তখন মটিতে হাত রাখা ও আকাশের দিকে মাথা উঁচু করা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলো। তুমি ওকে রেখে নির্দ্বিধায় চলে যেতে পার।”

বক্ষ বিদারনের ঘটনা

ইবনে ইসহাক বলেন,

সাওর ইবনে ইয়াযীদ কতিপয় বিদ্বান ব্যক্তির নিকট থেকে (আমার ধারণা, একমাত্র খালিদ বিন মা’দান আল কালয়ীর নিকট থেকেই) বর্ণনা করেছেন যে, কতিপয় সাহাবী একরার হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামকে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিজের সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, শোনো। আমি পিতা ইবরাহীমের দোয়ার ফল এবং ভাই ঈসার সুসংবাদের পরিণতি। আমি গর্ভে আসার পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর মধ্য এথকে একটা জ্যোতি বেরুলো যা দ্বারা সিরিয়ার প্রসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গেলো। আর বনু স’দ ইবনে বাক্র গোত্রে আমি ধাত্রীয় ােলে লালিত-পালিত হই। এই সময় একদিন আমার এক দুধভাই-এর সাথে আমেিদর (ধাত্রী মাতা হালীমার) বাড়ীর পেছনে মেষ চরাতে যাই। তখন সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক আমার কাছে আসে। তাদের কাছে একটা সোনার তশতরী ভর্তি বরফ ছিল। তারা আমাকে ধরে আমার পেট চিড়লো। অতঃপর আমার হৃদপি- বের করে তাও চিরলো এবং তা থেকে এক ফোটা কালো জমাট রক্ত বের করে তা ফেলে দিল। তারপর ঐ বরফ দিয়ে আমার পেট ও হৃদপি- ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। অতঃপর তাদের একজন অপরজনকে বললো : মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম) তাঁর উম্মাতের দশজনের সাথে ওজন কর। সে আমাকে পরিমাপ করলো এবং আমি দশজনের চাইতে বেশী হলাম অতঃপর সে আবার বললো : তাঁকে তাঁর উম্মাতের একশে জনের সাথে ওজন কর। আমি একশো জনের চাইতেও বেশী হলাম। অতঃপর সে আবার বললো :তাঁকে তাঁর উম্মাতের এক হাজার জনের সাথে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সাথে ওজন করলে আমি এবারও ওজনে তাদের চাইতে বেশী হলাম। অতঃপর সে বললো : রেখে দাও, আল্লাহর কসম, তাঁকে যদি তাঁর সমগ্র উম্মাতের সাথেও ওজন করা হয় তাহলেও তিনিই তাঁদের সবার চাইতে ওজনে বেশী হবেন।”

দাদার অভিভাবকত্বে

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম তাঁর মা আমিন বিনতে ওযাহাব ও দাদা আবদুর মুত্তালিব ইবনে হাশিমের জীবদ্দশায়ও আল্লাহর তদারক ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এই সময় আল্লাহ পতি দ্রুত তাঁর শারীরিক প্রবৃদ্ধি দান করেন, যাতে আল্লাহর ইস্পিত অলৌকিকত্ব তাঁর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যখন তাঁর বয়স হয় ছয় বছর, তখন মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘আবওয়া’ নামক স্থানে তাঁর মাতা ইনতিকাল করেন। সেখানে শিশু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামকে সাথে নিয়ে তিনি বনী আদ ইবনে নাজ্জার গোত্রে মুহাম্মাদের (সা) মামাদের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। মক্কা অভিমুখে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ইনতিকাল করেন। মায়ের ইনতিকালের পর হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম দাদা আবদুল মুত্তালিবের একক তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে থাকেন। আবদুল মুত্তালিবের জন্য কা’বা শরীফের ছায়ায় চাদর বিছানো হতো। আবদুল মুত্তালিব সেখানে উপস্থিত না হওযা পর্যন্ত ঐ চাদরের আশে পাশে বসে থাকতো তাঁর পুত্র পৌত্ররা আবদুল মুত্তালিবের সম্মানার্থে কেই তাঁর ওপর বসতো না। কিন্তু দৃঢ়চেতা কিশোর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম এসেই বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়তেন। তাঁর চাচা তাঁকে ধরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব বলতেন, “তোমরা আমার পৌত্রকে বাধা দিও না। আল্লাহর কসম, সে এক অসাধারন ছেলে।” অতঃপর তাঁকে সাথে নিয়ে চাদরের ওপর বসতেন এবং তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে আদার করতেন। তাঁর সব কাজই তাঁর ভাল লাগতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস আট  বছর পূর্ণ হলে আবদুল মুত্তালিব মারা যান। আবরাহার হস্তী বাহিনী নিয়ে কা’বা শরীফ  আক্রমণ করার আট বছর পর তিনি মারা যান।

চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্বে

আবদুল মুত্তালিবের তিরোধানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। তৎকালে বনু লেহাব গোত্রের এক ব্যক্তি মানুষের দৈহিক লক্ষণসমূহ দেখে ভাগ্য বিচার করতো। সে যখন মক্কায় আসতো, কুরাইশরা তাদের ছেলেদের নিয়ে তার কাছে ভীড় জমাতো। সে ছেলেদের শরীরের ওপরে নজর বুলিয়ে তাদের ভাগ্য বলতো। অন্যদের সাথে আবু তালিবও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে উক্ত গণকের কাছে গেলেন। গণক তাঁর দিকে তাকালো এবং পরক্ষণেই যেন এবটু ভাবতে আরম্ভ করলো। ক্ষণিকের জন্য সে বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের কথা এড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর বললো, “এই বালককে নিয়ে একটু বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।” আবু তালিব বালক মুহাম্মাদের প্রতি গণকের অধিক মনোযোগ লক্ষ্য করে তাঁকে কৌশলে সরিয়ে দিলেন। এতে গণক বললো, “তোমাদের এ কি কা-! বালকটাকে আমার কাছে আবার  নিয়ে এসো। আল্লাহর কসম, এ এক অসাধারণ বালক।”

পাদ্রী বাহীরার ঘটনা

কিছুদিন পরের ঘটনা। আবু তালিব এক কাফিলার সাথে সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন বাণিজ্যোপক্ষে। যাত্রার প্রক্কালে বালক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম) তাঁর সাথে যাওয়ার আবদার করলেন। স্নেবিগলিত চাচা তাঁর আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আমি তাঁকে সাথে নিয়ে যাবো, তাঁকে রেখে আমি কক্ষণও কোথাও যাবো না।”

আবু তালিব তাঁকে সাথে নিয়ে সফরে বেরুলেন। কাফিলা বুসরা এলাকায় পৌঁছলে যাত্রবিরতি করলো। সেখানে ছিলেন বাহীরা নামে এক খৃস্টান পাদ্রী। এক গীর্জায় তিনি থাকতেন। ঈসায়ী ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী। দীর্ঘকাল ব্যাপী ঐ গীর্জায় একখানা আসমানী কিতাব রক্ষিত ছিলো। পুরুষানুক্রমে ঐ জ্ঞানের উরাধিকার চলে আসছিলো। বাহীরর কাছ দিয়ে ইতিপূর্বে তারা প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু তিনি কারো সামনে বেরুতেন না বা কারো সাথে কথা বলতেন না। কিন্তু এই বছর যখন কুরাইশদের কাফিলা আবু তালিব ও বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ ঐ স্থানে বাহীরার গীর্জার পাশে যাত্রাবিরতি করলো তখন বাহীরা তাদের জন্য প্রচুর খাদ্যের ব্যবস্থা করলেন।

কথিত আছে বাহীরা তাঁর গীর্জায় বসেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পান। তিনি কাফিলার এগিয়ে আসার সময় দেখেন যে, সমগ্র কাফিলার মধ্যে একমাত্র বালক মৃহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই আকাশ থেকে একখ- মেঘ ছায়া দিয়ে চলেছে। অতঃপর তারা একটা গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলে মেঘ এবং সেই গাছের ডালপালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঝুঁকে ছায়া দিতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে বাহীরা গীর্জা থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং লোক পাঠিয়ে কাফিলার লোকদেরকে বলে পাঠালেন, “হে কুরাইশ বনিকগণ, আমি আপনাদের জন্য খাওয়ার বন্দোবন্ত করেছি। আপনাদের মধ্যে ছোটবড় দাস বা মনিব সবাইকে এসে খাদ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি।” কুরাইশদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বললো, হে বাহীরা, আজকে আপনি নতুন মহিমায় ম-িত হয়েছেন। ইতপূর্বে আমরা বহুবার আপনার নিকট দিয়ে যাতায়াত কেরছি। কিন্তু কখনো আপনি এরূপ আতিথেয়তা দেখাননি। আজকে আপনার এরূপ করার কারণ কি?” বাহীরা বললেন, “সে কথা ঠিকই। আগে আমি কখনো এরূপ করিনি। তবে আজ আপনারা আমার অতিথি। তাই মনের ইচ্ছা আপনাদের যত্ন করি,আপনাদের জন্য খাবার তৈরী করি এবং আপনার সকলেই খাবার গ্রহণ করুন।”

অতঃপর সকলেই খেতে গেলেন। কিন্তু অল্পবয়স্ক হবার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফিলার বহরের সাথে গাছের ছায়ায় বনে রইলেন। খাওয়ার জন্য সমবেত কুরাইশী বণিকদের সবাইকে ভালভাবে পরখ করে বাহীরা সেই পরিচিত হাব-ভাব ও চালচনের কোন লক্ষণ দেখতে পেলে না, যা বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন। তাই তিনি বললেন, হে কুরাইশী অতিথিবৃন্দদ, আপনাদের কেউই যেন আমার খাবার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না থকেন।” তারা বললেন, “হে বাহীরা, যারা এখনে আসার মত তারা সবাই এসেছেন। শুধুমাত্র একটি বালক কাফিলার বহরে রয়েছে। সে কাফিলার মধে কনিষ্ঠতম।” বাহীরা বললেন, “না, তাঁকে বাদ রাখবেন না। তাঁকেও ডাকুন। সেও আপনাদের সাথে খাবার গ্রহণ করুক।” জনৈক কুরাইশী বললো, “লাত-উয্যার শপথ, আবদুল্লাহ ইবনে আবুদল মুত্তালিবের ছেলে আমাদের সাথে থাকবে অথচ আমাদের সাথে খাবার গ্রহণ করবে না। এটা হতে পারে না। এটা আমাদের জন্য নিন্দনীয় ব্যাপার।” একথা বলেই সে উঠে গিয়ে বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে কোলে করে নিয়ে এলো এবং সবার সাথে খাবারের বৈঠকে বসিয়ে দিলো। এই সময় বাহীরা তাঁর সমগ্র অবয়ব গভীরভাবে দেখতে লাগলেন এবং দেহের বিশিষ্ট নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর বিবরণ তিনি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে পেয়েছেন। সমাগত অতিথিদের সকলের খাওয়া শেষ হলে এবং তারা এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলে বাহীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, “হে বৎস, আমি তোমাক লাত ও উয্যার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, আমি যা জিজ্ঞেস করবো তুমি তার জবাব দেবে।” বাহীরা লাত ও উয্যার দোহাই দিলেন এই জন্য যে, তিনি কুরাইশদেরকে পরস্পর কথাবার্তা বলার সময় ঐ দুই মূর্তির শপথ করতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে লাত-উয্যার দোহাই দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ, আমি ঐ দুই দেবতাকে সর্বাধিক ঘৃণা করি।” বাহীরা বললেন, “আচ্ছা তবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, যা জিজ্ঞেস করবো তার জবাব দেবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, কি কি জানতে চান বলুন।” অতঃপর বাহীরা তাঁকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তাঁর ঘুমন্ত অবস্থার কথা, তাঁর দেহের গঠন-প্রকৃতি ও অন্যান্য অবস্থার কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সব প্রশ্নের যা জবাব দিলেন, তা বাহীরার জানা তথ্যের সাথে হুবহু মিলে গেল। তারপর তিনি তাঁর পিঠ দেখলেন। পিঠে দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওয়াতের মোহর অংকিত দেখতে পেলেন। মোহর অবিকল সেই জায়গায় দেখতে পেলেন যেখানে বাহীরার পড়া আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুসারে থাকার কথা ছিল।

এসব করার পরে বাহীরা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, “বালকটি আপনার কে?” তিনি বললেন, “আমার ছেলে।” বাহীরা বললেন, “সে আপনার ছেলে নয়। এই ছেলের পিতা জীবিত থাকতে পারে না।” আবু তালিব বললেন,“বালকটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।” বাহীরা বললেন, “ওর পিতার কি হয়েছিল?” আবু তালিব বললেন, “এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে।” বাহীরা বললেন, “এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে।” বাহরিা বললেন, “ঠিক, এ রকম হওয়ার কথা। আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গৃহে ফিরে যান। খবরদার, ইয়াহুদীদের থেকে ওকে সাবধানে রাখবেন। আল্লাহর কসম, তারা যদি এই বালককে দেখতে পায় এবং আমি তার যে নিদর্শন দেখে চিনেছি তা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা ওর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে। কেননা আপনার এ ভ্রাতৃষ্পুত্র অচিরেই এক মহা মহামানব হিসাবে আবির্ভূত হবেন।”অতঃপর তাঁকে নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে গেলেন।

ফিজারের যুদ্ধ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিশ বছরের তরুন, তখন ফিজার যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। ফিজার যুদ্ধ নামকরনের কারণ এই যে, এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিনানা ও কাইস ঈলান গোত্রদ্বয়ের উভয়েই তাদের পরস্পরের নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ লংঘন করেছিল। কুরাইশ ও কিনানার যৌথ বাহিনীর নেতা ছিলেন হারব ইবনে উমাইয়া। দিনের প্রথমাংশে যুদ্ধে কাইস কিনানাকে পরাজিত করে। কিন্তু দিনের মধ্যাহ্ন ভাগে কিনানা জয়ী হয়।[১৫.ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিজার যুদ্ধে কয়েকদিন অংশগ্রহণ করেন। তাঁর চাচারা তাঁকে সঙ্গে করে রণাঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ও বর্শাগুলো প্রতিহত করতাম এবয় তা কুড়িয়ে এনে চাচাদের হাতে তুলে দিতাম।” এটা ছিল সর্বশেষ ফিজার যুদ্ধ। এটি ফিজার আল-বারাদ নামে খ্যাত। ইতপূর্বে আরো তিনটি ফিজার যুদ্ধ সংগটিত হয়েছিল। প্রথমটি কিনানা ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে, দ্বিতীয়টি কুরাইশ ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে এবং তৃতীয়টি কিনানা ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে।]

খাদীজা রাদিয়ল্লাহ আনহার সাথে বিয়ে

খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি লোকজনকে নির্দিষ্ট বেতনে ও লভ্যাংশের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে নিয়োগ করতেন। ব্যবসায়ী গোত্র হিসেবে কুরাইশদের নাম-ডাক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মহত্ত্বের কথা জানতে পেরে তিনি তাঁর কাছে লোক পাঠিয়ে তাঁর পণ্যসামগ্যী নিয়ে সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বললেন যে, এজন্য তিনি অন্যদেরকে যা গিয়ে থাকেন তার চেয়ে উত্তম সম্মানী তাঁকে দেবেন। মাইসারাহ নামক এক কিশোরকেও তাঁর সাহায্যের জন্য সঙ্গে দিতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং খাদীজার পণ্য সামগ্রী ও দাস মাইসারাহকে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন। অনতিবিলম্বে তিনি সিরিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন।

সিরিয়ায় পৌঁছে তিনি জনৈক ধর্মযাজকের গীর্জার নিকটবর্তী এক গাছের নীচে বিশ্রাম করলেন। ধর্মযাজক মাইসারাহকে জিজ্ঞেস করলেন, “গাছটির নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি কে?” মাইসারাহ বললেন, “তিনি হারামের অধিবাসী জনৈক কুরাইশ বংশীয় ব্যক্তি।” ধর্মযাজক কললেন, “এই গাছের নীচে নবী ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি!”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আনীত পণ্য বিক্রি করে দিলেন এবং নতুন কিছু জিনিস ক্রয় করলেন। অতঃপর তিনি মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। পথে যেখানেই দুপুর হয় এবং প্রচ- রৌদ্র ওঠে, মাইসারাহ দেখতে পায় যে, দু’জন ফিরিশতা মুহাম্মাদকে ছায়া দিয়ে রৌদ্র থেকে রক্ষা করেছে এবং তিনি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে এগিয়ে চলেছেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি খাদীজাকে তাঁর ক্রয় করা পণ্যদ্রব্য বুঝিয়ে দিলেন। খাদীজা ঐ মাল বিক্রি করে প্রয় দ্বিগুণ মুনাফা লাভ করলেন। মাইসারাহ খাদীজাকের যাজকের বক্তব্য ও নবীকে (সাঃ) দুই ফিরিশতার ছায়াদানের বিষয় অবহিত কললেন। খাদীজা ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বুদ্ধিমতি ও সম্ভ্রান্ত মহিলা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব ও সততার সাথে পরিচিত হওয়া তার জন্য একটা অতিরিক্ত সৌভাগ্য রূপে বিবেচিত হলো, যা নিছক আল্লাহর ইচ্ছাক্রমেই তিনি লাভ করলেন। মাইসারাহ কাছে উক্ত অলৌকিক ঘটনার কথা শুনে খাদীজা লোক পাঠিয়ে তাঁকে বললেন, “ভাই, আপনাদের গোত্রের মধ্যে আপনার যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, যে আত্নীয়তার বন্ধন এবং সর্বোপরি আপনার বিশ্বস্ততা, চরিত্রমাধুর্য ও সত্যবাদিতার যে সুনাম রয়েছে, তাতে আমি মুগ্ধ এবং অভিভূত।” এই কথা বলে খাদীজা তাঁকে বিয়ে করার প্রন্তাব দেন। কুরাইশদের মধ্যে খাদীজা ছিলেন সর্বাপেক্ষা অভিজাত বংশীয়া, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত এবং অতিশয় ধনাঢ্য মহিলা। এ কারণে সম্ভব হলে তাঁর গোত্রের সকলেই তাঁকে বিয়ে করার অভিলাষ পোষণ করতো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার এ প্রস্তাব চাচাদেরকে জানালেন। চাচা হামযা খাদীজার পিতা খুয়াইলিদ ইবনে আসাদের (ইবনে আবদুল উযযা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই) সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলেন এবং বিয়ে সম্পন্ন হলো।[১৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মোহরানা হিসেবে খাদীজাকে ২০ টি উট দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম স্ত্রী এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননি।]

খাদীজার গর্ভে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একমাত্র ইবরাহীম ছাড়া সব সন্তান জন্মে তাঁরা হলেন : কানিম, তাহির তাইয়েব, যয়নব, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা। কাসিমের নামানুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবুল কাসিম নামেও খ্যাত হন। কাসিম ও তাহির জাহেলিাতের যুগেই মারা যান। কিন্তু মেয়েরা সবাই ইসলামের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে পিতার সাথে হিজরাত করেন।[১৭. বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তাহির ও তাইয়েব দুই ব্যক্তি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো এ দুটোই আবদুল্লাহর উপনাম। তাঁকে এই দুই নেিমই ডাকা হতো।]

 

ওয়ারারা বিন নওফেলের ভাষ্য

খাদীজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উযযা ছিলেন পূর্বতন আসমানী কিতাবে ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন একজন খৃস্টান প-িত। পার্থিব জ্ঞানেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। হযরত খাদিজা মাইসারাহর নিকট থেকে খৃস্টান ধর্মযাজকের যে মন্তব্য শুনেছিলেন এবং মাইসারাহ নিজে দুইজন ফেরেশতা কর্তৃক ভাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছায়াদানের যে দৃশ্য অবলোকন করেছিল তা ওয়ারাকাকে জানালেন। ওয়ারাকা বললেন, “খাদীজা, এ ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো যে, মুহাম্মাদ এ যুগের নবী। আমি জানতাম, বর্তমান মানক বংশধরদের কাছে একজন নবীর আগমন আসন্ন হয়ে উঠেছে এবং তাঁর প্রতীক্ষা করা হচ্ছে। এটা সেই নবীরই যুগ।” একথা বলে ওয়ারাকা প্রতীক্ষিত নবীর আগমণ অনেক বিলম্বিত হওয়ায় আক্ষেপ করতেন। অধীর অপেক্ষায় অনেক সময় তিনি বলতেন, “আর কত দেরী হবে!” এবাবে তিনি আক্ষেপ করে নীচের কবিতাটি আবৃত্তি করতেন :

[আরবী ************]

“আমি অত্যন্ত নাছোড়বান্দা হয়ে এমন এবটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে স্মরণ রেখে চলেছি, যা দীর্ঘদিন যাবৎ অনেককে ফুঁপিয়ে কাঁদতে উদ্বুদ্ধ করেছে। (সে বিয়য়টির) অনেক বিবরণের পর নতুন করে খাদীজার কাছ থেকেও বিবরণ (পাওয়া গেল), বস্তুতঃ হে খাদীজা, আমার প্রতীক্ষা খুবই দীর্ঘায়িত হয়ে গেছে। আমার প্রত্যাশা, মক্কার উচ্চভূমি ও নিম্নভূমির মধ্য থেকে তোমার বাস্তব রূপ প্রতিভাত হওয়া দেখতে পাই, যে কথা তুমি ঈসায়ী ধর্মযাজকের বলে জানিয়েছ। বন্তুতঃ ধর্মযাজকদের কথা বিকৃত করা আমি পছন্দ করি না।”

[আরবী ************]

“মুহাম্মাদ অচিরেই আমাদের সরদার ও নেতা হবেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীকে তিনি পরাজিত করবেন, আর দেশের সর্বত্র আলো ছড়াবেন, যে আলো দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি জগৎকে তিনি উদ্ভাসিত করে তুলবেন। যারা তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তাদেরকে তিনি পর্যুদস্ত করবেন আর যারা তাঁর সাথে আপোষকামী হবে তারা হবে বিজয়ী। হায় আফসোস! যখন এসব ঘটনা ঘটবে তখন যদি আমি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে তোমাদের সবার আগে আমিই তাঁর দলভুক্ত হতাম।”

পবিত্র কা’বার পুনর্নিমাণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর তখন কুরাইশগণ পবিত্র কা’বার ভবন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল পবিত্র কা’বার ছাদ তৈরি করা। কেননা ছাদ নির্মাণ না করলে দেয়াল ধসে যাওয়ার আশংকা ছিল। ঐ সময় কা’বার দেয়াল সাড়ে তিন হাতের সামান্য বেশী উঁচু ছিল এবং তাও শুধুমাত্র পাথরের ওপর পাথর সজিয়ে নির্মিত ছিল। কোন গাঁথুনি ছিল না। ঘটনাক্রমে ঐ নময় জনৈক রোমান ব্যবসায়ীর এক ব্যবসায়ীর একখানি জাহাজ সমুদ্রের প্রবাহের সাথে ভেসে জিদ্দার উপকৗলে এন আছড়ে পড়ে এবং ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায। এই জাহাজের তক্তাগুলো কুরাইশরা নিয়ে যায় এবং পবিত্র কাবার ছাদ তৈরীর কাজে ব্যবহার করার জন্য তা ছেঁটেকেচে ঠিকঠাক করে। মক্কায় জনৈক মিসরীয় রাজমিন্ত্রীরও আবির্ভাব ঘটে এবই সময়। পবিত্র কা’বার সংস্কার সাধনে তার দ্বারা কিছু কাজ নেয়া যাবে বলে কুরাইশগণ মনে মনে স্থির করে ফেলে। পবিত্র কা’বা সংলগ্ন কূপ থেকে তখন একটা সাপ প্রতিদিন উঠে আসতো এবং কা’বার দেয়ালের ওপরে বসে রোদ পোহাতো। যে কূপ থেকে সাপটা উঠে আসতো তার মধ্যে কা’বার জন্যপ্রতিদিন উৎসর্গীকৃত জিনিসসমূহ নিক্ষেপ করা হতো। সাপের কারণে কুরাইশগণ আতংকিত ছিল। কেননা সাপটা এমন ভয়ংকর ছিল যে, কেউ তার ধারেও ঘেঁষতে পারতো না। কেউ তার কাছে গেলেই ফনা বিস্তার করে সশব্দে চামড়ায় চামড়া ঘষে মোচড় খেতো এবং মুখ ব্যাদান করতো। এভাবে একদিন সাপটি যথন পবিত্র কা’বার দেয়ালের ওপর রোদ পোহাচ্ছিলো তখন আল্লাহ সেখানে একটা পাখী পাঠালেন। পাখী সাপটাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। তখন কুরাইশগণ আশ্বস্ত হয়ে বরলো : আশা করা যায় যে, আল্লাহ আমাদের ইচ্ছায় সম্মতি দিয়েছেন। আজ আমাদের কাছে একজন প্রীতিভাজন মিস্ত্রী রয়েছে, প্রয়োজনীয় কাঠের যোগাড় হয়ে গেছে। আর সাপের হাত থেকেও আল্লাহ নিষ্কৃতি দিয়েছেন।

অতঃপর তারা কা’বার দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে নির্মণের আয়েজন করলো। এই সময় আবু ওয়াহাব ইবনে আমর ইবনে আয়েয ইবনে ইমরান ইবনে মাখযূম উঠে কা’বার একটা পাথর বিচ্ছিন্ন করে হাতে তুলে নিল। কিন্তু পাথরটি তৎক্ষণাৎ তার হাত থেকে সটকে পড়লো এবং যেখানে তা ছিল সেখানে পুনঃস্থাপিত হলো। এ আশ্চর্য ব্যাপার দেখে সে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা এই কা’বার ভবন র্মিাণে শুধু তোমাদের বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ নিয়েজিত কর। এত ব্যভিচার, সুদ কিংবা উৎপীড়ন দ্বারা অর্জিত সম্পদ ব্যয় করো না।”

অতঃপর কুরাইশগণ কা’বার গৃহনির্মণের কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেল। দরজার অংশ নির্মাণের ভার বনু আবদ মানাফ ও যুহরার ভাগে, রুকনে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যবর্তী অংশ নির্মাণের ভার বনী মাখযূম গোত্রের ভাগে এবং তাদের সাথে আরো কয়টি কুরাইশ গোত্র যুক্ত হলো, কা’বার মেঝে নির্মাণের ভার বরী জুমাহ ও বনী সাহামের ভাগে, আর হাজরে আসওয়াদ সংলগ্ন অংশ বনী আবদুদদার, বরী কুসাই ও বনী আসাদ ইবনে আবদুল উয্যা ও বনী আদী ইবন কা’বের ভাগে পড়লো।

এবার ভাঙ্গার  কাজে হাত দেয়ার পালা কিন্তু এ কাজে হাত দিতে প্রত্যেকেই এক অজানা ভয়ে ভতি হয়ে পড়লো। তখন ওয়ালীদ ইবনুল মুগিিরা ঘোষণা করলো, “ আমিই ভাঙ্গার কাজ শুরু করছি। এই বলে সে কোদাল হাতে নিয়ে জীর্ণ ভবনের এক প্রান্তে গাঁড়িয়ে বরলো, “হে আল্লাহ, তোমার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হইনি এবং আমরা যা করছি তা সদুদ্দেশ্যেই করছি।” অতঃপর রুকনে ইয়ামানী ও বুকনে আসওয়াদের কোণ থেকে খানিকটা ভেঙ্গে ফেললো। পরবর্তী রাত সবাই উৎকণ্ঠার সাথে কাটালো। সবাই কললো, “দেখা যাক, ওয়ালীদের ওপর কোন আপদ আসে কিনা। যদি তেমন কিছু হয় তাহলে ভাঙবো না। বরং যেটুকু ভাঙ্গা হয়েছে তা আবার জুড়ে সাবেক অবস্থায় বহাল করবো। অন্যথায় বুঝবো আল্লাহ আমাদের উদ্যোগে সন্তুষ্ট। অবশিষ্ট অংশও ভেঙ্গে ফেলবো।” ওয়ালীদ পরদিন সকালে স্বাভাবিকভাবে আরদ্ধ কাজে ফিরে এলো। এবং কা’বার দেয়াল ভাঙতে আরম্ভ করলো। তার সাথে অন্যান্য লোকেরাও ভাঙতে লাগলো। এ ভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নির্মিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে থামলো। অতঃপর তারা সবাই উটের পিঠের কূজাকৃতির দুর্লভ সবুজ পাথর সংগ্রহ করতে গেল, যার একটা আর একটার সাথে লেগে থাকে।[১৮. কোন কোন বর্ণনায় বরা হয়েছে, পাথরগুলো বর্শার ফলকের ন্যায় সবুজ।]

অতঃপর কুরাইশ গোত্রগুলো কাবা পুনঃনির্মাণের উদ্দেশ্যে পাথর সংগ্রহ করলো। প্রত্যেক গোত্র আলাদা ভাবে সংগ্রহ করলো ও পুনঃনির্মাণের কাজ সমাধা করলো। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন হলে এবার তা যথাস্থানে কে স্থাপন করবে তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হরো। হাজরে আসওয়াদ তুলে নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করার সম্মান লাভের বাসনা প্রত্যেকেরই প্রবল হয়ে উঠলো। এ নিয়ে গোত্রগুলো সংঘবদ্ধ হতে লাগলো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

বর্ণিত আছে যে, ঐ সময় সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনুল মুগীরা নিম্নরূপ আহ্বান জানালেন, “হে কুরাইশগণ, এই পবিত্র মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই তোমরা এই বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব দাও।” সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। অতঃপর দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম  প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, “এতো আমাদের আল আমীন (পরম বিশ্বস্ত) মুহাম্মাদ তাঁর ফায়সালা আমরা মাথা পেতে নেব।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাদমান লোকদের কাছাকাছি গিয়ে উপনীত হলে সবাই তাঁকে তাদের বিবাদের বিয়য়টা জানালে তিনি করলেন, “আমাকে একখানা কাপড় দাও।” কাপড় দেয়া হলে তিনি তা বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদ উক্ত কাপড়ের মধ্যস্থলে স্থাপন করে বললেন “প্রত্যেক গোত্রকে এই কাপড়ের চারপাশ ধরতে হবে।” সবাই তা ধরলো ও উঁচু করে যথাস্থানে নিয়ে রাখলো। অতঃপর তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে যথাস্থানে রাখলেন ও তার উপর গাঁথুনি দিলেন।

আরব গণক, ইহুদী পুরেহিত ও খৃস্টান ধর্মযাজকদের ভবিষ্যদ্বাণী

ইহুদী পুরেহিত, খৃস্টান ধর্মযাজক ও আরব গণকগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছিলেন যে, তাঁর আগমনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ইয়াহুদ ও খৃস্টান যাজক সম্প্রদায় এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তাদের স্ব স্ব আসমানী কিতাবে বর্ণিত শেষ নবী ও তাঁর আবির্ভাবের সময়ের লক্ষণসমূহ বিচার করে এবং তাদের নবীগণ তাঁর সম্পর্কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন তার নিরিখে আর আরব গণকের ভবিষ্যদ্বাণীর উৎস ছিল ফিরিশতাদের কথাবার্তা আড়ি পেতে শ্রবণকারী জিনদের কাছ থেকে পাওয়া খবর। তখনও উল্কাবাণ নিক্ষেপ করে শয়তানদেরকে বিতাড়িত করতেঃআড়িপাতা থেকে নিবৃত্ত করা হতো না। এই শয়তানরা গণক নারী-পুরুষদের কাছে আসতো। ফলে তারা মাঝে মাঝে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে কিছু কিছু পূর্বাভাস দিত। সাধারণ আরবরা এ সব পূর্বাভাসে তেমন কর্ণপাত করতো না। কিন্তু হযরতের আবির্ভাব ঘটার পর এবং আভাস দেয়া লক্ষণগুলো বাস্তবে সংঘঠিত হবার পর সকলেই তা জানতে ও উপলব্ধি করতে পালো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের সময় যখন আসন্ন হয়ে উঠলো তখন শয়তানদের আড়িপাতা বন্ধ করা হলো এবং যেসব ঘাঁটিতে বসে তারা আড়িপাততো সেসব ঘাঁটিতে তাদের আনাগোনা উল্কাবাণ নিক্ষেপ করে বন্ধ করা হলো। এতে জিনরা বুঝতে পারলো যে, এ পদক্ষেপ সৃষ্টিজগতে আল্লাহর কোন বিশেষ  প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা বলবৎ করার লক্ষ্যেই গৃহীত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহর (সা) দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

ইবনে হিশাম বলেন,

হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র মাহাম্মাদের পুত্র ইবরাহীম থেকে গুফরার আযাদকৃত দাস উমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক ও চারিত্র্রিক বৈশিষ্ট্যের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

আলী ইবনে আবু তালিব যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করতেন তখনই বলতেন, “তিনি অধিক লম্বা ছিলেন না, আবার খুব বেঁটেও ছিলেন না বরং তিনি উচ্চতায় মধ্যম আকৃতির ছিলেন। তাঁর চুল অত্যধিক কুঞ্চিত ছিল না আবার একবারে অকুঞ্চিতও ছিল না। বরং তা কিঞ্চিত কোঁকড়ানো। তিনি খুব বেশী স্থুল বা মোটা  দেহের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর মুখম-ল একেবারে গোলাকার ও ক্ষুদ্র ছিলনা। চোখ দুটো ছিল কালো। লম্বা  ভ্রƒ-যুগল, গ্রন্থি’র হাড়গুলো ও দুই স্কন্থের মধ্যবর্তী হাড়টি ছিল উঁচু ও সুস্পষ্ট। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল হালকা লোমে আবৃত। হাত ও পায়েরপাতা ছিল পুষ্ট, চলার সময় পা দাবিয়ে দিতেন না, মনে হতো যেন কোন নিম্ন ভূমিতে নামছেন। কোনদিকে ফিরে তাকালে গোটা শরীর নিয়ে ফিরতেন। তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে নবুওয়াতের সীল বা মোহর লক্ষণীয় ছিল। বস্তুতঃ তিনি ছিলেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ দানশীল, শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক ও মিশুক। প্রথম নজরে তাঁকে দেখে সবাই ঘাবড়ে যেতো।” তাঁর প্রশংসাকারী আলী (রা) বলেন, “তাঁর মত মানুষ তাঁর আগেও দেখিনি পরেও দেখিনি।”

ইনজীলে রাসূলুল্লাহর (সা) বিবরণ

ইবনে ইসহাক বলেন,

হযরহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঈসা আলাইহিস্ সালামের যে বিবরণ ও প্রতিশ্রুতি ঈসার সহচর ইউহান্না কর্তৃক সংকলিত ইনজীলে বর্ণিত হয়েছে যা স্বয়ং ঈসা আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত ওহী অনুসারে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, আমার জানা মতে তা এইঃ

“যে ব্যক্তি আমাকে হিংসা ও ঘৃণা করে, সে স্বয়ং আল্লাহকে ঘৃণা করে। যেসব কাজ আর কেউ কখনো করেনি, তা যদি আমি তোমাদের সামনে করে না দেখাতাম, তাহলে তাদের (অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের ) কোন দোষ হতো না। কিস্তু এখন তারা আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা ভেবেছে যে, এভাবে তারা আমাকে ও আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে। এসব ঘটেছে এজন্য যাতে খোদায়ী গ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়। বস্তুতঃ তারা অন্যায়ভাবে আমাকে ঘৃণা করেছে। ‘মানহামান্না’Ñযাকে আল্লাহ পাঠাবেন- যদি তোমাদের কাছে আসেন, তবে তিনিই আমার পক্ষে স্ক্ষ্য দেবেন। তিনি আল্লাহর নিকট থেকে আগত পবিত্র আত্না। আর তোমরাও অবশ্যই আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কারণ প্রথম থেকেই তোমরা আমার সঙ্গে আছ। আমি তোমাদের কে এ সমস্ত কথা এজন্য বললাম, যাতে তোমরা অভিযোগ না করতে পার। [১৯.বাইবেল যোহন ১৫:২৩-৩৬ দ্রষ্টব্য।] সুরিয়ানী ভাষায় ‘মুনহামান্না’ অর্থ মুহাম্মাদ। আর রোমান ভাষায় এর প্রতিশব্দ হরো ‘বারাকলিটাস।’

 

নবুওয়াত লাভ

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস যখন চল্লিশ বছর হলো, আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণাস্বরূপ এবং গেটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁরা নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদরেকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সেই অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।

আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন, “আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের সমই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।”

আবদুল মালিক ইবনে উবাইদুল্লাহ বর্ণনা বলেনঃ

আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও মার্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুওয়াতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে  বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!” ( হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি সালাম)। এ কথা শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশে-পাশে ডানে-বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিছুদিন কেটে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শুন্তে ও দেখতে থাকলেন। অতঃপর রমযান মাসে তিনি যখন হেরা গুহায় [২০. মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের গুহার নাম হেরা।] অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে পরম সম্মান ও মর্যাদার বাণী বহন করে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এলেন।

উবাইদ ইবনে ‘উমাইর থেকে বর্ণিত আছে যে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এক মাস হেরা গুহায় কাটাতেন। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও এই একইভাবে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে নিভৃত তপস্যায় মগ্ন হতো। প্রতি বছর একটা মাস তিনি এভাবে নির্জনে ইবাদাত করে কাটাতেন। উক্ত মাসে তাঁর কাছে যত দরিদ্র লোকই থাকতো তাদেরকে তিনি খাবার দিতেন। এক মাসের এই নির্জনবাস সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার আগে সর্বপ্রথম কা’বা শরীফে প্রবেশ করে সাতবার বা ততোধিক বার তাওয়াফ করতেন এবং একাজ করার পরই কেবল বাড়ীতে ফিরে আসতেন। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক তাঁকে পরম সম্মানে ভূষিত করার মাসটি অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির বছরের রমযান মাস সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি হেরায় অবস্থানের জন্য রওয়ানা হলেন। অবশেষে সেই মহান রাতটি এলো, যে রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রিসালাত দিয়ে গৌরবান্বিত করলেন। এই সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম তাঁর কাছে আসলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এই অবস্থায় জিবরীল একখ- রেশমী কাপড় নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখ-ে কিছু লেখা ছিল। জিবরীল আমাকে বললেন, “পড়ুন”! আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।”

তখন তিনি আমাকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, আমি ভাবলাম, মরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন!” আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।” তিনি পুনরায় আমাকে সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এবারও চাপের প্রচ-তায় আমার মৃত্যুর আশংকা হলো। আবার তিনি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, “পড়ৃন”! আমি বললাম, “কি পড়বো?” তিনি বললেন, “ইকরা বিসমি রাব্বিকা....। অর্থাৎ পড়ুন আপনার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন, আর আপনার প্রভু সদাশয় অতি। তিনিই কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সেইসব জিনিস শিক্ষ দিয়েছেন যা সে জানতো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এই পর্যন্ত পড়িয়েই জিবরীল থামলে এবং তারপর চলে গেলেন। এরপর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হলো যেন আমি আমার মানসপটে কিছু লিখে নিয়েছি এরপর আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম “ হে মুহাম্মাদ, আপনি আল্লাহর রাসুর এবং আমি জিবরীল।” আমি ওপরে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম. জিবরীল একজন মানুষের আকৃতিত আকাশের দূর দিগন্তে ডানা দু’খানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মাদ আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরীল।” আমি স্তব্ধ হযে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এইরূপ নিশ্চলভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পিছনে সরতে বা সামনে এগুতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। এই সময় খাদীজা আমাকে খুঁজতে লোক পাঠালো। মক্কার উঁচু এলাকায় পৌঁছে তারা আবার খাদীজার কাছে ফিরে গেল। অথচ আমি তখনো ঐ একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর জিবরীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে চললাম। খদীজার কাছে উপনীত হয়ে তার কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম। সে বললো, “হে আবুল কাসিম, আপনি কোথায় ছিলেন? আমি আপনার খোঁজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কার উচ্চভূমিতে আপনাকে খুজে ফিরে এসছে।” আমি যা কিছু দেখেছিলাম সবকিছু খাদীজাকে খুলে বললাম। খাদীজা বললো, “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলেছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

অতঃপর খাদীজা কাপড়-চোপড়ে আবৃত হয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদীজার চাচাতো ভাই। তিনি খ্রস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপ-িত ছিলেন। বিশেষতঃ তাওরাত ও ইনজীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা ও শোনা সমস্ত য়টনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে ওয়ারাকা বলে উছলেন, “কুদ্দূসুন কদ্দূসুন! মহা পবিত্র ফেরেশতা! মহা পবিত্র ফেরেশতা!! আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মাদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন। বস্তুতঃ মুহাম্মাদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। [২১.সুহাইলী বলেনঃ ঈসা (আ) সময়ের ব্যবধানের দিক দিয়ে নিকটতর নবী হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারাকা তার পরিবর্তে মূসার নামোল্লেখ করলেন এই যে, ওয়ারাকা তখন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর খৃস্টানদের মতে হযরত ঈসা (আ) নবী নন। বরং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হয়রত ঈসা (আ) আল্লাহ তায়ালার তিনটি সত্তার একটি যা ঈসার সত্তায় একাকার হয়ে গিয়েছে। খৃস্টানদের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।]তাঁকে বলো, তিনি যেন অবিচল থাকেন।”

খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গিলেন এবং ওয়ারাকা যা বলেছেন তা তাঁকে জানালেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেরা গুহায় মাসব্যাপী ইবাদাত শেষ হলে তিনি মক্কায় ফিরে যথারীতি কা’বার তাওয়াফ করতে শুরু করলেন। এই সময় ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, তুমি যা দেখেছো ও শুনেছো- বলতো।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সমস্ত ঘটনা কললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, “নিশ্চিত জেনো, তুমি এ যুগের মানব জাতির নবী। সেই মহাদূতই তোমার কাছে এসেছিলেন যিনি মূসার কাছেও আসতেন। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমাকে দেশান্তরিত করা হবে এবং তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন জীবিত থাকি তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” অতঃপর ওয়ারাকা তাঁর  কাছে মাথা এগিয়ে নিয়ে এলেন  এবং তাঁর কপালে চুমু খেলেন। তাওয়াফ সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ী ফিরে গেলেন।

কুরআন নাযিলের সূচনা

পবিত্র রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল শুরু হয়। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন,

“রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানব জাতির জন্য পথনির্দেশক রূপে, হিদায়াতের সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ সহকারে, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে।”

মহান আল্লাহ আরো বলেন.

“আমি এই কুরআন লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। লাইলাতুল কদর কী তা কি তুমি জানো? লাইলাতুল কদর সহস্র মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ফিরিশতাগণ ও জিবরীল অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের ইচ্ছায় ওবং প্রভাত হওয়া পর্যন্ত এ রাত শান্তিময় হয়ে থাকে।”(সূরা কদর)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,

“হা-মীম! সুস্পষ্ট গ্রন্থের শপথ! নিশ্চয়ই এই কিতাবকে আমি একটি কল্যাণময় রজনীতে নাযিল করেছি। নিশ্চিতভাবে নিশ্চিভাবেই আমি সাবধান করতে চেয়েছি। এ ছিল এমন এক রাত, যে রাতে আমার হুকুমে সকল বিষয়ের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফায়সালা করা হয়। আর আমি একজন রাসূল পাঠাতে চাচ্ছিলাম।”(সুরা দুখান)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,

“তোমরা যদি আল্লাহর ওপর এবং আমার বান্দার ওপর পৃথকীকরণ ও দুই দলের মুখোমুখী হওয়ার দিনে আমি যা নাযিল করেছি তার ওপর ঈমান এন থাক....” এখানে মুখোমুখী হওয়ার দিন অর্থ বদরের ময়দানে মুশরিকদের ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখোমুখী হওয়ার দিন।

খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদের ইসরাম গ্রহণ

খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনলেন। আল্লাহর কাছ থেকে যে প্রত্যাদেশ তিনি পেলেন তা সত্য বলে মেনে নিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের  কাজে তাঁকে সমযোগিতা করলেন। বস্তুতঃ তিনিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেন প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও তাঁকে সত্যরূপে গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।

এভাবে আল্লাহ তাঁর নবীর দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করেন। যখনই অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হতো, কেউ তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করতো ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো, তখন তিনি মর্মাহত হতেন। কিন্তু খাদীজার কাছে গেলেই আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর মনোকষ্ট দূর হয়ে যেতো। খাদীজা তাঁকে সান্ত¦না দিতেন, তাঁর মনের দুঃখ-বেদনা হালকা করে দিতেন, তাঁর দাওয়াতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে স্বীকৃতি দিতেন এবং মানুষের আচরণকে যাতে তিনি হালকাভাবে গ্রহণ করেন, সেজন্য অন্রপ্রণিত করতেন। আল্লাহ তাঁর (খাদীজার) ওপর রহমত নাযিল  করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এ কারণে আমি খাদীজাকে জান্নাতে এমন একটি গৃহের সুসংবাদ দিতে আদিষ্ট হয়েছি, যে গৃহ অনুপম কারুকার্যখচিত মুক্তার তৈরী এবং যেখানে কোন হৈ চৈ, দুঃখ-কষ্ট ও অসুস্থতা থাকবে না।”

ওহীর বিরতি

এরপর কিছুদিনের জন্য ওহী বন্ধ থাকে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠলো। এরপর জিবরীল (আ) তাঁর কাছে সূরা ‘আদ্ দুহা’ নিয়ে আবির্ভূত হলেন। যে মহান প্রতিপালক তাঁকে নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করেছেন তিনি ঐ সূরাতে শপথ করে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে ত্যাগ করেননি এবং তাঁর প্রতি বৈরীও হননি। মহান আল্লাহ বলেন, “মধ্যাহ্নের শপথ এবং তিমিরাচ্ছন্ন রজনীর শপথ!

তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেননি এবং পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি বৈরিও হননি।” অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, আর তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণ করার পর পুনরায় ভালোবেসেছেন এমনও হয়নি। “বস্তুতঃ তোমার জন্য পূর্বের অবস্থার চেয়ে পরবর্তী অবস্থাই ভালো।” অর্থাৎ আমার নিকট তোমার প্রত্যাবর্তনের পর তোমার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দুনিয়াতে তোমাকে যা দিয়েছি তার চেয়ে উত্তম। অবশ্যই তিনি তোমাকে অচিরেই এতো পরিমাণে প্রদান করবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ায় সাফল্য ও বিজয় এবং আখিরাতে প্রতিদান। “তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? আর তিনিই তোমাকে দিশেহারা দেখে পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং তোমাকে দরিদ্র অবস্থায় পেয়ে সম্পদশালী করেছেন।” এ আয়াত ক’টিতে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সম্মান এবং তাঁর মাতৃ-পিতৃহীন, সহায়-সম্বলহীন ও দিশেহারা অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি যে করুণা-অনুকম্পা দেখিয়েছেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাঁকে যে শোচনীয় দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। “অতএব তুমি ইয়াতীমের প্রতি ক্রোধ প্রদর্শন করো না এবং সাহায্য প্রার্থনাকারীকে ধমক দিও না।” অর্থাৎ আল্লাহর দুর্বল বান্দাদের ওপর ঐদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করো না এবং নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করোনা। “আর তোমার প্রতিপালকের দেয়া নিয়ামতের কথা প্রচার কর।” অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত প্রপ্তির মাধ্যমে যে অতুলনীয় সম্পদ ও অনুপম মর্যাদা তুমি লাভ করেছ, তার কথা মানুষকে জানাও ও তাদেরকে সেদিকে দাওয়াত দাও।

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি সংগোপনে তাঁর নিকটতম লোকদের মধ্য হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে দীন প্রচারে আত্ননিয়োগ করলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করে স্বয়ং তাঁর ওপর ও সমগ্র মানব জাতির ওপর যে মহা অনুগ্রহ করেছেন তার কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন।

প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী

পুরুষদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনেন, তাঁর সাথে নামায আদায় করেন, এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওহী মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন তাঁরই চাচা আবু তালিবের পুত্র আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর।

হযরত  আলীর (রা) ওপর আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ যে তাঁর কল্যাণ চেয়েছিলেন এবং সে জন্য তাঁর উপযোগী ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন, সেটা তাঁর ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায়। কুরাইশদের তখন ঘোর দুর্দিন। বহু সন্তানের পিতা হওয়ায় আবু তালিব নিদারুণ আর্থিক সংকটে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেক চাচা ছিলেন আব্বাস। তিনি ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে সচ্ছলতম ব্যক্তি। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আপনার ভাই আবু তালিব অধিক সন্তানের ভারে জর্জরিত। দেখতেই পাচ্ছেন মানুষ কি ভীষণ দুর্দশায় ভুগছে। আসুন, আমরা তাঁর সন্তান ভার লাঘব করি। তাঁর পুত্রদের মধ্য হ’তে একজনের দায়-দয়িত্ব আমি গ্রহণ করি আর অপর একজনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে দু’টি সন্তানের দায়-দায়িত্ব থেকে তাঁকে রেহাই দেয়া যাবে।”

আব্বাস বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই।”

অতঃপর তাঁরা উভয়ে গিয়ে আবু তালিবকে বললেন, “যতদিন দেশবাসী বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত হচ্ছে না ততদিনের জন্য আমর আপনার সন্তানদের ভার লাঘব করতে চাই।” আবু তালীব বললেন, “তোমরা আকীলকে আমার কাছে রেখে যাও। তারপর যাকে খুশী নিয়ে যাও।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আলীকে নিলেন এবং তাঁকে নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর আব্বস নিলেন জাফরকে এবং তাঁকে তিনি স্বীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। এরপর আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। তাই নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে আলী তাঁর ওপর ঈমান আনলেন ও তাঁকে নবী হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে তাঁর অনুসরন করতে লাগলেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, নামাযের সময় উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দুর্গম গিরি গুহায় চলে যেতেন, আর তাঁর সাথে আলীও যেতেন। কিন্তু এ কাজটি তাঁর পিতা, চাচা ও গোত্রের সকলের অগোচরে সঙ্গোপনে করতে থাকলেন।সেখানে তাঁরা দু’জনে গিয়ে নিভৃতে নামায পড়তেন এবং সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরতেন। এভাবেই তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন আবু তালিন তাঁদের দুজনকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, এটা আবার কোন দীন (ধর্ম) যার অনুসরণ তুমি করছো?” তিনি বললেন, “চাচা, এটা আল্লাহর দীন, তাঁর ফেরেশতাদের দীন, তাঁর নবী-রাসূলদের দীন। আর বিশেষতঃ আমাদের পিতা ইবরাহীমের দীন। আল্লাহ আমাকে রাসূল বনিয়েছেন এবং এই দীনসহ মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। হে চাচা, আমি যত লোককে এই  দীনের শিক্ষা দিয়েছি  এবং যত লোককে এই জীবন  বিধান গ্রহনের আহ্বান জনিয়েছি তাদের সবলের চাইতে আপনি এই দাওয়াত পাওয়ার অধিক হকদার। আর যত লোক আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করেছে এবং আমাকে কাজে সহযোগিতা করেছে তাদের তুলনায় আপনারই বেশী কর্তব্য এ আহ্বানে সাড়া দেয়া ও সহযোগিতা করা।”

আবু তলিব বললেন, “ভাতিজা, আমি আমার পূর্বপুরুযদের ধর্ম ও রীতিনীতি বর্জন করতে পারি না। তবে আল্লাহর কসম, আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার এ তৎপরতার দরুন তোমাকে কোন অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না।”

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন যালিদ ইবনে হারিস্ ইবনে শুরাহবীল ইবনে কা’ব ইবনে আবদুল উযযা। ইতিপূর্বে খাদীজার ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম ইবনে হিযাম ইবনে খুয়াইলিদ সিরিয়া থেকে যায়িদ ইবনে হারিসাসহ বেশ কযেকজন ক্রীতদাষ নিয়ে আসেন। একদিন তার ফুফু খাদীজা তার কাছে এলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খাদীজার বিয়ে হয়ে গেছে। হাকীম বললেনম, “ফুফু, আপনি এই দাসগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একজনকে পছন্দ করুন। যে ছেলেটিকেই আপনি পছন্দ করবেন তাকেই আমি আপনাকে দিয়ে দেব।” তিনি যায়িদকে পছন্দ করে নিয়ে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার কাছে যায়িদকে দেখে তাকে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা কে উপহার হিসেবে তাকে দিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করলেন। এটা ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের ঘটনা।

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বাক্র ইবনে আবু কুহাফা। তাঁর আসল নাম আতীক। আর আবু কুহাফার প্রকৃত নাম ছিল উসমান। আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও তাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কুরাইশদের ও তাদের ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁর মত বিচক্ষণ জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান লোক। গোত্রের  লোকেরা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পা-িত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। এ জন্য গোত্রের মধ্য থেকে যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতো ও তাঁর নিকট অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল, তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাঁর দাওয়াতে একে একে ইসলাম গ্রহণ করলেন উসমান এবনে আফফান, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। এই পাঁচজন এবং আবু বাক্র, আলূ ও যায়িদ-মোট আটজনই ছিলেন প্রথম মুসলিম। তাঁরাই প্রথম নামায কায়েম করেন ও ইসলামকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন।

এরপর আবু উবইদা ইবনুল জাররাহ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, [২২.আরকামের বাড়ী ছিল সাফা পাহাড়ের ওপর। এই বাড়ীতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হযরত উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশে পৌঁছার পূর্বে পর্যন্ত এভাবে গোপনে অবস্থান ও দাওয়াতের কাজ চলতে থাকে। চল্লিশজন পূর্ণ হবার পর তারা জনসমক্ষে আত্ন প্রকাশ করেন।]

উসমান ইবনে মাযউন এবং তাঁর দুই ভাই কুদামা ও আবুদল্লাহ, উবাইদা ইবনে হারেস, সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর ও তাঁর স্ত্রী উমার উবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা, আসমা বিনতে আবু বাক্র ও আয়িশা বিনতে আবু বাকর (আয়িশা তখন অল্পবয়স্কা বালিকা), খাব্বাব ইবনে আরাত, উমাইর ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মাসউদ ইবনে কারী, সালীত ইবনে আমর, আইয়াশ ইবনে আবু রাবীয়া ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সুলামা, খুনাইস ইবনে হুযাফা, আমের ইবনে রাবীয়া, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর ভ্রাতা আবু আহমদ, জাফর ইবনে আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, হাতেব ইবনে হারেস ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে মুজাল্লাল, তাঁর ভ্রাতা হুতাব ও তাঁর স্ত্রী ফুকাইহা বিনতে ইয়াসার, মা’মার ইবনে হারেস, সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউন, মুত্তালিব ইবনে আযহার ও তাঁর স্ত্রী রামলা বিনতে আবু আউফ, নাহহাম তথা নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ, আমের ইবনে ফুহাইরা, খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস ও তাঁর স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, হাতেব ইবনে আমর, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ইবনে রাবীয়া, ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ, বুকাইর ইবনে আবদে ইয়ালীলের পুত্র খালিদ, আমের, আকেল ও ইয়াস, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও সুহাইব ইবনে সিনান রুমী [২৩.সুহাইব জন্মগতভাবে আরব। তিনি শৈশবে রোমকদের হাতে বন্দী হন এবং তাদের মাঝেই দাস হিসেবে বড় হন। পরে কালব গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁকে ক্রয় করে এন মক্কায় বিক্রয় করে। আদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করেছেন। হাদেিস সাহাইব উসলাম গ্রহণকারী প্রথম রুমবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।]  ইসলাম গ্রহণ করেন।

প্রকাশ্য দাওয়াত

এরপর লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। অতঃপর মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তাঁর বাণী উচ্চকণ্ঠে প্রচার করার নির্দেশ দেন এবং আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে  পড়তে বলেন। নবুওয়াত লাভের পর ইসলামের প্রকাশ্য প্রচার শুরু হবার আগে গোপন প্রবার কাজ তিন বছর ধরে চলে। তখন আল্লাহ এই নির্দেশ দেন,“হে নবী,এখন আপনি উচ্চকণ্ঠে প্রচার শুরু করুন এবং মুশরিকদের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবে না।” তিনি আরো বলেন, “হে নবী, আপনি আপনার নিকট-আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন আর আপনার অনুসারী মু’মিনদের প্রতি অনুকম্পাশীল ও সদয় থাকুন। আর বলুন : আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ নামায পড়ার সময় দুর্গম গিরিগুহায় চলে যেতেন এবং লোকজনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়তেন। একদিন সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের এবটি ক্ষুদ্র দল মক্কার কোন এক পর্বত গুহায় নামায পড়ছেন, এমন সময় মক্কার মুশরিকদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা মুমিনদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসক এই সময় একটা মরা উটের চোয়ালের হাড় দিয়ে প্রচ- জোরে আঘাত হেনে মুশরিকদের একজনের মাথা ফাটিয়ে দেন। ইসলামের জন্য এটাই ছিল রক্তপাতের প্রথম ঘটনা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক প্রকাশ্য দাওয়াত দিলেও যতক্ষণ তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করেননি ততক্ষণ তারা তাঁর থেকে দূরে যায়নি কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখরও হননি। কিন্তু যখন তিনি তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করলেন তখনই তারা তাঁর আন্দোলনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক জিনিস বলে মনে করলো। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে ক্ষেপে উঠলো এবং তাঁর বিরুদ্ধতা ও শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। তবে স্বল্পসংখ্যক লোক যারা তখনো আত্মপ্রকাশ করেননি- ইসলামের খাতিরে এই শত্রুতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর চাচা আবু তালিব পুর্ণ সহানুভূতি ও অনুকম্পা দেখাতে থাকেন। তিনি কুরাইশদের আক্রমণের মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে থাকলেন এবং তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজ অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু কুরাইশরা যখন দেখলো, সম্পর্কচ্ছেদ ও দেব-দেবীর সমলোচনার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রবল আপত্তিকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিন্দুমাত্র পরোয়া করছেন না, অধিকন্তু তাঁর চাচা তাঁকে আশ্রয় দিয়ে চলছেন, কোন মতেই তাঁকে কুরাইশদের হাতে সমর্পণ করছে না; তখন একদিন কুরাইশদের গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সদলবলে আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললো, “হে আবু তালিব আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমতাবস্থায় হয় আপনি তকে এসব থেকে বিরত রাখুন নতুবা তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দিন।” আবু তালিব তাদেরকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদায় করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকলেন ও তাঁর প্রচার-প্রসারের কাজ অব্যাহত রাখলেন। ফলে কুরাইশদের বিদ্বেষ ও আক্রোশ দিন দিন বেড়ে যেতে লাগলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠলো এবং পরস্পরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিতে আরম্ভ করলো।

তাই পুনরায় তারা আবু তালিবের কাছে উপস্থি হয়ে বললো, হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও মুরুব্বী। আমারা আপনাকে গণ্যমান্য ও শ্রদ্ধেয় মনে করি।

আমরা বলেছিলাম, আপনার ভাতিজাকে নিষেধ করুন কিন্তু আপনি তা করলেন না। আল্লাহর কসম, এভাবে আর চলতে দিতে পারি না। সে আমাদের সমলোচনা দেব-দেবীর নিন্দা ও আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাওরানোর যে ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে তা আমরা আর সহ্য করতে পারি না। এখন হয় আপনি তাকে নিবৃত করবেন নচেৎ আমরা আপনাকে সহ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো এবং একপক্ষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আর থামবো না।”

আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ভাতিজা তোমার সম্প্রদায়ের লোকজন আমার কাছে এসে এইসব কথা বলেছে।” এই বলে তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ যা বলেছিলো তা তাঁকে বললেন। তারপর বললেন, “অবস্থা যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তখন তুমি নিজেকে ও আমাকে সামলে চলো। আমার ওপর আমার সাধ্যের বেশী কোন কিছু চাপিয়ে দিও না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, চাচা মত পাল্টে ফেলেছেন, কুরাইশদের মুকাবিলায় তাঁকে একাকী  ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন এবং তাঁর সহায়তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “চাচা, আল্লাহর কসম করে বলছি, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এন দেয় এবং তার বিনেময়ে আমাকে এই কাজ ত্যাগ করতে বলে, তবুও আমি এটা ত্যাগ করবো না। আমি ততদিন পর্যন্ত এ কাজ করতে থাকবো, যতদিন না আল্লাহ তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন কিংবা এই কাজ করতে করতে আমি ধ্বংস হয়ে যাই।” এই কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো অতঃপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চলে যেতে উদ্যত হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে আবু তালিব তাঁকে ডেকে বললেন, “হে ভাতিজা, কাছে এসো।” তিনি কাছে গেলেন। আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, ঠিক আছে। তুমি যা বলতে চাও বলতে থাক। আমি কখনো কোন কারণে তোমাকে ওদের কাছে সর্পণ করবো না।”

কুরাইশরা যখন জানতে পারলো যে, আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননাকর অবস্থার মুখে একা ছেড়ে দিতে রাজি নন এবং তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ও শত্রুতা সত্ত্বেও তাঁকে তাহাদের হাতে তুলে না দিতেও অবিচল, তখন তারা উমারাহ ইবনে ওয়ালদি ইবনে মুগীরা নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে নিয়ে গেয়ে বললো, “হে আবু তালিব, এই যুবককে দেখুন, এর নাম উমারাহ ইবনে ওয়ালীদ কুরাইশ গোত্রে এর মত সাহসী, শক্তিমান ও সুদর্শন যুবক আর নেই। একে আপনি পুত্র হিসেকে গ্রহণ করুন। এর বুদ্ধিমত্তা ও সাহায্য-সহোযোগিতা দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পারবেন। আর আপনার ঐ ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনার পূর্বপুরুষের ধর্মের বিরোধিতা করছে, আপনার সম্প্রায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামি ঠাওরাচ্ছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, আমরা তাকে হত্যা করি। একজন মানুষের বিনিময়ে একজন মানুষ আপনি পেয়ে যাচ্ছেন।”

আবু তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার আমার ওপর চপিয়ে দিচ্ছ। আমি কি এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যে, তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে দেবে, আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করবো আর আমার সন্তান তোমাদের হেিত তুলে দেবো, তোমরা তাকে হত্যা করবে? খোদার কসম, জেনে রেখো, এটা কখনো হবে না।”

মুতয়িম ইবনে আদী বললো, “হে আবু তালিব, আপনার সম্প্রদায় আপনার কাছে ন্যয়সঙ্গত প্রস্তাবই দিয়েছে। আপনি নিজেও যা পছন্দ করেন না তা থেকে তারা আপনাকে অব্যাহতি দিতে চাচ্ছে। অথচ মনে হচ্ছে, আপনি তাদের কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন।” আবু তালিব মুতয়িমকে বললেন, “আল্লাহর কসম, তারা আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আসলে তুমি আমাকে অপমানিত করতে বদ্ধপরিকর। এজন্য গোটা সম্প্রদায়কে আমার বিরুদ্ধে লিলিয়ে দিতে চাচ্ছ। এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পার।”

এবার ব্যাপারটা সবার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিল। কুরাইশরা পরস্পরকে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে দিল এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠোর চাপ দিতে লাগলো একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতন থেকে নিরাপদ রইলেন। চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করলেন।

আবু তালিব যখন দেখলেন কুরাইশরা চরম হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে, তখন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করা ও তাঁর প্রতি যে কোন অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন। এই দুই গোত্রের সকলেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলো ও তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। একমাত্র আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত আবু লাহাব সমর্থন দিল না।

কুরআন সম্পর্কে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার মন্তুব্য

প্রবীণ কুরাইশ নেতা ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার কাছে কুরাইশদের একটি দল সমবেত হলো। তখন হজ্জের মওসুম সমাগত। ওয়ালীদ বললো, “হে কুরাইশগণ, হজ্জের মওসুম সমাগত। আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তোমাদের এখানে লোক আসবে। আর মুহাম্মাদের কথা তারা ইতিমধ্যেই শুনেছে। সুতরাং তোমরা তার সম্পর্কে একটি সর্বসম্মত মত স্থির কর। এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে যেন কোন রকম মতানৈক্য না থাকে। একজন একটা বলবে, আরেকজন তার কথা খ-ন করবে এমন যেন না হয়। তাহনে একজনের কথা আরেকজনের কথা দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।”

 সবাই বললো, “তাহলে আপনিই একটা মত ঠিক করে দিন। আমরা সবাই সেই মতেরই প্রতিধ্বনি করবো।”ওয়ালীদ বললো, “বলো তোমারাই বলো, আমি শুনি।” সমবেত সবাই বললো, “আমরা বলবো, মাহাম্মাদ একজন গণক।” ওয়ালীদ বললো, “না, সে গণক নয়। আমরা অনেক গণককে দেখেছি। মাহাম্মাদের কথাবার্তা গণকের ছন্দবদ্ধ অস্পষ্ট কথার মত নয়।”

সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, মুহাম্মাদ পাগল।”

ওয়ালীদ বললো, “না, সে পাগলও নয়। আমরা অনেক পাগল দেখেছি, আর পাগলামী কাকে বলে তাও জানি। পাগলের কথাবার্তায় জড়তা ও অস্পষ্টতা থাকে, প্রবল ভাবাবেগের মূর্ছনা এবং সন্দেহ-সংশয়ে তা ভারাক্রান্ত থাকে। কিন্তু মুহাম্মাদের কথায় তা নেই।”

সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে একজন কবি।”

ওয়ালীদ বললো, “না সে কবিও নয়। আমরা সব ধরনের কবিতা সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু মুহাম্মাদের কথা কোন ধরনের কবিতার আওতায় পড়ে না।”

সবাই এবার বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে যাদুকর।” ওয়ালীদ বললো, “সে যাদুকরও নয়। আমরা যাদুকর ও যাদু অনেক দেখেছি। কিন্তু তাদের মত গিরা দেয়া ও গিরায় ফুঁক দেয়ার অভ্যাস মুহাম্মাদের নেই।” সবাই বললো, “তাহলে আপনি কি বলতে চান?”

ওয়ালীদ বললো, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মাহাম্মাদের কথা শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। তার গোড়া অত্যন্ত শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা ফলপ্রসূ। তোমরা যে কথাই বলবে তা মথ্যিা বলে প্রতিপন্ন হবে। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত কথা হবে তাকে যাদুকর বলা। কেনা সে এমনভাবে কথা বলে যা ভাইয়ে ভাইয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে ও আত্মীয়-স্বজনের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে যাদুর মতই কার্যকর। তাই তাকে যথার্থ যাদুই বলা চলে এর প্রভাবে জাতি বাস্তুবিকই বিভেদের শিকার হয়েছে।

এরপর হজ্জের মওসুমে লোকজনের আগমন শুরু হলে কুরাইশরা লোকজনের যাতায়াতের পথে জটলা করে বসে থাকতে লাগলো। আর যখনই কেউ তাদের পাশ দিয়ে যেতো তখনই তাকে বলতো মুহাম্মাদের সংস্পর্শ থেকে যেন সে সাবধান থাকে। আর তাকে তারা মুহাম্মাদের তৎপড়তা সম্পর্কেও অবহিত করতো। এই উপলক্ষে আল্লাহ ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা সম্পর্কে নাযিল করলেন,

“যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি তার সাথে বুঝাপড়ার দায়িত্ব আমার জন্য রেখে দাও। তাকে সৃষ্টি করার পর আমি অনেক সম্পদ দিয়ে সর্বক্ষণ পাশে থাকার মত অনেক পুত্র সন্তান দিয়েছি এবং তার নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছি। এরপরও যাতে তাকে আরো অধিক দান করি সেজন্য সে লালায়িত। তা কক্ষণো হবে না। সে আমার আয়াতসমূহের প্রতি অত্যন্ত বৈরীভাবাপন্ন।”

এরপর যার সাথেই দেখা হয়, তার কাছেই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঐসব কথা বলতে লাগলো। হজ্জের মওসুম শেষে আরবরা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো তখন তাদের মুখে কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গই আলোচিত হতে লাগলো। এভাবে আরবের প্রতিটি জনপদে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়লো।

রাসূলুল্লাহর (সা) ওপর উৎপীড়নের বিবরণ

ক্রমেই কুরাইশরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সহচরদের শত্রুতায় তারা বেসামাল হয়ে উঠলো। তারা মূর্খ ও বখাটে ধরনের লোকদের উস্কিয়ে দিতে লাগলো। এইসব অর্বাচীন তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে গালাগালি এবং নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। তাঁকে কনি, যাদুকর, জ্যোতিষী ও পাগল বলে অপবাদ দিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রসার করার কাজে অবিচল থাকরেন। ক্রমেই তিনি অধিকতর প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দিতে লাগলেন। আরবদের বাতিল রসম রেওয়াজের সমালোচনা, তাদের মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান ও তাদের কুফরী মতবাদের সাথে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদের কথা তাদের কাছে ঘোর আপত্তিকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বলেন-

“একদিন যখন কুরাইশ সরদারগণ হাজরে আসওয়াদের নিকট সমবেত হয়েছে, তখন আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললো, “এই লোকটার ব্যাপারে আমরা যতটা সহিষ্ণুতা দেখিয়েছি তা নজিরবিহীন। সে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে এবং আমাদের দেবদেবীকে গালাগালি করেছে। অত্যন্ত নাজুক ও মারাত্মক ব্যাপারে আমরা তাকে সহ্য করেছি।” এভাবে তাদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকাকালে সহসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখম-লে আমি সে মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। দ্বিতীয়বার যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন তখন তারা আবার শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আমি তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। তৃতীয় বারে তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আবার তারা অনুরূপ মন্তব্য করলে তিনি সেখানে থেমে বললেন, “হে কুরাইশগণ, শোন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার শপথ করে বলছি, আমি তোমাদের সর্বনাশ বয়ে এনেছি (যদি তোমরা ঈমান না আন)।”

তাঁর উক্তিতে জনতা বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে গেল। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্ষণকাল আগেও তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী আক্রোশ ও উস্কানিমূলক কথা বলেছে, সেও যথাসম্ভব মিষ্ট কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শান্ত করতে উদ্যত হলো। এমনকি সি বলতে বাধ্য হলো, “আবুল কাসিম, তুমি যাও। তুমি তো আর নির্বোধ নও।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে গেলেন। পরদিন সবাই একই স্থানে সমবেত হলো। আমিও সেখানে ছিলাম। তখন তারা বলাবলি করতে রাগলো, “দেখলে তো! মহাম্মাদের কতদূর বাড় বেড়েছে এবং সে কতদূর ধৃষ্টতা দেখালো। তোমরা যে কথা একবারেই পছন্দ কর না তা সে তোমাদের মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিল। আর তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। আর যায় কোথায়! সকলে একযোগে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সবাই তাঁকে ঘেরাও করে বলতে থাকলো, “তুমিই তো আমাদের ধর্ম ও দেব-দেবীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলে থাকো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ আমিই ঐসব কথ বলে থাকি।” আমি দেখলাম তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে তাঁর গলার ওপরের চদরের দু’পাশ ধরে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা কতে উদ্যত হয়েছে। সেই মুহূর্তে হযরত আবু বাক্র এগিয়ে গিয়ে বাধা দিলেন। তিনি কেঁদে ফিললেন এবং বললেন, “একটি লোক আল্লাহকে নিজের রব কলে ঘোষনা করেছ, এই কারণে কি তোমরা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে।”

এরপর জনতা সেখান থেকে চলে গেল। সেদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরাইশদের যেরূপ মারাত্মক আক্রমণ দেখেছি, তেমন আর কখনও দেখিনি।”

হামযার ইসলাম গ্রহণ

আসলাম গোত্রের একজন তুখোড় স্মৃতিধর ব্যক্তি আমাকে বললেন,

“একদিন সাফা পর্বতের পাশে আবু জাহল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাত পায়। ঐ সময় সে তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে তাঁকে গালি দেয়। সে তাঁকে অত্যন্ত অপ্রীতিকর কথা বলে। ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি এবং তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রতি শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে কোন একটি কথা বললেন না। আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের এক দাসী নিজের ঘরে বসে এসব কটূক্তি শুনতে পায়। অতঃপর আবু জাহল সে স্থান ত্যাগ করে কা’বার পাশে কুরাইশদের এক দরবারে গিয়ে বসে।

এর অল্পক্ষণ পওেরই আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হামযা তীর-ধনুক সজ্জিত অবস্থায় শিকার থেকে ফিরছিলেন। তিনি একজন ভাল শিকারী ছিলেন। শিকারের প্রতি তীর নিক্ষেপে ও শিকারের সন্ধান করায় তিনি বেশ পটু ছিলেন। এরকম শিকার করে যখনই তিনি ফিরতেন তখন পথে কুরাইশদের কোন দরবার বা জটলা দেখলে সেখানে থামতেন, সালাম দিতেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। তিনি ছিলেন কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ও তাগড়া জোয়ান। তিনি যখন আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের দাসীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। দাসি হামযাক দেখেই বললো, একটু আগে হিশামের পুত্র আবুল হাকাম [২৪. আবুল হাকাম আবু জাহলের উপনাম বা উপাধি। তার নাম আমর ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে মাখযুম।] তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদের সাথে কি আচরণ করেছে তা যদি দেখতে। এখানে মুহাম্মাদ বসা ছিল। তাকে দেখেই সে তার সাথে দুর্ব্যবহার ও গালাগালি করেছে। তার সাথে অত্যন্ত আপত্তিকর আচরণ করেছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা কথাও না বলে চলে গেল।”

হামযা এ কথা শুনে ক্রোধে অধীর হয়ে পড়লেন। কেননা আল্লাহ তাঁকে ইসলামের গৌরব মুকুট পরাতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি আবু জাহলেন সন্ধানে দ্রুত ছুটে গেলেন। পথে কারো কাছে দাঁড়ালেন না। তাঁর ইচ্ছা ছিল আবু জাহলকে পেলেই তাকে শিক্ষা দেবেন। মসজিদে হারামে ঢুকেই  দেখলেন, সে দরবার জমিয়ে বসে আছে। তিনি তার গিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়েই ধনুক দিয়ে তাকে প্রচ- আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করে দিলেন। অতঃপর বললেন, “তুই মুহাম্মাদকে গালাগালি করিস? অথচ আমি তার ধর্ম গ্রহণ করেছি। সে যা কিছুই বলে আমি তা সমর্থনকারী। পারিস তো আমাকে পাল্টা আঘাত কর দেখি।”

তৎক্ষণাৎ বনী মাখযুম গোত্রের কিছু লোক ছুটে এল হামযার বিরুদ্ধে আবু জাহলকে সাহায্য করতে। কিন্তু আবু জাহল বললো, “তোমরা হামযাকে কিছু বলো না। কেনানা আমি সত্যিই তার ভতিজাকে অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় গালাগালি করেছি।”

হামযা ইসলামের ওপর দৃঢ় ও অবিচল রইলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কার্যক্রমে সাহায্য ও সহায়তা অব্যাহত রাখলেন। হামযার (রা) ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশরা উপলব্ধি করলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এখন আর নিপীড়ন ও হেয় করা সহজ হবে না। কিছু করতে গেলেই হামযা এসে রুখে দাঁড়াবে। তাই আপাততঃ তারা উৎপীড়নের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে দিল।

 

রাসূলুল্লাহর (সা) আন্দোলন প্রতিরোধে উতবার ফন্দি

একটি সুত্র আমাকে জানিয়েছে যে, বিশিষ্ট কুরাইশ সরদার উতবা ইবনে রাবীআ একদিন কুরাইশদের দরবারে বসে ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সমজিদে হারামে একাকী বসেছিলেন। উতবা বললো, “হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদের কাছে যেয়ে কিছু কথা বলবো। তার কাছে কিছু প্রস্তাব রাখবো। হয়তো সে কিছু প্রস্তাব মেনে নেবে এবং তার প্রচার বন্ধ করবে। তোমরা এটা কেমন মনে কর?”

এ সময়ে হামযা ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করেছে। তাই সকলে বললো, “খুব ভালো প্রস্তাব। আপনি যান এবং কথা বলুন।”

উতবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  কাছে গেল এবং তাঁর পাশে গিয়ে বসলো। সে বললো, “ভতিজা, তুমি আমাদেরগোত্রের মধ্যে কতখানি সম্ভ্রান্ত ও বংশমর্যাদা সম্পন্ন তা তোমার অজানা নয়। তুমি একটা মারাত্মক ব্যাপার নিয়ে তোমার জাতির কাছে আবির্ভূত হয়েছ। তোমার এ দাওয়াত জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তুমি তাদেরকে বেকুফ ঠাউরিয়েছ এবং তাদের পূর্বপুরুষদের হেয় প্রতিপন্ন করেছ। আমার কথা শোনো! তোমার কাছে কয়েকটা বিকল্প প্রস্তাব রাখছি। একটু ভেবে দেখো এর কিছু কিছু মেনে নিতে পার কিনা।”

রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “বেশ, বলুন। আমি শুন।”

উতবা বললো, “ভাতিজা, তুমি যে নতুন দাওয়াত দিতে শুরু করেছ, এর দ্বারা যদি বিপুল সম্পদ লাভ করা তোমার  ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তোমার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে তোমাকে আমাদের ভিতরে সবচেয়ে বিত্তশালী বানিয়ে দেবো। আর যদি তুমি পদমর্যাদা লাভ করতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে এ দেশের রাজা  বানিয়ে দেবো। আর যদি এমন হয়ে থাকে যে, তোমার কাছে জ্বিন আসে, তাকে তুমি হটাতে পারছ না, তাহলে আমরা তোমার চিকিৎসা করাবো। যত টাকা লাগুক তোমাকে সুস্থ করে তুলবো। কেননা অনেক সময় জ্বিন মানুষের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তাকে তাড়ানোর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।”

এই পর্যন্ত বলে উতবা থামলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনোযোগ সহকারে উতবার কথা শুনছিলেন। তার কথা শেষ হলে তিনি বললেন, “হে আবুল ওয়ালীদ, আপনার কথা কি শেষ  হয়েছে?”-“হাঁ।” তিনি বললেন, “তাহলে আমার কিছু কথা শুনুন।” উতবা বললো, বলো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুরা হামীম আস সাজদা তিলাওয়াত করা শুরু করলেন। “বিসমিল্লাহির রাহমনির রাহীম। হা-মীম! এটা পরমত করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব। আরবী ভাষায় নাযিলকৃত কিতাব কুরআন। এর আয়তগুলোকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, জ্ঞানী লোকদের জন্য। সুসংবাদবাহী ও সতর্ককারী হিসেবে তা এসেছে। কিস্তু তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে; তারা শুনতে চায় না। তারা বলে, তুমি যে বিষয়ের দিকে আমাদের আহ্বান করছো, আমাদের মন তা থেকে পর্দার আড়ালে রয়েছে।”উতবা স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। সে পেছনের দিকে হাতে ভর দিয়ে বসে খুবই মনোযোগের সাথে তাশুনছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করতে করতে ঐ সূরায় সিজদার আয়াতে গিয়ে থামলেন এবং সিজদা করলেন।[২৫.আয়াতটি হলো এই : দিন ও রাত,সূর্য ও চন্দ্র এ সবই আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। তোমরা সূর্য ও চন্দ্রের উদ্দেশ্যে সিজদা করো না- একমাত্র আল্লাহকে সিজদা কর,যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন- যদি একমাত্র তাঁর ইবাদাত করতে প্রস্তুত থেকে থাক।] এরপর বললেন, “যা শুনবার তা তো শুনলেন। এখন যা করনীয় মনে করেন করুন।”

অতঃপর উতবা উঠে তার সঙ্গীসাথীদের কাছে ফিরে গেলো। সঙ্গীরা তাকে দেখে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, উতবা এক রকম চেহারা নিয়ে গিয়েছিল, এখন ভিন্ন রকম চেহারা নিয়ে ফিরে আসছে।” দলবলের মধ্যে গিয়ে বসতেই সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবুল ওয়ালীদ, আপনার কথা কী?”

উতবা বললো, “আমি এমন বাণী শুনেছি যা আর কখনো শুনিনি। হে কুরাইশগণ, সত্যিই তা কবিতাও নয়, কোন জ্যোতিষীর কথাও নয়। তোমরা আমার কথা শোনো এবং এই ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এই লোকটা যা করতে চায় করতে দাও। তার সাথে কোন সংশ্রব রাখো না। আমি নিশ্চিত যে, মুহাম্মাদ যে কথা প্রচারে নিয়োজিত, তা ভবিষ্যতে বিরাট আলোড়ন তুলবে। আরবরা যদি তার বিপর্যয় ঘটায় তাহলে তোমরা অন্যের সাহায্যে তার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলে। আর যদি সে আরবদের ওপর জয়যুক্ত হয় তাহলে তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব হবে। তার মর্যাদা তোমাদেরই মর্যাদার কারণ হবে। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান জনগোষ্ঠী।” এ কথায় সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, “মুহাম্মাদ এবার তোমাকে যাদু করেছে।” উতবা বললো, “এটা আমার অভিমত। এখন তোমরা যা ভাল বুঝ কর।”

কুরাইশ নেতাদের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) কথোপকথন

মক্কার কুরাইশ গোত্রসমূহের নারী ও পুরুষদের মধ্যে ইসলাম ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কুরাইশরা মুসলমানদের যাকে পারতে আটক করে রাখতো এবং তার উপর কঠিন অত্যাচার চারাতো!

এই অবস্থায় পরিপেক্ষিতে একদিন সূর্যাস্তের পর প্রত্যেক গোত্র থেকে কুরাইশ সরদারগণ কা’বা শরীফের নিকট জমায়েত হলো। যারা জমায়েত হলো তারা হচ্ছে উতবা ইবনে রাবীয়া, শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, নাদার ইবনে হারেস,আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, যামআ ইবনে আসওয়াদ, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আবু জাহল ইবনে হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া, আস ইবনে ওয়ায়েল, নুবাইহ্ ইবনে হাজ্জাজ, মুনাববিহ ইবনে হাজ্জাজ এবং উমাইয়া ইবনে খালাফ। তারা পরস্পরকে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদকে ডেকে পাঠাও, তার সাথে কথা বল, প্রয়োজনে ঝগড়াও কর। তাহলে জনতার কাছে তোমরা দোষ এড়িয়ে যেতে পারবে।” যথার্থই তাঁর কাছে দূত পাঠানো হলো। দূত গিয়ে বললো, “কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তোমার সাথে কথা বলার জন্য জমায়েত হয়েছেন। তাদের কাছে একটু চলো।”

একথা শোনা মাত্রই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রস্তপদে তাদের কাছে ছুটে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি তাদের কাছে যে দাওয়াত দিয়েছেন সে সম্পর্কেই বোধ হয় তারা নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করেছে। বস্তুতঃ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আস্তরিকভাবে কামনা করতেন যে, তারা সঠিক পথে ফিরে আসুক। তাদের গোয়ার্তুমি ও অত্যাচারে তিনি ভীষণ দুঃখিত ছিলেন। তিনি গিয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের পাশে বসলেন। তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ তোমার সাথে কিছু কথা বলার জন্য আমরা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। খোদার কসম, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ, তেমন আর কোন আরব কখনো করেছে কলে আমাদের জানা নেই। তুমি পূর্বপুরুষদের ভর্ৎসনা করেছ, প্রচলিত ধর্মের নিন্দা করেছ, দেব-দেবীকে গালিগালাজ করেছ, বুদ্ধিমান লোকদের বোকা ঠাউরিয়েছ এবং জাতির ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়েছ। মোটকথা, আমাদের ও তোমার মধ্যে কোন খারাপ জিনিসই আনতে তুমি বাকী রাখনি। এখন কথা হলো এসব কথা বলে তুমি যদি সম্পদ অর্জন করতে মনস্থ করে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে টাকা কড়ি সংগ্রহ করে দিই, যাতে তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী হতে পার। আর যদি এর দ্বারা তুমি পদমর্যাদার প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে সরদার বানিয়ে দিই। আর যদি তুমি রাজা বাদশাহ হতে চাও তাহলে এস তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে নিই। আর তোমার কাছে যে দূত আসে সে যদি কোন জ্বিন-ভূত হয়ে থাকে এবং তোমার ওপর পরাক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে আমরা যত টাকা লাগুক, তোমার চিকিৎসা করাতে প্রস্তুত যাতে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ অথবা তোমার সম্পর্কে জনত্র কাছে আমাদের কোন জবাবদিহি করতে না হয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, “তোমরা যা যা বলছ তার কোনটাই আমি চাই না। আমি যে দাওয়াত তোমাদের কাছে পেশ করেছি তার উদ্দেশ্য এ নয় যে, আমি তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের মধ্যে পদমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হতে চাই কিংবা তোমাদের রাজা হতে চাই। আমাকে আল্লাহ তোমাদের কাছে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তিনি আমার প্রতি এক কিতাব নাযিল করেছেন  এবং তোমাদের জন্য সাবধানকারী ও সুসংবাদ দানকারী হতে আমাকে আদেশ করেছেন। তাঁর আদেশ অনুসারে আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে কল্যাণের জন্য সদুপদেশ দিয়েছি। এখন তোমরা যদি আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করে নাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য বয়ে আনবে। আর যদি তা প্রত্যাখ্যান কর তাহলে তোমাদের ও আমার ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না আসা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”

তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমরা যে কয়টা প্রস্তাব তোমার কাছে পেশ করলাম তার কোনটাই যদি তোমার কাছে  গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে আর একটা কথা শোনো। তুমি তো জান, দুনিয়ায় আমাদের মত সংকীর্ণ আবাসভূমি আর কারো নেই, পানির অভাব ও অন্যান্য উপকরণের দৈন্যের  কারণে আমরা যেরূপ দুঃসহ জীবন যাপন করি, পৃথিবীতে আর কোন জাতি এমন জীবন যাপন  করে না। সুতরাং তোমার যে প্রভু তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তার কাছে প্রর্থনা কর যেন তিনি এই পাহাড় পর্বতগুলোকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে নেন যাতে আমাদের আবাসভূমি আরো প্রশস্ত হয় এবং তিনি যেন ইরাক ও সিরিয়ায় নদ-নদীর ন্যায় আমাদের এ দেশেও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। তাঁর কাছে আরো প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের পুনর্জীবিত করেন এবং পুনর্জবীত পূর্বপুরুষদের মধ্যেই কুসাই ইবনে কিলাবও যেন অন্তর্ভুক্ত থাকেন যিনি অন্যতম সত্যবাদী ন্যায়নিষ্ঠ নেতা ছিলেন। তাদেরকে আমরা তোমার কথা সত্য না মিথ্যা জিজ্ঞেস করবো। তারা যদি বলেন তুমি সত্যবাদী এবং আমাদের দাবী অনুসারে তুমি যদি কাজ কর তাহলে আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবো, তোমার খোদাপ্রদত্ত মর্যাদা আমরা স্বীকার করবো এবং তোমাকে যথার্থই আল্লাহর রাসূল বলে মেনে নেব।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “এসব ব্যাপার নিয়ে আমি তোমাদের  কাছে আসিনি। আমাকে আল্লাহ যে জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছেন, তাছাড়া আর কোন কিছু আমার ইখতিয়ারে সেই। আর যা দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এটা যদি তোমরা গ্রহণ কর তাহলে এটা দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে। আর যদি অগ্রাহ্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”

তারা বললো, “এ প্রস্তাবও যদি তোমার মনঃপূত না হয়, তাহলে তুমি নিজের জন্য একটা কাজ কর। তোমার প্রতিপালককে বল তোমার সাথে একজন ফেরেশ্তা পাঠাতে। তিনি আমাদের সামনে তোমার কথা সত্য বলে সাক্ষ্য দেবেন এবং তোমার পক্ষ হয়ে আমাদের সাথে কথা বলবেন। আর আল্লাহ তোমার জন্য আনেকগুলো বাগবাগিচা ও প্রাসাদ বানিয়ে দিক এবং অনেক সোনা রূপার ধনদৌলত দান করুক। এতে করে তোমার যে অর্থলিপ্সা দেখতে পাই তা মিটবে। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত বাজারে ঘোরাফেরা কর এবং আমাদেরই মত জীবিকা অন্বেষণ কর। তোমার এসব ধনদৌলত হলে আমরা বুঝবো, তুমি যথার্থই আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং তোমার প্রভুর কাছে মর্যাদাবান। তুমি নিজের ধারণা মুতাবিক সত্যিই যদি রাসূল হয়ে থাক তাহলে এসব করে দেখাও তো দেখি।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, না এটাও আমি করবো না। আমি আল্লাহর কাছে এসব জিনিস চাইতে পারবো না। আমি তোমাদের কাছে এসব জিনিস নিয়ে আাসিনি। আল্লাহ আমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছেন। তোমরা যদি আমার আহ্বানে সাড়া দাও, তবে সেটা হবে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের উৎস। আর যদি প্রত্যাখ্যান কর, তাহলে আল্লাহ যা করেন তাই হবে। তিনি যতক্ষণ আমার ও তোমাদের মধ্যে নিষ্পত্তি করে না দেন ততক্ষণ আমি ধৈর্য ধারন করবো।”

তারা বললো, “তাহলে কয়েক টুকরো মেঘ আমাদের মাথার ওপর ফেলে দাও, যেমন তুমি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তা পারেন। এটা না করলে আমরা তোমার ওপর ঈমান আনবো না।”

রাসূলুল্লাহ বললেন, “এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে অবশ্যই তা করতে পারেন।”

তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, তোমার প্রতিপালক কি এটা জানতেন না যে, আমরা তোমার সাথে বৈঠকে বসবো এবং যা এখন তোমার কাছে চাইলাম তা তোমার কাছে চাইবো? তিনি কি তোমার কাছে এসে আমরা যেসব কথা উত্থাপন করলাম তার জবাব তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারলেন না এবং তোমার দাওয়াত অগ্রাহ্য করলে আমাদের  তিনি কি করবেন তা জানাতে পারলেন না? আমরা জানতে পেরেছি যে, ইয়ামামায় বসবাসকারী ‘রাহমান’ নামক এক ব্যক্তি তোমাকে এসব কথা শিখিয়ে দেয়। [২৬.লোকটি হলো মুসাইলিমা ইবনে হাবিব হানফী। সে মুসাইলিমা কাযযাব (মিথ্যাবাদী) নামে প্রসিদ্ধ। সে বয়সে প্রবীণ ছিল এবং জাহিলী যুগে  তাকে ‘রাহমান’ বলে ডাকা হতো। (রাউদুল আনফ)]

আল্লাহর শপথ, আমরা কথনো রাহমানকে বিশ্বাস করবো না। মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আমরা আমাদের অক্ষমতার কথা জানাচ্ছি। তোমার আচরণ আমাদের সাথে যতদূর গড়িয়েছে তাতে আমরা তোমাকে ছাড়বো না। হয় তুমি আমাদের ধ্বংস করবে নচেৎ আমরা তোমাকে ধ্বংস করবো- তার আগে আমরা ক্ষান্ত হবো না।” সমবেত লোকদের একজন বললো, “আমরা ফেরেশতাদের পূজা করি। ফেরেশতারা হলো আল্লাহর মেয়ে।’ আর একজন বললো, “আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে হাজির কর নচেৎ আমরা তোমরা ওপর ঈমান আনবো না।”

এসব কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে এলেন। তাঁর ফুফাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরাও তাঁর সাথে এলো। সে বললো, “শোনো মুহাম্মাদ তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমার কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করলো। তার একটাও তুমি গ্রহণ করলে না। তারপর তারা এমন কতকগুলো জিনিস তোমার কাছে দাবী করলো যা দ্বারা আল্লাহ তোমাকে যে পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বলে তুমি নিজে বলে থাক তা জানতে ও বুঝতে পারে এবং তোমাকে স্বীকার করতে ও তোমার অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু তুমি সে দাবগিুলোও পূরণ করলে না। তুমি যে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তুমি যে আল্লাহর রাসূল তা জানার জন্যও তারা কিছু দাবী জানালো তোমার কাছে। তুমি তাও রাখলে না। আল্লাহর কসম, তুমি একটা সিঁড়ি দিয়ে আকাশে চড়বে এবং তোমাকে আকাশে উঠে যেতে আম স্বচোখে দেখবো, অতঃপর তোমার সাথে চারজন ফেরেশতা আসবেন এবং তারা তোমার দাবীর সত্যতার সাক্ষ্য দেবে- তানা হলে আমি তোমার ওপর ঈমান আনবো না। এমনকি তুমি যদি এসব করে দেখিয়ে দাও তাহলেও আমার মনে হয় না যে, আমি তোমার ওপর ঈমান আনব।”২৭.এই ব্যক্তি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলাম গ্রহণ করেন।

এরপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে চলে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে ত্যাগ করে অত্যন্ত ব্যাথিত ও বিষণœ মনে বাড়ী চলে এলেন। কেননা তাঁকে যখন ডেকে নেয়া হয় তখন তিনি খুবই আশান্বিত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যতঃ যখন দেখলেন যে, তারা তাঁর থেকে আরো দূরে সরে গেল, তখন তাঁর দুঃখের সীমা থাকলো না।

আবু জাহলের আচরণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার পর আবু জাহল বললো, “হে কুরাইশ, শোন! মুহাম্মাদ বিছুতেই তার নীতি ত্যাগ করতে রাজী নয়। আমাদের ধর্মের সামালোচনা, আমাদের পূর্বপুরুষদের নিন্দা, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধতা বলে বিবেচনা করা এবং আমাদের দেব-দেবীকে গালমন্দ করার বদ্ধমূল স্বভাব সো কিছুতেই পরিহার করবে না। আমি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি, কাল যত বড় পাথর আমি উত্তোলন করতে পারি, হাতে নিয়ে তার অপেক্ষায় থাকবো। নামাযে যখনই সে সিজদায় যাবে, তখনই সেই পাথর দিয়ে আমি মাথা গুড়িয়ে দেবো। এরপর যা হয় হবে। তোমরা আমাকে বিচারে সোপর্দ কর কিংবা রক্ষা কর, সেটা তোমাদের বিবেচ্য। বনু আবদ মানাফ যা ভালো মনে করে তাই করবে।” সবাই কললো, “আল্লাহর শপথ আমরা কিছুতেই তোমাকে বিচারের জন্য সোপর্দ করবো না তুমি যা সংকল্প করেছো তা করে ফেলো।”

পরদির আবু জাহল সত্যি সত্যি প্রকা- একখানা পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপেক্ষায় বসে রইলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিত্যকার অভ্যাস মত নামায পড়তে গেলেন। মক্কায় বাস করলেও তিনি সিরিয়ার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যে, কা’বা তাঁর ও সিরিয়ার মাঝখানে পড়তো। তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। আর কুরাইশরা তাদের সম্মেলন স্থলে বসে আবু জাহল কি করে সেজন্য অধীর আগ্রহে প্রহন গুনতে লাগলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সিজদায় গেলেন তখন  আবু জাহল পাথর উত্তেলন করে তাঁর দিকে  এগিয়ে গেল। তার কাছে যেতেই পরাজিত, ভীত-বিহ্বল ও বিবণর্ষ চেহারা নিয়ে ফিরে এলা। তার হাত দুটো যেন পাথরের ওপর নিথর ও নিশ্চল হয়ে গিয়েছে। সে পাথরখানা দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। এসময় কুরাইশদের কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে গেল এবং বললো, “হে আবুল হাকাম, তোমার কী হলো?” সে বললো, “আমি মুহাম্মাদরে কাছে চলে গিয়েছিলাম এবং গতরাতে তোমাদের কাছে যে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলাম, তাই কার্যকর করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু যে মাত্র তার কাছে গিয়েছি অমনি একটা প্রকা- ও ভয়ংকর উট তার ও আমার মধ্যে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহর শপথ, আম কখনো এমন ভয়ংকর চুঁট, ঘাড় ও দাঁতওয়ালা উট দেখিনি। উটটা আমাকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হেয়ছিলো।”

নাদার ইবনে হারেসের বিবরণ

আবু জাহলের এসব কথা বলার পর নাদার ইবনে হারেস উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, “হে কুরাইশ জনতা, আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এমন এক আপদ আপতিত হয়েছে যার প্রতিকারে তোমারা এখনো কোন কৌশল অবলম্বন করতে পারনি। মুহাম্মাদ ছিল তোমাদের মধ্যে একজন তরুণ কিশোর মাত্র। সে ছিল তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ও সবচেয়ে সত্যবাদী। সে ছিল সবচেয়ে বিশ্বস্ত।ভ কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করা মাত্রই সে নতুন জিনিস নিয়ে আবির্ভূত হলো। তখন তোমরা তাকে বললে যাদুকর। না, আল্লাহর শপথ, সে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকরদের দেখেছি। তাদের তন্ত্রমন্ত্র ও ফুকও আমরা দেখেছি। তোমরা তাকে বললে জ্যোতিষী। আল্লাহর শপথ, সো জ্যোতিষী নয়। জ্যোতিষীদের মারপ্যাঁচ ও রংঢং আমরা অনেক শুনেছি ও দেখেছি। পাগলের কথাবার্তায় যে জড়তা, আবোল াতবোল ও ভাবেবেগ থাকে, তা তাঁর কথাবার্তায় অনুপস্থিত। হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদের অবস্থাটা খতিয়ে দেখ। আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এক ভয়াবহ মুসীবত আপতিত হয়েছে।”

নাদার ইবনে হারেস ছিল কুরাইশদের সবচেয়ে কুটিল ও কুচক্রী সেনাদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নানাভাবে কষ্ট দেয়া ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করাই ছিল তার কাজ। সে হীরায় কিছুকাল কাটিয়েছিল এবং সেখান থেকে  পারস্যের রাজ-রাজাদের কাহিনী শিখে এসেছিলো। রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের উপাখ্যানও সে জানতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বৈঠকে বসে আল্লাহর বাণী শোনাতেন  এবং তাঁর জাতিকে পূর্বতন জাতিগুলো কিভাবে আল্লাহর রোষের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেসব কথা উল্লেখ করে হুঁশিয়ার করতেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা শেষ করে উঠে যাওয়া মাত্রই সে বলতো, “হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদের চেয়েও সুন্দর কাহিনী বলতে পারি এসো, আমি তোমাদেরকে তাঁর কথার চেয়ে চটকদার কথা শুনাই।” অতঃপর সে তাদেরকে পারস্যের রাজাদের এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের উপাখ্যান শোনাতো। তারপর বলতো, “মুহাম্মাদ আমার এসব কথার চেয়ে কি সুন্দর কথা বলতে পারে?”

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলতেন, “নাদার ইবনে হারেস সম্পর্কে কুরআনে আটটি আয়াত নাযিল হয়েছে।”

যখনই তার সামনে আয়াতগুলো পাঠ করা হয় তখনই সে বলে : এগুলো তো প্রাচীনকালের উপাখ্যান!” এই আয়াতটি এবং ‘প্রাচীন কালের উপাখ্যান’- এর উল্লেখ অন্য যেসব আয়াতে হয়েছে, তা এই নাদার ইবনে হারেস সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে

দুর্বল মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার

যারা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করেছিলো সেসব সাহাবার ওপর মুশরিকরা ভীষণ অত্যাচার চালাতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যকার মুসলমানদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে  পড়লো। কোথাও বা তাদেরকে অন্তরীণ রেখে মারপিট করে, ক্ষুৎপিপাসায় অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে, কোথাও বা দ্বি-প্রহরে প্রচ- গরমের সময় মক্কার রৌদ্রতপ্ত মরুপ্রন্তরে শুইয়ে দিয়ে নির্যাতন চালাতে থাকলো। যারা দুর্বল এভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করা হতো। কেউ কেউ অসহ্য নির্যতনের চাপে ইসলাম ত্যাগ করতো। আবার কেউ কেউ সাহায্য সমর্থন পেত এবং এভাবে আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করতেন। আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ক্রীতদাস বিলাল এক সময় বনু জুমাহ গোত্রের এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বিলাল ইবনে রাবাহ। তাঁর মার নাম ছিল হামামাহ। তিনি তাদের মধ্যেই আশৈশব লালিত পালিত হয়েছিলেন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও পবিত্রাত্মা মুসলিম ছিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে হুযাফা ইবনে জুমাহ রৌদ্রতপ্ত দুপুরে তাঁকে মক্কার সমভূমিতে নিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিতো। অতঃপর তাঁর বুকের ওপর একটা প্রকা- পাথর চাপা দিয়ে রাখার নির্দেশ দিত। তারপর তাকে বলতো, “মুহাম্মাদকে অস্বীকার করে লাত ও উয্যার পূজা করতে রাজী না হলে আমৃত্যু এভাবেই থাকতে হবে।” এহেন কঠিন যন্ত্রণা ভোগের মুহূর্তেও তিনি কলতেন, “আহাদ” অর্থৎ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক। তিনি এভাবে নিযৃাতন ভোগের সময় যখন ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ উচ্চারণ করতেন, তখন মাঝে মাঝে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল তাঁর কাছ দিয়ে যেতেন। বিলালের ঐ কথা শুনে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলও সাথে সাথে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, হে বিলাল, সত্যই আল্লাহ এক, আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।“ এরপর ওয়ারাকা উমাইয়া ইবনে খালাফের কাছে এবং বিলালকে নির্যাতনকারী বরী জুমাহ গোত্রের অন্যান্যদের কাছে যেয়ে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, এই কারণে তোমরা যদি তাকে মেরে ফেল, তাহলে আমি তাকে অবশ্যই মহাপুণ্যবান মনে করবো এবং তার পদধূলি নেবো।” একদিন সেখান দিয়ে আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন বিলালকে সেই একই পন্থায় নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি উমাইয়া ইবনে খালাফকে বললেন, “এই অসহায় মানুষটাকে নির্যাতন করতে তোমার কি একটুও আল্লাহর ভয় হয় না? আর কত দিন এটা চালাবে?”

সে বললো, “তুমিই তো ওকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই ওকে এ অবস্থা থেকে রেহাই দাও।”

আবু বাকর বললেন, “আমি তাই করবো। আমার কাছে ওর চেয়েও তাগড়া ও শক্তিশালী একটা ছেলে আছে সে তোমার ধর্মের অনুসারী। এর বদলে আমি তাকে দিয়ে দেবো।” সে বললো, “আমি রাজী।” আবু বাক্র বললেন, “আমি রাজী। সেটা তোমাকে দিলাম।” অতঃপর তিনি সেটা দিলেন উমাইয়াকে  এবং উমাইয়ার কাছ থেকে বেলালকে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন। হিজরাতের আগে আবু বাক্র বিলালসহ মোট সাতজন নওমুসলিম গোলামকে স্বাধীন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আমের ইবনে ফুহাইরা, উম্মে উবাইস ্এবং যিননীরা। যিননীরাকে মুক্ত করার সময় তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা তা দেখে বললো, “ওর চোখ নষ্ট হয়েছে লাত ও উয্যার অভিশাপেই।” যিননীরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, তোদের আমি কখনো মুক্ত করবো না”, তখন আবু বাক্র সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কথাটা শোনামাত্রই বললেন, “হে অমুকের মা, তুমি শপথ ভঙ্গ কর।” সে বললো, “কী বলছো! শপথ ভঙ্গ করবো? তুমিই তো ওদেরকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই মুক্ত কর।” আবু বাক্র বরলেন, “আমি ওদেরকে নিয়ে নিলাম! ওরা মুক্ত ও স্বাধীন। মেয়ে দুটিকে বললেন, “তোমরা মহিলার আটা ফিরিয়ে দাও।” মেয়েদ্বয় বললো, “হে আবু বাক্র, আগে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেব এবং পরে আটা ফিরিয়ে দেব কি?” আবু বাক্ র বললেন, “সে তোমাদের ইচ্ছা।”

আর একবার তিনি বনী মুয়াম্মালের একজন নও মুসলিম বাঁদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। উমার তখনো মুশরিক। তিনি মারতে মারতে যথন ক্লান্ত হযে গেলেন তখন তাকে বললেন, “তোর কাছে আমি ওজর জানাচ্ছি যে, শুধু ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণেই তোকে আর মারতে পাররম না।” মেয়েটি বললো, “আল্লাহ তোমার সাথে যেন এরূপ আচরণই করেন।” এই দৃশ্য দেখে আবু বাক্র তৎক্ষণাৎ বাঁদীটি কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন।

আবু বাক্রের (রা) পিতা আবু কুহাফা একদিন তাঁকে বললেন, “বেটা, আমি দেখছি তুমি শুধু দুর্বল দাস দাসীদেরকে মুক্ত করছো। যদি তুমি শক্তিশালী জোয়ান পুরুষ দাসদের মুক্ত করতে তাহলে প্রয়োজনের সময় তারা তোমার পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারতো।” একথা শুনে আবু বাক্র বললেন, “হে পিতা, আমি যা করছি তা একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করছি।”

বনু মাখযূম গোত্রের লোকেরা আম্মার ইবনে ইয়াসার ও তাঁর পিতামাতাকে তপ্ত দুপুরের সময় মক্কার উতপ্ত মরুভূডমিতে নিয়ে নির্যাতন করতো। তাঁদের গোটা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ওপর নির্যাতন চলাকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে উপস্থিত হতেন এবং সান্তনা দিয়ে বলতেন, হে ইয়াসারের পরিবার, ধৈর্য ধারণ কর। তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।” আম্মারের মাতাকে (সুমাইয়া) তারা মারতে মারতে মেরেই ফেললো। তথাপি তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি।

আর পাপিষ্ঠ আবু জাহল যখনই শুনতো যে অমুক ইসলাম গ্রহণ করেছে, অমনি তার বিরুদ্ধে কুরাইশদেরকে উস্কিয়ে দিত। ইসলাম গ্রহণকারী যদি ভালো পদমর্যাদাধারী ব্যক্তি হতো তাহলেও তাঁকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতো এবং বলতো, “তুমি তোমার বাপের ধর্ম ত্যাগ করেছ। অথচ তোমার বাপ তোমার চেয়েও উত্তম। কাজেই আমরা তোমাকে বেকুফ প্রতিপন্ন করবো, তোমার মতামত যে খারাপ ও ভুল, তা আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো, তোমার মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে তবে ক্ষান্ত হবো।”  আর যদি তিনি ব্যবসায়ী হতেন তবে তাকে বলতো, “আমরা তোমার ব্যবসায়ের সর্বনাশ ঘটাবো এবং তোমার মালপত্র নষ্ট করে দেবো।” আর যদি দুর্বল কেউ হতো তাহলে মারপিট করতো ও তার বিরুদ্ধে লোকজনকে লেলিয়ে দিত।

সাঈদ ইবনে যুবাইর বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের ওপর কি এতদূর অত্যাচার চালাতো যার ফলে তারা ইসলাম ত্যাগ করলেও তাদের ওপর দোষারোপ করা চলতো না?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ। তারা তাঁদেরকে প্রহার করত এবং অনাহার ও পিপাসায় কষ্ট দিত। তাঁদের এক একজন এ ধরনের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এতদূর হীনবল হয়ে পড়তেন যে, সোজা হয়ে বসে থাকতেও পারতেন না।

এহেন নির্যাতন চালানোর পর তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করতো, ‘স্বীকার কর আল্লাহর ছাড়া লাত-উয্যাও তোমার মাবুদ?’ কেউ কেউ বলতো, হাঁ।’ এমনকি একটা তুচ্ছ পোকামকড়ও দেখিয়ে বলতো, ‘আল্লাহ্ ছাড়া একেও মাবুদ বলে মান তো?’ কেউ কেউ অসহ্য নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনন্যোপায় হয়ে বলতো, ‘হাঁ’।”

আবিসিনিয়ার মুসলমানদের প্রথম হিজরাত

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন একদিকে তাঁর সাহাবীদের ওপর অসহনীয় নির্যাতন চলছে। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা লাভ ও আবু তালিবের সহায়তা লাভের কারণে তিনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জীবন যাপন করছেন। অথচ তিনি তাঁদের ওপর আপতিত যুলুমকে কিছুমাত্র রোধ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমরা যদি আবসিনিয়ায় চলে যাও মন্দ হয় না। সেখানে একজন রাজা আছেন যার রাজত্বে কারো ওপর যুুলুম হয় না। এ দেশটা সত্য ও ন্যায়ের আশ্রয়স্থল। যতদিন এই অসহনীয় পরিস্থতি থেকে আল্লাহ তোমাদের মুক্ত না করেরন ততদিন সেখানে অবস্থান কর।” এই উপদেশ অনুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ কুফরীতে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হবার আশংকায় এবং নিজের দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচানোর তাকিদে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের জন্য আবিসিনিয়ায় চলে গেলেন। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর এটাই প্রথম হিজরাত।

এই হিজরাতের জন্য যাঁরা প্রথম স্বদেশ ত্যাগ করেণ তাঁরা হলেন উসমান ইবনে আফফান ও তাঁর স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা রুকাইয়া, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ও তাঁর স্ত্রী সাহলা বিনতে সুহাইল, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, মুসআব ইবনে ‘উমাইর, আবদুর রহমান্ ইবনে আউফ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ ও তাঁর স্ত্রী লায়লা বিনতে আবি হাসমা, আবু সাবরা ইবনে আবু বুহম ও সুহাইল ইবনে বাইদা। এই দশজন আবিসিনিয়ায় হিজরাতকারী প্রথম মুসলমান। (ইবনে হিশামের মতে উসমান ইবনে মাযউন ছিলেন দলনেতা।) এরপর দেশত্যাগ করেন জাফর ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তারপর একের পর এক মুসলমানরা সেখানে গিয়ে সমবেত হতে থাকেন। কেউবা সপরিবারে কেউবা পরিবার পরিজন ছেড়ে একাকী। এভাবে যেসব মুসলমান হিজরাত করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে বসবাস করা শুরু করেন, তাঁদের সংখ্যা সর্বমোট ৮৩ জনে দাঁড়ায়। অবশ্য যেসব অল্পবয়স্ক শিশু কিশোর তাঁদের সাথে গিয়েছিল কিংবা সেখানে যাওয়ার পর জন্মগ্রহণ করেছিল তারা এ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত নয়।

মুহাজিরদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবিসিনিয়ায় কুরাইশদের দূত প্রেরণ

কুরাইশগণ যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ আবিনিনিয়ায় গিয়ে নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করছেন, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, নাজাশীর নিকট দু’জন যোগ্য দূত পাঠাবে। এতে নাজাশী তাদেরকে সেখান থেকে ফেরত পাঠাবে এবং তারা তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার সুযোগ পাবে। তারা মুসলমানদেরকে তাঁদের নিরাপদ ও নিরুপদ্রব আশ্রয় থেকে যে করেই হোক বের করে আনতে বদ্ধপরিকর হলো। এ উদ্দেশ্যে যে দু’জন লোককে পাঠালো তারা হলো আবুদল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ’আস ইবনে ওয়ায়েল। কুরাইশরা দূতদ্বয়ের মাধ্যমে নাজাশীকে দেয়ার জন্য বিপুল উপঢৌকন সংগ্রহ করলো। অতঃপর তাদেরকে নাজাশীর কাছে পাঠালো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরা বলেন, আমরা আবিসিনিয়ায় গিয়ে উপস্থিত হবার পর একজন উত্তম প্রতিবেশী পেলাম। তিনি স্বয়ং নাজাশী। আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করলাম। নির্বিঘেœ আল্লাহর ইবাদাত করতে লাগলাম। কোন কষ্টদায়ক ব্যবহারও কেউ করছিল না এবং কোন অপ্রীতিকর কথাও আমাদের শুনতে হচ্ছিল না। কুরাইশগণ একথ জানতে পেরে সিদ্ধান্ত নিল যে,  নাজাশীর কাছে আমাদের ব্যাপারে দু’জন পারদর্শী দূত পাঠাবে এবং নাজাশীর কাছে আমাদের মক্কার দুর্লভ ও নয়ানাভিরাম জিনিস উপঢৌকন পাঠাবে। নাজাশীর কাছে মক্কা থেকে যেসব  জিনিস আসতো তার মধ্যে সবচেয়ে উত্ম জিনিস বিবেচিত হতো সেখানকার চামড়া। তাই তাঁর জন্য কুরাইশরা প্রচুর চামড়া সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন। নাজাশীর রাজকর্মচারী ও দরবারীদের কাউকেই তারা উপহার দিতে বাদ রাখেনি। এসব উপহার উপঢৌকন সহকারে আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ‘আসকে পাঠালো এবং তাদের করণীয় কাজ তাদেরকে বুঝিয়ে দিল। তারা তাদেরকে বলে দিল, “মুহাজিরদের সম্পর্কে নাজাশীর সাথে কথা বলার আগে তোমরা প্রত্যেক দরবারী ও রাজকর্মচারীকে উপঢৌকন দিয়ে অনুরোধ করবে, তিনি যেন মুহাজিরদেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করেন এবং সমর্পণ করার আগে তাদের সাথে যেন কোন কথা না বলেন।”

এরপর তারা রওনা হলো এবং নাজাশীর কাছে এসে উপনীত হলো। তখন আমরা উত্তম প্রতিবেশীর কাছে উত্তম বাসস্থানে বসবাস করছি। নাজাশীর সাথে কথাবার্তা বলার আগে তারা প্রতিটি দরবারী ও রাজকর্মচারীকে উপঢৌকন দিল। তাদের প্রত্যেককে তারা বললো, “আমাদের দেশ থেকে কতকগুলো বেকুব যুবক বাদশাহর রাজ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিজ জাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে অথচ আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা এক নতুন উদ্ভট ধর্ম তৈরী করেছে। সে ধর্ম আপনাদের ও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। জাতির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত লোকেরা আমাদেরকে বাদশাহর কাছে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি ওদেরকে ওদের স্বাজাতির কাছে ফেরত পাঠান। আমরা যখন বাদশারহর সাথে কথা বলবো তখন আপনারা বাদশাহকে ওদের ফেরত পাঠাতে ও ওদের সাথে কোন কথা না বলতে পরামর্শ দেবেন। কেননা তাদের দোষত্রুটি সম্পর্কে তাদরে জাতিই সবচেয়ে ছাল জানে।” দরবারীরা সবাই এতে সম্মতি জানালো। অতঃপর তারা নাজাশাকীকে উপঢৌকন দিল এবং তিনি তা গ্রহণ করলেন। অতঃপর তারা তাঁর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। তারা বললো, “হে বাদশাহ, আমাদের দেশ থেকে কতিপয় নের্বোধ যুবক আপনার দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের স্বাজাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে এবং আপনার ধর্মও গ্রহণ করেনি তারা একটা উদ্ভট ধর্ম উদ্ভাবন করে নিয়ছে যা আপনার ও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। তাদের ব্যাপারে আপনার কাছে তাদের কওমের সবচেয়ে সম্মানিত লোকেরা আমাদেরকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাদেরও মুরব্বী ও আম্মীয়-স্বজন। ওদেরকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ নিয়েই আমরা এসেছি। তাদের কি দোষত্রুটি আছে সে সম্পর্কে তাদের মুরব্বীরা ও আত্মীয়রাই সমধিক অবগত।”

উম্মে সালামা বলেন, নাজাশী মুহাজিরদের বক্তব্য শুনুক এটা আবুদল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ‘আসের কাছে সবচেয়ে অবাঞ্ছিত ব্যাপার ছিল। রাজার  দরবারীরা রাজাকে বললো, “হে বাদশাহ, ওরা দু’জন ঠিকই বলেছে। তাদের জাতির তাদের দোষত্রুটি ভালো জানে। কাজেই ওদেরকে এই দূতদ্বয়ের হাতে সমর্পণ করে দিন। ওরা ওদেরকে স্বদেশ ও স্বজাতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাক।”

নাজাশী ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “না, এ পরিস্থিতিতে আমি তাদেরকে এই দূতদ্বয়ের হাতে সমর্পণ করবো না। একদল লোক আমার সান্নিধ্যে বাস করছে। তারা আমার দেশে অতিথি হয়েছে। তারা অন্যত্র না গিয়ে আমার কাছে আসাকে অগ্রগণ্য মনে করেছে। আমি তাদেরকে ডাকবো এবং এই আগন্তুকদ্বয়ের বক্তব্য সম্পর্কে তাদের বক্তব্যও শুনবো। যদি দেখি, এরা  দু’জন যেরূপ বলছেন, আশ্রিতরা সত্যিই তদ্রƒপ, তা হলে ওদেরকে সমর্পণ করবো এবং তাদের জাতির কাছে ফেরত পাঠাবো; অন্যথায় পাঠাবো না। যতদিন তারা আমার কাছে থাকতে চাইবে সাদরে রাখবো।”

উম্মে সালামা বলেন, অতঃপর নাজাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ডেকে পাঠালেন। নাজাশীর বার্তাবাহক যখন মুহাজিরদের ডাকতে গেল, তখন সবাই পরামর্শে বসলেন। এক অপরকে  জিজ্ঞেস করলেন, বাদশাহর কাছে গিয়ে কি বলা যাবে। সবাই এক বাক্যে বললেন, “আমরা যা জানি এবং আমাদের নবী যা নির্দেশ দিয়েছেন ত-ই বলবো। তাতে পরিণতি যা হয় হবে।”

তাঁরা দরবারে এলেন। নাজাশী তার আগেই ধর্মযাজকদে ডেকে হাজির করে রেখেছেন। তাঁরা বাদশাহর সামনে ইনজীল খুলে বসেছেন। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের সেই ধর্মটা কি যা গ্রহণ করে তোমরা নিজ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছো।এবং আমার ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করোনি?”

জাফর ইবনে আবু তালিব উত্তরে বললেন, “হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম অজ্ঞ জাতি। আমরা মূর্তিপূজা করতাম, মৃত জন্তুর গোশত খেতাম এবং অশ্লীল ও খারাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম, আমরা নিকট আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করতাম এবং আমাদের মধ্যে যে সবল সে দুর্বলের হক আত্মসাত করতো। এমতাবস্থায় আল্লাহ আমাদের কাছে আমাদের মধ্যে থেকেই এক ব্যক্তিকে নবী করে পাঠালেন। আমরা তাঁকে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও সত্যবাদী বলে জানি এবং বিশ্বস্ত ও সচ্চরিত্র রূপে তাঁকে দেখেছি। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইাবাদাত  করার ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করার আহ্বান জানালেন। আমরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য যেসব বস্তু তথা পাথর ও মূর্তি ইত্যাদির পূজা করতাম, তা তিনি ছাড়তে বললেন। তিনি সত্য কথা বলা, আমানত রক্ষা করা, আত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করা, প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং নিষিদ্ধ কাজ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাদের অশ্লীল কাজ করতে, মিথ্যা কথা বলতে, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাত করতে ও নিরপরাধ নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করতে নিষেধ করলেন। আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করতে ও তাঁর সাথে শরীক না করতে বললেন। নামায পড়তে ও যাকাত দিতে বললেন।” এভাবে জাফর একে একে ইসলামের বিধানগুলো তুলে ধরলেন।

জাফর আরো বললেন, “আমরা তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলাম। তিনি আল্লাহর তরফ থেকে যেসব বিধান দিলেন তার অনুসরণ করতে লাগলাম। এক আল্লাহর ইবাদাত করতে লাগলাম এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক  করলাম না। তিনি যেসব জিনিস হারাম ঘোষণা করলেন আমরা তা থেকে বিরত রইলাম, আর যেসব জিনিস হালাল ঘোষণা করলেন আমরা তা  হালাল বলে মেনে নিলাম। এতে আমাদের জাতি  আমাদের শত্রু হয়ে গেল, তারা আমাদের ওপর নির্যাতন চালাতে লাগলো এবং আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত থেকে মূর্তিপূজায় ফিরিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা আমাদের ওপর চাপ দিতে লাগলো যাতে আমরা ঘৃণ্য অপকর্মগুলোকে আবার হালাল মনে করে নিই। তারা যখন এভাবে আমাদের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে উঠলো, যুলুম-নির্যতন দ্বারা আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুললো এবং  আমাদের মনোনীত ধর্ম পালনে বাধা দিতে লাগলো, তখন আমরা আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিলাম। অন্যদের চেয়ে আপনাকেই উত্তম মনে করলাম এবং আপনার প্রতিবেশী হয়ে থাকতে আগ্রহী হলাম। হে বাদশাহ, আমাদের আশা এই যে, আপনার কাছে অত্যাচারের শিকার হবো না।”

নাজাশী তাঁকে বললেন, “তোমাদের নবী আল্লাহর বাণী নিয়ে  সেছেন্ তার কোন অংশ কি তোমার কাছে আছে?” জাফর বললেন, “হ্যাঁ, আছে।” নাজাশী বললেন, “আমাকে পড়ে শোনাও।” জাফর সূরা মারিয়ামের প্রথম থেকে  কতিপয় আয়াত পড়ে শোনালেন। আয়াতগুলো শুনে নাজাশী কাঁদতে লাগলেন। তাঁর দাড়ি অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তাঁর সাথে সাথে ধর্মযাজকরাও কাঁদতে কাঁদতে ইনজীল ভিজিয়ে ফেললেন। এরপর নাজাশী বললেন, “আমি নিশ্চিত যে, এই বাণী এবং ঈসার বাছে যে বাণী আসতো, উছয় একই উৎস থেকে নির্গত। হে কুরাইশ দূতদ্বয়, তোমরা বিদায় হও। আমি কিছুতেই ওদেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করবো না। ওরা এখানেই থাকবে।”

উম্মে সালামা বলেন, দরবার থেকে বেরিয়ে আমর ইবনুল ‘আস বললেন, “আল্লাহর শপথ, আগামীকাল আমি আবার নাজাশীর কাছে আসবো। তখন তাঁকে এমন কথা বলবো যা আশ্রিত মুসলমানদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত সংযত ছিলেন। তিনি বললেন, “এরূপ করো না। যদিও তারা আমাদের বিরোদী, তথাপি আমাদের এতদূর যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাদের বহু রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন রয়েছে।” আমর ইবনুল ’আস বললেন, “আমি নাজাশীকে জানাবো যে, মুসলমানরা হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ামকে স্রেফ আল্লাহর বান্দা বলে বিশ্বাস করে।”

পরদিন আমরা নাজাশীর দরবারে পুনরায় হাজির হয়ে তাঁকে বললেন, “হে বাদশাহ, আশ্রিতরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলে থাকে। আপনি ওদের ডাকুন এবং ঈসা(আ) সম্পর্কে তাদের মতামত কি তা জিজ্ঞাসা করে দেখুন।”

বাদশাহ আবার মুসলমানদেরকে দরবারে ডাকলেন ঈসা (আ) সম্পর্কে মতামত জিজ্ঞাসা করার জন্য। উম্মে সালামা বলেন, এবারে আমরা সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলাম। মুসলমান মুহাজিররা আবার পরামর্শের জন্য সমবেত হলেন। সবার সামনে এখন নতুন প্রশ্ন, বাদশাহ ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কি বলবো। অবশেষে সবাই স্থির করনেল যে, আল্লাহ যা বলেছেন এবং আমাদের নবী যে সত্য ধারনা দিয়েছেন, আমরা ঠিক তাই বলবো। ফলাফল যা হওয়ার হবে।

মুহাজিররা দরবারে হজির হলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা মারিয়ামের পুত্র ঈসা সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ কর?” জাফর ইবনে আবু তালিব বললেন, “আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন, আমরা তাতেই বিশ্বাস করি। তিনি বলেছেন, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁরই ফুঁকে দেয়া আত্মা এবং তাঁরই বাণী যা তিনি কুমারী ও পুরুষদের স্পর্শমুক্ত মারিয়ামের ওপর নিক্ষেপ করেছিলেন।”

এ কথা শুনে নাজাশী প্রবল উচ্ছ্বাসবশে মাটিতে হাত চাপড়িয়ে একখানা ক্ষুদ্র কাঠ হাতে নিলেন এবং বললেন, “আল্লাহর শপথ, তুমি যা বলেছো তার সাথে মারিয়ামের পুত্র ঈসার এই কাঠির পরিমাণ পার্থক্যও নেই।”

বাদশাহর এই কথা বলার সময় পার্শ্বস্থ দরবারীরা ক্রোধবশে ফিসফিস করে কি যেন বললো। বাদশাহ তা শুনে বললেন, “যতই ফিসফিস করোনা কেন, আমার মত অপরিবর্তিত থাকবে। হে মুহাজিরগণ, তোমরা এখন নিজ নিজ বাসস্থানে চলে যাও। আমার রাজ্যে তোমরা সম্পূর্ণ নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে বাস করতে থাক। যে তোমাদের গালাগাল করবে তাকে জরিমানা করা হবে। তোমাদের কোন একজনকেও কষ্ট দিয়ে আমি যদি পাহাড় স্বর্ণ লাভ করি, তথাপি আমি তা করা পছন্দ করি না। হে রজকর্মচারীগণ, তোমরা এই দূতদ্বয়ের দেয়া উপঢৌকনগুলো ফিরিয়ে দাও। ওগুলোতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।”

উম্মে সালামা বলেন, “এরপর তারা উভয়ে চরম লাঞ্ছনার গ্লানি মাথায় নিয়ে ফিরে গেলেন। তাদের আনা উপঢৌকনও ফেরত দেয়া হলো। আমরা তাঁর কাছে অত্যন্ত নিরুদ্বেগ আবাসিক পরিবেশ ও পরম সুজন প্রতিবেশীর সাহচর্যে বসবাস করতে লাগলাম।”

উম্মে সালামা বলেন, এইরূপ নিরুদ্বেগ পরিবেশে আমরা জীবন যাপন করছিলাম। সহসা আবিসিনিয়াা এক ব্যক্তি নাজাসীর সাথে তাঁর রাজত্বের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলো। সেই সময় আমরা যেরূপ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছিলাম সেরূপ আর কখনো পড়িনি। আমাদের আশংকা ছিল ঐ ব্যক্তি যদি নাজাশীর বিরুদ্ধে জয়ী হয় তাহলে সে হয়তো নাজাশীর মত আমাদের আশ্রয় দিতে চাইবে না এবং আমাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারও স্বীকার করবে না। নাজাশী তাঁর ঐ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলে গেলেন। দুই প্রতিপক্ষের মাঝখানে পড়লো নীলনদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাজির সাহাবীগণ বললেন, “এমন কোন ব্যক্তি কি এখানে আছেন যিনি আবিসিনীয় জনগনের এই যুদ্ধের সময় রণাঙ্গণে উপস্থিত হবে  এবং যুদ্ধের ফলাফল কি হয় তা দেখে এসে আমাদের জানাবেন?” যুবাই ইবনুল আওয়াম বললেন, “আমি যাবো।” বয়সে কনিষ্ঠতম এই সাহাবীর ইচ্ছায় সবাই সম্মতি দিলেন।

একট চামড়ার মশকে হাওয়া ভরে যুবাইরের সঙ্গে দেয়া হলো। তিনি ওটা বুকের ওপর স্থাপন করলেন। অতঃপর তার ওপর ভর করে সাঁতরে নীলনদের কিনারে গিয়ে উঠলেন। তারপর হেঁটে রণ্ঙ্গনে হাজির হলেন।

উম্মে সালামা বলেন, এই সময় আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি যেন নাজাশী তার শত্রুর ওপর জয়লাভ করেন এবং দেশের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব বহাল থাকে। আমরা যখন যুদ্ধের ফলাফর জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিলাম তখন সহসা যুবাইরকে দেখা গেল। তিনি কাপড় নাড়তে নাড়তে দৌড়ে আসছিলেন এবং বলেছিলেন, “তোমরা সুসংবাদ শোন, নাজাশী জয়লাভ করেছেন। আল্লাহ তাঁর শত্রুকে ধ্বংস করেছেন এবং আবিসিনিয়ায় তাঁর কর্তৃত্ব বহাল রেখেছেন।” এরপর আবিসিনিয়ায় তাঁর শাসন সুসংহত হয়। আমরা সেখানে সর্বোত্তম স্থানে অবস্থান করছিলাম। অবশেষে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে যাই। তিনি তখনো মক্কায় অবস্থান করছিলেন।

 

উমার ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ

আমর ইবনুল ’আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ যখন মক্কায় কুরাইশদের কাছে ফিরে আসলো তখন কুরাইশরা জানতে পারলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেই, অধিকন্তু নাজাশী তাদেরকে অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলেও বিদায় দিয়েছেন। এই সময় হযরত উমারও ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একরোখা ও দুঃসাহসী। তাঁর অসাক্ষাতেও কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে সাহস করতো না। হামযা ও উমারের মত দুই বীরকে কিছু বলতে বা করতে সাহস করতো না। হামযা ও উমারের মত দুই বীরকে সাথী হিসেবে পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ কাফিরদের যুলুম থেকে অনেকটা নিরাপত্তা লাভ করেন। বলতে গেলে তাঁরা শক্তি মত্তায় কুরাইশদেরকেও ছাড়িয়ে গেলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা) বলতেন, “খাত্তাবের পুত্র উমার ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমরা কা’বা ঘরে গিযে নামায পড়তে পারতাম না। উমার ইসলাম গ্রহণ করার পর কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ করে কা’বার সামনে গিয়ে নামায আদায় করেন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়ি। কিছুসংখ্যক সাহাবা হিজরাত করে হাবশায় [আবিসিনিয়া] যাওয়ার পর উমার (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন।”

উমারের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটা এইরূপ : তাঁর বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব ও তার স্বামী সাঈদ ইবনে যায়িদ তখন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ব্যাপারটা তাঁরা উভয়েই উমারের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন। বনী আদী ইবনে কা’ব গোত্রের নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ নাহহামও গোত্রের লোকদের ভয়ে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখেন। তিনি ছিলেন হযরত উমারেরই জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। আরেকজন সাহাবী খাব্বাব ইবনুল আরাত ফাতিমা বিনতে খাত্তাবের কাছে মাঝে মাঝে তাঁকে কুরআন শরীফ পড়াতে আসতেন। একদিন উমার তলোয়ার হাতে নিয়ে বেরিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর গুটিকয়েক সাহাবীর সন্ধানে। তিনি পূর্বাহ্নে জানতে পেরেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাঁর চল্লিশজন নারাী পুরুষ সহচরকে নিযে সাফা পর্বতের নিকট একটি বাড়ীতে সমবেত হয়েছেন। সেখানে তাঁর সাথে হামযো ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা), আবু বাক্র সিদ্দক (রা) ও আলী ইবনে আবু তালিব (রা) সহ সেইসব মুসলমান ছিলেন যারা আবিসিনিয়া না গিয়ে মক্কাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলেন। নাঈম উমারের (রা) মুখোমুখী দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছ উমার?”

উমার বললো, “আমি ঐ বিধর্মী মুহাম্মাদের সন্ধানে যাচ্ছি, যে কুরাইশদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদেরকে বেকুফ সাব্যস্ত করেছে, তাদের ধর্মের নিন্দা করেছে এবং তাদের দেবদেবীকে গালি দিয়েছে। আমি তাকে হত্যা করবো।”

নাঈম তাঁকে বললেন, “উমার, তুমি নিশ্চয়ই আত্মপ্রবঞ্চিত হয়েছো। তুমি কি মনে কর যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করার পর বনু আবদে মানাফ তোমাকে ছেড়ে দেবে এবং তুমি অবাধে বিচরণ করতে পারবে? তুমি বরং নিজের ঘর সামলাও।

উমার বললেন, “কেন, আমার গোষ্ঠীর কে কি করেছে?”

নাঈম বললেন, “তোমার ভগ্নিপতি ও চাচাতো ভাই সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর এবং তোমার বোন ফাতিমা। আল্লাহর শপথ, ওরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তারা মুহাম্মাদের ধর্মের অনুসরণ করে চলেছে। কাজেই পারলে আগে তাদেরকে সামলাও।”[২৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বিপন্ন হবার আশংকা বোধ করে উমারের মনযোগ অন্যদিকে চালিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এতে করে ফাতিমা ও তাঁর স্বামীর নির্যাতিত হবার সম্ভাবনা থাকলেও সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাশংকার তুলনায় অনেক হালকা ব্যাপার।]

এ কথা শোনামাত্রই উমার বোন ও ভগ্নিপতির গৃহ অভিমুখে ছুটলেন। তখন সেখানে খাব্বাব ইবনুল আরাতও উপস্থিত। তাঁর কাছে পবিত্র কুরআনের অংশবিশেষ ছিল যা তিনি সাঈদ দম্পতিকে পড়াচ্ছিলেন। ঐ অংশে সূরা ত্বাহা লেখা ছিল। তাঁরা উমারের আগমন টের পেলেন। খাব্বাব তৎক্ষন্ৎ একটি ক্ষুদ্র কক্ষে আত্মগোপন করলেন। ফাতিমা কুরআন শরীফের অংশটুকু লুকিয়ে ফেললেন। উমার গৃহে প্রবেশের প্রক্কালে শুনছিলেন যে, খাব্বাব কুরআন পড়ে তাঁদের দু’জনকে শোনাচ্ছেন। তিনি প্রবেশ করেই বললেন, “তোমরা কি যেন পড়ছিলে শুনলাম।” সাঈদ ও ফাতিমা উভয়ে বললেন, “তুমি কিছুই শোননি।” উমার বরলেন, “আল্লাহর শপথ, আমি শুনেছি, তোমরা মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করেছো এবং সেটাই অনুসরণ করে চলছো।” এ কথা বলেই ভগ্নিপতি সাঈদকে একটা চড় দিলেন। ফাতিমা উঠে এসে স্বামীকে তার প্রহার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। উমার ফাতিমাকে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, তিনি আহত হলেন।

উমারের এই বেপরোয়া আচরণ দেখে তারা উভয়ে বললেন,“হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং আল্লাহ ও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। এখন আপনি যা খুশী করতে পারেন।” উমার তাঁর বোনের দেহে রক্ত দেখে নিজের এহেন আচরণে অনুতপ্ত হলেন।

তারপর অনুশোচনার সুরে বোনকে বললেন, আচ্ছা, তোমরা যে বইটা পড়ছিলে, সেটা আমাকে দাও তো। আমি একটু পড়ে দেখি মুহাম্মাদ কি বাণী প্রচার করে?” এখানে উল্লেখ্য যে, উমার লেখাপড়া জানতেন।

তাঁর বোন বললেন, “আমাদের আশংকা হয়, বইটা দিলে তুমি নষ্ট করে ফেলবে।”

উমার দেবদেবীর শপথ করে বললেন, “তুমি ভয় পেও না। আমি ওটা পড়ে অবশ্যই ফিরিয়ে দেব।” একথা শুনে বোনের মনে এই মর্মে আশার সঞ্চার হলো যে, তিনি হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবেন। তাই তিনি বললেন, “ভাইজান, আপনি মুশরিক হওয়ার কারনে অপবিত্র। অথচ এই বই স্পর্শ করতে হলে পবিত্রতা অর্জন করা প্রয়োজন।”[২৯.কুরআন শরীফ স্পর্শ করার জন্য পবিত্রতার শর্ত সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, ফরয। আবার কারো কারো মতে ফরয নয়-মুস্তাহাব।]

উমার তৎক্ষনাৎ গিয়ে গোসল করে পবিত্র হয়ে আসলেন। ফাতিমা এবার কুরআন শরীফ  দিলেন। খুলেই যে অংশটি তিনি দেখলেন তাতে ছিল সূরা ত্বাহা। এথম থেকে কিছুটা পড়েই বললেন, “কি সুন্দর কথা! কি মহান বানী!” আড়াল থেকে এ কথা শুনে খাব্বাব বেরিয়ে এসে বললেন, “ উমার মনে হয়, ্আল্লাহ তার নবীর দোয়া কবুল করে তোমাকে ইসলামের জন্য মনোনীত করেছেন। গতকাল তিনি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আবুল হাকাম ইবনে হিশাম অথবা ইমার ইবনুল খাত্তাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর।’ হে উমার, তুমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও, তুমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও!”

উমার তখন বললেন, “হে খাব্বাব, আমাকে মুহাম্মাদের সন্ধান দাও। আমি তাঁর কছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।” খাব্বাব বললেন, “তিনি সাখা পর্বতের নিকট একটা বাড়ীতে কিছুসংখ্যক সাহাবার সাথে অবস্থান করছেন।”

উমার তাঁর তলোয়ার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের সন্ধানে চললেন। যথাস্থানে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলেন। আওয়াজ শুনে একজন সাহাবা উঠে এসে জানালা দিয়ে তাঁকে দেখলেন। সেখলেন উমার তরবারী হাতে দাঁড়িয়ে। তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গেলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, উমার দরজায় তরবারী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” হামযা রাদিয়ল্লাহু তা’য়ালা আনহু বললেন, “তাঁকে আসতে দাও। যদি ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে আমরা তাকে সহযোগিতা করবো আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তবে তাঁর তরবারী দিয়েই তাকে হত্যা করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে আসতে দাও।” তিনি উমারকে ভেতরে যেতে অনুমতি দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে উমারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং কক্ষের ভেতরে তাকে সাক্ষাত দান করলেন। তিনি উমারের পাজামার বাঁধনের জায়গা অথবা গলায় চাদরের দুই প্রান্ত যেখানে একত্রিত হয় সেখানে শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলেন। তারপর করলেন, “হে খাত্তাবের পুত্র, কি উদ্দেশ্যে এসছো? আল্লাহর শপথ, আল্লাহর তরফ থেকে তোমার উপর কোন কঠিন মুসিবত না আসা পর্যন্ত তুমি সংযত হবে বলে আমার হয় না।”

উমার বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি  আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের প্রতি ঈমান আনার জন্যই এসছি।”

একথা শোনামাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন জোরে ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের সবাই বুঝতে পারলো যে, উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে। হামযার পরে উমারের ইসলাম গ্রহণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণের মনোবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেল। তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে, এই দু’জন এখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মুশরিকদের যুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারবেন এবং তারা সবাই ওদের দু’জনের সহযোগিতায় মুসলমানদের শত্রুদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। এরপর সাহাবাগণ সেই স্থান থেকে নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেলেন।

উমার রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর সেই রাতেই চিন্তা করতে লাগলাম যে, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে কট্রর দুশমন কে আছে। আমি তার কাছে যাবো এবং আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাকে জানাবো। আমি স্থির করলাম যে, আবু জাহলই বড় দুশমন। অতঃপর সকল হতেই আমি তার বাড়ীতে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলাম। আবু জাহল বেরিয়ে আমার সামনে আসলো। সে বললে, “ভাগ্নে, তোমাকে খোশ আমদেদ জানাচ্ছি। [৩০.উমারের (রা) মাতা হানতামা বিনতে হিশাম আবু জাহলের বোন ছিলেন।]

কি মনে করে এসছো?” আমি বললাম, “আপনাকে জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।” এ কথা শোনামাত্র সে আমার মুখের ওপর এই বলে দরজা বন্ধ করে দিল, “আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক, যে খবর তুই এনছিস তাকেও কলংকিত  করুক।”

চুক্তিনামার বিবরণ

কুরাইশরা দেখলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ একটা নিরাপদ ও নিরুপদ্রব স্থানে আশ্রয় পেয়েছে এবং নাজাশী তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। তারা দেখলো, উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে।

ফলে উমার ও হামযার মত লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের দলভুক্ত হয়েছে এবং ইসলাম মক্কার পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এসব দেশে তারা পুনরায় মিলিত লো এবং এই মর্মে একটা চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করাার সিদ্ধান্ত নিলো যে, বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের সাথে অবশিষ্ট কুরাইশগণ এখন থেকে আর কোন বিয়ে শাদী ও বেচাকেনা করবে না।

একটি সম্মেলন আহ্বান করে তারা এই চুক্তিনামা সম্পাদন ও স্বাক্ষর করলো। এরপর চুক্তিনামাটি কা’বা শরীফের ভেতরে ঝুলিয়ে রাখলো, যাতে তাদের মনে ওটার গুরুত্ব ও প্রভাব বেশী হয়।

মানসূর ইবনে ইকরামা এই চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদদোয়ায় তার কয়েকটি আঙ্গুল অসাড় হয়ে যায়।

এ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের লোকগণ আবু তালিবের শরণাপন্ন হয়। তারা সবাই তার কাছে সমবেত হলো এবং সবাই আবু তালিবের সাথে তার গিরিবর্তে প্রবেশ করলো। অপরদিকে বনু হাশিম গোত্র থেকে আবু লাহাব বেরিয়ে গিয়ে বৈরী কুরাইশদের সাথে মিলিত হলো এবং তাদের পক্ষ সমর্থন করলো। সে বলতো. “মুহাম্মাদ আমাকে এমন সব বিষয় বলে যা আমি দেখতে পাইনে। সে বলে মৃত্যুর পরে আবার জীবন হবে। একথা বিশ্বাস করলে আমার হাতে আর কি থাকলো?” এরপর সে তার দ্ইু হাতে ফুঁক দেয় আর বলে, “তোমাদের উভয়ের ধ্বংস সাধিত হোক। (অর্থাৎ উভয় হাতের ) মুহাম্মাদ যা বলে তার কোনটাই আমি তোমাদের ক্ষেত্রে দেখি না।”(হাতে আমলনামা আসার ব্যাপারে নিয়ে উপহাস করাই সম্ভবতঃ তার উদ্দেশ্য।(অনুবাদক) এই  এসঙ্গে আল্লাহ এই আয়াত নযিল করেন :

[আরবী *************]

“আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক”

বনু আবদুল মুত্তালিব ও বনু হাশিম গোত্রদ্বয়ের গিরিবর্তে অবরোধ জীবন যাপন চলে দুই বা তিন বছর। এই সময় তারা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেন। দুই একজন সহৃদয় কুরাইশ আত্মীয়ের গোপন সহযোগিতা ছাড়া কিছুই তাদের কাছে পৌঁছতো না।

[৩১. কারো কারো মতে সূরা লাহাবের শানে নুযুল এইরূপ: আল্লাহ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘনিষ্ঠতম আত্মীয় স্বজনের নিকট ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেন তখন একদিন তিনি সাফা পর্বতে আরেহণ করে সমগ্র মক্কাবাসীকে ডাক দেন। সবাই সমবেত হলে তিনি বললেন, “আমি যদি তোমাদের বলি যে, পর্বতের অপর পাশে সমভূমিতে একটি সেনাদল তোমাদের ওপর হামলা করার জন্য ওত পেতে আছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?” তখন সবাই এক বাক্যে বললো, “তোমাকে তো কখনো মিথ্যা কথা বলতে  দেখিনি।” তখন তিনি বললেন, “আমি তোমাদের হুঁশিয়ার করছি এক কঠিন শাস্তি সম্পর্কে।” এই সময় আবু লাহাব বলে, “তুই মর! এই জন্য আমাদের ডেকেছিস?” এর জবাবে সূরা লাহাব নাযিল হয়।]

রাসূলুল্লাহর (সা) উপর কুরাইশদের নির্যাতন

আল্লাহর বিশেষ রক্ষা ব্যবস্থার কারণে আপন চাচা বনু আবদুল মুত্তালিব ও বনু হাশিম গোত্রের কার্যকর প্রতিরোধের মুখে শারীরিক কোন আক্রমন চালাতে পারেনি। তাই তারা অনন্যোপায় হয়ে তাঁকে নিন্দা, কটাক্ষ, উপহাস বিদ্রƒপ করা এবং তাঁর সএথ ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার পথ বেছে নেয়। কুরআন কুরাইশদের এ জাতীয় ক্রিয়াকলাপ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতামূলক আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা ও বিশ্লেষণসহ নাযিল হতে থাকে। এ জাতীয় আচরণকারীদের কারো কারো নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদের নাম উল্লেখ না করে কাফিরদের সম্পর্কিত সাধারণ বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কুরাইশদের মধ্য থেকে এ জাতীয় যেসব লোকের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব অন্যতম। তার স্ত্রী উম্মে জামীল বিনতে হারব ইবনে ইমাইয়কে “হাম্মালাতার হাতাব” অর্থাৎ কাঠ বহনকারিণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা সে কাঁটা সংগ্রহ করে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাতায়াতের পথে ছড়িয়ে রাখতো। এজন্যই আল্লাহ তাদের উভয়ের সম্পর্কে এই সূরা নাযিল করেন :

[আরবী *************]

“ভেঙ্গে গিয়েছে আবু লাহাবের দুই হাত, আর সে ব্যর্থ হয়েছে। তার সম্পদ ও অর্জিত কোন কিছুই তার কাজে আসেনি। অবশ্যই সে শিখাবিশিষ্ট আগুনে নিক্ষিপ্ত এবং তার সাথে তার স্ত্রীও- যে কাষ্ঠ বহনকারিনী। তার গলায় থাকবে খেজুর ছালের রশি।”

ইবনে ইসহাক বলেন, আমি শুনেছি, উম্মে জামীল যখন তার ও তার স্বামীর ব্যাপারে নাযিল হওয়া কুরআনের এই সূরার কথা শনলো, তখন হাতে একটা পাথর মুষ্টিবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট উপস্থিত হলো। এই সময় তিনি আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়ারøাহ তা’য়ালা আনহুর সঙ্গে কা’বা শরীফের পাশে মসজিদে হারামে বসে ছিলেন। সে সেখানে তাঁদের দু’জনের কাছে এসে দাঁড়াতেই আল্লাহ তা’য়ালা তার চোখ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অদৃশ্য করে দিলেন। ফলে সে আবু বাক্র ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলো না। সে বললো, “হে আবু বাক্র, তোমার সঙ্গী কোথায়? আমি শুনেছি, সে আমার নিন্দা করে। আল্লাহর শপথ, তাকে পেলে আমি এই পাথর তার মুখের উপর ছুড়ে মারতাম।” এ কথা বলে সে চলে গেল। আবু বাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি মনে করেন যে, সে আপনাকে দেখতে পেয়েছে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে আমাকে দেখতে পায়নি। আল্লাহ আমাকে দেখবার শক্তি তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”

আর উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে হুযাফা ইবনে জুমাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলেই উচ্চস্বরে গালাগালি ও অস্ফুট স্বরে নিন্দা করতো। আল্লাহ তার সম্পর্কে সুরা হুমাযা নাযিল করেন :

[আরবী *************]

‘সামনাসামনি কটু কথা বলতে, অসাক্ষাতে নিন্দা করতে এবং ধনসম্পদ উপার্জন করে তা গুনে গুনে রাখতে অভ্যস্ত এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অনিবার্য ধ্বংস। সে মনে করে, তার সম্পদ তাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। কক্ষণো নয়, সে অবশ্যই চূর্ণবিচুর্ণকারী স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে। আর সেই চুর্ণ বিচূর্ণকারী স্থানটা কি, তাকি তুমি জান? সেটা আল্লাহর আগুন, যাকে উত্তপ্ত করা হয়েছে, যা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদের ওপর ঢেকে বন্ধ করে দেয়া হবে, তা উঁচু উঁচু স্তম্ভে পরিবেষ্টিত থাকবে।”

আর একজন ছিল ’আস ইবনে ওয়ায়েল সাহামী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সাহাবী খাব্বাব ইবনুল আরাত একজন কর্মকার ছিলেন। তিনি তরবারী বিক্রি করেছিলেন। এই সুবাদে ’আসের নিকট তার বেশ কিছু টাকা পাওনা ছিল। তিনি সেই টাকার তাগাদা দিতে গেলে ’আস বললো, “হে খাব্বাব, তোমাদের লোক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাস করে যে, জান্নাতে যারা যাবে  তারা যত খুশী সোনা, রূপা, পোশাক ও চাকর নফর পাবে, তাই না?” খাব্বাব বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ’আস বললো, “তাহলে হে খব্বাব, আমাকে কিয়ামাত পর্যস্ত সময় দাও। আমি জান্নাতে গিয়ে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেবো। হে খাব্বাব, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি ও তোমার সাথী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে অগ্রগন্য হবে না এবং আমার চেয়ে এবং আমার চেয়ে বেশী সৌভাগ্যশালীও হবে না।” এ প্রেক্ষিতে ’আস সম্পের্কে আল্লাহ নাযিল করেন-

[আরবী *************]

“তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো যে আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করে এবং বলে যে, আমাকে তো ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দিয়ে সমৃদ্ধ করা হতেই থাকবে। সে কি গায়েব জেনে ফেলেছে, কিংবা করুণাময় আল্লাহর কাছ থেকে কোন প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে? কক্ষণো নয়! সে যা বলে আমি লিখে রাখবো এবং তাঁর  শাস্তি আরো বাড়িয়ে দেবো? যে  সন্তান ও ধন সম্পদের কথা সে বলে, তা শেষ পর্যন্ত আমারই অধিকারভুক্ত হবে এবং সে একাকীই আমার কাছে হাজির হবে।” (সূরা মারিয়াম)

অপর এক রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, আবু জাহল ইবন হিশাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে বলে, “হে মুহাম্মাদ, আমাদের দেবদেবীকে গালাগালি করা তোমাকে বন্ধ করতে হবে। নচেত তোমার খোদাকে গাল দেবো।” এ প্রসঙ্গে আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন :

[আরবী *************]

“ওদের দেবদেবীকে তোমরা গাল দিও না। তাহলে ওরা  শত্রুতা ও অজ্ঞতার কারণে আল্লাহকে গাল দেবে।” (আল আনয়াম)

নাদার ইবনে হারেস ইবনে কালাদা ইবনে আবদে মানাফ ইবনে আবদুদ্ দার ইবনে কুসাই ছিল এমনি আর একজন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বৈঠকে আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন, কুরাইন তিলাওয়াত করতেন এবং কুরাইশদেরকে অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের অনুরূপ পরিণতির শিকার হওয়া সম্পর্কে সাবধান করে দিতেন এবং ঐ বৈঠকের শ্রোতদের কাছে পারস্যের বীর রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের কাহিনী বলতো। তারপর সে বলতো, “মুহাম্মাদ আমার চেয়ে ভাল কাহিনী শোনাতে পারে না। মুহাম্মাদের কাহিনীগুলো তো প্রচীন যুগের কিচ্ছা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। ওগুলো মুহাম্মাদ যেমন লিখে রেখেছে, তেমনি আমিও লিখে রেখেছি।” তার সম্পর্কে আল্লাহ নযিল করেন,

[আরবী *************]

“তারা বলেছে : এসব প্রচীন যুগের কিচ্ছা কাহিনী যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো তাকে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে শেখানো হয়। হে নবী, তুমি বল : এ বাণী  তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সকল গুপ্ত রহস্য জানেন। বস্তÍতঃ তিনি ক্ষমাশীল করুণাময়।” (আল কুরআন)

[আরবী *************]

“অবিশ্বাসীকে  যখনই আমার আয়াত পড়ে শোনানো হয় অমনি সে বলেঃ এসব তো প্রাচীন কালের কিচ্ছা কাহিনী মাত্র।” (আল কালাম)

আরো নাযিল হয়,

[আরবী *************]

“এমন  প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপিষ্ঠের জন্যে ধ্বংস যার সামনে পঠিত আল্লাহর আয়াতগুলো শুনেও সে দাম্ভিকতার ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায় এবং এমন ভান করে যেন শুনেনি। সুতরাং তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ জানিয়ে দাও।” (আল জাসিয়া)

আর এক ব্যক্তি হলো আখনাস ইবনে শুরাইক ইবনে আমর ইবনে ওয়াহাব সাকাফী। সে ছিল একজন গণ্যমান্য লোক। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নানা উপায়ে লাঞ্ছনা দিত এবং অকথ্য কথা বলতো। আল্লাহ তার সম্পর্কে সূরা আলা কালামে বলেন,

[আরবী *************]

“এমন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যে অত্যধিক কসম খায়, যার কোন গুরুত্ব নেই, যে অতিমাত্রায় গালাগাল করে ও চোগলখুরী করে বেড়ায়, যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালংঘন করে, পাপ কাজে লিপ্ত থাকে, যে অতিমাত্রায় দুষ্কৃতিকারী, অত্যাচারী এবং সর্বোপরি যে পরিচয়হীন।”

ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা বলেছিল, “কুরাইশ গোত্রে আমার মত সরদার এবং সাকীফ গোত্রে আবু মাস’উদ আমর ইবনে উমাইর সাকাফী থাকতে ওহী নাযিল হলো কিনা মুহাম্মাদের ওপর আমরা দুই শহরের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব কিনা বাদ পড়ে গেলাম।”

এর জবাবে আল্লাহ নাযিল করেন  সূরা যুখরুফের আয়াত,

[আরবী *************]

“তারা বলেছে : দুই শহরের[৩২. অর্থাৎ মক্কা ও তায়েফ] কোন একজন প্রধান ব্যক্তির ওপর কুরআন নাযিল হলেই ভাল হতো। তোমার প্রভুর অনুগ্রহ ওরাই বণ্টন করে থাকে? পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা আমিই তাদের মধ্যে বণ্টন করেছি এবং তাদের কিছু সংখ্যক লোককে অপর কিছুসংখ্যক লোকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি, যার ফলে একে অপরকে কাজে লাগাতে পারে। আসলে তারা যা সংগ্রহ করছে তার চেয়ে তোমার প্রভুর অনুগ্রহই উৎকৃষ্ট।”

উকবা ইবনে আবু মুয়াইত ও উবাই খালফ উভয়ে পরস্পরের অন্তরঙ্গ সহচর ছিল। একবার উকবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসেছিল এবং তাঁর কথা শুনেছিল। উবাই এখবর জানতে পেরে উকবার কাছে এসে বললো, “তুমি মুহাম্মাদের মজলিসে বসেছো এবং তার কথা শুনেছো তা কি আমি শুনিনি মনে করেছো?” অতঃপর সে কঠিন শপথ বাক্য উচ্চারণ করে বললো, “তুমি যদি মুহাম্মাদের মজলিসে বসে থাক এবং তার কথা শুনে থাক আর তার মুুখে থু থু নিক্ষেপ না করো তবে তোমার মুখ দেখা আমার জন্য হারাম হয়ে যাবে।” আল্লাহর অভিসম্পাত উকবার  উপর! হতভাগা সত্যি সত্যি আল্লাহর দুশমন উবাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলো।

এ সম্পর্কে আল্লাহ নাযিল করলেন,

[আরবী *************]

“যেদিন যালিম নিজের আঙ্গুল কামড়ে অনুশোনা করবে এবং ভাববে, হায়! আমি যদি রাসূলের সহযোগিতা করতাম। হায়! আমি যদি অমুককে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। সে তো আমাকে বিপথগামী করে দিয়েছে আমার কাছে পথনির্দেশ আসার পর। বস্তুতঃ শয়তান মানুষকে হেয় করতে খুবই সিদ্ধহস্ত।”

একদিন উবাই ইবনে খাল্ফ একখানা জীর্ণপ্রায় পুরনো হাড় নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেল এবং সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, তুমি কি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ এই ধ্বংসপ্রায় হাড়কে পুনর্জীবিত করবেন? অতঃপর সে ওটা নিজের হাতের ওপর গুড়ো করে বাতাসে ফুঁক দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে উড়িয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ হ্যাঁ, আমি বলি আল্লাহ এ হাড়কে এবং তোমাকে জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর পুনর্জীবিত করবেন। অতঃপর তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আয়াত নযিল করেন করলেন,

[আরবী *************]

“সে আমাকে দিয়ে দৃষ্টান্ত দেয় আর নিজের সৃষ্টির ব্যাপারটা ভুলে যায়। সে বলে, ‘এই অস্থিগুলো যখন জরাজীর্ণ হয়ে গেছে, তখন কে এগুলোকে আবার জীবিত করবে?’ তুমি তাকে বল, ‘এগুলিকে তিনি পুনর্জীবিত কবেন যিনি প্রথমবার এগুলিকে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সৃষ্টির সব কাজই জানেন। তিনিই সেই আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য শ্যামল সবুজ গাছ হতে আগুন উৎপন্ন করেছেন আর তা দিয়ে তোমরা নিজেদের চুলো জ্বালাও।” (ইয়াসীন)

আর একদিন যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার তাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব ইবনে খালফ ও ’আস ইবনে ওয়ায়েল সাহামী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরলো। তারা সবাই ছিল নিজ নিজ গোত্রের প্রবীণ ব্যক্তি। তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ. এসো আমরা তোমার আল্লাহর পূজা করি আর  তুমি আমাদের দেব-দেবীর পূজা কর। এভাবে আমরা পরস্পরের কাজে শরীক হয়ে যাই। যদি তোমার মাবুদ আমাদের দেব-দেবীর চেয়ে ভাল হয়ে থাকে তা হলে আমরা তার পুজার অংশ হয়ে গেলাম। আর যদি আমাদের দেবতা তোমার খোদার চেয়ে ভাল হয়ে থাকে তাহলে তুমিও তার অংশ পেয়ে গেলে।”এর জবাবে আল্লাহ নযিল করলেন,

[আরবী *************]

“হে নবী, তুমি বল : হে কাফিরগণ, তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার ইবাদাত করি না। আর আমি যাঁর ইবাদাত করি তোমরা তাঁর ইবাদাত কর না। আমি তার ইবাদাত করবো না যার ইবাদাত তোমারা করছো, আর আমি যাঁর ইবাদাত করি তোমরাও তার ইবাদাত করবে না। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।” (আল কাফিরুন)

আল্লাহ্ কাফিরদেকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য যাক্কুম বৃক্ষের উল্লেখ করলে আবু জাহল ইবনে হিশাম বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ যে যাক্কুম বৃক্ষের ভয় দেখাচ্ছে, সেটা কি জান?” তারা বললো, ‘না’ তখন সে বললো, “মদীনার খেজুর যা মাখন সহকারে রাখা হয়। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মদীনায় যদি বসবাস করার সুযোগ পাই তাহলে তৃপ্তি সহকারে ওটা খাবো।” এই প্রসঙ্গে আল্লাহ নাযিল করলেন,

[আরবী *************]

“যাক্কুম গাছ গুনাহগারের খাদ্য হবে, তেলের গাদের মত পেটের ভেতরে এমনভাবে উথলে উঠবে যেমন ফুটন্ত পানি টগবগ করে উথলে ওঠে।” (আদদুখান)

অর্থাৎ যাক্কুম সম্পর্কে আবু জাহল যা বলে আসলে তা নয়।

একবার ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কথা বলতে আরম্ভ করেন। তিনি ওয়ালীদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছিলেন। এই সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাপ শুরু করে দিলেন এবং তাঁকে এ কুরআন পড়ে শোনাতে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁর এ আগমন ও কথাবার্তা বিরক্তিকর বলে মনে হলো। কারণ তিনি ওয়ালীদের সাথে কথাবার্তায় তেমন মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। ফলে তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি যে আশা পোষণ করছিলেন  সেটা প- হয়ে যাবার উপক্রম হলো। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের কথাবার্তা অতিমাত্রায় বেড়ে যেতে আরম্ভ করেছে দেখে তিনি বিরক্তিভরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তাঁকে কোন গুরুত্ব দিলেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে নাযিল করলেন,

[আরবী *************]

“সে (রাসূল) ভ্রূ কুঁচকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল এ কারণে যে, তার কাছে অন্ধ লোকটি এসছিল। তুমি জান, সে হয়তো শুধরে যেত কিংবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার জন্য কল্যানকর হতো। পক্ষান্তরে যে লোক অনাগ্রহী তার প্রতি তুমি বেশ মনোযোগ দিচ্ছ। অথচ সে শুধরে না গেলেই বা তোমার কি আসে যায় আসে? আর যে লোক তোমার নিকট দৌড়ে এলো এবং যে পরিণাম সম্পর্কে ভয় করছিলো তুমি যে লোক তোমার নিকট দৌড়ে এলো এবং যে পরিণাম সম্পর্কে ভয় করছিলো তুমি তার প্রতি অনীহা দেখাচ্ছ। কক্ষণো নয়, এটা একটা উপদেশ-যার ইচ্ছা গ্রহণ করবে। সম্মানিত গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ, যা উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ও পবিত্র।” (সুরা ’আবাসা)

অর্থাৎ আল্লাহ বলেন : আমি তোমাকে সকলের জন্য সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করে পঠিয়েছি এবং তোমাকে নির্দিষ্ট কারো জন্য পাঠাইনি। অতএব যে যা চেয়েছে তা থেকে তাকে বঞ্চিত করো না। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছুক নয় তাঁর জন্য লালায়িত হয়ো না।

যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর বাড়ীর চৌহদ্দিতেই কষ্ট দিত তারা হলো আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আবুল ’আস, উকবা ইবনে আবু মুয়াইত, আদী ইবনে হামরা আস্ সাকাফী ও ইবসুল আসদা আল-হাযালী। এরা সবাই ছিল তাঁর প্রতিবেশী। হাকাম ইবনে  আবুল ’আস ছাড়া এদের মধ্যে কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। বর্ণিত আছে, এসব লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায পড়তেন তখন তাঁর ওপর ছাগলের নাড়ীভুড়ি ছুড়ে মারতো। কেউ কেউ তাঁর বাড়ীতে রান্নার জন্য চড়ানো হাড়িতেও ঐ নাড়ীভুড়ি নিক্ষেপ করতো। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাধ্য হয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে নামায পড়তে লাগলেন। তারা তাঁর শরীরে নাড়িভুড়ি নিক্ষেপ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা তা একটা লাঠির মাথায় উঠিয়ে বাড়ীর বাইরে যেতেন এবং সংশ্লিষ্ঠ লোকের ঘরের দরজায় গিয়ে বলতেন, “হে আবদে মানাফের জাতিগোষ্ঠি, এটা তোমাদের কোন ধরনের প্রতিবেশীসুলভ আচরণ? তারপর তিনি সেই নাড়ীভুড়ি রাস্তায় ফেলে দিতেন।”

আবিসিনিয় থেকে মক্কার লোকদের ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে মুহাজিরদের প্রত্যাবর্তন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবী আবিসিনিয়ায় হিজরাত করেছিলেন, তাঁরা শুনলেন যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। একথা শুনে তাঁরা মক্কা অভিমুখে রওনা দিলেন। মক্কা নগরীর কাছাকাছি পৌঁছলে তাঁরা জানতে পারলেন যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে যে কথা তাঁরা শুনেছেন তা ঠিক নয়। ফলে মক্কাবাসীদের কারো সহযোগিতা নিয়ে অথবা গোপনে ছাড়া কেউই নগরীতে প্রবেশ করলেন না। সর্বমোট ৩৩জন সাহাবী আবিসিনিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। উসমান ইবনে মাযউন ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার আশ্রয়ে এবং আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ ইবু তালিব ও তার মাতা রাবাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিবের আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন।

চুক্তি বাতিল হওয়ার কাহিনী

বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে গিরিবর্তে অবরোধ করে রাখার লক্ষ্যে কুরাইশগণ যে চুক্তিনমায় সই করে, কুরাইশদের একটি দল অবশেষে তা  বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব হিশাম ইবনে আমরের। কারণ, তিনি ছিলেন নাদলা ইবনে হিশাম ইবনে আবদে মানাফের মা-শরীক সৎভাই। হিশাম অবরুদ্ধ বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের কাছে আসতেন ও তাঁদেরকে উটের পিঠে করে এনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতেন। গিরিবর্তের প্রবেশ মুখে এস নিজের মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খুলে তা দিয়ে এক পাশে সজোরে আঘাত করতেন। তারপর গিরিবর্তের ভেতরে প্রবেশ করতেন। পুনরায় আসতেন এবং পোশাক দিয়ে যেতেন। এভাবে বিভিন্ন সময় দরকারী জিনিসপত্র সরবরাহ করতেন।

একদিন যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরার কাছে গেলেন। তিনি ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা আতিকার ছেলে। গিয়ে বললেন, “হে যুহাইর, তুমি নিজে তো খেয়ে পরে ও স্ত্রী পরিজন নিয়ে দিব্যি সুখে আছ, অথচ তোমার মামারা কোথায় কিভাবে আছেন তাও তোমার জানা আছে। তারা বয়কট অবস্থায় রয়েছেন। কেউ তাদের সাথে বেচাকেনা করে না, বিয়েশাদী করে না। তুমি কি করে এ অবস্থ মেনে নিয়েছো? আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, ওরা যদি আবুল হাকাম ইবনে হিশামের (আবু জাহল) মামা হতো, আর তুমি যদি তাদেরকে এভাবে বয়কটকরতে তাকে অনুরোধ করতে, তাহলে সে কখ্খনো তোমার অনুরোধ রক্ষা করতো না।” যুহাইর বললো. “ব্যস,হয়েছে। আর বলতে হবে না। শোনো হিশাম, আমি একা কি করতে পারি? আমার সাথে যদি আর একজন লোক হতো তা হলে এই চুক্তি বাতিল করার উদ্যেগ নিতাম।” হিশাম কললেন, “লোক তো একজন পেয়েছি।” যুহাইর বললো, “কে তিনি? ” হিশাম বললো, “আমি নিজে।” যুহাইর বললো, “আর একজন লোক খুঁজে বের কর।”

হিশাম মুতয়িম ইবনে ’আদীর কাছে গিয়ে তাকে বললো, “হে মুতয়িম, বনু আবদ মানাফের দুইজন লোক যদি অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়, তাহলে তুমি কি কুরাইশদের মন রক্ষা করার জন্য সে দৃশ্য নীরবে দেখবে? কুরাইশদেরকে যদি এভাবে সুযোগ দিতে থাক তাহলে তারা তোমাদের দিকেও দ্রুত ধেয়ে আসবে।” মুতয়িম বললো, “বেশ তো বুঝলাম। আমি একা কি করতে পারি?” হিশাম বললো, “তুমি তো আর একজন লোক পেয়ে গেছো।” মুতয়িম বললো, “সে কে?” হিশাম বললো, “আমি নিজেই সে ব্যক্তি।” মুতয়িম বললো, “তৃতীয়ি একজন লোক আমাদের খুঁজে বের করা দরকার।” হিশাম বললো, “তৃতীয় একজন লোকও পেয়ে গেছি।” মুতয়িম বললো, “কে সে?” হিশাম বললো, “যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া।” মুতয়িম বললো, “চতুর্থ আরেকজন খুঁজে বের কর।”

তখন সে বুখতারী ইবনে হিশামের কাছে গেল। তার কাছে গিয়ে সে মুতয়িমকে যা বলেছিল তারই পুনরাবৃত্তি করলো। আবুল বুখতারী বললো, “আমরা যদি এটা করতে যাই তাহলে আমাদের সাহায্যকারী  কেউ হবে  কি?। ” সে বললো, “হ্যাঁ।” সে বললো, “কে?” হিশাম বললো, “যুহাইর, মুতয়িম এবং আমি নিজে।” আবু বুখতারী বললো, “পঞ্চম আরেকজন লোক খুঁজে বের কর।”

তখন সে যাম’আ ইবনে আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিবের কাছে গেল। সে অবরুদ্ধদের সাথে তার আত্মীয়তা ও অধিকারের উল্লেখ করে তার সাথে বিষয়টা আলোচনা করলো। যাম’আ বললো, “তুমি যে কাজে আমাকে আহ্বান করছো আর কেউ কি তার পক্ষে আছে?” সে বললো, “হ্যাঁ।”  অতঃপর সে তাকে সবার সাম বললো।

এরপর মক্কার উচ্চভূমিত হাজ্জন নামক পর্বতের পাদদেশে তারা সমবেত হবার একটা তারিখ নির্ধারণ করলো। যথাসময়ে তারা সেখানে জমায়েত হলো এবং চুক্তিনামাটা বাতিল করানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল। যুহাইর বললো, “আমি নিজে এ ব্যাপারে অগ্রণী হয়ে সবার সাথে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব নিলাম।”

পরদিন সকালে তারা সবাই কুরাইশদের সভাস্থলগুলোতে গিয়ে জড়ো হলো। যুহাইর জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক  পরে উপস্থিত হলো এবং সাতবার কা’বার তাওয়াফ করে সমবেত জনতার কাছে এসে বললো, “হে মক্কাবাসী, আমরা খাবো পরবো, আর বনু হাশিম অবরুদ্ধ অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে, কেউ তাদের সাথে কেনাবেচা করতে পারবে না-এটা কি করে চলতে পারে? আল্লাহর শপথ, এই সম্পর্ক-বিনাশী ও যুলুমের প্ররোচনা দানকারী চুক্তিনামা ছিঁড়ে ফেলার আগে আমি ক্ষান্ত হবো না।”

মসজিদে হারামের এক কোণায় উপবিষ্ট  আবু জাহল বলে উঠলো, “তুমি মিথ্যা বলছো। আল্লাহর শপথ, ওটা ছেঁড়া হবে না।” তখন যাম’আ ইবনে আসওয়াদ বললো “আল্লাহর শপথ, তুমি নিজে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। এই চুক্তিনামা যখন লেখা হয়, তখন আমরা ঐ জিনিসটির ব্যাপারে সম্মত ছিলাম না।” আবুল বুখতারী বললো, “যাম’আ ঠিক বলেছে। এই চুক্তিতে যা লেখা হয়েছে আমরা তা মানি না কিংবা স্বীকারও করি না।”মুতয়িম ইবনে আদী বললো.“তোমরা দু’জন ঠিক বলেছো। এর বিপরীত কথা যে বলে সে মিথ্যুক। আল্লাহর কাছে আমরা এই চুক্তির সাথে আমাদের সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি এবং এতে  যা লেখা হয়েছে  তা অগ্রাহ্য করছি।” হিশাম ইবনে আমরও অনুরূপ কথা বললো। সব শুনে আবু জাহল বললো, “ব্যাপারটা রাতের অন্ধকারে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং এ সম্পর্কে অন্য কোথাও পরামর্শ করা হয়েছে। ” আবু জাহল যখন একথা বলছিল তখন আবু তালিব মসজিদের এক কোণে কসে ছিলেন। মুতয়িম চুক্তি নামাটা ছিঁড়ে ফেলার জন্য এগিয়ে গেলো। কিন্তু ওটা হাতে নিয়ে দেখলো একমাত্র “বিসমিকা আল্লাহুম্মা” ( হে আল্লাহ তোমার নামে) এই শব্দটি ছাড়া সমগ্র চুক্তিনামাটা উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে।

চুক্তিনামার লেখক মানসূর ইবসে ইকরামের হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল বলে কথিত আছে।

ইরাশ গোত্রের এক ব্যক্তির আবু জাহলের নিকট উট বিক্রির ঘটনা

ইবনে ইসহাক বলেন, আবদুল মালিক ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবু সুফিয়ান সাকাফী যিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, আমাকে জানিয়েছেন :

ইরাশ গোত্রের এক ব্যক্তি তার একটা উট নিয়ে একবার মক্কায়  আসে। আবু জাহল তার কাছ থেকে উটটা খরিদ করে নেয়। কিন্তু তার দাম নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে।

ইরাশী লোকটা অনন্যোপায় হয়ে কুরাইশদের একটি সভায় গিয়ে হাজির হয়। সেখানে উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে সে বলে, “হে কুরাইশগণ, আবুল হাকাম ইবনে হিশামের কাছ থেকে আমর পাওনা আপনারা কেউ কি আদায় করে দিতে পারেন?

দেখুন, আমি একজন বহিরাগত পথিক। আমাকে দুর্বল পেয়ে সে আমার পাওনা দিতে গড়িমসি করছে।” এই সময় মসজিদের একপাশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে ছিলেন। উপস্থিত কুরইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখিয়ে বললো, “ঐ যে লোকটা বসে আছে দেখছো, তার কাছে গিয়ে বল। সে তোমার পাওনা আদায় করে দেবে।” আসলে তারা বিদ্রƒপাচ্ছলেই কথাটা বলেছিল। আবু জাহল ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের কথা তাদের অজানা ছিল না।

উট বিক্রেতা ইরাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তাঁকে বললো, “হে আল্লাহর  বান্দা, আবুল হাকাম ইবনে হিশাম তার দাপট দেখিয়ে আমার পাওনা নিয়ে টালবাহানা করছে। আমি একজন বহিরাগত পথিক। আমি এই লোকগুলির কাছে জিজ্ঞেস করলাম আমার হক কে আদায় করে দিতে পারে? তারা সবাই আপনাকে দেখিয়ে দিল। আপনি তার কাছ থেকে আমার পাওনা আদায় করে দিন। আল্লাহ আপনাকে রহমত করবেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার সাথে এসো।” এই বলে তিনি তাকে সাথে নিয়ে চললেন। কুরাইশরা তাঁকে ঐ লোকটা সাথে যেতে দেখে এক ব্যক্তিকে পেছনে পেছনে পাঠিয়ে দিয়ে বললো, “যাও, দেখে এসো. মুহাম্মাদ (সা) কি করে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু জাহলের বাড়ী চলে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দরজায় করাঘাত করলেন। সে ভেতরে থেকে বললো, “কে?” তিনি বললেন, “আমি মুহাম্মাদ, একটু বেরিয়ে এসো!” সে তখনই বেরিয়ে এলো। ভয়ে তার প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম এবং চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বরলেন, “এই ব্যক্তিকে তার পাওনা দিয়ে দাও।” সে তৎক্ষনাৎ বললো, “আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর, তার পাওনা দিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে সে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে উট বিক্রেতাকে তার পাওনা দিয়ে দিল।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন। উট বিক্রেতাকে বললেন, “এবার তুমি তোমার কাজে ফিরে যাও।” সে কুরাইশদের সেই সভায় গিয়ে হাজির হলো এবং উপস্থিত লোকদেরকে বললো, “আল্লাহ তাঁকে উত্তম পুরষ্কার দিন। তিনি আমাকে আমার পাওনা আদায় করে দিয়েছেন।” আর যে ব্যক্তিকে তারা পেছনে পেছনে পাঠিয়েছিল তাকে বললে,“এই, তুমি কি দেখলে?” সে বললো, “সে এক আশ্চর্য কান্ড! তাকে কিছুই করতে হয়নি। যেয়ে শুধু দরজায় করাঘাত করেছে, আর অমনি সে যেন আতংকিত হয়ে বেরিয়ে আসলো। সে তাকে বললো, এই ব্যক্তির পাওনা দিয়ে দাও। সে বললো, আচ্ছা, একটু অপেক্ষা কর। এক্ষুণি দিয়ে দিচ্ছি। এই বলে ভেতরে গিয়ে তৎক্ষনাৎ পাওনা এনে দিয়ে দিল।” কিছুক্ষণের মধ্যে আবু জাহল সেখানে উপস্থিত হলে সবাই তাকে বললো, “কি ব্যাপার, তোমার কি হয়েছে? আজ তুমি যে কা- করেছো, এমন তো আর কখনো করতে দেখিনি? ” আবু জাহল বললো, “এটা সত্য যে, মুহাম্মাদ আমার দরজায় কড়ানাড়া ছাড়া আর কিছু করেনি। আমি শুধু তার শব্দটা শুনেই ভয় পেয়ে যাই এবং পরক্ষণেই তার সামনে আসি। আমি দেখতে পেলাম. তার মাথার ওপর একটা ভয়ংকর আকারের উট। তার মত চুঁট, ঘাড় ও দাঁতবিশিষ্ট কোন উট আমি আর কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ, অস্বীকার করলে সে নিশ্চিত আমাকে খেয়ে ফেলতো।”

ইসরা বা রাত্রিকালীন সফর

একদিন রাত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় অর্থাৎ বাইতুল মাকদিসে নিয়ে যাওয়া হয়। [৩৩.সুহাইলী বলেন : ঘটনাটা মদীনায় হিজরাতের এক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল বলে কেউ কেউ উল্লেক করেছেন।] এই সময় কুরাইশ গোত্রের মধ্যে এবং অন্যান্য গোত্রের লোকজনের মধ্যে ইসলাম বেশ প্রসার লাভ করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বোরাক আনা হয়। এটি একটি চতুষ্পদ জন্তু। পুর্বতন নবীদেরকেও এই জন্তুর পিঠে সওয়ার করানো হতো। এটি এত দ্রুতগামী যে, সে দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলতো। তিনি সেই জানোয়ারে সওয়ার হলেন। তাঁর সঙ্গী (জিবরীল) তাঁকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। আকাশ ও পৃথিবীর অসংখ্য নিদর্শন দেখতে দেখতে তিনি  এগিয়ে যেতে লাগলেন। এভাবে চলতে চলতে বাইতুল মাকদিস গিয়ে থামলেন। সেখানে নবীদের এক বিরাট সমাবেশ দেখতে পেলেন। তার মধ্যে ইবরাহীম (আ). মূসা (আ) ও ঈসাকেও (আ) দেখলেন। তাঁদের সবাইকে নিয়ে এক জামায়াতে নামায পড়লেন। তারপর তাঁর কাছে তিনটা পাত্র আনা  হলো। একটিতে পানি, একটিতে মদ এবং একটিতে দুধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঐ তিনটি পাত্র আমার সামনে রাখার পর শুনতে পেলাম কে যেন বলছেঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি পানি ভরা পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনি বিপথগামমী হবেন এবং তাঁর উম্মতও ডুববে। আর যদি মদের পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনি বিপথগামী হবেন এবং তাঁর উম্মতও বিপথগামী হবে। আর যদি তিনি দুধের পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনিও হিদায়াত লাভ করবেন এবং তাঁর উম্মাতও  হিদায়ত লাভ করবে।” এ কথা শুনে আমি দুধের পাত্রটা নিলাম এবং তা থেকে দুধ পান করলাম। তখন জিবরীল (আ) আমাকে বললেন : “হে মুহাম্মাদ! আপনিও সুপথগামী হয়েছেন আর আপনার উম্মাতও।”

হাসান (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি হাজরে আসওয়াদের কাছে ঘুমিয়ে ছিলাম। সহসা জিবরীল এলেন। তিনি আমাকে চিমটি কাটলেন। আমি উঠে বসলাম কিন্তু কোন কিছু না দেখে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনি আবার এসে আমাকে চিমটি কাটলেন। আমি আবার উঠে বসলাম এবং কিছু না দেখে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনি তৃতীয়বার এলেন এবং পুনরায় চিমটি কাটলেন। এবারে আমি উঠে বসতেই তিনি আমার বাহু ধরে টান দিলেন। সেখানে আমি একটা সাদা বর্ণের জন্তু দেখতে পেলাম। তা ছিল খচ্চর ও গাধার মাঝামাঝি আকৃতির। তার দুই উরুতে দুটি পাখা। পাখার সাহায্যে সে পা সঞ্চালন করে। আর হাত দুটিকে সে দৃষ্টির শেষ সীমায় দিয়ে রাখে। তিনি আমাকে ঐ জন্তুটির ওপর সওয়ার করালেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন। দুজনের কেউ কাউকে হারিয়ে না ফেলি, এতটা পাশাপাশি আমরা চলতে লাগলাম।” হাসান (রা) তার বর্ণনায় বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলতে লাগলেন।আর তাঁর সাথে জিবরীলও চলতে লাগলেন। বাইতুল মাকদিস গিয়ে তাঁরা যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে দেখলেন নবীদের একটি দল সমবেত হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস্ সালামও উপস্থিত আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হয়ে তাঁদের নিয়ে নমায পড়লেন। অতঃপর তাঁর কাছে দুটো পাত্র হাজির করা হলো। একটাতে মদ, অপরটায় দুধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ ভর্তি পাত্রচা নিলেন, তা থেকে কিছুটা দুধ পান করলেন এবং মদভর্তি পাত্রটা বর্জন করলেন। তা দেখে জিবরীল বরলেন, “হে মুহাম্মাদ! আপনি নিজেও ইসলামের পথে চালিত হয়েছেন আর আপনার উম্মাতও ইসলামের পথে চালিত হয়েছে। মদ আপনাদের ওপর হারাম হয়েছে।” এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন। পরদিন সকালে তিনি কুরাইশদের কাছে গেলেন এবং রাত্রের ঘটনা ব্যক্ত করলেন। অধিকাংশ লোক তা শুনে বললো, “আল্লাহর শপথ, এ এক আজব ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মক্কা থেকে সিরিয়া কত কাফিলা যায়। তাদের যেতে একমাস এবং আসতে এক মাস সময় লাগে। আর এত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে মুহাম্মাদ কিনা একরাতেই সেখানে গেল আবার মক্কায় ফিরেও এলো!”

হাসান (রা) বলেন, “এই ঘটনা শুনে বহু সংখ্যক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করলো। লোকেরা আবু বাক্রের (রা) কাছে গিয়ে তাঁকে বললো, “হে আবু বাক্র, তোমার বন্ধুকে কি তুমি বিশ্বাস কর? সে বলছে, সে  নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদাস গিয়েছিলো, সেখানে সে নামায পড়েছে, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে!”

আবু বাকর বললেন, “তোমরা কি তাকে অবিশ্বাস কর?” সবাই বললো, “হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজন এই কথাই বলছে।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, তিনি যদি একথা বলে থাকেন তা হলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে তোমরা আশ্চর্য হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন যে, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত ওহী আসে মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস  করে থাকি। তোমরা যে ঘটনা নিয়ে চোখ কপালে তুলছো তার চেয়েও এটা বিস্ময়কর।” অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগণকে বলেছেন যে, আপনি গত রাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমণ করেছেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ।” আবু বাকর (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, বাইতুল মাকদাসের আকৃতি কেমন আমাকে বলুন। কেননা বাইতুল মাকদাস আমি গিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “এই সময় আমার সামনে বাইতুল মাকদাস তুলে ধরা হলো এবং আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে (রা) তার আকৃতির বর্ণনা দিতে লাগলেন। আর তা শুনে আবু বাক্র (রা) বলতে লাগলেন, “আপনি ঠিক বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।” বর্ণনা দেয়া শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু ব্ক্রাকে বললেন, “হে আবু বাক্র, তুমি সিদ্দীক।” সেদিনই তিনি আবু বকরকে (রা) সিদ্দীক তথা ‘পরম সত্যনিষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াভ (রহ) বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর  সাহাবীদের কাছে হযরত ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি ঐ রাতে তাঁদেরকে দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন, “দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে  হযরত ইবরাহীম (আ) তোমাদের সঙ্গীর (অর্থাৎ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) সাথেই সর্বাধিক সাদৃশপূর্ণ। আর মূসা আলাইহিস সালাম বাদামী রঙের দীর্ঘাকায় একহারা গড়নের ও উন্নত নাসা সুপুরুষ ছিলেন। মনে হয় যেন শানুয়া গোত্রের কোন লোক। ঈসা (আ) মাঝারী গড়নের, লাল বর্ণের, নরম ও সোজা চুল এবং মুখে বহুসংখ্যক তিলবিশিষ্ট। দেখে মনে হয়, তাঁর চুল থেকে পানির বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। সবে মাত্র হাম্মাম থেকে গোসল করে বের হয়েছেন। তোমাদের মধ্যে উরওয়াহ ইবনে মাসউদ সাকাফীর সাথে তাঁর দৈহিক সাদৃশ্য সর্বাধিক।”

 

মি’রাজের ঘটনা

ইবনে ইসহাক বলেন, আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “বাইতুল মাকদাসের অনুষ্ঠানাবলী সমাপ্ত হলে আমার সামনে ঊর্ধাকাশে আরোহণের সিঁড়ি হাজির করা হলো। এমন সুন্দর কোন জিনিস আমি আর কখনো দেখিনি। মৃত্যুর সময় হলে মানুষ এই সিঁড়িই দেখতে পায় এবং এর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। আমার সঙ্গী (জিবরাইল) আমাকে ঐ সিঁড়িতে আরোহণ করালেন এবং আমাকে সাথে নিয়ে আকাশের একটি দরজায় গিয়ে থামলেন। এ দরজাকে ‘বাবুল হাফাযাহ’ বা রক্ষকদের দরজা বলা হয়। এখানে ইসমাঈল নামক একজন ফিরিশতা কর্তব্যরত রয়েছেন। তাঁর অধীনে রয়েছে বার হাজার ফেরেশতা এবং এইসব ফেরেশতার প্রত্যেকের অধীনেও আবার বার হাজার করে ফেরেশতা রয়েছে।” এই হাদীস বর্ণনা করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন,

[আরবী *************]

“তোমার প্রভুর সৈন্য সামন্তের সংখ্যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।” (সূরা আলা মুদ্দাস্সির)

“অতঃপর যখন আমাকে নিয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন তখন ঐ ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি মুহাম্মাদ।’ ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি নবী?’ জিবরীল বললেন, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি আমার কল্যাণ কামনা করে দোয়া করলেন।”

প্রথম আকাশে প্রবেশের পর আমি দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি বসে আছেন। তাঁর কাছে সকল মৃত মানুষের আত্মা হাজির হচ্ছে। কোন কোনটা হাজির হলে তিনি খুব খুশী হচ্ছেন এবং প্রশংসা করে বলছেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আবার কোন কোনটা হাজির হলে তিনি চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলছেন, ‘আহ! এটি একটি অপবিত্র আত্মা যা একটি পাপপংকিল দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে জিবরাইল, ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ইনি আপনার পিতা আদম (আ)। তাঁর কাছে তাঁর সন্তানদের আত্মা হাজির করা হয়। কোন মুমিনের আত্মা দেখলে তিনি আনন্দিত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে বেরিয়েছে।’ ্আর কোনা কাফিরের আত্মা দেখলে তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন, তাকে অপছন্দ করেন এবং তার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পাপাত্মা যা কোন পাপিষ্ঠ দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’

অতঃপর কতগুলো লোক দেখলাম। তাদের ঠোঁট উটের মত এবং তাদের হাতের মুঠোয়  দগদগে জ্বলন্ত  ছোট ছোট পাথর টুকরো রয়েছে। সেগুলো তারা মুখে পুরছে। আর পরক্ষণেই তা মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী।’

এরপর আরো কিছু সংখ্যক লোক দেখলাম। তাদের পেটের মত বীভৎস আকৃতির পেট আর কখনো দেখিনি। দেখলাম, ফেরাউনের সহযোগীদের যে পথ গিয়ে দোযখে নেয়া হচ্ছে, সেই পথের ওপর তারা [৩৪.ফিরাউনের সহযোগীদের জাহান্নামের কঠিনতম শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।] অবস্থান করছে। তারা পিপাসা-কাতর উটের মত ছটফট করছে। আর ফিরাউনের দোযখগামী অনুসারীরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে যাচ্ছে তথাপি সেখান থেকে একটু সরে বসবার ক্ষমতাও তাদের নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সুদখোর।’

অতঃপর আরো একদল লোক দেখলাম। তাদের সামনে উৎকৃষ্টমানের পুষ্ট গোশত রয়েছে। আর তার পাশেই রয়েছে উৎকট দুর্গন্ধ যুক্ত খারাপ গোশত। অথচ তারা ভালো গোশত বাদ দিয়ে খারাপ গোশত খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব লোক যারা বৈধ স্ত্রী থাকতে নিষিদ্ধ স্ত্রী  লোকের কাছো যায়।’

অতঃপর কিছু সংখ্যক নারীকে দেখলাম তাদের স্তনে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘হে জিবরীল এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব নারী যারা ব্যভিচারের মাধ্যমে অন্যের ঔরসজাত সন্তান স্বামীর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।’

এরপর তিনি দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দুই খালাতো ভাই ঈসা (আ) ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারীয়ার (আ) সাক্ষাত পেলাম।

অতঃপর জিবরীল (আ) আমাকে তৃতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তাঁর চোহারা পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। আমি বললাম, ‘হে জিবরীল, ‘ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি ইয়াকুবের (আ) পুত্র ইউসুফ (আ)।’

অতঃপর চতুর্থ আকাশে আরোহণ করে সেখানে আর এক ব্যক্তিকে দেখলাম। জিবরাইল জানালেন ইনি ইদ্রিস (আ)। অতঃপর পঞ্চম আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে দেখলাম, সাদা চুল ও দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী এক বৃদ্ধ। অত সুন্দর বৃদ্ধলোক, আমি আর কখনো দেখিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘তিনি স্বজাতির কাছে প্রিয় হারুন ইবনে ইমরান (আ)’! অতঃপর ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছলাম। সেখানে দেখলাম বাদামী রংয়ের লম্বা নাক বিশিষ্ট এক দীর্ঘায়ী পুরুষ, যেন শানুয়া গোত্রের লোক। আমি বললাম জিবরাইল ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ‘তিনি আপনার ভাই মূসা ইবনে ইমরান (আ)।’

অতঃপর আমাকে সপ্তম আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দেখলাম, বাইতুল মামুরের দরজার কাছে একটি চেয়ারে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তোমাদের সঙ্গী (অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা) স্বয়ং তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। বাইতুল মামুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে এবং তারা আর ফিরে আসে না। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে?” তিনি বললেন, ‘তিনি আপনার পিতা ইবরাহীম (আ)।’

অতপর তিনি আমাকে নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করলেন। সেখানে ঈষৎ কালো ঠোঁট বিশিষ্ট একটি পরমা সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কার জন্য?’ সে বললো, ‘যায়িদ ইবনে হারেসার জন্য।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারেসাকে এই সুসংবাদটি জানিয়ে দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এরপর আমি ফিরে এলাম। আসার পথে মূসা ইবনে ইমরানের (আ) সাথে দেখা হলো। বস্তুত: তিনি তোমাদের একজন উত্তম বন্ধু। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ওপর কয় ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে?” আমি বললাম, ‘প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত।’ মুসা বললেন, ‘দেখ, নামায বড় কঠিন কাজ। তোমার উম্মাত খুবই দুর্বল। তুমি আল্লাহর কাছে ফিরে যাও এবং তোমার উম্মাতের জন্য দায়িত্ব আরো হালকা করে দিতে বল।’ আমি আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম এবং আমার ও আমার উম্মাতের দায়িত্ব হালকা করে দিতে অনুরোধ করলাম আল্লাহ দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।অতঃপর ফিরে আসলাম। মূসার সাথে আবার দেখা হলো। তিনি আবার আগের মত বললেন। আমি আবার গিয়ে আল্লাহকে নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানালাম। আল্লাহ আরে দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন। এভাবে তিনি ক্রমাগত আমাকে পরামর্শ দিতে লাগলেন।

যখনই তাঁর কাছে ফিরে যাই, তিনি বলেন, ‘যাও, আরো কমিয়ে দিতে বলো। এভাবে কমাতে কমাতে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাকি রইল। এবারও মূসার (আ) কাছে ফিরে এলে তিনি আরো কমিয়ে আনার পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, ‘বহুবার আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়েছি এবং কমিয়ে দিতে বলেছি। আমি লজ্জাবোধ করছি। তাই আর ফিরে যেতে পারবো না।’

অতএব যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঈমান ও সতর্কতার সাথে পড়বে, সে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয নামাযের সওয়াব পাবে।”

আবু তালিব ও খাদীজার ইনতিকাল

অতঃপর একই বছর আবু তালিব ও খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর একের পর এক বিপদ-মুসিবত আসতে থাকে। খাদীজা (রা) ছিলেন তাঁর এক পরম সত্যনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি নিজের যাবতীয় দুঃখ কষ্টের কথা তাঁর কাছে বলতেন। আর চাচা আবু তালিব ছিলেন তাঁর সহায় ও ঢালস্বরূপ। তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতেন এবং তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতেন। মদিনায় হিজরাতের তিন বছর পূর্বে খাদীজা ও আবু তালিবের মৃত্যু ঘটে।

আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন নির্যাতন শুরু করলো, আবু তালিবের জীবদ্দশায় যা তারা করার সাহস করেনি। এমনকি একদিন কুরাইশদের একজন অত্যন্ত নীচাশয় অর্বাচীন তার চলার পথে গতিরোধ করে তাঁর মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধুলো নিয়ে বাড়ী গেলেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাথার ধুলো মুছে পরিষ্কার করে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছিলেন, “মা, কাঁদিস না! তোর আব্বাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন।” এ পর্যায়ে তিনি বললেন, “আবু তালিব মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আমার সাথে কোন রকম খারাপ আচরণ করতে পারেনি।”

আবু তালিব রোগাক্রান্ত হলে রোগের চরম পর্যায়ে কুরাইশরা একদিন এই বলে সলাপরামর্শ করলো যে, তার রোগ মারাত্মক অবস্থায় উপনীত, হামযা ও উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে, কুরাইশদের সকল গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে, এমতবস্তায় আবু তালিবের কাছে আমাদের যাওয়া উচিত। তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর মধ্যস্থতায় মুহাম্মাদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি করা উচিত। নতুবা তাঁর দলবল আমাদের ধনসম্পদ পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, “উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু জাহল, উমাইয়া ইবনে খালাফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব প্রমুখ বড় বড় কুরাইশ নেতা আবু তালিবের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তারা তাঁকে বললো, “হে আবু তালিব, আপনি আমাদের কাছে কতখানি শ্রদ্ধার পাত্র তা আপনার অজানা নয় আজ আপনি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। আপনার জীবন নিয়ে আমরা শংকিত। আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরনও আপনার জানা। কাজেই তাকে ডাকুন, মৃত্যুর আগে  তার সাথে আমাদের একটা আপোষরফা করে দিয়ে যান। তার সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিন এবং আমাদের সম্পর্কে তার কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি আদায় করে দিন, যাতে আমরা তার ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করি এবং সে ও আমাদের ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করে আর সেও আমাদের  ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করি আর সেও আমাদের ও আমাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে।”

আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁকে বললেন, “ভাতিজা, এরা তোমার সম্প্রদায়ের  নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা এসেছে তোমার নিকট থেকে একটা কথা নিতে এবং তার বিনিময়ে তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা আমার নিকট থেকে একটা মাত্র কথা গ্রহণ করে তাহলে সহগ্র আরবের মালিক হয়ে যাবে এবং  অনারব লোকেরা সবাই তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। ” আবু জাহল বললো, “বেশ! তা হলে একটা কেন, দশটা কথা গ্রহণ করতেও রাজী আছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা ঘোষণা কর যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং অন্য যে সব দেব-দেবীর পূজা করো তা আর করবে না।” এ কথা শুনে তারা সবাই হাততালি দিল। অতঃপর বললো, “আচ্ছা মুহাম্মাদ, তুমি কি চাও যে, আমরা অন্য সব দেব-দেবীর বদলে শুধুমাত্র একজনের পূজা করি? এটা তোমার একটা আজগুবি কথা।” এরপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “দেখ, এই লোকটির কাছে তোমার যা প্রত্যাশা করছো তা সে কখনো দেবে না। অতএব তোমরা চলে যাও। তার ও তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত বাপদাদার ধর্ম পালন করতে থাক।”

সবাই সেখান থেকে চলে গেলে আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা,আমার মনে হয, তুমি তাদেরকে অন্যায় কিছু অনুরোধ করনি।”

আবু তালিবের মুখে এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আশার সঞ্চার হলো। তাই তিনি আবু তালিবকে এই বলে পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, “চাচা, আপনি একবার বলুন। তাহলে কিয়ামতের দিন আপনার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য বৈধ হয়ে যাবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরূপ আগ্রহী হতে দেখে আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, আমার মুত্যুর পরে তোমার ও তোমার ভাই বোনদের অপমানিত হতে হবে এবং কুরাইশরা ভাববে যে আমি  শুধু মৃত্যুর ভয়ে ঈমান এনেছি। এই আশংকা যদি না থাকতো তা হলে আমি কালেমা পড়তাম ও ঈমান আনতাম। আমি শুধু তোমাকে খুশী করার জন্যই এ কথা বলছি।”

এরপর আবু তালিবের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে আব্বাস দেখলেন, আবু তালিব ঠোঁট নাড়ছেন। তিনি তাঁর মুখের দিকে কান এগিয়ে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা তুমি যে কালেমা পড়তে বলেছো, আমার ভাই তা পড়েছে।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি শুনতে পাইনি।”

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কুরাইশদের যে লোকজন আবু তালিবের কাছে এসেছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেনঃ

[আরবী *************]

“সা-দ। উপদেশ পরিপূর্ণ কুরআনের শপথ। অবিশ্বাসীরাই বরং অহংকার ও হঠকারিতায় লিপ্ত। তাদের পূর্বে আমি কত জাতিকেই না ধ্বংস করে দিয়েছি। তখন তারা আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তখন আর রক্ষা পাওয়ার অবকাশ ছিল না। এই লোকেরা তাদের মধ্যে থেকেই একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হওয়ায় বিষ্মিত হয়েছে আর অবিশ্বাসীরা বলতে লাগলো, ‘এই ব্যক্তি তো যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি সমস্ত খোদার স্থানে একজন মাত্র খোদাকে বসিয়েদিল! এটা নিতান্তই অদ্ভুত ব্যাপার!’ তাদের নোতারা এই বলতে বলতে চলে গেল, ‘চল, নিজেদের দেব-দেবীর প্রতি অবিচল থাকো। এটা অর্থাৎ যে কথা বলা হচ্ছে তা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক। এ রকম কথা তো আমরা সাম্প্রতিক কালের কোন ধর্মের নিকট থেকেই শুনতে পাইনি। নিশ্চয়ই এটা মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা সা-দ)

‘সাম্প্রতিক কালের ধর্ম’ অর্থ খৃস্টধর্ম- যার অনুসারীরা বলতো যে, আল্লাহ তিনজনের তৃতীয়জন। অতঃপর আবু তালিব মারা গেলেন।

সাহায্য লাভের আশায় বনু সাকীফ গোত্রের শরণাপন্ন হওয়া

আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ভীষণ অত্যাচার শুরু করলো যা তাঁর চাচা আবু তালিব বেঁচে থাকলে তারা করতে পারেনি। তাই তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধে সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের আশায় তায়েফে বনু সাকীফ গোত্রের কাছে গেলেন।তিনি আশা করেছিলেন যে, তারা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবে, তাই একাকীই তিনি সেখানে গেলেন।

তায়েফে পৌঁছে তিনি বনু সাকীফ গোত্রের সবচেয়ে গণ্যমান্য তিন ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হলেন। তারা তিন ভাই আবদ ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব। তাদের পিতার নাম আমর ইবনে উমাইর। তাদের একজন কুরাইশ গোত্রের বনু জুমাহ উপগোত্রের বংশের মেয়ে বিয়ে করেছিলো। তাদের কাছে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম প্রচারে সহায়তা করার অনুরোধ জানালেন। তিনি তাদেরকে কুরাইশদের বিরোধিতার মুখে তাঁকে সমর্থন করার অনুরোধ জানালেন। তাদের একজন বললো, “আল্লাহ যদি তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন  তা হলে তিনি কা’বা শরীরফর গেলাফ খুলে ফেলুন।” [এর অর্থ সম্ভবতঃ এই যে, তাঁকে রাসূল করে পাঠানোর কারণে কা’বার মর্যাদা বিনষ্ট হয়েছে। কেননা তাঁর মত একজন অসহায় লোককে রাসূল বানানো তাদের কাছে অযৌক্তিক। -অনুবাদক] আর একজন বললো, “আল্লাহ কি রাসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না?” তৃতীয় জন বললো, “তোমার সাথে আমি কোন কথাই বলবো না। তুমি যদি তোমার দাবী অনুসারে সত্যিই রাসূল হয়ে থাকো তা হলে তো তোমার কথার প্রতিবাদ করতে যাওয়া বিপজ্জনক। আর তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তা হলে তোমার সাথে আমার কথা বলাই অনুচিত।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কথা না বলে সেখান থেকে উঠে আসলেন। বিদায় হবার আগে তাদেরকে অনুরোধ করলেন যে, তোমরা যখন আমার দাওয়াত গ্রহণ করলে না তখন আমার কথা আর কারো কাছে প্রকাশ করো না। ওরা অন্যদের কাছে তাঁর  কথা প্রচার করে তাঁর বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এই আশংকায় তিনি এরূপ করলেন। কিন্তু তারা সে অনুরোধ রক্ষা করলো না। তারা বরং গোত্রের মূর্খ, নির্বোধ ও দাস শ্রেণীর লোকদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালি দিতে ও হৈ হল্লা করতে করতে চারদিক থেকে ছুটে এলো। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁকে ঘিরে ধরলো। তিনি বাধ্য হয়ে উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া নামক দুই ভাইয়ের দেয়াল ঘেরা ফলের বাগানে আশ্রয় নিলেন। তারা দুই ভাই সে সময় বাগানেই ছিলো। সাকীফ গোত্রের যেসব লোক তাঁর পিছু নিয়েছিলো তারা তখন ফিরে চলে গেল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আঙ্গুর ঝোপের ছায়ায় গিয়ে বসলেন। উতবা ও শাইবা তাঁর উপর তায়েফবাসীর অবর্ণনীয় অত্যাচার এতক্ষন নীরবে প্রত্যক্ষ করছিলো। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরাইশ উপ-গোত্রের সেই মহিলাটির সাক্ষাত ঘটে। তিনি তাকে বললেন, “তোমার দেবররা আমার সাথে কি আচরণ করলো দেখলে তো?”

অতঃপর একটু শান্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে নিম্পরূপ দোয়া করলেন,

[আরবী *************]

“হে আল্লাহ, আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা, সহায় সম্বল ও বিচক্ষণতার অভাব এবং  মানুষের কাছে আমার নগণ্যতা ও অবজ্ঞা-উপেক্ষার জন্য আপনারই কাছে আমি ফরিয়াদ করছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়াবান, আপনি দুর্বল ও উপেক্ষিতদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। কার রহম ও করুণার ওপর আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আমার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার ওপর প্রভাবশালী ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে? আমার উপর আপনি যদি স্বস্তি ও নিরাপত্তা দান করেন তবে সেটা আমার জন্য নিঃসন্দেহে স্বস্তির কারণ। আমি আপনার সেই জ্যোতির আশ্রয় চাই যার আবির্ভাবে সকল অন্ধকার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং যার সাহায্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল সমস্যার সুরাহা হয়। আপনার সকল ভর্ৎসনা মাথা পেতে নিতে আমি প্রস্তুত। আপনার সাহায্য ছাড়া আর কোন উপায়ে শক্তি সামর্থ্য লাভ করা সম্ভব নয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এহেন শোচনীয় অবস্থা এবং এতক্ষণ যাবত তাঁর ওপর যে অত্যাচার চলছিল প্রত্যক্ষ করে উতবা ও শাইবা ভ্রাতৃদ্বয় তাঁর সাথে তাদের বংশীয় বন্ধনের কথা মনে করে বিচলিত হয়ে উঠলো। আদ্দাস নির্দেশ পালন করলো। সে আঙ্গুর ভর্তি পাত্রটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নিয়ে রাখলো এবং তাঁকে  বললো, ‘খান।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন।

আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “একথা তো (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ ) এ দেশের লোকদের বলতে শুনি না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আদ্দাস, তুমি কোন্ দেশের মানুষ? তোমার ধর্মই বা কি? ” সে বললো, “আমি একজন খৃষ্টান। আমি নিনুয়া বা নিনেভার অধিবাসী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন, আমিও নবী।” এ কথা শোনামাত্রই আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঝুঁকে পড়লো এবং তাঁর মাথায়, হাতে ও পায়ে চুমু খেতে লাগলো।

এ দৃশ্য দেখে রাবীয়ার পুত্রদ্বয় পরস্পরকে বলতে লাগলো, “আরে! ছেলেটাকে তো নষ্ট করে দিল দেখছি।” আদ্দাস উতবা ও শাইবার কাছে ফিলে এল। তারা তাকে বললো, “কিহে আদ্দাস! তোমার কি হলো যে ঐ লোকটির মাথায় ও হাতে -পায়ে চুমু খেলে?” সে বললো, “হে আমার মনিব, পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে ভালো লোক নেই। সে আমাকে এমন একটা বিষয় জানিয়েছে যা নবী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।” তারা বললো, “হে আদ্দাস, কি বাজে বক্ছো। তার প্ররোচনায় পড়ে তুমি নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করো না কারণ তার ধর্মের চেয়ে তোমার ধর্ম উত্তম।”

নাসীবীনের জ্বিনদের ঘটনা

বনু সাকীফের কাছ থেকে হতাশ হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে চললেন। পথে নাখলা [মক্কা থেকে দুই দিন দুই রাতের দূরত্বে অবস্থিত দুটো উপত্যকার নাম। একটার নাম নাখলাতুল ইয়ামানিয়া, অপরটির নাম নাখলাতুল শামিয়া।] উপত্যকায় পৌঁছে মধ্যরাতে তিনি নামায পড়ছিলেন। এই সময়ে নাসীবীনের সাতজন জ্বিন ঐ স্থান দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত শুনলো। নামায শেষ হ’লে তারা নাসীবীনে [মুসেল থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে আববের একটি শহর বা জনপদ।]ফিরে গিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছে কুরআনের বানী পৌঁছিয়ে দিল- যার প্রতি তারা পথিমধ্যে শোনা মাত্রই ঈমান এনেছিলো। পবিত্র কুরআনের সূরা জ্বিন ও সূরা আহকাফে আল্লাহ এই জিনদের কাহিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বর্ণনা করেছেন। সূরা আহকাফের আয়াত কয়টি হলো, “সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন আমি তোমার দিকে জ্বিনদের একটি দলকে পরিচালিত করলাম যেন তারা কুরআন শুনতে পারে। তারা সেখানে পৌঁছে পরস্পরকে বললো: ‘তোমরা চুপ করে শোনো’। তাদের কুরআন শোনা শেষ হলে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে সাবধান করতে লাগলো। বললো, ‘হে আমাদের জাতি, আমরা এমন এক গ্রন্থের তিলাওয়াত শুনে এসেছি যা মূসার পরবর্তী সময়ে তাঁর কিতাবের ( তাওরাতের ) সত্যায়নকারী  এবং সত্য ও নির্ভুল পথের দিশারী হয়ে নাযিল হয়েছে। হে আমাদের জাতি, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আন তা হলে তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন।”

সূরা জ্বিনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, “হে নবী, তুমি বল যে, আমাকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে একদল জ্বিন কুরআনের বাণী শুনেছে”.... এরূপ সমগ্র সূরাটিই জ্বিনদের সংক্রান্ত আলোচনায় পরিপূর্ণ।

ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে রাসূল্লাহ (সা) সব গোত্রের কাছে হাজির হলেন

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উপস্থিত হলেন। দুর্বল শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক-যারা তাঁর প্রতি আগেই ঈমান এনছিল তারা ছাড়া গোটা কুরাইশ সম্প্রদায়ই তাঁর নিকৃষ্টতম দুশমনে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সময় মক্কায় আগত নানা গোত্রের লোকদের কাছে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহব্বান জানালেন এবং বললেন, “আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত নবী। তোমরা আমাকে সমর্থন করো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করো তা হলে আল্লাহ আমার কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তা তোমাদের কাছে পেশ করবো এবং বিশ্লেষণ করবো।”

রাবিয়া ইবনে আব্বাদ বর্ণনা করেন:

আমি তখন সবেমাত্র যুবক। পিতার সাথে মিনায় গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন  মক্কার বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন আরব গোত্রের শিবিরসমূহে গিয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিচ্ছিলেন, “হে অমুক অমুকের বংশধর, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমাদেরকে এসব প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা আমাকে সমর্থন কর, আমার প্রতি ঈমান আন এবং আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা কর আর আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিতে পারি।” এই সময় তাঁর পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছিল একজন টেরাচোখা, মাথায় দুটো জটাধারী এবং আদন অঞ্চলের পোশাক পরিহিত একটি লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তাঁর দাওয়াতী বক্তৃতা শেষ করেন,অমনি সে বলে, “হে অমুক অমুকের বংশধর, এই ব্যক্তিটি (মুহাম্মাদ) তোমাদেরকে লাত ও উযযার পূজা ত্যাগ করতে বলছে এবং বনু মালিক ইবনে উকাইশের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বর্জন করতে বলছে। [৩৫.উকাইশ অর্থ অপ্রাপ্ত উট যা যে কোন জিনিস দেখে  ভয়ে পালায়। বনু মালিক ইবনে উকাইশ জ্বিনদের একটি গোত্রের নাম।] এক নতুন ও বিভ্রান্তিকর দাবী তুলে মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। তার আহ্বান সে দিকেই। তোমরা তার কথায় কান দিও না এবং তার অনুসরণ করোনা।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছু ধাওয়া করে যে লোকটি তাঁর  দাওয়াতকে খ-ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কে?” তিনি বললেন, “সে মুহাম্মাদের চাচা আবু লাহাব আবদুল উযযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব।”

 ইবনে ইসহাক হলেন, ইবনে শিহাব যুহরী আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগতভাকে কিন্দা গোত্রের লোকদের প্রতিটি শিবিরে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাদের সরদার মুলাইহ সহ সকলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

তিনি বনু আমের ইবসে সা’সা’য়া গোত্রের লোকদের কাছেও যান, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকেন এবং নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। জবাবে বাইহারা ইবনে ফিরাস নামক এক ব্যক্তি বললো, “আমি যদি এই কুরাইশ যুবককে নিই তা হলে তার সাহায্যে গোটা আরব ভূমি দখল করতে পারবো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর নিম্নরূপ সংলাপ হয়,

বাইহারা: “আচ্ছা, যদি আমরা তোমার আনুগত্য করি ও তোমর কাজে সহায়তা করে অতঃপর আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন, তখন কি আমাদের হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেবে?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: “ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।”

বাইহারা: “তাহলে শুধু তোমার খাতিরে সমগ্র আরব জাতির সামনে আমাদের বুক পেতে দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? তুমি বিজয়ী হলে তো ক্ষমতা চলে যাবে অন্যদের হাতে তোমার এ কাজে আমাদের শরীক হওয়ার কোন দরকার নেই।”

এভাবে বনু আমের গোত্রও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। হজ্জ শেষে লোকদের মক্কা ত্যাগ করে নিজ নিজ এলাকার দিকে যাত্র করলো। বনু আমের গোত্রের লোকজনও নিজ গোত্রের কাছে ফিরে দিয়ে তাদের এক অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে উস্থিত হলো। বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারতেন না। প্রতি বছরই তারা হজ্জ থেকে ফিরে এসে ঐ বৃদ্ধের কাছে যেতো এবং সেখানকার ঘটনাবলী তাকে  জানাতো। এ বছরও তারা ফিরে গেলে বৃদ্ধ তাদেরকে  তাদের উৎসবের ঘটনাবলী জিজ্ঞেস করলো তারা বললো, “এবার কুরাইশদের এক যুবক আমাদের কাছে এসেছিলো। বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের আরো একজন লোক তার পিছু পিছু এসেছিলো। সেই যুবকের দাবী হলো, সে নবী। সে আমাদের কে অনুরোধ জানিয়েছিলো যে, আমরা যেন তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করি, তার সমর্থন করি এবং তাকে আমাদের এলাকায় নিয়ে আসি।” একথা শুনে বৃদ্ধ তার নিজের মাথার ওপর হাত দু’খানা রাখলেন এবং বললেন, “হে বনী আমের, তোমরা যা হারিয়ে এসছো, তা আবার ফিরে পাওয় যায় কিনা ভেবে দেখো। কারণ ইসমাঈলের বংশধর কখনো নবী হবার মিথ্যা দাবী করেনি। আল্লাহর শপথ, ঐ যুবক যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। তোমরা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে না?”

আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব কলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হানীফা গোত্রের লোকদের সাথেও তাদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করেন, তাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছান এবং  তাঁকে সমর্থন দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা সবচেয়ে জঘন্যভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে লাগরেন। হজ্জ কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে মক্কায় কিছু লোক সমবেত হলেই তিনি তাদের কাছে যেতেন। এভাবে প্রত্যেক গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতেন। তাঁর কাছে আগত খোদায়ী রাহমাত ও হিদায়াত গ্রহণ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানাতেন। যে কোন নামকরা ও গণ্যমান্য আরব মক্কায় এসেছে জানতে পারলেই তিনি তার কাছে যেতেন এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।

বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সুয়াইদ ইবনে ছামিত হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কা এসে সে খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দেখা করলেন এবং তাকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন সুহাইল বললো, “তুমি যে বাণী শোনাচ্ছ, তার অনুরূপ কিছু আমার কাছেও আছে।” রাসূলুল্লাহ বললেন,“ তোমার কাছে কি বাণী আছে? ” সে বললো, “লোকমানের বাণী সম্বলিত একখানি পুস্তিকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এই বাণী খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে যে  বাণী, তা এর চেয়েও ভাল। তা হলো কুরআন, আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন,এটা হচ্ছে হিদায়াত এবং আলোর উৎস।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুয়াইদকে কুরআন পড়ে শোনালেন। তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সুয়াইদ এ দাওয়াত উপেক্ষা করলো না। সে বললো,“তুমি যে কুরআনের বাণী শোনালে, তা সত্যিই অপূর্ব। ” অতঃপর সুয়াইদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বিদায় হয়ে মদীনায় নিজ গোত্রে ফিরে গেল। এর কিছুকাল পরেই খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। বনু ‘আমর গোত্রের লোকেরা বলতো, “আমাদের বিশ্বাস, সুয়াইদ মুসলমান হিসেবে মারা গেছে। ” মদীনার পার্শ্ববর্তী বুয়াস নামক স্থানে আওস ও খজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তার আগেই সুয়াইদ নিহত হয়েছিল।

মদীনায় ইসলাম বিস্তারের সূচনা

অবশেষে সেই সময়টি এসে উপস্থিত হলো যখন আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়মাল্যে ভূষিত করা, তাঁর নবীকে অধিকতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং তাঁকে দেয়া প্রতিশ্রুতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবারও নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথরীতি হজ্জ উৎসবে আগত লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে ও তাঁকে আপন করে গ্রহণ করার জন্য আরব গোত্রগুলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন। এবার তিনি কিছুসংখ্যক মদীনাবাসীর সাক্ষাত পেলেন। এরা ছিলেন মদীনার খাজরাজ গোত্রের একটি দল। আকাবার [ ৩৬. মক্কা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এটি মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গা। এখান থেকে পাথর নিক্ষেপ হজ্জের অন্যতম বিধি।] কাছাকাছি এক স্থানে তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। আল্লাহ এই দলটির কল্যান সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই এই ঘটনা ঘটেছিলো। [৩৭. এ ঘটনা ঘটে নবুওয়াতের একাদশ বছরে।] তাদের সাথে দেখা হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস  করলেন, “আপনারা কারা? ” তারা বললো,“আমরা খাজরাজ গোত্রের লোক।” তিনি পুনরায় বললেন, “যা ইহুদিদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ আপনারা কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?” তাঁরা বললো, “হ্যাঁ।” তিনি বললেন, “আপনারা একটু বসবেন কি? আমি আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।” তারা বললো, বেশ,বলুন।” এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে দাওয়াত দিলেন, তাদের সামনে ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন।

আগে থেকেই মহান আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণের সহায়ক একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। মদীনায় তাদের আশেপাশে ইহুদীরা বাস করতো। তারা আসমানী কিতাকের অধিকারী ছিলো এবং সেই সুবাদে তাদের কাছে ঐশী জ্ঞান ছিল। খাজরাজ ও অন্যান্য আরব গোত্র ছিল মুশরিক তথা প্রতিমাপূজারী। ইতিপূর্বে এইসব পৌত্তলিক আরবকে আগ্রাসী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে ইহুদীরা তাদের এলাকা দখল করে বসতি স্থপন করে পৌত্তলিক ও ইহুদেিদর মধ্যে যখনই কোন অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভত হতো, তখনই ইহুদীরা পৌত্তলিকদেরকে এই বলো শাসাতো, “এ যুগের নবীর আগমনের সময় আসন্ন হয়ে উঠেছে। ঐ নবী এলে আমরা তাঁর সেতৃত্বে ‘আদ ও ইরাম জাতিকে যেভাবে পাইকারী হত্যা করা হয়েছিল, তোমদেরকে সেইভাবে কচুকাটা করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাজরাজ গোত্রের দলটির সাথে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন তখন তারা এক অপরকে বলতে লাগলো, “আল্লাহর শপথ, ইনিই তো সেই নবী যার কথা বলে ইহুদরিা আমাদেরকে হুমকি দেয় ও শাসায়। এখন ইহুদীদেরকে কিছুতেই আমাদের আগে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দেয় উচিত হবে না।” এইরূপ চিন্তার বশবর্তী হয়ে তারা তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। তারা বললো, “আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এক ভয়ংকর শত্রুর শত্রুতার মুখে অসহায় অবস্থায় রেখে এসেছি। আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের গোটা সম্প্রদায়কেই আপনার সমর্থক করে দেবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে গিয়ে আপনার দাওয়াত তাদের কাছেও তুলে ধরবো। আল্লাহ যদি তাদেরকে আপনার সমর্থক বানিয়ে দেন তা হলে আপনার চেয়ে স্মমানিত ও পরাক্রান্ত আর কেউ থাকবে না।”

এভাবে তারা ঈমান আনা ও ইসলামকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। যতদূর জানা যায়, খাজরাজ গোত্রীয় এই দলটির সদস্য ছিল ছয়জন। মদীনায় পৌঁছে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য গোত্রের কাছে পেশ করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। এভাবে ক্রমে মদীনার প্রতিটি ঘরে ইসলমের দাওয়াত পৌঁছে গেল। এমন একটি বাড়ীও অবশিষ্ট রইলো না, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা আলোচিত হতো না।

আকাবার প্রথম বাইয়াত

পরবর্তী বছর আরো বারো জন হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আসলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইসলাম গ্রহণ পূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করলেন। এই অঙ্গীকার গ্রহণ অনুষ্ঠানকে আকাবার প্রথম বাইয়াত বলা হয়। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মুসলিম নারীদের বাইয়াত গ্রহণের পদ্ধতিতে যা মক্কা বিজয়ের পরের দিন পুরুষদের বাইয়াত গ্রহণের অব্যবহিত পর সাফা পর্বতের ওপর অনুষ্ঠিত হয়। আকাবার প্রথম বাইয়াত  অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পচিালনার নির্দেশ আসার পূর্বে। এ বাইয়াতে অংশ গ্রহণকারেিদর মধ্যে ছিলেন আসআদ ইবনে যুরারা, রাফে ইবনে মালিক, ‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত এবং আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান।

‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত বলেন, “আমি আকাবার প্রথম বাইয়াতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম বারোজন পুরুষ। নারীদের বাইয়াতের পদ্ধতিতেই আমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয এবং তাছিল যুদ্ধের নির্দেশ আসার পূর্বেকার ঘটনা। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না, চুরি-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাবো না এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতা করবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য জান্নাতও রয়েছে। আর এর কোন একটি ভঙ্গ করলে তোমাদের পরিণতি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত থাকবে। ইচ্ছে করলে তিনি শাস্তি দেবেন, ইচ্ছে করলে মাফ করে দেবেন।”

ইবনে ইসাহাক কলেন: মদীনার এই দলটি যখন নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুস’য়াব ইবনে উমাইরকে পাঠিয়ে দিলেন তাদেরকে কুরআন পড়ানো, ইসলাম শিক্ষা দেয়া ও ইসলামী বিধানের তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি মদীনার শিক্ষাগুরুরূপে অভিহিত হতেন। তিনি মদীনার মুসলমানদেরকে নামাযও পড়াতেন। কেননা এক গোত্রের লোক অন্য গোত্রের লোকের ইমামতি করুক এটা আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় পছন্দ করতো না।

 

আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত

কিছুদিন পর মুস’য়াব ইবনে উমাইর মক্কা ফিরলেন। মদীনার কিছু কিছু নওমুসলিম তাঁদের স্বগোত্রীয় পৌত্তলিকদের সাথে হজ্জ উপলক্ষে মক্কা গেলেন। আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা সবাই আকাবায় সমবেত হওয়ার জন্য [৩৮. দশই জিলহজ্জের পরবর্তী তিন দিনকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়। তাশরিক অর্থ চামড়া রৌদ্রে শুকানো। আরবরা এই সময় কুরবানীর পশুর চামড়া শুকাতো।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কথা দিলেন। বলাবাহুল্য আল্লাহর রাসূলের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বিজয় দান, ইসলাম মুসলমানদের শক্তিম ব্রদ্ধি এবং অংশীবাদ ও অংশীবাদীদের পতন ঘটাতে আল্লাহর ইপ্সিত মুহূর্তটি সমাগত হলে এই দ্বিতীয় বাইয়াত সম্পন্ন হ।েপ।া।

কা’ব ইবনে মালিক বলেন: আমরা আমাদের গোত্রের মুশরিক হাজীদের সাথে মক্ক অভিমুখে রওনা হলাম। আমরা ততক্ষণে নামায পঢ়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এবং ইসলামের বিধি –বিধান শিখে নিয়েছি। আমাদের প্রবীণ মুরুব্বী ও গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূরও আমাদের সহযাত্রী। আমরা সফরে রওনা হয়ে মদীনা থেকে বেরুতেই রারা বললো, “শোনো, আমি একটা মত স্থির করেছি, জানি না তোমরা তাতে একমত হবে কিনা।

আমরা বললোম, “সেটা কি?” তিনি বললেন, “আমি ঠিক করেছি, কা’বাকে পেছনে রেখে নামায পড়বো না বরং কা’বার দিকে মুখ করেই নামায পড়বো। ” আমরা তাকে বললাম, “আমরা তো জানি, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া অর্থাৎ বাইতুল মাকদাসের দিকে ফিরেই সামায পড়ে থাকেন। আমরা তাঁর বিরোধিতা করতে পারি না।” তিনি বললেন, “তা হলে আমি কা’বা ও বাইতুল

মাকদাস-উভয়ের দিকে মুখ করে নামায পড়বো।” আমরা বললাম, “আমরা কিন্তু তা করবো না।” তাই নামাযের সময় হলে আমরা বাইতুল মাকসাদের দিকে মুখ করে নামায পড়তাম আর তিনি পড়তেন কা’বার দিকে মুখ করে। এভাবে আমরা মক্কায় এসে পৌঁছলাম। তিনি জিদ ধরে এসেছেন তার জন্য আমরা তাকে তিরস্কার করতে করতে এসেছি। কিন্তু তিনি কোনক্রমেই তার জিদ বর্জন করেননি। মক্কায় পৌঁছার পর তিনি আমাকে বললেন, “ভাতিজা, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করবো, সারাপথ আমি যেভাবে নামায পড়েছি, তা ঠিক হলো কিনা” তোমাদের কে যেভাবে আমার বিরুদ্ধে কাজ করতে দেখলাম, তাতে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।”

কা’ব ইবনে মালিক বলেন, “অতঃপর আমরা  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে বেরুলাম। আমরা তাঁকে চিনতাম না এবং ইতিপূর্বে কথনো তাঁকে দেখিনি। একজন মক্কাবাসীর সাথে দেখা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় আছেন?” সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিন?” আমরা বললাম, ‘না।’ সে বললো, “তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে কি চেন?” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ আমরা আব্বাসকে  আগে থেকেই চিনতাম। তিনি আমাদের এলাকা দিয়ে ব্যবসা উপলক্ষ্যে যাতায়াত করতেন। মক্কাবাসী লোকটি বললো, “মসজিদে হারামে প্রবেশ করে যাঁকে আব্বাসের সাথে বসা দেখবে তিনিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, আব্বাস বসে আছেন আর তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বসে আছেন। আমরা সালাম দিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন,    তুমি কি এই দুই ব্যক্তিকে চেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি তাদেরকে চিনি। ইনি গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূর। আর ইনি কা’ব ইবনে মালিক।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সম্পর্কে যা বললেন তা আমি ভুলতে পারব না। তিনি বললেন,তিনি বললেন, “কবি কা’ব ইবনে মালিক না কি?” আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন বারা বললেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি এই সফরে বের হওার পূর্বেই আল্লাহ আমাকে ইসলাম গ্রহনের তাওফীক দান করেছেন। এরপর আমি কা’বার দিকে মুখ  করে নামায পড়তে লাগলাম। কিন্তু আমার সঙ্গীরা আমার মত অগ্রাহ্য করেছে। এজন্য আমি সংশয়াপন্ন হয়ে পড়েছি। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কোনটা সঠিক মনে করেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি একটা কিবলার দিকে নামায পড়তে। ধৈর্য ধরে সেই কিবলার অনুসরণ করলে ভালো হতো।”

এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিবলাকে মেনে নিলেন এবং আমাদের সাথে বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তে লাগলেন। পরে আমরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাতের ওয়াদা করলাম। যেদিন হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ হলো তার পরবর্তী রাতটাই ছিল আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হবার প্রতিশ্রুত রাত। তখন আমাদের সাথে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম আবু জাবির। তিনি ছিলেন অন্যতম সম্মানিত সমাজপতি। তাঁকেও আমরা সাথে নিলাম। কিন্তু আমাদের সাথে কারা আছে আর আমরা কি করতে যাচ্ছি তা আমাদের সহযাত্রী গোত্রীয় মুশরিকদেরকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি। আমরা আবু জাবিরকে বললাম, “হে আবু জাবির, আপনি আমাদের একজন সম্মানিত সরদার। আপনি যে জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, তা আমাদের  দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্বিত ব্যাপার। আপনি পরকালে দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হন তা আমরা চাই না।” অতঃপর তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং তাঁকে জানালাম যে, আজ আকাবাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের মিলিত হবার কথা রয়েছে। আবু জাবির তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে আকাবার বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি একজন আহ্বায়কে পরিণত হন।

সেই রাতে আমরা আমাদের কওমের লোকদের সাথে কাফিলার মধ্যেই ঘুমালাম। রাত এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত  হওয়ার পর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেয় ওয়াদা মুতাবিক আকাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নিশাচর পাখীর মত অতি সন্তর্পণে ও অতি গোপনে বেরিয়ে পড়লাম। পথ চলতে চলতে আমরা  আকাবার নিকটবর্তী গিরিবর্তে গিয়ে সমবেত হলাম। আমরা সর্বমোট তিহাত্তর জন লোক জমায়েত হলাম। আমাদের সাথে দুইজন মহিলাও ছিলেন। তাঁরা হলেন মুসাইব বিনতে কা’ব ও আসমা বিনতে আমর ইবনে আদী। [৩৯. ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সময় মহিলাদের হাত স্পর্শ করতেন না। তিনি শুধু মৌখিক অঙ্গীকার নিতেন। তাঁরা অঙ্গীকার করলে তিনি বলতেন, ‘তোমরা যেতে পার। তোমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছে।’ ]

কা’ব ইবনে মালিক বলেন, আমরা গিরিবর্তে সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক্ষায় রইলাম। অবশেষে তিনি তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে  সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছেলন। তখনও আব্বাস ইবলাম গ্রহণ করেননি। তিনি কেবল ভ্রাতস্পুত্রের ঐ গুরুত্বপূর কাজটি প্রত্যক্স করা ও তাঁর নিরপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যই এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বৈঠকে বসলেন, তখন সর্বপ্রথম আব্বাস আমাদের সাথে কথা বললেন। তিনি বললেন, “হে খাজরাজ গোত্রের জনম-ণী মুহাম্মাদ আমাদের মধ্যে কিরূপ মর্যাদার অধিকারী,তা আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের জুলুম নির্যাতন থেকে আমরা এ যাবত রক্ষ করেছি। তাঁর সম্প্রদাযের মধ্যে তিনি একটা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে তাঁর সম্প্রদায় ও জন্মভূমিতে  তিনি সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকারী। তা সত্ত্বেও আপনাদের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ এবং আপনাদের মধ্যেই তিনি থাকতে কৃতসংকল্প। এখন আপনারা ভেবে দেখুন, তাঁকে আপনারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তা রক্ষা করতে পারবেন কিনা এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে নিরাপদে রাখতে পারবেন কিনা। তা যদি পারেন তা হলে আপনাদের দায়দায়িত্ব ভালো করে বুঝে নিন। আর যি মনে করেন যে, ভবিষ্যতে আপনারা তাঁকে তাঁর শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবেন এবং সাথে করে নিয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে লাঞ্ছনার মুখে ঠেলে দেবেন, তা হলে এখনই সেই দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কেননা বর্তমানে তিনি তাঁর স্বজাতির কাছে ও আপর মাতৃভূমিতে সম্মানে ও নিরাপদে আছেন।” আব্বাসের এ কথাগুলো শোনার পর আমরা বললাম, “আপনার কথা আমরা শুনলাম। হে আল্লাহর রাসূল, এখন আপনি বলুন এবং যেমন খুশী অঙ্গীকার নিন!”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে এবার তাঁর কথা বললেন। প্রথমে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলামের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, “আমি তোমাদের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার চাই যে, তোমরা তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যেভাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকো, আমাকেও সেভাবে রক্ষা করবে।”

তৎক্ষণাৎ বারা ইবনে মা’রূর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ। যে মহান সত্তা আপনাকে নবী করে সত্যদীনসহ পাঠিয়েছে তাঁর শপথ করে বলছে, আমরা স্বজন ও স্ত্রী-সন্তানদের যেভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকি, আপনাকেও সেভাবে রক্ষা করবো। হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার আনুগত্য করার শপথ গ্রহণ করলাম। আল্লাহর শপথ, আমরা য্দ্ধু ও অস্ত্রের মধ্যেই লালিত পালিত। আমরা পুরুষানুক্রমে যোদ্ধা জাতি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বারার কথা শেষ না হতেই আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের সাথে ইহুদীদের মৈত্রী সম্পর্কে রয়েছে এবং আমরা তা ছিন্ন করতে যাচ্ছি। এসব করার পর আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করলে আপনি কি আমভদের ত্যাগ করে নিজ গোত্রে ফিরে যাবেন?” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “আমি বরং তোমাদের জীবন মরণ ও সুখ দুঃখের চিরসঙ্গী হবো, তোমাদের রক্তপাতকে আমি নিজের রক্তপাত বলে গণ্য করবো। আমি চিরকাল তোমাদের থাকবো এবং তোমরা চিরকাল আমার থাকবে। তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে, আমিও তার সাথে যুদ্ধ করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্য থেকে বারো জন নকীব বা আহ্বায়ক নির্বাচন করে আমার কাছে পাঠাও যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদের এই অঙ্গীকারে শামিল করে নিতে পারে।” তারা তখন বারো জন আহ্বায়ক নির্বাচন করে। তন্মধ্যে নয় জন ছিল খাজরাজ গোত্রের এবং তিন জন আওস গোত্রের।[৪০. খাজরাজের নয় জন আহ্বায়ক হলেন: আসাদ ইবনে যুরারা, সা’দ ইবনে রাওয়াহা, রাফে’ ইবনে মালিক, বারা ইবনে মা’রূর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম, উবাদা বনে ছামিত, সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমর ইবনে খুরাইস। আর আওস গোত্রের তিন জন ছিলেন: উসাইদ ইবনে হুদাইর, সা’দা ইবনে খাইসামা ও রিফায়া ইবনে মুনযির। ইবনে হিশাম বলেন, বিজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ রিফায়ার স্থলে আবুল হাইসাম ইবনে তাইহানকে আহ্বায়ক বলে উল্লেখ করেন।]

যিনি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে হাত রেখে বাইয়াত করেন তিনি বারা ইবনে মা’রূর। পরে তিনি নিজ গোত্রকে ঐ বাইয়াতে শামিল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের এই বাইয়াত অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শয়তান আকাবার পর্বত শীর্ষ থেকে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো যে, ও রকম বিকট চিৎকার আমি আর কখনো শুনিনি। সে চিৎকার করে বলছিলো, “হে মিনাবাসী, মুজাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির সাথে  ধর্মদ্রোহীরা যে যোগসাজশ করলো তা কি তোমরা লক্ষ্য করলে না? [৪১.মুজাম্মাম অর্থ ধিকৃত বা নিন্দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মুহাম্মাদের (প্রশংসিত) বিপরীত শব্দ। মুশরিকরা তাঁকে এই নামে ডাকতো। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বলতো সাবি অর্থাৎ সাবি অর্থাৎ ধর্মত্যাগী বা বে-দীন।]  ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ হলো আকাবার শয়তান আযেব ইবনে উযাইবের চিৎকার।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা নিজ নিজ কাফিলায় বলে যাও।”

‘আব্বাস এবন উবাদা ইবনে নাদালা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, যে আল্লাহ আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আপনি চাইলে আমরা আগামীকালই মিনায় অবস্থানকারীদের ওপর তরবারী নিয়ে হামলা চালাবো।”

এরপর আমরা গিয়ে শয্যাগ্রহণ করলাম এবং সকাল পর্যন্ত ঘুমালাম। সকাল হতেই কুরাইশদের বিরাট একটি দল আমাদের ঘিরে ধরলো।। তারা বললো, “হে খাজরাজ গোত্রের লোকগণ, আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমরা মুহাম্মাদকে আমাদের মধ্য থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছো এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তার সাথে ষড়যন্ত্র¿ করছো। সত্যি বলতে কি, আরবের আর কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধের চেয়ে তোমদের সাথে যুদ্ধ আমাদের কছে সবচেয়ে অপছন্দীয়।” এ কথা শুনে আমাদের যেসব মুশরিক সেখানে ছিল, তারা আল্লাহর শপথ করে করতে লাগলো, “এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রই এখানে হয়নি এবং আমরা তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানি না।”

বস্তুত:তারা সত্য কথাই বলছিল। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানতো না। তারা যখন আল্লাহর শপথ করে কুরাইশদের এসব বলে আশ্বস্ত করছিল তখন আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এরপর মিনা থেকে লোকজন চলে গেলে কুরাইশরা ব্যাপারটা আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান চালালো। শেষ পর্যন্ত তারা জানতে পারলো যে, ঘটনাটা সত্য। অতঃপর আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের সন্ধানে তারা চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। মক্কার নিকটবর্তী আযাখের নামক স্থাকে তারা সা’দ ইবনে উবাদা, মুনযির ইবনে আমররে সাক্ষাত পেলো। মুনযিরকে তারা ধরতে পারলো না, কেবল সা’দ ধরা পড়লেন। সা’দের চুল ছিল বেশ লম্বা। তারা তাঁকে ধরে উটের রশি দিয়ে দুই হাত ঘাড়ের সাথে এঁটে বাঁধলো। তারপর তাঁকে পিটাতে পিটাতে চুল ধরে টানতে টানতে মক্কায় নিয়ে গেল।

এ সম্পর্কে সা’দ নিজে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নরূপ, আমি তাদের হাতে ধৃত ও বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায কুরাইশদের একটি দল আমার কাছে আসলো। তাদের ভেতরে খুবই উজ্জ্বল ফর্সা, সুন্দর ছিপছিপে লম্বা ও মিষ্টি চেহারার অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষকে দেখলাম। আমি মনে মনে বললাম: এই বিপুল জনতার মধ্যে কারো কাছে যদি ভালো  ব্যবহার প্রত্যাশা করা যেতে পারে তা হলে এই ব্যক্তির কাছেই। কিন্তু এ লোকটা আমার কাছে এসে প্রথমেই আমাকে প্রচ- এক থাপ্পড় কষে দিলো। তখন আমি মনে মনে বললাম, এই লোকটার কাছ থেকেই যখন এমন ব্যবহার পেলাম, তখন আর কারো কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার  আশা করা যায় না। এভাবে তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমি তখন সম্পূর্ণ অসহায়। সহসা জনতার মধ্য হতে এক ব্যক্তি আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললো, “আহ্! কি দুঃখজনক দশা তোমার। আচ্ছা কুরাইশদের ভেতরে কি তোমার জানাশোনা বা লেনদেন আছে এমন একটা লোকও নেই?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আছে। আমি এক সময় যুবাইর ইবনে মুতয়িম ইবনে আদীর বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আশ্রয় দিতাম এবং আমাদের অঞ্চলে কেউ তাদের ওপর যুলুম করতে  চাইলে তাদেরকে রক্ষা করতাম। তা ছাড়া হারেস ইবনে হারব ইবনে উমাইয়ার বাণিজ্য প্রতিনিধিদেরকেও সাহায্য করতাম। ”লোকটি বললো, ‘তা হলে ঐ দু’জনের সাম উল্লেখ করে খুব উচ্চস্বরে ধ্বনি দাও। তাদের সাথে তোমার যে সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ কর।” আমি সঙ্গে সঙ্গে ঐ দু’জরের নামে ধ্বনি দিলাম। আর ঐ লোকটি তৎক্ষণাৎ যুাবাইর ও হারেসের সন্ধানে ছুটে গেলো এবং কা’বার সন্নিকটে মসজিদুল হারামের মধ্যে তাদেরকে পেলো।

অতঃপর সে তাদেরকে বললে, “মক্কার অদূরের সমভূমিতে খাজরারের একটা লোককে এই মুহূর্ত ভীষণভাবে পিটানো হচ্ছে। সো মার খাচ্ছে আর তোমরদের দু’জনের নামোল্লেখ করে বলছে যে, তার সাথে নাকি তোমাদের জানাশোনা আছে।”যুবাইর ও হারেস বললো, “লোকটি কে?” সে বললো, ‘সা’দ ইবনে উবাদা।” তারা বললো, “ঠিকই বলেছে। সে আমাদের ব্যবসায়ীদেরকে তাদের এলাকায় গেলে আশ্রয় দিতো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করতো।” অতঃপর উভয়ে এসে সা’দকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করলো। তারপর সা’দ চলে গেলেন।

আকাবার শেষ বাইয়াত ও তার শর্তাবলী

আকাবার শেষ বাইয়াতটি সম্পন্ন হয় আল্লাহর তরফ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি লাভের পর। তাই যুদ্ধের অঙ্গীকার ছাড়া এই বাইয়াতের শর্তাবলী ছিলো প্রথম বাইয়াতের শর্তাবলীর অনুরূপ। প্রথম বাইয়াত ছিল মক্কা বিজয়ের মহিলাদের বাইয়াতের অনুরূপ। কারণ প্রথম বাইয়াতের সময় আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তাই অনুমতি লাভের পর আকাবার শেষ বাইয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদের নিকট থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, তারা দুনিয়ার সকল কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। তিনি তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অঙ্গীকারের শর্তাবলী আরোপ করেন এবং সেই শর্তাবলী সহ অঙ্গীকার পালন করলে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে বলে ঘোষণা করেন।

‘উবাদা ইবনে ছামিত (রা) বর্ণনা করেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলাম। সেই অঙ্গীকারের শর্তবলী ছিলো এই: অবস্থা কঠিন কিংবা স্বাভাবিক যা হোক না কেন আমরা সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবো এবং আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবো না।”

সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ লাভ

আকাবার বাইয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের বা প্রয়োজনে রক্তপাত ঘটানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। তখন পর্যন্ত তাঁকে শুধু আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া, যুলুম নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করা এবং অজ্ঞ লোকদের ক্ষমা করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণকারী যেসব লোককে ঘরবাড়ী ত্যাগ করতে হয়েছিলো, তাদের উপরে কুরাইশরা চরম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিলো। অসহ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ কেউ ইসলাম ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছিলো। কুরাইশরা বেশ কিছু সংখ্যাক ঈমানদারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এভাবে মুসলমানেদের কেউবা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো, কেউবা ইসলাম পরিত্যাগ করেছিল, কেউবা দেশত্যাগ করেছিলো। তাদের তধ্যে অনেকে হাবশায় এবং অনেকে মদীনায় হিজরাত করেছিলো এভাবে সবদিক দিয়েই মুসলমানরা যখন লাঞ্ছিত ও সর্বস্বান্ত, কুরাইশরা খোদাদ্রোহিতার শেষ সীমায় উপনীত এবং তাঁর নবী প্রত্যাখ্যাত, তখনই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা এবং যালিম খোদাদ্রোহীদেরকে পর্যুদস্ত করার অনুমতি দিলেন। উরওয়া ইবনে যুবাইর ও অন্যান্য বর্ণনাকারীদের নিকট থেকে আমি যা জানতে পেরেছি। তদনুসারে আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা ও ঈমানদারদের প্রতিরক্ষার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত বৈধ ঘোষণা করে সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয়, তা হলো-

[আরবী *************]

“যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া গেল। কারণ তারা মাযলুম। বস্তুত: আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার মত ক্ষমতাশালী। তারা সেই সব লোক, যাদেরকে শুধু ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ এই কথাটুকু বলার কারণে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ঘরবাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেয় হয়েছে। আল্লাহ যদি একদল মানুষকে আরেক দল দিয়ে দমন করার ব্যবস্থ না রাখতেন তাহলে মন্দির, গীর্জা, সব ইবাদাতখানা ও মসজিদসমূহ, যেখানে বেশী করে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়ে থাকে ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহকে যে সাহায্য করবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। বস্তুত: আল্লাহ শক্তিশালী মহা প্রতাপান্বিত। তারা সেই সব লোক যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা ও সুযোগ দিলেই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং অন্যায় ও অসত্যকে প্রতিরোধ করবে। আল্লাহর হাতেই সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি। (সূরা হজ্জ ৩৯-৪১)

অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের ওপর যুলুম নির্যাতন হওয়ার কারণেই আমি তাদের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ বৈধ করেছি। তারা মানুষের প্রতি কোন অপরাধ বা পাপ করেনি। তারা যখনই বিজয়ী হবে তখনই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ প্রতিহত করবে। এরপর আল্লাহ আবার নাযিল করেনÑ

[আরবী *************]

“তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যাতে কোন মু’মিনকে আর তার দীন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা না হয় এবং একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য অবশিষ্ট থাকে।” (সূরা বাকারাহ্) অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাাত বা দাসত্ব করা হয়, অন্য কারো নয়।

মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরাত করার অনুমতি দান

আল্লাহর তরফ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন যুদ্ধের অনুমতি দেয় হলো আর মদীনাবাসীদের উপরোক্ত দলটি ইসলামী বিধানের অনুসরণ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুরসারীদের সর্বত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব মুসলমানকে মদীনায় হিজরাত করে তাদের আনসার ভাইদের কাছে-চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমি ও কিছুসংখ্যক ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন।” ফলে মুসলমানগণ দলে দলে হিজরাত করতে শুরু করলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরাতের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।

মদীনায় হিজরাতকারী মুসলমানদের বিবরণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কুরাইশ বংশীয় প্রথম মুহাজির ছিলেন বনী মাখযুম গোত্রের আবু সালামা ইবনে আবুদুল আসাদ। আকাবার বাইয়াতের এক বছর আগে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। ইতিপূর্বে তিনি আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে আসেন। এই সময় কুরাইশরা তাঁকে উৎপীড়ন করতে লাগলো। তিনি মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহনের খবর শুনতে পেলেন। এবং তাঁর সাথে হিজরাত করে চলে গেলেন। আবু সালামার পর আমের ইবনে রাবীয়া এবং মদীনায় তার স্ত্রী লায়লা বিনতে আবু হাসমা মদীনায় হিজরাত করেন। তারপর আবুল্লাহ ইবনে জাহাশ তাঁর পরিবার পরিজন ও ভাই আবদ ইবনে জাহাশকে সাথে নিয়ে হিজরাত করেন। তাঁর ভাইয়ের আর এক নাম ছিলো আবু আহমাদ। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিলো ক্ষীণ। তা সত্ত্বেও তিনি কারো সাহায্য ছাড়াই মক্কার উচ্চ ও সমতল এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি ছেলেন একজন কবি।

এপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও আইয়াশ ইবনে আবু রাবিয়া মাখযুমী হিজরাত করে মদীনায় চলে যান। অতঃপর ব্যাপকহারে মুসলমানগণ মদীনায় হিজরাত করতে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরাত

সাহাবীগণ হিজরাত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থেকে গেলেন। এ সময়ে আলী ইবনে আবু তালিব, আবু বাক্র সিদ্দীক ও মুষ্টিমেয় ক’জন সাহাবা ছাড়া আর কেউ মক্কায় ছিলেন না। অন্য যারা ছিলো তারা হয় কাফিরদের হাতে বন্দী ছিল নতুবা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আবু বাকর (রা) প্রায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হিজরাত করার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়ো করো না। হয়তো আল্লাহ তোমাকে একজন সাথী জুটিয়ে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তাঁর হিজরাতের সঙ্গী হন। হযরত আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) এরপর থেকে তাই কামনা করতেন। কুরাইশরা যখন দেখলো যে, অন্যত্র তাদের গোত্রের বাইরের বহু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গীরা তাদের কাছে হিজরাত করে চলে যাচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পারলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরগন একটা নিরাপদ আবাসভূমি পেয়ে গেছেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশত্যাগের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেলো। তারা ভাবলো যে, তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছেন।

এ ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য তারা পরমর্শগৃহ ‘দারুন্ নাদওয়ায়’ সমবেত হলো। এই গৃহটি ছিলো কুসাই ইবনে কিলাবের বাড়ী। কুরাইশরা যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে এখানেই সমবেত হতো। এবার তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর ব্যাপারে কি করা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করতে বসলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তারা নির্ধারিত দিনে সেখানে সমবেত হলো। এই দিনকে ‘গণসমাবেশ দিবস’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাদের পরামর্শ গৃহে ঢুকবার পথে ইবলিস কম্বল আচ্ছদিত এক বৃদ্ধের বেশে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে সবাই বললো, “বৃদ্ধ এই  লোকটি কে?” সে বললো, “আমি নাজদের অধিবাসী। [৪২.সুহাইলী মতে, শয়তান নিজেকে নাজদবাসী বলে পরিচয় দেয়ার কারণ হলো, কুরাইশরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো যে, তিহামা অঞ্চলের কোন লোককে এই পরামর্শ সভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কেননা তারা মনে করতো, তিহামাবাসী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমর্থক। এজন্য ইবলিস নাজদবাসী বৃদ্ধের রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।]

তোমরা যে উপলক্ষে আজ সমবেত হচ্ছো, তা আমি শুনেছি। তাই তোমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য এসেছি। আশা করি আমার উপদেশ ও পরামর্শ থেকেও তোমরা বঞ্চিত হবে না।”একথা শুনে সবাই তাকে পরম সমাদরে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সে সবার সাথে প্রবেশ করলো। ততক্ষণে কুরাইশদের বড় বড় নেতা ও সরদার ভেতরে আসন গ্রহণ করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “এই লোকটির তৎপড়তা বর্তমানে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমরা সবাই তা জান। সে তার বাইরের অনুসারীদের নিয়ে কখন যে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার কোন ঠিক নেই। তার আক্রমণ থেকে আমরা এখন নিরাপদ নই। অতএব, সবাই মিলে তার ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”

সলাপরামর্শ চলতে থাকলো। এক সময় একজন বললো, “তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে কোন অর্গলবদ্ধ  কুঠরীতে বন্দী করে রাখ। তারপর ইতিপূর্বে তার মত  কবিদের যে পরিণতি হয়েছে তারও সেই পরিণতি অর্থাৎ শোচনীয় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাক। যুহাইব, নাবেগা ও তাদের মত অন্যান্য কবির এই পরিণতি হযেছিল। ” তখন বুড়ো বললো, “না, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তোমরা যদি তাকে বন্দী কর, তা হলে বদ্ধ কুঠরীতে  তার বন্দী হওয়ার খবর তার বাইরের অনুসারীদের কানে চলে যাবে। সে অবস্থায় তারা তোমাদের ওপর হামলা  চালিয়ে তাকে তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতঃপর তাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং একদিন  তারা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবে। কাজেই তোমাদের এ সদ্ধিান্ত সঠিক নয়। অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পার কিনা, ভেবে দেখ।”

এরপর আবার আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। একজন বললো, “আমরা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবো। এরপর তাকে নিয়ে আমাদের আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। সে একাবার আমাদের কাছ থেকে চলে গেলে কোথায় গেলো বা কোথায় থাকলো আমরা তার কোন পরোয়া করবো না। সে চলে গেলে আমরা তার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এরপর আমাদের পারস্পরিক মৈত্রী ও বন্ধুত্ব এবং অন্যান্য ব্যাপারে আমরা নিজেরাই শুধরে স্বাভাবিক করে নিতে পারবো।”

নাজদের বৃদ্ধ বললো, “না, এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত হলো না। তোমরা কি তার অনুপম বাচনভঙ্গি, মিষ্ট ভাযা, যুক্তিগ্রাহ্য কথা এবং তথাকথিত ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত মন মগজ আছন্নকারী ব্যাপারগুলো দেখনি? তোমরা যদি এই পদক্ষেপ নাও, তাহলে এমনও হতে পারে যে, সে অন্য কোন আরব গোত্রে গিয়ে হাজির হবে, আর তার মিষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী কথা দিয়ে তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং তারা তার অনুসারী হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের নিয়ে তোমাদের ওপর হামলা চালিয়ে তোমাদের দেশ দখল করে তোমাদের হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে। তোমরা এটা বাদ দিয়ে অন্য কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”

এবার আবু জাহল বললো, “আমার একটা মত আছে য এতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কারো মাথায় আসেনি।” সবাই বললো, “বলো দেখি, আবুল হাকাম তোমার মত কি।”

সে বললো, “আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন শক্তিশালী সম্ভ্রান্ত যুবক বাছাই করতে হবে। তারপর তাদের প্রত্যেককে আমরা একটা করে ধারালো তরবারী দেবো। ওই যুবকেরা এক যোগে হামলা চালিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করবে। এভাবে আমরা তার থেকে নিস্তার পেতে পারি। আর তারা সবাই মিলে যখন এ কাজটা করবে, তখন মুহাম্মাদের খুনের দায় দায়িত্ব সকল গোত্রের ঘাড়েই কিছু না কিছু পড়বে। ফলে আবদ মানাফ গোষ্ঠী সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে খুনের প্রতিশোধ নিতে পারবে না। রক্তপণ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে। আমরা সকল গোত্র মিলে তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেবো।”

নাজদের বৃদ্ধ বললো, “এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।”

এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পরামর্শ সভার সমাপ্তি ঘোষনা করা হলো এবং সবাই যার যার বাড়ীতে চলে গেলো।

তৎক্ষণাৎ জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস তাঁকে বললেন, “আপনি প্রতিদিন যে বিছানায় ঘুমান আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।”রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত ঘাতকের দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের দরজায় এসে সমবেত হয়ে ওত পেতে থাকলো। তিনি কখন ঘুমান তার প্রতীক্ষা করতে লাগলো। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর ওপর হামলা চালাবে এই তাদের বাসনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) বললেন, “তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও এবং আমার এই সবুজ হাদরামাউতী চাদর দিয়ে আপাদমস্তক আবৃত করে রাখ। তোমার ওপর তাদের দিক থেকে কোন আঘাত আসবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমাবার সময় ঐ চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নিতেন।

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কারযী বলেন, ঘাতক দলে আবু জাহলও ছিলো। ঘাতকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীর দরজার জাময়েত হলে আবু জাহল তাদেরকে বললো, “ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে যে, তোমরা যদি তার অনুসরণ কর তাহলে তোমাদের আরব ও অনারব সবার জন্য জর্ডানের বাগ বাগিচার মত অসংখ্য বাগ বাগিচা তৈরী করে দেয়া হবে। কিন্তু যদি তার অনুসরণ না কর তা হলে তোমরা ধ্বংস ও নির্মূল হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করে তোমাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে তাদের সামনে আসলেন। তিনি এক মুষ্ঠি ধূলি হাতে নিলেন। অতঃপর আবু জাহলকে লক্ষ্য করে বলতে লগলেন, “হ্যাঁ, আমি এ কথা বলি এবং যাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে তুমিও তাদেরই একজন।” এই সময় আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন। ফলে তারা তাঁকে দেখতে পেলো না। তিনি ঐ ধূলি তাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। তিনি তখন সূরা ইয়াসীনের নিন্মোক্ত আয়াতসমূহ পড়ছিলেন-

“ইয়াসীন! জ্ঞানের ভা-ার কুরআনের কসম, নিশ্চয়ই তুমি রাসূল। তুমি সঠিক পথের ওপর আছ। এ কুরআন মহাপরাক্রান্ত করুনাময়ের নাযিল করা, যাতে তুমি এমন একটি জাতিকে সাবধান করে দিতে পার যাদের পূর্বপুরুষদের সাবধান করা হয়নি। পলে তারা অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তাদের অধিকাংশ লোকই আল্লাহর আযাবের যোগ্য তাই তারা ঈমান আনছে না। আমি তাদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। সেই বেড়িতে তাদের থুতনি পর্যন্ত শ্রংখলিত হয়ে গেছে। এ জন্য তারা মাথা উঁচু করে রয়েছে। আমি তাদের সামনে একটি প্রাচীর এবং পেছনে আরেকটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি। তাই তারা দেখতে পায় না।” এই আয়াত কয়টি পড়তে পড়তে তিনি তাদের প্রত্যেকের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর নিজের ইচ্ছামত একদিক চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর বাইরের এক ব্যক্তি তাদের কাছে এসে  জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এখানে কি জন্য অপেক্ষা করছো?” তারা বললো, “আমরা মুহম্মাদের অপেক্ষায় আছি।” সে বললো, “আল্লাহ তোমাদেরকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। মুহাম্মাদ তো তোমাদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেছে। তোমাদের মাথায় কি রয়েছে, তা কি দেখতে পাচ্ছো না?” তখন প্রত্যেকে মাথায় হাত দিয়ে দেখলো, ধূলিতে মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

অতঃপর তারা গৃহতল্লাশী শরু করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাদর গায়ে দিয়ে আলীকে (রা) বিছানায় শয়িত দেখে বললো, “এই তো মুহাম্মাদ, চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে।” তাই তারা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলো। সকালে আলী (রা) বিছানা থেকে উঠলে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো, “লোকটা তাহলে তো ঠিকই বলেছে যে, মুহাম্মাদ চলে গেছে।”

ইবনে ইসহাক বলেন, আবু বাক্র ছিলেন খুব ধনবান ব্যক্তি। তিনি রাসূলুল্লাহর কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়া করোনা। আল্লাহ হয়তো তোমাকে নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে নিজের বাড়ীতে রেখেছিলেন। হিজরাতের প্রস্তুতিস্বরূপ তিনি এই কাজ করেছিলেন।

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রের বাড়ীতে সকালে হোক বা বিকেলে দিনে অন্ততঃ একবার যেতে ভুলতেন না। সেই দিনটা এসে উপনীত হলো যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কার স্বগোত্রীয়দেরকে ছেড়ে হিজরাত করে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেদিন তিনি দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন। ঐ সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখে আবু বাক্র বললেন, “নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় আসতেন না।” তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বাক্রের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা বিনতে আবু বকর ছাড়া আর কেউ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা এখানে অন্য যারা রয়েছে, তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনার কি হয়েছে? আমাকে বলুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ আমাকে মক্কা থেকে চলে যাওয়ার ও হিজরাত করার অনুমতি দিয়েছেন।” আবু বাক্র বললেন, “আমিও কি সঙ্গে যেতে পারবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তুমিও সঙ্গে যেতে পারবে?।” আয়িশা (রা) সবলেন, সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও কাঁদতে পারে। আমি আবু বাক্র (রা) কে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অত:পর আবু কাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।” অতঃপর তারা আবদুল্লাহ ইবনে আরকাতকে পথ দেখিয়ে নেবার জন্য ভাড়া করে সাথে নিলেন। সে ছিলো মুশরিক। উট দুটো তার কাছেই রেখে গেলেন। সে নির্ধারিত সময়ের জন্য উট দুটির দেখাশুনা ও তত্ত্বাবধান করতে থাকলো।

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা ত্যাগের সময় তাঁর মক্কা ত্যাগের কথা শধুমাত্র আলী ইবনে আবু তালিব (রা), আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এবং আবু বাকরের পরিবার পরিজন ছাড়া আর কেউ জানতো না। আলীকে ব্যাপারটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে মক্কায় কিছুদিন থাকতে বলেছিলেন। মক্কার লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নানা রকমের জিনিস গচ্ছিত রাখতো। যারা কোন জিনিস নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করতো না তারা  তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমানত রাখতো। কারণ তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথা সবার জানা ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের পর ঐ আমানত ফেরত দেয়ার জন্যই তিনি আলীকে (রা) দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাকে মক্কায় আরো কিছুদিন থাকার নির্দেশ দেন।

এবার আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ী থেকে বের হবার পালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবু বাক্রের (রা) কাছে আসলেন। তারপর আবু বাক্রের ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে উভয়ে বের হলেন। অতঃপর তাঁরা মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত ‘সাওর’ পর্বতের একটি গুহার পাশে গিয়ে তার ভেতরে প্রবেশ করলেন। আবু বাকর তাঁর ছেলে ‘আবদুল্লাহকে বলে গেলেন, দিনের বেলায় লোকেরা তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলাবলি করে কিনা, তা যেন সে মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সব কথা জানায়। (মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম ও পরে স্বেচ্ছায় মজুরীর ভিত্তিতে কর্মরত) ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, সে যেন দিনের বেলায় তাঁর মেষপাল চরায়, অতঃপর সেগুলোকে সাওরের ঐ পর্বত গুহার কাছে ছেড়ে দেয় এবং সন্ধ্যার সময় পর্বত গুহায় তাঁদের সাথে দেখা করে। আসমা বিনতে আবু বাক্র প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। [৪৩. হাসান বসরী (রহঃ) থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবু বাক্র (রা) সাওর পর্বত গুহায় পৌঁছেন রাতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রবেশের আগে আবু বাক্র (রা) গুহায় প্রবেশ করলেন। সেখানে কোন হিং¯্র প্রাণী বা সাপ আছে কিনা তা ভালো করে দেখে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ]আবু বাক্রকে (রা) সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওর পর্বত গুহায় তিনদিন  অবস্থান করেন। এদিকে কুরাইশরা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য একশো উট পুরস্কার ঘোষণা করলো। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সারা দিন কুরাইশদের সাথেই মিলেমিশে থাকতেন এবং তাদের সলাপরামর্শ শুনতেন। তারা তাঁদের উভয়ের সম্পর্কে যা যা মন্তব্য করতো তাও শুনতেন। অতঃপর সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সারা দিনের যাবতীয় খবর জানাতেন। আর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরা মক্কাবাসীদের পশুপালের সাথেই আবু বাকরের (রা) মেষপাল চরিয়ে বেড়াতো। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সেগুলোকে ‘সাওর’ পর্বতগুহার কাছে নিয়ে ছেড়ে দিতো, তখন তাঁরা উভয়ে মেষের দুধ দোহন করতেন অথবা জবাই করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সকালে ‘সাওর’ পর্বত গুহা থেকে বেরিয়ে মক্কায় যেতেন তখন আমের ইবনে ফুহাইরা তার মেষপাল নিয়ে পিছু পিছু যেতেন যাতে তার পদচিহ্ন মুছে যায়। এভাবে তিনদিন অতিবাহিত হলে তাদের সম্পর্কে মক্কাবাসীদের হৈ চৈ ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসলো। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আরাকাত নিজে একটি উটে চড়ে রাসূলুল্লাহ ও আবু বাক্রের (রা) উট দুটিকে সাথে নিয়ে সাওর পর্বত গুহায় হাজির হলো। আসমা বিনতে আবু বাকর পথের খাবার নিয়ে তাদের কাছে আসলো। কিন্তু খাবার ঝুলিয়ে বেঁধে দেয়ার মত কোন রশি আনতে সে ভুলে গিয়েছিলো। উভয়ে রওনা হলেন। আসমা খাবার ঝুলানো চেষ্টা করলো, কিন্তু দেখলো কোন রশি নেই। অগত্যা সে নিজের কোমর বন্ধনী খুলে তা ফেড়ে রশি বনিয়ে খাবার বেঁধে ঝুলিয়ে দিলো। এই জন্য আসমা বিনতে আবু বাক্রকে ‘যাতুননিতাকাইন’ দুটি কোমর বন্ধনীর  অধিকারিণীর বলে অভিহিত করা হতো। [৪৪.ইবনে হিশাম বলেন, আমি একাধিক বিজ্ঞজনের কাছে শুনেছি যে, আমাকে যাতুননিতাকাইন অর্থাৎ ‘দুই কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হতো। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, আসমা যখন খাবারের পাত্র বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে চাইলো, তখন নিজের বেল্টটি দ্বিখ-িত করলো, একটি দিয়ে তা ঘুরিয়ে বাঁধলো, অপরটি দিয়ে ঝুলালো।]

আবু বাক্র উট দুটোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এনে সবচেয়ে ভালো উটটি তাঁকে দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবার হোক। এতে আরোহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে উট আমার নয় তাতে আমি আরোহণ করবো না।” তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটি আপনার। আপনার উপর আমার পিতামাতা কুরবান হোক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না তবে কত দাম দিয়ে এটি কিনেছো বল।” আবু বাক্র উটের দাম বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি এই দামের বিনিময়ে উটটি নিলাম।” আবু বাক্র বললেন, “উট ও তার দাম উভয়ই আপনাকে দিয়ে দিলাম।”

অতঃপর উভয়ে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে পথিমধ্যে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য পেছনে চড়িয়ে নিলেন।”

আসমা বিনতে আবু বাকর বলেন, আবু বাক্র (রা) ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হয়ে যাওয়ার পর আবু জাহল সহ কুরাইশদের একটি দল আসলো। তারা আবু বাক্রের (রা) দরজার সামনে দাঁড়ালো। আমি তাদের কাছে গেলাম। তারা বললো, “তোমার আব্বা কোথায়? ” আমি বললাম, ‘আব্বা কোথায় জানি না।” সঙ্গে সঙ্গে পাষ- নরাধম আবু জাহল আমার মুখে এমন জোরে থাপ্পর মারলো যে, আমার কানবালাটি ছিটকে পড়ে গেলো।

অতঃপর তারা চলে গেলো। ইতিমধ্যে তিনদিন কেটে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিকে রওয়ানা হয়েছেন তার কোন হদিস পাওয়া গেলো না। হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে এক জিন গান গাইতে গাইতে আসলো। লোকেরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলো না। কিন্তু তার আওয়াজ শুনে  তাকে অনুসরণ করতে  লাগলো। দেখতে দেখতে সে মক্কার উচ্চভূমি অতিক্রম করে চলে গেল। সে যে গানটি গাচ্ছিলো তা হলো:

[আরবী *************]

“মানুষের প্রভু আল্লাহ সেই দুই বন্ধুকে সর্বোত্তম পুরস্কার দিক-যারা উম্মে মা’বাদের বাড়ীতে [৪৫. উম্মে মা’বাদের প্রকৃত নাম আতিকা বিনতে খালিদ। সে বনু কা’ব গোত্রের এক মহিলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘আবু বাক্র, আমের ইবনে ফুইহারা ও আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত এই মহিলার বাড়ীতে যাত্রাবিরতি করেন। তাঁরা এই মহিলার কাছ থেকে কিছু গোশত ও খোরমা ক্রয়ের ইচ্ছা ব্যাক্ত করেন। কিন্তু সেখানে কোনটাই ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে মা’বাদের ঘরের এক কোণে একটা ছাগল দেখতে পেলেন। ছাগলটি দুধ দিতো না। তিনি ঐ মহিলার নিকট ছাগলটির দোহন করার অনুমতি চাইলেন। অতঃপর তিনি হাত দেয়ে তার পালান ধরতেই তা দুধে ভরে উঠলো। এ দৃশ্য দেখে মহিলা তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন]

আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তারা বদান্যতা সহকারে যাত্রাবিরতি করেছে, অতঃপর পুনরায় যাত্রা করেছে। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের বন্ধু হয়েছে, সে সফলকাম হয়েছে। বনু কা’বের যুবতীটির মুসলিমদের ব্যবস্থা তদারক করার জায়গায় উপস্থিত থাকা ও উপবিষ্ট থাকার জন্য সমগ্র বনু কা’বই অভিনন্দিত হোক।”

তার এ কথা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন।”

সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’সাম বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পথে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা তাঁকে পাকড়াও করে আনার বিনিময়ে একশো উষ্ট্রী পুরস্কার ঘোষণা করেন। একদিন আমি নিজ গোত্রের পরামর্শ সভায় বসে আছি আমাদেরই এক ব্যক্তি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। সে বললো, “আল্লাহর শপথ, আমি এই মাত্র তিনজনের  একটা দলকে যেতে দেখে আসলাম। আমার মনে হয়, তারা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গী সাথীরাই হবে।” আম তাকে চোখ টিপে চুপ করতে ইশারা করলাম। অতঃপর বললাম, “ওরা অমুক গোত্রের লোকজন। তাদের একটা পশু হারিয়ে গেছে, সেটাই খুঁজে বেড়াচ্ছে।” সে বললো, “হয়তো তাই।”

সে আর কোন কথা বললো না। সেখানে অল্প কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি বাড়ীতে গেলাম এবং ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমার ভাগ্য গণনার তীরটিও সাথে নিলাম। তারপর যুদ্ধের পোশাক পরে রওয়ানা হলাম। পথে বেরিয়ে এক জায়গায় গিয়ে তীর দিয়ে ভাগ্য গণনা করলাম। যা আমার একেবারেই অপছন্দ, তীর ঠিক সেই ভবিষ্যদ্বণীই করলো। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদের কোন ক্ষতি হবে না।’ আসলে আমার ইচ্ছা ছিলো তাকে পাকড়াও করে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়ে পুরস্কারের একশো উষ্ট্রী লাভ করা। তাদের পদচিহ্ন ধরে আমি দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে  এগিয়ে চললাম ঘোড়টি আমাকে নিয়ে যেইমাত্র প্রবল বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে, অমনি সেটি হোঁচট খেলো। আমি ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে ছিটকে রাস্তার ওপর এসে পড়লাম। আমি তখন মনে মনে বললাম,‘ব্যাপার কি!’ আবার ভাগ্য গননার তীর বের করে তা দিয়ে গণনা করলাম। এবারও একই ফল পাওয়া গেলো: ‘তার কোন ক্ষতি হবে না।’ অথচ এরূপ সিদ্ধান্ত আমার কাম্য ছিলো না। আমি তবুও নাছোড়বান্দা।

কিছুতেই থামতে রাজী নই। আবার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে জোরে ঘোড়া হাঁকালাম। মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীরা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেলো এবং তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই মুহূর্তে ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। আমি ছিটকে পড়লাম। মনে মনে বললাম ব্যাপার কি! আবার তীর বের করে গণনা করলাম। এবারও অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্ত বেরুলো: ‘তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।’ এবারও আমি দমলাম না। তাদেরকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। আবার তাদেরকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দেখতে পাওয়া মাত্রই ঘোড়া আবার হোঁচট খেলে এবার ঘোড়ার সামনের পা দুটি মাটিতে দেবে গেলো এবং আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। পা দু’খানা টেনে বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে কু-লি পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম যে, মুহাম্মাদকে আমার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং সে অজেয়। অতঃপর আমি তাদেরকে ডাক দিয়ে বললাম, “আমি জুসামের পুত্র সুরকা। তোমরা একটু থামো, তোমাদের সাথে আমার কথা আছে। আল্লাহর শপথ, তোমাদের ব্যাপারে আমার সংশয় দূর হয়ে গিয়েছে। আমার দিক থেকে কোন অবাঞ্ছিত ব্যাবহার তোমরা পাবে না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে বললেন, “তাকে জিজ্ঞেস করো সে আমাদের কাছে কি চায়?” আমি বললাম, “আমাকে একটা বাণী লিখে দাও। সেই লেখা তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা প্রমাণস্বরূপ থাকবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে কিছু লিখে দিতে বললেন।

আবু বাক্র (রা) একটা হাড়ের ওপর (অথবা কাপড়ের টুকরায়  অথবা ভাঙ্গা মৃৎ পাত্রের টুকরায়) একটা বাণী লিখে আমার দিকে ছুড়ে মারলেন। আমি সেই টুকরাটা কুড়িয়ে নিলাম এবং আমার তীরের খাপের মধ্যে পুরে নিয়ে ফিরে আসলাম। এই ঘটনার কথা অতঃপর আর কারো কাছে ব্যক্ত করলাম না। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলেন এবং হুনাইন ও তায়েফ অভিযান সম্পন্ন করলেন, তখন আমি ঐ লেখাটা নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী জো’রানায় তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি আনসারদের একটি সেনাদলের কাছে উপস্থিত হলাম। তারা বর্শা দিয়ে আমাকে মৃদু খোঁচা দিতে দিতে বললো, “ভাগো, ভাগো। কি চাও এখানে?” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তখন উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। আমি যেন এই মুর্হূতেও দেখতে পাচ্ছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চর্বির মত সচ্ছ ও শুভ্র পাদু খানি জিনের পাদানিতে রেখে বসে আছেন। আমি সেই লিখিত টুকরাটি উঁচু করে দেখিয়ে বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটি সেই বস্তু যাতে আপনি একটি বাণী লিখে দিয়েছিলেন। আমি জুসামের পুত্র সুরাকা। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আজ ওয়াদা পালন ও সৌজন্য প্রদর্শনের দিন। কাছে আস।” আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করার মত একটি বিষয় মনে হলে তা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু এখন তা মনে সেই। আমি বললাম, “হে আল্লাহর  রাসূল, আমি নিজের উটের জন্য পানি দিয়ে চৌবাচ্চা ভরে রাখি। কিন্তু অন্যদের পথহারা উটগুলো এসে তার ওপর চড়াও হয় এবং পানি পান করে ফেলে। এভাবে ঐ সব উটকে পানি পান করাই তা হলে আমার সওয়াব হবে কি? তিনি বললেন, “ যে কোন প্রাণীর চাহিদা পূরণ করলেই সওয়াব হয়।” এরপর আমি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার সদকার প্রাণী পৌঁছিয়ে দিলাম।

ইবনে ইসহাক বলেন, পথপ্রদর্শক আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে এগিয়ে চললো। অতঃপর উপকূলবর্তী এলাকায় গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে উসফান অঞ্চলের নিম্নভূমি দিয়ে অগ্রসর হয়ে কুদাইদ অতিক্রম করার পর খাররার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর লেকফ্ ও মাদলাজা লেকফ্ অতিক্রম করে মাদলাজ মাহাজ নামক জায়গায় পৌঁছলো। সেখান থেকে মারজাহ মাহাজ, মারজাহ যিল গাদাওয়াইন তারপর বাতন যি কাশর ও জাদাজিদ হয়ে আজরাদ পৌঁছলো। তারপর মাদলাজা তিহিনের শত্রু এলাকা যা-সালাম অতিক্রম করে আবাবিদ ও তারপরে আল-ফাজ্জাহ অতিক্রম করলো।

ইবনে হিশাম বলেন, অতঃপর সে তাদেরকে নিয়ে আরজ নামক স্থাকে উপনীত হলো। তাখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস ইবনে হাজার নামক স্থানে উপনীত হলো। তখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস হাজার নামক এক ব্যক্তি ইবনুর রিদা নামক তার একটা উটে আরোহণ করিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। মাসউদ ইবনে হুনাইদা নামক তার এক ভৃত্যকেও সে তাঁর সাথে পাঠালো। এরপর পথপ্রদর্শক তাদের উভয়কে  নিয়ে আরজ ত্যাগ করলো। রুকুবার ডান দিক দিয়ে সানিয়াতুল আয়ের হয়ে বাতনু রীমে গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে সরাসরি কুবায় বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রের বসতিতে গিয়ে হাজির হলো। তখন ছিলো রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখের প্রখর রৌদ্র ঝলসানো দুপুর। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে এসে গিয়েছে।

 

কুবায় উপস্থিতি

আবদুর রহমান ইবনে উয়াইমি ইবনে সায়েদা স্বগোত্রীয় বিপুল সংখ্যাক সাহাবীর এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: আমরা যখন শুনতে পেলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে রওয়ানা হয়েছেন এবং যে কোন দিন মদীনায় পৌঁছতে পারেন বলে আমরা মনে করছিলাম, তখন থেকে প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর আমাদের এলাকার উন্মুক্ত প্রন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক্ষা করতাম। সূর্যের উত্তাপ অসহনীয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সরতাম না। যখন আর কোন ছায়া থাকতো না তখন ফিরে যেতাম। তখন ছিলো প্রচ- গরমের মৌসুম। যে দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যি সত্যি এসে পৌঁছলেন, প্রতিদিনের মত সেদিনও আমরা প্রান্তরে বসে অপেক্ষা করছিলাম। সূর্য মাথার ওপর আসার  কারণে যখন কোন ছায়া অবশিষ্ট থাকলো না তখন আমরা বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছলেন। একজন ইহুদী সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছিলো। আমরা কিভাবে তাঁর অপেক্ষায় থাকতাম তা সে দেখেছিলো। তাই সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, “হে কায়লার বংশধরগণ, [৪৬. এ কথা দ্বারা সমগ্র আনসারদেরকে বুঝায়। কায়লা তাদের এক খ্যাতনামা পিতামহী ছিলেন।]

তোমাদের সৌভাগ্যের ধন এসে গিয়েছে।”

আমরা একটা খেজুর গাছের ছায়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলাম। তাঁর প্রায় সমবয়সী আবু বাক্র (রা) তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আমাদের অধিকাংশ লোকই তখন পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেনি। তাঁকে দেখার জন্য বিরাট জনতার ভিড় জমলো অথচ কে আবু বাক্র আর কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কেউ বুঝতে পারছিলো না। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরের ওপর থেকে ছায়া সরে গেলো, তখন আবু বাক্র (রা) নিজের চাদর দিয়ে তাঁকে ছায়া দিতে লাগলেন। তখন আমরা সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনতে পারলাম।

ইবনে ইসহাক বলেন, অনেকের মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম কুলসূম ইবনে হিদামের, আবার কারো মতে সা’দ ইবনে খাইসামার মেহমান হন। যারা বলেন, তিনি কুলসূম ইবনে হিদামের মেহমান হয়েছিলেন, তাঁরা বলেন যে, তিনি কুলসূমের বাড়ীতে  থাকলেও লোকজনকে সাক্ষাত দানের জন্য অকৃতদার সা’দ ইবনে খাইসামার বাড়ীতে গিয়ে বসতেন। মুহাজিরদের ভেতরে যারা অবিবাহিত তাঁরাও ঐ বাড়ীতেই থাকতেন। আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) মেহমান হন হাবিব ইবনে ইসাফের, মতান্তরে খাবেজা ইবনে যায়িদের।

আলী ইবনে আবু তালিব (রা) মক্কায় তিন দিন অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গচ্ছিত আমানতসমূহ মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেন এবং তারপর হিজরাত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে যান। তিনিও কুলসূম ইবনে হিদামের মেহমান হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুবাতে ইবনে আওফ গোত্রে সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার এই চার দিন অবস্থান করেন। এই সময় তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

মদীনায় উপস্থিতি

অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি শুক্রবার কুবা ত্যাগ করেন। বনু সালেম ইবনে আওফের বস্তিতে গিয়ে তিনি জুমার নামায পড়েন। বাতনুল ওয়াদীর মসজিদে তিনি জুমার নামায আদায় করেন। বাতনুল ওয়াদীর আর এক নাম ওয়াদীয়ে রানুনা। এখানেই তিনি মদীনায় প্রথম জুমার নামায আদায় করলেন।

ইতবান ইবনে মালিক ও আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা সহ বনু সালেম ইবনে আওফের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তাতে খুশী হয়ে আমাদের এখানেই আপনি স্থায়ীভাবে বসবাস করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের উষ্ট্রীকে দেখিয়ে বললেন, “একে তোমরা পথ ছেড়ে দাও। আল্লাহর তরফ থেকে এটির ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার।” সবাই তাই করলো। উষ্ট্রী নিজের ইচ্ছামত চলতে লাগলো। বনু বায়াদা গোত্রের বস্তির নিকট যখন  হাজির হলো, তখন যিয়াদ ইবনে লাবীদ ও ফারওয়া ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু বায়াদা গোত্রের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের এখানে আসুন, আমাদের যে জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে তাঁর মধ্যে এসে বসবাস করুন।” তিনি বললেন, “এই উষ্ট্রীকে তার ইচ্ছামত যেতে দাও। কেননা ওকে যথাস্থানে আমাকে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ” উষ্ট্রীটি চলতে লাগলো। বনু সায়েদার বস্তিতে পৌঁছলে সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু সায়েদার একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারাও বনু বায়াদা ও বনু সালেমের মত একই অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু বায়াদা ও বনু সালেমকে যে কথা বলেছিলেন বনু সায়েদাকেও তাই বললেন। উষ্ট্রী অগ্রসর হতে লাগলো। যখন সেটি খাযরাজ গোত্রের বনু হারেস পরিবারের বাড়ীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলো, তখন সা’দ ইবনে রাবী, খবেজা ইবনে যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বনু হারেস পরিবারের আরো কিছু লোককে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারা তাদের পরিবারে অবস্থান করা ও তাদের জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ওপর আস্থা রাখার আমন্ত্রণ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা উষ্ট্রীকে যেতে দাও। কেননা এটি আমাকে উপযুক্ত  স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট।”  সকলে পথ ছেড়ে দিলো এবং উষ্ট্রীটা সামনের দিকে এগিয়ে চললো। চলতে চলতে উষ্ট্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামাদের পরিবার বনী আদী ইবনে নাজ্জারের বাড়ী অতিক্রম করলো। তখন বনী আদী ইবনে নাজ্জারের কতিপয় লোককে সাথে নিয়ে সালীত ইবনে কায়েস ও আবু সালীত উসাইরা ইবনে আবি খাবিজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনারা আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তার ওপর আস্থা রাখুন।” তিনি বললেন, “উষ্ট্রীকে তার খেয়াল খুশীমত যেতে দাও। কারণ ওকে উপযুক্ত স্থানে আমাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” এখানে উল্লেখ থাকে যে, বনী আদী ইবনে নাজ্জারেরই মেয়ে ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের মা সালামা বিনতে আমর।

বনু মালিক ইবনে নাজ্জারের বাসস্থানের কাছে এসে উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। সে যেখানে বসলো সেখানেই পরবর্তীকালে সমজিদে নববীর প্রবেশদ্বার তৈরী হয়। তৎকালে ঐ জায়গাটা ছিলো বনু নাজ্জারের দুটো ইয়াতীম শিশুর খেজুর শুকাবার জায়গা। শিশু দুটো হলো আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইল। তাদের লালন পালন করতো মায়য ইবনে আকরা। উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিঠ থেকে নামলেন না। স্থির হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষন পর উষ্ট্রীটি সামান্য কিছুদূর এগিয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও তার লাগাম শক্ত করে ধরে রাখলেন। অতঃপর উষ্ট্রী পিছনের দিকে ফিরে তাকালো এবং পুনরায় তাঁর প্রথম বিরতি স্থানে ফিরে এলা। সেখানে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। এবারে সে নড়াচড়া ও শব্দ করলো। তার বুক ও গলার নিম্নাংশ মাটিতে ঠেকিয়ে  দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উষ্ট্রীর পিঠ থেকে নামলেন। আবু আইয়ুব খালিদ ইবনে যায়িদ তাঁর  আসবাবপত্র নামিয়ে নিলো এবং নিজের ঘরে নিয়ে রাখলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের মেহমান হলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খেজুর শুকাবার জায়গাটা কার?” মায়ায ইবনে আকরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইলের। ওরা আমার পালিত ইয়াতীম। আমি তাদেরকে সম্মত করিয়ে নেবো। আপনি এখানে মসজিদ তৈরী করুন। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানে  মসজিদ নির্মাণে আদিষ্ট হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মসজিদ ও ঘরবাড়ী তৈরী হওয়া পর্যন্ত আবু আইয়ুবের বাড়ী অবস্থান করলেন। এই মসজিদ নির্মাণের কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই যোগদান করেন, যাতে মুসলমানরাও অংশগ্রহণ করার প্রেরণা পায়। ফলে মুহাজির ও আনসারগণ সকলেই ঐ কাজে পূর্ণ আগ্রহের সাথে অংশ নেন। এ সম্পর্কে জনৈক মুসলমান স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন,

“আমরা যদি বসে থাকি আর নবী কাজ করেন, তা হবে আমাদের চরম ভ্রষ্টতার পরিচায়ক। ” মসজিদ নির্মানের সময় মাঝে মাঝেই মুসলমানরা উদ্দীপনার সাথে কবিতা বলতেন। যেমন: “আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। ” আর তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,“আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।”

মসজিদ ও থাকার ঘর নির্মিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের বাড়ী থেকে নিজের ঘরে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।

আবু আইয়ুব বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমার বাড়ীতে মেহমান হলেন, তখন তিনি নিচের তলায় থাকতে লাগলেন আর আমি ও আমার স্ত্রী উপরে। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি উপরের তলায় থাকি আর আপনি নীচের তলায় থাকেন তা আমার কাছে নিতান্ত অপছন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। অতএব আপনি ওপরে থাকুন। আর আমরা নেমে এসে নীচে থাকি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, “আমাদের নীচে থাকাটা আমাদের জন্য এবং যারা আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে আসে তাদের জন্য অধিকতর সুবিদাজনক।”

এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের তলায় এবং আমরা ওপরের তলায় বাস করতে লাগলাম। একবার আমাদের একটা পানি ভর্তি কলসী ভেঙ্গে গেলো। আমাদের একটি মাত্র কম্বল ছিলো আর কোন লেপ বা শীতবস্ত্র ছিলোনা। অগত্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ে তা থেকে পানি পড়বে এবং তাতে তিনি কষ্ট পাবেন এই আশংকায় আমি ও আমার স্ত্রী ঐ কম্বলটা দিয়েই পানি মুছে ফেললাম।

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের জন্য খাবার তৈরী করে পাঠাতাম। তিনি ঐ খাবারের উদ্বৃত্তটুকু ফেরত পাঠালে আমি ও আমর স্ত্রী বরকতের আশায় তাঁর হাত লাগানো জায়গা থেকেই খেয়ে নিতাম। একদিন রাত্রে এইভাবে তাঁর জন্য খাবার পাঠালাম। সেই খাবারে আমরা কিছু পিঁয়াজ বা রসুনও দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফেরত পাঠালেন। আমরা ঐ খাবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত স্পর্শ করার কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। ফলে আমি ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার জন্য আমার বাপ-মা কুরবান হোক। আপনি খাবার ফেরত পাঠালেন অথচ তাতে আপনার হাতের স্পর্শের কোন চিহ্নই দেখলাম না। আপনি যখনই খাবার ফেরত  দিতেন, আমি ও আমার স্ত্রী বরকত লাভের জন্য সেই খাবার আপনার হাত লাগানোর জায়গা থেকে খেতাম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি খাবারের মধ্যে অমুক গাছের গন্ধ পেয়েছি। যেহেতু আমাকে অনেকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আলাপ করতে হয়, তাই আমি খাইনি। অবশ্য তোমরা ওটা খেতে পার।” এরপর আমরা ঐ খাবার খেয়ে নিলাম। অতঃপর আর কখনো আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পিঁয়াজ বা রসুন পাঠাইনি ইবনে ইসহাক বলেন এরপর মুহাজিররা হিজরাত করে একের পর এক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসতে লাগলেন। একমাত্র যারা বন্দী ছিলেন অথবা কঠোর নির্যাতনে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরাই মক্কায় থেকে  গেলেন। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার ছাড়া আর সব কয়টি পরিবারেরই অবস্থা এরূপ ছিলো যে, তারা তাদের পরিবারের সব লোক এবং ধন সম্পদ মদীনায় নিয়ে আসতে পারেনি। যে কয়টি পরিবার তাদের সকল সদস্যসহ হিজরাত করতে সক্ষম হয়েছিলো তারা হলো,বনু জুমাহ গোত্রের বনু মাযউন পরিবার, বনু উমাইয়ার মিত্র বনু জাহাশ ইবনে রিয়াব এবং বনু সা’দ ইবনে লাইসের বনু বুকাইর পরিবার যারা বনু কা’বের মিত্র ছিলো। হিজরাতের পর এদের ঘরবাড়ী একেবারেই জনশূন্য ও অর্গলবদ্ধ ছিল।

মদীনাতে ভাষণ দান ও চুক্তি সম্পাদন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় পৌঁছেন এবং পরবর্তী বছর সফর মাস পর্যন্ত মদীনাতেই অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁর জন্য মসজিদ ও ঘর তৈরী করা হয়। উপরন্তু মদীনার আনসারদের এই গোত্রটির (বনু মালিক ইবনে নাজ্জার) ইসলাম গ্রহণের ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একমাত্র খতমা, ওয়াকেদ, ওয়ায়েক ও উমাইয়া এই চারটি পরিবার ছাড়াও আওস গোত্রের একটি গোষ্ঠী পৌত্তলিকতা আঁকড়ে থাকে।

আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান আমর কাছে বর্ণনা করেছেন যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রথম যে ভাষণ দেন তাতে প্রথমে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করেন। তারপর নিম্নবর্ণিত কথাগুলো বলেন:

“হে জনম-লী, তোমরা আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয় কর। জেনে রেখো, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো সহসাই মারা যাবে, তার মেষপাল দেখার লোকও থাকবে না। অতঃপর তার রব জিজ্ঞেস করবেন। কোন দোভাষীও সেখানে থাকবে না। তিনি বললেন,‘তোমার কাছে কি আমার রাসূল আসেনি? আমি কি তোমাকে ধন সম্পদ অনুগ্রহ বিতরণ করিনি? তা থেকে তুমি কতটুকু আখিরাতের জন্য পাঠিয়েছো?’ তখন সে ডানে বামে তাকাবে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাবে না। সামনের দিকে তাকাবে। সেখানে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। যে ব্যক্তি নিজেকে  দোযখ থেকে রক্ষা করতে পারে, তার নিজেকে রক্ষা করতে যত্নবান হওয়া উচিত তা যদি একটা খোরমার অংশ দিয়েও হয়। যার এটুকু ক্ষমতা সেই তারও উচিত অন্তত ভালো কথা বলে নিজেকে  দোযখ থেকে রক্ষা করা। কেননা প্রতিটি ভালো কাজের পুরস্কার দশগুণ থেকে সাতশো গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।”

আরেকবার তিনি নিম্নরূপ ভাষণ দেন,

“সকল প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করি ও তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। আমরা তাঁর কাছে প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনা ও খারাপ কাজ থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করেন তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারে না। আর আল্লাহ যার জন্য গুমরাহীর অনুমোদন দান করেন তাকে কেউ সুপথগামী করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক ও লা শরীক। বস্তুত: আল্লাহর কিতাব হলো সর্বোত্তম কথা। যে ব্যক্তির অন্তরে তিনি কুরআনকে আকর্ষণীয় করেছেন এবং যাকে কুফরীতে নিমজ্জিত থাকার পর ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন এবং যে মানুষের কথা বাদ দিয়ে কুরআনকে গ্রহণ করেছে সে সফলকাম। কেননা কুরআনের চেয়ে সুন্দর ও অলংকারম-িত কথা আর নেই। আল্লাহ যা পছন্দ করেন তোমরা তাই পছন্দ কর। আল্লাহকে সমগ্র মন দিয়ে ভালবাস। আল্লাহর বাণী চর্চা ও তাঁর স্মরণে গাফিল হয়ো না এবং মনকে কঠিন হতে দিও না। কেননা আল্লাহ তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টি থেকেই কিছু সংখ্যককে বাছাই করেন। তার আমল থেকেও কিছু আমলকে মনোনীত বলে স্থির করেছেন। তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকেও কিছু সংখ্যাক বান্দাকে মনোনীত করেছেন। তিনি উত্তম কথা পছন্দ করেন। মানুষকে কিছু দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হালাল ও হারাম দুই-ই আছে। অতএব আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করো না। তাঁকে যথার্থভাবে ভয় কর। তোমরা যে সব কথা মুখে বলে থাক তার ভেতরে যে কথা উত্তম তাকে কার্যে পরিণত করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সম্যবাদী হও, আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা  গড়ে তোল। আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার লংঘিত হলে তিনি ক্রুদ্ধ হন। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একটি ঘোঘনাপত্র সম্পাদন করেন। এই দলীলের মাধ্যমে তিনি ইহুদীদের সাথে শাস্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও গ্রহণ করেন, তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও ধন সম্পদে তাদের মালিকানার স্বীকৃতি দেন এবং তদের সাথে কিছু শর্ত প্রদান ও গ্রহণ করেন। সে ঘোষণাপত্র নিম্নরূপ:

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মু’মিন মুসলমানগণ এবং পরবর্তীকালে যারা তাদের অনুসারী হয়ে তাদের সাথে শরীক হবে ও একসাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষ থেকে এ একটি ঘোষণাপত্র। সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তারা একটি স্বতস্ত্র উম্মাহ। কুরাইশদের মধ্য থেকে আগত মুহাজিররা তাদের ইসাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণœ থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অটুট থাকবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মু’মিনদের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার বিধান চালু থাকবে। বনু সায়েদাও তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া চলবে। বনু হারেস তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণœ থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তপণের ভিত্তিতে মুক্তি দেয়ার রীতি অব্যাহত থাকবে। আর বনু জুশামও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দী মুক্তির নীতি অক্ষুণœ থাকবে। বনু নাজ্জারও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের  মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে। বনু আমর ইবনে আওফ ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি অব্যাহত থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়া চলবে। বনু নাবীত ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের  মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে। বনু আওস ইসলাম গ্রহনকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়া চলবে। মু’মিনগণ তাদের মধ্যকার ঋণগ্রন্ত ও অধিক সন্তানধারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও মুক্তিপণদানে সঙ্গতভাবে আর্থিক সাহায্য করবে। কোন মু’মিন অন্য মু’মিনের মিত্রের বিরোধিতা করবে না। খোদাভীরু মু’মিনগণ তাদের মধ্যকার বিদ্রোহী, ঘোরতর নির্যাতক, অপরাধী, মুসলিম সমাজের স্বার্থের ক্ষতিকারক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যাবস্থা নেবে এবং এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে, চাই সে তাদের কারো ছেলেই হোক না কেন। কোন কাফিরের স্বার্থে এক মু’মিন অন্য মু’মিনকে হত্যা করবে না এবং কোন কাফিরকে কোন মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমের অধিকার সমানভাবে নিরাপদ। একজন নগণ্যতাম অমুসলিমকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে। মু’মিনরা পরস্পরের মিত্র হয়ে থাকবে, তবে অন্যদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। আর ইহুদীদের  মধ্য হতে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে, সে আমদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে। এ ধরনের লোকদের ওপর কোন যুলুম চলতে  দেয়া হবে না এবং তাদের ওপর কাউকে হামলা চালাতে সাহায্য করা হবে না। মু’মিনদের রক্ষাকবচ সবার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। ইসলামের স্বার্থে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেই যুদ্ধে মুসলমান কোন অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ছাড়া আপোষরফা করবে না। আমাদের মধ্য হতে প্রতিটা যোদ্ধাদল অন্য যোদ্ধাদলকে অনুসরণ করবে। মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে। খোদাভীরু মু’মিনগণ সর্বশ্রেষ্ঠ ও দৃঢ়তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মদীনার কোন মুশরিক কুরাইশ সম্প্রদায়ের কারো জানমালেরর্ কষক বা জিম্মাদার হতে পারবে না, আর কোন মু’মিনের ক্ষতি সাধনে তাকে প্রশ্রয় দেবে না। যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে মৃত্যুদ- অপরাধ না করা সত্ত্বেও হত্যা করবে এবং তা যথাযথভাবে প্রমাণিত হবে, তাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হবে। অবশ্য নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে অন্য কোন উপায়ে খুশী করে থাকলে প্রাণদ- হবে না। তবে সর্বাবস্থায় মুমিনরা সকলে ঐ মুসলিম হন্তার বিরুদ্ধে থাকবে এবং তার পক্ষপাতিত্ব করা কোন মুমিনের জন্য হালাল হবে না। এই ঘোষণাপত্রকে মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে অটুট বিশ্বাস রাখে এমন কোন মু’মিনের জন্য ইসলামী বিধানে উদ্ভট জিনিস সংযোজনকারীর সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এ ধরনের লোককে সাহায্য করবে কিংবা আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহর লা’নত এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর গজব নামবে। তার পক্ষে কোন সুপারিশ বা পণ গ্রহণ করা হবে না। আর তোমরা যখনই কোন বিষয়ে মতবিরেধে লিপ্ত হবে, তখন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হবে।

মু’মিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদের যুদ্ধের রসদ যোগানোতে অংশ নেবে। বনু আওফের ইহুদিরা মু’মিনদের সাথে একই উম্মাতভুক্ত বলে গণ্য হবে, তারা নিজে এবং তাদের মিত্ররাও। কিন্তু মুসলমানরা ও ইহুদীরা সে অবস্থায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। তবে যে ব্যক্তি যুলুম অত্যাচার ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হবে সে কেবল নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসই ডেকে আনবে। বনু নাজ্জারভ্কুত ইহুদীদের  অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান। অনুরূপভাবে বনু হারেস, বনু সায়েদা, বনু জুশাম, বনু আওস, বনু সা’লাবা ও বনু শতাইবার ইহুদীদের অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান। তবে যুলুম অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত ব্যাক্তি নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের কেবল ধ্বংসই সাধন করবে। সা’লাবার যাবতীয় বাহ্যিক ব্যাপার তাদের ভেতরকার ব্যাপারের সমপর্যায়ে তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতা যেন সাবাইকে পাপাচার থেকে রক্ষা করে। সা’লাবার মিত্রদের অধিকার তাদের নিজেদেরই সমান। ইহুদেিদর আভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। তাদের ভেতর থেকে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ছাড়া মদীনার বাইনে যেতে পারবে না। প্রত্যেকের জেনে রাখা উচিত যে, কোন প্রকারের তর্ক বা জেরা দ্বারা আগুন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসের বিনিময়েই হত্যা করলো। অবশ্য নিহত ব্যক্তি অপরাধী হলে আলাদা কথা। আল্লাহ তায়ালা এ ক্ষেত্রে অধিকতর মহানুভবতা পছন্দ করেন। ইহুদীদের ব্যয়ভার তারা নিজেরাই বহন করবে এবং মুসলামানদের ব্যয়ভারও তারা নিজেরাই বহন করবে। এই ঘোষণাপত্রকে যারা মেনে নিয়েছে তদের কর্তব্য, কোন শরীক যুদ্ধরত থাকলে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা এবং পরস্পরের মধ্যে হিতকামনা, সদুপদেশ ও মহানুভবতার সম্পর্ক থাকবে, কোন পাপা কাজে একজন আর একজনের সাথে শরীক  হবে না। নিজের মিত্রের ক্ষতি সাধন এক ভয়ংকর নজিরহীন অপরাধ। মাযলুমকে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য। মু’মিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে। [৪৭. অর্থাৎ আল্লাহ ও মুমিনগণের তাদের সহযোগিতা নিতে আপত্তি নেই।] এই ঘোষণাপত্রের শরীকদের জন্য ইয়াসরিবের অভ্যন্তরে ভাগ সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রতিবেশী যদি অপরাধী না হয় এবং ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত না থেকে থাকে তা হলে তার জান, মাল ও ইজ্জত নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের মতই পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী। কারো বাড়ীর ভেতরে বাড়ীর মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতে হবে। আল্লাহ সর্বাধিক সতর্কতা ও সততার সাথে এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন দেখতে আগ্রহী।[৪৮. উল্লেখযোগ্য যে, এই ঘোষণাপত্র যখন গ্রহণ করা হয় তখন জিজিয়া আরোপ করা হয়নি এবং মুসলমানগণ দুর্বল ছিল। সে সময় ইহুদীরা মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করলে যুদ্ধলব্ধ সম্পদে ইহুদীদের অংশ থাকতো। এই ঘোষণাপত্রে তাদের জন্য যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল।] জেনে রাখা দরকার যে, কুরাইশ ও তাদের সহযোগীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না। ঘেষনাপত্র গ্রহণকারীগণ মদীন আক্রমণকারীকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে। আর যখন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপনের আহ্বান জানানো হবে তখন তারা আহ্বানকারীর সাথে সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করবে। এ ধরনের কোন সন্ধি ও মৈত্রীর দিকে তাদেরকে যখন আহ্বান জানানো হবে তখন তা মেনে চলা মু’মিনদের জন্যও বাধ্যতামূলক হবে। তবে যে বা যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকরবে তখন তারা তাদের প্রাপ্য অংশ সেই পক্ষের নিকট থেকে নেবে যে পক্ষ তাদেরকে বাহিনীতে ভর্তি করেছিল। আওসে ইহুদীদের ও তাদের  মিত্রদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের মতই এবং ঘোষণাপত্র সম্পাদনকারীদের কাছ থেকে তারা পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লাভ করতে পাবে। কেউ সততার পথ অবলম্বন করলে তার পূর্বতন পাপাচার ক্ষমার চোখে দেখতে হবে। কেউ খারাপ কাজ করলে তা তার নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। আল্লাহ এই ঘোষণাপত্রের আনুগত্রের ব্যাপারে সর্বধিক সততা ও সত্যবাদিতা দেখতে চান। এই ঘোষণাপত্র কোন অত্যাচারী বা অপরাধীর জন্য রক্ষকবচ নয়। যুলুম কিংবা অপরাধে লিপ্ত না হলে য্দ্ধু থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা নিস্ক্রিয় বসে থাকা লোকও মদীনার চৌহদ্দির ভেতরে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি সততা ও খোদাভীতির পথে অবিচল থাকবে, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আশ্রয়দাতা ও সহায়ক থাকবেন।”

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আসসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন। তিনি যা বলেননি, তা তার ওপর আরোপ করা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। আমি জানতে পেরেছি যে, তিনি প্রতি দুইজনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি আলী ইবনে আবু তালিবের হাত ধরে বললেন, “এ হলো আমার ভাই।” এভাবে নবীদের সরদার, মুত্তাকীদের নেতা, বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের রাসূল, বিশ্বজাহানে যাঁর কোন জুড়ি নেই- তিনি আর আবু তালিব তনয় আলী (রা) নতুন করে ভ্রাত্র বন্ধনে আব্দধ হলেন। আর আল্লাহ ও রাসূলের সিংহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও  যায়িদ ইবনে হারেসার ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপিত হলো। উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার প্রক্কালে হামযা অছিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত্যু হলে যায়িদ ইবনে হারেসা তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। আবু তালিবের পুত্র জাফর তাইয়ার ও বনু সালামা বংশোদ্ভূত মুয়ায ইবনে জাবাল পরস্পর ভ্রাতৃ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উমার ইবনুল খাত্তাব ও ইতবান ইবনে মালিক পরস্পর ভাই হন। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ ও সা’দ ইবনে মুয়ায, আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও সা’দ ইবনে রাবী, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সালামা ইবনে সুলামা, উসমান ইবনে আফফান ও আওস ইবনে সাবিত, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ ও কা’ব ইবনে মালিক, সাঈদ ইবনে যায়িদ ও উবাই ইবনে কা’ব, মুসআব ইবনে উমাইর ও আবু আউয়ূব ভালিদ, আবু হুযাফা ইবনে উতবা ইবনে কা’ব, মাসআব ইবনে উমাইর ও আবু আইয়ূব খালিদ, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ও ‘উব্বাদ ইবনে বিশর, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এবং আবু যার গিফারী ও মুনযির ইবনে আমর পরস্পর ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করেন। এছাড়াও হাতিব ইবনে আবু বালতাআ ও উয়াইম ইবনে সায়েদা, সালমান ফারসী ও আবুদ্ দারদা এবং আবু বাক্রের (রা) আযাদকৃত দাস বিরার ও আবু রুয়াইহার মধ্যে ভ্রাতৃ বন্ধন স্থাপিত হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যে সব সাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন তাদের মধ্যে উল্লিখিত সাহাবীদের নামই আমি জানতে পেরেছি।

আযানের সূচনা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় তাঁর  মুহাজির ভাইদের সবাইকে কাছে পেয়ে এবং আনসারদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তখন ইসলাম একটি সুসংহত শক্তিতে  পরিণত হলো। সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত নামায কায়েমের ব্যবস্থা হলো, যাকাত ও রোযা ফরয হলো এবং অপরাধ দমনের আইন চালু হলো। হালাল হারামের বিধানও কার্যকর হলো। এভাবে ইসলাম তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আনসারদের এই গোত্রটিই ঈমান গ্রহণের পর এখানে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর মুসলমানগণ নামাযের সময় হলেই তাঁর কাছে আপনা থেকেই জমায়েত হতো, ডাকতে হতো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনস্থ করলেন, ইহুদীরা যেমন শিঙ্গা বাজিয়ে নামাযের জন্য লোক জমায়েত করে থাকে তিনিও তেমনি শিঙ্গা বাজানোর ব্যাবস্থা করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাপারটা তাঁর মনঃপূত না হওয়ায় বাদ দিলেন। এরপর ঘণ্টা বাজিয়ে মুসলমানদেরকে নামাযে ডাকায় বিষয়টি চিন্তা করলেন।

এইসব চিন্তাভাবনা চলাকালেই আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ কিভাবে মানুষকে ডেকে জমায়েত করতে হয় তা স্বপ্নে দেখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, অচেনা একজন লোক সবুজ কাপড় পড়ে এবং একটা ঘণ্টা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকটা আমার কাছ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি তাকে বললাম, ‘ওহে আল্লাহর বান্দা, তুমি কি এই ঘন্টাটা বিক্রি করবে?’ সে বললো, ‘ঘণ্টা দিয়ে তুমি কি করবে?’ আমি বললাম, ‘নামাযের জন্য লোকজনকে ডাকবো।’ সে বললো, ‘তোমাকে এর চেয়ে ভালো জিনিস শিখিয়ে দেবো?’ আমি বললাম, ‘কি জিনিস, বলতো।’ সে বললো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।” রাসূলুল্লাহকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, “ইনশাআল্লাহ এই স্বপ্ন সত্য। তুমি বিলালকে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়াও। তাকে কথাগুলো শিখিয়ে দাও। সে আযান দিক। কেননা ওর আওয়াজ তোমার আওয়াজের চেয়ে বড়।” বিলাল আযান দিলেন। উমার ঘরে বসে তা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চাদর টানতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ যে স্বপ্ন দেখেছে, আমিও সেই রকম দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।”

কতিপয় সাহাবীর রোগাক্রান্ত হওয়ার বিবরণ

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,

মদীনায় জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল সর্বাদিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এ থেকে ম্ক্তু রেখেছিলেন। আবু বাক্র ও তাঁর দুই ভৃত্য বিলাল ও ‘আমের ইবনে ফুহাইরা একই ঘরে বাস করতেন। তাঁরা সবাই জ্বরে আক্রান্ত হলেন। আমি তাঁদেরকে দেখতে গেলাম। তখনো পর্দার বিধান নাযিল হয়নি। আক্রান্তদের রোগযন্ত্রণা ছিল অবর্ণনীয়। আমি প্রথমে আবু বাকরের (রা) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বা, আপনার কেমন লাগছে?” তিনি একটা কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন,

“প্রত্যেক মানুষ তার আপনজনের কাছে অবস্থান করে। অথচ মৃত্যু তার অতি নিকটেই।”

আমি বুঝতে পারলাম এবং মনে মনে বললাম, “আব্বা নিশ্চয়ই প্রলাপ বকছেন। ’

অতঃপর আমের ইবনে ফুহাইরার কছে গিয়ে বললাম, “আমের, আপনার শরীর কেমন?”

তিনিও কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন, “মৃত্যুর সাদ উপভোগ করার আগেই মৃত্যু লাভ করেছি,

কাপুরুষের মৃত্যু তার মাথার ওপরেই থাকে,

প্রত্যেকটি লোক তার সর্বশক্তি দিয়ে জিহাদ করে, ষাঁড় যেমন শিং দিয়ে নিজের চামড়া বাঁচায়।”

আমি বুঝতে পারলাম, ‘আমের সংজ্ঞা হারিয়ে প্রলাপ বকছেন।

বিলালের জ্বরের প্রকোপ যখন বৃদ্ধি পেতো তিনি বাড়ীর উঠানে গিয়ে শুয়ে পড়তেন।

তারপর উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করে বলতেন,

“আহা! আমি কি একটি রাত ইযখের ও গোলাপের সাহচর্যে ফাখখে কাটাতে পারবো?

আর একটি দিনও কি আমি মাজান্নার [৪৯. ফাখ্খ: মক্কায় বাইরের একটি জায়গার নাম। উযখের : এক ধরনের সুগন্ধী উদ্ভিদের নাম। মাজান্না: মক্কার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত একটি বাজার।] জলাশয়ে নামবার সুযোগ পাবো? আর শামা ও তাফীল পর্বত দুটোকে কি আর একবারও দেখতে পাবো?[৫০. শামা ও তাফীর মক্কার দুটো পাহাড়ের নাম।]

তাঁদের কাছে যা শুনলাম তা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে জানালাম। আমি বললাম, “জ্বরের প্রচ-তায় তাঁরা সবাই প্রলাপ বকছেন। যা বলছেন তা তাঁরা নিজেরাই বুঝেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, আপনি মদীনাকে আমাদের কাছে মক্কার মত বা তার চেয়েও বেশী প্রিয় করে দিন। এখানে যেসব ফসল ফলে তাতে আমাদের জন্য বরকত দিন। এখান থেকে যাবতীয় রোগব্যাধি দূর করে মাহইয়ায়াতে [৫১. মাহইয়ায়া সিরিয়ার হাজীদের ইহরাম বাঁধার জায়াগা জুহফার অপর নাম।] নিয়ে যান।”

 

হিজরাতের তারিখ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় পৌঁছেন তখন সময় ছিল রৌদ্রতপ্ত দুপুরের প্রাক্কাল। তারিখ ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। এটা নবুওয়াতের ১৩ বছর পরের ঘটনা। অতঃপর রবিউল আউয়াল মাসের বাকী দিনগুলো এবং রবিউস সানী, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানী, রযন, শা’বান, রমাদান, শাওয়াল, যিলকাদ, যিলহাজ্ব ও মুহররমার মাস মদীনাতেই অবস্থান করেন। [অর্থাৎ হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পরে এই সময়ে মদীনার বাইরে কোথাও যাননি: - সম্পাদক]

প্রথম যুদ্ধাভিযান

মদীনা আগমনের ঠিক ১২ মাস পর সফর মাসে তিনি ওয়াদ্দান তথা আবওরা অভিযানে বের হন। কুরাইশ ও বনু দামরা ইবনে বাক্রের সন্ধানে তিনি ওয়াদ্দান পৌঁছেন। সেখানে বনু দামরা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। অতঃপর তিনি কোন রকম ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন না হয়েই নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। সফর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো ও রবিউল আউয়াল মাসের প্রথমাংশ সেখাইেন অতিবাহিত করেন।

উবাইদা ইবনে হারিসের নেতৃত্বে অভিযান

রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে এই যুদ্ধের ঝান্ডা বেঁধেছিলেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অবস্থানের এই সময়েই তিনি উবাইদা ইবনে হারিসকে ৬০ অথবা  ৮০ জন লোকের একটি অশ্বারোহী বাহিনীসহ পাঠালেন। তাঁরা সবাই ছিলেন মুহাজির। আসারদের কেউই তাঁদের সাথে ছিলেন না। দলটি সানিয়াতুল মুররায় নিম্নভূমিতে একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছিলে কুরাইশদের বিরাট একটি  দলের সম্মুখীন হলো। কিন্তু কোন য্দ্ধু হলো না। কেবল সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস  একটি তীর নিক্ষেপ করেন। এটাই ছিল ইসলামী বাহিনীর প্রথম তীর নিক্ষেপ। অতঃপর দলটি ফিরে এলো। মুসলমানরা ছিলো তখন বেশ উদ্দীপ্ত।

সমুদ্র উপকূলের দিকে হামযার নেতৃত্বে অভিযান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সময় হামযার (রা) নেতৃত্বে ৩০ জন ঘোরসওয়ার মুহাজিরের একটি দলকে ঈসের দিক দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। এ অভিযানেও কোন আনসারকে পাঠালেন না। এবার মুসলিম বাহিনী আবু জাহলেন নেতৃত্বাধীন মক্কার ৩০০ অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হলো। মাজদী আবনে আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় তখনও কোন সংঘর্ষ ঘটলো না। তিনি উভয় পক্ষকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ফলে উভয় বাহিনী পরস্পর থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে গেল। এবারও কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলো ন।

বুয়াত অভিযান

রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে বেরিয়ে বুয়াত নামক স্থানে পৌঁছলেন। এখানে গেলেন রিদ্ওয়ার দিক দিয়ে। কোন যুদ্ধ ছাড়াই তিনি মদীনায় ফিরে এলেন। সেখানে  তিনি রবিউস সানীর অবশিষ্ট দিনগুলো এবং জমাদিউল উলার প্রথম ভাগ অতিবাহিত করলেন। [৫২. এই অভিযানে যাওয়ার সময় সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউনকে (রা) মদীনায় দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বুয়াত : ইয়াম্বুর নিকটবর্তী জুহাইনা গোত্রের এলাকার একটি পর্বতের নাম। ]

উশাইরা অভিযান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় কুরইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেন।[ ৫৩. এই সময় আবু সালামা ইবনে আবুদর আসাদকে (রা) মদীনা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।]বনু দীনারের গিরিবর্ত দিয়ে অতঃপর হাবারের মরুভূমির মধ্য দিয়ে বাহিনী নিয়ে ইবনে আযহার উপত্যাকায় পৌঁছে একটি গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে নামায পড়লেন। এজন্য সেখানে একটি মসজিদ রয়েছে। সেখানে তাঁর জন্য খাবার তৈরী করা হলে তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। ঐ স্থানে ডেকচি রাখার রাখার জায়াগা এখনো সুস্পষ্ট। তাঁকে সেখানকার ‘মুশতারাব’ নামক ঝর্ণা থেকে পানি পান করানো হলো। অতঃপর তিনি খালায়েক নামক স্থানকে বাম দিকে রেখে যাত্রা শুরু করলেন এবং আবদুল্লাহ গিরিপথ অতিক্রম করলেন। অতঃপর বাম দিকে ঘুরে ইয়ালইয়াল নামক সমভূমিতে পৌঁছে ইয়ালইয়াল ও দাবুয়ার সংযোগস্থলে যাত্রাবিরতি করলেন এবং সেখানকার একটি কুয়া থেকে পানি পান করলেন। অতঃপর ফারশ মিলালের সমভূমির মধ্য দিয়ে চললেন। অবশেষে ইয়ামামের ছোট ছোট পার্বত্য অঞ্চলের পথ পেলেন। অতঃপর সেই পথ ধরে ইয়াম্বুর সমভূমি দিয়ে উশাইরাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। এখনে জামাদিউল উলা এবং জামাদিউস সানীর কয়েকটা দিন অবস্থান করলেন। এখানে বনু মাদলাজ এবং তার বনু দামরা গোত্রীয় মিত্রদেরকে বশ্যতা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরে এলেন।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। ৮ জন মুহাজিরের এই বাহিনী হিজাযের খাযযার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরলো।

সাফওয়ান অভিযান: প্রথম বদর অভিযান

উশাইরা অভিযান থেকে ফেরার দশ দিনের কম সময়ের মধ্যে একদিন কুরয ইবনে জাবের ফেহরী মদীনার আশপাশে ছেড়ে দেয়া উট ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষনাৎ তার পিছু ধাওয়া করলেন। [৫৪. এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারিসাকে মদীনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।] তিনি বদর প্রন্তরের একপাশে সাফওয়ান সামক একটি উপত্যকায় পৌঁছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরয ইবনে জাবেরের নাগার পেলেন না। এ ঘটনাকে প্রথম বদর অভিযান বলা হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন এবং জামাদিউস সানী মাসের বাকী দিনগুলো এবং রযব ও শা’বান মাস মদীনাতেই কাটালেন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রযব মাসে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে প্রথম বদর অভিযান থেকে প্রত্যাগত মুহাজিরদের ৮ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী পাঠালেন। তাদের মধ্যে কোন আনসারকে অন্তর্ভুক্ত করলেন না। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশকে একটি পত্র দিয়ে বললেন যে, দুইদিন পথ চলার পর এই পত্রখানা খুলে পড়বে, তার আগে নয়। চিঠি পড়ার পর তাতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে অনুসারে কাজ করবে এবং সঙ্গীদের কারো উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেবে না।

দুইদিন ধরে পথ চলার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা ছিল, “আমার এই চিঠি যখন তুমি পড়বে, তখুনি রওনা হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে গিয়ে যাত্রাবিরতি করবে। সেখানে কুরাইশদের জন্য ওত পেতে থাকবে এবং কোন তথ্য পেলে আমাকে জানাবে।”

আবুদল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠিখানা পড়েই বললেন,“আমি মেনে নিলাম ও অনুগত রইলাম। ” অতঃপর সঙ্গীদেরকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নাখলায় গিয়ে কুরাইশদের জন্য ওৎ পেতে থাকতে বলেছেন এবং কোন খবর জানলে তা তাঁকে জানতে বলেছেন। আর এ ব্যাপারে তোমাদের কারো ওপর বাধ্যতামূলক কোন দায়িত্ব চাপাতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি শাহাদাত লাভে ইচ্ছুক থাকে তবে সে যেন যায়। আর যে তা চায় না, সে যেন ফিরে যায়। তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন করবো।” একথা বলার পর আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সঙ্গে সবাই রওয়ানা হয়ে গেল। কেউই ফিরে গেল না। তিনি হিজাযে প্রবেশ করলেন। বাহরান নামক স্থানে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গায ওয়ান তাদের উট হারিয়ে ফেললেন। তাঁরা দু’জন ঐ উটকে অনুসরন করে চলছিলেন। ফলে ঐ উট খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে তাঁরা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ থেকে পিছিয়ে পড়লেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর সঙ্গীগণ যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চলতে চলতে তাঁরা নাখলাতে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। এই সময় তাঁদের নিকট দিয়ে কুরাইশদের একটি কাফিলা কিসমিস চামড়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই সাথে কুরাইশদের অন্যান্য পণ্যদ্রব্যও ছিল। এই দলের মধ্যে আমর ইবনে হাদরামী, উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও তার ভাই নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকাম ইবনে কাইসান ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের দল তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে গেলো কেননা তারা তাদের খুব নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলো। উক্কাশা ইবনে মুহসান ওদের কাছে চলে গেলেন। তাঁর মাথা মু-ানো ছিল। তাঁকে দেখে কুরাইশরা আশ্বস্ত হলো। বললো, “এরা স্থানীয় বাসিন্দা। এদের দিক থেকে কোন ভয় নেই।” ওদিকে মুসলমানগণ কুরাইশদের ব্যাপারে পরামর্শে বসলেন। ঐদিন ছির রযব মাসের শেষ দিন। সকলে মত প্রকাশ করলেন যে, আজকে কুরাইশদের এই কাফিলাকে ছেড়ে দিরে এরপরই তারা হারাম শরীফের এলাকায় প্রবেশ করবে এবং আমাদের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। পক্ষান্তরে আজ যদি তাদেরকে হত্যা করা হয় তাহলে নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর দোষে দোষী হতে হবে। তাই তারা দ্বিাধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং কুরাইশ কাফিলার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে  সংকোচ বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে একমত হলেন যে, যাকে যাবে পারা যায় হত্যা করতে হবে এবং তাদের যার কাছে যা আছে তা নিয়ে নিতে হবে। ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ তামিমী আমর ইবনে হাদরামীকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। আর উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও হাকাম ইবনে কাইসানকে বন্দী করলেন। নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে আত্মরক্ষা করলো। তাকে কিছুতেই ধরা সম্ভব হলো না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ কাফিলার অবশিষ্ট লোক ও বন্দী দুজনকে নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি। ” অতঃপর তিনি কাফিলা ও বন্দীদেরকে আটকে রাখলেন এবং তাদের সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তিতে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ সবার সামনে খাটো ও লা জওয়াব হয়ে গেলেন। তাঁর দলের লোকেরা ভাবলেন তদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। মুসলমানরা এ কাজের জন্য তাদেরকে তিরস্কার করলেন। ওদিকে কুরাইশরা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সহচররা নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লংঘন করেছে। তারা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাত ঘটিয়েছে, অন্যের সম্পদ হস্তগত করেছে এবং লোকজনকে বন্দী করেছে।” মক্কাতে যে কয়জন মুসলমান তখনো ছিলেন তাদের একজন জবাব দিলেন, “মুসলমানরা যা করেছে, শা’বান মাসে করেছে। [একথা বলার পেছনে যুক্তি ছিলো যে, রজব মাসের শেষ তারিখের সূর্যাস্তের পর শা’বান মাস শুরু হয়েছিলো।-সম্পাদক]

এই প্রচারনা অভিযান যখন ব্যাপক আকার ধারণ করলো তখন আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এই আয়াত নাযিল করলেন:

[আরবী *************]

“তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বল: এ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অন্যায়। তবে আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় হলো

আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখা,কুফরী করা, মসজিদে হারামে যেতে বাধা দেয় এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা। বস্তুতঃনির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বিপথগামী করা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ। তারা অবিরতভাবে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, যাতে করে সাধ্যে কুলালে তোমাদেরকে ধর্মান্তরিত করতে পারে।” (আল বাকারাহ)

অর্থাৎ তোমরা যদি হারাম মাসে হর্তাকা- করেও থাক, তবে তারা তো আল্লাহর পথে চলতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছে, সেইসাথে কুফরীও করেছে এবং মসজিদে হারামে তোমাদেরকে যেতে দেয়নি। আর তোমরা মসজিদুল হারামের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তোমাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তোমাদের একজন কাফিরকে হত্যা করার চাইতে মারাত্মক অপরাধ। আর তারা যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করতো এবং কুফরী ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতো, সেটা হত্যার চেয়েও জঘন্য কাজ। আর এই জঘন্যতম অন্যায় কাজ তারা তোমাদের সাথে অবিরতভাবেই করে চলেছে এবং তা থেকে ফিরছে না বা তাওবাহ করছে না।

কুরআনে যখন এই পথনির্দেশ এলো এবং আল্লাহ মুসলমানদের ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আটক কাফিলা ও বন্দীদেরকে সরকারীভাবে গ্রহণ করলেন। কুরাইশরা তাঁর কাছে উসমান ও হাকামকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবাবে  এদেরকে জানালেন, “আমাদের দুইজন লোক সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাযওয়ান ফিরে না আসা পর্যন্ত বন্দীদের মুক্তি দেবো না। কেননা তোমাদের দ্বারা ওদের জীবন বিপন্ন হবার আশংকা রয়েছে।”অচিরেই সা’দ ও উতবা ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দিলেন। তবে বন্দীদ্বয়ের মধ্যে হাকাম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করেন ও সাচ্চা মুসলিমে পরিণত হন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই থেকে যান। পরে বীরে মাউনার ঘটনায় তিনি শহীদ হন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যায় এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।

কিবলা পরিবর্তন

বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের আঠার মাস পর শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়।

বদরের যুদ্ধ

এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি বিরাট কাফিলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সে কাফিলায় কুরাইশদের বহু সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সম্ভার রয়েছে। কাফিলায় মাখরামা ইবনে নওফেল ও আমর ইবনুল ‘আসসহ কুরাইশ বংশোদ্ভূত ৩০ অথবা ৪০ জন লোক রয়েছে। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা কুরাইশদের কাফিলা। এতে প্রচুর ধন-সম্পদ রয়েছে। তোমরা ওদিকে যাও। হয়তো আল্লাহ ঐসব সম্পদ তোমাদের হস্তগত করে দেবেন।” মুসলমানরা কাফিলাকে ধরার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউবা ত্বরিৎ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেউবা একটু শৈথিল্য দেখালেন এবং দেরী করলেন। কারণ তারা ধারণা করতে পারেননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন।

হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। পথচারী যার সাথেই দেখা হলো, তাকে সে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। কেননা সে মুসলমানদের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রন্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত কোন কোন পথচারী তাকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিল যে, মুহাম্মাদ তাঁর সহচরদেরকে তোমার ও তোমার কাফিলার ওপর আক্রমণ চালাতে চলেছে। সুতরাং আবু সুফিয়ান সাবধান হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীকে তৎক্ষণাৎ মজুরীর বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দিল। তাকে বলে দিল, সে যেন কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ নিরাপদে নিয়ে আসার জন্য কিছু অস্ত্রসজ্জিত লোক পাঠাতে অনুরোধ করে এবং মুহাম্মাদ যে তার দলবলসহ তাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত তা তাদেরকে জানায়। দামদাম খুব দ্রুত মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।

দামদাম মক্কা পৌঁছার তিন দিন আগে আবদুল মুত্তালিব তনয়া আতিকা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভাই আব্বাসকে ব্যাপারটা জানালেন। বললেন, “ভাই, আজ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমার সম্প্রদায়ের ওপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়বে। কাজেই আমি তোমাকে যা বলছি কাউকে বলো না।”

আব্বাস বললেন, “তুমি স্বপ্নে কী দেখেছো?”

আতিকা বললেন, “দেখলাম, একজন সওয়ার মক্কার পার্শ্ববর্তী সমতল ভুমিতে এসে নামলো। অতঃপর উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘হে কুরাইশগণ, তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে যাও, হুঁশিয়ার!” অতঃপর তার উট তাকে নিয়ে আবু কুবাইস পর্বত শিখরে আরোহণ করলো। অতঃপর আবার চিৎকার করে একই কথা ঘোষণা করলো। তারপর সেখান থেকে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিল। পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পড়তেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল এবং তার কোন না কোন টুকরো মক্কার প্রত্যেক বাড়ীতে গিয়ে পড়লো।”

আব্বাস বললেন, “এটা গুরুতর স্বপ্ন। তুমি কাউকে এটা বলো না। সম্পূর্ণ গোপন রেখো।”

এরপর আব্বাস বাইরে বেরুতেই তার বন্ধু ওয়ালীদ ইবনে রারিয়ার সাথে তার দেখা হলো। তিনি তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালেন এবং তাকে সাবধান করে দিলেন যেন কাউকে না বলে। ওয়ালীদ ব্যাপারটা তার পিতা উতবাকে জানালো। এভাবে কথাটা সমগ্র মক্কায় রটে গেল। কুরাইশরা সকল মহফিল ও বৈঠকে এ নিয়ে আলাপ করতে লাগলো।

আব্বাস বলেন, আমি পরদিন কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে গেলাম। আবু জাহ্ল সেখানে কুরাইশ একদল লোকের সাথে আতিকার স্বপ্ন নিয়ে আলাপ করছিলো। আবু জাহ্ল আমাকে দেখেই বললো, “আব্বাস, তাওয়াফ শেষ করে এ দিকে এসো।” তাওয়াফ শেষে আমি তাদের কাছে  গিয়ে বসলাম। আবু জাহ্ল আমাকে বললো, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, এই মহিলা- নবী কবে তোমাদেরকে এসব কথা বলেছে?”

আমি বললাম, “কিসের কথা?”

আবু জাহ্ল, “আতিকার দেখা সেই স্বপ্নের কথা।”

আমি বললাম, “সে কী স্বপ্ন দেখেছে?”

আবু জাহ্ল, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, তোমাদের পুরুষরা নবুওয়াতী করতে করতে অবশেষে তোমাদের মহিলারাও দেখছি নবুওয়াতী শুরু করে দিল। আতিকা নাকি স্বপ্নে দেখেছে, কে বলেছে, ‘তিন দিনের মধ্যে তৈরী হয়ে যাও।’ আমরা তোমাদের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করবো। যদি কথা সত্য হয় তাহলে তো যা হবার হবে। আর যদি তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও কিছু না ঘটে তাহলে আমরা  তোমাদের সম্পর্কে লিখিত ঘোষণা জারী করে দেব যে, আরবে তোমাদের মত মিথ্যাবাদী পরিবার আর নেই।”

আব্বাস বলেন, আবু জাহলের উক্তিতে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হলাম। বললাম: আতিকা কোন স্বপ্ন দেখেনি। অতঃপর যার যার কাজে চলে গেলাম। বিকালে আবদুল মুত্তালিব পরিবারের প্রত্যেক মহিলা এক এক করে আমার কাছে এসে বললো, “এই পাটিষ্ঠ খবিসটাকে তোমরা কেন এত সহ্য করছো? সে এতদিন আমাদের পুরুষদের যা ইচ্ছে  বলেছে। এখন সে আমাদের নারীদেরকেও যা ইচ্ছে বলতে শুরু করেছে। তুমি এসব শুনছো, অথচ তোমার কোন সম্ভ্রমবোধ জাগছে না।” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করছি। আমি বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তবে ওকে আমি দেখে নেব। আর একবার বলুক, তখন তোমাদের হয়ে যা করা দরকার, তা আমি করবোই।”

আতিকার স্বপ্নের তৃতীয় দিন পর আমি সেখানে গেলাম। আমি তখন রাগে ও ক্ষোভে ফুঁসছি। ভাবছিলাম, বেটার সাথে যে আচরণ করা দরকার ছিল, ত করতে পারিনি। আবার যদি সুযোগ পাই, তবে যা করতে পারিনি তা এবার করে দেখাবো। আমি মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে তাকে দেখতে পেলাম। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম যে, সেদিন যেসব কথা বলেছে, তার কিছু অংশের পুনরাবৃত্তি করলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। আবু জাহল ছিল হালকা পাতলা গড়নের, কিন্তু তার চাহনি ছির তীক্ষè, ভাষা ছিল তীব্র ধারালো। সহসা সে দ্রুত মসজিদের দরজায় দিকে এগিয়ে এলো। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর অভিশাপ হোক ওর ওপর! ওর কী হয়েছে? ওর সমগ্র সত্তা এমন ভীতসন্ত্রস্ত কেন? তবে কি আমার ভর্ৎসনার ভয়ে? সহসা বুঝতে পারলাম, সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীর হাঁকডাক শুনেছে যা আমি তখনো শুনিনি। দামদাম মক্কার মরুভূমিতে এসে তার উটের ওপর বসেই চিৎকার করে বলছে, “হে কুরাইশগণ, মহাবিপদ! মহাবিপদ! তোমাদের ধন সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে। মুহাম্মাদ তার সহচরদেরকে ঔ সম্পদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তোমরা তো আর রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্য করতে অগ্রসর হও! সাহায্য করতে অগ্রসর হও!” গিফারী চিৎকার করে এ কথা বলার আগেই উটের নাক কেটে, হাওদা উল্টিয়ে দিয়ে এবং নিজের জামা ছিঁড়ে একটা তেলেসমাতি কা- করে ফেলেছে।

এই ভয়াবহ ঘটনার কারণে আমরা কেউ কারো প্রতি মনোযোগী হতে পারলাম না। লোকজন অতি দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেলো। তারা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কি মনে করেছে যে, আমরা ইবনুল হাদরামীর কাফিলার মত অসহায়? [৫৫. অর্থাৎ আমর ইবনুল হাদরামী, যাকে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের বাহিনী হত্যা করে। ]কক্ষনো না, এবার তারা অবশ্যই অন্য রকম অভিজ্ঞতা লাভ করবে। সেদিন তারা মাত্র দুইজনের মুকাবিলায় এমন ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছে। তাও এমন ধরনের লোক যে, হয় যুদ্ধের ময়দান থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, নতুবা নিজের জায়গায় অন্যকে পাঠাতে চায়। আর আজ গোটা কুরাইশ গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। কুরাইশদের কোন গণ্য মান্য লোক আজ বাদ পড়েনি। কেবলমাত্র আবু লাহাব বাদ পড়েছে এবং তার জায়গায় আসী ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাকে পাঠিয়েছে।” এই ব্যক্তির নিকট আবু লাহাম চার হাজার দিরহামের পাওনাদর ছিল। সে দারিদ্রের জন্য ঐ ঋণ শোধ করতে পারেনি। সেজন্য এ পাওনা টাকার বিনিময়ে সে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেয় তার স্থলাভিষিক্ত করে।

 উমাইয়া ইবনে খালাফও যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ছিল স্থূলদেহী রাশভারী এক বৃদ্ধ। উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তার কাছে এলো। উমাইয়া তখন মসজিদুল হারামে লোকজনের সাথে বসে ছিল। সে তাকে চন্দন কাঠের তৈরী একটা সুগন্ধি দিয়ে বললো, “নাও, তুমি এটি দিয়ে সুবাসিত হও। কারণ তুমি তো মেয়ে মানুষ।” উমাইয়া বললো, “দূর হ’ এখান থেকে! আল্লাহ তোকে কুৎসিত করে দিক।” লজ্জা পেয়ে বুড়ো উমাইয়া অতঃপর যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।

প্রস্তুতি নেয়া সম্পন্ন হলো এবং রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য সবাই বদ্ধ পরিকর হলো। তখন তাদের সাতে বনু বাক্র ইবনে আবদ্ মানাতে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার কথা মনে করে তাঁরা বললো, “আমাদের আশংকা হয় যে, ওরা পেছন দিক থেকে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে।” এ আশংকা তাদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত করে তুলছিল। তখন ইবলিস সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশআম আল মুদলাজীর আকৃতি ধারণ করে তাদে কাছে হাজির হলো। সে বললো, “আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক থাকছি যেন কিনানা গোত্র তোমাদের ওপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে।” এ আশ্বাস লাভ করার পর তারা দ্রুতবেগে মক্কা ত্যাগ করলো।

ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তখন রমযান মাসের কয়েকটা দিন অতিবাহিত হয়েছে। তিনি আমর ইবনে উম্মে মাকতুমকে নামায পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। মুসআব ইবনে উমাইরের হাতে সাদা পতাকা তুলে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ছিল দুটো কালো পতাকা। তার একটি ছিল আবু তালিব তনয় আলীর নিকট এবং এটির নাম ছিল ঈগল। অপরটি ছিল জনৈক আনসারের নিকট। ঐদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের কাছে সর্বমোট ৭০ টি উট ছিল। তারা পালাক্রমে ঐগুলোতে আরোহণ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আলী ইবনে আবু তালিব ও মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ একটি উটের পিঠে পালাক্রমে আরোহণ করতে লাগলেন। আর হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই ভৃত্য যায়িদ ইবনে হারিসা ও আবু কাবশা আরোহণ করতে লাগলেন আরেকটিতে। আরেকটিতে চড়তে লাগলেন আবু বাক্র, উমার ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে মক্কার পথ ধরে চলতে লাগলেন এবং মদীনার বাইরের গিরি প্রবেশপথে পৌঁছিলেন। অতঃপর সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আকীক, যুল হুলায়ফা, আওলাতুল জায়েশ, তুরবাম, মালাল, মারইনের গামীছূর হাম্মাম, ইয়ামামের কংকরময় ভূমিতে সাইয়ালা, ফাজ্জুর রাওহা এবং সেখান থেকে শানুকায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে আরকাজ যারিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছলে এক বেদুইনের সাথে দেখা হলো। বেদুইনকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন লোকজন দেখেছে কিনা। কিন্তু তার কাছে কোন খবর পাওয়া গেলো না। সাহাবারা ঐ লোকটাকে বললো, ‘আল্লাহর রাসূলকে সালাম দাও।’ সে বললো, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল আছে নাকি?’ সবাই বললো, হ্যাঁ।’ অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তুমি যদি আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকে তাহলে বলতো আমার এই উষ্ট্রীর পেটে কি আছে?” সালামা ইবেন সুলামা ইবনে ওয়াকশ তাকে বললো, “তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করো না। আমার কাছে এসো, আমি বলছি ওর পেটে কি আছে। তুমি ঐ উষ্ট্রীটার সাথে সঙ্গম করেছিলে। তাই ওর পেটে তোমার ঔরসের একটা ছাগলের বাচ্চা রয়েছে।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে সালামাকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর। লোকটার সাথে তুমি অশ্লীল কথা বলছো?” অতঃপর অন্যদিকে মনোযোগ দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাওহার ‘সাজসাজ্’ নামক কূপের নিকট গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। সেখান থেকে আবার রওয়ানা হলেন। কিছুদূর গিয়ে মক্কার পথ ত্যাগ করে ডান দিকের পথ ধরে নাজিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর গন্তব্যন্থল ছিল বদর। বদরের নিকটবর্তী একটি জায়গায় পৌঁছে তিনি রুহকান নামক একটি উপত্যাকা পাড়ি দিলেন। এই উপত্যকাটি নাজিরা ও সাফরা গিরিপথের মধ্যস্থলে অবস্থিত। সেখান থেকে তিনি গিরিপথে গিয়ে উপনীত হলেন। অতঃপর সেখান থেকে নেমে সাফরার নিকট পৌঁছলেন। এখানে পৌঁছে তিনি বাসবাস ইবনে আমর জুহানী ও আদী ইবনে আবু জাগবা জাহানীকে বদর এলাকায় পাঠালেন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও অন্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ঐ দু’জনকে আগে পাঠিয়ে দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন।

পথিমধ্যেই তিনি জানতে পারলেন ও, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফিলাকে রক্ষা করার জন্য সদলবলে মক্কা থেকে যাত্রা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খবর সাহাবাদের জানালেন এবং এ মুহূর্তে তাদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে সকলের সাথে পরামর্শ করলেন। সর্বপ্রথম আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) উঠে দাঁড়ালেন ও তাঁর মতামাত অতি চমৎকারভাকে ব্যক্ত করলেন। এরপর মিকদাদ ইবনে আমর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আপনাকে যেদিকে বলতে বলেছেন সেদিকে এগিয়ে চলুন। আল্লাহর কসম, বনী ইসরাঈল যেমন মুসাকে (আ) বলেছে, ‘তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে রইলাম’Ñ আমরা সে রকম কথা আপনাকে বলবো না। আমরা বলছি, আপনি ও আপনার রব গিয়ে লড়াই করুন, আমরাও আপনার ও আপনার রবের সহযোগী হয়ে লড়াইতে শরীক আছি। সেই মহান সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সুদূর ইয়ামানের বারকুল গিমাদেও যান, তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে সেখানে যাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকদাদকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সম্বোধন করলেন, “তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও।” আনসারদের এত গুরুত্বদানের কারণ ছিল এই যে, তারা ছিল মুসলমানদের সহায়। তারা যখন আকাবাতে বাইয়াত করেছিলো তখন বলেছিলো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যত দিন আমাদের আবাসভূমিতে না যাবেন ততদিন আমরা আপনার দায়িত্ব নিতে অপরাগ। যখন আপনি আমাদের কাছে যাবেন তখন আমাদের দায়িত্বে থাকবেন। আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদেরকে যেভাবে সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করি ঠিক সেইভাবে আপনাকে রক্ষা করবো।” এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশংকা করেছিলেন যে, আনসাররা হয়তো মনে করতে পারে যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল তাদের ওপর তাঁর সাহায্য করার ও তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায়। আনসাররা এরূপ ভেবে থাকতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের আবাসভূমির বাইরে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে যেতে চাইলে তাঁর সাথে যাওয়া তাদের দায়িত্ব নয়। তাই তিনি যখন আনসারদেরকে সম্বোধান করলেন তখন সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বোধ হয় আমাদের মতামত জানতে চাচ্ছেন।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ।” সা’দ বললেন, “আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা পরম সত্য। আর এই প্রত্যয়ের ভিতরেই আমরা আপনার কাছে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, আমরা আপনার নির্দেশ মানবো ও আনুগত্য করবো। হে আল্লাহর রাসূল, তাই আপনি যা ভাল মনে করেন, করুন। আমরা আপনার সাথে আছি। সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে মহাসত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, সামনের এই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আপনি যদি তার অথৈ পানিতে নামেন, আমরাও আপনার সাথে নামবো। আমাদের একটি লোকও আপনাকে ছেড়ে পেছনে থাকবে না। আগামীকাল যদি আপনি আমাদের সাতে নিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হতে চান, ততেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যুদ্ধে ধৈর্যশীল এবং শত্রুর মুকাবিলায় সংকল্পে অবিচল। আশা করি, আল্লাহ আপনাকে আমাদের এমন তৎপরতা দেখবার সুযোগ দেবেন, যাতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করে আমাদের নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের বক্তব্য শুনে খুশী হলেন এবং খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। অতঃপর বরলেন, “তোমরা বেরিয়ে পড়। আল্লাহ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দুই কাফিলার যে কোন একটি আমাদের হাতে পরাভূত হবো।[ ৫৬.একটি হলো আবু সুফিয়ান ও আমর ইবনুর আ’স সহ বাণিজ্যিক কাফিলা, অপরটি আবু জাহলের নেতৃত্বে আগত সমর সজ্জায় সজ্জিত সুবিশাল বাহিনী।] আল্লাহর কসম, আমি যেন এখনই কুরাইশদের শোচনীয় মৃত্যু ঘটতে দেখছি।”

অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর প্রান্তরের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলেন। তারপর তিনি নিজে আর একজন সাহাবাকে [৫৭. ইনি আবু বাক্র সিদ্দীক রাদিয়ল্লাহু আনহু।]নিয়ে টহল দিতে বেরুলেন। কিছুদূর গিয়ে জনৈক বৃদ্দ আরবের সাক্ষাত পেলেন। তিনি কুরাইশদের কথা কিছু জানেন কিনা এবং মাহাম্মাদ ও তাঁর সহচরদের সম্পর্কে কোন খবর শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধ বললেন, “তোমরা কারা বল, তা না হলে বলবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমরা যা জানতে চেয়েছি, সেটা আগে বল। তারপর আমরা আমাদের পরিচয় দেবো।” বৃদ্ধ বললেন, “শুনেছি, মুহাম্মাদ ও তাঁর সহচরগণ অমুক দিন যাত্র শুরু করেছেন। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার এখন অমুক জায়গায় থাকার কথা। আর কুরাইশদের সম্পর্কে শুনেছি, তারা অমুক দিন রওয়ানা দিয়েছে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার আজ অমুক জায়গায় এসে পৌঁছার কথা।” উভয় দল সত্যি যেখানে উপস্থিত হয়েছে, বৃদ্ধ সেই স্থানের  কথাই বললেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কোথা থেকে এসেছো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পানি থেকে। ”বৃদ্ধ বললেন, “পানি থেকে’ অর্থ কি?” ইরাকের পানি থেকে নাকি?

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কছে এলেন রাত্রে তিনি আলী ইবনে আবু তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস সহ একদল সাহাবীকে কুরাইশদের খোঁজ খবর নিতে বদর প্রান্তরের পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে পাঠালেন। সেখানে তাঁরা কুরাইশদের এক পাল পানি পানরত উট দেখতে পেলেন এবং তার মধ্যে বনু হাজ্জাজ গোত্রের ভৃত্য আসলাম ও বনু আস ইবনে সাঈদের ভৃত্য আরীদ আবু ইয়াসারের সাক্ষাত পেলেন। তাঁরা ঐ ভৃত্যদ্বয়কে সাথে নিয়ে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ছিলেন। তাদেরকে জিজ্ঞস করা হলো, “তোমরা কারা?” তারা বললো, “আমরা কুরাইশদের পানি বহনকারী। তাদের জন্য খাবার পানি নিতে আমাদেররকে পাঠিয়েছে।” মুসলমানগণ তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। তাদের ধারণা ছিল, ওরা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর তাদেরকে প্রহার করা হলো পিটুনীর চোটে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে, তারা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর মুসলমানগণ তাদেরকে ছেড়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করে বললেন, “ওরা যখন  সত্য বললো তখন তখন ওদের তোমরা প্রহার করলে। আর যখন মিথ্যা বললো তখন ছেড়ে দিলে। এটা তোমাদের কেমন কাজ? ওরা ঠিকই বরেছে। ওরা কুরাইশদের লোক। তোমরা আমাকে কুরাইশদের খবর বল।” তারা বললো,“আল্লাহর কসম, ঐ দূর প্রন্তরে বালুর টিলাটা দেখছেন, ওর অপর পার্শ্বেই তারা রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা সংখ্যায় কত?” আসলাম ও আরীদ বললো, “জানি না।” তিনি বললেন, “প্রতিদিন কয়টা জন্তু জবাই করে?” তারা বললো, “কোন দিন দশটা, কোন দিন নয়টা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে ওদের সংখ্যা নয়শো থেকে হাজারের মধ্যে হবে।”অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “কুরাইশ নেতাদের মধ্যে কে কে এসেছে?” তারা বললো, ‘উতবা ইবনে রাবীআ, শাইবা ইবনে রাবীআ, আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিযাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারেস ইবনে আমের ইবনে নওফেল, তুয়াইমা ইবনে আদী ইবনে নওফেল, নাদার ইবনে হারেস যাম’আ ইবনে আসওয়াদ, আবু জাহেল ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালাফ, হুজাজের দুই পুত্র নাবীহ ও মুনাব্বিহ, সুহাইল ইবনে আমর এবং আমর ইবনে আব্দ উদ্।” এ বিবরণ নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের সামনে গিয়ে বললেন, “মক্কা তোমাদের নিকট তার কলিজার টুকরাগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

ইতি পূর্বে বাসকাস ইবনে আমর ও আদী ইবনে আবু যাগবা টহল দিতে দিতে বদর প্রান্তরে এসে থামে। তারা জলাশয়ের নিকটবর্তী একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে উট থেকে নামলো এবং একটা মশকে পানি ভরে নিল। মুজদী ইবনে আমর জুহানী তখন জলাশয়োর কিনারে ছিল। জলাশয়ের কাছে আগত লোকদের মধ্যে দুটি বাঁদী ছিল। তাদের একজন অপরজনের কাছে তার প্রাপ্য পরিশোধ করার দাবী জানাতে লাগলো ঋনগ্রস্ত বাঁদীটি বললো,“কাফিলা কাল অথবা পরশুদিনই আসছে। তখন আমি কাফিলার কাজ করে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেবো।” মুজদী বরলো, “তুমি ঠিকই বলেছো।” অতঃপর সে উভয়ের মধ্যে আপোষ করিয়ে দিল। আদী ও বাসবাস একই কথোপকথন  শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গেল এবং যা শুনেছে তা তাঁকে জানালো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কাফিলাকে পেছনে রেখে আগে আগে এলো। সে জলাশয়ের কাছে গিয়ে মুজদী ইবনে আমরকে জিজ্ঞেস করলো, “কারো আনাগোনা টের পেয়েছো নাকি?” সে বললো, “সন্দেহজনক কাউকে দেখিনে। কেবল দুজন উট সওয়ারকে দেখলাম এই পাহাড়টার কাছে এসে উট থেকে নামলো। তারপর মশকে পানি ভরে চলে গেল।” আবু সুফিয়ান সেই জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে বাসবাস ও আদী উট থেকে নেমেছিলো। সেখানে তাদের উটদ্বয়ের খানিকটা গোবর পেয়ে তা তুলে নিল এবং সেটা ভেঙে ছিন্ন ভিন্ন করলো। তার ভেতর সে কতকগুলো আঁটি পেল। এ আঁটি দেখে সে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা ইয়সরিবের পশুখাদ্য।” সে দ্রুত বেগে তার কাফিলার কাছে ছুটে গেল। কাফিলাকে সে ভিন্ন পথে চালিত করে বদর প্রান্তর বামেরেখে সমুদ্র কিনারে পথ ধরে দ্রুত চলে গেল।

আবু সুফিয়ান যখন নিশ্চিন্ত হলো যে, তার কাফিলাকে সে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে, তখন সে কুরাইশবাহিনীর কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালো, “তোমরা তোমাদের বাণিজ্যিক কাফিলা, তোমাদের লোকজন ও ধন সম্পদকে রক্ষা করার জন্য এসেছো। আল্লাহ ওগুলোকে রক্ষা করেছেন। অতএব তোমরা মক্কায় ফিরে যাও।” জবাবে আবু জাহর বললো, “বদরের মেলা পর্যন্ত না গিয়ে আমরা কিছুতেই ফিরবো না। এখানে তিন দিন থাকবো, পশু জবাই করে ধুমধাম করে খাবারের আয়োজন করবো, মদ খাবো, গায়িাকারা বাদ্য বাজিয়ে গান গাইবে, আরবদেরকে আমাদের অভিযানের কথা ও বাহিনী গড়ে তোলার কাহিনী শোনাবো।  এভাবে তাদের মনে আমাদের  ভীতি চিরকালের জন্য বদ্দমূল হয়ে যাবে। অতএব মেলায় চলো।” উল্লেখ্য যে, বদরের প্রান্তরে প্রতি বছর একটি মেলা বসতো এবং তা ছিল আরবের নামকরা মেলা।

আতঃপর কুরাইশরা তাদের আয়োজন ও প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলো। তারা বদর প্রান্তুরের অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী মরুময় টিলার অপর পার্শ্বে গিয়ে তাঁবু ফেললো। আল্লাহ প্রবল বৃষ্টি লামালেন। প্রান্তরের মাটি তেমন উষর ছিল না, খানিকটা রসালো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ এতটা বৃষ্টি পেলেন যে,তাঁদের অবস্থানস্তলের মাটি ভিজে গেল। কিন্তু চলাচলে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করলোনা। পক্ষান্তুরে কুরাইশদের অবস্থানস্থলের মাটি এত বেশী স্যাঁত সেতে হয়ে গেল যে, তাদের চলাচল অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে আরো বেশী পানি জমা হয়েছে এমন জায়গায় সরিয়ে নিলেন।

হুবাব ইবনে মুনযির বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই জায়গাটা কি আপনি আল্রাহর নির্দেশক্রমেই বাছাই করেছেন যার থেকে আমরা একটুও এদিক ওদিক করতে পারি না? অথবা এটা কি আপানার নিজের রণকৌশলগত অভিমত?” তিনি বললেন, “এটা নেহায়েত একটা রণকৌশল এবং আমার নিজস্ব অভিমত।” হুবাব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ জায়গাটা বাছাই করা ঠিক হয়নি। অতএব সবাইকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়ুন। যেখানে অপেক্ষঅকৃত কম পানি আছে সেখানে তাঁবু ফেলুন। অতঃপর আমরা সেই জায়গার আশে পাশে যে কূপ আছে তা বন্ধ করে দেবো। তার ওপর চৌবাচ্চা তৈরী করে সেটা পানি দিয়ে ভরে রাখবো। অতঃপর শত্রু পক্ষের সাথে লড়াই করবো। ফলে আমরা পর্যাপ্ত খাবার পানি পাবো। কিন্তু ওরা পাবে না। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিক বলেছো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে উঠলেন। সামান্য পানি জমা স্থানে এসে তাবু ফেললেন। অতঃপর পানির কূপ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাই করা হলো। অতঃপর কূপের ওপর একটা চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি ভরে রাখা হলো।এবং তাতে পানির পাত্র ফেলে রাখা হলো।

সা’দ ইবনে মু’আয বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদেরকে অনুমতি দিন, আমরা আপনার জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করি, আপনি তার ভেতরে থাকবেন এবং আমরা হবো আপনার বহনকারী। অতঃপর শত্রুর মুকাবিলায় যাবো। আল্লাহ যদি আমাদেরকে বিজয়ী করেন তাহলে আমাদের আশা পূর্ণ হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে আপনাকে আমরা বহন করে নিয়ে যাবো। আপনি অন্যান্য মুসলমানের সাথে মিলিত হবেন। হে আল্লাহর নবী, বিপুল সংখ্যক মুসলমান আপনার সাথে শুধু এই জন্য আসতে পারেনি যে, আপনি যুদ্ধে যাবেন তা তারা জানে না। তারা আপনাকে আমাদের চেয়ে কম ভালবাসে না। তারা যদি জানতো যে, আপনি যুদ্ধে যাচ্ছেন তাহলে তারা যুদ্ধে না এসে ক্ষান্ত হতো না। তাদের দিয়ে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করতেন এবং তারা আপনার হিতাকাক্সক্ষী হতো এবং আপনার সহযোগী হয়ে লড়াই করতো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের কথা শুনে খুশী হলেন, তাঁর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করা হলো এবং তিনি তার মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন।

সকাল বেলা কুরাইশরা বালুর টিলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তাদেরকে নামতে দেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, এই সেই কুরাইশ যারা গর্ব ও অহংকারের সাথে আপনার সাথে বিদ্রোহ ও আপনার রাসূলকে অস্বীকার করে আজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। হে আল্লাহ, আপনি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন তাঁর সময় সমুপস্থিত। হে আল্লাহ, ওদেরকে আজ সকালেই ধ্বংস করে দিন। ”

সবাই যখন ময়দানে নামলো তখন কুরাইশদের একটি দল সামনে অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৈরী করা চৌবাচ্চায় এসে উপনীত হলো। এই দলের মধ্যে হাকীম ইবনে হিযামও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “ওদেরকে বাধা দিও না।” বস্তুতঃ ঐ চৌবাচ্চা থেকে যে যে পানি খেয়েছে, সে ঐ দিন নিহত হয়েছে। একমাত্র হাকীম ইবনে হিযাম এর ব্যতিক্রম সে নিহত হয়নি। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ভালো মুসলমানে পরিণত হয়। এই ঘটনাকে সে আজীবন স্মরণ রেখেছিল। এমনকি কখনো দৃঢ়ভাবে কসম করতে হলে বলতো, “সেই মহান সত্তার কসম যিনি আমাকে বদর যুদ্ধের দিন রক্ষা করেছেন।”

মুসলমানগণ শান্ত ও স্থির হলে কুরাইশরা ইমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য পাঠালো। সে যোড়ায় চড়ে বাহিনীর চারপাশ দিয়ে একট চক্কর দিয়ে ফিরে গিয়ে বললো, “তিনশোর সামান্য কিছু বোশী বা কম হতে পারে। তবে আমাকে আর একটু সময় দাও দেখে আসি ওদের কোন গুপ্ত ঘাঁটি বা সাহায্যকারী আছে কিনা।” অতঃপর সে সমস্ত প্রান্তর ঘুরলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। অতঃপর ফিরে গিয়ে বললো, “কোন কিছুই সন্ধান পেলাম না। তবে তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা মরণপণ করে এসেছে। ইয়াসরিবের উষ্ট্রীগুলো সুনিশ্চিত মৃত্যু বহন করে এনেছে। ওরা এমন একটা দল তরবারীই যাদের একমাত্র সহায় ও রক্ষক। আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিত যে, ওদের একজন নিহত হলে তার বদলায় তোমাদের একজন নিহত হবে। তারা কুরাইশদের মধ্য থেকে যখন তাদের সমসংখ্যক মানুষ হত্যা করবে, তখন আর তা আমাদের জন্য সুখবর হবে না। অতএব তোমরা এখনো ভেবে দেখো।”

হাকীমইবনে হিযাম এ কথা শুনে কুরাইশ বাহিনীর লোকদের কাছে গেল। প্রথমে সে উতবা ইবনে রাবীআকে গিয়ে বললো, “হে ওয়ালীদের পিতা, আপনি কুরাইশদের একজন প্রবীণ নেতা। আপনার কথা সবাই মানে। আপনি কি এমন একটা কাজ করতে প্রস্তুত যা করলে অনন্তকাল ধরে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন?” সে বললো, “হাকীম, তুমি কি বরতে চাচ্ছো?” হাকীম বললো, “আপনি কুরাইশবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আপনার মিত্র ‘আমর ইবনে হাদরামীর হত্যাকা-ের ব্যাপারটা মিটিয়ে দেবার দায়িত্ব নিন।” উতবা বললো, “তা আমি করতে রাজী। সে ব্যাপারে আমি তোমার কথা রাখবো। হাদরামী আমার মিত্র এবঙ তার রক্তপণ ও আর্থিক ক্ষতি পূরণ করে দিতে আমি প্রস্তুত। তুমি আবু জাহলের কাছে যাও। আমি মনে করি, কুরাইশদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে সে ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করবে না।” অতঃপর উতবা ইবনে রাবীআ দাঁড়িয়ে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ ও তার সহযোগীদের সাথে লড়াই করে আমাদের কোন লাভ হবে না। বস্তুতঃ আজ যদি আমরা তাকে হত্যা করতে সক্ষম হইম তা হলেও আমাদের ভেতের কখনো সদ্ভাব জন্মাবে না। একজন আর একজনের মুখ দেখা পছন্দ করবে না। কেননা সে তার চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই কিংবা কোন আত্মীয়ের হত্যাকারী বল চিহ্নিত হবে অতএব, বলো আমরা ফিরে যাই এবং মুহাম্মাদ ও তার অনুচরদের পথ থেকে সরে দাঁড়াই। তাদের ব্যাপারটা আরববাসীর উপর অর্পণ করি। সমগ্র আরববাসী মিলে যদি তাকে হত্যা করে তাহলে তো আমাদের উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে। আর যদি তা না করে তাহলে মুহাম্মাদের কাছে আমরা অন্ততঃ নির্দোষ থাকবো।”

হাকীম বলেন, অতঃপর আমি আবু জাহলের কাছে গেলাম, দেখলাম, সে তার যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামে শাণ দিচ্ছে। আমি তাকে বললাম, “হে আবুল হিকাম, উতবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।” অতঃপর উতবা যা বলেছে তা তাকে জানালাম। সে সঙ্গে বললো, “উতবার মাথা বিগড়ে গেছে। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ তাকে যাদু করেছে। এটা কখ্খনো সম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদের ও মাহাম্মাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমরা ফিরবো না। উতবা যা বলেছে তা তার মনের কথা নয়। যেহেতু মাহাম্মাদ ও তার অনুচররা সংখ্যায় খুবই নগন্য এবং তাদের ভেতরে তার ছেলেও রয়েছে, যুদ্ধ হলে তার ছেলের জীবন বিপন্ন হবে তা ভেবে সে একথা বলেছে।” অতঃপর সে নিহত আমর ইবনে হাদরামীর ভাই আমের ইবনে হাদরামীর কাছে এই মর্মে খবর পাঠালো যে, “তোমার মিত্র ইতবা কুরাইশদেরকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। অথচ তুমি তোমার প্রতিশোধের সুযোগ নিজের চোখে নাগালের মধ্যে দেখতে পাচ্ছো। সুতরায় তুমি কুরাইশদের তোমার ভাই- এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দাও। ” ‘আমের ইবনে হাদরামী উঠে দাঁড়ালো এবং বুকের কাপড় খুলে ‘হায় আমর! হায় আমর!!’ বলে চিৎকার করে মাতম করতে থাকলো। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। কুরাইশরা রণোন্মাদ হয়ে উঠলো। উতবা যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল, আমের তা এক নিমিষে নস্যাৎ করে দিল।

আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখযুমী ছিল কুরাইশদের মধ্যে চরম অসৎ ওগুা স্বভাবের লোক। সে তার ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু করে দিল। সে ঘোষণা করল। “মুসলমানদের জলাধার থেকে আমি পানি পান করবো। কিংবা তা ভেঙ্গে ফেলবো। এম যদি আমার মৃত্যুও ঘটে, পরোয়া করি না। ” এই বলে সে ময়দানে নামলে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব তার মুখোমুখি হলেন। দুইজনের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলাকালে হামযা আসওয়াদের পায়ে তরবারীর আঘাত করলেন। তার পা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ সময় সে চৌবাচ্চার কাছেই ছিল। সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল এবং তার পা থেকে ফিনকি দিযে রক্ত ছুটতে লাগলো।সে পুনরায় হামাগুড়ি দিয়ে চৌবাচ্চার দিকে এগুলো এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লো। হামযা তার পিছু ধেয়ে গেলেন এবং চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরেই তাকে হত্যা করলেন।

এরপর ময়দানে অবতীর্ণ হলো উতবা ইবন রাবীআ। তার ভাই শাইবা ও ছেলে ওয়ালীদ তার সঙ্গে এলো। কুরাইশদের ব্যুহ ছেড়ে সামনে গিয়ে সে হুংকার দিয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানালে আনসারদের মধ্য হতে তিন যুবক আউফ ও মুয়াওয়েব ইবন হারেস (দুই ভাই) এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা তার মুকাবিলায় এগিয়ে গেলেন। কুরাইশরা বললো “তোমরা কারা?” তাঁরা বললেন, “আমরা আনসার।” তারা বললো, “তোমাদের দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর একজন চিৎকার করে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারা আমাদে সমকক্ষ, তাদেরকে পাঠাও।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাইদা ইবনে হারেস হামযা ও আলীকে পাঠালেন। তাঁরা গিয়ে নিজ নিজ পরিচয় দিলে প্রতিপক্ষ খুশী হয়ে বললো, “ঠিক আছে। এবার মর্যদাসম্পন্ন প্রতিপক্ষ পাওয়া গেছে।” মুসলিম বাহিনীর সবকনিষ্ঠ মুজাহিদ উতবা ইবনে রাবীআর বিরুদ্ধে, হামযা শাইবার বিরুদ্ধে এবং আলী ওয়ালীদ ইবনে উতবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। হামযা শাইবাকে এবং আলী ওয়লীদকে পাল্টা আঘাত হানার সুযোগও দিলেন না। প্রথম আঘাতেই সাবাড় করে দিলেন। আর উবাইদা ও উতবা উভয়ে একটি করে আঘাত বিনিময় করলো এবং উভয়ে গুরুতরভাবে আহত হলো। হামযা ও আলী (রা) দ্রুত ছুটে দিয়ে নিজ নিজ তরবারী দিয়ে উতবাকে খতম করে দিলেন। অতঃপর তারা উবাইদাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে পৌঁছিয়ে দিলেন।

এরপর উভয় পক্ষ একযোগে পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেল এবং পরস্পরের কাছাকাছি হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহবাদেরকে বলে দিলেন, তিনি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা যেন হামলা না করে। তিনি বললেন, “কুরাইশরা তোমাদের ঘেরাও করে ফেললে তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে হটিয়ে দিও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় মুসলিম বাহিনীকে সারিবদ্ধ করে আবু বাক্র সিদ্দীকসহ তাঁর মঞ্চসদৃশ স্থানে অবস্থান করতে লাগলেন। সেখানে আর কেউ ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি সাহায্য প্রেরণের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ, এই মুষ্টিমেয় মুসলমান যদি আজ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আপনার ইবাদত করার জন্য কেউ থাকবে না।” আবু বাক্র(রা) বরতে লাগলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহ আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই পালন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সময় নিজ মঞ্চের ভেতরে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়রেন। অতঃপর সাহায্য এসে গেছে। এই দেখোনা জিবরীল একটি ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁকিয়ে আসছেন। তাঁর পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে ধূলোর আস্তরণ জমে গেছে।” পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে রণাঙ্গনে গেলেন এবং মুজাহিদগণকে এই বলে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করলেন, “সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের সাতে ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে যুদ্ধ করবে এবং শুধু সামনের দিকে এগুতে থাকবে, কোন অবস্থায় পিছু হটবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।” বনু সালামা গোত্রের উমাইর ইবন হুমাম (রা) হাতে কয়েকটি খোরমা নিয়ে খাচ্ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনেই বললেন, “বাহ! আমার তাহলে জান্নাতে যাওয়ার পথে শাহাদাত লাভ করা ছাড়া তো আর কোন বাধাই নেই দেখছি।” একথা বলেই তিনি হাতের খোরমাগুলো ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং তরবারী নিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি ধুলি হাতে নিয়ে কুরাইশদের দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর এই বলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, “ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যাক।” অতঃপর সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন, “জোর হামলা চালাও।” অল্পক্ষণের মধ্যেই কুরাইশদের চরম পরাজয় ঘটলো। কুরাইশদের বড় বড় নেতাদের অনেকেই নিহত ও বন্দী হলো।

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “আমি জানতে পেরেছি যে,বনু হাশিমের কিছু সংখ্যক লোককে জোর জবরদস্তি করে যুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। কাজেই বনু হাশিমের কেউ তোমাদের সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম কারো সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। কেননা তাকেও জবরদস্তিমূলকভাবে টেনে আনা হয়েছে।” মুসলিম বাহিনীর জনৈক আবু হুযাইফা বললেন, “আমরা আমাদের বাপ-ভাই-পুত্র ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করবো, আর আব্বাসকে কেন ছাড়বো? আমার সামনে পড়লে আমি তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবোই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ কথা শুনলেন তখন উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) ডেকে বললেন, “হে উমার, আল্লাহর রাসূলের চাচার মুখে কি তরবারী দিয়ে আঘাত করা যায়।” উমার বললেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ, অনুমতি দিন আমি তরবারী দিয়ে ওর ঘাড়টা কেটে ফেলি। আমি নিশ্চিত যে, আবু হুযাইফা মুনাফিক হয়ে গেছে।” পরবর্তীকালে আব হুযাইফা বলতেন, “বদর যুদ্ধের দিন আমার ঐ কথাটা বলা আমাকে শংকিত করে তুলেছে। শাহাদাত লাভের দ্বারা এর কাফফারা না হওয়া পর্যন্ত আমার এ শংকা দূর হবে না।” পরে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

মুসলমানদের অনেক দুর্যোগের দিনে ফেরেশতারা সাহায্য করেছেন। কিন্তু নিহতদের ভেতরে আবু জাহলের লাশ আছে কিনা খুঁজে দেখার নির্দেশ দিলেন। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি তার মস্তক ছিন্ন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা আল্লাহর দুশমন আবু জাহলেন মাথা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সত্যি কি তাই?” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম, সত্যি।” ইবনে মাসউদ বলেন, আবু জাহলকে হত্যা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিজ্ঞা  ছিল। আমি অতঃপর তার মাথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রাখলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দের লাশ কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ছাড়া আর সবার লাশ নিক্ষেপ করা হলো। উমাইয়ার লাশ  তার সামরিক পোশাকের মধ্যে ফুলে সেঁটে গিয়েছিল। সাহাবীগণ তাকে পেশাক থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে তার গোশত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে তাঁরা তাকে যেমন ছিল তেমনভাবেই রেখে মাটি ও পাথর চাপা দিলেন। কুয়ার ভিতর নিক্ষেপ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে দাঁড়ালেন। তখন মধ্যরাত। সাহাবীগণ শুনতে পেলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে একে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত সকলের নাম নিয়ে সম্বোধন করে বললেন, “হে কুয়ার অধিবাসী, হে উতবা, শাইবা, উমাইয়া ও আবু জাহল! আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা যথাযথভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবরূপে পেয়েছি।” মুসলমানগণ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, যারা মরে পচে গিয়েছে তাদেরকে আপনি সম্বোধন করছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার কথা তোমরা যেমন শুনতে পাও তারাও তেমনি শুনতে পাচ্ছে। সাড়া দিতে পারছে না।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীর কাছে যে গণিমতের মার (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) রয়েছে, তা একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ তা নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হলেন। যারা ঐ সম্পদ সংগ্রহ করেছেন তারা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা।” যারা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছিরেন তাঁরা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা, কেননা আমরা যদি যুদ্ধ না করতাম তাহলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করার সুযোগ পেতে না, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় আমরা তোমাদের সাথে গণিমত সংগ্রহের কাজে যোগ দিতে পারিনি, ফলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করতে পেরেছো।” শত্রুরা ভিন্ন পথ দিযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমন চালাতে পারে এই আশংকায় যারা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা আমাদের চেয়ে বেশি হকদার নও, শত্রুকে আমরাও বাগে পেয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিলাম। আর এইসব মালপত্র সংগ্রহ করতেও আমাদের কোন বাধা ছিল না এবং আমরা সংগ্রহ করতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু শত্রুরা নতুন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে এই আশংকায় আমরা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত হই। সুতরাং এই সম্পদে তোমাদের অধিকার আমাদের চেয়ে বেশী নয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে মদীনার উঁচু এলাকায় এবং যায়িদ ইবনে হারিসাকে নিম্ন এলাকায় মুসলমানদের বিজয় সয়বাদ দিয়ে পাঠালেন। অতঃপর তিনি সদলবলে মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে উতবা ইবনে আবু মুরাইত ও নাদার ইবনে হারেসও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের কাছ থেকে পাওয়া গণিমতের সম্পদও সাথে নিয়ে চললেন। আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে আমর ইবনে আউফকে গণিমতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফরা গিরিপথ থেকে বেরিয়ে যখন গিরিপথ ও নাজিয়ার মধ্যবর্তী বালুর পাহাড়ে উপনীত হলেন তখন সেখানে বসে তিনি মুসলমানদের মধ্যে গণিমতের মাল সমভাবে বণ্টন করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। রাওহাতে পৌঁছলে সাখানকার মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের আল্লাহ যে মহাবিজয় দান করেছেন সেজন্য অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। তখন সালামা ইবনে সুলামা (রা) বললেন, “তোমরা কিসের জন্য আমাদেরকে মুবারকবাদ জানাচ্ছ? কতকগুলো ঝানু বৃদ্ধ লোকের সাথেই তো আমরা লড়াই করে এলাম। বন্দী উটের মত তারা হীনবল হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা তাদের জবাই করে দিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন এবং বললেন, “ভাতিজা ওরাই তো হর্তাকর্তা।”

সাফরা গিরিপথে পৌঁছে যুদ্ধবন্দী নাদার বিন হারেসকে হত্যা করা হলো। আবু তালিব তনয় আলী তাকে হত্যা করলেন। অতঃপরে তাঁরা পুনরায় অগ্রসর হলেন। আরকুয যারীয়াতে পৌঁছে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকেও হত্যা করা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলে উকবা বললো, “শিশুদের দেখাশুনার জন্য কে থাকলো, হে মুহাম্মাদ!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে শুধু বললেন, “আগুন!” অতঃপর আসেম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আফলাহ্ আনসারী উকবা ইবনে মুয়াইতাকে হত্যা করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রা করলেন। তিনি যুদ্ধবন্দীদের পৌঁছার একদিন আগেই মদীনায় পৌঁছলেন। যুদ্ধবন্দীরা পৌঁছলে সাহাবাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে রাখা হলো। তারপর তিনি বললেন, “যুদ্ধবন্দীদের প্রতি তোমরা সহানুভূতির মনোভাব রাখবে।”

ওদিকে হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানিময় সংবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম মক্কায় পৌঁছলো। কুরাইশগণ তাদো নিহতদের জন্য বিলাপ করতে লাগলো। তারপর সংযত হয়ে পরস্পরকে বলতে লাগলো, “এমন বিলাপ করো না। মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা জানতে পাররে খুশীতে বগল বাজাবে। আর বন্দীদের খালাস করিয়ে আনতে তাড়াহুড়ো করো না যাতে মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কড়াকড়ি করার সুযোগ পায়।” আবদুল মুত্তালিব তনয় আসওয়াদ তার তিন ছেলেকে হারিয়েছিল। ছেলে তিনটি হলো: যামআ, আকীল ও হারেস। তার ইচ্ছা হচ্ছিল ছেলেদের জন্য বিলাপ করতে। এই সময় গভীর রাতে সে এক শোকাহত নারী কণ্ঠের কান্না শুনতে পেল। দৃষ্টিশক্তিহীন আসওয়াদ তার এক গোলামকে বললো, “যাও তো খোঁজ নিয়ে এসো, উচ্চস্বরে বিলাপ করা বৈধ করা হয়েছে কিনা। দেখ, কুরাইশগণ তাদের নিহতদের জন্য কাঁদছে কিনা। তাহলে আমি যামআর জন্য কাঁদবো। কেননা আমার কলিজা পুড়ে গেছে।” গোলাম ফিরে এসে জানালো, “এক মহিলা তার উট হারিয়ে বিলাপ করছে। এ কথা শুনে আসওয়াদ নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করলো, “ঐ মহিলা একটা উটের জন্য এমন করে রাত জেগে কাঁদছে, এ কেমন কথা? আসলে কিন্তু সে জওয়ান উটের জন্য নয় বরং এমন এক পূর্ণিমার চাঁদের জন্য কাঁদছে, যার সৌভাগ্য খুবই সীমিত। সেই পূর্ণিমার চাঁদ যার জন্য বনু হুসাইস, মাখযুম ও আবুল ওয়ালীদের গোত্র ক্রন্দনরত। যদি আমি কাঁদি তাহলে আকীরের জন্য ও বীর কেশরী হারেসের জন্য কাঁদার মানুষ অনেক রয়েছে। সেই অসংখ্য কান্নারত লোকের উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বস্তুত: যামআর কোন জুড়ি নেই।”

অতঃপর কুরাইশগণ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ দিযে খালাস করে আনার আয়োজন করলো। প্রথমে তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুক্ত করার জন্য তাদের সম্মতি নেয়ার পর মুসলমানগণ বললেন, “এবার পণের অর্থ দাও।” মিকরায বললো, “তোমরা সুহাইলের পরিবত্যে আমাকে আটক করে রেখে তাকে ছেড়ে দাও যাতে সে গিয়ে তার পণের অর্থ পাঠিয়ে দিতে পারে।” এ কথায় সম্মত হয়ে তাঁরা সুহাইলকে ছেড়ে দিলেন এবং তার বদলে মিকরাযকে বন্দী করে রাখলেন। তার আগে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে অনুমতি দিন সুহাইলের সামনের দাঁত উপড়ে ফেলি যাতে কথা বলতে তার জিহ্বা বেরিয়ে আসে এবং আপনার বিরুদ্ধে আর কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে না পারে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তার চেহারা বিকৃত করবো না। তাহলে নবী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার চেহারা বিকৃত করে দেবেন।”

যুদ্ধবন্দীদের একজন ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা, তাঁর কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল ‘আস ইবনে রাবী ইবনে আবদুল উয্যা। যয়নাবের ইসলাম গ্রহনের ফলে আবুল আসের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যতঃ তাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম ছিলেন না। তাই যয়নাব মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মুশরিক স্বামীর ঘর করতে থাকেন। এই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাত করেন। পরে কুরাইশরা বদরের যুদ্ধে গেলে আবুল আসও তাদের সাথে যোগ দেয়। এভাবে সে যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নীত হয়।

অতঃপর মক্কাবাসীরা যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ পাঠাতে লাগলো। যয়নাবও আবুর আ’স ইবনে রাবী’র মুক্তিপণ বাবদ কিছু টাকা ও বিয়ের সময় খাদীজার দেয়া হার পাঠিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারখানি দেখে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। সাহাবীদেরকে তিনি বললেন, “তোমরা যদি ভাল মনে কর তবে যয়নাবের পাঠানো মুক্তিপণ ফেরত দিয়ে তার বন্দীকে মুক্ত করে দিতে পার।” সাহাবীগণ তাকে মুক্তি দিলেন এবং মুক্তিপণ বাবদ পাঠানো টাকা ও হার ফেরত দিলেন।

আবুল ‘আস মক্কায় গিয়ে এবং যয়নাব মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাস করতে লাগলেন। ইসলাম তাদের বিচ্ছেদ ঘটালো। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে আবুল ‘আস ব্যবস্ায় উপলক্ষে সিরিয়া গেল। তার কাছে নিজের ও কুরাইশদের ব্যবসার টাকা আমানত হিসেবে ছিল যা তাকে মূলধন হিসেবে দেয়া হয়েছিল। সে কেনাবেচা সম্পন্ন করার পর যখন প্রত্যাবর্তন করছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরিত একটি বাহিনী তার পণ্যদ্রব্য কেড়ে নেয় এবং আবুল ’আস পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। সেনাদল যখন রাসূলের কন্যা যয়নাবের নিকট উপস্থিত হয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। যয়নাব তাকে আশ্রয় দিলেন। সে তার জিনিসপত্র ফেরত চাইতে এসেছিল। সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়তে গেলেন এবং সাহাবীদের সাথে সামাযে দাঁড়ালেন। তখন যয়নাব নারীদের কক্ষ থেকে চিৎকার করে বললো, “হে জনগণ, শুনে রাখ, আমি আবুল ’আস ইবনে রাবী’কে আশ্রয় দিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফেরানোর পর সবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “হে মুসলমানগণ, আমি যে কথা শুনতে পেরেছি, তোমরাও কি তা শুনেছো?” সবাই বললো, “হ্যাঁ শুনেছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহর কসম, এই ঘোষণা শুনবার আগে আমি এ ঘটনার কিছুই জানতাম না। চুক্তি অনুসারে যে কোন ব্যক্তি মুসলমানদের নিকট আশ্রয় নিতে পারে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যার কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, “যয়নাব, আবুল আসকে সযতেœ রাখ। কিন্তু সে যে নির্জনে তোমার কাছে না আসে। কেননা তুমি এখন তার জন্য হালাল নও।”

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেন, যে সেনাদলটি আবুল আসের জিনিসপত্র ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কাছে তিনি বার্তা পাঠালেন, “তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি তা তোমরা জান। তোমরা তার কিছু জিনিস হন্তগত করেছো। তোমরা যদি সদয় হয়ে তার জিনিস ফিরিয়ে দাও, তবে তা হবে আমাদের পছন্দনীয়। আর যদি না দিতে চাও ওটা গণিমতের মাল যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। এসব সম্পদের আইনগত অধিকারী তোমরাই।” তাঁরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা বরং তার জিনিস তাকে ফিরিয়েই দেব।” এরপর কেউ বালতি নিয়ে এলো। কেউ তার পুরনো মশক, কেউ তার চামড়ার পাত্র এবং কেউবা তার ছোট একটা কাঠের হাতল পর্যন্ত ফিরিয়ে দিল। এভাবে তার সব জিনিস সে হুবহু ফেরত পেলো। একটা জিনিসও বাকি রইলো না। পরে সে ঐসব জিনিস মক্কায় নিয়ে গেল এবং কুরাইশদের যার যে জিনিস তা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের আর কারো কোন জিনিস কি ফেরত পেতে বাকী আছে?” তারা বললো, “আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমাদের আর কোন প্রাপ্য ইেন। তুমি আমাদের সাথে একজন সত্যিকার আমানতদর ও মহৎ লোকের ন্যায় আচরণ করেছো।” তখন সে বললো, “তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি শুধু এ আশংকায় ইসলাম গ্রহণ করিনি যে, তোমরা হযতো ভাবতে আমি তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই এরূপ করেছি। আল্লাহ যখন এগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাবস্থা করেছেন এবং আমি দায়মুক্ত হয়েছি, তখনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।” অতঃপর আবুল আস (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসেন।

বদরের যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যাদের অনুকম্পা প্রদর্শন করে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়েছির তারা হলেন: আবুল আস ইবনে রাবী, মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফী ইবনে আবু রিফায়া এবং আবু আযযা আমর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উসমান। আবু আযযা ছিল দরিদ্র এবং বহু কন্যাদায়গ্রস্ত। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার কি অর্থ সম্পদ আছে তা আপনার জানা। আমি অত্যন্ত অভাবী এবং বহু সন্তানভারে ক্লিষ্ট। অতএব আমাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মুক্তিপণ মাফ করে দিলেন এবং অঙ্গীকার নিলেন যে, সে আর কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। আবু আযযা তার গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় নিন্মোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করে

“রাসূল মুহাম্মাদের নিকট আমার এ বার্তাটি কে পৌঁছিয়ে দেবে?

আপনি সত্য এবং বিশ্ব সম্রাট সকল প্রশংসার অধিকারী।

আপনি সেই ব্যক্তি যিনি সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহব্বান জানান,

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,

আপনি আমাদের পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,

আপনি যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, সে চরম হতভাগা,

আর যার সাথে আপোষ করেন সে পরম ভাগ্যবান।”

মুশরিকদের থেকে যে মুক্তিপণ আদায় করা হয় তার পরিমাণ ছিল বন্দিপ্রতি এক হাজার দিরহাম থেকে চার হাজার দিরহাম। তবে বিত্তহীন ব্যক্তিকে অনুকম্পা দেখানো হয় এবং বিনা পণে মুক্তি দেয়া হয়। মোট ৮৩ জন মুহাজির, ১৬১ জন আওস গোত্রীয় আনসার এবং ১৭০ জন খাজরাজ গোত্রীয় আনসার বদর যুদ্ধে অংগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে গণিমতের অংশ দেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিম সংখ্যা আনাসার ও মুহাজির মিলে তিনশো চৌদ্দ জন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সবাইকে গণিমতের অংশ ও পারিশ্রমিক প্রদান করেন। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই রমযান, শুক্রবার সকাল বেলা।

 

বনু সুলাইম অভিযান

বদর যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সাত দিন অবস্থান করেন। অতঃপর বনু সুলইম গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি নিজেই এতে নেতৃত্ব দেন এবং তাদের কাদর নামক একটি জলাশয় দখল করেন। এখানে কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হননি। মদীনায় শাওয়ালের বাকী দিনগুলো ও পুরো যিলকা’দ মাস কাটান। এই সময়ে তিনি কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদের অধিকাংশকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেন।[৫৮. এই অভিযানে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিবা ইবনে আরকাতা গিফারীকে মদীনার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে যান। কেউ কেউ বলেন, ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান ]

সাওয়ীক অভিযান

জিলহাজ্ব মাসেই আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাওয়ীক অভিযান চালায়। এই বছর মুশরিকরা হজ্ব বাদ দিয়েই যুদ্ধে এসেছিল। কেননা আবু সুফিয়ান এবং কুরাইশদের অন্যান্য লোকেরা বদর থেকে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মক্কায় ফিরেই প্রতিজ্ঞা করলো যে, মাহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আর একটি হামলা চালিয়ে উপযুক্ত প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসলের পানি মাথায় লাগাবো না [৫৯. হজ্ব ও বিয়ে শাদীর মত এই গোসলেরও রেওয়াজ জাহিলিয়াত যুগে ছিল।] এই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য আবু সুফিয়ান দুশো ঘোড় সওয়ার নিয়ে রওনা হলো। নাজদিয়া অতিক্রম করে সে মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত ‘সায়েব’ নামক পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী একটি ঝর্ণার কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলো। অতঃপর রাতের আঁধারে সে বনু নাযীরের হুয়াই ইবনে আখতাবের বাড়ীতে পৌঁছে দরজায় করাঘাত করলো। হুয়াই শংকিত হয়ে দরজা খুলতে অস্বীকার করলো। অগত্যা আবু সাফিয়ান সালাম ইবনে মিশকামের কাছে গেল। এই ব্যক্তি ছিল তৎকালে বনু নাযীরের সরদার এবং তাদের আপৎকালীন সংকট মুকাবিলার জন্য সঞ্চিত তহবিলের সংরক্ষক। আবু সুফিয়ান তার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি প্রার্থনা করলে সে অনুমতি দিল। সে তাকে আপ্যায়নও করলো। সালাম তাকে মদীনার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অবহিত করলো। অতঃপর আবু সুফিয়ান রাত থাকতেই তার সহচরদের কাছে চলে গেল। সে কুরাইশ বাহিনীর কিছু লোককে মদীনার পাঠিয়ে দিল। তারা মদীনার পার্শ্ববর্তী উরাইব নামক স্থানে উপনীত হলো। সেখানকার খেজুর বাগানে তারা আগুন জ্বালালো। সেখানে তারা আনসার  ও তার জনৈক মিত্রকে তাদের একটি যৌথ কৃষি খামারে পেয়ে হত্যা করলো। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মদীনাবাসী তাদের এই কর্মকা- টের পেয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। বাশীর ইবনে আবদুল মুনযিরকে মদীনার দায়িত্বে রেখে গেলেন। ‘কারকারাতুল কাদর’ নামক স্থানে পৌঁছে আবু সুফিয়ান ও তার দলবলের কোন হদিস না পেয়ে ফিরে এলেন। খামারের ভেতরে তাদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র দেখতে পেলেন। হালকা হয়ে দ্রুত পালানোর উদ্দেশ্যে তারা ওগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়।[৬০.ক্রুাইশদের ফেলে যাওয়া এই সব জিনিসের মধ্যে বেশীরভাগ ছিল গম বা জবের ছাতুÑ যা দুধ, মধু ও ঘি দিয়ে অথবা পানি দিয়ে খাওয়া যায়। এই ছাতুকে আরবীতে সাওয়ীক বলা হয়। আর এই কারনেই এই অভিযানের নাম হয়েছে ‘সাওয়ীক অভিযান।’] বিনাযুদ্ধে ফিরে আসা হলো বলে মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা কি আমাদের জিহাদ বলে গণ্য হবে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, “হ্যাঁ।”

যূ-আমার অভিযান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ীক অভিযান থেকে ফিরে এসে যিলহাজ্ব মাসের অবশিষ্ট পুরো অথবা প্রায় পুরো সময় মদীনাতে অতিবাহিত করেন। তারপর নাজদের গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানকেই যূ-আার অভিযান বলা হয়। পুরো অথাবা প্রায় সমগ্র সফর মাস তিনি নাজদে অবস্থান করেন। পুরো রবিউল আউয়াল কিংবা অল্প কয়েকদিন বাদে রবিউল আউয়াল মাস মদীনাতেই কাটান।

বাহরানের ফুরু অভিযান

এবার কুরাইশদের বিরুদ্ধে তিনি আর একটি অভিযান পরিচালনা করলেন। তিনি হিজায অতিক্রম করে ফুরু অঞ্চল হয়ে বাহরান পৌঁছেন। সেখানে রবিউস সানী ও জামাদিউল উলা অতিবাহিত করেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

বুন কাইনুকার যুদ্ধ

বনু কাইনুকার মূল ঘটনা ছিল এই যে, জনৈক আরব মহিলা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে বিক্রি করে। সেখানে সে এক স্বর্ণকারের দোকানের কাছে বসে। দোকানের লোকেরা মহিলার মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলা তা করতে অস্বীকার করে। অতঃপর স্বর্ণকার এই মহিলার পরিধানের কাপড়ের একটা কোণা ধরে তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা এটা টের পায়নি। ফলে সে উঠে দাঁড়ালে অমনি উলঙ্গ হয়ে যায়। বাজারের লোকেরা তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। জনৈক মুসলমান স্বর্ণকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। স্বর্ণকার ছিল ইহুদী। তাই ইহুদীরাও সংঘবদ্ধ হযে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে। তখন নিহত মুসলমানের পরিবার-পরিজন মুসলমানদের কাছে ফরিয়াদ জানায় তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালালে বনু কাইনুকার সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বেঁধে যায়।

মদীনার ইহুদীদের মধ্যে বনু কাইনুকাই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নতজানু করলে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবসে সুলুল তাঁর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথায় কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুণ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমাকে ছাড়।” এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখম-ল রক্তিম হয়ে যায়। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, “আরে। আমাকে ছাড় তো।” সে বললো, “না, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা আগে দিন, তারপর ছাড়বো। বিশ্বাস করুন, চারশো নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশো বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।”

এরপর উবাদা ইবনে ছামিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলেন। বনু কাইনুকার সাথে তাঁরও মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাঁর কোন পরোয়া না করে তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন এবং তাদের সাথে তার কৃত চুক্তির দায়দায়িত্ব থেকে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের সামনে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করলেন।তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মিত্র ও বন্ধু শুধুমাত্র আল্লাহ, রসূল ও মু’মিনগণ। এসব কাফিরের মৈত্রী থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।”

উবাদা ইবনে ছামিত ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কেই সূরা মায়িদার নিম্নলিখিত আয়াতগুলো নাযিল হয়,

“হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের কখনো বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। ওরা পরস্পরের মিত্র। তোমাদের মধ্য হতো যে ব্যক্তি তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ দেখান না। যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে তুমি দেখতে পাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করে আর বলে: আমাদের আশংকা হয়, আমাদের ওপর বিপদ-মুসিবত এসে পড়ে কিনা। আল্লাহ তো বিজয় দিতে পারেন কিংবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। তখন তারা মনের ভেতরে লুকানো ব্যাপার নিয়ে অনুতপ্ত হবে। মুমিনরা বলেঃ এই নাকি কসম খেয়ে লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানো সেই লোকদের অবস্থা যারা বলে যে, তারা তোমাদের সাথেই রয়েছে। তাদের সমস্থ নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ তার দীন ত্যাগ করে, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয় যখন আল্লাহ এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটাবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, যারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কারো নিন্দা বা তিরস্কারের পরোয়া করবো না। এরূপ দৃঢ় হতে পারাটা আল্লাহ অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র বিরাজিত সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু ও মিত্র তো একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই সব মু’মিন যারা নামাযী, যাকাত দাতা ও আল্লাহর অনুগত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে আল্লাহর দলভুক্ত হবে এবং তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে থাকে।”

যায়িদ ইবনে হারিসার কারাদা অভিযান

কারাদা নাজদের একটি জলাশয়। এখানে অভিযান পরিচালনার কারণ ছিল এই যে, বদরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুরাইশরা তাদের সিরিয়া যাতায়াতের চিরাচরিত পথে চলাচল বিপদজ্জনক মনে করে ইরাকের পথ ধরে যাতায়াত করা শুরু করলো। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী দল এই পথ দিয়ে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের সাথে তাদের প্রধান পণ্যদ্রব্য ছিল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য। বনু বাক্র ইবনে ওয়ায়িলের ফুরাত ইবনে হাইয়ান ছিল তাদের ভাড়াটে পথপ্রদশক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কাফিলাকে আক্রমণ করার জন্য যায়িদ ইবনে হারিসাকে পাঠালেন। তিনি কারাদার গিয়ে কাফিলাকে ধরলেন। কাফিলার লোকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলে তিনি পণ্যসম্ভারসহ সমগ্র কাফিলাটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন।

উহুদ যুদ্ধ

বদর যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের কলংক মাথায় নিয়ে কুরাইশ কাফিররা যখন মক্কায় পৌঁছলো এবং আবু সুফিয়ান তার কাফিলা নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল তখন আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবীআ, ইবরিমা ইবনে  আবু জাহল ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াসহ কুরাইশদের একটি দলÑ যাদের পিতা, পুত্র কিংবা ভাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের কাছে গেল। আবু সুফিয়ানের ঐ কাফিলায় সেবার যে মুনাফা অর্জিত হয় তা তখনো তর কাছেই ছিল। তারা বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ তোমাদের বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এবার এই কাফিলার যাবতীয় সম্পদ দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য কর, তাহলে আশা করি আমরা আমাদের হারানো লোকদের উপয্ক্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবো।” সবাই সম্মতি দিল।

অতঃপর আবু সুফিয়ান, তার কাফিলার অন্তর্ভুক্ত অকুরাইশীগণ, বিশেষত: কিনানা গোত্র ও তিহামাবাসীদের মধ্যে যারা কুরাইশদের প্রতি অনুগত ছিল, যুদ্ধে যেতে সম্মাতি দিল, তখন কুরাইশগণও মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতিহিংসা বৃত্তিকে  উস্কিয়ে দেয়ার জন্য এবং যোদ্ধাদের পালানো রোধ করার জন্য কুরাইশরা তাদের কিছু সংখ্যাক মহিলাকেও সঙ্গে নিল। সেনাপতি আবু সুফিয়ান স্বীয় স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাকে, উকরিমা বিন আবু জাহল উম্মে হাকিম  বিনতে হারেসকে, হারেস বিন হিশাম ফাতিমা বিনতে ওয়ালীদকে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বারযা বিনতে মাস’উদকে এবং আমর ইবনুল আস বারিতা বিনতে মুনাব্বিহকে সঙ্গে নিল। অতঃপর তারা মদীনা অভিমুখে  অগ্রসর হলো।মদীনার সম্মাুখস্থ উপত্যাকার মুখে অবস্থিত খাল থেকে নির্গত দুইটি ঝর্নার কিনারে বাতনুস সুবখার পাহাড়ের কাছে গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ তাদের ঐ স্থানে অবস্থান গ্রহণের কথা শুনতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আমার একটি গরু জবাই করা হয়েছে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যেন ফাটল ধরেছে। আরো দেখলাম, আমি একটা সুরক্ষিত বর্মের ভেতরে হাত ঢুকিয়েছি।[ ৬১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “গরু জবাই এর তাৎপর্য এই যে, আমার কিছু সংখ্যক সাহাবী নিহত হবে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যে ফাটল দেখলাম সেটা আমার পরিবারভুক্ত এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার আলামত।”]এই বর্ম দ্বারা আমি মদীনাকে বুঝেছি। তোমরা যদি মনে কর, মদীনায় অবস্থান করবে এবং কুরাইশরা যেখানে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে থাকাকালেই তাদেরকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেবে, তাহলে সেটা করতে পার। তারপরও যদিওরা ওখানেই অবস্থান করে তাহলে সেটা তাদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থান বলে প্রমাণিত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে মদীনায় বসেই আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলে মদীনার বাইরে যেতে চাচ্ছিলেন না। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুলেরও মত ছিল অনুরূপ মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার বিপক্ষে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি এবং যাদের জন্য আল্লাহ উহাদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদানের সৌভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তাঁরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, শত্রুর মুকাবিলার জন্য আমাদেরকে মদীনার বাইরে নিয়ে চলুন। ওরা যেন মন করতে না পারে যে, আমরা দুর্বল কিংবা কাপুরুষ হয়ে গেছি।”

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, মদীনাতেই অবস্থান নিন, বাইরে যাবেন না। আল্লাহর কসম,আমরা মদীনার বাইরে গেলেই শত্রুরা আমাদের ক্ষতি বেশী করতে পারবে। আর শত্রুরা যদি মদীনায় প্রবেশ করে আক্রমণ চালায় তাহলে আমরা শত্রুদের অধিকতর বিপর্যয় ঘটাতে পারবো। অতএব হে আল্লাহর রাসূল, কাফিররা যেমন আছে ওদেরকে তেমনি থাকতে দিন। তারা যদি ওখানেই থেকে যায় তাহলে এ জায়গাটা তাদের জন্য জঘন্যতম অবরোধস্থল বলে সাব্যস্ত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে আমাদের পুরুষরা তাদের  সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে এবং স্ত্রী ও শিশুরা ওপর থেকে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করবে। আর যদি ফিরে যায় তাহলে যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে যাবে।” পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেসব মুসলমান মদীনার বাইরে কুরাইশদের সাথে লড়াই করতে আগ্রহী ছিলেন, তারা তাঁদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন। সে দিনটি ছিল জুম’আর দিন। একই দিন মালিক ইবনে আমর নামক জনৈক আনসার ইন্তিকাল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জানাযা পড়লেন। অতঃপর মুসলিম জনতার সামনে আসলেন। তিনি মদীনায় বসেই কুরাইশদের মুকাবিলা করতে চেয়েছিলেন ভেবে মুসলমানগণ অনুতপ্ত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনার মত পছন্দ করিনি,এটা আমাদের উচিৎ হয়নি। আপনি যদি মদীনাতেই অবস্থান করতে চান তবে তাই করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, তা হয় না, যুদ্ধের পোশাক পরার পর যুদ্ধ না করে তা খুলে ফেলা কোন নবীর পক্ষে শোভা পায় না।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাজার সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলেন। মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শাওত নামক স্থানে পৌঁছার পর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল আলাদা হয়ে গেল। সে বললো, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কথা শুনলেন, আমার কথা শুনলেন না। হে জনতা, আমি বুঝি না আমরা কিসের জন্য এতগুলো লোক প্রাণ দেবো?”

সে তার গোত্রের মুনাফিক ও সংশয়মান অনুসারীদের সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তদের পিছু পিছু গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাদেরকে দোহাই দিচ্ছি। তোমাদের মুসলমান ভাইদেরকে এবং আল্লাহর নবীকে উপস্থিত শত্রুর হামলার মুখে ফেলে যেও না।” তারা বললো, “যুদ্ধ হবে মনে করলে তোমাদের রেখে যেতাম না। আমাদের মনে হচ্ছে যুদ্ধ হবে না।” তারা যখন কিছুতেই রণাঙ্গনে ফিরে আসতে রাজী হলো না তখন আবদুল্লাহ বললেন, “হে আল্লাহর দুশমনরা, আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে দিন। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের মুখাপেক্ষী রাখবেন না। আল্লাহই তাঁর জন্য যথেষ্ট।”

আনসারগণ বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের ইহুদী মিত্রদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়?” তিনি বললেন, “ওদের দিয়ে কোন কাজ নেই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলেন। উহুদ পাহাড়ের নিকটবর্তী উপত্যাকায় তিনি অবাস্থান গ্রহণ করলেন। সৈণ্যদেরকে পাহাড়ের নিকটবর্তী প্রান্তে মোতায়েন করলেন এবং পাহাড়কে পেছনে রেখে দাঁড়ালেন। সৈন্যদেরকে বললেন, “আমি যুদ্ধের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ য্দ্ধু শুরু করবে না।”  কুরাইশরা ইতোমধ্যে তাদের সমস্ত উট ও ঘোড়া উহুদের অদূরে মুসলমানদের খাল বিধৌত ছামগার ফসল সর্মদ্ধ ভূমিতে ছেড়ে দিয়েছে। এ জন্য যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম নিষেধাজ্ঞা শুনে জনৈক আনসার বললেন, “আউস ও খাজরাযের ফসলী  জমি থেকে আমরা এখনো আমাদের প্রাপ্য অংশ আদায় করিনি। এমতাবস্থায় সেখানে পশু চরানো কিভাবে বরদাশত করা যায়?”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাতশ’ সৈন্যকে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে ৫০ জন সৈন্যের তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি করলেন। তিনি সাদা কাপড় দ্বারা চিহ্নিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, “ঘোড়সওয়ার শত্রুদেরকে তীর বর্ষণ করে তাড়িয়ে দিও। যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি আর পরাজিত হই কোন অবস্থায়ই কাউকে পেছন দিক থেকে আসতে দেবে না। দৃঢ়ভাবে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকো, যেন তোমার দিক থেকে আমরা আক্রান্ত না হই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটো বর্ম এক সাথে পরে নিলেন এবং পতাকা দিলেন মুস’আব ইবনে উমাইরের হাতে।

পনর বছর বয়স্ক সামুরা ইবনে জুনদুব ও রাফে ইবনে খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন প্রথমে যোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করেননি।পরে অনেক সাহাবী বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, রাফে ভাল তীরন্দাজ।” তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। রাফেকে অনুমতি দিলে আবার অনেকে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সামুরা রাফেকে মল্লাযুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে।” তখন তিনি সামুরাকেও অনুমতি দিলেন। কিন্তু উসামা ইবনে যায়িদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, যায়িদ ইবনে সাবিত, বারা ইবনে হাযম ও উসাইদ ইবনে যুহাইরকে অনুমতি দেননি। পরে খন্দক যুদ্ধে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়। তখন তাদের বয়স ছিল পনর বছর।

কুরাইশরা তাদের তিন হাজার যোদ্ধাবিশিষ্ট সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করলো। তাদের সাথে দুশো ঘোড়া ছিল। এই ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ডান পাশে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে এবং বাম পাশে ইকরিমা ইবনে আবু জাহলকে রাখা হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ তরবারী দেখিয়ে বললেন, “এই তরবারীর হক আদায় করতে কে প্রস্তুত আছো?” অনেকেই এগিয়ে গেল। তিনি কাউকেই তরবারী দিলেন না।

আবু দাজানা এগিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ তরবারীর হক কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ তরবারী দিয়ে শত্রুকে এত বেশী আঘাত হানতে হবে যেন তা বাঁকা হয়ে যায়।” আবু দুজানা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমি নেব এবং হক আদায় করবো।” তিনি আবু দাজানাকেই তরবারিখানা দিলেন। বস্তুত : আবু দুজানা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর যোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তিনি ভীষণ গর্বিত ভঙ্গীতে চলতেন। তাঁর একটা লাল বন্ধনী ছিল। তা দিয়ে যখন নিজের গায়ে আঘাত করতেন তখন লোকে বুঝতো যে, তিনি এক্ষুণি যুদ্ধে নামবেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে তরবারীটা নেয়ার পর সেই বন্ধনীটা বের করলেন এবং নিজের মাথায় তা দিয়ে আঘাত করলেন। অতঃপর সৈন্যদের ব্যুহের মাঝে হেলে দুলে গর্বিত ভঙ্গীতে চলতে লাগলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “রণাঙ্গন ছাড়া হাঁটা চলার এই ভঙ্গীটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়। ”

ওদিকে আবু সুফিয়ান তার বাহিনীর পতাকাবাহী বনু আবদুদ দারের লোকদেরকে যুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বললো, “হে বনু আবদুদ দার, তোমরা বদরের যুদ্ধে আমাদের পতাকা বহন করেছিলে। কিন্তু সে যুদ্ধে আমাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা  দেখেছো। মনে রেখ, সৈন্যদের ওপর পতাকার দিক থেকেই হামলা এসে থাকে। পতাাক যদি নেমে যায় তাহলে সৈন্যরা পর্যুদস্ত হয়। সুতরাং তোমরা হয় পতাকা দৃড়ভাবে ধরে রাখবে নয়তো সরে যাবে। ওটা আমরাই ধরে রাখতে পারবো।” এ কথা শুনে পতাকাবাহীরা পতাকার প্রতি মনোযোগী হলো এবং আব সুফিয়ানের কাছে প্রতিজ্ঞা করে বললো, “আমরা আমাদের অধিনায়কত্ব তোমার কাছে অর্পণ করছি। আগামীকাল যখন আমরা লড়াইয়ে নামবো, তখন দেখে নিও আমরা কেমন লড়াই করি।” আবু সুফিয়ান এই সংকল্পই তাদের মধ্যে সৃস্টি  করতে চেয়েছিলো।

পরের দিন লড়াই শুরু হলে উতবার কন্যা হিন্দ তার সহযোগী মহিলাদের সথে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে পুরুষদের পিছু পিছু চলতে লাগলো এবং এই বলে তাদে উত্তেজিত করতে লাগলো:

“চমৎকার, হে বনু  আবদুদ্ দার,

চমৎকার  তোমাদের তৎপরতা) হে পশ্চাদ্দিকের রক্ষকগণ!

প্রতিটি ধারালো তরবারী দ্বারা আঘাত হানো”

তারা আরো বলছিলো, “যদি ধাবমান থাক, আলিঙ্গন করবো এবং নরম গদি বিছিয়ে দেবো

আর যদি পিছিয়ে যাও

আলাদা হয়ে যাবো,

আমাদের ভালোবাসা পাবে না তোমরা।”

উহুদের যুদ্ধে সাহাবীগণ যাতে পরস্পরকে চিনতে পারে সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে একটা প্রতীক ধ্বনি শিখিয়ে দিলেন, তা হলো, “আমিত, আমিত!” অর্থাৎ মরণ আঘাত হানো। মরণ আঘাত হানো।

ক্রমে যুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করলো। আবু দুজানা এমন অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন যে, যাকেই সামনে পান হত্যা করতে করতে এগিয়ে যান। যুবাইর ইবনুল আওয়াম বলেন, “মুশরিকদের একটা লোক আমাদের কোন সৈনিককে দেখলেই তাকে হত্যা করতে লাগলো। আবু দুজানা ও এই লোকটি পরস্পর কাছাকাছি এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন দু’জনকে একত্রিত করেন। অচিরেই দু’জন মুখোমুখি হলো এবং উভয়ে উভয়কে আঘাত হানতে শুরু করলো। মুশরিক লোকটা আবু দুজানাকে আঘাত করলো। আবু দাজানা তার চামড়ার তৈরী ঢাল দিয়ে আঘাত ফেরালেন। তরবারী ঢালের মধ্যে ঢুকে আটকে রইল। আর আবু দাজানা তাকে পাল্টা আঘাত করে হত্যা করলেন। অতঃপর দেখলাম তিনি হিন্দ বিনতে উতবার মাথার ওপর তরবারী উত্তোলন করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তরবারী নমিয়ে নিলেন। [৬২. আবু দুজানা বলেন: রণাঙ্গনে দেখলাম কে একজন কাফিরদেরকে উস্কিয়ে দিচ্ছে। আমি তার প্রতিরোধে এগিয়ে গেলাম। তরবারী তুলতেই সে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। দেখলাম সে একজন স্ত্রীলোক। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবারী দিয়ে একজন নারীকে আঘাত করলে তরবারীর অমর্যাদা হবে মনে করে বিরত রইলাম।]

হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) য্দ্ধু করতে করতে আরতাহ ইবনে আবদ শুরাহবীলকে হত্যা কলেন। সে ছিলো পতাকা বহনকারী দলের অন্যতম সদস্য। পরক্ষণেই তিনি দেখতে পেলেন সিবা ইবনে আবদুল উয্যা তার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে। তিনি তাকে যুদ্ধের চ্যালেজ্ঞ দিলেন। বললেন, “ওহে হাজামনীর বেটা, আমার সামনে আয়। ” সিবার মা মক্কায় খাতনা করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

যুবাইর ইবনে মতিয়িমের গোলাম ওয়াহশী বলেন, আমি হামযার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম, তিনি স্বীয় তরবারী শত্রুদের দিকে তুলছেন আর চোখের নিমিষেই তাদেরকে সাবাড় করে দিচ্ছেন। সামনের কাউকেই জীবিত ছাড়ছেন না। যুদ্ধ করতে করতে তাঁর সারা দেহ ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে ধূসর বর্ণের উটের মত হয়ে গেছে। এই সময় সিবা ইবনে আবদুল ইযযা আমার সম্মাুখ দিয়ে গিযে হামযার কাছাকাছি হলো। হামজা তাকে দেখে হুংকার ছাড়লেন, “এই হাজামনীর বেটা, আয় আমার কাছে, মজা দেখাই!” এই বলেই তাকে আঘাত হানলেন। কিন্তু তার মাথায় আঘাত লাগলোনা বলে মনে হলো। আমি হামযার প্রতি আমার বর্শা তাক করলাম। লক্ষ্য ঠিক হয়েছে বলে যখন নিশ্চিত হলাম, তখন ছুঁড়ে মারলাম তাঁর প্রতি। বর্শা তাঁর তরপেটে গিয়ে বিদ্ধ হলো এবং দুই উরুর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তিনি এ অবস্থায়ও আমার দিকে এগুলেন। কিন্তু পরক্ষণেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে গেলেন। আমি তাকে খানিকটা সময় দিলাম। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন আমি গিয়ে আমার বর্শা টেনে বের করলাম।

অতঃপর কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ফিরে গেলাম। রণাঙ্গনে আমার হামযাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজন ছিল না। আমি তাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীন হতে পারবো জেনেই তাকে হত্যা করলাম। মক্কা ফিরে যাওয়া মাত্রই আমাকে স্বাধীন করে দেয়া হলো। অতঃপর মক্কাতেই বাস করতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলে আমি পালিয়ে তায়েফে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। কিন্তু তায়েফ থেকে একদর প্রতিনিধি ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারলাম না যে, কোথায় যাবো। ভাবলাম, সিরিয়া কিংবা ইয়ামানে চলে যাবো। কেননা সেখানে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। ইতোমধ্যে এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণ করলে এবং কালেমায়ে শাহাদাত পড়লে কাউকেই হত্যা করেন না।” এ কথা শুনে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেলাম। তিনি আমার উপস্থিতিতে এবং তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে সত্য দীনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। চোখ তুলে একবার আমর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসো। তুমি কিভাবে হামযাকে হত্যা করেছিলে আমাকে বলো।” আমি তাকে ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। সব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তুমি কখনো আমর সামনে আসবে না। আমি যেন তোমাকে না দেখি।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন আমি তাঁর কাছে গেলেই এক পাশে সরে যেতাম যেন আমার মুখ তিনি দেখতে না পান।

মুস’য়াব ইবনে উমাইর (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করার জন্য বীরোচিতভাবে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। তাঁকে হত্যা করেছিলো ইবনে কিময়া লাইসী। সে মনে করেছিরো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই হত্যা করেছে। তাই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” মুসয়াব নিহত হরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবের হাতে পতাকা অর্পন করলেন। অতঃপর আলী (রা) ও অন্যান্য মুসলিম বীর শার্দুলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

উহুদের যুদ্ধ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের পতাকাতলে বসলেন। তিনি আলী (রা) কে দূত মারফত নির্দেশ দিলেন যে, “পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও।” আলী এগিয়ে গিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “আমি বিভীষিকার বাবা।” [৬৩.কুরাইশ পক্ষের আবু সা’দ হুংকার দিয়েছিলো, “আমি বিভীষিকা সৃষ্টি কারী। আমার সাথে লড়তে কে প্রস্তুত আছে, আস।” এর জবাবেই আলী (রা) উক্ত হুংকার দেন।] আবু সা’দ এগিয়ে এসে তাকে বললো, “হে বিভীষিকার বাবা, তোমার লড়াই করার শখ আছে নাকি?” আলী বললেন, “হ্যাঁ, আছে।” অতঃপর উভয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আঘাত ও পাল্টা আঘাত চললো। অবশেষে আলী একটা আঘাত করেই তাকে ধরাশয়ী করে ফেললেন। ধরাশায়ী করেই আলী (রা) সেখান থেকে সরে গেলেন এবং তাকে মরণ আঘাত হানলেন না। আলীকে তাঁর সঙ্গীরা বললেন, “ওকে চূড়ান্ত আঘাত না করে সরে গেলেন কেন?” তিনি জবাব দিলেন, আবু সা’দ আমাকে তার যৌনাঙ্গ দেখিয়েছে। কিন্তু আমার মনে তার প্রতি দয়া ও করুণার সঞ্চার হলো এবং সেই করুনাবশেই আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। তবে বুঝতে পেরেছি যে, স্বয়ং আল্লাহই তাকে হত্যা করেছেন।”

আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহ (রা) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুসাফে ইবনে তালহা ও তাঁর  ভাই জুলাস ইবনে তালহাকে হত্যা করেন। উভয়কেই তিনি এক এক করে বর্শা দিযে আঘাত করেন এবং  প্রত্যেকে আহত অবস্থায় তার মা সুলাফার কাছে যায় এবং তার কোলে মাথা রাখে। সুলাফা পুত্রকে জিজ্ঞেস করে, “ হে প্রিয় বৎস, তোমাকে কে আহত করলো?” সে জবাব দেয়, “ইবনে আবুল আকলাহ।” তখন  সুলাফা মান্নত করে যে, আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহকে হত্যা করা সম্ভব হলে সে তার মাথা খুলিতে মদ পান করবে।

হানযালা ইবনে আবু আমের গাসীল [ফেরেশতারা তাঁকে গোসল দিয়েছিলেন বলে তাঁকে মরণোত্তর গাসিল উপাধিতে ভূষিত করা হয়।] আবু সুফিয়ানের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এক পর্যায়ে হানযালা আবু সুফিয়ানের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। তা দেখে শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ নামক কুরাইশ যোদ্ধা হানযালাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমাদের বন্ধু হানযালাকে ফেরেশতারা গেসল করাচ্ছেন। ” পরে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে জানা যায় যে, তাঁর ওপর গোসল ফরয ছিল। জিহাদের ডাক শোনার পর আর গোসল করার অবকাশ পাননি। তৎক্ষণাৎ রণাঙ্গনে চলে যান।

এরপর আল্লাহ মুসলমানদের ওপর সাহায্য নাযিল করেন এবং তাদের সাথে কৃত স্বীয় ওয়াদা পূরণ করেন। ফলে তারা কুরাইশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে হত্যা ও নির্মূল করতে সক্ষম হন। মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের মুখে তিষ্ঠাতে না পেরে কাফিররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং মারাত্মকভাবে পরাজয় বরণ করে।

যুবাইর (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি উতবা তনয়া হিন্দ ও তার সহচরদেরকে উর্ধশ্বাসে পালাতে দেখেছি। তাদেরকে পাককড়াও থেকে বাঁচানোর জন্য মুশরিকদের কোন বড় বা ছোট দলকে এগুতে দেখলাম না। এভাবে বিজয় যখন ষোলকনায় পূর্ণ হতে চলেছে, তখন সহসা তীরন্দাজ বাহিনী তদের অবস্থান ত্যাগ করে পলায়নরত কুরাইশ বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো এবং আমাদের পেছরেন গিরিপথটাকে খোলা রেখে গেল। আমরা পেছন দিক থেকে আক্রান্ত হলাম। ঠিক এই সময় কে যেন চিৎকার করে বললো, “মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে।” অনন্যোপায় হয়ে আমরা রণাঙ্গনে ফিরে এলাম, আর কুরাইশ বাহিনীও আমাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অথচ আমরা তাদের পতাকাবাহীদেরকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করেছিলাম এবং এতখানি অচল করে দিয়েছিলাম যে, তাদের ভুলু-িত পতকার কাছেও কেউ যেতে পারেনি। অবশেষে আমরাহ বিনতে হারেসিয়া নাম্নী এক মহিলা তা তুলে নিয়ে কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেয়। অতঃপর সেই পতাকাকে কেন্দ্র করে ও সম্বল করে তারা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়।

মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে শুত্রুরা তাদের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক আক্রমণ চালালো। ফলে সে দিনটা হয়ে দাঁড়ালো এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা ও পরিশুদ্ধির দিন। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমানকে আল্লাহ শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করলেন। এমনকি শত্রুরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি শরীরের এক পার্শ্বে একটি আঘাত খেলেন। এতে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গেল এবং তাঁর মুখম-ল ও ঠোঁট আহত হলো। উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস তাঁকে এ আঘাত করেছিলো। তাঁর সমগ্র মুখম-ল রক্তাক্ত হয়ে গেল। তিনি হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বললেন, “যে জাতি তার নবীর মুখম-ল রক্তরঞ্জিত করে সে জাতি কি করে কল্য্যন লাভ করবে? অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকছেন।” আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ উক্তির জবাবে নিন্মোক্ত আয়াত নাযিল করলেন:

[আরবী *******]

“(হে নবী!) কোন চূড়ান্ত ফায়সালার ইখতিয়ার তোমার নেই। ইখতিয়ার রয়েছে আল্লাহর হাতে। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। কেননা তারা যালিম। ”(আলে ইমরান)

আবু সাঈদ খুদরীর (রা) বর্ণনা মতে উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বর্শার আঘাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডান দিকের নিচের দাঁত ভেঙে যায় এবং তাঁর নীচের ঠোঁট আহত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে শিহাব জুহরী তাঁর কপাল জখম করে দেয়। আর ইবনে কুমরা তাঁর  চোয়ালের উপরিভাগে আঘাত হানে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণের দুটো অংশ ভেঙে তার চোয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়। অতঃপর মুসলমানদেরকে তাদের অজান্তে ফেলে মারার মত জন্য আবু আমের যে গর্ত খুড়ে রেখেছিল তার একটি তে তিনি পড়ে যান। এই সময় আলী (রা) এসে তাঁর হাত ধরেন এবং তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) তাঁকে ওপরে তোলেন। তাঁদের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়াতের সক্ষম হন। আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনে সিনান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের রক্ত চুষে নেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললেন, “আমর রক্ত যার রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে গোযখের আগুন তকে স্পর্শ করতে পারবে না।”

মুশরিক বাহিনী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কুরবানী করতে প্রস্তুত?  এ কথা শুনে যিয়াদ ইবনে সাকান সহ পাঁচজন আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ ইবনে সাকান কিংবা আম্মারা ইবনে ইয়াযীদ ইবনুস সাকান। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতরভাবে আহত হলেন। ইতিমধ্যে মুসলমানদের  একটি দল সেখানে ফিরে এলো এবং উক্ত আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আহত সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন, “ওকে আমার কাছে আনো।” মুসলমানগণ তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলো। তিনি নিজের জানুর ওপর তার মাথা রেখে শোয়ালেন। এই অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী ইনতিকাল করলেন।

আবু দুজানা (রা) নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর টিঠে তীর বিদ্ধ হচ্ছিলো আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে তাঁর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে তাঁর গায়ে বিদ্ধ তীরের সংখ্যা প্রচুর। আ সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিরক্ষার চেষ্টায় তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সা’দ বললেন, “আবু  দুজানাকে দেখলাম, আমাকে একটার পর একটা তীর দিয়েই চলছেন আর বলছেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক। তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাক।’ এমনকি সময় সময় তিনি ফলকবিহীন তীরও দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘নিক্ষেপ কর।”

পরাজয় ঘটার এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাত লাভের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন কা’ব ইবনে মালিক। কা’ বলেন, “শিরস্ত্রাণের ভেতরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিলো আর তা দেখেই আমি চিনতে পারলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম “হে মুসলমানগণ, সুসংবাদ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে আছেন। তিনি এখানে।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইশারা করে বললেন, “তুমি চুপ থাক।”

মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চেনার পর তাঁকে নিয়ে সবাই পর্বতের ঘাঁটিতে চলে গেলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক, উমার ফারুক, আলী ইবনে আবু তালিব, তালহা ইবন উবাইদাল্লাহ ও যুবাইর ইবনুর আওয়াম সহ একদল মুসলমান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের ঘাঁটিতে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন উবাই ইবনে খালাফ সেখানে পৌঁছলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, এ যাত্রা তুমি প্রাণে বেঁচে গেলেও তোমার নিস্তার নেই।” মসলমানগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ লোকটিকে সহানুভূতি দেখানো কি আমাদের কারো জন্য সঙ্গত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওকে আসতে দাও।” সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে, তিনি হারেস ইবনে সিম্মারের কাছ থেকে বর্শা নিলেন। কোন কোন বর্ণনানুসারে, বর্শা হাতে নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ভংয়কর পাঁয়তারা করলেন যে, উট প্রবল জোড়ে নড়ে উঠলে তার পিঠের ওপর বসা বিষাক্ত ভিমরুলের ঝাঁক যেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে যায়; আমরাও ঠিক তেমনি ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে দূরে সটকে পড়লাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার ঘাড়ের ওপর বর্শার আঘাত হানলেন। আঘাত খেয়ে উবাই ইবনে খালাফ তার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো এবং বেশ কয়েকটা গড়াগড়ি খেলো।

ইতিপূর্বে উবাই ইবনে খালাফ মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম সাথে দেখা করে বলতো, “হে মুহাম্মাদ, আমার একটা ঘোড়া আছে। তার নাম ‘আওজ’। তাকে আমি প্রতিদিন এক ফারাক (প্রতি ৪০ কেজি) ভুট্রা খাওয়াই। এই ঘোড়ায় চড়েই আমি তোমাকে হত্যা করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিতেন, “বরং আল্লাহ চাহেতো আমিই তোমাকে হত্যা করবো।”

উবাইয়ের কাঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জখমটি করে দিয়েছিলেন, সেটা তেমন গুরুতর জখম না হলেও তা দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। ঐ অবস্থাতেই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ আমাকে খুন করেছে।” কুরাইশরা বললো, “আসলে তোমার মন অতিমাত্রায় ঘাবড়ে গেছে। তোমার কোন ভয় নেই।” সে বললো, “মক্কায় থাকাকালেই মুহাম্মাদ আমাকে বলেছিলো: তোমাকে আমিই হত্যা করবো।’ এখন আমার আশংকা হয়, সে যদি আমার প্রতি শুধু থুথুও নিক্ষেপ করে তা  হলেও আমি মরে যাবো।” কুরাইশরা তাকে নিয়ে মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে সারেফ নামক স্থানে আল্লাহর এই দুশমনের জীবনলীলা সাঙ্গ হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বত ঘাটির মুখে উপনীত হলে আলী ইবনে আবু তালিব (রা) পানির সন্ধানে বেরুলেন, উহুদের পাশ্ববর্তী জলাশয় বা প্রস্তর ঘেরা হ্রদ ‘মেহরাস’ থেকে মশক ভরে পানি আনলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পান করতে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানিতে একটা দুর্গন্ধ পেয়ে তা পান করলেন না। বরং এ পানি দিয়ে তিনি মুখের রক্ত ধুয়ে ফেললেন এবং কিছুটা মাথায় ঢালতে ঢালতে বললেন, “আল্লাহর নবীর মুখকে যে ব্যক্তি রক্তে রঞ্জিত করেছে সে আল্লাহর ভয়ংকর ক্রোধের শিকার হবে।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের একটি টিলার ওপর আরোহণে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং শুধু দুটি  বর্মের সাহায্য নিয়ে শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। টিলায় আরোহণের চেষ্টায় ব্যর্থ হলে তালহা ইবনে উবাইদাল্লাহ (রা) তাঁকে ঘাড়ে করে আরোহণ করালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তালহা রাসূলের প্রতি যে সদাচরণ করলো তাতে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেল।”

উহুদ যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিল বনু সা’লাবা গোত্রের মুখাইরীক। উহুদ যুদ্ধের দিন সে তার স্বগোত্রীয় ইহুদীদেরকে বললো, “হে ইহুদীগণ, তোমরা নিশ্চিতভাবেই জান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য।” ইহুদীরা বললো, “আজ তো শনিবার।” সে বললো, “তোমাদের জন্য শনিবারের অজুহাত যুক্তিযুক্ত নয়।” অতঃপর সে তরবারী ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলো। সে বললো, “আমি যদি মারা যাই তাহলে আমার সমস্ত সম্পত্তি মুহাম্মাদের। তিনি ঐ সম্পত্তি যেভাবে খুশী ব্যবহার করবেন। ” অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেল এবং তাঁর পক্ষে লড়াই করে নিহত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মুখাইরীক ইহুদীদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।”

আবু হুরাইরা (রা) বলতেন, “তোমারা আমাকে বলে দাও, কে সেই ব্যক্তি যে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ সে নামায পড়েনি?” লোকেরা জবাব দিতে না পেরে জিজ্ঞাস করতো, “কে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি?” তিনি বলতেন, “বনু আবদুল আশহালের উসাইরিম আমর ইবনে সাবিত ইবনে ওয়াকাশ।” হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান বলেন, “আমি মাহমুদ ইবনে আসাদকে জিজ্ঞেস করলাম, “উসাইরিম কি রকম লোক ছিল?” তিনি বললেন “সে আগে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন উহুদ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন সেদিন সে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করে ও ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর নিজের তরবারী নিয়ে ছুটতে থাকে এবং রণাঙ্গনে পৌঁছে যায়। সে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করে এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে। পরে বনু আবদুল আশহালের লোকেরা রণাঙ্গনে তাদের লোকদের লাশ খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়। তারা তাকে চিনতে পেরে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, উসাইরিম এখান এলো কিভাবে? সেতো ইসলামকে  অস্বীকার করতো। তখন সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আমর, তুমি কি কারণে এখানে লড়াই করতে এলে? স্বগোত্রের টানে, না ইসলামের আকর্ষষে?’ সে বললো, ইসলামের আকর্ষণে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আমি ঈমান এনেছি এবং মুসলমান হয়েছি। তরপর তরবারী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলাম এবং যুদ্ধ করে আহত হয়েছি। এর কিছুক্ষণ পরই উসাইরিম তাদের চোখের সামনে মারা গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘটনা শুনে বললেন: সে জান্নাতবাসী।”

আমর ইবনে জামুহ ছিলেন একজন সাংঘাতিক খোঁড়া লোক। তাঁর সিংহের মত চারটি  ছেলে ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করতে যেতো।উহুদ যুদ্ধের দিন তারা তাদের পিতা আমরকে আটকিয়ে রাখতে চাইলো। বললো, “আল্লাহ আপনাকে যুদ্ধে যাওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ” আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, “আমার ছেলেরা আমাকে এই যুদ্ধে আপনার সাথে যেতে দিতে চায় না। আল্লাহর কসম, এই খোঁড়া পা নিয়েই আমি জান্নাতে প্রবেশ করার আশা রাখি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ যে তোমাকে জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন সে কথা ঠিকই।” পক্ষান্তরে তাঁর ছেলেদেরকে তিনি বললেন, “তোমাদের পিতাকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিলেও পার। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে শাহাদাত নির্ধারিত রেখেছেন।” অতঃপর আমর উহুদে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। ওদিকে উতবার কন্যা হিন্দ এবং তার সহচরীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিহত সাহাবীদের লাশ বিকৃত করতে শুরু করলো। তাঁদের নাক কান কেটে ফেললো। হিন্দ তা দিয়ে পায়ের খারু বা গুলফ বন্ধনী ও গলার মালা বানালো এবং যুবাইর ইবনে মুতয়িমের গোলাম ওয়াহশীকে সেইসব গুলফবন্ধনী, মালা ও কানের দুল উপহার দিল। সে হামযার কলিজা বের করে চিবালো, কিন্তু গিলতে না পেরে ফেলে দিল।

হালিস ইবনে যাব্বান সেদিন কুরাইশ বাহিনীতে হাবশী সৈন্যদের অধিনায়ক ছিল। সে আবু সফিয়ানের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। দেখলো, আবু সফিয়ান তার বর্শার ফলক দিয়ে হামযার চিবুকে আঘাত করছে আর বলছে, “অবাধ্য কোথাকার। এখন মজাটা আস্বাদন কর”। হালিস, এ দৃশ্র দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। বনু কিনানার লোকেরা কাছেই ছিল। তাদেরকে ডেকে বললো।, “হে বনু কিনানা, কুরাইশ নেতার বা- দেখো। নিজের মৃত চাচাতো ভাইয়ের সাথে কি আচরণ করছে।” আবু সুফিয়ান অপ্রতিভ হয়ে বললো, “কি আপদ, এটা আমার পদঙ্খলন। কাউকে বলো না।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান রণাঙ্গণ থেকে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। রওনা হবার পূর্ব মুহূর্তে সে পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে উচ্চাস্বরে ধ্বনি দিল, “কর্মতৎপর লোকেরা যথার্থ পুরস্কার পেয়েছে। যুদ্ধের জয়পরাপয় পালাক্রমে হয়ে থাকে। একদিন এ পক্ষে, আর একদিন অন্যপক্ষে। হে হুবাল, (মূর্তির নাম) তুমি পরাক্রান্ত হও। অর্থাৎ তোমার ধর্মকে জয়যুক্ত কর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধ্বনির জবাব দেয়ার জন্য উমারকে (রা) নির্দেশ দিয়ে বললেন, “তুমি বল, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ। আমরা ও তোমরা সমান নই। আমাদের নিহতরা জান্নাতবাসী আর তোমাদের নিহতরা দেযখবাসী।” উমার যখন এই পাল্টা ধ্বনি দিয়ে আবু সুফিয়ানের জবাব দিলেন, তখন আবু সুফিয়ান বললো, “উমার, একটু এ দিকে এসো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে বললেন, “যাও, সে কি বলতে চায় শুনে এসো।” উমার এগিয়ে গেলেন। আবু সুফিয়ান বললো, “হে উমার, তোমাকে আল্লাহর দোহাই। সত্য করে বলো, আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি?” উমর বললেন, “আল্লাহর কসম, না। তিনি এই মুহূর্তেও তোমার কথাবার্তা শুনেছেন।” আবু সুফিয়ান বললা, “তোমাকে আমি ইবনে কুময়ার চেয়ে সৎ ও সত্যবাদী মনে করি।” উল্লেখ্য যে, ইবনে কুময়া কুরাইশদের আছে বলেছিলো, “আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান উমারকে সম্বোধন করে বললো, “তোমাদের নিহতদের কিছু লাশ বিকৃত করা হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমি তা করতে নির্দেশ দেইনি, নিষেধও করিনি। আবার এ কাজে আমি খুশীও নই, অসন্তুষ্টও নই।”

আবু সুফিয়ান রণাঙ্গন ত্যাগ করে যাওয়ার সময় “তোমাদের সাথে আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবার দেখা হবে” বলে যুদ্ধের আগাম চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশক্রমে জনৈক সাহাবী আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দিলেন যে, আগামী বছর তার মুকাবিলা করতে তাঁরাও প্রস্তুত রয়েছেন।

কুরাইশ বাহিনী ময়দান ত্যাগ করে রওয়ানা হয়ে যাবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, ওদের পেছনে পেছনে গিয়ে লক্ষ্য কর, ওরা কোথায় যায় এবং কি করে। তারা যদি অশ্বপালকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায় এবং উটে আরোহণ করে তাহলে বুজতে হবে, তারা মক্কা অভিমুখে  চলেছে। আর যদি ঘোড়ায় আরোহণ করে ও উট টেনে নিয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তারা মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আল্লাহর শপথ, তারা মদীনা আক্রমণ করতে চাইলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য নিযে হাজির হবো এবং প্রতিরোধ করবো।” আলী (রা) বলেন, “আমি তাদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম,তারা অশ্বপাল দক্ষিন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং উটে চড়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেছে।”

এবার মুসলমানগণ নিহতদের সন্ধানে বেরুলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ বিন রাবীর সন্ধান নিয়ে দেখ, সে মৃত, না জীবিত।” এক আনসারী সাহাবা তাঁর খোঁজ করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁকে নিহতদের মাঝে মারাত্মকভাবে আহত ও মুমূর্ষু অবস্থায় পেলেন। তাঁকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হুকুম দিয়েছেন তুমি বেঁচে আছ না মারা পড়েছো তা দেখতে।” সা’দ বললেন, আমাকে মৃতই মনে কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানিয়ে বলো: হে আল্লাহর রাসূল, সা’দ ইবনে রাবী আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছে যে, একজন নবীকে তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে যতটা উত্তম পুরস্কার দেয়া সঙ্গত তাই যেন আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে দেন। আর মুসলমানদের নিকট আমার সালাম পৌঁছে দিয়ে বলো: সা’দ ইবনে রাবী বলেছে যে, তোমাদের একটি লোকও জীবিত থাকতে তোমাদের নবীর কাছে যদি দুশমন পৌঁছতে পারে তাহলে আল্লাহর কাছে তোমরা কোন সাফাই দিতে পারবে না।” এ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই সা’দ মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়লেন। অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে সা’দের খবর জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (রা) সন্ধানে বের হলেন। তাঁকে প্রান্তরের মধ্যস্থলে পেলেন। দেখলেন, তার পেট চিরে কলিজা বের করা হয়েছে এবং নাক কান কেটে তাঁর লাশ বিকৃত করা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সাফিয়া যদি দুঃখ না পেতো এবং একটা চিরস্থায়ী রীতির জন্ম হওয়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে আমি হামযাকে এখানেই রেখে চলে যেতাম এবং তার লাশ পশু পক্ষিকে খেতে দিতাম। আল্লাহ যদি আর কোন রণাঙ্গনেও আমাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়যুক্তকরে তাহলে আমি তাদের ত্রিশ জনের লাশকে এভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত করবো।” মুসলমানরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিদারুণ মর্মাহত ও চাচার প্রতি পাশবিক আচরণে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত দেখলো, তখন তাঁরাও প্রতিজ্ঞা করলো যে, কোন সময় কুরাইশদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তাদের লাশ এমনভাবে বিকৃত করবে যার কোন নজীর আরবের ইতিহাসে নেই।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের ঐ প্রতিজ্ঞা প্রসঙ্গেই আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন-

[আরবী *******]

“তোমরা যদি কাউকে শাস্তি দাও তাহলে তাদের পক্ষ থেকে যেমন শাস্তি তোমরা পেয়েছিলে তার সমপরিমাণ শাস্তি দাও। আর যদি সহিষ্ণুতার পরিচয় দাও তাহলে (জেনে রাখ) ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। তুমি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর। তেমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। তাদের আচরণে মর্মাহত হয়ো না এবং তাদের দুরভিসন্ধিতে মনকে সংকীর্ণ করো না।”

এ আয়াত দুইটির  প্রভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের ক্ষমা করলেন এবং লাশ বিকৃত করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বললেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার লাশ একটি চাদরে আবৃত করলেন। তারপর জানাজার নামায আদায় করলেন। তারপর অন্যান্য লাশের পাশে এনে রাখা হলো এবং প্রত্যেকের জন্য তিনি জানাজা পড়লেন। এভাবে হামযার জন্য বাহাত্তর বার জানাজা পড়লেন।

ইবনে ইসহাক বলেন, হামযাকে দেখতে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা সাফিয়া এলেন। হামযা ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার পুত্র যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে বললেন, “তুমি তোমার মার সাথে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দাও যেন সে ভাইয়ের এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে না পায়। ” যুবাইর গিয়ে বললেন, “মা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে ফিরে যেতে বলছেন।” সাফিয়া বললেন, !“কেন?” আমার ভাইয়ের লাশ বিকৃত করার কথা আমি শুনেছি। ওটা আল্লাহর পথেই হয়েছে এবং তা আমার জন্য খুশির ব্যাপার। ইনশাআল্লাহ আমি সবর করবো এবং সন্তুষ্ট থাকবো।” যুবাইর বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তাকে আসতে দাও।” সাফিয়া এলেন, হামযাকে দেখলেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়লেন ও তাঁর জন্য ক্ষমা প্রর্থনা করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তাঁর লাশ দাফন করা হলো।

মুসলমানদের অনেকে শহীদের লাশ মদীনায় নিয়ে দাফন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে এরূপ করতে নিষেধ করেন এবং যেখানে নিহত হয়েছে সেখানেই দাফন করতে বলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবা এথকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শহীদদের লাশ দেখলেন তখন বললেন, “আমি এঁদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহর পথে যেÑই আহত হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন তাকে পুনর্জীবিত করবেন, তখন তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে রক্তের রং থাকবে রক্তেরই মত আর ঘ্রাণ হবে মৃগনাভির মত। তোমরা দেখ, এদের মধ্যে কে বেশী কুরআন আয়ত্ত করেছিল। অতঃপর সেরূপ ব্যক্তিকে  অন্যান্যদের মুখোমুখি রেখে দাফন কর।” অতঃপর এক এক কবরে দুই থেকে তিনজনকে একসাথে দাফন করা হলো।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। এই সময় হামনা বিনতে জাহাশ নাম্নী এক মহিলা তাঁর সাথে দেখা করলেন। তাঁকে প্রথমে তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের শাহাদাতের খবর দেয়া হলে তিনি ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন। এরপর তাঁকে তাঁর মামা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের খবর দেয়া হলে তিনি পুনরায় ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন এরপর তাঁকে জানানো হলো যে, তাঁর স্বামী মুসয়াব ইবনে উমাইর শহীদ হয়েছেন, তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন, “এজন্য মেয়ের স্বামী তাঁর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।” মামা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে তাঁকে অবিচলিত এবং স্বামীর মৃত্যুর খবরে চিৎকার করতে দেখেই তিনি এ কথা বলেন।

এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আবদুল আশহাল ও জাফর পরিবারের আনসারি সাহাবীদের বাড়ীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন যুদ্ধে নিহত আপনজনদের বিয়োগে ব্যথিত ও শোক সন্তপ্ত পরিবারগুলোর মর্তভেদী কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। এই সময় হামযার কথা মনে করে তিনিও কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “হাময়ার জন্য কোন ক্রন্দসী নেই!” পরে সা’দ ইবনে মুয়ায ও উসাইদ ইবনে হুদায়ের বাড়ীতে ফিরলে তারা তাদের পরিবারের নারীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচার জন্য কাঁদতে ও বিলাপ করতে নির্দেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার জন্য ঐসব মহিলার কান্না শুনতে পেয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, মসজিদে বসে তার কাঁদছে। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। এখন তোমরা চলে যেতে পার। কেনান তোমরা আমাকে যথেষ্ট সাহনুভূতি দেখিয়েছ।”

বনু দিনারের আরেক মহিলা। তার স্বামী, ভাই ও পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। তাকে তার ঐসব আপনজনের নিহত হওয়ার খবর শোনানো হলে সে নির্বিকারভাবে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কি অবস্থা?” সবাই বললো, “তিনি ভাল। তুমি যেমন পছন্দ কর, তিনি সে রকমই আছেন।”মহিলা বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দেখাও। আমি তাকে দেখে নিই।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখানো হলো। মহিলা দেখেই বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য যে কোন মুসিবত নিতান্তই তুচ্ছ।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ীতে পৌছে তরবারীখানা তাঁর কন্যা ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “প্রিয় বেটি, এটা ধুয়ে পরিষ্কার কর। আজ এটি বড় কাজে এসেছে।” আলী ইনে আবু তালিবও তাঁর তরবারী ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “এ তরবারী খানা থেকেও রক্ত ধুয়ে দাও। আল্লাহর শপথ এটি বড় কাজে এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যদি আজ যুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ হযে থাক, তবে জেনে রাখো, সাহল ইবনে হানিফ এবয় আবু দাজানাও তোমার সাথে জিহাদে সর্তনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে।”

উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১ ৫ই  শাওয়াল শনিবার।পরদিন ১ ৬ই শাওয়াল রোববার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষক ঘোষণা করে দিলেন যে, শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে। তবে গতকালের যুদ্ধে উপস্থিত থাকেনি এমন কেউ আজ যেতে পারবে না। বরং কাল যারা ছিল তারাই শুধু যেতে পারবে। এ কথা শুনে যাবির ইবনে আবদুল্লাহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আমার সাত বোনকে পাহারা দেয়ার জন্য আমাকে বাড়ীতে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেয়েদের কাছে কোন পুরুষ থাকবে না এমনভাবে তাদের রেখে যাওয়া আমর বা তোমার কারো পক্ষেই সমীচিন হবে না। আর আমি বাড়ী বসে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তোমার জিহাদে যাওয়াকে অগ্রধিকার দেয়াও আমর পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তুমি তোমার বোনদের কাছে থেকে যাও। তাই আমি তাদের কাছে থেকে গিয়েছিলাম।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর পিছু ধাওয়ার অভিযানে তাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল শুধু শত্রুকে ভয় দেখানো। তাদের পশ্চাদ্ধাবন যে মুসলমানদের শক্তির পরিচায়ক এবং উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয় যে তাদের কিছুমাত্র হতোদ্যম করে দেয়নি, শত্রুকে তা বুুঝিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান চালানো হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরিয়ে মদীনা থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত হামরাউল আসাদ নামক স্থানে উপনীত হলেন। সেখানে সোম, মঙ্গল ও বুধবার পর্যন্ত অবস্থন করার পর মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে। মা’বাদ ইবনে আবি মা’বাদ আল খুযায়ী ছিলেন তখনো মুশরিক। তাঁর গোত্র খুযআর মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতো এবং তিহামা অঞ্চলে তাঁর গোপনীয়তা সংরক্ষণ করতো। আর তিহমায় যা-ই ঘটুক তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করতো। তাঁর কাছে কিছুই গোপন করতো না। মা’বাদের সাথে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা হলো। উহুদের ঘটনা সম্পর্কে সে বললো, “মুহাম্মাদ আপনার যে বিপর্যয় ঘটেছে তাতে আমরা ব্যথিত ও দুঃখিত। আমরা সাবাই কামনা করছিলাম যে, আপনাকে যেন আল্লাহ নিরাপদ রাখেন।” অতঃপর মা’বাদ চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামরাউল আসাদেই রইলেন। রাওহাতে [৬৪. মুজইনা গোত্রের বাসস্থান এই রাওহা জনপদ হাঁটাপথে মদীনা থেকে দুই দিনের দূরত্বে অবস্থিত। ]গিয়ে মা’বাদের দেখা হলো আবু সুফিয়ার ও তার অনুচরদের সাথে। তরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের ওপর পুনরায় হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা পরস্পর বলাবলি করছিল, “মুহাম্মাদের সহচরদের প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেকেই তো খতম করেছি, কিন্তু একবারে নিশ্চিহ্ন না করে মক্কায় ফিরে যাচ্ছি। অবশিষ্টদের ওপর বরং আবার হামলা করবো এবং তাদেরকে শেষ করেই তবে ক্ষান্ত হবো।” এই সময় মা’বাদকে দেখে আবু সুফিয়ান বললো, “মা’বাদ, ওদিককার খবর কি?” মা’বাদ বললো, দেখলাম মুহাম্মাদ তার সহচরদের নিয়ে এক বিপুল জনতার সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং তাদের নিয়ে তোমাদের পিছু ধাওয়া করতে ছুটে আসছে। আমি এরূপ জনসমাবেশ আর কখনো দেখিনি। উহুদের যুদ্ধের দিন যারা যুদ্ধে আসেনি এবার তারাও মুহাম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে।

তাদের মধ্যে তোমাদের ওপর এমন ভয়ংকর ক্রোধ ও আক্রোশ দেখলাম, যা আমি আর কখনো দেখিনি।” আবু সুফিয়ান বললো, “বল কি?” মা’বাদ বললো, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি। ওরা হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে। তুমি রওনা হবার আগেই হয়তো ওদের ঘোড়ার মাথা দেখা যাবে।” আমরা তো ওদের অবশিষ্ট লোকগুলোকে সাবাড় করে দেয়ার জন্য পুনরায় হামলা করতে প্রস্তুত হয়েছি।” মা’বাদ বললো, “তাহলে আমি নিষেধ করছি। এ কাজটি করো না। তাদের প্রস্তুতি দেখে আমি একটা কবিতা পর্যন্ত রচনা করে ফেলেছি। আবু সুফিয়ান বললো, “কি কবিতা রচনা করেছো? শোনাও তো দেখি।” মা’বাদ বললো, “কবিতাটি এই:

“তাদের তর্জন-গর্জনে আমার উট তো ভয়ে ভিমরি খাওয়ার যোগাড়

খাট চুলওয়ালা ঘোড়ার পাল যখন যমীনের ওপর সয়লাবের মত বয়ে চললোঃ

দ্রুতবেগে ধেয়ে চললো লম্বালম্বা দৃপ্ত সিংহপুরুষদের নিয়ে রণাঙ্গনে

নিরস্ত্র সিপাহীদের মত তারা টলটলায়মান নতশির নয়।

আমি তৎক্ষনাৎ দৌড়ে পালালাম। ভাবলাম, পৃথিবীটা নুয়ে যাচ্ছে

যখন তার আমাদের দিকে ধেয়ে এল এক অপরজেয় অধিনায়কের সাথে।

আমি বললাম, সেই জনম-লরি পদাঘাতে উপত্যাকা কেঁপে উঠেছে।

পবিত্র হারামের অধিবাসীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও কা-জ্ঞানসম্পন্ন,

তাদেরকে আমি দ্ব্যর্থহনি ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি আহমাদের সেনাবাহিনী থেকে।

অবশ্য তাঁর বাহিনীর মধ্যে কোন ইতরামী নেই।

আসলে আমি যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছি তার জন্য উপযুক্ত ভাষা নেই।”এ বিবরণ শুনে আবু সুফিয়ান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যুদ্ধযাত্রা থেকে নিবৃত্ত হলো।

বনু আবদুল কায়েসের একটি কাফিলার দেখা হলো আবু সুফিয়ানের সাথে। সে বললো, “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” তারা বললো, “মদীনায়।” আবু সুফিয়ান বললো, “কি উদ্দেশ্যে?” আরা বললো, “খাদ্য আনা নেয়ার উদ্দেশ্যে।” সে বললো, “তোমরা কি মুহাম্মাদের নিকট আমর একটা বার্তা পৌঁছে দেবে? পৌঁছে দিলে আমি আগমীকাল উকাযের বাজারে গিয়ে তোমাদেরকে প্রচুর পরিমাণ কিসমিস দেবো।” তারা বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে সম্মত হলো। সে বললো, “মুহাম্মাদকে বলবে যে, আমরা তার ও তার দলবলের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের অবশিষ্টাংশকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো হামরাউল আসাদে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে তারা সেখানে দেখা করলো এবং আবু সুফিয়ানের বার্তা তাঁর নিকট পৌঁছিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে কথা শুনে বললেন, “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকীল! (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি অতি উত্তম অভিভাবক।)” অতঃপর ঐ এলাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে দুশমনের দু’জন চর মুয়াবিয়া ইবনে মুগীরা ইবনে আবুল আস ও আবু ইযযাত যামাহী ধরা পড়লো। শোষোক্ত ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করেছিলেন এবং পরে বিনা মুক্তিপণেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে হত্যা করবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মক্কায় গিয়ে তুমি তৃপ্তির সাথে বলবে যে, মুহাম্মাদকে দু’বার ধোঁকা দিয়েছি সে সুযোগ তোমাকে দেয়া হবে না। হে যুবাইর, ওর শিরচ্ছেদ কর।” যুবাইর সঙ্গে সঙ্গে তার শিরচ্ছেদ করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। মদীনায় আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবনে সুলুল নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রক্তি ছিল। প্রত্যেক জুম’য়ার দিন সে নিজের গোত্রের কাছে নিজের মর্যাদা জাহির করার জন্য একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই জনগণের সামনে ভাষণ দিতে শুরু করতেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলতো, “হে জনম-লী, এই যে আল্লাহর রাসূল তোমাদের সামনে উপস্থিত। তাঁর দ্বারা আল্লাহ তোমাদের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি করেছেন্ সুতরাং তোমরাও তঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা কর এবং তাঁর কথা শোনো ও মেনে চল।” এই বলেই সে বসে পড়তো। উহুদ যুদ্ধের আগে তার এই ভূমিকায় কেউ আপত্তি করতো না। কিন্তু উহুদ যুদ্ধে সে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং বহু সংখ্যক লোককে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এরপরও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণ দেয়র সময় জুম’য়ার দিন আগের মতই নিজের ভরিক্কী জাহির করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রমংসা করত উঠে দাঁড়ালো। মুসলমানগণ তৎক্ষণাৎ চারদিক থেকে তার কাপড় টেনে ধরলেন আর বললেন, “আল্লাহর দুশমন, বস্। তুই যা করেছিস তাতে তোর মুখে ওসব কথা শোভা পায় না।” তখন সে সমবেত মুসল্লীদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য যে কথাটি বলছিলাম তা যেন খারাপ কথা হয়ে গেল।” মসজিদের দরজায় জনৈক আনসারী সাহাবীর সাথে তার দেখা হলো। তিনি বললেন, “তোমার কি হলো?” সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার চেষ্ট করছিলাম। তাতে তাঁর সহচরগণ আমার ওপর চড়াও হয়ে আমাকে টানতে ও তিরস্কার করতে লাগলো। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলাম অথচ সবার কাছে তা খুব খারাপ মনে হলো।”আনসারী সাহাবী বললেন, “যাও, তুমি ফিরে যাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন।” সে বললো, “তিনি আমার জন্য ক্ষমা চাইবেন এটা আমি চাই না।”

ইবনে ইসহাক বলেন, “উহুদ যুদ্ধ ছিল চরম পরীক্ষা ও মুসিবতের দিন। এটা দিয়ে আল্লাহ মু’মিনদের পরীক্ষা ও মুনাফিকদের ছাটাই বাছাই করেন। যারা মুখে ঈমানের দাবী করতো কিন্তু মনে মনে গোপনে কুফরী ধ্যান-ধারণা পোষণ করতো এই দিন তারা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর আল্লাহ তাঁর যেসব প্রিয় বান্দাকে শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন এ দিন তাদেরকে শাহাদাত দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।”

 

হিজরীর তৃতীয় সন: রাজী সফর

উহুদ যুদ্ধের পর আজাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় থেকে এ দল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনার সহচরদের মধ্য থেকে একটি দলকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যারা আমাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান শিক্ষা দেবে ও কুরআন পড়াবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বুকাইর, আসিম ইবনে সাবিত, খুবাইব ইবনে আদী, যায়িদ ইবনুদ দাসিনা ও অবদুল্লাহ ইবনে তারিককে পাঠিয়ে দিলেন। আমীর মনোনীত করলেন মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদকে। তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। হিজাজের এক প্রান্তে ‘উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হুদয়ার ওপর অবস্থিত হুযাইল গোত্রের জলাশয় রাজীতে পৌঁছলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকরা হুযাইল গোত্রকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো। সাহাবীগণ তখনও সওয়ারীর পিঠে। দেখলেন, তরবারীধারী লোকজন তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। তাঁরা নিজ নিজ তরবারী নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন কাফিররা বললো, “আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদেরকে হত্যা করতে চাই না। আমরা তোমাদের দ্বারা মক্কাবাসীর কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করতে চাই।আল্লাহর কসম করে প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদেরকে হত্যা করবো না।” কিন্তু মুরসাদ ইবন আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বাকাইর এবং আসিম ইবনে সাবিত বললেন, “আমাদের কোন মুশরিকের প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকারে আস্থা নেই।” আসিম ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন:

“আমার তো দুর্বলতা নেই, কেননা আমি শক্তিমান বর্শাধারী পুরুষ

আমার ধুনক রয়েছে এবং তাতে তীব্র ও তীক্ষè তীর রয়েছে।

শক্ত ও মোটা বর্শার ফলক সে তীরে আঘাত খেয়ে ছিটকে যায়

আসলে মৃত্যুই সত্য, জীবন হলো বাতিল।

আল্লাহ মানুষের জন্য যা নির্ধারিত করে রেখেছেন তা অনিবার্য

আর মানুষ তার অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য।”

অতঃপর তাঁরা কাফিরদের সাথে লড়াই করলেন এবং তিনজনই শাহাদাত বরণ করলেন।

আসিম নিহত হলে হুযাইল গোত্রের লোকজন তার মাথা সুলাফা বিনতে সা’দের নিকট বিক্রি করতে মনস্থ করলো। ঐ মহিলার দুই ছেলে উহুদ যুদ্ধে আসিমের হাত মারা যাওয়ার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র এ উদ্দেশ্যে আসিমের  মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র ও উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা আনতে গেলে ভিমরুল ও মৌমাছি তার লাশ ঘিরে রাখায় আনতে পারলো না। তারা বললো, “এখন ওটা এখানেই থাক। বিকাল বেলা ভিমরুল ও মৌমাছি চলে যাবে। তখন আমরা তার মাথা কেটে আনবো।” এই বলে তারা চলে গেল। ইত্যবসরে আল্লাহ ঐ এলাকায় বন্যার তা-ব বইয়ে দিলেন এবং সেই বন্যায় আসিমের লাশ ভেসে উধাও হয়ে গেল।

শাহাদাতের পূর্বে আসিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনি নিজেও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। কোননা তিনি মুশরিকদেরকে মনে প্রাণে অপবিত্র মনে করতেন ও ঘৃণা করতেন। উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন শুনলেন যে, ভিমরুল ও মৌমাছি ঘিরে রাখার কারণে মুশরিকরা আসিমের লাশ স্পর্শ করতে পারেনি, তখন বললেন, “আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাকে এভাবেই হিফাজত করেন। আসিম তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোন মুশরিককে তিনি স্পর্শ করবেন না এবং কোন মুশরিককেও তাঁর দেহ স্পর্শ করতে দেবেন না। আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর পর তাকে ঠিক তেমনিভাবে রক্ষা করেছেন, যেমন জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।”

যায়িদ ইবনে দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক এরা তিনজন নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহী হলেন। তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে গ্রেফতারী বরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে গ্রেফতার করে বিক্রির জন্য মক্কায় নিয়ে চললো। যাহরান পর্যন্ত পৌঁছলে আবদুল্লাহ ইবনে তারিক হাতের বাঁধন খুলে মুক্ত হলেন এবং তরবারী ধারণ করলেন। কাফিররা তাঁকে ধরতে পারলো না। কিন্তু দূর থেকে পাথর ছুড়ে তাকে শহীদ করলো। যাহরানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

অতঃপর খুবাইব ইবনে আদী ও যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিয়ে তাঁরা মক্কায় উপনীত হলো। কুরাইশদের কাছে হুযাইল গোত্রের দু’জন বন্দী ছিল। তাদের বিনিময়ে তারা ঐ দ্ইু সাহাবীকে কুরাইশদের কাছে বিক্রি করলো। খুবাইবনে কিনলো উকবা ইবনে হারেসের পক্ষে হুজায়ের ইবনে আবু ওহাব, যাতে উকবা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ তাঁকে হত্য করতে পারে। আর যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া স্বীয় পিতা উমাইয়া ইবনে খালফের হত্যার বদলে হত্যা করার জন্য। সাফওয়ান তার গোলাম নাসতাসের সাথে তাঁকে হারাম শরীফের বাইরে তানয়ীমে পাঠিয়ে দিল হত্যার উদ্দেশ্যে। সেখানে আবু সুফিয়ান সহ কুরাইশদের এক বিরাট জনতা যায়িদকে ঘিরে ধরলো। যায়িদকে যখন হত্যা করার জন্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আবু সুফিয়ান বললো, “হে যায়িদ, তোমার বদলে আজ যদি আমরা মুহাম্মাদকে হাতে পাই এবং তাকে হত্যা করি ও তোমাকে তোমার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দিই তাহলে তুমি কি তা পছন্দ করবে?” যায়িদ বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি এতটুকুও পছন্দ করবো না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে আছেন সেখানে থাকা অবস্থাতেই তাঁর গায়ে কাঁটা ফুটবে, তিনি তাতে যন্ত্রণায় ভুগবেন আর আমি নিজের পরিজনের মধ্যে আরামে বসে থাকবো।”

আবু সুফিয়ানের মন্তব্য এই যে, “মুহাম্মাদকে তার সাহাবীরা যেরূপ ভালোবাসতো এমন গভীর ভালোবাসা আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।” এরপর নাসতাস যায়িদকে হত্যা করলো।

হুজাইর ইবনে আবু ওহাবের এ মুক্তিপ্রাপ্ত দাসী মাবিয়া ইতিমধ্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, বলেন, খুবাইব আমার কাছেই ছিলেন। তঁকে আমার ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। একদিন তাঁকে দেখলাম, মানুষের মাথার মত বড় একটা আঙ্গুরের থোকা নিয়ে আঙ্গুর খাচ্ছেন। অথচ এ সময় মক্কায় আঙ্গুর ছিল না। তাঁর হত্যার সময় যখন ঘনিয়ে এলো তখন মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ পাক সাফ হবার জন্য আমার কাছে একখানা ক্ষুর চাইলেন। পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে আমি তাকে ক্ষুর আনিয়ে দিলাম। ক্ষুর নিয়ে ঐ ছেলেকে খুবাইবের ঘরে ঢুকতে বললাম। সে ঘরে চলে গেলে সহসা আমার মনে হলো। একি করলাম। সর্বনাশ! এই লোকটি যদি ছেলেটিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় তাহলে কি হবে? সে তো নিজের জীবন নাশের বদলে একজনের জীবন নিয়ে আগাম প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। ছেলেটি যখন খুবাইবকে ক্ষুর দিল তখন তিনি বললেন, “তোমার মা তোমাকে এই ক্ষুর নিয়ে আমার কাছে পাঠানোর সময় ভয় পায়নি তো?” এই বলে ছেলেকে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলেন।

এরপর খুবাইবকে কুরাইশরা তানয়ীমে নিয়ে গেল হত্যা করতে। খুবাইব বললেন, “তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দাও।”তারা বললো, “ঠিক আছে, পড়।”

তিনি খুব নিখুঁতভাবে দু’রাকাত নামায প্রড়ে নিলেন। অতঃপর কাফিরদের  সামনে গিয়ে বললেন, “তোমরা যদি মনে না করতে যে,আমি মরার ভয়ে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী নামায পড়ে সময় কাটাচ্ছি তাহলে আমি আরো কিছুক্ষণ নামায পড়তাম।” বস্তুত: মুসলমানরা যখনই এ ধরনের হত্যরর সম্মুখীন হন তখন দু’রাকাত নামায পড়া তাদের একটা রীতিতে পরণিত হয়েছে এবং খুবাইবই এ রীতির প্রথম প্রচলনকারী অগ্রনায়ক।

অতঃপর কাফিররা তাঁকে একটা কাঠের ওপর চড়িয়ে কষে বাঁধলো। এই সময় খুবাইব নিম্নরূপ দোয়া পড়লেন, “হে আল্লাহ, আমরা আপনার রাসূলের বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। সুতরাং আগামীকাল সকালের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  নিকট আমাদের সাথে যে আচরন করা হলো তার খবর পৌঁছিয়ে দিন। হে আল্লাহ, এই দুশমনদেরকে আপনি গুনে গুনে এক এক করে হত্যা করুন এবং এদের কাউকে ছেড়ে দেবেন না।” অতঃপর তারা খুবাইবকে (রা) হত্যা কররো। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত নাযিল করুন।

আবু সুফিয়ান পুত্র মুয়াবিয়া (রা) বলতেন, “সেদিন খুবাইবের চারপাশে যারা জমায়েত হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের সাথে আমিও ছিলাম। তখন এরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, কারোর ওপর অভিশাপ দেয়া হলে সে যদি তৎক্ষনাৎ কাত হয়ে শুয়ে পড়ে তাহলে এ অভিশাপ থেকে সে বেঁচে যায়।”

জুমাহী গোত্রের সাঈদ ইবনে আমেরকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) সিরিয়ার কোন এব এলাকায় প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তিনি আকষ্মিকভাবে লোকজনের সামনে মূর্ছা যেতেন। উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) একথা জানানো হলো। তাঁকে জানানো হলো যে, সাঈদের কি যেন হয়েছে। উমার (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সাঈদ, তোমার কি হয়েছে? ” সাঈদ বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন, আমর কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি। তবে আমি খুবাইবে হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং খুবাইবের বদদোয়া শুনেছিলাম। সেই বদদোয়ার কথা যখনই আমার মনে পড়ে এবং আমি কোন মজলিসে থাকি তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।” পরে উমারের কাছে থেকে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, আসিম ও মুরসাদের দলটি যখন রাজীতে আক্রান্ত হলো তখন সে খবর শুনে মুনাফিকরা মন্তব্য করলো, “ধিক এই ধোঁকা খাওয়া লোকগুলোকে যারা এমন করে মারা পড়লো। তারা বাড়ীতেও থাকলো না, আর তাদের নবীর দাওয়াতও পৌঁছালো না। ”আল্লাহ মুনাফিকদের এ কথাবার্তার জবাবে আয়াত নাযিল করলেন।”

[আরবী *********]

কোন কোন লোক এমন ও আছে যার কথা পার্থিব জীবনে তোমাকে চমৎকৃত করে দেয় র্(অর্থাৎ মুখ দিয়ে ইসলামের চমৎকার বুলি আওয়ায়) এবং তার মনে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী মানে (তার মনের অবস্থা তার মুখের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত) অথচ সে ন্যায় ও সত্যের কট্রর দুশমন। (অর্থাৎ তোমার সাথে যখন আলাপ-আলোচনা করে তখন ঘোরতর বিতর্কে লিপ্ত হয়।) আর যখন সে ক্ষমতার অধিকারী হয় তখন পৃথিবীতে অরাজকাত ছড়ায় এবং ফসল ও মানবকুলকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ তার এই ধ্বংসাত্মক বার্যকলাপ পছন্দ করেন না। তাকে যখন আল্লাহকে ভয় করতে বলা হয়, তখন তার আত্মসম্মানবোধ তাকে পাপের পথে আগলে রাখে এ ধরনের লোকের জাহান্নামই যথেষ্ট। আর তা অত্যন্ত খারাপ জায়গা। আবার কেউ কেউ এমনও আছে যে,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (আল্লাহর  পথে জিহাদ করতে ও তার হক আদায় করতে গিয়ে) নিজেকে কুরবানী করে দিয়েছে। বস্তুত: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর বড়ই অনুকম্পশীল।” শেষের কথা কয়টিতে রাজী অভিযাত্রী মুসলমানদের কথাই বলা হয়েছে।

এ ঘটনা সম্পকে ঐতিহসিকগণ খুবাইবের কবিতা উদ্বৃত করেছেন। খুবাইব যখন জানতে পারলেন যে, তাঁকে শূলে চড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় হয়েঁেছ তখন এ কবিতাটি বলেন:

“দলগুলো তাদের সকল গোত্রকে আমার চারপাশে একত্রিত করেছে

তারা যতদূর পারে আমার ওপর শত্রুতা জাহির করেছে,

কেননা আমি স্বীয় প্রাণ বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও আপন আদর্শে অবিচল রয়েছি।

তারা তাদের সকল নারী ও সন্তানদেরকে, জমায়েত করেছে,

আর আমাকে দীর্ঘ ও সুরক্ষিত ডালের নিকটবর্তী করা হয়েছে

(শূলে চড়ানোর জন্য)

আমার প্রবাস জীবন ও মর্মবেদনার আকুতি শুধু আল্লাহর কাছেই তুলে ধরছি।

আর শত্রুর দলসমূহ আমার হত্যার জন্য যে আয়োজন করেছে তাও।

অতএব, হে আরশের অধিপতি,আমার  বিরুদ্ধে যে কুমতলব আঁটা হয়েছে,

তার ওপর আমাকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দিন।

শত্রুরা আমার গোশত বিক্রী করে দিয়েছে,

আর সেই সাথেই আমার জীবনের আশার প্রদীপ নিভে গেছে।

তবে সেটা (আসন্ন মৃত্যু ) কেবলমাত্র ইলাহর উদ্দেশ্যেই,

তিনি যদি চান আমার টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও অশেষ বরকত

দান করতে পারেন,

তারা আমাকে এক ইলাহর বদলে মৃত্যু ও কুফরীর

কোন একটি গ্রহণ করতে বলেছিল।

আমার চোখ সে দুটোকেই অগ্রাহ্য করেছে এবং আমর মন

মোটেই (মৃত্যুভয়ে) ভীত নয়

আমি মৃত্যুর কিছুমাত্র পরোয়া করি না, কেননা আমাকে মরতে হবেই।

আমি শুধু নিস্তার চাই সর্বগ্রাসী জাহান্নামের আগুন থেকে।

আল্লাহর শপথ, আমি কোনই ভয় পাবো না যখন মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবো, আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিহত হয়ে আমি যে দিকেই ঢলে পড়িনা কেন।

আমি শত্রুর সামনে বিন্দুমাত্রও নমনীয়তা দেখাবো না,

প্রকাশ করবো না কোনই অস্থিরতা। কেননা আল্লাহর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন।”

খুবাইবের জন্য শোক প্রকাশ করে হাস্সাস ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করেণ,

“তোমার চোখের কি হলো যে, অশ্রু থামছেই না (নিজেকে সম্বোধন করে)

বুকের ওপর দিয়ে অবিরত ধারায় গড়িয়ে চলেছে মুক্তার মত

খুবাইবের শোকে-যিনি সেই যুবকদের অন্যতম যারা জেনেছে,

তাঁর (আল্লাহর) সাথে যখন তুমি মিলিত হবে তখন ব্যর্থতা কিংবা

অস্থিরত থাকবে না।

অতএব, হে খুবাইব, তুমি চলে যাও! আল্লাহ তোমাকে উত্তম পুরষ্কার দিন।

তোমারা কি জবাব দেবে যদি নবী তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন  (হে কুরাইশরা)

যখন পুণ্যবান ফেরেশতারা চক্রবালে সমবেত থাকবে,

কিসের বদলায় আল্লাহর সাক্ষীকে তোমরা হত্যা করলে?

একজন খোদাদ্রোহী সুবিধাবাদী ও দেশে দেশে উৎপাত সৃষ্টিকারী লোকের বদলায়?

(উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধে হারেসকে খুবাইব (রা) হত্যা করেছিলেন।)

বীরে মাউনার ঘটনা (৪র্থ হিজরী)

শাওয়াল মাসের অবশিষ্ট অংশ, যিলকাদ, যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করলেন। এই বছরের হজ্জ মুশরিকরা বর্জন করেছিল। সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বীরে মাউনার অভিযাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের মাত্র চার মাস পর।

ঘটনার পটভূমি হলো, ‘মুলায়িবুল আসিন্নাহ’ (বর্শা খেলায় পারদর্শী) নামে খ্যাত আবু বারা আমের ইবনে মালিক ইবনে জা’ফর রাসূলুল্লাহর সাথে দেখা করতে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করলো না, ইসলামের বিরুদ্ধেও কিছু বললো না। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নাজদবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তারা তাদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেন, আমার মনে হয়, তাহলে তারা আপনার দ্বীন গ্রহণ করনে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নাজদবাসী তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে আমার আশংকা হয়।” আবু বারা বললেন, “আমি তদের নিরাপত্তার জিম্মাদার। আপনি তাদেরকে পাঠিয়ে দিন। তারা জনগণকে আপনার দ্বীনের দিতে দাওয়াত দিক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছা বাছা চল্লিশজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সায়েদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুনযির ‘মুয়ান্নিক লিয়ামুত’ [তাঁকে এ উপাধিদানের কারণ হলো, তিনি শাহাদাত লাভের জন্য দ্রুতগতিতে ধাবমান হন।] (দ্রুত মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী) নামে অভিহিত হতেন। তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস ইবনে ছিম্মা, হারাম ইবনে মিলহান, উরওয়া ইবনে আসমা, নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা ও আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। তাঁরা রওয়ানা দিয়ে বীরে মাউনাতে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী।

ইসলামের কট্রর দুশমন আমের ইবনে তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান (রা)। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহানকে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও খতম করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “ আমরা বনু বারার প্রতিশ্রƒতি  ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।” আমের অগত্যা সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং  লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া দামরী ও জনৈক আনসারী [মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা। ] সাহাবী কোন কারণে দল থেকে কিছুদূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন। আনসারী আমর ইবন উমাইয়াকে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” আনসারী বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। আমি নিজে কখনো লোকমুখে হত্যাকা-ের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না।” অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।

আমর ইবনে উমাইয়াকে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত কারকারাতে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। বনু আমেরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা নিরাপত্তা ও আনাক্রমণ চুক্তি যে ছিল, সেকথা আমর জানতেন না। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বনু আমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যাকা- চালিয়েছে এবং সে কারণে বনু আমের থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের  জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।” আবু বারা ঘটনা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত হলেন। আমের ইবনে তুফাইল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়ে দেয়ার এবং তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ওপর বিপদ নেমে আসায় আবু বারা ক্ষোভ প্রকাশ করে। নিতদের মধ্যে আমের ইবনে ফুহাইরাও ছিলেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমের ইবনে তুফাইল বলতো, “ঐ দলের ভেতরে একটি লোক ছিল যাকে হত্যা অব্যবহিত পর তাঁকে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে দেখলাম। অবশেষে দেখলাম সে যেন আকাশে উঠে উধাও হয়ে গেছে। কে সেই, লোকটি?” লোকেরা বললো, “সে আমের ইবনে ফুহাইরা।”

বনু নাবীরের বহিষ্কার (চতুর্থ হিজরী)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া (রা) কর্তৃক নিহত বনু আমেরের লোক দুটোর জন্য রক্তপণ আদায় করার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে বনু নাযীরের কাছে গেলেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। বনু নাযীর ও বনু আমেরের মধ্যেও অনরূপ চুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বনু নাযীরের কাছে গেলেন তখন তারা তাঁকে স্বাগত  জানালো এবং রক্তপণের ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে সম্মত হলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের মাথায় চাপলো এক কুটিল ষড়যন্ত্র। তারা গোপনে সলাপরামর্শ করতে লাগলো কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা যায়। তারা মনে করলো, এমন মোক্ষম সুযোগ আর কখনো পাওয়া যাবে না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা প্রাচীরের পার্শ্বে বসে ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বাক্র, উমার ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম। বনু নাযীরের লোকেরা পরস্পর সলাপরামর্শ করলো। তারা বললো, “কে আছ যে পাশের ঘরের ছাদে উঠে বড় একটা পাথর মুহাম্মাদের ওপর গড়িয়ে দিতে পারবে এবং তার কবল থেকে আমাদেরকে রেহাই দেবে?” বনু নাযীরের এক ব্যক্তি আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা’ব এ কাজের জন্য ছাদের ওপর আরোহণ করলো।

ঠিক এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তাঁর সঙ্গী সাহাবীগণ তখনো টের পাননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় গিয়েছেন। তাঁরা অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন তিনি ফিরছেন না, তখন তাঁরা তাঁর খোঁজে বেরুলেন। পথে এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মদীনা থেকে আসছে। তাঁরা তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধান চাইলেন। সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি।” সাহাবীগণ তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বনু নাবীরের ওপর আক্রমণ করা জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর মুসলমানদেরকে নিয়ে তিনি বনু নাযীরের ওপর আক্রমণ চালালেন। তারা তাদের দুর্গসমূহে আশ্রয় নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে খেজুরের গাছসমূহ কেটে ফেলতে ও তা জ্বলিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তা দেখে বনু নাযীরের লোকেরা দূর থেকে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ, তুমি তো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করতে এবং যে তা করতো তার নিন্দা করতে এখন কেন তুমি খেজুর গাছ কাটছো এবং জ্বালিয়ে দিচ্ছো?”

এই সময় বুন আওফ ইবনে খাযরাজ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি যথা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সুলুল, তার আমানত রক্ষক মালিক ইবনে আবু কাওফাল সুওয়াইদ ও দায়িম বুন নাযীরকে এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে, “তোমারা ভয় পেয়ো না বা আত্মসমর্পণ করো না। আমরা কিছুতেই তোমাদেরকে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হতে দেব না। তারা যদি তোমারেদ সাথে যুদ্ধ করে তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে যাবো।” বনু নাযীর তাদের সাহায্যের অপেক্ষায় থেকে আত্মসমর্পন বা মুকাবিলা কোনটাই করলো না। আর শেষ পর্যন্ত কোন সাহায্যও এলো না। আল্লাহ তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করলো, “রক্তপাত করবেন না। বরং আমাদেরকে বহিষ্কার করুন, আমরা আমাদের সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে যাবো। অস্তাবর সম্পত্তির যতটুকু প্রত্যেকের উট বহন করে নিয়ে যেতে পারে, ততটুকু নিয়ে যাওয়অর অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। বুন নাযীরের প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করা হলো। তারা উটের পিঠে বহনোপযোগী অস্থাবর সম্পদ নিয়ে গেল। এই সময় কেউ কেউ তার ঘরের দরজার ওপরের অংশ ভেঙ্গে উটের পিঠে করে নিয়ে যেতে লাগলো। কতক লোক খাইবারে এবং কতক সিরিয়ায় বলে গেল। যারা খাইবার গিয়েছিলো তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকাইক ও হুয়াই ইবনে আখতাব। খাইবারের অধিবাসীরা তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করলো।

আবু বাকরের পুত্র আবদুল্লহ বলেন, “আবু বাক্র (রা) জানিয়েছিলেন যে, বুন নাযীর তারেদ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে  ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোও নিয়ে গিয়েছিলো। দাসীরা তাদের পেছনে থেকে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের মধ্যে উরওয়া ইবনে ওরারদ ’আবাসীর স্ত্রী উম্মে ’আমরও ছিল। সালমা নাম্মী ও মহিলাকে তারা তার স্বামীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল।[ ৬৫. এই মহিলার প্রথমে বিয়ে হয় মুযইনা গোত্রে। উরওয়া ইবনে ওয়ারদ একবার তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লুঠতরাজ করে। সেই সময় এ মহিলাকে সে ধরে নিয়ে যায়। উরওয়া বনু নাযীরের কাছে প্রায়ই আসা যাওয়া করতো এবং তাদের কাছ থেকে ধার কর্জ নিত। আবার কখনো বা নিজের লুঠ করা দ্রব্যাদি বিক্রি করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সে তাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে। তখন তারা উরওয়াকে মদ খওয়ায় এবং কৌশলে তাকে তার কাছ থেকে কিনে নেয়। এই ক্রয় বিক্রয়ে তারা প্রয়োজনীয় সাক্ষীও সংগ্রহ করে। উরওয়া পরবর্তী সময় আক্ষেপ করে এ সম্পর্কে এরূপ কবিতা আবৃত্তি করতো, “আল্লাহর দুশমনরা আমাকে মদ খাইয়ে মিথ্যাচার ও চক্রান্তের মাধ্যমে কাবু করে নিয়েছিল। হায় অদৃষ্ট! কিভাবে আমি এমন প্রস্তাবে রাজী হলাম, যা আমার বিবেক অপছন্দ করে।” ] তারা এত ধুমধাম ও গর্বের সাথে যাচ্ছিলো যে, সে যুগে আর কোন গোত্রকে ও রকম ধুমধাম করতে দেখা যায়নি।”

তারা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রেখে গিয়েছিলো। এই সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিলো। সেটা তিনি যেভাবে খুশী কাজে লাগাতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সম্পত্তি শুধুমাত্র প্রথম হিজরাতকারী সাহাবাদের মধ্যে বণ্টন করেন। আনসারদের সাহল ইবনে হুনাইক ও আবু দুজানা সিমাক ইবনে খারাশা তাদের দারিদ্রের কথা জানালে তাদেরকেও কিছু দান করেন। বনু নাযীরের প্রসঙ্গে সমগ্র সূরা আল হাশর নযিল হয়। আল্লাহ বনু নাযীরের ওপর যে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাসূলকে দিয়ে তাদের ওপর সৈন্য অভিযান পরিচারনা করিয়ে তাদে বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করান, এই সূরায় তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি আহলে কিতাব কাফিরদেরকে (মুসলিম মুজাহিদদের) প্রথম হানাতেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তোমরা ধারণা করতে পারনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ওপর এমনভাবে চড়াও হলেন যে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি। আল্লাহ তাদের মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চর করে দিলেন। (ফলে) তারা তাদের ঘরবাড়ী নিজেদের হাতেও ভেঙ্গেছে আবার মুমিনদের হাত দিয়েও বঙ্গিয়েছে।  কেননা তারা নিজেরাই তাদের ঘরের দরজায় উপরের অংশ ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।)

অতএব, হে বুদ্ধিমান লোকেরা, শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ যদি তাদের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত না দিয়ে থাকতেন (যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি প্রতিশোধই বটে) তাহলে দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন (তরবারী দ্বারা), অধিকন্তু তাদের জন্য পরকালে রয়েছে দোজখের শাস্তি (বহিষ্কার ছাড়াও)। তোমরা যেসব সতেজ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো উভয় কাজই আল্লাহর অনুমোদিত এবং তা শুধু নাফরমানদের অপদস্ত করার জন্যই। আর তাদের (বনু নাযীরের) যা কিছু সম্পদ আল্লাহ তাঁর রাসুলের দখলে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা তোমাদের উট ও ঘোড়া দৌড়িয়ে অর্জন করা জিনিস নয়, বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যার ওপর ইচ্ছা পরাক্রান্ত করে দেন। আর আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট জনপদের লোকদের থেকে যে সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ( অর্থাৎ উট, ঘোড়া চালিয়ে যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দখলে এসেছে। তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য, ইয়াতীম মিসকীন ও পথিকের জন্য, যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। আর রাসূল তোমাদের কে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিবৃত্ত করেছেন তা থেকে নিবৃত্ত হও।”

এখানে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের বিধান বর্ণনা করেছেন।

এরপর আল্লাহ বলেন,

“তুমি কি মুনাফিকদের অবস্থা দেখনি, তারা তাদের কুফরীতে লিপ্ত আহলে কিতাব ভাইদেরকে (অর্থাৎ বনু নাযীরকে) বলেঃ তোমাদেরকে যদি বহিষ্কার করা হয় তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবো। আর তোমাদের স্বার্থের ব্যাপারে অন্য কারো কথা কখনো শুনবো না, আর যদি তোমাদের ওপর যুদ্ধ চপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবে। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী। তারা যদি বহিষ্কৃত হয় তবে ঐ মুনাফিকরা কখনো তাদের সাথে বেরিয়ে যাবে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে কখনো সাহায্য করবে না, আর যদি সাহায্য করেও, তবে তারা (শেষ পর্যন্ত ময়দানে টিকবে না বরং মাঝখানেই) রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে। অতঃপর তাদের কাছে আর কোথাও থেকে কোন সাহায্য আসবে না। আসলো তাদের মনে তোমাদের ভয় আল্লাহর ভয়ের চেয়েও বেশী। কেননা তারা একটা নির্বোধের দল। তারা কখনো তোমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারবে না, যদি বা লড়ে তবে সুরক্ষিত জনপদে অথবা দেয়ালের অপর পাশ থেকে ছাড়া নয়। তাদের ভেতরে পারস্পরিক মতবিরোধ খুবই প্রকট। তোমরা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করলেও আসলে তাদের মন বিভেদ-ক্লিষ্ট। কেননা তারা বিবেক বুদ্ধিহীন গোষ্ঠী। তারা সেই জনগোষ্ঠীর মতই যারা, যারা অল্পদিন আগেই কৃতমর্তের ফল ভোগ করেছে। তাছাড়া তাদের জন্য আরো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (অর্থাৎ বনু কুইনুকার মত) তারা শয়তানের মতই, যে শয়তান মানুষকে বলে: কুফরী কর। আর যখনই সে কুফরী করে, অমনি বলে: ‘আমি তোমার ধার ধারি না। আমি তো বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। ’তাদের উভয়্রেই শাস্তি হলো, তারা চিরকার আগুনে পুড়বে। আর ওটাই হলো যালিমদের কর্মফল।”

 

যাতুর রিকা অভিযান (৪র্থ হিজরী)

বনু নাযীরের ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো রবিউল আউয়াল মাস ও জমাদিউল আউয়ালের একটা অংশ মদীনায় কাটালেন। এরপর নাজদে বনু মাহারিব গাতফানের উপগোত্র বনু সা’লাবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেন।মদীনার শাসনভার অর্পণ করে গেলেন আবু যার গিফারীর ওপর। নাজদে গাতফান গোত্রের আবাসভূমি এলাকা নাখাল পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। এটাই যাতুর রিকা [৬৬. রিকা অর্থ টুকরো কাপড় যা তালি দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই নামকরণের কারণ হলো এই অভিযানে তালি দেয়া পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন, ভূমি অত্যন্ত প্রস্তরময় হওয়ায় সৈন্যগণ পায়ে কাপড়ের টুকরো বেঁধে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে এই নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, যাতুর রিকা একটি গাছের নাম বা ঘটনাস্থল ছিল।] অভিযান। এখানে তিনি গাতফান গোত্রের এক বিরাট সমাবেশের সম্মুখীন হলেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের কাছাকাছি হলো। কিন্তু যুদ্ধ হলো না। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষ পরস্পর সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে প্রস্থান করেন।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন: আমি একটা দুর্বল উটে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নাখল থেকে রওনা হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সদলবলে যাত্রা করলেন তখন অন্যান্য সহযাত্রী দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আমি পেছনে পড়তে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে জিজ্ঞোসা করলেন, “হে জাবির, তোমার অবস্থা কি?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পেছনে ফেলেছে।” তিনি বললেন, “উটটি  থামাও।” আমি উটটিকে থামালাম, রাসূলুল্লাহও তাঁর উট থামালেন। এবার তিনি বললেন, “তোমার হাতের এই লাঠিটা আমাকে দাও অথাবা কোন একটা গাছ থেকে ডাল কেটে আমাকে লাঠি বানিয়ে দাও।” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাঠি দিলাম। তিনি ঐ লাঠি দিয়ে আমার উটকে বেশ কয়েকবার গুতা দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, “আরোহণ কর।” আমি আরোহণ করলাম। তখন আমার উটটি এত দ্রুতো চলতে লাগলো যে, রাসূলুল্লাহর উটকেও পেছনে ফেলে যেতে লাগলো।

কথা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “জাবির, তোমার উটটি কি আমার কাছে বিক্রি করবে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, ওটা আপনাকে বিনামূল্যেই দেব।” তিনি বললেন, “না বিক্রি কর।” আমি বললাম, “কত দাম দেবেন?” তিনি বললেন, “এক দিরহাম।” আমি বললাম, “তাহলে ্আমার লোকসান হবে।” তিনি বললেন, “তা হরে দুই দিরহাম দেব?” আমি বললাম, ‘না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমাগত দাম বাড়াতে বাড়াতে এক উকিয়া (এক আউন্স) পর্যন্ত বললেন। তখন আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপান এই দামে খুশী তো?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমি বললাম, “তাহলে আপনাকে ওটা দিলাম।” তিনি বললেন, “আমি নিলাম।” অতঃপর বললেন, “জাবির, তুমি বিয়ে করেছো?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “কুমারীকে না বিবাহিতাকে?” আমি বললাম, “বিবাহিতাকে।” তিনি বললেন, “একটা তরুণী বিয়ে কর না কেন? সে তোমার সাথে কৌতুক করতো। আর তুমিও তার সাথে কৌতুক করতে পারতে?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা তাঁর সাতটি কন্যা রেখে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এই জন্য আমি একজন বয়স্কা মহিলা বিয়ে করেছি, যে ওদের তত্ত্বাবধান ও লালন পালন করতে পারে।” তিনি বললেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি ঠিকই করেছো।” অতঃপর বললেন, “আমরা যদি সিরার পৌঁছে যাই তাহলে একটি উট জবাই করতে বলবো এবং তা জবাই করা হবে। অতঃপর তোমার স্ত্রীর মেহমানদারীতে একদিন সেখানে কাটাবো। তাকে ইসলামের কথা শোনাবো এবং সে আমাদেরকে বালিশ বিছানা দিয়ে যত্নআদর করবে।” ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের তো বালিশ নেই।” তিনি বললেন, “বালিশ অবশ্যই মিলবে। তুমি সেখানে পৌঁছার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে।”

অতঃপর সিরারে [সিরার মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে একটি জায়গা।] পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট জবাই করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জবাই করা হলো। আমরা ঐ উটের গোশত খেয়ে একদিন অতিবাহিত করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধ্যা বেলা বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সেইসাথে আমরাও প্রবেশ করলাম। স্ত্রীকে সব ঘটনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যা যা বলেছেন তা জানালাম। স্ত্রী তা শুনে বললো, “আমার সিদ্ধান্ত শুনে নাও, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা শুনবো ও মানবো।”

সকাল বেলা আমি উটের মাথা ধরে টেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং তাঁর থাকার ঘরের দরজার সামনে বেঁধে রাখলাম। অতঃপর আমি মসজিদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে গিয়ে বসলাম। মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটি দেখে বললেন, “এটা কি?” উপস্থিত জনতা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই উট জাবির নিয়ে এসেছে।” তিনি বললেন, “জাবির কোথায়?” সবাই আমাকে ডেকে তাঁর নিকট হাজির করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভাহিজা, এ উট তুমি নিয়ে যাও। এটা তোমার উট।” অতঃপর বিলালকে ডেকে বললেন, “জাবিরকে নিয়ে যাও এবং এই উটের মূল্য বাবদ এক উকিয়া দাও।” আমি বিলালের সাথে গেলাম। আমাকে তিনি এক উকিয়ার কিছু বেশী দিলেন। আল্লাহর কসম, উটটি এভাবে বরাবরই আমার সমৃদ্ধি সাধন করে আসছিল এবং আমার বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন  থেকে বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে ফিরবার পথে তার সাথে যে ঘটনা ঘটে, এটা সেই মর্যাদারই সর্বশেষ প্রতিফলন।

জাবির (রা) আরো বলেন, যাতুর রিকা অভিাযান শেষে নাখল থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রওনা হলাম। এই সময় একজন মুসলমান জনৈক মুশরিকের স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে রণাঙ্গন থেকে প্রস্থান করলেন। তার স্বামী বাড়ীতে ফিরলো, ইতিপূর্বে সে অনুপস্থিত ছিলো। সে যখন তার স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর শুনলো তখন কসম খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের একজনকে অন্ততঃ হত্যা না করে সে ক্ষান্ত হবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম পদচিহ্ন অনুসরন করে চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। অতঃপর বললেন, “আজ সারারাত জেগে কে আমাদের পাহারা দিতে প্রস্তুত আছে?” একজন মুহাজির ও একজন আনসারী রাজী হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পাহাড়ের গুহার মুখে পাহারায় নিয়োগ কররেন। সাহাবীদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপোষে রাতটি এভাবে ভাগ করে নিলেন যে, রাতের প্রথম ভাগ পাহারা দেবেন আনসারী এবং শেষের ভাগ মুহাজির। সেই অনুসারে মুহাজির প্রথম রাত ঘুমালেন আর আনসারী দাঁড়িয়ে নামায পড়া শুরু করলেন।

মুশরিক ঘাতক গভীর রাতে সোখানে এসে উপনীত হলো। নামায আদায়রত আনসারীকে দেখে সে বুঝতে পারলো যে, তিনি মুসলমানদের পাহারাদার। তৎক্ষনাৎ সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর সে ঐ তীর দেহ থেকে টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি অবিচলিত রইলেন এবং নামায অব্যহত রাখলেন। এরপর সে আরো একটা তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেটিও তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর ঘাতক তাও দেহ থেকে টেনে বের করলো এবং নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি নামাযে অবিচল রইলেন। অতঃপর সে তৃতীয় তীর নিক্ষেপ করলো। এই তীরও ওই সাহাবীর দেহ ভেদ করলো। ঘাতক তা টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। এবার তিনি রুকু ও সিজদা করে নামায শেষ করলেন এবং তাঁর সঙ্গীকে জাগালেন। তাঁকে বললেন, “উঠে বস। ঘাতক আমাকে জখম করে অচল করে ফেলেছে।” সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘাতক উভয়কে দেখে বুঝলো যে, তাঁরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে সাবধান হয়ে গেছে। তাই সে পালিয়ে গেল।

মুহাজির সাহাবী আনসারীর রক্তাক্ত দেহ দেখে বরলেন, “সুবাহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীরের আঘাতেই জাগালেন না কেন?” আনসারী সাহাবী বললেন, “আমি নামাযে একটি সূরা পড়ছিলাম। সূরাটি শেষ না কের নামায ভঙ্গ করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু শত্রু অব্যাহতভাবে তীর নিক্ষেপ করতো থাকায় আমি রুকু সিজদা করে আপনাকে ডাকলাম। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো এই আশংকা যদি না থাকতো তাহলে আমি খুন না হওয়া পর্যন্ত নামায় ভঙ্গ করতাম না।”

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ যাতুর রিকা অভিযান শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রজবের শেষ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।

দ্বিতীয় বদর অভিযান (৪র্থ হিজরী সন)

আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জের সময় ঘনিয়ে আসায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসে আবার বদর অভিযানে বেরুলেন[৬৭.উল্লেখ্য যে, এ সময় তিনি আনসারী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সুুলুলকে মদীনার শাসনভার দিয়ে যান।]এবং সেখানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে তিনি আবু সুফিয়ানের অপেক্ষায় আটটি রজনী অতিবহিত করলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান মক্কাবাসীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে মাজনা গিয়ে যাত্রাবিরতি করলো। সে যাহরান হয়ে  এখানে উপনীত হয়। তারপর মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের জন্য যুদ্ধ করা কেবল ভাল ফসল ফলার বছরেই শোভা পায়, যখন তোমরা তোমাদের গাছপালার তত্ত্বাবধান করতে পারবে এবং দুধ পান করতে পারবে। কিন্তু এটা তো অজন্মার বছর। আমি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরাও ফিরে চলো।” তার কথায় লোকেরা ফিরে গেল। মক্কাবাসী তাদেরকে ‘ছাতুখোর বাহিনী’ নামে অভিহিত করে। তারা বলতো, “তোমরা তো শুধু ছাতু খেতে লড়াইয়ে গিয়েছিলে।”

ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায় বদরের প্রন্তরে বসে প্রহর গুনতে লাগলেন এই সময় মাখশা ইবনে আমর দামরী তাঁর কাছে এলো। ওয়াদ্দান অভিযানে এই ব্যক্তিই বনু দামরা গোত্রের পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সন্ধি করেছিলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি কুরাইশদের মুকাবিলা করতে এই জলাশয়ের পাশে এসেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “সত্যিই তাই হে বুন দামরার ভাই! এ অবস্থা দেখেও তুমি যদি চাও তবে তোমাদের সাথে আমাদের যে সন্ধি রয়েছে তা প্রত্যাহার করে যুদ্ধ করতে আমরা প্রস্তুত। যুদ্ধের মাধ্যমেই আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিন তা চাইলে তাতে  আমাদের অমত নেই।” সে বললো, “না, হে মুহাম্মাদ, আল্লাহর  শপথ, আমাদের তাতে কোন প্রয়োজন নেই।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই সময় মা’বাদ ইবনে আবু মা’বাদ আল খুযায়ী তাঁর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। সি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপস্থিত দেখতে পেয়ে নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দ্রুত উট হাঁকিয়ে চলে গেল।

“(আমার উট) মুহাম্মাদের ও মদীনার কালো কিসমিস সদৃশ খেজুরের সান্নিধ্যের প্রতি বিতৃষ্ণ। সে ছুটে চলেছে তার বাপের পুরানো রসম রেওয়াজের প্রতি অনুগত হয়ে। কুদাইদের জলাশয়ে আজকে এবং দাজনাদের জলাশয়ে কালকে বিকালের মধ্যে তাকে পৌঁছে যেতেই হবে।[কুদাইদ মক্কার নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম।]

আর সাহাবী আবদুল্লাহ রাওয়াহা আবু সুফিয়ানের অনুপস্থিতিকে লক্ষ্য করে নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন,

“আবু সুফিয়ানের সাথে বদর প্রান্তরে মুখোমুখি হবার জন্য আমরা ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু তার ওয়াদার সত্যতা পেলাম না এবং সে ওয়াদা রক্ষাকারী নয়। কসম করে বলছি, তুমি যদি ওয়াদা রক্ষা করতে  (হে আবু সুফিয়ান) ও আমাদের মুখোমুখি হতে তাহলে ধিকৃত ও তিরস্কৃত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হতে এবং মিত্রদেরকেও হাতছাড়া করে ফেলতে। এই বদর প্রান্তরেই আমরা উতবা ও তার ছেলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেলে গিয়েছি। আবু জাহলের লাশও এখানে রেখে গিয়েছি। তোমরা আল্লাহর রাসূলকে অমান্য করলে! তোমাদের ধর্মমত এবং তোমাদের কুৎসিত ও বিভ্রান্তিকর কর্মকা-কে ধিক! তোমরা আমাকে যতই ভর্ৎসনা করো, তবুও বলবো, রাসূলুল্লাহর জন্য আমার ধন-জন সবই কুরবানকৃত। আমরা তাঁর অনুগত। তাঁকে ছাড়া কাউকে কোন অঙ্গীকার দিই না। তিনি আমাদের জন্য অন্ধকার রাতের দিশারী ধ্রুব নক্ষত্র।”

দুমাতুল জান্দাল অভিযান (৫ম হিজরী: রবিউল আউয়াল)

বদরের দ্বিতীয় অভিযানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে যান এবং সেখানে একমাস অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ বর্জন করে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের চতুর্থ বছর। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুমাতুল জান্দালে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে কোন সংঘর্ষ তো হয়ইনি, এমনকি তাঁকে সে স্থান পর্যন্ত যেতেও হয়নি। তিনি মদীনায় ফিরে এসে সেখানেই বছরের বাকী সময় কাটিয়ে দেন।

খন্দক যুদ্ধ (৫ম হিজরী, শাওয়াল)

পঞ্চম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের পটভূমি হলো, বন নাযীর ও বনু ওয়াইরের ইহুদীদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কা গিয়ে কুরাইশদেরকে মদীনার ওপর হামলা চালিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আহ্বান জানায় এবং এ কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।  এই দলের মধ্যে উল্লোখযোগ্য লোক ছিল বনু নাযীর গোত্রের সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, হুয়াই ইবনে আখতাব, কিনানা ইবনে আবুল হুকাইক এবং ওয়াইল গোত্রের হাওয়া ইবনে কায়েস ও আবু আম্মার। তারা আরবের বহু সংখ্যক গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে প্ররোচিত করে। কুরাইশরা তাদেরকে বললো, “ইহুদীগণ, তোমরা প্রথম কিতাবের অধিকারী। আমাদের সাথে মুহাম্মাদের যে বিষয় নিয়ে মতভেদ, তা তোমরা ভাল করেই জান্ োতোমরাই বলো আমাদের ধর্ম ভাল না মুহাম্মাদের ধর্ম ভাল?” তারা বললো, “তোমাদের ধর্ম মুহাম্মাদের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তোমরা সত্যের নিশানাবাহী!”

তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার এই আয়াতগুলো নাযিল করেন,

“তুমি কি সেই কিতাবধারীকে দেখোনি যারা মূর্তি ও খোদাদ্রোহী শক্তিকে মানে এবং কাফিরদেরকে মু’মিনদের চেয়ে বেশী সুপথপ্রাপ্ত অভিহিত করে। তারাই আল্লাহর অভিশাপগ্রস্ত। আর যারা আল্লাহর অভিশপ্ত তাদের কোন সাহায্যকারী কখনো মিলবে না। তাদের কি আল্লাহর রাজত্বে কোন অংশ আছে যে তারা মানুষকে তা থেকে কণামাত্রও দেবে না। নাকি তারা মানুষকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ প্রদান করেছেন অর্থাৎ নবুওয়াত তার ব্যাপারে হিংসা করে? আমি ইবরাহীমের বংশধরকে তো কিতাব ও তত্ত্বজ্ঞান দান করেছি এবং তাদেরকে বিরাট রাজত্ব দিয়েছি। তাদের কেউ কেউ তার ওপর ঈমান এনেছে আবার কেউ কেউ তা গ্রহণ করতে মনুষকে বাধা দিয়েছে। তাদের জ্বালানোর জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।”

ইহুদীরা যখন কুরাইশদের সম্পর্ক এরূপ কথা বললো তখন তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। অধিকন্তু তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হামলা চালানোর আমন্ত্রণ জানালো তখন তারা তাতে একমত হলো এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। পরে ঐসব ইহুদী গাতফান গোত্রের কাছে গেল এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানালো। তাদের সাথে নিজেদের অংশ নেয়ার আশ্বাস তারা দিল। তাদেরকে জানালো যে, কুরাইশরাও তাদের সাথে একমত হয়ে আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত হয়েছে।

যথাসময়ে কুরাইশ বাহিনী ও তাদের দলপতি আবু সুফিয়ান যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লো। গাতফানও বেরুলো বনু ফাজারা ও তার দলপতি উয়াইনা ইবনে হিসনকে সাথে নিয়ে। আর বুন মুররাকে সাথে নিয়ে হারেস ইবনে আওফ ইবনে আবু হারেসা ও আসজা গোত্রসে সাথে নিয়ে তার দলপতি মিসআর ইবনে রুযাইরা রওনা হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধপ্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ মদীনার চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করালেন। মুসলমানরা যাতে সওয়াবের আশায় এই কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজ হাতে পরিখা খননের কাজ করেন। তাঁর সাথে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে খননের কাঝে যোগ দেয়। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ অবিশ্রান্তভাবে এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কেবল কিছুসংখ্যক মুনাফিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের থেকে দূরে থাকে। তারা নানা রকমের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কাজে ফাঁকি দিতে ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অজ্ঞাতসারে ও বিনা অনুমতিতে চুপিসারে বাড়ী চলে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের মধ্যে কারো যদি মারাত্মক অসুবিধাও দেখা দিত এবং অনিবার্য প্রয়োজনে নিজ পরিবার পরিজনের কাছে যাওয়ার দরকার পড়তো তা হলেও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যথারীতি জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যেতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই তারা এসে অবশিষ্ট কাজে শরীক হতো। এভাবে তারা পুণ্যকর্মে আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতো। আল্লাহ তায়ারা এসব মু’মিনের প্রসঙ্গে সূরা নুরের এ আয়াত ক’টি নাযিল করেন:

“মু’মিন তারাই Ñ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে রত থাকলেও তাঁর অনুমতি না নিয়ে কোথাও যায় না। যারা তোমার কাছে অনুমতি চায় তারাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করে। হে নবী, তারা (মু’মিনরা) তোমার কাছে তাদের কোন ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তুমি তাদেরকে ইচ্ছা হলে অনুমতি দিও এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল।”

মুসলমানদের মধ্যে যারা নিষ্ঠাবান, সৎকর্মের প্রতি আগ্রহী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত, তাদেরকে লক্ষ্য করেই এই আয়াত কয়টি নাযিল হয়।

যেসব মুনাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুমতি না নিয়েই চুপে চুপে চলে যেতো তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরো বলেনÑ

“তোমাদের প্রতি রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরকে আহ্বান করার মত মনে করো না। আল্লাহ তোমাদের এইসব লোককে ভালভাবেই জানেন যারা আড়ালে আবডালে চুপে চুপে সরে পড়ে। রাসূলের হুকুম অমান্যকারীদের এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত যে, তাদের ওপর যে কোন মুহূর্তে মুসিবত কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত হতে পারে। মনে রেখো, আসমান ও যমীনের সবকিছুই আল্লাহর। তোমরা কে সত্যের অনুসারী আর কে মিথ্যার অনুসারী তা তিনি ভালভাবেই অবহিত। আর যেদিন তাঁর কাছে তারা ফিরে যাবে সেদিন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্ক জানিয়ে দেবেন। বস্তুত: আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।” (সূরা নূর আয়াত-৬৪)

এই আয়াত ক’টিতে রাসূলের অনুমতি না নিয়ে তাঁর নির্দেশিক কাজ থেকে গোপনে সরে পড়া মুনাফিকদের বিবরণ দেয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিখা খনন সম্পন্ন করতেই কুরাইশরা কিনানা গোত্র, তিহামার অধিবাসী ও তাদের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন মিলিয়ে সর্বমোট দশহাজার যোদ্ধা নিয়ে এসে পৌঁছলো। তারা রুমা নামক স্থানে জুরুফ ও জুগাবার মধ্যবর্তী মুজতামাউল আসইয়ালে শিবির স্থাপন করলো। গাতফান গোত্রের লোকেরাও তাদের নাজদবাসী মিত্রদের নিয়ে হাজির হলো। তারা উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে ‘সালা’ নামক পাহাড়কে পেছনে রেখে মুসলিম বাহিনীকে মোতায়েন করলেন। তাঁর ও শত্রুদের মাঝে থাকলো পরিখা। শিশু ও নারীদেরকে তিনি আগে ভাগেই দুর্গের মধ্যে রেখে আসার ব্যবস্থা করেন।

আল্লাহর দুশমন বনু নাযীর গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইযার কা’ব ইবনে আসাদের কাছে গেল। বনু কুরাইযার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপোষ ও অনাগ্রাসন চুক্তির সংগঠক ছিল এই কা’ব ইবনে আসাদ। সে বনু কুরাইযার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরেক শান্তির অঙ্গীকার দেয় ও চুক্তি সম্পাদন করে। কা’ব ভেতরে বসেই হুয়াইয়ের আগমন টের পেয়ে তার মুখের ওপর দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। হুয়াই দরজা খুলতে বললে সে দরজা খুলতে অস্বীকার করে। হুয়াই পুনরায় দরজা খুলতে অনুরোধ কররে কা’ব বললো, “ধিক তোমাকে হুয়াই, তুমি একটা অলক্ষুণে লোক। আমি মুহাম্মাদের সাথে  চুক্তিবদ্ধ এবং সে চুক্তি আমি ভঙ্গ করবো না। আমি মুহাম্মাদের আচরণে প্রতিশ্রুতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার পরিচয়ই পেয়েছি।”

হুয়াই বললো, “কি হলো! দরজাটা একটু খোল না। আমি তোমার সাথে কিছু আলাপ করবো।” কা’ব বললো, “আমি দরজা খুলতে পারবো না।” হুয়াই বললো, “তোমার খাদ্য গ্রহণ করবো মনে করেই তুমি দরজা বন্ধ করেছো।” এ কথায় কা’ব অপ্রস্তুত হয়ে গেল এবং দরজা খুলে দিল। অতঃপর সে বললো, “আমি তোমার জন্য এ যুগের শ্রেষ্ঠ গৌরব এবং উত্তাল তরঙ্গময় সমুদ্র এনে হাজির করেছি। নেতা ও সরদারসহ সমস্ত কুরাইশ বাহিনীকে আমি জড়ো করেছি এবং তাদেরকে রুমা অঞ্চলের মুজতামাউর আসইয়ালে এনে হাজির করেছি। অপরদিকে গোটা গাতফান গোত্রকেও তাদের নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’য় এনে দাঁড় করিয়েছি। তারা সবাই আমার সাথে এ মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদেরকে নিশ্চিহ্ন না করে ক্ষান্ত হবে না।” কা’ব বললো, “তুমি বরং আমার মুখে চুনকালি মাখানোর আয়োজনই করেছো। তুমি এমন মেঘমালা সমবেত করছো যা বৃষ্টি বর্ষণ করে পানিশূন্য হয়েছে। এখন তার শুধু তর্জন গর্জন সার। তার দেয়ার মত কিছুই নেই। অতএব, হে হুয়াই, ধিক্ তোমাকে! আমাকে উত্যক্ত করো না। যেমন আছি থাকতে দাও। মুহাম্মাদ আমার সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। সে শুধু সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতারই পরিচয় দিয়েছে।” তথাপি হুয়াই নাছোড়বান্দা হয়ে কা’বের সাথে লেগে রইলো। সে তার ঘারের ওপর হাত রেখে নাড়তে থাকলো এবং অবশেষে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলো। সে তার নিকট থেকে অঙ্গীকার আদায় করতে সক্ষম হলো। সে বললো যে, কুরাইশ ও গাতফান যদি মুহাম্মাদকে হত্যা না করেই ফিরে যায় তাহলে সে কা’বের সাথে তার দুর্গে অবস্থান করবে এবং উভয়ে পরস্পরের সুখ দুঃখের সম অংসীদার হবে। এভাবে কা’ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি ভঙ্গ করলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি আওস গোত্রের তৎকালীন নেতা সা’দ ইবনে মুয়ায ইবনে নু’মান (রা), খাযরাজের নেতা সা’দ ইবনে উবাদা ইবনে দুলাইম (রা), আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা) ও খাওয়াত ইবনে যুবাইরকে (রা) পাঠালেন। তাদেরকে বলে দিলেন, “তোমরা গিয়ে দেখো, যে খবরটা পেয়েছি তা সত্য কিনা। যদি সত্য হয় তাহলে ফিরে এসে সংকেতমূলক ধ্বনি দিয়ে আমাকে জানাবে। প্রকাশ্যে বরে সাধারণ মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দিওনা। আর যদি তারা চুক্তির অনুগত থাকে তাহরে ফিরে এসে সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে।”

তারা গিয়ে দেখলেন কা’ব ও হুয়াই এবং তাদের সাঙ্গ পাঙ্গরা যে রকম জানা গিয়েছিলো তার চেয়েও জঘন্য মনোভাব পোষণ করছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে। তারা বললো, “রাসূলুল্লাহ আবার কে? মুহাম্মাদের সাথে কোন চুক্তি বা অঙ্গীকার নেই।” একথা শুনে সা’দ ইবনে মুয়ায (রা) তাদের তিরষ্কার করলেন।

জবাবে তারাও তাকে পাল্টা তিরস্কার করলো। বস্তুত: সা’দ ইবনে মু’য়ায একটু চড়া মেজাজের লোক ছিলেন। সা’দ ইবনে উবাদা তাকে বললেন, “তিরস্কার বাদ দিন। আমাদের ও তাদের মধ্যে যে চুক্তি রয়েছে, তা তিরস্করের চেয়ে অনেক বেশী।” এরপর উভয় নেতা ও তাদের সঙ্গীদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, “আজাল ও কারা।” অর্থাৎ আজাল ও কারার লোকেরা সাহাবী খুবাইব ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) প্রতি রাজী’তে যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, এরাও সেই পথ ধরেছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার। হে মুসলমানগণ! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো।”

এই সময় মুসলমানদের ওপর আপতিত দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। তাদের মধ্যে ভীতি প্রবল হয়ে উঠলো। চারদিক থেকে চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকলো। মুসলিম দলভুক্ত মুনাফিকদের মুনাফেকীও প্রকাশ পেতে আরম্ভ করলো। মুআত্তিব ইবনে কুশাইর তো বলেই ফেললো, “মুহাম্মাদ আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারর্স ও রোম সা¤্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাবো। অথচ আজ অবস্থা এই যে, আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছিনা।” আওস ইবনে কায়যী বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের বাড়ী-ঘর  তথা পরিবার পরিজন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। (অর্খাৎ তাদেরই গোত্রের কিছুসংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে হুমকি এসছে।) অতএব আমাদেরকে বাড়ীতে ফিরে যেতে দিন। কেননা আমাদের বাড়ী-ঘর মদীনার বাইরে অবস্থিত।” এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুশরিকরা বিশ দিনের বেশী এবং একমাসের কম সময় পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করলেন। দুইপক্ষের মধ্যে তীর নিক্ষেপ ও অবরোধ ছাড়া আর কোন রকম যুদ্ধ হয়নি।

মুসলমানদের (অবরোধ দীর্ঘায়িত হওয়ার দরুন) দুঃখ-কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাতফান গোত্রের দুইজন নেতা উয়াইনা ইবনে হিসন ও হারেস ইবনে আওফের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালেন যে, তারা যদি তাদের লোকজন নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের (রা) বিরওদ্ধে এই অবরোধ ত্যাগ করে চলে যায় তাহলে  তিনি তাদেরকে মদীনার পুরা উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ দেবেন। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গাতফানীদের মধ্যে সন্ধি হলো এবং সন্ধির দলিল লেখা হলো। কেবল স্বাক্ষর দান ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের কাজটা বাকী রইলো। তবে লেনদেনের ব্যাপারে উভয় পক্ষের দরকাষাকষি ও সম্মতি দানের কাজটা চূড়ান্ত করা হলো। অবশিষ্ট কাজটুকু করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে মু’য়ায ও সা’দ ইবনে উবাদাকে (রা) ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদেরকে বিষয়টা অবহিত করলেন এবং পরামর্শ চাইলেন। উভয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এটা কি আমাদের কল্যাণার্থে আপনার প্রস্তাব, না আল্লাহ আপনাকে এজন্য নির্দেশ দিয়েছেন যা আমাদের করতেই হবে?” তিনি বললেন, “এটা আমার নিজের উদ্যোগ। কারণ আমি দেখছি গোটা আরব ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমাদের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে এবং সবদিক দিয়ে তোমাদের ওপর দুর্লংঘ্য অবরোধ আরোপ করেছে। তাই যতটা পারা যায় আমি তাদের শক্তি চূর্ণ করতে চাচ্ছি।

সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইতিপূর্বে আমরা এবং এসব লোক শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিলাম। তখন আমরা আল্লাহকে চিনতাম না এবং আল্লাহর ইবাদাতও করতাম না। সে সময় তারা মেহমানদারীর অথবা বিক্রয়ের সূত্রে ছাড়া আমাদের একটা খোরমাও খেতে পারেনি। আর আজ আল্লাহ যখন আমাদেরকে ইসলামের গৌরব ও সম্মানে ভূষিত করেছেন, সত্যের পথে চালিত করেছেন, তখন তাদেরকে আমাদের ধন-সম্পদ দিতে হবে? আল্লাহর কসম, আমাদের এ সবের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কসম, তরবারীর আঘাত ছাড়া তাদেরকে আমরা আর কিছুই দেবো না। এভাবেই আল্লাহ তাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাহলে এ ব্যাপারে তোমার মতই মেনে নিলাম।” এরপর সা’দ ইবনে মুয়ায চুক্তিপত্র খানা হাতে নিয়ে সমস্ত লেখা মুছে ফেললেন। এরপর তিনি বললেন, “ওরা যা পারে করুক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ শত্রুর অবরোধের ভেতরে অবস্থান করতে লাগলেন। কোন যুদ্ধই হলো না। অবশ্য আমর ইবনে উদ, ইকরিমা ইবনে আবু জাহল, হুবাইরা ইবনে আবু ওয়াহাব ও দিরার ইবনে খাত্তাব প্রমুখ কতিপয় কুরাইশ অশ্বরোহী যুদ্ধ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। তারা ঘোড়ায় চড়ে বুন  কিনানার কাছে এসে বললো, “হে বনু কিনানা, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আজ দেখবে যুদ্ধে কারা বেশী পারদর্শী।” অতঃপর তারা দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল এবং পরিখার কিনারে থামলো। পরিখা দেখে তারা হতবাক হয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা এমন একটা যুদ্ধ কৌশল আরবরা কখনো উদ্ভবন করতে পারেনি।”[৬৮. ইবনে হিশাম বলেন, কথিত আছে যে, সালমান ফারসী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।]

অতঃপর পরিখার সবচেয়ে কম প্রশস্ত জায়গা দেখে তারা পরিখা পার হলো। ঘোড়ায় চড়ে তারা সালা পর্বত ও পরিখার মধ্যবর্তী মুসলমানদের অবস্থানে যেয়ে হাজির হয়। আলী (রা) কতিপয় মুসলমানকে সাথে নিয়ে  মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং যে উন্মুক্ত স্থানটি দিয়ে কাফিররা ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছিল সেখানেই তাদের গতিরোধ করে দাঁড়ান। অশ্বারোহীরা তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে।

‘আমর ইবনে আব্দ উদ বদর যুদ্ধে আহত হয়ে এতটা অচল হয়ে গিয়েছিল যে, উহুদ যুদ্ধে হাজির হতে পারেনি। সে নিজের মর্যাদা জাহির করার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ প্রতীক দ্বারা নিজেকে চিহ্নিত করে এসেছিল। সে এসেই হুংকার দিল, “কে লড়াই করবে আমার সাথে?” আলী (রা) তার সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “হে আমর, তুমি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিলে যে, কুরাইশদের কোন লোক তোমাকে যে কোন দুইটি কাজের একটির দিকে দাওয়াত দেবে, তুমি তা গ্রহণ করবে। সত্য কিনা?” সে বললো, ‘হ্যাঁ!’ আলী (রা) বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”

সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”

সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে যুদ্ধের দাওয়াত দিচ্ছি।” সে বললো, “তা ভাতিজা, আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই না।” আলী (রা) বললেন, “কিন্তু আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই।” একথা শুনে আমর উত্তেজিত হলো। সে ঘোড়ার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রথমে ঘোড়াকে হত্যা করলো এবং তার মুখে আঘাত করলো। অতঃপর আলীর (রা) দিকে এগিয়ে এলো। উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হলো। অবশেষে আলী (রা) তাকে হত্যা করলেন।

এরপর তার ঘোড়সওয়ার দলটি পরাজিত হয়ে পরিখা পেরিয়ে পালিয়ে গেল। আমর নিহত হওয়ায় হতাশ হয়ে আবু জাহল তনয় ইকরিমা বর্শা ফেলে পালালো। তা দেখে মুসলিম কবি হাস্সান ইবনে সাবিত বললেন:

“সে পালিয়ে গেল এবং আমাদের জন্য তার বর্শা ফেলে রেখে গেল।

হে ইকরিমা, তুমি এমন ভান করেছো যেন (যুদ্ধ) করোনি।

তুমি নর উটপাখির মত উর্ধশ্বাসে পালিয়েছো।

ভাবখানা এই যে তুমি যেন রাস্তা থেকেই আলাদা হয়েছো

তুমি আপোষের মনোভাব নিয়ে একটুও পেছনে ফেরনি।

(তোমার পালানো দেখে) তোমার পিঠ বলে মনে হচ্ছিলো।”

খন্দক ও বনু কুরাইযার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের সংকেতধ্বনি ছিল “হুম, লা-ইউনছারুন।” অর্থাৎ শত্রুপক্ষের পরাজয় অবধারিত। শত্রুদের শক্তি ও পরাক্রম এবং অতিমাত্রায় সংখ্যাধিক্যের চাপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণকে প্রচ- ভয় ও ত্রাসের মধ্যে রণাঙ্গনে টিকে থাকতে হয়েছিলো।

অবশেষে নাঈম ইবনে মাস’উদ এসে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমার গোত্র এ কথা জানে না। এখন আপনি আমাকে প্রয়োজনীয় যে কোন নির্দেশ দিন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাদের মধ্যে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে শত্রুপক্ষের বিশ্বাসভাজন। তুমি যদি পার, আমাদের পক্ষ হয়ে শত্রুদের পর্যুদস্ত করো। য্দ্ধু তো কৌশলেরই নামান্তর।”

নাঈম ইবনে মাস’উদ বনু কুরাইযা গোত্রের কাছে গেলেন। জাহিলী যুগে তিনি তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তিনি তদেরকে বললেন, “হে বুন করাইযা, আমি তোমাদের কত ভালবাসি তা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা আছে। বিশেষ করে তোমাদের সাথে আমার যে নিখাদ সম্পর্ক রয়েছে, তা তোমাদের অজানা নয়।” তারা বললো, “হ্যাঁ, এ সত্য। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ ছিল না।” তখন তিনি বললেন, “কুরাইশ ও গাতফানের অবস্থা তোমাদের থেকে স্বতন্ত্র। এ শহর তোমাদেরই শহর। এখানে তোমাদের স্ত্রী, সন্তান ও ধন-সম্পদ রয়েছে। এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কুরাইশ ও গাতফান মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবীদের সাথে লড়তে এসেছে। তোমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছো। অথচ তাদের আবাসভূমি, ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন অন্যত্র রয়েছে। সুতরাং তারা তোমাদের মত অবস্থায় নেই। তারা যদি এখানে স্বার্থ দেখতে পায় তাহলে তারা তা নেবেই। আর যদি না পায় তবে নিজেদের আবাসভূমিতে চলে যাবে। তখন তোমরা এই শহরে একাকী মুহাম্মাদের সম্মুখীন হবে। সে অবস্থায় তার বিরুদ্ধে তোমরা টিকতে পারবে না। অতএব মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে হলে আগে কুরাইশদের মধ্য হতে কতিপয় নেতাকে জিম্মি হিসেবে হাতে নাও। তারা তোমাদের হাতে জামানত হিসেবে থাকবে। তখন তোমরা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তোমরা মুহাম্মাদের সাথে লড়াই করা তোমাদের ঠিক হবে না।” তারা বললো, “তুমি ঠিক পরামর্শ দিয়েছো।”

এপর তিনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে আবু সুফিয়ান ও তার সহযোগী কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, আমি তোমাদের পরম হিতাকাক্সক্ষী এবং মুহাম্মাদের ঘোর বিরোধী। আমি একটা খবর শুনেছি। সেটা তোমাদেরকে জানানো আমার কর্তব্য ও তোমাদের হিত কামনার দাবী। কথাটা তোমারা কারো কাছে প্রকাশ করো না।”

নাইম বললেন, “তাহলে শোন। ইহুদীরা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে অনুতপ্ত হয়েছে। তারা মুহাম্মাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে, আমরা যা করেছি তার জন্য অনুতপ্ত। এখন আমরা যদি কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের নেতৃস্থানীয় কিছু লোককে পাকড়াও করে তোমার কাছে হস্তান্তর করি আর তুমি তাদের হত্যা করো তাহলে কি তুমি আমাদের প্রতি খুশী হবে? এরপর আমরা তোমার সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশ ও গাতফানের অবশিষ্ট সবাইকে খতম করবো।’ একথায় মুহাম্মাদ রাজী হয়েছে।” নাঈম আবু সুফিয়ানকে আরো বললেন, “ইহুদীরা যদি তোমাদের কতিপয় লোককে জিম্মী রাখতে চায় তা হলে খবরদার একটি লোকও তাদের হাতে সমর্পণ করো না।”

এরপর নাঈম গাতফানীদের কাছে গিয়ে বললেন, “হে বনু গাতফান, তোমরাই আমার স্বগোত্র ও আপনজন। তোমরা আমার কাছে সবার চাইতে প্রিয়। মনে হয়, আমার বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিযোগ নেই।” তারা বললো, “তুমি সত্য বলেছো। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই।” নাঈম বললেন, “তাহলে আমি যে খবর দিচ্ছি তা কাউকে জানতে দিওনা।” তারা বললো, “ঠিক আছে। তোমার কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা হচে।” নাঈম তখন তাদেরকে অবিকল কুরাইশদের কাছে যা বলেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করলেন এবং জিম্মীর প্রশ্নে কুরাইশদের কাছে য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন গাতফানীদের কাছেও তাই উচ্চারণ করলেন।

পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসের শনিবারের পূর্বরাত্রের ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূলের সপক্ষে গোটা পরিস্থিতির মোড় পরিবর্তন করে দিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও গাতফান গোত্রের নেতৃবৃন্দ ইকরিমা ইবনে আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশ ও গাতফানীদের একটি দল পাঠালো বনু কুরাইযার কাছে। তারা গিয়ে বনু কুরাইযাকে বললো, “আমরা আর তিষ্ঠাতে পারছি না। আমাদের উট-ঘোড়া সব মারা যাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমরা মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করে চূড়ান্ত একটা ফায়সালা করে নিতে চাই।” তারা বললো, “আজ শনিবার। এই দিন আমরা কিছুই করি না। ইতিপূর্বে আমাদের কিছু লোক শনিবারে একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলো। তার ফলে যে পরিণতি হয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নয়। তাছাড়া আমরা তোমাদের সহযোগিতা করার জন্য মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে তোমরা যদি তোমাদের কিছু লোককে আমাদের হাতে নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে জিম্মী রাখো তাহলে তোমাদের সহযোগিতা করতে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি। আমাদের আশংকা হয় যে, যুদ্ধে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা যুদ্ধ অব্যাহত রাখা কঠিন মনে করলে তোমরা আমাদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে মুহাম্মাদের মুঠোর মধ্যে অসহায়ভাবে রেখে নিজ দেশে ফিরে যাবে। অথচ মুহাম্মাদের মুকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।”

বনু কুরাইযার এই জবাব নিয়ে প্রতিনিধিদল যখন ফিরলো তখন কুরাইশ ও গাতফানীরা পরস্পরকে বললো, “নাঈম ইবনে মাসউদ আমাদেরকে যে খবর দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। অতএব বনু কুরাইযাকে জানিয়ে দেয়া হোক যে, আমরা তোমাদের কাছে একজন লোকও জিম্মী হিসেবে সমর্পণ করতে রাজী নই। যুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকেতো এসে যুদ্ধ করো।” কুরাইশ ও গাতফানীদের এ জবাব নিয়ে পুনরায় বনু কুরাইযার কাছে দূত গেলে বনু কুরাইযার নেতারা পরস্পরকে বললো, “দেখরে তো নাঈম যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। কুরাইশ ও গাতফানীরা শুধু যুদ্ধই চায়। আমাদের ভালোমন্দ নিয়ে তাদের কোন মাতাব্যাথা নেই। তারা যদি লাভবান হয় তাহলে তো তাদেরই স্বার্থ উদ্ধার হলো। অন্যথায় তারা আমাদেরকে মুহম্মাদের হাতে অসহায়ভাবে রেখে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে।”

কাজেই তার কুরাইশ ও গাতফানীদের জানিয়ে দিল যে, “যতক্ষণ না তোমরা আমাদের হাতে জিম্মী না দেবে ততক্ষণ আমরা তোমাদের সহযোগী হয়ে মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করবো না।” এভাবে তারা গাতফান ও কুরাইশদের প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করলো এবং শত্রুদের ভেতরে আল্লাহ কোন্দল সৃষ্টি করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দিলেন। তদুপরি সেই প্রচ- শীতের রাতে আল্লাহ তাদের ওপর অত্যন্ত ঠন্ডা বাতাস প্রবাহিত করলেন। সে বাতাস তাদের তাঁবু ফেলে দিল এবং রান্নার আসবাবপত্র তছনছ করে দিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাদের এই কোন্দল ও বিভেদের খবর পৌঁছলে তিনি সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে রাতের বেলা শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠালেন।

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযী থেকে বর্ণিত। জনৈক কুফাবাসী সাহাবী হুযাইফা ইবনে ইয়ামানকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন ও তাঁর সাহচর্যে থেকেছেন?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সে বললো, “আপনারা তাঁর সাথে কি রকম ব্যবহার করতেন।” হুযাইফা বললেন, “আমরা তাঁর জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করতাম।” কুফাবাসী লোকটি বললো, “খোদার কসম, আমরা যদি তাঁকে জীবিত পেতাম তাহলে তাঁকে মাটিতে হেঁটে চলতে দিতাম না, বরং ঘাড়ে চড়িয়ে রাখতাম।” হুযাইফা (রা) বললেন, ভাতিজা, শোনো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমরা পরিখায় ছিলাম। তিনি রাতের একাংশ নামায পড়ে কাটালেন। পরে তিনি আামাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে শত্রুদের গতিবিধির খোঁজ নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে? আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, সে যেন জান্নাতে আমার সাথী হয়!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজ সেরে ফিরে আসার শর্ত আরোপ করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে কেউ-ভয়, শীত ও ক্ষুধার দরুন যাওয়ার শক্তি পাচ্ছিলো না। কেউ যখন প্রস্তুত হলো না তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন। ফলে আমাকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই হলো। তিনি বললেন, “হে হুযাইফা, যাও শত্রুদের ভেতরে যাও, তারপর দেখো তারা কি করছে। আমাদের কাছে ফিরে এসে তুমি কোন কিছু ঘটিয়ে বসোনা যেন।”

এরপর আমি গেলাম এবং সন্তপর্ণে শত্রু বাহিণীর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখনো আল্লাহর অদৃশ্য সেন্যরা তাদেরকে হেস্তনেস্ত করে চলেছেক। তাদের তাঁবু ও রান্নার হাঁড়ি পাতিল সবই ল-ভ- হয়ে গেছে এবং আগুন নিভে গেছে।

তখন আবু সুফিয়ান তাদের বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা প্রত্যেকে নিজের আশেপাশে খেয়াল করে দেখো, অন্য কেউ আছে কিনা।” একথা শোনার পর আমিই প্রথম পার্শ্ববর্তী লোকের গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে?” সে বললো, “অমুকের ছেলে অমুক।”[৬৯. শরহুল মাওয়াহেরে বর্ণিত হয়েছে: হুযাইফা বলেন, “আমার ডানপাশে যে ব্যক্তি বসেছিল, তার হাতের ওপর হাত রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, ‘আমি আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবিয়া।’ তারপর বামপাশে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, আমি আমর ইবনুল আস।”]

পরে আবু সুফিয়ান বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা যে স্থানে অবস্থান করছো সে স্থান আর অবস্থানের যোগ্য নেই। আমাদের উট-ঘোড়াগুলো মরে গেছে। আর বনু কুরাইযা আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে। আমরা যা অপছন্দ করি তারা তাই করেছে। প্রচ- ঝড় বাতাসে আমাদের কি দশা হয়েছে তা দেখতেই পাচ্ছ। আমাদের রান্নার সাজ-সরঞ্জাম, তাঁবু ইত্যাদি ল-ভ- হয়ে গেছে। এমনকি আগুনও নিভে গেছে। অতএব তোমরা সবাই নিজ বাড়ী অভিমুখে যাত্রা করো। আমি রওনা হচ্ছি।”

একথা বলেই সে তার উটের দিকে এগিয়ে গেল। উটটি ছিল বাঁধা। সে সেটির পিঠে উঠে বসলো। অতঃপর সেটিকে আঘাত করলো। তিনবার আঘাত করার পর সেটি লাফিয়ে উঠলো। উটটার বাঁধন খুললেও সেটি দাঁড়িয়েই ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে নির্দেশ না দিতেন যে, “ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন কিছু ঘটিয়ে বসবে না” তাহলে আমি ইচ্ছা করলেই তাকে হত্যা করতে পারতাম।

হুযাইফা বললেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গেলাম। তখন তিনি একটি ইয়ামানী কম্বল গায়ে জড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। নামাযের মধ্যেই তিনি আমাকে দেখে পায়ের কাছে টেনে নিলেন এবং কম্বলের একাংশ আমার গায়ের উপর তুলে দিলেন। এই অবস্থায়ই তিনি রুকু ও সিজদা করলেন। সালাম ফিরানোর পর আমি তাঁকে শত্রুদের  সব খবর জানালাম।

গাতফানীরা কুরাইশদের ফিরে যাওয়ার কথা জানতে পেরে স্বদেশ ভূমির পথে রওনা হলো। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ পরিখা ত্যাগ করে মদীনায় চলে গেলেন এবং অস্ত্র রেখে দিলেন।

বনু কুরাইযা অভিযান (৫ম হিজরী)

জুহরের সময় জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তাঁর মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত জীনধারী খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘হ্যাঁ।’ জিবরীল বললেন, “কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। আর আপনিও রণাঙ্গন থেকে মুসলমানদের দাবীতেই ফিরছেন! হে মুহাম্মাদ আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।”

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়ে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের পুত্র আলীকে (রা) নিজের পতাকা নিয়ে বনু কুরাইযার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী (রা) রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একটা যঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। এসব শুনে তিনি ফিরে চললেন, পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোন কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে দেখলে তারা ঐ ধরনের কিছুই বলতো না।” অতঃপর তিনি বনু কুরাইযার দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে বললেন, “হে বানরের ভাইয়েরা, আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন তো? তাঁর শাস্তি ভোগ করছো তো?” তারা বললো, “হে আবুল কাসিম, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রচলিত ডাক নাম) তোমার তো কিছুই অজানা নেই।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য কুরআনে তাঁদেরকে তিরস্কার করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।

কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের লোকজন স্বদেশ অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইযার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো, “হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যে কোন একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো, “মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে  নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানÑসন্তিতির জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।” তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।” সে বললো, “এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সাবইকে হত্যা করি। তারপর তরবারী নিয়ে মুহাম্মাদ ও তঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুল করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।” সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?” কা’ব বললো, “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবতঃ মুহম্মাদ ও তাঁর সাহবীগণ আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চন্ত থাকবে। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।” তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে  আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।” কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারা জীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”

তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, “আপনি আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

আবু লুবাবা বলেন, “আমি তৎক্ষনাৎ উপলব্ধি করলাম যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে বসেছি।”[৭০. বনু কুরাইযাকে অবরোধ করা হলো তারা নিজেদের ধ্বংস অনিবার্য মনে করে শাস ইবনে কায়েসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালো। সে গিয়ে তাঁর কাছে বনু নাযীরকে যে শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে সেই শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়ার সুপারিশ করলো অর্থাৎ শুধুমাত্র সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী ও উটের পিঠে যতটা মালপত্র নেয়া যায়, তাই নিয়ে যেতে দেয়া। আর অবশিষ্ট সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তারা রেখে যাবে। অস্ত্রশস্ত্র আদৌ নেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনৃরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সে বললো, “তাহলে শুধু আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে বিতাড়িত করে দিন। উটের পিঠে করে মালপত্র মোটেই নিতে চাই না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাঁর ফায়সালা মেনে নেয়ার ওপরই গুরুত্ব দিলেন। শাস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জবাব নিয়েই ফিরে গেল। (জারফানী প্রণীত শরহুল মাওয়াহেব) শরহুল মাওয়াহেযে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, প্রাণভিক্ষার অনুরোধ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাখ্যান করায় আবু লুবাবা মনে করেছিলেন যে, বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিলে তাদেরকে হত্যাই করবেন। তাই তাদেরকে ইংগিতে সেই বিষয়টাই অবহিত করেন।]আবু লুবাবা পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে বললেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেয়া  পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তাকে মুক্ত করতে পারি না।”

উম্মে সালামা (রা) বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “জানাতে পার।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” উল্লেখ্য যে, তখনো পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি।

এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেক মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযরের নামাযে যাওয়ার সময় তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন।

ইবনে হিশাম বলেন, আবু লুবাবা ছ’দিন খুঁটির সাথে আবদ্ধ ছিলেন। প্রত্যেক নামাযের সময় তাঁর স্ত্রী এসে নামাযের জন্য বাঁধন খুলে দিত। তারপর আবার খুঁটির কাছে এসে তিনি নিজেকে বেঁধে নিতেন।

পরদিন সকাল বেলা বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আওস গোত্রের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইযা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মুকাবিলায় তারা আমাদের সহায়তা করে থাকে। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানাই আছে।” বনু কুরাইযার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কাইনুকা গোত্রকে অবরোধ করেছিলেন। তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। তারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাদের প্রাণভিক্ষা চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করেছিলেন। আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আওস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ ইবনে মুয়াযকে আমি সালিশ নিযুক্ত করলাম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে মুয়াযকে জনৈক মুসলমানের স্ত্রী রুফাইদার নিকট মসজিদে নববীর একটা তাঁবুতে রেখেছিলেন। এই মহিলা আহতদের চিকিৎসা এবং আর্ত মুসলমানদের সেবা করতেন। সা’দ খন্দক যুদ্ধে তীরের আঘাতে আহত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বললেন, “সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ যাতে সে আমার কাছেই থাকে এবং আমি তার খোঁজ খবর নিতে ও সেবা-যত্ন করতে পারি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে সালিশ নিয়োগ করলে তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল। গাধার পিঠে তারা চামড়ার গদি স্থাপন করেছিল। তিনি ছিলেন খুব মোটাসোটা সুদর্শন পুরুষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বলতে থাকে, “হে সা’দ, তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করো। তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছেন এই জন্য যাতে তুমি তাদের প্রতি সহৃদয় আচরণ কর।” তারা খুব বেশী অনুনয় বিনয় করছে দেখে তিনি বললেন, “সা’দের জন্য সময় এসেছে সে যেন আল্লাহর দ্বীরেন ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কা না করে।” একথা যারা তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কেউ কেউ বনু আবদুল আশহালের বস্তিতে ফিরে গেল। তখন বনু কুরাইযার কিছু লোক তাদের কাছে এলো। সা’দ তাদের কাছে পৌঁছার আগেই তারা তাদের কাছে সবকিছু শুনে নিজেদের মৃত্যু অবধারিত মনে করে কাঁদতে লাগলো।[৭১. “সা’দের জন্য সময় এসেছে, সে যেন আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কার না করে”- সাদের এই উক্তি শুনে তারা বুঝলো যে, তিনি হয়তো তাদের হত্যার রায় দেবেন। তাই মৃত্যুর আগেই নিশ্চিত মৃত্যুর আভাস পেয়ে তারা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল।]

সা’দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” তখন কুরাইশরা ও মুহাজিরগণ বলতে লাগলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নির্দেশ ও কেবল আনাসারদের জন্য।” আনসারগণ বললেন, “এ নির্দেশ সবার জন্য।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।” সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবেÑতোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” সা’দ অবশ্য শ্রদ্ধাবশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা উল্লেখ করলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইযার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”

এরপর বনু কুরাইযার সবাইকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে এনে মদীনার কাইস বিনতে হারিসার বাড়ীতে আটক করে রাখা হলো। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বাজারে গেলেনÑযেখানে  আজও মদীনার বাজার অবস্থিত। এক দলে ভাগ করে আনলেন এবং ঐ সব পরিখার ভেতরে তাদেরকে হত্যা করা হলো। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাব এবং বনু কুরাইযার গোত্রপতি কা’ব ইবনে আসাদকেও হত্যা করা হলো। তাদের সংখ্যা ছিল সর্বমোট ছয় বা সাত শ’। যারা তাদের সংখ্যা আরো বেশী মনে করেন তাদের মতে তাদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় শ’য়ের মধ্যে। তাদেরকে যখন দলে দলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তারা গোত্রপতি কা’ব ইবন আসাদকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হে কা’ব, আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে বলে আপনি মনে করেন?” কা’ব বললো, “তোমরা কি কিছুই বুঝ না? দেখছো না, যে ডেকে নিচ্ছে সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার? দেখছো না তোমাদের যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম, সবাইকে হত্যা করা হবে।”

এভাবে এক এক করে সবাইকে হত্যা করা হলো।

ইসলামের জঘন্যতম দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাবকে আনা হলো। তার গায়ে গোলাপী রংয়ের একটা পোশাক ছিল। সে এর সব জায়গায় ছোট ছোট করে ছিঁড়ে রেখেছিলো যাতে তা কেড়ে নেয়া না হয়। তার দু’হাত রশি দিয়ে ঘাড়ের সাথে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে বললো, “তোমার শত্রুতা করে আমি কখনোই অনুতপ্ত হইনি। তবে আল্লাহকে যে ত্যাগ করে তাকে পর্যুদস্ত হতেই হয়।” এরপর সে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললো, হে জনম-লী, আল্লাহর হুকুম অলংঘনীয়। বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ ভাগ্যলিপি ও মহা হত্যাকা- নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।” এ কথাগুলো বলে সে বসে পড়লো এবং এরপর তার শিরচ্ছেদ করা হলো।

উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদিয়ল্লাহু আনহা বলেন, বনু কুরাইযার একজন মহিলা ছাড়া আর কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। সেই মহিলাটি আমার কাছে নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তার গোত্রের লোক নিহত হচ্ছিলো। সহসা জনৈক ঘোষক উচ্চস্বরে বলল, “সে কি? তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, “আমাকে হত্যা করা হবে।” আমি বললাম “অমুক মহিলা কোথায়?” একথা শুনে সে বললো, এই তো আমি।” “কেন?” সে বললো, “একটা কা- ঘটিয়েছি সে জন্য।” এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং হত্যা করা হলো।[৭২. ইবনে হিশাম বলেন, এই মহিলাই যাঁতার পাথর ছুঁড়ে সাহাবা খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে হত্যা করেছিলো।]

আয়িশা (রা) বলতেন, “সেই মহিলাটির কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার এই ভেবে বিস্ময় লাগে যে, সে নিহত হবে জেনেও প্রফুল্লচিত্তে ও হাসিখুশীতে ডুবে ছিল।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আতিয়া কুরাযী বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন কিশোর। আমাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।”

আইয়ুব ইবনে আবদুর রহমান বলেন, সালমা বিনতে কায়েস নাম্নী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈকা খালাÑ যিনি তাঁর সাথে উভয় কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন এবং মহিলাদের বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেছিলেনÑ রাসূলুল্লাহর নিকট রিফায়া ইবনে সামুয়েল কুরাযীর জীবন রক্ষার আবেদন করেন। তিনি বলেন, “রিফায়া নামায পড়া ও উটের গোশত খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন ও তাঁর জীবন রক্ষা করেছিল। এই লোকটি (রিফায়া) প্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং সালমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলে। সে আগে থেকেই সালমার পরিবারকে চিনতো। এভাবে সালমা রিফায়ার জীবন রক্ষা করেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন। তারপর সা’দ ইবনে যায়িদ আনসারীকে বনু করাইযার কিছু সংখ্যক দাসদাসীকে দিয়ে নাজদ পাঠিয়ে দেন। তাদের বিনিময়ে তিনি সেখানে থেকে মুসলমানদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়া খরিদ করে আনেন।

বনু কুরাইযার মহিলাদের মধ্য থেকে রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য মনোনীত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকাল পর্যন্ত সে তাঁর মালিকানায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে করে পর্দার আড়ালে নেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল, তার চেয়ে বরং আমাকে আপনি দাসী হিসেবে আশ্রয় দেন। এটা আমার ও আপনার উভয়ের জন্যই অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট হবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা মতই কাজ করলেন তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করার সময় সে ইসলাম গ্রহণের ঘোর বিরোধিতা করেছিল এবং  ইহুদী ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে দূরে রইলেন এবং মর্মাহত হলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের সাথে বৈঠকে আছেন এমন সময় পিছনের দিকে জুতার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই সালাবা ইবনে সাইয়া আমাকে রায়হানার ইসলাম গ্রহণের খবর দিতে আসছে। ” সত্যই সালাবা এলেন এবং জানালেন, রায়হানা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমে তিনি খুশী হলেন।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে খন্দক যুদ্ধ ও বনু কুরাইযার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিভাবে মুসলমানগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের ওপর কি অপার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং কিভাবে তিনি তাদেরকে সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করে উভয় যুদ্ধে বিজয় দান করেছেন, তা বর্ণনা করেছেন। অথচ তার আগে মুনাফিকরা অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, বিশাল এক বাহিনী তোমাদের ওপর চড়াও হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেন তা স্মরণ কর। তখন আমি তাদের ওপর প্রচ- ঝটিকা এবং এমন এক সেনাবাহিনী (ফিরিশতা) পাঠিয়েছিলাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমাদের কার্যকলাপও আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তারা যখন সবদিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ চালালো, যখন অনেকের চোখ ভয়ে বিষ্ফোরিত ও প্রাণ কণ্ঠনালীতে উপনীত হলো এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকমের ধারণা করতে লাগলে তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং  তাদেরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়া হলো। মুনাফিক ও অসুস্থ মনের লোকেরা বলছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের একটা দল বললো: হে ইয়াসরিববাসীগণ, তোমাদের এখন অবস্থানের অবকাশ নেই, কাজেই ফিরে যাও। তখন তাদের কোন কোন দল নবীর কাছে এই বলে অনুমতি চাচ্ছিলো যে, আমাদের পরিবার পরিজন বিপদের সম্মুখীন। আসলে তা বিপদের সম্মুখীন ছিল না। তারা শুধু পালাবার বাহানা খুঁজছিল।”

আওস ইবনে কায়যী ও তার সমমনাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়।

“যদি (মদীনার) সকল দিক দিয়ে শত্রু ঢুকে পড়তো এবং তাদেরকে ফিৎনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থাৎ শিরক করার আহ্বান জানানো হতো তাহলে তারা অবশ্যই তা করতো। এরূপ করতে তারা কদাচিৎ দ্বিধা করতো। ইতিপূর্বে তারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলো যে, রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে না। আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। ( এই বনু সালামা ও বনু হারেসা গোত্রদ্বয় উহুদ যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করার পর ওয়াদা করেছিল যে, আর কখনো তার এরূপ কাজ করবে না। সেই ওয়াদার কথা আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেনÑ যা তারা আপনা থেকেই করেছিল।) হে নবী, তুমি বল, মৃত্যু বা হত্যা থেকে পালিয়ে তোমাদের কোন লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জীবনকে ভোগ করার সুযোগ পাবে মাত্র। বল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করা কিংবা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আল্লাহর সে সিদ্ধান্ত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই তার অভিভাবক বা সহায় হিসেবে পাবে না। তোমাদের মধ্যে কারা বাধা সৃষ্টিকারী এবং কারাই বা তাদের ভাইদেরকে বলে, ‘আমাদের সাথে এসো’। এসব মুনাফিকরা খুব কমই যুদ্ধে যেয়ে থাকে। (অর্থাৎ আত্মরক্ষা ও দায় সারার প্রয়োজন ছাড়া) শুধুমাত্র তোমাদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করাই তাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধ যখন সমাগত হয় তখন তাদেরকে তুমি দেখবে, তোমার দিকে ভয়ে এমনভাবে তাকাবে, মুমূর্ষ চেতনাহীন ব্যক্তির চোখ যেমন মৃত্যুর ভয়ে ঘুরতে থাকে। তারপর বিপদ কেটে গেলে তারা গণিমতের সম্পদের লোভে উচ্ছাসিত ভাষায় তোমাদের কাছে গিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াবে। (অর্থাৎ এমন সব কথা বলবে যা তোমরা পছন্দ করো না। কেনান তারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং কোন সওয়াবও পাবে না। তাই মৃত্যুকে তার ঠিক তেমনি ভয় পায় যেমন ভয় পায় মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যারা বিশ্বাসী নয় তারা)। তারা ঈমান আনেনি ফলে আল্লাহ তাদের সকল সৎকাজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুতঃ এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ কাজ। তারা মনে করে, দলগুলো (অর্থাৎ হানাদার কুরাইশ ও গাতফান ) চলে যায়নি। আর যদি তারা পুনরায় হামলা করে বসে তাহলে তারা মরুভূমির বুকে বেদুঈনের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের খোঁজÑখবর নিতে থাকবে, আর তোমাদের মধ্যে থাকলেও তারা খুব কমই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো।”

এরপর আল্লাহ মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোামাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসীদের জন্য।” [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে থেকে কিংবা তার মর্যাদা থেকে স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট যারা তাদের  জন্য নয়] এরপর মু’মিনদের সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরীক্ষাকে স্বীকার করে নেয়ার ও মেনে নেয়ার যে মনোভাব তাদের রয়েছে, তার উল্লেখ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “মু’মিনরা যে সময় হানাদার দলগুলোকে দেখলো তখন বললো: এ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেয়া প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতি তাদের ঈমানকে ও আত্মনিবেদনকেই বাড়িয়ে দেয়।” (অর্থাৎ বিপদে ধৈর্য, অদৃষ্টের আছে আত্মসমর্পণ এবং সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব)।

“অনেক মু’মিন আছে যারা আল্লাহর কাছে দেয়া অংগীকার পূরণ করেছে। তাদের কেউ তো কর্তব্য সমাধান করে ফেলেছে। (অর্থাৎ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন, যেমন বদর ও উহুদের শহীদগণ) আবার কেউ কেউ প্রতীক্ষমান আছে। (অর্থাৎ আল্লাহর সাহয্যের জন্য এবং রাসূল ও সাহাবীগণ যা করে গেছেন তা করার জন্য তারা এতে আদৌ কোন পরিবর্তন সাধন করেনি। (অর্থাৎ কোন সন্দেহ-সংশয় বা সংকোচ পোষণ করেননি কিংবা বিকল্প পথ খোঁজেননি) আল্লাহ তায়ালা সত্যনিষ্ঠদেরকে তাদের সত্যনিষ্ঠার পুরষ্কার দেবেন এবং ইচ্ছা করলে মুনাফিকদের আযাব দেবেন, কিংবা মাফ করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আর আল্লাহ কাফিরদেরকে (অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফানীদেরকে) তাদের ক্রোধ ও আক্রোশসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোন কল্যাণই তাদের ভাগ্যে জোটেনি। মু’মিনদের হয়ে লড়াই করা জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কেননা তিনি তো শক্তিমান পরক্রমশালী। আহলে কিতাবদের যে গোষ্ঠটি (অর্থাৎ বনু কুরাইযা) তাদের সাহয্য করেছিল আল্লাহ তাদের সুরক্ষিত জায়গাগুলো থেকে তাদেরকে বের করে এনেছেন এবং তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাদের একাংশকে হত্যা ও অপরাংশকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছো। (অর্থাৎ পুরুষদের হত্যা করেছো এবং নারী শিশুদের বন্দী বানিয়েছ।) আর আল্লাহ তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী, ধন-সম্পদ এবং যে জায়গা আদৌ পায়ে মাড়াওনি (অর্থাৎ খাইবার) সে জায়গাও তোমাদের অধিকারভুক্ত  করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।”

বনু কুতাইবার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সা’দ ইবনে মুয়াযের জখমটির হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং তিনি শাহাদাত লাভ করেন।

হাসান বাসরী (রাহ) বলেন, সা’দ খুব মোটাসোটা ও ভারী লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর লাশ বহনকারীরা তাঁকে অস্বাভাবিক রকম হালকা বোধ করে। তখন মুনাফিকদের কেউ কেউ বললো, সা’দ তো খুব ভারী ছিলেন। অথচ আমরা এত হালকা লাশ আর দেখিনি।”একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হালকা মনে হয়েছে তার কারণ এই যে, তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে তোমরা ছাড়াও অনেকে ছিল (অর্থাৎ ফেরেশতা)। আল্লাহর কসম, সা’দের রূহ পেয়ে ফেরেশতারা উল্লাসিত ও আনন্দিত হয়েছে। তার ইনতিকালে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে।”

খন্দক যুদ্ধে তিনজন মুশরিক নিহত হয়েছিল। মুনাব্বিহ ইবনে উসমান তাদের একজন। সে তীরবিদ্ধ হয় এবং আহত অবস্থায় মক্কায় গিয়ে মারা যায়। আর একজন বনু মুখযুমের নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ। সে খন্দক ডিঙ্গিয়ে এসেছিল। ধরা পড়ে নিতহ হয়। সে তীরবিদ্ধ। তার লাশ মুসলমানদের অধিকারে ছিল। মুশরিকরা তার লাশ কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার লাশ বা তার মূল্য দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তার লাশ দিয়ে দেয়া হলো। তৃতীয় ব্যক্তি ছিল বনু আমের গোত্রের আমর ইবনে আব্দ উদ। আলী ইবনে আবু তালিব (রা) তাকে হত্যা করেন।

বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযানে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে যাঁতার পাথর ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বললেন, “খাল্লাদ দু’জন শহীদের সওয়াব পাবে।” সাহাবী আবু সিনান মারা যান বনু কুরাইযাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ করার সময়। তাঁকে বনু কুরাইযার গোরস্থানে দাফন করা হয়। খন্দকের দু’পাশে সেনা সমাবেশের অবসান ঘটলে এবং কাফিররা পরিখা ত্যাগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এরপর কুরাইশরা আর কখনো তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে না বরং এরপর তোমরাই তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।”

বস্তুত তারপর কুরাইশ পক্ষ থেকে মুসলমানদের ওপর আর কোন আক্রমণ হয়নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে মক্কা বিজয়ের সুযোগ দেন।

বুন লিহইয়ান অভিযান

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহাজ্জ, মুহাররম, সফর, রবিউল আউয়াল ও রবিউস সানী এই ক’মাস মদীনায় অবস্থান করেন। বনু কুরাইযা বিজয়ের পর ৬ষ্ঠ মাসে জামাদিউল উলাতে তিনি বনু লিহইয়ান অভিযানে বের হন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল রাজীর অধিবাসিদের কাছে খুবাইব ইবনে আদী ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) ফেরত চাওয়া। তিনি এমনভাবে বের হন যে, মনে হচ্ছিল তিনি সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেছেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাজীবাসীর ওপর আক্রমণ চালানো।

মদীনা থেকে বের হয়ে তিনি মদীনার পার্শ্ববর্তী পাহাড় গুরাব হয়ে সিরিয়াগামী রাস্তা ধরে প্রথমে মাখীদ, তারপর বাতরা গমন করেন। সেখানে বাম দিকে মোড় নিয়ে মদীনার অদূরবর্তী সমভূমি ‘বীনে’র ওপর দিয়ে ইয়ামাম পর্বতমালা অতিক্রম করে মক্কাগামী রাস্তা ধরে অগ্রসর হলেন। এরপর ক্ষিপ্রগতিতে বনু লিহ্ইয়ানের আবাসভূমি ‘গুরান’ পৌছেন। গুরান হলো আমাজ ও উসফানের মধ্যবর্তী সমভূমি যা ‘সায়া’ নামক অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। গুরান গিয়ে দেখলেন, তারা আগেভাগেই সাবধান হয়ে নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেছ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরানে শিবির স্থাপন করলেন। তাঁর অতর্কিত আক্রমণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, “আমরা যদি উসফানে শিবির স্থাপন করি তাহলে মক্কাবাসী মনে করবে আমরা মক্কা যাচ্ছি।” অতঃপর তিনি দু’শ ঘোড়সওয়ার সাহাবীকে সাথে নিয়ে উসফানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর দু’জন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালেন। তারা কুরাউল গুমাইম পর্যন্ত পৌঁছলো। তারার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বহিনী নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী এবং আমাদের প্রতিপালকের প্রশংকারী। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই সফরের দুঃখ-কষ্ট থেকে এবং পরিবার পরিজন ও ধনÑসম্পদের ক্ষতি থেকে।”

 

যী কারাদ অভিযান

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অল্প কয়েকদিন কাটালেন। সহসা উয়াইনা ইবনে হাসান ফযারী গাতফানীদের কতিপয় ঘোড় সওয়ারকে সাথে নিয়ে মদীনার অদূরে গাবা নামক স্থানে বিচরণরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাভীন দুধেল উটগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তা লুট করে নেয়। এই লুণ্ঠত উটগুলোর সাথে বনী গিফার গোত্রের এক ব্যক্তি এবং তার স্ত্রীও ছিল। তারা লোকটিকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে সহ উটগুলো নিয়ে যায়।

এই লুণ্ঠনের ব্যাপারটা সর্বপ্রথম জানতে পারেন সালামা ইবনে আমর ইবনে আকওয়া। তিনি তালহা ইবনে আবদুল্লাহর গোলামকে সাথে নিয়ে তীর ধনুক সজ্জিত হয়ে গাবাতে গিয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিল একটা ঘোড়া। তিনি সানিয়াতুল ওয়াদা পাহাড়ের এক কিনারে গিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “বাচাঁও।” অতঃপর তাদেরকে অনুসরণ করে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেলেন। হিংস শ্বাপদ যেমন শিকারের  পেছনে ছোটে তিনি ঠিক তেমনিভাবে ছুটলেন। ছুটতে ছুটতে তাদেরকে ধরে ফেললেন এবং তাদেরকে লক্ষ্য করে তীর ছুরতে শুরু করলেন। প্রতিটা তীর নিক্ষেপকালে তিনি বলছিলেন, “এই লও, আমি আকওয়ার পুত্র। আজকে পাপিষ্টদেরকে খতম করার দিন।” লুণ্ঠনকারীরা যেই তাকে ধাওয়া করে অমনি তিনি সরে পড়েন এবং পরক্ষণেই আবার বেরিয়ে মুকাবিলা করতে এগিয়ে যান। এভাবে তিনি সুযোগ পেলেই তীর নিক্ষেপ করেন আর বলেন, “লও, আমি আকওয়া বেটা। আজকে পাপিষ্ঠদের খতম করার দিন।” ওদিকে লুণ্ঠনকারীরা আর্তনাদ করতে থাকে, “লোকটা দিনের প্রথমভাগেই আমাদের ওপর এমন কঠোর হয়ে উঠলো।”

সালামার চিৎকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ণগোচর হলো। তিনি চিৎকার করে ঘোষণা করলেন, “বিপদ! বিপদ!” সঙ্গে সঙ্গে বিপুলসংখ্যক সাহাবী পিঠে সওয়ার হয়ে তাঁর কাছে সমবেত হতে লাগলেন। প্রথমে মিকদাদ ইবনে আমর, তারপর আব্বাদ ইবনে বিশর, তার একে একে সা’দ ইবনে যায়িদ, উসায়েদ বিন যুহাইর, উক্কাশা ইবনে মুহসান, মুহরিদ ইবনে নাদালা, আবু কাতাদাহ হারেস ইবনে রাবয়ী ও আবু আইয়াশ তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে যায়িদের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “লুণ্ঠনকারীদের ধাওয়া করে যেতে থাক। আমি পরে আরো লোক পাঠাচ্ছি।” সা’দ- এর বাহিনী পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের ধরে ফেললো। প্রথমেই আবু কাতাদাহ হাবীব ইবনে উয়াইনাকে হত্যা করে নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলেন এবং তারপর গিয়ে নিজের দলের লোকদের সাথে যোগ দিলেন।

কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং একদল মুসলমানকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে হাবীবকে আবু কাতাদাহ  চাদরে জড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। সঙ্গী সাহাবীগণ ইন্নালিল্লাহ পড়ে বলতেন, “কি সর্বনাশ! আবু কাতাদাহ নিহত হয়েছে?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, এ আবু কাতাদাহ নয়। আবু কাতাদার  হাতে এ লোকটি নিহত হয়েছে। তবে সে তাকে নিজের চাদরে জড়িয়ে রেখেছে যাতে তোমরা বুঝতে পারো যে, এ তারই সঙ্গী।” উক্কাশা ইবনে মুহসান লুণ্ঠনকারীদের দু’জন- আওবার ও তার পুত্র আমরকে ধরে একসাথেই হত্যা করলেন। তারা একই উটে চড়ে যাচ্ছিল। কিছুসংখ্যাক লুণ্ঠিত উটও তাঁরা পুনরুদ্ধার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যূ-কারাদের পাহাড়ের কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। এরপর বাদবাকী মুসলমানগণ তার কাছে কাটালেন। সালাম ইবনুল আকওয়া বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে যদি একশ’ লোক দিয়ে পাঠান আমি বাদবাকী উটগুলো ছিনিয়ে আনতে এবং লুণ্ঠনকারীদের ধরতে পারবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তারা এখন গাতফানের লোকদের কাছে রাত্রের আহার গ্রহণ করছে।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের মধ্যে প্রতি একশ’ জনে একটা উট বিতরণ করলেন এবং তা খেয়েই তাঁরা দিন অতিবাহিত করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে আসলেন।

গিফারীর স্ত্রীর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি উটে আরোহণ করে তাঁর কাছে উপনীত হলো এবং তার স্বামীর মৃত্যুর খবর জানালো। তারপর বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি মানত করেছি যে, যদি আমি এই উটের পিঠে চড়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাই তাহলে এটা আল্লাহর নামে জবাই করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “উটটাকে তুমি খুবই খারাপ প্রতিদান দিতে চেয়েছো। আল্লাহ তোমাকে তার পিঠে চড়িয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, আর তুমি কিনা তাকে জবাই করতে চাও! আল্লাহর নাফরমানীর ব্যাপারে কোন মানত চলে না। তুমি যার মালিক নও, তা দিয়ে মনত পূরণ করা চলে না। এটা আমার উট। তুমি নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যাও। আল্লাহ তাতেই তোমার কল্যাণ করবেন।”

বনু মুসতালিকের অভিযান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাদিউস সানীর অবশিষ্টাংশ এবং রযব মাস মদীনায় অতিবাহিত করলেন। তারপর ৬ষ্ঠ হিজরীর শা’বান মাসে খাজায়া গোত্রের বনু মুস্তালিক শাখার বিরুদ্ধে অভিযান চালান।

এক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, বুন মুসতালিক গোত্র তাঁর সৈন্য সমাবেশ করছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হারেস ইবনে আবু দিরার যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যতম স্ত্রী জুয়াইরিয়ার পিতা। এ খবর পেয়েই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্য সামন্ত নিয়ে তাদের মুকাবিলায় বেরুলেন। মুরাইসী নামক ঝর্ণার কিনারে তাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হলো। আল্লাহ বনু মুস্তালিককে পরাজিত করলেন। তাদের বহু লোক নিহত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্তান, নারী ও সম্পদ গণীমত হিসেবে গণ্য করলেন।

বনু কালব ইবনে আওফ গোত্রের হিশাব ইবনে সুবাবা নামক জনৈক মুসলিম এতে নিহত হলেন। তাঁকে শত্রুপক্ষীয় মনে করে উবাদা ইবনে সমিতের (রা) দলভুক্ত জনৈক আনসারী সাহাবী ভুলক্রমে হত্যা করেন।

ঝর্ণার কিনারে অবস্থানকালেই মুসলমানদের মধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো। জাহজাহ ইবনে মাসউদ নামক বনু গিফারের এক ব্যক্তিকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর ঘোড়া রাখার জন্য মজুর হিসাবে নিয়োগ করেন। পানি নিয়ে সিনান ইবনে আবার জুহানীর সাথে তার ঝগড়া হয় এবং ক্রমে ঝগড়া মারামারিতে রূপান্তরিত হয়। তখন জুহানী চিৎকার করে ডাকলো “হে আনসারগণ, বাঁচাও।” জাহজাহও চিৎকার করে বললো, “হে মুহাজিরগণ, আমাকে বাঁচাও।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তখন তার গোত্রের একদল লোকের সাথে অবস্থান করছিল। কিশোর যায়িদ ইবনে আরকামও সেই দলের মধ্যে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার শুনে উত্তেজিত হয়ে বললো, তারা কি শেষ পর্যন্ত এমন কান্ড ঘটালো? ওরাতো আমাদের মাঝে থেকেই দল ভারী করে অহমিকায় মেতে উঠেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের ও মুহজিরদের অবস্থা সেই প্রবাদ বাক্যের মতই গড়াচ্ছে যে, ‘নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাসোটা বানাও, দেখবে একদিন সে তোমাকেই কেটে খাবে।’ আল্লাহর কসম, এবার যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।” তারপর তার স্বগোত্রীয়দের বলতে লাগলো, “তোমার নিজেদের কি সর্বনাশ করেছ, এখন দেখ। ওদেরকে এ দেশে ঠাঁই দিয়েছো। তোমাদের সম্পদের ভাগ দিয়েছো। ওদের প্রতি অমন বদান্যতা যদি না দেখাতে তাহলে ওরা অন্যত্র যেতে বাধ্য হতো।”

যায়িদ ইবনে আরকাম এসব কথাবার্তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। এ সময় তিনি সবেমাত্র শত্রুকে পরাস্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তিনি যখন এই খবর শুনলেন তখন তার কাছে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দিন তাকে যমের ঘরে পাঠাক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উমার আমি যদি তা করি তাহলে লোকেরা বলবে যে,মুহাম্মাদ নিজেই তার সহচরদের হত্যা করছে। তা করা যায় না। তবে তুমি এখনই এখান থেকে রওনা হবার নির্দেশ জানিয়ে দাও।” যে সময় এ নির্দেশ দেয়া হলো সে সময় সাধারণত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও রওনা হতেন না। তথাপি সবাই রওনা হলো।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই  ইবনে সুলুল যখন জানতে পারলো যে যায়িদ ইবনে আরকাম তার কথাগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন, তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে গিয়ে কসম খেয়ে বলতে লাগলো, “যায়িদ যা বলেছে, আমি সেসব কথা বলিনি।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যেহেতু স্বগোত্রে খুবই সম্মানিত লোক বলে গণ্য হতে তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যেসব আনসারী সাহাবী ছিলেন তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, যায়িদ হয়তো ভুল শুনেছে  এবং সে যা বলেছে তা হয়তো পুরোপুরি মনে রাখতে পারেনি।” এভাবে তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি একটু সৌজন্য দেখালেন  এবং তাকে বাঁচিয়ে দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হলেন, তাঁর সাথে উসায়েদ ইবনে হুদাইস দেখা করলেন। তাঁকে সালাম ও অভিবাদন পূর্বক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বড়ই অসুবিধাজনক সময়ে যাত্রা করেছেন। সাধারণত এরকম সময়ে আপনি কোথাও যাত্রা করেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের সঙ্গী লোকটি কি বলেছে তা শোননি?” তিনি বললেন, “কোন্ সঙ্গী?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।” উসায়েদ বললেন, “সে কি বলেছে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার ধারণা, সে যদি মদীনায় ফিরে যেতে পারে তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে।” উসায়েদ বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ইচ্ছা করলে তাকে আমরা বের করে দিতে পারি। সত্যই সে অত্যন্ত হীন ও নীচ। আর আপনি পরাক্রান্ত।” তিনি আরো বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, তার প্রতি একটু নমনীয় হোন। আল্লাহর কসম, আপনাকে আল্লাহ আমাদের এমন সময় এসে দিয়েছেন যখন তার গোত্র তাকে মুকুট পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই সে মনে করে, আপনি তার থেকে একটা রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে একদিন একরাত ধরে পথ চললেন। পথে প্রচ- রৌদ্রে তাদের অসহনীয় কষ্ট হতে লাগলো। তাই এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। লোকেরা মাটিতে নামতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। আগের দিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথায় লোকদের ভেতর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল তা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে অসময়ে যাত্রা করেছিলেন। বিশ্রাম শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। হিজাজের মধ্য দিয়ে যাত্রাকালে তিনি একটি ঝর্ণার কাছ যাত্রাবিরতি করলেন। সে স্থানটার নাম বাক্য়া। সেখান থেকে পুনরায় যখন যাত্রা শুরু হলো তখন মুসলমানদের উপর দিয়ে হঠাৎ একটা কষ্টদায়ক ভীতিপ্রদ বাতাস বয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ বাতাসকে তোমরা ভয় পেয়ো না। একটা মস্তবড় কাফিরের মৃত্যু ঘটেছে। সে জন্যই এ বাতাস।” মদীনায় ফিরে দেখেন বনু কাইনুকা গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি রিফায়া ইবনে যায়িদ ঐ দিনই মারা গেছে। সে ছিল মুনাফিকদের আশ্রয়স্থল তথা কুমন্ত্রণাদাতা।

কুরআন শরীফের সূরা মুনাফিকুন ্আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মত লোকদের সম্পর্কেই যায়িদ ইবনে আরকামের কানে হাত রেখে বললেন, “এই ব্যক্তি তার কানের সাহায্যে আল্লাহর ওয়াদা পালন করেছে।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহ তার পিতার ব্যাপারটা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি শুনেছি, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে তার বৈরী কথাবার্তার জন্য হত্যা করতে ইচ্ছুক। যদি সত্যিই আপনি ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে নির্দেশ দিন আমি তার মাথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দিই। আল্লাহর কসম, খাযরাজ গোত্র জানে যে, ঐ গোত্রে আমার চেয়ে পিতৃভক্ত লোক আর নেই। আমার আশংকা হয় যে, আপনি আমার পিতাকে হত্যার জন্য কাউকে নির্দেশ দেবেন। আর সে তাকে হত্যা করবে, তখন আমার পিতৃহত্নাকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে হয়তো আমার প্রবৃত্তি কুপ্ররোচনা দিয়ে আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলবে। ফলে তাকে হত্যা করে আমি জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবো। কেননা সেক্ষেত্রে আমি একজন কাফিরের বদলায় একজন মু’মিনকে হত্যার দায়ে দোষী হবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না সে যতদিন আমাদের সাথে থাকে ততদিন তার প্রতি আমরা নমনীয় থাকবো এবং ভালো ব্যবহার করবো।”

এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখনই কোন অঘটন ঘটাতো, তার গোত্রের লোকেরাই তাকে শায়েস্তা করতো। তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করতো এবং পাকড়াও করতো। এই অবস্থা জেনে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) বললেন, “উমার, পরিস্থির পরিবর্তনটা দেখছো তো? তুমি যেদিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলে সেদিন যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো। কিন্তু আজ যদি তাকে হত্যার নির্দেশ দিই তাহলে সেদিন যারা নাক সিটকাতো তারাই আজ তাকে হত্যা করবে।” উমার (রা) বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি জানি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্তের চাইতে অধিক কল্যাণকর।”

যে মুসলমানকে উবাইদা ইবনে সামিত (রা) শত্রুর লোক সন্দেহে ভুলবশতঃ হত্যা করেছিলেন, সেই হিসাম ইবনে সুবাবার ভাই মিকইয়াস ইবনে সুবাবা একদিন মক্কা থেকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে নিজের ভাইয়ের খুনের পণ দাবী করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তপণ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। মিকইয়াস নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করেছিলো। রক্তপণ পাওয়ার পর সে অল্প কিছুদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অবস্থান করে। তারপর একদিন তার ভ্রাতৃহন্তাকে হত্যা করে ইসলাম ত্যাগ করে মক্কা চলে যায়।

ওইদিন বনু মুসতালিকের বহুলোক নিহত হয়েছিল। [৭৩. ইবনে হিশাম বলেন, বনু মুসতালিকের যুদ্ধে মুসলমানদের শ্লোগান ছিল, “হে সাহায্যপ্রাপ্ত, হত্যা কর, হত্যা কর।”] আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) হাতে মালিক ও তার পুত্রসহ বনু মুসতালিকের দু’জন লোক নিহতক হয়। আর আবদুর রহমান ইবনে আওফ হত্যা করেন অশ্বারোহী আহমার বা উহাইমিরকে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন অনেক যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক করেন। তাদেরকে তিনি মুসলমানদের মধ্যে দাসদাসীরীপে বণ্টন করে দেন। এইসব যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে একজন ছিলেন বনু মুসতালিকের গোত্রপতি হারেস ইবনে আবু দিরার দুহিতা জুয়াইরিয়া যিনি পরবর্তীকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আবহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু মুসতালিকে যুদ্ধবন্দীদেরকে বণ্টন করলে জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে অথবা তার এক চাচাতো ভাইয়ের ভাগে পড়েন। জুয়াইরিয়া তৎক্ষণাৎ মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তিলাভের উদ্যেগ নেন। তিনি ছিলেন খুবই লাবণ্যময়ী মিষ্টি মেয়ে।

তাঁকে যেই দেখতো সে-ই মুগ্ধ হয়ে যেতো। জুয়াইরিয়া মুক্তি লাভের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সাহায্য কামনা করেন। তাঁকে আমার ঘরের দরজায় দাঁড়তে দেখেই আমি তাঁকে খারাপ মনে করি। আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর যে মনোহর রূপ আমি দেখছি তা নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টি এড়াবে না। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি হারেস ইবনে আবু দিরারের কন্যা। আমার পিতা গোত্রের সরদার। আমি কি বিপদে পড়েছি তা আপনার অজানা নয়। আমি সাবিত ইবনে কায়েস Ñ অথবা তার চাচাতো ভাইয়ের ভাগে পড়েছি। আমার মুক্তিপণ আদায়ে আপনার সাহায্য কামনা করছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি যদি তোমার জন্য আরো ভালো কিছুর ব্যবস্থা করি?” তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, সেটা কি?” তিনি বললেন, “আমি তোমার পক্ষ হতে মুক্তিপণ আদায় করে দিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো।” জুয়াইরিয়া বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, “আমি এতে রাজী আছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তাই করলাম।”মুসলমানগণ যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়াইরিয়াকে বিয়ে করেছেন তখন  তাঁরা তাঁদের হাতে বন্দী বনু মুসতালিকের সব লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয় বিবেচনা করে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এভাবে বনু মুস্তালিকের একশ’ বন্দী শুধু  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জুয়াইরিয়ার বিয়ে হওয়ার কারণে মুক্তিলাভ করলো। সত্যি বলতে কি নিজ গোত্রের জন্য জুয়াইরিয়ার চেয়ে কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে এমন কোন মহিলার কথা আমার জানা নেই।

ইয়াজীদ ইবনে রোমান বলেন, বনু মুসতালিক গোত্র ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ালীদ ইবনে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকে তাদের কাছে প্রেরণ করেন। তাঁর আগমনের খবর শুনে গোত্রের বহু অশ্বারোহী তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলো। এদিকে ওয়ালীদ এসব দেখে ভয় পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গিয়ে বললেন যে, গোত্রের লোকেরা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে এবং তাদের দেয় যাকাত আনতে দেয়নি। এতে মুসলমানগণ বনু মুসতালিককে আক্রমণ করার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক এই সময় বনু মুস্তালিকের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি আমাদের কাছে দূত পাঠিয়েছেন শুনে আমরা তাকে অভ্যর্থনা করতে এবং আমাদের দেয় যাকাত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ত্বরিত গতিতে ফিরে এলেন। পরে শুনলাম, তিনি আপনাকে বলেছেন যে, আমরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলাম। আল্লাহর কসম, আমরা সে জন্য আসিনি।” এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ সূরা হুজুরাতের এ আয়াত দু’টি নাযিল করেন।

“হে মুমিনগণ, তোমাদের কাছে কোন ফাসিক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে এলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখো যাতে অজান্তে কোন গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হ’য়ে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও। আর জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রয়েছেন। তিনি যদি অনেক ব্যাপারে তোমাদের মত অনুসরণ করেন তাহলে তোমরা মুসিবতে পড়ে যাবে। ..........”

এই সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আয়িশা (রা) ও ছিলেন। তাঁকে নিয়ে তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন মদীনার কাছাকাছি এক জায়গায় এলে একদল মুসলমান আয়িশার (রা) ওপর অপবাদ করে বসে।

৬ষ্ঠ হিজরী সনে বনু মুসতালিক অভিযানকালে অপবাদের ঘটনা

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই  সফরে যেতেন, তখনই কোন স্ত্রী তাঁর সাথে যাবেন তা নিয়ে লটারী করতেন। যার নামে লটারী উঠতো তিনি তাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বনু মুসতালিক অভিযানকালেও তিনি যথারীতি লটারী করলেন এবং তাতে আমার নাম উঠলো। তাই তিনি আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন।

তৎকাল মেয়েদের মধ্যে স্বল্পহারের প্রচলন ছিল। তাই শরীরের গোশত স্ফীত হয়ে ওজন বেড়ে যেতো না। সফরকালে আমার উট যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে আমি হাওদায় বসতাম। লোকজন এসে হাওদা উঠিয়ে পিঠে স্থাপন করতো এবং তা রশি দিয়ে উটের পিঠে বেঁধে দিতো। এরপর যাত্রা শুরু হতো।

বনু মুসতালিক অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তনকালে মদীনার নিকটে এসে এক জায়গায় একরাত কাটালেন। তারপর আবার যাত্রার ঘোষণা হলে সদলবলে যাত্রা শুরু হলো। এই সময় আমি প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার গলায় একটা ইয়ামানী মুক্তার মালা ছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে আসার পর আমি দেখলাম যে, সেই হার আমার গলায় নেই। কখন যে তা পরে গেছে আমি মোটেই টের পাইনি। অগত্যা আমি তা খুঁজতে আবার কাফিলা থেকে বেরিয়ে যেখানে প্রকৃতির ডাকে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। ইতিমধ্যে কাফিলা যাত্রার আয়োজন করলো। আমি হারটি খুঁজে পেলাম। যারা আমার উটের হাওদা উঠায় তারা ্আমার উটের কাছে এসে যথারীতি হুদাটা উঠিয়ে দিল। ততক্ষণে তাদের যাত্রার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তারা যখন হাওদা উঠালো, তখন ভাবলো আমি যথারীতি হাওদার ভেতরেই আছি। তাই তারা হাওদা উঠিয়ে তা উটের সাথে বেঁধে দিল। আমার হাওদার অবস্থান সম্পর্কে তাদের মোটেই সন্দেহ হলো না। তারপর তারা উট হাঁকিয়ে যাত্রা করলো। আমি হার কুড়িয়ে নিয়ে যখন কাফিলায় রাত্রি যাপন স্থানে ফিরে এলাম তখন ময়দান ফাঁকা। সেখানে কেউ নেই। সমগ্র কাফিলা রওনা হয়ে গেছে। অনন্যোপায় হয়ে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঐ স্থানেই শুয়ে রইলাম। ভাবলাম আমার অনুপস্থিতি দেখলে তারা অবশ্যই আমার খোঁজে ফিরে আসবে। আমি তখনো শুয়ে আছি। দেখলাম সাফওয়ান ইবনে মুয়াল্লাল সুলামী আমার কাছ দিয়ে যাচ্ছে। সেও কোন প্রয়োজনে কাফিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সে কাফিলার সাথে রাত যাপনও করেনি। দূর থেকে আমাকে দেখে সে এগিয়ে এলো এবং আমার আছে এসে দাঁড়ালো। পর্দার হুকুম নাযিল হবার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এ যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী।” আমি তখনো কাপড়ে আবৃত। সে বললো, “আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি কিভাবে পেছনে পড়লেন?” আমি তার সাথে কোন কথা বললাম না। অতঃপর সে উট এগিয়ে দিয়ে বললো, “আরোহণ করুন।” সে একটু দূরে সরে গেল। আমি উটের পিঠে সওয়ার হলাম। আর সে উটের মাথা ধরে কাফিলার দিকে দ্রুত এগিয়ে চললো। এবাবে সকাল হলো। লোকজন এক জায়গায় বিশ্রাম করছিলো। এমন সময় সে আমাকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে হাজির হলো। এই দৃশ্য দেখেই অপবাদ আরোপকারীরা অপবাদ রটালো। মুসলমানদের মধ্যে তা নিয়ে চাঞ্চল্য ও হুলস্থ’ল পড়ে গেল। কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারলাম না। মদীনায় পৌঁছেই আমি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি তখনো ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি না। কথাটা ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আমার পিতা-মাতার কানেও গেল। তাঁরাও আমাকে এর বিন্দুবিসর্গ জানতে গিলেন না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম। আমার প্রতি আগের মত সহৃদয় ব্যবহার তাঁর কমে গেল। কখনো অসুস্থ হলে তিনি আমাকে আদর সোহাগ করতেন। কিন্তু এবারের অসুস্থতায় তিনি তা করলেন না। এটা আমার কাছে খুব ভাল লাগলো না। আমার পরিচর্যার জন্য আমার মা কাছে ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে তিনি আমার কাছে এসে শুধু বলতেন, “কেমন আছ?” এর বেশি একটা কথাও তিনি বলতেন না। এতে আমি খুবই মনোকষ্ট পোহাচ্ছিলাম। তাঁর এ নিরস ও হৃদয়হীন আচরণ দেখে একদিন আমি তাঁকে বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি আমার মার কাছে চলে যাই। তিনি আমার পরিচর্যা করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়ে বললেন, “যেতে পার, কোন বাধা নেই।”

আমি মার কাছে চলে গেলাম। তখনো আমি রটনা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। বিশ দিনেরও বেশি রোগে ভুগে আমি জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেলাম।

আমরা ছিলাম আরব। অনারবদের মত আমাদের বাড়ীতে পায়খানা বানাতাম না। এসব আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। আমরা নারীরা খোলা ময়দানে গভীর রাত্রে গিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতাম। আমি কোন এক রাত্রে আবদুল মুত্তালিব তনয় আবু রেহেমার কন্যা উম্মে মিসতাহর সাথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার সাথে চলতে গিয়ে এই মহিলা হঠাৎ নিজের গায়ের কম্বলে পা জড়িয়ে হোঁচট খেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কপাল পুড়–ক মিস্তাহর।” আমি বললাম, “ছি! ছি! এ আপনি কি বলেছেন, এমন একজন মুহাজিরের নামে এমন কথাÑ যিনি বদরের যুদ্ধে শরীক হয়েছেন?” তিনি বললেন, “ওহে আবু বাক্রের মেয়ে, তুমি কি ওর ব্যাপারে কিছু শোন নি?” আমি বললাম, “কিসের ব্যাপার?” তখন তিনি  আমাকে রটিত অপবাদের কথা জানালেন। আমি বললাম, “এ রটনায় কি মিসতাহও যোগ দিয়েছিল?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, ও ছিল।”

আয়েশা বলেন: একথা শোনার পর আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। ঘরে ফিরে এলাম এবং কাঁদতে লাগলাম। কান্নার চোটে আমার কলিজা বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মাকে বললাম, “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। লোকেরা যা বলার তাতো বলেছেই। কিন্তু আপনি যে তাঁর বিন্দুমাত্রও আমাকে জানালেন না। ব্যাপার কি?” মা বললেন, “মা, ব্যাপারটা তুমি হালকাভাবে নাও। কোন মেয়ে যদি সুন্দরী হয়ে এবং তার স্বামী যতি তাকে খুব ভালবাসে আর তার যদি সতিনও থাকে, তাহলে পুরুষ এবং স্ত্রী নির্বিশেষে সবাই তাকে পেয়ে বসে। তার বিরুদ্ধে এন্তার রটনায় লিপ্ত হয়।”

ইতিমধ্যে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। এই ভাষনের কথাও আমি জানতাম না। তিনি ভাষনের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর বললেন, “হে লোকজন! কিছু লোক আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিচ্ছে? তাদের ব্যাপারে অসত্য কথা বলছে. অথচ আমি আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে ভাল ছাড়া মন্দ কিছু জানি না। আর এমন একটি লোক সম্পর্কে অপবাদ রটানো হচ্ছে যার সম্পর্কেও আমি ভাল ধারণা পোষণ করি। আমার অনুপস্থিতিতে সে কখনো আমার ঘরে প্রবেশ করে না।”

আয়িশা বলেন: এই অপবাদ রটনার প্রধান ও নেপথ্য নায়ক ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল। খাযরাজ গোত্রের কিছু লোকও তার সহযোগী ছিল। মিসতাহ ও হামনা বিনতে জাহাশ (উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিনতে জাহাশের বোন) যেটুকু বলেছিল ঐ মুনাফিক দল তাকে অতিরঞ্জিত করে তুলেছে। হামনার বোন যায়নাব বিনতে জাহাশ রাসূলুল্লাহ অন্যতমা স্ত্রী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র যায়নাবকে আমার সমান মর্যাদা দিতেন। অথচ যায়নাব আমার সম্পর্কে একটিও খারাপ কথা বলেননি। আল্লাহ তাকে সততার উচ্চতম মানে বহাল রেখেছিলেন। কেমল হামনা বিনতে জাহাশই অপবাদ রটনায় অংশগ্রহণ করে। এমনকি সে তার বোনের জন্য আমার সাথে বাকবিত-াও করতো। তার এ আচরণে আমি খুবই বিব্রত ছিলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত ভাষণ দিলে উসায়েদ ইবনে হুদায়ের বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, অপবাদ আরোপকারীরা যদি আওস গোত্রের লোক হয় তাহলে আমরাই তাদের শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি খযরাজের লোক হয় তাহলে আমাদেরকে আপনি যে নির্দেশ দিতে চান, দিন। আল্লাহর শপথ, এ ধরনের লোকেরা হত্যার যোগ্য।” সাদ ইবনে উবাদকে ভাল লোক বলেন মনে হতো। একথা শুনে সে বললো, “মিথ্যা কথা, আমরা তাদেরকে হত্যা করবো না। তারা খাযরাজ গোত্রের লোক, তাই তুমি  এ কথা বলছো। তোমার গোত্রের লোক হলে একথা বলতে না।” উসায়েদ বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। আসলে তুমি একজন মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো।”

আয়িশা (রা) বলেন: এরপর দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল। আওস ও খাযরাজ ্ও দুই গোত্রে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ারও আশংকা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে আলী (রা) ও উসামা ইবনে যায়িদকে (রা) ডেকে পরামর্শ করলেন। উসামা আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার স্ত্রী? তার সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। এটা একটা মিথ্যা ও অলীক অপবাদ।” আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, স্ত্রীলোকের অভাব নেই। আপনি ইচ্ছা করলে একজন স্ত্রীর হলে আর এক স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারেন। তবে দাসীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। সে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবে।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশার পরিচারিকা বারীরাকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য ডাকলেন। সে এলে আলী (রা) তাকে ভীষণভাবে প্রহার করলেন। তারপর বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সত্য কথা বলবি।” বারীরা বললো. “আল্লাহর শপথ! আয়িশাকে আমি সচ্চরিত্র বলেন জানি। তার মধ্যে কোন দোষই আমি দেখতে পাইনি। তবে শুধু এতটুকুই পেয়েছি যে, আমি গম পিষে আটা বানিয়ে আয়িশাকে তা হিফাজত করতে বলি। কিন্তু কখনো কখনো সে আটার কথা ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলে।”

আয়িশা (রা) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তখন আমার পিতামাতা আমার কাছেই বসেছিলেন। আমার কাছে তখন জনৈকা আনসারী মহিলা উপবিষ্টা। আমি কাঁদছিলাম আর আমার সাথে এ মহিলাও কাঁদছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে বসে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, “আয়িশা, লোকেরা যা বলেছে সে ধরনের কোন খারাপ আজ যদি করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবাহ কবুল করে থাকেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটুকু শুনতেই আমার অশ্রু থেমে গেল। তাঁর উপস্থিতি যেন আমি আর অনুভবই করতে পারলাম না। পিতামাতা আমার পক্ষ থেকে তাঁকে জবাব দেবেন বলে আশা করছিলাম। কিন্তু তাঁরা কোন কথাই বললেন না। আল্লাহর শপথ, আমি নিজেকে কখনো এতটা মর্যাদাবান বলে ভাবিনি যে, আল্লাহ আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত নাযিল করবেন, যা মসজিদে মসজিদে তিলাওয়াত করা হবে এবং নামাযে পড়া হবে। আমি শুধু এতটুকুই আশা করছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে কিছু দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমার ওপর আরোপিত অপবাদ খ-ন করে দেবেন। কেননা আল্লাহ তো জানেন না যে আমি নির্দোষ। স্বপ্ন না হোক, মামুলীভাবে একটা খবর হয়তো আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দেবেন। কিন্তু কুরআনে অঙ্গীভূত যে ওহী, আমার হয়তো সম্পর্কে তা নাযিল হবে তা নাযিল হবে আল্লাহর কসম, আমি নিজেকে এতটা মর্যাদাবান কখনো ভাবিনি।

পিতামাতাকে নিরুত্তর দেখে আমি তাঁদেরকে বললাম, “আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন জবাব দিলেন না?” তাঁরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, জবাব দেবার মত কোন কিছু আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।” বস্তুত সেই দিনগুলোতে আবু বাকরের (রা) পরিবার যেরূপ সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, অতবড় সংকটে আর কোন পরিবার কখনো পড়েছে বলে আমার জানা নেই।

পিতামাতাকে আমার ব্যাপারে নীরব থাকতে দেখে আমার গ-দেশ পুনরায় চোখের পানিতে ভভসতে লাগলো এবং আমি কাঁদতে লাগলাম। আমি বললামি, “আল্লাহর শপথ! আপনি যে গুনাহর কথা বলছেন সেজন্য আমি কখনো তাওবাহ করবো না। আমি জানি, লোকেরা যা রটিয়ে বেড়াচ্ছে তা যদি স্বীকার করি তাহলে এমন বিষয় স্বীকার করে নেয়া হবে যা আমার দ্বারা আদৌ সংঘটিত হয়নি। স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষী যে, আমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর আমি যদি তা অস্বীকার করি তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না।” আয়িশা বলেন: অতঃপর আমি ইয়াকুব আলাইহিস সাল্লামের নাম স্মরণ করতে চেষ্ট করলাম। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। অগত্যা বললাম, “ইউসুফ আলাইহিস সাল্লামের পিতা যে কথা বলেছিলেন আমি সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করবোÑ ‘পূর্ণ ধৈর্য অবলম্বনই সুন্দর পন্থা।’ তোমরা যা বর্ণনা করছো সে ব্যাপারে আল্লাহই (আমার) একমাত্র সহায়।” এ কথা বলার পরই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহীর লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। তাঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো এবং তাঁর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে রেখে দেয়া হলো। আমি দৃশ্য দেখে সম্পূর্ণ নির্বিকার, বেপরোয়া ও নির্ভীক রইলাম। আমি জানতাম যে, আমি নির্দোষ। আল্লাহ আমার ওপর যুলুম করতে পারেন না। পক্ষান্তরে আমার পিতা মাতার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। যদি ওহীর দ্বারা রটিত অপবাদটি সত্য বলে ঘোষিত হয়, সেই ভয়ে তাঁদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো।

আয়িশা (রা) বলেন: কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। সেই প্রচ- শীতের দিনেও তাঁর গা দিয়ে মুক্তার দানার মত ঘাম পড়ছিলো। তিনি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “আয়িশা তোমার জন্য সুসংবাদ! আল্লাহ তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেছেন।” আমি বললাম, “আল্লাহর শোকর ও প্রশংসা।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে গিয়ে মুসলিম জনগণকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিলেন এবং কুরআনের যে আয়াতগুলো ঐ ব্যাপরে নাযিল হয়েছে তা তাদের পড়ে শোনালেন। তারপর মিসতাহ ইবনে উসামা, হাসসান ইবনে সাবিত ও হামনা বিনতে জাহাশের ক্ষেত্রে অপবাদ রটনার শাস্তি কার্যকর করলেন। কারণ তারা এই অপবাদের অন্যতম রটনাকারী ছিলেন।

ইবনে ইসহাক বনু নাজ্জারের কিছু লোকের উদ্ধৃতি দিযে বলেনঃ

আবু আইযুুব খালিদ ইবনে যায়িদকে তার স্ত্রী উম্মে আইয়ুব বলেছিলেন, “আয়িশা সম্পর্কে যা রটানো হচ্ছে, তুমি কি তা শুনেছো?” আবু আইয়ুব বললেন, “হ্যাঁ, শুনেছি। সে তো মিথ্যা কথা। উম্মে আইয়ুব, এ রকম কাজ কি তুমি করতে পারতে?” উম্মে আইয়ুব বললেন, “কখনো না।” আবু আইয়ুব বললেন, “আল্লাহর শপথ, আয়িশা তো নিঃসন্দেহে তোমার চেয়েও ভালো।”

আয়িশা বলেন: কুরআনে এই অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে যে কয়টি আয়াত নাযিল হয়, তার কয়েকটি এই, “যারা এই মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছে তারা তোমাদেরই একটি গোষ্ঠী। এ ঘটনাকে তোমরা নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না। আসলে এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এই গোষ্ঠীর মধ্যে যে যেটুকু পাপ করেছে তার ফল সেই ভোগ করবে। আর তাদের মধ্যে যে এই অপকর্মের বেশীরভাগ দায়িত্ব নিয়েছে তার জন্য তো বিরাট আযাব রয়েছে।” (এ আয়াতে হাসসান ইবনে সামিত ও তাঁর সহযোগীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা অপবাদ রটনায় অংশ নিয়েছিলেন।) “তোমরা যখন কথাটা শুনেছিলে তখন মু’মিন স্ত্রী পুরুষেরা নিজেদেরই লোক সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলো না কেন? (অর্থাৎ আবু আইয়ুব ও তার স্ত্রীর মত) যখন তোমরা মুখ থেকে মুখে কথাটা গ্রহণ করছিলো এবং যা জানো না তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছিলে, আর এসে একটা হালকা জিনিস মনে করছিলে। অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।”

আয়িশা (রা) ও তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর আবু বাক্র (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, মিসতাহ যখন এমন জঘন্য অপবাদ আয়িশার বিরুদ্ধে রটিয়েছে তখন তার ভরণ-পোষণের ভার আমি আর বহন করবো না এবং তার বিন্দুমাত্রও উপকার করবো না। ” উল্লেখ্য যে, মিসতাহ তার একজন দরিদ্র আত্মীয় ছিল এবং তিনি তার ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহ করতেন।

আবু বাক্রের এই প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে নাযিল হলো, “তোমাদের মধ্যে যারা সচ্ছল ও অনুগ্রাহক তারা যেন আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র ও আল্লাহর পথে হিজরাতকারীদের প্রতি বদান্যতা না দেখানোর প্রতিজ্ঞা না করে। তারা যেন ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমদেরকে ক্ষমা করুন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াত শুনে তৎক্ষণাৎ বললেন, “হ্যাঁ, আমি চাই আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।” ্অতঃপর তিনি মিসতাহর ভরণ-পোষণের ভার পুনরায় গ্রহণ করেন এবং  আর কখনো এ দায়িত্ব ত্যাগ করবেন না বলে শপথ নেন।

ইবনে ইসহাক বলেন: আয়িশার (রা) প্রতি অপবাদ আরোপের জন্য হাসসান ইবনে সাবিতের যে শাস্তি হয় মুসলমানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি সে সম্পর্কে নিম্নরূপ কবিতা আবৃত্তি করেন,

“হাসসান সমুচিত শাস্তি পেয়েছে। আর হামনা এবং মিসতাহও।

কেননা তার অশ্লীল কথা বলেছিল।

তাদের নবীর মহিষী সম্পর্কে আনুমানিক উক্তি করে এবং তাঁকে দুশ্চিন্তগ্রস্ত করে

তারা আরশ অধিপতির ক্রোধের শিকার হয়েছিল।

তারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছিল, চিরস্থায়ী গ্লানিকর অপপ্রচারণাকে গুরুত্ব

দিয়ে চারদিকে ছড়িয়েছিল এবং অপমানিত করেছিল।

(ফলে) রটনাকারীদের ওপর শাস্তির দ- মুষলধারে

বৃষ্টি বর্ষণের মত বর্ষিত হতে লাগলো।”

হুদাইবিয়ার ঘটনা (৬ষ্ঠ হিজরী সন)

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় রমযান ও শাওয়াল মাস অতিবাহিত করলেন। যুলকাদাহ মাসে উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কোন যুদ্ধ করার অভিসন্ধি তাঁর ছিল না। [৭৪. ইবনে হিশামের মতে, এই সময় মদীনার শাসনভার অর্পণ করা হয় নামীলা ইবনে আবদুল্লাহ লাইসীর ওপর।] মদীনার অধিবাসী সাধারণ আরব এবং  আশপাশের মরুচারী বেদুইনদেরকেও তিনি তাঁর সফরসঙ্গী করে নিলেন। তিনি আশংকা করছিলেন যে, কুরাইশরা চিরাচরিত পন্থায় তাঁকে হয় আল্লাহর ঘর যিয়ারতে বাধা দেবে, অথাবা যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসবে। এ আশংকার কারণে যারা সফরসঙ্গী হতে চেয়েছিল তাদের অনেকেই যাত্রা স্থগিত রাখলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদবাকী আরব, মুহাজির  ও আনাসারদের নিয়ে যাত্রা করলেন। সঙ্গে কুরবানীর উটের বহরও নিয়ে চললেন এবং উমরার ইহরাম বেঁধে নিলেন।[৭৫. ৭০ টি উট সঙ্গে নিয়েছিলেন। উমরা যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৭০০। প্রতি দশজনের জন্য একটি উট নেয়া হয়েছিল।] যাতে কুরাইশরা তাঁর তরফ থেকে যুদ্ধের আশংকা না করে এবং তিনি যে শুধুমাত্র আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়েছেন বুঝতে পারে।

তিনি মক্কার কাছাকাছি উসফানে পৌঁছলে তাঁর সাথে বিশর ইবনে সুফিয়ান কা’বীর দেখা হলো। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, নিকটেই কুরাইশ বাহিনী সমবেত হয়েছে। তারা আপনার যাত্রার কথা শুনে বিরাট উটের বহর নিয়ে আপনার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা আগেই যুতুয়াতে সমবেত হয়েছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে, আপনাকে  কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে তারা কুরাউল গামীমে [৭৬.যুতুয়া মক্কার নিকটবর্তী একটি জায়গা। কুরাউল গামীম উসফান থেকে ৮ মাইল আগে অবস্থিত একটি উপত্যকা।] এগিয়ে এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ধিক কুরাইশদেরকে! জঙ্গী মনোভাব তাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমাকে গোটা আরববাসীর সাথে একটু বুঝাপড়া করার সুযোগ দিলে ওদের অসুবিধা কোথায়?  আরবরা যদি আমাকে পর্যুদস্ত করে তাহলে তাতে কুরাইশদের  মনষ্কামনাই পূর্ণ হবে। আর যদি আল্লাহ আমাকে আরবদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করেন তাহলে সবাই ইসলামে আশ্রয় পাবে। যদি তারা ইসলাম কবুল নাও করে তা হলেও তারা আরো অধিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে। কুরাইশরা ভেবেছে কি? আল্লাহর কসম, শেষ পর্যন্ত জিহাদ করে যাবোÑ হয় এ বিধান জয়যুক্ত হবে, না হয় আমি শেষ হয়ে যাবো।”

অতঃপর তিনি বললেন, “এমন কেউ কি আছ যে আমাদেরকে কুরাইশরা যে পথে সমবেত হয়েছে তা থেকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারবে।” অতঃপর সেই ব্যক্তি দুর্গম পার্বত্য পথ দিয়ে তাদের নিয়ে গেল। এ অভিযানটা মুসলমানদের জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। অবশেষে তারা উপত্যকার প্রান্তে সমভূমিতে গিয়ে উপনীত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানগলকে বললেন, তোমরা বল, “আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাওবা করি।” সবাই তাই বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এই কথাটাই মূসা (আ) বনী ইসরাঈলদের বলতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা তা বলতে রাজী হয়নি।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে ডান দিকে জামজের ভিতর দিয়ে সানিয়াতুল মুরার অভিমুখে মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত হুদাইবিয়ার উপত্যকায় গিয়ে উপনীত হবার নির্দেশ দিলেন। মুসলিম বাহিনী নির্দেশ মুতাবিক যাত্রা করলো। কুরাইশদের অগ্রবর্তী ঘোড়সাওয়ার দল ভিন্নদিক থেকে মুসলিম সেনাদলের অগ্রাভিযান লক্ষ্য করে বিদ্যুগ বেগে কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে সানিয়াতুল মুরারে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানেই তাঁর উট থেমে গেল। লোকেরা বললো, “উট থেমে গেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উট থামেনি এবং থামা তার রীতি নয়। তবে যে জিনিস আবরাহার হস্তিবাহিনীকে থামিয়ে রেখেছিল, সেই জিনিসই ওকে মক্কা যাত্রা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে। আজকে কুরাইশরা আমাকে রক্তের বন্ধনের দোহাই দিয়ে যে প্রস্তাবই দেবে আমি তা মেনে নেব।” অতঃপর তিনি সহযাত্রীদের যাত্রাবিরতি করতে বললেন। সবাই বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এখানে মোটেই পানি নেই। কিভাবে আমরা এখানে যাত্রাবিরতি করবো?” তিনি একটি তীর বের করে একজন সাহাবীর হাতে দিয়ে একটি শুকনো কুয়ার ভেতরে তা নিক্ষেপ করতে বললেন। তিনি তীর নিক্ষেপ করলে কুয়া পানিতে ভরে উঠলো এবং মুসলমানরা সেখানে যাত্রাবিরতি করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করলে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা খাযায়া গোত্রের কয়েকজন লোকজন তাঁর কাছে এলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাপ আলোচনা করলো। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন?” তিনি জানালেন, তিনি কোন যুদ্ধ  বিগ্রহের উদ্দেশ্যে আসেননি। বরং শুধু পবিত্র কা’বার যিয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এসেছেন। তিনি বিশর বিন আবু সুফিয়ানকে যেকথা বলেছিলেন তাদেরকও তাই বললেন। তারা ফিরে গিয়ে কুরাইশদের বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা মুহাম্মাদের ব্যাপারে খুবই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক। আসলে তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি। কা’বাঘর যিয়ারত করতে এসেছেন মাত্র।”

একথা শুনে কুরাইরা তাদের ওপর উল্টো দোষারোপ করলো এবং অপ্রীতিকর কথাবার্তা শুনিয়ে দিল। তারা বললো, “যদি সে যুদ্ধ করতে না এসে থাকুক তবুও তাকে আমরা কখনো জবরদস্তিমূলকভাবে মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না। সাধারণ আরবরাও একথা জানে যে, মক্কাবাসী কখনো কাউকে এ শহরে জোরপূর্বক ঢুকতে দেয়নি।”

খাযায়া গোত্রের মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে সকলেই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের পরম হিতাকাংখী ও তাঁর সকল গোপনীয় বিষয়ের সংরক্ষক। মক্কায় যাই ঘটুক তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা গোপন করতো না।

কুরইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মিকরায ইবনে হাফ্স ইবনে আখইয়াফকে পাঠালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকরাযকে আসতে দেখে দূর থেকেই মন্তব্য করলেন, “এ লোকটি বিশ্বাসঘাতক।” সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে আলাপ আলোচনা করলে তিনি বুুদাইল ও তার সঙ্গীদের যা বলেছিলেন, মিকরাযকেও তাই বললেন। সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তাই জানালো।

এরপর কুরাইশরা হুলাইস ইবনে আলকামা অথবা ইবনে যাবানকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পাঠালো। তাকে দেখেই তিনি মন্তব্য করলেন, “এ লোকটি একটি খোদাভক্ত জাতির সদস্য। আমদের কুরবানীর পশুগুলো তার সামনে নিয়ে দেখিয়ে দাও।” হুলাইস যখন দেখলো, কুরবানীর চিহ্ন বহনকারী বিশাল উটের পাল তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে এবং দীর্ঘদিন কুরবানীর জায়গায় পৌঁছতে না পারার কারণে ওগুলোর গায়ের পশম ঝরে পড়েছে তখন সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে যা দেখেছে তা বর্ণনা করলো। কুরবানীর পশুগুলো দেখে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উমরার উদ্দেশ্যেই এসেছেন সে ব্যাপারে তার আর কোন সন্দেহই রইল না এবং সেজন্য তাঁর সাথে দেখা করে জিজ্ঞসাবাদ করার প্রয়োজনই বোধ করলো না। তার কথা শুনে কুরাইশরা বললো, “তুমি চুপ করে বস। তুমি মূর্খ বেদুইন, কি বুঝবে?” একথা শুনে সে রেগে গেল। সে বললো “হে কুরাইশগণ! এ ধরনের কার্যকলাপের জন্য আমরা তোমাদের সাথে জোটবদ্ধ হইনি এবং এর জন্য তোমাদের সাথে চুক্তিও সম্পাদন করিনি। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর যিয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য এসেছে তাকে কি বাধা দেয়া হবে? আমি শপথ করে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, মুহাম্মাদ যে প্রবিত্র উদ্দেশ্যে এসেছে তা যদি তাকে করে যেতে না দাও তাহলে গোত্রের সকল লোককে নিয়ে আমি একযোগে তোমাদের ত্যাগ করে চলে যাবো।” তার বললো,“হুল্লাইস, একটু থামো! আমাদের একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে দাও।”

এরপর কুরাইশরা উরওয়াহ ইবনে মাসউদ সাকাফীকে রাসূলুল্লাহর নিকট পাঠালো। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে বসে পড়লো। বললো, “হে মুহাম্মাদ, তুমি কি তোমার আপনজনদের জব্দ করার জন্য এই বিরাট জনতাকে জমায়েত করেছ? তবে জেনে রেখো, কুরাইশরাও তাদের দুর্বল উটের বহর নিয়ে সিংহের বেশ ধারণ করে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তোমাকে বলপ্রয়োগে নগরে ঢুকতে কখনোই দেবে না। আল্লাহর শপথ, অতি শীগ্রই এইসব লোক তোমাকে একাকী রেখে আলাদা হয়ে যাবে।” আবু বাক্র সিদ্দিক (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে বসে এসব কথা শুনছিলেন। তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেন, “তুই গিয়ে লাতের অংগ চাট। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছেড়ে চলে যাবো ভেবেছিস?” উরওয়াহ বললো, “এই লোকটি কে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ হচ্ছে আবু কুহাফার পুত্র। ” উরওয়াহ আবু বাক্রকে (রা) লক্ষ্য করে বললো, “এক সময় তুমি আমার উপকার করেছিলে তা নাহলে আজ তুমি যে কথা বললে তার প্রতিশোধ নিতাম। সেই উপকারের বদলায় এটা ছেড়ে দিলাম।” এরপর উরওয়াহ কথা বলতে বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়ি নাড়াচাড়া করতে লাগলো। এই সময় মুগীরা ইবনে শ’বা (রা) তরবারী হাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উরওয়াহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়িতে হাত দিলেই মুগীরা তরবারী দিয়ে তার হাতে টোকা দেন আর বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে হাত দিও না। নচেৎ এই তরবারী তোমার ঘাড়ে পড়বে।” উরওয়াহ বললো, “ধিক তোমাকে। কি কর্কশ ও কঠিন হৃদয় তুমি।“ এ দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। উরওয়াহ জিজ্ঞেস করলো, “হে মুহাম্মাদ, এ লোকটা কে?” তিনি বললেন, “সে তোমার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শু’বা।” (মুগীরা ও উরওয়াহ উভয়েই বনু সাকীফ গোত্র থেবে উদ্ভুত) উরওয়াহ বললো, “রে নিমকহারাম, এই সেদিনই তো আমি তোর কত বড় উপকারটা করলাম।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উরওয়ার সাথে কথাবার্তা বললেন। তাকে জানালেন যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি।[৭৭.ইবনে হিশাম বলেন, মুগীরা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বনু সাকীফের বনু মালিক পরিবারের ১৩ জন লোককে খুন করেছিলেন। ফরে উভয় পবিারের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন বনু মালিককে ১৩টি মুক্তিপণ দিয়ে মুদীরাকে অব্যাহতি লাভে সাহায্য করে এবং উভয় পরিবারের মধ্যে আপোষরফার ব্যবস্থা করে। এখানে উরওয়া সেই ঘটনার দিকেই ইংগিত দিয়েছে।]

উরওয়াহ  ইবনে মাসউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বিদায় নিল। সে দেখে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা তাঁকে কত ভক্তি ও তা’যীম করে। তিনি অযু করলে অযুর পানি নেয়ার জন্য, থু থু ফেললে তা নেয়ার জন্য এবং চুল পড়লে তা পাওয়ার জন্য সবাই প্রতিযোগিতা ও কাড়াকাড়ি করে। কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে সে বললো, “হে কুরাইশগণ! আমি পারস্য সম্রাট কিসরাকে, রোম সম্রাট সিজারকে এবং আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজাশীকে তাদের সমকালো রাজকীয় পরিবেশে দেখেছি। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদকে তাঁর সাহাবীরা যেরূপ ভক্তিশ্রদ্ধ করে তেমন আর কোন রাজাকে আমি প্রজাদের এরূপ ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে দেখিনি। কোন কিছুর বিনিময়েই তারা মুহাম্মাদকে শত্রুর মুখে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে প্রস্তুত নয়। এমতবস্থায় তোমরা যা ভালো মনে কর করতে পার।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খিরাস উমাইয়া খাযারীকে মক্কায় কুরাইশদের কাছে পাঠালেন। তাঁকে নিজের উট সালাবের ওপর চড়িয়ে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠালেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটটিকে হত্যা করে খিরাসকে (রা) হত্যা করতে উদ্যত হলো। কিন্তু বিভিন্ন গোত্রের কিছু লোক মিলে তাঁকে রক্ষা করে ও মুক্ত করে দেয়। পরে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসেন।

এরপর তিনি উমার ইবনুর খাত্তাবকে (রা) তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য মক্কায় কুরাইশ নেতাদের কাছে পাঠাতে মনস্থ করলেন। কিন্তু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, কুরাইশদের হাতে আমার প্রাণ যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বনু আদী ইবনে কা’বের এমন কোন লোক মক্কায় নেই যে, আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। আর আমি যে কুরাইশদের কেমন কট্রর দুশমন তা তারা ভাল করেই জানে। আপনি বরং উসমান ইবনে আফফানকে (রা) পাঠিয়ে দিন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য আমার চেয়ে অনেক বেশী প্রভাবশালী।” তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমানকে (রা) পাঠালেন, যেন তিনি মক্কাবাসীকে বুঝিয়ে দিতে পারেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্যে আসেননি বরং উমরাহ করতে এসেছেন। উসমান (রা) চলে গেলেন। সেখানে প্রবেশের পর আবান ইবনে সাঈদের সাথে তাঁর দেখা হলো। আবান তাঁকে আশ্রয় দিল। ফরে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হলেন। উসমান (রা) আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতাদের সাথে দেখা করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্তা পৌঁছিয়ে দেন। তারা উসমানকে বললো, “দেখ উসমান, তুমি যদি কা’বা তাওয়াফ করতে চাও তবে তাওয়াফ করে নাও। ” উসমান বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ না করা পর্যন্ত আমি করবো না।” কুরাইশরা উসমানকে (রা) আটক করে রাখে। ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানরা শুনলেন যে, উসমান (রা) শহীদ হয়েছেন।

বাইআতুর রিদওয়ান

ইবনে ইসহাক বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মুূহূর্তে শুনলেন যে, উসমান (রা) নিতহ হয়েছেন, সে মুহুর্তেই বললেন, “কুরাইশদের সাথে লড়াই না করে স্থান ত্যাগ করবো না।” তিনি মুসলমানদেরকে লড়াইয়ের জন্য প্রতিজ্ঞা করালেন। এটাই বাই’আতুর রিদওয়ান। এ বাই’আত সম্পন্ন হয়েছিল একটি বৃক্ষের নীচে। সাধারণ মুসলমানরা বলতেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান কুরবানী করা শপথ গ্রহণ করেছিলেন।” তবে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলতেন যে, এটা জান কুরবানীর বাই’আত ছিল না।” তবে আমরা যেন পালিয়ে না যাই সেজন্য বাই’আত গ্রহণ করা হয়েছিল।”[৭৮.ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, আবু সিনান আল আসাদী (রা) সর্বপ্রথম বাই’আত করেন।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মুসলমানকে শপথ গ্রহণ করান। এক ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ বাই’আত থেকে বাদ পড়েনি। বাদপড়া এই ব্যক্তির নাম জাদ্দ ইবনে কায়েস। সে ছিল বনু সালামা গোত্রের লোক। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলতেন, ‘উটের বগলের ভিতর লুকিয়ে এই ব্যক্তি বাই’আত থেকে বাদ থাকে। তার সেই লুকানোর দৃশ্য আমার চোখে একনো ভাসছে।”

অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিতভাবে জানলেন যে, উসমানের (রা) নিহত হওয়ার খবর ভুল।

শান্তি চুক্তি বা হুদাইবিয়ার সন্ধি

কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুহাইল ইবনে আমরকে পাঠালো। তারা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আপোষ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠালো। এই আপোষরফার একমাত্র লক্ষ্য হবে মুহাম্মাদ যেন অবশ্যই এ বছরের মত মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যায়। আরবরা যেন কখনো বলতে না পারে যে, মুহাম্মাদ কুরাইশদের ওপর শক্তিপ্রয়োগ করে মক্কায় প্রবেশ করেছে।

সুহাইল ইবেন আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। তাকে আসতে দেখে তিনি বললেন, “ এ লোকটিকে তখনই পাঠানো হয়েছে যখন কুরাইশরা নিশ্চয়ই সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” সুহাইল এসে খুব লম্বা আলাপ জুড়ে দিল। তারপর সন্ধির ব্যাপারে উভয়পক্ষে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলো।

সন্ধি চুক্তির সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে লিখিত রুপ নিতে শুধু বাকী, এই সময় উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু বাকরের (রা) নিকট ছুটে গিয়ে বললেন, “ হে আবু বাক্র, তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” আবু বাক্র বললেন “হ্যা”। উমার বললেন, “আমরা কি মুসলমান নই?” আবু বাক্র বললেন, “অবশ্যই।” ইমার বললেন, “কুরাইশরা কি মুশরিক নয়?” আবু বাক্র বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন, “তাহলে কিসের  জন্য আমরা আমাদের দীনের ব্যাপারে এভাবে নতিস্বীকার বরতে যাচ্ছি?” আবু বাক্র বললেন “উমার, তার আনুগত্য কর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।” উমার বললেন “আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল।”

তারপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” তিনি বললেন “হ্যা।” উমার বললেন, “ওরা কি মুশরিক নয়?”  তিনি বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন “তাহলে কি কারণে আমরা আমাদের দীনের প্র¤েœ এই অবমাননা বরদাশত করতে যাচ্ছি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তার নির্দেশ আমি কখনো লংঘন করবো না। আর তিনি আমাকে কখনো বিপথগামী করনে না।”

পরবর্তীকালে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “আমি সেদিনের সেই ভ্রান্ত আচরণের জন্য সারাজীবন সাদকা, নামায রোযা ও গোলাম আযাদ করার মাধ্যমে কাফফারা গেয়ার চেষ্টা চালিয়েছি। আমার কথাগুলোর খারাপ পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য আমি এমব করেছি। অবশেষে আমার আশার সঞ্চার হয়েছে যে, আমি ভাল ফল পাবো।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) ডেকে বললেন “লেখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।” সুহাইল বললো, “এটা আমার অজানা কথা। তুমি বরং লেখ, বিসমিকা আল্লাহুম্মা।” ( হে আল্লাহ, মোতার নামে।) অতঃপর তিনি বললেন “লেখ, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহাইল ইবনে আমরের সাথে নিম্নলিখিত মর্মে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন।” একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুহাইল ইবনে আমর বলে উঠলো “আমি যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূল বলেই মানতাম তাহলে তো তোমার সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতাম না। শুধু তোমার নাম ও পিতার নাম লেখ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাই লেখ। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিম্নলিখিত মর্মে আমরের পুত্র সুহাইলের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। তারা উভয়ে একমত হয়েছে যে, দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই দশ বছর জনগণ পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সব রকমের আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। ুকরাইশদের কোন লোক তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুহাম্মাদের নিকট এলে তিনি তাকে ফেরত পাঠাবেন। আর মুহাম্মাদের সাহাবাদের কেউ কুরাইশদের কাছে আসলে কুরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। আমাদের এই চুক্তি কখনো লংঘিত হবে না। উভয় পক্খ আন্তরিকভাবে ও পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তা মেনে চলবে। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কেউ গোপন পাচারের কাজে লিপ্ত হবে না। মুহাম্মাদ অথবা কুরাইশ যে কোন পক্ষের সাথে যে কেউ এ চুক্তিতে অংশগ্রঞন বা নতুন চুক্তি করতে চাইলে অবাধে তা করতে পারবে।” এই ধারা ঘেষিত হওয়া মাত্র বনু খাযরা গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের সাথে এবং বনু বাক্র কুরাইশদের সাথে তদক্ষনাৎ মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করলো। সন্ধি চুক্তিতে আরো লিপিবদ্ধ করা হলো, “তুমি (মুহাম্মদ) এ বছর আমাদের শহর মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যাবে। আগামী বছর আমরা তোমার জন্য মক্কার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে অন্যত্র চলে যাবো। তুমি অবাধে প্রবেশ করবে এবং তোমার সাথীদের নিয়ে তিনদিন মক্কায় অবস্থান করবে। কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে নিতে পারবে। তরবারী ছাড়া ঢুকবার বাধ্যবাধকতা  থাকবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সুহাইল ইবনে আমরের তত্ত্বাবধানে যখন এই সন্ধিচুক্ িলিপিবদ্ধি করা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জানদাল শৃংখলিত অবস্থায় সেখানে এসে হাজির হলো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি নিকট পালিয়ে এসেছেন। এ সময় ঐ স্থানে রাসূলুল্লাহ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন না। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের দেখা স্বপ্নে যে বিজয়ের ইংগিত ছিল সে ব্যাপারে তারা সংশয়য়বিষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। তাই তারা সন্ধি চুক্তিতে এ বছর (উমরা ছাড়াই) ফিরে যাওয়ার ধারা সন্নিবেশিত হতে দেখে এবং রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা বরদাশত করতে ও মেনে নিতে দেখে মহা বিপাকে পড়ে যান এবং প্রায় পথভ্রষ্ট হবার উপক্রম হন। ওদিকে আবু জানদালকে দেখে সুহাইল ইবনে আমর বেসামাল হয়ে তার তুখে প্রচন্ড এক চপেটাঘাত করলো এবং তার বুকের কাপড় টেনে ধরলো। সে তখন বলছিল, “হে মুহাম্মাদ, আবু জানদাল আসার আগেই তোমার ও আমার মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে কথা সত্য।” অতঃপর সে আবু জানদালকে বুকের কাপড় ধরে প্রবল জোড়ে টানতে লাগলো মক্কায় ফেরত পাঠানোর জন্য। আর আবু জানদাল উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো “হে মুসলমানগণ, আমাকে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যারা নির্যাতন করছে সেই কুরাইশদের কাছেই কি আমাকে য়েরত পাঠানো হবে?” তার এ আর্তচিৎকারে মুসলসমানদের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন “হ আবু জানদাল, তুমি সবর কর এবং নিজের  অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাক। তুমি ও তোমার মত যেসব অসহায় ও নির্যাতিত মুসলমান তোমার সাতে মক্কায় রয়েছে, আল্লাহ তাদের মুক্তির জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। আমরা কুরাইশদের সাথে একটা সন্ধি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছি। এ ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী মেনে আমরা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমরা তাদেরকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবো না।”

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু জানদালের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন “হে আবু জানদাল, সবর কর। ওরা তো মুশরিক। ওদের সবার রক্ত কুকুরের রক্তের সমতুল্য।” উমার (রা) একথা বলার পাশাপাশি আবু জানদালের কাছে নিজের তরবারী এগিয়ে গিচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি আশা করছিলাম যে, আবু জানদাল তরবারী নিয়ে তার পিতাকে হত্যা করে ফেলুক। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত তার পিতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যাপারটা ওখানেই থেকে যায়।

দলীলটি লেখার কাজ শেষ হলে মুসলমান ও মুশরিক উভয় পক্ষের অনেকে এর সাক্ষী হলেন। সাক্ষীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা), আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল ইবনে আমর,, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মাহমুদ ইবনে মাসলাম, মিকরায ইবনে হাফস ও আলি ইবনে আবু তালিব (রা)। মিকরায তখনো মুশরিক ছিল। আর আলী (রা) ছিলেন দলীলের লেখক।

কুরবানীর উটগুলোকে কিভাবে কুরবানী করে ইহরাম মুক্ত হওয়া যায় সে মস্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম চিন্তিত ছিলেন। তখনো তিনি ইহরাম অবস্থায় নামায আদায় করছিলেন। চুক্তি সই হয়ে গেলে তিনি নিজের কুরবানীর পশুটা কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সব সাহাবীও কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমেুখে যাত্রা করলেন। মক্কা ও মদীনার মাঝখানে থাকতেই সূরা আল ফাতহ্ নায়িল হলোঃ

“হে নবী, আমি তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয়ের উদ্বোধন করেছি, যেন আল্লাহ তোমার আগের ও পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন তোমার ওপর তার নিয়ামত পূর্ণ করেন এবং তোমাকে নির্ভুল পথে চালিত করেন।”

আল্লাহ আরো বলেন “আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বাপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি স্বাপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই নিরাপদে ও নির্ভয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে নিরাপদে মাথার চুল মুন্ডিয়ে ও ছেঁটে নির্ভিকচিত্তে প্রবেশ করবে। সে (আল্লাহর রাসূল) সেই জিনিস অবগত হয়েছে যা তোমরা অবগত হওনি। ঐ ঘটনার (হুদাইবয়ার সন্ধির) পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।”

যুহরী বলেন: পূর্বে ইসলামের যতগুলো বিজয় অর্জিত হয়েছে তার মধ্যে এটিই (হুদাইবিয়ার সন্ধি) ছিল সবচেয়ে বড় বিজয়। আগে মানুষ বিপক্ষের মুখোমুখি হলেই যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কিন্তু সন্ধি হলে যুদ্ধের অবসান ঘটলো আর তার ফলশ্রুতিতে লোকজন পরস্পরের সাথে নির্ভয়ে মেলামেশা ও আলাপ আলোচন করার সুযোগ পেল। ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এ সময়ে এমন অবস্থা হলো যে সামান্য কান্ডজ্ঞান ছিলো এমন ব্যক্তির সাথে ইসলাম সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলেই সে ইসলাম গ্রহণ করতো। সন্ধি পরবর্তী দুই বছরে যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা সন্ধি পূর্ব ইসলাম গ্রহণকারীদের মোট সংখ্যার চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশী। [৭৯.ইবনে হিশাম বলেন, যুহরীর এ উক্তির সপক্ষে প্রমান এই যে, রাসূলুল্লাহ হুদাইবয়োতে গিয়েছিলেন ১৪০০ মুসলামানকে সঙ্গে নিয়ে। এর মাত্র দু’বছর পরে তিনি যখন মক্কা বিজয়ে যান তখন তার সাথে ছিল দশ  হাজার মুসলমান।]

 

খাইবার বিজয়: ৭ম হিজরীর মুহাররাম মাস

হুদাইবিয়া থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাসের কিছু অংশ অতিবাহিত করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ করেনি। মুহাররামের শেষাংশে তিনি খাইবার অভিযানে বের হন।

আবু মুয়াত্তাব ইবনে আমর (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার পৌছে সাহাবীদের বললেন “থামো।” তাদের মদ্যে আমিও ছিলাম। এরপর বললেন “হ আল্লাহ, আসমান যমীন ও তার মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর অদিপতি, সব শয়তান এবং তারা যত লোককে গুমরাহ করেছে তাদেরও সর্বময় মালিক এবং বাতাস ও তার চালিত, বাহিত ও উৎক্ষিপ্ত জিনিসসমূহের নিরংকুশ প্রভু, আমরা আপনার কাছে এই জনপদ তার, অধিবাসীদের পক্ষ থেকে সব রকমের অকল্যাণ থেকে আনার আশ্রয় প্রার্থনা কির। আল্লাহর নামে তোমরা এগিয়ে যাও।” তিনি প্রতিটি জনপদে প্রবেশকালেই এ কথা গুলো বলতেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম সকাল বেলা ছাড়া কোন জনগোষ্ঠির ওপর আক্রমণ করতেন না। সেখানে আযান শুনলে থেমে যেতেন। আযান না শুনলে আক্রমণ চালাতেন। আমরা রাতের বেলা খাইবারে পৌছে যাত্রাবিরতি করলাম। কিন্তু কোন আযান শুনতে পেলেন না। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়ে যাত্রা করলেন। আমি আবু তালহার পেছনে সওয়অর হয়েছিলাম। আমার পা রাষূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের পা স্পর্শ করছিল। সকাল বেলা খাইবারের শ্রমিকরা কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে দিনের কাজে বেরুচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনিকে দেখে তারা সবিস্ময়ে বলে উঠলো, “সর্বনাশ! মুহাম্মাদ তার বাহিনীসহ হাজির হয়েছে দেখছি”- বলেই তারা পালিয়ে পেছনে ফিরে যেতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার! খাইবারের পতন ঘটেছে। আমরা কোন জনপদে আগমন করলেই তার অধিবাসীর সকাল বেলাটা দুর্ভাগ্যময় হয়ে ওঠে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম মদীনা থেকে খাইবার যাওয়ার সময় ই’স্র পাহাড়ের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। এজন্য সেখানে একটা মসজিদ তৈরী করা হয়। এরপর যান ‘সাহাবা’র মথ্য দিয়ে। তারপর তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে রাজী উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করেন। এখানে তিনি খাইবারবাসী ও গাতফানীদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন াতে গাতফানীরা খাইবারবাসীদের সাহায্য করতে না পারে। তারা সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খাইবারের ইয়াহুদীদের সাহায্য করতো।

গাতফানীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথা শুনে একদল যোদ্ধা সংগ্রহ করে খাইবারের ইয়াহুদীদের শক্তিবৃদ্ধি করতে অগ্রসর হলো। কিছুদুর গেলেই পেছনে ফেলে আসা তাদের পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের ওপর আপতিত একটা বিপদের শেঅরগোল শুনতে পেল। তারা ভাবলো, মুসলমানরা হয়তো তাদের পরিবার পরিজনের ওপর ভিন্ন দিক থেকে গিয়ে চড়াাও হয়েছে। তাই ফিরে গিয়ে তারা নিজ নিজ পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত হলো এবং খাইবারবাসী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুকাবিলার জন্য ছেড়ে দিল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমান্বয়ে খাইবারের ইয়াহুদীদের ধন সম্পদ ও দুর্গসমূহ এক এক করে দখল করতে লাগলেন। তিনি সর্বপ্রথম তাদের ‘নায়েম’ দুর্গ জয় করেন। এখানে সাহাবী মাহমুদ ইবনে মাসলামা শহীদ হন। তাঁর ওপর গম পিষা যাঝতার পাট ছুড়ে মারা হলে তিনি শহীদ হন। এরপর আবুল হুকাইকের দুর্গ ‘কামূস’ বিজিত হয়। সেখানে থেকে তিনি কিছুসংখ্যক ইয়াহুদীকে আটক করেন। তাদের মধ্যে হুয়াই ইবেন আখতাবের কন্যা সাফিয়া অন্যতম। সে কিনানা ইবনে রাবীর স্ত্রী ছিল। তার দু’জন চাচাতো বোনও গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন। দাহইয়া ইবন খালীফা কালবী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সাফিয়াকে চেয়েছিলেন। তিনি সাফিয়অকে নিজের জন্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বলে দাহইয়াকে তার চাচাতো বোনকে দিয়ে দেন। ক্রমে খাইবারের গ্রেফতারকৃত লোকদেরকে সাহাবীদের সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

এক এক করে খাইবারের কিল্লাগুলো এবং তাদের ধনসম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হচ্ছিল। কেবল ওয়াতীহ ও সুলালিম নামক কিল্লা দুটি দখল করা তখনও বাকী ছিল। সবশেষে তিনি এ দুটি কিল্লা জয় করেন। এ দুটিকে তিনি দশদিনের অধিক সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন।

ইয়াহুদ নেতা মরারহাব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুকাবিলায় এগিয়ে এস একটি রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটি হলোঃ

“সমগ্র খাইবার জানে যে, আমি মারহাব। (অর্থাৎ খুব প্রতাপশালী)

অস্ত্র দিয়ে আঘঅত করতে পারদর্শী, অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী বীর।

কখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই আবার কখনো শক্ত আঘাত করি।

শার্দুলেরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেয়ৈ আসে তখন আমার ধারে কাছেও

কেউ ঘেঁষতে পারে না।”

সে চ্যালেঞ্জ করলো,, “এসো আমার সাথে দ্বান্ধ যুদ্দ করতে কে প্রস্তুত আছ?” কা’ব ইবনে

মালিক (রা) রণসংগীত আবুত্তি করেই তার জবাবে বললেন,

“খইবার জানে যে আমি কা’ব। আমি দুঃখ দুর্দশা ঘুচাই, সাহসী ও অনমনীয়।

যখন যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন যুদ্ধের পর যুদ্ধই চলতে থাকে।

আমার আছে বিজলীর আলোকচ্ছটার মত ধারালো তরবারীটা।

আমরা তোমাদেরকে পদদলিত করবো যাতে সব জটিলতার অবসান ঘটে।

এতে আমরা পুরস্কৃত হবো অথবা আমাদের কাছে

প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ চলে আসবে!  (সে সম্পদ আসবে) বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে

এবং তাতে কোন তিরস্কারের অবকাশ থাকবে না।”

রাসূলুল্লাহ বললেন, “এই লোকটির সাথে কে লড়তে প্রস্তুত আছে?” মুহাম্মাাদ ইবনে

মাসলামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার সাথে লড়তে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ লড়াকু। আমি ওর থেকে স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই। গতকাল সে আমার ভাইকে (মাহমুদ ইবনে মাসলামা) হত্যা করেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “যাও। হে আল্লাহ, মারহাবকে পর্যুদস্ত করতে ওকে সাহায্য কর।” অতঃপর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও মারহাবকে মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। একটি পুরনো বৃক্ষ তাদের মাঝখানে আড় হয়ে দঁড়ালো। উভয়ে পালাক্রমে ঐ গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে লাগলো। এক সময় মারহাবের তরবারী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ঢালে আটকে গেল। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলাম তরবারীর আঘাতে মরহাবকে হ্যা করলেন।

মারহাব নিহত হলে তার ভাই ইয়াসার হুংকার দিয়ে এগিয়ে এলা। হিশাম ইবনে উরওয়অর মতানুসারে যুবাইর ইবনুল আওয়াম তার সাথে বুঝতে গেলেন। একথা শুনে তাঁর মাতা সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেন,, হে আল্লাহর রাসুল আমার পুত্র কি নিহত হবে?” তিনি বললেন “না, তোমার পুত্র ইনশায়াল্লাহ ইয়াসারকে হত্যা করবে।” যুবাই্র সিত্যি সত্যিই ইয়াসারকে হতা করলেন।

সালামা ইবনে আমর ইবনে আকওয়অ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারে কোন একটি দুর্গ অধিকার করার জন্য আবু বাক্র সিদ্দীককে (রা) পতাকা দিয়ে পাঠালেন। তিনি যুদ্ধ কররেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি করেও তিবি দুর্গ জয় করতে না পেরে ফিরে এলেন। পরদিন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) পাঠালেন। তিনিও তুমুল যুদ্ধ করলেন। কিন্তু অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কাল সকালে আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তার হাতেই দুর্গ জয় করাবেন। তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে কখনো পালাবার মত লোক না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) ডাকলেন। তিনি তখন চক্ষুরোগে ভুগছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চোখে থু থু দিলেন এবং বললেন, “এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও। আল্লাহ যতক্ষণ তোমার হাতে বিজয় না দেন ততক্ষণ লড়াই করে যাও।”

সালামা বলেনঃ তিনি এগিয়ে গেলেন। শত্রুকে কাবু করার মত প্রচন্ড বলবীর্য ও পরাক্রম ছিল তাঁর। তিনি শুধু হেলেদুলে পায়তারা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। আমরা তাঁর পেছনে তাঁর অনুসরণ করছিলাম। তিনি কিল্লার নীচে একটা পাথর স্ত’পের মধ্যে পতাকা স্থাপন করলেন। ওপর থেকে একজন ইয়াহুদী তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আবু তালিবের পুত্র আলী।” ইয়াহুদী বললো “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।” অবশেষে আলীর হাতইে বিজয় দান করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারবাসীকে তাদের দুই দুর্গ ওয়াতীহ ও সুলালিমে অবরোধ করলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই তখন তারা তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খাইবার থেকে তাদেরকে বহিস্কার করার প্রস্তাব দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মেনে নিলেন ও প্রাণভিক্ষঅ দিলেন। ইতিপূর্বেই তিনি তাদের আশঙ্কা আন্ নাতাহাহ ও আল কুতাইবার ভূমিসহ সমস্ত স্থাবর অস্থঅবর সম্পদ এবং ঐ দুটি দুর্গ ছাড়া সকল দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ফদাকবাসী  সমস্ত খবর জানতে পারলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে বিতাড়িত করণ এবং জমিজমা ও ধনসম্পদ হস্তগত করার অনুরোধ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে যারা এই অনুরোধ নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়েছিল তাদের মধ্যে মুহাইসা ইবনে মাসউদ ছিলো অন্যতম। সে ছিল বনু হারেসার লোক। খাইবারবসী এই ব্যবস্থা প্রথমে মেনে নেয়। কিন্তু পরে অনুরোধ করে যে আমাদেরকে বহিস্কার না করে অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে জমি চাষের কাজে নিয়োজিত করুন। তারা যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলে যে এখানকার জমিজমা আমরাই ভাল আবাদ করতে সক্শস এবং এ কাজে আমরাই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মঞ্জুর করে তাদের সাথে আপোষরফা করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার আমাদের থাকবে। ফাদাকবাসীও এই শর্তে তাঁর সাথে আপোষ করলো। এভাবে খাইবার মুসলামানদের যৌথ সম্পদ এবং ফাদাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হলো। কেননা ফাদাক জয় করতে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন পড়েনি।

এসব  আপোষরফার পর রাসূলুল্লাহ সাল্ল াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঠিক তখনই সাল্লাম ইবনে মুসকামের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারেস তাঁকে একটি ভুনা বকরী উপহার দিল। ভুনা ছাগলটি পাঠানোর আগে সে জিজ্ঞেস করে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামা বকরীর কোন্ অংশ খেতে বেশী পছন্দ করেন?” তাকে জানানো হলো যে, তিনি উরু বা রানের গোশত বেশী পছন্দ করেন। তখন সে উরুতে বেশী করে বিষ মিশিয়ে দেয়। অতঃপর পুরো ছাগলটিকে সে বিষাক্ত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে আসে। তা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এক টুকরো গোশত চিবালেন কিন্তু গিললেন না। সাহাবী বিশর ইবনে বারা ইবনে মা’রুরও তাঁর সাথে বসে খাচ্ছিলেন। বিশরও এক টুকরো গোশত মুখে নিয়ে চিবালেন। তিনি গেলে ফেললেন। কিন্তু সরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উগরিয়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, “এই হড্ডিটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তা বিষাক্ত।” অতঃপর তিনি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। সে স্বীকারোক্তি করলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এমন কাজ কেন করলে?” সে বললো, “আপনি আমার কওমের সাথে কি আচরণ করেছেন তা আপনার জানা আছে। আমি ভাবলাম আপনাকে এভাবে বিষ খাওয়াবো। আপনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে আপনার হাত থেকে উদ্দার পাবো আর যদি নবী হয়ে থাকেন হাহলে তো আপনাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) সাবধান করে দেয় হবে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু বিশর যে টুকরাটি খেয়েছিলেন তাতেই তিনি মারা গেলেন। খাইবার বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদিউল কুরাতে চলে গেলেন। সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকদিন অবরোধ করে রাখেলেন, অতঃপর মদীনা চলে গেলেন।

খাইবার কিংবা পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার সাথে বাসর রাত কাটান। আনাস ইবনে মালিকের  (রা) মা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান সাফিয়াকে বধূর বেশে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গম্বুজ সর্দশ একটি তাঁবুতে তাকে নিয়ে বাসর রাত যাপন করলেন। এদিকে আবু ইয়ুর খালিদ ইবনে যায়িদ (রা) উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে সারারাত জেগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লামাকে পাহারা দিলেন। সারারাত তিনি তাঁবু গ্রহের চারপাশে টহল দেন। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কি আবু আইয়ূব। তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই মহিলার পক্ষ থেকে আপনা রওপর কোন বিপদ আস এই আশংকায় আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। কেননা তার পিতা, স্বামী ও গোত্রের অন্যান্য লোকজনকে আপনি হত্যা করিয়েছেন। তাছাড়া সে সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই তার দিক থেকে আপনার ওপর বিপদের আশংকা করেছিলাম।” অনেকে বলেন: একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, আবু আইয়ূব যেভাবে সারারাত আমারহিফাজতে নিয়োজিত ছিল তেমনি আপনিও তাকে হিফাজত করুন।”

খাইবার থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রাবিরতি করেন। শেষ রাতে তিনি বললেন, “আমরা যাতে এখন ঘুমাতে পারি সেজন্য ফজরের সময় আমাদের ডেকে দেয়ার দায়িত্ব কে নিতে পারে?” বিলাল (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ দায়িত্ব নিতে পারি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহগামী মুসলমানগণ যাত্রাবিরতি করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন্ রাতে বিলাল (রা) নামায পড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ নামায পড়ার পর তিনি উটের গায়ে হেলান দিয়ে প্রভাত হবার প্রতীক্ষায় বসে রইলেন। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ও মুসলিম মুজাহিদগন যথাসময়ে ঘুম থেকে জাগতে সক্ষম হলেন না। তপ্ত রোদের পরশ লাগার সাথে সাথেই তাদের ঘুম ভাংলো। প্রথমেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম জেগে উঠলেন। উঠেই তিনি বিলালকে (রা) বললেন, “বিলাল, মুমি আজ এ কি করলে?” তিনি বললেন “হে আল্লাহর রাসূল, যে ঘুমে আপনাকে ধরেছিল সেই ঘুমের কাছে আমিও পরাভূত হয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো।” এরপর তিনি নিজের উট নিয়ে অল্প কিছুদুর এগিয়ে গেলেন। অতঃপর উট থামিয়ে তিনি অযু করলেন। সাহাবাগণও অযু করলেন। তারপর বিলালকে নামায শুরু করার জন্য ইকামাত দিতে বললেন। তিনি ইকামাত বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি সাহাবীদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমরা কখনো নামায পড়েতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই পড়ে নেবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম কর।”

খাইবার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ইবনে লুকাইম আবাসীকে (রা) খাইবারের যাবতীয় মুরগী ও গ্রহপালিত প্রাণী পুষতে দিয়েছিলেন। সফর মাসে খাইবার বিজয় সম্পন্ন হয়। ইবনে লুকাইম খাইবার সম্পর্কে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যা নিম্নরুপঃ

“এক দুরুন্ত দুঃসাহসী সাদা বেশধারী সেনাদল পরিবেষ্টিত নবী কর্তৃক

নাতা আক্রান্ত হলো,

নাতাবাসী যখন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো

এবং আসলাম ও গিফার গোত্রদ্বয়ও তার মাঝে বিছিন্ন হলো

তখন তারা নিশ্চিত হলো পরাজয় সম্পর্কে।

বনু আমর ইবনে জুরআর লোকেরা প্রভাতকালেই দেখতে পেল,

আশ্ শ্কা এর অধিবাসী দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকারে পতিত হয়েছে।

তার সমগ্র সমভ’মি জুড়ে দৌড়ে গেছে ধ্বংস ও মৃত্যু।

প্রত্যুষে চিৎকারকারী মোরগগুলো ছাড়া কোন কিছুকেই তা অবশিষ্ট রাখেনি।

আর প্রতিটি দুর্গকে অধিকার করেছে আবদ্ আশহাল

কিংবা বনু নাজ্জারের আশ্বারোহীগণ।

[আশ আলহাল ও বনু নাজ্জার আনসারদের দুটো গোত্রের নাম।]

আর মুহাজির যারা শিরস্ত্রাণের ওপর দিয়ে তাদের কপালকে উন্মুক্ত করেছে-

যারা পালানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।

আমি জানতাম, মুহাম্মদ অবশ্যই জয়লাভ করবে এবং

যুগ যুগ ধরে সেখানে অবস্থান করবে।

সেই দিনের চিৎকারে হুংকারে ইহুদীদের চোখে খুলে গেছে।”

 

জাফর ইবন আবু তালিবের আবিসিনিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন

ইবনে হিশাম বলেনঃ

শা’বী জানিয়েছেন যে, আবু তালিব তনয় জা’ফর খাইবার বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে আসেন। তিনি তাঁর কপালে চুমু খেলেন এবং আলিঙ্গন করে বললেন, “আজ আমি খাইবার বিজয়ে বেশিী খুশি না জা’ফরের প্রত্যাবর্তনে বেশী খুশী তা নির্ণয় করতে পারিছি না।” ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে যারা আবিসিনিয়াতে থেকে গিয়েছিলেন তাদেরকে আনতে নাজাশীর নিকট আমর ইবন উমাইয়া দামারীকে পাঠানো হয়। তিনি তাদেরকে দু’খানা জাহাজে করে নিয়ে আসেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদন করার পর খাইবারে অবস্থান করছিলেন। সেখানে যেসব সাহাবী প্রবাস জীবন কাটাচ্ছিলেন তাঁরা হলেন বনু হাশিম ইবনে আবদ্ মানাফ গোষ্ঠির জাফর ইবনে আবু তালিব, তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস খাস’য়ামিয়া, আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে জন্মগ্রহণকারী পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর। বনু আবদ্ শামস ইবনে আবদ্ মানাফ গোষ্ঠির খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে উমাইয়া, তার স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, পুত্র সাঈদ ও কন্যা আমাহ্- উভয়ে আবিসিনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। খালিদের ভাই আমর, পরবতীকালে উমার ইবনুল খাত্তাব নিয়োজিত ইসলামী বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ মুয়াইকীব ইবনে আকু ফাতিমা, এবং আবু মুস আশআরী। বনু আসাদ ইবনে আবদুল উযযার- আসাওয়াদ ইবনে নাওফেল ইবনে খুয়াইলদ।

বনু আবদুদ দার ইবনে কুসাইয়ের- জাহাম ইবনে কায়েস।

বনু যুহরা আমের ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে মাসউদ।

বনু তায়েম ইবনে মারেরের- হারেস ইবনে খালিদ ইবনে সাখার।

বনু জুমাহ ইবনে আমরের-উসমান ইবনে রবীয়া ইবনে উহ্যান।

বনু সাহম ইবনে আমরের- মাহমিয়া ইবনে আল জাযা।

বনু আদী ইবনে কা’বের - মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সাদলাহ।

বনু আমের ইবনে লুয়াই এর- আবু হাতিম ইবনে আমর ও মালিক ইবনে রাবীয়া।

বনু হারেস ইবনে ফিহির ইবনে মালিকের – হারিস ইবনে আবদুল কায়েস ইবনে লাকীত।

সেখানে অবস্থানকারী যেসব মুসলমান ইনতিকাল করেন তাঁদের স্ত্রীদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে চলে আসেন। নাজাশী সর্বমোট ১৬ জন পুরুষকে আমর ইবনে দামারীর সাথে দুইখানা জাহাজে করে পাঠিয়ে দেন। আবিসিনিয়ার প্রবাসী মুসলামদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে প্রত্যাবর্তন করেননি বরং তার পরে এসেছেন এবং যাদেরকে নাজাশী এই দুই জাহাজে পাঠাননি- তাদের মধ্যে সর্বমোট পুরুষের সংখ্যা ছিল ৩৪ জন।

 

উমরাতুল কাযাঃ ৭ম হিজরী সনঃ জিলকাদ মাস

খাইবার থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় রবিউল আউয়াল থেকে শাওয়াল মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন সামরিক অভিযানে নিজে গমন করেন অথবা অন্য সাহাবীদের পাঠান।

এরপর যুলকা’দা মাসে তিনি আগের বছরের পরিত্যক্ত উমরার কাযা আদায় করার জন্য মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন্ আগের বছর এই মাসেই মুশরিকরা তাঁতে পথিমধ্যে বাধা দেয় ও উমরা বাদ দিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য করে। ঐ একই সফরে আগের বছর যেসব মুসলিম তাঁর সহচরবুন্দ অত্যন্ত অভাব অনটন ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালতিপাত করছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ কুরাইশরা রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের দেখবার জন্র তাদের সম্মিলন গ্রহ ‘দারুন্ নাদওয়া’তে কারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর চাদর ডান বগলের নীচে ও বাম কাঁধের ওপর পেচিয়ে পরলেন এবং ডান হাত উঁচু করে ডান বগল ফাঁক করে বললেন, “আজকে যে ব্যক্তি নিজেকে শক্তিমান বলে জাহির করবে আল্লাহ তার ওপর রহমত করবেন।” একথা বলার পর তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন্ অতঃপর তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ জোরে জোরে বীরোচিত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। কা’বা ঘরের আড়ালে গিয়ে কুরাইশদের দৃষ্টির অন্তরালে গেলে রুকনে ইয়ামনী চুম্বন করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেছটে রুকনে আসওয়াদে পৌছে এক চক্কর সমাপ্ত করলেন। অতঃপর আগের মত বীরোচিত ভঙ্গিতে জোরে জোরে হাঁটলেন। এভাবে তিন চক্কর দিলেন এবং বাকী চক্করগুলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে সম্পন্ন করলেন।

এই সফরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মাইমুনা বিনতে হারিসকে (রা) বিয়ে করেন। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) এই বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনদিন মক্কায় অবস্থান করলেন। তৃতীয় দিন হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উযযার নেদৃত্বে কুরাইশদের কয়েকজন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তোমরা মক্কায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অতএব তুমি মক্কা ত্যাগ কর।” [৮০. অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তিতে নির্ধারিত মেয়াদ ৩ দিন।]

কুরাইশরা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এখানে তোমাদের উপস্থিতিতে আমি যদি বিয়ে সম্পন্ন করি এবং তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করি আর তোমরা তাতে যোগ দাও তাহলে ক্ষতি কি?” তারা বললো “তোমার খাবারে আ,াদের প্রয়োজন নেই। তমি চলে যাও।”

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ত্যাপ করলেন। নিজের ভৃত্য আবু রাফেকে তিনি মাইমুনার (রা) দেখালোমানর জন্য রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তানয়ীমের নিকটবর্তী সারেফ পৌছেলেন। আবু রায়ে মাইমুনাকে (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহইমুনার (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাইমুনার (রা) সাথে বাসর রাত পাপন করলেন এবং পরে মদীনায় ফিরে গেলেন। ইবনে হিশাম বলেনঃ আবু উবাইদার বর্ণনা মতে এই সফর শেষেই আয়াত নাযিল হয়, “আল্লাহ তাঁর রাসূলুরে স্বাপ্ন সত্যে পরিনত করেছেন। (স্বপ্নে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে) তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারমে নিরাপদে ও নির্ভিকভাবে শাথা মুন্ডিয়ে বা চুল ছেঁেট প্রবেশ করবে। তোমরা যা জানতে পারনি আল্লাহর রাসূল তা জেনেছেন। অতঃপর তার অব্যবহিত পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।” (আল ফাতহ, শেষ রুকু)

মুতার যুদ্ধঃ ৮ম হিজরী সনঃ জামাদিউল উলা 

যুহাজ্জের বাকী অংশ এবং রবিউস্ সানী পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই কাটালেন। এ বৎসর মুশরিকরা হজ্জে নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধান করলো। যায়িদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে জামাদিউল আউয়াল মাসে তিনি মুসলমানদের একটি বাহিনীকে সিরিয়া অভিানে পাঠান। এই বাহিনী মূতা নামক স্থানে যুদ্ধের সম্মীখীন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল যে, যায়িদ যদি শহীদ কিংবা আহত হন তাহলে জাফর এবং জাফর শহীদ কিংবা আহত হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা সেনাপতির দায়িত্ব নিয়োজিত হবেন।

তিন হাজার মুসলমান যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। মুসলমানগণ তাদের বিদায় ও সালাম জানাতে এলে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা কেঁদে ফেললেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি বললেন “দুনিয়ার মোহে কিংবা তোমাদের মায়ায় কাঁদছি না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওাসালাল্লামকে কুরআনের একটি আাত পড়তে শুনেছি। সে আয়াতে দোযখের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ

“তোদমাদের প্রত্যেককে ঐ জাহান্নামের কাছে আসতে হবে। এটা তোমার প্রতিপালকের  চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ (মরিয়ম) আমি বুঝতে পারছি না জাহান্নামের পার্শ্বে যাওয়ার পর আমি কিবাবে তা থেকে উদ্ধার পাবো?” মুসলমানগণ তাঁকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের সঙ্গী হোন! তেনি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের বাছে সহী সালামতে ফিরিয়ে আনুন।”

জবাবে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“আমি পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আর কামনা করছি যেন

(কাফিরদের) রক্তক্ষয়কারী ব্যপিক আঘাত হানতে সক্ষম হই।

অথবা আমার (রক্ত) পিপাসু হাত দিয়ে বর্শার এমন আাঘাত হানতে পারি

যা (শত্রুকে) দ্রুত মৃত্যুর মুখে নিক্ষিপ্ত করবে ও তার কলিজা ও নাড়িভুঁড়ি

ছিন্নভিন্ন করে দেবে।

যেন আমার কবরের কাছে দেিয় অতিক্রমকারীরা বলতে পার যে, এই  ব্যক্তিকে

আল্লাহ হিদায়াতের পথে চালিত করে গাজী বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সে

সুপথে চালিত হয়েছিল।”

অতঃপর বাহিনী রওনা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের সাথে কিছুদুর গেলেন, কিছুদুর গিয়ে তিনি তাদেরকে বিদায় দিয়ে যখন ফিরে এলেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“যে (মহান) ব্যক্তিকে বিদায় জানালাম,

আল্লাহ সেই শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও সর্বোত্তম বিদায়কারীকে খেজুরের বীথিতে সুখে শান্তিতে রাখুন।” অতঃপর মুসলিম বাহিনী যাত্রা শুরু করলো। শামের (সিরিয়া) মায়ান নামক স্থানে পৌছে তারা যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে তারা জানতে পারলেন যে,, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে বালকা এলাকার মায়াব নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেছে। লাখাম, জুযাম, বাহরা ও বালী গোত্রের আরো এক লাখ লোক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বালী গোত্রের এক ব্যক্তি এবং ইরাশ গোত্রের আর একজনস তার সহকর্মী। তার নাম মালিক ইবনে রাফেলা। মুসলিম বাহিনী এসব খবর জেনে মায়ানে দু’দিন অবস্থান করলো এবং তাদের করনীয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলো। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পত্র পাঠিয়ে শত্রুর লোক লস্করের সংখ্যা জানাবেন। তিনি হয় আরো সৈন্য পাঠিয়ে তাদের সাহায্য করবেন, নচেত যা ভাল মনে করেন নির্দেশ দেবেন এবং সেই মুতাবিক তারা কাজ করবেন।

আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করে বললেন, “হে মুসলিমগণ! আজ তোমরা যা অপছন্দ করছ সেটাই তোমরা কামনা করছিলে। আর তা হলো শাহাদাত। আমরা সংখ্যা-শক্তি বা সংখ্যধিক্যের জোরে লড়াই করি না। যে জীবনব্যবস্থার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন তার জন্য আমরা লড়াই করি। অতএব এগিয়ে যাও, বিজয় বা শাহাদাত এ দুটো  উত্তম জিনিসের যেকোন একটা অবশ্যই আমাদের জন্য নির্ধারিত আছে।”

মুসলমানগণ সবাই বললেন, “আল্লাহর শপথ, ইবনে রাওয়াহা হক কথা বলেছে।”

অতঃপর মুসলমানগণ অগ্রসর হলেন। বালকা সীমান্তের কাছে পৌছতেই তারা হিরাক্লিয়াসের সম্মিলিত রোমক ও আরব বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। বালকার সেই স্থানটির নাম মাশারিফ। শত্রুরা নিকটবর্তী হলো। মুসলমানরা একদিকে সরে গিয়ে মৃতা নামক একটি গ্রামে অবস্থান নিলেন্ বাহিনীর দক্ষিণ ভাগে বনু উযরাব কুতবা ইবনে কাতাদাকে (রা) এবং বাম অংশে আনসারী উবায়া ইবনে মালিককে (রা) দায়িত্ব দিয়ে মুসলমানগণ রণপ্রস্তুতি নিলেন। অতঃপর উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। প্রধান সেনাপতি যায়িদ ইবনে হারিসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা বহন করে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তারপর পতাকা হাতে নিলেন জাফর ইবনে আবু তালিব। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়ার পা কেটে ফেললেন এবং যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। শাহাদাত বরণের প্রাক্কালে তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“আহ! কি চমৎকার জান্নাত এবং তার সান্নিধ্য লাভ!

জান্নাত যেমন অতি উত্তম ও পবিত্র, তার পানীয়ও তেমনি।

রোমকদের আযাব ঘনিয়ে এসেছে, তারা কাফির এবং

আমার তুলনায় লনেক নিকৃষ্ট যদিও তাদের আঘাত খেয়েছি।”

ইবনে হিশাম বলেনঃ

নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি জানতে পেরেছি যে, জাফর ইবনে আবু তালিব প্রথমে ডান হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। শত্রুর তরবারীতে ডান হাত কাটা গেলে বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। সে হাতও কাটা গেল। তখন তিনি তা দুই ডানা াদয়ে চেপে ধরলেন্ এরপর শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরণ করলেন। আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল তেত্রিশ বছর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে দুইখানা ডানা দেন যা দিয়ে তিনি যেখানে খুশী উড়ে বেড়াতে থাকেন। কথিত আছে যে, একজন রোমক সৈন্য তাঁকে তরবারীর আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছিল।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ জা’ফর শহীদ হওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরলেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে লড়াইতে অংশ নেবেন কিনা ভাবতে ও কিছুটা  ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। অতঃপর স্বগতভাবে বললেন,

“কসম খেয়ে বলছি, হে ইবনে রাওয়অহা, এই ময়দানে তোমাকে নামতেই হবে,

হয় তোমাকে নমাতেই হবে নচেত তোমাকে তা অপছন্দ করতে হবে।

সকল মানুষ যদি রণহংিকার দিয়ে জমায়েত হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে

কান্নার রোলও পড়ে থাকে,

তোমাকে কেন জান্নাত সম্পর্কে নিস্পৃহ দেখছি?

সুখে শান্তিতে অনেকদিন তো কাটিয়ে দিয়েছো,

অথচ তুমি তো আসলে একটি পুরনো পাত্রে

এক ফোটা পানি ছাড়া আর কিছুই ছিলে না।

হে আমার আত্মা, আজ যদি নিহত না হও তাহলেও তোমাকে

একদিন মরতে হবে।

এটা (রণাঙ্গন) মৃত্যুর ঘর যাতে তুমি প্রবেশ করেছো।

তুমি এ যাবত যা চেয়েছো পেয়েছো।

এখন যদি ঐ দু’জনের মত (যয়িদ ও জাফর) কাজ কর

তাহলে সঠিক পথে চালিত হবে।”

অতঃপর তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই এক চুকরো হাড্ডি জড়িত গোশত এনে তাঁকে দিয়ে বললেন “নাও, এটা খেয়ে একটু শক্তি অর্জন  কর। কেননা তুমি এই ক’দিনে অত্যধিক কষ্ট করেছো।” তিনি গোশতের টুকরোটা নিয়ে দাঁত দিয়ে কিছুটা ছিড়ে নিয়েছেন এমন সময় এক পাশে লোকজনের ভীষণ মারামারি হুড়োহুড়ির  শব্দ শুনতে পেলেন। তখন তিনি বললেন “আমি বেঁচে থাকতে?” তিনি গোশতের টুকরোটা ছুড়ে ফেললেন। তরবারী হাতে অগ্রসর হলেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

এরপর বনু আজলান গোত্রের সাবিত ইবনে আকরাম পতাকা হাতে নিলেন। তিনি বললেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সর্বসম্মতভাবে একজন সেনাপতি বানাও।” সবাই বললো “আপনিই আমাদের সেনাপতি।” তিনি বললেন, “আমি এ দয়িত্ব পালনে সক্ষম নই।” তখন মুসলমানগণ খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে সেনাপতি বানালেন। তিনি পতাকা হাতে নিয়ে বীর বিক্রমে লড়াই করতে লাগলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে একবার এক কিনারে চলে যান আবার এগিয়ে আসেন। এভাবে লড়াই চালাতে লাগলেন। একবার তিনি যেই এক কিনারে গিয়েছেন অমনি রোমক বাহিনীও কিনারে চলে গেল এবং রণেভঙ্গ দিল। পরে তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীকে নিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। বর্নিত আছে যে, মুসলিম বাহিনী যখন শত্রু কর্তক আক্রান্ত হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “যয়িদ ইবনে হারিসা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে। এরপর জা’ফর পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। এতে আনসারদের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তারা ভাবলেন, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার একটা অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে হয়তো। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “জাফরের পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর বললেন “আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, এই তিনজনকে জান্নাতে সোনার পালংকে আরোহণ করানো হয়েছে। আমি দেখলাম আবদুল্লাহ৯ ইবনে রাওয়াহার পালংক খানিকটা বাঁকা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি কারণে হয়ে?ে আমাকে জবাব গেওয়া হলো যে, যায়িদ ও জা’ফর মুহুর্তে মাত্র বিলম্ব না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”

খালিদ লোক লস্কর নিয়ে মদীনায় ফিরে চললেন। মদীনার নিকটবর্তী হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাধারণ মুসলমানরা তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন। বিশেষত শিশু ও বালক-বালিকারা অধিকতর দ্রুতগতিতে দৌড়ে এগুতে লাগলো। রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়ে মুসলিম জনসাধারণের সাথে এগিয়ে চলেছেন। তিনি বললেন, “তোমরা শিশুদেরকে নিজ নিজ সওয়ারীর পিঠে তুলে নাও। আর জাফরের ছেলেকে আমার কাছে দাও। আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আনা হলো। তিনি তাকে সওয়ারীর ওপর নিজের সামনে বসালেন।

এ সময় মদীনার মুসলমানগণ এই বাহিনীর দিকে মাটি ছুড়ে মারছিল আর বলছিল, “ওহে  পলাতকের দল! তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদে গিয়ে পালিয়েছো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলরেন, “না তারা ভাগেন। বরং তারা নতুন করে হামলা চালবে ইনশাআল্লাহ।”

এই সময় হাস্সান ইবনে সাবিতের কবিতা শুনে মূতার যুদ্ধ-ফেরত সাহাবীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবিতাটির মর্ম নিম্নরুপঃ

“মদীনাতে আমি কাটিয়াছি অপেক্ষকৃত কষ্টদায়ক রজনী

সকল মানুষ যখন ঘুমিয়েছে তখন আমি ঘুমাতে পারিনি।

বন্ধুর স্মুতি আমার চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছে,

বস্তুতঃ স্মৃতিই হলো কান্নার প্রধান উদ্দীপক।

সত্যিই বন্ধুকে হারানো একটা বিরাট পরীক্ষ,

তবে অনেক মহৎ ব্যক্তি আছেন যারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে

ধৈর্য ধারণ করেন।

সর্বোত্তম মুসলমানদের দেখলাম একের পর এক দলে দলে

যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাদের পরপরই ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উত্তর পুরুষগণ।

মূতায় একের পর এক শাহাদাত বরণকারী এই লোকদেরকে

আল্লাহ কখনো নৈকট্য লাভে বঞ্চিত করবেন না,

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলো দুই ডানাধারী জাফর,

যায়িদ ও আবদুল্লাহ। বস্তুতঃ মৃত্যুর কারণগুয/েলা ছিল বড়ই ভয়াবহ।

একদা সকালে তারা মু’মিনদের নিয়ে যুদ্ধে যাত্রা করলো জনৈক ভাগ্যবান

ব্যক্তি ছিল তাদের অধিনায়ক।

বনু হাশিম গোষ্ঠির মধ্যে যিনি পূর্নিমার চা^ঁদের মত দীপ্ত,

যুলুমকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন যেই দুঃসাহসী বীর।

তারপর তিনি প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন রণাঙ্গনের পরাজেয় পৌত্তলিকের ওপর।

অবশেষে এক সময় তিনি বেসালভাবে নুয়ে পড়ে গেলেন।

আর শহীদদের দলভুক্ত হলেন যার পুরস্কার জান্নাত

এবং সবুজ নিবিড় কাননসমুহ।

আমরা জা’ফরের মদ্যে লক্ষ্য করতাম মুহাম্মাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য এবং

নির্দেশ প্রদানের বেলায় সুদৃড় অধিনায়কত্ব।

বনু হশিম বংশে মর্যাদা ও পৌরবের স্তম্ভ এখনো বিদ্যমান।

তারা ইসলামের পর্বত সদৃশ আর তাদের সহচরগণ

সেই সৌম্য দর্শন মহৎ সজ্জনদের মদ্যে রয়েছেন জা’ফর, আলী,

সর্বজনমন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হামযা, আব্বাস ও আকীল।

বস্তুতঃ চন্দন বৃক্ষের যেখানেই নিংড়ানো হোক সেখান থেকে

চন্দনের (অর্থাৎ সুগন্ধিযুক্ত) নির্যাসই বেরুতে বাধ্য।

(অর্থাৎ বনু হামিমের বংশের যে পরিবারেই কোন সন্তান ভুমিষ্ঠ হোক

সে উল্লিখিত সন্তানদের মতই হবে। উক্ত বংশের যে পরিবারেই

সে জন্মলাভ করুক না কেন।)

কোন কঠিন সমস্যায় যখন লোকেরা নিরুপায় ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে,

তখন তাদের দ্বারাই সংকটের সুরাহা হয়।

তাঁরা সব আল্লহর আপনজন, তাঁদের ওপর আল্লাহ

তাঁর বিধান নাযিল করেছেন এবং

তাঁদের কাছেই সুরক্ষিত রয়েছে সেই পবিত্র গ্রন্থ।”

মক্কা বিজয়ঃ ৮ম হিজরী, রমাযান মাস

মূতার যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাদিউস সানী ও রজব মাস মদীনায় অবস্থান করেন।

এই সময় বনু বকর বনু খুযায়া গোত্রের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের কারণ ছিল ইসলাম আগমণের পূর্বে বনু হাদরামী গোত্রের মালিক ইবনে আব্বাদ নামক এক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে খুযায়া গোত্রের বসতিস্থল অতিক্রম করার সময় তাদের লোকেরা তাকে হত্যা করে এবং তার কাছে যা কিছু ছিল ছিনিয়ে নেয়। এর ফলে বুন বকর জনৈক খুযায়ীর ওপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধে খুযায়া গোত্র ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে বনু বকরের একাংশ বনু দায়েলের সরদার আসওয়াদের তিন সন্তান সালমা, কুলসুম ও যুয়াইবকে হারাম শরীফের সীমানার কাছে হত্যা করে। কেননা আসওয়াদ ছিল হাদরামীর তি¤্র। এই বিষয় নিয়ে বনু বকর ও বনু খযায়ার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলে আসছি। ইসলামের অব্যুদয় ঘটার ফলে উভয় গোত্রের এই উত্তেজনা স্তিমিত হয় এবং তাদের মনোযোগ চলে যায় ইসলামের দিকে। কুরাইশগণ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধিতে একটি শর্ত ছিল এ যে, কোন তৃতীয় পক্ষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা কুরাইশদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করতে পারবে। তদনুযায়ী বনু বকর কুরাইশদের এবং বনু খযায়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিত্রতার ঘোষণা করে।

চুক্তি সম্পাদিত হওয়অর পর বনু বকরের শাখা বনু দায়েল বনু খযায়ার দ্বারা আসওয়াদের উক্ত তিন সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করে। তাই বনু দায়েল পরিবারের প্রধান নাওফেল ইবনে মুয়াবিয়া প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। উল্লেখ্য যে, এই লোকটির গোটা বনু বকরের ওপর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। একদিন রাত্রে খুযায়া গোত্রের লোকেরা তাদের নিজস্ব ঝর্ণা ওয়াতীরে আবস্থানকালে নাওফেল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তিলে খুযয়ীদের একজনকে হত্যা করলো। আর যায় কোথায়। উভয় গোত্র অন্যান্য গোত্রের সাথে দল পাকিয়ে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। কুরাইশরা এই সময় বনু বকরকে অন্ত্র দিল এবং তাদের সহযোগিতায় কুরাইশদের অনেকেই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে খযায়ীদের সাথে যুদ্ধ করলো। গিশেহারা হয়ে খুযায়া গোত্র মসজিদুল হারামের নিষিদ্ধ গন্ডীর মধ্যে আশ্রয় নিল। নাওফেলের নেতৃত্বে প্রতিহিংসাপরায়ণ দায়েল গোত্রের লোকেরা তাদের ধাওয়া করে হারাম শরীফ পর্যন্ত এলো। বনু বকরের লোকেরা নাওফেলকে বললো “হে নওফেল, এবার থামো। আমরা এখন হারাম শরীফের অভ্যন্তরে আছি। খোদাকে ভয় কর।”

তখন নাওফেল একটা সাংঘাতিক কথা বলে বসলো। সে বললো, “আজকে তার কোন ইলাহ বা প্রভু নেই। হে বনু বকর, তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তোমরা তো হারাম শরীফে চুরি করতেও কুণ্ঠিত হও না। (উল্লেখ্য যে কা’বা শরীফের সোনার তৈরী বহু মূল্যবান মূর্তি চুরি করার অভিযোগ কুরাইশদের বিরুদ্ধে ছিল।) এখন এখানে প্রতিশোধ নিতে কুণ্ঠিত হও কেন?” ইতিপূর্বে ওয়অতীর ঝর্ণার কাছে রাতের আঁধারে ‘মুনাব্বিহ’ নামক জনৈক দুর্বলচিত্ত খুযারীকে হত্যা করেও তাদের পিপাসা মেটেনি। মুনাব্বিহ তামীম ইবনে আসাদ নামক তার গোত্রের অপর এক ব্যক্তিকে সাথে করে বেরিয়েছিল। মুনাব্বিহ বললো “হ তামীম, তুমি নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর। আমি তো মরতেই যাচ্ছি। তারা আমাকে হয় হত্যা করবে নয় ছেড়ে দেবে।” তামীম সেখান থেকে পালিয়ে গেল আর তারা মুনাব্বিহকে হত্যা করলো।

খুযায়ার লোকেরা মক্কায় তাদের এক মিত্র বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাবেক এক গোলাম রাফের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও বনু বকর ও কুরাইশদের মিলিত আক্রমণে খুযায়ার অনেকেই প্রাণ হারায়। এভঅবে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লামের মিত্র বনু খুযায়াকে হারাম শরীফের নিষিদ্ধ স্থানে হত্যা করে হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। এরপর আমর ইবনে সালেম খুযায়ী ও বনু কা’বের এক ব্যক্তি মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের সাতে সাক্ষাত করে সব ঘটনা বিবৃত করে। এই ঘটনা ছিল মক্কা বিজয়ের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদে লোকজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে ছিলেন তখন সে সেখানে গিয়ে উপনীত হয় এবং একটি কবিতা আবৃত্তি করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। কবিতাটির মর্ম এই:

“হে প্রভু! আমি মুহাম্মাদের নিকট আমাদের পিতা ও তাঁর পিতার পুরানো মৈত্রীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ও তা কার্যকরী করার অনুরোধ জানাই। তোমরা সন্তান ছিলো। আর আমরা পিতা ছিলাম। সেখানে আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তা ত্যাগ করিনি। আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমাদেরকেত অবিলম্বে সাহায্য কর। আর আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান কর যেন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন যিনি (চুক্তি থেকে) বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। তাকে যদি আবমাননা করা হয় তাহলে তাঁর মুখে কলংক লেপন করা হবে। তিনি রয়েছেন এমন একটি বাহিনীর সঙ্গে যা সমুদ্্েরর মত ফেনারাশি নিয়ে প্রবাহিত।  জেনে রাখ) কুরাইশরা তোমার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারা তোমার সন্ধি লংঘন করেছে এবং কাদা নামক স্থানে আমার জন্য গুপ্ত ঘাঝটি স্থাপন করেছে। তারা সংখ্যায় অল্প ও শক্তিতে অপেক্ষাকৃত হীনবল। তারা আল ওয়াতীরে গোপন রাত্রি যাপন করেছে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাহিনী শুনে বললেন, “ হে আমর, তোমাকে সাহায্য করা হবে।” এর অব্যবহিত পর তিনি আকাশে এক খন্ড মেঘ দেখে বললেন, “এই মেঘখন্ডটিই বনু কা’বের সাহায্যের সূচনা করবে।”

এরপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা বনু খুযায়ার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তাঁকে তাদের বিপদ মুসিবতের কথা এবং কুরাইশরা বনু বকরকে তহাদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার কথা অবহিত করলো। অতঃপর মক্কায় ফিরে গেল। তার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে জানালেন “তোমরা ধরে নিতে পার যে, আবু সুফিয়অন তোমেদের কাছে এসেছে এবং সন্ধি চুক্তি অলংঘনীয় করা ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে।”

বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা ও তার সাথীরা মক্কায় ফিরে যাওয়ার সময় উসফানে আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের সাথে তাদের সাক্ষাত হলো। কুরইশরা তাকে রাসূলুল্লাহর নিকট সন্ধি চুক্তিকে অলংঘনীয় ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য াফিয়েছে। কেননা তারা বনু খুযায়ার সাথে যে আচরণ করেছে তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “বুদাইল, তুমি কোথা থেকে আসছো।” সে ধারণা করেছিল যে বুদাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের কাছেই গিয়েছিল। বুদাইল জবাব দিল, “এই এলাকায় বনু খুযায়ার লোকদের সাথে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম।” আবু সুফিয়অন বললো “তুমি মাহাম্মাদরে কাছে যাওনি?” সে বললো ‘না।’ বুদাইল মক্কা চলে গেলে আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট থামানোর জায়গায় গিয়ে তার গোবর পরীক্ষা করলো। গোবরের মধ্যে খেজুরের আটি দেখে বললো, “নিশ্চয়ই বুদাইল মুহাম্মাদের নিকট গিয়েছিল।” খেজুরের আটিকে সে তার মদীনায় যাওয়ার আলামত হিসেবে গণ্য করলো।

তারপর আবু সুফিয়ান রওনা হয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছে নিজের কন্যা উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার কাছে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বসার উপক্রম করতেই উম্মে হবীবা বিছানা গুেিয় ফেললেন। তা দেখে আবু সুফিয়ান বললে, “হে আমার কন্যা তুমি কি আমাকে ঐ বিছানায় বসার যোগ্য মনে করনি?” উম্মে হাবীবা বললেন, “ওটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের বিছানা। আর আপনি একজন মুশরিক, অপবিত্র। আমি চাই না যে, আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বনে।” আবু সুফিয়ান বললো “হ আমার কন্যা, আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার তুমি খারাপ হয়ে গিয়েছো।”

আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলো এবং কথা বললো। কিন্তু তিনি তার কোন কথার জবাব দিলেন না। অতঃপর সে আবু বাকরের (রা) নিকট গিয়ে এ মর্মে অনুরোধ করলো যাতে তিনি রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার সম্পর্কে সুপারিশ করেন। আবু বাক্র (রা) এ অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।

অতঃপর সে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) নিকট গিয়ে অনুরুপ অনুরোধ করলো। উমার বললেন “কি বলছ্!ো আমি তোমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামের নিকট সুপারিশ করবো? আমি যদি ছোট ছাড়া কোন সহযোগী না পাই তবুও তোমার সাথে লড়াই করবো?”

এরপর সে আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) নিকট গেল। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতিমা (রা) ছিলেন। তাঁর সামনে শিশু হাসান (রা) হামাগুড়ি দিচ্ছিলো। সে বললো, “হে আলি তুমি আমার প্রতি সর্বাধিক দয়ালু। আমি তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে। ব্যার্থ হয়ে ফিলে যেতে চাই না। কাজেই তুমি আমার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সুপারিশ কর।” তিনি বললেন, “ধিক তোমাকে হে আবু সুফিয়অন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প গ্রহণ করেছেন, আমরা সে সম্পর্কে তাঁর সাথে কথা বলতে অক্ষম।”

অনন্যোপায় হয়ে আবু সুফিয়ান ফাতিমার (রা) দিেিক তাকালো। বললো, “হে মুহাম্মদের কন্যা।! তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার এই শিশু পুত্র লোকজনকে রক্ষা করার নির্দেশ দেবে আর তার ফলে সে চেরকালের জন্য আরবের নেতা হয়ে থাকবে?” ফাতিমা (রা) বললেন, “আমার ঐ ছেলে লোকজনকে রক্ষ করার যোগ্য হয়নি। তাচাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না।”

আবু সুফিয়ান বললো, “হে আলী! আমি দেখছি পরিস্থিিিত আমার প্রতিকূল। এখন আমাকে একটা সদুপদেশ দাও।” আলী (রা) বললেন, “তোমার উপকারে আসবে এমন কোন উপদেশ আমার জানা নেই। তবে তুমি তো বনু কিনানা গোত্রের নেতা। তুমি যাও, লোকজনকে রক্ষা কর। অতঃপর তোমার জন্মস্থানে অবস্থান করতে থাক।” সে বললো, “এতে আমার শেষ রক্ষা হবে তো?” আলী (রা) বললেন, “তা আমার মনে হয় ন্ াতবে এ ছাড়া তোমার জন্য আর কোন উপায়ও দেখছি না।” অতঃপর আবু সুফিয়ান মসজিদে গিয়ে ঘোষণা করলো “হে জনতা! আমি সকল মক্কাবাসীর রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি।” এই বলেই সে উটে চড়ে প্রস্থান করলো। কুরাইশদের কাছে গেলে তারা জিজ্ঞোস করলো, “কি করে এসেছো?” সে সে বললো, “মাহাম্মাদের কাছে গিয়ে কথা বললাম। সে কোন কথারই জবাব দিব না। তারপর আবু বাকরের কাছে গেলাম। সেও কোন আশাপ্রদ কথা বললো না। তারপর গেলাম উমারের কাছে। তাকে সবচেয়ে কট্রর দুশমন পেলাম। তারপর আলীর সাথে দেখা করতে গেলাম। তাকে সবার টাইতে নমনীয় মনে হলো। আলী আমাকে একটা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। সে কাজ আমি করেছি। জানি না তাতে কিছু হবে কি না।”

সবাই বললো, “আলী তোমাকে কি করতে বলেছে?” আবু সুফিয়ান বললো  সে আমাকে বলেছিল মক্কাবাসীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে। সেটা আমি ঘোষণাদিয়ে এসেছি।” জনতা বললো, “মুহাম্মদ কি তোমাকে এ কাজ করার অনুমতি দিয়েছে?” সে বললো ‘না।’ জনতা বললো “তাহলে আলী তোমার সাথে তামাশা করেছে মাত্র। এ তোমার কোন উপকারে আসবে না।” সে বললো, “কিন্তু এছাড়া আমার কোন গত্যন্তুর ছিল না।”

রাসূলুল্লাহা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সকল মুসলমান এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। আবু বাক্র (রা) তাঁর কন্যা আয়িশার (রা) কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি জিনিসপত্র গোছগাছ করভেন। তা দেখে তিনি বললেন, “হে আয়িশা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন?” আয়িশা (রা) বললেন, “হাঁ আব্বা আপনিও প্রস্তুতি নিন।” আবু বাক্র বললেন, “তিনি কোথায় যেতে মনস্থ করেছেন বলে মনে কর।” আয়িশা বললেন, “জানি না।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সুষ্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করতে যাচ্ছেন। তিনি তাদেরকে সফরের জন্য তৈরী হতে বললেন। তিনি আরও বললেন,!“হে আল্লাহ! কুরাইশদের থেকে আমাদের প্রস্তুতির যাবতীয় খবর গোপন রাখুন যাতে আমরা তাদের ওপর আকস্মিকভাবে গিয়ে চড়াও হতে পারি।” মুসলমানগণ অল্পক্ষনের মাধ্যেই তৈরী হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন এমনস সময় সাহাবী হাতিব ইবনে আবু বালতায় (রা) জনৈক মহিলার মাধ্যমে কুরাইশদের কাছে একটা চিঠি পাফিয়ে দিলেন। চিঠিতে জানিয়ে দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে যাওয়ার আয়োজন করেছেন। মহিলা চিঠিটা তার খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে রওয়ানা হলো। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাতিবের কারসাজির রহস্য ফাঁস করে দিলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে,  তোমরা পথিমধ্যে সেই মহিলাকে পাকড়রও করবে এবং তার কাছে থেকে হাতিবের চিঠি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে- যাতে হাতীব মক্কাবাসীকে আমাদের অভিযান প্রস্তুতির সব খবর জানিয়ে সাবধান করে দেয়েছে।” তাঁরা উভয়ে রওনা হয়ে গেলেন এবং খলীফা নামক স্থানে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। তারা তাকে উট থেকে নামিয়ে তার উটের হাওদার মধ্যে চিঠির সন্ধান করলেন। কিন্তু পেলেন না। আলী (রা) বললেন “আল্লাহর কসম্ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মিথ্যা হতে পারে না এবং আমরাও মিথ্যা বলছি না। এই চিঠি বের করে দাও, নচেত আমরা তোমার দেহ তল্লাশী করবো।”

মহিলা যখন দেখলো আলী (রা) নাছোড়বান্দা, তখন সে বললো, তুমি অন্য দিকে মুখ ফিরাও।” তিনি মুখ ফিরালেন। মহিলা নিজের খোঁপা খুলৈ চিঠি বের করলো। আলী (রা) ও যাবাইর (রা) চিঠি নিয়ে রাসূলুল্লাহর দরবারে উপস্থিত হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতিবকে ডেকে তার চিঠি পাঠানোর কারন জিজ্ঞেস করলেন। হাতিব বললেন, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি আমার ঈমানে বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন আসেনি। মক্কায় আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। অথচ কুরাইশদের মধ্যে আমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়েছে। তাই এভাবে আমি তাদের সহানুভুতি লাভ করতে চেয়েছি।”

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে মুনাফেকী করেছে। আমাকে অনুমতি দিন তার ঘাড় কেটে ফেলি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে উমার, তোমার তো জানা নেই। এমনও তো হতে পারে যে আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরকে বদরের দিন বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যাখুশী কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।”

আল্লাহ তায়ালা হাতিব সম্পর্কে সুরা মুমতাহিনায় আয়াত নাযিল করলেন: “হে মুমিনগণ! যারা আমার ও তোমাদের শত্রু তাদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা দেখিয়ে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়ো না। ......... ইবরাহীম ও তার সহচরদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। সে তার জাতিকে বলেছিলো, আমরা তোমাদের ও আল্লাহ ছাড়া আর যাদের তোমরা দাসত্ব করছো- পরোয়া করি না। আমরা তোমাদের সম্পর্ককে অস্বীকার করলাম। আর আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতার উদ্ভব হয়েছে যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহকে মা’বুদ বলে মেনে নাও।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হলেন। এ সময় আবু বুরহুম গিফারীকে মদীনায় তাঁর খলিফা নিয়োগ কররৈন। রমযানের দশ দনি অতিবাহিত হবার পর তিনি যাত্রা করলেন। তিনি নিজে এবং মুসলমানগণ সকলেই রোযা রাখলেন। উসফান ও আমাদের মধ্যবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে পৌছলে সকলে ইফতার করলেন।

এখান থেকে দশ হাজার মুসলমানকে সাথে নিয়ে তিনি আবার রওনা করলেন এবং মাররুয যাহরানে পৌছে যাত্রাবিরতি করলেন। পথিমধ্যে বনু সুলাইমের সাতশ মতান্তরে এক হাজার ও বনও মুযাইনার এক হাজার লোক তাঁর সাথে যোগ দিল। এ সময় আরবে এমন কোন গোত্র ছিল না যার বেশ কিছু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি। মুহাজির ও আনসারদের সকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং কোন একজনও পিছপা হননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরোনে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। তখনো পর্যন্ত কুরাইশরা তাঁর যাত্রা বা তিনি কি করতে যাচ্ছেন তা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেননি। ঐ সময় এক রাতে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করতে বের হলো। পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) সালুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করেছিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ইবনে মুগীরা পথিমধ্যে (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী) নাইফুল উকাব নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে উপনীত হলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাল্লামের সাক্ষাতপ্রার্থী হলে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনা রচাচাতো ভাই ও শ্যালক এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ ওদের দিয়ে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার চাচাতো ভাই তো আমাকে অপমান করেছে। আর আমার শ্যালক (আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া উম্মে সালামার সৎ ভাই) মক্কায় অবস্থানকালে আমার চরম বিরোধীত করেছে।”

তারা যখন উভয়ে এই জবাব পেলো তকন আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস বললো “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে সাক্ষাত করার সুযোগ না দেন তাহলে আমি আমার এই ছেলে নিয়ে  নিরুদ্দেশ হয়ে একদিকে চলে যাবো এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মরবো।”

একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন বিগলিত হলো। তিনি অনুমতি দিলেন। তখন তার াউভয়ে তাঁর কাছে গেলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইতিপূর্বে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক যেসব কবিতা আবৃত্তি করেছেন তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। ইসলাম প্রহণ করার পর নতুন কবিতা আবৃত্তি করলেন? এ কবিতার মর্ম নিম্ন রুপঃ

“আমি যেদিন সেনাপতি হয়ে লড়াই করবো, মুহাম্মাদের বাহিনী

মুশরিক বাহিনীর ওপর অবশ্যই জয়যুক্ত হবে।

(মুশরিক বাহিনী) রাতের আঁধারে দিশেহারা যাত্রীর মত।

আজ আমার পালা এসেছে যখন আমি হিদায়াত লাভ করেছি।

আমাকে সেই হিদায়াতকারী হিদায়াত করেছে, বদলে দিয়েছে

এবং আমাকে আল্লাহর সাহচর্য পৌছিয়ে দিয়েছে

যাকে আমি (একদিন) দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

সেদিন আমি মুহাম্মাদের মাঝে আন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং

তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে রণপাঁয়তারা করেছিলাম,

আর আমাকে মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ডাকা হচ্ছিলো

যদিও আমি তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট হইনি।

তিনি যে পথে চলছিলেন সে পথেই চলতে থাকলেন-মুশরিকদের

খেয়াল খুশী মুতাবিক কথা বললেন না

যদিও তিনি বিশুদ্ধ মতের অধিকারী হিসেবে কথা বলছিলেন

তথাপি তাঁকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করা হয়েছিল।

যতক্ষন আমি হিদায়াত পাইনি ততক্ষণ প্রত্যেকে বৈঠকে তাদেরকে (মুশরিকদেরকে)

খুশী করতে চেয়েছিলাম এবং (মুসলিম) জনতার সাথে সংযুক্ত হইনি।

সুতরাং বনু সাকীফকে বলে দাও, আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না।

বনু সাীফকে বলে দাও, আমাকে নয় অন্য কাউকে ভীতি প্রদর্শন করুক।

কেননা আমি সেই বাহিনীর ভেতরে ছিলাম না যে বাহিনী

জনপদকে আক্রমণ করেছিল

এবং সে আক্রমণ আমার জিহ্বা কিংবা হাতের দ্বারা সংঘটিত হয়নি।

সে বাহিনীতে ছিল দূরাঞ্চল থেকে আগত গোত্রসমূহ যে এবং

সাহাম ও সুরদাদ থেকে আগত অচেনা যোদ্ধারা।”

কথিত আছে যে, তিনি যখন কবিতার এই অংশটি আবৃত্তি করছিলেন, “আমাকে আল্লাহর সাহচর্যে পৌছিয়ে দিয়েছে সেই ব্যক্তি যাকে আমি বহু দূরে তড়িয়ে দিয়েছিলাম” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুক চাপড়ে বলেছিলেন, তুমিই তো আমাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরানে যাত্রাবিরতি করলে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব প্রমাদ গুলেন। তিনি বুঝলেন যে কুরাইশরা যদি স্ব উদ্যোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্রামের কাছে এসে সন্ধি না করে এবং তিনি যদি জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেন তাহলে কুরাইশরা চিরতরে নির্মুল হয়ে যাবে।

আব্বাস (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরটিতে আরোহণ করে আরাক নামক স্থানে এস খোঁজ করতে লাগলাম কোন কাঠুরিয়া, দুধওয়ালা কিংবা আর কোন লোক মক্কায় যায় কিনা। তাহলে বলবো মক্কাবাসীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের খবর দিতে যাতে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করার আগে তাঁর কাছে এসে সন্ধি করে।

আমি এই অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার কথাবার্তা শুনতে পেলাম। তারা উভয়ে কথাবার্তা বলছিল। আবু সুফিয়ান বলছিল “গতরাত্রে আমি যে রকম আগুন দেখলাম এমন আগুন আর কখনো দেখিনি এবং  এত বড় বাহিনীও আর কখনো দেখিনি।” বুদাইল বলছিল, “এটা নিশ্চয়ই খুযায়া গোত্রের বাহিনী। তারা নিশ্চয়ই যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়েছে।” আবু সুফিয়ান জবাব দিল, “খুযায়ার এত প্রতাপ ও জনবল নেই যে, এত আগুন জ্বালাবে এবং এত বড় বাহিনীর সমাবেশ ঘটাবে।” আমি আবু সুফিয়ানের কন্ঠস্বর চিনতে পেরে বললাম, “ওহে আবু সুফিয়ান।” সে বললো “কে আব্বাস নাকি?” আমি বললাম, ‘হাঁ।’ সে বললো “খবর কি?” আমি বললাম, “তুমি জান না? এই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী। আল্লাহর শপথ! কুরাইশদের জবীন বিপন্ন।” সে বললো “তাহলে এখন উপায় কি?” আমি বললাম,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাকে হাতে পান তাহলে খুন করে ফেলবেন। অতএব এই খচ্চরের পেছনে ওঠো। আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে নিয়ে গিয়ে তোমার জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।”

অতঃপর সে আমার পেছনে চড়ে বসলো। আর তার সঙ্গীদ্বায় ফিরে গেল। আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আমি মুসলিম বাহিনীর এক এক অগ্নিকুন্ডের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই বলিেছলো, “এ কে?” কিন্তু একবার নজর বুলিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরে আমাকে আরোহী দেখে প্রত্যেকেই শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমার পেছনে যে আবু সুফিয়ান রয়েছে তা কেউ লক্ষ্য করছিল না।

উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সামনে দিয়ে যখন অতিক্রম করলাম তখন তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। পেছনে আবু সুফিয়ানকে বসা দেখে বললেন, “আল্লাহর শত্রু আবু সুফিয়ান! আল্লাহর শুকরিয়া যে, কোন চুক্তি ছাড়াই তোমকে আমাদের হস্তগত করে গিয়েছেন।” একথা বলেই তিনি দৌড়ে চললেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। এদিকে আমিও দ্রুত ছুটলাম। উমার ও খচ্চর কেউই তেমন দ্রুতগামী ছিল না। তথাপি খচ্চর একটু আগে গেল। খচ্চর থেকে নেমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের নিকট গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে উমার (রা) ও গেলেন সেখানে। তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই যে আবু সুফিয়ান। আল্লাহ ওকে অনায়াসেই জুটিয়ে দিয়েছেন। ওর সাথে আমাদের কোন চুক্তিও হয়নি। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিন ওর গর্দান উড়িযে দিই।”

আমি বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি।” অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসলাম এবং তার মাথা আকর্ষণ করে বললাম, “আল্লাহর কসম, আজ রাতে ওকে আমি ছাড়া কারো সাথে একা থাকতে দেব না।”

উমার (রা) আবু সুফিয়ান সম্পর্কে অনেক কথা বলতে লাগলেন। তা শুনে আমি বললাম, “চুপ কর, উমার! আবু সুফিয়ান বনু কা’ব গোত্রের লোক হলে (বনু কা’ব উমার (রা) এর গোত্র) তুমি এ রকম বলতে না। বনু আবদ মানাফের লোক বলেই তুমি এ রকম বলছো।”

উমার বললেন, “আব্বাস! আপনি এ রকশ কথা বলবেন না। আমার পিতা যদি ইসলাম গ্রহন করতেই তবে তাঁর ইসলামের চাইতে আপনার ইসলাম গ্রহণ আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আবু সুফিয়ানকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

আমি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে গেলাম। রাত্রে সে আমার কাছে থাকলো। সকাল বেলা তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক তোমাকে। আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই একথা মেনে নেয়ার সময় কি তোমার এখনো হয়নি?” সে বললো, “আপনার উদারতা, মহত্ত্ব, স্বজনবাৎসল্য অতুলনীয়। আমার ধারণা, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ যদি থাকতো তাহলে এতদিনে আমাকে সাহায্য করতো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক্ তোমাকে! আমি যে আল্লাহর রাসূল, তা কি  এখন পর্যন্ত তুমি উপলদ্ধি করনি?” আবু সুফিয়ান বললো, “আপনার জন্য আমার মাতাপিতা উৎসর্গ হোক! আপনি এত উদার সহনশীল এবং আত্মীয় সমাদরকারী যে, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না। তবে আপনার রাসূল হওয়া সম্পর্কে আমার একনো কিছু দ্বিাধা-সংশয় রয়েছে।” আব্বাস তখন বললেন, “ধিক তোমাকে! ইসলাম গ্রহণ কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। নচেত এক্ষুণি তোমার গর্দান মারা হবে।”

আবু সুফিয়ান সত্যের সাক্ষ্য দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর আব্বাস (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু সুফিয়ান একটু মর্যাদা লোভী। কাজেই তাকে গৌরবজনক একটা কিছু দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্ইাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিজের বাড়ীর দরজা বন্ধ করে রাখবে সেম নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি সমজিদুল হারামে প্রবেশ করবে তাকেও কিছু বলা হবে না।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট থেকে বের হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, তাকে উপত্যকার কিনারে পাহাড়ের মাথায় গিরিপথে একটু থমিয়ে রাখো। আল্লাহর সৈনিকরা তার সামনে দিয়ে যাক এবং সে তাদেরকে দেখুক।” আব্বাস বলেন, এরপর আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জায়গার কথা বলেছিলেন সেই গিরিপথে তাকে থামিয়ে রাখলাম। এরপর বিভিন্ন গোত্র নিজ নিজ পতাকার পেছনে সারিবদ্ধভাবে রওনা হলো। যখনই একটা গোত্র তার সামনে দিয়ে যায়, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, “হে আব্বাস! এরা কারা?” আমি বলি, “এরা বনু সুলাইম অথবা বনু মুযাইনা অথবা অমুক গোত্র, তমুক গোত্র।” আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ এদের সাথে আমার কোন তুলনাই হয়না।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিজের সবুজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। [৮১. এই বাহিনীকে সবুজ বাহিনী বলা হয় এই জন্য যে, এতে লোহা নির্মিত জিনিসের সমাবেশ ঘটেছিল সর্বাধিক পরিমাণ। (ইবনে হিশাম)] এতে মুহাজির ও আনসারদের সমাবেশ ঘটেছিল। এ বাহিনীতে লোহার ধারালো অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। আবু সুফিয়ান বললো, “সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! হে আব্বাস এর কার?” আমি বললাম “এ বাহিনীতে রয়েছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর সাথে আছেন মহাজির ও আনসরাগণ। সে বললো, “এ বাহিনীর মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহর শপথ, হে আব্বাস! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র আগামীকাল এক বিরাট সা¤্রাজ্যের অধিপতি হতে যাচ্ছেন।” আমি বললাম, “হে আবু সুফিয়ান! এটা কোন রাজকীয় ব্যাপার নয়। এটা নবুয়াতের প্রতাপ।” সে বললো, “তাহলে এটা কতই না চমৎকার।” আমি বললাম, “তুমি তাড়াতাড়ি কুরাইশদের কাছে চলে যাও।” আবু সুফিয়ান মক্কা গিয়ে ঘোষণা করে দিল, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মদ এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছে যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। এখন আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে যে আশ্রয় নেবে তার ভয় নেই।”

এই সময় উতবার কন্যা হিন্দ আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে তার গোঁফ টেনে ধরে বললো, “হে কুরাইশগন, এই মোটা পেটুককে হত্যা কর। জাতির নেতৃত্বের মর্যাদায় থেকে সে কলংকিত হয়েছে।”

আবু সুফিয়ান বললো, “তোমাদের বিপর্যয় সম্পর্কে সাবধান হও। এই মহিলার কথায় তোমরা বিপথগামী হয়ো না। তোমাদের ওপর এক অপ্রতিরোধ্য বাহিনী সমাপত। এমতাবস্থায় আমার বাড়ীতে যে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে।”

সবাই বললো, “তোর ওপর অভিসম্পাত! তোর বাড়ী আমাদের কি কাজে আসবে?” আবু সুফিয়ান বললো, “ যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে এবং যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থকবে।”

লোকেরা সবাই যার যার বাড়ীতে অথবা মসজিদুল হারামে চলে গেল।

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) যিতুয়ার পৌছে লাল ইয়ামানী কাপড় দিয়ে পাগড়ী বাধলেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহের ফলে যে বিজয় লাভ করতে চলেছেন তার জন্য মাথা নীচু করে চলতে লাগলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি মাথা এত নীচু করেছিলেন যে তাঁর দাড়ি উটের দেহ স্পর্শ করছিল।

আসমা বিনতে আবু বাক্র (রা) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সা) যখন যিতুয়াতে থামলেন তখন আবু কুহায়া (আবু বাকরের (রা) পিতা) তার এক অল্প বয়ষ্কা কন্যাকে বললেন, “আমাকে আকু কুবাইস পাহাড়ের ওপর নিয়ে চল।’ আবু কুহাফা তখন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়েটি তাকে পাহাড়ের ওপর নিয়ে গেল। তখন আবু কাহাফা তাঁর কন্যাকে বললেন, “ তুমি কি দেখছো?” সে বললো, “একটা বিরাট সনসমাবেশ দেখতে পাচ্ছি।” তিনি বললেন, “ঐ তো সেই বাহিনী।” মেয়েটি বললো, “আরো দেখতে পাচ্ছি এক ব্যক্তি ঐ জনসমাবেশের সামনে একবার আগে আর একবার পেছনে ছুটছে।” তিনি বললেন, “তিনি ঐ বাহিনীল অধিনায়ক।” মেয়েটি বললো, “এবার জনসমাবেশটি বিচ্ছিন্ন হয়েছে।” আবু কুহাফা বললেন, “তাহলে বাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।” এবার আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ী নিয়ে চল। মেয়েটি তাঁকে নিয়ে পাহাড়  থেকে নামলো।। আবু কুহাফা বাড়ী পৌছার আগেই বাহিনী তাঁর কাছে পৌছে গেল। মেয়েটির গলায় একটি রুপার হার ছিল, কে একজন তা ছিনিয়ে নিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌছে সমজিদুল হারামে প্রবেশ করলে আবু বাক্র (রা) তার পিতাকে নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে বললেন, “এই বৃদ্ধকে ঘরে রেখে এলে না কেন?” আমিই তার কাছে যেতাম।”

আবু বাক্র (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার যাওয়ার চাইতে তাঁর আসাই অধিকতর শোভনীয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সামনে বসালেন। অতঃপর তাঁর বুকে তাহ বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন।” তঃক্ষনাঃ আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর আবু বাক্র তাঁকে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। এ সময় আবু কুহাফার মাথায় ‘সাগামা’ নামক সাদা এক ধরনের গুল্ম জড়ানো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাঁর চুল থেকে এটা সরিয়ে দাও।”

অতঃপর আবু বাক্র তাঁর বোনের হাত ধরলেন। বললেন, “আল্লাহর কসম, আমার বোনের জন্য আজ ইসলামই গলার হার?” এর জবাবে কেউ কিছু বললো না। আবু বাক্র বললেন, “হে আদরের বোন! তোমার হার হারিয়ে যাওয়াতে মনে কষ্ট নিও না।”

মক্কা বিজয় ও তায়েফের যুদ্ধে দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ মুহাজিরদের জন্য ‘বনু আবদুর রহমান’ খাযরাজ গোত্রের জন্য ‘বনু আবদুল্লাহ’ এবং আওসের ‘বনু উবাইদুল্লাহ’ সাংকেতিক নাম রেখেছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশের নির্দেশ দেন তখন মুকলিম অধিনায়কগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, “হামলা না চালানো হলে কারো সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না।” কেবল কয়েকজন লোকরে নাম উল্লেখ করে বলেন যে, “এর কা’বার গিলাফের মধ্যে লুকিয়ে থকালেও তাদেরকে হত্যা করবে।” এদের একজন বনু আমেরের আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ। এই ব্যক্তি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে ওহী লেখক হিসেবে নিয়োজিত হয়। তারপর পুনরায় ইসলাম ত্যাগ করে মুশরিকহয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে যায়। এ জন্য রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাত তাকে হত্যা করাা নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পালিয়ে তার দুধভাই উসমান ইবনে আফফানের কাছে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কলে। উসমান (রা) তাকে লুকিয়ে রাখেন। পরে মক্কার অবস্থ াস্বাভাবিক এবং জনগণ শান্ত হয়ে আসলে তিনি তাকে রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লেেমর নিকট হাজির করেন। উসমান (রা) তার প্রাণের নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম কোন জবাব না দিয়ে দীর্ঘ নীরবতা পালন করেন। অতঃপর বলেন “আচ্ছা।” পরে উসমান (রা) চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি চুপ ছিলাম যাতে তোমরা কেউ তাকে হত্যা করার সুযোগ পাও।” আনসারী সাহাবাদের একজন বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে একটু ইংগিত দিলে পারতেন।” তিনি বলরেন,  “কোন নবী ইংগীত দিয়ে মানুষ হত্যা করায় নসা।” [৮২.ইবনে হিশাম বলেন, এই ব্যক্তি পরে আবার ইসলাম গ্রহন করেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর খিলাফত আমলে তাকে সরকারী কাজে নিয়োজিত করেন। পরে তৃতীয় খলিফা উসমান (রা) তাঁকে সরকারী কাজের দায়িত্ব দেন।]

দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল বনু তামীম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল। তাকে হত্যার নির্দেশ প্রদানের কারণ ছিল, সে যখন মুসলমান ছিল তখন তাকে অপর এক ব্যক্তির সাথে যাকাত আদায় করতে পাঠানো হয়। তার সাথে একজন মুসলমান খাদেমও ছিল। পথিমধ্যে এক জায়গায় তারা যাত্রাবিরতি কলে। এই সময়ে সে ভৃত্যকে একটি ছাগল জবাই করে খাবার তৈরী করতে বলে। কিন্তু ভৃত্যটি খাবার তৈরী না করে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সে তাকে হত্যা করে ইসলাম ত্যাপ করে মুশরিক হয়ে যায়।

তার দ’জন দাসী ছিল। তারা রাসুলূল্লাহ সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক গান গাইত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে খাতালকে তার দুই দাসীসহ তহ্যার নির্দেশ দেন।

আর একজন হলো ‘হুয়াইরিস ইবনে সুকাইজ’। সে মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহকে উত্যক্ত করতো।

আর একজন মিকইয়াস ইবনে লুবাবা। একজন আনসারি সাহাবা ভুলক্রমে তার ভাইকে হত্যা করলে মিকইয়াস উক্ত আনসারীকে হত্যা করে। অতঃপর মুশরিক হয়ে কুরাইশদের কাছে চলে যায়। একজন্য তিনি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।

আর একজন হলো বনু আবদুল মুত্তালিবের আবাদকৃত দাসী  সারা। সেও মক্কায় অবস্থানকালে রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামকে উত্যক্ত করতো।

আর একজন আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা।

ইকরিমা ইয়ামানে পালিয়ে যায় এবং তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতে হারেস ইসলাম গ্রহণ করে। উম্মে হাকীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্াইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইকরিমার নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে নিরাপত্তা দেন। তখন সে ইকরিমাসে ইয়ামান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। পরে ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করে।

আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল ও মিকইয়াসকে হত্যা করা হয। তবে আবদুল্লাহর দাসীদ্বয়ের একজনকে হত্যা করা হয়। অপরজন পালিয়ে যায়। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। সারাকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে। আলী (রা) হয়াইরিসকে হত্যা করেন।

আবু তালিবের কন্যা উম্মে হনী (রা) বলেনঃ মক্কা বিজয়ের প্রক্কালে বনু মাথযুম গোত্রের আমার দুই দবের পালিয়ে এসে আমার কাছে আশ্রয় নেয়। উম্মে হানীয় স্বামী ছিল মাখযুম গোত্রের হুবাইয়া ইবনে আবু ওয়াহাব। উম্মে হনী বর্ণনা করেনঃ তারা আমার কাছে আসার সাথে সাথে আমার ভাই আলী ইবেন আবু তালিব (রা) আমার কাছে এসে বললেন “আমি ওদেরকে হত্যা করবো।” আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি তখন গোসল করছিলেন। গোসলের পাত্রে খামীর করা আটা লেগেছিল। ফাতিমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দিলেন। গোসল সম্পন্ন করে তিনি আট রাকাআত যুহার নামায পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোশ আমদেদ হে উম্মে হানী! তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো, আমিও তাকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছো আমিও তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। কাজেই আলী যেন তাদেরকে হত্যা না করে।”

সাফিয়া বিনতে শাইবা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং লোকজন শান্ত হলে তিনি সওয়ারীতে আরোহণ করে কা’বা শরীফে গিয়ে তাওয়াফ করলেন। এই সময় তিনি এক প্রান্ত বাঁকা একটি লাঠি দিয়ে ইশারা করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তওয়াফ শেষ করে তিনি উসমান ইবনে তালহাকে ডেকে তার নিকট থেকে কা’বার চাবি নিলেন। দরজা খুলে দেয় হলে তিনি কা’বার ভেতরে প্রবেশ করলৈন। সেখানে কাঠের তৈরী একটি কবুতরের মূর্তি দেখতে পেলেন। তিনি তা ভেঙ্গে ছুড়ে ফেললেন। অতঃপর তিনি কা’বার দরজার ওপর দন্ডায়মান হলেন। লোকেরা এ সময় তাঁর পক্ষ থেকে প্রাণের নিরাপত্তা লাভের নিমিত্তে সমজিদুল হারামে আশ্রয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল।]

ইবনে ইসহাক বলেন: আমি বিশ্বস্ত লোকদের নিকট শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার গরজার ওপর দাঁড়িয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ

“আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও লা-শরীক। তিনি তাঁর ওয়াদা পালন করেছেন, স্বীয় বান্দাকে বিজয়ী করেছেন এবং তিনি কাফিরদের সংগঠিত দলগুলোকে  পরাস্ত করেছেন। শুনে রাখ, অতীতের যে কোন রক্ত, সম্পদ বা অর্থের দাবী আমার এই পায়ের তলায় দলিত করলাম। (অর্থাৎ রহিত করলাম) তবে কা’বায় সেবা এবং হাজীদের আপ্যায়নের রীতি চালু থাকবে। শুনে রাখ, ভুলক্রমে হত্যা ইচ্ছাকৃত হত্যার কাছাকাছি। চাই তা লাঠি দ্বারা হোক কিংবা ছড়ি দ্বারা হোক। এর জন্য চল্লিশটা গাভীন উটসহ একশত উট দিয়াত দিতে হবে। হে কুরাইশরা তোমাদের জাহিলিয়াতের আভিজাত্য এবং পূর্বপুরুষদের নামে বড়াই করার প্রথা আল্লাহ রহিত করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদমের সন্তান এবং আতম মাটির তৈরী।” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলৈন,

“হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। শুধুমাত্র পরিচিতির সুবিধার জন্য তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠিতে বিভক্ত করেছি। আসলে তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু সে-ই আল্øাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানার্হ।” (হুজারাত) অতঃপর তিনি আরো বললেন, “হে কুরাইশগণ, তোমরা আমার কাছে কি ধরনের আচরণ প্রত্যাাশা কর?” সবাই বললো, “উত্তম আচরণ। কেননা তুমি আমাদের এক মহান ভ্রাতা এবং এক মহান ভ্রাতার পুত্র।”

তিনি বললেন, “যাও, তোমরা সকলে মুক্ত, স্বাধীন।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে বসলেন। তাঁর কাছে আলী ইবনে আবু তালিব এলন। তাঁর হাতে ছিল কা’বার চাবি। তিিন বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, হাজীদের আপ্যায়নের সাথে কা’বার দ্বার রক্ষকের দায়িত্বও আমাদের হাতে নিয়ে নিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উসমান ইবেন তালহা কোথায়?” উসমানকে ডাকা হলো। তিনি বললেন, “হে উসমান! এই নাও তোমার চাবি। আজকের দিন সৌজন্য ও সহৃদয়তা প্রদর্শনের দিন।”

ইবনে হিশাম বলেনঃ কিছুসংখ্যক জ্ঞানী রোকের নিকট থেকে আমি জানতে পেরেছি যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে ফিরিশতা ও অন্যান্য অনেক কিছুর প্রতিকৃতি দেখতে পেলেন। এমনকি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতিকৃতি দেখতে পেলৈন। তার হাতে রয়েছে ভালমন্দ নির্ধারণের তীর সমূহ। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর অভিশাপ হোক মুশরিকদের ওপর। আমাদের প্রবীনতম মুরব্বীকে ভালমন্দ নির্ধারনের তীর বানিয়ে ছেড়েছে। কোথায় ইবরাহীম আর কোথায় এসব?” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “ ইবরাহীম ইহুদীও ছিলেন না খৃষ্টানও না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। তিনি মুশরিকও ছিলেন না।”

অতঃপর ঐসব প্রতিকৃতি বিনষ্ট করার নির্দেশ দিলেন এবং তা বিনষ্ট করা হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলালকে (রা) সাথে নিয়ে কা’বার ভেতর প্রবেশ করেন। তাঁকে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। তখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আত্তাব ইবনে উসাইদ এবং হারেস ইবনে হিশাম কা’বার আঙিনায় উপবিষ্ট। আত্তাব ইবনে উসাইদ বললো, “ভাগ্যিস আল্লাহ (আমার পিতা) উসাইদকে সসম্মানে আগেভাগে সরিয়ে নিয়েছেন। তা না হলে আজ এই আযান শুনে সে এমন কিছু কথা বলে বসতো যা তার ক্রোধেরও উদ্রেক করতো।” হারেস ইবনে হিশাম বললো, “আমি যদি মনে করতাম সে (মুহাম্মাদ) হক পথে চলছে তাহলে আমি তার অনুসরণ করতাম।” আবু সুফিয়ান বরলো, “আমি কিছুই বলবো না। একটা কথাও যদি বলি তাহলে এই পাথরের টকরোগুলোও তা ফাঁস করে দেবে।”

এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে এলন। তিনি বললেন, “তোমরা যা বলাবলি করেছো আমি তা শুনেছি।” হারেস ও আত্তাব বললো, “আমরা সাকষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। আমাদের কাছে যারা ছিল তাদের কেউই তো এ কথা আপনাকে জানায়নি। কাজেই এ কথা আপনাকে জানানোর জন্য আমাদের কোন সঙ্গীকেই দোষারোপ করতে পারি না।” (তাই এটা নিশ্চয়ই আল্লাহ জানিয়েছেন এবং আল্লাহর রাসূল হলেই সেটা সম্ভব।)

ইবনে হিশাম বলেনঃ

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন স্বীয় সওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কায় প্রবেম করে সবার আগে কা’বা শরীফ তাওয়অফ কররৈন। তখনো কা’বার চারপাশে সীসা দিয়ে সংরক্ষিত মূর্তিসমূহ বিরাজ করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি ুদয়ে মূর্তিগুলোর দিকে ইংগিত করে বললেন, “সত্য এসেছে এবং বাতিল উৎখাত হয়েছে। বস্তুতঃ বাতিল উৎখাত হওয়ারই যোগ্য।” একথা বলে যে মূর্তিটার দিকেই তিনি ইশারা করতে লাগলেন, তা চিৎ বা উপুড় হয়ে যেতে লাগলো। এভাবে এক একে সবক’টা মূর্তিই ধরাশায়ী হলো।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র আমাকে জানিয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কা’বার তাওয়াফ করছিলেন তখন ফুজালা ইবেন উমাইর লাইসী তাকে হত্যা করার ফন্দি আঁটে। এই ফন্দি নিয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হলেই তিন বললেন, “কে,, ফুজালা নাকি” সে বললো “হাঁ।” হে আল্লাহর রাসূল।” তিনি বললেন, “তুমি মনে মনে কি ভাবছিলে?” সে বললো, “কিছুই না, আমি আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে বললেন, “আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর।” অতঃপর তার বুকের ওপর নিজের হাত রাখলেন। তাতে তার মন শান্ত হলো। পরবর্তীকালে ফুজালা বলতো, “রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মুহুর্তে আমার বুকের ওপর থেকে হাত তুলে নিলেন তখন থেকে পৃথিবীতে কোন জিনিস আমর কাছে তাঁর চাইতে প্রিয় বলে মনে হয়নি।”

ফুজালা আরো বলেনঃ এরপর আমি নিজ পরিবারের কাছে চললাম। যাওয়ার সময় এমন এক মহিলার কাছ দিয়ে গেলাম যার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে বললো, “এসো আমরা গল্প করি।” আমি বললাম,  ‘না।’

এ প্রসঙ্গে ফুজালা নিম্নরুপ কবিতা আবৃত্তি করেন,

“মহিলাটি আমাকে কথা বলতে ডাকলো। আমি বললাম, আল্লাহ ও ইসলাম তোমার আহ্বানে সাড়া দিতে নিষেধ করেন। তুমি যদি বিজয়ের দিন মুহাম্মাদ ও তাঁর বাহিনীকে  দেখতে - যেদিন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চ’র্ণবিচর্ণ করা হচ্ছিলো, তাহলে দেখতে যে, আল্লাহর দ্বীন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং শিরক অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।”

ইবনে ইসসাক বলেনঃ মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন কর্বমোট দশ হাকার মুসলমান। তম্মধ্যে বনু সুলাইম গোত্রের সাতশ মতান্তরে এক হাজার, বনু গিফার ও বনু আসলামের চার, মুফাইনার এক হাজার তিন জন, আর অবশিষ্ট সবাই কুরাইশ ও আনসার, তাদের মিত্র এবং তামীম, কাইস ও আদাস গোত্রত্রয় সহ আরব গোত্রসমূহের লোস।

মক্কা বিজয়ের দিন সম্পর্কে রচিত প্রসিদ্ধ কবিতা হলো হাসসান ইবনে সাবিত আনসারীর কবিতাঃ

“যাতুল আসাবি ও জিওয়া থেকে আযরা পর্যন্ত গোটা এলাকা উকাড় হয়ে গেছে। জিওয়ার ঘরবাড়ী বিরান হয়ে গেছে। বনু হাশহাশ গোত্রের এলাকা এখন উষর মরুভুমি। প্রবল বাতাস তার চি‎হ্ন মুছে দেয় এবং আকাশ সেখানে বারি বর্ষণ করে না। ইতির্পূবে সেখানে একজন ইপকারী বন্ধু ছিল, ঐ এলাকার শ্যামল বনানীতে উট মেষ চরে বেড়াতো। সেসব স্মৃতিচারণ এখন থাক। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, রাত গভীর হয়ে এল আমার ঘুম আসে না। এর কারন সেই আলুলায়িত কুন্তলা (এলোমেলো বিশৃঙখল অবস্থা) যা তাকে জাপটে ধরেছিল, ফলে তার মনের শান্তি ঘুঁচাবার উপায় নেই। যেন বাইতুব বা’সের গুপ্ত বস্তু মধু ও পানি তার সাথে মিশানো হতো। একদিন যখন পানীয় বস্তুসমূহের পর্যালোচনা হবে, তখন দেখা যাবে, ঐগুলো উৎকৃষ্ট সুপেয় বস্তু এবং উৎসর্গীকৃত। তাকে তিরষ্কারের অধিকার দেবো যদি আমরা তিরষ্কারযোগ্য কোন কাজ করি-চাই তা গালাগাল বা প্রহার পর্যন্ত গিয়ে পড়াক। আমরা সেই সব পানীয় পান করবো ফলে তাৎক্ষনিকভাবে আমরা রাজা বাদশাহে পরিণত হবো, পরিনত হবো সেই সিংহে- যা কোন কিচুর সম্মুখীন হতে ভয় পায় না। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, যা ধুলা উড়িয়ে ছোটে এবং যার গন্তব্য হলো কা’দা (মক্কার উচ্চভ’মি), জানি না তোমরা তা দেখেছো কিনা। যে বাহিনী লাগাম নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়  (কে আগে সওয়ার হবে সে জন্য) যা অতিশয় আগ্রহী এবং যার ষাড়ের ওপর রক্তপিপাসার বর্শা রয়েছে। আমাদের ঘোড়াগুলো অতি দ্রুতবেগে ছোটে। মহিলারা ওড়না গিয়েও তাকে হাঁকিয়ে নিতে পারে। তোমরা যদি আমাদের বাধা না দাও তা’হলে আমরা উমরা করবো- অবশ্য বিজয় অবধারিত হয়ে আছে এবং সমস্ত পর্দা ছিন্ন হয়ে গেছে। (অর্থাৎ বিজয়ের সুষ্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে) অন্যথায় ববিষ্যতের কোন যুদ্ধের জন্য অন্বেষা কর। আল্লাহর দূত জিবরীল আমাদের মধ্যে রয়েছেন। তিনি পরম পবিত্র আত্মা- যার সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহ বলেন যে, এমন এক বান্দাকে আমি পাঠিয়েছি যিনি বিপদ আপদে উকারী হক কথা বলে থাকেন। আমি তার কাযৃকলাপের সাক্ষী। তোমরা তাকে মেনে নাও। কিন্তু তোমরা  (হে মক্কাবাসী০ জবাব দিলে, আমরা তাকে মানবো না, মানবার কোন ইরাদা আমাদের নেই। আল্লাহ আরো বললেন, আমি আনসার বাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তাদের লক্ষ্য হলো যুদ্ধ। আমাদের কিছু না কিছু মুকাবিলা করতে হয়-কখনো গালাগলি, কখনো যুদ্ধ, কখনো তিরষ্কার। যারা তিরষ্কার বা গালাগালি করে তাদেরকে ছন্দায়িত বাষায় দাঁতভাঙ্গা জবাব দিই, আর যারা আমাদের রক্তপাতে লিপ্ত হয় তাদের ওপর আঘাত হানি। আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দাও (আমাদের মক্কায়) প্রবেশ আসন্ন। আর এটা ষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের তরবারী তোমাকে গোলাম বানিয়ে ছেড়েছে এবং আবদুদ দার গোত্রের সরদারদেরকে দাস বানিয়ে ছেড়েছে। তুমি মুহাম্মাদকে গালাগালি করেছো। আর আমি তার জবাব দিয়েছি এবং আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান রয়েছে। তুমি এক পরম কল্যানময় পরোপকারী ও একনিষ্ঠ সত্যপন্থী গালাগলি করেছো। যিনি আল্লাহর পরম বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পূর্ণ করা যার জীবন ব্রত। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলকে গালাগাল করে আর যে ব্যক্তি তাঁর প্রশংসা করে ও সাহায্য করে সে কি সমান হতে পারে? বস্তুত আমার পিতা, দাদা এবং আমার সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুহাম্মাদের সম্ভ্রমকে তোমাদের হাত থেকে রক্ষ করবো। আমার জিহ্বা অকাট্য এবং নির্দোষ। আমার সমুদ্রকে কোন বালতি দিয়ে কলুষিত করা সম্ভব নয়।”২৮২

 

হুনাইনের যুদ্ধ: ৮ম হিজরী

হাওয়াবিন গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা বিজয়ের কথা শুনে মালিক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। হাওয়াবিনের সাথে বনু সাকীফ, বনু নাসর, বনু জুশাম ও বনু স’দের সকলে ও বনু হিলালের স্বাল্পসংখ্যক লোকও সংঘবদ্ধ হলো। বনু সা’দ ও বনু হিলালের এই মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া বনু কায়েসের আর কেউ এই সেনা সমাবেশে অংশগ্রহন করেনি।

বনু জাশাম গোত্রে দুরাইদ ইবনে সাম্মা একজন প্রবীণ লোক ছিল। সে যুদ্ধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিল। যুদ্ধের পরামর্শ দেয়া ছাড়া তার আর কোন কিছু করার ছিল না। বনু সাকীফের দু’জন সরদার ছিল। তাদের মিত্রদের মধ্যে ছিল কারেব ইবনে আসওয়অদ আর বনু মালিকের ছিল যুলখিমার সুবাই ইবনে হারেস এবং তার ভাই আহমার ইবনে হারেস। তবে মালিক ইবনে আওফ নাসারী ছিল গোটা বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক। মালিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে তার বাহিনীর লোকদের প্র্রত্যেকে নিজ নিজ স্ত্রী সন্তান ও অস্থাবর সম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে বাধ্য করলো। আমতাস উপত্যকায় পৌছলে তার কাছে দুরাইদ ইবনে সাম্মা সহ বিপুল জনতা সমবেত হলো। দুরাইদ আওতাস ইপত্যকায় পৌছে তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কোন জায় গা?” সবাই বললো, ‘আওতাস’। সে বললো, ‘হ্যা, এটা যুদ্ধের উপযুক্ত জায়গা বটে। বেশী উচুও না প্রস্তরময়ও না, আবার খুব বেশী নরমও না। তবে উট, ছাগল ও গাধার ডাক, আর শিশুদের কান্নাকাটি শুনতে পাচ্ছি কেন?” সবাই বললো, “মালিক ইবনে আওফ তার বাহিনীর লোকদের সাথে তাদের ধনসম্পদ ও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে।” সে বললো, “মালিক কোথায়?” মালিককে ডেকে আনা হলো। দুরাইদ বললো, “ওহে মালিক, তুমি নিজ গোত্রের পরিচালক ও নেতা। আজকের দিনের পরেও কত দিন আসবে তার শেষ নেই। এখানে উট, গাধা ও ছাগলের ডাক ও শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কেন?” মালিক বললো, “আমি লোকজনের সাথে তাদের পরিবার পরিজন ও সহায়-সম্পদও নিয়ে এসেছি।” দুরাইদ বললো, ‘কেন?’ মালিক বললো, “প্রত্যেকের পেছনে তার পরিবার পরিজন ও সহায় সম্পদ থাকবে এবং তাদেরকে রক্ষা করারা জন্য সে প্রাণপণে লড়াই করবে। রণাঙ্গন ছেড়ে কেউ পালবে না।” দুরাইদ মালিকের যুক্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো, “আসলে তুমি দেখছি মেষ পালকের মতই (বুদ্ধি রাখ, সেনানায়কের মত নয়)। যে পরাজিত হয়, তার কি আর কোন কিছুতে লাভ হয়? যুদ্ধে যদি পরাজয় ঘটে তাহলে নিজের বিপর্যয়ের সাথে সাথে নিজের পরিবার পরিজন এবং ধন সম্পদও গোল্লায় যাবে।”

দুরাইদ পুনরায় বললো, “বনু কাব ও বনও কিলাবের খবর কি?” মালিক বললো, “তাদের কেউ যুদ্ধে আসেনি।” দুরাইদ বললো, ‘তাহলে তো আসল লড়াকু বীর সিপাহীরাই আসেনি। আজ যদি সত্যিকার বিজয় ও পৌরব লাভের সুযোগ থাকতো তাহলে বনু কাব ও কিলাব অবশ্যই আসতো। আমার মনে হয়, বনু কাব ও কিলাব যেটা করেছে, তোমাদের তা অনুসরণ করা উচিত ছিল। আচ্ছা তোমাদের সাথে উল্লেখযোগ্য যোদ্ধাাদের কে কে এসেছে?” লোকেরা  বললো “আমর ইবনে আমের ও আওফ ইবনে আমের।” দুরাইদ বললো, “ওরা দুর্বল যোদ্ধা, ওদের দিয়ে কোন লাভও হবে না, ক্ষতিও হবে না। হে মালিক শোন, হাওয়াযিন গোত্রকে শত্রুর মুখে নিক্ষেপ করে তুমি কোন ভাল কাজ করনি। তাদেরকে তাদের নিজ নিজ নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দাও। তারপর এই মুসলমানদের সাথে তোমার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে লাড়াই কর। তুমি যদি জয়লাভ কর তাহলে পরে এস তারা তোমার সাথে যোগ দেবে। আর যদি হেরে যাও তাহলে অন্ততঃ তোমার লোকদের পরিবার পরিজন ও ধনসম্পদ রক্ষা পাবে।” মালিক বললো, “না এটা আমি করবো না। তুমি নিজে যেমন বুড়ো হয়েছ, তোমার বুদ্ধিও তেমনি জরা ব্যধিগ্রস্ত হয়েছে। হে হাওয়াযিন জনতা, তোমারা হয় আমার আনুগত্য করবে নতুবা আমি এই তরবারী নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে একাই লড়ে যাবো।” আসলে দুরাইদের কথা মত কাজ করে তার খ্যাতি বা তার বুদ্ধিমত্তার সুনাম হোক এটা মালিকের মনঃপুত ছিল না। সমবেত যোদ্ধারা মালিকের আনুগত্য করার অঙ্গীকার করলো। দুরাইদ বললো, “আমি আজকের এ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজী নই।” সে কবিতার ছন্দে বললোঃ

“হায়! আমি যদি এ যুদ্ধের সময় তরুণ থাকতাম

তাহলে হরেক রকমের রণকৌশল দেখাতাম। বিরাটকায়

পাহাড়ী ছাগল সদৃশ লম্বা চুলওয়ালা বাহিনী পরিচালনা করতাম।”

অতঃপর মালিক বললো, “মুসলিম বাহিনীকে দেখা মাত্রই তরবারী খাপমুক্ত করে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

হাওয়াযিনের এই রণপ্রস্তুতির কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাদরাদ আসলামীকে কৌশলে তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পাঠালেন। আবদুল্লাহ তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাওয়াযিনের মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সময় তাঁকে জানানো হলো যে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছে অনেক অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম রয়েছে। সাফওয়ান তখনও মুশরিক। তার কাছে লোক পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদি ধার চাইলেন শত্রর সাথে লড়াই করার জন্য। সাফওয়অন জিজ্ঞেস করলো, “মুহাম্মাদ, তুমি এগুলো কেড়ে নিচ্ছো নাকি?” রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, ধার নিচ্ছি এবং গ্যারান্টি দিচ্ছি যে,, এগুলো তোমাকে ফেরত দেয়া হবে।” সে বললো, “আমার আপত্তি নেই।” অতঃপর সে একশট বর্ম ও তার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্র ধার দিল। কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাকে ঐসব অস্ত্র পরিবহণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানান এবং সে যথাযথভাবে তারও ব্যবস্থা করে।

পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের মধ্য থেকে দুই হাজার এবং মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর সাথে মদীনা থেকে আগত দশ হাজার সাহাবীসহ মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হলেন। এই সময় অবশিষ্ট মক্কাবাসীর জন্য তিনি আত্তাব ইবনে উসাইদকে মক্কার শাসক নিযুক্ত করেন এবং নিজে সসৈন্যে হাওয়াযিনের মুকাবিলায় অগ্রসর হন।

হারেস ইবনে মালিক থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইন অভিযানে বের হলাম। আমরা সবেমাত্র জাহিলিয়াত থেকে মুক্ত হয়েছি এবং জাহিলিয়াতের রসম রেওাজকে তখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। যাতু আনওয়াত নামক একটা বিরাটকায় সবুজ পতেজ গাছ ছিল। কুরাইশ কাফিরগণ এবং অন্যান্য আরবরা প্রতিবছর ঐ গাছের কাছে আসতো, গাছের ডালে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রেখে একদিন তার ছায়ায় অবস্থান করতো এবং সেখানে জন্তু জবাই করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইেিন যাওয়অর পথে একটা বড় গাছ দেখে আমরা বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! কাফিরদের যেমন যাতু আনওয়াত আছে, তেমনি আমাদেরও একটা যাতু আনওয়াত গ্রহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবর, মূসার (আ) জাতি তাঁকে যেমন বলেছিল, কাফিরদের যেমন দেবদেবী আছে আমাদের জন্যও তেমনি একজন দেবতা গ্রহণ করুন,-তোমাদের এ উক্তিটাও তেমনি। এগুলো পুরনো প্রথা। তোমরা প্রচীন প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছো।”

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমরা হুনাইন প্রান্তরের কাছাকাছি এলাম,, এবং তিহামার একটি প্রশস্ত পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে নেমে চলতে লাগলাম। তখনো ভোরের আলো দেখা দেয়নি। শত্রু সেনারা আমাদের আগেই ঐ উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং সংকীর্ন দুর্গম গিরিগুহায় ও তার আশেপাশে লুকিয়ে আমাদের জন্য ওত পেতে ছিল। তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। আমরা সম্পূন্য নিঃশংকচিত্তে গিরিপথ দিয়ে নেমে চলেছি- এই সময় হঠাৎ তারা একযোগে আমাদের ওপর প্রচন্ড হামলা চালালো। হামলার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে আমাদের লোকেরা যে যেদিকে পারলো উঠিপড়ি করে ছুটে পালাতে লাগলো এবং একজন আর একজনের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। কারো দিকে কারো বিন্দুমাত্র লক্ষ্য করার যেন ফুরসত নেই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান দিকে সরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “হে সৈনিকরা! তোমরা কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে এসো। আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। কিসের জন্য উটের ওপর উপ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে?” কিন্তু স্বল্পসংখ্যক মুহাজির, আনসার ও পরিবারভুক্ত লোক ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে কেউ থাকলো না। সবাই চলে গেল।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ মুসলিম বাহিনীর লোকেরা নণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের কাছে অবস্থানকারী মক্কার কিছু পাষন্ড প্রকৃতির লোক পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে নানা রকম কথাবার্তা চলতে লাগলো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব বললো, “সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত গেলেও এদের পরাজয় শেষ হবে না।” লটারী, ভাগ্য গণণা ও জুয়া খেলার কাজে ব্যবহার্য তীর তখনো আবু সুফিয়ানের কাছেই ছিল।

জাবালা ইবনে হাম্বল চিৎকার করে বললো, আজ মুহাম্মাদের যাদুর ক্ষমতা শেষ হলো।” শাইবা উসমান বললো, “ঐ দিন আমি স্থির করলাম যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করে কুরাইশদের সমস্ত খুনের বদলা নেব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি যেই রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হয়েছি, অমনি কি একটা ভয়ংকর বন্তু আমার সামনে এসে আড় হয়ে দাঁড়ালো, তা আমার মনকে আছন্ন করে ফেললো এবং তাকে হত্যা করতে পারলাম না। আমি উপলদ্ধি করতে পারলাম যে, তাঁকে আঘাত করা আমার সাধ্যাতীত।”

মক্কাবাসীদের একজন আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের পথে মক্কা ত্যাপ করার পরপরই আল্লাহর সৈনিকদের বিপুল সংখ্যা দেখে তিনি বলেছিলন, “আজকে আর যাই হোক, সংখ্যা স্বল্পতার কারণে আমরা পরজায় বরণ করবো না।”

আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর সাদা খচ্চরটির লাগাম ধরে বলেছিলাম। আমি খুব মোটাসোটা ও বুলন্দ কণ্ঠের অধিকারী ছিলাম। ভীতসন্ত্রত হয়ে মুসলিম সৈনিকদের উর্ধশ্বাসে ছুটতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে লোকেরা, আমি তোমাদেরকে কারো প্রতি ফিরে তাকাতে দেখছি না!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “আব্বাস! চিৎকার করে এভাবে যাক দাওঃ হে আনসারগণ! ওহে বাবুল বৃক্ষের নীচে অংগীকারদাতাগণ!”

আমি আদেশ অনুসারে ডাকতে লাগলে প্রত্যেকে লাব্বায়েক বলে সাড়া দিতে লাগলো। এই সময় অশ্বারোহী সাহাবীদের কেউ কেউ ছুটন্ত ও পলায়নরত উটের গতি ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে বর্ম দিয়ে তার ষ্কন্ধে আঘাত করেন। তাতেও ফিরতে না পেরে অস্ত্র িেনয়ে উট থেকে নেমে আসেন এবং উচকে ছেড়ে দেন। অতঃপর যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে এগিয়ে যান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট পৌছে যান। এভাবে একশ জনের মত সাহাবী জমায়েত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলেন।

প্রথমে “হে আনসারগণ” বলে ডাকা হতে থাকে। পরে শুধু “হে খাযরাজ” বলে ডাকা শুরু হয়। কেননা খাবরাজ রণাঙ্গনে দৃঢ়চিত্ত বলে আরবদের কাছে সুপরিচিত ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাযরাজের বহিনী নিয়ে এগুতে থাকেন। তারপর রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, প্রচন্ড সংঘর্ষ চলছে। তা দেখে বললেন,“এবার রণাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।”

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ

হাওয়াবিন গোত্রীয় সেনাপতি উটের ওপর সওয়ার হয়ে লাড়াই করছিল। এই সময় আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও জনৈক আনসার তার দিকে ধেয়ে গেলেন এবং তার উটের পায়ে আঘাত করলেন। উট পিছনে ভর করে বসে পড়লো। তখন আনসারী সেনাপতিকে আঘাত হাঁটুর নীচ থেকে তার পা কেটে ফেললেন। সে তৎক্ষনাৎ নীচে পড়ে গেল। এই সময় যুদ্ধ অভংকর রুপ ধারণ করলো এবং এর গতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মুসলমানগণ পরাজয়ের অবস্থা থেকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে সারিবদ্ধ যুদ্ধবন্দী না আসা পর্যন্ত তা শেষ হলো না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ারন ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তলিবের দিকে তাকালেন। তিনি সেদিন অথ্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম দেখলেন, তিনি তার খচ্চরের লাগাম ধরে রেখেছেন। তা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে?” তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার ভাই।”

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রান্তরের এক দিকে উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহানকে তার স্বামী আবু তালহার সাথে দেখাতে পেলেন। তিনি কোমর পেট একটা চাদর দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন। পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহা তখন তাঁর গর্তে। আবু তালহা উট তাঁর সাথে রয়েছে এবং উট ছুটে যাবে এই ভয়ে তার নাকের চুলের রশি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উম্মে সুলাইম নাকি?” তিনি বললেন, “হ্যা”, হে আল্লাহর রাসুল, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি যেভাবে হামলাকারী শত্রুদেরকে হত্যা করছেন সেভাবে যারা আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় তাদেরকেও হত্যা করুন। কেননা তারা হত্যার যোগ্য।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,, “হে উম্মে সুলাইম। এ জন্য কি আল্লাহই যথেষ্ট নন?” তখন উম্মে সুলাইামের কাছে একটা খনজর ছিল। আবু তালহা বললেন, “হে উম্মে সুলাইম, খনজর কি জন্য।” উম্মে সুলাইম বললেন, “এটা রেখেছি এ জন্য যে, কোন মুশরিক আমার দিকে এগিয়ে আসতে দুঃসাহস দেখাে ল এ দ্বারা তার পেট ফেড়ে ফেলবো।” আবু তালহা বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, চোখের ব্যধি নিয়েও উম্মে সুলাইম কি বলছে শুনেছেন?”

আবু কাতাদাহ (রা) বর্ণনা করেনঃ হুনাইন যুদ্ধের দিন আমি দেখলাম একজন মুশরিক ও একজন মুসলমান পরস্পরের সাথে যুঝছে। এই সময় আর একজন মুশরিক ঐ মুশরিককে সাহায়ের জন্য এগিয়ে এল। তখন আমি তার পওর আক্রমণ চালিয়ে তরবারীর আঘাতে তার হাত কেটে ফেললাম। আর হাত দিয়ে সে আমাকে জাপ্টে ধরলো। সে আমাকে কিছুতেই ছাড়ছিলো না বরং মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই সে অধিক রক্তপাতে দুর্বল হয়ে না পড়লে আমাকে সে মেরেই ফেলতো। সে পড়ে গেলে আমি তাকে হত্যা করলাম। অতঃপর চারদিকে যে যুদ্ধ চলছিল সেজন্য তার দিকে আমি আর ভ্রুক্ষেপ করতে পারিনি। এই সময় জনৈক মক্কাবাসী এস তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করবে তার যাবতীয় জিনিস হত্যাকারী পাবে।” আমি বললাম, “ইয় রাসূলাল্লাহ, আমি একজনকে হত্যা করেছি। তার অনেক জিনিসপত্র ছিল। পরে যুদ্ধের প্রচন্ডতায় আমি আর তার দিকে লক্ষ্য করতে পারিনি। তার জিনিষপত্র  কে নিয়েছে জানি না।” মক্কাবাসী একজন বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আবু কাতাদার কথা সত্য। ঐ নিহত ব্যিক্তির যাবতীয় জিনিসপত্র আমার কাছে রয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে ওকে আমার সাথে আপোষ করিয়ে দিন।” আবু বাক্র সিদ্দিক (রা) বললেন, “আল্লাহর কসম এ জিনিসপত্রের ব্যাপারে আপোষ বলবে না। তুমি আল্লাহর এক সিংহের কাছে মতলব স্দি করতে এসেছ- যে আল্লাহর দঈনের জন্য লাগাই করে? আর তুমি কিনা তার যুদ্ধলদ্ধ জিনিসে ভাগ বসাতে চাও?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবু বাক্র ঠিকই বলেছে। তুমি আবু কাতাদাকে জিনিসগুলো ফিরিয়ে দাও।”

আবু কাতাদাহ বলেনঃ অতৎপর আমি ঐ সব জিনিসপত্র সেই মক্কাবাসী লোকটির কাছ থেকে আদায় করে বিক্রি করলাম। আর তার মূল্য দিয়ে ছোট একটা খেজুরের বাগান নিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনে আমার মালিকানাভুক্ত প্রথম সম্পদ।

ইবনে ইসহাক বলেন: হাওয়াযিনরা পরাজিত হওয়ার পর হিসাব নিয়ে দেখতে পেল যে, সাকীফের বনু মালিক গোত্রেরই সবাদিক প্রানহানি ঘটেছে। এ গোত্রের সত্তর জন লোক যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রাবীয়া ইবনে হারেস ইবনে হাবীব। এ গোত্রের সেনাপতি ছিল যুলখিমাল। সে নিতহ হলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ সেনাপতি হয় এবং সেও নিহত এয়। এ যুদ্ধে মুশরিকদের শোচনীয় পরাজয় ঘটার পর তারা মালিক ইবনে আওফ সহ তায়েফ চলে যায়। এদের কিছু সৈন্য আওতাসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে থাকে। আর কিছু সংখ্যক নাখলার দিকে চলে যায়। নাখলার দিকে যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে সাকীফের বনু গিয়ারা উপগোত্র ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো না। মুশরিক বাহিনীর যে অংশটি আওতাসের দিকে যায় তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আমের আশয়ারীকে পাঠান। সেখানে তিনি কিচুয পরাজিত সৈন্যকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেন।

একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে আবু আমের আশয়ারী শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর তাঁর চাচাতো ভাই আবু মূসা আশয়ারী সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় লাভ করেন এবং মুশরিকরা পরাজিত হয়।

পরাজয়ের মুখে মালিক ইবনে আওফ স্বগোত্রীয় একদল অশ্বারোহী নিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় অবস্থান করেন। তাদেরকে তিনি বলেন, “দুর্বল লোকেরা চলে যাক। অতঃপর শক্তিশালী লোকেরা আসবে। ততক্ষণ তোমরা এখানে অপেক্ষা কর।” দুর্বল পরাজিত সৈন্যরা চলে যাওয়া পর্যন্ত সে সেখানে অবস্থান করলো।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেন। তার লাশের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপুল লোক সমাগম দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এখানে কি হয়েছে?” সকলে বললো, “খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক সহচরকে বললেন, “খালিদের সাথে গিয়ে দেখা কর এবং বল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে শিশু, মহিলা, অথবা দিন মজুর ও দাস দাসীকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন বলেছিলেন, “বনু সা’দ ইবনে বকরের বিজাদকে যদি পাও তবে তাকে পালাতে দিও না।” সে একটা বড় অপরাধ করেছিল। মুসলমানগণ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন এবং তাকে সপরিবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধবোন শায়মা বিনতে হারেসকেও নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে তার সাথে কিছু রূঢ় ব্যবহার করা হয়। তখন সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার দুধবোন।” তিনি বললেন, “তার প্রমাণ কি?” সে বললো, “যখন আমি আপনাকে আমার উরুর ওপর তুলেছিলাম তখন আপনি  আমার পিঠে কামড় দিয়েছিলেন। সেই চি‎হ্ন টি এখনো আছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামড়ের চি‎হ্নটি দেখে চিনতে পারলেন। তিনি নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে সসম্মানে বসতে দিলেন এবং বললেন, তুমি যদি আমার কাছে থাকা পছন্দ কর তাহলে সসম্মানে থাকতে পার। আর যদি পছন্দ কর যে, তোমাকে কিছু উপঢৌকন দিই এবং তুমি নিজ গোত্রে ফিরে যাবে তাহলে তাও করতে পার।” সে বললো, “আমাকে যা দিতে চান দিয়ে আমার গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনেক কিছু দিয়ে তার কওমের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বনু সাদের বর্ণনা অনুসারে তিনি তাকে মাকস্থল নামক একটি দাস এবং তার একটি দাসী উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলেন। শায়মা পরে ঐ দাসদাসীকে পরস্পরে সাথে বিয়ে দেন এবং তাদের বংশধারা বহুদিন পযন্ত তাদের মধ্যে চলতে থাকে।

ইবনে হিশাম বলেনঃ

আল্লাহ তায়ালা হুনাইন যুদ্ধ সম্পর্কে এ আয়াত কয়টি নাযিল করেন,

“আল্লাহ তোমাদেরকে অনেকগুলো রণাঙ্গনে সাহায্য করেছেন। হুনাইনের যুদ্ধের দিনেও করেছেন-যখন তোমরা নিজ সংখ্যাধিক্যের কারণে গর্বিত হয়েছিলে। কিন্তু সে সাংখ্যাধিক্যে তোমাদের কোন লাভ হয়নি। সেদিন বিশাল পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং তোমরা পালিয়েছিলে। তারপর আল্লাহ শান্তি ও স্বস্তি আনেন তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের প্রতি। আর তার এমন বাহিনী পাঠান যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ কাফিরদেরকে এভাবে শাস্তি দেন। বস্তুত: কাফিরদের সমুচিত শাস্তি এটাই।” (আত্ তাওবাহ)

ইবনে ইসহাক বলেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হুনাইনের সমস্ত যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধলব্ধ অর্থ এনে রাখা হয়। মাসউদ ইবনে আমও গিফারীকে গণীমত তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে গনীমত ও যুদ্ধবন্দীদেরকে জি’রানা নামক স্থানে রাখা হয়।

তায়েফ যুদ্ধ: ৮ম হিজরী সন

বনু সাকীফের পরাজিত বাহিনী তায়েফে গিয়ে নগরীর দ্বার রুদ্ধ করে দেয় এবং পুনরায় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। উরওয়া ইবনে মাসউদ ও গাইলান ইবনে সালামা হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে অংশ নেননি। তারা জুরাশে ট্যাংক, কামান ও দবুর জাতীয় যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।

হুনাইনের বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরুলেন। এই অভিযান সম্পর্কে কা’ব ইবনে মালিক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তার অর্থ হলো- “তিহামা ও খাইবার থেকে আমরা সকল সংশয় দূর করে তরবারীকে বিশ্রাম দিয়েছিলাম। তরবারীগুলোকে আমরা দাওস অথবা সাকীফের যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছিলাম। আর সেসব তরবারী যদি কতা বলতো তবে চূড়ান্ত কথাই বলমো। সে তরবারী যদি তোমরা তোমাদের বাসস্থানের আঙ্গিনায় দেখতে না পাও, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের কেউ  (তোমাদেরকে) রক্ষা করতে চাইলেও তার প্রতি আমি মোটেই  বন্ধুভাবাপন্ন হয়ো না। আমরা  (তোমাদের) ঘরের ছাদগুলোকে ভেঙ্গে ওয়াজ্জের প্রান্তরে নিয়ে যাবো। ফলে তোমাদের ঘরবাড়ী বিরান হয়ে যাবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে নাখলা ইয়ামনিয়াতে, তারপর কাব্নে, তারপর মুলাইহে, তারপর সেখান থেকে লিয়া এলাকার বুহরাতুর রুগাতে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়ে তাতে নামায পড়লেন। এরপর দাইকা নামক রাস্তা দিয়ে নাখাবে গিয়ে বনু সাকীফের এক ব্যক্তির জমির কাছে ‘ছাদেরা’ নামক কুল গাছের নীচে যাত্রাবিরতি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই লোকটির চরমপত্র দিলেন যে, “এই জায়গা খালি করে দিয়ে সরে যাও, নচেৎ আমরা তোমার দেয়াল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবো।” লোকটি বেরিয়ে যেতে অস্বীকার করলে তিনি তার দেয়াল ভেঙ্গে দিলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার যাত্রা শুরু করলেন। তায়েফের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করে সৈন্যদের নিয়ে তাতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এইখানে কতিপয় সাহাবী তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের সৈন্যরা তায়েফের দেয়ালের পাশেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই নগরের ভেতর থেকে তায়েফবাসীদের নিক্ষিপ্ত তীর তাঁদের ওপর এসে পড়েছিল। তায়েফবাসীরা শহরের দরজা এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে, মুসলমানগণ তার ভেতরে ঢুকতে পারলো না। তীরবিদ্ধ হয়ে কতিপয় সাহাবী শাহাদত বরণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা বাহিনীকে নিয়ে নগরীর সেই স্থানে স্থাপন করলেন যেখানে আজ তায়েফের সমজিদ অবস্থিত। তিনি তায়েফবাসীকে অবরোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভিযানে উম্মে সালামা (রা) সহ দুজন স্ত্রী সহগামিনী হয়েছিলেন। তাঁদের জন্য তিনি গম্বুজ আকৃতির দু’টি ঘর নির্মাণ করে দিলেন। সেই ঘরের মাঝে তিনি নামায আদায় করেন। অতঃপর তিনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। বনু সাকীফ ইসলাম গ্রহণ করলে আমর ইবনে উমাইয়া (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায পড়ার জায়গাফ মসজিদ তৈরী করেন। এই মর্মে জনশ্রুতি আছে যে, ঐ মসজিদে একটি যোদ্¦া দল থাকতো। প্রতিদিনই তাদের রণহুংকার ও তর্জন গর্জন শোনা যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীকে অবরোধ করে তীর ধনুক দ্বারা তুমুল যুদ্ধ করলেন। [৮৩. ইবনে হিশাম বলেছেন,, এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামান ব্যবহার করেন। তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে তিনি যে কামান ব্যবহার করেন সেটাই ইসলামের প্রথম কামান।]

তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য যে দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছিল সে দিন সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী একটি ট্যাংকের নীচে ঢুকলেন, অতঃপর তা নিয়ে তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সংঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হলেন। বনু সাকীফ গোত্রের লোকরা তাদের ওপর আগুনে পোড়ানো লোহার শেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। এতে সাহাবীগণ ট্যাংকের নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। আর যিনিই বের হন তিনিই সাকীফের তীরে বিদ্ধ হন। এভাবে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান শহীদ হন। এই পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাকীফের বাগান কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ তা কেটে ফেলতে শুরু করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সাকীফের অবরোধ চলাকলে একদিন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) কে বললেন, “হে আবু বাক্র, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে এক পেয়ালা ঘি উপহার দেয়া হয়েছে। একটা মোরগ এসে ঠোকরাতে ঠোকরাতে পেয়ালার ঘি টুকু ফেলে দিল।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আমার মনে হয়, আজ আপনি বনু সাকীফকে পরাজিত করতে পারবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার ধারণাও তাই।”

একদিন উসমান ইবনে মাযউনের স্ত্রী খুয়াইলা বিনতে হাকীম (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ যদি আপনাকে তায়েফবাসীর ওপর বিজয় দান করেন তাহলে বনু সাকীফের সবচেয়ে অলংকার সাজ্জিতা মহিলা বাদিয়া বিনতে গীলান অথবা ফারেগা বিনতে আকীলের অলংকার আমাকে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “আমাকে যদি বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি না দেওয়া হয় তা হলেও?” খুয়াইলা একথা শুনে চলে গেলেন এবং উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) কথাটা জানালেন। উমার (রা) তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, খুয়াইলা যে কথা আমাকে জানালো তা কি আপনি বলেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হ্যা’। উমার (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি কি আপনি পাননি?” তিনি বললেন, ‘না।’ উমার বললেন, “তাহলে কি আমি এখন মুসলমানদেরকে এ স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হাঁ।’ উমার (রা) তখন মুসরিম বাহিনীকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। যাত্রা শুরু হলে সাঈদ ইবনে উবাইদ আওরাজ দিলেন, “বনু সাকীফ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেলো।” উয়াইনা ইবনে হিসন বললেন, “হাঁ, আপন মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে (রয়ে গেলা)।” জনৈক সাহাবী বললেন, “হে উয়াইনা! মুশরিকরা আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করলো আর তমি তাদের প্রশংসা করছো? অথচ তুমি এসছো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে লড়াই করতে। ধিক্ তোমাকে।” তিনি বললেন, “আসলে আমি তোমদের পক্ষে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো সে জন্য আসিনি। আমি এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, মুহাম্মাদ তায়েফ জয় করলে আমি বনু সাকীফের একটা মেয়েকে হস্তগত করবো যাতে সেই মেয়রে গর্ভে আমার একটা পুত্র জন্ম নেয়। কারণ বনু সাকীফ অত্যন্ত তীক্ষè মেধার অধিকারী।”

অবরোধ চলাকালে তায়েফের কিছু সংখ্যক দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট আসে এবং ইসলাম গ্রহণ কলে। তিনি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন। পরবর্তী সময়ে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের কেউ কেউ ঐ দাসদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করে। আবেদনকারীদের মধ্যে হারেস ইবনে কালদা চিলেন অন্যতম। তিনি তাদের ‘না’ সূচক জবাব দেন এবং বলেন, “ওরা আল্লাহর মুক্ত বান্দা। ওদেরকে আবার আমি দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে পারি না।”

মোট বারোজন সাহাবী তায়েফে শাহাদাত বরণ করেন। তন্মধ্যে সাতজন কুরাইশ, চারজন আনসার এবং একজন বনু লাইস গোত্রের।

যুদ্ধ ও অবরোধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ ত্যাগ করলে বুজাইর ইবনে যুহাইর তায়েফ ও হুনাইনের বর্ণনা দিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যার মর্ম হলো-

“হুনাইনের প্রান্তরে সমবেত হওয়ার দিনে, আওতাসে সমবেত হওয়ার প্রভাত কালে এবং বিদ্যুত চমকানের দিন  শেষেক্তটি সম্ভবতঃ তায়েফ) তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। প্রতারণার মাধ্যমে হাওয়াযিন তার জনতাকে সমবেত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নীড়ভ্রষ্ট শতধঅ বিভক্ত পাখীর মত হলো। আমাদের কোন অবস্থান গ্রহণকেই তারা বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। পেরেছে শুধু তাদের প্রাচীর ও খন্দকের ভেতরটা ঠেকিয়ে রাখতে। তায়েফবাসী যাতে বেরিয়ে আসে সেজন্য চেষ্ট করলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ করে তারা তাদের ঘরে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকলো। তারা অনুতপ্ত হয়ে একদিন ফিরে যাবে সেই বিশালকায় বাহিনীর কাছে- যে বাহিনী মৃত্যুর দীপ্ত গৌরবে উদ্ভাসিত-যে বাহিনীর সমাবেশে সবুজ আভা পরিস্ফুট। (নাজাদের) হাযান পর্বতে যদি তাকে চালিত করা হয় তবে সে পর্বত নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যাবে। বনের সিংহরা কাঁটাযুক্ত ঘাসের ওপর দিয়ে যেভাবে চলে আমরা সেইভাবে চলি। যেন আমরা দ্রুতগামী ঘোড়া, যা চলার পথে কখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আবার মিলিত হয়। সব রকমের যুদ্ধবর্মই আমরা পরে থাকি। এসব বর্মই আমাদের দুর্গের কাজ করে- যেমন অগভীর কুয়ার ভেতরে পুঞ্জিভূত বাতাস বেরিয়ে গেলে তা দুর্গের মত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্মগুলো এত দীর্ঘ যে তা আমাদের জুতা স্পর্শ করে এবং তা দাউদ (আ) এবং হীরার বাদশাহ আমর ইবনে হিন্দের তৈরী বর্মের মত সুনির্মিত।”

হাওয়াযিনের জমিজমা

যুদ্ধবন্দী, তাদের কিছুসংখ্যক লোককে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য উপঢৌকন দান এবং কিচু লোককে পুরস্কার প্রদানের বিবরণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ হাওয়াযিনের বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে সাথে নিয়ে তায়েফ থেকে জিরনাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। ইতিপূর্বে সাকীফের অবরোধ ত্যাগ করে তাদের থেকে চলে যাওয়ার সময় একজন সাহাবী তাঁতে বনু সাকীফের বজন্য বদদোয়া করতে বলেন। জবাবে তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! সাকীফকে হিদায়াত দান কর ও আমার কাছে হাজির কর।”

হাওয়াযিনের একটি প্রতিনিধদল জিরানাতে এসে তাঁর সাথে দেখা করলো। তকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হাওয়াযিনের গোত্রের ছয় হাজার শিশু ও নালি যুদ্ধবন্দী ছিল। আর উচ ও বকরীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। প্রতিনিধিরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও আত্মীয়-স্বজন। আমাদের ওপর কি ভয়াবহ বিপদ আপতিত তা আপনার অজানা নেই। অতএবআমাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করুন। আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।”

হাওয়যিনের এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। তার অব্যবহিত পর বনু সা’দ ইবনে বকরের এর একজন উঠে দাঁড়ালো। এ ব্যক্তি হলো যুহাইর ওরফে আবু সুরাদ। সে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, যুদ্ধবন্দীদের ভেতর আপনার ফুফু, খালা ও আপনার লালন-পালনকারিণীরাই রয়েছে। [৮৪. লালন পালনকারিণী বলতে দুগ্ধ-দাত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের দুধমাতা হালিমা এই বনু সা’দ গোত্রেরই মহিলা ছিলেন এবং তা হাওয়াযিনেরই একটি শাখা।] আমরা যদি হারেস ইবনে আবু শিমার অথবা নুমান ইবনে মুনযিরকে দুধ খাওয়াতাম এবং তারা যদি আজ আপনার জায়গায় অধিষ্ঠিত হতো হাতলে তারাও আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতো। আপনি তো তাদের চেয়েও উত্তম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা তোমাদের সম্পদ এবং স্ত্রী ও শিশুদের মধ্যে কোনটিকে অগ্রধিকার দিতে চাও?” তারা বললো, “আপনি যদি দুটোর একটাই নিতে বলেন তাহলে আমাদের শিশু ও মহিলাদেরকেই ফিরিয়ে দিন।” তিনি বললেন, “যেসব মহিলা ও শিশু আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীর কাছে আছে তাদেরকে আমি দিয়ে দিচ্ছি। আর বাদবাকীদের জন্য তোমরা যোহরের নামাযের সময় জমায়াতে হাজির হও। তখন মুসলমানদের সবার কাছে এই বলে আবেদন জানাবে যে, ‘আমরা আমাদের স্ত্রী ও শিশুদের ফেরত চাই। যারা মুলমানদের কাছে রয়েছে তাদের জনস্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করছি তিনি যেন মুসলমানদেরকে সুপারিশ করেন আর যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট রয়েছে তাদের জন্য মুসলমানদেরকে অনুরোধ করছি তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করেন।’ তখন আমি আমার কাছে যারা রয়েছে তাদেরকে ফেরত দেব এবং মুসলমানদেরকে অনুরোধ করবো যেন তারাও ফেরত দেয়।”

যোহরের নামাযের সময় হাওয়াযিন ও বনু সা’দের প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশমত কাজ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সামনে ঘোষণা করলেন, “সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণও বললেন, “আমাদের কাছে যারা আছে আমরা তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কাছে সমর্পণ করলাম।” কেবল আকরা ইবনে হারেস নিজের ও বনু তামীমের, উয়াইদা ইবনে হিসন নিজের ও বনু ফাজারের এবং আব্বাস ইবনে মিরদাস নিজের ও বনু সুলাইমের পক্ষ থেকে এ আবেদনে সাড়া দিলো না। কিন্তু বনু সুলাইম আব্বাসকে অগ্রাহ্য করে বললো, “ আমাদের যার কাছে যত নালী ও শিশু আছে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে অর্পণ করলাম।: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা নিজ নিজ অধিকার ত্যাগ করতে চাও না তাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, এরপর সর্বপ্রথমে যে যুদ্ধবন্দী আমার হস্তগত হবে তা থেকে তাদের প্রত্যেককে একটির বদলে ছয়টি করে দেবো। কাজেই এদের শিশু ও নারী ফেরত দাও।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম হাওয়াযিনের প্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করলেন, “মালিক ইবে ন আওফের খবর কি?” তারা বললো, “সে তায়েফে বনু সাকীফের সাথে রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন, “মালিকেেক তোমরা জানিয়ে দাও, সে যদি মুসলমান হয়ে আমার কাছে হাজির হয় তাহলে আমি তাকে তার সমস্ত সম্পদ ও বন্দী লোকদেরকে ফেরত দেবো এবং আরো একশো উট দেবো।” মালিকের আশংকা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্তাব বনু সাকীফ জানতে পারলে তারা তাকে আটক করবে। তাই সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করলো। সে পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় একটি উটকে তার বাহন হিসেবে প্রস্তুত করে রাখলো। অতঃপর তায়েফ থেকে গভীর াতে একটি ঘোড়ায় চড়ে ঐ উটের কাছে পৌছলো। অতঃপর সেই উটের পিঠে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলো। কিরানা অথবা মক্কায় তাঁর সাথে মিলিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সকল বন্দী ও সম্পদ ফেরত দিলেন এবং একশোটি উটও দিলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করলো এবং নিষ্ঠাবান মুসমলমানের পরিণত হলো। অতঃপর মালিক ইবনে আওফ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় একটি কবিতা আবৃত্তি করলো। কবিতাটি নিম্নরুপঃ

“সমগ্র মানব সমাজে আমি মুহাম্মাদের সমতুল্য কোন মানুষ দেখিনি, বা শুনিনি।

সে কাউকে কোন কিছু দেয়অর প্রতিশ্রুতি দিলে তা যথাযথভাবে রক্ষা করে

এবং বিপুল পরিমাণে দান করে

উপরূন্ত তুমি যদি চাও

তবে সে আগামীকাল কি ঘটবে তাও বলে দিতে পারে।

যখন বড় বড় গোত্রতিরা নিজ নিজ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সহ পালিয়ে গেছে

এবং অত্রন্ত তীক্ষèধার তরবারীও আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছে

ধূলিধূসরিত রণাঙ্গনে তখনো সে শাবকদের পাহারায় নিযোজিত ও

ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকা হিংসের মহ অবিচল।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মালিক ইবনে আওফকে তার স্বগোত্রীয় মুসলমানদের এবং বনু সুমালা, বনু সালেমা ও বনু কাহম গোত্রের মুসলমানদের আমীর নিযুক্ত করেন। মালিক এইসব মুসলমানদের সাথে নিয়ে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে অব্যাহত লাড়াই চালাতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বশীভূত করেন। বনু সাীফের কবি আবু মিহজান খেদোক্তি করে কবিতা আবৃত্তি করে,

“একদিন শত্রুরা আমাদেরকে ভয় করে চলতো। অথচ

আজ কিনা বনু সালেম আমাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

সকল সম্পর্কের পবিত্রতা লংঘন ও ওয়াদা ভঙ্গ কলে

মালিক তাদের সহযোগিতায় আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি

আমাদের বাড়ীঘরের ওপরে চড়াও হয়ে বসেছে।

অথচ আমাদেরই প্রতিশোধ নেয়ার কথা ছিল।”

অতঃপর মুসলমানদের মধ্যে অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফাই (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) তথা উট ও ছাগলের ভাগ দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। পীড়াপীড়ি করতে করতে তারা তাঁকে একটি গাছের নীচে নিয়ে গেলে গাছে তাঁর চাদর আচকে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা আমার চাদরখানা দাও। আল্লাহর কসম, তিহামার বৃক্ষরাজির মত বিপুল সম্পদও যদি থাকতো তাহলে আমি তা তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। আমার ভেতরে কৃপণতা, ভীরুতা ও মিথ্যার লেমমাত্রও তোমরা দেকতে পেতে না।” অতঃপর তিনি তার উটের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার ঘাড়ের ওপর থেকে একটা চুল হাতে নিয়ে তা দেখিয়ে বললেন “হে মুসলিম জনতা, আল্লাহর কসম, তোমাদের ফাই থেকে-এমনকি এই পশমগাছি থেকেও আমার প্রাপ্য এক পঞ্চমাংশের বেশী নয়। অথচ সেই এক পঞ্চমাংশেও আমি তোমাদেরকেই দিয়ে দিয়েছি। সুতরাং যদি কেউ এই সম্পদ থেকে একটা সুঁই ও সুতাও নিয়ে থাক তবে তা ফিরিয়ে দাও। মনে রেখ, যে ব্যক্তি খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন ঐ খিয়ানত তার জন্য আগুনের রূপ নেবে এবং চরম অপমান ও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

জনৈক আনসারী তার উটের হাওদার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ সেলাই করার জন্য কিছু পশমের সুতা নিয়েছিলেন তিনি তা ফেরত দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ এ থেকে আমার প্রাপ্য অংশ তোমাকে দিলাম।” তিনি বললেন, “আপনি খিয়ানত সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তাতে আমার এ জিনিসের মোটেই প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তা ফেরত দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন জয় করার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের সম্পদ প্রদান করেন। নিম্নলিখিত ব্যক্দিদেরকে তিনি একশ’টি করে উট দেন: আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া, হাকীম ইবনে হিযাম, হারেস ইবনে কালদা, হারেস ইবনে হিশা, সুহায়েল ইবনে আমর, হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উয্যা, আলা ইবন জারিয়া, উয়াইনা ইবনে হিসন, আকরা ইবনে হারেস, মালিক ইবনে আওফ ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া।

নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে একশ’র কম  উট প্রদান করেন ৎ মাখরামা ইবনে রাওয়াল যুহরী উমাইর ইবনে ওয়াহাব আল-জুমাহী, হিশাম ইবনে আমর ও আমর ইবনে লুয়াই। আর সাঈদ ইবনে ইয়ারবু  ও সাহমীকে পঞ্চাশটি করে উট দেন।

আব্বাস ইবনে মিরদাসকে দেন পঞ্চাশটিরও কম। সে রাগান্বিত হয়। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিরস্কার করে নিচের কবিতাংশ আবৃত্তি করে,

“এগুলো আমার ছিনিয়ে নেয় দ্রব্য ছিল। আমি অশ্¦ শাবকের পিঠে সওয়ার হয়ে সমতল ভূমির জনপদে হামলা চালিয়ে এগুলো পেয়েছিলাম। নিজের গোত্রের লোকদের ঘুম থেকে জাগিয়ে রেখে ছিনিয়ে এনেছিলাম যেন তারা না ঘুমায়। কিন্তু তারা ঘমিয়ে পড়েছিল আর আমি একা জেগে ছিলাম। উয়াইনা ও আকরা যা পারেনি আমি ও আমার ঘোড়া সেই সম্পদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে আমি একজন দক্ষ লড়াকু।  কিন্তু আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে দেযা হয়নি। তবে একবোরে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবল কয়েকটি ছোট উট আমাকে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর চারটি পা এখনো তেমন লম্বা হয়নি। হিসন এবং হারেস (একশো উট প্রাপ্ত উয়াইনা ও আকরার পিতা) আমার পিতার (মিরদাসের) চেয়ে সমাজে বেশি প্রতিপত্তিশালী ছিল না। আর আমি নিজেও ওদের দুজনের চেয়ে নগণ্য নই। আজ আপনি যাকে অপমানিত করলেন সে আর কখনো সম্মানিত হবে না।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে নির্দেশ দিলেন, “যাও, ওকে আরো কিছু দিয়ে খুশী কর এবং তার মুখ বন্ধ কর।” সাহাবাগণ তাকে আরো কিছুসংখ্যক উট গিয়ে খুশী করলেন।

আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রের নেতাদের প্রতি এরূপ বদান্যতা প্রদর্শন করায় এবং আনসারগণকে কিছুই না দেয়ায় তারা খুবাই অসন্তুষ্ট হন এবং কেউ কেউ আপত্তিকর কথাবার্তা বলা শুরু করেন। এমনকি কেউ কেউ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আপনজনদেরকে খুশী করেছেন।” এ সময় সা’দ ইবনে উবাদা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি গনীমতের সম্পদ যেভাবে বিলিবন্টন করলেন তাতে আনসারগণ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। আপনি এসব সম্পদ নিজের গোত্র কুরাইশ ও অন্যান্যদের মধ্যে বন্টন করলেন। অথচ আনসারদের কিছু দিলেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে সা’দ! তোমার নিজের মনোভাব কি?” তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আমার গোষ্ঠীর একজন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে তোমার গোষ্ঠীকে এখানে হাজির কর।”

সা’দ আনসারদেরকে সেখানে জমায়েত করলেন। কিছুসংখ্যক মুহাজিরও সেখানে এসে হাজির হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন না। এভাবে ঐ সকল আনসার সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের াকছে গেলেন। প্রথমে তিনি যথাযথভাবে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন, “হে আনসারগণ, তোমাদের পক্ষ থেকে কিচু আপত্তিকর কথা উচ্চারিত হতে শুনেছি এবং আমার ওপর তোমরা ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ  হয়েছো বলে জানতে পেরেছি। বলতো আমি যখন তোমাদের কাছে আসি তখন কি তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ কি তোমদেরকে হিদায়াত দান করেননি? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদের সচ্ছল করেননি? তোমরা কি পরস্পরের শত্রু ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদেরকে পরস্পরের কাছে প্রিয় করে দেননি?” তারা বললেন, “হা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ করেছেন।” তিনি আরো বললেন, “হে আনসারগণ, তোমরা জবাব দাও না কেন?” তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনাকে কি জবাব দেবো? আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অনুগ্রহ করেছেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা বলতে পার যে, তুমি আমাদের কাছে এসেছিলে এমন অবস্থায় যখন কেউ তোমার প্রতি ঈমান আনেনি, আমরাই কেবল ঈমান এনছিলাম। সবাই তোমাকে নির্যাতন করেচিল শুধু আমরাই তোমাকে সাহায্য করেছিলাম, তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমরাই তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, তুমি অসহায় অবস্থায় আমাদের কাছে এসেছিলে আমরা তোমাকে আপনজন করে নিয়েছিলাম। এ কথাগুলো বললে তোমাদের মোটোই মিথ্যা বলা হেব না। এবং সবাই তার সত্যতা স্বীকার করবে। হে আনসারগণ, দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের জন্য তোমরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেলে? এক শ্রেনীর লোককে আমি আগেই আস্থাবান ছিলাম এটা কি তোমাদের পছন্দ হয়নি? হে আনসারগণ, তোমরা কি এতে খুশী নও যে, লোকেরা উট ও বকরী নিয়ে চলে যাক, আর তোমরা তার বদলে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে যাও? যে আল্লাহর হাতে মাহুম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, আমাকে যদি হিজরাত করে আসতে না হতো, তাহলে আমি তোমাদেরই মত আকজন আনসার হতাম। সবাই যদি একপথে চলে আর আনসাররা যদি ভিন্ন পথে চলে আমি আনসারদের পথ ধরেই চলবো। হে আল্লাহ! তুমি আনসারদের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং সন্তানদের বংশধরের ওপরও রহমত বর্ষণ কর।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ভাষনে আনসার সাহাবীগণ এত কাঁদলেন যে, দাড়ি পর্যন্ত সিক্ত হয়ে গেল। তারা সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের ভাগে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়েই সন্তুষ্ট এবং তাতেই গৌরবান্বিত।’

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। মুসলমানরাও যে যার কাজে চলে গেল।

জি’রানা থেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) উমরা পালন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাব ইবনে উসাইদকে সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং আত্তাব মুসলমানদের সাথে নিয়ে ৮ম হিজরী সনে হজ্জ পালন করেন।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আালাইহি ওয়াসাল্লাম জি’রানা থেকে উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মাররুয যাহরানের নিকটবর্তী মাজান্নাতে বিজয়লব্দ অবশিষ্ট সম্পদ সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিলেন। উমরা সমাপন করে তিনি মদীনা চলে গেলেন এবং আত্তাব ইবনে উসাইদকে (রা) সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন। মুসলিম জনগণকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান ও কুরআন শিক্ষ দেয়ার উদ্দেশ্যে আত্তাবের সাথে মুয়ায ইবনে জাবালকেও (রা) রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বিজয়লব্ধ অবশিষ্ট সম্পদ সাথে করে মদীনায় নিয়ে গেলেন। তিনি এই উমরা সম্পন্ন করেন যুলকাদা মাসে। তাই তাঁর মদীনা গমন সংঘটিত হয়েছিল যুলকা’দার শেষায়শ অথবা যুল-হাজ্জের প্রথমাংশে। ইবনে ইসহাক বলেন, আরবদের প্রচলিত নিয়মেই সে বছরের হজ্জ সম্পন্ন হয়। আত্তাব (রা) মুসলমানদের সঙ্গে হ্জ্জ পালন করেন। [৮৫. ইবনে হিশাম বলেন, যায়িদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাবকে মক্কার শাসক হিসেবে নিয়োগ করার পর তাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা দেন। তিনি একদিন মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “এক দিরহাম ভাতা পেয়েও যার তৃপ্তি হয় না আল্লাহ তাকে কখনো তৃপ্ত করবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা ঠিক করে দিয়েছেন। আমি এখন কারো মুখাপেক্ষী নই।”] এটা ছিল ৮ম হিজরী সন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর থেকে তথা যুলকা’দা মাস থেকে নিয়ে নবম হিজরী সনের রমযান পর্যন্ত তায়েফবাসী শিরক ও ইসলাম বিরোধিতায় অবিচল থাকে।

 

তায়েফ ত্যাগের পর কা’ব ইবনে যুহাইরের ইসলাম গ্রহণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর বুজাইর ইবনে যুহাইর তার ভাই স্বনির্বাচিত বিশিষ্ট কবি কা’ব ইবনে যুহাইরকে চিঠি মারফত জানায় যে, “মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করতো তাদের অনেককে তিনি হত্যা করেছেন। কুরাইশ কবিদের মধ্যে ইবনে যাবয়ারী ও হুবাইরা প্রমুখ পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। তুমি যদি বাঁচতে চাও তবে কালবিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হও। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে ও  তাওবাহ করে তাঁর কাছে আসে তিনি তাঁকে হত্যা করেন না। আর যদি তা না কর তবে দুনিয়ার যেখানে নিরাপদ মনে কর সেখানে গিয়ে আশ্রয় নাও।”

ইতিপূর্বে কা’ব এক কবিতায় বলেছিল,

“বুজাইয়ের কাছে আমার এই বার্তা পৌছিয়ে দাও, আমি যা বলেছি তা গ্রহণ করতে কি তোমার প্রবৃত্তি হয়. আর যদি তা গ্রহণ না কর তাহলে আমাকে আনাও, অন্য কোন্ জিনিসের প্রতি তুমি আগ্রহী? তুমি সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা আমি তাঁর পিতামাতার মধ্যে দেখিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদের) এবং তুমি তোমার পিতামাতার মধ্যেও দেখনি? আমার কথা যদি ুতমি গ্রহণ না করা তাহলে আমি দুঃখ করবো না এবং তুমি ভুল করে ক্ষতিপ্রস্ত হলেও আর শুধরে দেব না। বিশ্বস্ত মানুষটি তোমকে সেই বিশেষ স্বভাব চরিত্র গড়ার উদ্দেশ্যে নতুন পানীয় পান করিয়েছে।”

কা’ব এই কবিতাটি বুজাইরের নিকট পাঠায় এবং বুজাইর তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে পড়ে শোনায়। তিনি যখন শুনলেন, “বিশ্বস্ত মানুষটি তোমাকে নতুন পানীয় পান করিয়েছে” তখন বলনে, “কা’ব মিথ্যাবাদী হলেও এ কথাটা সত্য বলেছে। আমিই সেই বিশ্বস্ত মানুষ।”

পুনরায় যখন আবৃত্তি করা হলো, “(তুমি কি) সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা তার মাতাপিতার মধ্যে তুমি দেখনি” তখন রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ, সে তার পিতামাতার মধ্যে এ চরিত্র দেখেনি।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ বুজাইরের চিঠি পেয়ে কা’ব চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। প্রাণের ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। তার আশেপাশে তার শত্রুভাবাপন্ন যারা ছিল তারা তাকে আরো ভীত  এবং সন্ত্রস্ত করার জন্য বলতে লাগলো,!“কা’বের মরণ আসন্ন।” অনন্যোপায় হয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের প্রশংসা করে একটা কবিতা লিখলো। এই কবিতায় সে তার নিজের ভীতি এবং তার শত্রুদের কর্তৃক তাকে সন্ত্রস্ত করার কথা উল্লেখ করলো। অতঃপর সে মদীনায় চলে গেল। সেখানে তার পূর্ব পরিচিত জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে গিয়ে উঠলো। অতঃপর সে ব্যক্তি কা’বকে নিয়ে ফজরের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের নিকট চলে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতে নামায পড়লো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইংগিত করে কা’বকে বললো,, “তিনিই রাসূলুল্লাহ। তুমি তাছর কাছে গিয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর।” কা’ব তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ্অলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁকে চিনতেন না। কা’ব বললো, “ ইয়া রাসূলুল্লাহ, কা’ব ইবনে যুহাইর তাওবাহ করে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে হাজির করি তাহলে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হঁ^া।” তখন সে বললে “ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর।” এই সময় জনৈক আনসার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে অনুমতি দিন, আল্লাহর এই দুশমনকে হত্যা করি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও। সে তাওবাহ করে এবং শিরক ত্যাগ করে এসেছে।” ঐ আনসারীর ব্যবহারে কা’ব সমগ্র আনসারদের প্রতি রাগান্বিত হয়। অবশ্য মুহাজিরগণ তাকে কোন অপ্রীতিকর কথা বলেননি। সে একটি কবিতা লেভে। কবিতাটি এরূপ -

“ (আমার স্ত্রী) সুয়াদ আমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে আমার মন ভেঙ্গে গেছে। আমি আজ অপমানিত এবং শৃংখলিত। তার পদানুসরণ করায় আমার কোন ণাল হয়নি। .... শুনেছি, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তথাপি, আমি আল্লাহর রাসূলের ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি। একটু সবুর করুন! যে আল্লাহ আপনাকে উপদেশ সমৃদ্ধ কুরআনের ঐশ্বর্য দান করেছেন তিনি যেন আপনাকে ন্যায়পথে পরিচালনা করেন। কুচক্রীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না। যদিও আমি বেফাঁস কথা অনেক বলে থাকি, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি আজ এমন (নাজুক) অবস্থানে আছি সেখানে বসে যা যা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি তা শুনলে হাতিও আতংকে অস্থির হয়ে যেত। অবশ্য তাকে আল্লাহর রাসূল যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে নিরাপত্তা দেন তাহলে আলাদা কথা। এ যাবত আমি রাতের আঁধারে ঊষর মরুপ্রান্তর দিয়ে ঘুড়ে বিড়িয়েছি। অবশেষে আমি আমার হাত দিয়েছি সেই ব্যক্তির হাতে যিনি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম এবং যার কথা একমাত্র হক কথা। সে হাত আমি আর ফিরিয়ে আনবো না। বস্তুতঃ আমি যখন তাঁর সাথে কথা বলি এবং যখন আমাকে বলা হলো, ‘তুমি অভিযুক্ত ও (বহু অঘটনের জন্য) দায়ী’, তখন তিনি আামার কাছে ‘ইশরে’র নিবিড় অরণ্যের সিংহের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন- যে সিংহ অন্য দুটি সিংহকে মানুষের গোশত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, একটি পর্বতের চূড়ায় দিকে যখন সে লাফ দেয় তখন সেই চূড়া জয় না করে সে ছাড়ে না, ‘জাও’ অঞ্চলের বন্য হিং¯্র জন্তুগুলো তার ভয়ে পালায় এবং মানুষেরা দল বেঁধেও তার এলাকায় চলাফেরা করার সাহস পায় না। তার এলাকায় শুধু এমন লোকই যেতে পারে যে নির্ভরযোগ্য এবং সে রক্তাক্ত অস্ত্র ও পুরনো ছেড়া পোশাকে চলতে পারে। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য পথের দিশারী এক উজ্জ্বল জ্যোতি এবং আল্লাহর এক অপরাজেয় তরবারী। কুরাইশদের একদল লোক যখন মক্কায় তার প্রতি ঈমান আনলো, তখন তাদের কেউ কেউ মু’মিনদের বললো, ‘দূর হয়ে যাও।’ তারা দুল হয়ে গেল বটে। তবে তারা (কুরাইশরা) সেই সমস্ত বীরদের মুকাবিলায় নিরস্ত্র ও অসহায় গয়ে গেল-যারা যুদ্ধের সময় অটুট সুদীর্ঘ সাদা বর্ম পরিধান করে থঅকে- যারা বিজয়ী হলেও উল্লঅসে ফেটে পড়ে না। (কেননা সেটা তাদের অভ্যঅসগত) আর পরাজিত হলেও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে না। (কেননা তারা জানে জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং পরবর্তীতে তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী) তারা শ্বেতকায় উটের মত স্থির শান্ত পদক্ষেপে চলে, কালেঅ খাটো লোকগুলো যখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় তখন তারা যুদ্ধ করেই আত্মরক্ষা কলে। আঘাত পড়লে তাদের বুকেই পড়ে। (পিঠে পড়ে না) কেননা তারা মৃত্যুর ভয়ে পালায় না। (বরং সামনে এগিয়ে যায় এবং শত্রুর আঘাতকে বুক পেতে গ্রহণ করে ও প্রতিরোধ করে)।”

আসেম বিন উমার ইবনে কাতাহাদ থেকে বর্ণিত। কা’ব যখন বললো, “কালো খাটো লোকগুলো যখন পালিয়ে যায়” তখন তার ওপর আসসারগণ রেগে যান। কেননা এ কথঅটা সে আমাদের আনসারদের উদ্দেশ্যেই বলেছিল। কারণ আমাদের একজন তার সাথে দুর্ব্যহার করেছিল। পরে আনসারদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সে আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং তাঁর দক্ষিণ হস্তের ভুমিকা পালনের প্রশংসা করে।

সে কবিতাটি এই-

“যে ব্যক্তি জীবনকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করতে চায় সে যেন পুণ্যবান আনসারদের সঙ্গ ত্যাগ না করে। মহত্ত্ব ও মহানুভবতা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। তাই তারা হলেন শ্রেষ্ঠ মানবদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কেবল বর্ম দিয়ে তীর বর্শাকে বলে আনেন। তাদের বর্মগুলো বর্শার মতই- কোন অংশে তা থেকে কম নয়। আগুনের অংগারের মত লাল ও তীক্ষèদৃষ্টি চোখ দিয়ে তারা তাকান। যুদ্ধের সম্মুখীন হলে মৃত্যুর জন্য তারা আপন প্রাণ নবীর হাতে সঁপে দেন। মু’মিনদের ধর্মকে তারা উত্তোলিত তরবারী ও বর্শা দিয়ে রক্ষা করেন। কাফিরদের রক্ত দিয়ে তারা পবিত্রতা লাভ করেন এবং একে তারা পুণ্যব্রত বলে বিবেচনা করেন। খিফয়ার গভীর অরণ্যে ঘাড়মোটা শিকারী  সিংহেরা যেমন যুদ্ধের অনুশীলন করে তারাও তেমনি রণদক্ষতা রপ্ত করেন। তারা যখন হামলাকরীর প্রতিরোধ করেন তখন তাকে সম্পূর্নরুপে থামিয়ে দেন। আলী ইবনে মাসউদ মাজেন গাছছানীকে তারা বদরের যুদ্ধে এমন আঘাত করেন যে, সমগ্র বনু নিযার তাতে শায়েস্ত হয় ও বশ্যতা স্বীকার কলে। সকল গোত্র যদি আনসারদের সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তা জানতো তাহলে আমার চরম বিরোধী যারা তারাও ব্যাপারটা স্বীকার করতো। তারা এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা চরম দুর্ভিক্ষের সময়ও রাত্রিকালে আগত অীতথিদের প্রতি বদান্যতা প্রদর্শন করে। তারা গাছছানের এমন এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক, যাদের আভিজাত্যে কোন ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না।”

নিজের স্ত্রী সুরাদ সম্পর্কিত কবিতাটি আবৃত্তি করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ কবিতায় তোমার আনসারদের প্রশংসা করা উচিত ছিল। কেননা তারা তার উপযুক্ত বটে।” তখন কা’ব এই শেষোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ইবনে হিশাম আরো বলেছেন যে, কা’ব তার স্ত্রী সায়াদকে নিয়ে শুরু করা কবিতাটি মসজিদে নববীতে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়ে শুনিয়েছিল।

তাবুক যুদ্ধ: রযব, নবম হিজরী সন

এরপর যুলহাজ্জ থেকে রযব মাস পযন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করেন এবং পরে মুসলমানগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুত হতে বলেন। যুহরী, ইয়াযীদ ইবনে রোমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র, আসেম ইবনে জামর প্রমুখ ঐতিহাসিক তাবুক অভিযানের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সে সময় মুসলমানদের জন্য সময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। একদিকে ছিল গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপ। অন্যদিকে দেশে চলছিল দুর্ভিক্ষ। যাদের কিছু ফল জন্মেছে তা একেবারে পেকে গিয়েছিল। লোকেরা তাদের ফল সংগ্রহ করা এবং ছায়াশীতল জায়গায় অবস্থান করার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঠিক এমন সময় বাইরে যাওয়া কারো মনঃপূত ছিল না। অধিকাংশ অীভযানে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সামান্য কছিু আভাস ইংগিত দিতেন। জানিয়ে দিতেন যে, যেদিকে রওয়ানা হচ্ছি আসল গন্তব্য তা থেকে আলাদ। কিন্তু তাবুক অভিযানের বেলায় সর্ম্পূর্ণ ভিন্ন রকম ব্যাপার ঘটলো। এক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলের কথা সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিলেন। কেননা গন্তব্যস্থান ছিল অনেক দূরের, সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং শত্রুর সংখ্যাধিক্যও ছিল গুরুতর পর্যায়ের। তাই লোকেরা যাতে অভিযানের জন্য যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে সেজন্য আগেভাগে তিনি সবকিছুই জানিয়ে দিলেন। তিনি মুসলমানগণকে প্রস্তুত হতে বললেন এবং জানালেন যে, এবার মুকাবিলা রোম সম্রাটের সাতে। এই প্রস্তুতি চলাকালে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সালামা গোত্রের জাদ্দ ইবনে কায়েসকে বললেন, “হে জাদ্দ, এ বছর রোমানদের সাথে লড়তে তুমি কি প্রস্তুত?” সে বললো, “হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে (পাপের) ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করার চাইতে আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দেবেন কি? আল্লাহর কসম, আমার গোত্রের লোকেরা জানে যে, আমি নারীদের প্রতি যতখানি দুর্বল, অতটা খুব কম লোকই আছে। রোমান মেয়েদের দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না বলে আমার আশংকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে আর মাথা ঘামালেন না। তিনি বললেন, “তোমাকে অনুমতি দিলাম।” জাদ্দ ইবনে কায়েস সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী ********]

“তাদের মধ্যে কেই কেউ বলে, ‘আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দিন, ফিতনার মধ্যে ফেবেন না।’ জেনে রেখো, তারা ফিতানার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েই আছে। জাহান্নাম নাফরমানদের ঘেরাও করেই রেখেছে।” অর্থাৎ সে রোমান নারীদের প্রতি আসক্ত হবার আশংকা বোধ করেছিল। আসলে সে আশংকা তার ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে না গিয়ে এবং নিজের স্বার্থকে অগ্রধিকার দিয়ে সে বরং আরো বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে। তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।

মুনাফিকরা একে অপরকে বললো, “এত প্রচন্ড গরমে তোরা সফরে যেও না।” তারা এভাবে জিহাদ থেকে ফিরে থাকতে সচেষ্ট ছিল ও সত্যের পথে দ্বিধা-সংশয়ে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সম্পর্কে নাযিল করলেন-

“তারা বললো, গরমের মধ্যে সফরে যেও না।  (হে নবী) তুমি বলে দাও, দোযখের আগুন সর্বাধিক গরম। তারা যদি তা বুঝতো (তাহলে এমন কথা বলতো না) অতএব তারা যেন কম হাসে এবং বেশী কাদে। তাদের অপকর্মের শাস্তি তাদের পেতেই হবে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের আয়েঅজন চালাতে লাগলেন এবং মুসলিম জনগণকে দ্রুত গ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বললেন। বিত্তবান মুসলমানগণকে তিনি সওয়ারীর পশু, টাকা-পয়সা ও রসদপত্র ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্য করতে উৎসাহিত করতে লাগলেন। ধনী মুসলমানগণ অনেক সাহায্য দিলেন এবং আল্লঅহর সুন্তুষ্টিকেই তারা যথেষ্ট মনে করতে লাগলেন। উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আন্হু এই সময় সকলের চাইতে বেশী দান করেন। [৮৬. ইবনে হিশাম বলেছেন, তাবুক অভিযাত্রী অভাব  পীড়িত মুসলিম জন্য তিনি এক হাজার দিনার দান করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত খুশী হন যে, তিনি দোয়া করেন, “হে আল্লাহ! তুমি উসমানের ওপর সন্তুষ্ট হও। আমি তার ওপর সন্তুষ্ট।”]

আনসার ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে সাতজন মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সওয়ারী জানোয়ার চাইলেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সওয়ারীর বাহন সরবরাহ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ফলে তারা জিহাদে যেতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান। ইতিহাসে এরা ‘বাকাউন’ অর্থাৎ ক্রন্দনকারী নামে পরিচিত। এরা হলেন: বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সালেম ইবনে উমাইর, বনু হারেসার উলবা ইবনে যায়িদ, বনু মাজেনের আবু লায়লা আবদুর রহমান, বনু সালমার আমর ইবনে হুমাম ও আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল মুযানী। কেউ কেউ বলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর, বনু ওয়াফেকের হারমী ইবনে আবদুল্লাহ এবং বুন ফাজারার ইরবাদ ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহুম।

বর্ণিত আছে যে, এদের মধ্যে দু’জন আবু লায়লা আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহ বিন মুগাফফালকে কাঁদতে দেখে ইবনে ইয়ামীন ইবনে উমাইর জিজ্ঞেস করেন, “ তোমরা কাঁদছ কেন?” তারা বললেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলাম তাবুক অভিযানে যাওয়ার জন্য সওয়ারী চাইতে। কিন্তু তিনি দিতে পারেননি। আমাদের কাছেও এমন কিছু নেই যা দ্বারা তাঁর সাথে অভিযানে যেতে পারি।” তখন ইবনে ইয়ামীন তাদেরকে একটা উট এবং কিছু খোরমা দিলেন। তাঁরা ঐ সওয়ারীতে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অভিযানে চলে গেলেন। বেদুইন মুসলমানদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে নানা রকম ওপর পেশ করে এবং অভিযানে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাদেরকে অনুমতি দেননি। কারো কারো মতে তারা ছিল বনু গিফার গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সফর শুরু হলো। কিছুসংখ্যক নিষ্ঠাবান ও খালিছ মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অীভযানে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। তাদের ঈমান সম্পর্কে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। কেবল সংকল্পের দৃঢ়তা দেখাতে না পারাই ছিল তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ। মদীনার উপকণ্ঠে অবস্থিত পার্বত্য পথ সানিয়াতুল ওয়াদাতে তিনি সেনাবাহিনী চালিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার অধীনস্থ লোকদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে সানিয়াতুল ওয়াদা’র নীচ দিয়ে যে পথ জুবাব পর্বতের দিকে গিয়েছে সেই পথে চালিত করলো। অনেকের মতে, এই বাহিনেিত বিপুল সংখ্যক লোক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার সহযাত্রী মুনাফিক ও সংশয়বাদীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্য রেখে গেলেন। তাঁকে তিনি পরিবার-পরিজনের সাথে থাকতে বললেন। মুনাফিকরা তাঁকে কেন্দ্র করে নানা রকমের অপবাদ রটনা করলো। তারা বলতে লাগলো যে, আলীকে অলস মনে করে তার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে রেখে গিয়েছেন। মুনাফিকদের এইসব কথা শুনে আলী (রা) অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন। তিনি তখন মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে জুরফ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন- যেখানে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও মদীনার আরো অনেকের জমিজমা ছিল। আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, মুনাফিকরা মনে করেছে যে, আপনি আমাকে অলস মনে করে আমার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য রেখে এসেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, “তারা মিথ্যা বলেছে। আমি তোমাকে আমার ও তোমার পরিবা-পরিজনের দেখাশুনার জন্য রেখে এসেছি। হে আলী! মূসা (আ) হারুন (আ) কে যে পর্যায়ে রেখেছিলেন তোমাকে যদি আমি সেই পর্যায়ে রাখি তাহলে তুমি কি খুশী নও? কেননা আমার পরে আর কেউ নবী হবে না।” একথা শোনার পর আলী (রা) মদীনায় ফিরে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানেব রওনা হয়ে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তাবুক অভিযানে রওনা হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর আবু খাইসামা (রা) তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে এলেন। দেখলেন, তাঁর দুই স্ত্রী বাগানের ভেতরে নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করছে। উভয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে। তিনি এসে তাঁবুর দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তার দুই স্ত্রীর প্রতি নজর দিলেন এবং তাঁর আরাম-আয়েশের জন্য তারা যে ব্যবস্থা করে রেখেছে তাও দেখলেন। তখন সংগতভাবে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোদ, বাতাস ও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন আর আবু খাইসামা কিনা ঠান্ডা ছায়ার সুন্দরী নারীর সাহচর্যে নিজ ভুমি ও সহায়-সম্পদের ভেতরে বসে তৈরী খাদ্য খাবে? এটা কখনো ঠিক হবে না। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের কারো তাঁবুতে ঢুকবো না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে জিহাদী সাজে সজ্জিত করে দাও।” তারা তাঁর সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁর উট এগিয়ে দেয়া হলো। আবু খাইসামা রওয়ানা হলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে দ্রুত ছুটলেন। তিনি তাঁবুতে অবস্থান নেওয়ার পর আবু খাইসামা সেখানে উপনীত হলেন। পথিমধ্যে অপর এক সাহাবা উমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহী আবু খাইসামার সঙ্গী  হলেন। তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানে অংশগ্রহন করতে যাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়ে যখন তাবুকের কাছাকাছি হয়েছেন তখন আবু খাইসামা উমাইরকে বললেন, “আমি একটা গুনাহ করে ফেলেছি। কাজেই তুমি একটু আমার পেছনে পড়লে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। আমাকে আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে পৌছতে দাও।”

তাবুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছাকাছি পৌছলে সাহাবীগণ তাঁকে দেখে বললেন, “একজন উষ্ট্রচালক এদিকে এগিয়ে আসছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সম্ভবতঃ আবু খাইসামা।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু খাইসামাই তো।” কাছে এসে উট থেকে নেমে আবু খাইসামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু খাইসামা, তুমি উপযুক্ত কাজই করেছো।” [৮৭. মূল শব্দটি হলো [আরবী ***] (আওলা লাকা) পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে তাফসীরকারগণের কেউ কেউ এর এরূপ অর্থও করেছেন, ‘তুমি ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়েছিলে।’ তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ প্রথম অর্থটাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ ‘তুমি তোমার উপযুক্ত কাজই করেছ।’] অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মোবারকবাদ দিলেন ও তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে সমৃদ্ধ জাতির বাসস্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম সেখানে স্বল্প যাত্রাবিরতি করেন। কোন কোন সাহাবী সেখানকার কূয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাবধান করে দেন যে, এখানকার পানি কেউ পান করো না এবং তা দিয়ে অযু করো না। এখঅনকার পানি দিয়ে কেউ আটা বানিয়ে থাকলে তা ঘোড়াকে খেতে দাও তোমরা খেয়ো না। রাতে এখঅনে কেউ একাকী বের হয়ো না। প্রায় সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মেনে চললেন। কেবল বনু সায়েদা গোত্রের দুইজন একাকী রাতে বের হয়েছিলেন। একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এবং অপরজন তার হারানো উটের সন্ধানে। যিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন তিনি যে স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন সেখানেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। আর যিনি উটের সন্ধানে বেরুলেন তিনি প্রবল বাতাসে উড়ে গিয়ে ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যাপারটা জানানো হলে তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে একাকী বেরুতে নিষেধ করিনি?” অতঃপর যে ব্যক্তি পায়খানা করতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দোয়া করলেন এতে তিনি সুস্থ হয়ে উছলেন। আর যিনি ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তাকে তাই গোত্রের লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা ফিরে যাওয়ার  পর তাঁর কাছে পৌছিয়ে দেন।

পরদিন সকালে দেখা গেল, কাফিলায় কারো কাছে এক ফোটা পানিও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ একখন্ড মেঘ পাঠিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং তাতে সকলের প্রয়েঅজন পূর্ণ হলো। সবাই পরবর্তী সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করেও রাখলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উট হারিয়ে গেল। সাহাবীগণ উট খুঁজতে বেরুলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উমার ইবনে হাযম নামে আকাবার বাইয়াতে ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী জনৈক সাবাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু আমরের বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি। তাঁর দলে ভেতরে যায়িদ ইবনে লুছাইত নামক বনু কাইনুকা গোত্রের জনৈক মুনাফিক ছিল।

উমারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত থাকাবাস্থায় তাঁর দলবলের কাছে বসে উক্ত যায়িদ ইবনে লুছাইত বললো, “আচ্ছা, মুহাম্মাদ তো দাবী করেন যে, তিনি নবী এবং তিনি তোমাদেরকে আকাশের খবর জানা। তিনি এতটুকু জানেন না যে, তাঁর উট কোথায়? ঠিক সেই মুর্হুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারার (রা) উপস্থিতিতেই বললেন, “একজন লোক বলছে যে, মুহাম্মাদ নিজেকে নবী বলে দাবী করে থাকেন এবং তোমাদেরকে আসমানের খবরাদি জানা, তিনি কেন তাঁর উট কোথায় তা জানেন না? আল্লাহর কসম, আল্লাহ যেটুকু আমাকে জানিয়েছেন সেইটুকু ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আল্লাহ আমাকে উটের সন্ধান দিয়েছেন। এই উপত্যকার ভেতরেই তা অমুক জায়গায় রয়েছে। একটি গাছের সাথে তার লাগাম আটকে গেছে। তোমরা গিয়ে উটটাকে নিয়ে এস।” সাহাবীগণ গিয়ে উট ধরে আনলেন। অতঃপর উমারা (রা) তাঁর দলবলের কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইমাত্র আমাদের কাছে এক বিস্ময়কর খবর জানালেন। আমাদের বাহিনীর মধ্যে কে নাকি এরূপ কথা বলেছে এবং আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন।” এই বলে তিনি যায়িদ ইবনে লুছাইতের কথঅ বলেছে ব্যক্ত করলেন। তখন উমারার (রা) দলের একজন যিনি দলের অভ্যন্তরেই ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট যাননি- বললেন, “আল্লাহর কসম, যায়িদই এ কথা বলেছে।” তখন উমারা (রা) যায়িদের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ঘাড়ে আঘঅত করে বললেন, “হে আল্লাহর বান্দারা, আমার কাছে এস। আমার কাফিলায় একটা সাপ লুকিয়ে আছে, আমি তা জানতেও পারিনি। হে আল্লাহর দুশমন, বেরিয়ে যা আমার কাফিলা থেকে। আমার সাথে আর থাকিস  না।”

বর্ণিত আছে যে, এরপর যায়িদ তাওবাহ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মৃত্যুকাল পর্যন্তই যায়িদ মুনাফেকী অব্যাহত রাখঅর দায়ে অভিযুক্ত ছিল।

যাত্রাপথে মাঝে মাঝে দুই একজন মুসরিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। মুসলমানগণ এ ধরনের কোন লোকের ফিরে যাওয়ার কথা জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “যেতে দাও। যদি তার মধ্যে সত্যপ্রীতি থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ আবার তাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। অন্যথায় আল্লাহ তার সাহচর্য থেকে তোমাদেরকে অব্যাহতি দিলেন। ভালই হলো।” এক সময় বলা হলো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু যারও পিছিয়ে গেছে। তাঁর উট তাকে পিছিয়ে দিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পিছিয়ে যায় তো যাক। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে তোমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে মনে করবে আল্লাহ তোমাদেরকে তার হাত থেকে রেহাই গিয়েছেন।: আবু যার (রা) তাঁর উটকে দ্রুত চালানের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হলো না। অগত্যা তিনি নিজের সাজ-সরঞ্জাম ও রসদপত্র ঘাড়ে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদানুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলে তিনি তাঁর সাথে এসে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একাকী হেঁটে আসতে দেখে বললেন, “আল্লাহ আবু যারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। সে একাই চলে, একাই মরবে এবং পুনরায় একাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, উসমান (রা) তাঁর খিলাফাতকালে যখন আবু যারকে (রা) রাবয়াতে নির্বাসিত করেন তখন সেখানে তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী ও ভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি তাঁদেরকে এই বলে অছীয়ত করেন যে “আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে গোসল ও কাফন দিয়ে রাস্তার ওপর রেখে দিও। অতঃপর সর্বপ্রথম যে কাফিলা তোমাদের কাছ দিয়ে যাবে, তাকে বলবে, এই লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার। তাঁকে দাফন করতে তোমরা আমাদের সাহায্য কর।” মৃত্যুর পরে স্ত্রী ও ভৃত্য অছীয়ত মুতাবিক কাজ কররেন এবং তাঁর লাশ রাস্তার ওপর রেখে দিলেন। এই সময় ইরাক থেকে একদল উমরাহ যাত্রীর সাথে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যাচ্ছিলেন। দলটি রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লাশটি দেখে থমকে দাঁড়ালো। অল্পের জন্য তা দলের উটের পাদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। ভৃত্যটি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার (রা)। তাঁকে দাফন করতে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন, তুমি একই চল, একাই মরবে এবং একাই পুররুজ্জীবিত হবে।” অতঃপর তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা নেমে তাঁকে দাফন করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক পৌছলে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রোবা তাঁর কাছে হাজির হয়ে জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করলো। অনুরুপভাবে জাবরা আজরুহর অধিবাসীরাও এসে জিযিা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিম্নরুপ সন্ধিপত্র লিখে দিলেনঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের তারফ থেকে ইউহান্না ইবনে রোবা ও আয়ালাবাসীর জন্য এবং তাদের সকল নৌ ও স্থল যানসমূহের জন্য নিরাপত্তা ঘোষনা করা যাচ্ছে। তাদের জন এবং তাদের সহযোগী সিরিয়া, ইয়ামান ও সাগররবাসীর নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রাসূল পূর্ণ দয়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যদি কেউ এই সন্থির বরখেলাফ কিছু করে তবে সে তার অর্থবিত্ত বলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে না। যে যার ক্ষতি সাধন করবে, তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। তারা যে কোন জলাশয়ের পানি ব্যবহার করতে পারবে এবং যে কোন নৌ ও স্থল পথে চলাচল করতে পারবে। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না।”

দুমার শাসনকর্তা উকায়দের - এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক খালিদ ইবনে ওয়ালদীকে প্রেরণ

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দের ইবনে আবদুল মালিকের নিকট প্রেণ করলেন। উকায়দের কান্দা গোত্রের একজন খৃষ্টান ছিল এবং সেখানকার বাদশাহ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদকে বলে দিলেন, “তুমি গিয়ে দেখবে উকায়দের গরু শিকার করছে।”

গ্রীষ্মের জ্যোৎ¯œা রাতে উকায়দের যখন ছাদের ওপর স্ত্রীসহ বসেছিল, তখন খালিদ তার দুর্গের দৃষ্টি সীমার ভেতরে পৌছে গেলেন। একটি বন্য গরু ঐ সময় উকায়দেরের প্রসাদের দরজায় শিং গিলে গুতোতে লাগলো। তার স্ত্রী বললো, “এমন গরু আর কখনো দেখেছো?” সে বললো, ‘না’। স্ত্রী বললো, “তাহলে এমন শিকার হাতছাড়া করা কি উচিত?” সে বললো, “কখখনো না।” এই বলেই সে নীচে নামালো এবং ঘোড়ায় সওয়ার হলো। সে নিজে এবং তার ভাই হাসানসহ পরিবারের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে শিকারের পছেনে ছুটলো। বাইরে বেরিয়েই তারা সালূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীর হাতে ধরা পড়লো। উকায়দেরের ভাই হাসান মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হলো। তার পরিধানে ছিল স্বর্ণের জরিদার একটি রেশমী জামা। খালিদ (রা) সেটা খুলে নিলেন এবং নিজে মদীনায় যাওয়ার আগেই একজনকে দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, উকায়দেরের জামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছানো হয়েে আমি তা দেখেিেছ। মুসলমানগণ তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বিস্মিত হচ্ছিল দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এইটে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছ? আল্লাহর কসম, জান্নাত সা’দ ইবনে মু’য়াযের জন্য যে রুমাল রয়েছে তা এর চেয়েও ভাল।”

ইবনে ইসহাক বলেন, খালিদ উকায়দেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তাকে প্রাণের নিরাপত্তা দিয়ে জিযিয়ার বিনিময়ে সন্ধি করলেন এবং মুক্ত করে দিলেন। সে তার এলাকায় ফিরে গেল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম তাবুক থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলেন না। বরং সেখানেই দশদিন অবস্থান করলেন। তারপর মদীনায় ফিরে এলন। পথিমধ্যেওয়াদিউল মুশাককাক উপত্যকায় একটা ক্ষুদ্র পাহাড়ী ঝর্ণা ছিল। তার পানি দ্বারা বড়জোর দুই বা তিনজন পথিকের পিপাসা নিবৃত্ত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আগে যারা ঐ উপত্যকায় পৌছবে, তারা যেন আমরা না আসা পর্যন্ত পানি পান না করে অপেক্ষ কের।” কিন্তু সবার আগে একদলমুনাফিক সেখানে পৌছে এবং সেখানে যেটুকু পানি ছিল তা পান করে ফেরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌছে দেখলেন একটু পানিও নেই। তিনি বললেন, “আমাদের আগে কে এখানে এসেছে?” তাকে জানানো হলো যে, অমুক অমুক প্রথমে সেখানে এসেছে। তিনি বললেন, “আমি তো নিষেধ করেছিলাম যে,, আমি এসে পৌছার আগে কেউ পানি পান করবে না।” অতঃপর তিনি ঐ মুনাফিকদের অভিশাপ ও বদদোয়া করেন। তারপর তিনি সওয়ারী থেকে নেমে পাহাড়ের পাদদেশে হাত রাখলেন। তৎক্ষনাৎ আল্লাহর ইচ্ছায় বিপুল পরিমাণ পানি গড়িয়ে পড়তে থাকলো। অতঃপর সেখান থেকে পানি পান কররেন, পাহাড়ের ঐ স্থানটায় হাত বুলালেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মত প্রবল গর্জনে পানির ফোয়ারা ছুটলো। লোকেরা তৃপ্ত পানি পান ও অন্যান্য প্রয়েঅজন পূর্ন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যদি দীর্ঘ আয়ু পাও তাহলে ভবিষ্যতে এই উপত্যকার খ্যতি শুনতে পাবে এবং এই পানি উপত্যকার আশপাশের এলাকাকে উর্বর  করে তুলবে।”

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ আবু রুহাম গিফারীর ভ্রাতুষ্পুত্র থেকে ইবনে উকায়মা লায়সী এবং লায়সী থেকে ইবনে শিহাব যুহরী বর্ণনা করেছেন যে,, আবু রুহাম কুলসুম ইবনে হুসাইন যিনি ‘বাইয়াতুল রিদওয়ান’ এ অংশগ্রহণকারী অন্যতম সাহাবী ছিলেন, বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাবুক অভিযানে যোগদান করেছিলাম। তাঁর সাথে সফর করছিলাম। একদিন রাতে যখন তাবুকের পার্শ্ববর্মী আখদার অতিক্রম করছিলাম তখন আল্লাহ আমাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। যেহেতু আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের ওসয়ারীর একেবারে নিকটবর্তী ছিল এবং দুটো কাছাকাছি হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ে আমার সওয়ারীর আঘাত লাগতে পারে এই আশংকায় আমি জেগে থাকতে এবং আমার সওয়ারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। এই অবস্থায় পথিমধ্যে রাতের একাংশে আমার ঘুম অদম্য হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারীর সাথে গায়ে গায়ে লেগে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘উহ’ শব্দে আমি জেগে উঠলাম। বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তিনি বললেন, “চলতে থাক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু গিফারের কে কে অভিযানে আসেনি তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন আর আমি তার জবাবে যেসব লোক আসেনি তাদের নাম বলতে লাগলাম। তিনি বললেন, “পাতলা দাড়ি ও ভ্রুওয়ালা লম্বা লালচে বর্নের লোকগুলোর খবর কি?” আমি তাঁকে তাদের না আসার কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘সবলদেহী খর্বাকার কালো লোকগুলো কি করেছে?” আমি বললাম, “আমাদের মধ্যে এ ধরনের কাউকে আমি দেখছি না।” তিনি বললেন, “হিজাযের গিফার ও আসলামের বসতি এলাকয় যাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে?” আমি তাদের কথা বনু গিফারের প্রসঙ্গেই স্মরণ করতে চেষ্টা করেচিলাম। কিন্তু মনে পড়েনি। অবশেষে আমার মনে পড়লো যে, তারা বনু আসলামের একটা গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যারা আমাদের মিত্র ছিল।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারা  অন্ততঃ নিজেদের একটা উট দিয়ে একজন সক্ষম যোদ্ধাকে আল্লাহর পথে জিহাদে আসতে সাহায্য করতে পারতো। এতে তাদের কোন বাধা ছিল না। আমার সঙ্গীদের ভেতরে আর যে যাই করুক, কুরাইশ মুহাজির, আনসার, বনু গিফার ও বনু আসলামের লোকদের আমার সাথে না আসা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক।

নবম হিজরীর রমযান মাসে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদলের আগমন ও ইসলাম গ্রহণ

ইবনে ইসহাক বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে আসেন এবং সেই মাসেই তাঁর কাছে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই প্রতিনিধিদল আগমনের পটভূমি এই যে, ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তায়েফ থেকে ফিরে আসেন তখন উরওয়া ইবনে মাকউদ সাকাফী তাঁর পিছু পিছু আসেন। মদীনায় পৌছারআগেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হন এবং ইসলাম গ্রহন করেন। অতঃপর তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওরা তোমাকে হত্যা করবে।” তিনি বনু সাকীফ গোত্রের গোঁয়ার্তুমি ও একগুয়েমীর কথা জানতেন। তিনি এও জানতেন যে, তারা নিজস্ব কোন লোকের দাওয়াত অগ্রাহ্য করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু উরওয়া বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের কাছে নবজাতক শিশুর চেয়েও প্রিয়।”

তিনি প্রকৃতই তাদের কাছে অনুরূপ প্রিয় ও মান্যগণ্য ছিলেন। অনন্তর তিনি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। তাঁর আশা ছিল গোত্রের মধ্যে তাঁর যতখালিন মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তাতে কেউ হয়তো তাঁর বিরোধিতা করবে না। তিনি নিজ গোত্রের ছাদের ওপর থেকে গোত্রের লোকদেরকে যথাযথভাবে দাওয়াত দিয়ে ও নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানিয়ে যখন তাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন চারদিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা হয়। একটি তীর তাকে আঘাত করে এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

বনু মালিকের মতে তাকে হত্যা করে বনু সালেম ইবনে মালিকের আওস ইবনে আওফ এবং তার মিত্রদের মতে তাকে হত্যা করে বনু আত্তাব ইবনে মালিকের ওয়াহাব ইবনে জাবের। (বনু সালেম ও বনু আত্তাব বনু সাকীফের শাখা বনু মালিকভুক্ত পরিবার)। উরওয়া আহত হওয়ার পর তাকে বলা হয়, “আপনার হত্যা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?” তিনি বলেন, “এটা আল্লাহর তরফ থেকে আমার জন্য এক পরম সম্মান ও গৌরব। আল্লাহ নিজেই আমাকে শাহাদাতের এই গৌরবে ভূষিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এই স্থান থেকে ফিরে যাওয়অর আগে তাঁর সাথে আগত যেসব মুজাহিদ শাহাদাত লাভ করেছেন, তাদের থেকে আমার মর্যাদা মোটেই বেশী নয়। কাজেই আমাকে তোমরা তাদের কাছেই দাফন করো।”

কথিত আছে যে, উরওয়াহ ইবনে মাসউদের শাহাদাতের খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করেন, “সূরা ইয়াসীনে যে মুজাহিদের শাহাদাতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে উরওয়া তার সাথে তুলনীয়।”

উরওয়াকে হত্যা করার পর এক মাস বনু সাকীফ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর তারা একটি পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হলো। তারা স্থির কররো যে,, চারপাশের গোটা আরব জাতি যেখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে সেখানে বনু সাকীফ একাকী তাদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সক্ষম নয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা স্থির করলো যে, পূর্বে যেমন তারা উরওয়াকে পাঠিয়েছিল তেমনি এবার আর একজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা উরওয়অ ইবনে মাসউদের সমবয়সী জনৈক আবদ ইয়ালীল ইবনে আমরের সাথে আলাপ করলো এবং তাকে বনু সাকীফের প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে ফিরে আসবে তখন বনু সাকীফ উরওয়ারর সাথে যে আচরণ করেছে তার সাথেও অনুরূপ আচরণ করবে। সে বললো, “আমার সাথে যদি আরো কয়েকজন লোক পাঠাও তাহলে আমি রাজী আছি, অন্যথায় নয়।” অবশেষে তারা ঠিক করলো যে, আব্দ ইয়ালীদের সাথে মিত্র গোত্রগুলো থেকে দু’জন এবং বনু মালিক থেকে তিনজন- সর্বমোট ছয়জনকে পাঠাবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা আব্দ ইয়ালীলের সাথে বনু মুয়াত্তাব পরিবারের হাকাম ইবনে আমর ও শুরাহবীল ইবনে গাইলানকে এবং বনু মালিক গোত্র থেকে বনু ইয়াসার পরিবারের উসমান ইবনে আবুল আসকে, বনু সালেম পরিবার থেকে আওস ইবনে আওফকে এবং বনু হারেস পরিবারের নুমায়ের ইবনে খারাশকে পাঠালো। আবদ ইয়ালীল দলনেতা হিসেবে তাদের নিয়ে রওনা হলো। সে উরওয়া বিন মাসমউদের ভাগ্য বরণের ঝুঁকি মুক্ত হবার অভিপ্রায়েই এই লোকদের সাথে নিল যাতে প্রত্যেকে তায়েফে ফিরে নিজ নিজ গোষ্ঠীকে এতে জড়িত করতে পারে।

প্রতিনিধিদল মদীনার নিকটবর্তী হলে একটি ঝর্ণার পাশে সাহাবাগণের কেউ কেউ উট চরানো সময় মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) দেখতে পেলো। ঐ উটগুলো পালাক্রমে চরানোর দায়িত্ব সাহাবীদের মধ্যেই ভাগ করা ছিল এবং ঐ সময়কার পালা ছিল মুগীরার। তাদের সাথে সাক্ষাত হওয়ার পর মুগীরা উটগুলোকে বনু সাকীফের প্রতিনিধিদের কাছে রেখেই ছুটে গেলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের আগমনের সুসংবাদ শোনানোর জন্য। মুগীরা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করার আগে আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) সাথে দেখা হেরা। তিনি তাকে জানালেন যে, বনু সাকীফের প্রতিনিধিরা ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে। তবে তারা চাফ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন তাদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেন এবং তাদের ধন-সম্পদ, জমিজমা ও অধিবাসীদের নিরাপত্তা চিশ্চিত করে একটা অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন। আবু বকর (রা) মুগীরাকে (রা) বলরেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর নামে অনুরোধ করছি, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে আমাকে আগে যেতে দাও এবং এ বিষয়ে তাঁর সাথে আমাকে আলোচনা করতে দাও।” মুগীরা (রা) এতে সম্মত হলেন। আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলেন এবং তাঁকে ঐ প্রতিনিধি দলের কথা জানারৈন। তারপর মুগীরা (রা) স্বগোত্রীয় বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। [উল্লেখ্য যে, মুগীরা (রা) বনু সাকীফ বংশোদ্ভুত ছিলেন]। দুপুর বেলা তিনি তাদের সাথে বিশ্রাম করেই কাটিয়ে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামী অভিবাদন জানানোর রীতি শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু সাক্ষাতের সময় তারা জাহিলী রীতি অনুসারেই অভিবাদন জানালো।

প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলে মসজিদে নববীর এক পাশে তাদের অবস্থানের জন্য একটি ঘর ঠিক করে দেয়া হয়। বনু সাকীফের জন্য একটি অঙ্গীকার পত্র লোকানো পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রতিনিধিদলের মধ্যে মত বিনিময় হয় খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আসের মাধ্যমে এবং এই খারিদই অঙ্গীকার পত্র লিখে দেন। এই সময়ে অঙ্গীকার পত্র লেখানো ও প্রতিনিধিদলের ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে আসা খাদ্যদ্রব্যও প্রথমে খারিদ না খেলে প্রতিনিধিদলের লোকজন খায়েনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা দাবী করে তার মধ্যে একটি ছিল, ‘তগিয়া’ অর্থাৎ লাভের পূজা অব্যাহত রাখতে দিতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে তা ভাঙ্গা চলবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তারা মেয়াদ কমিয়ে এক বছর করে। তাও প্রত্যাখ্যান করা হলে তারা কমাতে কমাতে এক মাসে নামিয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাও প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিনিধিদল এই দাবীর যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তাছিল এই যে, তারা তাদের গোত্রের অর্বাচীন শ্রেনী, তরুণ বংশধর ও নারীদের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে চান এবং গোত্রের লোকেরা ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার আগে মূর্তি ধ্বংস করার শাদ্যমে তাদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি কার তাদের মনঃপূত ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুতেই এ দাবী মানলেন না। তিনি বরং জোর দিয়ে বললেন যে, তিনি অবিলম্বে ঐ মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) পাঠাবেন। তারা এ দাবীও করেছিল যে, তিনি যেন তাদে নামায পড়তে এবং মূর্তিগুলোকে তাদের নিজ হাতে ভাঙ্গতে বাধ্য না করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফ সাফ বলে দিলেন যে,, নামায ছাড়া ইসলাম হতে পারে না তবে তোমাদের হাত দিয়ে মূর্তি ভাঙ্গতে বাধ্য করে হবে না। প্রতিনিধিদল নামাযকে মেনে নেয় ‘অবমাননাকর’ বলে মন্তব্য করেও তা মেনে নিতে সম্মত হলো।

অতঃপর তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য অঙ্গীকারনামা লিখে দিলেন। তারপর তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন উসমান ইবনে আসকে। তিনি ছিলেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য এবং কুরআন ও ইসলাম শিখতে অপেক্ষাকৃত বেশী আগ্রহী ছিলেন। আবু বাক্র (রা) তার সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে উসমানই ইসলাম বুঝতে ও কুরআন শিখতে অধিকতর মনে হয়েছে।”

দায়িত্ব সমাপনান্তে প্রতিনিধিদল যখন তায়েফ অভিমুখে রওনা হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) মূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের সাথেই পাঠিয়ে দিলেন। তারা উভয়ে প্রতিনিধিদলের সাথে রওনা হয়ে গেলেন। তায়েফের উপকণ্ঠে পৌছে মুগীরা (রা) আবু সুফিয়ানকে (রা) আগে পাঠাতে চাইলেন। আবু  সুফিয়ান তা অস্বীকার করে বললেন, “তুমি তোমার গোত্রের লোকদের সাথে আগে গিয়ে দেখা কর।” আবু সুফিয়ান ‘যুল হুদুম’ নামক জলাশয়ের কাছে থেকে গেলেন আর মুগীরা শহরে প্রবেশ করেই কোদাল নিয়ে লাভ ও অন্যান্য মূর্তি ভাঙ্গার জন্য তাদের ওপর চড়াও হলেন। মুগীরার (রা) গোতও বনু মুয়াত্তাব তাকে সহায়তা করলো এবং তা এই আশংকায় যে, তার পরিণতি যেন উরওয়া ইবনে মাসউদের মত না হয়। ওদিকে বনু সাকীফের মহিলারা মূর্তির জন্য মাতমকরতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। তারা বলতে লাগলো,

“রক্ষকের জন্য তোমরা কাঁদ [৮৮.মুশরিকরা লাতকে ‘দাফফা’ অর্থাৎ রক্ষক নামে অভিহি করতো। কেননা তারা বিশ্বাস করতো যে, লাত তাদেরকে শত্রু ও আপদ থেকে রক্ষা করে।]  নিমকহারামেরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। [৮৯.অর্থাৎ বনু সাকীফের লোকেরা তাদের রক্ষকের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছে এবং তাকে ধ্বংস হওয়ার জন্য মগীরার হাতে সোপর্দ করে চলে গেছে।]

তারা এর জন্য ভালো করে যুদ্ধও করলো না।” [৯০. অর্থাৎ রক্ষককে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করতে আসা উচিত ছিল। কিন্তু কেউ সেজন্য এগিয়ে এলো না।]

অতঃপর মুগীরা যখন লাতকে কুঠার দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন তখন আবু সুফিয়ান “আহা! আহা!” করতে লাগলেন।

লাতকে ধ্বংস করার পর মুগীরা মন্দিরের সমস্ত ধনরত্ন সংগ্রহ করে আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠালেন। এই ধনরতেœর মধ্যে ছিল বিপুল পরিমাণ সোনা ও রেশমী দ্রব্যাদি।

উরওয়া ইবনে মাসউদ শহীদ হওয়ার পর তার ছেলে আবু মুলাইহ ও ভ্রাতুষ্পুত্র কারেব ইবনে আসওয়াদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে এবং বনু সাকীফের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদেরকে চিরতরে ত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। এটা হচ্ছে ইয়ালীল প্রতিনিধিদলের আগমনেরও আগের ঘটনা। আবু মুলাইহ ও কারেব ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “তোমরা যাকে খুশী অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ কর।” তারা বললেন, “আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন,  তোমাদের মামা আবু সুফিয়ানকেও?” তারা বললেন, ‘হা’। পরে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুগীরা ও আবু সুফিয়ানকে লাভ ধ্বংস করতে পাঠালে আবু মুলাইহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, লাতর মন্দির থেকে যে ধনরত্ন উদ্ধার করা হবে তা থেকে আমার পিতার ঋণ শেঅধ করে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলে কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আসওয়াদের ঋণও শোধ করে দিন।”উল্লেখ্য যে, উরওয়া ও আসওয়াদ আপন ভাই ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আসওয়াদ মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে।”কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি একজন মুসরিম আত্মীয়কে অর্থাৎ আমাকে সাহায্য করুন। কেননা ঋণ আমার ঘাড়েই চেপে আছে এবং আমিই সাহায্য চাইছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলেন এবং আবু সুফিয়ানকে বলে দিলেন, “লাভের ধনরত্ন থেকে উরওয়া ও আসওয়অদের ঋণ শোধ করে দিও।” মুগীরা ধনরত্ন আবু সুফিয়ানের কাছে দেয়ার সময় তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লামের নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিলেন। আবু সুফিয়ান উরওয়া ও আসওয়াদের ঋণ শোধ করে দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সাকীফের জন্য যে অংগীকারনামা লিখে দিলেন তা নিম্নরুপঃ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মু’মিনদের প্রতি। ওয়াজ্জের (তায়েফের একটি জায়গা) কষ্টময় বৃক্ষরাজি কাটা নিষিদ্ধ। যে ব্যক্তি এ আদেশ লংঘন করবে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তাকে পাকড়াও করে নবী মুহাম্মাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশ। এ ঘোষণাপত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর নির্দেশে খালিদ ইবনে সাঈদ কর্তৃক লিখিত। কেউ যেন এ ঘোষণাপত্র লংঘন না করে। লংঘন করলে তা নিজের জন্য শাস্তি ডেকে আনারই নামান্তর হবে। কেননা এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশেই লিখিত।”

নবম হিজরী সালকে ‘প্রতিনিধিদল আগমনের বছর’ হিসেবে আখ্যায়িতকরণ। সূরা আন নাছর এই বছরই নাযিল হয়

ইবনে ইসহাক বলেন: মক্কা ও তাবুক বিজয়, বনু সাকীফের ইসলাম গ্রহণ ও আনুগত্যের শপথ প্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চারদিক থেকে আরবদের প্রতিনিধিদল আসতে শুরু করে।

আরবরা বলতে গেলে একমাত্র কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় ছিল। তারাই ছিল আরবদের নেতা ও দিশারী। তারা ছিল কা’বা শরীফ ও মসজিদুল হারামের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক এবং ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীমের (আ) অবিসম্বাদিত উত্তরপুরুষ। আরবের কেউ তা অস্বীকার করতো না। অথচ এই কুরাইশরাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগেছিল। মক্কা বিজয়ের সাথে সাথে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নত হলো এবং ইসলামের বশ্যত স্বীকার করলো। তখন আরবরা বুঝলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জয়যাত্রা রোধ করে ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে এমন ক্ষমতা তাদের নেই্ তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলো। চারদিক থেকে তাঁর কাছে লোকজন আসতে ও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। এ কথাটাই আল্লাহ তা’আলা সূরা নাছরে এভাবে বলেছেন-

[আরবী *******]

“আল্লাহর সাহায্র ও বিজয় যখন এসে গেছে এবং তুমি দেখছো যে, লোক দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে, তখন প্রশংসা সহ তোমার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তার কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।”

বনু তামীমের প্রতিনিধিদলের আগমন ও সূরা হুজুরাত নাযিল

আরব গোত্রসমূহ থেকে প্রতিনিধিদল আগমন শুরু হলে সর্বাগ্রে উতারিদ বিন হাকেব তামিমীর নেতৃত্বে বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই দলে বনু তামীমের নেতৃস্থানীয় লোকজনও ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকরা ইবনে হারেস, বনু মা’দের যাবারকান ইবনে বদর ও আমর ইবনে আহতাম এবং হাবহাব ইবনে ইয়াযীদ। এছাড়া নুয়াইম ইবনে ইয়াযীদ, কায়েস ইবনে হারেস, কায়েস ইবনে আসেম ও উযাইনা ইবনে হিসনও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইতিপূর্বে মক্কা বিজয় এবং হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে আকরা ইবনে হারেস ও উয়াইরা ইবনে হিসন অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা দু’জন বনু তামীমের প্রতিনিধিদলেও যোগ দেন। বনু তামীমের এই প্রতিনিধিদল মসজিদে নববীর কাছে এসে বাড়ীর বাইরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উচ্চস্বরে এই বলে ডকতে শুরু করে, “হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে আসুন এবং আমাদের সাতে দেখা করুন।” তাদের এই চিৎকার ও হাঁকডাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কষ্টকর হলো। তারা বললো, “আমরা এসেছি আপনার কাচে আমাদের গৌরবোজ্জল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে। তাই আমাদের প্রধান বক্তা ও কবিকে কথা বলার অনুমতি দিন।” তিনি অনুমতি দিলেন। তখন উতারিদ ইবনে হাজ্জেব বলতে লাগলো, “সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাদের ওপর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং একমাত্র তিনিই এর ক্ষমতা রাখেন। যিনি আমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন এবং আমাদেরকে বিপুল ধন সম্পদে ও ঐশ্বর্য্যে সমৃদ্ধ করেছেন। যার দ্বারা আমরা বদান্যতার পরিচয় দিয়ে থাকি। যিনি আমাদেরকে সমগ্র প্রাচ্যবাসীর মধ্যে সর্বাধিক জনবল ও ধনবলের অধিকারী করেছেন। আমাদের সমকক্ষ আর কেউ আছে কি? আমরাই কি তাদের নেতা এবং সবচেযে অভিজাত নই? আভিজাত্য ও কৌলিন্যে যে আমাদের সমকক্ষতার দাবী করে সে নিজ শেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিক। আমরা ইচ্ছা করলে আরো অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিয়ে বেশী বাগাড়ম্বর করতে আমরা লজ্জাবোধ কলি। আমাদের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা সুপরিচিত। আপনাদেরকে আমাদের মত আত্মপরিচয়মূলক বক্তব্য পেশ করা এবং আরো ভালো বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দানের জন্যই এসব কথা বললাম।”

এ পর্যন্ত বলেই উতারিদ বসলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিত ইবনে সায়েসকে (রা) বললেন, “ওঠো এবং তার ভাষনের জবাব দাও।”

সাবিত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“সেই মহান আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা, আসমান ও যমীনে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর করেছেন, তাঁর জ্ঞানের পরিধি তাঁর কর্তৃত্বের পরিমন্ডল জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া কখনো কোন জিনিষের উদ্ভব ও আবির্ভাব ঘটে না, আমাদের মধ্যে রাজা বাদশাহর আবির্ভাব তাঁরই অনুগ্রহের ফল। আপন অনুগ্রহের বশেই তিনি আপন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠতম বংশীয়, আভিজাত্যে ও অতুলনীয় সাত্যবাদিতার গুণে ভূষিত ব্যক্তিকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। অতঃপর তাঁর ওপর স্বীয় গ্রন্থ নাযিল করেছেন, তাঁকে সমগ্র মানব জাতির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেছেন, একমাত্র তিনিই সমগ্র বিশ্বজগতের মধ্যে আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিরূপে গণ্য হয়েছেন। অতঃপর মানুষকে তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন, ফলে তাঁর স্বগোত্র ও আপনজনের মধ্র থেকে মুহাজিরগণ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেছেন- যারা সবার চাইতে কুলীন, সবার চাইতে সম্ভ্রান্ত ও মর্যাাদাশীল, সবার চাইতে সৎকর্মশীল। যারা সর্বপ্রথম রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল তারা আমরাই। সুতরাং আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ সাহায্যকারী এবং তাঁর রাসূলের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী। যারা ঈমান আনে না তাদের সাথে আমরা যুদ্ধ করি; যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে তাদের জানমাল আমাদের হাত থেকে নিরাপদ, আর যে কুফরী করে তাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের ভিত্তিতেই আমরা সংগ্রামে লিপ্ত হই। সে সংগ্রামের কোন শেষ নেই। তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য বৈধ। একথা বলেই আমি নিজের জন্য এবং সকল মুসলমান নারী পুরুষের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। আস্সালামু আলাইকুম।”

অতঃপর যাবারকান ইবনে বদর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন। কবিতাটির মর্ম এইঃ

“আমরাই সম্মানিত। কোন গোত্র আমাদের সমকক্ষ নয়। রাজা বাদশাহ আমাদের মধ্যেই বিরাজমান এবং আমাদের  উদ্যোগেই তাবত উপাসনালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কত গোত্রকে আমরা বলপূর্বক লুণ্ঠন করেছি তার শেষ নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের মান মর্যাদা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে। দুর্ভিক্ষের সময়ও আমাদের লোকের ভূনা গোশত আহার করায়। মেঘ যখন মানুষের আকাঙ্খা মুতাবিক বৃষ্টি বর্ষন করে না তখন রাত্রিকালে পথিকেরা সব জায়গা থেকেই আমাদের কাছে ছুটে আসে আর আমরা তাদের খাবারের আয়োজন করি। তখন আমরা বড় বড় উট জবাই করি এবং মেহমানদের পেট ভরে খাওয়অই। এটাই আমাদের মজ্জাগত রীতি। যখনই তুমি দেখবে যে, আমরা কোন গোত্রের কাছে গিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের গর্ব প্রকাশ করছি, তখনই দেখতে পারেব যে, তারা আমাদের অনুসারী হয়ে যাচ্ছে আর তাদের মাথা অবনমিত হয়ে আসছে। সুতরাং আজ যে ব্যক্তি আমাদের সামনে তার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরবে, তার বর্ণনায় আমরা নতুন জ্ঞান লাভ করবো এবং আমাদের প্রতিনিধিদল ফিরে গেলে সে তথ্য প্রচারিত হবে। আমরা কারো শ্রেষ্ঠত্বের মানতে রাজী নই। তবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কেউ অস্বীকার করবে না। এভাবেই আমরা গৌরব ও গর্বে অজেয়।”

হাসসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু তামীমের কবির জবাব দেওয়ার জন্য তলব করলেন। তিনি এসে কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন। সে কবিতায় মর্ম নিম্নরুপঃ

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন তখন আমাদের মধ্যে তাঁকে পছন্দকারী  ও অপছন্দকারী উভয় রকমের লোক থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করেছি। আমাদের বসতিতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে আমরা তাঁকে তরবারী সজ্জিত হয়ে সকল জালিম ও আগ্রাসীর হাত থেকে রক্ষা করেছি। তিনি এক সম্মাানিত গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন- যা (সিরিয়ার) জারিয়াতুল জাওলানের সন্নিহিত অপরিচিত লোকদের মধ্যে অবস্থিত। প্রাচীন মহত্ত্ব, আভিজাত্য এবং রাজকীয় সম্মান ও কঠিন মুসিবত সহ্য করার মত গৌরব আর কিছুতে নেই।”

হাসসান বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছেই আমি প্রতিনিধিদ দলের কবি যে কবিতা আবৃত্তি করেছিল হুবহু তার ছন্দ অনুকরন করে পাল্টা কবিতা আবৃত্তি করলাম। যাবারকান তার কবিতা আবৃত্তি সম্পন্ন করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসানকে বললেন, “হে হাসসান! যাবারকানের কবিতার জবাব দাও।” হাসসান দাঁড়িয়ে জবাবী কবিতা আবৃত্তি করলেন। কবিতার মর্ম নিম্নরুপ:

“কুরাইশ বংশের নেতৃবৃন্দমানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপিত করেছেন। খোদাভীতি যাদের জীবনের গোপন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং যারা ন্যায় ও সততাকে অনুকরণ করে তারা সকলেই তাদের ওপর খুশী। তারা কুরাইশী নেতৃবৃন্দ। এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা যুদ্ধরত হলে শত্রুকে পর্যুদস্ত করে দেন অথবা (নিদেনপক্ষে) নিজের গোষ্ঠীর (মু’মিনদের)কল্যাণ সাধনের চেষ্ট করেন এবং কল্যাণ সাধন করেন। এটা তাদের কোন নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বস্তুতঃ চরিত্রের যা কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য তাই খারাপ। তাদের পরে জনগণের মধ্যে আর যদি কোন বিজয়ীর আগমন ঘটে তা’হলে এ রকম প্রত্যেক বিজয়ী তাদের নগন্যতম বিজয়ীদের চেয়েও নগণ্যতর। তারা যদি  কোথাও দুর্বলতা দেখিয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ সেখানে কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম নয়। আর সকল মানুষ যেখানে কৃতিত্ব দেখায় সেখানে তারা কোন দুর্বলতা দেখায় না। তারা যদি সাধারণ মাুনষের সাথে প্রতিযোগিতা করে কিংবা অভিজাত ও মর্যাদাশীলদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করে তাবে তারাই অগ্রগামী হয়ে থাকে। তারা এমন নিস্কলুষতার উল্লোখ করা হয়। তারা কোনম অপবিত্রতায় জড়িত হয় না এবং কোন লোভ লালসা তাদেরকে হীনতায় পতিত করে না। প্রতিবেশীর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনে তারা কার্পন্য করে না এবং কোন তুচ্ছ জিনিসের প্রতি তারা মোহাবিষ্ট হয় না। আমরা যখন কো গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করি তখন তা গোপন রাখি না এবং বুনো গরুর তম গোপনে হিং¯্রতায় মত্ত হই না। যুদ্ধ যখন আমাদের ওপর আগ্রাসী মুষ্ঠি উত্তোলন করে এবং নিরীহ মানুষ যখন তার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তখন আমরা তাকে বাগে আনি ও বশীভূত করি। তারা (কুরাইশ নেতৃবৃন্দ) শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে পারলে গর্বিত হয় না এবং নিজেরা পরাজিত হলেও হতাশ ও ভীত হয় না। তারা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে লড়াইতে লিপ্ত থাকে তখন তাদের অবস্থা হিলয়ার জঙ্গলের সেই সিংহের মত যার পায়ের কবজিতে শিকল পরানো সম্ভব নয়। তারা স্বোচ্ছায় যা দেয় তাই গ্রহণ কর। আর ক্রোধবশে যা দিতে চায় না তা নিতে চেয়ো না। তাদের সাথে যুদ্ধ করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও তিক্ত। অতএব তাদের শত্রুতা পরিত্যাগ কর। যখন অন্যান্য লোকেরা দলে দলে বিক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের প্রকৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তখনও আল্লাহর রাসূলকে তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধা করে। আমার একাত্মতা বোধকারী মন তাদের প্রতি আমার প্রশংসা উৎসর্গ করেছে, যে কোন মানুষের জিহ্বাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ লোকগণ গুরুত্ব সহকারে অথবা ঠাট্রাচ্ছলে যাই বলুক না কেন- তারাই [মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীরা] সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী।”

কবিতা ও পাল্টা কবিতা পাঠের এই পালা শেষ হওয়ার পর আগন্তুক প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শুভেচ্ছামূলক প্রচুর উপঢৌকন দিলেন। প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসার সময় আমর ইবনে আহতাম নামক এক অল্পবয়স্ক যুবককে উটের কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছিল। কায়েস ইবনে আসেম তার প্রতি কিছুটা ক্রুব্ধ ছিল। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের এক ব্যক্তিকে সওয়ারী কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তবে সে অল্পবস্ক তরুণ।” সে তার ব্যাপারটা একটু হালকা করে দিতে চাচ্ছিল এবং তাকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই- এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও অন্যান্যদের মত উপঢৌকন দিলেন। কায়েসের এ কথা জানতে পেরে আমর ইবনে আহতাম তাকে তিরস্কার করে কবিতা আবৃত্তি করলো-

“তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার নিন্দা করেছিস, কিন্তু মিথ্যা বলেছিস আর আমার ক্ষতিও করতে পারিসনি।

আমরা তোদের ওপর সর্বাত্মকভাবে প্রভুত্ব করেছি। অথচ তোদের প্রভুত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পথে।”

ইবনে ইসহাক বলেন, এই প্রতিনিধিদল সম্পর্কেই সূরা হুজুরাতের এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী *******]

“হে রাসূল! যারা আপনাকে বাড়ীর বাইরে পর্দার আড়ালে থেকে হাঁকডাক করে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (হুজুরাহ)

বনু আমেরের প্রতিনিধি আমের ইবনে তুফাইল ও আরবাদ ইবনে কায়েসের ঘটনা

বনু আমেরের তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল এল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তারা হলো আমের ইবনে তুফাইল, আরবাদ ইবনে কায়েস ও জাব্বার ইবনে সালামী। এরা ছিল গোত্রের সবচেয়ে কুচক্রী সরদার। আমের ইবনে তুফা।ীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে এক মারাত্মক চক্রান্ত এঁটে এসেছিল। ইতিপূর্বে তাঁর গোত্রের লোকজন- দেশের অধিকাংশ লোকে ইসলাম গ্রহণ করছে- এই যুক্তি দেখিয়ে তাকেও মুসলমান হবার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে বলে, “আমি শপথ নিয়েছি। সমগ্র আরব জাতি আমার নেতৃত্ব মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি থামবো না। আজ কিনা কুরাইশ গোত্রের এই তরুণের নেতৃত্ব আমি মেনে নেব।” আমের আরবাদকে বললো, “আমরা দু’জনে যখন মুহাম্মাদের সাথে দেখা করতে যাবো তখন দু’জনে দু’দিকে বসবো। মুহাম্মাদ যখন আমার সাথে কথা বলতে  আমার দিকে মুখ ফেরাবে ঠিক তখনই তুমি তাঁকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে।”

অতঃপর প্রতিনিধিদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করলো। আমের বলতে লাগলো, “হে মুহাম্মাদ, আমাকে একটু নির্জনে কথা বরার সুযোগ দাও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যতক্ষণ এক আল্লাহর ওপর ঈমান না আনবে ততক্ষণ সে সুযোগ দেব না।” আমের আরবাদকে সুযোগ দেয়ার জন্য বার বার ঐ একই কথা বলতে লাগলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কিচুতেই তার সাথে নির্জনে কথা বলতে রাজী হলেন না তখন সে প্রতিনিধিদল নিয়ে সটকান দিল। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল, “দেখে নিও, আমি বিরাট এক বাহিনী নিয়ে তোমার ওপর হামলা চালাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে আমের ইবনে তুফাইল থেকে রক্ষা কর।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমের আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ, ধিক্ তোমাকে, যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তার কি করলে? আল্লাহর কসম, প্রথিবীতে আমি তোমাকেই সবচেয়ে বীর পুরুষ মনে করতাম এবং তোমাকেই সবচেয়ে বেশী ভয় করে চলতাম। আজ থেকে আর তোমাকে ভয় করােবা না।” আরবাদ বললো, “তোর সর্বনাশ হোক! তাড়াহুড়া করিসনে। আমাকে যা করতে বলেছিলি তা করতে উদ্যত হয়েই দেখি, আমার সামনে তুই ছাড়া আর কেউ নেই। সে অবস্থায় কোপ দিলে তো ঘাড়েই পড়তো। শেষ পর্যন্ত তোকেই আমি কোপ দেব নাকি?”

অতঃপর তারা নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে আল্লাহ আমের ইবনে তুফাইলের ঘাড়ে প্লেগ দিলেন। বনু সালুলেল এক মহিলার বাড়ীতে গিয়ে সে ঐ প্লেগেই মারা গেল। মৃত্যুকালে সে বিলাপ করে বলতে লাগলো, “হে বনু আমের। আমাকে কি শেষ পর্যন্ত উটের গলগন্ডতেই ঘরলো আর তাও বনু সালুলের এক মহিলার বাড়িতে?” [৯১. বনু সালুল আরবদের মধ্যে অত্যন্ত কাপুরুষ ও হীনমনা গোত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। কবি সামাওয়াল বলেন, “আমরা এমন এক গোষ্ঠী যারা হত্যাকে বনু আমের ও বনু সালুলেল মত লজ্জাকর মনে করি না।”] আমেরকে সমাধিস্থ করে তার সঙ্গীরা বনু আমেরের বসতিতে দুটো ছাগল নিয়ে হাজির হলো। প্রতিনিধিদের গোত্রের লোকেরা আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ! তোমরা কি করে এলে?” সে বললো, “কিছুই না। সে (মুহাম্মাদ) আমাদেরকে এমন এক সত্তার ইবাদাত করার আহ্বান জানিয়েছে যাকে নাগালে পেলে আমি তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করতাম।” এ কথা বলার এক বা দুই দিন পর আরবাদ তার উট নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সহসা আল্লাহ তার ওপর আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করে উট সহ আরবাদকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলেন। আরবাদ ছিল কবি লাবীদের ভাই। সে আরবাদের মৃত্যুতে নিম্নরূপ শোকগাথা রচনা করে:

“মৃত্যু কাউকেই ছেড়ে দেয়না, স্নেময় পিতাকেও না।

আরবাদের ওপর একমাত্র মৃত্যুরই আশংকা করতাম- আকাশ থেকে কোন দুর্যোগ

কিংবা সিংহের আক্রমণের আশংকা করতাম না।

অতএব, হে চক্ষু, আরবাদের জন্য অশ্রুবর্ষণ করোনা কেন?

যখন আমরা নারী পুরুষ সকলেই কঠিন দুঃখ কষ্টের ভেতররে কাল কাটাচ্ছিলাম

তখন তারা সবাই যদি চিৎকার করতো আরবাদ তার পরোয়া করতো না।

আর তারা যদি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো তবে

সেক্ষেত্রেও আরবাদ মধ্যম পন্থা অবলম্বন  করতো।

সে একজন মিষ্টভাষী বুদ্ধিমান এবং ন¤্র হৃদয় মানুষ।

সেই সাথে তার মধ্যে তিক্ততাও ছিল।

বৃক্ষরাজি যখন শীতকালে উজাড় হয়ে যায়, এবং পুনরায় তা যখন ফলাদায়ক ও

তরতাজা হয় এবং অবশিষ্ট আশাপ্রদ জিনিসগুলো দেখা দেয়,

(অর্থাৎ দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং পরে আবার দেশে ফসল উৎপন্ন

হওয়ার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়।) তখন সে (আরবাদ)

জঙ্গলের হিংস্র সিংহের চেয়েও বরিত্ব এবং অভ্যস্ত সূক্ষদর্শিতা পরিচয় দিত)।

তার শোকে আহত মাতমকারিনীরা মাতম করছে, যেন তরুণ হরিণীরা

ঊষর মরুভূমিতে (নিষ্ফল রোদন করছে।) দুর্যোগের দিনটাতে

সেই বীর অশ্বারোহীর বজ্রঘাতে মৃত্যু আমাকে মর্মাহত করেছে।

সে ছিনতাই করতো আবার লুণ্ঠিত ব্যক্তি যদি তার কাছে আসতো তাহলে তাকে

ক্ষতিপূরণ দিত, ইচ্ছা হলে (লুণ্ঠিত জিনিস) ফিরিয়ে দিত।

তার অনেক অভাব থাকা সত্ত্বেও উদ্ভিদ উৎপাদন করে থাকে।

প্রস্তরময় অঞ্চলের অধিবাসীরা মাত্রই ভাগ্যাহত তা

তাদের জনসংখ্যা যতই বেশী হোক না কেন।

কখনো তারা একটু সমৃদ্ধশালী হলেও পরক্ষণেই আবার তাদের কপালে

নেমে আসে দারিদ্র। তারা সংখ্যায় অধিক হলেও ধ্বংস ও

বিনাশের কবলে পড়ার জন্যই হয়।

 

জারুদের নেতৃত্বে বনু আবদুল কায়েসের প্রতিনিধিদলের আগমন

বনু আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিদল খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী জারুদ ইবনে আমরের নেতৃত্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে। হাসান বর্ণনা করেন করেন: জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করলো, তিনি তার নিকট ইসলাম পেশ করলেন এবং তাকে ইসলাম প্রহণের দাওয়াত ও উপদেশ দিলেন। জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লা। আমার একটা ধর্ম আছে। এখন আপনার ধর্ম গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে রাজী আছি। তবে নিজ ধর্ম ত্যাগ করায় আমার কোন ক্ষতি হবে না- আমাকে এ নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারেন কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যা, আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি ইসলাম গ্রহণের অর্থ দাঁড়াবে এই যে, আল্লাহ তোমার ধর্মের চেয়েও ভাল ধর্ম গ্রহণ করার সুযোগ দিলেন।”

এ কথা শুনে জারুদ ও তার সঙ্গীরা ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দেশে ফিরে যাওয়অর জন্য সওয়ারী [বাহন] প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারী প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। তখন জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের স্বদেশ গমনের পথে অনেক লাওয়ারিশ পথভ্রষ্ট উট পাওয়া যায়। সেগুলোতে চড়ে আমরা যেতে পারি কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না,খবরদার। এগুলোতে আরোহণ করো না। ওগুলো দোযখে যাওয়ার বাহন হবে।”

অতঃপর জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে স্বদেশ মুখে রওনা হলেন। তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইসলামের ওপর অবিচল ছিলেন এবং খুবই ভালো মুসলমান ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর যখন কিছু লোক ইসলাম ত্যাগ করে, সে সময়ও তিনি বেঁচে ছিলেন।

তার গোত্রের কয়েকজন মুসলমান তাদের পূর্ব ধর্মে ফিরে গেলে জারুদ তাদের সামনে ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম- এ কথা ব্যাখ্যা করলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দিলেন। তিনি বললেন, “হে লোকজন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি এ কথাও ঘোষণা করছি যে, যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দেয় না সে কাফির।”

মুসাইলিমা কাযযাব সহ বনু হানীফা প্রতিনিধিদলের আগমন

মুসাইলিমা কাযযাব সহ বনু হানীফা প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে তারা আনসারদের এক মহিলা বিনতে হারিসের বাড়ীতে ওঠে যিনি পরবর্তী সময় বনু নাজ্জারের গ্রহিনী হন। মদীনাবাসী জনৈক ঐতিহাসিক জানিয়েছেন যে, বনু হানীফার প্রতিনিধিদল মুসাইলিমাকে কাপড়ে ঢেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাদের সাথে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটা পাতা-ছাঁটা খেজুরের ডাল। ডালের মাথার দিকে কয়েকটি পাতা ছিল। কাপড়ে আচ্ছাদিত মুসাইলিমা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছে তাঁর সাথে কথা বললো এবং কিছু দান প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যদি এই খেজুরের ডালটি আমার কাছে চাও তবে তাও আমি দেব না।”

ইবনে ইসহাক বলেন: ইয়ামামার অধিবাসী বনু হানীফার জনৈক বৃদ্ধ আমাকে মুসাইলিমার ঘটনাঅন্য রকম জানিয়েছেন। তিনি বলেন,

বনু হানীফার প্রতিনিধদল যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করতে আসে তখন মুসাইলিমাকে উটের কাফিলায় রেখে আসে। প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানায় যে, মুসাইলিমাও তাদের সাথে উপস্থিত হয়েছে। তারা বলে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা আমাদের এক সঙ্গীকে উটের কাফিলার রক্ষক হিসেবে রেখে এসেছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলের অন্যান্য সদস্যকে যেরূপ উপঢৌকন দেন সেরূপ তাকেও দেন। তিনি এ কথাও বললেন “তোমাদের ঐ সঙ্গিটি তোমাদের চাইতে কম মর্যাদার লোক নয় যে, তাকে এখানে না এনে তোমাদের জিনিসপত্র পাহারা দিতে রেখে এসেছ।” অতঃপর প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে চলে গেল এবং তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দিয়েছিলেন তা তার হাতে পৌছিয়ে দিল। অতঃপর তারা ইয়ামামার পৌছা মাত্রই মুসাইলিমা ইসলাম ত্যাগ করলো এবং মিথ্যা নবুওয়অতের দাবী কের বসলো। সে বললো, “তোমারা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমার কথঅ উল্লেখ করেছিলে তখন তিনি কি বলেননি যে,, ‘সে তোমাদের চাইতে কম মর্যাদাশীল নয়।’এ কথা তিনি এ জন্যই বলেছেন যে, আমি যে তার সহকর্মী নবী তা তিনি জানেন।” এরপর সে তাদের কাছে নানা রকমের ছন্দবদ্ধ কথা বলে কুরআনের সাথে সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তার এ ধরনের একটি ছন্দবদ্ধ উক্তি হলো,

[আরবী *******]

“আল্লাহ গর্ভবতী মহিলাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন নেকনা তিনি তাদের পেট থেকে চলাচল করতে সক্ষম মানুষ বের করেছেন-নাড়ীভুঁড়ি ও তরল পদার্থের মধ্য থেকে।”

মুসাইলিমা তার গোত্রের জন্য মদ ও ব্যভিচার হালাল এবং নামায মাফ করে দেয়। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত সে স্বীকার করতে থাকে। বনু হানীফা গোত্র তার এ মনগড়া দাবী মেনে নেয়।

উপরোক্ত দুই রকমের বর্ণনার মধ্যে কোনটি সঠিক তা আল্লাহই ভাল জানেন।

হাতিম তাঈ-এর পুত্র আদীর ঘটনা

আদী ইবনে হাতিম বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমি তাঁর প্রতি যতটা ঘৃণ্য পোষন করতাম অতটা আরবের আর কেউ করাতা না। আমি নিজে সম্ভ্রান্ত খৃষ্টান ছিলাম। আমি গোত্রপতি হিসেবে রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমার মনে তাঁর প্রতি প্রবল বিদ্বেষ জন্ম নিল। আমার এক আরব গোলাম ছিল। সে আমার উট চরাতো। তাকে বললাম, “আমার জন্য ভাল পোষমানা মোটাসেটা দেখে কয়েকটা উট প্রস্তুত রাখো এবঙ এগুলো আমার কাছে বেঁধে রাখো। তারপর যখন শুনবে, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী এদিকে আসছে তখন আমাকে জানাবে।” সে উট এনে আমার কাছে বেঁধে রাখলো।

একদিন সকালে সে আমার কাছে এসে বললো, “হে আদী, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী তোমার ওপর চড়াও হলে কি করতে চেয়েছিল এক্ষুণি তা কর।” আমি কতকগুলো পতাকা উড়তে দেখে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো, কিসের পতাকা?” তারা বললো, “এগুলো মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীর পতাকা।” আমি একথা শুনে গোলামকে বললাম, “তাহলে আমার উটগুলো কাছে নিয়ে এসো।” একটি উটের পিঠে আমি চড়ে বসলাম। অপরগুলিতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বসালাম। তারপর সিরিয়ার খৃষ্টনাদের কাচে যাওয়ার জন্য উচের কাফিলা হাঁকালাম। কাফিলা জোশিয়া পার্বত্য পথ ধরে রওনা হলো। পেছনে হাতিমের এক কন্যাকে গোত্রে রেখে গেলাম। আমি সিরিয়ায় গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল অশ্বারোহী আমার সন্ধানে এসে হাতিমের কন্যাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে নিয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে হাজির করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সিরিয়া পালানোর খবর জেনে ফেলেছিলেন। তিনি হাতিমের কন্যাকে মসজিদে নববীর এক পার্শ্বে অবস্থান করতে দিলেন। সেখানে অণ্যান্য যুদ্ধবন্দিনী মহিলা ও আটক ছিল। হাতিমের কন্যা ছিল সুবক্তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সে বললো,“ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা মারা গেছেন এবং তত্ত্বাবধায়ক নিখোঁজ হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমার ওপর অনুগ্রহ করুন, আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কে তোমার তত্ত্বাবধায়ক?” সে বলে, “আদী ইবনে হাতীম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে আদী আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল থেকে পালিয়েছে সে?” এ কথা বলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। হাতিম তনয়া বলেন পরদিন আবার তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আবার আগের দিনের মত বললাম। তিনিও আগের দিনের জবাবের পুনরাবৃত্তি করলেন। তার পরের দিন আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পাশ দিয়ে যেতে লাগলেন। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারী এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “উঠে দাঁড়াও এবং রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বল।” আমি দাঁড়ালাম এবং পুনরায় বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি পিতৃহীনা এবং আমার অভিভাবকও নিখোঁজ। অতএব আমার ওপর অনুকম্পা প্রদর্শন করুন। আল্লাহ আপনাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমার আবেদন আমি গ্রহণ করছি। তুমি এখান থেকে বেরুবার জন্য তাড়াহুড়া  করো না। তোমার গোত্রের এমন কোন বিশ্বস্ত লোক পেলে আমাকে জানবে যে তোমাকে তোমার দেশে পৌছেয়ে দিতে পারে।” আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে ব্যক্তি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বলতে বলেছিল তিনি আবু তালিবের পুত্র আলী (রা)। আমি সেখানে থাকতে লাগলাম। অবশেষে বালী অথবা কুজায়া গোত্রের একদল উষ্ট্রারোহী এল। আমার ইচ্ছা ছিল সিরিয়াতে ভাইয়ের কাছে যাবো। তাই ঐ কাফিলাকে উপযুক্ত সঙ্গী মনে করে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার গোত্রের একদল লোক এসেছে। তাদের ওপর আমার আস্থা আছে এবং আমার গন্তব্যে পৌছার জন্য ওরা উপযোগী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সওয়ারী দিলেন, পাথেয় দিলেন এবং পোশক-পরিচ্ছদ দিলেন। আমি দলটির সাথে রওনা হয়ে সিরিয়া পৌছে গেলাম।

আদী বলেনঃ আমি স্বীয় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসে ছিলাম। সহসা এক উষ্ট্রারোহী মহিলাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম, সম্ভবত সে হাতিমের কন্যাই হবে। দেখলাম, সত্যিই তাই। সে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। বললো, “আত্মীয়তা ছিন্নকারী যলিম। তোমার পিতার পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যকে অরক্ষিত রেখে নিজের সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পলিয়ে এসেছো?” আমি বললাম, “হে বোন! আমাকে তিরষ্কার করো না। আমার বাস্তবিকই কোন ওজর নেই। তুমি যা বলছো আমি সত্যিই তাই করেছি।”

সে উটের পিঠ থেকে নামল এবং আমার কাছেই থাকতে লাগলো। সে একজন প্রখর ধীশক্তি সম্পন্না মহিলা ছিল। আমি বললাম, “মুহাম্মাদ সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?” সে বললো, “আমার ধারণা, তোমার অবিলম্বে তাঁর আন্দোলনে যোগদান করা উচিত। যদি তিনি নবী হয়ে থাকেন তাহলে যে তাঁর কাছে আগে যাবে তার প্রতি তাঁর বেশী অনুগ্রহ হবে। আর যদি তিনি রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে ইয়ামনের সম্ভ্রান্ত লোকদের সামনে তোমার গৌরব মোটেই হ্রাস পাবে না। তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে।” আমি বললাম, “তুমি যা বলছো সেটাই সঠিক।” এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করার জন্য মদীনা অভিমুখে রওনা হলাম। সেখানে পৌছে মসজিদে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে নিয়ে আপন গৃহ অভিমুখে রওনা হলেন। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা হলো। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দাঁড়াতে বললো। তিনি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তার নানান অভাব অভিযোগের কথা শুনলেন। তা দেখে আমি মনে মনে বললাম, “আল্লাহর কসম, এ লোক কোন রাজা-বাদশাহ হতে পারেন না।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিয়ে তাঁর গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে খেজুর ছলের তৈরী একটি গদীতে বসতে দিলেন। আমি বললাম, “আপনি বসুন।” তিনি বললেন, “না তুমি বস।” আমি তাতে বসলাম। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন মাটিতে।

আমি মনে মনে বললাম, এটা নিশ্চয়ই কোন রাজার চরিত্র হতে পারে না। অতঃপর বললেন, “হে আদী ইবনে হাতীম। তুমি কি রাকুসী নও?” [৯২. রাকুসী তৎকালীন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বলা হতো এই গোত্র খৃষ্টান ও সাবী ধর্মমতের মধ্যবর্তী একটা ধর্মমত পোষন করতো।] আমি বললা, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তুমি কি তোমার গোত্রের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক চতুর্থাংশ ভোগ করা না?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “এটা কিন্তু তোমার ধর্মে অবৈধ।” আমি বললা, “সত্যিই তাই।” আমি এই সময় নিশ্চিত হলাম যে তিনি সত্যই আল্লাহর নবী যিনি মানুষকে বিস্মৃত কথা স্মরণ করিয়ে এবং অজানা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে থাকেন। অতঃপর বললেন, “হে আদী। সম্ভবতঃ মুসলমানদের দারিদ্র দেখে তুমি ইসলামে প্রবেশ করছো না। আল্লাহর কসম, সে দিন বেশী দূরে নয় যখন মুসলমানরা এত বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোকই পাওয়া যাবে না। তোমার ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ এও হতে পারে যে, মুসলমানদের সংখ্যা কম ও তাদের শত্রুসংখ্যা বেশী। আল্লাহর কসম, সেদিন নিকটবর্তী যখন তুমি শুনবে যে কাদেসিয়া থেকে এক মহিলা একাকিনী নির্ভয়ে ও নিরাপদে উষ্ট্রে আরোহণ করে পবিত্র ঘর যিয়ারত করতে এসেছে। তুমি যত রাজা-বাদশাহ দেখছো তাও অমুসলিমদের মধ্যে দেখছো বলেও হয়তো ইসলাম গ্রহণ করছো না। কিন্তু আল্লাহর কসম, সেদিন অত্যাসন্ন যখন ব্যবিলনের শ্বেত প্রাসাদগুলো মুসলমানদের দখলে চলে আসবে।”

আদী বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটো ভবিষ্যদ্বানী আমি পূর্ন হতে দেখেছি। এসটা শুদু বাকী রয়েছে এবং আল্লাহর কসম, সেটিও পূর্ণ হবেই। ব্যাবিলনের শ্বেত প্রসাদসমূহ আমি দখলে আসতে দেখেছি। কাদেসিয়া থেকে নিরাপদে একাকিনী মহিলার হজ্জ সমপনেও দেখেছি। আর সম্পদের প্রাচুর্য এত হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোক পাওয়া যাবে না- সেটিও একদিন বাস্তব হয়ে দেখা যাবে।

ফারওয়া ইবনে মুসাইক মুরাদীর আগমন

ইবনে ইসহাক বলেন: কান্দার রাজাদের প্রভুত্ব অস্বীকার করে ফারওয়া ইবনে মুসাইক মুরাদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল। ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে মুরাদ ও হামদানের মধে সংঘটিত যুদ্ধে হামদান মুরাদের বিপুল ক্ষতি সাধন করে এবং ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ইতিহাসে সে দিনটি ‘ইয়াওমুর রদম’ অর্থাৎ ‘গন কবর রচনার দিন’ নামে খ্যাত। সেদিন হামদানী বাহিনীর মুরাদ আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিল আজদা ইবনে মালিক।”

ফারওয়া কান্দায় রাজাদের ত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার সময় নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করে:

“আমি যখন দেখলাম কান্দার রাজারা বিশ্বাসঘাতকের মত রাজ্যের

নারীদের ইজ্জত আবরুকে অবজ্ঞা করেছে, তখন

নিজের সওয়ারীতে আরোহণ করে উত্তম অনুগ্রহ ও উত্তম আশ্রয়ের আশায়

মুহাম্মাদের নিকট রওয়ানা হলাম।”

ফারওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থাপিত হলে তিনি বললেন, “হে ফারওয়া! ইয়াওমুর রাদমে তোমার জাতি যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তাতেই কি তুমি মর্মাহত হয়েছো।” সে বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে কে না মর্মাহত হয়?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “শোনো, ইসলাম গ্রহণ করলে তোমার জাতির এই ক্ষতি সত্ত্বে উত্তরোত্তর কল্যাণ সাধিত হবে।”

এরপর তিনি ফাওয়াকে মুরাদ, যুবাইদ ও মাজহিদ গোত্রের শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন এবং তার সাথে যাকাত আদায়কারী হিসেবে খালিদ ইবনে সাঈদকে পাঠিয়ে দিলেন। খালিদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের সময় পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাবের নেতৃত্বে যুন যুবাইদের একটি প্রতিনিধিদলের আগমন

আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাবের নেতৃত্বে যুন যুবাইদের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইতিপূর্বে আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খবর শুনে কায়েস ইবনে মাকশুহ মুরাদীকে বলেছিল, “হে কায়েস! তুমিতো তোমার গোত্রের সরদার। আমরা শুনতে পেলাম, মুহাম্মাদ নামক কুরাইশ বংশীয় এক ব্যক্তি হিজাযে নিজেকে নবী পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদেরকে নিয়ে তার কাছে চল, দেখা যাক সে যে দাবী করে, তা সত্য কিনা। যদি সত্যিই সে নবী হয় তাহলে তুমি অবশ্যই বুঝতে পারবে। আর আমাদের কাছে যদি প্রতিভাত হয় যে, সে সত্যিই নবী, তাহলে অনুসরণ করবো। আর যদি তা না হয় তাহলে তার জ্ঞানের দৌড় কতদূর, তা আমাদের জানা হয়ে যাবে।” কিন্তু কায়েস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তা নির্বুদ্ধিতা প্রসূত মত বলে আখ্যায়িত করে। এপর আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাব নিজেই সদলবলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এ খবর পেয়ে কায়েস ইবনে মকশুহ বললো, “আমর আমার বিরোধিতা করলো এবং আমার মত অগ্রাহ্য করলো। আচ্ছা মজা দেখাবো।” সে আমরকে ভীষণভাবে হুমকী দিল ও শাসালো।

[ইবনে হিশামের মতে উক্ত অভিযানে হামদানের নেতৃত্ব দিয়েছিল মালিক ইবনে হারিস হামদানী।]

তার জবাবে আমর নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করেছিল:

“সা’নার ঘটনার দিন তোমাকে একটা সঠিক উপদেশ দিয়েছিলাম,

তোমাকে উপদেশ দিয়েছিলাম আল্লাহকে ভয় করতে ও ন্যায়ের সাতে একমত হতে।

তুমি মৃত্যু হতে রক্ষা পেয়েছো সেই গাধার মত-যে তার খুঁটির ওপর গর্বিত।

সে আমাকে একটি ঘোড়ার ওপর পেয়েছে,

যার ওপর বসে আমি তার গতিরোধ করতে সক্ষম।

আমি এমন বর্ম পরিহিত যা পাথুরে জমিতে অবস্থিত

একটা স্বচ্ছ পানির পুকুরের মত প্রশান্ত।

সে বর্মে আঘাত খেয়ে বর্শা ঘুরে যায় এবং তার ভাল অংশ দূরে ছিটকে পড়ে।

যদি তুমি আমার মুকাবিলায় আস তাহলে দেখবে

এক কেশর বিশিষ্ট সিংহের মুকাবিলায় এসছো।

তখন আমাদের দুর্দম যোদ্ধাকে বজ্রমুষ্ঠি ও উন্নত গ্রীবা

(অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য অধীরভাবে প্রস্তত) দেখতে পাবে।

যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোন সমবয়স্ক যোদ্ধা তাকে কাবু করতে চায় তাহলে সে-ই

তাকে পরাজিত করে, তাকে পাকড়াও করে উর্ধে উৎক্ষেপ করে,

অতঃপর ভুতলে নিক্ষেপ করে হত্যা করে,

তার মগজ বের করে তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়,

অতঃপর তাকে গিলে কেয়ে ফেলে।

শিরকের অত্যাচারে তার দাঁত ও নখর কলুষিত।”

পরে ফারওয়া ইবনে মুসাইকের শাসনাধীন বনু যুবাইর গোত্রে আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সময় পর্যন্ত অবস্থান করে। এরপর ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়। সত্য ভ্রষ্ট হওয়ার সময় সে নিম্নরূপ কবিতা আবৃত্তি করেঃ

“ফারওয়ার শাসন আমাদের কাছে নিকৃষ্টতম শাসন বলে মনে হয়েছে।

তাকে আমরা সেই গাধার মত পেয়েছি যে জরায়ুর ভেতরে নাক ঢুকিয়ে গ্রাণ নেয।

তুমি যদি এ শাসন দেখতে হে আবু আমর, তাহলে

দেখতে পিশাচ ও বিশ্বাসঘাতক দিয়েই তার দল পরিপূর্ণ।”

আশয়াস ইবনে কায়েসের নেতৃত্বে কিন্দার প্রতিনিধিদলের আগমন

ইবনে ইসহাক বলেন: কিন্দার প্রতিনিদিদল নিয়ে আশয়াস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আগমন করেন। যুহরী ইবনে শিহাব আমাকে জানিয়েছেন যে, আশয়াস কিন্দার আশিজন উষ্ট্রারোহী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মসজিদে নববীতে মিলিত হন। তার দল সুন্দরভাবে চুল আঁচড়ানো, চোখে সুরমা লাগানো এবং নকশী করা রেশম সংযুক্ত ইয়ামনী জুব্বা পরা অবস্থায় এসেছিল। তারা দেখা করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা কি মুসলমান হওনি?” তারা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তাহলে তোমাদের গায়ে এত রেশমের ছড়াছড়ি কেন?” একথা বরার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের পোশাকের রেশমী অংশ ছিড়ে ফেলে দিলেন। তারপর আশয়াস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন,

“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা যেমন ‘আকিলুল মুরাব’ এর বংশধর আপনিও তেমনি ‘আকিলুল মুরার’ [৯৩. এটি বনু কিন্দার এক পূর্বপুরুষের উপাধি। যেহেতু কুরাইশদের অন্যতম পূর্বপুরুষ কিলাব ইবনে মুরার এর মাতা বনু কিন্দার মেয়ে ছিলেন, আশয়াস তাঁকে মাতামহের দিক থেকে আকিলুল মুরাবের বংশধর বলে রসিকতা করেন।] এর বংশধর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “তোমরা এই বংশ পরিচয় আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও রাবীয়া ইবনে হারেসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ কর।” ঐ দুই ব্যক্তি ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসা উপলক্ষে দূরবর্তী কোন আরব জনপদে গেলে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলতেন, “আমরা ‘আকিলুল মুরার’- এর বংশধর।” এ কথা বলে তারা নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির চেষ্ট করতেন। কারণ কিন্দা গোত্রে বহু রাজন্যবর্গ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, “না, আমরা বরং নাদার ইবনে কিনানার বংশধর। আমরা মায়ের বংশধররূপে পরিচিত হই না এবং পিতৃপরিচয় কখনো বর্জন করি না।” অতঃপর আশয়াস ইবনে কায়েস তাঁর সহচরদের নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাওয়অর তাড়া দিয়ে বললেন, “তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে কি? আল্লাহর কসম, এমন কথা যে বলে (পিতৃ বংশ পরিচয়ের পরিবর্তে যে মায়ের বংশ পরিচয় প্রচার করে) তাকে আশি যা বেত না মেরে ছাড়ি না।”

সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ আযদীর আগমন

আযদ গোত্রের একদল লোক সাথে নিয়ে সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ আযদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং খুব নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে গোত্রের মুসলিম সদস্যদের আমীর নিযুক্ত করলেন এবং তাদের নিয়ে আশপাশের মুশরিক ইয়ামানী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনার নির্দেশ দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে জিহাদ করার লক্ষ্যে প্রথমে জুরাশ অীভযানে বের হলেন। ইয়ামানী গোত্র অধ্যূষিত এই শহরটি সে সময় ছিল প্রাচীর ঘেরা ও সুরক্ষিত। মুসলিম বাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করতে ছুটে আসছে একথা শুনে খাশয়াম গোত্র ইয়ামনীদের সাথে যোগ দেয়। সুরাদের বাহিনী ইয়ামনী খাশয়ামীদেরকে প্রায় একমাস অবরোধ করে রাখে এবং তারাও জুরাশের ভেতরে থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে অক্ষত থাকে। অতঃপর সুরাদ তার বাহিনী নিয়ে ফিরে যান। তিনি যখন শাকার পর্বতের কাছে পৌছেন তখন জুরাশবাসী তাঁকে পরাজিত মনে করে তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে। যেই মাত্র তারা সুরাদের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলো অমনি তিনি তাদের ওপর আক্রমণ চালালেন এবং তাদের বিপুল সংখ্যক লোককে হত্যা করলেন। ইতিপূর্বে জুরাশবাসী দু’জন লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মদীনার পাঠিয়েছিল। একদিন আছরের পর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বসলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শাকার কোথায় অবস্থিত।” জুরাশবাসী লোক দুটি বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের অঞ্চলে একটা পাহাড় আছে। আমরা জুরাশবাসী তাকে ‘কাশার’ বলে থাকি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওই পাহাড়টার নাম কাশার নয় শাকার।” তারা বললো, “শাকারের কি হয়েছে ইয়া রাসূলুল্লাহ?” তিনি বললেন, “সেখানে এই মুহুর্তে প্রচুর লোক নিহত হচ্ছে।”

লোক দুটি আবু বাক্র কিংবা উসমান রাদিয়াল্লাহ আনহুর নিকট হিয়ে বসলে তারা বললেন,, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমদের গোত্রের মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছেন। তোমরা তাঁকে তোমাদের গোত্রের বিপদমুক্তির জন্য দোয়া করতে অনুরোধ কর।” তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুরোধ করলে তিনি এইরূপ দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, জুরাশবাসীর ওপর থেকে এ বিপদ দূর করে দাও।” অতঃপর তারা দুজন জুরাশ অভিমুখে যাত্রা করলো। সেখানে পৌছে তারা জানতে পারলো যে, সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ জুরাশবাসীকে ঠিক সেইদিন সেই মহুর্তে হত্যা করেছিলেন যেদিন এবং যে সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে ঐ ঘটনার কথঅ উল্লেখ করেছিলেন।”

জুরাশের প্রতিনিধিদল রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে ইসলাম গওহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শহরের চারপাশে পশু চারণের জন্য কয়েকটি সুরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ করে দিলেন। ঘোড়া, উট ও চাষের বলদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে এলাকা চি‎িহ্নত করা হলো এবং ঘোষণা করা হলো যে, ঐসব এলাকায় যে কোন লোকের পশু চরে বেড়াবে তা ধরে নেয়া বা খাওয়া কারো জন্য বৈধ হবে না।

হিমইয়ার বংশীয় রাজাদের দূতের আগমন

হিমইয়ার রাজন্যবর্গ তাদের ইসলাম গ্রহণের খবর জানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পত্রসহ দূত পাঠান। এই রাজন্যবর্গের মধ্যে ছিলেন হারেস ইবনে আব্দ কুলাল, নুআঈম, মা’আফির ও হামদানের উপশাসক নুমান কায়ল। [৯৪. কায়ল শব্দটি সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ কেবল  বলেন এর অর্থ রাজা। অন্যান্যরা বলেন এর অর্থ রাজার নিছর কোন পদস্থ কর্মকর্ত। শেষোক্ত মতটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক অভিযান থেকে ফিরে আসার সময় এসব দূত আগমন করে। ইয়ামানের অধিপতি যুররা পাঠান মালিক ইবনে মাররা বাহাওয়ীকে। তারা সকলেই নিজেদের ইসলাম গ্রহণ, শিরক বর্জন এবং মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে দূত ও চিঠি পাঠান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে তাঁদেরকে নিম্নরূপ চিঠি লেখেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল ও নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রুআইন, মায়াফির হামদানের অধিপতি ইবনে আব্দ কুলাল, নুআঈম ইবনে আব্দ কুলাল ও উপশাসক নুমানের প্রতি। আমি মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। আমরা রোমক ভূমি থেকে ফেরার পর তোমাদের দূত মদীনাতে আমাদের সাথে দেখা করে তোমাদের বার্তা আমাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছে। তারা তোমাদের ইসলাম গ্রহণ ও মুশরিকদের হত্যা করার খবর আমাদেরকে জানিয়েছে। তোমরা যদি সততার পথে চল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, নামায কায়েম কর, যাকাত দাও, গনীমত থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে এক পঞ্চমাংশ, নবীর অংশ ও তার বন্টনপূর্ব বাছাই করা অংশ এবং মুমিনদের ওপর ধার্যকৃত অবশ্য দেয় সাদকা প্রদান কর, তাহলে আল্লাহর হিদায়াত লাভ করবে। ধার্যকৃত অবশ্য দেয় সাদকা হলো, যেসব কৃষিভূমি বৃষ্টি ও খঅলের পানি দ্বারা সিঞ্চিত তার ফসলের এক দশমাংশ এবং কৃত্রিমভঅবে সিঞ্চিত কৃষিভূমির ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ।

আর চল্লিশটা উটে একটা দুই বছরের বেশী বয়সের উষ্ট্রী শিশু এবং ত্রিশটায় একটা দুই বছরের বেশী বয়সের উট। প্রতি পাঁচটা উটে একটা ছাগল, দশটা উটে দুইটা ছাগল, চল্লিশটা গরুতে একটা গাভী, ত্রিশটাতে এক বছর অথবা দুই বছর বয়স্ক বাছুর এবং প্রতি চল্লিশটা গরুতে একটা গাভী, ত্রিশটাতে এক বছর অথবা দুই বছর বয়স্ক বাছুর এবং প্রতি চল্লিশটা চারণশীল ছাগল বা ভেড়ায় একটা করে ছাগল। এগুলো মুমিনদেরওপর আল্লাহর ধার্য করা অপরিহার্য সাদকা। এর বেশী দিলে আরো ভালো কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু এইটুকু প্রদান করবে, তারা ইসলামের আনুগত্যের প্রমাণ দেবে এবং মু’মিনদেরকে মুশরিকদের ওপর বিজয়ী হতে সাহায্য করবে, সে-ই মু’মিন। সকল মু’মিনদের যতটা অধিকার ও দায়দায়িত্ব তারও ততটা অধিকার ও দায়দায়িত্ব। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাঁর সার্বিক নিরপত্তার জিম্মাদার। কোন ইহুদী ও খৃষ্টান ইসলাম গওহণ করলে সে মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার অধিকার ও দায়দায়িত্ব অন্যান্য মু’মিনদের সমান। আর যদি কেউ নিজের ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মে বহাল থঅকতে চায় তবে তাকে জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করা হবে না। তবে এ ধরনের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ গোলাম  কিংবা স্বাধীন যাই হোক না কেন, তাকে জিযিয়া দিতে হবে। জিযিয়ার পরিমাণ মায়াফের (ইয়ামানী কাপড় বিশেষ) এর ক্রয়মূল অনুসারে এক দীনার অথবা তদপরিমাণ কাপড়। যে ব্যক্তি এই জিয়িয়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করবে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তার নিরাপত্তার জিম্মাদরা। আর যে ব্যক্তি তা পদান করতে অস্বীকার করবে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন।

ইয়মানের অধিপতি যুরযাকে আল্লাহর নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমার দূত মুয়ায ইবনে জাবাল, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ, মালিক ইবনে উবাদাহ ও উকবা ইবনে নামির ও তাদের সঙ্গীরা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যখন তোমাদের কাছে যাবে তখন তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে, আর তারা যদি তোমাদের প্রজাদের কাছে প্রাপ্য যাকাত ও জিযিয়া উসুল করে আমী মুয়ায ইবনে জাবালের অধীনস্থ দুতদের কাছে পৌছিয়ে দেয় তাহলে যুরা যেন তাতে সম্মতি দেয়।

মুহাম্মাদ পুনরায় ঘোষণা করছেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

আরো উল্লেখ থাকে যে, মালিক ইবনে মাররা বাহাত্তরী আমাকে জানিয়েছে যে, তুমি (যুররা) হিমইয়ার নরপতিদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছো এবং মুশরিকদের হত্যা করেছো। এজন্য তুমি সুসংবাদ ও মুবারকবাদ নাও এবং হিমইয়ারের প্রতি বাল আচরণ কর। বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং কাউকে নির্যাতন করো না। মনে রেখ, আল্লাহর রাসূল তোমাদের ধনী-গরীব সকলেরই অভিভাবক। যাকাত সাদকা মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার পরিজনের জন্য বৈধ নয়। যাকাত হলো ধন সম্পদের পবিত্রতা সাধনের উপায় এবং তা শুধু মুসলিম দরিদ্র ও পথিকের জন্য বৈধ। মালিক সুষ্ঠুভাবে ও বিশ্বস্ততার সাথে তোমার বার্তা পৌছিয়ে দিয়েছে। কাজেই তাঁর সাথে ভাল আচরণ করার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। আমার অনুসারীদের মধ্যে থেকে অত্যন্ত সৎ, সুযোগ্য, জ্ঞানী ও পরহেজগার লোকদেরকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে সদাচরণ করার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। কারণ তাদের রিপোর্টই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন বিবেচিত হবে। ওয়সসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।”

মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়ামানে পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহর উপদেশ 

ইবনে ইসহাক বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁর কাছে এ মর্মে বর্ণনা করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুয়াযকে (রা) দূত হিসেবে পাঠান, তখন কতিপয় উপদেশ দেন ও তাঁর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “সহজভাবে ইসরামের দাওয়াত পেশ করবে, কঠিনভাবে নয়। তাদের মনে আশার আলো জাগাবে, বীতশ্রদ্ধ করে দেবে না। তাহলে কিতাবের একি গোষ্ঠির সাক্ষাত পাবে। ওরা জিজ্ঞেস করবে যে, জান্নাতের চাবিকাঠি কি? তাদের বলবে, আল্লাহ এক ও তাঁর কোন শরীক নেই-এই সাক্ষ্য প্রদানই জান্নাতের চাবি।”

অভিযান পরিচালনাকালে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের (রা) হাতে বনু হারিস গোত্রের ইসলাম গ্রহণ

ইবনে ইসহাক বলেন: দশম হিজরীর রবিউস সানী অথবা জামাদিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে নাজরানের বনু হারিস ইবনে কা’ব গোত্রের কাছে এই নির্দেশদিয়ে পাঠালেন যে, “যুদ্ধে লিপ্ত হওয়অর আগে তাদেরকে ইসলামের দিকে তিন দিন পর্যন্ত দাওয়াত দেবে। তারা যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে তা মেনে নেবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে।”

খালিদ রওনা হলেন। বনু হারিসের বসতিতে পৌছে খালিদ তাঁর সঙ্গীদের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে নির্দেশ দিলেন। তারা বরতে লাগলেন, “হে জনগণ, তোমরা  ইসলাম গ্রহণ কর। তাহলে তোমরা নিরপদে থাকবে।” লোকরা ইসরাম গ্রহণ করতে লাগলো, খালিদ তাদের কাছে থেকে গেলেন। তাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ সম্পর্কে অবহিত করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এ নির্দেশও দিয়েছিলেন যে, নাজরানবাসী যদি যুদ্ধ করার বদলে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তিনি যে তাদের কাছে থেকে যান এবং তাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত শিক্ষা দিতে থাকেন। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিম্নরূপ চিঠি লিখলেন,

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের তরফ থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ওপর শাস্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হোক। আপনার কাছে আমি আল্লাহর প্রশংসা ব্যক্ত করছি, তিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর করুণা ও শাস্তি বর্ষিত হোক আপনার ওপর। আপনি আমাকে বনু হারিসের কাছে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, আমি যেন তিন দিন পর্যন্ত যুদ্ধ না করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেই। তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে যেন তা মেনে নেই। তাদের সাথে অবস্থান করি এবং ইসলামের বিস্তৃত বিধান, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ শিক্ষা দিই।  আর যদি তার ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে আমি যেন তাদের সাথে যুদ্ধ করি। ইমি তাদের কাছে এসেই তিন দিন ধরে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিয়েছি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অনুসারে। আমি এখানকার জনগণের কাছে আমার সঙ্গীদেরকে পাঠিয়েছি। তারা এই বলে দাওয়াত দিয়েছে, ‘হে বনু হারিস! ইসরাম গ্রহণ কর্ াতাহলে তোমরা নিরপদে থাকবে।’

ফলে বনু হারিস যুদ্ধ করেনি এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি তাদের মধ্যেই অবস্থান করছি এবং আল্লাহ যে আদেশ করেছেন সেই মুতাবিক তাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। আর আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তাদেরকে বিরত রাখছি।  আর তাদেরকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান শিক্ষা দিচ্ছি এবং এ কাজ এই চিঠি লেখার সময় পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইয়া রাসূলুল্লাহ, আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদের কাছে নিম্নরূপ চিঠি লিখলেন: “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নিকট। তোমার ওপর শান্তি বির্ষত হোক। আমি তোমার কাছে সেই আল্লাহর প্রশংসা ব্যক্ত করছি, যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ  নেই। দূত মারফত তোমার চিঠি পেয়ে জানতে পারলাম যে, যুদ্ধ না করেই বনু হারিস ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তোমাদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তুমি জানিয়েছ যে, আল্লাহ তাদেরকে তাঁর হিদায়াতের বাণী দ্বারা হিদায়াত করেছেন। অতএব তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও এবং সেই সাথে সাবধানও করে দাও। এবার তুমি চলে এস এবং বনু হারিসের একটি প্রতিনিধিদলকে আমার কাছে আসতে বলে দাও। ওয়াসাল্লামু আলাইকম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি পেয়ে খালিদ মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে ফিরে এলেন। তাঁর সাথে বনু হারিসের একটি প্রতিনিধিদলও এল। এ প্রতিনিধিদলের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন: কায়েস ইবনুল হুসাইন, ইয়াযীদ ইবনে আবদুল মাদান, ইয়াযীদ ইবনে মুহাজ্জাল, আবদুল্লাহ ইবনে কুরাদ যিয়াদী, শাদ্দাদ ইবনে আবদুল্লাহ কানানী ও আমরইবনে আবদুল্লাহ দিবাবী। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের নিকট এলে তাদের দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ভারতীয়দের মত দেখতে এরা কারা?” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এরা বনু হারিসের লোক।” তাঁরা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে তাঁকে সালাম দিলেন। তারা বললেন, “আমরা সাক্ষ দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি ও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।” তিনি আবার বললেন, “আচ্ছা তোমরাই সেই জাতি না যাদেরকে পেছনে হটিয়ে দিলে আরো এগিয়ে আসে?” তিনি চারবার কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “খালিদ যদি একথা না জানাতো যে, তোমরা বিনা যুদ্ধে ইসলাম গ্রহণ করেছ তাহলে আমি তোমাদের মস্তক ছেদন করে তোমাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে দিতাম।” ইয়াযীদ ইবনে আবদুল মাদান বললেন,  “জেনে রাখুন, আমরা আপনার কিংবা খালিদের প্রশংসা করিনি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তা হলে কার প্রশংসা করেছো?” তাঁরা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা সেই মহা প্রতাপন্বিত ও মহাপরাক্রান্ত আল্লাহর প্রশংসা করেছি যিনি আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন।” তিনি বললেন, “তোমরা সত্যই বলছো।” তিনি আরো বললেন, “তোমরা জাহিলী যুগে কিসের জোরে যুদ্ধ বিগ্রহে প্রতিপক্ষের ওপর জয়  লাভ করতো?” তারা বললেন, “কই, আমরা তো কারো ওপর জয়লাভ করতাম না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ। যারা তোমারেদ সাথে যদ্ধে লিপ্ত হতো তাদের ওপরতোমরা জয়লাভ করতে।” প্রতিনিধিগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, প্রতিপক্ষের ওপর আমাদের জয় লাভের কারণ ছিল এই যে, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতাম, কলহ বিবাদে লিপ্ত হতাম না। আর কখনো কারো ওপর প্রথমে বা অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালাতাম না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা সত্য বলছো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়েস ইবনে হুসাইনকে বনু হারিসের আমীর নিয়োগ করেন।

অতঃপর বনু হারিসের প্রতিনিধিদল শাওয়ালের শেষভাগে অথবা যুলকান্দার প্রথম ভাগে নিজ এলাকায় ফিরে গেল। তাদের যাওয়ার চার মাস পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেন।

প্রতিনিধিদল চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হারিসকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও তাঁর সুন্নাহ শিক্ষা দেয়া এবং তাদের সাদকা আদায় করার জন্য আমর ইবনে হাযম (রা) কে প্রেরণ করেন। তিনি নিজের নির্দেশাবলী সম্বলিত একটি পত্রও তাঁকে দেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে এটি একটি ঘোষণাপত্র। হে মুমিনগণ, তোমরা চুক্তি পালন কর। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইয়ামানে প্রেরিত তাঁর দূত আমর ইবনে হাযমের জন্য এটি একটি নির্দেশনামা। আমরকে তিনি সর্বত্র ও সর্বাস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা তাঁকে ভয় করে চলে এবং যারা ভাল কাজ করে। তাকে নির্দেশ দেয়া গেল যে, সে যেন সবসময় ন্যায় ও সত্যের পথে অনুসরণ করে, যেভাবে আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন। সে যেন মানুষকে কল্যাণের পথ চলার প্রেরণা দান করে ও আদেশ জারী করে। তাদের মধ্যে কুরাআনের শিক্ষা বিস্তার করে ও কুরাআন সম্পর্কে মানুষকে সূক্ষজ্ঞান বিতরণ করে এবং কেউ যাতে নাপাক অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করে সে ব্যাপারে যেন সাবধান করে দেয়। কিসে মানুষের ভাল হবে এবং কিসে মন্দ হবে, তা যেন জানিয়ে দেয়, হক ও ন্যায়ের ওপর যারা চলে তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করে আর যারা যুলুম করে তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর হয়। কেননা আল্লাহ যুলুমকে র্ঘণা করেন এবং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ‘সাবধান! যালিমদের আল্লাহর লানত!’সে যেন মানুষকে জান্নাতের এবং তার উপযোগী কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে আর জাহান্নাম ও তার উপযোগী কাজ থেকে হুঁশিয়ারী করে দেয়। মানুষকে ইসলামের সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত জ্ঞঅন দানের জন্য সে যেন তাদের প্রিয় হবার চেষ্টা করে, তাদেরকে বড় হজ্জ ও ছোট হজ্জ তথা উমরার নিয়মকানুন, সুন্নাত, ফরয ও আল্লাহর নির্দেশবলী শিক্ষা দেয়। সে যেন মানুষকে মাত্র একখঅনা ছোট কাপড় পরে নামায পড়তে নিষেধ করে, অবশ্য সেই কাপড়খানা যদি এতটা বড় হয় যে, তার এক প্রান্ত পরে অপর প্রান্ত ঘাড়ের ওপর ঘুরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেটা আলাদা কথা। একটি মাত্র কাপড় পরে ঠ্যাং উচিয়ে এমনভাবে বসতে সে যেন মানুষকে নিষেধ করে যাতে তার লজ্জাস্থান নগ্ন হয়ে যায়। সে যেন পুরুষদের চুল বেণী করে পিঠের ওপর ঝুলিয়ে দিতে নিষেধ করে। উত্তেজনার সময় জনসাধারণকে গোত্র ও আত্মীয়-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে ডাকতে যেন নিষেধ করে এবং শুধু এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালার নামে ডাকতে আদেশ দেয়। যারা আল্লাহর দিকে না ডেকে গোত্র-গোষ্ঠী বিশেষের দিকে ডাকে তাদেরকে যেন তরবারী দিয়ে উৎখাত করা হয় এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়েস ইবনে হুসাইনকে বনু হারিসের আমীর নিয়োগ করেন।

অতঃপর বনু হারিসের প্রতিনিধিদল শাওয়ালের শেষভাগে অথবা যুলকাদার প্রথম ভাগে নিজ এলাকায় ফিরে গেল। তাদের যাওয়ার চার মাস পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করেন।

প্রতিনিধিদল চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হারিসকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও তাঁর সুন্নাহ শিক্ষা দেয় এবং তাদের সাদকা আদায় করার জন্য আমর ইবনে হাযম (রা) কে প্রেরণ করেন। তিনি নিজের নির্দেশাবলী সম্বলিত একটি পত্রও তাঁকে দেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ

“বিমমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে এটি একটি ঘোষণাপত্র। হে মুমিনগণ, তোমরা চুক্তি পালন কর। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইয়ামানে প্রেরিত তাঁর দূত আমর ইবনে হাযমের জন্য এটি একটি নির্দেশনামা। আমরকে তিনি সর্বত্র ও সর্বাস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা তাঁকে ভয় করে চলে এবং যারা ভাল কাজ করে। তাকে নির্দেশ দেয়া গেল যে, সে যেন সবসময় ন্যায় ও সত্যের পথে অনুসরণ করে, যেভাবে আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন। সেযেন মানুষকে কল্যাণের পথ চলার প্রেরণা দান করে ও আদেশ জারী করে। তাদের মধ্যে কুরআনের শিক্ষা বিস্তার করে ও কুরআন সম্পর্কে মানুষকে সূক্ষ্মজ্ঞান বিতরণ করে এবং কেউ যাতে নাপাক অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করে সে ব্যাপারে যেন সাবধান করে দেয়। কিসে মানুষের ভাল হবে এবং কিসে মন্দ হবে, তা যেন জানিযে দেয়, হক ও ন্যায়ের ওপর যারা চলে তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করে আর যারা যুলুম করে তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর হয়। কেননা আল্লাহ যুলুমকে ঘৃণা করেন এবং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ‘সাবধান। যালিমদের ওপর আল্লাহর লানত।’ সে যেন মানুষকে জান্নাতের এবং তার উপযোগী কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে আর জাহান্নাম ও তার উপযোগী কাজ থেকে হুঁশিয়ারী করে দেয়। মানুষকে ইসলামের সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত জ্ঞান দানের জন্য সে যেন তাদের প্রিয় হবার চেষ্টা করে, তাদেরকে বড় হজ্জ ও ছোট হজ্জ তথা উমরার নিয়মকানুন, সুন্নাত, ফরয ও আল্লাহর নির্দেশাবলী শিক্ষা দেয়। সে যেন মানুষকে মাত্র একখানা ছোট কাপড় পরে নামায পড়তে নিষেধ করে, অবশ্য সেই কাপড়খানা যদি এতটা বড় হয় যে, তার এক প্রন্ত পরে অপর প্রান্ত ঘাড়ের ওপর ঘুরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেটা আলাদা কথা। একটি মাত্র কাপড় পরে ঠ্যাং উচিয়ে এমনভাবে বসতে সে যেন মানুষকে নিষেধ করে যাতে তার লজ্জাস্থান নগ্ন হয়ে যায়। সে যেন  পুরুষদের চুল বেণী করে পিঠের ওপর ঝুলয়ে দিতে নিষেধ করে। উত্তেজনার সময় জনসাধারণকে গোতও ও আত্মীয়-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে ডাকতে যেন নিষেধ করে এবং শুধু এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালার নামেডাকতে আদেশ দেয়। যারা আল্লাহর দিকে না ডেকে গোত্র-গোষ্ঠী বিশেষের দিকে ডাকে তাদেরকে যেন তরবারী দিয়ে উৎখাত করা হয় এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর একজন বিশ্বস্ত লোক আবু হুরাইরার (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে জানিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের আগে ত্রিশজন দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তাদের প্রত্যেকেই নবুওয়াতের দাবীদার হবে।”

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিযুক্ত কর্মচারী ও আমীরগণের যাকাত আদায়ের অভিযান

ইবনে ইসহাক বলেন:

ইনতিকালের পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম দখলকৃত সকল দেশ ও অঞ্চলের যাকাত আদায়ের জন্য তাঁর নিযুক্ত আমীর ও কর্মচারীগণকে পাঠান। সানয়াতে পাঠালেন মুহাজির ইবনে আবু উমাইয়াকে। তিনি সানয়াতে থাকাকালেই আনসী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বনু বিয়াজা আনসারী গোত্রের যিয়াদ ইবনে লাবীদকে (রা) হাদরামাউমে, আদী ইবনে হাতিমকে (রা) বনু তাই ও বনু আসাদ গোত্রে, মালিক ইবনে নুযাইরাকে (রা) বনু হানযালা গোত্রে, যাবারকান ইবনে বদরকে (রা) বনু সা’দ গোত্রের একাংশে, কায়েস ইবনে আসিমকে একই গোত্রের অপরাংশে এবং আল্ াইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠালেন নাজরানের (মুসলমানদের নিকট থেকে) যাকাত ও (খৃষ্টনদের নিকট থেকে) জিযিয়া আদায় করতে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মুসাইলিমার চিঠি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে তার জবাব

“আল্লাহর রাসূল মুসাইলিমার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাকে আপনার নবুওয়াতের অংশীদার করা হয়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকটা আমাদের ভাগে এবং অপর অর্ধেক সুরাইশদের ভাগে। তবে কুরাইশরা সবসময় বাড়াবাড়ি করে থাকে।”

এই চিঠি নিয়ে দু’জন দূত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। ইবনে ইসহাক বলেন: ‘বনু আশজা’ গোত্রের জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে সালমা ইবনে নাঈমের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, নাঈম বলেছেন, দূতদ্বয়ের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “তোমাদের দু’জনের বক্তব্য কি?” তার বললো, “মুসাইলিমা যা বলে আমরাও তাই বলি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহর কসম দূতদের হত্যা করা যদি নীতিবিরুদ্ধ না হতো তাহলে আমি তোমাদের শিরচ্ছেদ করতাম।”

অতঃপর তিনি মুসাইলিমাকে লিখলেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মিথ্যা দাবীদার মুসাইলিমার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহর তরফ থেকে আগত হিদায়াতের অনুসারী তার ওপর সালাম। জেনে রাখ, পৃথিবী  সম্পূর্ন আল্লাহর। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করেন আর আখিরাতের সাফল্য খোদাভীরুদের জন্য।” এই পত্রবিনিময় অনুষ্ঠিত হয় দশদ হিজরীতে।

বিদায় হজ্জ

অতঃপর যুলকা’দা মাস শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম হাজ্জের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং মুসলমানদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। যুলকা’দা মাসের পাঁচ দিন অবশিষ্ট থাকতে তিনি হজ্জ উপলক্ষে রওন হলেন।

হজ্জের প্রক্কালে তিনি জনগণকে হজ্জের নিয়মকানুন শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আল্লাহর প্রশংসার পর তিনি বললেন,

“হে জনগণ, আমার কথা শোন। আমি সম্ভবতঃ এই স্থানে এ বছরের পর আর কখনো তোমাদের সাথে মিলিত হতে পরবো না। হে জনতা, আজকের দিনে ও এই মাসে যেমন অন্যের জ্ঞান মালের ক্ষতি সাধন তোমাদের ওপর হারাম তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত তা হারাম হয়ে গেল। তোমরা শীঘ্রই আল্লাহর কাছে হাযির হবে এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। তোমাদের কাছে (আল্লাহর বানী) পৌছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি পালন করেছি। যার কাছে কারো গচ্ছিত জিনিস রয়েছৈ সে যেন মালিকের কাছে তা ফেরত দেয়। সকল সুদ রহিত করা হলো। [৯৫. সব রকমের ঋণ, খুন ও জখমের প্রতিশোধ রহিত করা হয়।] তোমরা শুধু মূলধন পাবে। তোমরা কারো ওপর যুলুম করবে না, যুলুমের শিকারও হবে না। আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা যে, কোন সুদ চলবে না। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সমস্ত সুদ রহিত করা হলো। জাহিলী যুগে সংঘটিত সকল খুন জখমের শাস্তি বা প্রতিশোধ গ্রহণ রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র ইবনে রাবীয়ার হত্যার শাস্তি বা প্রতিশোধ রহিত করছি। ইবনে রাবীয়া বনু লাইস গোত্রে দুগ্ধপোষ্য ছিল। বনু হুযাইল তাকে হত্যা করে। সেই হত্যাকান্ড দিয়েই আমি জাহিলী যুগের সকল হত্যাকান্ড ক্ষমা করার কাজ শুরু করছি।

অতঃপর হে জনতা, তোমাদের এই ভূখন্ডে শয়তানের আর কখনো পূজা অর্চণা প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। সে এ ব্যাপারে নিরাশ হয়েছে। তবে তোমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে যাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে থাক, শয়তানের আনুগত্য করলে তাতেই সে খুশী হবে। অতএব তোমদের দ্বীনের ব্যাপারে শয়তান সম্পর্কে সাবধান থেকো।

হে জনগণ, নিষিদ্ধ মাসগুলোকে পরবর্তী বছরের জন্য মুলতবী রাখা আরো জঘন্য কুফরী কর্ম। কাফিররা এই প্রথা দ্বারা গুমরাহীর পথে চালিত হয়। এর মাধ্যমে তারা রক্তপাতকে এক বছর বৈধ আর এক বছর অবৈধ করে নেয। এভাবে তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ দিনগুলোকে ফাঁকি দেয়ার চক্রান্ত করে। এভাবে কার্যতঃ তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজকে বৈধ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বৈধ কাজকে অবৈধ করে নেয়। আকাশ ও পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময তার নিজস্ব নিয়মে গড়িয়ে চলেছে। আল্লাহর কাছে মাস হলো বারোটা। তার মধ্যে চারটা হলো নিষিদ্ধ। তিনটা মাস এক নাগড়ে আর একটা মুদার গোত্রের রজব মাস। সে মাসটা শা’বান ও জামাদিউস সানীর মাঝখানে অবস্থিত। [৯৬. রজব মাসকে ‘মুদার গোত্রের রজব’ বলার তাৎপর্য এই যে, এই মাসটাকে মুদার গোত্রেই গুরুত্ব দিত। আরবের কোন গোত্র এ মাস  নিষিদ্ধ মাস হিসেবে আমল দিত না।]

তোমাদের নারীদের প্রতি তোমাদের কিছু কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে। নারীরা তোমাদের বিছানায় অন্য কাউকে শোয়বে না। এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হবে না- এটা তাদের কর্তব্য। কেননা এটা তোমাদের ঘৃণার উদ্রেক করে থাকে। আর তা যদি করেই বসে তবে তাদের থেকে আলাদা বিছানায় শোয়া এবং মৃদু প্রহার করার অধিকার আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছেন। তবে যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে তাদের স্বাভাবিকভাবে খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেয়া তোমাদের কর্তব্য। নারীদের প্রতি শুভকামী থাক। কেননা তারা তোমাদের কাছে অক্ষম বন্দীস্বরূপ। আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদেরকে প্রহণ করেছো। আল্লাহর বিধান অনুসারেই তোমরা তাদেরকে বৈধ করে নিয়েছো।

হে মানব সকল, তোমরা আমার কথা হৃদয়ঙ্গম কর। আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার কাজ আমি সম্পন্ন করেছি। আর তোমাদের কাছে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো বিপথগামী হবে না। প্রকাশ্য সুস্পষ্ট জিনিস আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। হে জনগণ-আমার কথা শোনো ও হৃদয়ঙ্গম কর। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মুসলমানরা ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইয়ের কোন জিনিস তার খুশী মনে দান করা ছাড়া নেয়া অবৈধ। তোমরা লোকদের ওপর যুলুম করো না। হে আল্লাহ, আমি কি তোমার দ্বীন মানুষের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি?” লোকেরা বললো, “হে, আল্লাহ, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে তোমার দ্বীন পৌছিয়ে দিয়েছেন।” তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।”

উসামা ইবনে যায়িদকে ফিলিস্তিন প্রেরণ

ইবনে হিশাম বলেন, উপরোক্ত ভাষণ দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে

মদীনায় ফিরে গেলেন এবং জিলহজ্জের অবশিষ্ট দিনগুলো, মুহাররাম ও সফর মাস সেখানে কাটালেন। তারপর তাঁর আজাদকৃত গোলাম যায়িদের পুত্র উসামার নেতৃত্বে শামে (সিরিয়ার) একটি বাহিনী পাঠালেন এবং তাকে ফিলিস্তিনের বালকা ও দারুম অঞ্চল অধিকার করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা সফরের প্রস্তুতি নিল। প্রথম হিজরতকারী সকল মুহাজির তাঁর সাথে যাত্রা করলেন।

রাজা-বাদশাহদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা) দূত প্রেরণ

ইবনে হিশাম বলেন:

ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় সাহাবীকে বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহর কাছে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। তাদের নিকট তিনি ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি পাঠান।

ইবনে হিশাম বলেনঃ আবু বাক্র হুযালী থেকে একজন বিশ্বস্ত লোক আমাকে জানিয়েছে যে, হুদাইবিয়ার দিন উমরা করতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “যে জনতা, আল্লাহ আমাকে সকল মানুষের নিকট রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। কাজেই ঈসার (আ) সহচরগণ যেমন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ চরেছিল তোমরা সেভাবে আমার বিরুদ্ধাচারণ করো না।” সাহাবীগণ বললেন, “হে, আল্লাহর রাসূল, ঈসার (আ) সহচরবৃন্দ কিভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল?” তিনি বললেন, “আমি তোমাদেরকে যেসব কাজ করতে বলি তিনিও তাদের সেইসব কাজ করতে বলতেন। কিন্তু তিনি যখন কাউকে নিকটবর্তী কোথাও পাঠাতে চাইতেন তখন সে মুখ তার ও গড়িমসি করতো। ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করলেন। ফলে গড়িমসিকারীদের প্রত্যেকের এমন পরিণতি হলো যে, যাকে যে জাতির পাঠানো হলো সে সেই জাতির ভাষাভাষী হয়ে গেল।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে কিছু লোককে দূত বানিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠালেন। রোম সম্রাটের কাছে পাঠালেন দেহইয়া ইবনে খলীফা কালবীকে, আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফঅ সাহমীকে পারস্য সম্রাটের নিকট, আমর ইবনে উমাইয়া দামরীকে আবিসিনিয়ার নাজাশীর নিকট, হাতিব ইবনে আমরকে ইয়ামামার দুই বাদশাহ সুমামা ইবনে উছাল ও হাওযা ইবনে আলীর নিকট, আলা ইবনে হাদরামীকে বাহরাইনের বাদশাহ মুনযির ইবনে সাওয়ার নিকট এবং শুজা ইবনে ওয়াহাব আসাদীকে সিরীয় সীমান্ত রাজ্যের রাজা হারিস ইবনে আবু শামর গাসসানীর নিকট।

ইবনে হিশাম বলেনঃ আমার জানামতে সালীতকে সুমামা, হাওযা ও মুনযিরের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল।

ইবনে ইসহাক বলেন: ইয়াযীদ ইবনে আবু হাবীব মিসরী আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি একটি বইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আরব ও আজমের বাদশাহদের নিকট এবং বিভিন্ন দেশে প্রেরিত দূতদের নাম দেখেছেন। তিনি সাহাবীদেরকে প্রেরণের সময় কি কি উপদেশ দিতেন তারও উল্লেখ ঐ বইতে রয়েছে। ইয়াযীদ ঐ বইখানা প্রখ্যাত পন্ডিত মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরীর নিকট পাঠান। যুহরী বইখানাকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেন। ঐ বইতে বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিকট এসে বললেন, “আল্লাহ আমাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। অতএব তোমরা আমার তর থেকে দাওয়াত পৌছিয়ে দাও। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করবেন। ঈসার (আ) সহচরদের মত তোমরা আমার বিরুদ্ধাচরণ করো না।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা কিভাবে বিরুদ্ধাচরণ করতো?” তিনি বললেন, ‘আমি যেরূপ তোমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে তিনিও তাদেরকে সেরূপ বিভিন্ন জায়গায় দাওয়াত পৌছানের দায়িত্ব দিতেন। যে ব্যক্তিকে তিনি নিকটবর্তী জায়গায় পাঠাতেন। সে খুশী হতো ও পছন্দ করতো। আর যাকে দূরে পাঠাতে চাইতেন সে অসন্তুষ্ট হতো ও অস্বীকার করতো। ঈসা (আ) এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করলেন। ফলে তাদের যাকে যে দেশে পাঠানো হতো সে সেই দেশের ভাষাভাষী হয়ে যেত।”

ইবনে ইসহাক বলেন: ‘ঈসা (আ) তাঁর যেসব সহচরকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন এবং তাঁর যেসব অনুগামী পরবর্তীকালে প্রেরত হ৮ন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সহচর পিটার্স ও তার অনুগামী পলস। পলস হাওয়ারী বা ঈসার (আ) সহচর ছিলেন না। এদেরকে পাঠানো হয় রোমানদের কাছে আন্দ্রায়েস ও মানতাকে এমন এক এলাকায় পাঠান যেখানকার অধিবাসীরা মানুষ খেত। টমাসকে পাঠান প্রাচ্যের ব্যবিলনে, ফিলিপসকে পাঠান আফ্রিকার কারতাজান্না বা আফ্রিকায়। ইয়াহান্নাকে পাঠান আসহাবুল কাহাফের জনপদ আফসুস নগরে। ইয়াকুবকে পাঠান আরবের হিজাযে, সাইমনকে পাঠান বারবারদের অঞ্চলে এবং ইাহুদকে পাঠান জোড়দের স্থানে। ইয়াহুদ ঈসার (আ) সহচর ছিল না।

সর্বশেষ অভিযান

ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারিসার পুত্র উসামাকে সিরিয়া প্রেরণ করেন এবং তাঁকে ফিলিস্তিনের বালকা ও দারুম এলাকা দখল করার নির্দেশ দেন। মুসলমানগন যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। এই অভিযানে প্রথম হিজরতকারী সকল মুসলমান অংশগ্রহণ করেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পীড়ার সূচনা

ইবনে ইসহা বলেনঃ উসামার নেতৃত্বে অভিযান শুরুর প্রস্তুতি চলতে থাকাকালেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং শেষ পর্যন্ত এই অসুস্থতাতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। অসুস্থতার সূচনা হয় মফর মাসের শেষের দিনগুলোতে অথবা পয়লা রবিউল আওয়ালে। পীড়ার সূচনা এভাবে হয় যে, তিনি একদিন গভীর রাত্রে মদীনার কবরস্থান বাকীউল গারকাদে যান এবং কবরবাসীর জন্য ইস্তিগফার করেন। পরদিন থেকে তিনি রোগ-যাতনার শিকার হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আযাদকৃত গোলাম আবু মুয়াইহবা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে মধ্যরাতের দিকে ডেকে তোলেন এবং বলেন, “হে আবু মুয়াইহিবা, আমি এই কবরস্থানের মৃতদের জন্য ইসতিগফার করতে আদিষ্ট হয়েছি। তুমি আমার সাথে চল।” আমি সাথে গেলাম। করবরস্থানের সামনে দাড়িঁয়ে তিনি বললেন,

“হে কবরবাসী, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আজকে লোকেরা যে অবস্থায় পতিত হয়েছে তার চাইতে তোমরা ঢের ভাল অবস্থায় আছ। ফিতনাসমূহ গভীর অন্ধকার রাতের মত সমুপস্থিত যা ক্রমান্বয়ে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। যে দুর্যোগই আসছে তা পূর্ববর্তীটার চেয়েও মারাত্মক।

অতঃপর আমাকে সম্বোধন করে বললেন, “হে আবু মুয়াইহিবা! আমাকে দুনিযঅর ধনসম্পদ ও তার স্থায়ী ভোগাধিকার এবং তারপর জান্নাত দান করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, তুমি এই ধনসম্পদ ও তা স্থায়ীভাবে ভোগের অধিকার, জান্নাত ও আল্লাহর সাক্ষাত লাভ- এ দুইটি মধ্যে যেটি ইচ্ছা গুহণ কর।”

আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি দুনিযার ধন সম্পদ ও তা স্থায়ীভাবে ভোগ করার অধিকার অতঃপর জান্নাত- এ দুটোকে ইখতিয়ার করুন।” তিনি বললেন, “না, আমি বরং আল্লাহর সাক্ষাত সাক্ষাত ও জান্নাতই গ্রহণ করেছি।”

এরপর তিনি ‘বাকী’ কবরবাসীর জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করলেন এবং ঘরে ফিরলেন। এরপরই তাঁর রোগ যাতনা শুরু হয় এবং তাতেই শেষ পর্যন্ত ইন্তিকাল করেন্

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়িশা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাবী থেকে ফিরে এসে দেখলেন, আমি মাথাব্যথায় কাতর হয়ে বলছি,, “উহ, মাথা গেল।” এ অবস্থা দেখে রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আয়িশা, আমারই বরং মাথা গেল। তারপর বললেন, “আচ্ছা, তুমি দি আমার আগে মরে যাও আর আমি তোমার কাফন দাফন ও জানাযা করি, তাহলে কেমন হয়?” আমি বললাম, “আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সে কর্মটি হলে আপনি ঘরে ফিরে আপনার স্ত্রী নিয়ে আমোদ প্রমোদ করবেন।”

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, তাঁর রোগযন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে। তখানো তাঁর স্ত্রীদের কাছে পালাক্রমে থাকতেন। কিন্তু সাহসাই রোগযন্ত্রণা বেড়ে গেল। এই সময় তিনি মাইমুনার (রা) ঘরে ছিলেন। তিনি তাঁর সকল স্ত্রীকে ডাকলেন এবং তাঁদের কাছে অনুমতি চাইলেন যে, তাঁর পরিচর্যা আমার ঘরেই হোক। সকলেই অনুমতি দিলেন।

রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রীগণ বা উম্মুহাতুল মু’মিনীনের বিবরণ

ইবনে হিশাম বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নয়জন স্ত্রী ছিলেন। যথা: আয়িশা বিনতে আবু বাক্র (রা), হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান ইবনে হরাব (রা), উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরা (রা), সাওদা বিনতে যামআ ইবনে কায়েস (রা), যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা), মাইমুনা বিনতে হারেস ইবনে হাযন (রা), জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস ইবনে আবু দিরার (রা) ও সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব। একাধিক নির্ভযোগ্য বিজ্ঞজান থেকে এদের বিবরণ জানা গেছে।

[রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোট স্ত্রীসংখ্যা তের। কিন্তু উল্লিাখত নয় জন তাঁর ইন্তিকালের সময় বেঁচে ছিলেন। দুই জন আগেই মারা যান। আর দুই জনের সাথে নাম মাত্র বিয়ে হয়েছিল। তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহিনী হননি।]

খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহ আনহা

খাদীজাই ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। তাঁর পিতা খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ মতান্তরে ভ্রাতা আমর ইবনে খুয়াইলিদ খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম তাঁকে বিশটি বকনা উষ্ট্রী মোহরানা দেন। ইব্রাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কয়টি সন্তান তাঁর গর্ভেই জন্মে। তাঁর পূর্ব স্বামী ছিলেন আবু হালা ইবনে মালিক। তিনি ছিলেন তিনি ছিলেন বনু আবুদদ দার গোত্রের মিত্র বনু উসাইদের লোক। আবু হালার স্ত্রী থাকাকালে তাঁর গর্ভে হিন্দ নামে একটি ছেলে ও যয়নাব নামে একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। আবু হালার পূর্বে তাঁর বিয়ে হয় আতীক ইবনে আবিদের সাথে। সেখানেও তাঁর আবদুল্লাহ নামে একটি ছেলে ও জারিয়া নামে একটি মেয়ে জন্মে।

আয়িশা বিনতে আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহা

মাত্র সাত বছর বয়সে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। মদীনায় হিজরাতের পর নয় বা দশ বৎসর বয়সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি আয়িশা (রা) ছাড়া আর কোন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করেননি। তাঁর পিতা আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) তাঁকে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা স্বরূপ চারশো দিরহাম প্রদান করেন।

সওদা বিনতে যাম’য়া রাদিয়াল্লাহু আনহা

সালীত ইবনে আমর মাতান্তরে আবু হাতিম ইবনে আমর তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা স্বরূপ চারশো দিরহাম প্রদান করেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম সাকরান ইবনে আমর। [৯৭. ইবনে হিশাম বলেন যে, ইবনে ইসহাক এই বর্ণনার সাথে একমত নন। তাঁর মতে আলী ও আবু হাতিম উভয়ে এই সময় আবিসিনিয়ায় প্রবাল জীবন যাপন করছিলেন। এই সময়ে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুপস্থিত ছিলেন।]

যায়নাব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহা

তাঁর ভাই আবু আহমাদ ইবনে জাহাশ তাঁর বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা দেন চারশো দিরহাম। তাঁর পূর্ব স্বামী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজাদ করা গোলাম যায়িদ ইবনে হারিসা (রা)।

যায়নাব সম্পর্কেই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়: “যায়িদ যখন তাঁকে ছেড়ে দিল তখন আমি তোমার সাথে তার বিয়ে দিলাম।”

উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা

তাঁর আর এক নাম হিন্দ। তাঁর বিয়ে দেন তাঁরই পুত্র সালামা। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুরের ছালভর্তি একটি গদি, একটি পেয়ালা, একটি প্লেট ও একটি যাঁতাকল দিলেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম আবদুল্লাহ আবু সালামা। সেখানে তাঁর চারটি সন্তান জন্মে। যথা: সালামা, উমার, যায়নাব এবং রুকাইয়া।

হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহা

পিতা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজে তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের সাথে চারশো দিরহাম মোহরানায় বিয়ে দেন। পূর্বে তাঁর বিয়ে হয়েছিল খুনাইস ইবনে হুযাফা সাহমীর সাথে।

উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান ইবনে হরব রাদিয়াল্লাহু আনহা

খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ের উদ্যোগ নেন ও প্রস্তাব দেন। তাঁরা উভয়ে তখন আবিসিনিয়ায় প্রবাসী জীবন যাপন করছিলেন। খোদ নাজাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের পক্ষ থেকে তাঁকে চারশো। দিনার মোহরানা দিয়ে দেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ আসাদী। তাঁর প্রকৃত নাম রমলা।

 

জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহা

খুযায়া গোত্রের এই মহিলা বনু মুস্তালিক যুদ্ধে যুদ্ধবন্দিনী হয়ে আসেন এবং সাবিত ইবনে কায়সের (রা) অংশে পড়েন। জুয়াইরিয়া হারিসের কাছ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এই মুক্তিপণ প্রদানে সাহায্যের জন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হন। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুক্তিপণ আদায় করতে রাজী হন এবং তাঁর সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দেন। জুয়াইরিয়া প্রস্তাবে সম্মত হন। অতঃপর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয।

ইবনে হিশাম উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়াইরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বনু মুস্তালিকের এলাকা থেকে ফিরলেন, পথিমধ্যে তিনি জনৈক আনসারী সাহাবার নিকট জুয়াইরিয়াকে আমানত রেখে তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়ে মদীনায় চলে গেলেন। মদীনায় পৌছাবার পর জুয়াইরিয়ার পিতা হারিস ইবনে আবু দিরার কণ্যার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপনীত হলেন। আকীক নামক স্থানে এসে হারিসের নজর পড়লো মুক্তিপণ স্বরূপ যে উটের বহর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে চলেছেন তার ওপর। দুটো উট তার অত্যধিক পছন্দ হলো। তিনি ঐ দুটো উটকে আকীক পাহাড়ের কোন এক গুহায় লুকিয়ে রাখলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, “হে মুহাম্মাদ, তোমরা আমার কন্যাকে বন্দী করে এনেছো। এই নাও তার মুক্তিপণ।” রাসূলুল্লাহ াসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সেই উট দুটোর কি হলো-যা তুমি আকীক পাহাড়েরর অমুক গুহায় লুকিয়ে রেখে এসেছো।” হারিস বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই আর আপনি আল্লাহর রাসুল। নিশ্চয়ই আপনাকে এ কথা একমাত্র আল্লাহই জানিয়েছেন।” হারিস ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর লোক পাঠিয়ে আকীক পাহাড় থেকে লুকানো উট দুটো আনলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর সব কয়টি উট সমর্পণ করলেন। কন্যা জুয়াইরিয়াকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হলো।

সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব রাদিয়াল্লাহু আনহা

ইহুদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সাফিয়াকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার থেকে যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে আনেন এবং স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন। এই বিয়েতে তিনি এক অনাড়ম্বর ওলীমার আয়োজন করেন যাতে চর্বি বা গোশতের পরিবর্তে শুধু খোরমা ও ছাতু দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকায়েক।

মাইমুনা বিনতে হারিস রাদিয়াল্লহু আনহা

আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে চারশো দিরহাম মোহরানা প্রদান করেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম আবু রোহম ইবনে আবদুল ্যযা। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনিই সেই মহিলা যিনি পবিত্র কুরআনের ভাষায় নিজেই নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব যখন এই মহিলার নিকট পৌছে তখন তিনি উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। তিনি প্রস্তাবের জবাবে তৎক্ষণাৎ বললেন, “এই উট ও তার আরোহী আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য নিবেদিত।” মহান আল্লাহ এর পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল করেন, “(তোমার জন্য বৈধ করা হয়েছে) যদি কোন মু’মিন রমণী নিজে আত্মনিবেদন করে আর নবী যদি তাকে বিয়ে করতে চান তা হলে।”

কেউ কেউ বলেনঃ নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সমর্পণকারিনী মহিলা তিনি নন বরং যায়নাব বিনতে জাহাশ। আবার কেউ বলেন, তিনি উম্মে শুরাইক গাযিয়া বিনতে জাবির। অন্যদের মতে তিনি বনু সামা গোত্রের জনৈকা মহিলা। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ব্যাপারটি বিলম্বিত করেছেন।

যায়নাব বিনতে খুযাইমা রাদিয়াল্লাহু আনহা

প্রথমে চাচাতো ভাই যাহাম ইবনে আমরের সাথে বিয়ে হয়। পরে উবাইদা ইবনূল হারিসের সাথে বিয়ে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে চারশো দিরহাম মোহরানার বিনিময়ে তাঁকে বিয়ে দেন কাবীসা ইবনে আমর হিলালী। ফকীর মিসকীন ও দারিদ্রের প্রতি তাঁর অত্যধিক দয়া ও মমত্ববোধের কারণে তাঁকে উম্মুল মাসাকীন বলা হতো।

এই এগারো জন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী, যাদের সাথে তিনি দাম্পত্য জীবন যাপন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা) এবং যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালেল সময় ও তার পরে জীবিত ছিলেন। এছাড়া দু’জনের সাতে তাঁর দাম্পত্য জীবন যাপন করা সম্ভব হয়নি হয়নি। একজন আসমা বিনতে নু’মান কিন্দিয়া। এই মহিলাকে বিয়ে করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শ্বেত বা কুষ্ঠ আক্রান্ত পান। তাই তাকে উপঢৌকন দিয়ে তার পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। অপরজন ‘আমরা বিনতে ইয়াযীদ কিলাবিয়া। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেই তাঁর কাছ থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং আল্লাহর কাছে পনাহ চাইছে।” অতঃপর তাকে তিনি তহার পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরত পাঠান। কেউ কেউ বলেন, যে মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পানাহ চেয়েছিল অর্থাৎ দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করতে অস্বীকার করেছিল সে হলো আসমা বিনতে নু’মান কিন্দিয়ার চাচাতো বোন। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাছে ডাকলে সে (গর্বভরে) বলে, “আমরা অভিজাত গোত্রের মানুষ। লোকেরা আমাদের কাছে আসে। আমরা কারো কাছে যাই না।” একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লাম তাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে ছয় জন ছিলেন কুরাইশ বংশীয়। যথা - খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা), আয়িশা বিনতে আবু বাক্র (রা), হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা), উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া (রা) ও সওদা বিনতে যামআ (রা)। আর বাদবাকী সাতজন অকুরাইশী। ছয় জন আরব বংশোদ্ভুত। যথা: যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা) (বনু আসাদ গোত্রের), যায়নাব বিনতে হারেস (রা) (বনু আমের গোত্রের), যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা) (বনু খাযায়া গোত্রের), আসমা বিনতে নুমান কিন্দিয়া (রা) (কিন্দা গোত্রের) এবং আমরা বিনতে ইয়াযীদ (রা) (বনু কিলাব গোত্রের)। আর একজন অনারব (ইহুদী) বংশোদ্ভূত, সাফিয়া (রা) বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব (বনু নাজীর গোত্রের)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ সংক্রান্ত অবশিষ্ট বিবরণ

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়িশা থেকে উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ, তাঁর থেকে মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম যুহরী এবং তাঁর থেকে ইয়াকুব ইবনে উতবা আমাকে জানিয়েচেন যে, আয়িশা (রা) বলেছেন, “(অন্যান্য স্ত্রীদের কাছ থেকে আমার ঘরে পরিচর্যঅর জন্য অবস্থানের অনুমতি লাভের পর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবারভূক্ত দুই ব্যীক্ত ফযল ইবলে আব্বাস (রা) ও অন্য একজনের কাঁধে ভর করে মাথায় পট্রি বাঁধা অবস্থায় পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মতে অপর ব্যক্তিটি ছিলেন আলী ইবনে আবু তালিব (রা)।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যন্ত্রণা বেড়ে গেল এবং তিনি কাতর হয়ে বললেন, “বিভিন্ন কুয়া থেকে সাত মশক পানি এনে আমার মাথায় ঢাল যাতে আমি জনগণের কাছে গিয়ে অঙ্গীকার আদায় করে আসতে পারি।” আমরা তাঁকে হাফসা বিনতে (রা) একটি বড় কাপড় ধোয় পাত্রের কাছে বসিয়ে তার মাথায় প্রচুর পরিমাণে পানি ঢাললাম। অবশেষে তিনি বললেন,

“যথেষ্ট হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে।”

যুহরী বলেন: আইয়ুব ইবনে বাশীর আমাকে জানিয়েছেন যে, মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বেরিয়ে এসে মসজিদের মিম্বারে বসলেন। অতঃপর তিনি মুখ খুলেই সর্বপ্রথম উহুদ যুদ্ধের শহীদদের জন্য রহমত কামনা করলেন ও তাঁদের জন্য ক্ষমা চাইলেন। তাঁদের জন্য রহমত কামনা করে তিিন অনেক দোয়া করলেন। অতঃপর বললেন, “এক বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়ার সম্পদ ও আল্লাহর নিকট যে নিয়ামত রয়েছে তার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে বললেন। সেই বান্দা  আল্লাহর কাছে যে নিয়ামত রয়েছে তা-ই বেছে নিল।” এ কথার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন আবু বাক্র সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বুঝেছিলেন যে, এই বান্দা খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কেউ নন। তাই তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের নিজেদেরকে আর আমাদের সন্তান সন্ততিকে বরং আপনার জানের বদলায় কুরবানী করে দিই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু বাক্র একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ কর।” অতঃপর বললেন, “মসজিদের এই উন্মুক্ত দরজাগুলো বন্ধ করে দাও। তবে আবু বাক্রের ঘরের সাথে সংলগ্ন দরাজা বন্ধ করো না। কেননা আমার সহচর্যে যত লোক এসেছে তার মধ্যে আবু বাক্রকেই আমি সর্বাধিক নির্ভযোগ্য সহযোগী পেয়েছি।”

আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সাথে একথাও বলেছিলেন, “আল্লাহর বান্দাদের ভেতর থেকে কাউকে যদি আমি নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতাম তাহলে আবু বাক্রকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু যদিদিন আমরা আল্লাহর কাছে সম্মিলিত না হই ততদিন শুধু সাহচর্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঈমানই আমাদের পারস্পরিক বন্ধনের যোগসূত্র হয়ে থাকবে।”

উরওয়া ইবনে যুবাইর প্রমুখ বিজ্ঞ ব্যক্তির সূত্র উল্লেখ করে আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে যুবাইর জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রোগাবস্থায় থাকা সত্ত্বেও উসামা (রা) বাহিনী প্রেরণে বিলম্ব হওয়ায় অস্থিরতা প্রকাশ করেন। ওদিকে কেউ কেউ প্রবীণ মুহাজির ও আনসারগণ থাকতে অল্পবয়স্ক তরুণ উসামা অধিনায়ক মনোনীত হওয়ায় মৃদু আপত্তি প্রকাশ করছিলেন। একথা জেনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় মিম্বারে এসে বসলেন। আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনগন, উসামার বাহিনী তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে যদি তোমাদের মধ্যে কথা উঠে থাকে তবে এ ধরনের কথা তোমরা তার পিতার অধিনায়কত্ব নিয়েও তুলেছিল। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, উসামা এ কাজের যোগ্য আর তাঁর পিতাও এ কাজের যোগ্য ছিল।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে এলেন। মুসলমানগণ উসামার বাহিনী প্রেরণের আয়োজন করতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগযন্ত্রণাও প্রবল হতে লাগলো। উসামা বাহিনী নিয়ে যখন মদীনা থেকে এক ফারসাখ দূরে অবস্থিত ন্মিনভূমিতে পৌছেছেন, সেখানে তাঁর সেনাবাহিনীও পৌছেছে এবং অন্যান্য মুসলমানগণও তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে, ঠিক তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা কি দাঁড়ায় দেখার জন্য। যুহরী বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে মালিক আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন তাঁর ভাষণে উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দোয়া এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে যা কিছু বলেছিলেন তার সাথে এ কথাও বলেছিলেন, “হে মুহাজিরগণ, তোমরা আনাসারদের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য রেখ। অন্যান্য লোকদের তো ক্রমেই আর্থিক সচ্ছলতা এসে থাকে। কিনউত আনসারদের বর্তমান অবস্থার আলোকে সে অবকাশ নেই। তারা আমার গোপনীয়তার সংরক্ষক ও আশ্রয়দাতা ছিল। সুতরাং ভাল ব্যবহারের বদলায় তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। আর তাদের থেকে কোন মন্দ ব্যবহার পেলে মাফ করে দিও।”

তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে বাড়ীর মধ্যে প্রবশে করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন।

এই সময় উম্মে সালামা ও মাইমুনা (রা) সহ তাঁর কতিপয় স্ত্রী এবং আসমা বিনতে উমাইস সহ মুসলমানদের কতিপয় স্ত্রীলোক তাঁর কাছে জমায়েত হলেন। তাঁর কাছে তাঁর চাচা আব্বাস (রা) আগেই উপস্থিত ছিলেন।

সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘লাদুদ’ নমাক ওষুধ খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। আর আব্বাস (রা) বললেন, “আমি তাঁকে অবশ্যই ‘লাদুদ’ খাওয়াবো।” শেষ পর্যন্ত তাঁকে লাদুদ খাওয়ানো হলো এবং তিনি সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে এ জিনিস কে খাইয়েছে?” সবাই বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার চাচা খাইয়েছেন।” তিনি বললেন, এটা হাবশার দিক থেকে আগত কিছু সংখ্যক মহিলার আনীত এক ধরনের ওষুধ। তোমরা কেন এটা প্রয়োগ করলে?” আব্বাস (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আশংকা করেছিলাম যে, আপনি ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হয়েছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঐ রোগে আল্লাহ আমাকে কখনো আক্রান্ত করবেন না। আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে আমার চাচা ছাড়া আর কেউ এই ‘লাদুদ’ থেকে অব্যাহতি পাবে না।” মাইমুনা (রা) কে রোযা অবস্থায় লাদুদ সেবন করতে হয়েছিল। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা তাঁর পরিবার-পরিজনকে ঐ ভুল কর্মের জন্য শাস্তি দোবর ব্যবস্থা করেছিলেন।

উসামা ইবনে যায়িদ (রা) বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়লে আমি এবং আমার সহগামী বাহিনী ও মুসলমানগণ মদীনায় ফিরে গেলাম এবং পরে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে, তিনি আকাশের দিকে হাত তুলতে লাগলেন এবং হাত নামিয়ে আমার গায়ে রাখতে লাগলেন। এতে বুঝলাম যে, তিনি আমার জন্য দোয় করছেন।

আয়িশা (রা) বলেনঃ

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ মুহুর্তে উপস্থিত হলে তাঁর শেষ যে কথাটা উচ্চারিত হতে শুনেছি তা ছিল এই: “বরং জানাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু, তাঁকে আমি চাই।” আমি তা শুনে মনে মনে বললাম: তিনি আমাদেরকে অগ্রাধিকার দেন না। এই সময় আমি বুঝতে পারলাম তিনি যে বলতেন “কোন নবীকে জীবন ও মৃত্যুর ইখতিয়ার না দিয়ে মৃত্যু দেয়া হয়নি, “-তার। মনোনীত সেই প্রয়তম বস্তুই তাঁর এই উক্তিতে বিঘোষিত হয়েছে-“বরং জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু তাঁকে আমি চাই।”

নামাযের জামায়াতে আবু বাক্র (রা) ইমামতি

যুহরী বলেন: হামযা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের কাছ থেকে আমি শুনেছি। আয়িশা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পীড়া অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে তিনি বললেন, “তোমরা আবু বাক্রকে নামায পড়িয়ে দিতে বল।” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আবু বকর অত্যন্ত কোমল হৃদয় মানুষ। তাঁর কন্ঠস্বর অত্যন্ত নীচু। কুরআন পড়তে গেলে প্রায়ই তাঁর কান্না পায়।” তিনি বললেন, “তাঁকে বল, নামায পড়িয়ে দিক।” আমি আবারও আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি বললেন, “তোমরা ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আচরণকারী মহিলাদের মত। যাও আবু বাক্রকে জামায়াতের ইমামতি করতে বল।” সত্য বলতে কি আমি আবু বাক্রকে (রা) ইমামতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম বলেই ঐ কথা বলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, যে কোন অঘটন ঘটলে লোকেরা আবু বাক্রকে (রা) দায়ী করবে এবং তাঁর ঘাড়েই দোষ চাপাবে। আমি জানতাম, লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত লোককে কখনো পছন্দ করবে না। এসব কারণেই আমি তাঁকে এ দায়িত্ব থেকে দূরে রাখতে আগ্রহী ছিলাম।

আবদুল্লাহ ইবনে যামআ বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগ আশংকাজনক অবস্থায় পৌছার সময় আমি মুসলমানদের একটি দল সহ তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এই সময় বিলাল (রা) তাঁকে নামায পড়তে ডাকলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নামায পড়াতে পারে এমন একজনকে ইমামতি করতে বল।” প্রথমে আমার দেখা হলো উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে। আমি “হে উমার, আসুন নামায পড়ান।” উমার (রা) নামাযের ইমামতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। উমার ছিলেন উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। তিনি তাকবীর বললে তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবু বাক্র কোথায়? এটা আল্লাহ ও মুসলমানগণের মনঃপূত নয়।” আবু বাক্রকে (রা) ডাকা হলো। উমার (রা) তাঁর আরম্ভ করা নামায শেষ করলে তিনি এলন। তারপর থেকে তিনিই নামায পড়াতে লাগলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে যামআ বলেন: উমার (রা) আমাকে বললেন, “হে ইবনে যামআ, ধিক্ তোমাকে! তুমি আমার সাথে এ কি আচরণ করলে? তুমি যখন আমাকে নামায পড়তে বলেছিলে তখন আমি ভেবেছিলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নামায পড়াতে বলেছেন। তা না হলে আমি পড়াতাম না।” আমি বললাম, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নির্দেশ দেননি আপনাকে নামায পড়াতে বলতে। তবে আবু বাক্রকে (রা) যখন পেলাম না তখন আমি উপস্থিত মুসলমানদের মধ্যে আপনাকেই নামায পড়ানোর জন্য সবচাইতে যোগ্য মনে করেছি।”

ইবনে ইসহাক বলেন: আনাস ইবনে মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে যুহরী আরো জানিয়েছেন যে, আল্লাহ যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরদিনের জন্য আপন সান্নিধ্যে ডেকে নেন কেদিন ছিল সোমবার। মুসলমানগণ জামায়াতে ফজরের নামায আদায় করছিলেন ঠিক সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা তুলে এবং দরজা খুলে বেরিয়ে আয়িশার (রা) গৃহ সংলগ্ন দরজার  চৌকাঠের ওপর দাঁড়ালেন। নামায আদায়কারী মুসলমানগণ তাঁকে এক নজর দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। এ সময় খুশীতে তাঁরা নামাযই ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কারো সাহায্য ছাড়া একাকী দাঁড়ানো দেখে তাদের মন থেকে সকল দুশ্চিন্তা ও আশংকা মুহুর্তের মধ্যে দূর হয়ে গেল। তিনি তাদের নামায আদায়ের শৃংখলা দেখে খুশীতে মুচকি হাসলেন এবং ইংগিতে বললেন, “নামায ছেড়ে দিও না বরং শেষ কর।” সেদিন সেই মুহুর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে যেরূপ মনোহর ভঙ্গীতে দেখেছিলাম, তেমন আর কখনো দেখিনি। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে গেলেন। লোকেরা তাঁকে রোগতুক্ত দেখে যে যার কাজে চলে গেল্ আবু বাক্র (রা) ও ‘সুনাহ’ এলাকায় তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন। [৯৮. এই স্থানটিতে আবু বাকরের (রা) জমি ও বাড়ী ছিল এবং সেখানে তিনি সপরিবারে থাকতেন।]

মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আমাকে কাসিম ইবনে মাহাম্মাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমারের (রা) নামায পড়ানো তাকবীর শুনলেন তখন বললেন, “আবু বাক্র কোথায়? আল্লাহ ও মুসলমানগণের নিকট আবু বাক্র (রা) ছাড়া অন্যের ইমামতি গ্রহণযোগ্য নয়।” বস্তুতঃ উমার (রা) যদি তাঁর ইনতিকালের প্রাক্কালে একটি কথা না বলতেন তাহলে মুসলমানগণ সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করতো যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রকে (রা) খলীফা নিয়োগ করে গেছেন। কিন্তু উমার (রা) মৃত্যুর পূর্বে এ ধারণা বাতিল করে দিয়ে যান। তিনি বলেন, “আমি যদি খলিফা নিয়োগ করে যাই তাহলে (বুঝে নিও যে) যিনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিরেন তিনিও ওটা তাদের স্বাধীন বিবেচনার ওপর সোপর্দ করে গিয়েছিলেন।” অতঃপর উমার (রা) খলিফা নিয়োগ না করে মারা যাওয়ায় মুসলমানগণরা বুঝলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রকে খলিফা নিয়োগ কেের যাননি।

আবু বাক্র ইবনে আবদুল্লাহ আমাকে (ইবনে ইসহাককে) বলেছেন: সোমবার আুব বাক্র (রা) যখন ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় ব্যন্ডেজ বেঁধে সেখানে ইপনীত হলেন। লোকেরা খুশী হয়ে কাতার থেকে সরে গেল। আবু বাক্র (রা) বুঝতে পারলেন যে, লোকজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই এরূপ করেছে। তাই তিনি তাঁর স্থান থেকে পিছিয়ে আসলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পিঠে হাত হাত দিয়ে সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, “তুমিই নামায পড়াও।” তারপর তিনি আবু বাক্রের (রা) ডান পাশে বসে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি মুসল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে এত উচ্চস্বরে ভাষণ দিলেন যে, মসজিদের বাইরে থেকেও তা শোনা গিয়েছিল। তিনি বললেন, “হে জনমন্ডলী, জাহান্নামের আগুনকে উত্তপ্ত করা হয়েছে। আর দুর্যোগসমূহ অন্ধাকরা রাতের মত ঘনিয়ে এসেছে। মনে রেখ, আমার নিজস্ব কোন জিনিস তোমাধের মেনে চলতে হচ্ছে না। আমি কুরআনের জিনিস নিষিদ্ধ করিনি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষণ শেষ করলে আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বাস্থ্য স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ভেবে এবং দিনটি স্ত্রী বিনতে খারেজার পালার দিন বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে স্বীয় পরিবারের কাছে ‘সুনাহে’ চলে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহে প্রবেশ করলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সেদিন আলী ইবনে আবু তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বাইরে এলে মুসলমান জনতা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবুল হাসান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন?” তিনি বললেন, “আলহামদুল্লিাহ”। তিনি সেরে উঠেছেন।” তখন আব্বাস (রা) তাঁর হাত ধরে বললেন, “আল্লাহর কসম, কয়েকদিন পর তোমাকে নেতৃত্ব নিতে হবে। আল্লহর কসম, আবুদল মুত্তালিবের ছেলেদের মুখে মৃত্যুর লক্ষ করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখেও তা দেখতে পেয়েছি। চল, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাই। যদি তাঁর অবর্তমানে ইসলাম ও মুসলমানদের দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তে তাহলে আমরা তা বুঝে নেব। আর যদি তা অন্যদের হাতে যায় তাহলে তাঁকে বলবো, আমাদের দিকে নজর দেয়ার জন্য তিনি যেন সবাইবে নির্দেশ দেন।” আলী (রা) বললেন, “আমি যাবো না। তিনি যদি এ দায়িত্ব আমাদেরকে দিতে অস্বীকার করেন তাহলে তাঁর পরে আর কেউ দেবে না।” অতঃপর সেইদিনই দুপুরের কাছাকাছি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন।

আয়িশা (রা) বলেনঃ

সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে সরাসরি আমার কাছে এলেন এবং আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। এ অব্যবহিত পর আবু বকরের (রা) পরিবারের এক ব্যক্তি একটা সবুজ মিসওয়াক নিয়ে আমার কাছে এল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, মনে হলো তিনি ওটা চাইলেন। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনাকে কি মিসওয়াকটা দেবো?” তিনি বললেন, “হাঁ।” অতঃপর তাঁকে দিলাম। তখন তিনি তা নিয়ে খুব বেশী করে মিসওয়াক কররেন এবং তারপর তা রেখে দিলেন। এরপর রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ আমার কোলের ওপর ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তাঁর চোখ বিস্ফারিত হয়ে আসছে। তিনি বলছিলেন, “জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু, তাঁকে চাই?” আমি বললাম, “আপনাকে নিজের মনের মত জিনিস চাইতে বলা হয়েছে। আপনিও উপযুক্ত জিনিস চেয়ে নিয়েছেন।”

এরপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ইবনে ইসহাক বলেন: আয়িশা (রা) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গৃহে অবস্থানের পালার সময়ে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে ইনতিকাল করেছেন। আমি এক্ষেত্রে কারো ওপর যুলুম করিনি। আমি যে ইনতিকালের সময় তাঁকে কোলে ধরে রেখেছিলাম তারপর তাঁকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে অন্যান্য মহিলাদের সাথে মুখ ও বুক চাপড়াতে আরম্ভ করেছিলাম - সে সব আমর বোকামী, তারুণ্যসুলভ সরলতা ছাড়া কিছু নয়।”

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন, তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতকগুলো মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা আলাইহিস সালামের সত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গিয়েছেন। মূসা (আ) চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসার (আ) মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার ফিরে আসবেন। এখন যার বলছে যে তিনি মারা গেছেন তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে।”

আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালেরর খবর জানতে পেরে ছুটে এলেন্ উমার (রা) থকনও ঐ কথা বলে চলেছেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আয়িশার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে গেলেন। তখন তাঁকে ইয়ামনী কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা আপনি আস্বাদন করেছেন। এরপর আপনার কাছে আর কখনো মৃত্যু আসবে না।” অতঃপর মুখ ঢেকে দিলেন। তারপর বাহিরে বেরিয়ে দেখেন উমার (রা) সেই একই কথা বলে চলেছেন। তিনি বললেন, “উমার। তুমি ক্ষান্ত হও। চুপ কর।” উমার (রা) কছিুতেই থামতে রাজী হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বাক্র (রা) জনগণকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমারকে (রা) রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এল। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন,

“হে জনমন্ডলী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।” তারপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন-

[আআরবী ******]

“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূলস অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।” (আলে ইমরান)

এরপর মানুষের মধ্যে এমন বাবান্তর ঘটলো যে, মনে হচ্ছিল তারা যেন আবু বাকরের মুখে শোনার আগে এ আয়াত কখনো শোনেইনি। তার আয়াতটি আবু বাকরের কাছ থেকে মুখস্থ করে নিল এবং অনবরত তা আবৃত্তি করতে লাগলো। আবু হুরাইরা বলেন,, উমার (রা) বলেছেন, “আবু বাকরের মুখে এ আয়াত শোনার পর আমি হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখনই অনুভব করলাম যে,, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লাম সত্যিই ইনতিকাল করেছেন।”

বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর আনসারী সাহাবীদের একটি দল সায়েদা গোত্রের ছাদযুক্ত চত্বরে জমায়েত হয়ে সা’দ ইবনে উবাদার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। ফাতিমার (রা) গৃহে আলী (রা), যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা) নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করলেন। উসাইদ ইবনে হুদাইরের (রা) নেতৃত্বে বনু আবদুল আশহাল গোত্রও তাঁদের অনুসরণ করলো। এই সময় এক ব্যক্তি আবু বাক্র (রা) ও উমারের (রা) কাছে এসে বললো, “আনসারগণের এই দলটি বনু সায়েদার চত্বরে জমায়েত হয়ে সা’দ ইবনে উবাদার নেতৃত্বে আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়েছে। এমতাবস্থায় তোমরা যদি মুসলমানদের ঐক্য বজায় রাখার প্রয়োজন অনুভব কর তাহলে তাড়াতাড়ি তারেদ কাছে যাও। নচেৎ অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। অথচ এখনও পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন দাফনও সারা হয়নি। তাঁর পরিবার পরিজন এখনো তাঁকে রুদ্ধদার গৃহে সংরক্ষণ করছেন।” উমার (রা) আবু বাক্রকে (রা) বললেন, “চলুন, আমরা এই আনসারী ভাইদের কাছে গিয়ে দেখিম তাদের ব্যাপারটা কি?”

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও উমার (রা) - এর বর্ণনা

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: [উমারের (রা) খিলাফতের শেষের দিকে আমি একদিন আবদুর রহমান ইবনে আওফের মিনাস্থ বাড়ীতে তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। আবদুর রহমান তখন উমারের (রা) কাছে ছিলেন। উমার তাঁর শেষ হজ্জ সমাপন করছিলেন। আবদুর রহমান (রা) উমারের (রা) কাছ থেকে ঘরে ফিরে দেখেন আমি তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। তৎকালে আমি তাঁকে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতাম। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) আমাকে বললেন, তুমি দেখলে অবাক হয়ে যেতে যে, একটি লোক আমীরুল মুমিনীন উমারের (রা) কাছে এস বলতে লাগলো, “হে আমীরুল মুমিনীন, অমুন ব্যক্তি সম্পর্কে কি আপনি কিছু বলবেন, যে বলেঃ উমার যদি মারা যেতেন তাহলে আমি অমুককে খলিফা নির্বাচন করতাম? আল্লাহর কসম, আবু বাকরের খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হওয়াটা ছিল নেহাৎ আকস্মিক ও অপ্রত্যশিত ঘটনা।” উমার (রা) এ কথা শুনে (একজন বিশেষ ব্যক্তিকে খলিফা করার পক্ষে ক্যানভাস করার প্রবণতা এবং প্রথম খলিফার নির্বাচনের অবমূল্যায়ন হতে দেখে) রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “আমি ইনশাআল্লাহ আজ বিকালেই জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবো এবং যারা মুসলমানদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিাকারকে বিকৃত ও বিনষ্ট করতে চাইছে, তাদের সম্পর্কে তাতেদরকে হুঁশিয়ার করে দেবো।” আবদুর রহমান (রা) বলেন, আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, এ কাজ করবেন না। কেননা হজ্জের সময় অনেক অজ্ঞ, অবুঝ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকও সমবেত হয়ে থাকে। আর আপনি যখনই জনসাধারনের মধ্যে দাঁড়াবেন তখন অজ্ঞ লোকেরা আপনার আশেপাশে থাকবে। আমার আশংকা হয়, আপনি যে কথা বলবেন অজ্ঞ লোকেরা তার ভুল অর্থ বুঝবে এবং চারদিক ছড়াবে। কাজেই মদীনায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করুন। কেননা মদীনাই রাসূলের কেন্দ্রভূমি। সেখানে আপনি গণ্যমান্য ও জ্ঞানী গুণী লোকদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পাবেন এবং যা বলতে চেয়েছেন তা সেখানে অবস্থানকালে বললে, সেখানকার বিচক্ষণ লোকেরা তা সঠিকভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে পারবে। কোন রকম কদর্থ করা বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকবে না।” উমার বললেন, “বেশ, তাই হবে। আমি মদীনায় গিয়ে প্রথম সুযোগেই এ কথা বলবো।”

ইবনে আব্বাস বলেন: আমরা যুলহিজ্জার শেষে মদীনায় পৌছলাম। আমি মিম্বারের কাছাকাছি সাঈদ ইবনে যায়িদকে পেয়ে তার গায়ে গায়ে ঘেষে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই উমারকে (রা) আসতে দেখলাম। তখন সাঈদ ইবনে যায়িদকে বললাম, “আজকে তিনি এমন একটি কথা বলবেন যা খলিফা হওয়ার পর আর কখনো বলেননি।” সাঈদ একথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, “এমন কি কথা বলতে পারেন যা কখনো বলেননি?” যা হোক, উমার গিয়ে মিম্বারে বসলেন মুয়াযযিনের আযান শেস হওয়া মাত্রই আল্লাহর প্রশংসান্তে নিম্নরূপ ভাষণ দান কররেন,

“আজ আমি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলবো যা আমার ভাগ্যে ছিল বলেই বলতে পারছি। হয়তো বা আমার মৃত্যু কাছাকাছি এসেই এটা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এর সঠিক মর্ম উলব্ধি করতে পারবে সে যেন অনর্থক আমি যা বলিনি, তা বলে না বেড়ায়। আল্লাহ মুহাম্মাদকে (সা) নবুওয়াত দান করেছিরেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেছিলেন। তার ভেতর ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা করাও সন্নিবেশিত হয়ের্ছি আমরা তা পড়েছি, শিখেছি ও অনুধাবন করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ শাস্তি কার্যকর করেছেন এবং তাঁর পরে আমরাও তা প্রয়োগ করেছি। আমার আশংকা হয় যে, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন হয়তো কেউ বলে বসবে, “আমরা আল্লাহর কিতাবে তো ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার শাস্তি কোথাও দেখতে পাই না।’ এভাবে আল্লাহর নাযিল করা একটা ফরয কাজ ত্যাগ করে লোক গুমরাহীতে লিপ্ত হবে। অথচ এই ‘রজম’ এর বিধান প্রত্যেক বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর জন্য আল্লাহ কিতাবে অকাট্যভাবে বিদ্যমান্ অবশ্য অপরাধটা সাক্ষী, কিংবা গর্ভসঞ্চার অথবা স্বীকারোক্তি দ্বার সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হওয়া চাই্ আমরা আল্লাহর কিতাবে এ বিধানও পড়েছি যে, নিজের পিতৃপরচয় বর্জন করো না। কেননা সেটা কুফরীর শামিল। সাবধান! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রশংসায় যেমন বাড়াবড়ি করা হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে তেমন অতিরঞ্জিত প্রশংসা করো না। আমাকে শুধু ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ বলে অভিহিত করো। আর একটা কথা বলছি, শোনো। আমি শুনেছি, অমুক ব্যক্তি নাকি বলেছে যে, উমার ইবনুল খাত্তাব মারা গেলে আমি অমুককে খলিফা মেনে নেব। তোমাদের কেউ যেন একথা বলে বিভ্রান্ত না করে যে, আবু বাকরের (রা) খিলাফত লাভ একটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল। ঘটনাটা আসলে সে রকমই ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তার সম্ভাব্য কুফল থেকে রক্ষা করেছেন। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমাদের মধ্যে আবু বাকরের মত উচ্চ মযার্দাসম্পন্ন ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আর কেউ নেই এবং ছিল না। সুতরাং যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করে কাউকে খলিফা মেনে নিয়ে বাইয়াত করবে, তার খিলাফত অচল এবং যে বাইয়াত করবে তার বাইয়াতও অবৈধ ও অগ্রাহ্য হবে। কেননা ও দু’ব্যক্তিকে হত্যার হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার আর কোন উপায় নেই।” [৯৯. এর তাৎপর্য এই যে, বাইয়াত তথা আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়ে কাউকে খলিফা, আমীর বা নেতা মেনে নেয়া একমাত্র পরামর্শ ও মতৈক্যের বৈধ হতে পারে। কিন্তু দুই ব্যক্তি যদি সমগ্র জামায়াত থেকে আলাদ হয়ে স্বেচ্ছাচারী পন্থায় একজন আর একজনের আনুগত্যের বাইয়াত করে তাহলে তা জামায়াতকে অগ্রাহ্য করা ওবিভক্ত করার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের বাইয়াত ঐ দুইজনের কারোই গ্রাহ্য হবে না। তারেদ ইভয়কে বর জামায়াত থেকে বহিস্কৃত করতে হবে, যে জামায়াত তাঁর সদস্যর ভেতর থেকে নেতা নির্বাচনে একমত। কেননা ঐ স্বৈরাচারী ব্যক্তিদ্বয়ের একজনকে যদি জামায়াত নেতা মেনে নেয় এবং বাইয়াত করে তাহলে যেহেতু তারা সমগ্র জামায়াতের মতামতকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে জামায়াতকে অপমানিত করেছে, তাই তাকে কে কখন হত্যা করে বসে বলা যায় না এবং কেউ তারেদ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে না। (লিসানুল আরব, [আরবী ***] অধ্যায় দ্রষ্টব্য মূল শব্দ [আরবী ***] এর অর্থ প্রসঙ্গে।)]

উমার (রা) বরেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর আমরা খবর পেলাম যে আনসারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বারে তাঁদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। আলী ইবনে আবু তালিব (রা), যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও তাঁদের সহচরগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাইলেন্ আর আবু বাকরের কাছে জমায়েত হলেন মুহাজিরগণ। আমি আবু বাকররেক (রা) বললাম, “আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আনসার ভাইদের কাছে চলুন।” তাদের কাছে যাওয়ার পথে তাদের দু’জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আমাদের দেখা হলো। তারা আনসারদের মনোভাব জানালেন। অতঃপর বললেন,  “হে মুহাজিরগণ, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” আমরা বললাম, “আমরা এই আনসার ভাইদের কাছে যাচ্ছি।” তাঁরা বললেন, “তাঁদের কাছে আপনাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাদের যা করনীয় তা করুন।” আমি বললাম, “আমাদের যেতেই হবে।” অতঃপর আমরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, সমবেত আনসারগণের মাঝখানে এক ব্যক্তি কম্বল মুড়ি গিয়ে মুখ ঢেকে আছে। আমর বললাম, “তাঁর কি হয়েছে।” তাঁরস বললেন, “অসুখ।” আমরা সেখানে বসলে তাঁদের এক বক্তা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিকালাতের সাক্ষ্য দিয়ে এবং আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। বললেন, “আমরা আল্লাহর আনসার এবং ইসলামের বীর সেনানী। আর হে মুহাজিরগণ। আপনার আমাদেরই একটি দল। আপনাদের একটি শান্তশিষ্ট মরুচারী দল আামদের সাতে এসে ইতিমধ্যেই যোগদান করেছে।”

উমার (রা) বলেন: আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং তার ওপর জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে। আমি এর জবাবে চমৎকার একটা বক্তৃতা তৈরী করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বাক্রকে শোনাতে চাইলাম। আবু বাকরের (রা) মধ্যে এক ধরনের তেজস্বিতা ছিল যার জন্য তাঁকে আমি খুবই ভয় পেতাম  এবং যথাসম্ভব তাঁর মনরক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। আবু বাক্র (রা) বললেন, “উমার। তুমি কিছু বলো ান।” আমি তার জিদ ধরে তাঁর রাগ বাড়াতে চাইলাম না। আমাদের চেয়ে ঢের বেশী শ্রদ্ধাভাজন ও জ্ঞানী ছিলেন আবু বাক্র (রা)। তিনি তাঁদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি অনেক সময় ধরে চিন্তা ভাবন  করে যে বক্তৃতা তৈরী করেছিলাম - যাতে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম তাঁর উপস্থিত বক্তৃতায় তার একটা কথাও বাদ তো গেলইনা বরং তার চেয়েও ভাল কথা তিনি বললেন। তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিস গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছোল তা যথার্থ বলেছো। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থকালে আরবার ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতো না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরনের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য এই দুইজনের যেকোন একজনকে পছন্দ করি। তোমরা এঁদের মধ্যে যাঁকে পছন্দ করা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইয়াত কর।” এই বলে তিনি আমরা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। তাঁর এই শেষের কথাটি ছাড়া আর কোন কথা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছিল, শিরচ্ছেদের জন্য বধূভূমিতে এগিয়ে যাওয়া গুনাহর কাজ হলেও তা বোধ হয় আমার কাছে আবু বাক্র (রা) থাকতে মুসলমানদের আমীর হওয়ার চাইতে ঢের বেশী পছন্দনীয় হতো।

উমার (রা) বলেন: আবু বাকরের (রা) এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমারেদ পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) তরফ থেকে আর একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতন্ডা হলো এবং বেশ চড়া গলায় কথা কথাবার্তা হতে লাগলো। আমার আশংকা হলো যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটা বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়। আমি (সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে) তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বাক্র, আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইয়াত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইয়াত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইয়াত করলেন। এরপর আমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেদ একজন বললেন, “তোমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।”

যুহরী বলেছেন: উরওয়াহ ইবনে যুবাই (রা) আমাকে জানিয়েছেন যে, আবু বাক্র (রা), উমার (রা) ও অন্যান্য মুহাজিরগণ বনু সায়েদার চত্বরে যাওয়ার সময় যে দুজন আনসারীর সাক্ষাত পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন উয়াইম ইবনে সায়েদা এবং বনু আজলানের মুয়ান ইবনে আদী। বর্ণিত আছে যে, উয়াইম ইবনে সয়েদা সেই ভাগ্যবান সাহাবীগণের অন্যতম যাদের প্রশংসায় আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছিলেন-

[আরবী *******]

“সেখানে (মসজিদে কুবাতে) এমনসব লোক রয়েছে যার পবিত্রতা অর্জন পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতাকামী লোকদেরকে ভালবাসেন।” (তাওবাহ)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এই গোষ্ঠীর মধ্যে উয়াইম ইবনে সায়েদা চমৎকার মানুষ।”

মুয়ান ইবনে আদী (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল হয় সেদিন মুসলমানরা ব্যাপকভাবে কান্নাকাটি করেছিল এবং বলেছিল, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগেই আমাদের মরে যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর ইনতিকালের পর আমারেদ ঈমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা রয়েছে।” কিন্তু একমাত্র মুয়ান ইবনে আদী বলেছিলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে মরা পছন্দ করি না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যেমন তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, তেমনি তাঁর ইনতিকালের পরও আবার নতুন করে ঈমান আনার সুযোগ পেয়েছি।” পরে আবু বাকরের (রা) খিলাফতের আমলে ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলিমা কাযযাবের সাথে লড়তে গিয়ে তিনি শাহাদাত লাভ করেন।

যুহরী আনাস ইবনে মালিকের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে জানান: বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে খিলাফতের প্রাথমিক বাইয়াত গ্রহণের পরদিন আবু বাক্র (রা) মসজিদের মিম্বারে বসলেন। তিনি কিছু বলার আগে উমার (রা) আল্লাহর প্রশংসা করে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেন, “হে জনগণ, গতকাল আমি তোমাদেরকে যে কথা বলেছিলাম [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যাননি, তিনি মূসার (আ) মত সাময়িকভাবে অন্তর্ধান হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি] তা আমি কুরআন থেকে পাইনি এবং রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাকে তা বলেননি। আমার ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক পুরোপুরিভাবে গুছিয়ে দিয়ে সবার শেষে ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। আল্লাহর যে কিতাব দ্বারা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের মনোনীত লক্ষ্যে চারিত করেছেন সে কিতাব আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বহাল রেখেছেন। এই কিতাবকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যেদিকে চারিত করেছেন সেদিকে তোমাদের চালিত করবেন। আজ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম তাঁর কাছেই তোমাদের নেতৃত্ব সমর্পণ করেছেন। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সঙ্গী- সওর পর্বত গুহায় তাঁর একনিষ্ঠ সহচর। অতএব তোমরা তাঁর কাছে বাইয়াত করে তাঁকে খলিফা বা আমীর হিসাবে গ্রহণ কর।” তখন েেলাকেরা দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে বাইয়াত করলো। এটিই ছিল বনু সায়েদা চত্বরের বাইয়াতের পর সার্বজনীন বাইয়াত।

অতঃপর আবু বাক্র (রা) বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “হে জনমন্ডলী, আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ কির তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে শুধরে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো ততক্ষণ সে আমার কাছে শক্তিশলী। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ আম হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল। মনে রেখ কোন জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্চনা গঞ্জনা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার কথামত চলবে। কিন্তু যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবো তখন তোমাদের আনুগত্য আমার প্রাপ্য হবে না। তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান থেকো আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করুন।”

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: উমারের (রা) খিলাফতকালে আমি একবার তাঁর সাথে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। একখানা ছড়ি হাতে তিনি যাচ্ছিলেন নিজের কোন কাজে। তাঁর সাথে তখন আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি আপন মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন আর ছড়ি সগিয়ে নিজের পায়ের উপর আঘাত করছিলেন। সহসা আমার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে ইবনে আব্বাস, জানো, কি জন্য আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সময় ঐ কথা বলছিলাম?” আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, আমি তা জানি না। আপনিই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “আমি একটি আয়াত পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মাতের মধ্যে ততদিন থাকবেন যতদিন তাদের সর্বশেষ ক্রিয়াকলাপ দেখে তার ওপর সাক্ষ্য দিতে পারেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই আমি কথাটা বলেছিলাম। আয়াতটি এই:

[আরবী *******]

“এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাত বানিয়েছি যেন মানব জাতির জন্য তোমরা সাক্ষী হতে পারো। এবং রাসূল তোমারেদ জন্য সাক্ষী হতে পারেন।” (বাকারাহ)

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন দাফন

ইবনে ইসহাক বলেন: আবু বাকরের (রা) বাইয়াত সুসম্পন্ন হওয়ার পর মঙ্গলবার দিন জনগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফনের আয়োজন করলো।

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র ও হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ আমাকে বলেছেন, আলী ইবনে আবু তালিব, আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, ফযল ইবনে আব্বাস, কুসাম ইবনে আব্বাস, উসামা ইবনে যায়িদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুক্ত গোলাম শাকরান (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁকে গোসল দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন। বনু খাযরাজ গোত্রের বনু আওফ পরিবারের আওস ইবনে খাওলী (রা) আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) বললেন, “হে আলী, আল্লাহর দোহাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন-দাফন আমাদের অংশ নিতে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।” আওস (রা) বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাব ছিরেন। আরী (রা) বললেন, “এসো।” তিনি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোসলে অংশগ্রহণ করলেন। আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের বুকের সাথে হেলান দিকে ধরে রাখলেন। আর আব্বাস, ফযল ও কুসাম (রা) তাঁকে আলীর (রা) সাথে সাথে প্রয়োজন মত ঘুরাতে লাগলেন। উসামা ইবনে যায়িত ও শাকরান (রা) তাঁর ওপর পানি ঢালতে লাগলেন আর আলী (রা) নিজের বুকের ওপর হেলান দিয়ে তাঁকে ধোয়াতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামা গায়েই ছিল। সেই জামার ওপর দিয়েই মৃদুভাবে কচলিয়ে ধুয়ে দিতে লাগলেন আলী (রা)। সরাসরি গায়ের চামড়ায় হাত লাগাননি। ধোয়ার সময় আলী (রা) বলছিলেন, “আমার মাতাপিতা আপনার ওপর কুরবান হোক। জীবিত বা মৃত উভয় অবস্থাতেই আপনার গোয়ে কত সুগন্ধ।” গোসলের সময় অন্যান্য মৃতের দেহ থেকে যেসব নাপাক বস্তু বের হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ থেকে তার কিছুই বের হয়নি।

আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত: গোসলের আয়োজন করতে গিয়ে গোসলের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা মতবিরোধের শিকার হলেন। প্রশ্ন ছিল এই যে, অন্যান্য মৃতের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাপড় খুলে ফেলে গোসল দেয়া হবে, না কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দেয়া হবে। এই মতভেদ চলাকালে সহসা আল্লাহ তাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। ঘুমের কারণে সকলেরই মুখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বুকের ওপর এসে পড়লো। সেই অবস্থায় ঘরের একপাশ থেকে এক অচেনা ব্যক্তি তাদেরকে বললো, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দাও।” অতঃপর জামা গায়ে রেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোসল দেয়া হলো এবং কাপড়ের ওপর দিয়েই গা কচলানো হলো।

ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লামের গোসল সম্পন্ন হলে তিনটি কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হলো, দুইখানা সুহারী এবং একখানা ইয়ামনী চাদর যা কয়েক ভাঁজ দিয়ে পরানো হলো।

ইবনে আব্বাস (রা): যখন কবর খননের প্রস্তুতি শুরু হলো তখন জানা গেল যে, আবু উবাইদা ইবনুল জারারাহ মাক্কাবাসীদের মত ‘দারীহ’ কবর খননেস পারদর্শী, আর আবু তালহা মদীনা ‘লাহাদ’ কবনর খননে পটু। আব্বাস (রা) দু’জনাকেই ডেকে পাঠালেন। বললেন, “ইয়া আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেটা ভাল হয় তার ব্যবস্থা করে দাও। শেসে পর্যন্ত আবু তালহাকেই পাওয়া গেল এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  লাহাদ কবর খনন করে দিলেন।

মঙ্গলবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাফন ও গোসল দিয়ে তাঁর বাড়ীতে তাঁর খাটে শুইয়ে রাখা হলো। এরপর দাফন নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে আবার মাতান্তর ঘটলো। কেউ বললেন, মসজিদে নববীতে দাফন করবো।” কেউ বললেন, “অন্যান্য সাহাবীদের কবরের পার্শ্বে দাফন করবো।” আবু বাক্র (রা) মীমাংসা করে দিলেন এই বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক নবীকে তার ইনতিকালের জায়গাতে দাফন করা হয়েছে।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিছানার শুয়ে ইনতিকাল করেছিলেন তা তুলে ফেলে তার নীচেই কবর খনন করে হলো। লোকজন দলে দলে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানাযা পড়তে লাগলো। পুরুষদের পড়া শেষ হলে মহিলার পড়লেন। তারপরে শিশু কিশোররা। অতঃপর বুধবারের মধ্যরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লামকে দাফন করা হলো।

আয়িশা (রা) বলেন:  বুধবারের মধ্যরাতে কোদাল মারার শব্দ শুনেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাফন করা হচ্ছে।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শোয়ানের জন্য কবরে নেমেছিলেন আলী, ফযল, কুসাম ও শাকরান (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)।

আওস ইবনে খাওলী এবারও আলীর (রা) নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কবরস্থ করার কাজে আনসারদের অংশ দেয়ার দাবী জানালে আলী (রা) তাঁকে কবরে নামতে বললেন এবং তিনি সকলের সাথে নেমে ঐ কাজে অংশ নিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কম্বলটি ব্যবহার করতেন শাকরান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কবরে শোয়ানের সময় সেটিও তাঁর সাথেই দাফন করে দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি বলেন, “আপনার পরে এ কম্বল আর কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।”

মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) দাবী করতেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেন। কেননা তিনি তাঁর আংটিটি ইচ্ছা করে কবরে ফেলে রেখে উঠে আসেন। তারপর আংটি পড়ে গেছে এই অজুহাত দিয়ে সবার শেষে কবরে নেমে আংটি তুলে আনেন এবং রাসূলুল্লাহ সর্বশেষে স্পর্শ করেন। এভাবে তিনি সর্বশেষ সাহচর্যের দাবীদার হন।

আবদুল্লাহ ইবনে হারিসের মুক্ত গোলাম মুকাসসাম আবুল কাসিম বর্ণনা করেন যে, উমার (রা) কিংবা উসমানের (রা) খিলাফতকালে আমি আলীর (রা) সাথে উমরাহ করি। তিনি তাঁর বোন উম্মে হানীর বাড়ীতে থাকেন। উমরাহ শেষে যখন গোসর সম্পন্ন করলেন তখন ইরাক থেকে একদল মুসলমান তাঁর সাথে এসে দেখঅ করেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন যে, মুগীরা ইবনে শু’বার এ দাবী সত্য কিনা যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেণ। আলী (রা) বললেন, “সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেন কুসাম ইবনে আব্বাস (রা)।”

উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা জানান যে, আয়িশা (রা) তাঁকে বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ বৃদ্ধির সময় তাঁর গায়ে একটি চতুস্কোণ কালো কম্বল ছিল। সেটা দিয়ে তিনি একবার শুখ ঢাকছিলেন আর একবার খুলছিলেন। আর বলছিলেন, “সেই জাতির ওপর আল্লাহর অভিশাপ যারা নবীর কবরকে সিজদার জায়গায় পরিণত করে।” এ কথা বলে তিনি নিজের উম্মাতকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন।

আয়িশা (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ অছীয়ত ছিল এই, “আরব উপদ্বীপে যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন না থাকে।”

ইবনে ইসহাক বলেন:

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের অব্যবহিত পর মুসলমানদেরকে ভয়াবহ দুর্যোগ ঘিরে ধরে। আয়িশা (রা) জানান যে, এই সময় আরবরা মুরতাদ হতে আরম্ভ করে, ইহুদী ও খৃস্টানরা মাথা তুলতে শুরু করে এবং মুনাফেকী ব্যাপক আকার ধারণ কলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারানোর দারুন মুসলমানদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় শীতের রাতে বর্ষণসিক্ত মেঘ পালের মত। আবু বাকরের (রা) নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার র্পূব পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। ইবনে হিশাম বলেন: আবু উবাইদা প্রমুখ বিজ্ঞ লোকেরা আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মক্কাবাসী ইসলাম ত্যাগ করা মনোভাব গ্রহণ করে। তা দেখে মক্কার তৎকালীন শাসনকর্তা আত্তাব ইবনে উসাইদ ভয়ে আত্মগোপন করেন। এরপর সুহাইল ইবনে আমের মক্কাবীদেরকে সমবেত করে ভাষণ দেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের কথা জানিয়ে বলেন, “তাঁর ইনতিকালে ইসলাম আরো শক্তিশালী হয়েছে। যে ব্যক্তি সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়াবে আমরা তার শিরচ্ছেদ করবো।”

এরপর লোকজন মত পাল্টালো এবং আত্তাব ইবনে উসাইদ আত্মপ্রকাশ করলেন।

এই অবস্থার কথাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) বলেছিলেন, “এমন এক অবস্থায় সে পড়াবে যখন তুমি তাকে খারাপ বলতে পারবো না।”

হাসসান ইবনে সাবিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালে নিম্নলিখিত শোকগাথা রচনা ও আবৃত্তি করেন:

“মদীনাতে রাসূলের উজ্জ্বল নিদর্শন ও স্মৃতি রয়েছে।

সাধারন নিদর্শন ও স্মৃতিসমূহ বিলীন ও নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যায়।

কিন্তু সেই পবিত্র স্থানের চি‎হ্নসমূহ অক্ষয় ও অমর,

যেখানে মহান পথ প্রদর্শকের আরোহণের স্মৃতি বিজড়িত মিম্বার বর্তমান।

সেখানে সেই সব ঘর রয়েছে যার মধ্যে আল্লাহর তরফ থেকে

জাজ্বল্যমান জ্যোতি নাযিল হতো

সেখানে তত্ত্বজ্ঞানের এমন সব কালজয়ী নিদর্শন বিদ্যমান

যা যুগ যুগ কালের অবর্তনেও বিকৃত হয় ন।

তা যতই প্রাচীন হয় ততই তা থেকে নতুন তত্ত্ব উদগত হয়।

সেখানে আমি চিনতে পেরেছি

রাসূলের (সা) চি‎হ্ন ও আদর্শকে, আরও চিনেছি

তাঁর কবরকে যাতে তিনি হয়েছেন সমাহিত।

সেখানে বসে আমি রাসূলের জন্য অশ্রুপাত করছি যার কারণে

অনেক চক্ষু অশ্রুপাত করে সৌভাগ্যবান হচ্ছে।

চক্ষুগুলো অশ্রুপাত করে প্রকৃতপক্ষে রাসূলের (সা)

অবদানগুলোই স্মরণ করছে-

যার সংখ্যা নির্ণয় করা আমার অসাধ্য।

আহমাদকে (সা) হারানোর বেদনায় রিক্ত ও ভারাক্রান্ত আমার মন তাঁর অবদান

স্মরণ করার কাজে নিয়োজিত হয়েছে।

কিন্তু তাঁর কোন অবদানের দশ ভাগের এক ভাগও স্মরণ করতে পারিনি।

কেবল দুঃ ভারাক্রান্ত মনে মুহাম্মাদ (সা) যে কবরে শুয়ে আছেন তার পাশে

দীর্ঘ সময় অবস্থান করা এবং অশ্রুপাত করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।

হে রাসূলের কবর, তুমি অশেষ বরকত ও কল্যাণের আধারে পরিণত হয়েছো।

যেমন হয়েছে নির্ভুল পথের দিশারী পদছোঁয়া এই গোটা অঞ্চল।

হে কবর, তোমার ভেতর ভেতর বরকাতে পরিপূর্ণ হয়েছে যা এক পূতঃপবিত্র সত্তাকে

ধারণ করে রেখেছে এবং আমার অতি প্রিয়জনকে।

প্রশস্ত ও স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত করে তৈরী করা হয়েছে।

সেই কবরের ওপর অনেকে অনেকে মকাটি ফেলেছে এবং চিরসবুজ

‘সুদ’ বৃক্ষ তাতে প্রোথিত হয়েছে।

রাত্রে লোকেরা (রাসূলুল্লাহকে (সা) সমাহিত করার মাধ্যমে

জ্ঞান, দয়া ও সহিষ্ণুতাকে

সমাহিত করেছে এবং তাঁর ওপর মাটি চড়িয়ে দিয়েছে যদিও

তিনি মাটিতে শোয়ানোর মত লোক নন।

সমাহিত করার পর তারা নবীকে (সা) হারিয়ে ব্যথিত মনে ফিরে গেছে

এবং তারেদ পিঠ ও হাত দুর্বল হয়ে গেছে।

সেই মহামনবের শোকে কাঁদতে কাঁদতে গেছে- যার শোকে তাঁর মৃত্যুর দিন

আকাশ আর পৃথিবীও কেঁদেছে

তাই তাঁর জন্য মানুষ আরো বেশী শোকাহত। কোনদিন কি

কোন মৃত ব্যক্তির শোক মুহাম্মাদের মৃত্যুশোকের সমতুল্য হয়েছে?

এই মৃত্যুর কারণে মানুষ ওহীর অবতরণক্ষেত্রে হারালো

যিনি ওহীর অবতরণক্ষত্রে ছিলেন তিনি আল্লাহর জ্যেতিতে উদ্ভাসিত ছিলেন

এবং সেই জ্যোতি তিনি ইয়ামান ও নাজদে পর্যন্ত বিতরণ করতেন।

যারা তাঁকে অনুসরণ করতো তাদেরকে তিনি দয়াময় আল্লাহর পথ দেখাতেন,

রক্ষা করতেন লাঞ্ছনা গঞ্জনা থেকে এবং ন্যায়ের পথ দেখাতেন।

তিনি তাদের এমন এক নেতা যিনি তাদেরকে হকের দিকে চাীরত করতেন

এবং তার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন।

তিনি সত্যের এমন এক শিক্ষক ও দিশারী

যার অনুসরণ করলেই পরিশুদ্ধি অর্জন করা যায়।

তিনি মু’মিনদের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন

এবং তাদের ওজর মেনে নিতেন।

যদি তারা ভালো ও নির্ভুল কাজ করতো  তাহলে তো তাদের কল্যাণে

স্বয়ং আল্লাহই উদারহস্ত ছিলেন।

আর যদি তাদের ওপর এমন কোন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হতো-

যা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য,

তাহলে একমাত্র তিনিই তা সহজ করে দিতেন।

মুহাম্মাদের (সা) অনুসরীরা যতদিন আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে থাকবে ততদিন

তিনি তাদের কাছে এমন এক দলীল হয়ে থাকবেন যা দিয়ে

তারা সকল ব্যাপারে সঠিক কর্মপন্থা নির্ণয় করতে পারবে।

মানুষের গুমরাহ হয়ে যাওয়া তাঁর কাছে অসহনীয় এবং তাদের হিদায়াত প্রাপ্তি

ও হিদায়াতের ওপর বহাল থাকা তাঁর একান্ত কাম্য।

------ সমাপ্ত -------

 

সীরাতে ইবনে হিশাম

ইবনে হিশাম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড