বাইয়াতের হাকিকাত

বাইয়াতের হাকিকাত

 


 

বাইয়াত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা।সাহাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর রাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন। মুসলমানদের সামস্টিক পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছে তার নিকট বাইয়াত হওয়ার এ তরিকা ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। প্রথম চার খলিফার পরও বাইয়াতের এ ধারা জারি ছিল। এমনকি যে খানে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যাবস্থা নেই সেখানেও দীনি মহলে বাইয়াত শব্দটি বেশ প্রচলিত আছে।

 

আমাদের দেশে পীর-মুরীদীর বেলায়ই এ পরিভাষাটি বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয়। যিনি মুরিদ হতে চান তাঁকে পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হতে হয়। দেশে বেশ সংখ্যাক পীর সাহেবান আছেন বলে এ পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। কিন্তু অনেকেই ইসলামের বাইয়াত পরিভাষাটির সঠিক তাতপরজ(হাকিকত) জানেননা। অথচ এ বিষয়টি ইসলামের সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

 

বাইয়াতের শাব্দিক অর্থ

 


 

বাইয়াত শব্দটি আরবি- শব্দ থেকে গথিত। ‘বাইয়’ অর্থ বেচা-কেনা,লেন-দেন, বিক্রি করা-খরিদ করা। এ শব্দটি বিক্রয় ও খরিদ উভয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়। তবে এর আসল অর্থ বিক্রয়য়। জিনিস দিয়ে দাম নেয়ার নাম আরবি এভাবেই আরবি অর্থ বিক্রি ও আরবি অর্থ ক্রয়য়। যেহেতু বিক্রয় ছাড়া ক্রয় হতে পারেনা, এবং ক্রয় ছাড়া বিক্রয় হতে পারে না সেহেতু এ দু’টো শব্দই উভয় অর্থেই বাইয়াত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবশ্য বিক্রয়ের কাজটাকেই বাইয়াত বলা হয়। আরবি শব্দের মূল অর্থ বিক্রয় বটে, কিন্তু এর গৌণ (secondary) অর্থ হলো চুক্তি,শপথ, অংগীকার। বেচা-কেনার ব্যাপারে ক্রেতার ও বিক্রেতার মধ্যে যেসব শর্ত(terms) ঠিক করা হয় তা মেনে নেয়ার চুক্তির ভিত্তিতেই লেন-দেন হয়ে থাকে। এভাবেই বাইয়াত শব্দটি চুক্তি,শপথ,অঙ্গীকার শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়।

 

আরবি শব্দের ক্রিয়া-বাচক শব্দ হলো আরবি এর অর্থ শুধু বিক্রয় শব্দেই সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ হয় চুক্তি করা, সম্মান প্রদর্শন করা, নেতৃত্ব মেনে নেয়া, আনুগত্যের শপথ করা, বিক্রয়ের জন্য পেশ করা, চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং ব্যবসায় লেন-দেন করা ইত্যাদি।

 

বিখ্যাত আরবি-ইংরেজি অভিধান আরবি যার সংকলক MILTON COWAN, তাতে আরবি অর্থ লিখা হয়েছেঃ

 

To sell, to make a contract, to pay homage, to acknowledge as sovereign or leader, to pledge allegiance, to offer for sale, to agree on the term of a sell, to buy, to purchase etc.

 

এ অভিধানে আরবি অর্থ লিখা হয়েছে- agreement, arrangement, business deal, commercial transaction, bargain, sale, purchase, homage etc.

 

কুরআনে এ পরিভাষার ব্যবহার

 


 

কুরআন মজীদে বাইয় শব্দটি বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রুজি রোজগারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম কাজে লেগে থাকার অর্থে কয়েকটি সূরায় ব্যবহার করা হয়েছে।

 

আরবি

 

‘জুমআর দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহ্‌র যিকরের দিকে দৌড়াও এবং বেচা-কেনা বাদ দাও।’ সূরা জুমআঃ৯ আয়াত)

 

আরবি

 

সেসব লোক যাদেরকে ব্যবসা,বেচা কেনা ও কাজ কারবার ইত্যাদি কোন কিছুই আল্লাহ্‌র যিকর থেকে গাফেল করে দেয় না।

 

  সূরা নুরঃ ৩৭

 

এ দুটো আয়াতে জীবিকা অর্জনের সব রকম ব্যাবস্থাকেই বাইয় শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।

 

সূরা তাওবা,সুরা ফাতহ, সূরা মুমতাহিনায় বাইয় শব্দটি রুপকভাবে বিক্রয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখানে বিক্রয় মানে নিজের সত্তা ও জান-মালকে কোন মহান উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌ ও রাসুলের নিকট সমর্পণ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বা ওয়াদা করা।

 

আরবি

 

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মুমিনদের জান ও মাল বেহেশতের বদলে কিনে নিয়েছেন। তার আল্লাহ্‌র পথে লড়াই করে,(দুশমনকে) মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।তাওরাত,ইঞ্জিল, ও কুরআনে তাদের জন্ন(বেহসত দেয়ার এ ওয়াদা) আল্লাহ্‌র দায়িত্ব একটা পাকা ওয়াদা, আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে বাইয়াত করেছ সে বিসয়ে তোমরা সন্তুষ্ট থাক। এটাই সবচেয়ে বড় কামিয়াবি।’ সূরা তাবা ১১১

 

আরবি

 

‘হে রাসুল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহ্‌র কুদরতের হাত ছিল। সূরা ফাতহ ১৮

 

আরবি

 

‘হে নবী! আপনার নিকট যদি মেয়েরা এ কথার উপর বাইয়াত হবার জন্য আসে যে তারা আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে শরিক করবেনা, চুরি করবেনা,যিনা করবেনা, তাদের সন্তান হত্যা করবেনা, নিজেরা কোন অপবাদ রচনা করে আনবে না ও ন্যায্য ব্যাপারে আপনার অবাধ্য হবে না, তা হলে আপনি তাদের বাইয়াত কবুল করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অতি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ সূরা মুমতাহিনা ১২

 

এ কয়টি আয়াতে বাইয়াত শব্দটি নির্দিষ্ট অর্থে ইসলামী পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা তওবাতে জান ও মাল আল্লাহ্‌র নিকট সমর্পণ করার অর্থে, সূরা ফাতহে রাসুলের নির্দেশে মৃত্যুবরণ করার অর্থে এবং সূরা মুমাতাহিনায় আল্লাহ্‌ ও রাসুলের সাথে নাফরমানি না করার ওয়াদার অর্থে বাইয়াত কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্‌ ও রাসুলের পূর্ণ আনুগত্যের শপথই এসব বাইয়াতের আসল উদ্দেশ্য।

 

সূরা তাওবাতে বাইয়াতে মানে মুমিনদের জান ও মালকে আল্লাহ্‌র মরজি মতো কাজে লাগাবার এবং নিজেদের খেয়াল এবং খুশি মতো ব্যবহার না করার ওয়াদা। সূরা ফাতহে বাইয়াত মানে রাসুল সাঃ এর নির্দেশে জীবন দেয়ার শপথ করা।হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে হযরত ওসমান রাঃ কে মক্কাবাসীরা হত্যা করেছে বলে গুজব শুনে কুরাইশদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায়ও উপস্থিত সকল সাহাবা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত বলে ঐ শপথ করেছিলেন। আর সূরা মুমতাহিনাতে আল্লাহ্‌ ও রাসুলের অবাধ্য না হওয়ার ওয়াদাই বায়াতের উদ্দেশ্য। সুতরাং এসব কয়টি আয়াতেই বাইয়াতের সারমর্ম হল মুমিনের জান মাল,ইচ্ছা- বাসনা,রথাত পূর্ব সত্তাকে আল্লাহ্‌র মর্জির নিকট সমর্পণ করা। এটাই ইসলাম কবুলের মর্মকথা। ইসলাম শব্দের অর্থও আত্নশমর্পন। বাইয়াতের মাধ্যমে আত্নশমর্পনের বাহ্যিকরূপ প্রকাশ পায়।

 

বাইয়াতের ব্যাখ্যা

 


 

সূরা তাওবাতে ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ পাক নিজেই ঘোষণা করেছেন যে, তিনি মুমিনদের জান অমাল খরিদ করে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়লা একথা বলেননি যে, মুমিনরা তাদের জান ও মাল তার কাছে বিক্রয় করেছে। কিন্তু মালের মালিক যদি তার মাল নিজের ইচ্ছায় বিক্রয় না করে তাহলে সে মাল কেউ খরিদ করতে পারে না।কারন জোর করে নিলে তা কেনা হয়েছে বলে গণন হয় না।

 

সব মুমিনই আল্লাহ্‌র নিকট তাদের জান ও মাল বিক্রয় করে না। যারা বিক্রয় করে তারাই সত্যিকারের মুমিন। তাই এ আয়াতে আল্লাহ্‌ একথাই বলতে চেয়েছেন যে, যারা নিজ ইচ্ছায় তাদের জান মাল বিক্রয় করেছেন তাদের কাছ থেকেই তিনি কিনেছেন। অর্থাৎ যাদের জান-মাল তিনি কিনেছেন তারা সন্তুষ্ট চিত্তেই বেচতে রাজী হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জোর করে কেনা হয়নি বা তাদেরকে বেচতে বাধ্য করা হয়নি।

 

কোন জিনিস কারো কাছ থেকে কিনলে বিক্রেতাকে অবশ্যই তার দাম দিতে হয়। তা নাহলে কেনার দায়িত্ব পালন করা হয় না। দাম না দিয়ে জিনিস নিলে বুঝা যায় যে মালের মালিক তার মাল কাউকে দান করেছে, বিক্রয় করেনি। তাই আল্লাহ পাক মুমিনের জান-মাল কিনে নিয়েছেন বলার সাহথে সাথেই দামের কোথাও উল্লেখ করেছেন। যে দাম তিনি দিতে চান তা দুনিয়ার কোন জিনিস নয়। তিনি এত বিরাট মূল্য দিতে চান যা দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যায় না।

 

মুমিনের জান-মালের বদলে তিনি বেশেস্ত দেবার কথা ঘোষণা করেছেন। যেহেতু বেহেস্ত দুনিয়ার জিবিনে পাওয়ার উপায় নেই, সেহেতু এখানে নগদ দাম পরিশোধ করাও শভব নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাক বাকিতেই মুমিনের জান-মাল কিনে নিয়েছেন। আল্লাহ্‌ নগদ দাম নিচ্ছেন না বলে মুমনের জান-মাল বিক্রয় করার সাথে সাথেই নিয়ে নেন না। বরং মুমিনের জান-মাল তার কাছেই আমানত রাখেন। যদি কেনার সময় জান-মাল আল্লাহ্‌র নিজের হাতেই নিয়ে নিতেন তাহলে ঝামেলা চুকে যেতো। কিন্তু আল্লাহ পাক কিনে নেয়ার ঘোষণা স্বীকার করেও মুমিনের জান মাল তার কাছেই আমানত রেখেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক বলতে চান যে, হে মুমিন তোমার জান-মাল আমার কাছে বক্রয় করেছ বলে তুমি দাবী করছ তা তোমাকে বাস্তব প্রমাণ করে দেকাহতে হবে। তোমার জান ও মাল আর তোমার মালিকানায় নেই। তোমার বাকি জীবনে এ জান মাল যদি সম্পূর্ণরূপে আমার মরজি মত ব্যবহার কর তাহলে আমি স্বীকার করবো যএ তুমি তা সত্যি আমার কাছে বেচেছ। এ প্রমাণ দিতে পারলে মৃত্যুর পরপারে ের দাম হিসেবে বেহেস্ত অবশ্যই পাবে।

 

রাসুলের নিকট বাইয়াত অর্থ কি?

 


 

কোন মাল কারো কাছে একবার বিক্রয় করার পর ের মালিকানা ষত্ব ক্রেতার হাতে চলে যায়। বিক্রেতা এ মাল আবার অন্য কারো কাছে বেচতে পারে না। কারন এক মাল একি ব্যক্তি কেমন করে বার বার বিক্রয় করবে?

 

মুমিন তার জান-মাল আল্লাহ্‌র কাছে বিক্রয় করার পর এর মালিকানার সত্ব ক্রেতার হাতে চলে গেছে। প্তহচ শাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ ের কাছে বাইয়াত হয়েছেন বলে কুরআন ও হাদিসে প্রমাণিত। তাই প্রশ্ন জাগে যে, রাসুল সাঃ এর কাছে বাইয়াত হওয়ার মানে কি? একবার আল্লাহ্‌র কাছে জান-মাল্বিক্রয় করা হয়েছে। রাসুল সাঃ ের নিকট আবার কি বিক্রয় করা হলো? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পেলেই বাইয়াতের হাকিকত বুঝাজাবে।

 

আগেই বলে হয়েছে যে, আল্লাহ পাক মুমিনের জান-মাল কিনে তারই হাতে আমানত রেখে দেন। সচেতন মুমিন একথা ভালভাবেই জানে যে। তার যে জান ও মাল আল্লাহ্‌র মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে তা আল্লাহ্‌র মর্জি মতো কাজে লাগানোই সঠিক দায়িত্ব। শয়তানের ওয়াসওয়াসায় ও নফসের ধোঁকায় পরে, পরিবার পরিজনের দাবিতে এবং আন্তীয় ও বন্ধু-বান্ধবের চাপে পরে আল্লাহ্‌র মর্জির খেলাফ জান ও মাল খরচ করে ফেলার আশঙ্কা অবশ্যই রয়েছে। তাই আল্লাহ্‌র এ আমানত সঠিকভাবে আল্লাহ্‌র মর্জি মত ব্যবহার করার উদ্দেশ্যই সাহাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন।

 

আল্লাহ্‌র নিকট জান মাল বিক্রয় করা মানে যাবতীয় শক্তি সামর্থ্ এবং সময়, সম্পদ ও শ্রম আল্লাহ্‌র আনুগত্তের অধীনে ব্যবহার করার ওয়াদায় আবদ্ধ হওয়া। এ ওয়াদা এমন ব্যপক যে ইচ্ছা শক্তি, চিন্তা শক্তি মনন শক্তি বং বুদ্ধিব্রত্তিকেও আল্লাহ্‌র মর্জির অধীন করা বুঝায়। এইরূপ পুরনাঙ্গ দাবী পূরণ করতে হলে আল্লাহ্‌র সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়। মানুষ যেভাবে শয়তানের ওয়াসওয়াসায়, নফসের ধোঁকা দুনিয়ার মোহ, অন্য মানুষের প্রচনা ইত্যাদি দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে তাতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ্‌র পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করা বাস্তবে সম্ভব হয় না। একারনেই আল্লাহ্‌র রাসুলের দিনই দাওয়াত যারা কবুল করেছেন তাদেরকে রাসুলের নেতৃত্ব মেনে জামায়াতবদ্ধ হবার তাগিদ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন। এ জাতিয় সাংগঠনিক বন্ধন ছাড়া আল্লাহ্‌র পুরনাঙ্গ আনুগতের পথে অগণিত বাঁধা দূর করা সম্ভব নয়। যার শ্নগথনিক শৃঙ্খলা কবুল করে রাসুলের জাম্যাতের শরিক হতে রাজী হয়েছেন তার আল্লাহ্‌র পুরনাঙ্গ আনুগত্তের উদ্দেশে সংগঠনের নির্দেশ পালন করতে অয়াদাবদ্ধ হয়েছেন, যাতে সকল প্রকার ধোঁকার থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। ইসলামী জামায়াতের আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌র আনুগত্য বাস্তবে সহজ ও সম্ভব হয়। জামায়াতের আনুগত্যের এ শপথই ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াত নামে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল সাঃ এর নিকটে যে বাইয়াত হন তা এ আনুগত্যেরই শপথ। সাহাবায়ে কেরাম বাস্তব জীবনই এর সাক্ষী যে তারাবাইয়াতের তাৎপর্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এ বাইয়াতের দাবী হলো রাসুলের পূর্ণ আনুগত্য। তাই দেখা যায় যে রাসুল সাঃ কোন কাজের নির্দেশ দিলে বিনা অজরে সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেন। যারা অজর পেশ করতো তাদেরকে কুরআনে মুনাফিক বলা হয়েছে।

 

একবার রসুল সাঃ সবাইকে যুদ্ধে যাবার হুকুম দিলেন। এক সাহাবির মা মৃত্যু শয্যায় থাকা স্বতেও তিনি যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যথা সময়ে হাজির হয়ে গেলেন। তিনি রাসুল সাঃ কে মায়ের অবস্থাটা জানালেন। ওজর পেশ করে না যাওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল না। কিন্তু অবস্থা জেনে রাসুল সাঃ তাঁকে মায়ের খেদমতে পাঠিয়ে দিলেন।

 

এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় যে, ঐ সাহাবি মাকে এ অবস্থায় ফেলে যাওয়া সম্ভব নয় বলে নিজেই যুদ্ধে না যাবার সিদ্ধান্ত নেননি। কারন বাইয়াতের দরুন এমন সিদ্ধান্ত নেবার কোন ইখতিয়ারই নেই বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রসূলের হাতে তুলে দিয়েছেন বাইয়াতের মাধ্যমে। তাই কোন ওযর আপত্তি দেখিয়ে রাসুলের আদেশ পালন না করার সিদ্ধান্ত নেননি। যদি তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তরি হয়ে রাসুলের নিকট হাজির না হতেন এবং নিজেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে তা বাইয়াতের খেলাফ হতো।

 

রাসুল সাঃ অবস্থা জেনে তাঁকে মায়ের খেদমত করার অনুমতিদেয়ার ফলে তিনি যুদ্ধে না যেও যুদ্ধে যাবার সওয়াব পেলেন। কিন্তু যদি তিনি নিজে এ সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে রাসুল সাঃ এর আদেশ অমান্য করার মত বড় অন্যায় হয়ে যেতো।

 

রাসুলের নির্দেশে তাবুক যুদ্ধে যেতে রাজী হয়েও বিলম্ব করে ফেলার কারনে ৩জন সাহাবিকে ৫০ দ্বীন পর্যন্ত এক ঘরে করে রাকাহ হয়েছিল। আল্লাহ পাক নিজে তাদের তাওবা কবুল হওয়ার কথা ঘোষণা না করা পর্যন্ত তাদের সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়েছিল। বাইয়াতের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব কতটুকু তা এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট।

 

এ বাইয়াত কি শুধু রাসুলের কাছেই হতে হয়?

 


 

সাহাবায়ে কেরাম সরাসরি রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছিলেন।রাসুল সাঃ এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন মানবসত্তা নেই। অথচ রাসুল সাঃ দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর সাহাবাগন হযরত আবুবকরের রাঃ নিকট আবার বাইয়াত হলেন। এভাবেই পরবর্তী খলিফাগণের নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। এ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে বাইয়াত এমন এক জরুরি নিয়ম যা রাসুলের পরও চালু রাখতে হয়েছে এবং উম্মতের মধ্যে এ নিয়ম চিরদিনই চালু থাকা উচিত।

 

অবশ্য রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত ও পরবর্তী কারো নিকট বাইয়াতের মধ্যে আনুগত্তের ব্যাপারে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সর্বাবস্থায় বিনা শরতে আল্লাহ রাসুলের আনুগত্য করতে হয়, কিন্তু রাসুল ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা চলে বনা, কুরআন সুন্নাহ্র অধীনে তাদের আনুগত্য করতে হয়। রাসুলের আনুগত্য নিরুঙ্কুস ও নিঃশর্ত অন্যের বেলায় তা শর্তাধীন। এখন প্রশ্ন হল ইসলামী বিধান অনুযায়ী এ বাইয়াত কার নিকট হওয়া উচিত? ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের জামায়াতে বা অন্য সংগঠনের দায়িত্বশীলদের নিকট বাইয়াত হতে হয়। যতদিন রাসুল সাঃ নিজে এ জামায়াতের দায়িত্বশীল ছিলেন ততদিন তারি নিকট বা তার নিযুক্ত কোন ব্যক্তির নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। দুনিয়া থেকে তার বিদায় হবার পর ঐ জামায়াতেরদায়িত্ব যার উপর পরেছে তারই নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকেই এ বিরাট শিক্ষা চলে এসেছে যে, মুসলমানদেরকে জামায়াতবদ্ধহয়ে থাকতে হবে এবং যিনিই ঐ জামায়াতের নেতা নির্বাচিত হন তাঁরই কাছে বাইয়াত হতে হবে। জামায়াতবিহীন অবস্থায় থাকা মুসলমানদের উচিত নয় এবং জামায়াতবদ্ধ হবার প্রমাণই হল জামায়াতের আমিরের নিকট বাইয়াত হওয়া।

 

বর্তমানে সারাদুনিয়ার এক্স পঁচিশ কোটি মুসলমান এক জামায়াতবদ্ধ অবস্থায় নেই। তাই গোতা উম্মতের কোন একজন নেতা বা আমীর নেই। এমনকি কোন এক দেশের সব মুসলমানও এক জামায়াতবদ্ধ নয়। প্রকৃত অবস্থা এই যে, বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে জামায়াতবদ্ধ হওয়ার চেতনাই দুর্বল হয়ে গেছে। এমনকি ওলামায়ে কেরামের মধ্যে এ চেতনা ব্যাপক নয়। এ কারনেই মুসলিমদের জীবনেই ইসলামের প্রভাব এত কমে গেছে।

 

প্রচলিত বাইয়াত

 


 

সাহাবায়ে কেরামের যুগে যে উদ্দেশ্যে বাইয়াত প্রচলন হয়েছিল বর্তমানে ঐ মহান উদ্দেশ্য চালু না থাকলেও বাইয়াতের পরিভাষা সমাজে এখনো প্রচিলত আছে।

 

বেশ কয়েকটি আরব দেশের বাদশাহগণ সরকারী দায়িত্ব গ্রহণের অংশ হিসেবে দেশের নাগরিকদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ বাইয়াত দ্বারা বাদশাহর নেতৃত্ব পরিচালিত সরকারের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য প্রকাশ করাই আসল উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে পীর সাহেবান তাদের মুরিদদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। দিনের ব্যাপারে পির সাহেবের হেদায়েত অনুযায়ী চলবার ওয়াদাই এ বাইয়াতের উদ্দেশ্য।

 

বাইয়াতের আসল উদ্দেশ্য

 


 

রাসুল সাঃ এর নিকট সাহাবায়ে কেরাম যে উদ্দেশ্য বাইয়াত হতেন। সেটাই হলো আসল উদ্দেশ্য। ঐ উদ্দেশ্য বাইয়াত এর পদ্ধতি চালু করতে হলে কয়েকটি শর্ত পূরণ হতে হবে।

 

১। রাসুল সাঃ ইকামাতের দিনের যে আন্দোলন করেছিলেন সে আন্দোলনের দাওয়াত সমাজে পেশ করতে হবে।

 

২। এ দাওয়াতে সারা দিয়ে যারা আন্দোলনে শরিক হতে আগ্রহী তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে।

 

৩। তাদের মন-মগজ ও চরিত্রকে ইকামাতে দিনের উদ্দেশ্য গড়ে তুলতে হবে।

 

৪। যারা ইকামতে দীনের বিরাট দায়িত্ব ভালভাবে বুঝে নিয়ে তাদের জান ও মাল আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে আগ্রহী তাদের নিকট থেকে বাইয়াত নিতে হবে।

 

৫। ইকামতে দীনের উদ্দেশ্যে গঠিত জামায়াতের সদস্যদের দ্বারা যিনি জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন্তারই নিকট বাইয়াত হতে হবে। এ নিয়মে যদি বাইয়াত হতে হবে। এ নিয়মে যদি বাইয়াত চালু হয় তাহলে তা প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তির নিকট বাইয়াত হওয়া বুঝায় না বরং ইসলামী জামায়াত বা সংগঠনের নিকটই বাইয়াত হওয়া বুঝায়।

 

মূলত বাইয়াত ব্যক্তি বিশেষের নিকট নয়, ইসলামী সংগঠনের নিকট হওয়াই যুক্তিযুক্তও। অবশ্য কোন ব্যক্তির নিকটই বাইয়াতের শপথনামা পেশ করতে হয়। কেননা সংগঠন জীবন সত্তা নয় যার নিকট তা পেশ করা যায়। রাই সংগঠনের দায়িত্বশীলের মাধ্যমে ইসলামী সংগঠনের নিকট বাইয়াত হতে হয়।

 

ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর মতো যেসব সংগঠন ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাইয়াতের ধারনাই চালু রয়েছে। যারা জামায়াতে ইসলামীর রুকন(সদস্য) হন, তারা শপথের গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠনের নিকট বাইয়াত হন। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে ৮ নং ধারা অনুযায়ী আমিরে জামায়াত বা তাঁর কোন প্রতিনিধি সামনে রুকনিয়াতের শপথ গ্রহণ করতে হয় এ শপথই বাইয়াত হিসেবে গণ্য।

 

বাইয়াতের দাবী

 


 

ইকামাতে দীনের মহান লক্ষে পরিচালিত কোন ইসলামী সংগঠনের নিকট যে ব্যক্তি বাইয়াত হন তাঁর নিয়ত এ বাইয়াতের দাবী নিম্নরূপঃ

 

১। এই বাইয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তির জান ও মাল অর্থাৎ গোটা সত্তা, যা আল্লাহ্‌র নিকট বিক্রয় করা হয়েছে, তা সাংগঠনিক পদ্ধতিতে ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্য ব্যবহার করার শপথই নেয়া হলো। তাই এ নিয়মেই জান ও মাল আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করতে হবে।

 

২। ইসলামী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে যে কোন নির্দেশ বা দায়িত্ব দেয়া হবে, তা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী না হলে বিনা দ্বিধায় পালন করতে হবে এবং এ ব্যাপারে দুনিয়ার কোন রকম ক্ষয়-ক্ষতির পরওয়া করা চলবে না।

 

৩। যদি সংগঠনের কোন দায়িত্বশীলদের নির্দেশ সঠিক নয় বলে কারো মনে হয়, তাহলে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করে মিমাংসায় পৌছাতে হবে। আলোচনা ছারাই নির্দেশ পালনে অবহেলা করা হলে বাইয়াতের খেলাফ হবে বলে এ বিষয়ে সাবধান হতে হবে।

 

৪। কোন বিশেষ অসুবিধা বা ওযরের কারনে যদি কোন নির্দেশ পালন করা অসম্ভব মনে হয়, তাহলে ঐ দায়িত্বশীলের নিকট ওযর পেশ করতে হবে। সংগঠন যে সিদ্ধান্ত দেয় তাই চূড়ান্ত বিবেচনা করতে হবে। সংগঠনের কোন সিদ্ধান্ত ছাড়া নিজের কোন ওযরের অজুহাতে নির্দেশ পালন নাকরলে বাইয়াতের খেলাফ কাজ হয়েছে বলে গণ্য হবে।

 

সব আন্দোলনেই শপথের রীতি আছে

 


 

বাইয়াতের মরম কথা হলো আনুগত্যের ধপথ। যারা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে আন্দোলন করে, তারা স্বাভাবিক কারনেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ ধরনের শপথের মাধ্যমে তাদের নিরুংকুস আনুগত্যের ব্যবস্থা করে। ইসলামী আন্দোলন ছাড়াও সবরকমের আন্দোলনেই এ জাতীয় শপথের রীতি আছে। লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে জীবন বিসর্জনের যে শপথ নেয়া হয় তা অগ্নি শপথ বা রক্ত-শপথ বা দ্রিপ্ত-শপথ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এমনকি নিজ দেহের রক্ত দিয়ে শপথ নামায় দরখাস্ত করার রীতিও চালু রয়েছে। কিন্তু ইসলামে একমাত্র আল্লাহ্‌র নাম নিয়েই শপথা নেয়া হয়।

 

 

 

ইকামাতে দীন ও বাইয়াত

 


 

রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে একথা প্রমাণিত যে, ইকামাতে দীনের কাজ সব ফরযের বড় ফরয। এ কাজের জন্যই আল্লাহ পাক রাসূল পাঠিয়েছেন বলে কয়েকটি সূরায় ঘোষণা করেছেন।

 

(আরবী)

 

‘তিনিই সে সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও আনুগত্যের একমাত্র সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, যেন রাসূল (সা.) তাকে (বিধানকে) আর সব রকমের আনুগত্যের বিধানের উপর জয়ী করেন।’ (সূরা তাওবা ৩৩, সূরা ফাত্‌হ ২৮ ও সূরা সফ ৯ আয়াত)

 

এ বিরাট কাজটি এমন যে নবীর পক্ষেও এ কাজ একা করা সম্ভব নয়। তাই এ কাজের জন্য একদল যোগ্য লোক তৈরি করার প্রচেষ্টা সকল নবীই করেছেন। যে নবী প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক পাননি তাঁর হাতে ইসলাম বিজয়ী হয়নি বা দীন কায়েম হতে পারেনি।

 

এ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, ইকামাতে দীনের জন্য মুসলিমদের জামায়াত বা সংগঠন অপরিহার্য। অর্থাৎ ইকামাতে দীনের এ বড় ফরয কাজটির জন্য জামায়াতবদ্ধ হওয়াও ফরয। এভাবেই জামায়াতবদ্ধ হওয়া দ্বিতীয় বড় ফরয। বাইয়াতই হল জামায়াতী বন্ধনের সূত্র। তাই ইকামাতে দীনের জন্য বাইয়াত ছাড়া উপায় নেই। প্রকৃত কথা এই যে, ঐ বাইয়াতই আসল ইসলামী বাইয়াত যা ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে ইসলামী সংগঠনের মধ্যে চালু হয়।

 

মুসলমানদের যেসব সংগঠনে বাইয়াত পরিভাষাটি করা সত্ত্বেও ইকামাতে দীনের কোন কর্মসূচী ও কর্ম তৎপরতা নেই, সেখানে বাইয়াতের আসল হাকিকাত নেই। নামায, রোযা ও যিকরের মতো ইসলামে বহু পরিভাষা যেমন মুসলিমদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এ সবের হাকিকাত চর্চা খুব কমই হয়েছে, তেমনি বাইয়াত পরিভাষাটির অবস্থাও তাই হয়ে আছে।

 

প্রকৃত পক্ষে বাইয়াত পরিভাষাটির দ্বারা এমন ইসলামী সংগঠনই বুঝায় যা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ এর উদ্দেশ্যেই গঠিত। রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত সাহাবায়ে কেরামের জামায়াতই এর আদর্শ নমুনা। বাইয়াতই ঐ জামায়াতের প্রাণ শক্তি।

 

সূরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একথাই বলেছেন যে, তিনি ঐ সব মু’মিনের জান ও মালই খরিদ করেছেন ‘যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, দুশমনকে মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।’ দীনে হককে কায়েমের আন্দোলন ছাড়া বাতিলের সাথে এ লড়াই হবার কোন কারণই নেই। সুতরাং কুরআন পাকে যে বাইয়াতের কথা বলা হয়ৈছেতা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর উদ্দেশ্যেই। ইকামাতে দীনের আন্দোলনের জন্যই বাইয়াত দরকার। আর বাইয়াতের মাধ্যমেই জামায়াতবদ্ধ হতে হয়। জামায়াতবদ্ধ না হয়ে ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

 

ইকামাতে দীন এর সাথে জামায়াত ও বাইয়াতের সম্পর্ককে নামায ও ওযুর সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায়। আল্লাহ পাক নামাযের জন্যই ওযুকে ফরয করেছেন। নামাযই হল আসল ফরয। ঐ ফরযটি ওযু ছাড়া হয়না বলেই ওযু ফরয। তেমনিভাবে জামায়াত ও বাইয়াত ছাড়া ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। ইকামাতে দীনই আসল ফরয। ঐ ফরযের প্রয়োজনেই জামায়াত ফরয আর বাইয়াতের বন্ধন ছাড়া জামায়াত মজবুত হতে পারে না এবং জামায়াতের উদ্দেশ্যও পূর্ণ হতে পারে না। অর্থাৎ জামায়াতবদ্ধ হবার ফরযটি বাইয়াতের মাধ্যমেই আদায় হয়।

 

কেউ যদি ওযূ করে কিন্তু নামায আদায় করার প্রয়োজন মনে না করে তাহলে সে ওযুর কোন সওয়াব পাবে না। সে ওযু করছে না বলে হাত মুখ ধুয়েছে বলাই উচিত হবে। যে নামাযের ধার ধারে না সে ওযুর অঙ্গগুলো ওযুর মতো ধুয়ে নিয়েছে বলেই সে অযু করেছে বলা ঠিক হবে না। কারণ নামাযী লোকই ওযু করে থাকে এবং সে নামাযী নয় বলে ওযু করেনি মনে করতে হবে।

 

তেমনিভাবে ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্য ছাড়া যে বাইয়াত তা আসল বাইয়াত নয়। ইসলামে বাইয়াতের যে হাকিকাত তা এ বাইয়াতে পাওয়া যায় না। তবুও বাইয়াত পরিভাষাটি যেভাবেই চালু থাকুক তা সমাজে বেঁচে আছে বলেই এর আসল হাকিকাত চর্চা কাজে লাগতে পারে। যদি বাইয়াত কথাটি লোকের নিকট পরিচিতই না থাকতো তাহলে এর মর্ম বুঝানো আরও কঠিন হতো। যেমন সমাজে যদি নামাযের প্রচলন না থাকতো তাহলে নামাযের হাকিকাত চর্চা করা আরও মুশকিল হতো।

 

আসল বাইয়াত আল্লাহর নিকট

 


 

হুদায়বিয়াতে সাহাবায়ে কেরামের নিরস্ত্র অবস্থা ও কুরাইশদের সাথে লড়াই-এর শপথ করার ঘটনাকে সূরা আল ফাত্‌হে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :

 

(আরবী)

 

‘হে রাসূল যারা আপনার নিকট বাইয়াত হয়েছে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট বাইয়াত হয়েছে। তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে।’ (সূরা আল ফাত্‌হ: ১০ আয়াত)

 

মুমিনের জান ও মাল আল্লাহর নিকট বিক্রয় করার পর তা মু’মিনের হাতেই আমানত রাখা হয়। তাই মু’মিন সে আমনত ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে দীনের পথে কাজে লাগায়। এভাবে কাজে লাগানোকে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে গ্রহণ করেন তা এ আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে।

 

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যখন মু’মিন তার জীবন উৎসর্গ করার কথা সংগঠনের নেতার নিকট ঘোষণা করে তখন সে ঘোষণা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই নিকট করা হয়। হুদায়বিয়ার ঐ শপথ রাসূল (সা.)-এর নিকট যেভাবে করা হয়েছে তা যেন আল্লাহরই নিকট করা হলো। তাই তাঁরা যখন রাসূল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে শপথ করছিলেন তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়ে শপথ করেছিলেন। তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়েছিলেন। জিহাদ ও ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে বাইয়াত হলে তা আসলে আল্লাহরই নিকট হয়ে থাকে।

 

জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণ শপথ গ্রহণের সময় যেসব কথা উচ্চারণ করেন তাতে নিম্নলিখিত আয়াতটিও রয়েছে :

 

(আরবী)

 

‘আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।’ (সূরা আল আনআম ১৬২)

 

এ আয়াতের মাধ্যমে যে বাইয়াত নেয়া হয় তা আসলে আল্লাহ পাকের নিকটই বাইয়াত করা হয়।

 

জামায়াতী জিন্দেগীর গুরুত্ব

 


 

মানুষ সামাজিক জীব। ইসলাম মানুষেরই জন্য। তাই ইসলঅম স্বাভাবিকভাবেই এমন বিধান দিয়েছে যা মানব সমাজের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। তাই ব্যক্তিকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ইসলাম এতো বিস্তারিত বিধি-বিধান দিয়েছে।

 

ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত একটি ভারসাম্যপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ বিধানই মানব জাতির কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এ জাতীয় বিধান একমাত্র আল্লাহই দিতে সক্ষম। তাই ইসলামই একমাত্র বিশ্বজনীন বিধান।

 

ঐ পূর্নাঙ্গ বিধানকে মানব সমাজে চালু করার দায়িত্ব দিয়েই রাসূল (সা.)-কে পাঠানো হয়েছে। সমাজ গঠনের কাজ সামাজিক প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য রাসূলের চেয়ে বেশী যোগ্য কেই হতে পারে না। কিন্তু সব রাসূলের জীবনে ইসলাম বিজয়ী হয়নি। কারণ ইসলামকে বিজয়ী করার যোগ্য একদল (জামায়াত) লোক যোগাড় না হলে যোগ্যতম রাসূলের পক্ষেও এ কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়।

 

এ কারণেই প্রত্যেক রাসূল সকল মানুষকে দীনের দাওয়াত দেয়ার পর যারা সাড়া দিয়েছৈন তাদেরকে ...(আরবী)... (আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর) বলে সাংগঠনিক দাওয়াতও দিয়েছেন। এ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের প্রতি ঈমান আনা যেমন ফরয ঈমানদারদের জামায়াতবদ্ধ হওয়াও তেমনি ফরয।

 

রাসূল (সা.) জামায়াতী জিন্দেগীর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন:

 

...(আরবী)...

 

১. ‘আমি তোমাদেরকে এমন পাঁচটি কথার হুকুম দিচ্ছি যা আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন – সংগঠনবদ্ধ হওয়া, নেতার কথা শুনা, আনুগত্য করা, হিজরত করা ও আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি)

 

...(আরবী)...

 

২. ‘যখন তিন জন লোক সফরে যাও তখন তোমাদের একজনকে আমীর বানাও।’ (আবূ দাউদ)

 

...(আরবী)...

 

৩. ‘যে ব্যক্তি জামায়াত পরিত্যাগ করল সে ইসলামের শিকল তার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলল।’ (মুসনাদে আহমাদ ও তিরমিযি)

 

মুসলিম জীবনে জামায়াতের এ বিরাট গুরুত্বের দরুনই ফরয নামায জামায়াতে আদায় করার জন্য এত তাকীদ হাদীসে রয়েছে। যারা নামাযের জামায়াতে আসেনা রাসূল (সা.) তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন।

 

কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন একথাই প্রমাণ করে যে, জামায়াতবদ্ধ জীবন যাপন করা ফরয।

 

ইকামাতে দীন ও জামায়াতী জিন্দেগী

 


 

ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে জামায়াতবদ্ধ করেছৈন। দীনকে বিজয়ী করার দায়িত্ব যদি ফরয হয়ে থাকে তাহলে জামায়াতবদ্ধ হওয়াও ফরয হওয়া স্বাভাবিক। আর জামায়াতবদ্ধ হবার বন্ধনসূত্রই হল বাইয়াত। বাইয়াতের মাধ্যমেই জামায়াতের বন্ধন মজবুত হয়।

 

জামায়াতে ইসলামীর রুকন হিসেবে যে শপথ গ্রহণ করতে হয় তা প্রকৃতপক্ষে ঐ বাইয়াতের বাস্তব রূপ। শুধু শপথ বা হলফ শব্দ দ্বারা ঐ দীনী গুরুত্ব বুঝায় না যা বাইয়াত শব্দ দ্বারা বুঝায়। তাই রুকনিয়াতের শপথকে বাইয়াতের মর্যাদা সম্পন্ন মনে করা উচিত। এ ছাড়া জামায়াতের আনুগত্যের সঠিক শরয়ী চেতনা জাগ্রত হতে পারে না।

 

প্রত্যেক সংগঠনেই শপথের রীতি চালু রয়েছে। জামায়াতের রুকনদের শপথ গতানুগতিক ধরনের নয়। এ শপথের ভাষা থেকে বুঝা যে, বাইয়াতের শরয়ী প্রয়োজন এতে সঠিকভাবেই পূরণ হয়।

 

বাইয়াত ও ইসলামী রাষ্ট্র

 


 

কেউ কেউ মনে করেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথেই বাইয়াতের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাদের মতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা না থাকলে বাইয়াতেরও প্রয়োজন নেই। একথার যুক্তি বোধগম্য নয়। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপনিতেই চালু হয় না। জামায়াতবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম। আর জামায়াতী জিন্দেগীর সাথেই বাইয়াতের সম্পর্ক। বাইয়াতের মজবুত সূত্রে আবদ্ধ জামায়াতের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হওয়া সম্ভব। সুতরাং বাইয়াতের ফসলই ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামী রাষ্ট্র বাইয়াত ব্যবস্থা ছাড়া কায়েমই হতে পারে না।

 

মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হবার পূর্বে রাসূল (সা.) এর মাক্কী জীবনে কি সাহাবায়ে কেরাম বাইয়াত হননি? রাসূল (সা.)-এর নিকট বাইয়াত হবার জন্য কি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়েছিল?

 

যুক্তির বিচারেও একথা না মেনে উপায় নেই যে, জামায়াত ও বাইয়াতই আগে এবং ইসলামী রাষ্ট্র পরে।

 

কে কোন জামায়াতে বাইয়াত হবেন?

 


 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কথাটির অস্তিত্ব থাকলেও এর সাংগঠনিক কোন রূপ এই। চার মাযহাবের অনুসারী ও আহলে হাদীস হিসেবে পরিচিত সকল মুসলিমই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে সংক্ষেপে সুন্নী বলা হয়। আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত কোন মাযহাবই শিয়া মতাবলম্বীগণকে তাদের মধ্যে গণ্য করেন না। অর্থাৎ শিয়াগন সুন্নী হিসেবে গণ্য নন।

 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জামায়াতের অনুসারী। আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে একমাত্র উৎকৃষ্ট আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) ঘোষণা করেছেন এবং রাসূল (সা.) তাঁর সাহাবাগণকে তাঁর আদর্শের সত্যিকার অনুসারী বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলই একমাত্র উসওয়াতুন হাসানা বটে, ইত্তেবায়ে রাসূলের (রাসূলের আনুগত্য) ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামই উসওয়াতুন হাসানা।

 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত দুনিয়ার সকল মুসলমান সাংগঠনিক আকারে কোন জামায়াত নয়। জামায়াতের আসল পরিচয়ই হল ইমারত। আমীর ছাড়া কোন জামায়াত হতে পারে না। দুনিয়ার সকল সুন্নী কোন এক ইমারতের অধীন নয়। এমনকি একই দেশের সকল সুন্নীগণও এক আমীরের বাইয়াত হন না।

 

সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে সুন্নীদের মধ্যে যারা ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে কোন সংগঠন (জামায়াত) কায়েম করেন তাদের মধ্য থেকে ঐ জামায়াতের একজন আমীর নির্বাচিত হবেন। ঐ জামায়াতের আর সব সদস্য ঐ নির্বাচিত আমীরের মাধ্যমেই বাইয়াত হবেন। এ আমীর শুধু এ জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরই আমীর। যারা এ জামায়াতে যোগদান করবে না তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত হলেও এ জামায়াতের আমীরের নিকট তাদের বাইয়াত হওয়া জরুরী নয়।

 

এ কারণেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর দেশের সকল সুন্নী মুসলিমানের আমীর নন। যারা জামায়াতে ইসলামীর সদস্য (রুকন) হন শুধু তারাই এই আমীরের মাধ্যমে জামায়াতের নিকট বাইয়াত হন। এমন কি জামায়াতে ইসলামীর নিষ্ঠাবান কর্মী হলেও সদস্য বা রুকন না হওয়া পর্যন্ত কেউ বাইয়াতের মধ্যে শামিল বলে গণ্য হয় না। এমন অনেক যোগ্য কর্মী আছেন রুকনদের চেয়েও বেশী কাজ করেন। কিন্তু তারা নিজের জান ও মাল ইকামাতে দীনের জন্য উৎসর্গ করার শপথ নিতে রাযী না হলে তাদেরকে রুকন হিসেবে গণ্য করা হয় না। এ শপথকেই ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াত বলা হয়।

 

বাইয়াত কি প্রত্যাহার করা যায়?

 


 

আসল বাইয়াত তো আল্লাহ তায়ালার নিকটই করা হয়। এ বাইয়াত ঈমানেরই দাবী। এ বাইয়াত প্রত্যাহার করা মানে ঈমান ত্যাগ করা। বেহেশতে যাবার নিয়ত থাকলে এ বাইয়াত প্রত্যাহার করার কথা চিন্তা করাও অসম্ভব।

 

কিন্তু ঐ বাইয়াতের দাবী পূরণের জন্য ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে গঠিত কোন জামায়াতের নিকট যে বাইয়াত হতে হয় তা দীনের স্বার্থে অবশ্যই প্রত্যাহার করা যেতে পারে। কোন জামায়াতের নিকট বাইয়াত হবার পর যদি এর চাইতেও উন্নতমানের দীনী জামায়াতের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে নিম্নমানের জামায়াতের নিকট থেকে বাইয়াত প্রত্যাহার করে ঐ উন্নতমানের জামায়াতের নিকট বাইয়াত হওয়াই উচিত। এ অবস্থায় বাইয়াত প্রত্যাহার করা মোটেই দোষণীয় নয়। কারণ উৎকৃষ্টতর জামায়াতের নিকট বাইয়াত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রত্যাহার করা আসলে প্রত্যাহার নয়, বাইয়াতের স্থান বদল মাত্র।

 

কিন্তু নিজের কোন দুর্বলতার দরুন বা ইসলামী আন্দোলনের পথে চলা কঠিন মনে করে যদি কেউ বাইয়াত প্রত্যাহার করে বা জামায়াত পরিত্যাগ করে তাহলে সে ঈমানের চরম দুর্বলতার পরিচয়ই দেয়। এ বিষয়ে হাদীসে কঠোর সতর্কবানী উচ্চারণ করা হয়েছে –

 

...(আরবী)...

 

‘জামায়াতের সাথে আল্লাহর রহমত থাকে। যে বিচ্ছিন্ন হয় সে দোযখেই নিক্ষিপ্ত হয়।’ (তিরমিযি)

 

...(আরবী)...

 

‘যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেলো সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (মুসলিম)

 

...(আরবী)...

 

‘যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করল এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা গেল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (মুসলিম)

 

জামায়াতে ইসলামী ও বাইয়াত

 


 

জামায়াতে ইসলামী আমীর ও রুকনদের মধ্যে বাইয়াতের এ সম্পর্কের ব্যাপারে যাতে আনুগত্যের সীমা সামান্যও লঙ্ঘন না হয় সে উদ্দেশ্যে একটি গঠনতন্ত্র দ্বারা গোটা সংগঠন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আমীর রুকনদের ভোটে নির্বাচিত মজলিসে শূরার নিকট জওয়াবদিহী করতে হয়। কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে আমীরের কোন ভুল হলে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেবার জন্য গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এমনকি আমীরের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার জন্যও গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে।

 

পীর-মুরীদীর মধ্যে বাইয়াত-এর পরিভাষাটি সীমাবদ্ধ অর্থে ব্যবহার করা হয়। জামায়াতের মধ্যে রুকনিয়াতের শপথের ক্ষেত্রে তা অনেক ব্যপক অর্থে প্রচলিত। জামায়াতের রুকন হওয়ার মানে আল্লাহর দীনের জন্য জান ও মাল আল্লাহর নামে ও তাঁরই সন্তুষ্টির আশায় সম্পুর্ণ উৎসর্গ করার শপথ নেয়া। বাইয়াতের যে অর্থ সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল জামায়াতের রুকনিয়াত দ্বারা সে অর্থই বুঝায়। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বাইয়াত পরিভাষাটি ব্যবহার করা না হলেও এর চেতনা ও তাৎপর্য অবশ্যই রুকনিয়াতের শপথের মধ্যে রয়েছে।

 

আল্লাহর দীন কায়েমের মহান সংকল্প নিয়ে নিজের জান ও মাল, সময় ও শ্রম এবং দৈহিক ও মানসিক যাবতীয় যোগ্যতা কুরবানী দেবার যে শপথ নিয়ে জামায়াতের রুকনিয়াত কবুল করতে হয় তা যে কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় বাইয়াতেরই অনুরূপ সে উপলব্ধি ও চেতনা সৃষ্টিই এ পুস্তিকার মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ পাক বাইয়াতের এ চেতনা দ্বারা সকল রুকনকে উদ্বুদ্ধকরণ ও কর্মতৎপর রাখুন – আমীন।

 

১৯৪১ সালে মাওলানা মওদূদী (র.)-এর উদ্যোগে লাহোরে সর্ব প্রথম যখন জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয় তখন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ যে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তার বিবরণ নিম্নরূপ:

 

“সর্ব সম্মতভাবে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেবকে আমীর নির্বাচিত করা হয়। বাইয়াতের প্রচলিত রীতি অবলম্বন করা হয়নি। বরং গোটা জামায়াত একসাথে এ শপথ নিয়েছে যে, উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী সবাই আমীরের আনুগত্য করবেন এবং তাঁর হুকুম মেনে চলবেন। এই বাইয়াতে আ’ম (সামষ্টিক বাইয়াত) আদায়ের পর আবার ঐ (কান্নাকাটির) অবস্থায়ই সৃষ্টি হল যা পূর্বে ঈমান তাজা করার সময় হয়েছিল।

 

জামায়াতের কার্য-বিবরণী প্রথম খণ্ডের এ বিবরণ থেকে একথা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে যে, জামায়াতের সূচনা থেকেই বাইয়াতের চেতনা সবার মধ্যে জাগরূক ছিল। আমীরে জামায়াতের আনুগত্যের যে শপথ তারা নিলেন তা যে ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াতই ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং জামায়াতের রুকনগণ যে শপথ নেন তা অবশ্যই বাইয়াত হিসেবে গণ্য।

 

জামায়াতের কর্মী ও সহযোগী সদস্যদের বাইয়াত

 


 

যারা জামায়াতে রুকনিয়াতের শপথ নেননি, কিন্তু কর্মী ও সহযোগী সদস্য হিসেবে ইসলামী আন্দোলনে শরীক আছেন তারা রুকনদের মতো পূর্নাঙ্গ বাইয়াত না করলেও ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে আংশিক বাইয়াত করেন। যারা সহযোগী সদস্য হন তারা জামায়াতের সাথে সহযোগিতার শপথ গ্রহণ করেন এবং যারা কর্মী তারা রুকন হওযার পথে এগিয়ে যাবার শপথই করেন। রুকনদের বাইয়াত হলো ...(আরবী)... এর (দৃঢ় সংকল্পের) বাইয়াত। যারা কর্মী তারা এর প্রস্তুতি গ্রহণেরই বাইয়াত নেন। আর যারা সহযোগী তারা সহায়তা করার জন্য বাইয়াত হন।

 

কিন্তু ঈমানের দাবী হলো পূর্নাঙ্গ বাইয়াত। ঈমানের এ দাবী পূরণের জন্য প্রত্যেক ঈমানদারেরই আকাঙ্খা, আগ্রহ ও সংকল্প থাকা উচিত। কারণ ঈমানের আসল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের কামিয়াবী। এ মহান উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে পূর্ণাঙ্গ বাইয়াতের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে আখিরাতের সাফল্য লাভ করার লক্ষ্যে পরিপূর্ণভাবে বাইয়াত হয়ে শরয়ী দাবী পূরণ করার তাওফীক দান করুন – আমীন।

 

--- সমাপ্ত ---

', 'বাইয়াতের হাকিকাত', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a4', '', '', '2019-10-31 17:05:11', '2019-10-31 11:05:11', '

\"\"

 

বাইয়াতের হাকিকাত

 

অধ্যাপক গোলাম আযম

 


 

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

 


বইটির অডিও শুনুনhttp://shibircloud.com/audio/lq/baiyater_hakikat.mp3

লো কোয়ালিটি ডাউনলোডহাই কোয়ালিটি ডাউনলোড

 


 

বাইয়াতের হাকিকাত

 


 

বাইয়াত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা।সাহাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর রাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন। মুসলমানদের সামস্টিক পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছে তার নিকট বাইয়াত হওয়ার এ তরিকা ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। প্রথম চার খলিফার পরও বাইয়াতের এ ধারা জারি ছিল। এমনকি যে খানে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যাবস্থা নেই সেখানেও দীনি মহলে বাইয়াত শব্দটি বেশ প্রচলিত আছে।

 

আমাদের দেশে পীর-মুরীদীর বেলায়ই এ পরিভাষাটি বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয়। যিনি মুরিদ হতে চান তাঁকে পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হতে হয়। দেশে বেশ সংখ্যাক পীর সাহেবান আছেন বলে এ পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। কিন্তু অনেকেই ইসলামের বাইয়াত পরিভাষাটির সঠিক তাতপরজ(হাকিকত) জানেননা। অথচ এ বিষয়টি ইসলামের সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

 

বাইয়াতের শাব্দিক অর্থ

 


 

বাইয়াত শব্দটি আরবি- শব্দ থেকে গথিত। ‘বাইয়’ অর্থ বেচা-কেনা,লেন-দেন, বিক্রি করা-খরিদ করা। এ শব্দটি বিক্রয় ও খরিদ উভয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়। তবে এর আসল অর্থ বিক্রয়য়। জিনিস দিয়ে দাম নেয়ার নাম আরবি এভাবেই আরবি অর্থ বিক্রি ও আরবি অর্থ ক্রয়য়। যেহেতু বিক্রয় ছাড়া ক্রয় হতে পারেনা, এবং ক্রয় ছাড়া বিক্রয় হতে পারে না সেহেতু এ দু’টো শব্দই উভয় অর্থেই বাইয়াত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবশ্য বিক্রয়ের কাজটাকেই বাইয়াত বলা হয়। আরবি শব্দের মূল অর্থ বিক্রয় বটে, কিন্তু এর গৌণ (secondary) অর্থ হলো চুক্তি,শপথ, অংগীকার। বেচা-কেনার ব্যাপারে ক্রেতার ও বিক্রেতার মধ্যে যেসব শর্ত(terms) ঠিক করা হয় তা মেনে নেয়ার চুক্তির ভিত্তিতেই লেন-দেন হয়ে থাকে। এভাবেই বাইয়াত শব্দটি চুক্তি,শপথ,অঙ্গীকার শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়।

 

আরবি শব্দের ক্রিয়া-বাচক শব্দ হলো আরবি এর অর্থ শুধু বিক্রয় শব্দেই সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ হয় চুক্তি করা, সম্মান প্রদর্শন করা, নেতৃত্ব মেনে নেয়া, আনুগত্যের শপথ করা, বিক্রয়ের জন্য পেশ করা, চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং ব্যবসায় লেন-দেন করা ইত্যাদি।

 

বিখ্যাত আরবি-ইংরেজি অভিধান আরবি যার সংকলক MILTON COWAN, তাতে আরবি অর্থ লিখা হয়েছেঃ

 

To sell, to make a contract, to pay homage, to acknowledge as sovereign or leader, to pledge allegiance, to offer for sale, to agree on the term of a sell, to buy, to purchase etc.

 

এ অভিধানে আরবি অর্থ লিখা হয়েছে- agreement, arrangement, business deal, commercial transaction, bargain, sale, purchase, homage etc.

 

কুরআনে এ পরিভাষার ব্যবহার

 


 

কুরআন মজীদে বাইয় শব্দটি বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রুজি রোজগারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম কাজে লেগে থাকার অর্থে কয়েকটি সূরায় ব্যবহার করা হয়েছে।

 

আরবি

 

‘জুমআর দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহ্‌র যিকরের দিকে দৌড়াও এবং বেচা-কেনা বাদ দাও।’ সূরা জুমআঃ৯ আয়াত)

 

আরবি

 

সেসব লোক যাদেরকে ব্যবসা,বেচা কেনা ও কাজ কারবার ইত্যাদি কোন কিছুই আল্লাহ্‌র যিকর থেকে গাফেল করে দেয় না।

 

  সূরা নুরঃ ৩৭

 

এ দুটো আয়াতে জীবিকা অর্জনের সব রকম ব্যাবস্থাকেই বাইয় শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।

 

সূরা তাওবা,সুরা ফাতহ, সূরা মুমতাহিনায় বাইয় শব্দটি রুপকভাবে বিক্রয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখানে বিক্রয় মানে নিজের সত্তা ও জান-মালকে কোন মহান উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌ ও রাসুলের নিকট সমর্পণ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বা ওয়াদা করা।

 

আরবি

 

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মুমিনদের জান ও মাল বেহেশতের বদলে কিনে নিয়েছেন। তার আল্লাহ্‌র পথে লড়াই করে,(দুশমনকে) মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।তাওরাত,ইঞ্জিল, ও কুরআনে তাদের জন্ন(বেহসত দেয়ার এ ওয়াদা) আল্লাহ্‌র দায়িত্ব একটা পাকা ওয়াদা, আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে বাইয়াত করেছ সে বিসয়ে তোমরা সন্তুষ্ট থাক। এটাই সবচেয়ে বড় কামিয়াবি।’ সূরা তাবা ১১১

 

আরবি

 

‘হে রাসুল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহ্‌র কুদরতের হাত ছিল। সূরা ফাতহ ১৮

 

আরবি

 

‘হে নবী! আপনার নিকট যদি মেয়েরা এ কথার উপর বাইয়াত হবার জন্য আসে যে তারা আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে শরিক করবেনা, চুরি করবেনা,যিনা করবেনা, তাদের সন্তান হত্যা করবেনা, নিজেরা কোন অপবাদ রচনা করে আনবে না ও ন্যায্য ব্যাপারে আপনার অবাধ্য হবে না, তা হলে আপনি তাদের বাইয়াত কবুল করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অতি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ সূরা মুমতাহিনা ১২

 

এ কয়টি আয়াতে বাইয়াত শব্দটি নির্দিষ্ট অর্থে ইসলামী পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা তওবাতে জান ও মাল আল্লাহ্‌র নিকট সমর্পণ করার অর্থে, সূরা ফাতহে রাসুলের নির্দেশে মৃত্যুবরণ করার অর্থে এবং সূরা মুমাতাহিনায় আল্লাহ্‌ ও রাসুলের সাথে নাফরমানি না করার ওয়াদার অর্থে বাইয়াত কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্‌ ও রাসুলের পূর্ণ আনুগত্যের শপথই এসব বাইয়াতের আসল উদ্দেশ্য।

 

সূরা তাওবাতে বাইয়াতে মানে মুমিনদের জান ও মালকে আল্লাহ্‌র মরজি মতো কাজে লাগাবার এবং নিজেদের খেয়াল এবং খুশি মতো ব্যবহার না করার ওয়াদা। সূরা ফাতহে বাইয়াত মানে রাসুল সাঃ এর নির্দেশে জীবন দেয়ার শপথ করা।হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে হযরত ওসমান রাঃ কে মক্কাবাসীরা হত্যা করেছে বলে গুজব শুনে কুরাইশদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায়ও উপস্থিত সকল সাহাবা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত বলে ঐ শপথ করেছিলেন। আর সূরা মুমতাহিনাতে আল্লাহ্‌ ও রাসুলের অবাধ্য না হওয়ার ওয়াদাই বায়াতের উদ্দেশ্য। সুতরাং এসব কয়টি আয়াতেই বাইয়াতের সারমর্ম হল মুমিনের জান মাল,ইচ্ছা- বাসনা,রথাত পূর্ব সত্তাকে আল্লাহ্‌র মর্জির নিকট সমর্পণ করা। এটাই ইসলাম কবুলের মর্মকথা। ইসলাম শব্দের অর্থও আত্নশমর্পন। বাইয়াতের মাধ্যমে আত্নশমর্পনের বাহ্যিকরূপ প্রকাশ পায়।

 

বাইয়াতের ব্যাখ্যা

 


 

সূরা তাওবাতে ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ পাক নিজেই ঘোষণা করেছেন যে, তিনি মুমিনদের জান অমাল খরিদ করে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়লা একথা বলেননি যে, মুমিনরা তাদের জান ও মাল তার কাছে বিক্রয় করেছে। কিন্তু মালের মালিক যদি তার মাল নিজের ইচ্ছায় বিক্রয় না করে তাহলে সে মাল কেউ খরিদ করতে পারে না।কারন জোর করে নিলে তা কেনা হয়েছে বলে গণন হয় না।

 

সব মুমিনই আল্লাহ্‌র নিকট তাদের জান ও মাল বিক্রয় করে না। যারা বিক্রয় করে তারাই সত্যিকারের মুমিন। তাই এ আয়াতে আল্লাহ্‌ একথাই বলতে চেয়েছেন যে, যারা নিজ ইচ্ছায় তাদের জান মাল বিক্রয় করেছেন তাদের কাছ থেকেই তিনি কিনেছেন। অর্থাৎ যাদের জান-মাল তিনি কিনেছেন তারা সন্তুষ্ট চিত্তেই বেচতে রাজী হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জোর করে কেনা হয়নি বা তাদেরকে বেচতে বাধ্য করা হয়নি।

 

কোন জিনিস কারো কাছ থেকে কিনলে বিক্রেতাকে অবশ্যই তার দাম দিতে হয়। তা নাহলে কেনার দায়িত্ব পালন করা হয় না। দাম না দিয়ে জিনিস নিলে বুঝা যায় যে মালের মালিক তার মাল কাউকে দান করেছে, বিক্রয় করেনি। তাই আল্লাহ পাক মুমিনের জান-মাল কিনে নিয়েছেন বলার সাহথে সাথেই দামের কোথাও উল্লেখ করেছেন। যে দাম তিনি দিতে চান তা দুনিয়ার কোন জিনিস নয়। তিনি এত বিরাট মূল্য দিতে চান যা দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যায় না।

 

মুমিনের জান-মালের বদলে তিনি বেশেস্ত দেবার কথা ঘোষণা করেছেন। যেহেতু বেহেস্ত দুনিয়ার জিবিনে পাওয়ার উপায় নেই, সেহেতু এখানে নগদ দাম পরিশোধ করাও শভব নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাক বাকিতেই মুমিনের জান-মাল কিনে নিয়েছেন। আল্লাহ্‌ নগদ দাম নিচ্ছেন না বলে মুমনের জান-মাল বিক্রয় করার সাথে সাথেই নিয়ে নেন না। বরং মুমিনের জান-মাল তার কাছেই আমানত রাখেন। যদি কেনার সময় জান-মাল আল্লাহ্‌র নিজের হাতেই নিয়ে নিতেন তাহলে ঝামেলা চুকে যেতো। কিন্তু আল্লাহ পাক কিনে নেয়ার ঘোষণা স্বীকার করেও মুমিনের জান মাল তার কাছেই আমানত রেখেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক বলতে চান যে, হে মুমিন তোমার জান-মাল আমার কাছে বক্রয় করেছ বলে তুমি দাবী করছ তা তোমাকে বাস্তব প্রমাণ করে দেকাহতে হবে। তোমার জান ও মাল আর তোমার মালিকানায় নেই। তোমার বাকি জীবনে এ জান মাল যদি সম্পূর্ণরূপে আমার মরজি মত ব্যবহার কর তাহলে আমি স্বীকার করবো যএ তুমি তা সত্যি আমার কাছে বেচেছ। এ প্রমাণ দিতে পারলে মৃত্যুর পরপারে ের দাম হিসেবে বেহেস্ত অবশ্যই পাবে।

 

রাসুলের নিকট বাইয়াত অর্থ কি?

 


 

কোন মাল কারো কাছে একবার বিক্রয় করার পর ের মালিকানা ষত্ব ক্রেতার হাতে চলে যায়। বিক্রেতা এ মাল আবার অন্য কারো কাছে বেচতে পারে না। কারন এক মাল একি ব্যক্তি কেমন করে বার বার বিক্রয় করবে?

 

মুমিন তার জান-মাল আল্লাহ্‌র কাছে বিক্রয় করার পর এর মালিকানার সত্ব ক্রেতার হাতে চলে গেছে। প্তহচ শাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ ের কাছে বাইয়াত হয়েছেন বলে কুরআন ও হাদিসে প্রমাণিত। তাই প্রশ্ন জাগে যে, রাসুল সাঃ এর কাছে বাইয়াত হওয়ার মানে কি? একবার আল্লাহ্‌র কাছে জান-মাল্বিক্রয় করা হয়েছে। রাসুল সাঃ ের নিকট আবার কি বিক্রয় করা হলো? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পেলেই বাইয়াতের হাকিকত বুঝাজাবে।

 

আগেই বলে হয়েছে যে, আল্লাহ পাক মুমিনের জান-মাল কিনে তারই হাতে আমানত রেখে দেন। সচেতন মুমিন একথা ভালভাবেই জানে যে। তার যে জান ও মাল আল্লাহ্‌র মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে তা আল্লাহ্‌র মর্জি মতো কাজে লাগানোই সঠিক দায়িত্ব। শয়তানের ওয়াসওয়াসায় ও নফসের ধোঁকায় পরে, পরিবার পরিজনের দাবিতে এবং আন্তীয় ও বন্ধু-বান্ধবের চাপে পরে আল্লাহ্‌র মর্জির খেলাফ জান ও মাল খরচ করে ফেলার আশঙ্কা অবশ্যই রয়েছে। তাই আল্লাহ্‌র এ আমানত সঠিকভাবে আল্লাহ্‌র মর্জি মত ব্যবহার করার উদ্দেশ্যই সাহাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন।

 

আল্লাহ্‌র নিকট জান মাল বিক্রয় করা মানে যাবতীয় শক্তি সামর্থ্ এবং সময়, সম্পদ ও শ্রম আল্লাহ্‌র আনুগত্তের অধীনে ব্যবহার করার ওয়াদায় আবদ্ধ হওয়া। এ ওয়াদা এমন ব্যপক যে ইচ্ছা শক্তি, চিন্তা শক্তি মনন শক্তি বং বুদ্ধিব্রত্তিকেও আল্লাহ্‌র মর্জির অধীন করা বুঝায়। এইরূপ পুরনাঙ্গ দাবী পূরণ করতে হলে আল্লাহ্‌র সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়। মানুষ যেভাবে শয়তানের ওয়াসওয়াসায়, নফসের ধোঁকা দুনিয়ার মোহ, অন্য মানুষের প্রচনা ইত্যাদি দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে তাতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ্‌র পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করা বাস্তবে সম্ভব হয় না। একারনেই আল্লাহ্‌র রাসুলের দিনই দাওয়াত যারা কবুল করেছেন তাদেরকে রাসুলের নেতৃত্ব মেনে জামায়াতবদ্ধ হবার তাগিদ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন। এ জাতিয় সাংগঠনিক বন্ধন ছাড়া আল্লাহ্‌র পুরনাঙ্গ আনুগতের পথে অগণিত বাঁধা দূর করা সম্ভব নয়। যার শ্নগথনিক শৃঙ্খলা কবুল করে রাসুলের জাম্যাতের শরিক হতে রাজী হয়েছেন তার আল্লাহ্‌র পুরনাঙ্গ আনুগত্তের উদ্দেশে সংগঠনের নির্দেশ পালন করতে অয়াদাবদ্ধ হয়েছেন, যাতে সকল প্রকার ধোঁকার থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। ইসলামী জামায়াতের আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌র আনুগত্য বাস্তবে সহজ ও সম্ভব হয়। জামায়াতের আনুগত্যের এ শপথই ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াত নামে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল সাঃ এর নিকটে যে বাইয়াত হন তা এ আনুগত্যেরই শপথ। সাহাবায়ে কেরাম বাস্তব জীবনই এর সাক্ষী যে তারাবাইয়াতের তাৎপর্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এ বাইয়াতের দাবী হলো রাসুলের পূর্ণ আনুগত্য। তাই দেখা যায় যে রাসুল সাঃ কোন কাজের নির্দেশ দিলে বিনা অজরে সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেন। যারা অজর পেশ করতো তাদেরকে কুরআনে মুনাফিক বলা হয়েছে।

 

একবার রসুল সাঃ সবাইকে যুদ্ধে যাবার হুকুম দিলেন। এক সাহাবির মা মৃত্যু শয্যায় থাকা স্বতেও তিনি যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যথা সময়ে হাজির হয়ে গেলেন। তিনি রাসুল সাঃ কে মায়ের অবস্থাটা জানালেন। ওজর পেশ করে না যাওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল না। কিন্তু অবস্থা জেনে রাসুল সাঃ তাঁকে মায়ের খেদমতে পাঠিয়ে দিলেন।

 

এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় যে, ঐ সাহাবি মাকে এ অবস্থায় ফেলে যাওয়া সম্ভব নয় বলে নিজেই যুদ্ধে না যাবার সিদ্ধান্ত নেননি। কারন বাইয়াতের দরুন এমন সিদ্ধান্ত নেবার কোন ইখতিয়ারই নেই বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রসূলের হাতে তুলে দিয়েছেন বাইয়াতের মাধ্যমে। তাই কোন ওযর আপত্তি দেখিয়ে রাসুলের আদেশ পালন না করার সিদ্ধান্ত নেননি। যদি তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তরি হয়ে রাসুলের নিকট হাজির না হতেন এবং নিজেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে তা বাইয়াতের খেলাফ হতো।

 

রাসুল সাঃ অবস্থা জেনে তাঁকে মায়ের খেদমত করার অনুমতিদেয়ার ফলে তিনি যুদ্ধে না যেও যুদ্ধে যাবার সওয়াব পেলেন। কিন্তু যদি তিনি নিজে এ সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে রাসুল সাঃ এর আদেশ অমান্য করার মত বড় অন্যায় হয়ে যেতো।

 

রাসুলের নির্দেশে তাবুক যুদ্ধে যেতে রাজী হয়েও বিলম্ব করে ফেলার কারনে ৩জন সাহাবিকে ৫০ দ্বীন পর্যন্ত এক ঘরে করে রাকাহ হয়েছিল। আল্লাহ পাক নিজে তাদের তাওবা কবুল হওয়ার কথা ঘোষণা না করা পর্যন্ত তাদের সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়েছিল। বাইয়াতের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব কতটুকু তা এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট।

 

এ বাইয়াত কি শুধু রাসুলের কাছেই হতে হয়?

 


 

সাহাবায়ে কেরাম সরাসরি রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছিলেন।রাসুল সাঃ এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন মানবসত্তা নেই। অথচ রাসুল সাঃ দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর সাহাবাগন হযরত আবুবকরের রাঃ নিকট আবার বাইয়াত হলেন। এভাবেই পরবর্তী খলিফাগণের নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। এ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে বাইয়াত এমন এক জরুরি নিয়ম যা রাসুলের পরও চালু রাখতে হয়েছে এবং উম্মতের মধ্যে এ নিয়ম চিরদিনই চালু থাকা উচিত।

 

অবশ্য রাসুল সাঃ এর নিকট বাইয়াত ও পরবর্তী কারো নিকট বাইয়াতের মধ্যে আনুগত্তের ব্যাপারে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সর্বাবস্থায় বিনা শরতে আল্লাহ রাসুলের আনুগত্য করতে হয়, কিন্তু রাসুল ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা চলে বনা, কুরআন সুন্নাহ্র অধীনে তাদের আনুগত্য করতে হয়। রাসুলের আনুগত্য নিরুঙ্কুস ও নিঃশর্ত অন্যের বেলায় তা শর্তাধীন। এখন প্রশ্ন হল ইসলামী বিধান অনুযায়ী এ বাইয়াত কার নিকট হওয়া উচিত? ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের জামায়াতে বা অন্য সংগঠনের দায়িত্বশীলদের নিকট বাইয়াত হতে হয়। যতদিন রাসুল সাঃ নিজে এ জামায়াতের দায়িত্বশীল ছিলেন ততদিন তারি নিকট বা তার নিযুক্ত কোন ব্যক্তির নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। দুনিয়া থেকে তার বিদায় হবার পর ঐ জামায়াতেরদায়িত্ব যার উপর পরেছে তারই নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকেই এ বিরাট শিক্ষা চলে এসেছে যে, মুসলমানদেরকে জামায়াতবদ্ধহয়ে থাকতে হবে এবং যিনিই ঐ জামায়াতের নেতা নির্বাচিত হন তাঁরই কাছে বাইয়াত হতে হবে। জামায়াতবিহীন অবস্থায় থাকা মুসলমানদের উচিত নয় এবং জামায়াতবদ্ধ হবার প্রমাণই হল জামায়াতের আমিরের নিকট বাইয়াত হওয়া।

 

বর্তমানে সারাদুনিয়ার এক্স পঁচিশ কোটি মুসলমান এক জামায়াতবদ্ধ অবস্থায় নেই। তাই গোতা উম্মতের কোন একজন নেতা বা আমীর নেই। এমনকি কোন এক দেশের সব মুসলমানও এক জামায়াতবদ্ধ নয়। প্রকৃত অবস্থা এই যে, বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে জামায়াতবদ্ধ হওয়ার চেতনাই দুর্বল হয়ে গেছে। এমনকি ওলামায়ে কেরামের মধ্যে এ চেতনা ব্যাপক নয়। এ কারনেই মুসলিমদের জীবনেই ইসলামের প্রভাব এত কমে গেছে।

 

প্রচলিত বাইয়াত

 


 

সাহাবায়ে কেরামের যুগে যে উদ্দেশ্যে বাইয়াত প্রচলন হয়েছিল বর্তমানে ঐ মহান উদ্দেশ্য চালু না থাকলেও বাইয়াতের পরিভাষা সমাজে এখনো প্রচিলত আছে।

 

বেশ কয়েকটি আরব দেশের বাদশাহগণ সরকারী দায়িত্ব গ্রহণের অংশ হিসেবে দেশের নাগরিকদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ বাইয়াত দ্বারা বাদশাহর নেতৃত্ব পরিচালিত সরকারের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য প্রকাশ করাই আসল উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে পীর সাহেবান তাদের মুরিদদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। দিনের ব্যাপারে পির সাহেবের হেদায়েত অনুযায়ী চলবার ওয়াদাই এ বাইয়াতের উদ্দেশ্য।

 

বাইয়াতের আসল উদ্দেশ্য

 


 

রাসুল সাঃ এর নিকট সাহাবায়ে কেরাম যে উদ্দেশ্য বাইয়াত হতেন। সেটাই হলো আসল উদ্দেশ্য। ঐ উদ্দেশ্য বাইয়াত এর পদ্ধতি চালু করতে হলে কয়েকটি শর্ত পূরণ হতে হবে।

 

১। রাসুল সাঃ ইকামাতের দিনের যে আন্দোলন করেছিলেন সে আন্দোলনের দাওয়াত সমাজে পেশ করতে হবে।

 

২। এ দাওয়াতে সারা দিয়ে যারা আন্দোলনে শরিক হতে আগ্রহী তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে।

 

৩। তাদের মন-মগজ ও চরিত্রকে ইকামাতে দিনের উদ্দেশ্য গড়ে তুলতে হবে।

 

৪। যারা ইকামতে দীনের বিরাট দায়িত্ব ভালভাবে বুঝে নিয়ে তাদের জান ও মাল আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে আগ্রহী তাদের নিকট থেকে বাইয়াত নিতে হবে।

 

৫। ইকামতে দীনের উদ্দেশ্যে গঠিত জামায়াতের সদস্যদের দ্বারা যিনি জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন্তারই নিকট বাইয়াত হতে হবে। এ নিয়মে যদি বাইয়াত হতে হবে। এ নিয়মে যদি বাইয়াত চালু হয় তাহলে তা প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তির নিকট বাইয়াত হওয়া বুঝায় না বরং ইসলামী জামায়াত বা সংগঠনের নিকটই বাইয়াত হওয়া বুঝায়।

 

মূলত বাইয়াত ব্যক্তি বিশেষের নিকট নয়, ইসলামী সংগঠনের নিকট হওয়াই যুক্তিযুক্তও। অবশ্য কোন ব্যক্তির নিকটই বাইয়াতের শপথনামা পেশ করতে হয়। কেননা সংগঠন জীবন সত্তা নয় যার নিকট তা পেশ করা যায়। রাই সংগঠনের দায়িত্বশীলের মাধ্যমে ইসলামী সংগঠনের নিকট বাইয়াত হতে হয়।

 

ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর মতো যেসব সংগঠন ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাইয়াতের ধারনাই চালু রয়েছে। যারা জামায়াতে ইসলামীর রুকন(সদস্য) হন, তারা শপথের গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠনের নিকট বাইয়াত হন। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে ৮ নং ধারা অনুযায়ী আমিরে জামায়াত বা তাঁর কোন প্রতিনিধি সামনে রুকনিয়াতের শপথ গ্রহণ করতে হয় এ শপথই বাইয়াত হিসেবে গণ্য।

 

বাইয়াতের দাবী

 


 

ইকামাতে দীনের মহান লক্ষে পরিচালিত কোন ইসলামী সংগঠনের নিকট যে ব্যক্তি বাইয়াত হন তাঁর নিয়ত এ বাইয়াতের দাবী নিম্নরূপঃ

 

১। এই বাইয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তির জান ও মাল অর্থাৎ গোটা সত্তা, যা আল্লাহ্‌র নিকট বিক্রয় করা হয়েছে, তা সাংগঠনিক পদ্ধতিতে ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্য ব্যবহার করার শপথই নেয়া হলো। তাই এ নিয়মেই জান ও মাল আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করতে হবে।

 

২। ইসলামী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে যে কোন নির্দেশ বা দায়িত্ব দেয়া হবে, তা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী না হলে বিনা দ্বিধায় পালন করতে হবে এবং এ ব্যাপারে দুনিয়ার কোন রকম ক্ষয়-ক্ষতির পরওয়া করা চলবে না।

 

৩। যদি সংগঠনের কোন দায়িত্বশীলদের নির্দেশ সঠিক নয় বলে কারো মনে হয়, তাহলে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করে মিমাংসায় পৌছাতে হবে। আলোচনা ছারাই নির্দেশ পালনে অবহেলা করা হলে বাইয়াতের খেলাফ হবে বলে এ বিষয়ে সাবধান হতে হবে।

 

৪। কোন বিশেষ অসুবিধা বা ওযরের কারনে যদি কোন নির্দেশ পালন করা অসম্ভব মনে হয়, তাহলে ঐ দায়িত্বশীলের নিকট ওযর পেশ করতে হবে। সংগঠন যে সিদ্ধান্ত দেয় তাই চূড়ান্ত বিবেচনা করতে হবে। সংগঠনের কোন সিদ্ধান্ত ছাড়া নিজের কোন ওযরের অজুহাতে নির্দেশ পালন নাকরলে বাইয়াতের খেলাফ কাজ হয়েছে বলে গণ্য হবে।

 

সব আন্দোলনেই শপথের রীতি আছে

 


 

বাইয়াতের মরম কথা হলো আনুগত্যের ধপথ। যারা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে আন্দোলন করে, তারা স্বাভাবিক কারনেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ ধরনের শপথের মাধ্যমে তাদের নিরুংকুস আনুগত্যের ব্যবস্থা করে। ইসলামী আন্দোলন ছাড়াও সবরকমের আন্দোলনেই এ জাতীয় শপথের রীতি আছে। লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে জীবন বিসর্জনের যে শপথ নেয়া হয় তা অগ্নি শপথ বা রক্ত-শপথ বা দ্রিপ্ত-শপথ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এমনকি নিজ দেহের রক্ত দিয়ে শপথ নামায় দরখাস্ত করার রীতিও চালু রয়েছে। কিন্তু ইসলামে একমাত্র আল্লাহ্‌র নাম নিয়েই শপথা নেয়া হয়।

 

 

 

ইকামাতে দীন ও বাইয়াত

 


 

রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে একথা প্রমাণিত যে, ইকামাতে দীনের কাজ সব ফরযের বড় ফরয। এ কাজের জন্যই আল্লাহ পাক রাসূল পাঠিয়েছেন বলে কয়েকটি সূরায় ঘোষণা করেছেন।

 

(আরবী)

 

‘তিনিই সে সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও আনুগত্যের একমাত্র সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, যেন রাসূল (সা.) তাকে (বিধানকে) আর সব রকমের আনুগত্যের বিধানের উপর জয়ী করেন।’ (সূরা তাওবা ৩৩, সূরা ফাত্‌হ ২৮ ও সূরা সফ ৯ আয়াত)

 

এ বিরাট কাজটি এমন যে নবীর পক্ষেও এ কাজ একা করা সম্ভব নয়। তাই এ কাজের জন্য একদল যোগ্য লোক তৈরি করার প্রচেষ্টা সকল নবীই করেছেন। যে নবী প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক পাননি তাঁর হাতে ইসলাম বিজয়ী হয়নি বা দীন কায়েম হতে পারেনি।

 

এ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, ইকামাতে দীনের জন্য মুসলিমদের জামায়াত বা সংগঠন অপরিহার্য। অর্থাৎ ইকামাতে দীনের এ বড় ফরয কাজটির জন্য জামায়াতবদ্ধ হওয়াও ফরয। এভাবেই জামায়াতবদ্ধ হওয়া দ্বিতীয় বড় ফরয। বাইয়াতই হল জামায়াতী বন্ধনের সূত্র। তাই ইকামাতে দীনের জন্য বাইয়াত ছাড়া উপায় নেই। প্রকৃত কথা এই যে, ঐ বাইয়াতই আসল ইসলামী বাইয়াত যা ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে ইসলামী সংগঠনের মধ্যে চালু হয়।

 

মুসলমানদের যেসব সংগঠনে বাইয়াত পরিভাষাটি করা সত্ত্বেও ইকামাতে দীনের কোন কর্মসূচী ও কর্ম তৎপরতা নেই, সেখানে বাইয়াতের আসল হাকিকাত নেই। নামায, রোযা ও যিকরের মতো ইসলামে বহু পরিভাষা যেমন মুসলিমদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এ সবের হাকিকাত চর্চা খুব কমই হয়েছে, তেমনি বাইয়াত পরিভাষাটির অবস্থাও তাই হয়ে আছে।

 

প্রকৃত পক্ষে বাইয়াত পরিভাষাটির দ্বারা এমন ইসলামী সংগঠনই বুঝায় যা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ এর উদ্দেশ্যেই গঠিত। রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত সাহাবায়ে কেরামের জামায়াতই এর আদর্শ নমুনা। বাইয়াতই ঐ জামায়াতের প্রাণ শক্তি।

 

সূরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একথাই বলেছেন যে, তিনি ঐ সব মু’মিনের জান ও মালই খরিদ করেছেন ‘যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, দুশমনকে মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।’ দীনে হককে কায়েমের আন্দোলন ছাড়া বাতিলের সাথে এ লড়াই হবার কোন কারণই নেই। সুতরাং কুরআন পাকে যে বাইয়াতের কথা বলা হয়ৈছেতা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর উদ্দেশ্যেই। ইকামাতে দীনের আন্দোলনের জন্যই বাইয়াত দরকার। আর বাইয়াতের মাধ্যমেই জামায়াতবদ্ধ হতে হয়। জামায়াতবদ্ধ না হয়ে ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

 

ইকামাতে দীন এর সাথে জামায়াত ও বাইয়াতের সম্পর্ককে নামায ও ওযুর সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায়। আল্লাহ পাক নামাযের জন্যই ওযুকে ফরয করেছেন। নামাযই হল আসল ফরয। ঐ ফরযটি ওযু ছাড়া হয়না বলেই ওযু ফরয। তেমনিভাবে জামায়াত ও বাইয়াত ছাড়া ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। ইকামাতে দীনই আসল ফরয। ঐ ফরযের প্রয়োজনেই জামায়াত ফরয আর বাইয়াতের বন্ধন ছাড়া জামায়াত মজবুত হতে পারে না এবং জামায়াতের উদ্দেশ্যও পূর্ণ হতে পারে না। অর্থাৎ জামায়াতবদ্ধ হবার ফরযটি বাইয়াতের মাধ্যমেই আদায় হয়।

 

কেউ যদি ওযূ করে কিন্তু নামায আদায় করার প্রয়োজন মনে না করে তাহলে সে ওযুর কোন সওয়াব পাবে না। সে ওযু করছে না বলে হাত মুখ ধুয়েছে বলাই উচিত হবে। যে নামাযের ধার ধারে না সে ওযুর অঙ্গগুলো ওযুর মতো ধুয়ে নিয়েছে বলেই সে অযু করেছে বলা ঠিক হবে না। কারণ নামাযী লোকই ওযু করে থাকে এবং সে নামাযী নয় বলে ওযু করেনি মনে করতে হবে।

 

তেমনিভাবে ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্য ছাড়া যে বাইয়াত তা আসল বাইয়াত নয়। ইসলামে বাইয়াতের যে হাকিকাত তা এ বাইয়াতে পাওয়া যায় না। তবুও বাইয়াত পরিভাষাটি যেভাবেই চালু থাকুক তা সমাজে বেঁচে আছে বলেই এর আসল হাকিকাত চর্চা কাজে লাগতে পারে। যদি বাইয়াত কথাটি লোকের নিকট পরিচিতই না থাকতো তাহলে এর মর্ম বুঝানো আরও কঠিন হতো। যেমন সমাজে যদি নামাযের প্রচলন না থাকতো তাহলে নামাযের হাকিকাত চর্চা করা আরও মুশকিল হতো।

 

আসল বাইয়াত আল্লাহর নিকট

 


 

হুদায়বিয়াতে সাহাবায়ে কেরামের নিরস্ত্র অবস্থা ও কুরাইশদের সাথে লড়াই-এর শপথ করার ঘটনাকে সূরা আল ফাত্‌হে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :

 

(আরবী)

 

‘হে রাসূল যারা আপনার নিকট বাইয়াত হয়েছে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট বাইয়াত হয়েছে। তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে।’ (সূরা আল ফাত্‌হ: ১০ আয়াত)

 

মুমিনের জান ও মাল আল্লাহর নিকট বিক্রয় করার পর তা মু’মিনের হাতেই আমানত রাখা হয়। তাই মু’মিন সে আমনত ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে দীনের পথে কাজে লাগায়। এভাবে কাজে লাগানোকে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে গ্রহণ করেন তা এ আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে।

 

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যখন মু’মিন তার জীবন উৎসর্গ করার কথা সংগঠনের নেতার নিকট ঘোষণা করে তখন সে ঘোষণা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই নিকট করা হয়। হুদায়বিয়ার ঐ শপথ রাসূল (সা.)-এর নিকট যেভাবে করা হয়েছে তা যেন আল্লাহরই নিকট করা হলো। তাই তাঁরা যখন রাসূল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে শপথ করছিলেন তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়ে শপথ করেছিলেন। তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়েছিলেন। জিহাদ ও ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে বাইয়াত হলে তা আসলে আল্লাহরই নিকট হয়ে থাকে।

 

জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণ শপথ গ্রহণের সময় যেসব কথা উচ্চারণ করেন তাতে নিম্নলিখিত আয়াতটিও রয়েছে :

 

(আরবী)

 

‘আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।’ (সূরা আল আনআম ১৬২)

 

এ আয়াতের মাধ্যমে যে বাইয়াত নেয়া হয় তা আসলে আল্লাহ পাকের নিকটই বাইয়াত করা হয়।

 

জামায়াতী জিন্দেগীর গুরুত্ব

 


 

মানুষ সামাজিক জীব। ইসলাম মানুষেরই জন্য। তাই ইসলঅম স্বাভাবিকভাবেই এমন বিধান দিয়েছে যা মানব সমাজের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। তাই ব্যক্তিকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ইসলাম এতো বিস্তারিত বিধি-বিধান দিয়েছে।

 

ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত একটি ভারসাম্যপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ বিধানই মানব জাতির কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এ জাতীয় বিধান একমাত্র আল্লাহই দিতে সক্ষম। তাই ইসলামই একমাত্র বিশ্বজনীন বিধান।

 

ঐ পূর্নাঙ্গ বিধানকে মানব সমাজে চালু করার দায়িত্ব দিয়েই রাসূল (সা.)-কে পাঠানো হয়েছে। সমাজ গঠনের কাজ সামাজিক প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য রাসূলের চেয়ে বেশী যোগ্য কেই হতে পারে না। কিন্তু সব রাসূলের জীবনে ইসলাম বিজয়ী হয়নি। কারণ ইসলামকে বিজয়ী করার যোগ্য একদল (জামায়াত) লোক যোগাড় না হলে যোগ্যতম রাসূলের পক্ষেও এ কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়।

 

এ কারণেই প্রত্যেক রাসূল সকল মানুষকে দীনের দাওয়াত দেয়ার পর যারা সাড়া দিয়েছৈন তাদেরকে ...(আরবী)... (আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর) বলে সাংগঠনিক দাওয়াতও দিয়েছেন। এ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের প্রতি ঈমান আনা যেমন ফরয ঈমানদারদের জামায়াতবদ্ধ হওয়াও তেমনি ফরয।

 

রাসূল (সা.) জামায়াতী জিন্দেগীর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন:

 

...(আরবী)...

 

১. ‘আমি তোমাদেরকে এমন পাঁচটি কথার হুকুম দিচ্ছি যা আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন – সংগঠনবদ্ধ হওয়া, নেতার কথা শুনা, আনুগত্য করা, হিজরত করা ও আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি)

 

...(আরবী)...

 

২. ‘যখন তিন জন লোক সফরে যাও তখন তোমাদের একজনকে আমীর বানাও।’ (আবূ দাউদ)

 

...(আরবী)...

 

৩. ‘যে ব্যক্তি জামায়াত পরিত্যাগ করল সে ইসলামের শিকল তার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলল।’ (মুসনাদে আহমাদ ও তিরমিযি)

 

মুসলিম জীবনে জামায়াতের এ বিরাট গুরুত্বের দরুনই ফরয নামায জামায়াতে আদায় করার জন্য এত তাকীদ হাদীসে রয়েছে। যারা নামাযের জামায়াতে আসেনা রাসূল (সা.) তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন।

 

কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন একথাই প্রমাণ করে যে, জামায়াতবদ্ধ জীবন যাপন করা ফরয।

 

ইকামাতে দীন ও জামায়াতী জিন্দেগী

 


 

ইকামাতে দীনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে জামায়াতবদ্ধ করেছৈন। দীনকে বিজয়ী করার দায়িত্ব যদি ফরয হয়ে থাকে তাহলে জামায়াতবদ্ধ হওয়াও ফরয হওয়া স্বাভাবিক। আর জামায়াতবদ্ধ হবার বন্ধনসূত্রই হল বাইয়াত। বাইয়াতের মাধ্যমেই জামায়াতের বন্ধন মজবুত হয়।

 

জামায়াতে ইসলামীর রুকন হিসেবে যে শপথ গ্রহণ করতে হয় তা প্রকৃতপক্ষে ঐ বাইয়াতের বাস্তব রূপ। শুধু শপথ বা হলফ শব্দ দ্বারা ঐ দীনী গুরুত্ব বুঝায় না যা বাইয়াত শব্দ দ্বারা বুঝায়। তাই রুকনিয়াতের শপথকে বাইয়াতের মর্যাদা সম্পন্ন মনে করা উচিত। এ ছাড়া জামায়াতের আনুগত্যের সঠিক শরয়ী চেতনা জাগ্রত হতে পারে না।

 

প্রত্যেক সংগঠনেই শপথের রীতি চালু রয়েছে। জামায়াতের রুকনদের শপথ গতানুগতিক ধরনের নয়। এ শপথের ভাষা থেকে বুঝা যে, বাইয়াতের শরয়ী প্রয়োজন এতে সঠিকভাবেই পূরণ হয়।

 

বাইয়াত ও ইসলামী রাষ্ট্র

 


 

কেউ কেউ মনে করেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথেই বাইয়াতের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাদের মতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা না থাকলে বাইয়াতেরও প্রয়োজন নেই। একথার যুক্তি বোধগম্য নয়। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপনিতেই চালু হয় না। জামায়াতবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম। আর জামায়াতী জিন্দেগীর সাথেই বাইয়াতের সম্পর্ক। বাইয়াতের মজবুত সূত্রে আবদ্ধ জামায়াতের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হওয়া সম্ভব। সুতরাং বাইয়াতের ফসলই ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামী রাষ্ট্র বাইয়াত ব্যবস্থা ছাড়া কায়েমই হতে পারে না।

 

মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হবার পূর্বে রাসূল (সা.) এর মাক্কী জীবনে কি সাহাবায়ে কেরাম বাইয়াত হননি? রাসূল (সা.)-এর নিকট বাইয়াত হবার জন্য কি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়েছিল?

 

যুক্তির বিচারেও একথা না মেনে উপায় নেই যে, জামায়াত ও বাইয়াতই আগে এবং ইসলামী রাষ্ট্র পরে।

 

কে কোন জামায়াতে বাইয়াত হবেন?

 


 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কথাটির অস্তিত্ব থাকলেও এর সাংগঠনিক কোন রূপ এই। চার মাযহাবের অনুসারী ও আহলে হাদীস হিসেবে পরিচিত সকল মুসলিমই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে সংক্ষেপে সুন্নী বলা হয়। আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত কোন মাযহাবই শিয়া মতাবলম্বীগণকে তাদের মধ্যে গণ্য করেন না। অর্থাৎ শিয়াগন সুন্নী হিসেবে গণ্য নন।

 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জামায়াতের অনুসারী। আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে একমাত্র উৎকৃষ্ট আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) ঘোষণা করেছেন এবং রাসূল (সা.) তাঁর সাহাবাগণকে তাঁর আদর্শের সত্যিকার অনুসারী বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলই একমাত্র উসওয়াতুন হাসানা বটে, ইত্তেবায়ে রাসূলের (রাসূলের আনুগত্য) ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামই উসওয়াতুন হাসানা।

 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত দুনিয়ার সকল মুসলমান সাংগঠনিক আকারে কোন জামায়াত নয়। জামায়াতের আসল পরিচয়ই হল ইমারত। আমীর ছাড়া কোন জামায়াত হতে পারে না। দুনিয়ার সকল সুন্নী কোন এক ইমারতের অধীন নয়। এমনকি একই দেশের সকল সুন্নীগণও এক আমীরের বাইয়াত হন না।

 

সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে সুন্নীদের মধ্যে যারা ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে কোন সংগঠন (জামায়াত) কায়েম করেন তাদের মধ্য থেকে ঐ জামায়াতের একজন আমীর নির্বাচিত হবেন। ঐ জামায়াতের আর সব সদস্য ঐ নির্বাচিত আমীরের মাধ্যমেই বাইয়াত হবেন। এ আমীর শুধু এ জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরই আমীর। যারা এ জামায়াতে যোগদান করবে না তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত হলেও এ জামায়াতের আমীরের নিকট তাদের বাইয়াত হওয়া জরুরী নয়।

 

এ কারণেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর দেশের সকল সুন্নী মুসলিমানের আমীর নন। যারা জামায়াতে ইসলামীর সদস্য (রুকন) হন শুধু তারাই এই আমীরের মাধ্যমে জামায়াতের নিকট বাইয়াত হন। এমন কি জামায়াতে ইসলামীর নিষ্ঠাবান কর্মী হলেও সদস্য বা রুকন না হওয়া পর্যন্ত কেউ বাইয়াতের মধ্যে শামিল বলে গণ্য হয় না। এমন অনেক যোগ্য কর্মী আছেন রুকনদের চেয়েও বেশী কাজ করেন। কিন্তু তারা নিজের জান ও মাল ইকামাতে দীনের জন্য উৎসর্গ করার শপথ নিতে রাযী না হলে তাদেরকে রুকন হিসেবে গণ্য করা হয় না। এ শপথকেই ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াত বলা হয়।

 

বাইয়াত কি প্রত্যাহার করা যায়?

 


 

আসল বাইয়াত তো আল্লাহ তায়ালার নিকটই করা হয়। এ বাইয়াত ঈমানেরই দাবী। এ বাইয়াত প্রত্যাহার করা মানে ঈমান ত্যাগ করা। বেহেশতে যাবার নিয়ত থাকলে এ বাইয়াত প্রত্যাহার করার কথা চিন্তা করাও অসম্ভব।

 

কিন্তু ঐ বাইয়াতের দাবী পূরণের জন্য ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে গঠিত কোন জামায়াতের নিকট যে বাইয়াত হতে হয় তা দীনের স্বার্থে অবশ্যই প্রত্যাহার করা যেতে পারে। কোন জামায়াতের নিকট বাইয়াত হবার পর যদি এর চাইতেও উন্নতমানের দীনী জামায়াতের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে নিম্নমানের জামায়াতের নিকট থেকে বাইয়াত প্রত্যাহার করে ঐ উন্নতমানের জামায়াতের নিকট বাইয়াত হওয়াই উচিত। এ অবস্থায় বাইয়াত প্রত্যাহার করা মোটেই দোষণীয় নয়। কারণ উৎকৃষ্টতর জামায়াতের নিকট বাইয়াত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রত্যাহার করা আসলে প্রত্যাহার নয়, বাইয়াতের স্থান বদল মাত্র।

 

কিন্তু নিজের কোন দুর্বলতার দরুন বা ইসলামী আন্দোলনের পথে চলা কঠিন মনে করে যদি কেউ বাইয়াত প্রত্যাহার করে বা জামায়াত পরিত্যাগ করে তাহলে সে ঈমানের চরম দুর্বলতার পরিচয়ই দেয়। এ বিষয়ে হাদীসে কঠোর সতর্কবানী উচ্চারণ করা হয়েছে –

 

...(আরবী)...

 

‘জামায়াতের সাথে আল্লাহর রহমত থাকে। যে বিচ্ছিন্ন হয় সে দোযখেই নিক্ষিপ্ত হয়।’ (তিরমিযি)

 

...(আরবী)...

 

‘যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেলো সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (মুসলিম)

 

...(আরবী)...

 

‘যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করল এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা গেল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (মুসলিম)

 

জামায়াতে ইসলামী ও বাইয়াত

 


 

জামায়াতে ইসলামী আমীর ও রুকনদের মধ্যে বাইয়াতের এ সম্পর্কের ব্যাপারে যাতে আনুগত্যের সীমা সামান্যও লঙ্ঘন না হয় সে উদ্দেশ্যে একটি গঠনতন্ত্র দ্বারা গোটা সংগঠন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আমীর রুকনদের ভোটে নির্বাচিত মজলিসে শূরার নিকট জওয়াবদিহী করতে হয়। কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে আমীরের কোন ভুল হলে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেবার জন্য গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এমনকি আমীরের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার জন্যও গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে।

 

পীর-মুরীদীর মধ্যে বাইয়াত-এর পরিভাষাটি সীমাবদ্ধ অর্থে ব্যবহার করা হয়। জামায়াতের মধ্যে রুকনিয়াতের শপথের ক্ষেত্রে তা অনেক ব্যপক অর্থে প্রচলিত। জামায়াতের রুকন হওয়ার মানে আল্লাহর দীনের জন্য জান ও মাল আল্লাহর নামে ও তাঁরই সন্তুষ্টির আশায় সম্পুর্ণ উৎসর্গ করার শপথ নেয়া। বাইয়াতের যে অর্থ সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল জামায়াতের রুকনিয়াত দ্বারা সে অর্থই বুঝায়। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বাইয়াত পরিভাষাটি ব্যবহার করা না হলেও এর চেতনা ও তাৎপর্য অবশ্যই রুকনিয়াতের শপথের মধ্যে রয়েছে।

 

আল্লাহর দীন কায়েমের মহান সংকল্প নিয়ে নিজের জান ও মাল, সময় ও শ্রম এবং দৈহিক ও মানসিক যাবতীয় যোগ্যতা কুরবানী দেবার যে শপথ নিয়ে জামায়াতের রুকনিয়াত কবুল করতে হয় তা যে কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় বাইয়াতেরই অনুরূপ সে উপলব্ধি ও চেতনা সৃষ্টিই এ পুস্তিকার মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ পাক বাইয়াতের এ চেতনা দ্বারা সকল রুকনকে উদ্বুদ্ধকরণ ও কর্মতৎপর রাখুন – আমীন।

 

১৯৪১ সালে মাওলানা মওদূদী (র.)-এর উদ্যোগে লাহোরে সর্ব প্রথম যখন জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয় তখন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ যে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তার বিবরণ নিম্নরূপ:

 

“সর্ব সম্মতভাবে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেবকে আমীর নির্বাচিত করা হয়। বাইয়াতের প্রচলিত রীতি অবলম্বন করা হয়নি। বরং গোটা জামায়াত একসাথে এ শপথ নিয়েছে যে, উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী সবাই আমীরের আনুগত্য করবেন এবং তাঁর হুকুম মেনে চলবেন। এই বাইয়াতে আ’ম (সামষ্টিক বাইয়াত) আদায়ের পর আবার ঐ (কান্নাকাটির) অবস্থায়ই সৃষ্টি হল যা পূর্বে ঈমান তাজা করার সময় হয়েছিল।

 

জামায়াতের কার্য-বিবরণী প্রথম খণ্ডের এ বিবরণ থেকে একথা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে যে, জামায়াতের সূচনা থেকেই বাইয়াতের চেতনা সবার মধ্যে জাগরূক ছিল। আমীরে জামায়াতের আনুগত্যের যে শপথ তারা নিলেন তা যে ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াতই ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং জামায়াতের রুকনগণ যে শপথ নেন তা অবশ্যই বাইয়াত হিসেবে গণ্য।

 

জামায়াতের কর্মী ও সহযোগী সদস্যদের বাইয়াত

 


 

যারা জামায়াতে রুকনিয়াতের শপথ নেননি, কিন্তু কর্মী ও সহযোগী সদস্য হিসেবে ইসলামী আন্দোলনে শরীক আছেন তারা রুকনদের মতো পূর্নাঙ্গ বাইয়াত না করলেও ইকামাতে দীনের উদ্দেশ্যে আংশিক বাইয়াত করেন। যারা সহযোগী সদস্য হন তারা জামায়াতের সাথে সহযোগিতার শপথ গ্রহণ করেন এবং যারা কর্মী তারা রুকন হওযার পথে এগিয়ে যাবার শপথই করেন। রুকনদের বাইয়াত হলো ...(আরবী)... এর (দৃঢ় সংকল্পের) বাইয়াত। যারা কর্মী তারা এর প্রস্তুতি গ্রহণেরই বাইয়াত নেন। আর যারা সহযোগী তারা সহায়তা করার জন্য বাইয়াত হন।

 

কিন্তু ঈমানের দাবী হলো পূর্নাঙ্গ বাইয়াত। ঈমানের এ দাবী পূরণের জন্য প্রত্যেক ঈমানদারেরই আকাঙ্খা, আগ্রহ ও সংকল্প থাকা উচিত। কারণ ঈমানের আসল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের কামিয়াবী। এ মহান উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে পূর্ণাঙ্গ বাইয়াতের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে আখিরাতের সাফল্য লাভ করার লক্ষ্যে পরিপূর্ণভাবে বাইয়াত হয়ে শরয়ী দাবী পূরণ করার তাওফীক দান করুন – আমীন।

 

--- সমাপ্ত ---

বাইয়াতের হাকিকাত

অধ্যাপক গোলাম আযম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড