হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস

প্রাথমিক কথা

শরীঅতে হাদীছের গুরুত্ব অপরিসীম, হাদীছ একাধারে কোরআন পাকের ব্যাখ্যা, রাছুলে করীমের জীবন আলেখ্য এবং শরীঅতে মোহাম্মদীর দ্বিতীয় উৎস। হাদীছ ব্যতীত কোরআন বুঝাই অসম্ভব। কোরআনে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে বহু আহ্কাম পালনের নির্দেশ দান করিয়াছেন। কিন্তু অনেক আহকামেরই বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ দান করেন নাই, ইহার ভার ন্যস্ত করিয়াছেন তিনি তাঁহার রাছূলের উপর। রাছূল আপন কথা ও কার্য প্রভৃতির দ্বারা উহার বিস্তারিত বিবরণ দান করিয়াছেন আর হাদীছে উহা সংরক্ষিত হইয়াছে। সুতরাং মানুষের মধ্যে হাদীছের আলোচনা যতই অধিক হইবে ততই তাহারা শরীঅত সম্পর্কে অধিক অবগত হইবে। দুঃখের বিষয় বাংলাভাষীদের মধ্যে বাংলা ভাষায় হাদীছের আলোচনা এ যাবৎ হয় নাই বলিলেই চলে। নাই, অথচ ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে অনেক হাদীছে ভুল বুঝাবুঝির আশংকাই অধিক; বরং কোন কোন হাদীছ বুঝা সম্পূর্ণ অসম্ভবও বটে।

এ অভাবের কিঞ্চিৎ পূরণ উদ্দেশ্যে আমি ১৩৭৬ হিজরীর ১লা মোহাররম মোঃ ৭ই আগষ্ট ১৯৫৬ইং মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা আরম্ভ করি। কিন্তু দেশের ঘটনাবলী হাদীছের হুজ্জিয়াত (শরীঅতের উৎস হওয়া) সম্পর্কে প্রমাণাদি নূতন করিয়া পেশ করার এবং যুগে যুগে –বিশেষ করিয়া প্রথম ও দ্বিতীয় যুগে হাদীছের সংরক্ষণ কিরূপে হইয়াছে তাহার ইতিহাস আলোচনা করার প্রতি জোর তাকীদ করিতে থাকে। অতএব, আমি মেশকাত শরীফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখিয়া এ কাজে আত্মনিয়োগ করি। কিন্তু আবশ্যক কিতাবাদির অভাব, ঢাকায় আমার স্থায়ীভাবে অবস্থানের অসুবিধা, সর্বোপরি আমার স্বাস্থ্যহীনতা এ ক্ষেত্রে আমার বিরাট অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় আমার পক্ষে যাহা সম্ভবপর হইয়াছে তাহা আমি মেশকাত অনুবাদের ভূমিকারূপে ‘হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ নামে সুধীবৃন্দের খেদমতে পেশ করিলাম। ইহার ভাল মন্দের বিচার তাঁহারাই করিবেন।

এখানে আমি আমার মোহতারাম দোস্ত মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, ঢাকা জামেয়া কোরআনিয়ার শায়খুল হাদীছ মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ হাজীগাঞ্জী, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার মোহাদ্দেছ মাওলানা উবাইদুল হক জালালাবাদী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ইছহাক ও ঢাকা বাংলা কলেজের অধ্যাপক মাওলানা আব্দুর রজ্জাক ছাহেবানের অশেষ শোকরিয়া আদায় করিতেছি যাঁহারা এ কাজে (হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস রচনার কাজে) নানাভাবে আমার সাহায্য করিয়াছেন। এছাড়া আমি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ হুছাইন সিলেটী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছের উস্তাদ মাওলানা শায়খ আব্দুর রহীম ছাহেবেরও অশেষ শোকরিয়া আদায় করিতেছি যাঁহারা কিতাবের বিশুদ্ধ করণে আমাকে বিশেষ সহায়তা করিয়াছেন।

অবশেষে রহমান ও রহীম আল্লাহ তা’আলার নিকট আমার নিবেদন, তিনি যেন দয়া পরবশ হইয়া আমার এ অকিঞ্চিৎকর খেদমতটিকে কবুল করেন এবং আখেরাতে ইহাকে আমার নাজাতের ওছীলা করেন। আ-মীন!!

১৮ জুমাদাল আখেরা ১৩৮৫ হিঃ

২৭ আশ্বিন ১৩৭২ বাং

১৪ অক্টোবর ১৯৬৫ ইং

আহকার –নূর মোহাম্মদ

গ্রামঃ নেয়াজপুর

পোঃ সিলোনিয়া

ফেনী, নোয়াখালী

বরাত

প্রথম ভাগ

রচনায় যে সকল কিতাব হইতে সরাসরিভাবে সাহায্য গ্রহণ করা হইয়াছেঃ

১। মা’রেফাতুল উলুমিল হাদীছ (আরবী*************)

-হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)

২। মোকাদ্দমায়ে ইবনুছ ছালাহ্ (আরবী*************) –ইবনুছ ছালাহ্ (মৃঃ ৬৪২ হিঃ)

৩। শারহে নুখবাতুল ফিকার (আরবী*********) –ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)

৪। তাদরীবুররাবী (আরবী**********) –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)

৫। মোকাদ্দমাতুশ শায়খ (আরবী***********) –শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেছ দেহলবী

৬। আররিছালাহ (আরবী*******) ইমাম শাফেয়ী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)

৭। কিতাবুল আমওয়াল (আরবী*******) –আবু উবাইদ কাছেম ইবনে ছাল্লাম (মৃঃ ২২৪ হিঃ)

৮। মোছনাদে দারেমী (আরবী*******) –ইমাম দারেমী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ)

৯। তা’বীলু মোখতালেফিল্ হাদীছ (আরবী*******) –ইবনে কুতাইবা দীনুরী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)

১০। মুখতাছারু জামেয়ে বয়ানিল এলম (আরবী*******) –ইবনে আব্দুল বার (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)

১১। ই’লামুল মোয়াক্কেয়ীন (আরবী*******) –ইবনুল কায়্যেম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ)

১২। আল মোআফেকাত (আরবী*******) –ইমাম শাতেবী (মৃঃ ৭৯০ হিঃ)

১৩। তাদবীনে হাদীছ (আরবী*******) –মানাজির আহছান গীলানী

১৪। তারজুমানুছ ছুন্নাহ (আরবী*******) –বাদরে আলম মিরাঠী

১৫। ফাহমে কোরআন (আরবী*******) –ছায়ীদ আকবরবাদী

১৬। শরহুল বোখারী (আরবী*******) –কিরমানী (মৃঃ ৭৮৬ হিঃ)

১৭। ফতহুলবারী (আরবী*******) –ইবনে হাজার আছকালানী

১৮। মাজমাউজ জাওয়ায়িদ (আরবী*******) –নুরুদ্দীন হাইছমী (মৃঃ ৮০৭ হিঃ)

১৯। কানজুল উম্মাল (আরবী*******) –আলী কোত্তাকী (মৃঃ ৯৫৫ হিঃ)

২০। জামউল ফাওয়ায়েদ (আরবী*******) –সোলাইমান ইবনুল ফাছী (মৃঃ ১০৯৪ হিঃ)

২১। আততাবাকাতুল কুবরা (আরবী*******) –ইবনে ছা’দ (মৃঃ ৩৩০ হিঃ)

২২। আল ইস্তী’আব (আরবী*******) –ইবনে আব্দুল বার (মৃঃ ৪৪৮ হিঃ)

২৩। তাজকেরাতুল হোফফাজ (আরবী*******) –ইমাম জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)

২৪। তাজরীদু আছমায়িছ ছাহাবাহ (আরবী*******) –ইমাম জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)

২৫। আল ইছাবাহ (আরবী*******) –ইবনে হাজার আছকালানী

২৬। তাহজীবুত তাহজীব (আরবী*******) –ইবনে হাজার আছকালানী

২৭। মিফতাহুছ ছুন্নাহ (আরবী*******) –আব্দুল আজীজ খাওলী মিছরী

২৮। ছহীফায়ে হাম্মাম বিন মুনাব্বেহ –ডঃ হামীদুল্লাহ

২৯। মাওজু’আতে কবীর (আরবী*******) –মোল্লাআলী ক্কারী

দ্বিতীয় ভাগ

পাক-ভারত

৩০। আখবারুল আখয়ার (আরবী*******) –শায়খ আব্দুল হক মোহদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১০৫০ হিঃ)

৩১। তাজকেরায়ে ওলামায়ে হিন্দ (আরবী*******) –রহমান আলী

৩২। নোজহাতুল খাওয়াতির (আরবী*******) –ছৈয়দ আবদুল হাই বেরেলবী

৩৩। তারীখে ‌ওলামায়ে হাদীছে হিন্দ (আরবী*******) –ইমাম খাঁ নোশহরবী

৩৪। তারীখে ওলামায়ে আহলে হাদীছ (আরবী*******) –মীর ইব্রাহীম শিয়ালকোটী

৩৫। India’s Contribution to the Study of Hadith Literature –Dr. Md. Ishaq

৩৬। তারিখুল হাদীছ (আরবী*******) –মুফতী আমুমুল ইহছান বরকতী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ)

৩৭। তাজকেরায়ে আওলিয়ায়ে বাঙ্গাল (আরবী*******) –মাওলানা ওবাইদুল হক সাতকানবী

৩৮। খান্দানে আজীজিয়া (আরবী*******) –মুখতার আহমদ

৩৯। সাওয়ানেহে কাছেমী (আরবী*******) –মাওলানা মানাজির আহছান গীলানী

৪০। তাজকীরাতুর রশীদ (আরবী*******) –মাওলানা আশেকে ইলাহী

৪১। হায়াতে আনওয়ার (আরবী*******) –সৈয়দ আজহার শাহ্

৪২। আশরাফুস সাওয়ানেহ (আরবী*******) –মুনসী আব্দুর রহমান

৪৩। তাজাল্লিয়াতে ওছমানী (আরবী*******) –আনওয়ারুল হাসান শেরকুটী

৪৪। তারীখে মাদ্রাসায়ে আলিয়া (আরবী*******) –মাওলানা আব্দুচ্ছাত্তার

৪৫। তাজকেরায়ে জমীর (আরবী*******) –হাফেজ ফয়েজ আহমদ ইছলামাবাদী

৪৬। আল ইয়ানেউল জনী (আরবী*******) –মাওলানা মোহাম্মদ মোহসেন ইবনে ইয়াহইয়া তরহাটী

৪৭। আল ইজদিয়াদুছ ছনী (আরবী*******) –মুফতী মোহাম্মদ শফী দেওবন্দী

৪৮। তাজকেরায়ে ওলামা ফিরিঙ্গী মহল (আরবী*******) –এনায়েতুল্লাহ আনছারী

৪৯। তারীখে দেওবন্দ (আরবী*******) –সৈয়দ মাহবুব রেজবী (রাজাবী)

৫০। মোকাদ্দমায়ে আনওয়ারুল বারী (আরবী*******) –সৈয়দ আহমদ রাজা বিজনৌরী

৫১। আল হায়াত বা’দাল মামাত (আরবী*******) –ফজলে হোছাইন বিহারী

৫২। ছিলছিলায়ে ফিরদাউছিয়া (আরবী*******) –প্রফেসর

৫৩। মোকাদ্দমায়ে আওজাজিল মাছালিক (আরবী*******) –মাওলানা জাকারিয়া কান্দলবী

৫৪। হায়াতে এ’জাজ (আরবী*******) –আবদুল আহাদ কাছেমী

 

অভিমত

জামেয়া কোরআনিয়া, লালবাগ, ঢাকা-এর ভূতপূর্ব প্রিন্সিপাল মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ছাহেব বলেনঃ

আল্লাহ তা’আলা তাঁহার নবীকে ওহীর মাধ্যমে  য জ্ঞান দান করিয়াছেন তাহা দুই প্রকারঃ এক প্রকার জ্ঞান যাহা মৌর। ইহার নাম ‘কিতাবুল্লাহ’ বা ‘আল কোরআন’। ইহার ভাব ও ভাষা উভয় স্বয়ং আল্লাহর। নবী করীম (ছাঃ) ইহাকে আল্লাহর ভাষায়ই প্রকাশ করিয়াছেন। দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞান যাহা প্রথম প্রকার জ্ঞানের ভাষ্য। ইহার নাম ‘ছুন্নাহ’ বা ‘আল হাদীছ’। ইহার ভাব আল্লাহর। নবী করীম ইহাকে আপন কথা, কার্য ও সম্মতি অর্থাৎ আপন জীবন দ্বারা প্রকাশ করিয়াছেন। ইহাও প্রথমটির ন্যায় শরীঅতে মোহাম্মদীর একটি উৎস। অতএব, উম্মতে মোহাম্মদী প্রথম প্রকার ওহীর সংরক্ষণের জন্য যে সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন এই দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞান যাহা প্রথম প্রকার জ্ঞানের ভাষ্য। ইহার নাম ‘ছুন্নাহ’ বা ‘আল হাদীছ’। ইহার ভাব আল্লাহর। নবী করীম ইহাকে আপন কথা, কার্য ও সম্মতি অর্থাৎ আপন জীবন দ্দারা প্রকাশ করিয়াছেন। ইহাও প্রথমটির ন্যায় শরীঅতে মোহাম্মদীর একটি উৎস। অতএব, উম্মতে মোহাম্মদী প্রথম প্রকার ওহীর সংরক্ষণের জন্য যে সকল ব্যবস্থা অবলস্বন করিয়াছেন এই দ্বিতীয় প্রকার ওহীর সংরক্ষণের জন্যও ঠিক সে সকল ব্যবস্থাই করিয়াছেন অর্থাৎ শিক্ষাকরণ ও হেফজ (মুখস্থ) করণ, অন্যদের উহা শিক্ষাদান, কিতাবে উহা লিপিবদ্ধ করণ এবং বাস্তবে উহাকে কার্যকরী করণ। আর এই সকল ব্যবস্থা ছাবাহীগণের যুগ হইতে এ পর্যন্ত বরাবর অব্যাহত রহিয়াছে। কোন যুগেই এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও শিথিলতা প্রদর্শিত হয় নাই। (অবশ্য ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগে লিখন অপেক্ষা মুখস্থ করণই প্রধান ছিল।

এতদব্যতীত আইনবেত্তাগণ (ফকীহগণ) আল কোরআনের ন্যায় ইহার আইনের দিক আলোচনা করিয়াছেন, দার্শনিকগণ (মোতাকাল্লেমীনগণ) ইহার দার্শনিক তথ্য প্রকাশ করিয়াছেন। ছুফীগণ ইহার আধ্যাত্মিক দ্বার উদঘাটন করিয়াছেন এবং মোহাদ্দেছীন বিশেষ করিয়অ জারহ-তা’দীলকারী ইমামগণ ইহার বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করিয়াছেন, আর এ ব্যাপারে ইহারা এত অধিক দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াছেন যাহার নজীর পেশ করিতে দুনিয়া সক্ষম নহে।

মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী ছাহেব তাঁহার মেশকাত-অনুবাদের ভূমিকায় ‘হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ নামে হাদীছ সম্পর্কে উম্মতে মোহাম্মদীর এ সকল তৎপরতারই বিশদ আলোচনা করিয়াছেন। অতঃপর তিনি মূল কিতাবের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ব্যাখ্যায় তিনি দৃঢ়তার সহিত মোতাকাদ্দেমীনদের (পূর্ববর্তীদের) মতেরই অনুসরণ করিয়াছেন। আমার মতে বাংলা ভাষায় মেশকাত শরীফের সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য অনুবাদ ইহাই প্রথম। আর ইহার ভূমিকা অর্থাৎ ‘হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস’-এর ন্যায় একটি মূল্যবান কিতাব বাংলা ভাষায় কেন উর্দু প্রভৃতি ভাষায় লেখা হইয়াছে বলিয়াও আমার জানা নাই। সত্যই ইতা বাংলা সাহিত্যের একটি অবদান। প্রকাশক ছাহেবের নিকট আমার অনুরোধ, তিনি যেন ইহার উর্দু অনুবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।

নাচিজ –শামছুল হক

২/৯/১৯৬৫ ইং

কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মোহাদ্দেছ, সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বাহরুল উলুম মাওলামা মোহাম্মদ হোছাইন ছাহেব বলেনঃ

শরীঅতে ইসলামীর দ্বিতীয় প্রধান উৎস হাদীছ বা ছুন্নাহর গুরুত্ব যে কত বেশী তাহা মুসলিম সমাজের কাছে মোটেই অবিদিত থাকার কথা নহে। কোরআনের ব্যাখ্যা, হযরত রাছুলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আলেখ্য হিসাবে ইহার গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুতঃ এলমে হাদীছ বা ছুন্নাহ ব্যতিরেকে ইসলামের রূপরেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা কোনমতেই কল্পনা করা যায় না।

এলমে হাদীছের এই গুরুত্ব অনুভব করিয়াই মুসলমানগণ প্রথমিক যুগ হইতেই ইহার সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য যে সাধনা করিয়া আসিতেছেন বিশ্বের অমুসলিম মনীষীবৃন্দও অকুণ্ঠভাবে এই সত্যকে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন। হাজার হাজার মুসলিম সন্তান ইহাকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। এই মহান ব্রত পালন করিতে গিয়া তাঁহারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, এমন কি শুধু রাবীর মুখ হইতে প্রত্যক্ষভাবে হাদীছ শ্রবণের জন্য মদীনা শরীফ হইতে দামেষ্ক পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথ পদব্রজে অতিক্রমের কষ্ট বরণ করিয়াছেন। এলমে হাদীছের প্রতি এবংবিধ অনুরাগ ও আসক্তির ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়।

মোহাদ্দেছীনে কেরামের এই কঠোর সাধনার ফলস্বরূপ এলমে হাদীছের বিপুল জ্ঞান-ভাণ্ডার আজও অবিকৃতরূপে আমাদের সম্মুখে মওজুদ রহিয়াছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রাথমিক যুগে কিছু সংখ্যক মনগড়া হাদীছও যে রচিত হয় নাই এমন নহে, তবে আমাদের মোহাদ্দেছীনে কেরাম যে অবিচল নিষ্ঠার সহিত ইহার যাচাই বাছাই করিয়াছেন তাহারও কোন তুলনা মিলে না। নেহাৎ মামুলী চারিত্রিক দোষ বা দোষ বলিয়াও যে সমস্ত অভ্যাসকে সচরাচর মনে করা হয় না, এমন হাদীছ বর্ণনাকারীর হাদীছ হইতেও সতর্কথা অবলম্বন করা হইয়াছে।

এতসব সত্ত্বেও হাদীছের প্রামাণিকতা নিয়া পাশ্চাত্যবাদী কতিপয় ইসলামবিদ্বেষী ও তাহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত কতিপয় মুসলিম সন্তানও সম্প্রতি প্রশ্ন তুলিয়াছেন। তাহাদের সৃষ্ট ধুম্রজাল ছিন্ন করত এলমে হাদীছের সঠিক তত্ত্ব ও ইতিহাস দেশবাসীর কাছে তুলিয়া ধরার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী ছাহেব তাঁহার অর্ধ শতাব্দীর অক্লান্ত সাধনাকে ইসলামের এই খেদমতের জন্য নিয়োজিত করিয়াছেন এবং কয়েক বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মেশকাত শরীফের অনুবাদের ভূমিকাস্বরূপ তিনশত পৃষ্ঠায় এলমে হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস জাতিকে উপহার দিয়াছেন। এই দায়িত্বপূর্ণ, গভীর ও গবেষণা সাপেক্ষ গ্রন্থ রচনার জন্য তাঁহার এই বিরাট গ্রন্থে এলমে হাদীছের পরিভাষা, শরীঅতের উৎস হিসাবে এলমে হাদীছ, হাদীছের প্রমাণিকতা, হাদীছ সংরক্ষণের ইতিহাস, পাকভারতে এলমে হাদীছ এমন কি বঙ্গে এলমে হাদীছ পর্যন্ত সবিস্তার বর্ণনা করিয়াছেন। মোহাদ্দেছীনে কেরামের সংক্ষিপ্ত জীবনী সহ পাকভারতের বিশেষ করিয়া বাংলার প্রায় হাদীছ শিক্ষা কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও তিনি ইহাতে যোজনা করিয়াছেন। এলমে হাদীছের এত ব্যাপক আলোচনা বাংলা ভাষায় তো নয়ই এমন কি উর্দু ফার্সীতেও ইতিপূর্বে হয় নাই। এলমে হাদীছ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও জ্ঞান লাভের জন্য প্রত্যেক মুসলমানের এই গ্রন্থ পাঠ করা বর্তব্য বলিয়া আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। হাদীছ শিক্ষার্থীদের জন্য এই গ্রন্থখানি অত্যন্ত উপাদেয় হইবে।

মাওলানা আ’জমী ছাহেব তাঁহার ভগ্ন স্বাস্থ্য লইয়া এলমে নববীর জ্ঞান পিপাসুদের জন্য বাংলা ভাষায় যে অমূল্য অবদান রাখিয়া যাইতেছেন তজ্জন্য তাঁহাকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ। দোআ করি, খোদা তাঁহার স্বাস্থ্যা ফিরাইয়া দিন, হায়াত দারাজ করুন এবং আরও দীর্ঘকাল পর্যন্ত মুসলিম সমাজকে তাঁহার দ্বারা উপকৃত করুন। আমিন!

জিন্দাবাজার, সিলেট

১০/৯/১৯৬৫ ইং

মোহাম্মদ হোছাইন

স্বনামখ্যাত শিক্ষাবিশারদ ও বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

এম-এ, (ক্যাল); ডিপ্লো-ফোন…. ডি-লিট্ (প্যারিস), বিদ্যাবচস্পতি ছাহেব বলেনঃ

মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী সাহেব একজন সুপ্রসিদ্ধ মুহাক্কি আলিম। তাঁহার রচিত  ‘হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ বহু অধ্যয়ন ও গবেষণার সুফল। ইহতে হাদীছের তত্ত্ব এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় হইতে এ পর্য়্ন্ত বিভিন্ন স্তরে হাদীসের ইতিহাস বিবৃত হইয়াছে। ইহাতে বিভিন্ন সময়ের মুহদ্দিসগণ এমন কি পাক-ভারতের এবং বাঙ্গালা দেশের আধুনিক কাল পযর্ন্ত সমস্ত প্রসিদ্ধ মুহদ্দিসের সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচিত হইয়াছে। আমার জ্ঞানানুসারে এরূপ হাদীস সম্বন্ধীয় পুস্তক ইহর পূর্বে রচিত হয় নাই। ইহা তাঁহার মিশকাত শরীফের বৃহৎ ভুমিকা এবং স্বতন্ত্র পুস্তকও বটে। মৌলানা সাহেব এই তথপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করিয়া বাঙ্গালা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের একটি বড় প্রশংসনীয় থিদমত করিয়াছেন। আমরা ইহার বহুল প্রচার এবং গ্রন্থকারের  নীরোগ দীর্ঘ জীবন কামনা করি । ইতি-

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

২৬/১২/৬৫ ইং

শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীয় আরবী-ইসলামী বিষয়ের সাবেক নিজাম-অধ্যাপক,নওগাঁ ইসলামী ইন্টামিডিয়েট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ঢাকস্থ বাংলা একাডেমী সংকলিত বাংলা ইসলামী বিশ্বকোষের সহ-সম্পাদক জনাব আবুল কাসিম মুহাম্মদ আদমুদ্দীন এম, এ, ছাহেব বলেনঃ

মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী সেই শ্রেণীর খ্যাতিসম্পন্ন আলেম যাঁহারা বিদ্যালয় ত্যাগের পর কিতাব পত্রকে ‘সালামু আলায়কুম’ না বলিয়া ‘দোলনা হইতে কবর পযর্ন্ত জ্ঞানাম্বেষণ কর’ বাণীর অনুসরণে আজীবন জ্ঞান সাধনায় রত। তাঁহার ন্যায় একজন প্রকৃত আলেম ব্যক্তি মেশকাত শরীফের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের কিতাবের অসুবাদে প্রবৃত্ত হওয়া সত্যই আনন্দের বিষয়। পুস্তকের ভুমিকা অর্থাৎ ‘হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ অংশটি বাংলা সাহিত্যে অভিনব বস্ত। কারণ হাদীস- তত্ত্ব  বা উছুলে হাদীস ও হাদীস ও হাদীসের ইতিহাস সম্বন্ধে স্বয়ংসম্পূর্ন কোন গ্রন্থ বাংলা ভাষার ও বাংলাভাষী জ্ঞান পিপাসুদের একটি বিরাট অভাব মোচন করিলেন ও বাংলাভাষী পাঠকদের  সম্মুখে এক নতুন জগতের দ্ধার উন্মোচিত করিলেন। ভূমিকার চতুর্থ অধ্যায়ে গ্রন্থকার জাল হাদীস চিনিবার উপায় ও জাল হাদীস হইতে বাঁচিবার যে যুক্তিপূর্ন পথ নিদের্শ করিয়াছেন তাহা এবং  ‘হাদীস রেওয়ায়তে বিশ্বস্ততার প্রমাণ’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটি বর্তমান যুগে হাদীসের প্রতি আস্থাহীন ও সন্দেহ পোষণকারী তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত করিবে বলিয়া আশা করি।

গ্রন্থের ভূমিকায় দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘বঙ্গে এলমে হাদীছ’ আলোচিত হইয়াছে। এই অধ্যায়টি আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী মুসলিম আলেমদের আত্মচেতনা জাগরূক করিতে সাহায্য করিবে বলিয়া মনে করি। অবশ্য মুসলিম বঙ্গের সর্বত্র আরও বহু সংখ্যক মোহাদ্দেস যে রহিয়াছেন ও অতীতে ছিলেন তাহা বলাই বাহুল্য। তাঁহাদেরও জীবনী ও হাদিসের খেদমতের কথা লোক সমক্ষে তুলিয়া ধরিতে সচেষ্ট হইবার অনুপ্রেরণা এই গ্রন্থ দিবে বলিয়া আশা করি।

মূল পুস্তকে মেশকাত শরীফ সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য দেওয়ায় পুস্তখানির মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। তাছাড়া অনুবাদে তিনি যে নীতি অবলম্বন করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার অনুবাদ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হইয়াছে বলিয়াই আমার ধারণা। আমি গ্রন্থখানির বহুল প্রচার কামনা করি। ইতি-

আবুল কাসিম মুহাম্মদ আদমুদ্দীন

বাংলা একাডেমী-ঢাকা

মাদ্রাসা-ই-আলেয়া ঢাকার সাবেক অধ্যক্ষ, পূর্বপাক মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডের (অবসরপ্রাপ্ত) রেজিষ্টার ও ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল, জনাব শায়খ শরফুদ্দীন এম-এ, বি-এল, ই-পি-এস-ই-এস ছাহেব বলেনঃ

খ্যাতনামা মহাক্কিক আলিম জনাব মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী সাহেবের লিখত ‘হাদীছে তত্ত্ব ও ইতিহা গন্থখানি সযত্নে পড়িয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। প্রায় তিনশত পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি তাঁহার দীর্ঘকালের গবেষণার ফল। ইলমে হাদীছ’সম্পর্কিত বহু জ্ঞাতব্য বিষয় ইহাতে স্থান পাইয়াছে। হযরত রাসুল (স) হইতে আরম্ব করিয়া বর্তমানকাল পযর্ন্ত সহী হাদীসের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও সংকলনের ইতিবৃত্ত যেমন সুসামঞ্জস ও মনোজ্ঞ হইয়াছে, হাদীসের প্রামাণিকতা ও যখন হাদীসের প্রামাণিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে প্রশ্ন তুলিয়াছে সেই সময় ইহার প্রকাশ অত্যন্ত সময়োচিত হইয়াছে। আশাকরি, এই গ্রন্থ পাঠে ইলমে হাদীস বিষয় বহু ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইবে। গ্রন্থটি বাংলা ভাষার একটি বিরাট কীর্তি। এই বিষয়ে এমন তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ এ পযর্ন্ত দেখা যায় নাই। ইহার উর্দু অনুবাদ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। তবে গ্রন্থকার গ্রন্থের দুই স্থানে লিখিয়াছে যে, হযরত আলী (রা) আব্দুল ইবনে সাবাকে তাহার দলবল সহ আগুনে পোড়াইয়া মারিয়াছেন। ইমাম জাহাবীর নিছক অনুমানমূলক কথাটির প্রতি এত গুরুত্ব আরোপ না করাই আমার মতে ভাল ছিল।

গ্রন্থখানি আসলে তাঁহার মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যার ভূমিকা স্বরূপই লেখা হইয়াছে। ইহা তাঁহার মেশকাত অনুবাদের প্রথম খণ্ডের সাথেও প্রকাশিত হইয়াছে।

খাকসার

শায়খ শরফুদ্দী

সিলেট, গাছবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য হেড প্রধান মোহাদ্দেছ

খ্যাতনামা মাওলানা শফীকুল হক ছাহেব বলেনঃ

মসুলমানদের কাছে কোরআনের পরই যে হাদীছে নববীর স্থান উর্ধ্বে একথা কাহারও অজানা নাই তাই উর্দুভাষী হাদীছ অনুবাদকদের মত বাংলা ভাষাও হাদীছের অনুবাদ সুযোগ বাংলা ভাষাভাষীদেরকেও দান করার জন্য হাদীছের বিভিন্ন কিতাবের বাংলা অনুবাদের অত্যধিক প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলার আলেম সমাজ এ মহান কর্তব্য সম্পাদে অগ্রসর হন নাই। অত্যন্ত সুখের বিষয় বর্তমানে মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী ছাহেব এ গুরুদায়িত্ব সম্পাদনে ব্রতী হইয়াছেন। তাঁহার অনূদিত মেশকাত শরীফের প্রথম জিলদ আমার হাতে পৌছিয়াছে। ইহাতে তিনি প্রথমতঃ এলমে হাদীছের পরিভাষা, হাদীছ গ্রন্থাদির প্রকরণ, ছাহাবীদের হাদীছ বর্ণনা, উম্মেতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব, বিভিন্ন যুগের হাদীছ গ্রন্হদি, ফেকা শান্ত্রের ইমামগণসহ  ছিহাহ ছিত্তার চেষ্টা, এলমে হাদীছ ও তাঁহাদের রচনাবলী জাল হাদীছ সৃষ্টর কারণ  ও উহা প্রতিরোধের পাকভারতে এলমে হাদীছের আগমন, এখানকার বিভিন্ন যুগের মুহাদ্দিছগণের জীবণী ও তাঁহাদের রচনাবলী এবং বিভিন্ন যুগের হাদীছ শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস বর্ণনা করিয়া পাক- ভারতের জ্ঞন পিপাসুদের বিশেষ করিয়া বাংলাভাষীদের জন্য যে অপূর্ব সুযোগ দান করিলেন তাহা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

দ্বিতীয়তঃ পাক-ভারতের বিশেষতঃ পুর্ব পাকিস্তানের বর্তমান কালের বিখ্যাত মুহাদ্দিছদের সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনা করিয়া লেখক এমন একটি দুঃসাধ্য ও কঠোর গবেষণা সাপেক্ষে কাজ করিয়াছেন যাহা শুধু লেখক এবং সুধী-মণ্ডলীই বুঝিতে পারেন। ইহা শুধু পাক-ভারতের জন্যই অনুদান করত উর্দুভাষী ভাইদেরও ইহা হইতে উপকৃত হইতে দেওয়া উচিত; বরং আরবী ভাষায় ইহর অনুবাদ করিয়া মসুলিম বিশ্বকে এদেশের এলমী অবদান সম্পর্কে জানিয়ে দিলেই এই কিতাবের পূর্ণ হক আদায় হইতে পারে। হাদীছের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া লিখক ঈমান প্রসঙ্গে যে বিস্তারিত ও সুষ্ঠু বর্ণনা দান করিয়াছেন, কবরের আজাবের সত্যতা প্রমাণের জন্য যে উপমা-উদাহরণের অবতারণা করিয়াছেন, তকদীর প্রসঙ্গে অপূর্ব ব্যাখ্যা দান করিয়াছেন, আহলুছ ছুন্নত ওল-জমাতের ভাষ্য যে ভাবে বর্ণনা করিয়াছেন বাংলা ভাষায় তাহা পাঠ করিয়া অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে লিখকের শোকরিয়া আদায় করিতেছি। উর্দু আরবী সম্পর্কে অনবিজ্ঞ ভাইদের জন্য ইহা লেখকের একটি অমুল্য অবদান।হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞান-পিপাসুদের ইহা পাঠ করা বরং  সর্বদা ইহার এক কপি হাতের কাছে রাখা উচিত বলিয়া আমি মনে করি। মুদ্দাকথা, এই কিতাবখানা গ্রন্হকারের এমন একটি গৌরবময় অবদান যাহার জন্য পাক-ভারতবাসীরা বিশেষতঃ এতদঞ্চলের অধিবাসীগণ সঙ্গতভাবেই গৌরব বোধ করিতে পারে।

দোয়া করি, আল্লাহ ত’আলা এই কৃতী সন্তানকে সমন্ত রোগ ভোগ হইতে মুক্তি দিন এবং তাঁহাকে দীর্ঘয়ু করত সুদীর্ঘকাল পযর্ন্ত দেশ ও জাতির খেদমত করার সুযোগ দান করুন। তাঁহার এই মহান কীর্তির জন্য আল্লাহ ইহকাল ও পরকালে তাঁহার মুখ উজ্জল করুন।  আমীন! ছুম্মা আমীন!

আহকার-শফীকুল হক

২৮ রমজান, ১৩৮৬ হিঃ

মাদ্রাসায়ে আলীয়া জামেউল উলুম

পোঃ গাছবাড়ী, সিলেট

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস

প্রথম খণ্ড

প্রথম অধ্যায়

জ্ঞাতব্য বিষয়

ছুন্নাহ বা হাদীছঃ

রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার নবী জীবনে যাহা বলিয়াছেন, করিয়াছেন বা অন্যের কোন কথা বা কার্যের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করিয়াছেন তাহাকে ‘ছুন্নাহ’ [ফেকাহ শাস্ত্রে ছুন্নত বলিতে –ফরয ওয়াজেব ব্যতীত এবাদতরূপে যাহা করা হয় তাহাকে বুঝায়, যথা ছুন্নত নামাজ। অপর অর্থ হইলঃ দ্বীন বা শরীয়তের সুপ্রচলিত বা মনোনিত পন্থা।]  বলে। ইহার অপর নাম ‘হাদীছ’। হাদীছ ব্যাপক অর্থে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের কথা, কার্য ও সম্মতিকেও ‘আছার’ বলে।

ছুন্নাহ বা হাদীছের উৎসঃ

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (ছঃ) আল্লাহর নবী ও রছূল ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মানুষও ছিলেন; সুতরাং তাঁহার নবী জীবনের কার্যাবলীকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ (ক) যাহা তিনি নবী ও রছুল পদের দায়িত্ব সম্পাদন উপলক্ষে করিয়াছেন এবং (খ) যাহা তিনি অপর মানুষের ন্যায় মানুষ হিসাবে করিয়াছেন যথা- খাওয়া, পরা ইত্যাদি। প্রথম শ্রেণীর কার্যবলী সমস্তই খোদায়ী নিয়ন্ত্রণাধীনে সম্পাদিত হইয়াছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর কার্যাবলী অবশ্য এইরূপ নহে।

শাহ ওলীউল্রাহ দেহলবী (রঃ) বলেনঃ রছুলুল্লাহর হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারের।

প্রথম প্রকার- যাহাতে তাঁহার নবুওত ও রেছালতের হাদীছ (নবী ও রছূল পদের) দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়সমূহ রহিয়াছে। নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ ইহার অন্তর্গতঃ

(১) যাহাতে –পরকাল বা ঊর্ধ্ব জগতের কোন বিষয় রহিয়াছে। ইহার উৎস ওহী।

(২) যাহাতে –এবাদত ও বিভিন্ন স্তরের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম-শৃঙখলার বিষয় রহিয়াছে। ইহার কোনটির উৎস ওহী আর কোনটির উৎস স্বয়ং রছুলুল্লাহর ইজতেহাদ। কিন্তু রছুলুল্রাহর ইজতেহাদও  ওহীর সমপর্যায়। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তাহাকে শরীয়ত সম্পর্কে কোন ভুল সিদ্ধান্তের উপর অবস্থান করা হইতে রক্ষা করিয়াছেন।

(৩) যাহাতে –এমন সকল জনকল্যাণকর বাণী ও নীতি-কথাসমূহ রহিয়াছে, যে সকলের জন্য কোন সীমা বা সময় নির্ধারিত করা হয় নাই। (অর্থাৎ, যাহা সার্বজনীন ও সর্বকালীন) যথা- আখলাক বা চরিত্র বিষয়ক কথা। ইহার উৎস সাধারণতঃ তাঁহার ইজতেহাদ।

(৪) যাহাতে –কোন আমল বা কার্য অথবা কার্যকারকের ফজীলত বা মর্যাদার কথা রহিয়াছে। ইহার কোনটির উৎস ওহী আর কোনটির উৎস তাঁহার ইজতেহাদ।

দ্বিতীয় প্রকার –যাহাতে –তাঁহার নবুওত ও রেছালাতের দায়িত্ব অন্তর্গত নহে, এরূপ বিষয়াবলী রহিয়াছে। নিম্নলিখিত বিষয়াবলী ইহার অন্তর্গতঃ

(১) যাহাতে –চাষাবাদ জাতীয় কোন কথা রহিয়াছে। যথা –তা’বীরে নখলের কথা। [মদীনার লোকেরা অধিক ফলনের জন্য নর খেজুর গাছের শীষ লইয়অ যাদা খেজুর গাছের সহিত লাগাইয়া দিন। একদা রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিলেনঃ ‘তোমরা ইহা না করিলেও পার’। ইহাতে ছাহাবীগণ এইরূপ করা বন্ধ করিয়া দিলেন। ফলে সে বৎসর ফলন কম হইল। ইহা দেখিয়া হুজুর বলিলেনঃ ‘আমি ধারণা করিয়াছিলাম যে, এইরূপ না করিলেও চলে। এইরূপ ধারণাপ্রসূত কথায় তোমরা আমায় দোষারোপ করিও না। ( কেননা, আমি আল্লাহর প্রতি কখনও অসত্য আরোপ করি না।]

(২) যাহাতে –চিকিৎসা বিষয়ক কোন কথা রহিয়াছে।

(৩) যাহাতে –কোন বস্তু বা জন্তুর গুণাগুণের কথা রহিয়াছে। (যথা –‘ঘোড়া কিনিতে গাড় করাল রং ও সাদা কপাল দেখিয়া কিনিবে’।_

(৪) যাহাতে –এমন সকল কাজের কথা রহিয়াছে, যে সকল কাজ তিনি এবাদতরূপে নহে, বরং অভ্যাসবশতঃ অথবা সংকল্প ব্যতিরেকে ঘটনাক্রমে করিয়াছেন।

(৫) যাহাতে –আরবদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীসমূহের মধ্যে তাঁহার কোন কাহিনী বর্ণনার কথা রহিয়অছে। যথা –উম্মেজারা ও খোরাফার কাহিনী।

(৬) যাহাতে –সার্বজনীন, সর্বকালীন নহে বরং সমকালীন কোন বিশেষ মোছলেহাতের কথা রহিয়াছে। যথা –সৈন্য পরিচালন কৌশল।

(৭) যাহাতে –তাঁহার কোন বিশেষ ফয়ছালা বা বিচার-সিদ্ধান্তের কথা রহিয়াছে।

এ সকলের মধ্যে কোনটির উৎস তাঁহার অভিজ্ঞতা, কোনটির উৎস ধারণা, কোনটির উৎস আদত-অভ্যাস, কোনাটির উৎস দেশ-প্রথা আর কোনটির উৎস সাক্ষ্য প্রমাণ। (যথা –বিচার-সিদ্ধান্ত।)

প্রথম প্রকার ছুন্নাহর অনুসরণ করিতে আমরা বাধ্য (ইহার বিস্তারিত বিবরণ দ্বিথীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এবং দ্বিতীয় প্রকার ছুন্নার মধ্যে যাহা তাঁহার ইচ্ছাকৃত অভ্যাসপ্রসূত বা যাহাকে তিনি পছন্দ করিতেন তাহাও আমাদের অনুকরণীয়।

ওহীর শ্রেণী ও হাদীছঃ

আল্লাহ তা’ আলা তাঁহার রছূলের প্রতি যে সকল ওহী নাজিল করিয়াছেন তাহা দুই শ্রেণীর প্রথম শ্রেণীর ওহীঃ যাহা – যে যে শব্দ বা বাক্যের সহিত নাজিল করা হইয়াছে তাহা হুবহু বহাল রাখাতে রছূলুল্লাহু আলাইহ ওয়াছাল্লাম বাধ্য ছিলেন। কোনআন পাক এই শ্রেণীর ওহী। ইহাকে ‘ওহীয়ে মাতলূ বলে। নামাজে কেবল ইহারই তেলাওত (আবৃত্তি) করা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ওহীর শব্দ বা বাক্য অবিকল বজায় রাখাতে রছূলুল্লাহ (ছ) বাধ্য ছিলেন না। ওহী দ্বারা প্রাপ্ত মূল ভাবটিকে তাঁহার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করার অধিকার তাঁহাকে দেওয় হইয়ছিল। ইহাকে ‘ওহীয়ে গায়র মাতল বলে। ইহা নামাজে পড়া যায় না। যে যে হাদীছ ওহী- প্রসূত তাহা এই দ্বিতীয় শ্রেণীরই ওহী-প্রসূত। হাদীছকে যে ‘ওহীয়েয গায়ের মাতলূ’ বলা হয়, ইহই তাহার অর্থ।

হাদীছ শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা

ছাহবী-যে ব্যাক্তি ঈমানের সহিত-

(ক) রছূলল্লাহ (ছঃ)-এর সাহচর্য লাভ করিয়াছেন বা

(খ) তাঁহাকে দেখিয়াছেন ও তাঁহার একটি হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন অথবা

(গ) একবার তাঁহাকে দেখিয়াছে- এবং ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, তাঁহাকে ‘ছাহাবী’ বলে।

তাবেয়ী- যিনি কোন ছাহাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন অথবা অন্ততঃপক্ষে তাঁহাকে দেখিয়াছেন, তাঁহাকে ‘তাবেয়ী’ বলে।

তাবে’ তাবেয়ী- যিনি কোন তাবেয়ীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন অথবা তাঁহাকে দেখিয়াছেন, তাঁহাকে ‘তাবে’-তাবেয়ী’ বলে।

রেওয়ায়ত- হাদীছ বা আছার বর্ণনা করাকে ‘রেওয়ায়ত’ বলে এবং যিনি বর্ণনা করেন তাঁহাকে ‘রাবী’ বলে।

কোন কোন সময় ‘হাদীছ’ বা ‘আছার’কেও রেওয়ায়ত বলে। যেমন বলা হয়ঃ এ সম্পর্কে একটি রেওয়ায়ত আছে।

ছনদ – হাদীছের রাবী পরম্পরাকে ‘ছনদ’ বলে। কোন হাদীছের  ছনদ বর্ণনা করাকে ‘ইছনাদ’ বলে। কখনো কখনো ‘ইছনাদ’ ‘ছনদের’ অর্থও ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

রেজাল- হাদীছের ‘রাবী; সমষ্টকে ‘রেজাল বলে। আর যে শাস্ত্রে রাবীদের জীবনী বর্ণনা করা হইয়াছে তাহাকে ‘এলমে আছমাউর রেজাল’ বলে।

মতন- ছনদ বর্ণনা করার পর যে মূল হাদীছটি বর্ণনা করা হয় তাহাকে ‘মতন’ বলে।

আদালত- যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে ‘তাকওয়া’ ও ‘মরুওত’ অবলম্বন করিতে (এবং মিথ্যা আচরণ হইতে বিরত থাকেতে)  উদ্বুদ্ধ করে, তাহাকে ‘আদালত’ বলে। ‘তাকওয়া’ অর্থে এখানে শিরক, বেদআত ও ফেছক প্রভৃতি কবীরাহ গুনাহ এবং পুনঃ পুনঃ ছগীরা গোনাহ করা হইতে বাঁচিয়া থাকাকে বুঝায়। ‘মরুওত’ অর্থে অশোভন বা অভদ্রোচিত কার্য হইতে দূরে থাকাকে বুঝায়,

যদিও ‘মোবাহ’ হয়। যথা-হাটে- বাজারে প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে প্রসাব করা ইত্যাদি। এরূপ কার্য করেন এমন ব্যক্তির বর্ণিত হাদীছ ছহীহ নহে।

আদল বা আদেল- যে ব্যক্তি ‘আদালত’ গুণসম্পন্ন তাঁহাকে ‘আদল’ বা ‘আদেল’ বলে। [অর্থাৎ, যিনি (১) রছুলুল্লাহর হাদীছ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা কথা বলেন নাই, (২) বা সাধারণ কাজ-কারবারে কখনো মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হন নাই, (৩) অজাতনামা অপরিচিত অর্থাৎ, দোষ-গুণ বিচারের জন্য যাহার জীবনী জানা যায় নাই এরূপ লোকও নহেন, (৪) বে-আমল ফাছেকও নহেন, (৫) অথবা বদ-এ’তেকাদ বেদআতীও নহেন, তাঁহাকে ‘আদল’ বলে।]

জবত- যে শক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্মৃতি বা বিনাশ হইতে রক্ষা করিতে পারে এবং যখন ইচ্ছা তখন উহাকে সঠিকভাবে স্মরণ করিতে পারে তাহাকে ‘জবত’ বলে।

জাবেত- ‘জাবেত’ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘জাবেত’ বলে।

ছেকাহ- যে ব্যক্তির মধ্যে ‘আদালত’ ও ‘জবত’ উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাঁহাকে ‘ছেকাহ’ ‘ছাবেত’ বা ‘ছাবাত’ বলে।

শায়খ- হাদীছ শিক্ষাদাতা রাবীকে তাঁহার শাগরেদের তুলনায় ‘শায়খ’ বলা হইয়া থাকে।

মোহাদ্দেছ- যে ব্যক্তি হাদীছ চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যাক হাদীছের ছনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁহাকে ‘মোহাদ্দেছ’ বলে।

হাফেজ, হুজ্জাত ও হাকেম- (ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগের পর) যিনি ছনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লক্ষ হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হাফেজ’ (হাফেজে হাদীছ) বলে। এইরূপে যিনি তিন লক্ষ হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হুজ্জাত’ আর যিনি সমস্ত হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হাকেম’ বলে।

এযাবৎ দুনিয়ায় কত ‘হাফেজে হাদীছ’ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। হাফেজ জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) তাঁহার ‘তাজকেরাতুল হোফফাজ’ নামক কিতাবে ১১ শতকেরও অধিক হফেজের জীবনী লিখিয়াছেন। ‘হুজ্জাত’গণের সংখ্যাও অনেক। তাঁহার বহু হুজ্জাতের জীবনী রহিয়াছেন। ‘হাকেম’দের সংখ্যাও কম নহে। হাদীছের হেফাজতের জন্য এসকল লোকের সৃষ্টি মুসলিম জাতির প্রতি সত্যই আল্লাহর এক বিরাট দান বলিতে হইবে।

শায়খাইন_ইমাম বোখারী ও মোছলেমকে এক সঙ্গে ‘শায়খাইন’ বলে। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে ‘শায়খাইন’ বলিতে ইমাম আবু হানীফা এ ইমাম আবু ইউছুফকে বুঝায়।

ছেহাহ ছেত্তা¬¬¬_বোখারী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ,তিরমিজী শরীফ, নাছায়ী শরীফ ও ইবনে মাজাহ-হাদীছের এই ছয়খানি কিতাবকে এক সঙ্গে ‘ছেহাহ ছেত্ত’ বলে, ইহাই প্রসিদ্ধ। কিন্তু বিশিষ্ট আলেমগণ ‘ইবনে মাজাহ’-এর স্থলে ‘মোআত্ত ইমাম মালেক আবার কেহ কেন ‘ছনানে দারেমী’কেই ‘ছেহাহ ‘ছেত্তার’ অপর চারি কিতাব (আবু দাউদ, তিরমিজী, নাছায়ী ও ইবনে মাজাহ)- কে এক সঙ্গে ‘ছুনানে আরবাআ বলে।

মোত্তফাক আলাইহে_ যে হাদীছকে একই ছাহাবী হইতে ইমাম বোখারী ও মোছলেম ইভয়ে গ্রহণ করিয়ছেন তাহাকে হাদীছে ‘মোত্তফাক আলাইহে’ (বা ঐক্যসম্মত হাদীছ) বলে।

হাদীছ শ্রেণীবিভাগ

হাদীছসমূহকে বাছাই করিতে যাইয়া আমাদের মোহদ্দেছগণ উহাদিগকে নিম্নলিলিত শ্রণী- সমূহে ভাগ করিয়াছেনঃ

হাদীছ প্রথমতঃ তিন প্রকারেরঃ কাওলী, ফে‘লী ও তাকরিরী। কথা জাতীয় হাদীছকে কাওলী কার্য বিবরণ সম্বলিত হাদীছকে ফে’লী এবং সম্মতিসূচক হাদীছকে তাকরিরী হাদীছ বলে। তিন প্রকারের হাদীছেরই নিম্নরূপ শ্রেণীবিভাগ রহিয়াছেঃ

                       (ক)

মারফু- যে হাদীছের ছনাদ রছূলুল্লাহ (ছঃ) পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহয স্বয়ং রছূলুল্লাহর হাদীছ বলিয়াই সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মারফু বলে।

মাওকূফ_ যে হাদীছের ছনদ কোন ছাহাবী পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহা স্বয়ং ছাহাবীর হাদীছ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মাওকুফ’ বলে। ইহার অপর নাম ‘আছার’।

মাকতু- যে হাদীছের ছনদ কোন তাবেয়ী পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহা স্বয়ং তাবেয়ীর হাদীছ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মাকতু’ বলে।

[ অনেকে ‘মাওকূফ’ ও মাকতূ ‘কে ‘হাদীছ’ না বলিয়া ‘আছার’ই বলিয়া থাকেন। আবার কখনো কখনো ‘আছার’ অর্থে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছকেও বুঝায়।– মোকাদ্দমায়ে ইবনুছছালাহ।]

                                                           (খ)

মোত্তছিল- যে হাদীছের ছনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবী বাদ পড়েন নাই অর্থৎ, সকল স্তরের সকল রাবীর নামই যথাস্থানে উল্লেখ রহিয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মোত্তছিল’ বলে। আর এ বাদ না পড়াকে বলা হয় ইত্তেছাল।

মোনকাতে- যে হাদীছের ছনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়িয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মোনকাতে’ বলে। আর এ বাদ পড়লে বলা হয় ‘এনকেতা’। এ হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারঃ ‘মোরছাল’ ও মোআল্লাক’।

মোরছাল- যে হাদীছের ছনদেরে ‘এনকেতা’ শেষের দিকে হইয়াছে অর্থাৎ ছাহাবীর নামই বাদ পড়িয়াছে এবং স্বয়ং তাবেয়ী রছূলুল্লাহ (ছঃ)- এর নাম করিয়া হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন তাহাকে ‘হাদীছে মোরছাল’ বলে। ইমামগণের মধ্যে কেবল ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকই (রঃ) ইহাকে বিনা শর্তে গ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের মতে তাবেয়ী শুধু তখনই ছাহাবার নাম বাদ দিয়া সরাসরি রছূলুল্লাহর নামে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যখন ইহা তাহার নিকট নিঃসন্দেহে রছূলুল্লাহর হাদীছ বলিয়য় সাব্যস্ত হইয়াছে।

মোআল্লাক- যে হাদীছের ছনদ ‘এনকেতা’ প্রথম দিকে হইয়াছে অর্থাৎ, ছাহাবীর পর এক বা একাধিক নাম বাদ পড়িয়াছে তাহাকে ‘মোআল্লাকে’ বলে। ইহা গ্রহণযোগ্য নহে।

[‘মোরছাল’ ও ‘মোআল্লাক’ মোনকাতে ‘রই যে দুইটি রকম বিশেষ তাহা পূর্বই বলা হইয়াছে। ইহা ছাড়াও ‘মোনকতে ‘র বহু রকম রহিয়াছে। সগুলির বর্ণনা এখনে সম্ভবপর নহেঅ}

কোন কোন গ্রন্হকার কোন কোন হাদীছের পূর্ণ ছনদকে বাদ দিয়া কেবল মূল হাদীছকেই বর্ণনা করিয়াছেন। এরূপ করাকে ‘তা লীক’ বলে। কখনো কখনো তা’ লীকরূপে বর্ণিত হাদীছকেও  ‘তা’লীক বলে। ইমাম বোখারীর (রঃ) কিতাবে এরূপ বহু ‘তা’লীক রহিয়াছে। কিন্তু অসুন্ধানে দেখা গিয়াছে যে, বোখারীর সমস্ত তা’ লীকেরই মোত্তাছিল ছনদ রহিয়াছে। অপর সংকলনকারীগণ এই সমস্ত তা’ লীক মোত্তাছিল ছনদ সহকারে বর্ণনা করিয়াছেন।

মোদাল্লাছ- যে হাদীছের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের (উস্তাদের) নাম না করিয়া তাঁহার উপরস্থ শায়খর নাম এভাবে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যাহাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উহা উপরস্ত শায়খের নিকট শুনিয়াছেন অথচ তিনি নিজে উহা তাঁহার নিকট শুনেন নাই (বরং তাঁহার প্রকৃত ওস্তাদই উহা তাঁহার নিকট শুনিয়াছেন)- সে হাদীছকে ‘হাদীছ মোদাল্লাছ’ বলে। মোদাল্লেছের হাদীছ গ্রহণযোগ্য নহে- যে পযর্ন্ত না একথা নিশ্চতরূপে জানা যায় যে, তিনি একমাত্র ছেকাহ রাবী হইতে তাদলীছ করেন অথবা তিনি উহা আপন শায়েখের নিকট শনিয়াছেন বলিয়া পরিস্কারভাবে বলিয়া দেন।

মোজতারাব-যে হাদীছের রাবী হাদীছের মতন বা ছনদকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকারে গোলমাল করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন – সে হাদীছকে ‘হাদীছ মোজতারাব’ বলে।

যে পযর্ন্ত না ইহার কোনরূপ সমম্বয় সাধান সম্ভবপর হয়, সে পযর্ন্ত ইহা সম্পর্কে তাওয়াককুফ (অপেক্ষা) করিতে হইবে। (অর্থাৎ, ইহাকে প্রমাণে ব্যবহার করা চলিবে না।)

মোদরাজ- যে হাদীছের মধ্যে রাবী তাঁহার নিজের অথবা অপর কাহারো উক্তি প্রক্ষেপ করিয়াছেন-সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোদরাজ’ (প্রক্ষিপ্ত) বলে এবং এইরূপে করাকে ‘ইদরাজ বলে। ইদরাজ হারাম- অবশ্য যদি উহা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশার্থে হয় এবং মোদরাজ বলিয়া সহজে বঝা যায়, তাব দূষণীয় নহে।

                                                                (গ)

মোছনাদ_ যে মারফূ’ হাদীছের, কাহারো মতে- যে কোন রকমের হাদীছের ছনদ সম্পূর্ণ মোত্তাছিল- সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোছনাদ বলে। (ইহার অপর অর্থ অপর স্থানে বলা হইবে।)

                                                                (ঘ)

মাহফুজ ও শাজ- কোন ছেকাহ রাবীর হাদীছ অপর কোন ছেকাহ রাবী বা রাবীগণের হাদীছ এর বিরোধী হইলে, যে হাদীছের রাবীর ‘জবত’ গুণ অধিক বা অপর কোন সূত্র দ্বারা যাহার হাদীছের সমর্থন পাওয়া যায় অথবা যাহার হাদীছের শ্রেষ্ঠত্ব অপর কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তাঁহার হাদীছটিকে ‘হাদীছে মাহফুজ’ এবং অপর রাবীর হাদীছটিকে ‘হাদীছ শাজ’ বলে এবং এইরূপ হওয়াকে ‘শজুজ” বলে। হাদীছের পক্ষে শজুজ একটি মারাত্মক দোষ। শাজ হাদীছ ‘ছহীহ রূপে গণ্য নহে।

মা ‘রূফ ও মোনকার- কোন জঈফ রাবীর হাদীছ অপর কোন জঈফ রাবীর হাদীছের বিরোধী হইলে অপেক্ষাকৃত কম জঈফ রাবীর হাদীসটিকে ‘হাদীছে মা ‘রূফ’ এবং অপর রাবীর হাদীছটিকে ‘হাদীছে মোনকার’ বলে এবং এইরূপ হওয়াকে ‘নাকারাৎ’ বলে। নারাকাৎ হাদীছের পক্ষে একটা বড় দোষ।

মোআল্লাল-যে হাদীছের ছনদ এমন কোন সূক্ষ্ম ক্রটি রহিয়াছে যাহাকে কোন বড় হাদীছ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত ধরিতে পারেন না, সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোআল্লাল হাদীছ ‘ছহীহ’ হইতে পারে না।

                                                              (ঙ)

মোতাবে’ও শাহেদ- এক রাবীর হাদীছের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীছ পাওয়া যায়, তাহা হইলে এই দ্বিতীয় রাবীর হাদীছটিকে প্রথম রাবীর হাদীছটির মোতাবে’ বলে- যদি উভয় হাদীছের মূল রাবী (অর্থাৎ, ছাহাবী) একই ব্যক্তি হন। আর এইরূপ হওয়াকে ‘মোতাবা’ আত’ বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হয়, তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীছটিকে প্রথম ব্যক্তির হাদীছের ‘শাহেদ’ বলে। আর এইরূ হওয়াকে ‘শাহাদাত’ বলে। মোতাবা’আত ও শাহাদত দ্বারা প্রথম হাদীছটির শক্তি বা প্রামণ্যতা বৃদ্ধি পায়।

                                                               (চ)

ছহীহ- যে মোত্তছিল হাদীছের ছনদের প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ ‘আদালত’ ও ‘জবত’ গুণসম্পন্ন এবং হাদীছটি ‘শজুজ’ ও ‘ইল্লত’ দোষমুক্ত- সে হাদীছকে ‘হাদীছে ছহীহ বলে।

[অর্থাৎ, যে হাদীছটি ‘মোনকাতে’ নহে; ‘মো’দাল’ নহে, ‘মোআল্লাক’ নহে, মোদাল্লাছ’ নহে, কাহারো কাহারো মতে ‘মোরছাল’ও নহে; ‘মোবহাম’ অথবা প্রসিদ্ধ জঈফ রাবীর হাদীছ নহে; স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার দবুন অনেক ভুল করেন এমন ‘মোগাফফাল’ রাবীর হাদীছ নহে এবং হাদীছটি ‘শাজ’ ও ‘মোআল্লাল’ও নহে- একমাত্র সে হাদীছকেই ‘হাদীছে ছহীহ’ বলে।]

হাছান-যে হাদীছের রাবীর ‘জবত’ গুণে পরিপুর্ণতার অভাব রহিয়াছে- সে হাদীছকে ‘হাদীছে হাছান বলে।

[ফকীহগণ সাধারণতঃ এই দুই প্রকার হাদীছ হইতেই আইন প্রণয়নে সাহয্য গ্রহণ করেন।]

জঈফ-যে হাদীছের কোন রাবী হাছান হাদীছের রাবীর গুণ সম্পন্নও নহেন- সে হাদীছকে ‘হাদীছে জঈফ’ বলে। [রাবীর জো’ফ বা দুর্বলতার কারণেই হাদীছটিকে জঈফ বলা হয়, অন্যথায় (নাউজুবিল্লাহ) রছুলের কোন কথাই জঈফ নহে। জঈফ হাদীছের জো’ফ কম ও বেশী হইতে পারে। খব কম হইলে উহা হাছানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশি হইতে হইতে উহা একেবারে ‘মাওজুতেও পরিণত হইতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদীছ আমলের ফজীলত বা আইনের উপকারিতা বর্ণনায় করা যাইতে পারে, আইন প্রণয়ন নহে।]

                                                             (ছ)

মাওজু’- যে হাদীছের রাবী জীবনে কখনো রছূলুল্লাহর নামে ইচ্ছা করিয় কোন মিথ্যা কথা রচনা করিয়াছে বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে –তাহার হাদীছকে ‘হাদীছে মাওজু’ বলে।

এইরূপ ব্যক্তির কোন হাদীছই কখনো গ্রহণযোগ্য নহে, যদিও সে অতঃপর খালেছ তওবা করে।

মাতরূক –যে হাদীছের রাবী হাদীছের ব্যাপারে নহে; বরং সাধারণ কাজ-কারবারে কখনও মিথ্যা কথা বলিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে –তাঁহার হাদীছকে ‘হাদীছে মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত হাদীছ বলে।

এইরূপ ব্যক্তিরও সমস্ত হাদীছ পরিত্যাজা। অবশ্য সে যদি পরে খালেছ তওবা করে এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য অবলম্বন লক্ষণ তাহার কাজ-কারবারে প্রকাশ পায় তা হইলে তাহার পরবর্তীকালের হাদীছ গ্রহণ করা যাইতে পারে।

মোবহাম –যে হাদীছের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায় নাই –যাহাতে তাহার দোষ গুণ বিচার করা যাইতে পারে –তাহার হাদীছকে ‘হাদীছে মোবহাম’ বলে। এইরূপ ব্যক্তি ছাহাবী না হইলে তাহার হাদীছ গ্রহণ করা যায় না।

                                                            (জ)

গরীব –যে ছহীহ হাদীছকে কোন যুগে মাত্র একজন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে গরীব’ বলে।

আজীজ –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগেই অন্ততঃ দুই জন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে আজীজ’ বলে।

মাশহুর –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগে তিন জন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে মাশহুর’ বলে। ফকীহগণ ইহাকে ‘মোস্তাফীজ’ বলেন।

গরীব, আজীজ ও মাশহুর –তিনো রকমের হাদীছকে এক সঙ্গে ‘খবরে আহাদ’ এবং প্রত্যেকটিকে পৃথকভাবে ‘খবরে ওয়াহেদ’ বলে।

খবরে ওয়াহেদ দ্বারা বিশ্বাস (একীন) লাভ হয় কি না তাহার বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পরিচ্ছেদে করা হইয়াছে।

মোতাওয়াতের –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগে এত অধিক লোক রেওয়ায়ত করিয়াছেন যত লোকের পক্ষে একত্রে মিথ্যা বলা সাধারণতঃ অসম্ভব বিবেচিত হয়, সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোতাওয়াতের’ বলে, এরূপ হওয়াকে ‘তাওয়াতোর’ বলে। মোতাওয়াতের হাদীছ দ্বারা এলমে একীন অর্থাৎ, এমন নিশ্চিত জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হয়, যাহা সমস্ত শোবাহ-সন্দেহের ঊর্ধ্বে।

হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারে মোতাওয়অতের হইতে পারেঃ (ক) ‘মোতাওয়াতেরে লফজী’ বা শব্দগত মোতাওয়াতের –যাহার লফজ বা শব্দ একই রূপে সকল যুগে বহু লোক বর্ণনা করিয়াছেন। উপরে দেওয়া সংজ্ঞাটি ইহারই। (খ) ‘মোতাওয়াতেরে মা’নভী’ বা ভাবগত মোতাওয়াতের –যাহার শব্দ ও আনুষঙ্গিক ব্যাপার বিভিন্ন হইলেও মূল ‘মানে’ বা অর্থটি সকল যুগেই বহু লোক বর্ণনা করিয়াছেন। যথা –‘দোআ করিতে হাত উঠান। রছূলে করীম (ছঃ)  কোন কোন দোআ’য় কি কি রূপে হাত উঠাইয়াছেন উহার বর্ণনা একরূপ না হইলেও তিনি যে, দোআ করিতে হাত উঠাইয়াছেন এই মূল অর্থটি সকলেই বর্ণনা করিয়াছেন।

এই ছাড়া আমল বা কার্য দ্বারাও একটি হাদীছ ‘মোতাওয়াতের’ হইতে পারে। যে হাদীছকে প্রত্যেক যুগেই বহু লোক কার্যকরী করিয়া আসিয়াছে –সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোতাওয়াতেরে আমলী’ বলা যাইতে পারে। এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে আহকামের সমস্ত হাদীছই মোতাওয়াতের।

কেননা, এ সকল হাদীছকে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগ হইতে এ যুগ পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানই কার্যকরী করিয়া আসিতেছে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হাদীছের রাবীর এ সংখ্যাগত প্রশ্নটি শুধু ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগেরই বিচার্য বিষয়। অতঃপর হাদীছসমূহ কিতাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার দরুন সমস্ত হাদীছই মোতাওয়াতের হইয়া গিয়াছে।

এলমে উছুলে হাদীছের বিষয়াবলী হইল অত্যস্ত জটিল, অথচ বাংলা ভাষায় ইহার আলোচনা ইতঃপূর্বে তেমন একটা হয় নাই। অতএব, এখানে সরল ভাষায় অত্যাবশ্যক বিষয়াবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল। বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য বিজ্ঞ আলেমদের নিকট দরয়াপ্ত করা আবশ্যক।

খবরে ওয়াহেদ দ্বারা জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হয় কি না?

‘মোতাওয়াতের’ হাদীছ দ্বারা যে একীন বা সন্দেহাতীত বিশ্বাস লাভ হইয়া থাকে তাহা বলার প্রয়োজন নাই। এখন দেকা যাক যে, ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাস লাভ হয় কি না?

কোনো ঘনটা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ বা উহাতে বিশ্বাস স্থাপন করার সাধারণ সূত্র হইল মাত্র দুইট, স্বয়ং ঘটনা প্রত্যক্ষ করা অথবা অন্যের নিকট উহার বিবরণ শুনা। হাদীছে রছূল সম্পর্কে ছাহাবীগণের জ্ঞান হইল প্রথম পর্যায়ের এবং আমাদের জ্ঞান দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ শুনা। আর শুনা কথায় বিশ্বাস স্থাপনের একমাত্র উপায় হইল যাহার মারফত কথাটি শুনা গিয়াছে তাহার বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হওয়া। সে বিশ্বস্ত হইলে কথায়ও বিশ্বাস জন্মে আর সে বিশ্বস্ত না হইলে কথায়ও বিশ্বাস জন্মে না। আমাদের দৈনন্দিন কাজ কারকারে আমরা ইহাই লক্ষ্য করিয়া থাকি। বিশ্বস্ত একজন ভৃত্যের কথায়ও সাধারণতঃ আমাদের বিশ্বাস জন্মে এবং সংশয় থাকে না। গুরুত্বপূর্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথায় আমরা সন্দেহ করি না। অন্যথায় আমাদের বহু কাজ-কারবার অচল হইয়া পড়িবে। ইতিহাসে আস্থা স্থাপন চলিবে না, সরকারি বার্তায় বিশ্বাস করা যাইবে না, অথচ এগুলি আমরা বিশ্বাস করিয়া থাকি।

এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিাচর করিলে ‘খবরে ওয়াহেদ’ (অর্থাৎ এক, দুই বা তিন জন প্রমুখাৎ বর্ণিত হাদীছ) দ্বারা  যে সংবিদিত বিষয়ে পূর্ণ বিশ্বাস লাভ হয় ইহা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। কারণ, হাদীছের বর্ণনাকারীগণের বিশ্বস্ততা এমন অগ্নি-পরীক্ষার ভিতর দিয়অ প্রমাণিত হইয়াছে, যাহার নজীর দুনিয়ায় কোন ব্যাপারেই মিলে না। তবে যে, সাধারণভাবে বলা হইয়া থাকে ‘খবরে ওয়াহিদ’ জ্বন্নী, (উহা দ্বারা জ্বন লাভ হ্য়,) ইহার অর্থ অবহিত হওয়ার পূর্বে ইহা অবহিত হওয়া আবশ্যক যে, কোনো সংবাদ সম্পর্কে সাধারণতঃ মানুষের মনে পাঁচটি অবস্থার সৃষ্টি হয়ঃ ১। শুনিবামাত্র উহাতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে –ইহাকে আরবীতে এলম বা একীন বলে। ২। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে না তবে বিশ্বাসের পাল্লা ভারী হইয়া থাকে। ইহাকে আরবীতে ‘জ্বন’ বা গালেবুররায় বলে। ৩। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস উভয়ের পাল্লা সমান থাকে। ইহাকে আরবীতে ‘শক’ বলে। ৪। বিশ্বাসের পাল্লা হালকা এবং অবিশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়। ইহাকে আরবীতে ওহম, বলে এবং ৫। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস। ইহাকে আরবীতে ‘কিজব’ বলে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আরবী ‘জ্বন’ শব্দটি যেমন দ্বিতীয় অবস্থার জন্য বলা হইয়া থাকে তেমন উহা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস ব্যতীত অপর সকল অবস্থার জন্যও বলা হইয়া থাকে। কোরআনে ইহার উদাহরণ রহিয়াছে। কোরআনের বিখ্যাত আভিধানিক ইমাম রাগেব ইস্পাহানী বলেনঃ ‘জ্বন’ সংবাদ সম্পর্কীয় সেই অবস্থারই নাম যাহা (বিশ্বাসের পক্ষে) ইঙ্গিত দ্বারা লাভ হইয়া থাকে। ইঙ্গিত যখন শক্তিশালি হয়, তখন উহা একীন বা দৃঢ় বিশআসে পরিণত হয়। আর ইঙ্গিত যখন দুর্বল হয়, তখন উহা ‘ওহমে’ পরিণত হয়। কোরআনের নিম্নলিখিত দুইট আয়াতে ইহা এলম বা পূর্ণ বিশ্বাসের অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছেঃ

(ক) (আরবী******************************) –যাহার ‘জ্বন’ (বিশ্বাস) করিয়া থাকে যে, তাহারা তাহাদের পরওয়ারদেগারের সহিত সাক্ষাৎ করিবে। ছূরা বাকারা-৪৬

(খ)  (আরবী******************************) –তাহার ‘জ্বন’ (বিশ্বাস) করে যে, তাহারা আল্লাহ পাকের সহিত মিলিত হইবে। এখানে ‘জ্বন’ এর অর্থ বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না। অপরপক্ষে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহে ‘জ্বন’ শব্দ শক বা ওহমের অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছেঃ

(ক) (আরবী******************************) –‘জ্বন’-এর অনুসরণ ব্যতীত এ ব্যাপারে তাহাদের কোনো এলমই নাই। -ছূরা নেছা-১৫৭

(খ) (আরবী******************************) –‘তোমরা আল্লা সম্পর্কে নানা রকমের ‘জ্বন’ (শোবাহ-সন্দেহ) করিতেছ’। -ছূরা আহজাব-১০

(গ) (আরবী******************************) –নিশ্চয় ‘জ্বন’ দ্বারা কোন সত্য লাব হয় না। -ছূরা নজম -২৮ (রাগিব)

মাওলানা শিব্বির আহমদ ওছমানী তাঁহার শরহে মোছলেমের ভূমিকায় বলেনঃ ‘খবরে ওয়াদেহ দ্বারা যে ‘জ্বন’ লাভ হইয়া থাকে তাহা একীন বা দৃঢ় বিশ্বাসের খুব কাছাকাছি সবল অবস্থারই নাম। মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার অধিকাংশ কার্য ইহার দ্বারাই সম্পাদিত হইয়া থাকে। কিন্তু ‘জ্বন’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে –বিশেষ করিয়া শক ও ওহমের অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার দরুন ইহাতে মহা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইয়াছে। সুতরাং এরূপ স্থলে ‘জ্বন’ শব্দ ব্যবহার করাই সঙ্গত নহে’। -শরহে মোছলেম, ৮

এ আলোচনার সার এ হইল যে, ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা ‘জ্বন’ লাভ হয়। ইহার অর্থ হইল একীনই লাভ হয়, ওহম বা শক নহে। তবে ‘মুতাওয়াতেরের’ ন্যায় একীন নহে –শুধু একথা বুঝাইবার জন্যই বলা হইয়া থাকেঃ ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা ‘জ্বন’ লাভ হইয়া থাকে।

বিশ্বস্ত হইলে একজনের কথাওয়ই যে একীন হাছিল হইতে পারে বা উহা গ্রহণ করা যাইতে পারে তাহার প্রমাণ কোরআন ও হাদীছেও রহিয়াছে। কোরআনে রহিয়াছে-

(আরবী******************************)

‘প্রত্যেক দল (ফিরকাহ) হইতে এক ‘তায়েফাহ’ (আরবী*******) যেন দ্বীনের জ্ঞান লাভ করার জন্য বাহির হইয়া যায়, অতঃপর দলে ফিরিয়া তাহাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে সতর্ক করে’। -ছূরা বারাআত-১২২। অথচ আরবীতে ‘তায়েফাহ’ একজনকেও বলে। একজনের কথা গ্রহণযোহ্য না হইলে এরূপ আদেশের কোন অর্থই হয় না।

কোরআনে আরো রহিয়াছে –

(আরবী******************************)

‘আল্লাহ তা’আলা আহলে কিতাব (ইহুদী-খৃষ্টান) আলেমগণের নিকট হইতে (তাহাদের নবীর মারফত) এ অঙ্গিকার গ্রহণ করিয়াছিলেন যে, তোমরা লোকদের নিকট উহা (কিতাব) খুলিয়া বলিবে এবং উহা গোপন করিবে না’। -ছূরা আলে ইমরান-১৮৭

এখানে আল্লাহর কিতাব বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করার আদেশ প্রত্যেক আলেমের প্রতি স্বতস্ত্রভাবেই প্রবর্তিত হইয়াছিল। কেননা, প্রত্যেক লোকের নিকট কিতাব বর্ণনার জন্য সকল আলেমের একত্র সমাবেশ সম্ভবপর নহে।

এইরূপে রছূলুল্লাহ (ছ)-ও শরীয়াতের আহকাম প্রচার এবং দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে অনেক সময় অনেক স্থলে মাত্র একজন বা দুই জন ছাহাবীকেই পাঠাইয়াছেন। একা হজরত মোআজ ইবনে জাবালকেই প্রচারক ও শাসকরূপে ইয়ামানে পাঠাইয়াছিলেন। বাদশাহদের নিকট দাওয়াতে ইসলামের চিঠি দিয়াও এক এক জন বাহককেই পাঠাইয়াছিলেন। বহু ব্যক্তি ব্যতীত এক, দুই বা তিন ব্যক্তির কথা ‘মো’তাবার’ বা বিশ্বাসযেগ্য না হইলে এরূপ একা পাঠানো কোন অর্থই থাকে না।

মশহুর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, হজরত আনাছ (রাঃ) একদা হজরত আবু তালহা, হজরত আবু উবাইদা ও হজরত ইবনে কা’বকে শরাব পান করাইতে ছিলেন, এমন সময় রছূলূল্লাহর পক্ষ হইতে এক ঘোষনাকারী আসিয়া ঘোষণা করিলেনঃ ‘শরাব হারাম হইয়া গিয়াছে, শরাব হারাম হইয়া গিয়াছে’। ইহা শুনিবা মাত্রই হজরত আবু তালহা বলিলেনঃ উঠ আনাছ, শরাবের মটকা ভাঙ্গ।

এইরূপে একদিন কুবাবাসীরা কুবার মসজিদে বায়তুল মাকদেছের দিকে ফিরিয়া নামাজ পড়িতেছিলেন, এ সময় এক ব্যক্তি আসিয়া বলিলঃ ‘কেবলা পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে, মক্কার কা’বাই আমাদের কেবলা নির্ধারিত হইয়াছে’। ইহা শুনিয়অ মুছল্লীগণ নামাজের মধ্যেই কা’বার দিকে ফিরিয়া গেলেন। এই সকল ঘটনা রছুলুল্লাহর জীবনেই সংঘটিত হইয়াছে; আর তিনি একথা বলেন নাই যে, তোমরা একজনের কথায় বিশ্বাস করিয়া কেন এইরূপ কাজ করিলে? অথচ ইহা শরীয়তের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

এতদ্ব্যতীত খোলাফায়ে রাশেদীন এক বা দুই জন ছাহাবী প্রমুখাৎ রছূলুল্লাহর হাধীছ অবগত হইয়া যে নিজদের বহু মত পরিবর্তন করিয়াছিলেন তাহার বহু উদাহরণ পাঠকগণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখিতে পাইবেন। এই আলোচনা হইতে ইহাই প্রমাণিত হইল যে, একজন বা দুই জন বিশ্বস্ত লোকের সংবাদেও জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হইয়া থাকে। সুতরাং তিন জনের সংবাদে অর্থাৎ, মাশহুর হাদীছ দ্বারা যে, নিশ্চিত বিশ্বাস বা একীন লাভ হয় তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতেছে না।

হাদীছের কিতাবের রকমবিভাগ

মোহাদ্দেছগণ হাদীছের কিতাব লিখিতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন এবং বিভিন্ন কিতাবকে বিভিন্নরূপে সাজাইয়াছেন। নীচে ইহার কতিপয় প্রসিদ্ধ রকমের নাম দেওয়া গেলঃ

জামে –[জামে শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যে কিতাবে বিভিন্ন মূল কিতাব হইতে ব্যাপকভাবে হাদীছ সংকলিত হইয়াছে তাহাকেও জামে বলা হইয়া থাকে।– : যে কিতাবে হাদীছসমূহকে বিষয় অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং যাহাতে ‘আকায়েদ, ছিয়ার, তফছীর, ফেতান, আদাব, আহকাম, রেকাক ও মানাকেব –এ আটটি প্রধান অধ্যায় রহিয়াছে তাহাকে ‘জামে’ বলে। যথা –‘জামেয়ে’ ছহীহ’ –ইমাম বোখারী, ‘জামেয়ে’ তিরমিজী’। তিরমিজীর কিতাবটি আসলে ‘জামে’ হইলেও উহা ‘ছুনান’ নামেই প্রসিদ্ধ। এ জাতীয় কিতাবে ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের হাদীছ রহিয়াছে।

হাদীছ রহিয়াছে।

ছুনান বা মোছান্নাফ –যে কিতাবে হাদীছসমূহকে বিষয় অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং যাহাতে তাহারাৎ, নামাজ, রোজা প্রভৃতি আহকামের হাদীছসমূহ সংগ্রহের প্রতিই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হইয়াছে, তাহাকে ‘ছুনান’ বা ‘মোছান্নাফ’ বলে। যথা –‘ছুনানে আবু দাঊদ’, ‘ছুনানে ইবনে মাজা’, ছুনানে দারেমী, ‘মোছান্নাফে ইবনে আমি শাইবা, ‘মোছান্নাফে আবদুর রাজ্জাক’ প্রভৃতি।

মোছনাদ –যে কিতাববে হাদীছসমূহকে ছাহাবীগণের নাম অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং এক এক ছাহাবী হইতে বর্ণিত হাদীছসমূহকে এক এক অধ্যায়ে স্থান দেওয়া হইয়াছে, তাহাকে ‘মোছনাদ’ বলে। যথা –‘মোছনাদে ইমাম আহমদ, ‘মোছনাদে তায়ালছী’, ‘মোছনাদে আবদ ইবনে হোমাইদ’ প্রভৃতি।

মো’জাম –যে কিতাবে হাদীছসমূহকে শায়খ অর্থাৎ, উস্তাদগণের নাম অনুসারে (তাঁতাদের মর্যাদা বা বর্ণনানুক্রমে) সাজানো হইয়াছে তাহাকে ‘মো’জাম’ বলে। যথা –‘মো’জামে ইবনে কানে’, ‘মো’জামে তবরানী’ (মো’জামে কবীর’, ‘মো’জামে ছগীর, মোজামে আওছাত) প্রভৃতি।

শেষোক্ত ‘মো’জাম’ তিনটি তবরানী কর্তৃক রচিত। ইহাতে তিনি হাদীছসমূহকে বর্ণনাক্রমে সাজাইয়াছেন। এ ‘মো’জাম’ নিয়মের প্রতিষ্ঠাতা হইতেছেন ইবনে কানে’ (রঃ) (মৃঃ ৩৫১ হিঃ)।

রেছালা –যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের হাদীছসমূহকে একত্র করা হইয়াছে তাহাকে ‘রেছালা’ বা ‘জুজ’ বলে। যথা –‘কিতাবুত তাওহীদ’ –ইবনে খোজাইমা; ইহাতে শুধু তাওহীদ সম্পর্কীয় হাদীছসমূহ একত্র করা হইয়াছে। ‘কিতাবুত তফছীর’ –ছাঈদ ইবনে জোবায়র; ইহাতে কেবল তফছীর সংক্রান্ত হাদীছসমূহ জমা করা হইয়াছে।

হাদীছের কিতাবের স্তরবিভাগ

হাদীছের কিতাবসমূহকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি স্তর বা তাবাকায় ভাগ করা যাইতে পারে। শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (রঃ) ও তাঁহার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’ নামক কিতাবে এরূপ পাঁচ স্তরে ভাগ করিয়াছেন।

প্রথম স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহে শুধুমাত্র ছহীহ হাদীছই রহিয়াছে। এ স্তরের কিতাব মাত্র তিনটিঃ মোআত্তা ইমাম মালেক, বোখারী শরীফ ও মোছলেম শরীফ। দুনিয়ায় এ কিতাব তিনটি র যত অধিক আলোচনা সমালোচনা হইয়াছে অপর কোন কিতাবের এরূপ হয় নাই। আলোচনায় ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছে যে, এ তিনটি কিতাবের সমস্ত হাদীছই নিশ্চিতরূপে ছহীহ। -হুজ্জাতুল্লাহ

[এ সকল কিতাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে করা হইবে]

দ্বিতীয় স্তরঃ এ  স্তরের কিতাবসমূহ প্রথম স্তরের খুব কাছাকাছি। এ স্তরের কিতাবে সাধারণতঃ ছহীহ ও হাছান হাদীছই রহিয়াছে। জঈফ হাদীছ ইহাতে খূব কমই আছে। নাছায়ী শরীফ, আবু দাঊদ শরীফ ও তিরমিজী শরীফ এ স্তরেরই কিতাব। ছুনানে দারেমী, ছুনানে ইবনে মাজাহ এবং শাহ ওলীউল্লাহ ছাহেবের মতে মোছনাদে ইমাম আহমদকেও এ স্তরে শামিল করা যাইতে পারে।

এ দুই স্তরের কিতাবের উপরই সকল মাজহাবের ফকীহগণ নির্ভর করিয়া থাকেন।

এ স্তরের কিতাবে ছহীহ, হাছান জঈফ, শাজ ও মোনকার-সকল রকমের হাদীছই রহিয়াছে। মোছনাদে আবু ইবনে রাজ্জাক, মোছাল্লাফে আবু বকর ইবনে  আবু শাইবা, মোছনাদে আবাদ ইবনে হোমাইদ, মোছনাদে তায়ালছী এবং বায়হাকী, তাহাবী ও তবরানীর  কিতাবসমূহ  এ স্তরেরই আন্তর্ভক্ত। বিশেষজ্ঞগণের  বাছাই ব্যতীত এ সকল কিতাবেরর হাদীছ গ্রহণ করা যাইতে পারে

চতুর্থ স্তরঃ

এ স্তরের কিতাবসমূহে সাধারণতঃ জঈফ ও গ্রহণের অযোগ্য হাদীছই রহিয়াছে। ইবনে হিব্বানের কিতাবুজ জুআফ, ইবনে আছীরের কামেল এবং খতীব বাগদাদী, আবু নোয়াইম, জাওজাকানী, ইবনে আছাকির, ইবনে নাজ্জার ও ফেরাদউছ দায়লামীর কিতাবসমূহ এ স্তরেরই কিতাব। মোছনাদে খাওয়ারেজমীও এ স্তরের যোগ্য।

পঞ্চম স্তরঃ উপরি-উক্ত স্তরে যে সকল কিতাবের স্থান নাই সে সকল কিতাবের নাম এখানে দেওয়া হয় নাই। উদাহরণস্বরূপ কেবল কতক কিতাবের নামই দেওয়া হইয়াছে।

                                        ছাহীহাইনের বাহিরেও ছহীহ হাদীছ রহিয়াছে

বোখারী ও মোছলেম শরীফ হাদীছের ছহীহ কিতাব। কিন্তু সম্যক ছহীহ হাদীছই যে বোখারী ও মোছলেমে রহিয়াছে তাহা নহে। ইমাম বোখারী (রঃ) বলিয়াছেনঃ

,আমি আমার এ কিতাবে ছহীহ ব্যতীত কোন হাদীছকে স্থান দেই নাই এবং বহু ছহীহ হাদীছকে আমি বাদও দিয়াছি।

এইরূপে ইমাম মোছলেম বলেনেঃ আমি একথা বলি না যে ইহার বাহিরে যে সকল হাদীছ রহিয়াছে সেগুলি সমস্তই জঈফ।

সুতরাং এই দুই কিতাবের বাহিরেও ছহীহ হাদীছ ও কিতাব রহিয়াছে। শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেছ দেহলবীর মতে ছেহাহ ছেত্তা’, ‘মোআত্তা ইমাম মালেক’ ও ছুনানে দারেমী’ (এ আটখানি) ব্যতীত নিম্নোক্ত কিতাবসমূহও ছহীহ (যদিও বোখারী ও মোছলেমের পর্যায়ে নহে)

১. ছহীহে খোজাইমা (আরবী)-আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক (মৃঃ ৩১১ হিঃ) ।

২। ছহীহে ইবনে হিব্বান (আরবী)-আবু হাতেম মোহাম্মদ ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হি) ।

৩। আল মোস্তাদরাক (আরবী)-হাকেম আবু আবদুল্লা নিশাপুরী (মৃঃ ৪০২ হিঃ) ।

[তিনি ইহা বোখারী ও মোছলেমের মান অনুসারে লিখিয়াছেন বলিয়া দাবী করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী মোহাক্কেক মোহাদ্দেছগণ তাঁহার এ দাবীকে সম্পূর্ণরূপে মানিয়া লইতে পারেন নাই; বরং কোন কোন হাদীছ  সম্পর্কে ইহারা বিরূপ সমলোচনা করিয়াছেন। সুতরাং ছহীহাইনের পর্যায়ে না হইলেও ইহা একটি ছহীহ কিতাব

৪। আল মুখতারাহ (আরবী) জিয়াউদ্দীন মাকদেছী (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ)

৫। ছহীহ আবু ‘ওয়ানাহ (আরবী) ইয়াকুব ইবনে ইছহাক (মৃঃ ৩১১ হিঃ)

৬। আল মোনতাকা (আরবী) ইবনুল জারুদ আবদুল্লাহ ইবনে আলী।

মোকাদ্দামায়ে শায়খ

এতহেদ্ব্যতীত মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ রাজা সিন্ধী (মৃঃ ২৮৬ হিঃ) এবং ইবনে হামজা জাহেরীরও (মৃঃ ৫৪৬ হিঃ) এক একটি ছহীহ কিতাব রহিয়াছে বলিয়া কোন কোন কিতাবে উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী মোহাদ্দেছগণ এগুলিকে ছহীহ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন কি না বা কোথাও এগুলির পণ্ডলিপি বিদ্যমান আছে কি না জানা যায় নাই

হাদীছের সংখ্যা

হাদীছের মূল কিতাবসমূহের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ‘মোছনাদ’ একটি বৃহৎ কিতাব। ইহাতে ৭ শত ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত ‘তাকরার {এক কথাকে পুনঃ পুনঃ বলাকেই ‘তাকরার বলে। আমাদের মোহাদ্দেছগণ নান কারণে এক হাদীছকে অধ্যায়ে বিভিন্নবার বর্ণনা করিয়াছেন।} সহ মোট ৪০ হাজার এবং ‘তাকরার’ বাদ ৩০ হাজার এবং রহিয়াছেন। শায়খ আলী মোত্তাকী জৌনপরীর ‘মোনতাখাবে কানজুল ওমমালে’ ৩০ হাজার এবং ‘কানজুল ওমমালে’ ( তাকরার বাদ) মোট ৩২ হাজার হাদীছ রহিয়াছে।। অথচ এই কিতাব বহু মূল কিতাবের সমষ্টি।  একমাত্র হাছান ইবনে আহমদ ছমরকন্দীর ‘বাহরুল আছানীদ’ কিতাবেই এক লক্ষ হাদীছ রহিয়াছে বলিয়া শুনা যায়। কিন্তু এ সংখ্যা ‘তাকরার’ বাদ কি না তাহা জানা যায় নাই। সুতরাং মোট হাদীছের সংখ্যা ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছারসহ সর্বমোট এক লক্ষের অধিক নহে বলিয়া মনে হয়। ইহার মধ্যে ‘ছহীহ’ হাদীছের সংখ্যা আরো অনেক কম। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরীর মতে প্রথম শ্রেণীর ছহীহ হাদীছের সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। - ম’রেফাতু ওলুমিল হাদীছ। ‘ছেহাহ ছেত্তায়’ মাত্র পৌণে ছয় হাজার হাদীছ রহিয়াছে। ইহার মধ্যে ২৩২৬টি হাদীছ মো্ত্তফাক আলাইহে। তবে যে বলা হইয়া থাকেঃ হাদীছের বড় বড় ইমামগণের লক্ষ লক্ষ হাদীছ জানা ছিল। তাহার অর্থ এই যে, অধিকাংশ হাদীছের বিভিন্ন  ছনদ রহিয়াছে। -তাদবীন-৪৫ পৃঃ। অথচ আমাদের মোহাদ্দেছগণ যে হাদীছের যতটি ছনদ রহিয়াছে তাহাকে তত হাদীছ বলিয়াই গণ্য করেন। অবশ্য প্রথম যুগে ছনদের সংখ্যা এত অধিক ছিল না; সময়ের দীর্ঘতার সহিত ছনদের দীর্ঘতা এবং উভয়ই বাড়িয়া গিয়াছে। একজন ওস্তাদের একধিক প্রসিদ্ধ শাগরেদের মারফত একটি ছনদ একাধিক শাখা ছনদে বিভক্ত হইয়া ছনদের সংগে সংগে হাদীছের সংখ্যাও হ্রাস পাইবে। এ কারণেই আমরা তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনদের মধ্যে কাহাকেও লক্ষ লক্ষ হাদীছের  হাফেজ বা রাবী বলিয়া দেখিতেছি না এমান কি জুহরী কাতাদাহ, আবু ইছহাক এবং ‘আ মাশের ন্যায় ইমামগণকেও নহে।প্রথমেই জানিয়া রাখা আবশ্যক যে, ছাহাবীদের সংখ্যা ও তখনকার মসলমানদের সংখ্যা এক নহে। কারণ, ৮ম হিজরীতে মাক্কা বিজিত হওয়ার পর সমগ্র আরবের অধিবাসীরাই মসুলমান হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু সকলের পক্ষেই যে রসূলুল্লাহ আলাইহে ওয়াছাল্লামের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। এইরূপে যাহারা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লামকে দেখিয়াছিলেন এবং যাহারা রছূলুল্লাহ (ছঃ) হইতে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন তাঁহাদের উভয়ের সংখ্যাও সমান নহে। কেননা, যাহারা রছূলুল্লাহর হাদীছ বর্ণনা করার সুযোগ ঘটিয়াছিল তাহা নহে।

যাঁহারা রছুলুল্লাহ আলাইহি ওয়াছাল্লামের নিকট হইতে সরাসরিভাবে অথবা অন্য ছাহাবীর মারফতে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন ইমাম আবু জুরআ রাজীর মতে কেবল তাঁহাদের সংখ্যাই ছিল এক লক্ষের উপর (এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার)। রছুলুল্লাহ (ছঃ)-এর এনতেকালের সময় ছাহাবীদের সংখ্যা ৬০ হাজার ছিল বলিয়া ইমাম শাফেয়ী (রঃ) যে উক্তি করিয়াছেন তাহা তিনি শুধু মক্কা ও মদীনা শরীফের ছাহাবীদের সম্বন্ধই করিয়াছেন। তখন মক্কা শরীফে ৩০ হাজার এবং মদীনা শরীফে ৩০ হাজার ছাহাবী ছেলেন-একথাও তিনি স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছেন। তবে তাঁহাদের অধিকাংশই পল্লীবাসী ছিলেন বলিয়া অনেকের জীবনী জানা যায় নাই। এ কারণে ‘আছমাউর রেজালের’ কিতাব যাঁহাদের জীবনী রহিয়াছে তাঁহাদের সংখ্যা ৯ হাজারের অধীক নহে। ইবনে আবদুল বার তাঁহার ‘আল ইসতিয়াবে’ ৭ হাজারের, ইবনুল আছীর জজরী তাঁহার ‘উছদুল গাবায়’ ৭৫৫৪ জনের এবং ইমাম জাহবী তাঁহার ‘তাজরীদে’ ১২৮১ জন ছাহাবীয়াহসহ মোট ৮৮০৮ জনের জীবনী আলোচনা করিয়াছেন।

মদীনার বাহিরে ছাহাবীগণঃ

রছুলুল্লাহ এনতেকালের পর সমস্ত ছাহাবী মদীনায়ই অবস্থান করেন নাই; বরং নানা কারণে তাঁহাদের অনেকেই ( কোরআন ও হাদীছের এলম সঙ্গে লইয়া) মদীনার বাহিরে বসবাস এখতিয়ার করিয়াছিলেন। ইহার ফলে কোরআন ও হাদীছের এলম সমগ্র মুসলিম রাজ্যেই ছড়াইয়া পড়ে। যাঁহারা বাহিরে ছিলেন হাকেম আবু আবদুল্লাহ তাঁহাদের এরূপ হিসাব দিয়াছেন-মক্কায় ২৬, কুফায় ৫১, বছরায় ৩৫, শামে ৩৪, মিছরে ১৬, খোরাছানে ৬, এবং জজীরায় ৩ জন। অন্য কিতাবে অন্যরূপে সংখ্যাও রহিয়াছে। হজরহ আলী, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ, হজরত আবু মুছা  আশআরী, হজরত ছা’দ ইবনে আবি ওককাছ, হজরত ছালমান ফারেছি (রা) প্রমুখ বিশিষ্ট ছাহাবেয়ে কেরাম কুফায় বসবাস করয়াছিলেন।

ছাহাবীগণের ফজীলত ও মর্যাদা

ছাহাবীগণের ফজীলত ও মর্যাদার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট যে, তাঁহাদীগকে আল্লাহ তা’আলা তাঁহার প্রিয় নবী ও শ্রেষ্ঠ রছুলের সহচর্যের জন্য মনোনিত করিয়াছেন। কোরআন এবং হাদীছেও তাঁহাদের ফজীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে বহু উক্তি রহিয়াছে।

কোরআনে রহিয়াছেঃ

(আরবী...................................................................................................)

(১) ‘আল্লাহ মু’মিনগণের প্রতি নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইলেন যখন তাহারা বৃক্ষতলে আপনার নিকট বয়আত গ্রহণ করিতেছিল এবং আল্লাহ তাহাদের অন্তরের সব কিছুই অবগত ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাহাদের মধ্যে শান্তি সৃষ্টি করিয়াছিলেন।‘-ছুরা ফাতহ ১৮

(আরবী........................................................................................................)

(২) ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যকার সে সকল অগ্রগামীগণ এবং যাহারা সততার সহিত তাহাদিগকে অনুসরন করিয়াছে তাহাদের উপর আল্লাহ রাজী হইয়াছেন এবং তাহারাও আল্লাহর উপর রাজী হইয়াছে।‘ ছূরা-বারাআত-১০০

(আরবী...............................................................................)

(৩)‘হে নবী! আপনার পক্ষে যথেষ্ট হইতেছেন আল্লাহ এবং সেই সকল মু’মিন যাহারা আপনার অনুসরণ করিতেছে।‘- ছূরা-আনফাল-৬৪

(আরবী.................................................................................................)

(৪) ‘(উপরি-উক্ত মাল) প্রাপ্য হইতেছে দরিদ্র মুহাজিরদিগের, যাহারা নিজেদের আবাসভূমি ও বিষয়-সম্পত্তি হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছে। তাহারা আল্লাহর রহমতে ও সন্তোষলাভের কামনা করিয়া থাকে এবং আল্লাহ ও তাঁহার রছুলের কাজে সাহায্য করিয়া থাকে-ইহারাই হইতাছে সত্যবাদী।‘-ছূরা হাশর-৮

(আরবী........................................................................................)

(৫) ‘যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং হিজরত করিয়াছে এবং যাহারা জেহাদ করিয়াছে আল্লাহর রাহে নিজেদের ধন-প্রাণ-কোরবান করিয়া, তাহাদের মরতবা আল্লাহর হুজুরে (অন্যদের তুলনায়) বহুগুণ অধিক। আর এই সকল লোকই হইতেছে সিদ্ধকাম।‘-ছূরা-বারাআত-২০

(আরবী.........................................................................................)

(৬) ‘কিন্তু এই রছূল এবং তাঁহার সঙ্গে যে সমস্ত মু’মিন আছে-তাহারা এযাবৎ জেহাদ করিয়া আসিয়াছে নিজেদের ধন-প্রাণ কোরবান করিয়া; ইহাদের জন্য আছে যাবতীয় কল্যাণ এবং ইহারাই হইল সফলকাম।‘-ছূরা-বারাআহ-৮৮

(৭) ‘মক্কা বিজয়ের পূর্বে দান করিয়াছে যাহারা এবং জেহাদ করিয়াছে যাহারা, তাহাদের সমান উহারা হইতে পারে না যাহারা ইহার পরে দান করিয়াছে এবং জেহাদ করিয়াছে; প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের মর্যাদা অনেক বেশী। আর প্রত্যক দলকেই আল্লাহ তা’আলা ভালোর (হুছনার) ওয়াদা দান করিয়াছেন।‘–ছূরা-হাদীদ-১০

(আরবী..........................................................................................)

(৮) ‘কিন্তু যাহাদের ‘হুছনা’ সম্বন্ধে আমার ব্যবস্থা পূর্ব হইতেই অবধারিত হইয়া রহিয়াছে তাহাদিগকে অবস্থিত করা হইবে জাহান্নাম হইতে দূরে।‘-ছূরা-আম্বিয়া-১০১

শেষোক্ত দুই আয়াত হইতে ইমাম আবু মোহাম্মদ ইবনে হাজম এই বুঝিয়াছেন যে, সমস্ত ছাহাবীই বেহেশতী। কেননা, প্রথম আয়াতে বলা হইয়াছেঃ ছাহাবীগণকে আল্লাহ পাক ‘হুছনার ওয়াদা দান করিয়াছেন। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হইয়াছেঃ যাহাদিগকে আল্লাহ ‘হুছনার’ ওয়াদা দান করিয়াছেন তাহাদীগকে জাহান্নাম হইতে দূরে রাখা হইবে। সুতরাং ছাহাবীদিগকে জাহান্নাম হইতে দূরে রাখা হইবে অর্থাৎ, বেহেশত দেওয়া হইবে।–এছাবা-১৯ পৃষ্ঠা

হাদীছে রহিয়াছেঃ

১ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মোগাফফাল বলেনঃ রছুলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেনঃ আমার আছহাব সম্পর্কে মন্তব্য করিতে আল্লাহকে ভয় করিবে; তাহাদিগকে নিন্দা বিদ্রূপের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করিবে না। যে ব্যক্তি তাহাদিগকে ভালবাসিবে সে আমাকে ভালবাসার দরুনই তাহাদিগকে ভালবাসিবে। আর যে ব্যক্তি তাহাদের সহিত বৈরীভাব পোষণ করিবে সে আমার সহিত বৈরীভাব পোষণ করার দরুনই তাহা করিবে। যে ব্যাক্তি তাহাদিকে কষ্ট দিল, সে আমাবে কষ্ট দিল। আর যে ব্যাক্তি আমাবে কষ্ট দিল সে (আসলে) আল্লাহকেই কষ্ট দিল। সুতরাং আল্লাহ শীঘ্রই তাহাকে কঠোরভাবে ধরিবেন। তিরমিজী, ইবনে হিব্বান, এছাবা ১৮ পৃঃ

২। হজরত আবু ছাঈদ খুদরী বলেনঃ রছূলুল্লাহ ( ছঃ) বলিয়াছেনঃ খোদার কছম (হে আমার উম্মতীগণ!) যদি তোমাদের কেহ ওহোদ পাহাড় পড়িমাণ স্বর্ণও দান করে তা হইলেও আমান ছাহাবীগণেরে এক মোদ বা অর্ধ মোদ ( এক সেরের মত) দানের মর্যদাও লাভ করিতে পারিবে না।– বোখারী, মোছলেম, এছাবা ২১ পৃঃ

৩। রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেনঃ সবোর্ত্তম যুগ হইল আমার যুগ অর্থাৎ আমার সহচরদের যুগ। অতঃ পর যাহারা ইহাদের পরে আসিবে।– এছাবা ২১ পৃঃ

৪। তাবেয়ী জির ইবনে হুবাইশ বলেনঃ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা’আলা তাঁহার বান্দাদের অন্তরসমূহের প্রতি লক্ষ্য করিলেন এবং উহাদের মধ্যে হজরত মোহাম্মদ মোস্তাফ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লামের অন্তরকে সর্বশ্র্রেষ্ঠ অন্তররূপে পাইলেন।তাআ তাহাকে পয়গম্বর পদে বরণ  করিলেন। অতঃপর তিনি তাঁহার অপর বান্দাদের অন্তরসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন এবং ছাহাবীদের অন্তরসমূহকে অপরাপর সমস্ত অন্তর হইতে উৎকৃষ্ট অন্তর হিসাবে পাইলেন: তাই তাঁহদিগকে তাঁহার উজীররূপে মনোনীত করিলেন। তাঁহারা দ্বীনের জন্য সংগ্রাম করিবেন। ইসতিয়াব-৬ পৃঃ

৫। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেনঃ রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা ‘আলা আমার ছাহাবীগণকে নবী-রছুল ব্যতীত সমগ্র মানব ও জিন জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন।

{ ইবনে হাজার বলেন, বাজ্জার এ হাদীছকে ছহীহ ছনদের সহিত বর্ণনা করিয়াছেন।}

এছাবা-২২ পৃঃ

এ সকল আয়াত ও হাদীছ থাকিতে ছাহাবীদের ফজিলত ও মর্যাদা কাহারো মতানুকূল্যের অপেক্ষা রাখে না।

                                           হাদীছ বর্ণনায় ছাহাবীগণের সত্যবাদিতা

হাদীছ বর্ণনা বর্ণনায় ছাহাবীগণ সকলেই সত্যবাদী (আদেল) কোন ছাহাবীই কখনো রছূলুল্লাহর নামে কোন মিথ্যা হাদীছ গড়িয়া বর্ণনা করেন নাই। হাফেজ ইবনে হাজার বলেনঃ ছাহাবীগণ সকলেই যে আদেল (হাদীছ বর্ণনায় সত্যবাদী), এ ব্যাপারে সমস্ত ছুন্নত জামাআত একমত। ছুন্নত জামাআতের বাহিরে কতক বেদআতী লোক অর্থাৎ মু’তাজিলা ও জিন্দীক { মুসলমান বেশে কাফের- ইসলামকে কলংকিত করা যাহার উদ্দেশ্য। } ব্যতীত ইহাতে কাহারো দ্বিমত নাই। খতীব বাগদাদী তাঁহার ‘কেফায়ায়’ বলিয়াছেনঃ ছাহাবীগণের ‘আদালত’ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার সাক্ষ্য বিদ্যমান রহিয়াছে। আল্লাহ বলেনঃ

১। আল্লাহ মু’মিনগণের প্রতি সন্তুষ্ট হইলেন যখন তাহারা বৃক্ষতলে আপনার নিকট বয়আত গ্রহণ করিতেছিল এবং আল্লাহ তাঁহাদের অন্তরের সবকিছুই অবগত ছিলেন।– ছূরা ফাতহ-১৮

২। মুহাজির ও আনছাগণের মধ্যকার সে সকল অগ্রগামীগণ এবং যাহারা সততার সহিত তাদের অনুসরণ করিয়াছেন তাহদের প্রতি আল্লাহ রাজী হইয়াছেন এবং তাহারাও আল্লাহর উপর রাজী হইয়াছে।–ছূরা-তাওবা-১০০

৩। হে নবী! আপনার পক্ষে যথেষ্ট হইতেছেন আল্লাহ এবং সেই সকল মু’মিন যাহারা আপনার অনুসরণ করিতেছে।–ছূরা আনফাল-৬৪

৪। (উপরি-উক্তি মাল) প্রাপ্য হইতেছে দরিদ্র মুজাহিরদিগের যাহারা নিজের আবাসভূমি ও বিষয়-সম্পত্তি হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছে। তাহারা আল্লাহর রহমত ও সন্তোষলাভের কামনা করিয়া থাকে এবং আল্লাহ ও তাঁহার রছুলের কাজে সাহায্য করিয়া থাকে; ইহারাই হইতেছে সত্যবাদী।–ছুরা হাশর-৮

এছাড়া এ ব্যাপারে বহু আয়াত রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলার এ সাক্ষ্যের পর ছাহাবীগণের সত্যবাদিতা অপর কাহারো সাক্ষ্যের অপেক্ষ করে না। আর যদি আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁহার রছুলের সাক্ষাৎ নাও থাকিত তা হইলেও তাঁহাদের সত্যবাদিতায় বিশ্বাস করিতে আমরা বাধ্য ছিলাম। কেননা, তাঁহারা যে ভাবে ইসালামের জন্য নিজেদের জান-মাল, ও আত্নীয়-স্বজনকে কোরবান করিয়াছেন এবং হিজরত ও জেহাদ করিয়া খোদা ও রছুল-প্রীতির পরিচয় দিয়াছেন তাহাতে কেহ তাঁহাদের প্রতি এ বিশ্বাস না করিয়া পারে না।

হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস

ইমাম আবু জোরআ রাজী বলেনঃ যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে ছাহাবীগণের বিরূপ সমালোচনা করিতে বা তাহাদীগকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে দেখিবে, তখন নিশ্চয়ই মনে করিবে যে, সে জিন্দীক। আসলে তাহার ঈমানই নাই। কারণ, রছূল সত্য, কোরআন সত্য এবং কোরআন আমাদিগকে যাহা দিয়াছে তাহাও সত্য’ অথচ এ সকল বিষয় আমরা ছাহাবীগণের মারফতেই লাভ করিয়াছি, তাঁহাদের সাক্ষ্যই আমরা এ সকল বিষয়কে সত্য বলিয়া জানিতে পারিয়াছি। সুতরাং যাহারা আমাদের সাক্ষীদিগকে ঘায়েল বা সন্দেহযুক্ত করিতে চাহে, প্রকৃতপক্ষে তাহারা আমাদের কোরআন-হাদীছেকেই সন্দেহযুক্ত করিতে চাহে। তাহারা জিন্দীক, তাহারাই সন্দেহের পাত্র।–এছাবা-১৭  পৃঃ

হাফেজ ইবনুছ ছালাহ বলেনঃ সকল ছাহাবীই  যে আদেল (হাদীছ বর্ণনায় সত্যবাদী) এ সম্বন্ধে সমগ্র উম্মত একমত। এমন কি, যাহারা রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর পর আত্নকলহে লিপ্ত হইয়াছিলেন তাহারাও আদেল। ইসলামের  জন্য তাহাদের নানাবিধ ত্যাগ ও বিভিন্ন গুণাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তাহাদের প্রতি এ ধারণা পোষণ না করিয়া পারা যায় না। আর ইহাই হইল বিজ্ঞ আলেমবৃন্দের সর্ববাদিসম্মত অভিমত। ইহারই উপর আল্লাহ তা’আলা মুসল-মানদিগকে একমত করিয়া দিয়াছেন। কারণ, ছাহাবীগণই হইলেন পরবর্তী লোকদের পক্ষে শরীয়ত লাভের একমাত্র মাধ্যম। তাহাদের বিশ্বস্ততা প্রতিপন্ন না হইলে শরীয়তের বিশ্বস্তাতাই বিপন্ন হইয়া পড়ে।–মোকাদ্দমা ২৬০ পৃঃ

ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেনঃ যেহেতু ছাহাবীগণের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার সাক্ষ্য বিদ্যমান রহিয়াছে, এজন্য পূর্ব ও পরবর্তী সকল মুসলমানই এ ব্যাপারে একমত। আর আমাদের আকীদাও ইহাই।–মোস্তাশফা, ফাহম। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী বলেনঃ আহলে ছুন্নাত জামাআতের নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে, ছাহাবীগণ সকলেই আদেল। আর প্রত্যক যুগেই নুতনভাবে ইহার পুনরাবৃত্তি করা হইয়াছে।–জাফরুল আমানী, ফাহম-১০২ পৃঃ

‘ছাহাবীগণ সকলেই আদেল’-এ প্রসঙ্গে শাহ ওলীউল্লা দেহলবী বলেনঃ ‘কোন হাদীছ বর্ণনাকারী রাবী আদেল’ মোহাদ্দেছগণের নিকট ইহা সাধারণতঃ যে অর্থে ব্যবরিত নহে। ‘ছাহাবীগণ সকলেই আদেল’ ইহার অর্থ ‘ হাদীছ বর্ণনায় তাঁহারা সকলেই সত্যবাদী’ । তাঁহাদের জীবনচরিত তন্ন তন্ন করিয়া দেখা গিয়াছে যে, তাঁহাদের কেহই কখনও রছুলুল্লাহর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়া বলেন নাই। রছুলুল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করাকে তাঁহারা মাহাপাপ বলিয়া মনে করিতেন এবং ইহাকে কঠোভাবে পরিহার করিয়া চলিতেন।–জাফরুল আমীন। ইমাম ইবনুল আম্বারী বলেনঃ ‘ছাহাবীগণ সকলেই আদেল’ ইহার অর্থ এই নহে যে, তাঁহারা মা’ছুম বা নিষ্পাপ-তাঁহাদের  কাহারো দ্বারা কখনো কোন অপরাধ সংঘটিত হয় নাই; বরং ইহার অর্থ এই যে, তাঁহারা হাদীছ বর্ণনায় সত্যবাদী। তাঁহাদের কেহই কখনো রছূলুল্লা ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়া বলেন নাই। সুতরাং ‘আদালত’ ব্যাপারে খুঁটিনাটি বিচারে প্রবৃত্ত না হইয়া সহজভাবেই তাঁহাদের রেওয়ায়ত গ্রহণ করিতে হইবে-যে পর্যন্ত না তাঁহাদের কাহারো দ্বারা এমন কোন কাজ সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া প্রমাণিত হয় যদ্দারা তাঁহার হাদীছ গ্রহণ করা যাইতে পারে না। আর এরূপ কোন কাজ তাঁহাদের কাহারো দ্বারা সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া প্রমাণিত হয় নাই।

                                                                                           -ইরশাদুল ফহুল, ফাহম ১৪২ পৃঃ

ছাহাবীদের প্রতি আস্থা নষ্ট করার অপচেষ্ট

ইসলামের শক্ররো ইসলামকে ধারাপৃষ্ঠা হইতে মছিয়া ফেলার উদ্দেশ্য যুগে যুগে যে সকল পস্থা অবলম্বন করিয়াছে সে সকলের মধ্যে রছূলুল্লাহর (ছঃ) ছাহাবীগণের নাম দুর্দাম রটনা করার পন্হাটি হইল সর্বাধিক সুক্ষ্ম ও মারাত্ম । কারণ, পরবর্তী উম্মতীগণের পক্ষে ইসলাম বা শরীয়ত লাভের একমাত্র মাধ্যমই হইলেন ছাহাবীগণ। ছাহাবীগণের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর কিতাব ও রছূলের ছুন্নাহ লাভ করিয়াছি। সুতরাং ছাহাবীগণের প্রতি আস্থা বজায় না থাকিলে কাহারো কক্ষে কোরআন-হাদীছে বিশ্বাস বা ইসালামের প্রতি আকর্ষণের কোন সূত্রই বাকী থাকে না। এ পন্হার উদ্ভবক হইল ছদ্মবেশী ইহুদী ইহুদী জিন্দীক আবদুল্লাহ ইবনে ছাবা। আদুল্লাহ ইবনে ছাবাই হজরত ওছমান গনীকে স্বজনপ্রিয় বলিয়া জন-সমাজে করম্কিত করার চেষ্টা করে। অতঃপর আব্বাসী আমলে এ পন্হার অনুসরণ করে অপর এক জিন্দীক- নাজ্জাম { ১. নাজ্জামের নাম ইনরাহীম, বাপের নাম ছাইয়ার। হাফেজ ইবনে হাজার লেছানুল মীজানে তাহাকে জিন্দীক বা মুসলিমবেশী কাফের বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। মৃঃ ২২৯ হিঃ। লেছান ১/৬৭ পৃঃ} নাজ্জম হজরত আবুবকর, ওমর আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ, জায়েদ ইবনে ছাবেত ও হজাইফা ইবনে ইয়ামানের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ছাহাবীগণের প্রতি এই বলিয়া দোষারোপ করে, যো তাঁহারা পরস্পর বিরোধী কাথা {

আমরা বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যে সকল কথা বলিয়া থাকি-সময় ও পরিস্থিতির বিভিন্নতাকে বাদ দিয়া দেখিলে আমাদের সে সকল কথা সমস্তই পরস্পর বিরোধী বলিয়া মনে হইবে। আর শক্ররা এইরূপেই দেখিয়া থাকে।} বলিয়াছেন এবং হজরত আবু হুরায়রাকে (রঃ) এই বলিয়া লোকের নিকট হেয় প্রতিপন্ন করিতে চাহে যে, তিনি অতি অল্প সময় রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লাম-এর সহচর্য লাভ করিয়া বহু সংখ্য সংখ্যক হাদীছ বর্ণন করিয়াছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ছাবার কার্ষের প্রতিবাদ করিয়াছেন স্বয়ং হজরত আলী (রঃ)। তিনি তাহাকে তাহার দলবলসহ আগুনে পোড়াইয়া মারিয়িছেন। আর নাজ্জামের কথার প্রতিবাদ করিয়াছেন মনীষী ইবনে কোতাইবাহ। ইবনে কোতাইবাহ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা তাহার প্রত্যেক কথার অসারতা প্রতিপন্ন করিয়া দিয়াছেন। আজ সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নবীগণের পর রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ছাহাবীগণই হইতেছেন সকল উম্মতের সেরা এবং তাঁহার সকলেই হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে সত্যবাদী। তথাপি ইসলামের পাশ্চাত্য সমালোচকগন যাহারা ইসলামের বিরুদ্ধে তৃণের সাহায্য লইতেও কুন্ঠাবোধ করেন না- ইবনে ছাবা ও নাজ্জামের পন্হা অবলম্ব করিয়া হজরত আবু হুরায়রা ও হজরত ইবনে আব্বাছের প্রতি তাঁহাদের রেওয়ায়তের অধিক্যের দরুন সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাদের মতে হজরত আবু হুরায়রার পক্ষে এত অল্প সময়ের নবী-সাহচর্যে এবং হজরত ইবনে আব্বাছের পক্ষে এত অল্প বয়সে এত অধিক হাদীছ আয়ত্ত করা ও তাহার মর্ম বুঝা সম্ভবপর নহে,- কাজেই তাহারা নিজেরাই  হাদীছ রচনা করিয়াছেন। হজরত আবু হুরায়রা এবং হাজরত ইবনে আব্বাছের জীবনী আলোচনার ভিতর দিয়অ এখন আমরা দেখাইতে চেষ্ট করিব যে, তাঁহাদের পক্ষে এত অধিক হাদীছ বর্ণনা করা ও তাহার মর্ম উপলদ্ধি করা সম্ভবপর ছিল কি না।

                                              (হজরত আবু হুরায়রা (রঃ)

হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) ইয়ামানের অধিবাসী দৌছী গোত্রের লোক ছিলেন। তাঁহার বয়স যখন ত্রিশের উপর, তখন তিনি তাঁহার গোত্রের সহিত মদীনায় উপনীত হন এবং মদীনায় রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছল্লামকে না পাইয়া খায়বরে গমন করেন। রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তখন খায়বরে ছিলেন। খায়বা যুদ্ধ সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসে সংঘটিত হয়। তখন হইতে একাদশ হিজরীর প্রথম ভাগে ( রবিউল আউয়াল  মাসে) রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর এন্তেকাল পর্যন্ত চারি বৎসরকাল তিনি রছূলুল্লাহ ছাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম  এর খদমতে হাজির থাকেন।–তাবাকাতে ইবনে ছা’দ ৪ /৩২৫-৩৮২ পৃঃ

হজরত আলী (রঃ) আমলে তাহাকে উক্ত পদ গ্রহণ করিতে বলিলে তিনি তাহা অস্বীকার করেন। অতঃপর হজরত মুয়াবিয়ার আমলে তিনি দুইবার মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন- মারওয়ানের পদচ্যুতির পূর্ব একবার এবং পরে একবার। শেষবারের কার্যকালে তিনি ৫৮ অথবা ৫৯ হিজরীতে মদীনায় এন্তাকাল করেন। এই সময়ে তাহার বয়স ছিল আশিরও উপরে।

                                                                                                               ইসতিয়াব ২০৬ পৃঃ

তিনি রছূলুল্লাহ (ছঃ) হইতে মোট ৫৩৭৪ টি বর্ণনা করিয়াছেন। এত অধিক সংখ্যাক হাদীছ ছাহবীদের মধ্যে অপর কেহ বর্ণনা করেন নাই। এমন দেখা যাক, তাঁহার পক্ষে এত অধিক হাদীছ বর্ণনা করা সম্ভপর ছিল না।

জ্ঞান আহরণেন আগ্রহঃ

ইসলাম গ্রহণ করার পর দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ-বিলাস ত্যাগ করিয়া রছূলুল্লাহর (ছঃ) নিকট হইতে জ্ঞান আহরণ করাকেই তিনি জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষণেরকের তরেও রছূলুল্লাহর (ছঃ) সংগ ত্যাগ করেণ নাই। এমন কি, জীবন ধারণোপযোগী অন্ন-বস্ত্রের যোগা-ড়ের জন্যও নহে। তিনি হুজুরের নিকট হইতে যাহা পাইতেন তাহাই খাইতেন এবং হুজুর যাহা দিতেন তাহাই পরিতেন। আর দিবারাত্র মসজিদে নববীর ছোফফায় (বারান্দায়) পড়িয়া থাকিতেন। এতদ্ব্যতীত তিনি অত্যন্ত নিঃসংস্ষ্কোচ স্বভাবের লোক ছিলেন। কখনো তিনি হুজুরের নিকট কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সংকোচবোধ করিতেন না। একবার তিনি হুজুরকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘হুজুর ! ক্বেয়ামতের দিন আপনার শাফায়াত কোন ভাগ্যবান প্রথম লাভ করিবেন ?’ ইহা শুনিয়া হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিলেনঃ ‘আবু হুরায়রা! আমি তোমার জ্ঞান আহরণের আগ্রহ লক্ষ্য করিয়া পূর্বেই অনুমান করিয়াছিলাম যে, এ সম্পর্কে তুমিই সর্বপ্রথম আমাক জিজ্ঞাসা করিবে ।‘-বোখারী, এছাবা-৪-২০৩ পৃঃ

স্মরণশক্তিঃ

হজরত আবু হুরায়রার স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। তিনি যাহা শুনিতেন তাহা আর সহজে ভুলিতেন না। তাঁহার স্মরণশক্তির জন্য তিনি নিজেও দোআ করিয়াছিলেন এবং স্বয়ং রছুলুল্লাহ (ছঃ)-ও তাঁহার জন্য দো’আ করিয়াছিলেন। হজরত যায়েদ ইবনে ছাবেত বলেনঃ একবার আমি, আমার এক সংগী এবং আবু হুরায়রা মসজিদে বসিয়া কিছু দো’আ করতেছিলাম। এমন সময় রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াছাল্লাম আসিয়া পৌছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমরা খামুশ হইয়া গেলাম। ইহা দেখিয়া হুজুর বলিলেনঃ “তোমরা তোমাদের কাজ করিত থাক।“ আমরা পুনরায় দো’আ করিত লাগিলাম এবং হুজুর আমাদের সহিত ‘আমীন আমীন’ বলিতে লাগিলেন। আমাদের দুই জনের দো’আ শেষ হইলে আবু হুরায়রা বলিলেনঃ “খোদা ! আমরা সংগীদ্বয় তোমার নিকট যাহা চাহিয়াছেন তাহা আমিও তোমার নিকট চাহি; অধিকন্ত আমি তোমার নিকট ইহাও চাহি যে, তুমি আমাকে এমন এলম দান করিবে যাহা আমি সহজে ভুলিয়া না যাই।“অতঃপর আমরা বলিলামঃ “হুজুর! আমাদিগকেও যেন আল্লাহ এরূপ এলেম দান করেন।“হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিলেনঃ “এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা তোমাদের আগেই দরখাস্ত করিয়া ফেলিয়াছে।“-নাছায়ী, এছাবা-৪-২০৫ পৃঃ

বোখারী শরীফে আছে, একদা হজরত আবু হুরায়রা রছুলুল্লাহ (ছঃ)-কে বলিলেনঃ “হুজুর, আমি আপনার নিকট অনেক হাদীছ শুনিয়া থাকি কিন্তু ভুলিয়া যাই। “ হুজুর বলিলেনঃ “তোমার চাদর বিছাও।“ আমি উহা বিছাইলাম (এবং হুজুর উহাতে কিছু পড়িয়া দিলেন ।) অতপর বলিলেনঃ “চাদর তোমার ছিনার ধারণ কর।“ আমি উহা ছিনায় ধারণ করিলাম। অতঃপর আমি আর কোন হাদীছ ভুলি নাই।–এছাবা-৪-২০৪ পৃঃ

মারওয়ানের লিখক কর্মচারী আবুজ জুয়াইজাহ বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রাকে কিছু হাদীছ বর্ণনা করিত বলিলেন। আবু হুরায়রা হাদীছ বর্ণনা করিলেন এবং আমি উহা গোপনে লিখিয়া লইলাম। এক বৎসর পর মারওয়ান পুনরায় তাঁহাকে সে সকল হাদীছ বর্ণনা করিতে বলিলেনঃ তিনি উহা বর্ণনা করিলেন। কিন্তু কোথাও একটি শব্দও বেশ-কম হইল না। এছাব-৪-২০৩ পৃঃ

মোটকথা, য়ে ব্যক্তির এরূপ স্মরণশক্তি, তাঁহার পক্ষে চারি বৎসর সময়ে ছনদ ব্যতিত সাড়ে পাঁচ হাজার হাদীছ মুখস্থ করা কি অসম্ভব? এরূপ সময়ে এ পরিমান হাদীছ মুখস্থ করার মত লোক এখনো দুনিয়ায় বিরল নহে।

অভিযোগ সম্পর্কে তাঁহার নিজের উত্তরঃ

হজরত আবু হুরায়রার নিজের জামানাই যে সকল লোক তাঁহার অবস্থা ভাল করিয়া জানিতেন না অথবা যাহারা তাঁহাকে ভালবাসিতেন না তাহাদের কেহ কেহ বলিতে আরম্ভ করিয়া-ছিলেন যে, আবু হুরাযরা (রাঃ) অধিক হাদীছ বর্ণনা করিয়া থাকেন। এ অভিযোগের উত্তরে তিনি নিজে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্য।

মারওয়ান যখন মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন, তখন তিনি কোন এক ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রার (রাঃ) প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেনঃ ‘লোকে বলে, আবু হুরায়রা (রাঃ) অধিক হাদীছ বর্ণনা করিয়া থাকেন। অথচ তিনি রছুলুল্লাহ  ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের ওফাতের অল্প দিন পূর্বেই মদীনায় আসিয়াছেন।‘ ইহা শুনিয়া হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলিলেনঃ খায়বার যুদ্ধের সময় সপ্তম হিজরীর প্রথম দিকেই আমি মদীনায় আসিয়াছি। তখন আমার বয়স ত্রিশের উপর। তখন হইতে আমি সর্বদা ছায়ার ন্যায় রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর সঙ্গে রহিয়াছি। আমি তাঁহার সহিত বরাবর তাঁহার বিবিদের ঘরে গিয়াছি। আমি তাঁহার সহিত (আমার সময়ে সংঘটিত ) সকল জেহাদেই শরীক হইয়াছি এবং তাঁহার সহিত হজ্জ ও উমরা পালন সমাপন করিয়াছি। করিয়াছি। এককথায় আমি দিবারাত্রই তাঁহার খেদমতে পড়িয়া রহিয়াছি। এসব কারণে আমি অন্যদের তুলনায় তাঁহার হাদীছ অধিক অবগত আছি। খোদার কছম, যাঁহারা আমার পূর্ব হইতে হুজুরের (ছঃ) খেদমতে ছিলেন তাঁহারাও আমার এ হাজিরবাশির (সদা উপস্থিতির) স্বীকৃতি দান করিয়াছেন; বরং তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার নিকট রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছও জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। এরূপ ব্যক্তিদের মধ্যে হজরত ওমর, হজরত ওছমান, হজরত তালহা ও হজরত জোবায়রও রহিয়াছেন।–তাবাকাতে ইবনে-এছাবা-৪-২০৬ পৃঃ

আমর ইবনে সাইদ বলেনঃ একদা হজরত আয়েশা (রাঃ) আবু হুরায়রা বলিলেনঃ ‘আম্মা, আপনাকে উহা হইতে সুর্মাদানী ও আয়না বাধা দিয়াছিল, আর আমাকে কোন কিছূই বাধঅ দিতে পারে নাই।‘-এছাবা-৪-২০৬ পৃঃ

হাদীছ বর্ণনায় সতর্কতাঃ

হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হাদীছ বর্ণনায় কতদূর সতর্ক ছিলেন তাহা নীচের ঘটনাগুলি হইতে অনুমান করা যায়।

একবার শফীয়াহ ইছবেহী নামক এক ব্যক্তি মদীনায় আসিয়া হজরত আবু হুরায়রাকে (রাঃ) একটি হাদীছ শুনাইতে অনুরোধ করিলেন। উত্তর হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলিলেনঃ “শুনাইব।“ অতঃপর বেহুঁশ হইয়া পড়িলেন। এভাবে তিনি তিনবার বেহুঁশ হইলেন এবং তিনবার হুঁশে আসিলেন। চতুর্থবারে তিনি এত অধিক বেহুঁশ হইলেন যে, একেবারে মাটিতে উপুড় হইয়া পড়িয়া গেলেন। শফিয়া বলেনঃ আমি তাঁহাকে উঠাইয়া লইলাম; হুঁশ ফিরিয়া আসিল। ইতঃপর  তাবেয়ী কোলাইব বলেনঃ আমি হজরত আবু হুরায়রাকে (রাঃ) একথা বলিয়া হাদীছ বর্ণনা আরম্ভ করিতে শুনিয়াছি-রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়াছে সে যেন তাহার স্থান দোজখে তৈয়ার করিয়া লয়।“ এছাবা-৪-২০৬ পৃঃ

আবু হুরায়রার প্রতি ছাহাবীগণের আস্থাঃ

হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রার প্রতি অপর কোন ছাহাবী কখনো অনস্থ প্রকাশ করেন নাই বা একথা বলেন নাই যে, আবু হুরায়রা (রঃ) রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নামে হাদীছ গড়িয়া বর্ণনা করেন।

মোস্তাদরাকে রিহয়াছেঃ আবু আমের তাবেয়ী বলেন, একদিন আমি হজরত তালহার নিকট ছিলাম। এমন সময় এক ব্যাতি আসিয়া বলিল, আবু মোহম্মদ (তালহা) আমি বুঝতে পারিতেছি না যে, রছূলুল্লাহকে এই ইয়ামানী ( আবু হুরায়রা) অধিক জানেন, না আপনি? তখন হজরত তালহা বলিলেনঃ ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে আবু হুরায়ারা রছূলুল্লাহ (ছঃ) নিকট  এমন সকল হাদীছ শুনিয়াছেন যাহা আমরা শুনিবার সুযোগ পাই নাই। তিনি তাঁহার এমন কথা জানেন যাহা আমরা জানিবার সুযোগ পাই নাই। কারণ, আমাদের বিষয়-সম্পত্তি ছিল, স্ত্রী-পুত্র ছিল আমরা কেবল সকাল-সন্ধ্যয় হুজুরের খেদমতে হাজির হইতাম এবং অবশিষ্ট সময়ে এ সবের তত্ত্ববধানে কাটাইতাম। আর আবু হুরায়রা ছিলেন সর্বত্যাগী মিছকীন, (তখন) তাঁহার না ছিল বিষয়-সম্পত্তি আর না ছিল স্ত্রী-পুত্র। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রছূলুল্লাহ (ছঃ) হাতে সোপর্দ করিয়া দিয়াছিলেন।রছূলুল্লাহ (ছঃ) যেখানে যাইতেন তিনিও সেখানে যাইতেন। হজরত তালহা পুনরায় বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হুরায়রা হুজুরের এমন সব কথা জানেন যাহা আমরা জানি না। তিনি তাঁহার নিকট এমন হাদীছ শুনিয়াছেন যাহা আমরা শুনি নাই। অতঃপর হজরত তালহা ইহাও পরিষ্কাররূপে বলিয়া দেন যে-

[ আরবী---------------------------------------------------------------------------]

‘আমাদের মধ্যে কেহ আবু হুরায়রার (রঃ) প্রতি এ অভিযোগ করেন নাই যে, আবু হুরায়রা রছূলুল্লাকহ (ছঃ) নামে এমন হাদীছ গড়িয়া বলিতেছেন যাহা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লাম বলেন নাই।–মুস্তাদরাক-৫১১ পৃঃ ফাহাম-১২৪ পৃঃ

বোখারী শরীফে আছেঃ হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) যখন রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নামে এ হাদীছ বণর্না করিলেনঃ যে ব্যাক্তি জানাযার নামাজ পড়িয়া মৃতের সহিত কবরস্থান পযর্ন্ত যাইবে তাহার জন্য দুই কীরাত রহিয়াছেন।“তখন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রঃ) বলিলেন, আবু হুরায়রা আমাদিগকে বহু হাদীছ শুনাইলেন এবং হজরত আয়েশার (রঃ) নিকট গিয়া উহা জিজ্ঞাসা করিলেন।হজরত আয়েশা (রাঃ) উহা সমর্থন করিলেন। তখন হজরত আব্দুল্লাহা বলিলেনঃ ওহো! আবু হুরায়রা (ঐ অনুসারে আমল করিয়া) নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষা বহু কীরাত অধিক লাভ করিয়াছেন।

এছারা-৪/২০৬,তাবাকাত-৪/৩৩২ পৃঃ

তাবেয়ী আবু ছালেহ (রঃ) বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা কর্তৃক ফজরের ছুন্নাতের পর কিছক্ষণ বিশ্রামের হাদীছটি বর্ণনা করার খবর শুনিয়া হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রঃ) বলিলেনঃ আবু হুরায়রা বড় বেশী হাদীছ বর্ণনা করেন। তখন কেহ তাহাকে প্রশ্ন করিলে, তাহা হইলে আপনি কি মনে করেন যে, আবু হুরায়রা না জানিয়া হাদীছ বর্ণনা করেন? উত্তর হজরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ অবশ্য তাহা নহে। তবে তিনি বেশী সাহসী,আর আমরা এত সাহসী নহ্ ইহা জানিতে পারিয়া হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) বলিলেনঃ আমি যদি হফেজ করিয়া রাখি, আর তাঁহারা তাহা ভূলিয়া যান ইহাতে আমার অপরাধ কি? –এছাবা-৪/২০৬ পৃঃ হজরত এজীদ ইবনে আব্দুল্লাহ বলেনঃ আমার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রঃ) হজরত আবু হুরায়রাকে (রাঃ) একটি হাদীছ বর্ণনা করিতে শুনিয়া বলিলেনঃ আমরা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলইহে ওয়াছাল্লাম-এর নামে যাহা বলি, ভয় করিয়া বলি, বেশী কথা বলিতে সাহস করি না, আর আবু হুরায়রা (রঃ) সাহস করিয়া অনেক কথাই বলেন। অবশেষে হজরত আব্দুল্লাহ ইহাও বলেনঃ ‘আবু হুরায়রা! আপনি আমাদের মধ্যে সকলের তুলনায় রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর খেদমতে অধিক হাজিরবাস ছিলেন এবং আমাদের সকলের তুলনায় অধিক হাদীছ অবগত আছেন। এছাবা-৪/২০৬ পৃঃ

হজরত ওরয়াহ ইবনে জোবায়র বলেনঃ একদা আমার পিতা হজরত জোবায়ার (রঃ তাঁহার বৃদ্ধাবস্থায়) আমাকে বলেন বলেনঃ মিঞা!  আমাকে এই ইয়ামানীর নিকট লইয়া চল। সে বহু হাদীছ বণর্না করিয়া থাকে। আমি তাঁহাকে হজরত আবু হুরায়রা নিকট লইয়া গেলাম। হজরত আবু হুরায়রা হাদীছ বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া আমার পিতা বলিলেন, ‘সত্যও বলিয়াছেন মিথ্যাও বলিয়াছেন। আমি বলিলাম, ইহার অর্থ কি আব্বা? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ আবু হুরায়রা (রঃ) রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিকট হইতে শুনিয়াছেন একথা সত্য। কিন্তু উহার কিয়দংশ অযথা স্থানে রাখিয়াছেন (অর্থাৎ,উহা ভুল বুঝিয়াছেন)।–এছাবা-৪/২০৭ পৃঃ

হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ আমার নিকট হাদীছ বর্ণনার খবর হজরত ওমরের (রঃ) নিকট পৌছিলে তিনি আমাকে (ডাকাইয়া) জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি অমুক ছাহাবীর ঘরে আমাদের বলিয়াছিলেনঃ ‘যে ব্যাক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার নামে মিথ্যা রচনা করিবে সে যেন তাহার স্থান দোজখে তৈয়ার করে।‘ইহা শুনিয়া হজরত ওমর (রাঃ) বলিলেন [আরবী------------------------] এখন হাদীছ বর্ণনা করিতে পার।‘ এছাবা-৪/২০৬ পৃঃ

হজরত উবাই ইবনে কা’ব বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিকট এমন সব কথাও জিজ্ঞাসা করিতেন যাহা অপর কেহ সাধারণতঃ জিজ্ঞাসা করিত না। এছাবা-ঐ

তাবেয়ীনদের সাক্ষ্যঃ

তাবেয়ী হজরত আবু ছালেহ ছাম্মান (রঃ)  বলেন, হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্মরণশক্তিসম্পন্ন বা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন।– এছাবা-ঐ

হাদীছ সমালোচক ইমামগণের সাক্ষ্যঃ

ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রঃ)- এর নিকট প্রায় ৮ শত আহলে এলম (বিদ্ধান ব্যাক্তি) হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন। তিনি তাহার সমসাময়িক লোকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন। এছাবা-৪/৩০২ পৃঃ

মোহাদ্দেছ আবু নোয়াইম বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন।–এছাবা।–ঐ

হাদীছ সমলোচনা ইমামগণের সাক্ষ্যঃ

ইমাম শাফেয়ী (রাঃ) বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট প্রায় ৮ শত আহলে এলম ( বিদ্ধান ব্যাক্তি) হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন। তিনি তাহার সমসাময়িক লোকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন।–এছাবা-৪/২০৩ পৃঃ

মোহাদ্দেছ আবু নোয়াইন বলেনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন।– এছাবা।– ঐ ইমাম জাহাবী বলনে, হজরত আবু হুরায়রা হাদীছের ভাণ্ডার ছিলেন। ফেকাহয়ও তিনি ছিলেন বড় ইমামগণের অন্তর্গত। (আরবী)----------------- তাজকেরাতুল হোফফাজ-১/২৮ পৃঃ

হাফেজে ইবনে হাজার আছকালানী  বলেন, হজরত আবু হুরায়রা (রঃ) তাহার সমসায়িকদের মধ্যে  সর্বাপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ  ছিলেন।– তাহজীবুত তাহজীব

ইমাম ইবনে আব্দুল বার বলেন, হজতে আবু হুরায়রা (রঃ) ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় হাফেজে হাদীছ ছিলেন। তিনি সকল হুজুরের খেদমতে থাকিতেন যখন মুহাজিরগণ তাহাদের ব্যবসায়ে এবং আনছারগণ তাহাদের ক্ষেত্র- খামারে ব্যস্ত থাকার দরুন হাজির থাকিতে পারিতন না। রছূলুল্লাহ (ছঃ) স্বয়ং তাঁহাকে হাদীছের লোভী ও আগ্রহশীল বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।- ইসতিয়াব- ২০৬ পৃঃ

হাকেম আবু আহমদ বলেন, হজারত আবু হুরায়রা (হুজেরের খেদমতে) অধিক হাজিরবাস (সদা উপস্থিত) ছিলেন। তিনি দিবারাত্র হুজুরের খদমতে পড়িয়া থাকিতেন। হুজুর যেখানে যাইতেন তিনি সেখানে তাঁহার হাদীছের সংখ্যা অধিক।– এছাবা-৪/২০৩ পৃঃ

হাদীছ সংকলন ইমামগণের আস্থাঃ

হজরত আবু হুরায়রার (রাঃ) প্রতি হাদীছ সংকলনকারী সমস্ত ইমামগণেরই যে আস্থা রহিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য। হাদীছ সংকলন ইমামগণর মধ্যে এমন কোন ইমাম নাই যিনি হজরত আবু হুরায়রা হাদীছ গ্রহণ করেন নাই। এমন কি ইমাম বোখারী তাঁহার ‘ছাহীহ’ তে ৪১৮ টি হাদীছ গ্রহণ করিয়াছেন। অথচ তাঁহাদের (হাদীছের ইমামদের) সর্বসম্মত নীতি এই যে, যে ব্যাক্তি রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছেল্লাম-এর নামে একটি মাত্র হাদীছও গড়িয়া বলিয়াছে তাহার কোন হাদীছই গ্রহণযোগ্য নহে।

ফেকাহর ইমামগণের আস্থাঃ

ফেকাহ শাস্ত্রের সকল ইমামই ফেকাহ রচনায় হজরত আবু হুরায়রার হাদীছের উপর নির্ভর করিয়াছেন। ফেকাহর কিতাব হইতে হজরত আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের ভিত্তিতে রচিত মাছআলাসমুহ বাদ দেওয়া হইলে ফেকাহর এক বিরাট অংশই বাদ পড়িয়া যাইবে। এখন বির্চায বিষয় এই যে, হজরত আবু হুরায়রা সম্পর্কে একদিকে ছাহাবা, তাবেয়ীন এবং হাদীছ ও ফেকাহর সেই সকল বিশেষজ্ঞগণ- যাঁহারা নিজেদের সমগ্র জীবনকে হাদীছ ও ফেকাহর খেদমতে ওয়াকফ করিয়া দিয়েছেন তাহাদের অভিমত আর অপর দিকে নাজ্জম জিন্দীক ও তাহার অনুসারীগণ, যাহাদের হাদীছ সম্বদ্ধে অভিজ্ঞতা তো দুরের কথা, স্বয়ং ইসলামে পযর্ন্ত আস্থা নাই  তাহরদের রায়, এ দুই- এর মধ্যে কনটি গ্রহণযোগ্য? বিচারের ভার আমরা পাঠকবর্গের বিচর-বুদ্ধির উপর ন্যস্ত করিলাম।

                                                                 (খ)

                                           হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বছ (রাঃ)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) রছূলুল্লাহ (ছঃ)- এর চাচা হজরত আব্বাছের পুত্র তিনি ৮ম হিজরীতে তাঁহার পিতা হজরত আব্বাছের সহিত মদীনা আগমন করেন। তাঁহার পিতা এই বৎসরই মক্কা বিজয়ের অল্পদিন পূর্ব প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ হিসাবে হজরত আবদুল্লাহ তিন বৎসরকাল রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সাহচর্য লাভ করেন। হুজুরের ওফাতের সময় আবদুল্লাহর বয়স ১২-১৫ বৎসরের মধ্যে ছিল।–ইসতিয়াব-৩৪৩ পৃঃ । তিনি ৭০-এর উপর বয়সে ৬৮ হিজরীতে তায়েফে এন্তেকাল করেন। হাদীছের কিতাবে তাঁহার প্রমখাৎ বর্ণিত মোট ১১৬০টি হাদীছ রহিয়াছে।

স্মরণশক্তি ও ধীশক্তিঃ

হজরত ইবনে আব্বাছের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। তিনি কোন কথা একবার শুনিলেনই স্মরণ রাখিতে পারিতেন। কথিত আছে যে, তিনি ওমর ইবনে রাকীয়ার একটি দীর্ঘ কবিতা একবা মাত্র শুনিয়াই মখস্থ করিয়া ফেলিয়াছেন।– জামে’-৩৬ পৃঃ। এভাবে তাঁহার ধীশক্তিও এত অসাধারণ ছিল যে, তিনি অতি সামান্য মনোযোগেইই নেহায়েত জতিল সমস্যার সমধান করিতে পারিতেন। হাদীছ ও ছারাতের কিতাব ইহার বহু নজীর রহিয়াছে। রছুলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন এবং তাঁহার এলম ও জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বহু দো’আ করিয়াছেন। একবার আবদুল্লাহ তাঁহার খালার ঘরে রছূলুল্লাহর (ছঃ) জন্য অজুর পানি যোগাড় করিয়া রাখিলেন। ইহাতে খুশী হইয়া রছূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহার জন্য দো’আ করিলেনঃ ‘আল্লাহ! তুমি আবদুল্লাহকে দ্ধীনের জ্ঞান ও কোরআনের সমঝ দান কর।‘ এভাবে একবার তিনি রছূলুল্লাহ সতিত (তাহাজ্জদ) নামাজে শরীক হইয়া আদবের খাতিরে সামান্য পিছনে সরিয়া দাড়াইলেন। ইহা দেখিয়া রছূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহার জন্য দো’আ করিলেনঃ আল্লাহ! তুমি তাহাকে এলম ও সমঝ দান কর। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেনঃ আমি রছূলুল্লাহকে (ছঃ) ইবনে আব্বাছের মাথায়া হাত ফিরাইতে এবং তাঁহার জন্য এই দো’আ করিতে দেখিয়াছিঃ ‘আল্লাহ তুমি আবদুল্লাহকে দ্ধীনেরে সমঝ এবং কোরআন বুঝিবার শক্তি দান কর।‘ এছাবা-২/৩২২ পৃঃ

জ্ঞান আহরণের আগ্রহঃ

হজরত ইবনে আব্বাছরে জ্ঞান আহরণের আগ্রহ অত্যন্ত প্রবল ছিল। এ উদ্দেশ্য তিনি সব সময় রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সঙ্গে থাকিতেন। হজরত আবদুল্লাহ প্রায় রাত্র তাঁহার খালা-আম্মা উম্মুল মু’মিনীন হজরত মাইমূনার গৃহেই যাপন করিতেন এবং হুজুরের নিকট হইতে জ্ঞান আহরণ করিতে। হুজুরের এন্তেকালের পর তাঁহার এ আগ্রহ আরো প্রবল হইয়া উঠে এবং তিনি প্রবণ ছাহাবীদের দ্ধারে যাইয়া রছূলুল্লাহ হাদীছ সংগ্রত করিতে আরম্ভ করেন। আদবের খাতিরে অনেক সময় তিনি তাঁহার আগমন সংবাদ না জানাইয়াই ছাহাবীদের দ্ধারে বসিয়া অপেক্ষা করিতেন। ফলে ধুলাবালিতে তাঁহার সর্বশরীর ঢাকিয়া যাইতে।

দারেমীতে আছেঃ তিনি রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর আজাদ করা গোলাম হজরত আবু রাফের নিকট যাইয়া হাদীছ জিজ্ঞাসা করিতেন এবং উহা লিখিয়া লইতেন। দারেমীতে ইহাও রহিয়াছে যে, একবার তিনি তাঁহার সমবয়স্ক জনৈক আনছারীকে বলিলেনঃ ‘হুজুর (ছঃ) এন্তাকল করিয়াছেন। (আজ আমরা তাঁহার নিকট হইতে জ্ঞান আহণের বঞ্চিত হইলাম) চল, তাঁহার ছাহাবীগণের নিকট হইতে জ্ঞানের প্রতি কে মোহতাজ হইবে? আনছারী উত্তর করিলেনঃ ‘এত প্রবীণ ছাহাবী থাকিতে তোমার জ্ঞানের প্রতি কে মোহতাজ হইবে?  ইহা শুনিয়া আবদুল্লাহ একাই জ্ঞান আহরণে আত্মনিয়োগ করিলেনঃ এই যু্বকটি আমা অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমানের কাজ করিছেন।

মোটকথা_ স্মরণশক্তি,ধীশক্তি ও আগ্রহ গুণে তিনি অল্প দিনের মধ্যেই কোরআন,  হাদীছ ও আববী সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন এবং অল্প বয়সে প্রবীণ ছাহাবীগণের নিকটও সম্মান লাভ করিতে সমর্থ হন। হজরত ওমর (রাঃ) পযর্ন্ত তাঁহাকে প্রবীণ ছাহাবীদের সারিতেই বসাইতেন। একবার জনৈক ছাহাবী ইহাতে আপত্তি করিলে হজরত ওমর (রাঃ) উপস্থিত মসলিসে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করিলেন। কেহই ইহার সন্তোষজনক দিতে পারিলেন না। অবশেষে হজরত ওমর (রাঃ) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছের প্রতি ইংগিত করিলেন। তিনি উহার এমন উত্তর দিলেন যাহাতে সকলেউ সন্তুষ্ট হইয়া গেলেন এবং হজরত ওমর (রাঃ) কতৃক তাঁহার সম্মানে কারণ বুঝিতে পারিলেন।

একবার এক ব্যাক্তি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে কোরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেনঅ।তিনি তাহাকে উহা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছের নিকট দরইয়াফত করিতে বলিলেন। প্রশ্নকারী ফিরিয়া  আসিয়া হজরত ইবনে আব্বাছের উত্তর নিবেদন করিলে হজরত ইবনে ওমর বলিলেনঃ  ‘আমি এ যাবঃ মনে করিতাম, কোরাআন সম্পর্কে কথা বলা ইবনে আব্বাছের দুঃসাহস বৈ কিছুই নহে। কিন্তু এখন বঝিতে পারিলাম,সত্যই ইবনে আব্বাছকে ‘জ্ঞন’ দান করা হইয়াছে।‘-এছাবা

এক কথায় অল্প বয়সেই তিনি এক অথৈ বিদ্যার সাগর পরিণত হন এবং লোক তাঁহাকে ‘হিবরুল উম্মাহ’ (আরবী_-------- বা জাতির জ্ঞানাচার্য নামে অভিহিত করেন। হজরত ইবনে আব্বাছ সম্পর্কে পাশ্চাত্য সমলোচকদের অভিযোগ এই যে, এত অল্প বয়সে একটি ছেলের পক্ষে হুজুর (ছঃ)-এর ক্থ ও কার্যের মর্ম উপলদ্ধি করা একরূপ অসম্ভব ব্যাপার। একথা, সত্য যে, হজরত ইবনে আব্বাছর বয়সের প্রতি নজর করিলে আপাততঃ ইহা কঠিন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু তাঁহার পরিবেশ ও অসাধারণ ধীশক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে ইহাতে আশ্চার্যবোধ করিবার কিছুই নাই। এ বয়সের একটা সাধারণ ছেলের পক্ষে রাজনৈতিক সমস্যাবলী উপলদ্ধি করা কঠিন হইলেও রাজ পরিবারভুক্ত ও রাজপরিবেশে প্রতিপালিত একটি বলিষ্ঠ ও অসাধারণ ছেলের পক্ষে ইহা মোটেই কঠিন নহে । নবী ছোলাইমান (আঃ) যে অল্প বয়সেই সূক্ষ্ম বুদ্ধির মালিক হইয়াছিলেন তাহার সাক্ষ্য আল্লাহ তা ‘আলাই দিয়াছেন । একজন নবী বা এত অতীততের কথা কেন, আমাদের এ শেষ যুগের সনীষীবৃন্দের মধ্যেও এমন অনেকে রহিয়াছেন যাঁহার প্রায় এ বয়সের মধ্যেই পূর্ণজ্ঞান লাভ করিয়াছিলন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া দশ বৎসর বয়সে সাধারণ পাঠ্য শেষ করিয়া পনর বৎসর বয়সে ‘ফতওয়া’ দিতে আরম্ভ করেন’ আর সতের বৎসর বয়সে কিতাব লেখা আরম্ভ করেন।শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী [(রঃ) মৃঃ ১১৭৬ হিঃ ] প্রায় এ বয়সেই একজন বিজ্ঞ  আলেমে পরিণত হন এবং মাওলানা  আবদুল্ হাই লক্ষ্মৌবী (মৃঃ ১৩০৪ হিঃ) ১৬/১৭ বৎসর বয়সে অনেক মূল্যবান কিতাব লেখেন।

অতএব, হজরত ইবনে আব্বছের ন্যায় একজন অসাধারণ ছেলের পক্ষে রছূলুল্লাহর (ছঃ) অর্থাৎ, আপন ভাইয়ের কথা না বুঝার অভিযোগ কি সত্যই তাঁহার প্রতি অবিচার নহে? এতদ্ধ্য ভীত তিনি যে, সমস্ত হাদীছই রছূলুল্লাহর জীবনে রছূলুল্লাহর নিকট হইতে লাভ করিয়াছিলেন এ কথা বলিতেছেন কে? তিনি কোন কোন হাদীছ হজরত ওমর (রাঃ), হজরত আলী (রাঃ) ও হজরত উবাই ইবনে কা’বের নিকট শুনিয়াও বর্ণনা করিয়াছেন। আর মোহাদ্দেছগণের সর্ববাদি সম্মত মত এই যে, এক ছাহাবী অপর ছাহাবী অপর ছাহাবীর নিকট হাদীছ শুনিয়া যদি তাঁহার (মধ্যস্থ ছাহাবীর) নাম উল্লেখ না করিয়া সোজাসুজি রছুলুল্লাহ (ছঃ)- এর নাম করিয়াও বর্ণনা করেন এবং বলেন যে, রছূলুল্লাহ (ছঃ) এইরূপে বলিয়াছেন বা করিয়াছেন- তাহাও জায়েজ আছে। কেনান, ছাহাবীগণ সকলেই আমদেল অর্থাৎ, হাদীছ বর্ণনায় সত্যবাদী। আর এ ব্যাপারে যদি হজরত ওমর আলী ও উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ)-ও সত্যবাদী।না হন, তবে দুনিয়াতে কে সত্যবাদী হইবেন?

দ্বিতীয় অধ্যায়

শরীয়তে ছুন্নাহর স্থান

রছূলের দায়িত্বঃ

আল্লাহ তা’আলা তাঁহার কিতাবে দুইটি কথা স্পষ্টভাবে বলিয়া দিয়াছেন। তাঁহার রছুল-এর দায়িত্ব এবং রছুল-এর উম্মতীদের কর্তব্য। রছূল-এর দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ বলিয়াছেন

[আরবী............................]

১. ‘আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি বড় মেহেরবানী করিয়াছেন যে, তিনি তাহাদের প্রতি তাহাদের মধ্য হইতে এমন একজন রছুল পাঠাইয়াছেন যিনি তাহাদের নিকট-(১) আল্লাহর আয়াতসমূহ আবৃত্তি (তেলাওয়াত) করেন, (২) (শিরক ও কুফরীর কলুষ হইতে) তাহাদিগকে পবিত্র করেন এবং (৩) তাহাদেরকে (ক) আল্লাহর কিতাব এবং (খ) হিকমত তা’লীম দিয়া থাকেন।‘ (ছুরা আলে ইমরান-১৬৪)

এই মর্মে ছুরা-বাকারায় দুইটি (১২৯,১৫১) এবং ছুরা জুমাআয় একটি আয়াত রহিয়াছে অপর জায়গায় বলিয়াছেনঃ

[আরবী............................]

২. ‘আমি আপনার প্রতি জিকর (কোরআন) নাজিল করিয়াছি যাহাতে আপনি-তাহাদের প্রতি যাহা নাজিল করা হইয়াছে, তাহাদিগকে তাহা খোলাসা করিয়া বুঝিইয়া দেন।– নহল-৪৪ কলুষ হইতে মানুষকে পবিত্র করা, এবং (৩) কিতাব ও হিকমত মানুষকে হাতে-কলমে তালীম রছুলেরে দায়িত্ব (কবলমাত্র কিতাব পৌছাইয়া দেওয়া (আবৃত্তি করা), (২) শিরক ও কুফরীর দেওয়া বা আল্লাহর কিতাব তাহাদিগকে খোলাসা করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া-এই সকল বিষয় হইল যে সকল দায়িত্ব (কেবলমাত্র কিতাব পৌছাইয়া দেওয়াই নহে)।প্রথমে দফা ব্যতীত তাঁহার অপর

উম্মতীদের কর্তব্যঃ

উম্মতীদের কর্তব্য হইল রছুলের ছুন্নাহর অনুসরণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

১.                [আরবী............................]

‘তোমরা আল্লাহর ‘এতাআত’ (আনুগত্য) করিবে এবং (আল্লাহর) রছূলরে ‘এতাআত’ করিবে।‘- ছূরা নেছা-৫৯ ছূরা মায়েদাহ-৯২, ছূরা নূর-৫৪ ছূরা-মোহাম্মদ-৩৩ এবং ছূরা তাগাবুনের-১২ আয়াতও ইহার অনুরূপ।

এ সকল আয়াতে রছূলের ‘এতাআত’ অর্থ যদি আল্লাহর ‘এতাআত’ অর্থাৎ তাহার কিতাবের অনুসরণই হয় তা হইলে ‘এতাআতের’ জন্য পৃথক ‘(আরবী)------‘(এতআত) শব্দ ব্যবহারের কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। তখন শুধু ‘(আরবী-------------) ‘ ‘আল্লাহ ও তাঁহার রছূলের ‘এতাআত’ কর’ বলাই যথেষ্ট হয়, যে ভাবে ছুরা-আলে ইমরানের একটি আয়াতে বলা হইয়াছে। সুতরাং এ সকল আয়াতে রছুলের ‘এতআত’ অর্থে রছুলের পৃথক ‘এতআত’অর্থাৎ তাঁহার ছন্নাহর অনুসরণকেই বঝিতে হইবে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বলেনঃ ‘রছূলের ‘এতআত ‘কে যদি আল্লাহ তা’আলার এতআত বা তাঁহার কোনআনের আহামের এতাআতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয় তা হইলে কোরআনে যে রছুলের বিশেষ এতআতের কথা বলা হইয়াছে তাহার কোন সার্থকতাই থাকে না।–এলাম

২। অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ

‘(আরবী-------------)

‘হে মু’মিনগণ। তোমরা আল্লাহর ‘এতাআত’ করিবে এবং আল্লাহর রছুল ও তোমাদের মধ্যকার ‘উলিল-আমরা’দের (কর্মকতাদের) ‘এতাআত’ করিবে। যদি কোন বিষয়ে তোমাদের (ও তোমাদের ‘উলিল-আমরা’দের) মধ্যে মতবিরোধ দেখা তা হইলে উহা আল্লাহর প্রতি ও (তাহার) রছুলেন দিকে হাওয়ালা করিবে।–ছূরা নেছা-৫৯

উক্ত আয়াতে সাধারণেন ও ‘উলিল-আমরের’ মধ্যে বিরোধকালে উলিল-আমরের হুকুমকে চুড়ান্ত বলিয়া গ্রহণ করা হয় নাই’ বরং তখন আল্লাহ ও তাঁহার রছুলের হুকুমের প্রতি রুজু করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে বঝা গেল যে, উলিল-আমরের হুকুমের স্বতন্ত্র বা স্বাধীন কোন মর্যাদা নাই; উলিল-আমরের হুকুম আল্লাহ ও তাঁহার হুকুমের প্রতি রুজু করার নির্দেশ এবং তাহার জন্য পৃথকভাবে (আরবী---------) বা ‘এতাআত’ শব্দ ব্যবহারের কোন কারণই ছিল না।

৩। অপর এক আয়াতে বলা হইয়াছেঃ

‘(আরবী-------------)

‘রছূল তোমাদের যাহা দেন তাহা গ্রহণ করিবে এবং যাহা হইতে বিরাত থাকিতে বলেন তাহা হইতে বিরাত থাকিবে।‘ছূরা-হাশর-৭

এ আয়াত হইতে রছূলুল্লাহর ছাহাবীগণ ইহাই বুঝিয়াছিলেন যে, আল্লাহর রছূলেন আদেশ নিষেধ আল্লাহরই আদেশ-নিষেধ। একদা উম্মে ইয়াকুব নাম্নী এক স্ত্রীলোক আসিয়া হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদকে (রাঃ) বলিলেনঃ শুনিলাম, আপনি না কি অমুক কাজ যাহারা করে তাহাদের প্রতি লা’নত করিয়া থাকেন। তিনি উত্তর করিলেনঃ  ‘হাঁ, কোরআন যাহা রহিয়াছেনঃ ‘আমি তাহা করিব না কেন? কোরআনের নাম শুনিয়া উম্মে উয়াকুব সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেনঃ ‘আঃ, কোরআনে রহিয়াছে?  আমি তো সমস্ত কোরআন পড়িয়াছি কৈ, আমি তো কোথাও তাহা হইলে নিশ্চয়ই ইহা দেখিতে; তুমি কি এ আয়াত দেখ নাইঃ ‘রছুল (ছঃ) তোমাদের যাহা দেন তাহা গ্রহণ করিবে এবং যাহা হইতে বিরত থাকিতে বলেন তাহা হইতে বিরত থাকিবে। উম্মে ইয়াকুব বলিলেনঃ ‘হাঁ, ইহা আমি দেখিয়াছি। তখন হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলিলেনঃ ‘রছুলুল্লাহ এ কাজ হইতে বিরত থাকিতে বলিয়াছেন এবং যাহারা উহা করে তাহাদের প্রতি লা’নত করিয়াছেন। সুতারাং আল্লাহও ইহা হইতে বিরত থাকিতে বলিয়াছেন এবং ইহা যাহারা করে তাহাদের প্রতি লা’নত করিয়াছেন।–বোখারী তাফছীরে ছুরা-হাশর

৪। অপর এক আয়াতে আছেঃ

(আরবী------------------------------------------)

‘যখন আল্লাহ ও তাঁহার রছূল কোন বিষয় ফয়ছালা করিয়া দেন, তখন সেই ব্যাপারে কোন মু’মিন নর নারীর নিজস্ব কোন এখতিয়ার থাকে না। আর যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও তাঁহার রছুলের নাফরমানী করে (ফয়ছালার ব্যাতিক্রম করে) সে প্রকাশ্য গোমরাহীতে পতিত হয়। আহযাবা-৩৬ এ আয়াতটি নাজিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে মুফাচ্ছিরগণ বলেনঃ ‘রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম জুলাইবীর নামীয় এক ছাহাবীর জন্য এক আনছারী মেয়ের বিবাহের হয় এবং বলা হয় যে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ফয়ছলার পর এ বিষয় এই যে, বিবাহের প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত করিলেন আল্লাহর রছূল (স্বয় আল্লাহ নহে), অথচ আল্লাহ ইহাকে নিজের সিদ্ধান্ত বলিয়াই ঘোষণা করিতেছেন এবং বলিতেছেন যে, ‘যখন আল্লাহ ও তাঁহার রছূল কোন সিদ্ধান্ত করেন। ইহাতে বুঝিগেল যে, আল্লাহর রছুলের সিদ্ধান্ত বস্ততঃ আল্লাহরই সিদ্ধান্ত। সঙ্গে একথাও যদি রছুল ছাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কোন সিদ্ধান্ত করিয়া ফেলেন উম্মতীগণ তাহা মানিতে বাধ্য।

৫। আর এক আয়াতে আছেঃ

(আরবী-------------)

‘আপনার রব্বের কছম! তাহারা কখনো মু’মিন হইতে পারিবে না যে পযর্ন্ত না তাহারা তাহদের বিরোধীয় বিষয়ে আপনাকে সালিস মানে, লয়।‘ ছুরা নেছ-৬৫

এ আয়াতে নাজিল হওয়ার কারণ সম্বদ্ধ বোখারী শরীফে যে ঘটনাটির উল্লেখ রহিয়াছে তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তাহাতে রাহয়াছেঃ রছূল্লাহ (ছঃ)- এর ফুফাতু ভাই হজরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম এবং জনৈক মদীনাবাসীর মধ্যে জামিনে পানি সেচ লইয়া এক মতবিরোদ দেখাদেয় এবং মীমাংসার জন্য উহা হুজুরের নিকট পেশ কা হয়। হুজুর ছাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়াছাল্লাম জুবায়েরকে বলিলেনঃ ‘তোমার জমিন সেচ করিয়া পরে উহা তোমার প্রতিবেশীর জমিনের দিকে ছারিয়া দিও। ইহা শুনিয়া প্রতিবেশীটি বলিয়া উঠিলঃ ‘আপনার ফুফাতু ভাই তো? ইহা শুনিয়া রাগে হুজুরের চেহারা লাল হইয়া গেল এবং হুজুর বলিলেনঃ ‘জুবায়ের, আইল ভাসিয়া যাওয়া পযর্ন্ত তুমি পান বন্ধ রাখিবে। (সে কি মনে করিয়াছে যে, আমি পক্ষাপাতিত্ব করিয়াছে?) হজরত জুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ ‘আমি মনে করি, আয়াতটি এ ঘটনা উপলক্ষেই নাজিল হইয়াছে।‘ বোখারী তাফছীরে ছূরা-নেছা

এখানে দেখা যাইতেছে যে, ফয়ছালা সম্পর্কে আপত্তি করায় আল্লাহ তাহার ঈমানকেই বাতিল করিয়া দিতেছেন অথচ ফয়ছালা ছিল রাছুলুল্লাহর, আল্লাহর নহে।

৬। অপর এক আয়াতে রহিয়াছেঃ

(আরবী****************************************************************)

‘যাহারা তাহার (রছুলের) হুকুমের বিরোধিতা করে তাহাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে, তাহাদের প্রতি যেন কোনো কঠিন বিপদ অথবা কঠোর আজাব আসিয়া না পড়ি।‘ ছূরা-নুর-৬৩

এসকল আয়াত হইতে ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে যে, রছূলুল্লাহ আলাইহে ওয়াছাল্লাম দ্বীন সম্পর্কে যাহা বলিয়াছেন-চাই উহা কোরআনরূপেই হউক, চাই ছুন্নাহরূপে-সবই ওহী, সবই আল্লাহর কথা। সুতরাং রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর উম্মতীদের পক্ষে তাহার ছুন্নাহর অনুসরণ করা ফরজ, যেভাবে আল্লাহরই কিতাবের অনুসরণ করা ফরজ, আল্লাহর রছুলের আনুগত্য (এতাআত) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী****************************************************)

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রছুলের এতাআত করিয়াছে সে আল্লাহরই এতাআত করিয়াছে।‘

ইমাম শাফেয়ী (রাঃ) বলেনঃ ওলামাদের সর্ববাদিসম্মত মতে ছুন্নাহ তিন প্রকার।----নেছা-৮০

(১) যাহাতে-কোরআনে যাহা রহিয়াছে হুবহু তাহাই রহিয়াছে।

(২) যাহাতে-কোরআনে যাহা রহিয়াছে তাহার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হইয়াছে।

(৩) যাহাতে-কোরআনে যে বিষয়ে নীরব সে বিষয়ে নূতন কথা ১.(আপাতদৃষ্টিতে নূতন বলিয়া মনে হইলেও আসলে উহা নূতন নহে। অবশ্য কোন কোনটির সম্পর্কে এত সূক্ষ্ণ যে, সকলের পক্ষে উহা বুঝা সহজ নহে। তবে রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের পক্ষে তাহাও সহজ ছিল।‘)

বলা হইয়াছ।

অতঃপর তিনি বলেনঃ ‘ছুন্নাহ যে কোন প্রকারেরই হোক না কেন আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্ট-ভাবে বলিয়া দিয়াছেন যে, উহাতে আমাদিগের তাহার রছুলের ‘এতাআত’ করিতে হইবে। রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছুন্নাহ জানিয়া উহার বরখেলাফ করার অধিকার আল্লাহ কাহাকেও দেন নাই।‘২(আরবি টিকা**********************************************************)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমও ছূন্নাহকে উপরি-উক্ত তির প্রকারে ভাগ করিয়া বলেনঃ ‘কোন প্রকারের ছুন্নাহই কিতাবুল্লাহর বিরোধী নহে। যেখানে ছুন্নাহয় নুতন কথা রহিয়াছে সেখানে উহা রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর পক্ষে হইতে নূতন বিধান বলিয়া মনে করিতে হইবে। এ ব্যাপারেও আমাদের অবশ্যই তাঁহার ‘এতাআত’ করিতে হইবে, অবাধ্যতা করা চলিবে না। ইহা দ্ধারা কিতাবুল্লাহর উপর ছূন্নাহর মর্যাদা দান করা হইতেছে না, বস্তুতঃ ইহা দ্ধারা আল্লাহ তা’আলা যে রছূলল্লাহ ছাল্লাহু আলাইলহে ওয়াছল্লাম-এর ‘এতআত’ করার নির্দেশ দিয়াছেন তাহারই বাস্তব-রুপে দান করা হইতেছে। এ ব্যাপারে যদি ‘তাহার ‘এতআত করা না হয়, তাহা হইলে তাঁহার  ‘এতাআতের’ কোন অর্থই থাকে না।

[আরবী টীকা---------------------------------------]

অতঃপর তিনি বলেনঃ যিনি (অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা) একথা লিয়াছেনঃ

(আরবী-----------------)

‘রছূল তোমাদের যাহা দেন তাহা গ্রহণ করিবে এবং যাহা হইতে বিরত থাকিতে বলেন তাহা হইতে বিরত থাকিবে।‘- তিনি তাঁহার রছূলের মারফত আমাদের উপর তাঁহার কিতাকের অতিরিক্ত এ সকল বিষয়কে শরীয়তের বিধানরূপে নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন।–

[আরবী টীকা-----------------------]

আর একটু অগ্রসর হইয়া তিনি বলেনঃ ইহার বিরুদ্ধাচরণ করা উহারই (অর্থাৎ, কিতাবুল্লাহরই) বিরুদ্ধাচরণ করা।‘ এক কথায় আল্লাহর কিতাব যেরূপ শরীয়তের অপর একটি উৎস,- রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছূন্নাহও সেরূপ শরীয়তের একটি উৎস- যদিও উভয়ের মর্যাদা সমান নহে। ইহা হইলে শরীয়তে ছুন্নাহর স্থান।

ছুন্নাহ অনুসরণের জন্য রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর তাকীদঃ

আল্লাহ তা’আলা যেরূপ রছূল-এর ছুন্নাহ অনুসরণের জন্য তাঁহার বান্দাদের তাকীদ করিয়াছেন, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম নিজেও তাঁহার উম্মতীদের তাঁহার ছু্ন্না অনুসরণের জন্য তাকীদ করিয়াছেনঃ

১। বিদায় হজ্জের খোঃবায় তিনি বলেনঃ

(আরবী-------------------)

আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছিঃ আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার রছূলের ছুন্নাহ। যে পযর্ন্ত তোমরা এই দুইটিকে ধরিয়া থাকিবে সে পযর্ন্ত গোমরাহ হইবে না।‘

মোআত্তা, মেশকাত

২।অন্য হাদীছে রহিয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

(আরবী-------------------)

‘আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছিঃ ইহা অবলম্বন করার পর তোমরা কখনো গোমরাহ হইবে না। আল্লাহর কিতাব এবং আমরা ছুন্নাহ। এই দুইটি এক অপর হইতে কখনও পৃথক হইবে না, যে পযর্ন্ত না কেয়ামতে হাওজের পাড়ে ইহার আমার সহিত মিলিত হয়।‘- মোস্তদরাকে হাকেম

৩। আর এক হাদীছে রহিয়াছেঃ

(আরবী-------------------)

‘আমার পর তোমাদের মধ্যে যাহারা বাচায়া থাকিবে তাহার বহু এখতেলাফ দেখিবে, তখন তোমরা আমার ছুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের ছুন্নাহকে মজবুত করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে।‘- আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবেন মাজাহ

৪। অন্য এক হাদীছে হরিয়াছেঃ

(আরবী-------------------)

যে ব্যক্তি আমার ছুন্নাহ হইতে বিমুখ হইবে  সে আমার মিল্লাতের মধ্যে নহে।

বোখারী ও মোছলেম

৫। তিনি আরও বলিয়াছেনঃ

(আরবী-------------------)

‘যে আমার ছুন্নাহকে ভালবাসিয়াছে সে আমাকে ভালবাসিয়াছে।–তিরমিজী

৬। অপর হাদীছে রহিয়াছে, হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছোনঃ

(আরবী-------------------)

যে ব্যাক্তি আমার ছুন্নতসমূহের মধ্যে এমন কোন ছুন্নতকে জেন্দা করিয়াছেন, যাহা আমার পর পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহার জন্য সে সকল লোকের পরিমাণ ছওয়াব রহিয়াছে, যাহারা ইহার সহিত আমল করিবে। অথচ তাহাদের ছওয়াবেরও কোন অংশ হ্রাস করা হইবে না।

তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ

ছুন্নাহ অস্বীকার সম্পর্কে রছুলুল্লাহর ভবিষ্যদ্বণীঃ

১। রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ

(আরবী-------------------)

‘(মু’মিনগণ) জানিয়া রাখ, আমাবে কোরআন দেওয়া হইয়াছেন এবং উহার সহিত উহার অনুরূপ (ছুন্নাহ)-ও দেওয়া হইয়াছে।আর ইহাও জানিয়া রাখ যে, এমন এক সময় আসিয়া পৌছিবে যখন কোন উদরপুর্ণ বড় লোক তাহার গদীতে ঠেস দিয়া বসিয়া বলিয়াঃ তোমরা শুধু এই কোরআনকেই গ্রহণ করিবে। উহাতে যাহা হালাল পাইবে তাহাকে হালাল জানিবে এবং উহাতে যাহা হারাম পাইবে তাহাকে হারাম মনে করিবে। অথচ আল্লাহর রছুল যাহা হারাম করিয়াছেন (অর্থাঃ, আমি যাহা হারাম বলিয়াছি) তাহা আল্লাহ যাহা হারাম করিয়াছেন তাহার অনুরূপ। অতঃপর রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম উদাহরণস্বরূপ গৃহপালিত গাধা, শিকার- দাওয়ালা পশু ও সন্ধতে আবদ্ধ অ-মুসলমান মুযাহিদদের হারানো বস্ত মুসলমানদের পক্ষে হালাল নহে এবং মুছাফিরকে আহার করানো আবশ্যক বলিয়া উল্লেখ বরেন’- অথচ এ সকল কথা কোরআনে নাই।– আবু দাউদ, দারেমী ও ইবনে মাজাহ, মিশকাত

২। অন্য হাদীছে রহিয়াছে, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলেনঃ

(আরবী-------------------)

‘আমি যেন তোমাদের কাহাকেও এরূপ না দেখিঃ সে তাহার গদীতে ঠেস দিয়া বসিয়া থাকিবে এবং তাহার নিকট আমার কোন পৌছিবে- যাহাতে আমি কোন বিষয় আদেশ করিয়াছি অথবা নিষধ করিয়াছি- আর সে বলিবেঃ ‘আমি এসব কিছু জানি না, আল্লাহর কিতাবে যাহা পাইবে তাহারই অনুসরণ করিব।

(আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী-মেশকাত)

ছুন্নাহ অস্বীকার করার রহম্যঃ

যে কোন ভাষায় একটি শব্দের বিভিন্ন অর্থ হইতে পারে; একটা বাক্যও একাধিক ভাব বুঝাইতে পারে। কোন বক্তা বা লেখক তাঁহার বক্তৃতা বা লেখায় (উদ্দেশ্যমূক প্রয়োগ ব্যতীত) কখনো উহা দ্ব্যর্থরূপে ব্যবহার করেন না। শব্দ বা ব্যক্য প্রয়োগকালে তাঁহার নিকট একটি মাত্র অর্থ বা ভাবই সুনির্দিষ্ট থাকে। বক্তার মখভংগি বা পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা শ্রোতা সহজেই উহা উপলব্ধি করিতে করিতে পারে।এরূপে লেখকের সহিত ব্যক্তিগতভাবে বা তাঁহার মতবাদ ও লেখকের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিবে। বিশেষ করিয়া যাহাকে উদ্দেশ করায়া কথা বলা হইয়াছে বা লেখা সে। পক্ষান্তরে এ সকল দিক দিয়া বক্তা বা লেখকদের সহিত যার যত অধিক ব্যবধান থাকিবে তাহার পক্ষেন্তরে তাঁহাদের উদ্দেশ্য বুঝা ততই কঠিন হইবে। তাঁহার নজদিক তাহাদের বক্তৃতা বা লেখা অনেক জায়গায় দ্ব্যর্থবোধক হইয়া দাড়াইবে।

এ সত্যকে সম্মুখি রাখিয়া বিচার করিলে বলিতে হইবে যে, আল্লাহর কালামের অর্থ বা উদ্দেশ্য আল্লাহর রছুলই অধিক বুঝিয়াছিলেন। কেননা, তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়াই উহা বলা হইয়াছে। (অতঃপর তাহার ছাহাবীগণই উহা অধিক বুঝিয়াছিলেন। কারণ তাহারা তাহার হাব-ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন।) অতঃপর তিনি তাহার কথা, কার্য ও মৌন-সম্মত তথা আপন জীবন দ্বারা উহার ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আর ইহারই নাম ছুন্নাহ। সুতরাং ছূন্নাহ হইল কোরআনের প্রকৃত অর্থ-নির্দেশক বা উহার বাস্তব ব্যাখ্যা। এমতাবস্থায় ছূন্নাহ অস্বীকার করার অর্থই হইল শরীয়তের বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করা। যাহারা ছূন্নাহ অস্বীকার করিবে তাহাদের পক্ষে কোরআনের যথেচ্ছা অর্থ করা চলিবে। তাহাদের উচ্ছৃংখল জীবন যাপনের পক্ষে সুযোগ বাহির হইয়া আসিবে। ইহাই হইল ছুন্নাহ অস্বীকার করার আসল রহস্য।

ছুন্নাহর আনুগত্য উম্মতীগণ

ছাহাবীগণের যুগ হইতে এ যোগ পর্যন্ত দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানই এ বিশ্বাস পোষণ করিয়া থাকে যে, আল্লাহর কিতাবের এতাআত বা হুকুম পালন করা যেমন ফরজ, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছুন্নাহর হুকুম পালন করাও তাহাদের পক্ষে তেমন ফরজ। আল্লাহর কিতাব যেরূপ ইসলামী শরীয়াতের একটি উৎস, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছূন্নাহও সেরূপ উহার অপর একটি উৎস। কিতাবুল্লাহর পরেই ছুন্নাহর স্থান। আর কিতাব ও ছূন্নাহ উভয় মিলিয়াই রচনা করিয়াছে ইসলামী শরীয়ত। ইমামগণ তাহাদের মাজহাবের বুনিয়াদও রাখিয়াছেন এ দুই-এর উপর।

ছাহাবীগণঃ

ছাহাবীগণের মধ্যে সকলেই ছুন্নাহকে ইসলামী শরীয়াতের একটি উৎস বলিয়া মনে করিতেন। তাহাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা কাহারো পক্ষে সম্ভবপর হইবে না। যিনি ছূন্নাহ সম্বন্ধে ইহার বিপরীত মত পোষণ করিতেন। তাই তাহাদের সম্মুখে যখনই কোন সমস্যা উপস্থিত হইত তখনই তাহারা প্রথমে উহার সমাধান আল্লাহর কিতাবে অতঃপর রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ছূন্নাহয় তালাশ করিতেন। খোলাফায়ে রাশেদীনেরও এ নিয়ম ছিল। তাহারা কখনো কোন বিষয় ইছতেহাদ করেন নাই যে পর্যন্ত না উহা ছূন্নায়হ অনুসন্ধান করিয়াছেন।

মাইমুন ইবনে মহরান বলেনঃ ‘হজরত আবু বকর ছিদ্দীকের (রাঃ) নিকট যখন কোন সমস্যা উপস্থিত হইত, তখন তিনি উহার সমাধান প্রথমে আল্লাহর কিতাবে তালাশ করিতেন। উহাতে না পাওয়া গেলে তিনি উহা রছূলের ছুন্নাহয় তালাশ করিতেন। তাহার জানা ছূন্নাহয়ও যদি উহা পাওয়া না যাইত তখন তিনি অপর ছাহাবীদের জিজ্ঞাসা করিতেন-এ ব্যাপারে রছূলুল্লাহর (ছঃ) কোন ছুন্নাহ রহিয়াছে কি না? দারেমী, হজ্জাত-১৪৯ পৃঃ। হজরত ওমর, হজরত ওছমান ও হজরত আলী (রাঃ) ও এ নিয়মেরই অনুসরণ করিয়াছেন। নীচে ইহার কতিপয় উদাহরণ দেওয়া গেল।

প্রথম খলীফা হজরত আবু বকর (রাঃ)ঃ

(১) রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর এন্তেকালের পর যখন তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে হজরত ফাতেমা (রাঃ), হজরত আব্বাছ (রাঃ) ও উম্মাহাতুল মু’মেনীনগণ স্ব স্ব মীরাছের দাবী জানাইলেন তখন তিনি তাহাদের সকলকে এই বলিয়া বারণ করেণ যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

‘আমরা নবীগণ কাহারো মীরাছ লাভ করি না এবং অপর কেহও আমাদের মীরাছ লাভ করে না। আমরা যাহা রাখিয়া যাই তাহা জনসাধারণেরই।‘ বোখারী ও মোসলেম, মেশকাত

(২) রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে কোথায় দাফন করা হইবে এ লইয়া যখন ছাহাবীগণ এখতেলাফ করিতে থাকেন, তখন হজরত আবু বকর (রাঃ) এ বলিয়া তাহাদের শান্ত করিয়া দেন যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

‘নবীগণ যেখানে সমাধীস্থ হইতে ভালবাসেন সেখানেই আল্লাহ তা’আলা তাহাদের ওফাত করেন।‘ তিরমিজী ও মোয়াত্তা

(৩) রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ওফতের পর যখন কোন কোন আরব গোত্র জাকাত প্রদান করিতে অস্বীকার করে এবং খলীফা হজরত আবু বকর (রাঃ) তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত করেন, তখন হজরত ওমর (রাঃ) তাহাকে  এ বলিয়া বারণ করিতে চাহেন যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ ‘আমাকে মানুষের সহিত লড়িতে আদেশ দেওয়া হইয়াছে যে পর্যন্ত না তাহারা কলেমা পড়ে, যখন তাহারা কলেমা পড়িবে তখন আইনসংগত কারণ ব্যতীত তাহাদের জান-মালের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নাই।‘ মেশকাত

এ সময় খলীফা হজরত আবু বকর (রাঃ) হজরত ওমর (রাঃ) কে এ বলিয়া উত্তর দান করিলেন না যে, আপনি কোরআন পেশ না করিয়া হাদীছ পেশ করিতেছেন কেন, হাদীছ হইতে কি শরীয়ত গ্রহণ করা যাইতে পারে? বরং তিনি (আবু বকর) অপর দলিল দ্বারা তাহাকে ব্যাপার বুঝাইয়া দিলেন।

(৪) রছুলুল্লাহ  (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম এর এন্তেকালের পর যখন আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে কাহাদের মধ্য হইতে খলীফা নির্বাচীত হইবেন এই নিয়া মতবিরোধ দেখা দিল, তখন হজরত আবু বকর (রাঃ) বলিলেনঃ ‘রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ ‘(প্রাথমিক) ইমাম বা খলিফাগণ কোরাইশদের মধ্যে হইতেই  হইবে।‘ ইহাতে সকলে শান্ত হইয়া গেলেন।

(৫) হজরত ছিদ্দীকের নিকট দাদী তাহার নাতীর মীরাছের অংশ পাইবে কি না জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি এ ব্যাপারে কোন হাদীছ আছে কি না ছাহাবীদের জিজ্ঞাসা করিলেন। ছাহাবী হজরত মুগীরা ইবনে শো’বা হাদীছ পেশ করিলেন এবং মোহাম্মদ ইবনে মাছলামা (রাঃ) উহার যথার্থতার সাক্ষ্য দান করিলেন, অতঃপর তিনি দাদীকে ষষ্ঠাংশ দেওয়ার হুকুম দিলেন।

খলীফা হজরত ওমর (রাঃ)ঃ

(১) হজরত ওমর (রাঃ) বলিয়াছেনঃ ‘ভবিষ্যতে এমন একদল লোক সৃষ্টি হইবে যাহারা কোরআনের দ্ব্যর্থ বা সন্দেহযুক্ত বর্ণনা লইয়া তোমাদের সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইবে। তোমরা ছুন্নাহ  দ্বারা তাহাদের উত্তর দিও। কেননা, ছুন্নাহ-অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণই কোরআনের অধিক মর্মাভিজ্ঞ হইয়া থাকেন।‘ (অর্থাৎ, ছুন্নাহয়ই কোরআনের সঠিক মর্ম বিবৃত হইয়াছে।)

                                                                                 মীজানে শা’রানীর ভূমিকা ১৩ পৃঃ

(২) একদা খলীফা ওমর (রাঃ) সাধারণ্যে ঘোষণা করিলেনঃ ‘আমি আমার কর্মচারীবৃন্দকে তোমাদের নিকট এজন্য পাঠাই নাই যে, তাহারা তোমাদের মারিয়া চর্ম খসাইয়া লইবে অথবা তোমাদের বিষয়-সম্পদ ছিনাইয়া লইবে। আমি তাহাদের এজন্য পাঠাইয়াছি যে, তাহারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন এবং তোমাদের নবীর ছুন্নাহ শিক্ষা দিবেন।‘-এ’লাম-১-১১৭ পৃঃ

(৩) হজরত ওমর (রাঃ) কাজী শুরাইহের প্রতি এক নিদের্শনামায় বলেন, ‘যদি তোমার নিকট এমন কোন ঘটনা উপস্তিত হয় যাহার সমাধান আল্লাহর কিতাবে রহিয়াছে, তা হইলে তুমি ঐরূপেই ফয়ছালা করিবে এবং কাহারো মতের পরওয়া করিবে না। আর এইরূপ ঘটনা যদি উপস্থিত হয় যাহার সমাধান আল্লাহর কিতাবে নাই তা হইলে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছুন্নাহয় তালাশ করিবে এবং তদনুযায়ী ফয়ছালা করিবে।‘

                                                                         দারেমী, হুজ্জাত ১৪৯ পৃঃ

(৪) একবার তিনি খোৎবা দানকালে বলিলেনঃ ‘লোকসকল!  তোমাদের জন্য ছুন্নত নির্দিষ্ট এবং ফরজ নির্ধারিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অপিচ তোমাদেরকে  দ্বীনের সরল-সোজা পথ প্রদর্শন করা হইয়াছে-যদি না তোমরা ইচ্ছা করিয়া লোকদেরসহ ডানে-বামে সরিয়া পড়।‘ অতঃপর তিনি বলিলেনঃ ‘সাবধান, (কোরআনে না থাকিলেও) ব্যভিচারীকে পাথর বর্ষাইয়া মারার হুকুম অস্বীকার করিয়া আল্লাহর অসন্তোষভাজন হইও না। কেননা, আল্লাহর রছুল ব্যভিচারীকে পাথর বর্ষাইয়া মারিয়াছিলেন, তাই আমরা ও ইহা করিয়া থাকি।‘ ই’তেছাম-১-৮৯ পৃঃ

(৫) তিনি আরও বলিয়াছেনঃ  ‘যাহারা দ্বীনের ব্যাপারে নিজেদের রায় দ্বারা মন গড়া কথা বলিবে তাহাদের হইতে সতর্ক থাকিবে। তাহারা হাদীছের শত্রু। হাদীছ হেফজ করা (রক্ষা করা)  তাহাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হইবে বলিয়াই তাহারা এইরূপ করিবে। ইহাতে তাহারা নিজেরাও গোমরাহ হইবে অপরদেরও গোমরাহ করিবে।‘ –ই’তেছাম-১-১২৪ পৃঃ

(৬) খলীফা হজরত ওমর (রাঃ) একবার সেনাপতি হজরত আবু উবাইদার যুদ্বক্ষেত্র পরিদর্শন উদ্দেশ্য শাম রওয়ানা হইলেন। ‘ছরগ’ নামক স্থানে পৌছায়া জানিতে পারিলেন যে, গন্তব্যস্থলে মহামারী আরম্ভ হইয়াছে। ইহাতে তিনি চিন্তিত হইয়া পড়িলেনঃ তথায় যাইতে হবে কি না এব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ কি? এ সময় হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বলিলেনঃ ‘আমি রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছিঃ কোথাও  মহামারী আরম্ভ হয় তবে ইচ্ছা করিয়া তথায় যাইবে না আর (পূর্ব হইতেই) যদি তথায় তুমি থাকিয়া থাক তাহা হইলে ভয়ে পলায়নও করিবে না।‘ ইহা শুনিয়া হজরত ওমর (রাঃ) তথা হইতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। ফাহম

(৭) হজরত ওমরের অভিমত ছিল, স্ত্রী তার নিহত স্বামীর দীয়তের অংশ পাইতে পারে না। ছাহাবী জাহহাক ইবনে ছুফইয়ান তাঁহাকে জানাইলেন যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আশইয়াম জেবাবীর দীয়ত (রক্তপণ) তাহার স্ত্রীকে প্রদানের জন্য তাহাকে (জাহহাককে) নির্দেশ দিয়াছিলেন। ইহা শুনিয়া তিনি নিজের মত পরিত্যাগ করেন।–তিরমিজী

(৮) এভাবে ‘জনীন’ বা ভ্রুণ হত্যার দীয়ত সম্পর্কে হজরত ফারূকের ধারণা ছিল; উট বা বকরী প্রদান করিলেই চলিবে। কিন্তু হজরত মুগীরা (রাঃ) প্রমুখাৎ যখন জানিতে পারিলেন যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম এ ব্যাপারে গোলাম-বাঁদী আজাদ করার কথাই বলিয়াছেন, তখন তিনি তাঁহার পূর্ব মত পরিবর্তন করিলেন। ফাহম ৮৮ পৃঃ

(৯) একদিন বনী ছকীফের একজন লোক আসিয়া হজরত ফারূককে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ (হজ্জের সময়) তাওয়াফে জিয়ারত করার পর যদি কোনো স্ত্রীলোকের ঋতু আরম্ভ হইয়া যায়, তাহা হইলে সে আর অপেক্ষা না করিয়া বাড়ী ফিরিতে পারে কি না? তিনি উত্তর করিলেনঃ না পারি না। (মিনায় অবস্থান করিতে হইবে) ছকফী লোকটি বলিলঃ ‘আমি রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে ইহার বিপরীত হুকুম দিতে শুনিয়াছি।‘ ইহা শুনিয়া হজরত ফারূক ছকফীর প্রতি দোররার আঘাত করিয়া বলিলেনঃ ‘(পাজি কোথাকার!) যে ব্যাপারে স্বয়ং রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নির্দেশ জানা আছে সে ব্যাপারে আবার আমায় জিজ্ঞাস করিলে কেন? ফাহম ৮৮ পৃঃ, মাআলিম-৪-৩২ পৃঃ

খলীফা হজরত ওছমান (রাঃ)

(১) ছাহাবীগণ খলীফা হজরত ওছমান গণীর হাতে খেলাফতের বয়আত এভাবে করিয়া-ছিলেনঃ ‘আমরা আল্লাহর কিতাব, রছুলের ছুন্নাহ এবং খলীফা হজরত আবু বকর ও ওমরের ছুন্নাহ অনুসারে চলিব-আপনার নিকট এই অংগীকার করিতেছি।‘ আর তিনিও তাঁহাদের নিকট হইতে এইরূপ বয়আতই গ্রহণ করিলেন।

(২) হজরত ওছমান গণী (রাঃ)-এর ধারণা ছিল, স্বামী-মৃত স্ত্রীলোক তাহার ইদ্দতকালে  যথা ইচ্ছা অবস্থান করিতে পারে। হজরত আবু ছাঈদ খুদরীর ভগ্নি ফরিয়াহ বিনতে মালেক যখন বলিলেনঃ ‘আমার স্বামী নিহত হওয়ার পর রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আমাকে আমার নিহত স্বামীর গৃহেই ইদ্দত পালন করিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন’, তখন তিনি তাঁহার নিজ মত পরিহার করিলেন।---মোয়াত্তা

(৩) হজরত ওছমান (রাঃ) ‘তামাত্তো’ বা হজ্জের সাথে ওমরাহ করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু হজরত আলী মোরতাজার নিকট হাদীছ শুনিয়া তিনি তাঁহার মত পরিত্যাগ করিলেন।

খলীফা হজরত আলী (রাঃ)ঃ

(১) একদা হজরত আলী (রাঃ) বলেনঃ ‘শরীয়ত যদি শুধু কেয়াছ অথবা কাহারো বিবেক-বুদ্ধির উপরই নির্ভরশীল হইত তা হইলে (ওজুর সময়) মোজার উপরদিকে মছেহ না করিয়া উহার নিচের দিকে মছেহ করাই সংগত হইত। অথচ রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম উহার উপরিভাগ মছেহ করিয়াছেন।--বুলুগুল মারাম

(২) একবার হজরত আলী মোরতাজার নিকট কতক ইসলামত্যাগী মুরতাদকে আনা  হইল। তিনি তাহাদের আগুনে পুড়াইয়া মারিতে নির্দেশ দিলেন। এসময় হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলিয়া উঠিলেনঃ ‘রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি তাহার দ্বীন পরিত্যাগ করিয়াছে তাহাকে (তরবারির দ্বারা) কতল করিবে।‘ ইহা শুনিয়া তিনি হুকুম পরিবর্তন করিলেন এবং বলিলেনঃ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) সত্য বলিতেছে।

খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রাঃ)ঃ

(১) পঞ্চম ‘খলীফায়ে রাশেদ’ হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রাঃ) বলেনঃ ‘রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম, অতঃপর খোলাফায়ে রাশেদীন বহু ছুন্নত কায়েম করিয়া গিয়াছেন। সে গুলি অনুসরণ করার মানে আল্লাহর কিতাবেরই সমর্থন করা, তাঁহার এতাআত-আনুগত্যের পূর্ণতা সাধন করা এবং তাঁহার দ্বীন পালনে শক্তি বৃদ্ধি করা। এ সকল ছুন্নাহর রদবদল করা বা উহার বিপরীত করা কাহারো পক্ষে জায়েজ নহে। যে  ব্যক্তি উহা অনুসারে আমল করিয়াছে সে হেদায়ত লাভ করিয়াছে। যে ব্যক্তি উহার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে সে জয়লাভ করিয়াছে। পক্ষান্তরে যে উহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে, সে মু’মিন-গণের পন্হা ত্যাগ করিয়া অপরদের পন্হা এখতিয়ার করিয়াছে।----এ’তেছাম-১-১০৩ পৃঃ

(২) হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ  তাঁহার শাসনকর্তাদের লিখিয়া  জানাইয়াছিলেন যে, আল্লাহর কিতাব  যাহা আছে সে সম্পর্কে কাহারো কোন রায় বা মত প্রকাশের অধিকার নাই। মনীষীবৃন্দের অভিমত কেবল সেই সম্পর্কে প্রযোজ্য যে সম্পর্কে আল্লাহর কিতাবে কোন সমাধান নাই এবং রছূলুল্লাহর ছুন্নাহয়ও কিছু নাই। রছূলুল্লাহর ছুন্নাহয় যে বিষয়ের সমাধান রহিয়েছে সে সম্পর্কেও কাহারো মত প্রকাশের কোন অধিকার নাই। দারেমী, হুজ্জাতুল-১৫০ পৃঃ

                                                         ছুন্নাহ সম্পর্কে ইমামগণ

ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)

ইমাম আজম আবু হানীফা (রাঃ) ছুন্নাহ সম্পর্কে স্বীয় অভিমত নিন্মলিখিত ভাষার (কথায়) ব্যক্ত করিয়াছেনঃ

১। ছুন্নাহ না হইলে আমাদের কেহই কোরআন বুঝিতে সক্ষম হইতে না। মীজানে শা’ রানী

২। সাবধান, দ্বীন সম্পর্কে কখনও কোনো মনগড়া কথা বলিবে না। এ সম্পর্কে ছুন্নাহর অনুসরণ করিবে। যে ব্যক্তি ছুন্নাহ হইতে দুরে সরিয়া গিয়াছে সে গোমরাহ হইয়াছে।

৩। মানুষ কল্যাণের সহিত থাকিবে যে পযর্ন্ত তাহাদের মধ্যে হাদীছ অনুসন্ধাকারী থাকিবে। যখন তাহার হাদীছবে বাদ দিয়া এলম তলব করিবে তখন ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইবে।

৪। যখন কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাইবে, তখন উহাই আমার মাজহাব।_ শামী-১/৬৩

৫।যখনই আমার কোন আল্লাহর কিতাব বা রছূলের হাদীছের বিপরীত বলিয়া প্রমাণিত হইবে, তখনই উহাকে পরিত্যাগ করিবে।– শামী

৬। এছাড়া তিনি নিজেই পাঁচ শতের উপরে হাদীছ হেফাজ ও রেওয়ায়ত করিয়াছেন, যাহা ‘মোহাম্মদে ইমাম আজম’ নামক কিতাবে সংগৃহীত হইয়াছে।

ইমাম মালেক (রঃ)

ইমাম মাকলে (রঃ) হাদীছ সম্বন্ধে তাঁহার অভিমত এভাবে প্রকাশ করিয়াছনঃ

(১) আমি একজন সাধারণ মানুষ, দ্বীন সম্পর্কে কোন কথার ভলও করিতে পারি এবং সত্যেও উপিনীত হইতে পারি। সুতরাং আমার কথাকে কিতাব ও ছুন্নহর সহিত যাচাউ করিয়া দেখিবে, যাহা উহাদের মোয়াফিক হইবে গ্রহণ করিবে এবং যাহা উহাদের মোখলিফ হইবে পরিত্যাগ করিবে।– জামে’ বয়ানুল এলম-৩২ পৃঃ

২। মানুষের কথাবে মানুষ গ্রহণও করিতে পারে অথবা বর্জনও করিতে পারে। কিন্তু নবীর কথাকে বর্জন করার অধিকার কাহারও নাই।– উছুলুল আহকাম ইবনে হাজম-৬/১৩৫ পৃঃ

৩। তাঁহার কিতাব ‘মোয়ত্তা’ই হাদীছের প্রতি তাঁহার আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা। তাহাকে তিনি আট শতের অধিক রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ সংগ্রহ করিয়াছেন।

ইমাম শাফেয়ী (রঃ)

ইমাম শাফেয়ী (রঃ) তাঁহার উছুলে ফেকহা সম্পর্কীয় ‘রিছালায়’ হাদীছ অনুসরণ করার অপরিহার্যতা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করিয়াছেন এবং কোরআনের বিভিন্ন আয়াত হইতে প্রমাণ করিয়াছেন যে, আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করা যেমন মুসলমানদের উপর ফরজ তেমন তাঁহার নবীর ছুন্নাহ গ্রহণ করিতে বাধ্য। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তাঁহার কিতাবে তাঁহার রছূলের কাথা গ্রহণ করিয়াছে সে আল্লাহর কথাই গ্রহণ করিয়াছে।– রিছালা ৭ পৃঃ

২। ‘আল্লাহ তা’আলা তাঁহার কিতাবে তাঁহার  নবীর ছুন্নাহ অনুসরণ করাকে ফরজ করিয়া দিয়াছেন’ নামে এক স্বতন্ত্র  শিরোনাম কায়েম করিয়া উহার এক স্থানে তিনি বলিয়াছেনঃ আল্লাহ ফরজ করিয়া দিয়াছেন।‘ অতঃপর বলেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা হজরত ইবরাহীমের দো’আয় ও অপর কয়েক জায়গায় দুইটি বিষয় উল্লেখ করিয়াছনঃ আল কিতাব’ ও ‘আল হিকমাত’।আল কিতাব’ তো হইল কোরআন-অভিজ্ঞ ‘অহলে এলম’ দিগকেও ইহার ও অর্থ করিয়ছি।– রিছালা-১৩ পৃঃ

৩।‘দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান এ ব্যাপারে একমত যে, যখন কাহারো নিকট কোনো ছহীহ ছুন্নাহ সস্পষ্ট হইয়া পড়িবে,তখন তাহার পক্ষে কাহারো কাথায় উহাকে পরিত্যাগ করা জায়েজ নহে।–এলাম-২/৩৬১ পৃঃ

৪। এতদ্ব্যতীত ‘মোছনাদে’ নামে হাদীছ শাস্ত্রে তাঁহার একটি কিতাবও রহিয়াছে।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ)

১। ইমাম আহমদ (রঃ) বলিয়াছেনঃ ‘যে ব্যক্তি রছূলের হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে সে ধ্বংসের মুখে পতিত হইয়াছে।– মানাকের ইবনে জাওজী-৮২ পৃঃ

২। হাদীছের প্রতি তাঁহার বিশ্বাস বা আনুগত্যের বড় প্রমাণ হইলে তাঁহার ‘আল মোছনাদ’। ইহাতে তিনি ৩০ হাজার হাদীছ সংগ্রহ করিয়াছেন এবং স্বীয় মাজহাবের ভিত্তিও ইহার উপরই স্থাপন করিয়াছেন।

শাহ্ ওলীউল্লাহ দেহলবী (রঃ)

শাহ্ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী বলিয়াছেনঃ সন্দেহমুক্ত এলম এবং দ্বীন সম্পর্কীয় যাবতীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানসমুহের মধ্যে এলমে হাদীছ হইতেছে সকলের মুল ও শীর্ষস্থানীয়। শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যাহা কিছু বলিয়াছেন, যাহা কিছু করিয়াছেন এবং অন্যের যে সকল কথা ও কাজ তাঁহার নিকট সমর্থিত হইয়াছে তাহা সবই উহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। বস্ততঃ এলমে হাদীছ হইতেছে অন্ধকারের বুকে প্রদীপ এবং হেদায়তের পথে আলোকস্তম্ভ। যে ব্যক্তি উহা আবৃত্তি করায়া তদনুযায়ী আলম করিয়াছে সে-ই সৎপথের সন্ধান লাভ করিয়াছে, পক্ষান্তারে যে ব্যক্তি উহা হইতে বিমুখ হইয়াছে সে নিঃসন্দেহে গোমরাহ ও ব্যর্থকাম হইয়াছে। হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা-২ পৃঃ

ছুফিয়ায়ে কেরাম ও ছুন্নাহঃ

হজরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রঃ) দো’আ কবুল না হওয়ার কারণ বর্ণনা করিতে যাইয়া বলেনঃ মানুষ রছূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর মহব্বতের দাবী করে অথচ তাঁহার ছন্নাতকে ছাড়িয়া দিয়াছে। ই’তেছাম-১/১০৮ পৃঃ

২।হজরত জুন্নুন মিছরী (রঃ) দুনিয়ার নানা অশান্তির কারণ বিশ্লেষণ প্রসংগে বলেনঃ ‘মানুষ রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছুন্নাত পরিত্যাগ করয়া নিজেরদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করিতে চালিয়াছে।–ই’তেছাম-১/১০৮ পৃঃ

৩। হজরত বিশর হাফী (রঃ) বলেনঃ ‘একবার রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আমায় স্বপ্নে বলিলেনঃ তুমি বলিতে পার কি তোমাকে অন্যদের উপর কেন মর্যাদ দান করা হইয়াছে? ছুন্নত অনুসরণ এবং নেক লোকদের ভালবাসার করণেই।_ ই’তেছাম-১/১০৯ পৃঃ

৪। হজরত আবু মোহাম্মদ আবদুল ওহহাব ছকফী (রঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা সঠিক জিনিস ব্যতীত কিছুই কবুল করেন না। অথচ কোনো জিনিসই খালেছ হইতে পারে না, যে পযর্ন্ত না উহা ছন্নাতের মোয়াফিক হয়। ই’তেছাম-১/১১ পৃঃ

৫। হজরত ছাহল তস্তরী (রঃ) বলেনঃ আমার নীতি হইল সাতটি।ইহার মধ্যে প্রথমটি হইল আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করা এবং দ্বিতীয়টি হইল রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ছন্নাতের তাবেদারী করা।‘_ঐ-১/৬৪ পৃঃ

৬। হজরত শাহ কিরমাণী (রঃ) বলেনঃ যে ব্যাক্তি হারাম দৃষ্টি হইতে স্বীয় চক্ষুদ্বয়কে রক্ষা করিয়াছে, সন্দেহযুক্ত ব্যাপার হইতে নিজকে দূরে রাখিয়াছে, অন্তরকে মোরাকাবা এবং করিয়াছে তাহার অন্তর-দৃষ্টি কখনো ভুল হইতে পারে না।_ঐ

৭। হজরত আবু ছোলাইমান দারানী (রঃ) বলেনঃ ‘যখন কোন ব্যাপারে আমার অন্তরে সন্দেহের উদ্রক হয় তখনই আমি বলি, দুই সত্যবাদী সাক্ষীর সাক্ষ্য ব্যতিরেকে ইহা আমি কখনো গ্রহণ করিব নাঃ_ আল্লাহর কিতাব এবং রছূলের ছুন্নাহ।_ঐ

৮। হজরত আবু কাছেম জুনাইদ বাগদাদী (রঃ) বলেনঃ ‘ছুন্নতের অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর দিকে যাওয়ার কোন পথই উন্মুক্ত নাই।_ঐ-১/১১৫ পৃঃ

ছুন্নাহর হেফাজত ও প্রচারের জন্য রছূল্লাহর নির্দেশঃ

যেহেতু ছুন্নহ শরীয়তে ইসলামীর একটি উৎস, এজন্য স্বয়ং রছূলুল্লাহ (ছঃ) ছুন্নাহর হেফাজত ওপ্রচারের জন্য তাঁহার উম্মতীদের কড়া নির্দেশ দিয়াছেনঃ

১। বোখরী শরীফে রহিয়াছেঃ ‘রছূলুল্লাহ (ছঃ) আবদুল কায়ছ গোত্রের প্রতিনিধিদলকে কতক আহকাম তালীম দেওয়ার পর বলিয়াছেনঃ

(আরবী*******************************)

‘তোমরা ইহাকে ভালোরূপে ইয়াদ করিয়া লও। অতঃপর যাহার অনুপস্থিত তাহাদের নিকট পৌছাইয়া দাও। বোখারী কিতাবুল এলম

২। ছাহবী হজরত মালেক ইবনে হুয়াইরেছ (ছঃ) বলেনঃ

(আরবী*******************************)

‘নবী করীম (ছঃ) আমাদের (কতিপয় বিষয় শিক্ষা দেওয়ার পর) বলিয়াছিলেনঃ তোমরা তোমাদের পরিবারের নিকট ফিরিয়া যাও এবং তাহাদের (এ সকল বিষয়) শিক্ষা দাও।‘বোখারী

৩। রছূলুল্লাহ (ছঃ) বিদায় হজ্জের খোৎবায় লক্ষধিক লোকের সমাবেশে বলিয়াছেনঃ

(আরবী*******************************)

‘প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে ইহা পৌছাইয়া দেয়। কেননা, উপস্থিত ব্যাক্তি হয়ত এমন ব্যক্তির নিকট উহা পৌছাইয়া দিবে যে ব্যক্তি তাহার (উপস্থিত ব্যক্তির) অপেক্ষা (হাদীছের পক্ষে) উত্তম রক্ষক হইবে। বোখারী কিতাবুল এলম

৪। হজরত উবাদা ইবনে ছামেত (রাঃ) বলেনঃ রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেনঃ

(আরবী*******************************)

‘আল্লাহ সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জল করুন যে ব্যক্তি আমার কোনো কথা শুনিয়া উহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছে এবং উত্তমরূপে উহা অনুধাবন করিয়াছে, অতঃপর উহা অন্যের নিকট পৌছাইয়া দিয়াছে। কেননা, এমন অনেক জ্ঞানের কথার বাহক (হাফেজ) আছে যাহারা নিজেরা জ্ঞানী নহে। এছাড়া অনেক জ্ঞানের বাহক এমন ব্যক্তির নিকট জ্ঞান বহন করিতে পারে, যে ব্যক্তি বাহক অপেক্ষা অধিকি জ্ঞানী। ‘(সুতরাং সে ইহা হইতে অনেক তথ্যের উদঘাট করিতে পারিবে)  (আহমদ, তীরমিজী, ইবনে মাজাহ, দারেমী।মেশকাত)

৫। হজরত ইবনে মাছউদ (রাঃ) বলেনঃ আমি রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছিঃ

(আরবী*******************************)

আল্লাহ সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জল করুন যে ব্যক্তি আমার নিকট কোনো কথা শুনিয়াছে অতঃপর উহাকে অন্যের নিকট পৌছাইয়া দিয়াছে ঠিক যেভাবে উহা শুনিয়াছে। কেননা, এমন অনেক ব্যক্তি রহিয়াছে যাহারা শ্রোতা অপেক্ষা অধি জ্ঞান রাখে।

তিরমিজী, ইবনে মাজাহ। মেশকাত

৬। হজরত আনাছ (রাঃ) বলেনঃ

(আরবী*******************************)

‘রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যখন কোনো কথা বলিতেন, তিনবার করিয়া পুনঃ পুনঃ বলিতেন যাহাতে শ্রোতা উহা উত্তমরূপে বুঝিয়া লইতে পারে।–বোখারী

৭।হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলেনঃ

(আরবী*******************************)

রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আমাদের নামাজের ‘তাশাহুদ’ শিক্ষা দিতেন যেভাবে কোরআনের ছুরা শিক্ষা দিতেন।– মোছলেম শরীফ

রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ছাহাবীদের শুধূ যে হাদীছের শিক্ষাই দিতেন তাহা নহে;  বরং তিনি উহা কখনো কখনো পুনরায় তাহাদরে নিকট হইতে শুনিয়াও লইতেন উহা ঠিক হইয়াছে কি না? তিরমিজীতে রহিয়াছে, একবার রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম হজরত বারা ইবনে  আযাবকে শুইবার কালে পড়ার জন্য একটি দো’আ বাতলাইলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করিলেনঃ বল দেখি আমি কী বলিয়াছি? সে(আরব**********) এর স্থালে বলিলঃ  (আরবী**************) অর্থাৎ ‘নবী’ শব্দের স্থলে ‘রছূল’ শব্দ বলিল যাহার অর্থ এখানে এক হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার বুকে খোচা মারিয়া বলিলেনঃ ‘না, হয় নাই; আমি যাহা বলিয়াছি তাহাই বল।

 

তৃতীয় অধ্যায়

হাদীছের হেফাজত ও প্রচারে উম্মতীগণ

এখন দেখা যাক যে, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিদের্শকে (হাদীছের হেফাজত ও প্রচারের নিদের্শকে) তাঁহার উম্মতীগণ কিতাবে গ্রহণ করিয়াছেন এবং যুগে যেগে ইহার জন্য কি কি উপায় অবলম্ব করিয়াছেন। উম্মতীগন ইহার জন্য প্রধানতঃ চারটি উপায় অবলম্ব করিয়াছেনঃ হাদীছের শিক্ষাকরণ ও হেফাজকরণ, উহার লিখন, উহার শিক্ষা দান এবং উহার মোতাবেক আমলকরণ। প্রত্যে যুগেই উম্মতীগণ তাঁহাদের প্রিয় রছূলের জীবনের প্রতিটি ঘাটনাকে জানিতে ও বুঝতে চেষ্টা করিয়াছেন। অতঃপর উহা অপরকে জানাইতে ও বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। ছাহাবীগণের যুগে হইতে এযাবৎ শিক্ষার ও ধারা অব্যাহত রহিয়াছে। উম্মতীগণের এমন কোন যুগ ছিল না।– যে যুগে তাঁহাদের এক বিরাট জামাআত এজন্য নিজেদের জীবনকে ওয়াকফ করিয়া দেন নাই। আজ ধর্মীয় শিক্ষার এ দুর্দিনেও দুনিয়ায় শত সহস্র হাদীছ শিক্ষার কেন্দ্র বিদ্যমান রহিয়াছেন এবং লক্ষ লক্ষ আশেকে রছূল দুনিয়ার লোভ ত্যাগ করিয়া ইহতে লাগিয়া রহিয়াছেন। ছাহাবীগণ রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-কে যাহা কিছু করিতে বা বলিতে দেখিয়াছেন সংগে উহার অনুসরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। অতঃপর তাবেয়ীগণ তাঁহাদের আমলের নমুনা গ্রহণ করিয়াছেন। এইরূপে উম্মতীগণের প্রতিটি যুগেই উহার পূর্ববর্তী যুগের অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে ও আসিতেছে।

প্রথমে ছাহাবীগণ রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর কথাকে নিজেদের স্মৃতিপটে জাগরিত রাখার চেষ্ট করিয়াছেন। অতঃপর যে পযর্ন্ত না তৃতীয়-চুতুর্থ শতব্দাতে সমস্ত ছূন্নাহ কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায় সে পযর্ন্ত  এ দায়িত্ব তাবেয়ীগণ পালন করিয়াছেন।এ সময় উম্মতীদের মধ্যে এমন হাজার হাজার ধীশক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন যাঁহারা ছুন্নাহর এক একটি শব্দকে শত শত ছন্দ সহকারে কণ্ঠস্থ রাখিয়াছেন।

এতদভিন্ন উম্মতীগণ বিশেষ সতর্কতা হিসাবে আল্লাহর কিতাবের ন্যায় রছূলের ছুন্নাহকেও কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতে প্রয়াস পাইয়াছন। ছাহাবীগণ রছূল্লাহ (ছঃ)-এর সম্মুখেই ইহার সূচনা করিয়াছেন; তাবেয়ীগণ আরো বহুদুর অগ্রসর হইয়াছেন এবং তাবে’ তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তীগণ ইহাকে চরমে পৌছাইয়াছেন। আজ দুনিয়ায় রছূলুল্লাহ ছুন্নহর এমন কোন অংশ বকী রহিয়াছে বলিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যায় না যাহা না যাহা কোন না কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ হয় নাই।পরবর্তী অধ্যায়সমুহে আমরা এ সকল বিষয় যুগওয়ারী কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ দিতে চেষ্ট করিব।

প্রথম যুগ

প্রথম যুগ বলিতে এখানে আমরা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নুবুওতের প্রথম হইতে হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের খেলাফত লাভ (৯৯ হিঃ) পযর্ন্ত মোট ১১২ বৎসর কালকেই বুঝাইতেছি। ইহা ছাহাবা এবং প্রবীণ তাবেয়ীনদের যুগ। এই যুগের শেষ পযর্ন্তই ছাহাবীগণ বাঁচিয়াছিলেন। হজরত আনাছ ইবনে মালেক (রঃ) ৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।এ যুগে হাদীছের হেফাজত ও প্রচারের জন্য পূর্বোক্ত চারটি উপায় অবলম্বন করা হয়। উম্মতীদের প্রথম শ্রেণী ছাহাবীগণ রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ছূন্নাহর হেফাজত ও প্রচারের নির্দেশকে কিভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা উপলদ্ধি করার জন্য প্রথমে জানা আরশ্যক যে, রছূলুল্লাহর প্রতি ছাহাবীগণের ভক্তি-শ্রদ্ধা কেমন ছিল।

রছূলুল্লাহর প্রতি তাহার ছাহাবীগণের ভক্তি-শ্রদ্ধা কেমন ছিল তাহার দুনিয়ার ইতিহাসে তালাশ করা বৃথা । ছাহাবীগণ তাহাদের প্রিয় রছূলের সামান্যতম ইশারায় তাহাদের জান-মাল ও প্রিয়জন-এক কথায় যথাসর্বস্ব কোরআন করিতে সর্বক্ষণ প্রস্তুত ছিলন। এবং ইহা করিয়াও দেখাইয়াছেন। ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানদের প্রতি শত্রুদের তীর বৃষ্টির ন্যায় বর্ষিত হইতেছিল, তখন ছাহাবীগেণে তাহাদের প্রিয় রছুলকে ব্যুহ রচনা করিয়া বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছিলেন। যাহার ফলে শক্রদের তীরে কোন কোন ছাহাবীদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হইয়া গিয়াছিল।হিজরতের সময় ছওর গিরি-গুহায় রছূলকে রক্ষা বরার উদ্দেশ্য হজরত আবু বকর ছিদ্দী (রাঃ) সাপের গর্ত নিজের পায়ের দ্বারা বন্ধ করায়া রাখিয়াছিলেন। সাপের দংশনে হজরত ছিদ্দীক কাতর হইয়া পড়িলেন, তথাপি প্রিয় রছূলের নিদ্রা ভংগের আশংকায় তাহার শির মোবারক অপন ক্রোড় হইতে সরাইলেন না। যে রাত্রে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-কে হত্যা করার জন্য কোরাইশগণ স্থির করিল, সেই রাত্রে হজরত আলী মোরতাজা নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া রছূলের বিছানায় শয়ন করিলেন এবং এইরূপে প্রিয় রছূলকে হিজরতের সুযোগ দিলেন।

কোরাইশ-দুত ওরওয়ান ইবনে মাছউদ ছকফী তাঁহার মুসলান হওয়ার পূর্বে হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে কোরাইশদের নিকট যাইয়া রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু  আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর প্রতি ছাহাবী গণের ভক্তি-শ্রদ্ধার যে ছবি আকিঁয়াছিলেন তাহা এখানে তাহার ভাষায় ব্যক্ত করা যাইতেছে তিনি বলেন বলেনঃ

(আরবী*******************************)

‘হে আমার জাতি খোদার কছম, আমি তোমাদের দুত হিসাব, রোমের সম্রাট, ইরানের শাহানশাহ এবং আসাবিসিনিয়ার রাজার দরকার গিয়াছি; খোদার কছম, কোন রাজা- বাদশাহর প্রতি তাঁহার প্রজা বা সভাসদগণকে এরূপ ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতে দেখি নাই যেরূপ মোহাম্মদের ছাহাবীগণ কাহার আগে কে করিবে তাহ লইয়া কাড়াকাড়ি করিতে আরম্ভ করে, আর যখন তিনি কথা বলেন, তাহার চুপ করিয়া থাকে। তাঁহার চুপ করিয়া থাকে। তাহার সম্ভ্রমে তাহার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি করিতেও সাহস করে না-বোখারী

এমতাবস্থায় ছাহাবীগণ যখন আল্লাহ তা’আলা ও তাহাদের প্রিয় রছূলের পক্ষ হইতে ছুন্নাহর হেফজত ওপ্রচারের জন্য নিদের্শপ্রাপ্ত হইলেন, তখন অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল তাহ সহজেই অনুমেয়।

                                                  ছাহাবীদের হাদীছ শিক্ষাকরণ

রছূলুল্লহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম- এর ছুন্নাহ অবগত হওয়ার জন্য ছাহাবীগণের আগ্রহাতিয্যের অবধি ছিল না, অনেকে তো ইহার জন্য নিজেদের জীবনকেই ওয়াকফ করিয়া দিয়াছিলেন। যথা-আছহাবে ছোফফা, আর যাহারা অন্যান্য দায়িত্ব দরুন সর্বক্ষণ হুজুরের খেদমতে হাজির থাকিতেন না, তাঁহারা যখনই সুযোগ পাইতেন হুজুরের খেদমতে হাজির হইতে চেষ্টা করিতেন বা অন্যের নিকট হুজুরের দরবারে কখন কি ঘটিয়াছে তাহা জানিয়া লইতে চেষ্টা করিতেন। কেহ তো ইহার জন্য অন্যের সহিত পালা ঠিক করিয়া লইয়াছিলেন। হজরত ওমর ফরূ (রাঃ) বলেনঃ

[আরবী*****************************]

‘আমি ও আমার এক আনছারী প্রতিবেশী (আতবান ইবনে মালেক সমজিদে নববী হইতে ৩/৪ মাইল দুরে অবস্থি )

‘আওয়ালী এলাকায়া বাস করিতেন; সুতরাং আমরা হুজুরের খেদমতে হাজির হওয়া জন্য পালা ঠিক করিয়া লইয়াছিলাম। তিনি একদিন হুজুরের খেদমতে হাজির হইতেন আর আমি একদিন হাজির হইতাম। যে দিন আমি হাজির হইতাম সে দিনের ওহী এবং অন্যান্য বিষয়ের খবর আমি তাঁহাকে দিতাম এবং তিনি যেদিন হাজির হইতেন সে দিন তিনি ঐরূপ করিতেন। বোখারী শরীফ

ছাহাবীগণ শুধু যে রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর জীবনকালেই তাঁহার হাদীছের হেফাজত ও প্রচারে তৎপর ছিলেনে তাহা নহে; বরং তাঁহার এন্তেকালেই পর তাঁহাদের এ তৎপরতা আরো বাড়িয়া যায়। হুজুরের এন্তেকালের পর কোন কোন ছাহাবী অপর ছাহাবীর নিকট হইতে হাদীছ সংগ্রহ করার জন্য শত শত মাইল সফরের  কষ্ট স্বীকার করেন। অথচ সেকালের সফর আজকালের ন্যায় এত সহজসধ্য ছিল না। হজরত আবু আইয়ুব আনছারীর ন্যায় একজন প্রবীণ ও মর্যাদাবান ছাহাবী একটি মাত্র হাদীছের জন্য মদীনা হইতে মিছর পযর্ন্ত সফর করিয়াছিলেন এবং উকবাহ ইবনে আমেরর নিকট উহা দরইয়াফত করিয়াছিলেন।

[তারীখুল হাদীছ ১৩ পৃঃ।] হজরত আনাস (রাঃ) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছের নিকট হইতে একটি হাদীছ সংগ্রহ করার জন্য এক মাসের পথ সফর করিয়াছিলেন।

 [তারীখুল হাদীছ ১৩ পৃঃ] [সম্ভবত ইহা শামের (সিরিয়ার) সফর; কেননা, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছ (রাঃ) তখন শামে অবস্থান করিতেন।] অপর এক ছাহাবী হজরত ফাজালা ইবনে উবাইদের নিকট হাদীছ জিজ্ঞাসা করার জন্য মিছর গমন করিয়াছিলেন।

[দারেমী ১২৭ পৃঃ] হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছের নিকট হইতে হাদীছ লাভ করার উদ্দেশ্যে শাম (সিরিয়া) গমন করিয়াছিলেন [বোখারী কিতাবুল এলম] এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হাদীছ সংগ্রহ করার জন্য প্রবীণ ছাহাবীদের দ্বারে দ্বারে যাইয়া পড়িয়া থাকিতেন। [দারেমী ১২৬ পৃঃ]

ছাহাবীগণের হাদীছ হেফজকরণ

ছাহাবীগণ আল্লাহর কিতাবের যেরূপ হেফজ ও আলোচনা করিতেন রছুলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছেরও সেইরূপ হেফজ ও আলোচনা করিতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলেনঃ ‘আমরা হুজুরের সময় হাদীছ হেফজ করিতাম।‘–মোছলেম, তাদবীন

হজরত আনাছ (রাঃ) বলেনঃ (আরবী****************************************************)

‘আমরা-পরবর্তী রাবী বলেন, আমার মনে হয় তিনি ৬০ জনই বলিয়াছেন-নবীয়ে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিকট চলিয়া যাইতেনঃ আর আমরা বসিয়া উহা একটার পর একটা পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিতাম। ইহার পর আমরা যখন মজলিস ত্যাগ করিতাম, তখন হাদীছ আমাদের অন্তরে এমনভাবে বদ্ধমূল হইয়া যাইত যেন উহা আমাদের অন্তরে রোপণ করা হইয়াছে।‘

                                                                                                    মাজমা ১৬১ পৃঃ

হজরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেনঃ ‘একদিন আমরা নবীয়ে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর সহিত ছিলাম, এমন সময় তিনি মসজিদে প্রবেশ করিলেন। দেখেলেন, তথায় কতিপয় লোক বসিয়া আছে। হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘তোমরা এখানে বসিয়া আছ কেন?’ তাঁহারা উত্তর করিলেনঃ আমরা ফরজ নামাজ পড়িয়াছি; অতঃপর এখানে বসিয়া আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার রছূলের ছুন্নাহ আলোচনা করিতেছি।‘

                                                                                                     -মুস্তাদরাক, তাদবীন

এক কথায় রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর জীবনের এমন কোন ঘটনা নাই যাহার অনুসন্ধান ছাহাবীগণ করেন নাই এবং উহা হেফজ করিয়া রাখেন নাই । আর ইহা তাঁহাদের আগ্রহ ও স্মরণশক্তির তুলনায় কঠিন ব্যাপার কিছুই ছিল না। আরবের এক একজন সাধারণ লোক পর্যন্ত শত শত কবিতা, বক্তৃতা এবং বিরাট বিরাট নছবনামা (কুল-পঞ্জিকা) হেফজ করিয়া রাখিত। ইসলাম-পূর্ব যুগের কবিদের কবিতা, বাগ্নী বক্তাদের বক্তৃতা এবং সমস্ত আরব গোত্রের নছবনামা আমরা এ সুত্রেই লাভ করিয়াছি।

ইবনে আবদুল বার বলেনঃ

(আরবী*****************************************)

‘আরবগণ প্রকৃতিগতভাবেই স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল এবং ইহা তাহাদের বৈশিষ্ট্যও বটে।

                                                                                                                     জামে’ ৩৫ পৃঃ

ছাহাবীদের মধ্যে কে কত হাদীছ হেফজ করিয়াছেলেন ও শিক্ষা দিয়াছিলেন তাহার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পরবর্তী ‘হাদীছ শিক্ষাদান’ পরিচ্ছেদে দেওয়া হইল।

ছাহাবীদের হাদীছ লিখনঃ

(এ সম্পর্কীয় বিস্তারীত বিবরণ ‘প্রথম যুগে হাদীছ লিখন’ পরিচ্ছেদে আসিতেছে।)

ছাহাবীগণের হাদীছ শিক্ষাদান

ছাহাবীগণ নিজেরা যেভাবে হাদীছ জ্ঞান অর্জন করাকে জরুরী বলিয়া মনে করিয়াছেন সেভাবে অন্যের নিকট উহা প্রচার করাকেও অবশ্য কর্তব্য বলিয়া বিবেচনা করিয়াছেন। রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর এন্তেকালের পর ছাহাবীগণের এক বিরাট জামাআত (প্রায় দুই হাজার) এ কর্তব্য সম্পাদনে ঝাঁপাইয়া পড়েন এবং সমগ্র আরব ভূমিকে হাদীছের এলমে উদ্ভসিত করিয়া দেন। মদীনায় হজরত আয়েশা (রাঃ), হজরত ইবনে ওমর (রাঃ) ও হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমখের দরছ চলিতে থাকে। মক্কা হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হাদীছ শিক্ষার এক বিরাট কেন্দ্র স্থাপন করেন।

কুফায় হজরত আলী মোরতাজ (রাঃ), ইবনে মাছউদ (রাঃ) ও হজরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) প্রমুখ বিশিষ্ট ছাহাবীগণ ইহতে আন্মনিয়োগ করেন। বছরায় হজরত আবু মাছা আশ আরী (রাঃ) শাসনকার্য পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে হাদীছের দরছও অব্যাহত রাখেনে এবং শামে হজরত আবু ছাঈদ খুদরী এবং মিছরে হজরত আমার ইবনুল আছ (রাঃ) ইহার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য ছাহাবীগণের মধ্যে যিনি যেস্থনে গিয়াছেন হাদীছের শিক্ষাদানকে সমস্ত করণীয় কার্যের মধ্যে অগ্রধিকার দান করিয়াছেন।

তবে হাদীছের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও শিক্ষাদান ব্যাপরে সকল ছাহাবীর সমান সুযোগ ছিল না, তাই সকলের পক্ষে সমপরিমাণ হাদীছ শিক্ষা দেওয়া বা রেওয়ায়ত করা সম্ভবপর হয় নাই। যাঁহারা এক হাজার বা ততোধিক হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন মোহাদ্দেছগণ তাঁহাদের বলেন, ‘মুকছিরীন’;যাঁহারা পাঁচ শত হইতে হাজারের কমসংখ্যক হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেনে তাঁহাদের বলেন, ‘মুতাওচ্ছেতীন’;যাঁহার চল্লিশ হইতে পাঁচ শত পযর্ন্ত হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন তাঁহাদের বলেন, ‘মুকিল্লীন’ আর যাঁহারা চল্লিশের কম হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন তাঁহাদের বলেন, ‘আকাল্লীন’।

                                                                                                       ইজালাতুল খাফা-২১৪ পৃঃ

নীচে প্রথম তিন শ্রেণীর ছাহাবীর নাম এবং তাঁহাদের বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা দেওয়া গেল।আকাল্লীনদের সংখ্যা অত্যধিক বলিয়া তাঁহাদের নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নহে।

                                                                 মুকছিরীনঃ [কিরমানী –শরহে বোখারী]

১। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)    (মৃঃ ৫৭ হিঃ)৫৩৬৪

২। হজরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ)    (মৃঃ ৯৩ হিঃ)     ২২৩৬

৩। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) (মৃঃ ৬৮ হিঃ)    ১৬৬০

৪। হজরত আবদুল্লহ ইবনে ওমর (রাঃ)    (মৃঃ ৭৩ হিঃ)    ১৬৩০

৫।হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ)   (মৃঃ ৭৪ হিঃ)    ১৫৪০

৬। হজরত আয়েশা আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ)(মৃঃ ৫৭ হিঃ)১২১০

৭। হজরত আবু ছাঈদ খুদরী (রাঃ) মৃঃ ৭৪ হিঃ)১১৭০

                                                                মুতাওচ্ছোতীনঃ [কিরমানী –শরহে বোখারী]

১। হজরত আবদুল্লহ ইবনে মাছউদ (রাঃ)  (মৃঃ ৩২ হিঃ)৮৪৮

 ২। হজরত আবদুল্লহ ইবনে আমরা ইবনুল আছ (রাঃ)    (মৃঃ ৬৩ হিঃ)     ৭০০

৩। হজরত আলী তোরতাজা (রাঃ)(মৃঃ ৪০ হিঃ)৫৮৬

৪। হজরত ওমর ফারূক (রাঃ)    (মৃঃ ২৩ হিঃ)৫৩৯

                                                                   মুকিল্লীন

১। উম্মুল ম’মিনীন হজরত উম্মে ছালমা (রাঃ)   (মৃঃ ৫৯হিঃ)৩৭৮

২। হজরত আবু মুছা আশ’আরী (রাঃ)    (মৃঃ ৫৪ হিঃ)৩৬০

৩। হজরত বারা ইবনে আজেব (রাঃ)    (মৃঃ ৭২ হিঃ)৩০৫

৪। হজরত আবু জর গেফারী (রাঃ)(মৃঃ ৩২ হিঃ)২৮১

৫। হজরত ছ’দ ইবনে আবি ওক্কাছ (রাঃ)  (মৃঃ ৫৫ হিঃ)২১৫

৬। হজরত ছাহল আনছারী (জুন্দব ইবনে কায়ছ রাঃ)    (মৃঃ ৯১ হিঃ)১৮৮

৭। হজরত উবাদা ইবনে ছামেত আনছারী (রাঃ)   (মৃঃ ৩৪ হিঃ)১৮১

৮। হজরত আবুদ্দারদা (রাঃ)(মৃঃ ৩২ হিঃ)১৭৯

৯। হজরত আবু কাতাদাহ আনছারী (রাঃ)  (মৃঃ ৫৪ হিঃ)১৭০

১০ হজরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ)(মৃঃ ২১ হিঃ)১৬৪

১১। হজরত বোরাইদা ইবনে হাছীব (রাঃ)  (মৃঃ ৬৩ হিঃ)     ১৬৪

১২। হজরত মোআজ ইবনে জাবাল (রাঃ)  (মৃঃ ১৮ হিঃ)     ১৭৫

১৩। হজরত আবু আইয়ুব আনছারী (রাঃ)  (মৃঃ ৫২ হিঃ)১৫০

১৪। হজরত আবু আইয়ুব আনছারী (রাঃ)  (মৃঃ ৩৫ হিঃ)১৪৬

১৫। হজরত জাবের ইবনে ছামুরাহ (রাঃ)  (মৃঃ ৭৪ হিঃ)১৪৬

১৬। হজরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)    (মৃঃ ১৩ হিঃ)১৪২

১৭। হজরত মুগীরাহ ইবনে শো’অবা (রা)  (মৃঃ ৫০ হিঃ)১৩৬

১৮। হজরত আবু বাকরাহ (রাঃ)  (মৃঃ ৫২ হিঃ)১৩০

১৯। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ)  (মৃঃ ৫২ হিঃ)১৩০

২০। হজরত মুআবিয়া ইবনে আবু ছুফইয়ান (রাঃ)  (মৃঃ ৬০ হিঃ)     ১৩০

২১। হজরত ওছমান ইবনে জায়দ (রাঃ)   (মৃঃ ৫৪ হিঃ)১২৮

২২। হজরত ছাওবান (রাঃ)(মৃঃ ৫৪ হিঃ)১২৭

২৩। হজরত নো’মান ইবনে বশীর (রাঃ)   (মৃঃ ৬৫ হিঃ)     ১২৪

২৪। হজরত ছামুরা ইবনে জুন্দুব (রাঃ)    (মৃঃ ৫৮ হিঃ)     ১২৩

২৫। হজরত আবু মাছউদ আনছারী (রাঃ)  (মৃঃ ৪০ হিঃ)১০২

২৬। হজরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ বাজালী (রাঃ)(মৃঃ ১৭৬ হিঃ)    ১০০

২৭। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাঃ)   (মৃঃ ৫১ হিঃ)৯৫

২৮। হজরত জায়দ ইবনে ছাবেত আনছারী (রাঃ)  (মৃঃ ৮৭ হিঃ)৯২

২৯। হজরত আবু তালহা (রাঃ)   (মৃঃ ৪৮ হিঃ)৯০

৩০। হজরত জায়দ ইবনে আরকাম (রাঃ)  (মৃঃ ৩৪ হিঃ)৯০

৩১। হজরত জায়দ ইবনে খালেদ (রাঃ)   (মৃঃ ৬৮ হিঃ)     ৮১

৩২। হজরত কা’ব ইবনে মালেক (রাঃ)    (মৃঃ ৭৮ হিঃ)৮০

৩৩। হজরত রাফে’ ইবনে খাদীজ (রাঃ)   (মৃঃ ৫০ হিঃ)৭৮

৩৪। হজরত ছালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ)  (মৃঃ ৭৪ হিঃ)৭৭

৩৫। হজরত আবু রাফে’ (রাঃ)    (মৃঃ ৭৪ হিঃ)৬৮

৩৬। হজরত আওফ ইবনে মালেক (রাঃ)  (মৃঃ ৩৫ হিঃ)৬৭

৩৭। হজরত আদীয় ইবনে হাতেম তায়ী (রাঃ)    (মৃঃ ৭৩ হিঃ)৬৬

৩৮। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবি আওফা (রাঃ)   (মৃঃ ৬৮ হিঃ)     ৬৫

৩৯। (উম্মুল মু’মীনীন) হজরত উম্মে হাবীবাহ (রাঃ)    (মৃঃ ৪৪ হিঃ)৬৫

৪০। হজরত ছালমান ফাছেরী (রাঃ)(মৃঃ ৩৪ হিঃ)৬৪

৪১। হজরত আম্মান ইবনে ইয়াছির (রাঃ)  (মৃঃ ৩৭ হিঃ)৬২

৪২। (উম্মুল মু’মীনীন) হজরত হাফছা (রাঃ)    (মৃঃ ৪৫ হিঃ)৬৪

৪৩। হজরত জোবাইর ইবনে মোতয়েম (রাঃ)     (মৃঃ ৫৮ হিঃ)     ৬০

৪৪। হজরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ (রাঃ)    (মৃঃ ৬০ হিঃ)     ৬০

৪৫। হজরত আছমা বিনতে আবু বকর (রাঃ)    (মৃঃ ৭৪ হিঃ)৫৬

৪৬। হজরত ওয়াছেলা ইবনে আছকা (রাঃ)(মৃঃ ৮৫ হিঃ)     ৫৬

৪৭। হজরত ওকবাহ ইবনে আমের (রাঃ)   (মৃঃ ৬০ হিঃ)     ৫৫

৪৮। হজরত ওমর ইবনে ওতবাহ (রাঃ)             ৪৮

৪৯। হজরত কা’ব ইবনে আমর (রাঃ)    (মৃঃ ৫৫ হিঃ)৪৭

৫০। হজতর ফাজালা ইবনে উবায়দ আছলামী (রাঃ)(মৃঃ ৫৮ হিঃ)     ৪৬

৫১। (উম্মুল মু’মিনীন) হজরত মাইমুনাহ (রাঃ)   (মৃঃ ৫১ হিঃ)৪৬

৫২। হজরত উম্মে হানী (হজরত আলী ভগ্নী) (রাঃ)    (মৃঃ ৫০ হিঃ)৪৬

৫৩। হজরত আবু জোহাইফা (রাঃ)(মৃঃ ৭৪ হিঃ)৪৫

৫৪। হজরত বেলাল মোয়াজ্জেনে রছুল (ছঃ) (রাঃ)(মৃঃ ১৮ হিঃ)     ৪৪

৫৫। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ)    (মৃঃ ৫৭ হিঃ)৪৩

৫৬। হজরত মিকদাদ ইবনে আছওয়াদ (রাঃ)     (মৃঃ ৩৩ হিঃ)     ৪৩

৫৭। হজরত উম্মে আতীয়াহ আনছারী (রাঃ)     ৪১

৫৮। হজরত হাকিম ইবনে হেজাম (রাঃ)   (মৃঃ ৫৪ হিঃ)৪০

৫৯। হজরত ছালমা ইবনে হানীফ (রাঃ)   ৪০

ছাহাবীগণরে হাদীছ অনুযায়ী আমলকরণ

ছাহাবীগণ যখনই রছূলুল্লাহ ছাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে কোন কাজ অথবা কোন কথা বলিতে দেখিয়াছেন তখনই তাঁহার অনুসরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহার শুধু যে শরীয়ত সম্পর্কীয় ব্যাপারেই রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর অনুসরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন তাহা নহে; বরং যে সকল কাজ তিনি নিছক ব্যক্তিগত আদত-অভ্যাস অনুসারে করিয়াছেন তাঁহারা সে সকল বিষয়েও তাঁহার অনুকরণ করার চেষ্টা করিয়াছেন। রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কোন কথা বলার বা কোন কাজ করার সময় কোন বিশেষ স্বরভংগি বা অংগভংগি করিয়া থাকিলে ছাহাবীগন সেই কথা বলার বা সেই কাজ করার সময় ঠিক সেইরূপ স্বরভংগি বা অংগভংগি করারও চেষ্টা করিয়াছেন। (হাদীছে ইহাকে রেওয়ায়তে মোছালছাল বলে।) এভাবে রছুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কোন স্থলে গমন কালে যে পথ অবলম্বন করিয়াছেন এবং ঐ পথের যে যে স্থানে যে যে কাজ করিয়াছেন ছাহাবীগণ সেই স্থানে গমনকালে সেই পথ করিয়াছেন এবং সেই সেই স্থানে সেই সেই কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমন (রাঃ) মদীনা-মক্কার মধ্যে গমনাগমন কালে পায়খানা-পেশাবের হাজত না হইলেও নিছক অনুকরণের খেয়ালেই সেই সেই স্থানে খানিকটা সমীয় বসিয়া থাকিতেন যে যে স্থানে হুজুর (ছঃ) পায়খানা-পেশাবের জন্য বসিয়াছিলেন।

ছাহাবীগণ রছুলুল্লাহ  (ছঃ)-এর কার্যের অনুকরণ করার ব্যাপারে কার্যের উদ্দেশ্য বুঝার অপেক্ষাও করিতেন না। হজরত ওমরের মত ব্যক্তি ‘হাজারে আছওয়াদকে’ চুম্বন করিয়াছেন।‘ এভাবে তিনি খানায়ে কা’বার তাওয়াফে ‘রমল’

[তাওয়াফ করার কালে বীরের ন্যায় সজোরে পদক্ষেপ করাকে ‘রমল’ বলে।] কারার কালে বলিয়াছিলেনঃ ‘মক্কার কাফের-দিগকে মদীনার মুসলমারদের বলবীর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ‘রমল’ করিয়াছিলেন। আমরা মতে এখন আর ইহার কোন প্রয়োজন নাই। তথাপি আমি ইহা এজন্য করিতেছি যে, হয়ত এ কাজের মধ্যে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের অন্য কোন উদ্দেশ নিহিত থাকিতে পারে।

এক কথায় রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের যাবতীয় এবাদত, মোআমালাত, কথা-বার্তা, লেবাছ-পোশাক, খাওয়া, পরা, উঠা-বসা, শয়ন-বিচরণ এমন কোন বিষয় নাই, যে বিষয়ে ছাহাবীগণ উহার অনুকরণ করার চেষ্টা করেন নাই। অতঃপর ছাহাবীগণের অনুসরণ করিয়াছন তাবেয়ীগণ । তাবেয়ীগণের; অনুসরণ  করিয়াছেন তবে’ তাবেয়ীগণ; আর তবে’- তাবয়ীদের অনুসরণ করিয়াছেন তাঁহাদের পরিবর্তীগণ।মোটকথা,  এ ব্যাপারে উম্মতীদের যুগ পরম্পরা বরাবর একে  অন্যেরর অনুসরণ করিয়া আসিয়াছেন ও আসিতেছেন। আজ রছূলের অনুসরণের শিথিলতার যুগেও উম্মতীগণ ওজু-গোসল, নামাজ- রোজা, হজ্জ-জাকাত প্রভৃতি এবাদত ঠিক সেই পদ্ধতিতেই সম্পাদ করিতেছেন যে পদ্ধতিতে প্রায় ১৪ শত বৎছর পূর্বে রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম সম্পাদন করিয়াছিলেন; অধিকন্তু তাহারা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লাল্লামের ব্যাক্তি আদত-অভ্যাসেরও অনুসরণ করিতেছে। তাহাজ্জুদের পর ফজরের ছুন্নাত পড়িয়া ক্লান্ত দুর করার উদ্দেশ্য রছূলুল্লাহ (ছঃ) খানিকটা সময় বিশ্রাম করিতেন। উম্মতীদের বিশিষ্ট ব্যাক্তিগণ আজও উহার অনুসরণ করিয়া থাকেন’। রছূলুল্লাহ (ছঃ) হাতে কাঠের ছড়ি ব্যবহার করিতেন, এজন্য তাহারা কাঠের ছড়ি ব্যবহার করিতেই ভালবালসেন। তাই বলিতেছিলাম যে, উম্মতীগণের আমল রছূলুল্লাহ  (ছঃ)- এর ছুন্নাহ রক্ষার একটি মস্ত বড় উপায়।ঐ উপায় রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সমস্ত ছুন্নাহই রক্ষা পাইয়াছে।

                                               তাবেয়ীনদের প্রতি ছাহাবীগণের নির্দেশ

ছাহাবীগণ শুদু যে নিজেরাই হাদীছের হেফাজত ও প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন তাহা নহে; বরং তাহারদের শাগরিদ তাবেয়ীনদের প্রতিও তাঁহার এ নির্দেশ দিয়াছিলেন। হজরত আলী (রাঃ) তাঁহার শাগরিদগণকে বলিতেনঃ

(আরবী******************************)

‘তোমর পরস্পর মিলিত হইবে এবং বেশী করিয়া হাদীছ আলোচনা করিবে; অন্যথায় হাদীছ তোমাদের অন্তর হইতে মুছিয়া যাইবে।–দারেমী-১/১৫০ পৃঃ

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ (রাঃ) বলিতেনঃ

(আরবী******************************)

তোমরা পরস্পর হাদীছ আলোচনা করিতে থাকিবে। কেননা, আলোচনাতেই হাদীছের জীবন।‘- দারেমী ১৫০পৃঃ হজরত আবু ছাঈদ খদরী বলেনঃ

(আরবী******************************)

‘তোমরা পরস্পর হাদীছ আলোচনা করিবে, আলোচনাই স্মরণ করাইয়া দেয়।‘ দারেমী-১/১৬৪ পৃঃ

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (ছঃ) তাহার শাগরিদগণের বলিতেন

(আরবী******************************)

‘আমাদের নিকট তোমরা যখন কোন হাদীছ শুনিবে; পরস্পরে উহা পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিবে। দারেমী-১/১৫৮ পৃঃ তিনি ইহাও বলিতেন যে,

(আরবী******************************)

;তোমরা পরস্পর পুঃ পুঃ তাহীছ আলোচনা করিতে থাকিবে: যাহাতে উহা তোমাদের অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইতে না পারে। কেননা উহা কোরআনের ন্যায় (কিতাব আকারে) এক জায়গায় সুরক্ষিত নহে। সুতরাং যদি তোমাদের উহার আলোচনা হইতে গাফেল থাক,তাহা হইলে উহা অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। তোমাদের কেহ যেন একথা না বলে যে কাল আলোচনা করিয়াছি আজ আর করিব না; বরং কাল করিয়াছ, আজও কর এবং আগামীকালও করিবে।          দারেমী-১/১৪৭, পৃঃ

হাদীছ লেখার ক্রমবিকাশঃ

 হাদীছ লেখার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, উহা তিনটি স্তর অতক্রম করিয়া আসিয়াছেঃ কিতাবাঃ, তাদবীন ও তাছনীফ। ছাহারা ও প্রবীণ তাবেয়ীনদের সময় রছূলুল্লা ছাল্লাল্লাহু ওয়াছাল্লাম সমস্ত হাদীছ সামগ্রিকভাবে একত্র করা হয় নাই। তাঁহাদের মধ্যে যিনি যে বিষয়ের যে হাদীছকে অত্যন্ত জরুরী বলিয়া মনে করিয়াছিলেন তাহা লিখিয়া লইয়াছিলেন হুজুরের সম্যক হাদীছ নহে।এরূপ লেখার জন্য তখন আরবীর সাধারণ শব্দ ‘কিতাবাৎ’ বা ‘কিতাব’ (লিখন) ই ব্যবহারে করা হইত। অতঃপর প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে স্বনামখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবনে শেহব জোহরীই প্রথম রছূলুল্লাহু ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের হাদীছসমূহকে সামগ্রিকভাবে একত্র করার চেষ্টা করেন। তাঁর সমসাময়িক তাবেয়ী আবুজ জেনাদের কথায় ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়।তিনি বলেনঃ

(আরবী******************************)

‘আমরা কেবল হালাল-হারাম সম্পর্কীয় হাদীছসমূহই লিখিয়া লইতাম; কিন্তু ইবনে শেহাব যাঁহার নিকট যাহা শূনিতেন তাহা সম্পূর্ণই লিখিয়া লইতেন।পরে যখন লোকের সকল প্রকার হাদীছের প্রতিই আবশ্যকতা দেখা দেয় তখন বুঝিলাম যে ইবনে শেহাবের নিকটই আমাদের সকলেন অপেক্ষা অধীক এলম রহিয়াছে। জামে’-৩৭ পৃঃ

আর এরূপ লেখাকে তখন ‘তাদবীন’নামে অভিহিত করা হয়। আবদুল আজীজ দারাওয়ারদীর একটি কথা হইতে ইহা বুঝা যায়; তিনি বলেনঃ

(আরবী******************************)

‘সর্বপ্রথম যিনি এলমের (অর্থাৎ হাদীছের) তাদবীন করিয়াছেন এবং উহাকে (সামগ্রিকভাবে) লিখিয়াছেন তিনি হইতেছেন ইবনে শেহাব।‘-জামে’ ৩৭ পৃঃ

তবে ইহাতেও (অর্থাৎ তাদবীনেও) হাদীছসমূহকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয় অনুসারে অধ্যায়, উজ-অধ্যায়ে সাজাইবার ব্যবস্থ করা হয় নাই। এ চেষ্টা প্রথম আরম্ভ হয় হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এবং ইহার নাম দওয়া হয় ‘তাছনীফ’। হাফেজ ইবনে হাজারের একটি উক্তি হইতে ইহা স্পষ্টাভাবে বুঝা যায়। তিনি বলেনঃ

(আরবী******************************)

‘সর্বপ্রথম যিনি প্রথম শতাব্দীর মাথায় খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজের আদেশে হাদীছ

‘তাদবীন’ করেন তিনি হইলেন ইবনে শেহাব জোহরী। অতঃপর উহা ছাড়াইয়া পড়ে। ইহার পর আরম্ভ হয় ‘তাছনীফ”যদ্দ্বারা বহু কল্যাণ সাধিত হয়।– ফাতহুল বারী-১/১৬৮ পৃঃ

‘তাছনীফ’ যে ‘তাদবীনে’র পরে আরম্ভ হইয়াছে একথা তিনি স্পষ্টভাবেই বলিয়া দিলেন। তবে এই ‘তাছনীফ’ সর্বপ্রথম কে করিয়াছিলেন তাহা অবশ্য সঠিকভাবে নির্ধাণ করা যায় না। অনেকের মতে ইবনে জোরাইজই (মৃঃ ১৫০ হিঃ) সর্বপ্রথম তাছনীফ করেন। এখানে বলা আবশ্যক যে, হাদীছ লেখার এই তিনটি স্তরের প্রতি দৃষ্টি না রাখার ফলে সাধারণভাবে মনে করা হইয়া থাকে যে,প্রথম শতাব্দীতে হাদীছ লেখা হয় নাই। প্রথম শতাব্দীতে হাদীছের ‘তাদবীন বা ‘তাছনীফ’ হয় নাই একথা তো সত্য; কিন্তু হাদীছ একেবারেই লেখা হয় নাই একথা সত্য নহে। কারণ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, প্রথম শতাব্দীতে স্বয়ং রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম, ছাহাবা, এবং প্রবীণ তাবেয়ীগণ কতৃক বহু হাদীছ লেখা হইয়াছিল- যদিও ‘তাদবীন’ বা ‘তাছনীফ রূপ নহে। নীচে এরূপ কতিপয় লেখার পরিচয়  দেওয়া গেল

রছূলুল্লাহু (ছঃ)-এর সময়ে সরকারী কার্যের মাধ্যমে হাদীছ লেখানঃ

একাদশ হিজরীর প্রথম দিকে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের একান্তকাল পর্যন্ত ইয়ামান ও বাহরাইন হইতে সিরিয়াল সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দশ লক্ষ বর্গমাইল আরব ভূমির উপর ইসলামের আধিপত্য স্থাপিত হয়। এই বিরাট রাষ্ট্রে শাসন উপলক্ষে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর বহু সময় বহু কার্য লিখিতভাবে সম্পাদন করিতে হয়। পার্শ্ববর্তী রাজা-বাদশাহদের সহিত পত্র বিনিময় করিতে হয় এবং বিভিন্ন গোত্রের সহিত বিভিন্ন চুক্তিও সম্পাদন করিতে হয়।

                                                             (ক)

১। মদীনা পৌছিয়াই রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছল্লাম প্রথমে মুহাজির, আনছার, তথাকার ইহুদী এবং অন্যান্য আরবীদের লইয়া একটি সম্মিলিত নাগরিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। অতঃপর ইহার জন্য ৫২ দফা সম্বলিত একটি শাসনতন্ত্র রচনা করেন।এই শাসনতন্ত্র নিয়মিতভাবে লিখিত হইয়াছিল। (সম্ভবতঃ ইহাই পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র)-ছীরাতে ইবনে হিশাম এবং আবু ওবাইদ-এর কিতাবুল প্রভৃতিতে ইহার পূর্ণ বিবরণ রহিয়াছেন।

[আরবী******************************]

আল্লাহর নবী ও রছূল মোহাম্মদ (ছঃ)-এর পক্ষ হইতে ইহা একটি দলীল যাহা কোরাইশের ম’মিন-মুসলমান ও ইয়াছরাব (মদীনা)-বাসী এবং যাহারা তাহাদের অনুসরণ করিবে ও তাহাদের সহিত যুক্ত হইবে তাহাদের মধ্যে সম্পাদিত হইল।আমওয়াল-১২৫ পৃঃ

২। এতদ্ব্যতীত এই নাগরিক রাষ্ট্রের একটি সীমানাও চিহ্নত করা হইয়াছিল এবং শাসনতন্ত্রের পরিশষ্টরূপে ইহাও স্বতন্ত্রভাবে লিখিত হইয়াছিল। ছাহাবী রাফে’ ইবনে খাদীজ বলেনঃ

[আরবী******************************]

‘(মক্ক শরীফের ন্যায়) মদীনাও একটি রহম।রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ইহাকে হরম সাব্যস্ত করিয়া গিয়াছেন। ইহা আমাদের নিকট খাওলানী চর্মে লিখিত হরিয়াছে।

মোছনাদে আহমদ, খণ্ডঃ ৪

                                                               (খ)

৩। মদীনা পৌছিয়া রছূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম লোক গণনা করিয়াছিলেন (সম্ভবতঃ ষষ্ঠ হিজরীতে) এবং লিখিতভাবে উহার বিবরণ দান করিতে পতিপয় ছাহাবীর প্রতি নির্দেশ দিয়াছিলেন। ছাহাবী হজরত হোজইফা (রাঃ) বলেনেঃ রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আমাদের প্রতি এরূপ নির্দেশ দিয়াছিলনঃ

[আরবী******************************]

‘এ যাবৎ যে সকল লোক মুসলমান হইয়াছে তাহাদের একটি লিখিত ফিরিস্তি তোমরা আমার নিকট দাখিল কর। সুতরাং আমরা ১৫ শত লোকের ফিরিস্তি তাহাদের নিকট দাখিল করি।

                                                                                                         বোখরী কিতাবুল জিহাদ

                                                              (গ)

রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আরবের বিভিন্ন গোত্রের সহিত যে সকল সন্ধি করিয়াছিলেন, সে সকলও নিয়মিতভাবে লিখিত হইয়াছিল। তারীখ ( ইতিহাস) ও ছীরাতের (নবী চরিতের) কিতাবসমুহে এরূপ বহু চুক্তির উল্লেখ রহিয়াছে।

৪। হুদায়বিয়ার সন্ধি যে লিখিতভাবে সম্পাদিত হইয়াছিল তাহা একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ কথা

৫। দ্বিতীয় হিজরীতে বনু জামরার সহিত যে চুক্তি করা হইয়াছিল তাহা নিম্নরূপে আরম্ভ করা হয়

আল্লাহ রছূল মোহাম্মদ (ছঃ)-এর পক্ষ হইতে বনু জামরার জন্য ইহা একটি দীলল।

                                                                                                         ছহীফায়ে হাম্মাম ১৬ পৃঃ

৬। খন্দক যুদ্ধের সময়ে বনু ফাজারাহ ও গাতফান গোত্রের সহিত যখন সন্ধি হয় তখনও একটি সন্ধিপত্র লিখিত হইয়াছিল। (যদিও পরে উহা বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হয়।)                                                                                                          ছহীফায়ে হাম্মম ১৭ পৃঃ

৭। নবম হিজরীতে দুমাতুল জান্দলেন শাসনকর্তা উকইদির ইবনে আবদুল মালেক হজরত খালেদ ইবনে ওলীদের বশ্যতা স্বীকার করিলে রছূলুল্লা (ছঃ) তাহাকে একটি স্মরকলিপি লিখিয়া দেন। আবু উবায়দ বলেনঃ [আরবী******************************]

‘এই লিপি আমি পাঠ করিয়াছি। তথাকার এক বৃদ্ধ ইহা আমাকে দেন। ইহা একটি শ্বেতচর্মে লিখিত ছহীফা। আমি ইহাকে অক্ষরে প্রতিলিপি করিয়া রাখিয়াছি। অতঃপর আবু উবায়াদ ইহার সমস্ত পাঠ তাঁহার কিতাবে উদ্ধত করেন।_আমওয়াল ১৯৪ পৃঃ

৮। রছূলুল্লাহ (ছঃ) নাজরানের খৃষ্টানদিগকে একটি চুক্তিপত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন। তাহা আরম্ভ করা হয় নিম্নরূপেঃ

[আরবী******************************]

‘ইহা একটি দলীল যাহা আল্লাহর নবী ও রছুল মোহাম্মদ নাজরানবাসীদের জন্য লিখিলেন। -আমওয়াল-১৮৮ পৃঃ। আবু উবায়দ ইহারও পূর্ণ বিবরণ তাঁহার কিতাবে দান করিয়াছেন।

৯। রছূলুল্লহ (ছঃ) বনু ছকীফদেরও একটি চুক্তিপত্র লিখিয়া দেন। তাহা নিম্নরূপে আরম্ভ করা হইয়াছেঃ

[আরবী******************************]

‘আল্লাহর নবী ও রছূল মোহাম্মদ বনাম ছকীফ ইহা একটি সনদ! –আমওয়াল-১৯০ পৃঃ

*-

+-*/১০ এইরূপে রছূলুল্লাহ (ছঃ) এবং হাজার-বাসীদের মধ্যেও একটি সন্ধিপত্র লেখা হইয়াছিল। হজরত ওরওয়াহ ইবনে জোবাইর বলেনঃ ‘বিছমিল্লাহ’র পর ইহা এইভাবে আরম্ভ করা হইয়াছেঃ

[আরবী******************************]

আল্লাহর নবী ও রছূল মোহাম্মদ বনাম আহলে হাজর ইহা একটি সন্ধিপত্র।

                                                                                                               আমওয়াল-১১২ পৃঃ

১১। হজরত ওরয়াহ ইবনে জুবায়র (রাঃ) আরো বলেনঃ রছূলুল্লহ (ছঃ) আয়লাবাসীদের একটি নিরাপত্তাপত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন। ‘বিছমিল্লাহ’ অন্তে ইহা নিম্নরূপ আরম্ভ করা হইয়াছেঃ

[আরবী******************************]

‘ইহা আল্লাহ এবং আল্লাহর রছূল মোহাম্মদ-এর পক্ষ হইতে ইউহন্নাহ ইবনে রূবাহ ও আয়লাবাসীদের জন্য একটি নিরাপত্তাপত্র। পত্রের শেষের দিকে রহিয়াছে, ইহা জোতইম ইবনে ছালাতের কলমে লিখিত।– কিতাবুল আমওয়াল-৫১৫ পৃঃ

১২। আবু উবায়দ তাহার কিতাবে পূর্ণ বিবরণসহ ইহাও উল্লেখ করিয়াছেন যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম খোজাআহ গোত্রকেও একটি আমান পত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন।

                                                                                                -কিতাবুল আমওয়াল-২০০ পৃঃ

(ঘ) রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কোন ব্যক্তি বিশেষকেও আমাননামা লিখিয়া দিয়াছিলেন।

১৪। বোখারী ও ছীরাতে ইবনে হিশামে এ কথার উল্লেখ রহিয়াছে যে, হিজরতের পথে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ছোরাকা ইবনে মালেককে একটি আমাননামা লিখিয়া দিয়াছিলেন।–ছহীফায়ে হাম্মাম-১৮ পৃঃ

(ঙ) রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার কোন কোন ছাহাবীকে সরকারী ভূমী দান করিয়াছিলেন এবং উহার নিদর্শনস্বরূপ তাঁহাকে ভূমিদানপত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন।

১৫। কিতাবুল আমওয়াল আবু দাঊদ শরীফে রহিয়াছে যে, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বেলাল ইবনে হারেছ মুজানীকে ‘কাবালিয়াহ’ নামক একখণ্ড ভূমীদান করিয়াছিলেন এবং ইহার জন্য নিন্মরূপ একটি ভূমিদানপত্র লিখিয়া দিয়াছিলেনঃ

(আরবী***********************************************************)

‘মোহাম্মদ রছুলুল্লাহ বেলাল ইবনে হারেছ মুজানীকে যে ভূমিদান করিলেন ইহা তাহার নিদর্শনপত্র। তিনি তাহাকে ‘কাবালিয়াহ’ নামক খনি ভূমিদান করিলেন।‘

                                                                  -কিতাবূল আমওয়াল-২৭৩ পৃঃ ও আবু দাঊদ-২-৭৯ পৃঃ

   ১৬। আবু কেলাবা বলেনঃ ‘একদিন ছাহাবী হজরত আবু ছা’লাবা খুশানী (রাঃ) বলিলেনঃ ‘হুজুর ! আমার নামে অমুক অমুক ভূমিখণ্ড লিখিয়া দিন।‘রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাহার নামে উহা লিখিয়া দিলেন এবং উবাই ইবনে কা’বের হাতে উহা লিখাইয়া লইলেন।–কিতাবুল আমওয়াল-১৭৪ পৃঃ

১৭। এভাবে ছাহাবী হজরত তামীম দারী (রাঃ) একদিন বলিলেনঃ‘হুজুর! আল্লাহ আপনাকে সমস্ত ভুমির মালিকানা দান করিবেন; ফিলিস্তিন ইসলামী রাষ্ট্রের শামিল হইলে বেতেলহামের আমার স্বীয় গ্রামটি আমার হইবে এইরূপ একটি দানপত্র আমাকে লিখিয়া দিন। হজরত ইকরাম (রাঃ) বলেনঃ হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাহাকে এরূপ একটি দানপত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন। অতঃপর খলীফা হজরত ওমরের সময় ফিলিস্তিন বিজিত হইলে তামীম দারী (রাঃ) উহা খলিফার নিকট পেশ করেন এবং খলীফা উহা বহাল রাখেন।‘

                                                                                               -কিতাবুল আমাওয়াল-১৭৪ পৃঃ

(তাকরীবুত তাহজীবের হাশিয়া ‘তা’কীবে’ উল্লেখ রহিয়াছে যে, উহা এযাবৎ তামীম দারীর (রাঃ) বংশধরদের নিকট বর্তমান আছে)

১৮। এইরূপে ছাহাবী হজরত ছিরাজ ইবনে মুজ্জাআর অনুরোধে রছূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহাকে ‘গাওরাহ’,’গোরাবাহ’ ও’হুবুল’ নাম তিন খণ্ড ভুমি সম্পর্কে একটি দানপ্র লিখিয়া দিয়াছিলেন। কিতাবুল আমওয়াল-২৮১ পৃঃ

                                                                 (চ)

রছূলুল্লাহ তৎকালীন রাজা-বাদশাহগণের নিকট তাহাদিকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাইয়া যে সকল পত্র লিখিয়াছিলেন সে সকলের কথা সর্বজনবিদিত।

১৯। মিছরের শাসনকর্তা মকাওকিছের নিকট লিখিত আসল পত্রখানিই ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে মিছরের এক গির্জার মোতাওয়াল্লীর নিকট পাওয়া গিয়াছে এবং বিশেষজ্ঞাগণের পরীক্ষায় উহা হুজুরের আসল পত্র বলিয়াই সাব্যস্ত হইয়াছে। ডক্টর হামীদুল্লাহ ছাহেব তাঁহার ‘আল ওছায়েকুছ ছিয়াছিয়াহ’ (আরবী) নামক কিতাবে ইহার প্রতিলিপি প্রকাশ করিয়াছেন।

২০। আবিসিনিয়ার শাসনকর্তা নাজ্জাশীর নিকট প্রেরিত পত্রখানিও পাওয়া গিয়াছে এবং ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে ‘জি আর এস, লণ্ডন’ কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে। ‘ছহীফায়ে হাম্মামের’২০ পৃষ্ঠায় ইহার নকল বা প্রতিলিপি রহিয়াছে।

২১। কাইজারের নিকট লিখিত পত্রখানিও এই সেদিন পযর্ন্ত বিদ্যমান ছিল বলিয়া ডক্টর হাদীদুল্লাহ ছাহেব ‘রছূল আকরম কী ছিয়াছী জিন্দেগী’ (আরবী) নামক কিতাবে উল্লেখ করিয়াছেন।

২২। ইরানের সম্রাট কেছরার (আরবী) নিকটও এরূপ একখানা পত্র লেখা হইয়াছিল বলিয়া সমস্ত ‘তারীখ’ও ‘ছীরাতের’ কিতাবে উল্লেখ রহিয়াছে। আবু উবায়দ বলেনঃ

(আরবী***********************************************************)

‘রছূলুল্লাহ (ছঃ) ইরানের কেছরার নিকট একখানি পত্র লিখিয়াছেন এবং বাহরাইনের ইরানীয় শাসনকর্তার মারফতে উহা পৌছাত (বাহককে) বলিয়াছেন।শাসনকর্তা উহা কেছারার নিকট পেশ করেন। কেছার যখন উহা পাঠ করিল, ক্রধে উহা ছিড়িয়া ফেলিল।‘ কিতাবুল আমওয়াল ২৩ পৃঃ

এই পত্রখানিও হালে (১৯৬২) সালের সভেম্বর মাসে) ইঞ্চি লম্বা ও ৮ ইঞ্চি চওড়া একটি কোমল চামড়ায় লেখ। নীচে হুজুরের সীলমোহরও রহিয়াছে। উহার মধ্যভাগ ছিড়া।

                                                                            -দৈনিক কুহিস্তান লাহোর, ২১শে জুন ১৯৬৩ ইং

২৩। রছূলল্লাহ (ছঃ) আল মুনজির ইবনে ছাওয়ার নিকটও একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন। আবু উবায়দ বলেনঃ

(আরবী***********************************************************)

রছূলল্লাহ (ছঃ) আল মুনজির ইবনে ছাওয়ার নিকট লিখিয়াছিলেনঃ আপনি শান্তির সহিত থাকুন। আমি আপনার নিকট আল্লাহর তারীফ করিতেছি যিনি ব্যতীত কোন মা’বুদ নাই। অতঃপর আপনাকে বলার কথঅ এই যে যে ব্যাক্তি আমাদের নামাজের ন্যায় নামাজ পড়িবে, আমাদের কেবলা (কা’বা)-কে কেবলা স্বীকার করিবে এবং আমাদের জবেহ করা গোশত খাইবে সে ব্যাক্তি মুসলমান, যাহার দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁহার রছূল গ্রহণ করিয়াছেন। এইরূপে মাজুছীদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইহা পছন্দ করিবে সে নিরাপদে থাকিবে আর যে ব্যক্তি উহা অস্বীকার করিবে তাহার উপর জিযিয়া (দেশরক্ষা কর) ধার্য করা হইবে।– কিতাবুল আমওয়াল-২০ পৃঃ

২৪। ওমান ও বাহরাইনের শাসনকর্তাদেরও তিনি ইসলামের প্রতি আহবান জানাইয়া পত্র লিখিয়াছেন।আবু উবায়দ বলেনঃ রছূলুল্লাহ (ছঃ) ইমানবসীদের নিকট নিম্নরূপ পত্র লিখিয়াছেনঃ ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করিবে সে মু’মিন। তাহার জন্য সে সকল অধিকার ও দায়িত্ব রহিয়াছেন যাহা একজন ম’মিনের জন্য রহিয়াছে। আর যে ব্যক্তি ইহুদী ও নাছরানী মতের উপর স্থির থাকিবে তাহাকে উহা হইতে বিরত করা হইবে না। তবে তাহার পক্ষে জিযিয়া দেওয়া অপরিহার্য হইবে।

                                                                                                    -কিতাবুল আমওয়াল-২১ পৃঃ

২৬। ইরানের শাসনকর্তা হারিছ ইবনে আবদে কোলাল, শরাইহ ইবনে কোলাল ও নোয়াইম ইবনে আবদে কোলাল-এর নিকটও তিনি ইসলামের দাওয়াতনামা পাঠাইয়াছিলেন।

                                                                                                     কিতাবুল আমওয়াল ২১ পৃঃ

২৭। এইরূপ রছূলুল্লাহ (ছঃ) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকটও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিয়া পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। আবু উবায়দের কিতাবুল আলওয়াল এবং ছিরাত ও তারীখের কিতাবে এ সকল পত্রের পূর্ণ বিবরণ রহিয়াছে। কিতাবের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এখানে সে সকলেন নকল দেওয়া গেল না।

                                                               (ছঃ)

২৮। রছূলুল্লাহ (ছঃ) আমরা ইবনে হাজাম প্রমুখ শাসনকর্তাদের নিকট ছদকা (রাজস্ব) উছূলেন নিয়ম এবং বিভিন্ন ফরজ, ছুন্নতসমুহ সম্পর্কে নির্দেশনামা লিখিয়ছিলেন।

                                                                                                                     জামে’ ৩৬ পৃঃ

২৯। আবু দাউদ ও তিরমিজী শরীফের ‘জাকাত’ অধ্যায় আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেনঃ

(আরবী***********************************************************)

রছূলুল্লাহ (ছঃ) জাকাতের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে একটি ফরমান লিপিবদ্ধ করান। কিন্তু উহা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের নিকট প্রেরণ করিবার পূর্বেই তিনি এন্তেকাল করেন।অতঃপর উহা তাঁহার তরবারির খাপে রাখিয়া দেওয়া হয়। খলীফা আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) জাকাত উছুলের ব্যাপারে তাহার এন্তেকালে পযর্ন্ত ইহা অনুসরণ আমল করেন।অতঃপর খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ) ও তাঁহার শাহাদাৎ পযর্ন্ত ইহার অনুসরণ করেন। আবু দাউদ আবু দাউদ শরীফ ইহাও রহিয়াছে  যে ইমাম জোহরী (রঃ) বলেনঃ এ লেখাটি আমার পড়ার  সুযোগ ঘটিয়াছে। ইহা হজরত ওমর ফারূকের আওলাদের নিকট ছিল এবং খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রঃ) ইহার কপি করাইয়াছিলেন।

৩০। রছূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহার এক সেনাপতির নিকট নিদের্শনামা লিখিয়াছেন এবং বলিয়াছিলেন যে, অমুক জায়গায় পৌছায় পূর্বে উহা পাঠ করিবে না ।সেনাপতি যখন পৌছেন তখন উহা পাঠ করনে এবং রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হুকম সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন।– বোখারী কিতাবুল এলম

(জ)

রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কোন কোন সাধারণ ব্যাপারে ও তাহার উম্মতীদের নিকট লিখিত হেদায়তনামা প্রেরণ করিয়াছিলেন।

৩১। দারেমীতে রহিয়াছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

‘রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ইয়ামীনবাসীদের নিকট লিখিয়া পাঠাইছিলেনঃ পাক ব্যক্তি ব্যতীত কেহ কোরআন শরীফ স্পর্শ করিতে পারিবে না; বিবাহের পূর্বে তালাক দেওয়া চলে না এবং খরিদ করার পূর্বে দাস ও আজাদ করা যাইতে পারে না।‘ দারেমী ২৯৩ পৃঃ

৩২। হজরত ইমাম জাফর ইবনে আলী (রাঃ) বলেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর এক তরবারির কোষে একটি ছহীফা পাওয়া গিয়াছে; তাহাতে লেখা রহিয়াছেঃ “যে ব্যক্তি কোন অন্ধকে পথভ্রষ্ট করিয়াছে সে ব্যক্তি অভিশপ্ত (মালউন), যে ব্যক্তি জমিনের সীমানা রদবদল করিয়াছে সেও অভিশপ্ত। এছাড়া যে ব্যক্তি নিজের আসল মুনিবকে অস্বীকার করিয়া অপরকে মুবিন বলিয়া স্বীকার করিয়াছে  সেও অভিশপ্ত।“

                                                                                                  জামে’ বায়ানুল এলম ৩৬ পৃঃ

৩৩। ছাহাবী মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) বলেনঃ

“রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম জাহহাকের নিকট লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেনঃ

আশইয়াম যেবাবীর ‘দিয়ত’ যেন তাহার স্ত্রীকে দেওয়া হয়।–এছাবা-১-৬৭ পৃঃ

৩৪। বোখারী শরীফে আছে, মক্কা বিজয়ের দিনে দণ্ডবিধি ও মানব অধিকার সম্পর্কে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম এক খোৎবা দান করেন। খোৎবা শুনিয়অ ইয়ামানের আবুশাহ নামক জনৈক ছাহাবী বলিয়া উঠেনঃ ‘হুজুর! ইহা আমাকে লিখিয়া দিন।‘ তখন হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম অপর ছাহাবীদের বলিলেনঃ (আরবী*******************) ‘তোমরা উহা আবু শাহকে লিখিয়া দাও।‘

৩৫। তবরানী ছগীরে রহিয়াছে, ছাহাবী ওয়াইল ইবনে হোজর (রাঃ) মুসলমান হইয়া কিছুদিন যাবৎ হুজুরের খেদমতে মদীনায় অবস্থান করেন। পরে বাড়ী ফিরিবার সময় রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাহাকে নামাজ, রোজা, শরাব ও সূদ সম্পর্কীয় মাছায়েল লিখাইয়া দেন।

                                                                                                         তাদবীনে হাদীছ ৭১ পৃঃ

মোটকথা, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর জামানায় সরকারীভাবে যে সকল দা’ওয়াতনামা, হেদায়তনামা, নির্দেশপত্র, চুক্তিপত্র ইত্যাদি লেখা হইয়াছিল তাহার সংখ্যা নগণ্য নহে। ডক্টর হামীদুল্লাহ তাহার ‘আল ওছায়েকুছ ছিয়াছিয়াহ’ নামক কিতাবে (দ্বিতীয় এডিশন) এ জাতীয় ১৪১ টি লেখার দান করিয়াছেন। ইহার সবগুলিই রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছের অন্তর্ভূক্ত।

ছাহাবীদের হাদীছ লিখনঃ

ছাহাবীদের এক অংশও যে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর অনুমতিক্রমে তাহার হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন তাহারও যথেষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে।

১। দারেমীতে রহীয়াছেঃ হজরত আবদূল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) রছুলুল্লাহ (ছঃ) এর নিকট হাদীছ লেখার অনুমতি চাহীয়া বলিলেনঃ

(আরবী*****************************************************)

‘হুজুর! আমি আপনার হাদীছ বর্ণনা ও প্রচার করার ইচ্ছা রাখি’ অতএব, আমি আমার অন্তরের হেফজের সহিত হাতের লেখার সাহায্য লইতে চাই-যদি হুজুরের অনুমতি হয়।‘

হুজুর বলিলেনঃ ‘যে আমার হাদীছ হয় তাহা হইলে অন্তরের হেফজের সহিত হাতের সাহায্যেও গ্রহণ করিতে পারে।‘-দারামী-১-১১৬ পৃঃ

হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ

(আরবী*********************************************)

‘আমি হুজুরের মুখে যাহা শুনিতাম হেফজ করার উদ্দেশ্যে তাহাই লিখিয়া লইতাম। কোরাইশ (মুহাজিরগণ) আমাকে এরূপ করিতে নিষেধ করিলেন এবং বলিলেনঃ তুমি কি হুজুরের সব কথাই লিখিতেছ? অথচ হুজুর (ছঃ) একজন মানুষঃ কখনও স্বাভাবিক অবস্থায় কথা বলিয়া থাকেন আর কখনো ক্রোধ অবস্থায়। (ক্রোধ অবস্থার কথা কি লেখা উচিত?) ইহাতে আমি বিরত হইয়া গেলাম এবং ব্যাপারটি সম্পর্কে হুজুরকে অবহিত করিলাম। ইহা শুনিয়া হুজুর (ছঃ) অঙ্গুলি দ্বারা স্বীয় জবানের প্রতি ইঙ্গীত করিয়া বলিলেনঃ তুমি লিখিতে থাক। জানিয়া রাখ যে, যে-পাক জাতের হস্তে আমার প্রাণ রহিয়াছে তাহার কছম, এ মুখ দিয়া কোন অবস্থায়ই না-হক কথা বাহির হয় না।‘-দারেমী-১-১৬৭ পৃঃ

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) যে হাদীছ লিখিতেন ইহার সমর্থন হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর কথায়ও পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা বলেনঃ

(আরবী*************************************************)

‘আবদুল্লাহ ইবনে আমর ব্যতীত রছুলুল্লাহ (ছঃ) এর কোন ছাহাবীই আমার অপেক্ষা অধিক হাদীছ অবগত নহেন। কেননা, তিনি লিখিতেন, আর আমি লিখিতাম না।‘------বোখারী

হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তাহার এই লেখা খাতাটির নাম রাখিয়াছিলেন ‘ছহীফায়ে ছাদেকাহ’ তিনি এ প্রসংগে একবার বলিয়াছিলেনঃ

(আরবী****************************************************)

‘দুইটি জিনিসের উৎসাহ না থাকিলে আমার দুনিয়ায় বাচিয়া থাকার কোন স্বাদ ছিল না। ইহার একটি হইতাছে ‘ছাদেকাহ’ আর অপরটি হইতেছে ‘ওহাজ’। ‘ছাদেকায়’ আমি রছুলুল্লাহর হাদীছ লিখিয়াছি। আর ‘ওহাজ’ একখণ্ড ভূমি যাহা আমার পিতা আমারকে দান করা হইয়াছিল এবং তিনি উহা তত্ত্বাবধান করিতেন।‘

 –দারেমী-১-১২৭ পৃঃ

এখানে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম আহমদ (রাঃ) এই পূর্ণ ছহীফাটিকে তাহার ‘মোছনাদের’ অন্তরর্ভূক্ত করিয়াছেন।

২। হজরত আলী (রাঃ)-ও রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর কিছুসংখ্যক হাদীীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন।

তাবেয়ী আবু জোহাফা (রাঃ) বলেনঃ

(আরবী******************************************************)

‘আমি হজরত আলী ইবনে আবুতালেব (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করিলামঃ কোরআন ব্যতীত রছুলুল্লাহ (ছঃ) এর পক্ষ হইতে আপনার নিকট আর জিনিস আছে কি? তিনি উত্তর করিলেনঃ কোনআন বুঝিবার ‘সমঝ’-যাহা আল্লাহ তাহার বান্দাদিগকে দান করেন এবং এই ছহীফায় যাহা আছে তাহা ব্যতীত আমার নিকট আর কিছূই নাই।‘

                                                                                      মোখতাছার জামে’ ৩৬ পৃঃ ও মেশকাত

৩। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) তাহার এই হাদীছসমুহ লিখিয়া লইয়াছিলেন। [পরবর্তী অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য।]

৪। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ (রাঃ) ও রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর কিছূসংখ্যক হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। তাবেয়ী হজরত মা’আন বলেনঃ

(আরবী***********************************)

‘হজরত আবদুল্লাহর পুত্র আবদুর রহমান (রাঃ) আমার নিকট একটি কিতাব বাহির করিয়া আনিলেন এবং শপথ করিয়া বলিলেন যে, ইহা তাহার পিতার নিজ হাতেরই লেখা।‘

                                                                                                      মোখতাছার জামে’ ৩৭ পৃঃ

৫। হজরত আনাছ (রাঃ) ও কিছু হাদীছ লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। হাকেমের ‘মুস্তাদরাকে’ রহিয়াছেঃ

(আরবী**********************************************)

‘হজরত ছাঈদ বিন হেলাল বলেনঃ আমরা যখন হজরত আনাছ ইবনে মালেককে অধিক পীড়াপীড়ি করিলাম তখন তিনি আমাদের নিকট একটি চোঙ্গা বাহির করিয়া আনিলেন এবং বলিলেন যে, ইহা আমি রছুলুল্লা ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম এর নিকট শুনিয়াছি এবং লিখিয়া লইয়াছি। অধিকন্ত্ত আমি ইহা রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে দেখাইয়া মঞ্জুরীও লাভ করিয়াছি’ –তাদবীনে হাদীছ ৬৭ পৃঃ

৬। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাঃ) ও রছূলুল্লাহ (ছঃ) এর কিছু হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন বলিয়া বোখারী শরীফের একটি হাদীছ হইতে জানা যায়।–বোখারী

৭। হজরত ছামুরাহ ইবনে জুনদুব (রাঃ) ও কিছু হাদীছ লিখিয়াছিলেনঃ হাফজ ইবনে হাজার তাহার ‘তাহজীবে’ ছুলাইমান ইবনে ছামুরার জীবনী আলোচনা করিতে যাইয়া বলিয়াছেনঃ

(আরবী************************************)

‘তিনি তাহার পিতার নিকট হইতে একটি বিরাট নোছখা (কপি) রেওয়াত করিয়াছেন।‘

                                                                              তাহজীব-৪-১৯৮ পৃঃ, তাদবীনে হাদীছ ৭২ পৃঃ

৮। মশহুর ছাহাবী খাজরাজ নেতা হজরত ছা’দ ইবনে উবাদার নিকটও একটি ‘ছহীফা’ ছিল বলিয়া ‘তিরমিজী’ শরীফের হাদীছ হইতে বোঝা যায়। হজরত ছা’দের পুত্র ইহা হইতে কোন কোন হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন। ---তাদবীনে হাদীছ ৭২ পৃঃ

৯। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) ও হাদীছ লিখিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়।তিরমিজী শরীফে হজরত আবদুল্লাহর শাগরিক ইকরামাহ হইতে বর্ণিত আছে যে, তায়েফের কতক লোক আসিয়া তাহার কিতাবসমুহ নকল করিতে চাহিলে তিনি উহা তাহাদের নিকট ‘ইমলা’ করেন (লেখার জন্য পড়িয়া শোনান)।

এছাড়া আবু দাঊদ শরীফে আছেঃ হজরত ইবনে আবি মলাইকা বলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ আমার নিকট এই হাদীছটি লিখিয়া পাঠাইছিলেন—রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলেনঃ ‘মোকদ্দামায় বিবাদীকেই হলফ করাইতে হইবে’।

                                                                                                          আবু দাউদ-২/১৫৪ পৃঃ

দারেমী প্রভৃতিতে ইহাও রহিয়াছে  যে, ইবনে আব্বাছ (রাঃ) তাঁহার এন্তেকালের সময় প্রায় এক উটের বোঝাই পরিমাণ কিতাব রাখিয়া গিয়াছিলেন। -ছহীফায়ে হাম্মাম-৪০ পৃঃ

১০। হজরত মুগীরা ইবনে শো’বা হজরত মুআবিয়ার অনুরোধে তাঁহার কিছু হাদীছ লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। বোখারী শরীফের একটি হাদীছ হইতে ইহা জানা যায়।–

(আরবী*********) –ছহীফায়ে হাম্মাম ৪২ পৃঃ

১১। ছাহাবী হজরত আবু বাকরাহ (রাঃ) তাঁহার নিকট একটি হাদীছ লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। আবু দাঊদ শরীফে (আরবী***************) ইহার উল্লেখ রহিয়াছে। হজরত আবু বাকরাহর পুত্র আবুদর রহমান বলেনঃ ‘আমার পিতা আমার নিকট লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, রছুলুল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছিলেনঃ ‘কোব বিচারক যেন রাগন্বিত অবস্থায় বিচার না করেন’। -ছহীফায়ে হাম্মাম ৪২ পৃঃ

১২। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) রছুলুল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর সময়ে হাদীছ না লিখিলেও রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ওফাতের পর যে তাঁহার নিকট শ্রুত হাদীছসমূহ তিনি লিখিয়া বা লেখাইয়া লইয়াছিলেন তাহার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁহার শাগরিদ হাছান ইবনে আমর জামরী বলেনঃ

(আরবী***********************************)

‘হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ)-এর নিকক আমি একটি হাদীছ বর্ণনা করিলাম, কিন্তু তিনি উহা চিনিতে পারিলেন না। আমি বলিলামঃ হুজুর! ইহা আমি আপনার নিকটই শুনিয়াছি’। ইহা শুনিয়া তিনি বলিলেনঃ ‘যদি আমার নিকটই শুনিয়া থাক তাহা হইলে উহা আমার নিকট কিতাবে লেখা রহিয়াছে’। এই বলিয়া তিনি আমার হাত ধরিয়া তাঁহার ঘরে লইয়া গেলেন এবং আমাকে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছ লেখা অনেক কিতাব (খাতা) দেখাইলেন, উহাতে এই হাদীছটিও পাওয়া গেল। অতঃপর তিনি বলিলেনঃ আমি কি তোমাকে বলি নাই যে, যদি উহা আমিই বলিয়া থাকি তাহা হইলে উহা আমার নিকট কিতাবে লেখা রহিয়াছে? [এরূপ ভুলিয়া যাওয়ার ব্যাপার তাঁহার বৃদ্ধাবস্থায়ই ঘটিয়াছিল্য।] –জামে’ বয়ানুল এলম, তাদবীনে হাদীছ-৬৪ পৃঃ

১৩। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) নিজে হাদীছ লিখিয়াছিলেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তিনি যে তাঁহার শাগরিদদিগকে লেখাইয়া দিয়াছিলেন তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘তাবাকাতে ইবনে ছা’দ’-এ রহিয়াছেঃ হজরত ছালমান ইবনে মূছা বলেন, আমি দেখিয়াছি যে, হজরত ইবনে ওমর তাঁহার শাগরিদ নাফে’কে ইমলা করিতেছেন আর নাফে’ উহা লিখিয়া লইতেছেন। -ছহীফায়ে হাম্মাম ৪০ পৃঃ

১৪। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) তাঁহার শাগরিদ ছাঈদ জুবায়রকে হাদীছ লেখাইয়া দিয়াছিলেন। দারেমী ও ‘তাবাকাতে ইবনে ছা’দ’ হইতে ইহা জানা যায়।

এছাড়া অন্য কোন ছাহাবী যে হাদীছ লেখেন নাই এমন কথা বলা চলে না। অনুসন্ধান কার্য চালাইয়া গেলে আরো কোন ছাহাবীর হাদীছ লেখার কথাও জানা যাইতে পারে। হজরত আবুল্লাহ ইবনে আমরের (রাঃ) একটি হইতে বোঝা যায় যে, অনেক ছাহাবীই হাদীছ লিখিয়াছিলেন। ‘তবরানীতে’ রহিয়াছেঃ [আরবী*****************************]

‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেনঃ এক সময় ছাহাবীদের মধ্য হইতে কতক লোক রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিকট ছিলেন এবং আমিও তাঁহাদের সহিত ছিলাম। আর আমি তাঁহাদের মধ্যে সকলের ছোট ছিলাম। তখন নবী করীম (ছঃ) বলিলেনঃ

‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার নামে মিথ্যা কথা বলিবে সে যেন তাহার স্থান দোজখে ঠিক করিয়া লয়’। অতঃপর সকলে যখন হুজুরের নিকট বাহির হইয়া আসিলেন আমি তাঁহাদেরে বলিলামঃ ‘আপনারা কিরূপে রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যাহা বলিলেন তাহা তো আপনারা শুনিলেন’। আমার কথা শুনিয়া তাঁহারা হাসিয়া বলিলেনঃ প্রিয় বৎস! আমরা যাহা কিছু শুনিয়াছি তাহা আমাদের নিকট লিখিতভাবে রক্ষিত আছে। (সুতরাং ভুল হইবার আশংকা নাই।)’ –তাদবীনে হাদীছ ২৪৭ পৃঃ

প্রবীণ তাবেয়ীদের হাদীছ লেখন

অনুসন্ধানে জানা যায়, কিছুসংখ্যক প্রবীণ তাবেয়ীও তাঁহাদের ওস্তাদ ছাহাবীগণের সম্মুখেই তাঁহাদের হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। সুতরাং ইহাও প্রথম শতাব্দীতেই সম্পাদিত হইয়াছিল। ছাহাবীগণ প্রথম শতাব্দী পর্যন্তই জীবিত ছিলেন।

১। হজরত বশীর ইবনে নাহীক তাঁহার উস্তাদ হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট শ্রুত হাদীছসমূহ লিখিয়া লইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে উহার বিশুদ্ধতার স্বীকৃতিও আদায় করিয়াছিলেন। দারেমীতে আছেঃ (আরবীঃঃঃঃঃঃঃঃ)

‘হজরত বশীর ইবনে নাহীক বলেনঃ আমি হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট যে সকল হাদীছ শুনিতাম তাহা লিখিয়া লইতাম। যখন আমি তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিলাম তখন সে সকল লেখা তাঁহার নিকট হাজির করিলাম। অতঃপর আমি উহা তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলাম এবং বলিলামঃ আমি আপনার নিটক যাহা শুনিয়াছি তাহা এই। শুনিয়া তিনি বলিলেন হাঁ, ঠিক আছে’। -দারেমী-১/১২৭ পৃঃ

২। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এই পূর্ণ ছহীফাটিকে তাঁহার মোছনাদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইয়াছেন। হালে বার্লিন ও দেমাস্কে ইহার দুইটি প্রাচীণ কপি পাওয়া গিয়াছে। ডঃ হামীদুল্লাহ কর্তৃক উহা সম্পাদিত হইয়া (উর্দু তরজমাসহ) লাহোর হইতে প্রকাশিত হইয়াছে এবং সকল সন্দেহের অবসান ঘটাইয়াছে। ইহাতে মোট ১৩৮টি হাদীছ লিখিয়া লন নাই এমন কথা বলা যায় না।

৩। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হজরত ছাঈদ ইবনে জুবায়র (মৃঃ ৯৫ হিঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ)-এর কিছু হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। দারেমীতে আছেঃ (আরবী*********************)

‘হজরত ছাঈদ বলেনঃ আমি রাত্রে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছের নিকট হাদীছ শুনিতাম এবং উহা উটের কাঠে লিখিয়া লইতাম।‘ অপর এক সূত্রে জানা  যায় যে,হজরত ছাইদ (রঃ) খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের আদেশে একটি তফছীর লিখিয়াছেন। সম্ভবতঃ উহা তাঁহার ওস্তাদ ছাহাবীদ্ধয়ের নিকট তফছীর সম্পর্কে শ্রুত হাদীছসমূহেরই সমষ্টি। [জাহাবীর মীজানে আতা ইবনে দীরারের জীবনী দ্রষ্টব্য]

৪। তাবেয়ী হজরত আবু আস্তারা (রঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছের কিছু হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। দারেমীতে আছেঃ

(আরবী*********************)

হজরত আবু আন্তারা (রঃ) বলেনঃ একবার হজরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) আমাকে একটি হাদীছ বর্ণনা করিলেন। আমি বলিলামঃ হুজুর! আমি কি ইহা আপনার নাম করিয়া লিখিয়া লইতে পারি? অতঃপর আবু আন্তারা বলেনঃ তিনি আমাকে উহা লিখার অনুমতি দিলেন বটে কিন্তু তিনি যেন তাহা দিতে চাহিতে ছিলেন না। -দারিমী-১/১২৮ পৃঃ

৫। হজরত ওরওয়াহ ইবনে জুবায়ার (রাঃ)  তাঁহার খালা হজরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) –এর নিকট শ্রুত  হাদীছসমূহ লিখিয়াছিলেন, কিন্তু কোন কারণে তিনি উহা ‘হাররার’অগ্নিকাণ্ডে নিজেই জ্বালাইয়া দেন। অবশ্য পরে তিনি উহার জন্য আক্ষেপ করেন এবং বলেনঃ (আরবী*****************)

‘আহা, আমি যদি আমার সমস্ত মাল-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের বিনিময়েও উহা রক্ষা করিতাম’। -তাহজীব-৭/১৮২ পৃঃ

৬। তারেয়ী হজরত আবান ইবনে ছালেহ (মৃঃ ১১৫ হিঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ)-এর কিছু হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। ছালেমাহ আলাবী বলেন-

(আরবী********************)

‘আমি আবানকে হজরত আনাছ (রাঃ)-এর নিকট ফলকে লিখিতে দেখিয়াছি’। -দারেমী-১/১২৭ পৃঃ

এছাড়া হজরত আনাছ তাঁহার সন্তানদিগকেও হাদীছ লেখার জন্য তাকীদ করিতেন। তাঁহার পৌত্র ছামামা ইবনে আবদুল্লাহ বলেনঃ (আরবী********************)

‘আমার দাদা হজরত আনাছ (রাঃ) তাঁহার সন্তাতদের বলিতেনঃ ‘বাবারা’ তোমরা এই এলম (হাদীছ)-কে লেখায় আবদ্ধ কর’। -দারেমী-১/১২৬ পৃঃ

৭। তাবেয়ী হজরত ওহাব ইবনে মুনাব্বেহ (রঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট শ্রুত হাদীছসমূহ লিখিয়া লইয়াছিলেন।–তাদবীনে হাদীছ

৮। তাবেয়ী ছালমান ইবনে কায়ছ ইয়াস্কুরী (রঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রঃ)-এর নিকট শ্রুত হাদীছসমূহ লিখিয়া লইয়াছিলেন। ইহা ‘ছহীফায়ে জাবের’ নামে প্রসিদ্ধ। ইমাম শা’বী (রঃ) এবং হজরত ছুফইয়ান ছওরী (রঃ) ইহা ছালমানের নিকট ছবক হিসাবে পড়িয়াছিলেন। -[তাদবীনে হাদীছ ৬৮ পৃঃ] ইমাম আহদম ইবনে হাম্বল (রঃ) হজরত কাতাদা (রঃ)-এর স্মরণশক্তির তারীফ করিতে যাইয়া বলেনঃ (আরবী********************)

‘তাঁহার নিকট একবারমাত্র ‘ছহীফায়ে জাবের’ পড়া হইলে তিনি উহা হেফজ করিয়া লন’। -তাজকেরাতুল  হোফফাজ-১/১০৪ পৃঃ

৯। হজরত আবু বোরাদা বলেনঃ (আরবী********************)

‘আমি আমার পিতা হজরত আবু মূছা আশয়ারী (রাঃ)-এর নিকট যখন কোন হাদীছ শুনিতাম তখন উহা লিখিয়া লইতাম। একবার তিনি বলিলেনঃ বাবা! তুমি কি করিতেছ? আমি বলিলামঃ আমি যাহা আপনার নিকট শুনিতেছি লিখিয়া লইতেছি। তিনি বলিলেনঃ দেখি, আমার নিকট আন। অতঃপর আমি উহা তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলাম। শুনিয়া তিনি বলিলেনঃ হাঁ, ঠিক হইয়াছে; আমি রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নিকট এইরূপই শুনিয়াছি। আশংকা হয়, পাছে বেশ কম না হইয়া যায়, তাই দেখিলাম’। -মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-১/১৫১ পৃঃ

১০। ইমাম মালেক (রঃ)-এর ওস্তাদ, বিখ্যাত তাবেয়ী হজরত নাফে’ তাঁহার ওস্তাদ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের (রাঃ) হাদীছ লিখিয়াছেন বলিয়া জানা যায়। ‘তাবাকাতে ইবনে ছা’দে রহিয়াছেঃ হজরত ছালমান ইবনে মূছা (রঃ) বলেনঃ ‘আমি দেখিয়াছি হজরত ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁহার শাগরিতদ নাফে’কে হাদীছ বলিতেছেন এবং নাফে উহা লিখিয়া লইতেছেন। -ছহীফায়ে হাম্মাম-৪০ পৃঃ

১১। ইমাম মুজাহিদ ইবনে জাবর (১০৪ হিঃ) তাঁহার ওস্তাদ হজরত ইবনে আব্বাছের (রাঃ) নিকট শ্রুত হাদীছসমূহ লিখিয়া লইয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়।

১২। হজরত ওমর ফারূকের (রাঃ) পৌত্র, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হজরত ছালেম ইবনে আবদুল্লাহ (রঃ)-ও হাদীছ লিখিয়াছিলেন। তাঁহার ও ইমাম নাখায়ীর শাগরিদ মানছুর বলেনঃ ‘শেষ বয়সে ইমাম নাখায়ীর স্মরণশক্তি হ্রাস পায় এংব তাঁহার বর্ণনায় হাদীছের কোন কোন অংশ বাদ পড়িতে থাকে। একদা আমি তাঁহাকে বলিলামঃ ‘এ হাদীছকে তো হজরত ছালেম এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেন’ তখন হজরত নাখায়ী বলিলেনঃ ‘ছালেম হাদীছ লিখিত আর আমি লিখিতাম না। (তাই তিনি কিতাব দেখিয়া উহা পূর্ণরূপে ইয়াদ রাখিয়াছেন।) –জামে বয়ানুল এলম-৩৩ পৃঃ

১৩। স্বনামখ্যাত ইমাম হজরত হাছান বছরী (রঃ)-ও হাদীছ লিখিয়াছিলেন। হজরত আ’মাশ বলেনঃ ‘হাছান বছরী বলিয়াছেন, আমার নিকট হাদীছ লিখিত কিতাবসমূহ রহিয়াছে; আমি ইহা বরাবর দেখিয়া থাকি’। -জামে’ ৩৩ পৃঃ

হাদীছ লিখিতে নিষেধ ও তাহার কারণ

(ক)

উপরের সুদীর্ঘ আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে বুঝা গেল যে, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার উম্মতীগণকে হাদীছ লিখিতে অনুমতি দিয়াছিলেন এবং তাঁহার ছাহাবীগণ সম্যক না হইলেও তাঁহার অনেক হাদীছই লিখিয়া লইয়াছিলেন, কিন্তু, ‘মোছলেম শরীফ’ ও ‘মোছনাদে আহমদে’ এরূপ হাদীছ রহিয়াছে যাহা হইতে বুঝা যায় যে, রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ লেখার ব্যাপারে তাঁহার অনুমতি ছিল না; বরং তিনি এইরূপ করিতে নিষেধই করিয়াছিলেন। মোছলেম শরীফে রহিয়াছেঃ (আরবী********************)

‘আমার নিকট হইতে কোরআন ব্যতীত তোমরা অন্য কিছু লিখিবে না। যে ব্যক্তি আমার নিকট হইতে কোরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখিয়াছে সে যেন উহা মুছিয়া ফেলে’। -মোছলেম, মোকাদ্দমা ১৮৮ পৃঃ

মোছনাদেত আহমদে রহিয়াছেঃ হজরত আবু ছাঈদ খুদরী বলেনঃ (আরবী********************)

‘আমরা রছুলুল্লাহ (ছঃ)-এর নিকট বসিয়া যাহা শুনিতাম তাহা লিখিয়া লইতাম। এই অবস্থায় একদিন হুজুর (ছঃ) আমাদের নিকট উপনীত হইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘তোমরা ইহা কি লিখিতেছ?’ আমরা বলিলামঃ ‘যাহা আমরা আপনার নিকট শুনিতেছি তাহাই লিখিতেছি’। ইহা শুনিয়া রছুলুল্লাহ (ছঃ) বলিলেনঃ আল্লাহর কিতাবের সহিত আবার কিতাব? আল্লাহর কিতাবকে অমিশ্র রাখ। অতঃপর (আবু ছাঈদ খুদরী রাঃ বলেন,) ইহা শুনিয়া আমরা যাহা লিখিয়াছিলাম তাহা এক জায়গায় করিলাম এবং সমস্ত জ্বালাইয়া দিলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করিলামঃ হুজুর! আমরা কি আপনার হাদীছ মুখে বর্ণনা করিতে পারি?’ হুজুর (ছঃ) বলিলেনঃ হাঁ, মুখে বর্ণনা করিতে পার। ইহাতে কোন আপত্তি নাই। তবে মনে রাখিও, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার নামে মিথ্যা কথা বলিবে সে যেন তাহার স্থান দোজখে তৈয়ার করিয়া লয়’। -মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-১/১৫০ পৃঃ

আমাদের মোহাদ্দেছগণ এই উভয় প্রকার বর্ণনার (পক্ষীয় ও বিপক্ষীয়) নিম্নরূপ মীমাংসা করিয়াছেন। হাফেজ ইবনে হাজার বলেনঃ  মোছলেম শরীফের হাদীছটিকে যদি রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ বলিয়া স্বীকারও করা যায় তাহা হইলেও উভয় প্রকার হাদীছের মধ্যে বাস্তবে কোন বিরোধ নাই। কারণ-

(আরবী********************)

১। ‘যাহাতে কোরআন ও হাদীছ মিশ্রিত হইয়া বিভ্রান্তির সৃষ্টি না করে, সে জন্য যখন কোরআন নাজিল হইতেছিল (এবং নিয়মিতভাবে লেখা হইতেছিল) তখন উহা (শুধু তখনকার জন্য) নিষেধ করা হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত অপর সময়ের জন্য অনুমতি ছিল।

২। ইহাও হইতে পারে যে, হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার হাদীছকে কোরআন এর সহিত একই সাথে লিখিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। ভিন্নভাবে লিখিতে তাঁহার কোন আপত্তি ছিল না। অথবা-

৩। ইহাও হইতে পারে যে, নিষেধ প্রথমে করা হইয়াছিল পরে উহা রহিত করা হইয়াছে এবং লেখার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। আমার মতে প্রথম দুই কথা হইতে ইহাই উত্তম।

৪। আবার কেহ কেহ (যথা –ইবনে আবদুল বার) ইহাও বলিয়াছেন যে, লেখার নিষেধ করার আশংকা ছিল। আর অনুমতি সে সকল লোকের জন্য ছিল যাহাদের পক্ষে এরূপ আশংকা ছিল না।

৫। এতদ্বতীত ইমাম বোখারী প্রমুখ ইমামগণের মতে আবু ছাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত (প্রথম) হাদীছটি রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছই নহে; উহা স্বয়ং আবু ছাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর উক্তি’। [অন্য কথায় ইহা হাদীছে মাওকুফ।] –ফাতহুল বারী-১/১৬৮ পৃঃ

ইমাম ইবনুছ ছালাহ বলেনঃ (আরবী********************)

১। ‘লেখার অনুমতি সম্ভবতঃ হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম সে সকল লোকের জন্যই দিয়াছিলেন যাহাদের পক্ষে ভুলিয়া যাওয়ার আশংকা ছিল এবং নিষেধ সে সকল লোকের পক্ষে ছিল যাহাদের স্মরণশক্তির উপর ভরসা করা যাইত –যাহাতে তাহারা লেখার উপর নির্ভর করিয়া স্মরণশক্তি হারাইয়া না ফেলে। অথবা-

২। হুজুর (ছঃ) হাদীছ লেখার নিষেধ সে সময়ের জন্য করিয়াছিলেন যে সময় উহার কোরআনের ছহীফার সহিত মিলিয়া যাইবার আশংকা ছিল’। -মোকাদ্দমা ১৮৮ পৃঃ

এছাড়া ইহাও হইতে পারে যে, হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম সম্যকভাবে ও নিয়মিতভাবে তাঁহার হাদীছ লিখিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। কারণ, তিনি তাঁহার পয়গম্বরী দূরদৃষ্টিতে দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, যদি তাঁহার জমানায় তাঁহার হাদীছসমূহ কোরআনের ন্যায় সম্যকভাবে এবং সমান গুরুত্ব সহকারে কিতাবে লেখা হয় তাহা হইলে পরবর্তী সময়ে উম্মতীগণ উহাকে কোরআনের মর্যাদাই দান করিবে। হজরত রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর বাক্য (আরবী********************)

 (আল্লাহর কিতাবের সহিত আবার অন্য কিতাব?) –হইতেও ইহাই  বোঝা যায়। মাওলানা মানাজের আহছান গিলানী তাঁহার ‘তাদবীনে হাদীছ’ নামক কিতাবে ইহার উপরই অধিক জোর দিয়াছেন।

(খ)

১। হজরত ওরওয়াহ ইবনে জোবাইর (রঃ) বলেনঃ (আরবী********************)

একবার হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) রছূলুল্লাহ (দঃ)-এর ছুন্নাহ লিখিতে ইচ্ছা করিলেন এবং এ ব্যাপারে অন্যান্য ছাহাবীগণের মতামত জানিতে চাহিলেন। তাঁহারা সকলেই লেখার পক্ষে মত প্রকাশ করিলেন, তথাটি তিনি এক মাস যাবৎ আল্লাহর নিকট ইহার ভাল-মন্দের জ্ঞান দানের জন্য দো’আ (এস্তেখারা) করিতে রহিলেন, ফলে আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে তৌফিক দিলেন। অতঃপর একদিন তিনি সকালে উঠিয়া বলিলেনঃ

অবশ্য আমি ছূন্নাহ লিখিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম, কিন্তু তোমাদের পূর্বেকার যুগের এমন একটি জাতির কথা স্মরণ হইল, যাহারা নিজেরা কিতাবসমূহ লিখিয়অ সে সকলের প্রতিই ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিল, অবশেষে আল্লাহর কিতাবকে ত্যাগ করিয়া বসিয়াছিল। অতএব, খোদার কছম, আমি আল্লাহর কিতাবকে অপর কিছুর সহিত মিশ্রিত করিব না’। -জামে’ ৩৩ পৃঃ

২। হজরত আলী মোরতাজা (রাঃ) একবার তাঁহার ওয়াজে বলিয়াছিলেনঃ (আরবী********************)

‘যাহাদের নিকট কোন লিখিত বিষয় রহিয়াছে তাহাদিগকে আমি আল্লাহর কছম দিয়া বলিতেছিঃ তাহারা বাড়ী ফিরিয়া যেন উহা মুছিয়া ফেলে। কেননা ইহার পূর্বে লোক এ কারণেই হালাক হইয়াছে যে, তাহাদের পণ্ডিত, পুরোহিতদের কথার তাবেদারীতে তাহারা আল্লাহর কিতাবকে ত্যাগ করিয়াছিল’। -জামে’ ২৩ পৃঃ

৩। হজরত আবুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলেনঃ (আরবী********************)

‘আমরা (নিজেরা) হাদীছ লিখি না এবং (অপরকে) লেখাইও না’। -জামে’ ৩৩ পৃঃ

৪। হজরত আবু নুজরা (রঃ) বলেনঃ আমি হজরত আবু ছাঈদ খুদরীকে জিজ্ঞাসা করিলামঃ (আরবী********************)

‘আপনি কি আমাদিগকে লেখাইয়া দিবেন না? কেননা, আমরা সুখস্থ রাখিতে পারি না। তিনি উত্তর করিলেনঃ না, আমি কখনো তোমাদের লেখাইব না এবং উহাকে কোরআনে পরিণত করিব না। আমরা যেভাবে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নিকট হইতে হেফজ করিয়া রাখিয়াছি, তোমরাও সেভাবে হেফজ করিয়া রাখিবে’। -দারেমী-১/১২২ পৃঃ

এরূপে তাবেয়ীনদের মধ্যে ইমাম জোহরী, শা’বী, নাখায়ী, কাতাদা প্রমুখ ইমামগণ হাদীছ লেখার পক্ষে ছিলেন না বলিয়া কোন কোন রেওয়ায়তে দেখিতে পাওয়া যায়।

ইমাম ইবনে আবদুল বার এ সকল বিষয়ের উল্লেক করিয়া তদুত্তরে বলেনঃ এলম (এলমে হাদীছ) লেখা যাঁহারা অপছন্দ করিয়াছেন, তাঁহারা দুই কারণে এরূপ করিয়াছেন। -(১) কোন লেখাকে যেন কোরআনের সমমর্যাদা দান করা না হয় এবং (২) লেখার উপর নির্ভর করিয়া আরবরা যেন তাহাদের স্মরণশক্তি হারাইয়া না ফেলে। এখানে যাঁহাদের কথা বলা হইয়াছে তাঁহারা সকলেই ছিলেন আরব –স্মরণশক্তি ছিল তাঁহাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। তাঁহারা তাঁহাদের এ প্রকৃতির কথাই বলিয়াছেন। প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ও ব্যাকরণবিদ খলীল বলেনঃ (আরবী********************)

‘কাগজ যাহা রক্ষা করিয়াছে, তাহা জ্ঞান নহে –অন্তর যাহা রক্ষা করিয়াছে তাহাই জ্ঞান’। এক বেদুইন কবি বলেন- (আরবী********************)

‘(মানুষ) জ্ঞানকে কাগজে আমানত রাখিয়া নষ্ট করিয়া দিয়াছে। কাগজ জ্ঞানের জন্য কেমন অপপাত্র’।

অতঃপর ইবনে আবদুল বার হজরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ), শা’বী, জোহরী, নাখায়ী ও কাতাদা প্রমুখের স্মরণশক্তির কথা উল্লেখ করিয়া বলেনঃ তাঁহারা একবার যাহা শুনিতেন, তাহা কখনো ভুলিতেন না। হজরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) ওমর ইবনে রবীয়ার একটি সুদীর্ঘ কবিতা একবার মাত্র শুনিয়া মুখস্থ করিয়া ফেলেন। ইবনে শেহাব জোহরী বাজে কথা কানে আসিয়া ইয়াদ হইয়া যাওয়ার ভয়ে রাস্তায় চলিতে কানে আংগুল দিয়া রাখিতেন। শা’বী বলেনঃ আমি জীবনে কখনো কোন ওস্তাদকে কোন হাদীছ পুনঃ বলিতে অনুরোধ করি নাই। -জামে’ বয়ানুল এলম ৩১ পৃঃ

৫। হাকেম আবু আবদুল্লাহ বর্ণনা করিয়াছেনঃ (আরবী********************)

‘হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমার পিতা (হজরত আবু বকর [রাঃ]) রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর পাঁচ শত হাদীছ লিখিয়া লইয়াছিলেন। অতঃপর তিনি এক রাত্রে খুব অস্থিরতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ইহাতে আমি চিন্তিত হইয়া পড়িলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলামঃ আব্বাজান! আপনি এরূপ করিতেছেন কেন? কোনরূপ শারীরিক অসুবিধা দেখা দিয়াছে, না কোন দিক হইতে কোন দুঃসংবাদ আসিয়াছে? (তিনি কোন উত্তর করিলেন না) যখন ভোর হইল, আমায় ডাকিয়া বলিলেনঃ ‘মা! তোমার নিকট যে হাদীছগুলি রাখা হইয়াছে, উহা আন দেখি’। আমি উহা উপস্থিত করিলাম। তিনি আগুন আনাইয়া উহা পুড়াইয়া ফেলিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ আব্বা! এরূপ করিলেন কেন? তিনি উত্তর করিলেনঃ ইহা ঘরে রাকিয়া আমি মরিতে চাহি না। কারণ, ইহাতে কতক অন্যের নিকট হইতে শোন হাদীছও রহিয়াছে, তাহার উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করিয়া আমি উহা লিখিয়া লইয়াছি, কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে, তিনি যেরূপ বলিয়াছেন, বস্তুতঃ হাদীছ সেরূপ নহে’। (অর্থাৎ তিনি রছূলুল্লাহ [ছঃ]-এর কথা ঠিকভাবে বুঝিতে কারেন নাই বা উহা ঠিকভাবে ইয়াদ রাখিতে পারেন নাই।) –কানজুল উম্মাল-১/২৩৭ পৃঃ

হাফেজ জাহী তাঁহার তাজকেরাতুল হোফফাজে এই রেওয়ায়তের উল্লেখ করিয়া বলেন যে, (আরবী*********) ‘ইহা ছহীহ নহে’। -তাজকেরাহ-১/৫ পৃঃ

হাফেজ ইবনে কাছীর বলেন, ‘এই রেওয়ায়তের রাবী আলী ইবনে ছালেহর পরিচয় জানা যায় না’। (অর্থাৎ তিনি মোবহাম।) –কানজ-১/২৩৭ পৃঃ। আর মোহাদ্দেছগণের সর্ববাদিসম্মত মতে অ-ছাহাবী মোবহাম (অজ্ঞাত পরিচয়) ব্যক্তির রেওয়ায়ত গ্রহণযোগ্য নহে।

এক কথায় হাদীছ লেখা হইতে ইহাদের বিরত থাকার অর্থ এই নহে যে, হাদীছ লেখাকে তাঁহারা নাজায়েজ মনে করিতেন বা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অমত রহিয়াছে বলিয়া জানিতেন। ব্যাপার যদি তাহাই হইত, তাহা হইলে হজরত ওমর ফারূকের পক্ষে ইহার জন্য পরামর্শ করার এবং ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষে ইহার অনুকূল সম্মতি দেওয়ার কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব; বরং ইহার বিপরীত আমরা ইহাও জানিতে পারিতেছি যে, হজরত ওমর ফারূক শেষের দিকে হাদীছ লেখার জন্য অন্য সকলকে তাকীদই করিয়াছিলেন। দারেমীতে রহিয়াছেঃ (আরবী********************)

‘আমর ইবনে আবু ছুফইয়ান বলেনঃ আমি হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাবকে বলিতে শুনিয়াছি; তিনি বলিতেনঃ (হাদীছকে) লিপিতে আবদ্ধ কর’। -দারেমী-১/১২৭ পৃঃ

এভাবে ইমাম ইবনে শেহাব জোহরী –যিনি প্রথমে হাদীছ লেখাকে অপছন্দ করিতেন, পরে তিনিই সামগ্রিকভাবে হাদীছ লেখার জন্য আগ্রহী হন।

‘‘জামে’ বয়ানুল এলমে’’  রহিয়াছেঃ জোহরী বলেন, আমরা (হাদীছ) লেখাকে অপছন্দ করিতাম; কর্তৃপক্ষ (খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ) আমাদের এজন্য বাধ্য করেন। এখন আমি নিজেই মনে করিতেছি যে, হাদীছ লিখাতে কাহাকেও বাধা দেওয়া উচিত নহে।

এছাড়া তাবেয়ী হজরত জাহহাক বলিতেনঃ ‘যখন কিছু শুনিবে, লিখিয়া লইবে। লেকার জন্য কিছু না পাওয়া গেলে দেওয়ালের গায়ে হইলেও লিখিয়া লইবে’। -জামে’। হজরত ছাবেত ইবনে কোররাহ তো এ পর্যন্ত বলিতেন যে, যাহারা এলম (হাদীছ) লেখে না, তাহাদিগকে আলেমই মনে করিবে না। -জামে’। হজরত ছাঈদ ইবনে ইব্রাহীম বলেনঃ ‘হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রঃ) আমাদিগকে হাদীছ লিখিতে আদেশ দেন। আমরা বহু কিতাব লিখিয়া লই। অতঃপর উহা তিনি রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠাইয়া দেন’। -জামে’

এখানে একথা মনে রাখা আবশ্যক যে, এলম অর্থে তৎকালে হাদীছকেই বুঝাইত।

 

দ্বিতীয় যুগ

এ যুগ হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম হইতে তৃতীয় শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক এক শতাব্দীর যুগ। এ যুগ তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের যুগ। এ যুগে হাদীছ অনুযায়ী আমলকরণ বরাবর অব্যাহত থাকে এবং শিক্ষাকরণ, শিক্ষাদান, হেফজকরণ ও লিখন বহুগুণে বাড়িয়া যায়।

তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনগণের

হাদীছ শিক্ষাকরণ

তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনগণের

হাদীছ শিক্ষাকরণ

ছাহাবীগণের উৎসাহদানের ফলে তাবেয়ীনদের মধ্যে এবং তাবেয়ীনগণের উৎসাহদানের ফলে তাবে’-তাবেয়ীনদের মদ্যে এইরূপ উৎসাহউদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যে, তাঁহাদের এক এক ব্যক্তি এক একটি হাদীছের নজ্য তৎকালের হাদীছের কেন্দ্র –মদীনা, মক্কা, বছরা, কুফা, শাম ও মিছর ঘুরিয়া বেড়ান। তাবেয়ী বোছর ইবনে উবায়দুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি একটি মাত্র হাদীছ লাভের জন্য এ সকল শহরের অনেকটিতে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি। -[দারেমী-১/১২৬ পৃঃ]  প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আবুল আলীয়া রেয়াহী (রঃ) বলেনঃ ‘আমি বছরায় (প্রবীণ তাবেয়ীনদের নিকট) হাদীছ শুনিয়া তৃপ্তিলাভ করিতাম না –যে পর্যন্ত না মদীনায় যাইয়া উহা স্বয়ং ছাহাবীদের মুখে শুনিতাম’। ; [দারেমী-১/১২৬ পৃঃ]  তাবেয়ী আবু কেলাবা বলেনঃ ‘মদীনা সফরকালে আমি প্রত্যাবর্তনের সমস্ত আয়োজন শেষ করিয়াও শুধুমাত্র একটি হাদীছ শোনার জন্য তিন.... পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়াছিলাম এবং হাদীছটি শুনিয়াই প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলাম’। (তিন অর্থে তিনি সম্ভবতঃ তিন মাসকেই বুঝাইয়াছেন।) [ দারেমী-১/১২৫ পৃঃ]  স্বনামখ্যাত তাবেয়ী ইমাম জোহরী হাদীছ লাভ করার জন্য প্রবীণ তাবেয়ী ওরওয়া ইবনে জুবায়রের দরজায় পড়িয়া থাকিতেন। [ দারেমী-১/১২৬ পৃঃ]

তাবেয়ীগণ ছাহাবীদের নির্দেশ অনুসারে হাদীছ হেফজ রাখার জণ্য উহা পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিতেন। তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ (রঃ) বলেনঃ (আরবী********************************)

‘আমরা ছাহাবী হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর নিকট যাইতাম, আর তিনি আমাদের হাদীছ বর্ণনা করিতেন। আমরা যখন তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিতাম, পরস্পর মিলিয়া উহা আলোচনা করিতাম’। -তাদবীনে হাদীছ-৯০ পৃঃ

একদিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ তাঁহার শাগরিদদের জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘হাদীছ আলোচনা ও ইয়াদ রাখার জন্য তোমরা পরস্পর মিলিত হও কি?’ উত্তরে তাঁহারা বলিলেনঃ ‘কোন দিন আমাদের কোন সংগী হাদীছ আলোচনায় যোগদান না করিলে আমরা বাড়ী যাইয়া তাহার সহিত উহা আলোচনা করি –যদিও তাহার বাড়ী কুফার শেষ প্রান্তে অবস্থিত হয়’। ইহা শুনিয়া হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলিলেনঃ ‘যে পর্যন্ত তোমরা এরূপ করিতে থাকিবে, কল্যাণের সহিত থাকিবে’। -দারেমী

তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীন ও পরবর্তী মোহাদ্দেছগণের

হাদীছ হেফজকরণ

ছাহাবীগণের পক্ষে ৫০-৬০ হাজার (অধিক হইতে অধিক লাখখানিক) ছনদবিহীন হাদীছ হেফজ বা রক্ষা করা মোটেই কঠিন ব্যাপার ছিল না, কিন্তু পরবর্তী যুগে ছনদ মুখস্ত করার আবশ্যকতা দেখা দেওয়ায় হাদীছ হেফজকরণের ব্যাপার কিছুটা কঠিন হইয়া উঠিলেও –যে পর্যন্ত না সমস্ত হাদীছ কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায় সে পর্যন্ত মোছলিম জাহানে –আরব ও গায়র আরবে –এমন এমন তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব হয়, যাঁহাদের স্মরণশক্তির কথা শুনিলে বিস্ময়ে হতবাক হইতে হয়।

ইমাম শা’বী (মৃঃ ১০৪ হিঃ) বলেনঃ আমি কখনও সাদা কাগজে কালির দাগ দিই নাই। আমি যাহা একবার শুনি তাহা আমার হেফজ হইয়া যায়। আমি কোন দিন কোন হাদীছ পুনঃ বলিতে কাহাকেও অনুরোধ কির নাই। আমি কবিতা মুখস্থ করিয়াছি সর্বাপেক্ষা কম, তথাটি একাধাকে একমাস বলিলেও কোনো পংক্তি পুনঃ বলিতে হইবে না। -[?]  মনীষী কাতাদা (মৃঃ ১১৭ হিঃ) সম্পর্কে ইমামা আহমদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ কাতাদার কোন কথা শুনিবামাত্রই হেফজ হইয়া যাইন। তিনি একবার মাত্র শুনিয়াই ‘ছহীফায়ে জাবের’ হেফজ করিয়া লইয়াছিলেন। -[তাজকেরা] ইমাম জোহবী (মৃঃ ১২৪ হিঃ) বলেনঃ আমি যখন জান্নাতুল বাকী’র দিকে যাই, তখন আমি আমার কানে আঙ্গুল দিয়া রাখি যাহাতে বাজে কথা আমার কানে প্রবেশ না করে। খোদার কছম, একবার যে কথা আমার কানে প্রবেশ করে, তাহা আমি কখনো ভুলি না। -[জামে’ বয়ানুল এলম] ইমাম ইছহাক ইবনে রাহওয়াইহ (মৃঃ ২৩৮ হিঃ)  বলেনঃ আমার কিতাবসমূহে লেখা ১ লক্ষ হাদীছ আমার চোখের সামনে ভাসিতেছে, ৩০ হাজার হাদীছ আমি গড় গড় করিয়া শুনাইতে পারি। দাঊদ ইবনে খাফফাফ বলেনঃ একবার ইমাম ইছহাক আমাদের ১১ হাজার হাদীছ লিখাইয়া দিলেন এবং আমরা লেখা দুরস্ত করিয়া লইবার উদ্দেশ্যে পরে উহা তিনি পুনঃ বলিলেন। কিন্তু কোথাও একটি অক্ষরও বেশ-কম হইল না। -[তাহজীব] ইমাম বোখারীর (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) তিন লক্ষ হাদীছ মুখস্থ ছিল। হাশেদ ইবনে ইছমাইল বলেনঃ বোখারী আমাদের সহিত শায়খদের নিকট হাদীছ শুনিতে যাইতেন, আমরা সকলেই লিখিতাম। বোখারী লিখিতেন না। এজন্য আমরা তাঁহাকে তিরস্কার করিলে একদিন তিনি আমাদের সমস্ত হাদীছ মুখস্থ শুনাইয়া দেন, অথচ তখন পর্যন্ত ১৫ হাজার হাদীছ লেখা হইয়াছিল। -[তারীখে খতীব –তারজমান] ইমাম আবু জুরআ রাজী বলেনঃ আমি এক লক্ষ হাদীছ এমনভাবে মুখস্থ বলিতে পারি, যেভাবে এক ব্যক্তি কুলহুয়াল্লা (আরবী*****) বলিতে পারে। আমার ঘরে ৫০ বৎসর আগেরে বহু লেখা রহিয়াছে, যাহা আমি এ সময়ের মধ্যে কখনও দেখি নাই, অথচ আমি বলিতে পারি যে, কোন কথা কোন কিতাবের কোন পৃষ্ঠায় কোন লাইনে রহিয়াছে। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেনঃ ছহীহ হাদীছের (অর্থাৎ, ছহীহ ছনদের) কুল সংখ্যা সাত লক্ষ আর এই যুবকটি (আবু জুরআ) ছয় লাখই মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। -[তাহজীবুত তাহজীব]  ইমাম তিরমিজী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ] একবার যাহা শুনিতেন, তাহাই তাঁহার কন্ঠস্থ হইয়া যাইত। একবার তাঁহার এক শায়খ পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁহাকে এক সঙ্গে ৪০টি হাদীছ শুনাইয়া উত্তর চাহিলে তিনি সাথে সাথে উহা শুনাইয়া দেন। -[তাজকেরা ২-১২৮] মোহাদ্দেছ আবু দাউদ তায়ালছী বলেনঃ ৩০ হাজার হাদীছ আমি ফরফর করিয়া শুনাইতে পারি, অথচ ইহাকে আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করি না। -[তাহজীব] ইমাম তকীউদ্দীন বা’লাবাক্কী একই বৈঠকে ৭০টি পর্যন্ত হাদীছ মুখস্থ করিতে পারিতেন। হোমাইদীর ‘আল জামউ বায়নাছ ছহীহাইন’ মোছলেমের ‘ছহীহ মোছলেম’ ও ইমাম আহমদের বিরাটকায় ‘মোছনাদে আহমদ’ কিতাবের বেশীর ভাগ তাঁহার মুখস্থ ছিল।

এইরূপ আর কত জনের উদাহরণ দিব? ইমাম জহরী এইরূপ হাফেজ হাদীছ মনীষীদের সম্পর্কে ‘তাজকেররাতুল হোফফাজ’ নামে চারি খণ্ডে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্হই রচনা করিয়াছেন, যাহাতে ১১ শতের অধিক হাফেজের জীবনী রহিয়াছেন। অথচ ছনদের সম্যক অবস্থাসহ যাহার এক লক্ষ হাদীছ অর্থাৎ, ছনদ মুখস্থ নাই, তাহাকে হাফেজ বলাই যায় না। এছাড়া উহাতে বহু হুজ্জাতের জীবনীও রহিয়াছে যাহাদের এইরূপে অন্ততঃ তিনি লক্ষ করিয়া হাদীছ’-ও কেবল (ছনদ) মুখস্থ ছিল।ইমাম বোখারীও এইরূপ একজন হুজ্জাত। দুনিয়াতে ‘হাকেমুল হাদীছ’ ও কেবল কম জন্মগ্রহণ করেন নাই, অথচ আপন সময় পযর্ন্ত প্রচলিত সমস্ত হাদীছের অবস্থা জানা না থাকিলে কাহাকেও হাকেম নাম অভিহিত করা যায় না।[ওলামায়ে ছলফ-শিরওয়ানী]

এই দ্বিতীয় যুগের কতিপয় বিখ্যাত হাফেজ হাদীছ

১। হজরত আমর ইবনে দীনার (মৃঃ ১১৬ হিঃ)

২। হজরত কাতাদা ইবনে দাআমা ছদুছী (মৃঃ ১১৭ হিঃ)

৩। ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার (মৃঃ১১৯ হিঃ)

( ইনিই হাজ্জাজের আদেশে কোরআন পাকের অক্ষরে প্রথম নোকতা ব্যবহার করেন বলিয়া অনেকে মনে করেন)

৪। ইমাম জোহরী মোহম্ম ইবনে মুছলিম ইবনে উবায়াদুল্লাহ ইবনে শেহাব (মৃঃ ১২৪ হিঃ)

৫। হজরত আবদুর রহমান ইবনে কাছেম ইবনে মোহাম্মদ (মৃঃ ১২৬ হিঃ মদীনা )

৬। ইমাম আবু ইছহাক ছিবিয়ী (রঃ ১২৭ হিঃ)

তিনি ৪০০ ওস্তাদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছিলেন-যাঁহাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন ছাহাবী।

৭। হজরত মানছুর ইবেন মো’তামের (মৃঃ ১৩৬ হিঃ কুফা)। তিনি হজ্জাত ছিলেন।

৮। হজরত রাবীয়াতুল-রায় (মৃঃ ১৩৬ হিঃ ইমাম মালেকের ওস্তাদ)

৯। হজরত দাউদ ইবনে দীনার (মৃঃ ১৩৯ হিঃ)

১০। হজরত ইউনুছ ইবনে উবায়দ (মৃঃ ১৩৯ হিঃ)।

১১।হজরত ছালমাহ ইবনে দীনার (মৃঃ ১৪০ হিঃ)।

১২। হজরত ছোলাইমান ইবনে দীনার (মৃঃ ১৪৩ হিঃ)।

১৩। হজরত ওকাইল ইবনে খালেদ আইলী ) মৃঃ ১৪৪ হিঃ)।তিনি হুজ্জাত ছিলেন।

১৪। হজরত হেশাম ইবনে ওরওয়াহ (মৃঃ ১৪৬ হিঃ)। তিনি হুজ্জাত ছিলেন এবং হাদীছ লিখিয়াও ছিলেন।

১৫। হজরত ইছমাইল ইবনে আবু খালেদ (মৃঃ ১৪৭ হিঃ)।

১৬। হজরত উবায়দুল্লাহ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ১৪৭ হিঃ)।

১৭। হজরত হোছাইন মুয়াল্লিম বছরী (মৃঃ ১৪৯ হিঃ)।

১৮। ইমাম মোহাম্মদ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ১৫১ হিঃ)। তিনি মাগাজী সম্পর্কে হাদীছের কিতাবও রচনা করিয়াছেন।

১৯। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আওন (মৃঃ ১৫১ হিঃ)

২০। হজরত মা’মার ইবনে রাশেদ (১৫৩ হিঃ)। তিনি হাদীছের হুজ্জাত ছিলেন ইয়ামানে সর্বপ্রথম তাছনীফ করিয়াছিলেন।

২১। ইমাম ছুফাইয়ান ছওরী (১৬৩ হিঃ)। তাঁহার ৩০ (ত্রিশ) হাজার হাদীছ মুখস্থ ‘জামে’ছওরী’ প্রভৃতি তাহার হাদীছের কিতাব।

২২। ইমাম আবু জোরআ ইবনে আবু শাইবাহ (  হিঃ খোরছান) লক্ষধিক তাঁহার মুখস্থ ছিল।

২৬। হজরত ইমাম ইবনে ইয়াহইয়া বছরী ( ১৬৪ হিঃ) তিনি হুজ্জত ছিলেন।

                                                         তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের

                                                                   হাদীছ শিক্ষাদান

হাদীছেন শিক্ষাকরণ ও হেফজকরণের ন্যায় উহা শিক্ষাদানের ব্যাপারেও তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের আগ্রহ ও তৎপরতার অন্ত ছিল না। তাঁহারদের প্রত্যেকেই হাদীছের একজন মোআল্লেম ছিলেন।রেজালেন কিতাব এইরূপ কয়েক হাজার তাবেয়ীন, তাবে’-তবেয়ীনের জীবনী রহিয়াছে যাঁহারা আজীবন হাদীছ শিক্ষায় ( রেওয়ায়তে) ব্যাপৃত ছিলেন। ইবনে ছাদ তাঁহার ‘তাবকাতে’ এইরূপ.... হাজার লোকের জীবনী আলোচনা করিয়াছন। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী তাঁহার ‘মা’রেফাতে উলুমিল হাদীছ’ গ্রন্হে ইহাদের প্রায় সাড়ে পাঁচ শত (৫৪১) এমন লোকের নামে করিয়াছেন যাঁহাদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করাকে বরকতও গৌরবের ব্যাপার বলিয়া মনে করা হইতে। নীচে এইরূপ কতিপয় হাদীছ শিক্ষাদাতার নাম দেওয়া গেলঃ

মদীনায়ঃ

১। হজরত ছাঈদ ইবনে মোছায়্যাব (মৃঃ ৯৪ হিঃ)।

২। হজরত ওরওয়া ইবনে জুবায়র (মৃঃ ৯৪ হিঃ)।

৩। হজরত আবু বোরদা ইবনে আবু মূছা আশআরী (মৃঃ ১০৪ হিঃ)

৪। হজরত ইকরামা মাওলঅ ইবনে আব্বাছ (মৃঃ ১০৭ হিঃ)।

৫। হজরত কাসেম ইবনে মোহাম্ম ইবনে আবু বকর ছিদ্দী (মৃঃ ১০৭ হিঃ)

৬। হজরত নাফে’ মাওলা ইবনে ওমর (মৃঃ ১০৭ হিঃ)

৭। হজরত ইবনে শেহাব জোহরী (মৃঃ ১৪২ হিঃ)।

৮। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে দীনার (মৃঃ ১২৭ হিঃ)

৯। হজরত আবুজ জেনাদ (মৃঃ ১৩১ হিঃ)

১০। হজরত জায়দ ইবনে আছলাম (মৃঃ ১৩৬ হিঃ)

১১। হজরত হেশাম ইবনে ওরওয়াহ (মৃঃ ১৪৬ হিঃ)।

১২। হজরত ইবনে আবি জে’ব_

১৩। হজরত ইমাম মালে  (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)

মক্কায়ঃ

১। হজরত মুজাহিদ ইবনে জাবার (মৃঃ ১০৪ হিঃ)।

২। হজরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (মৃঃ ১১৪ হিঃ)।

৩। হজরত আমরা ইবনে দীনার (মৃঃ ১২৬ হিঃ)

৪। হজরত ইবনে জোরাইজ (মৃঃ ১৬০হি)

কুফায়ঃ

১। হজরত ইব্রাহীম নাখায়ী (মৃঃ ৯৫ হিঃ )

২। হজরত ছাঈদ ইবনে জুবায়র (মৃঃ ৯৫ হিঃ)

৩। হজরত শা’বী (আমের) (মৃঃ ১০৩ হিঃ)

৪। হজরত আবু ইছহাক ছাবিয়ী (মৃঃ ১১৭ হিঃ)

৫। হজরত আ’মাশ (মৃঃ ১৪৮ হিঃ)

৬। হজরত মেছআর ইবনে কেদাম (মৃঃ ১৫৫ হিঃ)

৭। হজরত জয়েদাহ ইবনে কাদামাহ (মৃঃ ১৬১ হিঃ)

৮। হজরত ইমাম ছুফাইয়ান ছাওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ)

৯। হজরত ছুফইয়ান ইবনে উয়ায়নাহ (মৃঃ ১৯৮ হিঃ প্রমুখ

বছরায়

১। হজরত আবু ওছমান নাহদী (মৃঃ ১০০ হিঃ)

২। হজরত কাতাদ ইবনে দাআমা (মৃঃ ১১৫ হিঃ)

৩। হজরত আইয়ুব ছিখতেয়ানী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ)

৪। হজরত হেশাম দস্তওয়াইহ (মৃঃ ১৫৪ হিঃ)

৫। হজরত ছাঈদ ইবনে আবি আরূবাহ (মৃঃ ১৫৬ হিঃ)

৬। হজরত ইমাম শো’বা ইবনে হাজ্জাজ (মৃঃ ১৬০ হিঃ)

৭। হজরত ইবনে আওন (মৃঃ ১৫০ হিঃ) প্রমুখ

                                                তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের

                                                           হাদীছ লিখন

হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষর দিকেই পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (মৃ ১০১ হিঃ) ব্যাপকভাবে হাদীছ সংগ্রহ করার জন্য মদীনার শাসনকর্তা আবু বকর ইবনে হাজম (মৃঃ ১১৭ হিঃ) এবং  ইসলামী রাষ্ট্ররে অন্যান্য প্রধান প্রধান কেন্দ্র ওলামা ও সরকরী কর্মচারী প্রতি এক ফরমান জারি করেন এবং বলেনঃ

{ আরবী********************}

‘আপনাদের রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ তালাশ করিয়া সংগ্রহ করুন। আমার আশংকা হইতেছে যে, ওলামাদের (ছাহাবা ও তাবয়ীনদের) মৃত্যুর সংগে সংগে হাদীছও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। কন্তু সাবধান! রছূলুল্লাহর হাদীছ ব্যতীত অপর কাহারো হাদীছ গ্রহণ করবেন না। [খলীফ হজরত ওছমানের আমলেই ছাহাবীদের দ্ধারা হাদীছ জাল করার ষড়যন্ত্র আরম্ভ হইয়া যায় এবং দেশের] এতদ্বতীত আপনার সর্বত্র মজলিস কায়েম করিয়া হাদীছ শিক্ষা দিতে থাকুন, যাহাতে যাহাদের জানা নাই তাহারা জানিতে পারে। কেননা, এলম গোপন করা হয় (অর্থাৎ তার র্চচা করা না হয়) তখন উহা বিলুপ্ত হইয়া যায়। বোখারী কিতাবুল এলম এই আমাদের ফলে দেশে হাদীছ সংগ্রহ করার এক বিরাট সাড়া পড়িয়া যায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলেমগণ (তবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনগণ) হাদীছ সংগ্রহ ও লেখার কাজে উঠিয়া-পড়িয়া লাগেন। নীচে ইহাদের লিখিত কতিপয় কিতাবের নাম দেওয়া গেলঃ

দ্বিতীয় যুগে লিখিত

                                                  কতিপয় হাদীছের কিতাব

তৃতীয় শতব্দীর বিখ্যাত গ্রন্হ-ঐতিহাসি ইবনে নদীম (মৃঃ ৩২৬ হিঃ) তাঁহার ‘আল ফিহরিন্ত’ নামক গ্রন্হ-পরিচিতি কিতাবে দ্বিতীয় শতব্দীতে রচিত প্রায় অর্ধশত হাদীছের কিতাবের নাম উল্লাখ করিয়াছেন।নীচে উহাদের মধ্যে কতিপয়ের নাম করা গেলঃ

১। কিতাবুছ ছুনান                            ইমাম মকহুল শামী                                 (মৃ ১১৬ হিঃ)

২। কিতাবুল ফরায়েজ                       আবু হেশাম মুগীরা                                 (মৃঃ ১৬৩  হিঃ)

৩। কিতাবুছ ছুনান                         ইমাম আবদুল মালেক ইবনে জোরাইজ           (মৃঃ১৫০ হিঃ)

৪। কিতাবুছ ছুনান   ছাঈদ ইবনে আবি আরূবা   (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)

৫। কিতাবুছ ছুনান   ইবনে আবি জে’ব    (মৃঃ ১৫৯ হিঃ)

৬। কিতাবুছ ছুনান   ইমাম আওজাঈ     (মৃঃ ১৫৯ হিঃ)

৭। কিতাবুল জামে’উল কবীরইমাম ছুফইয়ান ছওরী (মৃঃ১৬১ হিঃ)

৮। কিতাবুল জামে’উছ ছগীরইমাম ছুফইয়ান ছওরী(মৃঃ ১৬১ হিঃ)

৯। কিতাবুছ ছুনান   জায়েদা ইবনে কোদামা ছফকী(মৃঃ ১৬১ হিঃ)

১০। কিতাবুজ জোহদা      ঐ

১১। কিতাবুল মানাকিব     ঐ

১২। কিতাবুছ ছুনান  ইমাম হাম্মাদ ইবনে ছালেমা   (মৃঃ ১৬৫ হিঃ)

১৩। কিতাবুল মাগাজীআবদুল মালিক ইবনে মোহাম্মদ

                                    ইবনে আবু বকর ইবনে হাজম(মৃঃ ১৭৬ হিঃ)

১৪। কিতাবুছ ছুনান  ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক     (মৃঃ ১৮১ হিঃ)

১৫। কিতাবুজ জোহদাঐ

১৬। কিতাবুল বিররে ওয়াছছেলাহ        ঐ

১৭। কিতাবুছ ছুনান  আবু ছাঈদ ইয়াহইয়া  (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)

                                    ইবনে জাকারিয়া ইবনে জায়েদা।

                                    ইনি মাদায়েন-এর কাজী ছিলেন।

[বিভিন্ন অঞ্চলে ছাড়াইয়া পড়ে। সম্ভঃ ইহা লক্ষ্য করয়াই হজরত ওমর ইবনে আবুদল আজীজ তুরায় এ ব্যবস্থ অবলম্ভন করেন এবং রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছকে জাল হাদীছ হইতে বাহিয়া লইতে আদেশ দেন। ছাহাবীদের হাদীছ জালেন বিবিরণ হাদীছ জাল ও তার প্রতিকার অধ্যায়ে দেওয়া হইয়াছে।]

১৮। কিতাবুছ ছুনান  হুশাইম ইবনে বশীর (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)

১৯। কিতাবুত তাহারাত    ইমাম ইছমাইল ইবনে উলাইয়া(মৃঃ ১৯৩ হিঃ)

২০। কিতাবুছ ছালাতঐ

২১। কিতাবুল মানাছিকঐ

২২। কিতাবুছ ছুনান  ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম(মৃঃ ১৯৪ হিঃ)

২৩। কিতাবুল মাগাজীঐ

২৪। কিতাবুছ ছুনান  মোহাম্মদ ইবনে ফোজাইল ইবনে     (মৃঃ ১৯৫ হিঃ)

২৫। কিতাবুজ জোহদগোজওয়ান

২৬। কিতাবুছ ছিয়ামঐ

২৭। কিতাবুদ দো’আ  ঐ

২৮। কিতাবুছ ছুনান  ইমাম ওয়াকী ইবনে জাররাহ  (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)

২৯। কিতাবুল মানাছিক     ইমাম আবু মোহাম্মদ ইছহাক আজরক(মৃঃ ১৯৫ হিঃ)

৩০। কিতাবুছ ছালাতঐ

৩১। কিতাবুল কেরা’আত    ঐ

৩২। কিতাবুল খারাজইমাম ইয়াহইয়া ইবনে আদম  (মৃঃ ২০৬ হিঃ)

ইহা প্রকাশিত

৩৩। কিতাবুল ফারায়েজ    ইমাম এজীদ ইবনে হারূন         (মৃঃ ২০৬ হিঃ)

৩৪। কিতাবুছ ছুনান  ইমাম আবদুর রাজ্জাক

                                    ইবনে হুমাম ছন’আনী(মৃঃ ২১১ হিঃ)

৩৫। কিতাবুল মাগাজীঐ

                                                -কিতাবুল ফিহরিস্ত-৩১৪-৩২৬ পৃঃ

৩৬। আল জামে    ইমাম মা’মার ইবনে রাশেদ   (মৃঃ ১৫১ হিঃ)

৩৭। কিতাবুল মাগাজীআবু মা’শার নজীহ সিন্দী    (মৃঃ ১৭০ হিঃ)

৩৮। কিতাবু জম্মুল মালাহী  ইবনে আবিদ্দুনয়া         (মৃঃ ১৮০ হিঃ)

৩৯। মো’আত্তাইমাম মালেক  (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)

৪০। কিতাবুল খারাজইমাম আবু ইউছুফ   (মৃঃ ১৮২ হিঃ)

৪১। মোআত্তা  ইমাম মোহাম্মদ(মৃঃ ১৮৯ হিঃ)

৪২। মোআত্তা কবীর  আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব(মৃঃ ১৯৭ হিঃ)

৪৩। আহওয়ালুল কিয়ামাহ   ঐ

৪৪। আল মুছনাদ    ইমাম শাফেয়ী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)

৪৫। কিতাবুল উম্ম   ঐ

ইহা ফেকাহর কিতাব হইলেও ইহাতে ছনদ সহ বহু হাদীছ রহিয়াছে।

৪৬। আল মুছনাদ   ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল   (১৬৪-২৪১ হিঃ)

দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত এ সকল হাদীছ গ্রন্থের অধিকাংশ আজ পাওয়া না গেলেও তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এ সকল গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল। ইবনে নদীম এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাদের নিকটতম যুগের লোক ছিলেন বলিয়া তিনি স্বয়ং এইগুলির প্রায় সকলটিই দেখিয়াছিলেন বা এ সম্পর্কে বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হইয়াছিলেন। তৃতীয় শতাব্দীর হাদীছ সংকলক মোহাদ্দেছগণ এ সকল গ্রন্থকার প্রমুখাৎ শুনিয়া সে সকল গ্রন্থের প্রায় সমস্ত হাদীছই তাঁহাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছেন।

এ যুগের তিন জন বিশিষ্ট হাদীছের ইমাম

১। ইমাম মালেক (রঃ)

[৯৩-১৭৯ হিঃ মোঃ ৭১১-৭৯৫ ইং]

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মালেক ইবনে আনাছ আছবাহী মদনী মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মদীনায়ই জীবন অতিবাহিত করেন। রছূলুল্লাহর মাজার ছাড়িয়া তিনি কখনো মদীনার বাহিরে যান নাই। একবার মাত্র মক্কা শরীফে হজ্জ করিতে গিয়াছিলেন। তিনি ‘তাবে’-তাবেয়ী’ (তাবেয়ীগণের শাগরিদ) ছিলেন। হজরত নাফে’, (আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের শাগরিদ) মোহাম্মদ ইবনে মুনকাদির ও ইমাম জোহরী প্রভৃতি বিখ্যাত তাবেয়ী ও বহু তাবে’-তাবেয়ীর নিকট তিনি হাদীছ শিক্ষা করেন। তাকওয়া-পরহেজগারী ও হাদীছ হেফজের ব্যাপারে তৎকালে কেহ তাঁহার সমকক্ষ ছিলেন না। হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মোআত্তা’ তাহারই রচিত। তিনি অতি অসাধারণ মনীষীসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ ‘ইমাম মালেক ও ইবনে উ’য়ায়না না থাকিলে হেজাজবাসীদের এলম বিলুপ্ত হইয়া যাইত’। ইমাম মালেকের ওস্তাদগণের মদ্যে এমন ব্যক্তি খুব খমই ছিলেন যিনি ইমাম মালেকের নিকট মাছআলা জিজ্ঞাসা করেন নাই।

ইমাম মালেক হাদীছের অত্যন্ত তা’জীম করিতেন। কোন লোক তাঁহার নিকট কোন মাছআলা দরইয়াফত করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাহার উত্ত দিতেন; কিন্তু কোন হাদীছ দরইয়াফত করিলে তিনি প্রথমে গোসল করিয়া উত্তম লেবাছ পরিতেন এবং গায়ে খোশবু লাগাইতেন। অতঃপর উচ্চ আসনে বসিয়া অতি ভীত-সন্ত্রস্তভাবে উহা বর্ণনা করিতেন। এভাবে তিনি রছূলূল্লাহর (ছঃ) এত আদব-লেহাজ করিতেন যে, তিনি সম্পূর্ণ অচল হইয়া না পড়া পর্যন্ত কখনো মদীনার পাক মাটিতে পায়খানা-প্রস্রাব করেন নাই। শহর-সীমার বাহিরে যাইয়াই উহা করিয়াছেন।

একবার রছুলুল্লাহর (ছঃ) জেয়ারত উপলক্ষে খলীফা হারূনুর রশীদ কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করেন। তখন তিনি ইমাম ছাহেবের নিকট অনুরোধ জানাইলেন যে, ‘আপনি যদি আমার ঘরে বসিয়া আমার ছেলে দুইটিকে কিছু শিক্ষা দেন তা হইলে আমি আনন্দিত হইব’। ইমাম ছাহেব উত্তরে জানাইলেনঃ ‘আল্লাহ এলমকে সম্মানিত করিয়াছেন। আপনি উহাকে অপমানিত করিতে চেষ্টা করিবেন না’। অতঃপর খলীফা তাঁহার পুত্র আমীন ও মামুনকে ইমাম ছাহেবের বাড়ীতে রাখিয়াই শিক্ষা দেন।

ইমাম মালেক (রঃ) ১৭৯ হিজরীতে মদীনায় এন্তেকাল করেন এবং মদীনার প্রসিদ্ধ গোরস্থান ‘জান্নাতুল বাকী’তে সমাধিস্থ হন।

 

২।ইমাম শাফেয়ী (রঃ)

[১৫০– ২০৪ হিঃ মোঃ ৭৬৭– ৮২০]

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রীছ শাফেয়ী ১৫০ হিঃ দক্ষিন ফিলিস্তিনের গাজা বা আছকালানে, কাহারো মতে মক্কার মিনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল তিনি মক্কা শরীফেই অতিবাহিত করেন। অতঃপর এলমের সন্ধানে তিনি দেশ–বিদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। সাত বৎসর বয়সেই তিনি কোরআন পাক হেফজ করিয়া লন। তিনি মক্কার মুফতীয়ে আজমের নিকট ফেকাহ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। ১৫ বৎসর বয়সেই তৎকালীন আলেমগণ তাহাকে ফতওয়া দেওয়ার অনুমতি দান করেন। অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ যাইয়া ইমাম মালেকের খেদমতে অবস্থান করেন। তাঁহার নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তাঁহার অনুমতিক্রমে তিনি বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদের আলেমগণ তাঁহার নিকট হাদীছ ও ফেকাহ শিক্ষা করেন। দুইটি  বৎসর অবস্থানের পর তথা হইতে তিনি পুনঃ মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিছু দিন পর আবার তিনি বাগদাদে আসেন এবং তথা হইতে মিছর গমন করেন। মিছরেই তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। মিছরেই তাঁহার মাজার।

ফেকাহ শাস্ত্রে তাঁহার যুগে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিলেন না। তিনি ইমাম আবু হানীফার (রঃ) ফেকাহ হইতেও উপকৃত হইয়াছিলেন। ইমাম মোহাম্মদ বলেনঃ ‘‘একবার শাফেয়ী আমার নিকট হইতে ইমাম আবু হানীফার ‘আওছাত’ নামীয় একটি কিতাব ধার গ্রহণ করেন এবং একদিন ও একরাত্রির মধ্যেই উহা মুখস্ত করিয়া লন। তিনি একজন শা‘এর বা কবিও ছিলেন’’। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ ‘‘তিনি দ্বীনের রবি এবং মানুষের পক্ষে শান্তির দূত ছিলেন। বিগত ৩০ বৎসর যাবৎ আমার এমন কোন রাত্র কাটে নাই যাহাতে আমি ইমাম শাফেয়ীর জন্য দো‌‌‌‌‌‌আ করি নাই’’। ইমাম আহমদ (রঃ) ইমাম শাফেয়ীর শাগরিদ ছিলেন।

ইমাম শাফেয়ী প্রায় ১১৪টি গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। ইহার মধ্যে তাঁহার ফেকাহর ‘কিতাবুল উম্ম’ই প্রসিদ্ধ। ইহাতে বহু হাদিছ রহিয়াছে। ‘মোছনাদ’ তাঁহার একটি স্বতন্ত্র হাদীছের কিতাব। কিতাব রচনায় তিনি কিরূপ সাধনা ও কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন তাহা ইহাতেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, রাত্রে যখনই তাঁহার কোন কথা মনে পডিত তখনই তিনি আলো জ্বালাইয়া উহা লিকিয়া লইতেন এবং এজন্য তাঁহার রাত্রে বারবারই আলো জ্বালিতে হইত, অথচ তখনকার জমানায় পাথর ঠুকিয়া আলো জ্বালানো সহজ ব্যাপার ছিল না।

৩। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ)

[১৬৭-২৪১ হিঃ মোঃ ৭৮০-৮৫৭ ইং]

ইমাম আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে হাম্বল বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদেই এন্তেকাল করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করিয়া হাদীছ অন্বেষণে কুফা, বছরা, মক্কা, মদীনা, শাম, ইরাক ও তাবরেজ ছফর করেন। ইমাম শাফেয়ীর বাগদাদ অবস্থানকালে তিনি তাঁহার খেদমতে প্রায় লাগিয়া থাকিতেন। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ ‘বাগদাদ ত্যাগকালে আমি আমার শাগরিদদের মধ্যে আহমদ ইবনে হাম্বলের ন্যায় উচ্চ জ্ঞানী আলেম ও দরবেশ ব্যক্তি আর কাহাকেও দেখিয়া আসি নাই’। ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ ‘আমি দুই শত মনীষী মাশায়েখকে দেখিয়াছি, কিন্তু আহমদ ইবনে হাম্বলের ন্যায় কাহাকেও দেখি নাই’। ইমাম দারেমী বলেনঃ ‘রছুলের হাদীছ সংরক্ষণ ব্যাপারে আহমদ ইবনে হাম্বল অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন’। তিনি কখনো কাহারো নিকট কিছু গ্রহণ করেন নাই। ৭৭ বৎসরকাল তিনি এভাবেই অতিবাহিত করেন এবং অতি দীন বেশে দুনিয়া হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। তাঁহাকে দেখিলে কাহারো আখেরাত ইয়াদ না হইয়া পারিত না। মু’তাজিলাদের কতক ভ্রান্ত মতবাদ অস্বীকার করায় তিনি খলীফা মো’তাছেম বিল্লাহ কর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং বেত্রাঘাত ও ইত্যাকার বহু নির্যাতন ভোগ করেন।

তিনি ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হাদীছ সংগ্রহ করিয়া তাঁহার ‘মোছনাদ’ লিখিতে বসেন এবং ৩০ হাজারের কিছু অধিক হাদীছ তাঁহার কিতাবে স্থান দেন। মোছনাদসমূহের মধ্যে তাঁহার কিতাবই সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা ছহীহ।

দ্বিতীয় যুগের দুইটি প্রসিদ্ধ কিতাব

১। ‘মোআত্তা’

এ যুগের কিতাবসমূহের মধ্যে ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’ হইতেছে প্রসিদ্ধতর ও ছহীহতর কিতাব। মোহাদ্দেছীনদের বিচার উহার সমস্ত হাদীছই ছহীহ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ী (র) বলেনঃ ‘আছমানের নীচে কিতাবুল্লাহর পর ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’ই হইল বিশ্বস্ততর কিতাব’। -হুজ্জাতুল্লাহ-১৩৩ পৃঃ। অবশ্য এ সময় ইমাম বোখারীর ‘আল জামেউছ ছহীহ’ লেখা হয় নাই। কিন্তু ইমাম শাহ ওলী উল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ) ও তাঁহার পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ) ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’র দশ গুণ হইলেও ইমাম বোখারী ও মোছলেম হাদীছ বর্ণনার পদ্ধতি, ছনদ বিচারের নিয়ম এবং হাদীছ হইতে ফেকাহ বাহির করার তরীকা ‘মোআত্তা’ হইতেই শিক্ষা করিয়াছেন। হাদীছের পরবর্তী কিতাবসমূহ ‘মোআত্তা’র বর্ধিত সংস্করণস্বরূপই। -হুজ্জাতুল্লাহ, মোছাওয়া, উজালা

ইমাম মালেক (রঃ) ‘মোআত্তা’ লিখিয়া মদীনার ৭০ জন বিশিষ্ট ফকীহ ও মোহাদ্দেছের নিকট পেশ করেন এবং তাঁহারা সকলেই ইহার সমর্থন করেন। এ কারণে তিনি ইহার নাম দেন ‘মোআত্তা’ বা সমর্থিত। ‘মোআত্তা’র আদর মোআত্তা লেখার যুগেই এত অধিক হইয়াছিল যে, সহস্রাধিক বিশিষ্ট আলেম ইমাম মালেকের নিকট তাঁহার এই ‘মোআত্তা’ শিক্ষা করেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম মোহাম্মদ, ইমাম শাফেয়ী, ইবনে ওহাব ও ইবনে কাছেমের ন্যায় মুজতাহিদ ও ফকীহ, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ছাঈদ কাত্তান, আবদুর রহমান ইবনে মাহদী ও আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় বিখ্যাত মোহাদ্দেছ এবং খলীফা হারূনুর রশীদ, আমীন ও মামুনের ন্যায় আমীর-ওমারাও রহিয়াছেন। পরবর্তী যুগের আলেমগণও ‘মোআত্তা’র প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। কেহ ইহার সনদ বিচার করিয়াছেন, কেহ ইহার মতনের গুণাগুণ আলোচনা করিয়াছেন, আর কেহ বা ইহার শরাহ করিয়াছেন। এক কথায় বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন আলেম ‘মোআত্তা’র বিভিন্ন দিক লইয়া আলোচনা করিয়াছেন।

‘মোআত্তা’র শরাহঃ

বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মোহাদ্দেছ ‘মোআত্তা’র শরাহ করিয়াছেন, যথাঃ-

১। শরহে মোআত্তা –ইবনে হাবীব মালেকী (মৃঃ ২৩৯ হিঃ)। সম্ভবতঃ ইহাই ‘মোআত্তা’র প্রথম শরাহ।

২। শরহে মোআত্তা –ইবনে আবদুল বার (মৃঃ ৪৩৬ হিঃ)। ‘তাকাচ্ছী’ ও ‘তামহীদ’ নামে তাঁহার দুইটি শরাহ রহিয়াছে।

৩। শরহে মোআত্তা –আব্দুল্লাহ ইবনে বাতলায়উছী আন্দালুছী (মৃঃ ৫২১ হিঃ)।

৪। শরহে মোআত্তা –ইবনুল আরবী –আবু বকর মোহাম্মদ মাগরেবী (মৃঃ ৫৪৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল কাবছ’।

৫। শরহে মোআত্তা –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। ইহার নাম ‘কাশফুল মোআত্তা’। ইহার সংক্ষেপ করিয়া তিনি নাম দিয়াছেন ‘তানবীরুল হাওয়ালেক’। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৬। শরহে মোআত্তা –জুরকানী –মোহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকী মিছরী (মৃঃ ১০১৪হিঃ)। ইহা মোআত্তার একটি বিস্তৃত শরাহ; ৪ খন্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

৭। শরহে মোআত্তা –মোল্লা আলী ক্বারী (মৃঃ ১১২২ হিঃ)

৮। শরহে মোআত্তা –শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ)। তাঁহার আরবী শরাহর নাম ‘আল-মোছাওয়া’ এবং ফরছী শরাহর নাম ‘আল মুছাফফা’। তাঁহার এই শরাহদ্বয় সম্মুখে রাখিয়া মোআত্তা আলোচনা করিলে এ যুগেও মানুষ ইজতেহাদের ক্ষমতা লাভ করিতে পারে বলিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন। উভয় শরাহ প্রকাশিত হইয়াছে।

৯। শরহে মোআত্তা –মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবী। ইহার নাম ‘আওজাজুল মাছালেক’। ইহা একটি উত্তম শরাহ।

এছাড়া অনেকে ‘মোআত্তা’র সংক্ষেপ করিয়াছেন। যথা –খাত্তাবী আবু ছোলাইমান (মৃঃ ৩৮৮ হিঃ) ও আবুল ওয়ালীদ বাজী (মৃঃ ৪৭৪ হিঃ)। আবার কেহ ইহার গরীব (দুর্বোধ্য) শব্দের অভিধান রচনা করিয়াছেন। যথা –বারকী। এছাড়া কাজী আবু আবদুল্লাহ ও জালালুদ্দীন ছুয়ুতী ইহার ছনদ বিচার করিয়াছেন।

২।মোছনাদে আহমদ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪০ হিঃ)সাড়ে সাত লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া তাঁহার এই কিতাব লিখিয়াছেন। ইহাতে সাত শত ছাহাবী কর্তৃত বর্ণিত ‘তাকরার’ বাদ মোট ৩০ (ত্রিশ) হাজারের মত হাদীছ রহিয়াছে। মোছনাদসমূহের মধ্যে ইহা একটি বৃহত্তর ও বিশ্বস্ততর মোছনাদ। ইহাতে কিছু ‘জঈফ’ হাদীছ সংযোজন করিয়াছেন বলিয়া মোহাদ্দেছগণ মনে করেন। ইমাম ইবনে জাওজী প্রমুখ সমালোচকগণ ইহার কতিপয় হাদীছের বিরূপ সমালোচনা করিয়াছেন। কিন্তু হাফেজ ইবনে হাজর ও জালালুদ্দীন ছুয়ুতী ইহার খণ্ডন করিয়াছেন। হযরত শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী এ পর্যন্ত বলিয়াছেন যে, ‘ইহার জঈফ হাদীছ পরবর্তী লোকদের ছহীহ হাদীছ অপেক্ষাও উত্তম’।

মোছনাদ  পদ্ধতিতে লেখা কিতাবের শরাহ করার রীতি মোহাদ্দেছগণের মধ্যে প্রচলিত নহে। তথাপি শেখ আবুল হাছান সিন্দী ইহার এক শরাহ করিয়াছেন বলিয়া জানা যায়। এছাড়া মিছরের বিখ্যাত মোহদ্দেছ আহমদ আবদুর রহমান ছাআতী ইহাকে ছুনানের নিয়মে বিষয় অনুসারে সাজাইয়া ইহার এক সংক্ষিপ্ত শরাহ করিয়াছেন এবং নামকরণ করিয়াছেন ‘আল ফাতহুররব্বানী’। ইহা হালে মিছর হইতে ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

 

তৃতীয় যুগ

তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ হইতে পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইহা প্রায় তিন শতাব্দীর যুগ। এ যুগে হাদীছের শিক্ষাকরণ ও শিক্ষাদান, উহা হেফজকরণ ও উহার মোতাবেক আমলকরণের ধারা পূর্বের ন্যায় অব্যাহত থাকে এবং লিখনের ধারা আরো জোরদার হইয়া উঠে।

এ যুগকে হাদীছের স্বর্ণযুগ বলা যাইতে পারে। এ যুগে এমন সকল হাফেজে হাদীসের জন্ম হয় যাঁহাদের নজীর দুনিয়া খুব কমই দে্খিয়াছে। এভাবে এ যুগে এমন এমন হাদীছ গ্রন্থাকারের আবির্ভাব হয় যাঁহাদের গ্রন্থাবলী দুনিয়ার এলমী ভাণ্ডারে আল্লাহর বিশেষ দানরূপে পরিগণিত। এ যুগেই ছেহাহ ছেত্তা প্রণেতা বোখারী, মোছলেম প্রমুখ ইমামগণের আবির্ভাব হয়। এ যুগেই ছনদ বিচার দ্বারা ছহীহ হাদীছকে গায়র ছহীহ হইতে চূড়ান্তরূপে বাছাই করা হয়। পূর্ব যুগে ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল যাহার সূচনা করেন ইমাম বোখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ) ও মোছলেম (২০৪-২৬১ হিঃ) এ যুগে তাঁহাদের কিতাবে ইহার চূড়ান্ত রূপ দান করেন। এ যুগেই রছুলুল্লাহর হাদীছকে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার হইতে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার নীতি গৃহীত হয় -[ইহার পূর্ব পর্যন্ত যাহারা লিখিয়াছেন তাঁহাদের অনেকেই যেখানে যে বিষয়ে একটি হাদীছে রছুল লিখিয়াছেন সেখানে সে বিষয়ে যদি ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের কোন আছার থাকিয়া থাকে তাহাও তাহার পাশে লিখিয়া লইয়াছেন। ইমাম মালেক তাঁহার ‘মোআত্তা’য় এরূপই করিয়াছেন। ইহাতে একটি উপকার এই হইয়াছে যে, ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার মাহফুজ (রক্ষিত) হইয়া গিয়াছে। যদ্দ্বারা হাদীছে রছুলের প্রকৃত ব্যাখ্যা জানা যায়। ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার প্রকৃতপক্ষে হাদীছে রছুলেরই ব্যাখ্যা। আবার কেহ কেহ আছারকে পৃথকভাবেও সংকলন করিয়াছেন। যথা –ইমাম আবূ ইউছুফ ও ইমাম মোহাম্মদ (রঃ) তাঁহাদের ‘কিতাবুল আছার’ এই ধরনেই দুইটি সংকলন। অবশ্য ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁহার ‘মোছনাদ’ কিতাবে শুধু হাদীছে রছুলই সংগ্রহ করিয়াছেন।] এবং ইমাম বোখারী ও মোছলেম তাঁহাদের কিতাবে প্রধানতঃ হাদীছে রছুলকেই স্থান দেন। এ যুগেই সমস্ত হাদীছ রাবীদের নিকট হইতে সংগৃহীত হইয়া কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায়। অতঃপর এমন কোন হাদীছ কাহারও নিকট রহিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যায় না যাহা কোন না কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ হয় নাই।

তৃতীয় যুগের কতিপয় প্রসিদ্ধ হাদীছের ইমাম

১। ইমাম বোখারী (রঃ)

[১৯৪-২৫৬ হিঃ মোঃ ৮১০-৮৭০ ইং]

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইছমাঈল বোখারী বর্তমান সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানের বোখারা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম বোখারী অসাধারণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৬ বৎসর বয়সে ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক ও ইমাম ওকী’ ইবনে জাররাহর হাদীছের কিতাবসমূহ মুখস্থ করিয়া লন এবং ১৮ বৎসর বয়সে কিতাব লিখিতে আরম্ভ করেন। হাদীছের জগদ্বিখ্যাত কিতাব ‘আল জামেউচ্ছহীহ’ ব্যতীত তিনি আরো বহু কিতাব লিখিয়া গিয়াছেন।

তিনি বলেনঃ ‘হাদীছ শিক্ষার জন্য আমি বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করিয়াছি, দুইবার মিছর ও শামে এবং চারিবার বছরায় গিয়াছি। একাধারে ছয় বৎসর হেজাজে (মক্কা ও মদীনায়) অবস্থান করিয়াছি এবং বহুবার বাগদাদ সফর করিয়াছি। আমি এক হাজার ৮০জন শায়খের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করিয়াছি ও লিখিয়াছি। এইভাবে ৬লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহা হইতে অতি অল্প সংখ্যক হাদীছকে আমার ‘জামেয়ে ছহীহ’ কিতাবে স্থান দিয়াছি এংব বহু ছহীহ হাদীছকেও বাদ দিয়াছি’।

ইমাম বোখারী প্রচুর অর্থের মালিক ছিলেন। কিন্তু তাঁহার সমস্ত অর্থই শিক্ষার্থী ও দরিদ্রদের জন্য ব্যয়িত হইয়াছে। তিনি কখনও জাঁকজমকের সহি চলেন নাই। কথিত আছে, তিনি ৪০ বৎসর যাবৎ রুটির সহিত কোন তরকারী ব্যবহার করেন নাই। কোন কোন সময় মাত্র দুই তিনটি বাদাম খাইয়া দিন কাটাইয়াছেন।

ইমাম তিরমিজী বলেনঃ ‘ইমাম বোখারী এ উম্মতের ভূষণ। তাঁহার মত লোক আমি কোথাও দেখি নাই’। মোহাদ্দেছ ইবনে খোজাইমা বলেনঃ ‘দুনিয়ায় ইমাম বোখারী হইতে অধিক অভিজ্ঞ ও হাদীছের হাফেজ আর কেহ নাই। ইমাম মোছলেমের মত লোক তাহার পদচুম্বন করিতে  চাহিতেন’। কেহ কেহ বলিয়াছেন যে, ‘ইমাম বোখারী দুনিয়াতে আল্লাহর নিদর্শনস্বরূপ’। ৯০ হাজার লোক তাঁহার নিকট তাঁহার কিতাব ‘জামেউছ্ছহীহ’ পড়িয়াছেন।

একবার বোখারার শাসনকর্তা তাঁহার নিকট অনুরোধ করিয়া পাঠাইলেন যে, ‘আপনি আপনার ‘জামেউছ্ছহীহ’ ও ‘তারীখে কবীর’ আমাকে পড়িয়া শুনাইলে আমি খুশী হইব’। উত্তরে তিনি বলিয়া পাঠাইলেনঃ ‘আমি এলমকে বে-ইজ্জত করিতে পারি না। যাহার আবশ্যক সে এখানে আসিয়া শুনিয়া যাইতে পারে’। আর কাহারো মতে শাসনকর্তা তাঁহার ছেলেদের পড়াইবার জন্য ইমাম ছাহেবের নিকট এমন একটা সময় নির্দিষ্টড় করিয়া লইতে চাহিয়াছিলেন, যে সময় অন্য কেহ তাহাদের সহিত শরীক না হয়। ইহাতে তিনি রাজী হইলেন না; বরং বলিয়া দিলেনঃ ‘এলমের দরওয়াজা সকলের জন্য সমানভাবেই খোলা। আমি এরূপ ভেদনীতি অবলম্বন করিতে পারি না’। ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া শাসনকর্তা তাঁহাকে বোখারা ত্যাগ করিতে নির্দেশ দেন। ইমাম ছাহেব বোখারা ছাড়িয়া ছমরকন্দের নিকট খরতং নামক স্থানে চলিয়া যান। কিন্তু তথাকার অধিবাসীরা (বিপদাশঙ্কায়) তাঁহাকে স্থান দিতে ইতস্ততঃ করে। ইহা দেখিয়া তিনি তাহাজ্জুদের পর আল্লাহর নিকট দো’আ করিলেনঃ ‘আল্লাহ! তোমার জমিন যখন আমার পক্ষে তংগ (সংকীর্ণ) হইয়া গিয়াছে তখন আমাকে দুনিয়া হইতে উঠাইয়া লও’। অতঃপর তিনি তথায় এন্তেকাল করেন।

২। ইমাম মোসলেম (রঃ)

[২০৪-২৬১ হিঃ মোঃ ৮১৭-৮৬৫ ইং]

ইমাম মোছলেম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মোছলেম কোশাইরী নিশাপুরী (রঃ) প্রাচীন খোরাছানের প্রধান নগর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন (খোরাছান এখন ইরান, আফগানিস্তান ও সোভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে ভাগ হইয়া গিয়াছে।)। এবং তথায়ই এন্তেকাল করেন।

প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি হাদীছের তালাশে বহু দেশ সফর করেন এবং খোরাছান, রায়, মিছর, ইরাক ও হেজাজ প্রভৃতি দেশের মাশায়েখদের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহুবার বাগদাদও গিয়াছেন এবং ইমাম বোখারী যখন তাঁহার শেষ জীবনে নিশাপুরে আগমন করেন তখন তিনি ইমাম বোখারীর খেদমতেও হাজির হন। এভাবে তিনি তিন লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করেন থখন তিনি ইমাম বোখারীর খেদমতেও হাজির হন। এভাবে তিনি তিন লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করেন এবং উহা হইতে বাছাই করিয়া মাত্র ৪ হাজার হাদীছ দ্বারা ‘ছহীহ’ নামক হাদীছের কিতাব সংকলন করেন। এছাড়া তিনি আরো বহু কিতাব রচনা করিয়া গিয়াছেন।

৩। ইমাম আবু দাউদ (রঃ)

[২০২-২৭৫ হিঃ মোঃ ৮১৭-৮৮৮ ইং]

ইমাম আবু দাঊদ ইবনে আশআছ  ছিজিস্তানী পূর্ব ইরানের ছিজিস্তান বা সীস্তানে জন্মগ্রহণ করেন্ (উহা এখন ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ভাগ হইয়া গিয়াছে।) তিনি খোরাছান, ইরাক, শাম ও মিছর পরিভ্রমণ করেন এবং সে সকল দেশের ওলামা ও মাশায়েখগণের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর তিনি বছরায়ই স্থায়ীভাবে বসবাস এখতেয়ার করেন। তবে বাগদাদেও তিনি আসা-যাওয়া করিতেন। বাগদাদে বসিয়াই তিনি তাঁহার প্রসিদ্ধ হাদীছের কিতাব ‘ছুনান’ সংকলন করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আমি ৫লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহা হইতে মাত্র সাড়ে চার হাজারের মত হাদীছ আমার কিতাবে গ্রহণ করিয়াছি। মানুষের জন্য উহার মধ্যে এই চারিটি হাদীছই যথেষ্টঃ হুজুর (ছঃ) বলিয়াছেনঃ (১) নিয়তের উপরই মানুষের আমল নির্ভর করে অর্থাৎ, নিয়ত অনুসারেই তাহার ছওয়াব দেওয়া হয়। (২) যাহা মানুষের পক্ষে জরুরী নহে তাহা ত্যাগ করাই তাহার খাটিঁ মুসলমানিত্বের পরিচায়ক। (৩) কোন মু’মিন প্রকৃত মু’মিন হইতে পারিবে না, যে পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যাহা ভালবাসে অন্যের জন্যও তাহা ভালবাসে এবং (৪) হালাল স্পষ্ট ও হারামও স্পষ্ট, উভয়ের মধ্যস্থলে রহিয়াছে সন্দেহজনক জিনিস (সুতরাং উহা হইতে বাঁচিয়া থাকিবে)।

আবু ছোলাইমান খাত্তাবী বলেনঃ দ্বীনের এলম সম্পর্কে আবু দাঊদের ‘ছুনানের’ ন্যায় কিতাব এযাবৎ লেখা হয় নাই। আলেমগণের মতে দ্বীনের কথা জানার জন্য কাহারো নিকট কোরআন এবং ‘ছুনানে আবু দা্ঊদ’ থাকিলেই যথেষ্ট। ইহাতে দ্বীনের প্রায় সমস্ত আহকাম সম্পর্কীয় হাদীছই রহিয়াছে। মূছা ইবনে হারূন বলেনঃ আবু দাঊদ আসিয়াছেন দুনিয়ায় হাদীছের জন্য আর আখেরাতের বেহেশতের জন্য।

৪। ইমাম তিরমিজী (রঃ)

[২০৯-২৭৯ হিঃ মোঃ ৮২৪-৮২৯ ইং]

ইমাম আবু মোহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিজী উত্তর ইরানের তিরমিজ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং এলমের অনুসন্ধানে খোরাছান, হেজাজ প্রভৃতি দেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি ইমাম বোখারীর নিকটও হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার কিতাব ‘আল জামে’ ‘ছেহাহ ছেত্তা’র অন্যতম কিতাব। উহাতে তিনি ছনদের জারহ ও তা’দীল বা দোষ-গুণ বিচার সম্পর্কে যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন তাঁহার পূর্বে কেহই তাহা করেন নাই। এ কারণে মোহাদ্দেছগণ তাঁহার এ কিতাবেই হাদীছের ছনদ সম্পর্কে বহছ (আলোচনা) করিয়া থাকেন। তিনি হাদীছে যেমন অদ্বিতীয় ছিলেন ফেকাহতেও তেমন অসাধারণ ছিলেন।

৫। ইমাম নাছায়ী (রঃ)

[২১৫-৩০৩ হিঃ মোঃ ৮৩০-৯১৫ ইং]

ইমাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শো’আইব নাছায়ী খোরাছানের প্রসিদ্ধ শহর নাছায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁহার জিন্দেহীর বেশীর ভাগই মিছরে কাটান এবং শেষ জীবনে দামেশকে (দেমাশক) আগমণ করেন। তিনি বহু দেশ পরিভ্রমণ করিয়া বহু মাশায়েখ হইতে হাদীছ সংগ্রহ করেন। ইমাম আবু দাঊদ তাঁহার একজন বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি প্রথমে ‘ছুনানে কবীর’ নামে হাদীছের একটি বিরাট গ্রন্থ সংকলন করেন। অতঃপর উহাকে সংক্ষেপ করিয়া ‘আল মুজতাবা’ নাম দেন। এই মুজতাবা ‘ছেহাহ ছেত্তা’র অন্যতম কিতাব। ইহা ‘নাছায়ী’ নামে প্রসিদ্ধ। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী বলেনঃ আমি আবু আলী নিশাপুরীকে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছিঃ মুসলমানদের মধ্যে চারি জন হাদীছের হাফেজ রহিয়াছেন। নাছায়ী ইহাদের অন্যতম। একবার দামেশকের মুআবিয়াপন্থী লোকেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলঃ হজরত আমীর মুআবিয়ার ফজীলত সম্পর্কে আপনি কিছু লিখিয়াছেন কি? তিনি উত্তর করিলেনঃ ‘না’ ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়অ তাহারা তাঁহাকে ভীষণভাবে প্রহার করে। ফলে তিনি গুরুতররূপে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়েন। অতঃপর রমলায় কাহারো মতে মক্কায় নীত হন এবং তথায় এন্তেকাল করেন।

৬। ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ)

[২০৯-২৭৩ হিঃ মোঃ ৮২৪-৮৮৬ ইং]

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইয়াজীদ ইবনে মাজাহ কাজরিনী ইরাকে আজম বা উত্তর-পশ্চিম ইরানের কাজবীন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এলম অন্বেষণে ইরাক, শাম, মিছর ও আরবদেশ সফর করেন এবং ইমাম মালেকের শাগরেদগণ –বিশেষ করিয়া ইমাম লায়ছ ইবনে ছা’দ হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। তাঁহার ‘ছুনান’ ছেহাহ্ ছেত্তার একটি কিতাব।

 

তৃতীয় যুগের

কতিপয় প্রসিদ্ধ কিতাব

এ যুগে এত অধিক হাদীছের কিতাব সংকলিত হইয়াছে যাহার পূর্ণ ফিহরিস্ত দেওয়া এখানে সম্ভবপর নহে। শুধু কতিপয় প্রসিদ্ধ কিতাবের আলোচনা এখানে করা গেল।

ছেহাহ ছেত্তা

ছহীহ বোখারী

ছেহাহ ছেত্তার কিতাবসমূহ উহাদের আসল নামে প্রসিদ্ধ না হইয়া উহাদের রচয়িতাদের নামেই প্রসিদ্ধ হইয়া গিয়াছে। যথা –বোখারী শরীফ, মোছলেম শরীফ প্রভৃতি। বোখারী শরীফের আসল  ও পূর্ণ নাম আল জামেউছ্ছহীহুল মোছনাদু (আরবী********************)এবং সংক্ষিপ্ত নাম ‘ছহীহে বোখারী’ (ইমাম বোখারীর ছহীহ)। সাধারণ্যে ইহাকে ‘ছহীহ বোখার’ বলে।

ইমাম বোখারী একদিন তাঁহার ওস্তাদ ইমাম ইছহাক ইবনে রাহওয়াইহ্-এর হাদীছের দরছে উপস্থিত ছিলেন। ওস্তাদ বলিলেনঃ ‘আহা! কেহ যদি শুধু ছহীহ হাদীছগুলিকে একত্র করিয়া দিত!’ অতঃপর ইমাম বোখারী এক রাত্রে স্বপ্নে দেখিলেনঃ রছূলূল্লাহ (ছঃ) উপবিষ্ট আছেন; আর বোখারী তাঁহার গায়ে পাখা করিতেছেন এবং মাছি তাড়াইতেছেন। বিশেষজ্ঞগণ তা’বীর করিলেনঃ বোখারী রছুলুল্লাহর হাদীছ হইতে মিথ্যার জঞ্জালকে অপসারিত করিবেন। অতঃপর তিনি তাঁহার এই কিতাব সংকলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং মক্কায় হেরেম শরীফে বসিয়া উহার মুসাবিদা পস্তুত করেন। অতঃপর মদীনার মসজিদে নববীতে বসিয়া উহার চূড়ান্তরূপ দান করেন। তিনি প্রথমে ‘এস্তেখারা’ এবং গোসল করিয়া দুই রাক’আত  নফল নামাজ পড়া ব্যতীত কোন হাদীছই তাঁহার কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন নাই।

ইমাম বোখারী ৬ লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া ‘তাকরার’ সহ ৭৩৯৭টি এবং ‘তাকরার’ বাদ  মাত্র ২৭৬১টি হাদীছকে তাঁহার এ কিতাবে স্থান দিয়াছেন এবং দীর্ঘ (১৬) ষোল বৎসর ইহার যাচাই-বাছাই কার্যে ব্যয় করিয়াছেন। এ সকল কারণে ইমাম বোখারীর এই কিতাব বিশ্বজোড়া এত জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে যে, কেবল তাঁহার নিকটস্থ ৯০ হাজার লোক ইহা শিক্ষা করেন। আর আজ  মুসলিম জাহানের এমন কোন স্থান নাই যেখানে ইহা শিক্ষা দেওয়া হইতেছে না। জনসাধারণ ইহাকে আল্লাহর কিতাবের পরেই স্থান দিয়া থাকেন।

বোখারীর শরাহঃ

বোখারীর কিতাবের যেরূপ আলোচনা-সমালোচনা হইয়াছে এবং যত টিকা-টিপ্পনী লেখা হইয়াছে আল্লাহর কিতাব ছাড়া অপর কোনো কিতাবেরই এত টিকা-টিপ্পনী লেখা হয় নাই। কেহ উহার সংক্ষেপ করিয়াছেন, কেহ উহার ছনদ বিচার করিয়াছেন, কেহ উহার বিশেষ অভিধান রচনা করিয়াছেন; আর কেহ উহার শরাহ বা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। মোল্লা কাতেব চলপী (মৃঃ ১০৫২ হিঃ) তাহার প্রসিদ্ধ কিতাব ‘কাশফুজ্জূনুনে’ ইহার প্রায় ৮০ খান শরাহ রহিয়াছে বলিয় উল্লেখ করিয়াছেন। পাক-ভারতের শরাহসহ এ তিন শতাব্দীর শরাহ উহাদের সহিত যোগ করিলে উহার শতের মত শরাহ রহিয়াছে বলিয়া মনে হয়। আমরা নীচে উহার কতিপয় প্রসিদ্ধ শরাহর নাম করিতেছিঃ

১। শরহে বোখারী –খাত্তাবী আবু ছোলাইমান (মৃঃ ৩৮৮ হিঃ)। ইহার নাম ‘এ’লামুছ ছুনান’ (আরবী******) ইহা একটি সংক্ষিপ্ত অথচ উত্তম শরাহ।

২। শরহে বোখারী –হাছান ছাগানী লাহোরী (মৃঃ ৬৫০ হিঃ)। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত শরাহ।

৩। শরহে বোখারী –কিরমানী –শামছুদ্দীন মোহাম্মদ ইউছুফ (মৃঃ ৭৮৬ হিঃ)। ইহা একটি উত্তম শরাহ। হালে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৪। শরহে বোখারী –বদরুদ্দীন জরকাশী (মৃঃ ৪৯৪ হিঃ)। ইহার নাম ‘আততানকীহ’।

৫। শরহে বোখারী –হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)। ইহার নাম ‘ফাতহুল বারী’, ইহা বোখারী শরীফের একটি প্রসিদ্ধ ও মূল্যবান শরাহ। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৬। শরহে বোখারী –বদরুদ্দীন আইনী (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ)। ইহার নাম ‘উমদাতুল কারী’, ইহাও বোখারীর একটি প্রসিদ্ধ ও মূল্যবান শরাহ। ইহাও প্রকাশিত হইয়াছে।

৭। শরহে বোখারী –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) ইহার নাম ‘তাওশীহ’। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত শরাহ।

৮। শরহে বোখারী –কাস্তালানী (মৃঃ ৯৩২ হিঃ)। ইহার নাম ‘ইরশাদুছছারী’। ইহা মধ্যম কলেবরের একটি উত্তম শরাহ। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৯। শরহে বোখারী –সৈয়দ আবদুল আউয়াল জৌনপুরী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘ফয়জুল বারী’।

১০। শরহে বোখারী –শায়খ ইয়াকুব ছরফী কাশ্মীরী (মৃঃ ৯৭৮ হিঃ)। ইহার নাম জানা যায় নাই।

১১। শরহে বোখারী –শায়খ নূরুল হক ইবনে শায়খ দেহলবী (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। ইহার নাম জানা যায় নাই।

১২। শরহে বোখারী –শায়খুল ইসলাম দেহলবী (মৃঃ অনুমান ১১৮০ হিঃ)। তিনি শায়খ দেহলবীর ৬ষ্ঠ অধঃস্তন পুরুষ। ইহা ফারছী ভাষায় লিখিত ভাষায় লিখিত। ‘তাইছীরুল কারী’র হাশিয়ায় ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। -Indias Contribution

১৩। শরহে বোখারী –শায়খ নূরুদ্দীন আহমদাবাদী (মৃঃ ১১৫৫ হিঃ)। ইহার নাম ‘নুরুল কারী’ (আরবী*******)

১৪। শরহে বোখারী –মাওলানা আহমদ আলী ছাহারানপুরী (মৃঃ ১২৯৭ হিঃ)। ইহা বোখারীর অতি প্রচলিত শরাহ। বোখারীর হাশিয়ায় ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

১৫। শরহে বোখারী –ছৈয়দ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী দেওবন্দী (মৃঃ ১৩৫২ হিঃ)। শাহ ছাহেব বোখারী শরীফ পড়াইবার কালে যে সকল ‘তাকরীর’ করিয়াছেন তাঁহার শাগরেদ মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী সে সকলকে একত্র করিয়া ‘ফয়জুল বারী’ নামে প্রকাশ করিয়াছেন।

অবশ্য ইহার মুসাবিদা তিনি একবার শাহ ছাহেবকে দেখাইয়অ তাঁহার দ্বারা তাছহীহ করাইয়াছেন। ইহা বোখারীর একটি উত্তম শরাহ! ইহা চারি খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

সহীহ মোছলেম

ইমাম মোছলেম তিন লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া মাত্র চারি হাজার হাদীছ (তাকরার বাদ) তাঁহার এ কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং পনর বৎসর ইহার যাচাই কার্যে ব্যয় করেন। কোন কোন মোহাদ্দেছ (যথা –আবু আলী নিশাপুরী)বোখারী শরীফের স্থলে মোছলেমের এ কিতাবকেই ছোহর মধ্যে প্রথমে হাদীছসমূহের তুলনামূলক মান নির্ধারণ করিয়াছেন, অতঃপর প্রতিটি হাদীছকে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়াছেন।

বোখারী শরীফের যেরূপ আলোচনা-সমালোচনা হইয়াছে মোছলেম শরীফেরও প্রায় সেইরূপ আলোচনা-সমালোচনা হইয়াছে। ইহার শরাহর সংখ্যাও অনেক। নীচে আমরা উহার কতিপয় প্রসিদ্ধ শরাহর নাম উল্লেখ করিলামঃ

মোছলেম শরাহঃ

১। শরহে মোছলেম –শরফুদ্দীন নাওয়াবী (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল মিনহাজ’। ইহা মোছলেম শরীফের একটি প্রসিদ্ধ ও উত্তম শরাহ। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

২। শরহে মোছলেম –ঈসা ইবনে মাছউদ জাওয়াবী (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ)। ইহার নাম ‘ইকমাল’(?)

৩। শরহে মোছলেম –মোহাম্মদ ইবনে খেলফাহ মালেকী (মৃঃ ৮২৮ হিঃ)। ইহার নাম ‘ইকমালুল মু’লিম’, (আরবী**********) ইহা চারি খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

৪। শরহে মোছলেম –কাস্তালানী (মৃঃ ৯২৩ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল ইবতেহাজ’। ইহা অতি বিরাট শরাহ; ৮খণ্ডে অর্ধেক সমাপ্ত হইয়াছে।

৫। শরহে মোছলেম (ফারছী) –শায়খ নূরুর হক ইবনে শায়খ দেহলবী (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। ডক্টর ইছহাক ছাহেব (এম,এ,এইচ,ডি) ইহাকে তাঁহার প্রপৌত্র হাফেজ ফখরুদ্দীন দেহলবীর কিতাব বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।

৬। শরহে মোছলেম –মোল্লা আলী কারী (মৃঃ ১১২২ হিঃ)। ইহা চারি খণ্ডে সমাপ্ত হইয়াছে।

৭। শরহে মোছলেম –শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (মৃঃ ১১২৯ হিঃ)।

৮। শরহে মোছলেম –ছৈয়দ মোরতাজা হাছান বিলগিরামী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) ইহার নামও ‘আল ইবতেহাজ’।

৯। শরহে মোছলেম –মাওলানা শিব্বীর আহমদ ওছমানী দেওবন্দী (মৃঃ ১৩৬৯ হিঃ)। ইহার নাম ‘ফতহুল মুলহিম’। ইহা একটি বিস্তৃত ও উত্তম শরাহ। ইহার প্রথমে একটি অতি মূল্যবান ভূমিকা রহিয়াছে।

ছুনানে নাছায়ী

ইমাম নাছায়ী প্রথমে ‘ছুনানে কুবরা’ নামে এক বিরাট কিতাব সংকলন করেন। কিন্তু উহার সমস্ত হাদীছ ‘ছহীহ’ ছিল না। অতঃপর উহা হইতে কেবল ছহীহ হাদীছ বাছাই করিয়া ‘আল মুজতানা’ বা ‘আল মুজতাবা’ নামে এই কিতাব লেখেন। ইহা সাধারণতঃ ‘ছুনানে নাছায়ী’ নামেই প্রসিদ্ধ। বাব (অধ্যায়) রচনায় ইহা ‘বোখারী’ এবং বিষয় বিন্যাসে ইহা ‘মোছলেমের’ বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। বিশুদ্ধতায় ইহা ছেহাহ ছেত্তার তৃতীয় স্থানে আছে বলিয়া অনেক মোহাদ্দেছের অভিমত। ইহাতে মোট ৪৪৮২টি হাদিছ রহিয়াছে। ইহার অনেক শরাহও রহিয়াছে।

নাছায়ীর শরাহঃ

১। শরহে নাছায়ী –ইবনুল মুলাক্কেন (মৃ ৮০৪ হিঃ)।

২। শরহে নাছায়ী –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃ ৯১১ হিঃ)। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত শরাহ।

৩। শরহে নাছায়ী –শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (মৃ ১১২৯ হিঃ)। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত শরাহ।

ইহা দিল্লির আনছারী প্রেস হইতে নাছায়ীর হাশিয়ায় প্রকাশিত হইয়াছে। -Indias Contribution

৪। হাশিয়ায়ে নাছায়ী –শামছুল ওলামা আহমদ দেহলবী ( ) ইহার নাম ‘হাশিয়ায়ে জাদীদাহ’ ইহাও হাশিয়ায়ে সিন্ধীর সহিত প্রকাশিত হইয়াছে।

ছুনানে আবু দাঊদ

ইমাম আবু দাঊদ (মৃ ২৭৫ হিঃ) ৫ লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া তাঁহার এই কিতাব সংকলন করিয়াছেন। ইহাতে ‘ছহীহ’, ‘হাছান’ এবং কিছু তন্নিম্ন পর্যায়ের হাদীছও রহিয়াছে। তবে তিনি ইহাতে এমন কোন হাদীছকে স্থান দেন নাই যাহাকে ফেকাহর ইমামগণ আমলের অযোগ্য বলিয়া মনে করিয়াছেন। এছাড়া কোন হাদীছে কোনরূপ ছনদগত ত্রুটি তাকিলে তিনি তাহাও বলিয়া দিয়াছেন। ছুনানসমূহের মধ্যে ইহা একটি ব্যাপক ও বিস্তারিত কিতাব। ইমাম আবু দাঊদ তাঁহার এই কিতাব সংকলন করিয়া ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে দেখাইলে তিনি ইহার প্রশংসা করেন। ইহাতে প্রায় পাঁচ হাজার (৪৮০০) হাদিছ রহিয়াছে। ইহার বহু শরাহ হইয়াছে।

আবু দাঊদের শরাহঃ

১। শরহে আবু দাঊদ –খাত্তাবী (মৃ ৩৮৮ হিঃ)। ইহার নাম ‘মাআলিমুছ্ছুনান’। (আরবী*****)

২। শরহে আবু দাঊদ –কুতুবুদ্দীন আবু বকর ইয়ামানী (মৃ ৬৫২ হিঃ)। ইহা চারি খণ্ডে সমাপ্ত।

৩। শরহে আবু দাঊদ –ইবনুল মুলাক্কেন (মৃ ৮০৪ হিঃ)

৪। শরহে আবু দাঊদ –আবু জুরআ ইরাকী (মৃ ৮২৬ হিঃ)। ইহা প্রথমাংশের শরাহ; ৭ খণ্ডে সমাপ্ত।

৫। শরহে আবু দাঊদ –শায়খ শিহাবুদ্দীন রামরী (মৃ ৮৪৮ হিঃ)।

৬। শরহে আবু দাঊদ –শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (মৃ ১১২৯ হিঃ)। ইহার নাম ‘ফতহুল ওয়াদুদ’।

৭। শরহে আবু দাঊদ –মাওলানা শামছুল হক ডয়ানবী (মৃ ১৩২৯ হিঃ)। ইহার নাম ‘গায়তুল মাকছুদ’। ইহা আবু দাঊদের একটি উত্তম ও বিস্তারিত শরাহ। ইহার এক খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছে।

৮। শরহে আবু দাঊদ –মাওলানা মোহাম্মদ আশরাফ আজীমাবাদী। ইহার নাম ‘আওনুল মা’বুদ’।

৯। শরহে আবু দাঊদ –মাওলানা খলীল আহমদ ছাহারানপুরী (মৃ ১৩৪৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘বজলুল মাজহুদ’। ইহা আবু দাঊদের একটি বিরাট ও উত্তম শরাহ। ইহা পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

জামেয়ে তিরমিজী

ইহা ‘ছুনানে তিরমিজী’ নামেও প্রসিদ্ধ। ব্যাপকতায় ইহা বোখারীর, বিন্যাসে মোছলেমের এবং আহকাম বর্ণনায় আবু দাঊদের স্থান অধিকার করিয়াছে। এছাড়া ইহাতে নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্টসমূহও রহিয়াছেঃ

(ক) ইহাতে ‘তাকরার’ প্রায়ই নাই। ইহার বর্ণনা প্রাঞ্জল ও সংক্ষেপ।

(খ) ইহাতে আবশ্যকমত ফকীহদের মাজহাবের প্রতিও ইংগিত করা হইয়াছে এবং কীরূপে হাদীছ হইতে ফেকাহ গৃহীত হয় তাহার নিয়মও বাতলানো হইয়াছে।

(গ) ইহাতে হাদীছসমূহকে ‘ছহীহ’, ‘হাছান’, ‘জঈফ’, ‘গরীব’ ও ‘মোআল্লাল’ প্রভৃতি স্তর ও করমে ভাগ করা হইয়াছে এবং কোনটি কোন স্তর বা রকমের হাদীছ তাহা বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

(ঘ) ইহাতে রবীদের নাম, লকব, কুনিয়াত প্রভৃতি দ্বারা তাঁহাদের সুস্পষ্ট পরিচয় দেওয়া হইয়াছে।

ইহাতে মোট ৩৮১২টি হাদীছ রহিয়াছে। ইহারও বহু শরাহ হইয়াছে।

তিরমিজীর শরাহঃ

১। শরহে তিরমিজী –শায়খ ইবনুল আরবী (মৃ ৫৪৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘আরেজাতুল আহওয়াজী’।

২। শরহে তিরমিজী –হাফেজ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ (মৃ ৭৩৪ হিঃ)। ইহাতে তিনি ১০ খণ্ডে তিরমিজীর মাত্র দুই তৃতীয়াংশের শরাহ করিয়াছেন;বাকী অংশ হাফেজ জায়নুদ্দীন ইরাকী পূর্ণ করিয়াছেন।

৩। শরহে তিরমিজী –ইবনুল মুলাক্কেন (মৃ ৮০৪ হিঃ)।

৪। শরহে তিরমিজী –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃ ৯১১ হিঃ)।

৫। শরহে তিরমিজী –শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (মৃ ১১২৯ হিঃ)।

৬। শরহে তিরমিজী –মাওলানা আবদুর রহমান মোবারকপুরী (মৃ ১৩৫১ হিঃ)। ইহার নাম ‘তোহফাতুল আহওয়াজী’।

৭। শরহে তিরমিজী –মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী দেওবন্দী (মৃ ১৩৫১ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল আরফুল শাজী’। ইহাতে তাঁহার তাকরীর (বক্তৃতা) জমা হইয়াছে।

ছুনানে ইবনে মাজাহ

মোতাকাদ্দেমীনগণ ইহাকে ‘ছেহাহ ছেত্তা’র শামিল করিতেন না। আবুল ফজল ইবনে তাহির মাকদেছীই (মৃ ৬০০ হিঃ) প্রথমে ইহাকে ‘ছেহাহ ছেত্তা’র শামিল করেন। অতঃপর ইহা ছেহাহ ছেত্তার একটি কিতাব হিসাবেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু ইহার পরিবর্তে কেহ ‘মোআত্তা’কে আর কেহ ‘ছুনানে দারেমী’কেই ছেহাহ ছেত্তার শামিল করা সমীচীন বলিয়অ মনে করেন। ইহাতে মোট ৪৩৩৮টি হাদিছ রহিয়াছে। ইহার ৩০টি হাদীছ রহিয়াছে। ইহার ৩০টি হাদিছ সম্পর্কে ইমাম জাহবী ‘জঈফ’ বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। ইমাম ইবনে জাওজীর মতে ইহাতে ১৩টি ‘মাওজু’ হাদিছ রহিয়াছে। হাফেজ ইবনে হাজার ইহার খণ্ডন করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, ফজীলতে কাজবীন সম্পর্কীয় একটি মাত্র হাদীছ ব্যতীত ইহাতে কোন ‘মাওজু’ হাদীছ নাই। ইহার অনেক শরাহ রহিয়াছে।

ইবনে মাজাহর শরাহঃ

১। শরহে ইবনে মাজাহ –আলাউদ্দীন মোগলতায়ী (মৃঃ ৭৬২ হিঃ)। ইহা একটি বিস্তারিত শরাহ।

২। শরহে ইবনে মাজাহ –ইবনুল মুলাক্কেন (মৃঃ ৮০৪ হিঃ)।

৩। শরহে ইবনে মাজাহ –কামালুদ্দীন দামীরী (মৃঃ ৮০৮ হিঃ)। ইহার নাম ‘দীবাজাহ’। ইহা অসমাপ্ত রহিয়াছে।

৪। শরহে ইবনে মাজাহ –ইব্রাহীহ ইবনে মোহাম্মদ হালাবী (মৃঃ ৮৪১ হিঃ)।

৫। শরহে ইবনে মাজাহ –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। ইহার নাম ‘মিছবাহুজ জুজাজাহ’ (আরবী******)

৬। শরহে ইবনে মাজাহ –শায়ক আবুল হাসান সিন্ধী (মৃঃ ১১২৯ হিঃ)।

৭। শরহে ইবনে মাজাহ –শাহ আবদুল গণী মুজাদ্দেদী দেহলবী (মৃঃ ১২৯২ হিঃ)। ইহার নাম ‘ইনজাহুল হাজাহ’ (আরবী*******)। ইহা ‘ইবনে মাজাহর’ একটি উত্তম শরাহ। ইহা হিন্দুস্তানে ইবনে মাজাহর হাশিয়ায় ছাপা হইয়াছে।

 

হাদীছ গ্রহণে ইমাম বোখারী ও মোছলেমের শর্তাবলী

হাদীছ বর্ণনাকারী রাবীগণকে সাধারণতঃ পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা হইয়া থাকে; ১ম শ্রেণী –যাহাদের হেফজ বা লেখার দ্বারা হাদীছ রক্ষা করার ক্ষমতা (জবত) অত্যধিক এবং আপন শায়খ বা ওস্তাদের সহিত মোলাজামাত (সম্পর্ক) ঘনিষ্ঠতর ছিল।

২য় শ্রেণী –যাহাদের হাদীছ রক্ষা করার ক্ষমতা অত্যধিক বটে; কিন্তু শায়খের সহিত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর নহে।

৩য় শ্রেণী –যাহাদের হাদীছ রক্ষা করার ক্ষমতা অত্যধিক নহে। কিন্তু শায়খের সহিত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর।

৪র্থ শ্রেণী –যাহাদের হাদীছ রক্ষা করার ক্ষমতাও অত্যধিক নহে এবং শায়খের সহিত সম্পর্কও ঘনিষ্ঠতর নহে।

৫ম শ্রেণী –যাহাদের মধ্যে এই দুই গুণও স্বল্প, অধিকন্তু অন্যান্য ত্রুটিও রহিয়াছে।

ইমাম বোখারী সাধারণতঃ প্রথম শ্রেণীর রাবীদের হাদীছই গ্রহণ করিয়াছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর রাবীদের হাদীছ কোথাও কোথাও শুধু প্রথম শ্রেণীর হাদীছের পোষকতার জন্যই উদ্ধৃত করিয়াছেন।

ইমাম মোছলেম প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর রাবীদের হাদীছ বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করিয়াছেন এবং তৃতীয় শ্রেণীর রাবীদের হাদীছ উহাদের সাহায্যের জন্য ব্যবহার করিয়াছেন।

ইমাম বোখারী বা মোছলেমের ‘শরায়েত’ বলিতে ইহাই বুঝায়।

কতিপয় প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেছ

১। আবদুর রাজ্জাক ইবনে হুমাম ছনআনী (মৃঃ ২১১ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একটি ‘মোছান্নাফ’ রহিয়াছে।

২। আছাদ ইবনে মূছা মারওয়ানী (মৃঃ ২১২ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার কিতাব রহিয়াছে।

৩। ইছমাঈল ইবনে হাম্মাদ ইবনে ইমাম আবু হানীফা (মৃঃ ২১২ হিঃ)। তিনি ‘বাক্কা’র কাজী ছিলেন। হাদীছে তাঁহার কিতাব রহিয়াছে।

৪। আবু উবায়দ কাছেম ইবনে ছাল্লাম (মৃঃ ২২৪ হিঃ)। ‘কিতাবুল আমওয়াল’ নামক গ্রন্থে তিনি রাজস্ব সম্পর্কীয় সমস্ত হাদীছ একত্র করিয়াছেন। ইহা একখানি অতুলনীয় কিতাব। ইহা হালে মিছর হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

৫। আবু জা’ফর মোহাম্মদ ইবনে ছাব্বাহ ‘বাজজার’ (মৃঃ ২২৭ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একটি ‘ছুনান’ রহিয়াছে।

৬। নোয়াইম ইবনে হাম্মাদ খোজায়ী (মৃঃ ২২৮ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার কিতাব রহিয়াছে।

৭। মুছাদ্দাদ ইবনে মুছারহাদ বছরী (মৃঃ ২২৮ হিঃ)। তিনি হাদীছে কিতাব লিখিয়াছেন।

৮। ইয়াইইয়া ইবনে মুঈন (মৃঃ ২৩৩ হিঃ)। তিনি ‘জারহ-তা’দীল’ ও হাদীছের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইমাম’ ও ‘হুজ্জাত’ ছিলেন। লোকে তাঁহার নিকট হইতে ১২লক্ষ হাদীছ লিখিয়া লইয়াছে।

৯। আলী ‘ইবনুল মাদীনী’ (মৃঃ ২৩৪ হিঃ)। তিনি হাদীছের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম। বোখারী তাঁহার ‘আল জামেউছ্ছহীহ’ সমালোচনার উদ্দেশ্যে তাঁহাকে দেখাইয়াছিলেন।

১০। আবু বকর ইবনে আবি শায়বা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একটি ‘মুছান্নাফ’ রহিয়াছে। তিনি ইমাম বোখারী ও মোছলেমের ওস্তাদ ছিলেন।

১১। ছাঈদ ইবনে মানছুর (মৃঃ ২৩৫ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একটি ‘মোছান্নাফ’ রহিয়াছে।

১২। ইমাম ইছহাক ইবনে রাহওয়াইহ (আরবী*************) (মৃঃ ২৩৮ হিঃ)। তিনি ইমাম বোখারীর ওস্তাদ এবং হাদীছের একজন ইমাম। একলক্ষ হাদীছ তাঁহার মুখস্থ ছিল। হাদীছে তাঁহার একটি ‘মোছনাদ’ রহিয়াছে। ইব্রাহীম ইবনে আবু তালেব বলেনঃ তিনি তাঁহার এই ‘মোছনাদ’ আমাদের একবার মুখস্থ এবং একবার দেখিয়া পড়াইয়াছিলেন।

১৩। ছাহনুন –আবদুছ ছালাম তনুখী (মৃঃ ২৪০ হিঃ)। ‘মুদাওওয়ানাহ’ (আরবী**********) তাঁহার ফেকাহর কিতাব হইলেও তাহাতে বহু হাদীছ রহিয়াছে।

১৪। আবদ ইবনে হোমাইদ (মৃঃ ২৪৯ হিঃ)। ‘মোছনাদে কবীর’ নামে হাদীছে তাঁহার একটি কিতাব রহিয়াছে।

১৫। বুন্দার –আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে বাশশার বছরী (মৃঃ ২৫২ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার কিতাব রহিয়াছে।

১৬। আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান (মৃঃ ২৫৫ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একখানি ‘মোছনাদ’ রহিয়াছে।

১৭। আবু মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দারেমী ছমরকন্দী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ)। ‘ছুনান’ তাঁহার কিতাব। ইহা সাধারণতঃ ‘মোছনাদ’ নামেই প্রসিদ্ধ। অনেকে ছুনানে ইবনে মাজাহর স্থলে ইহাকে ছেহাহ ছেত্তার অন্তর্ভূক্ত করেন। ইহা দুই খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

১৮। আবু জা’ফর আহমদ ইবনে ছানান কাত্তান ওয়াছেতী (মৃঃ ২৫৮ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

১৯। ইবনে হানজার –আবু আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে হানজার জুরজানী (মৃঃ ২৫৮ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

২০। ইয়াকুব ইবনে শায়বা (মৃঃ ২৬২ হিঃ)। তাঁহার ‘মোছনাদে কবীর’ একটি উত্তম কিতাব। কিন্তু ইহা অসমাপ্ত।

২১। মোহাম্মদ ইবনে মাহদী (মৃঃ ২৭২ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

২২। বাকী ইবনে মাখলাদ কোরতবী (কর্ডোভা মৃঃ ২৭৬ হিঃ)। ‘মোছনাদে কবীর’ তাঁহার কিতাব। ইহাতে তিন শতের অধিক ছাহাবীর হাদীছ একত্র করা হইয়াছে।

২৩। আহমদ ইবনে হাজেম (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার একটি ‘মোছনাদ’ রহিয়াছে।

২৪। ইব্রাহীম ইবনে ইছমাঈল তুছী (মৃঃ ২৮০ হিঃ) ‘মোছনাদে আম্বরী’ তাঁহার কিতাব। -মিফতাহ

২৫। হাফেজ আহমদ ইবনে মোহাম্মদ বূনী (মৃঃ ২৮০ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব। -দুওয়ালে ইছলাম

২৬। ইব্রাহীম ইবনুর আছকারী (মৃঃ ২৮২ হিঃ)। ‘মোছনাদে আবু হুরায়রা’ তাঁহার কিতাবের নাম। ইহাতে কেবল হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছসমূঞ একত্র করা হইয়াছে।

২৭। মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ রাজা (আরবী****) সিন্ধী (মৃঃ ২৮৬ হিঃ)। তাঁহার একটি ‘ছহীহ’ কিতাব রহিয়াছে বলিয়া জানা যায়। -তারীখে হাদীছ

২৮। আহমদ ইবনে আমর শায়বানী (মৃঃ ২৮৭ হিঃ)। তাঁহার কিতাব ‘আল মোছনাদ’-এ প্রায় ৫০ হাজার হাদীছ রহিয়াছে বলিয়া খাওলী তাঁহার ‘মিফতাহে’ উল্লেখ করিয়াছেন।

২৯। আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ইস্পাহানী  (মৃঃ ২৯১ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৩০। আবু মুসলিম কাশী (মৃঃ ২৯১ হিঃ)। ‘ছুনান’ তাঁহার কিতাব। -দুওয়ালে ইসলাম।

৩১। আবু বকর আহমদ ইবনে আমর ‘বাজ্জার’ (মৃঃ ২৯২ হিঃ)। ‘মোছনাদে বাজ্জার’ তাঁহার কিতাব।

৩২। মোহাম্মদ ইবনে নাছর মারওয়াজী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)। ‘কিতাবে মোহাম্মদ ইবনে নাছর’ নামে তাঁহার কিতাব প্রসিদ্ধ।

৩৩। ইব্রাহীম ইবনে মা’কাল নাছাফী (মৃঃ ২৯৫ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৩৪। কাজী ইউসুফ ইবনে ইমাম আবু ইউসুফ (মৃঃ ২৯৭ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘ছুনান’। -দুওয়ালে ইছলাম

৩৫। ইব্রাহীম ইবনে ইউসুফ হানজাবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৩৬। হাছান ইবনে ছুফইয়ান (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)। ‘মুছনাদে কবীর’ তাঁহার কিতাব।

৩৭। ইবনুল জারূদ আবদুল্লাহ (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)। ‘আল মোন্তাকা’ তাঁহার কিতাব। শায়খ দেহলবী ইহাকে একটি ছহীহ কিতাব বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন।

৩৮। আবু ইয়া’লা মুছেলী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৩৯। ইবনে জরীর তাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ)। ‘তাহজীরুল আছার’ হাদীছে তাঁহার অভিনব ও উত্তম কিতাব বলিয়া আবদুল আজীজ খাওলী মন্তব্য করিয়াছেন।

৪০। আবু হাফছ ওমর ইবনে মোহাম্মদ ইবনে বাহর (মৃঃ ৩১১ হিঃ)। ‘আছছহীহ’ তাঁহার কিতাব। -দুওয়ালে ইছলাম

৪১। ইবনে খোজাইমা মোহাম্মদ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ৩১১ হিঃ) ‘আছছহীহ’ তাঁহার কিতাব।

৪২। মোহাম্মদ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ৩১৩ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৪৩। আবু আওয়ানা ইয়াকুব বিন ইছহাক ইস্পাহানী (মৃঃ ৩১৬ হিঃ)। ‘আছছহীহ’ তাঁহার কিতাব।

৪৪। আবু জা’ফর তাহাবী মিছরী (মৃঃ ৩২১ হিঃ)। ‘শরহে মাআনীল আছান’ (আরবী*****) ও ‘শরহে মুশকিলুল আছার’ (আরবী*******) তাঁহার দুইটি অতি মূল্যবান কিতাব।

৪৫। কাছেম ইবনে আছবাগ আন্দালুছী (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ)। ‘ছহীহ মোস্তাকা’ তাঁহার কিতাব।

৪৬। ইবনে ছাফফান ছাঈদ ইবনে ওছমান বছরী (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ)। ‘ছহীহ মোস্তাকা’ তাঁহার কিতাব।

৪৭। আবু হাতেম ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)। ‘আছছহীহ’ তাঁহার কিতাব।

৪৮। তযরানী ছোলাইমান ইবনে আহমদ (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)। ‘মোজামে কবীর’, ‘মোজামে ছগীর’ ও ‘মোজামে আওছাত’ তাঁহার কিতাব। ‘মোজামে কবীরে’ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হাদীছ রহিয়াছে।

৪৯। হাছান ইবনে মোহাম্মদ মাছেরজাছ (আরবী*****) খোরাছানী (মৃঃ ৩৬৫ হিঃ)। ‘মোছনাদে কবীর’ নামে ৭০ খণ্ডে তাঁহার একটি হাদিছের কিতাব রহিয়াছে বলিয়া জাহবী উল্রেক করিয়াছেন। -দুওয়ালে ইছলাম।

৫০। আবু ইছহাক ইবনে নাছর রাজী (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৫১। ইবনে শাহীন –দারাকুতনী –আবুল হাছান আলী (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)। ‘ছুনানে কুবরা’ প্রভৃতি হাদীছে তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

৫২। ইবনে শাহীন –আবু হাফছ ওমর (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ মো’জাম’ ‘তারগীব’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

৫৩। খাত্তাবী –আবু ছোলাইমান আহমদ ইবনে মোহাম্মদ বুস্তী (মৃঃ ৩৮৮ হিঃ)। ‘মাআলে মুছছুনান’ (আরবী******) তাঁহার কিতাবের নাম।

৫৪। ইবনে জুমাই –মোহাম্মদ ইবনে আহমদ (মৃঃ ৪০২ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৫৫। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)। ‘মুস্তাদরাক’ তাঁহার কিতাব। ইহা তিনি বোখারী ও মোছলেমের পরিশিষ্ট হিসাবে লিখিয়াছেন।

৫৬। খাওয়ারেজমী (মৃঃ ৪২৫ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৫৭। আবু নোয়াইম ইস্পাহানী (মৃঃ ৪৩০ হিঃ)। ‘হিলয়াতুল আওলিয়া’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

৫৮। বায়হাকী –আবু বকর খোরাছানী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ)। ‘ছুনানে কুবরা’, ‘শোআবুল ঈমান’ প্রভৃতি তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব। উভয়  কিতাব প্রকাশিয় হইয়াছে।

৫৯। ইবনে হাজম –আবু মোহাম্মদ আলী জাহেরী আন্দালুছী (স্পেনী মৃঃ ৪৬৫ হিঃ)। ‘জামেয়ে ছহীহ’ ও ‘মাহাল্লা’ তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

৬০। জাঞ্জালী –ছা’দ ইবনে আলী (মৃঃ ৪৭১ হিঃ)। ‘মোছনাদ’ তাঁহার কিতাব।

৬১। হোমাইদী –মোহাম্মদ ইবনে নছর (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ)। তিনি ‘আল জামউ বাইনাছ্ছহীহাইন’ কিতাবে বোখারী ও মোছলিমের হাদীছসমূহ তাকরার বাদ একত্রিত করিয়াছেন।

৬২। আবুল ওয়ালীদ ছোলাইমান বাজী আন্দালুছী (মৃঃ ৪৭৬ হিঃ)। ‘আল-মোস্তাক’ তাঁহার কিতাব।

৬৩। হাকিম তিরমিজী –আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ (মৃঃ ৫০৫ হিঃ)। ‘নাওয়াদেরুল উছুল’ তাঁহার কিতাব।

৬৪। হাফেজ আবু মোহাম্মদ হাছান ইবনে আহমদ ছমরকন্দী হানাফী (মৃঃ ৪৯১ হিঃ)। ‘বাহরুল আছানীদ’ (আরবী**********) তাঁহার কিতাব।আবদুল আজীজ খাওলী বলেনঃ ইহাতে এক লক্ষ হাদীছের সমাবেশ করা হইয়াছে। ইহা অতি বিরাট ও উত্তম কিতাব। ইহার ন্যায় কিতাব এ যাবৎ লেখা হয় নাই।

এছাড়া এ যুগে আরো বহু মোহাদ্দেছ বহু কিতাব লেখেন।

চতুর্থ যুগ

এ যুগ হিজরী ৫ম শতাব্দীর পর হইতে আরম্ভ হইয়া এ যাবৎ চলিতেছে। এ যুগে হাদীছের মোতাবেক আমলকরণ, হাদীছ শিক্ষাকরণ ও শিক্ষাদান এবং হাদীছের লিখন পূর্বের ন্যায়ই চলিতে আছে, কিন্তু হেফজকরণ প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কারণ, পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, তৃতীয় যুগ পর্যন্তই সমস্ত হাদীছ রাবীদের নিকট হইতে সংগৃহীত হইয়া কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। অতঃপর হেফাজতের উদ্দেশ্যে ছনদ সহকারে হাদীছ মুখস্ত রাখার কোন প্রয়োজন নাই। অতএব, এ যুগের লোকেরা পূর্ববর্তীদের কিতাবের আলোচনা-সমালোচনার প্রতিই মনোনিবেশ করেন। কেহ কাহারো কোন কিতাবের ছনদ বিচার করেন, কেহ উহার সংক্ষেপ করেন, আর কেহ উহার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। কেহ বা বিভিন্ন কিতাবের হাদীছসমূহ একত্র করিয়া হাদিছের বিশ্বকোষ রচনা করেন, আর কেহ বিভিন্ন কিতাব হইতে হাদীছ নির্বাচন করিয়া সংকলন তৈয়ার করেন। কেহ হাদীছের দুর্বোদ্য শব্দসমূহের অভিধান রচনা করেন এবং কেহ হাদীছ সংশ্লিষ্ট অপরাপর এরমের উৎকর্ষ সাধনের প্রতি মনোযোগ দেন। এক কথায় লিখনের ধারা মূল হাদীছ সংকলন হইতে এদিকে মোড় পরিবর্তন করে এবং হাদীছ সম্পর্কীয় বহু শাখা এলমের সৃষ্টি করে।

ছহীহাইনের একত্রকরণঃ

অনেকে তাকরার বাদ দিয়া ছহীহাইন অর্থাৎ, বোখারী ও মোছলেম শরীফের হাদীছসমূহকে একত্রিত করিয়াছেন, যথা-

১। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ জাওজাকী (মৃঃ ৩৮৮ হিঃ)।

২। ইবনুল ফারাত –ইছমাঈল ইবনে আহমদ (মৃঃ ৪১৪ হিঃ)।

৩। বার্কানী –আহমদ খাওয়ারেজমী (মৃঃ ৪৩৫ হিঃ)।

৪। মোহাম্মদ ইবনে আবু নছর হোমাইদী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল জামউ বাইনাছ্ছহীহাইন’। ইহা অতি প্রসিদ্ধ কিতাব।

৫। মুহীউছ্ছুন্নাহ বাগাবী (মৃঃ ৫১৬ হিঃ)।

৬। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল হক ইশবেলী (মৃঃ ৫৮২ হিঃ)।

৭। ইবনে আবিল হু্জ্জাহ্ –আহমদ ইবনে মোহাম্মদ কোরতবী (কর্ডোভা) (মৃঃ ৬৪২ হিঃ)।

ছেহাহ ছেত্তার একত্রকরণঃ

ছেহাহ ছেত্তা অর্থাৎ, বোখারী, মোছলেম, আবু দাঊদ, তিরমিজী ও মোআত্তা-এর হাদীছ সমূহকে তাকরার বাদ দিয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক একত্র করিয়াছেন; যথা-

১। ‘রজীন’ –আবুল হাছান আহমদ ইবনে মুআবিয়া আবদারী (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ অথবা ৫২৫ হিঃ)। তিনি ইহার নাম দিয়াছেন ‘তাজরীদুছ ছেহাহ’। ইহাতে তিনি এমন কতক হাদীছকেও স্থান দিয়াছেন যাহা এ সকল কিতাবে পাওয়া যায় না। অধিকন্তু তাঁহার কিতাবের তারতীব (বিন্যাস)ও উত্তম নহে। ইহাকে উত্তমরূপে তারতীব দিয়াছেন মাজদুদ্দীন ইবনুল আছীর জজরী মূছেলী (মৃঃ ৬০৬ হিঃ) এবং তাহার নাম করিয়াছেন ‘জামেউল উছুল’ (আরবী*******) [ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরীতে ইহার একটি হস্তলিখিত কটি বিদ্যমান আছে।] কিন্তু ইহাতে অনেক হাদীছের একাধিক জায়গায় তাকরার রহিয়াছে। এছাড়া তিনি কোনো কোনো হাদীছের সহিত তাঁহার ব্যাখ্যা ও ব্যাকরণকেও জুড়িয়া দিয়াছেন। ফলে কিতাব বিরাট আকার ধারণ করিয়াছেন। এ কারণে অনেকে ইহার সংক্ষেপ করার প্রয়াস পাইয়াছেন। যথা-

(ক) মোহাম্মদ মারওজী (আরবী***) (মৃঃ ৬৮২ হিঃ)।

(খ) কাজী হিবাতুল্লাহ বারেজী (মৃঃ ৭১৮ হিঃ)। বারেজী একদিকে যেমন, জজরীর ব্যাখ্যা ও ব্যাকরণকে বাদ দিয়াছেন, অপর দিকে তেমনি রজীন কর্তৃক সংযোজিত ছেহাহ ছেত্তার বাহিরের হাদীছসমূহকেও ছাঁটাই করিয়াছেন। কিন্তু হাদীছের রাবীদের নাম এবং মূল কিতাবের হাওয়ালা (বরাত) পূর্ববৎ কিতাবের হাশিয়াতেই (মার্জিনে) রাখিয়া দিয়াছেন –যাহাতে পাঠকগণ অনেক সময় ভুলে পতিত হইতে বাধ্য না হয়। বারেজীর এ কিতাবের নাম ‘তাজরীদুল উছুল’- (আরবী***) ইহার কটি কোথাও বিদ্যমান আছে কিনা আমার জানা নাই।

(গ) ইবনুদ দীবা শায়বাণী (ইবনুর রবী নহে)। আবদুর রহমান ইবনে আলী (মৃঃ ৯৪৪ হিঃ)। তিনি ‘জামেউল উছুল’কে উত্তমরূপে সাজাইয়া নাম দিয়াছেন ‘তাইছীরুল উছুল’- (আরবী******)

ইহাতে তিনি প্রত্যেক হাদীছের প্রথম দিকে রাবী ছাহাবীর নাম এবং শেষের দিকে মূল কিতাবের বরাত জুড়িয়া দিয়াছেন। অবশ্য কোনো কোনো হাদীছের অত্যাবশ্যক ব্যাখ্যাকেও পূর্ববৎ বহাল রাখিয়অছেন। এছাড়া তিনি রজীনের অতিরিক্ত হাদীছসমূহকেও বাদ না দিয়া রজীনের নামেই উহার উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা একটি অতি উত্তম কিতাব। ইহাতে ছেহাহ ছেত্তার সমস্ত হাদীছই এক সঙ্গে পাওয়া যায়। অবশ্য অধ্যায়ের তারতীব বর্ণনানুক্রমিক হওয়ায় বিষয় তালাশে কিছুটা অসুবিধা ঘটে। (মিছরের ছালাফিরা প্রেস হইতে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।)

আমি ইহার প্রথম দুই খণ্ডের হাদীছসমূহ গুনিয়া দেখিয়াছি। ইহাতে রজীনের ৬৫টি হাদীছসহ মোট ২৮৪১টি হাদীছ রহিয়াছে। এ অনুপাতে হিসাব করিলে পূর্ণ চারি খণ্ড কিতাবে পৌণে ছয় হাজারের মত হাদীছ রহিয়াছে বলিয়া মনে হয়।

২। ইবনুল খারাত –আবদুল হক ইশবেলী (ইশবেলীয়া মৃঃ ৫৮২ হিঃ)। ইনিও ছেহাহ ছেত্তার হাদীছসমূহকে তাকরার বাদ দিয়া এক কিতাবে একত্র করিয়াছেন।

৩। কুতবুদ্দীন নহরওয়ালী সিন্ধী, মক্কী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তাঁহার ‘জামেউছ ছেহাহ’ একটি উত্তম কিতাব বলিয়া খাওলী মত প্রকাশ করিয়াছেন। -মিফতাহ-১১০পৃঃ

৪। হাফেজ জিয়াউদ্দীন মাকদেছী (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ)। তিনি তিরমিজী ব্যতীত বাকী পাঁচ কিতাবের মোত্তাফাকাহ (একমতে বর্ণিত) হাদীছসমূহকে একত্র করিয়া নাম দিয়াছেন ‘আল মুয়াফিকাত’।

৫। শায়খ মানছুর আলী নাছীফ মিছরী। তিনি হাল জমানার লোক। তিনি ‘ইবনে মাজাহ’কে বাদ দিয়া অপর পাঁচ কিতাবের হাদীছসমূহকে ফেকাহর তারতীব অনুসারে সাজাইয়াছেন এবং নাম দিয়াছেন ‘আততাজুল জামে’ (আরবী*******) ইহা মিছরের হালাবিলা লাইব্রেরী হইতে প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে বিষয় অনুসারে হাদীছ তালাশ করিতে বেশ সুবিধা হয়।

সাধারণ জামেঃ

অতেকে আবার বিভিন্ন কিতাবের হাদীছসমূহকে ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করিয়া হাদীছের বিশ্বকোষ রচনার চেষ্টা করিয়াছেন। এ সকল কিতাবকে সাধারণতঃ ‘জামে’ বা ‘জাওয়ামে’ বলা হইয়া থাকে। নীচে এরূপ কতিপয় প্রসিদ্ধ জামে’র নাম দেওয়া গেলঃ

১। ‘বাহরুল আছানীদ’ –আবু মোহাম্মদ হাছান ইবনে আহমদ ছমরকন্দী (মৃঃ ৪৯১ হিঃ)। তাঁহার কিতাবে তিনি এক লক্ষ হাদীছের সমাবেশ করিয়অছেন বলিয়া আবদুল আজীজ খাওলী উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে ইহাকেই হাদীছের সর্ববৃহৎ কিতাব বলা যাইবে। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে কিনা তাহা আমার জানা নাই।

২। ‘জামেউল মাছানীদ’ (আরবী******) –ইবনুল জাওজী (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ)। ইহাতে তিনি ছহীহাইনের সহিত তিরমিজী ও মোছনাদে আহমদের হাদীছকে একত্র করিয়াছেন। আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ মক্কী (মৃঃ ৯৬৪ হিঃ) ইহাকে উত্তমরূপে সাজাইয়াছেন।

৩। ‘জামেউল মাছানীদ’ –ইবনে কাছীর –হাফেজ ইছমাঈল ইবনে কাছীর দেমাশকী (মৃঃ ৭৭৪ হিঃ)। ইহাতে তিনি ছেহাহ ছেত্তার হাদীছের সহিত মোছনাদে আহমদ, মোছনাদে আবু ইয়ারা, মোছনাদে বাজ্জার ও তবরানীর তিনটি মো’জামের হাদীছকে একত্র করিয়াছেন।

৪। ‘মাজমাউজ জাওয়ায়েদ’ (আরবী*******) –নূরুদ্দীন আবুল হাছান আলী ইবনে আবু বকর ইবনে ছোলাইমান হায়ছমী (৮০৭ হিঃ)। ইহাতে তিনি ইবনুল আছীরের ‘জামেউল উছুলের’ সহিত মোছনাদে আহমদ, মোছনাদে আবু ইয়ালা, মোছনাদে বাজ্জার ও তবরানীর তিনটি মো’জম অর্থাৎ, মোট ১২টি কিতাবের হাদীছকে একত্র করিয়াছেন। ইহা দশ খণ্ডে প্রকামিত হইয়াছে।

৫। ‘তাছহীলুল-উছুল’ (আরবী****) –মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী (মৃঃ ৮১৭ হিঃ)। ইহাতে তিনি জজরীর ‘জামেউল উছুল’কে উত্তমরূপে সাজাইয়া উহার সহিত আরো কতিপয় কিতাবের হাদীছকে একত্র করিয়াছেন।

৬। ‘ইতহাফুল খেয়ারাহ’ (আরবী*****) –আহমদ ইবনে আবু বকর বুছীরী (মৃঃ ৮৪০ হিঃ)। ইহাতে ছেহাহ ছেত্তার হাদীছের সহিত মোছনাদে তায়ালছী, মোছনাদে হোমাইদী, মোছনাদে মোহাম্মদ, মোছনাদে ইবনে আবু আমর, মোছনাদে ইছহাক ইবনে রাহওয়াইহ, মোছনাদে ইবনে আবু শায়বা, মোছননাদে আহমদ ইবনে মুনীর, মোছনাদে আবদ ইবনে হোমাইদ, মোছনাদে হারেছ ইবনে আবু ওছামা, মোছনাদে আবু ইয়ালা –মোট ১৬টি কিতাবের হাদীছ একত্র করা হইয়াছে। ইহা একমত ‘বাব’ বা অধ্যায়ে বিভক্ত।

৭। ‘জামউল জাওয়ামে’ (আরবী******) –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী মিছরী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। ইহাতে তিনি সমস্ত হাদীছকে একত্র করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু সমাপ্ত করার পূর্বেই তিনি এন্তেকাল করেন। শায়খ আলী মোত্তাকী জৌনপুরী মক্কী (মৃঃ ৯৫৫ হিঃ) ‘জামউল জাওয়ামে’কে উত্তমরূপে সাজাইয়া ‘কানজুল উম্মাল’ (আরবী*****) নাম করিয়াছেন। ‘কানজুল উম্মাল’কে সংক্ষেপ করিয়া নাম করিয়াছেন ‘মোন্তাখাবে কানজুল উম্মাল’। ইহাতে মোট ৩০ হাজার হাদীছ রহিয়াছে, মোত্তাকীর উভয় কিতাব প্রকাশিত হইয়াছে।

৮।‘জামউল ফাওয়ায়েদ’ (আরবী****) –মোহাম্মদ ইবনে ছোলাইমান ইবনুল ফাছী (মৃঃ ১০৯৪ হিঃ)। ইহাতে ‘মাজমাউজ জাওয়ায়েদের’ হাদীছের সহিত ইবনে মাজাহ ও ছুনানে দারেমীর হাদীছসমূহকে একত্র করা হইয়াছে। এ হিসাবে ইহা ১৪টি কিতাবের সমষ্টি। ইহা অতি ক্ষুদ্র লিথো অক্ষরে মাত্র এক জিলদে হিন্দুস্থানে প্রকাশিত হইয়াছে।

এখানে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে সকল হাদীছ গৃহীত হইয়াছে কেবল সে সকল হাদীছই ছহীহ। অপরাপর কিতাব বিশেষ করিয়া মোছনাদসমূহ হইতে যে সকল হাদীছ গৃহীত হইয়াছে সে সকল হাদীছ বিচারসাপেক্ষ। মোহাদ্দেছগণের বিচারে যে যে হাদীছ ছহীহ বলিয়া সাব্যস্ত হইবে কেবল সে সে হাদীছই গ্রহণযোগ্য। মোছনাদসমূহের মধ্যে এক মোছনাদে আহমদই নির্ভরযোগ্য কিতাব।

সংকলনঃ

কেহ কেহ হাদীছের মূল কিতাব হইতে আবশ্যক হাদীছ নির্বাচন করিয়া সংকলন (ইস্তেখাব) তৈয়ার করিয়াছেন। কতিপয় মশহুর সংকলনের নাম নীচে দেওয়া গেলঃ

১। মাছাবীহুছছুন্নাহ –মুহীউছ্ছুন্নাহ বাগাবী (মৃ ৫১৬ হিঃ)। ইহাতে তিনি মোট ৪৪৩৪টি হাদীছ সংকলন করিয়াছেন। তিনি ইহার প্রত্যেক অধ্যায়কে দুইটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করিয়া প্রথম পরিচ্ছেদে বোখারী ও মোছলেমের এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ‘হেছান’ নামে অপরাপর কিতাবের হাদীছসমূহকে স্থান দিয়াছেন। কিন্তু প্রত্যেক হাদীছের প্রথম দিকে বর্ণনাকারী ছাহাবীর নাম এবং শেষের দিকে মূল কিতাবের বরাত না দেওয়ায় পরবর্তী লোকগণ ইহার বিরূপ সমালোচনা করিতে থাকেন। হিজরী অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে খতীব তাবরেজী মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ প্রত্যেক হাদীছের প্রথম দিকে বর্ণনাকারী ছাহাবীর নাম এবং শেষের দিকে মূল কিতাবের বরাত জুড়িয়া দেন। অধিকন্তু তিনি প্রায় সকল অধ্যায়ের শেষ ভাগেই তৃতীয় একটি পরিচ্ছেদ (ফছল) বাড়াইয়া উহাতে অধ্যায় সংশ্লিষ্ট আরো বহু হাদীছের সমাবেশ করেন। অতঃপর ইহার নাম করেন ‘মেশকাতুল মাছাবীহ’ (ইহাই আমাদের আলোচ্য কিতাব)। উভয় কিতাব প্রকাশিত।

২। মাশারেকুল আনওয়ার –শায়খ হাছান ছাগানী লাহোরী (মৃ ৬৫০ হিঃ)। ইহাতে তিনি ‘ছহীহাইন’ হইতে মোট ২২৪৬টি শুধু রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর কাওলী হাদীছকে নির্বাচন করিয়াছেন। ইহার তারতীব এন নূতন ধরনের বর্ণনানুক্রমিক। ইহা হাদীছের একটি অতি মূল্যবান ও মকবুল কিতাব। বহু শতাব্দীব্যাপী বিভাগপূর্ব ভারত ও অন্যান্য দেশের পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল। ইহার বহু শরাহ রহিয়াছে। ছৈয়দ আহমদ শহীদের খলীফা মাওলানা খুররম আলী বালহুরী ইহার উর্দু তরজমা ও সংক্ষিপ্ত শরাহ লেখেন। মাওলানা আবদুল হালীম চিশতী ইহাকে ছুনানের তারতীব অনুসারে সাজাইয়া বালহুরীর তরজমা ও শরাহসহ হালে করাচী হইতে প্রকাশ করিয়াছেন।

৩। ‘আল লু’লুউ ওয়াল মারজান’ (আরবী******) –ওস্তাদ মোহাম্মদ ফুয়াদ আবুদল বাকী মিছরী। ইহাতে কেবল ছহীহাইনের ‘মোত্তাফাকুন আলাইহে’ হাদীছ সমূহ একত্র করা হইয়াছে। ইহা মিছরের হালাবিয়া লাইব্রেরী হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

এছাড়া আহকাম সম্পর্কীয় কিতাবসমূহও আসলে এ জাতীয় সংকলনই। পরবর্তী অধ্যায়ে এ জাতীয় কতিপয় প্রসিদ্ধ কিতাবের নাম দেওয়া গেল।

আহকাম বিষয়ক হাদীছসমূহের একত্রকরণঃ

অনেকে আবার শুধু আহকামের হাদীছসমূহকে একত্র করিয়াছেন। যথা-

১।ইবনুল খারাত –আবু মোহাম্মদ আবদুল হক ইশবেলী (মৃঃ ৫৮১ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘আহকামে কুবরা’ ও ‘আহকামে ছুগরা’।

২। হাফেজ আবদুল গনী মাকদেছী (মৃঃ ৬০০ হিঃ)। ‘উমদাতুল আহকাম’ তাঁহার কিতাবরে নামা। ইহাতে তিনি ‘ছহীহাইনের’ আহকাম বিষয়ক হাদীছসমূঞ একত্র করিয়াছেন। ইবনে দাকীকুল ঈদ ইহার এক সংক্ষিপ্ত শরাহ করিয়াছেন। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৩। ইবনে শাদ্দাদ হালাবী (মৃঃ ৬৩৬ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘দালায়েলুল আহকাম’।

৪। শায়খুল ইছলাম মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী (মৃঃ ৬৫২ হিঃ)। (ইমাম ইবনে তাইমিয়ার দাদা)। তাঁহার মোছনাদে আহমদের আহকাম সম্পর্কীয় হাদীছসমূহকে একত্র করিয়াছেন। ইহা একটি উত্তম কিতাব। কাজী শাওকানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) ‘নায়লুল আওতার’ (আরবী*******) নামে ইহার এক বিস্তারিত শরাহ করিয়াছেন।

৫। শায়খ মুহেব্ব তাবারী (মৃঃ ৬৯৪ হিঃ)। ‘আহকামে কুবরা’, ‘আহকামে ছুগরা’ ও আহকামে উছতা’ নামে তাঁহার তিনটি কিতাব রহিয়াছে।

৬। ইবনে দাকীকুল ঈদ (মৃঃ ৭০২ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল ইলমাম’ তিনি নিজে ইহার এক শরাহও করিয়াছেন।

৭। ইবনে কাছীর –ইমামদুদ্দীন (মৃঃ ৭৪৪ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘আহকামে ছুগরা’।

৮। শায়খ ইমাদুদ্দীন ইবনে কোদামামহ হাম্বলী (মৃঃ ৭৪৪ হিঃ)। তাঁহার ‘আল মোহাররার’ –(আরবী****) একটি উত্তম কিতাব। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

৯। জায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘তাকরীবুল আছানীদ’ – (আরবী*******)। তাঁহার পুত্র আবু জুরআ (আরবী****) ইরাকী ইহার এক শরাহ করিয়াছেন। ৮ জিলকদে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

১০। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘বুলগুল মারাম’। ইহাতে ১৪০০ শত হাদীছ রহিয়াছে। ইহার বহু শরাহ হইয়াছে। ইছমাঈল ছাগানী লাহোরী কৃত ‘ছবুলুছ ছালাম’ (আরবী*****) ইহার একটি উত্তম শরাহ।

১১। জহীর আহছান শাওক নিমুবী (মৃঃ ১৩২৯ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘এ’লাউছছুনান’- (আরবী********)। মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর আদেশক্রমে ইহাতে তিনি হানাফী মাজহাব সম্পর্কীয় হাদীছসমূহ একত্র করিয়াছেন এবং তাহার বিশদ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ইহা ২০ খণ্ডে সমাপ্ত একটি বিরাট কিতাব। পূর্ণ প্রকাশিত হইয়াছে।

১৩। মাওলানা জাফরুদ্দীন রেজাবী। তাঁহার কিতাবের নাম ‘জামেয়ে রেজাবী’ –(আরবী**************) ইহাতেও কেবল হানাফী মাজহাব বিষয়ক হাদীছসমূঞই একত্র করা হইয়াছে। ইহা দুই জিলদে সমাপ্ত।

১৪। মুফতী ছৈয়দ আমীমূল এহছান (হেড মৌলবী ঢাকা আলিয়অ মাদ্রাসা)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘ফেকহুছছুনানে ওয়াল আছার’ (আরবী*********)। ইহাতেও শুধু হানাফী মাজহাব সম্পর্কীয় হাদীছসমূহের সমাবেশ করা হইয়াছে। সংক্ষিপ্ত হইলেও ইহা একটি উত্তম কিতাব। ইহা এক জিলদে প্রকাশিত হইয়াছে।

 

চতুর্থ যুগের

কতিপয় প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেছ

১। মহীউছছুন্নাহ বাগাবী –আবু মোহাম্মদ হোছাইন ইবনে মাছউদ (মৃঃ ৫১৬ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে। যথা –‘মো’জাম, ‘শরহে ছুন্নাহ’, ‘মাছাবীহুছ ছুন্নাহ (মেশকাত শরীফ ইহারই সংশোধিত আকার), ‘আল জামউ বাইনাছ ছহীহাইন’ (আরবী*****************) প্রভৃতি।

২। রজীন –আবুল হোছাইন ইবনে মুআবিয়া আবদারী ইমামুল হারামাইন (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ)। ইনিই প্রথম ছেহাহ ছেত্তাকে একত্র করিয়াছেন। ‘জামেউল উছুল’ ইহারই সংশোধিত সংস্করণ।

৩। মাজরী –আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে আলী (মৃঃ ৫৩৬ হিঃ)। ‘শরহে মোছলেম’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

৪। ইবনুল আরবী –কাজী আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ মালেকী (৫৫৩ হিঃ)। ‘আহকামুল কোরআন’ ও ‘আরেজাতুল আহওয়াজী’ (শরহে তিরমিজী) তাঁহার দুইটি প্রসিদ্ধ কিতাব।

৫। কাজী ইয়াজ –আবুল ফজল ইবনে আমর ছবতী মালেকী (মৃঃ ৫৪৪ হিঃ)। ছীরাতুননবী সম্পর্কে ‘শাফা’ নামে তাঁহার একটি অতি মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে। ‘মাশারেকুল আনওয়ার’ তাঁহার অপর একটি প্রসিদ্ধ কিতাব। ইহাতে তিনি মোআত্তা ও ছহীহাইনের হাদীছসমূহ একত্র করিয়া উহার শরাহ করিয়াছেন।

৬। ফিরদাউছ দায়লামী হামদানী (মৃঃ ৫৫৮ হিঃ)। ‘মোছনাদে ফিরদাউছ’ তাঁহার একটি মূল কিতাব।

৭। ইবনুল আছাকের –আবুল কাছেম ইবনে হাছান (মৃঃ ৫৭১ হিঃ)। ‘মো’জাম’ তাঁহার একটি মূল কিতাব। এছাড়া ‘আরবাঈন’ ও ‘মোয়াফেকাত’ (আরবী**********) নামে হাদীছে তাঁহার আরো দুইটি কিতাব রহিয়াছে। ‘তারীখে দেমাশক’ তাঁহার ইতিহাসের প্রসিদ্ধ কিতাব।

৮। ইবনে জাওজী –আবুল ফরজ আবদুর রহমান বাগদাদী হাম্বলী (মৃঃ ৫৭৭ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৯। ইবনুল খারাত –আবদুল হক ইশবেলী (মৃঃ ৫৮১ হিঃ)। ‘আল আহকাম’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

১০। ছুহাইলী –আবুল কাছেম আবদুর রহমান মালেকী (মৃঃ ৫৮১ হিঃ)। ‘রাওজুল আনাফ’ শরহে –ছীরাতে ইবনে হিশাম তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

১১। আবদুল গনী মাকদেছী হাম্বলী (মৃঃ ৬০০ হিঃ)। হাদীছে ‘উমদাতুল আহকাম’ (আরবী**********) এবং রেজালে ‘আল কামাল’ তাঁহার দুইটি মূল্যবান কিতাব।

১২। ইবনুল আছীর –মাজদুদ্দীন মোবারক বিন মোহাম্মদ জজরী (মৃঃ ৬০৬ হিঃ)। প্রসিদ্ধ ‘জামেউল উছুল’ তাঁহারই কিতাব। তাঁহার ‘নেহায়া’ হাদীছের অভিধান সম্পর্কে একটি মূল্যবান কিতাব।

১৩। ইবনুল আছীর –উজ্জুদ্দীন আবুল হোছাইন আলী ইবনে মোহাম্মদ জজরী (মৃঃ ৬৩০ হিঃ)। ছাহাবীদের জীবনী সম্পর্কে ‘উছদুল গাবাহ’ (আরবী********) এবং ইতিহাস সম্পর্কে ‘আল কামেল’ তাঁহার দুইটি জগদ্বিখ্যাত কিতাব। (প্রকাশিত)

১৪। ইবনুছ ছালাহ –তকীউদ্দীন ইবনে ওছমান (মৃঃ ৬৪৩ হিঃ)। উছুলে হাদীছ সম্পর্কে তাঁহার ‘আল মোকাদ্দমা’ অতি মূল্যবান কিতাব। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

১৫। মাজদুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে মাহমুদ (মৃঃ ৬৪৩ হিঃ)। ‘আনছাবুল মোহাদ্দেছীন’ তাঁহার রেজালের কিতাব।

১৬। শায়খ হাছান লাহোরী হানাফী (মৃঃ ৬৫০ হিঃ)। ‘মাশারেকুল আনওয়ার’ এবং ‘শরহে বোখারী’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

১৭। শায়খুল ইছলাম ইবনে তাইমিয়াঃ মাজদুদ্দীন আবদুছছালাম হাররানী (মৃঃ ৬৫২ হিঃ)। প্রসিদ্ধ ইমাম তকীউদ্দীন ইবনে তাইমিয়া তাঁহারই পৌত্র। ‘মোন্তাকাল আখবার’ তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

১৮। আল মুনজেরী –আবদুল আজীম ইবনে আবদুল করীম (মৃঃ ৫৬৫ হিঃ)। ‘আততারগীব ওয়াততারহীব’ ও ‘মোকতাছারে আবু দাঊদ’ প্রভৃতি তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

১৯। ইবনে ছাইয়্যেদুননাছ –আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ (মৃঃ ৬৫৯ হিঃ)। (আরবী*******) ‘উয়নুল আছর’ ও ‘শরহে তিরমিজী’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

২০। তূরে পেশতী –শিহাবুদ্দীন ফজলুল্লাহ (মৃঃ ৬৬০ হিঃ)। ‘শরহে মাছাবীহ’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

২১। ইজ্জুদ্দীন ইবনে আবদুছ ছালাম ‘শায়খুল ইসলাম’ (মৃঃ ৬৬০ হিঃ)।

২২। নাওয়াবী –মুহীউদ্দীন আবু জাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফুদ্দীন (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ)। তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে যথা –‘শরহে মোছলেম’, ‘কিতাবুল আজকার’, ‘কিতাবুর রিয়াজ’ প্রভৃতি।

২৩। ইবনে দাকীকুল ঈদ –আবুল ফাতহ তকীউদ্দীন মোহাম্মদ (মৃঃ ৭০২ হিঃ)। ‘শরহে উমদাতুল আহকাম’ প্রভৃতি তাঁহার কিতাব।

২৪। দামইয়াতী আবু মোহাম্মদ (মৃঃ ৭০৭ হিঃ)। ‘মো’জাম’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

২৫। ইমাম ইবনে তাইমিয়া –তকীউদ্দীন ইবনে আবদুল হালীম ইবনে আবদুছ ছালাম হাররানী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ)। ‘মিনহাজুছছুন্নাহ’ প্রভৃতি তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

২৬। কুতবুদ্দীন হালাবী হানাফী (মৃঃ ৭৪০ হিঃ)। ‘শরহে বোখারী’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

২৭। খতীব তাবরিজী –ওলীউদ্দীন আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ (৮ শতকের শেষ)। ‘মেছকাত’ তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

২৮। মেজ্জী –আবুল হাজ্জাজ জামালুদ্দীন ইউছুফ (মৃঃ ৭৪২ হিঃ)। রেজাল শাস্ত্রে ‘তাহজীবুল কামাল’ তাঁহার কিতাব।

২৯। হাফেজ জিয়াউদ্দীন মাকদেছী (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ)। ‘মোয়াফেকাত’ নামে তাঁহার একটি কিতাব রহিয়াছে।

৩০। তীবী –শরফুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে হাছান (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ)। তিনি মেশকাত প্রণেতা খতীব তাবরিজীর উস্তাদ এবং ‘মেশকাতের’ প্রথম ব্যাখ্যাকার।

৩১। ইবনে কুদামাহ –মোহাম্মদ ইবনে আহমদ হাম্বলী (মৃঃ ৭৪৪ হিঃ)। ‘আল মুহাররার’, ‘আল মুগনী’ তাঁহার দুইটি মূল্যবান কিতাব।

৩২। জাহবী –শামছুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। ইনি রেজাল শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম। তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে। রেজালের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘তাযকেরাতুল হোফফাজ’, ‘মীজানুল ইতেদাল’, ‘তাজরীদু আছমাইছ ছাহাবা’ এবং ইতিহাসের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘দুওয়ালুল ইসলাম’ তাঁহারই কিতাব।

৩৩। ইবনুল কাইয়্যেম –শামছুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ (মৃঃ ৭৫১ হিঃ)। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার শাগরিদ। ‘এলামুল মুয়াক্কেয়ীন’ ‘এহকামুল আহকাম’ ‘জাদুল মাআদ’ (আরবী*******) প্রভৃতি তাঁহার মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৩৪। তকীউদ্দীন ছুবকী (মৃঃ ৭৫৬ হিঃ)। ইনি মিছরের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ‘শিফাউছ ছাকাম’ (আরবী******) প্রভৃতি তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৩৫। হাফেজ জামালুদ্দীন জায়লায়ী হামদানী (মৃঃ ৭৬২ হিঃ)। ‘নছবুর রায়াহ’ –(আরবী******) তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৩৬। শায়খ আলাউদ্দীন মোগলতায়ী হানাফী (মৃঃ ৭৬২ হিঃ)। ‘শরহে ইবনে মাজাহ’ প্রভৃতি তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৩৭। আলাউদ্দীন মারদীনী হানাফী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ)। ‘আল জওহারুন নাকী’ (আরবী********) তাঁহার একটি প্রসিদ্ধ কিতাব।

৩৮। কিরমানী –শামছুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে ইউছুফ (মৃঃ ৭৮৬ হিঃ)। তাঁহার বোখারীর শরাহ একটি প্রসিদ্ধ কিতাব (প্রকাশিত)।

৩৯। ইবনে রজব হাম্বলী (আরবী******) –জায়নুদ্দীন (মৃঃ ৭৯৫ হিঃ)। ‘শরহে বোখারী’ ‘শরহে তিরমিজী’ ‘শরহে আরবাঈনে নাওয়াবী’ প্রভৃতি তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৪০। জায়নুদ্দীন ইরাকী –আবদুর রহীম ইবনে ছোলাইমান শাফেয়ী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ)। ‘আলফিয়াহ’, ‘তাখরীজে আহাদীছে এহয়াউল উলুম’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

৪১। নূরুদ্দীন শিরাজী (মৃঃ ৮১৬ হিঃ)। ইনি ছৈয়দ শরীফ জুরজানীর শাগরীদ ছিলেন। তিনি ইরান হইতে হাদীছ লইয়া হিন্দুস্থান আগমন করেন।

৪২। দামীরী –কামালুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে মূছা (মৃঃ ৮০৮ হিঃ)। ‘শরহে ইবনে মাজাহ’ এবং জীববিজ্ঞানের বিখ্যাত কিতাব ‘হায়াতুল হায়ওয়ান’ তাঁহারই কিতাব।

৪৩। নূরুদ্দীন শিরাজী (মৃঃ ৮১৬ হিঃ)। ইনি ছৈয়দ শরীফ জুরজানীর শাগরিদ ছিলেন। তিনি ইরান হইতে হাদীছ লইয়া হিন্দুস্থানে আগমন করেন।

৪৪। ফিরোজাবাদী –মজদুদ্দীন আবু তাহের মোহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব (মৃঃ ৮১৭ হিঃ)। হাদীছে ‘আল আহাদীছুজ জঈফাহ’ এবং ‘লোগাতে কামূছ’ প্রভৃতি তাঁহার বহু বিখ্যাত কিতাব রহিয়াছে।

৪৫। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী –আবুল ফজল শিহাবুদ্দীন শাফেয়ী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)। হাদীছ ও রেজাল শাস্ত্রে তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে। বোখারীর শরাহ ‘ফাতহুল বারী’ (আরবী********) তাঁহার অমর কীর্তি। ‘বুলুগুল মারাম’ ‘তাহজীবুত তাহজীব’, ‘লেছানুল মীজান’, ‘নোখবাতুল ফিকর’ প্রভৃতি তাঁহার হাদীছ ও রেজালের কিতাব।

৪৬। আইনী –হাফেজ বদরুদ্দীন মাহমুদ ইবনে আহমদ হানাফী (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ)। তাঁহার বোখারীর শরাহ ‘উমদাতুল কারী’ (আরবী**********) অতি মূল্যবান কিতাব। এছাড়া ‘মুগনীল আখইয়ার’ প্রভৃতি তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৪৭। তকীউদ্দীন শোমান্নী (আরবী********) আবুল আব্বাছ হানাফী (মৃঃ ৮৭২ হিঃ)।

৪৮। কাছেম ইবনে কুতলুবাগা হানাফী (মৃঃ ৮৭৯ হিঃ)। ‘শরহে মাফাতীহ’, (আরবী*********) ‘শরহে ফাতহুল মুগীছ’ প্রভৃতি তাঁহার অনেক কিতাব রহিয়াছে।

৪৯। ছাখাবী –শামছুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আলী (মৃঃ ৯০২ হিঃ)। ‘আলকওলুল বাদী’, ‘আল মাকাছেদুল হাছানাহ’ প্রভৃতি তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৫০। ছুয়ুতী –জালালুদ্দীন শাফেয়ী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। হাদীছ প্রভৃতি বহু শাস্ত্রে তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে। হাদীছের ‘জামউল জাওয়ামে’ তাঁহারই কিতাব।

৫১। কাস্তালানী –শিহাবুদ্দীন শাফেয়ী (মৃঃ ৯২২ হিঃ)। বোখারীর শরাহ ‘আল ইরশাদুছছারী’ (আরবী*********) এবং ছীরাতের ‘আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়া’ (আরবী*******) তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

৫২। ইবনে হাজার মক্কী –আবুল আব্বাছ আহমদ ইবনে মোহাম্মদ (মৃঃ ৯৫৪ হিঃ)। ‘জাওয়াজির’ (আরবী******) প্রভৃতি তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৫৩। শায়খ আলী মোত্তাকী বোরহানপুরী মক্কী (মৃঃ ৯৭৫ হিঃ)। হাদীছ, কোরআন সম্পর্কে তাঁহার শতাধিক কিতাব রহিয়াছে। হাদীছের বিখ্যাত কিতাব ‘কানজুল উম্মাল’ (আরবী*******) তাঁহারই অমর কীর্তি।

৫৪। শায়খ মোহাম্মদ তাহির পাট্রনী গুজরাটী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। ‘মাজমাউল বেহার’ (আরবী******) নামে হাদীছের অভিধান সম্পর্কে তাঁহার একটি বিরাট ও মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে। এছাড়া ‘মাওজু’ হাদীছ সম্পর্কে ‘আল মাওজুআত’ ও ‘কানূনুল মাওজুআত’ নামে তাঁহার আরো দুইটি কিতাব রহিয়াছে। রেজাল শাস্ত্রে তাঁহার ‘আল মুগনী (আরবী******) একটি সংক্ষিপ্ত ও মূল্যবান কিতাব।

৫৫। মোল্লা আলী কারী –নূরুদ্দীন আলী ইবনে ছূলতান মোহাম্মদ হারাবী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ)। হাদীছে মেশকাত শরীফের শরাহ ‘মেরকাত’ (আরবী******) এবং অন্যান্য বিষয়ে তাঁহার আরো বহু কিতাব রহিয়াছে।

৫৬। ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে ছানী –শায়খ আহমদ সারহিন্দী (মৃঃ ১০৩৫ হিঃ)। ‘আরবাঈন’ নামে হাদীছে তাঁহার একটি কিতাব রহিয়াছে। এছাড়া তাঁহার মিশনের ভিত্তিই ছিল হাদীছের উপর।

৫৭।  মোনাবী –শামছুদ্দীন মোহাম্মদ আবদুর রউফ (মৃঃ ১০৩৫ হিঃ)। ‘আল আতহাফুছ ছানিয়া’ তাঁহার হাদীছের কিতাব।

৫৮। আজীজী –আলী ইবনে আহমদ (মৃঃ ১০৪৩ হিঃ)। ‘আছছিরাজুল মুনীর’ নামে তিনি ছুয়ুতীর ‘জামেয়ে ছগীরের’ এক শরাহ করিয়াছেন।

৫৯। শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১০৫২ হিঃ)। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার এক শতকের মত কিতাব রহিয়াছে। মেশকাত শরীফের শরাহ ‘লুমআত’, ‘আশেয়্যাতুল লুমআন’ (আরবী*******) তাঁঞারই কিতাব। ছীরাতে তাঁহার ‘মাদারেজুন নুবুওত’ ‘শরহে ছিফরুছ ছাআদাত’ (আরবী******) দুইটি প্রসিদ্ধ কিতাব।

৬০। হাফেজ ফোররুখ শাহ ইবনে খাজিনুর রহমাত ইবনে ইমাম রব্বানী (মৃঃ ১০৭০ হিঃ)। ছনদসহ তাঁহার ৭০ হাজার হাদীছ মুখস্থ ছিল।

৬১। শায়খ মোহাম্মদ নুরুল হক ইবনে শায়খ আবদুল হক দেহলবী (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। তিনি ‘তাইছীরুল কারী’ নামে বোখারী শরীফের একটি শরাহ করেন। এছাড়া ভারত ইতিহাস সম্পর্কে তাঁহার একটি মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৬২। শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (মৃঃ ১১২৯ হিঃ)। তিনি বোখারী শরীফ ব্যতীথ ছেহাহ ছেত্তার অপর পাঁচ কিতাব এবং মোছনাদে আহমদের শরাহ করিয়াছে। -ওলামায়ে হিন্দ। কিন্তু মুফতী আমীমুল এহছান ছাহেব মোছনাদে আহমদের স্থলে মোছনাদে আবু হানীফার উল্লেখ করিয়াছেন।

৬৩। শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ)। তিনি ইমাম ও মুজতাহিদ ছিলেন। হাদীছে তাঁহার ‘মোআত্তা-এ-মালেকের’ আরবী শরাহ ‘আল মুছাওয়া’ (আরবী******) ফারছী শরাহ ‘আল মুছাফফা’ (আরবী*****) এবং বোখারী শরীফের “শরহে তারাজেমে আবওয়াবে বোখারী” অতি মূল্যবান কিতাব। এছাড়া তাঁহার জগদ্বিখ্যাত কিতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’-এর শেষাংশও আসলে হাদীছেরই শরাহ।

৬৪। ছৈয়দ মোরতাজা হোছাইন বিলগিরামী জাবীদী (মৃঃ ১২০৫ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার ১৭/১৮টি কিতাব রহিয়াছে। ‘তাজরীদুল-বোখারী’ তাঁহারই কিতাব।

৬৫। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ)। তিনি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও তাঁহার স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। ‘উজালায়ে নাফেয়াহ’, ‘বুস্তানুল মোহাদ্দেছীন’, ‘তা’লীকাতুল মুছাওয়া’ ও ‘আল মাওজুআত’ তাঁহার হাদীছ সম্পর্কীয় কিতাব। মাওলানা আবদুল আহাদ কাছেমী ‘উজালা’র আরবী অনুবাদ করিয়াছেন।

৬৬। কাজী মোহাম্মদ ইবনে আলী শাওকানী ইয়ামানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ)। তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেছ। ‘নায়লুল আওতার’ (আরবী**********) তাঁহার একটি মূল্যবান কিতাব।

৬৭। শায়খ আবেদ সিন্ধী (মৃঃ ১২৫৭ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার ‘শরহে তাইছীরুল উছুল, ‘শরহে বুলুগুল মারাম, ‘হছরুল শারিদ’ (আরবী*********) প্রভৃতি অনেক মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৬৮। শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী (মৃঃ ১২৬২ হিঃ)। তিনি শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর দৌহিত্র ও তাঁহার স্থলাভিষিক্ত ছিলেন।

৬৯। শাহ আবদুল গনী মুজাদ্দেদী দেহলবী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ)। ইবনে মাজাহর শরাহ ‘ইনজাহুল হাজাহ’ (আরবী*******) তাঁহার একটি প্রসিদ্ধ কিতাব। তিনি শাহ ইছহাকের শাগরিদ এবং মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহী ও দেওবন্দ ‘দারুল উলুম’ এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাছেম ছাহেব প্রমৃখ মোহাদ্দেছগণের ওস্তাদ ছিলেন।

৭০। মাওলানা আহমদ আলী মাহারনপুরী (মৃঃ ১২৯৭ হিঃ)। হাদীছে তাঁহার বোখারী শরীফের একটি সুপ্রচলিত শরাহ রহিয়াছে। (বোখারীর হাশিয়ায় প্রকাশিত।)

৭১। নওয়াব ছিদ্দীক হাছান খাঁ (মৃঃ ১৩০৭ হিঃ)। হাদীছ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার বহু কিতাব রহিয়াছে।

৭২। মিঞা ছাহেব –ছৈয়দ নজীর হোছাইন দেহলবী (মৃঃ ১৩২০ হিঃ)। তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেছ ও ওস্তাদ ছিলেন।

৭৩। মাওলানা শামছুল হক ডায়ানবী (মৃঃ ১৩২৯ হিঃ)। তাঁহার ‘গায়াতুল মাকছুদ’ নামে আবু দাঊদ শরীফের একটি উত্তম শরাহ রহিয়াছে।

৭৪। মাওলানা খলীল আহমদ সাহারনপুরী (মৃঃ ১৩২৯ হিঃ)। তাঁহার ‘গায়াতুল মাকছুদ’ নামে আবু দাঊদ শরীফের একটি উত্তম শরাহ রহিয়াছে।

৭৫। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাছান দেওবন্দী (মৃঃ ১৩৩৯ হিঃ মোঃ ১৯২০ ইং)। তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেছ এবং দেওবন্দ মাদ্রাছার শায়খুল হাদীছ ছিলেন।

৭৬। মাওলানা ছৈয়দ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী দেওবন্দী (মৃঃ ১৩৫২ হিঃ)। তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেছ ছিলেন। বোখারী শরীফেল মলঅঞ ‘ফয়জুল বারী’ (আরবী******) এবং তিরমিজী শরীফের শরাহ ‘আল আরফুশশাজী’ (আরবী**********) তাঁহারই তাকরীরের (বক্তৃতার) সমষ্টি। উভয় কিতাব প্রকাশিত হইয়াছে।

৭৭। মাওলানা শিব্বীর আহমদ ওছমানী দেওবন্দী (মৃঃ ১৩৬৯ হিঃ মোঃ ১৯৪৯ ইং)। মোছলেম শরীফের শরাহ ‘ফতহুল মুলহিম’ তাঁহার প্রসিদ্ধ কিতাব।

৭৮। আল্লামা জাহিদুল কাওছারী ইস্তাম্বুলী মিছরী (মৃঃ ১৩৭৪ হিঃ)। তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি মোস্তফা কামাল কর্তৃক ইস্তাম্বুল হইতে নির্বাসিত হন এবং মিছরে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। হাদীছ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

৭৯। মাওলানা ছৈয়দ হোছাইন আহমদ (ফয়জ আবাদী) মদনী (মৃঃ ১৩৭৭ হিঃ)। তিনি দেওবন্দ দারুল উলুমের শায়খুল হাদীছ ছিলেন।

 

চতুর্থ অধ্যায়

হাদীছ জাল ও তার প্রতিকার

রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর ছাহাবীগণ রছূলুল্লাহর নামে হাদীছ জাল করিয়া বর্ণনা করা তো দূরের কথা, তাঁহাদের জানা হাদীছ বর্ণনা করিতেও ভয় করিতেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁহার বান্দাদের মধ্য হইতে যাঁহাদিগকে তাঁহার রছুলের সাহচর্যের জন্য মনোনিত করিয়াছিলেন এবং যাঁহারা আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে নিজেদের যথাসর্বস্ব ত্যাগ করিয়া রছূলের পিছনে রছুলের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন তাঁহারাই রছূলের নামে মিথ্যা হাদিছ গড়িয়া সেই দ্বীনের ভিত্তিমূলকে ধ্বংস করিয়া দিবেন ইহা কল্পনা করাও অসম্ভব।

মোছলেম প্রভৃতি ছহীহ কিতাবে ‘মোতাওয়াতের’ হাদীছ রহিয়াছেঃ “যে ব্যক্তি মিথ্যা আরোপ করিয়াছে সে যেন তাহার স্থান দোজখে প্রস্তুত করিয়া লয়”। ইহাতে ছাহাবীগণ এতই ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, ভুলক্রমে কোথাও মিথ্যা আরোপিত হওয়ার ভয়ে কোন কোন ছাহাবী রছূলুল্লাহর নাম করিয়া সহজে কোন কথাই বলিতে চাহিতেন না। সমস্ত ‘রেজাল’ ও ‘তারীখের’ কিতাব খুঁজিয়া কাহারো পক্ষে এরূপ একটি দৃষ্টান্ত বাহির করা সম্ভবপর হইবে না যাহাতে কোন ছাহাবী রছূলুল্লাহর নামে মিথ্যা কথা রচনা করিয়াছেন বলিয়া উল্লেখ রহিয়াছে। ছাহাবীগণ নিঃসঙ্কোচে একে অন্যের সমালোচনা করিয়াছেন; এমন কি, স্বয়ং খলীফা ও আমীর ওমারাদের সমালোচনা করিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। কিন্তু তাঁহাদের কাহাকেও কখনো একথা বলিয়া কাহারো সমালোচনা করিতে দেখা যায় নাই যে, অমুক ব্যক্তি (ছাহাবী) রছূলুল্লাহর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়াছেন; বরং দীর্ঘজীবী ছাহাবী হজরত আনাছ (যিনি ছাহাবীদের যুগের শেষের দিকে ৯৩ হিজরীতে এন্তেকাল করিয়াছেন) বলেনঃ (আরবী***************************************)

‘আমরা একে অন্যের প্রতি (মিথ্যার) সন্দেহ করিতাম না। অর্থাৎ, আমাদের কেহ এ ব্যাপারে সন্দেহের পাত্র ছিলেন না’। -তাদবীন ৪৩৭ পৃঃ। হজরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) অধিক হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে হজরত আবু হুরাইরা রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদিছ রচনা করিয়াছেন। খলীফা হজরত আবু বকর ও ওমর (রাজিয়াল্লাহু আনহুম) অনেক ছাহাবীর নিকট তাঁহার হাদীছ সম্পর্কে সাক্ষ্য তলব করিয়াছেন, কিন্তু কখনো এ সন্দেহের প্রকাশ করেন নাই যে, বর্ণনাকারী রছূলুল্লাহর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়াছেন। তাঁহাদের সন্দেহের বিষয়বস্তু ছিল তাঁহাকে বর্ণনার সময় পর্যন্ত হুবহু তাহা ইয়াদ মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন কি না এবং বর্ণনার সময় পর্যন্ত হুবহু তাহা ইয়াদ রাখিতে পারিয়াছেন কি না –ইহা প্রমাণ করার জন্যই তাঁহারা অপর ব্যক্তির সাক্ষ্য তলব করিতেন, মিথ্যার সন্দেহে নহে। খলীফা হজরত ওমরের নিকট ফাতেমা বিনতে কায়েছ (রাঃ) যখন এমন একটি হাদীছ বর্ণনা করিলেন যাহা তাঁহার মতে কোরআন ও ছুন্নাহর বিপরীত, তখন তিনি উহা শুধু এই বলিয়াই প্রত্যাখ্যান করিলেন যে-

(আরবী*******************************)

‘আমি এমন একটি মেয়েলোকের কথায় আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবীর ছুন্নাহকে বাদ দিতে পারি না যার সম্পর্কে আমার জানা নাই যে, সে রছুলুল্লাহর কথা ঠিকভাবে স্মরণ রাখিতে পারিয়াছে কি ভুলিয়া গিয়াছে’।

হজরত আবু মূছা আশআরী (যিনি দীর্ঘদিন কুফার শাসনকর্তা ছিলেন এবং যিনি ছিফফীনের যুদ্ধে হজরত আলীর পক্ষে সালিস নিযুক্ত হইয়াছিলেন) একবার হজরত ওমরের বাড়ীতে গেলেন এবং বাড়ীর দরজায় দাঁড়াইয়া তিনবার ছালাম জানাইলেন। অন্দর হইতে প্রবেশের অনুমতিসূচক কোন উত্তর আসিল না, তিনি প্রত্যাবর্তন করিলেন। অতঃপর হজরত ওমর তাঁহাকে ডাকিয়া  পাঠাইলেন এবং প্রত্যাবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে হজরত আবু মূছা বলিলেনঃ ‘রছুলুল্লাহ (ছঃ) বলিয়াছেনঃ (অনুমতির প্রার্থনাসূচক) তিনবার ছালাম জানাইবার পরও যদি প্রবেশের অনুমতি না পাওয়া যায় তা হইলে বাড়ীতে প্রবেশ না করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে’। ইহা শুনিয়া হজরত ওমর তাঁহাকে বলিলেনঃ (আরবী*******************)

‘ইহা যদি আপনি রছুলুল্লাহর নিকট শুনিয়া ঠিকভাবে স্মরণ রাখিয়া থাকেন তবে তো ভালো, নতুবা আমি আপনাকে এমন কঠোর শাস্তি দিব যাহা অন্যের জন্য শিক্ষার বস্তু হয়’। -জামউল ফাওয়ায়েদ ১৪৪ পৃঃ

অতঃপর হজরত আবু মূছা যখন ছাহাবী আবু ছাঈদ খুদরীকে সাক্ষীস্বরূপ উপস্থিত করিলেন তখন হজরত ওমর তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিলেনঃ (আরবী****************************************)

‘আবু মূছা! আমি আপনার প্রতি মিথ্যার সন্দেহ করি নাই। আমি এজন্য ইহা করিয়াছি –যাহাতে অপর (অ-ছাহাবী) লোকের রছুলুল্লাহ (ছঃ)-এর নামে মিথ্যা হাদীছ গড়ার সাহস না করে’। -জামউল ফাওয়ায়েদ ১৪৪ পৃঃ

হজরত ওমরের কার্যের তাৎপর্য এই যে, হাদীছ বর্ণনাকারী যে পর্যন্ত না সম্পূর্ণরূপে নিঃসন্দেহ হয় যে, তিনি যাহা বর্ণনা করিতেছেন তাহা ঠিক রছূলুল্লাহরই হাদীছ, সে পর্যন্ত তাহার পক্ষে উহার সহিত রছূলুল্লাহর নাম ব্যবহার করা জায়েজ নহে। এরূপ করা রছূলুল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করারই শামিল। এ কারণেই দেখা যায়, কোন কোন ছাহাবী হাদীছ জানা সত্ত্বেও উহার বর্ণনার বিরত থাকিতেন। একবার হজরত আবদুল্লাহ তাঁহার পিতা জুবায়রকে (হুজুরের ফুফাত ভাই) বলিলেনঃ ‘আব্বা! আপনি হুজুরের হাদীছ বর্ণনা করেন না কেন?’ উত্তরে হজরত জুবায়র বলিলেনঃ ‘বাবা! আমি যে হুজুরের খেদমতে ছিলাম না বা তাঁহার হাদীছ আমার জানা নাই তাহা নহে। ব্যাপার এই যে, আমি ভয় করি, ভুলে যেন তাঁহার প্রতি মিথ্যা আরোপিত হইয়া না যায়। কেননা, তিনি বলিয়াছেনঃ ‘যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা আরোপ করিয়াছে, সে যেন তাহার স্থান দোজখে তৈয়ার করিয়া লয়’।

হজরত আয়েশা ছিদ্দীকার নিকট যখন বলা হইল যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেনঃ ‘রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ ‘জীবিতদের ক্রন্দনের দরুন মৃত ব্যক্তির আজব হইয়া থাকে’। তিনি (আয়েশা) ইহার কঠোর প্রতিবাদ করিলেন, কিন্তু এই কথা বলিয়া প্রতিবাদ করিলেনঃ (আরবী***********************************)

‘আল্লাহ আবু আবদুর রহমানকে (ইবনে ওমরকে) মাফ করুন। অবশ্য তিনি মিথ্যা বলিতেছেন না। তবে তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন অথবা রছুলুল্লাহর কথা ঠিকভাবে বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। আসল ব্যাপার হইতেছে এই যে, রছুলুল্লাহ (ছঃ) একটি (সদ্য দাফনকৃত) ইহুদী মেয়েলোকের কবরের নিকট দিয়া যাইবার কালে বলিয়াছিলেন যে, মেয়েলোকটি কবরে আজাব ভোগ করিতেছে আর তাহার পরিবারের লোকেরা তাহার জন্য কাঁদিতেছে’। -মেশকাত, বোখারী ও মোছলেম।

এক কথায় রছূলুল্লাহর ছাহাবীদের মধ্যে কেহ কখনো তাঁহার নামে হাদীছ জাল করেন নাই। জানা যায়, রছূলুল্লাহ জীবনে মাত্র এক ব্যক্তিই রছূলুল্লাহর নাম করিয়া একটি মিথ্যা কথা বলিয়াছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর বলেনঃ (আরবী********************************************)

‘এক ব্যক্তি রছূলুল্লাহর লেবাছের ন্যায় লেবাছ পরিয়া মদীনার একটি বাড়ীতে উপস্থিত হয় এবং বলে যে, রছূলুল্লাহ আমাকে বলিয়াছেনঃ ‘তুমি যে বাড়ীতে ইচ্ছা প্রবেশ করিয়া দেখিতে পার’। ইহা শুনিয়া তাহারা বলিলেনঃ ‘আমরা রছূলুল্লাহর চরিত্র অবগত আছি; রছূলু্ল্লাহ (ছঃ) কখনো এরূপ অনাচারের হুকুম দিতে পারেন না’। অতঃপর তাহারা তাহাকে একটা ঘরে আবদ্ধ রাখিয়া রছূলুল্লাহর নিকট সংবাদ দেন। সংবাদ পাইয়া রছূলুল্লাহ (ছঃ) হজরত আবু বকর ও ওমরকে বলিলেনঃ ‘তোমরা তাহার নিকট যাইয়া দেখ; জীবিত পাইলে হত্যা করিবে এবং লাশ আগুন লাগাইয়া পোড়াইয়া দিবে’। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ রছূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁহাদিগকে ইহাও বলিয়াছিলেনঃ ‘তোমরা যাইয়া সম্ভবতঃ তাহাকে জীবিত পাইবে না’। বস্তুতঃ তাহাই হইয়াছিল। তাঁহারা তথায় পৌঁছিবার পূর্বেই সাপের দংশনে সে জাহান্নামবাসী হইয়াছিল। -জামউল ফাওয়ায়েধ ২৭ পৃঃ

রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর আমলেও কোন অ-ছাহাবী পর্যন্ত হাদীছ জাল করার দুঃসাহস করিতে পারে নাই। তাঁহারা এ সম্পর্কে এত কড়া নজর রাখিতেন যে, ছাহাবীদের নিকট পর্যন্ত তাঁহারা সাক্ষ্য তলব করিতেন। হজরত মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) নানীর পক্ষে নাতির মীরাছ লাভের হাদীছ বর্ণনা করিলে হজরত ছিদ্দীক তাঁহার নিকট সাক্ষ্য তলব করেন। এভাবে হজরত আবু মূছা আশআরী অনুমতির জন্য ছালাম সংক্রান্ত হাদীছ বলিলে হজরত ওমর ফারূক তাঁহাকে প্রমাণ উপস্থিত করিবার নির্দেশ দেন। (ইহা পূর্বে বলা হইয়াছে।)

রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নামে হাদীছ জালের অপচেষ্টা প্রথমতঃ আরম্ভ হয় হজরত ওছমান গনীর আমলে ইসলামের পরম শত্রু ইহুদীদের দ্বারাই। ইহুদীরা প্রথমে কোরাইশদের সহিত মিলিত হইয়া ইসলামের মূলোচ্ছেদ করিতে চেষ্টা করে। ইহাতে অকৃতকার্য হইয়া তাহারা হাদীছ জাল করার এ ঘৃণিত পন্থা অবলম্বন করে। ইহার খোলাসা এই যে, দক্ষিণ আরবের ইয়ামানবাসী আবদুল্লাহ ইবনে ছাবা নামক এক শিক্ষিত ধুরন্ধর ইহুদী হজরত ওছমান গনীর নিকট আসিয়া বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে এবং গোপনে ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এক বিরাট ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। সে এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনটি পন্থা অবলম্বন করে। (১) রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করিয়া ইসলামের পবিত্রতা নষ্ট করা। (২) মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করিয়া তাহাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করা এবং (৩) ছাহাবীদের নামে দুর্নাম রটনা করিয়া ইসলামের প্রতি মানুষের আকর্ষণকে বিনষ্ট করা। কেননা, পরবর্তী অ-ছাহাবী লোকদের পক্ষে ইসলাম লাভের একমাত্র মাধ্যম হইতেছেন ছাহাবীগণই; সুতরাং ছাহাবীগণের প্রতি আস্থাহীন করিতে পারিলে কাহারো পক্ষে ইসলামের প্রতি আকর্ষণের কোন সূত্রই থাকিবে না।

আবদুল্লাহ ইবনে ছাবার দৃষ্টিতে ছিল খেলাফতের কেন্দ্র মদীনা হইতে দূরে অবস্থিত মুসলমানদের প্রধান প্রধান সেনানিবাসঃ বছরা, কুফা ও মিছরই ছিল তার কার্যের পক্ষে উপযুক্ত ক্ষেত্র। কারণ, এ সকল স্থান একদিকে যেমন ছিল খলীফার দৃষ্টি হইতে বহু দূরে অবস্থিত, তেমনই সে সকল স্থানের সৈন্যরা ছিল অধিকাংশ অ-ছাহাবী নও-মুসলমান তরুণ –যাহাদের পক্ষে রছূলুল্লাহর সাহচর্য লাভ করিয়া ইসলাম সম্পর্কে পরিপক্ক হওয়ার বা সরাসরিভারে রছূলুল্লাহর নিকট হইতে হাদীছ লাভের কোন সুযোগ ঘটে নাই। এভাবে তাহার দৃষ্টিতে হজরত আলী মোরতাজাই ছিলেন উপযুক্ত পাত্র যাহার নাম করিয়া মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা অত্যন্ত সহজ। কেননা, তিনি হইতেছেন রছূলুল্লাহর নিকট-আত্মীয় এবং হজরত ফাতেমা জাহরার স্বামী। আবদুল্লাহ ইবনে ছাবা তাই মদীনা হইতে বছরা গমন করে এবং বলিতে থাকে যে, হযরত আলী মোরতাজা রছূলুল্লাহ-এর নিকট হইতে কোরআনের এলম ছাড়াও এক বিশেষ এলমপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং তিনি হইতেছেন রছূলুল্লাহর উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ করিয়াছেন এবং ওছমান এ ব্যাপারে তাহাদের অনুসরণ করিতেছেন। এতদ্ব্যতীত সে ইহাও বলিতে যে, আবু বকর, ওমর ও ওছমানের প্রতি হজরত মোরতাজা নারাজ, কিন্তু কোন মছলাহাতে তিনি ইহা প্রকাশ করিতেছেন না। অবশেষে সে ইহাও জানিতে পারেন নাই। আর সে ধুরন্ধরও ইহার গোপনীয়তার জন্য সকলের প্রতিই কড়া নির্দেশ দিয়া রাখিয়াছিলেন। -তোহফায়ে ইছনা আশারিয়া

বছরার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ ইবনে আমের তাহার আচরণে সন্দেহ করিয়া তাহাকে বছরা ত্যাড় করিতে নির্দেশ দেন। বছরা ত্যাগ করিয়া সে মুসলমানদের দ্বিতীয় সেনানিবাস কুফায় প্রবেশ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তরুণ সৈন্যগণকে হাত করিয়া লয়। অতঃপর সে কুফা হইতে বিতাড়িত হইয়া মিছর উপস্থিত হয় এবং মিছরকে কেন্দ্র করিয়া চারিদিকে তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করিতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই সে আশাতীত সফলতা লাভ করে এবং তৃতীয় খলীফা হজরত ওছমান গনীকে শহীদ করাইতে সমর্থ হয়।

অবশেষে হজরত আলী মোরতাজা (রাঃ) তাঁহার খেলাফতকালে আবদুল্লাহর ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হইতে পারিয়া তাহার অনুচরদেরসহ তাহাকে আগুনে পোড়াইয়া মারেন। ইমাম জাহবী বলেনঃ (আরবী**************************************)

‘আমি মনে করি, হজরত আলী (রাঃ) তাহাকে (আবদুল্লাহ ইবনে ছাবাকে) আগুনে পোড়াইয়া মারিয়াছিলেন’। -তাদবীন ৪৪৯ পৃঃ

আর ইহাই হইল হাদীছ জালকারীদের জন্য রছূলুল্লাহ (ছঃ) কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি। [ছাবায়ী ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য ‘তারীখে তাবারী’ এবং শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (রঃ)-এর ‘তোহফায়ে ইছনা আশারিয়া’ দ্রষ্টব্য।]

হজরত আলী মোরতাজা ছাবায়ীদের নির্মূল করিলেন সত্য, কিন্তু তাহারা যে হাদীছ জাল করার কু-আদর্শ স্থাপন করিল তাহার প্রতিকার সহজে সম্ভবপর হইল না। তাহাদের এই জঘন্য আদর্শ অনুসরণ করিয়া উমাইয়াদের আমলে, অতঃপর আব্বাছীয়াদের আমলেও অনেকে হাদীছ জাল করিল। কেহ এইরূপে ইসলামকে ধ্বংস করার মানসে, কেহ তাহার রাজনৈতিক মতলব হাছিলের উদ্দেশ্যে, আর কেহ তাহার ধর্মীয় মতবাদের সাহায্যার্থে, কেহ বা আমীর-ওমারাদের সন্তুষ্টি বিধানের গরজে হাদীছ জাল করিল। এমন কি এক শ্রেণীর অপরিণামদর্শী ছুফীরাও জনসাধারণকে ধর্মের প্রতি অধিক আকৃষ্ট করার খেয়ালে হাদীছ গড়িয়া লইল। ফলে ওছমানী খেলাফতের শেষের দিক হইতে আরম্ভ করিয়া আব্বাছীয়াদের প্রথম ভাগ পর্যন্ত শতাধিক বৎসরে বাজারে বহু জাল হাদীছ চালু হইয়া গেল।

তবে আমাদের মোহাদ্দেছগণের আপ্রাণ চেষ্টা ও তদবীরের ফলে শেষ পর্যন্ত এ অপচেষ্টা বন্ধ হইয়া যায় এবং সমস্ত আসল ও জাল হাদীছ আলো-অন্ধকারের ন্যায় সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া পড়ে। আজ দুনিয়ায় এমন কোন হাদীছ নাই যার সম্পর্কে বলা যায় না যে, উহা আসল কি নকল, ছহীহ কি গায়র ছহীহ। মোহাদ্দেছগণ আমাদের হাতে আসল-নকল পৃথক করার এমন এক কষ্টিপাথর দিয়া গিয়াছেন যদ্দ্বারা আমরা যখন ইচ্ছা কোন হাদীছকে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারি।

জাল প্রতিরোধের ব্যবস্থাঃ

হাদীছ জাল প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, যথা- (১) জালকারীকে শাস্তি দেওয়া, (২) বর্ণনাকারীর নিকট সাক্ষ্য তলব করা, (৩) বর্ণনাকারীর নিকট হইতে হলফ গ্রহণ করা, (৪) হাদীছের ছনদ বর্ণণা করিতে বাধ্য করা এবং (৫) ছনদ পরীক্ষা করা। নীচে ইহার প্রত্যেকটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা গেল।

(১) শাস্তিদানঃ

হাদীছ জাল প্রতিরোধের প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে জালকারীর প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরের পূর্বোক্ত বর্ণনা হইতে বোঝা যায়, এ ব্যবস্থা স্বয়ং রছূলুল্লাহ (ছঃ)-ই প্রবর্তন করিয়াছিলেন। হজরত আলী মোরতাজা কর্তৃক ছাবায়ীদের আগুনে পোড়াইয়া মারাও এ কথারই সাক্ষ্য দেয়। এভাবে খেলাফতে রাশেদার পরও যখনই কোন ব্যক্তি সম্পর্কে হাদীছ জালের কথা প্রমাণিত হইয়াছে তখনই তাহার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। হারেস ইবনে ছাঈদ কাজ্জাবকে খলীফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান এবং গায়লান দেমাশকীকে খলীফা হিশাম ইবনে আবদুল মালেক এ অপরাধেই কতল করিয়াছিলেন। অতঃপর খলীফা মানছূর আব্বাছী রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নামে মিথ্যা আরোপকারী মোহাম্মদ ইবনে ছাঈদ মাছলুবকে এজন্যই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়াছিলেন। এভাবে বনি উমাইয়াদের গভর্ণর খালেদ ইবনে আবদুল্লাহ কাছরী মিথ্যা হাদীছ রচনাকারী বয়ান ইবনে জুরাইককে এবং বছরার আব্বাছীয় গভর্ণর মোহাম্মদ ইবনে ছোলাইমান কুখ্যাত হাদীছ জালকারী আবদুল করীম আবিল আওজাকে প্রণদণ্ডে দণ্ডিত করিয়াছিলেন।

(২) সাক্ষ্য তলবঃ

রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছকে ভেজালমুক্ত রাখার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে হজরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) বর্ণনাকারীর নিকট হইতে সাক্ষ্য তলব করার নিয়ম প্রবর্তন করেন। নানীর পক্ষে নাতির মীরাছ লাভ সংক্রান্ত হাদীছে তিনি হজরত মুগীরা ইবনে শো’বার নিকট সাক্ষ্য তলব করিয়াছিলেন।

অতঃপর হজরত ওমর ফারূকও ইহারই অনুসরণ করেন। ছালাম সম্পর্কীয় হাদীছে তাঁহার হজরত আবু মূছা আশআরীকে প্রমাণ উপস্থিত করিতে বলা ইহার প্রমাণ।

(৩) হলফ গ্রহণঃ

ছাবায়ীদের হাদীছ জালের অবস্থা দেখিয়া হজরত আলী মোরতাজা (রাঃ) প্রমাণ অভাবে বর্ণনাকারীর নিকট হইতে হলফ গ্রহণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। অবশ্য এ ব্যবস্থা পরবর্তী যুগে আর চালু ছিল না। কারণ, যে ব্যক্তি রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নামে মিথ্যা কথা বলিতে পারে তাহার পক্ষে মিথ্যা হলফ করা দুঃসাধ্যের ব্যাপার কিছুই ছিল না।

(৪) ছনদ বর্ণনাঃ

হজরত আলী মোরতাজা (রাঃ) একদিকে যেমন হাদীছ বর্ণনাকারীর নিকট হইতে হলফ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করেন অপরদিকে তিনি (অ-ছাহাবীদের) ছনদ ব্যতিরেকে হাদীছ বর্ণনা করিতেও নিষেধ করেন। ‘শরহে মাওয়াহিবে’ রহিয়াছেঃ (আরবী***********************)

‘হজরত আলী (রাঃ) হাদীছ শিক্ষার্থীগণকে ছনদ ব্যতীত হাদছি না লিখিতে নির্দেশ দিয়াছেন’। -তারীখুল হাদীছ ৯৩ পৃঃ

অতঃপর জনসাধারণ ছনদ ব্যতীত হাদীছ গ্রহণ করিতে দ্বিধাবোধ করিতে থাকে, ফলে বলা ও লেখা উভয় ক্ষেত্রেই ছনদ বর্ণনা হাদীছের এক জরুরী অংগ হইয়া পড়ে এবং আলেমগণ ইহাকে দ্বীনের অংগ বলিয়াই অভিহিত করেন। যাবৎ না পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত হাদীছ কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায় তাবৎ তাঁহারা ছনদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

এখানে বোধ হয় একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে, আমাদের আলেমগণ শুধু যে হাদীছের ব্যাপারেই ছনদ বর্ণনার কড়াকড়ি ব্যবস্থা করিয়াছেন তাহা নহে; বরং অভ্যস্ত হইয়া পড়ার দরুন সাধারণ ইতিহাসেও তাঁহারা পূর্ণ ছনদ বর্ণনা করিয়াছেন যার নজীর দুনিয়ার কোন জাতিই পেশ করিতে সক্ষম নহে। ইমাম ইবনে হাজম সত্যই বলিয়াছেনঃ ‘ছনদ আল্লাহর একটি বিশেষ দান যাহা তিনি শুধু এই জাতিকেই দান করিয়াছেন’।

(৫) ছনদ পরীক্ষা

এ কথা সত্য যে, ছনদ প্রবর্তন দ্বারা বেপরোয়াভাবে হাদীছ জাল করার পথ অনেকটা রুদ্ধ হইয়া যায়; কিন্তু উহা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হইয়া যায় নাই। কারণ, যাহারা হাদীছ জাল করিতে পারে তাহাদের পক্ষে ছনদ জাল করা অসাধ্যের ব্যাপার কিছুই নহে। অতএব, এ পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার এবং জাল ও আসল হাদীছকে পৃথক করার জন্য আমাদের মনীষীবৃন্দ ছনদের ‘জারহ ও তা’দীল’ বা রাবীদের দোষ-গুণ বিচারের ব্যবস্থা প্রতর্বন করেন এবং এ উদ্দেশ্যে ‘আছমাউর রেজাল’ নামে লক্ষ লক্ষ রাবীদের জীবনী সংগ্রহের এন্তেজাম করেন। ইহাতে তাঁহারা ছনদের প্রতিটি ব্যক্তি বা রাবীর পূর্ণ জীবনী সংগ্রহের এন্তেজাম করেন। ইহাতে তাঁহারা ছনদের প্রতিটি ব্যক্তি বা রাবীর পূর্ণ জীবনী অর্থাৎ, তিনি কবে, কোথায়, কোন বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন? কবে, কোথায়, কত বয়সে এন্তেকাল করিয়াছেন? তাঁহার নাম, লকব –[লকব –স্থান, বংশ বা বৃত্তি প্রভৃতিগত নাম; যথা –মদনী, কোরাইশী, হালওয়ায়ী। কুনিয়াত –‘অমুকের পিতা’ বা ‘অমুকের পুত্র’রূপ নাম। যথা আবু হানীফা (হানীফার পিতা), ইবনে হাম্বল (হাম্বলের পুত্র)।] বা কুনিয়াত কি ছিল এবং কাহাকে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছিলেন, তাঁহার আদালত ও জবত কেমন ছিল ইত্যাদি আলোচনা করেন।

এক কথায় রাবীর জীবনের এমন কোন ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর দিকও নাই, যে সম্পর্কে আমাদের মনীষীবৃন্দ অনুসন্ধান করেন নাই বা তাহারা দোষ-গুণ জাহির করিয়া দেন নাই। ইহার ফলে একদিকে যেমন এক একটি জাল হাদীছ পৃথক হইয়া পড়ে অপরদিকে জাল করার নূতন চেষ্টাও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হইয়া যায়। কারণ, ইহাতে দুষ্কৃতকারীদের হাতে-নাতে ধরা পড়ার এবং চরমভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার আশংকা বর্তমান।

জারহ ও তা’দীলকারী কতিপয় প্রসিদ্ধ ইমাম

ছাহাবীদের মধ্যেঃ

১। হজরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) (মৃঃ ১৩ হিঃ)

২। হজরত ওমর ফারূক (রাঃ) (মৃঃ ২৩ হিঃ)

৩। হজরত ওছমান গনী (রাঃ) (মৃঃ ৩৫ হিঃ)

৪। হজরত আলী মোরতাজা (রাঃ) (মৃঃ ৪০ হিঃ)

৫। হজরত আয়েশা (রাঃ) (মৃঃ ৫৭ হিঃ)

৬। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) (মৃঃ ৬৮ হিঃ)

[ছাহাবীগণের জারহ ও তা’দীল করার স্বরূপ বোঝার জন্য দেরায়থগত পরীক্ষার ভূমিকা দেখুন।]

তাবেয়ীনদের মধ্যেঃ

১। হজরত ছাঈদ ইবনে মুছাইয়াব (মৃঃ ৯৫ হিঃ)

২। হজরত আ’মাশ (মৃঃ ১৪৮ হিঃ)

৩। হজরত ইমাম আবু হানীফা (মৃঃ ১৫০ হিঃ)

তাঁহারা রাবীদের ‘জারহ-তা’দীল করিয়াছিলেন। অথচ ঐ যুগে জঈফ রাবীর সংখ্যা খুব কমই ছিল।

তাবে’-তাবেয়ীনদের মধ্যেঃ

১। হজরত মা’মার ইবনে রাশেদ (মৃঃ ১৫৩ হিঃ)

২। হিশাম দস্তওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ)

৩। ইমাম আওজায়ী (মৃঃ ১৫৬ হিঃ)

৪। ইমাম শো’বা ইবনে হাজ্জাজ (মৃঃ ১৬০ হিঃ)

[ইনিই সর্বপ্রথম ‘জারহ ও তা’দীল’ সম্পর্কে নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করেন]

৫। ইমাম ছুফইয়অন ছওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ)

৬। হজরত হাম্মাদ ইবনে ছালামাহ (মৃঃ ১৬৭ হিঃ)

৭। ইমাম লাইছ ইবনে ছা’দ (মৃঃ ১৭৫ হিঃ)

৮।ইমাম মালেক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)

৯।ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (মৃঃ ১৮১ হিঃ)

১০। আবু ইছহাক ফাজারী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ)

১১। মোহাম্মদ ইবনে ইমরান (মৃঃ ১৮৫ হিঃ)

১২। বিশর ইবনে মোফাজ্জল (মৃঃ ১৮৬ হিঃ)

১৩। হুশাইম ইবনে বশীর (মৃঃ ১৮৮ হিঃ)

১৪।ইবনে উলাইয়াহ (আরবী******) (মৃঃ ১৯৩ হিঃ)

১৫। ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)

১৬।ইমাম ওয়াকী ইবনে জাররাহ (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)

১৭। ইমাম ছুফইয়ান ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ ১৯৮ হিঃ)

এই তাবে’-তাবেয়ীনদের শেষ যুগেই এ সম্পর্কে নিয়মিতভাবে কিতাব লেখা আরম্ভ হয় এবং ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ছাঈদ কাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) প্রথম এ বিষঙেয় কিতাব লেখেন। তাঁহার অনুসরণ করেন আবদুর রহমান ইবনে মাহদী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ), মোহাম্মদ ইবনে ছা’দ কাতেবে ওয়াকেদী (মৃঃ ২৩০ হিঃ), ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (মৃঃ ২৩৩ হিঃ),আলী ইবনে মাদানী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ)। ইঁহারাই হইলেন এ বিষয়ের ইমাম ও অগ্রণী। অতঃপর যাঁহারা লিখিয়াছেন তাঁহারা ইঁহাদের উপরই অধিকতর নির্ভর করিয়াছেন।

ইঁহারা ছাড়া এ যুগে বা পরবর্তী যুগে যাঁহারা রাবীদের ‘জারহ-তা’দীল’ করিয়াছেন। নীচে তাঁহাদের কতিপয় মশহুর ব্যক্তির নাম দেওয়া গেলঃ

১। আবু দাঊদ তায়ালছী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)

২। ইয়াজীদ ইবনে হারূন (মৃঃ ২০৬ হিঃ)

৩। আবদুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাম (মৃঃ ২১১ হিঃ)

৪। আবু আছিম জাহহাক (মৃঃ ২১২ হিঃ)

৫।ইবনুল মাজুশুন (মৃঃ ২০৩ হিঃ)

৬। আবু খাইছামা জুহাইর ইবনে হরব (মৃঃ ২৩৪ হিঃ)

৭। আবু জা’ফর আবদুল্লাহ নবীল (জোরজাহ)

৮। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নুমাইর (মৃঃ ২৩৪ হিঃ)

৯। আবু বকর ইবনে আবি শাইবাহ (মৃঃ ২৩৫ হিঃ)

১০। আবদুল্লাহ ইবনে আমর কাওয়ারীরী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ)

১১। ইমাম ইছহাক (মৃঃ ২৩৭ হিঃ)

১২। হাফেজ আবু জা’ফর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আম্মার মুছেলী (মৃঃ ২৪২ হিঃ)

১৩। আহমদ ইবনে ছালেহ (মৃঃ ২৪৮ হিঃ)

১৪। হারূন ইবনে আবদুল্লাহ হাম্মাল (মৃঃ ২৪৩ হিঃ)

১৫। ইছহাক কুছাজ (মৃঃ ২৫১ হিঃ)

১৬। ইমাম দারেমী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ)

১৭। ইমাম বোখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ)

১৮। ইমাম মোছলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ)

১৯। আজালী (ইজলীর) (মৃঃ ২৬১ হিঃ)

২০। ইমাম আবু জুরআ রাজী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ)

২১। ইমাম আবু দাঊদ (মৃঃ ২৭৫ হিঃ)

২২। বাকী ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)

২৩। আবু হাতেম রাজী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ)

২৪। আবু জুরআ দেমাশকী (মৃঃ ২৮১ হিঃ)

২৫। আবদুর রহমান ইবনে ইউছুফ বাগদাদী (মৃঃ ২৮৩ হিঃ)

২৬। ইব্রাহীম ইবনে ইছহাক (মৃঃ ২৮৫ হিঃ)

২৭। মোহাম্মদ ইবনে আওজায়ী হাফেজে কর্ডোভা (মৃঃ ২৮৯ হিঃ)

২৮। আবু বকর ইবনে আবু আছেম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ)

২৯। আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ (মৃঃ ২৯০ হিঃ)

৩০। ছালেহ জুরজাহ (মৃঃ ২৯৩ হিঃ)

৩১। আবু বকর বাজ্জার (মৃঃ ২৯২ হিঃ)

৩২। মোহাম্মদ নাছর মারওয়া (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)

৩৩। মোহাম্মদ ইবনে ওছমান ইবনে আবু শাইবাহ (মৃঃ ২৯৭ হিঃ)

৩৪। আবু বকর ফারইয়াবী

৩৫। ইমাম নাছায়ী (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)

৩৬। ছাজী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)

৩৭। আবু ইয়া’লা মুছেলী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)

৩৮। আবুল হাছান ছুফইয়ান

৩৯। ইবনে খোজাইমা (মৃঃ ৩১১ হিঃ)

৪০। ইবনে জারীর তাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ)

৪১। আবু জা’ফর তাহাবী (মৃঃ ৩২১ হিঃ)

৪২। আবুল বাশার দুওলাবী (মৃঃ ৩১১ হিঃ)

৪৩। আবু আরূবা হাররানী (মৃঃ ৩১৮ হিঃ)

৪৪। আবুল হাছান আহমদ ইবনে ওমাইর

৪৫। আবু জা’ফর ওকাইলী (মৃঃ ৩২২ হিঃ)

৪৬।ইবনে আবু হাতেম রাজী (মৃঃ ৩২৭ হিঃ)

৪৭। আহমদ ইবনে নাছার বাগদাদী (মৃঃ ৩২৩ হিঃ)

৪৮। আবু হাতিম ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)

৪৯। তবরানী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)

৫০। আবদুল্লাহ ইবনে আদী জুরজানী (মৃঃ ৩৬৫ হিঃ)

৫১। আবু আলী হুছাইন ইবনে মোহাম্মদ নিশাপুরী (মৃঃ ৩৬৫ হিঃ)

৫২। আবুশ শায়খ ইবনে হাইয়ান (মৃঃ ৩৬৯ হিঃ)

৫৩। আবু বকর ইছমাঈলী (মৃঃ ৩৭১ হিঃ)

৫৪। আল হাকেম আবু আহমদ (মৃঃ ৩৭৮ হিঃ)

৫৫। ইমাম দারা কুতনী (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)

৫৬। ইবনে শাহীন (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)

৫৭। ইবনে মন্দাহ –আবু আবদুল্লাহ (মৃঃ ৩৯৫ হিঃ)

৫৮। হাকেম আবু আবদুল্লাহ (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)

৫৯। আবু নছর কালাবাজী (মৃঃ ৩৯৮ হিঃ)

৬০। আবদুর রহমান ইবনে ফাতীছ (আরবী****) (মৃঃ ৪০২ হিঃ)

৬১। আবদুল গনী ইবনে ছাঈদ (মৃঃ ৪০৯ হিঃ)

৬২। আবু বকর ইবনে মারদুইয়াহ (মৃঃ ৪১৬ হিঃ)

৬৩। মোহাম্মদ ইবনে আবুল ফাওয়ারেছ বাগদাদী (মৃঃ ৪১২ হিঃ)

৬৪। আবু বকর বেরকানী (মৃঃ ৪২৫ হিঃ)

৬৫। আবু হাকিম আবদারী

৬৬। খালাফ ইবনে মোহাম্মদ ওয়াছেতী (মৃঃ ৪০১ হিঃ)

৬৭। আবু মাছউদ দেমাশকী (মৃঃ ৪০০ হিঃ)

৬৮। আবুল ফজল ফালাকী (মৃঃ ৪৩৮ হিঃ)

৬৯। হাছান ইবনে মোহাম্মদ খালাল বাগদাদী (মৃঃ ৪৩৯ হিঃ)

৭০। আবু ইয়া’লা খলীলী (মৃঃ ৪৪৬ হিঃ)

৭১। ইমাম ইবনে আবদুল বার (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)

৭২। ইবনে হাজম জাহিরী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ)

৭৩। ইমাম বায়হাকী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ)

৭৪। খতীব বাগদাদী আবু বকর (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)

৭৫। ইবনে মা’কুলা (মৃঃ ৪৭৫ হিঃ)

৭৬। আবুল ওয়ালীদ বা’জী (মৃঃ ৪৭৪ হিঃ)

৭৭। আবু আবদুল্লাহ  হোমাইদী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ)

৭৮। জুহলী (মৃঃ ৫০৭ হিঃ)

৭৯। আবুল ফজল ইবনে তাহের মাকদেছী (মৃঃ ৫০৭ হিঃ)

৮০। মু’তামিন ইবনে আহমদ (মৃঃ ৫০৭ হিঃ)

৮১। শিরুইয়াহ দায়লামী (মৃঃ ৫২২ হিঃ)

৮২। ছামআনী (মৃঃ ৫৬২ হিঃ)

৮৩। আবু মূছা মাদীনী (মৃঃ ৫৮১ হিঃ)

৮৪। আবুল ফারজ ইবনে জাওজী (মৃঃ ৫৭৭ হিঃ)

৮৫। ইবনে আছাকের আবুল কাছিম (মৃঃ ৫৭১ হিঃ)

৮৬। ইবনে বাশকুয়াল (মৃঃ ৫৭৮ হিঃ)

৮৭। আবু বকর হাজিমী (মৃঃ ৫৮৪ হিঃ)

৮৮। আবদুল গনী মাকদেছী (মৃঃ ৬০০ হিঃ)

৮৯। রোহাবী (আরবী******)

৯০। ইবনুল মোফাজ্জাল মাকদেছী (মৃঃ ৬১৬ হিঃ)

৯১। আবুল হাছান –ইবনে কাত্তান (মৃঃ ৬৩৮ হিঃ)

৯২। ইবনুল আনমাতী (মৃঃ ৬১৯ হিঃ)

৯৩। ইবনে লোকতাহ (মৃঃ ৬২৯ হিঃ)

৯৪। হাফেজ ইবনুছ ছালাহ (মৃঃ ৬৪৩ হিঃ)

৯৫। আবদুল আজীম মুনজেরী (মৃঃ ৫৬৫ হিঃ)

৯৬। আবু আবদুল্লাহ বারজালী (মৃঃ ৬৩৬ হিঃ)

৯৭। ইবনুল আবার

৯৮। আবু শামাহ (মৃঃ ৬২৫ হিঃ)

৯৯। ইবনে দুবাইছী (মৃঃ ৬৩৭ হিঃ)

১০০। ইবনে নাজজার (মৃঃ ৬৪৩ হিঃ)

১০১। ইবনে দাকীকুল ঈদ (মৃঃ ৭০২ হিঃ)

১০২। শারফো মাদুমী

১০৩। দেমইয়াতী –আবু মোহাম্মদ (মৃঃ ৭০৭ হিঃ)

১০৪। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (মৃঃ ৭২৮ হিঃ)

১০৫। মেজজী –আবুল হাজ্জাজ (মৃঃ ৭৪২ হিঃ)

১০৬। ইবনে ছাইয়েদুন-নাছ (মৃঃ ৭৫৯ হিঃ)

১০৭। আবু আবদুল্লাহ ইবনে আইবক

১০৮। ইমাম জাহবী –শামছুদ্দীন (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)

১০৯। শিহাব ইবনে ফজলুল্লাহ (মৃঃ ৭৪৯ হিঃ)

১১০। আলাউদ্দীন মোগলতায়ী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ)

১১১। আলাউদ্দীন তুরকেমানী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ)

১১২। শারীফুল হোছানী দেমাশকী

১১৩। জায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ)

১১৪। ওলীউদ্দীন ইরাকী

১১৫। নূরুদ্দীন হায়ছামী (মৃঃ ৮০৭ হিঃ)

১১৬। বুরহানুদ্দীন হালাবী (মৃঃ ১৩ হিঃ)

১১৭। ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)

১১৮। বদরুদ্দীন আইনী (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ)

১১৯। ইবনে কুতলুবাগা (মৃঃ ৮৭৯ হিঃ)

১২০। ইমাম ছাখাবী (মৃঃ ৯০২ হিঃ)

-মিফতাহ-১৪৭ পৃঃ

জারহ-তা’দীল সম্পর্কীয় কিতাব

‘জারহ-তা’দীল’ বা ‘আছমাউর রেজাল’ সম্পর্কীয় কিতাব বিভিন্ন প্রকারের। সাধারণ কিতাবঃ যাহাতে ছাহাবী অ-ছাহাবী, ছেকাহ ও জঈফ সকল শ্রেণীর রাবীর সকল দিক আলোচনা করা হইয়াছে। বিশেষ কিতাবঃ যাহাতে শুধু এক শ্রেণীর রাবীর যথা –ছাহাবী, ছেকাহ, জঈফ বা জালকারীদের জীবনী আলোচনা করা হইয়াছে অথবা রাবীদের জীবনের কোন একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে; যথা –রাবীদের শুধু জন্ম-মৃত্যুর তারিখ। কোন কোন কিতাবে কেবল রাবীদের জন্ম-মৃত্যুর তারিখেরই বিশেষ অনুসন্ধান করা হইয়াছে। অথবা কোন কোন কিতাবে শুধু রাবীদের নাম, লকব ও কুনিয়াতেরই বিশেষভাবে তাহকীক করা হইয়াছে। এছাড়া কোন কোন কিতাবে কেবল কোন কোন বিশেষ কিতাবের জারহ-তা’দীল করা হইয়াছে।

সাধারণ কিতাবঃ

১। আততাবাকাতুল কুবরা –মোহাম্মদ ইবনে ছা’দ (মৃঃ ২৩০ হিঃ)। ইহা ‘তাবাকাতে ইবনে ছা’দ’ নামে প্রসিদ্ধ। ইহা এ বিষয়ের সর্ববৃহৎ এবং সর্বপ্রথম কিতাব। ইহা হালে প্রকাশিত হইয়াছে। জালালুদ্দীন ছুয়ুতী ‘ইনজাজুল ওয়াদেল মোন্তাকা’ নামক কিতাবে ইহার সংক্ষেপ করিয়াছেন।

২। কিতাবুত তাবাকাত –আলী ইবুনল মাদানী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ)

৩। কিতাবুত তাবাকাত –খলীফা ‘ইবনে খাইয়াত’ (মৃঃ ২৪০ হিঃ)

৪। তারীখে কবীর –ইমাম বোখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ)। ইহা বর্ণনাক্রমিক কিতাব। মোছলেম ইবনে কাছেম ইহার এক পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন। এছাড়া ‘তারীখে আওছাত’ এবং ‘তারীখে ছগীর’ নামে ইমাম বোখারীর আরো দুইটি কিতাব রহিয়াছে। ‘আওছাত’ সন অনুপাতে লেখা হইয়াছে। ইবনে আবু হাতিম (মৃঃ ৩২৭ হিঃ) এগুলিক আলোচনা করিয়া এক বিরাট কিতাব লিখিয়াছেন।

৫। রুয়াতুল ই’তেবার –ইমাম মোছলেম (মৃঃ ২৬১ হিঃ)। ইহা একটি উত্তম কিতাব।

৬। কিতাবুত তারীখ –ইবনে আবু খাইছমাহ (মৃঃ ২৭৯ হিঃ)। ইহা একটি উত্তম কিতাব।

৭। কিতাবুত তারীখ –ইবনে খুররম হুছাইন ইবনে ইদরীছ (মৃঃ ৩০১ হিঃ)। ইহা বোখারীর ‘তারীখে কবীরের’ ন্যায় বর্ণনাক্রমিক কিতাব।

৮। আততাময়ীজ –ইমাম নাছায়ী (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)

৯। কিতাবুল জারহ ওয়াততা’দীল (আরবী*********)-ইবনুল জারূদ (মৃঃ ৩০৭ হিঃ)।

১০। কিতাবুল জারহ ওয়াততা’দীল –ইবনে আবু হাতিম রাজী (মৃঃ ৩২৭ হিঃ)।

১১। কিতাবুল আওহাম ওয়াল ঈহাম –ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)। ইহা ১০ খণ্ডে সমাপ্ত।

১২। আল ইরশাদ –আবু ইয়া’লা খলীলী (মৃঃ ৪৪৬ হিঃ)।

১৩। মীজানুল ই’তেদাল –ইমাম জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। ইহা একটি মূল্যবান ও প্রসিদ্ধ কিতাব। এছাড়া এ বিষয়ে তাঁহার একটি তারীখও রহিয়াছে।

১৪। আততাকমীল (আরবী*****************) –ইমাদুদ্দীন ইছমাঈল ইবনে কাছীর (মৃঃ ৭৭৪ হিঃ)। ইহাতে তিনি মেজজীর ‘তাহজীব’ ও জাহবীর ‘মীজানের’ সহিত আরো কিছু তথ্যের সমাবেশ করিয়াছেন। ইহা এ বিষয়ের একটি উত্তম কিতাব।

১৫। আততাকমেলাহ (আরবী************) –ঐ।

১৬। তাবাকাতুল মোহাদ্দেছীন –ইবনে মুলাক্কেন –ওমর ইবনে আলী (মৃঃ ৮০৪ হিঃ)। এছাড়া তাঁহার ‘আল কামাল’ নামেও একটি কিতাব রহিয়াছে।

১৭। তাহজীবুল কালাম –ইমাম মেজজী (মৃঃ ৭৪২ হিঃ)। ইহাতে তিনি আবদুল গনী মাকদেছীর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল-কামাল’কে উত্তমরূপে সাজাইয়াছেন।

১৮। আল মুগনী –শায়খ মোহাম্মদ তাহের পাট্টনী সিন্ধী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। ইহা রাবীগণের নামের ‘জবত’ [জের জবরের উল্লেখ করিয়া নামের পঠনকে নির্ভুল করা] বিষয়ক একটি উত্তম কিতাব বলিয়া শায়খ দেহলবী মত প্রকাশ করিয়াছেন। -আখবারুল আখইয়ার

 

ছাহাবীগণের জীবনী সম্পর্কীয় কিতাব

ছাহাবীগণের জীবনী অর্থ তাঁহাদের মধ্যে কে হাদীছ সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য এবং কে বিশ্বাসযোগ্য নহেন ইহার অনুসন্ধান করা নহে। কারণ, ছাহাবীগণ সকলেই যে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন –তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাঁহাদের জীবনী আলোচনার অর্থ এই যে, তাঁহাদের কে, কবে, কোথায় মুসলমান হইয়াছেন এবং কতদিন রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সাহচর্য (ছোহবত) লাভ করিয়াছেন, অতঃপর কবে, কোথায় এন্তেকাল করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট কে কোথায় হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন প্রভৃতি জানা। এ সকল কথা জানা না থাকিলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, তিনি ছাহাবী ছিলেন কি তাবেয়ী এবং তাঁহার নিকট যে বা যাহারা হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন বলিয়া দাবী করিতেছেন তাহার বা তাহাদের সে দাবী সত্য কি না। এসব কারণে অনেকেই ছাহাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেন। যথা-

১। ইমাম বোখারী -(মৃঃ ২৫৬ হিঃ)। তিনি এ ব্যাপারে সকলের অগ্রণী।

২। হাফেজ বাগাবী –আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল আজীজ (মৃঃ ৩৩৩ হিঃ)।

৩। হাফেজ আবু বকর আবদুল্লাহ ইবনে আবু দাঊদ (মৃঃ ৩১৬ হিঃ)।

৪। ইবনুছ ছাকান –আবু আলী ছাঈদ ইবনে ওছমান বছরী (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ)।

৫। ইবনুছ ছাকান –আবু হাতেম মোহাম্মদ ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)

৬। তবরানী –আবুল কাছেম ছোলাইমান ইবনে আহমদ (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)।

৭। ইবনে শাহীন –ওমর ইবনে আহমদ আবু বকর (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)।

৮। আবু মানছুর বাওয়ারদী-

৯। ইবনে মান্দাহ –আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ৩৯৫ হিঃ)। আবু মূছা মাদীনী তাহার কিতাবের পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন।

১০। হাফেজ আবু নোয়াইম –আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)।

১১। ইবনে আবদুল বার –আবু ওমর ইউছুফ কোরতবী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল ইসতিয়াব’ (আরবী)। ইবনে ফাতহুন প্রমুখ ইহার পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন।

১২। ইবনুল আছীর –ইজ্জুদ্দীন আবুল হোছাইন আলী ইবনে মোহাম্মদ জজরী (মৃঃ ৬৩০ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘উছদুল গাবাহ’। ইহা একটি বিরাট কিতাব। কিন্তু ইহাতে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রহিয়াছে।

১৩। ইমাম জাহবী –শামছুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। ‘তাজরীদু আছমাইছ ছাহাবাহ’ (আরবী***********) তাঁহার কিতাবের নাম। ইহাতে ‘উছদুল গাবাহ’র ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করা হইয়াছে।

১৪। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল এছাবা’ (আরবী**********)। ইহাই এ বিষয়ের সর্বাপেক্ষা ব্যাপক কিতাব। ইসতিয়াব’ ও ‘উছদুল গাবায়’ যে সকল নাম বাদ পড়িয়াছে ইহাতে সেগুলির সমাবেশ করা হইয়াছে। জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। ‘আইনুল এছাবা’ নামে ইহার সংক্ষেপ করিয়াছেন।

ছেকাহ রাবীদের জীবনী সম্পর্কীত কিতাব

শুধু ছেকাহ রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াও অনেকে অনেক কিতাব লিখিয়াছেন। যথা-

১। কিতাবুছ ছেকাত –আজালী হাফেজ আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ (মৃঃ ২৬১ হিঃ)।

২। কিতাবুছ ছেকাত –আবু হাতেম বুস্তী মোহাম্মদ ইবনে হিব্বান (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)।

৩। কিতাবুছ ছেকাত –ইবনে শাহীন –আবু হাফছ ওমর ইবনে আহমদ শাহীন (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)।

৪। কিতাবুছ ছেকাত –জায়নুদ্দীন কাছেম ইবনে কুতলুবাগা (মৃঃ ৮৭৯ হিঃ)।

৫। তাবাকাতুল হোফফাজ –ইবনে দাব্বাগ (মৃঃ ৫৪৬ হিঃ)।

৬। তাবাকাতুল হোফফাজ –ইবনে মোফাজ্জল মাকদেছী (মৃঃ ৬১৬ হিঃ)।

৭। তাজকেরাতুল হোফফাজ –ইমাম জাহবী –শামছুদ্দীন (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। [ইহা অতি মশহুর কিতাব (প্রকাশিত)]

৮। তাবাকাতুল হোফফাজ –হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)।

৯। তাবাকাতুল হোফফাজ –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)।

১০। তাবাকাতুল হোফফাজ –তাকীউদ্দীন ইবনে ফাহদ।

১১। তাবাকাতুল হোফফাজ –মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ হাশেমী।

জঈফ রাবীদের জীবনী সম্পর্কীয় কিতাব

অনেকে আবার স্বতন্ত্র কিতাবে কেবল জঈফ রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেন। যথা-

১। কিতাবুজ জুআফা –ইমাম বোখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ)।

২। কিতাবুজ জুআফা –(আরবী**********) –ইমাম নাছায়ী (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)।

৩। কিতাবুজ জুআফা –উকাইলী মোহাম্মদ ইবনে আমর (মৃঃ ৩২২ হিঃ)।

৪। কিতাবুজ জুআফা –ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)। ইহা একটি বিরাট কিতাব।

৫। আল কামেল ইবনে আদী –আবু আহমদ (মৃঃ ৩৬৫ হিঃ)। ইহা এ বিষয়ের সর্ববৃহৎ ও সর্বজনগ্রাহ্য কিতাব। পরবর্তী মোহাদ্দেছগণ ইহার উপরই অধিকতর নির্ভর করিয়াছেন। ইবনুর রুমিয়া আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইশবেলী (মৃঃ ৬৩৭ হিঃ) ‘আল হাফিল’ নামে ইহার এক বিরাট পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন।

৬। কিতাবুজ জুআফা –ইমাম দারা কুতনী (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)।

৭। কিতাবুজ জুআফা –হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)।

৮। কিতাবুজ জুআফা –ইমাম ইবনে জাওজী (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ)। ইহা একটি বিরাট ও প্রসিদ্ধ কিতাব। হাফেজ জাহবী (৭৪৮ হিঃ) ইহার সংক্ষেপ করিয়াছেন; অতঃপর ইহার পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন। এছাড়া হাফেজ আলাউদ্দীন মোগলতায়ীও (মৃঃ ৭৬২ হিঃ) ইহার এক পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন।

৯। কিতাবুজ জুআফা –ইমাম হাছান ছাগানী লাহোরী (মৃঃ ৬৫০ হিঃ)।

১০। মীজানুল ই’তেদাল –ইমাম জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। ইহা এ বিষয়ের একটি ব্যাপক এ মূল্যবান কিতাব। হাফেজ জায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ) ‘জায়নুল মীজান’ নামে দুই খণ্ডে ইহার এক পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ) ‘লেছানুল মীজান’ নামে ইহার এক পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন এবং তাহার ‘তাহরীরুল মীজান’ ও ‘তাকবীমুল মীজান’ নামক কিতাবদ্বয়ে ইহাকে সুন্দররূপে সাজাইয়াছেন। এছাড়া এ বিষয়ে আরো বহু কিতাব রহিয়াছে।

মোদাল্লেছীণ ও মোরছেলীনদের জীবনী আলোচনা

শুধু মুদাল্লেছীনদের জীবনী আলোচনা করিয়া স্বতন্ত্র কিতাব লিখিয়াছেন অনেকেই। যথা-

১। ইমাম হোছাইন ইবনে আলী কারাবিছী (২৪৮ হিঃ)। ইনি ইমাম শাফেয়ীর শাগরিদ ছিলেন।

২। ইমাম নাছায়ী –আহমদ ইবনে শোয়াইব (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)।

৩। ইমাম দারা কুতনী (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ)।

৪। ইমাম আলায়ী। তাঁহার কিতাবের নাম ‘জামেউততাহছীল’। -(আরবী********) হাফেজ জায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ) ইহার ‘জায়ল’ (পাদ পরিশিষ্ট) লিখিয়াছেন। অতঃপর তাঁহার পুত্র ওলীউদ্দীন ইরাকী, আলায়ীও তাঁহার পিতার কিতাবকে একত্র করিয়া এক স্বতন্ত্র কিতাব লিখিয়াছেন।

৫। ইমাম জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)। তিনি ইহা পদ্যে লিখিয়াছেন। তাঁহার শাগরিদ আহমদ ইবনে ইব্রাহীম মাকদেছী আলায়ীর কিতাব হইতে আরো কতক নাম সংগ্রহ করিয়া ইহার পরিশিষ্ট লিখিয়াছেন।

৬। ইব্রাহীম ইবনে মোহাম্মদ হালাবী (মৃঃ ৮৪১ হিঃ)। তাঁহার কিতাবের নাম ‘তাবয়ীন’ –(আরবী**********)। ইহাতে তিনি পূর্ববর্তী নামসমূহের সহিত আরো ৩২টি নূতন নামের সমাবেশ করিয়াছেন।

৭। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)। তিনি ইহাদের সহিত আরো ৩৯ জনের জীবনী যোগ করিয়াছেন। সুতরাং তাঁহার কিতাবে মোট ১৫২ জন মোদাল্লেছের নাম রহিয়াছে।

৮। জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। এ বিষয়ে তাঁহার একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব রহিয়াছে। ‘মোরছেলীন’দের সম্পর্কে স্বতন্ত্র কিতাব লিখিয়াছেন ইবনে আবু হাতেম রাজী (মৃঃ ৩২৭ হিঃ)। ইহা ‘মারাছীলে আবি হাতেম’ নামে প্রসিদ্ধ।

হাদীছ জালকারীদের জীবনী আলোচনা

জঈফ ও মাতরূক রাবীদের জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে যদিও হাদীছ জালকারী মিথ্যুকদের প্রায় সকলের জীবনীই আলোচিত হইয়া গিয়াছে, তথাটি আমাদের মোহাদ্দেছগণের অনেকে স্বতন্ত্রভাবে তাহাদের জীবনী আলোচনা করা সমীচীন মনে করিয়াছেন এবং পৃথক কিতাবে তাহাদের জীবনী লিখিয়া গিয়াছেন। নীচে এইরূপ দুইটি কিতাবের নাম দেওয়া গেল।

(ক) আল কাশফুল হাদীছ (আরবী*********) –হালাবী।

(খ) কানুনুল মাওজুআত –মোহাম্মদ ইবনে তাহের পাট্টনী সিন্ধী।

রাবীদের জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কীয় কিতাবঃ

যে রাবী যাঁহার নিকট হাদীছ শুনিয়াছেন বলিয়া দাবী করাহ হইতেছে তিনি তাঁহার যুগ পাইয়াছিলেন কি না ইহা পরীক্ষা করার জন্য অনেকে বিশেষ তাহকীক করিয়া শুধু রাবীদের জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে কিতাব লিখিয়াছেন। যথা-

১। হাফেজ আবু ছোলাইমান মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। তিনি হিজরতের প্রথম সন হইতে ৩৩৮ সন পর্যন্ত সনক্রমে হিসাবে এক কিতাব লেখেন এবংকোন কোন সনে কোন কোন শায়খ বা রাবী এন্তেকাল করিয়াছেন তাহার ফিরিস্তি দান করেন। হাফেজ আবু মোহাম্মদ ইবনে আবদুল আজীজ কাত্তানী (মৃঃ ৪৪৬ হিঃ) ইহার এক পরিশিষ্ট লেখেন। অতঃপর হিবাতুল্লাহ ইবনে আহমদ আফফানী কাত্তানীর কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন এবং ৪৮৫ সন পর্যন্ত পৌঁছেন। আফফানীর এ কিতাবের পরিশিষ।ট লেখেন আলী ইবনে মোফাজ্জাল মাকদেশী (মৃঃ ৬১১ হিঃ)। ইহাতে তিনি ৫৮১ সন পর্যন্ত মৃত সকল শায়খ বা রাবীদের নাম যোগ করেন। অতঃপর ইবনুল মোফাজ্জালের এ কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন হাফেজ আবুদল আজীম মুনজেরী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘তাকমেলাহ’ (আরবী**********)। মুনজেরীর কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন তাঁহার শাগরিত ইজ্জুদ্বীন আহমদ ইবনে মোহাম্মদ। ইহাতে তিনি ৬৭৪ সন পর্যন্ত পৌঁছেন। অতঃপর ইজ্জুদ্দীনের কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন আহমদ ইবনে আইবক দেমইয়াতী এবং ৭৪৯ সন পর্যন্ত সকল হাদীছ বর্ণনাকারীর নাম ইহার সহিত যোগ করেন। আর আইবকের কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন হাফেজ জায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ)।

২। বারজালী –আবুল কাসেম মোহাম্মদ দেমাশকী (মৃঃ ৭৩৮ হিঃ)। ইহার পরিশিষ্ট লেখেন তকীউদ্দীন রাফে’। ইহাতে তিনি ৭৭৪ সন পর্যন্ত পৌঁছেন। তকীউদ্দীনের কিতাবের পরিশিষ্ট লেখেন অপর এক তকীউদ্দীন ইবনে হাজার।

৩। মোবারক ইবনে আহমদ আনছারী। তাঁহার কিতাব ‘ওয়াফায়াতুশ শুয়ুখ’।

৪। হাব্বাল –ইব্রাহীম ইবনে ইছমাঈল (মৃঃ ৪৮২ হিঃ)। (কিতাবুল ওয়াফায়াত।)

রাবীদের নাম, লকব ও কুনিয়াত সম্পর্কীয় কিতাবঃ [ডাকনাম, উপনাম বা উপাধিসূচক নামকে লকব বলে। পিতা বা পুত্রের সহিত সম্পর্কিত নাম যথা অমুকের বাপ অমুকের পুত্র, ইহাকে কুনিয়াত বলে। ‘কবী’ জঈফের বিপরীত শব্দ। ইহার অর্থ সবল বা নির্ভরযোগ্য।]

এক নামের, এক লকবের বা এক কুনিয়াতের বিভিন্ন রাবী রহিয়াছেন। ইহা রাবীদের পরিচয়ের পক্ষে নিতান্ত অসুবিধার ব্যাপার বটে। ইহাতে কোন ‘জঈফ’ রাবীকে নির্ভরযোগ্য (কবী) অথবা ‘কবী’কে ‘জঈফ’, জাল রাবীকে আসল রাবী অথবা আসল রাবীকে জাল মনে করা যাইতে পারে। এ কারণে আমাদের একদল মনীষী যে রাবী তাহার নামের সহিত পরিচিত তাহার লকব বা কুনিয়াত কি এবং যিনি তাঁহার কুনিয়াত বা লকবের সহিত পরিচিত তাঁহার নাম কি তাহা অনুসন্ধান করিয়াছেন। যথা-

১। আলী ইবনে মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ)

২। ইমাম নাছায়ী (মৃঃ ৩০৩ হিঃ)

৩। ইবনে হিব্বান বুস্তী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ)

৪। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)

৫। আবু বকর শিরাজী (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)

৬। ইবনে আবদুল বার (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)

৭। আবুল ফজল (মৃঃ ৪৬৭ হিঃ) [তাঁহার কিতাবের নাম ‘মুন্তাহাল কামাল’ (আরবী********)]

৮। ইবনে জওজী (মৃঃ ৫৭৭ হিঃ)

৯। হাফেজ জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) [তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল মোকতানা’]

১০। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)

বিশেষ বিশেষ কিতাবের রাবীদের জীবনী আলোচনা

অনেকে আবার বিশেষ বিশেষ কিতাবের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেন; যথা-

বোখারী শরীফঃ

বোখারী শরীফের ছনদসমূহে যে সকল রাবীদের নাম রহিয়াছে তাঁহাদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। আহমদ ইবনে মোহাম্মদ কালাবাজী (মৃঃ ৩৯৮ হিঃ)

২।  মোহাম্মদ ইবনে দাঊদ কুরদী (মৃঃ ৯২৮ হিঃ)

মোছলেম শরীফঃ

মোছলেম শরীফের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। আহমদ ইবনে আলী ইস্পাহানী (মৃঃ ২৬৯ হিঃ)

২। ইবনে মানজু ওয়াইয়াহ (কাজনুওয়াইহ) (মৃঃ ৪২৮ হিঃ)

মোআত্তাঃ

মোআত্তা-এ-মালেকের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)

মোছনাদে আহমদঃ

ইহার রাবীগণের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। আবু মূছা ইস্পাহানী

আবু দাঊদঃ

ইহার রাবীগণের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। হোছাইন ইবনে মোহাম্মদ হিব্বানী (মৃঃ ৪৯৮ হিঃ)

কিতাবুল আছারঃ

ইমাম আবু ইউছুফ ছাহেবের ‘কিতাবুল আছার’-এর রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। মোহাম্মদ আবুল ওফা আফগানী

কিতাবুল আছার ও কিতাবুল হুজাজঃ

ইমাম মোহাম্মদ ইবনে হাছান শায়বানীর এ দুই কিতাবের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। মাওলানা আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লী (মৃঃ ১৩৪৪ হিঃ)

কিতাবুল আছার ইমাম মোহাম্মদঃ

ইহার রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। মাওলানা আবদুর রশীদ নো’মানী

শরহে মাআনীল আছারঃ

ইমাম তাহাবীর এ কিতাবের রাবীগণের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী –মাহমুদ ইবনে আহমদ (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ)

(‘কাশফুল আছতার’ নামে ইহার সংক্ষেপ করিয়াছেন শায়খ ছাহেবুল এলম সিন্ধী। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।)

মেশকাত শরীফ

মেশকাত শরীফের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেন স্বয়ং উহার প্রণেতাঃ

১। আল্লামা খতীব তাবরেজী (মৃঃ ৮০০ হিজরীরর কাছাকাছি)

ছহীহাইনঃ

বোখারী ও মোছলেম শরীফের রাবীদের জীবনী একসাথে আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। মোহাদ্দেছ হিবাতুল্লাহ লালাকানী (মৃঃ ৪১৮ হিঃ)

২। মোহাম্মদ তাহের মাকদেছী (মৃঃ ৫০৭ হিঃ)

ছুনানে আরবা’আ

ছুনানে আরবা’আ –আবু দাঊদ, নাছায়ী, তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ –এ চারি কিতাবের রাবীদের জীবনী আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। মোহাদ্দেছ আহমদ ইবনে মোহাম্মদ কুরদী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ)

মোআত্তাঃ

মোআত্তা-এ মালেক, মোছনাদে আহমদ, মোছনাদে শাফেয়ী ও মোছনাদে আবু হানীফা –এ চারি কিতাবের রাবীদের জীবনী এক সংগে আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)

ছেহাহ ছেত্তাঃ

ছেহাহ ছেত্তার ছয় কিতাবের রাবীদের জীবনী এক সংগে আলোচনা করিয়াছেনঃ

১। আবু মোহাম্মদ আবদুল গনী মাকদেছী (মৃঃ ৬০০ হিঃ) [তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল কামাল’]

২। জামালুদ্দীন ইউছুফ মেজজী (মৃঃ ৭৪২ হিঃ)

তিনি মাকদেছীর ‘আল কামাল’কেই সুন্দররূপে সাজাইয়াছেন এবং নাম দিয়াছেন ‘তাহজীবুল কামাল’। ইহা অতি উত্তম কিতাব। ৩৩ খণ্ডে সমাপ্ত হইয়াছে।

৩। ইবনুল মুলাক্কেন (মৃঃ ৮০৪ হিঃ)

তিনি মেজজীর ‘তাহজীবের’ই সংশোধন ও পরিবর্তন করিয়াছেন তাঁহার ‘ইকমালূত তাহজীব’ কিতাবে।

৪। জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (আরবী***********************) (মৃঃ ৯১১ হিঃ)

তিনি ‘তাহজীবুল কামালের’ সহিত আরো কিছু তথ্য যোজন করিয়া তাহার নাম রাখিয়াছেন ‘জাওয়ায়েদুর রেজাল’

৫। হাফেজ জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)

তাঁহার কিতাবের নাম ‘আল কাশেফ’। ইহাতে তিনি মেজজীর তাহজীবকে সংক্ষেপ করিয়াছেন।

৬। হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)

তিনি মেজজীর ‘তাহজীবের’ এবারতকে সংক্ষেপ করিয়া এবং বিষয়বস্তু বাড়াইয়া নাম রাখিয়াছেন ‘তাহজীবুত তাহজীব’। অতঃপর ইহাকে সংক্ষেপ করিয়া নাম করিয়াছেন ‘তাকরীবুত তাহজীব’। এ উভয় কিতাবই প্রকাশিত হইয়াছে। জাহবীর ‘মীজান’ এবং ইবনে হাজারের ‘তাহজীব’ এব বিষয়ের দুইটি প্রসিদ্ধ ও উৎকৃষ্ট কিতাব।

এছাড়া এ বিষয়ে আরো অনেকে অনেক কিতাব লিখিয়াছেন। হাফেজ আবুল মাহাছেন দেমাশকী (মৃঃ ৭৬৫ হিঃ) তাহার ‘আত তাজকেরা’ (আরবী**************) নামক কিতাবে এক সংগে দশ কিতাবের ছনদ আলোচনা করিয়াছেন। -মেফতাহুছ ছুন্নাহ

এক কথায় আমাদের মনীষীবৃন্দ রাবীদের জীবনী সম্পর্কে এত অধিক আলোচনা-সমালোচনা করিয়াছেন যার নজীর দুনিয়ার কোন জাতিই পেশ করিতে সক্ষম নহে। প্রসিদ্ধ প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ ডঃ স্প্রীংগার বলিয়াছেন, দুনিয়ার এমন কোন জাতি ছিল না এবং এখনো নাই যাহারা মুসলামানদের ন্যায় আছমাউর রেজালের মত একটি বিরাট শাস্ত্রের আবিস্কার করিতে পারিয়াছেন, যদ্দ্বারা পাঁচ লক্ষ লোকের জীবনী জানা যাইতেছে।

-মোকাদ্দমায়ে এছাবা

জাল হাদীছ সংগ্রহ

বাছাই করিয়া ছহীহ হাদীছসমূঞ সংগ্রহ করার পর জাল হাদীছ সংগ্রহ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। তথাটি আমাদের মনীষীবৃন্দ আসল ও নকল দুইট জিনিসকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার এবং জনসাধারণকে নকল হাদীছের ধোঁকা হইতে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে নকল হাদীছসমূহ সংগ্রহ করারও পৃথকভাবে ব্যবস্থা করিয়াছেন। ইহাকে হাদীছ জাল প্রতিকারের সর্বশেষ ব্যবস্থা বলা যাইতে পারে। নীচে এরূপ কতিপয় জাল হাদীছ সম্বলিত কিতাবের নাম দেওয়া গেলঃ

১। ‘আল মাওজুআত’ (আরবী*******) –ইবনে জাওজী হাম্বলী (মৃঃ ৫৭৭ হিঃ)।

২। ‘আদদুররুল মুলতাকাত’ (আরবী**********) হাছান ছাগানী লাহোরী (মৃঃ ৬৫০ হিঃ)।

৩। ‘কিতাবুল আবাতীল’ (আরবী*******************) –জুজেজানী।

৪। ‘আল মুগনী’ (আরবী***************) –মুছেলী।

৫। ‘আল লাআলিউল মাছনূআ’ (আরবী***************) জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)।

৬। ‘আদদুরারুল মুনতাশেরাহ’ (আরবী***************) –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)।

৭। ‘জায়লু লাআলিউল মাছনুআ’ –‘ঐ’

৮। ‘আল মাওজুআত’ –ইবনুল কিরাণী।

৯। ‘আল মাকাছিদুল হাছানাহ’ (আরবী****************) –ইমাম ছাখাবী (মৃঃ ৯০২ হিঃ)। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

১০। ‘আল মাছনু ফিল আহাদীছুল মাওজু –মোল্লা আলী কারী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ)

১১। ‘মাওজুআতে কবীর’- ‘ঐ’

১২। ‘তাজকিরাতুল মাওজুআত’ –মোহাম্মদ তাহের পাট্টনী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।

১৩। ‘তাময়ীজুত তাইয়েবা’ (আরবী********************) –শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১০৪৬ হিঃ)।

১৪। ‘আল ফাওয়াএদুল মাজমুআহ’ (আরবী*********************) –ইমাম শাওকানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ)।

১৫। ‘আল আছারুল মারফুআহ’ (আরবী*******************) –মাওলানা আবদুল হাই লক্ষ্মৌবী।

১৬। ‘আল কালামুল মারফু’ (আরবী***********************) –মাওলানা আনওয়ারুল্লাহ হায়দরাবাদী।

 

দেরায়াতগত পরীক্ষা

আমাদের মোহাদ্দেছগণ শুধু যে হাদীছের রেওয়ায়াত বা বর্ণনাগত পরীক্ষাই করিয়াছেন তাহা নহে; বরং তাঁহারা হাদীছের দেরায়াত (বা শব্দ ও অর্থ)-গত পরীক্ষাও যথাযথভাবে করিয়াছেন। রেওয়ায়াতগত পরীক্ষা অতি দুরূহ ব্যাপার বলিয়া লোকেরা ইহা হইতে বিরত থাকিতে পারে এই আশংকায়ই তাঁহারা উহার প্রতি অধিক জোর দিয়াছেন। কারণ, রেওয়ায়াতগত পরীক্ষার জন্য হাজার হাজার রাবীর জীবনচরিত পুংখানুপুংখরূপে জানা আবশ্যক, যাহা সকলের পক্ষে কোন মতেই সম্ভবপর নহে।

দেরায়াতগত পরীক্ষার সূচনা স্বয়ং ছাহাবীদের আমলেই হয়। হজরত ওমর ফারূকের নিকট যখন ফাতেমা বিনতে কায়ছ ইদ্দতকালীন খোরপেষ সর্ম্পীয় হাদীছটি বর্ণনা করেন তখন তিনি এই বলিয়া উহা প্রত্যাখ্যান করেন যে, হাদীছটি কোরআন এবং অপর প্রসিদ্ধ হাদীছের খেলাফ। সম্ভবতঃ ফাতেমা উহা ঠিকভাবে ইয়াদ রাখিতে পারেন নাই। এভাবে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর যখন এ হাদীছটি  বলিলেনঃ

“মৃত ব্যক্তির জন্য পরিবারস্থ লোকের ক্রন্বদের দরুন কবরে তাহার আজাব হইয়া থাকে”। তখন হজরত আয়েশা (রাঃ) বলিলেনঃ “তাহা হইতে পারে না। কোরআনে রহিয়াছেঃ একের গোনাহর বোঝা অন্যে বহন করে না”। সুতরাং রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর কথা আবদুল্লাহ বুঝিতে পারেন নাই। একবার হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলিলেনঃ হুজুর বলিয়াছেনঃ ‘আগুনে পাক করা জিনিস খাইলে ওজু নষ্ট হইয়া যায়’। ইহা শুনিয়া হজরত ইবনে আব্বাছ বলিলেনঃ ‘তাহা হইলে গরম পানি খাইলেও তো ওজু যাইবার কথা, অথচ তাহা কেহ বলে না; আপনি হয়তো হুজুরের কথা বুঝেন নাই অথবা তাহা ঠিকভাবে স্মরণ রাখিতে পারেন নাই সুতরাং ইহা গ্রহণযোগ্য নহে। এভাবে ছাহাবী হজরত ছাবেত যখন মে’রাজ সম্পর্কীয় হাদীছে বলিলেনঃ ‘হুজুর বলিয়াছেনঃ ‘আমি বোরাককে মাকদেছের কড়ার সহিত বাধিঁয়াছিলাম’ তখন ছাহাবী হজরত হোজাইফা বলিলেনঃ ‘কেন’ বোরাকের পালাইবার ভয়ে? তাহা হইতে পারে না; সে রাত্রে সমস্ত জিনিসকেই হুজুরের হুকুমের অধীণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। অতএব, আপনি হুজুরের কথা ঠিকভাবে বুঝিতে পারেননাই। অথবা স্মরণ রাখিতে পারেন নাই’। এ ধরনের আরো বহু ঘটনা রহিয়াছে।

ছাহাবীগণের এ সূত্র ধরিয়া পরবর্তী মনীষীগণ ইহার বিস্তারিত নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করিয়াছেন। নিম্নে ইবনে জাওজী ও মোল্লা আলী ক্বারী কর্তৃক নির্ধারিত কতিপয় নিয়ম বা ধারা উদ্ধৃত করা গেলঃ

১। যে হাদীছ ভাষাগত দোষে দুষ্ট তাহা হুজুরের হাদীছ নহে বলিয়া মনে করিতে হইবে। কারণ, রছূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ছিলেন আরবী সাহিত্যে অদ্বিতীয় জ্ঞানী।

২। যে হাদীছ শরীয়তের কোন সুস্পষ্ট উছুল বা নীতির বিপরীত।

৩। আকল বা বুদ্ধি সম্পর্কীয় সমস্ত হাদীছ

৪। যে হাদীছ বাস্তব অভিজ্ঞতার বিপরীত। যথা- ‘বেগুন সর্বরোগের নাশক’ হাদীছ।

৫। যে হাদীছ কোরআনের স্পষ্ট অর্থের বিপরীত।

৬। যে হাদীছ অপর প্রসিদ্ধ হাদীছের বিপরীত।

৭। যে হাদীছ এজমায়ে উম্মতের খেলাফ।

৮। যে হাদীছে সামান্য আমলের জন্য মহাপুরস্কারের ঘোষণঅ রহিয়াছে।

৯। যে হাদীছে লঘু অপরাধে গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা রহিয়াছে।

১০। যে হাদীছের অর্থ নেহাত হীন। যথা –‘জবহে করা ব্যতীত কদু খাইও না’।

১১। যে হাদীছের রাবী এমন লোকের নিকট হইতে বর্ণনা করিতেছেন যাঁহার সহিত রাবীর সাক্ষাৎ হয় নাই। অপর দিকে এ হাদীছ তাঁহার নিকট হইতে অপর কোন রাবীও বর্ণনা করেন নাই।

১২। যে হাদীছে এমন বিষয় রহিয়াছে যাহা অবগত হওয়া সকল মুসলমানের পক্ষে আবশ্যক, অথচ হাদীছটি এ (এক) রাবী ছাড়া অপর কেহ অবগত নহে।

১৩। যে হাদীছে এমন কথা রহিয়াছে যাহা বাস্তবে ঘটিলে বহু লোকই তাহা অবগত হইত, অথচ এ রাবী ছাড়া অপর কেহ তাহা অবগত নহে।

১৪। যে হাদীছের বর্ণনা অতিরঞ্জিত।

১৫। যে হাদীছের কথা নবীগণের কথার অনুরূপ নহে।

১৬। যে হাদীছের ভবিষ্যদ্বাণীতে কোন সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ রহিয়াছে।

১৭। যে হাদীছের কথা কোন চিকিৎসকের কথা হওয়াই অধিক সঙ্গত।

১৮। যে হাদীছের অসম্ভাব্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রহিয়াছে; যথা- উজ ইবনে ওনক সম্পর্কীয় (তিন হাজার হাত বা অপর বর্ণনা, ৭০ হাত লম্বা ছিল) সংক্রান্ত হাদীছ।

ইহাতে দেখা গেল যে, আমাদের মোহাদ্দেছগণ হাদীছ বিচারের কত সূক্ষ্ম এবং কত যুক্তিগত ব্যবস্থা করিয়াছেন। -মাওজুআতে কবীর ও ফাহমে কোরআন

ইমামগণের হাদীছ বাছাই

হাদীছের ইমামগণ রেওয়ায়াত ও দেরায়াতের এ সকল সূত্র অনুসারেই হাদীছ বাছাই করিয়াছেন এবং লক্ষ লক্ষ [মোহাদ্দেছগণ একটি হাদীছের যতটি ছনদ রহিয়াছে তাহাকে তত হাদীছ বলিয়াই গণ্য করেন। সুতরাং লক্ষ লক্ষ হাদীছ যাচাই করার অর্ত লক্ষ লক্ষ ছনদ পরীক্ষা করা।] হাদীছ হইতে কঠোরভাবে পরীক্ষা করিয়া উহা হইতে মাত্র কয়েক হাজার হাদীছকে তাঁহাদের কিতাবের জন্য মনোনিত করিয়াছেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, ইমাম মালেম (রঃ) প্রথমে এক লক্ষ হাদীছ বাছাই করিয়া দশ হাজার হাদীছ তাঁহার কিতাবে লেখেন; অতঃপর উহা হইতে বাছাই করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৭২০টি হাদীছকে অবশিষ্ট রাখেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) সাড়ে সাত লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহা হইতে মাত্র ৩০ (ত্রিশ) হাজার হাদীছকে তাঁঞার কিতাবে স্থান দেন। এভাবে ইমাম বোখারী ৬ (ছয়) লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া মাত্র আড়াই হাজার (২৪৬০টি) হাদীছ তাঁহার ‘জামেয়ে ছহীহ’তে গ্রহণ করেন। ইমাম মোছলেম তিন লক্ষ হাদীছ হইতে ছাঁটিয়া মাত্র চারি হাজার হাদীছ তাঁহার কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম আবু দাঊদ ৫ লক্ষ হাদীছ বাছাই করিয়া মাত্র পাঁচ হাজার হাদীছকে তাঁর ছুনানে গ্রহণ করেন। এভাবে ইমাম নাছায়ী, তিরমিজী এবং ইবনে মাজাহও লক্ষ লক্ষ রেওয়ায়াত হইতে বাছিয়া অতি অল্প সংখ্যক রেওয়ায়াতই তাঁহাদের কিতাবের জন্য ইনতেখাব করিয়াছেন। ইমাম দারেমী এবং অন্যান্য ছহীহ কিতাবের রচয়িতাগণও এরূপ করিয়াছেন।

এতদসত্ত্বেও পরবর্তী হাদীছ সমালোচক (নাকেদীনে হাদীছ) ইমামগণ এ সকল কিতাবের এর এক এক হাদীছকে পুনরায় কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া দেখিয়াছেন। সুতরাং কোনো হাদীছের ছহীছ হওয়ার অর্ত হইল মহা অগ্নি-পরীক্ষার ভিতর দিয়া উহার উত্তীর্ণ হওয়া।

সত্য কথা এই যে, আমাদের  মোহাদ্দেছগণ আমাদের রছূলের হাদীছের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য যাহা করিয়াছেন অন্য কোন জাতি তাহাদের আল্লাহর কিতাবের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যও ইহার শতাংশের একাংশ পর্যন্ত করিতে পারে নাই। প্রাচ্য বিদ্যা বিশারদ ডঃ মাগেলিউথ ঠিকই বলিয়াছেনঃ ‘হাদীছের জন্য মুসলমানরা যত ইচ্ছা গর্ব করিতে পারে; ইহা তাহাদের পক্ষে শোভা পায়’।

হাদীছ রেওয়ায়তে বিশ্বস্ততার প্রমাণ

হাদীছের ইমামগণের পরীক্ষায় যে সকল হাদীছ ‘ছহীহ’ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে সে সকল হাদীছ যে সত্যই রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ ইহার বহু বাহ্যিক প্রমাণও রহিয়াছে। নিম্নে ইহার কতিপয়ের উল্লেখ করা গেলঃ

১। মকাওকিছের নামে লিখিত পত্রঃ

৬ষ্ট হিজরীতে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পর রছূলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম আরবের চতুর্দিকের রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের প্রতি ‘দাওয়াত’ দিয়া বহু ‘দাওয়াতনামা’ প্রেরণ করেন। এ সকল ‘দাওয়াতনামা’র বিবরণ হাদীছ, ছীরাত ও তারীখের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। এসময় রছূলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম মিছরের কিবতী বংশীয় খৃষ্টান শাসনকর্তা ‘মকাওকিছ’-এর নিকটও একখানা দাওয়াতনামা প্রেরণ করিয়াছিলেন। ইহার বিবরণ সমস্ত কিতাবেই রহিয়াছে। দাওয়াতনামাখানি ১৮৫০ সালে মিছরের এক গির্জা হইতে ফরাসী পণ্ডিত মঁসিয়ে বারতেলমী কর্তৃক আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং বিশেষজ্ঞগণের পরীক্ষায় তাহা রছূলে করীমের সেই আসল দাওয়াতনামা বলিয়াই সাব্যস্ত হইয়াছে। দাওয়াতনামাখানি বর্তমানে কনষ্টান্টিনোপলে রক্ষিত আছে। প্রাপ্ত দাওয়াতনামার বিবরণ এই- (আরবী************************************)

‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দা ও তাঁহার রছূল মোহাম্মদ বনাম কিবতীদের নেতা মকাওকিছ। যে ব্যক্তি সত্যের অনুসরণ করিয়াছে তাহার প্রতি ছালাম। ইতঃপর –আমি আপনাকে ইসলামের ডাকে সাড়া দিতে আহবান জানাইতেছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, নিরাপদে থাকিবেন। (ইহাতে) আল্লাহ আপনাকে দুই গুণ ছওয়াব দিবেন। যদি আপনি পশ্চাদপসরণ করেন তাহা হইলে আপনার উপর কিবতীদের গোনাহও বর্তাইবে। [হে গ্রন্থধারীগণ! আস, এমন একটি কথার দিকে যাহা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান। আমরা যেন আল্লাহ ব্যতীত কাহারও উপাসনা না করি এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক কা করি, পরস্তু আমাদের কেহ যেন আল্লাহ ব্যতীত একে অন্যকে প্রভু না বানায়। যদি তাহারা পশ্চাদপসরণ করে তা হইলে (হে মু’মিনগণ,) তোমরা বল এবং ঘোষণা কর, আমরা নিশ্চয়ই আল্লাহর অনুগত।]-[বন্ধনীর মধ্যকার বাক্যসমূহ কোরআনের আয়াত। রছূলে করীম পত্রে উহার উদ্ধৃতি দিয়াছেন।]

-রছূলে আকরাম কী ছিয়াছী জিন্দেগী ১৩৬ পৃঃ

এখন দেখা যাইতেছে যে, পত্রের বিবরণ (এবারত) এবং হাদীছ ও ছীরাতের কিতাবের বিবরণের মধ্যে কোথাও কোন গরমিল নাই। উভয়ই হুবহু এক। একটি শব্দের মধ্যে যে সামান্য বেশ-কম পরিলক্ষিত হয় তাহাও অর্থের দিক দিয়া নহে, অর্থ একই, পত্রে রহিয়াছে ‘দেআয়াহ’আর কিতাবে রহিয়াছে ‘দাইয়াহ’।

এখানে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, মোছলেম শরীফের এক হাদীছে আছেঃ হজরত আনাছ (রাঃ) বলেনঃ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যখন কিছরা, কাইজার ও নাজ্জাশী প্রমুখের নিকট পত্র লিখিতে ইচ্ছা করিলেন তখন তাঁহাকে বলা হইল যে, তাঁহারা সীল-মোহর ব্যতীত কোন পত্র গ্রহণ করেন না। সুতরাং হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম সীল-মোহর করার জন্য একটি রূপার আংটি তৈয়ার করাইলেন যাহাতে ‘মোহাম্মদুর রাছুলুল্লাহ’ বাক্য খোদাই করা হইয়াছিল। বোখারীর বর্ণনায় ইহাও রহিয়াছে যে, এই বাক্যটি তিন সারিতে (ছতরে) খোদাই করা হইয়াছিল। নীচের দিক হইতে প্রথম সারিতে ‘মোহাম্মদ’ উহার উপর দ্বিতীয় সারিতে ‘রাছূল’ এবং উহার উপর তৃতীয় সারিতে ‘আল্লাহ’ শব্দ।

এখন দেখা যাইতেছে মিছরে প্রাপ্ত পত্রে  সীল-মোহরও রহিয়াছে এবং উহার রূপও হুবহু হাদীছে বর্ণিত রূপই। ইহা অপেক্ষা মোহাদ্দেছগণের হাদীছ রেওয়ায়তে বিশ্বস্তার বড় প্রমাণ আর কি হইতে পারে?

২। মুনজির ইবনে ছাওয়ার নামে লিখিত পত্রঃ

ইবনুল; কাইয়্যেমের ‘জাদুল মা’দ এবং কাস্তালানীর ‘মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া’ প্রভৃতি কিতাবে রহিয়াছে; নবী করিম (ছঃ) বাহরাইনের ইরানী শাসনকর্তা মুনজির ইবনে ছাওয়ার নিকট তাঁহার ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁহাকে পূর্বপদে বহাল রাখিয়া নিম্নলিখিতরূপ একখানা পত্র লিথিয়াছিলেনঃ

( আরবী**************************************)

‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আল্লাহর রছুল মোহাম্মদ-এর পক্ষ হইতে মনজির ইবনে ছাওয়ার নামে। আপনার প্রতি ছালাম হউক। অতঃপর আমি আপনার নিকট আল্লাহর প্রশংসা করিতেছি যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নাই এবং আমি ঘোষণা করিতেছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই এবং মোহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁহার রছূল। ইতঃপর- আমি আপনাকে আল্লাহ (আ’জ্জা ও জাল্লা)-এর নামে স্মরণ করাইয়া বলিতেছি যে, যে ব্যক্তি ভাল কাজ করিবে সে নিজের জন্যই তাহা করিবে এবং যে ব্যক্ত আমার প্রেরিত লোকজনের অনুগত থাকিবে এবং তাহাদের কথা মানিয়া চলিবে সে আমার অনুগত রহিল আর যে তাহদের কল্যাণ কামনা করিবে সে আমার কল্যাণ কামনা করিল। জানিয়া রাখিবেন যে, আমার (পূর্বে) প্রেরিত দুতগণ আপনার প্রশংসা করিয়াছেন। আম আপনার কওম সম্পর্কে আপনার সুপারিশ কবুল করিলাম। সুতরাং যাহারা যে সম্পদ লইয়া মুসলমান হইয়াছে তাহাদিগকে মাফ করিয়া দিন। আর আপনি যতদিন ভালভাল চলিবেন আমি আপনকে আপনার পদ হইতে কখনও অপসারিত করিব না। আর যে ইহুদী আপন ইহুদী মতের উপর এবং যে মাজনু ( আগ্নিপুজক) আপন মাজুছী মতের উপর অবস্থান করিতে চাহিবে ( সে তাহা করিতে পারিবে) তবে জিজিয়া দিতে বাধ্য থাকিবে।;

রছুল আকরাম কী..........১৫১ পৃঃ

হুজুরের প্রেরিত এই আসল পত্রখানিই ১৮৬২ সালে দামেশকে পাওয়া গিয়াছে। ইহার বিবরণ ও কিতাবের বিবরণ মধ্যে বাস্তবে কোন গরমিল নাই। এক জায়গায় যে সামান্য গরমিল দেখা যায় তাহা অর্থের দিক দিয়া নহে। অর্থ রহিয়াছে (আরবী) আর কিতাবে রহিয়াছে (আরবী)

৩। নাজ্জাশীর নাম লিখিত পত্রঃ

১৯৩৮ সালে দামেশকে নবী করীম (ছঃ) বনাম নাজ্জাশী (সম্ভবতঃ আছহেমার পরবর্তী নাজ্জাশী) একখানি পত্র পাওয়া গিয়াছে। পত্রখানি ১৩/১-২ ইঞ্চি লম্বা এবং ৯ ইঞ্চি চওড়া একটা

কোমল চাওড়ায় (ঝিল্লিতে) ১৭ লাইনে লেখা। ইহার নীচে নবঅ করিমের সীল-মোহরও রহিয়াছে। ইহার বিবরণ নিম্নরূপঃ

(আরবী***************************************)

এই পত্রখানির বিবরণ এবং ‘ছীরাতে হালাবিয়াহ’ কিতাবের বিবরণ সম্পর্ণ এক। ইহাতে কি আমাদের ছীরাত লেখক ও হাদীছ সংকলন মোহাদ্দেছগণের সাধুতা এবং হাদীছ রেওয়ায়তে তাঁহাদের বিশ্বস্তাতার প্রমাণ পাওয়া যায় না?

৪। ইরান-সম্রাটের নামে লিখিত পত্রঃ

রছূলে আকরাম (ছঃ) তৎকালীন। ইরানের সম্রাট (কিছরা) খসরু পারবেজের নামেও একখানি ‘ইসলামের দাওয়াতনামা’ প্রেরণ করিয়াছিলেন। রছূলে আকরামের দূত আবদুল্লাহ ইবনে হোজাফা (রাঃ) উহা খসরুর নিকট পৌছিইলে খসরু রাগে উহা ফারিয়া ফেলেন। ইহা হাদীছ ও ছীরাতের কিতাবসমূহে রহিয়াছে।

কুদরতের লীলা-খেলা-এই ফাঁড়া চিঠিখানিও ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে লেবাননের প্রাত্তন উজীর মিঃ হেনরী লুজের ব্যাক্তিগত পাঠাগরে পাওয়া গিয়াছে এবং বিশেষজ্ঞগণের পরীক্ষায় উহা হুজুরের সেই আসল চিঠি বলিয়াই প্রমাণিত হইয়াছে। ইহা ৮-১৫ ইঞ্চি একটি অতি কোমল চামড়ায় তৎকালে আরবে প্রচলিত কুফার লিপি পদ্ধতিতে (কুফী রছমুল খতে) লেখা। ইহার নীচে হুজুরের সেই সীলমোহরও রহিয়াছে। ইহার মধ্যভাগ ফাঁড়া। লাহোর হইতে প্রকাশিত ২১ শে জুন ১৯৬৩ সালের ‘কুহিস্তান’ পত্রিকায় পূর্ণ বিবরণসহ ইহার ছবি প্রকাশিত হইয়াছে। রছূলে করীম ছাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের এ ধরনের প্রায় আড়াই দাওয়াতনামা, সন্ধিপত্র ও নির্দেশনামা প্রভৃতির বিবরণ বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।কালের গর্ভ হইতে এ সকলের আর কোনটা যে প্রকাশ পাইবে না আর আমাদের সমস্ত দ্বিধা-সন্দেহের অবসান ঘটাইবে না তাহা কে বলিতে পারে?

৫। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তাঁহার শাগরিদ হাম্মাম ইবনে মুনাব্বেহকে শতাধিক হাদীছ লেখাইয়া দিয়াছিলেন। ইহা ‘ছহীফায়ে হাম্মাম’ নামে প্রসিদ্ধ। ইহার সমস্ত হাদীছকেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) তাঁহার ‘মোছনাদে’ গ্রহণ করিয়াছেন। এই ছহীফার দুইটি প্রাচিন পাণ্ডুলিপি অতি হালে আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং ডঃ হামীদুল্লাহর সম্পাদনায় প্রকাশিত হইয়াছে-ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এখানেও দেখা যাইতেছে যে, ছহীফায়ে হাম্মামে যে হাদীছ যে ভাবে রহিয়াছে ‘মোছনাদে’ আহমদেও সে হাদীছ ঠিক সেই ভাবেই রহিয়াছে। ইহার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, আমাদের ইমামগণ হাদীছ রেওয়ায়তে অতুলনীয় বিশ্বস্তার পরিচয় পরিয়াছেন?

৬। হেজাজের আগুনঃ

বোখারী ও মোছলেমে রহিয়াছেঃ হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ ‘সে পর্যন্ত কেয়ামত কায়েম হইবে না যে পর্যন্ত না হেজাজ হইতে একটি আগুন জাহির হয় যাহা দ্বারা শামের অন্তগর্ত বুছরার ছোট ছোট পর্বতমালা পর্যন্ত দেখা যাইবে।

কোরতবী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেন যে, ৬৫৪ হিঃ অর্থাৎ, হাদীছটি কিতাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার সাড়ে তিন শতাধিক বৎসর পর মদীনার নিকটবর্তী এক স্থান হইতে এরূপ একটি আগুন জাহির হয় এবং সমগ্র দেশে আতংকের সৃষ্ট করে।

৭। বাগদাদের পতন ও কনস্টান্টিনোল বিজয়ঃ

এভাবে যে সকল হাদীছে তুর্কীদের হাতে বাগদাদের পতন এবং মসলমানদের দ্বারা ‘কনস্টান্টিনোপল’ বিজয়ের সংবাদ রহিয়াছে, হাদীছ লেখার বহু সতাব্দী পর (৬৫৬ হিজরীতে) হালাকু খাঁ কর্তৃক কনস্টান্টিনোল বিজয় দ্বারা হাতা পূর্ণ হইয়া সে সকল হাদীছের সত্যাতার প্রমাণ করিয়া দিয়াছে। এ সকল হাদীছ বোখারী, মোছলেম, আবু দাউদ ও নাছয়ীতে রহিয়াছে আর এ সকল কিতাব হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েই লেখা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত যে সকল হাদীছে শেষ জমানার লোকের পিতা-মাতার প্রতি উপেক্ষা, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি আগ্রত স্ত্রীর প্রতি এবং অযোগ্য লোকের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বণী রহিয়অছে, আজ  কি সে সকল হাদীছরে সত্যতা দিবালোকের মত স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে না?

 

দ্বিতীয় খণ্ড

পাক-ভারতে এলমে হাদীছ

দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম অধ্যায়

এখন আমার দিখিতে চেষ্ট করিবে যে, আমাদের এ পাক-ভারতে রছূলুল্লাহর উম্মতীগণ তাঁহার ছুন্নাহর হেফাজত ও প্রচারে কতখানি অংশগ্রহণ করিয়াছেন।

পাক-ভারত উপমহাদেশেরে সহিত আরবদের সম্পর্কে অতি পুরাতন। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরবগণ বাণিজ্য ব্যাপদেশে এখানে যাতায়াত করিত বলিয়া বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ইসলামী যুগে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেই (৪০ হিজরীর মধ্যেই) পাক-ভারতের পশ্চিম উপকুল পর্যন্ত মুসলিম প্রচারক ও মুজাহিদ বাহিনী পৌছিয়ালেন বলিয়া ইতিহাস সাক্ষ্যা দেয়। বনিউমাইয়াদের আমলে খলীফপ ওলীদের সময় (৮৬-৯৬ হিঃ মোঃ ৭০৫-১৪ ইং) ৯৩ হিঃ মোঃ ৭১১ ইং মোহাম্মদ ইবনে কাছেম কর্তৃক নিয়মিতভাবে সিন্ধু বিজিত হয় এবং উহা খোরাছান প্রদেশের অংশরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমন্ত এলাকায় পরিণত হয়। মুজাহিদ বাহিনীর একদল লোক স্থায়ীভাবে সিন্ধুতে বসতি স্থাপন করেন এবং দ্বিন ও এলমে দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ইহাদের অনেকেই ছিলেন তাবেয়ী ও তাবে’-তাবেয়ী। সুতরাং দ্বিধহীনভাবেই বলা যায় যে, প্রথম শতাব্দীতেই এলমে হাদীছ সিন্ধু পর্যন্ত পৌছিয়াছিল: তবে এ সময়কার বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় না। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সিন্ধু রীতিমত কেন্দ্রীয় শাসনেরই অধীনে থাকে: অতঃপর কেন্দ্রীয় শাসনমুক্ত হইয়া ইহা কতক ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিনত হয়। তৃতীয় শতাব্দীতে এ সকল ক্ষুদ্র রাজ্যেও ধ্বংস হইয়া যায় এবং তদস্থলে শিয়া মতাবলম্বী ‘বাতেনী’ সম্প্রদায়ের অধিকার স্থাপিত হয়। ফলে কিছু দিনের জন্য মুসলিম জগতের সহিত ইহার যোগসুত্র ছিন্ন হইয়া যায়। পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে (৪১২ হিঃ) ছোলতান মাহমুদ মাহমুদ গজনবী খাইবার গিরিপতথে ভারতে প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করিয়া গজনী রাজ্যের অন্তর্ভক্ত করেন।  ফলে ভারতের সহিত মুসলিম জগতের সম্পর্কে পুনঃস্থাপিত হয়। অতঃপর সপ্তম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত এক এক করিয় উপমহাদেশের সকল অংশই মসলমানদের করতলগত হয় এবং দিল্লীতে উহার রাজধানী স্থাপিত হয়। এ সময় মধ্য এশিয়ার খোরাছান ও তুর্কিস্তান প্রভৃতি স্থান হইতে বহু মুসলমান সৈনিক, ব্যবসায়ী, আলেম ও মোহাদ্দেছ এদেশে আগমন করেন এবং স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস এখতেয়ার করেন। তখন হইতে এদেশে এলমে হাদীছের স্থায়ী চর্চা আরম্ভ হয়

পাক-ভারতে এলমে হাদীছের যুগ বিভাগঃ

পাক-ভারতে এলমে হাদীছের ক্রমবিকাশ কালকে প্রধানতঃ পাঁচ ভাগ বা যুগে ভাগ করা যাইতে পারে। যথা-

প্রথম যুগ

এ যুগ প্রথম শতাব্দীর হিজরীর (৭ ম খৃঃ) প্রথম হইতে ছোলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত আক্রমণ পর্যন্ত (৩৯৩ হিঃ, ১০০৩ খৃঃ) প্রায় চারি শতাব্দীর যুগ। এ যুগের বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় না। তবে এ কথা সত্য যে, এলমে হাদীছের শিক্ষা সিন্ধুতেই (দেবল, মানছুরা ও খোজদার প্রভৃতিতেই ) সীমাবদ্ধ ছিল। সিন্ধুর এ দিকের ভুভাগ তখনও ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভক্ত হয় নাই।

খলীফা হজরত ওমর ফারূকের আমলে (১৩-২৩ হিঃ) তৎকর্তৃক বাহরাইন ও ওমানে নিযুক্ত শাসনকর্তা ছাহাবী

হজরত ওছমান ইবনে আবুল আছ ছকফী তাঁহার ভ্রাতা আল হাকামেক সিন্ধুর বরুচ এবং অপর ভ্রাতা মগীরাহ ইবনে আবুল আছকে দেবল অভিযানে প্রেরণ করেন।তাঁহারা শক্রদের পরাস্ত করেন এবং ভারত সীমান্তে প্রথম ইসলামী পতকা উড্ডীন করেন। খলীফা হজরত ওছমান গনীর আমলে (২৩-৩৫ হিঃ) তৎকর্তৃক মাকরানে নিযুক্ত শাসনকর্তা ওবাইদুল্লাহ ইবনে মা’মার তামীমী সিন্ধু নদ পর্যন্ত সমগ্র ভুভাগ স্বীয় শাসনাধীনে আনয়ন করেন এবং তথাকার অধীবাসীদের করদানে বাধ্য করেন। তবে ভারতের আবহাওয়া অনুকুল নহে জনিয়া হজরত আলী মোরতাজার আমলে (৩৫-৪০ হিঃ) তাঁহার অনুমতিক্রমে ৩৯ হিজরীর একেবারে প্রথম দিকে হারেছ ইবনে মুররাহ আবদী এক স্বেচ্ছা সৈনিক বাহিনী লইয়া ভারত আক্রমণ করেন এবং সিন্ধুর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ইলামী রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু ৪২ হিঃ উত্তর সিন্ধুর কিকান নামক স্থানে তিনি তাঁহার অধিকাংশ সৈন্যসহ শক্ত হস্তে নিহত হন।অবশেষে হজরত মুআবিয়ার আমলে ( ৪১-৬০) প্রথমে আবদুল্লাহ ইবনে ছাওয়া আবদী, পরে ছেনান ইবনে ছালামাহ হুজাইলী ভারত সীমান্তে আক্রমণ করেন।অতঃপর ৪৪ হিঃ তাবেয়ী মোহাল্লাব ইবনে আবু ছোফরাহ (১২ হাজার সৈন্যসহ) পাঞ্জাবের লাহোর ও বান্না পর্যন্ত অগ্রসর হন।–বালাজুরী-৪৩৮ পৃঃ এ সকল অভিযান উপলক্ষে নিশ্চয় বহু ছাহাবী এদেশে আগমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে আমরা যাঁহাদের নাম জানিতে পারিয়াছি তাঁহাদের সংখ্যা বেশী নহে। (তাঁহাদের নামের তালিকা পরে দেওয়া হইয়াছে) দ্বিতীয় শতাব্দীতে কতক আরবীয় তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী এ দেশে আগমন করেন এবং স্থায়ীভাবে সিন্ধুতে বসতি স্থাপন করেন। অবশ্য বিখ্যাত তাবে’-তাবেয়ী আবু মা’শার নজীহ সিন্ধী (মৃঃ ১৭০ হিঃ) খাছ সিন্ধুবাসী ছিলেন বলিয়া জানা যায়।তবে তিনি আরবেই হাদীছ শিক্ষা করেন এবং আরবেই (বাগদাদেই) জীবন অতিবাহিত করেন।

ছাহাবীগণের আগমণ

১। আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ওতবান

২। আশ ইয়াম ইবনে আমর তামীমী।

৩। ছোহার ইবনে আল আবদী।

৪।ছোহাইল ইবনে আদী।

৫।হাকাম ইবনে আবু আ’ছ ছকফী

ওছমানী আমলেঃ

৬। ওবাইদুল্লাহ ইবনে মা’মার তামীমী।

৭।আবদুর রহমান ইবনে ছামুরাহ বছরী (মৃঃ ৫০ হিঃ)। তিনি ৩১ হিঃ সিস্তানের শাসনকর্তা রূপে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং সিন্ধুর বহু এলাকা স্বীয় অধিকারে আনয়ন করেন।

তাবেয়ীনঃ

৮। ছেনান ইবনে ছালামাহ ইবনে মোহাব্বাক হুজাইলী (মৃঃ ৫৩ হিঃ)। রেজাল শাস্ত্রকার ইবনে ছ’আদ তাঁহাকে প্রথম শ্রেণীর তাবেয়ী এবং ইবনে হাজার শেষ শ্রেণীর ছাহাবী বলিয়াছেন। তিনি হজরত মুআবিয়ার আমলে ইরাকের শাসকর্তা জিয়াদ কর্তৃক সেনাপতি নিযুক্ত হইয়া সিন্ধুর কিকান প্রভৃতি বহু স্থান ইসলামী রাজ্যের অন্তরভুক্ত করেন এবং দুই বৎসর উহা স্বীয় শাসনধীনে রাখেন। ৫৩ হিঃ কোছদারে (বর্তমান বেলুচিস্তনের খোজদারে) শক্র কর্তৃক তিনি নিহত হন।

৯। মোহল্লাব ইবনে আবু ছোফরাহ (মৃঃ ৮৩ হিঃ) তিনি হজরত মুআবিয়ার আমলে সিস্তান এর শাসনকর্তা আবদুর রহমান ইবনে ছামুরার আদেশে পাঞ্জাবের লাহোর ও বান্না আক্রমণ করেন।

১০।মুছা ইবনে ইয়াকুব ছকফী। তিনি সেনাপতি মোহাম্মদ ইবনে কাছেম কর্তৃক আলোরের কাজী (বিচারক) নিযুক্ত হন এবং তথায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। ‘উচে’ তাঁহার বংশধরগণ বহুদিন যাবৎ হাদীছ-কোরআনের আলো জ্বালাইতে থাকেন।

১১। ইয়াজীদ ছাহাবী ইবনে আবু কাবশাহ দেমাশকী (মৃঃ ৯৭ হিঃ। উমাইয়া খলীফা ছোলাইমান (৯৬-৯৮ হিঃ) মোহাম্মদ ইবনে কাছেমকে বরখাস্ত করিয়া তাঁহার স্থলে ইয়াজীদকে পাঠান। ইয়াজীদ ছাহাবী হজরত আবুদ্দারদা (রাঃ) ও শোরহাবীল ইবনে আওছ প্রমখ হইতে বহু হাদীছ রেওয়ায়ত করিয়াছেন।–Indias Contribution

১২। আমর ইবনে মুছলিম বাহেলী (মৃঃ অনুঃ ১২৩ হিঃ)। তিনি ইয়া’লা বিন ওবাইদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। খলীফা হজরত  ওমর ইবনে আবদুল আজীজের আমলে (৯৯-১০১ হিঃ) তিনি সিন্ধু এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘদিন ঐ পদে বহাল থাকেন।

১৩।মোফাজ্জাল ইবনে মোহাল্লাব ইবনে আবু ছোফরাহ (মৃঃ ১০২ হিঃ)। তিনি ছাহাবী হজরত নো’মান ইবনে বশীরের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। খোরছানের শাসনকর্তা ইয়াজীদ ইবনে মোহল্লাব (তাঁহার ভাই) খলীফা ইয়াজীদ ইবনে আবদুল মালেকের আমলে (১০১-৫ হিঃ) উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং রাজাকীয় সৈন্যের হাতে পরাজিত হন। মোফাজ্জাল তাঁহার পরামর্শক্রমে ১০২ হিঃ কান্দাবিলের (পাঞ্জাবের) আমীর ওদ্দা ইবনে হামীদের নিকট আশ্রয়ের তালাশে আসনে।

১৪। আবু মূছা ইছরাঈল ইবনে মূছা বছরী (মৃঃ ১৫৫ হিঃ অনুঃ)। তিনি বিখ্যাত তাবেয়ী হজরত হাছান বছরী (মৃঃ ১১০ হিঃ) ও আবু মূছা আশজায়ী (মৃঃ ১৯৫ হিঃ)-এর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি ব্যবসায় উপলক্ষে সিন্ধু আগমন করেন এবং সিন্ধুতে স্থায়ী বসবাস এখতেয়ার করেন।

১৫। আবু বকর রবী ইবনে ছবীহ বছরী (মৃঃ ১৬০ হিঃ) তিনি হজরত হাছান বছরী প্রভৃতির নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অনেকের মতে তিনিই প্রথম হাদীছের কিতাব তাছনীফ করেন। তিনি খলীফা মাহদীর আমলে (১৫৮-৬৯ হিঃ) এক নৌবাহিনীর সহিত সিন্ধু আগমন করেন এবং তথাকার এক দ্বীপে এন্তেকাল করেন।

১৬। আবু মা’শার নজীহ সিন্ধী (মৃঃ ১৭০ হিঃ)। তিনিই সম্ভবতঃ প্রথম ভারতীয় ব্যক্তি যিনি হাদীছ শাস্ত্রে বিশেষতঃ মাগাজীতে পণ্ডিত্য লাভ করেন। তিনি যুদ্ধবন্দী হিসাবে নীত হন এবং তথায় হজরত নাফে’ (মৃঃ ১১৭ হিঃ) ও মোহম্মদ ইবনে  কা’ব কোরাইজী (মৃঃ ১০৮ হিঃ) প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়ীনগণের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর বাগদাদে স্থায়ী বসবাস এখতেয়ার করেন। তাঁহার নাতি-পোতাদের মধ্যে অনেকেই বড় বড় মোহাদ্দেছ হন। indias-24

১৭। আবু জ’ফর মোহাম্মদ ইবনে ইব্রহীম দায়ীবলী (দেবলী মৃঃ ৩২২ হিঃ) তিনিই প্রথম দায়বলী (দেবলী), যিনি হাদীছ শিক্ষার জন্য আরব গমন করেন এবং মোহাম্মদ ইবনে জাম্বুর মক্কী (মৃঃ ২৪৮ হিঃ) ও আবদুর রহমান ইবনে ছবীহ প্রমুখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি মক্কায় আবস্থান  করেন এবং তথায় এন্তেকাল করেন।

১৮।আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ দায়বলী (মৃঃ ৩৪৩ হিঃ) তিনি এ যুগের একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেছ। তিনি হাদীছ আম্বষণে তৎকালীন হাদীছের প্রসিদ্ধ কেন্দ্রঃ বছরা, কফা, বাগদাদ, মক্কা, মিছর, দেমাশক, বায়রুত হাররান, তোস্তর, আসকার প্রভৃতি পরিভ্রমণ করেন এবং বহু বড় বড় মোহাদ্দেছের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অবশেষে নিশাপুরে বসতি স্থাপন করেন এবং তথায় এন্তেকাল করেন। হাকেম আবু  আবদুল্লাহ নিশাপুরী (৪০৫ হিঃ) তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

১৯। আলী ইবনে মূছা দায়েলী। তিনি খালাফ দায়বলীর ওস্তাদ ছিলেন।

২০। ইব্রহীম ইবনে মোহাম্মদ দায়বলী (মৃঃ ৩৪৫ হিঃ) ও মক্কার বিখ্যাত মোহাদ্দেছ আলী ইবনে ছায়েল কবীর (মৃঃ ২৯১ হিঃ)-এর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

২১। মোহাম্মদ ইবনে মাহাম্মদ দায়বলী ওররাক (মৃঃ ৩৪৬ হিঃ)। তিনি বছরার কাজী আবু খলীফা (মৃঃ ৩০৫ হিঃ) ও বাগদাদের মোহাদ্দেছ জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ ফারয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) প্রমুখ বহু মনীষীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাকেম আবু আবদুল্লাহ (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

২২। খালাফ ইবনে মোহাম্মদ দায়বলী (মুঃ অনুঃ ৩৬০ হিঃ)। তিনি দেবলে শায়খ আলী ইবনে মূছা দেবলীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর বাগদাদের হাদীছ শিক্ষা দেন। আবুল হাছান আহমদ ইবনে মোহাম্মদ জুন্দী ( মৃঃ ৩৯৬ হিঃ) তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

২৩। আবু বকর আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে হারুন দেবলী (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তিনি ২৭৫ হিঃ দেবল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে রায়, পরে দাগদাদের গমন করেন এবং তথাকার মোহাদ্দেছ জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ ফারয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) ও আহমদ ইবনে শরীফ কুফীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। বাগদাদের বহু মোহাদাদেছ তাঁহার শাগরিদী এখতেয়ার করেন।

২৪। আবুল আব্বাছ আহমদ ইবনে মোহাম্ম মানছুরী। তিনি পারস্যের বিখ্যাত মোহাদ্দেছ আবুল আব্বাছ ইবনে আছরাম (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) এবং বছরার আবু রাওয়াক আহমাদুল হিজনী শিক্ষা করেন এবং হাদীছে তাঁহার গভীর জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিখ্যাত পর্যটক মাকদেছী (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তাঁহাকে মানছুরায় হাদীছ শিক্ষা দিতে দেখেন।

২৫। আবু মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর মানছুরী (মৃঃ ৩৯০ হিঃ) তিনি হাছান ইবনে মোকাররাম প্রমুখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং হাকেম আবু আবদুল্লাহ তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।_indias, 31-41 p.

দ্বিতীয় যুগ

হিজরী ৫ম শতাব্দীর প্রথম হইতে (মাহমুদ গজনবীর ভারত আক্রমণ হইতে) ৮ম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কর্তৃক প্রায় চারি শতাব্দীর যুগ। এ যুগের প্রথম দিকে ( ৪১২-১৬ হিঃ) ছোলতান মাহমুদ গজনবী কর্তৃক পাঞ্জাব বিজিত হইলে এলমে হাদীছের আলো পাঞ্জাবে আসিয়া পৌছে এবং পাঞ্জাব হাদীছের একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র পরিণত হয়। তিনি সিন্ধুকে ইছমাঈলিয়া শিয়াদের কবল হইতে উদ্ধার করিলে সিন্ধুতেও হাদীছের পুনঃ চর্চা আরম্ভ হয়। এতদ্ব্যতীত এ যুগের মাঝামাঝি ছোলতান মোহাম্মদ ঘোরী কর্তৃক দিল্লী বিজিত হইলে ( ৫৯০ হিঃ মোঃ ১১৯৩ ইং) তথায়ও হাদীছের আলো বিকীর্ণ হইতে থাকে। এ যুগেই প্রথমতঃ ভারতীয় মোহদ্দেছগণ কর্তৃক হাদীছের কিতবি লেখা আরম্ভ হয় এবং তাঁহাদের লেখা কতিপয় মোহাদ্দেছের নাম নাম নীচে দেওয় গেল

১।আল হাছান ইবনে  হামীদ দেবলী (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)।তিনি তাঁহার একং ব্যবসায় উপলক্ষে বাগদাদে গমন করেন এবং এক বিশেষ কারণে জ্ঞান অর্জনের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন। তিনি আলী ইবনে মোহাম্মদ ইবনে ছাঈদ মুছেলী (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)।তিনি তাঁহার এক ব্যব্যসায় উপলক্ষে বাগাদদ গমন করেন এবং এক বিশেষ কারণ ঞ্জান অর্জনের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন। তিনি আলী ইবনে মোহাম্মদ ইবনে ছাঈদ মুছেলী (মৃঃ ৩৫৯ হিঃ) মোহাদ্দেছ দালাজ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ) ওমোহাম্মদ নাককাশ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ) প্রমুখের নিকট হদীছ শিক্ষা করেন।

২। আবুল কাছেম শোয়ইব ইবনে মোহাম্মদ দবেলী (মৃঃ ৪০৯ হিঃ। তিনি মিছরে যাইয়া হাদীছের দরছ কায়েম করেন। মোহাদ্দেছ আবু ছাঈদ ইবনে ইউছ তাঁহার নিকট হাদীচ শিক্ষা করেন।

৩। শায়খ ইছমাঈল লাহোরী (মৃঃ ৪৪৪ হিঃ)।তিনি ৩৯৫ হিঃ। খোরাছান হইতে হাদীছ লইলয়া লাহোর আগমন করেন এবং তথায় স্থায় বসতি স্থাপন করেন। তিনিই প্রথমে পাঞ্জাবে হাদীছ চর্চা আরম্ভ করেন। তাঁহার হাতে বহু লোক ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

৪। জা’ফর ইবনে খাত্তাব কুছদারী (মৃঃ অনুঃ ৪৫০ হিঃ)  তিনি আবদুছ ছামাদ ইবনে মোহম্মদ আছেমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি বলখে অবস্থান করেন এবং তথায় এন্তেকাল করেন।

৫। ছিবওয়াইহ ইবনে ইছমাঈল কুছদারী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) ।তিনি মোহাদ্দেছ আবদুল কাছেম আলী ইবনে মোহাম্মদ হোছাইনী, ইয়াহইয়া ইবনে ইব্রহীম মাকহুল ও রাজা ইবনে আবুল কাছেম আলী ইবনে মোহাম্মদ হোছাইনী, ইয়াহইয়া ইবনে ইব্রাহীম মাকহুল ও রাজা ইবনে আবদুল ওহীদ ইস্পাহানীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি মক্কায় বসবাস এখতেয়ার করেন এবং তথায় হাদীছ শিক্ষা দেন।

৬। আলী ইবেন ওছমান হুজবেরী লাহোরী (মৃঃ ৪৬৫ হিঃ) । তিনি মোহাদ্দেছ আবুল ফজল মোহাম্মদ ইবনে হাছান খাতানী প্রমুখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ‘কাশফুল মাহজুব’ নামে (তাছাওফে) তাঁহার এক মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।তিনি লাহোর এন্তেকাল করেন।

India’s, নোজহাহ

৭। আবুল হাছান আলী ইবনে ওমর লাহোরী (মৃঃ ৫২৯ হিঃ)। তিনি আবু আলী মোজফফার ইবনে ইলয়াছ ছাঈদীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। নোজহাহ

৮। শায়খ আবুল কাছেম মাহমুদ ইবনে মোহম্মদ লাহোরী (মৃঃ ৫৪০হিঃ) তিনি ‘কিতবুল আনছাব’ প্রণেতা নিজে তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।

৯। আবু মোহাম্মদ বখতিয়ার ইবনে আবদুল্লাহ ফাচ্ছাদ হিন্দী (মৃঃ ৫৪১ হিঃ)। তিনি বাগদাদ ও বছরায় বহু মোহাদ্দেছর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।তিনি আরবে এন্তেকাল করেন।

১০। আবুল হাছান বখতিয়ার ইবনে আবদুল্লাহ ছূফী হিন্দী (মৃঃ ৫৪২ হিঃ) তিনি বাগদাদ ও বছরায় বহু মোহাদ্দেছের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ছামআনী তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়া ছিলেন।

১১। আবুল ফাতহ আবদুছছামাদ ইবনে আবদুর রহমান লাহোরী (মৃঃ ৫৫০ হিঃ)। তিনি আবুল হাছান আলী ইবনে ওমর লাহোরী প্রমোখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ছামআনী তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন।–নোজহাহ-১-৩০৭ পৃঃ

১২। আমর ইবনে ছাঈদ লাহোরী (মৃঃ ৫৮১ হিঃ)। হাফেজ আবু মুছা মাদীনী তার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

১৩। ছৈয়দ মোরতাজা কুফি (মৃঃ ৫৮৯ হিঃ)। ছোলতান মোহাম্মদ ঘোরীর আমলে (৫৭০-৬০২ হিঃ) । তিনি হিন্দুস্তান আগমন করেন এবং যোগ্যতা গুণে তাহার  সেনাপতি পদ লাভ করেণ।

১৪। ইমাম হাছান ছাগানী—মজীউদ্দীন আবুল ফাজায়েল হাছঅন ইবনে মোহাম্মদ ছাগানী লাহোরী (মৃঃ ৬৫০ হিঃ। তিনি তাহার পিতার নিকট হাদীছ প্রভৃতি এলম শিক্ষা করেন। অতঃপর মক্কা আদান ও হিন্দুস্তানের অন্যান্য মোহাদ্দেছেন নিকট উহা (হাদীছ) পুণঃ শ্রবণ করেন। হাদীছের বিখ্যাত কিতাব ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ তাহারই সংকলিত। ইহাতে তিনি বোখারী ও মোছলেম শরীফ হইতে ২২৭২ টি রছুলুল্লাহ (ছঃ)-এর কাওলী হাদীছ জমা করিয়াছেন। বহু দিন যাবৎ ইহা এদেশের পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল। ইহার প্রায় শতের মত শরাহ লেখা হইয়াছে। ছৈয়দ শহীদ বেরেলবীর খলীফা মাওলানা খোররম আলী বলহুরী ইহার উর্দু তরজমা করিয়াছেন। হালে ছলীম চিশতী ইহাকে বিষয় অনুসারে সাজাইয়া বলহুরীর তরজমাসহ লাহোর হইতে প্রকাশ করিয়াছেন। ইহা একটি অতি ছহীহ ও মূল্যবান কিতাব। এছাড়া হাদীছ, ফেকহ ও অভিধানে তাহার আরো বহু মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে।

তিনি ৫৭৭ হিঃ লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষা লাভের পর বাগদাদে যাইয়া বসতি স্থাপন করেন।খলীফা নাসের বিল্লাহ তাঁহাকে ছোলতান আলতমাসের আমলে (৬০৭-৩৩ ইং) দিল্লীর দরবারে স্থায়ী দুত হিসাবে নিযুক্ত করেন।তিনি প্রায় বিশ বৎছর কাল এই  পদে সমাসীন থাকেন এবং দিল্লীতে হাদীছ চর্চা করেন।

১৫। শায়খুল ইসলাম বাহদ্দীন ‘জাকারিয়া মুলতানী’ (মৃঃ ৬৬৬ হিঃ)। তিনি শায়খ কামালুদ্দীন ইয়ামানীর শাগরিদ ও শায়খ শেয়খ শেহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর খলীফা ছিলেন।

১৬। কাজী মিনহাজুছ ছিরাজ জুজেজানী (মৃঃ ৬৬৮ হিঃ)। তিনি খোরাছনে জন্মগ্রহণ করেন অতঃপর হিন্দুস্থান আগমন করেন। তিনি সম্রাটদের অধীনে বড় বড় সরকারী পদ লাভ করেন।তিনি যথাক্রমে উচের ফিরুজিয়া মাদ্রাছা ও দিল্লীর নাছিরিয়া মাদ্রাছার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। তাঁহার পিতা ছোলতান মোহাম্মদ ঘোরীর আমলে (৫৭০-৬০২ হিঃ) সেনা বিভাগের বিচারক ছিলেন।

১৭। মাওলানা বুরহানুদ্দীন মাহমুদ বলখী (মৃঃ ৬৮৭ হিঃ) তিনি ইমাম ছাগানীর নিকট হাদীছ এবং হেদায়া প্রণেতা আল্লামা বুরহানুদ্দীন মিরগীনানীর নিকট ফেকাহ শিক্ষা করেন। তিনি সম্রাট  গিয়াছুদ্দীন বলনের সময়ে ( ৬৬৪-৬৮৬ হিঃ) দিল্লী আগমন করেন এবং মাশারিকুল আনওয়ার শিক্ষা দিতে থাকেন।

১৮। মাওলানা কামালুদ্দীন জায়েদ- মোহাম্মদ ইবনে আহমদ মারিকেলী দেহলবী (মৃঃ ৬৮৪ হিঃ) তিনি ইমাম ছাগানী ও তাঁহার শাগরিদ বুরহানুদ্দীন মাহমুদ বলখীর নিকট হাদীছ এবং  হেদায়া প্রণেতার নিকট ফেকাহ শিক্ষা করেন। অতঃপর দিল্লীতে দরছ কায়েম করেন।

১৯। মাওলানা রজীউদ্দীন বাদায়উনী (মৃঃ ৭০০ হিঃ) তিনি মক্কা, মদীনা ও বাগদাদে যাইয়া হাদীছ শিক্ষা করেন এবং লাহোরে এন্তেকাল করেন। হাদীছে তাঁহার কিতাব রহিয়াছে

২০। শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামহ ঢকোবী। তিনি সম্রাট আলতামাসের সময় (মৃঃ ৬০৭-৩৩ হিঃ মোঃ ১২১০-৩৬ ইং) দিল্লী হইতে সোনাগাঁও (ঢাকা) আগমন করেন এবং স্থায়ীভাবে তথায় বসতি স্থাপন করেন।তিনি একজন বিখ্যাত আলেম ও মোহাদ্দেছ ছিলেন। সম্ভবতঃ তাঁহার দ্বারাই প্রথমে বাংলায় আসিয় হাদীছ চর্চা আরম্ভ হয়। বিখ্যাত ওলী শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মানীরী (বিহার) বাংলায় আসিয়া তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

২১। আবু হাফছা ছেরাজুদ্দীন ওমর ইবনে ইছহাক হিন্দী (মৃঃ ৭০৩ হিঃ) তিনি হাদীছ, ফেকাহ ও মোনাজারাফ (তর্কশাস্ত্রে) একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি শায়খ ওজীহুদ্দীন দেহলবী, শামছুদ্দীন দুলী (?), ছেরাজুদ্দীন ছকফী ও রুকনুদ্দীন বাদাউনী প্রমুখের নিকট ফেকাহ এবং কুতবুদ্দীন কাস্তালানীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। মক্কা ও মদীনায় তিনি হাদীছ শিক্ষা দেন এবং মিছর যাইয়া আসকরের কাজী নিযুক্ত হন। হাদীছ তাঁহার ‘লাওয়ামে’ (আরবী******************) নামে ‘জামউল’ জাওয়ামে’ ছুয়ুতীর এক শরাহ রিহিয়াছে। আকায়েদের বিখ্যাত কিতাব ‘শহরে আকীদাতুত তাহাবী’ (আরবী******************) তাঁহারই রচিত।

আখবারুল আখইয়ার নোজহাহ India ‘S

২২। শায়খ আলী ইবনে নাগুরী। তিনি তাঁহার পিতা হামীদ নাগুরীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি একজন জবরদস্ত ওলী ও মোহাদ্দেছ ছিলেন।

২৩। শায়খ ছফীউদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আবদুর রহিম আরমুবী (মৃঃ ৭১৫ হিঃ) তিনি হিন্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁহার নানর নিকট এলম শিক্ষা করেন। তিনি ইয়ামান, মক্কা ও মিছর পরিভ্রমণ করিয়া অবশেষে দামেশেকে বসবাস এখতেয়ার করেন। তথায়ই তাঁহার সহিত ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সহিত মোনাজারা হয়।ইমাম জাহবী তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

২৪ ছোলতানুল মাশায়েখ হজরত শায়খ নেজামুদ্দীন আওলিয়া (মৃঃ ৭২৫ হিঃ)। তিনি আরবী সাহিত্য, ফেকাহ ও উছুলে ফেকাহ প্রভুতি এলম শায়খ আলাউদ্দীন উছুলী বাদায়উনী ও মাওলানা শামছদ্দীন খাওয়ারেজমীর নিকট এবং হাদীছ মাওলানা কামালুদ্দীন জাহেদের নিকট শিক্ষা করেন। মাশারিকুল আনওয়ার তাঁহার মুখস্থ ছিল। তিনি শায়খ ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর (রঃ) এর খলীফা ছিলেন।

২৫। শায়খ মুহীউদ্দীন কাশানী দেহলবী (মৃঃ ৭১৯ হিঃ) তিনি হজরত ছোলতানুল মাশায়েখের শাগরিদ ও মুরীত ছিলেন। হাদীছ, তফছীর ও ফেকাহয় তাঁহার অগাধ জ্ঞান ছিল।

২৬। শায়খ ফরীদুদ্দীন মাহমুদ নাগুরী (মৃঃ ৭২৫ হিঃ) তিনি তাঁহার পিতা আলী নাগুরীর নিকট হাদীছ শাক্ষা করেন- নোজহাহ

২৭। মায়খ নেজামুদ্দীন আল্লামী (মৃঃ ৭৩৫ হিঃ) তিনি হজরত ছোলতানুল মাশায়েখের শাগরিদ ও মুরীদ ছিলেন। হাদীছ পাণ্ডিত্যের দরুন তিনি ‘জুবদাতুল মোহাদ্দেসীন’ নামে অভিহিত হন।

২৮। মাওলানা শামছুদ্দীন ইয়াহইয়া আওধী (মৃঃ ৭৪৭ হিঃ) তিনি ছোলতানুল মাশায়েখের শাগরিদ ও মুরীদ ছিলেন।হাদীছে মাশারিকুল আনওয়ারের তাঁহার এক শরাহ রহিয়াছে।

২৯। মাওলান ফখরুদ্দীন জাররাদী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) তিনি ছোলতানুল মাশায়েখের খলীফা ও আখি ছেরাজ বাঙ্গালীর ওস্তাদ ছিলেন।তিনি বাগদাদে হাদীছ শিক্ষা করেন।

৩০। হজরত আখি ছেরাজ বাঙ্গালী। তিনি হজরত ছোলতানুল মাশায়েখের খলীফা ও বিখ্যাত ওলীআল্লাহ শায়খ আলাউল হক পাণ্ডবীর পীর ছলেন।

৩১।শায়খ নছীরুদ্দীন চেরাগে দেহলী (মৃঃ ৭৫৭হিঃ) তিনি মুহীউদ্দীন কাশানী ও শামছুদ্দীন আওধীর নিকট এলমে জাহের এবং ছোলতানুল মাশয়েখেরে নিকট এলমে বাতেন শিক্ষা করেন।

৩২। মাওলানা আবদুল আজীজ আরদেবিলী। তিনি ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ প্রখ্যাত রেজাল মাস্ত্রকার ইউছফ মেজ্জী্ ও ইমাম জাহবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। সম্রাট মোহাম্মদ তোগলক (৭২৫-৫২ হিঃ) তাঁহার নিকট হাদীছ শ্রবণ করেন।

৩৩। মাখদুম শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মানীরী বিহারী (মৃঃ ৭৮২হিঃ) তিনি শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ ঢাকোবীর শাগারিদ ও শায়খ নজীবুদ্দীন ফিরদাউছীর খলীফা ছিলেন।

৩৪।শায়খ ওজীহুদ্দীন। তিনি চেরাগে দেহলীর মুরীদ ও বড় একজন মোহাদ্দেছ ছিলেন। তাঁহার ‘মেফতাহুল জেনান’ নামক কিতাবে তিনি মাশারিকুল আনওয়ার হইতে বহু হাদীছ নকল করিয়াছেন (ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ইহা রক্ষিত আছে।)

৩৫। শায়খ মোজফফার বলখী (মৃঃ ৭৮৫হিঃ) হাদীছে তিনি মাশারিকুল আনওয়ারের এক শরাহ লেখেন। সম্রাট ফিরোজ শাহ তোগলক (৭৫২-৯০ হিঃ) কর্তৃক তিনি দিল্লীর ‘কুশেকে লাল’ মাদ্রাছার আধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি শায়খ মানীরীর খলীফা ছিলেন।

৩৬। ইফতেখাররুদ্দীন বানী। হাদীছ, তফছীর, মান্তক ও হিকমতে তাঁহার অগাধ জ্ঞান ছিল।

৩৭। শায়খ জামালুদ্দীন হোছাইন ইবনে আহমদ বোখারী আচী। তিনি একজন প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মোহাদ্দেছ ছিলেন। সম্রাট ফিরোজ শাহ তোগলক তাঁহার মুরীদ ছিলেন।

৩৯। শায়খ ইলমুদ্দীন ছোলাইমান ইবনে আহমদ মুলতানী। তিনি মাখদুম ইয়াহইয়া মানীরীকে মোছলেম শরীফ উপহার দিয়াছিলেন।– তারীখুল হাদীছ।

৪০। শায়খ ইলমুদ্দীন ছোলাইমান ইবনে আহমদ মুলতানী। তিনি সম্রাট গিয়াছুদ্দীন তোগলকের সময় দিল্লী আগমন করেন।

৪১। শায়খ আলী ইবনে শেহাব হামদানী। তিনি ‘ফাজায়েলে আহলে বায়ত’ সম্পর্কে ‘মোছনাদে ফিরদাউছ’ হইতে ৭০টি হাদীছ সংগ্রহ করিয়া এক কিতাব লেখেন।

আখবারুল আখইয়ার,নোজহাহ, india’s

তৃতীয় যুগ

এ যুগ নবম শতাব্দী হিজরীর প্রথম হইতে একদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পযর্ন্ত প্রায় সোয়া দুই

শতাব্দীর যুগ। এ যুগের প্রথম দিকে গুজরাটের আমীর প্রথম আহমদ শাহ ( ৮১৪-৪৪ হিঃ) কর্তৃক ভারত ও আরবের মধ্যে সমুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপন করা হইলে উভয় দেশের মধ্যে সরাসরিভাবে লোক গমনাগমনের অপূর্ব সুযোগ ঘটে। হাদীছ আকঙ্ক্ষীর আরব ও মিছর যাইয়া তথাকার মোহদ্দেছদের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করার সুযোগ লাভ করে।নবম শতাব্দীর প্রথম দিক হইতে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি পযর্ন্ত বহু  হাদীছ শিক্ষার্থী আরব ও মিছরে যাইয়া হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানী ( মৃঃ ৮৫২ হিঃ) ও বিখ্যাত মোহাদ্দেছ ইবনে হাজার হাইছমী মক্ক ( মৃঃ ৯৫৫ হিঃ) প্রমুখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া হাদীছ দ্বারা দেশকে গুলজার করিয়া দেন। এ কারণে এ যুগকে ছাহাবী ও হাইছমীর শাগরিদগণের যগও বলা যাইতে পারে।

এতদ্ব্যতীত এ সময় ইরানে শিয়া-প্রধান্য স্থাপিত হওয়ায় বহু ছন্নী আলেম ও মোহদ্দেছ ভারতে হিজরত করেন, ফলে ভারতে হাদীছ চর্চা দ্বিগুণ জোরদার হইয়া উঠে।

নীচে এ যুগের কতিপয় বিশিষ্ট মোহাদ্দেছের নাম দেওয়া গেলঃ

১। মাওলানা নূরুদ্দীন সিরাজী-আবুল ফাতহ নূরুদ্দীন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ শিরাজী। তিনি মজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী ( মৃঃ ৮১৭ হিঃ) মীর ছৈয়দ শরীফ জুরজনী ( মৃঃ ৮২২ হিঃ) শামছূদ্দীন জজরী ( মৃঃ ৮৩৩ হিঃ) ও বাব ইউছুফ হারাবী প্রমুখের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি ইরান হইতে ( সম্ভবতঃ আহমদ শাহর আমলের ৮১৪-৪৪ হিঃ) গুজরাটে আগমন করেন এবং ভারতবাসীদের হাদীছ শিক্ষা করার জন্য প্রেরণা দান করেন। এ কারণে তাঁহাকেও এ যগের প্রবর্তক বলা যাইতে পারে।

২। হাফেজ রুকনুদ্দীন কুরাইশী জ’ফরাবাদী ( মৃঃ ৮২০ হিঃ) তিনি হাদীছের হাফেজ ছিলেন। এক লক্ষ হাদীছ তাঁহার মুখস্থ ছিল।

৩। ছৈয়দ মোহাম্মদ গীছূদরাজ-আবুল ফাতহ ছদরুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে ইউছুফ মোসাইন দেহলবী ( মৃঃ ৮২৫ হিঃ) তিনি শেখ শরফুদ্দীন কাতহিলী ( ?), তাজুদ্দীন মোকাদ্দাম ও কাজী আবদুল মোকতাদেরের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।তিনি দিল্লী হইতে গুজরাট ও দৌলতাবাদ হইয়া গুলবরগায় উপনীত হন এবং ফিরোজ শাহ বাহমনী ( মৃঃ ৮০০-২৫ হিঃ)- এর নিকট উচ্চ সম্মান লাভ করেন। হাদীছ তাঁহার ( ছুফী মত অনুসারে) মাশারিকুল আনওয়ারের এক শরাহ, মাশারিকএর অনুবাদ, কিতাবুল আরবাই ( চল্লিশ হাদীছ) ও ছীরাতে নববঅ সম্পর্কে এক কিতাব রহিয়াছে।

৪। শায়খ বদরুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইস্কান্দারী দামমীনী ( মৃঃ ৮২৭ হিঃ)। তিনি ( মৃঃ ৭৬৩ হিঃ) আলোকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁহার দাদা বাহাউদ্দীন দামামীনী, মাম ইবনে খালদুন ( মৃঃ ৮০৮ হিঃ) এবং কায়রো ও মক্কার বড় বড় মোহাদ্দেছগণের নিকট হাদীছ ও অন্যান্য এলম শিক্ষা করেন। তিনি প্রথমে মিছরের ‘আল আজহার’ ও পরে ইয়ামানের জামে’ জাবীদে শিক্ষাদান করেন। অতঃপর ( মৃঃ ৮২০ হিঃ মোঃ ১৪১৭ ইং) ছোলতান আহমদ শাহর আমলে গুজরাট আগমন করেন। তথা হইতে তিনি ( ফিরোজ শাহ বাহমনীর সময় ৮০০-২৫হিঃ) দাক্ষিণাত্যের গুলবরগায় আসেন এবং ২২৭ হিঃ তথয় এন্তেকাল করেন। হাদীছ ‘মাছবিহুল জামে’নামে বোখারী শরীফের,’তা’লীকুল মাছাবীহ’ নামে ‘মাছবীহুছ ছন্নার’ এক একটি শরহ এবং ফতহুর রব্বানী’ নামে অপর এক কিতাব রহিয়াছে।_ ইণ্ডিঃ ৮৭ হিঃ

৫। ইয়াহইয়া ইবনে আবদুর রহমান হাশেমী ( মৃঃ ৮৪৩ হিঃ)। তিনি মক্কয় ইবনে হাজার আছকালানীর শাগরিদ ইবনে ফাহাদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং ৮৩০ হিঃ বোম্বাই-এর কাম্বে আগমন করেন। তথা হইতে গুলবরগায় আসেন এবং বেরারে এন্তেকাল করেন।

৬। হোছাইন ইবনে মইজুদ্দীন বিহারী ( মৃঃ ৮৪৪ হিঃ)। তিনি প্রথমে তাঁহার মাম শায়খ মোজাফফার বলখী, পরে মক্কার পথে আদনে খতীব আদনীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি তাঁহার কিতাব ‘আওরাদে দাহ ফছলী’তে বহু হাদীছ নকল করিয়াছেন।

৭। কাজী শেহাবুদ্দীন দৌলতাবাদী ( মৃঃ ৮৪৯ হিঃ)। তিনি দাক্ষিণাত্যের দৌলতাবাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং দিল্লীতে শায়খ মুইনুদ্দীন ইমরানী ( মৃঃ ৮০৭ হিঃ) মাওলানা খাজেগী ( মৃঃ ৮১৯ হিঃ) ও কাজী আবদুল মুকতাদিরের নিকট শিক্ষালাভ করেন। তিনি হজরত চেরাগে দেহলীর মুরীদ এবং এ যুগের একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেনে। ‘মানাকিছু ছা’দাত’ কিতাবে তিনি রহিয়াছে।

৮। মাওলানা খাজেগী-শামছুদ্দীন খাজগী ইবনে আহমদ কড়বী ( মৃঃ ৮৭৮ হিঃ)। তিনি ‘মাশারিক’ হইতে ৪০টি  হাদীছ সংগ্রহ করিয়া এক ‘আরবাইন’ লেখেন।

৯। খাজা ইমাদুদ্দীন ওরফে মাহমুদ গাওয়ান ( মৃঃ ৮৮৬ হিঃ)। তিনি হাফেজ ইবনে হাজার আছকালানীর নিকট কায়রোতে হাদীছ শিক্ষা করেন এবং হিন্দুস্তানে আসিয়া গুলবরগায় বাদশাহ হুমায়ুন শাহর দরবারে মন্ত্রি পদ লাভ করেন।অতঃপর মোহাম্মদ শাহ বামনির আদেশে ৮৮৬ হিঃ নিহত হন।

১০। শায়খ আবল ফাতহ ইবনে রাজী মক্কা মালবী ( মৃঃ ৮৮৬ হিঃ)। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তথায় ইমাম ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর গুজরাটে আসয়া মন্দুর রাজধানী মালবে ৩০ বৎসরকাল অবস্থান করেন। পরে মক্কায় যাইয়া এন্তেকাল করেন।

১১। শায়খ আহমদ লঙ্গর দরইয়া ইবনে হাছান মোজফফার বলখী ( মৃঃ ৮৯১ হিঃ)। তিনি তাঁহার দাদ হজরত মোজফফার বলখীর আদেশে ছয় মাসে’মাছবীহুছছুন্নাহ’ হেফজ করিয়াছিলেন।তিনি বিহারে মানীর শরীফের একজন বিখ্যাত ছূফী ছিলেন।

১২। শায়খ ওমর ইবনে মোহাম্মদ দেমাশকী খাম্বায়েতী ( মৃঃ ৯০০ হিঃ)। তিনি দেমাশকে জন্মগ্রহণ করেন এবং কায়রোতে সারা বিনতে জামআ ( মৃঃ ৮৫৫ হিঃ) এবং মক্কায় ইমাম ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর ব্যবসায় উপলক্ষে বোম্বাইর কাম্বে ( খাম্বায়েতে) আসিয়া তথাকার কাজী ( বিচারক) নিযুক্ত হন।

১৩। শায়খ আহমদ ইবনে ছালেহ ( মৃঃ অনুঃ ৯০৬ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতা ছালেহ মক্কী মালবে অবস্থানকালে তথায় ( মালবে) জন্মগ্রহণ করেন।অতঃপর মক্কয় যাইয়া ইমাম ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং ছোলতান গিয়াছুদ্দীন মালবীর সময় ( ৮৭৪-৯০৬হিঃ) মালবে প্রত্যাবর্তন করেন। আখবারুল আখইয়ার, নোজহাহ ও india’s contr.

১৪। মোহাককেক জালালুদ্দীন দাওয়ানী ( মৃঃ ৯২৮ হিঃ)। তিনি ইরানের প্রসিদ্ধ মান্তেকী কুতবুদ্দীন রাজী তাহতানীর শাগরিদ ছিলেন। সম্রাট ফিরোজ শাহর আমলে তিনি দিল্লী আগমন করেন এবং হাওজে আলায়ীর উপর নির্মিত মাদ্রাছায় হাদীছ, তফছীর শিক্ষা দেন।

১৫। মাওলান আবদুল আজীজ ইবনে মোহাম্মদ তুসী ( মৃঃ ৯১০ হিঃ)। তিনি খোরাছানের তুসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইবনে হাজার আছকালানীর শাগরিদ আবদুল আজীজ আজহারী, মীর আছীলুদ্দীন শিরাজী ( মৃঃ ৮৮৩ হিঃ) ও ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষ করেন। অতঃপর দাক্ষিণাত্যে আসিয়া মাহমুদ গাওয়াঁনের শ্যালকের গৃহশিক্ষাক নিযুক্ত হন।

১৬। শায়খ আবু বকর ইবনে মোহাম্মদ বারওয়াজী ( বরুচী মৃঃ অনুঃ ৯১৫ হিঃ)। তিনি গুজরাটের বরুচে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং প্রথম মাহমুদ শাহ গুজরাটীর জন্য ‘হিছনে হাছীনে’র গুজরাটের বরুচে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং প্রথম মাহমুদ শাহ গুজরাটীর জন্য ‘হিছনে হাছীনে’র এক ফার্সী তরজমা করেন।

১৭। মালুকুল মাহাদ্দেছীন শায়খ ওজীহুদ্দীন মোহাম্মদ মালেকী ( মৃঃ ৯১৯ হিঃ)। তিনি মিছরে জন্মগ্রহণ করেন এবং স্বীয় পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মক্কয় ইমাম ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর তিনি কিছু দিনের জন্য ইয়ামানের জায়লা মাদ্রাছায় শিক্ষকত করেন। তথা হইতে গুজরাটে আসিয়া হাদীছের দরছ কায়েম করেন। ছোলতান প্রথম মাহমুদ ( ৮৬৩-৯১৭হিঃ) তাঁহাকে মালেকুল মোহাদ্দেছীন ( মোহাদ্দেছীন- সম্রাট) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রী করেন।

১৮। শায়খ মোহাম্মদ ইবনে ইজদান বখশ বাঙ্গালী শেরওয়ানী। তিনি একডালায় বসিয়া বোখারী শরীফ অনুলিপি করেন এবং তৎকালীন বাংলার বাদশাহ আলাউদ্দীনকে ( ৯০৫-২৭ হিঃ) উপহার দেন। ইহা  এখনো পাটনার বাকিঁপুর লাইব্ররীতে বিদ্যমান আছে।

১৯। হোছাইন ইবনে আবদুল্লাহ কিরমানী ( মৃঃ ৯৩০ হিঃ)। তিনি ছাখাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং মক্কা হইতে বিজাপুরের কাবুল আসিয়া ৪ ( চার) বৎসরকাল অবস্থান করেন। অতঃপর মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন।

২০। শায়খ জামালুদ্দীন ইবনে ওমর হাজরামী ( মৃঃ ৯৩০ হিঃ)। তিনি ছাখাবীর নিকট এবং জাবীদে আবদুল লতীফ শিরাজী ও মোহাম্মদ ছায়েগের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর গুজরাটে আসিয়া দ্বিতীয় মোজফফার শাহর শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি মুনজেরীর ‘তারগীব তারহীবের’ এক সংক্ষিপ্তসার রচনা করেন।

২১। ছৈয়দ রফীউদ্দীন ছুফুবী ( মৃঃ ৯৫৪ হিঃ)। তিনি মোহাককেক জালালুদ্দীন দাওয়ানী মাহমুদ শাহ গুজরাটির সময় ( ৮৬৩-৯১৭হিঃ)  গুজরাটে আগমন করেন।গুজরাট হইতে সিকান্দর লুদীর আমলে (৮৯৪-৯২৩ হিঃ) আগ্রায় আসিয়া বসবাস এখতেয়ার করেন এবং ৩৪ বৎসর যাবৎ লুদী কর্তৃক নির্মিত মাদ্রাছায় হাদীছ তফছীর শিক্ষা দেন। তিনি ইরানের ছুফুবী রাজবংশের লোক ছিলেন।

২২। আবুল ফাতহে থানেসরী ( থানেম্বরী মৃঃ ৯৬০  হিঃ)।সৈয়দ ছুফুবীর এন্তেকালের পর তিনি তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হন।

২৩। মীর ছৈয়দ আবদুল আওয়াল জৌনপুরী ( মৃঃ ৯৬৮ হিঃ)। তিনি প্রথমে তাঁহার দাদা ছৈয়দ আলাউদ্দীন হোছাইনীর নিকট এবং পরে আরবে যাইয়া তথাকার মোহাদ্দেছীনদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর আহমদাবাদের গুজরাটে আসিয়া হাদীছের দরছ কায়েম করেন। আকবরী আমলে খান খানানের অনুরোধে ৯৬৬ হিঃ দিল্লী আগমন  করেন এবং দুই বৎসর পর তথায় এন্তেকাল করেন। হাদীছে তিনি ‘ফয়জুল বারী’ নামে বোখারী শরীফের এক বিস্তৃত শরাহ এবং ‘ছিআদাতে’র এক সংক্ষিপ্তসারে লিখিয়াছেন।

২৪। শায়খ আবদুল মালেক গুজরাটি আব্বাছী ( মৃঃ অনুঃ ৯৭০ হিঃ)। তিনি তাঁহার ভ্রাতা ও ছাখাবীর শাগরিদ কুতবুদ্দী আব্বাছীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং আজীবন গুজরাটে হাদীছ শিক্ষা দেন। তিনি কোরআন ও বোখারী শরীফের হাফেজ ছিলেন।

২৫। মীর মোরতাজা শরীফী জুরজানী (মৃঃ ৯৭২ হিঃ)। তিনি মক্কায় ইবনে হাজার হাইছমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ৯৭২ হিঃ তিনি দাক্ষিণাত্য হইয়া আগ্রায় উপনীত হন এবং আকবরী দরবারে প্রভূত সম্মান লাভ করেন। তিনি মীর ছৈয়দ শরীফের পৌত্র ছিলেন।

২৬। শায়খ আলী মোত্তাকী বোরহানপুরী (মৃঃ ৯৭৫ হিঃ)। তিনি ৮৮৫ হিঃ জৌনপুরের নিকট বোরহানপুরের কাজী (বিচারক) নিযুক্ত হন। ৯৪১ হিঃ তিনি গুজরাটে উপনীত হন এবং তথা হইতে মক্কায় যাইয়া স্থায়ী বসবাস এখতেয়ার করেন। মক্কায় তিনি ইমাম ছাখাবীর প্রপৌত্র মোহাম্মদ ছাখাবী, শায়খ আবুল হাছান বকরী

(মৃঃ ৯৫২ হিঃ) ও ইবনে হাজার হাইছমীর নিকট হইতে পুনরায় হাদীছের সনদ হাছিল করেন।

ইছলামী বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার শতাধিক কিতাব রহিয়াছে। হাদীছে তাঁহার ( ১ ) ‘মানহাজুল ওমমাল’ ( ২ ) ইকমালুল মানহাজ ( ৩ ) গায়াতুল ওমমাল, ( ৪ ) আল মুস্তাদরাক, ( ৫ ) কানজুল ওমমাল’ ( ৬ ) ও মোস্তাখাবে কাজুল ওমমাল প্রভৃতি দশটি অতি মুল্যবান কিতাব রহিয়াছে। তাঁহার ‘কানজুল ওমমাল’কে হাদীছের বিশ্বকোষ বলা চলে। ইহাতে তকরার বাদ মোট ৩২ ( ? ) হাজার হাদীছ রহিয়াছে।

২৭ । মাখদুম ভিকারী।– নিজামু্দ্দীন ইবনে ওমর কাকুবী ভিকারী ( মৃঃ ৯৮১ হিঃ )। তিনি ঝাসিঁ ওলক্ষৌতে শায়খ ইব্রাহীম ইবনে মাহাম্মদ বাগদাদী ও জিয়াউদ্দীন মোহাদ্দেছ মদনীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি ‘আল মিনহাজ’ নামে উছুলে হাদীছের এক কিতাব লিখেন।

২৮। খাজা মোবারক ইবনে আররাজানী বানারসী  ( মৃঃ ৯৮১ হিঃ )। তিনি তাঁহার পিতা মাখদুম আররাজনীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ‘মাদারিজুল আখবার’ নামে তিনি বাগাবীর মাছাবীর পুনঃ তারতীব দেন এবং এই একই নামে ছাগানীর মাশারিকু আনওয়ারকে বিষয় অনুসারে সাজান। ( বাকিঁপুর লাইব্রেরীতে ইহার কপি বিদ্যমান আছে।) তিনি শেরশাহ সুরীর আমলে (৯৪৫-৫২ হিঃ ) তাঁহার মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

২৯।মোল্লা আলী তারেমী ( মৃঃ ৯৮১ হিঃ)। তিনি  মেশকাত শরীফের এক শারাহ লেখেন।

৩০। মীর কাঁলা মোহাদ্দেছ_( মোহাম্মদ ইবনে মাওলানা খাজা মৃঃ ৯৮৩ হিঃ) তিনি শিরাজে মাওলানা জামালুদ্দীন মোহাদ্দেছর পুত্র মীরকশাহর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন, অতঃ পর মক্কায় হাদীছ শিক্ষা দেন। মক্ক হইতে তিনি ভারত আগমন করেন এবং যুবরাজ সলীমের ( জাহঙ্গীরের ) গৃহশিক্ষাক নিযুক্ত হন।

৩১। শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে ছা’ দুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ৯৮৪হিঃ)। তিনি আলী মোত্তাকীর শাগরিদ এবং সিন্ধর একজন বিশিষ্ট  মোহাদ্দেছ ছিল্লেন।

৩২। শায়খ জামালুদ্দীন মোহাম্মদ তাহের পাট্তনী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। তিনি হিঃ উত্তর গুজরাটের পাট্তনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ওস্তাদুজ্জামান শায়খ মাতহার ও শায়খ নাগুরীর নিকট আবশ্যক এলম হছিল করেন। অতঃপর মক্কয় যাইয়া ছয় বৎসর-কাল ইবনে হাজার হাইছমী, আবুল হাছান বকরী- বিশেষ শায়খ আলী মোত্তাকীর নিকট হাদীছের উচ্চ জ্ঞান লাভ করেন। ৯৫০ হিঃ দেশে ফিরিয়া তিনি সমাজ সংস্কার ও হাদীছ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীছ তাঁহার বহু ম্যল্যবান কিতাব রহিয়াছে। হাদীছ অভিধানের বিখ্যাত কিতাব ‘মাজমাউল বেহার’,রেজালশাস্ত্রে ‘আল মুগনী’ ও ‘আছমাউর রেজাল’, মাওজুআতের ‘তাজকেরাতুল মাওজুআত’ ও কানূনে মাওজুআত’ তাঁহারাই রচিত। তিনি এ যুগের একজন ইমামুল হাদীছ ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন।

৩৩। শায়খ আবদুল মু’তী হাজরামী (মৃঃ ৯৮৯ হিঃ)। তিনি ৯০৫ হিঃ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং কায়রোতে বিখ্যাত মোহাদ্দেছ শায়খ জাকারিয়া আনছারীর নিকট স্বীয় পিতাসহ হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর ৯৬০ হিজরীর পূর্বে গুজরাট আগমন করেন এবং বোখারী শরীফ শিক্ষা দিতে থাকেন। রেজালে বোখারী সম্পর্কে তাহার একটি অসমাপ্ত কিতাব রহিয়াছে।

৩৪। শায়খ আবদুন নবী গঙ্গুহী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি স্বনামখ্যাত ছুফী আবদুল কুদ্দুছ গুঙ্গুহীর (মৃঃ ৯৪৫ হিঃ) পৌত্র ছিলেন। তিনি আরবে ইবনে হাজার হাইছমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং সম্রাট আকবরের শিক্ষক ও রাজ্যের ‘ছদরুছ ছদুর’ নিযুক্ত হন। তিনি ৯৮৬ হিঃ অর্থাৎ আকবরের ধর্মমত পরিবর্তনের পূর্ব পযর্ন্ত এই পদে বহাল থাকেন। তাঁহার রচনা_ ( ক ) ‘ছুনানুল হুদা ফী মোতাবায়াতিল মোস্তাফা’ ( খ ) ‘ওজায়েফুল ইয়াওমে ওয়াল লায়লাহ’।

৩৫। ছৈয়দ আবদুল্লাহ আইদরুছ তারেমী আহমদাবাদী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি (দক্ষিণ আরবে) হাজরামাউতের তারেমে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইবনে হাজার হাইছমী ও ছাখাবীর শাগরিদ ইবনুদ দীবা নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ৯৫৮ হিঃ তিনি গুজরাটে ( বর্তমান পাকিস্তানের ) আহমাদাবাদে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। তিনি একজন বিখ্যেত ছুফী ও মোহাদ্দেছ ছিলেন।

৩৬। মাখদুমুল মুলক শায়খ আবদুল্লাহ আনছারী ছোলতানপুরী ( মৃঃ ৯৫০ হিঃ )। তিনি বর্তমান কপুরতালার ছোলতানপুর জন্মগ্রহণ করেন। আকবরপন্হী ওলামাদের উৎপীড়েনে তিনি মক্ক পলায়ন করেন। অতঃপর দেশে ফিরিয়া গুজরাটে বসবাস করেন।–(ক) ‘শরহে শামায়েলে’ ( খ ) ‘ইছমাতুল আম্বিয়া।

৬৭। শায়খ শেহাবুদ্দীন আব্বাছী ( মৃঃ ৯৯২ হিঃ )। তিনি ৯০৩ হিঃ মিছরে জন্মগ্রহণ করেন। এবং শায়খ জাকারিয়া আনছারীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর গুজরাটের আসিয়া বসবাস এখতেয়ার করেন। মাকদেছীর ‘ওমদাতুল হাদীছ’ ও নাবাবীর ‘আরাবাইন’ তাঁহার মুখস্থ ছিল।

৩৮। আবুছ ছাআদাত মোহাম্মদ ফকীহী ( মৃঃ ৯৯২ হিঃ )।তিনি ইবনে হাজার হাইছমী ও আবুল হাছান বকরীসহ মক্কা, হাজরামাউত ও জাবীদের প্রায় ৯০ জন শায়খের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর ৯৫৭ হিজরীর পূর্বে গুজরাটে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন।

৩৯। রাহমাতুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহা সিন্ধী ( মৃঃ ৯৯৩ হিঃ )।তিনি মক্কায় আলী মোত্তকীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং মদীনায় হাদীছ শিক্ষা দেন। অতঃপর  ৯৮২ হিঃ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এবং পুনরায় মক্কায় যাইয়া এন্তেকাল করেন। হিন্দূস্তান অবস্থাকালে আকবরের সমালোচক প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মোল্লা আবদুল কাদের বাদায়উনী তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

৪০। শায়খ ওজীহুদ্দীন আলাবী গুজরাটী ( মৃঃ ৯৮৮ হিঃ )। তিনি শায়খ ইমাদুদ্দীন তারেমী ( মৃঃ ৯৪১ হিঃ ) ও শায়খ গাওছ গোয়ালিয়ারীর নিকট এলম শিক্ষা করেন এবং আহমাদাবাদে মাদ্রাছা কায়েম করিয়া ২৫ বৎসরকাল তথায় হাদীছ- তফছীর শিক্ষা দেন। হাঁদীছে তাঁহার ‘শরহে নোখবা’র এক শরাহ রহিয়াছে

৪১। শায়খ তৈয়ব সিন্ধী ( মৃঃ ৯৯৯ হিঃ )।তিনি ছৈয়দ আবদুল আওয়াল হোছাইনী ( মৃঃ ৯৬৮ হিঃ )-এর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। এবং বোরহানপুর ও বেরারের ইলিয়াছপুরে র্দীঘ ২৫ বৎসরকা হাদীছ শিক্ষা দেন। শায়খ জামালুদ্দীন বোরহানপুরী তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি মিশেকাত শরীফের এক ‘তালীক ‘বা শরাহ লেখেন।

৪২। শায়খ ইব্রাহীম ইবনে দাউদ মানিকপুরী ( মৃঃ ১০০১ হিঃ )।তিনি এ যুগের একজন প্রথম শ্রেণীর মোহাদ্দেছ ছিলেন।

৪৩। শায়খ ইয়াকুব ছরফী কাস্মীরী ( মৃঃ ১০০৩ হিঃ )।তিনি প্রথমে কাস্মীর ও ছমরকন্দে মা’কুলাত ও ফেকাহ. অতঃপর মক্কায় ইবনে হাজার হাইছমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হজরত মুজাদ্দেদে আলফে ছানী ( মৃঃ ১০৩৪ হিঃ ) তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছ তাঁহার রচনা- (ক) ‘শরহে বোখারী শরীফ’, (খ) রেছালায়ে আজকার’,  (গ) ‘মাগাজীউন নবুওত’।

৪৪। শায়খ তাহের ইবনে ইউছুফ সিন্ধী ( মৃঃ১০০৪ হিঃ )। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শায়খ শেহাবুদ্দীন সিদ্ধী এবং হাদীছ ছৈয়দ আবদুল আওয়াল হোছাইনীর নিকট লাভ করেন। হাদীছে তাঁহার এ সকল কিতাব রহিয়াছে—(ক) ‘তালখীছে শরহে আছমাউর রেজাল বোখারী’—কিরমানী, (খ) ‘শরহে বোখারী শরীফ’. (গ) ‘মুলতাকাতে জামউল জাওয়ামে’—ছুয়ুতী, (ঘ) ‘রিয়াজুছ ছালেহীন’।

৪৫। মোহাদ্দেছ জহরনাথ কাশ্মীরী। তিনি হাইছমী ও মোল্লা আলী তারেমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেণ এবং কাশ্মীরে হাদীছ শিক্ষা দেন। তিনি একজন নও মুসলিম ছিলেন।

৪৬। মাওলানা ফরীদ বাঙ্গালী। তিনি আকবরের সমসাময়িক (৯৬৩-১০১৪ হিঃ) একজন বড় মোহাদ্দেছ ছিলেন। --তাজকেরায়ে ওলামায়ে হিন্দ।

৪৭। শায়খ আলীমুদ্দীন মন্দুরী (সিন্ধু)। তিনি ও যুগের একজন বিশিষ্ট মোহাদ্দেছ ছিলেন।

৪৮। শায়খ আহমদ ইবনে ইছমাঈল মন্দুবী। তিনি এ যুগের একজন বিশিষ্ট মোহাদ্দেছ ছিলেন।

৪৯। মাওলানা মোহাম্মদ লাগেরী। তিনি লাগেরের মুফতি ও মোহাম্মদ ছিলেন।

৫০। হাজী মোহাম্মদ কাশ্মীরী (মৃ ১০০৬হিঃ)। তিনি মক্কায় হাইছমী ও মদীনায় বিভিন্ন মোহারদ্দেছের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর দেশে ফিরিয়া হাদীছ চর্চায় আত্ননিয়োগ করেন। ইসলামী বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার ৮০টির মত কিতাব রহিয়াছে। হাদীছে তাঁহার নিম্নলিখিত কিতাবসমূহ রহিয়াছে—(ক) ‘শরহে শামায়িল’, (খ) ‘শরহে ,মাশারিকুল আনওয়ার’, (গ) ‘শরহে হিছনে হাছীন’ ও (ঘ) ‘খোলাছাতুল জামে’ বা হাদীছ সংগ্রহ।

৫১। মাওলানা ওছমান ইবনে ঈসা সিদ্ধী (মৃ ১০০৮ হিঃ)। তিনি সিন্ধুতে মাওলানা ওজীহুদ্দীন আলাবী (মৃ ৯৯৪ হিঃ), কাজী মোহাম্মদ মারভী ও শায়খ হোছাইণ বাগদাদীর নিকট হাদীছ-তফছীর শিক্ষা করেন। অতঃপর বোরহানপুরে আসিয়া মোহাম্মদ শাহ ফারুকী (৯৭৪-৮৪ হিঃ মোঃ ১৫৬৬-৭৬ ইং) কর্তৃক তথাকার মাদ্রাছার অধ্যাপক ও রাজ্যের মুফতি নিযুক্ত হন। তিনি ‘গায়াতুত তাওজীহ’ নামে বোখারী শরীফের এক শরাহ লেখেন।

৫২। শায়খ মোনাওয়ার ইবনে আবদুল মজীদ লাহোরী (মৃঃ ১০১০ হিঃ)। তিনি লাহোরে শায়খ ছা’দুল্লাহ বণি-ইসরাঈলী (মৃঃ অনুঃ ১০০০ হিঃ) ও শায়খ ইছহাক কাকু (মৃঃ ৯৯৬ হিঃ)-এর নিকট হাদীছ-তফছীর শিক্ষা করেন। ৯৮৫ হিঃ মোঃ ১৫৭৭ ইং সম্রাট আকবর কর্তৃক তিনি মালবের ‘ছদর’ নিযোক্ত হন। কিন্তু আকবরের নূতন মতের বিরোধিতা করায় ৯৯৫ হিঃ মোঃ ১৫৮৭ হিঃ তিনি গোয়ালিয়ারের দুর্গে বন্দী হন। ৫ বৎসর পর আগ্রা দুর্গে নীত হন এবং কঠোর শাস্তির দরুন ১০১০ হিঃ মোঃ ১৬০২ ইং তথায় প্রাণ ত্যাগ করেন। হাদীছে তাঁহার ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ ও ‘হিছনে হাছীন’-এর এক একটি শরাহ রহিয়াছে। তিনি গোয়ালিয়ার জেলে বসিয়া একটি তফছীরও লিখিয়াছেন।

৫৩। শায়খ ইমাদুদ্দীন মোহাম্মদ আরেফ ও আবদুন নবী শাত্তারী (মৃঃ ১০৩০ হিঃ)। তিনি আগ্রান আবদুল্লাহ ছুফীর খলীফা ছিলেন। হাদীছে তাহার কিতাবঃ (ক) ‘জরীয়াতুন  নাজাত’ ‘শরহে মেশকাত’, (খ) ‘শরহে আছছালাতু মিরাজুল মু’মিনীন,’ (গ) ‘শরহে খায়রুল আছমায়ে আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান’, (ঘ) ‘শরহে নোখবাতুল ফকির,’ (ঙ) ‘লাওয়ামিউল আনওয়ার (ছৈয়দগণের ফজীলত)।

৫৩। শায়খ ইছহাক ইবনে ওমর হিন্দী (মৃঃ ১০৩২ হিঃ)। তিনি আবদুল্লাহ ছোলতানপুরীর (মৃঃ ৯৯০ হিঃ) শাগরিদ ছিলেন। হাদীছে তাহার শামায়েলে তিরমিজীর এক শরাহ রহিয়াছে।

৫৫। ছৈয়দ আবদুল কাদের আইদরুছী আহমদাবাদী (মৃঃ ১০৩৭ হিঃ মোঃ ১৬২৭ ইং)। তিনি তাহার পিতা ছৈয়দ আবদুল্লাহ আইদরুছের নিকট সকল এলম শিক্ষা করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বহু কিতাব লিখিয়াছেন। ‘আননুরুছ ছাফের ফী আয়ানিল কারনিল আশের’ তাহার এক বিখ্যাত কিতাব। এছাড়া হাদীছে তাহার নিম্নলিখিত কিতাবসমূহ রহিয়াছে--- (ক) ‘আল কামহুল বারী-বে-খতমে ছহীহিল বোখারী’, (খ) ‘ইকদুল লাআল ফী ফাজায়িলিল আল’, (গ) ‘রেছালাহ ফি মানাকিবিল বোখারী,’ (ঘ) ‘আল কাওলুল জামে’ ফী বয়ানিল এলমিন নাফে’। ----আখবার, ইণ্ডিয়াস, তারীখুর হাদীছ প্রভৃতি।

 

চতুর্থ যুগ

[ইমামে রব্বানী ও শায়খ দেহলবীর যুগ]

এ যুগ একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ হইতে দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ পর্যন্ত অর্থাৎ, ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে  ছানী শায়খ আহমদ সারাহিন্দী ও শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেছ দেহলবী হইতে শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ মোঃ ১৭৬২ ইং ) পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাব্দীর যুগ। এ যুগে হাদীছ ওলামা ও ছুফীদের মাদ্রাছা ও খানকাহ হইতে জনসাধারণের অন্তঃপুরে যাইয়া পৌছিতে সমর্থ হয়। এ যুগে একদিকে যেমন ইমামে রব্বানী ও তাহার আওলাদ এবং অনুসারীগণ শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমে হাদীছকে জনসাধারণের বাস্তব জীবনে রুপায়িত করার জন্য জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করেন, অপর দিকে শায়খ আবদুল হক মোহাম্মদ দেহলবী (মৃঃ ১০৫২ হিঃ মোঃ ১৬৪২ ইং) এবং তাহার বংশধর ও শাগরিদগণ তৎকালে বহুল প্রচারিত সরল ও রাজকীয় ফারছী ভাষায় হাদীছের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের তরজমা ও ব্যাখ্যার মারফতে উহাকে আরবী উচ্চ শিক্ষিতদের গবেষণার বস্ত হইতে নামাইয়া সাধারণ ফারছি শিক্ষিতদেরও বোধগম্য বিষয় করিয়া তোলেন।

ইমামে রব্বানীর পূত্র-পৌত্রাদির মধ্যে খাজা ছাঈদ ‘খাজিনুর রহমত’ (মৃঃ১০৭০ হিঃ), খাজা মা’ছুম ওরওয়াতুল উছকা (মৃঃ ১১১৪ হিঃ), শাহ আবু ছাঈদ মুজাদ্দেদী দেহলবী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) ও শাহ আবদুল গণী মুজাদ্দেদী দেহলবী (মৃঃ১২৯৬ হিঃ)। অপর দিকে শায়খ দেহলবীর বংশধরগণের মধ্যে শায়খ নূরুল হক দেহলবী (মুঃ ১০৭৩ হিঃ), শায়খ ছায়ফুল্লাহ দেহলবী, শায়খ মুহিববুল্লাহ দেহলবী, হাফেজ ফখরুদ্দীন দেহলবী (মৃঃ ১১৫০ হিঃ), শায়খুল ইছলাম দেহলবী (মৃঃ ১১৮০ হিঃ) ও শায়খ ছালামুল্লাহ দেহলবী রামপুরী (মৃঃ ১২২৯ হিঃ) প্রমুখ মনীষীগণ এ যুগে নানাভাবে হাদীছের প্রভৃত খেদমত করেন।

এতদ্ব্যতীত তাহার শাগরিদ, দর-শাগরিদগণের মধ্যে খাজা হায়দার (মৃঃ ১০৫৭ হিঃ), খাজা খাওন্দ (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ), বাবা দাঊদ মেশকাতী (মৃঃ ১০৯৭ হিঃ) মীর ছৈয়দ আবদুল জলীল বিলগ্রামী (মৃঃ ১১৩৭ হিঃ), মীর ছৈয়দ মোবারক বিরগ্রামী (মৃঃ১১১৫ হিঃ), শায়খ এনায়েতুল্লাহ কাশ্মীরী (মৃঃ ১১৮৫ হিঃ) ও মীর ছৈয়দ আজাদ বিলগ্রামী (মৃঃ ১২০০ হিঃ) প্রমুখের খেদমতও অবিস্মরণীয়।

ইমামে রব্বানী

[মৃঃ ১০৩৪ হিঃ মোঃ ১৬২৪ ইং]

১।ইমাম রববানী মুজাদ্দেদ আলফে ছানী আহমদ ইবনে আবদুল্লা ফুরূকী সারহিন্দী (মৃঃ ১০৩৪ হিঃ মোঃ ১৬২৪ ইং)। তিনি ৯৭১ হিঃ মোঃ ১৫৬৪ ইং পূর্ব পঞ্জাবের অম্তগর্ত সারহিন্দ (সাহরান্দ) নাম স্থানে করেন। প্রাথমিক শিক্ষা স্বীয় পিতার নিকট লাভ করার পর তিনি প্রথমে সিয়ালকোটে, পরে কাশ্মীরে গমন করেন এবং মোল্লা কামালুদ্দীন কাশ্মীরী (মৃঃ ১০১৭ হিঃ) ও শায়খ ইয়াকুব ছরফী (মৃঃ ১০০৩ হিঃ)_এর নিকট হইতে হাদীছ, তফছীর ও মান্তেক-হিকমত প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর তিনি আবদুর রহমান ইবনে কাহফের শাগরিদ কাজী বাহলুল বদশীর নিকট হইতেও হাদীছের এজাজত লাভ করেন।‘তাছাওফে’ তিনি হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ নকশবন্দ-এর (মৃঃ ১০১২ হিঃ) খলীফা ছিলেন। তাঁহার বিরাট সংস্কারমূলক কার্যের দরুন দুনিয়া তাঁহাকে (প্রথম এক হাজার বৎসরের পর ) দ্বিতীয় হাজারের জন্য ‘মুজাদ্দেদ’রূপে মানিয়া লয়। তাঁহার সংস্কারকার্যের বিবরণ এখানে দেওয়া যেমন অপ্রাসঙ্গিক তেমন অসম্ভবও। তাঁহার সংস্কারকার্যে

না হইলে আকবারের এলহাদের দরুন ও উপমহাদেশ হইতে ইসালাম তখনই বিদায় গ্রহণ করিত।

শায়খ দেহলবী

[মৃঃ ১০৫২ হিঃ মোঃ ১৬৪২ ইং]

২। শায়খ আবদুল হক ইবনে ছায়ফুদ্দীন মোহ্দ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১০৫২ হিঃ মোঃ ১৬৪২ ইং) তিনি ৯৫৪ হিঃ দিল্লীর এক প্রসিদ্ধ ছূফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার উর্ধ্বতন পুরুষ আগা মোহাম্মদ তুর্ক বোখারা হইতে ভারতে আগমন করেন। তিনি ফারছী-আরবী, মা’কুলাত ও মানকুলাত প্রভৃতি যাবতীয় এলম তাঁহার পিতা ও দেশের কতিপয় বিশিষ্ট আলেমের নিকট শিক্ষা করনে। অতঃপর মক্কা শরীফ যাইয়া ৯৯৬-১০০০ হিঃ চারি বৎসরকাল শায়খ আলী মোত্তাকীর বিশিষ্ট শাগরিদ ও খলীফা শায়খ আবদুল ওহাহব মোত্তাকী বোরহানপুরী মক্কার (মৃঃ ১০১০ হিঃ) নিকট হাদীছ ও তাছাওফের উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। হাদীছ, তফছীর ও তারীখ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার শতের মত কিতাব রহিয়াছে।– আবজাদ। নীচে তাঁহার কতিপয় কিতাবের নাম দেওয়া গেল। (ক) ‘আত তরীকুল কাইয়েম শরহে ছিফরুছ ছাআদাত।‘ (প্রকাশিত) (খ) ‘লমআতুত তানকীহ শরহে মেশকাতুল মাছাবীহ। আরবীতে ইহা মেশকাত শরীফের একটি বিস্তারিত শরাহ (ঝাঁকিপুরে ইহার কপি বিদ্যমান আছে এবং ঢাকা মাদ্রাছায়ও আছে।) (গ) ‘আশেআতুল লুমআত’। ইহা মেশকাত শরীফের ফারছী অনুবাদসহ সংক্ষিপ্ত অথচ অতি মূল্যবান শরাহ। (মেশকাতরে ব্ঙ্গানুবাদ আমি ইহারই অনুসরণ করিয়াছি।) (ঘ) ‘জামেউল বারাকাতুল মোন্তাখাব। ইহাতে তিনি মেশকাত শরীফের প্রত্যেক অধ্যায়ের কতিপয় হাদীছ নির্বাচান করিয়া অতঃপর উহার এমনভাবে শরাহ করিয়াছেন যাহাতে সমস্ত অধ্যায়ের বিবরণ জানা যায়। (ইহার কপিও ঝাকিপুরে আছে।)(ঙ) ‘মা ছাবাতা বিছছুন্নাহ’। ইহতে মাস ও দিনের ফজীলত সম্পর্কেয় হাদীছ জমা করা হইয়োছে। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। (চ) ‘আল আরবাঈন ফী ওলুমিদ্দীন’ (JAR.SB NO-21) (ছ) ‘তরজমায়ে আরবাঈন’। ইহাতে শাসনকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে চল্লিশ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহার ফারছী অনুবাদ করিয়াছেনে। (জ) ‘কাশকুল এখতেবাস ফী আহকামিম লেবাস’। ইহাতে রছূলুল্লাহ ছাল্লল্লাহু আইলাইহে ওয়াছাল্লাম –এর লেবাছ সম্পর্কীয় হাদীছসমূহ এক্র করা হইয়াছে। (ঝ) ‘জিকরে এজাজাতুল হাদীছ ফিল কাদীমে ওয়ালহাদীছ’। (ঞ) ‘মাদারিজুন নবুওত’, ফারছীতে রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম  (ছঃ)-এর বিরাট জীবনী গ্রন্হ।(প্রকাশিত)

৩। মাওলানা মোহাম্মদ ইবনে ছিদ্দীক লাহোরী (মৃঃ  অনুঃ ১০৪০ হিঃ)। তিনি ‘নুজুমুল মেশকাত’ নামে মেশকাত শরীফের এক শরাহ করেন। এছাড়া ইবনে হাজার মক্কীর ‘আজ জাওয়াজের’ কিতাবেরও তাঁহার এক শরাহ রহিয়াছে।

৪। শায়খ হাবীবুল্লাহ কন্নুজী (মৃঃ ১০৪১ হিঃ) তিনি ‘রাওজাতুন নবী’ নামে ছীরাতের এ কিতাব লিখিয়াছেন।

৫। শায়খ হোছাইনী লাহোরী (মৃঃ ১০৪৫ হিঃ)

৬। খাজা হায়দর পতলু ইবনে ফিরোজ কাশ্মীরী (মৃঃ ১০৫৭ হিঃ)। তিনি প্রথমে কাশ্মীরে বাব জহরনাথ কাশ্মীরীর এবং পরে দিল্লীতে শায়খ আবদুল হক মোহদ্দেছ দেহলবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।

৭।খাজা ছাঈদ ইবনে ইমামে রব্বানী ওরফে খাজিনুর রহমত (মৃঃ ১০৭০ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতা ইমামে রব্বানী ও আবদুর রহমান রুমীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হারামাইন রওনা হইবার পূর্ব পর্যন্ত (মৃঃ ১০৩৪  হিঃ) তিনি তাঁহার পিতার খানকায় হাদীছ-তফছীর প্রভৃতি এলম শিক্ষা দিতে থাকেন। হাদীছে তাঁহার মেশকাত শরীফের এক শরাহ রহিয়াছে।

৮। শায়খ নরুল হক দেহলবী ইবনে শায়খ আবদুল হক দেহলবী (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। তিনি হাদীছসহ যাবতীয় এলম তাঁহার পিতা শায়ক দেহলবীর নিকট শিক্ষা কেরন। তিনি পাক-ভারতীয় মোহাদ্দেছগণের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মোহাদ্দেছ। হাদীছে তাঁহার ‘তাইছীরুল করী’ নামে বোখরী শরীফেরর এক বিস্তারিত ফারছী শরাহ এবং ‘শামায়িলে তিরমিজী’র অপর এক শরাহ রহিয়াছে।

৯। মোল্লা ছোলাইমান আহমদাবাদী। তিনি শায়খ দেহলবীর শাগরিদ ছিলেন।আহমদাবাদে এখনও তাঁহার হাদীছের ছিলছিল জারি রহিয়াছে।– তারীখুল হাদীছ

১০। শায়খ মোহাম্মদ হোছাইন খানী। তিনি শায়ক দেহলবীর শাগরিদ ছিলেন।

১১।খাজাহ মা’ছুম ইবনে ইমামে রব্বানী ওরফে ওরওয়াতুল ওছকা (মৃঃ ১০৮০ হিঃ)। তিনি হাদীছ প্রথমে দেশে তাঁহার পিতা এবং পরে হারামাইন অবস্থানকালে তথাকার মোহাদ্দেছগণের নিকট শিক্ষা করেন। তিনি ইমামে রব্বানীর দ্বিতীয় পুত্র এবং সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের (মৃঃ ১১১৯ হিঃ) পীর ছিলেন। তাঁহার ৯ লক্ষ মুরীদ ছিল বলিয়া কথিত আছে।

১২।ছৈয়দ জা’ফর বদলে আলম আহমদাবাদী (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতা ছৈয় জালালের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ৫৪ ঘন্টায় তিনি পুর্ণ কোরআন পাক লিখিতে পারেতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁহাকে গর্ভণর পদ দিতে চাহিলে তিনি তাহা অস্বঅকার করেন। হাদীছে তাঁহার ‘আল ফয়জুত তারী’নামে বোখারী শরীফের এক শরাহ এবং ‘রওজতুলশাশহ’ নামে অপর এক বিরাট কিতাব রহিয়াছে।

১৩। খাজা খাওদ মুঈনুদ্দীন ওরফে ‘হজরতে ‘ইশা’ কাশ্মীরী  (মৃঃ১০৮৫ হিঃ)। তিনি হাদীছ, তফছীর, ফেকাহ প্রভৃতি এলম শায়খ দেহলবীর নিকট শিক্ষা করেন।

১৪। বাবা দাউদ মেশকাতী (মৃঃ ১০৯৭ হিঃ)। তিনি হাদীছ খাজা হায়দর কাশ্মীরী ও তাছাওফ খাজা খাওন্দের নিকট শিক্ষা করেন। মেশকাত শরীফ তাঁহার মুখস্থ ছিল বলিয়া তাঁহাকে মেশকাত বলা হয়।

১৫। শায়খ ‘আবতু ইউছুফ’ ইয়াকুব বানানী লাহোরী (মৃঃ ১০৯৮হিঃ)। তিনি শাহজাহা নিয়া মাদ্রাছার অধ্যাপক’ শাহজাহানী আমলে (মৃঃ১০৩৭-৬৯ হিঃ)। মীরে আদল এবং আলমগীরের সময় (মৃঃ১০৬১-১১১৯ হিঃ) ‘নাজিরুল মাহাকেম’ ছিলেন। হাদীছে তাঁহার তিনটি মূল্যবান কিতাব রহিয়াছে। (ক) ‘আলখায়রুল জারী ফী শরহিল বোখারী।( আরবী****************) (খ) ‘আলমু’লিন ফী শরহিল মোছলেম।( আরবী***) (গ) ‘আল মুছাফফা ফী শরহিল মোআত্ত’। ( আরবী****)

১৬। মির্জা জান আওহাদুদ্দীন বারকী জলন্দরী (মৃঃ অনুঃ ১০০ হিঃ )। তিনি ‘নজমুদদুরারে ওয়াল মারজান’ ( আরবী***********) নামে ছীরাতুন্নবী সম্পর্কে এক কিতাব লিখিয়াছন।

১৭। মাহবুবে আলম ইবনে জা’ফর বদরে আলম আহমদাবাদী (মৃঃ ১১১১ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতা জা’ফর বদরে আলমের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং ‘জিনাতুন নোকাত’ নামে মেশকান শরীফের এক শরাহে লিখেন। এছাড়া তিনি আরবী ও ফারাছীতে কোরআন পাকের দুইটি তফছীরও লিখেন।

১৮। হাফেজ ফরনোখ শাহ ইবনে খাজিনুর রহমত ইবনে ইমাম রব্বানী (মৃঃ ১১১২ হিঃ) ছানদসহ তাঁহার ৭০ হাজার হাদীছ মুখস্থ ছিল।

১৯। মীর ছৈয়দ মোবারক বিলগ্রামী (মৃঃ ১১১৫ হিঃ)। তিনি শায়খ নূরল হক দেহলবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছে তাঁহার অগাধ জ্ঞানের দরুন তিনি ‘কুততুল মোহাদ্দেছীন’ উপাধিতে ভুষিত হন।

২০। মাওলানা নায়ীম ছিদ্দীকী জৌনপুরী (মৃঃ ১১২০ হিঃ)।তিনি তর্কশাস্ত্রে ‘মোনাজারায়ে রশীদিয়া’ (আরবী****) প্রণেতা মাওলানা আবদুর রশীদ জৌরপুরী (মৃঃ ১০৮৩হিঃ) শাগরিদ ছিলেন। হাদীছে তাঁহার মেশকাত শরীফের এক শরাহ রহিয়াছে।

২১। শায়খ ইনায়েতল্লাহা কাশ্মীরী (মৃঃ ১১৮৫ হিঃ)। তিনি খাজা হায়দরের এক পত্রের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং ৩৬ বৎসর যাবৎ কাশ্মীরে হাদীছ শিক্ষা দেন।

২২। শায়খ  মুহিববুল্লাহ ইবনে নুরল্লাহ ইবনে নুরল হক দেহলবী (মৃঃ অনুঃ ১১২৫ হিঃ)। তিনি তাঁহার দাদা শায়খ নুরুল হক দেহলবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি ‘মাম্বাউল এলম’ নামে মোছলেম শরীফের এক শরাহ করেন। তাঁহার পুত্র হাফেজ ফখরুদ্দীন ইহাকে সাজাইয়া লিখেন, ফলে ইহা তাঁহার নামে প্রসিদ্ধ হাইয়া যায়।

২৩। শায়খ মোহাম্মদ আকরাম ইবনে আবদুর রহমান সিন্ধী (মৃঃ ১১৩০ হিঃ)। তিনি ‘ইম আনুন নজর নামে ‘নোখবাতুল ফিকর-এর এক বিস্তারিত শরাহ করেন। ইহা লক্ষ্ণৌর আবদুল হাই মনহুমের লাইব্রেরীতে বিদ্যমান আছে।

২৪। মীর ছৈয়দ আবদুল জলীল বিলগ্রামী (মৃঃ ১১৩৮ হিঃ)।তিনি বিলগ্রামের মীর ছৈয়দ মোবারক, মীর ছা’দুল্লাহ, মীর তোফায়ল এবং লক্ষ্ণৌর মাওলানা গোলাম নকশবন্দ প্রমুখ মনীষীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। বিখ্যাত সাহত্যিক ও মোহাদ্দেছ মীর আজাদ বিলগ্রামী তাঁহার দৌহিত্র।

২৫। শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আমীন আব্বাছী ওরফে খুবুল্লাহ এলাহাবাদী (মৃঃ ১১৪৪ হিঃ)। তিনি তাঁহার চাচা বা মামা আফজাল ইবনে আবদুর রহমান এলাহাবাদীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছে তাঁহার এসকল কিতাব রহিয়াছেঃ (ক) ‘ইনায়েতুল কারী শরহে ছোলাছিয়াতুল বোখারী’। (আরবী***********) (খ) ‘আরবাউন’ (৪০ হাদীছ)। (গ) ‘তাজকেরাতুল আছহাব’। (ঘ) মা’খাজুল ই’তেকাদ’ (আরবী*****)। (ঙ) শরহে হাদীছে ছালাতুত তাছবীহ’ ( আরবী**************)। (চ) তরজুমায়ে ওজায়েফুন নবী।

২৬।মাওলানা আমীনুদ্দীন ইবনে মাহমুদ ওমরী জৌনপুরী (মৃঃ ১১৪৫হিঃ)। তিনি মাওলানা আরশাদ ইবনে আবদুর রশীদ জৌনপুরী ছাত্র ছিলেন। তিনি শায়খ দেহলবীর ‘আশেআতুল লুমআত’কে সংক্ষেপ করিয়াছেন।

২৭। হাজী আফজাল সিয়ালকোটী (মৃঃ ১১৪৬হিঃ)। তিনি খাজিনুর রহমতের পুত্র খাজা আবদুল আহাদ সারহিন্দীর নিকট হাদীছের এজাজত লাভ করেন।– কাওলুল জামীল

২৮। হাফেজ ফখরুদ্দীন আবদুছ ছামাদ ইবনে মুহিববুল্লাহ দেহলবীর নিকট হাদছ শিক্ষা করেন এবং তাঁহার মোছলেম শরীফের শরাহ ‘মাম্বাউল এলম (আরবী*****************) কে সাজইয়া লিখেন।

২৯। মাওলানা নুরুদ্দীন ছালেহ আহমদাবাদী (মৃঃ ১১৫৫হিঃ)। তিনি হাদীছ মাওলানা মাহবুব আলম আহমদাবাদীর শাগরিদ ছিলেন। তিনি আহমদাবাদে ‘হেদায়েত বখশ’ নামে এক মাদ্রাছা স্থাপন করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার দেড় শতের মত কিতাব রহিয়াছে। হাদীছে তাঁহার ‘নুরুল কারী’ নামে বোখারী শরীফের এক শরাহ রহিয়াছে।

৩০। শায়খ ছিবগাতুল্লাহ রেজবী (মৃঃ ১১৫৭ হিঃ)

৩১। শাহ ফাখির জায়ির এলাহাবাদী ইবনে শায়খ মোহাম্মদ ইয়াহইয়া এলাহাবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ)। তিনি মদীনায় শায়খ হায়াত সিন্ধীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। কথিত আছে, শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর সহিতও তাঁহার পরিচয় ছিল। তিনি একধারে মোহাদ্দেছ, কবি ও দরবেশ ছিলেন। হাদীছে তাঁহার ‘ইছবাতু রাফউল ইয়াদাইন’ (আরবী***********) ও ‘ছিফরুছ ছাআদতের’ পদ্যানুবাদ প্রসিদ্ধ।

৩২। শায়খুল ইছলাম ইবনে হাফেজে ফখরুদ্দীন দেহলবী (মৃঃ ১১৭৫ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতা হাফেজ ফখরুদ্দীন দেহলবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছে তাঁহার নিম্নলিখিত কিতাবেসমূহ রহিয়াছেঃ (ক) ‘শরহে বোখরী’ (ফারছী) ১৩০৫ হিঃ ইহা শায়খ নুরুল হক দেহলবীর তাই ছীরুল কারীর’ হাশিয়ার উপর লক্ষ্ণৌ হইতে প্রকাশিত হইয়াছে। (খ) ‘রেছালায়ে কাশফুল গেতা’ (আরবী.......................................) (গ) ‘তারদুল-আওহাম’ (আরবী................................) (India contri, তারীখুল হাদীছ, ওলামা কী শানদার মাজী)।

পঞ্চম যুগ

[ওলীউল্লাহী যুগ]

এ যুগের সূচনা হয় হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে। এ যুগের প্রবর্তক হইতেছেন শাহ ওলীউল্লাহ মোহাম্মদ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ)। তিনি হারামাইন –মক্কা ও মদীনা হইতে হাদীছে উচ্চ জ্ঞান লাভ করিয়া ১১৪৫ হিঃ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং দীর্ঘ ৩০ বৎসরকাল শিক্ষা ও রচনার মাধ্যমে উহার প্রচার করিতে থাকেন। অসংখ্য মোহাদ্দেছ তাঁহার নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করিয়া দেশে ছড়াইয়া পড়েন এবং দেশকে হাদীছ দ্বারা উদ্ভাসিত করিয়া দেন। তাঁহার পর তাহার সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ) তাহার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ৬০ বৎসরেরও অধিককাল হাদীছের শিক্ষায় ব্যাপৃত থাকেন। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর পর তাহার দৌহিত্র শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী (মৃঃ ১২৬২ হিঃ) স্বীয় পিতামহের স্থান অধিকার করেন এবং (মক্কায় হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত) ২০ বৎসরকাল দিল্লীতে হাদীছ শেক্ষা দেন। শাহ ইছহাক দেহলবীর পর হাদীছ শিক্ষা আরও ব্যাপকতা লাভ করে। তাহার প্রসিদ্ধ শাগরিদ মাওলানা আবদুল গনী মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ) ও মিঞা ছাহেব ছৈয়দ নজীর হোছাইন দেহলবী (মৃঃ ১৩০২ হিঃ) দিল্লীতে দুই বিভিন্ন কেন্দ্র এবং মাওলানা আলম আলী নগীনবী রামপুরে ও মৌলনা কারী আব্দুর রহমান পানিপথী পানিপথী হাদীছ শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।

শাহ আবদুল গনীর পর (বরং তাহার জীবনের শেষের দিকেই) হাদীছ শিক্ষা অধিকতর ব্যাপকতা লাভ করে। মাওলানা মাজহার নানুতবী (মৃঃ ১৩০২ হিঃ) সাহারপুর জিলার সদরে ‘মাজাহেরে উলুম’ নামে এবং মাওলানা মোহাম্মদ কাছেম নানুতবী (মৃঃ ১২৯৭ হিঃ ঐ জিলার) দেওবন্দে ‘দারুল উলুম’ নামে দুইটি নূতন কেন্দ্র স্থাপন করেন। এভাবে মাওলানা মশীদ আহমদ গঙ্গুহী (মৃঃ ১৩২৩ হিঃ ঐ জিলার) গঙ্গুহতে স্বীয় খানকার এবং মাওলানা আবদুল হাই লক্ষৌবী (মৃঃ ১৩০৪ হিঃ) লক্ষৌর ফিরিঙ্গী মহল্লায় পৃথকভাবে হাদীছ শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। অতঃপর ক্রমে পাক-ভারতে হাদীছ শিক্ষার আরও কেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং পাক-ভারত হাদীছ শিক্ষার ব্যাপারে বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করে।

এক কথায় এ যুগকে পাক-ভারতে এলমে হাদীসের স্বর্ণযুগ বলা যাইতে পারে। এ যুগে এলমে হাদীছ অপরাপর বিষয়বলীর উপর প্রাধান্য লাভ করে এবং উচ্চ শিক্ষার মাপকাঠি হিসাবে গৃহিত হয়।

এ যুগের পর পর কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যাইতে পারেঃ

 

প্রথম স্তর

শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী

[১১১৪-১১৭৬ হিঃ মোঃ ১৭০৩-১৭৬২ ইং]

শাহ ওলীউল্লাহ ইবনে আবদুর রহিম দেহলবী ওমরী (১১১৪ হিঃ মোঃ ১৭০৩ ইং) দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। ৭ বৎসর বয়সে তিনি কোরআন হেফজ এবং ১৫ বৎসর বয়সে পূর্ণ শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৭ বৎসর বয়সে (তাঁহার পিতার নিকট হইতে) তাছাওফে খেলাফত লাভ করেন। হাদীছের মেশকাত শরীফ, শামায়িলে তিরমেজী ও বোখারী শরীফের কিয়দংশ তিনি তাহার পিতা শাহ আবদুর রহিম দেহলবী (মৃঃ ১১৩১ হিঃ) এর নিকট এবং পূর্ণ মেশকাত ও হাদীছের অপর কয় কিতাব হাজী আফজাল সিয়ালকোটির নিকট শিক্ষা করেন। ১১৪৩ হিঃ মোঃ ১৭৩০ইং তিনি হারামাইন (মক্কা ও মদীনা) গমন করেন এবং তথায় শেখ আবু তাহের কুরদি মদনী (মৃঃ ১১৪৫ হিঃ), শেখ ওয়াফদুল্লাহ মক্কী ও শেখ ওমর ইবনে আহমদ মক্কী প্রমুখ প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেছগণের নিকট হাদীছে উচ্চ জ্ঞান লাভ করেন। ১১৪৬ হিঃ, মোঃ ১৭৩৩ ইং তিনি হারামাইন হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং দিল্লীতে তাঁহার পিতার রহীমিয়া মাদ্রাছায় হাদীছ-কোরআন শিক্ষাদানে আত্ননিয়োগ করেন।

পূর্ণ ৩০ বৎসরকাল কোরআন-হাদীছ শিক্ষাদান ও বিভিন্ন সংস্করকার্যসম্পাদনের পর ৬৩ বৎসর বয়সে ১১৭৬ হিঃ মোঃ ১৭৬২ ইং তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন।

তাঁহার ন্যায় প্রতিভাশালী ও প্রজ্ঞাবান ব্যাক্তি দুনিয়ায় খুব কমই জন্মলাভ করিয়াছেন। তিনি একাধারে মুজতাহেদ, মুজাদ্দেদ, মুফাছছের, মোহাদ্দেছ, ছুফী, দার্শনিক ও শরীয়াত তত্বজ্ঞানী ছিলেন। এ সকল বিষয়ে তিনি শতের উপর ছোট-বড় মূল্যবান কিতাব প্রণয়ন করিয়াছেন। (ত্রিশ-এর অধিক পাওয়া যায় না।) দর্শন ও তত্বজ্ঞান সম্পর্কে তাঁহার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’ বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে একটি মহামূল্য অবদান। কোরআন বুঝিবার উপায় ও নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে তাঁহার ‘আল ফাওজুল কাবীর’ একটি অতুলনীয় কিতাব। ‘ফাতহুর রাহমান’ নামে তাঁহার কোরআন পাকের ফারছী অনুবাদ অনুবাদকদের জন্য পথপ্রদর্শক। ইজতেহাদ সম্পর্কে তাঁহার ‘ইকদুল জীদ’ অন্ধদের পক্ষে চক্ষু দানকারী। এক কথায় তাঁহার রচনাবলী হইতেছে অন্ধকারে আলোকস্তম্ভ। তাঁহার রচনাবলীর আলোচনা ব্যতীত এ যুগে কাহারও পক্ষে আল্লাহ ও রছুল প্রদর্শিত সত্য পথের সন্ধান লাভ করা সুকঠিন।

তিনি তাঁহার রচনায় কোন বিশেষ মাজহাব, তরীকা বা পন্হার প্রতি পক্ষপাত না করিয়া যেখানে যাহা হক মনে করিয়াছেন তাহাই ব্যক্ত করিয়াছেন। হাদীছ শিক্ষায় তাঁহার এ নীতি ছিল সুপ্রকট। তাঁহার হাদীছ শিক্ষার নীতি ওলামাদের নিকট এতই মকবুল (গ্রহনিয়) হইয়াছে যে, আজ পাক-ভারতে হাদীছ শিক্ষার এমন কোন ছিলছিলা নাই যাহা তাঁহাতে আসিয়া বর্তায় না। পাক-ভারত কেন, দুনিয়ার বহু হাদীছ শিক্ষার ছিলছিলাই তাঁহাতে আসিয়া বর্তায়।

হাদীছে তাহার রচনাঃ

১। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বলেগাহ’। ইহা দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে সৃষ্টি রহস্য, কর্মফলতত্ত্ব, শরীয়ততত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে। দ্বিতীয় ভাগে তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তিতে হাদীছের ব্যাখ্যা দান করা হইয়াছে।

২। ‘মুছাফফা’, ইহা মোয়াত্তা ইমাম মালেকের ফারছী শারাহ। ইহাতে তিনি মাজহাব চতুষ্টয়ের মধ্যে কোন বিশেষ মাজহাবের প্রতি পক্ষপাত না করিয়া ইজতেহাদের ভিত্তিতে হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তাঁহার এ কিতাব গভীরভাবে আলোচনা করিলে অনুসন্ধানী ব্যক্তিগল আজও ইজতেহাদের পথ পাইতে পারেন বলিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন।–প্রকাশিত

৩। ‘মুছাওয়া’, ইহা ইমাম মালেকের ‘মোয়াত্তা’র আরবী শরাহ। ইহাতে তিনি ইমাম মালেকের নিজস্ব অভিমতগুলিকে বাদ দিয়া আসল হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা করিয়াছেন।–প্রকাশিত

৪।‘আরবায়ীন’। ইহাতে হজরত আলী (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত চল্লিশ হাদীছ সংগ্রহ করা হইয়াছে; ইহা মাওলানা খোররম আলী বালগুরী ও হাদী আলী লক্ষ্ণৌবীর শরাহসহ দিল্লীর মোস্তাফিয়া প্রেস হইতেপ্রকাশিত হইয়াছে।

৫। ‘ওয়াছীকাতুল আখইয়ার’, ইহাতে তিনি ইমাম নাওয়াবীর ছেহল হাদীছের শরাহ করিয়াছেন।

৬। ‘আদ দুররুছ ছামীন’ (আরবী........................................)। ইহাতে তিনি রছুলুল্লাহ (ছঃ) এর স্বপ্ন সম্পর্কীয় হাদীছ সমূহ একত্রিত করিয়াছেন।–প্রকাশিত

৭। ‘আল ফজলুল মুবীন’ (আরবী........................................)। ইহাতে কতক ‘মোছালছাল’ হাদীছ জমা করা হইয়াছে।–প্রকাশিত

৮। ‘আল ইরশাদ’ (আরবী.............................)। ইহাতে তিনি তাহার হাদীছ লাভের ছনদসমূহ বর্ণনা করিয়াছেন।

৯। ‘তারাজিমূল বোখারী’। ইহাতে তিনি ছহীহ বোখারীতে অবলম্বিত নীতিসমূহের আলোচনা করিয়াছেন।

১০। ‘শরহে তারাজিমে আবওয়াবে বোখারী’। ইহাতে ছহীহ বোখারীর ‘তরজুমাতুল বাব’-এর শরাহ করা হইয়াছে।

১১। ‘আছারুল মোহাদ্দেছীন’ (আরবী...............................)। হায়দরাবাদের আছফিয়া লাইব্রেরীতে ইহার পাণ্ডুলিপি বিদ্যামান আছে।

১২। ‘মাকতুবাত’ (আরবী....................................)। ইহাতে তিনি ইমাম বোখারী ও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন ।

                                                                                         ---india’s contribution-174p

তাহার প্রসিদ্ধ শাগরিদগণঃ

হাদীছে শাহ ছাহেবের বহু শাগরিদ রহিয়াছেন। নিম্নে তাঁহাদের কতিপয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম দেওয়া গেল।

১। কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথী (মৃঃ ১২২৫ হিঃ)। তিনি শায়খ জালালুদ্দীন কবিরুল আওলিয়ার বংশধর এবং হজরত মির্জা জানে জানান দেহলবীর (মৃঃ ১২০৫ হিঃ) খলীফা ছিলেন। হাদীছ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার অগাধ জ্ঞানের দরুন শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী তাঁহাকে ‘বায়হাকীউল ওকত’ (যুগের বায়হাকী) উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁহার ন্যায় ইসলামিয়াতে সর্ববিষয়ে পারদর্শী লোক কুত্রাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে। তাঁহার ‘তফছীরে মাজহারী’ ইহার সাক্ষ্য।

হাদীছে তাঁহার ‘আল লুবাব’ নামে একটি কিতাব রহিয়াছে। ইহাতে তিনি শামছুদ্দীন ছালেহীর (মৃঃ ৯৪২ হিঃ) ‘ছুবুলুল হুদা’ কিতাবের তৃতীয় খণ্ডকে সংক্ষেপে করিয়াছেন। ‘মানারুল আহকাম’ (আরবী...................................)। নামে তাঁহার একটি অতি মূল্যবান কিতাব। (প্রকাশিত হয় নাই। (আরবী.......................) দ্রষ্টব্য)

২। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর জেষ্ঠক পুত্র। (তাহার পূর্ণ পরিচয় পরে আসিতেছে।)

৩। মাওলানা মোহাম্মদ আশেক ফুলতী। তিনি শাহ ছাহেবের মামাত ভাই, সুরিদয় ও খলীফা ছিলেন। শাহ ছাহেবকে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’ লেখার জন্য তিনিই উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিলেন। তিনি শাহ আবদুল আজিজ দেহলবীর ওস্তাদ ছিলেন। ---খান্দানে আজীজিয়া-৩০ পৃঃ

৪। মাওলানা রফীউদ্দিন মোরাদাবাদী (মৃঃ ১২১৮ হিঃ)। ‘ছালউল কায়ীব’—(আরবী...................................) ও ‘শরহে আরবায়ি নাওয়াবী’ নামে হাদীছে তাঁহার দুইটি কিতাব রহিয়াছে।

৫। মাওলানা খায়রুদ্দীন ছুরতী (মৃঃ ১২০৬ হিঃ)।মাওলানা রফীউদ্দীন মোরাদাবাদী শাহ ওলীউল্লাহর পরে তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছিলেন।–খান্দানে আজীজিয়া ৫৯ পৃঃ

৬। খাজা মোহাম্মদ আমীন কাশ্মীরী। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর প্রাথামিক ওস্তাদ।

৭। মাওলানা মুঈন ইবনে মোহাম্মদ আমীন সিন্কী। ‘দেরাছাতুল লবীব’ (আরবী........................................) নামে তাঁহার একটি মূল্যবান কিতাব রহিয়াছেন।

৮।মাওলানা মোহাম্মদ ইবনে পীর মোহাম্মদ বিলগ্রামী এলাহাবাদী।

৯। ফকীহ নুর মোহাম্মদ বুঢানবী। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর শ্বশুর। শাহ আবদুল আজীজ তাহার নিকট ফেকাহর উচ্চজ্ঞান লাভ করেন।

১০। মাওলানা মাখদুম লক্ষ্ণৌবী।

১১। মাওলানা জামালুদ্দীন রামপুরী।

১২। মাওলানা সৈয়দ মোরতাজা বিলগ্রামী জাবীদী (মৃঃ ১২০৫ হিঃ)। তিনি প্রথমে শাহ ছাহেবের নিকট, পরে ইয়ামানে তথাকার মোহাদ্দেছগণের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছে ১৭টি কিতাবসহ বহু বিষয়ে তাহার বহু কিতাব রহিয়াছে। তিনি মিছরে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন।

 দ্বিতীয় স্তর

শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী

[১১৫৯-১২৩৯ হিঃ মোঃ ১৭৪৬-১৮২৪ ইং]

তিনি ১১৫৯ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁহার পিতার ন্যায় ১৫ বৎসর বয়সেই হাদীছসহ সমস্ত এলমে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং ১৭  বৎসর বয়সে তাছাওফের ছনদ হাছিল করেন। তিনি হাদীছ ও অন্যান্য প্রায় সকল এলমই তাঁহার পিতা ওলীউল্লাহ দেহলবীর নিকট শিক্ষা  লাভ করেন। হাদীছ, তফছীর, ফেকাহ এবং মান্তেক, হিকমত (---গ্রীকবিজ্ঞান)-এর ন্যায় অংক, জ্যামিতি, ভূগোল ও ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁহার জ্ঞান ছিল অতলস্পর্শী সমুদ্রতুল্য। তিনি তাঁহার পিতার এন্তেকালের পর হাদীছ ও ‘তাছাওফ’ শিক্ষাদানে তাহার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ৬০ বৎসরকাল অসংখ্য আল্লাহর বান্দাকে ইহা বিতরণ করেন। অনেকের মতে হাদীছের প্রচার তাঁহার পিতা অপেক্ষা তাঁহার দ্বারাই অধিক হইয়াছে। ৮১ বৎসর বয়সে ১২৩৯ হিঃ তিনি দিল্লীতে এন্তেকাল করেন।

হাদীছে তাহার রচনাঃ

১। ‘উজালায়ে নাফেয়াহ’। ইহা তাঁহার উছুলে হাদীছ সম্পর্কীয় একটি তথ্যপূর্ণ কিতাব। (মাওলানা আবদুল আহাদ কাছেমী ‘আল উলালাতুন নাজেআহ’ (আরবী............................................) নামে ইহার আরবী অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছেন।)

২। ‘বুস্তানুল মোহাদ্দেছীন’ । ইহাতে তিনি হাদীছের ৯৫টি প্রসিদ্ধ কিতাব ও উহাদের রচয়িতাগণের পরিচয় দান করিয়াছেন।

৩। ‘তা’লীকাতুন আলাল মুছাওয়া’। ইহাতে তিনি তাঁহার পিতার মুছাওয়া গ্রন্হের পাদটীকা লিখিয়াছেন।

৪। ‘আল মাওজুআত’। ইহা মাওজু হাদীছ সম্পর্কীয় কিতাব। (লক্ষ্ণৌর ‘নুদওয়াতুল ওলামা’র লাইব্রেরীতে ইহার পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান আছে।)

৫। ‘মায়াজের হেফজুহু লিন্নাজের’ (আরবী..................................), এছাড়া ‘তফছীরে আজীজী’ও ‘ফতওয়ায়ে আজীজী’ তাঁহার আরো দুইটি মূল্যবান কিতাব।

তাহার প্রসিদ্ধ শাগরিদগণঃ

তাঁহার সমস্ত শাগরিদগণের ফিরিস্তি দান করা সম্ভবপর নহে। এখানে শুধু এমন কতক প্রসিদ্ধ লোকের নাম করা হইতেছে যাহারা কোথাও না কোথায় হাদীছ শিক্ষায় আত্ননিয়োগ করিয়াছিলেন।

১। শাহ রফীউদ্দীন ইবনে ওলীউল্লাহ  দেহলবী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)। তিনি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর দ্বিতীয় পুত্র। তিনি  একজন গভীর জ্ঞানী লোক ছিলেন। যখন কোন বিষয় আলোচনা করিতেন শ্রোতাগণ মনে করিতেন যে, এ বিষয়ে তাহার অপেক্ষা গভীর জ্ঞানী লোক কেহই নাই। তাঁহার কোরআন পাকের উর্দু তরজমা (শাব্দিক), ‘মোকাদ্দমাতুল এলম’ ও ‘আত তাকমীল’ প্রভৃতি কিতাব সত্যই তাঁহার জ্ঞান গভীরতার পরিচয়ক। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। শাহ আহমদ ছাঈদ মুজাদ্দেদী ও তাঁহার ভাই শাহ আবদুল গনী মুজাদ্দেদী, শাহ ছাহেবের পুত্র শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)—ইহারা সকলেই শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর ন্যায় শাহ রফীউদ্দিন দেহলবীর নিকটও হাদীছ শিক্ষা করেণ।

২। শাহ আবদুল কাদের দেহলবী (১২৪১ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহর তৃতীয় পুত্র। তিনি ১১৬৭ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার কোরআন পাকের উর্দু তরজমা একটি তুলনাহীন তরজমা। বিশেষজ্ঞগনের মতে কোরআন পাকের এরূপ বিশুদ্ধতম ও সফল তরজমা দ্বিতীয়খানী নাই। ‘মুজেহুল কোরআন’ নামে তিনি উক্ত তরজমার যে পাদটীকা লিখিয়াছেন তাহাও অতি মূল্যবান। এ তরজমা ও পাদটীকায় তিনি ১৮ বৎসরকাল ব্যয় করিয়াছেন । শিক্ষাদান অপেক্ষা তিনি এবাদতেই অধিক মশগুল থাকিতেন। তাঁহার শাগরিদগণের মধ্যে ফজলে হক খায়রাবাদী, শাহ মোহাম্মদ দেহলবী, মাওলানা ইমামুদ্দীন বখশী ও মাওলানা আবদুল হাই বুঢানবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৩। শাহ আবদুল গনী দেহলবী (মৃঃ ১২২৭ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ও শাহ ইছমাঈল শহীদের পিতা।

৪। শাহ ইছরাঈল শহীদ (মৃঃ ১২৪৬ হিঃ)। তিনি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল গনী দেহলবীর পুত্র। তিনি দিল্লীতে এবং জেহাদের ছফরে অনেককে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন। মাওলানা বেলায়েত আলী ছাহেব ছফরকালেই বেরেলবীতে তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।–তারাজিম। তিনি একজন অসাধারণ জ্ঞাণী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার তাওহীদ সম্পর্কীয় কিতাব ‘তাকবীয়াতুল ঈমান’, তাছাওফ সম্পর্কীয় কিতাব ‘আকাবাত’ ও ‘ছেরাতে মোস্তাকীম’।ইমামত বা খেলাফ সম্পর্কীয় কিতাব ‘মানছাবে ইমামত’ এবং উছুলে ফেকাহ সম্পর্কীয় ‘রিছালাহ’ জ্ঞানভাণ্ডারের অমুল্য সম্পদ। তিনি ১১৯৩ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৪৬ হিঃ ছৈয়দ সাহেব বেরেলবীর সহিত শিখদের বিরূদ্ধে জেহাদে সীমান্তের বালাকোটে ‘শাহাদাত’ লাভ করেন। হাদীছে তাঁহার দুইটি কিতাব রহিয়াছেঃ

(ক) ‘তানবীরুল আইনাইন’ (আরবী................)

–তারাজিম ৯৩ পৃঃ।

১২৫৬ হিঃ ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।–খান্দানে আজীজিয়া

(খ) ‘তানকীদুল জওয়াব’ (আরবী................................)।

৫। শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)। তিনি শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর পুত্র। হাদীছ, তফছির প্রভৃতি এলমে তাঁহার অসাধারণ জ্ঞান ছিল। তিনি প্রথমে কিছু দিন এ সকল এলম শিক্ষাদানে রত থাকেনম, পরে শিক্ষাদান ছাড়িয়া কেবল এবাদতে আত্ননিয়োগ করেন। শাহ আবদুল গনী মুজাদ্দেদীর ভাই শাহ আবদুর রশিদ তাঁহার নিকট শিক্ষালাভ কারয়াছিলেন।–তারাজিম

৬।মুফতি ছদরূদ্দীন খাঁ কাশ্মীরী দেহলবী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ)। তিনি দিল্লীতেই হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি দিল্লীর ছদরুল ছুদুর ছিলেন। ‘মোন্তাহাল মাকাল’---

(আরবী.......................................) নামে হাদীছে তাহার একটি কিতাব রহিয়াছে।

৭। মাওলানা আবদুল হাই দেহলবী (মৃঃ ১২৪৩ হিঃ)। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর জামাতা। তিনি আবদুল কাদের দেহলবীর নিকটও পড়িয়াছেন। তিনি ছৈয়দ শহীদ বেরেলবীর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। মাওলানা আবদুল কায়উম বৃঢানবী, ভূপালী (মৃঃ ১২৯৯ হিঃ) তাঁহারই পুত্র।

৮। মাওলানা হাছান আলী মোহাদ্দেছ লক্ষ্ণৌবী। তিনি লক্ষ্ণৌতে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন।

৯। মাওলানা হোছাইন আহমদ মলীহাবাদী (মৃঃ ১২৭৫ হিঃ)। তিনি  লক্ষ্ণৌর নিকট মলীহাবাদেই হাদীছ শিক্ষা দেন।

১০। শাহ রউফ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)।তিনি হজরত মুজাদ্দেদে আলফে ছানীর বংশধর ছিলেন। ভূপালে বসতি স্থাপন করেন এবং তথায় হাদীছ শিক্ষা দেন। উর্দু ভাষায় ‘তফছীরে রউফি’ তাহারই রচিত।

১১। মাওলানা আবদুল খালেক দেহলবী।

১২। মাওলানা খোররম আলী বালহুরী (মৃঃ ১২৭১ হিঃ)। তিনি ছাগানীর মাশারিকুল আনওয়ার এবং শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী আরবায়ীনের উর্দূ তরজমা করেন ও পাদটীকা লিখেন।

১৩। শাহ (খাজা) আবু ছাঈদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ)। শাহ আবদু গনী মুজাদ্দেদীর পিতা। তিনি ১১৯৬ হিঃ রামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ফনুনাত তিনি মুফতি শরফুদ্দীন দেহলবীর নেকট এবং হাদীছের মোছলেম শরীফ শাহ রফীউদ্দীন নিকট শিক্ষা করেন। অতঃপর শাহ ছাহেব হইতে ছেহাহ ছেত্তার এজাজত লাভ করেন। তিনি দিল্লী ও রামপুরে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং টংকে এন্তেকাল করেন।

১৪। মাওলানা মোহাম্মদ শাকুর মাছলী শহরী (মৃঃ ১৩০০ হিঃ)। তিনি আ’জমগড়ের নিকট মাছলী শহরে হাদীছ শিক্ষা দেন।

১৫। মাওলানা জহুরুল হক কলন্দরী। তিনি পাটনায় ফুলবারী শরীফে হাদীছ শিক্ষা দেন।

১৬। মাওলানা ছৈয়দ আওলাদ হাছান কন্নুজী (মৃঃ ১২৫৭ হিঃ)। তিনি কন্নুজে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে বহু কিতাব রচনা করেন। হাদীছে তিনি ‘রাহে জান্নাত’ নামে একটি আরবায়ীনের উর্দু তরজমা করেন। নওয়াব ছিদ্দীক হাছান খাঁ ভূপালী তাহার পুত্র।

১৭। মাওলানা করমুল্লা (করীমুল্লাহ) মোহাদ্দেছ (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ)। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। মাওলানা আবদুল আজীজ তাহার ‘তফছীরে আজীজ’ তাহারই জন্য লিখিয়াছিলেন।

১৮। মাওলানা ছালামতুল্লাহ বাদায়উনী। তিনি কানপুরে হাদীছ শিক্ষা দেন।                                                                                                                --india’s 180p

১৯। মাওলানা মুফতী রশীদুদ্দীন খাঁ দেহলবী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। মাওলানা কাছেম নানুতবী ও মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহীর ওস্তাদ মাওলানা মামলুক আলী নানুতবী তাঁহার একজন বিশিষ্ট ছাত্র।----(আরবী.....................................)

২০। শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী (মৃঃ ১২৬২ হিঃ)। (তাহার পূর্ণ পরিচয় পরে আসিবে।)

২১। শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব দেহলবী (মৃঃ ১২৮৩ হিঃ মোঃ ১৮৬৬ ইং)। শাহ ইছহাক দেহলবীর ছোট ভাই। তিনি শাহ আবদুল আজিজ দেহলবীর এন্তেকালের পর স্বীয় ভ্রাতা শাহ ইছহাক ছাহেবের নিকটও হাদীছ শিক্ষা করেন ও ভ্রাতার সহিত দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেওয়ার পর সেখানেই এন্তেকাল করেন।

২২। মাওলানা আলে রছুল। তিনি মাওলানা আহমদ রেজা খাঁ বেরেলবীর ওস্তাদ ছিলেন।

২৩। মাওলানা ছৈয়দ কামরুদ্দীন হাছানী। তাহার জন্যই শাহ ছাহেব ‘উজালায়ে নাফেয়া’ কিতাবটি লিখেন।

২৪। শাহ গোলাম আলী দেহলবী। তিনি মির্জা মাজহার জানে জানানের খলীফা ছিলেন।

২৫। মাওলানা ছালামতুল্লাহ মোরাদাবাদী।

২৬। মাওলানা হায়দর আলী টংকী (মৃঃ ১২৭৭ হিঃ)।

২৭। মাওলানা আহমদুদ্দীন বাগাবী (মৃঃ ১২৮২ হিঃ)। তিনি পাঞ্জাবী হাদীছ প্রচার করিয়াছেন।---খান্দানে আজীজিয়া

২৮। মাওলানা গোলাম মুহীউদ্দীন বগবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)।

২৯। মুফতি ইলাহী বখশ ইবনে আল্লামা শায়খুল ইছলাম কান্দলবী (মৃঃ ১২০৯-এর পর)। ‘শিয়ামুল হাবীব’ নামে ছীরাতে তাহার একটি কিতাব রহিয়াছে। তিনিই মাওলানা রূমীর মসনবীর শেষ খণ্ড লিখিয়া উহাকে পূর্ণ করিয়াছেন।

তৃতীয় স্তর

শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী

[১১৭২-১২৬২ হিঃ মোঃ ১৭৫৮-১৮৪৬ ইং]

তাঁহার পিতার নাম মোহাম্মদ আফজাল ফারূকী দেহলবী। তিনি ১১৭২ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সেই স্বীয় পিতামহ শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী ও পিতামহের ভ্রাতৃদ্বয় শাহ আবদুর কাদের দেহলবী ও শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর নিকট হাদীছসহ যাবতীয় শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। পিতামহের জমানাত