কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা

প্রসঙ্গ কথা

 

মূল গ্রন্থটি পাঠ করার আগে কয়েকটি বিষয়ে পাঠকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইঃ

  •  
  • ১। এটি মাওলানা মওদুদীর নিজের সংকলিত কোনো মৌলিক হাদীস গ্রন্থ নয়, বরং এটি বিখ্যাত “মিশকাত মাসাবীহ” গ্রন্থের “ফাদায়েলুল কুরআন” ( কুরআনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা ) অংশের ব্যাখ্যা।
  •  
  • ২। এই ব্যাখ্যাও মাওলানার নিজের হাতের লিখিত নয়, ( মাওলানা লাহোরে দারসে কুরআন ও দারদে হাদীস প্রদান করতেন। তাঁর এসব দারস সাপ্তাহিক “আইন” “এসিয়া” ও কাওসার পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হতো ) এছাড়া অনেকে এগুলো টেপ রেকর্ডারের সাহায্যে রেকর্ড করে নিতেন।
  •  
  • ৩। ‘আইন’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং টেপ রেকর্ডার থেকে এ গ্রন্থটি সংকলন করেছেন জনাব হাফীযুর রহমান আহসান ( পাকিস্তান ) বক্তৃতা আকারে প্রকাশিত দারসকে তিনি গ্রন্থাকারে সাজিয়েছেন। এজন্যে তাঁকে কিছু সম্পাদনার কাজও করতে হয়েছে। এর আগে তিনি মাওলানার ‘রোযা’ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর দারসও গ্রন্থাকারে সংকলন করে প্রকাশ করেছেন।
  •  
  • ৪। মাদ্রাসা এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ যেভাবে ছাত্রদেরকে বিশেষ নিয়ম নীতি অনুসরন করে দারস দিয়ে থাকেন, কিংবা কোন মুহাদ্দিস যেভাবে হাদীসের ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করে থাকেন, এখানে সেরকম নিয়ম পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি। বরং এখানে উপস্থিত শ্রোতাদের মানসিক দক্ষতাকে সামনে রেখেই দারস পেশ করা হয়েছে।
  •  
  • ৫। একদিকে লিপিবদ্ধ গ্রন্থ এবং উপস্থিত শ্রোতাদের উপযোগী বক্তৃতা যেমন সমমানের হতে পারেনা, অপরদিকে পত্রিকার রিপোর্ট এবং টেপরেকর্ড থেকে বক্তৃতার সংকলন তৈরির ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি বিচ্চুতি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সর্বোপরি এ সংকলন তৈরি হওয়ার পর মাওলানা নিজে দেখে দিতে পারেননি। তাই এ গ্রন্থতটকে মাওলানার নিজ হাতে লেখা অন্যান্য গ্রন্থের মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক হবেনা।
  •  
  • ৬। এ যাবত যে কথাগুলি বললাম, তাহলো গ্রন্থটি প্রনয়ন সংক্রান্ত। এখন বলতে চাই গ্রন্থটির উপকারীতার কথা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সাধারন পাঠকদের জন্যে গ্রন্থটি খুবই উপকারী প্রমানিত হবে। এতে রয়েছে একদিকে হাদীস অধ্যয়নের উপকারীতা আর অপর দিকে রয়েছে সহজ সরল ব্যাখ্যা লাভের উপকারীতা।
  •  
  • ৭। এই সংকলনটি যেহেতু পবিত্র কুরআন মাজীদের মহত্ত্ব ও মর্যাদা বিষয়ক, সে কারনে আমরা এর প্রথম দিকে মাওলানার বিখ্যাত তাফসীর “তাফহীমুল কুরআনের” ভুমিকা থেকে কুরআন সংক্রান্ত কিছু জরুরি কথা সংকলন করে দিয়েছি।
  •  

 

মহান আল্লাহ তায়ালা এ গ্রন্থের সাহায্যে পাঠকমহলে পবিত্র কালামে পাকের মহত্ত্ব ও মর্যাদা অনুধাবনের তৌফিক দিন। আমীন।।

 

আব্দুস শহীদ নাসিম

 

ডিরেক্টর

 

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রিসার্চ একাডেমী, ঢাকা।

 

 

কুরআন ও কুরআনের মর্যাদা অনুধাবনের উপায়

 

কুরআন মাজীদকে বুঝতে হলে প্রারম্ভিক সুত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহন করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপ –

 

১। সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষকে একধরনের স্বাধীনতা ( Autonomy ) দান করে তাঁকে দুনিয়ায় নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।

 

২। মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন- আমিই তোমাদের এবং সমগ্র সৃষ্টিলোকের একমাত্র মালিক, মা’বুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীন নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদের বন্দেগী, পূজা ও আনুগত্য লাভের অধিকারও নেই। দুনিয়ার এই জীবনে তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্যে পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ। তোমাদের জন্যে সঠিক কর্মনীতি একটিই- তোমরা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মা’বুদ এবং শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্যে যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমরা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা মোতাবেক জীবন যাপন করবে যেন আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হয়। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্যে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা এবং নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্থিরতার মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখিরাতে প্রবেশ কালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা, দুঃখ, কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্তে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।

 

৩। এ কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য ( আদম ও হাওয়া ) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্যে বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাঁদের এবং তাঁদের সন্তান সন্তুতিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধরেরা মূর্খতা, অজ্ঞতা এবং অন্ধকারের মাঝে সৃষ্টি হননি। আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁদের জীবন সূচনা করেন সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে। তারা সত্যকে জানতেন। তাঁদেরকে জীবন বিধান ( ইসলাম ) দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর আনুগত্য ছিল তাঁদের জীবন পদ্ধতি। তারা তাঁদের সন্তানদেরকেও আল্লাহর আনুগত্য অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরনে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি ( অর্থাৎ দ্বীন ) থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে। গাফলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে একসময় তারা এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানবিক ও অমানবিক এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্ত্বাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের ( আল ইলম ) মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রন ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহ নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি ( শরীয়ত ) পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোঁক প্রবনতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্যে নিজেরাই এমন বিধান তৈরি করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন জুলুম নিপীড়নে ভরে গেছে।

 

৪। আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোর পূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে তা হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত  সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমস্ত মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্যে তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাঁর সাথে অসামঞ্জস্যশীল। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহন করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তাঁর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁকে পথ নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্যে তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে এমন একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যারা তাঁর উপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদের কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বানী। যথার্থ সত্য জ্ঞান এবং জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেরকে দান করে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্যে এদেরকে নিযুক্ত করেন।

 

৫। এরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাঁদের এ আগমনের সিলসিলা বা ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তারা সবাই একই দীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচয় করানো হয়েছিলো তারা সবাই ছিলেন তাঁরই অনুসারী। তারা সবাই ছিলে একই হিদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই মানুষের জন্যে নৈতিকতা এবং সমাজ সংস্কৃতির যে চিরন্তন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো তারা ছিলেন তাঁরই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দ্বীন ও হিদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহন করে তাঁদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উম্মতে পরিনত করেন যারা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধচারন প্রবনতা প্রতিরোধ করার জন্যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগন প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সুচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সব সময় দেখা গেছে মানব গোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহন করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহন করে উম্মতে মুসলীমার অঙ্গীভূত হয় তাঁরাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাঁদের কোন কোন উম্মত আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বানীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রন ঘটিয়ে এবং তাঁর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তাঁর চেহারাই বিকৃত করে দেয়।

 

৬। সব শেষে বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠান। ইতোপূর্বে বিভিন্ন নবীকে যে দায়িত্ব দিয়ে তিনি দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারন মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের পথভ্রষ্ট উম্মতদেরকেও তিনি আল্লাহর দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহনের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হিদায়াত পৌঁছে দেয়ার এবং এই দাওয়াত ও হিদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মতে পরিনত করাই ছিল তাঁর কাজ যারা একদিকে আল্লাহর হিদায়াতের উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্য দিকে সমস্ত দুনিয়ায় সংশোধন ও সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হিদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মহান আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন।

\r\n\r\n

কুরআনের মূল আলোচ্য

 

কুরআন সম্পর্কিত এই মৌলিক ও প্রাথমিক কথাগুলো জেনে নেয়ার পর পাথকদের জন্যে এই কিতাবের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় ও লক্ষ্য বিন্দু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা সহজ হয়ে যায়।

 

এর বিষয়বস্তু মানুষ। প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ কিসে- এ কথাই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু। এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, আপাত দৃষ্টি, আন্দাজ-অনুমান নির্ভরতা অথবা প্রবৃত্তির দাসত্ব করার কারনে মানুষ আল্লাহ, বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা, নিজের অস্তিত্ব ও নিজের পার্থিব জীবন সম্পর্কে যেসব মনগড়া মতবাদ গড়ে তুলেছে এবং ঐ মতবাদগুলোর উপর ভিত্তি করে যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে যথার্থ জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে তা সবই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিনতির দিক দিয়ে তা মানুষের জন্যে ধংসকর। আসল সত্য তাই যা মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করার সময় আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছিলেন। আর এই আসল সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের জন্যে ইতোপূর্বে সঠিক কর্মনীতি নামে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতির আলোচনা করা হয়েছে তাই সঠিক, নির্ভুল ও শুভ পরিনতির দাবীদার।

 

এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ও বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বনের প্রতি আহবান জানানো এবং আল্লাহর হিদায়াতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা। মানুষ নিজের গাফলতি ও অসতর্কতার দরুন এগুলো হারিয়ে ফেলেছে এবং তাঁর শয়তানী প্রবৃত্তির কারনে সে এগুলোকে বিভিন্ন সময়ে বিকৃত করার কাজই করে এসেছে। এই তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে কুরআন পাঠ করতে থাকলে দেখা যাবে এই কিতাবটি তাঁর সমস্ত পরিসরে কোথাও তাঁর বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে পড়েনি। প্রথম থেকে নিয়ে  শেষ পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন ধরনের বিষয়াবলী তাঁর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যেমনভাবে একটি মোতির মালার বিভিন্ন রঙের ছোট বড় মোতি একটি সুতোর বাঁধনে একসাথে, একত্রে একটি নিবিড় সম্পর্কে গাঁথা থাকে। কুরআনে আলোচনা করা হয় পৃথিবী ও আকাশের গঠনাকৃতির, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং বিশ্ব জগতের নিদর্শন সমূহ পর্যবেক্ষণের ও অতীতের বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর। কুর্বানে বিভিন্ন জাতির আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা করা হয়। এই সাথে অন্যান্য আরো বহু জিনিসের উল্লেখও করা হয়। কিন্তু মানুষকে পদার্থ বিদ্যা, জীব বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা অন্য কোন বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কুর্বানে এগুলো আলোচনা করা হয়নি। বরং প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্য সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারনা দূর করা, যথার্থ সত্যটি মানুষের মনের মাঝে গেঁথে দেয়া, যথার্থ সত্য বিরোধী কর্মনীতির ভ্রান্তি ও অশুভ পরিনতি সুস্পষ্ট করা তুলে ধরা এবং সত্যের অনুরূপ ও শুভ পরিনতির অধিকারী কর্মনীতির দিকে মানুষকে আহবান করাই এর উদ্দেশ্য। এ কারনে এতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা কেবলমাত্র ততটুকুই এবং সেই ভঙ্গিমায় করা হয়েছে যতটুকু এবং যে ভঙ্গিমায় আলোচনা করা হয় তাঁর মূল লক্ষ্যের জন্যে প্রয়োজন। প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সব সময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য ও একাত্মতা সহকারে তাঁর সমস্ত আলোচনা ‘ইসলামী দাওয়াতের’ কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে-----------।

\r\n\r\n

কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি

 

কুরআন একটি অসাধারন গ্রন্থ। দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ অসংখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনের দিকে এগিয়ে আসে। এদের সবার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোন পরামর্শ দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এই বিপুল সংখ্যক অনুসন্ধানীদের মধ্যে যারা একে বুঝতে চান এবং এ কিতাবটি মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভুমিকা পালন করে এবং তাঁকে কিভাবে পথ দেখায়- একথা জানতে চান- আমি কেবল তাঁদের ব্যাপারেই আগ্রহী। এই ধরনের লোকদের কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি এখানে কিছু পরামর্শ দেবো। আর এই সংগে সাধারন লোকেরা এ ব্যাপারে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তারও সমাধান করার চেষ্টা করবো। কোন ব্যক্তি কুরআনের উপর ঈমান রাখুন আর নাই রাখুন তিনি যদি এই কিতাবকে বুঝতে চান তাহলে সর্বপ্রথম তাঁকে তাঁর নিজের মন- মস্তিষ্ককে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অনুকূল – প্রতিকুল উদ্দেশ্য ও স্বার্থ চিন্তা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করতে হবে। এ কিতাবটি বুঝার ও হৃদয়ঙ্গম করার নির্ভেজাল ও আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। যারা মনের মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা পূর্বে রেখে এ কিতাবটি পড়েন তারা এর বিভিন্ন ছত্রের মাঝখানে নিজেদের চিন্তাধারাই পড়ে যেতে থাকেন। আসল কুরআনের সামান্য বাতাসটুকুও তাঁদের গায়ে লাগেনা। দুনিয়ার যেকোন বই পড়ার ব্যাপারেও এ ধরনের অধ্যয়ন রীতি ঠিক নয়। আর বিশেষ করে কুরআন তো এই ধরনের পাঠকদের জন্যে তাঁর অন্তর্নিহিত সত্য ও গভীর তাৎপর্যময় অর্থের দুয়ার কখনোই উন্মুক্ত করে না।

 

তারপর যে ব্যক্তি কুরআন সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান লাভ করতে চায় তাঁর জন্য সম্ভবত একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু যে এর অর্থের গভীরে নামতে চায় তাঁর জন্যে তো দুইবার পড়ে নেয়াও যথেষ্ট হতে পারে না। অবশ্যই তাঁকে বার বার পড়তে হবে। প্রতি বার একটি নতুন ভংগিমায় পড়তে হবে। একজন ছাত্রের মতো পেন্সিল ও নোট বই সাথে নিয়ে বসতে হবে। জায়গা মতো প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করতে হবে। এভাবে যারা কুরআন পড়তে প্রস্তুত হবে, কুরআন যে চিন্তা ও কর্মধারা উপস্থাপন করতে চায় তাঁর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনটা যেন তাঁদের সামনে ভেসে উঠে- কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাঁদের অন্ততপক্ষে দুইবার এই কিতাবটি পড়তে হবে। এই প্রাথমিক অধ্যয়নের সময় তাঁদের কুরআনের সমগ্র বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাপক  ভিত্তিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। তাঁদের দেখতে হবে, এই কিতাবটি কোন কোন মৌলিক চিন্তা পেশ করে এবং সে চিন্তাধারার উপর কিভাবে জীবন ব্যবস্থার অট্টালিকার ভিত গড়ে তোলে? এ সময়কালে কোন জায়গায় তাঁর মনে যদি কোন প্রশ্ন জাগে বা কোন খটকা লাগে, তাহলে তখনি সেখানেই সেসম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সেটি নোট করে নিতে হবে এবং ধৈর্যসহকারে সামনের দিকে অধ্যয়ন জারী রাখতে হবে। সামনের দিকে কোথাও না কোথাও তিনি এর জবাব পেয়ে যাবেন, এরি সম্ভাবনা বেশী। জবাব পেয়ে গেলে নিজের প্রশ্নের পাশাপাশি সেটি নোট করে নেবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যয়নের পর নিজের কোন প্রশ্নের জবাব না পেলে ধৈর্য সহকারে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করতে হবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দ্বিতীয় বার গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করার পর কালেভদ্রে কোন প্রশ্নের জবাব অনুদঘাটিত থেকে গেছে।

 

এভাবে কুরআন সম্পর্কে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী লাভ করার পর এর বিস্তারিত অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাঠককে অবশ্যি কুরআনের শিক্ষার এক একটি দিক পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পর নোট করে নিতে হবে। যেমন মানবতার কোন ধরনের আদর্শকে কুরআন পসন্দনীয় গণ্য করেছে অথবা মানবতার কোন ধরনের আদর্শ তাঁর কাছে ঘৃণার্হ এবং প্রত্যাখ্যাত এ কথা তাঁকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্যে তাঁকে নিজের নোট বুকের মধ্যে একদিকেলিখতে হবে ‘পসন্দনীয় মানুষ’ আবার আওন্নদিকে লিখতে হবে ‘অপসন্দনীয় মানুষ’ এবং উভয়ের নীচে তাঁদের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য লিখতে রাখতে হবে। অথবা যেমন, তাঁকে জানার চেষ্টা করতে হবে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল এবং কোন কোন জিনিসকে সে মানবতার জন্যে ক্ষতিকর ও ধংসাত্নক গণ্য করে – এ বিষয়টিকেও সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে জানার জন্যে আগের পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ নোট বইতে কল্যাণের জন্য ‘অপরিহার্য বিষয় সমূহ’ এবং ক্ষতির জন্য ‘অনিবার্য বিষয় সমূহ’ – এই শিরোনাম দুটি পাশাপাশি লিখতে হবে। অতঃপর প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করার সময় সংশ্লিষ্ট বিষয় দুটি সম্পর্কে নোট করে যেতে হবে। এ পদ্ধতিতে আকীদাহ-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা, অধিকার, কর্তব্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, দলীয় সংগঠন- শৃঙ্খলা, যুদ্ধ, সন্ধি এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়াবলী সম্পর্কে কুরআনের বিধান নোট করতে হবে এবং এর প্রতি বিভাগের সামগ্রিক চেহারা কী দাড়ায়, তারপর এগুলোকে একসাথে মেলালে কোন ধরনের জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। আবার জীবনের বিশেষ কোন সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হলে এবং সে ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হলে সেই সমস্যা সম্পর্কিত প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এই অধ্যয়নের মাধ্যমে তাঁকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মৌলিক বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে। মানুষ আজ পর্যন্ত সে সম্পর্কে কি কি চিন্তা করেছে এবং তাঁকে কিভাবে অনুধাবন করেছে? কোন কোন বিষয় এখনো সেখানে সমাধানের অপেক্ষায় আছে? মানুষের চিন্তার গাড়ি কোথায় গিয়ে আটকে গেছে? এই সমাধানযোগ্য সমস্যা ও বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানার এতিই সবচেয়ে ভালো এবং সুন্দর পথ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এভাবে কোন বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন করতে থাকলে এমন সব আয়াতের মধ্যে নিজের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ায় যাবে, যেগুলো ইতোপূর্বে কয়েকবার পড়া হয়ে থাকলেও এই তত্ত্ব সেখানে লুকিয়ে আছে একথা ঘুনাক্ষরেও মনে জাগে নি।

\r\n\r\n

কুরআনের প্রানসত্তা অনুধাবন  

 

কিন্তু কুরআন বুঝার এই সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে কাজ করার বিধান ও নির্দেশ নিয়ে কুরআন এসেছে কার্যত ও বাস্তবে তা না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কুরআনের প্রানসত্তার সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেনা। এটা নিছক কোন মতবাদ বা চিন্তাধারার বই নয়। কাজেই আরাম কেদারায় বসে বসে এ বইটি পড়লে এর সব কথা বুঝতে পারা যাবার কথা নয়। দুনিয়ার প্রচলিত ধর্ম চিন্তা অনুযায়ী এটি নিছক একটি ধর্ম গ্রন্থও নয়। মাদ্রাসায় ও খানকায় বসে এর সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। শুরুতে ভুমিকায় বলা হয়েছে, এটি একটি দাওয়াত এবং আন্দোলনের কিতাব। সে এসেই এক নিরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে নির্জন ও নিঃসংগ জীবন ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহ বিরোধী দুনিয়ার মোকাবেলায় দাড় করিয়ে দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। যুগের কুফরী, ফাসেকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। সচ্চরিত্র সম্পন্ন সত্যনিষ্ঠ লোকদেরকে প্রতিটি গ্রহান্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাঁদের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তির আহবানের মাধ্যমে নিজের কাজ শুরু করে খিলাফতে ইলাহিয়ার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ণ তেইশ বছর এই কিতাবটি এই বিরাট ও মহান ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছে। হক ও বাতিলের এই সুদীর্ঘ এবং প্রানান্তকর সংঘর্ষকালে প্রতিটি মঞ্জিল ও প্রতিটি পর্যায়েই সে একদিকে ভাংগার পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং অন্যদিকে পেশ করেছে গড়ার নকশা। এখন বলুন, যদি আপনি ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দ্বীন ও কুফরীর সংগ্রামে অংশগ্রহণই না করেন, যদি এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মনযিল অতিক্রম করার সুযোগই আপনার না ঘটে, তাহলে নিছক কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করলে তাঁর সমুদয় তত্ত্ব কেমন করে আপনার সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে? কুরআনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি নিজেই কুরআনের দাওয়াত নিয়ে উঠবেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ শুরু করবেন এবং এই কিতাব যেভাবে পথ দেখায় সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে থাকবেন। একমাত্র তখনই, কুরআন নাযীলের সময়কালীন অভিজ্ঞতাগুলো আপনি লাভ করতে সক্ষম হবেন। মক্কা ও হাবশা ( বর্তমান ইথিওপিয়া ও তায়েফের মনজিলও আপনি দেখাবেন ) বদর ও উহুদ থেকে শুরু করে হুনাইন ও তাবুক পর্যন্ত মনজিল আপনার সামনে এসে যাবে। আপনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মুখোমুখি হবেন। মুনাফিক ও ইহুদীদের সাক্ষাতও আপনি পাবেন। ইসলামের প্রথম যুগের উৎসর্গিত প্রান মুমিন থেকে নিয়ে দুর্বল হৃদয়ের মুমিন পর্যন্ত সবার সাথেই আপনার দেখা হবে। এটা এক ধরনের ‘সাধনা’। একে আমি বলি ‘কুরআনী সাধনা’।  এই সাধনা পথে ফুটে ওঠে এক অভিনব দৃশ্য। এর যতগুলো মনযিল অতিক্রম করতে থাকবেন তাঁর প্রতিটি মনযিলে কুরআনের কিছু আয়াত ও সূরা আপনা আপনি আপনার সামনে এসে যাবে। তারা আপনাকে বলতে থাকবে – এই মনযিলে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলো এবং সেখানে এই বিধানগুলো এনেছিল। সে সময় অভিধান, ব্যাকরন ও অলংকার শাস্ত্রীয় কিছু তত্ত্ব সাধকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু কুরআনের নিজের প্রানসত্তাকে তাঁর সামনে উন্মুক্ত করতে কার্পণ্য করবে, এমনটি কখনো হতে পারে না।

 

আবার এই সাধারন নিয়ম অনুযায়ী মানুষ ততক্ষন পর্যন্ত কুরআনের বিধানসমুহ, তাঁর নৈতিক শিক্ষাবলী, তাঁর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধি বিধান এবং জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে তাঁর প্রনীত নীতি নিয়ম- ও আইনসমূহ বুঝতে পারবে না যতক্ষন না সে নিজের বাস্তব জীবনে এগুলো কার্যকর করে দেখবে। যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের অনুসৃতি নেই সে তাঁকে বুঝতে পারবে না। আর যে জাতির সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান কুরআন বিবৃত পথ ও কর্মনীতির বিপরীত দিকে চলে তাঁর পক্ষেও এসবের সাথে পরিচিত হয়ে সম্ভবপর নয়।

\r\n\r\n

কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা

 

কুরআন সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে পথ দেখাবার দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে, এ কথা সবাই জানে। কিন্তু কুরআন পড়তে বসেই কোন ব্যক্তি দেখতে পায়, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর নাযিল হওয়ার সমকালীন আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করেই তাঁর বক্তব্য পেশ করেছে।  তবে কখনো কখনো মানব জাতি ও সাধারন মানুষকেও সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এমন সব কথা বলে যা আরববাসীদের রুচি-অভিরুচি, আরবের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ইতিহাস ও রাজনীতির সাথেই সম্পর্কিত। এসব দেখে এক ব্যক্তি চিন্তা করতে থাকে, সমগ্র মানব জাতিকে পথ দেখাবার জন্যে যে কিতাবটি অবতীর্ণ হয়েছিলো তাঁর মধ্যে সাময়িক, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়সমূহ ও উপাদান এতো বেশী কেন? এ বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারনে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে ; তারা মনে করেন, সম্ভবত এ কিতাবটি সমকালীন আরববাসীদের সংশোধন ও সংস্কারের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীকালে জোর পূর্বক টানা হেঁচড়া করে তাঁকে চিরন্তনভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্য জীবন বিধান রূপে গণ্য করা হয়েছে।

 

যে ব্যক্তি নিছক অভিযোগ হিসেবে নয় বরং বাস্তবে কুরআন বুঝার জন্যে এ ধরনের অভিযোগ আনেন তাঁকে আমি একটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে কুরআন পড়ার সময় সেই সব স্থানগুলো একটু দাগিয়ে রাখুন যেখানে কুরআন কেবলমাত্র আরবদের জন্য এবং প্রকৃত পক্ষে স্থান, কাল ও সময় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এমন আকীদা- বিশ্বাস, চিন্তা বা ভাবধারা অথবা নৈতিক বিধান বা কার্যকর নিয়ম কানুন উপস্থাপন করা হয়েছে। কুরআন একটি বিশেষ স্থানে একটি বিশেষ যুগের লোকদেরকে সম্বোধন করে তাঁদের মুশরীকি বিশ্বাস ও রীতি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁদের আসে পাশের জিনিসগুলোকে ভিত্তি করে তাওহীদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমান দাড় করায়- নিছক এতোটুকু কথার ভিত্তিতে কুরআনের দাওয়াত ও তাঁর আবেদন স্থানীয় ও সাময়িক- এ কথা বলা যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শিরকের প্রতিবাদে সে যা কিছু বলে তা কি দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিটি শিরকের ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে খাপ খেয়ে যায় না যেমন আরবের মুশরিকদের শিরকের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিলো? সেই একই যুক্তি প্রমাণগুলোকে কি আমরা প্রতিটি যুগের ও প্রতিটি দেশের মুশরিকদের চিন্তার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না? আর তাওহীদের প্রমান ও প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনী প্রমা পদ্ধতিকে কি সামান্য রদবদল করে সব সময় ও সব জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে না? জবাব যদি ইতবাচক হয়ে থাকে, তাহলে একটি বিশ্বজনীন শিক্ষা কেবলমাত্র একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ জাতিকে সম্বোধন করা দান করা হয়েছিলো বলেই তাঁকে স্থানীয় ও সাময়িক বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন দর্শন, জীবন- ব্যবস্থা ও চিন্তা দর্শন নেই যার প্রথম থেকে নিয়ে শেষ  পর্যন্ত সমস্ত কথাই বস্তু নিরপেক্ষ ( Abstract ) বর্ণনা ভংগিতে পেশ করা হয়েছে। বরং কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তাঁর ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এ ধরনের পূর্ণ বস্তু নিরপেক্ষতা সম্ভন নয়। আর সম্ভন হলেও তা নিছক কাজীর গরুর মতো খাতাপত্রেই থাকবে, গোয়ালে তাঁর নাম নিশানাও দেখা যাবে না। কাজেই মানুষের জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তাঁর পক্ষে কোন বাস্তব বিধানের রূপ নেয়া কোন দিনই সম্ভব হবে না।

 

তাছাড়া কোন চিন্তামূলক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে চাইলে তাঁর জন্যে আদৌ এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং যথার্থই বলতে হয়, শুরু থেকেই তাঁকে আন্তর্জাতিক বানাবার চেষ্টা করা তাঁর জন্য কল্যাণকরও নয়। আসলে তাঁর জন্য সঠিক ও বাস্তব সম্মত পন্থা একটিই। এই আন্দোলনটি যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও মুলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবনের ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাঁকে পূর্ণ শক্তিতে সেই দেশেই প্রবেশ করতে হবে যেখান থেকে তাঁর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে। সেই দেশের লোকদের মনে এই দাওয়াতের তাৎপর্য অঙ্কিত করে দিতে হবে, যাদের ভাষা, স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও আচরনের সাথে আন্দোলনের আহবায়ক নিজে সুপরিচিত। তারপর তাঁকে নিজের দেশেই ঐ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত করে তাঁর ভিত্তিতে একটি সফল জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ স্থাপন করতে হবে। তবেই তো দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাঁদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী স্বতঃস্ফ্রুতভাবে এগিয়ে এসে তাঁকে অনুধাবন করতে ও নিজের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে। কাজেই কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থাকে প্রথমে শুধুমাত্র একটি জাতির সামনে পেশ করা হয়েছিলো এবং কেবলমাত্র তাদেরকেই বুঝাবার ও নিশ্চিন্ত করার জন্য যুক্তি প্রদর্শনের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেই তা একটি নিছক জাতীয় দাওয়াত ও আন্দোলন- একথা বলার পেছনে কোন যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় ও একটি আন্তর্জাতিক এবং একটি সাময়িক ও একটি চিরন্তন ব্যবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার বিশেষত্বগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে-

 

জাতীয় ব্যবস্থা হয় একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য বা তাঁর বিশেষ অধিকারসমূহের দাবীদার। অথবা তাঁর নিজের মধ্যে এমন কিছু নীতি ও মতাদর্শ থাকে যা অন্যান্য জাতির মধ্যে ঠাই পেতে পারে না। বিপরীত পক্ষে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সকল মানুষের মর্যাদা  হয় সমান, তাঁদের সমান অধিকার দিতেও সে প্রস্তুত হয় এবং তাঁর নীতিগুলোর মধ্যেও বিশ্বজনীনতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে একটি সাময়িক ব্যবস্থা অবশ্যি এমন কিছু নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁর সমস্ত কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। আর এর বিপরীত পক্ষে একটি চিরন্তন ব্যবস্থার নীতিগুলো সব রকমের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলে। এই বিশিষ্টগুলো দৃষ্টির সামনে রেখে যদি কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করেন বা বিষয়গুলোর কারনে সত্যি সত্যিই কুরআন উপস্থাপিত ব্যবস্থাকে সামটিক বা জাতীয় হবার ধারনা পোষণ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এতে সন্দেহ নেই।

\r\n\r\n

পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান

 

কুরআন সম্পর্কে একজন সাধারন পাঠকও শুনেছেন যে, এটি একটি বিস্তারিত পথ নির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা ও বিধি- বিধানের সন্ধান সে পায় না। বং সে দেখে নামাজ ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও, যার উপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তাঁর জন্যও এখানে যাবতীয় বিধি বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয় নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন অর্থে একটি পথ নির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে থাকার কারনেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটি নাযিল করেন নি, তিনি এই সাথে একজন পয়গম্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে কেবলমাত্র একটি গৃহ নির্মাণের নক্সা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিঃসন্দেহে গৃহ নির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহ নির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সরকারীভাবে নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারাতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর ইমারাতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নকশার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুঁটি নাটি  বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্সাটার বিরুদ্ধে অসম্পূর্ণতার অভিযোগ আনা কোনমতেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন সম্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতাবে মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমান ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত রীতি-নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না এবং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোনে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন পথে হওয়া উচিৎ, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবন ধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল। দুনিয়াবাসীর সামনে কুরআন প্রদত্ত মুলনীতির ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।

 

   ( তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা থেকে )

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

\r\n\r\n

কুরআন শিক্ষাদানকারীর মর্যাদা

 

আরবী****

 

১। হযরত উসমান ( রাঃ ) থেকে বর্ণিততিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যদের তা শিক্ষা দেয়-  তিনিই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ( সহীহ বুখারী )

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানীর তাৎপর্য এই যে, যে ব্যক্তি নিজে সর্বপ্রথম কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করে, অতঃপর আল্লাহর বান্দাদের কাছে তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করে – তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম মানুষ।

\r\n\r\n

কুরআনের শিক্ষাদান দুনিয়ার সর্বোত্তম ধন-সম্পদের চেয়েও উত্তম

 

আরবী*****

 

২। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ( তাঁর হুজরা  থেকে ) বেড়িয়ে আসলেন আমরা তখন সুফফায় ছিলাম তিনি বললেন, তোমাদের কে এটা পছন্দ করে যে, সে প্রতিদিন বোথহান বা আকীকে যাবে এবং উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি উট নিয়ে আসবে কোনরূপ অপকর্ম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই? আমরা সবাই বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই এটা পছন্দ করে তিনি বললেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি মসজিদে যাবে এবং আল্লাহর কিতাব থেকে দুটি আয়াত লোকদের শিক্ষা দেবে অথবা পাঠ করবে, তার এ কাজ প্রতিদিন দুটি করে উট লাভ করার চেয়েও অধিক মূল্যবান যদি সে তিনটি আয়াত শিক্ষা দেয় অথবা পড়ে তাহলে এটা তিনটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম এভাবে যতগুলো আয়াত শিখানো হবে অথবা পড়বে তত সংখ্যক উট লাভ করার চেয়ে উত্তম -----( সহীহ মুসলিম )

 

মসজিদের নববীর চত্তরকে সুফফা বলা হতো। এর উপরে ছাপরা দিয়ে তা মসজিদে নববীর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। মক্কা মুয়াযযামা এবং আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে যেসব মুসলিম হিজরত করে মদিনায় এসেছিলেন তারাই এখানে অবস্থান করতেন। তাঁদের কোন বাড়ি-ঘরও ছিলো না এবং আয়- উপার্জনও ছিলো না। মদীনার আনসারগন এবং অপরাপর মুহাজিরগন যে সাহায্য করতেন তাতেই তাঁদের দিন চলতো। এসব লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে সারাক্ষন উপস্থাইত থাকতেন। বলতে গেলে তারা ছিলেন একটি স্থায়ী আবাসিক প্রতিস্থানের ছাত্র। বোতহান এবং আকীক মদিনা তাইয়েবার সাথে সংযুক্ত দুটি উপত্যকার নাম। একটি মদিনার দক্ষিন পার্শে এবং অপরটি উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত ছিল। এই দুটি উপত্যকা এখনো বর্তমান আছে। ততকালে এই দুই স্থানে উটের বাজার বসতো। হুজুর ( সাঃ ) অর্থহীন, সম্পদহীন সুফফাবাসীদের সম্বোধন করে বললেন, ভাই, তোমাদের কে দৈনিক বোতহান এবং আকীকে গিয়ে উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি করে উট বিনামূল্যে নিয়ে আসতে চায়? তারা আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই তা ভালবাসবে। অতঃপর তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে কেউ অপরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিক্ষা দিলে তা বিনামূল্যে দুটি উৎকৃষ্ট উট লাভ করার চেয়েও উত্তম। এভাবে সে যতগুলো আয়াত কাউকে শিক্ষা দেবে তা তত পরিমান উট পাওয়ার চেয়েও উত্তম বলে বিবেচিত হবে। লক্ষ্য করুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষন পদ্ধতি কি অসাধারন ছিল। তিনি জানতেন, এই সুফফাবাসীরা শুধু এ কারনে নিজেদের বাড়ি- ঘর পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন যে, তারা আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহন করে নিয়েছিলেন এবং পার্থিব সুযোগ- সুবিধাকে তারা মোটেই পছন্দ করতেন না। তাঁদেরকে বাধ্য হয়ে নিজেদের বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। শয়তান তাঁদের এই নিঃসম্বল অবস্থার সুযোগ নিতে পারে এই আশংকায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুকৌশলে তাঁদের চিন্তাধারার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। এবং বললেন- তোমরা যদি আল্লাহর বান্দাদের কুরআন পাঠ করে শুনাও এবং তাঁদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও তাহলে এটা তোমাদের হাতে বিনামূল্যে উট এসে যাওয়ার চেয়েও অধিক উত্তম হবে। তোমরা যদি অন্যদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিখিয়ে দাও তাহলে এটা বিনামূল্যে দুটি ভালো উট লাভ করার চেয়ে অনেক কল্যাণকর। এভাবে তাঁদের মন- মগজে এ কথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর দীনের উপর ঈমান এনে থাকো এবং এই দীনের খাতিরেই হিজরতের পথ বেছে নিয়ে এখানে এসে থাকো তাহলে এখন সেই দীনের কাজেই তোমাদের সময় এবং শ্রম ব্যয়িত হওয়া উচিৎ যে জন্য তোমরা বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে এসেছ। তোমরা দুনিয়াকে পাওয়ার আকাংখা করার পরিবর্তে বরং তোমাদের সময় দীনের কাজে ব্যয়িত হওয়া উচিৎ। এতে আল্লাহর সাথে তোমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করে এবং তাঁর বান্দাদের সত্য- ন্যায়ের পথ দেখিয়ে দিয়ে তোমরা আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভের অধিক উপযোগী হতে পারো।

 

এসব লোককেই তাঁদের ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার কারনে আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনেই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক বানিয়ে দিলেন। তারা নিজেদের জীবনেই দেখে নিলেন যে, মানুষ যদি ধৈর্য সহকারে আল্লাহর দীনের পথ অবলম্বন করে তাহলে এর ফল কি হয়।

\r\n\r\n

কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ

 

আরবী****

 

৩। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁর ঘরে তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রী পেতে কি পছন্দ করে? আমরা বললাম, হ্যাঁ তিনি বললেন- তোমাদের কারো নামাজে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করা তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রীর মালিক হওয়ার তুলনায় অধিক কল্যাণকর --------( সহীহ মুসলিম )

 

            মোটা তাজা ও গর্ভবতী উস্ট্রী আরবদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে উদাহরণ পেশ করে বলেছেন- যদি তোমরা নামাজের মধ্যে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করো তবে টা তোমাদের ঘরে বিনামূল্যের তিনটি উট এসে হাজির হয়ে যাওয়ার চেয়ে অধিক কল্যাণকর। এই উদাহরণের মাধ্যমে রাসুলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমান সর্বসাধারণের মধ্যে এ কথা বদ্ধমূল করে দিতে চেয়েছেন যে, কুরআন তাঁদের জন্য কতো বড় রহমতের বাহন এবং কুরআনের আকারে কতো মূল্যবান সম্পদ তাঁদের হস্তগত হয়েছে। তাঁদের মনমগজে এই অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে যে, তাঁদের কাছে যেটা বড় থেকে বিরাটতর সম্পদ হতে পারে – কুরআন এবং এর একটি আয়াত তাঁর চেয়েও অধিক বড় উত্তম সম্পদ।

\r\n\r\n

কুরআন না বুঝে পাঠ করলেও কল্যাণের অধিকারী হওয়া যায়

 

আরবী****

 

৪। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি, কুরআন লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত এবং পুতপবিত্র ফেরেশতাদের সাথে থাকবে আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে যায় এবং অতি কষ্টে তা পাঠ করে তাঁর জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে --------( বুখারী ও মুসলিম)  

 

      কুরআন মাজীদেই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে এই কুরআনকে মহাসম্মানিত এবং অতীব পবিত্র ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ জন্য বলা হয়েছে – যে ব্যক্তি কুরআন থেকে জ্ঞান অর্জন করে, গভীর বুৎপত্তি সৃষ্টি করে এবং এ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করে সে এই ফেরেশতাদের সাথী হবে। এর অর্থ এই নয় যে, সে এই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এই ফেরেশতারা যে স্থান ও মর্যাদা লাভ করেছে তাকেও সেই মর্যাদা ও স্থানের অধিকারী করা হবে।

 

কোন কোন লোক এরূপ ধারনা করে যে, কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করে আর কি ফায়দা- যদি সে তা না বুঝে পাঠ করে। কিন্তু এরূপ ধারনা পোষণ করা ঠিক নয়। কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করার মাঝেও অনেক ফায়দা আছে। যেমন আপনি দেখতে পাবেন, এমন অনেক গ্রাম্য প্রকৃতির লোক রয়েছে যার মুখের ভাষা পরিস্কার রূপে ফুটেনা। সে অনেক কষ্ট করে এবং মাঝে মাঝে আটকে যাওয়া সত্ত্বেও কুরআন পড়তে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কেও বলেছেন যে, - তাঁর জন্যও দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। একটি পুরস্কার কুরআন তেলাওয়াত করার এবং অপরটি কুরআন পড়ার জন্য কষ্ট স্বীকার করার বা পরিশ্রম করার।

 

এখন কথা হলো, না বুঝে কুরআন পড়ার কি লাভ? এ প্রসংগে আমার প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি কি পৃথিবীতে কখনো এমন কোন লোক দেখেছেন যে ইংরেজী বর্ণমালা পড়ার পর ইংরেজী ভাষার কোন বই নিয়ে পড়তে বসে গেছে এবং এর কিছুই তাঁর বুঝে আসছে না। চিন্তা করুন, কোন ব্যক্তি কেবল এই কুরআনের সাথেই এরূপ পরিশ্রম কেন করে। সে আরবী বর্ণমালার প্রাথমিক বই নিয়ে কুরআন পাঠ শেখার অনুশীলন করে, শিক্ষকের সাহায্যে তা শেখার চেষ্টা করে, ধৈর্য সহকারে বসে তা পড়তে থাকে যদিও তাঁর বুঝে আসে না কিন্তু তবুও তা পড়ার চেষ্টা করতে থাকে – সে শেষ পর্যন্ত কেন করে থাকে? যদি তাঁর অন্তরে ঈমান না থাকতো, কুরআনের প্রতি তাঁর বিশ্বাস না থাকতো, সে যদি এটা মনে না করতো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা পাঠে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা যায়- তাহলে শেষ পর্যন্ত সে এই শ্রম ও কষ্ট কেন স্বীকার করে? পরিস্কার কথা হচ্ছে কুরআন আল্লাহর কালাম এবং কল্যাণময় প্রাচুর্যময় কালাম – এই বিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়েই সে তা পাঠ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করে। অতএব, প্রতিদান না পাওয়ার কোন কারণই থাকতে পারেনা।

 

আবার এ কথাও মনে করা ঠিক নয় যে, এমন ব্যক্তির জন্য কুরআন শিক্ষা করা এবং তা বুঝার জন্য উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। এ চেষ্টা তাঁকে অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু যে লোক মনে করে যে, কুরআন যদি কারো বুঝে না আসে তবে তা পাঠ করা তাঁর জন্য অনর্থক এবং মূল্যহীন। এরূপ ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কুরআন না বুঝে পড়ার মাঝেও নিশ্চিতই ফায়দা রয়েছে।

\r\n\r\n

যার সাথে ঈর্ষা করা যায়

 

আরবী*****

 

৫। হযরত ইবনে উমর ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- দুই ব্যক্তি ছাড়া কেউ ঈর্ষার পাত্র নয় এক, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের জ্ঞান দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ( অর্থাৎ নামাজে দণ্ডায়মান অবস্থায় তেলাওয়াত করছে অথবা তাঁর প্রচার- প্রসার বা শিক্ষা দেয়ার কাজে ব্যপৃত রয়েছে ) দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে ----( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

    এ হাদীসের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানদার- সম্প্রদায়ের চিন্তা চেতনায় যে কথা বসিয়ে দিয়েছেন, তা হচ্ছে- কোন ব্যক্তির পার্থিব উন্নতি, প্রাচুর্য এবং নামকাম কোন ঈর্ষার বস্তুই নয়। ঈর্ষার বস্তু কেবল দুই ব্যক্তি। এক, যে ব্যক্তি কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং সে দিনরাত নামাজের মধ্যে তা পাঠ করার জন্য দণ্ডায়মান থাকে, অথবা আল্লাহর বান্দাদের তা শেখানোর কাজে ব্যস্ত থাকে, তা শেখার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং এর প্রচার করে। দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে তাঁর অপচয়  না করে, বিলাসিতায় ও পাপ কাজে ব্যয় না করে বরং দিনরাত আল্লাহর নির্দেশিত পথে তা ব্যয় করে - - এ ব্যক্তিই ঈর্ষার পাত্র।

 

  এই সেই শিক্ষা যার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের দৃষ্টি ভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধন করেন এবং তাঁদেরকে নতুন মূল্যবোধ দান করেন। তিনি তাঁদেরকে বলে দিলেন, মর্যাদা ও গুরুত্ব দান করার মতো জিনিস মূলত কি এবং মানবতার উচ্চতম নমুনাই বা কি যার ভিত্তিতে তাঁদের নিজেদের গঠন করার আকাংখা ও প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ।

 

  হাদীসের মূল পাঠে বিদ্বেষ শব্দ ব্যবহার করার পরিবর্তে ঈর্ষা শব্দ ব্যবহার করার কারন হচ্ছে – ঈর্ষার এমন একটি জিনিস যা হিংসা বিদ্বেষের মতো মানুষের মনে আগুন লাগিয়ে দেয় না। হিংসা বিদ্বেষ যদিও ঈর্ষারই একটি ভাগ কিন্তু তা এতটা তীব্র যে এর কারনে মানুষের মনে আগুনের মতো একটি উত্তপ্ত জিনিস লেগেই থাকে। হাসাদ যেন এমন একটি গরম পাত্র যা প্রায়ই সারা জীবন মানুষের মনে আগুন জালিয়ে রাখে। এজন্য এখানে ঈর্ষার আবেগের তীব্রতা প্রকাশ করার জন্যে হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

 

  হাসাদের মধ্যে মূলত দোষের কারন হচ্ছে এই যে, মানুষ চায় অমুক জিনিসটি সে না পেয়ে বরং আমি পেয়ে যাই অথবা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হোক এবং আমাকে তা দেয়া হোক অথবা তা যদি আমার ভাগ্যে না জোটে তাহলে এটা যেন তারও হাতছাড়া হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে হাসাদের মূল অর্থ। কিন্তু এখানে হাসাদ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহার হয় নি।

 

 এখানে কেবল ঈর্ষার অনুভুতির প্রখরতা ব্যক্ত করার জন্যই হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের মনে যদি ঈর্ষার আগুন লাগতেই চায় তাহলে এই উদ্দেশ্যেই লাগা উচিৎ যে, তোমরা দিনরাত কুরআন শেখা এবং শেখানোর কাজে ব্যাপৃত থাকো। অথবা তুমি সম্পদশালী হয়ে থাকলে তোমার এই সম্পদ অকাতরে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, রাতদিন সর্বদা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনের জন্য, তাঁর দীনের প্রচার- প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্যয় করতে থাকো। এভাবে তুমি অন্যদের জন্যও ঈর্ষার পাত্রে পরিনত হয়ে যাও।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদের সাথে মুমিনের সম্পর্ক

 

আরবী****

 

৬। হযরত আবু মুসা আশয়ারী ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  যে মুমিন কুরআন পাঠ করে সে কমলা লেবুর সাথে তুলনীয় এর ঘ্রাণও উত্তম এবং স্বাদও উত্তম আর যে মুমিন কুরআন পাঠ করে না সে খেজুরের সাথে তুলনীয় এর কোন ঘ্রান নেই কিন্তু তা সুমিষ্ট আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে না সে মাকাল ফল তুল্য এর কোন ঘ্রাণও নেই এবং স্বাদও অত্যন্ত তিক্ত আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে সে রাইহান ফলের সাথে তুলনীয় এর ঘ্রান অত্যন্ত সুমিষ্ট কিন্তু স্বাদ অত্যন্ত তিক্ত -----------( বুখারী ও মুসলিম )

 

   অপর বর্ণনায় আছে, “যে মুমিন বাক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে সে কমলা লেবু সদৃশ। আর যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে না কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করে সে খেজুর তুল্য।”

 

 কুরআন মাজীদের মর্যাদা ও মহানত্ত হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অর্থাৎ কুরআন মাজীদ স্বয়ং একটি সুগন্ধী। মুমিন ব্যক্তি এর তেলাওয়াত করলেও সুগন্ধি ছড়াবে আর মুনাফিক ব্যক্তি পাঠ করলেও ছড়াবে।

 

  অবশ্যই মুমিন এবং মুনাফিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য তা ঈমান ও নিফাকের কারনেই হয়ে থাকে। মুমিন বাক্তি যদি কুরআন পাঠ না করে তাহলে তাঁর সুগন্ধি ছড়ায় না, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব মিষ্টি ফলের মতই সুস্বাদু। কিন্তু যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করেনা তাঁর সুগন্ধিও ছড়ায় না ও তাঁর ব্যক্তিত্ব তিক্ত এবং খারাপ স্বাদযুক্ত ফলের মতো।

 

  অপর এক বর্ণনায় আছে- যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে সে কমলা লেবু ফল- সদৃশ। আর যে মুমিন কোরআন পড়ে না কিন্তু তদানুযায়ী আমল করে সে খেজুরের সদৃশ। উল্লেখিত দুটি বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য কেবলমাত্র এতোটুকু যে, এক বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং এর উপর ঈমান রাখার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে এবং অপর বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং তদানুযায়ী কাজ করার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে। মৌলিক দিক থেকে উভয়ের প্রানসত্ত্বা একই।

\r\n\r\n

কুরআন হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতি লাভের মাধ্যম

 

আরবী****

 

৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  আল্লাহ তায়ালা এই কিতাবের ( কুরআন ) মাধ্যমে একদল লোককে উন্নত করবেন এবং অপর দলকে পতন ঘটাবেন ----- ( সহীহ মুসলিম )

 

        এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে- যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের উন্নতি বিধান করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁদের মস্তক সমুন্নত রাখবেন। কিন্তু যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে অলস হয়ে বসে থাকবে এবং তদানুযায়ী কাজ করবেন। অথবা যেসব লোক এই কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে নিম্নস্তরে নামিয়ে দেবেন। দুনিয়ায়ও তাঁদের জন্য কোন উন্নতি নেই এবং আখেরাতেও কোন সুযোগ- সুবিধা নেই।

\r\n\r\n

 কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনে ফেরেশতারা সমবেত হয়

 

আরবী****

 

৮। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত উসাইদ ইবনে হুদাইর ( রাঃ ) বলেন যে, তিনি একরাতে নিজের ঘরে বসে নামাজের মধ্যে সূরা বাকারা পড়ছিলেন তাঁর ঘোড়াটি নিকটেই বাধা ছিল হঠাৎ ঘোড়াটি লম্ফ- ঝম্ফ শুরু করে দিলো তিনি তখন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন ঘোড়াটি শান্ত হয়ে গেলো তিনি যখন পুনরায় তেলাওয়াত শুরু করলেন ঘোড়াটি আবার লাফ-ঝাপ শুরু করে দিলো অতঃপর তিনি পাঠ বন্ধ করলেন ঘোড়াটিও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো তিনি আবার কুরআন পড়া শুরু করলে ঘোড়াটিও দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলো তিনি সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করে নিলেন কারন তাঁর ছেলে ইয়াহিয়া ঘোড়ার নিকটেই ছিল তাঁর ভয় হল ঘোড়া হয়তো লাফালাফি করে ছেলেকে আহত করতে পারে তিনি ছেলেকে এর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে আসমানের দিকে মাথা তুললেন তিনি ছাতার মত একটি জিনিস দেখতে পেলেন এবং তাঁর মধ্যে আলোকবর্তিকার মতো একটি জিনিস দেখলেন  সকালবেলা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি বললেন- হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? রাবী বলেন- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার ভয় হল ঘোড়াটি না আবার আমার ছেলে ইয়াহিয়াকে পদদলিত করেকেননা সে এর কাছেই ছিল আমি নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে ছেলেটির কাছে গেলাম আমি আসমানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎ দেখতে পেলাম- যেন একটি ছাতা এবং তাঁর মধ্যে একটি আলোকবর্তিকা জ্বলজ্বল করছে

 

আমি ( ভয় পেয়ে ) সেখান থেকে চলে আসলাম ( অর্থাৎ খোলা আকাশের নীচ থেকে ) যেন আমার দৃষ্টি পুনরায় সেদিকে না যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তুমি কি জান এগুলো কি? তিনি বললেন, না রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) বললেন- এরা ছিল ফেরেশতা তোমার কুরআন পড়ার আওয়াজ শুনে তারা কাছে এসে গিয়েছিলো তুমি যদি তেলাওয়াত অব্যাহত রাখতে তাহলে তারা ভর পর্যন্ত অপেক্ষা করতো এবং লোকেরা তাঁদের দেখে নিতো কিন্তু তারা লোক চক্ষুর অন্তরাল হতো না ----- ( বুখারী ও মুসলিম )

 

      এটা কোন জরুরী কথা নয় যে, যখনই কোন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে এবং সেও অনুরূপ ঘটনার সম্মুখীন হবে।  স্বয়ং হযরত উসাইদ ইবনে হুদাইরের সামনে প্রত্যহ এরূপ ঘটনা ঘটতো না। তিনি তো সবসময়ই কুরআন পাঠ করতেন। কিন্তু এই দিন তাঁর সামনে এই বিশেষ ঘটনাটি ঘটে- যে সম্পর্কে আমরা জানি না যে, তা কেন ঘটলো। ইহা তাহার একটি বিশেষ ‘কারামাত’ যাহা সব সময় প্রকাশ পায় না। এই জন্যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেননি যে, তোমার সামনে হামেশাই এরূপ ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ প্রতিদিন রাতে তুমি যদি এভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকো তাহলে ভোরবেলা এরূপ ঘটনা ঘটবে যে, ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে থাকবে আর লোকেরা তাদের দেখে নেবে। এর পরিবর্তে তিনি বলেছেন- পুনরায় যদি কখনো এরূপ ঘটে তাহলে তুমি নিশ্চিন্তে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। এর মধ্যে কোন শংকার কারন নেই।

 

 কিন্তু আজকাল আমরা এরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি না কেন? আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ প্রত্যেকের সাথে এরূপ ঘটনা ঘটান না। তিনি তাঁর প্রতিটি মাখলুক এমনকি প্রতিটি ব্যক্তির সাথে ভিন্ন ভিন্ন আচরন করে থাকেন। তিনি প্রতিটি ব্যক্তিকেই সব কিছু দেননি। আর এমন কেউ নেই যাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকেন।

\r\n\r\n

কুরআন পাঠকারীদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়

 

আরবী****

 

৯। হযরত বারআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি সূরা কাহফ পড়ছিল এবং তাঁর নিকটেই একটি ঘোড়া দুইটি দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এ সময় একটি মেঘখণ্ড তাঁর উপর ছায়া বিস্তার করলো এবং ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসতে লাগলো তা যতো নীচে আসতে থাকলো তাঁর ঘোড়া ততই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলো যখন ভোর হল তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লামের কাছে এসে তাঁকে এ সম্পর্কে অবহিত করলো তিনি বললেন- এটা হলো প্রশান্তি যা কুরআনের সাথে নাযিল হচ্ছিলো ---( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 পূর্ববর্তী হাদীসে উল্লেখিত ফেরেশতাদের পরিবর্তে এখানে প্রশান্তি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশান্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করা বড়ই কঠিন। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জায়গায় ‘সাকীনাহ’ ( প্রশান্তি ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।  আল্লাহ তায়ালার সেই রহমত বা অনুগ্রহ যা মানুষের মনে প্রশান্তি, নিশ্চিন্ততা ও শীতলতা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে আত্মিক দিক থেকে অনাবিল শান্তি অনুভব করে তাঁর জন্যে ‘সাকীনাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি বিশেষ সাহায্য আসতে থাকে তবে তা বুঝানোর জন্যেও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব, এটা মুশকিল যে, এখানে কি এ শব্দটি ‘ফেরেশতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অথবা আল্লাহর এমন কোন করুনার কথা বুঝানো হয়েছে যা সেই ব্যক্তির নিকটতর হচ্ছিলো।

 

  এরূপ ঘটনাও সবার ক্ষেত্রে সংঘটিত হয় না এবং স্বয়ং ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সব সময় ঘটেনি। এটা এমন একটি বিশেষ অবস্থা ছিল যা ঐ ব্যক্তির সামনে প্রতিভাত হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এর অর্থ তাৎপর্য বলে দেয়ার জন্যে বর্তমান না থাকতেন  তাহলে ঐ ব্যক্তি সব সময় অস্থিরতার মধ্যে কালাতিপাত করতো যে, তাঁর সামনে এটা কি ঘটে গেলো।

 

 উল্লেখিত দুইটি হাদীসেই এই বিশেষ অবস্থায় ঘোড়ার দৌড় এবং লম্ফ-ঝম্ফের কথা বলা হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, কোন কোন সময় পশু-পাখি এমন সব জিনিস দেখতে পায় যা মানুষের চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। আপনারা হয়তো একথা পড়ে থাকবেন যে, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পূর্বেই পাখিরা লুকিয়ে যায়। চতুষ্পদ জন্তুগুলো পূর্বক্ষণেই জানতে পারে যে, কি ঘটতে যাচ্ছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাব হওয়ার পূর্বেই কুকুর এবং অন্যান্য প্রানী চিৎকার শুরু করে দেয়। এর মূল কারন হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে এমন কিছু ইন্দ্রীয় শক্তি দান করেছেন যা মানব জাতিকে দেওয়া হয় নি। এর ভিত্তিতে বাকশক্তিহীন প্রাণীগুলো এমন কতগুলি বিষয়ের জ্ঞান অথবা অনুভূতি লাভ করতে পারে যা মানুষের জ্ঞান অনুভুতির সীমা বহির্ভূত।

\r\n\r\n

সূরা ফাতিহার ফযিলত

 

আরবী*****

 

১০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “যে ব্যক্তি এমন নামাজ পড়লো, যার মধ্যে উম্মুল কুরআন ( সূরা ফাতিহা ) পাঠ করে নি- তাঁর নামাজ অর্থ ও মূল্যহীন থাকে যাবে (রাবী বলে ) একথাটি তিনি তিনবার উল্লেখ করলেন “তাঁর নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে” আবু হুরাইরাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা যখন ইমামের পিছনে নামাজ পড়বো, তখন কি করবো? তিনি জবাবে বললেন- তখন মনে মনে পাঠ করো কেননা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “মহান আল্লাহ বলেন, আমি নামাজকে আমার এবং বান্দার মাঝে দুই সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছি বান্দাহ যা চাইবে আমি তাকে তা দান করবো বান্দাহ যখন বলে, “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ( যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক ), তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন- বান্দাহ আমার প্রশংসা করেছে যখন সে বলে, আর-রাহমানির রাহীম ( তিনি দয়াময়, তিনি অনুগ্রহকারী ), তখন মহামহিম আল্লাহ বলেন, বান্দাহ আমার মর্যাদা স্বীকার করেছে এবং আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বান্দাহ যখন বলে, ইয়াকা না’বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তায়িন ( আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার এবং বান্দার মাঝে ( অর্থাৎ বান্দাহ আমার ইবাদাত করবে, আর আমি তাঁর সাহায্য করবো ), আমার বান্দাহ যা চায়, আমি তা দেবো যখন বান্দাহ বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম অলাদ্দ দোয়াল্লিন ( আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন, সেই সব বান্দাহদের পথে যাদের আপনি নিয়ামত দান করেছেন, যারা অভিশপ্তও নয় এবং পথ ভ্রষ্টও নয় ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার বান্দার জন্যে এবং আমার বান্দা যার প্রার্থনা করেছে তা সে পাবে”----- ( মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ )

\r\n\r\n

ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ

 

  জামায়াতে নামাজ পরাকালীন সময়ে মুক্তাদিগনকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। আবু হুরাইয়ারহ বলেছেন, মুক্তাদিগন চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠ করে নিবে। ইমাম শাফেয়ীর মতে মুক্তাদিগনকে সর্বাবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। ইমাম আবু হানিফার মতে, কোন অবস্থায়ই মুক্তাদিগন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের মতে, ইমাম ফাতিহা পাঠের শব্দ যদি মুক্তাদিগনের কানে আসে তাহলে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না, বরং ইমামের পাঠ মনোযোগ সহকারে শুনবে। কিন্তু ইমামের ফাতিহা পাঠের শব্দ মুক্তাদিগনের কানে না আসলে তারা ফাতিহা পাঠ করবে।

 

 ইমাম আবু হানীফা প্রথম দিকে অনুচ্চ শব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে মুক্তাদিগনের সূরা ফাতিহা পাঠ করার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশিষ্ট হানাফী আলেম আল্লামা মোল্লা আলী কারী, আবু হাসান সিন্ধী, আব্দুল হাই, রশীদ আহমাদ নিঃশব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন ( হক্কানী তাফসির- মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী।

 

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন, ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আমি যতটুকু অনুসন্ধান করেছি তাঁর আলোকে অধিকতর সঠিক পন্থা হচ্ছে এই যে, ইমাম যখন উচ্চস্বরে ফাতিহা পাঠ করবে, মুক্তাদিগন তখন চুপ থাকবে। আর ইমাম যখন নিঃশব্দে ফাতিহা পাঠ করবে, তখন মুক্তাদীরাও চুপে চুপে ফাতিহা পাঠ করবে। এই পন্থায় কুরআন ও হাদীসের কোন নির্দেশের বিরোধিতা করার কন সন্দেহ থাকে না। ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল সামনে রেখে এরূপ একটি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।

 

 কিন্তু যে ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইমামের পেছনে ফাতিহা পাঠ করে না, অথবা সর্বাবস্থায় ফাতিহা পাঠ করে আমরা এটা বলতে পারিনা যে, তাঁর নামাজ হয় না। কেননা উভয় মতের স্বপক্ষে দলীল আছে এবং এই ব্যক্তি জেনে বুঝে উদ্দেশ্যমুলকভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশের বিরোধিতা করছে না। বরং তাঁর কাছে দলীলের ভিত্তিতে যে মতটি প্রমানিত, সে সেই মতের উপর আমল করছে। ( রাসায়েল-মাসায়েল, ১ম খণ্ড, পাতা-১৭৯, ১৮০ )

\r\n\r\n

কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা ফাতিহা

 

আরবী*****

 

১১। হযরত আবু সাঈদ ইবনে মুয়াল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ছিলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম আমাকে স্বশব্দে ডাকলেন আমি ( তখন নামাজরত থাকার কারনে ) তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না অতপর আমি তাঁর কাছে এসে বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আমি নামাজে রত ছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহ কি বলেননি, “আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল যখন তোমাদেরকে ডাকেন তখন তাঁদের ডাকে সাড়া দাও” ( সূরা আনফাল, আয়াত ২৪ ) অতপর তিনি বললেন, তোমার মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান এবং সবচেয়ে বড় সূরাটি শিখিয়ে দেবো না? একথা বলে তিনি আমার হাত ধরলেন অতঃপর আমরা যখন মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আপনি বলেছেন- “আমি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি অবশ্যই শিখিয়ে দেবো” তিনি বললেন- তা আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ( সূরা ফাতিহা ) এটাই সাবউল মাসানী ( পুনরাবৃত সাত আয়াত ) এবং তাঁর সাথে রয়েছে মহান আল কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে ----( সহীহ বুখারী )

 

  হযরত আবু সাঈদের ( রাঃ ) নামাজরত অবস্থায় তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  ডাকার দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁকে ডাকছিলেন, তখন তিনি নফল নামাজ পড়ছিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহবান শুনার পর তাঁর কর্তব্য ছিল নামাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাছে হাজির হওয়া। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দেয়া ফরয। আর তিনি তো তখন নফল নামায পড়ছিলেন। মানুষ যে কাজেই রত থাকুক- যখন তাঁকে আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে ডাকা হবে তখন এই ডাকে সাড়া দেয়া তাঁর উপরে ফরয।

 

‘সাবউল মাসানী’ – বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে – সেই সাতটি আয়াত যা নামাজে পুনঃ পুনঃ পাঠ করা হয়, অর্থাৎ সূরা ফাতিহা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এই সাতটি আয়াত সম্বলিত সূরাটি কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা এবং এর সাথে রয়েছে কুরআন মাজীদ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- এই আয়াত কয়টি পৃথক যা বার বার পাঠ করা হয় এবং তাঁর সাথে কুরআন মাজীদের অবস্থান। একথার তাৎপর্য হচ্ছে- একদিকে পুরা কুরআন শরীফ এবং অন্য দিকে সূরা ফাতিহা। এখান থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মত পোষণ করেছেন যে, এটা কুরআন মাজীদের সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা সমগ্র কুরআনের মুকাবেলায় এই সুরাকে রাখা হয়েছে। এখানে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এই যে, ফাতিহাকে সবচেয়ে বড় সূরা বলার অর্থ এই নয় যে, তা শব্দ সংখ্যা বা আয়াত সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় সূরা। বরং এর অর্থ হচ্ছে- বিষয়বস্তুর বিচারে সূরা ফাতিহা সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা কুরআন মাজীদের পুরা শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এই সুরার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআনের সাহায্যে বাড়ি ঘর সজীব রাখো            

 

আরবী******

 

১২। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা নিজেদের ঘরকে কবরে পরিনত করো না। যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় তা থেকে শয়তান পলায়ন করে। ---- ( সহীহ মুসলিম )

 

 এ হাদীসে দুটি বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে। এক, নিজেদের ঘরকে কবরস্থানে পরিনত করো না। এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে- তোমাদের ঘরের অবস্থা যদি এই হয় যে, তাতে নামায পড়ার মতো কোন লোক নেই এবং কুরআন পড়ার মতো কোন লোকও নেই। আর কোনরূপেই এটা প্রকাশ পায় না যে, তাতে কোন ঈমানদার লোক বা কুরআন পাঠকারী বসবাস করে- তাহলে এরূপ ঘর যেন একটি কবরস্থান। এটা মৃত জনপদ। এটা জীবন্তদের জনপদ নয়।

 

 দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- যেহেতু সমস্ত পুরুষ লোক মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করে থাকে – এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম বলেছেন, নিজেদের ঘরকে তোমরা কবরস্থান বানিও না। অর্থাৎ পুরা নামায মসজিদেই পড়ো না, বরং এর কিছু অংশ ঘরে আদায় করো। যদি ঘরে নামায না পড়ো তাহলে এর অর্থ হচ্ছে- আপনারা মসজিদকে ঠিকই জীবন্ত রেখেছেন, কিন্তু ঘর কবরস্থানের মতো হয়ে গেছে। এজন্য এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার যাতে মসজিদও প্রাণচঞ্চল থাকবে এবং ঘরও জীবন্ত থাকবে। এজন্য ফরয নামায সমূহ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করা এবং সুন্নাত, নফল ও অন্যান্য নামায ঘরে আদায় করা পছন্দনীয় বলা হয়েছে। এতে উভয় ঘরেই প্রান চাঞ্চল্য বিরাজ করবে।

 

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, যে ঘরে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয় সেখান থেকে শয়তান পলায়ন করে। একদিকে রয়েছে সমস্ত কুরআন মাজীদের মর্যাদা, অপরদিকে রয়েছে প্রতিটি সুরার রয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য। এখানে সূরা বাকারার মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- যে ঘরে এই সূরা পাঠ করা হয় সেখান থেকে শয়তান ভেগে যায়। এটা কেন হয়? এর কারন হচ্ছে- সূরা বাকারার মধ্যে পারিবারিক জীবন এবং দাম্পত্য বিষয় সংক্রান্ত আইন- কানুন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিবাহ ও তালাকের সাথে সম্পর্কিত আইনও এ সূরায় পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণিত হয়েছে। সমাজকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার যাবতীয় মূলনীতি এবং আইন- কানুন এ সুরার আলোচনার আওতায় এসে গেছে। এ জন্য যেসব ঘরে বুঝে শুনে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় এবং তদানুযায়ী কাজ করা হয় সেসব ঘরে শয়তান প্রবেশ করে কখনো ঝগড়া- বিবাদ বাঁধাতে সফলকাম হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানব জীবনের সংশোধনের জন্যে যে পথ নির্দেশ দিয়েছেন – তা যাদের জানা নেই অথবা জানা আছে কিন্তু তাঁর বিরোধিতা করা হচ্ছে- শয়তান কেবল সেখানেই ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যে পরিবারের লোকেরা আল্লাহর হুকুম পালন সম্পর্কে অবগত এবং তদানুযায়ী জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত- শয়তান সেখানে কোন পাত্তাই পায় না এবং কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয় না।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদ কিয়ামতের দিন শাফায়াৎকারী হবে

 

আরবী*****

 

১৩। হযরত আবু উমামা ( রা ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ তোমরা কুরআন পড়ো। কেননা কুরআন তাঁর পাঠকদের জন্য কিয়ামতের দিন শাফায়াতকারী হয়ে আসবে। দুটি চাকচিক্যময় ও আলকিত সূরা- বাকারা ও আলে ইমরান পাঠ করো। কেননা এই সূরা দুটি কিয়ামতের দিন এমনভাবে আসবে যেন- দুটি ছাতা অথবা ছায়া দানকারী দুই খণ্ড মেঘ অথবা অথবা পাখির পালকযুক্ত দুটি প্রসারমান ডানা। তা নিজের পাঠকদের পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তি প্রমান পেশ করতে থাকবে। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ করো। কেননা তা গ্রহন করলে বরকত ও প্রাচুর্যের কারন হবে। এবং তা পরিত্যাগ করলে আফসোস, হতাশা ও দুঃখের কারন হবে। বিপথগামীরা এই সুরার বরকত লাভ করতে পারে না। - --( সহীহ মুসলিম )

 

এ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম প্রথমে যে কথা বলেছেন তা হল “তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো”। কেননা তা কিয়ামতের দিন তাঁর পাঠকদের জন্যে শাফায়াতকারী হবে। একথার অর্থ এই নয় যে, তা মানুষের যাবতীয় বিপথ দূর করার জন্য অনমনীয় সুপারিশকারী হয়ে দাঁড়াবে বরং এর অর্থ হচ্ছে- যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কুরআন পড়েছে এবং তদানুযায়ী নিজের জীবন সংশোধন করেছে- এই কুরআন কিয়ামতের দিন তাঁর শাফায়াতের কারন হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার আদালতে এ কথা উত্থাপিত হবে যে, এই বান্দাহ তাঁর কিতাব পাঠ করেছে, তাঁর অন্তরে ঈমান বর্তমান ছিল, সে যখনই এই কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা পাঠ করতে নিজের সময় ব্যয় করেছে। এ জন্যই তা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে পাঠকের জন্য শাফায়াতকারী হবে।

 

 দ্বিতীয় যে কথাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তা হল-  কুরআন মাজীদের দুটি অতি উজ্জ্বল সূরা অর্থাৎ সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান পাঠ করো। এ সূরা দুটিকে যার ভিত্তিতে আলোকময় সূরা বলা হয়েছে তা হচ্ছে- এই দুটি সুরার মধ্যে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী-খ্রিস্তানদের সামনে পূর্ণাংগভাবে যুক্তি প্রমান তুলে ধরা হয়েছে এবং মুশ্রিকদের সামনেও। অনুরূপভাবে মুসল্মান্দেরকেও এই সূরাদ্বয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত দান করা হয়েছে। মোট কথা এই দুটি সূরায় কুরআন মাজীদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই জন্য বলা হয়েছে এই সূরা দুইটি পাঠ করো। কিয়ামতের দিন এই সূরা দুইটি এমনভাবে উপস্থিত হবে যেমন কোন ছাতা অথবা মেঘ খণ্ড অথবা পালক বিছানো পাখির পাখা। এই সূরাদ্বয় তাঁর পাঠকারীর স্বপক্ষে দলীল- প্রমান পেশ করবে, তাঁদের সাহায্য করবে। কিয়ামতের দিন যখন কারো জন্য ছায়া বাকী থকবে না তখন এই কঠিন মুহূর্তে কুরআন তাঁর পাঠকারীদের জন্য ছায়া হয়ে উপস্থিত হবে। অনুরূপভাবে এই সূরাদ্বয় কিয়ামতের দিন তাঁর পাঠককে বিপদ-মুসিবত থেকে উদ্ধারকারী এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারে সাহায্যকারী হবে।

 

পুনরায় সূরা বাকারা সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা হয়েছে – যে ব্যক্তি তা পাঠ করে তা তাঁর জন্য বরকত ও প্রাচুর্যের কারন হবে। আর যে ব্যক্তি তা পাঠ করে না তাঁর জন্য এটা আফসোসের কারন হবে। সে কিয়ামতের দিন আফসোস করে বলবে- দুনিয়াতে সূরা বাকারার মতো এতো বড় নিয়ামত তাঁর সামনে এসেছে কিন্তু সে তা থেকে কোন কল্যাণ লাভ করেনি। অতঃপর তিনি বলেছেন, বাতিলপন্থী লোকেরা এই সুরাকে সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মধ্যে সামান্যতম অন্যায় ও অসত্যের পূজা মওজুদ রয়েছে সে এই সুরাকে বরদাশত করতে পারে না। কেননা এই সূরাদ্বয়ের মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাতিলের মূলোৎপাটনকারী বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়েছে। যা কোন বাতিল পন্থী লোক বরদাশত করতে পারেনা।

\r\n\r\n

সূরা বাকারা ও আলে ইমরান

 

ঈমানদার সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবে

 

আরবী*****

 

১৪। হযরত নাওয়াশ ইবনে সাময়া’ন ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ এবং তদানুযায়ী আমলকারী লোকদের উপস্থিত করা হবে। তাঁদের অগ্রভাগে সূরা বাকারা এবং সূরা আলে ইমরান থাকবে। এ দুইটি যেন মেঘমালা অথবা মেঘের ছায়া- যার মধ্যে থাকবে বিদ্যুতের মতো আলোক অথবা সেগুলো পালোকে বিছানো পাখির পাখার ন্যায় হবে। এই দুইটি সূরা তাঁদের পাঠকারীদের স্বপক্ষে যুক্তি প্রমান পেশ করতে থাকবে। --( সহীহ মুসলিম )

 

 পূর্ব হাদীসেও কিছুটা শাব্দিক পার্থক্য সহকারে একই বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এটাও হতে পারে যে, উভয় সাহাবীই একই সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ হাদীস শুনে থাকবেন। এবং উভয়ে নিজ নিজ ভাষায় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। আর এটাও হতে পারে যে, বিভিন্ন স্থানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই একই হাদীস বর্ণনা করে থাকবেন এবং দুই সাহাবীর বর্ণনা দুই ভিন্ন স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকবে। যাই হোক একথা সুস্পষ্ট যে, হাদীস দুইটির বিষয়বস্তু প্রায়ই এক।

 

পূর্ববর্তী বর্ণনায় শুধু কুরআন মাজীদ পাঠকারীদের উল্লেখ ছিল, কিন্তু এ হাদীসে তদানুযায়ী আমল করার কথাও বলা হয়েছে। পরিস্কার কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন মাজীদ যদি সুপারিশকারী হয় তাহলে তা এমন লোকদের জন্যই হবে যারা কুরআন পাঠ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তদানুযায়ী কাজও করেছে। যদি ধরে নেয়া হয় যে, কোন ব্যক্তি কুরআন মাজীদ তো ঠিকই পড়ে কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করে না তাহলে কুরআন তাঁর পক্ষে দলীল হতে পারে না। এ হাদীসে পরিস্কার বলা হয়েছে- কুরআনের যেসব পাঠক তদানুযায়ী কাজ করে- কুরআন তাঁদের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে দাঁড়াবে এবং তাঁদের সাহায্য ও সুপারিশ করবে। কিয়ামতের দিন যখন ঈমানদার লোকেরা আল্লাহর দরবারে হাজির হবে তখন তাঁদেরকে কুরআনই সেখানে নিয়ে যাবে। যখন তাঁদেরকে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হবে তখন কুরআনই যেন তাঁদের পক্ষে মুক্তির সনদ হবে। আমরা যেন দুনিয়াতে এই কুরআন অনুযায়ী জীবিন যাপন করে এসেছি – এই অর্থেই নবী ( সাঃ ) এর এই হিদায়াতনামা। অন্য কথায় তাঁদের মুক্তির জন্য স্বয়ং এই কুরআনের সুপারিশই যথেষ্ট হবে। কেবল ঈমানদার সম্প্রদায়ের সাথেই এরূপ আচরন করা হবে। এই দিন কাফের এবং মুনাফিকদের সাথে কুরআনের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। আর যেসব লোকেরা কুরআনের নির্দেশাবলী জানা সত্ত্বেও তাঁর বিরোধিতা করেছে কুরআন তাদেরও সহযোগী হবেনা।

 

 তিনি আরো বলেছেন, সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান ঈমানদার সম্প্রদায়ের আগে আগে থাকবে। এর কারন হচ্ছে- এই দুইটি আইন-কানুন সংক্রান্ত সূরা। সূরা বাকারায় ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক জীবনের জন্য আইনগত হিদায়াত দান করা হয়েছে। আর সূরা আলে ইমরানে মুনাফিক ও কাফের সম্প্রদায় এবং আহলে কিতাব সবার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ সূরায় উহুদ যুদ্ধের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ ভাবে এই সূরা দুইটি মুমিন জীবনের জন্য হিদায়াতের বাহন। কোন ব্যক্তি যদি এই সূরাদ্বয়ের শিক্ষা অনুযায়ী নিজের পারিবারিক জীবনকে সংশোধন করে নিজের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে তদানুযায়ী ঢেলে সাজায় এবং দুনিয়ায় ইসলামের সাথে যেসব ব্যাপারের সম্মুখীন হবে তাতেও যদি তারা এর হেদায়েত মোতাবেক ঠিক ঠিক কাজ করে তাহলে এরপর তাঁর ক্ষমা ও পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ ত্রুটি থাকতে পারেনা। অতএব, এ সূরা দুইটি হাশরের ময়দানে ঈমানদার সম্প্রদায়ের হেফাজত করবে। হাশরের ময়দানে যে বিভিষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করবে এই সূরাদ্বয় তা থেকে তাঁদেরকে রক্ষা করবে এবং আল্লাহর আদালতে হাজির হয়ে তাঁদের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমান পেশ করবে।

\r\n\r\n

কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত আয়াতুল কুরসী

 

আরবী****

 

১৫। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- হে আবুল মুনযির, আল্লাহ তায়ালার কিতাবে তোমার জানা কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি বললাম- আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি পুনরায় বললেন- হে আবুল মুনযির, আল্লাহ তায়ালার কিতাবে তোমার জানা কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি বললাম- “আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম” আয়াত। রাবী বলেন- তিনি আমার বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন – এই জ্ঞান তোমার জন্য মোবারক হোক এবং প্রাচুর্যময় হোক। --------( সহীহ মুসলিম )

 

হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই সব সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা কুরআন সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞান লাভের অধিকারী ছিলেন, কুরআন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে কুরআন সম্পর্কে সর্বাধিক অভিজ্ঞ লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

 

 এ হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষন পদ্ধতির একটি দিক। সাহাবায়ে কেরাম দীনের কতটা জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং কুরআনকে কতটা বুঝছেন তা জানার জন্য তিনি মাঝে মাঝে তাঁদেরকে বিশেষ বিশেষ প্রশ্ন করতেন। সাহাবাদের নীতি ছিল, তারা রাসুলুল্লাহর প্রশ্নের জবাব নিজেদের জ্ঞান অনুযায়ী দেয়ার পরিবর্তে আরো অধিক জানার লোভে আরজ করতেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই অধিক ভালো জানেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, তিনি নিজে তা বলে দিবেন এবং এতে তাঁদের জ্ঞানের পরিধি আরো বেড়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য যদি সাহাবাদের আরো অধিক শেখানো হতো তাহলে সাহাবাদের বক্তব্য “আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভালো জানেন” – প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে দিতেন। আর যদি তাঁর উদ্দেশ্য হতো সাহাবাগন আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে কি পরিমান জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন তা জানা- তাহলে তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং তাঁর পুনরাবৃত্তি করতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে উত্তর আশা করতেন। এখানে এই দ্বিতীয়টি উদ্দেশ্য ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) কে প্রথম দফা প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বললেন- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল অধিক ভালো জানেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহর লক্ষ্য ছিল উবাই ইবনে কা’বের জানামতে কুরআন মাজীদের কোন আয়াতটি সর্বাধিক ভারী- তা অবগত হওয়া, তাই তিনি পুনরায় একই প্রশ্ন করলেন। এর উত্তরে তিনি বললেন- আয়াতুল কুরসী হচ্ছে সবচেয়ে বড় আয়াত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জবাবের সমর্থন করলেন।

 

  আয়াতুল কুরসীর এই মহত্ত্ব এবং গুরুত্ব এই জন্য যে, কুরআন মাজীদের যে কয়টি আয়াতে একত্ববাদের পূর্ণাংগ বর্ণনা দেয়া হয়েছে- আয়াতুল কুরসী তাঁর অন্যতম। আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা এবং গুনাবলীর সর্বাঙ্গীণ বর্ণনা এক তো সূরা হাশরের শেষ আয়াতে রয়েছে, দ্বিতীয়ত সূরা ফুরকানের প্রাথমিক আয়াত এবং তৃতীয়ত সূরা ইখলাছ ও আয়াতুল কুরসীতে রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) যখন এই জবাব দিলেন তখন রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) তাঁর বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন- এই জ্ঞান তোমার জন্য কল্যাণকর হোক। বাস্তবই তুমি সথিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছ যে, এই আয়াতই কুরআন মাজীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ আয়াত। আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কে সঠিক ধারনা দেয়ার জন্যই কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে। মানুষ যদি আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে না পারে তাহলে তাঁর বাকী সমস্ত শিক্ষাই সম্পূর্ণ বেকার এবং অর্থহীন হয়ে যায়। মানুষের মাঝে তৌহিদের বুঝ এসে গেলে দীনের ভিত্তি কায়েম হয়ে গেলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে আয়াতের মধ্যে তৌহিদের বিষয়বস্তুকে সর্বোত্তম পন্থায় বর্ণনা করা হয়েছে তাই কুরআন মাজীদের সর্ববৃহৎ আয়াত।

\r\n\r\n

আয়াতুল কুরসীর ফযিলত সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর ঘটনা

 

আরবী*****

 

১৬। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রমযানের ফিতরার সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। একরাতে এক আগন্তুক আমার কাছে আসলো এবং ( স্তূপীকৃত ) শস্য ইত্যাদি হাতের আজল ভরে উঠাতে লাগলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পেশ করবো। সে বলতে লাগলো, আমি খুবই অভাবগ্রস্থ মানুষ, আমার অনেক সন্তান রয়েছে এবং আমার নিদারুন অভাব রয়েছে। আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) বলেন- আমি ( দয়া পরবশ হয়ে ) তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। যখন সকাল হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবু হুরাইরাহ, তুমি গত রাতে যাকে গ্রেফতার করেছিলে তাঁর খবর কি? আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, সে নিজের নিদারুন অভাবের কথা বর্ণনা করলো এবং বলল, তাঁর অনেক সন্তান – সন্তুতি রয়েছে। এ জন্য আমি দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। তিনি বললেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমি নিশ্চিত হলাম যে, সে পুনরায় আসবে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, সে পুনরায় আসবে। অতএব তাঁর আসার প্রতীক্ষায় আমি ওঁত পেতে থাকলাম। পরবর্তী রাতে সে ফিরে এসে খাদ্য শস্য চুরি করতে লাগলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি অবশ্যই তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির করবো। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। কেননা আমি গরীব মানুষ এবং আমার বালবাচ্চা রয়েছে। আমি আর কখনো আসবো না। আমি পুনরায় দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় দিন ভোরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবু হুরাইরাহ তোমার খবর কি? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সে তাঁর কঠিন অভাবের কথা বর্ণনা করলো এবং বলল, তাঁর অনেক বাল-বাচ্চা রয়েছে। আমি দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- সে তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছে এবং সে পুনরায় আসবে। আমি তাঁর আসার অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকলাম। অতএব সে পুনরায় এসে খাদ্য শস্য চুরি করলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি অবশ্যই তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করবো। এটা তিনবারের শেষ বার এবং প্রতিবারই তুমি বলেছ, আমি আর আসবো না অথচ তুমি আসছ। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আপনাকে এমন কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দেব যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অশেষ কল্যাণ দান করবেন। রাতের বেলা আপনি যখন নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাবেন তখন এই আয়াতুল কুরসী –“আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম” শেষ পর্যন্ত পাঠ করবেন। আপনি যদি এরূপ করেন তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা আপনার জন্য একজন হিফাজতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত কোন শয়তান আপনার কাছে ভিড়তে পারবেনা। ( রাবী বলেন ) সে যখন আমাকে এটা শিখালো আমি তখন তাঁকে ছেড়ে দিলাম। ভোরবেলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তোমার বন্দীকে কি করলে? আমি বললাম, সে আমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিয়েছে। তাঁর দাবী হচ্ছে, এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমাকে উপকৃত করবেন। নবী ( সাঃ ) বললেন- “সে তোমাকে সত্য কথাই বলেছে, কিন্তু সে নিজে হচ্ছে ডাহা মিথ্যুক। তুমি কি জানো তুমি তিন রাত যাবত কার সাথে কথা বলেছ? আমি বললাম, না, আমি জানি না। তিনি বললেন- সে ছিল একটা শয়তান।” ( সহীহ  বুখারী )

 

এখানে রমযানের যাকাত বলতে ফিতরার মাল বুঝানো হয়েছে। দিনের বেলা তা থেকে বিতরন করার পর যা অবশিষ্ট থাকতো রাতের বেলা তাঁর হেফাজতের প্রয়োজন দেখা দিত। একবার হযরত আবু হুরাইরাহ যখন এই মালের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন তখন এই ঘটনা ঘটেছিল যার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে।

 

 এটা এমন সব ঘটনার অন্তর্ভুক্ত যে সম্পর্কে মানুষ কোন ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয় যে, এটা কিভাবে ঘটলো। যাই হোক এধরনের  ঘটনা  একাধিকবার মানুষের সামনে ঘটেছে।

 

কুরআন মাজীদের ফযিলত সম্পর্কিত অধ্যায়ে এ হাদীস সন্নিবেশ করার কারন এই যে, শয়তান নিজেও একথা স্বীকার করে যে, যে ব্যক্তি রাতের বেলা আয়াতুল কুরসী পাঠ করে শয়ন করে তাঁর উপর শয়তানের কোন আধিপত্য চলে না।

 

এ কথা পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরআন মাজীদের এমন কয়েকটি স্থান রয়েছে যেখানে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তৌহিদের পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তির মন মগজে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের চিত্র অংকিত হয়ে গেছে তাঁর উপর শয়তানের আধিপত্য কি করে চলতে পারে? এই শয়তান তো তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেনা।

 

এই আয়াতুল কুরসী যদি কোন ব্যক্তি বুঝে পড়ে এবং এর অর্থ যদি সে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তাহলে শয়তান তাঁর ধারে কাছে আসারও দুঃসাহস করে না। আয়াতুল কুরসী স্বয়ং বরকত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ। শুধু এর তেলাওয়াতও বরকত ও কল্যাণের কারন হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু পাঠক যদি তাঁর অর্থ বুঝে পড়ে তাহলে তাঁর উপর শয়তানের কোন প্রভাবই খাটে না।

\r\n\r\n

দুটি নূর

 

যা কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছে

 

আরবী*****

 

১৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জীব্রীল ( আঃ ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসা ছিলেন। এসময় তিনি আকাশের দিক থেকে দরজা খোলার শব্দের অনুরূপ শব্দ শুনতে পেলেন। হযরত জিব্রাঈল ( আঃ ) নিজের মাথা উপরের দিকে উত্তোলন করে দেখলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বললেন, এটা আসমানের একটি দরজা যা আজই প্রথম খোলা হয়েছে। এ দরজা ইতিপূর্বে আর কখনো খোলা হয় নি। ইত্যবসরে এই দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা নাযিল হয়। জিব্রাঈল ( আঃ ) বললেন, এ হচ্ছে এক ফেরেশতা- আসমান থেকে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে, ইতিপূর্বে এই ফেরেশতা আর কখনো পৃথিবীতে নাযিল হয়নি। এই ফেরেশতা এসে তাঁকে সালাম করে বলল, দুটি নূরের সংবাদ গ্রহন করুন, যা কেবল আপনাকে দেয়া হয়েছে এবং অন্য কোন নবীকে দেয়া হয়নি। তা হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষাংশ। এ দুটির একটি শব্দ পাঠ করলেও আপনাকে সেই নূর দান করা হবে। -------( সহীহ মুসলিম )

 

  এ হাদীস পড়তে গিয়ে মানুষের মনে প্রথম যে প্রশ্নের উদয় হয় তা হচ্ছে- আসমানের দরজা খুলে যাওয়া এবং তা থেক দরজা খোলার শব্দ আসার তাৎপর্য কি? এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম একথা বুঝে নিতে হবে যে, আসমানের কোন দরজা খোলার শব্দ জিব্রাঈল ( আঃ ) অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনেছিলেন, আমি বা আপনি নেই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে-  আসমানি জগতের ঘটনাগুলো এমন পর্যায়ের যে, তা যথাযথভাবে তুলে ধরার মতো শব্দ মানবীয় ভাষায় নেই বা হতেও পারেনা। এজন্য এসব ব্যাপার বুঝানোর জন্যে বা মানুষের বোধ গম্যের কাছাকাছি আনার জন্য রূপক ভাষা বা উপমা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দুনিয়াতে যেভাবে দরজা খোলা হয় এবং এর যা অবস্থা হয় অনুরূপভাবে ঊর্ধ্ব জগতেরও অসংখ্য দরজা রয়েছে এবং সেগুলো যখন খোলা হয় তখন তাঁর মধ্য দিয়ে কোন কিছু যাতায়াত করে থাকে। এমন নয় যে, দরজা সব সময় খোলা থাকে এবং যখন তখন যে কেউ আসা যাওয়া করতে পারে। এ থেকে জানা গেলো যে, আসমানের কোন দরজা খোলা এবং তাঁর মধ্য দিয়ে উপর থেকে কোন ফেরেশতার নীচে আসার ঘটনা ঘটেছিলো, যাতে দরজা খোলার শব্দের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে। এই অবস্থাটা অবশ্যই অনুভূত হয়- কিন্তু তা কেবল আল্লাহর ফেরেশতা অথবা তাঁর রাসুলই অনুধাবন করতে পারেন। আমরা তা অনুভব করতে পারিনা। কেননা এগুলো মানুষের অনুভূতিতে ধরা পড়ার মতো কোন জিনিস নয়।

 

এ হাদীসে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে- রাসুলুল্লাহকে যে ফেরেশতা সুসংবাদ দেয়ার জন্যে এসেছিলেন তিনি ইতিপূর্বে আর কখনো পৃথিবীতে আসেন নি। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এই বিশেষ পয়গাম পাঠানোর জন্যেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি পৃথিবীতে যাতায়াতকারী ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা ছিল এই যে, আপনার কল্যাণ হোক। আপনাকে এমন দুইটি তুলনাহীন জিনিস দেয়া হয়েছে যা পূর্বে কোন নবীকেই দেয়া হয়নি। তাঁর একটি হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং অপরটি হচ্ছে সূরা বাকারার শেষাংশ।

 

ঘটনা হচ্ছে এই যে, সূরা ফাতিহার সামান্য কয়টি আয়াতের মধ্যে এতো বিরাট বিষয়বস্তুর বর্ণনা করা হয়েছে যে, পুরা কুরআন শরীফের সংক্ষিপ্ত সার এতে এসে গেছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য হচ্ছে- আমাকে বাক্য ও কথা দান করে হয়েছে যার মাধ্যমে বিরাট বিরাট বিষয়বস্তু কয়েকটি ছত্রেই আদায় হয়ে গেছে। বাইবেলের সাথে কুরআনের তুলনা করে দেখলে জানা যায় যে, কখনো কখন যে কথা বর্ণনা করতে বাইবেলের কয়েকটি পৃষ্ঠা খরচ করা হয়েছে তা কুরআনের একটি মাত্র ছত্রেই বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা এই সংক্ষিপ্ততা এবং পূর্ণাংগতার দিক থেকে অগ্রগণ্য। তথাপি সূরা ফাতিহার এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অর্থ এই নয় যে, এই সুরার মধ্যে যে বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে তা ইতিপূর্বে কোন নবীর কাছে আসেনি। কথা এটা নয়, কারন সব নবীই সেই শিক্ষা নিয়ে আগমন করেছেন যা এই সূরায় বর্ণনা করা হয়েছে, পার্থক্য কেবল এই যে, এই সুরার মাত্র কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থবোধক একটি সমুদ্রের সংকুলান করা হয়েছে এবং দীনের সার্বিক শিক্ষার সার সংক্ষেপ এতে এসে গেছে। এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত কোন জিনিস পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি।

 

দ্বিতীয় নূর যার সুসংবাদ এই ফেরেশতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনিয়েছেন তা হচ্ছে সূরা বাকারার শেষ অংশ। এই আয়াতগুলিতে তৌহিদের পুরা বর্ণনা এবং নবী আলাইহিমুস সালামের যাবতীয় সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা করা হয়েছে। এতে ইসলামী আকীদাহ পূর্ণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ঈমানদার সম্প্রদায়কে বলে দেয়া হয়েছে হক ও বাতিলের সংঘর্ষে যদি সমগ্র কুফরী শক্তিও তাঁদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তাহলে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করেই তাঁদের মোকাবেলা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য এবং বিজয়ের জন্যে দোয়া করতে হবে। এই শেষ অংশে উল্লেখিত অসাধারন বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে তাঁকে এমন নূর বলা হয়েছে যা পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি।

\r\n\r\n

সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের ফযিলত

 

আরবী*****

 

১৮। হযরত আবু মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে তা তাঁর জন্য যথেষ্ট হবে। ---------( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 অর্থাৎ এই দুইটি আয়াত মানুষকে যে কোন ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট। কোন ব্যক্তি যদি এই আয়াতগুলি ভালমতো হৃদয়ঙ্গম করে পড়ে তাহলে সে এর গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

\r\n\r\n

সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতের ফযিলত

 

আরবী****

 

১৯। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ( বিপর্যয় ) থেকে নিরাপদ থাকবে। ----( সহীহ মুসলিম )

 

  সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যে সময় তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অধীন খ্রিষ্টানদের উপর কঠোর নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো এবং তাঁদেরকে একথা স্বীকার করতে বাধ্য করা হচ্ছিলো যে, তারা এক আল্লাহকে পরিত্যাগ করে রোমীয়দের মা’বুদ এবং দেবতাদের প্রভু হিসাবে মেনে নিবে এবং এদের সামনে মাথা নত করবে। এই কঠিন সময়ে কয়েকজন নওজোয়ান হযরত ঈসা ( আঃ ) এর উপর ঈমান আনে এবং তারা এই অমানুষিক অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি সব কিছু ফেলে রেখে পালিয়ে আসে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমরা কোন অবস্থাতেই আমাদের মহান প্রতিপালককে পরিত্যাগ করবো না এবং শিরকের পথও ও অবলম্বন করবোনা- এতে যাই হোক না কেন। সুতরাং তারা কারো আশ্রয় না চেয়ে কেবল আল্লাহর উপরে ভরসা করে পাহাড়ে গিয়ে এক গুহায় বসে যায়।

 

বলা হয়েছে যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের এই প্রাথমিক আয়াতগুলো মুখস্থ করে নিবে এবং তা নিজের মন- মগজে বসিয়ে নেবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। প্রকাশ থাকে যে, দাজ্জালের ফিতনাও এই ধরনেরই হবে- যেমন ঐ সময়ে এই যুবকগন যার সম্মুখীন হয়েছিলো। এজন্য যে ব্যক্তির সামনে আসহাবে কাহাফের দৃষ্টান্ত মওজুদ থাকবে সে দাজ্জালের সামনে মাথা নত করবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি এই দৃষ্টান্ত ভুলে গেছে সে দাজ্জালের ফিতনার স্বীকার হয়ে পড়তে পারে। এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো নিজের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করবে সে দাজ্জালের বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাবে।

\r\n\r\n

সূরা মুমিনুনের ফযিলত

 

আরবী****

 

২০। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যখন অহী নাযিল হতো তখন তাঁর মুখের কাছ থেকে মৌমাছির গুনগুন শব্দের মতো আওয়াজ শুনা যেত। আমি কিছুক্ষন বসে থাকলাম তিনি কিবলার দিকে ফিরলেন এবং দুই হাত তুলে বললেন- “হে আল্লাহ, আমাদের আরো দাও এবং কমিয়ে দিওনা, আমাদের মনে- সম্মান দান করো এবং অপদস্থ করোনা, আমাদের ( তোমার নিয়ামত ) দান করো এবং বঞ্চিত করোনা, আমাদের অন্যদের অগ্রবর্তী করো, অন্যদেরকে আমাদের অগ্রবর্তী করোনা, আমাদের উপর তুমি রাজী হয়ে যাও এবং আমাদের সন্তুষ্ট করো।” অতঃপর তিনি বললেন- “এই মাত্র আমার উপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যার মানদণ্ডে কেউ উত্তীর্ণ হলে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতে যাবে।” অতপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। --অতঃপর তিনি দশটি আয়াত পাঠ সম্পন্ন করলেন।”---( তিরমিযি, নাসাঈ, আহমাদ, হাকেম )

 

আরবী****

 

২১। হযরত ইয়াজীদ ইবনে বাবনুস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, কুরআনই হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের চরিত্র। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে------- তিনি “এবং যারা নিজেদের নামায সমূহের পূর্ণ হেফাজত করে,” পর্যন্ত পাঠ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এরূপই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র।”-----------( নাসাঈ )

 

আরবি*****

 

২২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে ‘আদন’ নামক জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এর একটি থাম সাদা মুক্তা পাথরের, একটি থাম লাল চুনি পাথরের এবং একটি থাম সবুজ পুষ্পরাগ মনির তৈরি। এর মেঝে কস্তুরির, এর নুড়ি পাথরগুলো মোতির তৈরি এবং লতাকুঞ্জ কুমকুমের তৈরি। অতঃপর তিনি তাঁকে বললেন, কথা বল। সে বলল, নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। তখন আল্লাহ বললেন, আমার ইজ্জত, শানশওকত ও মহত্ত্বের শপথ, কোন কৃপণ তোমার মধ্যে প্রবেশ করার জন্যে আমার কাছে প্রার্থনা করতে পারবেনা। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন, “বস্তুত যেসব লোককে তাঁদের দীলের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই কল্যাণ লাভ করবে।”

 

হাদীসের যে দশটি আয়াতের কথা বলা হয়েছে তা নিম্নরুপঃ

 

আরবি*****

 

“মুমিন লোকেরা নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করেছে, যারা নিজেদের নামাযে ভীতি ও বিনয় অবলম্বন করে। যারা অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হয়। যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নিজেদের স্ত্রীদের ছাড়া এবং সেই মেয়েদের ছাড়া- যারা তাঁদের দক্ষিন হস্তে মালিকাধিন হবে। এই ক্ষেত্রে ( হেফাজত না করা হলে ) তারা তিরস্কারযোগ্য নয়। অবশ্য যে ব্যক্তি এদের ছাড়া অন্য কিছু চাইবে তারা সীমা লংঘনকারী হবে। যারা নিজেদের আমানত এবং নিজেদের ওয়াদা-চুক্তি রক্ষনাবেক্ষন করে। যারা নিজেদের নামাযের হেফাজত করে। এরাই হচ্ছে উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।”

 

এখানে মুমিন বলতে সেই সব লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করে নিয়েছে, তাঁকে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করেছে এবং তাঁর উপস্থাপিত জীবন-বিধানকে অনুসরন করে চলতে প্রস্তুত হয়েছে।

 

  এই সুরার প্রথম ৯ টি আয়াতে ঈমানদার লোকদের সাতটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন মুমিন ব্যক্তি এই সাতটি গুন অর্জন করতে পারলে সে নিশ্চিতই বেহেস্তে যাবে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দশম ও একাদশ আয়াতে এদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশত জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন। অতএব আয়াতে উল্লেখিত গুন বৈশিষ্ট্য গুলো অর্জন করার একান্ত চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।

 

  প্রথম গুন হচ্ছে- বিনয় ও নম্রতা সহকারে নামায আদায় করা। ‘খুশু’ শব্দের অর্থ কারো সামনে বিনীতভাবে অবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, নিজের কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, স্থির রাখা। অন্তরের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কথা চিন্তা করে সন্ত্রস্থ হয়ে পড়বে। আর দেহের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন মাথা নত করবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়বে, দৃষ্টি অবনমিত হবে, কণ্ঠস্বর নরম ও বিনয়পূর্ণ হবে। এই খুশুই হচ্ছে নামাযের আসল প্রানশক্তি ও ভাবধারা। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে আর মুখের দাড়ি নিয়ে খেলা করছে। তখন তিনি বললেন-

 

আরবী****

 

“এই ব্যক্তির অন্তরে যদি ‘খুশু’ থাকতো তাহলে তাঁর অংঙ্গ- প্রতংঙ্গের উপর ‘খুশু’ পরিলক্ষিত হতো।’’ ( তাফসীরে মাযহারী, তাফহীমুল কুরআন )

 

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা। মূল শব্দ হচ্ছে ‘লাগবুন’-। এমন প্রতিটি কথা ও কাজকে ‘লাগবুন’ বলা হয় যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং নিষ্ফল। যেসব কথা ও কাজের কোনই ফল নাই, উপকার নাই, যা থেকে কোন কল্যাণকর ফলও লাভ করা যায় না, যার প্রকৃতই কোন প্রয়োজন নেই এবং যা থেকে কোন ভালো উদ্দেশ্য লাভ করা যায়না- এ সবই অর্থহীন, বেহুদা ও বাজে জিনিস এবং ‘লাগবুন’ বলতে এসবই বুঝায়। ঈমানদার লোকদেরকে এসব জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-

 

আরবী****

 

“মুমিন লোকেরা যদি এমন কোন জায়গায় গিয়ে পড়ে যেখানে অর্থহীন ও বাজে কাজ বা কথা হচ্ছে – তাহলে সেখান থেকে আত্মমর্যাদা সহকারে কেটে পড়ে।” (সূরা ফুরকান, আয়াত-৭২)

 

মুমিন ব্যক্তি সুস্থ স্বভাবের অধিকারী হয়ে থাকে। সে পবিত্র চরিত্র ও উন্নত রুচির ধারক। সে অর্থপূর্ণ কথা বার্তাই বলবে, কিন্তু অর্থহীন গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করতে পারেনা। সে হাস্যরস ও রসিকতা করতে পারে, কিন্তু তাৎপর্যহীন হাসিঠাট্টা নয়। সে অশ্লীল গালিগালাজ, লজ্জাহীন কথাবার্তা বলতেও পারেনা, সহ্যও করতে পারেনা। আল্লাহ তায়ালা বেহেশতের একটি বৈশিষ্ট এই উল্লেখ করেছেন যে,

 

আরবী****

 

“সেখানে তারা কোন অর্থহীন ও বেহুদা কথাবার্তা শুনবেনা।” ( সূরা গাশিয়া, আয়াত- ১১ )

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী****

 

“মানুষ যখন অর্থহীন বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তাঁর ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে।”

 

---( তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তাই ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ )

 

তৃতীয় বৈশিষ্ট হচ্ছে- যাকাত দেয়া এবং যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হওয়া। যাকাত অর্থ একদিকে যেমন আত্মার পবিত্রতা অর্জন, অন্যদিকে এর অর্থ ধন সম্পদের পবিত্রতা বিধান।

 

চতুর্থ বৈশিষ্ট হচ্ছে- লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। এর দুটি অর্থ রয়েছে। এক, নিজের দেহের লজ্জাস্থান সমূহকে ঢেকে রাখা, নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং অপর লোকদের সামনে নিজের লজ্জাস্থানকে প্রকাশ না করা।

 

দুই, তারা নিজেদের পবিত্রতা এবং সতীত্বকে রক্ষা করে। অর্থাৎ অবাধ যৌনাচার করে বেড়ায়না। পাশবিক প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করেনা।

 

পঞ্চম বৈশিষ্ট হচ্ছে- আমানতের রক্ষনাবেক্ষন ও তা প্রত্যর্পণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী*****

 

“যার আমানাতদারীর গুন নাই তাঁর ঈমান নাই।” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

ষষ্ঠ বৈশিষ্ট হচ্ছে- ওয়াদা- চুক্তির রক্ষনাবেক্ষন করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী****

 

“ যে ওয়াদা – চুক্তি রক্ষা করেনা তাঁর কোন ধর্ম নাই। ” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

বস্তুত আমানতের খেয়ানত এবং ওয়াদা- চুক্তিকে ভঙ্গ করাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোনাফিকের চারটি লক্ষনের অন্যতম দুইটি বলে উল্লেখ করেছেন।

 

“সে যখন ওয়াদা করে ভংগ করে এবং তাঁর কাছে যদি আমানত রাখা হয় তাঁর খেয়ানত করে।”--------( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

সপ্তম বৈশিষ্ট হচ্ছে—নামাযের হেফাজত করা। নামাযের হেফাজতের অর্থ হচ্ছে নামাযের নির্দিষ্ট সময় সমূহ, এর নিয়ম- কানুন, শর্ত ও রোকন সমূহ, নামাযের বিভিন্ন অংশ- এক কথায় নামাযের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহের পূর্ণ সংরক্ষণ করা।

 

যে ব্যক্তি এসব গুন বৈশিষ্টের অধিকারী হয়ে যায় এবং এর উপর স্থির থাকে, সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের অধিকারী।

\r\n\r\n

সূরা ইয়াসিনের ফযিলত

 

আরবী****

 

২৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- প্রতিটি জিনিসেরই একটি হৃদয় আছে এবং কুরআনের হৃদয় হচ্ছে সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ তায়ালা তা পাঠের বিনিময়ে তাঁকে দশবার পূর্ণ কুরআন পাঠ করার সওয়াব দান করবেন।------ ( ইমাম তিরমিযি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একে গরীব হাদীস বলেছেন )

 

আরবী*****

 

২৪। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। আর যে ব্যক্তি সূরা হা-মীম পাঠ করে। যার মধ্যে ধোঁয়ার কনা উল্লেখ আছে ( অর্থাৎ সূরা দোখান ) – সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। ----- ( হাফেজ তাঁর গ্রন্থে এ হাদীস উল্লেখ করেছেন )

 

আরবী****

 

২৫। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- তাঁর গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।

 

আরবী***

 

২৬। হযরত মা’কিল ইবনে ইয়াসার ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “এটা তোমাদের মুমূর্ষু ব্যক্তিদের নিকট পাঠ করো।” অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন। -( আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমাদ )

 

আরবী****

 

২৭। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আমি আশা করি আমার উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে এই সূরাটি ( সুয়ার ইয়াসীন ) গাঁথা থাক। ----------- ( সহীহ বুখারী )

 

   হাফেজ ইমামুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাসীর দামেশকী ( মৃত ৭৭৪ হিঃ ) বলেন, এসব হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ আলেমগন বলেছেন, কোন কঠিন বিপদ বা শক্ত কাজ সামনে উপস্থিত হলে – তখন এই সূরা পাঠ করার বরকতে আল্লাহ তায়ালা সেই বিপদ বা কাজকে সহজ করে দেন। মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট এই সূরা পাঠ করতে বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এসময় আল্লাহ তায়ালা রহমত ও বরকত নাযিল করেন এবং সহজভাবে রূহ বের করে নেয়া হয়। আসল ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন। ইমাম আহমাদ ( রঃ ) বলেছেন- আমাদের প্রবীণরা বলতেন, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে আল্লাহ তাঁর কষ্ট লাঘব করে দেন। ( তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৪ )

 

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন- ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দাহহাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উআইনা বলেন- ‘ইয়াসীন’ অর্থ ‘হে মানুষ’ বা ‘হে ব্যক্তি’। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, ইয়া সাইয়েদ ( হে নেতা ) কথাটির শব্দ সংক্ষেপ হচ্ছে ‘ইয়াসীন’। এই সব কটি অর্থের দিক দিয়ে বলা যায়, এখানে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকেই সম্বোধন করা হয়েছে।

 

‘সূরা ইয়াসীন কুরআনের হৃদয়’ – এই উপমাটি ঠিক তেমনি যেমন বলা হয়েছে ‘সূরা ফাতিহা কুরআনের মা’। সূরা ফাতিহাকে কুরআনের মা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে কুরআন মাজীদের সমস্ত শিক্ষার সারকথা বিবৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা ইয়াসীন কুরআনের জীবন্ত ও প্রানবন্ত দীল এই হিসাবে যে, এই সূরা কুরআনের দাওয়াতকে অতীব জোরালোভাবে পেশ করে। এর প্রচণ্ডতায় স্থবিরতা চূর্ণ হয় এবং প্রানে অগ্নিশীলতা সৃষ্টি হয়।

 

 মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, এর ফলে মুসলমানের মনে মৃত্যুকালে সমস্ত ইসলামী আকীদাহ তাজা ও নতুন হয়ে যায় এবং তাঁর সামনে আখেরাতের পুরা নক্সা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর তাঁকে পরবর্তী কোন সব মঞ্জিলের সম্মুখীন হতে হবে- তা সে স্পষ্ট জানতে পারে। এই কল্যাণ দৃষ্টির পূর্ণতা বিধানের জন্যে- আরবী বোঝেনা এমন সব লোকের সামনে এই সূরা পাঠ করার সাথে সাথে তাঁর অর্থও পড়ে শুনানো আবশ্যক। এর সাহায্যেই নসিহত স্মরণ করিয়ে দেয়ার কাজটিও পূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হতে পারে। -( সূরা ইয়াসীনের ভূমিকা, তাফহীমুল কুরআন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৪ )

\r\n\r\n

সূরা মুলকের ফযিলত

 

আরবী****

 

২৮। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক সাহাবী কবরের উপর তাবু টানান। তিনি অনুমান করতে পারেননি যে, এটা একটা কবর। এটা ছিল একটি লোকের কবর। ( সাহাবী শুনতে পেলেন ) সে সূরা মুলক পাঠ করছেন। তা শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একটি কবরের উপর আমার তাবু টানাই। আমি জানতাম না যে, তা একটি কবর। তাঁর মধ্যে একটি লোক সূরা মুলক পাঠ করছে ( শুনলাম )। সে তাঁর শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কবরের আযাব প্রতিরোধকারী, এটা তাঁর পাঠকারীকে কবরের আযাব থেকে বাচায়। -( তিরমিযি )  

 

আরবী****

 

২৯। হযরত আউ হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদে ত্রিশটি আয়াত সম্বলিত একটি সূরা আছে। তা কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করলে তাঁকে মাফ করে দেয়া হয়। সূরাটি হচ্ছে- “তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক-----” ( তিরমিযি )

 

৩০। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা “আলিফ-লাম-মীম তানযীল ( সাজদাহ ) এবং ‘তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক’ না পড়া পর্যন্ত ঘুম যেতেন না। -----------( তিরমিযি )

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান

 

৩১। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন শরীফ পড়তে অক্ষম? সাহাবীগন বললেন- এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন কিভাবে পড়তে পারে? তিনি বললেন – “কুল হু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ” ( সূরা ইখলাছ ) এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। -------------( মুসলিম, ইমাম বুখারী এ হাদীসখানা হযরত আবু সাঈদ খুদরীর সুত্রে বর্ণনা করেছেন )

 

পুরা কুরআন শরীফে নিম্নোক্ত বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছেঃ

 

(এক), আহকাম বা আইন-কানুন, (দুই) নবীদের ঘটনাবলী অর্থাৎ ইতিহাস, (তিন), আকায়েদ বা ইসলামী বিশ্বাসের শিক্ষা- প্রশিক্ষণ। যেহেতু আকায়েদের মূল হচ্ছে তৌহিদ এবং তৌহিদকে বাদ দিলে ইসলামী আকীদার কোন অর্থই বাকী থাকে না। এজন্য সূরা ইখলাছ তৌহিদের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা হওয়ার কারনে এটাকে এক তৃতীয়াংশের সমান সাব্যস্ত করা হয়েছে।

 

চিন্তা করুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষনের ধরন কতটা অতুলনীয় ছিল। তিনি এমন সব কথা ও বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তা দ্রুত অংকিত হয়ে যেত এবং তাঁর মানসটে গেঁথে যেত। কোন ব্যক্তির মনে একথা দৃঢ়মূল করার জন্য অর্থাৎ সূরা ইখলাছের কি গুরুত্ব রয়েছে তা বুঝানোর জন্যে কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতার প্রয়োজন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র সামান্য কয়েকটি কথার মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, যদি তোমরা সূরা ইখলাছ একবার পাঠ করো তাহলে এটা যেন এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করার সমতুল্য হয়ে গেলো।

 

এই একটি মাত্র বাক্যে এই সুরার যে গুরুত্ব মানুষের মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায় তা কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতায়ও সম্ভব নয়। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তিনি সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম

 

আরবী****

 

৩২। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর অধিনায়ক বানিয়ে পাঠালেন। সে নিজের সঙ্গীদের নামাজ পড়ানোর সময় সূরা ইখলাছের মাধ্যমে সর্বদা কিরাত শেষ করতো। তাঁর যখন অভিযান থেকে ফিরে আসলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একথা ব্যক্ত করলে, ত্নি বললেন- তোমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করো সে কেন এরকম করেছে? সুতরাং তারা তাঁকে একথা জিজ্ঞেস করলো। সে বলল, এই সুরার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে আমি এই সূরাটি পড়তে ভালোবাসি। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে গিয়ে সুসংবাদ দাও আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ভালোবাসেন। ----------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

যে সামরিক অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অংশ গ্রহন করতেন না তাঁকে সারিয়াহ বলা হতো। আর যে সামরিক অভিযানে তিনি নিজে অংশ গ্রহন করতেন তাঁকে গাযওয়া বলা হয়।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের যুগে এবং পরবর্তীকালেও একটা উল্লেখযোগ্য  কাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল যে, যে ব্যক্তি জামায়াতের আমীর হতো সে-ই দলের নামাজের ইমামতি করতো। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি কোন সামরিক অভিযানের অধিনায়ক হতো তাহলে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই থাকতো। অনুরূপভাবে কেন্দ্রে খলীফা ( ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ) নামাযে ইমামতি করতেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতেন। এখানে যে সামরিক অভিযানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর অধিনায়কের অভ্যাস ছিল তিনি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর একান্তভাবেই সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। একথা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোচরে আনা হল এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে এর কারন জানা গেলো তখন তিনি তাঁকে সুসংবাদ দিলেন, তুমি যখন এই সূরা পাঠ করতে এতো পছন্দ করো যে, এতে উত্তম পন্থায় আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে- তাই আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে ভালোবাসেন। পূর্ববর্তী- হাদীসে বলা হয়েছে সূরা ইখলাছ এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। আর এখানে বলা হয়েছে- সূরা ইখলাছে সুন্দরভাবে তৌহিদের বর্ণনা থাকার কারনে যে ব্যক্তি এই সুরাকে পছন্দ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।

 

দুনিয়ার কোন কিতাবেই এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে তৌহিদকে পূর্ণাংগভাবে বর্ণনা করা হয়নি, যার মাধ্যমে দুনিয়ায় বিরাজমান সমস্ত গোমরাহির মূল শিকড় একই সাথে কেটে ফেলা হয়েছে। এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে এত বড় বিষয়বস্তু এমন পূর্ণাঙ্গভাবে কোন আসমানি কিতাবেই বর্ণিত হয়নি। সমস্ত আসমানি কিতাব যা অল্প বিস্তার বর্তমানে দুনিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই বিষয়বস্তু অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতে যে ব্যক্তি এটাকে বুঝতে চেষ্টা করে, এর প্রানসত্তার সাথে পরিচয় লাভ করেছে সে এই সুরার সাথে গভীর ভালোবাসা রাখে। স্বয়ং এই সুরার নাম সূরা ইখলাছই- এই নিগূঢ় তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে যে, এটা সেই সূরা যা খালেছ তৌহিদের শিক্ষা দেয়। তা এমন তৌহিদের শিক্ষা দেয় যার সাথে শিরকের নাম গন্ধ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। এ জন্যে যে ব্যক্তি উল্লেখিত কারনে এই সুরার সাথে মহব্বত রাখে সে আল্লাহ তায়ালারও প্রিয় বান্দাহ হিসাবে গণ্য হয়।

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছের প্রতি আকর্ষণ বেহেশতে প্রবেশের কারন

 

আরবী****

 

৩৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল- ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এই সূরা অখলাছকে ভালোবাসি। তিনি বললেন- তোমার এই ভালোবাসা তোমাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে। --------( তিরমিযি, বুখারী )

 

জানা গেলো যে, এই সুরার প্রতি ভালোবাসা একটি স্থিরিকৃত ব্যাপার। কোন ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত এই কথার দ্বারাই হয়ে গেছে যে, এই সূরাটি তাঁর প্রিয় ছিল। কিন্তু কোন ব্যক্তির অন্তর শিরকের যাবতীয় মলিনতা থেকে সম্পূর্ণ পাক হওয়া এবং খালেছ তৌহিদ তাঁর মন মগজে বদ্ধমূল হওয়া ছাড়া এই সুরার প্রেমিক হওয়া সম্ভব নয়। অন্তরে খালেছ তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাই বেহেশতের চাবি। যদি তৌহিদের ধারনায় ত্রুটি থেকে যায় তাহলে বেহেশতের কোন প্রশ্নই আসে না। মানুষের জীবনে যদি অন্যান্য ত্রুটি- বিচ্চুতি থেকে থাকে তা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন, কিন্তু তৌহিদের বিশ্বাসের মধ্যে গোলমাল থাকলে তা ক্ষমার অযোগ্য।

 

যদি কারো মনে নির্ভেজাল তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে তাঁর মধ্যে অন্যান্য ত্রুতি-বিচ্চুতি খুব কমই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু যদিও বা থেকে যায় তাহলে সে তওবা করার সৌভাগ্য লাভ করবে। মনে করুন, যদি তওবা করার সুযোগও না পায় এবং সে তওবা করতে ভুলে গিয়ে থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাঁর ক্ষমা হয়ে যাবে। কেননা খালেছ তৌহিদ হচ্ছে এমনই এক বাস্তব সত্য- আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হওয়া যার উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি খালেছ তৌহিদের অনুসারী- সে আল্লাহর বিশ্বাসভাজনদের অন্তর্ভুক্ত। আর অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে আল্লাহর আচরন যেমন হয়- তাঁর বিশ্বাসভাজনদের প্রতিও তাঁর আচরন তদ্রূপ নয়। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন- এই সুরার প্রিয়পাত্র হওয়াটাই তোমার বেহেশতে প্রবেশের ফায়সালা করে দিয়েছে।     

\r\n\r\n

সূরা ফালাক ও সূরা নাস- দুটি অতুলনীয় সূরা

 

আরবী****

 

৩৪। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তুমি কি দেখেছো আজ রাতে এমন কতগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে যার নযীর কখনো দেখা যায়নি? তা হচ্ছে- “কুল আউউযুবি রাব্বিল ফালাক—এবং কুল আউসু বি রাব্বিন নাস” সূরাদ্বয়। ---( সহীহ মুসলিম )

 

এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাস ও ফালাক সম্পর্কে বলেছেন যে, এ দুটি অতুলনীয় সূরা, যার দৃষ্টান্ত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এর কারন হচ্ছে- পূর্বেকার আসমানি কিতাব গুলোতে এই বিসয়বস্তু সম্বলিত কোন সুরার উল্লেখ নেই। এ সূরাদ্বয়ও অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু পূর্ণাংগ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু বিবৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় যে কারনে এ সূরা দুটির বিষয়বস্তু ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া যায় তাহলো- এটা মানুষকে যে কোন ধরনের শংসয়- সন্দেহ, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করে এবং যে কোন ব্যক্তি পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে হকের রাস্তায় চলতে পারে।

 

প্রথম সূরাটিতে বলা হয়েছে এই কথা বলে দাও যে, আমি সেই মহান রবের আশ্রয় প্রার্থনা করি যিনি ভোরের উন্মেষকারী, সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে হেফাজতকারী, অন্ধকার রাতে আবির্ভাব হওয়া যাবতীয় ভয়-ভীতি ও শংকা থেকে মুক্তি দানকারী এবং যেসব দুষ্ট লোক যাদুটোনা এবং অন্যান্য উপায়ে মানুষের ক্ষতি সাধনে তৎপর তাঁদের আক্রমন থেকে নিরাপত্তা দানকারী। দ্বিতীয় সূরায় বলা হয়েছে, তুমি বলে দাও – সেই মহান সত্তার আশ্রয় গ্রহন করছি যিনি মানুষের রব, মানুষের মালিক এবং মানুষের উপাস্য। যেস মানুষ এবং শয়তানেরা অন্তরের মধ্যে সন্দেহ-শংসয় সৃষ্টি করে- আমি এদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

 

কোন ব্যক্তি যদি ‘আইউযুবি রাব্বিল ফালাক’ এবং ‘আউউযুবি রাব্বিন নাস’ বাক্যগুলো নিজের জবানে উচ্চারন করে এবং সে যেসব বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে- সেগুলোকে আবার ভয়ও করছে – তাহলে তাঁর মুখ থেকে এই শব্দগুলো বের হওয়া নিরর্থক। যদি সে একনিষ্ঠ এবং হৃদয়ঙ্গম করে একথাগুলো উচ্চারন করে তাহলে তাঁর দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, কেউই তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, এখন কেউই তাঁর কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারবে না। কেননা সে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করেছে, যিনি এই মহা বিশ্বের মালিক এবং সমগ্র মানব কুলেরও একচ্ছত্র অধিপতি। যখন সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করলো এবং ঘোষণা করে দিলো, এখন আমি আর কারো অনিষ্টের আশংকা করি না- এরপর তাঁর আর ভীত- সন্ত্রস্ত্র হওয়ার আর কোন কারন থাকতে পারে না। মানুষ তো কেবল এমন সত্তারই আশ্রয় নিয়ে থাকে যার সম্পর্কে তাঁর আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, সে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার শক্তি রাখে। যদি কেউ আশ্রয় দেয়ার শক্তিই না রাখে তাহলে তাঁর কাছে কেবল নির্বোধ ব্যক্তিই আশ্রয় চাইতে পারে। এক ব্যক্তি বিবিধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে কারো আশ্রয় গ্রহন করে থাকে। এক, যে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। দুই, যাদের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে ভেগে এসে  তাঁর আচলে আশ্রয় নিচ্ছে- এদের সবার শক্তি ও ক্ষমতা তাঁর কাছে মূল্যহীন। যতক্ষন তাঁর মধ্যে এ দুটি বিষয়ে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে, সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করতে পারে না। সে যদি এই প্রত্যয় সহকারে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করে তাহলে তাঁর ভয়-ভীতি ও আশংকা বোধ করার কোন অর্থই হয় না।

 

যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার এরূপ শক্তি ও ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর রাস্তায় কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে সে কাউকে ভয় করতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই- সে যার ভয় করতে পারে। সে সম্পূর্ণভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করবে এবং গোটা দুনিয়ার বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে।

 

হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজের ভাইয়ের সাথে ফিরাউনের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে পৌছে গেলেন। এতোবড় বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে মাত্র দুটি প্রান কিভাবে রুখে দাঁড়ালেন? শুধু এই জন্য যে, আল্লাহর আশ্রয়ের উপর তাঁদের আত্মবিশ্বাস ছিল। যখন আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করা হয় তখন পরাশক্তির বিরুদ্ধেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন? কেবল আল্লাহর উপর ভরসা থাকার কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার পিছনে আল্লাহর শক্তি রয়েছে, যিনি সমগ্র বিশ্ব এবং সকল শক্তির মালিক। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন, আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প রাখে- তাদেরও আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে এবং তাঁর আশ্রয়ের উপর অবিচল আস্থা- বিশ্বাস থাকতে হবে- চাই তাঁদের কাছে উপায়-উপকরন, সৈন্য সামন্ত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র থাক বা না থাক। মানুষ এরূপ দুঃসাহস তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর আশ্রয় সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ ঈমান থাকে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এগুলো অতুলনীয় বাক্য যা এই দুটো সূরায় বর্ণিত হয়েছে। কেননা এতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় এবং বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে কেবল আল্লাহ তায়ালার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে একজন মুমিনের অন্তরে তাঁর দেয়া আশ্রয় সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।

\r\n\r\n

কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যেও বরকত রয়েছে

 

আরবী****

 

৩৫। হযরত আয়েশা ( রাঃ )  থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যখন বিছানায় শুতে যেতেব, নিজের উভয় হাতের তালু একত্রে মিলিয়ে তাতে সূরা “কুল হু আল্লাহু আহাদ—”, “কুল আউউযু বি রাব্বিল ফালাক” এবং “কুল আউউযু বি রাব্বিন নাস” পড়ে ফু দিতেন। অতপর তিনি নিজের হাতের তালুদ্বয় সমস্ত দেহে তা যতদুর পৌছতে সক্ষম ফিরাতেন। প্রথমে মাথায়, অতঃপর মুখমণ্ডলে, তারপর দেহের সামনের ভাগে। তিনি এভাবে তিনবার করতেন। -( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

কালামে ইলাহীর শব্দভাণ্ডারে, তাঁর উচ্চারনে এবং এর বিষয়বস্তু সব কিছুর মধ্যেই কল্যাণ, প্রাচুর্য ও বরকত লুকিয়ে আছে। এর সম্পূর্ণটাই বরকত আর বরকত, কল্যাণ আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আল্লাহর কালাম বুঝতেন এবং তদানুযায়ী কাজ করতেন এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন, অনুরূপভাবে তিনি কালামে ইলাহীর মধ্যে নিহিত অন্যান্য বরকতও লাভ করার চেষ্টা করতেন। যেমন, কুরআনের আয়াত পড়ে পানিতে ফু দেয়া এবং নিজে পান করা বা অন্নকে পান করানো, তা পড়ে হাতে ফু দেয়া অতঃপর তা দেহে মর্দন করা- এভাবে তিনি কুরআনের বরকতের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কোন দিকই ছাড়তেন না। আজো যদি কোন ব্যক্তি এরূপ করে তবে করতে পারে এবং এটাও বরকতের কারন হবে। তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই বরকতের ফায়দা কেবল এমন ব্যক্তিই লাভ করতে পারে, যে কুরআনের বাহ্যিক দিকের সাথে সাথে এর বাতেনি দিকের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখে। যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের উদ্দেশ্যের বিপরীত জীবন যাপন করে, আবার সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে নিজের বুকে ফুক দেয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে- সে অবশেষে কোন ধরনের বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে পানাহ চাচ্ছে? সে যে সুদ খেয়ে সমাজের অনিষ্ট সাধন করেছে- এখন পুলিশ বাহিনী যেন তাঁকে গ্রেপ্তার না করে- এজন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছে? এই জন্য একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, যে ব্যক্তি বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআনের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করছে কেবল সে-ই এর বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। এরপর কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যে যে বরকত রয়েছে তা সে অনায়াসে লাভ করতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাত দিন কুরআনের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং নিজের কথায় ও কাজে কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করছে তাঁর জন্য এই বরকত ও কল্যাণ হতে পারে না।

 

কিয়ামতের দিন পক্ষ অবলম্বনকারী তিনটি জিনিস-

\r\n\r\n

কুরআন, আমানাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক

 

আরবী****

 

৩৬। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  কিয়ামতের দিন তিনটি জিনিস আরশের নীচে থাকবে। এক, কুরআন যা বআন্দার পক্ষে বা বিপক্ষে আরজি পেশ করবে। এর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দুটি দিক রয়েছে। দুই, আমানত এবং তিন, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ফরিয়াদ করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে রক্ষা করেছে- আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে ছিন্ন করেছে- আল্লাহ- তায়ালাও তাঁকে ছিন্ন করবেন। ( ইমাম বাগাবীর শরহে সুন্নাহ)

 

কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ, আমানত এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের আল্লাহ পাকের আরশের নীচে থাকার অর্থ এই নয় যে, উল্লেখিত জিনিসগুলো সেখানে মানুষের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে- এই তিনটি সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের মোকদ্দমা সমূহের মীমাংশা করার জন্য সামনেই উপস্থিত থাকবে। এ তিনটি জিনিসকে দৃষ্টান্তের আকারে পেশ করা হয়েছে। যেমন কোন রাষ্ট্র প্রধানের দরবারে তাঁর তিনজন উচ্চপদস্থ প্রিয় ব্যক্তি দণ্ডায়মান হয়ে আছে। এবং তারা বলে দিচ্ছে কোন ব্যক্তি কেমন প্রকৃতির এবং কি ধরনের ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। এভাবে যেন একটি চিত্র ফুতিয়ে তোলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মানুষের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সামনে আসবে তা হচ্ছে- আল কুরআন। এই কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে- “ইউহাজ্জুল ইবাদ”। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, কুরআন বান্দাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করবে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, সে বান্দাদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করবে।

 

এই ধরনের বক্তব্য পূর্বের একটি হাদীসেও এসেছে – “আল কুরআনু উজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন হয় তোমার স্বপক্ষে দলীল হবে অথবা তোমার বিপক্ষে দলীল হবে। কুরআন এসে যাওয়ার পর এখন ব্যাপারটি দুই অবস্থা থেকে খালী নয়। যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশ মতো কাজ করে থাকো তাহলে এটা তোমাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেবে। আর যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশের বিপরীত কাজ করো, তাহলে এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে তখন যদি এই প্রমান পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদের আকারে যে নির্দেশনামা পাঠিয়ে ছিলেন- সে তদানুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেছে, তখন কুরআনই তাঁর পক্ষে প্রমান পেশ করবে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আরজ পেশ করবে- এই ব্যক্তি দুনিয়াতে আপনার নির্দেশ মতো জীবন যাপন করে এসেছে। তাই তাঁকে এই পুরস্কার দান করা হোক। কিন্তু যে ব্যক্তি কুরআনের নির্দেশ পাওয়ার পরও তাঁর বিপরীত কাজ করেছে – কুরআন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালাবে।

 

আরো বলা হয়েছে, কুরআনের একটি বাহ্যিক দিক এবং একটি অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে- কুরআনের একটি দিক হচ্ছে এর পরিস্কার শব্দমালা যা প্রতিটি ব্যক্তিই পড়তে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে- এই শব্দমালার অর্থ ও এর লক্ষ্য। কিয়ামতের দিন কুরআনের শব্দও সাক্ষী হবে এবং এর অর্থও সাক্ষী হবে। কুরআন মাজীদে এমনি হুকুম বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, অমুক কাজ নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ কাজটি করলো। এই অবস্থায় কুরআনের শব্দ সমূহ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।

 

অনুরূপভাবে কুরআন মাজীদের শব্দমালার মধ্যে সেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যার মাধ্যমে জানা যায় যে, কুরআন মানুষের মধ্যে কোন প্রকারের নৈতিকতার পরিপুষ্টি সাধন করতে চায় আর কোন ধরনের নৈতিকতার বিলোপ চায় ; কোন ধরনের জিনিস আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় এবং কোন জিনিস অপছন্দনীয়। এভাবে কুরআন মাজীদ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় জীবন প্রনালী কি তাঁর নীল নকশাও পেশ করে। এখন কোন ব্যক্তি যদি এর বিপরীত জীবন প্রনালী অনুসরন করে তাহলে গোটা কুরআনই তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। পুরা কুরআনের প্রানসত্ত্বা এবং তাঁর তাৎপর্য এই ব্যক্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে।

 

কুরআনের পড়ে দ্বিতীয় যে জিনিস আরশের নীচে বান্দাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা হচ্ছে আমানত। এখানে আমানত শব্দটি সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। মানুষের মাঝে আমানতের যে সাধারন অর্থ প্রচলিত আছে তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কাছে টাকা –পয়সা, অলংকারাদি অথবা অন্য কোন জিনিস একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই বিশ্বাসে জমা রাখলো যে, দাবী করার সাথে সাথে তা পুনরায় ফেরত পাওয়া যাবে। এটা আমানতের একটি সীমিত ধারনা। অন্যথায় আমানতের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে তাঁর কাছে নিজের কোন অধিকার এই ভরসায় গচ্ছিত রাখে যে, সে তাঁর এই হক আত্মসাৎ করবে না। এটাই হচ্ছে আমানত। যদি কোন ব্যক্তি এই আমানত আত্মসাৎ করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হয়ে দাঁড়াবে।

 

এখন দেখুন আমাদের কাছে সর্বপ্রথম আমানত হচ্ছে আমাদের দেহ যা আমাদের প্রতিপালক আমাদের কাছে সোপর্দ করেছেন। এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস দুনিয়াতে কিছু নেই। সমস্ত শরীর কথা তো প্রশ্নাতীত, এর কোন একটি অংগের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর এই যমীন। এখানে আমাদের প্রতিটি লোকের কাছে যতটুকু ক্ষমতা ও কৃতিত্ব রয়েছে- কারো হাতে বেশী আবার কারো হাতে কম, এসবই আমানত। এরপর দেখুন মানবীয় ও সামাজিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু আমানত আর আমানত। মানুষের পারস্পরিক জীবনের সম্পর্কের সূচনা বিবাহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সমগ্র মানব সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোকের দাম্পত্য সম্পর্ক। এখান থেকে গোটা মানব সমাজের সূচনা। এ সবই আমাদের কাছে আমানত। নারী একজন পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। এই আত্মবিশ্বাসের ওপর সে নিজেকে তাঁর কাছে সপে দেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষ। সে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। অপরদিকে পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের দায়িত্ব সাড়া জীবনের জন্য এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের কাছে তুলে নেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত মহিলা। সে তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে, সে তাঁর ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত ইত্যাদি যা কিছুই তাঁর তত্ত্বাবধানে রাখবে- সে এর কোনরূপ খেয়ানত করবে না। অনুরূপভাবে সন্তানদের অস্তিত্বও আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। পিতা মাতার প্রতি সন্তানদের এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, তারা তাঁদের কল্যাণেই ব্রতি হবে। স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে তাঁদের কোন অমঙ্গল করবে না ও তাঁদের স্বার্থের কোনরূপ ক্ষতি করবে না। সন্তানদের স্বভাব- প্রকৃতির মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস নিহিত রয়েছে। যে সন্তান কেবল ভূমিষ্ঠ হল তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এই গুন বর্তমান রয়েছে। মনে হয় যেন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার মাঝে অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে।

 

অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে অপরের হাতে তুলে দেয় এই বিশ্বাসে যে, সে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। কোন ব্যক্তি ওপর ব্যক্তির কন্যাকে তাঁর বংশের মান- মর্যাদার উপরে ভরসা করেই বিয়ে করে। আত্মীয়তার ব্যাপারটিও এরূপ- একে অপরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে। স্বয়ং এক প্রতিবেশী ওপর প্রতিবেশীর উপর নির্ভর করে থাকে। সে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতিবেশী দেয়াল ভেঙ্গে অবৈধভাবে তাঁর ঘরে অনুপ্রবেশ করবে না। এভাবে আপনি আপনার গোটা জীবনের প্রতি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, সমস্ত মানবীয় সম্পর্ক এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্থাপিত হচ্ছে যে, অপর পক্ষ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

 

কোন দেশের পুরা সরকারী ব্যবস্থা একটি আমানত। গোটা জাতি তাঁর আমানত সরকারের হাতে তুলে দেয়। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের যাবতীয় উপায়- উপকরন জাতীয় সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয়। সরকারের যতো কর্মচারী রয়েছে তাঁদের হাতে জাতির আমানতই তুলে দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে জাতি তাঁর পুরা আমানতই সপে দেয়। লাখ লাখ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করুন। জাতি তাঁদেরকে সুসংগঠিত করে দেশের অভ্যন্তরে রেখে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহে তাঁদের স্থাপন করে। নিজেদের খরচে তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র কিনে দেয় এবং জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হয়। তাঁদেরকে এই বিশ্বাসে সংগঠিত করে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যে, তারা দেশ ও জাতির হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবে। এবং তাঁদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করার ব্যাপারে খেয়ানত করবে না।

 

এখন যদি এসব আমানতের চতুর্দিক থেকে খেয়ানত হতে থাকে তাহলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এজন্য এই আমানত সেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে উপস্থিত হবে। যে যতো বেশী খেয়ানত করেছে সে ততখানী শক্তভাবে পাকড়াও হবে। আর যে ব্যক্তি আমানতের যতো বেশী হক আদায় করেছে সে তত অধিক পরিমানে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার লাভের অধিকারী হবে।

 

তৃতীয় যে জিনিস কিয়ামতের দিন অসাধারন গুরুত্বের অধিকারী হবে তা হচ্ছে ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’ – রেহেম। আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন একটি জিনিস যার উপর মানব সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে। মানবীয় সভ্যতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি এবং তাঁর সামনে যেসব আত্মীয়- স্বজন রয়েছে তাঁদের সমন্বয়ে একটি বংশ বা গোত্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে যখন অসংখ্য বংশ এবং গোত্র একত্রিত হয় তখন একটি জাতির সৃষ্টি হয়। এসব কারনে কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপরে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করাকে মানবীয় সভ্যতা- সংস্কৃতির শিকড় কর্তনকারী জিনিস বলা হয়েছে। এজন্যে বলা হয়েছে রেহেম অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক হচ্ছে সেই তৃতীয় জিনিস যার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা হবে। এই দিন আত্মীয়তার সম্পর্ক চিৎকার করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে অটুট রেখেছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অটুট রাখবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে করতন করেছে আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ত্যাগ করবেন। যখন কোন ব্যক্তি নিজের আত্মীয়- স্বজনের প্রতি নির্দয় হয় এবং তাঁদের সাথে শীতল সম্পর্ক বজায় রাখে- সে দুনিয়াতে কারো বন্ধু হতে পারে না। যদি সে কারো বন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে এবং নিজের কোন ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বন্ধুর বেশ ধারন করেছে। যতক্ষন তাঁর স্বার্থ রক্ষা পাবে ততক্ষণই সে তাঁর বন্ধু হয়ে থাকবে। যেখানে তাঁর স্বার্থে আঘাত লাগবে- সেখানেই সে তাঁর বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কেননা, এটা যথার্থই বাস্তব সম্মত যে, যে ব্যক্তি নিজের ভযিকে আপন বলে গ্রহন করে না সে অপরের আপন কিভাবে হতে পারে? এ কারনেই কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার উপরে এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এখানে হাদীসে উল্লেখিত শব্দে এর কিছু বর্ণনা করা হয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআনের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদা

 

আরবী***

 

৩৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে ( কিয়ামতের দিন ) তাঁকে বলা হবে, কুরআন পাঠ করো এবং উপরে উঠতে থাকো। তুমি দুনিয়াতে যে গতিতে থেমে থেমে কুরআন পাঠ করেছো- অনুরূপ গতিতে তা পাঠ করতে থাকো। তোমার বাসস্থান হবে সেই সর্বশেষ আয়াত যা তুমি পাঠ করবে। ( আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ ও নাসাঈ )

 

সাহেবে কুরআন বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যিনি কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন। যেমন আমরা এমন ব্যক্তিকে মুহাদ্দিস বলি যিনি হাদীসের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন এবং এমন ব্যক্তিকে নামাযী বলি যিনি নামাযের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় মশগুল থেকেছেন- তিনিই হলেন কুরআনের ধারক ও বাহক। কিয়ামতের দিন তাঁকে বলা হবে, তুমি কুরআন পাঠ করতে থাকো এবং উন্নত স্তরের দিকে উন্নিত হতে থাকো। তুমি যেখানে পৌছে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করবে, সেখানেই হবে তোমার মনযীল। অর্থাৎ যে স্থানে পৌছে তুমি কুরআনের সর্বশেষ আয়াত পড়বে, সেখানেই হবে তোমার চিরস্থায়ী বাসস্থান। এ জন্যই বলা হয়েছে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে থেমে থেমে তা পাঠ করো। তাহলে তুমি সর্বোচ্চ মনযিলে পৌছে যেতে পারবে।

\r\n\r\n

যার স্মৃতিপটে কুরআন নেই সে বিরান ঘর সমতুল্য

 

আরবী***

 

৩৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ কুরআন যে ব্যক্তিকে আমার যিকির এবং আমার কাছে দোয়া করা থেকে বিরত রেখেছে- আমি দোয়াকারী বা প্রার্থনাকারীদের যা দান করি তাঁর চেয়ে অতি উত্তম জিনিস তাঁকে দান করবো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেননা সমস্ত কালামের উপর আল্লাহর কালামের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে- যেভাবে সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। ( তিরমিযি, দারেমী, বায়হাকী )

 

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআনের চর্চায় এতটা মশগুল রয়েছে যে, অন্যান্য উপায়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার জন্য সে যিকির- আযকার করারও সময় পায় নি, এমনকি তাঁর কাছে দোয়া করারও সুযোগ পায় নি, তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রার্থনাকারীদেরকে আমি যতো বড় জিনিসই দান করি না কেন কুরআন পাঠকারীদের দোয়া করা ছাড়াই কুরআনের বরকতে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবো।

 

এটা হাদীসে কুদসী। হাদীসে কুদসী হচ্ছে- যে হাদীসের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন যে, “আল্লাহ বলেছেন”। হাদীসে কুদসী এবং কুরআনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কুরআনের মতন ও ( মূল পাঠ ) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে নাযিল হয় এবং এর বিষয়বস্তুও আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব। তা কুরআনের অংশ হিসেবে নাযিল হয়। এ জন্যই জিব্রাঈল ( আঃ ) যখন কুরআন নিয়ে আসতেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে দিতেন যে, এটা কুরআনের আয়াত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব শব্দে এসেছে। অপরদিকে হাদীসে কুদসির ভাষা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজস্ব, কিন্তু এর ভাব এবং বিষয়বস্তু আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব যা তিনি তাঁর নবীর অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন। কখনো কখনো হাদীসে কুদসীর ভাষাও মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু তা কুরআনের অংশ হিসেবে আসে নি। যেমন, আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। নামাযের মধ্যে যেসব যিকির পড়া হয়, তা সবই আল্লাহ তায়ালার শিখানো। কিন্তু তা কুরআনের অংশ বানানোর জন্য শেখানো হয় নি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁরই ভাষায় কোন বিষয়বস্তু নাযিল হলে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া হতো যে, তা কুরআনের সাথে যোগ করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।

 

এই হাদীসে কুদসীর অংশ “উতিয়াস সায়েলীন” পর্যন্ত শেষ হয়েছে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বলেছেন, সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর আল্লাহ তায়ালার যেরূপ মর্যাদা রয়েছে, যাবতীয় কথার উপরে তাঁর কথার অনুরূপ মর্যাদা রয়েছে- কেননা তা আল্লাহ তায়ালার কালাম। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির তুলনায় যতটা শ্রেষ্ঠ, তাঁর কথাও সৃষ্টির কথার চেয়েও ততটা শ্রেষ্ঠ। উপরের কথার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইয়াহি ওয়া সাল্লামের এ কথা যোগ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কুরআন ছাড়া অন্য যে কোন দোয়া- দরূদের কথাই বলা হোক না কেন মানুষের তৈরি কালাম, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কালাম নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মানুষের তৈরি কথা যতই উন্নত মানের ও মর্যাদাসম্পন্ন হোক না কেন তা আল্লাহর কালামের সামনে কিছুই নয়। আল্লাহর সামনে মানুষের যেই মর্যাদা, তাঁর কালামের সামনে তাঁদের রচিত এই কালামেরও ততটুকু মর্যাদা। অতএব, তোমরা সবচেয়ে মর্যাদাবান আল্লাহ তায়ালার এই কালামের পিছনে যতটা সময় ব্যয় করেছো- তা অতীব মূল্যবান কাজে ব্যয় হয়েছে। তোমরা যদি দোয়ার মধ্যে তোমাদের সময় ব্যয় করো তাহলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান কাজেই তোমাদের সময় ব্যয় করলে। অতএব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করার পরিবর্তে কুরআন পাঠেই তাঁর সময় ব্যয় করে তাহলে তাঁকে দোয়াকারীদের তুলনায় উত্তম জিনিস কেন দেয়া হবে।

\r\n\r\n

কুরআনের প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ নেকী

 

আরবী****

 

৪০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে তাঁর জন্য এর বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। ( কুরআনে এই মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে যে ) প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন সওয়াব রয়েছে। আমি একথা বলছি না যে, ‘আলিফ, লাম, মীম’ একটি হরফ। বরং এলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। ---------( তিরমিযি, দারেমী )

 

অর্থাৎ ‘আলিফ- লাম- মীম’ কয়েকটি হরফের সমন্বয়। প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে এবং প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন পুরস্কার রয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআন প্রতিটি যুগের ফিতনা থেকে রক্ষাকারী

 

আরবী****

 

৪১। তাবেঈ হযরত হারিস আল-অ’ওয়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ( কুফার) মসজিদে বসা লোকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকেরা- বাজে গল্প-গুজবে মেতে রয়েছে। আমি হযরত আলীর কাছে হাযির হলাম। আমি তাঁকে অবহিত করলাম যে, লোকেরা এভাবে মসজিদে বসে বাজে গল্প-গুজব করছে। তিনি বললেন, বাস্তবিকই লোকেরা তাই করছে? আমি বললাম- হ্যাঁ। তিনি বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ খবরদার, অচিরেই এমন যুগ আসবে যাতে বিপর্যয় শুরু হবে। আমি আরজ করলামঃ হে আল্লাহর রাসুল, এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় কি? তিনি বললেন- আল্লাহর কিতাব ( এই বিপর্যয় থেকে আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা সম্ভব )। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহের কি অবস্থা হয়েছিলো তাও এই কিতাবে আছে। তোমাদের পরে আসা লোকদের উপর কি অতিবাহিত হবে তাও এ কিতাবে আছে। তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার বিধানও এতে বিবৃত হয়েছে। এই কুরআন হচ্ছে সত্য মিথ্যার- মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কিতাব। এটা কোন হাসি ঠাট্টার বস্তু নয়। যে অহংকারী তা পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাঁকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি এই কুরআন পরিত্যাগ করে অন্যত্র হেদায়াত তালাশ করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি এবং প্রজ্ঞাময় যিকির ও সত্য সরল পথ। তা অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি কখনো বিপথগামী হয় না। তা যবানে উচ্চারন করতে কষ্ট হয় না। জ্ঞানীগণ কখনো এর দ্বারা পরিতৃপ্ত ও বিতৃষ্ণ হয় না। একে যতই পাঠ করে তা পুরাতন হয় না। এর বিস্ময়কর তথ্য সমূহের অন্ত নেই। এটা শুনে জীনেরা স্থির থাকতে পারেনি, এমনকি তারা বলে উঠলো- “আমরা এমন এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সৎ পথের সন্ধান দেয়। অতএব আমরা এর উপরে ঈমান এনেছি”। ( সূরা জীন ; ১, ২ )

 

যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বলে সে সত্য কথা বলে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী কাজ করবে সে পুরস্কার পাবে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী ফায়সালা করবে সে ন্যায়ানুগ ফায়সালা করতে পারবে। যে ব্যক্তি লোকদের এই কুরআন অনুসরনের দিকে ডাকে সে তাঁদের সরল পথেই ডাকে। ( তিরমিযি, দারেমী )

 

নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম সৌন্দর্য এই বলেছেন যে, কুরআনে এটাও বলা হয়েছে যে, অতীত জাতিসমূহ কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ অনুসরন করার কারনে তাঁদের পরিনাম কিরূপ হয়েছিলো এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে যারা ভ্রান্ত পথে চলেছিল তাঁদেরই বা কি পরিনতি হয়েছিলো। কুরআনে এও বলা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ভ্রান্ত পথের অনুসারীদের কি পরিনতি হবে এবং সঠিক পথের অনুসারীদের ভাগ্যে কি ধরনের কল্যাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআনে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এর মীমাংসা কিভাবে হওয়া উচিৎ।

 

‘হুয়াল ফাসলু’- বাক্যাংশের অর্থও হচ্ছে, কুরআন মাজীদ চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কথা বলে এবং পূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে বলে, এর মধ্যে হাসি-ঠাট্টা ও উপহাস মূলক এমন কোন কথা বলা হয়নি, যা মানা বা না- মানায় কোন পার্থক্য সূচিত হয় না।

 

অতঃপর বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কুরআন ছেড়ে দিয়ে  অন্য কোথা থীক হেদায়াত লাভের চেষ্টা করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এর অর্থও হচ্ছে- এই কিতাব ছাড়া আর কোথাও থেকে এখন আর হেদায়াত লাভ করা যেতে পারে না। যদি অন্য কোন উৎসের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

 

আরো বলা হয়েছে- এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি। অর্থাৎ কুরআন হচ্ছে- বান্দাহ এবং তাঁর প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। যে ব্যক্তি কুরআনকে শক্তভাবে ধারন করবে, খোদার সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে ছেড়ে দিলো, সে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললো।

 

কুরআনের প্রজ্ঞাময় যিকির হওয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটা এমন এক নসীহত যার গোটাটাই হিকমত, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে।

 

আরো বলা হয়েছে- কুরআন অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে- যদি কোন ব্যক্তি কুরআনকে নিজের পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করে, তা থেকে  হেদায়াত লাভের চেষ্টা করে এবং তাঁর জীবনে যেসব সমস্যা ও বিষয়াদি উপস্থিত হয় তাঁর সমাধানের জন্যে যদি সে কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্য কোন চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে পারবে না। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি পূর্ব থেকে নিজের চিন্তাধারাকে তাঁর মন-মগজে শক্তভাবে বসিয়ে নেয় এবং কুরআনকেও তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী ঢালাই করতে চায়- তাহলে এই পন্থা তাঁকে তাঁর আকাশ- কুসুম কল্পনা থেকে মুক্ত করতে পারে না। হ্যাঁ, যদি কোন ব্যক্তি কুরআন থেকেই পথনির্দেশ লাভ করতে চায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখানে যা কিছু পাওয়া যাবে তা সে মেনে নিবে এবং যা কিছু এখানে পাওয়া যাবে না তা সে গ্রহন করবে না- তাহলে এমন ব্যক্তিকে তাঁর নিজের কল্পনা বিলাসও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্যের চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে সক্ষম হবে না।

 

অতপর বলা হয়েছে, কারো মুখের ভাষা কুরআনের মধ্যে কোনরূপ ভেজাল মেশাতে সক্ষম হবে না। এ ব্যাপারটি একটি সুস্পষ্ট মু’যিযা- আল্লাহ তায়ালা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা এমন সময়ে বলেছেন, যখন এই কুরআন কেবল পেশ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরও এটা চূড়ান্ত কথা হিসাবে বিরাজ করছে যে, আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি এর সাথে কোন কিছু সংমিশ্রণ করতে পারে নি। সে সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল না যে, কুরআনে কোনরূপ মিশ্রন ঘটাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বানী হিসেবে একথা বলা হয়েছিলো। আজ শত শত বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমানিত হয়েছে যে, যা কিছু বলা হয়েছিলো বাস্তবিক অর্থেই তা ছিল হক। এরই নাম মুযিযা।

 

আরো বলা হয়েছে- আলেমগন তা থেকে কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলেম সে কুরআন তেলাওয়াত, তা অনুধাবন এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় জীবন অতিবাহিত করে দেয় কিন্তু কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। তাঁর কাছে এমন কোন সময় আসবে না যখন সে এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারবে যে, কুরআন থেকে তাঁর যা শেখার ছিল সে তা শিখে নিয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে এবং এখন তাঁর আর কোন জ্ঞানের দরকার নেই। আজ পর্যন্ত কোন আলেমই বলতে পারেনি যে, সে কুরআন থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছে, তাঁর যা কিছু অর্জন করার ছিল তা সে অর্জন করে নিয়েছে, এখন আর তাঁর অতিরিক্ত কিছু শেখার প্রয়োজন নেই।

 

অতঃপর বলা হয়েছে, কুরআন যতবারই পাঠ করো না কেন তা কখনো পুরান হবে না। যতো উন্নত মানের কিতাবই হোক- আপনি দুই- চার, দশ-বিশবার তা পড়তেই শেষে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তারপর আর তা পড়তে মন চাইবে না। কিন্তু কুরআন হচ্ছে এমন এক অনন্য কিতাব যা জীবনভর পাঠ করা হয়, বারবার পাঠ করা হয় তবুও মন পরিতৃপ্ত হয় না। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা তো দিনের মধ্যে কয়েকবার পাঠ করা হয় কিন্তু কখনো বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় না যে, কতদিন ধরে লোক একই জিনিস বারবার পাঠ করছে। এটাও কুরআন মাজীদের এক অনন্য মু’যিযা এবং এর অসাধারন সৌন্দর্যের একটি নিদর্শন।

 

আরো বলা হয়েছে, কুরআন মাজীদের রহস্য কখনো শেষ হবার নয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন পারহ, এ নিয়ে চিন্তা- গবেষনা করতে এবং তথানুসন্ধান করতে করতে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর রহস্য কখনো শেষ হয় না। কখনো কখনো এমনও হয় যে, মানুষ একাধারে চল্লিশ পঞ্চাশ- বছর ধরে কুরআনের অধ্যয়নে কাটিয়ে দেয়ার পর কোন একসময় কুরআন খুলে পড়তে থাকে। তখন তাঁর সামনে এমন কোন আয়াত এসে যায় যা পাঠ করে মনে হয় যেন আজই সে এ আয়াতটি প্রথম পাঠ করছে। তা থেকে এমন বিষয়বস্তু তাঁর সামনে বেরিয়ে আসে যা জীবনভর অধ্যয়নেও সে লাভ করতে পারেনি। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এর রহস্য কখনো শেষ হবার নয়।

 

কুরআন মাজীদের মর্ম বানী শুনে জীনদের ঈমান আনার ঘটনা সূরা জীন এবং সূরা আহকাফে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা গেলো যে, কুরআন এমন প্রভাবশালী বক্তব্য পেশ করে- মানুষ তো মানুষ জীনেরাও যদি একগুঁয়েমি, গোঁড়ামি এবং হঠকারিতা পরিহার করে উন্মুক্ত মন নিয়ে কুরআনের বানী শুনে তাহলে তাদেরও একথা সাক্ষী না দিয়ে উপায় থাকে না  যে, কুরআন সঠিক পথের নির্দেশ দান করে এবং এর উপর ঈমান এনে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।

 

কুরআন মাজীদের এসব বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনাগত ভবিষ্যতে যেসব ফিতনা এবং বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে বাঁচার মাধ্যম এই কুরআন ছাড়া আর কিছুই নয়। একথাও পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন মাজীদে এমন জিনিস রয়েছে যার কারনে তা কিয়ামত পর্যন্ত সব সময় মানব জাতিকে যে কোন ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।

\r\n\r\n

কুরআন চর্চাকারীর পিতামাতাকে

 

নূরের টুপি পরিধান করানো হবে

 

আরবী***

 

৪২। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে- কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে নূরের টুপী পরিয়ে দেয়া হবে। সূর্য যদি দুনিয়াতে তোমাদের ঘরে নেমে আসে তাহলে এর যে আলো হবে- ঐ টুপীতে তাঁর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলো হবে। অতএব যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী যাবতীয় কাজ করে তাঁর প্রতি আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ হতে পারে বলে তোমাদের ধারনা? ( আহমাদ, আবু দাউদ )

 

 এখানে এমন পিতা-মাতার কথা বলা হয় নি যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন অধ্যয়ন করতে বাধা দেয়। এবং কুরআন পাঠকারী ছেলেদেরকে মোল্লা হয়ে গেছে বলে টিটকারি দেয় এবং বলে, এখন সে আর আমাদের কোন কাজে লাগার উপযোগী নয়। এ আর কি পার্থিব কাজ করবে- এতো কুরআন পড়ায় লেগে গেছে। এখানে এমন পিতামাতার কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন পড়িয়েছে। এবং তাঁদের এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যে, তাঁদের জীবদ্দশায় এবং তাঁদের মৃত্যুর পরও তারা কুরআন পড়তে অভ্যস্ত হয়ে রয়েছে এবং তদানুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছে। তাঁর এই কুরআন পাঠ শুধু তাঁর জন্যেই পুরস্কার বয়ে নিয়ে আসবে না বরং তাঁর পিতামাতাকেও পুরস্কৃত করা হবে। আর সেই পুরস্কার হচ্ছে কিয়ামতের দিন তাঁদেরকে মর্যাদাপূর্ণ, গৌরবময় ও আলোক উদ্ভাসিত টুপি পরিয়ে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, যে ব্যক্তি নিজে এই কুরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়- তাঁর উপর আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ বর্ষিত হবে এবং সে কতো কি পুরস্কার পাবে।

\r\n\r\n

কুরআনের হেফাজত না করা হলে তা দ্রুত ভুলে যাবে

 

আরবী****

 

৪৩। হযরত আবু মুসা আশআরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদকে স্মৃতিপটে ধরে রাখার এবং সংরক্ষণ করার দিকে লক্ষ্য দাও। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন। উট যেভাবে দড়ি ছিড়ে বন্ধন মুক্ত হয়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে- কুরআন সেভাবে এবং তাঁর চেয়েও দ্রুত স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ---------( বুখারী ও মুসলিম )

 

  অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করার পর তা স্মরণ শক্তির আধারে ধরে রাখার জন্যে যদি চিন্তা ভাবনা না করে এবং বারবার অধ্যয়ন না করে তাহলে তা মানুষের মন থেকে পলায়ন করে থাকে- যেভাবে উট তাঁর রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে। এর কারন হচ্ছে- মানুষ যতক্ষন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা স্মৃতিপটে ধরে রাখার চেষ্টা না করে ততক্ষন তাঁর আত্মা কুরআনকে গ্রহন করতে পারে না। যদি এটা না করা হয় তাহলে সে কুরআনকে তাঁর স্মৃতিপট থেকে ঢিলা করে দেয় এবং এর ফলে তা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেননা কুরআন তাঁর উপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে- তা থেকে মুক্ত হওয়ার দুর্বলতা তাঁর মধ্যে বর্তমান রয়েছে। কুরআন তাঁর জন্যে যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে সে তা অতিক্রম করতে চায়। যে ব্যক্তি নফসের গোলাম হয়ে যায় এবং নিজের নফসকে আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য বাধ্য করে না সে কখনো কখনো কুরআনের বানী শুনে ঘাবড়িয়ে যায়- না জানি এমন কোন আয়াত এসে যায় যা তাঁকে ভ্রান্ত ও নাজায়েজ কাজ করা থেকে বাঁধা দিয়ে বসে। এ জন্য বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ মুখস্থ করার পর তা স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করো। অন্যথায় তা উটের রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার ন্যায় তোমার স্মৃতিপট থেকে পলায়ন করবে।

\r\n\r\n

কুরআন মুখস্থ করে তা ভুলে যাওয়া জঘন্য অপরাধ

 

আরবী***

 

৪৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তির জন্য এটা খুবই খারাপ কথা যে, সে বলে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। ( আসল কথা হচ্ছে তাঁর অবহেলার কারনে ) তাঁকে এটা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কুরআনকে কণ্ঠস্থ রাখার আপ্রান চেষ্টা করো। কেননা তা পলায়নপর উটের চেয়েও দ্রুত মানুষের বক্ষঃস্থল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। -------( বুখারী, মুসলিম- মুসলিমের বর্ণনায় আছে, উট তাঁর বন্ধন থেকে যেভাবে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে )।

 

এখানেও একই কথা ভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করার পর তা ভুলে যাওয়া এবং এই বলা যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি- এটা খুবই খারাপ কথা। মূলত তাঁর ভুলে যাওয়ার অর্থও হচ্ছে- সে কুরআনের কোন পরোয়া করেনি এবং তা মুখস্থ করার পর সে দিকে আর লক্ষ্য দেয় নি। যেহেতু সে আল্লাহ তায়ালার কালামের প্রতি মনোযোগ দেয়নি এ জন্য আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে তা ভুলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর কালাম এমন ব্যক্তির কাছে রাখা পছন্দ করেন না যে তাঁর সমাদরকারী নয়। এই জন্য বলা হয়েছে, কুরআনকে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করো এবং তা কণ্ঠস্থ করার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। অন্যথায় উট বন্ধনমুক্ত হয়ে যেভাবে পালাবার চেষ্টা করে- অনুরূপভাবে কুরআনও বক্ষস্থল থেকে বের হয়ে চলে যায়।

\r\n\r\n

কুরআন মুখস্থকারীর দৃষ্টান্ত

 

আরবী****

 

৪৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কুরআন মুখস্থকারী এমন ব্যক্তি সদৃশ যার কাছে বাঁধা উট রয়েছে। যদি সে তাঁর রক্ষনাবেক্ষন করে তাহলে তা তাঁর কাছে থাকবে। আর যদি সে এটাকে আযাদ করে দেয় তাহলে তা ভেগে যাবে। --( বুখারী ও মুসলিম )

 

 হযরত আবু মুসা আশআরী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে তিনটি বর্ণনার একই বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন। এ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে লোকদের মনে একথা বদ্ধমূল করিয়েছেন যে, যার যতটুকু পরিমান কুরআন মুখস্থ আছে সে যেন তা মুখস্ত রাখার চেষ্টা করে। তা যদি স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা না করো এবং বারবার তা পাঠ না করো তাহলে এটা তোমাদের মন থেকে ছুটে যাবে।

 

আপনি দেখে থাকবেন, যারা কুরআনের হাফেজ তাঁদের সব সময় কুরআন পড়তে হয়। যদি তারা রমযান মাসে কুরআন শুনাতে চায় এ জন্যে তাঁকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এর কারন হচ্ছে- মানুষ কুরআন মুখস্ত করার পর যদি তা সংরক্ষিত করার চেষ্টা না করে তাহলে তা খুব দ্রুত তাঁর স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে চলে যায়।

\r\n\r\n

মনোনিবেশ সহকারে ও একাগ্র চিত্তে কুরআন পাঠ করো

 

আরবী***

 

৪৬। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের দীল যতক্ষন পর্যন্ত কুরআনের সাথে লেগে থাকে ততক্ষন তা পাঠ করো। যখন আর পাঠে মন বসে না তখন উঠে যাও ( অর্থাৎ পড়া বন্ধ করো)। ------------  ( বুখারী ও মুসলিম )

 

 এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন এমনাবস্থায় কুরআন পাঠ না করে যখন তাঁর মন পূর্ণরূপে কুরআনের দিকে নিবিষ্ট হচ্ছে না। সে গভীর মনোযোগের সহকারে এবং আগ্রহের সাথে যতটা সম্ভব কুরআন পাঠ করবে। মূল বিষয় মনযিলের পর মনযিল কুরআন পড়ে যাওয়া নয়। বরং পূর্ণ একাগ্রতা সহকারে এবং অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করে পড়াই হচ্ছে আসল ব্যাপার। এটা নয় যে, আপনি একপারা কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তখন আপনি এমন অবস্থায় বসে কুরআন পরছেন যে, আপনার মনোযোগ মোটেই সে দিকে নেই। এর চেয়ে বরং আপনি গভীর মনোযোগের সাথে এক রুকু পাঠ করুন। মানুষ যদি তা না করতে পারে তাহলে মনযিলের পর মনযিল কুরআন পাঠ করে কি হবে? এজন্যই বলা হয়েছে- কুরআন পড়ার সময় যদি মন ছুটে যায় তাহলে পড়া বন্ধ করে দাও।

\r\n\r\n

রাসুলুল্লাহর কিরাত পাঠের পদ্ধতি

 

আরবী***

 

৪৭। হযরত কাতাদা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনাস ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিরাত পাঠের ধরন কিরূপ ছিল? তিনি বললেন- তিনি শব্দগুলো টেনে টেনে ( অর্থাৎ পূর্ণাংগ ভাবে উচ্চারন করে ) পড়তেন। অতঃপর আনাস

 

( রাঃ) “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করে শুনালেন এবং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে আদায় করলেন। বিসমিল্লাহ, আর-রাহমান, আর- রাহীম ( আল্লাহ, রহমান এবং  রহীম শব্দক’টি টেনে টেনে পড়লেন )। -------------------- ( সহীহ বুখারী )

 

  অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না বরং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে পরিস্কার ভাবে উচ্চারন করে পাঠ করতেন। এর অর্থও এই নয় যে, তিনি অস্বাভাবিক পন্থায় কুরআন পাঠ করতেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি প্রতিটি শব্দ ধীর স্থিরভাবে এবং পূর্ণাংগভাবে উচ্চারন করে এমন ভঙ্গিতে পাঠ করতেন যে, পড়ার সময় মানুষের মনমগজ পূর্ণভাবে সেদিকে নিয়োজিত হতো যে- কি পাঠ করা হচ্ছে এবং এর তাৎপর্য কি?

\r\n\r\n

মহান নবীর সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ

 

আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়

 

আরবী***

 

৪৮। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – আল্লাহ তায়ালা কোন কথা এতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন না যতটা মনোযোগের সাথে কোন নবীর কণ্ঠস্বর শুনে থাকেন- যখন তিনি সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ করেন।-------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

আরবী***

 

৪৯। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- একজন নবী যখন সুললিত কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করেন- তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর পাঠ যতটা যত্ন সহকারে শুনেন অন্য কোন কিছু ততটা যত্ন সহকারে শুনেন না। ------ ( বুখারী ও মুসলিম )

 

  পূর্ববর্তী হাদীস এবং এ হাদীসের বক্তব্য মূলত একই। এর অর্থ হচ্ছে- সুললিত কণ্ঠে নবীর কুরআন পাঠ এমন এক জিনিস যার প্রতি আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক আকর্ষণ রয়েছে। এ জন্য তিনি নবীর কুরআন পাঠ যতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন তদ্রূপ অন্য কিছু শুনেন না।

\r\n\r\n

যে ব্যক্তি কুরআনকে নিয়ে স্বয়ং

 

সম্পূর্ণ হয় না সে আমাদের নয়  

 

আরবী***

 

৫০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করে না অথবা কুরআনকে পেয়ে অন্য সবকিছু থেকে বিমুখ হয় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ------- ( সহীহ বুখারী )

 

 এখানে ‘সুমধুর স্বর’- অর্থ কি তা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া প্রয়োজন। কুরআনকে সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা এক কথা, আর তা গানের সুরে পাঠ করা আরেক কথা। সুমধুর কণ্ঠে পড়া হচ্ছে এই যে, মানুষ কুরআনকে উত্তম পদ্ধতিতে, উত্তম সুরে পাঠ করবে। তাহলে কোন শ্রবণকারী উপস্থিত থাকলে তাঁর পাঠ সে মনোযোগের সাথে শুনবে এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। উত্তম সুরে পাঠ করার মধ্যে কেবল কণ্ঠস্বর উত্তম হওয়াই নয়- বরং সে এমন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করবে- যেন সে নিজেও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। কুরআন পাঠ করার ভঙ্গি এরূপ হওয়া উচিৎ যে, সে যে বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত পাঠ করছে তদনুযায়ী তাঁর কণ্ঠস্বর ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হবে এবং সেই আয়াতের প্রভাবও তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি শাস্তি সম্পর্কিত কোন আয়াত এসে যায় তাহলে তাঁর অবস্থা ও উচ্চারন ভঙ্গিও এমন হবে যেন তাঁর মধ্যে ভীত সন্ত্রস্র অবস্থা ক্রিয়াশীল রয়েছে। যদি সে সওয়াব বা আখিরাতের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কিত কোন আয়াত পাঠ করে, তখন তাঁর মধ্যে আনন্দ ও খুশির ভাব জাগতে হবে। সে যদি কোন প্রশ্নবোধক আয়াত পাঠ করে তখন সে তা প্রশ্নবোধক বাক্যের ধরন অনুযায়ী পাঠ করবে। পাথক কুরআন শরীফ এভাবে নিজে হৃদয়ঙ্গম করবে এবং প্রভাবান্বিত হয়ে পাঠ করবে। শ্রবণকারী যেন  শুধু তাঁর মধুর সুরের দ্বারাই প্রভাবিত না হয়, বরং তাঁর প্রভাবও যেন সে গ্রহন করতে পারে- যেমন একজন উন্নত মানের বক্তার বক্তৃতার প্রভাব তাঁর শ্রোতাদের উপর পড়ে থাকে। এদিকে যদি লক্ষ্য দেয়া না হয় এবং গানের সুরে কুরআন পাঠ করা হয়- তাহলে সে কুরআনের সমঝদার নয়। বর্তমান যুগের পরিভাষায় এর নাম সংস্কৃতি তো রাখা যায়, কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে কুরআন তেলাওয়াত হতে পারে না। সুর এবং লয়ের মাধ্যমে কুরআন পাঠ সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না।

 

‘তাগান্না বিল কুরআন’- এর আরেক অর্থও হচ্ছে এই যে, কুরআনকে নিয়ে মানুষ দুনিয়ার অন্য সবকিছুর মুখাপেক্ষীহীন হয়ে যাবে। সে কুরআন মাজীদকে আয়-উপার্জনের হাতিয়ার পরিনত করবে না। বরং সে কুরআনের ধারক হয়ে- যে মহান খোদার এই কালাম- তাঁর উপরই ভরসা করবে। কারো কাছে সে হাত পাতবে না এবং কারো সামনে তাঁর মাথা নত হবে না। সে কাউকেও ভয় করবে না, কারো কাছে কিছু আশাও করবে না। যদি এটা না হয় তাহলে সে কুরআনকে তো ভিক্ষার পাত্র বানিয়েছে- কিন্তু সে কুরআনকে পেয়েও দুনিয়াতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে নি।

\r\n\r\n

রাসুলুল্লাহ সাঃ, কুরআন এবং সত্যের সাক্ষ্যদান

 

আরবী***

 

৫১। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের উপরে থাকা অবস্থায় আমাকে বললেন- “আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও”। আমি আরজ করলাম, আমি আপনাকে কুরআন পাঠ করে শুনাবো? অথচ তা আপনার উপরই নাযিল হচ্ছে, তিনি বললেন- “আমি অপরের মুখে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে চাই”। অতএব আমি সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে থাকলাম। যখন আমি এই আয়াতে পৌছলাম- “আমি যখন প্রত্যেক উম্মাতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী হাযির করবো এবং এই সমস্ত সম্পর্কে- তোমাকে ( হে মুহাম্মাদ ) সাক্ষী হিসেবে পেশ করবো তখন তারা কি করবে ” তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “আচ্ছা যথেষ্ট হয়েছে”। হঠাৎ আমার দৃষ্টি তাঁর চেহারায় পতিত হলে আমি দেখলাম- তাঁর দুচোখ দিয়ে আশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ------------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়্যুত প্রাপ্তির পরে এই দুনিয়ায় যতো লোক এসেছে তারা সবাই তাঁর উম্মত। যদি তারা তাঁর উপর ঈমান এনে থাকে তাহলে এক অর্থে তারা তাঁর উম্মত। আর যদি তারা ঈমান না এনে থাকে তাহলে তারা অন্য অর্থে তাঁর উম্মত। কেননা, প্রথমত- যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনে থাকবে তারা তাঁর উম্মত। দ্বিতীয়ত- যেসব লোকের কাছে তাঁকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাঁরাও তাঁর উম্মত। রাসুলুল্লাহকে ( সাঃ )  যেহেতু সমস্ত মানব জাতির কাছে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, এজন্য তাঁর নবুয়্যত প্রাপ্তি থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যতো লোকের আবির্ভাব হবে তারা সবাই তাঁর উম্মত।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মুখে সূরা নিসার আয়াত শুনে আশ্রুসজল হয়ে পড়লেন কেন?  এ ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করুন।

 

আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালতে সব জাতিকে উপস্থিত করা হবে এবং প্রত্যেক জাতির উপর নিজ নিজ নবীকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে- তিনি তখন সাক্ষী দেবেন, আমি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশসমূহ তাঁদের কাছে যথাযথভাবে পৌছে দিয়েছি। তখনই তাঁদের বিরুদ্ধে হুজ্জাত ( পূর্ণাংগ প্রমান ) সম্পন্ন হবে। নবীর পক্ষ থেকে যদি এ ব্যাপারে কন ত্রুটি থেকে গিয়ে থাকে ( আল্লাহ না করুন ) তাহলে তিনি আল্লাহর বানী পূর্ণরূপে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করার সাক্ষী দিতে পারেন না। নবী যদি এই সাক্ষ্য না দিতে পারেন ( যদিও এরূপ হবে না ) তাহলে তাঁর উম্মাতগন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে এবং মোকদ্দমার সাক্ষ্যও খতম হয়ে যাবে।

 

নিজের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর অনুভূতি ছিল। নবী ( সাঃ ) যখন উল্লেখিত আয়াত শুনলেন তখন এই অনুভূতির ফলশ্রুতিতেই তাঁর দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি কতবড় দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন যে, আজ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষের আবির্ভাব হবে- তাঁর মাধ্যমেই তাঁদের উপর আল্লাহর হুজ্জাত ( চূড়ান্ত প্রমান ) পূর্ণ হবে। এই অনুভুতিই তাঁকে অস্থির করে রেখেছিল। তিনি সব সময়ই ভাবতেন, এই হুজ্জাত পুরা করার ক্ষেত্রে আমার যদি সামান্য পরিমান ত্রুটিও থেকে যায় তাহলে এই উম্মতকে গ্রেফতার করার পরিবর্তে আমাকেই পাকড়াও করা হবে।

 

গভীরভাবে চিন্তা করুন, এর চেয়ে বড় যিম্মাদারী কি কোন মানুষের হতে পারে? আর এর চেয়েও কি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে পারে যে, সেই যুগ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত গোটা মানব জাতির সামনে আল্লাহ তায়ালার হুজ্জাত পুরা করার দায়িত্ব এককভাবে এক ব্যক্তির উপর পড়বে। কার্যত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গুরুত্বপূর্ণ পদেই সমাসীন ছিলেন। এই কঠিন যিম্মাদারীর অনুভুতিই তাঁর কোমরকে নুজ করে দিত। এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শান্তনা দেয়ার জন্য এই আয়াত নাযিল করেন-

 

“আমি কি আপনার উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে রাখিনি যা আপনার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল?”

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিকে এই মহান এবং কঠিন দায়িত্বের অনুভূতি রাখতেন, অপরদিকে এটা সব সময় তাঁকে অস্থির করে রাখতো, আমি যাদের হেদায়াতের পথে ডাকছি তারা কেন তা থেকে দূরে স্বরে যাচ্ছে- এবং কেনই বা তারা নিজেদের জন্য একটি ভয়াবহ পরিনতি নির্দিষ্ট করে নিচ্ছে? যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

 

“আপনি মনে হয় এই চিন্তায়ই নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেবেন যে, এরা কেন ঈমান আনছে না? ” ( সূরা আশ শুয়ারা, আয়াত- ৩ )

 

 এ কারনেই তিনি যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে এই আয়াত ( সূরা নিসা ) পাঠ করতে শুনলেন তখন তাঁর দুচোখ থেকে আশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবং তিনি বললেন, আচ্ছা হয়েছে, আর নয়, থেমে যাও। এখন আর সামনে অগ্রসর হতে হবে না।

\r\n\r\n

কুরআনী ইলমের বরকতে উবাই ইবনে কা’বের মর্যাদা

 

আরবী***

 

৫২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’বকে বললেন- আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে কুরআন পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। উবাই ( রাঃ ) পুনরায় বললেন- সত্যিই কি মহাবিশ্বের প্রতিপালকের দরবারে আমার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আনাস ( রাঃ ) বলেন- একথা শুনে উবাই ইবনে কা’বের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। অপর এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে “লাম ইয়াকুনিল্লাযিনা কাফারু” সূরা পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বললেন- আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। এতে উবাই ইবনে কা’ব ( আবেগাপ্লুত হয়ে ) কেদে দিলেন। --( বুখারী ও মুসলিম )

 

 হযরত উবাই ইবনে কা’বের এমন কি বিশেষত্ব ছিল যার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এতো উচ্চ স্থান, এতো বড় সম্মান ও পদমর্যাদা দান করলেন? হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে- হযরত উবাই ইবনে কা’ব সাহাবাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা যে অসংখ্য পন্থায় সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন তাঁর মধ্যে একটি ছিল, যে সাহাবীর মধ্যে কোন বিশেষ প্রতিভা এবং অসাধারন যোগ্যতার সমাবেশ ঘটতো- আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে বিশেষ ব্যবহার করতেন। যাতে এই বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ এবং লালন ঘটতে পারে এবং তাঁর শৌর্য-বীর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করা হয়েছে, আপনি উবাই ইবনে কা’বকে কুরআন পাঠ করে শুনান। হযরত উবাই ইবনে কা’ব এটা জানতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আল্লাহু আকবর, আমার এই মর্যাদা যে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমার নাম নিয়ে আমার উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আপনি এ থেকে অনুমান করতে পারেন, সাহাবাদের অন্তরে কুরআন মাজীদের প্রতি কি ধরনের মহব্বত ও আকর্ষণ ছিল। তাঁদের কতো সম্মান ও মর্যাদা ছিল যে, তারা আল্লাহ তায়ালার নজরে পড়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সাথে বিশেষ আচরন করেছেন।

\r\n\r\n

কুরআনকে শত্রুর এলাকায় নিয়ে যেও না

 

আরবী***

 

৫৩। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন সাথে নিয়ে শত্রু এলাকায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। ----- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

  মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, কুরআন শরীফ সাথে নিয়ে দুশমনদের এলাকায় যেও না কেননা শত্রুর হাতে পড়ে যাওয়া সম্পর্কে আনি নিরাপদ মনে করি না।

 

মোট কথা যে এলাকায় কুরআন নিয়ে গেলে তাঁর অসম্মান হওয়ার আশংকা আছে সেখানে যেনে শুনে কুরআন নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

\r\n\r\n

আসহাবে সুফফার ফযিলত

 

আরবী***

 

৫৪। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদিন দুর্বল ( গরীব ও নিঃস্ব ) মুহাজিরদের একটি দলের সামনে বসা ছিলাম। তারা নিজেদের লজ্জা নিবারনের জন্য পরস্পর লেগে বসেছিল। কেননা এসময় তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকার মতো কাপর ছিল না। এই মুহাজিরদের মধ্যেকার একজন কারী আমাদের কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং আমাদের দলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন তখন কুরআন পাঠকারী চুপ হয় গেলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সালাম দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- তোমরা কি করছিলে? আমরা আরজ করলাম, আমরা আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকদের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যাদের সম্পর্কে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে ধৈর্য ধারন করি। আবু সাঈদ ( রাঃ) বলেন, তিনি আমাদের মাঝে এমনভাবে বসে গেলেন যে, আমাদের এবং তাঁর মাঝে কোন পার্থক্য থাকলো না। ( মনে হচ্ছিলো তিনি আমাদের মধ্যেকারই একজন বিশেষ কেউ নন )। অতপর তিনি হাতের ইশারায় বললেন- এরূপ বস। অতঃপর তারা বৃত্তাকারে বসে গেলেন এবং তাঁদের সবার চেহারা তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেলো। অতঃপর তিনি বললেন- নিঃস্ব মুহাজিরদের জামায়াত, তোমরা পূর্ণাংগ নূরের সুসংবাদ গ্রহন করো, যা তোমরা কিয়ামতের দিন লাভ করেবে। তোমরা ধনীদের চেয়ে অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আখেরাতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান। ----------( আবু দাউদ )

 

  দুর্বল মুহাজির বলতে বৃদ্ধ অথবা শারিরীক দিক থেকে দুর্বল এমন লোকদের বুঝানো হয় নি, বরং এর অর্থও হচ্ছে নিতান্ত গরীব এবং আর্থিক অনটনে জর্জরিত। অর্থাৎ যেসব মুহাজির কোন অর্থ-সম্পদ ছাড়াই শুধু এক কাপড়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসছিলেন। তাঁদের কাছে না ছিল পরনের কাপড়, না ছিল খাবার সামগ্রী, আর না ছিল মাথা গোঁজার ঠাই। কিন্তু আল্লাহর দীনের সাথে তাঁদের সংশ্রব এবং কুরআনের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ এমনই ছিল যে, অবসর বসে থেকে অনর্থক কথাবার্তায় সময় কাটানোর পরিবর্তে তারা আল্লাহর কালাম শুনতেন এবং শুনাতেন।

 

এ স্থানে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআন মাজীদে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা কেন বলা হয়েছিলো, তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাহি ওয়া সাল্লাম এজন্য আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন কেন? একথা কুরআন মাজীদের এমন স্থানে বলা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ দান করেছেন যে- মক্কার এই বড় বড় সর্দার এবং ধনিক শ্রেনীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার কোন পরোয়াই করবে না। এবং কখনো এ চিন্তায়ও লেগে যাবে না যে- তাঁদের কেউ যদি তোমার দলে ভিড়ে যেত তাহলে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বের উসিলায় এ দীনের প্রসার ঘটতো বরং তাঁর পরিবর্তে যেসব দরিদ্র লোক এবং কাংগাল কিন্তু ঈমান গ্রহন করে তোমার কাছে এসেছে- তুমি তাঁদের নিত্য সাথী হয়ে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো, তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে যাও এবং তাঁদের সাহচর্যে আশ্বস্ত থাকো।

 

***সূরা কাহাফে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-

 

“হে নবী, তোমার দলকে এই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো যারা নিজেদের প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর তাঁদের দিক থেকে কখনো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তুমি কি দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাকজমক পছন্দ করো? এমন কোন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি স্মরণশুন্য করে দিয়েছি এবং যে লোক নিজের নফসের খাহেশের অনুসরন করে চলার নীতি গ্রহন করেছে, আর যার কর্মনীতি সীমা লংঘনমুলক। পরিস্কার বলে দাও, এই মহাসত্য এসেছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে। এখন যার ইচ্ছা তা মান্য করবে আর যার ইচ্ছা তা অমান্য করবে, অস্বীকার করবে।”—( আয়াত নং ২৮, ২৯ )

 

 কোন ব্যক্তি যখন আল্লাহর দীনের প্রচারের জন্য বের হয়ে যায় তখন তাঁর আকংখা থাকে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর ডাকে সাড়া দিক। তাহলে তাঁর আগমনে কোথাও দীনের কাজের প্রসার ঘটবে। এই অবস্থায় যখন গরীব ও দুর্বল লোকেরা, যাদের সমাজে বিশেষ কোন পদমর্যাদা নেই, এসে তাঁর আহবানে নিজের উৎসাহ প্রকাশ করে এবং এ কাজের জন্য নিজেকে পেশ করে দেয়- তখন সে চিন্তা করে এই যেসব লোকের সমাজে কোন স্থান নেই তাঁদের নিয়ে আমি কি করবো? এরা যদি ভেড়ার পালের মতোও জমা হয়ে যায় তবুও এসব গুরুত্বহীন লোকের দ্বারা দীনের আর কি প্রসার ঘটবে? দীনের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী লোকের এরূপ চিন্তা আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় নয়। এজন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করলেন যে, তিনি যেন ঈমান গ্রহণকারী সাধারন মর্যাদা সম্পন্ন গরীব লোকদের কম গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন মনে না করেন, তিনি যেন তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করে থাকেন, তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি যেন তাঁদের উপেক্ষা করে বড় বড় শেখ ও প্রতিপত্তিশীল লোকদের দলে আনার চিন্তায় বিভোর না হয়ে যান।

 

মক্কার কাফেরদের নেতারাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রুপ করে বলতো- কৈ তাঁর উপর তো মক্কার কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক ঈমান আনছে না, জাতির বিচক্ষন ও প্রভাবশালী লোক- যাদের কাছে লোকেরা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারের ফায়সালার জন্যে আসে, তাঁদের কেউই তো তাঁর সাথে নেই। এই নীচু শ্রেনীর লোকেরাই তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তিনি মনে করেছেন এদের নিয়েই তিনি দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে দেবেন। তাঁদের এই বিদ্রুপের জবাবে এই কথা বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সেই মূলত মূল্যবান মানুষ। যে ব্যক্তি ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে না জ্ঞানী হতে পারে আর না কোন নেতা বা শেখ হতে পারে। আজ যদিও কোন ব্যক্তি শেখ হয়ে আছে কিন্তু আগামীকাল তাঁর এই শেখগীরি খতম হয়ে যাবে এবং এই মর্যাদাহীন, দুঃস্থ গরীব লোকেরাই তাঁদের গদি উলটিয়ে দেবে। এ জন্য বলা হয়েছে, যেসব লোক তোমার দলে এসে গেছে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং তাঁদের দিক থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই দুর্দশাগ্রস্ত মুহাজিরদের দেখলেন যে, তারা কতটা আগ্রহ ও ভালবাসার সাথে কুরআন পড়া শুনছেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া তিনি এমন লোকদের আমার সঙ্গী করেছেন যাদের সাথে আমাকেও সবর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জন্য শুকরিয়া আদায় করলেন যে, তাঁর সাথে এমন লোকেরা এসে গেছে যাদের মধ্যে এই যোগ্যতা বর্তমান রয়েছে এবং তারা এতটা মজবুত ঈমানের অধিকারী যে আল্লাহর দীনের খাতিরে নিজেদের বাড়িঘর, সন্তান-সন্তুতি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে।

 

অতপর নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মুহাজিরদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং তারা সম্পদশালী লোকদের চেয়ে পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের শান্তনার বানী শুনিয়ে দিলেন, আল্লাহর দীনের খাতিরে তোমরা যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করছ, যে ভয়-ভীতির মধ্যে তোমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যে জন্য তোমরা তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছো এবং দুঃখ-দারিদ্রকে আরাম-আয়েশের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছ- এর বিনিময়ে তোমাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে যে, তোমরা কিয়ামতের দ্বীন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং ধনী লোকদের অর্ধদিন আগে বেহেশতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে। কিয়ামতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান।

 

 আখেরাতের অর্ধদিন এবং এটা দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান হওয়ার তাৎপর্য কোন ব্যক্তিই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। ঐ জগতের সময়ের মানদণ্ড এই দুনিয়ার চেয়ে ভিন্নতর এবং প্রতিটি জগতেই সময়ের মানদণ্ড ভিন্নরূপ- একথা হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের উল্লেখ করেছেন। এ জন্য এর খোঁজখবর ও অযথা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লিপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একথা সেখানে গিয়েই জানা যাবে সেখানকার সময় এবং কালের অর্থ কি এবং এর মানদণ্ডই বা কি?

\r\n\r\n

সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো

 

৫৫। হযরত বারাআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা সর্বাধিক সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো।           ( আহমাদ, আবু দাউদ, দারেমী )

 

অর্থাৎ যতদূর সম্ভব সুন্দর উচ্চারন ভঙ্গিতে এবং মার্জিত আওয়াজে কুরআন শরীফ পাঠ করো। এমন অমার্জিত পন্থায় পাঠ করোনা যার ফলে অন্তর কুরআনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবর্তে আরো দূরে চলে যায়।

\r\n\r\n

কুরআন পড়া শিখে তা ভুলে যাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার

 

আরবী***

 

৫৬। হযরত সা’দ ইবনে উ’বাদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ার পর তা ভুলে যায়- সে কিয়ামতের দিন কুষ্ঠ অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাযির হবে। ----( আবু দাউদ, দারেমী )

 

 হাদীস বিশারদগণ বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসে কুষ্ঠ হওয়ার অর্থ শুধু দৈহিকভাবে কুষ্ঠ হওয়া নয়, বরং একথা প্রবাদ বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে এবং এর অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ অসহায়। যেমন আমরা বলে থাকি, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। মূলত মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি। বরং মানুষের ঘাড়ে কঠিন বিপদ এসে চাপলেই এরূপ বলা হয়। অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় কারো অসহায়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলা হয়ে থাকে- তাঁর হাত কাঁটা। ইতিপূর্বে একটি হাদীসে এসেছে, “আল কুরআনু হুজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন তোমার পক্ষে প্রমান হবে বা বিপক্ষে প্রমান হয়ে দাঁড়াবে। এখন এমন এক ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন যার ঈমান আছে এবং সেই ঈমানের ভিত্তিতে সে কুরআন পাঠ করেছে কিন্তু তা পড়ার পর ফের ভুলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর কাছে এমন কোন প্রমান অবশিষ্ট আছে যা সে আল্লাহর দরবারে পেশ করবে? কুরআন ভুলে যাওয়ার পর তো তাঁর প্রমান তাঁর হাত থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তাঁর কাছে এমন কোন জিনিস নেই যা সে নিজের নির্দোষিতার স্বপক্ষে পেশ করবে। এ হচ্ছে সেই অসহায় অবস্থা- কিয়ামতের দিন সে যাতে লিপ্ত হবে। এটা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সে হাত কাটা অবস্থায় উঠবে।

\r\n\r\n

তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম করোনা

 

আরবী***

 

৫৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করেছে সে কুরআন বুঝেনি। -----( তিরমিযি, আবু দাউদ, দারেমী )

 

   অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে গোটা কুরআন খতম করে ফেলে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, সে কুরআনের কি বুঝল? এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে- কমপক্ষে তিন দিনে কুরআন খতম করো। এর চেয়ে অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম করতে পারলে তা আরো ভালো, কিন্তু এর কম সময় নয়। কেননা যদি কোন ব্যক্তি দৈনিক দশপারা কুরআন মধ্যম গতির চেয়েও দ্রুত পাঠ করে তাহলে সে এ অবস্থায় কুরআনের কিছুই বুঝতে পারবে না।

\r\n\r\n

প্রকাশ্যে অথবা নিরবে কুরআন পড়ার দৃষ্টান্ত

 

আরবী***

 

৫৮। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আওয়াজে কুরআন পাঠ করে সে ঐ ব্যক্তির মতো যে প্রকাশ্যে দান- খয়রাত করে। আর যে ব্যক্তি নিরবে কুরআন পাঠ করে সে গোপনে দান- খয়রাতকারীর সাথে তুল্য। --( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

 

  অর্থাৎ নিজ নিজ স্থানে উভয় পন্থায়ই কুরআন পাঠ করার সওয়াবও লাভ হয় এবং উপকারও হয়। কোন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে দান খয়রাত করে তাহলে অন্যদের উপরও তাঁর প্রভাব পড়তে পারে এবং তাদেরও দানখয়রাত করার দিকে মনোনিবেশ বাড়তে পারে। তাঁদের অন্তরেও আল্লাহর রাস্তায় দানখয়রাত করার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যদি গোপনে দানখয়রাত করে তাহলে তাঁর মধ্যে নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সৃষ্টি হয় এবং সে রিয়াকারী বা প্রদর্শনেচ্ছা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কুরআন পাঠ করার মধ্যে ফায়দা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বান্দাদের পর্যন্ত এর শিক্ষা পৌছে যায় এবং লোকদের মাঝে কুরআন পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট আওয়াজে বা গোপনে কুরআন পড়ার ফায়দা হচ্ছে এই যে, এভাবে কোন ব্যক্তি ইখলাছ ও নিষ্ঠা সহকারে এবং প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য কুরআন পাঠ করতে পারে এবং এর মধ্যে অন্য কোনরূপ আবেগের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না।

\r\n\r\n

কুরআনের উপর কার ঈমান গ্রহণযোগ্য  

 

৫৯। হযরত সুহাইব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে কুরআনের হারাম করা জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে- সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। -------------  ( তিরমিযি )   

 

  কুরআন যে আল্লাহর কালাম- এর উপর ঈমান আনা এবং কুরআনে হারাম ঘোষিত জিনিসকে হালাল বানানো— এ দুইটি জিনিস একত্রে জমা হতে পারে না। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা মানুষের কাছে কতিপয় গ্রহন করার এবং কতিপয় জিনিস পরিত্যাগ করার দাবী করে। যে ব্যক্তি কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে এবং সে কুরআনকে বাস্তবিকই আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে—তাঁর জীবন যাপন থেকে এর কোন প্রমান পাওয়া যায় না—তাঁর কুরআন মানার দাবী করার এবং তা পাঠ করার ফায়দা কি   আছে?   

\r\n\r\n

নবী ( সাঃ ) এর কিরআত পাঠের ধরন

 

আরবী***

 

৬০। হযরত ইয়া’লা ইবনে মামলাক ( তাবেয়ী ) থেকে বর্ণিত। তিনি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে কিরআত পাঠ করতেন? তখন উম্মে সালামা এমনভাবে কুরআন পাঠ করে শুনালেন যাতে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে কানে আসলো। ------ ( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

 

 অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না, বরং তিনি এমনভাবে কুরআন পাঠ করতেন যে, লোকেরা প্রতিটি অক্ষর পরিস্কার শুনতে পেতো। সামনের হাদীসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসবে।

 

আরবী****

 

৬১। হযরত উম্মে সালমা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুকরা টুকরা করে কুরআন পাঠ করতেন ( অর্থাৎ প্রতিটি বাক্য পৃথক পৃথক করে পড়তেন- অতঃপর থামতেন। ) ---- ( তিরমিযি )

 

  এখানে আরো পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে বা তাড়াহুড়া করে কুরআন পাঠ করতেন না। অর্থাৎ তিনি একই নিঃশ্বাসে “আলহামদু লিল্লাহ থেকে অলাদ দয়াল্লিন” পর্যন্ত পড়ে ফেলতেন না। বরং প্রতিটি বাক্যের শেষে বিরতি দিতেন।

\r\n\r\n

কতিপয় লোক কুরআনকে দুনিয়া লাভের উপায় বানিয়ে নেবে

 

আরবী***

 

৬২। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে আসলেন। আমরা তখন বসে কুরআন পাঠ করছিলাম। আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং অনারব লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কুরআন পাঠ শুনে বললেন-  পড়ে যাও,  তোমাদের সকলের পাঠই সুন্দর। অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা খুবই শুদ্ধভাবে এমন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করবে যেভাবে তীর লক্ষ্য ভেদ করার জন্য সোজা করা হয় কিন্তু এর দ্বারা তাঁদের পার্থিব স্বার্থ লাভই হবে উদ্দেশ্য, আখেরাত লাভ তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। ---------- ( আবু দাউদ, বায়হাকী )

 

 যাবের ( রাঃ ) এই যে বললেন, আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং ভিন্ন ভাষাভাষী লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সবাইকে বললেন, পড়ে যাও, সবাই সঠিক পড়ছ—তিনি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, যেহেতু এই জামায়াতে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্রের লোক ছিল এজন্য তাঁদের পাঠের ধরণও পৃথক পৃথক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের সকলের পাঠের সৌন্দর্য বর্ণনা করলেন। বাহ্যত তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় সঠিক উচ্চারনে এবং সঠিক ভঙ্গিতে কুরআন পাঠকারী ছিলেন না। আর প্রত্যেক ব্যক্তির কণ্ঠও সুমধুর ছিল না। তাছাড়া তাঁদের কারো কারো ভাষা ও উচ্চারন ভংগির মধ্যে ত্রুটিও থাকতে পারে। এজন্য তাঁদের কুরআন পাঠের পদ্ধতি ও ভংগির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান থাকাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের দেখে বললেন, তোমরা সকলেই সঠিকভাবে পাঠ করছ এবং তোমরা এই উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করছ যে, তোমরা দুনিয়াতে তদানুযায়ী জীবন যাপন করবে। এজন্য তোমরা সঠিক অর্থে কুরআন পাঠ করার হক আদায় করছ, তোমাদের পাঠ সম্পূর্ণ ঠিক আছে। চাই তোমরা উন্নত পর্যায়ের তাজবীদ শাস্ত্র জানো বা নাই জানো এবং কিরআত পাঠের নীতিমালা সঠিক এবং উত্তম পন্থায় তা পাঠ করে থাক বা না থাকো। এমন একটি সময় আসবে যখন কুরআন ঠিকই পড়া হবে, তা সঠিক কায়দা-কানুন এবং তাজবীদে শাস্ত্রের উত্তম নীতিমালা অনুযায়ী সঠিকভাবে পড়া হবে—যেমন লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার জন্য তীর সোজা করা হয়। কিন্তু তাঁদের এ পাঠের উদ্দেশ্য হবে সামান্য পার্থিব স্বার্থ লাভ করা, আখেরাত লাভ করা তাঁদের উদ্দেশ্য হবে না। অতএব তাঁদের এই পাঠ মোটেই কোন কাজে আসবে না। অবশ্য তোমাদের এই পাঠ একজন সাধারন গ্রাম্য লোকের পাঠের মতো যতই নিম্নমানের হোক না কেন—তাই কাজে আসবে। মূলত এই পাঠই আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় হবে। সুতরাং তোমাদের সকলের কুরআন পড়াই সুন্দর।  

\r\n\r\n

গান ও বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করোনা

 

আরবী***

 

৬৩। হযরত হুজাইফা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা আরবদের স্বরে এবং সুরে কুরআন পাঠ করো। কিন্তু সাবধান, আহলে ইশক এবং দুই আহলে কিতাব ( ইহুদী-খ্রিস্টান ) সম্প্রদায়ের স্বরে এবং সুরে মতো নয়। অচিরেই আমার পরে এমন একদল লোকের আগমন ঘটবে যারা গানের সুরে বা বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করবে। কুরআন তাঁদের কণ্ঠনালীর নীচে পৌছবে না। তাঁদের অন্তর দুনিয়ার প্রতি মহগ্রস্ত হয়ে থাকবে এবং যারা তাঁদের পদ্ধতিকে অনুসরন করবে তাদের অন্তরও। --- ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

 আরবী স্বরে এবং আরবী সুরে কুরআন পাঠ করার তাকীদ করার অর্থ এই নয় যে, অনারব লোকেরাও আরবদের সুরে এবং স্বরে কুরআন পাঠ করবে। মূলত একথার দ্বারা যা বুঝানো উদ্দেশ্য তা হচ্ছে- কোন আরব যখন কুরআন পাঠ করে সে এমনভাবে পাঠ করে যেমন আমরা আমাদের ভাষায় কোন বই পড়ে থাকি। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন নিজের ভাষায় কোন বই পড়েন তখন আপনি তা ইনিয়ে বিনিয়ে এবং গানের সুরে পাঠ করেন না। বরং নিজের ভাষার বই পুস্তক যেভাবে পাঠ করার নিয়ম সেভাবেই পাঠ করেন। অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার অর্থ হচ্ছে- কুরআন এমন সহজ সরল ও স্বভাবগত পন্থায় পাঠ করবে যেভাবে একজন আরবী ভাষী ব্যক্তি তা পাঠ করে থাকে। ইতপুরবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বানী উল্লেখিত হয়েছে- “কুরআনকে তোমাদের উত্তম স্বরে সৌন্দর্যমণ্ডিত করো”। অতএব বুঝা যাচ্ছে উত্তম সুরে পড়া এবং আরববাসীদের মতো সাদাসিধাভাবে কুরআন পাঠ করার অর্থ একই। কেননা সাদাসিদাভাবে কুরআন পড়ার অর্থ এই নয় যে, কোন ব্যক্তি বেমানানভাবে এবং ভয়ংকর শব্দে কুরআন পাঠ করবে।

 

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- সাবধান, আহলে ইশকের স্বরে কুরআন পাঠ করো না। অর্থাৎ গায়করা যেভাবে মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে- অনুরূপভাবে কুরআন পাঠ করো না।

 

অতঃপর তিনি বলেছেন, অচিরেই এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআনকে গানের সুরে পড়বে অথবা স্ত্রীলোকদের মতো বিলাপের সুরে পড়বে। কিন্তু এই পড়া তাঁদের কণ্ঠনালীর নিচে নামবে না। অর্থাৎ তাঁদের অন্তর পর্যন্ত কুরআনের আবেদন পৌছবেনা। শুধু তাই নয়, বরং তাঁদের অন্তঃকরণ দুনিয়াবী চিন্তায় লিপ্ত থাকবে। এবং তাঁদের অন্তঃকরনও যারা তাঁদের পাঠ শুনে দোল খেতে থাকে আর বলে সুবহানাল্লাহ।

 

 নবী ( সাঃ ) এ ধরনের কুরআন পাঠকারী এবং তা শুনে মাথা দোলানো ব্যক্তিদের এ জন্য সতর্ক করেছেন যে, এই কুরআন কোন কবিতার বই নয় যে, বসে বসে তা শুনবে এবং প্রশংসার স্তবক বর্ষণ করবে আর মারহাবা মারহাবা প্রতিধ্বনি তুল্বে। বর্তমানে আমাদের এখানে কুরআন পাঠের মজলিশে যেমনটা হচ্ছে। কখনো কখনো তো এসব মাহফিলের অবস্থা এমন হয়ে দাড়ায় যেন কবিতার আসর বসছে আর কি? এই পন্থা ত্রুটি মুক্ত নয়।

\r\n\r\n

সুমধুর সুরে কুরআন পাঠ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে

 

আরবী***

 

৬৪। হযরত বারাআ ইবনে আযেব  (রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকে বলতে শুনেছি- তোমরা নিজেদের উত্তম কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করো। কেননা সুমধুর স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ------------ ( দারেমী )

 

  এ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হাদীস এসেছে। কোনটিতে যদি গানের সুরে কুরআন পড়তে বাঁধা দেয়া হয়েছে তাহলে অপরটিতে তা সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে জানআ গেলো, গানের সুরে পড়া এবং সুমিষ্ট আওয়াজে পড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, একটি পসন্দনীয় আর অপরটি অপসন্দনীয়।

\r\n\r\n

সুকণ্ঠে কুরআন পড়ার অর্থ কি

 

আরবী***

 

৬৫। হযরত তাউস ইয়েমেনী মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি কুরআনকে উত্তম স্বরে উত্তম পন্থায় পাঠকারী? তিনি বললেন- যে ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনে তোমার এমন ধারনা হবে যে, আল্লাহকে ভয় করছে। --------- ( দারেমী )

 

  দেখুন, এখানে সুকণ্ঠে কুরআন পাঠ করার অর্থকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন বললেন- কুরআনকে সুমধুর আওয়াজ দ্বারা সৌন্দর্য মণ্ডিত করো এবং তা সুমিষ্ট স্বরে পাঠ করো, কিন্তু গানের সুরে পড়না- তখন লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, সুমিষ্ট স্বরে কুরআন পাঠ করার অর্থ কি? এরপর তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন- কুরআনকে এমন ভঙ্গীতে পাঠ করো যেন শ্রোতা স্বয়ং অনুভব করতে পারে যে, তুমি খদাকে ভয় করছ। খোদার ভয়শূন্য হয়ে মানুষ যখন কুরআন পাঠ করে তখন তাঁর অবস্থা ভিন্নরূপ হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করে এবং খোদার ভয় জাগ্রত রেখে পাঠ করে তাঁর অবস্থা হবে অন্যরকম। যে প্রতিটি জিনিসের প্রভাবকে গ্রহন করে কুরআন পাঠ করে। তাঁর পাঠের ধরন এবং মুখের ভংগি থেকেই তাঁর এই খোদাভীতির  প্রকাশ ঘটে।   

\r\n\r\n

কুরআনকে পরকালীন মুক্তির উপায় বানাও

 

আরবী***

 

৬৬। হযরত আবীদাহ মুলাইকী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আহলে কুরআন, ( কুরআন পাঠকারীগণ) কুরআনকে কখনো বালিশ বানাবে না, বরং দিনরাত তা পাঠ করবে। যেভাবে পাঠ করলে এর হক আদায় হয়- সেভাবে পাঠ করবে। তা প্রকাশ্যভাবে এবং সুললিত কণ্ঠে পাঠ করবে। এর মধ্যে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে তা নিয়ে গভীরভাবে চিনাত- ভাবনা করবে। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। তাঁর সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। কেননা এর সওয়াব           ( আখেরাতে )  অবশ্যই পাওয়া যাবে। --( বায়হাকী )

 

বলা হয়েছে- ‘কুরআনকে বালিশে পরিনত করো না’। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, মানুষ যেভাবে বালিশের উপর মাথা রেখে শোয়ার জন্য লম্বা হয়ে পড়ে যায়—অনুরূপভাবে কুরআনকে বালিশের বিকল্প বানিয়ে তাঁর উপর মাথা রেখে শুয়ে যেও না। বরং এর অর্থ পরবর্তী বাক্য থেকে পরিস্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ কুরআনের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। এরূপ অবস্থা যেন না হয় যে, নিজের কাছে কুরআন মওজুদ রয়েছে। কিন্তু নিজেই অলসতায় ডুবে রয়েছে এবং কখনো দৃষ্টি উত্তোলন করে এর প্রতি তাকায় না এবং এ থেকে পথ নির্দেশ ল্যাব করার চেষ্টাও করে না। অতঃপর বলা হয়েছে- ‘এই দুনিয়ায়ই কুরআনের সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। যদিও এর সওয়াব নিশ্চিতই রয়েছে এবং অবশ্যই তা পাওয়া যাবে।’ অর্থাৎ এই দুনিয়ায় এর সওয়াব তুমি না-ও পেতে পারো বরং এর উল্টো কোথাও তুমি এর কারনে শত্রুর কঠোরতার শিকার হয়ে যেতে পারো। কিন্তু এর সওয়াব অবশ্যই রয়েছে—যা অবশ্যই আখেরাতে পাওয়া যাবে। পার্থিব জীবনেও কখনো না কখনো এর সওয়াব মিলে যেতে পারে। কিন্তু তোমরা তা পার্থিব সওয়াব লাভের জন্য পড়ো না বরং আখেরাতের সওয়াব লাভের জন্য পাঠ করো।

\r\n\r\n

প্রাথমিক পর্যায়ে আঞ্চলিক উচ্চারনে কুরআন পাঠের অনুমতি ছিল

 

আরবী***

 

৬৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি হিশাম ইবনে হাকীম ইবনে হিযামকে ( রাঃ )  সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। কিন্তু আমার পাঠের সাথে তাঁর পাঠের গড়মিল লক্ষ্য করলাম। অথচ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এ সূরাটি শিখিয়েছেন। অতএব, আমি তাঁর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ধত হলাম। কিন্তু ( ধৈর্য ধারন করলাম এবং ) তাঁকে অবকাশ দিলাম। সে তাঁর কিরআত শেষ করলো। অতঃপর আমি তাঁর চাদর ধরে টানতে টানতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি তাঁকে সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। আপনি এ সূরাটি আমাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সে তা অন্যভাবে পাঠ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে ছেড়ে দাও। অতপর তিনি হিশামকে বললেন- পড়। সুতরাং আমি তাঁকে যেভাবে পাঠ করতে শুনেছিলাম ঠিক সেভাবেই সে তা পাঠ করলো। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরূপই নাযিল হয়েছে। অতপর তিনি আমাকে বললেন- কুরআন সাত হরফে নাযিল করা হয়েছে। অতএব যেভাবে পাঠ করা সহজ সেভাবেই তা পাঠ করো। ----- (বুখারী ও মুসলিম )

 

  ‘সাত হরফে’ অর্থ- সাত ধরনের উচ্চারন ভঙ্গি অথবা সাত ধরনের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য। আরবী ভাষায় আঞ্চলিক শব্দের পার্থক্য একটি প্রসিদ্ধ বিষয়। আরবের বিভিন্ন গোত্র ও এলাকার ভাষার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য সূচীত হয়। স্থানীয় বাক্যরীতি, উচ্চারন-ভঙ্গি, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ভাষাগত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকা সত্যেও ভাষার মৌলিক ধাঁচ এক ও অভিন্ন। ভাষার স্থানীয় ঢং এবং পার্থক্যের দৃষ্টান্ত আপনারা এখানেও পেয়ে থাকবেন। সুতরাং আপনি যদি পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় যান তাহলে দেখতে পাবেন এর প্রতিটি জেলা বরং একই জেলার বিভিন্ন অংশে ভাষার বিভিন্নতা রয়েছে। উর্দু ভাষারও একই অবস্থা। পেশোয়ার থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত চলে যান, মাদ্রাজ থেকে তাঁর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যান। উর্দুভাষীগণ একই বিষয় প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন বাক্যরীতি, উচ্চারন ভঙ্গি, প্রবাদ বাক্য ইত্যাদি ব্যবহার করে। দিল্লি, হাদ্রাবাদ, দাক্ষিণাত্য এবং পাঞ্জাবে একই উর্দু ভাষার বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। বাংলা ভাষার অবস্থাও তদ্রূপ। একই বিষয়বস্তু প্রকাশ করার জন্য কলিকাতা, গোহাটি এবং ঢাকার বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

 

আরবের আঞ্চলিক ভাষায়ও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান ছিল এবং বর্তমানেও আছে। আরবের উপদ্বীপে আপনি ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত অথবা ইয়েমেন থেকে ইরাক পর্যন্ত ভ্রমন করেন। তাঁদের উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করে থাকবেন। এই বিষয়বস্তু আরবের এক এলাকার এক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, আবার অন্য এলাকায় ভিন্নরূপে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের কারনে অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সুতরাং এই হাদীসে সাত হরফ বলতে এই উচ্চারন ভঙ্গি, বর্ণনা ভঙ্গি ইত্যাদির পার্থক্য বুঝানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআন শরীফ যদিও বা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতিতে নাযিল হয়েছে, কিন্তু আরববাসীদের স্থানীয় উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। একজন আরবী ভাষী লোক যখন কুরআন পাঠ করে তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্য বর্তমান থাকা সত্যেও অর্থ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন সূচীত হয় না। হারাম জিনিস হালাল হয়ে যাওয়া অথবা হালাল জিনিস হারাম হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তৌহিদের বিষয়বস্তু শেরেকী বিষয়বস্তুতে পরিনত হতে পারে না ।

 

কুরআন যতক্ষন আরবের বাইরে ছড়ায় নি এবং আরবরাই এর পাঠক ছিল এই অনুমতি কেবল সেই যুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে এই অনুমতি ও সুবিধা রহিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি কেন দেয়া হল তাও বুঝে নেয়া দরকার। এর কারন ছিল এই যে, তৎকালীন সময়ে লিখিত আকারে কুরআনের প্রচার হচ্ছিলো না। আরবের লোকেরা লেখাপড়াই জানতো না। অবস্থা এরূপ ছিল যে, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হাতে গনা মাত্র কয়েকজন লেখাপড়া জানা লোক ছিল। আরবে লেখাপড়ার যা কিছু রেওয়াজ ছিল তা ইসলামের আগমনের পরেই হয়েছে। সুতরাং এযুগের লোকেরা মুখে মুখে কুরআন শুনে তা মুখস্ত করে নিতো। যেহেতু তাঁদের মাতৃভাষা ছিল আরবী, এজন্য কুরআন মুখস্ত করতে এবং মুখস্ত রাখতে তাঁদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। একজন আরব যখন কুরআন শুনত তখন পুরা বিসয়বস্তুই তাঁর মুখস্ত হয়ে যেত। এরপর সে যখন অন্যদের কাছে তা বর্ণনা করতো তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্যের কারনে তাঁর বর্ণনার মধ্যে অনুরূপ ধরনের উচ্চারনগত পরিবর্তন হয়ে যেত। এতে মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য সূচীত হতো না। স্থানীয় বাক্যরীতি অনুযায়ী তারা যেভাবে পাঠ করতো বিষয়বস্তু সেভাবে বর্ণিত হতো। এর ভিত্তিতে সেই যুগে আরবদের জন্য নিজ নিজ এলাকার উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করার সুযোগ রাখা হয়েছিলো।

 

  হযরত উমর ( রাঃ ) যেহেতু মনে করেছিলেন, তিনি যেভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কুরআন শুনেছেন--ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের তা পাঠ করা উচিৎ। এজন্য তিনি যখন হিশাম ( রাঃ ) কে ভিন্ন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করতে শুনলেন তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তিনি যতো সময় ধরে পাঠ করতে থাকলেন, উমর ( রাঃ ) নিজ স্থানে ততক্ষন অস্থির অবস্থায় কাটাতে থাকেন। এদিকে তিনি কুরআন পাঠ শেষ করলেন, ওদিকে উমর তাঁর চাদর টেনে ধরলেন এবং তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এনে উপস্থিত করলেন। এখন দেখুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজে কি ধরনের ধৈর্য, বিনয়, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য ছিল। তিনি একান্তই প্রশান্ত মনে তাঁর কথা শুনলেন। তারপর অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে বুঝালেন যে, তোমরা উভয়ে যেভাবে কুরআন পাঠ করো তা সঠিক এবং নির্ভুল। আল্লাহ তায়ালা দুই ভাবেই তা পাঠ করার অনুমতি দিয়েছেন।

\r\n\r\n

দীনী ব্যাপারে মতবিরোধের সীমা এবং সৌজন্যবোধ

 

আরবী***

 

৬৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুরআন পাঠ করতে শুনলাম। এর পূর্বে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভিন্নভাবে কুরআন পড়তে শুনেছি। আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলাম এবং তাঁকে জানালাম ( এই ব্যক্তি ভিন্ন পন্থায় কুরআন পাঠ করছে )। আমি অনুভব করলাম, কথাটা তাঁর মনপুত হল না। তিনি বললেন- তোমরা উভয়ে ঠিকভাবে পাঠ করেছো। পরস্পর মতবিরোধ করো না। কেননা তোমাদের পূর্বে যেসব জাতি ধংস হয়েছে। তারা এই মতবিরোধের কারনেই ধংস হয়েছে। ----- ( সহীহ বুখারী )

 

 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে মাসউদকে বুঝালেন যে, মতবিরোধ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে শিক্ষা বা হুকুম পরিবর্তিত হয় না—তাহলে এধরনের মতবিরোধ সহ্য করতে হবে। যদি তা না করে তাহলে আপশে মাথা ফাটাফাটিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এভাবে উম্মতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা এবং বিপর্যয়ের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু যেখানে দীনের মূলনীতি অথবা দীনের কোন হুকুম পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে—সেখানে মতবিরোধ না করাই বরং অপরাধ। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে মতবিরোধ না করার অর্থ হচ্ছে--- দীনের মধ্যে তাহরিফকে ( বিকৃতি ) কবুল করে নেয়া। এটা আরেক ধরনের বিপর্যয় যার দরজা বন্ধ করে দেয়া স্বয়ং দীনের খাতিরেই প্রয়োজন।

\r\n\r\n

অবিচল ঈমানের অধিকারী সাহাবী

 

নবীর প্রিয় পাত্র খোদার অনুগৃহীত

 

আরবী****

 

৬৯। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ( একদিন ) আমি মসজিদে নববীতে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায পড়তে লাগলো। সে নামাযের মধ্যে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হল। অতপর আরো এক ব্যক্তি আসলো। সে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, প্রথম ব্যক্তির কিরআত থেকে তা ভিন্নতর ছিল। আমরা নামায শেষ করে সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম। আমি বললাম, এই ব্যক্তি এমনভাবে কিরআত পড়েছে যা আমার কাযহে সঠিক মনে হয়নি। আর এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও ভিন্ন ধরনের কিরআত পাঠ করেছে ( এটা কেমন ব্যাপার )? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়কে ( নিজ নিজ পন্থায় ) কুরআন পাঠ করার নির্দেশ দিলেন। অতএব তারা কুরআন পাঠ করলো। তিনি উভয়ের পাঠকে সঠিক বললেন। এতে আমার অন্তরে মিথ্যার এমন কুমন্ত্রনার উদ্রেক হল যা জাহেলী যুগেও কখনো আমার মনে জাগেনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আমার এ অবস্থা লক্ষ্য করলেন, তিনি আমার বুকে সজোরে হাত মারলেন, ( মিয়া, চেতন হও, কি চিন্তা করছ? )। তিনি হাত মারতেই আমি যেন ঘামে ভেসে গেলাম, আমার বুক যেন চৌচির হয়ে গেলো এবং ভয়ের চোটে আমার মনে হল যেন আমি স্বয়ং আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন- হে উবাই, আমার কাছে যখন কুরআন পাঠানো হয় তখন আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, আমি যেন তা এক হরফে ( একই উচ্চারন ভঙ্গিতে ) পাঠ করি ( এবং সেটি ছিল কুরাইশদের উচ্চারন ভংগি )। আমি প্রতি উত্তরে বললাম, আমার উম্মতের সাথে নমনীয় ব্যবহার করা হোক। অতপর আআমকে দ্বিতীয়বার বলা হল, দুই হরফে কুরআন পাঠ করতে পারো। আমি প্রতি উত্তরে আরজ করলাম, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। তৃতীয় বারের জবাবে বলা হল, আচ্ছা কুরআনকে সাত রকমের    ( আঞ্চলিক ) উচ্চারন ভঙ্গিতে পাঠ করতে পারো। আরো বলা হল, তুমি যতবার আবেদন করেছো ততবারই জবাব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তোমাকে তিনটি দোয়া করারও অধিকার দেয়া হল, তুমি তা এখন করতে পারো ( এবং তা কবুল করা হবে ) এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন, হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন ”। আর তৃতীয় দোয়াটি আমি সেদিনের জন্য রেখে দিয়েছি যেদিন সমস্ত সৃষ্টিকুল আমার শাফায়াত লাভের আশায় চেয়ে থাকবে—এমনকি ইবরাহীমও ( আঃ )। ---------- ( সহীহ মুসলিম )

 

  হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেহায়েত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী ছিলেন। তিনি প্রবীন এবং প্রাজ্ঞ সাহাবাদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে জানতেন যে, কার মধ্যে কি যোগ্যতা এবং কামালিয়াত রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের কামালিয়াত ছিল এই যে, তাঁকে কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী মনে করা হতো। এই উবাই ইবনে কা’বের সামনেই এমন ঘতাওনা ঘটলো যে, দুই ব্যক্তি ভিন্ন দুই পন্থায় কুরআন পাঠ করলো যা তাঁর জানামতে সঠিক ছিল না। তিনি তাঁদের উভয়কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির করলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়ের পাঠকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অন্তরে এক কঠিন এবং মারাত্মক অসওয়াসার ( বিভ্রান্তি ) উদ্রেক হয়। তা এতই মারাত্মক ছিল যে, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জাহেলী যুগেও এতো জঘন্য বিভ্রান্তি আমার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি যা এসময় আমার মধ্যে উদয় হয়েছিলো। তাঁর মনে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো তা হচ্ছে- এই কুরআন কি খোদার তরফ থেক এসেছে না কোন মানুষের রচিত জিনিস—যা পাঠ করার ব্যাপারে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে।

 

অনুমান করুন, এই হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ ধরনের একজন সুউচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর মনে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামগনও মূলত মানুষই ছিলেন, ফেরেশতা ছিলেন না এবং মানবীয় গুনাবলী থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন না। তাঁদের কামালিয়াত ছিল এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থেকে কোন মানুষ যতটা উত্তম ফায়দা উঠাতে পারে তা তারা উঠিয়েছেন। তাঁর প্রশিক্ষনের আওতায় সাহাবাদের এমন একটি দল তৈরি হয়ছিল যে, মানব জাতির ইতিহাসে কখনো এ ধরনের মানুষ দেখা যায় নি। কিন্তু তা সত্যেও তারা তো মানুষই ছিলেন। এজন্য যখন এমন একটি ব্যাপার সামনে আসলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া আল্লাম ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় দুই ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনছেন আবার দুটোকেই সহীহ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তখন হঠাৎ করে ঐ সাহাবীর মনে এমন খেয়াল আসলো যার উল্লেখ আলোচ্য হাদীসে রয়েছে।

 

 এখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি দেখুন। মুখমন্দলের অবস্থা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মনে কি সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সাথে সাথে তিনি তাঁকে সাবধান এবং সতর্ক করার জন্য তাঁর বুকে হাত মারলেন, মিয়া, সচেতন হও। কি চিন্তায় মগ্ন হয়েছ?

 

একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, মনের মধ্যে অসওয়াসা সৃষ্টি হলেই মানুষ কাফের হয়ে যায় না এবং গুনাহগারও হয় না। অসওয়াসা এমন এক মারাত্মক জিনিস যে, আল্লাহ তায়ালা যদি তা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে বাঁচার উপায় আছে, অন্নথায় কোন মানুষই তা থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে, সাহাবাগন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে আরজ করতেন, হে আল্লাহর রাসুল, কখনো কখনো আমাদের মনের মধ্যে এমন সংশয় সৃষ্টি হয় যে, তাতে আমাদের মনে হয় আমাদের পরিনতি খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের আখেরাত নষ্ট হয়ে গেছে। একথার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আসল ব্যাপার তা নয় যে, তোমাদের মনে অসওয়াসা আসবে না। বরং আসল ব্যাপার হচ্ছে তা এসে তোমাদের মনে যেন স্থায়ী হতে না পারে। কোন খারাপ ধারনা মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে তা শেষে হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার দরবারে এজন্য পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যদি নিকৃষ্ট খেয়াল আসার পর তোমরা এটাকে নিজেদের মনে স্থান দাও এবং এর পোষকতা করতে থাকো, তাহলে এটা এমন জিনিস যা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে।

 

  হযরত উবাই ইবনে কা’বের মনের মধ্যে একটি ঘৃণ্য এবং বিপর্যয়কর অসওয়াসা সৃষ্টি হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথেই অনুভব করলেন যে, তাঁর মনে এই অসওয়াসা এসেছে। এজন্যে তিনি তাঁর বুকে চপেটাঘাত করলেন। তিনি চপেটাঘাত করতেই উবাই ( রাঃ ) সংবিত ফিরে পেলেন এবং সাথে সাথে তিনি অনুভব করতে পারলেন যে, আমার মনে কতো নিকৃষ্ট অসওয়াসা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, এটা অনুভব করতেই আমার মনের মধ্যে এমন কম্পন সৃষ্টি হল, মনে হল আল্লাহ তায়ালা আমার সামনে উপস্থিত এবং ভয়ের চোটে আমার ঘাম ছুটে গেলো।

 

তাঁর এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া মূলত তাঁর অবিচল ঈমান এবং পূর্ণতার আলামত বহন করে। তাঁর ঈমান যদি এই পর্যায়ের শক্তিশালী না হতো তাহলে তাঁর মধ্যে এরূপ কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

 

কোন ব্যক্তির ঈমান যদি মজবুত হয় এবং তাঁর অন্তরে কোন খারাপ অসওয়াসা আসে তাহলে সে কেপে যাবে এবং সে দ্রুত নিজের ভ্রান্তি বুঝতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যক্তির ঈমানে যদি বক্রতা থেকে থাকে তাহলে তাঁর অন্তরে খারাপ অসওয়াসা আসবে এবং তা তাঁর ঈমানকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে চলে যাবে। অতপর সে নিজের ঈমানের দুর্বলতার কারনে এ ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যাবে। অতপর সেই কুমন্ত্রনা আবারো তাঁর মনে জাগ্রত হবে এবং তাঁর ঈমানকে আর একটা নাড়া দিয়ে চলে যাবে। এমনকি একসময় তাঁর পুরা ঈমানকেই নড়বড় করে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু মজবুত এবং সবল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তির অবস্থা এরূপ হয় না। সে কুমন্ত্রনা জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যায়। হযরত উবাই ইবনে কা’বের   ( রাঃ ) প্রতিক্রিয়া সেকথারই সাক্ষ্য বহন করে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের ( রাঃ ) সতর্ক হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বুঝানোর পর পরিস্কার করে বললেন, প্রথমে কুরআন মাজীদ যখন নাযিল হয় তখন তা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভংগি অনুযায়ী নাযিল হয়। এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মাতৃভাষা ছিল। কিন্তু তিনি নিজে আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করলেন যেন তা অনুরূপ উচ্চারন ভংগিতেও পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়। আবেদনের ভাষা ছিল নিম্নরুপঃ “হাব্বেন আলা উম্মাতি----- আমার উম্মাতের সাথে নম্র ব্যবহার করুন।” তাঁর অনুভূতি ছিল, আমার মাতৃভাষা সাড়া আরবে প্রচলিত ভাষা নয়, বরং বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী গোত্র সমূহের মধ্যে কিছুটা স্থানীয় বাক্যরীতিরও উচ্চারন প্রচলিত রয়েছে। এজন্য সব লোকের জন্য যদি কেবল কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত ভাষার রীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয় তাহলে তারা কঠিন পরিক্ষায় নিমজ্জিত হবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা হোক। সুতরাং প্রথম আবেদনের জবাবে দুই রকম বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল।

 

নিজ বান্দার সাথে আল্লাহ তায়ালার ব্যবহারও আশ্চর্যজনক। প্রথম দফা দরখাস্তের জবাবে সাত রকম পন্থায় কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় নি। অথচ সাত রকম পন্থায় পাঠ করতে দেয়ার ইচ্ছাই ছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফা আবেদন করার অপেক্ষা করলেন। এভাবে একদিকে মনে হয়, রাসুলুল্লাহকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল যে, নবী হিসাবে তাঁর মধ্যে নিজের দায়িত্ব পালনের কতটা অনুভূতি রয়েছে। এজন্য প্রথমে একক ভংগিতেই কুরআন নাযিল করা হয়। কিন্তু যেহেতু তাঁর মনে এই অনুভূতি জাগ্রত ছিল যে, আরবের লোকদের হেদায়াত করাই আমার সর্ব প্রথম দায়িত্ব। আর আরবদের ভাষায় স্থানীয় পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। যদি কুরআন মাজীদের একটি মাত্র অঞ্চলের বাক্যরীতি অনুযায়ী পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে লোকেরা কঠিন বিপদে পড়ে যাবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। জবাবে দুই আঞ্চলিক রীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। তিনি পুনরায় আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে আরো নম্র ব্যবহার করা হোক। এভাবে তাঁর দুই দফা আবেদন করার পর সাত রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। এরপর আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, যেহেতু তুমি আমার কাছে তিনবার দরখাস্ত করেছো এবং আমি তিনবারই জবাব দিয়েছি—এজন্য এখন তোমাকে আমার কাছে অতিরিক্ত তিনটি দোয়া করার অনুমতি সেয়া হল। পরম দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান করার এই ধরন আপনি লক্ষ্য করুন। এ জিনিসটিকেই তিনি কুরআন মাজীদে বলেছেন-

 

“রহমাতী অয়াসিয়াত কুল্লা শাইয়েন------ আমার অনুগ্রহ প্রতিটি সৃষ্টির উপর প্রসারিত হয়ে আছে।” ( সূরা আরাফ ; ১৫৬ )

 

এই হচ্ছে রহমতের ধরন যে, তুমি যেহেতু তোমার উম্মতের সাথে নম্র ব্যবহার করার জন্যে আমার কছে তিনবার আবেদন করেছে—তাই তোমার দায়িত্ব পালনের এ পদ্ধতি আমার পছন্দ হয়েছে। এজন্য তোমাকে এখন আরো তিনটি আবেদন করার অধিকার দেয়া হল। আমি তা অবশ্যই কবুল করবো।

 

 এখন দেখুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইবার দোয়া করে তৃতীয় বারের দোয়াটি আখেরাতের জন্য হাতে রেখে দিয়েছেন। অন্য দুটি দোয়াও তিনি কোন পার্থিব স্বার্থ, ধন-দৌলত এবং ক্ষমতা ও কৃতিত্ব হাসিল করার জন্য করেন নি। বরং তিনি দোয়া করলেন, আমার উম্মতের সাথে ক্ষমা সুন্দর ব্যবহার করা হোক। তিনি বলেছেন- “ইগফিরলি উম্মাতি------ আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন।” আরবী ‘মাগফিরাত’ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে ক্ষমা করা, অপরাধ উপেক্ষা করা, অপরাধ দেখেও না দেখা ইত্যাদি।  ‘মিগফার’ বলা হয় এমন শিরস্ত্রানকে যা মাথাকে ঢেকে রাখে, গোপন করে রাখে। সুতরাং ‘ইগফিরলি উম্মাতি’- বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে- আমার উম্মাতের সাথে ক্ষমা, নম্রতা ও উদারতা পূর্ণ ব্যবহার করা হোক।

 

এরকম ব্যবহার তো হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তি অপরাধ করলো এবং দ্রুত তাঁকে শাস্তি দেয়া হল। আরেক রকম ব্যবহার হচ্ছে এই যে, আপনি অপরাধ করেছেন আর আপনার অপরাধকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং আপনাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি পুনরায় অপরাধ করছেন এবং আপনাকে সংযত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এভাবে পুনঃ পুনঃ আপনার অপরাধ উপেক্ষা করে আপনাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি যেন শেষ পর্যন্ত সংশোধন হতে পারেন এবং নিজেকে সংযত করতে পারেন।

 

ঘটনা হচ্ছে, মুসলমান যে জাতির নাম—তাঁদের কাছে আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ কালাম কুরআন মাজীদ অবিকল মওজুদ রয়েছে। এর মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন প্রকার রদবদল হতে পারেনি। আবার মুসলমানরাই সেই জাতি যাদের কাছে মহানবী ( সাঃ ) এর সীরাত, তাঁর বানী এবং তাঁর পথনির্দেশ অবিকল ও অপরিবর্তিত অবস্থায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত আছে। তাঁদের খুব জানা আছে হক কি এবং বাতিল কাকে বলে। তারা এও জানে যে, আমাদের কাছে আমাদের প্রতিপালকের দাবী কি। আমাদের প্রিয় নবী ( সাঃ ) কোন পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের একটি জাতি যদি ব্যক্তিগতভাবে অথবা সামস্টিগতভাবে নাফরমানী বা অসাদাচরন করে বসে কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ডলে- পিষে শেষ করে না দেন--- তাহলে এটা তাঁর সীমাহীন রহমত, বিরাট ক্ষমা এবং অনুগ্রহ ছাড়া আর কি? এক ধরনের অপরাধ তো হচ্ছে- অপরাধী জানতেই পারেনা যে, সে অপরাধ করেছে এবং সে আবারো অপরাধ করে বসলো। এ অবস্থায় সে এক ধরনের নম্র ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। কিন্তু এক ব্যক্তির জানা আছে আইন কি? এই আইনের দৃষ্টিতে কোন জিনিসটি অপরাধ তা তাঁর জানা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আইন ভঙ্গ করে। এর অর্থ হচ্ছে- এই ব্যক্তি কঠোর শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। বর্তমান কালের মুসলমানদের দৃষ্টান্ত হল এটাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখুন আজ তের- চৌদ্দশত বছরে আল্লাহ তায়ালার ব্যাপক শাস্তি আজ পর্যন্ত মুসলমানদের উপর নাযিল হয়নি। যদিও কোন কোন স্থানে পরীক্ষামুলক ভাবে বিপর্যয় এসেছে তবে অন্য স্থান সামলিয়ে নিয়েছে। এতো সেই দোয়ারই ফল যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করেছিলেন- আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন, তাঁদের অপরাধ উপেক্ষা করুন, তাঁদের সাথে কঠোরতা না করুন। সুতরাং তাঁর সেই দোয়া বাস্তবিকই কবুল হয়েছে।

 

এখানে একথাও ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, ‘ইগফির লি উম্মাতি’ বাক্যের দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কখনো উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমার উম্মত যে কোন ধরনের খারাপ কাজই করুক না কেন তা সবই ক্ষমা করে দেয়া হবে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তির নিজের কাধে বকরী বহন করে নিয়ে আসবে তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। সে আমাকে দাকবে – ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া রাসুলুল্লাহ।। -- আমি তাঁকে কি জবাব দেব? আমি বলব- এখন আমি তোমার কোন উপকারে আসবো না। কারন পূর্বেই আমি তোমার কাছে খোদার বিধান পৌছে দিয়েছি।” অর্থাৎ তোমরা যদি এমন অপরাধ করে আসো যার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিৎ--- তাহলে তোমরা আমার শাফায়াত লাভের অধিকারী হতে পারবে না। কিয়ামতের দিনের শাফায়াতের অর্থ এই নয় যে, সে যেহেতু আমার লোক, সুতরাং দুনিয়াতে জুলুম- অত্যাচার করেই আসুক না কেন জনগনের অধিকার আত্মসাৎ করেই আসুক না কেন কিন্তু তাঁকে ক্ষমা করিয়ে দেয়া হবে। আর অন্যরা জুলুম করলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতের অর্থ কখনো এটা নয়।

\r\n\r\n

পঠন ভঙ্গির পার্থক্যের কারনে অর্থের কোন পার্থক্য হয় না

 

আরবী***

 

৭০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- জিব্রাঈল ( আঃ ) প্রথমে আমাকে এক রীতিতে কুরআন পড়িয়েছেন। অতপর আমি তাঁর কাছে বার বার দাবী তুললাম যে, কুরআন মাজীদ ভিন্ন রীতিতেও পাঠ করার অনুমতি দেয়া হোক। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং তা সংখ্যায় সাতরীতি পর্যন্ত পৌছাল। অধঃস্তন রাবী ইবনে শুহাব যুহরী বলেন, যে সাত হরফে ( রীতি ) কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে—তা সংখ্যায় সাত হওয়া সত্ত্বেও যেন একটি রীতিরই বিকল্প ব্যবস্থা ছিল। এই একাধিক রীতিতে কুরআন পাঠ করলে ( কথা একই থাকে) হালাল-- হারামের মধ্যে পরিবর্তন সূচীত হয় না। ------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

  সাত রীতিতে কুরআন পড়ার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে যখন ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে উঠলো, তখন এই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব সমূহের মধ্যে একটি ছিল জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। কেননা মুসলমান এবং জাহেলিয়াত দুটি জিনিসের একই দর্পণ হতে পারে না। প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র জনগণকে মৌখিক পদ্ধতিতে দীনের শিক্ষা দান করেছে। কিন্তু এর সাথে সাথে গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। সুতরাং খেলাফতে রাশেদার যুগে এতো ব্যাপক আকারে শিক্ষা সম্প্রসারনের কাজ চলে যে, একটি তথ্যের ভিত্তিতে সে সময় শতকরা একশো জন লোকই অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। লোকেরা যেন কুরআন পড়তে সক্ষম হয়ে যায় এই লক্ষ্য সামনে থাকায় এরূপ ফল সম্ভব হয়েছিলো। অর্থাৎ মুসলমানদের দৃষ্টিতে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়ার সর্বপ্রথম গুরুত্ব এই ছিল না যে, লোকেরা যেন দুনিয়াবী ব্যাপারসমূহ লিখন ও পঠনে পারদর্শী হয়ে যাক। এতো কেবল একটা কর্মগত সুবিধা। আসল ফায়দা এই যে, লোকেরা কুরআন পড়ার যোগ্য হয়ে যায়। যখন তারা কুরআন পড়ার যোগ্য হবে না এবং সরাসরি জানতে পারবে না যে, তাঁর প্রতিপালক তাঁর উপর কি কি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তাঁকে কোন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন এবং সে পরীক্ষায় তাঁর সফল হওয়ারই বা পথ কি, আর বিফল হওয়ার কারন সমূহই বা কি—ততক্ষন তারা একজন মুসলমানের মতো জীবন যাপন করার যোগ্য হতে পারবে না। এ জন্য জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা ইসলামী সমাজে মৌলিক গুরুত্বের দাবীদার। ইসলামী খেলাফত এই কাজকে নিজের মৌলিক কর্তব্য বিবেচনা করেই আঞ্জাম দিয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাথমিক যুগেই মদিনায় শিক্ষা সম্প্রসারনের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের ঘটনায় জানা যায়, যখন কুরাইশ গোত্রের লোক বন্দী হয়ে আসলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের বললেন- তোমাদের মধ্যে যে লেখাপড়া জানে সে এখানে এতজন বালককে লেখাপড়া শেখাবে। তাহলে কোনরূপ বিনিময় ব্যতিরেকে তাঁকে মুক্ত করে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে লোকদেরকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

 

জনগণকে যখন শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব হল এবং তারা লেখাপড়ার উপযুক্ত হয়ে গেলো, এরপর বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারনে কুরআন পড়ার অনুমতি রহিত করে দেয়া হল এবং শুধু কুরাইশদের ভাষার প্রচলন অবশিষ্ট রাখা হয়। কেননা কুরআন মাজীদ কুরাইশদের আঞ্চলিক ভাষায় নাযিল হয়েছিলো। যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মাতৃভাষা ছিল। তাঁর নিয়ম ছিল, যখনই কুরআন মাজীদ নাযিল হতো, তখন প্রথম অবসরেই তিনি কোন লেখাপড়া জানা সাহাবীকে ডেকে তা শিখিয়ে দিতেন। এখানে বলা প্রয়োজন যে, কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি ছাড়াও প্রথম দিকে আরবের অপরাপর এলাকার বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এই অনুমতি রহিত করে দেয়া হয়। আর প্রথম থেকেই কুরআন মাজীদ কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত অভিধান অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়।

\r\n\r\n

আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পড়ার অনুমতি

 

একটি বিরাট সুযোগ ছিল

 

আরবী****

 

৭১। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাঈল ( আঃ ) এর সাথে সাক্ষাত করলেন। তিনি বললেন-  হে জিব্রাঈল, আমি একটি নিরক্ষর উম্মতের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। এদের মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ, কিশোর- কিশোরী এবং এমন ব্যক্তি যে কখনো পড়া-লেখা করেনি। জিব্রাঈল ( আঃ ) বললেন- হে মুহাম্মদ, কুরআন সাত রীতিতে নাযিল হয়েছে। --- ( তিরমিযি )

 

মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, জিব্রাঈল ( আঃ ) আরো বললেন- “কুরআন যেসব রীতিতে নাযিল হয়েছে তা আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট।”

 

নাসাঈর বর্ণনায় আছে, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- জিব্রাঈল এবং মিকাঈল ( আঃ ) আমার কাছে আসলেন। জিব্রাঈল আমার ডান পাশে বসলেন এবং মিকাঈল আমার বাম পাশে বসলেন। অতপর জিব্রাঈল আমাকে বললেন- কুরআন মাজীদ এক রীতিতে ( অর্থাৎ কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি অনুযায়ী ) পাঠ করুন। মিকাঈল আমাকে বললেন, আরো এক রীতিতে পাঠ করার অনুমতি চান। ( আমি এই অনুমতি চাইতে থাকলাম )। এমনকি শেষ পর্যন্ত সাত রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। সুতরাং এর প্রত্যেক রীতিই আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট।”

 

প্রত্যেক রীতি নিরাময়কারী ও যথেষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে—এর মধ্যে কোন প্রকারের ভ্রান্তির আশংকা নেই। কুরাইশদের অভিধান অনুযায়ী কুরআন পাঠ যেভাবে আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট অনুরূপভাবে অন্যান্য গোত্রের অভিধান অনুযায়ী তাঁর পাঠ আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট। এর মধ্যে যে কোন গোত্রের অভিধান অনুযায়ী কুরআন পাঠ করলে তাতে কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও অর্থের পরিবর্তন ঘটার কোন আশংকা নেই।

\r\n\r\n

কুরআন পড়ে শুনানোর পারিশ্রমিক নেয়া অবৈধ

 

আরবী***

 

৭২। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। একবার তিনি এক কাহিনীকারের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে কুরআন পড়ছিল আর ভিক্ষা চাচ্ছিল। এ দেখে তিনি ইন্না লিল্লাহি অ-ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করলেন, অতপর বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে তাঁর যা চাওয়ার আছে তা যেন আল্লাহ তায়ালার কাছে চায়। কেননা অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা কুরআন পাঠ করবে এবং মানুষের কাছে এর বিনিময় চাইবে। ---( আহমাদ, তিরমিযি)

 

  হাদিসটির বিষয়বস্তু পরিস্কার। তবুও এখানে একটি কথা খেয়াল রাখা দরকার। কুরআন শরীফ পড়ে তাঁর বিনিময় লওয়া কিংবা নামায পড়িয়ে তাঁর পারিশ্রমিক গ্রহন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে যদিও নেহায়েত নিষিদ্ধ কাজ এবং প্রাচীন ফিকাহবিদগণ তা নাজায়েজ হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন ; কিন্তু পরবর্তীকালে এমন কিছু বিষয়ের উদ্ভব হয় যার ফলে সমসাময়িক কালের ফিকাহবিদগণ লক্ষ্য করলেন যদি এই জাতীয় কোন পারিশ্রমিক গ্রহন করা চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ রাখা হয় তাহলে মসজিদ সমুহে পাঁচ ওয়াক্তের নিয়মিত আযান ও জামায়াত সহকারে নামায আদায়ের ব্যবস্থা চালু না থাকার এবং কুরআন শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে এবং মসজিদের দেখাশুনা ও তা সজীব রাখার কাজ ব্যহত হতে পারে। এজন্য তারা একটি বিরাট কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যেসব লোক নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করার অথবা কুরআন শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহন করবে তাঁদের জন্য পারিশ্রমিক নেয়া জায়েজ। তবুও নীতিগতভাবে একথা স্বস্থানে ঠিকই আছে যে, কোন আলেম যদি অন্য কোন উপায়ে নিজের সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য অর্থ উপার্জন করতে পারেন এবং সাথে সাথে বিনা পারিশ্রমিকে কোন নির্দিষ্ট মসজিদে নামাযের জামায়াতে নিয়মিত ইমামতি করতে সক্ষম হন তাহলে এর চেয়ে ভালো কথা আর কি হতে পারে? যে ব্যক্তি মসজিদের দরজায় বসে জুতা সেলাই করে জীবিকা অর্জন করে এবং পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে ইমামতি করার দায়িত্ব গ্রহন করে এবং কারো কাছ থেকে একটি পারিশ্রমিক গ্রহন করেনা--- আমার মরে এই ইমাম খুবই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এতদসত্তেও যদি কোনভাবেই তা সম্ভব না হয় এবং সে ধরনের কোন কাজেরও সংস্থান করা না যায়, তাহলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ইমাম সাহেব বেতন গ্রহন করবেন। মসজিদ কমিটিও ইমাম সাহেবের বেতনের ব্যবস্থা করে মসজিদকে জীবন্ত রাখার ব্যবস্থা করবেন।

\r\n\r\n

কুরআনকে জীবিকা অর্জনের উপায়ে পরিনতকারী অপমানিত

 

আরবী****

 

৭৩। হযরত বুরাইদাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে রুটি রুজি অর্জন করার উদ্দেশ্যে কুরআন পড়ে, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আসবে যে, তাঁর চেহারায় কেবল হাড়গোড়ই অবশিষ্ট থাকবে এবং তাতে গোশত থাকবে না। --( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

কোন ব্যক্তির চেহারায় গোশত না থাকার অর্থ সে অপমানিত হবে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি অমুক ব্যক্তি বে-আব্রু হয়ে পড়েছে। শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে- চেহারার সৌন্দর্য। সুতরাং কারো অপমানিত হওয়ার ব্যাপারটি আমরা অনেক সময় বলে থাকি “তাঁর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে”। অর্থাৎ তাঁর আসল চেহারা ধরা পড়ে গেছে এবং লোক সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। অতএব, চেহারায় গোশত না থাকাটা ‘লাঞ্ছিত ও অপমানিত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআন পড়াকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উপায়ে পরিনত করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাঁকে অপমানিত করবেন।

\r\n\r\n

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দুই সুরাকে পৃথককারী

 

আরবী***

 

৭৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিল না যে, এক সূরা কথায় শেষ হয়েছে। এবং অপর সূরা কথা থেকে শুরু হয়েছে। অবশেষে তাঁর উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নাযিল হয়। ---- ( আবু দাউদ )

 

  অর্থাৎ সূরা সমূহের সূচনা এবং সমাপ্তি নির্ণয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অসুবিধার সম্মুখীন হলেন, আল্লাহ তায়ালা তখন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নাযিল করে বলে দিলেন, যেখানে উল্লেখিত বাক্য শুরু হয়েছে সেখানেই একটি সূরা শেষ হয়েছে এবং অপর সূরা শুরু হয়েছে। এভাবে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ আয়াতটি মূলত সূরা সমূহের মাঝে সীমারেখা হিসাবা ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা সমূহের সূচনা ও সমাপ্তি নির্দেশ করার জন্যে এ আয়াত নাযিল করেন। এ তাসমিয়া কুরআন মাজীদের ‘সূরা নামলের’ একটি আয়াত ( ৩০ ) হিসাবেও নাযিল হয়েছে। সাবা রাজ্যের রানী তাঁর সভাসদগণকে বললেন- আমার নামে হযরত সুলাইমান ( আঃ ) এর একটি চিঠি এসেছে। তা ‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা শুরু হয়েছে ( ওয়া ইন্নাহু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ) সেখানে এটা ঐ সুরার আয়াত হিসাবে নাযিল হয়েছে। আর এখানে বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা এটাকে সূরা সমূহের মাঝে সীমারেখা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এখন এই তাসমিয়া দ্বারা প্রতিটি সূরা শুরু হয়। অবশ্য একটি ব্যতিক্রম আছে। তা হচ্ছে সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ নেই। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখান যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিলো তাতে সূরা তাওবার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ ছিল না। এ জন্য সাহাবাগন তা অনুরূপভাবেই নকল করেছেন। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তাতে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেন নি।

 

এ থেকে আপনারা অনুমান করতে পারেন যে, সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মাজীদকে গ্রন্থাকারে সংকলন করার সময় কতটা দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের জানা ছিল যে, সূরা সমূহকে পরস্পর থেকে পৃথক করার জন্য প্রতিটি সুরার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ লেখা হয়েছিলো। তারা এর উপর অনুমান করে সূরা তাওবার সুচনায় তা লিখে দিতে পারতেন। অথবা এরূপ ধারনাও করতে পারতেন যে, সম্ভবত এই সুরার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ লেখানোর খেয়াল তাঁর নাও থাকতে পারে। অথবা যে সাহাবীকে দিয়ে তিনি অহী লেখাতেন হয়তো তিনি তা লিখতে ভুলে গিয়ে থাকবেন ; বরং এধরনের কোন ভিত্তিহীন কিয়াসের আশ্রয় না নিয়ে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখান মাসহাফ যেভাবে পেয়েছেন হুবহু সে ভাবেই নকল করেছেন। কিন্তু নিজেদের পক্ষ থেকে এর মধ্যে একটি বিন্দুও সংযোজন করেন নি।

 

  এটা আল্লাহ তায়ালার এক মহান অনুগ্রহ যে, তিনি তাঁর কিতাবের হেফাজতের জন্য এই অতুলনীয় ব্যবস্থা করেছেন। দুনিয়ায় বর্তমানে এমন কোন আসমানি কিতাব নেই যার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার বানী তাঁর আসল অবস্থায় এবং কোন মিশ্রন ও রদবদল ছাড়া এভাবে সংরক্ষিত আছে। এই মর্যাদা কেবল কুরআন মাজিদেরই রয়েছে।

\r\n\r\n

সাহাবাগন কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মুখস্ত করেছেন

 

আরবী***

 

৭৫। তাবেঈ হযরত আলকামা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা ( সিরিয়ার ) হেমস নগরীতে ছিলাম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) সূরা ইউসুফ পাঠ করলেন। সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বললো- এটা এভাবে নাযিল হয় নি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি এ সূরা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পড়েছি। আমার পাঠ শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তুমি ঠিকভাবে পড়েছ”। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) লোকটির সাথে কথা বলছিলেন, এ সময় তিনি তাঁর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেন। তিনি বললেন- তুমি শরাব পান করেছো আর কুরআন শুনে তা মিথ্যা সাব্যস্ত করতে চাচ্ছ? অতএব তিনি তাঁর উপর ( মদ পানের অপরাধে ) শাস্তির দণ্ড কার্যকর করেন। --- ( বুখারী ও মুসলিম )

 

 এ হাদিসটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- সাহাবাদের মধ্যে যারা লোকদের মাঝে কুরআন পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেছেন—তারা হয় সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনে তা মুখস্ত করেছেন, অথবা অন্যের কাছে শুনে তা মুখস্ত করে তা আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনিয়েছেন। তিনি তা শোনার পর এর সমর্থন করেছেন যে, তুমি সঠিক মুখস্ত করেছো। এভাবে আমাদের কাছে কুরআন পৌঁছানোর কোন মাধ্যম এরূপ ছিলনা যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ থাকতে পারে।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদ কিভাবে একত্রে জমা করা হয়েছিলো

 

আরবী***

 

৭৬। হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সময় ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য সাহাবা শহীদ হলেন, হযরত আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম হযরত উমরও ( রাঃ ) সেখানে হাযির আছেন। আবু বকর (রাঃ) আমাকে বললেন- উমর আমার কাছে এসেছে এবং সে বলছে- “ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের অসংখ্য কারী ( যাদের কুরআন মুখস্ত ছিল এবং লোকদের তা পড়ে শুনাতেন ) শহীদ হয়ে গেছেন। আমার আশংকা হচ্ছে--- অন্যান্য যুদ্ধেও যদি কুরআনের কারীগন শহীদ হয়ে যায়, তাহলে কুরআনের বিরাট অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমার রায় হচ্ছে এই যে, আপনি কুরআনকে একত্রিত ( বইয়ের আকারে গ্রন্থাবদ্ধ ) করার নির্দেশ দেন।”

 

আবু বকর ( রাঃ ) বলেন, আমি উমরকে বললাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কাজ করেননি তা তুমি কিভাবে করবে? উমর ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ এটা খুবই ভালো কাজ। সে এ ব্যাপারে আমাকে বরাবর পীড়াপীড়ি করতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা-- এ কাজের জন্য আমার অন্তরকে উম্মুক্ত করে দিলেন। ( অর্থাৎ আমি আশ্বস্ত হলাম যে, এটা খুবই উপকারী কাজ এবং তা একটি শরঈ প্রয়োজনকে পূর্ণ করবে।) আমার অভিমতও উমরের অভিমতের সাথে মিলে গেলো।

 

যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, অতপর আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে বললেন, “তুমি একটি যুবক বয়সের লোক এবং বুদ্ধিমান। তোমার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ নেই ( অর্থাৎ তুমি যে কোন দিক থেকে নির্ভরযোগ্য )। তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অহী লেখার কাজেও নিয়োজিত ছিলে। অতএব তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলো খুঁজে বের করো এবং একত্রে জমা করো।” যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহর শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে আনার হুকুম দিতেন তাহলে এটা আমার কাছে এতো কঠিন মনে হতোনা--- যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ। আমি আরজ করলাম, আপনি একাজ কেমন করে করবেন যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি? আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ এটা বড়ই ভালো কাজ।

 

অতপর আবু বকর ( রাঃ ) এ কাজের জন্য আমাকে বার বার তাগাদা দিতে থাকলেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিলেন--- যার জন্য তিনি আবু বকর ( রাঃ ) এবং উমরের ( রাঃ ) অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতপর আমি কুরআন মাজীদকে খেজুরের বাঁকল, সাদা পাথরের পাত এবং লোকদের বুক ( স্মৃতি ) থেকে তালাশ করে একত্রে জমা করা শুরু করে দিলাম। অবশেষে আমি সূরা তাওবার শেষ আয়াত আবু খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেলাম। তা আর কারো কাছে পেলাম না। আয়াতটি হচ্ছে- “লাকাদ- জায়াকুম—রাসুলুম- মিন আন ফুসিকুম” শেষ পর্যন্ত। এভাবে কুরআন মাজীদের যে সহীফা একত্রিত করা হল বা লেখা হল তা হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) জীবদ্দশা পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। অতঃপর তা হযরত উমরের ( রাঃ ) কাছে তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত থাকে। অতঃপর তা উম্মুল মু’মিনিন হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর যিম্মায় থাকে। ----      ( সহীহ বুখারী )

 

  হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) মনে এই সন্দেহ উদ্রেক হয় যে, কুরআন মাজীদ একত্রে জমা করা যদি কোন জরুরী কাজ হতো এবং দীনের হেফাজতের জন্য এটা করার প্রয়োজন হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামই তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন মাজীদকে একত্রিত করে পুস্তকের আকারে সংকলিত করিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি যখন একাজ করেননি আমরা তা করার দুঃসাহস কি করে করতে পারি? কিন্তু হযরত উমরের ( রাঃ ) যুক্তি ছিল এই যে, কোন একটি কাজ যদি উত্তম বলে বিবেচিত হয় এবং শরীয়ত ও ইসলামের মৌলিক কাজের অনুকূল হয়, তাহলে এর শরঈ প্রয়োজন থাকা এবং তা স্বয়ং একটি ভালো  ও কল্যাণকর কাজ হওয়া এবং এর বিপক্ষে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্তমান না থাকাটাই সেই কাজ জায়েজ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এজন্যই তিনি বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমার দৃষ্টিতে এ কাজ উত্তম।

 

“খোদার শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেন তাহলে এ কাজ আমার কাছে এতটা কঠিন মনে হতো না, যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ”। ----- হযরত যায়েদের ( রাঃ ) এই মন্তব্য তাঁর তীক্ষ্ণ অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব বহন করে যে, কুরআন একত্রে জমা করা একটি কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ।

 

কুরআন মাজীদকে বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত করা, অতঃপর তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত ক্রমানুযায়ী লিপিবদ্ধ করা এবং তাতে কোনরূপ ভুল—ভ্রান্তি না হওয়া মূলতই এক কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছিল। “আমার দ্বারা যদি বিন্দু পরিমাণও ভুল হয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কুরআন ভ্রান্তি সহকারে পৌছার সমস্ত দায়দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হবে।” ---হযরত যায়েদ ( রাঃ ) এর মনে এই অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এই অনুভূতির কারনেই তিনি বলেছেন—পাহাড় উত্তোলন করে নিয়ে আসার চেয়েও অধিক কঠিন কুরআন সংকলনের এই বোঝা আমার উপরে চাপানো হয়েছে।

 

এ হাদীস থেকে জানা যায়, তিনটি উৎস থেকে কুরআন মাজীদ সংগ্রহ করা হয়েছে।

 

একটি উৎস এই ছিল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কুরআন মাজীদ লিখিয়েছিলেন তা খেজুর বাঁকল, সাদা পাথরের পাতলা তক্তির উপর লেখা ছিল। রাসুলুল্লাহর ( সাঃ ) নীতি ছিল--- যখন অহী নাযিল হতো, তিনি লেখাপড়া জানা কোন সাহাবীকে ডেকে তিনি নির্দেশ দিতেন--- এই সূরাটি অথবা এই আয়াতগুলো অমুক অমুক স্থানে লিখে দাও। এই সাহাবীদের কাতিবে অহী বা অহী লেখক বলা হতো। লেখা শেষ হলে আবার তিনি তা পড়িয়ে শুনতেন যাতে এর নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। অতপর তা একটি থলের মধ্যে ঢেলে দিতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে ( সামনের হাদীসে আসছে ) এও বলে দিয়েছেন যে, অমুক আয়াত অমুক সুরার অংশ এবং অমুক আয়াতের পরে এবং অমুক আয়াতের পূর্বে সংযোজিত হবে। অনুরূপভাবে সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাসও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে দিয়েছেন। এতে লোকেরা জানতে পারল যে, সূরাগুলোর ক্রমবিন্যাস কিভাবে করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কুরআন মাজীদকে একটি পুস্তকের আকারে লিখাননি—যে আকারে আজ তা আমাদের সামনে রয়েছে।

 

হযরত যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, এই থলের মধ্যে পাথরের যেসব তক্তি এবং খেজুর বাঁকল ছিল আমি তা বের করে নিলাম। এর সাথে আরো একটি কাজ এই করলাম যে, যেসব লোকের কুরআন মুখস্ত ছিল তাঁদের ডেকে তাঁদের পাঠ পাথর ও বাকলে লেখা কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখলাম। এভাবে দুইটি উৎসের সাথে কুরআনের আয়াতগুলোর সামঞ্জস্য নির্ণীত হওয়ার পর তা একটি পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা হল।

 

হযরত যায়েদ ( রাঃ ) যে বলেছেন, সূরা তাওবার সর্বশেষ আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা ( রাঃ ) এর কাছে পেয়েছি--- এর অর্থ এই নয় যে, এই আয়াত ঐ থলের পাণ্ডুলিপির মধ্যেই ছিল না। কেননা এই ব্যবস্থা করা হয়েছিলো যে, এই থলের মধ্যে যা কিছু পাওয়া যায় তা হাফেজদের মুখস্ত কুরআনের সাথে মিলানোর পরে লেখা হবে। অতএব তাঁর কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমি কুরআনের যে কয়জন হাফেজ পেলাম, তাঁদের মধ্যে সূরা তাওবার এই শেষ আয়াত কেবল খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) মুখস্ত ছিল। আমি থলের পাণ্ডুলিপির সাথে মিলানোর পর তা সংকলন করলাম।

 

মাসহাফে উসমানী কিভাবে প্রস্তুত করা হয়

 

আরবী***

 

৭৭। হযরত আনাস ইবনে মালেক ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ( রাঃ ) হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে আসলেন। এটা সেই যুগের কথা যখন তিনি সিরিয় বাহিনীর সাথে আর্মেনিয়া বিজয়ে এবং ইরাক বাহিনীর সাথে আজারবাইজান বিজয়ে অংশ গ্রহন করেছিলেন। লোকদের বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ হযরত হুজাইফাকে ( রাঃ ) উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি হযরত উসমানকে ( রাঃ ) বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন, ইহুদী-খ্রিস্টানদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিভেদ সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করার চিন্তাভাবনা করুন।

 

অতএব, হযরত উসমান ( রাঃ ) হাফসাকে ( রাঃ ) বলে পাঠালেন, আপনার কাছে কুরআন শরীফের যে সহীফা ( অর্থাৎ মাসহাফে সিদ্দিকী ) রয়েছে তা আমাকে পাঠিয়ে দিন। আমরা এটা দেখে আরো কপি নকল করিয়ে দেব। অতপর মূল কপি আপনাকে ফেরত দেব। হযরত হাফসা ( রাঃ ) মাসহাফ খানা ( পুস্তকাকারে সংকলন ) হযরত উসমানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অতপর তিনি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ( রাঃ ), হযরত সাঈদ ইবনুল আস ( রাঃ ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে হিশাম ( রাঃ ) এই চার ব্যক্তিকে এ কাজে নিযুক্ত করলেন। তারা মাসহাফে সিদ্দিকী থেকে আরো কয়েকটি মাসহাফ তৈরি করবেন। উপরোক্ত এই চার ব্যক্তির মধ্যে কুরাইশ বংশের তিন ব্যক্তিকে ( হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সাঈদ ইবনুল আস এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ) তিনি নির্দেশ দিলেন, যদি কখনো কুরআনের কোন জিনিস নিয়ে তোমাদের সাথে যায়েদের মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা কুরআনকে কুরাইশদের বাক্যরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। কেননা তা এই রীতিতে নাযিল হয়েছে। তারা তাই করলেন। যখন তারা পুস্তকাকারে কুরআনের নতুন সংকলন তৈরির কাজ শেষ করলেন হযরত উসমান ( রাঃ ) মাসহাফে সিদ্দিকী হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর কাছে ফেরত পাঠালেন। তিনি কুরআনের এক একটি সংকলন ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন, এই সংকলন ছাড়া আর যতো সংকলন রয়েছে তা যেন আগুনে জালিয়ে দেয়া হয়।

 

অধঃস্তন রাবী ইবনে শিহাব যুহরী বলেন, যায়েদ ইবনে সাবিতের পুত্র আমাকে বলেছেন, তিনি তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছেন, আমরা যখন এই মাসহাফে উসমানী সংকলন করছিলাম তখন আমি সূরা আহযাবের একটি আয়াত খুঁজে পাচ্ছিলাম না যা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পড়তে শুনেছি। আমি এ আয়াতের খজে লেগে গেলাম। তা খুজাইমা ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ) এর কাছে পাওয়া গেলো। আয়াতটি হচ্ছে—“মিনাল মুমিনিনা রিজালুন সাদাকু মা আহাদুল্লাহ আলাইহি----- ”। অতএব আমরা তা এই মাসহাফে উল্লেখিত সূরায় সংযোজন করলাম। ----- ( বুখারী )

 

  হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামানের ( রাঃ ) শংকিত হওয়ার কারন ছিল এই যে, লোকদেরকে যেহেতু নিজ নিজ আঞ্চলিক রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল--- এজন্য পরবর্তীকালে যখন বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আরবের বিভিন্ন এলাকার লোকেরা এসে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে যায় সেখানে তাঁদের মধ্যে কুরআনের পাঠ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই অবস্থা দেখে হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামান ( রা; ) অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি শংকিত অবস্থায় হযরত উসমান ( রাঃ ) এর দরবারে হাযির হন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনি এই উম্মাতের কথা চিন্তা করুন। তা না হলে তাঁদের মধ্যে কুরআন নিয়ে এমন কঠিন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে যাবে--- যেরূপ তাওরাত ও ইঞ্জীল কিতাব নিয়ে পর্যায়ক্রমে ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং হযরত উসমান ( রাঃ ) বিষয়টির নাজুকতাকে সামনে রেখে কুরআনের একটি নিখুঁত সংকলন তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

 

অতপর উসমান ( রাঃ ) এই সংকলনকে অবশিষ্ট রেখে বাকি সব সংকলন জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ এজন্য দিলেন যে, লোকেরা যখন লেখা ও পড়ার উপযুক্ত হয়ে গেল তখন তারা নিজ নিজ গোত্রের বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন শরীফ লিখেও নিয়েছিল। তাঁদের এই সংকলনগুলো যদি পরবর্তীকালে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে হযরত উসমানের তত্ত্বাবধানে তৈরিকৃত এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরিত সংকলনের সাথে বিরোধ দেখা দিত। বিভিন্ন রকমের সংশয়ের সৃষ্টি হতো। এজন্য যার যার কাছে লিখিত কুরআন বা তাঁর অংশ বিশেষ, এমনকি কোন আয়াত ছিল তাও তাঁদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সাথে সাথে এই মর্মে সরকারী নির্দেশ জারি করা হয় যে, সরকারী তত্ত্বাবধানে কুরআনের যে সংকলন তৈরি করা হয়েছে, এটাই এখন আসল নোসখা হিসাবে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি কুরআনের নিজস্ব কপি তৈরি করতে চায় সে এই সরকারী নোসখা দেখেই তা তৈরি করবে। এভাবে ভবিষ্যতের জন্য কুরআনের লেখন ও পঠন মাসহাফে উসমানীর উপর সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়।

 

যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) বলেছেন, সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেয়েছি। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) যুগে যে মাসহাফ লেখা হয়েছিলো--- মনে হয় এর কাগজ খুব শক্ত ছিল না। খুব সম্ভব ঐ আয়াতটি দুর্বল কাগজে লিপিবদ্ধ ছিল। মাসহাফে উসমানী নকল করার সময় পরিস্কার ভাবে তাঁর পাঠোদ্ধার করা যায় নি। তাই এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া আরো লক্ষ্য করার বিষয়, যায়েদ ইবনে সাবিতের যদিও স্মরণে ছিল যে, উল্লেখিত আয়াতটি সূরা আহযাবের নির্দিষ্ট স্থানে ছিল, কিন্তু তবুও তিনি এমন ব্যক্তির খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করলেন যার এ আয়াত মুখস্ত আছে। তাতে পরিস্কারভাবে প্রমান হয়ে যাবে যে, এ আয়াতটি মূলত কুরআন মাজিদেরই অংশ। খোঁজ করতে গিয়ে তিনি এ আয়াতটি খুজাইমা আনসারীর কাছে পেয়ে গেলেন। অতএব তিনি তা লিখে নিলেন।

 

 কুরআন শরীফ লিখন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সাহাবাদের কঠোর সতর্কতা অনুমান করুন। স্বয়ং যায়েদের ( রাঃ ) এ আয়াত মুখস্ত ছিল এবং তিনি নিজেই মাসহাফে সিদ্দিকীতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর এও মনে আছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ আয়াত পাঠ করতে শুনেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি কেবল নিজের স্মৃতির উপর নির্ভর করে তা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে নেননি--- যতক্ষন অন্তত একজন সাক্ষী এর স্বপক্ষে পাওয়া না গেছে।

 

সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাস রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) করেছেন

 

আরবী***

 

৭৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হযরত উসমান ( রাঃ ) কে বললাম, কি ব্যাপার, আপনি যে সূরা আনফালকে সূরা তাওবার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন? অথচ সূরা আনফালের আয়াত সংখ্যা হচ্ছে ৭৫ এবং সূরা তাওবার আয়াত সংখ্যা একশোর বেশী। ( আর যেসব সুরার আয়াত সংখ্যা শতের অধিক সেগুলো কুরআন শরীফের প্রথম দিকে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আপনি এই সূরা দুটির মাঝখানে বিসমিল্লাহ লিখেননি। আপনি সূরা আনফালকে প্রথম দিককার বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন--- এর কারন কি? অথচ এর আয়াত সংখ্যা একশোর কম। )

 

উসমান ( রাঃ ) জবাবে বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি এই ছিল যে, লম্বা সূরা সমূহ নাযিল হওয়ার যুগে যখন তাঁর উপর কোন আয়াত নাযিল হতো তিনি তাঁর কোন কাতিবকে ডেকে বলতেন, যে সূরায় এই এই বিষয় আলোচিত হয়েছে তাঁর মধ্যে এই আয়াত লিখে রাখো। এভাবে যখন কোন আয়াত তাঁর উপর নাযিল হতো, তিনি বলতেন- এ আয়াতটি অমুক সূরায় সংযোজন করো যাতে এই এই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। সূরা আনফালও মদিনায় প্রথম দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। ( বদরের যুদ্ধের পরে এই সূরা নাযিল হয় ) আর সূরা তাওবা মাদানী যুগের শেষ দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এই সূরা দুটির বিষয়বস্তুর মধ্যে যদিও সামঞ্জস্য রয়েছে কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় আমাদেরকে পরিস্কারভাবে একথা বলেননি যে, সূরা আনফাল সূরা তাওবারই অংশ। এজন্য আমি এই সুরা দুটিকে পৃথক পৃথক এবং পাশাপাশি রেখেছি এবং এর মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিখিনি। এটাকে আমি বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করেছি। --- ( মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ )

 

  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ—“এই আয়াতকে অমুক সুরার অন্তর্ভুক্ত করো যার মধ্যে অমুক বিষয় আলোচিত হয়েছে”---- এতে প্রমান হচ্ছে যে, তিনি নিজেই সূরা সমূহের নামকরন করেছেন, তিনি বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে এর নামকরন করেননি। অথচ বিভিন্ন সুরার নাম কেবল ( সুরার ) নিদর্শন হিসাবেই রাখা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় সুরার নাম ‘আল বাকারা’—রাখার কারন এই নয় যে, তাতে গাভীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বরং এটা কেবল এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সুরার এক স্থানে গাভীর উল্লেখ আছে।

 

 এ হাদীস থেকে দ্বিতীয় যে কথাটি জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় সূরাগুলোর ক্রমিক বিন্যাস করতে থেকেছেন। অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, তিনি এও বলতেন—“এই আয়াতকে অমুক আয়াতের পূর্বে এবং অমুক আয়াতের পরে  ( দুই আয়াতের মাঝখানে ) সংযোজন করো।” এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই এক একটি সুরার ক্রমিক বিন্যাসও সম্পন্ন করা হয়েছিলো এবং তা পূর্ণাংগভাবে লিখেও রাখা হয়েছিলো। যখন নামাযে কুরআন মাজীদ পাঠ করা হতো তখন এর কোন ক্রমবিন্যাস ছাড়া তা পড়াও সম্ভব ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন সূরা লেখাতেন, সেও ক্রমিকতা অনুযায়ী তা পড়া হতো। আর সেই ক্রমধারা অনুযায়ী লোকেরা তা শুনত।

 

  সূরা আনফাল এবং সূরা তাওবার মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য রয়েছে। উভয় সুরার মধ্যেই জিহাদের আলোচনা হয়েছে। দুই সুরাই একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। উভয় সূরায়ই কাফের ও মুনাফিকদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দুটি সুরাতেই জিহাদের বিধান বর্ণিত হয়েছে এবং আমাদেরকে জিহাদে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে দুইটি সুরার মাঝে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

 

এই সূরা দুটিকে পৃথক পৃথক ভাবেই রাখা হয়েছে। কিন্তু সূরাদ্বয়ের মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিপিবদ্ধ করা হয় নি। এ ব্যাপারে হযরত উসমান ( রাঃ ) এর ভাষ্য হচ্ছে--- বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে এই সূরা দুটিকে পরস্পর পাশাপাশি রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা একই সূরায় পরিনত করা হয়নি। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় পরিস্কার ভাবে একথা বলেননি যে, এ দুটি একই সূরা, তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখানো পাণ্ডুলিপিতে সূরা তাওবার প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা পাওয়া যায় নি—এজন্য মাসহাফে উসমানীতেও তা লেখা হয় নি। বর্তমানেও আপনারা কুরআন শরীফ পাঠ করছেন--- একটি সূরা শেষ করে অপর সূরা শুরু করছেন--- কিন্তু এই সূরা দুটির মাঝখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা নাই। এ থেকে আপনারা অনুমান করতে পারেন সাহাবায়ে কেরাম কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মাজীদ সংকলন করেছেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে লেখানো পাণ্ডুলিপিতে যে সূরা তাওবা পাওয়া গেছে তাঁর সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’  নেই   ( যেমন আমরা হাদীস থেকে জানতে পাই ) এ কারনে মাসহাফে উসমানীতেও এই সুরার সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা হয় নি।

 

--- সমাপ্ত ---

', 'কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%93-%e0%a6%ae%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%be', '', '', '2019-11-04 10:39:47', '2019-11-04 04:39:47', '

 

 

কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা

 

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

\r\n\r\n\r\n


\r\n\r\n

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

 

প্রসঙ্গ কথা

 

মূল গ্রন্থটি পাঠ করার আগে কয়েকটি বিষয়ে পাঠকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইঃ

\r\n\r\n

  •  
  • ১। এটি মাওলানা মওদুদীর নিজের সংকলিত কোনো মৌলিক হাদীস গ্রন্থ নয়, বরং এটি বিখ্যাত “মিশকাত মাসাবীহ” গ্রন্থের “ফাদায়েলুল কুরআন” ( কুরআনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা ) অংশের ব্যাখ্যা।
  •  
  • ২। এই ব্যাখ্যাও মাওলানার নিজের হাতের লিখিত নয়, ( মাওলানা লাহোরে দারসে কুরআন ও দারদে হাদীস প্রদান করতেন। তাঁর এসব দারস সাপ্তাহিক “আইন” “এসিয়া” ও কাওসার পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হতো ) এছাড়া অনেকে এগুলো টেপ রেকর্ডারের সাহায্যে রেকর্ড করে নিতেন।
  •  
  • ৩। ‘আইন’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং টেপ রেকর্ডার থেকে এ গ্রন্থটি সংকলন করেছেন জনাব হাফীযুর রহমান আহসান ( পাকিস্তান ) বক্তৃতা আকারে প্রকাশিত দারসকে তিনি গ্রন্থাকারে সাজিয়েছেন। এজন্যে তাঁকে কিছু সম্পাদনার কাজও করতে হয়েছে। এর আগে তিনি মাওলানার ‘রোযা’ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর দারসও গ্রন্থাকারে সংকলন করে প্রকাশ করেছেন।
  •  
  • ৪। মাদ্রাসা এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ যেভাবে ছাত্রদেরকে বিশেষ নিয়ম নীতি অনুসরন করে দারস দিয়ে থাকেন, কিংবা কোন মুহাদ্দিস যেভাবে হাদীসের ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করে থাকেন, এখানে সেরকম নিয়ম পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি। বরং এখানে উপস্থিত শ্রোতাদের মানসিক দক্ষতাকে সামনে রেখেই দারস পেশ করা হয়েছে।
  •  
  • ৫। একদিকে লিপিবদ্ধ গ্রন্থ এবং উপস্থিত শ্রোতাদের উপযোগী বক্তৃতা যেমন সমমানের হতে পারেনা, অপরদিকে পত্রিকার রিপোর্ট এবং টেপরেকর্ড থেকে বক্তৃতার সংকলন তৈরির ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি বিচ্চুতি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সর্বোপরি এ সংকলন তৈরি হওয়ার পর মাওলানা নিজে দেখে দিতে পারেননি। তাই এ গ্রন্থতটকে মাওলানার নিজ হাতে লেখা অন্যান্য গ্রন্থের মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক হবেনা।
  •  
  • ৬। এ যাবত যে কথাগুলি বললাম, তাহলো গ্রন্থটি প্রনয়ন সংক্রান্ত। এখন বলতে চাই গ্রন্থটির উপকারীতার কথা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সাধারন পাঠকদের জন্যে গ্রন্থটি খুবই উপকারী প্রমানিত হবে। এতে রয়েছে একদিকে হাদীস অধ্যয়নের উপকারীতা আর অপর দিকে রয়েছে সহজ সরল ব্যাখ্যা লাভের উপকারীতা।
  •  
  • ৭। এই সংকলনটি যেহেতু পবিত্র কুরআন মাজীদের মহত্ত্ব ও মর্যাদা বিষয়ক, সে কারনে আমরা এর প্রথম দিকে মাওলানার বিখ্যাত তাফসীর “তাফহীমুল কুরআনের” ভুমিকা থেকে কুরআন সংক্রান্ত কিছু জরুরি কথা সংকলন করে দিয়েছি।
  •  

 

মহান আল্লাহ তায়ালা এ গ্রন্থের সাহায্যে পাঠকমহলে পবিত্র কালামে পাকের মহত্ত্ব ও মর্যাদা অনুধাবনের তৌফিক দিন। আমীন।।

 

আব্দুস শহীদ নাসিম

 

ডিরেক্টর

 

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রিসার্চ একাডেমী, ঢাকা।

 

\r\n\r\n

কুরআন ও কুরআনের মর্যাদা অনুধাবনের উপায়

 

কুরআন মাজীদকে বুঝতে হলে প্রারম্ভিক সুত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহন করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপ –

 

১। সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষকে একধরনের স্বাধীনতা ( Autonomy ) দান করে তাঁকে দুনিয়ায় নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।

 

২। মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন- আমিই তোমাদের এবং সমগ্র সৃষ্টিলোকের একমাত্র মালিক, মা’বুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীন নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদের বন্দেগী, পূজা ও আনুগত্য লাভের অধিকারও নেই। দুনিয়ার এই জীবনে তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্যে পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ। তোমাদের জন্যে সঠিক কর্মনীতি একটিই- তোমরা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মা’বুদ এবং শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্যে যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমরা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা মোতাবেক জীবন যাপন করবে যেন আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হয়। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্যে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা এবং নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্থিরতার মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখিরাতে প্রবেশ কালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা, দুঃখ, কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্তে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।

 

৩। এ কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য ( আদম ও হাওয়া ) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্যে বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাঁদের এবং তাঁদের সন্তান সন্তুতিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধরেরা মূর্খতা, অজ্ঞতা এবং অন্ধকারের মাঝে সৃষ্টি হননি। আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁদের জীবন সূচনা করেন সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে। তারা সত্যকে জানতেন। তাঁদেরকে জীবন বিধান ( ইসলাম ) দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর আনুগত্য ছিল তাঁদের জীবন পদ্ধতি। তারা তাঁদের সন্তানদেরকেও আল্লাহর আনুগত্য অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরনে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি ( অর্থাৎ দ্বীন ) থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে। গাফলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে একসময় তারা এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানবিক ও অমানবিক এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্ত্বাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের ( আল ইলম ) মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রন ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহ নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি ( শরীয়ত ) পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোঁক প্রবনতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্যে নিজেরাই এমন বিধান তৈরি করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন জুলুম নিপীড়নে ভরে গেছে।

 

৪। আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোর পূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে তা হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত  সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমস্ত মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্যে তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাঁর সাথে অসামঞ্জস্যশীল। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহন করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তাঁর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁকে পথ নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্যে তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে এমন একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যারা তাঁর উপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদের কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বানী। যথার্থ সত্য জ্ঞান এবং জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেরকে দান করে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্যে এদেরকে নিযুক্ত করেন।

 

৫। এরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাঁদের এ আগমনের সিলসিলা বা ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তারা সবাই একই দীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচয় করানো হয়েছিলো তারা সবাই ছিলেন তাঁরই অনুসারী। তারা সবাই ছিলে একই হিদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই মানুষের জন্যে নৈতিকতা এবং সমাজ সংস্কৃতির যে চিরন্তন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো তারা ছিলেন তাঁরই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দ্বীন ও হিদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহন করে তাঁদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উম্মতে পরিনত করেন যারা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধচারন প্রবনতা প্রতিরোধ করার জন্যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগন প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সুচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সব সময় দেখা গেছে মানব গোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহন করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহন করে উম্মতে মুসলীমার অঙ্গীভূত হয় তাঁরাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাঁদের কোন কোন উম্মত আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বানীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রন ঘটিয়ে এবং তাঁর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তাঁর চেহারাই বিকৃত করে দেয়।

 

৬। সব শেষে বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠান। ইতোপূর্বে বিভিন্ন নবীকে যে দায়িত্ব দিয়ে তিনি দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারন মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের পথভ্রষ্ট উম্মতদেরকেও তিনি আল্লাহর দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহনের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হিদায়াত পৌঁছে দেয়ার এবং এই দাওয়াত ও হিদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মতে পরিনত করাই ছিল তাঁর কাজ যারা একদিকে আল্লাহর হিদায়াতের উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্য দিকে সমস্ত দুনিয়ায় সংশোধন ও সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হিদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মহান আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন।

\r\n\r\n

কুরআনের মূল আলোচ্য

 

কুরআন সম্পর্কিত এই মৌলিক ও প্রাথমিক কথাগুলো জেনে নেয়ার পর পাথকদের জন্যে এই কিতাবের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় ও লক্ষ্য বিন্দু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা সহজ হয়ে যায়।

 

এর বিষয়বস্তু মানুষ। প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ কিসে- এ কথাই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু। এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, আপাত দৃষ্টি, আন্দাজ-অনুমান নির্ভরতা অথবা প্রবৃত্তির দাসত্ব করার কারনে মানুষ আল্লাহ, বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা, নিজের অস্তিত্ব ও নিজের পার্থিব জীবন সম্পর্কে যেসব মনগড়া মতবাদ গড়ে তুলেছে এবং ঐ মতবাদগুলোর উপর ভিত্তি করে যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে যথার্থ জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে তা সবই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিনতির দিক দিয়ে তা মানুষের জন্যে ধংসকর। আসল সত্য তাই যা মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করার সময় আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছিলেন। আর এই আসল সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের জন্যে ইতোপূর্বে সঠিক কর্মনীতি নামে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতির আলোচনা করা হয়েছে তাই সঠিক, নির্ভুল ও শুভ পরিনতির দাবীদার।

 

এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ও বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বনের প্রতি আহবান জানানো এবং আল্লাহর হিদায়াতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা। মানুষ নিজের গাফলতি ও অসতর্কতার দরুন এগুলো হারিয়ে ফেলেছে এবং তাঁর শয়তানী প্রবৃত্তির কারনে সে এগুলোকে বিভিন্ন সময়ে বিকৃত করার কাজই করে এসেছে। এই তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে কুরআন পাঠ করতে থাকলে দেখা যাবে এই কিতাবটি তাঁর সমস্ত পরিসরে কোথাও তাঁর বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে পড়েনি। প্রথম থেকে নিয়ে  শেষ পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন ধরনের বিষয়াবলী তাঁর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যেমনভাবে একটি মোতির মালার বিভিন্ন রঙের ছোট বড় মোতি একটি সুতোর বাঁধনে একসাথে, একত্রে একটি নিবিড় সম্পর্কে গাঁথা থাকে। কুরআনে আলোচনা করা হয় পৃথিবী ও আকাশের গঠনাকৃতির, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং বিশ্ব জগতের নিদর্শন সমূহ পর্যবেক্ষণের ও অতীতের বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর। কুর্বানে বিভিন্ন জাতির আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা করা হয়। এই সাথে অন্যান্য আরো বহু জিনিসের উল্লেখও করা হয়। কিন্তু মানুষকে পদার্থ বিদ্যা, জীব বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা অন্য কোন বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কুর্বানে এগুলো আলোচনা করা হয়নি। বরং প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্য সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারনা দূর করা, যথার্থ সত্যটি মানুষের মনের মাঝে গেঁথে দেয়া, যথার্থ সত্য বিরোধী কর্মনীতির ভ্রান্তি ও অশুভ পরিনতি সুস্পষ্ট করা তুলে ধরা এবং সত্যের অনুরূপ ও শুভ পরিনতির অধিকারী কর্মনীতির দিকে মানুষকে আহবান করাই এর উদ্দেশ্য। এ কারনে এতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা কেবলমাত্র ততটুকুই এবং সেই ভঙ্গিমায় করা হয়েছে যতটুকু এবং যে ভঙ্গিমায় আলোচনা করা হয় তাঁর মূল লক্ষ্যের জন্যে প্রয়োজন। প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সব সময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য ও একাত্মতা সহকারে তাঁর সমস্ত আলোচনা ‘ইসলামী দাওয়াতের’ কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে-----------।

\r\n\r\n

কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি

 

কুরআন একটি অসাধারন গ্রন্থ। দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ অসংখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনের দিকে এগিয়ে আসে। এদের সবার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোন পরামর্শ দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এই বিপুল সংখ্যক অনুসন্ধানীদের মধ্যে যারা একে বুঝতে চান এবং এ কিতাবটি মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভুমিকা পালন করে এবং তাঁকে কিভাবে পথ দেখায়- একথা জানতে চান- আমি কেবল তাঁদের ব্যাপারেই আগ্রহী। এই ধরনের লোকদের কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি এখানে কিছু পরামর্শ দেবো। আর এই সংগে সাধারন লোকেরা এ ব্যাপারে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তারও সমাধান করার চেষ্টা করবো। কোন ব্যক্তি কুরআনের উপর ঈমান রাখুন আর নাই রাখুন তিনি যদি এই কিতাবকে বুঝতে চান তাহলে সর্বপ্রথম তাঁকে তাঁর নিজের মন- মস্তিষ্ককে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অনুকূল – প্রতিকুল উদ্দেশ্য ও স্বার্থ চিন্তা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করতে হবে। এ কিতাবটি বুঝার ও হৃদয়ঙ্গম করার নির্ভেজাল ও আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। যারা মনের মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা পূর্বে রেখে এ কিতাবটি পড়েন তারা এর বিভিন্ন ছত্রের মাঝখানে নিজেদের চিন্তাধারাই পড়ে যেতে থাকেন। আসল কুরআনের সামান্য বাতাসটুকুও তাঁদের গায়ে লাগেনা। দুনিয়ার যেকোন বই পড়ার ব্যাপারেও এ ধরনের অধ্যয়ন রীতি ঠিক নয়। আর বিশেষ করে কুরআন তো এই ধরনের পাঠকদের জন্যে তাঁর অন্তর্নিহিত সত্য ও গভীর তাৎপর্যময় অর্থের দুয়ার কখনোই উন্মুক্ত করে না।

 

তারপর যে ব্যক্তি কুরআন সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান লাভ করতে চায় তাঁর জন্য সম্ভবত একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু যে এর অর্থের গভীরে নামতে চায় তাঁর জন্যে তো দুইবার পড়ে নেয়াও যথেষ্ট হতে পারে না। অবশ্যই তাঁকে বার বার পড়তে হবে। প্রতি বার একটি নতুন ভংগিমায় পড়তে হবে। একজন ছাত্রের মতো পেন্সিল ও নোট বই সাথে নিয়ে বসতে হবে। জায়গা মতো প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করতে হবে। এভাবে যারা কুরআন পড়তে প্রস্তুত হবে, কুরআন যে চিন্তা ও কর্মধারা উপস্থাপন করতে চায় তাঁর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনটা যেন তাঁদের সামনে ভেসে উঠে- কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাঁদের অন্ততপক্ষে দুইবার এই কিতাবটি পড়তে হবে। এই প্রাথমিক অধ্যয়নের সময় তাঁদের কুরআনের সমগ্র বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাপক  ভিত্তিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। তাঁদের দেখতে হবে, এই কিতাবটি কোন কোন মৌলিক চিন্তা পেশ করে এবং সে চিন্তাধারার উপর কিভাবে জীবন ব্যবস্থার অট্টালিকার ভিত গড়ে তোলে? এ সময়কালে কোন জায়গায় তাঁর মনে যদি কোন প্রশ্ন জাগে বা কোন খটকা লাগে, তাহলে তখনি সেখানেই সেসম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সেটি নোট করে নিতে হবে এবং ধৈর্যসহকারে সামনের দিকে অধ্যয়ন জারী রাখতে হবে। সামনের দিকে কোথাও না কোথাও তিনি এর জবাব পেয়ে যাবেন, এরি সম্ভাবনা বেশী। জবাব পেয়ে গেলে নিজের প্রশ্নের পাশাপাশি সেটি নোট করে নেবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যয়নের পর নিজের কোন প্রশ্নের জবাব না পেলে ধৈর্য সহকারে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করতে হবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দ্বিতীয় বার গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করার পর কালেভদ্রে কোন প্রশ্নের জবাব অনুদঘাটিত থেকে গেছে।

 

এভাবে কুরআন সম্পর্কে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী লাভ করার পর এর বিস্তারিত অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাঠককে অবশ্যি কুরআনের শিক্ষার এক একটি দিক পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পর নোট করে নিতে হবে। যেমন মানবতার কোন ধরনের আদর্শকে কুরআন পসন্দনীয় গণ্য করেছে অথবা মানবতার কোন ধরনের আদর্শ তাঁর কাছে ঘৃণার্হ এবং প্রত্যাখ্যাত এ কথা তাঁকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্যে তাঁকে নিজের নোট বুকের মধ্যে একদিকেলিখতে হবে ‘পসন্দনীয় মানুষ’ আবার আওন্নদিকে লিখতে হবে ‘অপসন্দনীয় মানুষ’ এবং উভয়ের নীচে তাঁদের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য লিখতে রাখতে হবে। অথবা যেমন, তাঁকে জানার চেষ্টা করতে হবে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল এবং কোন কোন জিনিসকে সে মানবতার জন্যে ক্ষতিকর ও ধংসাত্নক গণ্য করে – এ বিষয়টিকেও সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে জানার জন্যে আগের পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ নোট বইতে কল্যাণের জন্য ‘অপরিহার্য বিষয় সমূহ’ এবং ক্ষতির জন্য ‘অনিবার্য বিষয় সমূহ’ – এই শিরোনাম দুটি পাশাপাশি লিখতে হবে। অতঃপর প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করার সময় সংশ্লিষ্ট বিষয় দুটি সম্পর্কে নোট করে যেতে হবে। এ পদ্ধতিতে আকীদাহ-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা, অধিকার, কর্তব্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, দলীয় সংগঠন- শৃঙ্খলা, যুদ্ধ, সন্ধি এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়াবলী সম্পর্কে কুরআনের বিধান নোট করতে হবে এবং এর প্রতি বিভাগের সামগ্রিক চেহারা কী দাড়ায়, তারপর এগুলোকে একসাথে মেলালে কোন ধরনের জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। আবার জীবনের বিশেষ কোন সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হলে এবং সে ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হলে সেই সমস্যা সম্পর্কিত প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এই অধ্যয়নের মাধ্যমে তাঁকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মৌলিক বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে। মানুষ আজ পর্যন্ত সে সম্পর্কে কি কি চিন্তা করেছে এবং তাঁকে কিভাবে অনুধাবন করেছে? কোন কোন বিষয় এখনো সেখানে সমাধানের অপেক্ষায় আছে? মানুষের চিন্তার গাড়ি কোথায় গিয়ে আটকে গেছে? এই সমাধানযোগ্য সমস্যা ও বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানার এতিই সবচেয়ে ভালো এবং সুন্দর পথ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এভাবে কোন বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন করতে থাকলে এমন সব আয়াতের মধ্যে নিজের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ায় যাবে, যেগুলো ইতোপূর্বে কয়েকবার পড়া হয়ে থাকলেও এই তত্ত্ব সেখানে লুকিয়ে আছে একথা ঘুনাক্ষরেও মনে জাগে নি।

\r\n\r\n

কুরআনের প্রানসত্তা অনুধাবন  

 

কিন্তু কুরআন বুঝার এই সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে কাজ করার বিধান ও নির্দেশ নিয়ে কুরআন এসেছে কার্যত ও বাস্তবে তা না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কুরআনের প্রানসত্তার সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেনা। এটা নিছক কোন মতবাদ বা চিন্তাধারার বই নয়। কাজেই আরাম কেদারায় বসে বসে এ বইটি পড়লে এর সব কথা বুঝতে পারা যাবার কথা নয়। দুনিয়ার প্রচলিত ধর্ম চিন্তা অনুযায়ী এটি নিছক একটি ধর্ম গ্রন্থও নয়। মাদ্রাসায় ও খানকায় বসে এর সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। শুরুতে ভুমিকায় বলা হয়েছে, এটি একটি দাওয়াত এবং আন্দোলনের কিতাব। সে এসেই এক নিরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে নির্জন ও নিঃসংগ জীবন ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহ বিরোধী দুনিয়ার মোকাবেলায় দাড় করিয়ে দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। যুগের কুফরী, ফাসেকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। সচ্চরিত্র সম্পন্ন সত্যনিষ্ঠ লোকদেরকে প্রতিটি গ্রহান্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাঁদের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তির আহবানের মাধ্যমে নিজের কাজ শুরু করে খিলাফতে ইলাহিয়ার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ণ তেইশ বছর এই কিতাবটি এই বিরাট ও মহান ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছে। হক ও বাতিলের এই সুদীর্ঘ এবং প্রানান্তকর সংঘর্ষকালে প্রতিটি মঞ্জিল ও প্রতিটি পর্যায়েই সে একদিকে ভাংগার পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং অন্যদিকে পেশ করেছে গড়ার নকশা। এখন বলুন, যদি আপনি ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দ্বীন ও কুফরীর সংগ্রামে অংশগ্রহণই না করেন, যদি এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মনযিল অতিক্রম করার সুযোগই আপনার না ঘটে, তাহলে নিছক কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করলে তাঁর সমুদয় তত্ত্ব কেমন করে আপনার সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে? কুরআনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি নিজেই কুরআনের দাওয়াত নিয়ে উঠবেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ শুরু করবেন এবং এই কিতাব যেভাবে পথ দেখায় সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে থাকবেন। একমাত্র তখনই, কুরআন নাযীলের সময়কালীন অভিজ্ঞতাগুলো আপনি লাভ করতে সক্ষম হবেন। মক্কা ও হাবশা ( বর্তমান ইথিওপিয়া ও তায়েফের মনজিলও আপনি দেখাবেন ) বদর ও উহুদ থেকে শুরু করে হুনাইন ও তাবুক পর্যন্ত মনজিল আপনার সামনে এসে যাবে। আপনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মুখোমুখি হবেন। মুনাফিক ও ইহুদীদের সাক্ষাতও আপনি পাবেন। ইসলামের প্রথম যুগের উৎসর্গিত প্রান মুমিন থেকে নিয়ে দুর্বল হৃদয়ের মুমিন পর্যন্ত সবার সাথেই আপনার দেখা হবে। এটা এক ধরনের ‘সাধনা’। একে আমি বলি ‘কুরআনী সাধনা’।  এই সাধনা পথে ফুটে ওঠে এক অভিনব দৃশ্য। এর যতগুলো মনযিল অতিক্রম করতে থাকবেন তাঁর প্রতিটি মনযিলে কুরআনের কিছু আয়াত ও সূরা আপনা আপনি আপনার সামনে এসে যাবে। তারা আপনাকে বলতে থাকবে – এই মনযিলে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলো এবং সেখানে এই বিধানগুলো এনেছিল। সে সময় অভিধান, ব্যাকরন ও অলংকার শাস্ত্রীয় কিছু তত্ত্ব সাধকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু কুরআনের নিজের প্রানসত্তাকে তাঁর সামনে উন্মুক্ত করতে কার্পণ্য করবে, এমনটি কখনো হতে পারে না।

 

আবার এই সাধারন নিয়ম অনুযায়ী মানুষ ততক্ষন পর্যন্ত কুরআনের বিধানসমুহ, তাঁর নৈতিক শিক্ষাবলী, তাঁর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধি বিধান এবং জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে তাঁর প্রনীত নীতি নিয়ম- ও আইনসমূহ বুঝতে পারবে না যতক্ষন না সে নিজের বাস্তব জীবনে এগুলো কার্যকর করে দেখবে। যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের অনুসৃতি নেই সে তাঁকে বুঝতে পারবে না। আর যে জাতির সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান কুরআন বিবৃত পথ ও কর্মনীতির বিপরীত দিকে চলে তাঁর পক্ষেও এসবের সাথে পরিচিত হয়ে সম্ভবপর নয়।

\r\n\r\n

কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা

 

কুরআন সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে পথ দেখাবার দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে, এ কথা সবাই জানে। কিন্তু কুরআন পড়তে বসেই কোন ব্যক্তি দেখতে পায়, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর নাযিল হওয়ার সমকালীন আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করেই তাঁর বক্তব্য পেশ করেছে।  তবে কখনো কখনো মানব জাতি ও সাধারন মানুষকেও সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এমন সব কথা বলে যা আরববাসীদের রুচি-অভিরুচি, আরবের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ইতিহাস ও রাজনীতির সাথেই সম্পর্কিত। এসব দেখে এক ব্যক্তি চিন্তা করতে থাকে, সমগ্র মানব জাতিকে পথ দেখাবার জন্যে যে কিতাবটি অবতীর্ণ হয়েছিলো তাঁর মধ্যে সাময়িক, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়সমূহ ও উপাদান এতো বেশী কেন? এ বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারনে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে ; তারা মনে করেন, সম্ভবত এ কিতাবটি সমকালীন আরববাসীদের সংশোধন ও সংস্কারের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীকালে জোর পূর্বক টানা হেঁচড়া করে তাঁকে চিরন্তনভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্য জীবন বিধান রূপে গণ্য করা হয়েছে।

 

যে ব্যক্তি নিছক অভিযোগ হিসেবে নয় বরং বাস্তবে কুরআন বুঝার জন্যে এ ধরনের অভিযোগ আনেন তাঁকে আমি একটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে কুরআন পড়ার সময় সেই সব স্থানগুলো একটু দাগিয়ে রাখুন যেখানে কুরআন কেবলমাত্র আরবদের জন্য এবং প্রকৃত পক্ষে স্থান, কাল ও সময় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এমন আকীদা- বিশ্বাস, চিন্তা বা ভাবধারা অথবা নৈতিক বিধান বা কার্যকর নিয়ম কানুন উপস্থাপন করা হয়েছে। কুরআন একটি বিশেষ স্থানে একটি বিশেষ যুগের লোকদেরকে সম্বোধন করে তাঁদের মুশরীকি বিশ্বাস ও রীতি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁদের আসে পাশের জিনিসগুলোকে ভিত্তি করে তাওহীদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমান দাড় করায়- নিছক এতোটুকু কথার ভিত্তিতে কুরআনের দাওয়াত ও তাঁর আবেদন স্থানীয় ও সাময়িক- এ কথা বলা যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শিরকের প্রতিবাদে সে যা কিছু বলে তা কি দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিটি শিরকের ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে খাপ খেয়ে যায় না যেমন আরবের মুশরিকদের শিরকের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিলো? সেই একই যুক্তি প্রমাণগুলোকে কি আমরা প্রতিটি যুগের ও প্রতিটি দেশের মুশরিকদের চিন্তার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না? আর তাওহীদের প্রমান ও প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনী প্রমা পদ্ধতিকে কি সামান্য রদবদল করে সব সময় ও সব জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে না? জবাব যদি ইতবাচক হয়ে থাকে, তাহলে একটি বিশ্বজনীন শিক্ষা কেবলমাত্র একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ জাতিকে সম্বোধন করা দান করা হয়েছিলো বলেই তাঁকে স্থানীয় ও সাময়িক বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন দর্শন, জীবন- ব্যবস্থা ও চিন্তা দর্শন নেই যার প্রথম থেকে নিয়ে শেষ  পর্যন্ত সমস্ত কথাই বস্তু নিরপেক্ষ ( Abstract ) বর্ণনা ভংগিতে পেশ করা হয়েছে। বরং কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তাঁর ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এ ধরনের পূর্ণ বস্তু নিরপেক্ষতা সম্ভন নয়। আর সম্ভন হলেও তা নিছক কাজীর গরুর মতো খাতাপত্রেই থাকবে, গোয়ালে তাঁর নাম নিশানাও দেখা যাবে না। কাজেই মানুষের জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তাঁর পক্ষে কোন বাস্তব বিধানের রূপ নেয়া কোন দিনই সম্ভব হবে না।

 

তাছাড়া কোন চিন্তামূলক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে চাইলে তাঁর জন্যে আদৌ এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং যথার্থই বলতে হয়, শুরু থেকেই তাঁকে আন্তর্জাতিক বানাবার চেষ্টা করা তাঁর জন্য কল্যাণকরও নয়। আসলে তাঁর জন্য সঠিক ও বাস্তব সম্মত পন্থা একটিই। এই আন্দোলনটি যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও মুলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবনের ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাঁকে পূর্ণ শক্তিতে সেই দেশেই প্রবেশ করতে হবে যেখান থেকে তাঁর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে। সেই দেশের লোকদের মনে এই দাওয়াতের তাৎপর্য অঙ্কিত করে দিতে হবে, যাদের ভাষা, স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও আচরনের সাথে আন্দোলনের আহবায়ক নিজে সুপরিচিত। তারপর তাঁকে নিজের দেশেই ঐ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত করে তাঁর ভিত্তিতে একটি সফল জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ স্থাপন করতে হবে। তবেই তো দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাঁদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী স্বতঃস্ফ্রুতভাবে এগিয়ে এসে তাঁকে অনুধাবন করতে ও নিজের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে। কাজেই কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থাকে প্রথমে শুধুমাত্র একটি জাতির সামনে পেশ করা হয়েছিলো এবং কেবলমাত্র তাদেরকেই বুঝাবার ও নিশ্চিন্ত করার জন্য যুক্তি প্রদর্শনের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেই তা একটি নিছক জাতীয় দাওয়াত ও আন্দোলন- একথা বলার পেছনে কোন যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় ও একটি আন্তর্জাতিক এবং একটি সাময়িক ও একটি চিরন্তন ব্যবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার বিশেষত্বগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে-

 

জাতীয় ব্যবস্থা হয় একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য বা তাঁর বিশেষ অধিকারসমূহের দাবীদার। অথবা তাঁর নিজের মধ্যে এমন কিছু নীতি ও মতাদর্শ থাকে যা অন্যান্য জাতির মধ্যে ঠাই পেতে পারে না। বিপরীত পক্ষে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সকল মানুষের মর্যাদা  হয় সমান, তাঁদের সমান অধিকার দিতেও সে প্রস্তুত হয় এবং তাঁর নীতিগুলোর মধ্যেও বিশ্বজনীনতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে একটি সাময়িক ব্যবস্থা অবশ্যি এমন কিছু নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁর সমস্ত কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। আর এর বিপরীত পক্ষে একটি চিরন্তন ব্যবস্থার নীতিগুলো সব রকমের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলে। এই বিশিষ্টগুলো দৃষ্টির সামনে রেখে যদি কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করেন বা বিষয়গুলোর কারনে সত্যি সত্যিই কুরআন উপস্থাপিত ব্যবস্থাকে সামটিক বা জাতীয় হবার ধারনা পোষণ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এতে সন্দেহ নেই।

\r\n\r\n

পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান

 

কুরআন সম্পর্কে একজন সাধারন পাঠকও শুনেছেন যে, এটি একটি বিস্তারিত পথ নির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা ও বিধি- বিধানের সন্ধান সে পায় না। বং সে দেখে নামাজ ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও, যার উপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তাঁর জন্যও এখানে যাবতীয় বিধি বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয় নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন অর্থে একটি পথ নির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে থাকার কারনেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটি নাযিল করেন নি, তিনি এই সাথে একজন পয়গম্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে কেবলমাত্র একটি গৃহ নির্মাণের নক্সা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিঃসন্দেহে গৃহ নির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহ নির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সরকারীভাবে নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারাতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর ইমারাতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নকশার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুঁটি নাটি  বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্সাটার বিরুদ্ধে অসম্পূর্ণতার অভিযোগ আনা কোনমতেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন সম্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতাবে মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমান ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত রীতি-নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না এবং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোনে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন পথে হওয়া উচিৎ, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবন ধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল। দুনিয়াবাসীর সামনে কুরআন প্রদত্ত মুলনীতির ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।

 

   ( তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা থেকে )

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

\r\n\r\n

কুরআন শিক্ষাদানকারীর মর্যাদা

 

আরবী****

 

১। হযরত উসমান ( রাঃ ) থেকে বর্ণিততিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যদের তা শিক্ষা দেয়-  তিনিই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ( সহীহ বুখারী )

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানীর তাৎপর্য এই যে, যে ব্যক্তি নিজে সর্বপ্রথম কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করে, অতঃপর আল্লাহর বান্দাদের কাছে তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করে – তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম মানুষ।

\r\n\r\n

কুরআনের শিক্ষাদান দুনিয়ার সর্বোত্তম ধন-সম্পদের চেয়েও উত্তম

 

আরবী*****

 

২। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ( তাঁর হুজরা  থেকে ) বেড়িয়ে আসলেন আমরা তখন সুফফায় ছিলাম তিনি বললেন, তোমাদের কে এটা পছন্দ করে যে, সে প্রতিদিন বোথহান বা আকীকে যাবে এবং উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি উট নিয়ে আসবে কোনরূপ অপকর্ম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই? আমরা সবাই বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই এটা পছন্দ করে তিনি বললেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি মসজিদে যাবে এবং আল্লাহর কিতাব থেকে দুটি আয়াত লোকদের শিক্ষা দেবে অথবা পাঠ করবে, তার এ কাজ প্রতিদিন দুটি করে উট লাভ করার চেয়েও অধিক মূল্যবান যদি সে তিনটি আয়াত শিক্ষা দেয় অথবা পড়ে তাহলে এটা তিনটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম এভাবে যতগুলো আয়াত শিখানো হবে অথবা পড়বে তত সংখ্যক উট লাভ করার চেয়ে উত্তম -----( সহীহ মুসলিম )

 

মসজিদের নববীর চত্তরকে সুফফা বলা হতো। এর উপরে ছাপরা দিয়ে তা মসজিদে নববীর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। মক্কা মুয়াযযামা এবং আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে যেসব মুসলিম হিজরত করে মদিনায় এসেছিলেন তারাই এখানে অবস্থান করতেন। তাঁদের কোন বাড়ি-ঘরও ছিলো না এবং আয়- উপার্জনও ছিলো না। মদীনার আনসারগন এবং অপরাপর মুহাজিরগন যে সাহায্য করতেন তাতেই তাঁদের দিন চলতো। এসব লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে সারাক্ষন উপস্থাইত থাকতেন। বলতে গেলে তারা ছিলেন একটি স্থায়ী আবাসিক প্রতিস্থানের ছাত্র। বোতহান এবং আকীক মদিনা তাইয়েবার সাথে সংযুক্ত দুটি উপত্যকার নাম। একটি মদিনার দক্ষিন পার্শে এবং অপরটি উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত ছিল। এই দুটি উপত্যকা এখনো বর্তমান আছে। ততকালে এই দুই স্থানে উটের বাজার বসতো। হুজুর ( সাঃ ) অর্থহীন, সম্পদহীন সুফফাবাসীদের সম্বোধন করে বললেন, ভাই, তোমাদের কে দৈনিক বোতহান এবং আকীকে গিয়ে উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি করে উট বিনামূল্যে নিয়ে আসতে চায়? তারা আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই তা ভালবাসবে। অতঃপর তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে কেউ অপরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিক্ষা দিলে তা বিনামূল্যে দুটি উৎকৃষ্ট উট লাভ করার চেয়েও উত্তম। এভাবে সে যতগুলো আয়াত কাউকে শিক্ষা দেবে তা তত পরিমান উট পাওয়ার চেয়েও উত্তম বলে বিবেচিত হবে। লক্ষ্য করুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষন পদ্ধতি কি অসাধারন ছিল। তিনি জানতেন, এই সুফফাবাসীরা শুধু এ কারনে নিজেদের বাড়ি- ঘর পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন যে, তারা আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহন করে নিয়েছিলেন এবং পার্থিব সুযোগ- সুবিধাকে তারা মোটেই পছন্দ করতেন না। তাঁদেরকে বাধ্য হয়ে নিজেদের বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। শয়তান তাঁদের এই নিঃসম্বল অবস্থার সুযোগ নিতে পারে এই আশংকায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুকৌশলে তাঁদের চিন্তাধারার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। এবং বললেন- তোমরা যদি আল্লাহর বান্দাদের কুরআন পাঠ করে শুনাও এবং তাঁদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও তাহলে এটা তোমাদের হাতে বিনামূল্যে উট এসে যাওয়ার চেয়েও অধিক উত্তম হবে। তোমরা যদি অন্যদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিখিয়ে দাও তাহলে এটা বিনামূল্যে দুটি ভালো উট লাভ করার চেয়ে অনেক কল্যাণকর। এভাবে তাঁদের মন- মগজে এ কথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর দীনের উপর ঈমান এনে থাকো এবং এই দীনের খাতিরেই হিজরতের পথ বেছে নিয়ে এখানে এসে থাকো তাহলে এখন সেই দীনের কাজেই তোমাদের সময় এবং শ্রম ব্যয়িত হওয়া উচিৎ যে জন্য তোমরা বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে এসেছ। তোমরা দুনিয়াকে পাওয়ার আকাংখা করার পরিবর্তে বরং তোমাদের সময় দীনের কাজে ব্যয়িত হওয়া উচিৎ। এতে আল্লাহর সাথে তোমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করে এবং তাঁর বান্দাদের সত্য- ন্যায়ের পথ দেখিয়ে দিয়ে তোমরা আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভের অধিক উপযোগী হতে পারো।

 

এসব লোককেই তাঁদের ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার কারনে আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনেই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক বানিয়ে দিলেন। তারা নিজেদের জীবনেই দেখে নিলেন যে, মানুষ যদি ধৈর্য সহকারে আল্লাহর দীনের পথ অবলম্বন করে তাহলে এর ফল কি হয়।

\r\n\r\n

কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ

 

আরবী****

 

৩। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁর ঘরে তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রী পেতে কি পছন্দ করে? আমরা বললাম, হ্যাঁ তিনি বললেন- তোমাদের কারো নামাজে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করা তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রীর মালিক হওয়ার তুলনায় অধিক কল্যাণকর --------( সহীহ মুসলিম )

 

            মোটা তাজা ও গর্ভবতী উস্ট্রী আরবদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে উদাহরণ পেশ করে বলেছেন- যদি তোমরা নামাজের মধ্যে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করো তবে টা তোমাদের ঘরে বিনামূল্যের তিনটি উট এসে হাজির হয়ে যাওয়ার চেয়ে অধিক কল্যাণকর। এই উদাহরণের মাধ্যমে রাসুলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমান সর্বসাধারণের মধ্যে এ কথা বদ্ধমূল করে দিতে চেয়েছেন যে, কুরআন তাঁদের জন্য কতো বড় রহমতের বাহন এবং কুরআনের আকারে কতো মূল্যবান সম্পদ তাঁদের হস্তগত হয়েছে। তাঁদের মনমগজে এই অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে যে, তাঁদের কাছে যেটা বড় থেকে বিরাটতর সম্পদ হতে পারে – কুরআন এবং এর একটি আয়াত তাঁর চেয়েও অধিক বড় উত্তম সম্পদ।

\r\n\r\n

কুরআন না বুঝে পাঠ করলেও কল্যাণের অধিকারী হওয়া যায়

 

আরবী****

 

৪। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি, কুরআন লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত এবং পুতপবিত্র ফেরেশতাদের সাথে থাকবে আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে যায় এবং অতি কষ্টে তা পাঠ করে তাঁর জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে --------( বুখারী ও মুসলিম)  

 

      কুরআন মাজীদেই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে এই কুরআনকে মহাসম্মানিত এবং অতীব পবিত্র ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ জন্য বলা হয়েছে – যে ব্যক্তি কুরআন থেকে জ্ঞান অর্জন করে, গভীর বুৎপত্তি সৃষ্টি করে এবং এ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করে সে এই ফেরেশতাদের সাথী হবে। এর অর্থ এই নয় যে, সে এই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এই ফেরেশতারা যে স্থান ও মর্যাদা লাভ করেছে তাকেও সেই মর্যাদা ও স্থানের অধিকারী করা হবে।

 

কোন কোন লোক এরূপ ধারনা করে যে, কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করে আর কি ফায়দা- যদি সে তা না বুঝে পাঠ করে। কিন্তু এরূপ ধারনা পোষণ করা ঠিক নয়। কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করার মাঝেও অনেক ফায়দা আছে। যেমন আপনি দেখতে পাবেন, এমন অনেক গ্রাম্য প্রকৃতির লোক রয়েছে যার মুখের ভাষা পরিস্কার রূপে ফুটেনা। সে অনেক কষ্ট করে এবং মাঝে মাঝে আটকে যাওয়া সত্ত্বেও কুরআন পড়তে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কেও বলেছেন যে, - তাঁর জন্যও দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। একটি পুরস্কার কুরআন তেলাওয়াত করার এবং অপরটি কুরআন পড়ার জন্য কষ্ট স্বীকার করার বা পরিশ্রম করার।

 

এখন কথা হলো, না বুঝে কুরআন পড়ার কি লাভ? এ প্রসংগে আমার প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি কি পৃথিবীতে কখনো এমন কোন লোক দেখেছেন যে ইংরেজী বর্ণমালা পড়ার পর ইংরেজী ভাষার কোন বই নিয়ে পড়তে বসে গেছে এবং এর কিছুই তাঁর বুঝে আসছে না। চিন্তা করুন, কোন ব্যক্তি কেবল এই কুরআনের সাথেই এরূপ পরিশ্রম কেন করে। সে আরবী বর্ণমালার প্রাথমিক বই নিয়ে কুরআন পাঠ শেখার অনুশীলন করে, শিক্ষকের সাহায্যে তা শেখার চেষ্টা করে, ধৈর্য সহকারে বসে তা পড়তে থাকে যদিও তাঁর বুঝে আসে না কিন্তু তবুও তা পড়ার চেষ্টা করতে থাকে – সে শেষ পর্যন্ত কেন করে থাকে? যদি তাঁর অন্তরে ঈমান না থাকতো, কুরআনের প্রতি তাঁর বিশ্বাস না থাকতো, সে যদি এটা মনে না করতো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা পাঠে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা যায়- তাহলে শেষ পর্যন্ত সে এই শ্রম ও কষ্ট কেন স্বীকার করে? পরিস্কার কথা হচ্ছে কুরআন আল্লাহর কালাম এবং কল্যাণময় প্রাচুর্যময় কালাম – এই বিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়েই সে তা পাঠ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করে। অতএব, প্রতিদান না পাওয়ার কোন কারণই থাকতে পারেনা।

 

আবার এ কথাও মনে করা ঠিক নয় যে, এমন ব্যক্তির জন্য কুরআন শিক্ষা করা এবং তা বুঝার জন্য উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। এ চেষ্টা তাঁকে অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু যে লোক মনে করে যে, কুরআন যদি কারো বুঝে না আসে তবে তা পাঠ করা তাঁর জন্য অনর্থক এবং মূল্যহীন। এরূপ ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কুরআন না বুঝে পড়ার মাঝেও নিশ্চিতই ফায়দা রয়েছে।

\r\n\r\n

যার সাথে ঈর্ষা করা যায়

 

আরবী*****

 

৫। হযরত ইবনে উমর ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- দুই ব্যক্তি ছাড়া কেউ ঈর্ষার পাত্র নয় এক, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের জ্ঞান দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ( অর্থাৎ নামাজে দণ্ডায়মান অবস্থায় তেলাওয়াত করছে অথবা তাঁর প্রচার- প্রসার বা শিক্ষা দেয়ার কাজে ব্যপৃত রয়েছে ) দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে ----( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

    এ হাদীসের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানদার- সম্প্রদায়ের চিন্তা চেতনায় যে কথা বসিয়ে দিয়েছেন, তা হচ্ছে- কোন ব্যক্তির পার্থিব উন্নতি, প্রাচুর্য এবং নামকাম কোন ঈর্ষার বস্তুই নয়। ঈর্ষার বস্তু কেবল দুই ব্যক্তি। এক, যে ব্যক্তি কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং সে দিনরাত নামাজের মধ্যে তা পাঠ করার জন্য দণ্ডায়মান থাকে, অথবা আল্লাহর বান্দাদের তা শেখানোর কাজে ব্যস্ত থাকে, তা শেখার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং এর প্রচার করে। দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে তাঁর অপচয়  না করে, বিলাসিতায় ও পাপ কাজে ব্যয় না করে বরং দিনরাত আল্লাহর নির্দেশিত পথে তা ব্যয় করে - - এ ব্যক্তিই ঈর্ষার পাত্র।

 

  এই সেই শিক্ষা যার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের দৃষ্টি ভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধন করেন এবং তাঁদেরকে নতুন মূল্যবোধ দান করেন। তিনি তাঁদেরকে বলে দিলেন, মর্যাদা ও গুরুত্ব দান করার মতো জিনিস মূলত কি এবং মানবতার উচ্চতম নমুনাই বা কি যার ভিত্তিতে তাঁদের নিজেদের গঠন করার আকাংখা ও প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ।

 

  হাদীসের মূল পাঠে বিদ্বেষ শব্দ ব্যবহার করার পরিবর্তে ঈর্ষা শব্দ ব্যবহার করার কারন হচ্ছে – ঈর্ষার এমন একটি জিনিস যা হিংসা বিদ্বেষের মতো মানুষের মনে আগুন লাগিয়ে দেয় না। হিংসা বিদ্বেষ যদিও ঈর্ষারই একটি ভাগ কিন্তু তা এতটা তীব্র যে এর কারনে মানুষের মনে আগুনের মতো একটি উত্তপ্ত জিনিস লেগেই থাকে। হাসাদ যেন এমন একটি গরম পাত্র যা প্রায়ই সারা জীবন মানুষের মনে আগুন জালিয়ে রাখে। এজন্য এখানে ঈর্ষার আবেগের তীব্রতা প্রকাশ করার জন্যে হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

 

  হাসাদের মধ্যে মূলত দোষের কারন হচ্ছে এই যে, মানুষ চায় অমুক জিনিসটি সে না পেয়ে বরং আমি পেয়ে যাই অথবা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হোক এবং আমাকে তা দেয়া হোক অথবা তা যদি আমার ভাগ্যে না জোটে তাহলে এটা যেন তারও হাতছাড়া হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে হাসাদের মূল অর্থ। কিন্তু এখানে হাসাদ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহার হয় নি।

 

 এখানে কেবল ঈর্ষার অনুভুতির প্রখরতা ব্যক্ত করার জন্যই হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের মনে যদি ঈর্ষার আগুন লাগতেই চায় তাহলে এই উদ্দেশ্যেই লাগা উচিৎ যে, তোমরা দিনরাত কুরআন শেখা এবং শেখানোর কাজে ব্যাপৃত থাকো। অথবা তুমি সম্পদশালী হয়ে থাকলে তোমার এই সম্পদ অকাতরে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, রাতদিন সর্বদা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনের জন্য, তাঁর দীনের প্রচার- প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্যয় করতে থাকো। এভাবে তুমি অন্যদের জন্যও ঈর্ষার পাত্রে পরিনত হয়ে যাও।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদের সাথে মুমিনের সম্পর্ক

 

আরবী****

 

৬। হযরত আবু মুসা আশয়ারী ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  যে মুমিন কুরআন পাঠ করে সে কমলা লেবুর সাথে তুলনীয় এর ঘ্রাণও উত্তম এবং স্বাদও উত্তম আর যে মুমিন কুরআন পাঠ করে না সে খেজুরের সাথে তুলনীয় এর কোন ঘ্রান নেই কিন্তু তা সুমিষ্ট আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে না সে মাকাল ফল তুল্য এর কোন ঘ্রাণও নেই এবং স্বাদও অত্যন্ত তিক্ত আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে সে রাইহান ফলের সাথে তুলনীয় এর ঘ্রান অত্যন্ত সুমিষ্ট কিন্তু স্বাদ অত্যন্ত তিক্ত -----------( বুখারী ও মুসলিম )

 

   অপর বর্ণনায় আছে, “যে মুমিন বাক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে সে কমলা লেবু সদৃশ। আর যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে না কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করে সে খেজুর তুল্য।”

 

 কুরআন মাজীদের মর্যাদা ও মহানত্ত হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অর্থাৎ কুরআন মাজীদ স্বয়ং একটি সুগন্ধী। মুমিন ব্যক্তি এর তেলাওয়াত করলেও সুগন্ধি ছড়াবে আর মুনাফিক ব্যক্তি পাঠ করলেও ছড়াবে।

 

  অবশ্যই মুমিন এবং মুনাফিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য তা ঈমান ও নিফাকের কারনেই হয়ে থাকে। মুমিন বাক্তি যদি কুরআন পাঠ না করে তাহলে তাঁর সুগন্ধি ছড়ায় না, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব মিষ্টি ফলের মতই সুস্বাদু। কিন্তু যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করেনা তাঁর সুগন্ধিও ছড়ায় না ও তাঁর ব্যক্তিত্ব তিক্ত এবং খারাপ স্বাদযুক্ত ফলের মতো।

 

  অপর এক বর্ণনায় আছে- যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে সে কমলা লেবু ফল- সদৃশ। আর যে মুমিন কোরআন পড়ে না কিন্তু তদানুযায়ী আমল করে সে খেজুরের সদৃশ। উল্লেখিত দুটি বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য কেবলমাত্র এতোটুকু যে, এক বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং এর উপর ঈমান রাখার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে এবং অপর বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং তদানুযায়ী কাজ করার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে। মৌলিক দিক থেকে উভয়ের প্রানসত্ত্বা একই।

\r\n\r\n

কুরআন হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতি লাভের মাধ্যম

 

আরবী****

 

৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  আল্লাহ তায়ালা এই কিতাবের ( কুরআন ) মাধ্যমে একদল লোককে উন্নত করবেন এবং অপর দলকে পতন ঘটাবেন ----- ( সহীহ মুসলিম )

 

        এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে- যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের উন্নতি বিধান করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁদের মস্তক সমুন্নত রাখবেন। কিন্তু যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে অলস হয়ে বসে থাকবে এবং তদানুযায়ী কাজ করবেন। অথবা যেসব লোক এই কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে নিম্নস্তরে নামিয়ে দেবেন। দুনিয়ায়ও তাঁদের জন্য কোন উন্নতি নেই এবং আখেরাতেও কোন সুযোগ- সুবিধা নেই।

\r\n\r\n

 কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনে ফেরেশতারা সমবেত হয়

 

আরবী****

 

৮। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত উসাইদ ইবনে হুদাইর ( রাঃ ) বলেন যে, তিনি একরাতে নিজের ঘরে বসে নামাজের মধ্যে সূরা বাকারা পড়ছিলেন তাঁর ঘোড়াটি নিকটেই বাধা ছিল হঠাৎ ঘোড়াটি লম্ফ- ঝম্ফ শুরু করে দিলো তিনি তখন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন ঘোড়াটি শান্ত হয়ে গেলো তিনি যখন পুনরায় তেলাওয়াত শুরু করলেন ঘোড়াটি আবার লাফ-ঝাপ শুরু করে দিলো অতঃপর তিনি পাঠ বন্ধ করলেন ঘোড়াটিও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো তিনি আবার কুরআন পড়া শুরু করলে ঘোড়াটিও দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলো তিনি সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করে নিলেন কারন তাঁর ছেলে ইয়াহিয়া ঘোড়ার নিকটেই ছিল তাঁর ভয় হল ঘোড়া হয়তো লাফালাফি করে ছেলেকে আহত করতে পারে তিনি ছেলেকে এর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে আসমানের দিকে মাথা তুললেন তিনি ছাতার মত একটি জিনিস দেখতে পেলেন এবং তাঁর মধ্যে আলোকবর্তিকার মতো একটি জিনিস দেখলেন  সকালবেলা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি বললেন- হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? রাবী বলেন- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার ভয় হল ঘোড়াটি না আবার আমার ছেলে ইয়াহিয়াকে পদদলিত করেকেননা সে এর কাছেই ছিল আমি নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে ছেলেটির কাছে গেলাম আমি আসমানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎ দেখতে পেলাম- যেন একটি ছাতা এবং তাঁর মধ্যে একটি আলোকবর্তিকা জ্বলজ্বল করছে

 

আমি ( ভয় পেয়ে ) সেখান থেকে চলে আসলাম ( অর্থাৎ খোলা আকাশের নীচ থেকে ) যেন আমার দৃষ্টি পুনরায় সেদিকে না যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তুমি কি জান এগুলো কি? তিনি বললেন, না রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) বললেন- এরা ছিল ফেরেশতা তোমার কুরআন পড়ার আওয়াজ শুনে তারা কাছে এসে গিয়েছিলো তুমি যদি তেলাওয়াত অব্যাহত রাখতে তাহলে তারা ভর পর্যন্ত অপেক্ষা করতো এবং লোকেরা তাঁদের দেখে নিতো কিন্তু তারা লোক চক্ষুর অন্তরাল হতো না ----- ( বুখারী ও মুসলিম )

 

      এটা কোন জরুরী কথা নয় যে, যখনই কোন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে এবং সেও অনুরূপ ঘটনার সম্মুখীন হবে।  স্বয়ং হযরত উসাইদ ইবনে হুদাইরের সামনে প্রত্যহ এরূপ ঘটনা ঘটতো না। তিনি তো সবসময়ই কুরআন পাঠ করতেন। কিন্তু এই দিন তাঁর সামনে এই বিশেষ ঘটনাটি ঘটে- যে সম্পর্কে আমরা জানি না যে, তা কেন ঘটলো। ইহা তাহার একটি বিশেষ ‘কারামাত’ যাহা সব সময় প্রকাশ পায় না। এই জন্যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেননি যে, তোমার সামনে হামেশাই এরূপ ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ প্রতিদিন রাতে তুমি যদি এভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকো তাহলে ভোরবেলা এরূপ ঘটনা ঘটবে যে, ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে থাকবে আর লোকেরা তাদের দেখে নেবে। এর পরিবর্তে তিনি বলেছেন- পুনরায় যদি কখনো এরূপ ঘটে তাহলে তুমি নিশ্চিন্তে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। এর মধ্যে কোন শংকার কারন নেই।

 

 কিন্তু আজকাল আমরা এরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি না কেন? আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ প্রত্যেকের সাথে এরূপ ঘটনা ঘটান না। তিনি তাঁর প্রতিটি মাখলুক এমনকি প্রতিটি ব্যক্তির সাথে ভিন্ন ভিন্ন আচরন করে থাকেন। তিনি প্রতিটি ব্যক্তিকেই সব কিছু দেননি। আর এমন কেউ নেই যাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকেন।

\r\n\r\n

কুরআন পাঠকারীদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়

 

আরবী****

 

৯। হযরত বারআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি সূরা কাহফ পড়ছিল এবং তাঁর নিকটেই একটি ঘোড়া দুইটি দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এ সময় একটি মেঘখণ্ড তাঁর উপর ছায়া বিস্তার করলো এবং ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসতে লাগলো তা যতো নীচে আসতে থাকলো তাঁর ঘোড়া ততই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলো যখন ভোর হল তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লামের কাছে এসে তাঁকে এ সম্পর্কে অবহিত করলো তিনি বললেন- এটা হলো প্রশান্তি যা কুরআনের সাথে নাযিল হচ্ছিলো ---( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 পূর্ববর্তী হাদীসে উল্লেখিত ফেরেশতাদের পরিবর্তে এখানে প্রশান্তি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশান্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করা বড়ই কঠিন। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জায়গায় ‘সাকীনাহ’ ( প্রশান্তি ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।  আল্লাহ তায়ালার সেই রহমত বা অনুগ্রহ যা মানুষের মনে প্রশান্তি, নিশ্চিন্ততা ও শীতলতা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে আত্মিক দিক থেকে অনাবিল শান্তি অনুভব করে তাঁর জন্যে ‘সাকীনাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি বিশেষ সাহায্য আসতে থাকে তবে তা বুঝানোর জন্যেও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব, এটা মুশকিল যে, এখানে কি এ শব্দটি ‘ফেরেশতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অথবা আল্লাহর এমন কোন করুনার কথা বুঝানো হয়েছে যা সেই ব্যক্তির নিকটতর হচ্ছিলো।

 

  এরূপ ঘটনাও সবার ক্ষেত্রে সংঘটিত হয় না এবং স্বয়ং ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সব সময় ঘটেনি। এটা এমন একটি বিশেষ অবস্থা ছিল যা ঐ ব্যক্তির সামনে প্রতিভাত হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এর অর্থ তাৎপর্য বলে দেয়ার জন্যে বর্তমান না থাকতেন  তাহলে ঐ ব্যক্তি সব সময় অস্থিরতার মধ্যে কালাতিপাত করতো যে, তাঁর সামনে এটা কি ঘটে গেলো।

 

 উল্লেখিত দুইটি হাদীসেই এই বিশেষ অবস্থায় ঘোড়ার দৌড় এবং লম্ফ-ঝম্ফের কথা বলা হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, কোন কোন সময় পশু-পাখি এমন সব জিনিস দেখতে পায় যা মানুষের চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। আপনারা হয়তো একথা পড়ে থাকবেন যে, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পূর্বেই পাখিরা লুকিয়ে যায়। চতুষ্পদ জন্তুগুলো পূর্বক্ষণেই জানতে পারে যে, কি ঘটতে যাচ্ছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাব হওয়ার পূর্বেই কুকুর এবং অন্যান্য প্রানী চিৎকার শুরু করে দেয়। এর মূল কারন হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে এমন কিছু ইন্দ্রীয় শক্তি দান করেছেন যা মানব জাতিকে দেওয়া হয় নি। এর ভিত্তিতে বাকশক্তিহীন প্রাণীগুলো এমন কতগুলি বিষয়ের জ্ঞান অথবা অনুভূতি লাভ করতে পারে যা মানুষের জ্ঞান অনুভুতির সীমা বহির্ভূত।

\r\n\r\n

সূরা ফাতিহার ফযিলত

 

আরবী*****

 

১০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “যে ব্যক্তি এমন নামাজ পড়লো, যার মধ্যে উম্মুল কুরআন ( সূরা ফাতিহা ) পাঠ করে নি- তাঁর নামাজ অর্থ ও মূল্যহীন থাকে যাবে (রাবী বলে ) একথাটি তিনি তিনবার উল্লেখ করলেন “তাঁর নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে” আবু হুরাইরাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা যখন ইমামের পিছনে নামাজ পড়বো, তখন কি করবো? তিনি জবাবে বললেন- তখন মনে মনে পাঠ করো কেননা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “মহান আল্লাহ বলেন, আমি নামাজকে আমার এবং বান্দার মাঝে দুই সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছি বান্দাহ যা চাইবে আমি তাকে তা দান করবো বান্দাহ যখন বলে, “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ( যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক ), তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন- বান্দাহ আমার প্রশংসা করেছে যখন সে বলে, আর-রাহমানির রাহীম ( তিনি দয়াময়, তিনি অনুগ্রহকারী ), তখন মহামহিম আল্লাহ বলেন, বান্দাহ আমার মর্যাদা স্বীকার করেছে এবং আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বান্দাহ যখন বলে, ইয়াকা না’বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তায়িন ( আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার এবং বান্দার মাঝে ( অর্থাৎ বান্দাহ আমার ইবাদাত করবে, আর আমি তাঁর সাহায্য করবো ), আমার বান্দাহ যা চায়, আমি তা দেবো যখন বান্দাহ বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম অলাদ্দ দোয়াল্লিন ( আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন, সেই সব বান্দাহদের পথে যাদের আপনি নিয়ামত দান করেছেন, যারা অভিশপ্তও নয় এবং পথ ভ্রষ্টও নয় ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার বান্দার জন্যে এবং আমার বান্দা যার প্রার্থনা করেছে তা সে পাবে”----- ( মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ )

\r\n\r\n

ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ

 

  জামায়াতে নামাজ পরাকালীন সময়ে মুক্তাদিগনকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। আবু হুরাইয়ারহ বলেছেন, মুক্তাদিগন চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠ করে নিবে। ইমাম শাফেয়ীর মতে মুক্তাদিগনকে সর্বাবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। ইমাম আবু হানিফার মতে, কোন অবস্থায়ই মুক্তাদিগন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের মতে, ইমাম ফাতিহা পাঠের শব্দ যদি মুক্তাদিগনের কানে আসে তাহলে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না, বরং ইমামের পাঠ মনোযোগ সহকারে শুনবে। কিন্তু ইমামের ফাতিহা পাঠের শব্দ মুক্তাদিগনের কানে না আসলে তারা ফাতিহা পাঠ করবে।

 

 ইমাম আবু হানীফা প্রথম দিকে অনুচ্চ শব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে মুক্তাদিগনের সূরা ফাতিহা পাঠ করার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশিষ্ট হানাফী আলেম আল্লামা মোল্লা আলী কারী, আবু হাসান সিন্ধী, আব্দুল হাই, রশীদ আহমাদ নিঃশব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন ( হক্কানী তাফসির- মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী।

 

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন, ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আমি যতটুকু অনুসন্ধান করেছি তাঁর আলোকে অধিকতর সঠিক পন্থা হচ্ছে এই যে, ইমাম যখন উচ্চস্বরে ফাতিহা পাঠ করবে, মুক্তাদিগন তখন চুপ থাকবে। আর ইমাম যখন নিঃশব্দে ফাতিহা পাঠ করবে, তখন মুক্তাদীরাও চুপে চুপে ফাতিহা পাঠ করবে। এই পন্থায় কুরআন ও হাদীসের কোন নির্দেশের বিরোধিতা করার কন সন্দেহ থাকে না। ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল সামনে রেখে এরূপ একটি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।

 

 কিন্তু যে ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইমামের পেছনে ফাতিহা পাঠ করে না, অথবা সর্বাবস্থায় ফাতিহা পাঠ করে আমরা এটা বলতে পারিনা যে, তাঁর নামাজ হয় না। কেননা উভয় মতের স্বপক্ষে দলীল আছে এবং এই ব্যক্তি জেনে বুঝে উদ্দেশ্যমুলকভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশের বিরোধিতা করছে না। বরং তাঁর কাছে দলীলের ভিত্তিতে যে মতটি প্রমানিত, সে সেই মতের উপর আমল করছে। ( রাসায়েল-মাসায়েল, ১ম খণ্ড, পাতা-১৭৯, ১৮০ )

\r\n\r\n

কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা ফাতিহা

 

আরবী*****

 

১১। হযরত আবু সাঈদ ইবনে মুয়াল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ছিলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম আমাকে স্বশব্দে ডাকলেন আমি ( তখন নামাজরত থাকার কারনে ) তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না অতপর আমি তাঁর কাছে এসে বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আমি নামাজে রত ছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহ কি বলেননি, “আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল যখন তোমাদেরকে ডাকেন তখন তাঁদের ডাকে সাড়া দাও” ( সূরা আনফাল, আয়াত ২৪ ) অতপর তিনি বললেন, তোমার মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান এবং সবচেয়ে বড় সূরাটি শিখিয়ে দেবো না? একথা বলে তিনি আমার হাত ধরলেন অতঃপর আমরা যখন মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আপনি বলেছেন- “আমি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি অবশ্যই শিখিয়ে দেবো” তিনি বললেন- তা আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ( সূরা ফাতিহা ) এটাই সাবউল মাসানী ( পুনরাবৃত সাত আয়াত ) এবং তাঁর সাথে রয়েছে মহান আল কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে ----( সহীহ বুখারী )

 

  হযরত আবু সাঈদের ( রাঃ ) নামাজরত অবস্থায় তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  ডাকার দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁকে ডাকছিলেন, তখন তিনি নফল নামাজ পড়ছিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহবান শুনার পর তাঁর কর্তব্য ছিল নামাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাছে হাজির হওয়া। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দেয়া ফরয। আর তিনি তো তখন নফল নামায পড়ছিলেন। মানুষ যে কাজেই রত থাকুক- যখন তাঁকে আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে ডাকা হবে তখন এই ডাকে সাড়া দেয়া তাঁর উপরে ফরয।

 

‘সাবউল মাসানী’ – বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে – সেই সাতটি আয়াত যা নামাজে পুনঃ পুনঃ পাঠ করা হয়, অর্থাৎ সূরা ফাতিহা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এই সাতটি আয়াত সম্বলিত সূরাটি কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা এবং এর সাথে রয়েছে কুরআন মাজীদ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- এই আয়াত কয়টি পৃথক যা বার বার পাঠ করা হয় এবং তাঁর সাথে কুরআন মাজীদের অবস্থান। একথার তাৎপর্য হচ্ছে- একদিকে পুরা কুরআন শরীফ এবং অন্য দিকে সূরা ফাতিহা। এখান থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মত পোষণ করেছেন যে, এটা কুরআন মাজীদের সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা সমগ্র কুরআনের মুকাবেলায় এই সুরাকে রাখা হয়েছে। এখানে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এই যে, ফাতিহাকে সবচেয়ে বড় সূরা বলার অর্থ এই নয় যে, তা শব্দ সংখ্যা বা আয়াত সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় সূরা। বরং এর অর্থ হচ্ছে- বিষয়বস্তুর বিচারে সূরা ফাতিহা সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা কুরআন মাজীদের পুরা শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এই সুরার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআনের সাহায্যে বাড়ি ঘর সজীব রাখো            

 

আরবী******

 

১২। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা নিজেদের ঘরকে কবরে পরিনত করো না। যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় তা থেকে শয়তান পলায়ন করে। ---- ( সহীহ মুসলিম )

 

 এ হাদীসে দুটি বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে। এক, নিজেদের ঘরকে কবরস্থানে পরিনত করো না। এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে- তোমাদের ঘরের অবস্থা যদি এই হয় যে, তাতে নামায পড়ার মতো কোন লোক নেই এবং কুরআন পড়ার মতো কোন লোকও নেই। আর কোনরূপেই এটা প্রকাশ পায় না যে, তাতে কোন ঈমানদার লোক বা কুরআন পাঠকারী বসবাস করে- তাহলে এরূপ ঘর যেন একটি কবরস্থান। এটা মৃত জনপদ। এটা জীবন্তদের জনপদ নয়।

 

 দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- যেহেতু সমস্ত পুরুষ লোক মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করে থাকে – এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম বলেছেন, নিজেদের ঘরকে তোমরা কবরস্থান বানিও না। অর্থাৎ পুরা নামায মসজিদেই পড়ো না, বরং এর কিছু অংশ ঘরে আদায় করো। যদি ঘরে নামায না পড়ো তাহলে এর অর্থ হচ্ছে- আপনারা মসজিদকে ঠিকই জীবন্ত রেখেছেন, কিন্তু ঘর কবরস্থানের মতো হয়ে গেছে। এজন্য এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার যাতে মসজিদও প্রাণচঞ্চল থাকবে এবং ঘরও জীবন্ত থাকবে। এজন্য ফরয নামায সমূহ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করা এবং সুন্নাত, নফল ও অন্যান্য নামায ঘরে আদায় করা পছন্দনীয় বলা হয়েছে। এতে উভয় ঘরেই প্রান চাঞ্চল্য বিরাজ করবে।

 

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, যে ঘরে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয় সেখান থেকে শয়তান পলায়ন করে। একদিকে রয়েছে সমস্ত কুরআন মাজীদের মর্যাদা, অপরদিকে রয়েছে প্রতিটি সুরার রয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য। এখানে সূরা বাকারার মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- যে ঘরে এই সূরা পাঠ করা হয় সেখান থেকে শয়তান ভেগে যায়। এটা কেন হয়? এর কারন হচ্ছে- সূরা বাকারার মধ্যে পারিবারিক জীবন এবং দাম্পত্য বিষয় সংক্রান্ত আইন- কানুন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিবাহ ও তালাকের সাথে সম্পর্কিত আইনও এ সূরায় পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণিত হয়েছে। সমাজকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার যাবতীয় মূলনীতি এবং আইন- কানুন এ সুরার আলোচনার আওতায় এসে গেছে। এ জন্য যেসব ঘরে বুঝে শুনে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় এবং তদানুযায়ী কাজ করা হয় সেসব ঘরে শয়তান প্রবেশ করে কখনো ঝগড়া- বিবাদ বাঁধাতে সফলকাম হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানব জীবনের সংশোধনের জন্যে যে পথ নির্দেশ দিয়েছেন – তা যাদের জানা নেই অথবা জানা আছে কিন্তু তাঁর বিরোধিতা করা হচ্ছে- শয়তান কেবল সেখানেই ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যে পরিবারের লোকেরা আল্লাহর হুকুম পালন সম্পর্কে অবগত এবং তদানুযায়ী জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত- শয়তান সেখানে কোন পাত্তাই পায় না এবং কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয় না।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদ কিয়ামতের দিন শাফায়াৎকারী হবে

 

আরবী*****

 

১৩। হযরত আবু উমামা ( রা ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ তোমরা কুরআন পড়ো। কেননা কুরআন তাঁর পাঠকদের জন্য কিয়ামতের দিন শাফায়াতকারী হয়ে আসবে। দুটি চাকচিক্যময় ও আলকিত সূরা- বাকারা ও আলে ইমরান পাঠ করো। কেননা এই সূরা দুটি কিয়ামতের দিন এমনভাবে আসবে যেন- দুটি ছাতা অথবা ছায়া দানকারী দুই খণ্ড মেঘ অথবা অথবা পাখির পালকযুক্ত দুটি প্রসারমান ডানা। তা নিজের পাঠকদের পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তি প্রমান পেশ করতে থাকবে। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ করো। কেননা তা গ্রহন করলে বরকত ও প্রাচুর্যের কারন হবে। এবং তা পরিত্যাগ করলে আফসোস, হতাশা ও দুঃখের কারন হবে। বিপথগামীরা এই সুরার বরকত লাভ করতে পারে না। - --( সহীহ মুসলিম )

 

এ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম প্রথমে যে কথা বলেছেন তা হল “তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো”। কেননা তা কিয়ামতের দিন তাঁর পাঠকদের জন্যে শাফায়াতকারী হবে। একথার অর্থ এই নয় যে, তা মানুষের যাবতীয় বিপথ দূর করার জন্য অনমনীয় সুপারিশকারী হয়ে দাঁড়াবে বরং এর অর্থ হচ্ছে- যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কুরআন পড়েছে এবং তদানুযায়ী নিজের জীবন সংশোধন করেছে- এই কুরআন কিয়ামতের দিন তাঁর শাফায়াতের কারন হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার আদালতে এ কথা উত্থাপিত হবে যে, এই বান্দাহ তাঁর কিতাব পাঠ করেছে, তাঁর অন্তরে ঈমান বর্তমান ছিল, সে যখনই এই কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা পাঠ করতে নিজের সময় ব্যয় করেছে। এ জন্যই তা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে পাঠকের জন্য শাফায়াতকারী হবে।

 

 দ্বিতীয় যে কথাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তা হল-  কুরআন মাজীদের দুটি অতি উজ্জ্বল সূরা অর্থাৎ সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান পাঠ করো। এ সূরা দুটিকে যার ভিত্তিতে আলোকময় সূরা বলা হয়েছে তা হচ্ছে- এই দুটি সুরার মধ্যে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী-খ্রিস্তানদের সামনে পূর্ণাংগভাবে যুক্তি প্রমান তুলে ধরা হয়েছে এবং মুশ্রিকদের সামনেও। অনুরূপভাবে মুসল্মান্দেরকেও এই সূরাদ্বয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত দান করা হয়েছে। মোট কথা এই দুটি সূরায় কুরআন মাজীদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই জন্য বলা হয়েছে এই সূরা দুইটি পাঠ করো। কিয়ামতের দিন এই সূরা দুইটি এমনভাবে উপস্থিত হবে যেমন কোন ছাতা অথবা মেঘ খণ্ড অথবা পালক বিছানো পাখির পাখা। এই সূরাদ্বয় তাঁর পাঠকারীর স্বপক্ষে দলীল- প্রমান পেশ করবে, তাঁদের সাহায্য করবে। কিয়ামতের দিন যখন কারো জন্য ছায়া বাকী থকবে না তখন এই কঠিন মুহূর্তে কুরআন তাঁর পাঠকারীদের জন্য ছায়া হয়ে উপস্থিত হবে। অনুরূপভাবে এই সূরাদ্বয় কিয়ামতের দিন তাঁর পাঠককে বিপদ-মুসিবত থেকে উদ্ধারকারী এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারে সাহায্যকারী হবে।

 

পুনরায় সূরা বাকারা সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা হয়েছে – যে ব্যক্তি তা পাঠ করে তা তাঁর জন্য বরকত ও প্রাচুর্যের কারন হবে। আর যে ব্যক্তি তা পাঠ করে না তাঁর জন্য এটা আফসোসের কারন হবে। সে কিয়ামতের দিন আফসোস করে বলবে- দুনিয়াতে সূরা বাকারার মতো এতো বড় নিয়ামত তাঁর সামনে এসেছে কিন্তু সে তা থেকে কোন কল্যাণ লাভ করেনি। অতঃপর তিনি বলেছেন, বাতিলপন্থী লোকেরা এই সুরাকে সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মধ্যে সামান্যতম অন্যায় ও অসত্যের পূজা মওজুদ রয়েছে সে এই সুরাকে বরদাশত করতে পারে না। কেননা এই সূরাদ্বয়ের মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাতিলের মূলোৎপাটনকারী বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়েছে। যা কোন বাতিল পন্থী লোক বরদাশত করতে পারেনা।

\r\n\r\n

সূরা বাকারা ও আলে ইমরান

 

ঈমানদার সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবে

 

আরবী*****

 

১৪। হযরত নাওয়াশ ইবনে সাময়া’ন ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ এবং তদানুযায়ী আমলকারী লোকদের উপস্থিত করা হবে। তাঁদের অগ্রভাগে সূরা বাকারা এবং সূরা আলে ইমরান থাকবে। এ দুইটি যেন মেঘমালা অথবা মেঘের ছায়া- যার মধ্যে থাকবে বিদ্যুতের মতো আলোক অথবা সেগুলো পালোকে বিছানো পাখির পাখার ন্যায় হবে। এই দুইটি সূরা তাঁদের পাঠকারীদের স্বপক্ষে যুক্তি প্রমান পেশ করতে থাকবে। --( সহীহ মুসলিম )

 

 পূর্ব হাদীসেও কিছুটা শাব্দিক পার্থক্য সহকারে একই বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এটাও হতে পারে যে, উভয় সাহাবীই একই সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ হাদীস শুনে থাকবেন। এবং উভয়ে নিজ নিজ ভাষায় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। আর এটাও হতে পারে যে, বিভিন্ন স্থানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই একই হাদীস বর্ণনা করে থাকবেন এবং দুই সাহাবীর বর্ণনা দুই ভিন্ন স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকবে। যাই হোক একথা সুস্পষ্ট যে, হাদীস দুইটির বিষয়বস্তু প্রায়ই এক।

 

পূর্ববর্তী বর্ণনায় শুধু কুরআন মাজীদ পাঠকারীদের উল্লেখ ছিল, কিন্তু এ হাদীসে তদানুযায়ী আমল করার কথাও বলা হয়েছে। পরিস্কার কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন মাজীদ যদি সুপারিশকারী হয় তাহলে তা এমন লোকদের জন্যই হবে যারা কুরআন পাঠ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তদানুযায়ী কাজও করেছে। যদি ধরে নেয়া হয় যে, কোন ব্যক্তি কুরআন মাজীদ তো ঠিকই পড়ে কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করে না তাহলে কুরআন তাঁর পক্ষে দলীল হতে পারে না। এ হাদীসে পরিস্কার বলা হয়েছে- কুরআনের যেসব পাঠক তদানুযায়ী কাজ করে- কুরআন তাঁদের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে দাঁড়াবে এবং তাঁদের সাহায্য ও সুপারিশ করবে। কিয়ামতের দিন যখন ঈমানদার লোকেরা আল্লাহর দরবারে হাজির হবে তখন তাঁদেরকে কুরআনই সেখানে নিয়ে যাবে। যখন তাঁদেরকে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হবে তখন কুরআনই যেন তাঁদের পক্ষে মুক্তির সনদ হবে। আমরা যেন দুনিয়াতে এই কুরআন অনুযায়ী জীবিন যাপন করে এসেছি – এই অর্থেই নবী ( সাঃ ) এর এই হিদায়াতনামা। অন্য কথায় তাঁদের মুক্তির জন্য স্বয়ং এই কুরআনের সুপারিশই যথেষ্ট হবে। কেবল ঈমানদার সম্প্রদায়ের সাথেই এরূপ আচরন করা হবে। এই দিন কাফের এবং মুনাফিকদের সাথে কুরআনের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। আর যেসব লোকেরা কুরআনের নির্দেশাবলী জানা সত্ত্বেও তাঁর বিরোধিতা করেছে কুরআন তাদেরও সহযোগী হবেনা।

 

 তিনি আরো বলেছেন, সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান ঈমানদার সম্প্রদায়ের আগে আগে থাকবে। এর কারন হচ্ছে- এই দুইটি আইন-কানুন সংক্রান্ত সূরা। সূরা বাকারায় ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক জীবনের জন্য আইনগত হিদায়াত দান করা হয়েছে। আর সূরা আলে ইমরানে মুনাফিক ও কাফের সম্প্রদায় এবং আহলে কিতাব সবার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ সূরায় উহুদ যুদ্ধের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ ভাবে এই সূরা দুইটি মুমিন জীবনের জন্য হিদায়াতের বাহন। কোন ব্যক্তি যদি এই সূরাদ্বয়ের শিক্ষা অনুযায়ী নিজের পারিবারিক জীবনকে সংশোধন করে নিজের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে তদানুযায়ী ঢেলে সাজায় এবং দুনিয়ায় ইসলামের সাথে যেসব ব্যাপারের সম্মুখীন হবে তাতেও যদি তারা এর হেদায়েত মোতাবেক ঠিক ঠিক কাজ করে তাহলে এরপর তাঁর ক্ষমা ও পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ ত্রুটি থাকতে পারেনা। অতএব, এ সূরা দুইটি হাশরের ময়দানে ঈমানদার সম্প্রদায়ের হেফাজত করবে। হাশরের ময়দানে যে বিভিষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করবে এই সূরাদ্বয় তা থেকে তাঁদেরকে রক্ষা করবে এবং আল্লাহর আদালতে হাজির হয়ে তাঁদের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমান পেশ করবে।

\r\n\r\n

কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত আয়াতুল কুরসী

 

আরবী****

 

১৫। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- হে আবুল মুনযির, আল্লাহ তায়ালার কিতাবে তোমার জানা কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি বললাম- আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি পুনরায় বললেন- হে আবুল মুনযির, আল্লাহ তায়ালার কিতাবে তোমার জানা কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি বললাম- “আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম” আয়াত। রাবী বলেন- তিনি আমার বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন – এই জ্ঞান তোমার জন্য মোবারক হোক এবং প্রাচুর্যময় হোক। --------( সহীহ মুসলিম )

 

হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই সব সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা কুরআন সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞান লাভের অধিকারী ছিলেন, কুরআন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে কুরআন সম্পর্কে সর্বাধিক অভিজ্ঞ লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

 

 এ হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষন পদ্ধতির একটি দিক। সাহাবায়ে কেরাম দীনের কতটা জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং কুরআনকে কতটা বুঝছেন তা জানার জন্য তিনি মাঝে মাঝে তাঁদেরকে বিশেষ বিশেষ প্রশ্ন করতেন। সাহাবাদের নীতি ছিল, তারা রাসুলুল্লাহর প্রশ্নের জবাব নিজেদের জ্ঞান অনুযায়ী দেয়ার পরিবর্তে আরো অধিক জানার লোভে আরজ করতেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই অধিক ভালো জানেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, তিনি নিজে তা বলে দিবেন এবং এতে তাঁদের জ্ঞানের পরিধি আরো বেড়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য যদি সাহাবাদের আরো অধিক শেখানো হতো তাহলে সাহাবাদের বক্তব্য “আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভালো জানেন” – প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে দিতেন। আর যদি তাঁর উদ্দেশ্য হতো সাহাবাগন আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে কি পরিমান জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন তা জানা- তাহলে তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং তাঁর পুনরাবৃত্তি করতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে উত্তর আশা করতেন। এখানে এই দ্বিতীয়টি উদ্দেশ্য ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) কে প্রথম দফা প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বললেন- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল অধিক ভালো জানেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহর লক্ষ্য ছিল উবাই ইবনে কা’বের জানামতে কুরআন মাজীদের কোন আয়াতটি সর্বাধিক ভারী- তা অবগত হওয়া, তাই তিনি পুনরায় একই প্রশ্ন করলেন। এর উত্তরে তিনি বললেন- আয়াতুল কুরসী হচ্ছে সবচেয়ে বড় আয়াত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জবাবের সমর্থন করলেন।

 

  আয়াতুল কুরসীর এই মহত্ত্ব এবং গুরুত্ব এই জন্য যে, কুরআন মাজীদের যে কয়টি আয়াতে একত্ববাদের পূর্ণাংগ বর্ণনা দেয়া হয়েছে- আয়াতুল কুরসী তাঁর অন্যতম। আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা এবং গুনাবলীর সর্বাঙ্গীণ বর্ণনা এক তো সূরা হাশরের শেষ আয়াতে রয়েছে, দ্বিতীয়ত সূরা ফুরকানের প্রাথমিক আয়াত এবং তৃতীয়ত সূরা ইখলাছ ও আয়াতুল কুরসীতে রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) যখন এই জবাব দিলেন তখন রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) তাঁর বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন- এই জ্ঞান তোমার জন্য কল্যাণকর হোক। বাস্তবই তুমি সথিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছ যে, এই আয়াতই কুরআন মাজীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ আয়াত। আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কে সঠিক ধারনা দেয়ার জন্যই কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে। মানুষ যদি আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে না পারে তাহলে তাঁর বাকী সমস্ত শিক্ষাই সম্পূর্ণ বেকার এবং অর্থহীন হয়ে যায়। মানুষের মাঝে তৌহিদের বুঝ এসে গেলে দীনের ভিত্তি কায়েম হয়ে গেলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে আয়াতের মধ্যে তৌহিদের বিষয়বস্তুকে সর্বোত্তম পন্থায় বর্ণনা করা হয়েছে তাই কুরআন মাজীদের সর্ববৃহৎ আয়াত।

\r\n\r\n

আয়াতুল কুরসীর ফযিলত সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর ঘটনা

 

আরবী*****

 

১৬। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রমযানের ফিতরার সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। একরাতে এক আগন্তুক আমার কাছে আসলো এবং ( স্তূপীকৃত ) শস্য ইত্যাদি হাতের আজল ভরে উঠাতে লাগলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পেশ করবো। সে বলতে লাগলো, আমি খুবই অভাবগ্রস্থ মানুষ, আমার অনেক সন্তান রয়েছে এবং আমার নিদারুন অভাব রয়েছে। আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) বলেন- আমি ( দয়া পরবশ হয়ে ) তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। যখন সকাল হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবু হুরাইরাহ, তুমি গত রাতে যাকে গ্রেফতার করেছিলে তাঁর খবর কি? আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, সে নিজের নিদারুন অভাবের কথা বর্ণনা করলো এবং বলল, তাঁর অনেক সন্তান – সন্তুতি রয়েছে। এ জন্য আমি দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। তিনি বললেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমি নিশ্চিত হলাম যে, সে পুনরায় আসবে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, সে পুনরায় আসবে। অতএব তাঁর আসার প্রতীক্ষায় আমি ওঁত পেতে থাকলাম। পরবর্তী রাতে সে ফিরে এসে খাদ্য শস্য চুরি করতে লাগলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি অবশ্যই তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির করবো। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। কেননা আমি গরীব মানুষ এবং আমার বালবাচ্চা রয়েছে। আমি আর কখনো আসবো না। আমি পুনরায় দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় দিন ভোরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবু হুরাইরাহ তোমার খবর কি? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সে তাঁর কঠিন অভাবের কথা বর্ণনা করলো এবং বলল, তাঁর অনেক বাল-বাচ্চা রয়েছে। আমি দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- সে তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছে এবং সে পুনরায় আসবে। আমি তাঁর আসার অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকলাম। অতএব সে পুনরায় এসে খাদ্য শস্য চুরি করলো। আমি তাঁকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি অবশ্যই তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করবো। এটা তিনবারের শেষ বার এবং প্রতিবারই তুমি বলেছ, আমি আর আসবো না অথচ তুমি আসছ। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আপনাকে এমন কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দেব যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অশেষ কল্যাণ দান করবেন। রাতের বেলা আপনি যখন নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাবেন তখন এই আয়াতুল কুরসী –“আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম” শেষ পর্যন্ত পাঠ করবেন। আপনি যদি এরূপ করেন তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা আপনার জন্য একজন হিফাজতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত কোন শয়তান আপনার কাছে ভিড়তে পারবেনা। ( রাবী বলেন ) সে যখন আমাকে এটা শিখালো আমি তখন তাঁকে ছেড়ে দিলাম। ভোরবেলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তোমার বন্দীকে কি করলে? আমি বললাম, সে আমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিয়েছে। তাঁর দাবী হচ্ছে, এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমাকে উপকৃত করবেন। নবী ( সাঃ ) বললেন- “সে তোমাকে সত্য কথাই বলেছে, কিন্তু সে নিজে হচ্ছে ডাহা মিথ্যুক। তুমি কি জানো তুমি তিন রাত যাবত কার সাথে কথা বলেছ? আমি বললাম, না, আমি জানি না। তিনি বললেন- সে ছিল একটা শয়তান।” ( সহীহ  বুখারী )

 

এখানে রমযানের যাকাত বলতে ফিতরার মাল বুঝানো হয়েছে। দিনের বেলা তা থেকে বিতরন করার পর যা অবশিষ্ট থাকতো রাতের বেলা তাঁর হেফাজতের প্রয়োজন দেখা দিত। একবার হযরত আবু হুরাইরাহ যখন এই মালের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন তখন এই ঘটনা ঘটেছিল যার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে।

 

 এটা এমন সব ঘটনার অন্তর্ভুক্ত যে সম্পর্কে মানুষ কোন ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয় যে, এটা কিভাবে ঘটলো। যাই হোক এধরনের  ঘটনা  একাধিকবার মানুষের সামনে ঘটেছে।

 

কুরআন মাজীদের ফযিলত সম্পর্কিত অধ্যায়ে এ হাদীস সন্নিবেশ করার কারন এই যে, শয়তান নিজেও একথা স্বীকার করে যে, যে ব্যক্তি রাতের বেলা আয়াতুল কুরসী পাঠ করে শয়ন করে তাঁর উপর শয়তানের কোন আধিপত্য চলে না।

 

এ কথা পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরআন মাজীদের এমন কয়েকটি স্থান রয়েছে যেখানে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তৌহিদের পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তির মন মগজে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের চিত্র অংকিত হয়ে গেছে তাঁর উপর শয়তানের আধিপত্য কি করে চলতে পারে? এই শয়তান তো তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেনা।

 

এই আয়াতুল কুরসী যদি কোন ব্যক্তি বুঝে পড়ে এবং এর অর্থ যদি সে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তাহলে শয়তান তাঁর ধারে কাছে আসারও দুঃসাহস করে না। আয়াতুল কুরসী স্বয়ং বরকত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ। শুধু এর তেলাওয়াতও বরকত ও কল্যাণের কারন হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু পাঠক যদি তাঁর অর্থ বুঝে পড়ে তাহলে তাঁর উপর শয়তানের কোন প্রভাবই খাটে না।

\r\n\r\n

দুটি নূর

 

যা কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছে

 

আরবী*****

 

১৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জীব্রীল ( আঃ ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসা ছিলেন। এসময় তিনি আকাশের দিক থেকে দরজা খোলার শব্দের অনুরূপ শব্দ শুনতে পেলেন। হযরত জিব্রাঈল ( আঃ ) নিজের মাথা উপরের দিকে উত্তোলন করে দেখলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বললেন, এটা আসমানের একটি দরজা যা আজই প্রথম খোলা হয়েছে। এ দরজা ইতিপূর্বে আর কখনো খোলা হয় নি। ইত্যবসরে এই দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা নাযিল হয়। জিব্রাঈল ( আঃ ) বললেন, এ হচ্ছে এক ফেরেশতা- আসমান থেকে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে, ইতিপূর্বে এই ফেরেশতা আর কখনো পৃথিবীতে নাযিল হয়নি। এই ফেরেশতা এসে তাঁকে সালাম করে বলল, দুটি নূরের সংবাদ গ্রহন করুন, যা কেবল আপনাকে দেয়া হয়েছে এবং অন্য কোন নবীকে দেয়া হয়নি। তা হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষাংশ। এ দুটির একটি শব্দ পাঠ করলেও আপনাকে সেই নূর দান করা হবে। -------( সহীহ মুসলিম )

 

  এ হাদীস পড়তে গিয়ে মানুষের মনে প্রথম যে প্রশ্নের উদয় হয় তা হচ্ছে- আসমানের দরজা খুলে যাওয়া এবং তা থেক দরজা খোলার শব্দ আসার তাৎপর্য কি? এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম একথা বুঝে নিতে হবে যে, আসমানের কোন দরজা খোলার শব্দ জিব্রাঈল ( আঃ ) অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনেছিলেন, আমি বা আপনি নেই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে-  আসমানি জগতের ঘটনাগুলো এমন পর্যায়ের যে, তা যথাযথভাবে তুলে ধরার মতো শব্দ মানবীয় ভাষায় নেই বা হতেও পারেনা। এজন্য এসব ব্যাপার বুঝানোর জন্যে বা মানুষের বোধ গম্যের কাছাকাছি আনার জন্য রূপক ভাষা বা উপমা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দুনিয়াতে যেভাবে দরজা খোলা হয় এবং এর যা অবস্থা হয় অনুরূপভাবে ঊর্ধ্ব জগতেরও অসংখ্য দরজা রয়েছে এবং সেগুলো যখন খোলা হয় তখন তাঁর মধ্য দিয়ে কোন কিছু যাতায়াত করে থাকে। এমন নয় যে, দরজা সব সময় খোলা থাকে এবং যখন তখন যে কেউ আসা যাওয়া করতে পারে। এ থেকে জানা গেলো যে, আসমানের কোন দরজা খোলা এবং তাঁর মধ্য দিয়ে উপর থেকে কোন ফেরেশতার নীচে আসার ঘটনা ঘটেছিলো, যাতে দরজা খোলার শব্দের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে। এই অবস্থাটা অবশ্যই অনুভূত হয়- কিন্তু তা কেবল আল্লাহর ফেরেশতা অথবা তাঁর রাসুলই অনুধাবন করতে পারেন। আমরা তা অনুভব করতে পারিনা। কেননা এগুলো মানুষের অনুভূতিতে ধরা পড়ার মতো কোন জিনিস নয়।

 

এ হাদীসে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে- রাসুলুল্লাহকে যে ফেরেশতা সুসংবাদ দেয়ার জন্যে এসেছিলেন তিনি ইতিপূর্বে আর কখনো পৃথিবীতে আসেন নি। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এই বিশেষ পয়গাম পাঠানোর জন্যেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি পৃথিবীতে যাতায়াতকারী ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা ছিল এই যে, আপনার কল্যাণ হোক। আপনাকে এমন দুইটি তুলনাহীন জিনিস দেয়া হয়েছে যা পূর্বে কোন নবীকেই দেয়া হয়নি। তাঁর একটি হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং অপরটি হচ্ছে সূরা বাকারার শেষাংশ।

 

ঘটনা হচ্ছে এই যে, সূরা ফাতিহার সামান্য কয়টি আয়াতের মধ্যে এতো বিরাট বিষয়বস্তুর বর্ণনা করা হয়েছে যে, পুরা কুরআন শরীফের সংক্ষিপ্ত সার এতে এসে গেছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য হচ্ছে- আমাকে বাক্য ও কথা দান করে হয়েছে যার মাধ্যমে বিরাট বিরাট বিষয়বস্তু কয়েকটি ছত্রেই আদায় হয়ে গেছে। বাইবেলের সাথে কুরআনের তুলনা করে দেখলে জানা যায় যে, কখনো কখন যে কথা বর্ণনা করতে বাইবেলের কয়েকটি পৃষ্ঠা খরচ করা হয়েছে তা কুরআনের একটি মাত্র ছত্রেই বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা এই সংক্ষিপ্ততা এবং পূর্ণাংগতার দিক থেকে অগ্রগণ্য। তথাপি সূরা ফাতিহার এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অর্থ এই নয় যে, এই সুরার মধ্যে যে বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে তা ইতিপূর্বে কোন নবীর কাছে আসেনি। কথা এটা নয়, কারন সব নবীই সেই শিক্ষা নিয়ে আগমন করেছেন যা এই সূরায় বর্ণনা করা হয়েছে, পার্থক্য কেবল এই যে, এই সুরার মাত্র কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থবোধক একটি সমুদ্রের সংকুলান করা হয়েছে এবং দীনের সার্বিক শিক্ষার সার সংক্ষেপ এতে এসে গেছে। এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত কোন জিনিস পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি।

 

দ্বিতীয় নূর যার সুসংবাদ এই ফেরেশতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনিয়েছেন তা হচ্ছে সূরা বাকারার শেষ অংশ। এই আয়াতগুলিতে তৌহিদের পুরা বর্ণনা এবং নবী আলাইহিমুস সালামের যাবতীয় সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা করা হয়েছে। এতে ইসলামী আকীদাহ পূর্ণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ঈমানদার সম্প্রদায়কে বলে দেয়া হয়েছে হক ও বাতিলের সংঘর্ষে যদি সমগ্র কুফরী শক্তিও তাঁদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তাহলে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করেই তাঁদের মোকাবেলা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য এবং বিজয়ের জন্যে দোয়া করতে হবে। এই শেষ অংশে উল্লেখিত অসাধারন বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে তাঁকে এমন নূর বলা হয়েছে যা পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি।

\r\n\r\n

সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের ফযিলত

 

আরবী*****

 

১৮। হযরত আবু মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে তা তাঁর জন্য যথেষ্ট হবে। ---------( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 অর্থাৎ এই দুইটি আয়াত মানুষকে যে কোন ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট। কোন ব্যক্তি যদি এই আয়াতগুলি ভালমতো হৃদয়ঙ্গম করে পড়ে তাহলে সে এর গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

\r\n\r\n

সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতের ফযিলত

 

আরবী****

 

১৯। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ( বিপর্যয় ) থেকে নিরাপদ থাকবে। ----( সহীহ মুসলিম )

 

  সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যে সময় তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অধীন খ্রিষ্টানদের উপর কঠোর নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো এবং তাঁদেরকে একথা স্বীকার করতে বাধ্য করা হচ্ছিলো যে, তারা এক আল্লাহকে পরিত্যাগ করে রোমীয়দের মা’বুদ এবং দেবতাদের প্রভু হিসাবে মেনে নিবে এবং এদের সামনে মাথা নত করবে। এই কঠিন সময়ে কয়েকজন নওজোয়ান হযরত ঈসা ( আঃ ) এর উপর ঈমান আনে এবং তারা এই অমানুষিক অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি সব কিছু ফেলে রেখে পালিয়ে আসে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমরা কোন অবস্থাতেই আমাদের মহান প্রতিপালককে পরিত্যাগ করবো না এবং শিরকের পথও ও অবলম্বন করবোনা- এতে যাই হোক না কেন। সুতরাং তারা কারো আশ্রয় না চেয়ে কেবল আল্লাহর উপরে ভরসা করে পাহাড়ে গিয়ে এক গুহায় বসে যায়।

 

বলা হয়েছে যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের এই প্রাথমিক আয়াতগুলো মুখস্থ করে নিবে এবং তা নিজের মন- মগজে বসিয়ে নেবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। প্রকাশ থাকে যে, দাজ্জালের ফিতনাও এই ধরনেরই হবে- যেমন ঐ সময়ে এই যুবকগন যার সম্মুখীন হয়েছিলো। এজন্য যে ব্যক্তির সামনে আসহাবে কাহাফের দৃষ্টান্ত মওজুদ থাকবে সে দাজ্জালের সামনে মাথা নত করবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি এই দৃষ্টান্ত ভুলে গেছে সে দাজ্জালের ফিতনার স্বীকার হয়ে পড়তে পারে। এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো নিজের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করবে সে দাজ্জালের বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাবে।

\r\n\r\n

সূরা মুমিনুনের ফযিলত

 

আরবী****

 

২০। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যখন অহী নাযিল হতো তখন তাঁর মুখের কাছ থেকে মৌমাছির গুনগুন শব্দের মতো আওয়াজ শুনা যেত। আমি কিছুক্ষন বসে থাকলাম তিনি কিবলার দিকে ফিরলেন এবং দুই হাত তুলে বললেন- “হে আল্লাহ, আমাদের আরো দাও এবং কমিয়ে দিওনা, আমাদের মনে- সম্মান দান করো এবং অপদস্থ করোনা, আমাদের ( তোমার নিয়ামত ) দান করো এবং বঞ্চিত করোনা, আমাদের অন্যদের অগ্রবর্তী করো, অন্যদেরকে আমাদের অগ্রবর্তী করোনা, আমাদের উপর তুমি রাজী হয়ে যাও এবং আমাদের সন্তুষ্ট করো।” অতঃপর তিনি বললেন- “এই মাত্র আমার উপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যার মানদণ্ডে কেউ উত্তীর্ণ হলে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতে যাবে।” অতপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। --অতঃপর তিনি দশটি আয়াত পাঠ সম্পন্ন করলেন।”---( তিরমিযি, নাসাঈ, আহমাদ, হাকেম )

 

আরবী****

 

২১। হযরত ইয়াজীদ ইবনে বাবনুস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, কুরআনই হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের চরিত্র। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে------- তিনি “এবং যারা নিজেদের নামায সমূহের পূর্ণ হেফাজত করে,” পর্যন্ত পাঠ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এরূপই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র।”-----------( নাসাঈ )

 

আরবি*****

 

২২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে ‘আদন’ নামক জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এর একটি থাম সাদা মুক্তা পাথরের, একটি থাম লাল চুনি পাথরের এবং একটি থাম সবুজ পুষ্পরাগ মনির তৈরি। এর মেঝে কস্তুরির, এর নুড়ি পাথরগুলো মোতির তৈরি এবং লতাকুঞ্জ কুমকুমের তৈরি। অতঃপর তিনি তাঁকে বললেন, কথা বল। সে বলল, নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। তখন আল্লাহ বললেন, আমার ইজ্জত, শানশওকত ও মহত্ত্বের শপথ, কোন কৃপণ তোমার মধ্যে প্রবেশ করার জন্যে আমার কাছে প্রার্থনা করতে পারবেনা। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন, “বস্তুত যেসব লোককে তাঁদের দীলের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই কল্যাণ লাভ করবে।”

 

হাদীসের যে দশটি আয়াতের কথা বলা হয়েছে তা নিম্নরুপঃ

 

আরবি*****

 

“মুমিন লোকেরা নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করেছে, যারা নিজেদের নামাযে ভীতি ও বিনয় অবলম্বন করে। যারা অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হয়। যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নিজেদের স্ত্রীদের ছাড়া এবং সেই মেয়েদের ছাড়া- যারা তাঁদের দক্ষিন হস্তে মালিকাধিন হবে। এই ক্ষেত্রে ( হেফাজত না করা হলে ) তারা তিরস্কারযোগ্য নয়। অবশ্য যে ব্যক্তি এদের ছাড়া অন্য কিছু চাইবে তারা সীমা লংঘনকারী হবে। যারা নিজেদের আমানত এবং নিজেদের ওয়াদা-চুক্তি রক্ষনাবেক্ষন করে। যারা নিজেদের নামাযের হেফাজত করে। এরাই হচ্ছে উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।”

 

এখানে মুমিন বলতে সেই সব লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করে নিয়েছে, তাঁকে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করেছে এবং তাঁর উপস্থাপিত জীবন-বিধানকে অনুসরন করে চলতে প্রস্তুত হয়েছে।

 

  এই সুরার প্রথম ৯ টি আয়াতে ঈমানদার লোকদের সাতটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন মুমিন ব্যক্তি এই সাতটি গুন অর্জন করতে পারলে সে নিশ্চিতই বেহেস্তে যাবে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দশম ও একাদশ আয়াতে এদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশত জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন। অতএব আয়াতে উল্লেখিত গুন বৈশিষ্ট্য গুলো অর্জন করার একান্ত চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।

 

  প্রথম গুন হচ্ছে- বিনয় ও নম্রতা সহকারে নামায আদায় করা। ‘খুশু’ শব্দের অর্থ কারো সামনে বিনীতভাবে অবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, নিজের কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, স্থির রাখা। অন্তরের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কথা চিন্তা করে সন্ত্রস্থ হয়ে পড়বে। আর দেহের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন মাথা নত করবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়বে, দৃষ্টি অবনমিত হবে, কণ্ঠস্বর নরম ও বিনয়পূর্ণ হবে। এই খুশুই হচ্ছে নামাযের আসল প্রানশক্তি ও ভাবধারা। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে আর মুখের দাড়ি নিয়ে খেলা করছে। তখন তিনি বললেন-

 

আরবী****

 

“এই ব্যক্তির অন্তরে যদি ‘খুশু’ থাকতো তাহলে তাঁর অংঙ্গ- প্রতংঙ্গের উপর ‘খুশু’ পরিলক্ষিত হতো।’’ ( তাফসীরে মাযহারী, তাফহীমুল কুরআন )

 

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা। মূল শব্দ হচ্ছে ‘লাগবুন’-। এমন প্রতিটি কথা ও কাজকে ‘লাগবুন’ বলা হয় যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং নিষ্ফল। যেসব কথা ও কাজের কোনই ফল নাই, উপকার নাই, যা থেকে কোন কল্যাণকর ফলও লাভ করা যায় না, যার প্রকৃতই কোন প্রয়োজন নেই এবং যা থেকে কোন ভালো উদ্দেশ্য লাভ করা যায়না- এ সবই অর্থহীন, বেহুদা ও বাজে জিনিস এবং ‘লাগবুন’ বলতে এসবই বুঝায়। ঈমানদার লোকদেরকে এসব জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-

 

আরবী****

 

“মুমিন লোকেরা যদি এমন কোন জায়গায় গিয়ে পড়ে যেখানে অর্থহীন ও বাজে কাজ বা কথা হচ্ছে – তাহলে সেখান থেকে আত্মমর্যাদা সহকারে কেটে পড়ে।” (সূরা ফুরকান, আয়াত-৭২)

 

মুমিন ব্যক্তি সুস্থ স্বভাবের অধিকারী হয়ে থাকে। সে পবিত্র চরিত্র ও উন্নত রুচির ধারক। সে অর্থপূর্ণ কথা বার্তাই বলবে, কিন্তু অর্থহীন গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করতে পারেনা। সে হাস্যরস ও রসিকতা করতে পারে, কিন্তু তাৎপর্যহীন হাসিঠাট্টা নয়। সে অশ্লীল গালিগালাজ, লজ্জাহীন কথাবার্তা বলতেও পারেনা, সহ্যও করতে পারেনা। আল্লাহ তায়ালা বেহেশতের একটি বৈশিষ্ট এই উল্লেখ করেছেন যে,

 

আরবী****

 

“সেখানে তারা কোন অর্থহীন ও বেহুদা কথাবার্তা শুনবেনা।” ( সূরা গাশিয়া, আয়াত- ১১ )

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী****

 

“মানুষ যখন অর্থহীন বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তাঁর ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে।”

 

---( তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তাই ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ )

 

তৃতীয় বৈশিষ্ট হচ্ছে- যাকাত দেয়া এবং যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হওয়া। যাকাত অর্থ একদিকে যেমন আত্মার পবিত্রতা অর্জন, অন্যদিকে এর অর্থ ধন সম্পদের পবিত্রতা বিধান।

 

চতুর্থ বৈশিষ্ট হচ্ছে- লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। এর দুটি অর্থ রয়েছে। এক, নিজের দেহের লজ্জাস্থান সমূহকে ঢেকে রাখা, নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং অপর লোকদের সামনে নিজের লজ্জাস্থানকে প্রকাশ না করা।

 

দুই, তারা নিজেদের পবিত্রতা এবং সতীত্বকে রক্ষা করে। অর্থাৎ অবাধ যৌনাচার করে বেড়ায়না। পাশবিক প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করেনা।

 

পঞ্চম বৈশিষ্ট হচ্ছে- আমানতের রক্ষনাবেক্ষন ও তা প্রত্যর্পণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী*****

 

“যার আমানাতদারীর গুন নাই তাঁর ঈমান নাই।” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

ষষ্ঠ বৈশিষ্ট হচ্ছে- ওয়াদা- চুক্তির রক্ষনাবেক্ষন করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

আরবী****

 

“ যে ওয়াদা – চুক্তি রক্ষা করেনা তাঁর কোন ধর্ম নাই। ” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

বস্তুত আমানতের খেয়ানত এবং ওয়াদা- চুক্তিকে ভঙ্গ করাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোনাফিকের চারটি লক্ষনের অন্যতম দুইটি বলে উল্লেখ করেছেন।

 

“সে যখন ওয়াদা করে ভংগ করে এবং তাঁর কাছে যদি আমানত রাখা হয় তাঁর খেয়ানত করে।”--------( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

সপ্তম বৈশিষ্ট হচ্ছে—নামাযের হেফাজত করা। নামাযের হেফাজতের অর্থ হচ্ছে নামাযের নির্দিষ্ট সময় সমূহ, এর নিয়ম- কানুন, শর্ত ও রোকন সমূহ, নামাযের বিভিন্ন অংশ- এক কথায় নামাযের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহের পূর্ণ সংরক্ষণ করা।

 

যে ব্যক্তি এসব গুন বৈশিষ্টের অধিকারী হয়ে যায় এবং এর উপর স্থির থাকে, সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের অধিকারী।

\r\n\r\n

সূরা ইয়াসিনের ফযিলত

 

আরবী****

 

২৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- প্রতিটি জিনিসেরই একটি হৃদয় আছে এবং কুরআনের হৃদয় হচ্ছে সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ তায়ালা তা পাঠের বিনিময়ে তাঁকে দশবার পূর্ণ কুরআন পাঠ করার সওয়াব দান করবেন।------ ( ইমাম তিরমিযি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একে গরীব হাদীস বলেছেন )

 

আরবী*****

 

২৪। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। আর যে ব্যক্তি সূরা হা-মীম পাঠ করে। যার মধ্যে ধোঁয়ার কনা উল্লেখ আছে ( অর্থাৎ সূরা দোখান ) – সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। ----- ( হাফেজ তাঁর গ্রন্থে এ হাদীস উল্লেখ করেছেন )

 

আরবী****

 

২৫। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- তাঁর গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।

 

আরবী***

 

২৬। হযরত মা’কিল ইবনে ইয়াসার ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “এটা তোমাদের মুমূর্ষু ব্যক্তিদের নিকট পাঠ করো।” অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন। -( আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমাদ )

 

আরবী****

 

২৭। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আমি আশা করি আমার উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে এই সূরাটি ( সুয়ার ইয়াসীন ) গাঁথা থাক। ----------- ( সহীহ বুখারী )

 

   হাফেজ ইমামুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাসীর দামেশকী ( মৃত ৭৭৪ হিঃ ) বলেন, এসব হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ আলেমগন বলেছেন, কোন কঠিন বিপদ বা শক্ত কাজ সামনে উপস্থিত হলে – তখন এই সূরা পাঠ করার বরকতে আল্লাহ তায়ালা সেই বিপদ বা কাজকে সহজ করে দেন। মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট এই সূরা পাঠ করতে বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এসময় আল্লাহ তায়ালা রহমত ও বরকত নাযিল করেন এবং সহজভাবে রূহ বের করে নেয়া হয়। আসল ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন। ইমাম আহমাদ ( রঃ ) বলেছেন- আমাদের প্রবীণরা বলতেন, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে আল্লাহ তাঁর কষ্ট লাঘব করে দেন। ( তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৪ )

 

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন- ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দাহহাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উআইনা বলেন- ‘ইয়াসীন’ অর্থ ‘হে মানুষ’ বা ‘হে ব্যক্তি’। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, ইয়া সাইয়েদ ( হে নেতা ) কথাটির শব্দ সংক্ষেপ হচ্ছে ‘ইয়াসীন’। এই সব কটি অর্থের দিক দিয়ে বলা যায়, এখানে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকেই সম্বোধন করা হয়েছে।

 

‘সূরা ইয়াসীন কুরআনের হৃদয়’ – এই উপমাটি ঠিক তেমনি যেমন বলা হয়েছে ‘সূরা ফাতিহা কুরআনের মা’। সূরা ফাতিহাকে কুরআনের মা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে কুরআন মাজীদের সমস্ত শিক্ষার সারকথা বিবৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা ইয়াসীন কুরআনের জীবন্ত ও প্রানবন্ত দীল এই হিসাবে যে, এই সূরা কুরআনের দাওয়াতকে অতীব জোরালোভাবে পেশ করে। এর প্রচণ্ডতায় স্থবিরতা চূর্ণ হয় এবং প্রানে অগ্নিশীলতা সৃষ্টি হয়।

 

 মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, এর ফলে মুসলমানের মনে মৃত্যুকালে সমস্ত ইসলামী আকীদাহ তাজা ও নতুন হয়ে যায় এবং তাঁর সামনে আখেরাতের পুরা নক্সা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর তাঁকে পরবর্তী কোন সব মঞ্জিলের সম্মুখীন হতে হবে- তা সে স্পষ্ট জানতে পারে। এই কল্যাণ দৃষ্টির পূর্ণতা বিধানের জন্যে- আরবী বোঝেনা এমন সব লোকের সামনে এই সূরা পাঠ করার সাথে সাথে তাঁর অর্থও পড়ে শুনানো আবশ্যক। এর সাহায্যেই নসিহত স্মরণ করিয়ে দেয়ার কাজটিও পূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হতে পারে। -( সূরা ইয়াসীনের ভূমিকা, তাফহীমুল কুরআন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৪ )

\r\n\r\n

সূরা মুলকের ফযিলত

 

আরবী****

 

২৮। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক সাহাবী কবরের উপর তাবু টানান। তিনি অনুমান করতে পারেননি যে, এটা একটা কবর। এটা ছিল একটি লোকের কবর। ( সাহাবী শুনতে পেলেন ) সে সূরা মুলক পাঠ করছেন। তা শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একটি কবরের উপর আমার তাবু টানাই। আমি জানতাম না যে, তা একটি কবর। তাঁর মধ্যে একটি লোক সূরা মুলক পাঠ করছে ( শুনলাম )। সে তাঁর শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কবরের আযাব প্রতিরোধকারী, এটা তাঁর পাঠকারীকে কবরের আযাব থেকে বাচায়। -( তিরমিযি )  

 

আরবী****

 

২৯। হযরত আউ হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদে ত্রিশটি আয়াত সম্বলিত একটি সূরা আছে। তা কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করলে তাঁকে মাফ করে দেয়া হয়। সূরাটি হচ্ছে- “তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক-----” ( তিরমিযি )

 

৩০। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা “আলিফ-লাম-মীম তানযীল ( সাজদাহ ) এবং ‘তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক’ না পড়া পর্যন্ত ঘুম যেতেন না। -----------( তিরমিযি )

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান

 

৩১। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন শরীফ পড়তে অক্ষম? সাহাবীগন বললেন- এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন কিভাবে পড়তে পারে? তিনি বললেন – “কুল হু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ” ( সূরা ইখলাছ ) এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। -------------( মুসলিম, ইমাম বুখারী এ হাদীসখানা হযরত আবু সাঈদ খুদরীর সুত্রে বর্ণনা করেছেন )

 

পুরা কুরআন শরীফে নিম্নোক্ত বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছেঃ

 

(এক), আহকাম বা আইন-কানুন, (দুই) নবীদের ঘটনাবলী অর্থাৎ ইতিহাস, (তিন), আকায়েদ বা ইসলামী বিশ্বাসের শিক্ষা- প্রশিক্ষণ। যেহেতু আকায়েদের মূল হচ্ছে তৌহিদ এবং তৌহিদকে বাদ দিলে ইসলামী আকীদার কোন অর্থই বাকী থাকে না। এজন্য সূরা ইখলাছ তৌহিদের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা হওয়ার কারনে এটাকে এক তৃতীয়াংশের সমান সাব্যস্ত করা হয়েছে।

 

চিন্তা করুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষনের ধরন কতটা অতুলনীয় ছিল। তিনি এমন সব কথা ও বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তা দ্রুত অংকিত হয়ে যেত এবং তাঁর মানসটে গেঁথে যেত। কোন ব্যক্তির মনে একথা দৃঢ়মূল করার জন্য অর্থাৎ সূরা ইখলাছের কি গুরুত্ব রয়েছে তা বুঝানোর জন্যে কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতার প্রয়োজন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র সামান্য কয়েকটি কথার মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, যদি তোমরা সূরা ইখলাছ একবার পাঠ করো তাহলে এটা যেন এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করার সমতুল্য হয়ে গেলো।

 

এই একটি মাত্র বাক্যে এই সুরার যে গুরুত্ব মানুষের মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায় তা কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতায়ও সম্ভব নয়। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তিনি সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম

 

আরবী****

 

৩২। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর অধিনায়ক বানিয়ে পাঠালেন। সে নিজের সঙ্গীদের নামাজ পড়ানোর সময় সূরা ইখলাছের মাধ্যমে সর্বদা কিরাত শেষ করতো। তাঁর যখন অভিযান থেকে ফিরে আসলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একথা ব্যক্ত করলে, ত্নি বললেন- তোমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করো সে কেন এরকম করেছে? সুতরাং তারা তাঁকে একথা জিজ্ঞেস করলো। সে বলল, এই সুরার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে আমি এই সূরাটি পড়তে ভালোবাসি। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে গিয়ে সুসংবাদ দাও আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ভালোবাসেন। ----------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

যে সামরিক অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অংশ গ্রহন করতেন না তাঁকে সারিয়াহ বলা হতো। আর যে সামরিক অভিযানে তিনি নিজে অংশ গ্রহন করতেন তাঁকে গাযওয়া বলা হয়।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের যুগে এবং পরবর্তীকালেও একটা উল্লেখযোগ্য  কাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল যে, যে ব্যক্তি জামায়াতের আমীর হতো সে-ই দলের নামাজের ইমামতি করতো। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি কোন সামরিক অভিযানের অধিনায়ক হতো তাহলে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই থাকতো। অনুরূপভাবে কেন্দ্রে খলীফা ( ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ) নামাযে ইমামতি করতেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতেন। এখানে যে সামরিক অভিযানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর অধিনায়কের অভ্যাস ছিল তিনি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর একান্তভাবেই সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। একথা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোচরে আনা হল এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে এর কারন জানা গেলো তখন তিনি তাঁকে সুসংবাদ দিলেন, তুমি যখন এই সূরা পাঠ করতে এতো পছন্দ করো যে, এতে উত্তম পন্থায় আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে- তাই আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে ভালোবাসেন। পূর্ববর্তী- হাদীসে বলা হয়েছে সূরা ইখলাছ এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। আর এখানে বলা হয়েছে- সূরা ইখলাছে সুন্দরভাবে তৌহিদের বর্ণনা থাকার কারনে যে ব্যক্তি এই সুরাকে পছন্দ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।

 

দুনিয়ার কোন কিতাবেই এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে তৌহিদকে পূর্ণাংগভাবে বর্ণনা করা হয়নি, যার মাধ্যমে দুনিয়ায় বিরাজমান সমস্ত গোমরাহির মূল শিকড় একই সাথে কেটে ফেলা হয়েছে। এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে এত বড় বিষয়বস্তু এমন পূর্ণাঙ্গভাবে কোন আসমানি কিতাবেই বর্ণিত হয়নি। সমস্ত আসমানি কিতাব যা অল্প বিস্তার বর্তমানে দুনিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই বিষয়বস্তু অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতে যে ব্যক্তি এটাকে বুঝতে চেষ্টা করে, এর প্রানসত্তার সাথে পরিচয় লাভ করেছে সে এই সুরার সাথে গভীর ভালোবাসা রাখে। স্বয়ং এই সুরার নাম সূরা ইখলাছই- এই নিগূঢ় তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে যে, এটা সেই সূরা যা খালেছ তৌহিদের শিক্ষা দেয়। তা এমন তৌহিদের শিক্ষা দেয় যার সাথে শিরকের নাম গন্ধ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। এ জন্যে যে ব্যক্তি উল্লেখিত কারনে এই সুরার সাথে মহব্বত রাখে সে আল্লাহ তায়ালারও প্রিয় বান্দাহ হিসাবে গণ্য হয়।

\r\n\r\n

সূরা ইখলাছের প্রতি আকর্ষণ বেহেশতে প্রবেশের কারন

 

আরবী****

 

৩৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল- ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এই সূরা অখলাছকে ভালোবাসি। তিনি বললেন- তোমার এই ভালোবাসা তোমাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে। --------( তিরমিযি, বুখারী )

 

জানা গেলো যে, এই সুরার প্রতি ভালোবাসা একটি স্থিরিকৃত ব্যাপার। কোন ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত এই কথার দ্বারাই হয়ে গেছে যে, এই সূরাটি তাঁর প্রিয় ছিল। কিন্তু কোন ব্যক্তির অন্তর শিরকের যাবতীয় মলিনতা থেকে সম্পূর্ণ পাক হওয়া এবং খালেছ তৌহিদ তাঁর মন মগজে বদ্ধমূল হওয়া ছাড়া এই সুরার প্রেমিক হওয়া সম্ভব নয়। অন্তরে খালেছ তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাই বেহেশতের চাবি। যদি তৌহিদের ধারনায় ত্রুটি থেকে যায় তাহলে বেহেশতের কোন প্রশ্নই আসে না। মানুষের জীবনে যদি অন্যান্য ত্রুটি- বিচ্চুতি থেকে থাকে তা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন, কিন্তু তৌহিদের বিশ্বাসের মধ্যে গোলমাল থাকলে তা ক্ষমার অযোগ্য।

 

যদি কারো মনে নির্ভেজাল তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে তাঁর মধ্যে অন্যান্য ত্রুতি-বিচ্চুতি খুব কমই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু যদিও বা থেকে যায় তাহলে সে তওবা করার সৌভাগ্য লাভ করবে। মনে করুন, যদি তওবা করার সুযোগও না পায় এবং সে তওবা করতে ভুলে গিয়ে থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাঁর ক্ষমা হয়ে যাবে। কেননা খালেছ তৌহিদ হচ্ছে এমনই এক বাস্তব সত্য- আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হওয়া যার উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি খালেছ তৌহিদের অনুসারী- সে আল্লাহর বিশ্বাসভাজনদের অন্তর্ভুক্ত। আর অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে আল্লাহর আচরন যেমন হয়- তাঁর বিশ্বাসভাজনদের প্রতিও তাঁর আচরন তদ্রূপ নয়। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন- এই সুরার প্রিয়পাত্র হওয়াটাই তোমার বেহেশতে প্রবেশের ফায়সালা করে দিয়েছে।     

\r\n\r\n

সূরা ফালাক ও সূরা নাস- দুটি অতুলনীয় সূরা

 

আরবী****

 

৩৪। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তুমি কি দেখেছো আজ রাতে এমন কতগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে যার নযীর কখনো দেখা যায়নি? তা হচ্ছে- “কুল আউউযুবি রাব্বিল ফালাক—এবং কুল আউসু বি রাব্বিন নাস” সূরাদ্বয়। ---( সহীহ মুসলিম )

 

এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাস ও ফালাক সম্পর্কে বলেছেন যে, এ দুটি অতুলনীয় সূরা, যার দৃষ্টান্ত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এর কারন হচ্ছে- পূর্বেকার আসমানি কিতাব গুলোতে এই বিসয়বস্তু সম্বলিত কোন সুরার উল্লেখ নেই। এ সূরাদ্বয়ও অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু পূর্ণাংগ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু বিবৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় যে কারনে এ সূরা দুটির বিষয়বস্তু ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া যায় তাহলো- এটা মানুষকে যে কোন ধরনের শংসয়- সন্দেহ, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করে এবং যে কোন ব্যক্তি পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে হকের রাস্তায় চলতে পারে।

 

প্রথম সূরাটিতে বলা হয়েছে এই কথা বলে দাও যে, আমি সেই মহান রবের আশ্রয় প্রার্থনা করি যিনি ভোরের উন্মেষকারী, সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে হেফাজতকারী, অন্ধকার রাতে আবির্ভাব হওয়া যাবতীয় ভয়-ভীতি ও শংকা থেকে মুক্তি দানকারী এবং যেসব দুষ্ট লোক যাদুটোনা এবং অন্যান্য উপায়ে মানুষের ক্ষতি সাধনে তৎপর তাঁদের আক্রমন থেকে নিরাপত্তা দানকারী। দ্বিতীয় সূরায় বলা হয়েছে, তুমি বলে দাও – সেই মহান সত্তার আশ্রয় গ্রহন করছি যিনি মানুষের রব, মানুষের মালিক এবং মানুষের উপাস্য। যেস মানুষ এবং শয়তানেরা অন্তরের মধ্যে সন্দেহ-শংসয় সৃষ্টি করে- আমি এদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

 

কোন ব্যক্তি যদি ‘আইউযুবি রাব্বিল ফালাক’ এবং ‘আউউযুবি রাব্বিন নাস’ বাক্যগুলো নিজের জবানে উচ্চারন করে এবং সে যেসব বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে- সেগুলোকে আবার ভয়ও করছে – তাহলে তাঁর মুখ থেকে এই শব্দগুলো বের হওয়া নিরর্থক। যদি সে একনিষ্ঠ এবং হৃদয়ঙ্গম করে একথাগুলো উচ্চারন করে তাহলে তাঁর দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, কেউই তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, এখন কেউই তাঁর কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারবে না। কেননা সে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করেছে, যিনি এই মহা বিশ্বের মালিক এবং সমগ্র মানব কুলেরও একচ্ছত্র অধিপতি। যখন সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করলো এবং ঘোষণা করে দিলো, এখন আমি আর কারো অনিষ্টের আশংকা করি না- এরপর তাঁর আর ভীত- সন্ত্রস্ত্র হওয়ার আর কোন কারন থাকতে পারে না। মানুষ তো কেবল এমন সত্তারই আশ্রয় নিয়ে থাকে যার সম্পর্কে তাঁর আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, সে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার শক্তি রাখে। যদি কেউ আশ্রয় দেয়ার শক্তিই না রাখে তাহলে তাঁর কাছে কেবল নির্বোধ ব্যক্তিই আশ্রয় চাইতে পারে। এক ব্যক্তি বিবিধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে কারো আশ্রয় গ্রহন করে থাকে। এক, যে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। দুই, যাদের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে ভেগে এসে  তাঁর আচলে আশ্রয় নিচ্ছে- এদের সবার শক্তি ও ক্ষমতা তাঁর কাছে মূল্যহীন। যতক্ষন তাঁর মধ্যে এ দুটি বিষয়ে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে, সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করতে পারে না। সে যদি এই প্রত্যয় সহকারে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করে তাহলে তাঁর ভয়-ভীতি ও আশংকা বোধ করার কোন অর্থই হয় না।

 

যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার এরূপ শক্তি ও ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর রাস্তায় কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে সে কাউকে ভয় করতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই- সে যার ভয় করতে পারে। সে সম্পূর্ণভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করবে এবং গোটা দুনিয়ার বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে।

 

হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজের ভাইয়ের সাথে ফিরাউনের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে পৌছে গেলেন। এতোবড় বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে মাত্র দুটি প্রান কিভাবে রুখে দাঁড়ালেন? শুধু এই জন্য যে, আল্লাহর আশ্রয়ের উপর তাঁদের আত্মবিশ্বাস ছিল। যখন আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করা হয় তখন পরাশক্তির বিরুদ্ধেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন? কেবল আল্লাহর উপর ভরসা থাকার কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার পিছনে আল্লাহর শক্তি রয়েছে, যিনি সমগ্র বিশ্ব এবং সকল শক্তির মালিক। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন, আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প রাখে- তাদেরও আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে এবং তাঁর আশ্রয়ের উপর অবিচল আস্থা- বিশ্বাস থাকতে হবে- চাই তাঁদের কাছে উপায়-উপকরন, সৈন্য সামন্ত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র থাক বা না থাক। মানুষ এরূপ দুঃসাহস তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর আশ্রয় সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ ঈমান থাকে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এগুলো অতুলনীয় বাক্য যা এই দুটো সূরায় বর্ণিত হয়েছে। কেননা এতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় এবং বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে কেবল আল্লাহ তায়ালার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে একজন মুমিনের অন্তরে তাঁর দেয়া আশ্রয় সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।

\r\n\r\n

কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যেও বরকত রয়েছে

 

আরবী****

 

৩৫। হযরত আয়েশা ( রাঃ )  থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যখন বিছানায় শুতে যেতেব, নিজের উভয় হাতের তালু একত্রে মিলিয়ে তাতে সূরা “কুল হু আল্লাহু আহাদ—”, “কুল আউউযু বি রাব্বিল ফালাক” এবং “কুল আউউযু বি রাব্বিন নাস” পড়ে ফু দিতেন। অতপর তিনি নিজের হাতের তালুদ্বয় সমস্ত দেহে তা যতদুর পৌছতে সক্ষম ফিরাতেন। প্রথমে মাথায়, অতঃপর মুখমণ্ডলে, তারপর দেহের সামনের ভাগে। তিনি এভাবে তিনবার করতেন। -( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

কালামে ইলাহীর শব্দভাণ্ডারে, তাঁর উচ্চারনে এবং এর বিষয়বস্তু সব কিছুর মধ্যেই কল্যাণ, প্রাচুর্য ও বরকত লুকিয়ে আছে। এর সম্পূর্ণটাই বরকত আর বরকত, কল্যাণ আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আল্লাহর কালাম বুঝতেন এবং তদানুযায়ী কাজ করতেন এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন, অনুরূপভাবে তিনি কালামে ইলাহীর মধ্যে নিহিত অন্যান্য বরকতও লাভ করার চেষ্টা করতেন। যেমন, কুরআনের আয়াত পড়ে পানিতে ফু দেয়া এবং নিজে পান করা বা অন্নকে পান করানো, তা পড়ে হাতে ফু দেয়া অতঃপর তা দেহে মর্দন করা- এভাবে তিনি কুরআনের বরকতের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কোন দিকই ছাড়তেন না। আজো যদি কোন ব্যক্তি এরূপ করে তবে করতে পারে এবং এটাও বরকতের কারন হবে। তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই বরকতের ফায়দা কেবল এমন ব্যক্তিই লাভ করতে পারে, যে কুরআনের বাহ্যিক দিকের সাথে সাথে এর বাতেনি দিকের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখে। যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের উদ্দেশ্যের বিপরীত জীবন যাপন করে, আবার সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে নিজের বুকে ফুক দেয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে- সে অবশেষে কোন ধরনের বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে পানাহ চাচ্ছে? সে যে সুদ খেয়ে সমাজের অনিষ্ট সাধন করেছে- এখন পুলিশ বাহিনী যেন তাঁকে গ্রেপ্তার না করে- এজন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছে? এই জন্য একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, যে ব্যক্তি বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআনের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করছে কেবল সে-ই এর বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। এরপর কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যে যে বরকত রয়েছে তা সে অনায়াসে লাভ করতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাত দিন কুরআনের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং নিজের কথায় ও কাজে কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করছে তাঁর জন্য এই বরকত ও কল্যাণ হতে পারে না।

 

কিয়ামতের দিন পক্ষ অবলম্বনকারী তিনটি জিনিস-

\r\n\r\n

কুরআন, আমানাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক

 

আরবী****

 

৩৬। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  কিয়ামতের দিন তিনটি জিনিস আরশের নীচে থাকবে। এক, কুরআন যা বআন্দার পক্ষে বা বিপক্ষে আরজি পেশ করবে। এর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দুটি দিক রয়েছে। দুই, আমানত এবং তিন, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ফরিয়াদ করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে রক্ষা করেছে- আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে ছিন্ন করেছে- আল্লাহ- তায়ালাও তাঁকে ছিন্ন করবেন। ( ইমাম বাগাবীর শরহে সুন্নাহ)

 

কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ, আমানত এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের আল্লাহ পাকের আরশের নীচে থাকার অর্থ এই নয় যে, উল্লেখিত জিনিসগুলো সেখানে মানুষের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে- এই তিনটি সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের মোকদ্দমা সমূহের মীমাংশা করার জন্য সামনেই উপস্থিত থাকবে। এ তিনটি জিনিসকে দৃষ্টান্তের আকারে পেশ করা হয়েছে। যেমন কোন রাষ্ট্র প্রধানের দরবারে তাঁর তিনজন উচ্চপদস্থ প্রিয় ব্যক্তি দণ্ডায়মান হয়ে আছে। এবং তারা বলে দিচ্ছে কোন ব্যক্তি কেমন প্রকৃতির এবং কি ধরনের ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। এভাবে যেন একটি চিত্র ফুতিয়ে তোলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মানুষের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সামনে আসবে তা হচ্ছে- আল কুরআন। এই কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে- “ইউহাজ্জুল ইবাদ”। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, কুরআন বান্দাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করবে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, সে বান্দাদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করবে।

 

এই ধরনের বক্তব্য পূর্বের একটি হাদীসেও এসেছে – “আল কুরআনু উজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন হয় তোমার স্বপক্ষে দলীল হবে অথবা তোমার বিপক্ষে দলীল হবে। কুরআন এসে যাওয়ার পর এখন ব্যাপারটি দুই অবস্থা থেকে খালী নয়। যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশ মতো কাজ করে থাকো তাহলে এটা তোমাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেবে। আর যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশের বিপরীত কাজ করো, তাহলে এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে তখন যদি এই প্রমান পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদের আকারে যে নির্দেশনামা পাঠিয়ে ছিলেন- সে তদানুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেছে, তখন কুরআনই তাঁর পক্ষে প্রমান পেশ করবে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আরজ পেশ করবে- এই ব্যক্তি দুনিয়াতে আপনার নির্দেশ মতো জীবন যাপন করে এসেছে। তাই তাঁকে এই পুরস্কার দান করা হোক। কিন্তু যে ব্যক্তি কুরআনের নির্দেশ পাওয়ার পরও তাঁর বিপরীত কাজ করেছে – কুরআন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালাবে।

 

আরো বলা হয়েছে, কুরআনের একটি বাহ্যিক দিক এবং একটি অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে- কুরআনের একটি দিক হচ্ছে এর পরিস্কার শব্দমালা যা প্রতিটি ব্যক্তিই পড়তে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে- এই শব্দমালার অর্থ ও এর লক্ষ্য। কিয়ামতের দিন কুরআনের শব্দও সাক্ষী হবে এবং এর অর্থও সাক্ষী হবে। কুরআন মাজীদে এমনি হুকুম বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, অমুক কাজ নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ কাজটি করলো। এই অবস্থায় কুরআনের শব্দ সমূহ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।

 

অনুরূপভাবে কুরআন মাজীদের শব্দমালার মধ্যে সেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যার মাধ্যমে জানা যায় যে, কুরআন মানুষের মধ্যে কোন প্রকারের নৈতিকতার পরিপুষ্টি সাধন করতে চায় আর কোন ধরনের নৈতিকতার বিলোপ চায় ; কোন ধরনের জিনিস আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় এবং কোন জিনিস অপছন্দনীয়। এভাবে কুরআন মাজীদ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় জীবন প্রনালী কি তাঁর নীল নকশাও পেশ করে। এখন কোন ব্যক্তি যদি এর বিপরীত জীবন প্রনালী অনুসরন করে তাহলে গোটা কুরআনই তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। পুরা কুরআনের প্রানসত্ত্বা এবং তাঁর তাৎপর্য এই ব্যক্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে।

 

কুরআনের পড়ে দ্বিতীয় যে জিনিস আরশের নীচে বান্দাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা হচ্ছে আমানত। এখানে আমানত শব্দটি সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। মানুষের মাঝে আমানতের যে সাধারন অর্থ প্রচলিত আছে তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কাছে টাকা –পয়সা, অলংকারাদি অথবা অন্য কোন জিনিস একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই বিশ্বাসে জমা রাখলো যে, দাবী করার সাথে সাথে তা পুনরায় ফেরত পাওয়া যাবে। এটা আমানতের একটি সীমিত ধারনা। অন্যথায় আমানতের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে তাঁর কাছে নিজের কোন অধিকার এই ভরসায় গচ্ছিত রাখে যে, সে তাঁর এই হক আত্মসাৎ করবে না। এটাই হচ্ছে আমানত। যদি কোন ব্যক্তি এই আমানত আত্মসাৎ করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হয়ে দাঁড়াবে।

 

এখন দেখুন আমাদের কাছে সর্বপ্রথম আমানত হচ্ছে আমাদের দেহ যা আমাদের প্রতিপালক আমাদের কাছে সোপর্দ করেছেন। এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস দুনিয়াতে কিছু নেই। সমস্ত শরীর কথা তো প্রশ্নাতীত, এর কোন একটি অংগের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর এই যমীন। এখানে আমাদের প্রতিটি লোকের কাছে যতটুকু ক্ষমতা ও কৃতিত্ব রয়েছে- কারো হাতে বেশী আবার কারো হাতে কম, এসবই আমানত। এরপর দেখুন মানবীয় ও সামাজিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু আমানত আর আমানত। মানুষের পারস্পরিক জীবনের সম্পর্কের সূচনা বিবাহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সমগ্র মানব সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোকের দাম্পত্য সম্পর্ক। এখান থেকে গোটা মানব সমাজের সূচনা। এ সবই আমাদের কাছে আমানত। নারী একজন পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। এই আত্মবিশ্বাসের ওপর সে নিজেকে তাঁর কাছে সপে দেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষ। সে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। অপরদিকে পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের দায়িত্ব সাড়া জীবনের জন্য এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের কাছে তুলে নেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত মহিলা। সে তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে, সে তাঁর ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত ইত্যাদি যা কিছুই তাঁর তত্ত্বাবধানে রাখবে- সে এর কোনরূপ খেয়ানত করবে না। অনুরূপভাবে সন্তানদের অস্তিত্বও আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। পিতা মাতার প্রতি সন্তানদের এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, তারা তাঁদের কল্যাণেই ব্রতি হবে। স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে তাঁদের কোন অমঙ্গল করবে না ও তাঁদের স্বার্থের কোনরূপ ক্ষতি করবে না। সন্তানদের স্বভাব- প্রকৃতির মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস নিহিত রয়েছে। যে সন্তান কেবল ভূমিষ্ঠ হল তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এই গুন বর্তমান রয়েছে। মনে হয় যেন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার মাঝে অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে।

 

অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে অপরের হাতে তুলে দেয় এই বিশ্বাসে যে, সে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। কোন ব্যক্তি ওপর ব্যক্তির কন্যাকে তাঁর বংশের মান- মর্যাদার উপরে ভরসা করেই বিয়ে করে। আত্মীয়তার ব্যাপারটিও এরূপ- একে অপরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে। স্বয়ং এক প্রতিবেশী ওপর প্রতিবেশীর উপর নির্ভর করে থাকে। সে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতিবেশী দেয়াল ভেঙ্গে অবৈধভাবে তাঁর ঘরে অনুপ্রবেশ করবে না। এভাবে আপনি আপনার গোটা জীবনের প্রতি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, সমস্ত মানবীয় সম্পর্ক এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্থাপিত হচ্ছে যে, অপর পক্ষ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

 

কোন দেশের পুরা সরকারী ব্যবস্থা একটি আমানত। গোটা জাতি তাঁর আমানত সরকারের হাতে তুলে দেয়। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের যাবতীয় উপায়- উপকরন জাতীয় সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয়। সরকারের যতো কর্মচারী রয়েছে তাঁদের হাতে জাতির আমানতই তুলে দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে জাতি তাঁর পুরা আমানতই সপে দেয়। লাখ লাখ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করুন। জাতি তাঁদেরকে সুসংগঠিত করে দেশের অভ্যন্তরে রেখে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহে তাঁদের স্থাপন করে। নিজেদের খরচে তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র কিনে দেয় এবং জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হয়। তাঁদেরকে এই বিশ্বাসে সংগঠিত করে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যে, তারা দেশ ও জাতির হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবে। এবং তাঁদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করার ব্যাপারে খেয়ানত করবে না।

 

এখন যদি এসব আমানতের চতুর্দিক থেকে খেয়ানত হতে থাকে তাহলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এজন্য এই আমানত সেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে উপস্থিত হবে। যে যতো বেশী খেয়ানত করেছে সে ততখানী শক্তভাবে পাকড়াও হবে। আর যে ব্যক্তি আমানতের যতো বেশী হক আদায় করেছে সে তত অধিক পরিমানে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার লাভের অধিকারী হবে।

 

তৃতীয় যে জিনিস কিয়ামতের দিন অসাধারন গুরুত্বের অধিকারী হবে তা হচ্ছে ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’ – রেহেম। আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন একটি জিনিস যার উপর মানব সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে। মানবীয় সভ্যতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি এবং তাঁর সামনে যেসব আত্মীয়- স্বজন রয়েছে তাঁদের সমন্বয়ে একটি বংশ বা গোত্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে যখন অসংখ্য বংশ এবং গোত্র একত্রিত হয় তখন একটি জাতির সৃষ্টি হয়। এসব কারনে কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপরে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করাকে মানবীয় সভ্যতা- সংস্কৃতির শিকড় কর্তনকারী জিনিস বলা হয়েছে। এজন্যে বলা হয়েছে রেহেম অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক হচ্ছে সেই তৃতীয় জিনিস যার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা হবে। এই দিন আত্মীয়তার সম্পর্ক চিৎকার করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে অটুট রেখেছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অটুট রাখবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে করতন করেছে আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ত্যাগ করবেন। যখন কোন ব্যক্তি নিজের আত্মীয়- স্বজনের প্রতি নির্দয় হয় এবং তাঁদের সাথে শীতল সম্পর্ক বজায় রাখে- সে দুনিয়াতে কারো বন্ধু হতে পারে না। যদি সে কারো বন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে এবং নিজের কোন ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বন্ধুর বেশ ধারন করেছে। যতক্ষন তাঁর স্বার্থ রক্ষা পাবে ততক্ষণই সে তাঁর বন্ধু হয়ে থাকবে। যেখানে তাঁর স্বার্থে আঘাত লাগবে- সেখানেই সে তাঁর বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কেননা, এটা যথার্থই বাস্তব সম্মত যে, যে ব্যক্তি নিজের ভযিকে আপন বলে গ্রহন করে না সে অপরের আপন কিভাবে হতে পারে? এ কারনেই কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার উপরে এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এখানে হাদীসে উল্লেখিত শব্দে এর কিছু বর্ণনা করা হয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআনের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদা

 

আরবী***

 

৩৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে ( কিয়ামতের দিন ) তাঁকে বলা হবে, কুরআন পাঠ করো এবং উপরে উঠতে থাকো। তুমি দুনিয়াতে যে গতিতে থেমে থেমে কুরআন পাঠ করেছো- অনুরূপ গতিতে তা পাঠ করতে থাকো। তোমার বাসস্থান হবে সেই সর্বশেষ আয়াত যা তুমি পাঠ করবে। ( আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ ও নাসাঈ )

 

সাহেবে কুরআন বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যিনি কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন। যেমন আমরা এমন ব্যক্তিকে মুহাদ্দিস বলি যিনি হাদীসের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন এবং এমন ব্যক্তিকে নামাযী বলি যিনি নামাযের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় মশগুল থেকেছেন- তিনিই হলেন কুরআনের ধারক ও বাহক। কিয়ামতের দিন তাঁকে বলা হবে, তুমি কুরআন পাঠ করতে থাকো এবং উন্নত স্তরের দিকে উন্নিত হতে থাকো। তুমি যেখানে পৌছে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করবে, সেখানেই হবে তোমার মনযীল। অর্থাৎ যে স্থানে পৌছে তুমি কুরআনের সর্বশেষ আয়াত পড়বে, সেখানেই হবে তোমার চিরস্থায়ী বাসস্থান। এ জন্যই বলা হয়েছে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে থেমে থেমে তা পাঠ করো। তাহলে তুমি সর্বোচ্চ মনযিলে পৌছে যেতে পারবে।

\r\n\r\n

যার স্মৃতিপটে কুরআন নেই সে বিরান ঘর সমতুল্য

 

আরবী***

 

৩৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ কুরআন যে ব্যক্তিকে আমার যিকির এবং আমার কাছে দোয়া করা থেকে বিরত রেখেছে- আমি দোয়াকারী বা প্রার্থনাকারীদের যা দান করি তাঁর চেয়ে অতি উত্তম জিনিস তাঁকে দান করবো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেননা সমস্ত কালামের উপর আল্লাহর কালামের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে- যেভাবে সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। ( তিরমিযি, দারেমী, বায়হাকী )

 

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআনের চর্চায় এতটা মশগুল রয়েছে যে, অন্যান্য উপায়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার জন্য সে যিকির- আযকার করারও সময় পায় নি, এমনকি তাঁর কাছে দোয়া করারও সুযোগ পায় নি, তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রার্থনাকারীদেরকে আমি যতো বড় জিনিসই দান করি না কেন কুরআন পাঠকারীদের দোয়া করা ছাড়াই কুরআনের বরকতে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবো।

 

এটা হাদীসে কুদসী। হাদীসে কুদসী হচ্ছে- যে হাদীসের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন যে, “আল্লাহ বলেছেন”। হাদীসে কুদসী এবং কুরআনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কুরআনের মতন ও ( মূল পাঠ ) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে নাযিল হয় এবং এর বিষয়বস্তুও আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব। তা কুরআনের অংশ হিসেবে নাযিল হয়। এ জন্যই জিব্রাঈল ( আঃ ) যখন কুরআন নিয়ে আসতেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে দিতেন যে, এটা কুরআনের আয়াত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব শব্দে এসেছে। অপরদিকে হাদীসে কুদসির ভাষা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজস্ব, কিন্তু এর ভাব এবং বিষয়বস্তু আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব যা তিনি তাঁর নবীর অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন। কখনো কখনো হাদীসে কুদসীর ভাষাও মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু তা কুরআনের অংশ হিসেবে আসে নি। যেমন, আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। নামাযের মধ্যে যেসব যিকির পড়া হয়, তা সবই আল্লাহ তায়ালার শিখানো। কিন্তু তা কুরআনের অংশ বানানোর জন্য শেখানো হয় নি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁরই ভাষায় কোন বিষয়বস্তু নাযিল হলে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া হতো যে, তা কুরআনের সাথে যোগ করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।

 

এই হাদীসে কুদসীর অংশ “উতিয়াস সায়েলীন” পর্যন্ত শেষ হয়েছে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বলেছেন, সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর আল্লাহ তায়ালার যেরূপ মর্যাদা রয়েছে, যাবতীয় কথার উপরে তাঁর কথার অনুরূপ মর্যাদা রয়েছে- কেননা তা আল্লাহ তায়ালার কালাম। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির তুলনায় যতটা শ্রেষ্ঠ, তাঁর কথাও সৃষ্টির কথার চেয়েও ততটা শ্রেষ্ঠ। উপরের কথার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইয়াহি ওয়া সাল্লামের এ কথা যোগ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কুরআন ছাড়া অন্য যে কোন দোয়া- দরূদের কথাই বলা হোক না কেন মানুষের তৈরি কালাম, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কালাম নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মানুষের তৈরি কথা যতই উন্নত মানের ও মর্যাদাসম্পন্ন হোক না কেন তা আল্লাহর কালামের সামনে কিছুই নয়। আল্লাহর সামনে মানুষের যেই মর্যাদা, তাঁর কালামের সামনে তাঁদের রচিত এই কালামেরও ততটুকু মর্যাদা। অতএব, তোমরা সবচেয়ে মর্যাদাবান আল্লাহ তায়ালার এই কালামের পিছনে যতটা সময় ব্যয় করেছো- তা অতীব মূল্যবান কাজে ব্যয় হয়েছে। তোমরা যদি দোয়ার মধ্যে তোমাদের সময় ব্যয় করো তাহলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান কাজেই তোমাদের সময় ব্যয় করলে। অতএব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করার পরিবর্তে কুরআন পাঠেই তাঁর সময় ব্যয় করে তাহলে তাঁকে দোয়াকারীদের তুলনায় উত্তম জিনিস কেন দেয়া হবে।

\r\n\r\n

কুরআনের প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ নেকী

 

আরবী****

 

৪০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে তাঁর জন্য এর বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। ( কুরআনে এই মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে যে ) প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন সওয়াব রয়েছে। আমি একথা বলছি না যে, ‘আলিফ, লাম, মীম’ একটি হরফ। বরং এলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। ---------( তিরমিযি, দারেমী )

 

অর্থাৎ ‘আলিফ- লাম- মীম’ কয়েকটি হরফের সমন্বয়। প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে এবং প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন পুরস্কার রয়েছে।

\r\n\r\n

কুরআন প্রতিটি যুগের ফিতনা থেকে রক্ষাকারী

 

আরবী****

 

৪১। তাবেঈ হযরত হারিস আল-অ’ওয়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ( কুফার) মসজিদে বসা লোকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকেরা- বাজে গল্প-গুজবে মেতে রয়েছে। আমি হযরত আলীর কাছে হাযির হলাম। আমি তাঁকে অবহিত করলাম যে, লোকেরা এভাবে মসজিদে বসে বাজে গল্প-গুজব করছে। তিনি বললেন, বাস্তবিকই লোকেরা তাই করছে? আমি বললাম- হ্যাঁ। তিনি বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ খবরদার, অচিরেই এমন যুগ আসবে যাতে বিপর্যয় শুরু হবে। আমি আরজ করলামঃ হে আল্লাহর রাসুল, এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় কি? তিনি বললেন- আল্লাহর কিতাব ( এই বিপর্যয় থেকে আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা সম্ভব )। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহের কি অবস্থা হয়েছিলো তাও এই কিতাবে আছে। তোমাদের পরে আসা লোকদের উপর কি অতিবাহিত হবে তাও এ কিতাবে আছে। তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার বিধানও এতে বিবৃত হয়েছে। এই কুরআন হচ্ছে সত্য মিথ্যার- মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কিতাব। এটা কোন হাসি ঠাট্টার বস্তু নয়। যে অহংকারী তা পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাঁকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি এই কুরআন পরিত্যাগ করে অন্যত্র হেদায়াত তালাশ করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি এবং প্রজ্ঞাময় যিকির ও সত্য সরল পথ। তা অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি কখনো বিপথগামী হয় না। তা যবানে উচ্চারন করতে কষ্ট হয় না। জ্ঞানীগণ কখনো এর দ্বারা পরিতৃপ্ত ও বিতৃষ্ণ হয় না। একে যতই পাঠ করে তা পুরাতন হয় না। এর বিস্ময়কর তথ্য সমূহের অন্ত নেই। এটা শুনে জীনেরা স্থির থাকতে পারেনি, এমনকি তারা বলে উঠলো- “আমরা এমন এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সৎ পথের সন্ধান দেয়। অতএব আমরা এর উপরে ঈমান এনেছি”। ( সূরা জীন ; ১, ২ )

 

যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বলে সে সত্য কথা বলে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী কাজ করবে সে পুরস্কার পাবে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী ফায়সালা করবে সে ন্যায়ানুগ ফায়সালা করতে পারবে। যে ব্যক্তি লোকদের এই কুরআন অনুসরনের দিকে ডাকে সে তাঁদের সরল পথেই ডাকে। ( তিরমিযি, দারেমী )

 

নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম সৌন্দর্য এই বলেছেন যে, কুরআনে এটাও বলা হয়েছে যে, অতীত জাতিসমূহ কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ অনুসরন করার কারনে তাঁদের পরিনাম কিরূপ হয়েছিলো এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে যারা ভ্রান্ত পথে চলেছিল তাঁদেরই বা কি পরিনতি হয়েছিলো। কুরআনে এও বলা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ভ্রান্ত পথের অনুসারীদের কি পরিনতি হবে এবং সঠিক পথের অনুসারীদের ভাগ্যে কি ধরনের কল্যাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআনে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এর মীমাংসা কিভাবে হওয়া উচিৎ।

 

‘হুয়াল ফাসলু’- বাক্যাংশের অর্থও হচ্ছে, কুরআন মাজীদ চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কথা বলে এবং পূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে বলে, এর মধ্যে হাসি-ঠাট্টা ও উপহাস মূলক এমন কোন কথা বলা হয়নি, যা মানা বা না- মানায় কোন পার্থক্য সূচিত হয় না।

 

অতঃপর বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কুরআন ছেড়ে দিয়ে  অন্য কোথা থীক হেদায়াত লাভের চেষ্টা করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এর অর্থও হচ্ছে- এই কিতাব ছাড়া আর কোথাও থেকে এখন আর হেদায়াত লাভ করা যেতে পারে না। যদি অন্য কোন উৎসের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

 

আরো বলা হয়েছে- এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি। অর্থাৎ কুরআন হচ্ছে- বান্দাহ এবং তাঁর প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। যে ব্যক্তি কুরআনকে শক্তভাবে ধারন করবে, খোদার সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে ছেড়ে দিলো, সে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললো।

 

কুরআনের প্রজ্ঞাময় যিকির হওয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটা এমন এক নসীহত যার গোটাটাই হিকমত, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে।

 

আরো বলা হয়েছে- কুরআন অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে- যদি কোন ব্যক্তি কুরআনকে নিজের পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করে, তা থেকে  হেদায়াত লাভের চেষ্টা করে এবং তাঁর জীবনে যেসব সমস্যা ও বিষয়াদি উপস্থিত হয় তাঁর সমাধানের জন্যে যদি সে কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্য কোন চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে পারবে না। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি পূর্ব থেকে নিজের চিন্তাধারাকে তাঁর মন-মগজে শক্তভাবে বসিয়ে নেয় এবং কুরআনকেও তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী ঢালাই করতে চায়- তাহলে এই পন্থা তাঁকে তাঁর আকাশ- কুসুম কল্পনা থেকে মুক্ত করতে পারে না। হ্যাঁ, যদি কোন ব্যক্তি কুরআন থেকেই পথনির্দেশ লাভ করতে চায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখানে যা কিছু পাওয়া যাবে তা সে মেনে নিবে এবং যা কিছু এখানে পাওয়া যাবে না তা সে গ্রহন করবে না- তাহলে এমন ব্যক্তিকে তাঁর নিজের কল্পনা বিলাসও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্যের চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে সক্ষম হবে না।

 

অতপর বলা হয়েছে, কারো মুখের ভাষা কুরআনের মধ্যে কোনরূপ ভেজাল মেশাতে সক্ষম হবে না। এ ব্যাপারটি একটি সুস্পষ্ট মু’যিযা- আল্লাহ তায়ালা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা এমন সময়ে বলেছেন, যখন এই কুরআন কেবল পেশ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরও এটা চূড়ান্ত কথা হিসাবে বিরাজ করছে যে, আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি এর সাথে কোন কিছু সংমিশ্রণ করতে পারে নি। সে সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল না যে, কুরআনে কোনরূপ মিশ্রন ঘটাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বানী হিসেবে একথা বলা হয়েছিলো। আজ শত শত বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমানিত হয়েছে যে, যা কিছু বলা হয়েছিলো বাস্তবিক অর্থেই তা ছিল হক। এরই নাম মুযিযা।

 

আরো বলা হয়েছে- আলেমগন তা থেকে কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলেম সে কুরআন তেলাওয়াত, তা অনুধাবন এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় জীবন অতিবাহিত করে দেয় কিন্তু কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। তাঁর কাছে এমন কোন সময় আসবে না যখন সে এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারবে যে, কুরআন থেকে তাঁর যা শেখার ছিল সে তা শিখে নিয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে এবং এখন তাঁর আর কোন জ্ঞানের দরকার নেই। আজ পর্যন্ত কোন আলেমই বলতে পারেনি যে, সে কুরআন থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছে, তাঁর যা কিছু অর্জন করার ছিল তা সে অর্জন করে নিয়েছে, এখন আর তাঁর অতিরিক্ত কিছু শেখার প্রয়োজন নেই।

 

অতঃপর বলা হয়েছে, কুরআন যতবারই পাঠ করো না কেন তা কখনো পুরান হবে না। যতো উন্নত মানের কিতাবই হোক- আপনি দুই- চার, দশ-বিশবার তা পড়তেই শেষে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তারপর আর তা পড়তে মন চাইবে না। কিন্তু কুরআন হচ্ছে এমন এক অনন্য কিতাব যা জীবনভর পাঠ করা হয়, বারবার পাঠ করা হয় তবুও মন পরিতৃপ্ত হয় না। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা তো দিনের মধ্যে কয়েকবার পাঠ করা হয় কিন্তু কখনো বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় না যে, কতদিন ধরে লোক একই জিনিস বারবার পাঠ করছে। এটাও কুরআন মাজীদের এক অনন্য মু’যিযা এবং এর অসাধারন সৌন্দর্যের একটি নিদর্শন।

 

আরো বলা হয়েছে, কুরআন মাজীদের রহস্য কখনো শেষ হবার নয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন পারহ, এ নিয়ে চিন্তা- গবেষনা করতে এবং তথানুসন্ধান করতে করতে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর রহস্য কখনো শেষ হয় না। কখনো কখনো এমনও হয় যে, মানুষ একাধারে চল্লিশ পঞ্চাশ- বছর ধরে কুরআনের অধ্যয়নে কাটিয়ে দেয়ার পর কোন একসময় কুরআন খুলে পড়তে থাকে। তখন তাঁর সামনে এমন কোন আয়াত এসে যায় যা পাঠ করে মনে হয় যেন আজই সে এ আয়াতটি প্রথম পাঠ করছে। তা থেকে এমন বিষয়বস্তু তাঁর সামনে বেরিয়ে আসে যা জীবনভর অধ্যয়নেও সে লাভ করতে পারেনি। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এর রহস্য কখনো শেষ হবার নয়।

 

কুরআন মাজীদের মর্ম বানী শুনে জীনদের ঈমান আনার ঘটনা সূরা জীন এবং সূরা আহকাফে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা গেলো যে, কুরআন এমন প্রভাবশালী বক্তব্য পেশ করে- মানুষ তো মানুষ জীনেরাও যদি একগুঁয়েমি, গোঁড়ামি এবং হঠকারিতা পরিহার করে উন্মুক্ত মন নিয়ে কুরআনের বানী শুনে তাহলে তাদেরও একথা সাক্ষী না দিয়ে উপায় থাকে না  যে, কুরআন সঠিক পথের নির্দেশ দান করে এবং এর উপর ঈমান এনে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।

 

কুরআন মাজীদের এসব বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনাগত ভবিষ্যতে যেসব ফিতনা এবং বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে বাঁচার মাধ্যম এই কুরআন ছাড়া আর কিছুই নয়। একথাও পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন মাজীদে এমন জিনিস রয়েছে যার কারনে তা কিয়ামত পর্যন্ত সব সময় মানব জাতিকে যে কোন ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।

\r\n\r\n

কুরআন চর্চাকারীর পিতামাতাকে

 

নূরের টুপি পরিধান করানো হবে

 

আরবী***

 

৪২। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে- কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে নূরের টুপী পরিয়ে দেয়া হবে। সূর্য যদি দুনিয়াতে তোমাদের ঘরে নেমে আসে তাহলে এর যে আলো হবে- ঐ টুপীতে তাঁর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলো হবে। অতএব যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী যাবতীয় কাজ করে তাঁর প্রতি আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ হতে পারে বলে তোমাদের ধারনা? ( আহমাদ, আবু দাউদ )

 

 এখানে এমন পিতা-মাতার কথা বলা হয় নি যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন অধ্যয়ন করতে বাধা দেয়। এবং কুরআন পাঠকারী ছেলেদেরকে মোল্লা হয়ে গেছে বলে টিটকারি দেয় এবং বলে, এখন সে আর আমাদের কোন কাজে লাগার উপযোগী নয়। এ আর কি পার্থিব কাজ করবে- এতো কুরআন পড়ায় লেগে গেছে। এখানে এমন পিতামাতার কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন পড়িয়েছে। এবং তাঁদের এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যে, তাঁদের জীবদ্দশায় এবং তাঁদের মৃত্যুর পরও তারা কুরআন পড়তে অভ্যস্ত হয়ে রয়েছে এবং তদানুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছে। তাঁর এই কুরআন পাঠ শুধু তাঁর জন্যেই পুরস্কার বয়ে নিয়ে আসবে না বরং তাঁর পিতামাতাকেও পুরস্কৃত করা হবে। আর সেই পুরস্কার হচ্ছে কিয়ামতের দিন তাঁদেরকে মর্যাদাপূর্ণ, গৌরবময় ও আলোক উদ্ভাসিত টুপি পরিয়ে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, যে ব্যক্তি নিজে এই কুরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়- তাঁর উপর আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ বর্ষিত হবে এবং সে কতো কি পুরস্কার পাবে।

\r\n\r\n

কুরআনের হেফাজত না করা হলে তা দ্রুত ভুলে যাবে

 

আরবী****

 

৪৩। হযরত আবু মুসা আশআরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদকে স্মৃতিপটে ধরে রাখার এবং সংরক্ষণ করার দিকে লক্ষ্য দাও। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন। উট যেভাবে দড়ি ছিড়ে বন্ধন মুক্ত হয়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে- কুরআন সেভাবে এবং তাঁর চেয়েও দ্রুত স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ---------( বুখারী ও মুসলিম )

 

  অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করার পর তা স্মরণ শক্তির আধারে ধরে রাখার জন্যে যদি চিন্তা ভাবনা না করে এবং বারবার অধ্যয়ন না করে তাহলে তা মানুষের মন থেকে পলায়ন করে থাকে- যেভাবে উট তাঁর রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে। এর কারন হচ্ছে- মানুষ যতক্ষন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা স্মৃতিপটে ধরে রাখার চেষ্টা না করে ততক্ষন তাঁর আত্মা কুরআনকে গ্রহন করতে পারে না। যদি এটা না করা হয় তাহলে সে কুরআনকে তাঁর স্মৃতিপট থেকে ঢিলা করে দেয় এবং এর ফলে তা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেননা কুরআন তাঁর উপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে- তা থেকে মুক্ত হওয়ার দুর্বলতা তাঁর মধ্যে বর্তমান রয়েছে। কুরআন তাঁর জন্যে যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে সে তা অতিক্রম করতে চায়। যে ব্যক্তি নফসের গোলাম হয়ে যায় এবং নিজের নফসকে আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য বাধ্য করে না সে কখনো কখনো কুরআনের বানী শুনে ঘাবড়িয়ে যায়- না জানি এমন কোন আয়াত এসে যায় যা তাঁকে ভ্রান্ত ও নাজায়েজ কাজ করা থেকে বাঁধা দিয়ে বসে। এ জন্য বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ মুখস্থ করার পর তা স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করো। অন্যথায় তা উটের রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার ন্যায় তোমার স্মৃতিপট থেকে পলায়ন করবে।

\r\n\r\n

কুরআন মুখস্থ করে তা ভুলে যাওয়া জঘন্য অপরাধ

 

আরবী***

 

৪৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তির জন্য এটা খুবই খারাপ কথা যে, সে বলে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। ( আসল কথা হচ্ছে তাঁর অবহেলার কারনে ) তাঁকে এটা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কুরআনকে কণ্ঠস্থ রাখার আপ্রান চেষ্টা করো। কেননা তা পলায়নপর উটের চেয়েও দ্রুত মানুষের বক্ষঃস্থল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। -------( বুখারী, মুসলিম- মুসলিমের বর্ণনায় আছে, উট তাঁর বন্ধন থেকে যেভাবে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে )।

 

এখানেও একই কথা ভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করার পর তা ভুলে যাওয়া এবং এই বলা যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি- এটা খুবই খারাপ কথা। মূলত তাঁর ভুলে যাওয়ার অর্থও হচ্ছে- সে কুরআনের কোন পরোয়া করেনি এবং তা মুখস্থ করার পর সে দিকে আর লক্ষ্য দেয় নি। যেহেতু সে আল্লাহ তায়ালার কালামের প্রতি মনোযোগ দেয়নি এ জন্য আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে তা ভুলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর কালাম এমন ব্যক্তির কাছে রাখা পছন্দ করেন না যে তাঁর সমাদরকারী নয়। এই জন্য বলা হয়েছে, কুরআনকে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করো এবং তা কণ্ঠস্থ করার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। অন্যথায় উট বন্ধনমুক্ত হয়ে যেভাবে পালাবার চেষ্টা করে- অনুরূপভাবে কুরআনও বক্ষস্থল থেকে বের হয়ে চলে যায়।

\r\n\r\n

কুরআন মুখস্থকারীর দৃষ্টান্ত

 

আরবী****

 

৪৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কুরআন মুখস্থকারী এমন ব্যক্তি সদৃশ যার কাছে বাঁধা উট রয়েছে। যদি সে তাঁর রক্ষনাবেক্ষন করে তাহলে তা তাঁর কাছে থাকবে। আর যদি সে এটাকে আযাদ করে দেয় তাহলে তা ভেগে যাবে। --( বুখারী ও মুসলিম )

 

 হযরত আবু মুসা আশআরী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে তিনটি বর্ণনার একই বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন। এ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে লোকদের মনে একথা বদ্ধমূল করিয়েছেন যে, যার যতটুকু পরিমান কুরআন মুখস্থ আছে সে যেন তা মুখস্ত রাখার চেষ্টা করে। তা যদি স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা না করো এবং বারবার তা পাঠ না করো তাহলে এটা তোমাদের মন থেকে ছুটে যাবে।

 

আপনি দেখে থাকবেন, যারা কুরআনের হাফেজ তাঁদের সব সময় কুরআন পড়তে হয়। যদি তারা রমযান মাসে কুরআন শুনাতে চায় এ জন্যে তাঁকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এর কারন হচ্ছে- মানুষ কুরআন মুখস্ত করার পর যদি তা সংরক্ষিত করার চেষ্টা না করে তাহলে তা খুব দ্রুত তাঁর স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে চলে যায়।

\r\n\r\n

মনোনিবেশ সহকারে ও একাগ্র চিত্তে কুরআন পাঠ করো

 

আরবী***

 

৪৬। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের দীল যতক্ষন পর্যন্ত কুরআনের সাথে লেগে থাকে ততক্ষন তা পাঠ করো। যখন আর পাঠে মন বসে না তখন উঠে যাও ( অর্থাৎ পড়া বন্ধ করো)। ------------  ( বুখারী ও মুসলিম )

 

 এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন এমনাবস্থায় কুরআন পাঠ না করে যখন তাঁর মন পূর্ণরূপে কুরআনের দিকে নিবিষ্ট হচ্ছে না। সে গভীর মনোযোগের সহকারে এবং আগ্রহের সাথে যতটা সম্ভব কুরআন পাঠ করবে। মূল বিষয় মনযিলের পর মনযিল কুরআন পড়ে যাওয়া নয়। বরং পূর্ণ একাগ্রতা সহকারে এবং অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করে পড়াই হচ্ছে আসল ব্যাপার। এটা নয় যে, আপনি একপারা কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তখন আপনি এমন অবস্থায় বসে কুরআন পরছেন যে, আপনার মনোযোগ মোটেই সে দিকে নেই। এর চেয়ে বরং আপনি গভীর মনোযোগের সাথে এক রুকু পাঠ করুন। মানুষ যদি তা না করতে পারে তাহলে মনযিলের পর মনযিল কুরআন পাঠ করে কি হবে? এজন্যই বলা হয়েছে- কুরআন পড়ার সময় যদি মন ছুটে যায় তাহলে পড়া বন্ধ করে দাও।

\r\n\r\n

রাসুলুল্লাহর কিরাত পাঠের পদ্ধতি

 

আরবী***

 

৪৭। হযরত কাতাদা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনাস ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিরাত পাঠের ধরন কিরূপ ছিল? তিনি বললেন- তিনি শব্দগুলো টেনে টেনে ( অর্থাৎ পূর্ণাংগ ভাবে উচ্চারন করে ) পড়তেন। অতঃপর আনাস

 

( রাঃ) “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করে শুনালেন এবং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে আদায় করলেন। বিসমিল্লাহ, আর-রাহমান, আর- রাহীম ( আল্লাহ, রহমান এবং  রহীম শব্দক’টি টেনে টেনে পড়লেন )। -------------------- ( সহীহ বুখারী )

 

  অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না বরং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে পরিস্কার ভাবে উচ্চারন করে পাঠ করতেন। এর অর্থও এই নয় যে, তিনি অস্বাভাবিক পন্থায় কুরআন পাঠ করতেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি প্রতিটি শব্দ ধীর স্থিরভাবে এবং পূর্ণাংগভাবে উচ্চারন করে এমন ভঙ্গিতে পাঠ করতেন যে, পড়ার সময় মানুষের মনমগজ পূর্ণভাবে সেদিকে নিয়োজিত হতো যে- কি পাঠ করা হচ্ছে এবং এর তাৎপর্য কি?

\r\n\r\n

মহান নবীর সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ

 

আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়

 

আরবী***

 

৪৮। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – আল্লাহ তায়ালা কোন কথা এতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন না যতটা মনোযোগের সাথে কোন নবীর কণ্ঠস্বর শুনে থাকেন- যখন তিনি সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ করেন।-------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

আরবী***

 

৪৯। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- একজন নবী যখন সুললিত কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করেন- তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর পাঠ যতটা যত্ন সহকারে শুনেন অন্য কোন কিছু ততটা যত্ন সহকারে শুনেন না। ------ ( বুখারী ও মুসলিম )

 

  পূর্ববর্তী হাদীস এবং এ হাদীসের বক্তব্য মূলত একই। এর অর্থ হচ্ছে- সুললিত কণ্ঠে নবীর কুরআন পাঠ এমন এক জিনিস যার প্রতি আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক আকর্ষণ রয়েছে। এ জন্য তিনি নবীর কুরআন পাঠ যতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন তদ্রূপ অন্য কিছু শুনেন না।

\r\n\r\n

যে ব্যক্তি কুরআনকে নিয়ে স্বয়ং

 

সম্পূর্ণ হয় না সে আমাদের নয়  

 

আরবী***

 

৫০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করে না অথবা কুরআনকে পেয়ে অন্য সবকিছু থেকে বিমুখ হয় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ------- ( সহীহ বুখারী )

 

 এখানে ‘সুমধুর স্বর’- অর্থ কি তা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া প্রয়োজন। কুরআনকে সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা এক কথা, আর তা গানের সুরে পাঠ করা আরেক কথা। সুমধুর কণ্ঠে পড়া হচ্ছে এই যে, মানুষ কুরআনকে উত্তম পদ্ধতিতে, উত্তম সুরে পাঠ করবে। তাহলে কোন শ্রবণকারী উপস্থিত থাকলে তাঁর পাঠ সে মনোযোগের সাথে শুনবে এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। উত্তম সুরে পাঠ করার মধ্যে কেবল কণ্ঠস্বর উত্তম হওয়াই নয়- বরং সে এমন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করবে- যেন সে নিজেও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। কুরআন পাঠ করার ভঙ্গি এরূপ হওয়া উচিৎ যে, সে যে বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত পাঠ করছে তদনুযায়ী তাঁর কণ্ঠস্বর ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হবে এবং সেই আয়াতের প্রভাবও তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি শাস্তি সম্পর্কিত কোন আয়াত এসে যায় তাহলে তাঁর অবস্থা ও উচ্চারন ভঙ্গিও এমন হবে যেন তাঁর মধ্যে ভীত সন্ত্রস্র অবস্থা ক্রিয়াশীল রয়েছে। যদি সে সওয়াব বা আখিরাতের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কিত কোন আয়াত পাঠ করে, তখন তাঁর মধ্যে আনন্দ ও খুশির ভাব জাগতে হবে। সে যদি কোন প্রশ্নবোধক আয়াত পাঠ করে তখন সে তা প্রশ্নবোধক বাক্যের ধরন অনুযায়ী পাঠ করবে। পাথক কুরআন শরীফ এভাবে নিজে হৃদয়ঙ্গম করবে এবং প্রভাবান্বিত হয়ে পাঠ করবে। শ্রবণকারী যেন  শুধু তাঁর মধুর সুরের দ্বারাই প্রভাবিত না হয়, বরং তাঁর প্রভাবও যেন সে গ্রহন করতে পারে- যেমন একজন উন্নত মানের বক্তার বক্তৃতার প্রভাব তাঁর শ্রোতাদের উপর পড়ে থাকে। এদিকে যদি লক্ষ্য দেয়া না হয় এবং গানের সুরে কুরআন পাঠ করা হয়- তাহলে সে কুরআনের সমঝদার নয়। বর্তমান যুগের পরিভাষায় এর নাম সংস্কৃতি তো রাখা যায়, কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে কুরআন তেলাওয়াত হতে পারে না। সুর এবং লয়ের মাধ্যমে কুরআন পাঠ সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না।

 

‘তাগান্না বিল কুরআন’- এর আরেক অর্থও হচ্ছে এই যে, কুরআনকে নিয়ে মানুষ দুনিয়ার অন্য সবকিছুর মুখাপেক্ষীহীন হয়ে যাবে। সে কুরআন মাজীদকে আয়-উপার্জনের হাতিয়ার পরিনত করবে না। বরং সে কুরআনের ধারক হয়ে- যে মহান খোদার এই কালাম- তাঁর উপরই ভরসা করবে। কারো কাছে সে হাত পাতবে না এবং কারো সামনে তাঁর মাথা নত হবে না। সে কাউকেও ভয় করবে না, কারো কাছে কিছু আশাও করবে না। যদি এটা না হয় তাহলে সে কুরআনকে তো ভিক্ষার পাত্র বানিয়েছে- কিন্তু সে কুরআনকে পেয়েও দুনিয়াতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে নি।

\r\n\r\n

রাসুলুল্লাহ সাঃ, কুরআন এবং সত্যের সাক্ষ্যদান

 

আরবী***

 

৫১। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের উপরে থাকা অবস্থায় আমাকে বললেন- “আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও”। আমি আরজ করলাম, আমি আপনাকে কুরআন পাঠ করে শুনাবো? অথচ তা আপনার উপরই নাযিল হচ্ছে, তিনি বললেন- “আমি অপরের মুখে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে চাই”। অতএব আমি সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে থাকলাম। যখন আমি এই আয়াতে পৌছলাম- “আমি যখন প্রত্যেক উম্মাতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী হাযির করবো এবং এই সমস্ত সম্পর্কে- তোমাকে ( হে মুহাম্মাদ ) সাক্ষী হিসেবে পেশ করবো তখন তারা কি করবে ” তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “আচ্ছা যথেষ্ট হয়েছে”। হঠাৎ আমার দৃষ্টি তাঁর চেহারায় পতিত হলে আমি দেখলাম- তাঁর দুচোখ দিয়ে আশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ------------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়্যুত প্রাপ্তির পরে এই দুনিয়ায় যতো লোক এসেছে তারা সবাই তাঁর উম্মত। যদি তারা তাঁর উপর ঈমান এনে থাকে তাহলে এক অর্থে তারা তাঁর উম্মত। আর যদি তারা ঈমান না এনে থাকে তাহলে তারা অন্য অর্থে তাঁর উম্মত। কেননা, প্রথমত- যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনে থাকবে তারা তাঁর উম্মত। দ্বিতীয়ত- যেসব লোকের কাছে তাঁকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাঁরাও তাঁর উম্মত। রাসুলুল্লাহকে ( সাঃ )  যেহেতু সমস্ত মানব জাতির কাছে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, এজন্য তাঁর নবুয়্যত প্রাপ্তি থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যতো লোকের আবির্ভাব হবে তারা সবাই তাঁর উম্মত।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মুখে সূরা নিসার আয়াত শুনে আশ্রুসজল হয়ে পড়লেন কেন?  এ ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করুন।

 

আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালতে সব জাতিকে উপস্থিত করা হবে এবং প্রত্যেক জাতির উপর নিজ নিজ নবীকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে- তিনি তখন সাক্ষী দেবেন, আমি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশসমূহ তাঁদের কাছে যথাযথভাবে পৌছে দিয়েছি। তখনই তাঁদের বিরুদ্ধে হুজ্জাত ( পূর্ণাংগ প্রমান ) সম্পন্ন হবে। নবীর পক্ষ থেকে যদি এ ব্যাপারে কন ত্রুটি থেকে গিয়ে থাকে ( আল্লাহ না করুন ) তাহলে তিনি আল্লাহর বানী পূর্ণরূপে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করার সাক্ষী দিতে পারেন না। নবী যদি এই সাক্ষ্য না দিতে পারেন ( যদিও এরূপ হবে না ) তাহলে তাঁর উম্মাতগন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে এবং মোকদ্দমার সাক্ষ্যও খতম হয়ে যাবে।

 

নিজের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর অনুভূতি ছিল। নবী ( সাঃ ) যখন উল্লেখিত আয়াত শুনলেন তখন এই অনুভূতির ফলশ্রুতিতেই তাঁর দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি কতবড় দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন যে, আজ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষের আবির্ভাব হবে- তাঁর মাধ্যমেই তাঁদের উপর আল্লাহর হুজ্জাত ( চূড়ান্ত প্রমান ) পূর্ণ হবে। এই অনুভুতিই তাঁকে অস্থির করে রেখেছিল। তিনি সব সময়ই ভাবতেন, এই হুজ্জাত পুরা করার ক্ষেত্রে আমার যদি সামান্য পরিমান ত্রুটিও থেকে যায় তাহলে এই উম্মতকে গ্রেফতার করার পরিবর্তে আমাকেই পাকড়াও করা হবে।

 

গভীরভাবে চিন্তা করুন, এর চেয়ে বড় যিম্মাদারী কি কোন মানুষের হতে পারে? আর এর চেয়েও কি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে পারে যে, সেই যুগ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত গোটা মানব জাতির সামনে আল্লাহ তায়ালার হুজ্জাত পুরা করার দায়িত্ব এককভাবে এক ব্যক্তির উপর পড়বে। কার্যত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গুরুত্বপূর্ণ পদেই সমাসীন ছিলেন। এই কঠিন যিম্মাদারীর অনুভুতিই তাঁর কোমরকে নুজ করে দিত। এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শান্তনা দেয়ার জন্য এই আয়াত নাযিল করেন-

 

“আমি কি আপনার উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে রাখিনি যা আপনার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল?”

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিকে এই মহান এবং কঠিন দায়িত্বের অনুভূতি রাখতেন, অপরদিকে এটা সব সময় তাঁকে অস্থির করে রাখতো, আমি যাদের হেদায়াতের পথে ডাকছি তারা কেন তা থেকে দূরে স্বরে যাচ্ছে- এবং কেনই বা তারা নিজেদের জন্য একটি ভয়াবহ পরিনতি নির্দিষ্ট করে নিচ্ছে? যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

 

“আপনি মনে হয় এই চিন্তায়ই নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেবেন যে, এরা কেন ঈমান আনছে না? ” ( সূরা আশ শুয়ারা, আয়াত- ৩ )

 

 এ কারনেই তিনি যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে এই আয়াত ( সূরা নিসা ) পাঠ করতে শুনলেন তখন তাঁর দুচোখ থেকে আশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবং তিনি বললেন, আচ্ছা হয়েছে, আর নয়, থেমে যাও। এখন আর সামনে অগ্রসর হতে হবে না।

\r\n\r\n

কুরআনী ইলমের বরকতে উবাই ইবনে কা’বের মর্যাদা

 

আরবী***

 

৫২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’বকে বললেন- আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে কুরআন পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। উবাই ( রাঃ ) পুনরায় বললেন- সত্যিই কি মহাবিশ্বের প্রতিপালকের দরবারে আমার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আনাস ( রাঃ ) বলেন- একথা শুনে উবাই ইবনে কা’বের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। অপর এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে “লাম ইয়াকুনিল্লাযিনা কাফারু” সূরা পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বললেন- আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। এতে উবাই ইবনে কা’ব ( আবেগাপ্লুত হয়ে ) কেদে দিলেন। --( বুখারী ও মুসলিম )

 

 হযরত উবাই ইবনে কা’বের এমন কি বিশেষত্ব ছিল যার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এতো উচ্চ স্থান, এতো বড় সম্মান ও পদমর্যাদা দান করলেন? হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে- হযরত উবাই ইবনে কা’ব সাহাবাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা যে অসংখ্য পন্থায় সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন তাঁর মধ্যে একটি ছিল, যে সাহাবীর মধ্যে কোন বিশেষ প্রতিভা এবং অসাধারন যোগ্যতার সমাবেশ ঘটতো- আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে বিশেষ ব্যবহার করতেন। যাতে এই বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ এবং লালন ঘটতে পারে এবং তাঁর শৌর্য-বীর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করা হয়েছে, আপনি উবাই ইবনে কা’বকে কুরআন পাঠ করে শুনান। হযরত উবাই ইবনে কা’ব এটা জানতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আল্লাহু আকবর, আমার এই মর্যাদা যে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমার নাম নিয়ে আমার উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আপনি এ থেকে অনুমান করতে পারেন, সাহাবাদের অন্তরে কুরআন মাজীদের প্রতি কি ধরনের মহব্বত ও আকর্ষণ ছিল। তাঁদের কতো সম্মান ও মর্যাদা ছিল যে, তারা আল্লাহ তায়ালার নজরে পড়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সাথে বিশেষ আচরন করেছেন।

\r\n\r\n

কুরআনকে শত্রুর এলাকায় নিয়ে যেও না

 

আরবী***

 

৫৩। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন সাথে নিয়ে শত্রু এলাকায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। ----- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

  মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, কুরআন শরীফ সাথে নিয়ে দুশমনদের এলাকায় যেও না কেননা শত্রুর হাতে পড়ে যাওয়া সম্পর্কে আনি নিরাপদ মনে করি না।

 

মোট কথা যে এলাকায় কুরআন নিয়ে গেলে তাঁর অসম্মান হওয়ার আশংকা আছে সেখানে যেনে শুনে কুরআন নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

\r\n\r\n

আসহাবে সুফফার ফযিলত

 

আরবী***

 

৫৪। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদিন দুর্বল ( গরীব ও নিঃস্ব ) মুহাজিরদের একটি দলের সামনে বসা ছিলাম। তারা নিজেদের লজ্জা নিবারনের জন্য পরস্পর লেগে বসেছিল। কেননা এসময় তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকার মতো কাপর ছিল না। এই মুহাজিরদের মধ্যেকার একজন কারী আমাদের কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং আমাদের দলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন তখন কুরআন পাঠকারী চুপ হয় গেলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সালাম দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- তোমরা কি করছিলে? আমরা আরজ করলাম, আমরা আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকদের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যাদের সম্পর্কে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে ধৈর্য ধারন করি। আবু সাঈদ ( রাঃ) বলেন, তিনি আমাদের মাঝে এমনভাবে বসে গেলেন যে, আমাদের এবং তাঁর মাঝে কোন পার্থক্য থাকলো না। ( মনে হচ্ছিলো তিনি আমাদের মধ্যেকারই একজন বিশেষ কেউ নন )। অতপর তিনি হাতের ইশারায় বললেন- এরূপ বস। অতঃপর তারা বৃত্তাকারে বসে গেলেন এবং তাঁদের সবার চেহারা তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেলো। অতঃপর তিনি বললেন- নিঃস্ব মুহাজিরদের জামায়াত, তোমরা পূর্ণাংগ নূরের সুসংবাদ গ্রহন করো, যা তোমরা কিয়ামতের দিন লাভ করেবে। তোমরা ধনীদের চেয়ে অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আখেরাতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান। ----------( আবু দাউদ )

 

  দুর্বল মুহাজির বলতে বৃদ্ধ অথবা শারিরীক দিক থেকে দুর্বল এমন লোকদের বুঝানো হয় নি, বরং এর অর্থও হচ্ছে নিতান্ত গরীব এবং আর্থিক অনটনে জর্জরিত। অর্থাৎ যেসব মুহাজির কোন অর্থ-সম্পদ ছাড়াই শুধু এক কাপড়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসছিলেন। তাঁদের কাছে না ছিল পরনের কাপড়, না ছিল খাবার সামগ্রী, আর না ছিল মাথা গোঁজার ঠাই। কিন্তু আল্লাহর দীনের সাথে তাঁদের সংশ্রব এবং কুরআনের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ এমনই ছিল যে, অবসর বসে থেকে অনর্থক কথাবার্তায় সময় কাটানোর পরিবর্তে তারা আল্লাহর কালাম শুনতেন এবং শুনাতেন।

 

এ স্থানে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআন মাজীদে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা কেন বলা হয়েছিলো, তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাহি ওয়া সাল্লাম এজন্য আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন কেন? একথা কুরআন মাজীদের এমন স্থানে বলা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ দান করেছেন যে- মক্কার এই বড় বড় সর্দার এবং ধনিক শ্রেনীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার কোন পরোয়াই করবে না। এবং কখনো এ চিন্তায়ও লেগে যাবে না যে- তাঁদের কেউ যদি তোমার দলে ভিড়ে যেত তাহলে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বের উসিলায় এ দীনের প্রসার ঘটতো বরং তাঁর পরিবর্তে যেসব দরিদ্র লোক এবং কাংগাল কিন্তু ঈমান গ্রহন করে তোমার কাছে এসেছে- তুমি তাঁদের নিত্য সাথী হয়ে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো, তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে যাও এবং তাঁদের সাহচর্যে আশ্বস্ত থাকো।

 

***সূরা কাহাফে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-

 

“হে নবী, তোমার দলকে এই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো যারা নিজেদের প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর তাঁদের দিক থেকে কখনো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তুমি কি দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাকজমক পছন্দ করো? এমন কোন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি স্মরণশুন্য করে দিয়েছি এবং যে লোক নিজের নফসের খাহেশের অনুসরন করে চলার নীতি গ্রহন করেছে, আর যার কর্মনীতি সীমা লংঘনমুলক। পরিস্কার বলে দাও, এই মহাসত্য এসেছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে। এখন যার ইচ্ছা তা মান্য করবে আর যার ইচ্ছা তা অমান্য করবে, অস্বীকার করবে।”—( আয়াত নং ২৮, ২৯ )

 

 কোন ব্যক্তি যখন আল্লাহর দীনের প্রচারের জন্য বের হয়ে যায় তখন তাঁর আকংখা থাকে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর ডাকে সাড়া দিক। তাহলে তাঁর আগমনে কোথাও দীনের কাজের প্রসার ঘটবে। এই অবস্থায় যখন গরীব ও দুর্বল লোকেরা, যাদের সমাজে বিশেষ কোন পদমর্যাদা নেই, এসে তাঁর আহবানে নিজের উৎসাহ প্রকাশ করে এবং এ কাজের জন্য নিজেকে পেশ করে দেয়- তখন সে চিন্তা করে এই যেসব লোকের সমাজে কোন স্থান নেই তাঁদের নিয়ে আমি কি করবো? এরা যদি ভেড়ার পালের মতোও জমা হয়ে যায় তবুও এসব গুরুত্বহীন লোকের দ্বারা দীনের আর কি প্রসার ঘটবে? দীনের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী লোকের এরূপ চিন্তা আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় নয়। এজন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করলেন যে, তিনি যেন ঈমান গ্রহণকারী সাধারন মর্যাদা সম্পন্ন গরীব লোকদের কম গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন মনে না করেন, তিনি যেন তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করে থাকেন, তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি যেন তাঁদের উপেক্ষা করে বড় বড় শেখ ও প্রতিপত্তিশীল লোকদের দলে আনার চিন্তায় বিভোর না হয়ে যান।

 

মক্কার কাফেরদের নেতারাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রুপ করে বলতো- কৈ তাঁর উপর তো মক্কার কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক ঈমান আনছে না, জাতির বিচক্ষন ও প্রভাবশালী লোক- যাদের কাছে লোকেরা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারের ফায়সালার জন্যে আসে, তাঁদের কেউই তো তাঁর সাথে নেই। এই নীচু শ্রেনীর লোকেরাই তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তিনি মনে করেছেন এদের নিয়েই তিনি দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে দেবেন। তাঁদের এই বিদ্রুপের জবাবে এই কথা বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সেই মূলত মূল্যবান মানুষ। যে ব্যক্তি ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে না জ্ঞানী হতে পারে আর না কোন নেতা বা শেখ হতে পারে। আজ যদিও কোন ব্যক্তি শেখ হয়ে আছে কিন্তু আগামীকাল তাঁর এই শেখগীরি খতম হয়ে যাবে এবং এই মর্যাদাহীন, দুঃস্থ গরীব লোকেরাই তাঁদের গদি উলটিয়ে দেবে। এ জন্য বলা হয়েছে, যেসব লোক তোমার দলে এসে গেছে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং তাঁদের দিক থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই দুর্দশাগ্রস্ত মুহাজিরদের দেখলেন যে, তারা কতটা আগ্রহ ও ভালবাসার সাথে কুরআন পড়া শুনছেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া তিনি এমন লোকদের আমার সঙ্গী করেছেন যাদের সাথে আমাকেও সবর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জন্য শুকরিয়া আদায় করলেন যে, তাঁর সাথে এমন লোকেরা এসে গেছে যাদের মধ্যে এই যোগ্যতা বর্তমান রয়েছে এবং তারা এতটা মজবুত ঈমানের অধিকারী যে আল্লাহর দীনের খাতিরে নিজেদের বাড়িঘর, সন্তান-সন্তুতি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে।

 

অতপর নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মুহাজিরদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং তারা সম্পদশালী লোকদের চেয়ে পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের শান্তনার বানী শুনিয়ে দিলেন, আল্লাহর দীনের খাতিরে তোমরা যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করছ, যে ভয়-ভীতির মধ্যে তোমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যে জন্য তোমরা তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছো এবং দুঃখ-দারিদ্রকে আরাম-আয়েশের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছ- এর বিনিময়ে তোমাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে যে, তোমরা কিয়ামতের দ্বীন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং ধনী লোকদের অর্ধদিন আগে বেহেশতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে। কিয়ামতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান।

 

 আখেরাতের অর্ধদিন এবং এটা দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান হওয়ার তাৎপর্য কোন ব্যক্তিই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। ঐ জগতের সময়ের মানদণ্ড এই দুনিয়ার চেয়ে ভিন্নতর এবং প্রতিটি জগতেই সময়ের মানদণ্ড ভিন্নরূপ- একথা হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের উল্লেখ করেছেন। এ জন্য এর খোঁজখবর ও অযথা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লিপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একথা সেখানে গিয়েই জানা যাবে সেখানকার সময় এবং কালের অর্থ কি এবং এর মানদণ্ডই বা কি?

\r\n\r\n

সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো

 

৫৫। হযরত বারাআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা সর্বাধিক সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো।           ( আহমাদ, আবু দাউদ, দারেমী )

 

অর্থাৎ যতদূর সম্ভব সুন্দর উচ্চারন ভঙ্গিতে এবং মার্জিত আওয়াজে কুরআন শরীফ পাঠ করো। এমন অমার্জিত পন্থায় পাঠ করোনা যার ফলে অন্তর কুরআনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবর্তে আরো দূরে চলে যায়।

\r\n\r\n

কুরআন পড়া শিখে তা ভুলে যাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার

 

আরবী***

 

৫৬। হযরত সা’দ ইবনে উ’বাদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ার পর তা ভুলে যায়- সে কিয়ামতের দিন কুষ্ঠ অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাযির হবে। ----( আবু দাউদ, দারেমী )

 

 হাদীস বিশারদগণ বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসে কুষ্ঠ হওয়ার অর্থ শুধু দৈহিকভাবে কুষ্ঠ হওয়া নয়, বরং একথা প্রবাদ বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে এবং এর অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ অসহায়। যেমন আমরা বলে থাকি, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। মূলত মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি। বরং মানুষের ঘাড়ে কঠিন বিপদ এসে চাপলেই এরূপ বলা হয়। অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় কারো অসহায়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলা হয়ে থাকে- তাঁর হাত কাঁটা। ইতিপূর্বে একটি হাদীসে এসেছে, “আল কুরআনু হুজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন তোমার পক্ষে প্রমান হবে বা বিপক্ষে প্রমান হয়ে দাঁড়াবে। এখন এমন এক ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন যার ঈমান আছে এবং সেই ঈমানের ভিত্তিতে সে কুরআন পাঠ করেছে কিন্তু তা পড়ার পর ফের ভুলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর কাছে এমন কোন প্রমান অবশিষ্ট আছে যা সে আল্লাহর দরবারে পেশ করবে? কুরআন ভুলে যাওয়ার পর তো তাঁর প্রমান তাঁর হাত থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তাঁর কাছে এমন কোন জিনিস নেই যা সে নিজের নির্দোষিতার স্বপক্ষে পেশ করবে। এ হচ্ছে সেই অসহায় অবস্থা- কিয়ামতের দিন সে যাতে লিপ্ত হবে। এটা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সে হাত কাটা অবস্থায় উঠবে।

\r\n\r\n

তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম করোনা

 

আরবী***

 

৫৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করেছে সে কুরআন বুঝেনি। -----( তিরমিযি, আবু দাউদ, দারেমী )

 

   অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে গোটা কুরআন খতম করে ফেলে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, সে কুরআনের কি বুঝল? এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে- কমপক্ষে তিন দিনে কুরআন খতম করো। এর চেয়ে অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম করতে পারলে তা আরো ভালো, কিন্তু এর কম সময় নয়। কেননা যদি কোন ব্যক্তি দৈনিক দশপারা কুরআন মধ্যম গতির চেয়েও দ্রুত পাঠ করে তাহলে সে এ অবস্থায় কুরআনের কিছুই বুঝতে পারবে না।

\r\n\r\n

প্রকাশ্যে অথবা নিরবে কুরআন পড়ার দৃষ্টান্ত

 

আরবী***

 

৫৮। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আওয়াজে কুরআন পাঠ করে সে ঐ ব্যক্তির মতো যে প্রকাশ্যে দান- খয়রাত করে। আর যে ব্যক্তি নিরবে কুরআন পাঠ করে সে গোপনে দান- খয়রাতকারীর সাথে তুল্য। --( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

 

  অর্থাৎ নিজ নিজ স্থানে উভয় পন্থায়ই কুরআন পাঠ করার সওয়াবও লাভ হয় এবং উপকারও হয়। কোন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে দান খয়রাত করে তাহলে অন্যদের উপরও তাঁর প্রভাব পড়তে পারে এবং তাদেরও দানখয়রাত করার দিকে মনোনিবেশ বাড়তে পারে। তাঁদের অন্তরেও আল্লাহর রাস্তায় দানখয়রাত করার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যদি গোপনে দানখয়রাত করে তাহলে তাঁর মধ্যে নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সৃষ্টি হয় এবং সে রিয়াকারী বা প্রদর্শনেচ্ছা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কুরআন পাঠ করার মধ্যে ফায়দা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বান্দাদের পর্যন্ত এর শিক্ষা পৌছে যায় এবং লোকদের মাঝে কুরআন পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট আওয়াজে বা গোপনে কুরআন পড়ার ফায়দা হচ্ছে এই যে, এভাবে কোন ব্যক্তি ইখলাছ ও নিষ্ঠা সহকারে এবং প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য কুরআন পাঠ করতে পারে এবং এর মধ্যে অন্য কোনরূপ আবেগের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না।

\r\n\r\n

কুরআনের উপর কার ঈমান গ্রহণযোগ্য  

 

৫৯। হযরত সুহাইব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে কুরআনের হারাম করা জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে- সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। -------------  ( তিরমিযি )   

 

  কুরআন যে আল্লাহর কালাম- এর উপর ঈমান আনা এবং কুরআনে হারাম ঘোষিত জিনিসকে হালাল বানানো— এ দুইটি জিনিস একত্রে জমা হতে পারে না। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা মানুষের কাছে কতিপয় গ্রহন করার এবং কতিপয় জিনিস পরিত্যাগ করার দাবী করে। যে ব্যক্তি কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে এবং সে কুরআনকে বাস্তবিকই আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে—তাঁর জীবন যাপন থেকে এর কোন প্রমান পাওয়া যায় না—তাঁর কুরআন মানার দাবী করার এবং তা পাঠ করার ফায়দা কি   আছে?   

\r\n\r\n

নবী ( সাঃ ) এর কিরআত পাঠের ধরন

 

আরবী***

 

৬০। হযরত ইয়া’লা ইবনে মামলাক ( তাবেয়ী ) থেকে বর্ণিত। তিনি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে কিরআত পাঠ করতেন? তখন উম্মে সালামা এমনভাবে কুরআন পাঠ করে শুনালেন যাতে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে কানে আসলো। ------ ( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

 

 অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না, বরং তিনি এমনভাবে কুরআন পাঠ করতেন যে, লোকেরা প্রতিটি অক্ষর পরিস্কার শুনতে পেতো। সামনের হাদীসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসবে।

 

আরবী****

 

৬১। হযরত উম্মে সালমা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুকরা টুকরা করে কুরআন পাঠ করতেন ( অর্থাৎ প্রতিটি বাক্য পৃথক পৃথক করে পড়তেন- অতঃপর থামতেন। ) ---- ( তিরমিযি )

 

  এখানে আরো পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে বা তাড়াহুড়া করে কুরআন পাঠ করতেন না। অর্থাৎ তিনি একই নিঃশ্বাসে “আলহামদু লিল্লাহ থেকে অলাদ দয়াল্লিন” পর্যন্ত পড়ে ফেলতেন না। বরং প্রতিটি বাক্যের শেষে বিরতি দিতেন।

\r\n\r\n

কতিপয় লোক কুরআনকে দুনিয়া লাভের উপায় বানিয়ে নেবে

 

আরবী***

 

৬২। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে আসলেন। আমরা তখন বসে কুরআন পাঠ করছিলাম। আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং অনারব লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কুরআন পাঠ শুনে বললেন-  পড়ে যাও,  তোমাদের সকলের পাঠই সুন্দর। অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা খুবই শুদ্ধভাবে এমন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করবে যেভাবে তীর লক্ষ্য ভেদ করার জন্য সোজা করা হয় কিন্তু এর দ্বারা তাঁদের পার্থিব স্বার্থ লাভই হবে উদ্দেশ্য, আখেরাত লাভ তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। ---------- ( আবু দাউদ, বায়হাকী )

 

 যাবের ( রাঃ ) এই যে বললেন, আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং ভিন্ন ভাষাভাষী লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সবাইকে বললেন, পড়ে যাও, সবাই সঠিক পড়ছ—তিনি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, যেহেতু এই জামায়াতে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্রের লোক ছিল এজন্য তাঁদের পাঠের ধরণও পৃথক পৃথক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের সকলের পাঠের সৌন্দর্য বর্ণনা করলেন। বাহ্যত তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় সঠিক উচ্চারনে এবং সঠিক ভঙ্গিতে কুরআন পাঠকারী ছিলেন না। আর প্রত্যেক ব্যক্তির কণ্ঠও সুমধুর ছিল না। তাছাড়া তাঁদের কারো কারো ভাষা ও উচ্চারন ভংগির মধ্যে ত্রুটিও থাকতে পারে। এজন্য তাঁদের কুরআন পাঠের পদ্ধতি ও ভংগির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান থাকাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের দেখে বললেন, তোমরা সকলেই সঠিকভাবে পাঠ করছ এবং তোমরা এই উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করছ যে, তোমরা দুনিয়াতে তদানুযায়ী জীবন যাপন করবে। এজন্য তোমরা সঠিক অর্থে কুরআন পাঠ করার হক আদায় করছ, তোমাদের পাঠ সম্পূর্ণ ঠিক আছে। চাই তোমরা উন্নত পর্যায়ের তাজবীদ শাস্ত্র জানো বা নাই জানো এবং কিরআত পাঠের নীতিমালা সঠিক এবং উত্তম পন্থায় তা পাঠ করে থাক বা না থাকো। এমন একটি সময় আসবে যখন কুরআন ঠিকই পড়া হবে, তা সঠিক কায়দা-কানুন এবং তাজবীদে শাস্ত্রের উত্তম নীতিমালা অনুযায়ী সঠিকভাবে পড়া হবে—যেমন লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার জন্য তীর সোজা করা হয়। কিন্তু তাঁদের এ পাঠের উদ্দেশ্য হবে সামান্য পার্থিব স্বার্থ লাভ করা, আখেরাত লাভ করা তাঁদের উদ্দেশ্য হবে না। অতএব তাঁদের এই পাঠ মোটেই কোন কাজে আসবে না। অবশ্য তোমাদের এই পাঠ একজন সাধারন গ্রাম্য লোকের পাঠের মতো যতই নিম্নমানের হোক না কেন—তাই কাজে আসবে। মূলত এই পাঠই আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় হবে। সুতরাং তোমাদের সকলের কুরআন পড়াই সুন্দর।  

\r\n\r\n

গান ও বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করোনা

 

আরবী***

 

৬৩। হযরত হুজাইফা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা আরবদের স্বরে এবং সুরে কুরআন পাঠ করো। কিন্তু সাবধান, আহলে ইশক এবং দুই আহলে কিতাব ( ইহুদী-খ্রিস্টান ) সম্প্রদায়ের স্বরে এবং সুরে মতো নয়। অচিরেই আমার পরে এমন একদল লোকের আগমন ঘটবে যারা গানের সুরে বা বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করবে। কুরআন তাঁদের কণ্ঠনালীর নীচে পৌছবে না। তাঁদের অন্তর দুনিয়ার প্রতি মহগ্রস্ত হয়ে থাকবে এবং যারা তাঁদের পদ্ধতিকে অনুসরন করবে তাদের অন্তরও। --- ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

 আরবী স্বরে এবং আরবী সুরে কুরআন পাঠ করার তাকীদ করার অর্থ এই নয় যে, অনারব লোকেরাও আরবদের সুরে এবং স্বরে কুরআন পাঠ করবে। মূলত একথার দ্বারা যা বুঝানো উদ্দেশ্য তা হচ্ছে- কোন আরব যখন কুরআন পাঠ করে সে এমনভাবে পাঠ করে যেমন আমরা আমাদের ভাষায় কোন বই পড়ে থাকি। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন নিজের ভাষায় কোন বই পড়েন তখন আপনি তা ইনিয়ে বিনিয়ে এবং গানের সুরে পাঠ করেন না। বরং নিজের ভাষার বই পুস্তক যেভাবে পাঠ করার নিয়ম সেভাবেই পাঠ করেন। অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার অর্থ হচ্ছে- কুরআন এমন সহজ সরল ও স্বভাবগত পন্থায় পাঠ করবে যেভাবে একজন আরবী ভাষী ব্যক্তি তা পাঠ করে থাকে। ইতপুরবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বানী উল্লেখিত হয়েছে- “কুরআনকে তোমাদের উত্তম স্বরে সৌন্দর্যমণ্ডিত করো”। অতএব বুঝা যাচ্ছে উত্তম সুরে পড়া এবং আরববাসীদের মতো সাদাসিধাভাবে কুরআন পাঠ করার অর্থ একই। কেননা সাদাসিদাভাবে কুরআন পড়ার অর্থ এই নয় যে, কোন ব্যক্তি বেমানানভাবে এবং ভয়ংকর শব্দে কুরআন পাঠ করবে।

 

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- সাবধান, আহলে ইশকের স্বরে কুরআন পাঠ করো না। অর্থাৎ গায়করা যেভাবে মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে- অনুরূপভাবে কুরআন পাঠ করো না।

 

অতঃপর তিনি বলেছেন, অচিরেই এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআনকে গানের সুরে পড়বে অথবা স্ত্রীলোকদের মতো বিলাপের সুরে পড়বে। কিন্তু এই পড়া তাঁদের কণ্ঠনালীর নিচে নামবে না। অর্থাৎ তাঁদের অন্তর পর্যন্ত কুরআনের আবেদন পৌছবেনা। শুধু তাই নয়, বরং তাঁদের অন্তঃকরণ দুনিয়াবী চিন্তায় লিপ্ত থাকবে। এবং তাঁদের অন্তঃকরনও যারা তাঁদের পাঠ শুনে দোল খেতে থাকে আর বলে সুবহানাল্লাহ।

 

 নবী ( সাঃ ) এ ধরনের কুরআন পাঠকারী এবং তা শুনে মাথা দোলানো ব্যক্তিদের এ জন্য সতর্ক করেছেন যে, এই কুরআন কোন কবিতার বই নয় যে, বসে বসে তা শুনবে এবং প্রশংসার স্তবক বর্ষণ করবে আর মারহাবা মারহাবা প্রতিধ্বনি তুল্বে। বর্তমানে আমাদের এখানে কুরআন পাঠের মজলিশে যেমনটা হচ্ছে। কখনো কখনো তো এসব মাহফিলের অবস্থা এমন হয়ে দাড়ায় যেন কবিতার আসর বসছে আর কি? এই পন্থা ত্রুটি মুক্ত নয়।

\r\n\r\n

সুমধুর সুরে কুরআন পাঠ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে

 

আরবী***

 

৬৪। হযরত বারাআ ইবনে আযেব  (রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকে বলতে শুনেছি- তোমরা নিজেদের উত্তম কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করো। কেননা সুমধুর স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ------------ ( দারেমী )

 

  এ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হাদীস এসেছে। কোনটিতে যদি গানের সুরে কুরআন পড়তে বাঁধা দেয়া হয়েছে তাহলে অপরটিতে তা সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে জানআ গেলো, গানের সুরে পড়া এবং সুমিষ্ট আওয়াজে পড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, একটি পসন্দনীয় আর অপরটি অপসন্দনীয়।

\r\n\r\n

সুকণ্ঠে কুরআন পড়ার অর্থ কি

 

আরবী***

 

৬৫। হযরত তাউস ইয়েমেনী মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি কুরআনকে উত্তম স্বরে উত্তম পন্থায় পাঠকারী? তিনি বললেন- যে ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনে তোমার এমন ধারনা হবে যে, আল্লাহকে ভয় করছে। --------- ( দারেমী )

 

  দেখুন, এখানে সুকণ্ঠে কুরআন পাঠ করার অর্থকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন বললেন- কুরআনকে সুমধুর আওয়াজ দ্বারা সৌন্দর্য মণ্ডিত করো এবং তা সুমিষ্ট স্বরে পাঠ করো, কিন্তু গানের সুরে পড়না- তখন লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, সুমিষ্ট স্বরে কুরআন পাঠ করার অর্থ কি? এরপর তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন- কুরআনকে এমন ভঙ্গীতে পাঠ করো যেন শ্রোতা স্বয়ং অনুভব করতে পারে যে, তুমি খদাকে ভয় করছ। খোদার ভয়শূন্য হয়ে মানুষ যখন কুরআন পাঠ করে তখন তাঁর অবস্থা ভিন্নরূপ হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করে এবং খোদার ভয় জাগ্রত রেখে পাঠ করে তাঁর অবস্থা হবে অন্যরকম। যে প্রতিটি জিনিসের প্রভাবকে গ্রহন করে কুরআন পাঠ করে। তাঁর পাঠের ধরন এবং মুখের ভংগি থেকেই তাঁর এই খোদাভীতির  প্রকাশ ঘটে।   

\r\n\r\n

কুরআনকে পরকালীন মুক্তির উপায় বানাও

 

আরবী***

 

৬৬। হযরত আবীদাহ মুলাইকী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আহলে কুরআন, ( কুরআন পাঠকারীগণ) কুরআনকে কখনো বালিশ বানাবে না, বরং দিনরাত তা পাঠ করবে। যেভাবে পাঠ করলে এর হক আদায় হয়- সেভাবে পাঠ করবে। তা প্রকাশ্যভাবে এবং সুললিত কণ্ঠে পাঠ করবে। এর মধ্যে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে তা নিয়ে গভীরভাবে চিনাত- ভাবনা করবে। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। তাঁর সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। কেননা এর সওয়াব           ( আখেরাতে )  অবশ্যই পাওয়া যাবে। --( বায়হাকী )

 

বলা হয়েছে- ‘কুরআনকে বালিশে পরিনত করো না’। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, মানুষ যেভাবে বালিশের উপর মাথা রেখে শোয়ার জন্য লম্বা হয়ে পড়ে যায়—অনুরূপভাবে কুরআনকে বালিশের বিকল্প বানিয়ে তাঁর উপর মাথা রেখে শুয়ে যেও না। বরং এর অর্থ পরবর্তী বাক্য থেকে পরিস্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ কুরআনের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। এরূপ অবস্থা যেন না হয় যে, নিজের কাছে কুরআন মওজুদ রয়েছে। কিন্তু নিজেই অলসতায় ডুবে রয়েছে এবং কখনো দৃষ্টি উত্তোলন করে এর প্রতি তাকায় না এবং এ থেকে পথ নির্দেশ ল্যাব করার চেষ্টাও করে না। অতঃপর বলা হয়েছে- ‘এই দুনিয়ায়ই কুরআনের সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। যদিও এর সওয়াব নিশ্চিতই রয়েছে এবং অবশ্যই তা পাওয়া যাবে।’ অর্থাৎ এই দুনিয়ায় এর সওয়াব তুমি না-ও পেতে পারো বরং এর উল্টো কোথাও তুমি এর কারনে শত্রুর কঠোরতার শিকার হয়ে যেতে পারো। কিন্তু এর সওয়াব অবশ্যই রয়েছে—যা অবশ্যই আখেরাতে পাওয়া যাবে। পার্থিব জীবনেও কখনো না কখনো এর সওয়াব মিলে যেতে পারে। কিন্তু তোমরা তা পার্থিব সওয়াব লাভের জন্য পড়ো না বরং আখেরাতের সওয়াব লাভের জন্য পাঠ করো।

\r\n\r\n

প্রাথমিক পর্যায়ে আঞ্চলিক উচ্চারনে কুরআন পাঠের অনুমতি ছিল

 

আরবী***

 

৬৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি হিশাম ইবনে হাকীম ইবনে হিযামকে ( রাঃ )  সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। কিন্তু আমার পাঠের সাথে তাঁর পাঠের গড়মিল লক্ষ্য করলাম। অথচ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এ সূরাটি শিখিয়েছেন। অতএব, আমি তাঁর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ধত হলাম। কিন্তু ( ধৈর্য ধারন করলাম এবং ) তাঁকে অবকাশ দিলাম। সে তাঁর কিরআত শেষ করলো। অতঃপর আমি তাঁর চাদর ধরে টানতে টানতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি তাঁকে সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। আপনি এ সূরাটি আমাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সে তা অন্যভাবে পাঠ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে ছেড়ে দাও। অতপর তিনি হিশামকে বললেন- পড়। সুতরাং আমি তাঁকে যেভাবে পাঠ করতে শুনেছিলাম ঠিক সেভাবেই সে তা পাঠ করলো। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরূপই নাযিল হয়েছে। অতপর তিনি আমাকে বললেন- কুরআন সাত হরফে নাযিল করা হয়েছে। অতএব যেভাবে পাঠ করা সহজ সেভাবেই তা পাঠ করো। ----- (বুখারী ও মুসলিম )

 

  ‘সাত হরফে’ অর্থ- সাত ধরনের উচ্চারন ভঙ্গি অথবা সাত ধরনের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য। আরবী ভাষায় আঞ্চলিক শব্দের পার্থক্য একটি প্রসিদ্ধ বিষয়। আরবের বিভিন্ন গোত্র ও এলাকার ভাষার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য সূচীত হয়। স্থানীয় বাক্যরীতি, উচ্চারন-ভঙ্গি, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ভাষাগত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকা সত্যেও ভাষার মৌলিক ধাঁচ এক ও অভিন্ন। ভাষার স্থানীয় ঢং এবং পার্থক্যের দৃষ্টান্ত আপনারা এখানেও পেয়ে থাকবেন। সুতরাং আপনি যদি পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় যান তাহলে দেখতে পাবেন এর প্রতিটি জেলা বরং একই জেলার বিভিন্ন অংশে ভাষার বিভিন্নতা রয়েছে। উর্দু ভাষারও একই অবস্থা। পেশোয়ার থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত চলে যান, মাদ্রাজ থেকে তাঁর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যান। উর্দুভাষীগণ একই বিষয় প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন বাক্যরীতি, উচ্চারন ভঙ্গি, প্রবাদ বাক্য ইত্যাদি ব্যবহার করে। দিল্লি, হাদ্রাবাদ, দাক্ষিণাত্য এবং পাঞ্জাবে একই উর্দু ভাষার বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। বাংলা ভাষার অবস্থাও তদ্রূপ। একই বিষয়বস্তু প্রকাশ করার জন্য কলিকাতা, গোহাটি এবং ঢাকার বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

 

আরবের আঞ্চলিক ভাষায়ও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান ছিল এবং বর্তমানেও আছে। আরবের উপদ্বীপে আপনি ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত অথবা ইয়েমেন থেকে ইরাক পর্যন্ত ভ্রমন করেন। তাঁদের উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করে থাকবেন। এই বিষয়বস্তু আরবের এক এলাকার এক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, আবার অন্য এলাকায় ভিন্নরূপে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের কারনে অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সুতরাং এই হাদীসে সাত হরফ বলতে এই উচ্চারন ভঙ্গি, বর্ণনা ভঙ্গি ইত্যাদির পার্থক্য বুঝানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআন শরীফ যদিও বা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতিতে নাযিল হয়েছে, কিন্তু আরববাসীদের স্থানীয় উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। একজন আরবী ভাষী লোক যখন কুরআন পাঠ করে তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্য বর্তমান থাকা সত্যেও অর্থ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন সূচীত হয় না। হারাম জিনিস হালাল হয়ে যাওয়া অথবা হালাল জিনিস হারাম হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তৌহিদের বিষয়বস্তু শেরেকী বিষয়বস্তুতে পরিনত হতে পারে না ।

 

কুরআন যতক্ষন আরবের বাইরে ছড়ায় নি এবং আরবরাই এর পাঠক ছিল এই অনুমতি কেবল সেই যুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে এই অনুমতি ও সুবিধা রহিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি কেন দেয়া হল তাও বুঝে নেয়া দরকার। এর কারন ছিল এই যে, তৎকালীন সময়ে লিখিত আকারে কুরআনের প্রচার হচ্ছিলো না। আরবের লোকেরা লেখাপড়াই জানতো না। অবস্থা এরূপ ছিল যে, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হাতে গনা মাত্র কয়েকজন লেখাপড়া জানা লোক ছিল। আরবে লেখাপড়ার যা কিছু রেওয়াজ ছিল তা ইসলামের আগমনের পরেই হয়েছে। সুতরাং এযুগের লোকেরা মুখে মুখে কুরআন শুনে তা মুখস্ত করে নিতো। যেহেতু তাঁদের মাতৃভাষা ছিল আরবী, এজন্য কুরআন মুখস্ত করতে এবং মুখস্ত রাখতে তাঁদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। একজন আরব যখন কুরআন শুনত তখন পুরা বিসয়বস্তুই তাঁর মুখস্ত হয়ে যেত। এরপর সে যখন অন্যদের কাছে তা বর্ণনা করতো তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্যের কারনে তাঁর বর্ণনার মধ্যে অনুরূপ ধরনের উচ্চারনগত পরিবর্তন হয়ে যেত। এতে মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য সূচীত হতো না। স্থানীয় বাক্যরীতি অনুযায়ী তারা যেভাবে পাঠ করতো বিষয়বস্তু সেভাবে বর্ণিত হতো। এর ভিত্তিতে সেই যুগে আরবদের জন্য নিজ নিজ এলাকার উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করার সুযোগ রাখা হয়েছিলো।

 

  হযরত উমর ( রাঃ ) যেহেতু মনে করেছিলেন, তিনি যেভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কুরআন শুনেছেন--ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের তা পাঠ করা উচিৎ। এজন্য তিনি যখন হিশাম ( রাঃ ) কে ভিন্ন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করতে শুনলেন তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তিনি যতো সময় ধরে পাঠ করতে থাকলেন, উমর ( রাঃ ) নিজ স্থানে ততক্ষন অস্থির অবস্থায় কাটাতে থাকেন। এদিকে তিনি কুরআন পাঠ শেষ করলেন, ওদিকে উমর তাঁর চাদর টেনে ধরলেন এবং তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এনে উপস্থিত করলেন। এখন দেখুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজে কি ধরনের ধৈর্য, বিনয়, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য ছিল। তিনি একান্তই প্রশান্ত মনে তাঁর কথা শুনলেন। তারপর অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে বুঝালেন যে, তোমরা উভয়ে যেভাবে কুরআন পাঠ করো তা সঠিক এবং নির্ভুল। আল্লাহ তায়ালা দুই ভাবেই তা পাঠ করার অনুমতি দিয়েছেন।

\r\n\r\n

দীনী ব্যাপারে মতবিরোধের সীমা এবং সৌজন্যবোধ

 

আরবী***

 

৬৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুরআন পাঠ করতে শুনলাম। এর পূর্বে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভিন্নভাবে কুরআন পড়তে শুনেছি। আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলাম এবং তাঁকে জানালাম ( এই ব্যক্তি ভিন্ন পন্থায় কুরআন পাঠ করছে )। আমি অনুভব করলাম, কথাটা তাঁর মনপুত হল না। তিনি বললেন- তোমরা উভয়ে ঠিকভাবে পাঠ করেছো। পরস্পর মতবিরোধ করো না। কেননা তোমাদের পূর্বে যেসব জাতি ধংস হয়েছে। তারা এই মতবিরোধের কারনেই ধংস হয়েছে। ----- ( সহীহ বুখারী )

 

 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে মাসউদকে বুঝালেন যে, মতবিরোধ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে শিক্ষা বা হুকুম পরিবর্তিত হয় না—তাহলে এধরনের মতবিরোধ সহ্য করতে হবে। যদি তা না করে তাহলে আপশে মাথা ফাটাফাটিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এভাবে উম্মতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা এবং বিপর্যয়ের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু যেখানে দীনের মূলনীতি অথবা দীনের কোন হুকুম পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে—সেখানে মতবিরোধ না করাই বরং অপরাধ। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে মতবিরোধ না করার অর্থ হচ্ছে--- দীনের মধ্যে তাহরিফকে ( বিকৃতি ) কবুল করে নেয়া। এটা আরেক ধরনের বিপর্যয় যার দরজা বন্ধ করে দেয়া স্বয়ং দীনের খাতিরেই প্রয়োজন।

\r\n\r\n

অবিচল ঈমানের অধিকারী সাহাবী

 

নবীর প্রিয় পাত্র খোদার অনুগৃহীত

 

আরবী****

 

৬৯। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ( একদিন ) আমি মসজিদে নববীতে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায পড়তে লাগলো। সে নামাযের মধ্যে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হল। অতপর আরো এক ব্যক্তি আসলো। সে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, প্রথম ব্যক্তির কিরআত থেকে তা ভিন্নতর ছিল। আমরা নামায শেষ করে সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম। আমি বললাম, এই ব্যক্তি এমনভাবে কিরআত পড়েছে যা আমার কাযহে সঠিক মনে হয়নি। আর এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও ভিন্ন ধরনের কিরআত পাঠ করেছে ( এটা কেমন ব্যাপার )? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়কে ( নিজ নিজ পন্থায় ) কুরআন পাঠ করার নির্দেশ দিলেন। অতএব তারা কুরআন পাঠ করলো। তিনি উভয়ের পাঠকে সঠিক বললেন। এতে আমার অন্তরে মিথ্যার এমন কুমন্ত্রনার উদ্রেক হল যা জাহেলী যুগেও কখনো আমার মনে জাগেনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আমার এ অবস্থা লক্ষ্য করলেন, তিনি আমার বুকে সজোরে হাত মারলেন, ( মিয়া, চেতন হও, কি চিন্তা করছ? )। তিনি হাত মারতেই আমি যেন ঘামে ভেসে গেলাম, আমার বুক যেন চৌচির হয়ে গেলো এবং ভয়ের চোটে আমার মনে হল যেন আমি স্বয়ং আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন- হে উবাই, আমার কাছে যখন কুরআন পাঠানো হয় তখন আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, আমি যেন তা এক হরফে ( একই উচ্চারন ভঙ্গিতে ) পাঠ করি ( এবং সেটি ছিল কুরাইশদের উচ্চারন ভংগি )। আমি প্রতি উত্তরে বললাম, আমার উম্মতের সাথে নমনীয় ব্যবহার করা হোক। অতপর আআমকে দ্বিতীয়বার বলা হল, দুই হরফে কুরআন পাঠ করতে পারো। আমি প্রতি উত্তরে আরজ করলাম, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। তৃতীয় বারের জবাবে বলা হল, আচ্ছা কুরআনকে সাত রকমের    ( আঞ্চলিক ) উচ্চারন ভঙ্গিতে পাঠ করতে পারো। আরো বলা হল, তুমি যতবার আবেদন করেছো ততবারই জবাব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তোমাকে তিনটি দোয়া করারও অধিকার দেয়া হল, তুমি তা এখন করতে পারো ( এবং তা কবুল করা হবে ) এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন, হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন ”। আর তৃতীয় দোয়াটি আমি সেদিনের জন্য রেখে দিয়েছি যেদিন সমস্ত সৃষ্টিকুল আমার শাফায়াত লাভের আশায় চেয়ে থাকবে—এমনকি ইবরাহীমও ( আঃ )। ---------- ( সহীহ মুসলিম )

 

  হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেহায়েত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী ছিলেন। তিনি প্রবীন এবং প্রাজ্ঞ সাহাবাদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে জানতেন যে, কার মধ্যে কি যোগ্যতা এবং কামালিয়াত রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের কামালিয়াত ছিল এই যে, তাঁকে কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী মনে করা হতো। এই উবাই ইবনে কা’বের সামনেই এমন ঘতাওনা ঘটলো যে, দুই ব্যক্তি ভিন্ন দুই পন্থায় কুরআন পাঠ করলো যা তাঁর জানামতে সঠিক ছিল না। তিনি তাঁদের উভয়কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির করলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়ের পাঠকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অন্তরে এক কঠিন এবং মারাত্মক অসওয়াসার ( বিভ্রান্তি ) উদ্রেক হয়। তা এতই মারাত্মক ছিল যে, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জাহেলী যুগেও এতো জঘন্য বিভ্রান্তি আমার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি যা এসময় আমার মধ্যে উদয় হয়েছিলো। তাঁর মনে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো তা হচ্ছে- এই কুরআন কি খোদার তরফ থেক এসেছে না কোন মানুষের রচিত জিনিস—যা পাঠ করার ব্যাপারে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে।

 

অনুমান করুন, এই হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ ধরনের একজন সুউচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর মনে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামগনও মূলত মানুষই ছিলেন, ফেরেশতা ছিলেন না এবং মানবীয় গুনাবলী থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন না। তাঁদের কামালিয়াত ছিল এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থেকে কোন মানুষ যতটা উত্তম ফায়দা উঠাতে পারে তা তারা উঠিয়েছেন। তাঁর প্রশিক্ষনের আওতায় সাহাবাদের এমন একটি দল তৈরি হয়ছিল যে, মানব জাতির ইতিহাসে কখনো এ ধরনের মানুষ দেখা যায় নি। কিন্তু তা সত্যেও তারা তো মানুষই ছিলেন। এজন্য যখন এমন একটি ব্যাপার সামনে আসলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া আল্লাম ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় দুই ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনছেন আবার দুটোকেই সহীহ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তখন হঠাৎ করে ঐ সাহাবীর মনে এমন খেয়াল আসলো যার উল্লেখ আলোচ্য হাদীসে রয়েছে।

 

 এখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি দেখুন। মুখমন্দলের অবস্থা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মনে কি সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সাথে সাথে তিনি তাঁকে সাবধান এবং সতর্ক করার জন্য তাঁর বুকে হাত মারলেন, মিয়া, সচেতন হও। কি চিন্তায় মগ্ন হয়েছ?

 

একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, মনের মধ্যে অসওয়াসা সৃষ্টি হলেই মানুষ কাফের হয়ে যায় না এবং গুনাহগারও হয় না। অসওয়াসা এমন এক মারাত্মক জিনিস যে, আল্লাহ তায়ালা যদি তা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে বাঁচার উপায় আছে, অন্নথায় কোন মানুষই তা থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে, সাহাবাগন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে আরজ করতেন, হে আল্লাহর রাসুল, কখনো কখনো আমাদের মনের মধ্যে এমন সংশয় সৃষ্টি হয় যে, তাতে আমাদের মনে হয় আমাদের পরিনতি খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের আখেরাত নষ্ট হয়ে গেছে। একথার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আসল ব্যাপার তা নয় যে, তোমাদের মনে অসওয়াসা আসবে না। বরং আসল ব্যাপার হচ্ছে তা এসে তোমাদের মনে যেন স্থায়ী হতে না পারে। কোন খারাপ ধারনা মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে তা শেষে হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার দরবারে এজন্য পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যদি নিকৃষ্ট খেয়াল আসার পর তোমরা এটাকে নিজেদের মনে স্থান দাও এবং এর পোষকতা করতে থাকো, তাহলে এটা এমন জিনিস যা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে।

 

  হযরত উবাই ইবনে কা’বের মনের মধ্যে একটি ঘৃণ্য এবং বিপর্যয়কর অসওয়াসা সৃষ্টি হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথেই অনুভব করলেন যে, তাঁর মনে এই অসওয়াসা এসেছে। এজন্যে তিনি তাঁর বুকে চপেটাঘাত করলেন। তিনি চপেটাঘাত করতেই উবাই ( রাঃ ) সংবিত ফিরে পেলেন এবং সাথে সাথে তিনি অনুভব করতে পারলেন যে, আমার মনে কতো নিকৃষ্ট অসওয়াসা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, এটা অনুভব করতেই আমার মনের মধ্যে এমন কম্পন সৃষ্টি হল, মনে হল আল্লাহ তায়ালা আমার সামনে উপস্থিত এবং ভয়ের চোটে আমার ঘাম ছুটে গেলো।

 

তাঁর এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া মূলত তাঁর অবিচল ঈমান এবং পূর্ণতার আলামত বহন করে। তাঁর ঈমান যদি এই পর্যায়ের শক্তিশালী না হতো তাহলে তাঁর মধ্যে এরূপ কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

 

কোন ব্যক্তির ঈমান যদি মজবুত হয় এবং তাঁর অন্তরে কোন খারাপ অসওয়াসা আসে তাহলে সে কেপে যাবে এবং সে দ্রুত নিজের ভ্রান্তি বুঝতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যক্তির ঈমানে যদি বক্রতা থেকে থাকে তাহলে তাঁর অন্তরে খারাপ অসওয়াসা আসবে এবং তা তাঁর ঈমানকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে চলে যাবে। অতপর সে নিজের ঈমানের দুর্বলতার কারনে এ ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যাবে। অতপর সেই কুমন্ত্রনা আবারো তাঁর মনে জাগ্রত হবে এবং তাঁর ঈমানকে আর একটা নাড়া দিয়ে চলে যাবে। এমনকি একসময় তাঁর পুরা ঈমানকেই নড়বড় করে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু মজবুত এবং সবল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তির অবস্থা এরূপ হয় না। সে কুমন্ত্রনা জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যায়। হযরত উবাই ইবনে কা’বের   ( রাঃ ) প্রতিক্রিয়া সেকথারই সাক্ষ্য বহন করে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের ( রাঃ ) সতর্ক হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বুঝানোর পর পরিস্কার করে বললেন, প্রথমে কুরআন মাজীদ যখন নাযিল হয় তখন তা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভংগি অনুযায়ী নাযিল হয়। এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মাতৃভাষা ছিল। কিন্তু তিনি নিজে আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করলেন যেন তা অনুরূপ উচ্চারন ভংগিতেও পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়। আবেদনের ভাষা ছিল নিম্নরুপঃ “হাব্বেন আলা উম্মাতি----- আমার উম্মাতের সাথে নম্র ব্যবহার করুন।” তাঁর অনুভূতি ছিল, আমার মাতৃভাষা সাড়া আরবে প্রচলিত ভাষা নয়, বরং বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী গোত্র সমূহের মধ্যে কিছুটা স্থানীয় বাক্যরীতিরও উচ্চারন প্রচলিত রয়েছে। এজন্য সব লোকের জন্য যদি কেবল কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত ভাষার রীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয় তাহলে তারা কঠিন পরিক্ষায় নিমজ্জিত হবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা হোক। সুতরাং প্রথম আবেদনের জবাবে দুই রকম বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল।

 

নিজ বান্দার সাথে আল্লাহ তায়ালার ব্যবহারও আশ্চর্যজনক। প্রথম দফা দরখাস্তের জবাবে সাত রকম পন্থায় কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় নি। অথচ সাত রকম পন্থায় পাঠ করতে দেয়ার ইচ্ছাই ছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফা আবেদন করার অপেক্ষা করলেন। এভাবে একদিকে মনে হয়, রাসুলুল্লাহকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল যে, নবী হিসাবে তাঁর মধ্যে নিজের দায়িত্ব পালনের কতটা অনুভূতি রয়েছে। এজন্য প্রথমে একক ভংগিতেই কুরআন নাযিল করা হয়। কিন্তু যেহেতু তাঁর মনে এই অনুভূতি জাগ্রত ছিল যে, আরবের লোকদের হেদায়াত করাই আমার সর্ব প্রথম দায়িত্ব। আর আরবদের ভাষায় স্থানীয় পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। যদি কুরআন মাজীদের একটি মাত্র অঞ্চলের বাক্যরীতি অনুযায়ী পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে লোকেরা কঠিন বিপদে পড়ে যাবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। জবাবে দুই আঞ্চলিক রীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। তিনি পুনরায় আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে আরো নম্র ব্যবহার করা হোক। এভাবে তাঁর দুই দফা আবেদন করার পর সাত রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। এরপর আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, যেহেতু তুমি আমার কাছে তিনবার দরখাস্ত করেছো এবং আমি তিনবারই জবাব দিয়েছি—এজন্য এখন তোমাকে আমার কাছে অতিরিক্ত তিনটি দোয়া করার অনুমতি সেয়া হল। পরম দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান করার এই ধরন আপনি লক্ষ্য করুন। এ জিনিসটিকেই তিনি কুরআন মাজীদে বলেছেন-

 

“রহমাতী অয়াসিয়াত কুল্লা শাইয়েন------ আমার অনুগ্রহ প্রতিটি সৃষ্টির উপর প্রসারিত হয়ে আছে।” ( সূরা আরাফ ; ১৫৬ )

 

এই হচ্ছে রহমতের ধরন যে, তুমি যেহেতু তোমার উম্মতের সাথে নম্র ব্যবহার করার জন্যে আমার কছে তিনবার আবেদন করেছে—তাই তোমার দায়িত্ব পালনের এ পদ্ধতি আমার পছন্দ হয়েছে। এজন্য তোমাকে এখন আরো তিনটি আবেদন করার অধিকার দেয়া হল। আমি তা অবশ্যই কবুল করবো।

 

 এখন দেখুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইবার দোয়া করে তৃতীয় বারের দোয়াটি আখেরাতের জন্য হাতে রেখে দিয়েছেন। অন্য দুটি দোয়াও তিনি কোন পার্থিব স্বার্থ, ধন-দৌলত এবং ক্ষমতা ও কৃতিত্ব হাসিল করার জন্য করেন নি। বরং তিনি দোয়া করলেন, আমার উম্মতের সাথে ক্ষমা সুন্দর ব্যবহার করা হোক। তিনি বলেছেন- “ইগফিরলি উম্মাতি------ আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন।” আরবী ‘মাগফিরাত’ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে ক্ষমা করা, অপরাধ উপেক্ষা করা, অপরাধ দেখেও না দেখা ইত্যাদি।  ‘মিগফার’ বলা হয় এমন শিরস্ত্রানকে যা মাথাকে ঢেকে রাখে, গোপন করে রাখে। সুতরাং ‘ইগফিরলি উম্মাতি’- বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে- আমার উম্মাতের সাথে ক্ষমা, নম্রতা ও উদারতা পূর্ণ ব্যবহার করা হোক।

 

এরকম ব্যবহার তো হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তি অপরাধ করলো এবং দ্রুত তাঁকে শাস্তি দেয়া হল। আরেক রকম ব্যবহার হচ্ছে এই যে, আপনি অপরাধ করেছেন আর আপনার অপরাধকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং আপনাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি পুনরায় অপরাধ করছেন এবং আপনাকে সংযত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এভাবে পুনঃ পুনঃ আপনার অপরাধ উপেক্ষা করে আপনাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি যেন শেষ পর্যন্ত সংশোধন হতে পারেন এবং নিজেকে সংযত করতে পারেন।

 

ঘটনা হচ্ছে, মুসলমান যে জাতির নাম—তাঁদের কাছে আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ কালাম কুরআন মাজীদ অবিকল মওজুদ রয়েছে। এর মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন প্রকার রদবদল হতে পারেনি। আবার মুসলমানরাই সেই জাতি যাদের কাছে মহানবী ( সাঃ ) এর সীরাত, তাঁর বানী এবং তাঁর পথনির্দেশ অবিকল ও অপরিবর্তিত অবস্থায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত আছে। তাঁদের খুব জানা আছে হক কি এবং বাতিল কাকে বলে। তারা এও জানে যে, আমাদের কাছে আমাদের প্রতিপালকের দাবী কি। আমাদের প্রিয় নবী ( সাঃ ) কোন পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের একটি জাতি যদি ব্যক্তিগতভাবে অথবা সামস্টিগতভাবে নাফরমানী বা অসাদাচরন করে বসে কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ডলে- পিষে শেষ করে না দেন--- তাহলে এটা তাঁর সীমাহীন রহমত, বিরাট ক্ষমা এবং অনুগ্রহ ছাড়া আর কি? এক ধরনের অপরাধ তো হচ্ছে- অপরাধী জানতেই পারেনা যে, সে অপরাধ করেছে এবং সে আবারো অপরাধ করে বসলো। এ অবস্থায় সে এক ধরনের নম্র ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। কিন্তু এক ব্যক্তির জানা আছে আইন কি? এই আইনের দৃষ্টিতে কোন জিনিসটি অপরাধ তা তাঁর জানা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আইন ভঙ্গ করে। এর অর্থ হচ্ছে- এই ব্যক্তি কঠোর শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। বর্তমান কালের মুসলমানদের দৃষ্টান্ত হল এটাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখুন আজ তের- চৌদ্দশত বছরে আল্লাহ তায়ালার ব্যাপক শাস্তি আজ পর্যন্ত মুসলমানদের উপর নাযিল হয়নি। যদিও কোন কোন স্থানে পরীক্ষামুলক ভাবে বিপর্যয় এসেছে তবে অন্য স্থান সামলিয়ে নিয়েছে। এতো সেই দোয়ারই ফল যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করেছিলেন- আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন, তাঁদের অপরাধ উপেক্ষা করুন, তাঁদের সাথে কঠোরতা না করুন। সুতরাং তাঁর সেই দোয়া বাস্তবিকই কবুল হয়েছে।

 

এখানে একথাও ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, ‘ইগফির লি উম্মাতি’ বাক্যের দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কখনো উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমার উম্মত যে কোন ধরনের খারাপ কাজই করুক না কেন তা সবই ক্ষমা করে দেয়া হবে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তির নিজের কাধে বকরী বহন করে নিয়ে আসবে তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। সে আমাকে দাকবে – ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া রাসুলুল্লাহ।। -- আমি তাঁকে কি জবাব দেব? আমি বলব- এখন আমি তোমার কোন উপকারে আসবো না। কারন পূর্বেই আমি তোমার কাছে খোদার বিধান পৌছে দিয়েছি।” অর্থাৎ তোমরা যদি এমন অপরাধ করে আসো যার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিৎ--- তাহলে তোমরা আমার শাফায়াত লাভের অধিকারী হতে পারবে না। কিয়ামতের দিনের শাফায়াতের অর্থ এই নয় যে, সে যেহেতু আমার লোক, সুতরাং দুনিয়াতে জুলুম- অত্যাচার করেই আসুক না কেন জনগনের অধিকার আত্মসাৎ করেই আসুক না কেন কিন্তু তাঁকে ক্ষমা করিয়ে দেয়া হবে। আর অন্যরা জুলুম করলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতের অর্থ কখনো এটা নয়।

\r\n\r\n

পঠন ভঙ্গির পার্থক্যের কারনে অর্থের কোন পার্থক্য হয় না

 

আরবী***

 

৭০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- জিব্রাঈল ( আঃ ) প্রথমে আমাকে এক রীতিতে কুরআন পড়িয়েছেন। অতপর আমি তাঁর কাছে বার বার দাবী তুললাম যে, কুরআন মাজীদ ভিন্ন রীতিতেও পাঠ করার অনুমতি দেয়া হোক। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং তা সংখ্যায় সাতরীতি পর্যন্ত পৌছাল। অধঃস্তন রাবী ইবনে শুহাব যুহরী বলেন, যে সাত হরফে ( রীতি ) কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে—তা সংখ্যায় সাত হওয়া সত্ত্বেও যেন একটি রীতিরই বিকল্প ব্যবস্থা ছিল। এই একাধিক রীতিতে কুরআন পাঠ করলে ( কথা একই থাকে) হালাল-- হারামের মধ্যে পরিবর্তন সূচীত হয় না। ------- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

  সাত রীতিতে কুরআন পড়ার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে যখন ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে উঠলো, তখন এই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব সমূহের মধ্যে একটি ছিল জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। কেননা মুসলমান এবং জাহেলিয়াত দুটি জিনিসের একই দর্পণ হতে পারে না। প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র জনগণকে মৌখিক পদ্ধতিতে দীনের শিক্ষা দান করেছে। কিন্তু এর সাথে সাথে গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। সুতরাং খেলাফতে রাশেদার যুগে এতো ব্যাপক আকারে শিক্ষা সম্প্রসারনের কাজ চলে যে, একটি তথ্যের ভিত্তিতে সে সময় শতকরা একশো জন লোকই অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। লোকেরা যেন কুরআন পড়তে সক্ষম হয়ে যায় এই লক্ষ্য সামনে থাকায় এরূপ ফল সম্ভব হয়েছিলো। অর্থাৎ মুসলমানদের দৃষ্টিতে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়ার সর্বপ্রথম গুরুত্ব এই ছিল না যে, লোকেরা যেন দুনিয়াবী ব্যাপারসমূহ লিখন ও পঠনে পারদর্শী হয়ে যাক। এতো কেবল একটা কর্মগত সুবিধা। আসল ফায়দা এই যে, লোকেরা কুরআন পড়ার যোগ্য হয়ে যায়। যখন তারা কুরআন পড়ার যোগ্য হবে না এবং সরাসরি জানতে পারবে না যে, তাঁর প্রতিপালক তাঁর উপর কি কি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তাঁকে কোন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন এবং সে পরীক্ষায় তাঁর সফল হওয়ারই বা পথ কি, আর বিফল হওয়ার কারন সমূহই বা কি—ততক্ষন তারা একজন মুসলমানের মতো জীবন যাপন করার যোগ্য হতে পারবে না। এ জন্য জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা ইসলামী সমাজে মৌলিক গুরুত্বের দাবীদার। ইসলামী খেলাফত এই কাজকে নিজের মৌলিক কর্তব্য বিবেচনা করেই আঞ্জাম দিয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাথমিক যুগেই মদিনায় শিক্ষা সম্প্রসারনের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের ঘটনায় জানা যায়, যখন কুরাইশ গোত্রের লোক বন্দী হয়ে আসলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের বললেন- তোমাদের মধ্যে যে লেখাপড়া জানে সে এখানে এতজন বালককে লেখাপড়া শেখাবে। তাহলে কোনরূপ বিনিময় ব্যতিরেকে তাঁকে মুক্ত করে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে লোকদেরকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

 

জনগণকে যখন শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব হল এবং তারা লেখাপড়ার উপযুক্ত হয়ে গেলো, এরপর বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারনে কুরআন পড়ার অনুমতি রহিত করে দেয়া হল এবং শুধু কুরাইশদের ভাষার প্রচলন অবশিষ্ট রাখা হয়। কেননা কুরআন মাজীদ কুরাইশদের আঞ্চলিক ভাষায় নাযিল হয়েছিলো। যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মাতৃভাষা ছিল। তাঁর নিয়ম ছিল, যখনই কুরআন মাজীদ নাযিল হতো, তখন প্রথম অবসরেই তিনি কোন লেখাপড়া জানা সাহাবীকে ডেকে তা শিখিয়ে দিতেন। এখানে বলা প্রয়োজন যে, কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি ছাড়াও প্রথম দিকে আরবের অপরাপর এলাকার বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এই অনুমতি রহিত করে দেয়া হয়। আর প্রথম থেকেই কুরআন মাজীদ কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত অভিধান অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়।

\r\n\r\n

আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পড়ার অনুমতি

 

একটি বিরাট সুযোগ ছিল

 

আরবী****

 

৭১। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাঈল ( আঃ ) এর সাথে সাক্ষাত করলেন। তিনি বললেন-  হে জিব্রাঈল, আমি একটি নিরক্ষর উম্মতের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। এদের মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ, কিশোর- কিশোরী এবং এমন ব্যক্তি যে কখনো পড়া-লেখা করেনি। জিব্রাঈল ( আঃ ) বললেন- হে মুহাম্মদ, কুরআন সাত রীতিতে নাযিল হয়েছে। --- ( তিরমিযি )

 

মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, জিব্রাঈল ( আঃ ) আরো বললেন- “কুরআন যেসব রীতিতে নাযিল হয়েছে তা আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট।”

 

নাসাঈর বর্ণনায় আছে, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- জিব্রাঈল এবং মিকাঈল ( আঃ ) আমার কাছে আসলেন। জিব্রাঈল আমার ডান পাশে বসলেন এবং মিকাঈল আমার বাম পাশে বসলেন। অতপর জিব্রাঈল আমাকে বললেন- কুরআন মাজীদ এক রীতিতে ( অর্থাৎ কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি অনুযায়ী ) পাঠ করুন। মিকাঈল আমাকে বললেন, আরো এক রীতিতে পাঠ করার অনুমতি চান। ( আমি এই অনুমতি চাইতে থাকলাম )। এমনকি শেষ পর্যন্ত সাত রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। সুতরাং এর প্রত্যেক রীতিই আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট।”

 

প্রত্যেক রীতি নিরাময়কারী ও যথেষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে—এর মধ্যে কোন প্রকারের ভ্রান্তির আশংকা নেই। কুরাইশদের অভিধান অনুযায়ী কুরআন পাঠ যেভাবে আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট অনুরূপভাবে অন্যান্য গোত্রের অভিধান অনুযায়ী তাঁর পাঠ আরোগ্য দানকারী এবং যথেষ্ট। এর মধ্যে যে কোন গোত্রের অভিধান অনুযায়ী কুরআন পাঠ করলে তাতে কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও অর্থের পরিবর্তন ঘটার কোন আশংকা নেই।

\r\n\r\n

কুরআন পড়ে শুনানোর পারিশ্রমিক নেয়া অবৈধ

 

আরবী***

 

৭২। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। একবার তিনি এক কাহিনীকারের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে কুরআন পড়ছিল আর ভিক্ষা চাচ্ছিল। এ দেখে তিনি ইন্না লিল্লাহি অ-ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করলেন, অতপর বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে তাঁর যা চাওয়ার আছে তা যেন আল্লাহ তায়ালার কাছে চায়। কেননা অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা কুরআন পাঠ করবে এবং মানুষের কাছে এর বিনিময় চাইবে। ---( আহমাদ, তিরমিযি)

 

  হাদিসটির বিষয়বস্তু পরিস্কার। তবুও এখানে একটি কথা খেয়াল রাখা দরকার। কুরআন শরীফ পড়ে তাঁর বিনিময় লওয়া কিংবা নামায পড়িয়ে তাঁর পারিশ্রমিক গ্রহন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে যদিও নেহায়েত নিষিদ্ধ কাজ এবং প্রাচীন ফিকাহবিদগণ তা নাজায়েজ হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন ; কিন্তু পরবর্তীকালে এমন কিছু বিষয়ের উদ্ভব হয় যার ফলে সমসাময়িক কালের ফিকাহবিদগণ লক্ষ্য করলেন যদি এই জাতীয় কোন পারিশ্রমিক গ্রহন করা চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ রাখা হয় তাহলে মসজিদ সমুহে পাঁচ ওয়াক্তের নিয়মিত আযান ও জামায়াত সহকারে নামায আদায়ের ব্যবস্থা চালু না থাকার এবং কুরআন শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে এবং মসজিদের দেখাশুনা ও তা সজীব রাখার কাজ ব্যহত হতে পারে। এজন্য তারা একটি বিরাট কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যেসব লোক নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করার অথবা কুরআন শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহন করবে তাঁদের জন্য পারিশ্রমিক নেয়া জায়েজ। তবুও নীতিগতভাবে একথা স্বস্থানে ঠিকই আছে যে, কোন আলেম যদি অন্য কোন উপায়ে নিজের সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য অর্থ উপার্জন করতে পারেন এবং সাথে সাথে বিনা পারিশ্রমিকে কোন নির্দিষ্ট মসজিদে নামাযের জামায়াতে নিয়মিত ইমামতি করতে সক্ষম হন তাহলে এর চেয়ে ভালো কথা আর কি হতে পারে? যে ব্যক্তি মসজিদের দরজায় বসে জুতা সেলাই করে জীবিকা অর্জন করে এবং পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে ইমামতি করার দায়িত্ব গ্রহন করে এবং কারো কাছ থেকে একটি পারিশ্রমিক গ্রহন করেনা--- আমার মরে এই ইমাম খুবই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এতদসত্তেও যদি কোনভাবেই তা সম্ভব না হয় এবং সে ধরনের কোন কাজেরও সংস্থান করা না যায়, তাহলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ইমাম সাহেব বেতন গ্রহন করবেন। মসজিদ কমিটিও ইমাম সাহেবের বেতনের ব্যবস্থা করে মসজিদকে জীবন্ত রাখার ব্যবস্থা করবেন।

\r\n\r\n

কুরআনকে জীবিকা অর্জনের উপায়ে পরিনতকারী অপমানিত

 

আরবী****

 

৭৩। হযরত বুরাইদাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে রুটি রুজি অর্জন করার উদ্দেশ্যে কুরআন পড়ে, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আসবে যে, তাঁর চেহারায় কেবল হাড়গোড়ই অবশিষ্ট থাকবে এবং তাতে গোশত থাকবে না। --( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

 

কোন ব্যক্তির চেহারায় গোশত না থাকার অর্থ সে অপমানিত হবে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি অমুক ব্যক্তি বে-আব্রু হয়ে পড়েছে। শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে- চেহারার সৌন্দর্য। সুতরাং কারো অপমানিত হওয়ার ব্যাপারটি আমরা অনেক সময় বলে থাকি “তাঁর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে”। অর্থাৎ তাঁর আসল চেহারা ধরা পড়ে গেছে এবং লোক সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। অতএব, চেহারায় গোশত না থাকাটা ‘লাঞ্ছিত ও অপমানিত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআন পড়াকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উপায়ে পরিনত করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাঁকে অপমানিত করবেন।

\r\n\r\n

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দুই সুরাকে পৃথককারী

 

আরবী***

 

৭৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিল না যে, এক সূরা কথায় শেষ হয়েছে। এবং অপর সূরা কথা থেকে শুরু হয়েছে। অবশেষে তাঁর উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নাযিল হয়। ---- ( আবু দাউদ )

 

  অর্থাৎ সূরা সমূহের সূচনা এবং সমাপ্তি নির্ণয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অসুবিধার সম্মুখীন হলেন, আল্লাহ তায়ালা তখন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নাযিল করে বলে দিলেন, যেখানে উল্লেখিত বাক্য শুরু হয়েছে সেখানেই একটি সূরা শেষ হয়েছে এবং অপর সূরা শুরু হয়েছে। এভাবে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ আয়াতটি মূলত সূরা সমূহের মাঝে সীমারেখা হিসাবা ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা সমূহের সূচনা ও সমাপ্তি নির্দেশ করার জন্যে এ আয়াত নাযিল করেন। এ তাসমিয়া কুরআন মাজীদের ‘সূরা নামলের’ একটি আয়াত ( ৩০ ) হিসাবেও নাযিল হয়েছে। সাবা রাজ্যের রানী তাঁর সভাসদগণকে বললেন- আমার নামে হযরত সুলাইমান ( আঃ ) এর একটি চিঠি এসেছে। তা ‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা শুরু হয়েছে ( ওয়া ইন্নাহু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ) সেখানে এটা ঐ সুরার আয়াত হিসাবে নাযিল হয়েছে। আর এখানে বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা এটাকে সূরা সমূহের মাঝে সীমারেখা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এখন এই তাসমিয়া দ্বারা প্রতিটি সূরা শুরু হয়। অবশ্য একটি ব্যতিক্রম আছে। তা হচ্ছে সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ নেই। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখান যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিলো তাতে সূরা তাওবার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ ছিল না। এ জন্য সাহাবাগন তা অনুরূপভাবেই নকল করেছেন। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তাতে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেন নি।

 

এ থেকে আপনারা অনুমান করতে পারেন যে, সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মাজীদকে গ্রন্থাকারে সংকলন করার সময় কতটা দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের জানা ছিল যে, সূরা সমূহকে পরস্পর থেকে পৃথক করার জন্য প্রতিটি সুরার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ লেখা হয়েছিলো। তারা এর উপর অনুমান করে সূরা তাওবার সুচনায় তা লিখে দিতে পারতেন। অথবা এরূপ ধারনাও করতে পারতেন যে, সম্ভবত এই সুরার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ লেখানোর খেয়াল তাঁর নাও থাকতে পারে। অথবা যে সাহাবীকে দিয়ে তিনি অহী লেখাতেন হয়তো তিনি তা লিখতে ভুলে গিয়ে থাকবেন ; বরং এধরনের কোন ভিত্তিহীন কিয়াসের আশ্রয় না নিয়ে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখান মাসহাফ যেভাবে পেয়েছেন হুবহু সে ভাবেই নকল করেছেন। কিন্তু নিজেদের পক্ষ থেকে এর মধ্যে একটি বিন্দুও সংযোজন করেন নি।

 

  এটা আল্লাহ তায়ালার এক মহান অনুগ্রহ যে, তিনি তাঁর কিতাবের হেফাজতের জন্য এই অতুলনীয় ব্যবস্থা করেছেন। দুনিয়ায় বর্তমানে এমন কোন আসমানি কিতাব নেই যার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার বানী তাঁর আসল অবস্থায় এবং কোন মিশ্রন ও রদবদল ছাড়া এভাবে সংরক্ষিত আছে। এই মর্যাদা কেবল কুরআন মাজিদেরই রয়েছে।

\r\n\r\n

সাহাবাগন কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মুখস্ত করেছেন

 

আরবী***

 

৭৫। তাবেঈ হযরত আলকামা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা ( সিরিয়ার ) হেমস নগরীতে ছিলাম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) সূরা ইউসুফ পাঠ করলেন। সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বললো- এটা এভাবে নাযিল হয় নি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি এ সূরা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পড়েছি। আমার পাঠ শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তুমি ঠিকভাবে পড়েছ”। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) লোকটির সাথে কথা বলছিলেন, এ সময় তিনি তাঁর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেন। তিনি বললেন- তুমি শরাব পান করেছো আর কুরআন শুনে তা মিথ্যা সাব্যস্ত করতে চাচ্ছ? অতএব তিনি তাঁর উপর ( মদ পানের অপরাধে ) শাস্তির দণ্ড কার্যকর করেন। --- ( বুখারী ও মুসলিম )

 

 এ হাদিসটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- সাহাবাদের মধ্যে যারা লোকদের মাঝে কুরআন পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেছেন—তারা হয় সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনে তা মুখস্ত করেছেন, অথবা অন্যের কাছে শুনে তা মুখস্ত করে তা আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনিয়েছেন। তিনি তা শোনার পর এর সমর্থন করেছেন যে, তুমি সঠিক মুখস্ত করেছো। এভাবে আমাদের কাছে কুরআন পৌঁছানোর কোন মাধ্যম এরূপ ছিলনা যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ থাকতে পারে।

\r\n\r\n

কুরআন মাজীদ কিভাবে একত্রে জমা করা হয়েছিলো

 

আরবী***

 

৭৬। হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সময় ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য সাহাবা শহীদ হলেন, হযরত আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম হযরত উমরও ( রাঃ ) সেখানে হাযির আছেন। আবু বকর (রাঃ) আমাকে বললেন- উমর আমার কাছে এসেছে এবং সে বলছে- “ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের অসংখ্য কারী ( যাদের কুরআন মুখস্ত ছিল এবং লোকদের তা পড়ে শুনাতেন ) শহীদ হয়ে গেছেন। আমার আশংকা হচ্ছে--- অন্যান্য যুদ্ধেও যদি কুরআনের কারীগন শহীদ হয়ে যায়, তাহলে কুরআনের বিরাট অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমার রায় হচ্ছে এই যে, আপনি কুরআনকে একত্রিত ( বইয়ের আকারে গ্রন্থাবদ্ধ ) করার নির্দেশ দেন।”

 

আবু বকর ( রাঃ ) বলেন, আমি উমরকে বললাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কাজ করেননি তা তুমি কিভাবে করবে? উমর ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ এটা খুবই ভালো কাজ। সে এ ব্যাপারে আমাকে বরাবর পীড়াপীড়ি করতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা-- এ কাজের জন্য আমার অন্তরকে উম্মুক্ত করে দিলেন। ( অর্থাৎ আমি আশ্বস্ত হলাম যে, এটা খুবই উপকারী কাজ এবং তা একটি শরঈ প্রয়োজনকে পূর্ণ করবে।) আমার অভিমতও উমরের অভিমতের সাথে মিলে গেলো।

 

যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, অতপর আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে বললেন, “তুমি একটি যুবক বয়সের লোক এবং বুদ্ধিমান। তোমার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ নেই ( অর্থাৎ তুমি যে কোন দিক থেকে নির্ভরযোগ্য )। তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অহী লেখার কাজেও নিয়োজিত ছিলে। অতএব তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলো খুঁজে বের করো এবং একত্রে জমা করো।” যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহর শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে আনার হুকুম দিতেন তাহলে এটা আমার কাছে এতো কঠিন মনে হতোনা--- যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ। আমি আরজ করলাম, আপনি একাজ কেমন করে করবেন যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি? আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ এটা বড়ই ভালো কাজ।

 

অতপর আবু বকর ( রাঃ ) এ কাজের জন্য আমাকে বার বার তাগাদা দিতে থাকলেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিলেন--- যার জন্য তিনি আবু বকর ( রাঃ ) এবং উমরের ( রাঃ ) অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতপর আমি কুরআন মাজীদকে খেজুরের বাঁকল, সাদা পাথরের পাত এবং লোকদের বুক ( স্মৃতি ) থেকে তালাশ করে একত্রে জমা করা শুরু করে দিলাম। অবশেষে আমি সূরা তাওবার শেষ আয়াত আবু খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেলাম। তা আর কারো কাছে পেলাম না। আয়াতটি হচ্ছে- “লাকাদ- জায়াকুম—রাসুলুম- মিন আন ফুসিকুম” শেষ পর্যন্ত। এভাবে কুরআন মাজীদের যে সহীফা একত্রিত করা হল বা লেখা হল তা হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) জীবদ্দশা পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। অতঃপর তা হযরত উমরের ( রাঃ ) কাছে তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত থাকে। অতঃপর তা উম্মুল মু’মিনিন হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর যিম্মায় থাকে। ----      ( সহীহ বুখারী )

 

  হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) মনে এই সন্দেহ উদ্রেক হয় যে, কুরআন মাজীদ একত্রে জমা করা যদি কোন জরুরী কাজ হতো এবং দীনের হেফাজতের জন্য এটা করার প্রয়োজন হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামই তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন মাজীদকে একত্রিত করে পুস্তকের আকারে সংকলিত করিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি যখন একাজ করেননি আমরা তা করার দুঃসাহস কি করে করতে পারি? কিন্তু হযরত উমরের ( রাঃ ) যুক্তি ছিল এই যে, কোন একটি কাজ যদি উত্তম বলে বিবেচিত হয় এবং শরীয়ত ও ইসলামের মৌলিক কাজের অনুকূল হয়, তাহলে এর শরঈ প্রয়োজন থাকা এবং তা স্বয়ং একটি ভালো  ও কল্যাণকর কাজ হওয়া এবং এর বিপক্ষে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্তমান না থাকাটাই সেই কাজ জায়েজ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এজন্যই তিনি বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমার দৃষ্টিতে এ কাজ উত্তম।

 

“খোদার শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেন তাহলে এ কাজ আমার কাছে এতটা কঠিন মনে হতো না, যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ”। ----- হযরত যায়েদের ( রাঃ ) এই মন্তব্য তাঁর তীক্ষ্ণ অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব বহন করে যে, কুরআন একত্রে জমা করা একটি কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ।

 

কুরআন মাজীদকে বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত করা, অতঃপর তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত ক্রমানুযায়ী লিপিবদ্ধ করা এবং তাতে কোনরূপ ভুল—ভ্রান্তি না হওয়া মূলতই এক কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছিল। “আমার দ্বারা যদি বিন্দু পরিমাণও ভুল হয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কুরআন ভ্রান্তি সহকারে পৌছার সমস্ত দায়দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হবে।” ---হযরত যায়েদ ( রাঃ ) এর মনে এই অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এই অনুভূতির কারনেই তিনি বলেছেন—পাহাড় উত্তোলন করে নিয়ে আসার চেয়েও অধিক কঠিন কুরআন সংকলনের এই বোঝা আমার উপরে চাপানো হয়েছে।

 

এ হাদীস থেকে জানা যায়, তিনটি উৎস থেকে কুরআন মাজীদ সংগ্রহ করা হয়েছে।

 

একটি উৎস এই ছিল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কুরআন মাজীদ লিখিয়েছিলেন তা খেজুর বাঁকল, সাদা পাথরের পাতলা তক্তির উপর লেখা ছিল। রাসুলুল্লাহর ( সাঃ ) নীতি ছিল--- যখন অহী নাযিল হতো, তিনি লেখাপড়া জানা কোন সাহাবীকে ডেকে তিনি নির্দেশ দিতেন--- এই সূরাটি অথবা এই আয়াতগুলো অমুক অমুক স্থানে লিখে দাও। এই সাহাবীদের কাতিবে অহী বা অহী লেখক বলা হতো। লেখা শেষ হলে আবার তিনি তা পড়িয়ে শুনতেন যাতে এর নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। অতপর তা একটি থলের মধ্যে ঢেলে দিতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে ( সামনের হাদীসে আসছে ) এও বলে দিয়েছেন যে, অমুক আয়াত অমুক সুরার অংশ এবং অমুক আয়াতের পরে এবং অমুক আয়াতের পূর্বে সংযোজিত হবে। অনুরূপভাবে সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাসও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে দিয়েছেন। এতে লোকেরা জানতে পারল যে, সূরাগুলোর ক্রমবিন্যাস কিভাবে করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কুরআন মাজীদকে একটি পুস্তকের আকারে লিখাননি—যে আকারে আজ তা আমাদের সামনে রয়েছে।

 

হযরত যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, এই থলের মধ্যে পাথরের যেসব তক্তি এবং খেজুর বাঁকল ছিল আমি তা বের করে নিলাম। এর সাথে আরো একটি কাজ এই করলাম যে, যেসব লোকের কুরআন মুখস্ত ছিল তাঁদের ডেকে তাঁদের পাঠ পাথর ও বাকলে লেখা কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখলাম। এভাবে দুইটি উৎসের সাথে কুরআনের আয়াতগুলোর সামঞ্জস্য নির্ণীত হওয়ার পর তা একটি পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা হল।

 

হযরত যায়েদ ( রাঃ ) যে বলেছেন, সূরা তাওবার সর্বশেষ আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা ( রাঃ ) এর কাছে পেয়েছি--- এর অর্থ এই নয় যে, এই আয়াত ঐ থলের পাণ্ডুলিপির মধ্যেই ছিল না। কেননা এই ব্যবস্থা করা হয়েছিলো যে, এই থলের মধ্যে যা কিছু পাওয়া যায় তা হাফেজদের মুখস্ত কুরআনের সাথে মিলানোর পরে লেখা হবে। অতএব তাঁর কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমি কুরআনের যে কয়জন হাফেজ পেলাম, তাঁদের মধ্যে সূরা তাওবার এই শেষ আয়াত কেবল খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) মুখস্ত ছিল। আমি থলের পাণ্ডুলিপির সাথে মিলানোর পর তা সংকলন করলাম।

 

মাসহাফে উসমানী কিভাবে প্রস্তুত করা হয়

 

আরবী***

 

৭৭। হযরত আনাস ইবনে মালেক ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ( রাঃ ) হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে আসলেন। এটা সেই যুগের কথা যখন তিনি সিরিয় বাহিনীর সাথে আর্মেনিয়া বিজয়ে এবং ইরাক বাহিনীর সাথে আজারবাইজান বিজয়ে অংশ গ্রহন করেছিলেন। লোকদের বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ হযরত হুজাইফাকে ( রাঃ ) উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি হযরত উসমানকে ( রাঃ ) বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন, ইহুদী-খ্রিস্টানদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিভেদ সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করার চিন্তাভাবনা করুন।

 

অতএব, হযরত উসমান ( রাঃ ) হাফসাকে ( রাঃ ) বলে পাঠালেন, আপনার কাছে কুরআন শরীফের যে সহীফা ( অর্থাৎ মাসহাফে সিদ্দিকী ) রয়েছে তা আমাকে পাঠিয়ে দিন। আমরা এটা দেখে আরো কপি নকল করিয়ে দেব। অতপর মূল কপি আপনাকে ফেরত দেব। হযরত হাফসা ( রাঃ ) মাসহাফ খানা ( পুস্তকাকারে সংকলন ) হযরত উসমানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অতপর তিনি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ( রাঃ ), হযরত সাঈদ ইবনুল আস ( রাঃ ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে হিশাম ( রাঃ ) এই চার ব্যক্তিকে এ কাজে নিযুক্ত করলেন। তারা মাসহাফে সিদ্দিকী থেকে আরো কয়েকটি মাসহাফ তৈরি করবেন। উপরোক্ত এই চার ব্যক্তির মধ্যে কুরাইশ বংশের তিন ব্যক্তিকে ( হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সাঈদ ইবনুল আস এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ) তিনি নির্দেশ দিলেন, যদি কখনো কুরআনের কোন জিনিস নিয়ে তোমাদের সাথে যায়েদের মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা কুরআনকে কুরাইশদের বাক্যরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। কেননা তা এই রীতিতে নাযিল হয়েছে। তারা তাই করলেন। যখন তারা পুস্তকাকারে কুরআনের নতুন সংকলন তৈরির কাজ শেষ করলেন হযরত উসমান ( রাঃ ) মাসহাফে সিদ্দিকী হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর কাছে ফেরত পাঠালেন। তিনি কুরআনের এক একটি সংকলন ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন, এই সংকলন ছাড়া আর যতো সংকলন রয়েছে তা যেন আগুনে জালিয়ে দেয়া হয়।

 

অধঃস্তন রাবী ইবনে শিহাব যুহরী বলেন, যায়েদ ইবনে সাবিতের পুত্র আমাকে বলেছেন, তিনি তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছেন, আমরা যখন এই মাসহাফে উসমানী সংকলন করছিলাম তখন আমি সূরা আহযাবের একটি আয়াত খুঁজে পাচ্ছিলাম না যা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পড়তে শুনেছি। আমি এ আয়াতের খজে লেগে গেলাম। তা খুজাইমা ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ) এর কাছে পাওয়া গেলো। আয়াতটি হচ্ছে—“মিনাল মুমিনিনা রিজালুন সাদাকু মা আহাদুল্লাহ আলাইহি----- ”। অতএব আমরা তা এই মাসহাফে উল্লেখিত সূরায় সংযোজন করলাম। ----- ( বুখারী )

 

  হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামানের ( রাঃ ) শংকিত হওয়ার কারন ছিল এই যে, লোকদেরকে যেহেতু নিজ নিজ আঞ্চলিক রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল--- এজন্য পরবর্তীকালে যখন বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আরবের বিভিন্ন এলাকার লোকেরা এসে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে যায় সেখানে তাঁদের মধ্যে কুরআনের পাঠ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই অবস্থা দেখে হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামান ( রা; ) অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি শংকিত অবস্থায় হযরত উসমান ( রাঃ ) এর দরবারে হাযির হন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনি এই উম্মাতের কথা চিন্তা করুন। তা না হলে তাঁদের মধ্যে কুরআন নিয়ে এমন কঠিন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে যাবে--- যেরূপ তাওরাত ও ইঞ্জীল কিতাব নিয়ে পর্যায়ক্রমে ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং হযরত উসমান ( রাঃ ) বিষয়টির নাজুকতাকে সামনে রেখে কুরআনের একটি নিখুঁত সংকলন তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

 

অতপর উসমান ( রাঃ ) এই সংকলনকে অবশিষ্ট রেখে বাকি সব সংকলন জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ এজন্য দিলেন যে, লোকেরা যখন লেখা ও পড়ার উপযুক্ত হয়ে গেল তখন তারা নিজ নিজ গোত্রের বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন শরীফ লিখেও নিয়েছিল। তাঁদের এই সংকলনগুলো যদি পরবর্তীকালে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে হযরত উসমানের তত্ত্বাবধানে তৈরিকৃত এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরিত সংকলনের সাথে বিরোধ দেখা দিত। বিভিন্ন রকমের সংশয়ের সৃষ্টি হতো। এজন্য যার যার কাছে লিখিত কুরআন বা তাঁর অংশ বিশেষ, এমনকি কোন আয়াত ছিল তাও তাঁদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সাথে সাথে এই মর্মে সরকারী নির্দেশ জারি করা হয় যে, সরকারী তত্ত্বাবধানে কুরআনের যে সংকলন তৈরি করা হয়েছে, এটাই এখন আসল নোসখা হিসাবে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি কুরআনের নিজস্ব কপি তৈরি করতে চায় সে এই সরকারী নোসখা দেখেই তা তৈরি করবে। এভাবে ভবিষ্যতের জন্য কুরআনের লেখন ও পঠন মাসহাফে উসমানীর উপর সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়।

 

যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) বলেছেন, সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেয়েছি। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) যুগে যে মাসহাফ লেখা হয়েছিলো--- মনে হয় এর কাগজ খুব শক্ত ছিল না। খুব সম্ভব ঐ আয়াতটি দুর্বল কাগজে লিপিবদ্ধ ছিল। মাসহাফে উসমানী নকল করার সময় পরিস্কার ভাবে তাঁর পাঠোদ্ধার করা যায় নি। তাই এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া আরো লক্ষ্য করার বিষয়, যায়েদ ইবনে সাবিতের যদিও স্মরণে ছিল যে, উল্লেখিত আয়াতটি সূরা আহযাবের নির্দিষ্ট স্থানে ছিল, কিন্তু তবুও তিনি এমন ব্যক্তির খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করলেন যার এ আয়াত মুখস্ত আছে। তাতে পরিস্কারভাবে প্রমান হয়ে যাবে যে, এ আয়াতটি মূলত কুরআন মাজিদেরই অংশ। খোঁজ করতে গিয়ে তিনি এ আয়াতটি খুজাইমা আনসারীর কাছে পেয়ে গেলেন। অতএব তিনি তা লিখে নিলেন।

 

 কুরআন শরীফ লিখন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সাহাবাদের কঠোর সতর্কতা অনুমান করুন। স্বয়ং যায়েদের ( রাঃ ) এ আয়াত মুখস্ত ছিল এবং তিনি নিজেই মাসহাফে সিদ্দিকীতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর এও মনে আছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ আয়াত পাঠ করতে শুনেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি কেবল নিজের স্মৃতির উপর নির্ভর করে তা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে নেননি--- যতক্ষন অন্তত একজন সাক্ষী এর স্বপক্ষে পাওয়া না গেছে।

 

সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাস রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) করেছেন

 

আরবী***

 

৭৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হযরত উসমান ( রাঃ ) কে বললাম, কি ব্যাপার, আপনি যে সূরা আনফালকে সূরা তাওবার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন? অথচ সূরা আনফালের আয়াত সংখ্যা হচ্ছে ৭৫ এবং সূরা তাওবার আয়াত সংখ্যা একশোর বেশী। ( আর যেসব সুরার আয়াত সংখ্যা শতের অধিক সেগুলো কুরআন শরীফের প্রথম দিকে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আপনি এই সূরা দুটির মাঝখানে বিসমিল্লাহ লিখেননি। আপনি সূরা আনফালকে প্রথম দিককার বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন--- এর কারন কি? অথচ এর আয়াত সংখ্যা একশোর কম। )

 

উসমান ( রাঃ ) জবাবে বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি এই ছিল যে, লম্বা সূরা সমূহ নাযিল হওয়ার যুগে যখন তাঁর উপর কোন আয়াত নাযিল হতো তিনি তাঁর কোন কাতিবকে ডেকে বলতেন, যে সূরায় এই এই বিষয় আলোচিত হয়েছে তাঁর মধ্যে এই আয়াত লিখে রাখো। এভাবে যখন কোন আয়াত তাঁর উপর নাযিল হতো, তিনি বলতেন- এ আয়াতটি অমুক সূরায় সংযোজন করো যাতে এই এই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। সূরা আনফালও মদিনায় প্রথম দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। ( বদরের যুদ্ধের পরে এই সূরা নাযিল হয় ) আর সূরা তাওবা মাদানী যুগের শেষ দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এই সূরা দুটির বিষয়বস্তুর মধ্যে যদিও সামঞ্জস্য রয়েছে কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় আমাদেরকে পরিস্কারভাবে একথা বলেননি যে, সূরা আনফাল সূরা তাওবারই অংশ। এজন্য আমি এই সুরা দুটিকে পৃথক পৃথক এবং পাশাপাশি রেখেছি এবং এর মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিখিনি। এটাকে আমি বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করেছি। --- ( মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ )

 

  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ—“এই আয়াতকে অমুক সুরার অন্তর্ভুক্ত করো যার মধ্যে অমুক বিষয় আলোচিত হয়েছে”---- এতে প্রমান হচ্ছে যে, তিনি নিজেই সূরা সমূহের নামকরন করেছেন, তিনি বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে এর নামকরন করেননি। অথচ বিভিন্ন সুরার নাম কেবল ( সুরার ) নিদর্শন হিসাবেই রাখা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় সুরার নাম ‘আল বাকারা’—রাখার কারন এই নয় যে, তাতে গাভীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বরং এটা কেবল এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সুরার এক স্থানে গাভীর উল্লেখ আছে।

 

 এ হাদীস থেকে দ্বিতীয় যে কথাটি জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় সূরাগুলোর ক্রমিক বিন্যাস করতে থেকেছেন। অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, তিনি এও বলতেন—“এই আয়াতকে অমুক আয়াতের পূর্বে এবং অমুক আয়াতের পরে  ( দুই আয়াতের মাঝখানে ) সংযোজন করো।” এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই এক একটি সুরার ক্রমিক বিন্যাসও সম্পন্ন করা হয়েছিলো এবং তা পূর্ণাংগভাবে লিখেও রাখা হয়েছিলো। যখন নামাযে কুরআন মাজীদ পাঠ করা হতো তখন এর কোন ক্রমবিন্যাস ছাড়া তা পড়াও সম্ভব ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন সূরা লেখাতেন, সেও ক্রমিকতা অনুযায়ী তা পড়া হতো। আর সেই ক্রমধারা অনুযায়ী লোকেরা তা শুনত।

 

  সূরা আনফাল এবং সূরা তাওবার মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য রয়েছে। উভয় সুরার মধ্যেই জিহাদের আলোচনা হয়েছে। দুই সুরাই একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। উভয় সূরায়ই কাফের ও মুনাফিকদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দুটি সুরাতেই জিহাদের বিধান বর্ণিত হয়েছে এবং আমাদেরকে জিহাদে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে দুইটি সুরার মাঝে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

 

এই সূরা দুটিকে পৃথক পৃথক ভাবেই রাখা হয়েছে। কিন্তু সূরাদ্বয়ের মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিপিবদ্ধ করা হয় নি। এ ব্যাপারে হযরত উসমান ( রাঃ ) এর ভাষ্য হচ্ছে--- বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে এই সূরা দুটিকে পরস্পর পাশাপাশি রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা একই সূরায় পরিনত করা হয়নি। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় পরিস্কার ভাবে একথা বলেননি যে, এ দুটি একই সূরা, তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখানো পাণ্ডুলিপিতে সূরা তাওবার প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা পাওয়া যায় নি—এজন্য মাসহাফে উসমানীতেও তা লেখা হয় নি। বর্তমানেও আপনারা কুরআন শরীফ পাঠ করছেন--- একটি সূরা শেষ করে অপর সূরা শুরু করছেন--- কিন্তু এই সূরা দুটির মাঝখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা নাই। এ থেকে আপনারা অনুমান করতে পারেন সাহাবায়ে কেরাম কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মাজীদ সংকলন করেছেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে লেখানো পাণ্ডুলিপিতে যে সূরা তাওবা পাওয়া গেছে তাঁর সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’  নেই   ( যেমন আমরা হাদীস থেকে জানতে পাই ) এ কারনে মাসহাফে উসমানীতেও এই সুরার সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা হয় নি।

 

--- সমাপ্ত ---

কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড